Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অনড় দাঁড়ালাম – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প352 Mins Read0
    ⤶ ⤷

     ১১০. আমরা শ্বাস নিতে পারছি না

    ১১০. আমরা শ্বাস নিতে পারছি না

    ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’, এ কথা শুধু জর্জ ফ্লয়েডের মুখ থেকে বেরোয়নি। এরিক গারনারের মুখ থেকেও বেরিয়েছিল যখন মাটিতে ফেলে পুলিশেরা তার গলা চেপে ধরেছিল। এরিক বলছিল, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’। কিন্তু তারপরও পুলিশেরা এরিকের কণ্ঠদেশ থেকে তাদের শক্ত বাহু সরিয়ে নেয়নি। কী দোষ ছিল এরিকের? সিগারেট বিক্রি করছিল, যে সিগারেট বিক্রিটা বৈধ ছিল না। কী দোষ করেছিল জর্জ ফ্লয়েড? কুড়ি ডলারের জাল নোট দিয়ে এক দোকান থেকে সিগারেট কিনেছিল। আরও দোষ তাদের ছিল, এরিক আর জর্জ দুজনেই কালো, দুজনই দরিদ্র। আজ আমেরিকার লক্ষ লক্ষ মানুষ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদ করছে। এরিকের জন্যও ঠিক একইরকমভাবে ২০১৪ সালে সারা আমেরিকা জুড়ে বর্ণবাদবিরোধী মিছিল বেরিয়েছিল। একইরকমভাবে মানুষ তখন স্লোগান দিয়েছিল ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’। এখন যেমন জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানুষ প্ল্যাকার্ডে লিখছে, ‘কালোদের জীবনও জীবন’। তখনও তাই করেছিল।

    আমেরিকায় তখন কালো প্রেসিডেন্ট। আর কালো লোকদের মেরে চলেছে সাদা পুলিশেরা। ২০১৪ সালেই মিশৌরির ফার্গুসনে এক সাদা পুলিশ মাইকেল ব্রাউন নামের কালো একটি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছিল। ছ’টি বুলেট ঢুকেছে মাইকেলের শরীরে। পুলিশের দাবি, মাইকেল এক দোকান থেকে সিগার চুরি করার চেষ্টা করেছিল। কেউ সিগার চুরি করতে চাইলে কোনও পুলিশের অধিকার নেই তাকে মেরে ফেলা। ফার্গুসনে সেদিনও প্রতিবাদের আগুন জ্বলেছিল।

    পুলিশের নৃশংসতা নতুন ঘটনা নয়। পুলিশি হেফাজতে গ্রেফতার হওয়া মানুষের মৃত্যুও নতুন ঘটনা নয়। নৃশংসতার এবং হত্যার শিকার হওয়া মানুষের মধ্যে কালো লোকের সংখ্যাটা বরাবরই বেশি, এও নতুন ঘটনা নয়। তবে নতুন কী? নতুন এটিই, কথা ছিল ঘর থেকে বের না হওয়ার, কথা ছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার, সেই কথা কেউ রাখছে না, বা রাখতে পারছে না। নিজের জীবন বাঁচানোর চেয়েও জরুরি হয়ে উঠেছে অন্যের জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম। পৃথিবীতে হঠাৎ উদয় হওয়া ভয়ংকর ছোঁয়াচে করোনা ভাইরাস ১ লক্ষেরও চেয়ে বেশি প্রাণ নিয়েছে যে দেশে, সে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনার ভয়ডর উপেক্ষা করে হত্যার প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছে।

    বর্ণবাদ আমেরিকায় নতুন কিছু নয়। শুধু পুলিশে নয়, আরও অনেক প্রতিষ্ঠানেই এটি আছে। সুপ্ত অবস্থায় আছে। কিন্তু আছে। আছে লক্ষ লোকের অন্তরে। বর্ণবাদ আমেরিকায় ভাইরাসের মতো আছে, ৪০০ বছর ধরে আছে। এই ভাইরাসের কোনও ভ্যাক্সিন এখনও বানানো হয়নি। ১৬১৯ সালে আমেরিকার জেমসটাউনে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা একটি লোককে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল । তখন থেকেই বর্ণবাদ চলছে, বৈষম্য চলছে, আজও চলছে। তবে এটা ঠিক, বৈষম্য আগে যেরকম বিপুল পরিমাণে ছিল, সেরকম এখন আর নেই। অনেক কমেছে। একসময় কালোদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। কালো ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করার অধিকার সাদাদের ছিল। ইচ্ছে হলে মেরে ফেলারও অধিকার তাদের ছিল। সেই দিন আর নেই। শত বছরের আন্দোলনের ফলে এখন ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। আইনের চোখে আমেরিকায় কালো সাদা, বাদামি, হলুদ সব মানুষ সমান। কিন্তু ঘৃণা কি এত সহজে উবে গেছে সাদাদের মন থেকে? এত সহজে এ যাওয়ার নয়। যে বৈষম্য একসময় বৈধ ছিল সর্বত্র, সেই বৈষম্য রাষ্ট্রে, প্রতিষ্ঠানে না থাকলেও সমাজে সংসারে তো আছেই। না থাকলেও মনে আছে, মনের গভীরে। কার মনের গভীরে কালো ত্বকের প্রতি ঘৃণা কিলবিল করছে, তা কে বুঝবে! পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিনকে দেখে কেউ কি বুঝতো যে কালোদের ওপর ঘৃণা তার এত বেশি যে কালোদের খুন করতেও সে দ্বিধা করবে না? আমেরিকার সমস্যা ভেতর-ঘরেই। অন্তরেই।

    আমেরিকার বর্ণবাদ শুধু কালোদের বিরুদ্ধে নয়, যে সাদা নয় তার বিরুদ্ধেই। বাদামি হলুদদের বিরুদ্ধে। যে ক্রিশ্চান নয়, তার বিরুদ্ধেও। আরব, মুসলিমদের বিরুদ্ধে। কিছু ক্ষেত্রে এমনকি ইহুদিদের বিরুদ্ধেও। এখন প্রশ্ন হল, বর্ণবাদ কি শুধু আমেরিকায়? শুধু ইউরোপে? বর্ণবাদ এশিয়া আর আফ্রিকায় নেই? ইউরোপ আর আমেরিকায় আফ্রিকা থেকে লোক ধরে নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশে ক্রীতদাস বানানো হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকায় কিন্তু নিজের লোকদেরই নিজেরা ক্রীতদাস বানিয়েছে।

    বর্ণবাদ জঘন্যভাবে পালিত হয়েছে আমেরিকায়, আবার এই আমেরিকাতেই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এশিয়া আর আফ্রিকায় কিন্তু বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন হয়নি। আগের চেয়ে বর্ণবাদ অনেক কম এখন, তারপরও আমেরিকায় একটি মৃত্যু ঘিরে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। পথে নামে কালোরা। তারা তো নামবেই। কিন্তু মুগ্ধ হই যখন সাদারা নামে। যখন মিছিলের অগ্রভাগে থাকে সাদারা। যখন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নামে সাদারা। যখন সাদাদের হাতে প্ল্যাকার্ড, আই ক্যান’ট ব্রীদ, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। এর নাম সহানুভূতি, সহমর্মিতা, মানবতা। এর নাম সভ্যতা।

    এ শুধু কালোদের সংগ্রাম নয়। এ আমেরিকার সাদা, কালো, বাদামি, হলুদ সবার সংগ্রাম। পুলিশের বর্বরতার বিরুদ্ধে, নৃশংসতার বিরুদ্ধে, ঘৃণা এবং বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সমতার পক্ষে, সমানাধিকারের পক্ষে সংগ্রাম। একটি সুষ্ঠু সভ্য সমাজ গড়ার জন্য আজ করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মানুষ রাস্তায় বেরিয়েছে। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আজ অবধি প্রতিবাদীদের সঙ্গে একাত্মবোধ করে কোনও ভাষণ দেননি, যে ভাষণ শুনে মানুষ আস্বস্ত হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধুই সামনের নির্বাচনে জেতার স্বপ্ন দেখছেন। করোনা ভাইরাসের মহামারী নিয়েও তিনি ছেলেখেলা করেছেন, বর্ণবাদের মহামারী নিয়েও তিনি একই কাজ করেছেন। যারা লুঠ করছে, আর যারা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছে, তাদেরকে এক কাতারে ফেলে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। অশোভন কথা বলছেন। ট্রাম্প সম্ভবত নির্বাচনে জিতবেন না। তিনি চলে গেলে নতুন কোনও প্রেসিডেন্ট আসবেন, কিন্তু বর্ণবাদের কি অবসান হবে? যেহেতু শ্রেণীবৈষম্য বহাল তবিয়তে বিদ্যমান, তাই বর্ণ-বৈষম্যও শ্রেণীবৈষম্যের সঙ্গে হাত হাত রেখে হাঁটবে। আমেরিকার দরিদ্রের মধ্যে অধিকাংশই কালো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে তারাই বেশি বঞ্চিত। সুতরাং ঘাড়ে হাঁটু গেড়ে বসে পোকামাকড়ের মতো তাদের মেরে ফেলতে খুব একটা কারোর অসুবিধে হয় না।

    একটি কালো লোকের পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে, এটি খবর হলে আমেরিকায় আগুন জ্বলতো না, ভিডিওটিতে হত্যার নির্মম দৃশ্যটি দেখেই মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। অন্যায় আর অত্যাচারের শিকার অনেকেই হচ্ছে, প্রতিদিনই হচ্ছে, হঠাৎ একটি অন্যায় মানুষকে নাড়ায়, একটি হত্যা মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে, একটি বিপ্লব সমাজ পরিবর্তন ঘটায়। সমাজ পরিবর্তন করার জন্য চিরকালই উদার এবং স্বপ্নবান মানুষেরা উদ্যোগ নিয়েছে।

    যেভাবে মানুষ জেগে উঠেছে, আমেরিকায় যেটুকু বর্ণবাদ অবশিষ্ট আছে, সেটুকু কোনও একদিন বিলুপ্ত হবে, এই আশা করতেই পারি। কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কেউ তো পথে নামে না। একে তো নারীবিদ্বেষ, তার ওপর বর্ণবিদ্বেষ। কালো মেয়েদের প্রেম হয় না, বিয়ে হয় না। ত্বক ফর্সা করার কেমিক্যালে ছেয়ে গেছে বাজার। এইসব কেমিক্যাল ত্বকের ক্ষতি করে জানার পরও কালো মেয়েরা বাধ্য হয় এইসব ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহার করতে। শুধু বর্ণ নয়, ভিন্ন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ তো উপমহাদেশে কম আগুন জ্বালায়নি, কম মানুষকে উদ্বাস্তু করেনি, সর্বস্বান্ত করেনি! কম মানুষকে হত্যা করেনি। তারপরও এই বিদ্বেষের কোনও কমতি নেই।

    আমেরিকায় যেমন কালোদের ওপর অত্যাচার হলে সাদারা প্রতিবাদ করে— এমন কেন সারা পৃথিবীতে হয় না, কেন আমাদের এই উপমহাদেশেও হয় না? এখানে হিন্দুরা আক্রান্ত হলে মুসলমানরা প্রতিবাদ করবে, মুসলমানরা আক্রান্ত হলে হিন্দুরা প্রতিবাদ করবে! এই সহানুভূতি না থাকলে সমাজে বিদ্বেষ আর বৈষম্য টিকে থাকবেই। সংখ্যালঘুর সমস্যা ঘোচানোর জন্য আন্দোলন সংখ্যাগুরুকেই করতে হয়, চিরকালই করতে হয়েছে।

    এশিয়ায় যত বৈষম্য, সত্যি বলতে তত বৈষম্য ইউরোপ, আমেরিকায় নেই। ওদের বৈষম্য চোখে পড়ে, কারণ ওদের বৈষম্যের প্রতিবাদ করে ওরা ব্যাপকভাবে, আমাদের সমাজের বৈষম্য যেমন আছে, তেমন থাকে, কারণ এগুলোর বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ হয় না। পুলিশি হেফাজতে আমাদের কম মানুষের মৃত্যু হয়েছে? কিন্তু কেউ পথে নামেনি। কাপড়ের আড়ালে ঘা লুকিয়ে রাখলে সেই ঘা হয়তো দেখা যায় না, কিন্তু সেই ঘা না সারালে অসুস্থ হয়ে সারাটাজীবন কাটাতে হয়। সুস্থ সভ্য সমাজ চাইলে সবরকম অন্যায়, সবরকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

    নিজেদের বৈষম্য ঘোচানোর চেষ্টা যে করে না, সে অন্যের সমাজের বৈষম্যের দিকে আঙুল তুলে নিন্দে করে, নির্লজ্জ হলেই করে। এমন নির্লজ্জের সংখ্যা আমাদের সমাজে প্রচুর। নিঃশ্বাস নিতে না পারা মানুষ যে আমাদের কত, তা কি আমরা গুণে শেষ করতে পারবো কোনওদিন? পারবো না।

    বাঙালি সংস্কৃতি কি বাংলাদেশে টিকে থাকবে না?

    ”আমার ৪ দশকের বাদ্যযন্ত্র গানের খাতা-নথিপত্র পুড়াইয়া করেছে ছাই

    মনের দুঃখ কার কাছে জানাই?

    ও ভাই গো ভাই আমার দোষ কি শুধু গান গাওয়া

    না ভাটির দেশে উজান বাওয়া?

    কোন দোষেতে শাস্তি পাইলাম একবার শুধু জানবার চাই?

    চোখের সামনে এহেন কান্ড আমার ঘরবাড়ি হয় লণ্ডভণ্ড

    আসমান তলে হইল ঠাই মনের দুঃখ কার কাছে জানাই।

    ও ভাই লো ভাই

    গুরু আমার আব্দুল করিম বলেছিলেন গানে গানে

    মানুষ ভজো পরম খোঁজ সুরেই তারে কাছে আনে।

    আজকে তারে স্মরণ করি গানের কথা খুইজা মরি!

    মুখে কোন ভাষা নাই।

    ও ভাই গো ভাই মনের দুঃখ কার কাছে জানাই।”

    এই গানটি কাঁদতে কাঁদতে গেয়েছেন বাউল রণেশ ঠাকুর।গানটি গাওয়ার দুদিন আগে তাঁর সংগীতের ঘরটি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পুড়ে গেছে তাঁর চল্লিশ বছরের সংগীত সাধনার বাদ্যযন্ত্র, তাঁর একতারা দোতারা, তাঁর ঢোল, হারমোনিয়াম, তাঁর গানের খাতাপত্র। এই ঘরটিতে বসে দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্তদের তিনি বাউল গান শেখাতেন। নিজে তিনি গান লিখতেন, সুর করতেন, গাইতেন। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের গানও তিনি গাইতেন, ভক্তদের সেসবও শেখাতেন। শাহ আবদুল করিম বেঁচেছিলেন রণেশ ঠাকুরের গানে। সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজান্ধল গ্রামে রণেশ ঠাকুরের বাড়ি। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের পড়শি তো ছিলেনই, প্রধান শিষ্যও ছিলেন তিনি। রণেশের ভাইও ছিলেন করিমের শিষ্য। বাউলের ঘরবাড়ি আজ ভষ্মীভূত।

    দুর্বৃত্ত কারা, তা নিশ্চয়ই যে কোনও সুস্থ সচেতন মানুষ আমরা অনুমান করতে পারি। আমাদের দ্বিধা নেই বলতে যে শিল্পসংগীত-বিরোধী ইসলামী মৌলবাদীর দল এই অপরাধটি করেছে। সম্ভবত তারা হিন্দু বিরোধীও। যদিও রণেশ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্ব নিয়ে গান গেয়েছেন, লালনের মতো জাতপাত তিনিও মানতেন না, ধর্মের বিভেদ নয়, মানবতার জয়গানই ছিল তাঁর আদর্শ, কিন্তু তাকে হিন্দু হওয়ার অপরাধে শাস্তি দিয়েছে অসহিষ্ণু বর্বর লোকেরা।

    ধ্বংসস্তূপ কি ব্যক্তি রণেশ ঠাকুরের সংগীত-কক্ষের ধ্বংসস্তূপ? আসলে সেটি বাংলা সংস্কৃতির ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চিহ্ন। ইসলাম যদি নৃত্য, সংগীত, শিল্প, ভাস্কর্য, সব কিছুরই বিরুদ্ধে, এবং ধর্মান্ধরা যদি সেটিই প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, সরকার এবং সমাজ থেকে তারা যদি কোনও বাধা না পায়, তবে আজ হোক, কাল হোক, সেই সমাজই বাংলাদেশে তৈরি হবে, যে সমাজে কোনও প্রাণীর ছবি আঁকা হবে না, কেউ নাচবে না, কেউ গাইবে না, কেউ সিনেমা তৈরি করবে না, কেউ ভাস্কর্য গড়বে না। একসময় তো ধর্মান্ধগুলো রেডিও-টেলিভিশনের বিরুদ্ধে ছিল। এখন ওতে সুবিধে হবে না বলে রেডিও-টেলিভিশনকে আঁকড়ে ধরেছে। কম্পিউটার, ইন্টারনেটকে আঁকড়ে ধরেছে। অমুসলিমদের আবিষ্কৃত যন্ত্রে ওদের এখন আর আপত্তি নেই। মোবাইল ফোনের বিরুদ্ধে থাকার কথা ওদের। কিন্তু সুবিধে হবে না বলে এটিকেও আঁকড়ে ধরেছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত এইসব যন্ত্রকে ওরা এখন নিজেদের ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে ব্যবহার করে । শুধু ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে নয়, কেউ কেউ তো এসবকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর কাজে, সন্ত্রাসী কাজকর্ম পরিচালনা করার কাজে।

    লালন শাহকেও জীবিত থাকাকালীন মৌলবাদীদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। শাহ আবদুল করিমকে হয়েছে। বাউল শিল্পী শরিয়ত বয়াতীকে জেলে পোরা হয়েছে, রীতা দেওয়ানকে হেনস্থা করা হয়েছে। কট্টর মৌলবাদীরা চিরকালই উদারনৈতিক সুফি মতবাদের বিরুদ্ধে। বিশ্বখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি জাদুঘরও পুড়িয়ে ছাই করেছে। অনুমান করতে কারও অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে কারা রণেশ ঠাকুরের সংগীতঘরটি পুড়িয়েছে। নিশ্চয়ই তারা পুড়িয়েছে যারা ঢাকার অদূরে লালন শাহের ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলেছিল। তারাই যুগে যুগে বাংলা ভাষাকে, বাংলা সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য রাজনীতি করছে। এ ইসলাম নয়, এ ইসলামের রাজনীতি। এই রাজনীতির উদ্দেশ্য হল, ইসলামের সংস্কৃতি ছাড়া আর কোনও সংস্কৃতি কোনও মুসলমানের দেশে টিকে থাকবে না। ধর্মান্ধ মুসলমান ছাড়া কোনও প্রগতিশীল মানুষ, কোনও মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, কোনও ধর্ম সংস্কারক, কোনও আধুনিক মননশীল মানুষের সে দেশে ঠাঁই নেই।

    আমি আগে বাঙালি মুসলমানদের বাঙালি বলতাম, এখন আর বলি না। এরা বাঙালি জাতিপরিচয় অনেক আগেই বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। আমি এদের বলি বাংলাদেশি, বাংলাদেশি মুসলমান। বাংলাদেশের মুসলিমরা না বাঙালি হতে পারছে, না আরবীয় হতে পারছে। এরা ধীরে ধীরে একটি নামপরিচয়হীন জীবে পরিণত হচ্ছে। কাবা যদি এদের শহরে থাকতো, কাবাকে কি এরা কখনও বন্ধ করতো? কাবার সামনে ভিড় করা বা হজ উমরাহ কি বন্ধ করতো? অবশ্যই না। কেউ বন্ধ করতে চাইলে তাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করতো। রওজা শরিফ জিয়ারত কি কোনও কারণে বন্ধ করতো এরা? প্রশ্নই ওঠে না। সৌদি আরবের কর্তারা কিন্তু সব বন্ধ করে দিয়েছেন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ করার উদ্দেশে। তাঁরাও এতটা মৌলবাদী নন, যতটা মৌলবাদী বাংলাদেশের মুসলমানেরা। সৌদি আরবে রোজা শেষ হওয়ার পরদিন থেকে পাঁচদিনের জন্য কার্ফু জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ ঈদের দিনে কার্ফু থাকবে সৌদি আরবে। কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবে না, কোথাও ঈদের নামাজের জমায়েত হতে পারবে না। বাংলাদেশের মুসলমানেরা অহরহই সৌদি আরবের পোশাকআশাক, ভাষা এবং সংস্কৃতির অনুকরণ করছে, কিন্তু ঈদের দিনের কার্ফুর কোনও অনুকরণ চলবে না।

    দেশ এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা একেকজন একেকটা রাজনৈতিক দলের বশংবদ ভৃত্যের ভূমিকা পালন করছেন। নিরপেক্ষ নির্ভীক কণ্ঠস্বর আজ বিলুপ্ত। বর্তমান সরকার দেশটিকে মূর্খ মৌলবাদীদের কবল থেকে রক্ষা করতে পারতো, সেই সুযোগ তাদের শতভাগ ছিল, কিন্তু সেই সুযোগকে কাজে না লাগিয়ে বরং মৌলবাদীদের আরও ভয়ংকর দৈত্য হতে দিয়েছে। মাদ্রাসাই এখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায় পাশ করা মৌলবিরাই এখন দেশের পণ্ডিত। এই দেশটির জন্য এখন যা অবশিষ্ট আছে, তা হল যে কজন অমুসলিম আর প্রগতিশীল চিন্তক দেশে আছে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে, অথবা তাদের জন্মের মতো চুপ করিয়ে দিয়ে একশ ভাগ ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া। সত্যিকার গণতন্ত্র বলে কিছু না থাকুক। ইসলামের আদর্শে দেশ চলবে। আল্লাহর আইন অর্থাৎ ‘কোরানের’ আইন কায়েম হবে। পবিত্র ‘হাদিস’ অনুসরণ করে সমাজ চলবে।

    এই দেশটির পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। পাকিস্তান থেকে ধ্যান ধারণায় পৃথক হওয়ার যোগ্যতাও এর নেই। আসলে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনাও ঠিক নয়। পাকিস্তানে যত বিপ্লবী আছেন, চিন্তাবিদ আছেন, সচেতন লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী আছেন, বাংলাদেশে তার সিকি পরিমাণও নেই। পাকিস্তানের মৌলবাদীরা পথেঘাটে, আর সেনাবাহিনীতে। বাংলাদেশের মৌলবাদীরা শুধু পথেঘাটে আর সেনাবাহিনীতে নয়, তারা সর্বত্র। তারা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তো বটেই, তারা সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রেও।

    বাংলাদেশের মৌলবাদীদের মূল শক্তির উৎস কিন্তু ধর্ম নয়, মূল শক্তির উৎস মূর্খতা। ধর্ম যদি উৎস হত, ধর্ম নিয়ে গবেষণা হত, ধর্ম নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হত। মোল্লা মৌলবিরা ভুলভাল বকলে হাতে নাতে ধরতে পারতো কেউ। কিন্তু মোল্লা মৌলবিরা হামেশাই মানবতার বিরুদ্ধে, নারীর বিরুদ্ধে, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে, আর পার পেয়ে যাচ্ছে। কারণ যুবসমাজের মূর্খতাই মোল্লা মৌলবিদের বাঁচায় আর যুবসমাজকে মৌলবাদী বানায়।

    হাসিনার ইচ্ছে ছিল মদিনা সনদে দেশ চালানোর। বেঁচে থাকাকালীন তাঁর ইচ্ছে পূরণ হোক। মদিনা সনদের ভিত্তি তিনি তাঁর শাসনামলে তৈরি করে ফেলেছেন, এখন শুধু তরতর করে মদিনা সনদের ইমারত উঠবে সেই ভিত্তিতে। কোনও বাউল আর বয়াতী গান গাইবে না, কেউ ঘুঙুর পরে নাচবে না, কোনও নারীবাদী সমানাধিকারের কথা লিখবে না। কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজবে না, কোনও মেয়ে বোরখাহীন পথ চলবে না, পাড়ায় পাড়ায় কোনও স্কুল নেই, কলেজ নেই, শুধু মাদ্রাসা, যেখানে আল্লাহর কিতাব মুখস্থ করানো হয়। কোনও বিজ্ঞান গবেষণাগার নেই, কোনও শিল্পকলা একাডেমি নেই, কোনও মিউজিয়াম নেই, চারদিকে শুধু মসজিদ। নামাজ পরার সংস্কৃতিই একমাত্র সংস্কৃতি। ইসলামের ইতিহাসই একমাত্র ইতিহাস।

    এমন দিন আসুক। যারা মনে করছে ১৪০০ বছর আগের সমাজব্যবস্থাই উত্তম ছিল, সেই সমাজ ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে এনে তারা বসবাস করুক। পৃথিবী দেখুক।

     ১ ১ ১. ধরা যাক করোনার টিকা এলো না, তাহলে?

    করোনা ভাইরাসের সঙ্গে কী করে বাস করতে হয় তা শিখতে হবে আমাদের। এ ছাড়া আর উপায় নেই। একথা বিজ্ঞানীরা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন। ১৮ মাস পরে অথবা সামনের সেপ্টেম্বরে যে টিকা আসার কথা ছিল, আমরা যে ঘরের ভেতর বসে দিনরাত সেই টিকা আসবে, দুনিয়া থেকে আপদ দূর হবে, আমরা আবার আগের জীবন ফিরে পাবো, সেই স্বপ্ন দেখছি, তার কী হবে? তার কিছুই হবে না, টিকা এলে আসবে, কিন্তু না এলে জীবন তো স্থবির পড়ে থাকবে না, আরও অনেক ভাইরাসের মধ্যে যেমন বাস করি, তেমন এই করোনার সঙ্গেও বাস করতে হবে। এর চেয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদ আর কী হতে পারে এই সময়?

    টিকা কবে নাগাদ আসবে তার ঠিক নেই, আদৌ আসবে কি না, এ নিয়ে কিছু বিজ্ঞানী এবং গবেষক সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তাঁরা বলেছেন, টিকা আবিষ্কার কোনও সোজা কথা নয়। সোজা হলে সার্স আর মার্স থেকে বাঁচার জন্য টিকা আবিষ্কার করা যেত। সার্স মার্স ইত্যাদিও করোনা ভাইরাস। এরা অনেক আগেই এসেছে। কিন্তু একটির জন্যও আজও টিকা বানানো সম্ভব হয়নি। নতুন করোনা ভাইরাস নিয়ে সমস্যা এ-ই যে এ বড় বেশি ছোঁয়াচে। সে কারণে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বেশি, মারাও পড়ছে বেশি। এটির টিকা বানাতে এত তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়, এই ভাইরাস তো তেমন ঘন ঘন রূপ পালটাচ্ছে না, তাহলে?

    টিকা তৈরি করার পদ্ধতি আসলেই খুব দীর্ঘ এবং জটিল। প্রথম পর্বে কয়েকজন মানুষকে টিকা দিয়ে দেখতে হবে। দ্বিতীয় পর্বে কয়েকশ’ মানুষকে টিকা দিয়ে দেখতে হবে। তৃতীয় পর্বে কয়েক হাজার মানুষকে টিকা দিয়ে দেখতে হবে। এইসব পরীক্ষানিরীক্ষায় সফল হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। নয় বলে আমরা যে টিকা পাবোই একথা জোর দিয়ে কোনও টিকাবিশেষজ্ঞ বলছেন না। সাধারণত দশ বছর সময় দরকার হয় টিকা বানাতে। এইচ আই ভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) ভাইরাসের টিকা আজও বানানো সম্ভব হয়নি। ৪০ বছর হয়ে গেল, এখনও চেষ্টা চলছে। ৭ কোটি ৫০ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে এইচ আই ভি দ্বারা যে রোগ হয় সেই রোগে, অর্থাৎ এইডসে। মরেছে ৩ কোটি ২০ লাখ লোক। এখন এইচ আই ভি ভাইরাসের সঙ্গেই মানুষ জীবনযাপন করে। কী করে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হয় তা মানুষ অনেকদিন ধরেই শিখেছে। আবোল-তাবোল কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্কে যাওয়া ঠিক নয়, গেলেও নিরাপদ যৌনতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। এসব রীতিনীতি এখন মানুষের স্বভাব চরিত্রের অংশ। করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে মাস্ক পরা, গ্লাবস পরা, হাত ধোয়া, মানুষের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, এগুলো মেনে চলাও একদিন খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, হয়তো হয়ে উঠবে স্বভাব চরিত্রের অংশ। বাঁচতে চাইলে এভাবেই আমাদের বাঁচতে হবে। এতে কোনও ভুল নেই। ভাবলে মনে হয় পরাবাস্তব একটি জগত এটি। হ্যাঁ এই পরাবাস্তবতাই এখন আমাদের বাস্তবতা।

    এই কোভিড১৯ অসুখটি, বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, প্রতি বছর শীতকালে উদয় হয়ে দুনিয়া তছনছ করবে। বছর বছর তো ডেঙ্গিও আসে। বছর বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা আসে। ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নিতে হয় প্রতি বছর। ইনফ্লুয়েঞ্জাতেও তো এখনও প্রচুর মানুষ মারা যায়। একসময় মিজলস বা হাম হলে প্রচুর লোক মারা যেত। ডেঙ্গি থেকে কী করে বাঁচতে হবে আমাদের জানা হয়ে গেছে। আমরা এসির জল, ফুলের টবের জল কোথাও জমতে দেবো না। জমলে ওই জলে ডেঙ্গির মশা জন্ম নেয়। মশা যেন আমাদের না কামড়ায় সেটা লক্ষ রাখতে হবে। মশারি টাঙাতে হবে, মশার ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। ডেংগির তো কোনও টিকা নেই। কিন্তু আমরা বর্ষাকালে সতর্ক হই কী করে মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারবো। বাজারে কত কিছু পাওয়া যায় ডেঙ্গির প্রকোপের সময়, সবই মশা দূর করার জন্য। আমার বাড়িতে আর গাড়িতে মশা মারার র‍্যাকেট তো এখনও আছে। যেভাবে ডেঙ্গিকে দূর করি, সেভাবে করোনা ভাইরাসকে দূর করতে হবে। এখন থেকে মশা মারার যন্ত্রের মতো হাতের কাছে রাখতে মাস্ক আর গ্লাবস।

    করোনার টিকা ধরে নিতে হবে আসবে না, সে কারণে করোনা রোগের চিকিৎসার চেষ্টায় আরও বেশি করে মন দিতে হবে। যেহেতু ভাইরাসের কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ হয় না, দেখতে হবে বাজারের কোনও ওষুধপত্র কাজ করে কিনা। ইতিমধ্যে ডাক্তাররা ম্যালেরিয়ার ওষুধ, ইবোলা রোগের ওষুধ, এইডসের ওষুধ, যক্ষার টিকা করোনা রোগীদের দিচ্ছেন। এক গবেষক তো সেদিন বললেন, পোলিওর টিকা সবাইকে খাওয়াতে, এতেই করোনা থেকে বাঁচা যাবে। অন্য রোগের টিকা দিয়ে কাজ হয় কি না ডাক্তাররা দেখছেন, টিকা আর ওষুধপত্রের মিশ্রণে কিছু তো কাজ হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো হত করোনার টিকা এলে। কিন্তু টিকা না এলে হাপিত্যেশ করে কি আমাদের মরে গেলে চলবে! আমাদের এভাবেই পরীক্ষা করে করে কিছু একটা ককটেল আবিষ্কার করতে হবে কাজ চালানোর জন্য। সুস্থ হয়ে ওঠা করোনা রোগীর রক্ত থেকে প্লাজমা নেওয়া হচ্ছে, এই প্লাজমার ভেতরে যে এন্টিবডি থাকে, তা দিয়ে অসুস্থকে সুস্থ করা যাচ্ছে আপাতত। এটিও তো করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আর একটি হাতিয়ার। মৃত্যুকে সামান্য হলেও তো রোধ করা যাচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম থাকলে লড়াইয়ে হেরে যেতে হবে। এইডসে, ম্যালেরিয়ায়, ডেঙ্গিতে, ফ্লুতেও তো বছর বছর মানুষ মরছে। করোনাতেও মরবে। এখন যেমন এই মহামারীর বা অতিমারীর মাঝখানে বসে এই মৃত্যুগুলোকে আমরা গুনছি আর আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছি, একসময় এই মৃত্যুও হয়তো স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, আমরা আর দুশ্চিন্তায় ঘরে বন্দি থাকবো না। নতুন দুনিয়া তার মতো করে গুছিয়ে নেবে। মানুষও করোনার ভাইরাস থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলবে। যে কোনও অবস্থার মধ্যে বসবাস করা শুধু আরশোলাই জানে না, মানুষও জানে।

    তবে মানুষ চেষ্টা করলে এই করোনার ভয়াবহতার লাগাম টেনে ধরতে পারতো। কে করোনা দ্বারা আক্রান্ত, কে সুস্থ, কে অসুস্থ, কে ভাইরাস বহন করছে, কে ছড়াচ্ছে, কার শরীরে এন্টিবডি আছে, কার শরীরে নেই, এসব জানলে আলাদা করা যেত সুস্থ আর অসুস্থকে। তা হলে ভাইরাস আর এক শরীর থেকে আর এক শরীরে লাফিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতো না। সুযোগ না পেলেই ভাইরাস তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে মুশকিলে পড়বে। মানুষ যত বেশি মানুষের কাছাকাছি যাবে, তত বেশি বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে ভাইরাস।

    করোনার প্রকোপ দূর করতে প্রচুর টেস্ট করতে হবে। দুনিয়ার সবাইকে টেস্ট করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। চীনের উহানে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। চিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে উহানের সবাইকে, ১ কোটি ১০ লাখ লোককে আগামী ১০ দিনে পরীক্ষা করে দেখা হবে। ওদিকে আমেরিকাও বলেছে আগামী ৭ দিনে ১ কোটি লোককে পরীক্ষা করবে।

    করোনা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ব্যাবসা বাণিজ্য, চাকরিবাকরি করার জন্য। অর্থনীতি ধসে পড়ছে। এভাবে চললে মানুষ না খেয়ে মরবে। অল্প অল্প করে তাই শহর-বন্দর খুলে দেওয়া হচ্ছে। ভাগ্যবানরা বেঁচে থাকবে, দুর্ভাগারা মরবে।

    দুর্ভাগাদের মধ্যে বেশিরভাগই গরিব শ্রমিক, যাদের পক্ষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজকর্ম করার উপায় নেই। যাদের পক্ষে বিল্পব করার উপায় নেই ধনী মালিকদের বিরুদ্ধে, যারা জীবনভর তাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম, যাদের ঘরে বসে থাকলে চলবে না, জীবিকার জন্য কাজে বেরোতে হয়, তারা শ্রমিক না হলেও তারা দুর্ভাগা। কোনওক্রমে ভাইরাস তাদের ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারলেই তাদের গণকবরে পাঠিয়ে দেবে। এই বাস্তবতা আমরা প্রথম মেনে নিতে না পারলেও ধীরে ধীরে মেনে নিচ্ছি। এ ছাড়া আসলে আমাদের আর উপায়ও নেই।

    রেস্তোরাঁ চালু করেছে কিছু দেশ। হাতে গোনা লোককে ঢুকতে দিচ্ছে। টেবিলগুলোর মধ্যে বিরাট দূরত্ব। করোনার অভিজ্ঞতা মানুষকে ক্যাফে রেস্তোরাঁ যাওয়া থেকে বিরত রাখবে। আজই তো আমাকে আমার একটি প্রিয় রেস্তোরাঁ থেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করা হল আমি কিছু খাবার চাই কি না, তারা হোম ডেলিভারি দেবে। আমি অতি সতর্ক, ডেলিভারি দেওয়ার লোকদের শরীরে কিছুদিন আগে ভাইরাস পাওয়া গেছে। সুতরাং বিশ্বাস নেই। আমি বাইরের খাবার খাবো না বলে দিই। অনেকরকম ব্যাবসাকেই আমার মনে হয় পাততাড়ি গুটোতে হবে। যেমন ক্যাফে রেস্তোরাঁর ব্যাবসা। জানি না, সময়ই বলবে। আমার এক চেনা চিত্রপরিচালক শুনেছি চলচ্চিত্র বানানোর বদলে এখন ওয়েব সিরিজ বানানোর চেষ্টা করছেন। কাজ বদলানো মনে হয় শুরু হয়ে গেছে। নতুন সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ বদলে যাবে।

    লকডাউনের সময় আমার নতুন একটি বই বেরোলো হারপার কলিন্স থেকে। হারপার কলিন্স ছাপানো বইয়ের বদলে ইলেকট্রনিক বই বের করেছে। এটি বিক্রিও হচ্ছে ভালো। মানুষ এখন বইয়ের দোকানে গিয়ে বই কেনা, বা অনলাইনে বই অর্ডার করে ডেলিভারি দেওয়া লোকের হাত থেকে বইয়ের প্যাকেট নিয়ে সাতবার সাবান দিয়ে হাত আর প্যাকেট ধোয়ার বদলে ই-বুক কিনছে অনলাইনে, কম্পিউটারেই পড়ে নিচ্ছে বই। এভাবেই তো জীবনযাপন পালটে যাচ্ছে।

    আমি শুধু ভাবছি আমার এত যে শাড়ি, শাড়িগুলো পরার কখনও কি সুযোগ পাবো? সুন্দর একটি শাড়ির সঙ্গে মাস্ক কি মানাবে? হয়তো এখন ভাবছি মানাবে না। একসময় হয়তো দেখবো, ঠিকই মানাচ্ছে। যে কোনও অবস্থাকে গ্রহণ করতে পারে মানুষ। পারে বলেই এত ভাইরাস এত ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও, এত ভূমিকম্প, এত টর্নেডো, এত বন্যা, সুনামির মধ্যেও মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। করোনাও মানুষকে বিলুপ্ত করতে পারবে না।

     ১ ১২. মানবিক পৃথিবী চাই

    মানুষ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে মানুষের অগুনতি করোনা-মৃত্যুতে। মানুষ ঘরবন্দি জীবন আর চাইছে না। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই লকডাউন ভাঙছে মানুষ। সমুদ্র সৈকতে সূর্যস্নান করার স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে চাইছে না, সমুদ্রে সাঁতার আর সার্ফিং-এর আনন্দকে চাইছে না ডুবিয়ে দিতে, মদ্যপানের সুখ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে চাইছে না, সুস্বাদু খাদ্য ভক্ষণের ইচ্ছে দূর করতে চাইছে না, চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় পার্কে হাঁটার, জগিং করার বা সাইকেল চালানোর দৈনন্দিন রুটিন থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে চাইছে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানুষ চালু করতে চাইছে ব্যাবসা বাণিজ্য, খুলতে চাইছে দোকানপাট, কলকারখানা। এই স্বাধীনতার মূল্য কি মানুষ দিচ্ছে না? করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। তারপরও স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে অনেকেই রাজি নয়। তারা বলছে, কতভাবেই তো মানুষের মৃত্যু হয়, কতরকম ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাসে হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় হয়, ট্রেন-প্লেন দুর্ঘটনায় হয়, বন্দুকবাজি, বোমাবাজিতে হয়, ক্যানসারে হয়, হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হয়। এগুলো নিত্যদিনের মৃত্যু। করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা যত, তার চেয়ে করোনায় তো বেঁচে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই ভয় কেটে গেছে মানুষের। সেই জীবন ফিরে পেতে চায়, যে জীবনটি তারা করোনার আবির্ভাবের আগে যাপন করেছে। চীনের দর্শনীয় স্থানে মানুষ এখন ভিড় করছে, নিউজিল্যান্ডে মৃতের সংখ্যা কম, মানুষ তাই ভিড় করছে রেস্তোরাঁয়, স্পেন দেখেছে করোনা কী করে কেড়ে নিয়েছে শত সহস্র প্রাণ, খোলা মাঠে তারা আজ বেরিয়ে জীবনের উৎসব করছে স্পেনের মানুষ, থাইল্যান্ডে বসে গেছে ফুটপাতের দোকান। মানুষ শ্মশানে পড়ে থাকতে কিছুতেই রাজি নয়। তারা জীবনের স্বাদ-গন্ধ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

    আমরা কেউ জানিনা কী ঘটতে যাচ্ছে। লকডাউন কিছুটা শিথিল করার পর আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুসংখ্যাও বাড়ছে। তারপরও শিথিল একটু একটু করে করতেই হবে, তা না হলে অর্থনীতি ধসে পড়বে, মানুষ না খেয়ে মরবে। একসময় লকডাউন উঠে গেলে করোনায় আক্রান্তের এবং মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন হয়তো প্রচারও হবে না। আমরা জানবোও না কোথায় কজন মারা যাচ্ছে। আড়ালে মৃত্যু ঘটলে আমাদের দুশ্চিন্তাও এখনকার মতো এমন প্রচণ্ড হবে না।

    করোনার ভালো একটি টিকা ঠিক কবে নাগাদ হাতে পৌঁছোবে কেউ জানি না। এর মধ্যে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হবে। প্রচুর বেঁচেও যাবে। শেষ পর্যন্ত ওই মন্ত্রই আমাদের মেনে নিতে হবে, ‘যে যাওয়ার সে যাবে, যে থাকার সে থাকবে’। করোনায় মৃত্যু হলে আজকাল ঘটা করে সৎকার করারও দরকার পড়ে না। আত্মীয়-বন্ধুদের চোখের আড়ালেই মানুষ চিরতরে চলে যাচ্ছে।

    করোনা মনে হচ্ছে মানুষকে স্বার্থপর বানাচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। যারা ‘করোনায় আক্রান্ত যদি হতে হয় হবো’ বলে লকডাউন অমান্য করে ঘর থেকে বেরোচ্ছে, তারাও কিন্তু প্রিয়জনের মৃত্যু হলে তার কাছে গিয়ে তার মুখটি শেষ বারের মতো দেখছে না, বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে না। আবেগ নিরুদ্দেশে গেছে। নিশ্চিন্তের জীবন আর কারোর নেই। যে কোনও সময় যে কেউ পিছলে পড়তে পারে, তাই নিজের ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ আর আনন্দকে মানুষ থাবা দিয়ে ধরতে চাইছে। অন্যের জন্য চোখের জল ঝরতে দিতে এখন অনেকেই রাজি নয়।

    ভারতবর্ষে মদ কেনার জন্য যে দীর্ঘ লাইন পড়েছে, কড়া রোদ আর তুমুল বৃষ্টি এলেও সে লাইনের দৈর্ঘ্য এতটুকু কমেনি। ১০০ কোটি টাকার মদ বিক্রি হয়ে গেল একদিনে। মদ্যপানের আনন্দটা কেউ ত্যাগ করতে চাইছে না।

    এর মধ্যে হেলিকপ্টার থেকে চমৎকার পুষ্পবৃষ্টি ঘটানো হল, ডাক্তার আর নার্সদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। কী অসাধারণ সেই দৃশ্য। আমার মনে হচ্ছিল ফুলই কি ডাক্তার আর নার্সদের খুশি করার জন্য এখন সবচেয়ে দরকারি? তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য কি সব উপকরণই হাতের কাছে আছে? তাঁদের সুরক্ষার পোশাক, তাঁদের এন নাইনটি ফাইভ মাস্ক, মাসান্তে করোনার টেস্ট? আমি জানি না কত টাকা খরচ হয়েছে পুষ্প বৃষ্টির পেছনে। ডাক্তার আর নার্সদের তো থালা আর তালি বাজিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানোই হয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে যে ডাক্তার এবং নার্স জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের যেন করোনায় আক্রান্ত হতে না হয়, তাঁদের যেন অকালমৃত্যু না হয়—সেই সুব্যবস্থার পেছনে টাকা ঢালা পুষ্পবৃষ্টির পেছনে টাকা ঢালার চেয়ে বেশি জরুরি। যদি বলা হয় ডাক্তার আর নার্সদের সুরক্ষার ব্যবস্থা পাকা। তাহলে তো ভালো, টাকা যদি হাতে আছেই খরচ করার, তবে ওই অভিবাসি শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা পাকা করা উচিত। লকডাউনের আগেই উচিত ছিল। তখন না হলেও এখন করা উচিত। সরকার বলে দিয়েছে শ্রমিকদের ট্রেনের টিকিট কিনতে হবে। কিন্তু হাতে ওঁদের টাকা কোথায় টিকিট কেনার? জম্মু থেকে হেঁটে বিহারে ফিরছেন শ্রমিকেরা। মাথায় বোঁচকা নিয়ে হাজার মাইল হাটাঁর প্রস্তুতি নিয়ে। দেখলে অসহ্য যন্ত্রণা হয় মনের কোথাও। মধ্যপ্রাচ্যে, এশিয়ায়, ইউরোপে আটকে পড়া ভারতীয়দের দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করছে সরকার। এটি চমৎকার উদ্যোগ। যাতায়াতের খরচ যাত্রী দেবেন, সরকার নয়। যাঁরা বিভিন্ন দেশে কাজেকর্মে বা বেড়াতে গিয়ে লকডাউনের কারণে আটকে গিয়েছেন, তাঁদের পকেটে টিকিটের টাকা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু গরিব শ্রমিকদের কিন্তু লকডাউনের কারণে কাজও নেই, বেতনও নেই। তাঁদের কাছ থেকে ট্রেনের ভাড়া চাওয়াটা অমানবিক। মানুষ কি অমানবিক হয়ে উঠছে দিনদিন?

    করোনা ভাইরাস বিশ্ব জুড়ে মানুষকে আক্রমণ না করলে লকডাউনের ঘটনা ঘটতো না। লকডাউনের ঘটনা না ঘটলে গরিবের সংখ্যা এবং তাদের অসহায়ত্বটাও বিশ্ববাসীর দেখা হত না। এখন আমরা জানি বিশ্বে কারা কেমন আছে। আমরা জানি উন্নত দেশে বাস করলেই চমৎকার স্বাস্থ্যসেবা জোটে না, সকলেই সেখানে নিরাপদ নয়, আমরা জানি তুমি পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছ, দেশে কোটিপতির সংখ্যা অনেক, তার মানে কিন্তু এই নয় যে তোমার দেশে দারিদ্র নেই, বা কেউ অভুক্ত নেই। ২০ লক্ষ শিশু ভারতের রাস্তায় বাস করে, তাদের কোনও ঘর নেই, কোনও খাদ্য নেই।

    ভালো উদ্যোগও কিন্তু ভারত সরকার নিয়েছে। রেশন কার্ড যাদের আছে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিনে পয়সায় রেশন দেওয়া হয়েছে। যাদের রেশন কার্ড নেই, তাদের বিনে পয়সায় রান্না করা খাবারও দেওয়া হয়েছে। অভুক্তকে খাদ্য দেওয়ার, বেকারকে চাকরি দেওয়ার, গৃহহীনকে আশ্রয় দেওয়ার, সবাইকে শিক্ষা দেওয়ার, নিরাপত্তা দেওয়ার এবং স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পদক্ষেপ যেন প্রতিটি দেশই নেয়, নিয়ে থাকলে করোনার অজুহাতে এ থেকে কোনও দেশই যেন সরে না আসে। করোনা পরবর্তী বিশ্বকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে যেভাবে রক্ষা করতে হবে, তেমনি মানবিক হতে হবে আগের চেয়ে বেশি। করোনার অভিজ্ঞতা মানুষকে যেন অমানবিক না করে, যেন মানবিক করে আরও। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মেনে নিলেও মানুষের মধ্যে যেন মানসিক দূরত্ব মেনে না নিই। পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা না থাকলে মানুষ ক্রমশ রোবট হয়ে উঠবে। রোবটের পৃথিবী এক ভয়াবহ পৃথিবী যে পৃথিবীতে বেঁচে না থাকলে আমার সত্যিই কোনও আফশোস হবে না। অনেকেরই হয়তো হবে না।

     ১ ১৩. করোনা ভাবনা

    করোনা ভাইরাস সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা দেন না। তাঁরা বলেন, এই ভাইরাস নতুন, আমরা এখনও গবেষণা করছি, সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। কিন্তু তারপরও কিছু অনুমান তো করা যায়। কেন দক্ষিণ এশিয়ায় করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাটা ইউরোপ আর আমেরিকার মৃত্যুর সংখ্যা থেকে কম? বেশ কিছু অনুমান হাওয়ায় ভাসছে। এক, বিসিজি টিকা। এখানকার মানুষকে যক্ষা প্রতিরোধক বিসিজি টিকা ছোটবেলাতেই দেওয়া হয়। চোখে পড়ছে যে সব দেশে বিসিজি টিকা দেওয়া হয়, সেসব দেশের মানুষ তুলনায় কম আক্রান্ত হচ্ছে, কম মারা যাচ্ছে। দুই, ইউরোপ আর আমেরিকায় আক্রমণ করছে করোনা ভাইরাস এ এবং সি, আফ্রিকা এবং এশিয়ায় যে ভাইরাসটি আক্রমণ করছে, সেটি করোনা ভাইরাস বি। বি ভাইরাসটি যে কোনও কারণেই হোক এ এবং সি’র মতো ভয়ংকর নয়। তিন, দক্ষিণ এশিয়ায়, ইউরোপ আর আমেরিকার চেয়ে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেশি। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বয়স্কদের চেয়ে ভালো। তারা হয় আক্রান্ত হচ্ছে না, আক্রান্ত হলেও সেরে উঠছে। গরম আবহাওয়ার কারণে কি কম ছড়াচ্ছে রোগ? বিজ্ঞানীরা নাকচ করে দিয়েছেন এই সম্ভাবনা। গবেষণা যেহেতু এখনও চলছে, ভাইরাস বিবর্তিত হচ্ছে, সুতরাং কোনও অনুমানকেই সঠিক উত্তর বলে ধরা যাবে না।

    কোভিড১৯ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ যদি বেশিরভাগই এ যাত্রা বেঁচেও যায়, ভাইরাসের দ্বিতীয় আক্রমণে বাঁচবে কি না বলা যায় না। ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি যাঁরা ভালো জানেন, সেই গবেষকরা আমাদের প্রস্তুত থাকতে বলছেন দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য। ওটি এটির চেয়েও প্রচণ্ড ভয়াবহ হবে। প্রথম মহাযুদ্ধে এক লক্ষ ষোলো হাজার লোক মরেছিল, আর এই করোনা ভাইরাসে এক লক্ষ সাতাত্তর হাজার আটশ’ জন মারা গেছে। তারপরও নাকি এটি কিছুই নয়। বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা বলছেন, আমরা এখনও করোনা ভাইরাসের আসল চেহারাটি দেখিনি, দ্বিতীয় আক্রমণে ভাইরাস তার বীভৎস চেহারা দেখাবে। ভাইরাস এত বারবার বিবর্তিত হচ্ছে যে গবেষকরা আশঙ্কা করছেন এটি ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো কোনও একটি সময়ে প্রতি বছর উদয় হবে। এবার আমেরিকা যে দুরবস্থা দেখেছে, সামনের শীতে নাকি এর চেয়েও বেশি দেখবে।

    আমার ভয় লাগছে, দেশে দেশে কীভাবে মানুষ অস্থির হয়ে উঠছে আগের জীবনে ফিরে যেতে। তারা আর ঘরে বসে থাকতে চাইছে না। অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে, বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, উৎপাদন বন্ধ, কারখানা বন্ধ। তারা সরকারকে চাপ দিচ্ছে সবকিছু আবার খুলে দেওয়ার জন্য। খুলতে তো হবেই, ভাইরাসের সংগেই আমাদের বসবাস করতে হবে, যে মরবে সে মরবে, যে বাঁচবে সে বাঁচবে থিওরিতে। ভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকি মানুষ নিতে চাইছে, কিন্তু অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারেই নিতে চাইছে না। বয়স্কদের বাঁচাবার জন্য তরুণদের যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, সম্ভবত তরুণরা সেই উপদেশকে আর গ্রহণ করতে চাইছে না। যারা মারা যাচ্ছে, তারা পরিবার-পরিজনকে একবার চোখের দেখা না দেখেই মারা যাচ্ছে। শুনেছি দূর থেকেও বিদায় জানাতে কেউ যাচ্ছে না। সরকারি লোকেরা সৎকারের ব্যবস্থা করছে।

    আগের জীবন কি সত্যিই আমরা কোনওদিন ফিরে পাবো না? বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে জীবনটি পাবো, সে এক নতুন জীবন, মোটেও আগের জীবনের মতো নয়। ভাবতেই কীরকম হু হু করে ওঠে বুকের ভেতর। বিমানে, ট্রেনে, বাসে ভ্রমণ, দর্শনীয় স্থানগুলোয় ঘুরে বেড়ানো, গ্রাম-শহর চষে বেড়ানো, সিনেমায়, থিয়েটারে যাওয়া, রেস্তোরাঁয় খাওয়া, ভিড়ের বাজারে হাঁটা, বিয়েবাড়ি, পার্টি, কনসার্ট সব কি স্মৃতির অ্যালবামেই রয়ে যাবে? ফিরে পাবো না? সৌহার্দ্য প্রকাশ করতে শারীরিক নৈকট্যের দরকার হয়। দূর থেকে কী করে ভালোবাসবে মানুষ? তাহলে কি মানুষ প্রেম করবে না, মা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরবে না, বন্ধুরা আলিঙ্গন করবে না? মানুষের জীবন থেকে কি সত্যিই উঠে যাবে ধরা-ছোঁয়া, চুম্বন, আলিঙ্গন? কিছুই জানিনা। বিজ্ঞানীরা কোনও আশার বাণী শোনাচ্ছেন না, বলছেন অন্তত ২০২২ পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখো। কারণ তো একটিই, সর্বনাশা ভাইরাস পৃথিবী থেকে বিদেয় হয়নি। এই ২০২২কে হয়তো বছর বছর বদলাতে হবে। ২০৩৩ পর্যন্ত, ২০৪৪ পর্যন্ত। মানুষের সঙ্গ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে রাখতে মানুষ হয়তো বিচ্ছিন্ন থাকতেই একসময় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। যারা পারবে না নিয়ম মানতে, তারা মরে যাবে। হয়তো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ আক্রমণে পৃথিবীর অর্ধেক অথবা তারও চেয়ে বেশি জনসংখ্যাই বিয়োগ হয়ে যাবে।

    বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অর্থনীতি চালু করতে চাইলে সবাইকে পরীক্ষা করতে হবে, হ্যাঁ সব মানুষকে। ৭৮০ কোটি মানুষকে। কার শরীরে ভাইরাস আছে, কার শরীরে নেই, তা দেখতেই হবে। বিজ্ঞানীরা তো আমেরিকাকে বলেই দিয়েছেন, যদি শহর-বন্দর খুলেই দিতে চাও, তবে দিনে পাঁচ লক্ষ টেস্ট করাও, যাদের শরীরে ভাইরাস আছে তাদের আলাদা করো। এ না হলে খুব বড় ঝুঁকি নেওয়া হবে। ঝুঁকি মানুষ নিতেই চায়। ঝুঁকি নিয়েই চেনা জীবনে ফিরতে চায়। এখনও আমরা জানিনা কী হতে যাচ্ছে।

    বিজ্ঞানীরা যখন বলেন, আরও ভয়ংকর আঘাত হানবে এই ভাইরাস, তখন আমি ভাবি, এর চেয়ে বড় আঘাত আর কী হতে পারে, এর চেয়ে ভয়ানক বিভীষিকা আর তো কিছু হতে পারে না। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ মরে যাচ্ছে, মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে ছড়াচ্ছে ভাইরাস, ভাইরাস পড়ে আছে এমন যে কোনও জায়গা স্পর্শ করলেই হাতে লেগে যাচ্ছে ভাইরাস, সেই ভাইরাস ফুসফুসে ঢুকে গিয়ে ফুসফুস অকেজো করে দিচ্ছে। হৃৎপিণ্ডও বন্ধ করে দিচ্ছে, মস্তিষ্কেও ক্ষরণ ঘটাচ্ছে। এর চেয়ে ভয়ানক, মারাত্মক, মৃত্যুময় তো আর কিছু হতে পারে না। তখন ভাবি এর চেয়ে মারাত্মক একটিই হতে পারে, বাতাসে ভাইরাস ভাসবে। অসুস্থ মানুষের কাশি থেকে এক মিটার বা সাত মিটার দূরের বাতাসে নয়, সমস্ত বাতাসে! তখন হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ছাড়া মানুষের আর উপায় থাকবে না।

    আমি একা ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছি, সঙ্গে পোষা বেড়াল। এভাবে দরজা-জানালা বন্ধ করে কতদিন মানুষ টিকে থাকতে পারে? এ জীবনে আনন্দ নেই, কিন্তু বেঁচে থাকা আছে। বেঁচে থাকার জন্য ভাইরাস যেমন যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজেকে পালটে যোগ্য করে নেয়, মানুষও তেমন। মানুষ তেমন বলেই এত দুর্যোগে বিপর্যয়ে আজও টিকে আছে। আমি তো ভাবছি টিকা নেওয়ার দিন দরজা খুলবো, তার আগে নয়।

    ভাইরাসের সঙ্গে সম্মুখ সমরে এখন মানুষ। কে হারবে, কে জিতবে কেউ জানি না। তবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভাইরাসকে দ্রুত হারানো সম্ভব। কিন্তু সেটা একেবারেই হচ্ছে না। আমেরিকা চীনকে দোষ দিচ্ছে, চীন আমেরিকাকে। আমেরিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে টাকা দেবে না জানিয়ে দিয়েছে। ওদিকে চীন তাদের ‘ভেজা বাজার’ আবার খুলেছে, যে বাজার থেকে ভাইরাস উঠে এসেছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল। চীনকে ওই বাজার বন্ধ করতে কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে? না বলেনি। কেন বলেনি কেউ আমরা জানিনা। এই দুঃসময়ে এইসব রাজনীতি সবাইকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার মতো মনে হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে জানতাম তারা ইউরোপের মঙ্গলের জন্য তৈরি। ইউরোপের এক দেশের বিপদে ইউরোপের অন্য দেশ দাঁড়ায় জানতাম। কিন্তু ইতালি আর স্পেনে যখন ভাইরাসের হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, ইউরোপের কটি দেশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওদের সাহায্য করতে? যে সময় জাতীয়তা ভুলে বিশ্বের এক হওয়ার কথা, পরস্পরকে সহযোগিতা করার কথা, দেশগুলো তখন মেতে আছে ঝগড়াঝাঁটিতে। মানুষের এই চরম দুর্দিনে কোনও নেতা নেই হাল ধরার, কেউ নেই যে আশা দেবে, আশ্বাস দেবে। দেশগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ভাইরাসের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। বিজ্ঞানীরাও দেশে দেশে বিচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করছেন। কিন্তু এই মারণ ভাইরাসকে রুখতে হলে সব দেশকে এক হয়ে কাজ করতে হবে, সব বিজ্ঞানীকে এক হয়ে ওষুধপত্র এবং টিকা আবিষ্কার করতে হবে। তা না হলে একটি জিনিসই আমরা আরও বেশি দেখতে থাকবো, মানুষের মৃত্যু। এই মহামারী যদি বিশ্বকে এক করতে না পারে, তবে কিছুই পারবে না।

     ১ ১৪. মানবতার সেবা করলে শত্রুকেও স্যালুট করবো

    ধর্মান্ধ লোকগুলো চিরকালই বড় স্বার্থপর। সব ধর্মের অন্ধদের কথা বলছি। তারা শুধু সেই কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চায়, যে কাজগুলো করলে, তাদের বিশ্বাস তারা পরকালে অনন্তকাল সুখভোগ করবে, অথবা চমৎকার পুনর্জীবন পাবে, অথবা নির্বাণলাভ করবে। ধর্মান্ধদের ধনসম্পদ মন্দির, মসজিদ বা প্রার্থনালয়ের পেছনে ব্যয় হয়। নিজের কল্পিত আখের গোছানো ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনও গুরুতর সমস্যা নিয়ে তারা চিন্তিত নয় মোটেও।

    মধ্যযুগে যখন ইউরোপে গির্জার শাসন চলতো, সেই যুগকে বলা হয় অন্ধকার যুগ। গির্জার অন্যায় অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে রাষ্ট্রের শাসনভার গির্জার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ধর্ম যখন সভ্য সমাজে ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে লাগলো, গির্জা তখন অবিশ্বাসীদের এবং ঈশ্বরের নিন্দুকদের হত্যা করার অসহিষ্ণু সংকল্প থেকে সরে এলো, তারা গৃহহীনকে আশ্রয় দিতে লাগলো, ক্ষুধার্তদের খাবার দিতে লাগলো, তৃষ্ণার্তকে জল পান করাতে লাগলো—এই সেবামূলক কাজ করেই তারা সমাজে ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো।

    আমরা এখনও মন্দির, মসজিদকে গির্জার মতো মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখি না। এর কারণ বোধহয় এটিই যে এখনও মন্দির, মসজিদের জনপ্রিয়তা প্রচণ্ড, এখনও মন্দির, মসজিদের বিরুদ্ধে জনগণ যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, এখনও তাদের প্রভাব এবং প্রতাপ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কারণ এখনও ধার্মিকের সংখ্যা প্রচণ্ড, এখনও ধর্মের ব্যাবসা প্রচণ্ড লাভবান ব্যাবসা। জনপ্রিয়তা হারালেই কি তবে গির্জার মতো মন্দির, মসজিদ মানবতার সেবায় মনোযোগ দেবে? কিছু কিছু সেবায় মন্দির জড়িত থাকলেও, মসজিদকে খুব একটা সেবামূলক কাজে যোগ দিতে দেখা যায় না। আজকাল তো বাংলাদেশের মসজিদ থেকে লাঠিসোটা নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের দাবিতে লোকদের বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। ভায়োলেন্স, ধর্ষণ, মাদক—সবকিছুতে মসজিদ-মাদ্রাসার ইমাম আর মৌলনাকে জড়িত থাকতে দেখা যায়। বলছি না সবাই জড়িত। কেউ কেউ জড়িত। কেউ কেউই বা জড়িত থাকবে কেন ধর্ম যদি তাদের নিরবধি সৎ এবং নিষ্পাপ মানুষ হতে শেখায়?

    যখন সকলের ঘরে থাকার কথা, যখন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভারতের দোকানপাট, স্কুলকলেজ সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যখন মানুষের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে গেছে, যে কোনও-রকম জমায়েত নিষিদ্ধ যখন, তখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং এশিয়ার করোনা-আক্রান্ত দেশ থেকে তাবলিগ জামাতের সদস্যরা দিল্লির নিজামুদ্দিনে এসে হাজার লোকের সম্মেলন করেছিল। সম্মেলন শেষে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। এদের অনেকের শরীরেই ছিল করোনা ভাইরাস, যে ভাইরাস ভয়ংকর সংক্রামক, যে ভাইরাস দ্বারা তারা অন্তত এক হাজার মানুষকে সংক্রামিত করেছে। এই খবর যখন জানাজানি হল, কট্টর হিন্দুদের মধ্যে যারা মুসলিম-বিরোধী তারা এমনই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো যে বলতে লাগলো মুসলিমরা জেনেবুঝেই ভারতের মানুষকে সংক্রামিত করেছে। ঘৃণা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো অরণ্যের আগুনের মতো। তাবলিগ জামাতের লোকদের মানুষ ডাকতে শুরু করলো ‘ভাইরাস’ বলে, ওদের কাজকে বলতে লাগলো ‘করোনাজিহাদ’। কিছু প্রচারমাধ্যমও দিনভর বলতে শুরু করলো তাবলিগ জামাত অমুসলিম নাগরিককে সংক্রামিত করার অসৎ উদ্দেশে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে গিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাবলিগ জামাতের কর্মকাণ্ড পছন্দ করি না, আমি মনে করি ১৪০০ বছর আগের আরবীয় জীবনধারা এই একবিংশ শতাব্দীতে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত একেবারেই যুক্তিহীন অর্থহীন বালখিল্য সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাবলিগ জামাতের সদস্যরা জেনেবুঝে শরীরে ভাইরাস বহন করেছে ভারতের লোকদের সংক্রামিত করার জন্য, এ আমি বিশ্বাস করি না। মালয়েশিয়ায় তাবলিগ জামাতের সম্মেলনেই ধরা পড়েছিল জামাতের বেশ কিছু লোক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। তারপরও ভারতে দিব্যি তারা ঢুকে গেল, নিজামুদ্দিন থানার পাশেই এক মসজিদে এক হাজারেরও বেশি লোকের তিনদিন ব্যাপী সমাবেশ হয়ে গেল! পুলিশের চোখের সামনে এই সম্মেলন করা কী করে সম্ভব হয়েছিল আমি জানি না। তাবলিগ জামাতের গুরু মোহাম্মদ সাদ আশ্বাস দিয়েছিলেন মসজিদে করোনা ঢুকবে না, ঢুকলে আল্লাহই করোনা থেকে বাঁচাবে। ধর্মান্ধরা তাঁর ওই কথা একশ’ ভাগ বিশ্বাস করেছিল। তারপর যখন শরীরে করোনা ধরা পড়লো, হাসপাতালে যেতে হল তাদের, কোয়ারেন্টিন করতে হল। ৩০০ বা ৪০০ লোক সুস্থ হয়ে উঠেছে। যারা সুস্থ হয়ে উঠেছে, তারা খুব ভালো একটি কাজ করছে, তারা হাসপাতালে রক্তদান করছে, ঠিক রক্ত নয়, রক্তের প্লাজমা। রক্তের তরল অংশকেই বলে প্লাজমা, আর এই প্লাজমাতেই থাকে এন্টিবডি। এই এন্টিবডি এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচানোর জন্য ভীষণই প্রয়োজন। প্লাজমার এন্টিবডিই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ভ্যাক্সিন বা টিকা হাতে এসে গেলে এন্টিবডির দরকার পড়বে না। কিন্তু যতদিন না ভ্যাক্সিন আসছে, ততদিন এই এন্টিবডিই ভরসা। তাবলিগ জামাতের দেওয়া প্লাজমা গ্রহণ করে, সর্বশেষ সংবাদ, কিছু রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছে।

    এখন প্রশ্ন হল, তাবলিগ জামাতকে যারা ঘৃণা করতো, তারা কি এখনও ঘৃণাই করতে থাকবে? আমার কথা বলতে পারি, আমি তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে হলেও তাদের এই রক্ত দেওয়ার উদ্যোগকে সাধুবাদ না দিয়ে পারিনি। বিপদে পড়েই হয়তো তারা রক্তদান করে পিঠের চামড়া বাঁচাতে চাইছে। পেছনে তাদের যে কারণই থাকুক প্লাজমা দান করার, সেটা বড় নয়। যে ব্যাপারটা ঘটেছে সেটা বড়। দায়িত্বহীন কাজ করে মানুষকে করোনায় সংক্রামিত করে নিন্দে জুটেছিল তাদের, ভালো কাজ করলে লোকের বাহবাও এখন কামিয়েছে। নিন্দের চেয়ে বাহবা পেয়ে বা প্রশংসা পেয়ে তাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগছে এখন।

    স্বার্থপরের মতো নিজের বেহেস্তে আদায় করতে তারা মানবকল্যাণ বিরোধী কাজ করেছিল। সেই তারাই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য প্লাজমা দান করছে। এর চেয়ে বড় ইবাদত আর কী হতে পারে! ধর্মের অপর নাম মনুষ্যত্ব হোক, সেই কত যুগ আগে বলেছিলাম। আজও ধর্মের সঙ্গে মানবতার ফারাক ঘুচলো না। তাবলিগ জামাত শুধু নয়, সকল ধার্মিকদের এটা বুঝতে হবে, মানবতার ওপরে আর কোনও ধর্ম নেই। মানুষ যত মানবিক হবে, তত মানুষের কথা ভাববে, মানুষকে অসুস্থতা থেকে অনাহার থেকে অনাচার থেকে বাঁচাবে, পশুপাখিকে কষ্ট-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করবে, পৃথিবীকে প্রাণী জগতের বাসযোগ্য করবে।

    অমুসলিমকে ঘৃণা করতে হবে, পরকালে সব অমুসলিমকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে, এইসব অবাস্তব অদ্ভুত চিন্তাভাবনা দূর না করলে ভালো মানুষ হওয়া যায় না। ভালো মুসলমান হওয়ার চেয়ে ভালো মানুষ হওয়া অনেক বেশি জরুরি। ভালো মুসলমান হতে গিয়ে অনেকে কিন্তু আইসিস, বোকো হারাম, আল কায়দা, তালিবানের সদস্য হয়েছে। ভালো মানুষ ও পথ মাড়ায় না। ভালো মানুষ নারীদের সমানাধিকারে বিশ্বাস করে, সব ধর্মের সব বর্ণের সব শ্রেণির মানুষের মানবাধিকারে বিশ্বাস করে।

    তাবলিগ জামাত নিঃসন্দেহে আমাকে শত্রু বলেই ভাবে। হয়তো তারা আমার ফাঁসি দাবি করে, আমার মুণ্ডুও হয়তো চায়। কিন্তু প্লাজমা দানকারী তাবলিগ জামাতের সদস্যদের আমি স্যালুট করি। আশা করছি জামাতের আরও লোক শিখবে যে বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই সবচেয়ে বড় ধর্ম। আজ মানবপ্রজাতির ওপর নেমে এসেছে চরম দুর্যোগ, চলছে বিশ্ব জুড়ে হাহাকার, প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। এই দুর্যোগের সময় যারা নিজেদের পূর্ব নির্ধারিত সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, অগুনতি মানুষের মৃত্যুতে যাদের কিছু যায় আসেনি, মানুষের কান্না, চোখের জল, হাহাকারের দিকে যারা ফিরেও তাকায়নি, যারা ব্যস্ত থেকেছে নিজের বেহেস্তে লাভের উদ্দেশে ওপরওয়ালাকে সুখী করতে, তারা সত্যিকার ধর্ম পালন করেনি। সত্যিকারের ধর্মে স্বার্থপরতা নেই, উদারতা আছে। সত্যিকার ধর্মে নিজের পরকালের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা পাকা করা নেই, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মহানুভবতা আছে। বহুকাল মানুষ হিংসে, ঘৃণা, জবরদখল, স্বার্থপরতাকে ধর্ম ভেবে এসেছে, এবার মনুষ্যত্ব আর মহানুভবতাকে ধর্ম বলে মানুক। করোনা তো গোটা বিশ্বকে পরিবর্তন করছে, মানুষকেও করুক। ধর্মের সংজ্ঞাও বদলে যাক। তাবলিগ জামাতও মানুষের শ্রদ্ধা পাওয়ার মতো কাজ শুরু করুক। শুধু রক্তদানের মধ্যেই যেন এ কাজ সীমাবদ্ধ না থাকে। তারা মসজিদ বানানোর বদলে আধুনিক হাসপাতাল বানিয়ে দিক, যে হাসপাতালে মানুষ বিনে পয়সায় চিকিৎসা পাবে। প্রতি বছর দেশে দেশে সম্মেলন করার চেয়ে দেশে দেশে ল্যাব বানিয়ে দিক, যে ল্যাবে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা হবে। অলৌকিকের চেয়ে লৌকিকের প্রয়োজন বেশি, তা বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলেই মনে মনে জানি।

     ১ ১৫. নতুন জীবন

    ১

    ঘরবন্দি জীবন আমার কাছে নতুন নয়। মেয়ে হয়ে জন্মেছি এই অপরাধে ইস্কুলকলেজের বাইরে পুরোটা কৈশোর জুড়ে ঘরবন্দি জীবনই তো কাটাতে হয়েছে। যৌবনেই বা কতটুকু আর স্বাধীনতা পেয়েছি। বাইরে যৌন হেনস্থা, অপহরণ, ধর্ষণ ওত পেতে আছে বলে ঘর থেকে বেরোতে পারিনি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমার লেখালেখিতে ইসলামের সমালোচনা ছিল বলে মৌলবাদীরা ফাঁসির দাবিতে মিছিল করতো। বইমেলায় শারীরিক আক্রমণ করতো। ওদিকে একের পর এক ফতোয়াও জারি হল। মুণ্ডু কেটে নিতে পারলে লাখ টাকা উপহার। তখনও বাধ্য হয়েছি ঘরবন্দি জীবন কাটাতে। সরকার একসময় মামলা করলো, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলো। তখনও আত্মগোপন করতে গিয়ে আবারও ঘরবন্দি জীবন। নির্বাসন জীবন শুরু হল ইউরোপে। সেখানেও নিরাপত্তারক্ষীরা আমাকে ঘরবন্দি জীবন দিয়েছিল। বিদেশ ফেলে যখন ভাষার টানে কলকাতায় ঠাঁই নিয়েছি, সেখানেও একের পর এক ফতোয়া। একসময় সিপিএম সরকার আমাকে রাজ্য ছাড়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কথা শুনিনি বলে আমাকে গৃহবন্দিত্ব উপহার দিল। আহারে সেইসব কষ্টের যন্ত্রণার দিনগুলি! কয়েক মাস ঘরবন্দি করে রাখার পর রাজ্য ছাড়তে শেষঅবধি বাধ্যই করলো। দিল্লিতেও কেন্দ্রীয় সরকার একই কাজ করেছিল, হয় ভারত ছাড়ো নয়তো ঘরবন্দি থাকো, বাইরে বলা হয়েছিল ‘সেইফ হাউজে’ আছি। সেখানেও কেটেছে আরও কয়েকটি মাস।

    এ কারণেই সম্ভবত একা একা একটি বাড়িতে দিনরাত পড়ে থাকা, বাইরের আলো হাওয়ার স্পর্শ না পাওয়া আমার কাছে খুব কিছু অস্বাভাবিক অসম্ভব নয়। বীন দেয়ার, ডান দ্যাটের মতো। টেনশান তখনও ছিল, এখনও আছে। পরাধীনতার ক্ষোভ ছিল, ফণা তুলে থাকা মৃত্যু ছিল চোখের সামনে। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও অনুভূতিগুলো প্রায় একই। বাইরে বেরোলে ধর্ষকেরা, গ্রেফতারি পরোয়ানা হাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগা পুলিশেরা, মুণ্ডু কাটায় আগ্রহী অর্থলোভী ধার্মিকেরা, ফাঁসির দাবিতে চিৎকার করা ধর্মান্ধ, আদর্শচ্যুত দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিক সবাই আমাকে খুন করবে, ঠিক এখন যেমন ইমিউনিটি না থাকা শরীরটি বাগে পেলে করোনা ভাইরাস আমাকে গলা টিপে হত্যা করবে।

    ভাইরাসকে কি দরজা বন্ধ করে রাখলেই ঠেকানো যায়! ফাঁকফোকড় দিয়ে কোনওদিন হয়তো ঢুকে যাবে, সাপ যেমন ঢুকে গিয়েছিল লখিন্দরের লোহার ঘরে। তবে যথাসম্ভব সতর্কই থাকতে চাই। চাই কারণ বিশ্বাস করি জীবন একবারই আসে, আর মৃত্যুতেই এই জীবনের সমাপ্তি, তাই এই জীবন বড় মূল্যবান। ধর্মবিশ্বাসীরা পরকালে বিশ্বাস করে, তাদের কাছে পরকালের জীবনটি মূল্যবান, এই জীবনটির ইতিতে তাই তারা তত কাতর হয় না।

    জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই। এ যাত্রা যদি বেঁচেও যাই, করোনা পরবর্তী পৃথিবী আমাদের আগের পৃথিবীর মতো যদি নাও হয়, তবুও যেন শেষ বিদায়ের আগে অন্তত বন্ধুদের হাত স্পর্শ করার, স্বজনকে আলিঙ্গন করার স্বাধীনতা পাই।

    ২

    এ নতুন জীবন আমাদের। করোনা-জীবন অথবা করোনা-পরবর্তী জীবন কিন্তু করোনা-পূর্ববর্তী জীবনের মতো হবে না। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলেছেন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং আমাদের মেনে চলতে হবে ২০২২ পর্যন্ত। আমার তো মনে হয় আরও অনেক বছর পর্যন্ত মেনে চলতে হবে। মাস্ক আর গ্লাবস পরে কিন্তু বাইরে বেরোতে হবে, সম্ভবত আরও অনেক বছর। অনেক বছর পর কি স্বাভাবিক হবে পৃথিবী? স্বাভাবিকের সংজ্ঞা হয়তো পালটে যাবে। নতুন একটি সদা সতর্ক জীবনই হয়তো ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। শুনছি ঘরের কাজকর্ম করার জন্য রোবট তৈরি হচ্ছে। মানুষের চেয়ে মানুষ হয়তো রোবটকেই বিশ্বাস করবে বেশি। আমরা কিছুই আসলে জানিনা কী হতে যাচ্ছে পৃথিবীতে। কেবল অনুমান করতে পারি।

    মাঝে মাঝে ভাবি অতটা হয়তো খারাপ নয় অবস্থা। সাবান দিয়ে ধুলেই হাত থেকে বা জিনিসপত্র থেকে ভাইরাস চলে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের সবটুকু বাতাসে ভাইরাস ভাসছে না। এখনও শুদ্ধ বাতাস পেতে পারি। এমন ভাইরাসও তো আসতে পারতো যে ভাইরাস সাবান দিয়ে ধুলেও হাত থেকে যেতো না, বাতাসে সারাক্ষণই ভেসে বেড়াতো, শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকে গিয়ে ফুসফুস ঝাঁজরা করে দিত, আসতে তো পারতো, পারতো না? এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষ জয়ী হতে পারবে না, এ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমেরিকা কী করে এবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জিতেছে দেখেছি। যে মহাশক্তিমান আমেরিকার আজ পৃথিবীকে ভাইরাসের কবল থেকে রক্ষ করার কথা, সে আমেরিকা আজ পৃথিবী তো দূরের কথা, নিজেকেই রক্ষা করতে পারছে না। এই অসহায় আমেরিকাও এক নতুন আমেরিকা।

    মহামারীর সময় যা হওয়া উচিত তা হচ্ছে না কোথাও। চারদিকে দেখছি হিংসে আর ঘৃণা বাড়ছে। ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য হিন্দুরা মুসলমানদের দোষ দিচ্ছে, মুসলমানরা ইহুদিদের দোষ দিচ্ছে, আমেরিকা চীনকে দোষ দিচ্ছে, চীন আমেরিকাকে দোষ দিচ্ছে। দোষ দেওয়ার সময় এখন নয়। বিভেদ- বিচ্ছেদের সময় এখন নয়। এখন এই দুর্যোগে সব দেশকে এগিয়ে আসতে হবে, পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে, এই ভয়ংকর ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়া কোনও দেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমেরিকা আগে যেমন একাই দাঁড়াতে পারতো, এখন তা আর পারছে না। চীন পেরেছে, অনেকে বলে চীন পেরেছে চীনে গণতন্ত্র নেই বলে। সরকারের আদেশ মৃত্যুভয়ে সকলে মানতে বাধ্য। তাই লকডাউন কোয়ারেন্টাইন ইত্যাদি একশ’ ভাগ কাজ করেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক কিছু দেশও—দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ডও তো ভাইরাস থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে। সকলে একজোট হয়ে যদি এই ভাইরাসের কবল থেকে মানুষকে মুক্ত না করে, তবে আরও লক্ষ, আরও কোটি মানুষকে জীবন দিতে হবে। রাজনীতিকরা অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত, অর্থনীতি ভেঙে গেলে তাদের ক্ষমতায় থাকা মুশকিল হবে। মানুষ মরছে মরুক, এতে বেশ কিছু রাজনীতিকের কিছু যায় আসে না। বিজ্ঞানীরা জীবন বাঁচাতে চাইছেন। দিনরাত ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করার জন্য পরিশ্রম করছেন। দিনরাত পরিশ্রম করছেন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়া মানুষের শরীরের এন্টিবডি পরীক্ষা করতে, এই এন্টিবডি দিয়ে অন্যান্যদের সুস্থ করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করতে। ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের আগে এই এন্টিবডিই হয়তো ভাইরাস ঠেকানোর জন্য বড় কোনও ভরসা হতে পারে । না কোনও ধর্মযাজক নয়, কোনও মৌলবি নয়, কোনও পুরোহিত নয়, বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন মৃত্যু রোধ করতে, তাঁদের হাতেই আছে মানুষকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা।

    ৩

    আলটিমেটলি কী হবে? এটুকু তো ধারণা করাই যায় ভ্যাক্সিন যদি ঠিক সময়মতো হাতে না আসে, তাহলে যাদের ইমিউনিটি কম, তারা মরে যাবে, যাদের বেশি তারা বেঁচে যাবে। আমরা কিন্তু জানি অনেক মাথামোটা লোকদের ইমিউনিটি চমৎকার। তাহলে কি মাথামোটা লোকদের হাতেই চলে যাবে পৃথিবী? হতে পারে। তবে আমি মনে করি মাথামোটাদের ভিড়েও কিছু বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ লোক থাকে, তারাই ভালো কাজগুলো করে। এ চিরকালেরই চিত্র। অধিকাংশ লোক কখনও প্রগতির বা আধুনিকতার পক্ষে নয়, তারা চিরকালই জরাজীর্ণ আঁকড়ে ধরে থাকার পক্ষে।

    নতুন যে পৃথিবী আসছে তাতে আমি বিশ্বাস করি মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানমনস্ক হবে, ধর্মকে ব্যবহার করে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া রাজনীতিকদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না, সাধারণ মানুষ, মোল্লা, মৌলবী, পীর, বাবা ইত্যাদির পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করবে। মাথামোটা মানুষের ভেতরেও পরিবর্তন আসবে। সোজা কথা এখনকার মানুষের চেয়ে স্মার্ট হবে নতুন পৃথিবীর মানুষ। আমরা অনেকেই সেই পৃথিবীকে হয়তো দেখে যেতে পারবো না, কিন্তু শুভ কামনা রয়ে যাবে।

     ১ ১৬. এই মৃত্যুপুরী আমার পৃথিবী নয়

    চীনের উহানে, চীন বলেছে, আড়াই হাজার লোক মরেছে করোনা ভাইরাসে। কিন্তু কিছু গবেষক জানাচ্ছেন এক উহানেই মারা গেছে চল্লিশ হাজারের চেয়েও বেশি লোক। যদি চীন জানাতো সঠিক তথ্য, যদি জানাতো যে এই ভাইরাস বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে, যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীন দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিরপেক্ষ হত, তবে হয়তো চীনের বাইরের দুনিয়া, বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকা আগেভাগেই সতর্ক হতে পারতো। সতর্ক না হওয়ার কারণেই আজ ইতালিতে ১৭ হাজারের চেয়েও বেশি, স্পেনে ১৪ হাজারের চেয়ে বেশি, যুক্তরাষ্ট্রে ১২ হাজারের চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু এখানেই শেষ নয়, হচ্ছেই।

    আজ সারা পৃথিবী ঘরবন্দি হয়ে বসে আছে। কিন্তু এভাবে তো অর্থনৈতিক অবস্থা ধ্বসে পড়বে। সে কারণেই ইমিউনিটি পাসপোর্টের কথা উঠেছে। যারা একবার করোনা ভাইরাসের শিকার হয়েছে, এবং যুদ্ধ করে সুস্থ হয়ে উঠেছে, তাদের শরীরে এন্টিবডি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, দেখা হচ্ছে ফের ভয়াবহ রকম আক্রান্ত হওয়ার কোনওরকম আশঙ্কা তাদের আছে কি না। না থাকলে তাদের ইমিউনিটি পাসপোর্ট দেওয়া হবে। সেই ইমিউনিটি পাসপোর্ট নিয়ে তারা বাইরে যাবে, কাজকম্ম, অফিস, আদালত, ব্যাবসাবাণিজ্য করবে। আর যাদের ইমিউনিটি নেই, তারা ঘরবন্দি থাকবে। যতদিন না ভ্যাক্সিন না আসে, ততদিন।

    পালটে যাওয়া পৃথিবীর দিকে তাকালে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের উদয় হয়, এই ভয়াবহ ভাইরাসের বিশ্বময় সংক্রমণ কি রোধ করা যেত না? উহানে যখন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তখন থেকেই যদি বন্ধ করে দেওয়া হত চীনের সঙ্গে বাইরের দেশের যাওয়া আসা, তা হলেই তো ভাইরাস চীনের বাইরে আসতে পারতো না। মনে আছে কিছু কিছু দেশ দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে উহান থেকে নিজেদের নাগরিককে বয়ে এনেছে? দেশপ্রেমের সঙ্গে কিন্তু ভাইরাস ঢুকে গেছে দেশে দেশে। চীন থেকে কয়েক লক্ষ মানুষও বিনা বাধায় ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীতে। তার ফল আজ ভোগ করছে গোটা পৃথিবী। মানুষের ভুলের কারণেই মানুষের এমন অগুনতি অকাল মৃত্যু।

    এই ভাইরাস গরিব, ধনী, উঁচু জাত, নীচু জাত, কালো, সাদা, হলুদ, বাদামি, হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ইহুদি আস্তিক নাস্তিক কিছুই মানছে না। সবাইকে কামড় বসাচ্ছে। প্রভাবশালী ধনীরা যেমন আক্রান্ত, সাধারণ ছাপোষা মানুষও আক্রান্ত। ব্রিটেনের রাজপুত্র, প্রধানমন্ত্রী আক্রান্ত, ইজরাইলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আক্রান্ত। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ৭০ জন মানুষ এর মধ্যে মারা গেছে। প্রিয় নিউইয়র্ক এখন এক মৃত্যুপুরী। কত লক্ষ লোক চীন থেকে, ইতালি থেকে ভাইরাস শরীরে নিয়ে ঢুকেছে নিউইয়র্কে। ঢুকে সংক্রামিত করছে আরও লক্ষ লোককে। যে সংক্রমণ শুধু হাঁচি আর কাশিতে নয়, কথা বললেও ছড়ায়, নিশ্বাস-প্রশ্বাসেও ছড়ায়, বাতাসেও টিকে থাকে কয়েক ঘণ্টা, শুধু এক মিটার দূরত্বে নয়, ছড়িয়ে পড়ে ছ’ মিটার দূরত্বেও— এই ভাইরাসকে নির্মূল করার কোনও উপায় আপাতত কারও জানা নেই।

    আমাদের সবাই এই ভাইরাসের কবলে পড়বো। এক গবেষক শুরুতেই বলেছিলেন, পৃথিবীর শতকরা আশি ভাগ মানুষকে এই ভাইরাস আক্রমণ করবে। মৃত্যু ছাড়া কি অন্য কিছু আছে আমাদের সামনে? ভ্যাক্সিন আছে। কিন্তু ভ্যাক্সিন বের হতে হতে দেড় বছর। হাতে পেতে পেতে জানিনা আর কত মাস বা বছর। তার আগ অবধি আমাদের মতো মানুষ যাদের বয়স হয়েছে, যাদের ডায়বেটিস, যাদের উচ্চ রক্তচাপ, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের নিশ্চয়ই লকডাউনে বাঁচতে হবে। কিন্তু ভাইরাস কি আমাদের ঘরেও ছলে-বলে-কৌশলে ঢুকে পড়বে না, লখিন্দরের লোহার ঘরে যেমন ঢুকেছিল সাপ?

    চীন এখন উহানকে লকডাউন থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। বন্য জন্তু বিক্রি করার দোকানও নাকি খুলেছে। বাঁদুড়, প্যাংগলিন এসবও নাকি বিক্রি হচ্ছে। সত্যিই কি? চীন সরকার তো নিষিদ্ধ করেছিল এসবের ব্যাবসা! আসলে চীন থেকে আসা তথ্য কোনটি সঠিক, কোনটি নয়—তা বোঝা দুরূহ। চীন যদি সেই বাঁদুড়, সেই প্যাংগলিন ইত্যাদি, যেসব থেকে ভাইরাস এসেছিল, সেসব ধরে ধরে আবার বিক্রি করতে থাকে, এবং খেতে থাকে, জানিনা হয়তো করোনার চেয়ে হাজার গুণ খারাপ ভাইরাস একদিন ওদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে। মানুষের তখন হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না।

    চীনে এখন করোনা ভাইরাসের রোগী কমতে কমতে শূন্যতে। অন্যদিকে আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, একই সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও। চীন যা পেরেছে, তা ইউরোপ বা আমেরিকা কেন পারেনি? তাহলে কি চীনই করোনা পরবর্তী বিশ্বের সুপার পাওয়ার? আসলে অস্ত্রসস্ত্র থাকলেই সুপার পাওয়ার হওয়া যায় না। আমেরিকা নিজের নাগরিকদের বাঁচাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। সাহায্য করতে চীন এগিয়ে এসেছে। চীন ইউরোপকেও ডাক্তারদের প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা পোশাক দিয়েছে। এইসব সাহায্যের দরকার হত না, যদি চীন বিশ্ববাসীকে প্রথমেই সঠিক তথ্য জানাতো। অথবা ইউরোপ এবং আমেরিকার যদি মহামারী বন্ধ করার সব সরঞ্জাম মজুত থাকতো।

    আমেরিকা যে কত সায়েন্স ফিকশান বানিয়েছে। সায়েন্স ফিকশানগুলো দেখিয়েছে ভিন্ন গ্রহ থেকে এলিয়েন এসে আক্রমণ করছে আমাদের গ্রহ, অথবা ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাস ছড়িয়ে পৃথিবীর মানুষ প্রজাতিকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে, তখন কে বাঁচায় পৃথিবীকে? আমেরিকা বাঁচায়। হায়! বাস্তবে প্রতিদিন একটি ভাইরাসের আক্রমণে হাজার হাজার লোক মরছে আমেরিকায়, আর প্রেসিডেন্ট অর্থহীন বাকোয়াজ করে যাচ্ছে প্রতিদিন!

    এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণে আসলে যার টাকা আছে, যার প্রতিপত্তি আছের চেয়ে যার ইমিউনিটি আছে, সে-ই বাঁচবে। বাকিরা মরে যাবে। এ এক নতুন পৃথিবী। সব হতাশা আর নিরাশার মধ্যেও কিছু আশা থাকতে হয়। আশা ছাড়া পৃথিবী অন্ধকার। আশা এই যে, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়ে গেছে প্রায়। এখন পরীক্ষানিরীক্ষা চলবে। পরীক্ষানিরীক্ষার পর আমরা পাবো সেই ভ্যাক্সিন। ভ্যাক্সিন পর্যন্ত যেন ভাইরাসের বিবর্তন না হয়। ইতিমধ্যে আমেরিকার ডাক্তাররা বলছেন এই ভাইরাস সম্ভবত এখন মস্তিস্কে আক্রমণ করছে, হৃৎপিণ্ডও বন্ধ করছে। এমনও তো হতে পারতো এই ভাইরাস এয়ারবর্ন। অর্থাৎ বাতাসের সর্বত্র এই ভাইরাস। শ্বাস নিলেই বাতাসের সঙ্গে ভাইরাস ঢুকে পড়ছে ফুসফুসে। ফুসফুসকে অকেজো করে দিচ্ছে কয়েক মিনিটের মধ্যে। কিন্তু তা নয়, করোনা ভাইরাস শুধু ভাইরাস বহনকারীদের আশেপাশের বাতাসের মধ্যে আছে, সর্বত্র নেই। আশা এই যে, এখনও পৃথিবীতে এমন বিজ্ঞানী এবং গবেষক আছেন, যাঁরা মানুষকে মারাত্মক সব ভাইরাসের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন, এবং এখনও বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করছেন।

    বাংলাদেশে এখনও করোনা আক্রান্তের সংখ্যাটা কম। বাংলাদেশও কি চীনের মতো ভুল তথ্য দিচ্ছে জানিনা। ভারতে এখন ৫০০০ করোনা আক্রান্ত মানুষ। সংখ্যা বেড়েছে তাবলিগ জামাতের তিন দিনব্যাপী ধর্মীয় সভার কারণে। ভারতের মানুষ এই তাবলিগ জামাতের লোকদের ওপর ভীষণই ক্ষিপ্ত। মানুষের এই দুঃসময়ে ধর্মান্ধরাই সবচেয়ে অহিতকর কাজ করে চলেছে। শুধু বাংলাদেশ বা ভারতে নয়, পৃথিবীর সর্বত্র। এখনও অনেক ধর্মান্ধরা মন্দির, মসজিদ, গির্জা, সিনেগগ খুলছে, সমবেত প্রার্থনায় সামিল হচ্ছে। এই যে এত বলা হচ্ছে ঘরের বাহির না হতে বা বাইরে ১০ জনের বেশি জমায়েত না করতে, আর যে কেউ শুনলেও ধর্মান্ধরা শুনছে না। তাবলিগ জামাতের মতো বিবেকবুদ্ধিবর্জিত লোক শুধু মুসলমানদের মধ্যে নয়, সব ধর্মের মানুষদের মধ্যেই আছে। আমেরিকার লুজিয়ানায় টম স্পেল নামের এক পুরোহিত গির্জা খুলে হাজার মানুষকে জড়ো করছেন। স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, তিনি লকডাউন মানেন না, মানবেন না। ইজরাইলের স্বাস্থ্য-মন্ত্রী সিনেগগ খুলে মানুষ জড়ো করছেন, প্রার্থনার আয়োজন করছেন, ঈশ্বরকে ডাকলে নাকি করোনা ধরবে না। এখন মন্ত্রীর শরীরে করোনা। দিল্লিতে তাবলিগ জামাতের আমির ১৩ থেকে ১৫ মার্চের সম্মেলনে বলেছিলেন, মসজিদে এলে করোনা ধরবে না। কী দেখা গেছে? জামাতীদের শত শত লোকের শরীরে ভাইরাস। তারা উদার হস্তে আরও মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে সে ভাইরাস। কর্ণাটকে মার্চের ১১ তারিখেও আইন অমান্য করে খোলা হয়েছে লক্ষী রঙ্গনাথ স্বামী মন্দির, দু-হাজার লোকের উৎসব হয়েছে সেদিন মন্দিরে।

    জানি না এই লকডাউন কতদিন চলবে। চীনের উহানে যেমন লকডাউনের আইন উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ এখন ঘর থেকে বেরোচ্ছে, ইস্কুল-কলেজে যাচ্ছে, দোকানপাটে, অফিস-আদালতে যাচ্ছে—সেই জীবন চীনের বাইরের মানুষ কবে পাবে? এর উত্তর কেউ জানে না। চীনকেই আমার মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর সুপার পাওয়ার। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশ যা পারেনি, চীন তা পেরেছে। যদি চীন ভুল তথ্য দিয়ে পৃথিবীকে বিভ্রান্ত করেও থাকে, এই তথ্য তো ভুল নয় যে চীনের যে শহর ছিল মাত্র দু/তিন মাস আগেও মৃত্যুপুরী, আজ সে শহর মানুষের ভিড়ে কলকোলাহলে জীবন্ত।

    করোনা ভাইরাসের পরবর্তী বিশ্ব নিশ্চয়ই এমন হবে, আর অস্ত্রের পেছনে নয়, বড় বাজেট যাবে স্বাস্থ্য খাতে। অস্ত্র দিয়ে বাঁচা যায় না, স্বাস্থ্য দিয়েই বাঁচা যায়। আগে তো বেঁচে থাকা, তারপর তো বাণিজ্য!

     ১ ১৭. ভাইরাস ডায়রি ২

    মার্চ ২৯

    আমরা কি আবার আমাদের সেই আগের জীবন ফিরে পাবো? পাবো না। পৃথিবী কি আগের মতোই আবার…? না। কিছুই আর আগের মতো নেই। পৃথিবী বদলে গেছে, আমাদেরও বদলে দিয়েছে। কিন্তু এইভাবে লকডাউন করে কতদিন কাটাতে পারবো আমরা? বেশিদিন নয়। এইভাবে হাত ধুয়ে ধুয়ে, মাস্ক পরে পরে, মানুষকে কমপক্ষে সাড়ে তিন ফুট দূরে রেখে রেখে কতদিন ভাইরাসের নাগাল থেকে দূরে থাকতে পারবো? বেশিদিন নয়। করোনা আমাদের সবাইকেই একদিন না একদিন ধরবেই। কারো রেহাই নেই। করোনার কবল থেকে কেউ বেঁচে ফিরবে, কেউ ফিরবে না।

    আমরা সবাই অপেক্ষা করছি ভ্যাক্সিনের। তাই না? বিজ্ঞানীরা বলেছেন ভ্যাক্সিন আসতে ১৮ মাস লাগবে। আমরা কি ভেবে নিচ্ছি ১৮ মাস পর ৭০০ কোটি লোক ভ্যাক্সিন পেয়ে যাবো? মোটেও না। প্রোডাকশানে সময় নেবে। ধরা যাক ৭০ লাখ ভ্যাক্সিন একদিনে তৈরি হল। তাহলে ৭০০ কোটি লোকের জন্য ভ্যাক্সিন বানাতে ১০০০ দিন লাগবে। ১০০০ দিন মানে কিন্তু প্রায় ৩ বছর। তো এখন থেকে ১৮ মাসকে যোগ করে সেটি দাঁড়ায় ৪ বছর। যতদিন না ভ্যাক্সিন পাচ্ছি, আমরা কেউ কি ভাইরাসকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবো? আমার মনে হয় না। অনেক বিজ্ঞানীও মনে করেন না। তাঁরা মনে করেন পৃথিবীর সবাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে, কেউ কেউ মনে করেন, সবাই না হলেও ৮০ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হবে।

    সোজা কথা মৃত্যু আসছে। আমরা যারা রিস্ক গ্রুপের তাদের কাছে খুব দ্রুত আসছে। মৃত্যু নিয়ে হাহাকার না করে বরং যে কটা দিন পাচ্ছি, তাকে কাজে লাগানো বুদ্ধিমানের কাজ। প্রতিটি দিনকে যেন ভেবে নিই এ আমার শেষ দিন।

    মার্চ ৩০

    মাঝে মাঝে মনে হয় আমি হয়তো ঘুমিয়ে আছি, পৃথিবীতে যা ঘটছে, তা ঘটছে আমার স্বপ্নের মধ্যে। ঘুম ভাঙলেই দেখবো সবকিছু আগের মতোই আছে।

    মার্চ ৩১

    ১৯২৬ সালে হরিয়ানার মিওয়াট অঞ্চলে মোহাম্মদ ইলিয়াস নামের এক লোক তাবলিগ জামাত শুরু করেছিল। ভারতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা দেওবন্দের জন্ম। ভারতে আহমদিয়া ধর্মের জন্ম। ইসলামের প্রচারে প্রসারে ভারতের ভূমিকা বিরাট।

    তাবলিগ জামাত এখন পৃথিবীতে এত ছড়িয়ে গেছে যে ১৫০টি দেশ থেকে প্রায় কয়েক কোটি লোক এতে অংশ নেয়। ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখে ৪ দিনব্যাপী তাবলিগ জামাতের সম্মেলন হল মালয়েশিয়ায়। ১৬০০০ লোক অংশগ্রহণ করেছিল। ১৫০০ ছিল বিদেশি। ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশের লোক তো ছিলই, চীন থেকে, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা লোকও ছিল। মালয়েশিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ করোনা রোগীর ভাইরাস এসেছে ওই তাবলিগ জামাত থেকে। এই খবরগুলো চারদিকে প্রচার হওয়ার পরও তাবলিগ জামাত দিল্লিতে সম্মেলন করার অনুমতি পেয়ে যায় কী করে জানিনা। এখন দিল্লিতে নানান দেশের তাবলিগিগুলো ভাইরাস ছড়িয়েছে। কত হাজার লোককে যে ওরা সংক্রামিত করেছে তার কোনও হিসেব আছে? তারা কি জানে না করোনার কারণে সারা বিশ্বের মানুষ গণহারে মারা পড়ছে? তাদের কি জমায়েত বন্ধ করা উচিত ছিল না? সামান্য মানবতাবোধও ধর্মান্ধ লোকদের মধ্যে নেই। তবলিগিরা জেনেবুঝে ভাইরাস ছড়ায়নি। কিন্তু অজ্ঞানতার অন্ধকারে লোকগুলো এমন ডুবে আছে যে বিশ্বময় যে মহামারী লেগেছে, তা নিয়ে এতটুকু দুশ্চিন্তা নেই। এ সময় তাদের ধর্মীয় সভা করাটা ছিল মানবতার বিরুদ্ধে বড় একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

    সৌদি আরবকে স্যালুট দিই। কাবা বন্ধ করে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। উমরাহ বন্ধ করেছে। নবীর রওজা শরিফ দর্শন বন্ধ করেছে, মসজিদ বন্ধ করেছে। ভারতে এখনও অনেক মসজিদ খোলা। লোকেরা নামাজ পড়তে মসজিদে ভিড় করে। লকডাউন মানছে না, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানছে না। ভারতের একটুখানি সৌদি আরবের মতো হওয়া দরকার।

    উজবেকিস্তান, কাজাকস্তান, তাজিকিস্তান—এই দেশগুলোয় কিন্তু তাবলিগ জামাত নিষিদ্ধ। তাবলিগ হাদিস ‘কোরান’ যেভাবে বলে, সেভাবে চলে। ১৪০০ বছর আগে মানুষ যেভাবে জীবন যাপন করত, সেভাবে জীবনযাপন করে। আক্ষরিক অর্থেই মৌলবাদী। যে দেশ আধুনিক হতে চায় বা সভ্য হতে চায়, সে দেশ মৌলবাদী আন্দোলনকে প্রশ্রয় দেয় না। আল কায়দার মতো সন্ত্রাসী দল তাবলিগের আইডি ব্যবহার করে সন্ত্রাসের উদ্দেশে এক দেশ থেকে আর এক দেশে ভ্রমণ করেছে। এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কি সমাজের কোনও উপকার করছে? প্রগতির বিরুদ্ধে গিয়ে সমাজকে পেছনে টেনে রাখলে উপকার নয়, অপকার হয় মানুষের। যত্রতত্র ভাইরাস ছড়িয়ে কত নিরীহ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। কী ভয়ংকর অপকারই না ওরা করলো মানবজাতির!

    ধর্ম মানুষকে স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, হিংসুক বানায়, খুব বোকাও বানায়। না হয় বুঝলাম ওরা বোকা। সরকার কী করে শুরু থেকে বিমান যাত্রা চালু রেখেছিল, সেই সব দেশেও দিব্যি বিমান যাওয়া-আসা করেছে যেসব দেশে ভাইরাস দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সময়মতো উচিত কাজটি করা হয়নি বলে শত শত তাজা জীবন আজ অকালে ঝরে পড়ছে।

    এপ্রিল ১

    এই যে লকডাউনে রয়েছি গোটা দেশ, কী লাভ যদি দেশের বাইরে থেকে নিশ্চিন্তে ভাইরাস বাহক দেশে চলে আসে, গোটা দেশে ঘুরে বেড়ায়, হাজার হাজার মানুষের সংস্পর্শে আসে! লকডাউন শেষপর্যন্ত কোনও কাজেই লাগলো না। মালয়েশিয়ার তাবলিগ জামাতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তো ফিরে গেছে দেশে, তাদের কি কোয়ারান্টাইন করা হয়েছিল? নিশ্চয়ই হয়নি।

    খুব দুঃখজনক এই যে, ধর্মান্ধ লোকেরা কিছুতেই নিজেদের সওয়াব, স্বার্থ, নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া পৃথিবীর সমস্যা, মানবজাতির হাহাকারের দিকে ফিরে তাকায় না। ইহজগত নিয়ে তারা ভাবে না, তারা পরকাল এবং অলৌকিকতা নিয়ে ঘোরের মধ্যে থাকে, আর জান্নাতবাসী হওয়ার জন্য যা কিছু করা দরকার বলে মনে করে তা যে করে হোক করে, বিধর্মীকে বা কাফেরকে খুন করে হলেও করে। তারা যুক্তিবাদী লোকদের আনা গণতন্ত্র ভোগ করে, সংগ্রাম করে অর্জন করা বাকস্বাধীনতা ভোগ করে, স্বাস্থ্যসেবা চিকিৎসা ভোগ করে, উদারতা, মানবতা ইত্যাদি সভ্য সমাজের গুণগুলি ভোগ করে আর ক্রমাগতই মানুষের মগজধোলাই করে চলে অনুদারতা, অযুক্তি, অবিজ্ঞান দিয়ে। এভাবেই চলছে, কোনও সরকার ওদের বাধা দেয় না।

    দিল্লির ধর্মীয় সভা থেকে প্রচুর লোক শরীরে ভাইরাস নিয়ে ফিরে গেছে ভারতের সর্বত্র, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারি। তারা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুপরিচিত সবার মধ্যে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। হিন্দু ধর্মান্ধরা গোমূত্র পানের পার্টি করছে, গোমূত্র পান করে করোনা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে, সারা গায়ে গোবর লেপে বসে আছে করোনা কাছে আসতে পারবে না এই বিশ্বাস নিয়ে। ধার্মিকদের যুক্তিবুদ্ধিহীনতা অসহ্য হয়ে ওঠে, বিশেষ করে এই মহামারীর সময়।

    লক্ষ করছি গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় করোনা ভাইরাস তেমনভাবে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমেরিকাও ঠিকঠাক লকডাউন করতে পারছে না। আমেরিকায় ভয়ংকর ভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। চীন কিন্তু ঠিকঠাক পেরেছিল। অগণতান্ত্রিক দেশেই তাহলে সম্ভব হচ্ছে মহামারী রোধ করা। চীনে তো সম্ভব হত না মড়ক চলাকালীন তাবলিগ জামাতের মতো কোনও ধর্মীয় সভা করা! সৌদি আরবেও সম্ভব হত না। শুধু এই ভারতীয় উপমহাদেশই সব সম্ভবের দেশ।

     ১ ১৮. আমার ভাইরাস ডায়রি

    মার্চ ৩

    শেষ পর্যন্ত এসেই গেল করোনা। এ শহরে মৃত্যুর হার ২ পারসেন্ট হওয়ার কিন্তু কোনও কারণ নেই। চোখে দেখা যায় না এমন ছোট ভাইরাস, পুরো মানব প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আর আমরা আমাদের ধনদৌলত নিয়ে, আমাদের উঁচু উঁচু দালানকোঠা নিয়ে, আমাদের বড়ত্ব শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কী গর্বই না করি। পারমাণবিক বোমা, অ্যাস্টরয়েড, কোনও ভাইরাস, কোনও বেয়াদপ ব্যাক্টেরিয়াই যথেষ্ট আমাদের নির্মূল করতে। আমাদের আসলে কারোর পায়ের তলায় মাটি নেই। আমরা পতঙ্গের মতো হাওয়ায় ভাসছি। অনিশ্চয়তা আমাদের জীবনে কালো টাট্টুর মতো সেঁটে আছে। আমরা বেঁচে আছি এই মনগড়া গল্প নিয়ে যে আমাদের মরণ নেই, আমরা বার বার জন্ম নেবো, অথবা আমরা কবর থেকে একবার জেগে উঠে আর কখনও মরবো না। আমাদের মানবপ্রজাতি এমন কোনও ভালো প্রজাতি নয়, ভায়োলেন্ট, সুপারস্টিশাস, সেলফিশ। এই প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে পৃথিবীর কিছু আসবে যাবে না।

    মার্চ ১০

    শুনছি করোনা ভাইরাস বাচ্চাদের মারছে না, মারছে বয়স হয়েছে যাদের, তাদের, বিশেষ করে যাদের ডায়বেটিস আর হাই ব্লাড প্রেশার আছে। আমার মতো রোগীদের পৃথিবী থেকে বিদেয় করে বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্তটা খারাপ নেয়নি ভাইরাসবাবু। এখন কি ভয়ে কাঁপতে হবে আমার? অবশ্যই না। জীবনকে যতদিন পারি, যেভাবে পারি উপভোগ করবো। এর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করবো। উপভোগ করা মানে কিন্তু মদ খেয়ে নাচানাচি নয়, অথবা শুয়ে বেড়ানো নয়। আমার কাছে উপভোগ করা মানে তো ভালো কোনও বই লেখা, ভালো কোনও বন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ গল্প করা, অথবা ভালো একটি বই পড়া, বা চমৎকার কোনও প্রকৃতি দেখা অথবা পোষা বেড়ালকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করা। আরও কতরকমভাবে উপভোগ করা যায়, অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে গলা চড়িয়ে, মানুষের সমমর্মী হয়ে, পশুদের ভালোবেসে, সমাজের পরিবর্তন ঘটিয়ে—মোদ্দা কথা জীবনকে অর্থপূর্ণ ক’রে। একদিন তো যেতেই হবে, ভাইরাসবাবু যদি ক্ষমা করে দেয় এবারের যাত্রা, সামনে কত রকমের ব্যাক্টেরিয়া, ক্যান্সার, ফেইল্যুর, ক্রিয়া বন্ধ হওয়া ইত্যাদি অপেক্ষা করছে, সবাই তো আর ক্ষমা করবে না। তার আগ অবধি জীবনের পুজো করাই বুদ্ধিমতীর কাজ।

    মার্চ ১১

    মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে এই ভাইরাস। সবচেয়ে ভয়ংকর, রোগের উপসর্গ না থাকলেও লোকেরা ভাইরাস আক্রান্ত হতে পারে, এবং ভাইরাস ছড়াতে পারে। সুতরাং আশেপাশে যাদেরকে সুস্থ বলে মনে করছি, তারা সুস্থ না হতেও পারে। দুনিয়াটা সেইসব পোস্ট এপোক্যালিপ্টিক সায়েন্স ফিকশানের মতো হয়ে যাচ্ছে কি না কে জানে, যেখানে মানুষ মরে শেষ হয়ে যায়, শুধু কিছু বন্য প্রাণী শহরময় ঘুরে বেড়ায়। অথবা অল্প কিছু মানুষ যারা বেঁচে থাকে, তারা মানুষের ভয়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখে। ইতালির রাস্তাঘাট তো এখন তেমনই দেখতে।

    কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফিকে ধরেছে এই ভাইরাস। এই ভাইরাস তো বিখ্যাত-অখ্যাত, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। আমরা যারা এখন মনে করছি অন্যকে ধরবে ভাইরাস, আমাকে ধরবে না—হয়তো পরীক্ষা করালে ভাইরাস পাবো শরীরে। এখন না পেলেও খুব শীঘ্র হয়তো পাবো।

    মার্চ ১৪

    উহান থেকে বাংলাদেশিদের নিয়ে আসার কী দরকার ছিল? সবচেয়ে ভালো উহানে থাকা। কারণ বাংলাদেশের থেকে চীনের স্বাস্থ্যসেবা ভালো, ওখানকার কোয়ারেন্টাইনের সিস্টেম ভালো। এ কথা বলার পর, বাপরে বাপ, টুইটারে কী গালি যে খেতে হয়েছিল আমাকে। আমি কী বুঝি, আমার নাকি কোনও ফ্যামিলি নেই, ফিলিংস নেই ইত্যাদি ব্লা ব্লা ব্লা।

    ইতালিতে ছড়িয়ে গেছে ভাইরাস। আর ভাইরাস রক্তে নিয়ে বাংলাদেশিরা ইতালি ছেড়ে চলে এসেছে ফ্যামিলি আর দেশের আবেগে। কী করবে এরা এখন? মা-বাবা-ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শিকে সংক্রামিত করবে। ছড়িয়ে পড়বে ভাইরাস এক শহর থেকে আর এক শহরে। সরকার কী করবে? বসে বসে আঙুল চুষবে, আর বিপদ দেখলে দেশ ছেড়ে পালাবে। কিন্তু পালাবেই বা কোন দেশে, সবখানেই তো ভাইরাস!

    মার্চ ২০

    এক জীবনে দুর্ভিক্ষ দেখেছি, যুদ্ধ দেখেছি, গণআন্দোলন দেখেছি, মিলিটারি ক্যু দেখেছি, শাসক-হত্যা দেখেছি, মুক্তচিন্তক-খুন দেখেছি, ধর্মীয় সন্ত্রাস দেখেছি। এক জীবনে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ ভাইরাসের আক্রমণে গণমৃত্যুও দেখা হল। এর আগে এ শুধু বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনিতেই দেখেছিলাম।

    জানিনা ভাইরাসের কবল থেকে বাঁচতে পারবো কি না। অসুস্থ মানুষের ধারেকাছে যাচ্ছি না, কিন্তু জ্বর কাশি নেই এমন কিছু লোক তো ভাইরাস ভেতরে নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মুখ থেকে ভাইরাস ছিটকে বেরোচ্ছে, হাত যেখানেই রাখছে সেখানেই ভাইরাস রয়ে যাচ্ছে, এইসবে আমার ছোঁয়া একেবারেই লাগবে না, এ হলপ করে বলতে পারবো না। মানুষ ২৪ ঘণ্টা হয়তো সাবধান থাকতে পারে, পারে অল্প কিছু দিন; প্রতিদিন নয়, দিনের পর দিন নয়। আমি হয়তো বাইরে বেরোচ্ছি না, কিন্তু বাইরে থেকে তো ঠিকই ঘরে কাজ করার লোক আসছে, ওরা তো সাত বাড়ি ঘুরে আমার বাড়ি আসছে। ওদের আমি প্রতিদিনই জিজ্ঞেস করি জ্বর কাশি নেই তো, ওরা না বলে। ওদের উত্তর আমাকে স্বস্তি দেয়। ওদের বলে দিই, কোনও রকম অসুস্থবোধ করলে যেন ডাক্তার দেখায় বা হাসপাতালে চলে যায়, বেতন নিয়ে ভাবতে হবে না, কাজ না করলেও পাবে। স্বস্তি তো ওদেরও দরকার।

    ঢাকায় শুনেছি বিদেশ থেকে এক মেয়ে এসে তার মাকে ভাইরাস উপহার দিয়ে চলে গেছে, ভাইরাসে মা’র মৃত্যু হয়েছে। দিল্লিতেও ইতালি থেকে ছেলে ফিরে মা’র সঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছে। সেও মা’কে উপহার দিয়েছে ভাইরাস। মা মারা গেছে। কতটুকু দায়িত্বজ্ঞানহীন পুত্র কন্যা! ভালো যে কোনও পুত্র কন্যার জন্ম দিইনি। কোনও গ্যারেন্টি আছে জন্মালে দায়িত্বজ্ঞানহীন হত না?

    আমার এক বিদেশি বন্ধু বলেছে, এই ভাইরাস আমাদের সবাইকে ধরবে,কিছু আগে বা কিছু পরে। কেন বলেছে, কে জানে। আমি তো ভাবছি, আর কদিন পর ভাইরাস বিদেয় নেবে। আবার পৃথিবী আগের মতো হয়ে উঠবে, জীবন্ত। আশা না থাকলে কি বাঁচা যায়? আমার যদি শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তখনও আমার আশা ফুরোবে না, আমি বলবো আমি না হয় যাচ্ছি, কিন্তু বাকি মানুষ বেঁচে থাকুক, পৃথিবী বাসযোগ্য হোক আরও।

    মার্চ ২১

    আমাকে করোনা ভাইরাস ধরলে আমি নির্ঘাত মরবো। কারণ আমার বয়স বেশি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। যখন আমার উপসর্গ শুরু হবে, কেউ আমাকে দেখতে আসবে না। সম্পূর্ণ একা তখন আমি। কী করবো তখন? প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতগুলো শুনতে থাকবো। একসময় মরে যাবো। আমার মৃতদেহ দূরে কোথাও নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। আমি যে দিল্লির এইমস আর নিউইয়র্কের ল্যাংগনে মৃতদেহ দান করেছি, কোনও লাভ হবে না, ভাইরাসে মৃত্যু হলে ওরা দেহ নেয় না।

    পৃথিবীটা হঠাৎ করে কীরকম ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এই পৃথিবীকে আমি চিনি না।

    মার্চ ২২

    কত নতুন তথ্য পাচ্ছি। কাচে, স্টিলে, প্লাস্টিকে করোনা ভাইরাস ৯ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। বাতাসেও বেশ বেঁচে থাকে। কাগজেও থাকে, কাপড়েও থাকে। শুধু কপারে থাকে কম, ৪ ঘণ্টা। করোনা (SARS-CoV-২) আক্রান্ত কেউ একবার কাশলেই তার মুখ থেকে ৩০০০ ড্রপলেটস বেরিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, ছোট ড্রপলেটস বাতাসে ভাসে। ওই ৩০০০ এর প্রতিটি থেকে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য এই—করোনা আক্রান্ত সবার কাশি জ্বর থাকে না। দিব্যি সুস্থ দেখতে, আসলে কিন্তু তার ভেতরে গিজগিজ করছে এই ভাইরাস। করোনার ভাইরাস ভেতরে নিয়ে কেউ কথা বলছে তোমার সামনে, তোমার নাক মুখ দিয়ে ঢুকে পড়ছে ভাইরাস। সে যেসব জায়গায় স্পর্শ করেছে, সেসব জায়গায় তুমি স্পর্শ করলে তোমার হাতে চলে আসবে ভাইরাস। ভাইরাস তার শরীরে, অথচ কোনও উপসর্গ শুরু হয়নি, অন্যকে যে আক্রান্ত করার ক্ষমতা তার আছে, সে নিজেও জানে না। এ কারণেই এই ভাইরাস বিশ্বময় এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। জানিনা এই ভয়ংকর ভাইরাসকে পরাজিত করার ক্ষমতা মানুষের আছে কি না। হয়তো নেই, হয়তো আমাদের সবাইকে ধরবে এই ভাইরাস। এরকম যখন ভাবছিলাম, তখন বিকেল ৫টা। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, সারা পাড়ার মানুষ যার যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা, কাঁসর-ঘণ্টা, শঙ্খ যা পাচ্ছে, বাজাচ্ছে সেই ডাক্তার এবং নার্সদের উদ্দেশে, যাঁরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজ করছেন। সম্মিলিত শঙ্খধ্বনি যখন রেকর্ড করছিলাম মোবাইলে, মৃত্যুর সামনে দাঁড়ানো বিপন্ন জনমানুষের আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছিল চারদিকের ওই শব্দ, আমার চোখ থেকে তখন টপ টপ ঝরে পড়ছিল জল।

    মার্চ ২৪

    আমাদের হয়তো প্রস্তুত থাকা দরকার কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার জন্য। যদি ভ্যাক্সিন চটজলদি না আসে, তা হলে যেভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, এভাবে ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবীর প্রায় সবাইকে এই ভাইরাস কামড় দেবে। দিলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের ভালো, যারা শক্তিমান, তারা ভাইরাসকে হারিয়ে দেবে, আর যাদের বয়স বেশি, অথবা যাদের ডায়বেটিস ইত্যাদি অসুখ আছে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা ভাইরাসের কাছে হেরে যাবে, হেরে যাবে মানে মরে যাবে। বিশ্ব জুড়ে তাই তো হচ্ছে। মাত্র কদিনেই ১৫ হাজারের চেয়েও বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ভাইরাস। পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে বয়স যাদের কম, সুস্থ এবং শক্তিমান যারা, তারা। তারা এই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঁচে গেলে তাদের শরীরে করোনা প্রতিরোধের ক্ষমতা জন্ম নেবে। করোনা তখনই বিদেয় নেবে যখন কাউকে আর আক্রান্ত করতে পারবে না। সোশ্যাল আইসোলেশন আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে পারবে, কিন্তু ভাইরাস দূর করতে পারবে না।

    আমাদের জেনারেশন সাফ হয়ে যাবে। নতুনদের গড়তে হবে এক নতুন পৃথিবী। সেই পৃথিবী কেমন হবে, তা নির্ভর করে কারা পৃথিবী গড়ছে। নতুন সেই পৃথিবী যে খুব চমৎকার হবে তা আমার মনে হয় না। যখন ভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াইয়ে মানবতার স্বার্থে ঘরবন্দি থাকার চেয়ে জরুরি কাজ আর নেই, তখন যে ইয়ং নারী-পুরুষ দিব্যি রাস্তায় বের হয়ে থালা বাজিয়ে নাচতে নাচতে করোনা ফেস্টিভ্যাল করেছে ভারতে, সিডনি আর সান্টা মারিয়ার সমুদ্র সৈকতে যে শত শত ইয়ং নারী-পুরুষ সূর্যস্নান করতে বসে গেছে, বাংলাদেশে যে ছেলেগুলো মিছিল করেছে মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার দাবি করে, আর ইতালি থেকে ফিরে যারা কোয়ারেন্টাইনে না থেকে বাড়ি চলে গেছে, তাদের মতো বোকা বুদ্ধিসুদ্ধিহীন বিবেক বর্জিতরাও কিন্তু বেঁচে থাকবে। তারা সমাজে কী ভূমিকা রাখবে সেটির ওপরও সমাজের গুণ-মান-চরিত্র নির্ভর করবে। প্রচুর গবেষক, বিজ্ঞানী, মানবতাবাদী, চিন্তক, লেখক, শিল্পীর মৃত্যু হবে। অনেক দক্ষ লোকই থাকবে না। সুস্থ শরীর দিয়ে যুদ্ধ জয় করা হয়তো যায়, কিন্তু পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠন করতে সুস্থ মস্তিকের দরকার হয়। সেটির যেন অভাব না হয় আগামীর পৃথিবীতে।

    মার্চ ২৫

    লকডাউনে আমার খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। ইউরোপ আমেরিকায় দীর্ঘকাল বাস করার কারণে রান্নাবান্না করা, বাসন ধোয়া, ঘরদোর গোছানো, ডাস্টিং, ঝারু মোছা, কাপড় ধোয়া, টয়লেট পরিষ্কার ইত্যাদি হাজার রকমের কাজ নির্বিঘ্নে করে ফেলতে পারি। একা থাকতেও কোনও অসুবিধে কখনো হয়নি কারণ জীবনের অর্ধেকটা বয়স একাই থেকেছি আমি।

    লকডাউনটা টিকা আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত চালু থাকলে ভালো হয়। এই সময় গরিবদের ঘরে ঘরে চাল, ডাল আর টাকাকড়ি পৌঁছে দেওয়া দরকার। কিছু দেশ তো তাই করছে।

    এই সার্স কোভ ২ ভাইরাস খুব বেশি বিবর্তিত না হলে টিকা আবিষ্কারে খুব বেশি দেরি হবে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন ফ্লুর টিকার মতো প্রতি বছর নতুন নতুন টিকা নয়, এই টিকা একবারই নিতে হবে, হাম আর গুটি বসন্তের টিকার মতো।

    ইতালি আর স্পেনের দিকে তাকানো যায় না। পিঁপড়ের মতো মানুষ মরছে। ইরান, আমেরিকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের শরীরে ভাইরাস ধরা পড়ছে। মানুষের জীবন যে কতটা কচু পাতায় জল, তা হাড়ে মজ্জায় যেন বোঝা হল আবারও। মানবপ্রজাতির সবচেয়ে বড় দুর্যোগের দিনে যারা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, স্বার্থপরতা নিয়ে থাকছে, অন্যের ক্ষতি হলে যাদের কিছু যায় আসে না—তাদের কিন্তু চীনে রাখা বড় জরুরি।

    দেখা যায় না এমন ছোট ভাইরাস আজ আমাদের প্রজাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। গোটা পৃথিবী লকডাউন, যেন নীল ডাউন হয়ে ভাইরাসের কাছে প্রাণভিক্ষে চাইছে। মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার এবং বাস করার সব আয়োজন আমরা করে ফেলেছি, কত শক্তিশালী আমরা, অথচ কত শক্তিহীন!

    এইসময় আমরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলেও মানসিক দূরত্ব যেন ঘুচিয়ে ফেলি। ভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, আমরা মানুষ—এই আমাদের আসল পরিচয়। নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, নাস্তিক, ছোট-বড়, ধনী-গরিব, সাদা-কালো, বাদামি-হলুদ, ফরাসি, চৈনিক, সিরীয়, ভারতীয় আরব ওলন্দাজ আমরা সব এক। দেশে দেশে যে বেড়া দিয়েছি, তা নিতান্তই অর্থহীন।

     ১ ১৯. ধর্মান্ধতা দিয়ে করোনা ভাইরাস ঠেকানো যাবে না

    ভারতে যা হচ্ছে তা হচ্ছে বলে বিশ্বাস হয় না। করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য গোমূত্র পানের ‘পার্টি’ হচ্ছে। দিল্লিতে গোমূত্র পার্টির আয়োজন করেছিল হিন্দু মহাসভা। করোনার কোনও প্রতিষেধক যেহেতু এখনও আবিষ্কার হয়নি, সেহেতু গোমূত্র পানই নাকি তাদের বাঁচাবে। দিল্লি থেকে কলকাতায় সংক্রামিত হয়েছে এই গোমূত্র পান। কলকাতাতেও গোমাতার পুজো এবং এবং গোমূত্র পানের আসর বসেছে।

    গোমূত্রের মাধ্যমে ভাইরাস দূর হওয়ার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায়নি। যারা প্রচার করছে যে গোমূত্র রোগ সারায়, তারা কোনও ল্যাবে পরীক্ষা করেনি। ল্যাবে পরীক্ষা না করে গোমূত্র রোগবালাই দূর করবে, এমন দাবি করাটা লোক ঠকানো ছাড়া কিছুই নয়। এই অপপ্রচার বন্ধ হওয়া জরুরি। যারা ধর্মান্ধ, তারা তো কোনও কিছুর প্রমাণ দেখতে চায় না, এটাই মুশকিল। বিশ্বাসকে যারা যুক্তির ওপরে স্থান দেয়, তাদের তো গোমূত্র, উটমূত্র, নিজমূত্র কত বর্জ্য পান করতে হয়। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র গোমূত্রের রোগ প্রতিরোধক গুণের দাবিকে বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি না দিলেও গোমূত্রের বিক্রি কিন্তু আকাশ ছুঁয়েছে। ধর্মান্ধতা এত প্রচণ্ড যে কোথাও কোথাও গরুর দুধের চেয়ে আজ গোমূত্রের দাম বেশি! বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছে ‘গোমূত্র চিকিৎসা ক্লিনিক’। বিক্রি হচ্ছে ‘গোমূত্র ক্যাপসুল’ এবং ‘ডিস্টিল্ড’ ও ‘মেডিকেটেড’ গোমূত্র! সৌদি আরবেও ছিল উটমূত্র বিক্রির দোকান। উটমূত্রও নাকি রোগ সারায়। আমার তো মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যে যে মার্স ভাইরাস এসে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটিয়েছিল, তার পেছনে উটমূত্র দায়ী। সৌদি সরকার উটমূত্র বিক্রি করা সে কারণেই হয়তো তখন বন্ধ করে দিয়েছিল। বাদুর থেকে ভাইরাস উটে গেছে, উট থেকে মানুষে। মূত্রে লাভ তো হয় না, বরং ক্ষতি হয়। কিন্তু কে শুনবে কার কথা! ভারতের মতো দেশে যুক্তিবাদী চার্বাকের উত্তরসূরিরা আজ গোমূত্র পান করে ভাইরাস হটাতে চাইছে। ধর্মান্ধতা সম্বল করে মানবপ্রজাতিকে সমূহ বিপদ থেকে বাঁচানো যায় না, শুধু লোক হাসানোর সার্কাস করা যায়। কেউ কেউ তো মন্দিরে মন্দিরে পুরোহিতদের মুখে মাস্ক, এমনকি দেবদেবীর মূর্তির মুখেও পরিয়ে দেওয়া হয়ছে মাস্ক। কেউ কেউ তো গায়ে গোবর লেপে বসে আছে। এই গোবর ভেদ করে নাকি ভাইরাস তাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারবে না। ধর্ম আর কুসংস্কার হাত ধরাধরি করে চলে। তিরুপতির মন্দির বন্ধ, সিরডি সাঁইবাবার মন্দির বন্ধ। বেলুড় মঠ বন্ধ। এই ভগবানই নাকি মানুষকে বাঁচায়। বিপদে মানুষকে রক্ষা করবে বলে মানুষ সারাবছর যাদের প্রার্থনা করে, তারাই মানুষের বিপদ দেখলে পালায়।

    ওদিকে মক্কায় তাওয়াফ বন্ধ করা হয়েছে, উমরাহও আপাতত বন্ধ, মদিনাতে মুহম্মদের কবর জিয়ারত করাও বন্ধ। সম্ভবত হজও বন্ধ করে দেওয়া হবে। বহু মসজিদ শুক্রবারের নামাজও বন্ধ করে দিয়েছে। কুয়েতে নতুন আজান দেওয়া হচ্ছে, নামাজের জন্য এসোর বদলে আজানে বলা হচ্ছে, ঘরে বসে নামাজ পড়ো। এ এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। কিন্তু বাঁচার জন্য এটি করতেই হচ্ছে। কারণ নামাজ পড়তে গিয়ে তুমি কারো কাছ থেকে ভাইরাস নিয়ে এলে তুমি তো পুরো পরিবারকে সংক্রামিত করবে। ১ থেকে ১০০, ১০০ থেকে ১০,০০০ এভাবে সংক্রামিত হতে থাকবে, আর মরতে থাকবে মানুষ। এক ভাইরাসই মানুষ-প্রজাতিকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এখন কিন্তু মোল্লারা বলছে না আমরা মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবো ভাইরাসের কবল থেকে তিনি যেন আমাদের বাঁচান। ধর্মের ব্যবসায়ীগুলো ভালো জানে যদি এই মুহূর্তে কেউ বাঁচায়, বাঁচাবে বিজ্ঞানীরা, যারা ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করায় ব্যস্ত।

    যাদের এই ব্যাপারে থ হয়ে যাওয়ার কথা, যাদের প্রচুর প্রশ্ন জাগার কথা, তারা, অগুণতি নিরীহ ধার্মিক দল, আজ কোথায়? অধিকাংশ লোক যেদিকে যায়, তারা সেদিকে যায়। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এই প্রশ্ন করে না। ঈশ্বর আছে কি না তার কোনও প্রমাণ দেখতে চায় না। যারা যুক্তিবাদ বা মুক্তচিন্তা বিষয়ে কিছু জানে না। তারা কি আজও জানতে চাইবে না, যে উপাসনালয়ে গিয়ে উপাসনা করলে ঈশ্বর বা আল্লাহ রোগ সারাবেন, সেই উপাসনালয় কেন মানুষের কল্যাণের জন্য বন্ধ করা হল, তাহলে কি কোনও উপাসনালয়ই সত্যিকার উপকার করে না মানুষের?

    ক্যাথলিকদের পবিত্র স্থান ভ্যাটিকেনের ভেতরেই পাওয়া গেছে করোনা ভাইরাস। পোপ নাকি ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কোথায়? তিনি তো ঈশ্বরপ্রদত্ত কোনও ওষুধের নাম এখনও কিছু বলতে পারছেন না। ভ্যাটিকেনের ভেতর ভাইরাসের ভয়। পোপ জনসম্মুখে যাচ্ছেন না। জনগণের উপস্থিতিতে নানারকম খ্রিস্টধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন হয় ভ্যাটিকেনে। ‘গুড ফ্রাইডে, ঈস্টার সব উৎসব অনুষ্ঠান এখন বাতিল করা হয়েছে, মানুষের জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। তাহলে ঈশ্বর কোথায়? ধার্মিকদের মনে কি এই প্রশ্নের উদয় হচ্ছে না?

    প্রতিটি রাষ্ট্রের উচিত সবরকম ধর্ম প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় অনুদান বন্ধ করে দেওয়া। মানুষের করের টাকায় আরাম করছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পোপ, পুরোহিত, যাজক আর মোল্লা-মৌলভি। এরা তো মানুষের কোনও উপকার করছে না। মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। এরাই যত অনাচার, অত্যাচার, আর অন্যায় করে বেড়াচ্ছ। শিশুদের ধর্ষণ করছে। নারীবিরোধী বিধান দিচ্ছে। কী দরকার এইসব প্রতিষ্ঠানের? অকল্যাণ ছাড়া ধর্ম আর কী করেছে শতাব্দী জুড়ে? মানুষ হত্যা, নারী-নির্যাতন, দেশ ভাগ, রক্তপাত, মানুষের প্রতি মানুষের হিংসে আর ঘৃণা ছড়ানো ছাড়া? প্রচুর মানুষ যদিও ধর্মের গ্রাস থেকে ইতিমধ্যে মুক্ত করেছে নিজেদের, বিশেষ করে উন্নত সভ্য পৃথিবীতে, কিন্তু দারিদ্র, বৈষম্য, নারীবিদ্বেষ, বর্বরতা যেখানে ভীষণ ভাবে বিদ্যমান, সেখানে ঈশ্বরের পুজোআচ্চাও ভীষণভাবে বিদ্যমান।

    বিবর্তনের তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন চার্লস ডারউইন ১৬০ বছর আগে। আজ অবধি তাঁর তত্ত্বকে খন্ডন করতে পারেনি। মানুষ শিম্পাজি জাতীয় প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষ হয়েছে—ডারউইনেরও বহু আগে ষোলোশ’ শতাব্দীতে গ্যালেলিও গ্যালিলেই, তারও আগে কোপারনিকাস দেখিয়ে দিয়েছিলেন ‘বাইবেলে’ মহাকাশ সম্পর্কে যে বার্তা আছে, তা ভুল। এরপরও কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের ঈশ্বরে বিশ্বাস করেই গেছে। অদৃশ্য ঈশ্বর দৃশ্যমান হয়নি, আজ অবধি ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ মেলেনি, তারপরও কিন্তু মানুষ অন্ধের মতো বিশ্বাসই করেই যাচ্ছে যে ঈশ্বর আছে। করোনা ভাইরাস বিশ্বময় ছড়িয়ে যাওয়ার পর, যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে সংক্রামিত হচ্ছে এই ভাইরাস, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সভা-সম্মেলন যেখানে অনেক মানুষের জমায়েত হয়। মানুষ রোগ মুক্তির জন্য মন্দির, মসজিদ, গির্জা এবং নানা উপাসনালয়ে ছুটে যায়, সেই উপাসনালয়গুলোও বন্ধ। তাহলে তো এই-ই দাঁড়াচ্ছে, আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান কেউ রোগ সারায় না, রোগ সারায় বিজ্ঞানী! মানুষকে বাঁচায় কোনও অলৌকিক শক্তি নয়, মানুষের ভরসা মানুষ। ধার্মিকরাও এখন আর তাদের ঈশ্বরের দয়ার অপেক্ষায় বসে নেই, তারা অপেক্ষা করছে কবে ভ্যাক্সিন বের করবে বিজ্ঞানীরা।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleফেরা – তসলিমা নাসরিন
    Next Article ফরাসি প্রেমিক – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }