Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অথৈজল – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প181 Mins Read0

    ২. পরদিন মঙ্গলগঞ্জে যাবার দিন নয়

    পরদিন মঙ্গলগঞ্জে যাবার দিন নয়।

    সুরবালা বললে—ওগো আজ ও পাড়ার অজিত ঠাকুরপোর মেয়েকে দেখতে আসবে। তোমাকে সেখানে থাকতে বলেচে।

    আমি বললাম—আজ আমার থাকা হবে না।

    —কেন, আজ আবার সেখানে? শক্ত রোগী আছে বুঝি?

    —না, ওদের বারোয়ারি লেগেচে। আমি না থাকলে চলবে না।

    মনে মনে কিন্তু বুঝলাম, কথাটা খাঁটি সত্যি নয়। আমার সেখানে না থাকলে খুব চলবে। ওদের আছে প্রেসিডেন্ট রামহরি সরকার, ক্লাইভ স্ট্রীটের রঙের দোকানের মালিক গোবিন্দ দাঁ, কলাধরপুরের প্রহ্লাদ সাধুখাঁ, কুঁদিপুরের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ চৌধুরী, আরও অনেকে। আমাকে ওরা যেতেও বলে নি।

    এই বোধ হয় জেনে শুনে প্রথম মিথ্যা কথা বললাম সুরবালাকে।

    আমায় যেতে হবে কেন তা নিজেও ভালো জানি নে।

    মনে মনে ভাবলাম—নাচ জিনিসটা তো খারাপ নয়। ওটা সবাই মিলে খারাপ করেচে। দেখে আসি না, এতে দোষটা আর কি আছে? সকালে সকালে চলে আসবো।

    দীনু বাড়ুই আজও জিজ্ঞাসা করলে—বাবু, রুগী দেখতে চললেন বুঝি?

    ওর প্রশ্নে আজ যেন বিরক্ত হয়ে উঠি। যেখানেই যাই না কেন তোর তাতে কি রে বাপু? তোকে কৈফিয়ৎ দিয়ে যেতে হবে নাকি? মুখে অবিশ্যি কিছু বললাম না।

    মাঝিকে বললাম—একটু তাড়াতাড়ি বাইতে কি হচ্চে তোর? ওদিকে আসর যে হয়ে গেল—

    খেমটার প্রথম আসরেই আমি একেবারে সামনে গিয়ে বসলাম। আবদুল হামিদ আজও আমার পাশে বসেছে। অন্যান্য সব বিশিষ্ট এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যারা কাল উপস্থিত ছিল, আজও তারা সবাই রয়েচে, যেমন, প্রহ্লাদ সাধুখাঁ, ওর ভাই নরহরি সাধুখাঁ, গোবিন্দ দাঁ, ইত্যাদি। আমি যেতেই সবাই কলরব করে উঠল—আসুন, ডাক্তারবাবু, আসুন।

    আবার সেই অল্পবয়সী মেয়েটি ঘুরে ঘুরে আমার সামনে এসে হাজির হতেই আমি দু’টি টাকা প্যালা দিয়ে দিলাম সকলের আগে। পকেট ভরে আজ টাকা নিয়ে এসেছি প্যালা দেওয়ার জন্যে। আবদুল হামিদ যে আমার নাকের সামনে রুমাল ঘুরিয়ে প্যালা দেবে, তা আমার সহ্য হবে না।

    কিন্তু সত্যিই কি তাই?

    আবদুল হামিদের চোখে বড় হবার জন্যেই কি পকেট পুরে টাকা এনেছি প্যালা দেবার জন্যে?

    নিজের কাছেই নিজের মনোভাব খুব স্পষ্ট নয়।

    আবদুল হামিদ আমার দেখাদেখি দু’টাকা প্যালা দিলে।

    আমার চোখ তখন কোনো দিকে ছিল না। আমি এক দৃষ্টে সেই অল্পবয়সী মেয়েটিকে দেখচি। কি অপূর্ব ওর মুখশ্রী। টানা টানা ডাগর চোখ দুটিতে যেন কিসের স্বপ্ন মাখা। ওর সারা দেহে কি হাড় নেই? এমন লীলায়িত ভঙ্গিতে দেহ-লতায় হিল্লোল তুলেচে তবে কি করে? নারীদেহ এমন সুন্দরও হয়!

    মেয়েটি আমার দিকে আবার এগিয়ে আসচে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে। কিন্তু ওর মুখে চোখে বেপরোয়া ভাব নেই, ব্রীড়া ও কুণ্ঠায় চোখের পাতা দুটি যেন আমার দিকে এগিয়ে আসার অর্ধপথেই নিমীলিত হয়ে আসচে। সে কি অবর্ণনীয় ভঙ্গি!

    আর গান?

    সে গানের তুলনা হয় না। কিন্নরকণ্ঠ বলে একটা কথা শোনাই ছিল, কখনো জানতাম না সে কি জিনিস। আজ ওর গলা শুনে মনে হল, এই হল সেই জিনিস। এ যদি কিন্নরকণ্ঠী না হয়, তবে কার প্রতি ও বিশেষণ সুষ্ঠুভাবে প্রযুক্ত হবে?

    আবদুল হামিদ এতক্ষণ কি বলেচে আমি শুনতে পাই নি। সে এবার আমার পা ঠেলতেই আমি যেন অনেকটা চমকে উঠলাম। দুপাটি দাঁত বের করে আমার সামনে একটা সিগারেট ধরে সে বলচে—শুনতে পান না যে ডাক্তারবাবু! নিন—

    আমার লজ্জা হল। কি ভেবে আবদুল হামিদ একথা বলচে কি জানি। ও কি বুঝতে পেরেচে যে আমি ওই মেয়েটিকে এক দৃষ্টে চেয়ে দেখচি? বোধ হয় পারে নি। কত লোকই তো দেখচে, আমার কি দোষ?

    গোবিন্দ দাঁ বললে—একবার কলকাতায় গেলে আমার দোকানে পায়ের ধুলো দেবেন।

    —হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কেন যাবো না?

    —আমড়াতলা গলির রায়চৌধুরীদের দেখেচেন?

    —না।

    —মস্ত বাড়ি আমড়াতলা লেনের মুখেই। টাকায় ছাতা পড়ে যাচ্চে, যাকে বলে বড়লোক—

    —ও!

    —সেবার আমাকে অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন করলে। তা ভাবলাম, অত বড়লোক, কি দিয়ে মুখ দেখি? একটা সোনার কাজললতা গড়িয়ে নিলাম রাধাবাজারে কুণ্ডু কোম্পানীর দোকান থেকে। আর খাওয়ানো কি! এ সব পাড়াগাঁয়ে শুধু কচুঘেঁচু খেয়ে মরে। দেখে আসুক গিয়ে কলকাতায় বড়লোকের বাড়ি—

    —ঠিক তো।

    আবদুল হামিদ এতক্ষণ নিজের কথা বলতে পায় নি। এবার সে ফাঁক বুঝে বললে—তা ঠিক, দাঁ মশায় যা বলেচেন। সেবার আমার ইউনিয়নের সাতটা টিউবওয়েল বসাবো। বড়বাবু নিজে থেকে টিউবওয়েলের স্যাঙ্কসন করিয়ে দিলেন। গ্যালাম নিজে কলকেতায়। বলি, নিজে নিয়ে এলে দুপয়সা সস্তা হবে। নিজের ইউনিয়নের কাজ নিজের বাড়ির মতো দেখতে হবে। নইলে এত ভোট এবার আমাদের দেবে কেন? সবাই বলে, চৌধুরী সাহেব আমাদের বাপ-মা। তারপর হল কি—

    রামহরি সরকার বড় অসহিষ্ণুভাবে বললে, ভোটের কথা যদি উঠালেন, চৌধুরী সাহেব, এবার দু নম্বর ইউনিয়ন থেকে আমার ভোট যা হয়েচে—ফলেয়ার হারান তরফদার দাঁড়িয়েছিল কি-না—ফলেয়ার যত ভোট সব তার—তা ভাবলাম, এবার আর হল না বুঝি। কিন্তু গাজিপুর, মঙ্গলগঞ্জ, আর নেউলে-বিষ্ণুপুর এই ক’খানা গাঁয়ের একজন লোকও ভোট দিয়েছিল হারান তরফদারকে?

    গোবিন্দ দাঁ’র ভালো লাগছিল না। কি পাড়াগাঁয়ের ভোটাভুটির কাণ্ড সে এখানে বসে শুনবে? ছোঃ, কলকাতায় কর্পোরেশনের কোনো ধারণাই নেই এদের!

    সেবার—। গোবিন্দ দাঁ গল্পটা ফেঁদেছিল সবে, এমন সময় সেই অল্পবয়সী নর্তকীটি ঘুরতে ঘুরতে আবার আমাদের কাছে এল। এবার সত্যিই বুঝলাম, সে আমার মুখের দিকে বার বার চাইচে, চাইচে আর চোখ ফিরিয়ে নিচ্চে। সে এক পরম সুশ্রী ভঙ্গি। অথচ আমি প্যালা দিচ্চি না আর। আবদুল হামিদ এর মধ্যে দুবার টাকা দিয়েচে।

    হঠাৎ আমার মনে হ’ল, সেই জন্যেই বা মেয়েটি বার বার আমার কাছে আসচে। আচ্ছা এবারটা দেখি, এক পয়সা প্যালা দেবো না।

    এবার রামহরি সরকার ও গোবিন্দ দাঁ একসঙ্গে প্যালা দিলে।

    আমি জানি এসব পল্লীগ্রামের খেমটা বা ঢপকীর্তনের আসরে, প্যালা দেওয়ার দস্তুরমতো প্রতিযোগিতা চলে গ্রাম্য বিশিষ্ট লোকদের মধ্যে। অমুক এত দিয়েচে, আমিই বা কম কিসে, আমি কেন দেবো না—এই হল আসল ভাব। কে কেমন দরের লোক এই থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে যায়। আমি সবই জানি, কিন্তু চুপ করে রইলাম। এর কারণ আছে। আমি একটা পরীক্ষা করতে চাই।

    এ সময় নেপাল প্রামাণিক এসে হাজির হল।

    বললে—আজ আমার ওখানে একটু চা খাবেন ডাক্তারবাবু।

    —তোমার ওখানে সেদিন চা তো খেয়েছি—আজ আমার ডাক্তারখানায় বরং তুমি আর আবদুল হামিদ চা খেও।

    গোবিন্দ দাঁ বললে—আমি বুঝি বাদ যাবো?

    —বাদ যাবে কেন? চলো আমার সঙ্গে।

    —তা হলে আমার বাড়িতে আপনি রাতে পায়ের ধুলো দেবেন বলুন?

    —এখন সে কথা বলতে পারি নে। কত রাতে আসর ভাঙবে, কে জানে?

    —সমস্ত রাত দেখবেন?

    —দেখি, ঠিক বলতে পারি নে।

    আবার মেয়েটি ঘুরে ঘুরে আমার সামনে এসেচে। কি জানি ওর মুখে কি আছে, আমি যতবার দেখচি, প্রত্যেকবারেই নতুন কিছু, অপূর্ব কিছু চোখে পড়ছে। অনেক মেয়ে দেখেচি জীবনে, কিন্তু অমন মুখ অমন চোখ আমি কারো দেখেচি বলে মনে তো হয় না।

    আমি এবারেও প্যালা দিলাম না।

    কিন্তু একবার ওর মুখের দিকে চাইতেই দেখি ও আমার মুখের দিকেই চেয়ে আছে।

    আমার অত্যন্ত আনন্দ হল হঠাৎ। অকারণ আনন্দ।

    ওই অপরিচিতা বালিকাটি আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে, এতে আমার আনন্দের কারণ কি, কে বলবে?

    সেই আনন্দের অদ্ভুত মুহূর্তে আমার মনে হল, আমি সব যেন বিলিয়ে দিতে পারি, যা কিছু আমার নিজস্ব আছে। সব কিছু দিয়ে দিতে পারি। সব কিছু। তুচ্ছ পয়সা, তুচ্ছ টাকা-কড়ি।

    সেই মুহূর্তে দুটাকা প্যালা হাত বাড়িয়ে দিতে গেলাম, মেয়েটি সাবলীল ভঙ্গিতে আমার সামনে এসে আমার হাত থেকে টাকা দুটি উঠিয়ে নিলে। আমার হাতের আঙ্গুলে ওর আঙ্গুল ঠেকে গেল। আমার মনে হল ও ইচ্ছে করে আঙ্গুলে আঙ্গুলে ঠেকালে। অনায়াসে টাকা দুটি তুলে নিতে পারতো সন্তর্পণে।

    চোখ বুজে চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইলাম।

    হঠাৎ এই খেমটার আসর আমার কাছে অসাধারণ হয়ে উঠল। আমার সাধারণ অস্তিত্ব যেন লোপ পেয়ে গেল। আমি যুগযুগান্ত ধরে খেমটা নাচ দেখচি এখানে বসে। আমি অমর, বিজর, বিশ্বে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই। যুগযুগান্ত ধরে ওই মেয়েটি আমার সামনে এসে অমনি নাচচে।

    ওর অঙ্গুলির স্পর্শে আমার অতি সাধারণ একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন জীবন ভূমার আনন্দ আস্বাদ করল। অতি সাধারণ আমি অতি অসাধারণ হয়ে উঠলাম। আরও কি কি হল, সেসব বুঝিয়ে বলবার সাধ্য নেই আমার। আমি গ্রাম্য ডাক্তার মানুষ, এ গ্রামে ও গ্রামে রোগী দেখে বেড়াই, সনাতনদা’র সঙ্গে গ্রাম্য-দলাদলির গল্প করি, একে ওকে সামাজিক শাসন করি, আর এই প্রহ্লাদ সাধুখাঁ, নেপাল প্রামাণিক, ভূষণ দাঁয়ের মতো লোকের প্রশংসা কুড়িয়ে বেড়াই। আমি হঠাৎ এ কি পেয়ে গেলাম? কোন অমৃতের সন্ধান পেলাম আজ এই খেমটা নাচের আসরে এসে? আমার মাথা সত্যিই ঘুরচে। উগ্র মদের নেশার মতো নেশা লেগেচে যেন হঠাৎ। কি সে নেশার ঘোর, জীবনভর এর মধ্যে ডুবে থাকলেও কখনো অনুশোচনা আসবে না আমার।

    .

    নেপাল প্রামাণিক বললে—তাহলে আমি বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে আসি। ক’পেয়ালা চা হবে?

    আমি সবিস্ময়ে বললাম—কিসের চা?

    —এই যে বললেন আপনার ডাক্তারখানায় চা হবে।

    —ও! দুধ?

    —হ্যাঁ, দুধ না হলে চা হবে কিসে?

    আবদুল হামিদ মন্তব্য করলে—ডাক্তারবাবুর এখন উঠবার ইচ্ছে নেই।

    আমার বড় লজ্জা হল। ও বোধ হয় বুঝতে পেরেচে আমার মনের অবস্থা। ও কি কিছু লক্ষ করেচে?

    আমি বললাম—চলো চলো, চা খেয়ে আসা যাক। ততক্ষণ নেপাল দুধ নিয়ে আসুক।

    আধঘণ্টা পরে আমরা ডাক্তারখানায় বসে সবাই চা খাচ্চি, গোবিন্দ দাঁ বলে উঠল—ছোট ছুঁড়িটা বেশ দেখতে কিন্তু। না?

    আবদুল হামিদ ওর মুখের কথা লুফে নিয়ে অমনি বললে—আমিও তাই বলতে যাচ্ছি—বড্ড চমৎকার দেখতে। ডাক্তারবাবু কি বলেন?

    —কে, হ্যাঁ—মন্দ নয়।

    গোবিন্দ দাঁ বললে—মন্দ নয় কেন? বেশ ভালো।

    আমি বললাম—তা হবে।

    আবদুল হামিদ বললে—ছুঁড়িটার বয়স কত হবে আন্দাজ?

    গোবিন্দ দাঁ বললে—তা বেশি নয়। অল্প বয়েস।

    —কত?

    —পনেরো কিংবা ষোল। দেখলেই বোঝা যায় তো—

    আবদুল হামিদ সশব্দে হেসে উঠল—হ্যাঁ, ওসব যথেষ্টই ঘেঁটেচেন আমাদের দাঁ মশায়। ওঁর কাছে আর আমাদের—

    ওদের কথাবার্তা আমার ভালো লাগছিল না। ওদের ওখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার জন্যেই বললাম—চলো চা খাইগে। রাত হয়ে যাচ্চে। আমি এখান থেকে অনেক দূর চলে যেতে চাই ওদের সঙ্গ ছেড়ে। ওরা যে মেয়েটির দিকে বার বার চাইবে, এও আমার অসহ্য—সুতরাং ওদেরও সরিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

    নেপাল প্রামাণিক দুধ নিয়ে এল। আমি সকলকে চা পরিবেশন করলাম।

    আবদুল হামিদ বললে—একদিন এখানে ফিস্ট করুন ডাক্তারবাবু, আমি একটা খাসি দেবো।

    গোবিন্দ দাঁও পিছপা হবার লোক নয়, সে বললে—আমি কলকাতা থেকে ভাদুয়া ঘি আনিয়ে দেবো। হুজুরিমল রণছোড়লাল মস্ত ঘিয়ের আড়তদার, পোস্তার খাঁটি পশ্চিমে ভাদুয়া। আমার সঙ্গে যথেষ্ট খাতির। আমাদের দোকান থেকে রঙ নেয় ওরা। সেবার হল কি—

    রামহরি সরকার ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললে—কিসের পশ্চিমের ঘি? আমার ইউনিয়নে যা গাওয়া ঘি মেলে, তার কাছে ওসব কি বললে ভাদুয়া মাদুয়া লাগে না। দেড় টাকা সের গাওয়া ঘি কত চাই? এখনি হুকুম করলে দশ সের ঘি নিয়ে এসে ফেলবে। করুন না ফিস্টি।

    এরা যে আবার আসরে গিয়ে বসে, এ যেন আমি চাই নে। ছুতো-নাতায় দেরি হয়ে যাক এ আমারও ইচ্ছে। সুতরাং আমি এদের ওই স্থূল ধরনের কথাবার্তায় উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিলাম। আরও পাঁচরকম ঘি-এর কথা হল, কি কি খাওয়া হবে তার ফর্দ হল, কবে হতে পারে তার দিন স্থির করতে কিছু সময় কাটলো। ওরা আসরে গিয়ে মেয়েটিকে না দেখুক।

    নেপাল প্রামাণিক এই সময় আমায় হাতজোড় করে বললে—একটা অনুরোধ আছে, আমার বাড়িতে লুচি ভেজেচে। বড়বৌ যত্ন করে ভাজচে আপনার জন্যে। একটু পায়ের ধুলো দিতে হবেই।

    আমার নিজেরও ইচ্ছে আর আসরে যাবো না। ওর ওখানে খেতে গেলে যে সময় যাবে, তার মধ্যে খেমটার আসর ভেঙে যাবে। বললাম—বেশ, তাতে আর কি হয়েচে? চলো যাই।

    .

    নেপাল প্রামাণিকের বড় চৌচালা ঘরের দাওয়ায় আমার জন্যে খাবার জায়গা করা হয়েচে, নেপাল প্রামাণিকের বড় বৌ থালায় গরম লুচি এনে পরিবেশন করলে। বড় ভক্তিমতী স্ত্রীলোক, ব্রাহ্মণের ওপর অমন ভক্তি আজকার কালে বড় একটা দেখা যায় না। আমার সঙ্গে কথা বলে না, তবে আকারে ইঙ্গিতে বুঝতে পারি ও কি বলতে চাইচে। যেমন একবার লুচির থালা নিয়ে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম—না মা, আর লুচি দিতে হবে না।

    নেপালকে আমার অদূরে খাবার জায়গা করে দেওয়া হয়েচে। সে বললে—নিন নিন ডাক্তারবাবু, ও অনেক কষ্ট করে আপনার জন্যে লুচি ভেজেচে। সন্দে থেকে আমাকে বলচে ডাক্তারবাবুকে অবিশ্যি করে খেতে বলবা।

    বড়বৌয়ের ঘোমটার মধ্যে থেকে মৃদু হাসির শব্দ পাওয়া গেল।

    খান-আষ্টেক গরম লুচি চুড়ির ঠুনঠান শব্দের সঙ্গে পাতে পড়লো।

    —উঁ হুঁ হুঁ—এত কেন? কি সর্বনাশ!

    বড়বৌ ফিস ফিস করে অদূরে ভোজনরত নেপালের কানের কাছে মুখ নামিয়ে কি বললে, নেপাল আমায় বললে—বড়বৌ বলচে ডাক্তারবাবুর ছোকরা বয়েস, কেন খাবেন না এ ক’খানা লুচি—এই তো খাবার বয়েস।

    আমি বললাম—আমার বয়েস সম্বন্ধে মায়ের একটু ভুল হচ্চে। ছোকরা বড় নই, পঁয়ত্রিশের কোঠায় পা দেবো আশ্বিন মাসে।

    আবার ফিস ফিস শব্দ। নেপাল তার অনুবাদ করে বললে—বড়বৌ হাসচে, বলচে, ওর ছোট ভায়ের চেয়েও কম বয়েস।

    আমি জানতাম নেপালের দুই সংসার। কিন্তু ওর বড় বৌটি সত্যই সুন্দরী, এর আগেও দুবার দেখেচি বৌটিকে। বয়েস চল্লিশের ওপরে হলেও দীর্ঘকাল নিঃসন্তান ছিল বলেই হোক বা যে কারণেই হোক, এখনো বেশ আঁটসাঁট গড়ন, দিব্যি স্বাস্থ্যবতী, গায়ের রঙ পঁচিশ বছরের যুবতীর মতো। বেশ শান্ত মুখশ্রী।

    আমি উত্তর দিলাম—মাকে বল আর দুখানা পটলভাজা দিতে—

    বৌটি পটলভাজা পাতে দিলে এনে।

    আমি মুখ তুলে তাকেই উদ্দেশ করে বললাম—আচ্ছা এ রকম কেন মা করো, বলো তো? চমৎকার রান্না কিন্তু নুন দাও না কেন? সেবারও তাই, এবারও তাই। সেবার বলে গেলাম তোমায়, তুমি নুন দিও তরকারিতে, ওতে আমার জাত যাবে না। তবুও নুন দাও নি এবার।

    বড়বৌ এবার খুব জোরে ফিস ফিস করলে এবং খানিকক্ষণ সময় নিয়ে।

    নেপাল হেসে বললে—বড়বৌ বলচে, ব্রাহ্মণের পাতে নুন দিয়ে তরকারি রেঁধে দেবো সে ভাগ্যি করি নি। এ জন্মে আর তা হয়ে উঠবে না। নরকে পচে মরবো শেষে? ছোট জাত আমরা—

    —ও সব বাজে কথা।

    —না ডাক্তারবাবু, আপনাদের মতো অন্যরকম। আপনারা ইংরেজী পড়ে এ সব মানেন না, কিন্তু ভগবানের কাছে দোষী হতে হবে তো?

    —ইংরেজী পড়ে নয় নেপাল, মানুষের সঙ্গে তফাৎ সৃষ্টি করেচে সমাজ, ভগবানকে টেনো না এর মধ্যে।

    —ভগবান নিজেই ব্রাহ্মণের পায়ের চিহ্ন বুকে ধরে আছেন। আছেন কি না আছেন বলুন?

    —আমি দেখি নি ভগবানকে, তাঁর বুকে কি আছে না আছে বলতে পারবো না। কিন্তু নেপাল, এটুকু তুমিও জানো আমিও জানি, তাঁর দেওয়া ছাপ কপালে নিয়ে কেউ পৃথিবীতে আসে নি।

    —তবে বাবু, কেউ ব্রাহ্মণ কেউ শুদ্দুর হয় কেন?

    —আমি জানি নে, তুমিই বলো।

    —কর্মফল। আপনার সুকৃতি ছেল আপনি ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেচেন, আমার পুণ্যি ছেল না, আমি শুদ্দুর হয়ে—

    এ তর্কের মীমাংসা নেই, বিশেষত এদের বুঝানো আমার সম্ভব নয়, সুতরাং চুপ করে খাওয়া শেষ করলাম।

    রাত বেশি হয়েচে। নেপাল বললে—আপনি শোবেন এখানে তো? বড়বৌ বলচে।

    —না, আমি ডিসপেনসারিতে শোবো। রাত বেশি নেই। ভোররাত্রে নৌকো ছাড়বো।

    —কষ্ট করে কেন শোবেন। বড়বৌ আপনার জন্যি ঘরে তক্তাপোশে বিছেনা পেতে রেখেচে।

    তখন যদি নেপাল প্রামাণিকের কথা শুনতাম, তার ভক্তিমতী সতীলক্ষ্মী স্ত্রীর কথা শুনতাম! তারপরে কতবার এ কথা আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু তখন আর উপায় ছিল না।

    .

    আমি নেপালের বাড়ি থেকে চলে এলাম ডাক্তারখানায়। নেপাল লণ্ঠন ধরে এগিয়ে দিয়ে গেল। ডাক্তারখানার ওদিকে বারান্দায় নৌকোর মাঝিটা অঘোরে ঘুমুচ্চে। আমি ঘরে ঢুকে নেপালকে বিদায় দিয়ে বিছানা পাতবার যোগাড় করচি, এমন সময় বাইরে গোবিন্দ দাঁ আর আবদুল হামিদের গলা পেলাম।

    আবদুল হামিদ বললে—ও ডাক্তারবাবু, আলো জ্বালুন—ঘুমুলেন নাকি?

    বললাম—কি ব্যাপার?

    নিশ্চয়ই এরা চা খেতে এসেচে। কিন্তু এত রাত্রে আমি দুধ পাই কোথায় যে ওদের জন্যে চা করি আবার? বিপন্ন মুখে দোর খুলে ওদের পাশের ঘরে বসিয়ে শোয়ার ঘর থেকে লণ্ঠন নিয়ে ডিসপেনসারি ঘরে ঢুকেই আমি দেখলাম একটি মেয়ে ওদের সঙ্গে। স্বভাবতই আমার মনে হল কারো অসুখ করেচে; নইলে এত রাত্রে ওরা দু’জনে ডিসপেনসারিতে আসবে কেন?

    ব্যস্ত সুরে বললাম—কি হয়েচে বলো তো? কে মেয়েটি?

    গোবিন্দ দাঁ বললে—বসুন, ডাক্তারবাবু, বসুন—কথা আছে।

    —কে বলো তো ও মেয়েটি?

    আবদুল হামিদ দাঁত বের করে হেসে বললে—আপনার রুগী। দেখুন তো—

    সেই কিশোরী নর্তকীটি। আমার মাথা যেন ঝিম ঝিম করে উঠল। মেয়েটির সলজ্জ দৃষ্টি মাটির দিকে নামানো। মনে হল, ওর কপাল ঘেমে উঠচে ক্লান্তিতে ও সকরুণ কুণ্ঠায়।

    আমি এগিয়ে এসে বলি—কি, কি ব্যাপার? হয়েচে কি?

    গোবিন্দ দাঁ হ্যা হ্যা করে হেসে উঠল—আবদুল হামিদের হাসির সুরটা খিক খিক শব্দে নদীর ধারে পুরনো শিমুল গাছে শিকরে পাখির আওয়াজের মতো।

    বিরক্ত হয়ে বললাম—আঃ, বলি কি হয়েচে শুনি না!

    গোবিন্দ দাঁ বললে—মাথা ধরেচে, মাথা ধরেচে—নেচে গেয়ে মাথা ধরেচে, এখন ওষুধ দিন, রোগ সারান।

    টেবিলের ওপর থেকে স্মেলিং সল্টের শিশিটা তুলে বললাম—এটা জোরে শুঁকতে বলো, এখুনি সেরে যাবে।

    আবদুল হামিদ আর একবার শিকরে পাখির আওয়াজের মতো হেসে উঠল। গোবিন্দ দাঁ বললে—আপনি চিকিচ্ছে করুন। আমরা চলি।

    —কেন, কেন?

    —আমাদের আর এখানে থাকার কি দরকার?

    সত্যই ওরা উঠে চলে যেতে উদ্যত হল দেখে আমি বললাম—বোসো বোসো। কি হচ্চে? ওষুধ শিশিতে দিচ্চি—

    গোবিন্দ দাঁ বললে—আপনি ওষুধ দেবেন দিন, দিয়ে ওকে পটল কলুর আটচালা ঘরে ওদের বাসা, সেখানে পাঠিয়ে দেবেন। আমরা চলি।

    আবদুল হামিদ বললে—ওষুধের দামটা আমার কাছ থেকে নেবেন।

    গোবিন্দ দাঁ বললে—কেন, আমি দেবো।

    ওদের ইতর ব্যবহারে আমার বড় রাগ হল। আমি ধমক দেওয়ার সুরে বললাম—কি হচ্চে সব? ওষুধ যদি দিতে হয় তার দামটা আমি না নিতেও তো পারি। বসো সব। কেউ যেও না। কি হয়েচে শুনি?

    গোবিন্দ দাঁ বললে—মাথা ধরেচে বললাম তো। ওগো, বল না গো, তোমার কি হয়েচে, তোমার চাঁদ মুখ দিয়ে কথা না বেরুলে আমাদের ডাক্তারবাবু বিশ্বাস করচেন না যে। বললে মাথা ধরেচে—নিয়ে এলাম ডাক্তারের কাছে। এখন রুগী-ডাক্তারে কথাবার্তা হোক, আমরা তো বাড়তি মাল—হ্যাবাক জিঙ্কের পিপের সোল এজেন্ট—এখানে আর আমরা কেন? ওঠো আবদুল হামিদ—

    সত্যিই ওরা চলে গেল। আমি মেয়েটির মুখের দিকে চাইলাম। দুটি চোখের সলজ্জ চাউনি আমার মুখের দিকে স্থাপিত। এভাবে আমি একা কোনো মেয়ের সঙ্গে মিশতে অভ্যস্ত নই, আমি যেন ঘেমে উঠলাম। তার উপরে অন্য কোনো মেয়ে নয়, যে মেয়েটি কাল থেকে আমার একঘেয়ে জীবনে সম্পূর্ণ নতুনের স্বাদ এনে দিয়েচে, সেই মেয়েটি। হঠাৎ আমি নিজেকে দৃঢ় করে নিলাম। আমি না ডাক্তার? আমার গলা কাঁপবে একটি বালিকার সঙ্গে চিকিৎসক হিসেবে কথাবার্তা বলতে?

    বললাম—কি হয়েচে তোমার?

    মেয়েটি আমার মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বললে—আপনি ডাক্তারবাবু?

    অদ্ভুত প্রশ্ন। এতটুকু মেয়ের মুখে! গম্ভীর মুখে বলবার চেষ্টা করলাম—তবে এখানে কি জন্য এসেচ? দেখতেই তো পাচ্চ!

    আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য। মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলে পরক্ষণেই লজ্জায় মুখখানি নীচু করে মুখে আঁচল চাপা দিলে—আঁচল-চাপা-মুখ আমার দিকে তুলে আবার ফিক করে হেসে উঠল। সে এক অদ্ভুত ভঙ্গি, সে ভঙ্গির অপূর্ব লাবণ্য আমার বর্ণনা করবার শক্তি নেই। আমার বুদ্ধি যেন লোপ পাবার উপক্রম হল—এমন ধরনের মেয়ে আমি কখনও দেখি নি। মেয়ে দেখেছি সুরবালাকে—শান্ত সংযত ভদ্র বড় জোর; দেখেচি শান্তিকে, না হয় নির্জন রাস্তায় অবসর খুঁজে কথা বলে, তাও দরকারী কথা, নিজের গরজে। এমন সাবলীল ভঙ্গি তাদের সাধ্যের বাইরে। তাদের দেহে হয় না, জন্মায় না। ছেলেমানুষ নারী বটে, কিন্তু সত্যিকার নারী।

    বললাম—হাসচো কেন? কি হয়েচে?

    —মাথা ধরেচে। অসুখ হয়েচে।

    —মিথ্যে কথা।

    —উহুঁ-হুঁ, ভারী ডাক্তার আপনি!

    যেন কত কালের পরিচয়। কোনো সঙ্কোচের বালাই নেই।

    ওর সামনের চেয়ারে বসে ওর হাত ধরলাম। ও হাত টেনে নিলে না। নির্জন ঘরে ও আর আমি। রাত একটা কিংবা দুটো। কে জানে, কে-ই বা খবর রাখে। আমার মনে হল জগতে ঐ মেয়েটি আমার সামনে বসে আছে যুগ যুগ ধরে। সারা বিশ্বে দুটি মাত্র প্রাণী—ও আর আমি।

    আমি বললাম—তোমার নাম কি?

    —কি দরকার আপনার সে খোঁজে?

    —তবে এখানে এসেচ কেন?

    —ওষুধ দিন। হাতটা ধরেই রইলেন যে দেখুন না হাত!

    —কিছুই হয় নি তোমার।

    —না, সত্যি আমার মাথা ধরেছিল।

    —এখন আর নেই।

    —কি করে বুঝলেন?

    —তুমি একটি দুষ্টু বালিকা। কত বয়েস তোমার? পনেরো না ষোলো?

    —জানি নে।

    আমি ওর হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললাম—তবে এখুনি যাও।

    ওর মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। আমার গলার সুর বোধ হয় একটু কড়া হয়ে পড়েছিল। ভীরু চোখে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললে—রাগ করলেন? না না, রাগ করবেন না। আমার বয়েস ষোলো।

    —নাম কি?

    —পান্না। ভালো নাম সুধীরাবালা।

    —যার সঙ্গে এসেচ ও তোমার কে হয়?

    —কেউ নয়। ওর সঙ্গে মুজরো করে বেড়াই, মাইনে দেয়, প্যালার অর্ধেক ভাগ দিতে হয়।

    —কোথায় থাকো তোমরা?

    —দমদমা সিঁথি। বাড়িউলীর বাগানবাড়িতে।

    —সে আবার কে?

    —বাড়িউলী মাসির টাকায় তো খেমটার দল চলে। থাকতে দেয় খেতে দেয়। সেই-ই তো সব।

    —ওষুধ দেবো? মিথ্যা কথা বলে এসেছ কেন এখানে? ওই তোমার সঙ্গের মেয়েটা এখানে তোমায় পাঠিয়েচে?

    —না।

    —সত্যি বলো। মিথ্যে ভান করচো কেন অসুখের? ও পাঠিয়েচে—না? তোমায় শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েচে?

    মেয়েটি লজ্জায় কেমন যেন ভেঙ্গে পড়ে বললে—তা না।

    বলেই মুখ নীচু করে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো ও সত্যি কথা বলচে। ওর সঙ্গিনী পাঠায় নি, ছল করে ও নিজেই এসেচে। স্বেচ্ছায় এসেচে। অসুখ-বিসুখও নয়—কোনো অসুখ নেই ওর।

    হঠাৎ মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে কেমন এক রকম অদ্ভুত স্বরে বললে,—আমি চললাম, আপনি বড় খারাপ লোক।

    বিস্ময়ের সুরে বললাম—খারাপ? কেন, কি করলাম তোমার?

    —আমি বলি নি তো কিছু! আমি যাই, আসর কোন দিকে? বাপরে, কত রাত হয়ে গিয়েচে! আমায় একটু এগিয়ে দিন না।

    —তা পারবো না। আসরে অনেক লোক, তোমার সঙ্গে আমায় দেখতে পেলে কে কি বলবে! আমি পথ দেখিয়ে দিচ্চি—তুমি যাও। কোনো ভয় নেই, বাজারের মধ্যে চরিদিকে লোক, ভয় কিসের।

    মেয়েটি চলে যেতে উদ্যত হলে আমার কৌতূহল অদম্য হয়ে উঠল। আমি খপ করে ওর হাত ধরে ওকে সেই চেয়ারখানাতে আবার বসিয়ে দিয়ে বললাম—কেন এসেছিলে, না বলে যাবার জো নেই পান্না,—না, এই নামই তো? রাগ করলে নাকি—ডাকনাম ধরে ডাকলাম বলে?

    মেয়েটি হেসে বললে—ডাকুন না যত পারেন!

    —তুমি এখানে এসে বসে আছ, তোমার সঙ্গের মেয়েটা কি ভাববে?

    —ভাবুকগে, আমার তাতে কি?

    —তুমি তো দেখচি খুব ছেলেমানুষ—তোমার কথার সুরেই তার প্রমাণ।

    পান্না চোখের ভুরু ওপরদিকে দুবার তুলে আবার নামিয়ে চোখ নাচিয়ে কৌতুকের সুরে বললে—হুঁ-উ-উ!

    শেষের দিকে জিজ্ঞাসার সুরটা নিরর্থক। কি সুন্দর হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে।

    আমার হঠাৎ মনে হল ওকে আমি বুকে টেনে নিয়ে ওর ফুলের মতো লাবণ্যভরা দেহটা পিষে দিই বলিষ্ঠ বাহুর চাপে। মাথার মধ্যে রক্ত চন চন করে উঠল। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ি। এ অবস্থা ভালো নয়। ও এখান থেকে চলে যাক, ছিঃ—

    —পান্না, তুমি চলো, এগিয়ে দিয়ে আসি।

    —আপনি বড় মজার লোক কিন্তু—আমি কেন এসেছিলাম জিজ্ঞেস করলেন না যে?

    —তুমি বললে না তো আবার জিগ্যেস করে কি হবে? তুমি এক নম্বরের দুষ্টু পান্না।

    —‘পান্না’ কেন, আমার ভালো নামে ডাকুন না, সু-ধী-রা বা-লা—

    —ওর চেয়ে পান্না ভালো লাগে—সত্যি বলচি।

    —আমিও সত্যি বলচি, আপনাকে আজ রাত্রে—

    এই পর্যন্ত বলেই কি একটা বলবার মুখে হঠাৎ থেমে গিয়ে ও সলজ্জ হেসে মুখ নীচু করে চুপি চুপি কি কতকগুলো কথা আপনা-আপনি বলে গেল।

    —কি বললে?

    —বলচি এই গিয়ে—আপনাকে আজ রাত্তিরে-এ-এ—

    —আঃ, লজ্জায় তো ভেঙে পড়লে! বলো না কি?

    —আমার লজ্জা করে না বুঝি! আমি যাই—এগিয়ে দিন।

    আমি উঠলাম। আমার সম্বিৎ ফিরে এসেচে। আমি চিকিৎসক, আমার ডাক্তারখানায় সমাগত একটি রোগিণীর সঙ্গে রাতদুপুরে বিশ্রম্ভালাপ শোভা পায় না আমার। পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস হয়েচে। বিবাহিত ভদ্রলোক।

    বললাম—চলো না, ওঠো। এগিয়ে দিয়ে আসি—

    হরি ময়রার দোকান পর্যন্ত এসে দেখি আসরের দিকে তখনও মেলা লোকের ভিড়। কেউ পানবিড়ি খাচ্চে, কেউ জটলা করে গল্প করচে। স্থানীয় বাজারের লোকে এখনও এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, পানবিড়ির দোকান এখনও খোলা।

    পান্না নিজেই আমার দিকে চেয়ে সলজ্জ কুণ্ঠায় ভদ্রঘরের বধূটির মতো বললে—আপনি যান, লোকের ভিড় রয়েচে। আপনাকে দেখতে পাবে।

    আমি দাঁড়িয়ে আছি, ও চলে যাচ্চে—যেতে যেতে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললে—কাল আমাদের শেষ দিন—জানেন তো?

    —জানি।

    —আপনি আসবেন?

    —তা বলতে পারিনে—আজ এত রাত পর্যন্ত জেগে, কাল বাড়ির ডাক্তারখানায় রুগী দেখতে হবে—

    —সন্দের পর কাল আরম্ভ হবে তো! আপনি আসবেন, কেমন তো? তার পরেই মাথা দুলিয়ে বললে—ঠিক, ঠিক, ঠিক। যাই—

    আমি কিছু বলবার আগেই পান্না হরি ময়রার দোকানের ছেঁচতলার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    .

    ফিরে চলে এলাম ডাক্তারখানাতে। মাথার মধ্যে কেমন করচে। পান্নার সঙ্গে জীবনের যেন অনেকখানি চলে গেল। জীবনকে এতদিনে কিছুই জানি নি, দেখি নি। শুধু ঘুরে মরেছি পাড়াগাঁয়ে ডাক্তারি করে আর সনাতনদার মতো গেঁয়ো লোকের প্রশংসা কুড়িয়ে। আজ যেন মনে হল, এ জীবন একেবারে ফাঁকা, এতে আসল জিনিস কিছুই নেই। নিজেকে ঠকিয়েছি এতদিন।

    মাঝি বললে—বাবু, বাড়ি যাবেন তো? নৌকো ছাড়ি?

    —একটা শক্ত কেস আছে, যাবো কি না তাই ভাবছি।

    —চলুন বাবু, কাল খাওয়া-দাওয়া করে চলে আসবেন।

    কাঠের পুতুলের মতো গিয়ে নৌকোতে উঠলাম। নৌকো ছাড়লো। আমি শুয়ে রইলাম চোখ বুজে কিন্তু কেবলই পান্নার মুখ মনে পড়ে,—তার সেই অদ্ভুত হাসি, সকুণ্ঠ চাউনি। লাবণ্যময়ী কথাটা বইয়ে পড়ে এসেছি এতদিন, ওকে দেখে এতদিন পরে বুঝলাম নারীর লাবণ্য কাকে বলে। কি যেন একটা ফেলে যাচ্ছি মঙ্গলগঞ্জের বারোয়ারিতলায়, যা ফেলে আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো না।

    মনে মনে একটা অদ্ভুত কল্পনা জাগলো।

    নিজেই অবাক হয়ে গেলাম আমার এ ধরনের কল্পনার সম্ভাব্যতায়। ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছি, সংসার ছেড়ে দিয়েছি, পান্না যদি আমাকে চায় তবে ওকে নিয়ে চলে গিয়েছি সুদূর পশ্চিমে কোনো অজ্ঞাত ছোট শহরে। পান্নার সীমন্তে সিন্দূর, মুখে সেই হাসি…আমার সঙ্গে এক নির্জন ছাদে…দুজনে মুখোমুখি…কেউ কোথাও নেই…কেউ আমাকে ডাক্তারবাবু বলে খাতির করবার নেই। এখানে আমার বংশগৌরব আমার সব স্বাধীনতা হরণ করেচে।…

    কিসের বংশগৌরব, কিসের যশমান?

    ওকে যদি পাই?

    হয়তো তা আকাশ-কুসুম। ও সব আলেয়ার আলো, হাতের মুঠোয় ধরা দেয় না কোনো দিন। পান্না আমার হবে, এ কথা ভাবতেই আমার সারা দেহমনে যেন বিদ্যুতের স্রোত বয়ে গেল। পান্না খাঁটি নারী, আমি এতদিন নারী দেখি নি। ওদের চিনতাম না। আজ বুঝলাম ওকে দেখে।

    পান্না আজ আমার ডাক্তারখানায় কেন এসেছিল? ওষুধ নিতে নয়। না ওষুধ নিতে? কিছুই বুঝলাম না ওর কাণ্ড। অসুখ কিছু ছিল না, মাথা ধরতে পারে হয়তো। কিন্তু যদি এমন হয়, ও ওষুধ নেবার ছল করে এসেছিল অভিসারে আমার কাছে? কিন্তু আবদুল হামিদ আর গোবিন্দ দাঁ সঙ্গে কেন?

    নাঃ, কিছুই পরিষ্কার হল না।

    আচ্ছা, যদি সত্যিই ও অভিসারে এসেছিল এমন হয়?

    কথাটা ভাবতে আমার দেহমনে আবার যেন বিদ্যুতের শিহরণ বয়ে গেল। তাও কি সম্ভব? আমার বয়েস পঁয়ত্রিশ, পান্না ষোল বছরের কিশোরী। অসম্ভব কি খুব? তবে এমন অনেক ঘটনার কথা জানি যেখানে এর চেয়েও বেশি বয়সে কিশোরীর প্রেম লাভ করেছিল, সে সব…

    আমার মতো গেঁয়ো ডাক্তারের অদৃষ্টে কি ওসব সম্ভব হবে? যা নাটক নভেলে পড়েছি, তা হবে আমার জীবনে মঙ্গলগঞ্জের মতো অজ পাড়াগাঁয়ে?

    মাথার মধ্যে কেমন নেশা…উঠে নদীর জল চোখে-মুখে দিলাম। আমার শরীরের অবস্থা যেন মাতালের মতো। মাঝি বললে—ডাক্তারবাবু, ঘুমোন নি?

    বললাম—না বাপু, মাধা গরম হয়ে গিয়েচে না ঘুমিয়ে।

    —চলুন বাবু, বাড়ি গিয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুম দেবেন এখন।

    আমি তখন ভাবছি, এসে ভুল করেছি। না এলেই হত।

    যদি এমন কিছু ঘটে বাড়ি গিয়ে, কাল সন্দেবেলা মঙ্গলগঞ্জে আসা না ঘটে? পান্নার সঙ্গে আর দেখা হবে না, ও চলে যাবে কলকাতায়। তা হবে না, অমন ভাবে পান্নাকে আমি হারাতে রাজি নই।

    বাড়ি এসে স্নান করে একটু মিছরির শরবৎ খেয়ে বৈঠকখানায় গিয়ে বসেছি, এমন সময় বড় মুখুয্যের ছেলে হারান এসে বললে—শশাঙ্কদা, একবার আমাদের বাড়ি যেতে হচ্চে—

    —কেন হে, এত সকালে?

    —জামাই এসেচেন, একটু চা খাবে তাঁর সঙ্গে সকালে।

    —মাপ করো ভাই, কাল সারারাত ঘুমুই নি। মঙ্গলগঞ্জে শক্ত কেস ছিল—

    —ভালো কথা, হ্যাঁ হে, মঙ্গলগঞ্জে নাকি বারোয়ারিতে ভালো খেমটা নাচ হচ্চে, কে যেন বলছিল—

    আমার বুকের ভেতরটা যেন ধড়াস করে উঠল। জিব শুকিয়ে গেল হঠাৎ। এর কারণ কিছু নয়, মঙ্গলগঞ্জের কথা উঠতেই পান্নার মুখ মনে পড়লো…ওর হাসি…সেই অপূর্ব লীলায়িত ভঙ্গি মনে পড়ে গেল…

    আমি সামলে নিয়ে বললাম—বারোয়ারি? হ্যাঁ হচ্চে শুনেছি…

    হঠাৎ আমার মনে হল খেমটা নাচ হচ্চে শুনে হারান যদি আজ আমার নৌকোতেই (কারণ আমি আজ যাবোই ঠিক করে ফেলেছি) মঙ্গলগঞ্জে যেতে চায় তবে সব মাটি। পান্নার সঙ্গে দেখা করার কোনো সুবিধে হবেন না ও অপদের সামনে, এমন কি হয়তো নাচের আসরেই যেতে পারবো না।

    সুতরাং ওপরের উক্তিটি শুধরে নেবার জন্যে বললাম—কিন্তু সে কাল বোধ হয় শেষ হয়ে গিয়েচে।

    —শেষ হয়ে গিয়েচে?

    উদাসীন সুরে বলি—তাই শুনছিলাম। আমার তো ওদিকে যাওয়া-টাওয়া নেই—লোকে বলছিল—

    হারান বললে—হ্যাঁ, তুমি আবার যাবে খেমটার আসরে নাচ দেখতে! তোমাকে আমি আর জানি নে! তা ছাড়া তোমার সময়ই বা কোথায়? তাহলে চলো একটু চা খেয়ে আসবে।

    —না ভাই, আমায় মাপ করো। হাতে অনেক কাজ আজকে—

    একটু পরে সনাতনদা এসে বললে—কাল নাকি সারা রাত কাটিয়েচ মঙ্গলগঞ্জে? কি কেস ছিল?

    বিরক্তির সঙ্গে বললাম—ও ছিল একটা—

    —আজ যাবে নাকি আবার?

    —এত খবর তোমায় দিলে কে? কেন বলো তো? গেলে কি হবে?

    সনাতনদা একটু বিস্মিত ভাবে আমার দিকে চাইলে, এই সামান্য প্রশ্নে আমার বিরক্তির কারণ কি ঘটতে পারে, বোধ হয় ভাবলে। বললে—না, না—তাই বলছিলাম—

    —হ্যাঁ, যেতে হবে। কেন বলো তো?

    যা ভয় করছিলাম, সনাতনদা বলে বসল—আমাকে নিয়ে যাবে তোমার নৌকোতে? নাকি, ভালো বারোয়ারি গান হচ্চে মঙ্গলগঞ্জে, একটু দেখে আসতাম—

    আমার বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল। বললাম—কে বললে ভালো? রামো, বাজে খেমটা নাচ হচ্চে, কলকাতার খেমটা-উলীদের—

    সনাতনদা জানে, আমি নীতিবাগীশ লোক, সুতরাং আমার সামনে সে বলতে পারলে না যে খেমটা নাচ দেখতে যাবে। আমিও তা জানতাম। খেমটা নাচের কথা শুনে সনাতনদা তাচ্ছিল্যের সুরে বললে—খেমটা? ঝাঁটা মারো! ও আবার ভদ্রলোকে দেখে! তুমি গিয়েছিল নাকি?…নাঃ, তুমি আবার যাচ্ছ ওই দেখতে!

    —গিয়েছিলাম একটুখানি।

    সনাতনদা সবিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে বললে—তুমি!

    হেসে বললাম—হ্যাঁ গো, আমি।

    সনাতনদা ভেবে বললে—তা তোমাকে খাতিরে পড়ে যেতে হয়। পাঁচজনে বলে, তুমি হলে ডাক্তারমানুষ—

    সনাতনদা আর ও সম্বন্ধে কিছু বললে না। অন্য কথাবার্তা খানিকক্ষণ বলে উঠে চলে গেল। আমি বাড়ির ভেতর গিয়ে স্নানাহার করে নিয়ে ওপরে শোবার ঘরে যেতেই সুরবালা এসে ঘরের জানালা বন্ধ করে দিয়ে গেল। চোখে আলো লাগলে দিনমানে আমার ঘুম হয় না সে জানে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি নে, উঠলাম যখন তখন বেলা বেশি নেই। তখুনি সুরবালা চা নিয়ে এল, বললে—ঘুম হয়েচে ভালো? এর মধ্যে কাপাসডাঙা থেকে একটা রুগী এসেছিল, বলে পাঠিয়েচি, বাবু ঘুমুচ্চেন। তারা বোধ হয় এখনো বাইরে বসে আছে। শক্ত কেস।

    বললাম—আমাকে আজও মঙ্গলগঞ্জে যেতে হবে।

    —আজও? কেন গা?

    সুরবালা সাধারণতঃ এরকম প্রশ্ন করে না। খাঁটি মিথ্যে কথা ওর সঙ্গে কখনো বলি নি। সংক্ষেপে বললাম—দরকার আছে। যেতেই হবে।

    —কাপাসডাঙায় যাবে না?

    —না, যেতে পারা যাবে না।

    এদিকে কাপাসডাঙার লোকে যথেষ্ট পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলে। তাদের রুগীর অবস্থা খারাপ, যত টাকা লাগে তা দেবে, অবস্থা ভালো, আমি একবার যেন যাই। ভেবে দেখলাম কাপাসডাঙায় রুগী দেখতে গেলে সারারাত কাটবে যেতে আসতে।

    সে হয় না।

    .

    মাঝিকে নিয়ে সন্ধ্যার পরেই রওনা হই। মঙ্গলগঞ্জ পৌঁছবার আগে আমার বুকের মধ্যে কিসের ঢেউ যেন ঠেলে উঠচে বেশ অনুভব করি। মুখ শুকিয়ে আসচে। হাত-পা ঝিম ঝিম করচে। এ আবার কি অনুভূতি, আমার এত বয়স হল, কখনও তো এমন হয় নি!

    একটি ভয় মনের মধ্যে উঁকি মারছে। পান্না আজ হয়তো অন্যরকম হয়ে গেছে। আজ সে হয়তো আর আমাকে চিনতেই পারবে না। তা যদি হয়, সে আঘাত বড় বাজবে বুকে।

    গোবিন্দ দাঁ দেখি ডাক্তারখানায় বসে।

    আমায় দেখেই দাঁত বের করে বললে—হেঁ হেঁ, ডাক্তারবাবু যে! এসেচেন?

    —কি ব্যাপার?

    —ব্যাপার কিছু নয়। ভাগ্যিস আপনি এলেন!

    —আমি? কেন অসুখ বিসুখ কারো?

    গোবিন্দ দাঁ সুর নিচু করে বললে—অসুখ যার হবার, তার হয়েছে। একজন যে মরে। সকাল থেকে সতেরো বার এনকুয়ারি করচে, ডাক্তারবাবু আজ আসবেন তো? আপনি না এলে তার অবস্থা যে কেষ্ট-বিরহে রাধার মতো!

    রাগের সুরে বললাম—যাও কি সব বাজে কথা বলো—

    গোবিন্দ দাঁ টেবিল চাপড়ে বললে—একটুও বাজে কথা নয়। মা কালীর দিব্যি। আবদুল হামিদকে তো জানেন? ঘোড়েল লোক। ও যতবার সে ছুঁড়ির সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছে, ততবার সে হাঁকিয়ে দিয়েছে। আমি একবার গিয়েছিলাম কখন আসর হবে জিজ্ঞেস করতে। আমাকে বললে—ডাক্তারবাবু আজ আসবেন তো? আমি যেমন বলেছি, তা তো জানি নে আসবেন কি না, অমনি মুখ দেখি কালো হয়ে গেল।

    আমার বুকের ভেতর যেন ঢেঁকির পাড় পড়চে। গোবিন্দ দাঁ হ্যাবাক জিংকের ব্যবসা করে, মনের খবর ও কি জানবে। জানলে এ সব কথা কি বলতো?

    মুখে বললাম—ও সব কথা আমায় শুনিয়ে লাভ কি? যাও।

    গোবিন্দ দাঁকে হঠাৎ একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বড় ইচ্ছে হল। কিন্তু জিজ্ঞেস করাটা উচিত কি না বুঝতে না পেরে একটু ইতস্তত করচি, দেখি ধূর্ত গোবিন্দ দাঁ বললে—কিছু বলবেন?

    —একটা কথা, কাল রাত্তিরে ওকে তোমরা এনেছিলে কেন? ঠিক কথা বলবে!

    —আমি বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না। ও আমাকে বললে, ডাক্তারবাবু কোথায় থাকেন? আবদুল হামিদও ছিল আমার সঙ্গে। তাই নিয়ে এসেছিলাম, হয় না হয় জিজ্ঞেস করে দেখবেন আবদুল হামিদকে। একবার নয়, ও ক’বার জিজ্ঞেস করেচে, আপনি কোথায় থাকেন? তখন বললাম—কেন? ও বললে—হাত দেখাব, অসুখ করেচে।

    —ও কি করে জানলে আমি ডাক্তার? ও আসরে ছাড়া আমায় দ্যাখে নি!

    —তা আমি জানি নে, সত্যি বলচি। কাউকে হয়তো জিজ্ঞেস করে থাকবে।

    কি একটা কথা বলতে যাবো, এমন সময় বাইরে কে ডাকল—কে আছেন?

    কম্পাউন্ডার তখনো আসেনি, আমি নিজেই বাইরে গিয়ে দেখি একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। বললাম—কোত্থেকে আসচো? মনে হল ওকে আমি খেমটা নাচের তবলা বাজাতে দেখেছি।

    লোকটা বললে—ডাক্তারবাবু আছেন?

    বললাম—কি দরকার?

    —দরকার আছে।

    কি মনে হল, বললাম—না, আসেন নি।

    —ও! আসবেন কি?

    —তা বলতে পারি নে।

    গোবিন্দ দাঁ লোকটাকে দেখে নি, ঘরের মধ্যে ঢুকতেই আমায় জিজ্ঞেস করলে—কে? নেই বলে দিলেন কেন? হয়তো শক্ত রোগ!

    —তুমি থামো না! আমার ব্যবসা আমি ভালো বুঝি।

    এমন সময় নেপাল প্রামাণিক এসে হাত জোড় করে বললে—একটা অনুরোধ। বড়বৌ বিশেষ করে ধরেচে, যাও ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এসো। রাত্তিরে যদি এখানে থাকতে হয়, তবে চলুন আমার কুটিরে। একটু কিছু খেয়ে আসবেন।

    বেশ লোক এই নেপাল ও তার স্ত্রী। কিন্তু আজ আমার যাওয়ার তত ইচ্ছে ছিল না, গোবিন্দ দাঁ বললে—যান না, নাচ শুরু হবে সেই দশটায়। হ্যাঁ নেপালদা, বলি আমাদের মতো গরিব লোকের কি জায়গা হয় না তোমাদের বাড়ি?

    নেপাল ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললে—হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো না, চলো।

    আমরা সবাই মিলে নেপালের বাড়ি এসে চা খেলাম; চায়ের সঙ্গে চিঁড়েভাজা ও নারকোল কোরা। একটু পরে গোবিন্দ দাঁ উঠে চলে গেল। আমি একাই বসে আছি; এমন সময়ে গোবিন্দ দাঁ আবার এল, আমায় বললে—একটু বাইরে আসুন।

    —কি?

    —আপনি সেই যে লোকটাকে ডাক্তার নেই বলে দিয়েছিলেন, সে কে জানেন? সে হল ওদের খেমটার দলের লোক। আপনি আসবেন না শুনে পান্নার মন ভারি খারাপ হয়েছে।

    —চুপ চুপ। এখানে কি ওসব কথা? কে বললে তোমায়?

    —আরে গরীবের কথাটাই শুনুন। তিনি নিজেই আমাকে এই মাত্তর ডেকে বললেন—ডাক্তারবাবু এসেছেন কিনা। দেখে আসচি বলে তাই এলাম আপনার কাছে। এখন একটা মজা করা যাক। আমি গিয়ে বলি আপনি আসেন নি।

    —তারপর?

    —তারপর আপনি হঠাৎ আসরে গিয়ে বসে প্যালা দিতে যাবেন। বেশ মজা হবে। কেমন?

    —না, ও আমার ভালো লাগে না। ও করে কি হবে?

    —করুন, করুন। আপনার হাতে ধরচি।

    —বেশ যাও, তাই হবে।

    .

    নেপালের ভক্তিমতী স্ত্রী খুব যত্ন করে আমাকে খাওয়ালো। বড় ভালো মেয়ে। সামনে বসে কখনো কথা বলে না, কিন্তু আড়াল থেকে সুখ-সুবিধে দেখে, গরম গরম লুচি এক-একখানা করে ভেজে পাতে দেওয়া, দুধ গরম আছে কিনা দেখা—সব বিষয়ে নজর। দু’দিন এখানে খেলাম, প্রতিদানে কি দেওয়া যায় তাই ভাবছি। একটা কিছু করা দরকার।

    আহারাদির ঘণ্টা দুই পরে আসর বসল। আমাকে গোবিন্দ দাঁ ডাকতে এল। ওর সঙ্গে গিয়ে আসরে বসলাম।

    একটু পরে পান্না ও তার সঙ্গিনী সাজসজ্জা করে আসরে ঢুকলো। আমি লক্ষ করে দেখচি, পান্না এসেই আসরের চারিদিকে একবার দেখলে। আমি বসেচি আবদুল হামিদের পেছনে। প্রথমটা আমায় ও দেখতে পেলে না। ওর কৌতূহলী চোখ দুটি যেন নিষ্প্রভ হয়ে গেল, সেটা আমার দৃষ্টি এড়ালো না।

    পান্না গাইতে গাইতে কখনও পিছিয়ে যায়, কখনো এগিয়ে যায়। একটু পরে আমার মনে হল, ও সামনের দিকে মুখ উঁচু করে চেয়ে চেয়ে দেখচে। গোবিন্দ দাঁ আমাকে ঈষৎ ঠেলা দিয়ে মৃদুস্বরে কি বললে, ভালো শুনতে পেলাম না। ও সত্যি সত্যি আমাকে খুঁজচে? আমার কত বয়স হয়েচে, আর ও কতটুকু মেয়ে! আমার বিরহ অনুভব করবে ও মনের মধ্যে?

    আর একটা নেশা আমায় পেয়ে বসল। মদের নেশার চেয়েও বেশি। নাচের আসরে বসে আমি দুনিয়া ভুলে গেলাম। কেউ কোথাও নেই। আছে পান্না, আছি আমি। ঐ সুন্দরী কিশোরী আমাকে ভালোবাসে। এ বিশ্বাস করি নি এখনও মনেপ্রাণে। তবুও ভাবতে ভালো লাগে, নেশা লাগে।

    হয়তো এটা আমার দুর্বলতা। আমার বুভুক্ষিত হৃদয়ের আকূতি। কখনো কেউ আমায় ওভাবে ভালোবাসেনি। সুরবালা? সে আছে, এই পর্যন্ত। কখনো তাকে দেখে আমার এমন নেশা আসে নি মনে।

    নাচের আসর থেকে উঠে চলে এলাম, গোবিন্দ দাঁর প্রতিবাদ সত্বেও। ওরা কি বুঝবে আমার মনের খবর? ওরা স্থূল জিনিস দেখতে অভ্যস্ত, স্থূল জিনিস নিয়ে কারবার করতে অভ্যস্ত। ওদের ভাষা আমি বুঝি না।

    ডাক্তারখানায় এসে দেখি, কেউ নেই। কম্পাউন্ডার গিয়ে বসেছে খেমটার আসরে। চাকরটাও তাই। নিজে আলো জ্বালি, বসে বসে স্টোভ ধরিয়ে একটু চায়ের ব্যবস্থা করি। পুরনো খবরের কাগজ একখানা পড়ে ছিল টেবিলে, তাই দেখি উলটে পালটে। ওই গোবিন্দ দাঁটা আবার এসে টানাটানি না করে! ও কি বুঝবে আমার মনের খবর?

    মাঝি কোথা থেকে এসে দাঁড়িয়ে বললে—বাবু চা খাচ্চেন, একটু দেবেন মোরে?

    —কিসে করে খাবে? নিয়ে এসো একটা কিছু—

    —নারকোলের মালা একটা আনবো বাবু?

    —যা হয় করো।

    —বাবু, বাড়ি যাবেন না?

    —না, সকালের দিকে খোঁজ করিস। এখন ঘুমিয়ে নিগে যা—

    মাঝির সঙ্গে কথা বলে যেন আমি বাস্তব জগতের সংস্পর্শে এলাম। যে জগতে আমি গ্রাম্যডাক্তারি করে খাই, সেখানে প্রেমও নেই, চাঁদের আলোও নেই, কোকিলের ডাকও নেই। কড়া চা খেয়ে ভাবি একটু ঘুমুবো, মাঝিও চলে গেল, সম্ভবত ঘুমুতে গেল। এমন সময় নেপাল দোর ঠেলে ঘরে ঢুকলো।

    বললাম—কি নেপাল, এত রাতে?

    —বাবু, আপনি শোবেন তা ভাবলাম এখানে মশারি নেই—আমার বাড়ি যদি—বৌ বলে দিলে—

    —তোমার বউ কোথায়? খেমটার আসরে নাকি?

    নেপাল জিভ কেটে বললে—রামোঃ, বড়বৌ কক্ষনো ওসব শুনতে যায় না।

    —শুনে বড় সুখী হলাম নেপাল। না যাওয়াই ভালো।

    —বাবু, একটা কথা বলি, আবদুল হামিদ আর গোবিন্দ দাঁর সঙ্গে আপনি মিশবেন না। ওরা লোক ভালো না।

    —সে আমি জানি!

    —বড়বৌও বলছিল—

    —কি বলছিলেন?

    —বলছিল, ডাক্তারবাবুকে বলে দিও যেন ওদের সঙ্গে না মেশেন। ওরা কুপথে নিয়ে যাবে তাঁকে। কত লোককে যে ওরা খারাপ করেচে আমার চোখের ওপর, তা আর কি বলব আপনাকে ডাক্তারবাবু। এই বাজারে ছিল হরি পোদ্দারের ছেলে বিধু, তাকে ওরা মদে মেয়েমানুষে সর্বস্বান্ত করে ছেড়ে দিল।

    —ও সব কিছু নয় নেপাল। নিজের ইচ্ছে না থাকলে কেউ কখনো কোথাও যায় না। ওসব ভুল কথা। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ আমায় খারাপ করতে পারে না জেনো। আমি যখন ওপথে নামবো, তখন নিজের ইচ্ছেতেই যাবো। লোকে বললেও যাবো, না বললেও যাবো।

    —না, আমি এমনি কথার কথা বলচি—মশারি দিয়ে যাই?

    —আনতে পারো।

    .

    নেপাল চলে যাবার আধঘণ্টা পরে আবার কে দোর ঠেলচে দেখে খিল খুলে দিতে গেলাম। গিয়ে দেখি পান্না দাঁড়িয়ে বাইরে। আসরের সাজ পরনে। ঝলমল করচে রূপ, মুখে পাউডার, জরিপাড় চাঁপা রঙের শাড়ি পরনে, একগোছা সোনার চুড়ি হাতে, ছোট্ট একটা মেয়েলি হাত-ঘড়ি চুড়ির গোছার আগায়, চোখে সুর্মা। সঙ্গে কেউ নেই।

    অবাক হয়ে বললাম—কি?

    ও ‘কিছু না’ বলে ঘরে ঢুকলো। বসল একখানা চেয়ার নিজেই টেনে। আমার বুকের ভেতর তখন কি রকম করচে। আমি ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়েই আছি। পান্নাও কোনো কথা বলে না। আমি একবার বাইরে মুখ বাড়িয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলাম, কেউ নেই।

    ফিরে এসে একটু কড়াসুরে বললাম—কি মনে করে?

    পান্না আমার মুখের দিকে চোখ তুলে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর আবার চোখ নিচু করে ঘরের মেঝের দিকে চাইল। কোনো কথা বললে না। ঈষৎ হাসির রেখা ওর ওষ্ঠের প্রান্তে।

    আমি বললাম—কিছু বললে না যে?

    —এলাম এমনি।

    বলেই ও একটু হেসে আবার মুখ নিচু করে মেঝের দিকে চাইলে।

    বললাম—তুমি কি করে জানলে আমি এখানে?

    —আমি জানি।

    —জানো মানে কি? কে বলচে?

    ও ছেলেমানুষের মতো দুষ্টুমির হাসি হেসে বললে—বলব না।

    আমি রাগের সুরে বললাম—তুমি না বললেও আমি জানি। আবদুল হামিদ, না হয় গোবিন্দ দাঁ।

    পান্না এবার আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দৃঢ়স্বরে বললে—না।

    ও সত্যি কথা বলচে আমার মনে হল। কৌতূহলের সুরে বললাম—তবে কে আমি জানতে চাই।

    পান্না মুষ্টিবদ্ধ হাতে নিজের বুকে একটা ঘুষি মেরে বললে—এই!

    —কি এই?

    —এইখানে জানতে পারে!

    হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে—আপনি তা বুঝবেন না। বলেই আবার ও মুখ নিচু করে মেঝের দিকে চাইলে। এবার শুধু মুখ নিচু নয়, ঘাড়সুদ্ধু নিচু। সে এক অদ্ভুত ভঙ্গি। ওর অতি চমৎকার সুডৌল লাবণ্যময় গ্রীবাদেশে সরু সোনার হার চিক চিক করচে, এলানো নামানো খোঁপা থেকে হেলা গোছা চুল এসে ঘাড়ের নিচের দিকে ব্লাউজের কাপড়ে ঠেকেচে। ওর মুখ দেখতে পাচ্চি নে—মনে হচ্চে এক অপূর্ব সুন্দরী লাবণ্যবতী কিশোরী আমার সামনে। ধরা দেবার সমস্ত লক্ষণ ওর ঘাড় নিচু করার ভঙ্গির মধ্যে সুপরিস্ফুট। অল্পক্ষণের জন্যে নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম, কি হত এ অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে, মানে আর কিছুক্ষণ স্থায়ী হলে, তা আমি বলতে পারি নে, সে সময় আমার মনে পড়লো নেপাল মশারি নিয়ে যে-কোনো সময়ে এসে পড়তে পারে। আমি ব্যস্তভাবে ওর হাত ধরে চেয়ার থেকে জোর করে উঠিয়ে বললাম—তুমি এক্ষুনি চলে যাও—

    ও একটু ভয় পেয়ে গেল। বিস্ময়ের সুরে বললে—এখুনি যাবো?

    —হ্যাঁ হ্যাঁ, এখুনি।

    —আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছেন?

    —এখুনি নেপাল আসবে মশারি নিয়ে। ওর বাড়ি থেকে মশারি আনতে গেল আমার জন্যে।

    পান্নার চোখে ভয় ও না-বোঝার দৃষ্টিটা চকিতে কেটে গেল। ব্যাপারটা তখন ও বুঝতে পেরেচে। বললে—আপনি আসরে চলুন।

    —না।

    —কেন যাবেন না? আমি মাথা কুটবো আপনার সামনে এখুনি। আসুন।

    —না।

    —তবে দেখবেন? এই দেখুন—

    সত্যিই ও হঠাৎ নিজের শরীরকে মাটির দিকে ঝুঁকিয়ে মেজের ওপর হাঁটু গেড়ে বসতে যেতেই আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম—থাক থাক, যাচ্ছি আসরে—তুমি যাও।

    পান্না কোনো কথাটি আর না বলে ভালো মানুষের মতো চলে গেল।

    একটু পরেই নেপাল মশারি নিয়ে ঘরে ঢুকলো।

    বললে—কোথায় চললেন? ঘরে কিসের গন্ধ?

    —কি?

    নেপাল মুখ ইতস্তত ফিরিয়ে নাক দিয়ে জোরে নিঃশ্বাস টেনে টেনে বললে—সেন্ট মেখেছেন বুঝি? সেন্টের গন্ধ!

    —তা হবে।

    পান্নার কাণ্ড। সস্তা সেন্ট মেখে এসে ঘরময় এই কীর্তি করে গিয়েছে। তবুও গন্ধটা যেন বড় প্রিয় আমার কাছে। ও যেন কাছে কাছে রয়েছে ওই গন্ধের মধ্যে দিয়ে।

    বললাম—শোব না। একটু আসরে যাচ্ছি।

    —কি দেখতে যাবেন ডাক্তারবাবু! যাবেন না।

    —তা হোক, কানের কাছে গোলমালে ঘুম হয় না। তার চেয়ে আসরে বসে থাকা ভালো।

    —চলুন আমার বাড়ি শোবেন। বড়বৌ বড় খুশি হবে এখন।

    —না। আসরে যাই একটু—

    নেপালের ওপর মনে মনে বিরক্ত হই। তুমি বা তোমার বড়বৌ আমার গার্জেন নয়; আমিও কচি খোকা নই। বার বার এক কথা বলবার দরকার কি?

    .

    একটু পরে আমি আসরে গিয়ে বসলাম। সামনেই পান্না। কিন্তু ওর দিকে যেন চাইতে পারচি নে। চোখের কোণ দিয়ে ওকে দেখচি। গোবিন্দ দাঁ, আবদুল হামিদ সবাই বসে। ওদের দলের মাঝখানে বসে আমার লজ্জা করতে লাগলো পান্নার দিকে চাইতে। পান্নাও আমার দিকে চেয়ে প্রথমবার সেই যে একবার মাত্র দেখলে, তারপর সেও আর আমার কাছে এলোও না, আমার দিকে ফিরেও চাইলে না।

    অনেকক্ষণ পরে একবার চাইলে, ভীরু কিশোরীর সলজ্জ চাউনি তার প্রণয়ীর দিকে। এই চাউনি আমায় মাতাল করে দিলে একেবারে, আমার অভিজ্ঞতা ছিল না, ভগবান জানেন সুরবালা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের দিকে কখনো খারাপভাবে চোখ মেলে চাই নি বা প্রেম করি নি। পাড়াগাঁয়ে ওসব নেইও অতশত। সুযোগ সুবিধার অভাবও বটে, তা ছাড়া আমার মতো নীতিবাগীশের এদিকে রুচিও ছিল না। সলজ্জ লুকানো চাউনির অদ্ভুত মাদকতা সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই আমার থাকবার কথা নয়। আমার হঠাৎ বড় আনন্দ হল। কেন আনন্দ, কিসের আনন্দ সে সব আমি ভেবে দেখিনি, ভেবে দেখবার প্রবৃত্তি তখন আমার নেইও। অত্যন্ত আনন্দে গা-হাত-পা যেন বেলুনের মতো হালকা হয়ে গেল। আমি যেন এখনি আকাশে উড়ে যেতে পারি। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ এই মুহূর্তে যদি কেউ থাকে তবে সে আমি। কারণ পান্নার ভালোবাসা আমি লাভ করেছি।

    ওই চাউনি আমায় বুঝিয়ে দিয়েচে সে কথা।

    সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পাগল করেচে ওই চিন্তা। আমার মনের মধ্যে আর একটা বুভুক্ষু মন ছিল, তার এতদিন সন্ধান পাইনি, আজ সে মন জেগে উঠেচে পান্নার মতো রূপসী কিশোরীর স্পর্শে। আমার মতো মধ্যবয়সী লোককে সতেরো-আঠারো বছরের একটি সুন্দরী কিশোরী ভালোবেসে ফেলেচে—এ চিন্তা এক বোতল উগ্র সুরার চেয়েও মাদকতা আনে। যার ঠিক ওই বয়সে ওই অভিজ্ঞতা হয়নি, সে আমার কথা কিছুই বুঝতে পারবে না। জীবনের সব কিছু অভিজ্ঞতা-সাপেক্ষ। সে রস যে পায় নি, হাজার বর্ণনা দিলেও সে বুঝতে পারবে না সে রসের ব্যাপার। এই জন্যেই বলেচে, অনধিকারীর সঙ্গে কোনো কথা বলতে নেই।

    এমন একটি অনধিকারী এই গোবিন্দ দাঁ! আবদুল হামিদটাও তাই। স্থূল মনে ওদের অন্য কোনো রসের স্পর্শ লাগে না, স্থূল রস ছাড়া। আবদুল হামিদ দাঁত বের করে বললে—আপনি বড় বেরসিক ডাক্তারবাবু—

    আমি বললাম—কেন?

    —অমন মাল নিয়ে গেলাম আপনার ডাক্তারখানায়—আর আপনি—

    —ওসব কথা এখানে কেন?

    —তাই বলচি।

    গোবিন্দা দাঁ বললে—ছুঁড়িটা কিন্তু চমৎকার দেখতে, যাই বলুন ডাক্তারবাবু! আর কি ঢং, কি হাসি মুখের, দেখুন না চেয়ে!

    আবদুল হামিদ বললে—ডাক্তারবাবু ওর ওপর কেমন চটা। কই, আপনি তো ওর দিকে ফিরেও চাইচেন না? অথচ দেখুন, আসর-সুদ্ধ লোক ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে—

    আমি যে কেন ওর দিকে চাইচি না, কি করে বুঝবে এই সব স্থূলবুদ্ধি লোক। আমি সব দিকে চাইতে পারি, শুধু চাইতে পারি না পান্নার মুখে। পান্নাও পারে না আমার দিকে চাইতে। এ তত্ব বোঝা এদের পক্ষে বড়ই কঠিন।

    আবদুল হামিদকে বললাম—বকবক না করে চুপ করে থাকতে পারো না?

    গোবিন্দ দাঁ বললে—ডাক্তারবাবু আমাদের সাধুপুরুষ কিনা, ওসব ভালো লাগে না ওঁর। ও রসে বঞ্চিত।

    আমি উঠেই চলে যেতাম আসর থেকে, শুধু পান্নার চোখের মিনতি আমাকে আটকে রেখেচে ওখানে। ওদের কথাবার্তা আমার ভালো লাগছিল না মোটে।

    আবদুল হামিদ আমার সামনে রুমালে বেঁধে দুটাকা প্যালা দিলে—আমাকে দেখিয়ে দিলে। আমি পারলাম না প্যালা দিতে। পান্নার সঙ্গে সেরকম ব্যবসাদারি করতে আমার বাধে।

    আমি বললাম—এ ক’দিনে যে অনেক টাকা প্যালা দিলে আবদুল—

    আবদুল হামিদ বললে—টাকা দিয়ে সুখ এখানে, কি বলেন ডাক্তারবাবু? কত টাকা তো কতদিকে যাচ্ছে!

    —সে তো বটেই, টাকা ধন্য হয়ে গেল।

    —ঠাট্টা করচেন বুঝি? আপনিও তো টাকা দিয়েচেন!

    —কেন দেবো না?

    —তবে আমাকে যে বলচেন বড়?

    —কিছু বলচি নে। যা খুশি করতে পারো।

    গোবিন্দ দাঁ বললে—ওসব কথা বোলো না ডাক্তারবাবুকে। উনি অন্য ধাতের লোক। রসের ফোঁটাও নেই ওঁর মধ্যে।

    আবদুল একচোট হো হো করে হেসে নিয়ে বললে—ঠিক কথা দাঁ মশায়। অথচ বয়সে আমাদের চেয়ে ছোট। আমাদের এ বয়সে যা আছে, ওঁর তাও নেই।

    আমি কাউকে কিছু না বলে ডিসপেনসারিতে চলে গেলাম। মাঝিটা অঘোরে ঘুমুচ্চে। তাকে আর ওঠালাম না। নিজেরও ঘুম পেয়েচে, কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা আমার মাথার মধ্যে এমন একটা গোলমালের সৃষ্টি করেচে যে ঘুম প্রায় অসম্ভব। আমি ব্যাপারটাকে ভালো করে ভেবে দেখবার অবকাশ পেয়েও পাচ্ছিনে। মন এখান থেকে একটা ভালো টুকরো, ওখান থেকে আর এক টুকরো নিয়ে আস্বাদ করেই মশগুল, সমস্ত জিনিসটা ভেবে দেখবার তার সময় নেই।

    এমন সময় দোরে মৃদু ঘা পড়লো। আমার বুকের মধ্যে যেন ঢেঁকির পাড় পড়লো সঙ্গে সঙ্গে। আমি বুঝেচি কে এত রাত্রে দরজায় ঘা দিতে পারে।

    পান্নার গায়ে একখানা সিল্কের চাদর। খোঁপা এলিয়ে কাঁধের ওপর পড়েচে; চোখ দুটোতে উত্তেজনা ও উদ্বেগের দৃষ্টি। সে যেন আশা করে নি আমায় এখন দেখতে পাবে। দেখে যেন আশ্বস্ত হয়েচে। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

    আমি বললাম—কি?

    পান্না চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, একবার ঘরের এদিক ওদিক চেয়ে দেখলে, বললে—এলাম আপনার এখানে।

    —তা তো দেখতে পাচ্ছি, কি মনে করে?

    —দেখতে এসেছি, মাইরি বলছি।

    —বেশ। দেখে চলে যাও—

    —তাড়িয়ে দিচ্চেন?

    —হ্যাঁ।

    —আপনি বড় নিষ্ঠুর, সত্যি—

    আমি হেসে ফেললাম। বললাম—আমি না তুমি? তুমি জান এখানে আসা কত অন্যায়?

    —তবু আসি কেন, এই তো?

    —ঠিক তাই।

    —যদি বলি, না এসে থাকতে পারি নে?

    —আমার বিশ্বাস হয় না।

    —কি করলে বিশ্বাস হয়? আমি এই দেয়ালে মাথা কুটবো? দেখুন—

    পান্না সত্যিই দেয়ালের দিকে এগিয়ে যায় দেখে আমি গিয়ে ওর হাত ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে কি হল, তীব্র বৈদ্যুতিক স্পর্শে যেন আমার সারা দেহ ঝিমঝিমিয়ে উঠল। সুরবালাকে ছাড়া আমি কোনো মেয়েকে স্পর্শ করি নি তা নয়। আমি ডাক্তার মানুষ, ব্যবসার খাতিরে কতবার কত মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে রোগ পরীক্ষা করতে হয়েচে, কিন্তু এমন বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সঞ্চারিত হয় নি সারা দেহে।

    পান্না ফিক করে হেসে বললে—ছুঁলেন যে বড়?

    বললাম—কেন ছোঁব না? তুমি মেথর নও তো—

    —আপনার চোখে তাদের চেয়েও অধম।

    —বেশ, যদি তাই হয়, তবে এলে কেন?

    —ওই যে আগে বললাম, আমার মরণ, থাকতে পারি নি।

    —কেন, গোবিন্দ দাঁ, আবদুল হামিদ?

    —আমি ঠিক এবার মাথা কুটবো আপনার পায়ে। আর বলবেন না ও কথা।

    পান্না খুব দৃঢ়স্বরে এই কথাগুলি বললে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের এদিক ওদিক চেয়ে দেখলে আবার।

    আমি বললাম—কি দেখচো?

    —ঘরে কেউ নেই? আপনি একা?

    —কেন বল তো?

    —তাই বলচি।

    —না। মাঝি ঘুমুচ্চে বাইরের বারান্দায়।

    —আপনার বাড়ি কোথায়?

    —এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে। নৌকো করে যাতায়াত করি।

    —আপনার নৌকোর মাঝি? ওকে বিদায় দিন!

    —বা রে, কেন বিদেয় করবো?

    পান্না মুখ নিচু করে রইল। জবাব দিলে না আমার কথার। আমি বললাম—শোনো, তুমি এখান থেকে যাও।

    পান্না বললে—তাড়িয়ে দিচ্ছেন?

    —দিচ্ছিই তো।

    —আচ্ছা, আপনার মনে এতটুকু কষ্ট হয় না যে আমি যেচে যেচে—

    এই পর্যন্ত বলেই পান্না হঠাৎ থেমে গেল। ওর ব্রীড়ামূর্ছিত হাসিটুকু বেশ দেখতে।

    আমি বললাম—আচ্ছা, বসো পান্না।

    পান্না মুখ তুলে আমার দিকে চেয়ে হাসলে। চোখের চাউনিতে আনন্দ। যে চেয়ারখানা ধরে সে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই চেয়ারটাতেই বসে পড়লো। ঘরের কোনো দিকে কেউ নেই। নির্জন রাত্রি। বর্ষার মেঘ জমেছে আকাশে শেষ রাতের শেষ প্রহরে, খোলা জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্চি। পান্না এত কাছে, এই নির্জন স্থানে, নিজে সেধে ধরা দিতে এসেছে। আমার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। বৃদ্ধ হয়ে পড়ি নি এখনো। পান্না চেয়ারে বসে সলজ্জ হাসি হাসলে আবার। ওর মুখে এমন হাসি আমি আজ রাত্রেই প্রথম দেখেচি। পুরুষের সাধ্য নেই এই হাসির মোহকে জয় করে। চেয়ারের হাতলে রাখা পান্না তার সুডৌল, সুগৌর, সালঙ্কারা বাহু আমার দিকে ঈষৎ এগিয়ে দিলে হয়তো অন্যমনস্ক হয়েই। কেউ কোনো কথা বলচি না, ঘরের বাতাস থম থম করছে—যেন কিসের প্রতীক্ষায়। নাগিনী কুহক দৃষ্টিতে আকর্ষণ করচে তার শিকারকে।

    এমন সময়ে বাইরের বারান্দাতে মাঝিটার জেগে ওঠবার সাড়া পাওয়া গেল। সে হাই তুলে তুড়ি দিচ্চে, এর কারণ ঠিক সেই সময়ে বৃষ্টি এসেচে বাইরে। বৃষ্টির ছাটে মাঝির ঘুম ভেঙ্গেচে।

    আমার চমক ভেঙ্গে গেল, মোহগ্রস্ত ভাব পলকে কেটে যেতে আমি চাঙ্গা হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে পান্নাও উঠে দাঁড়ালো। শঙ্কিত কণ্ঠে বললে—ও কে?

    —আমার মাঝি, সেই তো—যার কথা বলেছিলাম খানিক আগে।

    —ও ঘরে আসবে নাকি?

    —নিশ্চয়ই।

    —আমি তবে এখন যাই। আপনি যাবেন, না থাকবেন?

    —যাবো।

    —না, যাবেন না। আজ আমাদের শেষ দিন। কাল চলে যাবো। আপনাকে থাকতে হবে। আমার মাথার দিব্যি। আমি আসবো আবার। কখনো যাবেন না।

    হেসে বললাম—তুমি হিপনটিজম করা অভ্যেস করেচ নাকি? ও রকম বার বার করে একটা কথা বলচো কেন?

    —সে আবার কি?

    —সে একটা জিনিস। তাতে যে-কোনো লোককে বশ করা যায়।

    —সত্যি? শিখিয়ে দেবেন আমাকে সে জিনিসটা?

    মনে মনে বললাম—সে আমাকে শেখাতে হবে না। সে তুমি ভীষণভাবে জানো।

    পান্না সামনের দোর খুলে বেরিয়ে গেল চট করে।

    রাত কতটা ছিল আমার খেয়াল হয়নি। সে খেয়াল ছিলও না। পান্না চলে গেলে মনে হল আমার সমস্ত সত্তা যেন ও আকর্ষণ করে নিয়ে চলে গেল। মেয়েমানুষের আকর্ষণে এমন হয় তা কোনো দিন আমার ধারণা নেই। সুরবালাও তো মেয়েমানুষ, কিন্তু তার আসঙ্গলিপ্সা আমাকে এমন কুহকজালে ফেলে নি কোনো দিন। মনের মধ্যে পান্নার চিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তা স্থান পায় তার সাধ্য কি! জীবনের এ এক অদ্ভুত ধরনের নতুন অভিজ্ঞতা। আজ মনে পড়লো, রামপ্রসাদ ও শান্তির কথা। বেচারি রামপ্রসাদের বোধ হয় এমনি অবস্থা হয়েছিল, তখন আমার অমন অবস্থা হয় নি, আমি ওর মনের খবর কেমন করে জানবো?

    পান্নার কি আছে তাও জানি না। এমন কিছু অপূর্ব ধরনের রূপসী সে নয়। অমন মেয়ে আর কখনও দেখি নি, এ কথাও অবিশ্বাস্য। সুরবালা যখন নববধূরূপে এসেছিল আমাদের বাড়ি, তখন ওর চেয়ে অনেক রূপসী ছিল, এখন অবিশ্যি তার বয়েস অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে; এখন আর তেমন রূপ নেই। কিন্তু ওসব কিছু নয় আমি জানি। পান্নার রূপ ওর প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, ওর মুখের শ্রীতে, ওর চোখের চাউনিতে, ওর মাথার চুলের ঢেউ-খেলানো নিবিড়তায়, ওর চটুল হাসিতে, ওর হাত-পায়ের লাস্যভঙ্গিতে। মুখে বলা যায় না সে কি। অথচ তা পুরুষকে কী ভীষণভাবে আকর্ষণ করে—আর আমার মতো পুরুষকে, যে কখনও ছাত্রবয়সেও মেয়েদের ত্রিসীমানা মাড়ায় নি। মেডিকেল কলেজে পড়বার সময় মিস রোজার্স বলে একজন এ্যাংলো ইন্ডিয়ান নার্সকে নিয়ে ছেলেদের মধ্যে কত দ্বন্দ্ব, কত নাচানাচি, কত রেষারেষি চলত। কে তাকে নিয়ে সিনেমাতে বেরুতে পারে, কে তাকে একদিন হোটেলে খাওয়াতে পারে—এই নিয়ে কত প্রতিযোগিতা চলত—আমি ঘৃণার সঙ্গে দূর থেকে সে সুন্দ-উপসুন্দর যুদ্ধ দেখেচি। কিন্তু আমার মনের অবস্থা যে কখনও এমন হতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাবি নি।

    এখন বুঝেচি, মেয়েদের মধ্যে শ্রেণীভেদ আছে, সব মেয়ে সব পুরুষকে আকর্ষণ করতে পারে না। কে কাকে যে টানবে, সে কথা আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। আচ্ছা শান্তিও তো চটুল মেয়ে আমাদের গ্রামের, শুনতে পাই অনেক পুরুষকে সে নাচিয়েচে, কিন্তু একদিনও তাকে বোন ছাড়া অন্য চোখে দেখি নি।

    মাঝি উঠে এসে বললে—বাবু, বাড়ি যাবেন নাকি?

    —না, আজ আর যাবো না।

    —বাড়িতে ভাববেন।

    —তুই যা না কেন, আমি একখানা চিঠি দিচ্চি।

    —তার চেয়ে বাবু, আমি বলি, আপনি চলুন না কেন। আমি আবার আপনাকে দুপুরের পর পৌঁছে দেবো।

    —আচ্ছা আমি ভেবে দেখি, তুই বাইরে বোস।

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅনশ্বর – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article হীরামানিক জ্বলে – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }