অনুভবে তুমি – ১৫
।।১৫।।
প্রিয়াঙ্কা, তুই তো ডিরেক্ট একদিন তোর মাকে জিজ্ঞেস করতেই পারিস, কিভাবে তোর বাবা-মায়ের বিয়েটা হয়েছিল? তোর কথামত, তোর মামারবাড়ি গরিব হলেও এমন রুচির কোনো মানুষের সঙ্গে নাকি তারা মেয়ের বিয়ে দিতেই পারে না। তাহলে সত্যিটা জানার চেষ্টা করিস না কেন এতদিন?
প্রিয়াঙ্কা ফোনটা কানে চেপে ধরে বলল, জিজ্ঞেস করেছিলাম কয়েকবার কিন্তু মা সেভাবে উত্তর দেয়নি। মামার বাড়িই তো গেছি সেই ছোটবেলায়। দাদু মারা যাবার পরে দিদাকে নিয়ে বড়মাসি চলে গিয়েছিল। তারপর থেকে মাও আর বাপের বাড়ি যায়নি। মাসিরা কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। এমনকি বড় মাসির ছেলের বিয়েতেও মাকে নিমন্ত্রণ করেনি, আসলে বাবার জন্যই কেউ সম্পর্ক রাখতে চায় না। প্রত্যেকেরই একটা সোশ্যাল স্ট্যাটাস তো আছে বুঝলি অনিক।
তাই মায়ের দিকের কোনো আত্মীয়ই আমাদের সঙ্গে রিলেশন রাখে না। বাবার আত্মীয় আদৌ কেউ ছিল কিনা জানি না, তবে এক জেঠু এসেছিলেন একদিন আমাদের বাড়িতে। মাকে বলছিলেন, দীপশিখা তোমার মত ভালো মেয়ে পেয়েও যে পীযুষ বদলাবে না এমনটা আমরা ভাবিনি। একটু সামলে রেখো, মেয়েটা বড় হচ্ছে, কোনো কেসে জড়ালে মেয়েটার বিপদ। মুখার্জীরা এসে বাড়ি বয়ে অপমান করে গেছে, ওদের বাড়িতে রং করতে গিয়ে নাকি কি অসভ্যতামি করে এসেছে পীযুষ। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, ওই একবারই জেঠুটাকে দেখেছিলাম। মা বলেছিল, তোর বাবার দাদা। দুটো মানুষের মধ্যে কত পার্থক্য। জেঠু নাকি স্কুল টিচার।
দীপশিখা মেয়ের ঘরের পাশ দিয়ে পেরোনোর সময় প্রিয়ার কথাগুলো শুনতে পেল। বোধহয় কোনো বন্ধুকে বলছে। নাকি অনিক নামের ওই ছেলেটাকে। প্রিয়ার মনে ছোট থেকেই মাকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন। দীপশিখা বেশিরভাগ প্রশ্নর উত্তরকেই ইগনোর করে গেছে প্রিয়ার কাছে, তাই মেয়েটার কৌতূহল আরও বেড়েছে। দীপশিখা নিরুপায়। প্রিয়াঙ্কাকে কোনোদিনই সব সত্যি বলা সম্ভব নয়। এমনিতেই মেয়েটা পীযুষ বিশ্বাসের মেয়ে বলে নিজেকে ঘৃণা করে, এরপর যদি বাপের গুণের কথা শোনে তাহলে হয়তো আত্মহত্যা করে বসবে। প্রিয়ার জন্যই এতগুলো বছর নিজের সব কষ্টকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে আছে ও। ও সুইসাইড করলে মেয়েটাকে হয়তো খারাপ জায়গায় বেচে দিত পীযুষ, তাই নিজের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয়েছে দীপশিখাকে। প্রিয়াঙ্কা একটা চাকরি পেলে ওর ভালো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তবে ওর ছুটি মিলবে এই ত্রিশ বছরের অভিশপ্ত জীবন থেকে। সেই আশাতেই দিন গুনছে ও। প্রতিটা দিন যেখানে সুদীর্ঘ ক্লান্তিকর লাগে, সেখানে এতগুলো অন্ধকার দুর্গন্ধময় দিন ও কাটালো কি করে কে জানে! ভাবতেই বুকের বাঁ দিকটা যন্ত্রণায় কনকন করে ওঠে। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তারা ভিড় করে এলো, এই অনিক নামের ছেলেটা প্রিয়াকে বিয়ে করবে তো? নাকি ওর বাবার চরিত্রের গল্প শুনে প্রিয়াকে দূরে সরিয়ে দেবে? যদি অনিকের ফ্যামিলি না মানে প্রিয়াকে বউ হিসেবে, তাহলেও কি অনিক থাকবে মেয়েটার সঙ্গে? নাকি সেই অসহায় মুহূর্তে হাত ছেড়ে দিয়ে পালাবে মেয়েটার। দীপশিখার মেয়ে বলেই হয়তো ভগবান প্রিয়ার ভাগ্যটাও অযত্নের লিখেছেন। সেখানেও হয়তো সুখ, শান্তি, গোছানো সংসার, কেয়ারিং স্বামী কিছুই লিখতে ভুলে গেছেন ভগবান। মায়ের মতোই কপালের রেখা নিয়ে জন্মায়নি তো প্রিয়া? তাহলে তো ডেস্টিনির কাছে হেরে যাবে দীপশিখার এতবছরের লড়াই। পাশে শুয়ে নাক ডাকছে পীযুষ। বিয়ের পর পর মদের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠতো ওর। বমি পেয়ে যেত। বমি করতে গেলেই মদ্যপ পীযুষ ঘাড় ধরে মেরে বলতো, শালী বমি করবি? মদের গন্ধ লাগছে? নে শুঁকে দেখ কেমন গন্ধ। ইচ্ছে করে দীপশিখার ঠোঁট দুটো নিজের মুখে ভরে দম আটকে দিতে চাইতো ওর। ছটফট করতো দীপশিখা। ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিল, মদের গন্ধে বমি পাওয়া বারণ, পেলে মার খেতে হবে। তাই এই গা গোলানো গন্ধে অভ্যস্ত করে নিচ্ছিল নিজেকে। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। দিব্য ঘুমায় এর মধ্যেই। শুধু মাঝে মাঝে বাবা-মায়ের মুখগুলো, আর পুরোনো কিছু স্মৃতি এসে নিঃশব্দে ভিজিয়ে দিয়ে যায় চোখের পাতাগুলোকে। আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না দীপশিখার। প্রিয়ার ভবিষ্যতের ভাবনা বারবার মনকে উতলা করে দিচ্ছে। অনিক যদি প্রতারণা করে মেয়েটাকে, যদি মেয়েটার স্বপ্নদেখা চোখ দুটোতে অবিশ্বাসের ঘন ছায়া এসে পড়ে, কি করে আগলাবে ও প্রিয়াকে। কতটুকু ক্ষমতা আছে ওর!
প্রিয়াঙ্কা যে অনিককে ভালোবাসে সেটুকু মা হয়ে বেশ বুঝেছে। বাবার আদর জীবনে পায়নি প্রিয়া, মায়ের মুখেও দিনরাত এক অদ্ভুত কাঠিন্য দেখেছে সেই ছোট থেকেই। মা স্নান করিয়ে, খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়েছে ঠিকই কিন্তু কখনো বুকে জড়িয়ে ধরে শরীরের সবটুকু উষ্ণতা প্রিয়াকে দিয়ে বলেনি, বাবা না বাসুক আমি তো বাসি তোকে ভালো। তাই দীপশিখা জানে ভালোবাসা নামক মায়াবী অনুভূতির বড্ড কাঙাল তার মেয়েটা। অনিকের মুখ থেকে বারবার হয়তো শুনতে চায় ভালোবাসি শব্দটা।
এখনও যে প্রিয়ার কাজল কালো চোখের দৃষ্টিতে ভালোবাসা নামক অপার্থিব উপলব্ধির প্রবঞ্চনতা, কাপুরুষতার রূপ ধরা পড়েনি, তাই ওর স্বপ্নগুলোর রং এখনও রক্তিম। মা হয়ে দীপশিখা চায়, ওর অনুভূতিগুলো কৃষ্ণচূড়ার আবির রঙে রাঙা হয়ে থাকুক, ধূসর না হয়ে যাক। তবুও মেয়েটাকে সামনে বসিয়ে একদিন বোঝাতে হবে। ভালোবাসার বাকি রূপগুলো সম্পর্কেও বলতে হবে। প্রিয়া হয়তো ভালোবাসার একটা রূপের কথাই জানে, যেখানে দৃঢ় বিশ্বাস, সোহাগী অভিমান আর আদুরে আব্দার মিলে মিশে গড়াগড়ি খায় পোষা বেড়ালের মত, আর ভালোবাসা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আজীবন পথ চলার অঙ্গীকার করে।
ভালোবাসা মানে হয়তো প্রিয়ার কাছে এমনই এক পৃথিবী একসঙ্গে চলার দৃঢ় অঙ্গীকার, কিন্তু ওকে বুঝতে হবে, ভালোবাসা মানে আচমকা আসা কালবৈশাখীর ঝড়ের দাপটও হতে পারে। যেখানে কিছু আন্দাজ করার আগেই সাজানো গোছানো ছোট্ট মনকুঠুরিটা ভেঙে তছনছ হয়ে যেতেও পারে। তারপরেও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে পাতাবিহীন, ডাল ভাঙা গাছের মত। ওকে বুঝতে হবে, ও মেয়ে, তাই ওর সহ্য ক্ষমতা হতে হবে বটবৃক্ষের মত। অকারণ আবেগ, ভালোলাগায় ভেসে যাওয়ার মত অনুভূতিগুলো ওর মধ্যে যত কম থাকবে ততই মঙ্গল।
দীপশিখার গায়ের ওপরে এসে পড়ল পীযুষের একটা হাত। এই হাতের কনুয়ের কাছে একটা গভীর আঘাতের চিহ্ন। ছুরি বা ঐজাতীয় কিছু দিয়ে কেউ আঘাত করেছিল হয়তো। দীপশিখা জানতে চেয়েছিল, কি হয়েছিল এখানে?
পীযুষ বলেছিল, রং করতে ভাড়ায় উঠেছিলাম, পিছনের গ্রিলে লেগে মাংস উঠে গিয়েছিল। বহুদিন ডানহাতের কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তা প্রায় মাস পাঁচেক তো হবেই। দীপশিখার দুর্ভাগ্য পীযুষের বলা কোনো কথাই কখনো বিশ্বাস করতে পারতো না ও। তাই পীযুষ যখন কথা বলে, ওর চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে সত্যতা যাচাই করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে ও, দীর্ঘ বছরের অধ্যবসায়ের ফলে শেষপর্যন্ত সফল হয়েছে দীপশিখা। এখন ও বুঝতে পারে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে। তাই পীযুষের হাতের এই ক্ষতটা যে গ্রিলের নয় সেটা ও বেশ ভালোই জানে। ঘুমন্ত পীযুষের মুখের দিকে তাকালো দীপশিখা। একদলা থুতু জমে উঠলো মুখের মধ্যে, গলার কাছটা তেঁতো হয়ে গেল যেন। মা বলতো, চোর, ডাকাত যেই হোক না কেন ঘুমন্ত মুখ দেখলে তার চরিত্র নাকি বোঝা যায় না! অপরাধীকেও নিষ্পাপ মনে হয় ঘুমালে। ঘুমন্ত মুখের যে-কোনো মানুষকে দেখলে নাকি মায়া জাগে মনে। কই এই মানুষটাকে দেখে তো কখনো মায়া জাগেনি দীপশিখার। তবে কি দীপশিখা হিংস্র কুটিল মনের! নাকি মায়া, দয়া অপাত্রে করা উচিত নয় বলেই জাগেনি। ঘুমন্ত পীযুষকে দেখলেই দীপশিখার একরাশ ঘৃণা দলা পাকিয়ে ওঠে বুকের কাছে। হাত নিশপিশ করে, মনে হয় গলাটা টিপে ধরলে কি ছটফট করতে করতে মরে যাবে মানুষটা? নাকি ঘুম থেকে উঠে ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওকেই চুলের মুঠি ধরে পেটাবে। তখন দীপশিখার রোগা রোগা অসহায় হাতদুটো অপারগ হবে নিজেকে বাঁচাতে!
দ্বিতীয়টাকেই সত্যি মনে করেই দিনের পর দিন পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ও। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। শুধু মনে মনে ভাবল, শেষ চেষ্টা করে দেখবে একবার, কিন্তু প্রিয়ার বিয়ের পরে, এখন নয়। ও জেলে থাকলে মেয়েটার বিয়ে দেবে কে!
সামনে অনেক কাজ দীপশিখার, এখন এসব খুনে ভাবনা তাড়াতে হবে মাথা থেকে। অনিকের সঙ্গে আলাপ করতে হবে, দীপশিখাকে বুঝতে হবে অনিক ঠিক কতটা চায় প্রিয়াকে।
সারাদিনের ক্লান্তি এসে ঘুম পারিয়ে দিতে চাইছে ওকে। এটুকুই যা শান্তি, এই রাতের সময়টুকুই ভাবনাহীন অখণ্ড বিশ্রাম। সব ভুলে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিতে পারলেই কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকা যায় অতীতের না পাওয়া, বর্তমানের ক্ষোভ আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে। চোখ দুটো ভারী হয়ে এলো, আহা কি শান্তি, কানের কাছে প্রিয় গানের অনুরণন, শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে দীপশিখা।
।।১৬।।
তো এই স্টেশন থেকে কিভাবে যাওয়া হবে? টোটো, অটো নাকি তোমার প্রেজেন্টের রোলস রয়েসে যাবো? অহনা হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই নৈঋতের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে ফেলল। হাসির দমকে ও ঝুঁকে যাচ্ছিল দেখেই নৈঋত বললো, তুমি শিওর তোমার সাইকোলজিক্যাল কোনো প্রবলেম নেই? আমার কিন্তু এই কয়েকঘণ্টা দেখেই মনে হচ্ছে ইমিডিয়েট ট্রিটমেন্ট করানোর দরকার। মা শেষ পর্যন্ত একটা পাগলীর সঙ্গে আমার বিয়ে দিচ্ছিল। এই অদ্ভুত সিচুয়েশনে, অপরিচিত স্টেশনে দাঁড়িয়ে পাগলের মত হাসতে যে কেউ পারে, না দেখলে তো বিশ্বাসই করতাম না!
অহনা নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করে বললো, এক্সট্রিমলি সরি। আসলে ছোটবেলায় আমি খুব গোপাল ভাঁড়ের কার্টুন দেখতাম। ওই যে টিভিতে হতো না, ঐগুলো। নৈঋত বললো, তো এখন সেই গোপাল ভাঁড়কে তুমি এখানে কোথায় পেলে? তার তো শুনেছি কৃষ্ণনগরে জন্ম। ঘূর্ণি নামক একটা জায়গায় তার মূর্তিও আছে। তিনি তো কৃষ্ণনগরের রাজার রাজসভার ভাঁড় ছিলেন। তাকে এই সূর্যপুরে কোথায় পেলে? অহনা নিজের একটা আঙুল নৈঋতের দিকে তাক করিয়ে বললো, এই যে, এইখানে। বিশ্বাস করুন, কালার ধুতি, তার উপরে গরদের ফিনফিনে পাঞ্জাবি, পায়ে নাগড়াই জুতো, লেডিজ জ্যাকেট, এমন অদ্ভুত কম্বিনেশনই আমায় সেই বিখ্যাত ব্যক্তিকে মনে করিয়ে দিল। বাবাই আপনাকে দেখলে প্রথমেই বলবে, বেশ করেছিস পালিয়ে এসেছিস, এমন ড্রেস সেন্সের ছেলেকে কেউ বিয়ে করে?
শীতের সকালের গুঁড়ি গুঁড়ি কুয়াশা ভেজা স্টেশনে নরম আলোয় অহনাকে বড্ড সুন্দরী লাগলো, ঠিক যেন বৃষ্টিভেজা কচুপাতা। ঝকঝকে অথচ জলের দাগ নেই এতটুকু। সবুজ সতেজ চোখমুখ, রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিটুকু শুধু অবাধ্যর মত রয়ে গেছে চোখের কাজলে।
নৈঋত নির্নিমেষ তাকিয়েছিল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়েটার দিকে। বেশির ভাগ মুভিতে বা উপন্যাসের নায়িকাদের লেখক বা পরিচালকরা ধপধপে ফর্সা অথবা ডালিম রঙা খোঁজেন। তাই নৈঋতের কেমন যেন ধারণা হয়ে গিয়েছিল সুন্দরী হবার প্রথম লক্ষণ বুঝি গম রঙা গায়ের রং। মানে সুন্দরী হবার বুঝি ওটাই ফার্স্ট ক্রাইটেরিয়া। এমনকি ওর পছন্দের গায়িকা থেকে নায়িকা যারা সো কল্ড সুন্দরী বলে পরিচিত তাদের গায়ের রংও বেদানার দানার মত নরম গোলাপি। কিন্তু অহনা এই তথাকথিত ভাবনা চিন্তাকে নিমেষে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে একাই একশো। এতদিনে নৈঋত বুঝলো, গোলাপি ফর্সা রং, লম্বা চুল, মাপা ফিগার মানেই সুন্দরী নয়। বরং যার দিকে তাকানোর পরে চোখ সরালে অকারণে সময় নষ্ট হবে বলে মনে হবে, তাকেই সুন্দরী বলা উচিত। এই যেমন এখন শীতের সকালের নরম সূর্যের আলোয় নৈঋত দেখছে অহনার হাসি হাসি মুখটা, আর যেটা দেখে ওর আঠাশ বছরের সংযমী হৃদয় অবধি তোলপাড় হতে শুরু করেছে। আর ওর আপ্রাণ চেষ্টাতেও কিছুতেই থামছে না ওই ওলটপালট করে দেওয়া ঝড়টা, বরং পূর্বাভাষ দিচ্ছে ঝড়ের প্রকোপ বাড়তে পারে বলে!
নৈঋত বাধ্য হয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো, লজ্জা করে না? ড্রেস সেন্স নিয়ে কথা বলতে? এক কাপড়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় মনে ছিল না, একটা নিরীহ মানুষ এই শীতের রাতে কেঁপে মরবে। আচ্ছা এখানে কোনো মার্কেট নেই? যেখান থেকে অ্যাটলিস্ট একটা পায়জামা আর টি শার্ট কিনে পরা সম্ভব?
অহনা হাসতে হাসতেই বললো, মার্কেট আছে, কিন্তু খুলবে সকাল দশটায়। চিন্তা নেই, আমার জ্যাকেটটা যেমন চেয়ে পরেছেন, তেমনি বাবাইয়ের কাছ থেকে একটা ট্রাকসুট আর টিশার্ট চেয়ে পরে ফেলবেন। বাবাই আর আপনার হাইট প্রায় একই। অহনা মুখে একটা ফিচেল ভঙ্গিমা করে বললো, তবে আমার বাবাই কোয়াইট হ্যান্ডসাম।
নৈঋত হাসতে হাসতেই বললো, আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আমরা বিয়েটা না করে পালালাম কেন? করেই পালিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে তোমার বাবাই আমায় বাবাজীবন বলে খাতির করতেন, আর জামাই আদর করে খাওয়াতেন। মানে আমাদের উদ্দেশ্যটা ঠিক কি? বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসে দুটো ফ্যামিলিকে বিপদে ফেলে এখানে দাঁড়িয়ে ড্রেস সেন্স বুঝছি? একটা কথা কিন্তু ঠিক অহনা। মানুষ যার সঙ্গে থাকে তার এফেক্ট বেশ ভালোমত পড়ে তার ওপরে। এই যেমন আমার ওপরে এখন ভর করেছে একটা মারকুটে, পাগলী রিপোর্টার, কোথায় যে নিয়ে যেতে চলেছে কে জানে! এতক্ষন মেয়ে জ্বালাচ্ছিলো, এরপর হতে হতে না হওয়া শ্বশুরমশাইয়ের জেরার মুখে পড়তে হবে। অহনা আমার মনে হচ্ছে, এবারে বোধহয় আমার ফিরে যাওয়া উচিত। তোমার প্রেজেন্ট, পাস্ট, ফিউচার যার সঙ্গে ইচ্ছে তুমি মিট করো, কিন্তু এমন আক্কেলজ্ঞানহীনতার কাজ করার পরে অনিরুদ্ধবাবুর সামনে দাঁড়ানোর মত সাহস আমার নেই। এর থেকে বরং আমি আমার বাড়ি ফিরে গিয়ে সকলকে যাহোক একটা কিছু বলবো।
টিকিট কাউন্টারের দিকে এগোতে যাচ্ছিল নৈঋত। অহনা চমকে উঠে বললো, ইয়ার্কি হচ্ছে? যখন বলেছিলাম চলে যান তখন আমার এক্সকে দেখবেন বলে এতদূর চলে এলেন। এখন তার সঙ্গে আলাপ না করিয়ে আমি তো যেতে দেব না।
নৈঋত থমকে দাঁড়িয়ে বললো, তবে যে এতক্ষণ বলেছিলে সেরকম কেউ নেই তোমার, অন্য কোন অজানা কারণে তুমি বিয়েটা করলে না, এখন আবার সেই কেউটা জুটলো কোথা থেকে? এই অহনা, তুমি সত্যিটা আমায় বলো তো, এনাফ হয়েছে। এসব ছেলেমানুষির কোনো মানে হয় নাকি?
অহনা ফিসফিস করে বললো, বাবাই ফোন করছে। এই ফোনের নম্বরটা শুধু বাবাইয়ের কাছেই দেওয়া আছে। এতক্ষন ট্রেনে সিগন্যাল পায়নি বোধহয়। প্লিজ নৈঋত, কি বলবো?
নৈঋত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, আমি কি জানি? আমায় জিজ্ঞেস করে পালিয়েছিলে? অহনা উত্তেজনার চোটে নৈঋতের বাঁ হাতটা চেপে ধরেছে। সেই সাহসী মারকুটে মেয়েটার চোখে একটা অদ্ভুত মায়াবী অসহায়তা। ফোনটা রিসিভ করতে ভয় পাচ্ছে।
নৈঋত ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো, হ্যাঁ আঙ্কেল, আমি নৈঋত কথা বলছি। অহনা আমার সঙ্গেই আছে। আমরা আপনার কাছেই যাচ্ছি। এখুনি প্লিজ খবরটা কাউকে দেবেন না। গিয়ে ডিটেলে সব বলছি। আপাতত আমিও আপনার মতোই অন্ধকারে, কেন পালালাম আমি নিজেও জানি না, তাই এই প্রশ্নটা করে বিব্রত করবেন না প্লিজ। আমরা আসছি। অনিরুদ্ধবাবু অবাক গলায় বলল, তুমি তিতিরের সঙ্গে? মানে? তোমরা কি একসঙ্গে পালিয়েছ? আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কাল রাতে কি তিতির এই নম্বর থেকে আমায় কল করার জন্য ট্রাই করেছিল? একটা মিস কল হয়ে রয়েছে দেখলাম। তারপর বহু ট্রাই করেও পাইনি। তিতিরের মা খুব টেনশন করছে, আমি কি করবো এখন নৈঋত?
নৈঋত থমকে বললো, যাই করুন পুলিশে ইনফর্ম করবেন না এখুনি। আমরা আসছি।
অহনা মুখটা নিচু করে বললো, বাবাই কি পুলিশে ইনফর্ম করেছে? বাবাইএর সঙ্গে অভিরূপ আঙ্কেলের খুব ভালো রিলেশন।
নৈঋত চোখ বড় বড় করে বললো, একটু খেয়াল করো দেওয়ালে দেওয়ালে বোধহয় তোমার ছবি পোস্টার আকারে লাগানো কমপ্লিট করে ফেলেছে তোমার পুলিশ আঙ্কেল। আর তাতে লেখা আছে, তিতির পাল, মোস্ট চ্যালেঞ্জিং রিপোর্টার, ওয়ান্টেড।
অহনা একটু ঘাবড়ানো গলায় বলল, হোয়াট! আমি কি খুনি নাকি, যে ওয়ান্টেড লেখা থাকবে আমার ছবির নিচে?
নৈঋত বললো, খুনি নয় পলাতক বলে লিখেছে বোধহয়।
অহনা থমকে বললো, বাজে না বকে বলবেন, বাবাই কি বললো আপনাকে?
নৈঋত বললো, তোমার রোলস রয়েস আর এক্স কারোরই যখন দেখা পাওয়া গেল না, তখন এই গোপাল ভাঁড়ের সঙ্গে ওই টোটোতে করেই চলো।
তোমার বাবাই বললো, একটু সাবধানে নিয়ে এসো তিতির পাখিকে, যেকোনো সময় ডানা মেলে উড়ে যেতে পারে। আমি বললাম, উড়েই তো গিয়েছিল, নেহাত আচমকা রাইগঞ্জের স্টেশনে দেখা হয়ে গেল আর আমিও কাঁধে চেপে বসলাম, তাই ডানা ঝাপটিয়েও নামাতে পারলো না।
বাই দ্য ওয়ে, তিতির নামটা বেশি ভালো যাচ্ছে তোমার স্বভাবের সঙ্গে।
অহনা অন্যমনস্কভাবে বললো, কেন, তিতির নামটা বেশি ভালো কেন?
নৈঋত নরম গলায় বলল, তিতির নামটার মধ্যে শুধু ডানা ঝাপটানোর শব্দ নেই, উড়ে যাওয়ার বাসনা ষোলো আনা আছে। তিতিরকে খাঁচায় ভরার ইচ্ছে আমারও নেই। নীল আকাশেই তাকে মানায় বেশি। আমার মা না বুঝে তাকে বাঁধতে চেয়েছিল। বড়জোর তার ওড়ার সঙ্গী হতে পারি, যদি সে সঙ্গী করতে চায় তবেই।
অহনা দৃঢ় গলায় বললো, এ লড়াই আমার একার, এ সত্য আমি একাই উদঘাটন করতে চাই।
নৈঋত স্মিত হেসে বললো, বেশ, তবে ফিরে আসবো। বলো তো এখনই ফিরে যাই।
অহনা একটু থেমে বললো, সারারাতের ক্লান্তিটুকু কাটিয়ে ফিরবেন। আমাদের বাড়িতে খাওয়ার সুযোগটুকুও দিইনি আপনাকে, সারারাত না খেয়ে আছেন।
নৈঋত মাঝপথেই বললো, তাই এখন খাইয়ে অতিথিসেবা করে বিদেয় দেবে তাইতো?
অহনা সামলে নিয়ে বললো, স্বামী, স্ত্রী নাই হলাম, বন্ধু ভাবতেই পারেন!
নৈঋত হেসে বলল, সে পারি বৈকি। কিন্তু আমার আবার এক বিরক্তিকর স্বভাব আছে সকলকে বন্ধু ভাবতে পারে না আমার মন।
অহনা বললো, ঠিকই, আমি বোধহয় আপনার বন্ধু হবারও যোগ্য নই তাই না?
নৈঋত কথাটাকে পাশ কাটিয়ে বললো, ওইযে খান দুই টোটো আছে, চলো ওতেই চাপা যাক।
মনে মনে বললো, হায়রে টুটাই, গাড়ি ছাড়া যে এক পা চলে না, তাকে আজকে আর কোন কোন যানবাহনে চড়তে হবে সেটাই দেখার। এরপরে হয়তো তিতির পাখি বলবেন, আমাদের বাড়ি যেতে গেলে একটা ঘন জঙ্গল পড়বে, সেখানে বাঘের পিঠে চেপে আধঘণ্টা, তারপর একটা নদী, সেই নদীতে কুমিরের পিঠে পনেরো মিনিট গেলে তবেই পৌঁছাবে গন্তব্যে।
কাল রাত থেকে ওর সঙ্গে যা যা ঘটছে তাতে সব কিছুই বোধহয় সম্ভব। নৈঋতেরও নেপলিয়নের মত গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘‘impossible is a word to be found only in the dictionary of fools’’।
পৃথিবীতে সব সম্ভব, তাই এমন জোকার মার্কা সেজে, খালি পেটে এই হতে হতে না হওয়া বউয়ের পিছন পিছন ব্যাগ বইছে প্রফেসর নৈঋত বসু।
ওই মেয়েকে দেখো, এতবড় কাণ্ড ঘটানোর পরেও নাকি আরও কিসব লড়াই বাকি আছে ওনার, সেসব একাই লড়তে চান। এনার তো ঝাঁসিতে জন্মানো উচিত ছিল। মনে হয় ঝাঁসির রানী মরেই এনার জন্ম হয়েছে। আত্মার দেহের পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই কিন্তু স্বভাবের নয়, সেটা বেশ বুঝতে পারছে নৈঋত।
কি হলো, বুদ্ধুর মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন উঠুন। অহনা টোটোয় উঠে ডাক দিল নৈঋতকে। উঠেই অল্প বয়সি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, পড়াশোনা করেছো? কেন, মাধ্যমিকের পর পড়া ছাড়লে কেন ভাই? বাবা কি করেন? নৈঋত আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললো, আর পড়ার ইচ্ছে থাকলে জানাতে পারো ভাই এই দিদিমণিকে। ইনি সকলের সব দুঃখ দূর করার জন্যই মানব দেহে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। ছেলেটি না বুঝেই বললো, না স্যার অনেক পড়ে ফেলেছি, হিসেব পারি, কাগজ পড়তে পারি, দরখাস্ত লিখতে পারি আর কিছুর দরকার নেই। পি এইচ ডি করে যদি ডোমের চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করে মানুষ তাহলে আমরা ভালোই আছি। দিনে তিনশো-পাঁচশো কামিয়ে নিই, চলে যাচ্ছে। অহনা বললো, পড়াশোনা লোকে শুধু চাকরি করবে বলেই করে না, নিজেকে শিক্ষিত করতেও করে ভাই। নৈঋত বললো, এখান থেকে তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যায় তো অহনা? এত জ্ঞান না নিতে পেরে যদি ও আমাদের নামিয়ে দেয় তাহলে কিন্তু হেঁটে যেতে হবে। অহনা বললো, আপনার মা বলেছিলেন, আপনি নাকি অত্যন্ত ভদ্র, শান্ত, কথাটা সত্যি নয় বুঝলেন!! নৈঋত বললো, সে তো তোমার মাও বলেছিল, মেয়ে আমাদের সাত চড়ে রা করে না। আমি তো দেখছি সাতটা কথার পরেই সে চড় থাপ্পড় মারতে শুরু করে। মায়েরা এমন বলেই থাকে, নিজেদের বাঁকা ট্যারা প্রোডাকশনগুলোকে মার্কেটে চালাবে বলে। ওটাকে সিরিয়াসলি নিতে নেই, বুঝলে? অহনা গজগজ করে বললো, সঙ্গে নেওয়াটাই ভুল হলো দেখছি। নৈঋত মুচকি মুচকি হাসছিল অহনার মুখের ভঙ্গিমা দেখে। যাক দামাল ঘোড়াটাকে এতক্ষণে একটু বাগে আনতে পেরেছে। এতক্ষণ ধরে তো এক তরফা ছুটিয়ে মারছিল নৈঋতকে। লাগাম ধরতে চেষ্টা করেও পারছিল না নৈঋত। বনবন করে ঘোরাচ্ছিলো ওকে লাগাম ছেঁড়া জেদি মেয়েটা। তবে কেন কে জানে কিছু কিছু সময় জেতার থেকেও হারতে বেশি ভালো লাগে। অহনার এই মারাত্মক জেদের কাছে হার স্বীকার করতে মন্দ লাগছিলো না নৈঋতের। অহনার এই ফোনটা থেকে একটা ফোন করে দেবে বাড়িতে? বলে দেবে মাকে, যে ও ঠিক আছে? না থাক, বরং অহনার বাবাকেই রিকোয়েস্ট করবে ওর বাবাকে একটা ফোন করে খবর দিতে। ও ফোন করলেই মায়ের এত এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে যে সামলাতে পারবে না নৈঋত।
অহনা আনমনে নিজের আঙুলের নখের নেলপালিস তুলছিল খুঁটে খুঁটে। ওর দুই ভ্রুর মাঝের গভীর ভাঁজটাই বলে দিচ্ছে ওর মন আপাতত এখানে নেই, সে বোধহয় দুশ্চিন্তা অথবা দুর্ভাবনায় পাড়ি দিয়েছে নৈঋতের অচেনা কোনো এক রাজ্যে। নৈঋত বললো, একে কোন পাড়ায় থামতে বলবো? মানে তুমি তো অন্য রাজ্যে বিচরণ করছো তাই বলছি আর কি? অহনা যেন সদ্য তপস্যা ভঙ্গ করলো, এমন ভাবেই উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, এই তো রাখালপাড়ার মোড়ে নামবো।
নৈঋত বেশ বুঝতে পারছিল অহনার মনের মধ্যে একটা দামাল ঝড়ের তাণ্ডব চলছে। সেটা শুধু বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসার জন্য নয়, আসার গোপন কারণটার জন্যই হয়তো। যে কারণটা ও কাউকে বলতেও পারছে না অথচ ওকে ক্ষতবিক্ষত করছে ক্রমাগত।
মেয়েটার সঙ্গে কাটানো এই কয়েক ঘণ্টায় নৈঋত অন্তত এটুকু বুঝেছে কাবেরী বসু মানুষ চিনতে ভুল করে না।
মেয়েটা একটু বেশিই সৎ, তাই বিয়েটা না করেই উঠে এসেছিল আসর থেকে। যদিও সেই কারণটা নৈঋতের একেবারেই চিন্তা ভাবনার বাইরে। তবে কিছু কিছু চোখ থাকে, যেখানে ডুব দিলে সৎ শব্দটা মাখামাখি হয়ে যায় শরীরে, তার থেকে অন্যরকম একটা সুগন্ধ বেরোয়। অহনার দৃষ্টিতে সেই সততা খুঁজে পেয়েছে নৈঋত, মাও হয়তো এই কারণেই বাসে দেখা হওয়া একটা মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল! অহনার দৃষ্টির সততাতে মাও নিশ্চয়ই নৈঋতের মতোই মুগ্ধ হয়েছিল। এই স্থিতধী গম্ভীর মেয়েটা যেন অন্য কেউ, আজ ভোরের ট্রেনে মারপিট করা, গালিগালাজ করা মেয়েটা নয়। এ যেন নিজের মধ্যে ডুব দিয়েছে নিজেকে আবিষ্কারের আশায়। কিন্তু ঢেউগুলো এসে ওর গতিপথকে এলোমেলো করে দিচ্ছে বারংবার, তাই পাড়ের ঝুরো বালি আঁকড়ে ধরে লড়াই করছে আপ্রাণ। নৈঋত নির্নিমেষ তাকিয়েছিল অহনার এমন এক ডুবন্ত মুখের দিকে। সকালের হাওয়ায় কিছু অবাধ্য চুলের গোছা এসে ওর কপালে পড়ছে, বার দুই অন্যমনস্কভাবে তাদের কপাল থেকে তোলার চেষ্টাও করলো, তারপর সবুজ মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকলো আনমনে।
খুব ইচ্ছে করছিল অহনার হাতটা ধরে বলে, তিতির পাখি প্লিজ, তোমার ওড়ার সঙ্গী করো আমায়, হয়তো আমি তোমার মত অত দ্রুত উড়তে পারবো না, হয়তো আমি পন্ড করবো তোমার কাজ, তবুও খড়কুটো এনে দেব তোমায় বাসা বানাবার জন্য, সারারাত শিয়রে বসে পাহারা দেব তোমার ঘুমন্ত মুখের, বন থেকে ফলমূল সংগ্রহ করে রাখবো তোমার জন্য, তাও কি আমায় সঙ্গে নেওয়া যায় না?
নৈঋত ঠোঁট ফাঁক করার আগেই অহনা বললো, ব্যাস, এখানেই রাখো।
নৈঋত পাঞ্জাবির পকেট থেকে ওয়ালেট বের করতেই অহনা বললো আমি দিচ্ছি, আমার কাছে খুচরো আছে।
একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিল ছেলেটার হাতে। বললো, দশ টাকা তুমি রাখো, চা খেও।
ছেলেটা উৎসাহের আতিশয্যে বললো, দিদি, জামাইবাবুকে আমাদের এখানের দর্শনীয় জায়গাগুলো যদি দেখাতে চান, আমার নম্বরটা রাখুন, ফোন করলেই চলে আসব। সব ঘুরিয়ে দেব দুশো টাকায়।
নৈঋত হেসে বললো, দর্শনীয় বস্তু সঙ্গে নিয়েই ঘুরছি ভাই, আর নাইবা দেখলাম।
ছেলেটি বেশ জোরে হেসে বললো, জামাইবাবু কিন্তু মাই ডিয়ার লোক। দিদি বরং একটু রাগী।
অহনা দাঁত চেপে বললো, বাড়িতে ঢুকবেন নাকি ওই টোটোতেই স্টেশনে ফেরত যাবেন সেটা ডিসাইড করুন।
নৈঋত ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে ভাই, ফোন নম্বরটা দিয়ে যাও, হয়তো লাগবে আমার। বুঝতেই তো পারছো, শ্বশুরবাড়িতে তো আর সারাজীবন থাকবো না, ফিরতে হবে বাড়ি, তাই তখন তোমাকেই ডাকবো। ছেলেটি নিজের ফোন নম্বর দিয়ে বললো, আচ্ছা জামাইবাবু চললাম।
জামাইবাবু শব্দটা শুনে নৈঋতের বেশ মজা লাগছিল, তাই হয়তো ওর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসির উদ্রেক হয়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে অহনা বললো, এই তো ড্রেস সেন্স, তারপর আর ওই ক্যাবলা ক্যাবলা হাসিটা না হাসলেই বোধহয় ভালো হয়। বাবাইয়ের সামনে দাঁড়াতে হবে বুঝে একটু সচেতন হয়ে বাড়িতে ঢুকুন।
নৈঋত ফিসফিস করে বললো, এই ড্রেসে কারোর পার্সোনালিটি আসে না সেটা তোমার জানা উচিত অহনা।
নাকে সিঁথি ময়ূর পরিয়ে যদি তোমায় দাঁড় করানো হতো তুমিও এমনই ক্যাবলা হয়ে যেতে। অহনা বললো, নাকে সিঁথি ময়ূর পরে না, কপালে পরে, বেসিক সেন্স নেই, আবার ইনি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসর! স্টুডেন্টরা চাটন দেয় না এটা সৌভাগ্য আপনার!
নৈঋত থমকে দাঁড়িয়ে বললো, কি? চাটন? এটা আবার কি শব্দ ?
অহনা গম্ভীর ভাবে বললো, ওটা আরবি শব্দ, পালি ভাষার মধ্যে দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেছে। তাই কিছুটা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
নৈঋত মনে মনে হেসে বললো, মহা বদমাশ মেয়ে একটা!
বাড়ির সামনে বেশ বড় একটা সাজানো বাগান। বাগানকে পেরিয়ে শুরু হয়েছে গোটা বাড়িটা। ছিমছাম দোতলা বাড়িটা খুব স্নিগ্ধ আকাশি রং করা। যেন স্বয়ং আকাশ এসে হাজির হয়েছে বাড়ির দেওয়ালে। বাগানের মাঝে ছাঁটা ঘাসের পায়ে চলা রাস্তাটা গিয়ে থেমেছে বার্নিস করা একটা কাঠের দরজার সামনে। রাস্তাটাকে মাঝখানে রেখে দুদিকে গোলাপ, ডালিয়া, নাম না জানা সিজন ফ্লাওয়ারের রঙিন ভিড়। গেটের গ্রিলের দরজাটা খুলতেই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ এসে বেশ অবাক গলায় বললেন, ওমা, তিতির দিদিভাই তুমি এখন এই বাড়িতে? নতুন জামাইকে সঙ্গে করে দাদাবাবুকে প্রণাম করতে এলে বুঝি। একবার ফোনে বলতে হয়তো, এখন বিজু তোমার কি দিয়ে যে আপ্যায়ন করবে কে জানে। বাসন্তীকে খবর পাঠাই, আগে এসে রান্না ঘরে ঢুকুক। কি যে করো না তোমরা, একবার জানাতে হয় তো। দাদাবাবু, দেখুন কে এসেছে…
অহনা গম্ভীর গলায় বলল, বিজু জ্যেঠু, ও তোমাদের জামাই নয়, বিয়েটা আমাদের শেষপর্যন্ত হয়নি। ওর নাম নৈঋত, ও যতক্ষণ আমাদের বাড়িতে আছে ততক্ষণ ওকে যত্ন করো আর নৈঋত বলেই ডেকো।
অহনার কাটা কাটা কথাগুলো বড্ড অসহ্য লাগছিলো নৈঋতের। মিথ্যে নয় বলেই বোধহয় দমবন্ধ হয়ে আসছিল। সত্যিই তো এই মুহূর্তে ঠিক কি পরিচয়ে ও অহনার বাড়িতে এসে উঠেছে? কাল রাতে বিয়ে ভেঙে গেছে, দ্য এন্ড। অহনা যে ওকে এতক্ষণ সহ্য করেছে সেটাই বোধহয় অনেক। কি করবে নৈঋত, ওই টোটোওয়ালাকে ফোন করে ডেকে নিয়ে ফেরত যাবে কি! এরপর তো অহনার বাবার মুখোমুখি হতে হবে, সেখানেও হয়তো নৈঋতকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেবে ওই মেয়ে। অনভিপ্রেত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ওকে। এসবের থেকে বোধহয় নিজের বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে সত্যিটা বললে, মা ঠিক বিশ্বাস করত। মা তো চেনে টুটাইকে।
নৈঋতের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে অহনা বললো, খেয়ে রেস্ট নিন, বিকেলের ট্রেনেই ফিরবেন। তার মধ্যে আমিই না হয় বাবাইকে বলবো আপনাদের বাড়িতে ফোন করে সত্যিটা বলতে, তাহলে আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারবেন। চলুন, ভিতরে চলুন। অহনারা যে বেশ অবস্থাপন্ন সেটা আগেই টের পেয়েছিলো নৈঋত। ওর বাবা তো রীতিমত সেলিব্রিটি। দীর্ঘদিন ধরে নামি সংবাদপত্রের ক্রীড়া সাংবাদিক। বেশিরভাগ সময় তো উনি দেশের বাইরেই থাকেন। অহনার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ হবার অনেক আগে থেকেই নৈঋত অনিরুদ্ধ পালকে চিনতো। ওনার খেলা বিষয়ক কলম পড়তো সেই স্কুল লাইফ থেকেই। তাই যেদিন ওদের বাড়িতে খুব সামান্য সময়ের জন্য আলাপ হয়েছিল সেদিনই নৈঋত বলে উঠেছিলো, আমি কিন্তু আপনাকে চিনতাম। মানে আপনার লেখা পড়ছি বহুবছর ধরে। ভদ্রলোক বোধহয় স্বল্পভাষী। স্মিত হেসে বলেছিলেন, আমার মেয়েকে দেখোনি টিভি চ্যানেলে?
নৈঋত হেসে বলেছিল, আগে চিনতাম না, মা দেখিয়েছিল একদিন। ভদ্রলোক বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ও আমার থেকেও অনেক বেশি নাম করবে একদিন, ওর মধ্যে সেই সম্ভাবনা আছে। নৈঋত বুঝেছিলো, বাবা মেয়ে বলতে অজ্ঞান। সেই বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নৈঋত যদি বলে, অহনার জন্যই আমি বিয়ের আসর থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছি তাহলে কি মেয়ে সোহাগী বাবা বিশ্বাস করবে, নাকি সবটা না শুনেই থাপ্পড় মারবে কে জানে! মেয়ের যা মারের হাত, বাবার যে থাকবে না তাই বা কে বলতে পারে। সুচেতাদেবী তো বলছিলেন, বাবাকে দেখেই নাকি মেয়ে ইন্সপায়ার্ড হয়ে এই প্রফেশনে এসেছে। তো বাবার মারপিট দেখেই হয়তো ক্যারাটে, কুংফু সব শিখেছে। বাবাও হয়তো ব্ল্যাকবেল্ট। হে ভগবান, এ কোন কুস্তিগিরদের বাড়িতে মা ওর বিয়ে দিচ্ছিল কে জানে!
অহনা আবার বললো, এটা আকাশ নয় আমাদের বাড়ির দেওয়াল, তাই তারা গোনার কিছু নেই। আসুন প্লিজ।
।।১৭।।
জামাটা গায়ে চাপাতে চাপাতেই খেয়াল করলো পীযুষ, প্রিয়া সেজেগুজে হাতে একটা ফাইল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা বেশ ডাগর হয়ে উঠছে আজকাল। মায়ের মতই সুন্দরী। তবে মায়ের মত রংটা পায়নি বরং ওর মত একটু শ্যামলা হয়েছে। মায়ের আরেকটা স্বভাবও পায়নি মেয়েটা। শান্ত, ধীর হয়নি মোটেই। পীযুষের এত মারের পরেও গোঙানির আওয়াজ ছাড়া তেমন কিছুই বেরোয়নি শিখার মুখ থেকে। সেখানে মেয়েটা যেন রনচণ্ডী হয়েছে। দুদিন গায়ে হাত দিতে গিয়েছিল পীযুষ, মেয়ে ঘর থেকে কাটারি বের করে বলেছিল, কেটে দু-আধখানা করে সর্বস্ব পুকুরের জলে ভাসিয়ে দেব। কাকপক্ষীতেও টের পাবে না। ওই পুকুরে স্নান করেই গায়ের রক্ত ধুয়ে নেব আমি। আর তোমার মত যমের অরুচি মরলে পাড়ার লোকও শান্তি পাবে, তাই তারাও খোঁজ করবে না। মনে রেখো আমি দীপশিখা নই, আমি প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাস, তোমার মত জানোয়ারেরই বাচ্চা, তাই আমার গায়েও কিছু গঙ্গার জল বইছে না। মেয়েটার সেদিনের রূপ দেখে ভয়ে ঘরে সেঁধিয়েছিলো পীযুষ। এতদিন পর্যন্ত কোনো জজ, ব্যারিস্টার, পুলিশ ,আমলাকে ভয় খায়নি পীযুষ কিন্তু নিজের মেয়েকে ভয় খেয়েছিল। সেদিন থেকেই মেয়েটাকে দেখলে একটাই কথা মনে হয়, ওর গুমোর শেষ করে দিতে হবে। ওই মেয়ে আবার বড়লোক বাড়ির ছেলেটার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে। অনিক দস্তিদার, দেখতে শুনতে ভালো, চাকরিও পেয়েছে, সে কেন পীযুষ বিশ্বাসের মেয়েকে পছন্দ করলো সেটা ভাবতে গেলেই ঠোঁটের কোণে থুতু জমে ওর। সব ছেলেরই একটাই জায়গায় চুলকানি, সেটা ও বেশ বুঝেছে। প্রিয়াকে এক-দুদিন ভোগ করবে তারপর বাড়ির পছন্দ বিয়ে করে কালী মন্দিরে পেন্নাম সারতে আসবে। তখন মা-মেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। বেশ হবে, ওই মেয়ের দেমাক কমবে। পীযুষ মেয়েছেলের দেমাক মোটে সহ্য করতে পারে না। সেই ছোটবেলায় স্কুলে এক দিদিমণিকে ওর খুব ভালো লাগতো। তাকে একদিন একটা গোলাপ ফুল নিয়ে গিয়ে দিয়েছিলো ও। দিদিমণি ফুলটা নিতেই ফুলের কাঁটায় দিদিমনির চাঁপাকলির মত আঙুলে রক্ত ঝরে। দিদিমণি ওই রক্ত মাখা হাতেই বেত নিয়ে পিটিয়েছিলো পীযুষকে। পিঠে লাল লাল দাগ করে দিয়েছিল। বাড়ি ফেরার পর দেখেছিলো, মা ওর বোনকে চুল বেঁধে দিচ্ছে। মাকে বলেছিল, দিদিমণি মেরেছে, পিঠ জ্বলছে। মা বোনের চুলে ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বলেছিল, বেশ করেছে মেরেছে, বদমাইসি করলে মারবেই।
ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে ও নিজের মা থেকে বোন সবাইকে মেয়েছেলে বলতে শুরু করেছিল। মা অনেক মেরেছে ওকে, মারতে মারতে মা ক্লান্ত হয়ে গেছে কিন্তু পীযুষ একইভাবে বলে গেছে, তুই মেয়েছেলে তোর মেয়েও মেয়েছেলে। মেয়েদের দেমাক পীযুষ সহ্য করে না। শিখা সেটা জানে বলেই পীযুষের সামনে কোনোদিন গলা তুলে কথা বলেনি, এতে শিখা মার হয়তো খেয়েছে কিন্তু মারা পড়েনি পীযুষের হাতে। কিন্তু প্রিয়াকে মরতে হবে, মরতে হবে প্রিয়াকে, এত দেমাক নিয়ে পীযুষের সামনে কোন মেয়ে চলতে পারে না। প্রিয়াকে শুনিয়ে বেশ জোরে জোরে বললো পীযুষ, এই যে শিখা, এবাড়ির সব খানকিকে বলে দিও, আমার টাকায় বসে বসে গিলবে আর আমার বুকের ওপরে দাঁড়িয়ে কথা বলবে এসব চলবে না।
প্রিয়া থমকে দাঁড়ালো দরজার সামনে, পিছন ঘুরে বললো, মা তোমার পূজনীয় পতিদেবকে বলে দিও, বিছানায় সুখ করে আমাকে যখন পৃথিবীতে এনেছিল তখন খাওয়াতেও হবে বৈকি। আর এমন বেজন্মার মেয়ে খানকিই হয়, সেটা নিয়ে আমি খুব বেশি ভাবছি না। বেশি গলাবাজি করলে সোজা গিয়ে পুলিশে খবর দেব, এসে তুলে নিয়ে যাবে, তারপর তোমার গরম জায়গায় রুলের বাড়ি মেরে ঠান্ডা করে দেবে, তাই আমার সামনে বেশি কপচিও না। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে, হাতের ফাইল সামলে হনহন করে বেরিয়ে গেল প্রিয়া।
কিছুক্ষণ স্থবিরের মত তাকিয়ে থাকলো পীযুষ। তারপরেই চোখ পড়ল রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে শিখা। ঠোঁটে একটুরো হাসি আছে নাকি দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো ও। এত বছর পীযুষকে জব্দ করতে পারেনি শিখা, তাই প্রিয়ার কাছে ওর পরাজয় দেখে নিশ্চয়ই খুশিই হয়েছে। পীযুষ বললো, হাসছিস নাকি শালী? মনে খুব ফুর্তি জেগেছে নাকি রে? কি মনে করেছিস, তুই আমার পয়সায় দুধ-কলা খাইয়ে জাত সাপ তৈরি করেছিস, ওর বিষে তুই আমায় মারবি মনে করেছিস নাকি রে? তাহলে ভালো করে শুনে রাখ, তোর মেয়েকে তুই সামলে রাখ, নাহলে এমন সর্বনাশ করবো ওর তখন ওর ওই নাগরও ওর মুখ দেখবে না।
একটু বোধহয় কেঁপে উঠলো দীপশিখা, সেদিকে তাকিয়ে বেশ জোরে হেসে উঠলো পীযুষ। শিখা স্বাভাবিক গলায় বলল, ভাত হয়ে গেছে খেয়ে বেরোবে তো?
পীযুষ কালো কালো দাঁত বের করে হেসে বললো, এই তো, এমন থাকবে বুঝেছো, তাহলে আর আমায় মারতে হয় না, শুধু মুধু নিজের হাতে ব্যথা করতে হয় না আমায়। আর তোমার ঐ গুণের মেয়েকেও একটু শিখিয়ে রেখো, বাবার পয়সায় যখন খাচ্ছে তখন তাকে সম্মান করতে হবে। শিখা ভাত বাড়তে বাড়তেই বললো, মেয়েটা বড় হয়ে গেছে, ওর বয়সী সবার তো বিয়ে হয়ে গেছে, ওর বিয়ের জন্য কিছু ভাবলে?
পীযুষ গরম ভাতে ডাল সেদ্ধ মাখতে মাখতে বললো, বিয়ে? কে বিয়ে করবে ওই বাচাল মেয়েকে?
লোকে তো একদিনের জন্য বিছানাতেও চাইবে না ঐরকম মুখরা মেয়েকে। সেখানেও লোকে নরম সরম মেয়েকেই চাইবে। শিখা দাঁত চেপে বললো, ও তোমার মেয়ে, নিজের মেয়ে সম্পর্কে এমন বলতে লজ্জা করে না তোমার! এঁটো হাতেই শিখার গালে একটা থাপ্পড় মেরে বললো, না করে না। একটা ভিজে ন্যাকড়াকে তোর বাবা আমায় গলায় বেঁধে দিলো, শালা এক ফোঁটা আগুন পেলাম না কোনদিন শরীরে, বিছানায় ভিজে কাঁথার মত পড়ে রইলি গোটা জীবনটা, তার মেয়ের শরীরে এত আগুন কোথা থেকে আসে রে? মেয়ের কাছ থেকে একটু আগুন ধার করে নিজের শরীরে নিস, আজ কাজ থেকে ফিরে পরখ করবো।
শিখা এঁটো গালেই বসে রইলো ঝিম ধরে। হাত ধুয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো পীযুষ। শালা, এই মা মেয়ের জন্য আজকাল মদের নেশাটাও ঠিক মত জমে না। কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়। এত দামি দামি মদ খেয়েও নেশা জমছে না। এদের জন্যই কপালটা ইদানিং একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। গত একমাস ধরে জুয়ায় হেরেই যাচ্ছে। মা-মেয়ের সারাদিনের অভিশাপেই হারছে ও।
তবে অনেক কষ্ট করে একটা খবর জোগাড় করতে পেরেছে ও। আন্দাজে তীরটা ছুঁড়েও দিয়েছে সেদিকে। দেখা যাক তীরের সঙ্গে কিছু টাকার নোট এসে জোটে কিনা ওর ভাঙা কপালে। রঙের মিস্ত্রি হিসাবে ওর নাম ডাক আছে এ অঞ্চলে। এ অঞ্চলে কেন, আশপাশের অনেক শহরেই ও কাজ করছে বহুদিন ধরে। বড়লোকের বাড়ি তো কম দেখলো না! শালাদের টাকা আছে, কিন্তু খরচের মন নেই। দেওয়ালে রঙের বেলায় দামি দামি কালার পছন্দ করে, আর শালারা মিস্ত্রিকে মুড়িতে একটা গজা কি শিঙারা দিয়েই কাজ শেষ। যদিও পীযুষ এখন আর ভাড়ায় উঠে রং করে না। গোটা ছয়েক লোক রেখেছে ও। এখন ও শুধু ইন্সট্রাকশন দেয়, কাজ ওরা করে। তবুও সেই ছোটবেলার অভ্যেস, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে সেই কবে রঙের কাজে হাত দিয়েছিল, তাই রং, স্পিরিট এসবের গন্ধ মদের মতোই নেশা ধরায় এখনও।
এই যে আশ্রয় কোম্পানির যে ফ্ল্যাটটার কাজে এখন হাত দিয়েছে রাইগঞ্জে, এর মালিক বেশ দিলদরিয়া পাবলিক। কাজ পছন্দ হলে মুড়ি চানাচুর নয়, মদের বোতলও দেয় মিস্ত্রীদের। নারায়ণ বোস পীযুষকে বলেছে, গ্রামের দিকে এখনো ফ্ল্যাট কালচার শুরু হয়নি। তাই রাইগঞ্জ থেকে সূর্যপুর, কালিয়াগঞ্জ, নীলপুর এগুলোতে পর পর ফ্ল্যাট বানানো শুরু করবে। বহু জায়গা কেনা আছে নারায়ণ বোসের। একদিন নিজেই বসে পীযুষের কাছে ওর খারাপ দিনের গল্প শুনিয়েছিলো লোকটা। সেদিনই বলেছিল, আগে রাইগঞ্জ, নীলপুর, দোগেছিয়ার স্টেশনের ধারে বসে সবজি বিক্রি করত। তারপর বাপটা অকালে মরে যেতেই তিনভাইয়ের মধ্যে জমি জায়গা ভাগ হয়ে গেল। দুই দাদা ভালো চাষের জমিগুলো নিয়ে ওকে চাষ না হওয়া দুটো ভিটে জমি দিলো বাস রাস্তার ধারে। একদিন নারায়ণ স্টেশনে বসে ফুলকপি বেচছে, তখন উৎপল বলে এক ভদ্রলোক এসে বলেছিল, শুনলাম নাকি রাস্তার ধারে তোমার জমি আছে? নারায়ণ অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে বলেছিল, আছে। কিন্তু সেখানে ভালো চাষ হয় না। তাই ভাগচাষ করবো বলে লাভ নেই, আগেই বলে দিলাম। উৎপল বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলেছিল, তোমার ঝুড়ির সব ফুলকপিগুলোর দাম কত? আমি যদি সবগুলো কিনে নিই তাহলে আমার সঙ্গে যাবে? নারায়ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিল, মানে? কোথায় যাবো? আমি গরিব বাড়ির ছেলে ঠিকই কিন্তু আমাদের পরিবারের সুনাম আছে, তাই যা-তা কাজ করতে পারবো না। উৎপল হেসে বলেছিল, না, চুরি ডাকাতি তোমায় দিয়ে হবে না। আপাতত আমায় তোমার জমিদুটো দেখাতে পারবে?
নারায়ণ একটু অবাক হয়েছিল লোকটির খামখেয়ালিপনায়। কিন্তু বাবা বলতো, কোনোদিন হাতের লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলবি না, তাহলে পরশপাথর পেয়েও হারাবি। ফুলকপিগুলো উৎপলকে বেচে দিয়ে ওকে সঙ্গে করে একটা রিকশায় চেপেছিলো নারায়ণ। তারপর জিটি রোডের ধারের প্রায় ধু ধু মাঠের পাঁচ বিঘে জমি দুটো দেখিয়েছিল। উৎপল উৎসাহিত হয়ে বলেছিল, এ জমির দলিল তোমার নামে? নারায়ণ জানতো উৎপলের আগ্রহ থাকবে না একটা চাষের পরেই। কারণ দিনরাত এক করে এবারে নারায়ণ জমিতে আলু চাষ করেছিল। শেষে ফসল তুলতে গিয়ে দেখেছিলো, বেশিরভাগ আলু দাগী আর কালো হয়েছে। পাড়ার গণ্য মান্য মানুষরা বলেছিল, ও পড়া জমিতে কি ভালো ফসল হয় নাকি? রাস্তা হওয়ার সময়েই ও জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে ও জমি পাথুরে হয়ে গেছে। ওখানে বাড়ি ঘর হলেও চাষ হবে না।
নারায়ণ বুঝেছিলো, দুই বিষয়ী দাদা ওকে ঠকিয়েছে। নিরুপায় হয়েই দাদাদের জমির ফসল বিক্রি করতো নারায়ণ স্টেশনে বসে।
উৎপলের কথায় নারায়ণ বলেছিল, হ্যাঁ দলিল-পরচা সব আমার নামে। উৎপল ওর হাত ধরে বলেছিল, তুমি আমার স্বপ্নের পার্টনার হবে। বিজনেস পার্টনার নয়, আমার দেখা স্বপ্ন সফল করার সঙ্গী হবে? নারায়ণ না বুঝেই বলেছিল, কিন্তু সব ফুলকপি তো বিক্রি করে দিয়েছি আপনাকে, আর তো কোনো সবজি নেই এখন আমার কাছে! উৎপল বুঝিয়ে বলেছিল, ও এই জায়গায় ফ্ল্যাট বাড়ি তুলতে চায়। খরচ ওর, জায়গা নারায়ণের। লাভ দুজনের সমান সমান। এই মুহূর্তে এত টাকা দিয়ে জায়গা কিনলে বাড়ি বানানোর টাকা আর থাকবে না উৎপলের কাছে। কেন কে জানে ওই পাগলা মত উৎপলকে সেদিন বিশ্বাস করেছিল নারায়ণ। সেই শুরু ওদের পার্টনারশিপের। বছর দুয়েকের মধ্যেই নারায়ণের জায়গায় তিনটে ফ্ল্যাট বাড়ি, সামনে লন নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। বাসস্ট্যান্ড আর স্টেশনের খুব কাছে, তাছাড়া পাশেই টিস্যু কারখানা থাকায় জমজমাট হতে সময় লাগেনি। কাগজে, টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল উৎপল। খুব তাড়াতাড়ি ওদের প্রায় সবগুলো ফ্ল্যাট বুক হয়ে গিয়েছিল। এত টাকা নারায়ণ এক সঙ্গে দেখেনি। উৎপল আর নারায়ণ একের পর এক জায়গা কিনেছিলো আর ফ্ল্যাট বানাচ্ছিলো। সেই থেকে স্টেশনের ধারে ফুলকপি বিক্রি করা নারায়ণ আজকের কন্ট্র্যাক্টর। এত বছরেরও ওর আর উৎপলের মধ্যে দোস্তি কিন্তু কমেনি, বরং বেড়েছে বিশ্বাস। ওদের আশ্রয় কোম্পানিতে এখন কাজ করে বেশ কিছু লোক। পীযুষের সঙ্গে নারায়ণের পরিচয় হয়েছিল এই ফ্ল্যাটবাড়ির রং করতে গিয়েই। নারায়ণ বলেছিল, তোমার কাজ আমার পছন্দ হয়েছে, কাস্টমারকে না ঠকিয়ে সৎ পথে ইনকাম করবে। মন দিয়ে যদি কাজ করো তাহলে কাজের অভাব হবে না। আশ্রয় কোম্পানির সব কাজ তোমায় দেব। যদিও আশ্রয়ের তখন এতটাও বাড়বাড়ন্ত হয়নি। পীযুষ তখন রাইগঞ্জের বাসিন্দা ছিল। বাড়ির কুলাঙ্গার ছেলে। এক দাদা পোস্টমাস্টার আরেক দাদা মাস্টার। পীযুষ মাধ্যমিক ফেল, এমনকি বোনটা পর্যন্ত বি.এ পাশ করেছিল। বাড়ির লোকজন লজ্জা পেত ওকে বিশ্বাসবাড়ির ছেলে বলে পরিচয় দিতে। পীযুষ অবশ্যই কোনোদিনই এসবের তোয়াক্কা করতো না। বোনটা পর্যন্ত বলেছিল, তোকে ভাইফোঁটা দিতে আমার ঘেন্না হয়। দুই দাদার সামনে মিষ্টি ধরে ফোঁটা দিত বোন, পীযুষ সেদিন বাড়িতে থাকতো ইচ্ছে করে, যদি কেউ ডাকে। মা বলতো, মদ, বিড়ি এসবের নেশাটা ছেড়ে দে তাহলেই তোকে সবাই আবার আগের মত ভালোবাসবে। বয়ে গেছে পীযুষের লোকের ভালোবাসা পেতে। মেয়েছেলে জাতটাকেই ঘেন্না করতো ও। বোন থেকে মা সবাই যেন ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতো। তাই রাস্তায় ডবকা মেয়ে দেখলেই পীযুষ তাকে নোংরা ইশারা করতো। ইভটিজিংয়ের দায়ে একবার জেলও হয়েছিল ওর। তখনও ওই নারায়ণ বোসই ওকে জামিন করিয়ে এনেছিল। রঙের মিস্ত্রি দরকার বলেই ওর খোঁজে এসেছিল বোধহয়।
নারায়ণ বোসের সঙ্গে এর আগেও পীযুষ কাজ করেছিল অনেকগুলো। তারপর বহুদিন বেপাত্তা ছিল ও রাইগঞ্জ বাজার থেকে। আবার এতদিন পরে ওর ”আশ্রয়” প্রজেক্টের কাজে ঢুকলো ও। এতদিন শুধু বাড়ি রংই করেছে, ফ্ল্যাটের কাজ করেনি। আবার এত বছর পরে ফ্ল্যাটের কাজে হাত দিয়েছে। এখানে টাকা বেশি। বিশেষ করে নারায়ণবাবুর মত লোক হলে তো কথাই নেই। ওকে দেখে নারায়ণবাবু বলেছিল, বহু বছর পর তোমায় দেখলাম। এদিকের বাজারে শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে শাদি করে সংসার পেতেছ। তাই আর খুঁজে বের করতে যাইনি। ভাবলাম অন্য কাজ পেয়েছো, হয়তো তাই এ চত্বর ছেড়ে দিয়েছ। পীযুষ হেসে বলেছিল, আজ্ঞে কাজ এখনও রঙেরই করি, তবে ঘরে মেয়ে বউ আছে যে এ কথা ঠিক। বয়েসও তো হলো বলুন।
নারায়ণবাবু রিমলেস চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ সরু করে তাকিয়ে বলেছিলেন, বয়েস হলেও স্বভাব বদলেছে বলে তো আমার মনে হচ্ছে না। কাজ দেব ঠিকই, কিন্তু এমন কিছু করবে না যেন বদনাম হয় আমার কোম্পানির। মনে রেখো এই চত্বরে আমরা নাম কামিয়েছি সততার দ্বারা।
পীযুষ হেসে বলেছিল, আমি এখন সংসারী মানুষ, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে সামনেই, এখন আর সেই বয়েস আছে স্যার? নারায়ণবাবু বলেছিলেন, মদের বোতল দেব কিন্তু অন্য ম এর দিকে যেন ঘুরেও তাকাতে না দেখি। দেখলেই বাতিল করবো কাজ থেকে।
জুয়ায় বেশ কিছু ধার হয়ে গেছে পীযুষের, তাই নারায়ণবাবুর এত কথা সহ্য করেও আশ্রয়ের কাজে ঢুকেছিলো ও। তবে এই মানুষটাকে ভিতর থেকে সম্মান করে ও। শূন্য থেকে একশোয় পৌঁছানো লোকদের ও হেব্বি সম্মান করে। আরেকটা সুবিধা আছে এই কোম্পানীতে কাজ করলে, আশ্রয়ের আইকার্ড গলায় ঝুলিয়ে পোস্ট অফিস থেকে ব্যাঙ্ক যেখানেই যাক না কেন কাজ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। আসলে ব্যাংকের সঙ্গে অনেক টাকার লেনদেন থাকে নারায়ণবাবুদের। তাই ওই কোম্পানির লোকজনকে একটু সম্মান দেয় ব্যাংক। এখান থেকে রাইগঞ্জ অনেকগুলো স্টেশন। প্রায় দেড়ঘণ্টার পথ, তাই ইদানিং কাজের পর বাড়িতে ফিরছিল না পীযুষ। ফ্ল্যাটেই সবার সঙ্গে থেকে যাচ্ছিল। মদ-মাংস নিয়ে বেশ কাটছিল। পরশু ফিরেছিল অনেকদিন পরে, ব্যাস মুডটা গেল চটকে। এই মেয়েছেলেগুলোর পাল্লায় পড়লে দামি মদের নেশাও টিকবে না। রাইগঞ্জের পাশেই নীলপুরে পীযুষদের দেশের বাড়ি। এত দিন ধরে রাইগঞ্জে আছে পীযুষ কিন্তু একদিনও দাদাদের কাছে যায়নি। লাস্ট বাড়ি গিয়েছিল মা মারা যেতে। তারপর আর কোনোদিনও যায়নি। শিখার কাছে শুনেছিল বড়দা নাকি একদিন গিয়েছিল ওদের বাড়িতে, তাও আর বাড়িমুখো হয়নি ও। বিয়ের পর অবশ্য মা বলেছিল, শিখাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকতে, কিন্তু বৌদিদের মুখভঙ্গি দেখে শিখাকে নিয়ে বাড়ি ভাড়া করে চলে গিয়েছিল ও।
সেই থেকেই নীলপুর, রাইগঞ্জ চত্বর ছেড়েছে পীযুষ।
সে বহু বছর আগেকার কথা। বেশ জোরে সাইকেল চালাচ্ছিল পীযুষ, দশটার ট্রেনটা ধরতেই হবে, নাহলে সবাই বসে ফাঁকি মারবে আর বিড়ি ফুঁকবে। শেষে নারায়ণবাবু ওকে এসে দোষারোপ করবে। আবার সপ্তাহখানেক বাড়ি ফিরবে না পীযুষ, কাজটা আরেকটু এগলে তারপর ফিরবে। তবে ওই মা মেয়েকে একেবারে বিশ্বাস করে না ও। পীযুষ না থাকলে হয়তো ঘরে লোক ঢোকাবে ওরা। তাই আচমকা হানা দিতে হবে বাড়িতে।
।।১৮।।
আমি কাল কলকাতা ফিরে যাব বৌদি। সুচেতার দিকে তাকিয়ে সৌমী বললো, চলে যাবে? কিন্তু মেয়েটা কোথায় গেল এখনও তো খোঁজ পাওয়া গেল না। সুচেতা জানে দাদা-বৌদি দুজনেই তেমন পছন্দ করে না সুচেতাকে। নেহাত বাবা মারা যাবার আগে এই বাড়িটা দুই ভাইবোনের নামে করে দিয়ে গেছে বলেই ”এ বাড়িতে ঢুকিস না” কথাটা এখনও বলে উঠতে পারেনি ওরা। যদিও সুচেতা এ বাড়িতে আসে হাতেগুনে। অহনা বড় হবার পর থেকে তো ওর স্কুল, পড়াশোনা, নিজের স্কুল সামলে আসাই হয় না। অহনা যখন ছোট ছিল তখন অনিরুদ্ধ বিদেশ ট্যুরে গেলে মাঝে মাঝে চলে আসত রাইগঞ্জের বাড়িতে। দাদা বৌদির ছেলে-মেয়ের সঙ্গে অহনার খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। টিনা আর তিপাইয়ের সঙ্গে দিনরাত খেলতো অহনা। এখান ছেড়ে কলকাতায় যেতেই চাইতো না। সুচেতার ছোটবেলাতেই মা মারা গিয়েছিল কিডনির রোগে। তখন ডায়ালিসিস ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। তাছাড়া রাইগঞ্জের হসপিটালে ট্রিটমেন্টও তেমন হতো না। ছয়মাস ধরে ভুগে ভুগে মা মারা গিয়েছিল। সুচেতা তখন ক্লাস এইটে পড়ে। রাইগঞ্জ স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুশোভনবাবু মানুষটা চিরকালই অগোছালো, সংসারী ছিলেন না কোনোদিনই। চিরটা কাল স্কুল স্কুল করেই মেতে থাকতেন। সুচেতার মা বেঁচে থাকতে সংসারের দিকে তাকাতেও হয়নি কোনোদিন। এবারে লক্ষীহীন সংসারে এলোমেলো উদাসীন মানুষটা পড়েছিলো মারাত্মক বিপদে। সুচেতা আর তার থেকে বছর তিনেকের বড় দাদা সোহমকে নিয়ে সংসারযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সুশোভনবাবু। অপটু হাতে কাজ করতে করতে মাঝে মাঝেই বলতেন, এ তোমার কেমন বিচার কমলিনী, আমাকে এভাবে একা করে দিয়ে চলে গেলে তুমি? সোহম ছিল মা ন্যাওটা। মা ছাড়া তার এক মুহূর্তও চলতো না। তাই ক্লাস ইলেভেনের সোহম মা চলে যাবার পরে একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। সুচেতা ছোট থেকেই বাবার পায়ে পায়ে ঘুরত। বড্ড ভালো লাগত বাবা নামক মানুষটার আদর্শ। বিনামূল্যে ছাত্রদের পড়ানো থেকে শুরু করে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পড়াশোনার খোঁজ নেওয়াটাও বাবার কাজ ছিল। মা বলতো, সরকার কি শুধু তোমাকেই মাইনে দেয় নাকি? আর কাউকে তো দেখি না ছুটির দিনে ছাত্রদের খোঁজ করতে বেরিয়েছে?
সুশোভনবাবু হেসে বলতেন, ওগো কমলিনী আমায় কেউ মাইনে দেয় বলে আমি এসব করি না। করি যে মাটিতে জন্মেছি তার ঋণ শোধ করার জন্য। এ মাটির কয়েকটা ছেলেমেয়েকেও যদি মানুষ করে গড়তে পারি তবেই হবে ঋণশোধ। ঋণী থাকতে আমার বড় ভয় হয়। পরপাড়ে গিয়ে জবাব দিতে হবে যে। খাওয়া-দাওয়া আয়েশ করা ছাড়া মাতৃভূমির জন্য আমি কি করে এসেছি? তাই তো এ জন্মে ঋণ চুকিয়ে দিয়ে যেতে চাই।
মা গজগজ করতে করতে বলতো, চিরটা কাল মানুষটা একগুঁয়ে থেকে গেল, নিজের ভালো বুঝলো না। সংসারের দিকে তাকালো না, দশের ভালো নিয়ে মেতে থাকলো। বাবা আদর করে বলতো, ওগো কমলিনী সংসারের জন্য তো তুমি একাই একশো গো, আমার দশভুজা। সুচেতা জানতো, মা সামনে যতই বাবাকে বকুক ঝকুক মনে মনে অনেকটা সম্মান করতো। তাই তো বাবা ফেরার আগে সুচেতাকে বলতো, বাথরুমে তোর বাবার গামছা, ধুতি এগুলো রেখে আয়, এত ক্লান্ত শরীরে ফেরে মানুষটা, আর কি দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকে!
সুচেতা ছোট থেকেই বাবার আদর্শে বড় হয়েছে, তাই শিক্ষকতা করার গোপন ইচ্ছেটা ও লালন করেছিল সেই মেয়েবেলা থেকেই। যদিও মা বলতো, মেয়েদের বেশি পড়ার দরকার নেই, সোহম পড়ুক, ওকে চাকরি করতে হবে, তোকে উচ্চামাধ্যমিকটা পাশ করিয়ে সম্বন্ধ দেখতে শুরু করবো। মায়ের এই কথাটা শুনলেই বুকটা কেঁপে উঠতো স্কুলের ভালো ছাত্রী সুচেতার। একদিন চুপি চুপি বাবার কানে গিয়ে নালিশও করে এসেছিল। বাবা, মা বলছে আমায় নাকি পড়াবে না বেশি দূর। দাদাকে পড়াবে আমার নাকি বিয়ে দিয়ে দেবে। বাবা একমুখ হেসে বলেছিল, তুই বাবাকে বিশ্বাস করিস তো? তাহলে আজ গীতার সামনে দাঁড়িয়ে তোকে কথা দিলাম, তুই যতদূর পারবি আমি তোকে পড়াবো। যদি ইচ্ছে হয় তবে বিয়ে করবি না হলে করবি না। ক্লাস সেভেন এইটের সুচেতা বুঝেছিলো, এই মানুষটার কথার দাম অনেক।
কিন্তু এই দৃঢ়চেতা মানুষটাই মায়ের মৃত্যুর পর বেশ ভেঙে পড়েছিলো ভিতরে ভিতরে। সামনে যতই শক্ত থাকার চেষ্টা করুক না কেন, ওদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে কিভাবে সংসার আর স্কুল সামলাবে সেটাই ছিল চিন্তার বিষয়। রাতের অন্ধকারে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বাবা বলতো, কমলিনী এভাবে শোধ নিলে তোমাকে অবহেলা করার? এভাবে মাঝ সমুদ্রে ডুবিয়ে দিলে আমার ছোট নৌকাটাকে? তুমি তো জানতে ধ্রুবতারা ছাড়া নাবিক দিকভ্রান্ত হবে, হারিয়ে যাবে মাঝ দরিয়ায়, তারপরেও কেন চলে গেলে কমলিনী? বাবার ডুকরে কান্নাটা বুকে এসে বেজেছিলো সুচেতার। একদিকে মা হারানোর কষ্ট, অন্য দিকে বাবার ভেঙে পড়াতে ক্লাস এইটেই শৈশব ছেড়ে রাতারাতি প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে গিয়েছিলো সুচেতা। বাবার হাত ধরে বলেছিল, চিন্তা করো না, আমি তো আছি। ওইটুকু বয়েসে অত মনের জোর যে কোথা থেকে পেয়েছিলো সেটা বোধহয় ও নিজেও জানতো না। বাবাও অবাক হয়ে তাকিয়ে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরেছিল সুচেতার হাত, বলেছিল পারবি? তোকে দেখতে পুরো তোর মায়ের মত। তোর গলার স্বরটাও তোর মায়ের মতন, তুই যখন বলছিস নিশ্চয়ই পারবি।
পিসি, মাসিরা পালা করে ছিলো কিছুদিন, কিন্তু সকলেরই সংসার আছে তাই ওদের সংসারের দায়িত্ব নিয়ে কেউ পড়ে থাকতে পারে না। বাধ্য হয়েই সুচেতা শিখে নিয়েছিল সংসারের খুঁটিনাটি। ভোরে উঠে নিজের পড়াশোনা করে রান্নাঘরে ঢুকে সকলের জন্য চা করতো, তারপরে ঢুকত জবাদি। কি রান্না হবে জবাদিকে বুঝিয়ে দিয়ে স্কুলের জন্য বইখাতা গুছিয়ে নিত। সবার টিফিন ভরে, স্নান সেরে স্কুলে ছুটতো। এভাবেই কি করে যেন মা চলে যাবার পরেও ঝড়ের গতিতে কেটে গিয়েছিল সুচেতার দিনগুলো। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, হুল্লোড় এসবের বাইরেও দায়িত্ব নামক এক ভারী বোঝা কাঁধে কেটেছিল ওর স্কুলবেলা। বাবা আবার মেতে উঠেছিলো ভালো ছাত্র তৈরির কাজে। সোহম তখন কলেজ স্টুডেন্ট, নিজের মধ্যেই নিজের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। চিরকালের একটু ইন্ট্রোভার্ট সোহম বাড়িতে বাবা বা বোনের সঙ্গে তেমন কথা বলতো না কোনোদিনই। মায়ের সঙ্গেই ছিল তার মনের আদানপ্রদান। তাই মা মারা যাবার পরে সংসারের দায়িত্ব সুচেতা নিলেও সোহমের কাছে কোনোদিনই আদরের বোন হয়ে উঠতে পারেনি। বরং ও বাবার প্রিয় ছিল বলেই হয়তো দূরত্বটা রয়েই গিয়েছিল দাদার সঙ্গে। ভাইবোনের খুনসুটি শেষ হয়েছিল বোধহয় ক্লাস টু-থ্রিতে। তারপর সুচেতার থেকে একটু কম মেধাবী সোহম বোনকে বোধহয় প্রতিযোগীর আসনে বসিয়ে ফেলেছিল নিজের অজান্তেই। সুচেতাও দাদাভাই বলে জড়িয়ে ধরতে পারেনি সোহমকে। স্কুল যাওয়ার আগে দাদার টিফিন গুছিয়ে দিয়েছে, দাদাকে ভাতের থালা সাজিয়ে দিয়েছে যত্ন করে, জন্মদিনে মায়ের পরিবর্তে ও পায়েস রান্না করেও দিয়েছে দাদাকে তবুও কেন কে জানে মনের দূরত্বটা কোনোভাবেই কমিয়ে আনেনি সোহম। সুচেতাও সংকোচে সরেই গিয়েছিল ক্রমশ। সোহম নিজের পছন্দের সাবজেক্ট ইংলিশ নিয়ে পড়তে শুরু করেছিল। সুচেতাও উচ্চমাধ্যমিকের পর পছন্দের সাবজেক্ট নিয়ে শুরু করেছিল কলেজ জীবন। ওর জীবনের বেস্ট টাইম কলেজ জীবনটা। না, অনিরুদ্ধর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বলে নয়। রায়গঞ্জের মফঃস্বল ছেড়ে, কাকা, জ্যাঠাদের ধারণা ”মেয়েদের এত পড়ার কি দরকারের” গন্ডি ছাড়িয়ে কলকাতার কলেজে ভর্তি আর হোস্টেলের ছোট ঘরে আরও দুজন রুমমেটের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করার লড়াইয়ে জিতে গিয়েছিল সুচেতা। সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাই ছিল সব থেকে বড় লড়াই। জবা ততদিনে ওদের সংসারের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। স্বামী পরিত্যক্তা জবাদি সুচেতার বাবাকে কাকু বলে ডাকলেও সম্মান করতো ঈশ্বরের মতই। বলতো, কাকু না থাকলে আমায় ওরা পিষে মারত। জবাদির মত সৎ মেয়ের হাতে রাইগঞ্জের বাড়ি, বাবা, দাদার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে কলকাতায় আসতে পেরেছিল সুচেতা। সোহম প্রথমেই বলেছিল, আমি রাইগঞ্জ ছেড়ে কোথাও যাবো না। তাই ও ভর্তি হয়েছিল নীলপুরে কলেজে। মাঝে দুটো স্টেশন ও ট্রেনেই যেত কলেজ। সুচেতার উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের পরে বাবা কানে কানে বলেছিল, আমার একটা স্বপ্ন ছিল, তুই পূরণ করবি সুচেতা?
বাবাকে ওভাবে ছেলেমানুষের মত আব্দার করতে কখনো দেখেনি সুচেতা। তাই ঘাড় নেড়ে বলেছিল, আমি তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করার চেষ্টা করবো বাবা। বাবা একটু নীরবে থেকে বলেছিল, তুই প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হবি? আমার খুব শখ ছিল প্রেসিডেন্সি থেকে পড়াশোনা করবো। কিন্তু নীলপুরে কলেজেই পড়তে হয়েছিল আমায়। গায়ে মফস্বলের গন্ধ মাখা সুচেতা বাবার হাতটা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, কিন্তু আমি চলে গেলে তোমার, দাদার কে যত্ন নেবে বাবা?
বাবা নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল, সোহম তো নিজের নিয়েই ব্যস্ত, আমিও তো সারাদিন স্কুল আর স্কুলের কাজ নিয়েই মেতে থাকি, বাড়িতে জবা আছে, ও ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। তাছাড়া তোর জেঠু বলছিলো, ভালো সম্বন্ধ আছে, সূচীর বিয়ে দিবি শুভ? বিয়ে দিলে তো তুই আর এ বাড়ি আঁকড়ে পড়ে থাকবি না। ধরে নে তোর বিয়েই দিয়ে দিলাম, তুই চলে গেলি কলকাতা। ক্লাস এইট থেকে এ সংসারের অনেক দায়িত্ব তুই পালন করেছিস রে। এবারে তোর স্বপ্নপূরণ করার দায়িত্ব আমার। শুধু তোর নয়, আমার অপূর্ণ ইচ্ছেটাও তুই পূরণ করে দিবি। সুচেতা বাবাকে কখনো এমন আবেগী গলায় কথা বলতেই দেখেনি, এ যেন দু-চোখে স্বপ্ন আঁকছে বাবা সুচেতাকে কেন্দ্র করে। তাই মনের সমস্ত দ্বিধা নিমেষে সরিয়ে ও বলেছিল, যাবো। বাবা উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, তাহলে আমি গিয়ে ফর্ম নিয়ে আসবো তোর রেজাল্ট নিয়ে গিয়ে।
কদিনের মধ্যেই বাবা ওকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিল বিশাল ক্যাম্পাসের কলেজটাতে। সেই শুরু সুচেতার কলকাতা জীবন। গা থেকে মফস্বলের গন্ধ মুছে নিজেকে শহুরে করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টায় ও তখন মশগুল। জীবন মানে রাইগঞ্জের বাজার নয়, এটা ও তখন বুঝতে শুরু করেছে। আশপাশের বন্ধুদের দেখে নিজেকে একটু একটু করে বদলানোর চেষ্টা করছিল সুচেতা। না বদলালে ও টিকে থাকতে পারবে না এখানের পরিবেশে, সেটুকু ও বেশ বুঝতে পেরেছিল। মনের ভিতরে সবুজটুকুকে বাঁচিয়ে রেখেই বাইরে ঘষে মেজে তৈরি করেছিল নিজেকে। পোশাক, কথা বলার ভঙ্গিমা, হাঁটাচলার স্টাইল সব রপ্ত করতে হবে ওকে। শুধু পড়াশোনা করলেই চলবে না। আরো অনেক কিছু শেখার আছে। এই একটু একটু করে ওর স্বপ্ন পূরণের দিনে অচমকাই দেখা হয়েছিল অনিরুদ্ধর সঙ্গে।
দেখাটা নেহাতই কাকতালীয়ভাবে হয়েছিল। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আনমনে চলে গিয়েছিল কলেজস্ট্রিটের একটা পুরোনো বইয়ের দোকানে, মনে পড়েছিলো ওর নিজের কিছু বই কেনার দরকার আছে। এটা ওটা ঘাঁটাঘাঁটি করার সময়েই একটা ছেলে এসে পিছন থেকে বলেছিল, এই যে মিস আপনার গলার চেনটা। চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে সুচেতা দেখেছিলো বেশ সুদর্শন একটি ছেলের হাতে ওর গলার লকেটওয়ালা সোনার চেনটা। ছেলেটির ডান হাতে ওর চেন আর বাঁ হাতে আরেকটা অল্পবয়সি ছেলের হাত ধরা আছে বেশ শক্ত করে। ছেলেটির মুখে কাতরতা। হাতে বেশ লাগছে সেটা ওর মুখভঙ্গিমা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সুচেতা জিজ্ঞেস করেছিল, আমার গলার চেন আপনার কাছে কি করে গেল?
ছেলেটি হেসে বলেছিল, ভায়া হয়ে। এই যে বীরপুরুষকে দেখছেন, এই মহারাজ আপনার অন্যমনস্কতার সুযোগে গলা থেকে এটা কুটুস করে কেটে নিয়ে দৌড়াচ্ছিলো। কিন্তু রিপোর্টারের শ্যেন নজরে পড়ে বেচারার আজকের বাজারটা নষ্ট হয়ে গেল। নিন চেনটা ধরুন, একে আমি থানায় চালান করে দিয়ে আসি। পকেটমার ধরায় আমার এক্সট্রা কোয়ালিটি আছে আমি নিজেও জানতাম না। না জেনেই এই নিয়ে তিনজনকে ধরলাম। সুচেতা চেনটা নিয়ে বলেছিল, কিন্তু আপনার পরিচয়টা তো….
আমার নাম অনিরুদ্ধ পাল, স্পোর্টস রিপোর্টার। সদ্য একটা দৈনিক পেপারে জয়েন করেছি। সুচেতা কিছু বলার আগেই বলেছিল, আরেকটু সচেতন হয়ে চলাফেরা করবেন। অনিরুদ্ধর হাত ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল পকেটমারটা। অনিরুদ্ধ ভিড় ঠেলে তাকে আবার ধরে ফেলল অদ্ভুত কায়দায়। ছেলেটা ছুরি বের করেছিল, সেটাও কিভাবে যেন কব্জির জোরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল অনিরুদ্ধ। তারপর তাকে টানতে টানতে হারিয়ে গিয়েছিল কলেজস্ট্রিটের গলিতে। সুচেতা তখনও কেমন ঘোরের মধ্যে ছিল। কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, কখন ওর হারটা কেটে নিলো ছেলেটা! আর কখনই বা অনিরুদ্ধ নামের ছেলেটা এই চোরটাকে ধরলো?
দোকানদার সুচেতার দিকে তাকিয়ে বলল, ওই স্যার আপনাকে পিছন থেকে ডাকছিল, আপনি শুনতেই পাননি। তারপর ছুটে গিয়ে ওই চোরটাকে ধরলেন।
কি বই দেব দিদিমণি?
সুচেতা বলেছিল নেক্সট ডে এসে নেব বই, আজ চলি।
হোস্টেলে ফিরে বান্ধবীদের বলেছিল আজকের বিকেলের বইপাড়ার গল্পটা। কিন্তু কেউই তখন অনিরুদ্ধ পালের সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারেনি। স্পোর্টস নিয়ে কোনোদিনই কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না সুচেতার। বরং খবরের কাগজ পেলেই মুভির পাতাটা একবার চোখ বুলিয়ে নিতো। কেন কে জানে তারপর থেকে একবার করে স্পোর্টসের পাতাটাও চোখ বুলিয়ে নিত। তারপরেই বার তিনেক গেছে বই পাড়ায় কিন্তু ওই রিপোর্টারের দেখা মেলেনি। সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে যখন অনিরুদ্ধর নামটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সুচেতা তখনই একদিন নামি কাগজের স্পোর্টসের পাতায় নিজস্ব প্রতিনিধির জায়গায় দেখেছিলো অনিরুদ্ধ পালের নামটা। আবারও বছর খানেক আগের বিকেলের স্মৃতিটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। কাগজের অফিসে ফোন করে অনিরুদ্ধর ফোন নম্বর চেয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ফোনটা ধরে থাকার পরে কেউ একজন কেজো গলায় বলেছিল, এভাবে আমাদের সিনিয়র রিপোর্টারের ফোন নম্বর আপনাকে দেওয়া যাবে না। বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দেওয়ার আগে সুচেতা বলেছিল, উনি আমার পরিচিত। কেটে গিয়েছিল ফোনটা।
সেদিন ছিল এক বৃষ্টি ভেজা দুপুর। কলেজ থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে কফিহাউসে বসেছিলো সুচেতা। হঠাৎই কেউ একজন কানের কাছে বলে উঠেছিলো, যাক, আজ চেনটা যাহোক গলাতেই আছে। বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠেছিলো সুচেতার। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলে উঠেছিলো, আমি তো আপনাকে অনেক খুঁজেছি….কিন্তু…
অনিরুদ্ধ স্মার্টলি হেসে বলেছিল, কেন খুঁজছিলেন? আংটি, কানের দুল কিছু হারিয়েছেন বুঝি?
সুচেতার দিকে অন্য বন্ধুরা তাকিয়েছিল। কেয়া আলটপকা বলেছিল, এই সেই স্পোর্টস রিপোর্টার? যার জন্য তুই আজকাল তিনটে নিউজ পেপার নিচ্ছিস?
ইস, কেয়াটা যে কি করে না! লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিয়ে সুচেতা বলেছিল, না অন্যকিছু হারাইনি, তবে সেদিন একটা ধন্যবাদও দেওয়া হলো না তাই আর কি। এটা আমার মায়ের স্মৃতি, তাই হারিয়ে গেলে সোনা হারানোর থেকেও বেশি কষ্ট পেতাম আমি আর বাবা।
অনিরুদ্ধ পাশের মেয়েগুলোর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে বলেছিল, তো আজ যখন কফিহাউসের টেবিলে হঠাৎ দেখা হয়েই গেল তখন টুকটুক করে এক রানই নেবেন? নাকি ওভার বাউন্ডারির ইচ্ছে আছে? সুচেতা না বুঝেই ভ্রু কুঁচকে বলেছিল, বুঝলাম না, আরেকবার বলুন….অনিরুদ্ধ স্মার্টলি বলেছিল, এই কথাটা যখন বোঝেননি, তখন এটার রিপিট করে আর লাভ নেই। আমি বরং অন্যভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। শুকনো ধন্যবাদ দিয়েই বিদেয় করবেন? নাকি কফি, ফিসফ্রাই অবধি টানবেন ধন্যবাদটাকে, সেটাই জিজ্ঞেস করছি। আমি কফি অর্ডার করার আগে ট্রিট পাবার লক্ষণ আছে কিনা সেটা আরেকবার শিওর হয়ে নিচ্ছিলাম, এই আর কি।
কেয়া ফিসফিস করে বললো, সূচী কি হ্যান্ডু রে ছেলেটা। তবে মারাত্মক স্মার্ট কিন্তু বস, একটু ধরে খেলিস। মানে টেস্ট খেলিস, ওয়ানডের রিস্ক নিস না। প্রথমেই আউট হয়ে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন, বুঝলি?
সুচেতা অনিরুদ্ধর দিকে বোকার মত তাকিয়ে বলেছিল, না, না, আমি ট্রিট দিচ্ছি। বলুন কি খাবেন?
অনিরুদ্ধ হেসে বলেছিল, তাহলে তো আপনাকে আমার টেবিলে এসে বসতে হয়, ট্রিট দেবেন আপনি, আর খাবেন অন্যদের সঙ্গে, তা কেমন করে হয়? অবশ্য যদি আপনার বন্ধুদের আপত্তি না থাকে তবেই। নাহলে আমি কাবাবের মধ্যমণি না হয়ে একপেশে হাড্ডি হয়ে সরে যাবো।
রূপালী কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে সুচেতার কানে কানে বলেছিল, তুই আউট হয়ে গেছিস অলরেডি। তাই ব্যাটিংয়ের আশা ছেড়ে দিয়ে বোলিং করার জন্য রেডি হ।
কেয়া বললো, যা ওঠ, বসে থাকিস না ভ্যাবলার মত। প্রায় দু-বছর আমরা অনেক চেষ্টা করে তোকে গড়ে-পিঠে নিয়েছি, আজ অন্তত মাঠে থাকিস প্লিজ, গ্যালারিতে দর্শকাসন অলংকৃত করিস না দয়া করে।
সুচেতা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল অনিরুদ্ধর টেবিলের দিকে। টেবিলে বসতেই অনিরুদ্ধ বলেছিল, তাহলে ফিসফ্রাই আর কফি অর্ডার করি? ব্ল্যাক কফি না মিল্ক কফি কোনটা বলবো আপনার জন্য?
সুচেতা ভীতু গলায় বলেছিল, মিল্ক কফি। সুচেতা বরাবরই নির্বিবাদী শান্ত মেয়ে নামেই পরিচিত ছিল রাইগঞ্জে। কোনোদিন কারোর মুখের ওপর কিছু বলে উঠতে পারলো না। অন্যায় দেখলেও মুখ বুজে সহ্য করে নিতো। সোহম তাও গোঁজ হয়ে নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিত, কিন্তু সুচেতা দুদিন পরে সব ভুলে আবার তার উপকার করতো। সেই ছোট থেকেই দায়িত্ব কর্তব্যের ভারে বাঁচতে বাঁচতে কবে যেন অপ্রিয় সত্য বলার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলেছিল ও। বন্ধুরা বলে, তোর সমস্যাটা কোথায় জানিস? তুই আনস্মার্ট নোস, তুই বড্ড ভীতু। সবেতেই তোর ভয়, তাই নিজেকে গুটিয়ে রাখিস বেশি, আর মনে করিস তুই মফঃস্বলের মেয়ে তাই শহরে অ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধা হচ্ছে!
সুচেতা জানে ও একটু ভীতু। বেশি চেঁচামেচি, ঝগড়া এসব শুনলেই ওর ভয় করতো ছোট থেকে।
ওর গলার জড়তা লক্ষ্য করেই অনিরুদ্ধ বললো, রিল্যাক্স, আমি মিডিয়ায় আপনার ছবি ছাপাতে আসিনি। তাই মুখটা অমন কাঁচুমাচু করে রাখবেন না। আর শুনুন, যদিও কারোর ব্যক্তিগত রুচিতে ইন্টারফেয়ার করা আমি পছন্দ করি না, তবুও বলছি, কখনো ব্ল্যাক কফি খেয়ে দেখবেন। এখানের ব্ল্যাক কফির এতটাই নিজস্বতা আছে যে দুধ মিশিয়ে নিজের রূপ বাড়াতে হয় না। যেমন কারোর কারোর চোখে এমন সৌন্দর্য থাকে যে কাজল লাগে না। সুচেতার চোখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল অনিরুদ্ধ। সুচেতা আরও লজ্জিত হয়ে টেবিলের বার্নিসের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। অনিরুদ্ধ গলার টোন সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে বলেছিল, আপনি লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটে বিশ্বাসী? মানে প্রথম দর্শনে প্রেমে বিশ্বাস করেন?
সুচেতা ঠিক কি বলবে না বুঝে বলেছিল, না, বিশ্বাসী নই।
অনিরুদ্ধ একটু গম্ভীরভাবে বলেছিল, আমিও বিশ্বাস করতাম না এতদিন।
সুচেতা একটু সাহস করে বলেছিল, এতদিন করতেন না, মানে এখন করেন?
অনিরুদ্ধ হেসে বলেছিল, মাঝে মাঝে নিজের চেনা জানা সব হিসেব নিকেস ওলটপালট হয়ে যায়। তখন মন আর মাথার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। মন অবাধ্যতা করে আর মস্তিস্ক স্নায়ুকে শক্ত করে ধরে রাখতে চায়। চলে মারাত্মক লড়াই, কে যে জিতবে কে জানে!
সুচেতা ফিসফ্রাই কামড়ে বললো, কে জিতলে আপনি খুশি হবেন?
অনিরুদ্ধ কফির কাপটা নামিয়ে বললো, আমি মাথাকে জেতাতে চাইছি আপ্রাণ, কিন্তু মন জিতলেই বেশি খুশি হই।
সুচেতা নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে বললো, এমন প্রেমে কি আপনি প্রায়শই পড়েন? মানে প্রথম দেখায় প্রেম বলেই জিজ্ঞেস করলাম। অনিরুদ্ধ হেসে বললো, না, যারা যারা আমার নিউজ অফিসে কল করে উদ্বিগ্ন হয়ে আমার খবর জানতে চায় শুধু তাদের প্রেমেই পড়ি।
সুচেতা ছটফট করে বলে ফেললো, আপনাকে কে বলল, আমি কল করেছিলাম?
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, ম্যাডাম রিপোর্টারের জব করি, চোখ কান খোলা না থাকলে পেট চলবে কি করে?
কিন্তু আপনিই তো বলেছেন, আমি নাকি আপনার পরিচিত, এখন এমন অপরিচিতর মত ব্যবহার করছেন কেন?
সুচেতাকে লজ্জা দিয়ে অপ্রস্তুত করেই যেন অনিরুদ্ধর আনন্দ। সুচেতা ব্যাগ খুলে বিল পেমেন্ট করতে গেলে অনিরুদ্ধ বললো, আমি পেমেন্ট করে দিয়েছি। আর ওই যে পার্সেলটা নিন, ওটা আপনার বন্ধুদের জন্য। যারা আপনাকে টেস্ট ম্যাচ খেলার পরামর্শ দিয়ে এই টেবিলে পাঠালো। সুচেতা কোনোমতে বললো, কিন্তু ট্রিট তো আমার দেবার কথা।
অনিরুদ্ধ বললো, পার্থিব জিনিস খুঁজে পেয়েছেন বলে ট্রিট না দিয়ে যদি কখনো অপার্থিব জিনিস হারিয়ে যায় আর কিছুতেই তাকে খুঁজে না পান, তখন না হয় আপনি ট্রিট দেবেন। সুচেতা লজ্জায় অধোবদন হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিছুতেই চেষ্টা করেও অনিরুদ্ধর দিকে তাকাতে পারছিল না সোজাসুজি।
কলেজ আর ডিপার্টমেন্টটা তো জানলাম, কিন্তু আপনার বাড়িটাই তো জানা হলো না। সুচেতার বাড়ি রাইগঞ্জ শুনে অনিরুদ্ধ বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলেছিল, সূর্যপুরে আমার বাবার একটা ছোট কটেজ আছে। বাবা মারা যাবার পরে ওখানে আর কেউ থাকে না। আমি ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম কয়েকবার। ইচ্ছে আছে সুবর্ণ নদীর ধারে ওই ছোট কটেজটাকে বড় করে একটা বাড়ি বানাবো। দিয়ে রিটায়ারমেন্টের পরে ওখানেই আত্মগোপন করবো। মানে অবসর কাটাবো আরকি। ওই রুটে বেশ কয়েকবার গেছি, তখনই যদি রাইগঞ্জে একবার নেমে পড়তাম তাহলে হয়তো পরিচয়টা আরও আগেই হয়ে যেত, তাই না?
অনিরুদ্ধ একটা কার্ড ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, এতে আমার অফিসের আর বাড়ির দুটোরই ফোন নম্বর আছে। টেস্ট ম্যাচে কাজে লাগতে পারে।
সুচেতা বললো, আমি আসছি, ওরা ওয়েট করছে।
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, আমিও করবো, অপেক্ষা।
সুচেতার গালে সেই মুহূর্তে কৃষ্ণচূড়ারা নিজেদের রং উজাড় করে দিয়েছিল। অনিরুদ্ধর সামনে থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলো ও। সারা রাস্তা রূপালী আর কেয়ার হাজার প্রশ্নের উত্তরে ও শুধু একটা কথাই বলেছিল, ভালোলাগা আর ভালোবাসায় বিস্তর ফারাক তাই না রে? কেউ কেউ বোধহয় ভালোলাগাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করে, তাই না? কেয়া বিজ্ঞের মত বলেছিল, জটিল কেস, অবজার্ভেশনে রাখতে হবে। অনিরুদ্ধকে প্রথম দেখাতেই সুচেতারও ভালো লেগেছিল। নিজে ভীতু বলেই বোধহয় সাহসী আর স্মার্ট অনিরুদ্ধ ওর মনে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছিল। কলেজে ক্লাসের ফাঁকে অনিরুদ্ধর বলা কিছু কথা বারবার মনে পড়া সত্ত্বেও সংকোচের বশেই ওর দেওয়া কার্ডটা নিজের ব্যাগে নিয়ে ঘুরলেও ফোনটা আর করা হয়ে ওঠেনি। অনিরুদ্ধর সঙ্গে দেখা হওয়ার একমাস অতিক্রান্ত। সেকেন্ড ইয়ারে এক্সামের ঠিক আগে আগেই একদিন কলেজের একজন স্টুডেন্ট এসে বলেছিল, দিদি তুমিই সুচেতা তাই না? কবাডি চ্যাম্পিয়ন? রাইগঞ্জে বাড়ি? একজন স্পোর্টস রিপোর্টার এসেছেন তোমার ইন্টারভিউ নিতে। ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, তোমাকে একবার দেখা করতে বললেন। দিদি তোমাকে দেখে বোঝাই যায় না তুমি কবাডি চ্যাম্পিয়ন।
সুচেতা বলতে যাচ্ছিল, জীবনে লুকোচুরি আর লুডো ছাড়া আর কোনো গেম ও কখনো খেলেইনি। কবাডি তো স্বপ্নেও আসেনি কোনোদিন। কিন্তু ক্যান্টিনের অনেকেই তখন ওর দিকে সুপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে সুচেতা বলেছিল, আপাতত আর খেলি না। সে অনেক দিন আগের কথা।
রূপালী কানের কাছে বলেছিল, অনিরুদ্ধ ওয়েট করছে, তুই যা। আবারও বলছি, আস্তে খেলিস মেরি মা। এ তোকে আজ কবাডি খেলাচ্ছে কাল বাস্কেটবল খেলাবে পরশু অলিম্পিক জেতাবে। একটু সাবধানে থাকিস সূচী।
সুচেতা মুখ টিপে হেসে বলেছিল, আস্তে নয় এবারে ভাবছি আটশো মিটার একসঙ্গে দৌড়াবো। দেখি স্পোর্টস রিপোর্টার পারে কিনা! সুচেতার ভিতরে তখন উত্তাল করা ঝড়, বাইরে স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। অনিরুদ্ধকে দূর থেকে দেখার পর শরীরের সমস্ত রক্তবাহী শিরাগুলো একসঙ্গে ছুটতে চাইছিলো বোধহয়। সুচেতার শাসন অমান্য করেই ওর গালে লালচে ছোপ ধরেছিল, ওর নাকের ডগায় ঘামের বিন্দু জমেছিল, হাতের তালু ঘামছিলো অনবরত, হাঁটার গতি শ্লথ হয়েছিল, পায়ের আঙুলগুলোতেও যেন এসে জমেছিল একরাশ লজ্জা।
সুচেতাকে দেখতে পেয়েই কয়েক পা এগিয়ে এসেছিল অনিরুদ্ধ, সেই একই রকম ভঙ্গিমায় হেসে বলেছিল, এভাবে বদনাম করবেন না আমার, এইটুকু আসতে আপনার পাক্কা কুড়ি মিনিট লাগলো, কস্মিনকালেও কবাডি চ্যাম্পিয়ন ছিলেন বললেও পাবলিক বিশ্বাস করবে না। সুচেতা বলেছিল, আপনাকে কে এমন ঢপ দিতে বললো? নাকি এই প্রফেশনে এমন মিথ্যেই সবাই বলে। অনিরুদ্ধ মুচকি হেসে বলেছিল, তথ্য গোপন করার অভিযোগে তো বরাবরই মিডিয়া অভিযুক্ত! মিডিয়ার লোক হিসাবে এ দোষ ঘাড়েই বহন করলাম। কিন্তু একটা কথা বলুন তো, আমি যদি বলতাম, সেকেন্ড ইয়ারের কেমিস্ট্রির মিস সুচেতার জন্য আমি ওয়েট করছি, তাহলে সকলের মনে প্রশ্ন জাগত এই ছেলেটা সুচেতার কে হয়? আপনার দিকে যাতে সন্দেহের তীর না যায় তাই তো আপনাকে ডিস্ট্রিক্ট কবাডি চ্যাম্পিয়ন বানালাম। সুচেতা মুচকি হেসে বলেছিল, ভাগ্যিস অলিম্পিকে গোল্ড জিতেছে বলেননি এই রক্ষে।
অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলেছিল, গুড গার্লের কি কলেজ বাংক করার অভ্যেস আছে? যদি না থাকে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে পারেন। নাহলে পরে আপনার নাতিপুতি শুনে হাসবে, বলবে ওমা দিদিয়া তুমি একদিনও কলেজ বাংক করোনি? আসলে এটা কলেজের ক্যান্টিনে মিষ্টি বেশি চায়ে তুফানি তর্ক তোলার মতই একটা অবশ্য করণীয় কাজ। সুচেতা লাজুক হেসে বলেছিল, কোথায় যেতে হবে?
অনিরুদ্ধ গলাটা আরও একধাপ খাদে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, আমার ফ্ল্যাট ফাঁকা থাকলেও নিজেকে গুড বয় প্রমাণ করার জন্য আমি সেখানে আপনাকে নিয়ে যাবো না। বরং লোকারণ্য কফিহাউসেই যাই চলুন।
সুচেতা হেসে বলেছিল, কথায় আপনার সঙ্গে পারার ক্ষমতা আমার নেই, প্রতি বলে গোল খাবো বেশ বুঝতে পারছি।
অনিরুদ্ধ সাবধানে বলেছিল, আসলে কি হলো, একটা ক্রিকেট ম্যাচ কভার করার জন্য আমায় কালকের ফ্লাইটে হায়দরাবাদ যেতে হবে, তাই ভাবলাম ডিউ কাজগুলো সেরেই যাবো। আমাকে আমার অফিসে সবাই কাজপাগল বলে। আমি নাকি কাজ পড়ে থাকলে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি না। তাই সপ্তাহ খানেক থাকবো না বলেই ডিউ কাজ সারায় মন দিলাম। তখনই মনে পড়ল, আপনার সঙ্গে দেখা করাটাও খুব জরুরি।
সুচেতা মজা করে বলেছিল, আমার আংটি, কানের দুল, চেন কিছুই তো হারায়নি আপাতত। তাহলে আমার সঙ্গে ডিউ কাজটা ঠিক কি বলুন তো?
অনিরুদ্ধ চেয়ারটা টেনে বললো, বসুন। আসলে আমার চুরি গেছে। তাই আজ সেই চোর ধরতেই যেতে হয়েছিল প্রেসিডেন্সি ক্যাম্পাসে। মানে বলতে পারেন নিতান্ত বাধ্য হয়েই। কি করবো বলুন, শহরের বাইরে যাচ্ছি, তাই চুরি করা জিনিসটা ফেরত চাইছি, প্লিজ দিয়ে দিন।
সুচেতা বলেছিল, তাহলে আজ একজনের অপার্থিব বস্তু চুরি গেছে তাইতো? ট্রিট আমি দিই আজকে।
অনিরুদ্ধ বলেছিল, ফেরত চাই, নাহলে কাজে মন বসছে না যে। সুচেতা লাজুক হেসে বলেছিল, আপনি সিওর ওটা আমার কাছেই আছে?
অনিরুদ্ধ কাতর গলায় বলেছিল, কথার মারপ্যাঁচে জড়িয়ে ফেলা মানুষটা নয়, তুখোড় রিপোর্টার নয়, সাকসেসফুল ম্যান নয় আজ তোমার সামনে বসে আছে নিতান্ত নিঃস্ব একজন প্রেমিক, তুমি কি তাকে খালি হাতে ফেরত দেবে সুচেতা?
সুচেতা জানতো না এমন করে কেউ প্রোপজ করতে পারে! স্বপ্নীল আবেগে ভেসে ভাঙা গলায় বলেছিল, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হলেও এই মুহূর্তে তোমাকে ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা আমার সত্যিই নেই অনি।
অনিরুদ্ধ আবেগী গলায় বলেছিল, এই নামেই ডেকো আমায়। এবারে নিশ্চিন্তে হায়দরাবাদ যাবো। মন দিয়ে নিউজ লিখবো। কেন জানো? নিজেকে বেঁধে দিয়ে গেলাম তোমার সঙ্গে, একই তরীতে পার হবো বাঁধভাঙা নদীটা।
সুচেতা বিল মিটিয়ে বলেছিল, বইপাড়ার বইয়ের পুরোনো গন্ধকে সাক্ষী রেখে কথা দাও, একসঙ্গে হাঁটবো এক পৃথিবী…অনিরুদ্ধ ভিড়ের মধ্যেই ওর হাতটা আলতো করে ধরে বলেছিল, হাঁটবো পৃথিবীর শেষ কিনারা পর্যন্ত।
হোস্টেলের সুপার প্রায়ই ডিনার শেষে ঘরে এসে বলতেন, সুচেতা তোমার কল আছে। তোমার বাবা কল করেছেন। সুচেতা হোস্টেলের ড্রয়িংরুমে ফোনটা ধরার পরেই ওপ্রান্ত থেকে অনি হেসে বলতো, কেমন আছিস মা? দিনরাত পড়াশোনা না করে গরিব ছেলেটাকে তো একটু মনেও করতে পারিস। আহা ছেলেটা কোথায় কোথায় ঘুরছে, তোকে না দেখতে পেয়ে কত কষ্ট পাচ্ছে বলতো।
সুচেতার হাসি থামতে চাইতো না। সুপার কটমট করে তাকিয়ে বলতো, এত হাসির কি আছে? বাবা তোমার বন্ধু নন, তাকে সম্মান করে কথা বলতে হয়। অকারণে হেসে গড়াচ্ছ কেন?
অনি শুনে বলেছিল, আর কি বলবো ম্যাডাম, আপনিই শুধু বুঝলেন আমার কষ্টটা। এ মেয়ে সম্মান দূরে থাক, ফোনে একটু আদর অবধি করে না।
সুচেতা ফিসফিস করে বলতো, তোমার দুষ্টুমি থামাবে? সুপার ভাবছেন, এত হাসছি কেন?
অনি সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, তুমি ওনাকে বলো আমার বাপ বলছেন, তোর সুপারের গলাটা মধু ঢালা, তাই শুনে হাসছি। এসব খুনসুটি করতে করতেই ওর আর অনিরুদ্ধর সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বের বন্ধনে ভালোবাসার আবরণ দিয়ে। অনিরুদ্ধর বাবা মারা গিয়েছিলেন ওর কলেজ লাইফে। মা বড়দা বড়বৌদির সংসারেই থাকেন। কলকাতায় বাড়ি হলেও কেন অনিরুদ্ধ ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে এই প্রশ্নটার উত্তরে অনি বেশ কিছুক্ষণ নীরব ছিল, তারপর বলেছে, আমার এমন প্রফেশন দাদা-বৌদির পছন্দ নয়। এমনকি দিদিরও যখন বিয়ে হয়নি তখন দিদিও বিরোধিতা করতো এই বেহিসেবি জীবনযাত্রার স্টাইলটাকে। ওর রাত করে ফেরা, ওর যখন তখন শহরের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া, এসব নিয়ে নাকি প্রায়ই অশান্তি হচ্ছিল বাড়িতে। এদিকে অনিরুদ্ধর এটাই স্বপ্ন। ও সিনিয়রমোস্ট স্পোর্টস রিপোর্টার হবে। পলিটিক্যাল বিট ওকে কোনোদিনই তেমন টানে না। ছোট থেকে ওই বাইশ গজের প্রতি ওর অমোঘ আকর্ষণ। না, ব্যাটে বলে এক করার আকর্ষণ নয়, মাঠের প্রতিটা কোনার খবর লেখা ওর নেশা। তাই এই বাড়ির অবাধ্য ছেলে হয়েই নিজের স্বপ্ন সার্থকের নেশায় নেমে পড়েছিলো ও। এখন মাঝে মাঝে যায় বাড়িতে, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মাকে কিছু টাকাও দিয়ে আসে। অনিরুদ্ধ সুচেতাকে বলেছিল, একটা ফ্ল্যাট বুক করেছিলাম। কিন্তু এতদিন সেই ফ্ল্যাট নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবিনি জানো। কিন্তু তুমি আসার পরে মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি পজেশন পেতে হবে ওই ফ্ল্যাটের। আপাতত রেন্টে আছে একটা ফ্ল্যাটে। কিন্তু খুব শিগগির ও কলকাতার বুকে একাধিক ফ্ল্যাট কিনবে এ আশা ওর আছে। সুচেতার খুব ভালো লেগেছিল ওর এই মারাত্মক পজেটিভ এনার্জিটা। কখনো অনির মুখে শোনা যায় না, ও পারবে না, ব্যর্থ হবে। বরং অনি সবসময় বলে, নিশ্চয়ই পারবো, শুধু সময়ের অপেক্ষা।
এত বছর অনির সঙ্গে ঘর করেও ওর মত সব নেগেটিভ দিকের একটা করে পজিটিভ অ্যাঙ্গেল খুঁজে বের করার বিশেষ ক্ষমতাটা রপ্ত করে উঠতে পারেনি সুচেতা। তাই তো ভাঙা বিবাহবাসর দেখে বুকটা কেঁদে উঠছে বারবার।
বৌদি আবার বললো, তোমার দাদা কি তোমায় দিয়ে আসবে কলকাতায়?
সুচেতা পুরোনো দিন থেকে ফেরত এলো রাইগঞ্জের বাড়িতে। তারপর নির্লিপ্ত গলায় বলল, না বৌদি, আমি একাই যেতে পারবো।
আনমনে আবার ভাবনার সমুদ্রে ডুব দিলো ও। বৌদি নিজের কাজে চলে গেল। এমন ফেলে ছড়িয়ে ভাঙা বিয়ে আগলে রাখলেই তো আর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে না। তাই গোছাতে হবে ওদের নিজের সংসার। সুচেতারও উচিত এবারে কলকাতার ফ্ল্যাটে ফেরত যাওয়া। অহনা যখন নিজের ইচ্ছেয় গেছে তখন ফিরবেও হয়তো মর্জি মত, তাই অকারণে এখানে বসে থেকে বিশেষ লাভ নেই। স্কুল জয়েন করবে সপ্তাহখানেক পর। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে এক সপ্তাহ ছুটি নেওয়া ছিল সুচেতার। স্কুলে ঢুকে টিচার্স কমন রুমে প্রথম দিন ঠিক কোন কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে ও ভাবতে ভাবতেই কলেজবেলায় স্বপ্নীল দিনগুলো চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল। ফিরে এলো বাস্তবের রূঢ়তা। মা হিসাবে ও যে ভীষণভাবে ব্যর্থ, সেটা অনিরুদ্ধর কথা বলার ভঙ্গিমাতেই লুকিয়ে ছিল। রাইগঞ্জ থেকে বিয়ে দেওয়াতেই আপত্তি ছিল অনিরুদ্ধর, সুচেতাই জেদ করে ওর দেশের বাড়ি থেকে বিয়েটা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা যে এভাবে ওকে বিদ্রুপ করবে ও কল্পনাও করতে পারেনি।
বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে দেখল টাটকা রজনীগন্ধার মালাটা দুলছে বাবার আবক্ষ ছবিতে। স্মিতহাস্য মানুষটার ঠোঁটের কোণে যেন লেগে আছে আলগা সংকোচ। সেদিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো সুচেতা। সেই ছোট থেকেই ওর সব মান অভিমান উজাড় করে বলতো যে মানুষটার কাছে সে মানুষটাও ওকে ছেড়ে চলে গেছে কতদিন আগে। নিজেকে বড্ড একলা লাগছে ওর। অনিরুদ্ধকে দোষারোপ করলেও সুচেতা জানে, দোষটা ওর। ধীর পায়ে নিজের ঘরে ঢুকলো ও। দোতলার দুটো ঘর আর এক তলার একটা ঘর আর ড্রয়িংয়ের পজিশনটা বাবা লিখে দিয়েছে সুচেতাকে। বাকি সব দাদার। সুচেতা কালে ভদ্রে এসেছে। অহনার আবার বেশ পছন্দের ছিল রাইগঞ্জের একতলার ঘর এবং সংলগ্ন বারান্দাটা। ও নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছিল ওই ঘরটা। প্রায়ই বলতো, আমি ভীষণ আনলাকি মা, দাদাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হলো না। কিন্তু দাদাইয়ের দেওয়া গিফটা আমার খুব পছন্দ। বেশ একটা মফস্বলের গন্ধ মাখা শহরে ছুটি ছাটায় কাটিয়ে আসলে মন্দ হয় না। মামা-মামী খুব পছন্দ করে না জেনেও অহনা আসতো এই বাড়িতে। এলে নিজের ঘরেই থাকতো। সোহম একদিন বলেছিল, হ্যাঁরে সূচী, কলকাতায় অতবড় ফ্ল্যাট থাকতেও তোরা এ বাড়ির পজেশন ছাড়বি না তাই না?
সুচেতা নরম গলায় বলেছিল, দাদা, তোরাই ব্যবহার কর বারোমাস, শুধু এলে আমায় আমার পুরনো ঘরে আর অহনাকে বাবার ঘরটা ছেড়ে দিস। বাবার শেষ ইচ্ছেটুকুকে মূল্য দিতেই আপাতত পজেশনটুকু থাকুক। পরে নাহয় দানপত্র করে দেব তোকে। সোহম চোখ সরু করে বলেছিল, তোর দানপত্রের আশা ছেড়েই দিলাম।
কেন যে দাদাটা কোনোদিনই ওকে নিজের ভাবতে পারলো না কে জানে!
ফোনের দিকে তাকালো আরেকবার, অনিরুদ্ধ বলেছিল তিতিরের খবর পেলেই জানাবে, মনটা বড্ড অশান্ত হয়ে আছে। একটা খবরও যদি পাওয়া যেত, তাহলে চিনচিনে যন্ত্রণাটা একটু কমতো।
অনি যখন দায়িত্ব নিয়েছে কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবে, এটুকু বিশ্বাস সুচেতার আছে ওর প্রতি। আরেকটু অপেক্ষা তো করতেই হবে।
।।১৯।।
অনিরুদ্ধর আজ মর্নিংওয়াকে যাওয়া হয়নি। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে বিরতি পড়েছে। বেরোবে বলে রেডি হয়েও মনটা অস্থির করার কারণেই পারেনি। সুচেতা কোনো কারণে কষ্ট পাচ্ছে দেখলে আজও একই রকম মনখারাপ করে ওর। কারণে অকারণে সুচেতার নানা অপমানের সম্মুখীন হবার পরেও সুচেতার ওপরে বেশিক্ষণ অভিমান করে থাকতে পারে না অনিরুদ্ধ। সামনে হয়তো কাঠিন্য বজায় রাখার চেষ্টা করে আপ্রাণ, কিন্তু সুচেতার চোখের জলে আজও একইরকমভাবে উদ্বেলিত হয় ওর মন।
নৈঋতের সঙ্গে কথা বলার পরও সুচেতাকে কোনো খবর দিতে পারেনি অনিরুদ্ধ। আগে ওরা আসুক, ওদের মুখে সবটা জেনে তারপর জানানো উচিত। একটা বইয়ের পাতা উল্টিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে অনিরুদ্ধ। কিন্তু বারংবার একটাই প্রশ্ন মনের মধ্যে এসে উঁকি দিচ্ছে তিতির পালালো কেন? পালালোই যদি তাহলে নৈঋতের সঙ্গে কেন? না মেলা অংকের মতই অস্বস্তিদায়ক হয়ে উঠেছে তিতিরের বিষয়টা। করতে কি চাইছে মেয়েটা?
মায়ের আর কোনো স্বভাব পাক না পাক জেদটুকু যাহোক পেয়েছে। মায়েরও তো জেদ কম নয়, নিজে যেটা বুঝবে সেটাই ঠিক। কলেজস্ট্রিটের দেখা সেই ভীতু ভীতু মেয়েটার মধ্যে যে এমন জেদ থাকতে পারে সেটা কি ঘুনাক্ষরেও আন্দাজ করতে পেরেছিল অনি! বরং তখন সুচেতার মুখটা দেখে মনে হতো, ভীতু ভীতু, মিষ্টি লাজুক একটা মেয়ে।
শহরে এসেও শহুরে কংক্রিটের ঘর্ষণে ওর মনটা পাথুরে হয়ে যায়নি বলেই একটু শান্তি আর স্নিগ্ধতার ছোঁয়া পেতে অনি বারবার ছুটে যেত সুচেতার কাছে। সুচেতার ওই কোমর ছাপানো ঘন চুল, একটু অন্যমনস্ক দৃষ্টি, আত্মভোলা আচরণটা অনিরুদ্ধকে আকৃষ্ট করেছিল প্রথম দিনেই। আত্মভোলা বলেই তো, গলার চেনটা কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছিল পকেটমার। প্রথম দর্শনে নিজের ভালোলাগার কথা সুচেতাকে জানানোর পরেই ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলেছিল, এমন প্রথম দর্শনে বুঝি অনেককে ভালো লাগে আপনার?
অনিরুদ্ধর বলা হয়নি, যা কিছু দেখতে পায় অভ্যস্ত চোখে সেদিকে নজরই পড়ে না ওর। যেগুলো দেখতে নিতান্ত অনভ্যস্ত লাগে সেখানে গিয়েই আটকে যায় ওর দৃষ্টি। তাই সুচেতার একটু মফস্বলের গন্ধ মাখা চোখের বিস্ময়েই থমকে গিয়েছিল অনিরুদ্ধ। যদিও লাজুক মেয়েটা কিছুতেই স্বীকার করতে চায়নি অনিকেও ওর ভালো লেগেছে।
সুচেতার ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গিমাটা আজও মনে আছে অনিরুদ্ধর। হায়দরাবাদ থেকে ফিরেছিল সেদিন রাতের ফ্লাইটেই। মধ্যরাতে ল্যান্ড ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙেছিল। ফোনটা রিসিভ করতেই সুচেতা ফিসফিস করে বলেছিল, আমি জানি তুমি ঘুমাচ্ছিলে, আজকেই ফিরেছ, সেটাও জানি। কাল সকালে ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়েও কল করতে পারতাম, কিন্তু দেরি হয়ে যাবে তাই হোস্টেলের সকলের ঘুমের সুযোগ নিয়ে এখন ড্রয়িংরুম থেকে করছি ফোনটা। একটু থতমত খেয়ে অনি বলেছিল, কি হয়েছে সুচেতা? এনি প্রবলেম?
সুচেতা গলাটা খাদে নামিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ, একটা বিশেষ জিনিস চুরি গেছে বলেই ফোন করছি তোমায়। ঘুমের ঘোরেই উঠে বসেছিলো বিছানায়।
সুচেতা বলেছিল, এই কদিন খুব মিস করেছি তোমায়, বন্ধুরা বলছে আমি নাকি ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। যে ম্যাচটা তুমি কভার করতে গিয়েছিলে সেটাও টিভিতে দেখেছি। আমি ক্রিকেট ভালোবাসি না তাও দেখেছি। শোনো, তোমার ডিপার্টমেন্টকে বলবে, যে রিপোর্টার স্টোরি কভার করতে যাবে তার ছবিও যেন টিভিতে দেখায়।
হো হো করে হেসে উঠেছিলো অনিরুদ্ধ।
তারপর হাসতে হাসতেই বলেছিল, এটা সিরিয়াসলি আমি বলবো। কালকেই অ্যাপ্লিকেশন করবো এই বলে যে, আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় লজ্জায় অন্য দিকে তাকিয়ে থাকা প্রেমিকাটিও এই অর্বাচীনের অদর্শনে রীতিমত অস্থির হয়ে যাচ্ছে। মধ্যরাতে ফোন করে আমায় মিস করছি সেটাও জানাচ্ছে। তাই এবার থেকে যেন আমাকে বেশি করে বাইরে ট্যুরে পাঠানো হয়। তবেই আমি আমায় মিস করার এমন মহার্ঘ কথাটি শুনতে পাব তার মুখে।
সুচেতা রেগে গিয়ে বলেছিল, সব সময় ইয়ার্কি ভালো লাগে না, বলে দিলাম।
অনি গভীর গলায় বলেছিল, আগামীকাল বিকেলে দেখা করি?
সুচেতা একটু ভেবে বলেছিল, সকালে আমার তেমন গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস নেই কিন্তু।
অনি রসিকতা করে বলেছিল, কিন্তু ম্যাডাম আপনার এই অর্বাচীন নগণ্য প্রেমিক যে এখন সিনিয়র সাংবাদিক। তাই তার কাজ যে বেড়েছে। সুতরাং বিকেলে দেখা করেই আমি বরং রাধিকার মানভঞ্জন করবো কেমন!
সুচেতা ধ্যাৎ বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিল।
সারাদিনের অফিস পলিটিক্স, এগিয়ে যাওয়ার হিংসুটে লড়াই, রাজনৈতিক প্রেশার, অযৌক্তিক সমলোচনা থেকে মুক্তি পেতেই অনিরুদ্ধ ছুটে যেত সুচেতার কাছে। সুচেতার নরম সবুজ মনটার স্নিগ্ধ ছায়ায় বসে দুদণ্ড বিশ্রাম নিলেই যেন অবসন্ন দেহে শক্তি সঞ্চয় হতো অনির। সেই সুচেতা দিনকে দিন কেমন যেন বদলে গেল। এর পিছনে কি অনিরুদ্ধরই দোষ আছে? হয়তো সুচেতাকে আরেকটু সময় দেওয়া উচিত ছিল। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে অনিই বোধহয় ওদের সম্পর্কের মধ্যে সূক্ষ্ম প্রাচীরটা তুলে দিয়েছিল। আর সুচেতা জেদ করে সেই প্রাচীরটাকে মজবুত সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দিলো। কষ্ট হয় অনির। আরেকবার যদি সেই কলেজের সুচেতাকে ফিরে পেত তাহলে বড্ড ভালো হতো। খ্যাতির শিখরে উঠে দেখেছে চারিদিকটা বড্ড কর্কশ, পাথুরে জমিতে ঠোক্কর খেয়েছে ও। চারপাশে তখন সুচেতার ঘন সবুজ মনটাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পায়নি। আবিষ্কার করেছে ওর প্রতি কর্তব্যরত সুচেতাও কাঠিন্যের বর্ম পরে নিয়েছে অনির অজান্তেই।
উপলব্ধি করেছে একটা বিশেষ সময়ে সুচেতার প্রতি আরেকটু বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল ওর। তাহলে হয়তো ওদের সম্পর্কের মধ্যে জমে থাকা বরফটা গলতে পারতো। হয়তো কিছুটা লীনতাপ শোষণ করে সুচেতা আবার আগের মত তরল হতো। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো নিজের অজান্তেই। আজকাল প্রায়ই পড়ে এই দীর্ঘশ্বাসটা। বুকের কাছে চাপ হয়ে থাকে একরাশ কষ্ট। তিতিরের বিয়েটা ভেঙে গেল, সেটার দোষও সুচেতা ওকেই দিলো। অনিরুদ্ধ জীবনে একটাই দোষ করেছিল, সুচেতার যখন সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল ওকে তখনই ও কেরিয়ারের শীর্ষে থাকায় বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে কাটিয়েছে। পরে অনেক চেষ্টা করেও সুচেতার জমে থাকা অভিমানকে আলগা করতে পারেনি। গুটিয়ে নিয়েছে সুচেতা, পাল্টে নিয়েছে নিজেকে। স্কুল, তিতির আর ওর প্রতি কর্তব্যটুকু করে গেছে যন্ত্রের মত। অনি একদিন বলেছিল, সুচেতা, প্লিজ এমন কঠিন হয়ে যেও না, যা হয়ে গেছে সেটাকে অ্যাক্সিডেন্ট ভেবে ভুলে যাও, স্বাভাবিক হও। সুচেতা অন্যমনস্কভাবে হেসে বলেছিল, আতঙ্কের দিনগুলোতে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতাম জানো, খুঁজে ফিরতাম সেই অনিকে। পেটের মধ্যে তখন অহনার উপস্থিতি টের পাচ্ছি, বড্ড একা লাগতো তোমার এত বড় সাজানো ফ্ল্যাটে। তুমি ফোনে বলতে চিন্তা কিসের, সব ঠিক হয়ে যাবে। ছুঁতে চাইতাম তোমায়, শুধু নিউজ পেপারে নিজস্ব প্রতিনিধির জায়গায় দেখতাম তোমার নামটুকু। তোমার সাফল্য এসেছে আর আমায় তোমার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছে অনেকটা দূরে।
সাংবাদিক অনিরুদ্ধ পালের সঙ্গে সেই অনির কত তফাৎ! ওই তফাৎটুকু আমি বোঝার আগেই আমার মন বুঝে গিয়েছিল, তাই তো আর তোমাকে ডিস্টার্ব করেনি সে। তরল অভিমানগুলোকে কঠিন করে ফেলেছে নিজের উদ্যোগে। অনিরুদ্ধ সুচেতার হাত ধরে বলেছিল, আর কি সব ভুলে আমায় আপন করা যায় না সুচেতা?
সুচেতা ক্লান্ত হেসে বলেছিল, যায় বুঝি? তুমি পেরেছ?
অনিরুদ্ধ শান্ত স্বরে বলেছিল, নিশ্চয়ই পেরেছি। সুচেতা চোখ দুটো নামিয়ে বলেছিল, কিন্তু আমার শরীরের উপলব্ধিরা যে অন্য কথা বলেছে আমায়।
অনি থেমে গেছে। বুঝেছে এ মানসিক দ্বন্দ্ব থেকে সুচেতা নিজেই বেরোতে চায় না। তাই আর জোর করেনি। তিতিরকে নিয়েই অবসরটুকু কাটিয়েছে অনি। কাজের প্রেশার বেড়েছে, তিতির বড় হয়েছে, বুড়ো হয়েছে অনিরুদ্ধ কিন্তু সেই কলেজস্ট্রিটে দেখা মেয়েটাকে হাজার খুঁজেও আর পায়নি। এখনো ওর ক্লান্ত মন বারংবার খোঁজে সেই মেয়েটাকে। পাবে না জেনেও ব্যর্থ চেষ্টা করে অনবরত।
দাদাবাবু, দেখুন কারা এসেছে….দিদিমণি আর জামাইবাবু এসেছে।
স্মৃতির ভিড় ঠেলে নিজেকে সামলে নিলো অনিরুদ্ধ। তিতিরের সম্মুখীন হতে হবে ওকে। হয়তো দিতে হবে অনেক প্রশ্নের উত্তর, তাই সচেতন করলো নিজেকে।
বিজু বেশ উত্তেজিত হয়ে ডাকছে বাইরে থেকে। তিতিরের গলা শোনা গেল। অনিরুদ্ধ ওঠার আগেই তিতির ঢুকলো ঘরে। নৈঋতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল অনিরুদ্ধ। ছেলেটা এমন কিম্ভূত টাইপের পোশাক কেন পরে আছে এখনও সেটাই বোধগম্য হলো না। কালার ধুতি, তসরের পাঞ্জাবি সঙ্গে পিঙ্ক কালারের লেডিস জ্যাকেট। নৈঋত বোধহয় অনিরুদ্ধর দৃষ্টি অনুসরণ করেই বললো, স্যার প্লিজ একটা পায়জামা আর একটা টিশার্ট দিয়ে আমায় উদ্ধার করুন। এভাবে এক বস্ত্রে আমায় রাইগঞ্জ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল, তাই আমি রণবীর সিংয়ের মত অদ্ভুত পোশাক পরে ঘুরছি, এটা কোনো মুখোপাধ্যায়ের ডিজাইন করা ড্রেস নয়।
ছেলেটার মধ্যে সেন্স অফ হিউমারটা অদ্ভুত। এমন ব্রিলিয়ান্ট ছেলেই অনির বরাবরের পছন্দ। সুচেতা তিতিরের জন্য সঠিক নির্বাচনই করেছিল।
তিতিরের মুখে বর্ষার ঘন মেঘ জমেছে। তাই নৈঋতের কথাতেও সামান্য হাসলো না মেয়েটা।
বিজু বোধহয় দরজার বাইরে থেকেই নৈঋতের কথাটা শুনেছিল, তাই দুমিনিটের মধ্যেই অনিরুদ্ধর একটা ট্র্যাকসুট আর টিশার্ট এনে বললো, জামাইবাবু, আপনি আমার সঙ্গে আসুন। এদিকে বাথরুম আছে, আমি গিজার অন করে দিয়েছি। আপনি ফ্রেস হয়ে নিন। এই জন্যই বিজুর বিকল্প এখনো কাউকে খুঁজে পায়নি অনিরুদ্ধ। মানুষটার সব দিকে বড্ড নজর।
অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে নৈঋত বললো, আমি আসছি। অনিরুদ্ধ নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো, তুমি ফ্রেস হয়ে এসে আগে ব্রেকফাস্ট করে নাও, তারপর কথা হবে।
তিতির ঠোঁটটা ফাঁক করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, অনিরুদ্ধ ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো ফ্রেস হয়ে নে।
তিতির ঘরে পরার পোশাক নিয়ে অনিরুদ্ধর অ্যাটাচ বাথে ঢুকে গেলো। ঘর থেকে ব্যালকনিতে এসে ফোনটা করলো অনিরুদ্ধ। সুচেতা শোনো, আশপাশে কেউ নেই তো? যেটা বলছি এখুনি ঐবাড়ির কাউকে জানাতে হবে না। সুচেতা উত্তেজিত হয়ে বলল, কোনো খারাপ খবর আছে অনি? আমি সবকিছু শোনার জন্য রেডি, তুমি বলো প্লিজ। সুচেতার গলাটা তিরতির করে কাঁপছে। অনিরুদ্ধ জানে যখন তরল যন্ত্রণাকে ও জমাট বাঁধানোর চেষ্টা করে তখনই এভাবে ওর গলা কাঁপে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ে। অনিরুদ্ধ একটু জোরেই বললো, আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়ের কিছু হবে না সুচেতা। তোমার সঙ্গে অন্যায় আমি হয়তো অনেক করেছি, কিন্তু এতটাও পাপ করিনি জীবনে যে আমি বেঁচে থাকতে আমার তিতিরের কিছু হবে! মন দিয়ে শোনো, শান্ত হও। তিতির আর নৈঋত এখন সূর্যপুরের বাড়িতে ঢুকলো। ওরা ওয়াশরুমে ঢুকেছে। এখনো কথা বলার সুযোগ পাইনি আমি। ঠিক কেন পালাল জেনে জানাচ্ছি তোমায়। তিতির একদম পারফেক্ট আছে।
সুচেতা বিস্মিত গলায় বলল, তুমি কি পাগলের মত বকছো অনি? তিতিরের শোকে কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? অহনার সঙ্গে যে ছেলেটার বিয়ে হচ্ছিল তার নাম নৈঋত বসু। তুমি কাকে নৈঋত ভেবে বসে আছো? তিতির কি অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে নাকি?
অনিরুদ্ধ নরম গলায় বলল, আমার কষ্ট হলেও বাস্তব বুদ্ধি যে লোপ পায় না সেটা তো তুমি জানোই। এর আগেও বহুবার তার প্রমাণ আমি দিয়েছি। তিতির ওভাবে চলে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু তাই জন্য উদ্ভ্রান্ত হয়ে ভুলভাল বকবো এমন নয়। নৈঋতকে সঙ্গে নিয়েই তিতির এসেছে এখানে। কেন ওর সঙ্গে পালিয়েছে সেটা আমার কাছেও বিস্ময়, সেটা জানার অপেক্ষায় আছি। জানতে পারলে কল করছি। দুজনেই সুস্থ আছে, তবে তিতির একটু গম্ভীর। তুমি টেনশন করো না। খাওয়া দাওয়া করে নিও নাহলে কিন্তু তোমার পেটে যন্ত্রণাটা বাড়বে। সুচেতা অভিমান ভরা গলায় বলল, মেয়ে তো তোমাকেই বেশি বিশ্বাস করে, তাই আমায় একটা ফোন করার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
অনি সাবধানে বললো, এখন মান অভিমানের সময় নয়। তিতিরের মনে কি চলছে সেটা জানাটা বেশি জরুরি। পারলে কলকাতা ব্যাক করো, নাহলে এখানেও আসতে পারো। মোটকথা রাইগঞ্জের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এস। ওখানে থাকলে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।
সুচেতা গম্ভীর গলায় বলল, আমার জন্য কেউ দুশ্চিন্তা করুক এটা আমি চাইছি না, রাখলাম।
ফোনটার দিকে তাকিয়ে অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বললো, কেন এত ভুল বোঝো সু? ভুল বুঝে ঠেলতে ঠেলতে তো তোমার অনিকে তুমি পাহাড়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে দিয়েছো। একবার ঠেলে দিলেই খাদে পড়ে যাব, তবুও তোমার হাতটা আমার দিকে একবারের জন্যও বাড়ালে না সু? ফাঁসির অপরাধীকেও তো তার শেষ ইচ্ছে জানাবার সুযোগ দেওয়া হয়, তার থেকেও কি বেশি দোষী আমি?
চোখের কোনটা জ্বালা করে উঠলো খ্যাতির শীর্ষে ওঠা সাংবাদিক অনিরুদ্ধ পালের।
দ্বিতীয় ফোনটা করার জন্য কন্ট্যাক্ট লিস্টে সার্চ বটন প্রেস করলো। নীলাদ্রি বসুকে খবরটা জানানো উচিত। ওরাও তো সন্তানের বাবা-মা, নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তায় আছে।