Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচিত গল্পসংগ্রহ

    লেখক এক পাতা গল্প1108 Mins Read0

    বিদ্যুৎলতা

    আমাদের দেশকালের এবং জীবনযাপনের যাবতীয় দৃশ্য উল্লেখ করা দরকার, এই কারণে যে তার একটা চালচিত্র ইতিহাসের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। যেমন আমাদের একান্নবর্তী পরিবার এবং বাবা-জ্যাঠা-কাকারা প্রবাস থেকে ফিরে বড়ো ঘরে প্রথমে মাথা ঠুকে তারপর গৃহদেবতার বারান্দায় প্রণাম করতেন। বড়ো ঘরে এক বৃদ্ধা বসবাস করেন, কানে শোনেন না, চোখে দেখেন না, অথচ তাঁর অনুমতি ছাড়া তৃণটুকু পর্যন্ত ধরা যেত না। তাঁর কথাই শেষ কথা এবং শেষ দিকটায় দেশে ঋণসালিশি বোর্ড হয়ে যাওয়ায় এবং সংসারের আয় কমে যাওয়ায় প্রাচুর্য আর। থাকে না। পিতামহীর বোধহয় প্রত্যয় জন্মে ফজলে হিন্দুদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে গরিবদের বীচি খাওয়াচ্ছে। পিতামহীর বাপের খুবই প্রভাব-প্রতিপত্তি, কারণ জমি এবং জমিদারিসহ সুদের কারবার, তল্লাটে তাঁর নুন খায়নি এমন মানুষজন কমই আছে, ফজলে তাঁর নানার হাত ধরে কাছারি বাড়িতে এলে বালিকা প্রভাবতী সমবয়সি ফজলেকে যথেষ্ট সমাদর করত। কথায় কথায় আমার পিতামহী বউমাদের শাসাতেন, মনে রাইখ, আমি বরিশাল্যার মাইয়া, আমার চোখে ফাঁকি দিয়া কাম সারবা সেইটা হইব না। শুনতাছি ফজলে দ্যাশের নেতা হইছেন, তুই নেতা হইছসত আমার কি। হিন্দুরা জমিদার জ্যোতদার, সুদের ব্যাবসা করে, ট্যাঁয়া থাকলে সকলেই করে, তগ ট্যাঁয়া নাই ক্যানরে নিব্বইংশা? হিন্দু জাতের যত দোষ। এবং ফজলে গরিব চাষিদের যত্রতত্র খুশিমতো সুদের আদায় পত্রে লাগাম দিতেই, পিতামহীর ঘরে সরকারমশাইর হাজিরার নির্দেশ এল। হাজিরা দিলে জানতে পারা গেল, সরকারমশাই বরখাস্ত হয়েছেন। সুদের কারবারে টাকা খাঁটিয়ে সদে-আসলে সব যেতে বসেছে। টাকা খাঁটিয়ে আর লাভ নেই এমন সিদ্ধান্তে প্রভাবতী স্থিরকৃত হলে, বাপ-জ্যাঠাদের ডেকে বললেন, খাতাপত্র সরকারমশাইর কাছ থাইকা বুইজা ন্যাও। আমি তীর্থে চইলা যামু। বলেই সবার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। পরদিন দরজা ভেঙে লাশ বের করা হল এবং আমরা টের পেলাম আমাদের প্রাচুর্য আর থাকছে না। দোল-দুর্গোৎসব বন্ধ হয়ে গেল। বছর না ঘুরতেই বাপ-জ্যাঠারা পৃথগন্ন এবং শেষমেষ, বাড়ির গৃহশিক্ষক বিদায় হলে আমার পিতাঠাকুর ফরমান জারি করলেন, অজুর পড়াশোনা বন্ধ। পড়ার খরচ চালাইতে পারমু না। মা ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকলেন।

    আসলে বাড়িটা শেষ পর্যন্ত আট শরিকের বাড়ি হয়ে গেল। আমার দাদাকে বড়োমামা এসে নিয়ে গেলেন, সেজোদা ছোড়দা শান্তি চলে গেল নারাণগঞ্জের সেজো জ্যাঠার বাড়ি, পড়ে থাকলাম আমি আর বড়দা মোহন। এবং কোনো বন্দোবস্ত হওয়ায় পড়াশোনা থেকে ছুটি হয়ে গেল। আমরা দুজন হাওয়ায় উড়তে থাকলাম। পড়া থেকে ছুটি কী যে মারাত্মক স্বাধীনতা। যখন তখন দু-ভাই বঁড়শি ফেলে পুকুরে বসে থাকি, বিকেলে কাবাডি খেলা সরকারদের উঠোনে, কখনো আখচুরি, আর পুকুরে ওয়ারে ওয়া। গাঁয়ের সমবয়সিরাও জুটে গেল। তখনকার গণ্ডগ্রামে পড়াশোনা অবশ্য কর্তব্য কখনো ভাবা হত না। একটাই মাইনর স্কুল ক্রোশখানেক দূরে, হাইস্কুল আরও দূরে-সাত-আট মাইল হাঁটলে অবশ্য আড়াই হাজার হাইস্কুল ধরা যায়, পিতাঠাকুর যখন বলে দিয়েছেন অত পয়সা খরচ করে হস্টেলে রেখে পড়ানোর ক্ষমতা নেই, তখন আমাদেরই বা দোষ কি। আমার বাবা বিষয়ী লোক নন। পালাগান লেখার বাতিক থাকলে যা হয় আর বড়ো জ্যাঠামশাই সেই কবে থেকে নিখোঁজ, নিখোঁজ বাপের ছেলের দায় নিতে আর কে চায় এবং যখন এমতাবস্থা অর্থাৎ আমরা ওয়ারে ওয়া কিরে ওয়া বলে গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে জলে ডাইভ দেওয়া শিখছি, সাঁতার জলে নামলে ওঠার নাম থাকত না, ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার এবং গভীর জলাশয়ের তলা থেকে এক ডুবে মাটি তুলে আনারও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল, ঠিক এই সময়ে এক সকালে সম্মানদির ছোটো ঠাকুরদা বাড়ি এসে হাজির। সব শরিকের বউমারাই তটস্থ—কারণ বউদের জন্য পৃথগন্ন, দায় তাদের, ছোটো ঠাকুরদা বৈঠকখানায় ঢুকে আমার সেজোকাকাকে নাগাল পেতেই

    তোরা কি মানুষ!

    সেজোকাকা ভালো ছেলের মতো প্রায় করজোড়ে শুধু দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কি মরে গেছি মানু!

    শত হলেও একমাত্র জীবিত গুরুজন, কী বলবেন সেজোকাকা বুঝতে পারছেন। থতোমত খেয়ে গেছেন।

    পুকুরে দেখলাম গুষ্টিসুষ্ঠু পোলাপানের লগে মোহন অজু। অগ স্কুল নাই। জলে নাইমা পুকুরে ডুব সাঁতার চিৎ সাঁতার দিয়া বারবার পাড়ে উঠে যাওয়া কি পড়ার অঙ্গ? চক্ষু লাল কইরা ফ্যালছে। জ্বর জ্বালা হলে কে দেখবে। সেজোকাকা খুবই কাতর গলায় বললেন, আজ্ঞে না। স্কুল নাই। অজুর বাবা হস্টেলের খরচ দিতে পারব না কইছে। মোহন বলছে সে আর পড়বে না। পড়তে তার ভালো লাগে না।

    কি করবে কইছে?

    তরকারি বিইচা খাইব কইছে।

    খাওয়া বাইর করতাইছি।

    ২.

    বারদি গ্রামের নাম শোনেনি এমন মানুষজন হাটেবাজারে পাওয়া কঠিন। কী নাই। বারদি লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম। ১৯ জ্যৈষ্ঠ মেলা বসে। সাতদিন ধরে হাজার হাজার মানুষ লাবড়া খিচুড়ি পায়েস খায়। পুণ্যার্জনে তীর্থদর্শনে সে এক মহামেলা। এই এলাকার জেলাসমূহের একজন জমিদারও বাদ যায় না। আশ্রমের প্রাঙ্গণে বিশাল মাঠ, সেখানে তাঁবু পড়ে। কাঙাল ভোজন চলে। শক্তি ঔষধালয়ের মথুরাবাবু পর্যন্ত পরিবারসহ সদর থেকে চলে আসেন। বারদির জমিদার চৈতন্য নাগ, অমৃত নাগ—বিশাল বিশাল প্রাসাদের পরে প্রাসাদ-আম জাম জামরুলের বাগান আর ছাগল বামনি নদী, তার কাঠের সাঁকো সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গের মহান বিপ্লবী নেতা জ্যোতি বসুর পৈতৃক ভিটাও আবিষ্কার করা গেছে। আর বারদির হাইস্কুলের খ্যাতির সঙ্গে আমি আর বড়দাও জড়িয়ে গেছি। ছোটো দাদুর সম্মানদির বাড়ি থেকে আমরা তখন বারদির হাইস্কুলে ভরতি হয়ে গেছি।

    গাঁয়ের বিভূতি কবিরাজকে ছোটো ঠাকুরদা বললেন, অবশ্য আমাদের নিয়ে গেছিলেন সঙ্গে, বড়ো ফ্যাসাদে পইড়া গেছি বিভূতি—তুই যদি পারস বারদির বিদ্যালয়ে ভরতি কইরা দে। অমৃত নাগারে তুই কইলেই হইব।

    আরে বাব্বা কী বিশাল চকমেলানো বাড়ি বিভূতি কবিরাজের। আর গাছপালা পাখি-কড়ই গাছ অর্জুন গাছ চন্দন গোটার গাছ এমনকী দারুচিনি ত্রিফলা থেকে আমলকি গাছ, লবঙ্গ গাছের জঙ্গল পর্যন্ত আছে—সামনে বিশাল দিঘি, বাঁধানো ঘাটলা, আর লম্বা একতলা বাড়ি—আস্তাবলে বিশাল বড়ো একটা আরবি ঘোড়া বিভূতি কবিরাজ অঞ্চলে দশ বিশ পঁচিশ পঞ্চাশ এবং আরও সব সংখ্যা যোগ করে যতই অঞ্চলটা লম্বা হয়ে যাক, আপত্তি নেই, বিভূতি কবিরাজের ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। শীত গ্রীষ্মে ঘোড়ায় আর বর্ষায় পানসি নৌকা—নৌকা না বলে নৌবহরই বলা ভালো, রান্নার ঠাকুর এক নৌকায়, এক নৌকায় বড়ো বড়ো কাচের বয়াম, কোনোটার স্বর্ণসিন্দুর কোনোটায় মুক্তাভস্ম আর বায়ুপিত্ত কফ নিরোধক নানাপ্রকারের বড়ি ভরতি বয়াম। ঝোপঝাড় জ্যোৎস্না আর মল্লিকা ফুল আর দিঘি পার হয়ে কিছুটা ভিতরে ঢুকলে মনে হবে অরণ্যে নির্বাসন। এই অরণ্যে একজন দেবীকে কখনো কখনো দেখা যায়। কথিত এই বনদেবী দর্শনে পুণ্য হয়। অপুত্রকের পুত্র হয়, নিখোঁজ স্বামী ঘরে ফিরে আসে। দিঘির চারপাশে এতবড়ো একটা অরণ্য আছে আমি আর বড়দা অবশ্য পরে টের পেয়েছিলাম। কারণ বিভূতি কবিরাজ বড়দাকে বিশেষ পছন্দ করতেন। তুমি কোন ক্লাশে পড়?

    এইটে।

    তোমার বাবা মহেন্দ্র কত বড় কৃতী পুরুষ ছিল জানো?

    বড়দার অবশ্য ফের একটা বছর নষ্ট হয়েছে। এবং সাধারণভাবে বড়দা দু বছরের কমে কোনো ক্লাশ থেকেই উত্তীর্ণ হতে চান না। আমার চেয়ে বড়দা পাঁচ বছরের বড়ো।

    তুমি কোন ক্লাশে?

    সিকসে।

    তিনি বিশাল বারান্দায় একটি ইজিচেয়ারে বসে আছেন। সাঁজবেলা। আমরা বারান্দার একপাশে বসে আছি। ভিতর বাড়িতে যে নানা গুঞ্জন সৃষ্টি হচ্ছে, নানা কৌতূহল—কেউ কেউ মুখ বের করে উঁকিও দিয়ে গেল। আমার ছোটো ঠাকুরদার কোনো নেশা নেই, বিভূতি কবিরাজ ছোটো ঠাকুরদাকে গাঁয়ের বরিষ্ঠ মানুষ হিসাবে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন—ধূমপানের ইচ্ছা হলে ভিতরের ঘরে ঢুকে যাচ্ছেন, আবার বের হয়ে আসছেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ভিতর বাড়িতে ডাক পড়ল—ঘরে ঘরে ঝাড় ল’নের দ্যুতি ছড়াচ্ছে এবং এই নিরবচ্ছিন্ন দ্যুতির মধ্যে এক বিস্ময়ীকে দেখা গেল।

    বিদ্যুময়ী হেসে গড়িয়ে পড়ছে—

    মোহন আমাকে চিনতে পারছ?

    আর মোহন! মোহন মাথা নীচু করে আছে। ঘামছে।

    দাদার হয়ে বললাম, আমার দাদা খুব লজ্জা পায়।

    এই মোহন তুমি লজ্জা পাও?

    বড়দা ঘাড় কাৎ করে বলল, না। যতই দস্যি মেয়ে হও আমি আর ডরাই না।

    আমিও তাকে চিনতে পারি। বারদির লোকনাথ মন্দিরের পুরোহিত অর্ঘ্যদাদুর সম্মতিতে আমরা ছোটোঠাকুরদার সঙ্গে এসেছি। সেবারে ঠাকুমাও এসেছিলেন। মেলায় এসে ঠাকুমাই চিঠি দিয়েছিলেন, বিভূতি তোর নাতনিটাকে পাঠায়। আমাদের সঙ্গে কদিন থেকে যাক। আমি নাতি-নাতনিদের নিয়ে এসেছি, মেলায় আমাদের তাঁবু পড়েছে, সেখানে তোর নাতনি আমার সঙ্গে থাকবে। তাকে দেখার বড়ো বাসনা। তখন অবশ্য বিদ্যুত্রয়ী ফ্রক পরে। এবং কিশোরী। সে, তাঁবুতে আমাদের সঙ্গে সাত-আট দিন রাত্রিবাসও করে। বড়োদা তাকে নিয়ে মেলায় ঘুরে বেড়াত। মেঘনা নদীর চরে গিয়েও বসে থাকত। দাদা ও রেবাদি পালিয়ে চরে বসে বিন্নির খই লালবাসা খেত। আসলে প্রেমের হাতেখড়ি বলা যায়। রেবাদি ঠাকুমার পালিতা কন্যা শেফালি পিসির কন্যে। পিসির অকালমৃত্যুতে ঠাকুমার সেই ভয়ঙ্কর শোকের কথাও আমাদের মনে আছে। বিদ্যুৎস্ময়ী না বলে বিদ্যুৎলতা বললে সেই পূর্বেকার ফ্রক পরা মেয়েটিকে বেশি মানায়। সে আর যে কিশোরী নেই, তরুণী হয়ে গেছে—তার রূপে আশ্চর্য বাহার আছে, তাকে না চেনার বড়দার কোনো হেতু থাকতে পারে না। সে আমাদের জন্য চিনেমাটির প্লেটে নানারকমের মিঠাই সাজিয়ে রেখেছে। আর বড়দার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে।

    বড়দা সহসা উঠে দাঁড়াল। বলল, এই অজু চল। আমরা বরং দাদুর পাশে গিয়ে বসি। তারপর রেবার দিকে তাকিয়ে বলল অত হাসার কী হল! এত দস্যুবৃত্তি ভালো না।

    রেবাদি বড়দার হাত ধরে বলল, ঠিক আছে হাসব না তুমি যে এত ভিতু জানব কি করে! আমার কী এমন অপরাধ ছিল। আমার যে ইচ্ছা করে। সকালে মেলা থেকে ফেরার দিন তুমিতো কথা বন্ধ করে দিয়েছিলে। আমি কিছুটা হতবাক। বুঝছি না রেবাদি কেন বড়দাকে ভিতু বলছে। সেই তাঁবুবাসের পর তো রেবাদির সঙ্গে আমাদের আর দেখাও হয়নি। যদি কিছু ঘটেও থাকে সেটাতো বছর পাঁচেক আগে বারদির লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মেলায়—এতদিন পর সেই স্মৃতির কোনো হাস্যকর ঘটনা কি দাদাকে দেখে রেবাদির মনে পড়ে গেছে। কিংবা রেবাদি কেন যে বলল, আমার পাপটা কি তোমাকে বলতেই হবে। এটা পাপ কাজ, তুই এটা কি করলি রেবা, আমি কি পাপ কাজ করেছি বলতে হবে। আজ না হোক, কোনো একদিন। এবার যাবেটা কোথায়! আমার যে ইচ্ছে করে। তার দাম দেবে না!

    তুমি খুব চপল, অসহিষ্ণু রেবা। অজু ছেলেমানুষ। তার সামনে কী আরম্ভ করলে! শোভন অশোভন বুঝবে না। তুমি আর কিন্তু ছোটোটি নেই!

    রেবাদি আঁচল দুলিয়ে শিস দিতে দিতে ভিতর বাড়ির দিকে চলে যেতেই আমার কেন যে মনে হল রেবাদি অনেক কিছু জানে, অথচ এটা জানে না মেয়েরা শিস দিলে সংসারের অমঙ্গল হয়। রেবাদি শহরে থাকে। গ্রীষ্মের বন্ধে কিংবা পূজার ছুটিতে আসে। এমনিতেও আসে। এই প্রকৃতির নিরিবিলি গাছপালা, পাখি, আস্তাবলের ঘোড়া, কিংবা দিঘির চারপাশের অরণ্য তাকে টানে। বড়দাকে তাদের বাড়িতে দেখে সে কি কিছুটা বেশি বুদ্ধিমতী সাজার ভান করছে! বাড়িতে ফেরার সময় আমাকে একা পেয়ে বড়দা বলল, তুই কিন্তু ওর সঙ্গে মিশবি না। ভারি পাজি পুচ্ছ পাকা মেয়ে। জেদি। যা কিছু খুশি করতে পারে। আরে যে মেয়ে ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে পারে; শহরে থাকিস বলে এত দেমাক ভালো না।

    মিশলে কী হবে বড়দা।

    তোকে নষ্ট করে দেবে অজু। শহরের মেয়ে ওরা সব জানে। রেবার স্বভাবচরিত্র ভালো না।

    কী জানে!

    জানি না, যা। কী জানে’, অতশত জানার দরকার নেই। রেবা ডাকলে সাড়া দিবি না।

    দাদুর বৈঠকখানা ঘরে আমরা থাকি, একটা চৌকি, দুটো চেয়ার একটা টেবিল, একটা মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে আলাদা পড়ার ঘরের বন্দোবস্ত। বলা ভালো, তখনকার দিনের বাড়িঘর সব টিনের, চৌচালা আটচালা, টিন কাঠের বেড়া, মুলি বাঁশের হেঁচা বেড়াও থাকে—একমাত্র এ-তল্লাটে একটাই পাকাবাড়ি বিভূতি কবিরাজের-তারপর যতদূরেই যাই না, কেবল দারিদ্র্য চোখে পড়ে। শনের চাল পাটকাঠির বেড়া আর বনঝঙ্গল। কোথাও আর পাকাবাড়ি চোখে পড়ে না, সেই বারদির স্কুলে গেলে চৈতন্য নাগ, অমৃত নাগের জমিদারি, পাকাবাড়ি দালানকোঠা সবই দেখা যায়। দালানকোঠা থাকলেই বাড়ির সম্ভম অন্যরকম। কোনো পাকাবাড়ি থাকলেই মনে হত কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবার এ-গাঁয়ে থাকে।

    বাড়িতে ছোটোদাদু, ঠাকুমা, দুই পিসি, কাজের লোক ইদা আর দুই কাকি। কাকারা কলকাতায়। দুই বাড়ির মেলামেশা একেবারে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো। রেবার সঙ্গে ছোটোকাকির ইদানীং অর্থাৎ আমরা আসার পর ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়েছে। রেবা ফাঁক খুঁজে ঠিক আমাদের ঘরে সবার আড়ালে ঢুকে যাবে, এবং আমার তখন কাজ ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া।

    তাদের কথোপকথন এ-রকমের। আড়াল থেকে শোনার চেষ্টা করি, চুমু খেলে দোষ হয়। জড়িয়ে শুলে দোষ হয় মোহনদা?

    হয়। দাদার এক কথা।

    কী করব বল। আমার যে ইচ্ছে হচ্ছিল, রাতে তাঁবুতে সবাই ঘুমিয়ে আছে। অন্ধকার। নদীর চরে শুধু চুমু খাওয়ায় রাগ করেছ, খারাপ লাগে না। তোমার মান ভাঙাতে পাশে গিয়ে শুয়েছিলাম।

    আর কিছু করিসনি।

    হ্যাঁ নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। কী করব, আমার যে ইচ্ছে করে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। একলাফে জায়গাটা থেকে আমার পালাতে ইচ্ছা করলেও কেন যে নড়তে পারলাম না। বাল্যবয়সে পাপবোধ বেশি মাত্রাতেই থাকে।

    গুরুজনদের কথা আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনাও পাপ।

    একদিন রেবাদি ফুঁসেও উঠল।-তুমি কাপুরুষ মোহন। দাদু আমাকে কী বলেছে জানো, কত বড়ো সম্ভান্তবংশের ছেলে মোহন, দুর্ভাগ্য বছর বছর ফেল করে। দীর্ঘকায় পুরুষ, পাল্টিঘর, তোর সঙ্গে মানাবে। চুমু খেলে পাপ হয়। অন্ধকারে শরীর আমার কেমন পাগল হয়ে উঠেছিল, তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পার না? তারপর রেবাদি বলেছিল, আমার দাদু তোমার বাবাকে কত বড়ো কৃতী মানুষ ভাবে জানো! বলে—কত বড়ো কৃতী মানুষ। বউঠানের কপাল মন্দ, কপালে সইল না। মাথার দোষ দেখা দিল—কম চিকিৎসা করিনি। আর আরোগ্য লাভ করল না। বড়দা বলেছিল, রেবা তুমি চরিত্রহীনা। সতীসাধ্বী নও। আমি চরিত্রহীনা মোহনদা? রেবাদি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে থাকল। হ্যাঁ হ্যাঁ, চরিত্রহীনা।

    আমি জানতাম, ফেরার দিনে কত করে বলেছি চিঠি দিয়ো। শহরের ঠিকানা দিলাম। বান্ধবীর ঠিকানা। চিঠি দিলে না। এতবড়ো সাধুপুরুষকে দিয়ে আমার কী হবে! দাদুকে বলেছি, আর যাই করো, ও কাজটা করো না। বারবার পরীক্ষায় যে ফেল করে, সে আবার মানুষ। পাড়ায় ঘরে ঢুকে দেখি বড়দা কাগজ কেটে ভাঁজ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কাগজটা একটা দোয়াত হয়ে গেল। বিভূতি পরিবারের বাড়ি এখন আমার অবারিত দ্বার। সবাই আমি গেলে খুশি হয়। রেবাদি ছুটে আসে।

    আমি কাগজের দোয়াত দিয়ে বললাম, চিঠি আছে দাদার। চিঠিতে কী লেখা আছে জানি—দাদা লিখেছেন, তুমি তোমার এই দ্বিচারিতার জন্য সারাজীবন ভুগবে। তোমার সন্তানসন্ততি হলে পাপবোধে ভুগবে। রেবাদি আর আমি সেই অরণ্যের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। চিঠিটা ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলে সব কেমন প্রজাপতি হয়ে উড়ে গেল। কী সুন্দর নারে? আয় তোকেও একটা চুমু খাই। কথা নেই বার্তা নেই খটাস করে চুমু খেয়ে বসল। তারপর বলল, তোর দাদাকে বলিস, দাদু আমার পাত্র দেখছে। ওরা জমিদার, মুকুলবাবুর ছোটো পুত্র। ওদের কলকাতায় বাড়ি আছে।

    কবিরাজ দাদা তোমার বিয়ে দিয়ে দেবে?

    দেবে না? আমি বড়ো হয়েছি না। বছর বছর যে ফেল করে, তার আবার দ্বিচারিতা। এত সংস্কৃত ঘেষা বাংলা সে পায় কোথায়! আমি দ্বিচারিণী হই হব। তোর দাদার শিক্ষা হওয়ার দরকার। তারপর আর কথাবার্তা নেই। কেমন গুম মেরে গেল রেবাদি। তারপর জঙ্গলের গভীরে ঢুকে যেতে থাকলে আমার কেমন ভয় হল, রেবাদি কোথায় যাচ্ছ? তোর দাদাকে খুঁজতে। বলেই একেবারে সায়া শাড়ি খুলে উদোম হয়ে গেল এবং আমার চোখ বিস্ফারিত।

    আমি দ্বিচারিণী, এই কথাগুলো বারবারই বলছে। দ্যাখ আমার কী আছে অজু, আমার এমন সুসময়, আর কিনা বলে আমার পাপ, এবং ক্ষেপে যাওয়ার তার মান-ইজ্জতেরও বোধ ছিল না। সে উড়তে থাকল যেন। জ্যোৎস্না রাতে মল্লিকা বনে এক নারীর অপার সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

    কখন যে দেখলাম ঘাটলায় রেবাদি বসে আছে নতমুখে। কাছে যেতেই বলল, কী রে তুই আমাকে খারাপ ভাবিসনি ত!

    না না, খারাপ ভাবব কেন রেবাদি।

    আমার মাথায় যে কী হয়। শরীরে যে কী হয়! তোরা পুরুষমানুষ ঠিক বুঝবি না। দাদুর কত সাধ, এমন সুপুরুষ তুই কোথায় পাবি রেবা। একেবারে বাপের চেহারা পেয়েছে মোহন। মোহনের বাবা মহেন্দ্র ঠিক এরকমই ছিল দেখতে। তারপরই আবার খেপে গেল রেবাদি। ওঠ ওঠ। যা বাড়ি যা। শরীরের আমার আগুন জ্বলছে। কখন কী করে বসি। তুইও আর ছোটো নস অজু। তোর তো ক্লাশ নাইন হল আর তোর অকৃত্রিম দাদা নির্লজ্জ বেহায়ার মতো নাইন থেকে টেনে উঠে আমার মাথা কিনে নিতে চাইছে।

    রেবাদির বিয়ের কথা হচ্ছে শুনেই বড়দা কেমন মনমরা হয়ে গেল। কোনো চিঠি দিয়েছে কি না জানতে চাইল। আসলে বিভূতি কবিরাজের নাতনি দাদুর আদরে একটু বেশিই স্বাধীনতা ভোগ করে। একদিন সকালে তাকে অশ্বপৃষ্ঠেও দেখা গেল। সে আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে। দাদা পালিয়ে গাব গাছে উঠে বসে থাকল।

    মেয়েটার যে মাথার ঠিক নেই, অতি আদরে বাঁদর হয়ে গেছে বুঝতেই পারে না, এ-বয়সে এ-সব সাজে না। তবে শত হলেও বিভূতি কবিরাজের একমাত্র নাতনি, তার পক্ষে সবই শোভা পায়। শহরে থাকলে নারী-স্বাধীনতারও সুযোগ অনেক বেশি। কাজেই রেবাদির পক্ষে সবই মানিয়ে যায়। আর বড়দা গাবগাছ থেকে নেমে কাগজ ভাঁজ করে একটা নৌকা বানিয়ে ফেলল। তার ভিতর সাধের চিরকুট লিখল–বিবাহ মানুষের অতি পবিত্র কর্তব্য। বিবাহের আগে কোনো শারীরিক সংসর্গ আমাদের ধর্মে পাপ বলে চিহ্নিত হয়। তুমি আসলে সোজা বাংলায় এঁটো পাতা। তোমার কলকাতার পাত্রটির নিতান্ত দুর্ভাগ্য। তুমি যে উচ্ছিষ্ট। তিনি নিশ্চয়ই জানেন না তুমি অগ্রহণীয়।

    খামে নয়, কারণ খাম হাতে থাকলেই পরিবারের কারও সংশয় হতে পারে, হাতে কার চিঠিরে! সুতরাং খেলার ছলে, কখনো দোয়াত, কখনো নৌকা, মাঝে মাঝে কাগজের তৈরি অ্যারোপ্লেনের ভূগর্ভে সেই অমূল্য চিঠি গোপনে বড়দা আমাকে দিয়ে পাচার করাত।

    তারপর দু-বাড়িতেই থমথমে ভাব। রেবাদি বলেছে, এর শেষ দেখে আমি ছাড়ব অজু। শহরে যাচ্ছি না। কারণ একটাই রেবাদিকে চিঠি না দিয়ে বড়দা অর্থাৎ ঠাকুর ভাই কেমন নিস্তেজ, আহারে রুচি নেই, এবং এক সকালে দেখা গেল পুকুরে নেমে ডুবের পর ডুব দিচ্ছে। পাড়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ডুব গোনার জন্য। একশো হয়ে গেছে—একবার চেঁচিয়ে বলাম একশো হয়ে গেছে, উঠে আসুন। কেবল বললেন, তুই গুনে যা। বাধাবিঘ্ন আমি পছন্দ করি না। সে জানে না আমি কে?

    এবং লোকজন জড়ো হয়। দাদা নিরন্তর ডুব দিতে দিতে কখন কাহিল হয়ে গেছে। লোকজন ছুটে আসছে। ছোটো দাদু পড়ে গেছেন বিপাকে। জল থেকে তুলে আনার পর কিছুটা অজ্ঞান অবস্থা। সে অবস্থায়ই মা-কালী ক্যত্যায়নী, দাদার ওপর ভর করেছেন।

    ও বিভূতি, সর্বনাশ।

    আমি জানি দাদা। আমারও কী নিস্তার আছে। নাতনি সারারাত চন্দন কাঠের অরণ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেকেই দেখেছে। বলে দেবদেবীর আবির্ভাব হয়—তাই রক্ষা। উলঙ্গ দেবী প্রত্যক্ষ করে মা মা বলে কেঁদেছে। প্রার্থনা করেছে। ওর মাসি মামিরা ওকে শেষে চাদর ছুঁড়ে দিয়ে চ্যাংদোলা করে তুলে এনেছে। ঘোটদাদু একটি বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, তোর নাতনির শরীর গরম হয়ে গেছে রে বিভূতি।

    এমনই চলছিল সব। বড়দা আজকাল খুব সকালে ওঠেন। প্রাতঃস্নান করেন। এবং মাঝে মাঝে শনিবার মঙ্গলবারে তাঁর ভর ওঠে। বাড়ির সবাই, অর্থাৎ দুই পিসি, ছোটোঠাকুমা থেকে ছোটো ঠুকরদা সবারই ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। ঠাকুর দেবতা নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় না। ঘরদোর পবিত্র রাখতেই হয়। বাড়িটা সবসময় উৎসবের মেজাজে থাকে।

    বড়দা অর্থাৎ মোহন সাঁজবেলায় পুকুরে নেমে গেলেই আমার অন্তরাত্মায় কাঁপুনি ধরে যেত।

    হয়ে গেল।

    কী হয়ে গেল!

    বড়দা পুকুরে আবার নেমে গেছে।

    ছোটঠাকুমা এবং বাড়ির কাজের লোকের সবারই ব্যস্ততা বেড়ে যেত। সারাবাড়ি গোবরজল ছিটিয়ে বাড়িটিকে দেবী আগমনের জন্য প্রস্তুত রাখা হত। বারান্দায় উঠোনে হ্যাজাকের আলো জ্বলত। গাঁয়ের লোকজন ভিড় করত এবং ক্রমে দাদার ওপর দেবী ভর হওয়ার বিষয়টি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে রটে যেতে থাকল। মানুষজন এমনিতেই ঈশ্বরবিশ্বাসী—তার ওপর জ্যান্তঠাকুরমা কাত্যায়নী অঞ্চলের কাত্যায়নীর থান খ্যাত দেবী। স্বেচ্ছায় পুণ্যবান ছোটোঠাকুরদার বাড়িতে তাঁর আবির্ভাব হতেই পারে।

    আমার অবশ্য কাজ বেড়ে গেল। ভর না ছাই, আসলে ভারাক্তি। দাদার জন্য আমারও লেখাপড়া লাটে ওঠার অবস্থা।

    এই অজু বাজারে যা।

    এই অজু মোহন আজ খিচুড়ি খাবে বলেছে। পায়েস খাবে বলেছে, খেজুরের গুড় আনবি, বেগুন আনবি—শিংনাথ বেগুন।

    কোনোদিন আবার পড়তে বসলেই ছোটোঠাকুরদা ডেকে পাঠাত, শোন মোহন বলেছে আজ কাচকি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাবে। তার ওপরে আর এক মুশকিল, রোজ রেবাদিকে দাদার খবর দিতে হয়।

    আজও স্কুলে যাবে না বলছে তার দাদা?

    বলল ত।

    কী মনে হয়, ভর উঠবে।

    তেমন লক্ষণ দেখছি না।

    স্কুলে যাবে না, বাড়ি বসে কী করবে?

    ঠাকুর ঘরে বসে গীতাপাঠ করবে।

    এই অজু কোথায় যাচ্ছিস!

    বেলপাতার ডাল।

    খুব জ্বালাচ্ছে তোর দাদা।

    কী করি বলো রেবাদি। জানো তো আমার ওপর খুব খাপ্পা।

    তোদের বাড়িটা দেখছি চিড়িয়াখানা হয়ে গেলরে। তোদের নিয়ে এল, বারদি স্কুলে ভরতি হলি, তোর দাদা টেস্টে অ্যালউ হল না, তুই হলি, খেপে তো যাবেই!

    না রেবাদি সেজন্য নয়।

    তবে কী জন্য।

    কাল তো তুমি যাওনি। কত লোক বাড়িতে। কত দূর দূর জায়গা থেকে লোক হাজির। অপুত্রকের পুত্র চাই, কন্যের ভালো ঘরে বিয়ে চাই, পুত্রের সামনে কোনো যদি অমঙ্গল থাকে, তার বিধান চাই। মা-কাত্যায়নীর সব বিধান নাকি ফলে যাচ্ছে। কী করে হয়? দোষের মধ্যে বলেছিলাম, মা কালীর গোঁফ থাকে নাকি।

    গোঁফ।

    হ্যাঁ গোঁফ। সেই গোঁফটি কিছুতেই ছাটবে না। আমি কত করে বললাম, দ্যাখ বড়দা গরদের শাড়ি পরে মেয়েমানুষের মতো বসে থাকিস, ফুল বেলপাতার পাহাড় জমে যায়, সব ভালো, তবে তোর মুখে আয় গোঁফ মানায় না। মা কালীর কি গোঁফ থাকে। মা কালীর মুণ্ডমালা থাকে। তুই কী রে বড়দা। রেবা হাসল।

    রেবাদি তুমি হাসছ কেন?

    হাসব না, কবে যেন একদিন গোঁফের প্রশংসা করেছিলাম। সেই থেকে গোঁফের ওপর খুব নজর। গোঁফ ছেটে ফেললে আমি কি তোর দাদাকে আস্ত রাখব।

    ও তোমার ভয়ে।

    তবে কী!

    তুমি রেবাদি বলতে পার না, অনেক তো হয়েছে, টেস্টে এলাউ হতে পারল না, ভর ওঠলে সূর্যমাস্টারও শুনেছি হাজির হয়। কড়জোড়ে দরজার সামনে বসে থাকে।–কখন মা জননী হাতে হাতে প্রসাদ দেবে, আচ্ছা সন্দেশের ঠোঙাটি কে সাপ্লাই করে বল তো। সূর্যমাস্টার ইচ্ছে করলেই এলাউ করে দিতে পারে, দিল না কেন, ভর উঠলে কাত্যায়নী, ভর না উঠলে মোহন মজুমদার। জানিস তোর দাদা হাড়ে বজ্জাত। আমার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে, আমি অগ্রহণীয়। সব বের করব।

    জানো রেবাদি, সারাক্ষণ পাহারা দিতে হয় এখন।

    পাহারা। রেবা ঘাটলায় বসে পা নাচাচ্ছিল।–পাহারা কেন?

    কোথায় কোনদিকে ছুটবে, কোথায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে—আর মা মা বলে চেঁচাবে। দু-হাত বাড়িয়ে মা কাত্যায়নীকে খুঁজবে। কোথায় গেলে মা তুমি। আমার আর ভাল্লাগছে না রেবাদি। সামনে পরীক্ষা।

    সেই।

    আজও সাঁজবেলায় পুকুরে নামবে মনে হয়। আজ তো শনিবার। সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। এবং এভাবে রটে যায়, শনিবার শনিবার ভর ওঠে। দাদা পূজার ঘরে চুপচাপ শুয়ে আছেন। সারাদিন কিছু খাননি। উপবাস। এইসবই ভর ওঠার সংকেত।

    কিন্তু দাদা মস্তবড়ো চাঁদের দিকে তাকিয়ে পুকুরপাড়ে বসে থাকলেন। পরনে সেই গরদের শাড়ি—লোকজনের ভিড় বাড়ছে। দাদা কেমন বাহ্যজ্ঞান শূন্য, তারপর ধীরে ধীরে জলে নেমে চেঁচালেন, মা মা, মা-কালী করালবদনা তারপর পুকুরে নেমে ডুব। আজ কি হাজারবার ডুব দেবেন, আমার কাজ পাহারা দেওয়া। একটা হ্যারিকেন হাতে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। কারণ দিন দিন উপসর্গ বাড়ছে।

    জলে নামার আগে বললাম, বড়দা, রেবাদি আসবে বলেছে। তোমার ভর ওঠা দেখবে।

    আর যায় কোথায়। এবারে গাবগাছেও সানাবে না—বড়দা ছুটছে। কোথায় ছুটছে জানি না। লোকজনও ছুটছে পেছনে। মা-কালীর ভর না তুলে কোথায় যাচ্ছেন, আপনার আসার ইচ্ছা পূর্ণ হোক মা। দৌড়াতে গিয়ে আমার হ্যারিক্যান নিভে গেল—মাঠ পার হয়ে এক দূরবর্তী কবরখানায় পাশে চলে এসেছি। এবং দাদার যা হয়, শত হলেও সাধক মানুষ আমার দাদা, গাছপালায় জলে, গাছপালায় ফলে যাকিছ ধরেন সবই মহাকালীর অংশ। জ্যোৎস্নায় আলো অন্ধকারে শুনতে পেলাম, অশ্বখুরের শব্দ। এবং তিনি সকলকেই অর্থাৎ যারা পুণ্যার্থী ভিড় করেছিল অজুদের বাড়িতে জ্যান্ত দেবীর আশায়, তাঁদের কাছে এক বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে—কেউ জায়গা ছেড়ে নড়বেন না, নড়লেই মা-কালীর কোপে পড়ে যাবেন!

    কবরখানার পাশে বিশাল এক প্রান্তরে বসে আছি—একটা ঝিল সামনে, জোনাকি জ্বলছে, নানারকমের জলজ ঘাসের সোঁদা গন্ধ। আতঙ্কে আমি কাহিল, এটা তো একটা পরিচিত ভূতুড়ে জায়গা। ভূতেরা এখানে খুশি হলে লাফাতে পারে, ঘাড় মটকে দিতে পারে আর বড়দা বেঁহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে।

    আমি যে কী করি।

    অশ্বখুরের শব্দ আরও শব্দময় হচ্ছে। আবার কখনো ভূতেরা লড়ালড়ি করলে কট কট শব্দ হয় কঙ্কালের হাড়গোড় ঠোকাঠুকি হলে যা হয়।

    আর তখনই দেবী আবিভূতা।

    তিনি লাফ দিয়ে নামলেন। তারপর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, কোথায় তারা। জ্যোৎস্নায় কিছুই স্পষ্ট নয়।

    বললাম, রেবাদী কী তুমি?

    তোরা কোথায়?

    এইত এখানে। খাদের মধ্যে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। সাধক মানুষ, তার এক কথা, হে মা কালী, হে মা জননী, মানুষের কল্যাণ করো রেবাকে সুখ্যাতি দাও। রেবাদি এসে কী করে বসবে কে জানে।

    বিশাল প্রান্তরে রেবাদি তার আলখেল্লার মতো আবরণটি খুলে দেখার আগে বলল, এই তুই যা তোদ্যাখ কোনো লোকজন ছুটে আসছে কি না। এসে বলবি সাধক মোহনচাঁদের নিষেধ আছে, আর এগুবেন না।

    আবরণটি খুলে একেবারে দাদার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রেবাদি। কারণ দাদা যে কোনো সময় ছুটে পালাতে পারে। রেবাদিকে বাঘের মতো ভয় পায়। কাপুরুষ কোথাকর। আমাদের দেশ বলেই সাধক, মহাপ্রভু সাজার তোমায় সুযোগ মিলেছে বোঝ? কোথায় আমার শরীর অপবিত্র, কোন জায়গায় বলো! মানুষ কখনো অপবিত্র হয়। অগ্রহণীয় হয়। এস—ঘোড়ার পিঠে বেঁধে ছেড়ে দেওয়া যেত—কিন্তু অজুটা যে একা পড়ে যাবে। আর কোনো পাগলামি নয়। আর যদি ভর ওঠে, মা কাত্যায়নী বলে হুংকার দাও সত্যি আমি মুকুলবাবুর ছোটোপুত্রকে বিয়ে করে কলকাতায় চলে যাব। অনেক সহ্য করেছি।

    দাদা সেই থেকে ভালো হয়ে গেলেন। তার ঠাকুর-ঠুকুর, মা-কালী কাত্যায়নীর পাগলামিও সেরে গেল। মানুষের শরীর কখনো অপবিত্র হয় না। রেবাদিই দাদাকে জ্যোৎস্না রাতে শরীর দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনানা রসের ৬টি উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article ৩০০ বছরের কলকাতা : পটভূমি ও ইতিকথা – ডঃ অতুল সুর

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }