Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অনন্ত অম্বরে – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প100 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৩. ১৯৬৭ সন। শীতের সকাল

    ১৯৬৭ সন। শীতের সকাল। রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের ঘরে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছি। ঘরটা প্রকাণ্ড হলেও অন্ধকার। দিনের বেলাতেও আলো জ্বলছে। সেই আলো অন্ধকারে প্রথম যা চোখে পড়ছে তা হল অপরিচিত একজন মানুষের তৈলচিত্র। মানুষটি রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। যেন পৃথিবীর সবার উপরেই তিনি বিরক্ত। ক্যামিকেলস-এর গন্ধে আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ঘরে কোন ধোয়া নেই, তবু মনে হচ্ছে কাঠ-কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়ায় ঘর ভরে আছে।

    চেয়ারে ছোটখাট একজন মানুষ বসে আছেন–তিনিই খোন্দকার মোকাররম হোসেন। চোখে ভারী চশমা। তার মুখ হাসি হাসি, তবে সেই হাসি থেকে কেন জানি কোন ভরসা পাওয়া যায় না বরং ভয় লাগে। তিনি নরম গলায় বললেন, তুমি কেমিস্ট্রি পড়তে চাচ্ছ কেন?

    আমি উত্তর দিলাম না। কারণ আমার মনে হল না তিনি কোন উত্তর শুনতে চাচ্ছেন। প্রশ্ন করতে হয় বলেই করা। প্রশ্ন করেই তিনি পাশে বসা অন্য একজন শিক্ষকের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলা শুরু করেছেন।

    আমার দিকে না তাকালে আমি প্রশ্নের জবাবই বা কেন দেব? আমার একটু ভয় ভয় লাগছে কারণ এখন যা হচ্ছে তার নাম ভর্তির ইন্টারন্যু। ইন্টারভু ভাল হলে দরখাস্তে সই করে দেবেন। ভর্তি হয়ে যাব। ফট করে কেমিস্ট্রির কোন প্রশ্ন করে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ফর্মূলা একটাও মনে নেই। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা হয়ে যাবার পর আর বই খুলে দেখিনি।

    আমার খানিকটা একা একাও লাগছে। সবার সঙ্গেই বাবা, খালু বা চাচা এসেছেন। কি পড়লে ভাল হয়, সাবসিডিয়ারী কি নেয়া যায় আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আমি একা। ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাবা চিঠি লিখে জানিয়েছেন–পড়াশোনার ব্যাপারটা তোমার। তুমি যা ভাল মনে কর তাই পড়বে। এখানে আমার বলার কিছু থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না।

    খোন্দকার মোকাররম হোসেন স্যার পাশের মানুষটির সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমিস্ট্রি পড়তে কি তোমার ভাল লাগে? বলেই আগের মত পাশের মানুষটির সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেশ মজার ব্যাপার তো!

    স্যারের কথা বলা শেষ হল। আমার দিকে একবার তাকিয়ে তৃতীয় কোন প্রশ্ন না করেই দরখাস্তে সই করে দিয়ে বললেন, মন দিয়ে পড়বে।

    ভর্তির ব্যাপারটা খুব সহজে হয়ে গেল। আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। বিরাট এই বিশ্ববিদ্যালয়টা এখন আমার। আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার নিজের জায়গায়। আর কি সুন্দর জায়গা! কার্জন হল–ফুলের বাগানের ভেতর লাল ইটের দালান। প্রাচীন প্রাচীন ভাব। এত ছাত্র-ছাত্রী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারপরেও যেন সব শান্ত। প্রকাণ্ড দুটা শিরীষ গাছ কেমিস্ট্রি বিল্ডিংটাকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে।

    কার্জন হলের পেছনেই কি বিশাল দুটা হল। ফজলুল হক হল এবং ঢাকা হল। এই হল দুটির সামনেও ফুলের বাগান। দুই হলের মাঝখানে সমুদ্রের মত বড় দীঘি। এই হল দুটির কামরাগুলি আমার পছন্দ হল না। কেমন যেন ছোট ছোট। আলো কম। সেই তুলনায় মহসিন হলকে খুব আকর্ষণীয় মনে হল। নতুন তৈরি হয়েছে। এখনো চালু হয় নি। এ বছরই চালু হবে। ঝকঝক করছে ছতলা আকাশছোঁয়া হল। দুটা লিফট আছে। লিফট আমি আগে কখনো দেখি নি। একবার লিফটে চড়েই মনে হল, এই হলে থাকতে না পারলে মানব জন্ম বৃথা।

    মহসিন হলের প্রধান গৃহশিক্ষক তখন পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহযোগী। অধ্যাপক মোহাম্মদ এমরান। ইনি কারণে এবং অকারণে অতি দ্রুত রেগে যেতে পারেন। ইনার কাছে ইন্টারভু দিতে যাবার আগ মুহূর্তে একজন আমাকে বলল, স্যারের প্রশ্নের উত্তর খুব সাবধানে দিবে। একজন কি উল্টাপাল্টা কথা বলেছিল, স্যার তাকে চড় মেরেছেন।

    কি সর্বনাশের কথা! ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা ছাত্রের গালে কেউ চড় মারতে পারে? ভয়ে এতটুকু হয়ে স্যারের ঘরে ঢুকলাম। স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন, সায়েন্সের ছাত্র তুমি মহসিন হলে থাকবে কেন? সায়েন্সের ছাত্রদের জন্যে ফজলুল হক হল, ঢাকা হল।

    আমি স্যার এই হলেই থাকব।

    কেন?

    এদের লিফট আছে স্যার।

    স্যার হেসে ফেললেন। হেসে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে হল হাসা ঠিক হয় নি। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করবে না। স্ট্রেইট লাইন চেন? স্ট্রেইট লাইন বানিয়ে ছেড়ে দেব। বিছানা-বালিশ আছে?

    আছে স্যার।।

    বিছানা-বালিশ নিয়ে পাঁচ তলায় চলে যাও। তোমাকে একটা সিঙ্গেল সীটেড রুম দেয়া হল।

    হলে ভর্তি, হলে সীট পাওয়ার ব্যাপারটা এত সহজ? বিশ্বাস হতে চায় না। আমি নিজের ঘরে ঢুকলাম। আগামী চার বছর এটাই আমার ঘর। রুম নাম্বার পাঁচশ চৌষট্টি। একটা কাগজে বড় বড় করে লিখলাম–

    হুমায়ূন আহমেদ
    রসায়ন প্রথম বর্ষ সম্মান
    রোল ৩২

    সেই কাগজ ঘরের দরজায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম।

    নতুন হলে যাত্রা শুরু হল। প্রথম রাতেই ইমপ্রুভড ডায়েট। রোস্ট, রেজালা, দৈ। খাওয়ার শেষে হলের বাইরের দোকান থেকে জীবনের প্রথম সিগারেটটি কিনে গম্ভীর ভঙ্গিতে টানা শুরু করলাম। ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হয়েছি–অনেক বড় হয়ে গেছি। এখন গম্ভীর ভঙ্গিতে সিগারেট টানা যেতে পারে। মাথা ঘুরছে তাতে কি? বমি বমি আসছে? আসুক না। আনন্দময় জীবনের এই তো শুরু।

    হলে ভর্তি হবার পরের সপ্তাহ থেকে ক্লাস শুরু হয়ে গেল। সকাল আটটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত একটানা ক্লাস। সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লাঞ্চ ব্রেক। দেড়টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ল্যাব। ভয়াবহ চাপ। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। সায়েন্স পড়ার একি যন্ত্রণা! আর্টস-এর ছেলেরা দেখি মহাসুখে আছে। একটা দুটা ক্লাস করে চলে আসে। দুপুরে ঘুমায়। এদের দেখে ঈর্ষায় গা জ্বলে যায়। হায়! কি বোকামি করেছি। কেন আর্টস পড়লাম না?

    আমাদের সময় রসায়ন বিভাগের নিয়ম ছিল সবচে জাঁদরেল শিক্ষকদের দেয়া হত প্রথম বর্ষের ক্লাস। তাঁরা ছাত্রদের ভিত তৈরি করে দিতেন। শক্ত ভিত তৈরি হলে পরবর্তী সময়ে তেমন সমস্যা হত না।

    ক্লাসে যেতে হত তৈরি হয়ে। পাঠশালার মত অবস্থা। স্যাররা প্রশ্ন করে করে অস্থির করে ফেলতেন। ক্লাস থেকে ছাত্র বের করে দেয়া ছিল নিত্যদিনকার ঘটনা। কলেজের স্যারদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের একটা বড় ধরনের প্রভেদ প্রথম দিনেই স্পষ্ট হয়ে গেল। কলেজের স্যাররা যখন পড়াতেন তখন মনে হত, যে বিষয়টা তাঁরা পড়াচ্ছেন সে বিষয়টা তাঁরা নিজেরা খুব ভাল জানেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাররা দেখলাম শুধু যে জানেন তা না, এত ভাল করে জানেন যে ছাত্র হিসেবে ভয় ধরে যায়।।

    ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়াতেন প্রফেসর আলি নওয়াব। তখন অবশ্যি তিনি রিডার (সহযোগী অধ্যাপক)। ক্লাসে ঢুকেই বললেন, বইগুলিতে যা পড়বে সবই বিশ্বাস করবে না। অনেক মিথ্যা কথা লেখা আছে।

    আমরা স্তম্ভিত। বই-এ মিথ্যা কথা মানে?

    স্যার বললেন, বইগুলিতে অনেক ভুল তথ্য থাকে। আমি সেগুলি তোমাদের দেখিয়ে দেব। তোমরা নিজেরাও ধরতে চেষ্টা করবে। প্রচুর গোঁজামিল আছে। ভুল থিওরী আছে।

    আমরা বিস্মিত, বই-এ লেখা থিওরী ভুল! কি আশ্চর্য কথা। স্যার শুধু মুখেই বললেন না–ভুল দেখিয়ে আমাদের চমকে দিলেন।

    চার ঘণ্টার ল্যাব। এক মুহূর্তের বিশ্রাম নেই। কাজ শেষ করতে হবে। অসংখ্য কাজ। গোদের উপর বিষফোড়ার মত ল্যাব ক্লাসে দুদিন পরপর ভাইভা। ভাইভা ভাল না হলে স্যাররা স্কলারশীপের বিলে সই করেন না। গার্ডিয়ানের কাছে চিঠি চলে যায়–পড়াশোনা সন্তোষজনক নয়।

    আজ যখন কেউ বলে, আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেমন কেটেছে? আমি নস্টালজিক কারণে বলি, খুব চমৎকার! অসাধারণ!

    আসলে কিন্তু খুব চমৎকার বা অসাধারণ জীবন তা ছিল না। কেন ছিল না একটু বলি চব্বিশ বছর আগে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক মোটেই ভাল ছিল না। শিক্ষকরা ছিলেন অন্য গ্রহের মানুষ। তাঁরা অনেকখানি দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। ক্লাস রুমের বাইরে ছাত্রদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল না বললেই হয়। ছাত্রদের কোন সমস্যায় তাঁদের কোন সহানুভূতি ছিল বলেও মনে হয় না।

    না-হওয়াটাই স্বাভাবিক। যোগাযোগ থাকলে তবেই তো সহানুভূতি তৈরি হবে। যোগাযোগই তো নেই।

    একটা ঘটনা বলি–রসায়ন বিভাগের বারান্দায় একটি ছেলে এবং মেয়ে মাথা নিচু করে গল্প করছিল। গল্প করার ভঙ্গিটি হয়ত আন্তরিক ছিল। এবং তারা গল্পও করছিল দীর্ঘ সময়। চেয়ারম্যনের ঘরে দুজনেরই ডাক পড়ল। চেয়ারম্যান সাহেব তাদের কি বললেন জানি না। মেয়েটি বের হয়ে এল কাঁদতে কাঁদতে। ছেলেটিকে ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে যেতে হল।

    সন্ত্রাস আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং অন্যতম সমস্যা। চব্বিশ বছর আগেও কিন্তু সন্ত্রাস একটি বড় সমস্যাই ছিল। এন এস এফ নামে তখন সরকার সমর্থিত একটি ছাত্র দল ছিল। তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিল। তারা ঘুরতো হকি স্টিক নিয়ে, ছুরি নিয়ে। কারো কারো হাতে থাকতো রিকশার চেইন। রিকশার চেইন না-কি অস্ত্র হিসেবে ভয়াবহ। দুএকজন ভাগ্যবানের কাছে ছিল পিস্তল।

    অন্য হলের কথা জানি না। আমাদের মহসিন হলে মাস্তান ছেলেদের জন্যে হলের বাবুর্চি আলাদা করে রান্না করত। তাদের খাবার পৌঁছে যেত তাদের ঘরে। এর জন্যে তাদের আলাদা কোন টাকা-পয়সা দিতে হত না। হলের শিক্ষকরা এইসব ব্যাপার অবশ্যই জানতেন। জেনেও না জানার ভান করতেন। আমি একটি ভয়াবহ ঘটনার উল্লেখ করে আমার কথার সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করব।

    সবে সন্ধ্যা হয়েছে, পলিটিক্যাল সায়েন্সের আমার পরিচিত এক ছাত্র মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ছুটে এসে বলল, ছতলায় এক কাণ্ড হচ্ছে, দেখে। আস। গেলাম ছ তলায়। একেবারে সিঁড়ির গোড়ার ঘরটা বন্ধ। ভেতর থেকে একটি মেয়ের চাপা কান্নার শব্দ আসছে। বাইরে তিন/চারজন কৌতূহলী ছেলে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, কি হয়েছে?

    তারা চাপা গলায় বলল, একটা মেয়েকে আটকে রেখেছে।

    তার মানে কি?

    তার মানে যা বলল তাতে আমার মাথা খারাপ হবার অবস্থা। ছ থেকে সাতজন মাস্তান ঐ ঘরে আছে। নারকীয় কাণ্ড হচ্ছে বিকেল থেকে। মেয়েটা এক সময় চিৎকার করছিল–এখন তাও করছে না। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, স্যারদের বলা হয়েছে?

    বলা হয়েছে। বলে লাভ নেই–স্যাররাও জানেন কারা এসব করছে।

    আমি ছুটে গেলাম আমাদের ব্লকে যে অ্যাসিস্টেন্ট হাউস টিউটর থাকতেন তাঁর কাছে। তিনি বললেন, তুমি তোমার নিজের কাজে যাও, আমরা দেখছি কি করা যায়।

    তাঁরা কিছুই দেখলেন না। এই ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে। আজকাল কিছু কিছু শিক্ষক যখন বলেন তাঁদের সময়টা ছিল স্বর্ণযুগ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন কঠিন। তখন অনেক কষ্টে আমি হাসি চাপি।

    আমাদের সময়ই শহীদুল্লাহ হলের (ঢাকা হল) একজন হাউস টিউটরকে অপমান করবার জন্যে এক প্রসটিটিউটকে নিয়ে আসা হল। সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাম ধরে ঐ শিক্ষককে ডাকতে লাগল।

    সরকার সমর্থিত এন এস এফ এর প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল দেখার মত। কারো হলে সীট হচ্ছে না। এন এস এফ-এর বড় চাঁইকে ধরলেই সীট হয়ে যেত।

    ত্রাস সৃষ্টিকারী কিছু চরিত্রের মধ্যে খোকা এবং পাঁচপাত্তুরের নাম মনে পড়ছে। এদের একজন পকেটে জীবন্ত সাপ নিয়ে বেড়াতো বলে শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়। এলাকায় সন্ত্রাসের সূচনা ওরাই করে। আমরা এখন সেই ট্র্যাডিশান বহন করে চলেছি–এর বেশি কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তখনো ছিলেন অসহায়, এখনো অসহায়। তাঁদের মেরুদণ্ড তখনো অশক্ত ছিল। এখনো অশক্ত আছে।

    যাক এসব কথা। হল জীবনের কিছু স্মৃতির কথা বলি। হলে থাকা ছেলেদের মধ্যে একটা বড় অংশই ছিল দরিদ্র। অনেকেই প্রথম এসেছে ঢাকা শহরে। কিছুতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। টাকা-পয়সা যা দেশ থেকে আসছে তাতে প্রয়োজন মিটছে না। প্রাইভেট টিউশানি ব্যাপারটি তখনো চালু হয় নি। এদের বাড়তি রোজগার বলতে কিছু নেই। এই ছেলেগুলি কখনো সকালে নাশতা করে না। বিকেলেও কিছু খায় না। ক্ষিধেয় অস্থির হয়ে এরা অপেক্ষা করে কখন রাতের খাবার দেয়া হবে। সন্ধ্যা হতেই এরা ডাইনিং হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, কখন ডাইনিং হল খোলা হবে। এদের নিয়ে হলের অন্য ছাত্ররা নানান ধরনের রসিকতা করে। হাসাহাসি করে। হলের স্মৃতি মনে হলেই আমার এই ছেলেগুলির কথা মনে হয়। হল সম্পর্কে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এই ছেলেদের সব সুখস্মৃতি নিশ্চয়ই ক্ষুধার নিচে চাপা পড়ে গেছে। আমি হলে থাকাকালীন সময়েই এদের একজন ইলেকট্রিক হিটারের তার হাতে জড়িয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। না, কোন প্রেমঘটিত ব্যাপার না–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাবার মত অর্থ জোগাড় করতে পারছে না, আবার বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তেও পারছে না। সে এই কষ্ট থেকে মুক্তি চায়।

    .

    সেই সময়কার খবরের কাগজে আমাদের হলেরই একটি ছেলে বিজ্ঞাপন ছাপাল–সে কোন ধনী পিতার কন্যাকে বিবাহ করতে চায়। বিনিময়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ দিতে হবে। সেই ছেলেকে নিয়ে কত হাসাহাসি। কেউ ভেবেও দেখল না কি গভীর বেদনায় সে পয়সা খরচ করে ঐ বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

    চারতলায় থাকতেন এক মৌলানা সাহেব। তার কথা মনে পড়ে। অতি ভদ্রলোক। দেখা হলেই হাসিমুখে নানান খবর জিজ্ঞেস করবেন। ভদ্রলোক ছিলেন মৌলানায়ে মুহাদ্দেস। সম্ভবত আরবী পড়তেন। তিনি একটা পাখি পুষেছিলেন। খাঁচায় বন্দি সেই পাখির যত্ন ছিল দেখার মত। পাখিটি অতিরিক্ত যত্নের কারণেই বোধহয়–মারা গেল। মৌলানা দীর্ঘ একটি শের (কবিতা) রচনা করলেন। যার প্রথম চরণ–

    মেরা বুলবুল মর গিয়া।

    যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই ধরে ধরে দীর্ঘ কবিতা শুনিয়ে অশ্রুবর্ষণ করেন।

    সপ্তাহখানেক পর তাঁর আত্মীয়স্বজনরা খবর পেয়ে তাকে দেশের বাড়ি নিয়ে গেল। কারণ পাখির শোকে তিনি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। এই মৌলানা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন নি।

    *

    মহসিন হলের ছতলার একটা ঘর ছিল ভূতে-পাওয়া। বাইরে থেকে তালাবন্ধ কিন্তু ভেতর থেকে গুনগুন গানের শব্দ পাওয়া যায়। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় কে যেন স্যান্ডেল পায়ে হাঁটে। রহস্য ভেদ হল দীর্ঘদিন পর। হাউস টিউটররা এক রাতে সেই ঘরে ঢুকে কাবার্ড খুলে রূপবতী এক তরুণীকে আবিষ্কার করলেন। স্যাররা হতভম্ব। জানা গেল মেয়েটি এই রুমের বাসিন্দা স্ট্যাটিসটিকস পড়ে জনৈক ছাত্রের স্ত্রী। দুজনে গোপনে বিয়ে করেছে। দুজনের বাবা-মাই তাদের বের করে দিয়েছে। বেচারা স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় যাবে! হলে এনে লুকিয়ে রেখেছে কাবার্ডে। এইখানেই এই অসহায় মেয়েটি ছমাস ছিল। দেশের এবং দেশের বাইরের কিছু সংবাদপত্রেও ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। যেসব মাস্তানরা মেয়ে নিয়ে এসে জঘন্য কীর্তি-কাহিনী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কিছুই বলে না। কিন্তু অসহায় এই ছেলেটিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের জন্যে বহিষ্কার করা হয়।

    .

    ১৯৬৯ সন। হলের টিভি রুমে আমরা বসে আছি অনেক রাত। রেডিও বাজছে। রানিং কমেট্রি হচ্ছে। অসম্ভব নাটকীয় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। মানুষ নামছে চাঁদে। আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছি–সত্যি কি নামতে পারবে? এই

    তো, এইতো নামল। আমরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম। আনন্দে দুটা চেয়ার ভাঙা হল। জানালার সব কটা কাঁচ ভাঙা হল। একজন উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে অচেতন হয়ে পড়ে গেল। তাকে বাতাস করা হচ্ছে, মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। কি অপূর্ব অভিজ্ঞতা।

    *

    সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড লেগেই থাকতো। কবিতা পাঠের আসর, গল্প পাঠ, রবীন্দ্র জন্মোৎসব–কিছু না কিছু আছেই। ছাত্রদের প্রবল উৎসাহ। প্রাণশক্তিতে ছেলেরা যে ঝলমল করছে তা স্পষ্ট বোঝা যেত। উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানে সেই প্রাণশক্তির পূর্ণ প্রকাশ দেখলাম। জীবনকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কত তুচ্ছ মনে করে তা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। গুলি হচ্ছে নীলক্ষেতে–কারফিউ চলছে। সেই কারফিউ অগ্রাহ্য করে মহসিন হলের ছেলেরা ছুটে গেল। গুলিবিদ্ধ দুটি মানুষকে হলে নিয়ে এল। তখন গভীর রাত। মানুষ দুটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমরা ভীত চোখে দেখছি।

    এদের চিকিৎসা প্রয়োজন–কারফিউর ভেতরই ছেলেরা এদের নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। এই স্মৃতি কি করে ভুলি?

    আরেকটি কথা না বললে রচনা অসম্পূর্ণ থাকবে। আমার লেখালেখি জীবনের শুরু হয় মহসিন হলে। ৫৬৪ নম্বর রুমেই রাত জেগে জেগে লিখে ফেলি প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস–নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার। যাত্রা শুরু করি অচেনা এক পথে। সেই পথ দুঃখ ও আনন্দময়।

    বছর পাঁচেক আগে মহসিন হলে গিয়েছিলাম। রাত দশটার মত বাজে। চুপি চুপি ৫৬৪ নম্বর রুমের সামনে দাড়িয়ে দরজায় টোকা দিলাম। এক ছেলে দরজা খুলে ভয়ংকর গলায় বলল, কি চাই?

    আমি থতমত খেয়ে বললাম, রং নাম্বার। ভুল জায়গায় এসেছি।

    পুরানো তীর্থক্ষেত্র দেখার শখ ছিল। দেখা হল না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসূর্যের দিন – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article দেখা না-দেখা – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }