Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প443 Mins Read0

    ০৮. সংস্কার

    মা’কে খুব কমই দেখেছি আমাদের সঙ্গে বসে ভাত খেতে। বাড়ির সবাইকে খাইয়ে বেলা চলে গেলে নিজে খান। আমরা খেয়ে যে খাবার বাঁচে, তা। মুরগি রান্না হলে মা’র ভাগে গলার হাড়, বুকের হাড়, পিঠের হাড়। মা খেয়ে যা থাকে, খায় চাকর চাকরানি। না থাকলে ক্ষতি নেই, ওদের খাবার আলাদা রাঁধা হয়, মাছ মাংস আমাদের, কাজের মেয়েদের জন্য পাইন্যা ডাল, শুঁটকি। এরকমই নিয়ম, এ নিয়ম নানির বাড়িতেও ছিল, নানিও খেতেন নানাকে খাইয়ে, ছেলেদের খাইয়ে, বাচ্চাকাচ্চা খাইয়ে, পরে। সবার খাওয়া হলে কাজের লোক খেত। পান্তা ভাত, নুন মরিচ দিয়ে, নয়ত নষ্ট হয়ে যাওয়া ডাল মেখে। আমরা যখন খাই, মা কখনও কোনও কাজের লোককে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেন না। ওরা নাকি আমাদের খাবারে নজর দেয়। সাত বছর বয়সে একদিন পেট কামড়াচ্ছে রাতে, মা বললেন ফুলবাহারিডারে দেখছিলাম হাঁ কইরা দেখতাছে তুই যহন খাস। ওর নজর লাগছে।

    মা নানির ঘর থেকে তিনটে পান এনে সর্ষের তেল মেখে পানগুলো এক এক করে আমার সারা পেটে ছুঁইয়ে আনছিলেন বলতে বলতে উইঠ্যা আয় বাও বাতাসের নজর, ফুলবাহারির নজর, এসব। পেট থেকে নজর তুলে নিয়ে পান তিনটে একটি কাঠিতে গেঁথে কুপির আগুনে পুড়িয়ে মা বললেন–নজর পুড়লাম।

    নজর কি মা? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

    মা বললেন কারও কারও চোক্কের নজর লাগে খুব। একবার ভিক্ষা করতে আইছে এক বেডি, উঠানের তাজা পাইব্যা গাছটার দিকে চাইয়া কইল আহা, কত পাইব্যা ধরছে! বেডি দরজার আড়াল হইতেই গাছটা পইড়া গেল। গুঁড়ি ধইরা কেউ লাড়ে নাই, ঝড় নাই, বাতাস নাই–চোক্কের সামনে আপনাসে পইড়া গেল গাছ।

    ফুলবাহারি তর খাওনের দিকে বুধয় চাইয়া কইছে আহা কি মজার খাওন! নজর পোড়ানোর পর ব্যথা কমে গেল। অবশ্য বাবা ওষুধ দিয়েছিলেন খেতে। মা বললেন নজরডা পুড়াইছি বইলা পেডের বেদনা ভালা হইছে।

    আকুয়া পাড়ায় তিন বেটির চোখ ছিল নজরের, মা বলেন। তারা যেদিকে তাকাত, গাছের দিকে হলে গাছ মরত, মানুষ হলে সে মানষ এমন অসুখে পড়ত যে শ্বাস ওঠে প্রায়। তিন বেটিকে দেখলে পাড়ার মানুষ দুয়োর এঁটে বসত। নানির বাড়ির দুটো গাছ প্রায় মরতে বসেছিল, তিন বেটির একজনের কাছ থেকে পানি পড়া এনে গাছের গোড়ায় ঢেলে বাঁচানো হয়েছিল গাছ। নানির মা, মা’দের দাদি, কুকুরে কামড়ালে পেটে কুকুরের বাচ্চা যেন না হয় সে ওষুধ দিতেন। সবরি কলার ভেতর, কেউ জানত না কি দিয়ে বানানো, গোল মরিচের মত দেখতে জিনিসটি পুরে খাইয়ে দেওয়া হত। সেটিই ওষুধ। ওষুধ খাওয়ার পর নিষেধের মধ্যে একটিই ছিল, কোনও সবরি কলা খাওয়া চলবে না তিন মাস। ওষুধে কাজ হত, মানুষের পেট থেকে আর কুকুরের বাচ্চা বেরোত না। পাড়ার কেউ কেউ নানির মা’র কাছ থেকে কলার ওষুধ নিয়ে যেত। বেশির ভাগ লোক খাওয়াত সাত পুকুরের পানি। সাতটি পুকুর থেকে এক আঁজলা করে পানি তুলে খাইয়ে দিলেই কুকুর কামড়ানো রোগীর জলাতঙ্ক রোগ সারত, মানুষের পেটে মানুষের বাচ্চাই ধরত, কুকুরের নয়। আমাকে কুকুর কামড়ানোর পর সাত পুকুরের পানিও খাওয়ানো হয়নি, মা’দের দাদি তখন মরে সারা, কলার ওষুধও হয়নি। পেটে ইনজেকশন দিচ্ছেন বাবা, দিলে কি হবে, শরাফ মামা হাততালি দিয়ে বলতেন পেটে তর কুত্তার বাচ্চা। হাঃ হাঃ। আমার ভয় হত খুব। পেট টিপে টিপে দেখতাম কুকুরের বাচ্চা সত্যিই বড় হচ্ছে কি না ভেতরে। বরইএর বিচি গিলে ফেললে শরাফ মামা বলতেন মাথা দিয়া বরই গাছ গজাইব। আমি ঠিক ঠিকই মাথায় হাত দিয়ে পরখ করতাম, বরই গাছের কোনও চারা চাঁদি ফেটে উঠছে কি না। মাথায় মাথায় ঠুস লাগলে বলা হত, শিং গজাবে, আরেকটি ঠুস ইচ্ছে করেই দিতে হত, দুটো হলে নাকি আর গজায় না। ফকরুল মামার মাথার সঙ্গে কলপাড়ে এক ঠুস লাগার পর আমি আর দ্বিতীয় ঠুসে যাইনি, এই মামাটিকে আমার বরাবরই বড় দূরের মনে হত, ঈশ্বর গঞ্জ থেকে আমরা সপরিবার ফিরে এলে ফকরুল মামাকে বড় মামা ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন লেখাপড়া করাতে। ঢাকা থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফিরেছেন, বড় মামা করাচি থেকে ফিরলে আবার গিয়ে কলেজে ভর্তি হবেন। ঢাকায় থাকা মানুষকে আমার আকাশের তারা বলে মনে হত, চাইলেই ছোঁয়া যায় না। ফকরুল মামা নিজেও ঠিক বোঝেননি টিউবয়েলের হাতলে নয়, লেগেছিল আমার মাথার সঙ্গে তাঁর মাথা। তিনি কলপাড়ে বসে উঁবু হয়ে মাথায় বাংলা সাবান মাখছিলেন, চোখ বুজে রেখেছিলেন সাবানের ফেনা যখন মাথা গড়িয়ে মুখে নামছিল, আর আমি গিয়েছিলাম বদনি ভরে পানি আনতে। শিং গজায় কি না দেখতে আয়না হাতে বসেছিলাম পুরো বিকেল, গজায়নি। শরাফ মামাকে জানালে প্রায় প্রতিদিনই বলতে লাগলেন আজ না হোক কাল গজাবে। শরাফ মামা যাই বলুন, শিং আমার সে যাত্রা গজায়নি।

    ফকরুল মামা গোসল টোসল করে ধোয়া লুঙ্গি আর শার্ট পরে বিকেলে দাঁড়িয়েছিলেন কুয়োর পাড়ে নানা এক পুঞ্জি রেখেছিলেন পাটশুলার, তার পাশে। পুঞ্জির দিকে এমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকার কারণ কি মা জিজ্ঞেস করতে ফকরুল মামা বলেছিলেন–না, ভাবতাছিলাম, যদি আগুন ধরাইয়া দেওন যাইত পুঞ্জিত, দেখতাম কেমনে কইরা পুড়ে। মা নানিকে গলা ছেড়ে ডেকে বললেন ফকরুলের কান্ড দেইখা যান মা, কী কয়। পুঞ্জিত আগুন লাগাইতে চায়। নানি চা বানাচ্ছিলেন, শুনে হাসলেন। নানি বিকেলে বড়দের জন্য চা বানান, মিটসেফের ভেতর থেকে কৌটো খুলে টোস্ট বিস্কুট দেন চা’র সঙ্গে। সন্ধের মুখে পুঞ্জিতে ঠিকই আগুন লাগল। খোঁজ পড়ল ফকরুল মামার। তিনি নেই বাড়িতে, চা বিস্কুট খেয়ে হাঁটতে গেছেন রাস্তায়। কার দোষ, সব্বনাশটি কে করেছে এসব প্রশ্নে না গিয়ে নানি কুয়ো থেকে বালতি বালতি পানি তুলে আগুনে ঢাললেন, ফটফট করে ফুটতে ফুটতে আগুন নারকেল গাছের চুড়ো অবদি উঠল। নানির পানিতে কোনও কাজ হল না। কুয়োর পাড়ের গাছগাছালি পুড়ে গেল। ফকরুল মামা ফিরে এসে পুঞ্জিতে আগুন লাগার কাহিনী শুনে মুষড়ে পড়লেন–হায় রে, এত ইচ্ছা আছিল পুড়লে কেরম লাগে, দেখি। আর আমিই কি না দেখতে পারলাম না। দোষ পড়ল গিয়ে ফুলবাহারির ওপর। টুটু মামা সাক্ষী দিলেন তিনি দেখেছেন ফুলবাহারি কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে। বিড়ি খেয়ে নিশ্চয় সে পুঞ্জির ওপর ফেলেছে বিড়ির পুটকি। ফুলবাহারিকে কিলিয়ে ভর্তা বানাবেন বললেন মা, তাকে বলে দেওয়া হল এ বাড়িতে আর বিড়ি খাওয়া চলবে না তার। ফুলবাহারি বিড়ি খাওয়া ধরেছিল আবার, খেত পাকঘরের বারান্দায় বসে। মুখ ভর্তি বসন্তের দাগঅলা সেই কালো মৈসাপের মত দেখতে ফুলবাহারির জন্য, যার কাঁধে বাড়ির সব অপকর্মের দোষ পড়ত, হঠাৎ আমার মায়া হতে থাকে পাজামা পরার বয়সে পৌঁছে, এক সকালে ঘুম থেকে উঠে অবকাশের ভেতর বারান্দায় কয়লা গুঁড়ো করে দাঁত মাজতে মাজতে। ফুলবাহারি শীতের সকালে ভাপা পিঠা বানাত, সে কি স্বাদ পিঠার, ধবল পিঠার মাঝখানে খেঁজুরের গুড়, ঢাকা থাকত পাতলা কাপড়ে, ভেতর থেকে গরম ধোঁয়া উঠত। নানি বাড়ি থেকে চলে আসার পর শীত আসে, শীত যায়, ভাপা পিঠা আর খাওয়া হয় না। দাঁত মাজতে মাজতে আমার বড় ইচ্ছে করে শীতের এই কুয়াশা-ডোবা সকালে একখানা ভাপা পিঠা পেতে। শীতের সকাল যদি খেজুরের রস, ভাপা পিঠা আর কোঁচড় ভরা শিউলি ফুল ছাড়া কাটে, তবে আর এ কেমন শীত! মা আমাদের গায়ে চাদর পেঁচিয়ে চাদরের দু’কোণা ঘাড়ের পেছনে নিয়ে গিঁট দিয়ে দিতেন। কুয়াশা কেটে সূর্য উঠলে রোদ পোহাতে বের হতাম মাঠে। এ বাড়িতে শীতের রোদও পোহানো হয় না। হঠাৎ করে যেন বড় নাগরিক জীবনে চলে এসেছি। মোটা উলের সোয়েটার পরে ঘরে বসে থেকে, রুটি ডিম খেয়ে শীতের সকাল পার করতে হয়।

    মণি বদনি ভরে পানি রেখে যায় আমার সামনে, যেন দাঁত মাজা শেষ হলে মুখ ধুই। ওকে বলিনি পানি দিতে, তবু। ফুলবাহারিও এমন করত, হেঁচকি উঠছে, নিঃশব্দে এক গ্লাস পানি দিয়ে যেত হাতে। হোঁচট খেয়ে পড়লাম, দৌড়ে এসে কোলে তুলে হাঁটুতে বা পায়ের নখে হাত বুলিয়ে দিত। মণি দেখতে ফুলবাহারির মত নয়, কিন্তু ওর মতই নিঃশব্দে কাজ করে, চাওয়ার আগেই হাতের কাছে কাংখিত জিনিস রেখে যায়। ওরা পারে কি করে এত, ভাবি। কাকডাকা ভোরে উঠে উঠোন ঝাঁট দেয় ওরা। নাস্তা তৈরি করে টেবিলে দিয়ে যায়। নাস্তা খাওয়া শেষ হলে থাল বাসন নিয়ে কলপাড়ে যায় ধুতে। ইস্কুলের পোশাক পরা হলে এগিয়ে এসে জুতো পরিয়ে দেয় পায়ে। জামা কাপড় ফেলে রাখি চেয়ারে টেবিলে, গুছিয়ে রাখে আলনায়। ময়লা হলে ধুয়ে দেয়। রাতে বিছানাগুলো শলার ঝাড়ুতে ঝেড়ে মশারি টাঙিয়ে গুঁজে দেয়। আমরা গুছোনো বিছানায় ঘুমোতে যাই। ঘুমিয়ে যাওয়ার অনেক পরে ওরা ঘুমোয়। রাতের বাসন কোসন মেজে, আমাদের এঁটো খাবারগুলো খেয়ে, তারপর। ঘুমোয় মেঝেয়। মশা কামড়ায় ওদের সারারাত, ওদের জন্য কোনও বিছানা বা মশারি নেই। ওদের মুখে মশার কামড়গুলো হামের ফুসকুরির মত লাগে দেখতে। শীতের রাতে লেপ নেই তোষক নেই, ছেঁড়া কাঁথা সম্বল। এরকমই নিয়ম, এই নিয়মে আমাকেও অভ্যস্ত হতে হয়, আমাকেও ওদের চড় থাপড় দিতে হয়, কিল গুঁতো দিতে হয়। রিক্সায় ওদের কোথাও নিলে পাদানিতে বসিয়ে নিই। জায়গা থাকলেও আমাদের পাশে বসার নিয়ম নেই ওদের। ওরা পরনের কাপড় জুতো পায় বছরে একবার, ছোট ঈদে। বাবা ওদের জন্য বাজারের সবচেয়ে কমদামি কাপড় কিনে আনেন। সবচেয়ে সস্তা সাবান পায় ওরা গায়ে মাখার। চুলে মাখার তেল পায় সস্তা সয়াবিন, নারকেল তেল দেওয়া হয় না। নারকেল তেল কেবল আমাদের চুলের জন্য। রাতে পড়তে বসি যখন, পায়ের কাছে বসে মশা তাড়ায় ওরা, হাতপাখায় বাতাস করে। পানি চাইলে দৌড়ে ওরা গ্লাস ভরে পানি এনে হাতে দেয়। আমাদের কারও জগ থেকে গ্লাসে ঢেলে পানি খাবার অভ্যেস হয়নি। হাতের কাছে পানি পেয়ে অভ্যেস। হাতের কাছে যা চাই, তাই পাই। আর ওদের অভ্যেস আমরা যা ইচ্ছে করি, তা পুরণ করার। ওরা জন্ম নিয়েছে কেবল মনিবের সেবা করার উদ্দেশে। ওদের মৃত্যু হবে মনিবের সেবা করতে করতে। ওদের অসুখ হলে ওদের ভৎসর্না করা হয়, ওরা মরে গেলে ওদের দুর্ভাগ্যকে দায়ি করা হয়। ওরা নোংরা, আমরা পরিষ্কার। ওরা নিচুতলার, আমরা ওপরতলার। ওরা ছোটলোক। আমরা বড়লোক। বই পড়ে বাংলা ইংরেজি গদ্য পদ্য শিখেছি। ব্যাকরণ শিখেছি। ভুগোল ইতিহাস শিখেছি। অঙ্ক বিজ্ঞান শিখেছি। সংসার আমাকে শিখিয়েছে নিচু জাত, উঁচু জাত, ছোটলোকি, বড়লোকি। বাল্যশিক্ষার অহংকার করিও না, দরিদ্রকে ঘৃণা করিও না, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, সংসারে এসে অক্ষরবাক্য সমেত হোঁচট খেয়ে পড়ে। এ বড় পুরোনো নিয়ম, শোষণ, দরিদ্রের ওপর ধনীর। আমিও এই অদৃশ্য শেকলে অলক্ষে জড়িয়ে পড়ি।

    মুখ ধুয়ে ঘরে আসার পর এক কাপ চা দিয়ে যায় মণি। সকালে চা খাওয়ার অভ্যেস হয়েছে সেই নানির বাড়িতেই। সকালে দু’রকম নাস্তা হত। প্রথম ছোট নাস্তা সকাল সাতটার দিকে, দশটার দিকে বড় নাস্তা। ছোট নাস্তা চা মুড়ি। চায়ের কাপে মুড়ি ফেলে চামচ দিয়ে তুলে তুলে খেতে হত। বড় নাস্তা পাতলা আটার রুটি সঙ্গে আগের রাতের মাংস, ভাজি, না হলে ডিম ভাজা, এসব।

    চায়ে চুমুক দিচ্ছি, রান্নাঘর থেকে শব্দ আসে হুড়োহুড়ির, মা চড় কষাচ্ছে, লাথি বসাচ্ছে মণির গায়ে। ওর পরনে আমার পুরোনো জামাখানা একটানে মা ছিঁড়ে ফেলেন আরও। মণির দোষ, সে পাতিল থেকে মাংস চুরি করে খেয়েছে। মা’র কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার পরও ও বলছে–মাংস বিলাইয়ে খাইছে।

    মা দাঁত খিঁচে বলেন–বিলাইয়ে না, তুই খাইছস। তুই একটা আস্তা চুরনি। এত খাওয়াই, তারপরও তর পেট ভরে না ছেড়ি! মাংস কি তরে দেইনা! কত বড় সাহস তর যে পাতিলে হাত দেস!

    মণি মার খেয়েও স্বীকার করে না সে চুরি করেছে। মা ঝাঁটা হাতে নিয়ে ওর পিঠে ঝপাং ঝপাং মেরে বলেন–স্বীকার কর এহনও যে তুই খাইছস।

    মা’র শাড়ি খসে পড়ে মাথা থেকে, বুক থেকে। আব্রুর দিকে মা’র তখন নজর নেই। মরিয়া হয়ে ওঠেন মণির স্বীকারোক্তি শোনার।

    মণি অনড় দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছিল। জল পড়ছিল চোখ থেকে গাল গড়িয়ে বুকে। দৃশ্যটির মধ্যে আমি নাক গলিয়ে বলি–কইয়া ফালা, আর খাইতাম না।

    মণি কাতর গলায় বলে–আর খাইতাম না।

    মা থামেন। ধমকে দূরে সরতে বলেন আমাকে।

    এসব লাথিঝাঁটা মণির কাছে ডাল ভাত।

    পরদিনই মণি তার জীবনের ঝুড়ি খুলে বসে মা’র সামনে।

    — আমি তহন কাঁইচলা আবু। বুনি খাই। নুনি, চিনি ছুডু ছুডু। বাবা আমগোর বেবাকতারে ফালাইয়া গেল গা। রাজমিস্তরির কাম করতে বাবা জামালপুর গেল, আর ফিইরা আহে নাই। মায়ে খবর পায়, বাবা একটা বিয়া করছে হেইনু। বিয়া করছে পুলার লাইগ্যা। একটা পুলার শখ আছিল বাবার।

    মা খানিক ঝিমোন, খানিক শোনেন। মা’র চুলের গোঁড়া থেকে লিক এনে, চামড়ায় ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা ঢেলা, আধাগুইড়া এনে বাঁ হাতের নখে রেখে ডান হাতের নখে চেপে ফোটায় মণি আর বলে–তিন মাইয়া জন্মাইছে দেইখা বাবা রাগে আর থাহে নাই। মায়ের যদি একটা পুলা অইত, বাবা যাইত না। পুলা কেমনে অইয়াইব মায়ে। আল্লাহ মায়েরে পুলা দেয় নাই। একচোখ্যা আল্লাহ আমার মা’ডার দিকে চাইল না। আল্লাহরে আর দুষ দেই ক্যা। আমার বাপটা বড় পাষাণ, পাষাণ না হইলে এইভাবে ফালাইয়া যায়! আইজকা বাপ থাকলে মানষের বাড়ি বন্দিগিরি কইরা খাইতে অইত না! বাপের ত ক্ষেমতা আছিল আমগোরে ভাত কাপড় দেওনের।

    বড় শ্বাস ফেলে ডান বাহুতে চোখের পানি মুছে মণি আবার শুরু করে–আমার মা পড়ে আমার চাচাগোর কাছে গেল, মামুগোর কাছে গেল। দূর দূর কইরা বেবাকে খেদাইল মায়েরে। তাগো চুলায় বাত ফুটতাছিল টগবগ কইরা। কি সোন্দর সুবাস, অহনও হেই সুৃবাস নাহো লাইগ্যা রইছে। আমগোরে কেউ একবেলা বাত দেয় নাই। ক্ষিদায় আমি কান্দি, নুনি কান্দো, চিনি কান্দো। মায়ে পুস্কুনি থেইকা শাপলা তুইলা সিদ্ধ কইরা খাইতে দিত। বাত নাই। বাড়ি বাড়ি ঘুইরা মায়ে বাতের মাড় মাইগ্যা আনে। হুগাইয়া আমগোর শইলো হাড্ডি ছাড়া কিছু নাই। খাওন না পাইয়া নুনিডা ব্যারামে পড়ল। শিং মাছের তরহারি দিয়া বাত খাইবার চায়। কেডা দিব! মা আল্লাহর কাছে কত কানল, এক চোখ্যা আল্লাহ ফিইরা চাইল না। নুনিডা মইরা গেল। কব্বরো নুনিডারে মাডি দিবার গিয়া মায়ের যে কী কান্দন। হেষে মা কাম খুঁজল মাইনষের বাড়ি। বিবিসাইবরা ছেড়ি উলা মায়েরে কামো নেয় না। মায়ে হেল্লিগা আমারে আর চিনিরেও কামে দিল। বান্দিগিরিই আছিল আমগোর কপালে। চিনি যেই বাড়িত কাম করত, হেই বাড়ির সাইবের খাইসলত আছিল খারাপ। চিনির বুহো বুলে আত দিত। বিবিসাইব দেইখ্যা চিনিরে খেদাইয়া দিছে। মা কত বাড়িত ঘুরল চিনিরে কামে দিবার। বিবিসাইবরা হেরে রাহে না। ডরায়। কয় আমরা ডাঙ্গর মাইয়া কামে রাহি না। চিনি অহন এক বাড়িত আছে, সাইব বিদেশো থাহে, বিবিসাইব থাহে পুলাপান লইয়া একলা।

    মা বলেন–ডাইনদিকে খাজ্যাইতাছে, উহুন পাইবি। খুঁজ।

    মণি মা’র মাথার ডানদিকে বিলি দিতে দিতে বলে–মা আমগোর মাতার উহুন মচকা দিয়া আনত। আনহে একটা মচকা কিন্যা লইনযে, উহুন ঝুরঝুরাইয়া পড়ব।

    মণির পরনে মলিন এক জামা, জামার তলে ছেঁড়া পাজামা। বছরে দুদিন পায়ে সেন্ডেল পরে, ঈদে। ঈদের পরদিনই তা খুলে রাখতে হয়, পরের ঈদে পরার জন্য। ঈদের দিন গোসল করে জামা সেন্ডেল পরে মণি আমাদের কাছে হাতের তালু পেতে পাউডার চায়। পাউডার পেয়ে খুশিতে সে দৌড়োয় পাকঘরের ভাঙা আয়নার সামনে, মুখ শাদা করে পাউডার মাখতে। ওইটুকুন আনন্দই জোটে তার বছরে। শাদা মুখে লাজুক হেসে বাড়ির বড়দের পায়ে ঈদের সালাম ঠুকে ফিরে যেতে হয় তাকে আবার পাকঘরে, ঈদের দিনের রান্নায় দম ফেলার জো নেই, সারাদিন বড় বড় পাতিলে পোলাও মাংস রান্না চলে। সারাদিন যায় মণির ফুঁকনি ফুঁকে চুলো ধরাতে, থাল বাসন মাজতে। মণির ঈদের জামা সন্ধেবেলাতেই মশলার রঙে, ছাইয়ে, কাদায় মলিন লাগে দেখতে।

    — মায়েরে মাইনষে কইছিল, উকুন এনে নখে টকাশ করে ফুটিয়ে মণি বলে একটা বিয়া বইতে। জামাই আবার পলায় যদি, খেদাইয়া দেয় যদি। মায়ে বিয়া বয় নাই। আমার বেতনের টেহা জমলে, আমি মারে লইয়া, চিনিরে লইয়া গেরামো যাইয়াম গা, যাইয়া একখান ঘর তুলবাম, মুগ্গা মুগ্গি কিইনা পালবাম। মুগ্গা মুগ্গি ডিম দিব, বাইচ্চা দিব, হেইতা বাজারো বেচলে আমগো ঠিহই পুষাইব।

    মণির চোখে রাজহাঁসের মত সাঁতরায় স্বপ্ন। মাসে পাঁচ টাকা বেতন তার এ বাড়িতে। কখনও সে তার বেতনের টাকা হাতে নিয়ে দেখেনি। মা’র কাছে টাকা জমা আছে। মণির যখন বিয়ে হবে, মা বলেছেন তাকে জমানো টাকা দিয়ে সোনার দুল বানিয়ে দেবেন একজোড়া, নাকের একটি ফুলও।

    — শুনার দুল দিয়া কি করাম! বিয়া বইলে আবার জামাইয়ে পুলা না অইলে যদি খেদাইয়া দেয়! আমারে বেতনের টেহাটি দিয়া দেইনযে, যহন যাইয়াম।

    মণির চোখের ভেতর রাজহাঁস গ্রীবা উঁচিয়ে। মণির স্বপ্নের ঘরে মা তার দুই মেয়ে চিনি আর মণিকে নিয়ে মাংসের ঝোল মেখে পেট পুরে ধোঁয়া ওঠা ভাত খেয়ে নীল মশারির নিচে নকশি কাঁথা গায়ে ঘুমোয়। এর চেয়ে বড় কোনও স্বপ্ন দেখতে মণি জানে না।

    সপ্তা দুই পরে বাড়িতে মা বাবা কেউ নেই, বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি পাড়ার মেয়েরাও আসেনি খেলতে, মণি বাসন মাজছে উঠোনে বসে, নারকেলের ছুবলায় ছাই মেখে। আমারও ইচ্ছে করে এলুমিনিয়ামের কালি পড়া বাসনগুলোকে মেজে ধবধবে শাদা বানাতে। মণির হাত থেকে পাতিল টেনে নিয়ে ছাইমাখা ছুবলায় ঘসি। ওর মুখ নীল হয়ে ওঠে আমার কান্ড দেখে, ঢ়োঁক গিলে বলে–খালুজান জানলে আমারে মাইরা ফালাইব আপা। আনহে যাইন। আমারে কাম করতে দেইন।

    — কেউ জানব না। তুই কাউরে কইস না। চল তাড়াতাড়ি মাইজা আমরা এক্কা দোক্কা খেলি। আমি বলি।

    মণির একটি চোখ খুশিতে নাচে। এক্কা দোক্কা সে হয়ত খেলেছে কখনও, এ বাড়িতে নয়। এ বাড়িতে চাকরানিদের খেলার নিয়ম নেই।

    — খেলবাইন আমার সাথে? খালা জানলে আমারে মারব। মণি চারদিক তাকায়, বাড়িতে কেউ নেই জেনেও তাকায়। তার আরেক চোখে দ্বিধা।

    — কেউ জানব না। গেট খুলনের শব্দ পাইলে আমরা খেলা বন্ধ কইরা দিয়াম। মণির দ্বিধার চোখটিতে চেয়ে বলি।

    উঠোনে দাগ কেটে এক্কা দোক্কা খেলি আমি আর মণি। বড়লোক আর ছোটলোক। মণিকে এত খুশি হতে কখনও দেখিনি আমি। ও ভুলে যাচ্ছিল আমি তার মনিবের মেয়ে। যেন আমরা অনেকদিনের সই, দু’জনই আমরা ছোটলোক, অথবা দু’জনই বড়লোক। হাতে পায়ে ধুলো আমাদের। আমি কিনি এক্কা, তেক্কা, যমুনা, মণি কেনে দোক্কা, চৌকা। খেলা পুরোদমে চলতে থাকে, এমন সময় কালো ফটকে শব্দ, ছিটকে পড়ি দু’জন দু’দিকে। মণি দৌড়োয় পাকঘরে। আমি পায়ে এক্কাদোক্কার দাগ মুছে দৌড়োই ঘরে, সোজা পড়ার টেবিলে। পাকঘর থেকে তড়িঘড়ি কাচের বাসন পত্র নিয়ে মণি দৌড়োয় কলপাড়ে, ধোবার কথা ছিল এসব। কলপারে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বেচারা, ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে কাচের গ্লাস, চিনেমাটির থাল, বাটি কাপ শত টুকরো হয়ে। মা দেখেন তাঁর শখের বাসনের হাল।

    চুলের মুঠি ধরে টিউবয়েলের হাতলের ওপর মণির কপাল ঠোকেন মা। কেটে রক্ত ঝরে কপাল থেকে। হাতলের গায়ে লেগে থাকে রক্ত। মণি ফ্যাকাসে চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। সে দিনই মণিকে বিদেয় করে দেওয়া হয়। দুটো ছেঁড়া জামা আর ঈদের সেন্ডেল পুঁটলিতে বেঁধে চোখের জল মুছতে মুছতে মণি মা’কে বলে–আমার বেতনের টেহাটি দেইন খালা।

    মা বলেন–কত বড় সাহস তর বেতনের টেহা দাবি করস! তুই আমার বাসন কিইনা দে, ভাঙছস যেইডি। তর বেতনের জমা টেহা দিয়া আমার বাসন কিনতে অইব। দূর অ। দূর অ আমার চোক্কের সামনেথে।

    মণি দূর হয় পুঁটলি বগলে করে। দু’বছরে এ বাড়ি থেকে তার অর্জন দুটো ছেঁড়া জামা আর একজোড়া কাল ফিতের সেন্ডেল। মণি তার মায়ের কাছে যাবে, মা তাকে অন্য কোনও বাড়িতে কাজে দেবে আবার পাঁচ টাকা মাসে। মণি আবার স্বপ্ন দেখবে। আমি বারান্দার থামে হেলান দিয়ে মণির চলে যাওয়া দেখি। ও মিলিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারে। ওকে পেছন ফিরতে দেখি না। ফুলবাহারিও এরকম চলে গিয়েছিল একদিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে, পেছন ফেরেনি। সন্ধে থেকে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। কুয়াশায় ভিজে যেতে থাকে ঘাস মাটি, ভিজতে থাকি আমি। চোখের পাপড়িগুলোয় শিশির জমে আমার। প্রফুল্লদের বাড়ি থেকে শিউলি ফুলের গন্ধ এসে আমাদের আঙিনা ভরে যায়।

    মা দুনিয়া দারি ছেড়ে দিতে চান, কিন্তু হাঁড়ে মজ্জার দুনিয়াদারি তাঁকে ছেড়ে কোথাও যায় না। চিনেমাটির থাল বাটি আর কাচের গ্লাসের জন্য মা এমনই কাতর হন যে মাগরেবের নামাজেও তিনি মন বসাতে পারেন না।

    বারান্দায় বসে কুঁ কুঁ করে কাঁদতে থাকে রকেট। মা জায়নামাজে বসে চেঁচান– কুত্তাডারে দূর কর। কুত্তা থাকলে বাড়িত ফেরেসতা আয়ে না।

    মিশনারির এক পাদ্রী যুদ্ধের পর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন তাঁর কুকুরটিকে দিয়ে গেছেন ছোটদাকে, ছোটদা গিটার শিখতে যেতেন মিশনারির কাছে এক বাড়িতে, যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখতেন বিশাল এক কুকুর পাদ্রীর পেছন পেছন হাঁটছে, ছোটদা কুকরটির দিকে বিস্ময়- চোখে তাকিয়ে থাকতেন। কুকুর বল মুখে নিয়ে দৌড়োত, পাদ্রী হাত বাড়িয়ে দিলে সেও ডান পা তুলে দিয়ে হ্যান্ডশেক করত। সেই কুকুর আমাদের বাড়ি আসার পর হৈ চৈ পড়ে গেল। রকেট বলে ডাকলেই কুকুর রকেটের মত দৌড়ে আসে। হাত বাড়ালে কুকুরও হাত বাড়ায়। বাবা বললেন–বাড়িতে কুকুর একটা দরকার আছে। কুকুর চোর খেদাইব। বাবা কসাইখানা থেকে সস্তায় হাড়গোড়অলা একধরনের মাংস কিনে আনেন রকেটের জন্য, জলে সেদ্ধ করে ওগুলো ওকে দেওয়া হয় খেতে। রকেটের আবার বাজে অভ্যেস, ফাঁক পেলেই ঘরের সোফায় গিয়ে শোয়। বিছানায় কাদা পায়ে ওঠে। নানিবাড়িতেও কুকুর দেখেছি, ঠিকানাহীন কুকুর, রাস্তায় ঘুরত, ক্ষিধে পেলে আজ এ বাড়ি কাল ও বাড়ি গিয়ে বিরস মুখে বসে থাকত, ফেলে দেওয়া এঁটোকাঁটা লেজ নেড়ে নেড়ে খেয়ে গাছের ছায়ায় ঘুমোত। ওসব কুকুর লোকের লাথি খেত, ঢিল খেত, গাল খেত। আর রকেট দেখি মানুষের মত আরাম চায়। গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে লেজ নাড়ে খুশিতে। কিন্তু মা বলে দেন–কুকুর হইল নাপাক জিনিস, নাপাক জিনিসরে দূরে রাখ। ব্যস রকেটের ঘরে আসা বন্ধ, বারান্দায় ঘুমোবে দিনে, রাতে শেকল ছেঁড়ে দেওয়া হবে, চোর তাড়াবে। রকেট চোখের আড়ালে থাকে দিনের বেলা, টিনের ঘরের বারান্দায়, কে যায় ওদিকে! হাবিজাবি জিনিসপত্র থাকে ও ঘরে। সারাদিন এমন হয় রকেটের ফুটো টিনের থালা খালি পড়ে থাকে। মা ভুলে যান রকেটকে খাবার দিতে। রাতে কুঁ কুঁ শব্দে কাঁদে রকেট।

    ইস্কুল থেকে ফিরে আমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করি–রকেটরে খাওয়া দিছ?

    মা বলেন–দিছি।

    — কহন দিছ? মনে হয় ক্ষিদা লাগছে রকেটের, আবার দেও।

    আমার নাপতানিতে মা রাগেন।–তর এত খোঁজ লওয়া লাগব না কহন দিছি। কুত্তা কহন কি খাইব না খাইব তা আমি বুঝবাম।

    রকেটের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মন বলে রকেট খায়নি। আধপেট খেয়ে আমার থালের খাবার মা’কে লুকিয়ে রকেটের ফুটো টিনের থালে ঢেলে দিই, রকেট লেজ নেড়ে মুখ ডুবিয়ে খায়। মুহূর্তে খেয়ে শেষ করে আরও খাওয়ার আশায় লেজ নাড়তে থাকে।

    বাবাও হঠাৎ হঠাৎ বলেন–কুকুরটা শুকাইয়া যাইতাছে। ওরে খাওয়া দেও না নাকি! মা বাবার ওপরও রাগেন। দাঁতে দাঁত ঘসে বলেন–খাওয়া আমি দিতাছি। খাওয়ার উপরে খাইলে কুত্তার শইলের লুম পইড়া যাইব। অত দরদ থাকলে নিজে রাইন্দা খাওয়াইও।

    রকেট শুকিয়ে যেতে থাকে। পেট মিশে যেতে থাকে পিঠের সঙ্গে। রকেট আবার নিজে শেকল খুলে বেরিয়ে আসতে শিখেছে, বেরিয়ে কালো ফটক খোলা পেলে সোজা চলে যায় রাস্তার ময়লা খুঁটে খেতে। রাস্তার কুকুর দল বেঁধে রকেটকে কামড়ায়। এক পাল নেড়ি কুত্তা আর একা এলসেসিয়ান। এলসেসিয়ান হেরে যায়। রকেটের গায়ে ঘাঁ হতে থাকে। মা বলেন–কুত্তার অসুখ হইছে। ভাত খাইলে বমি করে। কুত্তারে আর ভাত দেওয়া ঠিক না।

    ছোটদা তাঁর গিটারে সুর তোলেন, শিস দিতে দিতে রাস্তায় হাঁটেন, পাশের বাড়ির ডলি পাল শিস শুনে তাদের জানালায় এসে দাঁড়ায়। বন্ধুরা বাড়িতে আসে আড্ডা দিতে, আড্ডা দিয়ে চুলে টেরি কেটে বন্ধুদের সঙ্গে ছোটদা বেরিয়ে যান বাইরে। রকেটের খবর নেওয়া আর তাঁর হয়ে ওঠে না।

    কুত্তা থাকলে বাড়িত ফেরেসতা আয়ে না, মা’র চিৎকার আমাকে এতটুকু নড়ায় না। যেমন আমি দাঁিড়য়েছিলাম, তেমন থাকি। যেন আমি শুনিনি মা কি বলছেন। যেন এ বাড়িতে ফেরেসতা আসুক না আসুক আমার কিছু যায় আসে না। যেন আমি ঝিঁঝির ডাক শুনছি খুব মন দিয়ে। গল্পের বই গেলা এক উদাসীন মেয়ে আমি, মা প্রায়ই আক্ষেপ করেন। আমি আজ না হয় সত্যিই উদাসীন। পথ হারিয়ে মণি যদি ফিরে আসে, গোপনে অপেক্ষা করি এক উদাসীন মেয়ে, কুয়াশায় ভিজে।

    মণিকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর মা দু’দিন ডাল ভাত রাধেঁন, একাই। মেজাজ খচে থাকে মা’র, বাবা বাড়ি ফিরলেই চেঁচান–ছেড়িগুলারে পাকঘরে আইতে দেয় না। অগোর কি বিয়া শাদি অইব না? জামাইরে রাইন্ধা খাওয়াইতে অইব না? বাপের বাড়ি থাইকা সব মেয়েরাই রান্দা শিহে। আর এইগুলান বেডার লাহান চলে।

    বাবা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলেন–এরা লেখাপড়া করে। পাকঘরে কাম করব ক্যা? কাম করার মানুষ রাখি নাই? আমার মেয়েরা যেন পাকঘরের ধারে কাছে না যায়। লেখাপড়া নষ্ট হইব।

    — লেহাপড়া কইরা, মা বলেন, উল্ডাইয়া দিতাছে এহেকটা। বাপ না থাকলে ঘরে, সারাদিন ছেড়িরা খেলে। কামের মানুষ খুজো। আমার একলার পক্ষে রান্ধাবাড়ি সম্ভব না। যে কামের ছেড়িই আয়ে, কাম কাজ শিখ্যা যহন একলাই পারে সব করতে, তহন যায় গা।

    মা রান্নাঘরে যাওয়া বন্ধ করে দেন, চুলোয় আগুন ধরে না। কেউ জানে না কে খড়ি চিড়বে, কে মশলা বাটবে, থাল বাসন মাজবে! রান্না করবে! কাপড়চোপড় ধোবে! ঘরদোর ঝারু দেবে! বাবাকে বোঝানো হয় সংসার অচল হয়ে আছে। তিনি ভাত চাইলে বলে দেওয়া হয় কামের মানুষ নাই, কেডা রানব ভাত! এদিকে, মা, বাবা যেন না জানেন, আমাদের খেতে দেন, বাড়িতে ভিখিরি এলে একবেলা খাবার দেবেন চুক্তিতে মশলা বাটিয়ে, থালবাসন ধুইয়ে, ভাত রাঁধিয়ে, আনাজপাতি কাটিয়ে, রাঁধেন।

    শেষ অবদি নতুন বাজারের উদ্বাস্তু এক মেয়েকে, শুয়ে ছিল ফুটপাতে, ডেকে তুলে নাম ধাম জিজ্ঞেস করে বাবা নিয়ে আসেন বাড়িতে।

    আপাতত, বলেন বাবা, রাখো।

    আপাতত হলেও মা পরীক্ষা নিতে বসেন। মা চেয়ারে বসে ভেতর বারান্দায়, মেয়েটি কাঠের থাম ধরে দাঁড়িয়ে। বয়স আট নয় হবে, নাক বেয়ে সর্দি ঝুলছে, ছাতা পড়া গা, চুল রোদে পুড়ে লাল, পরনে একটি ময়লা হাফপ্যান্ট কেবল, একসময় শাদা ছিল বোধহয় এর রং, এখন মেটে রঙের, পুরু কাদা জমে শুকিয়ে আছে পায়ে। ঠ্যাংএর চামড়া খরার মাটির মত ফাটা। মা তেতো গলায় জিজ্ঞেস করেন–কি নাম তর?

    — রেনু। মেয়ে নাকের সর্দি টেনে ফিরিয়ে নিয়ে নাকে, বলে।

    — কি কি কাম পারস? মা জিজ্ঞেস করেন।

    রেনু কথা বলে না। উঠোনের গাছগাছালি দেখে, হাঁস মুরগি দেখে।

    মা রেনুর আগামাথায় তীক্ষ্ম চোখ ফেলে আবার জিজ্ঞেস করেন–কুনোদিন কাম করছস কারও বাড়িত?

    রেনু মাথা নেড়ে বলে–না।

    –তর মা বাপ নাই? ধমকে শুধোন।

    –মা আছে। বাপ নাই। রেনু নির্বিকার বলে, যেন বাবা মা থাকা না থাকা বড় কোনও ঘটনা নয়।

    মা মিঠে স্বরে জিজ্ঞেস করেন–আরও ভাই বইন আছে?

    — নাহ। যায় আসে না ভঙ্গিতে, রেনু।

    — মশলা বাটতে পারবি? কাপড় ধুইতে?

    রেনু ঘাড় কাত করে, পারবে।

    মা নাক কুঁচকে, রেনুর গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে বলেই কি না, বলেন–ভাত রানতে পারস?

    রেনু আবার ঘাড় কাত করে, পারে।

    পরীক্ষায় পাশ হয় রেনুর। রেনু বহাল হয়ে যায়। মা তাকে কলতলায় পাঠান সাবান মেখে, গায়ের ময়লা তুলে গোসল করতে। গোসল সারলে হাতের তালুতে তেল ঢেলে দেন চুলে মাখার। আমার পুরোনো একখানা জামা পরতে দিয়ে বাসি ডাল দিয়ে পান্তা খেতে দেন। খেয়ে রেনুকে ঘর ঝাড়ু দিতে বলেন, ঘর ঝাড়ুর পর মশলা বাটা, ভাত রাঁধা। মা রেনুর কাজ লক্ষ করেন আড়াল থেকে।

    বাড়িতে কাজের লোক একটি গেলে আরেকটি আসে। মণি গেলে রেনু আসে। এক ছোটলোক গিয়ে আরেক ছোটলোক। ছোটলোকে শহর ভতি। হাত বাড়ালেই ছোটলোক। আমাদের আরাম আয়েশে কোনও ছেদ পড়ে না।

    রেনুর হাতে সংসার তুলে দিয়ে মা পীরবাড়ি যান। মজলিশ শুনে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে বাড়ি ফেরেন। দুনিয়াদারির মা বাপ তুলে গাল দেন, আবার ভাত রাঁধতে গিয়ে জাউ করে ফেললে রেনুর গালে কষে চড় কষান।

    মা’র মেজাজ এই ভাল, এই খারাপ। কাজের লোক মা’র মেজাজের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে এ বাড়িতে। মা’র ভালবাসাও হঠাৎ হঠাৎ উপচে পড়ে। রেনুকে কায়দা পড়াতে বসেন রাতে। রেনু আরবি অক্ষরে হাত রেখে পড়ে আলিফ বে তে সে। আমার পুরোনো জামা একটির জায়গায় দুটো চলে যায় রেনুর দখলে।

    বড়র পিরিতি বালির বাঁধ
    ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণে চাঁদ।

    এ বাড়িতে রেনুর খাপ খাওয়ানোর আগেই রকেট মরে পড়ে থাকে বারান্দায়। মা বাবাকে খবর পাঠান মেথর ডেকে আনতে, মরা কুত্তাডারে বাইরে ফালাইতে। বাবা তাঁর ওষুধের দোকানের এক কর্মচারি পাঠিয়ে দেন। সে রকেটের গলায় দড়ি বেঁধে টেনে বাড়ির বাইরে নিয়ে যায়। উঠোনের মাটির ওপর দাগ পড়ে য়ায় রকেটের যাওয়ার। আমি দৌড়ে গোসলখানায় যাই, কাঁদতে। এই একটি জায়গা আছে বাড়িতে, নিজেকে লুকোনো যায়। রকেট আর রকেটের মত ছুটে আসবে না ডাকলেই। হাতে বিস্কুট নিয়ে দাঁড়ালে দৌড়ে এসে লাফিয়ে বিস্কুট নেবে না মুখে। আমরা রাস্তায় বেরোলে রকেটও বেরোত, পাড়ার লোকেরা হাঁ হয়ে আমাদের এলসেসিয়ান দেখত। মোড়ে গিয়ে বলতাম রকেট বাড়ি যা, আমাদের বাধ্য খোকা এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে যেত। সেই রকেট না খেতে পেয়ে, অসুখে ভুগে, ছলছল চোখে আমাদের দেখতে দেখতে চুপচাপ মরে গেল। কেউ তাকে পশু হাসপাতালেও একদিন নিয়ে গেল না। আমি এ বাড়ির ঢেঙ্গি ছেড়ি, আমি নাক গলালে গাল শুনতে হয়। তাই নিজের নাক কান ঠোঁট সাধ্যমত গুটিয়ে রেখেছিলাম। রকেট মরে যাওয়ার পর নতুন একটি কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এলেন মা নানি বাড়ি থেকে। দেশি কুকুর। ওকে রকেট নামে ডাকার ইচ্ছে ছিল, মা বললেন এর নাম পপি। মা যা বলেন, তাই, পপি। পাবনায় এক কারাপালের কুকুরের নাম পপি ছিল, মা’র শখ তাই পপি রাখার। মা ছাগল পোষে, কবুতর পোষে, মুরগি পোষে, এখন কুকুর। মা তাঁর পপিকে এখন খাওয়ান দাওয়ান। এখন আর তেমন বলেন না কুত্তা নাপাক জিনিস, কুত্তা থাকলে বাড়িত ফেরেসতা আসে না। দেখতে দেখতে পপি মা’র খুব ন্যাওটা হয়ে পড়ে। মা এখন পপির মনিব। মা নিজের পাত থেকে পপির থালে মাংস তুলে দেন। পপিকে খেলা শেখাতে চাই, শেখে না, ছুঁড়ে দেওয়া বল লাফিয়ে মুখে নিতে পারে না। পপি একখানা শাদামাটা চোর তাড়ানো কুকুর হয়ে ওঠে। মা শাদামাটা কুকুরকে আদরযত্ন করেন, রেনুকেও করেন। রেনু মা’র গা টিপে দেয় রাতে। বিলি কেটে দেয় চুলে। মা তাকে আরবি অক্ষর শেখানো শেষ করে বাংলা অক্ষর শেখাতে শুরু করেন। তবু রেনু বিনিয়ে বিনিয়ে ফাঁক পেলেই কাঁদে, তার মা’র জন্য পরান পোড়ে।

    এত করলাম তারপরও কান্দস, মা বলেন, বান্দির জাত বান্দিই থাকবি। বাড়ি বাড়ি বান্দিগিরি কইরাই তর খাইতে অইব।

    বাবা রেনুর ঘাড় ত্যাড়ামির খবর শুনে তার মা’কে খুঁজে পেতে নিয়ে আসেন বাড়িতে। মা’কে বলেন–রেনুর মায়েরেও রাখো। মায়ে ভারি কাম করব, আর ছেড়ি করবে ফুটফইরমাশ।

    রেনুর মা’র জন্য পরদিন বাবা একটা ছাপা সুতি শাড়ি কিনে আনেন। মা শাড়িটির বুনট দু’আঙুলে পরখ করে বলেন কাপড়ডার বাইন বড় ভালা। দামি কাপড়। এরম কাপড় আমিও বছরে দুইডা পাই না।

    কাজে লাগা অবদি রেনুর মা’কে উঠতে বসতে ধমকান মা। বাবা বাড়ি ফিরলে বলেন — এই বেডির স্বভাব চরিত্র ভালা না।

    –ক্যান কি করছে? বাবার চোখে কৌতূহল।

    –বাজার লইয়া দোহানের কর্মচারি আইছিল দুপুরে, দেহি ফিসফিস কইরা কথা কয় হের সাথে। মা বলেন–একখান ব্লাউজ দিছি পিনতে। পিন্দোনা। ব্যাডাইনের সামনে বুক দেহাইয়া হাডে।

    বাবা চুপ করে থাকেন।

    বাবার চুপ হয়ে থাকা দেখলে মা’র গা জ্বলে।

    মাস পার হয় রেনু আর তার মা’কে দিয়েই, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মা আবার অসময়ে বাড়ি ফিরতে থাকেন, জায়নামাজে বসে জিকির করতে থাকেন আল্লাহর। সংসারে এই আছেন তিনি, এই নেই। রেনুর মা’র হাতে অলক্ষে চলে যায় গোটা সংসারের ভার। তেল লাগবে কি নুন লাগবে, কালিজিরা কি এলাচি, রেনুর মা’র কাছেই জিজ্ঞেস করেন বাবা। অবসরে সে চুল বাঁধে, গুনগুনিয়ে গান করে। মা’র দেখে এত রাগ হয় যে বলেন–গান কইর না রেনুর মা। কামের মানুষ কাম করবা। মুখ বুইজা করবা।

    রেনুর মা গুনগুন থামায়।

    সে সময়ই এক রাতে, যে রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে শরৎচন্দোর দেবদাস পড়ে কেঁদে কেটে বালিশ ভিজিয়ে তোষকের তলায় নিরাপদে বইটি রেখে সবে ঘুমিয়েছি, ভীষণ শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠি। শব্দটি ঠিক কিসের প্রথম অনুমান হয় না। কান পেতে থেকে বুঝি মা’র চিৎকার, সেই সঙ্গে দরজায় শব্দ, ধুড়ুম ধুড়ুম। কোনও বন্ধ দরজা ঠেলছে কেউ। জোরে। ভাঙতে চাইছে। বাড়িতে কি ডাকাত এল! আমার হাত পা অবশ হতে শুরু করে, গা ঘামতে। শ্বাস বন্ধ করে শুয়ে থাকি আশংকায়। চোখ বুজে, যেন অঘোরে ঘুমোচ্ছি, যেন গলায় কোপ বসাতে মায়া হয় চোর ডাকাতের। কেউ দৌড়োচ্ছে বারান্দায়। আরও একজন কেউ। তীব্র চিৎকার বারান্দার দিকে আসছে। কেউ একজন গলা চেপে কথা বলছে, কাকে, কি, বোঝার সাধ্য নেই।

    ঘুম আমার যেমন ভাঙে, ইয়াসমিনেরও। ও ফিসফিস করে বলে–কী হইছে বুবু?

    — জানি না। অষ্ফুট স্বরে বলি।

    বুকের ভেতর ধুমধুম করে হাতুড়ি পড়ে আমার। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বারান্দার দাপাদাপি কমে এলে দাদাকে, ছোটদাকে ঘুম থেকে তুলে যে খবরটি দেন মা, তা চোর ডাকাতের নয়। বাবার। বাবা ধরা পড়েছেন রাত আড়াইটায় রান্নাঘরে রেনুর মা’র বিছানায়। মা’র পাতলা ঘুম, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ঘরগুলোয় হেঁটে হেঁটে পরখ করছিলেন দরজা জানালা সব বন্ধ আছে কি না, চোরের উপদ্রব যেহেতু, তাই করেন উঠে। বাবার ঘরের দরজাখানা বারান্দায় যাওয়ার, দেখলেন মা, সিটকিনি খোলা। মশারি তুলে দেখলেন বাবা নেই বিছানায়। পেশাবখানায় খুঁজলেন, বাবা নেই। বারান্দায়, নেই। রান্নাঘরের ভেতর থেকে শব্দ আসছে কিছুর। কান পেতে শুনলেন ভেতরে বাবার গলা আর চৌকির, রেনুর মা যে চৌকিতে বিছানা পাতছে গত সাতদিন ধরে, মটমট আওয়াজ। এত রাতে বাবা শুতে গেছেন রান্নাঘরে রেনুর মা’র সঙ্গে! আমি মশারির চাঁদির দিকে চেয়ে থাকি নিস্প্রাণ। আমার পাশে ইয়াসমিন শুয়ে থাকে বড় বড় চোখ মেলে, নিশব্দে। দুনিয়াদারি ছেড়ে দেওয়া মা বিনিয়ে বিনিয়ে সারারাত কাঁদেন। মা’র কান্নার সঙ্গে জেগে থাকে আমার, ছোটদার, দাদার আর ইয়াসমিনের দীর্ঘনিঃশ্বাস।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন
    Next Article লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.