Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অগোচরা – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প123 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    অধ্যায় ২০ – ফাঁদ

    পরদিন মনিকা ফ্ল্যাটে এলো। ওর গম্ভীর মুখ দেখে মনে হলো জীবনে অনেক পুরোপুরি ভড়কে আছে। শক্ত নার্ভের মেয়ে, কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে গেছে, সহজে ভড়কে যাবার কথা না।

    উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো, গতকাল ওর বদ্দা কী বলেছে। সত্যি বলতে ওর কথাবার্তা, আচার-আচরণ আমার কাছে কপটতা ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না। আমি নিশ্চিত, ও সব জানে। জেনেও না জানার ভাণ করছে।

    বেশ কাটাকাটাভাবেই ওকে বললাম, ওর দাদা আর নাইজেল নামের এক লোক আমাকে দিয়ে আরেকটা কাজ করাতে চাইছে।

    কিন্তু আমার কথা কীভাবে ওর বদ্দা আর নাইজেল জানতে পারলো? ও তো আমাকে অপরেশ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে ওর বদ্দার কাছে! আমি কে, কী করি, কী করেছি-এসব ওদের জানার কথা না।

    হতভম্ব দেখালো মনিকাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ক-দিন আগে ওর বদ্দার এক লোক মির্জা গালিব স্ট্রিটে আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখেছে। সেই লোক আগে বিধুর সঙ্গে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে কাজ করতো।

    কথাটা অবিশ্বাস্য শোনালো আমার কাছে। বিধুদার হয়ে কাজ করলেও আমার কথা জানার কথা নয়। কতো সতর্কতার সঙ্গে আমি ওসব কাজ করেছি। বিধুদাও আমাকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছে সব সময়। আমি ছিলাম তার গোপন মারণাস্ত্র। দাদা, মনিকা আর নাটকা গেসু ছাড়া কেউ জানতো না এটা। গেসু আর বিধুদা এখন নেই, মনিকা ছাড়া অন্য কে আছে, ওদেরকে এসব কথা বলার?!

    মনিকা চিন্তিত হয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। সে-ও বুঝতে পারছে না, কীভাবে ঐ লোক আমাকে চিনতে পারলো, এতকিছু জানতে পারলো।

    আমি ওর কথা বিশ্বাস করলাম না। কিন্তু মনে একটা খটকা রয়েই গেল—মনিকা যদি ওর দাদাকে আমার কথা বলেই থাকে, তাহলে অপরেশ নামের নাটকের দরকার হলো কেন? আর সজলের কথাই বা কীভাবে জানলো ওরা?-যে কথা মনিকাও জানে না।

    গভীর করে শ্বাস নিয়ে মনিকা বলল, এই নাইজেল খুবই ভয়ঙ্কর প্রকৃতির লোক। হুন্ডি থেকে শুরু করে ড্রাগ, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, এমনকি নারীপাচারের সঙ্গেও জড়িত। ওর মধ্যে কোনো রকম মায়া-দয়া নেই। প্রথম জীবনে ঢাকার ধোলাইখালে চোরাই মটরপার্টস চক্রের হয়ে কাজ করেছে, এরপর ফেন্সিডিল বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেকগুলো খুনখারাবি করার পর ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় এসে নাড়ু গেঁড়েছে। সীমানা পেরিয়ে মাঝেমধ্যে যখন ঢাকায় যায়, তখন কেউ না কেউ খুন হয়ে যায় ওখানে।

    মনিকার বদ্দা আর নাইজেল মিলে মির্জা গালিব স্ট্রিটে ডান্স-বারটা চালায় এখন। ওদের আরো কিছু ব্যবসা আছে এখানে। কলকাতায় আসার পর সজলকে নাইজেলের সঙ্গে মনিকার বদ্দা-ই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। পরে এই নাইজেলকে দিয়েই বিধুকে খুন করায় সজল।

    গতকাল রাতে মনিকাকে ওর দাদা বলেছে, আমার আসল পরিচয় আর ধর্ম লুকিয়ে ভালো করেনি। এখন ভালোয় ভালো তার পার্টনার নাইজেলের জন্য আমি যেন কাজটা করে দেই, নইলে তার পার্টনার বিগড়ে যাবে। ওর বদ্দাও চায় না নাইজেল অসন্তুষ্ট হোক। আমি যদি এ কাজটা না করি, তাহলে আমার তো ক্ষতি করবেই, মনিকার-ও ক্ষতি হয়ে যাবে।

    ওর বদ্দা ওর কী ক্ষতি করবে?! যারপরনাই বিস্মিত হলাম আমি।

    নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মনিকা, কিছু বলতে গিয়েও বলল না। শেষে শুধু বলল, পরে সবটা খুলে বলবে আমাকে।

    পুরোপুরি ধন্দে পড়ে গেলাম আমি। নাইজেল, মনিকার বদ্দা আর মনিকা…কে যে কার সঙ্গে কোন সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই। নিজেকে ফাঁদে আটকে পড়া ইঁদুর বলে মনে হলো।

    অধ্যায় ২১ – শূন্যস্থান পূরণ

    সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোরাবালিতে পড়ে গেলাম আমি। কাকে বিশ্বাস করবো? কাকে করবো না? বিশ্বাস করার মতো আদৌ কেউ আছে কি?

    এখন পর্যন্ত যা জেনেছি মনিকার কাছ থেকেই জেনেছি। এরমধ্যে কতোটুকু সত্যি আছে, নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। এরকম অন্ধকারে থেকে কোন সিদ্ধান্তটা নেবো আমি? কোন সিদ্ধান্ত আমাকে এই চক্র থেকে বের হতে সাহায্য করবে? অক্ষতভাবে!

    মনিকার প্রতি আমার যে অবিশ্বাস, সন্দেহ, সেটা আরো বেড়ে গেল। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে বিচ্ছিরি কোনো চালাকি আছে। আছে অনেকগুলো ফাঁক আর খটকা। কিন্তু সেটা যে কী, বুঝতে পারলাম না।

    সবকিছু গভীরভাবে ভেবে দেখলাম। এই অন্ধকার জগতে পরিস্কারভাবে কিছুই দেখা যায় না। যা দেখা যায়, তার অনেকটাই ধোঁয়াশা আর প্রহেলিকাময়। কিন্তু চোখ দিয়ে যেটা দেখা যায় না, মনের চোখ দিয়ে সেটা দেখে নিতে হয়। আমিও তাই করলাম।

    আমি বিশ্বাস করি না মনিকাকে। মনিকা বিশ্বাস করে না আমাকে আর ওর বদ্দাকে, এ ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত আমি-বিধানগরের এই ফ্ল্যাটের কথা ওর দাদার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে ও, আর আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে যক্ষের ধন!

    সম্ভবত নাইজেলকেও বিশ্বাস করে না মনিকা। লোকটা সম্পর্কে যা যা বলল, তাতে করে মনে হয়েছে, ও বরং ভয় পায় তাকে।

    আর নাইজেল, যাকে আমি এর আগে কখনও দেখিনি, তাকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। এই লোককে বিশ্বাস করা, তার হয়ে কাজ করা আত্মহত্যার শামিল।

    ফাঁকা ফ্ল্যাটে সম্পূর্ণ একা, এ ঘর থেকে ও ঘরে পায়চারি করতে করতে পাঁচ-ছয়টা সিগারেট ধ্বংস করে অনেক কিছু ভেবে দেখলাম আমি। বিধুদার বিপুল পরিমাণের সম্পদ মনিকা তার বদ্দার মাধ্যমে কলকাতায় নিয়ে এসেছে। আমি নিশ্চিত, শুরুতে সেই সম্পদের বেশিরভাগ ওর দাদার কাছেই রেখেছিল কিন্তু পরে একটা অংশ অন্য কোনোভাবে, অন্য কারোর মাধ্যমে এখানে নিয়ে এসে এই ফ্ল্যাটে লুকিয়ে রেখেছে।

    খুব বেশিদিন হয়নি এই জগতে ঢুকেছি, কিন্তু অন্যদের চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা একটু আলাদা। শুরুতেই এই অন্ধকার জগতের গভীরে ঢুকে পড়েছি। ভালো করেই জানি, এখানকার লোকজন কোন স্বার্থে কী করতে পারে।

    যতোটুকু জানি আর যতোটুকু জানি না-মাঝের সেই শূণ্যস্থানগুলো পূরণ করার পর মনে হলো, কুয়াশা ভেদ করে সত্যের অবয়ব কিছুটা হলেও দেখতে পাচ্ছি।

    সেটা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি কুৎসিত।

    অধ্যায় ২২ – প্রস্তুতি

    অনেক ভাবনা-চিন্তা করার পর কাজটা করতে রাজি হয়েছি আমি।

    রাইফেল, টেলিস্কোপ আর সাইলেন্সারসহ সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেবে নাইজেল, সঙ্গে লোকজনও দেবে। আমি বলে দিয়েছিলাম, অন্তত দুদিন আগে রাইফেলটা আমার হাতে আসা চাই। অন্য অস্ত্রের বেলায় এ কথাটা খাটে কি না জানি না, কিন্তু লং রেঞ্জের রাইফেল হাতে পেলাম আর শট নিলাম-বিষয়টা এমন নয়। অস্ত্রটার সঙ্গে একটু আগেভাগে পরিচিত হতে হয়, নেড়েচেড়ে দেখতে হয় সব ঠিকঠাক আছে কি না।

    ঘটনার দু দিন আগে ফ্ল্যাটে এলো মনিকা, তার হাতে একটা ত্রিকোণাকৃতির বাক্স-ওটার লিডের উপরে একটা ইলেক্ট্রিক গিটারের স্টিকার লাগানো-দেখে যেন মনে হয় ইলেক্ট্রিক গিটারের বাক্স।

    আগামি পরশু সন্ধ্যায় বিধান নগরে সাধু নামের একজন গাড়ি নিয়ে আসবে, তার সঙ্গে চলে যাবো জায়গামতো। মনিকা জানালো, আমি যেন এই ভবনের সামনে না দাঁড়িয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়াই, তাহলে ঘুণাক্ষরেও লোকটা বুঝতে পারবে না এই ফ্ল্যাটটা কোন ভবনে অবস্থিত।

    বুঝতে পারলাম, মনিকা এই ফ্ল্যাটটা ওর দাদার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা করছে। একটু আগে ও নিজেও একই কাজ করেছে-সাধু নামের একজন ওকে গাড়িতে করে রাইফেলের বাক্সসহ এখানে নামিয়ে দেবার সময় রাস্তার মোড়ে নেমে গেছে ও।

    চলে যাবার সময় মনিকা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ ধরে কিন্তু কিছুই বলল না। আমিও কিছু বললাম না। বলার মতো কিছু নেই-ও।

    মনিকা চলে যাবার পর কাজে নেমে পড়লাম আমি। বিকেলের দিকে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম অজয়দের ওষুধের দোকানে। চা আর সিগারেটের পর তার দিকে একটা এনভেলপ বাড়িয়ে দিলাম।

    “এইটা কী?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো আমার বন্ধু। এনভেলপটা খুলে ওর চোখ কপালে উঠে গেল। “সব দেখি ডলার! এত্ত ডলার কই পাইলি…” প্রশ্নটা শেষ করার আগেই হজম করে ফেলল। “এইগুলা তুই আমারে দিতাছোস!… ক্যান?”

    আমি কেবল স্মিত হাসলাম। পঞ্চাশটা নোট। পাঁচ হাজার ডলার। আশা করি এই টাকা দিয়ে ওষুধের দোকানটা গুছিয়ে নিতে পারবে অজয়।

    ওকে আমি খুব বেশি কৃতজ্ঞতা দেখানোর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলাম ওখান থেকে দ্রুত চলে এসে। সত্যি বলতে, আমি নিজেকেই বাঁচিয়ে দিলাম এটা করে। উপকার পেয়ে মানুষ যখন কৃতজ্ঞতা দেখাতে শুরু করে, আমার তখন খুবই অস্বস্তি লাগে। কাছের মানুষ হলে এটা বেশি হয়।

    চলে আসার আগে অজয়কে শুধু বললাম, একটা কাজে কলকাতার বাইরে যাবো, কয়েকদিন দেখা হবে না।

    ফ্ল্যাটে আসার পথে স্টেশনারি দোকান থেকে কিছু পলিথিনের জিপারব্যাগ আর একটা গামটেপ কিনে নিলাম।

    অধ্যায় ২৩ – ও মনিকা!

    আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে সকালের দিকে মনিকা চলে এলো ফ্ল্যাটে।

    ওর আসার কথা ছিল আগামিকাল রাতে, কাজ শেষ হবার পর। হুট করে এভাবে চলে আসায় আমার সমস্ত পরিকল্পনা হোঁচট খায় কি না, সে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লাম।

    মনিকাকে দেখে মনে হলো, ও অনেক লজ্জিত। খুব কমই আমার চোখে চোখ রাখলো। ওর চেহারায় বিমর্ষ একটা ভাবও আছে। ভীষণ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

    মনিকা জানালো, আমাকে ওর অনেক আগেই কিছু কথা বলা উচিত ছিল। ওর বদ্দা নাইজেলের সঙ্গে মেশার পর থেকে অনেকটাই বদলে গেছে। আগে শুধু সিগারেট খেতো, এখন মদ আর নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছে, সেই সঙ্গে জুয়া খেলার মতো বাজে নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে। প্রতি সন্ধ্যায় ডান্সবারের পেছনে জুয়ার আসর বসায়। ক্যাসিনোতে জুয়া খেলার জন্য প্রায়ই নেপাল চলে যায় নাইজেলের সঙ্গে। ওর বৌদির সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বদ্দাকে নিয়ে খুব টেনশনে আছে। ওর প্রায় সব টাকা বদ্দার কাছে গচ্ছিত। সে টাকা কোনো রকমে উদ্ধার করতে পারলেই কলকাতা ছাড়বে।

    ঢাকায় বিধুর বাড়ি আছে, আরো কিছু সহায়-সম্পত্তিও আছে। ওগুলো বিক্রি করে বহু দূরে নতুন ঢাকার কোথাও উঠবে। কিন্তু এসব কথা ঘুণাক্ষরেও ওর বদ্দা যেন জানতে না পারে। ভালোয় ভালোয় আজকের কাজটা করে আমি যেন সহিসালামতে ফিরে আসি।

    আমি ওকে অভয় দিলাম, সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই এগোবে। এরকম কাজ তো আমি আগেও করেছি-কোনো সমস্যা হয়নি। এবারও হবে না।

    অভয় পেয়ে আমার চোখে চোখ রাখলো মনিকা। সেই চোখ অশ্রুসজল। তারপর জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। আমার বুকে মাথা রেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, রাতে ওর ঘুম হয়নি একফোঁটাও। খুব খারাপ লাগছিল, তাই চলে এসেছে।

    আমিও ওকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে। যদিও ওর কথাগুলো শুনতে ভালো লেগেছে, কিন্তু আমার মনের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা আরেকটি অংশ এসব কথা বিশ্বাস করলো না।

    অন্য অংশটি তখন মনিকার ভালোবাসার ঝড়ে কাবু। ও আমাকে উদভ্রান্তের মতো চুমু খেতে লাগলো। আমার বুকে মুখ ঘষলো পরম আদর করে। কতো বার যে বলল : ও আমাকে ভালোবাসে!

    আশ্চর্যের ব্যাপার, মুহূর্তে যাবতীয় অবিশ্বাস আর সন্দেহ উবে গেল, ভর করলো সুতীব্র আবেগ। আমিও ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে চাইলাম ওকে।

    এক সময় দুজনেই টের পেলাম, আমাদের মিলিত হতে হবে। শোবার ঘরে চলে গেলাম আমরা। বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে কনডমের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলতে যাবো, অমনি আমার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে গেল মনিকা।

    *

    পরম নিশ্চিন্তে মনিকা ঘুমাচ্ছে।

    ওর নগ্ন শরীরটা ঢেকে আছে পাতলা একটা চাদরে। চুলগুলো এলিয়ে পড়ে আছে সাদা ধবধবে বালিশের উপর। আমি ওর নিশ্বাসের মৃদু শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

    বিছানা থেকে উঠে বসলাম আমি, একটা সিগারেট ধরালাম। বেডসাইড টেবিলের পাশে রাখা রাইফেলের বাক্সটা মেঝেতে রেখে খুলে দেখলাম সব ঠিক আছে কি না।

    স্টিভেন্সন কোম্পানির একটা হান্টিং রাইফেল। টেলিস্কোপটার গায়ে রাশান ভাষায় কিছু লেখা। সাইলেন্সারটা ওমেগা থার্টিসিক্স এম-এর। রাইফেলের স্ট্যান্ড আর একটা ম্যাগাজিন। পাঁচটা গুলি।

    গুলিগুলো হাতে নিয়ে দেখলাম। একদম নতুন। ড্যাম্প হবার কোনো সম্ভাবনা নেই—আশ্বস্ত হলাম আমি। বাক্সটা বন্ধ করে রেখে দিলাম।

    একটু পর মনিকার ঘুম ভেঙে গেল, উঠে সোজা চলে গেল বাথরুমে। প্রমাদ গুণলাম আমি। সাধারণত স্নান করার পর পুজোর ঘরে যায় ও। এখনও কি যাবে?

    কিছুক্ষণ পর আমার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে ভেজা শরীরে সালোয়ার-কামিজ গলিয়েই পুজোর ঘরে চলে গেল মনিকা। আমি উদ্বিগ্নতার সঙ্গেই বসে রইলাম শোবার ঘরে। দরজা দিয়ে বার বার তাকালাম বন্ধ দরজার দিকে। পুজো করার সময় ও ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে সব সময়।

    খুঁট খাঁট শব্দ হচ্ছে কি না শোনার জন্য কান পাতলাম। সেরকম কিছু শুনতে পেলাম না, কেবল নিজের বুকের ঢিপ ঢিপানি ছাড়া। তীরে এসে তরী ডুবে যাবার আশঙ্কা করলাম। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি গতকাল বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর ও আবার আজ সকালে ফ্ল্যাটে চলে আসবে।

    থমথমে মুখে ঠাকুরঘর থেকে বের হয়ে এলো মনিকা। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। সোজা এসে আমার সামনে দাঁড়ালো ও। তারপর চমকে দিয়ে আমার কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে দিলো। বলল, অমঙ্গল আমাকে ছুঁতে পারবে না।

    হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।

    দুপুরের দিকে মনিকা চলে গেল, যাবার আগে দরজার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। বলে গেল, আগামিকাল সকালে এসে রাতে থাকবে. অনেক কথা বলার আছে।

    আমার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

    ও মনিকা!

    অধ্যায় ২৪ – সবজল

    কথামতো সন্ধ্যা সাতটায় নির্দিষ্ট রাস্তার মোড়ে রাইফেলের বাক্সটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

    একটা হাতঘড়ি পরেছি, বার বার সেটাতে সময় দেখছিলাম, তারপরই মনে পড়লো, এটা উদ্বিগ্নতার লক্ষণ। ঘড়িতে যতোই সময় দেখি না কেন, ঐ লোক যখন আসার তখনই আসবে, এক সেকেন্ড আগেও আসবে না।

    গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলাম। নার্ভ শক্ত রাখতে হবে আমাকে। কোনো রকম ভুল করা যাবে না। বাক্সটা হাতে নিয়ে একটু পায়চারি করলাম। ভেতরের সমস্ত উদ্বিগ্নতা দূর করার চেষ্টা করলাম আমি।

    খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, পাঁচ-দশ মিনিট পরই একটা হলুদ রঙের অ্যাম্বাসেডর ট্যাক্সি এসে থামলো আমার পাশে। গাড়িতে দুজন বসে আছে—-একজন ড্রাইভারের পাশে, কালো সানগ্লাস পরা। পেছনের সিটে বসা লোকটি জানালা দিয়ে মাথা বের করে আমাকে দেখেই চওড়া হাসি দিলো। তাকে দেখে একটা ধাক্কা খেলাম আমি ।

    নাটকা গেসুর সেই বন্ধু!

    সজলকে মারার আগে গেসু আমাকে কেরাণীগঞ্জে এই লোকটার বাড়িতেই নিয়ে গেছিল। আরো একবার বুঝতে পারলাম, দুনিয়াটা আসলেই ছোট-এখানে কেবল হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকেই খুঁজে পাওয়া যায় না, এরকম লোকজনের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়।

    “কী খবর?” দরজা খুলে দিয়ে বলল। “চিনবার পারছো?” নিজেকে ধাতস্থ করতে একটু সময় লাগলো আমার। “গাড়িতে ওঠো।” দরজা খুলে দিয়ে আমার হাত থেকে রাইফেলের বাক্সটা নিয়ে নিলো সে।

    আমি চুপচাপ পেছনের সিটে বসলাম। ড্রাইভারের পাশে যে লোকটা বসে আছে, সে রিয়ার-মিরর দিয়ে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

    “আমার নাম জানো তো, নাকি?”

    মাথা দোলালাম আমি। গেসু আমার সামনে কী নামে ডেকেছিল একে, মনে করতে পারলাম না।

    “আমার নাম সবজল…ওর নাম সাধু…” সামনের সিটের লোকটাকে দেখিয়ে বলল।

    আমি কোনো কথা বললাম না।

    “কুন বিল্ডিংয়ে থাকো,” গাড়ির ভেতর থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে জানতে চাইলো সবজল।

    যে ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ, সেটার দিকে ইঙ্গিত করলাম।

    “কয় তলায়?”

    তিন সংখ্যাটা বের হয়ে গেল মুখ দিয়ে।

    দাঁত বের করে হাসলো সে। “চলো তাইলে…” সাধু নামের লোকটাকে বলল।

    গাড়িটা ছুটতে শুরু করলো আমাদের নিয়ে।

    “মালটা ঠিক আছে না?” রাইফেলের বাক্সে টোকা মেরে জানতে চাইলো।

    মাথা নেড়ে সায় দিলাম আমি।

    “সাইলেন্সারটা কালেক্ট করতে গিয়া আমার আর সাধুর জান বাইর হইয়া গেছে। এইসব জিনিস এইখানে সহজে পাওয়া যায় না।”

    এবার বুঝতে পারলাম, এই সবজলই মনিকার বদ্দাকে আমার কথা বলেছে-এই লোকই মনিকার সঙ্গে আমাকে দেখেছে মির্জা গালিব স্ট্রিটে।

    কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বললাম না।

    একটা সিগারেট ধরালো সবজল। “কাম সারার পর সাধু তোমারে এইখানে নিয়া আসবো,” আয়েশ করে জানালার বাইরে ধোঁয়া ছাড়লো। “এইবার কইলাম পলাইও না।” কথাটা বলেই হেসে ফেলল, যেন খুব মজার কিছু ছিল ওই ঘটনাটা। সাধু, ওরে চোখে চোখে রাইখো!”

    রিয়ার-মিররে দেখতে পেলাম, সামনে বসা লোকটা কেমন আমোদিত হয়ে বাঁকাহাসি দিচ্ছে।

    অধ্যায় ২৫ – চুকা

    রাত আটটার দিকে সাধু আমাকে পার্কস্ট্রিটের রাস্তার পাশে একটা ভবনের দোতলায় নিয়ে এলো। লোকটার চেহারা যেমন অপ্রীতিকর তেমনি কুটিল। ক্ষণে ক্ষণে মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি দেখা যায় ওর মুখে। কথা একদমই বলে না। আর যখন তাকায়, বলতে গেলে চোখের পলক ফেলে না।

    পুরনো দিনের একটা ভবন। রাস্তার দিকে বড় একটা জানালার দুটো কপাট সামান্য ফাঁক করে বাইরেটা দেখলাম। সবজল আমাদের সঙ্গে উপরে আসেনি, ট্যাক্সিটা নিচে এই

    ভবনের সামনে পার্ক করে রাখা হয়েছে, একদম ফুটপাত ঘেষে। জানালা দিয়ে আমি সেটা দেখতে পেলাম।

    ঘরে একটা রিডিং টেবিল, দুটো চেয়ার আর এক সেট সোফা আছে। রিডিং টেবিলটা জানালার সামনে এনে ওটার উপরে রাইফেলটার স্ট্যান্ড সেট করলাম। টেলিস্কোপ আর সাইলেন্সার লাগানোর পর রাইফেলটা বসালাম স্ট্যান্ডের উপরে। একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম আমি। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

    রাস্তার ঠিক ওপাড়ে, একটা পাব থেকে এক লোক বেরিয়ে আসতেই আমি ট্রিগার টিপে দেবো। কাজটা কঠিন কিছু না। এই জানালা থেকে খুব বেশি হলে ষাট-সত্তুর ফিটের মতো দূরে। এর আগে কখনও এত কম দূরত্বে শুট করিনি।

    পকেট থেকে টার্গেটের একটা ছবি বের করে দেখালো সাধু। আর সেটা দেখে চমকে গেলাম আমি।

    মাউড়া হামিদ!

    আগের চেয়ে একটু বেশি ভারিক্কি হয়ে গেছে তার শরীর, পুরু গোঁফও রেখেছে। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে বুঝতে পারলাম, মির্জা গালিব স্ট্রিটের কোথাও দাঁড়িয়ে ছিল, দূর থেকে কেউ তার অগোচরে ছবিটা তুলেছে।

    এর সঙ্গেই অজয়ের দেখা হয়েছিল ক-দিন আগে।

    সাধু আমাকে জানালো, আজকে সে পরে আছে ঘিয়ে রঙা পোলো শার্ট আর নেভি ব্লু-জিন্স প্যান্ট। আশ্বস্ত করে বলল, সে যেহেতু সঙ্গে আছে চিনতে কোনো ভুল হবে না। লোকটা বের হলেই দেখিয়ে দেবে।

    একটু পর সবজল এসে চারটা বিয়ার দিয়ে গেল সাধুকে। বিয়ার খেতে খেতে একের পর এক সিগারেট ধরিয়ে গেল লোকটা, আমাকে কিছুই সাধলো না।

    জানালার সামনে চুপচাপ বসে রইলাম আমি। ঘরের সব বাতি বন্ধ। জানালার ওইটুকু ফাঁক গলে বাইরের স্ট্রিট-লাইটের আলো ঢুকে ঘরটাকে মৃদু আলোকিত করেছে, সেই আলোতেই সাধুর মুখ দেখতে পাচ্ছি। আমার ডানপাশে জানালার কাছে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার চিন্তা-ভাবনা পড়ার চেষ্টা করলাম।

    একটু পর নিরবতা ভেঙে জানতে চাইলাম, গুলি করার সময় মাজল ফ্ল্যাশ হয়, সেটা যদি ওদের কেউ দেখে ফেলে, তাহলে তো বুঝে যাবে কী হয়েছে।

    “বুঝলে কী হবে?…কিচ্ছু হবে না।” বিয়ারে চুমুক দিয়ে লাপরোয়া ভঙ্গিতে বলল সাধু। “ওদের কারোর সঙ্গে কিছু নেই…দৌড়ে পালাবে শালারা।

    উচ্চারণ শুনে বোঝা যাচ্ছে ও এখানকার কেউই হবে। আমি দেখেছি ওর কাছে সাইলেন্সার লাগানো একটা অটোমেটিক পিস্তল আছে। কোমরের পেছনে গুঁজে রেখেছে সেটা-একটু আগে মেঝে থেকে বিয়ারের বোতলটা নেবার জন্য নিচু হতেই চোখে পড়েছে আমার।

    মনে হচ্ছে আজকের পরিস্থিতিটা আমার প্রথম শুটের মতোই। সেদিনও আমি অনিচ্ছায়, সজল ভাইয়ের গানপয়েন্টে থেকে গুলি করেছিলাম। আজকে অবশ্য সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে আমি গানপয়েন্টেই আছি!

    দীর্ঘ সময় অন্ধকারে থাকার কারণে আমার চোখ সয়ে এলো। আমি নিশ্চিত, সাধুরও। আমরা এখন একজন আরেকজনের অভিব্যক্তি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। সে অবশ্য আমার চিন্তা-ভাবনা পড়ার চেষ্টা করছে না। হয়তো দরকার মনে করছে না।

    কিন্তু আমার দরকার আছে। প্রচণ্ড উত্তেজনা চলছে আমার ভেতরে। অনেক অভিজ্ঞতা থাকার পরও আমি আমার নার্ভ ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছি। নার্ভাস হবার কারণেই বোধহয় হাতের নখ কামড়াতে শুরু করে দিলাম এক পর্যায়ে

    গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলাম আমি। যে কাজটা করবো তার জন্য নার্ভ শক্ত রাখার চেয়েও শান্ত রাখা বেশি জরুরি। সোফার দিকে তাকালাম। তিনটা কুশন আছে। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই সাধু বলে উঠল :

    “আমি একটু আসছি।”

    পাশের অ্যাটাচ্‌ড বাথরুমে ঢুকে পড়লো সে, তবে দরজাটা খোলাই রাখলো, বাতিও জ্বালালো না।

    কমোডের উপরে তার প্রস্রাব পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হলো, একটা তাগড়া ঘোড়া পেচ্ছাব করছে!

    আমি আর জানালার দিকে তাকিয়ে নেই. বাথরুমের খোলা দরজার দিকে চেয়ে আছি। আলগোছে রাইফেলটা স্ট্যান্ডসহ তুলে নিলাম হাতে।

    একটু পরই প্রস্রাবের শব্দ মিইয়ে এলো।

    তারপর কমোড ফ্ল্যাশ করার শব্দ।

    জিপার লাগাচ্ছে এখন।

    একটু পরই দরজার সামনে ওর কালচে অবয়বটা দেখা গেল।

    সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার চাপলাম।

    থুপ করে শব্দটা হতেই হুড়মুড়িয়ে বাথরুমের ভেতরে ছিটকে পড়ে গেল সাধু। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে শব্দ করলো কেবল, তারপর আর কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না।

    যাবার কথাও নয়। গুলিটা সম্ভবত ওর বাঁ-চোখের ঠিক নিচে লেগেছে। আমি অবশ্য কপালটা টার্গেট করেছিলাম।

    রাইফেলটা হাতে নিয়েই চেয়ার থেকে উঠে বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম। বাথরুমের দেয়ালে সাধু কাঁধ এলিয়ে, হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। বাঁ-দিকে কাত হয়ে আছে তার মাথাটা। আবছা অন্ধকারেও দেখতে পেলাম, ক্ষতস্থান থেকে গল গল করে রক্ত ঝরছে।

    ফিরে এলাম আবার জানালার সামনে। রাইফেলটা আগের জায়গায় রেখে চেয়ারে বসে রইলাম চুপচাপ। এখন আমার নার্ভ বেশ শক্ত। আত্মবিশ্বাসী আমি। সাধুর বেচে যাওয়া একটা বিয়ার পান করতে লাগলাম। আমার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। এই জঙ্গলে এতক্ষণ শিকার আর শিকারীর খেলা চলছিল-আমি শিকারী হতে পেরেছি!

    সাধুকে মারার প্রায় দশ মিনিট পর পাব থেকে ঘিয়ে রঙা পোলো শার্ট আর জিন্সপ্যান্ট পরা মাউড়া হামিদ বের হয়ে এলো। তার সঙ্গে পাণ্ডামতোন দুজন লোক আছে, সিগারেট খেতে খেতে ওই লোক দুটোকে নিয়ে ফুটপাতে এসে দাঁড়ালো সে। পাণ্ডাদের একজন হাত তুলে একটা ট্যাক্সি ডাকলো। হলুদ রঙের একটা ট্যাক্সি এসে থামতেই তারা সবাই উঠে পড়লো তাতে।

    ওদের গাড়িটা চলে যাবার পর ডানচোখ বন্ধ করে বাঁ-চোখ দিয়ে নিচের ফুটপাতে পার্ক করে রাখা গাড়িটার দিকে তাকালাম। সবজল নিশ্চয়ই নড়েচড়ে বসেছে। পরক্ষণেই ডানচোখ খুলে টেলিস্কোপ দিয়ে পাবের মেইন দরজাটা দেখতে লাগলাম।

    গাড়ি থেকে সবজল বের হয়ে এলো না কিন্তু মিনিটখানেক পর পাবের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো নাইজেল। তার হতবুদ্ধিকর মুখটা দেখতে পেলাম টেলিস্কোপে। প্রথমেই সে তাকালো রাস্তার উল্টোদিকে পার্ক করে রাখা গাড়িটার দিকে, সবজলের সঙ্গে সম্ভবত চোখাচোখি হলো তার। চোখেমুখে ইশারা করে বোঝাতে চাইলো-হয়েছেটা কী! তারপরই বিস্ময়ে তাকালো আমার জানালার দিকে। টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে তার সঙ্গে প্রায় চোখাচোখি হয়ে গেল আমার।

    গভীর করে নিশ্বাস নিলাম। নাইজেলের চোখে অবিশ্বাস আর ক্রোধ উপচে পড়ছে যেন। নিশ্বাসটা ছাড়ার সময়েই ট্রিগারে চেপে বসলো আমার আঙুল। কয়েক পা পিছিয়ে ফুটপাতের উপরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে।

    আমি অনেকটাই নিশ্চিত, ওর মাথায় লাগাতে পেরেছি।

    ভাগ্য ভালো, এই সময়টাতে ফুটপাতে কেউ নেই। আশেপাশের কেউ এখনও খেয়াল করেনি একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

    এবার নজর দিলাম নিচের গাড়িটার দিকে, কিন্তু সবজল ওখান থেকে আর বের হয়ে এলো না। গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দেবার শব্দ পেলাম, তারপরই সেটা চলে গেল ওখান থেকে।

    আমি ঝটপট রাইফেল আর স্ট্যান্ডটা গুটিয়ে গিটারের বাক্সে ভরে নিলাম। নিচে যখন নেমে এলাম, ততক্ষণে বিপরীত দিকের ফুটপাতে জড়ো  হয়েছে অল্পবয়সি কয়েকজন ছেলেমেয়ে, শুরু হয়ে গেছে হট্টগোল।

    কোনো দিকে না তাকিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। একটা মোড়ে এসে খালি ট্যাক্সি পেয়ে উঠে পড়লাম তাতে। তিক্তমুখে একদলা থুতু ফেললাম বাইরে।

    অধ্যায় ২৬ – ফেরা

    যা করেছি আমার বুঝমতোনই করেছি!

    যে জগতে ঢুকে পড়েছি, সেখানে কোনো কিছুর ব্যাপারেই নিশ্চিত হবার উপায় নেই—যেটাকে সত্য বলে মনে হয়, সেটাও সত্য নয়। একই কথা খাটে মিথ্যেগুলোর ব্যাপারেও। এর কারণ, এই জগতে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করার অভিনয় করে। কিংবা বিশ্বাসের মুখোশ পরে থাকে।

    এখানে কেবল বোকাদের ডিকশনারিতেই বিশ্বাস শব্দটা পাওয়া যায়।

    অবিশ্বাসের সাথেই এ জগতের মানুষগুলো বেঁচেবর্তে থাকে যতোদিন থাকা সম্ভব হয়। একটা সীমা পর্যন্ত অবিশ্বাসকে তারা মেনে নেয়; মানিয়েও নিতে পারে। কিন্তু সেই সীমা অতিক্রম করে ফেললে, বেঈমানি হিসেবেই ধরা হয়। তখন কঠিনতম শাস্তি না দেয়ার একটাই মানে-এ জগতে তুমি বেমানান। রাজনীতিতে যেমন স্যাক্রিফাইস করলে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়, এখানে তেমনি ক্ষমা করলে টিকে থাকা যায় না।।

    এখন বুঝতে পারি, বিধুদা কেন খলিলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। তার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভেবে দেখেছি, আমি হলেও খলিলকে সন্দেহ করতাম। হয়তো ওকে মৃত্যুদণ্ড দেবার ব্যাপারে আমার মধ্যে একটু দ্বিধা তৈরি হতো- এটুকুই। শেষ পর্যন্ত আমিও বিধুদার মতো একই কাজ করতাম।

    মনিকা, মনিকার বদ্দা আর নাইজেলের মধ্যে আসলে কী সম্পর্ক, আমার পক্ষে নিশ্চিত করে জানা সম্ভব নয়। ওদের কার কী স্বার্থ, কে কার হয়ে কাজ করছে, তা-ও জানি না। এর আগে বিধুদা, মনিকা, সজল আর নাটকা গেসুর মধ্যেকার সম্পর্কগুলো আসলে কী ছিল, জানতাম না আমি।

    ধরেই নিয়েছিলাম, মনিকার সঙ্গে ওর বদ্দার সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। আর সেটার কারণ আমি না। ফ্ল্যাটে ডলার আর স্বর্ণ লুকিয়ে রাখার কারণে এমনটা ভেবে নিয়েছি। আমি নিশ্চিত, মনিকার বদ্দা ওর বিপুল পরিমাণের টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করতে চায়, আর চায় বলেই আমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা মেনে নিতে পারছে না। এখানে ধর্মের ব্যাপারটা কেবলই অজুহাত।

    সম্ভবত সবজল আমার আসল পরিচয় মনিকার বদ্দাকে জানিয়ে দেবার পরই লোকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, শুরু করে পরিকল্পনা। আর এ কাজে নাইজেলের সাহায্য নিতে বাধ্য হয় সে। আমার ধারণা, নাইজেল কিংবা মনিকার বদ্দা আমাকে খুন করার আগে একটু ব্যবহার করে নিতে চেয়েছিল। শুনতে উন্নাসিকের মতো শোনালেও, আন্ডারওয়ার্ল্ডে আমার মতো একজন অগোচরা কয়জন আছে?

    আমি এ জগতে দুর্লভ থেকেও দুর্লভতর। আমাকে হাতের মুঠোয় পেলে কে না ব্যবহার করতে চাইবে?

    হয়তো এ কাজটা করার পরই আমাকে মেরে ফেলা হতো। মনিকাকে বলা হতো, কাজটা করতে গিয়ে আমি ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে প্রতিপক্ষের হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়েছি। আবার এমনও হতে পারে, আরো কয়েকটা কাজ করিয়ে নেবার পর আমাকে হত্যা করতো তারা।

    তবে সবকিছু বিবেচনা করে আমার মনে হয়েছে, এই কাজটা করানোর পরই আমাকে খুন করা হতো। আর সেটা করতো সাধু নামের লোকটি। তার কাছে সাইলেন্সার পিস্তল ছিল। এটার একটাই মানে, নিরবে কাজটা সারতে পারতো সে।

    লোকটা বসেছিল আমার ঠিক পাশেই, দীর্ঘ সময় এক ঘরে থাকলেও আমার সঙ্গে তেমন একটা কথা বলেনি। হয়তো একটু পর খুন করবে বলেই এটা করেছে। অনেক খুনি এমনটা করে। নিজের নার্ভ ঠিক রাখার জন্য শিকারের সঙ্গে বেশি কথা বলে না।

    রাইফেলের টেলিস্কোপে চোখ রাখার সময় আমার পক্ষে সাধুর দিকে লক্ষ্য রাখা সম্ভব ছিল না। তবে ওর জন্য কাজটা সহজ ছিল। হামিদকে মারার পর আলগোছে পিস্তল বের করে আমার মাথায় গুলি করে দিতে পারতো। তারপর একটা নাটক সাজাতো, বাংলাদেশের এক সন্ত্রাসী আরেক সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে ভারতের মাটিতে, কলকাতায়।

    ঐ ঘরে যাবার আগে আমি অনেক ভেবেছি, কী করে সাধুকে নিষ্ক্রিয় করবো। কিন্তু ঘরে ঢোকার পরই ঠিক করেছিলাম, শুট করার মুহূর্ত আসার আগে আমি সাধুকে বলবো সোফা থেকে একটা কুশন দিতে; সাধু সেটা নেবার জন্য একটু সরে গিয়ে উপুড় হতো আর তখনই রাইফেলটা স্ট্যান্ডসহ তুলে নিয়ে ওকে পেছন থেকে গুলি করে দেবো।

    কিন্তু সেটা বলার আগেই টয়লেটে চলে যায় সাধু, আমার জন্য কাজটা সহজ করে দেয় সে। টয়লেটে কাজ সেরে বের হবার সময় তাকে আমি খুব সহজেই শুট করতে পেরেছিলাম।

    সাধুকে সরিয়ে দেবার পর নাইজেলকে আমার ক্রশহেয়ারে আনতে তেমন বেগই পেতে হয়নি।

    সত্যি বলতে, নাইজেল, সাধু কিংবা সবজল ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি আমি এমনটা করতে পারি। ভাগ্যিস, ভাবেনি! হয়তো আমার নিরীহ চেহারাটা দেখে তাদের মনে হয়নি আমি এমন কিছু করতে পারি। তারা তো আর জানে না আমি অনেক কিছু আন্দাজ করে নিতে পেরেছিলাম। আমার দিক থেকে দেখলে, আমি কোনো সুযোগই নেইনি। সুযোগ নেবার মতো অবস্থায় ছিলামও না।

    মনিকার বদ্দা ঢাকায় এসে কিংবা লোক পাঠিয়ে আমার পিছু নেবার চেষ্টা করবে? সবজলকে দিয়ে?

    যদি সে এটা করে, আমি খুবই অবাক হবো। সবজল চাইবে না তৃতীয় বার আমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাক-এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত

    আর মনিকা? সে কী করবে?

    সত্যি বলতে, আমার মনের দুটো অংশ দু’রকম কথা ভেবে রেখেছে। তবে খুব করে যেটা চাই, সেটা হলেই বেশি খুশি হবো আমি।

    কে চায় প্রতারিত হতে? কাছের মানুষের কাছ থেকে বিশ্বাস ভঙ্গের বেদনা পেতে?

    *

    রিক্সাটা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে আসতেই অনেকদিন পর বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে নিলাম। মনে হলো কতোদিন দেখিনি এ জায়গাটা।

    লক্ষ্মীবাজারের নন্দলাল দত্ত লেনের বাসাটা নিশ্চয়ই অন্য কাউকে ভাড়া দিয়ে দিয়েছে বাড়ির মালিক। তাই সাতসকালে ওখানে না গিয়ে সোজা চলে এলাম গেন্ডারিয়ায়।

    মুন্না খুব রাত করে ঘুমায়। এখনও সেই অভ্যেস থাকার কথা। তার বাড়ির দারোয়ান আমাকে ভালো করেই চেনে। অনেকদিন পর দেখে দাঁত বের করে হাসলো, জানতে চাইলো এতদিন কোথায় ছিলাম। ছোট্ট করে তাকে কেবল বললাম, বিদেশে গেছিলাম। তারপর বরাবরের মতোই তাকে বিড়ি খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিয়ে সোজা উপরে চলে গেলাম আমি।

    চিলেকোঠায় এসে মুন্নার ঘরের দরজার কড়া নাড়লাম।

    “ওই, কে?!” একটু পর ভেতর থেকে বিরক্তি নিয়ে জবাব দিলো

    আমি কিছু না বলে আবারো কড়া নাড়লাম।

    “আরে বোবা নাকি!” কাচা ঘুম ভেঙে গেছে বলে রেগেমেগে বলল। “এত সকালে কেঠায়…?… কথা কয় না ক্যান!”

    একটু পরই দরজাটা খুলে গেল, আমাকে দেখে হা করে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “বাঁইচ্যা আছোস তাইলে!” বিস্ময়ে বলে উঠলো, তারপরই জড়িয়ে ধরলো আমাকে।

    হড়বর করে অনেক প্রশ্ন করলো মুন্না, আমি তার খুব কমই জবাব দিলাম। ওকে জানালাম, পরে সবকিছু বলবো। কয়েকটা দিন আমাকে এখানে থাকতে হবে।

    মুন্না আর কোনো প্রশ্ন করলো না।

    জামা-কাপড় ছেড়ে একটা লুঙ্গি আর টিশার্ট পরে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। আমাদের ঘুম ভাঙলো দশটার দিকে। অনেকদিন পর দুজনে মিলে ইয়াসির হোটেলে গিয়ে নাস্তা করলাম।

    এ কয়দিনে পুরান ঢাকার তেমন কিছুই বদলায়নি, তারপরও অচেনা লাগছে আমার কাছে। আমি নিশ্চিত, দুয়েকটা দিন পর আবারো এটা আগের রূপে ফিরে আসবে আমার কাছে।

    অধ্যায় ২৭ – বিশ্বাস

    দশ হাজার ডলার আমার কাছে সামান্য টাকা নয়। এ টাকা দিয়ে একটা বছর আরাম-আয়েশে চলে যাবে, তবে এরমধ্যে কিছু একটা নিশ্চয়ই করতে পারবো।

    মনিকার যক্ষের ধন থেকে ডলারের মাত্র একটা বান্ডিল নিয়ে এসেছি আমি। আরেকটা বান্ডিলের অর্ধেক দিয়েছি অজয়কে। অতোগুলো ডলার আর স্বর্ণ আমার পক্ষে দেশে আনা সম্ভব ছিল না। আমি এমন কোনো হুন্ডি-ব্যবসায়িকেও চিনি না যার মাধ্যমে এটা করতে পারতাম। তাই অনেক ভেবেচিন্তে একটা বান্ডিল দু’ ভাগে ভাগ করে জুতোর শুকতলায় রেখে অনায়াসেই নিয়ে আসতে পেরেছি।

    দেশে আসার পর দ্বিতীয় কি তৃতীয় দিন মুন্নার কাছে তৃপ্তির কথা জানতে চাইলাম আমি। সে অবশ্য ওর সত্যিকারের নামটা জানে না।

    “ওর খবর তো জানি না, দোস্ত,” কাঁধ তুলে ঠোঁট উল্টে বলল। “রিপন কইবার পারে…ডাকুম ওরে?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

    পরদিন রিপন এলো মুন্নার চিলেকোঠায়। “ওই মাইয়ার কুনো খবর নাই…জায়গা বদলাইছে, আগের জায়গায় থাকে না। কই থাকে জানি না, ভাই।”

    একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার ভেতর থেকে।

    “ওর চায়া ভালা মাল আছে আমার কাছে…এক্কেরে ফিলোর নায়িকা…এফডিসিতে চান্স নিছিলো…নিয়া আহুম, ভাই?”

    মুন্না আমার দিকে তাকালো জবাবের আশায়। মাথা দুলিয়ে না করে দিলাম।

    “ফিল্মের মাইয়া না, তুই একটা কলেজ স্টুডেন্ট লইয়া আয়।”

    মুন্নার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম। কাঁধ তুলল সে। মেয়েমানুষের ব্যাপারে আমার বন্ধুর অভ্যেস আগের মতোই রয়ে গেছে। অবশ্য এরকম অভ্যেস কয়েক মাসে বদলে যাবারও কথা নয়।

    “ডাইল খাবি?” রিপন চলে যাবার পর মুন্না বলল।

    না। ফেন্সিডিল এখন বিস্বাদ লাগে। কলকাতায় থাকতে মনিকা আমার জন্য অনেক ভালো মানের হুইস্কি নিয়ে আসতো। ওখানে ওসব জিনিস দেদারসে বিক্রি হয় একেবারে প্রকাশ্যে আর বৈধভাবে।

    “আমি হালায় এহনও ডাইল ছাড়বার পারলাম না,” আক্ষেপে বলল মুন্না। “এই কাশির সিরাপ আমারে পায়া গেছে।”

    সত্যি বলতে এ দেশের তরুণ সমাজের বেশিরভাগকেই পেয়ে বসেছে এই কাশির সিরাপটি I

    মুন্নাকে বললাম, এরচেয়ে বিদেশি হুইস্কি অনেক ভালো।

    “অনেক দাম…রোজ রোজ খাইলে রাজার ভাণ্ডারও শ্যাষ অয়া যাইবো। আমার বাপ আলিমুদ্দীনের ভাণ্ডার শ্যাষ অইবো এক বছরেই!” কথাটা বলেই চুপ মেরে গেল সে, বিমর্ষ হয়ে গেল তার মুখ। “আব্বায় গত মাসে হার্ট ফেইল কইরা মইরা গেছে।”

    কী বলবো ঝুঝতে পারলাম না। শোক প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা আমার কোনো কালেও ছিল না। কাউকে সান্ত্বনা দিতে গেলে কেমনজানি অস্বস্তি লাগে। পারি শুধু চুপচাপ মাথা নিচু করে রাখতে।

    কয়েক মুহূর্ত পর প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য মুন্নাকে বললাম, সে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করার কথা ভাবছে কি না।

    “কী ব্যবসা করুম?” পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো আমার বন্ধু। “নওয়াবপুরের দোকানেই তো বহি না…কর্মচারিরাই চালায়।”

    মুন্নার বাপের একটা হার্ডওয়্যারের ব্যবসা আছে নবাবপুরে। ওকে ওর বাপের ব্যবসার হাল ধরতে বললাম। আমার মুখ থেকে এ কথা শুনে অবাকই হলো সে।

    “তুই বদলায়া গেছোস,” সিলিংয়ের দিকে উদাস চোখে চেয়ে সিগারেট টানতে টানতে বলল। “এদ্দিন কই আছিলি, কী করছোস…কিছুই তো জানি না। তুই-ও কিছু কস্ না।” মুন্নার কণ্ঠে মৃদু অভিযোগের সুর।

    ঠিক করলাম, তাকে সবটা না-হলেও অনেক কিছু বলা উচিত। সবাইকে অবিশ্বাস করা কি সম্ভব? মুন্না আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ না, তাকে এইটুকু বিশ্বাস করা-ই যায়।

    অবিশ্বাসে সত্য মিললেও বিশ্বাসে মেলে প্রশান্তি!

    অধ্যায় ২৮ – চিরকুট

    চিঠি না, একটা চিরকুট।

    খাম নেই, প্রেরকের নাম নেই, আর সেটা পাঠানো হয়েছে লোকমারফত।

    যে ছেলেটা এই চিরকুট নিয়ে এসেছে, মুন্না তাকে চেনে না। ছেলেটা শুধু বলেছে, ওর নাম বাবু, পাঁচবাড়িতে থাকে। ধুপখোলা মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে পাড়ার এক ছেলের সঙ্গে কথা বলছিল মুন্না, তখনই ছেলেটা এসে ওকে সালাম দেয়, চিরকুটটা দিয়ে বলে, এটা যেন সে আমাকে দিয়ে দেয়।

    “এইটা আবার ক্যাঠায় পাঠাইলো?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো মুন্না। “তুই বুঝবার পারতাছোস কিছু?”

    সত্যি বলতে, চিরকুটটা না পড়েই আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম কে পাঠিয়েছে। মুন্নাকে সেটা বললামও। সে এখন মনিকার কথা জানে।

    “ওয় পাঠাইছে!” বিস্মিত হলেও আর কিছু বলল না।

    চিরকুটটা ভাঁজ করে স্ট্যাপলার মারা, সেটা খুলে পড়তে শুরু করলাম :

    আমি জানি তুমি এখন ঢাকায় আছো। তোমার বন্ধু মুন্নার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখাসাক্ষাত হয়, সেই ভরসায় এটা পাঠালাম। তুমি ওর কথা বলেছিলে আমাকে। আমি খুব বিপদে আছি। ভয়ঙ্কর বিপদে। আমার সব শেষ। নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় তিল তিল করে যা কিছু জমিয়েছিলাম, তার কিছুই এখন নেই। আমার আপন দাদা, যাকে আমি বাবার মতো সম্মান করতাম, মানতাম, বিশ্বাস করতাম, সে-ই এখন আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। পুরোপুরি বদলে গেছে মানুষটা। আমার জীবনের কোনো মূল্য নেই তার কাছে। আমার টাকা-পয়সা সব আত্মসাৎ করে আমাকে নিঃস্ব করে ফেলেছে।

    অনেকদিন আগে থেকেই আমি টের পাচ্ছিলাম, দাদার মতিগতি বদলে যাচ্ছে, তাকে আর বিশ্বাস করতে পারিনি, তাই অন্য এক হুন্ডি ব্যবসায়ির মাধ্যমে ঢাকা থেকে টাকা এনে বেশ কিছু ডলার আর স্বর্ণ কিনে ফ্ল্যাটে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কী করে যেন দাদা সেটা টের পেয়ে গেছে, পুরো ফ্ল্যাট লণ্ডভণ্ড করে সেগুলো খুঁজেও পেয়েছে।

    তোমাকে না পেয়ে আমি যখন দাদার কাছে তোমার কথা জানতে চাই, তখন সে উল্টো বলে, তুমি বেঈমানি করেছো তাদের সঙ্গে। বিরাট বড় ক্ষতি করেছো তুমি। আর এসবের কলকাঠী নেড়েছি আমি। সেজন্যে আমার গায়েও হাত তুলেছে দাদা।

    ওইদিন কী হয়েছে, আমি জানি না। দাদাও আমাকে কিছু বলেনি। তবে তুমি যা-ই করেছো, ভালো মনে করেই করেছো, এই বিশ্বাস আমার আছে।

    তুমি হয়তো ভেবেছো তোমাকে বিশ্বাস করিনি বলেই ফ্ল্যাটে ওগুলো লুকিয়ে রাখার কথা গোপন রেখেছিলাম তোমার কাছ থেকে। সত্যিটা তুমি বুঝবে কি না জানি না, আমি আসলে ভয় থেকে এটা করেছি। টাকা-পয়সা মানুষকে কতো দ্রুত বদলে দেয় সেটা আমি দাদাকে দেখেই বুঝে গেছিলাম। আমি চাইনি, তুমিও ওভাবে বদলে যাও। তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসি আমি। তোমাকে আমি আমার আশ্রয় ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার মন্দ ভাগ্য, তোমাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম সেটাও ভেঙে গেল।

    আমি যদি সবটা খুলে বলতাম, তাহলে হয়তো তুমি আমাকে ভুল বুঝতে না। বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে এখন পর্যন্ত যা কিছু করেছি, মুক্তি পাবার জন্যই করেছি।

    তোমাকে অমন বিপদের মুখে ঠেলে দেবার জন্য আমি লজ্জিত। ভেবেছিলাম কাজটা করে দিলে দাদা খুশি হবে, আমাদের বিয়ে মেনে নেবে, টাকা- পয়সাগুলোও ফিরিয়ে দেবে। কতো বড় বোকামিই না করেছি আমি।

    একেবারে নিঃস্ব হয়ে ঢাকায় চলে এসেছি আমি। তোমার খুব কাছাকাছিই আছি। যদি দেখা করো, কিছু কথা বলতাম। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। শুধু একটা কথাই বলবো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। যদি না পারো, অন্তত ঘৃণা কোরো না।

    .

    চিরকুটটার শেষে কোনো নাম লেখা নেই।

    স্বীকার করছি, এটা পড়ার পর মনিকার প্রতি যে অবিশ্বাস, সেটা ফিকে হয়ে এলো। যদিও আমার মনের একটা অংশ বলছে, এটা একটা ফাঁদ হতে পারে। তবে সেটা নিশ্চয়ই মনিকা পাতেনি। সম্ভবত ওর দাদার চাল। তবে আমার এই কণ্ঠস্বরটা বেশ দুর্বল শোনালো নিজের কাছে।

    ভালোবাসা আর আশ্রয়!-মনিকার এই শব্দদুটো আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

    অধ্যায় ২৯  – তার মুখের দিকে দেখি!

    মনিকার বদ্দা হলো সেই ধরণের খারাপ মানুষ, যারা প্রচণ্ড রকমের পাষণ্ড আর লোভী হলেও আদতে ভীষণ ভীতু। সত্যিকারের সাহস বলতে যা বোঝায়, তার ছিঁটেফোঁটাও নেই।

    মনিকার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতেই হবে, ওর বদ্দার ব্যাপারে আমার অনুমাণ পুরোপুরি মিলে গেছে। আমার মনের একটা অংশ মনিকাকে অবিশ্বাস করলেও, অন্য অংশটি আশায় বুক বেঁধে ছিল-মনিকা আমাকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। সেই অংশটিই জিতে গেছে শেষ পর্যন্ত। আর সেজন্যেই আজ আমি এখানে।

    বিধুদার পৈতৃক বাড়িটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।

    পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের পাঁচবাড়ি হিসেবে পরিচিত এই মহল্লায় হিন্দুধর্মালম্বীদের সংখ্যাই বেশি। বিধুদার উত্থান এখান থেকেই। বাস্তবে লোকটা যেরকমই হয়ে থাকুক না কেন, এই মহল্লায় বিধুদা রীতিমতো অবতার। মৃত বিধুদা এখনও এই তল্লাটে বেশ প্রভাব রাখে। তার প্রতি অনুগত প্রচুর লোকজন আছে। তারা এখানে বিধান কৃষ্ণ সরকার স্মৃতি সংঘ গঠন করেছে। স্মৃতি সংঘের অফিস-ঘরে তার বিশাল আকারের ছবিতে মালা দেয়া আছে।

    মুন্নাকে সব বলার পর সে খোঁজখবর নিয়ে বের করে তার এক খালাতো ভাইয়ের বন্ধু পবন এখানে থাকে। পবনদের দোতলার একটা ঘরের পুব-দিকের জানালা দিয়ে বিধুদার বাড়িটা দেখা যায়। পুরান ঢাকার আর সব বাড়ির মতো এখানকার বাড়িগুলোও একটার সঙ্গে একটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। কান পাতলে পাশের বাড়ির আলাপও শোনা যায়। এখানে কোনো কিছুই লুকিয়ে করার জো নেই।

    “বৌদি একলা-ই আইছে…” নিজের ঘরের খাটের উপর বসে পবন বলল। “…আর কাউরে দেখি নাই।”

    “হের এক দাদা আছে না?… বিশু…হেরে তুমি চেনো?” জানতে চাইলো মুন্না।

    কাঁধ তুলল পবন। “হুনছি হেয় কলকাতায় থাকে…জীবনেও দেহি নাই।”

    আমরা তিনজন চা-সিগারেট খেলাম। পবন তেমন কোনো প্রশ্ন করলো না। সম্ভবত মুন্না তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে বারণ করে দিয়েছে আগেই।

    জানালার পুরনো কপাটটা একটু ফাঁক করে দেখছি আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি, এমন সময় একটা ঘরের জানালার সামনে ওকে দেখতে পেলাম।

    বাঁ-চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গেছে। চেহারায় বিপর্যস্ততার ছাপ। এ কয়দিনে স্বাস্থ্যও ভেঙে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে,শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত।

    এই প্রথম মনিকার মুখটা দেখে আমার ঠিক সেরকম মায়া হলো, যেমনটা মোমেনার বেলায় হয়েছিল। ইচ্ছে করলো এক্ষুণি ছুটে গিয়ে ওর মুখটা দুহাতে ধরি।

    অদ্ভুত এক আবেগ ভর করলো আমার মধ্যে। ওর সঙ্গে মিলিত হবার সময়, শীর্ষসুখের সময়টাতে যেরকম আবেগ ভর করতো, তার চাইতেও অনেক বেশি তীব্র।

    আস্তে করে জানালার কপাটটা ঠেলে পুরোপুরি খুলে দিলাম। মনিকা একটু চমকে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল ও, অপলক চোখে চেয়ে রইলো আমার দিকে। ঘরের ভেতরে পবন আর মুন্নার নিচুস্বরের কথাবার্তাগুলো হারিয়ে গেল নিমেষে।

    টপ টপ করে মনিকার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। কিন্তু আমার থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরালো না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকন্ট্রোল (বেগ-বাস্টার্ড ৭) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article দরিয়া-ই-নুর – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }