Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অগোচরা – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প123 Mins Read0
    ⤷

    অধ্যায় ১ – শুরুর আরম্ভ

    পরম নিশ্চিন্তে যে মেয়েটা আমার নগ্ন বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে, সে জানেই না আমি কী ভাবছি। আমি ভাবছি, আদৌ মুক্তি পেয়েছি কি না?

    মুক্তি আছে আমার হাতের নাগালে আর পাশের ঘরে!

    আমি একজন শুটার। ছিলাম আর কি। সত্যি বলতে, হতে হতেও হয়ে উঠিনি। যদি হতাম, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পদক থাকতো আমার ঝুলিতে। কিন্তু সে সুযোগ আমি কখনও পাইনি। বলা ভালো, আমাকে সুযোগই দেওয়া হয়নি। অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল আমাকে, আর এই ঘটনাটাই আমূল পাল্টে দেয় আমার জীবন।

    আমার চেয়ে ভালো শুটার না হয়েও সালেকীন নামের একজন এশিয়ান গেমসের ৫০ মিটার দূরপাল্লার শুটিংয়ে অংশ নেবার সুযোগ পেয়ে যায়। দীর্ঘদিন থেকে সে শুটিং ক্লাবের মেম্বার। অন্যদিকে আমাকে কখনও সাধারণ মেম্বারশিপও দেয়নি তারা।

    সালেহীনের আরেকটি বড় পরিচয় ছিল-প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর আপন ভাগ্নে সে। এদিকে আমি…আমার গল্পটা আসলে সিনেমার মতো। কখনও কখনও মনে হয়, সিনেমাও এমনটা হয় কী না কে জানে!

    এ দেশে মন্ত্রী মানে ছোটখাটো রাজা। নারীকে পুরুষ, পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া সবই করতে পারে এরা। নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ভাগ্নেকে এশিয়ান গেমসে পাঠায় ঐ মন্ত্রী, ধুলিস্যাৎ করে দেয় আমার স্বপ্ন। ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এ রকম সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবো। এমন অন্যায়ের শিকার হয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম, ডুবে গিয়েছিলাম হতাশায়। চারপাশের মানুষজন আমার পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিতো। তাদের এই সান্ত্বনা আরো বেশি অসহ্য ঠেকতো আমার কাছে।

    তীব্র হতাশা নিয়ে এখানে সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করে দিলাম, সঙ্গি হিসেবে পেয়ে গেলাম বাল্যবন্ধু মুন্নাকে। এর আগে তার সঙ্গে অতোটা সখ্যতা ছিল না আমার, ক্লাস টু থেকে এইট পর্যন্ত পড়েছি একসঙ্গে, কিন্তু মুন্না পর পর দুবার ফেল করলে আমাদের স্কুল থেকে টিসি দেয়া হয় তাকে, সে চলে যায় অন্য একটা স্কুলে। এরপর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগও কমে আসে আমার। পাশাপাশি মহল্লায় থাকি বলে মাঝেমধ্যে পথেঘাটে দেখা হতো অবশ্য।

    আমার এমন দুর্দিনে সেই মুন্নাই হয়ে উঠল একমাত্র সহচর। ফেন্সিডিলে আসক্ত ছিল সে, আমার দুঃখ ভোলাতে উদাত্তচিত্তে বোতল বাড়িয়ে দিয়েছিল—সেই থেকে শুরু হয়ে গেল আমারও।

    তবে তার ফেন্সিডিল সেবনের সঙ্গি হলেও আমাকে এক টাকাও খরচ করতে হতো না। ফেন্সি সেবন করার পর প্রচুর চিনি দিয়ে চা পান করতাম নেশা গাঢ় করার জন্য, সেই সাথে চলতো সিগারেট। গভীর রাতে বাড়ি ফিরতাম, কখনও কখনও মুন্নার বাড়িতেও থেকে যেতাম রাতে। সারা রাত আমরা ভিসিআরে হিন্দি-ইংরেজি সিনেমা দেখতাম, সিগারেট খেতাম। ভোরের দিকে ক্লান্তিতে ঘুম আসতো। খুব বেলা করে উঠতাম দুজন। মানুষজন যখন দুপুরের খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিতো, আমরা তখন নাস্তা করতাম। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একটা ঘোরের মধ্যে। ভালো-মন্দ হিসেব করার মতো বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি।

    কিন্তু আমার এই আসক্তির কথা বেশিদিন গোপন থাকেনি।

    বাবাকে হারিয়ে ছিলাম জ্ঞান হবার আগেই, মাকে হারাই ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়। পরগাছার মতো বড় ভাইয়ের সংসারে মানুষ হয়েছি, সেই ভাই নেশা করার কথা জেনে যাবার পর ভীষণ রেগে গেল, চড়থাপ্পড় মেরে গালাগালি করলো আমাকে। তারটা খেয়ে-পরে আমি কী না নেশা করছি! ভাবি আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছিল, এমন ছেলে বাড়িতে থাকলে তার সন্তানেরাও নষ্ট হয়ে যাবে।

    খুব আত্মসম্মানে লেগেছিল কথাগুলো। সেদিনই এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়ি আমি। চিরতরের জন্য। একই এলাকায় থাকার সুবাদে বড়ভাই আর ভাবির সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে গেলে তারা এড়িয়ে যেতো আমাকে। এক সময় আমিও এড়িয়ে যেতে শুরু করলাম। আমার জীবন থেকে মুছে ফেললাম তাদেরকে, হয়ে গেলাম পুরোপুরি পরিবারবিহীন পিছুটানহীন একজন মানুষ।

    মুন্নার বাপের বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল পুরান ঢাকায়, একটা বাদে সবগুলো ভাড়া দিয়ে রাজার হালে থাকতো তারা। গেন্ডারিয়ায় এরকম একটি ভাড়া দেয়া বাড়ির চিলেকোঠায় মুন্নার ঘর ছিল মওজ-মাস্তি করার জন্য। ওখানে ইয়ার-দোস্ত নিয়ে তাস খেলতো, নেশাপানি করতো, কখনও কখনও মেয়েমানুষ নিয়ে আসতো। বাড়ি ছাড়ার পর কিছুদিনের জন্য আমার ঠাঁই হলো সেই চিলেকোঠায়। সেখানে তাস খেলা, মদ্যপান চলতো প্রতিদিন।

    রিপন নামে হ্যাংলা মতোন এক ছেলে ছিল মুন্নার পরিচিত, সেই ছেলে কোত্থেকে যেন অল্প বয়সি তরুণীদের নিয়ে আসতো রাতের বেলায়। মেয়েগুলোকে রেখে চলে যেতো, নিয়ে যেতো পরদিন সকালে। দেখে মনে হতো কলেজপড়ুয়া, খারাপ মেয়ে হিসেবে ওদেরকে মেনে নিতে কষ্ট হতো আমার।

    এমন না যে মুন্না একাই সম্ভোগ করার জন্য নিয়ে আসতো ওদেরকে, প্রতিবার আমাকেও সাধতো কিন্তু আমি কখনও ওসব করিনি। কেন করিনি, জানি না।

    আমার কি ঘেন্না লাগতো? অস্বস্তি হতো? নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। কাজ শেষে মুন্না ঘুমিয়ে পড়তো, নয়তো ছাদের এককোণে গিয়ে সিগারেট খেতো, তখন ওদের সঙ্গে আলাপ করতাম আমি, নিতান্তই আগ্রহ থেকে।

    নাম কি? কই থাকো?

    এই পেশায় কেন আসছো?

    বাড়িতে কে কে আছে?

    সত্যি বলতে, এমন প্রশ্ন শুনে মেয়েগুলো খুবই বিরক্ত হতো। সম্ভবত এরকম প্রশ্ন তারা অনেকবার অনেকের কাছ থেকে শুনেছে। তবে তারা বুঝতো আমি মুন্নার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ঐ চিলেকোঠাতেই থাকি, তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও জবাব দিতো।

    মিথ্যেই বলতো তারা। আমি বুঝতাম, তারপরও ওদের মিথ্যেগুলো শুনতাম আগ্রহ নিয়ে। মিথ্যে যদি ধরা যায়, সত্যিটাও বের করে নেওয়া যায় অনায়াসে। আমি ওদের মিথ্যে থেকে সত্যিটা আন্দাজ করে নিতাম।

    কোনো মেয়েই আসল নাম বলতো না। সুন্দর সুন্দর বানোয়াট সব নাম ছিল ওদের। আর সেসব নামের বেশিরভাগই বাংলা-হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের থেকে নেয়া।

    তবে একজন আমাকে সত্যিকারের নামটা বলেছিল। উত্তরবঙ্গের কোথাও তার বাড়ি, ঢাকায় এসেছিল পড়াশোনা করতে, থাকতো কলেজের হোস্টেলে। হুট করে বাপ মারা গেলে অভাবে পড়ে যায়, টিউশনি করে নিজের অন্ন সংস্থান করতে শুরু করে, কিন্তু ছোটদুটো ভাইবোন আর মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে চেপে বসলে বাধ্য হয়ে কলেজ হোস্টেলের এক সিনিয়র আপুর মাধ্যমে এ পথে নামে।

    মুন্নার কী করে যেন ধারণা হয়ে গেছিল আমি সম্ভবত বহু ব্যাবহৃত কোনো মেয়ের সঙ্গে ওসব করতে আগ্রহী না, তাই এই লাইনে একদম আনকোরা ওই মেয়েটাকে নিয়ে আসে এক দিন।

    তৃপ্তি নামের সেই মেয়েটার চেহারায় ছিল অদ্ভুত মায়া।

    মুন্নাকে যখন বললাম, কুমারী হলেও আমি এসব করবো না, ও তখন বিপাকেই পড়ে গেছিল। পুরো টাকাটা অগ্রিম দিয়ে দিয়েছিল, কিছু না করলেও ফেরত নিতে পারবে না।

    “তাইলে আর কী…আমিই করি।” গাল চুলকে বলেছিল সে।

    তৃপ্তিকে নিয়ে মুন্না তার চিলেকোঠায় ঢোকার সময় দরজার কাছে এসে মেয়েটা পেছন ফিরে তাকিয়েছিল আমার দিকে। ওর চোখে সুতীব্র মায়া মুহূর্তে গ্রাস করে ফেলে আমায়। কী যে হয়, জানি না। হুট করেই মুন্নাকে পেছন থেকে ডাক দেই আমি।

    মত বদলেছি…আমিই করবো!

    অবাক হয়ে মুন্না আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে ছিল কেবল, তারপর অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বলেছিল, “তোর লাইগ্যাই তো আনছি।”

    আমাদের রেখে চুপচাপ ছাদ থেকে চলে যায় সে।

    আমি আর তৃপ্তি সারা রাত গল্প করেছিলাম। ও ওর শৈশবের কথা বলেছিল আমাকে : সাঁতারকাটা শেখা; দুরসম্পর্কের এক ফুফাতো ভাই কৈশোরে ওর বুকে হাত দেবার চেষ্টা করা; শীতের ভোরে ওর মায়ের ভাপা পিঠা বানানো; ঈদের আগের দিন মেহেদি লাগাবার আয়োজন-সব।

    এসব কথা যখন বলছিল, কেমন বিষন্ন হয়ে গেছিল ওর চোখদুটো। ক্ষণে ক্ষণে সেই চোখ উচ্ছ্বল হয়ে উঠলেও পরক্ষণেই আবার ঢেকে ফেলছিল কপট অভিব্যক্তিতে কিংবা বিষণ্ণতার ভারি চাদরে।

    “তুই কি তৃপ্তির প্রেমে পড়ছোস?”

    পরদিন ফেন্সিডিল খাওয়ার পর সিগারেটে টান দিতে দিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল মুন্না।

    তার প্রশ্নটা যারপরনাই অবাক করেছিল আমাকে।

    “আরে ব্যাটা তাজ্জবের কী আছে! এইরহম কাহিনি তো আছে।” তারপর আয়েশ করে সিগারেট টেনে টেনে গল্পটা বলেছিল : “এসএসসি’র পরীক্ষা দেওনের পর আমি আর আমগো মহল্লার দীন ইসলাম নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে গেছিলাম…দীন ইসলাম ক্লাস নাইন থিকা খানকিপট্টিতে যায়…আমরা যহন গেলাম, শবনম নামের এক মাইয়ারে লাগানোর পর হালারপুতে পুরা দিওয়ানা হইয়া গেল। দিওয়ানা মাইনে পুরাই দিওয়ানা… দুইদিন পর পর টানবাজারে যায়। একদিন আমারে কী কয়, জানোস?”

    আমি উন্মুখ হয়ে রইলাম শোনার জন্য।

    “কয়, শবনরে বিয়া করবো!” সিগারেটে শেষ টানটা বেশ জোরে দিয়ে হাসতে লাগলো মুন্না। “পুরা মাথা খারাপ হয়া গেছিল মাদারচোদের। ওর এই আলগা পিরিতি হোগা দিয়া ভইরা দিছে টানবাজারের মাস্তানরা। ক্যামনে জানি হেরা টের পাইয়া গেছিল…খানকি ভাগাইতে চাস, মাদারচোদ! দীন ইসলামরে এমন মাইর দিছে…থেরেটও করছে…আর যদি টানবাজারে দেহি, মাইরা শীতলক্ষ্যায় ফালায়া দিমু।”

    ঐ মেয়েটাও কি দীন ইসলামকে ভালোবাসতো? এমন প্রশ্ন না করে পারিনি আমি।

    “ক্যামতে কমু,” গাল চুলকে বলেছিল মুন্না। “তয় ঐ মাইয়াও ভাইগ্যা যাইতে রাজি হয় নাই।”

    সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম।

    “খানকিপাড়ায় এইরকম বহুত মানুষ আহে যায়…লাগায়া মাগায়া দিওয়ানা হইয়া কয় ভালোবাসে, বিয়া করবো, বুঝছোস? মাইয়াগুলান এইসব বহুত দেহে…দুইদিন পর এইসব নাগোরগো পেরেম-পিরিতি ফুট্টুস মারে!” কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুন্না আবার বলল, “তুইও কি তৃপ্তির…”

    মাথা দোলালাম আমি। জোর দিয়ে বললাম, ও রকম কিছুই না। মেয়েটার প্রতি আমার মায়া জন্মে গেছে। স্রেফ মায়া। আমার কথা শুনে অবাক হয়েছিল মুন্না। অচেনা মানুষের প্রতি মায়া জন্মে কীভাবে? বিশ্বাস করতে পারছিল না।

    “মায়া করোস ভালা কথা, মায়া কইরা-ই লাগাইতি!”

    মায়া যে কী, মুন্নাকে সেটা বোঝাতে পারিনি। কেন যে মেয়েটার প্রতি আমার হুট করে মায়া জন্মালো, নিজেও জানি না। এই মায়ার তল কিংবা বিস্তৃতি কোথা থেকে শুরু, কোথায় গিয়ে শেষ হয়, তা-ও আমার অজানা।

    শুধু জানি, মায়া খুব খারাপ জিনিস!

    তৃপ্তির সঙ্গে রাত কাটালেও ওকে আমি ছুঁয়েও দেখিনি মেয়েটাও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কেন এমনটা করলাম। ওকে শুধু বলেছিলাম, এমনি। আর মানুষ যখন বলে এমনি…বুঝে নিতে হবে ‘এমনি’টা এমনি এমনি কিছু না, গভীর কারণ রয়েছে এর পেছনে। যে কারণের কথা সে গুছিয়ে বলতে পারে না। কিংবা বলতে চায় না।

    এভাবে কিছুদিন চলার পর মনের ভেতরে খচখচানি শুরু হয়ে গেল-মুন্নার দয়ায় আর কতো দিন? টাকা রোজগারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে আমাকে। নিজের অন্নের সংস্থান নিজেকেই করতে হবে।

    কিন্তু কী করবো আমি?

    এখন পর্যন্ত একটা কাজই ভালোভাবে করতে পারি-লং রেঞ্জের রাইফেল দিয়ে শুটিং করা। বাড়ি ছাড়ার পর পড়াশোনার পাটও চুকে গেছে। জগন্নাথ কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম, ক্লাস করেছিলাম মাত্র কয়েক মাস, হতাশার চোরাবালিতে ডুবে যাবার পর সেখানে আর যাওয়া হয়নি।

    একদিন সেই কলেজের এক ছাত্রনেতা সজল ভাই দেখা করলো আমার সঙ্গে। পাশের মহল্লার বড় ভাই হিসেবে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। আমার মহল্লার কিছু বড় ভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল তার, মহল্লায় নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতো। দেখা হলে সালাম দিতাম, সে-ও আমার খোঁজ খবর নিতো। হয়তো শাঁখারিবাজারের শুকলাল ঘোষে ঢুকেছি কাচ্চি খেতে, দেখি সজল ভাইও আছে সেখানে, ব্যস, বিলের টাকা আর দিতে হতো না আমাকে। এটা পুরান ঢাকার অলিখিত নিয়ম-বড়রা ছোটদের হোটেলের বিল দিয়ে দেয়।

    সজল ভাইয়ের বাপ বিরাট বড়লোক, অঢেল টাকার মালিক, তাই দেদারসে টাকা খরচ করতে কসুর করতো না। ঐদিন আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাবাব-পরোটা খাইয়ে আপ্যায়ন করলো খুব। অন্য সবার মতো সান্ত্বনাও দিলো, সেই সাথে উসকে দিলো আমার ভেতরে থাকা তুষের আগুন।

    “তোর মতো শুটাররে কেমনে বাদ দিলো হারামজাদারা!” আমার কাঁধে স্নেহময় হাত রেখে আক্ষেপের ভঙ্গিতে বলেছিল। “সালেকীনের মামুর আরেক ভাইগ্না আজগর কলেজে ভর্তি হইছে…মামুর জোরে আমাগো পার্টিতে হান্দাইছে।”

    বুঝতে পারলাম, সালেকীনের মামা আমার সাথে যা করেছে, সজল ভাইদের সঙ্গেও তাই করছে।

    “আমরা কতোদিন ধইরা কতো কষ্ট কইরা রাজনীতি করি আর এই হালারপো দুইদিন ধইরা কলেজে ঢুইকা-ই রেডিমেড নেতা হইবার চাইতাছে! ওর হোগা দিয়া আমি নেতাগিরি ঢুকায়া দিমু!”

    এসব রাজনীতির সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমাকে কেন এসব কথা বলছে সজল ভাই?—মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

    “ওরে খায়া ফালাইতে অইবো।”

    আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেছিল। যেন যুগ যুগ ধরে আমরা দুজনে মিলে ‘খেয়ে ফেলার কাজটা করছি একসঙ্গে। স্পষ্ট কথা, তারপরও আমি বুঝতে পারছিলাম না।

    “ত্রিশ হাজার দিমু তোরে…” কথাটা বলেই পকেট থেকে দশ হাজার টাকার বান্ডিল বের করে দেয়। “এই কামটায় কোনো রিস্ক নাই। গোলাগুলির মইদ্যে দূর থেইক্যা মাইরা দিবি…সব ব্যবস্থা করুম আমি। কেউ কিচ্ছু বুঝবার পারবো না।”

    তারপর সবটা খুলে বলেছিল। আমার কাজ কেবল নিরাপদ দূরত্বে থেকে সহি নিশানা লাগানো।

    ত্রিশ হাজার টাকা তখনকার দিনে কম না। হেসেখেলে আমার ছয় মাস চলে যাবে। তারপরও অনেক দ্বিধা ছিল আমার মধ্যে কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল ঐ মন্ত্রীর উপরে ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ উগলে দেবার সুযোগ আর অতোগুলো টাকার হাতছানির যৌথ প্রলোভনে রাজি হয়ে গেলাম আমি।

    জগন্নাথ কলেজে বিবাদমান দুটো ছাত্রসংগঠনের মধ্যে মারামারি লাগার পর কলেজ ক্যাম্পাস দখল করে ফেলেছিল সজল ভাইদের প্রতিপক্ষ সংগঠনটি। ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হবার পর তারা তক্কে তক্কে ছিল পুণর্দখল করার জন্য। কিন্তু একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে ক্যাম্পাস হয়ে পড়ে দূর্গ-সশস্ত্র প্রহরা থাকে দিন-রাত। ভেতরে ঠিক কতোজন কতোগুলো অস্ত্র নিয়ে কোথায় অবস্থান করছে, সেটা নিশ্চিত করে জানার উপায় থাকে না। তার চেয়েও বড় কথা, গুলির মজুদ কী রকম, সেসব জানতে পারা আরো কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজ অবশ্য সহজ হয়ে গেছিল একজনের কারণে।

    সজল ভাইদের নেতা ছিল বাবু বিধান কৃষ্ণ সরকার, পুরান ঢাকার সবাই তাকে বিধুদা বলে ডাকতো। সাহসী হিসেবে খ্যাতি ছিল লোকটার। পুরান ঢাকার অলিগলিতে পোড়খাওয়া লোকজন সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে, নাপিতের চেয়ারে বসে কিংবা মজলিসি আড্ডায় বলাবলি করতো, বিধু মোটেও কোনো সন্ত্রাসী না, সন্ত্রাসী বানানোর কারখানা! প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে ডিঙি নৌকা বাইতো, এমন ছেলেকেও রাতারাতি দুর্ধর্ষ ক্যাডার বানিয়ে দিতো সে।

    সবখানে বিধুদার লোক ছিল। এমন কি শত্রুপক্ষের ভেতরেও! ওদের সব খবর ছিল তার কাছে। কয়টা অস্ত্র, কী কী, কোনটা কে চালায়, কোন অস্ত্রের গুলির মজুদ কতো। দাদা-ই ঠিক করেছিল কবে হামলা চালানো হবে ক্যাম্পাস পুণর্দখল করার জন্য।

    কলেজের ছাত্রনেতা হবার বয়স বিধুদার পেরিয়ে গেছে বহুকাল আগেই, তারপরও এলাকায় আধিপত্য কায়েম রাখতে নিজের দখলে নিতে হবে সেটা। আশেপাশের বাকি কলেজগুলোও তার দখলেই তার স্নেহভাজনরা চালায়।

    এই হামলার আগেভাগেই আমাকে কলেজের বাইরে একটি মার্কেটের ছাদে লংরেঞ্জের রাইফেল নিয়ে ওঁৎ পেতে বসে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় সজল ভাই। ওই ছাদ থেকে ক্যাম্পাসের প্রবেশপথের ভেতরটা পরিস্কার দেখা যায়।

    বিধুদা তার দলবল নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লে আমি মন্ত্রীর ভাগ্নেকে ঘায়েল করবো, সমস্ত দোষ গিয়ে পড়বে প্রতিপক্ষ দলের উপরে। সহজ হিসেব, কাজটাও খুব বেশি কঠিন হবে না আমার জন্য।

    বাইরে থেকে হামলা হতেই আক্রমণের জবাবে ক্যাম্পাসের ভেতরে থাকা প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনটি পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে, গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয় কলেজের আশপাশ। দুপক্ষের এই গোলাগুলি চলে টানা এক ঘণ্টা ধরে।

    রাইফেলের টেলিস্কোপে আমি দেখতে পেলাম বিধুদাকে। দুহাতে দুটো অটোমেটিক পিস্তল দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ছে সশস্ত্র লোকজন নিয়ে। তার মধ্যে ভয়ের লেশমাত্র নেই।

    নিজের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য মন্ত্রীর ভাগ্নেও যোগ দেবে বিধুদার সশস্ত্র গ্রুপে-সজল ভাই এমনটাই বলেছিল আমাকে। নেভি ব্লু টি-শার্ট পরা যে ছেলেটি অটোমেটিক পিস্তল হাতে থাকবে, সে-ই মন্ত্রীর ভাগ্নে, সালেকীনের ভাই।

    কিন্তু টেলিস্কোপে চোখ রেখে আমি বিধুদার সশস্ত্র দলে ওরকম কাউকে দেখতে পেলাম না। কয়েকজনের হাতে পিস্তল, বাকিরা কাটা রাইফেল নয়তো সেকান্দার বন্দুক দিয়ে গুলি ছুঁড়ছে আর এক পা-দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাসের ভেতরে।

    সজল ভাইকে জানালাম, সালেকীনের ভাইকে দেখা যাচ্ছে না।

    “বিধুদারে দেখতাছোস?”

    তাকে তো দেখা যাচ্ছে সবার আগে।

    “বিধুদারে টার্গেট কর্!”

    কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি সজল ভাইয়ের কথা বুঝতে পারলাম না। টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে তাকালাম তার দিকে। আমার ঠিক পাশেই আছে সে, কোমর থেকে পিস্তল বের করে জিন্সের প্যান্টে আলতো করে চাপড় মারলো।

    “জলদি কর্!…ভিতরে ঢুইকা পড়বো!”

    রীতিমতো বজ্রাহত আমি। এরকম কথা শোনার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। সজল ভাই তার নিজের নেতাকে মারতে চাচ্ছে!

    “যা কইতাছি কর্!” পিস্তলটা দিয়ে নিজের গাল চুলকে খুবই শান্তকণ্ঠে আদেশ করলো।

    দম বন্ধ হয়ে এলো আমার। চট করেই বুঝে গেলাম, তার কথার বরখেলাপ হলে আমার জন্য কী পরিণতি অপেক্ষা করবে। কিন্তু এটাও মাথায় জেঁকে বসলো, কাজ শেষে আমাকে…

    “গুলি কর্!” তাড়া দিলো সজল ভাই

    জীবনের প্রথম মিশনেই, রীতিমতো গানপয়েন্টে আমি। ভয়ানক বিপদ। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।

    বিধুদাকে টেলিস্কোপের ক্রশ-হেয়ারে নিয়ে নিলাম। সে তখন ক্যাম্পাস দখল করা জেনারেলের ভূমিকায়। দুহাতে পিস্তল নিয়ে নিজের ক্যাডার বাহিনিকে নির্দেশ দিচ্ছে

    জায়গামতো অবস্থান নেবার জন্য। ততক্ষণে ভেতরে থাকা প্রতিপক্ষ দলের ক্যাডাররা ক্যাম্পাস থেকে সটকে পড়তে শুরু করেছে। আকাশের দিকে তাক্ করে বিধুদা গুলি ছুঁড়তে লাগলো প্রতিপক্ষকে পালানোর সুযোগ করে দেবার জন্য।

    ট্রিগার না চেপে আর কোনো উপায় ছিল না।

    আমার অব্যর্থ নিশানা বিধুদাকে বিদীর্ণ করে ফেলল! সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়লো সে। সদ্য ক্যাম্পাস দখল করা তার ক্যাডার বাহিনি হতভম্ব হয়ে পড়লো এ ঘটনায়। এলোপাথারি গুলি ছুঁড়তে শুরু করলো তারা।

    আমার দম বন্ধ হয়ে এলো। এই বুঝি সজল ভাইয়ের পিস্তলটা গর্জে উঠবে, পেছন থেকে উড়িয়ে দেবে আমার মাথার খুলি!

    “গুটায়ে ফেল সব…জলদি কর্!”

    সজল ভাই তাড়া দিলো। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। এ যাত্রায় প্রাণটা বেঁচে গেল তাহলে!

    রাইফেল, টেলিস্কোপ আর স্ট্যান্ডটা গুটিয়ে ব্যাগে ভরে নেবার পর সজল ভাই আমাকে নিরাপদে বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিলো। কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারলো না কিন্তু সারাটা রাত নির্ঘুম কাটলো আমার। মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো, যা করেছি ঠিকমতো করতে পেরেছি তো?

    পরদিন সজল ভাই ডেকে পাঠালো আমাকে। ইসলামপুরের পরিত্যক্ত এক হিন্দু-বাড়িতে দেখা করলাম। নির্জন দোতলায় একটা চেয়ারে বসে বিয়ার খাচ্ছে বিমর্ষ মুখে। গত বছর স্বৈরাচারের পতনের পরই এই বাড়িটা দখলে নিয়েছে সে।

    “হালায় তো মরে নাই,” আফসোসের সুর তার কণ্ঠে। “গুলি ঠিকই লাগছে, তয় হাতে…” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আরেকটু এইদিক ওইদিক হইলেই কাম হইয়া যাইতো।”

    অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রাখলাম আমি।

    “যাউকগিয়া, কেউ যেন এইটা জানবার না পারে, আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলল সজল ভাই। “জানবার পারলে আমি তো শ্যাষই…তুই-ও খাম হইয়া যাইবি। বুঝছোস?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে পুরো ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে দিলো।

    এটা আমি আশা করিনি। ভেবেছিলাম কাজ যেহেতু হয়নি টাকা আর দেবে না।

    চুপচাপ টাকাগুলো নিয়ে চলে আসি ওখান থেকে।

    অধ্যায় ২ – তৃপ্তি

    কেউ কিচ্ছু জানতে পারেনি, বুঝতে পারেনি আমি কী করেছি।

    পরদিন মুন্নাকে যখন বললাম তৃপ্তিকে নিয়ে আসার জন্য, সে খুব অবাক হয়েছিল।

    “লাগাইবি?”

    আমি এর কোনো জবাব দেইনি। তবে আর কোনো প্রশ্নও করেনি মুন্না। এই একটা কারণে ওর সাথে আমার ভালো বনতো খুব কম প্রশ্ন করতো। তার চেয়েও বড় কথা, প্রশ্ন করার পর উত্তর না পেলে চাপাচাপি করতো না। এভাবে প্রশ্ন হজম করা সহজ কাজ নয়, অসাধারণ গুণের ব্যাপার এটা।

    সেদিন রাতেই রিপন নামের ছেলেটা নিয়ে এসেছিল তৃপ্তিকে। মুন্না আমাদের দুজনকে রেখে চলে গেছিল চুপচাপ। মেয়েটার সঙ্গে গল্প করেছিলাম আমি। ও আমাকে অনেক কথা বলেছিল, আমিও আমার কথা বলেছিলাম ওকে। কে কতোটা মিথ্যে বলেছিল, সত্যি বলেছিল, জানি না। তবে ওর সঙ্গে গল্প করতে আমার ভালো লেগেছিল। সম্ভবত তৃপ্তিরও ভালো লেগেছিল।

    রাতভর গল্প করেছি আমরা, সেই সাথে কাবাব-পরোটা আর কোল্ডড্রিঙ্কস খেয়েছি। ঠিক যেমনটা বন্ধুদের সাথে করি সেভাবে একটা সিগারেটও ভাগ করে খেয়েছিলাম। ভোরের দিকে ও ঘুমিয়ে পড়লে আমি ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে ছিলাম। কতোই না নিষ্পাপ লাগছিল দেখতে! ওর মুখটা খুব ছুঁতে ইচ্ছে করলেও দমিয়ে রেখেছিলাম নিজেকে। আশ্চর্য, ওকে এত কাছে পেয়েও ওর প্রতি কোনো যৌন তাড়ণা অনুভব করিনি। যদিও দেখতে খুব আকর্ষণীয় ছিল ও। প্রচলিত অর্থে সুন্দরিই বলা যায়।

    সকালে রিপন আসার আগেই আমি ওর হাতে বিশ হাজার টাকা তুলে দেই।

    “এত টাকা!…কী জন্যে?” অবাক হয়েছিল খুব।

    পরিচয়ের পর অনেক কথার মধ্যে ও বলেছিল, সেলাইয়ের কাজ পারে। এই টাকা দিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনতে পারবে, তাতে করে হয়তো অভিশপ্ত পথে আর নামতে হবে না।

    বাড়িয়ে দেয়া টাকার দিকে না, স্থিরচোখে ও চেয়ে ছিল আমার দিকে। সেই চোখে ছিল অঢেল মায়া। আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওর মুখটা দুহাতে ধরে বলি : এই অভিশপ্ত জীবন থেকে বের হয়ে যাও। এটা তোমার জন্য না!

    কিন্তু পারিনি। এটা করতে প্রেমিক হৃদয় লাগে; লাগে, নিজেকে অকপটে প্রকাশ করার সামর্থ্য। আমি মোটেও সে রকম কেউ না।

    এক পর্যায়ে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে থেকেই বলেছিল, “দয়া করতাছেন?”

    তার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। আমার কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে মায়াভরা চোখে তাকিয়েছিল ও। আমার ইচ্ছে করছিল ওর মুখটা দুহাতে ধরে বলি, এত মায়া কেন তোমার চেহারায়!

    কিন্তু আমি সেটাও করতে পারিনি। শুধু বলেছিলাম, আমি চাই না ও এসব কাজ করুক।

    “আমারে বাঁচাইতে চাইতাছেন?”

    মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলাম আমি।

    “ক্যান?”

    ওর এ কথার জবাবে কিছুই বলতে পারিনি। আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটাও আর কিছু বলেনি। উদাস চোখে চুপ মেরে ছিল কেবল। তার টল টলে চোখের দিকে তাকিয়ে আমি টের পেয়েছিলাম, মায়া শুধু খারাপই না, ভয়ঙ্করও!

    সম্ভবত আমি চাইনি এই নিষ্পাপ মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাক। আমার মতো বেপথে চলে যাক। আমি আমার নষ্ট হবার কষ্টটা বুঝি! হয়তো সে কারণেই মোমেনাকে নষ্ট হবার পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে এক ধরণের তৃপ্তি পেতে চেয়েছিলাম!

    অধ্যায় ৩ – খপ্পর

    পরের সপ্তাহে কী একটা কাজে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছ দিয়ে বাংলাবাজারে যাচ্ছিলাম, এমন সময় কেউ আমাকে পেছন থেকে ডাকলো।

    তাকিয়ে দেখি বিধুদার ডানহাত হিসেবে পরিচিত নাটকা গেসু। খুবই অবাক হয়েছিলাম, তারচেয়ে বেশি পেয়েছিলাম ভয়। একই এলাকার বাসিন্দা হিসেবে তাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। নাকবোচা এই সন্ত্রাসীর সঙ্গে তেমন একটা কথাবার্তা হতো না আমার, পারতপক্ষে এড়িয়েই চলতাম।

    “দাদায় তোমারে ডাকছে।”

    কথাটা শোনামাত্রই অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল আমার। গেসু জানালো, গতকালই বিধুদা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তো দাদা কেন আমাকে ডাকছে, বুঝতে পারছিলাম না। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করলো। কোনোভাবে কথাটা ফাঁস হয়ে যায়নি তো?

    নাটকা গেসুকে বললাম, আমি একসময় গিয়ে দেখা করে আসবো দাদার সঙ্গে। আমার কথা শুনে সে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।

    “এহনই যাইতে অইবো…আমার লগে!”

    যেন আমাকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছে। গেসুর কোমরে সব সময় পিস্তল থাকে আর সেটা লুকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টা করে না। বুঝতে পারলাম, পালাবার পথ নেই।

    দুরু দুরু বুক নিয়ে হাজির হলাম বিধুদার বাড়িতে। তার ঘরে এর আগেও দুয়েকবার গেছি, সব সময়ই দেখেছি দশ- বারোজন ক্যাডার ভিড় করে থাকে, কিন্তু ঐদিন ঘরে কেউ নেই, একেবারে খালি! শুধু বিধুদা বসে আছে বিছানার উপরে।

    প্রমাদ গুণলাম আমি।

    আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই দাদা অমায়িক হাসি দিলো। সব সময় এমনভাবেই হাসে সে। সন্ত্রাসী হলেও তার আচার- ব্যবহার বেশ ভালো। আমি কখনও তাকে খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি। মুখ গোমড়া দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। লোকে বলতো, মানুষ খুন করার আগেও নাকি তার মুখে হাসি লেগে থাকে।

    “বাম হাতটার উপর দিয়া গেছে…বুঝলি?” ব্যান্ডেজ করা আর সিঙ্গে ঝোলানো বাঁ-হাতের বাইসেপ দেখিয়ে বলল দাদা। “বিরাট বাঁচা বাঁইচ্যা গেছি। একটু ওদিক হইলেই আমি শ্যাষ হইয়া যাইতাম।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এটা আমার চেয়ে ভালো কে জানে!

    “তয় হাতের অবস্থা ভালা না। রাইফেলের গুলি তো, হাড্ডি-গুড্ডি গুঁড়া কইরা দিছে।”

    রাইফেলের গুলি! বিধুদা কীভাবে জানতে পারলো এটা?

    “সামনের মাসে ইন্ডিয়া যামু… ট্রিটমেন্ট করাইতে হইবো।”

    আমার বুকের হাতুড়ি পেটার শব্দটা নিজের কানে শুনতে পেলাম। আমাকে তার পাশে, খাটে এসে বসতে বলল দাদা। বাধ্য ছেলের মতো তাই করলাম।

    “মনিকা? ও মনিকা?” এবার আমার কাঁধে হাত রেখে স্ত্রীকে ডাকলো। “এইখানে একটু ফিনি দিয়া যাও…তোমার এক দেওর আইছে!”

    বিধুদার কথাবার্তা আমার কাছে আরো বেশি ভীতিকর ঠেকলো। বৌদি এসে এক বাটি ফিনি দিয়ে গেলেও নিজের পরিণতি নিয়ে শঙ্কিত আমি, মিষ্টান্নের স্বাদ উপভোগ করার মতো অবস্থায় নেই।

    “গুলি খাওনের পর আমি অনেক ভাবছি, বুঝলি?” থুতনী চুলকে বলল বিধুদা। “গুলিটা ক্যাম্পাসের ভিতর থেইক্যা কেউ করে নাই।”

    এ কথা শোনার পর আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সম্ভবত হৃদস্পন্দনও থেমে গেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

    “ক্যাম্পাসের যেইহানে গুলি খাইছি, কাইলকা হাসপাতাল থিকা সোজা ওইখানে গিয়া দেখছি কোন অ্যাঙ্গেল থিকা গুলিটা করছে!”

    আমার কপাল বেয়ে ঘাম ছুটেছিল কি না তা-ও বলতে পারবো না।

    “কামটা ক্যাম্পাসের বাইরে থিকা করছে!” বিধুদা আমার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “অনেক দূর থেইক্যা মারছে।”

    আমার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হলো।

    “কাটা রাইফেল দিয়া করে নাই…কাটা রাইফেলগুলা তো থ্রি-নট-থ্রি’র হয়…আমারটা ফাইভ পয়েন্ট সিক্স এমএমের। এই জিনিস পুরান ঢাকার কোনো ক্যাডার ইউজ করে না।”

    দাদা একটু থেমে আবার বলল, “ডাক্তারের কাছ থিকা বুলেটটা নিয়া নিছি আমি।” এরপর ফিরনির বাটিটা আমার হাতে তুলে দিলো। “আরে, ঠাণ্ডা হয়া যাইতাছে তো…খাস্ না ক্যালা?”

    যন্ত্রের মতো আমি ফিরনির বাটিটা হাতে নিয়ে বসে রইলাম, যেন এক পেয়ালা মৃত্যু আর আমি সেটা যেচে যেচে পরখ করতে চাইছি না!

    “আমাগো সজল…” কথাটা বলে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে আমার দিকে তাকালো দাদা। “ক্যাম্পাস দখলের আগের দিন কইছিল, ওর নাকি শরীর খারাপ। এহন বুঝবার পারছি, আখা শরীর খারাপ করলো ক্যান।”

    আমি আলতো করে ঢোক গিললাম। আমার গলা চেপে আসছিল। দমবন্ধ অবস্থা। মনে হচ্ছিল, এই ঘর থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবো না।

    “সবকিছু হিসাব কইরা দেখছি, এইটা যে করছে তার হাতের নিশানা সেই রকম! অনেক দূর থিকাও লাগাইবার পারে!”

    বিধুদার পায়ে পড়বো কি না বুঝতে পারছিলাম না। মাথা ভন ভন করতে শুরু করেছে ততক্ষণে।

    “মাগার পুরান ঢাকায় এই রকম তুখাড় শুটার কয়টা আছে, ক তো দেহি?”

    আমার অন্তরাত্মা ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল। দাদা সবই জেনে গেছে। জীবন নিয়ে যে এখান থেকে ফিরে যেতে পারবো না, এ ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই।

    “মাঈনু আছে…ওয় ওইদিন পুরান ঢাকায় আছিল না।” আচমকা আমার পিঠে হাত রাখলো দাদা। “তোর জায়গায় অন্য কেউ হইলে আইজকা আমি বাঁইচ্যা থাকতে পারতাম না!”

    কয়েক মুহূর্ত কিছুই বুঝতে পারিনি আমি। বিধুদা কি আমার সঙ্গে মশকরা করছে? হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে।

    “চাইলে তুই খুব সহজেই মাইরা ফালাইতে পারতি আমারে!”

    ভয়ে ঢোক গিলতেও সাহস হচ্ছিল না। স্মিত হাসি দিয়ে আমাকে আশ্বস্ত করলো দাদা।

    অবশেষে সাহস সঞ্চয় করে সবটা খুলে বললাম তাকে। না বলে আমার উপায় ছিল না। সবই তো জেনে গেছে!

    প্রসন্নভাবে হেসে বলল বিধুদা, “এহন সব ক্লিয়ার!”

    আমি যে এশিয়ান গেমস থেকে বাদ পড়ে হতাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি সেটা জানতো দাদা। আরো জানতো, সজলের সঙ্গে ও আমার চিন-পরিচয় আছে। আর যে ভবনের ছাদ থেকে গুলিটা করা হয়েছে সেটা সজলের দূরসম্পর্কের এক চাচার। এভাবে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে সত্যিটা বের করে ফেলেছে সে।

    লোকে কী আর এমনি এমনি বলে, বিধুদা সন্ত্রাসী না, সন্ত্রাসী বানানোর কারখানা।

    “আরে ব্যাটা, আরেকটু উপরে মারবি না!…মাংসে লাগলে এতোটা ভুগতে হইতো না…হাড্ডি তো গুঁড়া কইরা দিছোস!”

    ঠাট্টারছলে বলেই হাহা করে হেসে ফেলল বিধুদা। আমার মনে হচ্ছিল, হাসতে হাসতেই কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি করে দেবে।

    কিন্তু এ রকম কিছুই করলো না দাদা, আমার পিঠ চাপড়ে দিলো আরেক বার।

    তাকে বললাম, অনেক দূর থেকে শট নিতে হয়েছিল, তা- ও রাতের বেলায়। সোডিয়াম লাইটের হলদেটে আলোয় পরিস্কার দেখতে পাইনি। অনেক কষ্টে তার হাতে লাগাতে পেরেছি।

    “এরশাদ হালারপুতে ঢাকা শহরটারে জন্ডিস বাত্তি দিয়া ভইরা দিছে,” হালকা মেজাজে কথাটা বলেই গুরুগম্ভীর হয়ে গেল বিধুদা। “আমি যে সব বুইঝা গেছি, এইটা কইলাম সজলরে কইবি না। কইলে ওয় তোরে মাইরা ফালাইবো।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

    “চিন্তা করিস না, গাদ্দারির সাজা ওয় পায়া যাইবো সময়মতো।”

    বুঝতে পারলাম, খুব জলদিই মানুষজন দেখবে গুলিবিদ্ধ হয়ে সজল ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে পুরান ঢাকার কোনো গলিতে কিংবা পরিত্যক্ত বাড়িতে।

    অকল্পনীয় হলেও সত্যি, বিধুদা আমাকে ছেড়ে দিলো-আদতে আমাকে নিজের কব্জায় নিয়ে নিলো সে। বলে দিলো, আমি যেন নিয়মিত তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। এমন কি চলে আসার সময় আমার হাতে কিছু টাকাও গুঁজে দিলো।

    ওদিকে মনিকা বৌদি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চোখ কুঁচকে চেয়ে রইলো আমার দিকে। যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে স্বামীর আততায়ীকে।

    এরপর থেকে আমি গোপনে দাদার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে শুরু করে দিলাম।

    ওদিকে সজল ভাই কীভাবে জানি টের পেয়ে গেছিল, তাকে আর এলাকায় দেখা গেল না। শুনলাম, আত্মগোপনে চলে গেছে।

    অধ্যায় ৪ – প্রথমা

    প্রায় দুই মাস পর বিধুদা আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে গেল। তার কথা শুনে বুঝতে পারলাম, আমাকে দিয়ে একটা কাজ করাবে।

    নদীর ওপারে, কেরাণীগঞ্জের এক মাফিয়া ডন মানিককে সরিয়ে দিতে চাইছে দাদা। কোথায়, কিভাবে কী করতে হবে, সবই বলে দিলো, সঙ্গে দিয়ে দিলো তার বিশ্বস্ত সহযোগী নাটকা গেসুকে। এই গিয়াসুদ্দিন আমাকে নিয়ে গেল ওয়ারির একটি ছয়তলা বাড়ির পাঁচতলার খালি ফ্ল্যাটে। ওখানকার পশ্চিমমুখী জানালা দিয়ে মানিকের বাড়ির মেইন গেটটা দেখা যায়। ঐ বাড়িটা যে আসলে মানিকের ছিল সেটা জানতো হাতেগোণা কয়েকজন মানুষ, তাদের মধ্যে বিধুদাও একজন। গেসুর কাছ থেকেই জানতে পারলাম, ওখানে থাকে মানিকের রক্ষিতা শায়লা। মানিক মাঝেমধ্যে আসে সেই বাড়িতে, রাত কাটিয়ে চলে যায় সকালে, সঙ্গে থাকে সশস্ত্র দেহরক্ষী।

    আপাত দৃষ্টিতে কাজটা সহজ মনে হলেও বিরাট বড় ঝুঁকি ছিল। পাঁচতলার জানালা দিয়ে গুলি করামাত্রই মানিকের দেহরক্ষীরা মাজল ফ্ল্যাশ দেখে বুঝে যাবে কোত্থেকে ওটা করা হয়েছে, তখন আর পাঁচতলা থেকে নেমে পালানো সম্ভব হবে না।

    এমন আশঙ্কার কথা শুনে নাটকা গেসু হেসে ফেলল। “এইটা লইয়া তোমারে চিন্তা করতে অইবো না। দাদায় সব ব্যবস্থা করছে।”

    কিন্তু কী ব্যবস্থা, আমাকে খুলে বলল না সে।

    রাত নয়টার পরই ঘরের সব বাতি নিভিয়ে জানালার কাছে রাইফেলটা স্ট্যান্ডের উপর রেখে অপেক্ষা করতে থাকলাম। গেসু আমার সাথেই ছিল, প্রচুর খাবার আর সিগারেট নিয়ে বসেছিল সে। আমার অবশ্য খাওয়ার রুচি চলে গিয়েছিল। একটু পর এক আদম সন্তানকে হত্যা করতে যাচ্ছি- জীবনে প্রথমবারের মতো। হোক না সে ভয়ঙ্কর মাফিয়া, দশ-বারোটি হত্যাকাণ্ডের হোতা; স্মাগলিং থেকে শুরু করে জমিজমার দখলদার!

    আমি জানতাম এই মানিকের সঙ্গে বিধুদার সম্পর্ক বেশ ভালো, কিন্তু হুট করে এতটা খারাপ হলো কেন?

    সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে নাটকা গেসু মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিল, “সম্পর্ক খারাপ অইবো ক্যালা?…ভালাই আছে। এত কিছু তোমার জানোনের দরকার নাই।” সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো বিধুদার ডানহাত। “দাদা কইছে মারতে, তুমি মারবা…কিস্সা খতম!”

    আমি আর কথা বাড়ালাম না, নজর দিলাম মানিকের বাড়ির মেইন গেটের দিকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর রাত এগারোটার একটু আগে সাদা রঙের একটি পাজেরো জিপ এসে থামলো সেই বাড়ির সামনে। প্রথমে গাড়ির সামনের দরজা খুলে নেমে এলো জাঁদরেল চেহারার এক দেহরক্ষী। যেমন লম্বা তেমনি পেটানো শরীর লোকটার। পেছনের সিট থেকে নেমে এলো দ্বিতীয় দেহরক্ষী। আগের জনের মতোই শারীরিক গড়ন তার। চারপাশে তাকিয়ে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা কাউকে ইশারা করলো সে। গাড়ি থেকে নেমে এলো গাট্টাগোট্টা আর নাদুস নুদুস শরীরের মানিক।

    টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে সবটাই দেখছিলাম আমি। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে রাইফেলে একটা সাইলেন্সারও সংযোজিত করেছি এই মিশনের জন্য।

    বাড়ির দারোয়ান গাড়ির হর্ন শুনে গেট খুলে দিলো। মানিক যে-ই না গেট দিয়ে ঢুকবে অমনি প্রথম গুলিটা করলাম আমি। একেবারে তার ঘাড়ের পেছন দিকে। জানতাম, উপর থেকে গুলিটা করেছি বলে মানিকের হৃদপিণ্ড কিংবা ফুসফুস বিদীর্ণ করে ফেলবে বুলেট।

    গাট্টাগোট্টা দেহটা নিয়ে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কেরাণীগঞ্জের শেঠ। তার দুজন দেহরক্ষী কিছু বুঝে ওঠার আগেই আশপাশ থেকে গোলাগুলি আর বোমার শব্দ হতে লাগলো।

    “আরেকটা শট লও!” তাগাদা দিলো আমার পাশে থাকা নাটকা গেসু।

    ঢোক গিলে জীবনের প্রথম খুনটা নিশ্চিত করলাম দ্বিতীয়বার ট্রিগার চেপে। এবার ভূপাতিত মানিকের মাথা লক্ষ্য করে মারলেও গুলিটা গিয়ে লাগলো তার ডান কানের নিচে। মাথার একপাশ প্রায় উড়ে গেল, রক্তের ছটা লাগলো গেটে। নাদুসনুদুস শরীরটা দুয়েক বার কাঁপুনি দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়লো চিরতরের জন্য।

    ওদিকে গোলাগুলি আর ককটেল বিস্ফোরিত হচ্ছে সমানে।

    কারা গুলি করছে?…বোমা মারছে?

    মুচকি হাসলো গেসু। “বোম মুক্তার।”

    পুরান ঢাকায় তখন ককটেল বানানোর জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে বোম মুক্তার নামের এক যুবক। শুধু বানানোই না, সেগুলো ঠিকমতো মারতেও পটু ছিল সে। বিকট আওয়াজ শুনে পুলিশও বুঝে যেতো এটা বোম মুক্তারের বানানো ককটেল।

    মুক্তারের গ্রুপও আছে এখানে?

    “আরে না…ওয় একলাই আছে।’

    আমি যারপরনাই বিস্মিত। মুক্তার একা গুলি করছে!…আবার ককটেলও মারছে?

    “গুলি না…ওইগুলা তাবিজ বোম। ঐ হালায় একাই এক শত…ককটেল আর তাবিজ বোমা মারতাছে সমানে।”

    ছোট্ট তাবিজের ভেতরে ককটেলের মসলা ভরে সেটাকে ক্ষুদে বোমায় রূপান্তরিত করার কারিগর ছিল মুক্তার। বিধুদা ওকে আগে থেকেই বলে দিয়েছিল, মানিক গুলিবিদ্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন ককটেল আর তাবিজ বোমা চার্জ করে।

    কাজশেষে পাঁচতলার উপর থেকে কখন সটকে পড়বো সেটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমি।

    “টেনশন নিও না,” গেসু বলল। “ঐ হালারপুতেরা হোগার কাপড় মাথায় তুইল্যা পলাইছে।”

    জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি মানিকের নিথর আর রক্তাক্ত দেহটা পড়ে আছে মুখ থুবড়ে তার রক্ষিতার বাড়ির গেটের সামনে। পাজেরো গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজা খোলা, দুই বডিগার্ড এবং ড্রাইভার উধাও।

    “…ইন্দুরের গর্তে হান্দাইছে,” মুখে প্রশান্তির হাসি মেখে বলল গেসু। “কইছিলাম না, পলাইবো।”

    ততক্ষণে পথঘাট জনশূন্য হয়ে পড়েছে, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়।

    আমি রাইফেলের স্ট্যান্ড আর রাইফেলটা গুটিয়ে নিলাম ব্যাগে।

    “খাটের নিচে রাইখ্যা দাও,” গেসু বলল। “কাইল আইসা নিয়া যামুনে।”

    তাই করলাম। ফাঁকা ফ্ল্যাটের একমাত্র খাটের নিচে ব্যাগটা রেখে দিলাম।

    মানুষ হত্যার জন্য অনুশোচনা হচ্ছিল। মানিকের মতো খারাপ মানুষ মারা যাক সেটা আমিও চাইতাম কিন্তু সমস্যা হলো সে আমার হাতে মরেছে, আমিই তাকে হত্যা করেছি। আমার জীবনের প্রথম নরহত্যা!

    তবে সত্যি বলতে, মানিককে হত্যা করার জন্য খুব বেশি অনুশোচনায় পুড়িনি আমি। প্রথমদিন রাতে ঘুমোতে সমস্যা হয়েছিল। নিজের মনকে এই বলে বুঝ দিয়েছিলাম, খারাপ একজন লোককে মেরেছি। বেঁচে থাকলে আরো অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করতো সে!

    মানিককে যে দূর থেকে লং রেঞ্জের রাইফেল দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সেটা কেউই বুঝতে পারেনি। বিধুদাকে শুট করার পর সে বুঝে গিয়েছিল, গুলিটা রাইফেলের এখান থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম আমি। একটা ভাইসে আটকে রাইফেলের কার্টিজ থেকে সীসার বুলেটগুলো খুলে একই বোরের পিস্তলের বুলেট লাগিয়ে নিয়েছিলাম, যাতে করে ফরেনসিক টেস্টে প্রমাণ হয় গুলিগুলো রাইফেলের নয়, পিস্তলের। তাছাড়া মানিক গুলিবিদ্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে ওঁৎ পেতে থাকা বোম মুক্তার যেভাবে ককটেল আর তাবিজ বোমা চার্জ করেছে, তাতে করে সবাই ধরে নিয়েছে, একদল আততায়ীর হাতেই নিহত হয়েছে লোকটা। তার দেহরক্ষীরাও একই কথা বলবে-অন্তত নিজেদের মুখ রক্ষা করার জন্য।

    আর সেটাই হয়েছিল। পরদিন শুনতে পাই, একদল অস্ত্রধারীর হাতে নিহত হয়েছে মানিক। তারা পাল্টা গুলি ছুঁড়লেও মনিবকে বাঁচাতে পারেনি। তাদের একজন পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে!

    দৃশ্যকল্পটা আমি তৈরি করে নিয়েছিলাম : ‘দেহরক্ষী’র সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে, ক্যারিয়ার বাঁচাতে নিজের পায়ে গুলি করেছে একজন—অবশ্যই হাঁটুর নিচে, মাংসপেশীতে।

    এ ঘটনার বেশ পরে আমি জানতে পেরেছিলাম, বুড়িগঙ্গা নদীর একটি ঘাট ইজারা নিতে চেয়েছিল বিধুদা, বহু বছর ধরে ঐ ঘাটের ইজারা নিয়ে আসছে মানিক, দাদা তাকে এবারের মতো ক্ষান্ত দিতে বলেছিল। কিন্তু কথা কথা শোনেনি লোকটা, তাই দাদা তার মতো করেই ক্ষান্ত দিয়েছিল কেরাণীগঞ্জের শেঠকে!

    সবার অগোচরে, বহু দূর থেকে আমি যে দক্ষ নিশানায় খুন করতে পারি, তার সদ্ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছিল বিধুদা। মানিককে মারার জন্য আমাকে বেশ ভালো টাকাই দিয়েছিল। মাঝেমধ্যে নাটকা গেসু বিদেশি মদও উপহার দিতো আমাকে। বুঝতাম, এগুলো বিধুদার তরফ থেকেই আসতো।

    অধ্যায় ৫ –  দোমড়ানো সাইকেল

    এই গোপন জীবনটা ভালোমতেই কাটাতে শুরু করলাম আমি। মুন্নার বাড়ি ছেড়ে লক্ষ্মীবাজারের নন্দলাল দত্ত লেনে একটা দোতলায় ঘর ভাড়া নিলাম। দিনের পর দিন কিছুই করতাম না, তারপরও মাস শেষে বিধুদা আমার হাতে ধরিয়ে দিতো বেশ ভালো অঙ্কের টাকা। তখনকার দিনে ওই পরিমাণ টাকা দিয়ে একজন মানুষ রাজার হালে থাকতে পারতো।

    আমিও তাই করতাম। দেরি করে ঘুম থেকে উঠতাম, নাস্তা করতাম পাড়ার ইয়াসির হোটেলে। নেহারি আর নান, নয়তো কলিজা ভুনা, পরোটা-নবাবি নাস্তা যাকে বলে। তবে প্রতি রাতে নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, যে জীবন যাপন করছি সেটা তো কখনও চাইনি। শুটিংয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাবো-এমন স্বপ্ন দেখতে না দেখতেই চুরমার হয়ে গেল, আর সেই ভগ্নস্তুপ থেকে জন্ম নিলো এমন এক খুনির, অলক্ষ্যে থেকে, অগোচরে থেকে যে আঘাত হানে।

    ভাগ্য ভালো, আমার এই পরিণতি দেখে যেতে পারেননি একজন মানুষ। যদি দেখতেন, কী কষ্টটাই না পেতেন তিনি!

    অভাবী আমি, এতিমও বটে। বড় ভাইয়ের দয়ায় তার পরিবারে ঠাঁই পেয়েছিলাম। ছোটখাটো একটা ব্যবসা ছিল আমার ভাইয়ের, নিজের ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ করার পর বাড়তি একজনকে টানার মতো অবস্থা ছিল না, তারপরও তিনি টানতেন। এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছি যেখানে আর যাই হোক, শুটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা সম্ভব ছিল না।

    কিন্তু অসম্ভব ঘটনাটাই ঘটে গেছিল আমার জীবনে, আর এজন্যে পুরো কৃতিত্ব পাবেন মাঈনু ভাই। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, একটা সাইকেলে করে তিনি বাসায় ফিরছেন আর তার পেছনে থাকতো লম্বা ত্রিভূজাকৃতির অদ্ভুত একটি ব্যাগ। কৌতুহলি আমি জানতে পেরেছিলাম, ওটা বন্দুকের ব্যাগ আর মাঈনু ভাই একজন শুটার।

    একদিন তাকে বললাম আমি তার শুটিং দেখতে চাই। সদাহাস্যময় মানুষটি কিছুদিন বাদেই আমাকে তাদের শুটিংক্লাবে নিয়ে গেলেন। ওখানে গিয়ে দেখি তার মতো অনেকেই বন্দুক-পিস্তল নিয়ে আসে শুটিং প্র্যাকটিস করতে, তার মধ্যে বেশ কিছু মেয়েও আছে। বেশিরভাগের রাইফেলের উপরে টেলিস্কোপ বসানো। সেটাতে চোখ রেখে, বেশ সময় নিয়ে নিশানায় গুলি ছোঁড়ে। এসব দেখে এক পর্যায়ে মুখ ফসকে বলে বসলাম, টেলিস্কোপ দিয়ে দেখে দেখে গুলি করা কী আর এমন কঠিন কাজ!

    কথাটা শুনে মাঈনু ভাই মুচকি হেসেছিলেন আর বাকিরা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল, যেন এক নাদান ঢুকে পড়েছে তাদের জগতে, যে জগত সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই।

    প্র্যাকটিসের এক পর্যায়ে আমার হাতে রাইফেলটা তুলে দিয়েছিলেন মাঈনু ভাই, খুশিতে লাফ দিয়ে উঠেছিলাম আমি। আনাড়ি হাতে ইয়া বড় রাইফেলটা ধরে, মাঈনু ভাইয়ের মতো অনুকরণ করে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম শুটিংরেঞ্জে। আমার প্রথম গুলিটা বুলস-আই’তে গিয়ে লাগলে সবাই অবাক হয়ে তাকালো। কেউ একজন বলে বসলো, ঝড়ে বক মেরেছি। জেদ চেপে গেল মাথায়। মাঈনু ভাইও আরেকটা শুট করার অনুমতি দিলেন। আমার দ্বিতীয় গুলিটা প্রথম গুলির ছিদ্রে গিয়ে আঘাত হানে। পুরো শুটিং রেঞ্জে নেমে আসে নিরবতা। বিস্মিত মাঈনু ভাই আরেকটা নিশানা করার জন্য ইশারা করেন তখন। তার চোখেমুখে অবিশ্বাস।

    তৃতীয় গুলিটাও বুলস-আই’তে হিট করলে ক্লাবের সদস্যরা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু মাঈনু ভাই শুধু অবাক হলেন না, স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলেন। আমার মধ্যে যে একজন সহজাত শুটার বাস করে, বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমি হলাম ন্যাচারাল শুটার, একটু প্র্যাকটিস করলেই আন্তর্জাতিক মানের শুটার হতে পারবো। আমাকে তিনি ক্লাবের মেম্বার বানাতে উঠে পড়ে লাগলেন। কিন্তু রাইফেল ছাড়া কীভাবে আমি মেম্বার হবো? আর সেটা কেনার টাকা আমার নেই। বড় ভাইয়ের কাছে এই আব্দার করলে কানফাটা এক চড় মেরে গরীবের এমন ঘোড়ার রোগ সারিয়ে দেবেন তিনি।

    সমস্যার সমাধান করলেন মাঈনু ভাই নিজেই, আমাকে তার পুরনো একটি এয়ার রাইফেল দিয়ে দিলেন। শুধু তাই না, চার-পাঁচ মাস পর কমনওয়েলথ গেমস, উনি চাইলেন আমাকে সেই গেমসের শুটিং টিমে ঢোকাতে।

    শুরু হলো আমার জীবনের আরেক অধ্যায়। মাঈনু ভাই ক্লাবের প্রেসিডেন্টকে রাজি করিয়ে আমাকে প্রাইমারি মেম্বারশিপ দেবার ব্যবস্থা করালেন, তার সঙ্গে সপ্তাহে দু-তিন দিন আমি শুটিংক্লাবে গিয়ে প্র্যাকটিস করতে শুরু করে দিলাম। খুব দ্রুতই সম্ভাবনাময় একজন শুটার হয়ে উঠলাম আমি। ন্যাশনাল লেভেলে যারা চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ ছিল তাদের সঙ্গে আমাকে প্র্যাকটিস করতে দিতেন। প্রচণ্ড আশাবাদী হয়ে তিনি আমার বড় ভাইকে জানিয়েছিলেন, খুব শীঘ্রই আমি বিদেশে যাবো একজন শুটার হিসেবে। কথাটা শুনে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলেন আমার ভাই। কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, আমি কীভাবে এত বড় শুটার বনে গেছি

    ক্লাবে সবাই আমার শুটিংয়ের তারিফ করতো। বলাবলি করতো, কমন ওয়েলথ গেমসে আমি নির্ঘাত স্বর্ণ জিততে পারবো। হয়তো দেশের হয়ে প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণও জয় করবো।

    কিন্তু এসব স্বপ্ন আর আকাঙ্খার মৃত্যু ঘটে একদিন। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, যে কি না আমাকে নিয়ে মাঈনু ভাইয়ের মতোই উচ্ছ্বসিত ছিলেন, তিনি জানালেন শুটিং ফেডারেশন আমাকে কমনওয়েলথ গেমস টিমে রাখেনি। তারা তাদের তালিকা আরো আগেই করে ফেলেছে। তাছাড়া, আমি যতো ভালো পারফর্মেন্সই করি না কেন, ন্যাশনাল লেভেলে অংশ নিয়ে ভালো না করা পর্যন্ত তারা আমাকে বিবেচনায় নেবে না।

    মাঈনু ভাই এতো সহজে হাল ছেড়ে দেননি। তিনি বলেছিলেন, সালেকীন এবং আমার মধ্যে একটা কম্পিটিশনের ব্যবস্থা করতে, যে ভালো করবে তাকেই যেন নেয়া হয় শুটিং টিমে।

    তার এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি ফেডারেশন। পরে মাঈনু ভাই খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, এক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এসব হয়েছে। সেই মন্ত্রীর আপন ভাগ্নে সালেকীনকে সুযোগ দেবার জন্য এইসব অজুহাত দেখানো হয়েছে আসলে।

    এই ঘটনায় আমি একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাঈনু ভাই আমাকে সব ভুলে প্র্যাকটিসে যেতে বলতেন, আগামী বছর ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেবার জন্য আমাকে প্রস্তুত হতে তাগাদা দিতেন। কিন্তু আমার মন ভেঙে গেছিল, শুটিংয়ে আর মন বসাতে পারিনি। হুট করে দেখতে শুরু করা স্বপ্নটা যখন ডানা মেলতে শুরু করলো, তখনই কী না ছেঁটে ফেলা হলো আমার ডানা!

    বড়মুখ করে পরিবার আর আত্মীয়স্বজনকে বলেছিলাম, কমনওয়েলথ গেমসে যাচ্ছি। সেজন্যে বড় ভাই একটা লাগেজও কিনে দিয়েছিলেন, নতুন পোশাকও বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। পরিচিতরা আমাকে নিয়ে গর্ব করতে শুরু করেছিল। এসবই এক লহমায় উবে গেল।

    এটা আমি মানসিকভাবে মেনে নিতে পারিনি। দ্রুতই হতাশার চোরাবালিতে পড়ে গেলাম। এমন খারাপ সময়ে যে মানুষটা আমাকে ভরসা দিতেন, সাহস দিতেন, সেই মাঈনু ভাই একদিন সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময় প্রাইভেট কারের ধাক্কায় মারা গেলেন। তার লাশ দেখার সাহস আমার হয়নি, কেবল দুমড়েমুচড়ে যাওয়া সাইকেলটা দেখেছিলাম।

    মাঈনু ভাইয়ের মৃত্যু আমাকে আরো বেশি কক্ষচ্যুত করে ফেলল। আমি আর কোনো আশার আলো দেখতে পেলাম না। ক্রমেই পরিণত হয়ে গেলাম নেশাগ্রস্ত আর চালচুলোহীন এক মানুষে।

    অধ্যায় ৬ – বাচ্চা

    মানিকের হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় তিন মাস আমি কিছুই করিনি।

    এরপর বিধুদা আমাকে দ্বিতীয় কাজের ভার দিলো। এবারের টার্গেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতা। সম্ভবত এটা ছিল মোটা অঙ্কের একটি কন্ট্রাক্ট। তবে আমি নিশ্চত করে বলতে পারবো না। হতে পারে ঐ ছাত্রনেতার সঙ্গে বিধুদার টেন্ডার নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়েছিল-কিংবা অন্য কিছু।

    যথারীতি নাটকা গেসু সব ব্যবস্থা করলো। আজিজ মার্কেটের আট তলার একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল আমাকে। ঐ ফ্ল্যাটের রাস্তার দিকের জানালা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল দেখা যায়, সেই হলের এক রুমে থাকতো ছাত্রনেতাটি। বিকেলের দিকে হলের বারান্দায় এসে ঐ নেতা সিগারেট ধরাতেই গেসু আমাকে দেখিয়ে দিলো। সব প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম, তাই গুলি করতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি আমার।

    ঐ নেতা গুলিবিদ্ধ হয়ে বারান্দায় লুটিয়ে পড়লেও অনেকক্ষণ যাবত কেউ টের পায়নি। আমরা যখন আজিজ মার্কেট থেকে বের হয়ে আসি, তখন শোরগোল শুনতে পাই।

    এই খুনের এক মাস পরই আরেকটা কাজ দেয়া হয় আমাকে আর কেন জানি আমি সেটা আঁচ করতে পেরেছিলাম আগেভাগেই।

    সজল ভাই!

    “ক্যামনে জানি বেঈমানটা জাইন্যা গেছে!” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল দাদা। “অ্যালার্ট হয়া গেছে খানকির পোলায়।”

    আমি চিন্তিত মুখে তাকালাম তার দিকে। তাহলে কি সজল ভাই জেনে গেছে আমি এখন দাদার হয়ে কাজ করি? যদি জেনে গিয়ে থাকে, তাহলে তো আমার জন্য সেটা ভয়ঙ্কর বিপদের হবে!

    “আমি আর গেসু ছাড়া কেউ তোর কাজকারবারের কথা জানে না!” বিড়বিড় করে বলেছিল দাদা।

    পুরান ঢাকা খুব বেশি বড় জায়গা নয়। ঘন বসতি এলাকা, পোড়খাওয়া রসিকজনেরা বলে, এখানে ঘরে বসে কেউ পাদ দিলেও পাশের বাড়ির লোকজন টের পেয়ে যায়। আমি যে দাদার হয়ে কাজ করছি সেটা জানা একদম অসম্ভব কিছুও নয় এখানে।

    “যাউক গিয়া, গেসু তরে সব ব্যবস্থা কইরা দিবো। আমার কাছে পাক্কা খবর আছে, বেঈমানটা কলকাতা থিকা আইছে।”

    দু-দিন পর গেসু আমাকে নিয়ে গেল ইসলামপুরের এক পুরনো দোতলা বাড়িতে। উচ্চতায় সেটা আধুনিক কালের তিনতলার চেয়েও উঁচু। সেই দোতলার ছাদের তিন ফুট উঁচু মোটা প্রাচীরের আড়ালে বসলাম রাইফেল নিয়ে। প্রাচীরের গায়ে বড় বড় নকশার ফোকরগুলোর একটাকে বেছে নিয়েছিলাম রাইফেলটা সেট করার জন্য। আশেপাশের পুরনো ভবনগুলো ছিল ইলেক্ট্রনিক্সের সরঞ্জাম, চশমা নয়তো ঘড়ির মার্কেট। রাত এগারোটার পর ওগুলো বন্ধ হয়ে গেছিল।

    সজল ভাই গোপনে ঢাকায় ফিরে এসেছে, উঠেছে ইসলামপুরের এক কাপড় ব্যবসায়ীর বাড়িতে। ইদানিং ঐ ব্যবসায়ীর সাথে ব্যবসাও শুরু করেছে সে। অবৈধভাবে আনা বিদেশি আর গার্মেন্টসের কাপড়ের রমরমা ব্যবসা চলে সেখানে। রাত এগারোটা-বারোটার পর সব ট্রাক আসে। স্থানীয় থানাকে ম্যানেজ করে কাজ করে ব্যবসায়ীরা। বড়সর চালান হলে ডিবি-এসবির লোকজনকেও ম্যানেজ করতে হয়। ঐদিন নিজেদের চালান আসবে বলে সজল ভাই সশরীরে উপস্থিত থেকে সেগুলো নিরাপদে আনলোড করাবে।

    কিন্তু রাত বারোটা বেজে গেলেও লোকটা বের হয়ে এলো না সেই বাড়ি থেকে। গেসু যথারীতি সিগারেট ফুঁকে গেল। “বাইর হইবো, টেনশন কইরো না,” আমাকে আশ্বস্ত করে বলল বার বার।

    একের পর এক ট্রাক আর কাভার্ট ভ্যান ঢুকছে, মাল খালাস করছে কিন্তু ঐ বাড়ি থেকে সজল ভাই বের হচ্ছে না।

    আমি না, রাত দুটোর পর খোদ গেসুই হাল ছেড়ে দিলো।

    “খানকিরপোলায় বাইর হয় না ক্যান!” শেষ সিগারেটটায় জোরে টান দিয়ে বলল সে।

    রাত আড়াইটার দিকে পাততাড়ি গুটিয়ে রাইফেল নিয়ে চলে এলাম আমরা। সজল ভাইয়ের মিশনটা সফল হলো না বলে বিধুদা টেনশনে পড়ে গেল।

    “হারামজাদা কি এইবারও বুইঝ্যা গেছে?”

    “কন কী!” বিস্মিত গেসু বলল। “ওয় ক্যামতে বুঝবো?”

    বিধুদা আমার দিকে তাকালো। মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। তিনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন? যে জগতে প্রবেশ করেছি, সেখানে এরকম সন্দেহ করাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আরো স্বাভাবিক, সন্দেহের বশে নিজের লোকজনকে মেরে ফেলা। সত্যি বলতে, আমি বেশ ঘাবড়ে গেছিলাম। নিজের অভিব্যক্তি লুকাতে পারছিলাম না বলে নিজের উপরেই রাগ হচ্ছিল 1 বেঘোরে প্রাণটাই না যায় এবার!

    “বিষয়টা কিন্তু খুব চিন্তার,” বিধুদা আমাকে বলল। “খবরটা লিক হয়া গেছে!”

    আমি ঢোক গিললাম। বিধুদা, আমি আর গেসু ছাড়া এটা কেউ জানে না।

    কয়েক মুহূর্ত গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন রইলো দাদা, কিচ্ছু বলল না।

    গেসু আর আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রতিটা মুহূর্ত যাচ্ছে আর দাদার নিরবতা আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। সম্ভবত গেসুরও।

    “ঠিক আছে, আমি দেখতাছি। তোরা এখন যা। একটু সাবধানে থাকিস,” অবশেষে বলেছিল।

    আমি আর গেসু হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। তবে তার শেষ কথাটা ভাবিয়ে তুলেছিল আমাদেরকে।

    “সজইল্যা হারামজাদা যদি সব জাইন্যা যায় তাইলে কইলাম বইসা বইসা আঙ্গুল চুষবো না…ওয়-ও পাল্টা হিট করবো আমাগো।”

    আতঙ্কিত হয়ে তাকালাম গেসুর দিকে। তার মতো ভয়ঙ্কর একজনকে চিন্তিত হতে দেখে আমিও ভড়কে গেলাম।

    “তুমি তো মিয়া কিছু ক্যারি করো না,” বিদায় দেবার আগে বলল সে। “এহন থিকা লগে একটা বাচ্চা রাখবা, ঠিক আছে?”

    আমি পিস্তল নিয়ে ঘুরবো! অবিশ্বাস্য মনে হলো আমার কাছে।

    “বিকালে কবরস্তানের সামনে থাইকো… দিমুনে একটা,” বলেই গেসু চলে গেল।

    আমাদের মহল্লার ভেতরে বহুকাল আগের ছোট্ট একটি কবরস্তান ছিল, সেখানে এক সময় ছোট বাচ্চাদের দাফন করা হতো। গেসুর বাড়ি ঐ পরিত্যক্ত কবরস্তানের কাছেই। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে অবশেষে আমি সেখানে গিয়ে দেখা করলাম। আমাকে নিয়ে গেসু ঢুকে পড়লো কবরস্তানের ভেতরে, কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে আমার কোমরে গুঁজে দিলো সেটা।

    “সেভেন পয়েন্ট-সিক্স-ফাইভ। ম্যাগাজিন ফুল লোড করা আছে।” একটু থেমে আবার বলল, “উল্টাপাল্টা কিছু দেখলেই বাইর কইরা গুলি কইরা দিবা। তোমার নিশানা তো ভালা…মিস হইবো না একটাও।”

    আমি হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এখন পর্যন্ত যা করেছি সবই অগোচরে। দুয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না আমি অপরাধ জগতে প্রবেশ করেছি। সবাই জানে, আমি একজন শুটার, ছেলে হিসেবেও ভদ্রগোছের। আমি কি গেসুদের মতো কোমরে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি? কিংবা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলি করতে?

    পর্দার আড়ালে থেকে, ধৈর্যসহকারে, অলক্ষ্যে কাউকে শুট করা আর বন্দুকযুদ্ধ এক নয়। আমাকে এখন তটস্থ থাকতে হবে সারাক্ষণ, পথে বের হলে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ইচ্ছে করলেও যেকোনো জায়গায় যেতে পারবো না।

    কিন্তু আমার এসব দুর্ভাবনা তিরোহিত করে দিলো স্বয়ং সজল ভাই। তাকে আর পুরান ঢাকায় দেখা গেল না। কিছুদিন পর শোনা গেল, সে না কি আবারো দেশ ছেড়েছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। গেসুকে ফিরিয়ে দিয়ে এলাম তার বাচ্চাটা।

    অধ্যায় ৭ – বুক তার বুলেটের নিশানা

    ফাঁকা মাঠ পেয়ে বিধুদা ব্যস্ত হয়ে গেল পুরান ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে।

    অনায়াসেই সেটা করতে পেরেছিল দাদা, খুব একটা কষ্টও করতে হয়নি তাকে। দু’ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও আমাকে দিয়ে নতুন কোনো কাজ আর করায়নি।

    তবে গেসু বসে থাকেনি, তাকে একটা কাজ দিয়েছিল দাদা। নিজের দলের ভেতরে খলিল নামে এক বেঈমানকে চিহ্নিত করেছিল সে। জানামতে, ছেলেটা বিশ্বস্তই ছিল কিন্তু দাদার সমস্ত সন্দেহ গিয়ে পড়লো তার উপরে। কোত্থেকে যেন গেসু জানতে পেরেছিল, সজল ভাইয়ের খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে খলিল মেলামেশা করে। ওর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু জানার দরকার পড়েনি। হাতজোর করে খলিল না কি দাদাকে বলেছিল, ঐ ছেলের সঙ্গে সে স্কুলে পড়েছে, তাদের সম্পর্কটা নিছক বন্ধুত্বের, এর সঙ্গে সজলের কোনো সম্পর্ক নেই। সে কোনো রকম বেঈমানি করেনি দাদার সাথে।

    কিন্তু অপরাধ জগতের অঙ্ক অন্য রকম। জটিল আর নির্মম এখানকার হিসেব-নিকেশ। কারো সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গেলেও খুব সতর্ক থাকতে হয়, সেটা যত নির্দোষ সম্পর্কই হোক না কেন।

    আমার মনে নানান প্রশ্ন। দাদা যে সজল ভাইকে মারবে এটা কি খলিল জানতো?

    “না জানলে লিক হইলো ক্যামতে?” গেসুর সোজাসাপ্টা জবাব।

    দ্বিমত পোষণ করলাম আমি। বিধুদা নিজের মুখেই বলেছে, সে বাদে আমি আর গেসু ছাড়া এটা কেউ জানে না।

    কাঁধ তুলেছিল গেসু। “কী জানি! দাদাই ভালা জানে। আমাগো এইটা নিয়া মাথা ঘামানোর দরকার নাই।”

    কিন্তু আমি মাথা ঘামাতে শুরু করলাম। নিছক সন্দেহের বশে নিজদলের বিশ্বস্ত একজনকে যদি খুন করা যেতে পারে, তবে আমি কোন ছাড়! আমার প্রতি সামান্য সন্দেহ তৈরি হলে তো খলিলের পরিণতি বরণ করতে হবে!

    এই হত্যাকাণ্ড ভাবিয়ে তুলল আমাকে, কোনোভাবেই মাথা থেকে তাড়াতে পারলাম না। এরকম সময় ছোট্ট একটা ঘটনা দেখে ফেললাম আমি, আর এটাই আমাকে সবকিছু বুঝতে সাহায্য করেছিল। এটা নিয়ে যদি গভীরভাবে না ভাবতাম তাহলে আজ আমি সাড়ে তিনহাত মাটির নিচে থাকতাম।

    দু-তিন দিন পর গেসু জানালো, দাদা আমাকে দেখা করতে বলেছে, আমি যেন আগামিকাল বিকেলে তার বাড়িতে যাই। কথাটা শুনে বুক কেঁপে উঠল আমার। গেসুর বলার ভঙ্গি কেমন জানি লেগেছিল। পুরান ঢাকায় থাকি, বৈঠকি খুনের কথা আমার অজানা নয়। এক সময় এখানকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একচ্ছত্র অধিপতি আকবর শেঠ টার্গেটকে বৈঠক করার কথা বলে ডেকে নিয়ে হত্যা করতো।

    পরদিন সকালে বেশ দেরি করে ঘুম থেকে উঠলাম, নাস্তা করার জন্য ইয়াসির হোটেলে যেতেই শুনলাম লোকজন বলাবলি করছে, বিধুদাকে একদল সন্ত্রাসী গুলি করে মেরে ফেলেছে। তার প্রাণবায়ু বুকে বিদীর্ণ করা আঠারোটি বুলেটের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে গেছে!

    হাজার হাজার মানুষের মতো আমিও লাশ দেখতে গেছিলাম। দূর থেকে দেখেছি, দাদার রক্তাক্ত নিথর দেহের উপর আছড়ে পড়ে বিলাপ করছে নাটকা গেসু। নিজের বাপ মারা গেলেও মানুষ এমন বিলাপ করে কী না সন্দেহ।

    আর বিধুদার বুকটা যেন বুলেটের নিশানা!

    অধ্যায় ৮ – ধোঁয়াশা

    সত্যি বলতে, বিধুদার মৃত্যুতে আমি অখুশি হইনি।

    এই মৃত্যু আমাকে কাঙ্খিত মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর যখন গেসু এলো আমার কাছে, বুঝতে পারলাম, পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি।

    “সজইল্যাই দাদারে মারছে,” বলেছিল বিধুদার ডানহাত। আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে ছিলাম তার দিকে। সজল ভাই না কি বিদেশের মাটিতে বসে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে আরেক সন্ত্রাসীকে ভাড়া করে বিধুদাকে হত্যা করিয়েছে। টাকার পরিমাণটাও গেসু জানে-ত্রিশ লাখ!

    “বৌদি কলকাতায় গেছে গিয়া হের ভাইয়ের কাছে। এইখানে সব কিলিয়ার অইলে আইবো।”

    কী বলবো বুঝতে পারলাম না, তাই চুপ মেরে রইলাম।

    “সজইল্যা ঢাকায় আইছে, বুক ফুলাইয়া ঘুইরা বেড়াইতেছে…খানকির পোলারে…” দাঁতে দাঁত পিষে বলল নাটকা গেসু। “ওরে না মারতে পারলে তুমি আর আমিও কইলাম শ্যাষ!”

    মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হলাম। যে জঙ্গলে আমাদের বসবাস সেখানে হয় শিকার করতে হবে নয়তো শিকার বনে যেতে হবে—অন্য কোনো বিকল্প নেই। গেসুকে এ-ও স্মরণ করিয়ে দিলাম, গতবারের মতো যেন না হয়।

    “এইবার মিস অইবো না। এইটা আমাগো জানের ব্যাপার।”

    আমাকে আশ্বস্ত করে চলে গেল গেসু। যাবার আগে অবশ্য সতর্ক করে গেল, আমি যেন সাবধানে থাকি। অন্তত সজল যতোদিন বেঁচে আছে।

    এ কথা বলার পর দিনই শ্যামবাজারের এক গলিতে গেসুকে গুলি করে একদল সন্ত্রাসী। বহু হত্যা-খুনের হোতা নাটকা গেসু যেমন সাহসী তেমনি সতর্ক। বিপদের গন্ধ আগেভাগেই টের পেয়ে যায়—ওই দিনও পেয়ে গেছিল। কিছু একটা আঁচ করতেই দৌড়ে পাশের গলিতে ঢুকে পড়ে। একটা গুলিও লাগেনি তার শরীরে।

    আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম আমি। গেসু হয়তো এই হামলার জন্য আমাকেই সন্দেহ করবে। কারণ আমার সঙ্গে দেখা করে সজল ভাইকে হত্যা করার কথা বলার পরই তার উপর এই আক্রমণটা হয়েছে। আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে গেসু আর যোগাযোগ করলো না আমার সঙ্গে। মনে অবশ্য ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তো নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে সে আত্মগোপনে চলে গেছে। ঘটনা যাই হোক, একেবারে গৃহবন্দী করে ফেললাম নিজেকে। উদ্বিগ্ন সময় পার করতে শুরু করলাম আমি। রাতে ঘুম আসতো না, খুঁটখাঁট শব্দেও চমকে উঠতাম। মনে হতো সজল ভাইয়ের ভাড়াটে খুনি কিংবা গেসু চলে এসেছে আমাকে মারতে!

    এক দমবন্ধ আর আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে শুরু করে দিলাম আমি। যে বাড়ির দোতলায় থাকতাম তার নিচতলায় থাকতো তিনজন কলেজ ছাত্র। ছোট্ট বাড়িটার মেইনগেট বলে কিছু ছিল না, যেকোনো সময় যে কেউ ঢুকে পড়তে পারতো। ফলে ঘুম-টুম বাদ দিয়ে সারা রাত জেগে থেকে জানালা দিয়ে নিচে চেয়ে থাকতাম। রাইফেলটাই ছিল আমার একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গি।

    এদিকে বিধুদা নেই, আমার হাতখরচও বন্ধ, জমানো টাকা শেষ হবার পথে। এভাবে একটা সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে গেল সুকঠিন উদ্বিগ্নতার মধ্য দিয়ে। সমস্ত আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে একরাতে দেখতে পেলাম কেউ একজন সিগারেট টানতে টানতে আমার বাড়ির দিকে আসছে!

    শীতকাল, সময়টা ডিসেম্বরের শেষের দিকে, ভারি কুয়াশা পড়েছে। লোকটার মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ, গায়ে লেদার জ্যাকেট। জিন্স প্যান্টের কোমরে যে একটা অস্ত্র গোঁজা আছে সেটা বুঝতে পারলাম।

    দোতলার জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে জমে গেছিলাম কয়েক মুহূর্ত। রাইফেলটা বুকের কাছে নিয়ে বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। বাঁচতে হলে মারতে হবে-না মারলে মরতে হবে!

    অবশেষে জানালা দিয়ে রাইফেলটা তাক্ করতেই লোকটা থমকে দাঁড়ালো, যেন টের পেয়ে গেছে! সিগারেট ফেলে দু- হাত উপরে তুলে ধরলো। বোঝাতে চাইলো, তার দিক থেকে কোনো হুমকি নেই। আস্তে করে জ্যাকেটটাও তুলে ধরলো সে-কোমরে একটা অস্ত্র গোঁজা আছে। এরপর দুহাত তুলে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো। আমাকে আশ্বস্ত করতে চাইলো, কথা বলতে এসেছে, খুনোখুনি করতে না। বাড়ির কাছে চলে আসার পর আমি তার মুখটা দেখতে পেলাম।

    নাটকা গেসুর চোখজোড়া আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমার ঘর অন্ধকার, বাতি বন্ধ করে রেখেছিলাম।

    “জরুরি কথা আছে!” প্রচণ্ড তাড়া গেসুর কণ্ঠে। “উল্টাপাল্টা কিছু কইরো না, ভাই…আমি তোমারে মারবার আহি নাই!”

    তার কণ্ঠে কিছু একটা ছিল, আমি ঠিক বোঝাতে পারবো না। রাইফেলটা আলগোছে সরিয়ে রাখলাম।

    “উপরে আইতাছি আমি…ডরাইয়ো না,” গেসু হাত নামিয়ে ফেলল আস্তে করে।

    আমি কিছুই বললাম না। মেস বাড়ির দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা উন্মুক্ত, জানালা দিয়ে দেখলাম, গেসু ধীর পদক্ষেপে উঠে আসছে।

    গভীর করে দম নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে আস্তে করে সেটা খুলে দিলাম।

    “বাতি জ্বালাইও না, আন্ধারই থাকুক,” গেসু ঘরে ঢুকে বলল।

    আমি আর তার দিক থেকে খারাপ কিছু আশঙ্কা করলাম না। আমার আমকাঠের সস্তা সিঙ্গেল খাটে ধপাস করে বসে পড়লো সে।

    “বহুত কষ্টে বাঁইচ্যা আছি। ক্যামতে বাঁইচ্যা আছি আল্লা জানে!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, “তুমি এহনও এইখানে আছো, মিয়া! সজইল্যা তো তোমারে খায়া ফালাইবো।”

    আমি যাবোটা কোথায়? করবোটা কী? একটা সপ্তাহ ধরে চোখে ঘুম নেই, সারা রাত পাহারা দেই জানালার সামনে বসে বসে।

    গম্ভীরভাবে মাথা দোলালো গেসু। “খানকির পোলায় পরশুগা আরেকবার অ্যাটেম্প নিছিল আমার উপরে!

    গেসুর উপর দ্বিতীয়বার যে হামলা করা হয়েছে সে খবর আমার জানা ছিল না।

    “কাপড়া মাকানে আমার মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে আছিলাম, রাইতে সিগরেট কিনার লাইগ্যা বাইর হইছি আর দেহি তিন-চাইরটা পোলা খাড়ায়া রইছে গল্লির মাথায়…আমারে দেইহা-ই গুলি করা শুরু করলো। কোনোমতে জানটা লইয়া পলাইছি।”

    গেসুর কথা শুনে আমার বিশ্বাস হলো না। পর পর দুবার সে সিনেমার নায়কদের মতো খুনিদের হাত থেকে বেঁচে গেছে! কেনজানি মনে হচ্ছিল, সবটা বানিয়ে বানিয়ে বলছে সে। সজলের হয়ে কাজ করছে না তো?

    ভীষণ সন্দেহ হলো আমার, আর সেটা গোপনও করলাম না। সে যে সূত্রাপুরের কাপড়া মাকানে আছে, এটা সজল কীভাবে জানতে পারলো? তার মামাতো ভাই নিশ্চয়ই বলেনি?

    “ওয় কেন কইতে যাইবো?” জোর দিয়ে বলেছিল নাটকা গেসু। “মাগার কেমতে জানলো বেঈমানটা, বুঝবার পারতাছি না।”

    আমিও কিছু বুঝতে পারছিলাম না। সবটাই ধোঁয়াশা বলে মনে হচ্ছিল।

    অধ্যায় ৯ – হিসেব

    এতোদিন ধরে একটা হিসেব মেলাতে পারিনি, এখন মিলে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা ঘটনা দেখার পর থেকে সন্দেহটা জেঁকে বসে আমার মধ্যে।

    কয়েক মাস আগে, বিধুদা তখন বহাল তবিয়তে পুরান ঢাকায় রাজত্ব করছে, জিন্দাবাহার লেনে এক বন্ধুর বাসায় আড্ডা দিয়ে বের হবার সময় দুজন মানুষকে দেখেছিলাম কয়েক মিনিটের ব্যবধানে একজনের মুখে ছিল মারপিটের চিহ্ন, অন্যজনের চোখেমুখে উন্মত্ত ক্রোধ।

    আমি দেখেছি মনিকা বৌদি জিন্দাবাহার লেন থেকে বের হচ্ছে রিক্সায় করে, তার চোখে সানগ্লাস কিন্তু সেই গ্লাসের আড়ালে ক্ষতচিহ্নটা পুরোপুরি লুকোতে পারেনি। দেখামাত্রই বুঝে গেছিলাম, তার চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গেছে।

    বিধুদার মতো মানুষের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারে এমন কে আছে? পরক্ষণেই জবাবটা পেয়ে গেছিলাম-বিধুদা ছাড়া আর কে!

    বৌদির রিক্সাটা চলে যাবার কিছুক্ষণ পরই দেখেছিলাম বাইকে করে সজল চলে যাচ্ছে সেই এলাকা থেকে। চোখেমুখে তিক্ততা। রাগে ফুঁসছে!

    বাঁকা হাসি দিয়ে গেসু সবিস্তারে বলেছে আমাকে, দ্বিতীয়বার হামলার শিকার হবার পর সে খোঁজখবর নিয়ে কী জানতে পেরেছে :

    বাইরে থেকে দেখলে মনিকা বৌদি আর বিধুদার সম্পর্কটা বেশ ভালোই ছিল, তবে তাদের মধ্যে আর যাই হোক স্বামী- স্ত্রীর সেই মধুর সম্পর্ক ছিল না! দাম্পত্য জীবন ছিল নিষ্প্রভ। বিধুদা ব্যস্ত ছিল রাজনীতি নিয়ে। এমন না যে সে নারীবিমুখ ছিল। বরং বহু নারীতে আসক্ত ছিল দাদা। ব্যাপারটা মনিকা বৌদিরও অজানা ছিল না।

    বছরখানেক আগে, বিধুদাদের পার্টি যখন ক্ষমতায় নেই তখন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হবার ভয়ে বিধুদা এবং সজল ভাই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। বৌদি আগে থেকেই সেখানে ছিল তার দাদার বাড়িতে। ওখানেই উঠেছিল বিধুদা, সজল উঠেছিল কাছের এক হোটেলে। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর পরই বিধুদা চলে আসে ঢাকায়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে না থাকলেও পরবর্তী প্রেক্ষাপটে নিজের মাঠ হাতছাড়া করতে চায়নি। তবে সজল ভাই তখনই ঢাকায় চলে আসেনি, আরো কয়েকটা দিন দেখে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই সময়টাতে বৌদির সাথে তার নিয়মিত দেখা হতো। দাদার হয়ে হাত খরচের টাকা দিতো তাকে। মনিকা বৌদি আবার কেনাকাটা করতে খুব পছন্দ করতো। সজল ভাই এটা বুঝতে পেরে তাকে শপিংয়ে নিয়ে যেতো, দুহাত ভরে উপহার দিতো। এভাবে তাদের মধ্যে সখ্যতা তৈরি হয়ে যায় দ্রুত, সবার অগোচরে। এক সময় দুজনেই চলে আসে ঢাকায়। এখানে এসেও তাদের গোপন অভিসার থেমে থাকেনি মাঝেমধ্যেই তারা দেখাসাক্ষাত করতো লুকিয়ে লুকিয়ে। সম্পর্কটা দ্রুত পরিণতির দিকে এগোতে থাকে। বিধুদা এসব জানলে কী হবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা ছিল তাদের, তাই কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে বৌদি একটা সিদ্ধান্ত নেয়-বিধু বেঁচে থাকলে তাদের সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ তো থাকবেই বরং কথাটা জেনে গেলে নিজহাতে দুজনকে খুন করতে এক মুহূর্তও দেরি করবে না।

    “মরার কয়দিন আগে দাদা এইটা জানবার পর বৌদিরে খুব মারছে, বেল্ট খুইল্যা পিটাইছে, ঘুসায়া নাক-মুখ ফাঁটায়া দিছে…মাগার বৌদি সব অস্বীকার করছে। দাদার হাত থিকা পিস্তলটা নিয়া কইছে, তারে যেন মাইরা ফালায়। দাদায় পুরা বোকাচোদা অয়া গেছিল।

    সজল ভাইকে নিশ্চয়ই বৌদি বলে দিয়েছিল বলেই সে সতর্ক হয়ে গেছিল। গেসু যে আমাকে দিয়ে তাকে হত্যা করাতে চাইছে, এটাও বৌদি জানিয়ে দিয়েছে তাহলে!

    “সজরে মারতে অইবো!” অন্ধকার ঘরে বলে উঠল নাটকা গেসু। “ওয় না মরলে আমরা দুইজনেই শ্যাষ।”

    কিন্তু সজল সতর্ক হয়ে গেছে, তাকে কি সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে?

    “এইটা আমার উপরে ছাইড়্যা দাও,” দৃঢ় কণ্ঠে বলল গেসু।

    ⤷
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকন্ট্রোল (বেগ-বাস্টার্ড ৭) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article দরিয়া-ই-নুর – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }