Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অথৈজল – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প181 Mins Read0

    ৫. দিনকতক বেশ আনন্দেই কেটে গেল

    দিনকতক বেশ আনন্দেই কেটে গেল।

    কিন্তু আমার মনে কেমন এক ধরণের অস্বস্তি শুরু হয়েচে, আমার নিজের উপার্জন এক পয়সাও নেই, পান্নার উপার্জনের অর্থ আমাকে হাত পেতে নিতে হচ্চে, না নিয়ে উপায় নেই। আমি ভাবতে আরম্ভ করেছি, এ ভাবে কতদিন চলবে। ও যা মুজরো করে এনেছিল, তা ফুরিয়ে এল। কলকাতার খরচ। ওর মনে ভবিষ্যতের ভাবনা নেই, বেশ হাসি গল্প গান নিয়ে সুখেই আছে—কিন্তু আমি দেখছি আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পান্নার টাকায় সংসার বেশিদিন চলা সম্ভব হবে কি? আমি সে টাকা বেশিদিন নিতেও পারবো না!

    পান্নাকে কথাটা বললাম।

    ও বুঝতে চায় না। বললে—তাতে কি? আমার টাকা তোমার নিলে কি হবে?

    —মানে নিলে কিছু হবে না। কিন্তু ওতে চলবে না।

    —কেন চলবে না? বেশ তো চলচে।

    —এর নাম চলা?

    বলেই সামলে নিলুম। পান্না সরল মেয়ে, তার জীবন-যাত্রার ধারণাও সরল ও সংক্ষিপ্ত। ওর মা ছিলো মুজরোওয়ালী, যা রোজগার করেচে তাতেই সেকালে সংসার চলে গিয়েচে, বিলাসিতা বাবুগিরি জানতো না। কোনোরকমে খাওয়া পরা চলে গেলেই খুশি। ওরও জীবন-যাত্রার প্রণালী সম্বন্ধে যে সহজ ধারণা আছে, আমি তার অপমান করতে চাইনি।

    বললাম—ধরো তুমি দু’দিন বসে থাকো, আসরের বায়না না পাও?

    —সে তুমি ভেবো না।

    —আমাকে বুঝিয়ে বলো কিসে চলবে? খাব কি দু’জনে?

    পান্না হি হি করে হেসে ওঠে। ঘাড় দুলিয়ে বলে—খেতে পেলেই ত তোমার হল?

    আমি চুপ করে রইলাম। ও সংসারের কোনো খবরই রাখে না। কি কথা বলব এ সম্বন্ধে ওকে?

    ও বললে—তুমি কি ভাবচো শুনি?

    —ভাবচি আমাকেও টাকা রোজগার করতে হবে।

    —বেশ, পার তো করো। আমি কি বারণ করেছি?

    —তুমি জান আমি ডাক্তার। আমাকে কোথাও বসে ডাক্তারখানা খুলতে হবে, তবে রোজগার হবে।

    —এই বাসার নিচের তলাতে ঘর খালি আছে, ডাক্তারখানা খোলো।

    —তুমি ভারি মজার মেয়ে পান্না! অত সোজা বুঝি! টাকা কই, ওষুধপত্র কিনতে হবে, কত কি চাই। টাকা দেবে?

    —কত টাকা বলো?

    —হাজার খানেক।

    —কত?

    —আপাততঃ হাজার খানেক।

    —উ রে!

    পান্না দীর্ঘ শিস দেওয়ার সুরে কথাটা উচ্চারণ করে চুপ করে গেল।

    আমি জানি ও অত টাকা কখনো একসঙ্গে দেখে নি। বললাম—তুমি ভাবছিলে কত টাকা?

    —আমি? আমি ভাবছিলাম পঁচিশ ত্রিশ।

    —দিতে?

    —আমার হার বাঁধা দাও, দিয়ে টাকা আনো।

    —থাক, রেখে দাও।

    .

    সেদিন দু’টি ডিসপেনসারিতে গিয়ে চাকরির চেষ্টা করলাম। কোথাও সুবিধে হল না। বসে বসে অনেকক্ষণ ভাবলাম একটা নির্জন স্থানে বসে।

    কিন্তু আসল কাজ হয়ে পড়লো অন্য রকম।

    পান্নাও নাচের আসরে বায়না নিতে লাগলো। আমি ওর সঙ্গে সর্বত্রই যাই, বাইজীর পেছনে সারেঙ্গীওয়ালার মতো। পরিচয় দিই দলের রসুইয়ে বামুন বলে, কখনো বলি আমি ওর দূর সম্পর্কের দাদা। এ এক নতুন ধরণের অভিজ্ঞতা; কত রকমের লোক আছে, কত মতলব নিয়ে লোকে ঘোরে, দেখি, বেশ ভালো লাগে। ওরই রোজগারে সংসার চলে। মাঘ মাসের শেষে কেশবডাঙ্গা বলে বড় একটা গঞ্জের বারোয়ারির আসরে পান্নার সঙ্গে গিয়েছি। বেশ বড় বারোয়ারির আসর, প্রায় হাজার লোক জমেচে আসরে। তার কিছু আগে স্থানীয় এক পল্লীকবির ‘ভাব’ গান হয়ে গিয়েচে। অনেক লোক জুটেছিল ‘ভাব’ গান শুনতে। তারা সবাই রয়ে গেল, পান্নার নাচ দেখতে। কিছুক্ষণ নাচ হবার পরে দেখলাম পান্না সকলক মুগ্ধ করে ফেলেচে। টাকা সিকি দুয়ানির প্যালাবৃষ্টি হচ্চে ওর ওপরে। গঞ্জের বড় বড় ধনী ব্যবসাদার সামনে সার দিয়ে বসে আছে আসরে। সকলেরই দৃষ্টি ওর দিকে।

    আমি বসেছিলাম হারমোনিয়ম-বাজিয়ের বাঁ পাশে। আমায় এসে একজন বললে—আপনাকে একটু আসরের বাইরে আসতে হচ্চে—

    —কেন?

    —ঝড়ুবাবু ডাকচেন।

    —কে ঝড়ুবাবু?

    —আসুন না বাইরে।

    লোকটা আমাকে আসর থেকে কিছুদূরে নিয়ে গেল একটা পুরনো দোতলা বাড়ির মধ্যে। সেখানে গিয়ে দেখি জনকতক লোক বসে মদ খাচ্চে। মদ খাওয়া আমি ঘৃণা করি। আমি চলে আসতে যাচ্চি ঘরে না ঢুকেই—এমন সময় ওদের মধ্যে একজন বললে—শুনুন মশাই, এদিকে আসুন। আমার সঙ্গের লোকটি বললে—উনিই ঝড়ুবাবু।

    ঝড়ুটড়ু আমি মানি নে, অধীর বিরক্তির সঙ্গে বললাম—কি বলচেন?

    —আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে।

    —কি কথা?

    —ওই মেয়েটির সঙ্গে আপনার কি সম্বন্ধ?

    —কেন?

    —বলুন না মশাই, আমরা সব বুঝতে পেরেচি।

    —ভালোই করেচেন। আমি এখন যাই।

    —না না, শুনুন। কিছু টাকা রোজগার করবেন?

    —বুঝলাম না আপনাদের কথা।

    আমি কিন্তু বুঝতে পেরেচি ওরা কি বলবে। আমি বাইরে যাবার জন্যে দরজার কাছে আসতেই একজন ছুটে এসে আমার সামনে হাত জোড় করে বললে—বেয়াদবি মাপ করবেন।

    মদের বোতলের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললে—চলে নিশ্চয়ই?

    আমি রাগের সুরে বললাম—না।

    —বেশ, বসুন না? কত টাকা চাই বলুন, রাগ করচেন কেন?

    ঝড়ুবাবু লোকটি মোটামতো, মদ খেয়ে ওর চোখ লাল হয়ে উঠেচে, গলার সুর জড়িয়ে এসেচে। একটা মোটা তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসে ছিল। আমার দিকে চেয়ে বললে—কুড়ি টাকা নেবেন? পঁচিশ? ওই মেয়েটিকে চাই।

    আমার হাসি পেল ওর কথা শুনে। ও আমাদের ভেবেচে কি?

    আমি কি একটা বলতে যাচ্চি, আমাকে যে সঙ্গে করে এনেছিল সে বললে—ইনি পল্লীকবি ঝড়ুমল্লিক। ঝড়ুমল্লিকের ‘ভাব’ শোনেন নি?

    আর একজন পার্শ্বচর লোক বললে—এ জেলার বিখ্যাত লোক। অনেক পয়সা রোজগার। দশে মানে, দশে চেনে।

    আমি ভালো করে লোকটার দিকে চেয়ে দেখলাম। এতক্ষণ ওর দিকে তেমন করে চাইনি, ভেবেছিলাম এই গঞ্জের পেটমোটা ব্যবসাদার। এবার আমার মনে হল লোকটা সরল প্রকৃতির দিলদরিয়া মেজাজের কবিই বটে।

    আমি নমস্কার করে বললাম—আপনিই সেই পল্লীকবি?

    ঝড়ু মল্লিক হেসে বললে—সবাই বলে তাই। এসো ভাই বসো এখানে। কিছু মনে করো না।

    —আপনার কথা আমি শুনেচি।

    —এসো বসো। এ চলে?

    —আজ্ঞে না, ওসব খাইনে।

    ঝড়ু মল্লিক পার্শ্বচরের দিকে চেয়ে বললে—যাও হে, তোমারা একটু বাইরে যাও—আমি ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলি। সবাই চলে গেল। আমার কাছে ঘেঁষে বসে নীচু সুরে বললে—তোমার স্ত্রী?

    —না।

    —সে আমি বুঝেচি। কি সম্পর্ক তাও বুঝলাম। আমি একটা কথা জানতে চাই। তুমি ভাই এর মধ্যে কেন?

    —তার মানে?

    —তার মানে তুমি ভদ্রলোক। আমি মানুষ চিনি। এর সঙ্গ ছেড়ে দাও। আমি ভুক্তভোগী, বড় কষ্ট পেয়েচি দাদা। কি করতে?

    —ডাক্তারি।

    —সত্যি? কি ডাক্তারি?

    —এম. বি. পাশ ডাক্তার।

    ঝড়ু মল্লিক সম্ভ্রমের মুখে বলে উঠল—বসো, ভালো হয়ে বসো। নাম জিজ্ঞেস করতে পারি? না থাক, বলতে হবে না। এখানে কতদিন?

    —তা মাস ছ’সাত হয়ে গেল।

    —বড় কষ্ট পাবে। আমিই বা তোমাকে কি উপদেশ দিচ্চি! আমি নিজে কি কম ভোগা ভুগেচি! এখনো চোখের নেশা কাটে নি। মেয়েটির নাম কি?

    —পান্না।

    —বেশ দেখতে। খুব ভালো দেখতে। আমি ওকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েচি। অমন মেয়ে এ রকম খেমটার আসরে বড় একটা দেখা যায় না। আচ্ছা, আমি তোমাকে কিছু বলব না আর ও নিয়ে। তুমি এখন ছাড়তে পারবে না তাও জানি। ও বড় কঠিন নেশা, নাগপাশ রে দাদা। বিষম হাবুডুবু খেয়েছি ও নিয়ে। নইলে আজ ঝড়ু মল্লিক সোনার ইট দিয়ে কোঠা গাঁথতে পারতো। এ কি রকম মেয়ে? পয়সাখোর?

    —না, তার উল্টো। বরং রোজগার করে ও, আমি বসে বসে খাই। পয়সাখোর মেয়ে ও নয়।

    মোটামুটি ঝড়ু মল্লিককে সব কথা বললাম। লোকটাকে আমার ভালো লেগেছিল, লোকটা কবি, এতেই আমি ওকে অন্য চোখে দেখেচি। নইলে এত কথা আমি ওকে বলতাম না।

    ঝড়ু মল্লিকের নেশা যেন কেটে গিয়েচে। সব শুনে বললে—এ নিয়ে আমার বেশ ‘ভাবগান’ তৈরি হয়। আসলে কি জানো ভায়া, ভাবেরই জগৎ। যার মধ্যে ভাবের অভাব, তাকে বলি পশু। এই যে তুমি, তুমি লোকটি কম নয়, নমস্য। যদি বল কেন, তবে বলি, ডাক্তারি ছেড়ে, ঘরবাড়ি ছেড়ে, স্ত্রী পুত্র ছেড়ে ওই এক ষোলো সতেরো বছরের মেয়ের পেছনে পেছনে কেন ঘুরে বেড়াচ্চ তুমি? সর্বস্ব ছেড়ে ওর জন্যে? সবাই কি পারে? তোমার মধ্যে বস্তু আছে। ভায়া, এসব সবাই বুঝবে না।

    আমি নিজের কথা খুব কমই ভেবেছি এ ক’মাস। চুপ করে রইলাম।

    ঝড়ুবললে—এ জন্মে এই, আসচে জন্মে এই ভাব দিয়ে তাঁকে পাবে?

    —তাঁকে কাকে?

    —ভগবানকে?

    উত্তরটা যেন তিনি প্রশ্ন করবার সুরে বললেন। আমার বেশ লাগছিল ওর কথা, শুনতে লাগলাম। কবি কিনা, বেশ কথা বলতে পারে। তবে বর্তমানে ভগবানের সম্বন্ধে আমার কোনো কৌতূহল নেই, এই যা কথা।

    ঝড়ুআবার বললে—হ্যাঁ ভায়া, মিথ্যে বলচি নে। এই সর্বস্বত্যাগের অভ্যেস ভাবের খাতিরে, এ বড় কম অভ্যেস নয়, পান্না তোমাকে শেখালে। ও না থাকলে শিখতে পেতে না। অন্য লোকে বলবে তোমাকে বোকা, নির্বোধ, খারাপ, অসৎ চরিত্র বলবে তোমায়।

    আমি বললাম—বলবে কি বলচেন, গ্রামের লোক এতদিন বলতে শুরু করেচে।

    —কিন্তু আমার কাছে ও কথা নয়। আমি ভাবের লোক, আমি তোমাকেও অন্য চোখে দেখব। তুমি ভাবের খাতিরে ত্যাগ করে এসেচ সর্বস্ব; তুমি সাধারণ লোক নও, জন্তু মানুষের চেয়ে অনেক বড়। খাঁটি মানুষ ক’টা? জন্তু মানুষই বেশি। পায়ের ধুলো দাও ভায়া—ভাব আছে তোমার মধ্যে—

    কথা শেষ না করেই ঝড়ু মদের ঝোঁকে কি ভাবের ঝোঁকে জানিনে, আমার পায়ের ধুলো নিতে এল ঝুঁকে পড়ে। আমি পা সরিয়ে নিয়ে তখনকার মতো কবির কাছ থেকে চলে এলাম। মাতালের কাছে বেশিক্ষণ বসে থাকা ভালো নয় দেখচি।

    ঝড়ু মল্লিকের কাছ থেকে চলে তো এলাম, কিন্তু ওর কথা আমার মনে লাগলো। নেশায় পড়ে গিয়েছি কথাটা ঠিকই, আমিও তা এক এক সময় বুঝতে পারি।

    কিন্তু ঝড়ু মল্লিক কবি যখন, তখন জানে এ নেশার মধ্যে কী গভীর আনন্দ! ছাড়া কি যায়? ছাড়া যায় না।

    .

    পান্না সেদিন নাচের আসরের পর এসে ঘুমিয়ে পড়েছে, অনেক রাত—বাইরে চাঁদ উঠেছে, শন শন করে হাওয়া বইচে—আমি বাইরের বারান্দায় শুয়ে ছিলাম—কিন্তু ও বলেছিল আমার কাছে এসে শোবে রাত্তিরে, নয়তো নতুন জায়গা, ভয়-ভয় করবে। নীলি এবার আসে নি, ও একাই মুজরো করতে এসেচে। ভয় ওর করতেই পারে, তাই রাত্রে আমি ঘরের মধ্যেই এলাম।

    পান্না অঘোরে ঘুমুচ্ছে, ওর গলায় সোনার হার। মেয়েমানুষ সত্যিই বড় অসহায়। যে কেউ ওর গলা থেকে হার ছিনিয়ে খুন করে রেখে যেতে পারে এ সব বিদেশ-বিভুঁয়ে। আর ওর যখন এ-ই উপজীবিকা, বাইরে না গিয়ে তখন ওর উপায় নেই। আমি ওকে ফেলে অনায়াসে পালাতে পারি, আমার মহাভিনিষ্ক্রমণ এই মুহূর্তেই সংঘটিত হতে পারে—কিন্তু তা আমি যাবো না। আমার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে চলে এসেচে, একে আমি অসহায় অবস্থায় ফেলে যেতে পারি?

    পান্না আমার পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে উঠল। জড়িত স্বরে বললে—কে?

    —আমি।

    —শোও নি?

    —না। আমি তোমার গলার হার চুরি করবো ভাবছিলাম।

    —সত্যি?

    —আমি মিথ্যে বলচি?

    —বোসো এখানে। হ্যাঁগো, তুমি তা পারো?

    —কেন পারবো না। পুরুষমানুষ সব পারে!

    —তোমার মতো পুরুষমানুষ পারে না। শোনো, একবার কি হয়েছিল আমার ছেলেবেলায়। শশীমুখী পিসি ছিল আমাদের পাড়ায়। পরমা সুন্দরী ছিল সে—আমার একটু একটু মনে আছে। তার সঙ্গে অনেক দিন থেকে রামবাবু বলে একটা লোক থাকতো। তার ঘরেই থাকতো, মদ খেতো, বাজার থেকে হিংয়ের কচুরি আনতো। একদিন রাত্রে, সেদিন সেই কালী পুজোয়, আমার বেশ মনে আছে—শশীমুখী পিসিকে খুন করে তার সর্বস্ব নিয়ে সেই রামবাবু পালিয়ে গেল। সকালে উঠে ঘরের মধ্যে রক্তগঙ্গা।

    —ধরা পড়েছিল?

    —না। কত খোঁজ করা হয়েছিল, কোনো সন্ধান নাকি পাওয়া গেল না।—তারপর শোনো না। ঘরে একটা ক্লকঘড়ি ছিল, তার মধ্যে শশীপিসি জড়োয়ার হার রাখতো। রামবাবু সেটা জানতো না—তার পরদিন সেই হার বেরুলো ঘড়ির মধ্যে থেকে, পুলিশে নিয়ে গেল। কার জিনিস কে খেল! আমাদের জীবনই এইরকম—বুক কাঁপে সব সময়। কখন আছি, কখন নেই। যত পাজী বদমাইশ লোক নিয়ে আমাদের চলতে হয়, ভালো লোক ক’টা আসে আমাদের বাড়ি? বুঝতেই পারচো তো।

    —অর্থাৎ আমি একজন পাজী লোক?

    —ছি, তোমাকে কি বলচি? আমি মানুষ চিনি। তোমার কাছে যতক্ষণ আছি, ততক্ষণ কোনো ভয় থাকে না।

    —আমায় বিশ্বাস হয়?

    —বিশ্বাস হয় কি না বলতে পারি নে। তবে তুমি যদি খুন করেও ফেলো, মনে দুঃখ না নিয়েই মরবো। তোমার ছুরি বুকে বিঁধবার সময় ভয় হবে না এতটুকু।

    —আচ্ছা তুমি এখন ঘুমোও, রাত অনেক হলো। আবার কাল তো সকাল সকাল নাচের আসর।

    —ঘুমুই আর তুমি আমাকে মেরে ফেলো গলা টিপে, না?

    —তা ইচ্ছে হয় তো গলা টিপে মারবো। ঘুমোও।

    .

    ঘুম ভেঙে উঠে দেখি পান্না তখনও অঘোর ঘুমুচ্চে। আমি উঠে বাইরে গেলাম। একটা কদম গাছ, ডালপালা বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সকালের রোদ বাঁকাভাবে গাছটার উপর পড়েচে। গাছটার দৃশ্য আমার মনে এমন এক অপূর্ব ভাব জাগালো যে আমি প্রায় সেখানে বসে পড়লাম। কি যে আনন্দ মনে, আমার এত বৎসরের অভিজ্ঞতায় কখনো আস্বাদ করি নি। আজ আমি পথের ফকির, পসারওয়ালা ‘ডাক্তার’ হয়ে খেমটাওয়ালীর সারেঙ্গী নিয়ে বেড়াচ্ছি—কিন্তু আমার মনে কোনো কষ্ট নেই, কোনো খেদ নেই।

    ঝড়ু মল্লিক ভাবওয়ালা যে পুরনো দোতলা বাড়িতে থাকে, সেটা একটা পুকুরপাড়ে। সারা রাত ভালো করে ঘুম হয় নি, পুকুরে স্নান করতে গিয়ে দেখি ঝড়ু ভাবওয়ালা পুকুরের ওপারে নাইচে।

    আমায় দেখে বললে—ডাক্তারবাবু—

    —কি বলুন?

    —চা খেয়েছেন সকালে? আসুন দয়া করে আমার আস্তানায়।

    —চলুন যাচ্চি।

    লোকটা আমার জন্য খাবার আনিয়েচে বাজার থেকে। খুব খাতির করে বসালে। লোকটাকে আমারও বড় ভালো লেগেছে, এমন দিলদরিয়া ধরণের লোক হঠাৎ বড় দেখা যায় না। সবিনয়ে আমার অনুমতি প্রার্থনা করে (যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না) একটু মদও সে নিজের চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে নিলে। এক চুমুকে চাটুকু খেয়ে নিয়ে আমায় বললে—চলবে?

    —না, আপনি খান—

    —তুমি ভাই নতুন ধরনের মানুষ। আমরা ভাবওয়ালা কিনা, ধরতে পারি। তোমায় নিয়ে ভাব লিখবো কিনা, একটু দেখে নিচ্চি। তুমি বড় ডাক্তার ছিলে, আজ ভাবের জন্যে সারেঙ্গীওয়ালা সেজেচ—

    —তা বলতে পারেন—

    —আর একটা কথা জিজ্ঞেস করি। কিছু মনে কোরো না। মা লক্ষ্মী বর্তমান?

    —হুঁ।

    —কোথায়?

    —দেশের বাড়িতে আছেন।

    ঝড়ু একটু চুপ করে থেকে বললে—তাই তো! ও কাজটা যে আমার তেমন ভালো লাগচে না। মা লক্ষ্মীকে যে কষ্ট দেওয়া হচ্চে। ওটা ভেবে দ্যাখো নি বোধ হয় ভায়া। নতুন নেশার মাথায় মানুষের কাণ্ডজ্ঞান থাকে না—তোমার দোষই বা কি? আমারও ওইরকম হয়েছিল ভায়া। তবে আমার স্ত্রী নেই, ঘর খালি, হাওয়া বইচে হু হু করে। কাল তোমায় একবার বলেছিলাম যে তুমি স্ত্রীপুত্র ছেড়ে বেড়াচ্চ পান্নার পেছনে, কিন্তু রাত্রে ভাবলাম মা লক্ষ্মী তো নাও থাকতে পারেন! তাই জিজ্ঞেস করলাম। আমার ব্যাপার শুনবে? আজ ঝড়ু সোনার ইট দিয়ে বাড়ি গাঁথতো, তোমাকে বললাম যে—

    ঝড়ু একটা লম্বা গল্প ফাঁদলে।

    জায়গাটার নাম সোনামুখী, সেখানে বড় আসরে ভাব গাইতে গিয়েছিল ঝড়ু। একজন অগ্রদানী বামুনের বাড়িতে ওর থাকবার বাসা দেওয়া হয়। বাড়িতে ছিল সেই ব্রাহ্মণের স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক বিধবা ভ্রাতৃবধূ। এই বধূটির বয়স তখন কুড়ি একুশ, পরমা সুন্দরী—অন্ততঃ ঝড়ুর চোখে। অনেক রাত্রে ভাবের আসর থেকে ফিরে এলে এই মেয়েটিই তার খাবার নিয়ে আসতো বাইরের ঘরে। ঝড়ু তার দিকে ভালো করে চাইতো না। ঝড়ু ভদ্রলোক, অমন অনেক গেরস্তবাড়ি তাকে বাসা নিয়ে থাকতে হয় কাজের খাতিরে দেশে-বিদেশে। গেরস্ত মেয়েরা ভাত বেড়ে দিয়েচে সামনে, কখনো উঁচু চোখে চায় নি।

    —সেদিন মেয়েটি ডালের বাটি সামনে ঠেলে দিতে গিয়ে আমার হাতে হাত ঠেকালো। বুঝলে? আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল—আহা! মেয়েটি বললে—গরম? আমি বললাম—না, সে কথা বলি নি। হঠাৎ আপনার হাতে হাত লাগলো, সেজন্যে আমি বড় দুঃখিত। কিছু মনে করবেন না। ডাল গরম নয়, ঠিকই আছে।

    —মেয়েটি বললে—আপনি চমৎকার ভাব তৈরী করেন—

    —আমি বললাম—আপনার ভালো লেগেচে?

    —মেয়েটি পঞ্চমুখে সুখ্যাতি করতে লাগলো আমার গানের। এমন নাকি সে কোথাও শোনে নি। রোজ সে আসরে গিয়ে আমার মুখের দিকে অপলক চোখে নাকি চেয়ে থাকে। তারপর বললে, সে নিজেও গান বাঁধে। আমি চমকে উঠলাম। একজন কবি আর একজন কবি পেলে মনে করে অন্য সব জন্তু-মানুষের মধ্যে এ আমার সগোত্র। তাকে বড় ভালো লাগে। আমি সেই মুহূর্তে মেয়েটিকে অন্য চোখে দেখলাম। বললাম—কই, কি গান? দেখাবেন আমায়? সে লজ্জার হাসি হেসে বললে—সে আপনাকে দেখাবার মতো নয়।

    —কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখালে। সে দিন নয়, পরের দিন দুপুরবেলা। বাইরের ঘরে শুয়ে বিশ্রাম করচি, বৌটি এসে বললে—ঘুমিয়েচেন? সেই গান দেখবেন নাকি?

    —আমি বললাম—আসুন আসুন, দেখি—

    —মেয়েটি একখানা খাতা আমার সামনে ফেলে দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল।

    —আমি বসে বসে সব গানগুলো মন দিয়ে পড়লাম। বেশ চমৎকার ভাব আছে কোনো কোনো গানের মধ্যে। আসলে কি জানেন, মেয়েমানুষের লেখা, যা লিখেচে তাই যেন অসাধারণ বলে মনে হতে লাগলো। আমার মনের রঙে রঙীন হয়ে উঠল ওর লেখা।

    —আধঘণ্টা পরে মেয়েটি আবার ফিরে এল।

    —আবার বললে—ঘুমুচ্চেন?

    —না, ঘুমুই নি। আসুন—

    —দেখলেন?

    —হ্যাঁ, সব দেখেচি। ভালো লেগেচে। আপনার বেশ ক্ষমতা আছে।

    —হ্যাঁ—ছাই!

    —কেমন একটা অদ্ভুত টানা টানা মধুর ভঙ্গিমার সুরে ‘ছাই’ কথাটা ও উচ্চারণ করলে। কি মিষ্টি সুর। আমি ওর মুখের দিকে ক্ষণিকের জন্যে চাইলাম। চোখাচোখি হয়ে যেতেই চোখ নামিয়ে নিলাম। তখনও আমি ভদ্রলোক। কিন্তু বেশিদিন আর ভদ্রতা রাখতে পারলাম না। সে আমার দুর্বলতা। লম্বা গল্প করবার সময় এখন নেই। এক মাসের মধ্যে তাকে নিয়ে পথে বেরুলাম।

    —বলেন কি—

    —আর কি বলি।

    —তারপর?

    —তারপর আর কি। তাকে নিয়ে চলে গেলাম নবদ্বীপ। পতিততারণ জায়গা। বহু পতিত তরে যাচ্চে। জলের মতো পয়সা খরচ হতে লাগলো। তাকে নিয়ে উন্মত্ত, ভাব গাইতে যেতে মনে থাকে না—

    —বলুন, বলুন—

    আমি নিজের দলের লোক পেয়ে গিয়েছি যেন এতদিন পরে। কি মিষ্টি গল্প। আমার মনের যে অবস্থা, তাতে অন্য গল্প ভালো লাগতো না। লাগতো এই ধরনের গল্প। আমার মন যে স্তরে আছে, তার ওপরের স্তরের কথা যে যতই বলুক, সে জিনিস আমি নেবো কোথা থেকে? আমার মনের স্তরে ঝড়ু মল্লিক ভাবওয়ালা আমার সতীর্থ।

    ঝড়ু আমাকে একটা বিড়ি দিতে এলো। আমি বললাম—আমি খাই নে, ধন্যবাদ।

    ও বিস্ময়ের সুরে বললে—তুমি কি রকম হে ডাক্তার? মদ খাও না, সিগারেট খাও না, তবে এ দলে নেমেচ কেন? নাঃ, তুমি দেখছি বড় ছেলেমানুষ। বয়েস কত? চল্লিশ? আমার ঊনপঞ্চাশ। এ পথের রস সবে বুঝতে আরম্ভ করেচ। এর পর বুঝতে পারবে। রসের আস্বাদ যে না জানে, সে মানুষ নয়। রসে আবার স্তর আছে হে, এসব ক্রমে বুঝবে। এই রসই আবার বড় রসে পৌঁছে দেবার ক্ষমতা রাখে—আমি যে ক’বছর তাকে নিয়ে ঘুরেছিলাম, সেই ক’বছর ভাবের পদ আমার মনে আসতো যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। দিন নেই, রাত নেই, সব সময় ভাবের পদ মনে আসচে, গান বাঁধছি সব সময়, আর দুনিয়া কি রঙীন! সে ক’বছর কি চোখেই দেখতাম দুনিয়াকে। আকাশ এ আকাশ নয়, গাছপালা এ গাছপালা নয়—আউশ চালের ভাত আর ভিজে ভাত খেয়ে মনে হত যেন শটীর পায়েস—

    —আহা, বেশ লাগচে। বলুন তারপর কি হল—

    —পরের ব্যাপার খুব সংক্ষেপ। সে দেশ বেড়াতে চাইলে, আমিও দেখালাম। পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, পরের গলগ্রহ হয়ে পড়েছিল, কখনো কিছু দেখে নি। আমি না দেখালে ওকে দেখাবে কে?

    —আপনাকে বেশ ভালোবাসতেন তো?

    —খুব। মেকি জিনিস আমাদের চোখে ধরা পড়ে যায়। তার ভালোবাসা না পেলে কি আর নেশা জমতো রে ভায়া?

    —তারপর দেশ বেড়ালেন?

    —হ্যাঁ। কালনা গিয়েচি, মধুমতী নদীতে নৌকা চড়ে কালীগঞ্জের বাজারে, বারোয়ারির আসরে গিয়েচি—ওদিকে বসিরহাট, টাকী—হাসনাবাদ—জ্যোৎস্নারাতে টাকীর বাবুদের বাগানবাড়িতে দু’জনে বেড়িয়েচি। তার মনে কোনো দুঃখু রাখি নি। কলকাতায় নিয়ে যাবো, সব ঠিকঠাক—এমন সময় ভায়া, আঁশমালির বাজারে গেলাম গান গাইতে। ওকে নিয়ে গেলাম। সেখানে হাটে বড় বান মাছ কিনলাম এক জোড়া, রাত্রে সেই মাছ খেয়ে দুজনেরই সকালে ভেদবমি। অনেক কষ্টে আমি বেঁচে উঠলাম, সে দুপুরের পরে মারা গেল। সে কখন গিয়েচে, আমি তা জানি না, আমার তখন জ্ঞান নেই। মানে আমার নিজেরই যাবার কথা, তা আমার রোগ-বালাই নিয়ে সে চলে গেল—বড্ড ভালোবাসতো কিনা।

    ঝড়ু ভাবওয়ালার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। আমি আর কোনো কথা বললাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পরে ঝড়ু বোধ হয় একটু সামলে নিয়ে বললে—পান্নাকে দেখে তার কথা মনে পড়লো, অবিকল ওর মতো দেখতে—তাই আমি বলি তোমাকে—কিছু মনে কোরো না ভায়া—

    —এখন কি একাই আছেন? ক’বছর আগের কথা তিনি মারা গিয়েছেন?

    —ন’ বছর যাচ্ছে। না, একা নেই। একা থাকতে পারে আমাদের মতো লোক? মিথ্যে সাধুগিরি দেখিয়ে আর কি হবে। আছে একজন, তবে তার মতো নয়। দুধের সাধ ঘোলে মেটানো। আর ধরো এখন আমাদের বয়েসও তো হয়েচে? এই বয়েসে আর কি আশা করতে পারি?

    .

    বেলা প্রায় দশটা। আমি ঝড়ু মল্লিকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় এসে দেখি পান্না কুটনো কুটচে, সেখানে দু’টি মেয়ে বসে আছে ওরই বয়সী। আমায় দেখে মেয়ে দু’টি উঠে চলে গেল। পান্না বললে—বোষ্টমের মেয়ে ওরা, এখানেই বাড়ি। আমি কীর্তন গাই কিনা জিজ্ঞেস করছিল।

    —কেন, খেমটা ছেড়ে ঢপের দল বাঁধবে নাকি?

    —তা নয়, মেয়ে দুটোর ইচ্ছে নাচগান শেখে। তা আমি বলে দিইচি, গেরস্তবাড়ির মেয়েদের এখানে যাতায়াত না করাই ভালো। আমরা উচ্ছন্নে গিয়েচি বলে কি সবাই যাবে?

    —খুব ভালো করেচ। আচ্ছা, তোমার মনে হয় তুমি উচ্ছন্নে গিয়েচ?

    —বোসো এখানে। মাঝে মাঝে গেরস্তবাড়ির বৌ-ঝি গঙ্গাস্নান করতে যেত, দেখে হিংসে হত। এখন আমার যেন আর সে রকমটা হয় না।

    —না হওয়ার কারণ কী?

    পান্না আমার দিকে চেয়ে সলজ্জ হেসে মুখ নিচু করলে। বললে—চা খাবে না? খাও নি তো সকালে। না, সে তোমাকে বলা হবে না। শুনে কি হবে? চা চড়াবো? খাবার আনিয়ে রেখেচি, দিই?

    —না, আমি ঝড়ু ভাবওয়ালার বাসায় চা খাবার খেয়ে এলাম। তুমি তখন ঘুমুচ্ছিলে। সেইখানেই এতক্ষণ ছিলাম।

    —ওমা, দ্যাখো দিকি! আমি কি করে জানবো, আমি তোমার জন্যে গরম জিলিপি আর কচুরি আনিয়ে বসে আছি। খাও খাও—

    —তুমিও খাও নি তো? সে আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি যখন দেখলে এত বেলা হয়ে যাচ্চে, তোমার ভাবা উচিত ছিল আমার চা খাওয়া বাকি নেই। তুমি খাবারও খাও নি, চাও খাও নি নিশ্চয়ই? ছি, নাও চড়াও চা, আমিও খাব।

    ঝড়ু মল্লিক ভাবওয়ালার ওখানে সন্ধ্যায় আমার নিমন্ত্রণ। পান্নাকেও নিয়ে যেতে বলেছিল।

    পান্নাকে বললাম সে কথা, কিন্তু ও যেতে চাইলে না। বললে—মেয়েমানুষের যেখানে সেখানে যেতে নেই পুরুষের সঙ্গে। তুমি যাও—

    হেসে বললাম—এত আবার শিখলে কোথায় পান্না?

    —কেন, আমি কি মেয়েমানুষ নই?

    —নিশ্চয়ই।

    —আমাদের এ সব শিখতে হয় না। এমনি বুঝি।

    —বেশ ভালো কথা। যেও না।

    —খাবার আমার জন্যে আনবে?

    —যদি দেয়।

    পান্না হাসতে লাগলো। তখন ও চা ও খাবার খাচ্চে। হাসতে হাসতে বললে—বললাম বলে যেন সত্যি সত্যি আবার তাদের কাছে খাবার চেয়ে বোসো না—

    .

    ঝড়ু মল্লিক বসে আছে ফরাস বিছানো তক্তপোশে। লোকটা শৌখিন মেজাজের। আমায় দেখে বললে—এসো ভায়া, বোসো। একটা কথা কাল ভাবছিলাম। আমার ভাবের দলে তোমরা দু’জনেই কেন এসো না। বেশ হয় তা হলে। আমি ভাবের গান লিখবো, তোমার উনি গাইবেন। পছন্দ হয়? আধাআধি বখরা।

    —কিসের আধাআধি?

    —বায়নার। যা যেখানে পাবো, তার আধাআধি।

    —আমি এর কিছুই জানি নে। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখি।

    —পয়সার জন্যে বলচি নে ভায়া। তোমাদের বড় ভালো লেগেচে—ওই যে বললাম—ভাব। ওই ভাবেই মরেছি। নয়তো বলছিলাম না সেদিন, ঝড়ু মল্লিক সোনার ইট দিয়ে বাড়ি করতে পারতো। পয়সার লালসা আমার নেই।

    খাবার অনেক রকম যোগাড় করেছে ঝড়ু। দু’জনের উপযুক্ত খাবার। পান্না কেন এলো না এজন্যে বার বার দুঃখ করতে লাগলো খেতে বসে। ও নাকি আমাদের প্রণয়ের ব্যাপার নিয়ে ভাবগান বাঁধবে, আসরে আসরে গাইবে। বললে—ভাই, লজ্জা মান ভয় তিন থাকতে নয়। নেমে পড় ভায়া, আসরে নামতে দোষ কি?

    ঝড়ু মল্লিক অসম্ভব রকমের কম খায় দেখলাম। ওর পাশে খেতে বসলে রীতিমতো অপ্রতিভ হতে হয়। খাওয়ার আয়োজন করেছিল প্রচুর, দু’তিন রকমের মাছ, মাংস, ঘি-ভাত, ডিমের ডালনা, দই, সন্দেশ। ঝড়ু কিন্তু খেল দু’এক হাতা ভাত ও দু’টুকরো মাছ ভাজা, একটু দই ও একটা সন্দেশ। সে যা খেলে তা একজন শিশুর খোরাক। আমি বললাম—এত কম খান কেন আপনি?

    —আমি গান বাঁধি, বেশি খেলে মন যবু-থবু অলস হয়ে পড়ে। কম খেলে থাকি ভালো। মাছ মাংস আমি কম খাই, তুমি আজ খাবে বলে মাছ মাংস রান্না হয়েচে, নয়তো আমি নিরামিষ খাই।

    —মদ খান তো এদিকে।

    —ওটা কি জানো ভায়া, না খেলে গান বাঁধবার নেশা জমে না। ছাড়তে পারি কই?

    —আমার ইচ্ছে করে আপনার মতো দেশে-বিদেশে গান গেয়ে বেড়াই। তবে না পারি বাঁধতে গান, না আছে গানের গলা।

    —এর মতো জিনিস আর কিছু নেই রে ভায়া। অনেক কিছু করে দেখলাম—কিন্তু সব চেয়ে বড় আনন্দ পেলাম এই আসরে গান গেয়ে বেড়িয়ে। পয়সাকে পয়সা, মানকে মান। সেই জন্যই তো বললাম—এসো আমার সঙ্গে।

    —আমি তো জানেন ডাক্তার মানুষ। আপনাদের মতো কবি নই। কোনো ক্ষমতা তো নেই ওদিকে। আমাকে আপনি সঙ্গে করে নিয়ে বিপদে পড়ে যাবেন। তার চেয়ে আমার ডাক্তারির একটা সুবিধে করে দিন না?

    —সে জায়গা আমি বলে দিতে পারি। কিন্তু তোমার ওঁকে নিয়ে কি করবে? ছোট্ট সমাজে ঘোঁট পাকাবে, তখন দেশ ছাড়তে হবে। বড় শহরে গিয়ে বোসো।

    —হাতে পয়সা নেই। ডিসপেনসারি করতে হলে একগাদা টাকা দরকার।

    —টাকা আমি যদি দিই? না থাক, এখন কোনো কথা বলো না। ভেবেচিন্তে জবাব দেবে। ওই যে ভাবেই মরেচে ঝড়ু মল্লিক, নইলে সোনার ইট দিয়ে—

    .

    পান্না দেখি খেতে বসেচে। রান্না করেচে নিজেই। একটা বাটিতে শুধু ডাল আর কিছুই খাবার নেই, আমি এত রকম ভালোমন্দ খেয়ে এলাম, আর ও শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাবে?

    —শুধু ডাল দিয়ে খাচ্চো কেন পান্না?

    —না, আর কাঁকরোল ভাতে।

    —মাছ মাংস পেলে না?

    —তুমি খাবে না, কে ওসব হাঙ্গামা করে। মেয়েমানুষের খাবার লোভ করতে নেই, জানো?

    —লোভের কথা হচ্চে না। মানুষকে খেতে তো হবে, খাটচো এত—না খেলে শরীর টিকবে?

    পান্না হেসে বললে—তোমাকে আর অত টিকটিক করতে হবে না খাওয়া নিয়ে। পুরুষমানুষের অন্য কাজ আছে, তাই দেখো গে।

    —ঝড়ু ভাবওয়ালা কি বলছিল জানো? বলছিল, আমার সঙ্গে এসে যোগ দাও। চলো একটা দল বেঁধে গান গেয়ে বেড়াই।

    —আমিও যাবো?

    —তুমি না হলে তো চলবেই না। তোমাকে নাচতে হবে, ঝড়ুর গান গাইতে হবে। যাবে?

    —না। কি দরকার? আমি একা কি কম পয়সা রোজগার করতে পারি? নাচের দলে যোগ দিয়ে পরের অধীন হয়ে থাকার কি গরজ?

    —ঝড়ু বলছিল—ও টাকা দেবে আমার ডিসপেনসারি খুলতে।

    —ওতেও যেও না। পরের অধীন হয়ে থাকা।

    —তবে কি করে চলবে?

    —তুমি নির্ভাবনায় বসে খাও। আমি থাকতে তোমার ভাতের অভাব হতে দেবো না। তুমি যদি চুপ করেও বসে থাকো, তাহলেও আমি চালিয়ে যাবো। আমার আয় কত জানো?

    —কত?

    —যদি ঠিক-মতো বায়না হয়, খাটি, তবে মাসে নব্বুই টাকা থেকে একশো টাকা। তোমার ভাবনা কি? তোমার বাবুগিরির জুতো আমি কিনে দেবো, কাঁচি ধুতি আমি কিনে দেবো—

    কাঁকরোল ভাতে দিয়ে ভাত খেতে খেতে পান্না ওর আয় আর ঐশ্বর্যের কথা যে ভাবে বর্ণনা করলে তা আমার খুব ভালো লাগলো। ওর কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই দেখচি। কাকে আয় বলে—ও কিছু জানে না। একটা অপারেশন কেসে আমি আশি টাকা রোজগার করেছি একটিমাত্র বিকেল বেলাতে। পান্না আমায় ওর আয় দেখাতে আসে। আমার হাসি পায়। আসলে বয়েস ওর কম বলেও বটে আর সামান্যভাবেই ওদের জীবন কেটে এসেচে বলেও বটে, বেশি রোজগার কাকে বলে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই ওর। এর আগেও তা আমি লক্ষ করেছি। পান্না হাসতে হাসতে বলেচে—বাবুর এক জোড়া ভালো জুতো চাই বুঝি? চলো এবার কলকাতায়, গিয়ে জুতো কিনে দেবো। কাল সতের টাকা প্যালা পেয়েছি আসরে, জানো? ভাবনা কি আমাদের? হি-হি—

    ও দেখচি খাঁটি আর্টিস্ট মানুষ। ঝড়ু ভাবওয়ালা আর ও একই শ্রেণীর। পান্নাকে এবার যেন ভালো করে বুঝলাম। পান্না সেই ধরণের মেয়ে, যে ভাবের জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে পারে। সংসারের ধার ধারে না, বেশি খোঁজ-খবরও রাখে না। যা আসে, তাতেই মহা খুশি। ঝড়ু মল্লিকের মতো পুরুষ আর ওর মতো মেয়েকে সাধারণ লোকের পর্যায়ে ফেলাই চলে না। আমার তো ওদের মতো ভাব নিয়ে থাকলে চলবে না, আমি খাঁটি বাস্তববাদী। পান্না যা-ই বলুক, আমাকে ওর কথায় কান দিলে চলবে না।

    কেশবডাঙ্গার বারোয়ারির আসরে পান্নার নাচ আরও দু’দিন হল। ওর নাম রটে গেল চারিধারে। সবাই ওর নাচ দেখতে চায়। আমায় বারোয়ারি কমিটির লোকেরা ডাক দিলে। একজন ব্যবসাদারের গদিতে ওদের মিটিং বসেচে। আমায় ওরা বললে—ও ঠাকুর মশাই, আপনাদের কর্ত্রীকে বলুন আরও দু’দিন এখানে ওঁর নাচ হবে—একটু কম করে নিতে হবে। সবাই ধরেচে, তাই আমাদের নাচ বেশি দিতে হচ্চে। বারোয়ারি ফান্ডে টাকা নেই।

    —কত বলুন?

    —ত্রিশ টাকা দু’দিনে।

    —আচ্ছা, জিজ্ঞেস করে আসি।

    —আপনি যদি করে দিতে পারেন, আপনি দু’টাকা পাবেন।

    —আচ্ছা।

    হায়রে! আমার হাসি পেল। দু’টাকা! আমার কম্পাউণ্ডার ঘা ধুতে দু’টাকা ফি চার্জ করতো। পান্নাকে আর কি বলব, আমি যা করবো তাই হবে। কিন্তু এদের সামনে জানানো উচিত নয় সেটা। আমাকে ওরা দলের রসুইয়ে-বামুন বলে জানে, তাই ভালো।

    একজন বললে—তা হলে আপনি চট করে জিজ্ঞেস করে আসুন।

    আমি বাইরে আসতেই একজন লোক বললে—একটা কথা আছে আপনার সঙ্গে। আপনাদের কর্ত্রীকে যদি আমরা দু’তিনজনে আমাদের বাগানবাড়িতে নেমন্তন্ন করি, উনি যাবেন?

    —বাগানবাড়ি আছে নাকি আবার এখানে?

    —এখানে নয়। এখান থেকে নৌকো করে যেতে হয় এক ভাঁটির পথ—খোড়্গাছির সাঁতরা বাবুদের কাছারিবাড়ি। সেখানকার নায়েব মুরলীধর পাকড়াশী কাল আসরে ছিলেন। তিনি বলে পাঠিয়েছেন। উনি কি নেন?

    —তা আমাকে এ কথা বলচেন কেন? আমি তো রসুইয়ে বামুন। উনি কি নেবেন না নেবেন সে কথা ওঁকে জিজ্ঞেস করলেই ভালো হয়।

    —আপনি যা বললেন ঠিকই, তবে কি জানেন আমাদের সাহস হয় না। কলকাতার মেয়েছেলে, আমরা হচ্ছি পাড়াগাঁয়ের লোক, কথা বলতেই সাহসে কুলোয় না। আপনি যদি করে দিতে পারেন, পাঁচ টাকা পাবেন। নায়েববাবু বলে দিয়েচেন।

    —আপনি এখানে অপেক্ষা করুন, আমি এসে বলচি।

    পান্নাকে গিয়ে সব কথা খুলে বললাম। পান্না হেসেই খুন। বললে—চলো বাপু, এখান থেকে আমরা চলে যাই। আমায় বুঝি নীলি পেয়েছে এরা? আর তোমায় বলি, তোমার রাগ হয় না এ সব কথা শুনে? তুমি কি রকম লোক বাপু? বারোয়ারিতে নাচের বায়না, দু’দিন বেশি হয় হোক, কিন্তু এ সব কি কথা? ছিঃ—

    —নাচের বায়না ত্রিশ টাকাতেই রাজি তো?

    —সে তুমি যা হয় করবে। আমি কি বুঝি?

    —চল্লিশ বলব?

    —বেশি দেয় ভালো।

    আমি ফিরে দেখি সাঁতরাবাবুদের নায়েবমশায়ের চর সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েচে। তাকে বললাম—হল না মশাই।

    —কেন, কেন? কি হল?

    —উনি কারো বাগানবাড়িতে যান না। ভালো ঘরের মেয়ে।

    —তাই নাকি?

    —মশাই আমি সব জানি। ওঁর স্বামী আছেন, একজন বড় ডাক্তার। নাচ টাচ উনি শখ করে করেন। সে ধরনের মেয়ে নন।

    লোকটা আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আমার কথা বিশ্বাস করলে কিনা জানি নে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে চলে গেল। বারোয়ারির কমিটির লোকেরা বললে—কি হল?

    —হল না মশাই।

    —কেন? কি হল বলুন না?

    —চল্লিশ টাকার কমে কর্ত্রী রাজী হবেন না।

    —তাই দেবো, তবে আপনার টাকা পাবেন না। ত্রিশ টাকায় রাজি করালে আপনাকে কিছু দিলেও গায়ে লাগতো না আমাদের।

    —না দেন, না দেবেন, আমি চেষ্টা করে করিয়ে তো দিলাম।

    কে একজন ওদের মধ্যে বললে—দাও, ঠাকুর মশাইকে কিছু দিয়ে দাও হে—বেচারি আমাদের জন্যে খেটেচে তো—

    ওরা আমাকে একটা আধুলি দিলে। পান্নাকে এনে দেখিয়ে বললাম—আমার রোজগার। তোমার জন্যে পেলাম।

    পান্না খুশি হয়ে বললে—আমি আরও তোমার রোজগারের পথ করিয়ে দেবো দেখো—

    হায় পান্না! এত সরলা বলেই তোমায় আমি ছাড়তে পারি নে।

    বললাম—সত্যি?

    —নিশ্চয়ই। কিন্তু হ্যাঁগো একটা কথা বলি—তুমি নিজে রোজগারের কথা ভাবো কেন? ও কথা তোলো কেন? তুমি বার বার ওই কথা আজ ক’দিন ধ’রে বলচো কেন? তুমি কি আমাকে ছেড়ে যেতে চাও?

    ওর গলার সুরে আবেগ ও উৎকণ্ঠার সুস্পষ্ট প্রকাশ আমাকে অবাক করে দিলে। পান্না শুধু সুন্দরী নারী নয়, অদ্ভুত ধরণের রহস্যময়ী, দয়াময়ী, প্রেমময়ী। নারীর মধ্যে এমন আমি ক’টিই বা দেখেচি। আমি হেসে চুপ করে রইলাম।

    ও আবার বললে—হ্যাঁগো, চুপ করে রইলে কেন? বল না গো—

    —আমি তা বলি নি।

    —তবে ও রকম কথা বলচো কেন আজ ক’দিন থেকে?

    পান্না কুমড়ো কুটচে দা দিয়ে। যেখানে যা লোকে দেয়, এখানে কেউ বঁটি দেয় নি ওকে। আমি সেদিকে চাইতেই ও হেসে ফেললে।

    বললে—কি করি বলো—

    —বাসার বঁটিখানা সঙ্গে করে আনলে না কেন?

    —হ্যাঁ, একটা ঘর-সংসার আনি সঙ্গে! ফাঁকি দিলে চলবে না, বলো আমি কি তোমাকে কষ্টে রেখেছি? সুখে রাখতে পারচি নে? হ্যাঁ গা, সত্যি করে বলো। আমি আরও পয়সা রোজগারের চেষ্টা করবো।

    —তুমি তা ভাবো কেন পান্না? আমিও তো এ ভাবতে পারি, আমার রোজগারে তোমাকে সুখী রাখবো?

    —কেন তা তুমি করতে যাবে? আমি কি সাতপাকের বৌ তোমার?

    —তার মানে?

    —সেখানে তোমাকে সংসার ঘাড়ে নিতেই হবে। এখানে তা নয়। এখানে আমি করবো। তুমি ও সব নিয়ে মাথা ঘামিও না লক্ষ্মীটি। বোলো যখন যা দরকার, আমি চেষ্টা করবো যুগিয়ে দিতে। আমার মাসিক আয় কত বলো দিকি? আশি নব্বুই কি এক শো টাকা। দু’টো প্রাণীর রাজার হালে চলে যাবে। নীলি কত পায় জানো? আমার সঙ্গে তো খাটতো। আমার আদ্ধেক রোজগার ওর। মুজরোর বায়নার আদ্ধেক, আসরের প্যালা যে যা পাবে, ওর ভাগ নেই। আমার প্যালা বেশি, ও বিশেষ পেতো না। কিন্তু কলকাতা শহরে ওরা দুই বোন বুড়ো মা—চালাচ্চে তো এক রকম ভালোই। আমাকে বলে, তোমার এত রোজগার, তুমি গহনা করলে না দু’খানা। আমি বলি আমার গহনাতে লোভ নেই, তোরা করগে যা। নাচটা আরো ভালো করে শেখবার ইচ্ছে। ভালো পশ্চিমে বাইজীর কাছে সাকরেদী করতে ইচ্ছে হয়। গহনা-টহনার খেয়াল নেই আমার। তুমি ভেবো না, তোমাকে সুখে রেখে দেবো।

    .

    ওকে নিয়ে কলকাতা আসবার দিনটা নৌকোতে ও ট্রেনে ওর কি আমোদ। ছেলেমানুষের মতো খুশি। বললে—এবার ক্যাশ ভাঙ্গো। খুব মান রেখেছে, কি বল?

    —তা তো বটে।

    —মোট কত টাকা হয়েচে বলো তো!

    —সাতষট্টি টাকা স’দশ আনা।

    —আর প্যালা?

    —সে তুমি জানো।

    —একুশ টাকা।

    আমার একটু দুষ্টুমি করবার লোভ হল।

    বললাম—সাঁতরা বাবুদের নায়েবের কথা শুনলে আরও অনেক বেশি হত—

    পান্না শুনে মারমুখী হয়ে বললে—ঠিক মাথা কুটবো তোমার পায়ে, অমন কথা যদি বলবে। আমি তেমন নই। ও সব করুক গে নীলি। ছিঃ—

    রাণাঘাটে গাড়ি বদলানোর সময় বললে—একটা ফর্দ করো—কলকাতার বাসায় জিনিসপত্র কিনতে হবে—

    —কি জিনিস?

    —কি জিনিস আছে? মাদুরের ওপর তো শুয়ে থাকা—

    —আর?

    —চায়ের ভালো বাসন তুমি কিনে আনবে ভালো দেখে। ফাটা পেয়ালায় চা খেয়ে তোমার অরুচি হয়ে গেল। আর একজোড়া জুতো নেবে না?

    ওকে আনন্দ দেবার জন্যে বললাম—নেবো না? ভালো দেখে একজোড়া নেবো কিন্তু—

    —হি-হি—জুতোর নাম শুনে অমনি লোভ হয়েছে। পুরুষমানুষের ব্যাপার আমি সব জানি।

    —কি জানো?

    —জুতোর ওপর বড্ড লোভ—

    —নাকি?

    —আমি যেন জানি নে আর কি!

    .

    কলকাতায় পৌঁছে তিন-চারদিনের মধ্যে যতদূর সম্ভব জিনিসপত্র কেনা-কাটা করা গেল। একজোড়া জুতো কেনবার সময় ও আমার সঙ্গে যেতে চাইলে। আমি সঙ্গে নিয়ে গেলাম না। ওর কষ্টার্জিত টাকায় দামী জুতো কিনতে চাই নে। কিন্তু ও সঙ্গে থাকলে তাই ঠিক কেনাবে। সস্তা দামের একজোড়া খেলো জুতো নিয়ে এসে বললাম—চমৎকার জুতো—এগারো টাকা দাম, তবে আমার এক জানাশুনা লোকের দোকান—

    —কত নিলে?

    —এই ধরো পাঁচ টাকা—

    —মোটে?

    —জুতো জোড়া দ্যাখো না, কি জিনিস। আমার জানাশুনো লোক, তাই দিয়েছে।

    উলটো ধরনের কথা বললাম। এরকম কথা বলা উচিত তখন, যখন ব্যয়-বাহুল্য নিয়ে কর্ত্রী অনুযোগ করেচেন। পান্না বলে—পছন্দ হয়েচে? পরো তো একবার!

    —এখন থাক।

    —আমি দেখি, পায় দাও না? পাম্পশু একজোড়া কিনলে না কেন?

    —ও আমি পছন্দ করি না।

    —তোমায় মানাতো ভালো।

    —এর পরে কিনে দিও—এখন থাক—

    —তোমায় সিল্কের জামা কিনে দেব একটা।

    —বাঃ চমৎকার। কবে দেবে?

    আমার যে খুব আগ্রহ হচ্ছে, এটা দেখানোই ঠিক। নয়তো ও মনে কষ্ট পাবে।

    পান্না হেসে বললে—বড্ড লোভ হচ্ছে, নয়? আমি জানি, জানি—

    —কি জানো?

    —তোমরা কি চাও, আমি সব জানি—

    —নিশ্চয়। দিও কিনে ঠিক কিন্তু—

    বাড়িতে তোরঙ্গ বোঝাই আমার কাপড়-চোপড়ের কথা মনে পড়লো। সুরবালার যা কাপড় চোপড় আছে, পান্নার তার সিকিও নেই। আমার পয়সা নেই আজ, নাহলে পান্নাকে মনের মতন সাজাতাম। ও বেচারির কিছুই নেই। আসরে মুজরো করবার কাপড় খানতিনেক আছে। আর আছে কতকগুলো গিল্টি সোনার গহনা। ওর মায়ের দেওয়া একখানা বেনারসী শাড়ি আছে ওর বাক্সে, কিন্তু সেখানা কখনো পরতে দেখিনি।

    .

    মাস তিন চার কেটে গেল।

    একদিন বাজার করে বাসায় ফিরে দেখি গুরুতর কাণ্ড। দু’তিনটি পুলিশের লোক বাড়িতে। পান্না দেখি ঘরের এক কোণে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    ব্যাপার কি? পুলিশের লোকরাই বললে। আমায় এখুনি থানায় যেতে হবে। পান্না নাবালিকা, আমি ওকে ওর মায়ের কাছ থেকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি।

    পান্নার মা থানায় জানিয়েছিল। এতদিন ধরে পুলিশে খুঁজে নাকি বের করেছে।

    এ আবার কি হাঙ্গামায় পড়া গেল!

    পান্না বললে, সে নিজের ইচ্ছায় চলে এসেছে। কোনো কথা টিকলো না। পুলিশে বললে, যদি পান্না সহজে তাদের সঙ্গে ওর মায়ের কাছে ফিরে যেতে রাজী হয়, তবে আমাকে ওরা রেহাই দেবে। ওরা আমাকেই কথাটা বলতে বললে পান্নাকে।

    পান্না কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েই আছে।

    আমি গিয়ে বললাম—পান্না শুনচো সব? কি করবে বলো, ফিরে যাও লক্ষ্মীটি—

    পান্না আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। কথা বললে না।

    আবার বললাম—পুলিশের লোক বেশি সময় দিতে চাইচে না। জবাব দাও। আমার কথা শোনো, বাড়ি যাও—

    —কেন যাবো?

    —নইলে ওরা ছাড়বে না। তুমি নাবালিকা। আমার সঙ্গে নিজের ইচ্ছায় আসতে পারো না ওরা বলছে।

    —তা’হলে ওরা তোমাকে কিছু বলবে না?

    —আমায় বলুক, তার জন্যে আমার মাথাব্যথা নেই। তোমাকে হয়রানি না করে।

    —আমি যাবো, ওদের বলো।

    পান্নার মুখ থেকে একথা যেমন বেরুলো, আমি যেন বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, সত্যি বলচি। এ আমি কখনো আশা করি নি। কেন ও যেতে চাইলো এত সহজে? আমি কখনো ভাবি নি ও একথা বলবে।

    আমার গলা থেকে কি যেন একটা নেমে বুক পর্যন্ত খালি হয়ে গেল। ভয়ানক হতাশায় এমনতর দৈহিক অনুভূতি হয় আমি জানি।

    আমি ওর কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে বললাম—বেশ, বেশ তাই বলি—

    —কোথায় নিয়ে যাবে ওরা?

    —তোমার মায়ের কাছে।

    পুলিশের লোকেরা আমার কথা শুনে গাড়ি ডাকলো, ওর জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দিলাম। কি-ই বা ছিল! গোটা দুই তোরঙ্গ। নতুন কেনা চায়ের বাসন ওর জিনিসের সঙ্গেই গাড়িতে তুলে দিলাম। বড় আশা করেছিলাম যাবার সময় যখন আসবে ও কখনো যেতে চাইবে না, ভীষণ কাঁদবে।

    পান্না নিঃশব্দে গিয়ে গাড়িতে উঠল।

    একবার কেবল আমার দিকে একটু একদৃষ্টে চেয়ে কি দেখে নিলো। তারপর তাড়াতাড়ি খুব হালকা সুরে বললে—চলি।

    যেন কিছুই না। পাশের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে, সন্ধ্যের সময় ফিরে আসবে।

    চলে গেল পান্না। সত্যিই চলে গেল।

    একটা পুলিশের লোক আমায় বললে—মশায়, কি করেন?

    রাগের সুরে বললাম—কেন?

    —না, তাই বলচি। বলচি মশায়, এবার পেত্নী ঘাড় থেকে নামলো; বুঝে চলুন। আমরা পুলিশের লোক মশায়। কত রকম দেখলাম, তবু যে যাবার সময় মায়াকান্না কাঁদলো না, এই বাহবা দিচ্ছি, কতদিন ছিল আপনার কাছে?

    —সে খোঁজে আপনার কি দরকার?

    বিরক্ত হয়ে মুখ ফেরালাম অন্য দিকে। পুলিশের লোকজন চলে গেল।

    .

    আমি কতক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম সামনের জানলাটার দিকে তাকিয়ে।

    আমার ভেতরে যেন কিছু নেই, আমি নিজেই নেই।

    উঃ, পান্না সত্যি চলে গেল? স্বেচ্ছায় চলে গেল?

    যাকগে। প্রলয় মন্থন করে আমি জয়লাভ করবো। ঘর ভাঙুক, দীপ নিবুক, ঘট গড়াগড়ি যাক। ও সব মেয়ের ওই চরিত্র। কি বোকামি করেছি আমি এতদিন।

    সামনের দোকান থেকে এক পেয়ালা চা খেয়ে এলুম। চা করতে পারতাম, সবই আছে, কিন্তু পেয়ালা পিরিচ নেই, সেগুলো তুলে দিইচি পান্নার গাড়িতে। ওরই জন্যে শখ করে কেনা, ওকেই দিলুম। পুরুষমানুষের প্রেম অত ঠুনকো নয়, তার শক্ত দৃঢ় ভিত্তি আছে। মরুক গে। ও ভাবনাতেই আমার দরকার কি?

    যাবার সময় একবার বলে গেল না, বেলা হয়েছে, বাজার করে এনে ভাত খেও।

    অথচ—

    যাক ও চিন্তা চুলোয়।

    হোটেল থেকে ভাত খেয়ে এলাম। বাজার থেকে বেছে বেছে মাগুর মাছ কিনে নিয়ে এসেছিলাম দু’জনে খাব বলে। সেগুলো মরে কাঠ হয়ে গেল। তারপর দেখি বেড়ালে খাচ্চে।

    পাশের বাড়ির শশিপদ স্যাকরা আমায় ডেকে বললে—ঠাকুর মশায়, তামাক খাবেন?

    —নাঃ।

    —বলি, বাড়িতে পুলিশ এসেছিল কেন?

    —তোমার দেখচি কৌতূহল বেশি।

    —রাগ করবেন না ঠাকুর মশাই। আমিও ভালো লোকের ছেলে। অনেক কিছু বুঝি। বলুন না আমারে।

    —ও চলে গেল।

    —মা ঠাকরুণ?

    তারপর শশিপদ স্যাকরা একটু নিচুস্বরে বললে—সেজন্য মন খারাপ করবেন না আপনি। ওসব অমনি হয়।

    —কি হয়?

    —ওই রকম ছেড়ে চলে যায়। ও সব মায়াবিনী।

    —তুমি এর কি জানো?

    —আমি অনেক কিছু জানি। মানুষ ঠেকে শেখে আর দেখে শেখে। কিন্তু আমি মশায় ঠেকে শিখেছিলাম। সে গল্প একদিন করবো।…খাওয়া দাওয়া কি করলেন? হোটেলে? আহা, বড্ড কষ্ট গেল। আমায় যদি আগে বলতেন! এখন কি করবেন?

    —কি করি ভাবচি।

    —উনি কি আবার আসবেন বলে মনে হয়?

    —জানি নে।

    —রাঁধতে পারেন?

    —না।

    —তা হলে তো মুশকিল। আমার বাড়ি যে খাবেন না, তাহ’লে আমিই তো ব্যবস্থা করতাম। আমার বাড়িও যশোর জেলায়। দেশের লোক আপনার।

    —বেশ বেশ।

    .

    সারাদিন পথে ঘুরে ঘুরে কাটলো এক রকম। রাত্রে অনেক দেরি করে বাসায় এলুম। কালও বেড়িয়ে ফিরে এলে পান্না বলেছিল,—একদিন চলো আমরা খড়দ’ যাবো। মায়ের সঙ্গে একবার ফুলদোল দেখতে গিয়েছিলাম, জানলে? বড্ড ভালো লেগেছিল। যাবে একদিন?

    আমি বলেছিলাম, চল সামনের শনিবার।

    ও হেসে বলেছিল—আমাদের আবার শনিবার আর রবিবার। তুমি কি আপিসে চাকরি করো!

    কিছু না, শশিপদ স্যাকরা ঠিক বলেচে। ওরা মায়াবিনী। রাত্রে ঘুমুতে গেলে ঘুম হয় না। হঠাৎ দেখি যে আমি কাঁদচি। সত্যিই কাঁদচি। জীবনের সব কিছু যেন চলে গিয়েছে। আর কোনো আমার ভরসা নেই। কোনো অবলম্বন পর্যন্ত নেই জীবনের। পান্না, এত নিষ্ঠুর হতে পারলে? চলেই গেলে! আচ্ছা, ও কি আমার ওপর রাগ করে, অভিমান করে চলে গেল?

    আমি ঘুম ছেড়ে উঠে ভাবতে বসলাম। যদি কেউ আমাকে ওর মনের খবর এনে দিতে পারতো, যদি বলে দিতে পারতো ও অভিমান করে গিয়েছে, আমি তাকে অন্তর থেকে আশীর্বাদ করতাম। আমি নিঃস্ব, দেওয়ার কিছুই নেই আমার আজ—নইলে অনেক টাকা দিতাম ওই সংবাদবাহককে।

    কিন্তু খবর কেউ না-ই বা দিল?

    আমি ভেবে দেখলে বুঝতে পারবো নিশ্চয়।

    আবার কখন শেষরাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছি ভাবতে ভাবতে।

    স্বপ্ন দেখেছি পান্না এসে বলছে—এত বেলা পর্যন্ত ঘুম, ওঠো চা করচি, খাও।

    বা রে—ধড়মড় করে ঠেলে উঠলাম। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস যেন ফেললাম, ঘুমঘোরজড়িত মন যেন আনন্দে নেচে উঠল—তাহ’লে কিছুই হয় নি, পান্না যায় নি কোথাও। মিথ্যা স্বপ্ন ওর যাওয়াটা।

    মূঢ়ের মতো শূন্য গৃহের চারিদিকে চাইলাম। কপোতী নীড় ছেড়ে পালিয়েছে। কেউ নেই।

    ঘুমিয়ে বেশ ছিলাম। ঘুম ভাঙলেই যেন পাষাণ-ভার চাপলো বুকে। সারাদিন এ পাষাণের বোঝা বুক থেকে কেউ নামাতে পারবে না।

    এই রকম বিভ্রান্তের মতো যে ক’টা দিন কাটলো তার হিসেব রাখিনি।

    দিন আসে যায়, রাত্রে ঘুমুই, আর কিছু মনে থাকে না।

    একা ঘরে শুয়ে কান্না আসে। বুক-ভাঙা কান্না।

    দিনমানে পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়ে ভুলে থাকি। কিন্তু রাত্রে একেবারে কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন হতে হয় শূন্য ঘরে।

    আশ্চর্যের কথা একটা, পান্না টাকাকড়ি একটাও নিয়ে যায় নি। আমার বালিশের তলায় রেখে দিয়েছে। বোধ হয় তাড়াতাড়িতে ভুলে গিয়েচে।

    ওর খবর পাবার জন্যে মরে যাচ্চি। কে দেবে এ সংবাদ?

    .

    এ কদিন বসে বসে ভাবলুম। কি আশ্চর্য আমার মনের এই তীব্র, তীক্ষ্ণ, উগ্র, অতি ব্যগ্র মনোভাব! এমন মন আমার মধ্যে ছিল তা কখনো আমি জানতে পারি নি। এ মন কোথায় এতদিন ঘুমিয়ে ছিল আমারই মধ্যে, সুরবালা এ ঘুম ভাঙাতে পারে নি—ভাঙিয়েচে পান্নার সোনার কাঠি।

    এ মন আমাকে একদণ্ড সুস্থির থাকতে দেয় না। সর্বদা পান্নার কথা ভাবায়। সব সময়, প্রতিটি মুহূর্তে। যে যাকে ভালোবাসে, সে তার কথা ছাড়া ভাবতে পারে না। ভাববার সামর্থ্য তার থাকে না। আগে বুঝতাম না এ সব কথা। এ অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, মন নিয়ে এ কারবার তখন আমার ছিল না। দিন রাত, চন্দ্র সূর্য, সকাল বিকেল, ইহকাল-পরকাল ভালো-মন্দ—সব গিয়ে সেই এক বিন্দুতে মিশচে—পান্না। যাঁরা ঈশ্বরের ভক্ত, তাঁদের নাকি এমন দশা হয় শুনেছি। ঈশ্বরের বিষয় ছাড়া ভাবতে পারেন না, ঈশ্বরের কথা ছাড়া কইতে পারেন না। ঈশ্বরের বিরহে চৈতন্যদেব নাকি বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে যেতেন। বিরহের এ অনুভূতি ভগবান যাকে আস্বাদ করান, সে ভিন্ন করতে পারে না। বিশেষ অবস্থায় পড়তে হয়। সুরবালা বাপের বাড়ি গেলে সে বিরহদশা আসে না। একেবারে হারিয়েচি, এই ভাব আসা চাই। সুরবালা তো কতবার বাপের বাড়ি গিয়েছে, এ দশা কি হয়েচে আমার জীবনে কখনো? তাই বলছিলাম, এখন বুঝছি ঈশ্বরভক্তদের যে তীব্র প্রেমের কথা শুনেছি বা পড়েচি—তা কবি-কল্পনা বা অতিরঞ্জিত নয়, অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। আমার চেয়ে হয়তো আরো বেশি সত্য।

    মনের ব্যাপারই এই। মনের ঠিক অবস্থায় না পড়লে কিছুতেই অন্যের মনের সেই অবস্থা সম্বন্ধে কোনো ধারণা করা যায় না। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝচি যা, আগে এই সব কথা বললে বিশ্বাস করতাম না। বিশ্বাস হত না। এসব জিনিস অনুমানের ব্যাপার নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ব্যাপার। আগে থেকে বললে কে বিশ্বাস করবে? পোড় খাওয়া না হলে পোড়ার জ্বালা কে ধারণা করবে? সাধ্য কি?

    ঠিক এই সময় বৌবাজার দিয়ে শেয়ালদ’এর দিকে যাচ্ছি একদিন, উদ্দেশ্য বৈঠকখানার মোড় থেকে একমালা নারকোল কেনা, হঠাৎ রাস্তার দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়ালাম! সনাতনদা যাচ্ছে ফুটপাতের কোল ঘেঁষে লালবাজার মুখে। সনাতনদাও আমাকে দেখতে পেয়েচে। নইলে আমি পাশ কাটাতুম। আমার পরনে ময়লা জামা, ধুতিও মলিন। পায়ে পান্নার টাকায় কেনা সেই পাঁচটাকা দামের খেলো জুতো জোড়া।

    সনাতনদা এগিয়ে এল আমার দিকে। অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চাইতে চাইতে এল। যেন বিশ্বাস করতে পারচে না যে আমি।

    বলি—কি সনাতনদা যে!

    ও বিস্ময়ের সুরে বললে—তুমি!

    —হ্যাঁ। ভালো আছো?

    সনাতনদা একবার আমার আপাদ-মস্তক চোখ বুলিয়ে নিলে। কি দেখলে জানি নে, আমার হাসি পেল।—কি দেখচ সনাতনদা?…ও যেন অবাক-মতো হয়ে গিয়েচে।

    সনাতনদা এসে আমার হাত ধরলে। আর একবার মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। বললে—এসো, চলো কোথাও গিয়ে বসি, অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে। চলো একটু ফাঁকা জায়গায়।

    বললাম—সুরবালা ভালো আছে? ছেলেপিলেরা?

    —চলো। বলচি সব কথা। একটা চায়ের দোকানে নিরিবিলি বসা যাক—

    —চায়ের দোকানে নয়, নেবুতলার ছোট্ট পার্কটায় চলো—

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅনশ্বর – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article হীরামানিক জ্বলে – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }