Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অনড় দাঁড়ালাম – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প352 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৮০. মসজিদে মৃত্যু আর নয়

    ৮০. মসজিদে মৃত্যু আর নয়

    মসজিদ পবিত্র স্থান। পবিত্র স্থান অবৈধভাবে নির্মিত হলে বড় দুঃখ হয়। গ্যাস পাইপলাইনের ওপর যারা মসজিদ নির্মাণ করে, তারা নিশ্চয়ই রাজউকের অনুমতি ছাড়াই করে। যে কোনও সময় গ্যাসের পাইপে দুর্ঘটনা ঘটে নিরীহ নামাজিদের মৃত্যু হতে পারে, জেনেই করে। যাদের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য নেই, তারা কি ভালো লোক? তাদের দ্বারা সমাজের আদৌ কি কোনও উপকার হয়? এই যে ২৮ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হল একটি মসজিদে, সেটির দায় কাদের? অপরাধীদের কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়াটা জরুরি যেন ভবিষ্যতে আর কেউ অবৈধ ভাবে মসজিদ নির্মাণে উৎসাহ না পায়। কোনও বাড়ি-ঘর দালান-কোঠাই অবৈধভাবে বানানো উচিত নয়। যেসব স্থানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়, সেসব নির্মাণে কোনওরকম খুঁত রাখা রীতিমতো অপরাধ। ধর্ম-ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম এত বেড়েছে যে আজ তারা পবিত্র স্থানকে অপবিত্র করতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ করতে দ্বিধা করছে না।

    মসজিদের ছ’টি এসিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, খবরটি শুনে তো আমি হতবাক। এক মসজিদের ভেতর ছটি এসি? মসজিদে যে এসি থাকে, সেটাই তো জানা ছিল না। ‘এই আরাম আয়েশ কবে থেকে’? এক দেশি ভাইকে সেদিন জিজ্ঞেস করলাম। ও বললো, ‘আজকাল মসজিদগুলো এক একেকটা রাজদরবারের মতো’। ছোটবেলায় আমি যে মসজিদ দেখেছি, সেসব ছিল সাধারণ। মার্বেল পাথর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ইত্যাদির বালাই ছিল না। ধনী গরিব সেসব মসজিদে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তো। মসজিদের যে দানবাক্স থাকে, সেসব বাক্সে প্রচুর দরদী মানুষ টাকা পয়সা দান করেন। সেসব টাকায় মসজিদকে রাজা বাদশাহর দরবারখানা না বানিয়ে গরিবদের দেওয়া উচিত, তাদের খাওয়ায়, শিক্ষায়, চিকিৎসায় ব্যয় করা উচিত।

    একসময় মুসলমানদের খানকাশরিফ ছিল। সেই খানকাশরিফে সব ধর্মের মানুষের প্রবেশ অবাধ ছিল। কোনও দরিদ্র, কোনও বিধর্মী, কোনও ছোটজাতকে দূরে ঠেলে দেওয়া হত না। ব্রাহ্মণ শূদ্র আশরাফ আতরাফ এক থালা থেকে খাবার খেতো। যে ক্ষুধার্ত তাকে খাদ্য দেওয়া হত, যে আশ্রয়হীন তাকে আশ্রয় দেওয়া হত, যে বস্ত্রহীন তাকে বস্ত্র দেওয়া হত, যে বুদ্ধিপরামর্শ চাইতো, তাকে বুদ্ধিপরামর্শ দেওয়া হত। খানকাশরিফের উদারতার কারণে ভারতবর্ষের বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কোথায় সেই উদারতা আজ? আজ মানুষের জন্য খরচ না করে ইমারতের জন্য খরচ করা হচ্ছে। মসজিদের চাকচিক্য বাড়লে পুণ্য বাড়ে না, মানুষের অন্তর শুদ্ধ হলে, মানুষ উদার হলে,ক্ষমাশীল, দয়াশীল হলে পুণ্য বাড়ে। যারা নবীজীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, তারা কি শুধু দাড়ি রেখে, জোব্বা পরে, মেসওয়াক করেই দায়িত্ব শেষ করতে চান? নবীজী কি তাঁর গরম-দেশে এসির আরামে বসে নামাজ পড়তেন? নবীজী মরুভূমির যে গরম সহ্য করেছেন, সেই গরম তো তাঁর উম্মতদেরও সহ্য করা উচিত। অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন তিনি, তাঁর মতো সাধারণ জীবন তো তাঁর উম্মতদেরও যাপন করা উচিত। আজকাল হুজুরদের দেখি গাড়িতে, এমনকি হেলিকপ্টারে চড়েও ওয়াজ করতে যান। লাখ লাখ টাকা নেন ওয়াজের জন্য। অথচ কোরান হাদিসের কথা তো বিনামূল্যেই শোনানো উচিত। ধর্ম যদি বাণিজ্য হয়ে ওঠে, তবে ধর্ম যে কোনও দ্রব্য সামগ্রীর মতোই মানুষ ওতে ভেজাল মেশাবে। ধর্ম তো মুনাফা লোটার জন্য নয়।

    এ খবর বড় দুঃখজনক যে মসজিদে নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবা লুকিয়ে রাখা হয়, কিছু ইমাম জড়িত মাদক ব্যবসায়। কিছু ইমাম বাচ্চাদের ধর্ষণও করেন। কিছু ইমাম আবার মসজিদের জন্য বরাদ্দ টাকা পয়সা নিজের পকেটে ঢোকান। মসজিদের বাইরে চিরকাল সাইনবোর্ড দেখেছি ‘জুতা চোর হইতে সাবধান’। কিছু লোক নাকি মসজিদে নামাজ পড়ার পর অন্যের জুতো পায়ে গলিয়ে দিব্যি বাড়ি চলে যায়। চোরও তাহলে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মাথা নোয়ায়! মুশকিল হল মাথা নোয়ালেই চোর ডাকাত ধর্ষক খুনী ভেবে বসে তাদের সকল অপরাধের জন্য তারা ক্ষমা পেয়ে গেছে। মানুষের ভয়ংকর ক্ষতি করার পর, সর্বনাশ করার পর ক্ষমা কেন পেয়ে যাবে বদ লোকেরা? তাহলে তো যাবতীয় অন্যায় নিশ্চিন্তেই করবে তারা, কারণ নামাজ রোজা হজ করলেই ক্ষমা পেয়ে যাবে বলে তারা যেহেতু বিশ্বাস করে। আল্লাহ অতি মহান, অতি উদার, সে কারণে অপরাধীকেও না হয় ক্ষমা করে দেন। কিন্তু রাষ্ট্রের উচিত তাদের শাস্তি দেওয়া। শাস্তি না দিলে ধর্মের নামে হেন অপকর্ম নেই যে এরা করবে না। তেতো সত্য এই, প্রচুর বদ-বদমাশ ধর্মকে নিজের অপকর্ম আর অপরাধ আড়াল করার জন্য ব্যবহার করে। সমাজের সকলের উচিত বদ-বদমাশদের চিহ্নিত করা। ধর্মের লেবাস পরলেই তাকে ক্ষমা করা উচিত নয়, মসজিদ মাদ্রাসায় দৌড়োলেই কারও সাত খুন মাফ হয়ে যায় না।

    অবৈধভাবে নির্মিত মসজিদ এবং যে সব মসজিদে অবৈধ কাজ কর্ম চলে, সেইসব মসজিদের দরজায় তালা লাগিয়েও সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। মানুষকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে অবৈধভাবে কোনও ইমারতই, এমনকি মসজিদও নির্মাণ করা যাবে না। কারণ বারবার দুর্ঘটনা ঘটলে লোকে মসজিদে যেতেই ভয় পাবে। আল্লাহতায়ালা সদা সর্বদা মসজিদকে রক্ষা করবেন— এই বিশ্বাসও মানুষের মন থেকে উঠে যাবে। অবৈধ কাজকর্ম চলতে থাকলে লোকে মসজিদকে পবিত্র এবং নিরাপদ স্থান বলে ভাববে না। ধর্মের ওপর লক্ষকোটি নিরীহ মানুষ নির্ভরশীল, বিশ্বাসই তাদের ভরসা, এই বিশ্বাস যদি টুকরো টুকরো হয়ে যায়, তাহলে তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন কিছু থাকবে না।

    মসজিদকে নিরাপদ এবং মানুষের কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করতে চাইলে আরও কিছু পদক্ষেপ করতে হবে। যেমন শিয়া, আহমদিয়া, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এবং নারীর প্রতি যেন ঘৃণার উদ্রেক হয়, এমন কোনও বক্তব্য যেন কোনও ইমাম পরিবেশন না করেন। মসজিদ হবে মানবতার জায়গা, কোনও হিংসে, ঘৃণা, বর্বরতা, সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্য মসজিদকে ব্যবহার করা ভয়ানক অন্যায়। মসজিদ রাজনীতির জায়গা নয়। মসজিদে ইবাদতের জায়গা। যত উদার হবে মানুষ, ইবাদত তত বিশুদ্ধ হবে। ইসলামকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করার দায়িত্ব মুসলমানের। ইসলামকে ঘৃণা মুক্ত, বিদ্বেষ মুক্ত করার দায়িত্ব মুসলমানের, আর কারও নয়।

    আমার মা’র মতো ধার্মিক আমি আজকাল আর দেখি না। মা নামাজ রোজা করতেন। কোরান পড়তেন নিয়মিত। কোরান বুঝে পড়ার জন্য আরবি শিখেছিলেন। আমার মা সকলের মঙ্গল চাইতেন। আমাদের বাড়ি ছিল হিন্দু পাড়ায়। মা হিন্দুদের যে কোনও অসুখে অভাবে পাশে দাঁড়াতেন। তাদের মানুষ বলে ভাবতেন। দরিদ্রর দারিদ্র ঘোচানোর জন্য সবরকম চেষ্টা করতেন।সমাজে সমতা চাইতেন। কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা একেবারেই মেনে নিতেন না। মা অসম্ভব সৎ ছিলেন। অসম্ভব উদার ছিলেন। এমন ধার্মিকই তো কাম্য। কিন্তু দিন দিন লক্ষ করছি, যত বেশি ধার্মিক বাড়ছে দেশে, তত বেশি ভেজাল ধার্মিকের সংখ্যা বাড়ছে। অসৎ, দুর্নীতিবাজ, মিথ্যুক, ধর্ষক, খুনীও আজকাল দাবি করে তারা ধার্মিক। তারা মসজিদ মাদ্রাসাকে, এমনকি ধর্মকেও নিজের স্বার্থে কুক্ষিগত করেছে। এই বদ-বদমাশদের হাত থেকে ধর্মকে বাঁচাতে হবে।

    ৮ ১. বিয়ে নারীকে কী দেয়?

    ব্যান্ড তারকা জেমসের প্রথম স্ত্রী রথিকে মনে আছে? ফটোসুন্দরী হয়েছিলেন, এক সময় বিজ্ঞাপনচিত্রে, নাটকে, টেলিছবিতে এমনকি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। সেই রথিকে বিয়ের পর অভিনয় ছাড়তে হয়েছিল, কারণ স্বামীর আদেশ। স্বামী জেমস সোজা বলে দিয়েছিলেন নাটক সিনেমা করা চলবে না। শেষ অবধি দুটো সন্তান জন্মাবার জেমস তালাক দেন স্ত্রীকে। অন্য একটি বিয়েও তখন তিনি করে নিয়েছেন। সন্তান নিয়ে রথিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয় ২০০৩ সালে। সেই থেকে তিনি নিজেই সন্তান বড় করেছেন। আমাদের জনপ্রিয় জেমস সন্তান লালনপালনে কোনওরকম সাহায্য করেননি, নিজের ধনদৌলতের কিছুই খরচ করেননি তাদের জন্য। বিয়ের পর রথিকে তাঁর অভিনয় থেকে সরে আসতে হয়েছিল, জেমসকে কিন্তু তাঁর গান থেকে সরে আসতে হয়নি। আজও সমাজে এমন ঘটনা ঘটে। মেয়েদের স্বাধীন এবং স্বনির্ভর হওয়ার পথে শিক্ষিত সচেতন পুরুষ বলে যাঁদের বিশ্বাস করি, তাঁরাই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ান।

    বিয়ে প্রথাটি আমাদের এই উপমহাদেশে নারী-পুরুষের বৈষম্যের ওপর এই একবিংশ শতাব্দীতেও দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর সকল প্রাণী যেমন প্রতিনিয়ত বিবর্তিত হচ্ছে, প্রাণীর তৈরি নিয়মনীতিগুলোরও বিবর্তন ঘটছে। কিন্তু বিয়ের বিবর্তন প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে। এখনও মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে উঠতে হয়। হিন্দু মেয়েদের সিঁথিতে সিঁদুর পরতে হয়, নানা কুসংস্কারের প্রতীক শাঁখা, পলা, লোহাও পরতে হয় হাতে। গলায় পরতে হয় মঙ্গলসূত্র। দীর্ঘদিন যাবৎ নারীর সমানাধিকার জন্য দেশে বিদেশে আন্দোলন চলছে, ওতে প্রভাবিত হয়ে কিছু শিক্ষিত এবং সচেতন মেয়ে শাঁখা সিঁদুর পরা বাদ দিয়েছেন। কোথায় প্রগতিশীলরা অন্তত মেয়েদের এই স্বাধীনতাকে সাদরে গ্রহণ করবেন, তা নয়, গৌহাটি হাইকোর্টের বিচারকরাই সেদিন প্রমাণ করলেন এখনও বৈষম্যকে আঁকড়ে ধরে আছে সমাজের প্রভাবশালী ক্ষমতাধর মানুষেরা। গৌহাটির হাইকোর্ট বিবাহ বিচ্ছেদের একটি মামলায় বিচ্ছেদ মঞ্জুর করার পক্ষে কারণ দেখালেন, স্ত্রীটি যেহেতু শাঁখা সিঁদুর পরছেন না, সেহেতু ধারণা করা যায় তিনি তাঁর স্বামীকে আর স্বামী হিসেবে মনে করেন না। বিচারকদের মতে শাঁখা-সিঁদুর না-পরা মানে নিজেকে অবিবাহিতা মনে করা বা সেই বিয়ে মেনে না-নেওয়া। এটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং নারীবিরোধী মানুষের বিচার হতে পারে, একে আদালতের বিচার বলে তো মানা যায় না। যে আদালতের কাজ লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, মানবাধিকার এবং নারীর সমানাধিকার রক্ষা করা, সেই আদালতই যদি বিয়ের চিহ্ন হিসেবে শাঁখা-সিঁদুর পরা মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক বলে মনে করেন, তাহলে নিশ্চয়ই তা দুর্ভাগ্যজনক। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন যতদিন না হবে, ততদিন নারীকে ভুগতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক তো বটেই। ভুলেই গিয়েছিলাম আদালত সমাজের বাইরের কিছু নয়। এর বিচারকরাও এই সমাজেরই লোক।

    মুশকিল হল, বাপ মায়ের বাড়িতে বিয়ে করে বউ তোলে পুরুষেরা, আজো। পুরুষেরা প্রাপ্তবয়স্ক হতে চায় না। তারা মা বাপের ‘কোলের শিশু’ হয়ে আজীবন কাটিয়ে দিতে চায়। বাপ মা ভাই বোন গায়ে গতরে বড় হওয়া পুরুষটির দেখভাল করে, তারপর যোগ হয় বধূ। আরেক সেবাদাসি। প্রাপ্ত বয়স্কের মতো নিজের দায়িত্ব নেওয়ার কাজটি আজও আমাদের বেশিরভাগ পুরুষ দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। বধূটি সম্পূর্ণ একটি নতুন পরিবেশে হিমশিম খায়। সবার মন রক্ষা করে চলতে হবে, না হলে লোকে তাকে মন্দ বলবে। নিজের স্বকীয়তা স্বাধীনতা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হয় মেয়েদের। এক্ষুনি আমি জানি শয়ে শয়ে মেয়ে এসে বলবে তাদের শ্বশুর শাশুড়ি কত ভালো, একেবারেই তাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়নি। কিন্তু কথা হচ্ছে, একটি মেয়েকে কেন স্বামীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বাস করতে হবে, স্বামীকে তো মেয়ের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বাস করতে, এবং সবার মন জুগিয়ে চলতে বলা হয় না! বিয়ে হলে একটি মেয়েকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী, চেনা পরিবেশ, চেনা এলাকা ত্যাগ করে স্বামীর বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। একটি পুরুষকে বিয়ের কারণে কিছুই ত্যাগ করতে হয় না। অসাম্যের একটা সীমা থাকা দরকার। বিয়ে সব সীমা ছাড়িয়ে যায়।

    আসামের যে লোকটি স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন, তাঁর অভিযোগ ছিল, স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে চান না। এটিই লোকটির তালাক দেওয়ার কারণ। স্ত্রী যদি পছন্দ না করেন স্বামী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে বাস করতে, তখন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা স্ত্রী নিয়ে আলাদা সংসার করেন, কিন্তু মা বাপের কোলের শিশুরা মা বাপের সঙ্গে বাস করার জন্য গোঁ ধরেন, স্ত্রীকে ত্যাগ করতে আপত্তি নেই তাঁদের। আমাদের পুরুষেরা কি শুধু মা বাপের কোলের শিশু? তাঁরা তো ছলে বলে কৌশলে স্ত্রীদেরও কোলের শিশু বনে যান। স্ত্রীরা তাঁদের নাওয়া খাওয়া থেকে শুরু করে তাঁদের জুতো মোজারও তদারকি করবেন— এটাই চান তাঁরা।

    আসামের অপদার্থ লোকটির প্রাপ্তবয়স্ক এবং দায়িত্বশীল পুরুষ হওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। তাই তালাকের আয়োজন। দুজন মানুষ একত্রে বাস করতে না চাইলে, দুজনের মধ্যে ভালোবাসা অবশিষ্ট না থাকলে, কেউ একজনও ভেবে চিন্তে তালাকের সিদ্ধান্ত নিলে কোনওরকম সমস্যা ছাড়াই তালাক সম্পন্ন হওয়া উচিত। হয়েওছে তাই। তালাক নিয়ে আপত্তি নেই। কিন্তু বিচারকের মন্তব্যটি নিয়ে আপত্তির আওয়াজ কানে আসছে। বিচারক বলেছেন বিবাহিত মেয়েদের শাঁখা সিঁদুর পরতে হবে। ওদিকে বিবাহিত পুরুষ মানেই কিন্তু অবিবাহিত পুরুষ। একটি পুরুষকে দেখে কেউ বলতে পারবে না সে বিবাহিত না কি অবিবাহিত। বিবাহিত এবং অবিবাহিত পুরুষেরা দেখতে একই। বিবাহিত পুরুষদের সকাল সন্ধে কোনও বিবাহের চিহ্ন বহন করতে হয় না। তাদের কোনও শাঁখা সিঁদুর পরতে হয় না। অসাম্যের একটা সীমা থাকা দরকার। সীমা যে নেই, আমরা জানি। বলছি, মেয়েদের, এমনকি স্বামীকে ভালোবাসেন এমন মেয়েদেরও যদি ইচ্ছে না করে শাঁখা সিঁদুর পরতে? তাহলে নিশ্চয়ই তাদের স্বাধীনতা থাকা উচিত ওসব না পরার? বিয়েটা বন্দিত্ব না হয়ে মুক্তি কেন হতে পারে না?

    ইউরোপ আমেরিকায় বিবাহিত ক্রিশ্চান আর ইহুদি পুরুষ এবং নারী উভয়েই অনামিকায় বিয়ের অঙ্গুরি পরে। ওটিই তাদের বিয়ের চিহ্ন। কোনও দম্পতির যদি ইচ্ছে না হয় অঙ্গুরি পরার, পরে না। সব ধর্মের মানুষদের মধ্যে এই স্বাধীনতা থাকা উচিত। মুসলমান পুরুষকে তো নয়ই, মুসলমান মেয়েকেও বিয়ের কোনও চিহ্ন বহন করতে হয় না, ব্যাপারটি ভালো। কিন্তু বিয়ের চিহ্ন বহন করতে হয় না বলে মুসলমান মেয়েরা যে অন্য ধর্মের মেয়েদের চেয়ে অধিক স্বাধীনতা ভোগ করে তা নয়। মুসলমান মেয়েরাও একই রকম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভুক্তভোগী।

    বিয়েটা দিন দিন ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। প্রভু-দাসির সম্পর্ককে আইনত বৈধ করার জন্য বিয়ে নামক ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল। মেয়েদের দুর্বল, পরনির্ভর ভাবা হত বলে, মেয়েদের শুধু যোনী আর জরায়ু ভাবা হত বলে শুরু হয়েছিল। মেয়েদের শরীরকে পুরুষের অধিকারভুক্ত করার জন্য শুরু হয়েছিল। ওইসব কারণের প্রতিটি এখন অকেজো এবং অর্থহীন। যে মেয়ে দুর্বল নয়, যে মেয়ে স্বনির্ভর, যে মেয়ের পরিচয় যোনী আর জরায়ু নয়, যে মেয়ে নিজের স্বাধীনতা এবং অধিকারে বিশ্বাস করে, যে মেয়ে প্রভু-দাসির সম্পর্ক মানে না, সমতা এবং সমানাধিকারে বিশ্বাস করে, সে মেয়ে বিয়েটা কোন দুঃখে করবে? বিয়েটা দরকার কিছু কোলের শিশু হওয়ার বাসনায় বুড়ো আঙুল চুষছে যে পুরুষগুলো, তাদের। কোনও বোধ বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিত সচেতন নারী পুরুষের জন্য বিয়ের দরকার নেই।

    আসলে বিয়ের মতো একটি প্রাচীন প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর পরিবর্তন এবং বিবর্তন জরুরি। এর নারীবিদ্বেষী আদি রূপটিকে বিদেয় করে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে একে আধুনিক করতে হবে। বিয়ে যেন স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে প্রভু-দাসির সম্পর্ক না করে। দুজনের ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ওপর যেন গড়ে ওঠে এই সম্পর্ক। কারও মানবাধিকার যেন খর্ব না হয় এই বিয়ের কারণে। বিয়ে যেন বন্দি না করে মেয়েদের, এ যেন হয়ে ওঠে বরং সবরকম বন্দিত্ব থেকে মুক্তি, এ যেন হয়ে ওঠে স্বাধীনতার আরেক নাম।

    ৮২. সামাজিক নেটওয়ার্কে নারীর নিরাপত্তা

    যা সমাজে আছে, তা সামাজিক নেটওয়ার্কে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজের মানুষ অন্তর্জালে ধরা পড়েছে। সমাজের মানুষের যে মানসিকতা, সেই একই মানসিকতা আমরা অন্তর্জালের মানুষের মধ্যে দেখি। তবে, একটু বেশিই দেখি। কারণ অনেকে আড়ালে থেকে নিজের মত প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যে মেয়েটির বা ছেলেটির ইচ্ছে হয় কবিতা লিখতে, আশেপাশের মানুষকে যে কথা সে জানাতে লজ্জাবোধ করে, সে কথা সে একঝাঁক অচেনা মানুষের হাটে হুট করে জানিয়ে দেয়, নিজেকে আড়ালে রেখে জানিয়ে দেয়, যাদের জানায় তারাও আড়ালে, সে জন্য জানাতে সে সংকোচবোধ করে না। অথবা মানুষ যেন দেখে, যেন শোনে, কোনও একদিন নিজে একটি গান গেয়ে ফেলে। অনলাইনে প্রতিভার স্ফুরণ দেখি। প্রতিভার ওপর আক্রমণও দেখি। যা সবচেয়ে বেশি দেখি, তা হল মেয়েদের যেভাবে হেনস্তা করে পুরুষেরা, যেভাবে গালিগালাজ করে, যে নোংরাভাবে প্রকাশ করে তাদের নারীবিদ্বেষ, যে উৎকটভাবে ছুড়ে দেয় ঘৃণা, যে জঘন্যভাবে নারীকে অপমান করে, যে কুৎসিতভাবে নারীকে মানসিক নির্যাতন করে।

    পুরুষেরা যে ভাষায় নারীকে অপদস্ত করে, হেনস্থা করে, সেই ভাষার উল্লেখ এখানে করা যাবে না, সেই বাক্যগুলো উদ্ধৃত করাও যাবে না, কারণ সেই ভাষাটি এতই কুৎসিত, সেই বাক্যগুলো এতই অকথ্য এবং অসভ্য এবং অশ্লীল যে এই পত্রিকার সম্পাদক তা ছাপার অযোগ্য বলে বিবেচনা করবেন। পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, নারীকে ছোট করতে, কলুষিত করতে, নিচু করতে, বিপর্যস্ত করতে পুরুষেরা কী ভাষা ব্যবহার করে। অনলাইনে, বিশেষ করে ফেসবুকে, টুইটারে, আমাকে খুব নোংরা ভাষায় আক্রমণ করা হয়। আশি-নব্বইয়ের দশকে আমার ওপর যে আক্রমণ হত, তা হত পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে, মেলায়, উৎসবে। অধিকাংশ নিন্দুক, হিংসুক, নারীবিদ্বেষী আমার নাগাল পেতো না। তারা এখন আমার নাগাল পেয়ে যায় সহজেই। আমি এখন তাদের এক ক্লিক দূরত্বে। যত ঘৃণা আছে তাই উগরে দিচ্ছে, যত হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা আছে, উগরে দিচ্ছে। দিয়ে শান্তি পাচ্ছে। টুইটারে এবং ফেসবুকে এই গালিবাজ নারীবিদ্বেষীদের টাইমলাইনে গিয়ে দেখেছি তারা সবাই ভদ্রলোক হিসেবে সমাজে পরিচিত, স্ত্রী সন্তান পরিবার পরিজন নিয়ে অতি সুন্দর সুষ্ঠু সামাজিক জীবনযাপন করে, ভালো চাকরিবাকরি ব্যবসাবাণিজ্য করে, প্রবলভাবে ধর্ম বিশ্বাসী এবং প্রবলভাবে পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী। এই লোকগুলো সমাজের রীতিনীতির সঙ্গে চমৎকার খাপ খাইয়ে চলে। আমাকে অন্যায়ভাবে অশ্লীলভাবে গালিগালাজ করার জন্য তাদের কোথাও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। তাদের নারীবিদ্বেষকে অত্যন্ত যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা হয়। আমি না হয় আমার তরুণ বয়স থেকেই নারীবিদ্বেষী পুরুষদের অশ্লীলতার আগুনে পুড়ে অঙ্গার না হয়ে ইস্পাত হয়েছি, কিন্তু সব নারীর পক্ষেই তো এমন আঘাত সামলে ওঠা সম্ভব নয়। আমার ফেসবুকের ইনবক্সে ‘শিক্ষিত সচেতন’ ভদ্রলোক বলে পরিচিত, ধার্মিক সজ্জন বলে পরিচিত পুরুষেরা পুরুষাঙ্গের অসংখ্য ছবি, নারী পুরুষের সংগমরত ছবি, নারীর নগ্ন শরীরের ছবি, মূলত পর্নোগ্রাফি পাঠিয়ে পাঠিয়ে আমাকে কী করে তারা ধর্ষণ করবে, তাই লেখে, প্রতিদিন লেখে। তারা সকলেই আমার অচেনা। তারা পড়েছে অথবা শুনেছে আমি নারীর সমানাধিকার চাই, তাই তাদের রাগ, তারা পড়েছে অথবা শুনেছে আমি মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, আমি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক। সে কারণে, শাস্তিস্বরূপ, ধর্ষণ করতে চায়, শুধু তাই নয়, কুকুর দিয়ে ধর্ষণ করাতে চায়। আমি ভেবেছিলাম আমার ওপর যেহেতু মৌলবাদী নারীবিদ্বেষীদের রাগ বহু পুরোনো, সে কারণে আমাকে এভাবে হেনস্থা করছে এরা। কিন্তু অবাক হয়ে যাই যখন শুনি ইনবক্সে পুরুষেরা এভাবে পর্নোগ্রাফি পোস্ট করে ধর্ষণ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে সব মেয়েদের, ফেসবুকে নতুন আসা কিশোরীদেরও ছাড় দেয় না। ওই কিশোরীদের কী দোষ? দোষ এই, ওরা হয়তো নিজের কোনও মত প্রকাশ করেছে তা ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী, বা পিতৃতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী সঠিক নয়। অথবা কিশোরীরা শুধু কিশোরী বলেই, নারী বলেই, হেনস্থা করা হয়। আমি হলফ করে বলতে পারি, সামাজিক নেটওয়ার্কে আসা কোনও মেয়েই, সে শিশু হোক, কিশোরী হোক, তরুণী হোক, যুবতী হোক, বৃদ্ধা হোক—কেউ অশ্লীলতা, অসভ্যতা, নোংরামি, ইতরামি, মানসিক অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। মেয়েদের আঘাত না করে পুরুষের যেন শান্তি নেই। এই অভিযোগ করলে পুরুষেরা সমস্বরে চিৎকার করে, তাদের দাবি, সব পুরুষ নারীকে হেনস্থা, নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি করে না, পুরুষ মাত্রই নারীকে সম্মান করে, যারা অসম্মান করে তারা পুরুষ নয়। কথাটা কি সত্যি? যারা নারীকে অসম্মান করে, যৌন নির্যাতন করে, তারা পুরুষ নয়? তারা তাহলে কী? সত্যি কথা হল, তারাও পুরুষ। চেহারা দেখে আমাদের উপায় নেই বোঝার কোন পুরুষ ধর্ষণ করবে, কোন পুরুষ করবে না। কথা শুনে, ব্যবহার দেখে, প্রোফাইল পড়েও আমাদের বোঝার উপায় নেই কে ভালো, কে ভালো নয়। সকলেই মুখোশ পরে থাকে। কোন পুরুষ খুন করবে, কোন পুরুষ করবে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে? সুখে ঘর সংসার করা বড় অফিসার-পুরুষদের দেখি স্ত্রীকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিয়েছে। এটা ঠিক, সব পুরুষ বর্বরতা করে না। কিন্তু সব পুরুষই কিন্তু বর্বরতা করার ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষমতা পুরুষতন্ত্র তাদের দিয়েছে। পুরুষেরা জানে তারা চাইলে বর্বরতা করতেই পারে, এতে কেউ তাদের একঘরে করবে না। তাদের অনেকে বর্বরতা করছে না, সেটার হয়তো কোনও কারণ আছে, কিন্তু খুব কম কারণই নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার কারণ।

    সমাজে একটি মেয়েকে যত হেনস্থা হতে হয়, অনলাইনে তার চেয়ে বেশি হতে হয়। অনলাইনে একটি মেয়ে শত লোক দ্বারা সহস্রবার ধর্ষিত হয়। এই ধর্ষণের কারণে একটি মেয়ে স্বস্তিতে তার কাজ করতে পারে না, লেখাপড়ায় মন বসাতে পারে না, তার গা ঘিন ঘিন করে, তার আত্মবিশ্বাস কমে শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়ে যায়। কোনও কোনও মেয়ে লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করে। অনলাইনের জীবনও বাস্তব জীবন। কারণ অনলাইনে যাদের সংগে দেখা হচ্ছে, বা কথা হচ্ছে, তারাও বাস্তবের রক্ত-মাংসের মানুষ। সে কারণে অনলাইনের জীবনকে তুচ্ছ করার কোনও উপায় নেই।

    আমি আমার ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করার অধিকার শুধু বন্ধু তালিকায় থাকা মানুষদের দিয়েছি। মাঝে মাঝে যখনই দুয়ার খুলে দিই, মন্তব্য করার অধিকার জনগণকে নির্বিচারে দিয়ে দিই… তখনই পুরুষের অশ্লীলতার বাঁধ ভেঙে যায়। মন্তব্যের পাতা উপচে পড়ে অশ্রাব্য গালিতে। ওইসব গালি পড়ে, এত দীর্ঘকাল পুরুষের অশ্লীলতা দেখে অভ্যস্ত আমিই মুষড়ে পড়ি, তাহলে কিশোরী তরুণী অথবা অনভ্যস্ত নারীদের মানসিক অবস্থার কী হয়, ভেবে শিউরে উঠি।

    একটা ভালো কাজ করা যায় না? অনলাইনেই পুরুষদের মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় না? কী করে নারীকে মানুষ ভাবতে হয়, তাদের অধিকারকে সম্মান করতে হয়, তা শেখানো যায় না? আলবৎ যায়। সেটিই করতে হবে। নারীকে যৌন হেনস্থা করা যে কতখানি বর্বরতা, নারীকে নির্যাতন করা যে কতখানি নির্বুদ্ধিতা… তা বোঝাতে হবে। অনেক কিশোরই আজ অনলাইনে। তারা ঘর থেকে, বিদ্যালয় থেকে, রাস্তাঘাট থেকে, টিভি কম্পিউটার থেকে নারীর সমানাধিকারের ব্যাপারে কোনও জ্ঞানার্জন করতে পারছে না। তাদের এবং নারীবিদ্বেষী পুরুষদের সকলকেই শেখানো হোক কী করে নারীকে যৌন বস্তু ভাবা বন্ধ করতে হয়, কী করে নারীকে হেনস্থা করা বন্ধ করতে হয়, কী করে নোংরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে বিদেয় করে দিতে হয়। মানুষ ক্রমশ নির্ভর করছে অনলাইনের ওপর। এখানেই ভবিষ্যৎ। এই জগৎটিতে যদি প্রতিনিয়ত নারীকে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে অপমান করা হয়, তবে নারীর কোনও সম্মান ভবিষ্যতের জগতেও নেই। অলৌকিক চরিত্রকে অসম্মান করলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মানুষকে গ্রেফতার হতে হয়, কিন্তু রক্ত-মাংসের লৌকিক চরিত্র নারীকে চূড়ান্ত অসম্মান করলেও, নিগ্রহ নির্যাতন করলেও কোনও আইনে তার শাস্তি নেই, সম্ভবত লৌকিক চরিত্রটি নারী বলে। নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পুরুষতন্ত্র নারীর ক্ষতি যতটা করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে পুরুষের ক্ষতি। পুরুষতন্ত্রের কারণে নারী হয়েছে অনুগত, বশ্য। আর পুরুষ হয়েছে হিংস্র, আর স্বার্থপর, নিষ্ঠুর আর বর্বর।

    ৮৩. থাপ্পড়

    আজকাল বাংলাদেশের খবরের কাগজে তালাকের খবর বেশ পড়ি। মিথিলার তালাক হয়ে গেছে, শমীর তালাক হয়ে গেছে, অপুর তালাক হয়ে গেছে, শাবনূরের তালাক হয়ে গেছে। তালাক হওয়ার পর আমরা জানতে পারি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। তালাকের আগে আমাদের কাছে মনে হত আদর্শ দম্পতি, সুখী দম্পতি। তাহলে কি আদর্শ সুখী দম্পতি বলতে কিছু নেই? নিশ্চয়ই আছে। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আদর্শ সুখী দম্পতির চিত্রটা এরকম—স্বামী সুখী, সুতরাং স্ত্রী পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী নিজেকে সুখী বলে মনে করে। আসলে সুখী হওয়ার ভান করে। সংসারে স্ত্রী যদি নিজের সব আশা আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে স্বামীর আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য যা কিছু করার করে—তাহলেই স্বামী সুখী। স্ত্রীদের মাথার ভেতরে জন্মের পর থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, স্বামীর সুখই স্ত্রীর সুখ। স্ত্রীর পৃথক অস্তিত্ব, পৃথক স্বপ্ন, পৃথক সুখ থাকার কোনও অর্থ হয় না। সত্যিকার সুখী হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই কোনও স্ত্রীর।

    গতকাল ‘থাপ্পড়’ নামে নতুন একটি হিন্দি ছবি দেখলাম। ঠিক এই বিষয়টিই ছবিতে বলেছেন পরিচালক অনুভব সিনহা। নিজের সব আশা আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে, খুব মন ঢেলে টুয়েন্টি ফোর সেভেন স্বামীর সেবা করছিল, শাশুড়ির সেবা করছিল, ঘর সংসার সামলাচ্ছিল এক শিক্ষিত মেয়ে। তারপর একদিন স্বামীর ভীষণ এক থাপ্পড় খেয়ে তার টনক নড়ে। সে যে নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করেছে অন্যের জন্য, যার থাপ্পড় খেতে হয়, যে কোনওদিন যার লাথিঝাঁটাও খেতে হতে পাবে—টনক নড়ে। তারপরই সে সিদ্ধান্ত নেয় স্বামীকে ত্যাগ করার, তাকে তালাক দেওয়ার।

    যারা হাউজওয়াইফ নয়, রীতিমতো স্বনির্ভর, তাদেরও অত্যাচার সইতে হয়। তারাও বাধ্য হয় স্বামীকে তালাক দিতে। সামান্য আত্মসম্মান যে নারীর আছে, সে নারীর পক্ষে সম্ভব নয় সেই পুরুষকে নিয়ে একসঙ্গে বাস করা, যে পুরুষ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ঘোর বিশ্বাসী। আসলে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো এই মন্ত্র দিয়েই একটি ছেলেকে বড় করে যে, সে রাষ্ট্রের, সমাজের, এবং পরিবারের অমূল্য সম্পদ। সুতরাং অমূল্য সম্পদকে দেখভাল করার দায়িত্ব পড়ে বাড়ির মেয়েদের ওপর। এর ফলে মেয়েরা চিহ্নিত হয় সম্পদের সেবিকা হিসেবে, সম্পদ হিসেবে নয়। এই অমূল্য সম্পদ যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন সে চোর হোক গুণ্ডা হোক, তাকে দেখভাল করার দায়িত্ব পড়ে স্ত্রীর ওপর। স্ত্রী স্বনির্ভর হোক, পরনির্ভর হোক, দায়িত্ব একই।

    যে স্বামী অত্যাচারী, মানসিক পীড়নকারী বা যে স্বামী স্ত্রীকে ভালোবাসে না, অবজ্ঞা করে, তুচ্ছ করে, বাড়ির চাকরবাকর ছাড়া, সন্তানের জন্মদাত্রী বা লালনপালনকারী ছাড়া কিছু মনে করে না, সেই স্বামীকে তালাক দিচ্ছে তারাই, যারা আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চায়। আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার ইচ্ছে খুব কম নারীরই আছে। জন্মের পর থেকে তাদের এভাবেই বড় করা হয় যেন আর যা কিছুই থাক, আত্মসম্মান বলে জিনিসটা না থাকে। পুরুষের যে জিনিস থাকা ভালো, নারীর সে জিনিস থাকা খারাপ। পুরুষের আত্মসম্মান থাকতে হবে, নারীর আত্মসম্মান থাকা চলবে না। পুরুষের রাগ থাকেই, নারীর রাগ থাকলে চলবে না। পুরুষকে সংসারী হওয়ার দরকার নেই, নারীকে সংসারী হতে হবে। পুরুষের জন্য রান্নাবান্না, সন্তান লালন পালনের প্রশ্ন ওঠে না, নারীকে সেসব করতেই হবে। পুরুষকে চালাক চতুর হতে হবে, নারীকে অত চালাক চতুর হওয়া মানায় না। পুরুষকে কর্মস্থলে উন্নতি করতে হবে, উন্নতির পেছনে নারীর না দৌড়োনোই উচিত। পুরুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যৌথ-জীবনে কী করতে হবে না হবে, নারীকে পুরুষের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। পুরুষ অথবা নারীকে কাউকে যদি জব করা বা বাড়ির বাইরে কাজ করা ছাড়তে হয়, তাহলে কার দিকে আঙুল তোলা হয়, কাকে ছাড়তে হয় সব, ঘরে বসে ঘর-সংসার দেখার, সন্তান লালন পালন করার কাজটি কাকে দেওয়া হয়? নারীকে দেওয়া হয়, টাকা উপার্জনের দায়িত্বটি, ক্ষমতার দায়িত্বটি নিঃসন্দেহে পুরুষকে।

    থাপ্পড় ছবিতে অনুভব সিনহা বলেছেন, আত্মসম্মান নিয়ে যদি বাঁচতে চাইতো মেয়েরা, তাহলে অর্ধেকের চেয়ে বেশি মেয়ে স্বামীকে ত্যাগ করতো। সংসারগুলো টিকে আছে, আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে মেয়েরা শেখেনি বলে, এবং চায় না বলে।

    বাংলাদেশে দেখছি কিছু নায়িকা বা গায়িকা তালাক দিচ্ছেন স্বামীকে। উচ্চপদে কর্মরত নারী বা স্বাবলম্বী কিছু নারীই এই সাহস দেখিয়েছেন। যদি আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইতো, যদি শুধু পুরুষের মতো মেয়েরাও নিজেদের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন সাধ পূরণকে অগ্রাধিকার দিতো, তাহলে প্রায় সব মেয়েকেই হয়তো সংসার ত্যাগ করতে হত। পুরুষতান্ত্রিক নিয়মে চলা একটি সংসারও বৈষম্যহীন নয়। এই নিয়মকে ভেঙে ফেললে কিন্তু ঠিকই বৈষম্যহীন সম্পর্ক তৈরি করা যায়। নারী পুরুষ দুজনই নিজেদের স্বপ্ন সাধ পূরণ করার চেষ্টা করবে। সংসারে ঘর গোছানো, বাড়ি পরিষ্কার, রান্নাবান্না, শিশু পালন, বাগান চর্যা ভাগাভাগি করে করবে। এই কাজগুলোকে ছোট কাজ বলে ভাবা হয়, যেহেতু এই কাজগুলো মেয়েরা করে। করুক পুরুষেরা, কাজের মূল্য যাবে বেড়ে।

    আমি যখন তালাক দিয়েছিলাম, একা থাকতে শুরু করেছিলাম, লোকে ছি ছি করেছে। গত তিরিশ বছরে লোকেরা আরও কিছু তালাক দেখেছে, অনেকটাই অভ্যস্ত হয়েছে। আমাকে যে ভাষায় গালাগালি করেছে আশির দশকে, এখন সে ভাষায় গালাগালি করা বন্ধ করেছে। তবে গালাগালি যে একেবারে থেমে গেছে তা নয়। মানুষ যত সভ্য হবে, তত অভ্যস্ত হবে তালাকে।

    মানুষ যখন বিয়ে করে, তখন যে রকম জীবন মনে মনে চায়, তা না-ও পেতে পারে। শুধু নারী নয়, পুরুষের চাওয়া পাওয়াও ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। আমি আমার বড় দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রেই দেখেছি, নিষ্ঠুর নির্মম স্ত্রী নিয়ে জীবন যাপন করেছে। এমন উদাহরণ খুব কমই দেশে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরাই ভোগে। মেয়েরাই চুপ থাকে। মেয়েরাই সহ্য করে। মেয়েরাই বিসর্জন দেয়। মেয়েরাই ত্যাগী হয়। মেয়েরাই থাপ্পড় খায়। শুধু স্বামীর নয়, সবার।

    নারীবাদী নেত্রী সুসান বি এন্থনী বলেছিলেন স্বামীকে স্ত্রীর তালাক দেওয়া অনেকটা বর্বর প্রভুর কাছে থেকে ক্রীতদাসীদের মুক্তি পাওয়ার মতো। ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হলে আমরা খুশি হই। কিন্তু স্ত্রী যখন স্বামীকে ত্যাগ করে চলে আসে, আমরা খুশি হই না কেন? এই প্রশ্নটি একটি বড় প্রশ্ন। এখানেই লুকিয়ে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মেনে চলার জন্য সবারই মগজধোলাই হওয়া মগজ। ধোলাই হওয়া মগজকে ধোলাই হওয়ার আগের অবস্থায় ফেরত নিতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।

    সোজা কথা এবং সাফ কথা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বৈষম্যহীন পরিবার তৈরি করা সম্ভব নয়। যদি সম্ভব কেউ করতে চায়, তবে তাদের ব্যক্তিগতভাবে সম্পূর্ণ পুরুষতন্ত্র-মুক্ত হতে হবে। পুরুষতন্ত্র জিনিসটাই নারী পুরুষের বৈষম্যকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই বৈষম্যকে বিদেয় করতে হলে সম্মিলিত সংগ্রামের যেমন প্রয়োজন, তেমন পুরুষতন্ত্রের গন্ধস্পর্শহীন ব্যক্তিগত জীবনও যাপন করা প্রয়োজন।

    যে স্ত্রীরা একবার নির্যাতন সহ্য করে, তারা কিন্তু বার বার নির্যাতন সহ্য করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যার এক থাপ্পড়ে টনক নড়ে না, তার শত থাপ্পড়েও টনক নড়ে না। বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের টনক নড়াটা খুব জরুরি। পুরুষতন্ত্রের নাগপাশ থেকে শুধু নারীকে নয় পুরুষকেও বের হয়ে আসতে হবে। বৈষম্যে ভরপুর একটা পচা পুরোনো সমাজ ব্যবস্থা আঁকড়ে পড়ে থাকা পুরুষের জন্যও সম্মানজনক নয়।

    ৮৪. নির্বাসনের ২৬ বছর

    আমার দাদা সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতো, কবিতা লিখতো। দেখে দেখে আমিও ১৩ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখতে শুরু করি। আরেকটু বড় হয়ে আমিও সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করি। এইভাবেই বিজ্ঞানের ছাত্রী শিল্প সাহিত্যের মধ্যে সময় এবং সুযোগ পেলেই ডুবে যেতাম। বইপোকা বলে সুনাম বা দুর্নাম ছিল ছোটবেলা থেকেই। মেডিক্যাল কলেজে একসময় পড়ার চাপ এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে আমাকে সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশনা স্থগিত রাখতে হয়েছিল। ডাক্তার হওয়ার পর, হাসপাতালের চাকরির ব্যস্ততার মধ্যেও লিখতে থাকলাম কবিতা প্রবন্ধ, গল্প উপন্যাস। সেগুলো বই হয়ে বেরোতে লাগলো। নিয়মিত কলাম ছাপা হতে লাগলো জাতীয় সাপ্তাহিকগুলোয়। লেখাগুলো প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিল, বইও ছিল বেস্ট সেলার লিস্টে, কিন্তু নারীর সমানাধিকারের পক্ষে আমার লেখাগুলো বাংলাদেশের নারীবিদ্বেষী সমাজের কর্তারা অবশ্য ভালো চোখে দেখলেন না। সব ধর্মই নারীর সমানাধিকারের বিরুদ্ধে—এ কথা লিখেছি বলে সব ধর্মের ঘোর বিশ্বাসীরা আমার ওপর ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। ইসলামের সমালোচনা করেছি বলে মুসলিম মৌলবাদীরা সারা দেশে আমার ফাঁসি চেয়ে বড় বড় মিছিল মিটিং শুরু করলো। মোল্লা মুফতিরা আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে শুরু করলো। রাজনৈতিক দলগুলো আমার পাশে না দাঁড়িয়ে দাঁড়ালো নারী বিদ্বেষী মোল্লা মৌলবিদের পাশে। সমাজের মানবাধিকার সংগঠনগুলো, এমনকি নারীবাদী দলগুলোও চুপ হয়ে রইলো। এমন সময় সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির মামলা করলেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল। জীবন বাঁচাতে আমাকে দু’মাস লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। দেশের আনাচেকানাচে পুলিশ আমাকে খুঁজছে, মোল্লারা আমাকে খুঁজছে মেরে ফেলার জন্য। সে সব ভয়াবহদিনগুলোর কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠি। শেষ অবধি ১৯৯৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সরকার আমাকে বের করে দেয় দেশ থেকে।

    সেই থেকে পড়ে আছি দেশের বাইরে। আজ ২৬ বছর পার হল। জীবন এভাবেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই বিদেশ বিভুঁইয়ে একদিন মরে পড়ে থাকবো। যখন দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি ওই যাওয়াই আমার শেষ যাওয়া। আমি কল্পনাও করতে পারিনি, দেশের কোনও সরকারই আমাকে আর কোনওদিনই দেশে ফিরতে দেবে না। ধীরে ধীরে আমার কাছের মানুষগুলো এক এক করে মরে যাবে, আমার মা, আমার বাবা, আমার নানি, প্রিয় খালারা, প্রিয় মামারা, আমার দাদারা, আমার শিক্ষকেরা, যাদের ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম। আমি কল্পনাও করতে পারিনি আমি কারও কাছে একটিবারের জন্যও যেতে পারবো না। কাউকে শেষবারের মতো দেখতে পাবো না।

    নির্বাসিত জীবনে কত কিছু ঘটেছে। পশ্চিম ইউরোপ আমাকে নিয়ে এক যুগ উৎসব করেছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়েছে, নাগরিকত্ব দিয়েছে, মান মর্যাদা দিয়েছে। যেখানেই গিয়েছি, আমাকে দেখার জন্য, আমার কথা শোনার জন্য উপচে পড়েছে মানুষ। বিভিন্ন দেশের প্রকাশকেরা আমার বই বিভিন্ন ভাষায় ছাপিয়েছেন। এত নাম এত খ্যাতি,—কিন্তু সব ছেড়ে আমি দেশে ফিরতে চেয়েছি। দেশের দরজা বন্ধ বলে এক সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাস করতে শুরু করেছি। কিন্তু রাজনীতি আমাকে বাধ্য করেছে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারত ত্যাগ করতে। এই যে আমাকে তাড়ানো হয় দেশ থেকে, রাজ্য থেকে, শহর থেকে, পাড়া থেকে, ঘর থেকে—২৬ বছরে আজও পায়ের তলায় মাটি নেই—তারপরও কিন্তু আমি দমে যাইনি, হতাশায় ভেঙে পড়িনি। যতবারই আমাকে লাথি মারা হয়েছে, ততবারই উঠে দাঁড়িয়েছি। মুক্তচিন্তার জন্য, আর মানবাধিকারের জন্য আমার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছি। শত দুঃসময়েও আমি এক চুল বিচ্যুত হইনি আমার আদর্শ থেকে। আমাকে একটা ইসলাম- বিরোধী ট্যাগ দিয়ে ধুরন্ধর রাজনীতিকরা রাজনীতি করেছেন আমাকে নিয়ে। আমি যে মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি, সে কথা বলতে অনেকের আপত্তি। মানবাধিকারের পক্ষে লেখা আমার ৫টি বই বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। বই নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে, বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি লোকও মুখ খোলে না দেশটিতে। দেশটি ক্রমে ক্রমে ইসলামী মৌলবাদীদের দাপট বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সরকারও নিষিদ্ধ করেছিল একটি বই। নিষেধাজ্ঞার দু’বছর পর সেটিকে অবশ্য হাইকোর্ট মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা কেন জারি করেছিল সরকার? কাউকে কি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে দেওয়া হবে না?

    আমি ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও ভারতকে বেছে নিয়েছি বাস করার জন্য। আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না, তাই ধর্মের কারণে হওয়া ভারত ভাগেও আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। ভারতকে নিজের দেশ ভাবতে আমার কোনও অসুবিধে হয় না। আমি তো ভারতেরই অনেকগুলো ভাষার একটি ভাষায় লিখি, কথা বলি। যেখানেই বাস করি, নারীর সমানাধিকারের জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লিখে যাবো, গণতন্ত্রের পক্ষে, বাকস্বাধীনতার পক্ষে, বৈষম্যহীন সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য লিখে যাবো, মানবতার জন্য লিখে যাবো, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হবো। এতে আমার মাথায় চাপাতির কোপ পড়বে তো, পড়ুক।

    ২৬ বছর নির্বাসনে আছি। কী দোষ করেছিলাম আমি ? মানবতার পক্ষে লেখালেখি করেছি এটিই আমার দোষ। শুধু কি তাই! এখনও ফতোয়া দেওয়া হয়, এখনও হুমকি আসে, এখনও পায়ের তলার মাটি সরে যায়! আর কত অনিশ্চয়তা, আর কত দুর্ভোগ পোহাতে হবে আমাকে? আসলে বেশ বুঝি, পৃথিবীর কোনও দেশই আমার দেশ নয়। আমার ভাষাটিই আমার দেশ, যে ভাষায় আমি কথা বলি, লিখি। আমার কাছ থেকে আমার যা কিছু ছিল, ধন দৌলত সব কেড়ে নেওয়া হল, ভাষাটি আশা করছি কেউ চাইলেও কেড়ে নিতে পারবে না।

    ২৬ বছর দীর্ঘ সময়। আমার ওপর নির্বাসনই শুধু নয়, ভারতেও বই নিষিদ্ধ হয়েছে, ব্ল্যাক লিস্টেড হয়েছি, গৃহ বন্দিত্ব জুটেছে, ফতোয়া জুটেছে, শুধু বই নয় নিজেও নিষিদ্ধ হয়েছি বিভিন্ন শহরে আর রাজ্যে, শারীরিক হামলা হয়েছে আমার ওপর, মানসিক তো অহর্নিশি হচ্ছেই। আমার লেখা ছাপানো বন্ধ করেছে মিডিয়ার বড় একটি অংশ, সাংঘাতিকভাবে সেন্সরের শিকার হয়েছি, রাজনৈতিক খুনের শিকার হতে হতে বেঁচে গিয়েছি। সোজা কথা, সুতোর ওপর বিপজ্জনক হাঁটা হাঁটছি। তারপরও এই ভারতেই থাকবো বলে পণ করেছি। কারণ ভারত অন্তত বলতে পারবে, বাকস্বাধীনতার মর্যাদা উপমহাদেশের একটি দেশ হলেও দেয়। ভারত ভিন্ন মতকে ফাঁসি দেয় না, জেলও পোরে না, বরং নিরাপত্তা দেয়। সত্যিকার গণতন্ত্র তো একেই বলে।

    ৮৫. আমাদের বাকস্বাধীনতা

    সেই দিনগুলো দুঃস্বপ্নের মতো আজও। মনে পড়ে কী করে আমাকে প্রথমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তারপর রাজস্থান থেকে, তারপর পুরো ভারত থেকেই তাড়ানো হয়েছিল। কী করে আমাকে গৃহবন্দি করা হয়েছিল। কী ভীষণ অনিরাপদ ছিলাম আমি রাষ্ট্রের ‘নিরাপদ গৃহে’। সরকার আমাকে ছলে-কৌশলে দেশ থেকে তাড়াতে চাইছে, আর আমি অসহায় এক নির্বাসিত লেখক—যার পাশে কোনও রাজনৈতিক দল নেই, সংগঠন নেই, সাধারণ কিছু মানুষ ছাড়া নামী দামি মানুষ নেই—একা বিশাল এক রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে অনড় দাঁড়িয়ে থেকেছি, সরকারি কোনও উপদেশ বা আদেশ মানিনি, শুধু মনোবল ছাড়া আর কিছুই ছিল না সম্বল। আমি কোনও অন্যায় করিনি, আমি কেন শাস্তি পাবো! পৃথিবীর সন্তান আমি, ভালোবেসে যে দেশটিতে বাস করতে চাইছি, সে দেশটিতে বাস করার কেন আমার অধিকার থাকবে না! সেক্যুলার গণতন্ত্র বলে দাবি করছে যে দেশ, সে দেশ কেন একজন সৎ. সাহসী আর সেক্যুলার লেখককে দেশ থেকে তাড়াবে, কিছু নারীবিরোধী, অসৎ আর অসহিষ্ণুমৌলবাদীকে খুশি করার জন্য!

    একসময় জীবন বাঁচাতে ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম বটে, কিন্তু শত নিষেধ, শত বাধা, শত তাণ্ডব, আর শত হুমকি সত্ত্বেও ফিরে এসেছি ভারতে। ভারত ছাড়া আমার উপায় নেই বলে নয়, ভারত যেন মুক্তচিন্তাকে সম্মান করে, সে কারণে। আমি আমার মত প্রকাশ করবো, সে মত অন্যের মতের চেয়ে ভিন্ন হোক, এবং ভারতে বাস করবো। ভারতকে দেখে যেন শেখে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো যেন অনুপ্রাণিত হয় তারা, যারা এখনও জানে না বাকস্বাধীনতা ঠিক কাকে বলে। এখনও যে আমি খুব নিশ্চিন্তে বাস করি ভারতবর্ষে তা নয়। এখনও মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছি। কলকাতার এক ইমাম আমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়ে আমাকে অপদস্থ করার মূল্য কুড়ি হাজার ঘোষণা করেছিলেন, তারপর মাথার মূল্য ধার্য করেছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা, এরপর তো বলেই ফেললেন ‘আনলিমিটেড অ্যামাউন্ট অব টাকা দেবেন আমার মুণ্ডুটি যে কেটে নিয়ে যেতে পারবে, তাকে। উত্তরপ্রদেশ থেকে মুসলিম ল’ বোর্ডের এক পরিচালক ঘোষণা করেছিলেন পাঁচ লক্ষ টাকা। নতুন ফতোয়া তো আগের চেয়ে ভয়ংকর। কেরালার আইসিস গোষ্ঠী ফেসবুকে ঘোষণা করেছিল আমাকে যেন অতি শীঘ্র মেরে ফেলা হয়। পার্লামেন্টে একজন বড় নেতা তো ধর্ম সম্পর্কে কবে কোথায় আমি কী বলেছি, তা নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ। বলে দিয়েছেন ধর্ম সম্পর্কে আমি যেন ভারতীয় কোনও মিডিয়ায় আমার মত প্রকাশ করার সুযোগ না পাই। সরকার কোথায় মৌলবাদীদের রুখবে তা নয়তো মৌলবাদীদের দাবিই এক এক করে মেটায়। আমার বই নিষিদ্ধ করা, আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়ানো, পত্র পত্রিকায় আমার লেখালেখি বন্ধ করা, টিভিতে আমার মেগা সিরিয়ালের প্রচার বন্ধ করে দেওয়া, ভারত থেকে আমাকে তাড়ানো এসবের পেছনে আছে ভোটব্যাংকের হিসেব, মৌলবাদীদের চোখ রাঙানিকে ভয় অথবা তাদের তোষণ। এই তোষণের রাজনীতি গণতন্ত্রকে বড় দুর্বল করে দেয়। রাজনীতিকরা কি জানেন না যে ধর্মীয় মৌলবাদীরা সমাজকে অন্ধকারে ফেলে রাখতে চায়, তারা নারীর অধিকারে তো নয়ই, মানবাধিকারেই বিশ্বাস করে না, তাদের মতের সঙ্গে যারা একমত নয়, তাদের বাক স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাস করে না। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান—সব মৌলবাদীদের চরিত্র কিন্তু একই। তারা সকলেই কিন্তু মুক্তচিন্তার বিরোধী।

    পৃথিবীতে শুধু আমি নই, আরও অনেক লেখককে সইতে হচ্ছে নির্যাতন। লেখককে চাবুক মারা হচ্ছে, জেলে ভরা হচ্ছে। নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে অথবা মেরে ফেরা হচ্ছে। বাকস্বাধীনতার গুরুত্ব এখনও একনায়করা তো নয়ই. অধিকাংশ গণতান্ত্রিক সরকারও বুঝতে চায় না। বাকস্বাধীনতার কথা বলতে গেলে অনেককে বলতে শুনি, এটির একটা সীমা আছে। বাকস্বাধীনতা মানে কারও অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া নয়। কখনও কারও অনুভূতিতে কোনও আঘাত লাগবে না—এভাবে সারাজীবন বাঁচতে চাওয়ার দাবি করাটা খুব অদ্ভুত। অন্যের কথায় এবং কাজে আমাদের সবার মনে অহরহই আঘাত লাগছে। মনে আঘাত লাগবেই, কারণ সমাজে নানা মানসিকতার মানুষ বাস করে। কারও মতের সঙ্গে নিজের মত না মিললে যদি অনুভূতিতে আঘাত লাগে, সে আঘাতকে পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের সবারই থাকে। শুধু কিছু কট্টর লোক অনুভূতির আঘাতকে সহ্য করবে না বলে চারদিকে অশান্তি করছে।

    গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে যায় যদি মানুষের বাকস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকার না থাকে। সমাজ বদলাতে হলে নানান লোকের নানান অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কারও কোনও অনুভূতিতে আঘাত দিতে না চাইলে সমাজটাকে বদলানো যাবে না। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে গেলে বা নারীবিরোধী আইন দূর করতে গেলেও মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। ধর্মানুভূতিতে আঘাত না দিয়ে খুব বেশি ভালো কাজ আজ অবধি সমাজে হয়নি। ইউরোপ থেকে গির্জার দুঃশাসন বন্ধ করার সময়ও প্রচুর লোকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছিল। গ্যালিলিওর কথায়, ডারউইনের ভাষ্যে লোকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কুসংস্কাচ্ছন্ন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কিন্তু তাদের আঘাত লাগবে বলে যদি আমরা মত প্রকাশ করা বন্ধ করে দিই, যদি আমরা বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিই, সভ্যতার চাকাকে থামিয়ে রাখি, তবে সমাজটাকে স্থবির জলাশয় হিসেবেই রেখে দিতে হবে, একে আর স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতস্বিনী করে গড়ে তোলা হবে না আমাদের। যে কথা সকলে শুনতে পছন্দ করবে, সেই কথাই যদি বলতে হয় তাহলে মত প্রকাশের অধিকারের কোনও প্রয়োজন পড়ে না। বাকস্বাধীনতা একমাত্র তাদের জন্যই, যাদের মতের সঙ্গে অধিকাংশ লোকের মত মেলে না। যে কথাটা তুমি শুনতে চাও না, সে কথাটি বলার অধিকারের নামই বাকস্বাধীনতা। বাকস্বাধীনতা তাদের দরকার নেই যাদের মত শুনে কেউ মনে আঘাত পায় না। বাকস্বাধীনতার পক্ষে না থেকে যখন সরকার বাকস্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষ নেয়, তখন নিজের দেশটার ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে।

    ভারতের মত-প্রকাশ-বিরোধী কয়েকটি কালো আইনের একটি বাতিল করার লড়াইয়ে হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে ছিলাম আমিও। এই আইনটির কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। আমারও হয়েছে। নারীবিরোধী-ও-মানবতাবিরোধী-ধর্মান্ধদের তথাকথিত ধর্মানুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে, সে কারণে জগত সজাগ। এখনও কি জগতের সময় হয়নি সবাইকে সমান চোখে দেখার! ধর্মান্ধদের বাড়তি খাতির না করার! যুক্তিবাদীদের মানবাধিকারকে সম্মান করার!

    শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এই লড়াই চলছে। লড়াইটা কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নয়, এই লড়াই দুটো মতবাদের মধ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মৌলবাদ। লড়াইটা বিজ্ঞানমনস্কতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে, যুক্তিবাদিতা আর কুসংস্কারের মধ্যে, জ্ঞান আর অজ্ঞানতার মধ্যে, সচেতনতা আর অচেতনতার মধ্যে, স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মধ্যে। এই লড়াইয়ে আমি জানি, আমি কোন পক্ষ। বিপক্ষের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে আমি, কিন্তু তার মতকে মেনেও নিতে চাই না, শ্রদ্ধাও করতে চাই না। তার মানে এই নয় যে ভোরবেলায় বিপক্ষের কেউ যখন মর্নিং ওয়াকে বেরোবে, আমি তাকে গুলি করে মারবো বা সে যখন ফুটপাতে হাঁটতে থাকবে, তাকে আমি চাপাতি চালিয়ে খুন করবো। না, কারও মত আমার অপছন্দ হলে তাকে আমি চুমু খাবো না, তার গালে আমি চড়ও দেবো না। আমি লিখবো। লিখে আমি আমার মত প্রকাশ করি। কারও যদি আমার লেখা পছন্দ না হয়, লিখে আমার লেখার প্রতিবাদ করতে পারেন, আমার মতের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করতে পারেন, কিন্তু আমাকে মারতে আসতে পারেন না। বাকস্বাধীনতার এই শর্তটি আজকাল অনেকেই জানেন। জানলেও কিছু কিছু মৌলবাদী-সন্ত্রাসী এই শর্তটি মোটেও মানতে চান না।

    এভাবে কি ধর্ম টিকে থাকে? পৃথিবীতে শত শত ধর্ম ছিল। এখন তারা বেশিরভাগই বিলুপ্ত। কোথায় আজ অলিম্পিয়া পাহাড়ের সেই ডাকসাইটে গ্রীক দেবতারা, কোথায় শক্তিশালী রোমানদের নামীদামি ঈশ্বর? কোথায় মিশরীয় ফারাওদের ঈশ্বর? সব আজ ইতিহাস। ইসলাম, ক্রিশ্চান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মও একসময় ইতিহাস হবে। যুগোপযুগি নতুন ধর্ম আসবে অথবা যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানমনস্কতায় মানুষের বিশ্বাস বাড়বে।

    এভাবেই হয়তো চলবে পৃথিবী। অশিক্ষা, জড়তা আর মূর্খতা চলবে শিক্ষা আর সচেতনতার পাশাপাশি। ধর্মান্ধ আর রাজনীতিক নিজেদের স্বার্থ দেখবে, সমাজটাকে অন্ধকারেই ফেলে রাখবে, শুধু সুস্থ সচেতন মানুষই সমাজ পাল্টাবে। হাতে গোণা কিছু মানুষই সমাজ পালটায়। চিরকাল তাই হয়েছে।

    শুধু মত ভিন্ন হওয়ার কারণে পৃথিবীর আর কারও যেন নির্বাসন দণ্ড ভোগ করতে না হয়। আর কাউকে যেন আমার মতো ভুগতে না হয়।

    ৮৬. দেশটাকে রক্ষা করবে কে?

    —গণতন্ত্রে কী থাকতে হয়? বাকস্বাধীনতা থাকতে হয়। ঠিক না বেঠিক?

    —ঠিক।

    —বাংলাদেশে কি বাকস্বাধীনতা আছে? আছে কি নাই? চিল্লাইয়া বলেন।

    —নাই।

    ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে আজ থেকে ২৫ বছর আগে দেশের একজন নারীবাদী লেখককে বাংলাদেশ সরকার নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। নারীবিরোধী মৌলবাদী অপশক্তিকে খুশি করার জন্য পাঠিয়েছিল। সরকার বদলেছে, মৌলবাদী অপশক্তির সঙ্গে আপসের বদল হয়নি। আজ অবধি সেই লেখককে দেশে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আজও ফতোয়াবাজ ধর্মব্যবসায়ীদের, আজও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানবাধিকারবিরোধীদের তুষ্ট করে চলতে হয় দেশের সরকারকে। দেশের সরকার মনে হচ্ছে এই অপশক্তির হাতে জিম্মি।

    কয়েক বছর যাবৎ দেশের বুদ্ধিদীপ্ত মুক্তচিন্তকদের এক এক করে কুপিয়ে মেরেছে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা। এই সন্ত্রাসীদের আজও বিচার হয়নি। যে কেউ যে কোনও কিছুতেই যে কারও বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে বলে চেঁচিয়ে উঠছে। পচা পুরোনো একটা আইন দেখিয়ে মুক্তবুদ্ধির শিক্ষিত সচেতন নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসাচ্ছে সরকার। জেলে ভরছে। ভিন্নমত যাঁদেরই ছিল, যাঁরাই সমাজের সংস্কার চেয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি করেছেন, ভয়ে দেশ থেকে পালিয়েছেন।

    কারা তাহলে দেশে বাস করবে? দেশ কাদের? এক পাল চাটুকার, আর অশিক্ষিত অসভ্য মোল্লা হুজুর, আর তাদের অসংখ্য বুদ্ধিসুদ্ধিহীন শিষ্য? সরকার কি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নয়? অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে বটে, কিন্তু নৈতিক অবনতি যে হচ্ছে? যদি শিক্ষা-সংস্কৃতিই না থাকে, যদি আধুনিকতা- সভ্যতাই না থাকে, তাহলে টাকাপয়সা দিয়ে কী করবে মানুষ।

    দেশের টাকাপয়সা সহায় সম্পদ লুঠ করে দেশপ্রেমিকরা নাকি বেশ পালাচ্ছে আজকাল। বিদেশে পাকাপাকিভাবে বাস করার সব আয়োজন সারা। ইউরোপ আমেরিকার প্রাসাদে এক একজন সুখে শান্তিতে বাস করবে। ধর্ম কর্মও করবে নিশ্চয়ই। পাপমোচনের জন্য তো হজ্বে যাবেই।

    সুফি সংগীত, পালাগান, বাউল ভাটয়ালি মুর্শেদি গাওয়ার লোকেরাই বোধহয় বাকি ছিল। এদের গর্দান নেওয়ার জন্য তৈরি ধর্মের তলোয়ার। নিরীহ গোবেচারা শরিয়ত বয়াতিকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। রিতা দেওয়ান নামে এক সুফি বাউলের ওপর আক্রমণ চলছে। তিনি তাঁর মতো করে গান গেয়েছেন, গান গাওয়ার আগে তাঁর মতো করে আধ্যাত্মিক বয়ান দিয়েছেন। তাঁর আধ্যাত্মিক বয়ান ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের পছন্দ হয়নি, তার তারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। রিতা দেওয়ান এই বর্বরদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, ভয়ে তটস্থ তাঁর দুটি মেয়েও হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছে। কী নিদারুণ সেই দৃশ্য। একজন শিল্পীকে ক্ষমা চাইতে হয় তাঁর শিল্পের জন্য। তাঁর অসহায়তা আর নিরাপত্তাহীনতা আমি হাড়ে মজ্জায় উপলব্ধি করেছি। চোখে জল এসেছে আমার। হ্যাঁ জল এসেছে আমার চোখে। আমার মনে হয়েছে রিতা দেওয়ান আমার বাংলাদেশ। আমার বাংলাদেশকে এক পাল ধর্ষক- খুনীর সামনে নতজানু হয়ে হাত জোড় করতে হয়েছে, কাতর অনুনয় করতে হয়েছে যেন তাকে বাঁচতে দেয়।

    বাংলাদেশকে ওরা নিজের মতো করে বাঁচতে দেয়নি। দেশের মেয়েদের যেভাবে পাক সেনারা ধর্ষণ করেছিল একাত্তরে, পাক সেনাদের এদেশি ভক্তরা দেশকে সেভাবে ধর্ষণ করছে আজ অনেক বছর।

    সুফি সংগীতশিল্পী রিতা দেওয়ানের বক্তব্য আমি শুনেছি, ওয়াজিদের আস্ফালনও শুনেছি, রিতা দেওয়ানের ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্যও আমি দেখেছি। শরিয়ত বয়াতির বক্তব্যও আমি শুনেছি। আমি বুঝে পাই না, কী কারণে এই সুফি সাধকদের গ্রেফতার করা হল। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। কে কিভাবে তার ঈশ্বরকে কল্পনা করে নেবে, সেটা সম্পূর্ণই তার ব্যাপার। আমার কল্পনার সংগে তার কল্পনা না মিললে সে দোষী—এরকম যে ভাবে, তাকে নিশ্চয়ই আমরা অসহিষ্ণু বলবো। অসহিষ্ণুতে ছেয়ে গেছে গোটা দেশ।

    আহমদীয়ারা মুসলমান নয়,—এই ফতোয়া দিচ্ছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। সমকামীদের হত্যা করো, সুফিদের খতম করো, নাস্তিকদের কতল করো— হুমকি দিয়েই যাচ্ছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে যারা এই হুমকি দেয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার, কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করি সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং ওদের সুরে সুর মেলাচ্ছে। ওদের সুরে সুর মিলিয়ে মুক্তচিন্তক প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।

    কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের সংস্কৃতিবান মানুষ বাংলাদেশ বাস করতে চায় না। তারা সুযোগ পেলেই দেশ ছাড়ছে। যারা আজও দেশে বাস করছে, তারা বাধ্য হয়ে বাস করছে। তাদের আর কোনও উপায় নেই বলে বাস করছে। এটি দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক নয় কি? যদি শিক্ষিত সভ্য বুদ্ধিমান প্রতিভাবান কেউই দেশে বাস করতে না চায়, সুযোগ পেয়েই দেশ ত্যাগ করে, দেশ তবে কাকে নিয়ে সমৃদ্ধ হবে? বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই।

    হয় তোমাকে সরকারের চাটুকার হতে হবে, তা না হলে মরতে হবে। হয় তোমাকে ধর্মান্ধ হতে হবে, মৌলবাদী হতে হবে, তা না হলে মরতে হবে। তুমি স্বাধীনতা এবং অধিকার নিয়ে ভাবো, হয় তোমাকে মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে, তা না হলে তোমাকে মরতে হবে।

    বাংলাদেশে মুখ বন্ধ করে থাকা, পালিয়ে যাওয়া, জেলে যাওয়া, নির্বাসনে যাওয়া, মরে যাওয়া গোষ্ঠীটির নাম সভ্যতা, আর চেঁচানো দাপিয়ে বেড়ানো ক্ষমতাবান গোষ্ঠীটির নাম অসভ্যতা। অসভ্যতার জয় জয়কার এখন। সরকারের কাছে সুস্থ চিন্তার চেতনার মানুষের আবেদন, বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি লোকগীতি পালাগান কবিগান বাউল ভাটিয়ালি ভাওয়াইয়া আধ্যাত্মিক গানকে বেঁচে থাকতে দিন, প্রগতিশীল প্রতিভাবান সংস্কৃতিবানদের বেঁচে থাকতে দিন। বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে বিজাতীয় ওয়াজ সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করা হচ্ছে। এটিকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে মোল্লাতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়া। এরাই দিন দিন বিকট আকার ধারণ করছে। এরাই গণতন্ত্রের কবর খুঁড়ে বসে আছে, এরাই একে কবর দেবে। নারীনেত্রীত্বের বিরুদ্ধে এরাই দেশ জুড়ে তাণ্ডব করবে। কয়েক যুগ এদের সঙ্গে সরকারের আপোস, কয়েক যুগ বুদ্ধিজীবীদের মুখ বুজে থাকা অথবা স্বার্থান্বেষী চাটুকারে রূপান্তরিত হওয়া—দেশকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে। এই অন্ধকার থেকে আলোয় আসা এখন খুব কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি কার দ্বারা সম্ভব অনেকের মতো আমারও জানা নেই।

    আজ শরিয়ত বাউলকে জেল থেকে মুক্ত করার এবং নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। আজ রিতা দেওয়ানকে নিরাপত্তা দেওয়ার এবং মুক্ত কণ্ঠে তাঁকে পালাগান গাওয়ার পরিবেশ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। বাংলার বাউলরা যেন মন খুলে গান গাইতে ভয় না পান। যারা ভয় দেখায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে।

    বাকস্বাধীনতার এবং মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে দেশে যত আইন আছে, সবগুলোকে বাতিল করলে ইসলাম নিয়ে এদের রাজনীতি বন্ধ হবে। ইসলাম একটি ধর্ম। কিন্তু এই ধর্মকে কুচক্রিরা রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করছে। ধর্মের রাজনীতি কেন গণতন্ত্রের রাজনীতিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছে। কেন পিছিয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রের রাজনীতি। গণতন্ত্র শক্তপোক্ত হলে কিন্তু ধর্মকে ধর্ম হিসেবে ব্যবহার না করে রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করা যেত না। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। ধর্ম যেভাবে যে মানতে চায়, সে সেভাবে মানবে। কিন্তু যখন কে কীভাবে মানবে, তা বলে দেওয়া হয়, যখন হুমকি ধামকি দেওয়া হয়, যখন ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না, যখন আইন প্রয়োগ করা হয়, ধর্ম এভাবে না মেনে ওভাবে মানলে জেল ফাঁসি হবে, তখন ওটি আর ধর্ম নয়, ওটি তখন রাজনীতি। ধর্মীয় অনুভূতি বলে যখন এক অদ্ভুত অনুভূতিকে আবিষ্কার করা হয়, এবং ঘোষণা দেওয়া হয় যে এটিকে আঘাত করা চলবে না, এমন কী দেশে আইন তৈরি করা হয় এটিকে স্পর্শ করলে বা আঘাত করলে জেল জরিমানা হবে—তখন সেটি ধর্ম নয়, সেটি রাজনীতি। সুস্থ রাজনীতিকরা, যারা সত্যিকার দেশপ্রেমিক, তারা ধর্মকে রাজনীতিতে নামতে বাধা দেন। ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রাখেন—কেউ বিশ্বাস করলে করবে, না করলে না করবে, যার যেভাবে ধর্ম মানতে ইচ্ছে করে—অন্যের কোনও ক্ষতি না করে, অন্যকে বিরক্ত না করে, অন্যের স্বাধীনতা নষ্ট না করে—মানবে। যে শাসকরা এই জরুরি কাজটি দেশের স্বার্থে করতে ব্যর্থ হন, তাঁরা মূলত ব্যর্থ। অশিক্ষিত অসভ্য বর্বর দেশও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পারে, আমরা কিন্তু ওই দেশগুলোকে সভ্য দেশ বলি না। ওই দেশগুলো নিশ্চয়ই আমাদের মডেল নয়। আমরা তবে কোনদিকে এগোচ্ছি?

    ৮৭. কাঁদো প্রিয় দেশ, কাঁদো

    ২৬ বছর আগে এসবের শুরু। আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল সিলেটের এক মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। কারও মাথার দাম ঘোষণা করা, অর্থাৎ জনগণকে বলা—তোমাদের মধ্যে ওর মুণ্ডুটা যে ব্যক্তি কেটে নিয়ে আসতে পারবে, অর্থাৎ তাকে হত্যা করতে পারবে, তাকে আমি মোটা অংকের টাকা দেব—নিশ্চয়ই খুব বড় এক অপরাধ। কিন্তু এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে তখনকার সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। মামলা করা, গ্রেফতার করা, জেলে ভরা তো দূরের কথা, সামান্য তিরস্কার পর্যন্ত করেনি। প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানকে বরং টিকিট দিয়েছিল ভোটে দাঁড়ানোর জন্য। প্রকাশ্যে মাথার দাম ঘোষণা করার পর অপরাধীর জনপ্রিয়তা যদি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোয় বেড়ে যায়, তাহলে তো নিশ্চিতই দেশ ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকেই যাত্রা করবে।

    ফতোয়ার উচ্ছ্বাসে রাস্তায় তখন প্রায় প্রতিদিন মিছিল হত। এক বদলোক থেকে বাকি বদলোক উৎসাহ পায়। সরকারের মৌনতাকেই লোকেরা সমর্থন বলে মনে করে। মিছিলে লোক আনা হত বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে। তারা জানতোই না তসলিমা কে, কী লেখে, কিন্তু তার ফাঁসি চাইতো। তসলিমা নাকি তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। মিছিল দিন দিন ফুলে ফেঁপে বড় হতে থাকে, এক সময় ‘অনুভূতির রাজনীতিক’রা হরতালের ডাক দেয়, সেই হরতাল সফল হয়। লং মার্চের ডাক দেয়, মানিক মিয়া এভিনিউতে ৪ লাখ মোল্লার সভা হয়। এক লেখিকার ফাঁসির দাবিতে তখন স্কুল কলেজ অফিস আদালত বন্ধ থাকে, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। উগ্র ধর্মান্ধ, আর জঙ্গি মুসলমানরা তখন রাস্তাঘাটে অবাধে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, রক্তপাত, আর নারকীয় উল্লাসে ব্যস্ত। সরকার ওদের শাস্তি তো দেয়ইনি, ওদের শান্ত করার কোনও ব্যবস্থাও নেয়নি। উলটে আমাকে শাসিয়েছে, আমার বিরুদ্ধে খালেদা সরকার মামলা করেছে, আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে, আমাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।

    যারা দুদিনের মধ্যে চার লাখ লোকের জমায়েত ঘটিয়ে দিতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলোর জিভ তখন তাদের দলে টানার মতলবে বেরিয়ে এসেছে। ওইসব বর্বর ফতোয়াবাজ আর ধর্ম ব্যবসায়ীদের অনেকেই পরে সংসদে বসেছে। আমি কোথায়? চিরকালের নির্বাসনে। কী অপরাধ ছিল আমার? আমার অপরাধ ছিল—নারীর সমান অধিকার দাবি করা, মানবাধিকারের লঙ্ঘন যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার কথা বলা, ধর্মীয় আইনের বদলে নারী পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরি করার দাবি করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য আবেদন করা।

    আমার প্রিয় দেশটিকে সেদিন দেখেছি কী রকম ভয়ংকর উন্মত্ত হতে। বর্বরদের উন্মত্ততাকে বারবার উস্কে দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে শাসকের দল। শুধু আমাকেই নির্বাসনে পাঠিয়ে শান্ত হয়নি ওরা, কত বুদ্ধিদীপ্ত তরুণকে বর্বরগুলো নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। সমাজ হয় ওদের ভয়ে তটস্থ, অথবা সহজে মগজধোলাই হয়ে এক একটা জড় পদার্থ হয়ে বসে আছে। পঙ্গপালে ছেয়ে গেছে দেশ। এই দেশকে বর্বরদের কবল থেকে কে বাঁচাবে? আমি তো কাউকে দেখিনা। যে দলকে নিয়ে আশা ছিল, সে দল ওদের সঙ্গে আপোস করেছে। বাকিরা ব্যস্ত সরকারের চাটুকারিতা করে আখের গুছিয়ে নিতে। মানবাধিকারে, বাকস্বাধীনতায়, গণতন্ত্রে, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা সৎ, নিষ্ঠ, আদর্শবাদী মানুষ আজ নেই বললে চলে।

    দেশ কতটা নষ্ট হলে একজন সুফি গায়ককে গ্রেফতার করতে পারে, রিমাণ্ডে পাঠাতে পারে, জেল-হাজতে ভরতে পারে, তা সামান্য বিবেক যাদের আছে, তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারে। ইসলামে গান নিষিদ্ধ নয়,—এ কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন শরিয়ত সরকার বাউল। মোল্লাতন্ত্র খুশি নয় শরিয়ত বাউলের ওপর, সে কারণে গ্রামে গঞ্জে পালাগান গাওয়া এই সুফিকে বন্দি করা হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র নেই, আছে মোল্লাতন্ত্র। মোল্লাতন্ত্র আছে বলেই অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তকদের হয় নিহত হতে হয়, নয়তো নির্বাসন জীবনযাপন করতে হয়।

    শরিয়তকে দোষী সাব্যস্ত করা মানেই ইসলামে গান বাজনা নিষিদ্ধ তা প্রতিষ্ঠিত করা। তাহলে কি বাংলাদেশে আজ থেকে সব গান বাজনা নিষিদ্ধ? রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, পল্লী গীতি, বাউল গান, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ব্যান্ডের গান, আধুনিক গান, গণ সংগীত, জীবনমুখী গান, জাতীয় সংগীত—সব নিষিদ্ধ? তাহলে সব নিষিদ্ধই করে দেওয়া হোক। শিল্প সাহিত্য সব নিষিদ্ধ হোক। ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হোক। শুধু মাদ্রাসা খোলা থাকুক। শুধু কোরান, হাদিস পড়া হোক। সুর বলতে কোথাও যদি কিছু থাকে, তা শুধু আজানের সুর। দেশ জুড়ে শুধু মসজিদ বানানো হোক, কোনও একাডেমী নয়, লাইব্রেরি নয়, জাদুঘর নয়। টুপি আলখাল্লা আর বোরখাই হোক নারী পুরুষের পোশাক, অন্য কিছু নয়। মাথার সামান্য চুল যদি বেরিয়ে আসে বোরখার ফাঁক দিয়ে, তাহলে রাস্তাঘাটে ধর্ম-পুলিশেরা পেটাবে মেয়েদের, যদি বোরখার তলায় যদি ট্রাউজার পরে কোনও মেয়ে, তাহলেও একশ’ চাবুক মারবে। দেশে কোনও আদালত নয়, থাকবে শুধু শরিয়া কোর্ট। জনতার সামনে তলোয়ারের এক কোপে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর ধর থেকে মুণ্ডু ফেলে দেবে। জনতা আল্লাহু আকবর বলে জয়ধ্বনি করবে। শুধু স্বামী-সন্তানের সেবা আর সন্তান উৎপাদনের জন্য ঘরবন্দি করা হোক নারীকে। আল্লাহর শাসন চলবে দেশে। পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হবে তাদের যারা নামাজ রোজায় গাফিলতি করবে, যারা ব্যাভিচার করবে, যারা ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন করবে। কোনও গণতন্ত্র, কোনও মানবাধিকার, নারীর অধিকার, কোনও বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার থাকবে না দেশে।

    আমি সত্যি চাইছি এমনই ভয়ংকর দিন আসুক বাংলাদেশে। মানুষ পরাধীনতার শেকলে বন্দি থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠুক। মানুষের দম বন্ধ হতে হতে শ্বাস নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠুক। শেষ অব্দি মানুষই মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠুক। মানুষ মানুষকে বাঁচাবার জন্য সত্যিকার গণতন্ত্র আনুক, সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষতা আনুক, সমাজকে সত্যিকার শিক্ষিত আর সভ্য করার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করুক। ফিরিয়ে আনুক, সাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃতি। ভুলে গেলে চলবে না বাংলার সংস্কৃতি বর্বর আরবদের সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের নাম, ধর্ম কোনও সংস্কৃতির নাম নয়, কানুনের নাম নয়। এটিকে ব্যক্তিগত চৌহদ্দি থেকে যদি বাইরে আসতে দেওয়া হয়, তাহলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা একে নিয়ে ধুন্ধুমার ব্যবসা শুরু করবে। তাই করেছে। রাজনীতি শুরু করবে, তাই করেছে। এখন কিছু কি বাকি আছে বাংলাদেশের সৌদি আরব, সুদান, সোমালিয়া বা সিরিয়া হওয়ার?

    ১৯৭১ সালে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আমদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে বিভিন্ন স্বৈরাচারী শাসক। আজ যে সরকার একাত্তরের রাজাকারকে ফাঁসি দেয়, সেই সরকার বর্তমান রাজাকারদের চুমু খায়। যে সরকার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে, সে সরকার রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখে। যে সরকার মানুষকে উদারপন্থী হতে বলে, সে সরকারের আনা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে উদারপন্থী হওয়ার অপরাধে মানুষকে জেলে যেতে হয়। তারপরও সরকার চুপ। যেভাবে চুপ ছিল এক এক করে যখন মুক্তচিন্তকদের হত্যা করেছিল জংগিরা। শুধুই গদি হারানোর ভয়।

    সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক যখন অন্যায়কে সমর্থন করে, আমাদের ক্ষমতাবান সরকারপ্রধানও মনে করেন, অন্যায়কে সমর্থন করতে হবে, তা না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন হারাতে হবে। আজ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ভেড়ায় পরিণত হয়, তবে তাদেরকে ভেড়ায় পরিণত করার দায় কিন্তু সবচেয়ে বেশি সরকারের। ভেড়ার সমর্থনের বদলে ভেড়াকে যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তাশীল, প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বও কিন্তু সবচেয়ে বেশি সরকারের। এই দায়িত্ব যদি আজ সরকার না নেয়, যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি কালা কানুন আজও বাতিল না করে, আজও যদি বাউল বয়াতিদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা না করে, যদি মুক্তচিন্তকদের দেশে ফিরিয়ে না আনে, যদি মানুষের বাকস্বাধীনতা রক্ষা আজও না করে—তবে আমরা নিশ্চিত যে দেশটিকে অন্ধকারের অতল গহবর থেকে বাঁচাবার সুযোগ পেয়েও বাঁচায়নি এই সরকার।

    দেশটিকে তাহলে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার অপরাধে অপরাধী সব সরকারই।

    ৮৮. ধর্ষণের শিকাররা মুখ লুকোয় কেন?

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ছাত্রীটির নাম কী? নাম কেন বলা হচ্ছে না? তার চেহারাও কেন দেখানো হচ্ছে না? আমরা কিন্তু ধর্ষকের চেহারা দেখে ফেলেছি, তার নাম যে মজনু তাও জেনে ফেলেছি। ধর্ষণের শিকারকে কেন মুখ লুকোতে হবে? ধর্ষকরা তো দিব্যি নাম ধাম সাকিন জানিয়ে দেয়, ক্যামেরার দিকে তাকাতে তাদের তো লজ্জাবোধ হয় না! তাহলে কি ঘটনা এই যে সমাজের ভয় একজন ধর্ষিতার আছে, কিন্তু একজন ধর্ষকের নেই? কেন নেই? এককালে না হোক, আজকাল তো ধর্ষকদের পুরুষেরাও মেনে নেয় না। তারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে নিজেরা যে ধর্ষক নয়, তা প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়, বলতে থাকে সব পুরুষ ধর্ষক নয়, ধর্ষককের জন্য কঠিন কঠিন শাস্তির প্রস্তাব দিতে থাকে, ফাঁসি, পুরুষাঙ্গ কর্তন, কত কী। তাহলে কেন আজও এই একবিংশ শতাব্দীতেও মেয়েরা নিজের পরিচয় লুকোতে বাধ্য হয়?

    আমরা জানি কেন লুকোয় পরিচয়। কারণ যতই মানুষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে বলুক, যতই ধর্ষককে গালি দিক, মানুষ আজও মেয়েকেই দোষী বলে মনে করে। মেয়েটি কী পোশাক পরেছিল? কোনও ছোট পোশাক? মেয়েটি যদি কোনও ছোট পোশাক না পরে থাকে, তবেও দোষ, কেন হিজাব পরেনি, যদি হিজাব পরে থাকে, তবেও দোষ কেন বোরখা পরেনি। মেয়েটি বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছিল, কেন একা যাচ্ছিল, একা গেলে তো এরকম হবেই। কেন কোনও পুরুষ আত্মীয় ছিল না সঙ্গে? কেন সন্ধ্যেয় যাচ্ছিল, দিনের বেলায় তো যেতে পারতো! দোষের শেষ নেই। ধর্ষণকে পুরুষের অধিকার বলে যারা বিশ্বাস করে, তারা পদে পদে মেয়েদের দোষ খুঁজে বেড়াবে বলার জন্য অন্য মেয়েরা তো ধর্ষণের শিকার হয় না, ও হলো কেন, নিশ্চয়ই ও খারাপ। নিশ্চয়ই ধর্ষিতা হতেই সে চেয়েছে! ধর্ষণের কারণ যে পুরুষের নারীবিদ্বেষ, নারীকে যৌনবস্তু ভাবার মানসিকতা, নারীকে নির্যাতন করাই যায়, নারী তো নিতান্তই তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তু—এই বিশ্বাস, তা অনেকে জানে না। অথবা জানলেও না জানার ভান করে।

    ধর্ষণের শিকার হলে হাজারো মেয়ে সাধারণত মুখ বুজে থাকে। তারা রাষ্ট্র করে না খবর। এই মেয়েটি জানিয়েছে সব্বাইকে। নিঃসন্দেহে সাহসী মেয়ে। কিন্তু সে ততটুকু সাহসী নয়, যতটুকু সাহসী হলে পাছে লোকে কী বলবে তার তোয়াক্কা করে না। দিল্লির বাসে যে মেয়েটিকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল, মৃত্যুর সঙ্গে যখন সে লড়ছিল, সারা পৃথিবীর সমর্থন সহানুভূতি পেয়েছিল সে, তারপরও নিজের নাম যে জ্যোতি সিং, তা বলেনি। তার নাম দেওয়া হয়েছিল নির্ভয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটির নামও কি তবে ওই জাতীয় কিছু একটা দেওয়া হবে?

    আর কতদিন এই ভিতু মেয়েদের আমরা নির্ভয়া বা সাহসীনী বলে ডাকবো?

    ধর্ষণের শিকার যারা, তারা যেন আর মুখ না লুকোয়। যদি এমন হয় যে ধর্ষণের শিকার হলে তাকে হেনস্থা করা হচ্ছে, তাহলে যারা হেনস্থা করছে, তাদের চিহ্নিত করা হোক। তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা হোক। শুধু ধর্ষণ যে করে, সে-ই দোষী? ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে যারা তার শিকারকে ঘৃণা করে, একঘরে করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, নির্যাতন কবে—তারাও তো ধর্ষকের মতোই। ধর্ষক করে শারীরিক নির্যাতন, সমাজের ভদ্রলোকেরা করে মানসিক নির্যাতন। এখনও শারীরিক নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবে ধরা হয়, মানসিক নির্যাতনকে নয়। ধর্ষণের পর একটি মেয়েকে পরিবার এবং সমাজ মানসিক নির্যাতন করে, এ কারণেই মেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়, আত্মহত্যা করে। শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে মানসিক নির্যাতন হাজার গুণ ভয়ংকর।

    ধর্ষণ পুরুষতন্ত্রের উপসর্গ ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই ঘোষণা দেয় যে নারী দুর্বল, পুরুষ সবল। পুরুষের জগৎ বাইরে, নারীর জগৎ ঘরে। পুরুষ অর্থকড়ি উপার্জন করে, নারী ঘর সংসার করে, শিশু পালন করে। নারীকে তার পিত্রালয় থেকে উঠিয়ে স্বামীগৃহে স্থান দেওয়া হয়। শৈশব কৈশোরে মেয়েরা পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন। নারীকে স্বামীর সেবা যত্ন করতে হবে, সন্তান, বিশেষ করে পুত্র সন্তান জন্ম দিতে হবে। নারী এবং পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় বেঁধেছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকাই প্রমাণ করে নারী নিতান্তই পুরুষের দাসি, যৌনদাসি। যৌনদাসিকে তাই খুব সহজেই রাস্তাঘাটের লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতে পারে। কোনও ধর্ষক ভাবে না সে অন্যায় করছে। ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন চলছে, যে নির্যাতনকে বৈধ বলে মনে করে দেশের প্রায় সবাই। ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলছে। স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে স্বামী। আজও স্বামীর ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে মানা হয় না। আজও গণিকালয়ে গিয়ে পুরুষেরা যে ধর্ষণ করে, সেই ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনকেও বৈধ বলে মানা হয়।

    ঘরে এবং বাইরে পুরুষ যা করে অভ্যস্ত, তা ধর্ষণ। তবে কেন একটি মেয়েকে সুযোগ পেলে অন্ধকারে নিয়ে ধর্ষণ করবে না? পুরুষকে তার পেশি, তার জোর, তার ক্ষমতা, তার সাহস নিয়ে, মোদ্দা কথা তার পৌরুষ নিয়ে গর্ব করতে শেখানো হয়েছে। ধর্ষণ সেই গর্ব থেকেই করে পুরুষ।

    মজনু নামক ধর্ষকটির কাছে শিক্ষিত অশিক্ষিত সব মেয়েই সমান। নারী, তার কাছে, যৌনাঙ্গ ছাড়া কিছু নয়। প্রচুর পুরুষ, ধর্ষক অথবা ধর্ষক নয়, নারীকে আস্ত একটি যৌনাঙ্গ বলেই বিচার করে। মজনু এমন কোনও অস্বাভাবিক কোনও পুরুষ নয়। সে সমাজের আর দশটা পুরুষের মতোই পুরুষ। তারও হয়তো বউ বাচ্চা আছে, অথবা বাবা মা ভাই বোন আছে। সে এই দেশেরই সন্তান। সে আসমান থেকে পড়েনি।

    মজনুরা আর কতকাল ধর্ষণ করবে মেয়েদের? পুরুষদের কি এখনও সময় হয়নি ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার? পুরুষেরা যেন পুরুষদের সেই ভাবে শিক্ষা দেয়, যেভাবে শিক্ষা দিলে পুরুষেরা ধর্ষণ করবে না, বা ধর্ষণ করলেও ধর্ষণ করা বন্ধ করবে। নারীরা চিৎকার করলে পুরুষেরা কান দেয় না। নারীরা জানে না কী করলে বা কী বললে পুরুষেরা ধর্ষণ বন্ধ করবে। পুরুষেরাই জানে পুরুষের মন। সুতরাং পুরুষের শিক্ষক, উপদেষ্টা পুরুষকেই হতে হবে। পুরুষকেই দল বেঁধে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ মানব সমাজে বাস করতে হলে, নারীর সঙ্গে এক সমাজে বাস করতে হলে, পুরুষকে নারী নির্যাতন বন্ধ করতেই হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।

    ৮৯. কয়েকটি জরুরি প্রসঙ্গ

    ১

    সুশান্ত সিং রাজপুতকে নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। ওঁকে কেউ হত্যা করেছে, নাকি নিজেই ফাঁসিতে ঝুলেছেন, যদি এ আত্মহত্যাই হয় তবে কারণ কী তার, স্বজনপোষণ নাকি অন্য কিছু ? পুলিশ কোনও খুনের আলামত পাচ্ছে না, কিন্তু বিতর্ক থামছে না। হোমড়া চোমড়াদের জিজ্ঞাসাবাদে নিচ্ছে পুলিশ।

    জিয়া খান তো আত্মহত্যা করেছিলেন, কই তাঁর ওই আত্মহত্যা আসলেই আত্মহত্যা কিনা, নাকি কেউ তাকে হত্যা করেছিল, এ নিয়ে কোনও তোলপাড় তো হয়নি। দিব্যা ভারতিকে কি হত্যা করা হয়েছিল নাকি তিনি পাঁচ তলার জানালা দিয়ে নিজেই লাফ দিয়েছিলেন মরবেন বলে, আজও কিন্তু এই প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনও উত্তর মেলেনি। সবচেয়ে অবাক হই, শ্রীদেবীর মতো বিখ্যাত অভিনেত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়েও কোনও সংশয় প্রকাশ করেনি বড় কোনও মিডিয়া বা সংগঠন, বা নামি দামি কেউ অথবা বলিউডের কেউ। আগের দিন নাচলেন মানুষটা। পরের দিন বাথটাবের জলে ডুবে মরে গেলেন!! ঘরে একজন উপস্থিত ছিলেন সেসময়। ডেথ সার্টিফিকেটও আনাড়ি হাতে লেখা ছিল। এ নিয়ে কাউকে জেরা করা হয়নি। বিদেশের মাটিতে মারা গেলেই কি জবাবদিহি করতে হয় না, আর সাত খুন মাফ হয়ে যায়?

    পুরুষেরা আত্মহত্যা করলে সহজে বিশ্বাস করা হয় না এ আত্মহত্যা, মেয়েরা আত্মহত্যা করলে এ আত্মহত্যা বলেই মানুষ চটজলদি বিশ্বাস করে ফেলে। কারণ তো ওই একই, মেয়েদের হৃদয় এত কোমল, তাদের এত আবেগ, তারা পারে না বাস্তবতার মুখোমুখি হতে।

    কত মেয়েকেই তো হত্যা করা হয়, কত মেয়েকেই তো আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে সমাজ। এসব নিয়ে কি সত্যিই তোলপাড় হয়? হয়তো মেয়েদের জীবনকে মূল্যহীন ভাবা হয় বলে তাদের মৃত্যুকেও মূল্যহীন ভাবা হয়। সাধারণ মেয়েদের অপঘাতে মৃত্যু হলে কেউ পরোয়া করে না, অসাধারণ মেয়েদের বেলায় অনেকটা তাই। কিছু কিছু ব্যাতিক্রম নিশ্চয়ই আছে।

    আজ টুইটারে আমি এই প্রশ্নটি করেছিলাম, সুশান্তর বেলায় প্রশ্ন উঠছে হত্যা না আত্মহত্যা, শ্রীদেবীর বেলায় কেন প্রশ্ন ওঠেনি হত্যা না ড্রাউনিং? একজন বল্লেন, ‘বয়সটা ম্যাটার করছে। শ্রীদেবীর বয়স বেশি, কেরিয়ারের শেষ। সুশান্তের অল্প বয়স, কেরিয়ারের শুরু।’ তাই বুঝি? জিয়া খানের বয়স তো সুশান্তের চেয়েও কম ছিল, তাতে কী হয়েছে!

    শ্রীদেবীর বয়স বেশি বলে তেমন কোনও তরঙ্গ সৃষ্টি হয়নি! অমিতাভের তো বয়স শ্রীদেবীর চেয়েও বেশি। আজ তিনি গত হলে মানুষ হাউমাউ করে কাঁদবে না? শুধু কি কাঁদবেই! সুশান্তর জন্য কত ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করে ফেললো, অমিতাভ’র জন্য হয়তো আরও বেশি করবে।

    ২

    সংযুক্ত আরব আমিরাত বলে দিয়েছে জনগণ যেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রিয়জনকে ঈদের উপহার দেওয়া থেকে বিরত থাকে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেখা সাক্ষাতের পরিবর্তে সামাজিক মাধ্যম, ই-মেইল ও টেলিফোনে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে বলা হয়েছে। আত্মীয় ও পরিবারের সঙ্গে দেখা করা যদি অতিজরুরি হয়, তা হলে সাক্ষাতের সময় সামাজিক দূরত্ব যেন অবশ্যই বজায় থাকে। গৃহকর্মীদের বলা হয়েছে বাইরের কারও সঙ্গে যেন সাক্ষাৎ না করে এবং কিছু জরুরি জিনিস যদি তাদের গ্রহণ করতেই হয়, যেন পিপিই পরে গ্রহণ করে। আরব আমিরাতে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছে ৩৪৫ জন। কিন্তু আরব দেশ হয়েও ঈদের মতো মূল ধর্মীয় উৎসবের অনেকটাই বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে। বড় জমায়েত বন্ধ রাখতে হবে, এর মানে ঈদের নামাজটাই বন্ধ রাখতে হবে। মানুষে মানুষে সৌহার্দের আলিঙ্গনই তো ঈদের মূল আনন্দ, সেই আলিঙ্গনও করা চলবে না। করোনার কামড় থেকে বাঁচতে হলে এই পথই অনুসরণ করতে হবে। আরব আমিরাতের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত সকলেরই গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশে এক এক করে অনেকেরই তো মৃত্যু হচ্ছে করোনায়। ঘরেই ঈদের নামাজ পরা, ঘরেই স্বজনদের সঙ্গে ভালোমন্দ খাওয়া—এটুকুতেই ঈদের উৎসবকে সীমিত রাখা উচিত। মহামারীর সময় বড় বড় গরু জবাই করে খানাপিনার উৎসব করলে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের করোনার করুণ মৃত্যুকে মোটেও পরোয়া করা হয় না। আমরা কি শোকের সময় আনন্দ করি? বাড়িতে কারও মৃত্যু হলে তো চুলোই নাকি ধরাতে হয় না। বাড়িতে বাড়িতে তো মৃত্যু হচ্ছেই, আমাদের গোটা গ্রহই তো আমাদের বাড়ি। এই গ্রহে গত কয়েক মাস যাবৎ আনন্দ তো নেই। ঈদের পর যদি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়, তবে কিন্তু মুসলিমদের ওপর রাগ বাড়বে মানুষের। মুসলিমদের নির্বুদ্ধিতা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি নিয়ে পৃথিবী আবারও চিৎকার করবে।

    লোকে যত চিৎকারই করুক, এ কথা সত্য যে আরব দেশে মানুষ ক্রমশ বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে, এ নিশ্চয়ই খুব ভালো লক্ষণ। কিছুদিন আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত মঙ্গল গ্রহে যান পাঠালো। কে বলেছে মহাশূন্যে শুধু ইউরোপ আমেরিকাই যান পাঠাবে, আর আরব দেশগুলো পড়ে থাকবে মাটিতে, ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে! যত বেশি অন্ধকার কাটিয়ে আলোয় আসবে মানুষ, তত স্পষ্ট হবে তারা, তাদের বুদ্ধিদীপ্ত অবয়ব।

    ৩

    সাদ্দাম হোসেনকে খুন করে ইরাককে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিল আমেরিকা। গণতন্ত্রের পথেই নাকি ইরাকে সুখ-শান্তি ফিরে আসবে। কোথায়, অনেক বছর তো হয়ে গেল! গণতন্ত্রের সব শাসকই তো জনতাকে শোষণ করছে। দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র, সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড এসব ঢেলে দেশটাকে কি হাল করেছে, দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। সাদ্দামের অত্যাচারে অনেকে অতিষ্ঠ ছিল তা ঠিক, কিন্তু সাদ্দামকে সরিয়ে যারা এলো, তাদের অত্যাচারেও তো জনগণ অতিষ্ঠ। তেল উৎপাদন করে দেশ, অথচ ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও বিদ্যুতের অভাবে মানুষকে ভুগতে হয়। মুসলমানের দেশে দুর্নীতি কেন ঘটে? মানুষ যদি ধর্ম পালন করেই, তা হলে দুর্নীতি কেন করে? ধর্ম তো লোভ, লালসা, অন্যকে ঠকানো, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করার বিপক্ষে বলেছে। তা হলে দুর্নীতিবাজরা যদি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েও, তিরিশটা রোজা রেখেও দুর্নীতি বন্ধ না করে, তবে নামাজ-রোজার জন্য আদৌ কি পুণ্য হবে তাদের? অনেকে মনে করে ওরা দুর্নীতি বেশি করে বলেই নামাজ, রোজাটা বেশি করে।

    ইরাকের সরকার বিরোধী মিছিলে গুলি চালিয়ে তিনজনকে মেরে ফেলেছে সরকারের পুলিশ বাহিনী। গত বছর মিছিলের ৫৫০ জনকে মেরে ফেলেছিল, আর ৩০,০০০ মানুষকে আহত করেছিল। প্রতিবাদ মিছিলে যে সরকার গুলি চালায়, সে সরকার কোনও গণতান্ত্রিক সরকার নয়। একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের জীবনের বিনিময়ে গণতন্ত্র আসার কথা ছিল ইরাকে, আজও আসেনি। আদৌ কোনওদিন আসবে কি না কে জানে।

    ৪

    আরব দেশগুলো যেভাবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। অবৈধভাবে হজ পালনের চেষ্টা করায় গতকাল হজ সিকিউরিটি ফোর্স ২৪৪ জনকে আটক করেছে। সৌদি প্রশাসন জানিয়েছে, অনুমতি না পাওয়ার পরেও তারা প্রটোকল ভেঙে হজ পালনের চেষ্টা করছিল। তাদের গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন আরও জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কড়া নিরাপত্তা বজায় রেখে সীমিত পরিসরে হজ পালন হচ্ছে। অনুমতি না থাকলে কেউ যেন এ বছর হজ পালনের চেষ্টা না করে। এবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বড্ড কঠিন।

    ৫

    চীন আর ভারত কি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে? আমি কোনওদিন কোনও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করিনি। কিন্তু আজ প্রকৃতির কাছে আমার প্রার্থনা— পৃথিবীতে যেন আর কোনওদিন এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের যুদ্ধ না বাঁধে। এই করোনা মহামারীই কি বুঝিয়ে দেয়নি অদৃশ্য ভাইরাসের কাছেও আমরা মানুষেরা কত অসহায়? মানুষ এখন সব এক হয়ে মিলেমিশে মানুষের সব শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, তা নয়, মানুষ মানুষকেই ঘৃণা করছে, মানুষকেই হত্যা করার পরিকল্পনা করছে। এর চেয়ে বড় অকল্যাণ আর কী হতে পারে! পারমাণবিক বোমার দুটো দেশে যখন ঝগড়া বাঁধে, আমরা জনগণ তো এমনিতে অসহায়, আমরা আরও অসহায় হয়ে পড়ি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleফেরা – তসলিমা নাসরিন
    Next Article ফরাসি প্রেমিক – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }