Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচিত গল্পসংগ্রহ

    লেখক এক পাতা গল্প1108 Mins Read0

    গির্জার সিঁড়িতে সারারাত

    আমরা আশা করছিলাম জাহাজ এবার দেশে ফিরবে। সেই প্রায় মাস এগারো আগে সফরে বের হয়েছি—কত কাল আগে যেন, নতুন জাহাজিরা দেশে ফিরতে চাইবেই। কারণ রক্তে নোনা জলের নেশা এখনও ঢোকেনি। তাছাড়া একটানা, শুধু নীল জল, নীল আকাশ, কতদিন ভালো লাগে! বন্দরে এলে দিনগুলি তবু কোথা দিয়ে যে শেষ হয়ে যায়। তখন মন খুব একটা খারাপ থাকে না। টাকা থাকলে ফুর্তি-ফার্তার অভাব হয় না।

    তবে সবাই একরকমের হয় না। জাহাজিরা প্রায় সবাই সংসারী মানুষ। টাকা উপার্জনের জন্য ঝড়তুফান ঠেলে পরিবার পরিজন থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে—যত দিন যায় তত দেশে ফেরার জন্য উন্মুখ। কোম্পানির ঘরে কত টাকা জমল, কলকাতায় ফিরে কত টাকা নিয়ে ঘরে ফেরা যাবে এসব হিসেব-নিকেশও শুরু হয়ে গেছে। এগারো-বারো মাসের সফর খুবই লম্বা সফর।

    মুশকিল ব্যাংক লাইনে নিয়ম বালাই কম। একবার জাহাজ কলকাতা থেকে ছাড়লে, আবার কবে খিদিরপুরে কিংবা জর্জ ডকে ফিরবে কেউ বলতে পারে না। লম্বা সফর হলে বিশ-বাইশ মাসও হয়ে যায়। কখনও তারও বেশি।

    আমি একেবারেই নতুন। ভদ্রা জাহাজের ট্রেনিং শেষ করে মাস দুই লেগেছে সি ডি সি পেতে। তারপরই এক ভাঙা লজঝরে কয়লার জাহাজে বের হয়ে পড়েছি। প্রথম দিকে সে কি অবস্থা গেছে। ফার্নেসে টন টন কয়লা বয়ে নিয়ে যাওয়া, ছাই ফেলা—আট ঘণ্টার ওয়াচ কখনও দশ বারো ঘণ্টায়ও শেষ হত না। যখন স্টকহোলড থেকে সিঁড়ি ধরে বোট-ডেকে উঠে আসতাম, মনে হত এবার হয়তো বেঁচে গেলাম, পরের ওয়াচে ঠিক পড়ে যাব। জাহাজ দুলছে, সামনে পিছনে কিংবা ডাইনে বাঁয়ে ঠিক হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। মাথা ঘুরছে। খেতে গেলে ওক উঠছে, খেতে পারছি না। সারেঙ সাব পই পই করে বলেছেন, দেখ পারবি কি না। কয়লার জাহাজ, বয়লারগুলো রাক্ষসের মতো কয়লা খায়—পেরে উঠবি না। রক্তবমি হবে। মাথা ঘুরে পড়ে যাবি—এমন সব সাংঘাতিক কথাবার্তার পরও ঠিক করে ফেলেছি যাবই। তাছাড়া উপায়ও নেই। একটা কাজ না হলে চলছে না, ভাই বোন বাবা মা সব আশায় আছে। বন্দরে জাহাজ আসে, চলেও যায়, মাস্তারে দাঁড়িয়ে থাকি, আমাকে নেয় না। দাড়ি-গোঁফ ভালো করে ওঠেইনি, পারবে কেন জাহাজের ধকল সামলাতে। আমিও নাছোড়বন্দা, কয়লার জাহাজ, তাই সই। উঠে পড়েছি। তারপর দিন যত যায়, কেমন মনমরা। যত দূরে যাই, তত আমার বাড়িঘর গাছপালা টানে।

    আশা এবারে ঠিক খবর পেয়ে যাব, জাহাজ দেশে ফিরছে।

    জাহাজে ফসফেট বোঝাই। নিউল্লাইমাউথ বন্দরে ঢুকছি। মাল এখানে খালাস হবার পর গম নিয়ে হয়তো দেশের দিকে ফিরতে পারব। এখন থেকে না হোক অস্ট্রেলিয়ার কোনও বন্দর থেকে গম বোঝাই হবে। সবাই এমনই যখন ভাবছি তখনই ডেক সারেঙ খবর দিল, এখনও বাড়িয়ালারা খসাচ্ছে না।

    জাহাজের বাড়িয়ালা মানে কাপ্তান। সেই বলতে পারে সব। এনজিন সারেঙের কাছে গেলাম। আমি বন্ধু দেবনাথ—আমরা বাঙালিবাবু, কারণ সেই ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে জাহাজি বলতে চিটাগাং নোয়াখালির মানুষজনদেরই বোঝাতো। দেশ ভাগ হয়ে যাবার পর তাদের উপর ভরসা করে থাকা চলে না। দলে দলে আমরা ঢুকছি। জাহাজে ডেকজাহাজি আর এনজিন-রুম জাহাজির সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। আমরা মাত্র তিনজন বাঙালিবাবু, বাকি সবাই সন্দীপ নোয়াখালির লোক।

    বঙ্কু, দেবনাথের এটা নিয়ে পাঁচ-সাতবার সফর হয়ে গেছে। আমার প্রথম সফর। একঘেয়ে সমুদ্র, শুধু জল আর জল কাঁহাতক ভালো লাগে। নিজের গরজেই এনজিন সারেঙের ফোকসালে ঢুকে গেলাম। বললাম, চাচা, কোনো খবর পেলেন?

    তিনি বয়লার স্যুট পরে উপরে উঠে যাবার জন্য ব্যস্ত। সহসা কেমন ক্ষেপে গিয়ে বললেন, কত বলেছি, ভেবে দ্যাখ, ব্যাংক লাইনের সফর করবি কি না! এখন মনমরা হয়ে থাকলে চলবে কেন? বাড়িয়ালা কী বলবে? তিনি কি জানেন! এজেন্টের অফিস থেকে খবর আসবে। খবর না এলে রা খসাবে কী করে! আল্লার বান্দাও জানে না, জাহাজ কবে ফিরবে!

    বুঝতে পারছি, আমার কষ্ট তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। মনমরা দেখলে তিনি আরও ক্ষেপে যান। হয়তো জাহাজ বন্দরে নোঙর ফেলেছে, বিকেলে সেজেগুঁজে জাহাজিরা কিনারায় নেমে যাচ্ছে, আমি যাচ্ছি না, ফোকসালে নিজের ব্যাংকে শুয়ে আছি—শুনেই ক্ষেপে যেতেন। ঝড়ের বেগে ঢুকে যেতেন আমার ফোসকালে, এই ওঠ, ওঠ বলছি। বন্ধু দেবনাথের সঙ্গে কিনারে ঘুরে আয়। ভালো লাগবে।

    আমার কখনও মনে হত আর হয়তো দেশেই ফেরা হবে না। আর হয়তো কখনও আমি আমার প্রিয় বাদশাহি সড়ক ধরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হতে পারব না, কিংবা রেললাইন পার হয়ে লালদীঘির ধারে বসে সেই গাছগাছালির ফাঁকে দূরের স্টেশন দেখতে পাব না। চোখ জলে ভার হয়ে আসত।

    কত বন্দরে গেছি, কত নারীর মুখ দেখেছি, ইশারায় কেউ ঘরে নিয়ে যেতে চেয়েছে, অবলীলায় আমাদের কেউ কেউ চলে গেলেও আমি যেতে সাহস পাইনি। নারী রহস্যময়, বড়ো টানে। কিন্তু জাহাজিদের মারাত্মক ব্যাধির কথা আমার জানা হয়ে গেছে। যৌন-সংসর্গ এড়িয়ে যতটা থাকা যায়। এসব কারণে দেবনাথ কখনও ক্ষেপে যেত, বলত তুই বেটা মরবি। জাহাজের কাজ তোকে দিয়ে হবে না। একেবারে ঈশ্বরের পুত্র সেজে বসে আছিস। তুই কি মানুষ না!

    এত সব অভিযোগ সত্ত্বেও কোনও কার্নিভেলে গেছি, কোনোদিন পানাহার, এই পর্যন্ত। তার বেশি নয়। একদিন শুধু ব্রাজিলের ভিক্টোরিয়া পোর্টে বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম। জাহাজের সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে পারছিলাম না। আমাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেছিল সবাই। সারেং আমার সঙ্গে প্রায় এক মাস কথা বললেন, তুই শেষে এই! তোর মা-বাবার কথা মনে হয় না! টাকা নষ্ট করতে কষ্ট হয় না!

    না পেরে আমিও খেকিয়ে উঠেছিলাম, বেশ করেছি। আরও করব। আপনি যা পারবেন করবেন। আসলে আমি যে বাটলারের রসদের খাতাপত্র লিখে উপরি রোজগার করছি। হাতে কাঁচা টাকা থাকলে যা হয়, নতুন বাটলার, কাপ্তান-বয়ের কাজ করত, ডারবানে অসুস্থ হয়ে বাটলার চলে গেলে, কাপ্তান-বয়কেই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছিল। পার্কসার্কাসের ইব্রাহিম বাটলার হয়ে গেল। উর্দুভাষী মানুষ। সামান্য লেখাপড়া আছে। কিন্তু এ-বিদ্যায় রসদের জমাখরচের খাতা রাখা তার পক্ষে কঠিন। জাহাজিদের মধ্যে আমিই লেখাপড়া জানা, কলেজে গেছি—এত যার বিদ্যার বহর তারই শরণাপন্ন হওয়া সুবিধাজনক, সে এসে আমায় ডেকে নিয়ে গেছিল কেবিনে, কাজটাতে সাহায্য করলে সে কাপ্তানের একটা সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে। পরের সফরে সে বাটলার হয়ে জাহাজেও উঠে যেতে পারবে। আমাকে খুশি করার জন্য নিউপোর্টে নেমে নতুন কালো রঙের এক জোড়া স্যুট করিয়ে দিয়ে বলেছিল, একেবারে ইংরাজের বাচ্চা। বহুত সুন্দর এবং এমন সব বলার পর, বন্দর এলেই কাঁচা টাকা পেয়ে যেতাম। স্যুট পরে বের হয়ে বাটলার একদিন আমার সঙ্গে ছবিও তুলল। সত্যি চেনা যায় না বাঙালিবাবুকে।

    যা বলছিলাম, আসল কথাটাই বলা হল না এখনও। ডেকে সারেংই খবর দিল, জাহাজ দেশে ফিরছে না। নতুন চুক্তি হয়েছে। ওসানিকা, কাকাতিয়া আর নেরু দ্বীপগুলো থেকে খোল ভর্তি ফসফেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে ফেলতে হবে। মেলবোর্ন, ফ্রিমেন্টাল, সাউথ ওয়েলসের উপকূলে ঘোরাঘুরি করবে জাহাজ।

    ক-মাসের চুক্তি তা অবশ্য জানা গেল না।

    জাহাজিরা কেউ মনমরা, কেউ খুশি। মনমরা আমার মতো অনেকে। একসময় টাকা উপার্জন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, আবার একসময় ঘরে ফেরার জন্য পাগল হয়ে যেতে হয়। আমরা এই ঘরে ফেরার দলের জাহাজিরা সারেঙের ঘরে ঢুকে যথেচ্ছ গালাগাল করলাম। তিনি বললেন, নসিব। তাঁর কিছু করার নেই।

    আমার নিজেরই খারাপ লাগল বুড়ো মানুষটার কথা ভেবে। সাদা দাড়ি, সাদা চুল, বড়ো অমায়িক এবং ধর্মভীরু। মানুষটিকে আমি একদিনও কিনারায় নামতে দেখিনি। অবসর সময়ে ধর্মগ্রন্থ পাঠ ছাড়া তাঁর আর কিছু করণীয় আছে দেখলে বোঝা যায় না। মনকে প্রবোধ দিই সবারই পরিবার পরিজন আছে। দেশের চিঠি এলে বার বার করে পড়ে। চিঠিটা শিয়রে রেখে দেয়। যারা পড়তে পারে না, তারা পড়িয়ে নেয়।

    আমার কাছে এভাবে একই চিঠি নিয়ে কতবার যে তারা আসে।—এই পড়ে শোনাই।

    -সকালে তো পড়ে শোনালাম।

    –আবার পড়।

    —না পারব না। নতুন কী আর আছে।

    —পড় না। লক্ষ্মী ছেলে। পড় শুনি।

    ওদের মুখ দেখলে আমার কষ্ট হত। আমারও চিঠি আসে। মা চিঠি দেন, বাবা দেন সব উপদেশ, যেন নষ্ট হয়ে না যাই, আভাসে বাবা এসবই চিঠিতে লিখতে চান। কে কেমন আছে, বাড়ির কোজাগরি লক্ষ্মীপূজায় আমি নেই বলে মা নাকি চোখের জল ফেলেছে। একই চিঠি আমিও বার বার পড়তে ভালোবাসি। যেন চিঠি তো নয়, মায়ের হাতের স্পর্শ। সব চিঠিই আমার বালিশের নীচে জমা থাকে। একই চিঠি কতবার যে পড়া হয়ে গেছে-মুখস্থ হরে গেছে, তবু পড়ি। বাড়ির চিঠি হাতে নিয়ে বসে থাকি। সমুদ্রের নীল জলরাশি, কিংবা কোনো দ্বীপের একটি নিঃসঙ্গ ফার্ন গাছের চেয়ে চিঠির জাদু যে কত অধিক টের পাই, যখন কেউ জাগিয়ে দিয়ে বলে, এই ওঠ। ওয়াচে যাবি। দেখি বুকের উপর চিঠি পড়ে আছে, যেন হৃৎপিণ্ডটার উষ্ণতা নিচ্ছিল চিঠিটা।

    আমাদের দেশে ফেরা সুতরাং অনিশ্চিত। কবে ফিরব জানি না। মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছি। জাহাজ বন্দরে বাঁধাছাদা হচ্ছে। ভারি সুন্দর শহর। নীল সবুজ হলুদ রঙের কাঠের বাড়ি পাহাড়ের উপত্যকার পাহাড়ের ঠিক নীচে বিশাল জলাশয়। সমুদ্রে নুড়ি পাথর ফেলে দুটো পাড় গড়ে তোলা হয়েছে। একদিক খোলা। জাহাজ ঢুকবার পথ। ছোট্ট বন্দর। সাত আটটা জাহাজ জেটিতে বাঁধা। জেটি পার হয়ে সমুদ্রের বালিয়াড়ি। অজস্র নারী-পুরুষ প্রায় উলঙ্গ হয়ে সাঁতার কাটছে কিংবা চেয়ারে ছাতার নীচে বসে বই পড়ছে। এসব দৃশ্য চোখে সয়ে গেছে। কাজ এখন কম। বিকেল চারটে বাজলে ছুটি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ডেকে উঠে রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়ালেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাই। কিছু ভালো লাগছে না।

    কিছু তো করার নেই, নিয়মকানুনের বান্দা, লম্বা সফর হলে অনেক টাকা, যারা টাকাই জীবনে সব ভেবে নিয়েছে, তারা খুশি। অবশ্য বেচারাদেরও দোষ নেই, তারা তো চায় লম্বা সফরে বেশি টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতে। অসুবিধা আমাদের মতো জাহাজিদের, কিংবা সদ্য বিয়ে করে আসা জাহাজিদের। দু-চার বছর হয়ে গেলেও কষ্ট—কিন্তু একটা সময়ে অনেকেই লম্বা সফর পছন্দ করে। আমাদের মতো বাড়িঘরের টানে কাহিল না। ফলে বিক্ষোভ আংশিক।

    তবু রক্ষে এই বন্দর এবং শহরে গাছপালা আছে। বিকেল হলেই যেমন সেজেগুঁজে নেমে যাওয়া তেমনি সাজগোজের পালা চলছে। আফটার-পিকে বাথরুম। স্নানের হুড়োহুড়ি। তেল কালি বার্নিশের কাজ এখন বেশি। মাত্র একটা বয়লার চালু রাখা হয়েছে। একজন করে ফায়ারম্যান ওয়াচে। আর সবার সাফ সুতরোর কাজ। কাজ সেরেই সবাই যে যার গরম জল নিয়ে ছুটছে বাথরুমে। ঝেড়ো শীতের হাওয়ায় মাস্তুলের দড়িদড়া ঠিক রাখা যাচ্ছে না।

    আমরা নেমে গেলাম।

    আমি দেবনাথ বন্ধু।

    জেটি পার হয়ে ডানদিকে সি-ম্যান মিশন। ওখানে ঢুকে সস্তায় দু-মগ বিয়ার খাওয়া গেল প্রথমে। আসলে শীতের ঠান্ডা থেকে আত্মরক্ষা করা। আমাদের ওই হয়েছে ঝামেলা—এখন এ-দেশে গ্রীষ্মকাল, অথচ গ্রীষ্মের শীতেই কাবু, শীতকালটা তবে কি ভয়াবহ, অবশ্য বরফের শীতও আমরা পেয়ে এসেছি, হামবুর্গ বন্দরে। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা বরফ, তার উপর দিয়ে হেঁটে যাও, ইচ্ছে করলে সাইকেল, চালিয়েও যাওয়া যায়—লেদার জ্যাকেট ওভারকোট থেকে শুরু করে হাতে সাদা দস্তানা পরে বরফের উপর দিয়ে হেঁটে যাবার মজাই আলাদা।

    সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে এখন মজা পাই না। বিকেলে হয়তো বেরই হতাম না—কিন্তু বন্ধু দেবনাথ এমন সব সুন্দর বাড়িঘরের কথা বলল যে, আর চুপচাপ শুয়ে থাকা গেল না। মাউরি মেয়ে-পুরুষরা একেবারে বাঙালিদের মতো দেখতে। দেখলে নাকি ভুল হবার কথা, ভুলে বাংলায় কথাও বলে ফেলতে পারি। গাউন স্কার্ট না পরলে শাড়ি পরলে বাঙালি ললনা। লম্বা চুল, বেণী বাঁধে। এসব শোনার পর ঠিক থাকি কী করে! মাউরি উপজাতিরাই এই দ্বীপের আদি বাসিন্দা। বড়ো গরিব। যা হয়ে থাকে সব দেশেই। পুরুষরাও একসময় লম্বা চুল রাখত, এখন রাখে না, তারা সাধারণত ফলের বাগান পাহারা দেয়, অথবা খামারবাড়ি আগলায়, চাষ আবাদ দেখে। দোকানে কেউ কাজ করে। অবশ্য পয়সাওয়ালা লোকও আছে। তবে শহরে বিশেষ তাদের দেখা যায় না।

    বন্দরের মুখেই ট্রাম পেয়ে গেলাম। ছোট্ট পাহাড়ি শহর। এক বগগা ট্রামে চড়ে পাহাড়ের চড়াই-উত্রাই ভাঙার সময় দেখলাম, সুন্দরী বালিকা কিংবা যুবতীরা হেঁটে যাচ্ছে। ট্রামেও আছে তারা। আমরা জাহাজি, তারা ঠিক চিনতে পারে। শহরে কোথায় কী আছে দেখবার, এরা ঠিক বলে দেয়। তবে বন্ধু দেবনাথ আগের এক সফরে এখানটায় এসেছিল বলে সব জানে—আমাদের শুধু ঘোরা, দোকানে ঢুকে এর ওর সঙ্গে আলাপ করা, আসলে নারীসঙ্গ, কারণ কাউন্টারে সুন্দর সব মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খদ্দের ধরার জন্য। আমরা কী কিনব নিজেরাও ঠিক বুঝতে পারি না। এখানকার বিখ্যাত গির্জা দেখতে যাওয়া যায়, কিংবা উপত্যকা পার হয়ে কোনো আপেলের বাগানে ঢুকে গেলে ঝরা পাতার খেলা দেখা যেতে পারে।

    ঠিকই বলেছে ওরা, মাউরি মেয়ে দেখলেই চেনা যায়। শ্যামলা রং, মুখের গড়ন ভারি কোমল, চোখ টানা। শহরের একদিকটায় মার্কেট। দু-তিন ফার্লংয়ের মতো পথ আমরা হেঁটে এসেছি ট্রাম থেকে নেমে। বাসে ওঠা যায়, কিন্তু বাসে উঠলে দু পাশের বাড়িঘরের ঠিক উত্তাপ পাওয়া যায় না। বাড়ির লাগোয়া বাগান, লাল সাদা গোলাপের ঝড় বয়ে যাচ্ছে যেন বাগানে, ক্ষণিকের জন্য আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা, বড়ো ঝকঝকে লাল নীল কাঠের পাটাতন করা বাড়ি। দালান কোঠা আছে, তবে কম। বাড়িগুলির পেছনে কমবেশি সবারই পাইনের অরণ্য। অনেকটা জায়গা নিয়ে বাড়িঘর। বোঝাই যায়, লোকজন কম। জমির ফলন ভালো, এ-দেশ থেকে রপ্তানি করার জন্য ফলের চাষ, গমের চাষ আর পাল পাল ভেড়া উপত্যকায় ছড়ানো ছিটানো। এক উদার পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলে যা হয়—আমরা একটা বড়ো টিলার উপরে উঠে এসে পেছনে অনেক দূরে এগমন্ট হিল দেখতে পেলাম। সৰ্যাস্ত। হচ্ছে। পাহাড়ের মাথায় যেন অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। লাল হয়ে গেছে উপরের আকাশ। অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলাম—পাখিরা উড়ে যাচ্ছে দূরে অদূরে—আকাশে এক বিন্দু মেঘ নেই—যেন এই শহরে যদি কোনো আলোর ব্যবস্থা না থাকত এগমন্ট হিলের সোনালি রংই যথেষ্ট। এমন দৃশ্য দেখে মুহ্যমান হয়ে পারা যায় না, চুপচাপ নেমে এসেছিলাম টিলা থেকে—এবং শহরে আলো জ্বলে উঠেছে, কী করে যে চোখ গেল সেই যুবতীর দিকে জানি না, যুবতী না বালিকা, কত যেন চেনা আমার নেশা ধরে গেল। ফলের কাউন্টারে সে দাঁড়িয়ে। ঢুকতেই মিষ্টি হাসল মেয়েটি। এমন হাসি দেখতে পেলে সারাদিন কেন, সারা জীবন মেয়েটির পাশে বসে থাকা চলে।

    বললাম কত দাম?

    মেয়েটি ফ্রক সামান্য তুলে বাউ করল। দাম বলল। খোঁপায় ফুল গোঁজা। সোনালি ফ্রক গায়। আমি যেন চিনি তারে—এই কি সেই মেয়ে, সে নীলনদের পাড় ধরে হেঁটে যায় কিংবা মিসিসিপির বনেজঙ্গলে সে কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকে— অথবা শীতলক্ষ্যার পাড়ে আম জাম গাছের ছায়ায় বড়ো হয়। মুগ্ধ চোখ তার পৃথিবীর রহস্য বয়ে বেড়ায়।

    কী হল কে জানে! এক ঠোঙা আপেল কিনে পয়সা দিলাম।

    মেয়েটি আমায় বাউ করল, ঠোঙাটা হাতে দিয়ে মিষ্টি হাসল। যেন বলল আবার এস।

    বন্ধু বলল, তুই কি পাগল, এগুলো কিনলি কেন? কে খাবে?

    বের হবার সময় পেছন কিরে তাকালাম–ঠোঁটে সেই রহস্যময় হাসি। আমাকে দেখছে। একেই মরণ বলে কী না জানি না।

    পরদিন একা বের হচ্ছি দেখে, সারেঙ সাব বললেন, কোথায় যাবি?

    বললাম, চার্চে।

    চার্চ।

    দেবনাথ পাশ থেকে বলল, মিছে কথা বলতে মুখে আটকায় না। তুই ঠিক সেই মেয়েটার কাছে যাচ্ছিস।

    সুবোধ বালকের মতো বললাম, না চাচা! আমি গির্জা দেখতে যাচ্ছি।

    এই শহরের প্রেসবেটেরিয়ান চার্চের খ্যাতি আছে। দেয়ালে নিপুণ কারুকাজ, বিশাল এলাকা নিয়ে চার্চ। পাইনের জঙ্গলে সহজে সেখানে হারিয়ে যাওয়া যায়। তবে এ-পাইন সে পাইন নয়। কৌরি-পাইন। বিশাল তার কাণ্ড, ডালপালা আকাশ ছুঁয়ে দিতে চায়।

    গির্জা আমি দেখতে যেতেই পারি, কিন্তু একা বের হচ্ছি দেখেই সারেভ সাব প্রমাদ গুনলেন।

    প্রশ্ন করলেন তিনি, বন্ধু দেবনাথ যাবে না?

    দেবনাথ বলল, না, আমাদের সঙ্গে বের হবেন না তিনি।

    আমি দেরি করতে পারছি না। পরে কী কথা হয়েছে জানি না। ঠিক সাঁজ লাগার মুখে দোকানের সামনে হাজির। মেয়েটি খদ্দের সামলাচ্ছিল। আমাকে দেখতে পায়নি। ভিতরে ঢুকলে, আবার সেই মিষ্টি হাসি। এ-যেন সেই আমাদের রাজকুমারীর গল্প, হাসলে মুক্তা ঝরে, কাঁদলে হিরে।

    সে যে ব্যস্ত এটুকু বোঝানোর জন্য কাউন্টারের পাশের একটা চেয়ারে বসতে বলল। ও কি টের পেয়েছে, অকারণ আমি গণ্ডা দুয়েক আপেল কিনে নিয়ে গেছি। ও কি আজ বলবে, তুমি তো আপেল কিনতে চাওনি, আমাকে খুশি করার জন্য আপেল বাধ্য হয়ে কিনেছ! অমন খদ্দের আমি চাই না। বলতে গেলে কেমন একটা অজানা আতঙ্কে ডুবে গেলাম—আমাদের দেশে দোকানে কোনো নারী কিছু বিক্রি করছে ভাবতেই পারি না। কেনার জন্য না, তাকে দেখার জন্য যাই-বুঝতে পারলে খুব ছোটো হয়ে যাব।

    মুখ ব্যাজার আমার। এভাবে একা সত্যি আসা ঠিক হয়নি। অপরিচিত জায়গা, কার মনে কী আছে কে জানে! এখন মানে মানে চলে যেতে পারলে বাঁচি।

    আমার দিকে সে তাকাচ্ছে না। খদ্দের সামলাচ্ছে। এ-সময়টায় ভিড় বোধ হয় বেশি হয়। আগে আগে চলে এসেছি। চেয়ারে বসে অস্বস্তি হচ্ছিল।

    বললাম, আমারটা দাও।

    সে হাসল। বলল, বোস।

    আবার বসে থাকা। আমি যে আপেল কিনতেই এতদূর এসেছি, তাকে দেখতে নয়, এটা যেন প্রমাণ না করতে পারলে ইজ্জত থাকবে না। এত সস্তা যদি ভাবে তবে মানুষের অহংকারে ঘা লাগে।

    উঠে দাঁড়ালাম। ঘড়ি দেখলাম, যেন আমার তাড়া আছে। ওকে বেশ গম্ভীর মুখে বললাম, আমি কি খদ্দের না! সবাইকে দিচ্ছ, আমাকে বসিয়ে রাখছ?

    মেয়েটির মুখে সেই হাসি। একটু হালকা হয়ে কাউন্টারে ঝুঁকে বলল, তুমি জাহাজি, ইণ্ডিয়ান।

    অবাক, এত জানে কী করে?

    বললাম, হ্যাঁ।

    —দেখেই বুঝেছি। না হলে এতদূর কেউ আপেল কিনতে আসে।

    আমি কী কাল ওর সঙ্গে কোনো নির্লজ্জ আচরণ করেছি। ইণ্ডিয়ানদের সম্পর্কে কি ওর কোনো ভালো ধারণা নেই। কিন্তু তেমন আচরণ তো করিনি। অথবা আমার মুগ্ধতা থেকে কি টের পেয়েছে, আমি যতদিন এ-বন্দরে আছি, একবার অন্তত তার দোকানে ফল কেনার ছলে তাকে দেখতে আসবই।

    দোকানটা যে তার নয় পরে জেনেছিলাম। সে কাজ করে। মালিক রাতের দিকে এসে সব হিসাব মিলিয়ে ক্যাশ গুনে নিয়ে যায়। তার বাঁধা মাইনের কাজ। তার দাদু আছে। শহর থেকে এগমন্ট হিলের দিকে যে বড়ো সড়ক চলে গেছে, দু-পাশে চড়াই উত্রাই ভেঙে, তারই কোনো টিলায় সে থাকে।

    সেদিন ওকে আমি পাত্তা দিতে চাইনি। আপেল কিনে বের হয়ে আসছিলাম, সে আমাকে ফের ডাকল। ফিরে গেলে বলল, আপেল কেনার জন্য এতদূরে আসার তোমার দরকার নেই। পোর্টের কাছে ওয়াগাদের অনেক বড়ো ফলের দোকান আছে। ট্রাম গুমটির ঠিক পাশে। সস্তায় আপেল পাবে। তোমার টাকার দরকার। অযথা এতদূর এসে সামান্য ফলের জন্য টাকা নষ্ট করবে কেন? যাওয়া আসার ভাড়াতে তোমার ফল কেনা হয়ে যাবে।

    মেয়েটির এই ঔদ্ধত্যে আমি হতবাক। যেন সোজাসুজি বুঝিয়ে দিতে চাইল, আর আসবে না।

    মুখ ব্যাজার করে ফের বের হয়ে আসতেই আবার ডাকল, কি খারাপ পেলে? আমি মাউরি নই। ইন্ডিয়ান। আমার নাম লতা বুচার। তোমরা ঠকলে কষ্ট হয়।

    নামটা আদ্ভুত।

    লতা বাংলা নাম। বুচার! বুচার কি পদবি।

    বললাম, তোমরা বুচার। কসাই।

    মেয়েটি হেসে বলল, না কসাই নই। বুচার আমার দাদুর বাবা খ্রিস্টান হবার সময় পদবি নিয়েছিলেন। আমার দাদু ওয়াগাদের আপেল বাগান পাহারা দেয়। বুড়ো হয়ে গেছে বলে সাঁজবেলাতেই ঘরে ফিরে যায়। ওয়াগা কোম্পানির বিশ্বাসী লোক। আমার দাদু ঠকেছে সারাজীবন, আমার বাবা মা ঠকেছে। আমার ঠাকুরদার বাবা এদেশে বিয়ে করে থেকে যান। তিনি জাহাজি ছিলেন। তিনিও ঠকেছেন। মনে হয় তিনি না এলে আমি ইন্ডিয়ার লোক হতে পারতাম। আমার ভালো লাগে না, কাজটা ছেড়ে দেব।

    এত সব শোনার ধৈর্য আমার ছিল না। তবু দাঁড়িয়ে সব শোনার পর বললাম, ধন্যবাদ। আর আসছি না। আমি জান গির্জা দেখতে বের হয়েছিলাম, এখন দেখছি গির্জায় সহজে কেউ যেতে পারে না, ইচ্ছে থাকলেও না। আমার মোহ ভেঙে দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    -গির্জা।

    –কাল সারারাত গির্জায় স্বপ্ন দেখেছি। তারপর কেন যে মুখ ফসকে বের হয়ে গেল, গির্জায় সিঁড়িতে তুমি আমি সারাক্ষণ বসেছিলাম স্বপ্নে। বিকেলে বের হয়ে পড়েছিলাম, আবার যদি সিঁড়িতে বসার সুযোগ পাই।

    লতা বুচার আমার কথায় কী ভাবল কে জানে। সামান্য সময়, দূরে কী দেখল। তারপর বলল, তুমি এমনি আসতে পার। এলেই ফল কিনতে হবে কেন? ফল কেনার জন্য যদি আস তবে বোকামি করবে।

    মেয়েরা এত সহজে এমন কথা বলতে পারে আগে জানতাম না। তার অকপট কথাবার্তায় আমার টান আরও বেড়ে গেল। সে কী বোঝাতে চাইল জানি না, একবার ভাবলাম জাহাজে ফিরে বন্ধু দেবনাথকে সব বলব—এ কথা বলল কেন! এমনি আসতে পার। ফল কেনার জন্য যদি আস তবে ঠকবে।

    কেন যে বলতে গেলাম, তুমি কাউকে ভালোবাস? এও যেন মুখ ফসকেই বের হয়ে গেল। এত কথা মেয়েদের সঙ্গে বলার আমার অভ্যাস নেই। দেশে এই বয়সের কোনো অনাত্মীয়া নারীকে এমন বলতে পারি দূরে থাক, কথা বলতে গেলেই বুক কাঁপত। কে কী ভাববে! আমায় কো-এডুকেশন কলেজে ছাত্রীদের আগলাতেন অধ্যাপকরা।

    লতার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হবার পর, আমায় কলেজ জীবনের কথা শুনে সে হেসে লুটিয়ে পড়ছিল!—বল কী! মেয়েদের জন্য আলাদা কমন রুম! অধ্যাপকদের পেছনে তারা আসে। ক্লাস হয়ে গেলে অধ্যাপকদের পেছন পেছন আবার চলে যায়। ভাবা যায় না।

    আমি বললাম, সত্যি।

    ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে আমাদের কলেজ জীবনের কথা ভাবলে এখন আমারও হাসি পায়। লতার কথা ভাবলে মন আমার এখনও খারাপ হয়ে ওঠে। কী সুন্দর মেয়েটা, শেষে কী না…

    লতা সেদিন বলেছিল, কাউকে ভালোবাসি না। কাউকে না। ওর চোখ মুখ কেমন জ্বলছিল ক্ষোভে অপমানে। লতা আর আমার সঙ্গে একটি কথা ও বলেনি। সে তার কাজ করে যাচ্ছিল। পালকের ঝাড়ন দিয়ে থাক থাক ধুলো বালি ঝাড়ছিল। ঝুড়ি থেকে বের করে আপেলগুলো নেকড়া দিয়ে মুছে সাজিয়ে রাখছিল। আমি বলেছিলাম, উঠি।

    সে বলেছিল, কাল আসছ?

    –বলতে পারব না।

    চলে আসছিলাম। সে ফেল ডাকল—শোনো।

    আমি ফিরে গেলে বলল, গির্জার সিঁড়িতে বসে থাকব দুজনে। এখানেই অপেক্ষা করব। দোকান বন্ধ থাকবে কাল। এলে এমনিতেই পেতে না।

    কাল আমারও ছুটি। কাল রবিবার। সবার ছুটি। লতা বুচারেরও। আমি কেন জানি সিঁড়িতে বসার লোভ সামলাতে পারলাম না।

    পরদিন গেলে দেখলাম সে আমার জন্য সত্যি অপেক্ষা করছে। সে আমাকে নিয়ে হেঁটে গেল। গির্জার সিঁড়িতে বসে থাকল। তার দাদুর গল্প, মা-বাবার গল্প করল। মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। কাজটা না করলে, সে আর তার বুড়ো দাদু খুব অসহায়, খেতে পাবে না, আশ্রয় থাকবে না এমন সব বললে, টান আরও বেড়ে

    জাহাজ আমাদের বিশ বাইশ দিন বন্দরে এমনিতেই থাকার কথা, কিন্তু ধর্মঘটের জন্য, কবে মাল খালাস শুরু হবে কেউ বলতে পারছে না।

    কবে জাহাজ ছাড়ছে জানা নেই।

    বিকেল হলেই আমার মন উতলা হয়ে উঠত। দোকানে গিয়ে বসে থাকতাম। সে খদ্দের সামলাত। আমি নিজেও তার হয়ে অনেক কাজ করে দিতাম। টাকা পয়সা গুনে দেওয়া পর্যন্ত। সে তার টিফিন বের করে খেতে দিত। না খেলে রাগ করত। কোনোদিন সে একটা আপেল দিয়ে বলত, খাও। জাহাজ তোমার কবে ছাড়ছে?

    বলতাম, জানি না। সে টের পেত জাহাজের খবরে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছি। বাড়ি না থাকায় আমার মা কোজাগরি লক্ষ্মীপূজায় চোখের জল ফেলেছে মন থেকে কেমন সব মুছে গেছে। এক অনাত্মীয়া এমন নিজের হয়ে যায়, এই প্রথম টের পেলাম।

    এক রবিবারে সে আমাকে তাদের ট্যুরিস্ট স্পটে নিয়ে গেল। বিশাল বনভূমি, হ্রদ, পাহাড় টিলা, ঝোপ-জঙ্গল এবং এমন গভীর জঙ্গলের ভিতর কেন ঢুকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমি কেমন কাতর হয়ে পড়ছি। বলছি, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

    সে শুধু বলল, এস না!

    সে কি আমাকে আজ জীবনের আরও কোনো গভীর বনভূমির খবর দিতে চায়। ও পরেছে, নরম উলের জ্যাকেট, পায়ে সাদা জুতো, নাইলনের মোজা, পায়ের রঙের সঙ্গে মিলে গেছে। হাত পা এত পুষ্ট, স্তন এত ভারী যে সে নড়চড়া করলে তারাও লাফিয়ে ওঠে। আমার মধ্যে এক অতর্কিত বাঘের আক্রমণ ঘটছে টের পেলাম। সে আমাকে নিয়ে পাশে বসল। জনহীন। দূরে কোনো পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। বিশাল গাছ সব চারপাশে। টিলার ছাদে উঠে এসে আমি হাপাচ্ছিলাম। ছোট্ট সবুজ উপত্যকা। সে আমার হাত টেনে শরীরের উষ্ণতা দেখল। ফ্লাকস থেকে কফি, ব্যাগ থেকে স্যাণ্ডউইচ, কিছু গ্রিন পিজ সেদ্ধ, চিজ এ-সব বের করে খেতে দিল—কিন্তু আমি টের পাচ্ছিলাম, তার শরীর আমাকে প্রলুব্ধ করছে। অতর্কিতে বাঘের আক্রমণ ঘটলে যা হয়ে থাকে, হঠাৎ সে আমার চোখে কী আবিষ্কার করে সব ফেলে দৌড়োতে থাকল।

    আমি ডাকছি, সব ফেলে চলে যাচ্ছ কেন?

    সে নেমে যাচ্ছে। বাঘের মতো আমাকে যেন ভয় পাচ্ছে।

    আবার চিৎকার করে ডাকলাম, তুমি আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছ কেন? ফ্লাকস, ব্যাগ তুলে নিয়ে পিছনে ছুটছি। ওর কি মাথা খারাপ আছে! এ কিরে বাবা, নিয়ে এল আর এখন কিনা আমাকে ফেলে, ফ্লাকস ব্যাগ সব ফেলে ছুটছে।

    আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলতে পারি। ভয় ধরে গেল। ডাকলাম, ল…তা…আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেলে। ল…তা…।

    কোনো সাড়া পেলাম না।

    আমি যেন আরও গভীর বনভূমিতে ঢুকে যাচ্ছি। ওকে আর দেখা যাচ্ছে না!

    আর পারলাম না, চিৎকার করে বললাম রাস্তা হারিয়েছি।

    আর তখন দেখি নীচে, অনেক নীচে, হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে সে হাত তুলে দিচ্ছে।

    ক্ষোভে অভিমানে নীচে নেমে ওর সঙ্গে আর একটা কথাও বললাম না। ব্যাগ ফ্লাকস দিয়ে সোজা এসে বাসে ওঠে পড়লাম। চেয়ে দেখি, সেও কখন আমার পাশে এসে বসে পড়েছে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।

    –কী হল!

    লতা কিছু বলল না।

    জাহাজে ফিরে সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। এমন বিচিত্র মেয়ে কে কবে কোথায় দেখেছে। তার গির্জায় বসে থাকা, আমার সংলগ্ন হয়ে বসে থাকার মধ্যে এক আশ্চর্য নরম উষ্ণতা যে টের পেত, সে কেন আমাকে এত ভয় পেয়ে নীচে নেমে গেল!

    আমার আর যাওয়া ঠিক কিনা ভেবে জাহাজ থেকে কদিন নেমে গেলাম না। এক রবিবারে দেখি লতা নিজেই হাজির। যে ফিরিয়ে দেয়, সে ভয় পায়, সে যদি যেচে আবার নিজেই চলে আসে ঠিক থাকি কী করে? আগের মতোই নিয়মিত আবার যাওয়া আসা। বন্ধু দেবনাথের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। অনেক দিন আমরা একসঙ্গে ওর দোকানে গেছি। সে বাড়ি থেকে আমাদের জন্য কোনোদিন নিজের হাতে রান্না করা খাবার উপহার দিত। খেতে যে খুব ভালো লাগত তা না, তবু নিতাম এবং তৃপ্তি করে খেতাম। কোনোদিন জাহাজে টিফিন ক্যারিয়ারে নিয়ে আসতে হত খাবার। পরদিন বিকালে ফিরিয়ে দিতাম। রাতও হয়ে যেত।

    এমনি একদিন টিফিন ক্যারিয়ার ফিরিয়ে দিতে গিয়ে টের পেলাম—বেশ রাত হয়ে গেছে। আটটায় দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। দেবনাথ বন্ধুর রাতে ওয়াচ আছে। পাহাড়ের নীচে বসে লতাকে নিয়ে গল্প জমে উঠেছিল। একবার ওর বাড়ি যাওয়া দরকার। কোথায় থাকে এটাই জানা হয়নি। আমার অভিজ্ঞতার কথাও বললাম। ওদের এক কথা, পাগলি!

    এমন কথায় আমি যে কষ্ট পাই ওরা বোঝে। ওকে ছোটো করলে যেন আমাকে ছোটো করা হয়—এই ধরনের নানা কথাবার্তায় রাত হয়ে গেলে, ওরা বলেছিল, তুই দিয়ে আয়। আমরা জাহাজে ফিরছি। ঘড়ি দেখে বলল, ইস, দেরি হয়ে গেল।

    গিয়ে দোকান বন্ধ দেখব বুঝতে পারিনি। কিন্তু ভিতরে আলো জ্বলছে! আলো জ্বলায় নিশ্চিত হলাম। দরজার বেল টিপলে, কিংবা ঠেলে দিলে তাকে দেখতে পাব। ভেবে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে মনে হল ধস্তাধস্তি হচ্ছে। ফলের ঝুড়ি ছিটকে পড়ছে। ওর গলা পেলাম। সে স্তিমিত গলায় আর্তনাদ করে উঠছে, ছেড়ে দাও। পারছি না। লাগছে! মা মেরির দোহাই।

    আর পারলাম না। লতাকে কি কেউ মারধোর করেছে। ধস্তাধস্তি কেন!

    দরজা ঠেলে দিতেই ঘরটা হাঁ হয়ে গেল। উত্তেজনায় মাথায় কিছু ঠিক থাকে না। দরজা লক করতে ভুলে গেছে। দোকান বন্ধ থাকলে দরজা ঠেলে কারও ঢোকার নিয়ম থাকে না। দেখছি লতার উপর একটা বিশাল লোক ফলের কাউন্টারের প্ল্যাটফরমে বাঘের মতো হামলে পড়েছে। লতা দু-হাতে বাধা দিচ্ছে। ওর শরীরের বেশবাস আলগা।

    এত উন্মত্ত যে, একটা লোক ভিতরে ঢুকে গেছে তাও টের পায়নি। লতা শুধু আমাকে দেখে ফেলেছে।

    আমি সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে এলাম। দৌড়ালাম। হা

    ত-পা কাঁপছে। কসাই লোকটা! লতার মালিক লোকাটা। লতাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল একদিন। আমি সেদিন রাতে জাহাজে ফিরতে পারিনি। গির্জার সিঁড়িতে শুয়ে আকাশ পাতাল ভেবেছি। এক অনাত্মীয়া নারীর জন্য চোখে এত জল আসে আগে জানতাম না। শীতে আমি জমে যাচ্ছিলাম। তবু মানুষের এক পাপ আমাকে তাড়া করছে। সকালে জাহাজে ফিরলে সবাই অবাক। সারেঙ সাব বললে, তুইও নষ্ট হয়ে গেলি!

    বললাম, হ্যাঁ চাচা। জাহাজে কাজ করলে কে কবে নষ্ট চরিত্রের হয়নি বলুন! নষ্ট হয়েছি বেশ করেছি। বেশ করেছি।

    বিকালে দোকানে গেছিলাম। মালিক লোকটি আজ নিজেই খদ্দের সামলাচ্ছে। মুখে অমায়িক হাসি।আসুন।

    শালা খচ্চর। বললাম, লতা আসেনি?

    -না।

    পরে প্রতিদিন বিকেলে গেছি।–লতা আসেনি?

    -না।

    একদিন লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, আর আসবে না। না বলে কয়ে কোথায় সে চলে গেল। পুলিশে ডাইরি করেছি। টাকা তছরুপের।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনানা রসের ৬টি উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article ৩০০ বছরের কলকাতা : পটভূমি ও ইতিকথা – ডঃ অতুল সুর

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }