অনুভবে তুমি – ১০
।।১০।।
অ্যাফেয়ার বা প্রেম যাকে বলে সেটা বোধহয় নীলাদ্রির সাথে কাবেরীর কোনোদিনই হত না, যদি না মাঝে নীলাদ্রির বন্ধু সুজন মিডিলম্যান হিসাবে না থাকতো। যদিও ওদের বিয়েটাকে বসুবাড়িতে সবাই প্রেমের বিয়েই বলেই জানে। কিন্তু নীলাদ্রি জানে কাবেরীর সঙ্গে ওর যেটা ছিল সেটাকে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব বললেই ঠিক বলা হবে। কেউই বোধহয় কাউকে কোনোদিন প্রোপোজ করতো না। নীলাদ্রি এমনিতেই এসব বিষয়ে স্বচ্ছন্দ নয় একেবারেই, কাবেরীও ততটা ডেসপারেট ছিল না কোনোদিনই। ও হয়তো নীলাদ্রির থেকে মিশুকে ছিল বেশি, গল্প করতে ভালোবাসতো সবার সঙ্গে। কিন্তু প্রেম নিবেদন করবে এমন সাহস ওরও ছিল না। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কাকে বিয়ে করবে! তারপর শেষ মুহূর্তে পছন্দ না হলে বিয়ের আসর থেকেও পালিয়ে যাচ্ছে! অদ্ভুত এদের সাহস, ঈর্ষণীয় স্পর্ধা এদের। নীলাদ্রি তো জীবনে কোনোদিন কাবেরীর বাইরে কিছু ভাবতেই পারলো না। ও জানে বসুবাড়িতে আড়ালে ওকে স্ত্রৈণ্য বলে ব্যঙ্গও করা হয়। যদিও বাংলা অভিধানের ওই শব্দটা ঠিক কেন তৈরি হয়েছিল ও জানে না। হয়তো পুরুষতন্ত্রকে আরও জোরদার করার জন্যই। স্ত্রৈণ্য শব্দের উচ্চারণে বোধহয় মেল ইগো আচমকা জেগে উঠতো, আর তারা নখ, দাঁত বের করে নিজের স্ত্রীর ওপরে হম্বিতম্বি করে নিজেদেরকে পুরুষসিংহ প্রমাণ করতে সফল হতো। নীলাদ্রির আবার ওই বিশেষ উত্তেজক শব্দটি শুনলে মনে মনে হাসিই পায়। মনে হয় কাবেরী ওর থেকে অনেক বেশি যোগ্য সাংসারিক দিক দিয়ে। তাই তার হাতে সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করে ও কোনো ভুল করেনি। বরং প্রতি পদক্ষেপে নিজেকে অপদার্থ প্রমাণের থেকে এই ভালো। সে বাজারে যাওয়ার সময় লিস্ট নিয়ে বেরোনো থেকে শুরু করে টুটাইয়ের এক্সামের প্রিপারেশন, সবেতেই কাবেরী অনেক বেশি পারদর্শী ওর থেকে। এটা মেনে নিতে কখনো মেল ইগো হার্ট হয়নি ওর। বাজারে লিস্ট না গিয়ে প্রমাণ করেছে ওর স্মৃতিশক্তি প্রবল দুর্বল, এক্সামের আগের দিন টুটাইকে পড়তে বসিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, টুটাইয়ের কোর্সটাই ও ভালো করে জানে না। আউট অফ সিলেবাস পড়াতে গিয়ে কাবেরীর বকুনিও জুটেছে বার দুয়েক। টুটাই হেসে বলেছে, বাবা ওগুলো তো এই টার্মেই নেই। এরকম বহু ব্যাপারে নিজের অক্ষমতা প্রমাণ করার থেকে বুদ্ধিমানের কাজ হলো, দায়িত্ববান স্ত্রীর কাঁধে দায়িত্বটুকু তুলে দিয়ে তার নির্দেশমত চালিত করা নিজেকে। নীলাদ্রিও তাই করে এসেছে এতকাল। কোনোদিন মনে হয়নি কাবেরী এটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রথম টুটাইয়ের বিয়ের ব্যাপারেই কাবেরীর সঙ্গে মতপার্থক্য হয়েছিল নীলাদ্রির, যদিও সেভাবে প্রতিবাদ করেনি ও। এখন বারবার মনে হচ্ছে কাবেরীকে আটকানো উচিত ছিল! শুনত কি কাবেরী? ওর তো অহনাকে বড্ড পছন্দ ছিল।
নীলাদ্রিরও যে পছন্দ ছিল না এমন নয়, কিন্তু মেয়েটাকে দেখেই একটু খামখেয়ালি, মুডি মনে হয়েছিল ওর। তাই জানিয়েছিল কাবেরীকে, কিন্তু কাবেরী ওর স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমতায় বুঝিয়ে দিয়েছিল, এই মেয়েই বেস্ট টুটাইয়ের জন্য। আজ যখন অনু বললো, দাদাভাই, সব ব্যাপারে চুপচাপ থাকাটাও কিন্তু ক্রাইম জানিস তো? টুটাই তোরও ছেলে, তাই তোর অপছন্দের কথাটা একটু জোরেই বলতে পারতিস। মানলাম বৌদিভাই সবদিক সুন্দরভাবে সামলায়, তুই হয়তো পারতিস না, আমি রেসপেক্ট করি বৌদিভাইকে, তবে তোর অপছন্দে বিয়েটা হচ্ছিল শুনে বিরক্তি আসছে।
অনুর কথা শুনে এই প্রথমবার নীলাদ্রির মনে হলো, কাবেরীকে বোধহয় এতটা অন্ধভাবে বিশ্বাস করাটা ঠিক হয়নি ওর। এই কথাটা মনে হওয়ার পর থেকেই বুকের বাম দিকে একটা নিস্তব্ধ কষ্ট অহেতুক পীড়া দিচ্ছিল ওকে। স্মৃতির পাতা উল্টে চলে গিয়েছিল কাবেরী সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তটাতে।
নীলাদ্রি তখন বছর তিনেক জয়েন করেছে রেলে। প্রমোশন হয়ে হয়ে আজ যে পজিশনে আছে তখন এই চেয়ারটা ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বাড়ির অবস্থা স্বচ্ছল থাকলেও কোনোদিনই খুব বিলাসিতায় মানুষ হয়নি নীলাদ্রি বা অনু কেউই। তাই নীলাদ্রি জানতো স্যালারি হাতে পেয়েই বিলাসিতায় গা ভাসানো সম্ভব নয়। অনুর বিয়ের দায়িত্ব কিছুটা হলেও ওকে নিতেই হবে। বাবার রিটায়ারমেন্টের পর পেনশনের টাকায় আর যাইহোক বিলাসিতা করা সম্ভব হয় না। তাই নীলাদ্রি বেশ গুছিয়ে চলছিল ওর স্বল্প স্যালারি থেকেই। তখনও এত পে কমিশনের রমরমা হয়নি, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি হলেও মাইনে কিন্তু সেই হাতে গোনা। এমন অবস্থায় দোতলা করা আর অনুর বিয়ে দেওয়াটা ছিল ফার্স্ট প্রায়োরিটি, নিজের বিয়ে বা প্রেম নিয়ে মোটেই কল্পনা করেনি নীলাদ্রি। ওর অমন আনরোম্যান্টিক জীবনে তখন কাবেরীর প্রবেশের কোনো সুযোগই ছিল না। তবুও কি করে যেন বরুণদেবের গোপন চোখ রাঙানিতে অবাধ্য বসন্ত বাতাস এসে রাঙিয়ে দিয়েছিল নীলাদ্রির আপাত গম্ভীর, রুটিন মাফিক, কেজো জীবনের দিনগুলোকে।
লাঞ্চ ব্রেকে সুজন এসে নিলাদ্রীকে বলেছিল, জানিস একটা মেয়েকে সাহেবের চেম্বারটা দেখিয়ে দিলাম, বোধহয় ক্ল্যারিক্যাল পোস্টে জয়েন করেছে গুডস ডিপার্টমেন্টে। নীলাদ্রি অবাক হয়ে বলেছিল, রেলটা যেহেতু তোর শ্বশুরের নয় তাই এখানে কয়েকশো এমপ্লয়ি রেগুলার জয়েন করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
সুজন বলেছিল, সেটা নয়, আসলে মেয়েদের মধ্যে অফিসিয়াল জব করার প্রবণতা বাড়ছে বুঝলি। শুধু টিচিং নয় এরা সব প্রফেশনেই আসছে। নীলাদ্রি হেসে বলেছিল, আমাদের ডিপার্টমেন্টেও তো তিনজন মহিলা আছেন রে। ওরা তো আমার সিনিয়র। আসলে কি বলতো, ছেলে-মেয়ে বলে নয় সবটাই মানসিকতার ব্যাপার। নীলাদ্রির কথাটা শেষ হবার আগেই বেশ সুন্দরী এক মহিলা পাশ থেকে বললো, একদম পারফেক্ট বললেন। সবটাই মানসিকতার ব্যাপার। জবের জন্য সব জায়গায় ট্রাই করছিলাম। স্টেট বা সেন্ট্রাল এমন বাছবিচার ছিল না। এটা হয়ে গেল জয়েন করে ফেললাম। নীলাদ্রি একটু চমকে তাকাতেই, সুজন বললো, সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো? কাজ মিটলো আপনার? এনিওয়ে এটাই হলো সেই বিখ্যাত রেল ক্যান্টিন। এখানে বাঁধাকপির তরকারি আর মাংসের ঘুগনির দায়িত্ব নিয়ে একই টেস্ট করে আমাদের সর্বজনবিদিত উদয়দা। আপত্তি না থাকলে বসতে পারেন, টেস্ট করেও দেখতে পারেন। মেয়েটি নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে বসতে পারি। নতুন অফিসে আনকম্ফোর্টেবল ফিল করেনি এমন স্মার্ট বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। তাই এখনও অবধি কারোর সঙ্গেই পরিচয় করে উঠতে পারিনি। দিন তিনেকের অফিস আসার ফলাফল জিরো বলতে পারেন। তবে সুজনদা, আপনি বোধহয় মানুষকে হেল্প করতে ভালোবাসেন। আমি লবিতে পুতুল নাচের মত গোলগোল চক্কর কাটছি দেখেই হয়তো বুঝেছিলেন, সমস্যায় পড়েছি। কাবেরী নিজেই নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমার নাম কাবেরী।
নীলাদ্রি অপ্রস্তুত গলার স্বরকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলেছিল, নিশ্চয়ই বসুন। আমি নীলাদ্রি বসু। আপনার মত সমস্যায় আমিও পড়েছিলাম বছর তিনেক আগে। তখনও এই আপনার সুজনদাই আগ বাড়িয়ে আমায় সঙ্গ দিয়েছিল। তারপর কি করে যেন, আমরা অলিখিত ভাবেই বন্ধু হয়ে গেলাম। সুজনের পরপকারী স্বভাবটা দেখছি এখনো বুদ্বুদের মত রয়েই গেছে। নতুনদের দেখলেই সেটা জেগে ওঠে। কাবেরী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বলেছিল, নতুন বন্ধুত্বের দিনটা সেলিব্রেট করা হোক, আমার বাড়ির আনা টিফিন আর আপনাদের উদয়দার বিখ্যাত ঘুগনি দিয়ে। না না, আপনাদের বেস্ট কুক উদয়দার সঙ্গে কম্পিটিশনে নামবো না, তবে মেয়ে অফিসে আসছে দেখে আমার মা উদ্বেলিত হয়ে গোটা পরিবারের লাঞ্চটা আমার লাঞ্চ বক্সে লোড করে দিয়েছে, সেটা একা উদ্ধার করা আমার কম্ম নয়। সুজন মুচকি হেসে বললো, একবার যখন দাদা ডেকেছ, তখন তোমায় সব রকম সাহায্য করতে রাজি এই সুজন মল্লিক। দাও দেখি, মাসিমা টিফিনে কি দিয়েছে মেয়েকে দেখি। তিন পার্টের লাঞ্চ বক্সটা টেনে নিয়ে সুজন খুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। নীলাদ্রি এটা বহুবার লক্ষ্য করেছে, অপরিচিত থেকে সদ্য পরিচিত সকলের সঙ্গেই সুজনের ব্যবহার বেশ খোলামেলা, কোনো জড়তা থাকে না ওর মধ্যে। এই জন্যই বোধহয় যে কেউ সুজনকে তাড়াতাড়ি নিজের করে নিতে পারে।
সুজনকে নীলাদ্রিরও বড্ড আপন মনে হয়, যার কাছে সুখ-দুঃখের কথা বলা যায় নির্দ্বিধায়।
তাই বলে মাত্র দশমিনিট আগে পরিচয় হওয়া একজন মহিলার টিফিন বক্স থেকে টিফিন শেয়ার করার কথা ভাবতেও পারে না নীলাদ্রি। একি লোয়ারের ক্লাসরুম নাকি, যে সবাই টিফিন ভাগ করে খাবে? এটা অফিস, আর নীলাদ্রি যথেষ্ট সিনিয়র পজিশনে আছে কাবেরীর থেকে। তাই এভাবে সুজনের সঙ্গে স্রোতে ভাসতে ও পারবে না। ওর চোখের দৃষ্টিতেও বোধহয় অস্বস্তি ফুটে উঠেছিলো, সেদিকে তাকিয়েই কাবেরী বললো, বুঝলেন সুজনদা আপনার বন্ধু বোধহয় একজন জুনিয়র অপরিচিতার সঙ্গে একসাথে বসে লাঞ্চ করতে কমফোর্ট ফিল করছেন না। তাই সুজনদা, প্লিজ ওনাকে আমার লাঞ্চ বক্সের খাবার খেতে রিকয়েস্ট করে আর বিব্রত করবেন না। নীলাদ্রি অবাক হয়ে দেখছিল কাবেরীর দিকে। এত স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে খুব কম মানুষকেই শুনেছে, তাছাড়া মহিলা কি মনের ভাষা পড়তে পারে নাকি? বেশ দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিল নীলাদ্রি। সুজনদা উদ্ধারকর্তার সুরে বলেছিল, আরে না না কাবেরী, নীল বরাবরই এমন রামগরুরের ছানা টাইপের মুখ করেই থাকে। ও নিয়ে বেশি ভেবো না। এই দাদা যতদিন এই ডিপার্টমেন্টে আছে ততদিন তোমার মায়ের হাতের এই লুচি আর আলুরদমের স্বাদ আমি মনে রাখব। ওহ, আরেকটা বক্সে কি আছে দেখতেই তো ভুলে গেছি। কাবেরী লাজুক হেসে বলেছিল, ওটাতে সুজির হালুয়া আছে, খেয়ে দেখুন। আর শুনুন, লাঞ্চ বক্সটা আপনার মাসিমা গুছিয়েছে ঠিকই কিন্তু রান্নাটা কিন্তু এই অধমের। আজকে এটাই বাড়ির জলখাবার বানিয়েছিলাম।
সুজন বেশ চমকিত গলায় বলল, বলো কি হে, এই কলিযুগেও মেয়েরা রান্নাঘরে ঢোকে বলছো?
তাহলে তো কাবেরী, এই পেটুক দাদাকে একদিন বাড়িতে বসিয়ে নিজের হাতে কচি পাঁঠার ঝোল রেঁধে খাওয়াতেই হবে। নীলাদ্রির অস্বস্তি চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছিল। সুজন যে কি করে মাঝে মাঝে, এত বাড়াবাড়ির কি আছে!
ঠিক সেই মুহূর্তেই উদয়দার ক্যান্টিনের ছেলেটা এসে মাংসের ঘুগনি আর তিনটে রুটির প্লেটটা নীলাদ্রির সামনে ঠকাস করে নামিয়ে দিয়ে বললো, স্যালাড আজ বাড়ন্ত আছে।
কাবেরী ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার জন্যও একপ্লেট ঘুগনি আর দুটো রুটি নিয়ে এসো তো ভাই।
কাবেরীর চোখ দুটোতে বেলাশেষের বিষণ্ণতা। সুজন নিজের মনে রসনাতৃপ্তি করেই চলেছে। নীলাদ্রির দিকে হয়তো আর ইচ্ছে করেই তাকাচ্ছে না কাবেরী। একটু বোধহয় অপমানিতই হয়েছে ওর ব্যবহারে। নীলাদ্রি নিজের প্লেটটা কাবেরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, শুরু করতে পারেন। কাবেরী একটু করুণ হেসে বললো, না না আপনি শুরু করুন, আমি খাচ্ছি ক্ষণ। সুজন হাসতে হাসতে বললো, আরে এত লুচি আছে তোমরা খাও প্লিজ।
নীলাদ্রি অবস্থাটা একটু স্বাভাবিক করার জন্যই বললো, তুমি যেভাবে শুরু করেছ, তাতে শেষ দেখে ছাড়বে সেটা বোধহয় উনি বুঝেই নিজের জন্য খাবারের অর্ডার করলেন। কাবেরী নীলাদ্রির কথার পিঠে সাবলীলভাবে বললো, ঠিক সে জন্য নয়, আপনার এত প্রিয় মেনু বলেই টেস্ট করতে চাইলাম। নীলাদ্রি এতক্ষণে মেয়েটার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো, কাবেরীকে এক কথায় সুন্দরী বললে কেউ বিরোধিতা করবে না, বরং সকলেই সহমত পোষণ করবে। মেয়েটার গালের ফর্সা রঙে একমুঠো আবিরের গড়াগড়ি মনে করায় লজ্জা পেলে মেয়েদের মন্দ লাগে না।
উদয়দার ক্যান্টিনের রুটি মুখে দিতেই কাবেরীর মুখভঙ্গি পাল্টে গিয়েছিল। নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলো, ও অম্লানবদনে চিবাচ্ছে ওই রুটি, আর জল জল ঘুগনি। যার মটর, আলু, পেঁয়াজ, টুকরো চারেক মাংস কিছুতেই নিজেদের পৃথক সত্ত্বা ছাড়তে নারাজ। প্রত্যেককে খুঁজে নেওয়া যাবে বাটিতে ডুব দিয়েই। কাবেরী একটু নাড়াচাড়া করে বললো, বেশ ভালোই খেতে। নীলাদ্রি হেসে বললো, মোটেই ভালো নয়। তবে মা অফিস আসার আগে ভাত রেঁধে দেয়, তাতেই মায়ের বেশ ছুটোছুটি হয়। এরপরে লাঞ্চের বোঝাটা চাপাতে চাইনি আরকি। আমার বাড়িতে অবশ্য সবাই জানে আমাদের রেল ক্যান্টিনে এতটাই উপাদেয় খাবার পাওয়া যায় যে বাড়ির টিফিন মুখে রোচে না। সুজনদা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললো, কাবেরী, নে নে তোর জন্য গোটা চারেক লুচি বাঁচিয়ে রেখেছি। নিজের পেটকে বকলাম বুঝলি? বললাম, এটা কলিযুগ এখানে ডায়নোসরের উপস্থিতি বড়ই ভয়ঙ্কর, এবারে থামো। নে নে খেয়ে নে। কাবেরী বোধহয় অবাক হয়ে দেখেছিলো সুজনকে। কত তাড়াতাড়ি কাবেরী ওর বোন আর তুই হয়ে গেল। আর সেখানে ওরই বন্ধু ভদ্রতা করেও এক চামচ সুজির হালুয়া টেস্ট করেও দেখলো না। এরা বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে কি করে সেটাই তো আশ্চর্যের বিষয়!
কাবেরীর দুই ভ্রুর মাঝের বিস্ময়কর ভাঁজের দিকে তাকিয়েই নীলাদ্রি বললো, চুম্বকের সম মেরুর আকর্ষণ ক্ষমতা থাকে না বোধহয় জানেন, বিপরীত মেরুই টানে বেশি। তাই এমন উদ্ভট আমিই প্রাণখোলা সুজনের সব থেকে কাছের বন্ধু হলাম।
কাবেরী নরম গলায় বলল, আপনি কি সকলের সঙ্গেই এমন কম কথা বলেন, নাকি জুনিয়র আর মহিলা বলে আমার সঙ্গে আনকম্ফোর্টেবল ফিল করছেন?
কাবেরী তাকিয়ে ছিল সোজাসুজি নীলাদ্রির দিকে। নীলাদ্রি ওর স্বচ্ছ মন পড়ে নেওয়া দৃষ্টির সামনে সংকুচিত হয়ে বলছিলো, বন্ধুত্ব হতে একটু সময় লাগে। বিশ্বাস জন্মাতেও একটু সময় প্রয়োজন বোধহয়। জীবনটাকে একটু বুঝে খরচ করতে ভালোবাসি আমি। সুজন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই কাবেরী ওর বক্সগুলো গুছিয়ে নিয়ে বললো, আমি খেয়ে নেব সুজনদা। ক্যান্টিনের কাউন্টারে গিয়ে রুটি, ঘুগনির দামটা মিটিয়ে বেশ দ্রুত চলে গেল ওদের সামনে থেকে।
কাবেরী চলে যেতেই সুজন নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কলকাতায় এখনও চিরকুমার সভা আছে নাকি নীল? জানিস কিছু এ সম্পর্কে?
হঠাৎ করে ট্র্যাক চেঞ্জ করে কথা বলাটা সুজনের একটা বদভ্যাস, এটার সঙ্গেও নীলাদ্রি যথেষ্ট পরিচিত।
নীলাদ্রি তখনও কাবেরীর অমন হঠাৎ চলে যাওয়ায় ঘোরের মধ্যেই ছিল। নিজেকে কেমন একটা অপরাধী মনে হচ্ছিল। মেয়েটা সদ্য অফিস জয়েন করেছে, তাই উত্তেজনাও ছিল ওর চোখেমুখে। নীলাদ্রির রূঢ় ব্যবহারের জন্যই দ্রুত পালিয়ে গেল মেয়েটা।
খারাপ লাগছে ওর, কেন যে ও সহজ হতে পারে না সকলের কাছে! এর মধ্যেই সুজনের আলটপকা প্রশ্নে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, অমন সভা কি আদৌ ছিল নাকি কখনো? আমি যতদূর জানি ওটা কবিগুরুর কল্পিত নাটক। সুজন বেশ জোর গলায় বলল, আরে ছিল ছিল। সাহিত্যিকরা শুনেছি অল্প দেখেন, বেশিটা কল্পনা করেন। আমাদের কবিগুরুও নিশ্চয়ই এমন কোনো সভা দেখেছিলেন।
নীলাদ্রি হেসে বলেছিল, হঠাৎ এমন সভার খোঁজ কেন হে? বাড়িতে পাত্রী দেখছে নাকি?
সুজন মুচকি হেসে বলেছিল, ভাবছি আমার এক বন্ধুকে ওই সভার সেক্রেটারি করে দেব। নীলাদ্রি কৌতূহলী হয়ে বলছিলো, বুঝলাম না, কাকে?
সুজন উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে যেতে বলেছিল, নীলাদ্রি বসুকে। যে কিনা মহিলাদের দিকে তাকালে নিজেকে অপবিত্র মনে করে, তাকেই ওই সভার সেক্রেটারি করবো ভাবছি। শোন নীল, তোর কিচ্ছু হবে না বুঝলি? তুই চিরকুমার সভা বানিয়ে বসে থাকবি। এই সুজনের কথা যদি শুনিস তাহলে তোর একটা হিল্লে করে দিতে পারি। সুজন চলে গিয়েছিল ভবিষ্যদ্ববাণী করে। নীলাদ্রি গা ঝেড়ে উঠে পড়েছিলো। শুধু মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতে অস্বস্তি কাজ করছিলো, কাবেরী আনন্দ করে নিজের রান্না খাওয়াতে এসেছিল, এক চামচ খেলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না বোধহয়। মেয়েটার সামনাসামনি হলে একটা ছোট্ট সরি বোধহয় বলতেই হবে নীলকে।
নীলাদ্রি তারপর দিন সাতেক লাঞ্চ টাইমেও খুঁজেছিলো কাবেরীকে কিন্তু দেখতে পায়নি। সরি বলা আর হয়ে ওঠেনি। সময়ই ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল নতুন জয়েন করা মেয়েটাকে। কিন্তু ডেস্টিনি বলেও একটা শব্দ আছে ডিকশনারিতে, তাই কাবেরী নামটা যখন আবছা হচ্ছিল নীলাদ্রির মনের খাতায় তখনই সুজন এসে বলেছিল, আগামীকাল কাবেরীর বার্থডে। তোর আর আমার দুজনের নিমন্ত্রণ ওদের বাড়িতে। যাবি তো? নাকি জুনিয়রের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেও তোর আপত্তি।
সুজন আর নীল প্রায় একই পোস্টে জব করে। সুজন যদি যেতে পারে তাহলে নীলাদ্রি নয় কেন! এই প্রশ্নটাই ছুঁড়েছিল সুজন নীলাদ্রির দিকে, কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক ঢঙে।
নীলাদ্রি আচমকা ধাক্কা খেয়ে বলেছিল, সে তোমার বোন, তুমি যাবে, আমি তো কোনো নিমন্ত্রণ পাইনি। নীলাদ্রিকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সুজন বলেছিল, নিমন্ত্রণ পেলেই যাবি তো? নীলাদ্রি ঘাড় নেড়ে বলেছিল, আগে তো ইনভাইটেশন পাই, তারপর ভেবে দেখবো।
সুজন গলা ঝেড়ে বেশ জোরেই ডেকেছিলো, কাবেরী…আয়, লজ্জা পাসনা, নীল যাবে কথা দিলো, তুই চট করে নিমন্ত্রণটা সেরে ফেল। পিলারের পিছন থেকে নিলাদ্রীকে চমকে দিয়ে বেবি পিঙ্ক কালারের চিকনের শাড়ি পরে সোজা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল কাবেরী। অপ্রস্তুত গলায় বলেছিল, বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু সুজনদা বললো, আপনাকে না ইনভাইট করলে নাকি সুজনদাও যাবে না। আমি জানি আপনি জুনিয়রদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না, তাই সাহস করে ইনভাইট করিনি।
নীলাদ্রি বুঝেছিলো, সুজনই কাবেরীকে ফোর্স করেছে নীলাদ্রিকে নিমন্ত্রণ করতে, তাই ও বাধ্য হয়ে এসেছে নীলাদ্রির সামনে। সুজন মুচকি মুচকি হাসছিল, নীলের কিছুই বলার নেই। একজন দায়ে পড়ে ওকে আমন্ত্রণ করছে, আর ওকেও বাধ্য করা হচ্ছে তার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য।
নীলাদ্রি অপ্রস্তুত গলায় বলেছিল, তার মানে আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই আপনি আজ এসেছেন তাই তো?
কাবেরী লজ্জিত গলায় বলেছিল, একেবারেই না, আপনি আমাদের বাড়ি গেলে আমি সত্যিই খুশি হবো।
কাবেরীর লজ্জিত মিষ্টি মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে নীলাদ্রি বলেছিল, বেশ, তাহলে আপনাকে ওইদিন খুশি করতেই আমি উপস্থিত থাকবো। অনাহুত ভাবলেও আসছি। কাবেরী আন্তরিকতার সঙ্গে বলেছিল, সত্যি আসবেন? আসলে ভীষণ খুশি হবো।
সেই শুরু ওদের আলাপের। তারপর কি করে যেন কাবেরীর কাছে দুজনের ডাকটা একটু আলাদা হয়ে গিয়েছিল। সুজনকে সুজনদা বললেও নীলাদ্রির নামের শেষে বিশেষ কোনো শব্দ বসায়নি কাবেরী। আপনি থেকে তুমিতে না নামলেও ভাববাচ্যে কথার আদানপ্রদান চলতেই থাকছিলো। নীলাদ্রিরও বেশ ভাল লেগেছিলো কাবেরী নামের দায়িত্ববান, কর্তব্যপরায়ণ, স্বাধীনচেতা মেয়েটাকে। সুজনের চিরকুমার তকমাটা যদি ভাঙতেই হয় তাহলে সেটা কাবেরীর মাধ্যমেই ভাঙবে ভেবে রেখেছিল মনে মনে। প্রেম নয় একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করত নীল ওর প্রতি। কাবেরীরও বোধহয় অপছন্দ ছিল না নীলকে। তাই সুজনের অনুপস্থিতিতে একদিন নীলাদ্রি কাবেরীকে বলেছিল, তুমি জব পেয়ে গেছ, প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছ, এবারে নিশ্চয়ই তোমার বাবা-মা তোমার বিয়ের সম্বন্ধ করবেন?
কাবেরী একটু চুপ করে থেকে, ডান হাতের আঙুল দিয়ে বাঁ হাতের অনামিকার কপার কালারের নেলপলিশটা খুঁটতে খুঁটতে বলেছিল, যদি কেউ কথা দেয় তাহলে অপেক্ষা করতে পারি আজীবন।
নীলাদ্রি সব বুঝেও মজা করে বলেছিল, যে কেউ কথা দিলেই চলবে বলছো?
কাবেরী হতভম্ব হয়ে বলেছিল, বয়েই গেছে, যার তার কথা মানতে।
নীলাদ্রি লেগপুলিংয়ের সুযোগ হাতছাড়া না করেই বলেছিল, সে তো বটেই, তুমি সুন্দরী, শিক্ষিতা, সেন্ট্রালের জব করছো, তুমি কেন আমার মত আনরোম্যান্টিক গোমড়া মুখো পাবলিকের কথায় অপেক্ষা করবে?
কাবেরী ততোধিক লজ্জা পেয়ে বলেছিল, আমি কি যার তার মধ্যে নীলাদ্রি বসুর নামটা রেখেছি নাকি?
নীলাদ্রি কোনোমতে হাসি সামলে বলেছিল, তাহলে নীলাদ্রি বসুর নামটা বুঝি বাতিলের দলে আছে! যার তার মধ্যেও তার স্থান অকুলান! হায়রে কপাল!
কাবেরী অসহ্য লজ্জায় ছটফট করতে করতেই বলেছিল, না, মোটেই না, আমি নীলাদ্রি বসুর নামটা স্পেশাল জায়গায় রেখেছি।
নীলাদ্রি স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বলেছিল, তা স্পেশালদের লিস্টটা কি একটু পাওয়া যাবে ম্যাডাম? কম্পিটিশনে নাম দেওয়ার আগে প্রতিযোগীদের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। কত জনের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে জানা থাকলে আগে থেকে প্রিপারেশন নেওয়া যায়।
কাবেরী টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, বেশ লিস্টটা কাল পাঠিয়ে দেব তাহলে।
পরের দিন সুজন একটা খাম এনে নীলের হাতে ধরিয়ে বলেছিল, চিরকুমার সভার প্ল্যানটা বাতিল করলাম বুঝলি নীল। সেক্রেটারি যাকে করবো ভেবেছিলাম সেই স্বয়ং ডুবে ডুবে প্রেম করছে। এরপর ওই সভার কৌলিন্য সঙ্কট হয়ে যাবে বুঝলি! এই নে ধর, প্রেরকের নামটা বোধহয় তোর জানা। সুজনের মুখের নির্মল হাসিতেই নীলাদ্রি আর কাবেরীর সম্পর্কের সুতোটা বাঁধা হয়েছিল শক্ত করে।
খামটা খুলতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, একটা আকাশি রাইটিং প্যাডের পেপার।
আমার মনের স্পেশাল মানুষদের লিস্টটা পাঠালাম, দেখুন লড়তে পারেন কিনা!
এক থেকে পাঁচ অবধি সংখ্যা লেখা। প্রতিটা সংখ্যার পাশেই একটাই নাম, নীলাদ্রি বসু।
শেষে লেখা, এই যাচ্ছেতাই লোকটা কথা দিলে অপেক্ষা করতে পারি আজীবন।
নীলাদ্রি অনুর বিয়ে দিয়েছিল ধুমধাম করে। অফিসের অন্য কলিগদের সঙ্গে কাবেরীও ইনভাইটেড ছিল।
কিন্তু কাবেরী বলেছিল, না বোনের বিয়েতে যাবো না, ওই বাড়িতে আমি দুধে আলতায় পা চুবিয়েই ঢুকবো।
নীলাদ্রির জন্য প্রায় বছর ছয়েক অপেক্ষা করছিল কাবেরী। অনুর বিয়ের বছর তিনেক পরে কাবেরী এসেছিল বসু পরিবারের বউ হয়ে। সুজনই উদ্যোগ নিয়ে দুই বাড়িতেই জানিয়েছিল। দুই বাড়িতেই আপত্তি ছিল না কারোর। তারপর থেকেই কিভাবে যেন নীলাদ্রি একটু একটু করে কাবেরীর ওপরে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। বাবা, মাকে হারানোর পরেও কাবেরী কোনোদিন ওকে একা হতে দেয়নি। নিজের সমস্ত ভাবনার দায়ভার কাবেরীর কাঁধে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্তেই ছিল নীলাদ্রি। মাঝে মাঝে মতানৈক্য ঘটেছে বৈকি, রাগ,অভিমানও ছিল ওদের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে, কিন্তু কোনদিনও নীলের মনে হয়নি কাবেরী কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই প্রথম কাবেরীর জেদটাকে পছন্দ করেনি নীলাদ্রি। অহনার সঙ্গে টুটাইয়ের বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি ও। টুটাই বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যাবার পর তো নীলাদ্রির মনেই হচ্ছে কাবেরীকে সব ব্যাপারে এতটা অন্ধ বিশ্বাস করা বোধহয় উচিত হয়নি। এই প্রথম কাবেরীর ওপরে থাকা পুরু বিশ্বাসের পর্দায় আঁচড় লাগলো।
।।১১।।
জীবনদার কথায় বিশ্বাস করতে একেবারেই মন চাইছে না প্রিয়াঙ্কার। মায়ের আবার বাচ্চা হবে? না, না এ যে অসম্ভব। মা অনিকের বিষয়টা বোধহয় টেরও পেয়েছে। সেদিন প্রিয়াঙ্কা ফোনে কথা বলছিল অনিকের সঙ্গে, মা ঘরে ঢুকে একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলেছিল, কোনো বন্ধু? মেলামেশার আগে তোর বাবার সম্পর্কে সব সত্যি বলবি বুঝলি! নাহলে পরে জানতে পারলে সে তোকে ছেড়ে চলে যাবে আর তুই পড়ে থাকবি এই অন্ধকারেই। বাবার কথা জানার পরে যদি কেউ ভালোবাসতে সাহস পায় তাকেই মন দিবি, নাহলে নয়।
তোর বিয়েটা দিলে তবেই আমার শান্তি। এই নরক থেকে যদি তোকে বের করতে পারি তাহলে মরেও সুখ।
নিজের জীবনটা তো এই আস্তাকুঁড়ে শেষ করলাম, তোরটাও যদি না বাঁচাতে পারি, তাহলে মা ডাকের অপমান। মা যখন কথা বলে তখন প্রিয়াঙ্কা অবাক হয়ে শোনে, মাকে বেশ শিক্ষিতই তো মনে হয়। বিশাল কিছু না হোক, উচ্চমাধ্যমিকটা মা পাশ করেছিল সেটা কথা প্রসঙ্গে বলেও ফেলেছিল একদিন। এইখানেই দ্বন্দ্বে পড়ে যায় প্রিয়াঙ্কা। মাকে দেখতে বেশ সুন্দর, বাপের বাড়িও শিক্ষিত ছিল, তাহলে কেন পীযুষ বিশ্বাসের মত লোকের সঙ্গে বিয়ে দিলো মায়ের? এই প্রশ্নের উত্তরে মা ক্লান্ত গলায় একটাই কথা বলেছে, ভাগ্য বলেও যে একটা কথা আছে রে প্রিয়া, ভুলে গেলে চলে! প্রিয়াঙ্কা জানে মায়ের বিবাহিত জীবনটা এতটাই কষ্টের যে সেটা নিয়ে বেশি কথা বলা মা একেবারেই পছন্দ করে না। দীপশিখা বিশ্বাস, প্রিয়াঙ্কার খুব ইচ্ছে ছিল কলেজে অভিভাবকের জায়গায় এই নামটাই লেখে, কিন্তু মাধ্যমিকের অ্যাডমিড কার্ডে পীযুষ বিশ্বাস থাকায় ওটাই রয়ে গেছে প্রিয়াঙ্কার নামের সঙ্গে জুড়ে।
কি মিষ্টি একটা নাম ওর মায়ের, দীপশিখা। প্রিয়াঙ্কা ছোটবেলায় বলেছিল, এই নামের মানে কি মা? মা অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, সলতে শেষ হওয়া, তেল ফুরিয়ে যাওয়া প্রদীপের শিখা, নরম বাতাসও যাকে নিভিয়ে দিতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। বড় হয়ে প্রিয়াঙ্কা বলেছিল, মা দীপশিখার মানে কিন্তু আরেকটাও আছে। দাউদাউ করে জ্বলে অন্যকে জ্বালিয়ে দেওয়া। পলকের জন্য মায়ের চোখের দৃষ্টিতে একটা হলকানি দেখেছিলো প্রিয়াঙ্কা। মাকে আরেকটু শক্ত করার জন্যই বলেছিল, রুখে দাঁড়ালে কার সাধ্যি তোমার মত দীপশিখার ধারে কাছেও আসে! মা চোখ নিচু করে বলেছিল, তুই না থাকলে নিজেকেই রাখতাম না। মায়ের চোখের ওই স্ফুলিঙ্গ মুহূর্তে বদলে গিয়েছিল ক্লান্তিতে। তবে প্রিয়াঙ্কা জানে মা বড্ড ঘৃণা করে বাবাকে। এই বয়েসে আবার সন্তান নেবার কথা বোধহয় ভাববে না মা। তাছাড়া প্রিয়াঙ্কার বিয়ে নিয়েও মা যথেষ্ট ভাবে, সেখানে নিশ্চয়ই এরকম পরিস্থিতি তৈরি করবে না, যেখানে প্রিয়াঙ্কাকে লোকের কৌতুকের পাত্রী হতে হবে। বাড়িতে ঢোকার আগেও জীবনদার কথাটা মনে পড়ে গেলো প্রিয়াঙ্কার। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো বুকটা। এতক্ষণের যুক্তি সাজানো মনটা আতঙ্কিত হয়ে উঠলো, বাড়িতে ঢুকে কি শুনবে ভেবেই! অসার ভারী পা দুটোকে টেনে নিয়ে ঢুকলো বাড়ির উঠানে। রান্নাঘর থেকে পেঁয়াজ ভাজার গন্ধ আসছে। বাবার সাইকেলটা নেই উঠানে। সোজা গিয়ে মাকেই প্রশ্নটা করবে ভাবলো প্রিয়াঙ্কা, কিন্তু কি বলবে বুঝতে পারছিল না। প্রশ্নটা কিভাবে মায়ের সামনে আনবে সেটাই তো জানে না ও। তবুও কাঁপা পায়ে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মা বললো, ইন্টারভিউ কেমন হলো রে? চাকরিটা হবে? কি মনে হচ্ছে? যাকগে, হাত পা ধুয়ে নে, ডিমের তরকারি আর রুটি করেছি, খেয়ে নে।
আচমকা প্রিয়াঙ্কা বললো, মা, বাবা জীবনদার দোকান থেকে প্রেগনেন্সি টেস্টের কিট কেন কিনেছে?
তোমার তো কদিন অ্যাসিডিটির জন্য বমি পাচ্ছিলো বললে!
মা ধীরে সুস্থে তরকারিটা কড়াই থেকে ঢাললো, গ্যাসের নব বন্ধ করে বললো, তোর বাবা আমার যে-কোনো শরীর খারাপ শুনলেই ওই একটাই ওষুধ নিয়ে আসে আমার জন্য। এই নিয়ে অন্তত পঞ্চাশবার টেস্ট করেছি ইউরিন। আগে ল্যাবে গিয়ে করিয়ে আনতো, এখন বাড়িতেই করে। মায়ের নির্লিপ্ত বলার ভঙ্গিমাতে চমকে উঠে প্রিয়াঙ্কা বললো, কিন্তু কেন মা? এই বয়েসে এমন টেস্ট কেন?
মা একটা বাটিতে প্রিয়ার জন্য তরকারি তুলতে তুলতে বললো, গায়ে জ্বর, বমি, ঠান্ডা লাগায় গা ম্যাজম্যাজ করলেই তোর বাবা টেস্ট করায়। কারণ তোর বাবা বিশ্বাস করে, তার অনুপস্থিতিতে আমি ঘরে অন্য লোক ঢোকাই, তাই যে-কোনো অসতর্ক মুহূর্তে আমি প্রেগনেন্ট হতেই পারি। প্রিয়া অবাক হয়ে বলল, মানে? তুমি অপমানিত বোধ করো না এতে?
মা, হেসে বললো, পাগলী মেয়ে, মান-অপমানের বোধটা জলাঞ্জলি দিয়েছি বলেই না ওই মানুষটার জন্য দু-বেলা রাঁধতে পারি! তুই যা, বকবক না করে খেয়ে নে। চিন্তা করিস না, তোর আর ভাইবোন কোনোদিনই হবে না। তোর বাবাকে লুকিয়ে আমি একটা কাজ করেছি, সেটা হলো লাইগেশন। খাবার দিচ্ছি, আগে খেয়ে নে প্রিয়া।
প্রিয়াঙ্কা তখনও ঘোরের মধ্যেই হেঁটে গেল বাথরুমের দিকে। ভাবছিলো, মা কি প্রস্তর মূর্তি, নাকি রক্তমাংসের মানুষ?
যে মানুষটাকে দু-মিনিট দেখলেই প্রিয়াঙ্কার মধ্যে রক্ত দেখার আদিম দুর্বার ইচ্ছে জেগে ওঠে, যে মানুষটার গলা শুনলেই কল্পনায় নিজেকে চোদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে পাঠাতেও ভয় করে না প্রিয়াঙ্কা—সেই মানুষটাকেই এতগুলো বছর ধরে কি করে সহ্য করছে ওই মহিলা! এটা বিস্ময়কর ঘটনা, সত্যিই দীপশিখা বিশ্বাস প্রিয়াঙ্কার বিস্ময়ের পাত্রী।
গরম রুটি আর তরকারিটা দেখে ও বুঝতে পারলো ওর মারাত্মক ক্ষিদে পেয়েছে। খেতে বসতেই আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি। এখন তো শীতকালেও যখন তখন আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামে। আবহাওয়া দপ্তর বারোমাসই জোরে অথবা হালকা বৃষ্টির সম্ভবনা বলতেই থাকে।
একটা রুটি শেষ করেতেই জোরে বৃষ্টি এলো। মা জানালাগুলো বন্ধ করছিল, প্রিয়াঙ্কা মনে মনে বললো, বুঝেছি দীপশিখা কেন তেল নিঃশেষ করে, সলতে শেষ হয়েও পুড়িয়ে দেয় না। মাথার ওপরে ছাদ আর পেটের ভিতরে খাদ্য— এই দুটো যে ওই লোকটাই জোগায়। বাবা নামক জন্তুটা সাইকেলে বেল বাজিয়ে জানান দিলো নিজের উপস্থিতি। এই বাড়ির উঠোনে ঢুকে বেল বাজানোটা অদ্ভুত লাগতো প্রিয়ার। মাকে জিজ্ঞেস করতে মা খুব সাধারণ গলায় বলেছে, এটা যে ওর বাড়ি, আমরা যে ওর আশ্রিত, ওই এ বাড়ির মালিক সেটা বোঝানোর জন্যই বোধহয় বাড়িতে ঢোকার পর আমাদের সচেতন করে। অনেকটা রাজা রাজসভায় প্রবেশের আগে যেমন সান্ত্রীরা জানিয়ে দিতো, মহারাজ দরবারে আসছেন, তেমন আর কি!
মায়ের এই নির্লিপ্ততা আরও অবাক করে প্রিয়াঙ্কাকে। সব জেনে বুঝেও এই মহিলা শুধু মেয়ের জন্যই এই মনুষত্বহীন মানুষটার সঙ্গে জীবন কাটিয়ে চলেছে।
এত উদাসীন কি করে থাকতে পারে একটা রক্ত মাংসের মানুষ। বাবার আওয়াজ পেয়েই মা ফিসফিস করে বললো, হাত মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দে। আমায় মারলেও বেরোবি না, বুঝলি কি বললাম? আমি সামলে নেব, তুই বেরোবি না। এটা ওদের বাড়ির নিত্যদিনের ঘটনা। মা ওকে জোর করে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে পড়ে পড়ে মার খায় ওই লোকটার হাতে, কখনো অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তি দেয় মাকে।
গালাগালির ভাষা শুনলে মনে হবে বিবাহিত স্ত্রী নয়, মায়ের কাছে বোধহয় কোনো খদ্দের এসেছে। একরাত থাকবে, পেমেন্ট করবে তারপর চলে যাবে। একেই মা খাবার ধরে দেবে একটু পরে। প্রিয়াঙ্কারও আর ক্লান্ত শরীরে নোংরামি দেখতে ইচ্ছে করছিল না, ওকে দেখলেই বাবার পৌরুষত্ব বেশি করে জেগে ওঠে, তাই ওই লোকটার সামনে না থাকাই ভালো। তাতে হয়তো মায়ের ওপরে অত্যাচারের মাত্রাটা একটু হলেও কমবে।
ফোনটা ভাইব্রেট করলো প্রিয়াঙ্কার, অনিক কল করছে। ফোনটা নিয়েই ঘরে ঢুকলো প্রিয়াঙ্কা। বাইরে থেকেই শুনতে পেল, জড়ানো গলায় বাবা বলছে, এই যে বাজারী মেয়েছেলে, তোমার বিদ্যেধরি শরীর নাচিয়ে ফিরলো? পেলো চাকরি ল্যাংটো হয়ে?
দরজায় ছিটকিনি না লাগিয়ে মা শুতে বারণ করেছে। তাই তাড়াতাড়ি ছিটকিনি লাগিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো প্রিয়াঙ্কা।
।।১২।।
আপনি নিজের ফোনটা কেন সুইচড অফ করে রেখেছেন বলবেন? কাবেরী আন্টিকে অন্তত একটা কল করে জানিয়ে দিন আপনি ভালো আছেন, আপনাকে কেউ কিডন্যাপ করেনি অন্তত। অহনা বিরক্ত মুখে কথাগুলো বললো নৈঋতকে। বেশ খানিকক্ষণ ধরেই দেখছে নৈঋত নিজের বন্ধ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে বোকার মত। অহনার ঝাঁঝালো গলায় বলা কথার উত্তরে নৈঋত খুব শান্ত স্বরে বললো, ওটাই ভাবছি, ঠিক কি বলা উচিত আমার মাকে! মা নিশ্চয়ই এতক্ষণে প্যানিক করছে, কারণ আর কেউ বিশ্বাস করুক না করুক মা জানে আমি কখনোই বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়ে বসুবাড়ির, মেইনলি কাবেরী বসুর সম্মান কিছুতেই মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারি না। তাই একটা কংক্রিট কজ খুঁজছি, যেটা বললে মা বুঝবে আমি নিরুপায় ছিলাম।
অহনা অপ্রস্তুত গলায় বলল, বুঝতে পারছি আপনি প্রেসারে আছেন। আর সবটাই হলো আমার জন্য। বারবার সরি বলে আপনাকে বিব্রত করতে চাইছি না, কিন্তু আন্টিকে একটা খবর দেওয়া কিন্তু জরুরি। আমার এই সিমের নম্বরটা বাবা ছাড়া আর কেউ জানে না। এটা থেকে একটা কল করবেন কি বাড়িতে?
মানে আপনার ফোনটা অন করলে তো শুধু কাবেরী আন্টি নয় অনেকেই প্রশ্নবানে অস্থির করে দেবে আপনাকে। নৈঋত আলতো হেসে বললো, এই সিমের নম্বরটা আপনার এক্স না মানে এই মুহূর্তে আপনার প্রেজেন্টও জানে না? নাকি এই সিমটা তার সঙ্গে কথা বলবেন বলেই এক্সক্লুসিভলি নিয়ে ছিলেন? উফ, বেশ জমাটি প্রেম কিন্তু আপনাদের। অহনা তিতিবিরক্ত হয়ে বলল, কি চাইছেন বলুন তো আপনি? কেন আমার পিছনে পড়ে আছেন?
নৈঋত উদাস গলায় বলল, তেমন কিছু তো চাই না, শুধু আপনার উড়ে আসা প্রেমিকের হাতে নিঃশর্তে আপনাকে সমর্পণ করতে চাই। এটুকুই চাহিদা এই অর্বাচীনের। তাহলে আপনার কাবেরী আন্টিকে কলটা করেই ফেলি, কি বলুন? দিয়ে বলেই দিই, অহনাকে ওর প্রেজেন্ট লাভারের হাতে তুলে দিয়ে ফিরছি কলকাতায়। যেন কেউ কোনো টেনশন না করে।
ফোনটা হাতে নিয়ে সুইচ অন করতে চাইল নৈঋত। অহনা ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে বললো, ইয়ার্কি নাকি? আপনি আমার নামে আন্টিকে যা পারবেন বলবেন আর সেটা আমি মেনে নেব? এসব বলা চলবে না।
নৈঋত মুচকি হেসে বললো, বেশ তাহলে বলছি, অহনার পালিয়ে বিয়ে করায় ইচ্ছে ছিল, তাই আমায় নিয়ে কোনো এক কালিয়াগঞ্জ নামক জায়গায় পালাচ্ছে। সেখানের কোনো মন্দিরে আমরা বিয়ে করে ফিরছি।
অহনা দাঁত চেপে বললো, বাংলা সিরিয়াল দেখার অভ্যেস আছে বুঝি? বসে বসে স্বপ্ন দেখছেন নাকি?
নৈঋত শান্ত গলায় বলল, তাহলে আপনিই আপনার কাবেরী আন্টিকে বলুন কেন পালালাম আমি! আমার মায়ের সঙ্গে তো আপনারাই প্রথম পরিচয় হয়েছিল বলে শুনেছি। মা-ই তো আপনাকে পছন্দ করেছিল, তাই না?
মায়ের সব পছন্দের ওপরেই আমার আর বাবার একটা অন্ধ বিশ্বাস ছিল, মনে হতো মা বোধহয় ভুল কিছু করতে পারে না। অহনা নৈঋতকে থামিয়ে দিয়ে বললো, এখন বুঝলেন তো মানুষ মাত্রই ভুল হয়, কাবেরী আন্টিও ভুল করে ফেলেছেন, আমায় পছন্দ করে, আপনি বরং ভুলটুকু শুধরে নিন প্লিজ। নৈঋত অহনার মুখের অস্বস্তিটুকু উপভোগ করছিল মন দিয়ে। কেন কে জানে, এই মুহূর্তে নৈঋতের আর ভয় করছে না। লোকলজ্জা, সমাজ, কলেজ, কলিগ, বসু পরিবারের ঐতিহ্য সব কিছুকে বাদ দিয়ে একটা অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করছিল স্বল্পপরিচিত মেয়েটার প্রতি। কি যেন আছে মেয়েটার দৃষ্টিতে, প্রতিমুহূর্তে ওকে আবিষ্কারের আশায় ডুব দিতে চাইছে নৈঋতের এত কালের সাবধানী মন।
এই নৈঋতকে তো ও নিজেই চেনে না। এতক্ষণ ওই অন্ধকার স্টেশনের কোণে বসে কতরকম ভাবনার জাল বুনছিলো ও। দুশ্চিন্তায় মাথার শিরাগুলো দপদপ করছিল তখন, আর এখন কোনো এক অজানা জায়গায় চলেছে এই মেয়েটার সঙ্গে অথচ দুশ্চিন্তা নামক ভয়ঙ্কর বস্তুটা যেন ওকে ছেড়ে পালিয়েছে অন্যত্র। নৈঋত বেশ বুঝতে পারছিল অহনার পার্সোনালিটি ধীরে ধীরে অকেজো করে দিচ্ছে ওর যুক্তিবাদী মনটাকে। ধীর, স্থির নৈঋতকে করে দিচ্ছে শেষ চৈত্রের দামাল হাওয়ার মত।
মেয়েটাকে রাগিয়ে দিতে বেশ মজা লাগছে ওর। অদ্ভুত একটা রহস্য আছে অহনার মধ্যে, নৈঋত বেশ বুঝতে পারছে বিয়ের আসর থেকে পালানোর পিছনে একটা বড়সড় কারণ আছে। এক্স লাভার বোধহয় সেই কারণ নয়। অহনার মত ব্যতিক্রমী মেয়ের কারণটাও যে বেশ ইউনিক হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মনে মনে মায়ের পছন্দের তারিফ করলো নৈঋত। হয়তো অহনা কোনোদিনই ওর হবে না, তবুও কালকের রাতটা আর এই প্রায় প্যাসেঞ্জারবিহীন ট্রেন জার্নিটা ওর মনে থাকবে চিরকাল।
অহনা আলগোছে বললো, আপনি তার মানে আমার সঙ্গেই যাবেন শেষ পর্যন্ত তাইতো?
নৈঋত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, কোনো সন্দেহ আছে নাকি? বুঝলেন অহনা, একটা কথা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে, তাই করছি…এই মুহূর্তে আমার সোশ্যাল স্ট্যাটাস নষ্ট করার জন্য আমার সব থেকে বেশি রাগ হওয়ার কথা ছিল আপনার ওপরে, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমার সব রাগের জীবাণুগুলো মৃতপ্রায় হয়ে গেছে কোনো এক অজানা বিক্রিয়ায়। ঠিক কোন কোন পদার্থের বিক্রিয়ায় তীব্র রাগের অনুভূতিগুলো ভালোলাগায় বদলে যায় সেটা অবশ্য আমি জানি না। যদিও উচ্চমাধ্যমিকে কেমিস্ট্রিতে আমার লেটার মার্ক ছিল, তবুও এই নতুন বিক্রিয়া পদ্ধতিটা আমার অজানাই রয়ে গিয়েছিল। অহনা শান্ত গলায় বলল, আপনার মা বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন, আমার ছেলে একটু বেশিই শান্ত, ভদ্র। তাই বলে আপনার ভদ্রতাটাকে আমি ব্যবহার করবো এমন কিন্তু নয়।
ওদের কথা শেষ হবার আগেই লম্বা ঝুলপির, জামার বোতাম খোলা অবাধ্য টাইপ দুটো ছেলে এসে বসলো অহনার পাশে।
একটা ছেলে অকারণেই মুখে অদ্ভুত অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছিল। বিরক্ত লাগছিলো নৈঋতের। কিন্তু এদের কাছে ছুরি টুরিও থাকে। প্রতিবাদ করতে গেলে যদি হিতে বিপরীত হয় তাহলে অহনাকে বিপদে পড়তে হবে। ও নাহয় ছেলে, কিন্তু মেয়েদের এখন প্রতি পদে পদে বিপদ, তাই ধৈর্য্য ধরে দাঁত চেপে লক্ষ্য করছিল ছেলেগুলোর উচ্ছৃঙ্খলতা। মাত্রা ছাড়াচ্ছিলো ওদের অসভ্যতা। নৈঋত ফিসফিস করে অহনাকে বললো, আপনি আমার ডানদিকে এসে বসুন। কামরা মোটামুটি ফাঁকা এখনো, আর যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের কাছ থেকে হেল্প পাবো বলে মনে হয় না। এরা কিন্তু ডেঞ্জারাস হয়। ভোরের আর রাতের ট্রেনে এদের বেয়াদপি প্রায়ই পড়ি খবরে। আপনি তো মিডিয়ায় আছেন, আমার থেকেও বেশি খবর দেখেন স্বচক্ষে, তাই বলছি, আমার এইপাশে এসে বসুন। আর শুনুন ছোট থেকে আমি জীবনে মারামারি করিনি, বরং ক্লাসের ছেলেরা আমাকেই পেটাতো, তাই সাঁতার না জানা লোকের সঙ্গে আছেন ভেবে আগে থেকেই সচেতন হন। ওই ছেলেটার পাশে বসে থাকার দরকার নেই। নৈঋতের ফিসফিস শুনেই একটি ছেলে চটুল হিন্দি গান ধরলো। অন্যটি অহনার প্রায় গায়ের ওপরে এসে বসেছে। নৈঋতের রাগটা বাড়ছে, থাকতে না পেরেই বললো, গোটা ট্রেন তো ফাঁকা, আপনারা এভাবে ভদ্রমহিলার গায়ের ওপরে বসছেন কেন? মিনিমাম ভদ্রতা কি ভুলে গেছেন নাকি? রেপুটেড বাড়ির ছেলে হলে এমন অসভ্যতা করতে পারতেন না।
একটা ছেলে মুচকি হেসে বললো, কেন দাদা, গার্লফ্রেন্ডকে একটু ভাগ করতে কি বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে? নাকি আমার করোনা আছে, যে আমি ছুঁলেই উনি আক্রান্ত হয়ে যাবেন? আরেকজন রানিং কমেন্ট্রি করলো, দাদার যা ফেস দেখছি তাতে গান্ধী আমলে জন্ম মনে হচ্ছে। ভদ্রতা শব্দের দায়টা বোধহয় দাদা একাই বহন করে বেড়াচ্ছেন কি বলুন? তা দাদা, এই নরম সরম ফেস নিয়ে এমন একটা সেক্সি মালকে তুললেন কি করে বলুন তো? শুধু ভালো চাকরির জোরে নাকি? তা দাদা আমাদের সিঙ্গেলদের জন্যও একটু আধটু অ্যাডভাইজ দিন প্লিজ।
অসহ্য আক্রোশে নৈঋতের ফর্সা কানের লতি লালচে হয়ে গেছে। শীতের ভোরেও নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অহনা নির্বিকার মুখে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা বললো, দাদাভাই, বৌদির সঙ্গে কি মান অভিমানের পালা চলছে নাকি? দুজনে দুদিকে বসে আছেন যে? নৈঋতের ইচ্ছে করছিল টেনে একটা থাপ্পড় দেয়। কিন্তু তারপর এরা দুজন মিলে যদি অহনার কোনো ক্ষতি করে তখন দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। কদিন আগেই একটা নিউজ পড়লো, চলন্ত ট্রেনে হাজবেন্ডের সামনেই তার স্ত্রীকে রেপ করেছে তিনজন ছেলে। ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠলো নৈঋত। অহনাকে সঠিকভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারলে তবেই শান্তি। এখন যদি ওকে রক্ষা করতে না পারে, তাহলে অহনা ভাববে কোন কাপুরুষকে বিয়ে করতে যাচ্ছিল ও!
গ্রীন আর ইয়েলো শার্ট পরা ছেলেটা অহনার কাঁধের কাছে মাথাটা প্রায় ঠেকিয়ে বললো, বৌদি দেবরজি আপনার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমালে কি আপনি রাগ করবেন? দাদা হয়তো রাগ করবে কিন্তু আপনি কি করবেন?
অহনা মুচকি হেসে বললো, দেবর বৌদির সম্পর্ক যখন তখন মজা তো চলতেই পারে। রাখো রাখো, কাঁধে কেন কোলে রাখো মাথা। ছেলেটা লালচে দাঁত বের করে হেসে উঠতেই চোখের নিমেষে অহনা ছেলেটার হাতটা ঘুরিয়ে ধরে বলল, মজা দেবরজি, জাস্ট ফান। ছেলেটা কঁকিয়ে উঠে বললো, উফ, লাগছে তো!
অহনা দাঁত চেপে বললো, কেন লাগছে কেন? তোদের মত শুয়োরের বাচ্চারাই ভোরের ট্রেনে, রাতের প্লাটফর্মে মেয়েদের রেপ করে যৌনাঙ্গের জোর দেখাস না, তো এখন জোর কোথায় গেল বে?
আরেকটা ছেলে এগিয়ে আসতেই জুতো সমেত পা দিয়ে সজোরে লাথি মারলো ছেলেটির গোপন অঙ্গে। সে কাতর হয়ে সিটের নিচে শুয়ে কাতরাতে লাগলো। অন্য ছেলেটার ততক্ষণে চুলের মুঠি ধরেছে অহনা, ছেলেটার মাথা সিটের পিছনে জোরে ঠুকে দিয়ে বললো, রোজ নিয়ম করে সোনাটাতে জাপানি তেল লাগাবি বুঝলি হারামজাদা? নাহলে এই লৎপতে শরীর নিয়ে ক্যালানি খেয়ে মরবি তো!
ট্রেনটা কোনো একটা অচেনা প্লাটফর্মে থামতেই ছেলেদুটো কোনোমতে অহনার হাত ছাড়িয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে নামলো। অহনা তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে, শালা, ছবি তোলা হলো না তাই, নাহলে আগামীকাল জেলের ভাত গিলতিস। টিভির ব্রেকিং নিউজে ফেমাস করে দিতাম তোদের।
নৈঋত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে ছিল, যেন চোখের সামনে কোনো একটা হিন্দি মুভির সিন দেখছে। শুধু হিরোর পরিবর্তে হিরোইন, এটাই যে পার্থক্য। একটু আগেই এই মেয়েটা লাল রঙের বেনারসি আর নাকে বড় নথ পরে ওর সামনে এসে বলেছিল, নৈঋতবাবু প্লিজ হেল্প মি। আপনিই পারেন এই মুহূর্তে আমায় বাঁচাতে, যাহোক করে বিয়েটা ক্যানসেল করে দিন। আপনি পালান, তাহলেই ভেঙে যাবে বিয়েটা। হাত জোর করে বলেছিল, আমি নিরুপায় হয়ে বলছি কথাটা আপনাকে। নৈঋত অসহায় গলায় বলেছিল, পালাবো? কিন্তু আমি তো এখানে কিছুই চিনি না, কি ভাবে পালাব? আর হঠাৎ আপনারই বা কি হলো, কিছুই তো বুঝতে পারছি না আমি। বিয়ের তো আর মাত্র দু-মিনিট বাকি, আমায় ড্রেস চেঞ্জ করতে বললো, এখন বলছেন পালাতে? আর ইউ ক্রেজি?
অহনা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিল, এছাড়া আমার উপায় নেই। আমি এই বিয়েটা করতে পারছি না।
প্লিজ, হেল্প মি নৈঋতবাবু। কাঁদো কাঁদো অসহায় অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই নৈঋত বলেছিল, পালাবো কি করে? অহনা কাউকে একটা কল করে বলেছিল, স্কুটি নিয়ে আমার ব্যালকনির পিছনে আয়, এখুনি বেরোবে ধুতি পরে, সোজা স্টেশনে দিয়ে আসবি।
নৈঋত শুধু পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে নিজের ওয়ালেট আর মোবাইলটার উপস্থিতি বোঝার সময়টুকুই পেয়েছিলো। তারমধ্যেই অহনা আতঙ্কিত মুখে বলেছিল, এই ব্যালকনি দিয়ে আসুন, ওই যে হলদে টিশার্ট পরা ছেলেটা স্কুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, উঠে পড়ুন। দেরি করবেন না প্লিজ, আমি রিয়েলি গ্রেটফুল আপনার কাছে। তখনও অহনার চোখের অসহায় দৃষ্টি নৈঋতকে চালনা করেছিল। মনে মনে ভেবেছিল, আহা মেয়েটা কতটা অসহায় অবস্থায় পড়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে, এমন এক অবলা নারীকে এই মুহূর্তে সাহায্য করাটা পুরুষ হয়ে নৈঋতের কর্তব্য।
কি কি যেন ভেবেছিল নৈঋত অহনা সম্পর্কে? অসহায়, অবলা, পরিস্থিতির শিকার! এসব কোনো কথাই প্রযোজ্য নয় এই মেয়ের জন্য। কি সব মুখের ভাষা? জাপানি তেল, ক্যালানি…আরও কিসব যেন বলছিলো… ওহ শুয়োরের বাচ্চা! এসব শুনলে বসু পরিবারের সকলে একসঙ্গে হার্টফেল করতো নিশ্চিত। এই মেয়েকে বিয়ে করতে চলছিল নৈঋত? এত ফুলনদেবী টাইপ লেডি।
নৈঋত একটু ভয়ে ভয়েই বললো, বলছিলাম, ছোট থেকেই এমন মারধর করা অভ্যেস ছিল নাকি বড় হয়ে হয়েছে? আর এমন সব মার্জিত ভাষাই বা কবে শিখলে?
কথাটা উত্তেজনার বশে বলেই নৈঋত বললো, মানে এই অহনাকে আপনি বলা উচিত না তুমি সেটা এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি না! তুমি বোধহয় বয়েসে আমায় জেঠুর বয়েসি নও, তাই তোমায় তুমিই বলি। পারমিশন নিয়ে নিলাম আগাম, কারণ এমন মারকুটে মেয়েকে আমি একটু ভয়ই পাচ্ছি।
অহনা লজ্জিত গলায় বলল, দুঃখিত। আসলে রিপোর্টারি করতে করতে এমন কিছু মানুষ দেখেছি যারা ভদ্রভাষার মানেই বোঝে না। তাই বাধ্য হয়ে স্ল্যাং ইউজ করতে হয়। আর মারামারি কিন্তু আমি শুরু করিনি, আমার গুরুর নিষেধ আছে, কখনো কাউকে অযথা আক্রমণ করবে না। শুধু আত্মরক্ষার জন্য বা অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্যই নিজের শিক্ষাকে কাজে লাগবে। আমিও তাই করেছি মাত্র। আর হ্যাঁ, তুমিই বেস্ট, আমিও স্বস্তি পাই তাহলে।
নৈঋত ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, গুরু মানে? কোন ডন নাকি? মা এ তুমি কাকে সিলেক্ট করেছিলে আমার জন্য?
অহনা মুচকি হেসে বললো, আমি মার্শাল আর্ট শিখেছি ক্লাস থ্রি থেকে এছাড়াও ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্ট। আমার গুরু শ্রী যোগেন মুখোপাধ্যায়। আমি ওনার খুব প্রিয় ছাত্রী ছিলাম। নৈঋত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, তুমি মার্শাল আর্ট জানো, ক্যারেটে কুং ফু জানো, এসব মা জানতো?
অহনা হেসে বললো, হ্যাঁ কাবেরী আন্টি সব জানতেন। ওনার সঙ্গে আমার পরিচয়ই তো হয়েছিল একজন পকেটমারকে পেটানো নিয়ে।
নৈঋত নরম গলায় বলল, তোমাকে আমি লাল বেনারসি আর ঘন কাজলে বেশ লাজুক অসহায় মনে করেছিলাম, এখন বুঝতে পারছি, ওটা আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল। মানে আমি, সেই তথাকথিত চূড়ান্ত শান্ত, ভদ্র নৈঋত বসু.. যে কিনা মুভিতে মারামারি দেখলেও চোখ চাপা দিই, তার বিয়ে হতে যাচ্ছিল ব্ল্যাক বেল্ট একজন মেয়ের সঙ্গে। একে ডেস্টিনি ছাড়া কি বলবো বলতো?
অহনা আনমনে বললো, আবার এটাও ডেস্টিনি, যে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হলো না। দুধে আলতায় পা দিয়ে বসু বাড়ির চৌকাঠ ডিঙানো আর আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। কাবেরী আন্টির মত লিবারেল শাশুড়ি পাওয়াও আমার কপালে নেই। এগুলোও তো ডেস্টিনি, তাই না? সঙ্গে আপনার মত অত্যন্ত ভদ্র একজন মানুষকে আমার মত রকবাজ মেয়ের সঙ্গে ঘর করতেও হলো না। কার কপাল ভালো বলবেন এক্ষেত্রে? আপনার না আমার? আমি হারালাম, আর আপনি বেঁচে গেলেন, তাই না?
নৈঋত আলতো করে বললো, ব্ল্যাকবেল্ট পাওয়া মেয়েরা যে মনটাও পড়তে পারবে এমন বোধহয় কোনো সংবিধানে লেখা নেই তাই না?
অহনা কথা ঘোরাবার জন্যই বললো, আপনার মা তো ছেলের প্রশংসা শুরু করেলে একটা জলজ্যান্ত মহাভারত রচনা হয়ে যায়, তো শুনেছিলাম আপনি ভালো কবিতা লেখেন এবং বলেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তো আমরা নেমে যাবো, আপনার গুণের কদর করতেও পারবো না। হয়তো দেখা হবে না আর কোনোদিন, তখন আফসোস রয়ে যাবে। তার থেকে বরং একটা কবিতা শুনিয়ে দিন এই আনরোম্যান্টিক মারদাঙ্গা করা মেয়েটাকে!
নৈঋত দেখছিল অহনার চোখে হারানোর যন্ত্রণা। কিন্তু বিয়েটা তো ও স্বেচ্ছায় ভাঙলো, তাহলে?
প্রশ্নের পর প্রশ্নে নৈঋতের খাতার পাতা ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। অর্ধেকের উত্তরও নেই ওর কাছে। তাই মনের মধ্যে একটা ভারী বাতাস দমবন্ধ করে দিতে চাইছে ওর। এর চেয়ে বরং কবিতা শ্রেয়। অহনার প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে বললো, বুঝতেই পারছো, মা বাড়িয়ে বলেছে, ভালো লিখি কিনা জানি না, তবে এলোমেলো লিখি। ওগুলোকে কবিতা না বলে শব্দগুচ্ছ বললে ওরাও নির্দ্বিধায় তোমার সামনে আসতে পারে আরকি! ওদের কবিতা বললে কৌলিন্য রক্ষার দায়ে নিজেদের আড়াল করে নেবে।
অহনা বললো, বেশ কথা বলেন তো আপনি। বেশ, শব্দগুচ্ছই বলুন তবে।
নৈঋত গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললো, স্বরচিত কিন্তু, ভুলত্রুটি মার্জনীয়।
‘এমন একজন প্রেমিকা চাই, যে ভালোবাসবে ঘন অন্ধকারের মত, যার গভীরতা মাপা যাবে না।
যে অভিমান করবে স্বচ্ছ জলের মত।
অন্তর পর্যন্ত দেখতে পাবো খুব সহজেই।
এমন একজন প্রেমিকা চাই, যে হবে কুয়াশার মত।
তার প্রেমের জালে বাধা পড়বো ক্ষণে ক্ষণে।
যার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালেই মনে হবে, শরীর নয়, সে আমাকে নিঃস্ব করছে অপরিসীম ভালোবেসে।
এমন একজন প্রেমিকা চাই, যে পাহাড়ি খরস্রোতা ঝর্ণার মত চঞ্চল, যে স্রোতহীন নদীকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে অনায়াসে।
যার গায়ের গন্ধে জংলি বুনো ফুলের আবেশ জড়ানো থাকবে, বাগানের যত্নে লালিত নয়।
যার চোখের চাহনিতে থাকবে পর্বতের উদারতা।
এমন একজন প্রেমিকা চাই, যে ভালোবাসাকে বুঝবে ভালোবাসা দিয়েই।
এমন একজন প্রেমিকা চাই, যে হবে অগোছালো, কিন্তু আমায় গুছিয়ে নেবে নিজের মত করে।’
অহনা বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নৈঋতের দিকে, ওর দৃঢ় চিবুকে ভালোবাসার হাতছানি, লোভ হচ্ছে অহনার, বড্ড লোভ। নৈঋতকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার লোভ কি? এসব কি ভাবছে অহনা, ওর সামনে অনেকটা পথ চলা বাকি। সেই পথের শেষে ঠিক কতটা অন্ধকার লুকিয়ে আছে সেটা এখনও জানে না অহনা। উজ্জ্বল সুখী সুখী দিনের টানে তাই ভাসতে পারছে না ও কিছুতেই। অহনা জানে, বাবা-মা ওর কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছে, আর ওই লুকানোর জন্যই ওদের দুজনের মধ্যে এখন তৈরি হয়েছে দূরত্ব। বাবার কাছ থেকে যেটুকু জানতে পেরেছে ও সেটুকুকে কেন্দ্র করেই এগোচ্ছে অহনা। জানেনা কি দেখবে শেষে, তাই ওর এই অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে কিছুতেই জড়াতে চায় না নৈঋতের মত সাদাসিধে ছেলেটাকে। নৈঋতের চোখের স্বচ্ছতাই বলে দিচ্ছে, মন আর মুখে ফারাক করতে এখনো শেখেনি ছেলেটা। ঠিক ওর বাবার মত। এমন একজন পুরুষকেই তো জীবনসঙ্গী হিসাবে কল্পনা করেছিল ও। তাকে পেয়েও হারালো নিজের ভাগ্যের দোষে। ওকে যারা চেনে তারা শুনলে হয়তো হাসবে, শেষ পর্যন্ত অহনা পাল ভাগ্য মানছে? টিভি রিপোর্টার অহনা, যে নাকি যুক্তি-তর্ক না করে কোনো সোজা কথাই বিশ্বাস করতে চায় না, সেই মেয়েটাই আজ ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিজের দোষস্খলন করতে চাইছে! কিন্তু মানতে বাধ্য হচ্ছে, নাহলে কেন ঠিক ওই সময়েই বিশেষ ওই খবরটা পেলো অহনা? আর আধঘণ্টা পরে এলেই তো বিয়েটা হয়ে যেত। তাই অহনা ভাগ্য নামক অতি অস্থির অবিবেচক বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।
নৈঋত লাজুক গলায় বলল, সরি, তোমায় বোর করলাম। জানি ভালো লাগেনি। অন্যমনস্ক অহনার মনে পড়লো কবিতা শেষ হয়ে গেছে মিনিট দুয়েক আগেই। ও প্রশংসা বাক্য উচ্চারণ না করেই ডুব দিয়েছিল নিজের ভাবনায়। নৈঋতের দিকে তাকিয়ে বলল, কাকে সামনে রেখে এমন একটা কবিতা লিখেছিলেন শুনি? নিজে তো শান্ত নদীটি, অথচ প্রেমিকার বেলায় অশান্ত ঝর্ণা চেয়েছেন কেন?
নৈঋত লাজুক হেসে বললো, কাউকে সামনে রেখে নয়, এ আমায় কল্পনায় ছিল। ভাবতেও পারিনি সত্যিই এমন মেয়ে পৃথিবীতে আছে!
অহনা মুচকি হেসে বললো, তো দেখা পেলেন আপনার খরস্রোতা ঝর্ণার?
নৈঋত সাবধানে বললো, পেলাম তো। তাকে নিজের করে না পেলেও তার বুনো জংলি গন্ধটা আমার নাকে জ্বালা ধরিয়েছে এটা ঠিক। কেন এমন বিপরীতমুখী প্রেমিকা চেয়েছিলাম তাই জানতে চাইছো তো? সত্যি বলছি জানি না জানো। হয়তো নৈঋত বড্ড ভাল ছেলে, খুব ভদ্র, কারোর মুখের ওপর কথা বলে না, বসু পরিবারের আইডল …ইত্যাদি প্রভৃতি শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম, অথবা কিছুতেই না খুলতে পারা ভালমানুষের ট্যাগটায় ভিতরে ভিতরে হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম। তাই কল্পনায় নিজেকে বদলাতে অক্ষম হয়ে জীবনসঙ্গিনীকেই দায়িত্ব দিয়েছিলাম আমাকে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে।
অহনা দুষ্টুমির ভরা গলায় বলল, ভাসতে চান অচেনা-অজানা জীবনে? সেখানে কিন্তু কমফোর্ট জোন নেই, বেরিয়ে আসার পথ নেই, শুধু দামাল স্রোতে ভেসে যাওয়া, জীবন যেদিকে নিয়ে যাবে প্রশ্ন না করে সেদিকেই এগিয়ে যাওয়া।
নৈঋত ভীতু গলায় বলল, আমি পারব না যে, শুধু শুধু বোঝা হবো না কারোর।
অহনা হেসে বললো, তাহলে সে আপনার কল্পনাতেই থাকুক ঘাপটি মেরে, বাস্তব বড় কঠিন ঠাঁই।
নৈঋত আনমনে বললো, কিন্তু সেই জংলি ফুলের বুনো গন্ধটা যে আমি আচমকাই পেলাম। মিষ্টতা নেই, তীব্র আকর্ষণ আছে সেই গন্ধে। সাহস থাকলে ওই গন্ধে ডুবিয়ে দিতাম নিজেকে।
অহনা বললো, এরপরেই সূর্যপুর, তার তিনটে স্টেশন পরে কালিয়াগঞ্জ। আমি সূর্যপুরে নামবো। বাবার কাছে আগে যাবো, তারপর কালিয়াগঞ্জ।
নৈঋত বললো, তোমার বাবা? মানে অনিরুদ্ধবাবু? উনি কলকাতার বাইরে থাকবেন শুনেছিলাম বিয়ের সময়। কি বিশেষ কাজে যেন বাইরে যেতে হবে ওনাকে, এমনই তো বলেছিলেন তোমার মা। উনি এখানে কি করছেন?
অহনার মুখটা মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। নৈঋত শান্ত হতে পারে কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট সেটা ওর ভাবা উচিত ছিল। মা, বাবার নিজেদের ইগোর জন্যই বাবা উপস্থিত হতে চায়নি অহনার বিয়ের আসরে। এই গোপন তথ্যটা নতুন হবু আত্মীয়ের কাছে বেমালুম চেপে গিয়েছিল মা।
নৈঋতের চোখে মাকে মিথ্যেবাদী প্রমান করতে মন চাইলো না অহনার। মা আর যাইহোক অহনার যে সর্বান্তকরণে ভালো চায় সেটুকু পাগলেও বুঝবে। অহনা সামলে নিয়ে বললো, বাবা কাল মধ্যরাতে ফিরেছে, এখানে আমাদের দেশের বাড়ি। তাই বিয়েতে থাকতে পারেনি, তবে রিসেপশনে বাবা যাবে আমায় কথা দিয়েছে।
নৈঋত করুণ হেসে বললো, অহনা রিসেপশনটা হলো না শেষ পর্যন্ত, তাই যাওয়ার প্রশ্নই নেই।
অহনা চোখ নিচু করে বললো, আপনি কি আমাদের দেশের বাড়িতে যাবেন? যদি না যান, আপনাকে হাওড়া যাওয়ার ট্রেনে তুলে দিয়ে তবেই আমি রওনা দেব।
নৈঋত কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার বাবা জানেন, তুমি বিয়ের আসর ছেড়ে এখানে আসছ?
ঘাড়টা দুদিকে নেড়ে অহনা বললো, না জানে না, যদি না মা ফোন করে থাকে। বাড়িতে ঢোকার আগে বাবাকে কল করে জেনে নিতে হবে, ওই বাড়ির পজিশন এখন কি? তবেই যেতে পারবো ওখানে।
নৈঋত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় বলল, তোমায় পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরবো। জানি, তুমি একা পারবে। আমার মত ভীরু মানুষকে তোমার দরকার নেই, তবুও নিজের প্রয়োজনেই তোমার সঙ্গে এটুকু পথ আমি যাবো।
অহনা ভয়ে ভয়ে বললো, প্লিজ থাকুন। বাবাকে একা ফেস করতে আমার ভয় করছে।
নৈঋত দেখছিলো, মারাত্মক সাহসী দামাল মেয়েটার চোখে অহেতুক ভয়ের ছায়া। বিশাল পর্বতের গায়ে মেঘেদের লুকোচুরি দেখার মতো এটাও বড়ই মিষ্টি লাগছিলো নৈঋতের। ওর কি ধীরে ধীরে অহনাকে ভালো লেগে যাচ্ছে? অদ্ভুত একটা টান অনুভব করছে কি? নিজের মনকে সাহস করে প্রশ্নটা করতে পারলো না নৈঋত। যদি ওর বেইমান মন সায় দিয়ে বসে, সেই ভয়েই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলো না ও! অহনা বললো, নামতে হবে চলুন।
অহনার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নৈঋত বললো, স্টেশনে সত্যিই কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না এই ভরসাতেই নামছি কিন্তু। অহনা একটু হেসে বললো, না থাকবে না। আমার এক্স, প্রেজেন্ট, ফিউচার কেউ থাকবে না, চলুন।
বুকের মধ্যে অচেনা অনুভূতির শিরশিরানি নিয়েই প্লাটফর্মে পা দিলো নৈঋত।
।।১৩।।
বাগানের ঘাস পরিষ্কার করতে করতে বিজু নিজের মনেই ভাবছিল, ভাগ্যের কি পরিহাস, কোথায় ছিল আর কোথায় আছে এখন। অনিরুদ্ধবাবু জানেন ও নেহাতই খেটে খাওয়া শ্রমিক ছিল, পকেটমার নয়। অতগুলো বছর একসঙ্গে থেকেও নিজের আসল পরিচয়টা কিছুতেই দিতে পারেনি বিজু। বিজয়চাঁদ মল্লিক খেটে খাওয়া শ্রমিক ছিলো না। ছিল বেশ অবস্থাপন্ন চাষীর ঘরের ছেলে। লেখাপড়ায় কোনোকালেই তেমন মন ছিল না বিজয়চাঁদের। ছোট থেকেই রাস্তাঘাটে যেখানেই গান হতো ও দাঁড়িয়ে পড়তো। একমনে তাকিয়ে থাকতো গায়কের দিকে। একদিন এক গানের শিক্ষকের সামনে পড়েছিলো বিজু। শিক্ষক এক ছাত্রকে বারবার শেখাচ্ছিলেন একটা সুর, ছাত্রটিও বারংবার ভুল করছিল। বিজু বগলে ফুটবল নিয়েই গানের স্কুলের জানালায় দাঁড়িয়েছিল আনমনে। গানের সুরই ওকে ফুটবলের মাঠ থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অনিল মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির বারান্দায়। বিকেল পাঁচটায় বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে খাতা হাতে যেত গান শিখতে। বিজু একবার গুনগুন করে আব্দার করেছিল ওর গোঁয়ার জেদি বাবার কাছে। বাবা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল ছেলের শখকে। মা বোঝাতে গেলে বলেছিল, পাড়ার যাত্রায় সীতা সাজবে নাকি তোমার ছেলে, যে তাকে গান শিখতে হবে? পড়াশোনাটা একটু করুক তারপর আমাদের চলতি খোল-ভুষির দোকানে বসবে। হিসেবটা ভালো শিখলে ওখানে আমি সারের ব্যবসাও খুলে দেব। বিশাল দোকানের কাজ সামলাবে না গান নাচ করবে বিজুর মা? ওসব লোক হাসানো কথা তুমি বলতে এস না আমায়। মল্লিক বাড়ির ছেলেরা নিজেদের জমিতে চাষ করে, নিজেদের ট্রাক্টর চালায়, নিজেদের দোকানে বসে ব্যবসা বাড়ায়, গান গেয়ে ভিক্ষে করে না।
বাবার চোখে গায়কদের সামান্য ইজ্জত না দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছিল বিজু। কারণ এযাবৎকাল দেখে আসছে বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস ওর দাদু-ঠাকুমারও নেই। মল্লিকবাড়িতে গৌরচন্দ্র মল্লিকের কথাই শেষ কথা। তারপর থেকেই রাস্তায় বাউল থেকে ভিখারি যারই গান শুনেছে বিজু তাকেই পকেট থেকে খুচরো বের করে দিয়ে বলেছে, আরেকবার গানটা গেয়ে শোনাবেন?
গান শোনা যেন তার নেশা। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারতো না ও এই নেশার থেকে। কেমন একটা ঘোর লেগে থাকতো ওর মনে। ওই ঘোরে ঘোরেই ফুটবলের মাঠ থেকে এসে দাঁড়াতো গানের মাস্টারের দুয়ারে। ছেলেটা ভুল সুরে গান গাইতেই রেগে গিয়েছিলেন মাস্টারমশাই। ঠিক তখনই নিজের অবস্থানের কথা ভুলে গিয়ে সঠিক সুরে গানের লাইনগুলো জানলা থেকেই গেয়ে উঠেছিলো বিজয়চাঁদ। মাস্টারমশাই চমকে উঠে বলেছিলেন, কে রে বাইরে? আয় ভিতরে আয় শিগগির। ভয়ে ভয়েই ভিতরে ঢুকেছিলো ও। অনিল মাস্টার স্বস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, তুই তো মল্লিকদের ছেলে, এ পাড়ায় কার কাছে গান শিখিস তুই?
বিজয়চাঁদ ঘাড় নেড়ে বলেছিল, গান তো শিখি না আমি। বাবা শিখতে দেয় না। মাস্টারমশাইয়ের চোখে অবিশ্বাসী দৃষ্টি দেখেছিলো বিজু। মাস্টারমশাই হারমোনিয়ামটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, এই গানটা গেয়ে দেখা দিকি, কেমন পারিস। বিজু মাথা নিচু করে বলেছিল, আমি তো হারমোনিয়াম বাজাতে জানি না, তবে গানটা গাইতে পারবো। মাস্টারমশাই অবিশ্বাস্য ঘটনা আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠে বলেছিলেন, বেশ ধর তবে….
ওহে তবলিয়া বাজাও দেখি..
হারমোনিয়ামের রিড বেজে উঠতেই বিজু গেয়ে উঠেছিলো, আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে….বয়ে চলে আঁধি আর রাত্রি…আমি চলি দিশাহীন যাত্রী…
বিজু গান শেষ করেই দেখেছিলো মাস্টারমশাইয়ের চোখে জল। ভয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছিল, ক্ষমা করবেন স্যার, বড্ড সাহস দেখিয়ে ফেললাম। স্যার তখন পাঞ্জাবীর হাতায় চোখের জল মুছে বলেছিলেন, সাহস কি রে, এ যে দুঃসাহস! আর তুই দুঃসাহস দেখাবি না তো দেখাবে কে রে? তোকে যে বীণাপাণি নিজের হাতে গড়েছেন রে বিজয়চাঁদ। সংগীতই তোর সাধনা হোক আজ থেকে। বিজু মুখ নিচু করে বলেছিল, কিন্তু বাবা যে বলেছে মল্লিকবাড়ির কেউ গান শেখে না, সবাই চাষ করে না হয় ব্যবসা করে। অনিল স্যার হো হো করে দরাজ গলায় হেসে বলেছিলেন, বেশ বেশ মল্লিকবাড়ির বিজয়চাঁদ মল্লিক না হয় একটু অন্য পথেই চললো জীবনে, তাতে কারোর তেমন কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। ক্লাস সিক্সের বিজু বাড়ির সকলকে লুকিয়ে সপ্তাহে তিনদিন আসতো অনিল স্যারের বাড়িতে। যেহেতু বাড়িতে হারমোনিয়াম ছিল না, তাই স্যারের বাড়িতে এসে গান শিখত। অনিল স্যারের ক্লাস ফোরের ছোট মেয়ে হাঁ করে বসে থাকতো বিজুর হারমনিয়ামের সামনে। আর মুখের দিকে তাকিয়ে বলতো, খুব ভালো গান। স্যার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, তুই শিখবি? তোর দিদি, দাদা কাউকে তো শেখাতেই পারলাম না, তুই শিখবি দীপা?
দীপা আর বিজু একসঙ্গেই বড় হয়ে উঠছিল। বিজয়চাঁদের গলায় সুর ছিল, আঙুলে তাল ছিল কিন্তু মাথায় বুদ্ধি ছিল না। তাই বুঝতে পারেনি ক্লাস টেনের দীপা কেন ওকে দেখলেই লজ্জায় বাগানের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। কেন ও গানের ক্লাসে ঢোকার আগে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে রঙিন শতরঞ্জি খানা। অনিল স্যারের বয়েস কালের মেয়ে দীপা। দীপার এক দাদা চাকরি সূত্রে বাইরে গিয়েছিল, সে আর বাড়ি ফেরেনি, সেখানেই বিয়ে করে সংসার পেতেছিলো। দীপার দিদির বেশ বড় ঘরেই বিয়ে দিয়েছিলেন স্যার, কিন্তু বড়লোকের বউ হয়ে ওর দিদিও ভুলেছিলো বাবা-মাকে। স্যারের গানের স্কুলে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই মাইনে দিতো না। যে কজন দিত, তাই নিয়েই স্যার সুখী ছিলেন। বিজয়ের খারাপ লাগতো বিনা মাইনেতে গান শিখতে। বিশেষ করে ওদের অবস্থা যেখানে স্যারের থেকে যথেষ্ট স্বচ্ছল সেখানে এ হেন সুযোগ নিতে ওর বড্ড অস্বস্তি লাগতো। তাই নিজের হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে দীপার হাতে দিয়ে বলতো, স্যারের দক্ষিণা দেবার ক্ষমতা আমার নেই, এটা তুমি রাখো, স্যারকে বিস্কুট, চা কিনে খাইও। দীপা কোনো সংকোচ না করেই বলতো, বিজুদা, মা বলে তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে, তোমার কাছে দরকারে সাহায্য নিতে অসুবিধে কোথায়? শোনো না বিজুদা, আমাদের স্কুলের সব মেয়েরা নীল পাড়ের ওপরে কলকা ডিজাইনের একটা নতুন শাড়ি কিনেছে প্রতিভা ক্লথ থেকে। অমন শাড়ির আমারও একটা বড় শখ। অনেক দাম বলে বাবা কিনে দিলো না। বিজু হেসে বলেছিল, কত দাম?
দীপা সংকোচের সঙ্গে বলেছিল, তা প্রায় দেড়শো টাকা মত। বিজু তারপর ফুটবল কিনবে, খাতা কিনবে, পেন কিনবে বলে বাবা-কাকু সকলের কাছে থেকে টাকা চেয়ে চেয়ে জমিয়েছিল দেড়শো টাকা। তারপর একদিন প্রতিভা ক্লথে গিয়ে কিনে এনেছিল দীপার স্কুলের কলকা ডিজাইনের একটা শাড়ি। দীপা শাড়িটা হাতে পেয়ে কেঁদে ফেলেছিল। আর গোলাপি ঠোঁট দুটো নেড়ে বলেছিল, আমায় নিয়ে যাবে তোমাদের বাড়ি?
বিজু খুব স্বাভাবিকভাবেই বলেছিল, তুমি যাবে আমাদের বাড়ি? বেশ কাল বিকেলে এসে নিয়ে যাবো তোমায়। দীপা হেসে বলেছিল, বুদ্ধুরাম। নিজের চুলগুলো এলোমেলো করে বুদ্ধুরাম শব্দের অর্থ খুঁজতে খুঁজতেই বাড়ি ফিরেছিল বিজু। আর ঢুকেই শুনেছিল, বাবা বলছে এই তো বিজু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে যাবে সামনের মাসেই, তারপর আর কষ্ট করে কলেজে যেতে হবে না। ওর যা লেখাপড়ার বহর, তাতে জজ ম্যাজিস্ট্রেট যে হবে না সে আমরা সবাই জানি। মল্লিকবাড়ির কেউই কলেজের ডিগ্রি পায়নি, তাই ও নিয়ে বেশি ভাবিও না। বরং খোল-ভুষির দোকানটাকেই আমি বাড়িয়ে সারের দোকান করে দিচ্ছি, ওটাই সামলাবে বিজু। দু-হাতে টাকা ইনকাম করবে। বছর দুয়েক পরে বিয়ে দিয়ে দেব, তাহলেই এই বাউন্ডুলে স্বভাবটা যাবে। পড়ায় যে বিশেষ আগ্রহ বিজয়চাঁদের ছিল তেমন নয়, তবে গান যে তার প্রাণ। স্কুলের, টিউশনির নাম করে গান শেখার কি হবে! দোকানে বসে টাকা গুনেই তার মানে কাটবে ওর জীবন। তবে রোজগার করলে সেই টাকায় একটা হারমোনিয়াম তো কেনাই যাবে। অনিল স্যার বলেছেন, তোকে আমার সবটা প্রায় দান করে দিয়েছি রে বিজয়। এখন শুধু প্র্যাকটিসের দরকার। আমার কাছে আর কিছুই নেই তোকে শেখানোর। স্যারের বয়েস বেড়েছে, ইদানিং হাঁপিয়ে যান বড্ড। মাঝে মাঝেই স্যারের গানের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিজয়ই শিখিয়ে দেয়। স্যার পাশে বসে হাসেন।
দীপা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার আগে আগেই ওকে একদল পাত্র দেখতে এসেছিল। বাবার বয়েস বাড়ছে, তাই মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে যেতে চান ওপরে। এদিকে বিজয়েরও স্যারের বাড়ি যাওয়া কমেছে। সে এখন পুরোপুরি ব্যবসাদার। বছর দুয়েক হলো ব্যবসায় বসছে। গানের নেশাও কিছুটা হলে কেটেছে, সময় পায় না খুব একটা। সেদিন দুপুরে দোকান বন্ধ করে ফিরছিল সাইকেল নিয়ে। দীপা পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল। ওকে দেখেই সাইকেল থেকে নেমেছিল বিজু। হাসিমুখে বলেছিল, কি হলো? কিছু চাই? শাড়ি পছন্দ হয়েছে বুঝি?
দীপা মাঝে মাঝেই শাড়ি, ব্লাউজ, কাঁচের চুড়ির বায়না ধরতো, তাই স্বাভাবিক গলাতেই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিল বিজয়। কিন্তু কেন কে জানে দীপা অগ্নিমূর্তি ধরে বলেছিল, আর জীবনেও যেন তোমার মুখ না দেখি, কোনোদিন আসবে না আমাদের বাড়িতে। আমার বিয়ে ঠিক করছে বাবা, জানো নিশ্চয়ই।
বিজয় অবাক হয়ে বলছিলো, তোমার বিয়েতে সব থেকে বেশি কাজ তো আমাকেই করতে হবে দীপা, স্যার তো বললেন সেদিন। স্যারের তো বয়েস হয়েছে।
দীপা রেগে গিয়ে বলেছিল, যে মানুষ মনের খবর নিলো না, বুঝলো না মনের কথা, সে কি করবে আমার বিয়ের কাজ!
বিজয়ের মোটা মাথায় এতদিনে ঢুকেছিলো দীপার সেই ছোট থেকে সব আচরণের মানে। শুধু ওর কাছেই আব্দার, ওকে দেখে লজ্জা পাওয়া, নতুন পোশাক পরে ওকে দেখানোর অপেক্ষায় ছটফট করা, নতুন গান তুলে ওকেই শোনানো…সবকিছুর অর্থ, সঙ্গে এই আজকের রাগের মানেও বুঝেছিলো। ফিরে যেতে উদ্যত দীপার হাতটা টেনে ধরে বলেছিল, মাস্টারমশাইকে বলি, আমাদের বাড়িতে তার ছোট মেয়ের সম্বন্ধ নিয়ে যেতে। কি বলো? তোমার কি আপত্তি আছে দীপা?
দীপার ঠোঁটের কোণে আচমকা খুশির ঝলক আর চোখের কোণে এক বিন্দু জলই বুঝিয়ে দিয়েছিল সে কি চাইছে।
বাড়িতে ঢুকে মায়ের কাছেই প্রথম বলেছিল বিজু দীপাকে বিয়ে করার কথাটা। মা একটু থমকে বলেছিল, ওই গানের মাস্টারের মেয়েটা? তা মন্দ কি! বেশ দেখতে, মাস্টাররা তো আমাদের থেকে উঁচু জাতের, তো বিয়ে দেবে তোর সঙ্গে? বিজু লাজুক গলায় বলেছিল, মাস্টারমশাই আসবেন সম্বন্ধ নিয়ে। মা হেসে বলেছিল, বেশ তোর বাবাকে বলবো আজকেই।
মাস্টারমশাই এসেছিলেন ওদের বাড়িতে। কিন্তু ওর বাবা অনেকটা বর পন চেয়েছিল। লজ্জায় মাথা নিচু করেছিল বিজু। বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস জোগাতে পারেনি তখন।
মাস্টারমশাই কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলেন, এটাই আমার শেষ কাজ, যতটুকু পারবো আপ্রাণ চেষ্টা করবো।
তারপর এসেছিল সেই বিভীষিকাময় রাত। যে রাতটা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় এই বয়েসের বিজুকে। বিজুর সঠিক বয়েসও অনিরুদ্ধবাবু জানেন না। বিজুরও হিসেব নেই। বোধহয় পঞ্চাশ বা তার থেকে একবছর কমই হবে।
অতগুলো বছর ওকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেয়নি ওই রাতের ঘটনাটা। লাল বেনারসি পরা, চন্দন আঁকা কপাল, খুশিতে ঝলমল করা দীপার মুখটা আজও চোখের সামনে ভাসছে। বিয়ের পিঁড়ি থেকে হিরহির করে টেনে এনেছিল বিজুর বাবা, কারণ মাস্টারমশাই গৌরচন্দ্র মল্লিকের দাবি অনুযায়ী পণের টাকা মেটাতে পারেননি। লগ্নভ্রষ্টা হয়েছিল দীপা। ছেলেকে বিয়ের আসর থেকে টেনে তুলে নিয়ে গিয়েছিল গৌরচন্দ্র, গলাবাজি করে বলেছিল, এই মাসেই ছেলের বিয়ে দেবে।
সেই মাসেই দীপার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, এক মদ মাতালে রঙের মিস্ত্রির সাথে। দীপা টুঁ শব্দটুকু করেনি। এমনকি কোমরে হাত দিয়ে বিজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আর বলেওনি, কেন বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে বিয়েটা করলো না বিজয়। অথবা, কেন ওকে লগ্নভ্রষ্টা করলো বিজয়, কোন অধিকারে? ভালোবাসার কি এমন নিষ্ঠুর প্রতিদানই পেতে হয়? এমন প্রশ্নও করেনি দীপা। ওর কোন এক মাসিই ওই মিস্ত্রির সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল, স্যার নাকি প্রথমে সায় দেননি, দীপাই নাকি জোর করে বিয়ে করেছে ওই মাতাল, বয়েসে বেশ বড় লোকটাকে।
বিজুর বিয়ের জন্যও পাত্রী খুঁজছিল ওর বাবা, যে বেশি পণ দিতে পারবে তাকেই বেচবে ছেলেকে। দীপার চোখের জলই ওকে গ্রামছাড়া করেছিল। শহরের কারখানায় কাজ নিয়েছিল বিজু। ঘর ছেড়ে মেসে থাকতো। শ্রমিকদের সঙ্গে কাজে যেত। যখন ইচ্ছে গান গেয়ে উঠতো। এভাবেই কাটিয়ে দিয়েছিল অনেকগুলো বছর।
তারপরেই ঘটনাচক্রে ভাসতে ভাসতে পৌঁছেছিল এই সূর্যপুরে। অনিরুদ্ধবাবুর মত ভালো মানুষ পেয়ে মন বসে গিয়েছিল এই সবুজঘেরা বাড়িটাতে। বিজুর এই বেরঙিন জীবনে গোলাপের বাগানটাই একমুঠো রং জোগান দিয়ে যায় অনবরত। তাই এদের নিয়েই বেশ মেতে থাকে ও। এসব কথা ও কাউকেই কোনোদিন বলেনি। আজ অনিরুদ্ধবাবু বললেন, তোমার জীবনের ঘটনা বলো বিজু, কাগজে ছাপাবো। তাই বোধহয় বহু পুরানো ধূসর হয়ে যাওয়া স্মৃতিরা সবাই মিলে ভিড় করে এলো দৃষ্টিপথে।
কলে হাত ধুয়ে বাগান থেকে উঠতে যাচ্ছিল বিজু, চোখে পড়লো গেটের গ্রিলের কাছে একটা অতি পরিচিত মুখ। একটু চমকে উঠলো বিজু, এসময় তো ওর আসার কথা নয়!
।।১৪।।
কাবেরীর ফোনটা ভাইব্রেট করছে, সুচেতা কলিং….
কোন মুখে অহনার মায়ের ফোনটা ধরবে কাবেরী, সেটাই তো বুঝতে পারছে না। টুটাইয়ের পালানোর পর ওদের সম্মুখীন হতেই তো লজ্জা করছে ওর। কিন্তু ফোনটা না ধরাটা আরও বেশি অভদ্রতা হবে বোধহয়। কাবেরীরই উচিত ছিল ফোন করে সুচেতার কাছে ক্ষমা চাওয়া। লজ্জায় আর সংকোচে সেটা করে উঠতে পারেনি এখনও। তাছাড়া একটু পরেই নিমন্ত্রিতরা চলে আসবে, তখন কিভাবে সম্মুখীন হবে তাদের। বাকি নিমন্ত্রণের লিস্টটা দেখে দেখে ফোনে সকলকে বারণ করতে হবে, ক্যাটারারদের বারণ করতে হবে। নীলাদ্রি অন্ধকার ঘরে ইজি চেয়ারে বসে আছে মুখ লুকিয়ে। কাবেরীকে কেন বিশ্বাস করেছিল এটাই হয়তো ভাবছে এই মুহূর্তে। টুটাইয়ের জন্য ওর উঁচু মাথাটা আজ মাটিতে মিশে যাবে, ভেবেই ছেলের ওপরে রাগটা আরও বেড়ে গেলো। এদিকে শুভ আবার অন্য একটা ভয় ধরিয়ে দিয়েছে, সেই নিয়েও মনটা ভারাক্রান্ত। শুভ বলছে, টুটাইয়ের নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে, যদিও নীলাদ্রি এটা মানতেই চাইছে না। নীলাদ্রির বক্তব্য হলো, কাবেরীর চাপে পড়ে টুটাই বিয়েটা করতে গিয়েছিল, তাই সুযোগ বুঝে পালিয়েছে। নীলাদ্রির কথা কাবেরীর বিশ্বাস হচ্ছে না। বরং শুভর কথায় যুক্তি আছে অনেকটা। অনু বললো, বৌদিভাই, সকলে তো আসতে শুরু করবে একটু বেলা হলেই, কি করবে? ফোনে বারণ করবে? আমার মনেহয় সেটা অনেক সম্মানের হবে। লোকজন বাড়ি বয়ে ইনসাল্ট করে যাওয়ার থেকে। কাবেরী শুভর দিকে তাকিয়ে বলল, প্লিজ শুভ, তোমার দাদার কাছ থেকে নিমন্ত্রণের লিস্ট আর ফোন নম্বরগুলো কালেক্ট করে যতটা পারো ফোন করার চেষ্টা করো। আমার মাথা কাজ করছে না, কি বলতে কি বলবো বুঝতেও পারছি না। অনু কাবেরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, বৌদিভাই, সবই আমাদের কপাল বুঝলে। একমাত্র ভাইপোর বিয়েতে কত আনন্দ করবো প্ল্যান করেছিলাম, এখন তো শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কাছে মুখ দেখানো দায় হয়ে উঠবে। ওরা তো শুধু সুযোগ খোঁজে। বাইরে থাকি বলে এমনিতেই অনেক কথা শুনতে হয়, তারপর বাপের বাড়ির এমন কেচ্ছা পেলে ও বাড়ির লোকজন ছেড়ে কথা বলবে ভেবেছো। কি যে হলো, টুটাই যে কেন ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছে কে জানে! ওর একটা খবর পেলেও নিশ্চিন্ত হতাম একটু। অনু নিজের মনেই বিজবিজ করছে। কাবেরী কানে অর্ধেক ঢুকছে অর্ধেক মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফোনটা আবার বাজছে দেখে বাধ্য হয়ে রিসিভ করলো কাবেরী। সুচেতার ম্রিয়মাণ গলাটা ভেসে এলো, কাবেরীদি নৈঋত কি বাড়ি পৌঁছেছে? তাহলে একটু কথা বলতাম ওর সঙ্গে। পারলে আমাদের ক্ষমা করবেন আপনারা।
কাবেরী চমকে গেছে, ক্ষোভে, দুঃখে কি সুচেতার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল নাকি! ওদের কাছে ক্ষমা চাইছে? অহনাকে আর ওর পরিবারকে রীতিমতো অপমান করে, মেয়েটাকে লগ্নভ্রষ্টা করে টুটাই পালিয়ে গেল, আর সুচেতা নৈঋতের খবর নিচ্ছে? আর কেউ না জানলেও কাবেরী জানে অহনার মত মেয়ের সঙ্গে যাই ঘটে যাক ওর নামের আগে পিছে কিছু শব্দ বসতেই ভয় পাবে। যেমন অপয়া, লগ্নভ্রষ্টা, অলুক্ষণে….ইত্যাদি বিশেষণগুলো অহনা নামক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কোনোদিন কোনোমুহূর্তেই খাপ খায় না। তাই টুটাই পালিয়ে এলেও অহনা যে বিশেষ ভেঙে পড়েনি এটা কাবেরী জানে। নরম সরম মেয়েলি স্বভাবটা অহনার মধ্যে নেই, তাই ঘর বন্ধ করে কাঁদবে না আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপও করবে না। সুচেতা হয়তো একটু ভেঙে পড়বে, যতই হোক মা তো! তাছাড়া বিয়েটা হচ্ছিল ওদের গ্রামের বাড়ি থেকে। যাদবপুরের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেই যদি এত ফিসফিস হয় তাহলে রাইগঞ্জে যে তার এফেক্ট ভালো মত পড়বে সেটা বেশ বুঝতে পারছে কাবেরী। অনুও বলছিলো,ওখানের লোকজন নাকি বলছিলো, বিয়ের সব খরচ পাত্রপক্ষের কাছ থেকে উসুল করা উচিত। সুচেতাই নাকি জোর গলায় বলেছে, ক্ষতি নৈঋতদেরও কিছু কম হয়নি, আমরা কি ভিখারি নাকি যে ওদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নেব! কাবেরী ওটা শুনেই মনে মনে বলেছিল, অহনার মা যে এমন হবে সেটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক। যদিও সুচেতা বলেছিল, অহনার মধ্যে নাকি ওর বাবার প্রভাবই বেশি। অনিরুদ্ধ পালের সঙ্গে ওই একবারই দেখা হয়েছিল কাবেরীর। ভদ্রলোক বেশ গম্ভীর টাইপ। তবে অত্যন্ত ভদ্র। অত বড় একজন সাংবাদিক হয়েও মাটির কাছাকাছি। নীলাদ্রিরও বেশ ভাল লেগেছিলো ভদ্রলোককে। কাবেরী কাঁপা গলায় বলল, একি বলছো সুচেতা, তোমরা ক্ষমা চাইছো কেন? টুটাই আজ যা করলো তাতে আমি হয়তো আর কখনো অহনার সম্মুখীন হতেই পারবো না। অমন মিষ্টি মেয়েটাকে নিজের ঘরে আনতে চেয়েছিলাম, এটাই বোধহয় ভগবানের সহ্য হলো না। তবে বিশ্বাস করো সুচেতা, আমি মা হিসাবে বলছি, টুটাইয়ের কোনো গোপন অ্যাফেয়ারের কথা আমি আজ অবধি শুনিনি। এমনকি অহনার ছবি দেখিয়েও বলেছিলাম, তোর যদি কাউকে পছন্দ হয় তাহলে বলতে পারিস নির্দ্বিধায়। তখনও বলেছিল, মা তোমার পছন্দ খারাপ কেন হবে। অহনাকে আমার খারাপ তো লাগেনি, বেশ ভালো। তুমিই বলো সুচেতা, এরপর আর অবিশ্বাস করি কি করে? এ তো আমাদের যুগ নয়, যে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে। এখনকার যুগের প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ে জুতোর ফিতের রং থেকে মাথার চুলের রং অবধি অত্যন্ত ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে পছন্দ করে, কেউ ওদের কিছু জোর করে গছিয়ে দিতে পারে না। চব্বিশঘণ্টা পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার না করার জ্ঞান দিয়ে দিয়ে জেরবার করে দেয়, তারা কিনা জীবনসঙ্গী বাছার সময় মায়ের পছন্দ মুখ বুজে মেনে নেবে? এটা কি মানা সম্ভব? লাইফ পার্টনার বদলাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে, লিভ ইন করছে, ব্রেকআপের হুজুগে ভাসছে সব, তারা নাকি আমার কথায় জোর করে বিয়ে করতে গিয়েছিল, এটা মানতে হবে আমায়? সুচেতা, টুটাই এখনো বাড়িতে ফেরেনি, ফোনের সুইচ অফ। তাই আসলে যে ঠিক কি ঘটেছিলো আমি এখনো বুঝতে পারছি না গো। আমি জাস্ট হেল্পলেস।
সুচেতার গলাটা ধরে এলো মনে হয়। নাক টানার একটা আওয়াজ পাওয়া গেলো। কাবেরী বলল, অহনা কি করছে গো? জানি জিজ্ঞেস করার মুখ নেই আমার, তবুও নির্লজ্জের মতই জানতে চাইছি।
সুচেতা ধীর গলায় বলল, অহনা বাড়িতে নেই। নৈঋত চলে যাবার ঘণ্টা খানেক পর অবধি দেখেছিলাম তাকে, নিজের ঘরে ছিল। তারপর দরজা খুলে দেখি, বেনারসি মাটিতে ছড়ানো, গহনাগুলো খুলে রাখা, মেয়ে ঘরে নেই। ঠিক কোথায় গেছে বলে যায়নি। তারও ফোন অফ, তাই কোনো খোঁজ পাইনি। নৈঋত ফিরলে একটু জানিও প্লিজ, অহনা কি তাকে কিছু বলেছিল? নাকি নৈঋত কিছু বলেছিল? এত ধোঁয়াশা লাগছে বিষয়টা যে এখন বিয়ের চিন্তা ছেড়ে ছেলেমেয়েগুলোর জন্য টেনশন হচ্ছে কাবেরীদি। কাবেরীর হাত থেকে আরেকটু হলেই ফোনটা পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে সামলে নিয়ে বললো, মানে? অহনা বাড়িতে নেই? কোথায় গেছে অত রাতে?
আরেকটা কথা বলতো সুচেতা, টুটাই তো তোমাদের ওই রাইগঞ্জে গেল এই প্রথমবার, ওর তো রাস্তাঘাট চেনারও কথা নয়, ও প্রাইভেট কার ছাড়া ট্রেনে বাসে একেবারেই স্বচ্ছন্দ ফিল করে না, তাহলে ঐ অপরিচিত জায়গা থেকে রাতের অন্ধকারে পালালো কি করে?
সুচেতা প্লিজ, চুপ করে থেকো না, আমার এবারে সত্যিই খুব টেনশন হচ্ছে।
সুচেতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমি এখনো কিছুই বুঝতে পারছি না। অহনার খবর পেলে তোমায় জানাবো, তুমিও নৈঋতের কোনো খবর পেলে প্লিজ জানিও। সুচেতা ফোনটা রেখে দিল।
কাবেরীর দ্বিতীয় দফায় সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল। এতক্ষণ ও শুধু ভাবছিলো টুটাই পালিয়েছে বিয়ের আসর থেকে, কিন্তু এখন তো শুনলো টুটাইয়ের চলে যাবার পরে অহনাও নাকি চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে।
যা কোনোদিন করেনি কাবেরী সেটা করবে ভেবে এগোলো টুটাইয়ের ঘরের দিকে। ওর ল্যাপটপ, বইপত্র সব ঘেঁটে দেখতে হবে, কোনো লুকানো ফাইল আছে কিনা সেটাও দেখতে হবে কাবেরীকে। দু-পা এগিয়েই ভাবলো, তাহলে কি শুভর কথাই ঠিক? অহনার সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেই বিয়ের আসর ছেড়েছে টুটাই?
হনহন করে টুটাইয়ের ঘরের দিকে এগোলো কাবেরী।
ওর ল্যাপটপ অন করলো, আজকাল আবার পাসওয়ার্ড দেওয়ার ঘটা হয়েছে সকলের। কি যে এত লুকোনোর প্রবণতা কে জানে! ওর বা নীলাদ্রির ফোনে তো কখনো পাসওয়ার্ডের প্রয়োজন হয়নি। ওরা কেউই কারোর ফোন ঘাঁটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি কখনো, মিনিমাম শিক্ষাদীক্ষা থাকলে কেউ কারোর পার্সোনাল ফোন বা পার্স ঘাঁটে না। সেটুকু যাদের নেই, তাদের ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না কাবেরী। আজ নিজেকে চূড়ান্ত অশিক্ষিত আর ব্যর্থ মনে হচ্ছে, তাই টুটাইয়ের অনুপস্থিতিতে ওর ঘর খুঁজতে এসেছে। ল্যাপটপ অন করতেই একটা মেয়ের নীলচে ওড়না উড়ছের ছবি স্পষ্ট হলো গোটা স্ক্রিন জুড়ে। পাসওয়ার্ড নেই বলেই, এটা ওটা ক্লিক করল কাবেরী। কাবেরী আর নীলের সঙ্গে টুটাইয়ের বেশ কিছু জয়েন্ট ফটো আছে একটা ফোল্ডারে। সঙ্গে ওই মেয়েটার বেশ কিছু ছবি। মেয়েটার পোশাক-আশাক মোটেও ভদ্র নয়। চাউনিটাও যেন কেমন, সাজগোজ বড্ড উগ্র টাইপ, তবে ফিগারটা দুর্দান্ত। তাহলে কি এই মেয়েটার জন্যই নৈঋত পালালো? এই ধরনের আল্ট্রামর্ডান মেয়ের সঙ্গে কাবেরী বা নীলাদ্রি কেউই বিয়ে দিতে চাইবে না বুঝেই চুপ করে ছিলো এতদিন?
মেয়েটার ছবির নিচে আবার দু-লাইন লেখাও আছে। তুঝে ইতনা ম্যা পেয়ার করো, রাব ভি সরমা যায়ে।
ছি ছি, টুটাই এভাবে ঠকালো কাবেরীকে। এই কথাগুলো যদি আগে বলতো, তাহলে অহনার ফ্যামিলিকে বিপদে ফেলতো না ও। এখন বুঝতে পারছে টুটাই ওভাবে পালিয়ে গেছে দেখেই অহনা বাধ্য হয়েছে বাড়ি ছাড়তে। বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না বলেই বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে অহনা। মেয়েটার বড় বড় সরল চোখ দুটো মনে পড়ে গেলো কাবেরীর। ছেলেটার রুচিটা যে এমন তা তো আগে বুঝতে পারেনি। মেয়েটা বোধহয় কলেজের কোনো ছাত্রী। অন্তত বয়েস দেখে তাই মনে হচ্ছে। নীলাদ্রিকে একবার ডেকে দেখানো উচিত টুটাইয়ের কাণ্ডটা। খুব বলছিলো না, অহনার মত ডেসপারেট মেয়ে নাকি টুটাইয়ের জন্য একেবারেই মিসম্যাচ, তাই টুটাই পালিয়েছে। অহনা স্মার্ট, স্বাবলম্বী, প্রতিবাদী কিন্তু এমন উগ্র নয়। এই মেয়ের যা পোশাক দেখছে কাবেরী তাতে একে যে টুটাই পছন্দ করতে পারে সেটাই তো ভাবতে পারছে না। সাদাসিধে ছিল ছেলেটা, কলেজের এই সবজান্তা মেয়েগুলোর পাল্লায় পড়েই এমন বিগড়ে গেল বোধহয়। নীলাদ্রি শুনলেই বলবে, তোমার ছেলে কচি খোকা নয়, অন্যকে দোষ দেওয়ার আগে ছেলের বয়েসটাও ভেবো। একজন কলেজের প্রফেসর যদি এমন বিহেভ করে তাহলে ছাত্র, ছাত্রীরা কি শিখবে শুনি? নীলাদ্রির ঘরের দিকে চুপি চুপি পা বাড়ালো কাবেরী। লম্বা বারান্দায় অনেকেই বসে আছে, সকলের মুখেই কৌতূহলী প্রশ্ন। কাবেরীকে দেখে ফিরে আসা বরযাত্রীর দল চুপ করে গেল। ফিসফিস যে চলবে সে ব্যাপারে ও নিশ্চিত। নীলাদ্রির সম্পর্কে দিদি জিজ্ঞেস করলেন, কাবেরী, টুটাইয়ের কোনো খবর পাওয়া গেলো রে? ছেলেটা কোথায় গেল বলতো? কাবেরী বাধ্য হয়ে ঘাড় নেড়ে বললো, এখনো খবর পাইনি।
রিনাদি মুখের ভাঁজে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে বললেন, এবারে বোধহয় পুলিশে খবর দেওয়া উচিত। এখন তো কি সব ফোন ট্র্যাক করে পুলিশ বলে দেয় যে মানুষটা কোথায় আছে! একবার নীলকে বলে দেখ, যদি কিছু করে।
কাবেরী ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল রিনাদির দিকে, চোখে একটা ভয় ভয় চাউনি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেল না। তার মানে কাবেরীর দিকে আঙুল এখনও ওঠেনি। সন্তান মানুষ করার ব্যর্থতা নিয়ে বোধহয় এরা তোলপাড় করছিল না। কাবেরী রিনাদিকে বললো, তোমরা চা খেয়ে নিও। নীলাদ্রি বেডরুমে নেই। ঘর ফাঁকা। কোথায় গেল ভাবতে ভাবতেই দেখলো স্টাডিতে আলো জ্বলছে। ধীর পায়ে এগোলো স্টাডির দিকে।
দেওয়ালে লাগানো একটা ফ্রেমের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে নীলাদ্রি। টুটাইয়ের সেই জন্ম থেকে এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন বয়েসের ছবি একটা দুর্দান্ত ফ্রেমের মধ্যে ফ্রেমবন্দি করেছিল নীল। হালকা আকাশি রঙের দেওয়ালে বাদামি রঙের বড় ফ্রেমটা ঝুলছে। কাবেরী ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই অন্যমনস্ক নীলাদ্রি বললো, দেখো ক্লাস ফাইভে একবার বায়না করেছিল, বাবার মত স্যুট পরবো, এটা কিনে দিতে হয়েছিল। তারপর বাবু গরমকালেও এটা গা থেকে খুলছিলো না। তুমি তো রীতিমত মারধর করে খুলিয়েছিলে। বলেছিলে, পিঠে ঘামাচি বেরোবে এই গরমে এটা পরে থাকলে। বড় হয়ে গেল টুটাইটা। বরাবরই মা হ্যাংলা, বাবার সঙ্গে ওর তেমন ভাব ছিল না কোনোকালেই। শুধু ছুটির দিনে ক্রিকেট খেলা ছাড়া। এক নাগাড়ে ওকে বল করতে হবে, কিছুতেই আউট হবে না ছেলে। আরেকটা বিষয়ে বাবার সঙ্গে ভাব ছিল, বাবা কি বই পড়ছে দেখে তাকেও পড়তে হবে। বাকি সময় তো আমি বলতাম, মায়ের চামচা, হাতা, খুন্তি। খুন্তি শুনে হেসে গড়িয়ে পড়তো ক্লাস সেভেনের টুটাই।
কত বড় হয়ে গেল, সেই বাইরে চুপচাপ আর ঘরে দুষ্টুমি করা ছেলেটা! এত বড় হয়ে গেল যে নিজের মনের কথাটুকুও বাবাকে বলার প্রয়োজন মনে করল না। যেদিন নেট ক্র্যাক করলো সেদিন ফোনে বলেছিল, বাবা পেয়ে গেছি, মাকে এখনই বলো না। সারপ্রাইজ দেব দুজনে মিলে। কালার পেন্সিল থেকে পছন্দের ব্যাট, তোমায় লুকিয়ে এসে আমার কানে কানে বলতো, কিনে দেবে? মা জানলে বকবে কিন্তু, বলবে অতিরিক্ত ফালতু খরচ। অফিস ফেরত নিয়ে আসতাম, চোখে চোখে ইশারা করে জেনে নিতো এনেছি কিনা! তারপর তোমার চোখ বাঁচিয়ে নিয়ে যেত আমার কাছ থেকে। আমি যেন ওর সমবয়সি কোনো বন্ধু, যে তোমার চোখে ফাঁকি দিয়ে ওকে হেল্প করবে, এমনই ভাবত বোধহয় আমায়।
কাবেরী দেখছিলো তার চিরপরিচিত মানুষটাকে। এতদিন তো ভাবত সদাগম্ভীর মানুষটা সংসারের কোনোদিকেই তাকিয়ে দেখে না। কাবেরীর ঘাড়ে গোটা সংসার আর টুটাইয়ের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছে। মাসের শেষে নিজের মাইনে টাকাটা কাবেরীর হাতে দিয়ে বলতো, যাক, এবারে নিশ্চিন্ত হলাম। সেই মানুষটাও ভিতরে ভিতরে এতটা জড়িয়েছিল সংসারের সঙ্গে কখনো বুঝতে পারেনি তো কাবেরী। টুটাইয়ের সঙ্গে এমন মিষ্টি বন্ধুত্বের খবরটা ওর অজানাই ছিল। নীলাদ্রির মত কঠিন মনের মানুষেরও চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। কাবেরী নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে, এমন ভেঙে পড়লে চলে! একবার এস আমার সঙ্গে। টুটাইয়ের ল্যাপটপ খুলেছি। একটা মেয়ের ছবি দেখলাম। তোমায় কিছু বলেছিল এর ব্যাপারে! নীলাদ্রির চোখে অবিশ্বাসী চাউনি, টুটাইয়ের কোনো গোপন সম্পর্ক ছিল? সেটা লুকিয়ে ও বিয়ে করতে গিয়েছিল? অসম্ভব, এটা যে কিছুতেই মেলাতে পারছে না টুটাইয়ের সঙ্গে। নীলাদ্রি বললো, তুমি চলো, আমি আসছি। বারান্দায় সব রয়েছে, একসঙ্গে বেরোবো না। কাবেরী বেরিয়ে এলো স্টাডি থেকে। নীলাদ্রির কষ্টকাতর মুখটা ভাসছিল চোখের সামনে। টুটাইয়ের ঘরে ঢুকে দেখলো, তুতান মানে অনুর ছেলে টুটাইয়ের একটা বই নিয়ে নাড়াঘাঁটা করছে। এই ছেলেটাকে বড্ড ভালো লাগে কাবেরীর। ছেলেটার মুখ আর মনে কোনো পার্থক্য নেই। বাবা-মায়ের মতোই হয়েছে। তবে কোনো কিছুতেই খুব বেশি কৌতূহল নেই। ওকে দেখেই বললো, মামী, টুটাইদার আর কোনো কন্ট্যাক্ট নেই না গো? আসলে ওই ফোনটার চার্জ চলে যেতে পারে, তাই জিজ্ঞেস করলাম। কাবেরী বললো, আছে, আরেকটা নম্বর আছে, কিন্তু দুটো সিমকে একটাই ফোনে ঢুকিয়ে রাখার ঠিক কি অর্থ সেটা এখনো আমি বুঝি না। তুতান বললো, এটা সত্যিই সমস্যার! ওর কথা শেষ হবার আগেই নীলাদ্রি ঢুকলো ঘরে। বললো, কি দেখাবে বলছিলে দেখাও। কাবেরী ল্যাপটপ অন করে বললো, দেখো, স্ক্রিনের মেয়েটাকে তুমি চেনো?
আমার তো মনে হয় এই মেয়েটার জন্যই টুটাই পালিয়েছে। কি রুচি হয়েছে ছেলেটার! তুমি বলছিলে, অহনার মত ডাকাবুকো মেয়ে বলেই নাকি ওর আপত্তি, কিন্তু এর পোশাক দেখো একবার, তাহলেই বুঝবে তোমার ছেলের রুচিটা আরও কতটা মর্ডান হয়েছে। এখন তো মনে হচ্ছে অহনাকে তোমার ছেলের ব্যাকডেটেড লেগেছিল বলেই হাওয়া হয়েছে। নীলাদ্রি খেয়াল করলো, আজকে কাবেরী টুটাইকে ওর ছেলে বলে বারবার স্বীকার করেছে। এতদিন পর্যন্ত টুটাইয়ের ভালো রেজাল্ট, টুটাইয়ের কবিতা কম্পিটিশন বা আঁকার কম্পিটিশনে ফার্স্ট হওয়া থেকে শুরু করে জব পাওয়ার সব ক্রেডিট নিজেই নিয়েছে। দিনরাত শুধু বলতো, আমার ছেলের রেজাল্ট দেখেছো! আমার ছেলে বলে কথা, এটা তো মানবে নীলাদ্রি? এসব শুনতে শুনতে কবে যে টুটাই কাবেরীর একার ছেলে হয়ে গিয়েছিলো কে জানে! ভাগ্যিস টুটাই একটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ করলো, তাই টুটাইয়ের বাবা হিসাবে পরিচিত হলো নীলাদ্রি। কাবেরীর দিকে তাকিয়ে নীলাদ্রি বললো, আজ আর টুটাই তোমার ছেলে নয় কাবেরী? শুধুই আমার ছেলে তাই তো?
মামার কথা শুনে তুতান ফিক করে হেসে দিলো। বললো তোমরাও দেখছি আমার বাবা-মায়ের মতোই ঝগড়া করো। আমিও যখন অবাধ্য হই মা তখন আমাকে বাবার ছেলে বানিয়ে দেয় নিশ্চিন্তে। কাবেরী একটু থতমত খেয়ে বললো, এমন বেআক্কেলে কাজ তোমার ছেলে বলেই না করতে পারলো। আমার তো বোঝা উচিত ছিল, বাবারই কোনো দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা নেই এই বয়েসে, তো ছেলের কোথা থেকে আসবে। আল্টিমেটলি ব্লাড কথা বলে বুঝলে নীল!
তুতান বললো, মামা, মামী তোমরা প্লিজ ঝগড়া থামাও। দাদাভাই মিসিং, সেটা নিয়ে ভাবো প্লিজ।
তুতানের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল কাবেরী। নীলের দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে ফোল্ডারটা দেখো, এই মেয়েটার ছবি আছে, এই মেয়েটাকেই বোধহয় টুটাই….
নীলাদ্রি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, নাম, ধাম, অ্যাড্রেস কিছু পেলে? তাহলে মনে হয় পালিয়ে এর কাছেই গেছে।
তুতান বললো, মামী, একটু সাইড দাও, আমি একবার ছবিটা দেখি..
কাবেরী সরে দাঁড়িয়ে বললো, তোকে দাদাভাই কিছু বলেছিল এ ব্যাপারে? তুই তো দাদাভাইয়ের সব জানতিস!
তুতান হাসতে হাসতে বললো, ধুর মামী তোমরা সত্যি বড় ব্যাকডেটেড গো। এ তো একজন গায়িকা। রিয়া কক্কর। আমরা তো সবাই ফিদা এর জন্য। আমার ফোনের ফোল্ডারেও এনার ছবি আছে। দেখি দেখি, দাদাভাইয়ের কালেকশনে যদি এক্সট্রা ছবি থাকে ওর তাহলে আমি নেব। ল্যাপটপটা টেনে নিল তুতান।
নীলাদ্রি ফিসফিস করে বললো, আমার ঘরেও সুচিত্রা সেন আর অপর্ণা সেন, অড্রে হেপবার্ন এর সাদাকালো পোস্টার ছিল। আমার ছেলে কিনা, তাই যার ফ্যান তার ছবি রেখেছে ভালোবেসে। অনেকে তো আবার অমিতাভের মুভি দেখতে বসলে এমনভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন অমিতাভ নেক্সট কিসটা রেখাকে নয় ওনাকেই করবেন। অথচ স্বীকার করার সৎসাহস নেই, সে তুলনায় টুটাই অনেক স্বচ্ছ আমি বলবো। আসলে আমার ছেলে কিনা, তাই অড্রে হেপবার্নকে ভালো লাগে বলতে মুখ কাঁপে না। দ্বিচারিতা নেই চরিত্রে।
কাবেরী বিরক্ত হয়ে বলল, টুটাইয়ের বিষয় নিয়ে কথা বললে ভালো হতো এখন। তুতান বলছে পুলিশে যোগাযোগ করতে, কি করবে বলো?
এই মেয়েটা যখন গায়িকা তখন ওর লাভারের কাছে চলে যাওয়ার যুক্তিটা বাদ দিয়ে ভাবলে ভালো হবে।
নীলাদ্রি বললো, দাঁড়াও, অনিরুদ্ধবাবু কল করছেন, দেখি কি বলেন! কাবেরী নীলের দিকে তাকিয়ে বলল, অহনার বাবা? দেখো টুটাইয়ের কোনো খবর দেন কিনা!