Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অগ্নিনিরয় – কৌশিক মজুমদার

    কৌশিক মজুমদার এক পাতা গল্প336 Mins Read0

    শৈলর কথা

    ১।

    সবে তখন সিপাই বিদ্রোহ শেষ হয়েছে। আগুনের আঁচ ধিকিধিকি জ্বলছে সারা ভারত জুড়ে। ঠিক এমন সময় কলকাতার অদূরেই চুঁচুড়ায় অন্য এক আগুন ঘনিয়ে উঠল। যদিও শুরুতে কেউই বুঝতে পারেননি যে এমনটাও হতে পারে। বাংলাদেশে কৌলীন্য প্রথা নিয়ে বছর চারেক আগে রামনারায়ণ তর্করত্ন একখানা নাটক লিখেছিলেন। নাম “কুলীনকুল-সর্বস্ব”। কালীসিংহী নিজের বাড়িতে এই নাটকের অভিনয় করালেন। ওরিয়েন্টাল থিয়েটারের প্রিয়নাথ দত্ত নিজে এই নাটকে অভিনয় করলেন। তাঁরই উদ্যোগে তাঁর মামা গদাধর শেঠের বাড়িতেও এই নাটকের অভিনয় হল। যে-ই দ্যাখে, সে-ই ধন্য ধন্য করে। খবর ছড়াতে দেরি হলনা। ১৮৫৮ সালের ৩ জুলাই চুঁচুড়ায় নরোত্তম পালের ছেলে শ্রীনাথের উৎসাহে প্রথমবার “কুলীনকুল- সর্বস্ব” অভিনীত হল। গায়ক রূপচাঁদ পক্ষী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই নাটকের অভিনয়ের জন্য গান রচনা করে অভিনেতাদের তালিম নিলেন। নাটকে প্রায় নয়শো লোক ভিড় জমিয়েছিলেন। এত ভিড় চুঁচড়োর মানুষ আগে কোনও বাড়ির কোনও অনুষ্ঠানে দেখেননি। দুর্গাপুজোতেও না। নাটক দেখে সবাই যখন বেরোচ্ছে, প্রায় সবাই গুনগুন করে নটীর গান গাইছে, “অধীনীরে গুণমণি পড়েছে কি মনে হে।” অল্পেতে স্বাদ মেটে না। ঠিক হল দুইদিন বাদে ৫ জুলাই আবার এই নাটকের দ্বিতীয় অভিনয় হবে। এদিকে খবর পৌঁছে গেল গঙ্গার অপর পাড়ে ভাটপাড়ায়। ভাটপাড়ার পণ্ডিতরা শুনলেন তাঁদের অপমান করে নাটুকে নারায়ণ নাটক বেঁধেছে, আর চুঁচড়োর পালবাড়িতে মহাসমারোহে সেই “এটোপ্লে” হচ্ছে। দুনিয়ার পেচাপেটি লোক দেখছে আর তালি বাজাচ্ছে। আর যায় কোথায়? একদল কুলীন ব্রাহ্মণ বেশ কয়েকটা নৌকা ভাড়া করে গঙ্গা পেরিয়ে এপারে এসে পালবাড়িতে চড়াও হলেন। দাবি একটাই, “এ নাটক অশ্লীল। এ নাটক দেখানো যাবেনা।” প্ৰায় মারামারি বাধার উপক্রম, এমন সময় সেই ব্রাহ্মণরা এমনদুটো ব্যাপার জানতে পারেন, যা তাঁদের অজ্ঞাত ছিল। এক, রামনারায়ণ নিজে ভাটপাড়ার বামুন বংশের ছেলে, আর দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, নরোত্তম পালের প্রচুর টাকাপয়সা। তিনি টাকা দিয়ে বামুনদের মুখ বন্ধ করে দিলেন। নাটক যথাসময়ে অভিনীত হল। কিন্তু সমাজের রোষে পড়ার ইতিহাস বাংলা নাটকের সেই প্রথম।

    এই ঘটনায় শাপে বর হল। কলকাতার পাশাপাশি চুঁচুড়াতেও নাটকের দল গড়ে উঠতে লাগল। চুঁচুড়ার কদমতলায় অক্ষয় সরকারের বাড়িতেও এমন একটা নাটকের দল গড়ে উঠল। অক্ষয় সরকার এককালে নবজীবন নামে একটা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ কে লেখেননি তাঁর সেই পত্রিকায়! এখনও কলকাতার বড়ো বড়ো দিগগজরা তাঁকে একডাকে চেনে। ইদানীং তাঁর শখ জেগেছে থিয়েটারের।

    পুজোর কিছু আগের কথা। ঠিক হল এবার ঘটা করে “প্রহ্লাদচরিত্র” অভিনীত হবে। প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা নাটমন্দিরে “প্রহ্লাদচরিত্র” রিহার্সাল হয়। অক্ষয় সরকার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদবির করেন। আর প্রতিদিনই নাটমন্দিরের ঠিক পাশের ভাঙা পাঁচিলে এক যুবককে বসে থাকতে দেখেন তিনি। সে একেবারে বিরক্ত করে না। শুধু ঠায় বসে থাকে আর তাকিয়ে থাকে তাঁদের দিকে। ভাঙা পাঁচিলটির মালিক একজন বৃদ্ধা। তাকে নগদ দুটো পয়সা দিলেই পাঁচিলের উপর বসে থিয়েটার দেখতে দেয়। পাঁচিলটির আরও মজা আছে। পাঁচিলের উপর থেকে থিয়েটারের সদর অন্দর দুটোই পরিপাটি করে দেখা যায়। যুবক দ্যাখে, কেমন করে অন্দরমহলে বসে নারদ হুঁকোয় দম নিয়েই ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে “নারায়ণ নারায়ণ” বলে স্টেজে ঢুকেছেন! অক্ষয় সরকার সব দেখেন। কিছু বলেন না।

    একদিন তিনি ছেলেটিকে ডেকে নিলেন। প্রথমে উলটে পালাতে গেছিল। পরে ন্যাপলা সহ তিন-চারজন দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে আনল। ছোটোখাটো চেহারা, মুখে লালিত্যের ভাব। ভগবান যেন মেয়ে বানাতে গিয়ে মুহূর্তের ভুলে একে ছেলে বানিয়ে দিয়েছেন। আচরণেও মেয়েলি ভাব স্পষ্ট। অক্ষয় সরকারের সামনে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল সে।

    “নাম কী?” খুব নরম সুরেই জিজ্ঞেস করলেন অক্ষয়।

    “আজ্ঞে শৈলচরণ। শৈলচরণ সান্যাল। পিতা রমাপ্রসাদ সান্যাল।”

    “আরে বলো কী হে! তুমি রমার ছেলে? তোমার বাবা তো এককালে আমার

    খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। আমরা এক আখড়ায় কুস্তি করতাম। তোমার আগে দুই দাদা আছে না? তারা কী করে?”

    “আজ্ঞে কুস্তি করে।”

    “আর তুমি? তুমি কুস্তি করো না?” বলেই অক্ষয় বুঝলেন প্রশ্নটা নেহাত বেফাঁস হয়ে গেছে। এই চেহারা আর এই গঠনে আর যাই হোক তৃপ্তি হয় না। তার জন্য অন্য ধাতু দরকার।

    ছেলেটি অবশ্য এ কথায় কিছু মনে করল না। সরল মুখে বলল, না। আমার ওসব ভালো লাগে না।”

    “তবে কী ভালো লাগে? নাটক দেখতে?”

    “আজ্ঞে, লেখালেখিও করি কিছু।”

    “নাটক করার ইচ্ছে আছে?”

    “আজ্ঞে ছেলেটি বোধহয় এমনটা আশা করেনি। সে হাঁ করে অক্ষয় সরকারের দিকে তাকিয়ে রইল। অক্ষয় ন্যাপলাকে বললেন, “ওরে ন্যাপলা, একে একটা বই দে দিখি। কেমন পার্ট পড়ে, শুনে দেখা যাক!”

    ন্যাপলা বই এগিয়ে দিতে যেতেই হাত বাড়িয়ে মানা করল ছেলেটা। তারপর গলার উড়নি মাথায় পেঁচিয়ে ঘোমটার মতো করে হাত নেড়ে হিরণ্যকশিপুর পত্নী কয়াধুর পার্ট বলা শুরু করলে-

    “আগে পুত্রকে সিংহাসনে বসাও, তারপর মহারানি সম্বোধন করো; নতুবা ও সম্বোধন আমার কানে বিদ্রূপ শোনায়, সেনাপতি! বড়ো রাজার মৃত্যুর পর যদি একদিনও দৈত্যনাথ সিংহাসনে বসে যেতেন, তা হলেও মহারানি কথার সার্থকতা আমার থাকত; কিন্তু তা হয়নি। তারপর নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রকেও যদি রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করে যেতেন, তা হলেও আমার রাজমাতা বা মহারানি সম্বোধনের মূল্য থাকত। কিন্তু এ যে সবই বিপরীত হয়ে গেল, সেনাপতি! হা, অতিরিক্ত ভ্রাতৃশোকে তার বুদ্ধিবিপর্যয় ঘটেছিল। তার সে মহাত্রুটির সংশোধন আমাকেই এখন করে নিতে হবে। তুমি যখন আমার হস্তগত, এক ফুৎকারে সব উড়িয়ে দেব। সব ভেঙে দেব।”

    “চমৎকার! অতি চমৎকার! শুধু শুনেই এত!” নিজের অজান্তেই ফ্ল্যাপ দিয়ে উঠলেন অক্ষয় সরকার। “শুধু গলায় একটু নজর দিতে হবে। ওসব হয়ে যাবে। ন্যাপলা, তুই এক কাজ কর। ছেনোকে বলে দে ওকে আর কয়াধুর পার্ট করতে হবে না। আমি আমার কয়াধুকে পেয়ে গেছি। শোনো হে ছোঁড়া, একজনকে বাদ দিয়ে তোমায় নিচ্ছি। মান বজায় রেখো।”

    ছেলেটি ইতস্তত করে।

    “কিছু বলবে?”

    “আজ্ঞে একটাই কথা ছিল। আমার বাবা দাদারা এসব পছন্দ করেন না। আপনি দেখবেন তাঁরা যেন না জানেন।”

    “নাটক মঞ্চস্থ হলে তো জানতেই পারবেন।”

    “পারবেন না। তখন তো মেক-আপ নিয়ে থাকব। আর আমাদের বাড়ির কেউ থ্যাটার দেখা পছন্দ করে না।”

    “হ্যান্ডবিলে তো তোমার নাম থাকবে।”

    “বদলে দেবেন।”

    “কী দেব?”

    “আজ্ঞে, কুমারী শৈলবালা দাসী।”

    গলা সাধার একটা উপায় একটা বার করা হল। ঘন্টাঘর থেকে কিছু দূরে একটা নির্জন ঘাটের নিচে খানিকটা সিমেন্ট দিয়ে আর খানিকটা পোস্তা বাঁধানো। চতুর্দিকে মাঠ, বন। গলা সাধার পক্ষে অতীব চমৎকার জায়গা। সারা দুপুর গলা সাধার কসরত চলে শৈলর। প্রাণপণে চিৎকার করতে হয়। গলার শির ফুলে যায়, ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে যায়, তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে আসে। তবু সে গলা সাধা থামায় না।

    পুজোতে “প্রহ্লাদচরিত্র” নাটকে কয়াধু চরিত্রখানি দুইখানি সোনার মেডেল পেল। একটা দিলেন শ্রীনাথ পাল স্বয়ং, আর অন্যটা চুঁচুড়োর ভট্টচার্য বাড়ির গিরীন ভট্টচার্য। অক্ষয় সরকারের দলে নারী চরিত্রে শৈলর স্থান পাকা হয়ে গেল।

    .

    ২।

    সাইগারসন দেশে ফেরার পর তারিণীর অবস্থা আবার সেই আগের মতো একটেরে হয়ে গেল। বরং আরও খারাপ হল। এর আগে নিজের ছোটো অফিস, ছোটো কেস নিয়ে একরকম কাটিয়ে দিচ্ছিল। মাঝের এই কয়দিন যেন ঝড়ের মতো এসে তার জীবন পুরো ওলটপালট করে দিয়ে গেছে। ম্যাজিকের মঞ্চে এক সন্ধ্যায় দুই জাদুকরের মৃত্যু, চিনা গুপ্তঘাতকের দল, রক্ত পরিবর্তন, সব মিলেমিশে যে উত্তেজনা সদ্য কাটিয়ে উঠেছে সে, তা এখন ভাবলে অলীক স্বপ্ন বোধ হয়। জোয়ার চলে যাবার পরের পলির মতো ওই দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতি ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রিয়নাথ নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তার মতো ছাপোষা লোককে সময় দেবার সময় তাঁর নেই। মাঝের এই কেসের ফলে সবচেয়েবড়ো যে ক্ষতি হয়েছে, তার বেশ কিছু বাঁধা মক্কেলের কাজ সে সময়মতো করে দিতে পারেনি। ফলে তারা অন্য গোয়েন্দা ধরেছে। এক অর্থে তারিণী এখন কর্মহীন। আবার সে ঘুরে ঘুরে পুরোনো মক্কেলদের সঙ্গে দেখা করছে। যদি কেউ কোনও কাজ দিতে পারে। সাহেবদের অনেকেই দেশে ফিরে গেছেন। নেটিভরা দরকার মতো তাকে দিয়ে কাজ করিয়েছে। এখন এমন ভাব করছে, যেন কোনও দিন দেখেইনি।

    সেদিন লোয়ার সার্কুলার রোডের এক সাহেবের বাড়িতে গেছিল তারিণী। ফেরার পথে দেখতে পেল জোড়া গির্জার সামনে মাটি খুঁড়ে কাঠের বেড়া লাগানোর কাজ চলছে। আগে এই গির্জা আমহার্স্ট স্ট্রিটে ছিল। তখন কোনও চূড়া ছিল না বলে লোকে ন্যাড়া গির্জা বলত। সে গির্জা ভেঙে পড়ায় ইদানীং নতুন জায়গায় নতুন করে গির্জা তৈরি হয়েছে। এবার অবশ্য আগের বারের চূড়ার হিসেব মেলাতে দুইখানি চূড়া বানিয়েছেন সাহেবরা। আনতে গির্জা একটা হলেও লোকে জোড়া গির্জা ডাকে। তারিণীর হাতে তেমন কোনও কাজ নেই। সে খানিক কোমরে হাত দিয়ে কাজ দেখতে লাগল। লম্বা কালো আলখাল্লা পরা কিছু সাহেব পাদ্রির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে দুই-একজন নেটিভ। তাদেরই একজনকে দেখে চমকে উঠল তারিণী। শৈল না? রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড় প্রচুর। তারই মধ্যে কোনওমতে রাস্তা পেরিয়ে ওদিকে গিয়ে সে শৈলকে চেপে ধরল। শৈলও তাকে দেখে অবাক! এতদিন বাদে তারিণীকে দেখবে আশা করেনি।

    “এখানে কী করচ ভাই?” তারিণী শুধাল।

    “সে অনেক কথা। ফুরসতে বলা যাবেখন। হাতের কাজটা সেরে নিই।”

    “হাতের কাজ! বলো কী হে! তুমি হিন্দু বামুনের ছেলে, তুমি কিনা ভাখুইয়ে, মান খুইয়ে কেরেস্তানি গির্জায় জন খাটচ? কত বড়ো বাড়ির ছেলে তুমি!”

    “আর বাড়ি! বাবা আমায় ত্যাজ্যপুত্তুর করেচেন ভাই।”

    “সে কী! কেন? আর অক্ষয় সরকারের দলে যে নাটক করতে? সেখানে ঠাঁইদিলে না?”

    “সেকান থেকেই তো গণ্ডগোল!”

    “আর ন্যাশনাল? সেখানেই তো ছিলে এতদিন। নাটক ছেড়ে দিলে?”

    শৈলর চোখ জলে ভরে এল, “সে অনেক কতা ভাই। তোমায় পরে সব বলবখন।”

    “পরে আবার কখন? তোমায় আমি ছোটো থেকে চিনি। এই জন খাটার জন্য। ভগবান তোমায় তৈরি করেননি। তুমি এসো দেকি আমার সঙ্গে।”

    “কোতায়?”

    “ক্লাইভ স্ট্রিটে আমার ছোটো একখানা আপিস আচে। আমার যদি দুবেলা দুমুঠো জোটে, তোমারও জুটে যাবে। আর নেহাত না ফুটলে হরিমটর”, তারিণী একটু হাসির চেষ্টা করল। “এখন চলো দেকিনি আমার সঙ্গে। মুক দেখে মনে হয় কতদিন কিচুখাওনি। শ্যালদার কাচে ভালো কচুরি, সবজি আর জিলিপি ভাজে। খাওয়ার চলো।”

    খানিক ইতস্তত করে শৈল বললে, “এরা যে এক আনা পয়সা দেবে বলেচে।”

    “রাখো সে পয়সা। তোমার মতো ছেলের পক্ষে ওই পয়সা নেওয়া পাপ।”

    খানিক কীসব ভেবে শৈল তারিণীর পিছু নিলে। শিয়ালদায় খাওয়াদাওয়া করে, ক্লাইভ স্ট্রিটে তারিণীর ঘরে গিয়ে বসল দুজনে। অগোছালো ঘর। যেমন অবিবাহিত পুরুষদের থেকে আশা করা যায়। এক প্রাস্তে একটা খাটিয়া পাতা। পাশে বেশ কিছু তাস, বড়ো একটা টুপি আর কিছু রঙিন কাগজ ছড়ানো। একধারে দুটি বড়ো দিশি মদের বোতল।

    “এগুলো কীসের? তুমি আবার নেশাও ধরেচ নাকি?”

    একগাল হেসে তারিণী বললে, “না হে! তোমার এক পুরোনো বন্ধু মাঝে মাঝেই একানে থাকেন কিনা। এসব তাঁরই অবদান।”

    “কে? গণপতি? তার কী খবর?”

    “খবর ভালোই। দর্জিপাড়ায় একন আর থাকে না। এদানি বেশ নামডাক হচ্চে। শো-এর কাজে প্রায়ই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। সবই ভালো, শুধু এই কারণবারিই তাকে খেলে। কত মানা করি… শুনবেই না।”

    শৈল কিছু বলে না একেবারে গুম মেরে বসে থাকে।

    “এবার তুমি বলো দেখি, সব কতা খুলে। চুঁচড়ো থেকে কলকেতায় পথম যকন এলে তখন কিচু শুধাইনি। কিন্তু আজ তোমায় ওভাবে দেকে বড্ড কষ্ট হচ্চে। আমায় যদি বন্ধু মানো, তবে কিছু লুকিয়ো না।”

    শৈল খানিক ফাঁকা দৃষ্টিতে তারিণীর দিকে চেয়ে রইল। তারপর দুই হাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। তারিণী এটা আশা করেনি। সে যত্ন করে শৈলর চোখের জল মুছিয়ে দিল। পিতলের ঘটি করে জল এনে দিল। সে জলের কিছু গলায় ঢেলে, কিছুটা মুখে, ঘাড়ে মাথায় দিয়ে সামান্য শান্ত হল শৈলচরণ। তারপর শুরু করল তার অদ্ভুত আখ্যান-

    চুঁচুড়ায় ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ অভিনয়ের পরে অক্ষয় সরকারের দলে শৈলর স্থান একরকম পাকা হয়ে গেল। তারপর একে একে ‘মীরাবাই’-এর মীরা, ‘জনা’-তে স্বয়ং জনা, ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে লেডি ম্যাকবেথ- যে-কোনো নাটকে প্ৰধান মহিলা চরিত্র মানেই শৈল। হ্যান্ডবিলে অবশ্য শৈলবালা। প্রায় সবকটি নাটকেই তার বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় থাকতেন ব্যোমকেশ সরকার। অক্ষয়ের বড়ো ছেলে। প্রেসিডেন্সি পাশ। সদ্যবিবাহিত। কিন্তু কোনও সন্তানাদি নেই। সেই ব্যোমকেশ মঞ্চের প্রেমকে বাস্তব করে তোলার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। প্রথমে শৈল বাধা দিয়েছিল। কিন্তু ব্যোমকেশকে ঠেকানো সহজ নয়। রিহার্সালের ফাঁকে, নাটকের সময় যেন আলগোছেই তাঁর হাত স্পর্শ করত শৈলর গোপনতম অঙ্গগুলোতে। সেই শিহরন উপেক্ষা করতে পারেনি শৈলও। সে ব্যোমকেশকে নিজের সবকিছু দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তারা দুজনেই জানত এ সম্পর্কের কোনও পূর্ণতা নেই। কিন্তু ভালোবাসা কোনদিন এত কিছু ভেবেছে! যেটা ভাবতে পারেনি, সেটা হল অত তাড়াতাড়ি অক্ষয় সরকার ওদের দুজনকে গ্রিনরুমে দেখে ফেলবেন। দলের কেউ নিশ্চয়ই খবর দিয়েছিল। ব্যোমকেশ গোটা দোষ খুব স্বাভাবিকভাবেই শৈলর উপর চাপান। তাঁর নাকি এসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। শৈলই ক্রমাগত তাঁকে ফুসলিয়ে…. ফলে অক্ষয় সরকার তাকে দল থেকে তাড়ালেন। খবর পেয়ে শৈলর বাবাও ত্যাজ্য পুত্র করলেন তাকে। কলকাতা আসা ছাড়া শৈলর আর গতি রইল না।

    এর পরের অংশ কিছুটা জানে তারিণী। কলকাতায় এসে রামানন্দ পালের বাড়িতে নাট্যসমাজে যোগ দেয় শৈল। অবশ্য অভিনেতা হিসেবে না। নাট্যকার হিসেবে। নাট্যসমাজ-এর বাঁধা নাট্যকার গোপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রামানন্দবাবুর সঙ্গে হিস্যা নিয়ে করে স্টারে যোগ দেন। রামানন্দ আতান্তরে পড়লে এই শৈলই “কলকেতার কালোয়াতি” নামে এক প্রহসন লিখে তাঁকে বাঁচায়। প্রহসন শৈল দক্ষতা ছিল দেখার মতো। হাসির গান লেখায় তার জুড়ি ছিল। “গুরুদেব স্যাঙাৎ সংবাদ” নাটকে তাঁর লেখা “ব্রান্ডি এল ঠান্ডি গেল পাণ্ডা হল কাত” গান মুখে মুখে ফিরতে লাগল। এমনকি নাটকের শুরুতে যে জাদু দেখানো হত তাতে জাদুকর গণপতিও হারমোনিয়াম বাজিয়ে শৈলর গান গাইত।

    রামানন্দ চেয়েছিলেন শৈল নাট্যসমাজেই থাক। কিন্তু দুটো সমস্যা হল। এক রামানন্দ শৈলকে দিয়ে নাটক লেখালেও তাঁকে অভিনয়ে চাপ দিতে চাইতেন না। খুব সম্ভবত অক্ষয় সরকারের দলের ঘটনা তাঁর কানে এসেছিল। অন্যদিকে ন্যাশনাল থিয়েটার প্রায় দেড়া দামে শৈলকে তাদের দলে যোগ দেবার প্রস্তাব দেয়। শৈলর কাছে এ এমন প্রস্তাব যা অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। তবে সে শর্ত দেয়, লেখার সঙ্গে সঙ্গে তাকে অভিনয়েও সুযোগ দিতে হবে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে ছেলে দানীবাণুর অনুরোধে গিরিশ ঘোষ রাজি হলেন।

    ন্যাশনালে শৈলর প্রথম অভিনয় ‘আদর্শ সতী’ নাটকে। নায়িকার সঙ্গীর ভূমিকায়। তারপরেই তার উল্কার গতিতে উত্থান। বিদ্যাসুন্দর-এর বিদ্যা, নবীন তপস্বিনীর তপস্বিনী, সরোজিনী আর কৃষ্ণকুমারীতে নামভূমিকায়। গিরিশ ঘোষের বয়স হয়েছে। আজকাল সব নাটক দেখতে আসেন না। ছেলের অনুরোধে নল- দময়ন্তী দেখতে এসে শৈলর অভিনয় দেখে দাঁড়িয়ে উঠে ক্ল্যাপ দিয়েছেন তিনি। ন্যাশনালে এমন সৌভাগ্য এক ভুমিবাবু আর বিনোদিনী ছাড়া আর কারও হয়নি। শৈলর খ্যাতি যখন প্রায় মধ্যগগনে, তখনই অনর্থ ঘটল।

    ন্যাশনালে দানীবাবুর কিছু ইয়ার দোস্ত ছিল। এদের পান্ডা রামতারণ বসু নামে এক বড়োলোকের ছেলে। ন্যাশনালে তার বাপ ভালো পয়সা ঢালে, সেই সুবাদে সে অভিনেতা। অভিনয়ের “অ” জানে না। কিন্তু প্রত্যেক নাটকে তার থাকা চাই। ধনী বাধ্য হয়ে ছোটো ছোটো রোল দেন তাকে। চুচ্চুরে মাতাল হয়ে নাটকের রিহার্সালে আসে, পার্ট ভুলে যায়, কিন্তু তার আসল নজর নাটকের মেয়েদের দিকে। নতুন কোনও মেয়ে এলেই ছলে বলে কৌশলে রামতারণ তাকে অঙ্কশায়িনী করে। অবশ্য এই ব্যাপারে সে উদার। একা ভোগ করার পক্ষপাতী সে নয়। তার বাগানবাড়িতে চার-পাঁচজন ইয়ার মিলে একত্রে ভোগ করে সেই ষোড়শী মেয়ের অপরিণত শরীর। অনেকসময় তাদের যৌনতার বিকৃতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে বহু মেয়ে প্রায় এক পক্ষকাল বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। সবাই সব জানে। কেউ কিছু বলে না।

    শৈলরই দুর্ভাগ্য, মুখ বদলাবার জন্য রামতারণের নজর পড়ল তার দিকে। প্রথমে ঠারেঠোরে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, বলেছিল শৈলকে তার বাগানবাড়িতে যেতে। শৈল রাজি হয়নি। শেষে একদিন রিহার্সালের শেষে অভিনয়ের অছিলায় শৈলকে জড়িয়ে চুম্বনের চেষ্টা করে রামতারণ। শৈল কোনওক্রমে তাকে ঠেলে পালিয়ে যায়। সেদিন রিহার্সালে দানীবাবু নিজে উপস্থিত ছিলেন। তিনি রামতারণকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। এতে হিতে বিপরীত হয়। রামতারণের দল হিংস্র হয়ে ওঠে। একদিন রিহার্সাল শেষে ফেরার সময় তারা শৈলর পিছু ধাওয়া করে। শৈল পালাতে যায়। লাভ হয় না। রামতারণ ও তার বন্ধুরা এক গলির ভিতরে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে একে একে পায়ুমন্থন করে। যন্ত্রণায় প্রায় চারদিন শয্যাশায়ী ছিল শৈল। সুস্থ হয়ে ন্যাশনালে ফিরে সে দানীবাবুকে গোটা ঘটনা জানায়। দানীবাবু গিরিশ ঘোষকে। বিচার বসে। বিচারে অন্তত দশজন সাক্ষ্য দেয়, সেই দিন রিহার্সালের পর রামতারণ জুড়িগাড়ি চেপে সোজা বাড়ি ফিরে গেছিল। সাক্ষীদের মধ্যে রামতারণের বন্ধু ছাড়াও গাড়ির সহিস, বাড়ির চাকর, এমনকি স্বয়ং রামতারণের বাবা শিবচরণ নিজে ছিলেন। বিচারের একেবারে শেষে এরা এক নতুন সাক্ষীকে নিয়ে আসে। এতদিন পর তাকে এইভাবে দেখবে বলে শৈল আশাও করেনি। চুঁচুড়োর অক্ষয় সরকারের ছেলে ব্যোমকেশ নিজে এসে জানায়, শৈলর চরিত্র ভালো না। সে থিয়েটারের পরিবেশ নষ্ট করে। ফলত বিচারে ন্যাশনাল থিয়েটার থেকে শৈলকে সেই মুহূর্তে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। শৈল পুলিশের কাছে যায়। কিন্তু ন্যাশনাল এই বিষয়ে কোনও ঝামেলা চাইছিল না। তারা পুলিশের মুখ টাকা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। বেশ কিছুদিন কাটে কাজের আশায়। অবশেষে ন্যাশনালেরই এক খ্রিস্টান লাইটম্যান তাকে জানায় সে যদি প্রভু যিশুর পাদপদ্মে নিজেকে অর্পণ করে, তবে চার্চ তার থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করতে পারে। তখন শৈলর যা অবস্থা, তাতে যে-কোনো প্রস্তাবই তার কাছে গ্রহণযোগ্য। সাতপাঁচ না ভেবেই এক রবিবার সকালে জোড়াগির্জায় তাকে ব্যাপটাইজ করা হয়। নতুন নাম হয় ডেভিড শৈলচরণ সান্যাল। এই অবধি বলে চুপ করে বসে থাকে শৈল। বোঝে না আর কী বলবে।

    এদিকে তারিণীর দিকে তাকিয়ে দ্যাখে তারও দুচোখ জলে ভরে গেছে। খুব মৃদু স্বরে তারিণী বলে, “তোমাকে আর গির্জায় গিয়ে গায়ে খাটতে হবে না। আমার কিছু পরিচিত দোকান ইত্যাদি আছে। তারা হ্যান্ডবিল, বিজ্ঞাপন লেখার লোক খুঁজছে। টাকাপয়সা ভালোই দেয়। তবে নাম হবে না। তুমি কিছুদিন একটু চুপ করে বসে থাকো। তারপর সব মিটলে আবার নাটক লিখো। ন্যাশনাল তো আর একা থিয়েটার না, অনেক থিয়েটার আচে, যারা তোমার নাটক পেলে লুপে নেবে। তবে কিছুদিন অপেক্কা কত্তে হবে এই যা। এর মধ্যে…” বলে চুপ করে গেল তারিণী।

    “কি ভাই? চুপ করে গেলে যে?”

    “না, ভাবছিলাম বলা উচিত হবে কি না। তুমি তো কেরেস্তান হয়েছ। এ কি স্বেচ্ছায়? নাকি আবার হিন্দু হবার…”

    “প্রশ্নই ওঠে না।”

    “তবে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার সুবিধে আছে। একটা সংঘ আছে। আমি এককালে এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। মাঝে কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না বটে, কিন্তু এদানি আবার যোগাযোগের সুযোগ ঘটেচে। তোমাকে আমি নিয়ে যাব। আলাপ করিয়ে দেব। সংঘের নানা কাজকম্ম সারাবছর চলে। কর্মীরা টাকাপয়সাও পায়। তোমার একটা হিল্লে হয়ে যাবে। একবার শুধু বাবু প্রসন্নকুমারকে ধরতে হবে।”

    “কে তিনি?”

    “আমাদের সংঘের প্রথম বাঙালি। সদাশয় মানুষ। তোমার কথা বললে না করবেন না।”

    “কী নাম তোমাদের সংঘের?”

    “দি ফ্ল্যাটারনাল অরগানাইজেশন অফ ফ্রিম্যাসনরি।”

    .

    ৩।

    যেদিন লজ থেকে বেরোনোর সময় ব্রাদার হ্যামিলটন শৈলর হাতে একটা গাল আটকানো খাম গুঁজে দিয়ে বলল, “আজ রাত নটায়”, শৈল প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। বছর দেড়েক হল সে ম্যাসনিক লক্ষের সদস্য হয়েছে। যাকে বলে “ফুল টাইম ওয়ার্কার”। ফলে এখন আর ক্লাইভ স্ট্রিটে থাকা হয় না। আর তারিণীর ওই ছোট্ট আপিসঘরে একা তারিণীর থাকা মুশকিল, দুইজন হলে তো লবেজান। তবু সে মাঝে মাঝে দেখা করতে যায়। কখনও তারিণীকে পায়, বেশিরভাগ সময় দরজা তালাবদ্ধ। পেটের দায়ে বেচারা ঘুরে বেড়াচ্ছে হয়তো। শৈলর একটা ছোটো ব্যবস্থা হয়েছে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের আপিসের এক ঘরে। দিনের বেলায় এখানে সংঘের কাজ হয়। সবাই চলে গেলে খাটিয়া পেতে এখানেই শুয়ে পড়ে শৈল। নাটক লেখাও চলছে তালে তালে। তবে এখন তার বুদ্ধি খুলে গেছে। ন্যাশনাল বাদে বাকি থিয়েটার কোম্পানিতে ঘুরে ঘুরে নাটক বেচে আসে। কামাই নেহাত মন্দ হয় না। প্রথমে শুধু পৌরাণিক নাটক লিখত। ইদানীং কমিক নাটক আর প্যান্টোমাইমের চাহিদা বাড়ায় শৈলর বড্ড সুবিধে হয়েছে। হাসির নাটক লেখায় তার জুড়ি নেই। তবে নাটকের জগতে সে নিজের খ্রিস্টান পরিচয় দেয় না। খ্রিস্টানের লেখা হিন্দু দেবদেবীর নাটকে এখনও অনেকের অনীহা রয়েছে। তাই ডেভিড নামটাকে সযতনে লুকিয়ে রাখে। তার লেখা মুকুল মঞ্জরী, উপেন্দ্র বিনোদিনী, স্বর্ণভস্ম প্রতিটাই মিনার্ভায় পঞ্চাশ রজনী অতিক্রান্ত করেছে। তবু তার মনে সামান্য খোঁচা লেগে আছে। একে তো অভিনয়ের সময় সুযোগ নেই, আর তার চেয়েও বড়ো কথা, ন্যাশনালে তার উপরে অত্যাচার করেও চার পাষণ্ড দিব্যি হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    ব্রাদারহুডে শৈল শুরুর দিকে তেমন কোনও কাজ পেত না। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের এই লজটা কলকাতার তৃতীয় লজ। এর একটা গালভরা নাম আছে “স্টার ইন দ্য ইস্ট”, পুবের তারা। কলকাতায় ম্যাসনদের প্রথম লজ স্থাপিত হয়েছিল ১৭৩০ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে। দ্বিতীয়টাও আশেপাশেই। পলাশির যুদ্ধের ঠিক আগে। সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করে আলিনগর বানানোর সময় এই দুটি লজই ধ্বংস করেন। ব্রাদারদের হত্যা করেন নৃশংসভাবে। তার আগে অবধি ব্রাদাররা নেহাতই ধর্মকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। দেশের রাজনীতিতে মাথা গলাতেন না। কিন্তু ১৭৯০ সালে এই পূর্বের তারা যখন গঠন হল, ততদিনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে জাঁকিয়ে বসা শুরু করেছে। ফলে ইংল্যান্ডের মতো এ দেশেও ব্রাদারহুড সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে গেল। ব্যাপারটা এতই গোপনে হল, যে কেউ জানতেই পারল না, যে এই দেশে বড়ো বড়ো অফিসার থেকে গভর্নর জেনারেল অবধি কে হবেন, তা ঠিক হয় বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের এক ছোটো ঘুপচি ঘর থেকে। প্রথমে ইংল্যান্ডের গ্র্যান্ডমাস্টাররা শেষ কথা বলতেন, কিন্তু সে নিয়ম এক ডিক্রি জারি করে বাতিল করেন স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনিই প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার অফ অল ইন্ডিয়া। এই সবই শৈল জেনেছে লজে যুক্ত হয়ে। তবে সে তুলনায় লজের কাজ বড্ড পানসে। একঘেয়ে। রবিবার করে যিশুর গান গাওয়াহয়। ইংরাজিতে। ইদানীং কিছু নেটিভ ব্রাদার যোগ দেওয়াতে কয়েকটা বাংলা গানও যোগ হয়েছে। সেসবই শৈলর লেখা। তবে ইদানীং সে বুঝতে পারছে, এই গোটা ব্যাপারের মধ্যেই কোথাও একটা ধোঁকা আছে। গ্র্যান্ডমাস্টার হ্যালিফ্যান্স নামেই সংঘের প্রধান। আসলে সংঘ চালান অন্য একজন। তাঁর আসল নাম সংঘের সাধারণ সদস্যরা জানে না। তিনি দেখতে কেমন তাও না। সবাই তাঁকে উল্লেখ করে মাস্টার ম্যাসন বলে। সেটাও প্রায় ফিসফিস করে। কিন্তু শৈল বুঝেছে, এই মাস্টার ম্যাসনের অঙ্গুলিহেলনেই ইংরেজ সরকারের বড়োবড়ো অফিসার বদলি হয়ে দেশে চলে যান, আচমকা পেটের অসুখে ভুগে মারা যান কেউ কেউ। ইনি অমিত ক্ষমতাশালী, ধুরন্ধর এবং নির্মম। ম্যাসনিক লগবুকে তাঁর একটাই পরিচয়, AG। বহুদিন পরে এর পুরো অর্থ জানতে পেরেছে শৈল, Absconditum Grandmaster, গোপন গ্র্যান্ডমাস্টার। মাঝে মাঝেই তাঁর গোপন ফরমান আসে লজে। সে ফরমান অস্বীকার করে, এমন সাধ্য কারও নেই। তার কোনও ফরমানে কোনও সই থাকে না। শুধু থাকে A আর G-র মধ্যে অদ্ভুত এক ছবি। পায়ে থাবা, ল্যাজ আর ডানাওয়ালা শয়তানের হাতে কিছু একটা তুলে দিচ্ছেন এক ম্যাসন। তাঁর এক হাতে টপ হ্যাট, অন্য হাতে ঝুড়ির মতো কিছু একটা।

    এই চিঠি মানেই সমনের মতো। অনেকে মাঝে মাঝেই সংঘ থেকে উধাও হয়ে যায়। আর ফেরে না। শোনা যায় তারা নাকি ফরমান পেয়েছিল। আবার এই ফরমান পেয়েই অনেকের ভাগ্য বদলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। শৈল নিজে দেখেছে। তাই তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। কী জানি তার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে!

    সেই সভাতেই প্রথমবার মাস্টার ম্যাসনকে দেখল শৈল। একেবারেই সাধারণ চেহারার এক মানুষ। ম্যাসনিক লজের বাইরে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের এক আয়ুর্বেদের দোকানের পিছনের ফাঁকা ঘরে শৈলকে ডেকে মাস্টার তাকে প্রথমবারের জন্য একটা গোপন মিশন দিলেন। চন্দননগরে তাঁদের এক ব্রাদার আছেন। লুকিয়ে। এই মুহূর্তে তাঁর খোঁজ ব্রাদারহুডের কাছে নেই। ব্রাদারহুড-ই এককালে তাঁকে বলেছিল গা ঢাকা দিতে। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে তাঁকে আবার দরকার। শৈলর কাজ তাঁকে খুঁজে বার করে আনা। যদি পারে, ব্রাদারহুড তার এই প্রতিদান মনে রাখবে।

    ঠিক সতেরো দিনের মাথায় চন্দননগরের ফ্যাস্তার দিন লোকটাকে খুঁজে বার করে তার হাতে মাস্টারের চিঠি ধরিয়ে দেয় শৈল। যদিও এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল এ যাত্রা তাকে আর বেঁচে কলকাতায় ফিরতে হচ্ছে না। লোকটার চেহারা দেখে বোঝা যায় না, গায়ে বাঘের শক্তি। পরের দিনই শৈল ফিরে এসে মাস্টার ম্যাসনকে জানায় তাঁর কাজ শেষ। মাস্টার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞাসা করেন। শৈল বলে। শুধু একটা ব্যাপার বাদে। একেবারে প্রথম দিন লোকটা যখন বাগানে কাজ করছিল, ঘরের জানলায় সে একটা কচি মেয়েকে দেখতে পায়। এই মেয়ে খাঁটি সাহেবের মেয়ে। অ্যাংলো না। এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। ইচ্ছে করেই মাস্টারকে সে এই তথ্য দিল না। তার কৌতূহল জেগেছে। তারিণী নামজাদা গোয়েন্দা! শৈলও কিছু কম নয়। সে নিজে ব্যাপারটার গভীরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল।

    প্রতিদানের বিষয়ে মাস্টার তাঁর কথা রেখেছিলেন। ঠিক তিনদিন বাদে সম্মান পূর্ণচন্দ্রোদয় কাগজে ছোটো করে ছাপা হল এই খবর-

    জীবন্ত দগ্ধ

    এই এক বৎসরের মধ্যে কলিকাতার চতুর্দিকে খুন ও ডাকাতি প্রায় মধ্যেই হয়। শুনিতে পাইতেছি যে এমত রাত্রি নাই যে তাহাতে ডাকাতি বা খুন বা উভয়ই না হয়। পরন্তু গত ৭ই শ্রাবণ গড়ের মাঠের নির্জন প্রান্তে যে নৃশংস ঘটনা ঘটিয়াছে, আমার সাধ্য নাই, তাহার সম্যক বর্ণনা করি। গগন প্রভাত হইতেই মেঘ মেদুর হইয়া রহিয়াছিল। বৃষ্টি হয় নাই। স্বাভাবিকভাবেই সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাটে লোক চলাচল ঈষৎ কমিয়া গিয়াছিল। খবরে প্রকাশ, রাত্র দশ ঘটিকাকালীন গড়ের মাঠের নিকট দিয়া পাঁচ সাতজন পথিক একত্রে গমন করিতেছিলেন। তাহারা একখানি সম্পূর্ণ আবদ্ধ ব্রুহ্যাম কৌচকে তীব্র হুতাশনে জ্বলিতে দেখিয়া হতবাক হইয়া যান। তাঁহারা নিশ্চিত, সেই অগ্নিজঠরের মধ্য হইতে প্রত্যেকেই মানবকণ্ঠের সুতীব্র আর্তনাদ শুনিতে পাইয়াছিলেন। ঘটনাস্থলে কোচোয়ান বা তাহার ঘোড়াটির চিহ্নমাত্র ছিল না। পথিকরা সেই তীব্র অগ্নির সম্মুখে যাইবার সাহস না করিয়া কোথা হইতে এক হাবিলদারকে ধরিয়া আনেন। তিনি আবার অন্য তিন-চারজন হাবিলদারকে আনিয়া অগ্নি নির্বাপণ করিলেও শেষরক্ষা হয় নাই। কৌচে আসীন চার যুবাপুরুষই জীবন্ত দগ্ধ হইয়া মৃত্যুবরণ করিয়াছেন।

    পুলিশ অনুসন্ধান করিয়া জানাইয়াছে ওই কৌচে প্রখ্যাত বসু পরিবারের শ্রীযুত বাবু শিবচরণের জ্যেষ্ঠ্য পুত্র রামতারণ ও তাঁর তিন ইয়ারদোস্ত কাশীনাথ মুখোপাধ্যায়, ভবানীচরণ সান্যাল ও নবীনচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায়ও আসীন ছিলেন। ওইদিন সন্ধ্যাকালে উহারা সোনাগাজিস্থিত একটি পতিতার সনে সময় অতিবাহিত করিয়ামদ্যপ অবস্থায় এই ভাড়াগাড়ি খানিতে উঠিয়া বসেন। পুলিশের অনুমান কোচোয়ান তাঁহাদের অগোচরে এই স্থানে আনিয়া বাহির হইতে তালা লাগাইয়া, ঘোড়াটিকে অর্গলমুক্ত করিয়া কৌচে অগ্নিসংযোগ করে। ইহার পশ্চাতে কোন ভীষণ ষড়যন্ত্র নাকি প্রতিশোধস্পৃহা রহিয়াছে, পুলিশ তাহার অনুসন্ধানে নিরত আছে। বাবু রামতারণ নির্বিবাদী ও অজাতশত্রু মানুষ ছিলেন বলিয়া তাঁহার বন্ধুদের মত। তিনি শখের অভিনেতা ছিলেন। ন্যাশনাল থিয়েটারে বেশ কয়েকটি নাটকে তাঁহাকে অভিনয় করিতে দেখা গিয়াছে। কে বা কাহারা তাঁহার প্রতি এই ভীষণ ক্রোধ পুষিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই বিষয়ে পুলিশ নিরুত্তর। এই সংক্রান্ত নূতন খবর পাইলে আমরা পাঠকদিগকে সমুদয় অবগত করিব।

    শৈল মৃদু হেসে কাগজ মুড়ে পাশে রেখে নতুন নাটক লিখতে বসল।

    .

    ৪।

    স্টারে উপেন্দ্র-বিনোদিনীর অভিনয়ের দিন প্রথমবার শৈল লোকটাকে দেখেছিল। খাঁটি সাহেব। এ দেশে থাকা চামড়াপোড়া সাহেব না। দেখে মনে হয় সদ্য বিলেত থেকে এসেছেন। শৈলর একটা স্বভাব আছে। ওর লেখা যে-কোনো নাটকের প্রথম অভিনয়ের দিন ঠায় উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে যায় প্রায় গোটা নাটকটাই। কোথাও কারও ভুলচুক হলে টাকরায় জিভ ঠেকিয়ে চিক চিক আওয়াজ করে। আবার কোনও ভালো দৃশ্য অভিনীত হলে দর্শকদের দিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করে তাদের কী অভিমত। নাটক তেমন না জমলে নিচের পুরুষরা একে একে কেটে পড়ে। উপরে চিকের আড়ালে হয়তো তার মা বা স্ত্রী বসে আছেন। তাঁদের টেরটি পেতে না দিয়ে এই সময়ে সোনাগাজি গিয়ে একটু ফূর্তিফার্তা করে নাটকের শেষে আবার ফিরে আসে। বাকিরা এমন চ্যাঁচাতে থাকে যে অভিনয় বন্ধ করতে হয়। হলের মধ্যে পানওয়ালারা গায়ের উপর দিয়ে পা মাড়িয়ে ছোটাছুটি করে, বাবুরা ‘পান সিগারেট’ বলে হুংকার ছাড়েন, কানের রগ ঘেঁষে ঠাঁই ঠাঁই শব্দে সোডার বোতল খোলেন। আজ অবশ্য সেসবের কিছুই হচ্ছিল না। প্রথম দিনই নাটক এমন জমেছে যে সকলে হাঁ করে দেখছে। উপেন্দ্র এবং বিনোদিনীর ভূমিকায় নবাগত অমরনাথ আর ডাকসাইটে অভিনেত্রী অমলাসুন্দরী। বিনোদিনী চরিত্রটিকে নিজের মনের মতো করে লিখেছে শৈল। বাংলা থিয়েটারের দর্শকরা খুব ভালো নাটক হলেও মাঝে মাঝেই নড়েচড়ে বসেন। আসনের গদি ছিঁড়ে নারকেলের ছোবড়া বেড়িয়ে এসেছে, সেখানে কোটি কোটি ছারপোকার বাস। তবু তারই মধ্যে সেই সাহেব একেবারে স্থির, অচঞ্চল। শৈল আরও অবাক হয়েছিল এটা দেখে যে, সাহেবের নাটক নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এক কোনায় বসে তিনি পাথরের মূর্তির মতো শৈলর দিকে তাকিয়ে আছেন। বড্ড অস্বস্তিকর এই দৃষ্টি। শৈলর সঙ্গে বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে। শৈল চোখ নামিয়ে নিয়েছে। সাহেব চোখ সরাননি।

    সেই প্রথম, তারপর কতবার কত অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় শৈল এই সাহেবকে দেখেছে। ক্লাইভ স্ট্রিটে তারিণীর অফিস থেকে বেরোবার মুখে, অমৃতলালকে তার নতুন প্যান্টোমাইম ‘একাকার’-এর পাণ্ডুলিপি দিতে যাবার সময়, আর সবচেয়ে বেশিবার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে সংঘের অফিসের আশেপাশে। লোকটা মুখে কিছুই বলে না, শুধু ছায়ার মতো শৈলকে অনুসরণ করে যায়। সংঘের আপিসের উলটো দিকে একটা চিনা খাবারের দোকান আছে। লোকটা তেমন দরকারে সেখানেই সারাদিন কাটায়। খাওয়াদাওয়া করে। কিন্তু কাচের বড়ো জানলা দিয়ে নজর রাখে সংঘের দিকে। শৈল প্রথমে ভেবেছিল সংঘকে জানাবে। কিন্তু জানায়নি। আসলে লখন আসার পর শৈলর বেশ আকস্মিক ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। আর সেটা খারাপের দিকেই। লখন আসার আগে মাস্টার ম্যাসন বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব শৈলকে দিতেন। ইদানীং লখন বলেকয়ে তার পেয়ারের কিছু লোককে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেয়। সে নিজে সংঘে আসে না। কোথায় থাকে কে জানে? কিন্তু শৈলর মতো নেটিভদের জন্য তার কথাই শেষ কথা। উপস্থিত না থেকেও সে সর্বব্যাপী। মাস্টার ম্যাসন এখন নিজেও সব নির্দেশ দেন না। লখনের মারফত নির্দেশ আসে। শৈলদের সেটাই মেনে চলতে হয়। এ ব্যবস্থা শৈলর ভালো লাগেনি। একদিন আচমকা লখন শৈলকে জানাল তার আর সংঘের আপিসে রাত কাটানো চলবে না। অতএব সে আবার ফিরে গেছে তারিণীর আপিসে। তারিণী মহাপ্রাণ। বন্ধুর জন্য কোনও অসুবিধাকেই সে গ্রাহ্য করে না। শৈল আগে সংঘ থেকে যে হাতখরচ পেত, সেটাও কমেছে। নাটকের সঙ্গে তাই বিজ্ঞাপনের কপিও লিখতে হয়। সে কপিতে আবার কাব্য লিখে দেয় তারিণী নিজে। মাঝেমধ্যে পায়ে পড়ে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের সেই ওষুধের দোকানের বিজ্ঞাপন কাম বার্তাও তাকেই লিখে দিতে হয়। শৈল ইদানীং তাই খানিক মরমে মরে থাকে।

    সেদিন সংঘের নানা কাজের হিসেবনিকেশ চলছিল, তাই বেরোতে একটু দেরি হল শৈলর। মনটা ভারী। আজই লখন তাকে ডেকে জানিয়েছে, সংঘে থাকতে হলে তার আর নাটক লেখা চলবে না। শৈল সচরাচর কোনও প্রশ্ন করে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে সে এতটাই অবাক হয়ে গেছিল যে কারণ জিজ্ঞাসা না করে পারেনি। কারণ হিসেবে লখন তাকে জানায়, নাট্যকাররা তরলমতি। সংঘের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য শৈলর জানা আছে। জ্ঞানত বা অজ্ঞানত সে এইসব নাটকে লিখে ফেললে সংঘের বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে। অবিলম্বে তাকে নাটক লেখা বন্ধ করতে হবে। শৈলর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ছোটো থেকে তার জীবনের লক্ষ্যই ছিল নাটক লেখা, অভিনয় করা। পরেরটা বন্ধ হলেও প্রথমটাকে আঁকড়ে ধরে কোনওমতে চালাচ্ছিল সে। আজ থেকে সেটাও গেল! শৈলর মাথা কাজ করছিল না। এতদিনের আনুগত্যের এই পুরস্কার!

    প্রথমে দুঃখ, পরে হতাশা, তারপর সেই হতাশা পরিণত হল রাগে। শৈল লিখবে। নতুন নাটক। এই নাটক একেবারেই তার অন্য নাটকের মতো হবে না। এতকাল ইচ্ছে করে সে সংঘের চিহ্নমাত্র নিজের লেখায় রাখত না। এবার রাখবে। শুধু রাখবেই না, সংঘের যে গোপনতম তথ্য তার কাছে আছে, সেটাও প্রকাশ করে দেবে। কিন্তু সংঘের সঙ্গে বেইমানি করে নয়। সে সবাইকে দেখিয়ে দেবে নাট্যকার শৈল সব পারে। এমনকি সাঁটে কথাও কইতে পারে। এমন সাঁটে সে এই নাটক লিখে অভিনয় করাবে, যে, স্বয়ং মাস্টার ম্যাসন অবধি দেখলে ধোঁকা খেয়ে যেতে বাধ্য হবেন। এটাই হবে নাট্যকার শৈলচরণের জীবনের সেরা কাজ, অমৃতলাল যাকে বলেন “ম্যাগনামওপাস”।

    রাস্তায় চলতে চলতেই অদ্ভুত এক প্লট এল তাঁর মাথায়। প্রহসন, তবে রূপকের আড়ালে। এমন কাজ বাংলা সাহিত্যে আগে কেউ করার সাহস দেখায়নি। শৈলই প্রথম এ কাজ করে দেখাবে। বিরাট নামডাক হবে তার। দেখা যাবে, তখন মাস্টারের ওই পেয়ারের লখন কী বলে…….

    নিজের চিন্তাতে এতটাই ডুবে ছিল শৈল যে, তাকে রোজ দেখতে থাকা সাহেব যে আজ উলটো দিকের দোকানের সামনে নেই, বরং সে সংঘ থেকে বেরোতে না বেরোতে, সেই রাস্তারই এক অন্ধকার কোণ থেকে শৈলর পিছু নিল, তা সে খেয়ালই করল না। ক্লাইভ স্ট্রিটের দিকে ঘোরার ঠিক আগের মোড়ে ল্যাম্পপোস্টের তলায় হাতের কনুইয়ের কাছে তীব্র চাপ অনুভব করল শৈল। চমকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল সেই সাহেব। বেঁটেখাটো, মাথায় টপ হ্যাট, হাতে ছড়ি। সাহেব আলগোছে বাঁ হাতে শৈলর হাত চেপে ধরে আছেন, আর শৈল কিছুতেই তা ছাড়াতে পারছে না। সাহেবের মুখে অদ্ভুত এক হাসি। কিন্তু তাঁর চোখ হাসছে না। সেই প্রথম ল্যাম্পপোস্টের আলোতে শৈল খেয়াল করল সাহেবের দুই চোখের মণির রং দুইরকম। ডানদিকেরটা নীল আর বাঁদিকেরটা ধূসর।

    সাহেব অত্যন্ত ভদ্রভাবে হালকা মাথা নুইয়ে শৈলকে বলল, “গুড ইভনিং। একটু কথা বলা যাবে?”

    .

    ৫।

    ইংরাজি বলা কওয়াতে শৈল আগে একেবারেই দড় ছিল না। সংঘে ঢোকার পর দায়ে পড়ে কাজ চালানোর মতো ইংরাজি বলতে পারে। সাহেবের চেহারা আর কথায় এমন কিছু একটা ছিল, যাতে শৈল স্পষ্ট বুঝতে পারল সাহেব অনুমতি চাইছেন না। আদেশ করছেন। এই লোক ‘না’ শোনার জন্য একেবারেই তৈরি না। সাহেবের চোখে মুখে ভয় ধরানো এমন একটা ভাব, যে সম্মোহিতের মতো শৈল আর আগুপিছু চিন্তা করতে পারল না।

    “চলুন”, বলতেই সাহেব তাকে প্রায় একভাবে ধরেই নিয়ে চললেন অলিগলি বেয়ে। এ শহরের গলিঘুঁজি সাহেবের চেনা। নিশ্চয়ই প্রচুর ঘোরাঘুরি করে সব চিনে নিয়েছেন। খানিক বাদেই দুজনে এসে হাজির হল গঙ্গার ধারে। রাতে এই জায়গাটা একেবারে কিছু ছোটো ছোটো সলপ আর সওদাগরি নৌকা গঙ্গায় ভেসে চলেছে। দূরে কে যেন একজন ঘাটে বসে আড়বাঁশিতে হংসধ্বনির সুর তুলছে। সাহেব সন্ধানী চোখে চারদিকটা একবার দেখে নিলেন। তারপর শৈলকে সরাসরি বললেন, “তুমি আমার হয়ে কাজ করবে?”

    “কাজ? কী কাজ? আপনি তো আমাকে চেনেনই না সাহেব!”

    “তোমার নাম শৈলচরণ সান্যাল। চুঁচুড়ার রমাপ্রসাদ সান্যালের ছেলে। বাবা তাড়িয়ে দেওয়ায় প্রথমে ন্যাশনাল থিয়েটারে গেছিলে। সেখানে তোমাকে ধর্ষন করা হয়। তারপরে তুমি এখানকার ব্রাদারহুডে যোগ দিয়েছ। কিন্তু ব্রাদারহুড তোমাকে সব দিয়েছে স্বাধীনতা ছাড়া। আমি তোমাকে সেই স্বাধীনতা দেব।”

    “কিন্তু আপনি…”

    ডান হাতের কোটের কিছুটা তুলে নিলেন সাহেব। গঙ্গার ধারে এখনও ইলেকট্রিক বাতি লাগেনি। তবু টিমটিমে গ্যাসবাতির আলোতে শৈল দেখতে পেল উচ্চিটা। ম্যাসনিক কম্পাস আর স্কেলের মধ্যে একটা চোখ জ্বলজ্বল করছে। কম্পাসের ঠিক মাঝে ইংরাজি G অক্ষর। গড, জিওমেট্রি, গ্র্যান্ড আর্কিটেক্ট অফ ইউনিভার্স।

    “কিন্তু এই চিহ্ন…..”

    “আমিও ব্রাদারহুডের সদস্য। তবে ইংল্যান্ডের। আমাকে এই দেশে পাঠানো হয়েছে বিশেষ এক কারণে।”

    “কী কারণ?”

    “সেটাই তোমায় বলব। তোমার সাহায্য আমার খুব প্রয়োজন। তবে তাতে তোমারও লাভ হবে। তুমি হিলি নামে এক দস্যুর কথা শুনেছ?”

    চমকে উঠল শৈল। ‘হিলির ভূত’-এর কথা সাহেব জানলেন কীভাবে? সাহেব তার অভিব্যক্তি দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। খুব শান্ত গলায় বললেন, “শোনো, তোমায় বলি, স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়া হিলির বিষয়ে উদ্বিগ্ন। সে ও দেশ থেকে পালিয়ে আসার সময় দুটো খুব ভয়ানক জিনিস চুরি করে এনেছে। একটা ভয়ানক আরক, যা মানুষকে শয়তান বানিয়ে দেয়, আর একটা ছোট্ট মেয়ে, দেখতে একেবারে নিষ্পাপ, কিন্তু সেই মেয়ে আসলে ডাইনি। কলকাতার ব্রাদারহুডের সবাই এদের কথা জানে না, একেবারে ভিতরের কিছু লোক জানে। এদের দিয়ে এরা রানির বিরুদ্ধে ভয়ানক এক ষড়যন্ত্র করতে চলেছে। আর যদি তারা সফলকাম হয়, তবে যে স্বাধীনতার খোঁজে তুমি হাপিত্যেশ করছ, তা এ জীবনে পাবে না।”

    শৈল কোনও উত্তর দিল না। তার মন এক অদ্ভুত দোলাচলে ভুগছে। সাহেব বলে চললেন, “ভাবছ এসব খবর আমি কী করে জানলাম? সংঘে আমার লোক আছে। তবে তারা কেউই তোমার মতো জায়গায় পৌঁছায়নি। আমার তোমাকেই দরকার। আমি জানি এই মুহূর্তে তোমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব না। সংঘে ঢোকার সময় তুমি যে শপথ নিয়েছ, তাতে সংঘের চোখে চিরকালের মতো তুমি বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাবে। কিন্তু অন্যদিকে ভাবো, এদের ষড়যন্ত্র একবার ফাঁস হয়ে গেলে মহারানি এদের শাস্তি দেবেন, আর সেই শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সবার। কেউ বাদ যাবে না। ভেবে দ্যাখো তুমি সেই দলে থাকবে কি না। অন্যদিকে আমাদের সাহায্য করলে স্বয়ং মহারানি তোমার পাশে থাকবেন। তোমার নাম গোপন থাকবে। শুধু তাই না, পুরস্কার হিসেবে তোমায় প্রচুর টাকা দেওয়া হবে। প্রচুর, যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। চাই কি, তুমি দরকার হলে নিজের নাটকের দল খুলে, থিয়েটার তৈরি করে নিজের মনের মতো নাটক লিখে অভিনয় করতে পারবে। ভেবে দ্যাখো।”

    শৈলর মনে যেন তুফান উঠেছে। একদিকে বিশ্বাসঘাতকতার পাপ, অন্যদিকে স্বাধীনতার হাতছানি। সংঘ তাকে পথের ভিখারি থেকে আজ এই জায়গায় এনেছে। কিছুদিন আগে হলেও সে এই সাহেবের কথায় কর্ণপাত করত না। কিন্তু এখন অবস্থা বদলাচ্ছে। এখনই জল না মাপতে পারলে ভবিষ্যতে হায়হায় করেও কোনও লাভ হবে না। অক্ষয় সরকার একটা কথা খুব বলতেন, হাওয়া থাকতে থাকতে পাল তুলে দাও, নইলে কোনও দিন তোমার নৌকা ঘাট ছেড়ে বেরোবে কি না কেউ জানে না।

    সাহেব বলে চলছিলেন, “এখানের ব্রাদারহুড একটা অন্ধগুহার মতো। আমাদের লন্ডনের গ্র্যান্ড লজ অবধি এদের কীর্তিকলাপ নিয়ে কিচ্ছু জানে না। আমি বেশ কয়েক মাসের চেষ্টায় তোমায় উদ্ধার করেছি। তুমি সংঘের একেবারে ভিতরের খবর জানো, কিন্তু সংঘ ইদানীং তোমার প্রতি অবিচার করছে। যদি তুমি চাও…”

    “কত টাকা?” সাহেবকে প্রায় থামিয়ে দিয়েই প্রশ্ন করল শৈল।

    “তুমি কত চাও?”

    “নতুন থিয়েটার গড়ে দল করতে অনেক টাকা লাগবে।”

    “মহারানির টাকার অভাব নেই।”

    “দশ হাজার।”

    “টাকা?”

    “পাউন্ড।”

    “আচ্ছা, তাই হবে। কিন্তু খবর যেন পাক্কাহয়।

    “হবে। আমি আপনাকে খুঁজে পাব কীভাবে?”

    “দরকার নেই। আমি তোমায় খুঁজে নেব। তুমি শুধু দুটো খবর দেবে। হিলির ভূত আর সেই মেয়েটা। এখন কোথায়? খুব বেশিদিন দিতে পারব না। বড়োজোর দিন কুড়ি।”

    “কিন্তু সাহেব, আপনার নামটুকুও জানা হল না যে…”

    “হিউড র‍্যাডি।”

    ক্লাইভ স্ট্রিটে ফিরতে ফিরতে নিজের কর্মপন্থা ঠিক করে নিল শৈল। এতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। সে যেমন ভেবেছিল, তেমন নাটক লিখবে, অভিনয় করাবে, আবার পাশে এই সাহেব যা যা জানতে চাইলেন সে খবরও নেবে। সংঘকে সে একটা শেষ সুযোগ দিতে চায়। না হলে সব ছেড়েছুড়ে বেড়িয়ে গিয়ে টাকা নিয়ে নতুন থিয়েটার গড়বে। মনে একটাই সন্দেহ ছিল, এই সাহের যে সত্যি কথা বলছে তার মানে কী? কিন্তু নয় নয় করেও সাহেব সংঘের যেসব তথ্য উগরে দিলেন সেটাও নেহাত সাধারণ লোকের জানার কথা না। আর শৈল এখন মহাবিড়ম্বনায় পড়েছে। সাহেবের কথা না মানলে চিরকাল লখনের ক্রীতদাস হয়ে থাকতে হবে। সেভাবে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া শ্রেয়।

    শৈল আড়িপাতা শুরু করল। বিশেষ করে লখন এলেই মাস্টার ম্যাসন গোপন মিটিং ডাকেন। আগে প্রায় সবকটাতেই শৈল থাকত। এখন সিকিভাগ মিটিং-এ তাকে রাখা হয়। কিন্তু শৈল এক উপায় বার করেছে। যে ঘরে মিটিং চলে, তার দেওয়াল কাঠের। একটা কাচের গেলাস দেওয়ালের বাইরে ঠেকিয়ে তাতে কান লাগিয়ে ভিতরের প্রায় সব কথাই শোনা যায়। আর গত কয়েকদিনে ইতিউতি যা যা শুনেছে শৈল, তাতে সেই সাহেবের কথাই সত্যি মনে হচ্ছে। এরা যা আলোচনা করছে, তা যদি বাস্তবে ঘটে, তবে অনর্থ হয়ে যাবে। শৈল রানির প্রজা। সে এমনটা হতে দিতে পারে না। প্রায় পনেরো দিন লাগল তার গোটা নাটকটা লিখতে। লিখে বারবার পড়ে দেখল। এবার ঠিকটি হয়েছে। একবার ভেবেছিল তারিণীকে জানাবে। তারপর নিজেই ভাবল, এখন না। হাতে টাকা এলে সেই টাকা থেকে কিছুটা সে তারিণীকে দিয়ে অবাক করে দেবে। এর মধ্যে একদিন বউবাজারের ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিও থেকে একটা বান্ডিল আনতে দেওয়া হয়েছিল শৈলকে। টাকাপয়সা সব দেওয়া আছে। শুধু গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। একমাস আগে হলেও ভিতরে কী আছে জানার কৌতূহল হত না শৈলর। কিন্তু এবার হল। ‘ভারতভিক্ষা’ নামের এক ছাপাই ছবি। তাতে মহারানিকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। পাশে এক বৃদ্ধা আর এক শিশু। এই শিশুটিও শৈলর চেনা। চন্দননগরে লখনকে খুঁজতে গিয়ে তার বাড়ির জানলায় অবিকল এই শিশুকেই দেখেছিল সে। সন্তর্পণে একটা ছবি সরিয়ে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়েনিল শৈল। তারপর রাস্তার ধারের ছাড়া কল থেকে এক আঁজলা জল নিয়ে বাকি বান্ডিলের উপরে ছড়িয়ে দিল ভালো। করে। সংঘ এই নিয়ে প্রশ্ন করায় বলল, রাস্তা ধোয়ার গাড়ির পাইপ বেকায়দায় জল ছিটিয়ে দিয়েছে। উপরের কিছু ছবি নষ্ট হয়ে গেছে। সামান্য ধমক খেলেও বেশি কিছু বললেন না মাস্টার ম্যাসন। বরং এই পাইপে জল দিয়ে রাস্তা ধোয়ার চেয়ে পুরোনো ভিস্তিই যে ভালো ছিল, তা বলে গজগজ করলেন। নষ্ট ছবিগুলো ছিঁড়ে মাটিতে পুঁতে দিতে বলা হল শৈলকে। মোট চারটে ছবি নষ্ট হয়েছিল। শৈল বলেছিল পাঁচটা। এই একটার গরমিল কেউ আর গুনে দেখেনি।

    .

    ৬।

    সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা। আষাঢ়ের মেঘের চরিত্র বোঝা দায়। সবসময় মনে হয় এই ঢালবে। আবার হয়তো সারাদিন একরকম মুখ ভার করে রইল। তারিণী আজ আপিসে নেই। গতকাল প্রিয়নাথ দারোগা এসেছিলেন। তারিণীকে নিয়ে চুঁচুড়া গেছেন। তারিণী নিজে শৈলকে কিছু বলেনি। তারিণী যখন ঘরে থাকে না, তখন শৈল লুকিয়ে তার ডায়রি পড়েছে। সে জানে বছর চারেক আগে তারিণী কী ভয়ানক এক মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল। সে জানে সাইগারসন ব্রিটিশ সরকারের খাস লোক। কিছু একটা ঘটেছে। নইলে তারিণী এমন সাত তাড়াতাড়ি দারোগাবাবুর সঙ্গে চুঁচড়ো ছুটত না। তবে কি সে যা সন্দেহ করেছিল সেটাই হতে চলেছে? রানি সব জেনে গেছেন? এবার তাদের শাস্তির পালা? যদি তাই হয়, তবে তাকে যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। র‍্যাডি সাহেবকে সব বলে দিতে হবে। খাটের একপাশে বান্ডিল বাঁধা নাটক পড়ে আছে। এগুলো নিয়ে তারিণীর সঙ্গে কথা বলা হয়নি। তারিণী বাড়িতে ফিরলেই দুই বন্ধু মিলে ঠিক করতে হবে এরপরে কী করা যায়। হাতে একদম সময় নেই।

    বাইরে মেঘ গর্জাচ্ছে। এমন সময় আপিসের সামনে একটা ছ্যাকরাগাড়ি থামল। তারিণী এল বুঝি। কিন্তু তারিণী তো সচরাচর গাড়ি চাপে না! গাড়ি থেকে প্রথমে প্রিয়নাথকে নামতে দেখেই শৈল বুঝে গেল যা করার এবার তাকে একা করতে হবে। তারিণীর সঙ্গে আলোচনার উপায় নেই। মনের ভাব তারিণীকে বুঝতে না দিয়েই সে বলল, “তুমি এয়েচ ভাই? বেশ হল। তোমার কথাই ভাবছিলেম। জরুরি দরকার। এখুনি আমায় বেরুতে হচ্চে। তবে চলে আসবখন। রাতের খাওয়া বেড়ে রেখেচি। একসঙ্গে খাওয়া যাবে।” প্রিয়নাথ ঠায় তার দিকে তাকিয়ে। এই লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে কেন ঘুরছে তারিণী? দেখেই মনে হয় ঘিলুতে কিছু নেই। তাঁকে পরখ করার জন্যেই শৈল তাঁকে শুধাল, “দারোগাবাবু, যে এককালে আপনার উপকার করেছিল, সে যদি অন্য কারও মহাক্ষতিতে লিপ্ত হয়, তবে আপনি কী করবেন?”

    দারোগা মিনমিন করে কী যেন বললেন। আইনমাফিক সাজার কথা। শৈল মনে মনে হাসল। জাবুলনদের দেবে আইনমাফিক সাজা? এবার আইন সে নিজের হাতে তুলে নেবে। অনেক হয়েছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত না করলেই নয়। অমৃতলালকে দেবার জন্য এক কপি নাটকের বই ফতুয়ার পকেটেই পোরা ছিল। আরও একটা ঢুকিয়েনিল। কাজে লাগতে পারে। তারপর অন্ধকারেই বেরিয়ে গেল।

    অমৃতলালের কাছে যাবার আগেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। এক বাড়ির রোয়াকে আশ্রয় নিল শৈল। আর তখনই ওদের দেখতে পেল। তিনটে লোক। আগাপাশতলা বর্ষাতিতে মোড়া। মাথায় টুপির জন্য মুখ দেখা যাচ্ছে না। ঠিক উলটো দিকের বাড়ির রোয়াকে দাঁড়িয়ে। ক্লাইভ স্ট্রিট থেকে বেরিয়েই এদের দেখেছিল শৈল। প্রথমে গা করেনি। কিন্তু নির্জন রাস্তায় এদের উপস্থিতিতে বেশ ভয়ভয় করতে লাগল তার। বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করা গেল না। প্রায় কাকভেজা হয়েই অমৃতলালের কাছে গেল সে। যদি ‘একাকার’-এর বদলে তার এই নতুন পালা অভিনয় করান অমৃতলাল। বিধি বাম। অমৃতলাল একরকম ভাগিয়েই দিলেন তাকে। যাবার আগে তবুও এক কপি নাটক তাঁকে দিয়ে গেল শৈল। দেখে যদি মন বদল হয়।

    এখন আর একটাই উপায়। চুঁচুড়ার সেই সাইগারসন। তিনি নাকি স্বয়ং ব্রিটিশ সরকারের লোক। তাঁকে নাটক বোঝানোর কিছু নেই। সরাসরি টাকা চাইতে হবে। সেই টাকা দিয়ে থিয়েটার হবে। আর সাইগারসন টাকা না দিলে দলের সঙ্গে বেইমানি করে সেই রাডিকেই সব বলে দেবে। যা থাকে কপালে। শিয়ালদহ থেকে চুঁচুড়াগামী শেষ ট্রেনে উঠল শৈল। বেশ বুঝতে পারল ওই তিনজন তার পাশের কামরায় গিয়ে উঠেছে।

    চুঁচুড়ায় সাইগারসনের কাছে সে খুব একটা সুবিধে করতে পারল না। প্রথমে তো তাঁর চাকর ঢুকতেই দিচ্ছিল না। শেষে দেখা হলেও টাকার ব্যাপারে তিনি পিছিয়ে এলেন। লন্ডনে যোগাযোগ করতে হবে, কথা বলতে হবে, দিন পনেরো সময় লাগবে। এদিকে ঘরে পুলিশ ঢুকে গেছে। তারিণীও ঠিক কোন পক্ষে আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তারিণীই তাকে সংঘে ঢুকিয়েছিল, কিন্তু এখন গা বাঁচাতে যদি সে শৈলকে ধরিয়ে দেয়? যাবার আগে বারবার সে সাহেবকে অনুরোধ করল, তারিণীকে যেন কিচ্ছুটি না জানানো হয়। সাহেব অন্তত মৌখিকভাবে রাজি হলেন।

    এখন উপায়? র‍্যাডির সঙ্গে কীভাবে দেখা করবে সে জানে না। আজ চুঁচুড়া থেকে কলকাতায় ফেরার শেষ ট্রেন চলে গেছে। নিজের বাড়িতে থাকার উপায় নেই। অক্ষয় সরকারের আড্ডার প্রশ্নই ওঠে না। একমাত্র উপায় তারিণীর সেই শরিকি বাড়ি। তারিণী বাড়িতে না থাকলেও তার আত্মীয়রা থাকেন। আজ রাতের মতো কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। শৈল সেদিকেই পা চালাল। রাস্তা অন্ধকার। বৃষ্টিটা আবার কেঁপে নামল। তোলা ফটক পেরোতে না পেরোতে শৈল বুঝল গোটা রাস্তায় সে একা। মানুষ তো দূরস্থান, একটা কুকুর অবধি রাস্তায় নেই। পকেটের নাটকটা ভিজে ন্যাতা হয়ে গেছে। সমস্যা নেই। আরও আটানব্বইটা আছে। এইসব ভাবতে ভাবতে চলেছে, এমন সময় রাস্তার ঠিক মাঝখানে মিশমিশে কালো একটা দেওয়াল যেন তার পথ অবরোধ করে দাঁড়াল। এক নিমেষে শৈলর পায়ের তলার মাটি সরে গেল যেন। তিনজনের মধ্যে মাঝের জন আকারে কিছু ছোটো। বর্ষাতির ফাঁক থেকে একটা ঢাকা লণ্ঠন বার করে ঝিলিমিলিটা সামান্য খুলে দিতেই চিনতে পারল শৈল। র‍্যাডি। কিন্তু র‍্যাডির এমন চেহারা আগে সে দেখেনি। চোখে মুখে তীব্র ঘৃণা যেন ফুটে উঠছে। এক ভয়ানক জিঘাংসাতাড়িত হয়ে এই অনাসৃষ্টির দিনেও সে কৃতান্তরমতো শৈলকে ধাওয়া করেছে।

    কেটে কেটে উচ্চারণ করল র‍্যাডি, “তোমার বাড়িতে দারোগা ঢুকছে আর তুমি সরকারি গোয়েন্দারবাড়িতে যাচ্ছ, কী মতলব বলো দেখি?”

    ভয়ে শৈলর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। সে কিছু বোঝার আগেই বাকি দুজন তাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে ঠেসে ধরল পাশের পগারের ধারের এক গাছের গায়ে। লণ্ঠনের আলোতে শৈল দেখতে পেল দুজনের হাতেই দুটো ছোরা চিকচিক করছে। ছোরার একদিক খাঁজকাটা।

    আবার একই প্রশ্ন করল র‍্যাডি। কোনওমতে যতটুকু জানে জবাব দিল শৈল। “এবার আসল কথায় এসো দেখি। কুড়ি দিন সময়দিয়েছিলাম। আজ আর একটু বাদেই কুড়ি দিন শেষ হবে। হিলির ভূত এখন কার কাছে? আর মেয়েটা কোথায়?”

    “হিলির ভূত…” কোনওমতে দম নিয়ে শৈল বলল, “হিলির ভূত লখনের কাছে। আর লখনের বোনের একটা মেয়ে আছে। নাম দ্রিনা। একবারে মেমসাহেবের মতো দেখতে। সংঘ তাকে খুব যত্নে লুকিয়ে রাখে।”

    “স্টারে কার কাছে গেছিলে?”

    “অমৃতলালের কাছে। নতুন নাটক জমা দিতে।”

    “তোমার না নাটক লেখা মানা?”

    “এটা ওদের ভয় দেখাতে। এই নাটক মঞ্চ পেলে ওরা বুঝত ওদের প্ল্যান ফাঁস হয়ে গেছে। আর রানির বিরুদ্ধে যাবার সাহস করত না।”

    “সে নাটক কোথায়?”

    “এক কপি আমার পকেটেই আছে”, পকেটে কোনওমতে হাত ঢুকিয়ে নাটকটা বার করে দেখাল শৈল। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে দলা পাকিয়ে গেছে প্রায়। “আর- একটা স্টারে অমৃতলাল বসু মশাইয়ের কাছে। বাকিগুলো তারিণীর আপিসে।”

    “শেষ প্রশ্ন, মাস্টার ম্যাসন কে? হল মাস্টার না, গোপন গ্র্যান্ডমাস্টার। যিনি এই সবকিছুর পিছনে আছেন।”

    একটু ইতস্তত করল শৈল। সংঘে শয়তানের নাম করাও এত পাপ না, মাস্টার ম্যাসনের নাম জানানো যতটা পাপ। মাত্র গুটিকয়েক তাঁর আসল পরিচয় জানে। শৈল তাদের একজন।

    শৈলর নীরবতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটো ছোরা ধীরে ধীরে তার চামড়া কেটে বসতে লাগল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল সে। কিন্তু এত রাতে তার চিৎকার কে শুনবে?

    বাধ্য হয়েই সে মাস্টার ম্যাসনের নাম বলল। আসল নাম। রাডি কিছু বলল না। তবে বোঝা গেল সে অবাক হয়েছে। শৈল দেখল তার দুপাশে দুই গুন্ডার চাপ কমে গেছে অনেকটাই। এবার একটু সাহস করে র‍্যাডিকে শুধাল, “আমি তো যা জানি, সব বলেই দিলাম। এবার আমার পুরস্কার? আপনি কথা দিয়েছিলেন….”

    “ঠিক। কথা দিয়েছিলাম বটে। সংঘে ঢোকার সময় যে চারটে শব্দ শেখানো হয়েছিল, মনে আছে?”

    “আজ্ঞে DIssImulo, FraternItatI, UnIo, OblItus। গোপনীয়তা, ভ্রাতৃত্ব, একতা, বিস্মৃতি।”

    “ঠিক। একদম ঠিক। এই তিন আর চারের মধ্যে অদ্ভুত সম্পর্ক, জানো তো। কেউ বলেনি বোধহয়। যে ব্যক্তি তিন নম্বর রক্ষা করতে পারে না, তার জন্য আছে চার নম্বর। চিরবিস্মৃতি। সংঘে বেইমানদের কোনও স্থান নেই। যে বেইমান, যার রক্তে বেইমানির বীজ, তাকে ধ্বংস করাই সংঘের লক্ষ্য।”

    শৈল কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই দিকের দুই জোয়ান তার মুখ বেঁধে দিল একটা কাপড়ে। বর্ষাতির পকেট থেকে রশি বার করে একজন বেঁধে ফেলল দুই হাত। শৈল বুঝতে পারল তার দুই পা টেনে ধরে ফাঁক করে দিয়েছে অন্যজন। এবার র‍্যাডি একদম ধীরেসুস্থে তার কোর্টের পকেট থেকে একইরকম একটা শাঁজকাটা ছোরা বার করল। হাতের ঢাকা লণ্ঠনটা রেখে দিল পাশে। শৈলর মনে হল তার দুই পায়ের ফাঁকে একটা গরম ধাতু ঢুকে সুতীব্র এক বেদনা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেহ জুড়ে। শুনতে পেল কাছেই কোথাও তীব্রগর্জনে বাজ পড়ল একটা। রাড়ির ছোরা যখন তার পেট দুফালা করে দিচ্ছে, তখনও শৈলর ডান হাতের বজ্রমুষ্টিতে ধরা তার লেখা শেষ ম্যাগনাম ওপাস “বিষম ভূত আর পুষ্পসুন্দরীর পালা”। কাগজের সেই মণ্ড এখন বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে। শত যন্ত্রণাতেও সে ওটাকে ছাড়েনি!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজু – অৎসুইশি
    Next Article নীবারসপ্তক – কৌশিক মজুমদার

    Related Articles

    কৌশিক মজুমদার

    নোলা : খাবারের সরস গপ্পো – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    সূর্যতামসী – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    আঁধার আখ্যান – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    নীবারসপ্তক – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.