অনুভবে তুমি – ৫
।।৫।।
আপনার ফোনটা একটু পাওয়া যাবে? মানে একটা বিশেষ কারণে আমি আমার ফোনটা সুইচড অফ করে রেখেছি, তাই প্লিজ হেল্প মি।
নৈঋতের কথা শেষ হবার আগেই চমকে উঠলো অহনা। আরে নৈঋত, আপনি এখনও যাননি? এখনও রাইগঞ্জ স্টেশনে আপনি কি করছেন মশাই? আপনাকে তো বাচ্চুদা মিনিমাম তিনঘণ্টা আগে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে গেছে, তখন থেকে আপনি বুঝি রাইগঞ্জ স্টেশনে বসে ট্রেন কাউন্ট করছিলেন?
নৈঋত মেয়েটাকে প্রথমে চিনতে পারেনি। জিন্স আর জ্যাকেট, মাথায় প্রায় মুখ ঢাকা টুপি, এখন গলা শুনে আর আলোতে কাছ থেকে দেখে বুঝতে পারলো, মেয়েটা অহনা। এর সঙ্গেই মধ্যরাতের লগ্নে ওর বিয়ে হবার কথা ছিল। নৈঋত ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কিন্তু আপনি এখনও স্টেশনে কি করছেন? আপনার ফিঁয়াসে কোথায়? আপনি যে বললেন, সে বাইরে আপনার জন্য ওয়েট করছে। আমি আপনার মাথায় সিঁদুর পরালেই নাকি সে সুইসাইড করবে, তো সেই মহান প্রেমিকটি কোথায়? আপনি একা কেন?
অহনা একটু সামলে নিয়ে বললো, আছে সে আছে, তার কাছেই তো যাবো এখন। কিন্তু আপনি কেন এখনও বাড়ি পৌঁছাননি বলবেন?
নৈঋত বিরক্তির স্বরে বললো, বিয়েটা যখন করবেন না তখন আগে কেন জানিয়ে দিলেন না? আপনি তো বোবা নন, আর তাছাড়া আপনার ফোনে ব্যালেন্স ছিল না এমনও নয়। এই মুহূর্তে আমি বাড়ি ফিরে যাব কি করে সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
অহনা বললো, আমাদের তো ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই তো বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম, কি করে বুঝবো বলুন প্রাক্তন আবার ফিরে আসবে, তাও আবার বিয়ের রাতে।
নৈঋত অসহিষ্ণু গলায় বলল, তার দায় কি আমার? এখন যদি সেখানে গিয়ে দেখেন আপনার প্রাক্তন আবার মত বদলেছে তাহলে কি আপনি আমাকে রিকল করবেন ভেবেছেন নাকি? শুনুন মিস অহনা, আপনি আপনার বাড়িতে সত্যিটা বলে তবেই বিয়ের আসর থেকে বেরোতে পারতেন। অকারণ আমাকে ভাগিয়ে দিয়ে বর পালিয়েছে বর পালিয়েছে রব না তুললেই ভালো করতেন! আমার তো একটা সোশ্যাল স্ট্যাটাস আছে নাকি? তাছাড়া আমাদের বসু পরিবারে আমার পরিচয় গুড বয় হিসাবে। গোটা পরিবারের চোখে আমাকে ছোট করে দিয়ে আপনার ঠিক কি লাভ হলো বলুন তো? আপনার মা আমায় রিকোয়েস্ট করেছিলেন, আপনাকে যেন ভালো রাখি। তিনিও ভাবলেন আমি লগ্নভ্রষ্টা করে দিলাম আপনাকে। চলুন, আপনাদের বাড়িতে চলুন, সত্যিটা সবাইকে বলবেন, তারপর আপনার এক্সের কাছে যাবেন। আমিও চাইনা আমার কাঁধে অপরাধের বোঝা চাপিয়ে ঘুরতে। আমার মা-বাবাকে সকলের সামনে ছোট করার কোনো অধিকার আমার নিজেরও নেই। অহনার একটা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো নৈঋত। এই মেয়েটার জন্য ওকে সবাই ভুল বুঝবে, আর এই মেয়েটা ওর প্রাক্তনের সঙ্গে হানিমুন করবে এটা তো হতে পারে না। নৈঋত ভালো ছেলে ঠিকই, কিন্তু এতটাও উদার নয়। পুরো বিষয়টা আরেকবার ভাবার চেষ্টা করলো ও। ঠিক কিভাবে ঘটে গেল ঘটনাটা।
আগে বিয়ের আসরে নৈঋতকে আনা হয়েছিল, কয়েকটা মন্ত্র পড়ার পরে আরেকটা ড্রেস চেঞ্জের জন্য ডাকা হলো ওকে। সেই ঘরে ঢুকতেই লাল বেনারসি পরা মেয়েটা এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলেছিল, প্লিজ আমায় বিয়ে করবেন না। এখুনি জানতে পারলাম আমার এক্স ওয়েট করছে আমার জন্য, আপনি পালান এখান থেকে। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমার এক দাদা আপনাকে স্কুটি করে রাইগঞ্জ স্টেশনে ছেড়ে দেবে। ওখান থেকে ট্রেন ধরলেই হাওড়া চলে যাবেন। প্লিজ হেল্প মি, আমি বিয়েটা করতে পারবো না। পিছনের গেট দিয়ে পালান, বাচ্চুদা আপনাকে পৌঁছে দেবে।
সানাইয়ের সুরটা বিষণ্ণ ঠেকেছিলো নৈঋতের কানে। অহনার চোখের আকুতি মুহূর্তের জন্য ভাবিয়েছিলো ওকে। নিজের পরিস্থিতির কথা না ভেবেই অহনার দেখানো পথে পালিয়ে এসেছিল বিবাহ আসর ছেড়ে। ঘন অন্ধকার পথে স্কুটিতে করে আসতে আসতে প্রথম মনে হয়েছিল, বসু বাড়ির সকলে কি ভাবে নেবে ব্যাপারটা। তাছাড়া অহনার মাও তো ভাববে নৈঋত ওনার মেয়েকে এই অবস্থায় রেখে পালিয়ে গেল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক স্টেশনের ঠান্ডায় বসে থেকে বেশ শীত ধরে গিয়েছিল ওর। এখন অহনাকে দেখে মাথার মধ্যে একটা অদ্ভুত বিজবিজে রাগ চাড়া দিচ্ছে। এই মেয়েটার এক্সের চক্করে পড়ে আজ ওর এই অবস্থা! নৈঋতের আচমকা টানে ব্যালেন্স না রাখতে পেরে অহনা এসে পড়লো নৈঋতের বুকের কাছে। শিরশির করে উঠলো অহনার গোটা শরীর। নৈঋতের পুরুষালি শক্ত হাতটা তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছে অহনাকে।
বেসামাল নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো, বিয়ে করতে এসেছিলেন বলে কি পুরো ডিওর শিশি গায়ে ঢালতে হয় নাকি! বাই দ্য ওয়ে এটা কোন ব্র্যান্ড?
নৈঋত অবাক হয়ে তাকালো অহনার দিকে। মেয়েটা কি উন্মাদ? এরকম একটা ভয়ানক পরিস্থিতিতে এমন প্রশ্ন করছে কি করে মেয়েটা! এ তো ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারবে মনে হচ্ছে। মুখে এক ফোঁটাও মেকআপ নেই, একটু আগের দেখা মেয়েটাই যেন নয়। দুই কপালের মাঝের লাল টিপ, চন্দনের বিন্দুগুলো উধাও, দুই সিঁথির মাঝের ছোট্ট সোনালী টিকলিটাও তো নেই। খোঁপা ঘিরে লালগোলাপ আর জুঁইয়ের মালারাও আর নেই, তার পরিবর্তে একটা ব্যাকক্লিপ ঘাড়ের কাছে এলোমেলো করে ধরে রেখেছে অহনার চুলগুলোকে।
মেকআপবিহীন চোখদুটো যেন আরও বুদ্ধিদীপ্ত। কাজলের রেখা আঁকা সলাজ চাহনি নেই, পরিষ্কার স্বচ্ছ চোখের চাহনিতে আত্মবিশ্বাসী অহংকার।
নৈঋত নিজের পরিস্থিতি ভুলে তাকিয়ে থাকলো অহনার দিকে। মেয়েটা নিখুঁত সুন্দরী নয়, তথাকথিত সেক্সি লুকও নয়, তবুও কি যেন আছে ওর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ চেহারায়। সেটা যে ঠিক কি তা আদৌ আবিষ্কার করতে পারেনি নৈঋত, কিন্তু যেদিন অহনাকে প্রথম দেখেছিলো সেদিনও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিল। আজও একইভাবে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
অহনা নিজেকে নৈঋতের বাঁধনমুক্ত করে বললো, বললেন না তো কোন ব্র্যান্ড?
নৈঋত ইতস্তত করে বললো, বন্ধুরা মিলে বিয়ে করতে আসার আগে পুরোটাই গায়ে ঢেলে দিয়েছিল।
অহনা চোখটা নিচু করে বললো, আমি রিয়েলি সরি নৈঋত, আমার জন্য আপনাকে এমন অকোয়ার্ড পজিশনে পড়তে হলো।
নৈঋত থমকে বললো, প্লিজ আমাকে দায়মুক্ত করুন, অন্তত আমায় বাবা, মা, পরিবারের সকলে যেন ভুল না বোঝে। অহনা নরম গলায় বলল, এখুনি সম্ভব নয় সেটা। কারণ আমার বাড়িতেও আমায় খুঁজছে সবাই। তাই আমি ফোন করলেই ওরা আবার জোর করে আমায় বাড়ি নিয়ে যাবে। তবে কয়েকটা দিন পরে আমি নিজে কাবেরী আন্টিকে ফোন করে বলে দেব আপনি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
টিকিট কাউন্টারে ঢুকেই অহনা বললো, একটা কালিয়াগঞ্জ দেবেন। পরক্ষণেই নৈঋতের দিকে তাকিয়ে একটা বিস্কিট কালারের জ্যাকেট নিজের ব্যাগ থেকে বের করে দিয়ে বললো, একটু ছোট ছোট হবে হয়তো, তবুও বেশ ঠান্ডা রয়েছে, পরতে পারেন। নৈঋত অনেকক্ষণ ধরেই শীতে কাঁপছিল। কিন্তু বাড়িতে কিভাবে ফেস করবে ভাবতে ভাবতে শীতের অনুভূতিটাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছিল না। জ্যকেটটা দেখে যেন হাতের চেটো দুটো আরও ঠান্ডা হয়ে গেল। অহনার হাত থেকে জ্যকেটটা নিয়ে পরে ফেললো। বুকের চেনটা অর্ধেক উঠে আটকে গেছে চেস্টে, তবুও একটা উষ্ণতা জড়িয়ে ধরলো ওর শীতল হয়ে আসা শরীরটাকে। কৃতজ্ঞ চোখে অহনার দিকে তাকিয়ে বলল, থ্যাংক ইউ। কিন্তু আপনি যদি আমায় নির্দোষ প্রমাণ না করেন তাহলে তো আমি আমার বাড়িতে পা রাখতেই পারবো না। সকলে ভাববে আমি আপনাকে বিবাহবাসরে ছেড়ে পালিয়ে এসেছি সেই দুঃখে আর অপমানে আপনিও চলে এসেছেন বাড়ি থেকে। আঙুলটা তো আমার দিকেই ওঠানো থাকবে অহনা, তাই প্লিজ…
নৈঋতের কথা শেষ হবার আগেই হো হো করে হেসে উঠলো অহনা। তারপর লালচে নেলপলিশ লাগানো আঙুলগুলো সমেত ডান হাতটা নিজের মুখে চেপে ধরে হাসিটা থামাতে চাইলো। নৈঋত বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি কি ম্যাড? আচমকা কাঁদেন, কখনো হাসেন, প্রবলেমটা কি আপনার?
অহনা হাসতে হাসতেই গম্ভীর হয়ে বলল, আমি কি করবো, ইউ লুক লাইক এ জোকার। মেরুন ধুতি, ক্রিম পাঞ্জাবি আর বিস্কিট আর পিঙ্ক মিক্স কালারের লেডিস জ্যাকেট, হোয়াট এ কম্বিনেশন ইয়ার!
নৈঋত নিজের দিকে তাকিয়ে হেসেই ফেললো শেষ পর্যন্ত। তারপর বললো, জীবনে প্রথম ধুতি পরলাম অথচ স্যুট করলো না। অহনা ফিসফিস করে বললো, আপনি হাওড়ার টিকিট কাটুন, দিয়ে বাড়ি ফিরুন, আমার বাড়িতে এতক্ষণে সবাই জেনে গেছে পালানোর খবরটা, তাই ওরাও খুঁজতে বেরোবে। নৈঋত একটু ভেবে নিজের ওয়ালেটটা বের করে বললো, আমাকেও একটা কালিয়াগঞ্জ দেবেন। অহনা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, আপনি কি করবেন সেখানে?
নৈঋত একটু গম্ভীরভাবে বললো, আপনার এক্সকে দেখতে যাচ্ছি, আপত্তি নেই নিশ্চয়ই, থাকলেও শুনছি না। চিন্তা নেই, দূর থেকে দেখেই চলে আসব, আসলে এমন ঘটনা তো শুধু রুপালি পর্দায় দেখা যায়। আজ যখন সেটা আমার সঙ্গেই ঘটলো তখন শেষ দৃশ্যের সাক্ষী হতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
অহনা থতমত খেয়ে বললো, তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি পরে হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের যুগলের ছবি পাঠিয়ে দেব। নৈঋত ক্লান্ত স্বরে বললো, ছবিতে কি আর সব বোঝা যায়? আমার মা যখন আপনার ছবি আমায় দেখিয়ে বলেছিল, দেখ তো টুটাই তোর পছন্দ কিনা? তখন কি আপনার পিঙ্ক টিশার্টে আর ব্ল্যাক জিন্সে লেখা ছিল, আপনি বিয়ের রাতে এক্সের সঙ্গে পালিয়ে যাবেন? তাই ছবিতে সবটুকু বোঝা যায় না, বরং লাইভ দেখাই বেস্ট। অহনা চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে বলল, এবারে কিন্তু আপনি অযথা বিব্রত করছেন আমায়। বুঝলাম আমি আপনার সঙ্গে অন্যায় করেছি, তাই বলে এভাবে অপ্রস্তুত করছেন কেন?
নৈঋত বললো, একটা অ্যানাউন্স হচ্ছে, এই ট্রেনটাই সম্ভবত কালিয়াগঞ্জ নামক অচেনা কোনো এক স্টেশনে থামবে, তাই না? চলুন, বাকি বিতর্ক ট্রেনে সেরে নেবেন।
ট্রেনটা জান্তব শব্দ করে এসে থামলো রাইগঞ্জ স্টেশনে। অহনার সঙ্গে নৈঋতও উঠলো একই কামরায়।
।।৬।।
কি রে মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন? তোর না চাকরির ইন্টারভিউ ছিল? এই প্রিয়াঙ্কা, বল না কিছু।
প্রিয়াঙ্কা ওর খসখসে গালে হাত বুলিয়ে বললো, হ্যাঁ রে অনিক তোর বাবা কখনো মদ খেয়ে তোর মাকে এসে পেটায়? কখনো তোর বোনকে খানকি বলে গালাগাল দেয়? কখনো তোর পড়ার সময় লাইট নিভিয়ে দিয়ে বলে, যা ল্যাম্প পোস্টের সামনে গিয়ে দাঁড়া গে যা! সেই ছোট থেকে দেখছি এই বাবা নামক প্রাণীটাকেই মা দুবেলা ভাত বেড়ে দেয়। রাতে বিছানাতেও সঙ্গ দেয়। স্কুল, কলেজে গিয়ে শুনলাম বাবাদের কাছে নাকি সব থেকে আপন হয় মেয়েরা। মেয়েদের সব আব্দার নাকি পূরণ করে বাবারা। জানিস অনিক, আমি আমাদের পাড়ার ওই মনসা মন্দিরের সামনে দিয়ে যাবার সময় রোজ প্রার্থনা করি, যেন আমার বাবাটা মরে যায়। কিন্তু ওই শালীও তো বড়লোকের ঠাকুর রে। তাই আমার কথা কিছুতেই শোনে না জানিস! অনিক প্রিয়াঙ্কার হাতটা আলতো করে ধরে বলল, আবার মুড অফ করিস না। বল না, ইন্টারভিউ কেমন ছিল? পোস্টঅফিসের ক্ল্যারিক্যাল জবটা কি হয়ে যাবে? কি মনে হচ্ছে রে? প্রিয়াঙ্কা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, যদি দেখতে সুন্দর হতাম ঠিক একটা জব জুটিয়ে ফেলতাম বুঝলি। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝেছি, শহরে পাত্তা পাওয়া আমার কম্ম নয়। শালা বড় অফিসের রিসেপসনিস্টগুলোকে দেখবি, যেন মনে হয় গা দিয়ে মাখন গড়িয়ে পড়বে। আমার চামড়া দেখ, ঘর্ষণ বল তৈরি হবে বুঝলি! তাই এসব ক্ল্যারিক্যাল জবের জন্যই লড়তে হবে। অনিক বললো, মুড ঠিক করলে ফুচকা খাওয়াবো। প্রিয়াঙ্কা হেসে বললো, ওসব বড়লোকের রোগ আমার নেই রে। মুড সুইং করার মত বিলাসিতা কি আমাকে মানায়? আমি তো জ্ঞান হয়ে ইস্তক দেখছি, বাবা মাকে ধরে রাতে মারে, আর দিনের বেলায় ভদ্রলোক হয়ে রঙের কাজে যায়। আমার বাবার টাকাপয়সা নেই এটা ভাবিস না। বাবার আন্ডারে গোটা পাঁচেক লোক খাটে। ওই যে নতুন কলোনিতে যে ছয়খানা ফ্ল্যাটবাড়ি হলো দেখলি, পুরো কাজটা বাবাই কন্ট্র্যাক্ট পেয়েছিলো। আসলে কি বলতো, বাবার টাকার হিসেবটা আমরাই কোনোদিন পেলাম না। এই আমার টিউশনির টাকায় নিজের লেখাপড়াটা চালিয়ে গেলাম। বাবা যে তার টাকা ঠিক কোথায় কি কাজে লাগায় আমি বা মা কেউ জানি না। তরল পদার্থে ওড়ায় সেটা জানি, আর সংসার খরচ বাবদ মায়ের হাতে যা দেয় সেটাতে টেনে টুনে খাওয়াটুকু জোটে। রোজ মাছ-মাংস না হলেও নিরামিষ জুটে যায়। এসব নিয়ে আমার তেমন আক্ষেপ নেই রে। শুধু একটাই প্রার্থনা করি ভগবানের কাছে, ওই লোকটাকে নরকে পাঠিও। আসলে পীযুষ বিশ্বাসের মেয়ে বলে লোকের কাছে পরিচয় দিতেই লজ্জা করে রে।
অনিক নিজের ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে বললো, খা। এসব কথা তো আমি জানি রে প্রিয়াঙ্কা। রোজ রোজ বলে নিজেকে কেন ক্ষতবিক্ষত করিস তুই?
প্রিয়াঙ্কা জলের ঢোকটা গিলে নিয়ে বললো, জানি তুই জানিস, কিন্তু তুই একটা কথা জানিস না যে আমার সব দুঃখ উগরে দেওয়ার জায়গাটাও তো তুই। অনিক, তোদের মত স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলিতে আমার মত মেয়েকে মেনে নেবে রে? অনিক একটু চুপ করে থেকে বললো, জানি না রে, তবে আমি এটুকু বুঝি, আমি ছাড়া তোকে কেউ বুঝবে না। তাই তোকে ছেড়ে কোথাও যেতেও পারবো না। প্রিয়াঙ্কা অনিকের হাতটা ধরে বলল, এখানে কি সেক্সি মেয়ের অভাব আছে নাকি বে? তোর কি মরন হয় না, এমন মরা কাঠের পিছনে জীবনটা বরবাদ করছিস কেন?
অনিক হেসে বললো, কি করবো বল, আমি কাঠে তেল মাখাতেই ভালোবাসি। আর শোন, আমি গতকাল প্রথম মাইনে পেলাম তাই তোর জন্য কয়েকটা গিফট এনেছি, প্লিজ নেব না বলিস না।
প্রিয়াঙ্কার চোখে শেষ বিকেলের কষ্ট মাখামাখি খাচ্ছে। ঠেঁটের কোণে জমে থাকা দুঃখ মেশানো ক্লান্তির ছায়া।
তবুও অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল, গিফট, মানে উপহার? তুইই তো আমার সব থেকে কিমতি উপহার রে পাগল। অনিক নিজের ব্যাগ থেকে একটা সিলভার কালারের রিস্টওয়াচ আরেকটা মেকআপ বক্স বের করে বললো, আমার জন্য সাজবি বুঝলি! তুই নিজেই জানিস না তুই কতটা সুন্দর। আমি বাইরে থেকে পরিষ্কার দেখতে পাই তোর ঝকঝকে মনটা। ঠিক শাপলা দীঘির জলের মত। লোকে বলে, মুখ হলো মনের আয়না। যার মন এমন স্বচ্ছ তার মুখে কেন সবসময় দুশ্চিন্তার রেখারা আঁচড় বসাবে বলতে পারিস? শোন না, সেই যে যেদিন তোকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিন যেমন ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক ছিল, দুই ভ্রুর মাঝে একটা ছোট্ট মেরুন টিপ ছিল, অমন করে সাজবি আমার জন্য! প্লিজ, না বলিস না।
প্রিয়াঙ্কা অবাক চোখে তাকালো সুপুরুষ অনিকের দিকে। ছেলেটা যে ওর মধ্যে ঠিক কি দেখেছে ও নিজেও জানে না। তবে অনিক যে ওকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে সেটা ও বেশ বোঝে। শুধু প্রিয়াঙ্কা নয়, ওর প্রতিটি শিরার লোহিতকণিকারাও জানে, অনিকের ভালোবাসাটা প্রথম বসন্তের নতুন পাতা গজানোর মতই অরিজিনাল। তাই অনিক যখন এভাবে আব্দার করে তখন মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে না প্রিয়াঙ্কা। কি বা এমন চায় ছেলেটা? ও সাজলে নাকি অনিকের আনন্দ, আসলে প্রিয়াঙ্কার খুশিতেই ছেলেটা খুশি হয়ে যায়। প্রিয়াঙ্কার চোখের কোনে আচমকা মেঘের আনাগোনা দেখেই অনিক হেসে বললো, যাক আগ্নেয়গিরিতেও মেঘের দেখা মেলে তাহলে!
একটা কথা মনে রাখিস প্রিয়াঙ্কা, তোর উডবি এখন সরকারি চাকুরি, তাই তুইও মস্ত বড়লোক। যখন যা দরকার ফোনে হুকুম করবি, যদি ততদিনে মাইনে শেষ না হয়ে যায় তাহলে তোর পায়ে হাজির হয়ে যাবে। নাহলে পরের মাসের মাইনে পাওয়া পর্যন্ত একটু ওয়েট করতে হবে, ব্যস। প্রিয়াঙ্কা বললো, ইন্টারভিউ ভালো ছিলো বুঝলি, আমারটাও বোধহয় লেগে যেতে পারে।
অনিক চুপি চুপি বললো, তোর জবটা হয়ে গেলে, দুজনের টাকায় লোন নিয়ে একটা দু কামরার ফ্ল্যাট নেব বুঝলি। বিয়ের পর সোজা ওই ফ্ল্যাটে উঠবো। তাহলে আমার বাড়ির কেউ তোকে অপমান করতে পারবে না কারণে অকারণে।
প্রিয়াঙ্কা কষ্ট করে হেসে বললো, স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে রে আমার চোখদুটো। দেখি তোর এই মেকআপ কিটস থেকে কাজল পরলে হয়তো আবার সব চিন্তা ঘুচিয়ে তোর মত স্বপ্ন দেখবে এই চোখদুটো। কিছুক্ষনের জন্যও যদি ভুলতে পারি নিজের অবস্থানটা তাহলেও শান্তি।
অনিক বললো, বললি না তো ঘড়িটা কেমন হয়েছে? তোর পছন্দ হয়েছে?
প্রিয়াঙ্কা আনমনে বললো, আমি তো তোকে বলিনি যে গত সপ্তাহে আমার ঘড়িটা হারিয়ে গেছে, তাও তুই কি করে বুঝতে পারিস রে আমার কোনটা প্রয়োজন?
অনিক নরম গলায় বলল, বললাম না, তোর মনটা দেখতে পাই। প্রিয়াঙ্কা আলগোছে বললো, আর কি কি দেখতে পাস? অনিক চোখটা সরু করে বললো, বাকি সব ওই নতুন ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখবো বিয়ের পর। আর যদি তুই ততদিন ধৈর্য্য ধরে না থাকতে পারিস একান্তই এখনই দেখাতে চাস, তাহলে …
প্রিয়াঙ্কা হেসে বললো, বজ্জাতি করিস না।
অনিক বললো, চল ফুচকা খাই, তোর মুড এখন বেটার হয়েছে। ফুচকাওয়ালাকে নুন ঝাল কম দেবার জন্য বকাঝকা করতেও পারবি, চল। প্রিয়াঙ্কা বললো, এত ভালোবাসিস কেন রে আমায়, বড্ড ভয় করে যে। ভালোবাসা শব্দে আমার বড্ড আতংক, ছোট থেকে পাইনি তো কখনো। অনিক ওর হাতটা চেপে ধরে বলল, বড়বেলায় পাবি, এখন চল তো…
প্রিয়াঙ্কার ঠোঁটে উন্মুক্ত আকাশের মতই একমুঠো হাসি ছড়িয়ে পড়লো। ফিসফিস করে বললো, পাগল একটা।
ফুচকার টক ঝাল স্বাদ জিভের মধ্যে পড়তেই প্রিয়াঙ্কার মনে পড়ে গেলো মায়ের বেশ কিছুদিন হল রাতের দিকে বমি বমি পাচ্ছে। মা বলছিলো, জানিস প্রিয়া জিভটা টক হয়ে থাকছে আর গলার কাছটা ঝাঁঝ মত। প্রিয়াঙ্কা নিজের ঘরের বিছানা গোছাতে গোছাতে বলেছিল, বাবাকে বলো, একটা ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে। যার জন্য দু বেলা রেঁধে বেড়ে রাখছো, তার তো এটুকু কর্তব্য, তাই না মা? মায়ের মুখটা মুহূর্তে থমথমে হয়ে গিয়েছিল। মা জানে প্রিয়াঙ্কা বাবা নামক মানুষটাকে মোটেই সহ্য করতে পারে না, তারপরেও মা যে কেন তাকে এত যত্ন করে সেটাই বুঝতে পারে না ও। কিন্তু ওই লোকটার প্রতি একটা আক্রোশ মনের মধ্যে জমিয়ে জমিয়ে আগুনের ফলার মত তীক্ষ্ন করে রাখছে ও। সুযোগ পেলেই ওই আগুনে পুড়িয়ে মারবে লোকটাকে।
উফ, কি ঝাল রে! বলে চেঁচিয়ে উঠলো অনিক। প্রিয়াঙ্কার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল মুখের ভিতরে টক ঝালের অনুভূতিতে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, হ্যাঁ রে অনিক, আমাদের দেশে আইন ফাঁকি দিতে গেলে কত টাকা লাগে রে? অনিক চোখ বড় বড় করে বললো, তুই থামবি! কি ভাবছিস এসব? প্লিজ প্রিয়াঙ্কা, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা দে যে এমন কিছু করবি না যাতে আমার দেখা স্বপ্নের রংটা ঘন কালো অথবা ধূসর হয়ে যায়। চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। প্রিয়াঙ্কা আলগোছে বললো, তুই চলে যা, আমি একবার জীবনদার মেডিকেল স্টোর হয়ে যাবো। মায়ের জন্য অ্যান্টাসিড নিতে হবে।
প্রিয়াঙ্কার দুই ভ্রুর মাঝে বিরক্তি আর দুশ্চিন্তার চিহ্নগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো, অনিকের চলে যাওয়ার ঠিক পরেই। মনে হলো ওর জীবনীশক্তির অর্ধেক যেন নিয়ে চলে গেল অনিক। যেটুকু সময় ওর সঙ্গে ছিল, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল অন্তত, আবার গিয়ে ঢুকতে হবে ওই নরকে। ওর এই চব্বিশ বছরের জীবনটার প্রতিটা মুহূর্ত বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে ওই বাড়িতে। বসন্ত বাতাস ওই বাড়ির জানলা দিয়ে ভুলেও প্রবেশ করে না। তারপরেও যে কি করে অনিক ওর জীবনে এসেছিল কে জানে! অনিকের সঙ্গে প্রথম দেখার মুহূর্তগুলো মনে পড়ছিল ওর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। পিছনে এসে একটা গাড়ি খুব জোরে ব্রেক কষে বললো, শালী গুঙ্গি নাকি? এত হর্ন দিচ্ছি শুনতেই পায় না। প্রিয়াঙ্কা পিছন ঘুরে দেখলো, ছোট গাড়ি নয় রীতিমত একটা ছয় চাকার লরি এসে ব্রেক কষেছে ওর এক হাত পিছনে। নির্বিকার প্রিয়াঙ্কা। ও জানে ভগবান ওকে এত সহজে নেবে না। বহুবার চেষ্টা করেছে ও নিজেকে শেষ করে দেবার, প্রতিবারই কোনো না কোনো কারণে বিফল হয়েছে। ও যদি রেললাইন ধরে চলে তাহলে হয়তো দেখা যাবে দূরপাল্লার ট্রেনের ইঞ্জিনই খারাপ হয়ে গিয়ে থমকে যাবে ওর ঠিক পিছনেই। তাই অ্যাক্সিডেন্টে ওর কোনো ভয় নেই, ও জানে ওর দুর্ঘটনা ঘটবেই না। এক জীবনে আর কটা দুর্ঘটনা ঘটবে? ওর জন্মটাই তো একটা মারাত্মক প্রহসন, ও মনে করে দুর্ঘটনা। পীযুষ বিশ্বাসের নামটা যখন স্কুল কলেজের খাতায় অভিভাবক হিসাবে লিখতে হয় তখন মনে হয়, এর থেকে বড় কোনো প্রহসন ওর জীবনে ঘটতেই পারে না। লরি ড্রাইভারের দিকে ইশারায় বললো, চালিয়ে দাও আমার ওপর দিয়েই।
লরি ড্রাইভার বেশ চেঁচিয়েই বললো, পাগলী শালী।
হ্যাঁ প্রিয়াঙ্কা নিজেও বিশ্বাস করে ও উন্মাদ। নাহলে ওই পরিবেশে থেকেও ও লড়ে যাচ্ছে কি করে? সুস্থ মানুষ যেখানে এক সেকেন্ডও টিকতে পারবে না, সেখানে বছরের পর বছর ধরে আছে ও। প্রিয়াঙ্কা জানে ও আস্তে আস্তে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে। এখন যেমন মৃত্যুভয় ওকে কাবু করতে পারে না, তেমনি অনিককে হারানোর ভয়ও ওকে আর দুর্বল করতে পারবে না।
ও জীবনদা, মায়ের গলা জ্বলছে, রোজ রাতের দিকে বমি বমি ভাব আছে। কোনো ওষুধ হবে গো?
জীবনদা ওর পান খাওয়া লালচে দাঁতে হেসে বললো, তোর বাপ তো একটু আগে প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট কিনে নিয়ে গেল, ভাই-বোনের খবর আছে নাকি আগে দেখ।
সারা শরীরে একটা বিজবিজে ঘৃণার অনুভূতি ওকে চেপে ধরলো। মায়ের পিরিয়ড এখনও হয় ও জানে। বাবার থেকে মা বয়েসে বছর তেরোর ছোট, মায়ের এখনো মেনোপজ হয়নি সেটা প্রিয়াঙ্কা জানে। কিন্তু চব্বিশ বছরের মেয়ের বিয়ে দেবার ভাবনা বাদ দিয়ে তারা এখন বাচ্চা নিচ্ছে? অনিকের ফ্যামিলি আর কি মেনে নেবে প্রিয়াঙ্কাকে? একটু সন্দেহের বশে বললো, জীবনদা মটকা গরম হয়ে আছে, এর মধ্যে ইয়ার্কি ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি একটা লিকুইড অ্যান্টাসিড দাও দেখি। জীবনদা তার ডাক্তারি বিদ্যে ফলিয়ে বললো, যদি তোর মা প্রেগন্যান্ট হয় তাহলে ডাক্তার না দেখিয়ে আমি কোনো ওষুধ দিতে পারব না রে প্রিয়া। তুই কাল কনফার্ম করে তারপর ওষুধ নিয়ে যাস। ঘন্টা খানেক আগেই তোর বাবা ওটা কিনে নিয়ে গেল।
প্রিয়াঙ্কার ইচ্ছে করছিল, সর্বশক্তি দিয়ে জীবনদার গলাটা টিপে ধরে সারাজীবনের মত কথা বলার ক্ষমতাটা বন্ধ করে দিতে। এসব কথা তাহলে আর শুনতে হতো না ওকে। কতজনকে মারবে ও গলা টিপে, এবারে তো সবাই আঙুল তুলবে, পুরো মহল্লা আঙুল তুলে বলবে, কি রে প্রিয়া, ভাই না বোন? এটা কি সত্যি? চোখের সামনে নিজের মেয়ের এমন হেনস্থা দেখেও মা ওদের পরিবারে আরেকটা প্রাণকে আনার সাহস পাচ্ছে? জোরে জোরে বাড়ির দিকে পা চালালো প্রিয়াঙ্কা। সত্যিটা ওকে জানতেই হবে।
।।৭।।
আমাকে সত্যিটা বলো অনিরুদ্ধ, প্লিজ। এসময় ভণিতা ভালো লাগছে না। গোটা বাড়ি ভর্তি আত্মীয়, ছেলের বাড়ির লোকজন অবশ্য চলে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে অহনা তোমার কাছেই গেছে। সুচেতার গলা দিয়ে হিসহিস করে আগুন ঝরছে যেন। অনিরুদ্ধ কাল প্রায় মধ্যরাতের পরে ঘুমিয়েছে। তাই ভোর রাতে এমন একটা ফোন পেয়ে ঠিক মেলাতে পারছে না ঘটনাগুলো। ঘুমের ঘোরে আছে বলেই হয়তো মাথার মধ্যে সুচেতার কথাগুলো কিলবিল করলেও সামঞ্জস্য খুঁজে পাচ্ছে না। অনিরুদ্ধ একটাই কথা বলতে চাইছিলো সুচেতার কথার মাঝে, কি হয়েছে? তিতিরের বিয়ের ব্যবস্থাপনায় কোনো খামতি হয়ে গেছে কি? পাত্রপক্ষ কি খাবার পায়নি? কিন্তু অনিরুদ্ধ তো মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করেনি। নামি ক্যাটারার, সুস্বাদু মেনু, দামি প্লেট সবই করেছিল প্রাণ ভরে। তাহলে খামতিটা কোথায় ঘটলো সেটাই বুঝতে পারছিল না সুচেতার অসংলগ্ন কথাতে। অনিরুদ্ধ ঘুম ঘুম লাল চোখে তাকিয়ে দেখল ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজছে। তার মানে আমন্ত্রিতদের খাবারের টাইম পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তাছাড়া লাস্ট সাড়ে এগারোটাতে যখন অনিরুদ্ধ ক্যাটারিং-এর মালিককে কল করেছিল, তখনও সে বলেছিল, কোনো প্রবলেম নেই। নৈঋত বা ওর পরিবার সম্পর্কে যেটুকু শুনেছিল অনিরুদ্ধ সুচেতার কাছ থেকে তাতে পণের প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া নৈঋতের বাবাও অনিরুদ্ধর সঙ্গে ওর অফিসে এসে পরিচয় করে গিয়েছিলেন, ভদ্রলোককে বেশ ভালোই লেগেছিল অনিরুদ্ধর। তাহলে এতক্ষণে তো বিয়ে সুন্দরভাবে মিটে যাওয়ার কথা। সুচেতার নিশ্চিন্তে কাটানোর সময় যখন প্রায় উপস্থিত তখন কেন ও এতটা উত্তেজিত হয়ে রয়েছে, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিল অনিরুদ্ধ ওর অর্ধেক কাজ করা ঘুমন্ত ব্রেনের সাহায্যে। সুচেতা আবার আক্রমণাত্মক স্বরে বললো, মেয়েকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো বলবে? তোমার সাপোর্ট না থাকলে বিয়ের রাতে অহনা কোনোভাবেই পালাতে সাহস পেতো না। ছি অনিরুদ্ধ, তুমি এভাবে প্রতিশোধ নিলে আমার অপমানের! অতগুলো বছর একসঙ্গে থেকেও তো তোমায় চিনতে পারলাম না গো। ভাবতেই পারছি না, তোমার মত একটা নীচ মানসিকতার মানুষকে আমি ভালোবেসেছিলাম এত কাল? মুখ আর মুখোশ দুটোই যার নিখুঁত তাকে আবিষ্কার করা বোধহয় আমার মত মানুষের কর্ম নয়, তাই না?
অনিরুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বলল, পাগলের মত না বকে একটু ক্লিয়ার করবে তিতির ঠিক কি করেছে?
সুচেতা হিসহিসে গলায় বলল, তোমার বড্ড আদরের না তিতির? বড্ড প্রশ্রয় দিয়েছো তুমি ওকে। স্বাধীনতা দিয়ে বন্ধুর মত মিশে মানুষ করতে চেয়েছিলে না তুমি ওকে? আজ তোমার এই মাত্রারিক্ত প্রশ্রয়ের জন্যই বিয়ের আসর ছেড়ে তোমার আদরের মেয়ে জাস্ট পালিয়েছে। কার সঙ্গে পালিয়েছে সেটা অবশ্য আমি জানি না অনিরুদ্ধ। তোমার তিতির পাখি তাই না? তাই তার ডানা কোথায় কোথায় উড়তে পারে সেই খবর তোমার কাছেই তো বেশি থাকবে তাই না অনিরুদ্ধ?
সুচেতার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল অনিরুদ্ধ। তিতির পালিয়েছে? কোথায়? বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি? কিন্তু কেন? মেয়েকে তো আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করেছিল অনিরুদ্ধ, যে নৈঋতকে ওর পছন্দ কিনা? তখন তিতির বলেছিল, বাবা নৈঋত বা কাবেরী আন্টিকে আমার অপছন্দ নয়, কিন্তু আমি একটা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই, তারপরে না হয় তাদের কাছে সত্যিটা বলেই শুরু করবো নতুন জীবন। আসলে মিথ্যের ওপরে কোনো সম্পর্কের ভীত স্থাপন করা ঠিক নয় বাবা, এটা তুমিই শিখিয়েছো আমায়। অনিরুদ্ধ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, কিছু পুরনোকে ভুলে যেতে হয় তিতির, তাতে জীবনটা সুন্দর হয়। তিতির বাবার হাতটা চেপে ধরে বলেছিল, আমি যদি বছর খানেক পরে বিয়ে করি তাহলে কি তুমি আমার ওপরে রাগ করবে বাবা? অনিরুদ্ধকে কখনো বাবাই কখনো বাবা, কখনো ডিয়ার যা ইচ্ছে বলে ডাকে অহনা। অনিরুদ্ধই আদর করে নাম দিয়েছে তিতির। অহনা যখন খুব ছোট তখন যখনই ঘুমাত দুটো হাতকে দুদিকে ডানার মত ছড়িয়ে দিত, সেই দেখে অনিরুদ্ধ একদিন সুচেতাকে বলেছিল, ঠিক যেন ছোট্ট তিতির। সেই থেকেই সুচেতার দেওয়া অহনা নামটাতে আর ডাকে না অনিরুদ্ধ। তিতিরের কথা শুনে ও বুঝেছিলো, মেয়েটা এখুনি বিয়ে করতে হয়তো চাইছে না, কিন্তু পাত্রকে পছন্দ নয় বা অন্য কোথাও অ্যাফেয়ার আছে এমন নয়। মেয়ের ফার্স্টলাভের খবরও আছে ওর কাছে। সুচেতা না জানলেও অনিরুদ্ধ জানে তিতির ফার্স্ট ইয়ারে উঠে একজন ম্যারেড প্রফেসরের প্রেমে পড়েছিলো। যদিও সে প্রেম ছিল একতরফা। তিতির একাই ভালোবাসতো ওর স্যারকে, কিন্তু সে প্রফেসর ওকে ছাত্রীর নজরেই দেখতো। একদিন তিতির সাহস করে স্যারকে প্রোপোজও করেছিল, স্যার নাকি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ”বিকেলে ভোরের ফুল” দেখে আর ”নীলঘূর্ণি” পড়ে পড়ে সবারই দেখছি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অহনা, আমি চাই তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করো, এসব পাগলামি তোমায় মানায় না।
অহনা নাকি স্পষ্ট সেই স্যারকে বলেছিল, আমি প্রোপোজ করছি বলেই যে আপনাকে রাজি হতে হবে এমন নয়। তবে প্রোপোজ করতে পারলাম না বলে যদি ভবিষ্যতে আফশোস হয়, তাই শুভ কাজটা সেরে রাখলাম। এবারে আমিও মন দিয়ে পড়বো, আপনিও মনযোগ সহকারে সংসার করুন। আপনার ছেলের তো সামনেই মাধ্যমিক, ওকে মন দিয়ে পড়ান। স্যার বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেনি। অহনা এরকমই, যখন যেটা মনে হয় অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে সেটাই করে। যেন মনে হয় সেটা না করা পর্যন্ত ও নিঃশ্বাস ফেলবে না। ওর এই মারাত্মক জেদটাকেই ভয় পায় অনিরুদ্ধ। সুচেতা বোঝে না, জোর করে কিছু মতামত চাপিয়ে দেয় অহনার ওপরে। তারফলে বহুবার মা-মেয়ের মধ্যে বিবাদ হয়েছে। প্রতিবারই মিডলম্যান হয়ে অনিরুদ্ধই সামলেছে বিষয়টা। কেউ কারোর জায়গা থেকে এক ইঞ্চিও সরবে না এমন পণ করেই একই ছাদের নিচে কাটিয়ে দিয়েছে এক সপ্তাহ থেকে এক মাসও। দুজনেই কষ্ট পেয়েছে আলাদা ভাবে, কিন্তু ইগো আর জেদ কোনোভাবেই ওদের মাঝের পাঁচিলটাকে ভাঙতে দেয়নি। শেষে রীতিমত ছেনি হাতুড়ি নিয়ে অনিরুদ্ধকেই নামতে হয়েছে বরফ শীতল প্রাচীর ভাঙতে। তিতিরকে সবটুকু চেনে বলেই অনিরুদ্ধ সুচেতাকে বলেছিল, বিয়েটা আর কিছুদিন পরে দিলে হয় না? ও যখন এই মুহূর্তে চাইছে না, তখন না হয়….
সুচেতা ব্যঙ্গাত্মকভাবে হেসে বলেছিল, কে চাইছে না, তুমি না ও? তুমি বুঝিয়েছো ওকে? নাকি ওর কথাটাকেই শিরোধার্য করে ভেস্তে দিতে চাইছো সম্বন্ধটাকে। অনিরুদ্ধ সুচেতার চোখে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেই তিতিরকে রাজি করিয়েছিল বিয়েটা করতে। বলেছিল, নৈঋত আর ওর পরিবারকে যদি তোর পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে বিয়েটা করেই ফেল তিতির। আসলে কি বলতো, তোর মা মন থেকে চাইছে এখানেই তোর বিয়েটা হোক। সম্বন্ধটা কোনোকারণে ভেঙে গেলে সুচেতা কষ্ট পাবে। তুইও নিশ্চয়ই কষ্ট পাবি মা অভিমান করে থাকলে।
বাবার মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, ওকে ডান, বিয়েটা সেরে নিয়েই আমি সত্য উদ্ঘাটনে নামবো। জানি, তুমি বা মা কেউই আমায় এ বিষয়ে হেল্প করবে না, কিন্তু তোমরা ভুলে যাচ্ছ কেন আমিও একজন সাংবাদিক। খবর জোগাড় করার কিছু রাস্তা তো আমারও জানা আছে, তাই না?
অহনার প্রফেশন বাছার ব্যাপারেও অনিরুদ্ধকেই সুচেতা বারবার দোষারোপ করেছে। অহনার নাকি ওকে দেখেই রিপোর্টার হবার ইচ্ছে জেগেছিল। কোনো প্রয়োজন ছিল না এইসব চ্যালেঞ্জিং প্রফেশনে ঢোকার। অহনার সব স্বেচ্ছাচারী আচরণের পিছনেই নাকি অনিরুদ্ধর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে, এমনটাই সুচেতার ধারণা। না ধারণা নয় বরং দৃঢ় বিশ্বাস বলাটাই ঠিক। তবে সুচেতার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তিতির বিবাহ আসর থেকে পালিয়েছে, এটা ভাবতে অনিরুদ্ধর একটু কষ্টই হচ্ছিল। তিতির জেদি, তিতির একগুঁয়ে কিন্তু এতটাও অবুঝ তো নয়। সেই ছোট থেকে অনিরুদ্ধর কানে কানে নিজের সব কথা বলতো ও, সেই মেয়েটা আজ এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিলো অথচ বাবাকে বললো না। শুধু সুচেতার কাছে নয়, সত্যিই বোধহয় তিতিরের কাছেও পর হয়ে গেছে ও। গলার কাছটা কেঁপে উঠলো ওর। চোখের সামনে ভেসে উঠলো পিঙ্ক ফ্রক পরা ছোট্ট তিতিরের ছবিটা। এই তো সেদিন জন্মালো মেয়েটা, ঠিক কবে এতটা বড় হয়ে গেল সে! বাবাকে না বলে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো! সুচেতা আবার বললো, তুমি না সিনিয়র রিপোর্টার, খবর খোঁজাই তো তোমার কাজ, তাই অহনার পালিয়ে যাবার খবরটা আমি নিজেই তোমায় দিলাম।
অনিরুদ্ধ বললো, বেশ রাগ করবে পরে, এখন পুরো ঘটনাটা আমায় ক্লিয়ার করে বলো, দরকার হলে পুলিশের হেল্প নিতে হতে পারে। সুচেতার গলাটা কেঁপে উঠলো, তারপর ভেঙে পড়া গলায় বললো, প্লিজ অনি থানা পুলিশ করো না। তাতে সম্মান কমবে বৈ বাড়বে না।
কত যুগ পরে সুচেতা আবার ওকে অনি বলে ডাকলো কে জানে! লাস্ট কবে ডেকেছিল মনে করার চেষ্টা করলো অনিরুদ্ধ। বয়েস হচ্ছে, স্মৃতিও এখন বড্ড অবাধ্য হয়ে উঠছে।
সুচেতা বলতে শুরু করলো, বিয়ের পিঁড়িতে নৈঋতের আশীর্বাদের পরে পোশাক বদলানোর জন্য ও ঘরে গিয়েছিল। আধঘন্টা পরে পুরোহিত যখন ডাকছেন তখন দেখা গেল বর নেই। অহনা একাই চুপ করে বসে আছে। নৈঋত ঠিক কোথা দিয়ে আর কেন পালালো সেটাই কেউ বুঝতে পারছিলাম না। ওদের পরিবারের লোক আমাদের থেকেও বেশি অবাক হয়েছিল। ওর বাবা গাড়ি নিয়ে দুজনকে পাঠিয়েওছিল আশপাশটা দেখে আসার জন্য। অহনার চন্দন আঁকা মুখের দিকে তাকিয়ে আমার তখন কষ্ট হচ্ছিলো অনি। মেয়েটা শেষপর্যন্ত লগ্নভ্রষ্টা হবে! জানি এসব পুরোনো কথা তুমি মানো না, কিন্তু আমি তো মানি, তাই মেয়েটার লাল বেনারসি পরা, নাকে নথ পরা মুখটার দিকে তাকিয়ে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, ঠিক তখনই অহনা বললো, আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ। নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। দরজার বাইরে ওরই দুটো বন্ধু রুমি আর চন্দ্রিমা বসেছিলো। সামনের দরজা দিয়ে ও বেরোয়নি, বেরিয়েছে পিছনের ব্যালকনি দিয়ে। আরেকটা কথা শোনো, নৈঋতকেও ওই পালাতে সাহায্য করেছে। কারণ নৈঋত এই বাড়িতে প্রথমবার এলো। ওর পক্ষে অহনার ঘরের পিছনের ব্যালকনির দরজা জানা সম্ভব নয়। বিয়ে বাড়িতে এত লোকজনের চোখে ধুলো দিয়ে নৈঋত কখনোই এই অপরিচিত জায়গা থেকে পালাতে পারতো না। যদি না তোমার তিতিরপাখি তাকে সাহায্য করতো। ওহ, তোমার আদরের তিতির একটা চিঠিও লিখে গেছে-সত্যের সন্ধান পেয়েছি, লক্ষ্য খুব কাছে, তাই বিয়েটা আপাতত স্থগিত থাকুক। ভেবে দেখো একবার মেয়ের স্পর্ধা। এর পরেও ওর মনে হয় ও ফিরলে নৈঋতের ফ্যামিলি ওকে মেনে নেবে? শুধু বসু পরিবার কেন, কোনো ভদ্র পরিবারই ওকে বউ হিসেবে মেনে নেবে না অনি! এত জানে অহনা আর এটুকু জানে না?
কেন এই সত্য উদ্ঘাটনের ভূতটা ওর মাথায় চাপলো বলবে? কে চাপালো ওর মাথায় এটা? নিশ্চয়ই তোমার কাছে এর কোনো জবাব নেই? না থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
অনিরুদ্ধ এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল সুচেতার কথা, এবারে গম্ভীর স্বরে বললো, তখনই বলেছিলাম, কলকাতা থেকে বিয়েটা দাও। কেন আমাদের ফ্ল্যাটে কি সমস্যা হচ্ছিল তোমার? তাছাড়া একটা বড়সড় বিয়ে বাড়ি ভাড়া করলেই তো মিটে যেত। নাকি নৈঋতের ফ্যামিলিকে তোমাদের বনেদিয়ানা না দেখালেই চলছিল না। রাইগঞ্জ থেকে বিয়ে দেবার প্ল্যানটা কার ছিল সুচেতা? আমার না তোমার? কলকাতায় বিয়েটা হলে এসব হতো না!
সুচেতা গলায় সমস্ত বিরক্তি মিশিয়ে বললো, কেন কলকাতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই? নাকি পালানোর সুযোগ নেই? তাছাড়া নৈঋতরাও তো ভাববে মেয়ের মামা, পিসি, মাসি কি কেউ নেই? শুধুই আমার স্কুলের কিছু কলিগ আর অহনার অফিসের বন্ধু, এছাড়া কলকাতায় আছেটা কে?
অনিরুদ্ধ কেটে কেটে বললো, আমি ছিলাম। তোমাদের রাইগঞ্জের বাড়িতে তো আমার প্রবেশের সুযোগ নেই, তাই যেতে পারলাম না।
সুচেতা বললো, অকারণ কাউকে দোষ দিও না। অহনার বিয়েতে তুমি থাকবে না, সিদ্ধান্তটা তোমার ছিল। আরেকটা কথা শোনো, কলকাতা কেন সেন্ট্রাল জেলের ভিতরে বিয়ের ব্যবস্থা করলেও তোমার তিতির পাখি হয়তো উড়েই যেত। কারণ ছোট থেকেই তিনি যখন যা ভাবেন তাই করেন কিনা! তখনই বলেছিলাম, সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো দরকার ওই মেয়েকে। এরকম ভুল সিদ্ধান্ত কোনো সুস্থ মানুষ নিতে পারে না।
এতক্ষণ অনেকরকম দোষারোপ করে ফোনেই অঝোরে কেঁদে ফেললো সুচেতা। অনিরুদ্ধ ধীর গলায় বলল, শান্ত হও, তিতির যথেষ্ট ম্যাচিওরড মেয়ে, নিশ্চয়ই ও কিছু বুঝেছে তাই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি দেখছি, ওকে ফোনে কানেক্ট করতে পারি কিনা দেখি।
সুচেতা বললো, ফোন সুইচ অফ বলছে ওর। এরপরেও বলবে, ও ঠিক করেছে? অনিরুদ্ধ প্লিজ, ওকে এভাবে অন্ধ সাপোর্ট করো না। এত ভালো একটা ফ্যামিলি, এত ভালো ছেলে, সব ভেঙে গেল। আসলে কি জানো অনি, আমি তো জানি আমার কপাল, তাই এতটা আশা করা বোধহয় আমার উচিত হয়নি!
অনিরুদ্ধ শান্তভাবে বললো, রেস্ট নাও, আমি কোনো খবর পেলেই দেব।
মা আর মেয়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা লড়াই চব্বিশঘণ্টাই চলে। অহনার এমন অনেক গোপন খবর ও জানে সেটা সুচেতার অজানা। মায়ের কাছে চিরকালই লুকিয়ে রাখে অহনা নিজেকে, ওর যত গল্প অনিরুদ্ধর সঙ্গে। মেয়ের বাবা বলেই হয়তো ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো। শীতের ভোর বড্ড শুনশান হয়, মেয়েটার কোনো ক্ষতি হবে না তো? যদিও মেয়েকে ছোট থেকেই মার্শাল আর্ট শিখিয়েছে ও। সুচেতার ইচ্ছে ছিল মেয়েকে নাচ শেখাবে, অনিরুদ্ধ কিছুটা বিরোধিতা করেই নাচের স্কুলের বদলে ওকে ভর্তি করে দিয়েছিল মার্শাল আর্টের ক্লাসে। তাই দীর্ঘদিন ক্যারাটে, মার্শাল আর্ট শেখার ফলে তিতির যে অন্য মেয়েদের মত নরম সরম সেটা নয়। তবুও দিনকাল যা খারাপ, ভয় তো করে! এখন কোথায় খুঁজবে ওকে! সুচেতা যদিও বলেছিল, পুলিশে খবর না দিতে, তবুও পুলিশ সুপারের সঙ্গে অনিরুদ্ধর বন্ধুর মত রিলেশন, পেশার কারণেই পরিচয় হয়েছিল, তারপর কি করে যেন বন্ধুত্বও হয়েছিল। অভিরূপ সান্যাল বলেন, সাংবাদিক আর মিডিয়া থেকে আমি বরাবরই দূরে থাকি, এদের আমি শত্রু ভাবি বুঝলে অনিরুদ্ধ! একমাত্র তোমাকেই কখনো শত্রু ভাবতে পারলাম না। তুমি আমাদের ডিপার্টমেন্টের গাফিলতি নিয়ে এত নিউজ করার পরেও নয়। অভিরূপকেই একবার ফোন করতে হবে। ও যদি গোপনে ওর কোনো সোর্স কাজে লাগাতে পারে তিতিরকে খুঁজতে, তাহলে ব্যাপারটা অনেক সহজ হবে। মেয়েটার খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত অস্থির লাগছে।
ঘর থেকে বেরিয়েই দেখলো ভোরের আলো আর শীতল হাওয়া প্রতিযোগিতা করে ওকে ছুঁতে চাইছে। বিজু গোলাপ বাগানে চায়ের পাতা ছড়াচ্ছে, আর ঘাস পরিষ্কার করছে নিজের মনে।
অনিরুদ্ধর পায়ের আওয়াজ পেয়েই বললো, দাদাবাবু, এই তো মাঝরাতে শুতে গেলেন, আবার এত ভোরে উঠে পড়লেন?
অনিরুদ্ধ আনমনে বললো, বুঝলে বিজু, সবার কপালে সুখ থাকে না, কারোর কারোর কপালে মঙ্গল, শনি সবকিছুর অবস্থান থাকে, তাই সে হয়ে যায় সব কিছুর কালপ্রিট। সেই হয়ে যায় ভিলেন বুঝলে!
বিজু হাঁ করে তাকিয়ে বলল, কি হয়েছে? বৌদিমনি ফোন করেছে নাকি? তার রাগ কমেছে?
অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, তুমি কি করে বুঝলে? আমি তো তোমায় কিছুই বলিনি!
বিজু এক মুঠো ঘাস ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে বললো, এই প্রথম আপনি এই বাড়িতে এসে এতদিন থাকলেন। নাহলে তো বৌদিমিনি আর তিতিরদিদিকে নিয়ে এক থেকে দু দিন এসেছেন হাওয়া বদল করতে। এবারে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে, ওদের কাউকে না নিয়ে এসে থাকলেন দেখেই বুঝলাম, কিছু একটা হয়েছে।
বৌদিমনি আমাদের ভারী ভালো মানুষ। গত বছর ফেরার দিনে আমায় বলেছিলেন, বিজুদা দেখো, তোমার দাদাবাবুর সাধের হলদে গোলাপের গাছগুলো যেন নষ্ট না হয়। হলদে গোলাপ ওনার বড় পছন্দের।
অনিরুদ্ধ হালকা হেসে বললো, তা আমি দিন সাতেক আছি বলে কি বিজয়চাঁদের অসুবিধা হচ্ছে নাকি, সে কথা বলে দিলেই আমি বোঁচকা বাঁধি।
বিজু মাটি হাতেই নিজের কান দুটো ধরে বলল, কি যে বলেন দাদাবাবু, আপনি আছেন বলেই তো বাড়িটাতে আবার কতদিন পরে গান বাজছে সকাল সন্ধে, প্রাণ পেয়েছে যেন। হাঁটতে যাবেন তো? দাঁড়ান, সোয়েটার আর টুপি নিয়ে আসি।
বিজু বাগান থেকে ওঠার তাগিদ করতেই অনিরুদ্ধ বললো, তুমি কাজ করো, আমি নিয়ে নিচ্ছি।
ঘরে ঢুকতেই ফোনটা আবার বেজে উঠলো, স্ক্রিনের ওপরে যার নাম উঠছে সেটা দেখে একটু চমকেই গেল অনিরুদ্ধ।
।।৮।।
চমকাবেন না মিস অহনা, আমিও আপনার সঙ্গেই যাচ্ছি। রাইগঞ্জ থেকে কালিয়াগঞ্জ। দুটো স্টেশনের শেষেই গঞ্জ আছে, এটা যদি আপনার দেশের বাড়ি হয় তাহলে ওটা নিশ্চয়ই আপনার মামার বাড়ি, তাই না?
আপনার এক্সকে দেখে, দুজনের ছবি তুলে তবেই বাড়ি ফিরবো। নৈঋত বেশ দৃঢ় গলায় বলল কথাগুলো।
অহনা বেশ বুঝতে পারছিল, ওর প্রাক্তনের গল্পটা নৈঋত ঠিকমত হজম করেনি। তাই হয়তো ওকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করবে বলেই, অচেনা জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ওর সঙ্গেই। নৈঋত আনমনে বললো, আপনার প্রিয় রং কি অহনা?
অহনা তখনও নিজের ভাবনার মধ্যেই ঘোরাফেরা করছিল। তাই নৈঋতের করা প্রশ্নটা ঠিক শুনতে পায়নি।
ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আমায় কিছু বললেন?
নৈঋত এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, এই কামরায় আর কাউকে বলার মত তো খুঁজে পেলাম না, অগত্যা আপনাকেই…
অহনা নৈঋতের বাইরের রূপটা দেখে মনে করেছিল ছেলেটা নেহাতই শান্ত প্রকৃতির, মুখচোরা, একে হ্যান্ডেল করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। এখন দেখছে ওর ধারণা ভুল। নৈঋত শান্ত ভদ্র, কিন্তু বোকা টাইপ নয়। সবকিছু যুক্তি দিয়ে বুঝে নিতে চায়। তাই অহনার এক্সের গল্পটা শুনলেও বিশ্বাস করেনি।
এতক্ষণ মায়ের চিন্তা হচ্ছিল অহনার, বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসাটা বোধহয় অত্যন্ত অন্যায় হলো। মাকে সকলের চোখে ছোট করে দেওয়া হলো। এমনিতেই বড় মামা আর মামীমা মাকে নানাভাবে অপমান করে সুযোগ পেলেই। কিন্তু এই মুহূর্তে বিয়েটা করে ফেললে, হয়তো আর কোনোদিনই সত্যের মুখোমুখি হবার সুযোগ পেত না ও। অন্য একটা পরিবার, তাদের সম্মান এসব ভাবতে ভাবতেই পিছিয়ে যেত লক্ষ্য থেকে। বিয়ে মানেই তো একটা বন্ধন, সেই বন্ধনে একবার আবদ্ধ হলে আর কি এভাবে অজানা অচেনার লক্ষ্যে বেরিয়ে পড়তে পারতো? অহনা এটুকু অন্তত ভালোই বোঝে, যতই মেয়েরা স্বাধীন হয়ে যাক, বিয়ের আগের আর পরের জীবনে আকাশ পাতাল পার্থক্য হয়ে যায়। তাই রবিদার জেনুইন খবরটা পাওয়ার পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে নিশ্চিন্তে বিয়ে করাটা ওর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
অহনা অন্যমনস্কভাবে বললো, ঘন কালো। এটাই আমার প্রিয় রং। এতটাই নিশ্ছিদ্র কালো যেখানে নিজের হাত, পা, মুখ নিজেই দেখতে পাবো না।
নৈঋত একটু অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, কালো আমারও খুব প্রিয় রং তবে সেটা অন্য কারণে। নিজেকে লুকিয়ে রাখবো বলে নয়।
অহনা ভাবলো, কথা বলে স্বাভাবিক হয়ে যদি একে পরের স্টপেজে নামিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে মন্দ হবে না।
নরম গলায় অহনা বললো, বললেন না তো, কালো কেন আপনার প্রিয় রং?
নৈঋত হেসে বললো, ভয়ংকর রকমের সুন্দর বলে। কালোকে আমার কেন জানি না পৌরুষের প্রতীক মনে হয়। ভীষণ স্ট্রং একটা ব্যক্তিত্ব আছে। মিষ্টতা নেই গোলাপি, আকাশির মত তবুও অহংকার আছে ষোলো আনার জায়গায় আঠেরো আনা।
অহনা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল নৈঋতের দিকে। বেশ কথা বলে তো ছেলেটা!
নৈঋত বললো, অনেকটা আমার এখনকার পজিশনের মত। আপনি সর্বান্তকরণে চাইছেন আমি এই ট্রেন থেকে নেমে যাই, মানে ষোলো আনা চাইছেন আপনার কাঁধ ফাঁকা করি, কিন্তু আমি নির্লজ্জের মত আঠেরো আনা চেপে বসে আছি।
অহনা মুচকি হেসে বললো, তারমানে কালো রঙের মত আপনারও বেশ অহংকার আছে বলুন? মানে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না আপনার মত একজন সুপুরুষ, সুপ্রতিষ্ঠিত পাত্রকে ছেড়ে শেষ মুহূর্তে কোনো মেয়ে অন্য কারোর হাত ধরতে যেতে পারে! অস্বস্তির থেকেও অহংকারে আঘাতটা বোধহয় আমি বেশি দিয়ে ফেলেছি তাই না নৈঋত?
নৈঋত একটু থমকে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো, হঠাৎ মিডিয়ায় কাজ করার ঝোঁক কেন চাপলো? আপনার বাবাকে দেখে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? না মানে আপনার বায়োতে যা দেখলাম তাতে তো….
অহনা ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বললো, প্রফেসর হতে পারতাম তাই তো? নোবেল জব, লোকজনের দৃষ্টিতে সম্ভ্রম। সেফটি লাইফস্টাইল। আমার মাও তাই বলে জানেন। মিডিয়া শুনলেই লোকজন কেমন একটা চোখে তাকায়, যেন মনে হয় বাকি সবাই যুধিষ্ঠিরের সেকেন্ড এডিশন, শুধু মিডিয়ার লোকগুলোই একচেটিয়া মিথ্যে বলার দায়িত্ব নিয়েছে। মিডিয়ার লোকজনের কি প্রয়োজন বলুন তো অকারণে মিথ্যে বলবে। আমাদের কাছে যতটুকু খবর এসে পৌঁছায় আমরা ততটুকুই দেখাই। অনেকসময় সঠিক খবরই আমরা পাই না। তাছাড়া রাজনৈতিক চাপে আমরাও বাধ্য হই কিছু খবর প্রকাশ্যে না আনতে। মিডিয়ায় কাজ করবো আর রুলিং পার্টির বিরোধিতা করে দুঃসাহসী হবো এমন ভাবলে অন্যত্র চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে, সঙ্গে বুলেটপ্রূফ জ্যাকেট পরে ঘুরতে হবে বুঝলেন! কে কখন ঠুকে দেবে জানতেও পারবেন না। তবে বাবার জবটা অনেক বেশি প্রেস্টিজিয়াস। বাবা এতবড় দৈনিকের সিনিয়র রিপোর্টার! আমি টিভি চ্যানেলের বলে আমার মুখটা হয়তো পাবলিক বেশি চেনে কিন্তু দুর্নাম কুড়াই আমরাই বেশি।
নৈঋত বললো, আমি শুনেছিলাম আমার মায়ের সঙ্গে নাকি আপনার রাস্তায় আচমকা পরিচয় হয়েছিল? মা যদিও বিষয়টা ক্লিয়ার করে বলেনি, তবে আমার মায়ের যেরকম পার্সোনালিটি তাতে রাস্তায় কারোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেলো আর মা তাকে নিজের পুত্রবধূ নির্বাচন করে ফেলবে এমনটা কিছুতেই নয়। অন্তত আমি এটা বিশ্বাস করি না।
অহনা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে নৈঋত এই বিয়ে ভাঙার কারণটা কি সেটাই বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই প্রথমে পরিচয়সূত্র ধরে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে!
বিয়ের আসর থেকে এভাবে পালাতে অহনাও চায়নি। এটা ওর শিক্ষা বা রুচি বিরুদ্ধ। আচমকা ফোনে ওই মেসেজটা দেখে ওর যে কি হয়ে গেল ও নিজেও জানে না। তবে এখন বুঝতে পারছে একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। বিয়েটা শুধু নৈঋত আর অহনার হচ্ছিল না, হচ্ছিল দুটো পরিবারের। এর সঙ্গে দুটো পরিবারের রেপুটেশন জড়িয়ে ছিল। ওর মত শান্ত বুদ্ধির মেয়ে কিভাবে এমন একটা কাজ করে ফেললো সেটাই বুঝতে পারছে না। এখন আর পিছিয়ে যাবার উপায় নেই।
নৈঋত নরম অথচ ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলল, প্রাক্তনকে লুকিয়ে রেখে বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন, বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এলেন এগুলোর কোনো সদুত্তর এখনো পর্যন্ত আমি পাইনি, এখন যে প্রশ্নটা করছি সেটার উত্তর আশা করছি।
অহনা এতক্ষণে খেয়াল করলো ওর বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা খুব জ্বলছে। এতক্ষণ উত্তেজনার বশে অনুভূতিগুলোও যেন কেমন বিকল হয়ে গিয়েছিল। এখন ট্রেনের হওয়াটা গায়ে লাগতে একটু শিরশির করে উঠলো শরীরটা। শেষ শীতের হিমেল হাওয়ায় আবার উপলব্ধি নামক বস্তুটি সচল হলো ওর মস্তিকের অভ্যন্তরে।
স্যান্ডেল থেকে পাটা বের করতে যেতেই দেখলো চ্যাটচ্যাট করছে। কি করে যেন পায়ের বুড়ো আঙুলটা কেটেছে খানিকটা। রক্ত বেরিয়েছে, আবার বন্ধ হয়ে শুকিয়েও গেছে। উত্তেজনায় কোনোটাই খেয়াল করেনি অহনা। পায়ের দিকে তাকাতেই নৈঋত বললো, এ বাবা কেটেছে তো! এতক্ষণ এত কথা বলছেন, প্রাক্তন কত হ্যান্ডসাম সেসব বলে চলেছেন আর আঙুল কেটেছেন সেটাই বলতে ভুলে গেছেন। সত্যি প্রেমের কি মহিমা। মানুষ দুঃখ, কষ্টও ভুলে যায়। জল আছে সঙ্গে? আমায় তো অর্ধ উলঙ্গ করে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন, নিম্নাঙ্গে এই যখন তখন খুলে যেতে পারে বস্তুটি নিয়ে আমি রাস্তায় বেরোলাম। জীবনে প্রথম ধুতি পরার অভিজ্ঞতা যে এমন বিভীষিকার হবে কে জানতো! তাই জল, ব্যাগ, ব্যান্ডেড এসব কিছুই নেই আমার সঙ্গে। যদি আপনার কাছে থাকে তো দিন, আমি আঙুলটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি।
আঙুলটা টনটন করছে অহনার, শরীরটাও বড্ড ক্লান্ত লাগছে। প্রায় সারাদিনের উপোসের পর এত ধকল আর নিতে পারছে না ও।
হ্যান্ড ব্যাগে একটা ছোট জলের বোতল আছে বোধহয়, আর পার্সে ব্যান্ডেড থাকারই কথা। ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করতেই নৈঋত হাত বাড়িয়ে বললো দিন আমায়। অহনার চোখের দ্বিধার চাউনি লক্ষ্য করে বললো, পায়ের আঙুল ছুঁলেও কি এক্স রাগ করবে নাকি?
মারাত্মক পজেসিভ এক্স দেখছি আপনার। কিন্তু আমিও তো মানুষ, অন্তত দেখতে মানুষের মত তাই এটাকে কর্তব্য মনে করি। জলের বোতলটা অহনার হাত থেকে নিয়ে ওর পায়ের আঙুলের ওপরে সাবধানে জলটা ঢাললো নৈঋত। চিড়চিড় করে জ্বলে উঠলো জায়গাটা।
নৈঋত বললো, কোথায় কাটলো? গাড়ির কোনো পার্টসে নয় তো? তাহলে কিন্তু প্রাক্তনের বুকে ঝাঁপাবার আগে টেটভ্যাক নিতেই হবে।
অহনা মৃদু স্বরে বললো, একটু কাটলেই ইনজেকশন নিতে হয় না, এরকম কত কাটে সকলের।
নৈঋত ভ্রু কুঁচকে বললো, আপনি শিওর স্বয়ং ভীষ্ম শরশয্যায় যাওয়ার আগে টেটভ্যাক নেননি? আমার কিন্তু মনে হয় আগে থেকেই প্রিকোশন নিয়েছিলেন ভদ্রলোক। তাই গোঁয়ার্তুমি না করে এক্সের হাত ধরার আগে একটা ইনজেকশন মাস্ট।
দিন ব্যান্ডেডটা দিন। নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমালটা বের করতে করতে বললো, ভাগ্যিস শীতকালেও রুমালটা সঙ্গে নিয়েছিলাম। অহনাকে চমকে দিয়ে নরম রুমাল দিয়ে ওর পায়ের আঙুলটা মুছিয়ে দিলো খুব আদুরে ভঙ্গিমায়। মারাত্মক অস্বস্তিতে ভুগছে অহনা, এই মুহূর্তে ও নৈঋতকে ওর জীবন থেকে ছেঁটে বাদ দিতে চাইছে আর নৈঋত যেন ততো জড়িয়ে ফেলছে ওকে। ব্যান্ডেডটা লাগাতে লাগাতে বললো, আমার না নিজেকে হাম দিল দে চুকে সনম মুভির অজয় দেবগণ মনে হচ্ছে।
না, একটু পার্থক্য অবশ্য আছে, অজয়ের সঙ্গে আল্টিমেটলি ঐশ্বর্য্যার বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল, তারপর অজয় ওর প্রাক্তন সলমনের সঙ্গে মেলাতে নিয়ে চলেছিল। আমার ক্ষেত্রে বিয়েটা হতে হতে হয়নি, বাকি সিকুওয়েন্স প্রায় একই, কি বলুন?
অহনা নিজের পাটা টেনে নিয়ে বললো, আরেকটা পার্থক্য আছে বুঝলেন, ঐশ্বর্য্যা অজয়কে বাধ্য করেছিল প্রাক্তনের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আর আমি আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি আপনি প্লিজ বাড়ি ফিরে যান।
নৈঋত আনমনে বললো, কি জানি কেন অজয় হতে ইচ্ছে হচ্ছে যে। নৈঋতের গলার হালকা কাঁপনটা কানে লাগলো অহনার। সত্যিই তো সমাজের লোকজনের কাছে নৈঋতকে তো কম অপমানিত হতে হবে না! বেচারা বোধহয় বাড়ি ফিরতেই ভয় পাচ্ছে। খারাপ লাগছে অহনার, ওর হঠকারিতার জন্যই এমন পরিস্থিতির তৈরি হলো। এখন তো মনে হচ্ছে বিয়ের পরে নৈঋতকে আসল বিষয় বুঝিয়ে বললে ও নিশ্চয়ই শুনত অহনার কথা। কিন্তু ও কতটাই বা চেনে নৈঋতকে, সত্যিটা সামনে আসার পরে আদৌ কিভাবে রিয়্যাক্ট করতো সেটাই ভাবনার বিষয়।
অন্যমনস্ক অহনা ভাবছিলো, মা-বাবার মুখোমুখি কি ভাবে হবে? তাছাড়া নৈঋতকেও তো এখনো নামানো যায়নি ঘাড় থেকে, এত প্রবলেম কি করে যে সলভ করবে কে জানে!
অহনা চিন্তান্বিত স্বরে বললো, ভাবছি আজকের দিনটা দেশের বাড়িতে রেস্ট নিয়ে কাল যাবো ওখানে।
নৈঋত চমকে গিয়ে বলল, মানে? আপনার এক্স থাকবে না স্টেশনে আপনার অপেক্ষায়! কোথায় দেশের বাড়ি যাবেন? সেখানে কে থাকে? আপনি করতে কি চাইছেন একটু ক্লিয়ার করবেন? আপনার কথায় এত পরিমাণে মিনারেল ওয়াটার মিশে আছে যে আমি খনিজ পদার্থের মধ্যে জাস্ট হাবুডুবু খাচ্ছি।
অহনা বিরক্ত হয়ে বলল, বারবার এক্স এক্স করবেন না তো! বিরক্ত লাগছে।
নৈঋত হেসে বললো, বেশ বেশ, তো আপনার প্রেজেন্ট ওয়েট করবে না ওই কালিয়াগঞ্জ না কালনাগ নামক স্টেশনে?
অহনা রেগে গিয়ে বলল, না কেউ থাকবে না। আমি আপাতত বাবার কাছে যাবো। রেস্ট নেব আজ, কাল ভোরে ওখান থেকে কালিয়াগঞ্জ। মাত্র একঘণ্টার পথ।
নৈঋত বললো, আপনার প্রেজেন্ট কি কালিয়াগঞ্জে থাকে?
অহনা জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বললো, হ্যাঁ, তাই থাকে, তাতে আপনার কি বলুন তো? আপনি এবারে নেমে যান, তারপর কলকাতা ব্যাক করুন। নৈঋত বললো, কষ্ট করে যখন এতদূর এলাম তখন একবার তো তেনার দর্শন করেই ফিরবো। এটা তো আমার মত কমন ম্যানের নৈতিক অধিকার, এটা আপনি আটকাতে পারবেন না।
অহনা ভাবছিলো নৈঋতের মা ভালোমত মিথ্যে বলেছেন ছেলের সম্পর্কে। উনি বলেছিলেন, ওনার ছেলে নাকি অত্যন্ত শান্ত, ভদ্র, কম কথা বলা মানুষ। তিনটের একটাও যদি সত্যি হতো তাহলে অহনাকে এতটা এফর্ট দিতে হতো না নৈঋতকে ভাগানোর জন্য। মায়ের সামনে নিশ্চয়ই ভদ্র ছেলে সেজে থাকে, তাই কাবেরী আন্টি জানতেও পারেনি তার ছেলেটি একটি মারাত্মক…
অহনার ভাবনাটুকুও শেষ করতে না দিয়ে নৈঋত বললো, কি ভাবছেন, আমি অত্যন্ত নাছোড়বান্দা, অসভ্য টাইপ ছেলে? আসলে কি বলুন তো, খুব বেশি ভদ্র হলে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসর হওয়া যায় না। যদিও বা যায় টিকে থাকা যায় না। আপনি জানেন, কোনোভাবে কলিগদের মাধ্যমে আমার বিয়ের খবরটা ডিপার্টমেন্টে ছড়িয়ে যাবার পরে কি হয়েছিল?
অহনার মাথায় এত চিন্তার ভিড় যে নৈঋতকে ওর স্টুডেন্টরা কি বলেছিল সেটা শোনার কোনোরকম আগ্রহ নেই ওর মধ্যে। কিন্তু নৈঋতের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে ও ঘটনাটা অহনাকে শোনাতে বদ্ধপরিকর। ওর কান দুটো যেহেতু হেডফোন বা তুলো দিয়ে ঢাকা নেই আর ও যেহেতু শুনতে পায় তাই অগত্যা শুনতেই হবে। অসহায় ভাবেই তাকালো নৈঋতের দিকে। নৈঋত বেশ উৎসাহের সঙ্গে বলতে শুরু করেছে, যখনই ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টরা জানতে পারলো আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তখনই শুরু হলো ফিসফাস। কিছুদিনের মধ্যে সেই ফিসফাস আর গোপন থাকল না। রীতিমত সরব আকারে ফিরে আসতে শুরু করলো আমার কাছে। যেমন, ক্লাসে ঢুকেছি একটি মেয়ে খুব নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করলো, স্যার হানিমুনে কোথায় যাবেন? পাহাড়, জঙ্গল না সমুদ্র? পাশ থেকে আরেকটি ছেলে বলে উঠলো, তুই এমন খাপছাড়া কোয়েশ্চেন করিস কেন রে মনীষা? আগে স্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখ, স্যার বিদেশে যাবে না এদেশের মাটিতেই ঘুরবেন?
পাশ থেকে আরেকজন বললো, স্যার শুনলাম নাকি ম্যাম রিপোর্টার? আপনার সঙ্গে কিভাবে পরিচয় হয়েছিল? লাভ না অ্যারেঞ্জড স্যার? আরেকজন মাতব্বর গোছের ছেলে সবাইকে থামিয়ে বললো, আঃ কি হচ্ছে এসব! কেন স্যারকে অ্যাম্বারাসিং কোশ্চেন করছিস তোরা? প্রায় দুবছর স্যারকে দেখেছিস তারপরেও চিনলি না স্যারকে! আমি ভাবলাম, যাক এই ছেলেটা অন্তত ভদ্র সভ্য আছে, শেষ পর্যন্ত বাঁচাল বোধহয় আমায়। আমার ভাবনা শেষ হবার আগেই সে বলল, আমি তো নিশ্চিত জানি স্যারের আরেঞ্জড ম্যারেজ, স্যার কোনোদিন মেয়েদের ঝাড়ি দিতেই পারে না। মানে আমি বিশ্বাস করি না, স্যার যেচে গিয়ে কোনো মেয়েকে প্রোপোজ করছে। স্যারের লুকটা দেখ, লাভ ম্যারেজ করার কোনোরকম চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিস তোরা স্যারের চেহারায়? তাহলে অকারণ এসব প্রশ্ন কেন করছিস? স্যার আপনি ওদের কথায় কিছু মনে করবেন না, তারপর বলুন, বৌদিকে আপনি পছন্দ করলেন নাকি আপনার মা?
আপনি ভাবতে পারছেন অহনা, এরা কি মারাত্মক লেভেলের লেগপুলিং করতে পারে। এসবের পরেও যখন ওই কলেজে টিকে আছি তখন আমিও নেহাত শান্ত ছেলে নয়। তবে এবার কলেজে ফিরে বিয়ে ভেস্তে যাবার খবরটা নিয়ে ঠিক কিভাবে ট্রলড হবো আমিও কল্পনা করতে পারছি না।
অহনা হেসে ফেলল ওর বলার ভঙ্গিমায়। জিজ্ঞেস করলো তা আপনি কি বললেন? কে পছন্দ করলো আমায়?
।।৯।।
বৌদিভাই, অহনাকে তো তুমিই পছন্দ করেছিলে, তাই না?
নীলাদ্রির বোন অনু কাবেরীর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো। না মানে, টুটাই কি কিছু জানিয়েছিল তোমায় যে অহনাকে ওর পছন্দ নয়, বা অন্য কাউকে ভালোবাসে? কাবেরী বিধস্ত চোখে তাকালো ননদের দিকে। না অনুর চোখে কোনো বিদ্রুপ নেই, বরং দুশ্চিন্তা ঘুরছে এলোমেলো। একমাত্র ভাইপোর বিয়েতে বেশ সুন্দর করে সেজেছিল অনু। বোধহয় পার্লার থেকে সেজে এসেছিল। অফ হোয়াইট আর রেড কম্বিনেশনে বিষ্ণুপুরী বালুচরি পরেছিলো। কানে গলায় মুক্তোর সেট। অনুর একটু ভারী ফরসা আভিজাত্যপূর্ণ চেহারায় মানিয়েছে ভারী। ঘাড়ের কাছে দুটো রেড জারবেরা দিয়েছে। যদিও এমন নিখুঁত সাজ এখন প্রায় বিপর্যস্ত, চোখের নিচের কালিটা বোধহয় কাজলের নয়, সারারাত জাগরণের চিহ্ন। ক্লিপ থেকে ফুলদুটো খুলতে খুলতেই আবার বললো, বৌদিভাই, বলো না, টুটাই কি কিছু বলেছিল তোমায়? আমার নিজের ভাইপো বলে বলছি না, আমি এমনিই সবার কাছে বলি, আমাদের টুটাইয়ের মত ছেলে লাখে মেলে না। এমনকি আমাদের তুতান অবধি বলে, মা, দাদার মত হতে পারিস না বলে বলে তুমি আমার কানটার বারোটা পাঁচ বাজালে। আজ যদি এটা আমার নিজের সন্তান তুতান করতো আমি আশ্চর্য হতাম না বিশ্বাস করো। তুতানের মধ্যে একটা কথা না শোনা অবাধ্যতা রয়েছে। কিন্তু আমাদের টুটাই এরকম করতে পারে এ যে কল্পনার অতীত। শুভময় বলছে, কিছু একটা গন্ডগোল আছে ওই মেয়ের মধ্যে, সেটা টের পেয়ে টুটাই পালিয়েছে। কাবেরী এতক্ষণে ঠোঁট খুলে বললো, কি বলছে শুভ? শুভময় এ বাড়ির জামাই হলেও কাবেরীর ভাইয়ের মত। বৌদির সব কিছুতেই তার পূর্ণ সমর্থন থাকে। অনু মজা করে বলে, বুঝলে বৌদিভাই তোমার ভাই বলে, বৌদির কাছ থেকে শিখে নাও সংসার চাকরি আর সন্তানকে কিভাবে ব্যালেন্স করতে হয়। একজনও আঙুল তুলে বলতে পারবে না সে অবহেলিত হচ্ছে। এটা শুধু বৌদিই পারে বুঝলে।
অনু আর নীলাদ্রি দুই ভাইবোন সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের। অনু বড্ড সরল, সাদাসিধে, মনে আর মুখে একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটে ওর। অনেক অপ্রিয় সত্যি ও মুখের সামনে বলে দেয়, কিন্তু আড়ালে তাকে নিয়ে আলোচনা করার মেয়ে অনু নয়। শুভময় কর্মসূত্রে ভূপালে থাকে, তাই বাপেরবাড়ি আসেই কম। তবে কাবেরীর সঙ্গে দারুণ একটা বন্ধুর মত সম্পর্ক। অনু গল্প করতে ভালোবাসে, বেশ খোলামেলা। নীলাদ্রি আবার অনামিকার বিপরীত স্বভাবের। কথা কম বলা সিরিয়াস টাইপ মানুষ। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মনে কি চলছে! একমাত্র কাবেরীই নীলাদ্রির মুখের শিরা-উপশিরায় ওঠানামা দেখে কিছুটা বুঝতে পারে। আজ অবশ্য নীলাদ্রির মুখের ভাঁজে কোনো অভিব্যক্তিই নেই, অন্তত কাবেরী খুঁজে পায়নি। শুধু চোখে একটা অদ্ভুত অসহায়তা ঝিমিয়ে রয়েছে। নীলাদ্রিকে আজ এত বছর চেনে কাবেরী, কোনোদিন ওর চোখে এমন করুণ দৃষ্টি দেখেনি ও, তাই মানসম্মান বাদ দিয়েও ইন্ট্রোভার্ট মানুষটা ওদের বাড়িতে কতটা অপমানিত হয়েছে ভেবেই কষ্ট হলো কাবেরী। নিজেকেই দোষারোপ করতে ইচ্ছে করছে ওর। নীলাদ্রি বলেছিল, মেয়েটার সব ভালো, কিন্তু বাবা-মায়ের মধ্যে কোনো একটা প্রবলেম চলছে মনে হলো। না, কেউ কারোর নামে কোনোরকম দোষারোপ করেনি ঠিকই, কিন্তু আমার যেন ওনাদের সম্পর্কটা একটু গোলমেলে লেগেছে। বিয়েতে নাকি অনিরুদ্ধবাবু কোনো একটা বিশেষ কারণে উপস্থিত থাকতেও পারবেন না বললেন। কাবেরী, টুটাই আমাদের একমাত্র ছেলে, আরেকবার ভাবলে হতো না? জানি অহনা সুন্দরী, শিক্ষিতা, সাকসেসফুল রিপোর্টার তবুও মন ঠিক সায় দিচ্ছে না। মেয়েটা যেন বড্ড ম্যাচিওর্ড, আমাদের টুটাই সে তুলনায় ইমোশনাল বেশি। কাবেরী এক ঝটকায় নীলাদ্রির কথাকে কাটা ঘুড়ির মত উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, অহনার মত মেয়েকে যদি টুটাইয়ের পছন্দ না হয় তাহলে কাকে হবে? অহনা প্রতিবাদী, স্মার্ট, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর একটা মেয়ে, ও পাশে থাকলে একটা অদ্ভুত পজেটিভ এনার্জি কাজ করে জানো। আমার তো প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়েছিল অহনাকে। নীলাদ্রি কম কথার মানুষ, তাছাড়া সাংসারিক ব্যাপারে খুব বেশি ইন্টারফেয়ারে করার মত মানুষও নয়। কাবেরী ওপরে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে অতগুলো বছর নিশ্চিন্তেই আছে। তাই জোরদার কোনো প্রতিবাদ করেনি, বরং নিমরাজি হয়ে মেনেই নিয়েছিল অহনার সঙ্গে বিয়েটা। যদিও আজকের ঘটনাটা কাবেরী কেন বাড়ির কেউ কল্পনাও করতে পারে না।
অনুর দিকে তাকিয়ে কাবেরী বিধস্ত গলায় বলল, কি বলছে শুভ? অনু হাত নেড়ে শুভকে ডাকলো, তারপর বলল, ও বলছিলো, টুটাই নিশ্চয়ই কিছু বুঝতে পেরেছে, ওই মেয়ের অবশ্যই কোনো প্রবলেম আছে, সেটা বুঝতে পেরেই টুটাই শেষ মুহূর্তে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
শুভময় এসে বসলো কাবেরীর পাশে, একটু গম্ভীর গলায় বলল, বৌদি কাল যেটা হলো সেটা আকাঙ্খিত ছিল না। কিন্তু আমার খটকা লাগছে অন্য জায়গায়, তোমরা আমায় বড়কর্তা করেছিলে। দাদা টুটাইয়ের গাড়িতে যায়নি, আমিই ছিলাম ওর সঙ্গে। টুটাইয়ের দুটো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে যাচ্ছিলাম। তখন কিন্তু আমি বারবার খেয়াল করেছি, টুটাইয়ের মুখে কোনো অস্বস্তি আছে কিনা। যেহেতু আমার অফিসের ঝামেলার জন্য মেয়ে দেখতে আসতে পারিনি তাই মজা করে টুটাইকে জিজ্ঞেসাও করলাম, আজকাল কিন্তু অ্যাপের যুগ টুটাই। ছবিতে তোর বউকে যতটুকু দেখেছি তাতে তো বেশ সুন্দরীই লাগলো, কিন্তু ওই যে বললাম অ্যাপ, ওতে তো হিড়িম্বাকেও শ্রীদেবী লাগে, ভালো করে দেখেছিলিস তো?
টুটাই দেখলাম লাজুক মুখে বললো, না পিসেমন, অহনাকে ছবিতে বরং একটু খারাপ লাগে, সামনে থেকে ও আরও সুন্দরী। বরং আমিই ওর পাশে অনুজ্জ্বল।
ওর বন্ধুরা টিপ্পনি কেটে বললো, বুঝলেন পিসেমন, নৈঋত আমাদের সুতো কাটা ঘুড়ির মত পুরো লাট খাচ্ছে বৌদির জন্য, এখন আপনি ওসব হিড়িম্বা, সূর্পণখা যাই বলুন না কেন, ডেস্টিনেশন রাইগঞ্জ। টুটাই একটু ধমকের সুরে বললো কি হচ্ছেটা কি! তোরা থামবি?
আমি আরও জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁরে টুটাই এই যে অহনা এমন একটা প্রফেশনে আছে যেখানে কাজটা কিন্তু বেশ চ্যালেঞ্জিং, মানে রিপোর্টারদের তো জানিস, জঙ্গলমহলেও ছুটতে হয় আবার বিস্ফোরক কোনো ভোট কেন্দ্রেও ছুটতে হয়, তো তোর এতে আপত্তি হয়নি?
টুটাই একটু হেসে বলেছিল, আসলে কি জানো পিসেমন, আমি তো কলেজে পড়াই, আমার জীবনটা বড্ড একঘেয়ে। ওই একই মুখস্ত কোর্স, একই রকম ছাত্রছাত্রী, রোজ একই লেকচার দিয়ে যাই। সত্যি বলতে কি মাঝে মাঝে মনে হয়, এর থেকে আইটি কোম্পানি জয়েন করলে ভালো হতো, তাও তো একটা টার্গেট ফিল করার ব্যাপার থাকতো! সেটাও কিন্তু একরকম চ্যালেঞ্জ। আমার জীবনটা ডালের পরে পোস্ত অথবা পোস্তর পরে ডাল মাখার মতই ভীষণ রকম গোছানো, একঘেয়ে। তাই যখন দেখলাম একটা মেয়ে যার কিনা একাডেমিক কেরিয়ার সরকারি চাকরি পাওয়ার মত হওয়ার পরেও এমন একটা জব বেছে নিয়েছে স্বেচ্ছায় তখন মেয়েটা সম্পর্কে একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট কাজ করলো জানো! মনে হলো, সবাই নৈঋত বসুর মত সাদামাটা জীবন চায় না, কেউ কেউ ফ্লাইটে ট্রাভেল না করে সাইকেলে করেও দেশ ঘোরা পছন্দ করে। আমার মত আয়েশি মানুষ তো আর ওসব পারবে না, তাই কোনো চ্যালেঞ্জিং মানসিকতার মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারলে মন্দ হয় না ভেবেই বিয়েটাতে মত দিয়ে দিলাম। দুটো আলাদা মেরুর বাসিন্দা হয়েও কিভাবে মানিয়ে নেব একে অপরকে এটা করতে করতেই হয়তো আমার জীবনের মনোটোনাস ব্যাপারটা কেটে যাবে।
বুঝলে বৌদি, টুটাইয়ের কথা শুনে আমি চমকে গিয়েছিলাম, ভাবছিলাম আমাদের সেই টুটাই? মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর আমার সামনে কাচুমাচু করে বলেছিল, পিসেমন, বাবা বলছে এখনই কম্পিউটার কিনে দেবে না, তুমি একটু বাবাকে বোঝাবে?
আমি পরেরদিন ওকে কম্পিউটার গিফ করাতে ও কি করবে বুঝতে না পেরে আমার জন্য এককাপ লিকার চা নিজের হাতে করে এনে বলেছিল, আমি করলাম তোমার জন্য! সেই টুটাই জীবন সম্পর্কে কত ভেবেছে। বিশ্বাস করো বৌদি, টুটাই কখনো এই বিয়ে ছেড়ে পালাতে চায়নি, ওই মেয়েই হয়তো বাধ্য করেছে, বা ওখানে গিয়ে ও কিছু শুনেছে। তবে শোনা কথা বিশ্বাস করে এত বড় সিদ্ধান্ত নেবার ছেলে ও নয়। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, ওই মেয়েটাই টুটাইকে কিছু বলেছে। আচ্ছা বৌদি তুমি ঠিক জানো অহনার এ বিয়েতে হান্ড্রেড পার্সেন্ট মত ছিল?
কাবেরী মনে করার চেষ্টা করলো অহনার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দৃশ্য থেকে বিয়ের সম্বন্ধ করা পর্যন্ত পুরো ঘটনাটা।
সেদিন কাবেরীর অফিস থেকে ফিরতে একটু রাত হয়েছিল। অফিসের কিছু পেন্ডিং কাজ সারতে সারতে দেরিই হয়েছিল। অফিস থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করার পর গোটা তিনেক ভিড় বাসকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল, এতটাই ভিড় ছিল যে ওঠার চেষ্টাই করেনি। ট্যাক্সি নেবে কিনা ভাবতে ভাবতেই একটা মোটামুটি ফাঁকা বাস এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে। বাসে উঠে বুঝেছিলো, বাইরে থেকে অল্প ফাঁকা লাগলেও ভিতরে বেশ ভিড় রয়েছে। নীলাদ্রি বরাবরই বললে, সাটেল কার ঠিক করে রাখো, অথবা বাড়ির গাড়িতে যাতায়াত করো, হলো তো অনেকদিন এইভাবে বাসে, ট্যাক্সিতে। নৈঋত সর্বদা প্রাইভেট কারে যাতায়াত করে, নীলাদ্রিও অফিস যায় সাটেল কারে, শুধু ব্যতিক্রমী কাবেরী। ওর যে কেন মনে হয়, বাসে, ট্রেনে ঘেমো গন্ধ মেশা জনজীবনের সঙ্গে মিশে থাকলে বেঁচে থাকার স্বাদ পাওয়া যায়। রোজ কত মানুষ যুদ্ধ করছে দেখলে নিজেরও জীবনী শক্তি পাওয়া যায়। তাই খুব সমস্যায় না পড়লে কাবেরী বাসেই যাতায়াত করে। নীলাদ্রির সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ হয়েছিল কাবেরীর তখন ও গাড়িতে যাতায়াত করার কথা ভাবতই না। বরং বাসভাড়াটাই ছিল ওর কাছে বিলাসিতা। সেই নীলাদ্রির আসমান-জমিন পার্থক্যটা যেন বড্ড চোখে লাগে। এখন তো এসি, গাড়ি, দামি মোবাইল, ফ্লাইটে ট্র্যাভেল করা এগুলো নীলাদ্রির নৈমিত্তিক প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে গেছে। কাবেরীকে প্রায়ই বলে, তুমি আর পাল্টালে না। কাবেরীর ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি এসে লুকোচুরি খেলে মনে মনে বলে, কেউ তো ধরে রাখুক অতীতের দিনগুলোকে। তাই বসু বাড়ির ইদানিং কালের চাকচিক্য ভরা জীবনে সেভাবে গা ভাসিয়ে দেয়নি কাবেরী। সেদিনও অফিসফেরত বাসে উঠেই একটা জায়গা খুঁজছিল। এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, তখনই চোখ আটকেছিলো অহনার দিকে। মেয়েটা হাত নেড়ে ডেকে বলেছিল, এদিকে আসুন। গেট থেকে ভিড় ঠেলে একটু একটু করে এগোচ্ছিল কাবেরী, মেয়েটা বোধহয় সামনের স্টপেজে নামবে, তাই সিটটা দেবে বলেই ডাকছে। মেয়েটার দিকে চোখ পড়তেই দেখলো ইশারায় কিছু বলছে। বুঝতে পারছিল না ও। বাইরে থেকে প্রায় ফাঁকা মনে হওয়া বাসটার পেটের খোলের মধ্যে এত লোক ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে। অফিস থেকে ওর বাড়ি প্রায় মিনিট চল্লিশের রাস্তা। বসে গেলে কষ্ট হয় না, কিন্তু দাঁড়িয়ে গেলে বুঝতে পারে নৈঋত অনেকটাই বড় হয়ে গেছে, তাই তার মাকে লোকে আর মধ্যবয়স্কা বলবে না। সামনের মধ্য শব্দটা খুব তাড়াতাড়ি বিতাড়িত হবে কাবেরী কাছ থেকে। মেয়েটার কাছে আসতেই মেয়েটা প্রায় লাফিয়ে উঠে বললো, আপনার ব্যাগটা চেক করুন প্লিজ। একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল কাবেরী। যা বাবা, সিট দেবে না? হঠাৎ ব্যাগ নিয়ে পড়লো কেন! ব্যাগটা ডিপ ব্লু, গতবছর নীলাদ্রি কিনে এনেছিল বাইরে ট্যুরে গিয়ে। বেশ এক্সপেন্সিভ বলে এতদিন আলমারির তাকেই শোভা বাড়াচ্ছিলো। একদিন নীলাদ্রি আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ব্যাগটা ব্যবহার করলেও কি নিজেকে উগ্র বিলাসী বলে মনে হবে তোমার? তাই রেখে দিয়েছো এটাকে?
নীলাদ্রির চোখের অভিমান দেখে সেদিন থেকে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল ব্যাগটা। অফিসে নিয়ে যাওয়ার পরই রিতাদি জিজ্ঞেস করেছিল, অরিজিনাল ইটালিয়ান লেদার মনে হচ্ছে কাবেরী? এর দাম তো প্রায় হাজার দশেক। রিতাদির আবার মারাত্মক ব্যাগের শখ। শাড়ির সাথে ম্যাচ করে ব্যাগ ইউজ করে রিতাদি। তাই দামদর ভালো জানে। দশহাজার দিয়ে ব্যাগ কিনেছে নীলাদ্রি! বাপরে, বাবা-ছেলে দুজনেই বড্ড ধনী হয়ে গেছে যেন। নৈঋতও সেদিন ওর নিজের ঘরে একটা টিভি থাকা সত্ত্বেও আরেকখানা প্রায় সত্তর হাজার টাকা দিয়ে টিভি কিনলো। কাবেরী কিছু বলতে গেলেই বাবা-ছেলে একটাই কথা বলে দাগিয়ে দেয় ওকে, মিডিল ক্লাস মেন্টালিটি থেকে বেরোও প্লিজ।
এই মেয়েটা বোধহয় ওর এই এক্সপেন্সিভ ব্যাগের দাম জিজ্ঞেস করবে বলেই ডাকছিল। বাপরে কিছু মেয়ের দৃষ্টিও বলিহারি। কে কি শাড়ি পরেছে, কে কি জুয়েলারি পরেছে সব নজরে আসে। অপরিচিত হলেও এরা দিব্যি জিজ্ঞেস করে বসে, কোথা থেকে কিনেছেন? কাবেরী বলতেই যাচ্ছিল, গিফট পেয়েছি, কত দাম, কোন দোকান থেকে কেনা কিছু জানি না। তার আগেই মেয়েটি প্রায় ধমকের সুরে বললো, আন্টি আপনার ব্যাগ চেক করুন কুইক। মনে হচ্ছে পিক পকেট হয়েছে। কথাটা শুনেই কাবেরী ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে হাতে নিয়েছিল, পিছনের চেনের নীচে কেউ ব্লেড চালিয়েছে। ওয়ালেট মিসিং, কারণ কাবেরী জানে এই থার্ড খাপে রাখে ও ওর ওয়ালেট। মেয়েটা স্থির গলায় বলল, বসুন এখানে। তারপর বাসের কন্ডাক্টরকে কিছু একটা বললো ফিসফিস করে। গেটম্যান বাসটা থামাতেই একটা রোগা মত ছেলে প্রায় লাফিয়ে নামলো, মেয়েটা ছেলেটার সঙ্গে লাফ দিলো বাস থেকে। কাবেরী অবাক হয়ে দেখলো, কি অদ্ভুত কায়দায় পালিয়ে যেতে চাওয়া ছেলেটাকে মেয়েটা ধরলো। ছেলেটা কঁকিয়ে উঠলো, সম্ভবত মেয়েটা মেরেছে ঘাড়ে, ছেলেটার একটা হাত মচকে ধরে টেনে তুললো বাসে। গেটম্যান ছেলেটার প্যান্টের ঝোলা পকেট থেকে আবিষ্কার করলো কাবেরী পিঙ্ক কালারের ওয়ালেটটা। যেটার মধ্যে ওর টাকা ছাড়াও তিনটে কার্ড রয়েছে, এছাড়াও বাড়ির একসেট চাবি। পার্সটা হাতে পেয়েও কেমন অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে ছিল কাবেরী। তখনও অপলক তাকিয়েছিল মেয়েটির দিকে। বিক্ষুব্ধ পাবলিক এতক্ষণে উঠে পড়েছে, ছেলেটিকে মেরে হাতের সুখ নেবে বলে। মেয়েটি খুব সাবধানী অথচ ফিসফিসিয়ে গলায় বলল, এনে আমার কার্ড, কাল কল করিস, এখন পালা। ছেলেটা কার্ডটা হাতে নিয়েই লাফ দিলো চলন্ত বাস থেকে। কাবেরী তখনও তাকিয়েছিল মেয়েটির দিকে। ধন্যবাদ জানাতে ভুলে গিয়েছিল, মেয়েটিও যেন ওর ধন্যবাদ প্রত্যাশী নয়, এমন ভাবেই কাউকে একটা ফোন করে বললো, তোমার কার্ড বিতরণ করলাম একজনকে, নতুন নেমেছে এ লাইনে, এখনো পোক্ত হয়নি হাত। পারলে একটা ব্যবস্থা করো। না না, বিজুকাকার মত কেসটা নয়, ব্যাগ সত্যিই কেটেছিল, কিন্তু অভ্যস্ত নয় বুঝলে? এখনই যদি ব্যবস্থা করা যায় তাহলে এ লাইনে একজন কমানো যাবে, এই আরকি। আমি ফিরবো, কিন্তু আরেকটা কাজ আছে, বাবা, তুমি কাল ফিরবে ফ্ল্যাটে, নাকি দেরি আছে?
কাবেরী বুঝেছিলো মেয়েটি তার বাবার সঙ্গে কথা বলে পকেটমার ছেলেটির একটি কাজের ব্যবস্থা করতে চাইছে। অদ্ভুত লেগেছিল কাবেরীর। মেয়েটার বয়েস কম, তবুও কত ম্যাচিওরিটি! তাছাড়া কি দুর্দান্ত শার্প ব্রেন, প্রথম দেখাতেই মেয়েটাকে খুব ভাল লেগে গিয়েছিলো কাবেরী। হালকা গলায় বলেছিল, বাবার নয়, তোমার একটা কার্ড পাওয়া যাবে?
মেয়েটি ফিক করে হেসে বলেছিল, আমি আমার ফোন নম্বর দিতে পারি, কার্ড তো এখনো নেই।
ফোননম্বরটা লোড করে নিয়ে কাবেরী বলেছিল, ফোন করলে বিরক্ত হবে না তো?
মেয়েটা হেসে বলেছিল, আপনি অহনা নামে সেভ করুন। আমার মা দিনে বার কুড়ি কল করে, তাতেও বেঁচে আছি যখন তখন আপনার একটা কলে আর কিভাবে বিরক্ত হবো! কাবেরীর বেশ মজা লেগেছিল নৈঋতের বয়সি একটা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে। টুটাইও ঠিক একই কথা বলে কাবেরীকে। মা এই কলকাতা শহরে কয়েক হাজার গাড়ি চলছে, তোমার ছেলে একাই ড্রাইভ করে ফিরছে না বুঝলে, তাই এই হাইপারটেনশনটা একটু কম করলে আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে ড্রাইভ করতে পারি! কাবেরী শুধু একটা কথাই বলে, আগে ছেলে-মেয়ের বাবা হও তখন বুঝবে টেনশন না হাইপারটেনশন! টুটাই মুখে বিরক্তির আওয়াজ করে বলে, মায়েরা এত ছেলেমানুষি করে কেন সেটা তো আগে জানবো তখন!
অহনার বোধহয় নামার সময় হয়েছে, পিঠের ব্যাগটা সামলে নিয়ে নিজের টিশার্টটা একটু ঠিক করে নিয়ে বললো, আসছি আন্টি, বি কেয়ারফুল। এই লাইনে কিন্তু এমন প্রায় হচ্ছে এখন।
অহনা নেমে গিয়েছিল, কাবেরীর মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে দিয়ে। ও তখন নিজের মেয়েবেলাটার কথা ভাবতে শুরু করেছিল। প্রচণ্ড স্টুডিয়াস, গুড গার্ল লুক থেকে যেন বেরোতে পারেনি কোনোদিনই ও। এমন মারপিট করার কথা তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। মনে পড়ে গেল কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে একটা দিনের কথা। কলেজে সোশ্যাল ছিল, বেশ সেজেগুজে বান্ধবীরা মিলে কলেজে এসেছিল। কাবেরীর শাড়ির কুঁচিটা খুলে যাচ্ছিল বলে ও বন্ধুদের বলেছিল, তোরা এগিয়ে যা, আমি আসছি। ওয়াশরুমের দিকে হাঁটছিল কুঁচি সামলে, একটা ছেলে এসে ওর পথ আগলে বলেছিল, শাড়িটা পরিয়ে দেব ঠিক করে? কাবেরীর শাড়ির আঁচলটা প্রায় ধরে বলেছিল, এস ঠিক করে পরিয়ে দিই। ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছিলো ও। কোনোমতে ওয়াশরুম ঢুকে গিয়েছিল। বেশ কয়েকবার উকি মেরে দেখেছিলো ছেলেটা তখনও ওখানে আছে কিনা! প্রায় আধঘণ্টা পরে ভয়ে ভয়ে ও বেরিয়েছিল ওখান থেকে। নিজের ওপরেই রাগ হয়েছিল কাবেরীর, এমন অপমানের উত্তরে ও যোগ্য জবাব দিতে পারলো না বলে। ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে টপটপ করে পড়েছিলো নিরীহ চোখের জল। সেদিনের কাবেরী আর আজকের অহনার মধ্যে কত অমিল, অহনারা কত সাহসী, সাবলীল, এমন মেয়েই তো চাই আজকের সমাজের জন্য।
কাবেরী যখন প্রেগনেন্ট তখন একদিন নীলাদ্রিকে বলেছিল, যদি আমার মেয়ে হয় তাকে আমি তৈরি করব আমার দেখা স্বপ্নের মত। যে মেয়ে তলোয়ারের মত ঝকঝক করবে, মরচে ধরবে না যার বুদ্ধিতে। নীলাদ্রি হেসে বলেছিল, মানে একটু গম্ভীর, লাজুক, অত্যন্ত ভদ্র কাবেরী টাইপ নয় তাইতো?
কাবেরী নিজের পেটের ওপরে হাত বুলিয়ে বলেছিল, একেবারেই নয়। সে আমার কল্পনায় আছে, যাকে আমি মেয়েবেলা থেকে লালন করে এসেছি, নিজেকে কোনোদিন সেই রূপে দেখতে গিয়ে দেখেছি মুখটা কেমন ধূসর হয়ে যায়। তখনই বুঝেছি, সে আমার সুচিন্তিত কল্পনা, আমায় স্বপ্ন, আমার ভাবনা, আমি নই। কাবেরীর মেয়ে হয়নি, হয়েছিল ছেলে। আর সেই ছেলেও অত্যন্ত শান্ত ভদ্র, নৈঋত নামটাও কাবেরীরই রাখা। নীলাদ্রির সঙ্গে মিল করেই বোধহয় নামটা রেখেছিলো তখন। কিন্তু কাবেরী একেবারেই চায়নি নৈঋত নীলাদ্রির মত ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা মানুষ হোক। কাবেরীর চাওয়াতেই তো আর সবকিছু হবে না। তাই নৈঋতকে যেমন নীলাদ্রির মত দেখতে সুপুরুষ হয়েছে তেমনিই বাবার মতই স্বভাবখানাও পেয়েছে, ঝুট-ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে পছন্দ করে না নৈঋত। খুব ছোট থেকেই টুটাই একটু নির্বিবাদী স্বভাবের, এই জন্যই ওকে স্কুলে পাঠিয়ে কখনো ভয় করতো না কাবেরীর। তবে ওই যে প্রতিবাদী, অকাট্য যুক্তিবাদী মেয়ের স্বপ্নটা দেখেছিলো ওটা অধরাই রয়ে গিয়েছিল। অধরা স্বপ্ন চিরকালই ভীষণ রকমের দামি হয়। হয়তো মানুষ এর নাগাল পায় না বলেই মহামূল্যবান হয়ে ওঠে প্রত্যেকের কাছে। অহনাকে সেদিন বাসে দেখার পর থেকেই কাবেরী দেখা সেই সুপ্ত স্বপ্নটা জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। মনে মনে ভেবেছিল, যদি অহনা নৈঋতের বউ হয় তাহলে মন্দ হবে না। এমন একটা ডাকাত ডাকাত মেয়ের স্বপ্নই তো লালন করছিল কাবেরী মনের মধ্যে।
অহনাকে দ্বিতীয়দিন দেখার পরে এ বাড়িতে ওকে নিয়ে আসার কাবেরীর ইচ্ছাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
সেদিনও অফিস যাওয়ার পথেই সুছন্দাদের বাড়িতে একবার ঢুঁ দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সুছন্দা কাবেরীর ইউনিভার্সিটির বন্ধু। মাঝখানে বেশ কিছু বছরের অদর্শনে যখন ওকে প্রায় ভুলতে বসেছিলো তখনই একটা নামি শাড়ির দোকানে এক মহিলাকে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে দেখেছিলো। কেন দামি শাড়ি একবার পরার পরেই আঁচলে ছেঁড়া বেরোয়। দোকানদার যত বলছে, এটা কোনো খোঁচায় ছিঁড়েছে মহিলা তত জোরে বলছে, পুরোনো স্টকের শাড়ি, কাস্টমারকে গছিয়ে দিয়েছেন, লজ্জা করে না। পুরোনো, পচা সিল্ক, তাই নরম্যালি ফেঁসে গেছে।
মহিলার একরোখা কথা বলার টেকনিকটা খুব চেনা লাগছিলো কাবেরীর। একটু মোটা হলেও মুখের গঠন দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ডেকে উঠেছিলো, সুছন্দা…
সুছন্দা কাবেরীকে বহুদিন পরে প্রথম দর্শনের চমক কাটিয়েই বলেছিল, এই চোরের দোকানে শাড়ি কিনতে এসেছিস? কিছুতেই কিনবি না। চল সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট দেব, দেখি এদের জোচ্চুরি কমাতে পারি কিনা। কাবেরীর হাত ধরে টান দিতেই দোকানের রিসেপশনে বসা ভদ্রলোক হে হে করে বলেছিল, আরে ম্যাডাম রাগছেন কেন? মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং তো হতেই পারে। আপনি তো এর আগেও বহু শাড়ি নিয়ে গেছেন আমার প্রতিষ্ঠান থেকে! কোনোবার কি এমনটা হয়েছে? যাকগে ভুল যারই হোক, আমি মনে করি কাস্টমার লক্ষ্মী। তাই ওটা বদলে আপনার পছন্দ মত ওই রেঞ্জের নতুন শাড়ি নিন আপনি। সুছন্দা কাবেরীকে সেই ইউনিভার্সিটির মতই পট করে একটা চোখ মেরে বলেছিল, দেখলি, সব শক্তের ভক্ত। কাবেরীর রুটিনমাফিক জীবনে সুছন্দা এনেছিল একঝলক পুরোনো ঠান্ডা হাওয়া। সেই থেকেই কাবেরীর কাছে নিজেকে ভুলতে দেয়নি সুছন্দা। সপ্তাহে ফোন করে বকবক, মাঝে মাঝেই ওর বাড়িতে কিটি পার্টির আয়োজন করে বন্ধুত্বটাকে আরও গাঢ় করে তুলেছিল। উত্তর কলকাতার সাবেকি পাড়ার বাড়ি ছেড়ে সদ্য উঠে এসেছে সাউথের ফ্ল্যাটে। আজ সেই ফ্ল্যাটেরই গৃহপ্রবেশ, তাই কাবেরীর উপস্থিতি একান্তভাবে কাম্য। অফিসের দোহাই দিলে ও বলেছিল, সেকেন্ড হাফে যাবি, পুজোর সময়টুকু থাকিস প্লিজ। সেই উদ্দেশ্যেই কাবেরী ওর যাদবপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঢাকুরিয়া যাবার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। তখনই দেখেছিলো, ওর চোখের সামনে একটা দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন ধরিয়ে দিল কতগুলো উদ্ভ্রান্ত ছেলে। হকচকিয়ে গিয়েছিল কাবেরী। মুহূর্তের মধ্যে দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছিল। বেশ কিছু ছেলের একটা দল সরকারি প্রপার্টি নষ্ট করার উদ্দেশ্যেই হসপিটালের দিকে ছুটছিলো লাঠি নিয়ে। বাসের কাঁচ ভাঙছিলো অবলীলায়। ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল কাবেরীর। কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছিল না। ঠিক সেই সময় একটা ছেলে ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে পটাপট ছবি তুলেছিল, আর অহনা ক্রুদ্ধ ছেলেগুলোর মুখের সামনে মাইক ধরে জিজ্ঞেস করছিল, আচ্ছা ছেলেটার তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে রাস্তায় একটা অন্য বাসের সঙ্গে, তাহলে আপনারা কেন বাকি সব বাস জ্বালাতে চলেছেন?
ছেলেটি দুটো অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে বললো, বাসটা স্টেট বাস ছিল। ছেলেটির বাইককে পিছন থেকে এসে মেরেছিলো, তারপরে ওই বাসটা স্পিডে বেরিয়ে যায়। সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, নাহলে এভাবেই জ্বলবে সব। কাবেরী অবাক হয়ে দেখছিল অহনাকে। কি অদ্ভুত সাহস মেয়েটার। রিপোর্টার বলেই কি এতটা সাহসী হতে হবে? নিজের প্রাণের মায়া নেই?
ছেলে দুটোর বাইট নিয়েই ও ছুটছিলো একটা দোকানদারের কাছে, প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তার কথা জানতে চেয়েছিল। ক্যামেরাম্যান সঙ্গে থাকলেও অহনাও মোবাইলে কিছু জিনিস রেকর্ডিং করছিল মনে হলো। তখনই উদ্ভ্রান্তের মত এদিক ওদিক করা কাবেরীকে চোখে পড়েছিলো অহনার। এগিয়ে এসে বলেছিল, এখুনি এখানে একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছে আন্টি। রাস্তা অবরোধ আছে। সরকারি বাসের সঙ্গে একটা বাইকের। বাইক আরোহী বোধহয় কোনো কলেজের ইউনিয়নের নেতা। তাই বিষয়টা বেশ ঘোরালো আকার নিচ্ছে। আপনি এখানে ট্যাক্সি, উবের কিছুই পাবেন না। আপনার বাড়ি কতদূর?
কাবেরী থমথমে গলায় বলেছিল, রিকশায় মিনিট দশেক হবে। অহনা ক্যামেরা সামলে ছুটে গিয়ে একটা গ্রে কালারের স্কুটি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে। বলেছিল, তাড়াতাড়ি উঠুন। আপনাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই আমায় অফিস ছুটতে হবে। আজকের ঘটনার রিপোর্ট দিতে হবে অফিসে। নেটওয়ার্ক প্রবলেম, মেল সেন্ড হচ্ছে না।
কাবেরী স্কুটিতে উঠেই বলেছিল, তুমি রিপোর্টার?
অহনা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ, আমার বাবাও নামকরা সাংবাদিক, তবে নিউজ পেপারের। আমি আপাতত অত বড় জায়গায় যাইনি তবে একদিন নিশ্চয়ই যাবো। চ্যালেঞ্জ নিতে আমি ভয় পাইনা, আমার চ্যানেল আমার ওপরে ভরসা করে।
কাবেরীকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিতেই ও বলেছিল, অহনা, বাড়িতে আসবে না একবার?
অহনা মিষ্টি করে হেসে বলেছিল, চিনে গেলাম তো আন্টি, যেকোনো সময় চলে আসব আপনার সঙ্গে দেখা করতে।
দাঁড়ায়নি অহনা, বেশ স্পিডেই স্কুটি চালিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেদিন থেকেই কাবেরীর মনে একটা চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল স্বল্পপরিচিতা অহনা। সাজগোজের পরিপাটি নেই, প্রচণ্ড সাহসী অথচ কর্তব্যপরায়ণ এমন মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না কাবেরীর। তাই অহনার বাড়ির অ্যাড্রেস খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ও। যদি এনগেজড না হয় তাহলে সম্বন্ধ করতে দোষ কোথায়? এমন কাকতলীয়ভাবে যোগাযোগের পিছনে নিশ্চয়ই কিছু ইঙ্গিত আছে ভগবানের। অহনাই কাবেরীর সেই কল্পিত মেয়ে যার মুখটা আঁকা ছিল ওর অন্তরের অন্তঃস্থলে। সেদিন রাতেই নিলাদ্রীকে বলেছিল অহনার কথা। নীলাদ্রি শুনে বলেছিল, বেশ তো, উপকার করেছে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে একদিন খাইয়ে দাও, সঙ্গে কিছু গিফ দিয়ে দাও মিটে গেল। এর মধ্যে টুটাইকে ঢোকাচ্ছ কেন! টুটাই কেন এমন দামাল টাইপের মেয়ের সঙ্গে আজীবন কাটাবে বলতো? শুধু তোমার পছন্দ বলে? টুটাই কিন্তু বরাবরই একটু শান্তশিষ্ট, ওর জীবনসঙ্গী এমন মারদাঙ্গা করবে এটা ও মেনে নেবে কাবেরী? তুমি নিজেও তো ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে যেতে পছন্দ করো, তেমন অকোয়ার্ড সিচুয়েশনে পড়লে তুমি নিজেই তো ঘাবড়ে যাও, একটু ভেবে দেখো প্লিজ। তোমার ওপরে আমার ভরসা আছে, কিন্তু টুটাইয়ের সারাজীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কিন্তু আমাদের নেই। বাবা-মা বলেই ওর ওপরে কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? টুটাই তোমায় একটু বেশিই বিশ্বাস করে, তাই কাবেরী যা করবে বিচক্ষণতার সঙ্গে করো। ওসব মেয়েকে সিনেমার পর্দায় মানায়, বাড়ির বউ হিসেবে নয়।
অনু এটুকু শুনেই বললো, বৌদি যাই বলো দাদা একদম ঠিক বলেছিল। না, না, আমি একেবারে ঘরোয়া, গৃহকর্মে নিপুণা এমন মেয়ের কথা বলছি না গো। জব করুক, যে কোনো অফিসিয়াল জব করুক, গান, নাচ করুক কিন্তু তাই বলে রিপোর্টার? তাও আবার টিভি চ্যানেলের। এদের তো শুনেছি জঙ্গলমহলে অবধি যেতে হয় খবর সংগ্রহের জন্য। ভাবতে পারছো, রিপোর্টারদের লাইফ কতটা রিস্কি? এসব জেনেও তুমি টুটাইয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলে কি করে বৌদি? টুটাই, দাদাভাই এরা মেনে নিল?
কাবেরী কোনো উত্তর দেবার আগেই শুভময় বললো, অহনার প্রফেশন নিয়ে আমার তো মনে হয় টুটাইয়ের কোনো প্রবলেম হওয়ার কথা নয়, টুটাই এখনকার ছেলে, ওদের ভাবনা আমাদের মত সেকেলে নিশ্চয়ই নয়। অনু বললো, টুটাইয়ের যদি এতই পছন্দ হতো, তাহলে ও বিবাহবাসর ছেড়ে পালালো কেন বলবে?
শুভময় নরম স্বরে বললো, আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, মেয়েটার কোনো অ্যাফেয়ার ছিল। আর সেটা জানার পরেই টুটাই এমন চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কাবেরী বললো, শুধু লোকের কথাতে এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো টুটাই? এমনও তো হতে পারে অহনাই কিছু বলেছিল টুটাইকে, তাই ও বাধ্য হয়েছিল ওখান থেকে পালাতে। কাবেরীর মনে পড়ে গেলো অহনার শেষ কথাটা।
অহনাকে যখন কাবেরী জিজ্ঞেস করেছিল, সত্যি করে বলতো, নৈঋতকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
অহনা একটু থেমে বলেছিল, এখুনি বিয়ে করতে ইচ্ছে ছিলো না। আর আন্টি এইটুকু সময়ে একজনের বাইরেটুকুই দেখা যায়। মানে, হাইট, ওয়েট, চেহারার কথা বলছি আরকি। ভিতরটা বোঝা সম্ভব নয়। আমার পক্ষেও নয়, নৈঋতের পক্ষেও নয়। পরবর্তীকালে সংসার করতে গিয়ে দেখলাম আমরা হয়তো ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। তাতে হয় আমরা অ্যাডজাস্ট করে নেব নয়তো সেপারেশন, তাই এখন এইটুকু দেখেই পছন্দ বলায় আমি বিশ্বাসী নই। তবে আপনাকে আমার সত্যিই বড্ড পছন্দ। আপনি আমার মায়ের মত টিপিক্যাল মেন্টালিটির নন। যদি হতেন তাহলে আমাকে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতেই চাইতেন না। নৈঋতের প্রফেশন নিয়ে আমার কোনো প্রবলেম নেই, আশা করবো বিয়ের পর আমিও আপনাদের কাছে থেকে সব রকম হেল্প পাবো আমার কেরিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার এখুনি বিয়ে করার সত্যিই ইচ্ছে ছিলো না। তবে আমার মায়ের আবার নৈঋতকে ভীষণ পছন্দ, এমন শান্তশিষ্ট ছেলেই মা বেশি পছন্দ করে। আসলে চব্বিশঘণ্টা নিজের মেয়ের বেচাল দেখতে দেখতে হয়তো ক্লান্ত হয়ে গেছে। মাকে আমি কোনো কারণ ছাড়াই ভীষণ ভালোবাসি, তাই মায়ের পছন্দকে এক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে চাই। কাবেরী অবাক হয়ে তাকিয়েছিল অহনার দিকে। এতটা স্পষ্ট কথা যে কেউ পাত্রপক্ষকে বলতে পারে, এমন ধারণাই ছিল না ওর। মনে মনে বাহবা দিয়ে বলেছিল, সাবাস অহনা, তোমরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে এ যুগের নারীদের। অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে কাবেরী বলেছিল, এমনই থেকো আজীবন। নৈঋত কখনো কারোর ব্যক্তিস্বাধীনতার হস্তক্ষেপ করে না। তাই আশা করি তোমাকেও ও সবটুকু স্বাধীনতা দেবে যেমন তুমি এ বাড়িতে পেয়ে এসেছো।
অহনা মুচকি হেসে বলেছিল, এবাড়িতে বাবা আমায় সাপোর্ট করে শুধু, মা তো দিনরাত বলেই যায়, এসব চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোনো স্কুলের জবের জন্য অ্যাপ্লাই করতে। এটা আমাদের বাড়ির রোজকার সমস্যা। তাই আপনি যেটাকে মেয়েবেলার স্বাধীনতা পাওয়া বলছেন, সেটা আমাকে রীতিমত লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে। তবে আমি নিশ্চিত যে আপনি আমার এই চ্যালেঞ্জিং প্রফেশনটাকে বেশ রেসপেক্ট করছেন, অন্তত আপনার কথা শুনে সেটাই ধারণা হয়েছে। ওই টিপিক্যাল শাশুড়ি টাইপ নন বলেই আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম। কাবেরী তখন গুছিয়ে নৈঋতের গুনগান করতে শুরু করেছিল অহনার কাছে। অহনা হেসে বলেছিল, মায়ের কাছে সব ছেলেই সুবোধ বালক হয় আন্টি, এটা তো মানবেন?
কাবেরীর বেশ ভাল লেগেছিলো এই অসম বয়সি বন্ধুত্বটা। কই অহনার সঙ্গে কথা বলার সময় একবারের জন্যও তো মনে হয়নি যে ওর বসুবাড়িতে আসতে কোনোরকম আপত্তি আছে! অথবা অন্য কোথাও অ্যাফেয়ার আছে!
তাহলে এই মুহূর্তে কাবেরীদের বাড়ির নহবতখানা থেকে কেন ভেসে আসছে না বিসমিল্লাহ শাহের সুর?
কেন সবাই কাবেরীর পছন্দর দিকে আঙুল তুলে বলছে, নৈঋত আর অহনা মিসম্যাচ ছিল বলেই ভেঙে গেল বিয়েটা। ওয়াড্রবের সামনেই রেখেছিলো লালচে কোরিয়াল বেনারসিটা, ওটা পরে বধূ বরণ করবে খুব আশা ছিল কাবেরীর। শাড়িটা যেন বিদ্রুপ করে বলছে, তুমি আজ ভুল প্রতিপন্ন হলে, তুমি সুসন্তান মানুষ করায় ব্যর্থ হয়েছ কাবেরী বসু, অহনার গোপন অ্যাফেয়ারের কথাও তুমি বুঝতে পারনি ওর নিষ্পাপ চোখদুটো দেখে!