Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প818 Mins Read0

    ঢাকার বইমেলা ও একটি প্রেমের গল্প

    রুদ্রকে নিয়ে যে যৌথজীবনের চমৎকার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে স্বপ্ন-পোড়া-ছাই আমার সর্বাঙ্গে ত্বকের মত সেঁটে থাকে। জানি রুদ্রর সঙ্গে জীবন যাপন সম্ভব নয়। জানি যার যার জীবনের দিকে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। জানি এখন সব ধুলোকালিছাই ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন হওয়ার সময়। তবু সময় গড়াতে থাকে, দিন পুড়তে থাকে নির্জন রোদ্দুরে, রাতগুলো অন্ধকারে তক্ষকের মত ডাকতে থাকে আর উঠোনের উচ্ছিষ্ট কাঠের মত বসে থাকি আমি নিজেকে নিয়ে। এই জীবনকে নিয়ে ঠিক কোনদিকে যাব, কোথায় গেলে নেই নেই করা হু হু হাওয়া আমার দিকে বদ্ধ উন্মাদের মত ছুটে আসবে না বুঝে পাই না। জীবনটিকে একবার পালক আরেক বার পাথর বলে বোধ হতে থাকে। এই যে জীবন, যে জীবনটি খুঁড়োতে খুঁড়োতে এসে শেষ অবদি বসেছে আমার গায়ে, কখনও মোটেও টের পাই না, আবার আমার ঘাড় পিঠ সব কুঁজো হয়ে যায় এই জীবনেরই ভারে। এই জীবনটিকে আমি ঠিক চিনি না, জীবনটি আমারই ছিল অথচ আমার ছিল না। দীর্ঘ দীর্ঘ বছর ধরে আমি এর যা কিছু পানীয় সব ঢেলে দিয়েছি একটি আঁজলায়, নিজের তৃষ্ণার কথা আমার একবারও মনে পড়েনি। পরে কাতর হয়ে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখছি জলহীন শুষ্ক মরুর মত পড়ে আছে জীবন। আমারই ঘড়ায় আমার জন্য কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রতিদিন সেই আগের মত আবার ঠিক আগের মতও নয়, ডাকপিয়নের শব্দে দৌড়ে যাই দরজায়। কারও কোনও চিঠির জন্য আমি অপেক্ষা করে নেই, জানি। কিন্তু চিঠির ভিড়ে চিঠি খুঁজি, একটি চেনা চিঠি খুঁজি, যে চিঠির শব্দ থেকে একরাশ স্বপ্ন উঠে ঘুঙুর পরে নাচে, যে চিঠির শব্দ থেকে রুপোলি জল গড়িয়ে নেমে আমাকে স্নান করায়। জানি যে আগের মত তার কোনও চিঠি আমি আর কোনওদিন পাবো না, তারপরও ভেতরে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা ইচ্ছেরা অবাধ্য বালিকার মত হুড়মুড় করে কী করে যেন বেরিয়ে আসে। আসলে এ আমি নই, আমার ভেতরের অন্য কেউ একটি চেনা হাতের লেখা খোঁজে চিঠির খামে। আমি নই, অন্য কেউ চেনা হাতের লেখার চিঠি না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রতিদিন ডাকপিয়নের ফেলে যাওয়া চিঠি হাতে নিয়ে সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনি আমি। আমার নয়, অন্য কারও। কোথাও কোনও গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকা সেই অন্য কাউকে ঠেলে সরাতে চাই দূরে, পারি না। রুদ্রর চিঠি আমি আর কখনও পাবো না জানি, তবু বার বার ভুলে যাই, প্রতিদিন ভুলে যাই যে পাবো না। ছাইএর ওপর উপুড় হয়ে অপ্রকৃতস্থের মত খুঁজতে থাকি তিল পরিমাণ স্বপ্ন কোথাও ভুল করে পড়ে আছে কি না।

    ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলায় প্রতি বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চেনা কবি সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, এমনকী কারও কারও সঙ্গে মেলার ভেতর চায়ের দোকানে বসা হয়, আড্ডা হয়, কিন্তু চোখ খুঁজে ফেরে একটি চেনা মুখ, একজোড়া চেনা চোখ। চোখের তৃষ্ণাটি নিয়ে প্রতিরাতে ঘরে ফিরি। তবে একদিন দেখা মেলে তার, আমার ভেতরের আমিটি আমাকে পা পা করে তার দিকে এগিয়ে নেয়। ইচ্ছে করে বলি, ‘তুমি কি ভাল আছ? যদি ভাল আছ, কী করে ভাল আছ? আমি তো ভাল থাকতে পারি না! এই যে আনন্দ করছ, কী করে করছ? আমি তো পারি না, দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পারি না। ’ কোনও কথা না বলে তাকে দেখি, বন্ধু বেষ্টিত রুদ্রকে অপলক চোখে দেখি। ইচ্ছে করে বেষ্টন ভেদ করে রুদ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, হাত ধরে তাকে নিয়ে আসি, সেই আগের মত দু’জন পাশাপাশি হাঁটি মেলার মাঠে। ইচ্ছেগুলো নাড়ি চাড়ি, ইচ্ছেগুলোর সঙ্গে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলি। ইচ্ছের চোখে কালো রুমাল বেঁধে দিয়ে দৌড়ে পালাই, জিতে গেছি ভেবে অট্টহাসি হাসি। আমার হাসিই, নিজের কানে শুনি কান্নার মত শোনাচ্ছে। রুদ্রর নতুন কবিতার বই বেরিয়েছে, তার আনন্দ আমি কেবল দূর থেকে অনুভব করি। ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’, তার নতুন বইটি কিনে যখন বাড়িয়ে দিয়েছি তার দিকে অটোগ্রাফ নিতে, রুদ্র কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা চোখে আমাকে দেখে প্রথম পাতায় লেখে, যে কোনও কাউকে।

    হ্যাঁ, আমি এখন রুদ্রর কাছে যে কোনও কেউ। বইটি হাতে নিয়ে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকা আমার ওপর ইচ্ছেগুলো বাঁদরের মত লাফাতে থাকে। ছিঁড়তে থাকে আমাকে। রুদ্র কি জানে কী ভীষণ রকম আমি চাইছি যেন সে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করে কেমন আছি আমি, কবে এসেছি ঢাকায়, কতদিন থাকব। চেনা মানুষগুলো সকলেই তো আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। রুদ্র কি আমার কম চেনা ছিল! কী করে এমন নিষ্পৃৃহ হতে পারে সে! কেউ কি এত শীঘ্র ভুলে যেতে পারে তার সবচেয়ে আপন মানুষটিকে। প্রশ্নগুলো আমার ইচ্ছেগুলোর কাঁধে সওয়ার হয়ে উৎসবমুখর মেলা ছেড়ে আমার সঙ্গে বাড়ি ফেরে।

    মেলার শেষদিকে রুদ্রর সঙ্গে কথা হয়, চা খাওয়া হয় মুখোমুখি বসে। জিজ্ঞেস করি পায়ের কথা। বলে আগের চেয়ে কম দূরত্ব সে ডিঙোতে পারছে এখন। সিগারেট ছেড়েছো? হেসে বলে, ও ছাড়া যাবে না। আর কিছু ছেড়েছে কি না জিজ্ঞেস করি না। আমার শুনতে ভয় হয় যে বাকি নেশাগুলোও তার পক্ষে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। রুদ্র অনেকক্ষণ আমার চোখের দিকে গভীর করে তাকিয়ে থেকে ভারী কণ্ঠে বলে, চল ঝিনেদা চল, কাল ভোরবেলা। আমি যাব কি না, যেতে চাই কি না, কোনও জানতে চাওয়া নয়। তার যেন দাবি আছে আমার ওপর, সেরকমভাবেই বলে। যেন রুদ্র জানেই যে আমি যাব। একবার স্পর্শ করলে কেঁদে উঠব অবুঝ বালিকা। কাল ময়মনসিংহে ফেরার কথা আমার, আর হঠাৎ কিনা ঝিনাইদহ যাওয়ার প্রস্তাব। ঝিনাইদহে কবিতার অনুষ্ঠান হচ্ছে, ওখানে আরও কিছু কবি যাচ্ছেন। সিদ্ধান্ত নিই আমি যাব ঝিনাইদহ, এ যাওয়া কোনও উৎসবের আনন্দে শরিক হওয়ার জন্য নয়। এ কেবলই রুদ্রর পাশে থাকার জন্য। তার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে আমার, আমরা আর স্বামী-স্ত্রী নই, কিন্তু এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কাছের মানুষ কে আছে আমার রুদ্র ছাড়া! বন্ধু কে আর আছে! দীর্ঘ বছর ধরে এক রুদ্রকেই আমি আপন করে তুলেছি, তাকেই আমি আমার জগৎ করে তুলেছি। রুদ্র আমাকে দুঃখ দিয়েছে জানি, কিন্তু আমি তো এ কথা অস্বীকার করতে পারি না তাকে যে ভালোবাসি।

    ঝিনাইদহ যাওয়ার বাস ছাড়ে বাংলা একাডেমি থেকে। পথে আমাদের আলাদা জীবনে যা ঘটছে ছোটখাটো ঘটনা দুর্ঘটনা সব বলি পরস্পরকে। একটি কথাই আমি কেবল লুকিয়ে রাখি, আমার কষ্টের কথা। রুদ্র হঠাৎ বলে, কবিতা শুনবে? প্রিয় কবির কবিতা শুনব না, এ কেমন কথা। রুদ্র, বাসে বসে পাশে বসে, পড়ে, দূরে আছো দূরে। বাইরের কৃষ্ণচূড়ার লালের দিকে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ, উদাসীন আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় লু হাওয়া। রুদ্র তার কবিতার কথা শোনাতে থাকে, ইদানীং সে দুহাতে লিখছে, প্রচুর রাজনৈতিক কবিতা, পাশাপাশি একটি কাব্য নাটকও। কবিতার খাতা বের করে নতুন লেখা কবিতাগুলো আমাকে পড়তে দেয়। লক্ষ্য করি, নিপাত যাক ধ্বংস হোক জাতীয় কবিতা ছাড়া ব্যক্তিগত অনুভবের কবিতাগুলো অন্যরকম, নতুন ধরনের। নতুন ধরনটি ধারণ করতে সময় নেয়, কিন্তু সে যে পুরোনো খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে, তা অনুভব করে প্রশান্তি আসে। নতুন ধরনটি ধীরে ধীরে একটি স্নিগ্ধ মনোরম জগতে নিয়ে দাঁড় করায়, যে জগতে ব্যক্তি রুদ্র অনেক বেশি আন্তরিক, অনেক বেশি গভীর।

    ঝিনাইদহে আমরা যে যার কবিতা পড়ি মঞ্চে, অসত্যের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচার অনাচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী কবিতা। মঞ্চ থেকে নেমে ধীরে হেঁটে, থেমে থেমে হেঁটে রুদ্র পিছিয়ে পড়ে যখন সবাই মিলে আমরা যাচ্ছি কোথাও! অল্প দূর হেঁটেই পায়ের যন্ত্রণা তাকে বারবারই দাঁড় করিয়ে দিলে কাঁধখানা বাড়িয়ে দিই যেন ভর দিয়ে দাঁড়ায়। বড় অসহায় দেখতে লাগে রুদ্রকে। ইচ্ছে করে তার অসুখগুলো এক ফুঁয়ে ভাল করে দিই, ইচ্ছে করে হাত ধরে দৌড়ে যাই দুটো উদ্দাম, উচ্ছল, উষ্ণ হৃদয়, সবার আগে, সামনে।

    রাতে অতিথিদের ঘুমোবার আয়োজন হচ্ছে যখন, আমার আর রুদ্রর জন্য আলাদা দুটি ঘরের ব্যবস্থা করা হল, কারণ অতিথিদের একজন বাড়ির কর্তার কানে কানে আমাদের বিয়ে-বিচ্ছেদের খবরটি পৌঁছে দিয়েছেন। রুদ্র আর আমি দুজনই আলাদা ঘরের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে এক বিছানায় ঘুমোই। অনেক অনেকদিন পর রুদ্র আমাকে স্পর্শ করে গভীর করে। অনেক অনেক দিন পর রুদ্র আমাকে চুমু খায়। অনেক অনেক দিন পর দুজনের শরীর একটি বিন্দুতে এসে মেশে। একবারও আমার মনে হয় না রুদ্র কোনও পরপুরুষ। মনে হয় না যে আমরা এখন পরস্পরের অনাত্মীয় কেউ, অবন্ধু কোনও। পরদিন ঝিনাইদহে সকাল হয়, লোকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কী করে পরপুরুষের সঙ্গে এক ঘরে ঘুমোতে রুদ্রর না হোক, আমার দ্বিধা হল না! আমার হয়নি। যে পাপবোধের কথা অন্যরা ভাবে, সেই পাপবোধের লেশমাত্র আমার মধ্যে নেই। কারও ভ্রুকুঞ্চন আমাকে স্পর্শ করে না। আমি রুদ্রকে কাগজেপত্রে ত্যাগ করেছি তা ঠিক, তবে কোনও পুরুষকে যদি আমার সবচেয়ে কাছের বলে মনে হয়, সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়, সে রুদ্র। এর মধ্যে এক বিন্দু কৃত্রিমতা নেই, এক ফোঁটা মিথ্যে নেই। ভালবাসি এক রুদ্রকেই, যতই তার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ থাকুক না কেন। এই ভালবাসার বোধটি আমি খুব গোপনে গোপনে লালন করি। এই বোধটি আমার একটি হাত নিয়ে রাখে রুদ্রর উষ্ণ কৃষ্ণ হাতে। এই বোধটি একা নিভৃতে বসে থাকে, সংসার যাপনের পরিকল্পনা করে না, ভবিষ্যতের কথা সামান্যও ভাবে না, বোধটি বোধহীন বটে।

    ঝিনাইদহ থেকে যখন ঢাকা ফিরছি, রুদ্র শিমুল নামের একটি মেয়ের কথা বলে, মেয়েটিকে সে গত বছরই প্রথম দেখে বইমেলায়, মেয়েটিকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা লিখেছে। কবিতাগুলো শোনায় আমাকে।

    হঠাৎ কী হয় জানি না, চোখ ভিজে ওঠে কী! বাসের জানালায় তাকিয়ে আড়াল করি ভেজা চোখ। খোলা জানালা গলে হাওয়ার সঙ্গে ধুলো আসছে উড়ে, যেন সেই ধুলো চোখে পড়েছে বলে দ্রুত মুছে নিচ্ছি, এমন করে মুছি জল। রুদ্রকে বুঝতে দিই না আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে। আমার তো কোনও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কেন হবে! রুদ্রর আর আমার জীবন এখন আলাদা। এখন সে কারও প্রেমে পড়তেই পারে, কাউকে সে বিয়ে করতেই পারে।

    হেসে, যেন রুদ্রর এই প্রেম আমাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে, সুখে আমি ফেটে পড়ছি, এমন স্বরে এবং ভঙ্গিতে বলি, জীবন বদল করতে রাজি মেয়েটি?

    রুদ্র বললো, হ্যাঁ।

    ভালোবাসো ওকে? —জিজ্ঞেস করি। রুদ্র তাকায় আমার চোখে। চোখে ফুটে আছে অসংখ্য শিমুল। চোখ সরিয়ে নিয়ে জানালায়, বাইরের ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া দেখতে দেখতে, কী জানি কোথাও সে শিমুল খুঁজছে কি না, সুখ-সুখ গলায় বলে, বাসি।

    আমি জানালার ওপারে ফসল উঠে যাওয়া নিঃস্ব ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে বলি, না এমনি। রুদ্রকে হঠাৎ করে খুব দূরের মানুষ বলে মনে হয়। বন্ধু সে আমার, কিন্তু যেন কাছের কোনও বন্ধু নয়। আপন সে আমার, কিন্তু তত যেন আপন নয়।

    গভীর রাতে ঢাকা পৌঁছোলে রুদ্র তার বাড়িতে নিয়ে যায় বাকি রাতটুকু কাটাতে। ইন্দিরা রোডেই রুদ্র একটি নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। দোতলায় রুদ্রর পেছন পেছন উঠে সোজা তার ঘরে ঢুকি। অচেনা ঘর, অচেনা ঘরটি অচেনারকম করে সাজানো। তবে আমাদের সেই আগের বিছানাটিই আছে, বিছানায় আগের চাদর, আগের নীল মশারি। সব চেনা। কিন্তু কোথায় যেন খুব অচেনা কিছু। বাকি রাতটুকু ঘুমন্ত রুদ্রর পাশে নির্ঘুম কাটাই। রুদ্রর সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক অনেকের ছিল, ওদের সঙ্গে মনের সম্পর্ক কখনও হয়নি, সবসময় সে বলেছে ওদের কাউকে সে ভালবাসে না। এখন কী নির্দ্বিধায় রুদ্র বলে, কাউকে সে ভালবাসে, কী অবলীলায় তার ভালবাসার গল্প আমাকে শোনায় সে! আলো-অন্ধকারে ঢেকে থাকা ঘরটিকে আবার দেখি, এ ঘরে নিশ্চয়ই শিমুল এসে বসে, শিমুলের চোখের দিকে রুদ্র তার ভালবাসায় কাঁপা চোখ দুটো রাখে।

    সকাল হলে শুয়ে থাকা রুদ্রর পাশে বসে কপালে দুটো চুমু খেয়ে, ঘন চুলগুলোয় আঙুলের আদর বুলিয়ে বলি, ভাল থেকো। রুদ্র মাথা নাড়ে, সে ভাল থাকবে। বলে, তুমিও ভাল থেকো। রুদ্রকে বিছানায় রেখেই আমি যাই বলে বেরিয়ে যাই। আমার তো যাওয়ারই কথা ছিল। রাস্তায় বেরিয়ে একটি রিকশার জন্য হাঁটতে থাকি। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া আমাকে স্পর্শ করছে, অথচ মনে হচ্ছে বৈশাখী কালো ঝড় আমার ভেতরের সবকিছু ওলোট পালোট করে দিচ্ছে, সব বুঝি ভেঙে দিচ্ছে আমার যা ছিল, নিঃস্ব করে দিচ্ছে আমাকে। বড় একা লাগে, কী জানি কেন, বড় একা লাগে। মনে হয় রাস্তায় একটি প্রাণী নেই, আমি একা হেঁটে যাচ্ছি কোথাও, কোথায় যাচ্ছি তা জানি না, কেবল হাঁটছি, পেছনে দৌড়োচ্ছে স্মৃতি, ঝাঁক ঝাঁক স্মৃতি। ময়মনসিংহের সেই দিনগুলো দৌড়োচ্ছে, কলেজ ক্যাম্পাস, ক্যান্টিন, প্রেসক্লাব, বোটানিক্যাল গার্ডেনের সেইসব দিন, সেই তীব্র তুমুল ভালবাসার দিনগুলো। ভালবাসার সুতোয় গাঁথা সেই স্বপ্নগুলো। স্মৃতিরা আমাকে এমন করে পেছন থেকে জাপটে ধরে, নিজেকে ছাড়াতে এত চেষ্টা করি, পারি না। অক্টোপাসের মত স্মৃতির হাতগুলো আমার কণ্ঠ চেপে ধরে, নিঃশ্বাস নিতে আমার কষ্ট হতে থাকে।

    সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবন্দিনী – তসলিমা নাসরিন
    Next Article আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ফেরা – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.