অনুভবে তুমি – ২০
।।২০।।
হ্যালো, হ্যাঁ অনিরুদ্ধবাবু বলুন। হ্যাঁ, আমি নৈঋতের বাবাই কথা বলছি।
কাবেরী পাশ থেকে বললো, ইনসাল্টিং কথা বললে, ফোনটা আমায় একবার দিও। আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত। ইশারায় কাবেরীকে চুপ করতে বলে নীলাদ্রি বললো, হ্যাঁ অনিরুদ্ধবাবু বলুন। আমি প্রথমেই বলি, টুটাই যা অন্যায় করেছে, মানে নৈঋত আজ যেটা করেছে তার জন্য আমি ওর বাবা হয়ে লজ্জিত। আমি এবং ওর মা দুজনেই আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অহনার মনের অবস্থা আমরা আন্দাজ করতে পারছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন এখনও নৈঋতের কোনো খবর আমরা পাইনি। ফোনটাও সুইচ অফ। আরেকটু বেলা হলে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে মিসিং ডায়রি করবো মনস্থির করেছি।
একটু থেমে গেলো নীলাদ্রি। কি ? কি বলছেন আপনি? নৈঋত আপনার কাছে! মানে? আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না, প্লিজ ক্লিয়ার করুন। কাবেরী পাস থেকে উত্তেজিত গলায় বলল, টুটাই? টুটাই ওনার কাছে? কেমন আছে ও, কিছু বিপদ হয়নি তো?
নীলাদ্রি কিছু বলার আগেই অনিরুদ্ধ বললো, নৈঋতের মাকে আশ্বস্ত করুন আগে। উনিও নিশ্চয়ই আমার মতই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। শুনুন, নীলাদ্রিবাবু, অহনা আর নৈঋত আপাতত আমার সূর্যপুরের বাড়িতে এসেছে। ওরা চেঞ্জ করতে গেছে। ফিরলে আমি সবটা জেনে আপনাকে কল ব্যাক করছি। আমিও এখনো অন্ধকারে আছি। কিছুতেই বুঝতে পারছি না, ওরা দুজন কেন বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এলো!
দুজন মানে? প্রায় আঁতকে উঠেছেন নীলাদ্রিবাবু। অহনা আর টুটাই এক সঙ্গে গেছে আপনার ওখানে? অহনাও পালিয়েছে রাইগঞ্জ থেকে? কখন? টুটাই যখন চলে গিয়েছিল তখন তো অহনা ছিল বাড়িতেই। তাহলে ওরা মিট করলো কোথায়? অনিরুদ্ধ বেশ বুঝতে পারছে ওদের মনেও একরাশ প্রশ্নের ঘনঘটা। এত প্রশ্নের উত্তর দেবার ক্ষমতা এই মুহূর্তে ওর নিজেরও নেই। কাল ঠিক কি হয়েছিল এখনো জানে না ও নিজেই। এদিকে নীলাদ্রিবাবু একটার পর একটা প্রশ্ন করেই চলেছেন। বাধ্য হয়ে অনিরুদ্ধ বললো, আমি আগে পুরোটা শুনে নিই তারপর আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেব। চিন্তা করবেন না ওরা সুস্থ আছে। নীলাদ্রিবাবু তখনও বিস্মিত কণ্ঠে বলে চলেছেন, অহনার সঙ্গে টুটাই কি করে গেল!
ফোনটা বাধ্য হয়ে ডিসকানেক্ট করে দিলো অনিরুদ্ধ। আগে ওদের সঙ্গে কথা বলা উচিত।
বিজু এসে ফিসফিস করে বললো, লুচি, বেগুন ভাজা আর আলুর দম বানানো গেছে কোনোমতে, এতে হবে দাদাবাবু?
অনিরুদ্ধ মজার ঢঙে বললো, খুব হবে, দৌড়াবে। বিজু কাঁচুমাচু মুখ করে বললো, আমি দিদিমণির বরকে জামাইবাবু ডেকেছি বলে দিদিমণি আমায় বেদম ধমক দিয়েছে। ওই জামাইবাবুটার নাম কি?
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, নৈঋত।
বিজু আপন মনে দুবার উচ্চারণ করলো নৈঋত।
অনিরুদ্ধ মনে মনে হেসে নিলো একচোট। সুচেতার মতই একই টেকনিকে ধমক দেয় তিতির। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায়। সুচেতা এখানে এখন থাকলে বোধহয় একটা খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে যেত মা-মায়ের। ঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলো অনিরুদ্ধ।
নৈঋতকে এখন বেশ ফ্রেস লাগছে। অনিরুদ্ধর আর ওর হাইট বা চেহারা একই রকম হওয়ায় ট্রাকসুট বা টিশার্ট দুটোই ফিট করে গেছে। নৈঋত হাসি মুখে বললো, এ দুটো ধার দিতে হবে স্যার। কলকাতা পৌঁছে কুরিয়ার করবো না হয়। অনিরুদ্ধ হেসে বললো, তোমার আর আমার সাইজ দেখছি একেবারেই এক। তাই এ পরে তোমায় কলকাতা যেতে হবে না। প্রপার ড্রেস পরেই যাবে। আপাতত খেয়ে নাও। ওর কথা শেষ হবার আগেই বিজু খাবারের থালা নিয়ে এসে রাখলো টেবিলে। নৈঋত সেদিকে তাকিয়ে বলল, এত অমৃত বিজুকাকা। জামাইবাবু না হয়েও দেখছি আপনি আমায় জামাই আদর করে ছাড়লেন। বিজু বললো, পেট ভরে খান দাদাভাই, লজ্জা করবেন না।
অনিরুদ্ধ জোরেই হাঁক দিলো, তিতির…..আয় খেয়ে নে।
বিজু বললো, দিদিমণি বললো, ওর খাবারটা ঘরে দিতে, তাই দিয়ে এলাম। অনিরুদ্ধ বেশ বুঝলো ওর সম্মুখীন হতে অস্বস্থি হচ্ছে তিতিরের। বেশ, তাহলে বরং তিতিরের সঙ্গে পরে কথা বলবে, আপাতত নৈঋতের কাছ থেকেই জানা যাক, ঠিক কি হয়েছিল!
নৈঋতকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেচারার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কাল সন্ধে থেকেই নিশ্চয়ই কিছু খাওয়া হয়নি। ওর দিকে তাকিয়ে অনিরুদ্ধ বললো, বিজু আরও লুচি দিয়ে যাও নৈঋতকে। এই তো বয়েস খাবার। জানো নৈঋত তোমার বয়েসে একবার আমার বড়মামার ছেলের বিয়েতে গিয়ে আমরা ভাই-দাদারা মিলে লুচি খাওয়ার কম্পিটিশন করেছিলাম। শেষে বাড়ির রাঁধুনি এসে বড়মামাকে বলেছিল, মাইনে পত্তর দিয়ে দিন বাবু, এ রাক্ষসের ফ্যামিলিতে আমি কাজ করবুনি। আমরাই তখন তার হাতে পায়ে ধরে আটকেছিলাম, কথা দিয়েছিলাম অমন রাক্ষুসে খাওয়া আর খাবো না। তাহলে বুঝতেই পারছো ঝুড়ি ঝুড়ি লুচি উড়ে গিয়েছিল। আর তুমি ছয়টা লুচি নিয়ে বলছো আর নয়! এ তো তোমাদের এই প্রজন্মের লজ্জা, তোমার পিৎজা, বার্গার খেয়েই লিভারের বারোটা বাজাচ্ছ। নৈঋত হেসে বললো, আপনার নিউজ পড়তে পড়তে বা টিভিতে আপনার সাক্ষাৎকার দেখতে দেখতে আপনার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। আজ এইটুকু কথা বলে মনে হলো ধারণাটা সর্বাংশে সত্যি নয়।
অনিরুদ্ধ বেগুন ভাজা দিয়ে লুচির টুকরোটা মুখে ভরে বলেছিল, যেমন?…এক্ষেত্রে উদাহরণ অপরিহার্য।
নৈঋত বিজ্ঞের মত বলেছিল, আপনাকে বড্ড দাম্ভিক মনে হয়েছিল, এখন দেখছি আপনার দুটো রূপ। কার্যক্ষেত্রে আপনি ড্যাম সিরিয়াস আর বাড়িতে আপনি অমায়িক। অনিরুদ্ধ থমকে গিয়ে বলল, বহুদিন পরে এই প্রজন্মের মুখে এমন পরিণত কথা শুনলাম। আমি তো মনে করতাম এই প্রজন্মের সবাই বোধহয় গলায় একটা করে গ্যাস বেলুন বেঁধে উড়ে বেড়ায়। তোমরাও এমন ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারো বুঝতে পারিনি তো। আসলে তোমাদের মুখে হট আর কুলের অর্থ একই হয় এটা শুনে শুনে আমিই বোধহয় ভুল বুঝতে শুরু করেছিলাম এই প্রজন্মকে। সকলে মনে হয় হাওয়াভাসি নয়, কেউ কেউ মাটিতেও পা রেখে, বিচার বিশ্লেষণ করে কথা বলে তার মানে! যাক বড় নিশ্চিন্ত হলাম। নৈঋত বললো, আসলে কি বলুন তো, এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ওপরে মানুষ বড় অবিচার করেছে। চারিদিকে খেলার মাঠ ভরিয়ে কমপ্লেক্স তৈরি করেছে, স্কুলে ভর্তি হতে না হতে ওদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ইঁদুর দৌড়ে। যে একটু পিছিয়ে যাচ্ছে সে শেষ হয়ে যাবে এই মানসিকতার থেকেই আসছে অবসাদ। দিনরাত মোবাইল আর কম্পিউটারের মধ্যে নিজেকে বন্দি রাখতে রাখতে এদের নাম হয়ে যাচ্ছে আনসোশ্যাল। কিন্তু একটু ভেবে দেখবেন তো, এদের এছাড়া আর ঠিক কি করার আছে!
অনিরুদ্ধ বললো, বেশ বেশ, সকলে যখন এই প্রজন্মকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত তখন তুমি যে এদের হয়ে লড়লে এতেই আমি ইম্প্রেসড। এখন বলতো, তিতির, মানে অহনাকে বিয়ে না করে বিয়ের আসর থেকে উঠে এসেছিলে কেন? ওকে কি তোমার পছন্দ হয়নি, নাকি অ্যাফেয়ার থাকা সত্ত্বেও জোর করে বাড়ির চাপে বিয়েতে বসতে বাধ্য হয়েছিলে? আমার কাছে নির্দ্বিধায় বলতে পারো। আমার তিতির পাখি বলে, মাই ডিয়ার বাবাই। কারণ কি জানো, আমি এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দোষারোপ করলেও মনে মনে এদের সঙ্গটা বেশ উপভোগ করি। তাই তিতির ওর যাবতীয় গোপন ডায়রির পাতা নির্ভয়ে উল্টায় আমায় সামনে।
নৈঋত সন্দেশে শেষ কামড়টা দিয়ে বললো, পর পর উত্তর দিই আপনার প্রশ্নের।
প্রথমত, আমার মা কাবেরী বসুই অহনাকে প্রথম দেখেছিলো। আমার কোনো অ্যাফেয়ার না থাকায়, মা বিয়ের ঠিক করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমার জ্ঞাতার্থে। তাই আমার পছন্দ হয়েছিল বলেই অ্যারেঞ্জড ম্যারেজটা হচ্ছিল।
দ্বিতীয়ত, আমি এই প্রথম রাইগঞ্জ নামক কোনো একটা স্থানে পৌঁছেছিলাম, যার কোনো অস্তিত্ব পৃথিবীর ম্যাপে এর আগে আমি দেখিনি। তাই রাতের অন্ধকারে গাড়িতে করে যে অপরিচিত জায়গাতে আমি পৌঁছেছিলাম সেখান থেকে গাড়ি ছাড়া একা পথ চিনে বেরিয়ে আসাটা আমার পক্ষে যে সম্ভব নয়, সেটা একটা উন্মাদেও বুঝবে।
তৃতীয়ত, বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাওয়া মানে দুই বাড়ির সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া। আমি চায়ের দোকানের বিপ্লবী নই, নামী কলেজের লেকচারার। তাই পারসোনাল রেসপেক্টের কথা ভেবে কোনোভাবেই পালাতে পারি না।
এবারে আপনি নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবেন, তাহলে কেন পালালাম? পালালাম না বলে বরং বলি বাধ্য হলাম। অহনাই আমায় এসে বলেছিল, আমি যেন ওকে বিয়েটা না করি। আমি যেন বিয়ের আসর থেকে পালাই। ওর এক্স নাকি ফিরে এসেছে, ও তাকেই বিয়ে করবে। ও ভীষণ অসহায়, এ অবস্থায় আমি যদি ওকে হেল্প না করি তাহলে ওকে সুইসাইড অবধি করতে হতে পারে। অহনাই পাড়ার এক দাদার স্কুটিতে চাপিয়ে আমায় রাইগঞ্জের স্টেশনে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিল।
আমি যখন স্টেশনের অন্ধকারে বসে মোবাইল অফ করে অগ্রপশ্চাৎ ভাবছি তখন ম্যাডাম সম্পূর্ণ অন্য মেকআপে অন্য মুডে স্টেশনে এসে হাজির। তিনিও নাকি ট্রেন ধরে যাবেন এক্সের কাছে। আমি তখন সত্যিটা জানার জন্য ওর পিছু নিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম এক্সের গল্পটা মিথ্যে, কিন্তু ঠিক কেন ও বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইল সেটা কিন্তু এখনও আমার কাছে ক্লিয়ার নয় স্যার। যাইহোক, এবারে আমাকে বাড়িতে ফেস করতেই হবে। ফিরে যাব আজ বিকেলেই। ওকে আপনার কাছে পৌঁছে দিয়ে গেলাম, আপনি বরং জেনে নিন কেন করলো এমন আমার এবং আমার গোটা পরিবারের সঙ্গে! কদিন আগে জানালেও আমরা ম্যানেজ করে নিতাম, এখন এই পরিস্থিতি ঠিক কিভাবে সামাল দেব জানি না।
অনিরুদ্ধ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল নৈঋতের দিকে। ছেলেটার চোখে সততা আছে। সাংবাদিক জীবনে মানুষ তো কিছু কম দেখলো না অনিরুদ্ধ, খুব কম চোখেই এমন স্বচ্ছতা দেখেছে ও। নৈঋতকে অপছন্দ হবার মত কোন কারণ এখনো পর্যন্ত অনিরুদ্ধর চোখে পড়েনি, তাও কেন তিতির এমন করলো সেটাই ভেবে চলছে ও। যথেষ্ট স্মার্ট, সপ্রতিভ, সেন্সেবেল, উইটি, সুদর্শন-সমস্ত গুনওয়ালা ছেলেই তিতিরের জন্য পছন্দ করেছিল সুচেতা। তাই হয়তো বিয়েটা ভেঙে যাওয়ায় মা হিসাবে সুচেতা এতটা ভেঙে পড়েছে।
নৈঋত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই অনি বললো, বিজু নৈঋতকে আমার স্টাডিতে নিয়ে যাও, ও একটু রেস্ট নিক। আর দুপুরে ভালোমন্দ মেনু করো বিজু, সস্তায় সেরে ফেলো না।
নৈঋত বললো, আপনি অকারণে ব্যস্ত হচ্ছেন। কলেজে মাঝে মাঝে লাঞ্চ টাইমে আমার ক্যান্টিনে খাওয়াও অভ্যেস আছে। সে তুলনায় এমন খাবার তো অমৃত। তাই বিজুকাকাকে আর বিব্রত করবেন না প্লিজ। আরেকটা কথা স্যার, আমি বিকেলে কলকাতা ফিরতে চাই, ডিরেক্ট কোনো ট্রেন আছে এখান থেকে? অনিরুদ্ধ হেসে বললো, বিকেলে আমার গাড়ি তোমায় যাদবপুরে পৌঁছে দিয়ে আসবে। তিতিরের মা যদি শোনেন তোমায় আমি ট্রেনে তুলে দিয়ে দায় সেরেছি, তো আমায় গৃহহীন হতে হবে। এখন নিশ্চিন্তে একটু বিশ্রাম নাও, তোমায় তোমার বাড়িতে সুরক্ষিত অবস্থায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার। আমার মেয়েকে যখন তুমি এত অপমানিত হবার পরও দায়িত্ব নিয়ে আমার কাছে পৌঁছে দিয়ে গেলে তখন বাবা হিসাবে আমারও এটুকু কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
নৈঋত মুচকি হেসে বললো, একটাই আব্দার স্যার, আপনার তিতির পাখি কেন আমায় রিজেক্ট করলো শেষ মুহূর্তে এটুকু জানতে পারলে শান্তিতে ফিরতে পারি। নাহলে মেল ইগোয় ঠোক্কর খেতে খেতে মেরুদণ্ডে ঘুন ধরার প্রবল সম্ভবনা আছে। তাই আসল কারণটুকু জেনে যেতে চাই। অনিরুদ্ধ নৈঋতের পিঠে হাত দিয়ে বললো, যদি আমি জানতে পারি তাহলে নিশ্চয়ই তোমায় জানাবো।
অনিরুদ্ধ ধীর পায়ে ঢুকলো তিতিরের ঘরে। তিতির অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়েছিল হলদে গাঁদা গাছগুলোর দিকে। বিজুর যত্নে ফুলের ভারে গাছগুলো ক্লান্ত যেন। ডালপালা জুড়ে ঝাঁপিয়ে এসেছে অজস্র ফুল। যেন হলদে ওড়না জড়িয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে লাজুক মেয়েটা। অনিরুদ্ধ দেখেই বুঝতে পারলো তিতিরের মনের মধ্যে এই মুহূর্তে কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ায় ওলটপালট করে দিচ্ছে সব। ও হয়তো আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সামাল দেবার কিন্তু পারছে কই! কি রে, টেবিলে আমাদের সঙ্গে জয়েন করলি না কেন? বাবাইয়ের ওপরে অভিমান নাকি? তোর বিয়ের সময় উপস্থিত থাকতে পারিনি বলে রাগ করেছিস? তিতির হাতের তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো চোখের জলটা। তারপর বেশ দৃঢ় গলায় বলল, তুমি সব জানতে, আমায় কেন বলোনি কোনোদিন? আমি তোমার ফাইল থেকে বেশ কিছু পুরোনো চিঠি আবিষ্কার করেছিলাম, যেগুলো তুমি লিখেছিলে মাকে। মা তখন রাইগঞ্জের বাড়িতে থাকতো। তুমি কলকাতার ফ্ল্যাটে।
কি বলিনি রে তিতির? তোর মায়ের সঙ্গে আমার অ্যাফেয়ার ছিল সেটা তুই জানতিস তো। আর কি বলিনি? মা কেন তোমায় বিয়ে করতে চাইছিলো না সেটার কারণটা বলোনি আমায়। অনিরুদ্ধ বললো, বলেছি, নিশ্চয়ই বলেছি। কয়েকমাস আগেই তো তোকে বললাম, সুচেতার জীবনে একটা অব্যক্ত কষ্ট আছে তিতির, পারলে আমার অবর্তমানে ওকে একটু প্রটেক্ট করিস। বলিনি তোকে?
তিতির গম্ভীর গলায় বলল, বাবাই এখন আমি কিছুটা জানি। পলিটিক্যাল বিট সামলাই আমি, হতে পারি তোমার মত নামি রিপোর্টার নই তবুও সোর্স আমারও কিছুটা তৈরি হয়েছে। সেই সোর্সকে কাজে লাগিয়েই আমিও বেশ কিছু সত্যি উদঘাটন করেছি। আর সেটা করার পর থেকে তুমি আমার চোখে অনেকটা নীচে নেমে গেছ। কেন অমন একটা ঘটনার কোনো প্রতিবাদ তুমি করোনি? একজন নামি দৈনিকের সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও কোনোরকম প্রতিবাদ তুমি করোনি। ধীর গলায় অনিরুদ্ধ বললো, আমি তোকে সত্যি বলতে চেয়েছিলাম বারবার, কিন্তু তোর মা আমায় ধিক্কার জানিয়েছে। তোর বিয়ের আগেও আমি তোকে একটু হিন্টস দিয়েছিলাম, জানি না তুই বুঝতে পেরেছিলিস কিনা। আর বাকি রইল প্রতিবাদ? না রে, জীবনের সব থেকে কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি প্রিয় মানুষটাকে বুকে আগলে রাখাটাই অনেক সময় বেশি প্রায়োরিটি পায়, প্রতিবাদ, সমাজ সংসার সবকিছু তখন তুচ্ছ মনে হয়। আর ওই প্রতিবাদ করতে গিয়ে গোড়াতেই তোর মামার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলাম আমি। তোর মামা বলেছিল, অনিরুদ্ধ তোমায় যেন দ্বিতীয়বার রাইগঞ্জের বাড়িতে পা দিতে না দেখি। আমার বাড়ি থেকেও ত্যাজ্য হয়েছিলাম একটাই কারণে, এরপরেও তুই বলবি তিতির যে আমি চেষ্টা করিনি? আমি জানি না তুই কতটা কি জেনেছিস, তবে আমি বলবো এই মুহূর্তে আর বোধহয় রিওপেন করা উচিত হবে না কিছুই।
বাবাই, আমি থ্রেট পেয়েছি। একাধিক ফোন কলস, বিয়ে ঠিক হবার পরে বেড়ে গিয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে জানিয়ে দেবার থ্রেটও পেয়েছি। যদিও আমি এগুলো নিয়ে চিন্তিত নই, কিন্তু শেষ দেখে ছাড়বো। তারপরেই আবার ফিরবো নরম্যাল লাইফে। আগে খুঁজে বের করবো তাকে, সম্মুখীন হবো সত্যের। তারপর না হয় বিয়ে, সংসার এসবে জড়াবো। একটা জিনিস তো বুঝতেই পারছো, বিয়ের পরেও এই সত্যি আমার পিছু ছাড়বে না। তখন বসু পরিবারে শুরু হবে সমস্যা। তাই বাধ্য হয়েই আমি লাস্ট চিরকুটটা পেয়ে বিয়ের আসর থেকে উঠে এসেছি।
অনিরুদ্ধ বললো, কি লেখা ছিল চিরকুটে?
তিতির বললো, সে আমি তোমায় বলতে পারবো না। তবে একটা কথা তোমায় বলি বাবাই, আমি শুধু সত্য জেনে চুপচাপ বসে থাকব না। তোমরা কেউ যদি আমার পাশে না থাক তাহলেও লড়াইটা আমি লড়বো। অনিরুদ্ধ মেয়ের জেদ জানে, তাই নরম গলায় বলল, বোধহয় ভুল করছিস। তিতির আরেকটু দৃঢ় গলায় বলল, আমি নিশ্চিত আমি ঠিক করছি। দেখো বাবাই আমি আন্দাজ করেছি মা আর তোমার মধ্যে ঠিক কি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। কেন তুমি আর মা এই মুহূর্তে আলাদা থাকছো সেটাও আমি আন্দাজ করেছি। মা হয়তো তোমায় দোষারোপ করেছে সমস্ত ব্যাপারে, কিন্তু তোমরা একটা জিনিস কেউ বুঝতে পারছো না, এই সত্যিটা কোনো না কোনোদিন আমার সামনে আসতোই। সে তোমার চিঠিগুলোর মাধ্যমেই হোক বা অন্য কোনোভাবে। ভেঙে পড়া গলায় অনিরুদ্ধ বললো, তিতির তোর মা অতগুলো বছর পরে আমায় বলেছে, আমি নাকি ওর দোষগুলো মেয়ের সম্মুখে আনব বলেই ওই চিঠিগুলো রেখে দিয়েছিলাম প্রমাণস্বরূপ। বিশ্বাস কর তিতির, তোর মায়ের সব চিঠিই আমার কাছে আছে। আমি যেগুলো লিখেছিলাম তোর মাকে সেগুলোও তোর মায়ের অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে চলে এসেছিল আমাদের ফ্ল্যাটে। আমি সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম। কোনো প্রমাণপত্র হিসাবে নয়। অতগুলো বছর একসঙ্গে কাটানোর পরেও যে সুচেতা এভাবে বলে দিতে পারবে আমায় সেটা বোধহয় কল্পনাতীত ছিল। তাই আঘাতটা গরম ফলার মতই এসে বুকে বেঁধেছিল। চেষ্টা করেও আর স্বাভাবিক হতে পারিনি। তারপর যে বাড়িতে আমার ঢোকার অধিকার নেই, সে বাড়ি থেকেই তোর বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তোর মা। এরপরেও কি সরে যাওয়া উচিত ছিল না তিতির? সত্যি বলতে কি আমারও কেন জানি না মনে হচ্ছিল তুই আর তোর মাও আমার কাছ থেকে দূরে যেতে চাইছিলিস। তাই তো তাড়াতাড়ি আমাদের ফ্ল্যাট ছেড়ে তোর মা নিজের কেনা ফ্ল্যাটে শিফট করলো রাতারাতি। আমার কাছে থাকলে নাকি মেয়েকে আমি দুর্বুদ্ধি দেব। কিছুতেই বিশ্বাস করলো না সুচেতা, অবশেষে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। দূরত্ব হয়তো ব্যবধান তৈরি করে খুব দ্রুত, কিন্তু একেবারে বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে আটকায়। তাই ওই মুহূর্তে তোর ভালোর জন্যই আমাদের মধ্যে দূরত্বটুকু খুব প্রয়োজন ছিল তিতির। তবে আবারও বলছি, তোকে আর সুচেতাকে ছেড়ে আমি ভালো নেই। সুচেতা আমার এমন জায়গায় আঘাত করেছে যে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও বোধহয় আমি হারিয়ে ফেলেছি। তাই তো লোকালয় ছেড়ে এখানে আড়াল খুঁজছি। তিতির অনিরুদ্ধর হাতটা ধরে বলল, বাবাই, কিন্তু সত্যিটা যে আমার জানার দরকার। নাহলে আমি রাতে ঘুমাতে পারছি না।
অনিরুদ্ধ নরম গলায় বলল, তোকে রিপোর্টার তৈরি করেছি, নাচ, গানের বদলে মার্শাল আর্ট শিখিয়েছি, নিজের মেরুদণ্ডে শক্ত করে দাঁড় করতে শিখিয়েছি, বাবা হিসাবে আমার কর্তব্য শেষ। তুই এখন স্বাবলম্বী একটা মেয়ে। তাই সবকিছু জানার অধিকার তোর আছে। তুই খুঁজে নে। বিপদে পরবি হয়তো, তবুও তোর বাবা হয়ে আমি বলবো, তোকে এমনই দেখতে চেয়েছিলাম আমি।
এ চত্বরের পুলিশ অফিসারের নম্বরটা রেখে দে, বলবি সাংবাদিক অনিরুদ্ধ পালের মেয়ে, তাহলেই ওরা তোকে হেল্প করবে। সত্যিটা খুঁজে পাওয়ার পরও যদি আমার গলা জড়িয়ে ধরে সেই ছোটবেলার মত আদর করতে মন হয়, তাহলে আসিস তিতির। আর কখনো খুব বিপদে পড়লে কল করিস। তিতির বললো, তার মানে এই কাজে তুমি আমায় হেল্প করবে না তাই তো?
অনিরুদ্ধ বললো, ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। সুচেতার কাছে কথা দিয়েছি। তোর এই প্রশ্নের মূলে আর জলসিঞ্চন করবো না আমি। তাই তোর বিয়ের সব খরচ করার অধিকার পেয়েছিলাম আমি। ক্ষমা করিস তিতির পাখি। তিতির বাবার দিকে তাকিয়ে দেখল, বাবার চোখের কোণ দুটো লালচে হয়ে গেছে। তিতির হেসে বললো, ভুলে যেও না আমি সাফল্যের শীর্ষে ওঠা অনিরুদ্ধ পালের মেয়ে, তাই শেষ সিঁড়িতে আমিও পা দেবই।
নৈঋত এসেছিল অহনার সঙ্গে একটা কথা বলতে, কিন্তু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুটা হলেও শুনতে পাচ্ছিলো বাবা-মেয়ের কথোপকথন। কি সত্য উদঘাটনে চলেছেন মহারানী কে জানে! আর বাবাটাও আরেক পাগল, যখন জানেই এটা রিস্কি, তখন তো মেয়েকে আটকানো উচিত ছিল, তা নয় বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আর এই মেয়ে মার্শাল আর্ট শিখে পরমাণু বোমের সামনেও যাওয়া যায় ভেবেছে হয়তো। আজব ফ্যামিলিতে বিয়ে দিচ্ছিল মা ওর। যাকগে হয়নি ভালোই হয়েছে। বাপরে, প্রাণে একটু ভয় ডর অবধি নেই। টুটাই তো এখনো ইঁদুরে ভয় পায়। যদিও কাউকে কোনোদিন সেটা বুঝতে দেয়নি, কিন্তু ও তো জানে। এমন অনেক কিছুতেই ও ভয় পায়, ভয় পাওয়াটা বোধহয় অন্যায় নয়। যদি এই মেয়ের মত কেউ ভয় না পেত তাহলে বাংলা, ইংরেজি অভিধানে এমন কোনো শব্দই থাকতো না। বাপরে, সাংবাদিক নয় পুরো ডাকাতের ফ্যামিলিতে বিয়ে হচ্ছিল ওর। গেছো মেয়ে আর সর্দার বাবা, মা-টা বোধহয় একটু নরম সরম। বিয়ের আগেই কি সুন্দর নৈঋতের হাত দুটো ধরে বলেছিল, আমার মেয়েটাকে একটু দেখো বাবা। এই মেয়েকে ও কি দেখবে? বরং এই মেয়েই ওকে দেখে নেবে টাইপ। ট্রেনে ওই লোফার টাইপের ছেলেগুলোকে বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল নৈঋতের। আর হবে নাই বা কেন, এমন যার বাবা তার মেয়ে তো এমনিই হবে। মেয়েকে গানের বা নাচের স্কুলে ভর্তি না করে মার্শাল আর্টে ভর্তি করে দিয়ে আসে। আরে ভবিষ্যতের কথাও তো ভাবতে হয় নাকি। এই মেয়ের যার সঙ্গে বিয়ে হবে তার দিকটাও তো বিবেচনা করা উচিত ছিল ভদ্রলোকের। নাকি ভেবেছিলেন, রাতের বেলা একটা কিকে মেয়ে পাশে শুয়ে থাকা আগাছাকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে একাই গোটা বিছানায় রাজ করবে! বাঃ, কি উচ্চ ভাবনাচিন্তা ভদ্রলোকের। নৈঋত আর বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে ঢুকে একটা প্রশ্ন করবে মনস্থির করলো! খুব নিরীহ প্রশ্ন, কিন্তু উত্তরটা অনিরুদ্ধবাবুকে দিতেই হবে। ভদ্রলোক তো জানতেন, ও কলেজের প্রফেসর। রীতিমত নোবেল জব। মারামারি, দাঙ্গা এসব নয়। কলম আর বইয়ের সঙ্গেই ওর সদ্ভাব। ওর একাডেমিক কেরিয়ারে কোনোদিন লেবু দৌড়ে জেতার রেকর্ড নেই, এরা কি ওকে অলিম্পিকে বক্সিং-এ গোল্ড জেতা পাবলিক ভেবেছিল নাকি? নিশ্চয়ই ভেবেছিল তাই এমন ফুলনদেবীর সঙ্গে ওর বিয়ে দিতে চেয়েছিল। না, ভদ্রলোককে উত্তর দিতেই হবে, কোন আক্কেলে উনি মেয়েকে এসব শিক্ষা দিলেন! মানে এই মুহূর্তে নৈঋতের সমস্যাটা হলো, ওই মেয়ের প্রেমে পড়েছে ওর বেহায়া, নির্লজ্জ, অপমানের ভাষা না বোঝা মন, এদিকে একে বিয়ে করলে কপালে চূড়ান্ত ভোগান্তি, এটাও টের পাচ্ছে ওর অতি সাবধানী মন। এমন অবস্থায় জন্য দায়ী এর বাবা। কোথায় মেয়েকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিয়েটা দিয়ে দেবে পরের লগ্নে তা নয় কোথায় কোন সত্য উদঘাটনে পাঠিয়ে দিচ্ছে ওর হতে হতে না হওয়া বৌটাকে। এরপর কি আর অহনাকে ফিরে পাবার ক্ষীণ আশাও অবশিষ্ট থাকলো নৈঋতের! বাড়ি ফিরলেই মা হয়তো এই অপমানের বোঝা হালকা করতে জেদ ধরে এ মাসেই নৈঋতের বিয়ে দেবে। আর বাবা এবারে নিতান্ত ঘরোয়া আলতা পরা, নূপুর পরা, ওগো হ্যাঁগো বলা মেয়ে খুঁজবে। উফ, সেই ন্যাকা মেয়েকে নিয়ে নৈঋত ঠিক কি করবে! অহনার প্রেমে যে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে উঠবেই বা কি করে! এমন বিপদে বোধহয় স্বয়ং ভগবানও পড়েননি। তাই যে সিচুয়েশনের সলিউশন ভগবানের কাছে নেই, সেটা ওকে দেবেনই বা কি করে! ভগবান ওকে উদ্ধার করতে পারবেন না এই সংকট থেকে। একমাত্র ভরসা মেয়েকে চূড়ান্ত প্রশ্রয় দেওয়া নৈঋতের পরম শত্রু বাবাটাই। একেই ম্যানেজ করতে হবে। বিজুকাকা কাটা গায়ে নুনের ছিটের মতই অহনার ছোটবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত তোলা সব ছবি সমেত একটা অ্যালবাম দিয়ে বলেছিল, দাদাভাই তুমি একা একা বোর হবে তাই এটা দিলাম, দেখো বসে বসে। নৈঋত মনে মনে হেসে ভেবেছিল, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ইন দ্য ইয়ার অফ ১৭৬১-র পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ স্বচক্ষে দেখেছেন। নাহলে কেউ বাড়িতে এলেই পুরোনো অ্যালবাম ধরিয়ে দেয় বোরনেস কাটানোর জন্য! অচেনা সব লোকেদের দেখে ওর কি লাভ আছে! অনিরুদ্ধবাবুর স্টাডিতে সবরকম বইই আছে। ভদ্রলোক বইপ্রেমী সেটা বোঝাই যাচ্ছিল কালেকশন দেখে। একটা বই হাতে নিয়ে মোবাইলটা প্লাগ পয়েন্টে চার্জ করতে দিলো। চার্জারটা বোধহয় অনিরুদ্ধবাবুর এক্সট্রা, গায়ে হালকা ধুলোর উপস্থিতি তাই বলছে। তবুও সে এখনও সচল আছে সেটা জানান দিলো নৈঋতের বন্ধ ফোনে ভাইব্রেট করে।
বইপত্র দেখা হলে আলগোছে অন্যমনস্কভাবেই বিজু কাকার দেওয়া পুরোনো অ্যালবামটা উল্টে ফেলেছিল। আর তখনই বুঝেছিলো, এ বাড়ির প্রতিটা মেম্বার ঠান্ডা মাথায় খুনি। এমন কি পরিচারক অবধি। নাহলে অহনার প্রেমে পড়বো কি পড়বো না ভাবা ওর সচেতন মনটাকে এক ধাক্কায় গভীর গর্তে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা কেউ করে যায়! সেই ছোটবেলার আদুরে তিতির থেকে স্কুলের জেদি মেয়েটা, কলেজের হরিণ চোখের চাউনির অহনা আর এখনকার আত্মঅহংকারী রিপোর্টারের বিভিন্ন পোজের ছবিগুলো কেউ ষড়যন্ত্র করে ওকে দেখায়!
ওগুলো দেখার পর থেকেই ও বুঝতে পেরেছে ওর মন আর ওর বশে নেই। তাই এ বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে প্রোপজটুকু অন্তত সেরেই যেতে হবে, এছাড়া কোনো রাস্তা নেই ওর। প্রপারভাবে প্রোপজ করলে যদি মেয়ের মনটা গলে তাহলে নেক্সট লগ্নে বিয়ের একটা চান্স ছিল। কিন্তু এখন বাবা, মেয়ের কথা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারলো, ঝুলপির চুলে পাক না ধরা পর্যন্ত অহনাকে ও পাবে না। হে ভগবান, এই ভদ্রলোক বাবা না কসাই! মেয়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম, নিজের জগতে বিরাজমান, আশেপাশের কার কি হলো দেখার অবসর নেই। কে ওনার থুতনির তিলে আটকে গেলো দেখার দরকার নেই, কে ওনার হালকা হাসির মায়ায় গৃহ ত্যাগ করবে পন করলো সেদিকেও দৃষ্টি নেই, কে ওনার অসহ্য ব্যক্তিত্বের মায়াজালে ভূপতিত হলো সেদিকেও খেয়াল নেই, উনি চলেছেন নিজের লক্ষ্যে। নৈঋত নিজের চুলের মুঠিটা ধরে আরেকটু সাহস সঞ্চয় করে নিলো, অহনার সম্মুখীন হতে গেলে যেটা দরকার সেটা হলো অদম্য সাহস।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নৈঋত বললো, অহনা, আসতে পারি ভিতরে?
।।২১।।
এসো, ওকে ভিতরে নিয়ে আয় প্রিয়া। অনিক আমি তোমার ছবি দেখেছি প্রিয়ার মোবাইলে। প্রিয়া যদিও প্রথমে বলেছিল, জাস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু তারপর আমার জেদি মেয়েটার মুখ দেখেই বুঝেছিলাম, বন্ধু শব্দটা বোধহয় সব সম্পর্কেই প্রযোজ্য। প্রিয়া অবাক হয়ে মাকে দেখছিলো। সেই ছোট থেকে দেখেছে ফিসফিস করে কথা বলে ওর মা। বাবার মারের ভয়ে সব সময় যেন তটস্থ। এদিক ওদিক তাকিয়ে কেমন একটা ঘোলা চোখে গলা খাদে নামিয়ে কথা বলা মাকে এই মুহূর্তে মেলাতে পারছে না প্রিয়া। এমন পরিষ্কার উচ্চারণে এমন সাবলীলভাবে কথা বলতে তো কখনো মাকে দেখেনি ও। আজ মাকে খুব মিষ্টি লাগছে। একটা হালকা বেগুনি শাড়ি পরেছে, সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। সিঁথিতে সিঁদুর রয়েছে কিন্তু খুব অল্প, বড্ড অবহেলায় পরা যেন। অন্য দিনের মত টকটকে চওড়া নয়। কপালে একটা মেরুন টিপ, কানে দুটো সোনার টপ, ফাঁকা গলা। এই অল্প সাজেই মাকে যেন দুর্গা ঠাকুরের মত লাগছে। অনিক ভিতরে এসে বসতেই প্রিয়া কারণ ছাড়াই মাকে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বললো, এইটুকু সেজে থাকতে পারো তো মা। মা হেসে বললো, আমি সাজলে তোর বাবার মনে হয় কারোর সঙ্গে আশনাই চলছে, তাই আরও মারে। প্রিয়া বললো, আজ হঠাৎ অনিককে ডেকে কেন পাঠালে মা? বাবা এসে গেলে কিন্তু ওকে অপমান করতে ছাড়বে না। মা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো, ওই অসুরের হাত থেকে যখন তোকে এতকাল রক্ষা করতে পেরেছি, তখন বাকিটুকু ভরসা কর। আজ সে দূরে গেছে। বোধহয় সপ্তাহখানেক ফিরবে না। কাউকে একটা ফোনে বলছিলো। আমার হাতে দু-হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললো, এক সপ্তাহ চালাবি, একটাও বেশি খরচ করবি না। তাই তো দেরি না করে অনিককে ডাকতে বললাম। আমি বেরোলে ঠিক ওর চ্যালারা খবর দিয়ে দেবে ফোনে। সেই জন্যই অনিককে আসতে হলো।
অনিক হেসে বললো, আন্টি এ কিন্তু ভারী অন্যায়। আমায় বসিয়ে রেখে আপনারা আমার নামে আলোচনা করছেন লুকিয়ে লুকিয়ে। প্রিয়া হেসে বললো— মা কানে কানে বললো, বড্ড বাজে ছেলে, একে বিয়ে করিস না।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখে জল চলে এসেছিল দীপশিখার। প্রিয়াকে এত খুশি লাস্ট কবে দেখেছে মনে নেই দীপশিখার। মেয়েকে চোখ পাকিয়ে বললো, চুপ, শান্ত-ভদ্র ছেলেটার সঙ্গে কেন এমন দুষ্টুমি করছিস প্রিয়া? যা, আজ তুই চা করে নিয়ে আয়। আমি একটু অনিকের সঙ্গে গল্প করি। প্রিয়া হাসতে হাসতেই চলে গেল রান্নাঘরে। প্রিয়া চলে যেতেই দীপশিখা বললো, অনিক তোমাকে একটা কথা ফ্র্যাঙ্কলি বলতে চাই, তুমি কি সত্যিই প্রিয়াকে বিয়ে করবে? মানে সম্পর্কটা নিয়ে তুমি সিরিয়াস? অনিক বেশ গম্ভীর গলায় বলল, হ্যাঁ আন্টি, আমি আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস। তবে প্রিয়া সিরিয়াস নয়। ওকে আমি যতই বোঝাতে যাই, ও বলে ওর মত ফ্যামিলির মেয়েকে নাকি আমার বিয়ে করা উচিত নয়। আন্টি আমি ওর বাবার কথা সবটুকু জানি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি শুধু প্রিয়াকেই চাই, ওর কোনোরকম ব্যাকগ্রাউন্ড আমি দেখতে চাই না। আমি ওকে ভালোবাসি আন্টি। দীপশিখা বললো, কিন্তু তোমার বাড়ি? পরিবারের বাকি সবাই কি পীযুষ বিশ্বাসের মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নেবে? অনিক দৃঢ় গলায় বলল, না নিলে ওই পরিবার আমায় ছাড়তে হবে। তবে আমার মা বলেছে, তোর সুখেই আমার সুখ অনিক। প্রিয়াকে মায়ের অপছন্দ নয়। বাবার একটু অমত আছে, সেটা প্রিয়ার বাবার বদনামের জন্যই হয়তো। ওটুকু আমি মানিয়ে নেব। দীপশিখা বললো, অনিক তোমায় যদি আমি বলি রেজিস্ট্রিটা করে রাখো, আনুষ্ঠানিক বিয়ের আগেই লুকিয়ে, তুমি রাজি হবে?
অনিক চেয়ার থেকে উঠে এসে দীপশিখার হাত দুটো ধরে বলল, প্লিজ আন্টি আপনি শুধু প্রিয়াকে রাজি করান। আমি কালকেই ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে বলবো পেপার রেডি করতে। তারপর একমাসের মধ্যেই রেজিস্ট্রিটা সেরে আসবো। প্রিয়া সার্ভিস পেলেই আনুষ্ঠানিক বিয়ে করবো। দীপশিখা বললো, অনিক কিছু মনে কোরো না। আমি ওর বাবাকে বিশ্বাস করি না। যে কোনো দিন যে কারোর সঙ্গে জোর করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবার চেষ্টা করতে পারে, আমার ক্ষমতা খুব সীমিত। আমি হয়তো প্রিয়াকে বাঁচাতে পারবো না। তাই এমন অনুরোধ করলাম। অনিক হাসি মুখে বললো, আমার মনের কথাটা বলে দিলেন আন্টি। প্রিয়া চা আর ঘরে বানানো শিঙারা, ঘুগনির প্লেট নিয়ে ঢুকতেই অনিক বললো, তুই যে রোজ রোজ বলিস, তোর বাড়ির পরিবেশ খুব খারাপ, কই কোনোদিন তো বলিস না এবাড়িতে একজন মা আছেন, যিনি ছেলেমেয়ের মনের না বলা কথাও বুঝতে পারেন। প্রিয়া টেবিলে খাবারের ট্রেটা রেখে বললো, জানতাম, আমার অনুপস্থিতিতে আমার সব বদগুনগুলো জেনে নিবি মায়ের কাছ থেকে।
দীপশিখা বললো, অনিক, বিশেষ কিছু আয়োজন করতে পারিনি। সবটুকুই ঘরে বানিয়েছি, খেয়ে নাও।
অনিক খেতে খেতেই বললো, আন্টি, এসব রান্না কিন্তু মেয়েটাকে একটু শিখিয়ে পরিয়ে পাঠাবেন। নাহলে মেয়ে তো শুধু বকতে ঝকতেই পারে আমায়! প্রিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, তোকে বলেছি না, বিয়ের কথা সিরিয়াসলি বলবি না, আমি ওটা নিয়ে স্বপ্ন দেখি না। একটা চাকরি জোগাড় করে মাকে নিয়ে এ বাড়ি ছাড়বো, ব্যস, এটুকুই স্বপ্ন। ঘর-সংসার, লালচে বেনারসি, সিঁথিতে আদুরে সিঁদুর, একাধিপত্যের রান্নাঘর এসব আমার জন্য নয়। তুই জানিস সবটুকু অনিক। তাই অকারণে এসব বলে মাকে কনফিউশনে ফেলিস না প্লিজ।
অনিক বললো, আন্টি শিঙারা আমার দারুন পছন্দ হয়েছে, সত্যি বলতে কি মৌচাক সুইটসকে হার মানাবে। এখন আপনি বলুন তো, আমাকে আপনার জামাই হিসাবে পছন্দ কিনা? এই বাজারে আমি সরকারি চাকরি জোগাড় করেছি। একজনকেই ভালোবেসেছি জীবনে। মা বলে, আমার ছেলেকে একটুকরো চাঁদ নয়, পুরো চাঁদের মত দেখতে। এত গালাগাল সহ্য করেও আমার ওয়ান ট্রাক মাইন্ড, আমি প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাসেই অগাধ বিশ্বাস রেখে এসেছি দীর্ঘদিন ধরে। এবারে বলুন আন্টি, এরপরেও যদি আমি বঞ্চিত হই তখন কি আপনি আমার পাশে দাঁড়াবেন না ?
অনিকের কথা বলার ধরনটি বড় পছন্দ হলো দীপশিখার। খুব কম সময়ে ছেলেটা মানুষকে আপন করে নিতে পারে। দীপশিখা বললো, আমি এখনো তোমার পাশেই আছি। শোন প্রিয়া, অনিকের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। তোরা খুব তাড়াতাড়ি রেজিস্ট্রি করে রাখবি। পরে সুযোগ মত বিয়েটা দেওয়া যাবে। তোর বাবাকে আমি বিশ্বাস করি না প্রিয়া, হয়তো কারোর কাছে টাকা নিয়ে তার সঙ্গে তোর বিয়ে দিয়ে দেবে জোর করে। তখন আমাকে চুপচাপ সেটা মেনে নিতে হবে, তাই আমি চাই তোর রেজিস্ট্রিটা হয়ে থাকুক। তাহলে ও আর কিছু করতে পারবে না। প্রিয়া এতক্ষণে বুঝতে পারলো, মা কেন কদিন ধরে অনিকের বিষয়ে জানতে এত আগ্রহী হয়ে উঠেছিল! এই জন্যই আজ সুযোগ পেয়েই অনিককে ডেকে আনতে বলেছিল বাড়িতে। তার মানে বাবা নামক ওই জানোয়ারটা কি প্রিয়ার বিয়ে সম্পর্কে কিছু বলেছে মাকে? সেইজন্যই মা ভয় পেতে শুরু করেছে? যতই মুখের সামনে ঐ লোকটার বিরোধিতা করুক ও, আসলে ভিতরে ভিতরে ওই সাইকো লোকটাকে ভয় করে। মায়ের কাছে গল্প শুনেছে লোকটা নাকি একদিন মদ্যপ অবস্থায় মায়ের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। মায়ের পরিত্রাহি চিৎকারে পাশের বাড়ির কাকিমা এসে বাঁচিয়েছিলো। সেই থেকেই সামনে প্রতিবাদ করলেও ওই লোকটাকে দেখলে ভিতরে ভিতরে আতঙ্কে থাকে প্রিয়া। এই লোক সব পারে, প্রিয়ার মুখে অ্যাসিড ঢেলে দেবার হুমকিও দিয়ে রেখেছে পীযুষ বিশ্বাস, প্রিয়ার বায়োলজিক্যাল বাবা।
অনিক বলছিলো, তাহলে আন্টি, আমি বরং ঐদিনের জন্য একটা রেড আর ইয়োলো কম্বিনেশনে বেনারসি কিনে রাখি। যতই হোক বিয়ে বলে কথা, বেনারসি, পাঞ্জাবি, মালা না হলে কেমন যেন ফিলিংস আসে না। দীপশিখা হেসে বললো, আমরাও একটা শর্ত আছে, বরের পাঞ্জাবি আর কনের বেনারসির খরচ আমার। প্রিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, ক্লান্ত অবশ্রান্ত চোখ দুটোতে স্বপ্নীল দৃষ্টি ফুটেছে। মেয়ের বিয়ের স্বপ্নে ঠোঁটের কোণে নিশ্চিন্ত হাসি দেখা দিয়েছে একটু। নির্মম হতে মন চাইলো না প্রিয়ার। তাছাড়া সত্যিই যদি বাবা জোর করে ওর বিয়ে দিয়ে দেয়, অনিককে ছাড়া পারবে অন্য কারোর বাহুলগ্না হতে! ঘৃণা হবে যে নিজের ওপরেই! মনে হবে, অনিক রাজি ছিল, মা সুযোগ করে দিয়েছিল, শুধু ওর জেদেই সব নষ্ট করে দিয়েছিল ও। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রিয়া বললো, এখনো দেখছি নারীদের ইচ্ছের মূল্য কেউ দেয় না, তাই আমার অনুপস্থিতিতে এই প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে। শাশুড়ি জামাই যখন নিজেদের সম্পর্কটা ঠিক করেই নিয়েছে তখন আমি আর কি বলবো। বাধ্য হয়ে জব পাবার আগেই রেজিস্ট্রি করতে হবে। আসলে কি বলতো অনিক, এ বাড়ি থেকে আমি কোনো শুভ কাজ করতে চাইছিলাম না রে। ভেবেছিলাম মাকে নিয়ে অন্য জায়াগায় শিফট যদি করতে পারি তবেই বিয়ে করবো। অনিক নরম গলায় বলল, তুই যতদিন সময় চাস দেব। এখনকার বিয়েটা না হয় কাগজ কলমে সাক্ষী রেখেই হোক। এটুকু বিশ্বাস বোধহয় তুই করতে পারিস। দীপশিখা বললো, তোমরা কথা বলো, আমি দেখি ফোনটা বাজছে রিসিভ করি।
ফোনটা হাতে নিয়ে একটু হন্তদন্ত হয়েই বেরিয়ে গেল দীপশিখা।
অনিক ইশারায় বললো, তোর থেকে আন্টির দরদ বেশি আমার প্রতি। আয়, একবার কাছে আয়। একবার ছুঁয়ে দেখ বুকের বাম দিকটা, নিজেকে খুঁজে পাস কিনা দেখ।
প্রিয়া এসে অনিকের বুকে মাথা গুঁজে বললো, ছুঁড়ে ফেলে দিবি না তো কোনোদিন? আমার জীবনে দেখা প্রথম পুরুষ পীযুষ বিশ্বাস, তাই পুরুষ শব্দটাকে শুধু ভয় নয়, মারাত্মক ঘৃণা করি রে। পারলে ওই ঘৃণা মিশ্রিত ভয়টাকে তাড়িয়ে দিবি আমার মন থেকে? অনিক আলতো করে হাত রাখল প্রিয়ার পিঠে, নরম গলায় বলল, কথা দিলাম কয়েক বছরের মধ্যেই পুরুষ শব্দের সমার্থকে তুইই লিখবি— ভালোবাসা, বিশ্বাস, নির্ভরতা।
দীপশিখা ইচ্ছে করেই ফোনটা ঘরে ওদের সামনে ধরেনি। ওদের এই আনন্দঘন মুহূর্তটুকুকে নিমেষে নিঃশেষ করে দিতে চায়নি। তাই স্ক্রিনে পীযুষ নামটা দেখেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। ফোনটা ধরতেই জড়ানো গলায় বলল, কি রে শালী, আমি যেমনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি বাড়িতে খদ্দের ঢুকিয়েছিস? কেন রে, খুব গরম ধরেছে বুঝি তোর? দীপশিখা জানতো কেউ না কেউ ঠিক দেখবে অনিককে এই বাড়িতে ঢুকতে। ফ্রিতে মজা নেবার জন্যই খবরটা ফোনে পৌঁছে দেবে পীযুষের কাছে।
গলাটা স্বভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বললো, কই কেউ তো আসেনি! তারপরেই কিছু যেন মনে পড়ে গেছে এমন ভাবে বললো, একটা ছেলে বাড়ির সামনে ছানা বিক্রি করছিল, তাই কিনেছি। বাড়িতে তো নয়, বাড়ির গেটের সামনে কিনেছি। পীযুষ একটু থমকে গিয়ে বলল, সত্যি বলছিস তো?
দীপশিখা গলার ওঠানামা বুঝতে না দিয়েই বললো, হয় নিজে এসে দেখে যাও, নাহলে যে খবরটা দিলো তাকেই বাড়িতে পাঠাও। পীযুষ গালি দিয়ে বললো, বেশি চালাকি করবি না মাগি আমার সঙ্গে। মনে রাখিস, ছানা, দুধ জুটছে আমার পয়সাতেই। দীপশিখা কায়দা করে বললো, তুমি কি রাতে ফিরবে? তাহলে তোমার জন্য রেখে দেব ছানা। পীযুষ একটু চেঁচিয়েই বললো, ন্যাকা মেয়েছেলে, জানিস না, আমি দূরে কাজে এসেছি, এক সপ্তাহ পরে ফিরবো। তাই বলে এই সুযোগে যদি কোনো বেগড়বাই করিস তুই বা তোর মেয়ে, তাহলে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেব দুটোকেই। চুপচাপ ঘরের মধ্যে থাকবি। বাইরের গেটে দাঁড়িয়ে নাগর খোঁজার দরকার নেই। ফোনটা কেটে দিলো পীযুষ। কিন্তু এই লোকটাকে একটুও বিশ্বাস করে না দীপশিখা। হয়তো এখুনি কোনো বোতলের বন্ধুকে বাড়িতে পাঠিয়ে খোঁজ নেবে, কেউ আছে কি না ভিতরে। তাই আর দেরি না করেই ডাকলো প্রিয়া, অনিককে একটু এগিয়ে দিয়ে আয়। অনিক, আমি পরে প্রিয়ার ফোন থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলবো। তুমি রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজটা কমপ্লিট করো বাবা। অনিক দীপশিখাকে প্রণাম করে বললো, চিন্তা করবেন না, খুব তাড়াতাড়ি আমি প্রিয়াকে রেজিস্ট্রি ম্যারেজে করছি। ততদিন ওকে একটু সামলে রাখুন প্লিজ আন্টি। প্রিয়া বেরিয়ে গেল অনিককে নিয়ে। বেশ জোরেই দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়লো দীপশিখা।
পীযুষের মদের ঠেকের বন্ধুরা কেন যে এভাবে নজর রাখে ওদের বাড়ির ওপরে কে জানে! বোধহয় পীযুষ নির্দেশ দিয়ে যায় ওদের। ভয় করে খুব, প্রিয়া বড় হয়েছে, যদি এই সব মাতালগুলো কোনো একটা সর্বনাশ করে দেয় মেয়েটার। যার বাবা এমন তার মেয়েও যে সহজলভ্য হবে এমনই ধারণা জন্মাতে কতক্ষণ! হয়তো কোনোদিন সবাই মিলে প্রিয়াকে ধরে …আর ভাবতে পারছে না দীপশিখা। অনিক এখনকার প্রিয়াকে ভালোবাসলেও তখনকার প্রিয়াকে কিছুতেই বিয়ে করবে না। সমাজ সংসার এখনো বোধহয় রেপ হওয়া মেয়েকে মেনে নিতে পারে না বউ হিসেবে! নিরপরাধ হলেও নয়। কেমন যেন সাদা পাতায় অনেকটা কালির দাগের মত। কিছুতেই ওঠে না। অথচ বিয়ের পর থেকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে যে ধর্ষিতা হয়ে যাচ্ছে দীপশিখা সেটার খোঁজ সমাজ কোনোদিন রাখে না। বৈবাহিক সম্পর্কে বোধহয় ধর্ষণের ছাড়পত্র দেওয়া হয় একচেটিয়া। পীযুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ওর শরীরটা। মনের ওপরে আধিপত্য বিস্তার করার কোনো চেষ্টাই কোনোদিন করেনি পীযুষ, ওর শুধু শরীরটুকুই দরকার ছিল। সাড়া না দেওয়া শরীরটুকু নিয়েই কাটাছেঁড়া করেছে ও এত বছর। মেয়ের বিয়ে দেবার বয়েস হয়ে গেছে ওর তবুও ওর ক্লান্ত যোনীকে বিশ্রাম দেয়নি পীযুষ। এখনো মদ্যপ অবস্থায় দীপশিখার বিশ্রাম চাওয়া যোনীদেশে চলে পীযুষের অকথ্য অত্যাচার। কষ্ট সহ্য করতে করতে দীপশিখার মনে হয়, খুন করা কি সত্যিই খুব অপরাধের! না দীপশিখা খুনি হতে পারেনি, পারেনি বলেই দিনের পরদিন সহ্য করে চলেছে ওই অমানুষটাকে। আগে আগে পীযুষের অনুপস্থিতিতে দরজা বন্ধ করে বাবার শেখানো গানের দুকলি গাওয়ার চেষ্টা করতো কিন্তু সেখানেও বারবার সামনে এসে দাঁড়াতো বিজয়ের মুখটা। বিজয়ের গাওয়া গান কানের কাছে যেন বেজে যেত অনবরত। বিজয়কে ভোলার আপ্রাণ চেষ্টাতেই গানকেও ত্যাগ করেছিল দীপশিখা। তখন একপ্রকার তীব্র অভিমানের বশবর্তী হয়েই পীযুষকে বিয়ে করেছিল ও। নাহলে বাড়ির কেউই পীযুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়নি ওর। বিজয়ের সঙ্গে দীপার বিয়েটা ঠিক হবার পরেই বাবা বলেছিল, বিয়ের আগে বাড়িটা রং করিয়ে নিলে মন্দ হয় না। সেই রং করানোর সূত্রেই ডেকেছিলো পীযুষকে। ও ওর দুটো রঙের মিস্ত্রি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল দীপাদের বাড়িতে। দীপা চা-মুড়ি দিতে গেলেই ওকে দেখে নোংরা ইশারা করতো। একদিন পথ আগলে বলেছিল, আমায় বিয়ে করবি? তোর ওই গায়ক বরের থেকে অনেক বেশি ইনকাম করি আমি। নেহাত বেশ কিছুদিন কাজ ছিল না তাই এখন সব ছোটখাটো কাজই নিচ্ছি। নাহলে আমি বড় বড় ফ্ল্যাটের কাজ করি শহরে। দীপা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, যেটা করতে এসেছেন করে মজুরি নিয়ে বাড়ি যান। অসভ্যতামি করবেন না। আর হ্যাঁ, বিয়েতে নিমন্ত্রণ খেতে আসবেন যেন। দীপার বড়মুখ করে বলা কথাটা শুনে বোধহয় সেদিন ভগবানও অলক্ষ্যে হেসেছিল। তাই বিজয়ের বাবা আচমকা অতগুলো টাকা বর পণ চেয়ে বসেছিলো। অত সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও কেন যে দীপার গরিব বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতে হয়েছিল সেটাই বুঝতে পারেনি দীপা। ভেবেছিল বিজয় হয়তো প্রতিবাদ করবে, রুখে দাঁড়িয়ে বলবে, ও দীপাকেই বিয়ে করবে। কিন্তু দীপার শেষ আশাটুকুকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছিল বিজয়ের ভীতু চেহারাটা। বিজয় আস্তে আস্তে বলেছিল, ক্ষমা করো। বিয়ের আসর থেকে বেনারসি, সোলার মুকুট, গলায় রজনীগন্ধার মালা পরা দীপাকে ফেলে রেখে বাবার সঙ্গে চলে গিয়েছিল বিজয়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বসেছিলো দীপা। ওর বাবা, দিদিরা কাঁদতে শুরু করেছিল। লগ্নভ্রষ্টা মেয়েকে নিয়ে বাবা ঠিক কি করবে বুঝতে পারছিল না। দীপার চোখে পড়েছিলো পীযুষ একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেঙে যাওয়া বিয়ের মজা দেখছে। দীপা ইশারায় ওকে ডেকে বলছিলো, বিয়ে করবে আমায়? পীযুষ হাতে চাঁদ পাওয়ার মত গলায় বলেছিল করবো। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। ওই গায়কের জন্য সাজানো বিয়ের আসরে আমি বিয়ে করবো না। এর পরের যে ডেটটা আছে, তাতে বিয়ে করবো আমি। আমার কিছু চাই না, কিন্তু বর আনতে গাড়ি পাঠাতে হবে তোমার বাবাকে। দীপার কথা শুনে দিদিরা বলেছিল, এটা ঠিক হচ্ছে না দীপা। একটা মদ্যপ রঙের মিস্ত্রি আমাদের বাড়ির জামাই হতে পারে না। দীপা শোনেনি কারোর কথা, ওর তখন একটাই উদ্দেশ্য ছিল বিজয়কে দেখিয়ে দেবে। বিজয়ের চোখের সামনে দিয়ে ও অন্যের হয়ে যাবে। অন্ধ অভিমানের বশবর্তী হয়েই পীযুষের মত মেয়েদের নোংরা ইঙ্গিত দেওয়া পুরুষকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছিল দীপশিখা। কয়েক দিনের মধ্যেই সকলের অমতে পীযুষকে বিয়ে করে বিজয়ের বাড়ির সামনে দিয়ে ফুলে সাজানো গাড়ি করে চলে এসেছিল দীপা। পরে অবশ্য শুনেছিল, বিজয়ের অন্যত্র বিয়ে দিতে চেয়েছিল ওর বাবা, বিজয় নাকি গ্রাম ত্যাগ করেছিল। বিজয় ঠিক কোথায় আছে, কি কাজ করে, বেঁচে আছে কিনা তাও জানে না গ্রামের কেউ। দীপশিখাও জানে না কেমন আছে বিজয়, শুধু এটুকুই জানে বিজয়ের ওপরে অভিমান করেই এভাবে নিজের জীবনটা শেষ করেছে ও। পীযুষের সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করার সময় মনে মনে বলেছে, বিজয়দা আমি তোমায় সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। যদি এসব সহ্য করে বেঁচে থাকি, তাহলে এজন্মেই আরেকবার সম্মুখীন হবো তোমার। একটাই প্রশ্ন করবো তোমায়, ভালোবাসা কি অন্যায় বিজয়দা? জানতে চাইবো আজও গান করো তুমি? আমি গান ছেড়েছি তোমায় ভুলতে, গান ভুলে গেলেও তোমায় ভুলিনি আজও। কখন যেন চোখের কোণে জল জমেছিল দীপশিখার অজান্তেই, প্রিয়া এসে বললো, কাঁদছো কেন মা? অনিককে তোমার পছন্দ হয়নি?
দীপা আঁচলের খুঁটে চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে বললো, পছন্দ হয়েছে রে। খুব সাহসী ছেলে, ভীরু নয়। তুই আমার মত ভুল করিসনি মানুষ চিনতে, তাই তো তোদের রেজিস্ট্রিটা করে দিতে চাই তাড়াতাড়ি।
প্রিয়া একটু চিন্তিত গলায় বলল, কিন্তু মা এই লোকটা তো সব খবর আগে পেয়ে যায়। যদি জানতে পারে কিছু, তখন তো তোমায় মারবে! আমি এই পোস্টঅফিসের জবটা মনে হচ্ছে পেয়ে যাবো। যদি এটা পেয়ে যাই, আমি আর অনিক ঠিক করেছি একটা দু-কামরার ফ্ল্যাট নেব। তখন ওখানে তুমি, আমি আর অনিক থাকবো। এই লোকটা ওখানে এন্ট্রি নিতে গেলে জাস্ট পুলিশে ইনফর্ম করব আমি। দীপশিখা হেসে বললো, সেকি জামাই বাড়িতে থাকবো? প্রিয়া জোর গলায় বলল, না মেয়ের বাড়িতে থাকবে, মেয়ের টাকায় খাবে, হ্যাপি?
দীপা বললো সে হবেখন। এখন শোন, আমার কাছে জমানো কিছু টাকা আছে, তুই আর অনিক একদিন বেরিয়ে বিয়ের পোশাকটা কিনে আনবি বুঝেছিস।
মা, এত তাড়াহুড়োর কি কিছু কারণ আছে?
আছে রে, নিশ্চয়ই আছে, ভালোবাসা হারিয়ে অন্যের সঙ্গে ঘর করার যে কি কষ্ট সেটা যদি জানতিস তাহলে বুঝতে পারতিস, কেন তাড়া দিচ্ছি। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিস, কল্পনায় যার সঙ্গে সংসার করেছিস তাকে হারিয়ে অন্যের ঘরনি হওয়ার থেকে মৃত্যু শ্রেয়। কিন্তু কি বলতো প্রিয়া, মৃত্যু হচ্ছে বড় দুর্মূল্য জিনিস, যে তাকে চায় তার কাছে সে যায় না, কিছুতেই যায় না। যে তাকে সাদরে গ্রহণ করতে চায় তাকে সে উপেক্ষা করে, আর যারা তাকে ভয় পায়, সে তাদের দুয়ারেই ফেলে তার নির্মম ছাপ। সুতরাং জীবন্ত লাশ হয়ে সারাটা জীবন অন্যের সংসার তোকে যাতে না করতে হয় আমি তার চেষ্টাই করছি। তুই অমত করিস না। অনিক খুব ভালো ছেলে, তোকে খুব ভালোবাসে, তুই ভালো থাকবি। প্রিয়া ঘাড় নেড়ে বললো, বেশ মেনে নিলাম তোমার কথা। এবারে বলতো, কাকে ভালোবাসতে তুমি?
দীপশিখা বললো, আমি বাসতাম, সে নয়। তাই সেসব আলোচনা থাক। চল, অনেক কাজ আছে, প্ল্যানটা ঠিকঠাক করতে হবে, তোর বাবা যেন টের না পায়।
।।২২।।
না মানে ওরা ঠিক কি ভেবেছিল বৌদি, যে আমরা কিছু টের পাবো না! অনুর চোখে মুখে তীব্র বিরক্তি। কাবেরী বললো, কিন্তু অনু এখনো কিন্তু আমরা পুরো ব্যাপারটা জানি না। মানে টুটাই কেন ওনার দেশের বাড়িতে গেল সেটাই তো ক্লিয়ার নয়। নীলাদ্রি বেশ গম্ভীর গলায় বলল, ভীষণ ইজি অংক কাবেরী, তোমার মত বুদ্ধিমতী মহিলার তো সমাধান না করার কথা নয়। অহনাই কোনো কারণে টুটাইকে প্রভোক করেছিল টুটাই যাতে বিয়ের আসর থেকে পালায়। টুটাই পালালে বর পালিয়েছের রব উঠবে, সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে অহনা পালাবে। খুব সহজ হিসেব। শুভ বললো, দাদা, আপনি বোধহয় ঠিকই বলেছেন। অনু ঘাড় নেড়ে বললো, ঠিক বলছিস দাদাভাই। ওই মেয়ের বুদ্ধিতেই টুটাই এমন করেছে। মেয়েটা কি মারাত্মক চালাক তুই শুধু একবার ভেবে দেখ। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পুরো দোষটা পড়বে টুটাইয়ের কাঁধে। আর মেয়ে লগ্নভ্রষ্টার কষ্ট নিয়ে সকলের কাছে থেকে সিমপ্যাথি আদায় করবে। আমারও মন বলছিলো, টুটাই এটা করতে পারে না। বাড়ির সম্মানের কথা ওর মাথায় একবারও আসবে না এটা হতে পারে না! তাছাড়া টুটাই একটা কলেজের প্রফেসর, ওর কলিগ, স্টুডেন্ট সকলের সামনে প্রেস্টিজ যাবে এমন কাজ ও করবে না। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ, হাওয়ার আগে কথা ছড়ায়।
কাবেরী অহনার হয়ে সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করে বললো, কিন্তু একটা হিসেবে একটু গন্ডগোল লাগছে আমার। কেন টুটাই অহনা এমন একটা কান্ড ঘটানোর পরেও ওর পিছন পিছন সূর্যপুর গেল? শুভ সঙ্গে সঙ্গে বললো, এগজ্যাক্টলি বৌদিভাই, আমিও ওই একই জায়গায় গিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি। কেন টুটাই ওখানে গেল। অনু বেশ বিরক্ত হয়ে বললো, তোমায় আর অংক মেলাতে হবে না। নিশ্চয়ই ওই মেয়ে টুটাইকে রাজি করিয়েছে ওকে ওখানে পৌঁছে দেবার জন্য। আর আমাদের ছেলেটা তো অভদ্রের মত বলতেও পারে না, যাবে না। তাই হয়তো ওকে বাবার বাড়িতে পৌঁছাতে গেছে। দেখ দাদাভাই এই মেয়ের সব গন্ডগোলে, মেয়ের বিয়েতে বাবা অনুপস্থিত। কি যেন কাজ পড়ে গেছে। এত সব গন্ডগোলের মধ্যে কেন টুটাইয়ের মত ভালো ছেলের বিয়ে হবে সেটা বলতে পারিস। যা হয় ভালোই হয়। আমি নিজে টুটাইয়ের যোগ্য কোনো ভদ্র ভালো মেয়ে দেখবো। কাবেরী কিছু বলার আগেই নীলাদ্রি বললো, সব অংকের উত্তর মিলে গেলেও কোনোভাবেই আমি আর ওই মেয়ের সঙ্গে টুটাইয়ের বিয়ে দেব না। এটা সকলে মনে রাখলে খুশি হব। কথাটা নীলাদ্রি কাবেরীর দিকে তাকিয়েই বললো। কাবেরী মাথা নিচু করে নিলো লজ্জায়। আসলে বসু বাড়িতে অহনাকে নিয়ে এত প্রশংসা করেছে যে এখন ওর দোষ শুনলে লজ্জাই করছে কাবেরীর। বলতে গেলে সকলের মতের কিছুটা বিরোধিতা করেই ও অহনাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল বউ হিসেবে। অহনার চোখের সততা এতটাই আকৃষ্ট করে রেখেছিল কাবেরীকে যে এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার সত্যিই কোনো দোষ থাকতে পারে। এতক্ষণ যখন শুনছিলো টুটাই পালিয়েছে তখনও বোধহয় এতটা কষ্ট হয়নি যতটা হচ্ছে বিশ্বাসটা অহনা ভঙ্গ করলো বলে! কিন্তু এই বয়েসে মানুষ চিনতে এমন গুরুতর ভুল করলো কাবেরী! মেয়েটাকে নিয়ে দুদিন শপিংয়ে গিয়েছিল কাবেরী, দেখেছিলো কিছুতেই দামি শাড়ি গয়না কিনতে চাইছে না ও। কাবেরীকে বলেছিলো, আন্টি অপচয় কোরো না। বিয়ের এই ভারী বেনারসি বা এই ভারী গয়নাগুলো আমি ঐ একদিনই পরবো, তারপর পরে থাকবে আলমারির কোণে, তাই বলছি এগুলোর পিছনে এতটা খরচ কোরো না। খবরের সন্ধানে বিভিন্ন গ্রামের দিকে যেতে হয় প্রায়ই। তখন দেখি, কত বাচ্চার জামার পিছনের হুকটা পর্যন্ত নেই, কত যুবতী ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে যৌবন ঢেকেছে কোনোমতে, কত পুরুষের জামার কলারে দারিদ্রের ছাপ, সে তুলনায় আমরা এমনিই প্রচুর বিলাসিতা করি। তারপর আর অপচয় কোরো না প্লিজ। আমি মাকেও বারণ করেছি, তাই তোমাকেও করলাম। তোমরা যদি সত্যিই আমায় কিছু দিতে চাও তাহলে টাকা দিয়ে দিও, আমি কয়েকটা আশ্রমের অনাথ শিশুদের দুদিন পেট ভরে খাইয়ে দেব। সেটা আমার বিয়ের বেস্ট গিফট হবে। কাবেরীর অবাক লেগেছিল। এইটুকু একটা মেয়ে এত লোভহীন হয় কি করে!
কাবেরীর সব হিসেব ওলোটপালোট হয়ে গেছে, তাই বুকের মধ্যে চিনচিনে যন্ত্রণাটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। অনেক আশা ছিল, অহনা এ বাড়িতে বউ হয়ে এলে নীলাদ্রি, নৈঋত থেকে এদের আত্মীয়স্বজন সকলে বুঝতে পারবে মেয়ে মানে সংসার সামলে হেঁসেলে ঢোকা নয়। অফিস ফেরত ক্লান্ত শরীরে সকলকে খাবার পরিবেশন করতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নয়। মেয়ে মানে নিজের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা নয়, বরং যাকে দেখলে মনে হবে স্বাধীনতা শব্দটা এর জন্যই তৈরি। যাকে দেখলে বিশ্বাস হবে মেয়েদেরকে নিজেদের অধিকার চেয়ে চেয়ে আদায় করতে হয় না, পুরুষদের মত সব অধিকারই মেয়েদেরও জন্মগত। শুধু প্রয়োগ করে না বলেই বেশ কিছু জায়গায় আজও পুরুষ এগিয়ে যাচ্ছে। না, পুরুষ বিদ্বেষ কাবেরীর নেই। শুধু অহনার মত মেয়েদেরকেও পুরুষরা হিংসে করে, এটাই দেখাতে চেয়েছিল ও। নৈঋত বারবার জিজ্ঞেস করেছিল, মা তুমি অহনার মধ্যে কি এমন দেখলে যে একবারে বউ করে আনতে চাইছো?
নীলাদ্রি বলেছিল, খুব যে ডানাকাটা পরী তাও তো নয়।
কাবেরী হেসে বলেছিল, এই হলো তোমাদের বড় রোগ। নিজের ছেলেকে পাড়ার অখাদ্য দানাদারের মত দেখতে হলেও বউ হিসেবে চন্দননগরের জলভরাই চাই।
নৈঋতকে দিয়ে যেমন অহনা বিয়ের পরে মডেলিং করাবে না, তেমনি নৈঋতও নিশ্চয়ই অহনাকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রেড কার্পেটে হাঁটানোর চিন্তা ভাবনা করছে না। তাই ডানাকাটা পরী কি হবে নীলাদ্রি? তোমার ছেলেও তো রূপকথার রাজপুত্র নয়, তাই না? টুটাই হেসে বলেছিল, মা তুমি তো দেখছি অহনার জন্য বেশ লড়ে যাচ্ছ। এবারে কিন্তু আমায় বিশ্বাস করতেই হচ্ছে, মেয়েটার মধ্যে সামথিং ইউনিক আছে যেটায় তোমার চোখ আটকেছে।
কাবেরী ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ, ওর সব থেকে বড় সম্পদ ও ভীষণ সৎ। জানি তোরা হয়তো হাসবি, বলবি ডুমুরের ফুল আর সৎ শব্দটা সমার্থক। তবুও আমি বলবো, যে ডুমুরের ফুল দেখেছে তাকে যেমন তুই বোঝাতে পারবি না এই ফুল হয় না, তেমনি আমাকেও বোঝাতে পারবি না সৎ মানুষ হয় না। এত কথা বলে রীতিমত সওয়াল করেছিল ও অহনার জন্য। সেই মেয়ে কিনা বয়ফ্রেন্ডের জন্য বিয়ের আসর থেকে পালালো? না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বয়ফ্রেন্ড থাকলে অহনা স্ট্রেইট বলতো, এই বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এর পিছনে অন্য কিছু আছে। জানতেই হবে কাবেরীকে। অহনা যে আর বসুবাড়ির বউ হতে পারবে না সে বিষয়ে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর হয়েই গেছে কাবেরী, তবুও সত্যিটা জানার জন্য ছটফট করছিল ও। বাড়িটা একটু ফাঁকা হলে সুচেতাকে কল করতে হবে।
সকাল থেকেই নীলাদ্রি ছোটাছুটি করছিল। ক্যাটারার থেকে ডেকরেটর, আত্মীয় থেকে কলিগ, পরিচিত সকলকে জানাতে হচ্ছে আগামীকাল ফুলশয্যার প্রীতিভোজটা হচ্ছে না বিশেষ কারণে তাই আপনারা আর কষ্ট করে এ বাড়িতে আসবেন না। বাকি যাদের পেমেন্ট করার সেগুলো মেটাচ্ছে নীলাদ্রি। ওকে দেখে কাবেরীর খারাপই লাগছে। দায়িত্ব থেকে বরাবর এড়িয়ে যাওয়া মানুষটাকে আজ বড় সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। এত লোককে ফোন করা থেকে শুরু করে একঘেয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাওয়া, তবুও যাক টুটাইয়ের খবরটা পেয়ে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে মানুষটা। নাহলে তো বলছিলো, থানায় যাবে মিসিং ডায়রি করতে। টুটাইয়ের ফোনটা যে কেন এখনো সুইচড অফ কে জানে। একবার কথা বলতে পারলে মনটা শান্ত হতো। শুভও সমানে হেল্প করছে নীলকে। শুভ সোফায় পা ছড়িয়ে বসে বললো, এই যদি বিয়েটা হতো দাদা, তাহলে আজকের সব পরিশ্রমকে কষ্ট মনে হতো না। কিন্তু যখনই মনে হচ্ছে বিয়েটা ভেঙে গেছে বলে আমরা ছুটাছুটি করছি তখনই যেন ক্লান্তি নামছে। ঠিক যেন দুর্গাপুজো হবার আগে প্যান্ডেল বাঁধার উৎসাহ আর দশমীর পরে প্যান্ডেল খুলে ফেলার নিরুৎসাহের মত, তাই না? নীলাদ্রি বিকেলের চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, অনিরুদ্ধবাবু বলেছিলেন কল করবেন সবটা জেনে। ভদ্রলোক আর কল করলেন না তো! সে যাকগে, বেশি জেনে লাভ নেই। ওই ফ্যামিলির সঙ্গে আমাদের যেহেতু আর কোনো যোগাযোগ থাকছে না, তাই নাড়িনক্ষত্র এখন জেনেই বা আমরা কি করবো, তাই না অনু?
অনু বিষণ্ণ মনে বললো, আমার ভাইপোটার সঙ্গেই এমন হতে হয় ভগবান! অনুর চোখটা ছলছল করছিল দেখে নীলাদ্রি বললো, এটা ভাবছিস কেন যে খুব খারাপ হয়েছে? বরং এভাবেও ভাবতে পারিস অনু, যে ওই মেয়ে যদি বিয়ের মাসখানেক পরে পালাত তাহলে এ বাড়ির কেমন বদনাম হতো, তারপর টুটাইয়ের মনের উপরেও প্রেসার তৈরি হতো অনেক বেশি। তার থেকে আমি তো বলবো ভগবান সঙ্গে আছেন বলেই যা ঘটার বিয়ের রাতেই ঘটে গেছে। আর আমাদের অফিসের ব্যানার্জীদাই তো টুটাইয়ের জন্য সম্বন্ধ এনেছিল। আমি তেমন পাত্তা দিইনি। ব্যানার্জীদার শালার মেয়ে, মেয়েটা বোধহয় মিউজিক নিয়ে পড়েছে, এখন কোনো কলেজের গেস্ট লেকচারার। অনু বললো, হ্যাঁ দাদা, এবারে যখন টুটাইয়ের জন্য পাত্রী দেখবি এমন স্কুল টিচার বা লেকচারার এমন দেখবি, এসব গেছো পলিটিক্যাল বিটে কাজ করা রিপোর্টার নয়, বুঝলি! কথাগুলো হয়তো ওরা এমনিই আলোচনা করছিল কিন্তু কেন কে জানে কাবেরীর গায়ে এসে লাগছিলো। বিশেষ করে এর কোনো প্রতিবাদও করার ক্ষমতা নেই ওর এই মুহূর্তে। টুটাই এখনও বাড়ি ফিরলো না এরা সবাই মিলে ওর মেয়ে দেখতে শুরু করে দিয়েছে। কালকের অমন বিশৃঙ্খল ঘটনাটা কাটিয়ে ওঠার জন্যই টুটাইয়ের খুব দ্রুত একটা বিয়ে দিতে হবে এমনটাই বোধহয় সকলে ভাবছে। অনু বললো, দাদা, তুই ওই ব্যানার্জীদাকে একটা কল করে দেখ না। পারলে আমরা কাল, পরশু যাবো মেয়ে দেখতে। দিন দশেক পরে আরেকটা লগ্ন আছে। ওই তো তুতানের ড্রয়িং টিচারের বিয়ে ওইদিন। ওই ডেটেই তাহলে টুটাইয়ের বিয়েটা দিয়ে দেব আমরা। নীলাদ্রি একটু ভেবে নিয়ে বললো, মন্দ বলিসনি। অন্তত মেয়েটার ছবিটা তো দেখা যেতেই পারে হোয়াটসআপে। তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নেব দেখতে যাবো কিনা। শুভময় এতক্ষণ চুপ করেই ছিল, এবারে বললো, হ্যাঁ আমিও থাকতে পারবো এই টাইমটা। আমার অফিসেও ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দেওয়াই আছে বিয়ে পার্পাসে। তবে অনু, টুটাই ফিরুক তারপর না হয়। কাবেরীও বলতে যাচ্ছিল একই কথা, তার আগেই নীলাদ্রি বললো, আমার মনে হয় টুটাইও চাইবে বিয়েটা সেরে ফেলতে, ওকেও তো কলেজ জয়েন করতে হবে। আমি চাই না, টুটাই ক্লাসে ঢুকলেই স্টুডেন্টরা চেঁচিয়ে বলুক, স্যার আপনার বউ কেন পালালো? ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্টুডেন্ট সম্পর্কে নিশ্চয়ই আমার থেকে তোমার ভালো ধারণা আছে শুভ, তাই তুমি নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছো টুটাইকে ঠিক কতটা অস্বস্তিতে পড়তে হবে কলেজে। আজ সন্ধেতেই আমি ব্যানার্জীদাকে কল করবো। দরকার পড়লে পুরোটা বলবো বুঝিয়ে, তাহলে ব্যানার্জীদাও সিচুয়েশনটা বুঝতে পারবে। অনু হাসি মুখে বললো, তাই কর দাদা। তুই ঠিকই বলছিস যা হয় ভালোর জন্য হয়। এসব রিপোর্টার, সাংবাদিক এদের জীবনে প্রবলেমের শেষ নেই, সারাটা জীবন টুটাইকে এসব সহ্য করতে হতো। কাবেরী ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আসার সময় শুনলো, নীলাদ্রি বলছে, এবারে আর আমি কারোর কথা শুনে দ্বিতীয় ভুল করবো না।
এ সংসারে পা দেওয়া থেকে সব মনে পড়ে যাচ্ছিল কাবেরীর। অনুর বিয়ে দিতে হবে বলে নীল তখন নিজের বিয়ে নিয়ে কিছুতেই ভাবতে রাজি নয়। কাবেরী বলেছিল অপেক্ষা করবো। তখন বোঝেনি এ সমাজে পড়াশোনা কমপ্লিট হয়ে যাওয়া, চাকুরিরতা মেয়ের কুমারী হয়ে থাকার পিছনের কারণটা সকলকে বোঝাতে বোঝাতে ও ক্লান্ত হয়ে যাবে। হয়েছিল ঠিক তাই, সকলেই জিজ্ঞেস করতো কাবেরী বিয়ে করছে না কেন? বয়েস তো হলো। চাকরি করছে, দেখতে শুনতে বেশ ভালো, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সম্বন্ধের পর সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিয়ে নীলের জন্য অপেক্ষা করছিল কাবেরী। নীলাদ্রির বাড়িতে কেউ কাবেরীর অস্তিত্বের কথাও জানতো না। কাবেরী ওর বাড়িতে নিলাদ্রীকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এবং বলেছিল ওদের সম্পর্কের কথা। নীল হেসে বলতো, তুমি বড্ড সাহসী কাবেরী। ও বলেছিল, যদি অনুর বিয়ের পর তোমার বাড়ি থেকে আমাদের সম্পর্কটা মেনে না নেয় তখন কি করবে নীল? না, নীলের কাছে এর সঠিক কোনো উত্তর ছিলো না। বলতো, সে পরের কথা পরে হবে। একটু ভয়েই যেন এড়িয়ে যেত কাবেরীর প্রশ্নটাকে। তবুও নীলের দোদুল্যমান উত্তরের ভরসাতেই অপেক্ষা করছিল কাবেরী। সেই কারণেই বোধহয় ওদের বিয়ের পর থেকেই নীলের ধারণা হয়েছিল কাবেরী সব সামলে নিতে পারে। তাই এ সংসারের সমস্ত দায়িত্ব ওর ওপরে দিয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিয়েছিল এতগুলো বছর। ওর বাবা-মাও কাবেরীকে ভরসা করতেন যতদিন বেঁচে ছিলেন। এই প্রথমবার নীলের মুখে কাবেরীকে বিশ্বাস না করার কথাটা শুনে তাই ভিতরে ভিতরে একটা অব্যক্ত কষ্ট দানা বেঁধেছিল। একেই বলে বোধহয় সংসারের জটিল অঙ্ক। নিরানব্বইটা ঠিকের পর একটা ভুল করলেই তুমি হয়ে যাবে ব্রাত্য। আগের সব গুন চিহ্ন মুহূর্তের ভাগ হয়ে গিয়ে তোমার স্কোর দাঁড়াবে এ বিগ জিরো। এই এখন যেমন সব কটা আঙুল কাবেরীর দিকে তাক করে বলছে, তুমি ভুল। না, টুটাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে আর কাবেরী কোনোরকম ইন্টারফেয়ার করবে না, বধূবরণ ছাড়া আর কোনো ভূমিকা থাকবে না টুটাইয়ের বিয়েতে। অনু, নীল, শুভময়, নীলের জ্যেঠতুতো দাদারা সবাই তো আছে, তারাই দায়িত্ব নিক। কাবেরী শুধু চায় টুটাই খুশি হোক।
সুচেতাকে একটা ফোন করে জিজ্ঞেস করবে কেন ওরা মা মেয়ে মিলে এভাবে কাবেরীর উঁচু মাথাটা নিচু করে দিলো লোকজনের সামনে, নিজের পরিবারে! এই উত্তরটা তো অহনা আর সুচেতা দুজনকেই দিতে হবে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শীতের দুপুর নিভে গিয়ে বিকেল নামা দেখছিলো কাবেরী। কত তাড়াতাড়ি মরা রোদের আলোটুকুকে শুষে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে সূর্য। পৃথিবীর বুকে এক ফোঁটা রশ্মিও যেন ফেলে যেতে রাজি নয় সে। বড় নিষ্ঠুর মনে হলো শীতের সূর্যকে।
।।২৩।।
সেদিন ঐরকম নিষ্ঠুর ভাবে কথাগুলো বলা বোধহয় ঠিক হয়নি অনিরুদ্ধকে। মানুষটা কাজের জন্য সময় হয়তো কম দিয়েছে সুচেতাকে কিন্তু দায়িত্ব থেকে কোনোদিন পিছপা হয়নি। সেই কলেজস্ট্রিট, প্রেসিডেন্সির দিনগুলো খুব মিস করে সুচেতা। তখনকার অনিরুদ্ধ অনেক বেশি সময় দিত সুচেতাকে। হয়তো তখনও সিনিয়র সাংবাদিক হতে পারেনি বলেই বাইরে ট্যুর করে এসেই পরের দিন ছুটে আসতো কলেজস্ট্রিট। কফিহাউসের ব্ল্যাককফিতে চুমুক দিয়ে অনেক লোকের ভিড়েও যেকোনো বাহানায় একবার ছুঁয়ে দিত সুচেতার আঙুলগুলো। ফিসফিস করে বলতো, মিস করেছিলে? সত্যি বলো। সুচেতা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলতো, বয়েই গেছে ভারী। অনি অভিমানী চোখে তাকিয়ে বলতো, বড্ড নিষ্ঠুর তুমি। মিথ্যে করেও তো বলতে পারতে, করেছো আমায় মিস। সুচেতা কফিতে চিনি মেশাতে মেশাতে বলতো, যে সর্বদা জোর গলায় দাবি করে আমায় ভালোবাসে, সে যদি মনের অন্দরেই প্রবেশ করতে না পারলো তাহলে তার ভালোবাসায় কি নিশ্চিতরূপে ভরসা করা উচিত অনি? অনিরুদ্ধ হেসে বলতো, প্রেসিডেন্সি দেখছি বেশ স্মার্ট করে দিচ্ছে তোমায়। সুচেতা হেসে বলতো, সাংবাদিকের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে বলেই একটু ট্রেন্ডী হচ্ছি এই আরকি। নাহলে ফার্স্ট বলেই আউট হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায় যে। অনি বলতো, তবুও সুচেতা তুমি তোমার গায়ের মাটি মাখা সোঁদা গন্ধটাকে একেবারে মুছে ফেলো না শহরের দূষণে। নিষ্ঠুরতা নয় তোমায় কোমলতা মানায়। হয়তো তখনকার সুচেতা কোমলই ছিল। ছিল তো বটেই, নাহলে কলকাতার স্কুলে চাকরি পাওয়ার পরে রাইগঞ্জ ছেড়ে আসতে হবে বলে কেঁদে ভাসিয়েছিলো সুচেতা। বাবা বলেছিল পাগলী, এ যে আমার বড় গর্বের দিন রে। তুই কূপমণ্ডূকতা ছেড়ে, রাইগঞ্জের পরিধি অতিক্রম করে পা রাখতে পেরেছিস শহরের স্কুলে। স্কুলের চাকরিটা পাওয়ার পিছনেও অনির অবদান অস্বীকার করার নয়। অনিই জোর করে অ্যাপ্লিকেশনটা করিয়েছিল। সুচেতা তখন ইংলিশে মাস্টার্স করছে। অনি বলেছিল, শোনো পড়াশোনা যেমন করছো করো, কিন্তু এই কমলা সুন্দরী স্কুলে একজন ইংরাজির শিক্ষিকা নিয়োগ করবেন ম্যানেজিং বডি, আমি খবর পেয়েছি। একটা অ্যাপ্লাই করতে দোষ কোথায়! সুচেতা বলেছিল, ধুর আমি পাবো না। শহরে কত স্মার্ট মেয়েরা আছে। অনিরুদ্ধ বলেছিল, অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারটা লাগে মশাই চাকরি পেতে গেলে। গ্রামে বসেই যেটা তুমি তৈরি করেছ। আর তোমার অনার্সের রেজাল্টও দুর্দান্ত, সুতরাং চান্স আছে। তারপর শোনো, বুঝতেই তো পারছো আমি একটা নামি দৈনিকের পেজে কাজ করি, তাই স্কুল কমিটি মিডিয়াকে চটাবে না। ব্যাকে যেটুকু পুশ লাগবে আমি তো আছি। সুচেতা বলেছিল, এ তো দু-নম্বরি। অনি ওর থুতনি ধরে বলেছিল, আহা রে, ইনোসেন্ট বেবি। সরকারি চাকরিতে এমন একটু আধটু হয়। মানে ধরো তুমি তোমার রেজাল্ট নিয়ে তৃতীয় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছো, তোমার কাঁধে একটু নামকরা কারোর হাত পড়লো তুমি ওমনি মন্ত্রবলে উঠে যাবে প্রথম সিঁড়িতে। তুমি দু-নম্বরি না করলে চতুর্থ সিঁড়ি থেকে দু-নম্বরি করেই কেউ প্রথম সিঁড়িতে উঠবে আর তুমি সততার মুখোশ আটকে বুকে ভালো রেজাল্টের ফাইল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ওই তৃতীয় সিঁড়ির ধাপেই। বুঝলেন ম্যাডাম। সুচেতার চাকরিটা হয়ে গিয়েছিল অনিরুদ্ধর তৎপরতায়। তখনও তো স্কুল সার্ভিস কমিশন চালু হয়নি, ওই ম্যানেজিং বডিই সিদ্ধান্ত নিতো, কাকে নিয়োগ করা হবে। অনি বোধহয় ওর বসের সাহায্যও নিয়েছিল এ ব্যাপারে। সুচেতা মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ারেই স্কুলের চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিল। বাবার মুখে হাসি ফুটেছিল, চোখে গর্ব। সেদিন সুচেতার মনে হয়েছিল, বাবাকে দেওয়া এটাই বোধহয় সুচেতার সব চেয়ে বেস্ট গিফ। সুচেতা চাকরি পাবার পরেই দাদা বলেছিলো, তুই যদি রাজি থাকিস তাহলে দোতলার মেঝেটা মার্বেল বসাব, তুই কিছু কন্ট্রিবিউট করবি? সুচেতা অবাক হয়ে ভেবেছিল, একটা চাকরি ওকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ করে দিলো সংসারে। অনিরুদ্ধ বলেছিল, সু, নতুন ফ্ল্যাটটা হ্যান্ডওভার করবে ওরা, তুমি নিজের মত করে সাজিয়ে নাও। সুচেতা তখন ভীষণ ব্যস্ত। একদিকে মাস্টার্সের শেষ কয়েকটা ক্লাস ওদিকে নতুন স্কুল, আবার অনির দেওয়া আরেকটা দায়িত্ব, ওদের ফ্ল্যাট সাজাতে হবে মনের মত করে। নিজেকে বড্ড বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর সুখী মানুষ মনে হয়েছিল ওর। দাদাকে সুচেতা বলেছিল, আমি মাসের মাইনে পেয়েই তোকে দেব, তুই কাজে লাগিয়ে দে। বাবা বলেছিল, বাড়িটাও রং করিয়ে নেব, এবারে তোর বিয়ের কথাও তো ভাবতে হবে। সুচেতা বাড়িতে বলতে চেয়েছিল অনিরুদ্ধর কথা কিন্তু কেমন যেন লজ্জা লজ্জা ভয়ে বলে ওঠা হয়নি। স্কুল সামলে অনির ফ্ল্যাট সাজাতে সাজাতেই মাস্টার্সের ফাইনাল এক্সাম দিয়েছিল সুচেতা। রেজাল্ট দেখে অনিরুদ্ধ বলেছিল, ইউ আর রিয়েলি ব্রিলিয়ান্ট সু। এত কিছু সামলেও এমন ভালো রেজাল্ট। বি.এডটা কমপ্লিট করে রাখো। সুচেতা বলেছিল, বছর খানেক পরে করি। যদিও পরের বছর সুচেতার বি.এড ভর্তি হওয়া হয়নি, অহনার বয়েস যখন ছয় তখন সুচেতা বি.এড করেছিল। অনিরুদ্ধ বলেছিল, বেশ সেই বরং ভালো। আমার কাছে থেকেই পরবর্তী পড়াশনা করো। সুচেতা বলেছিল, বাবা সেদিন বিয়ের কথা বলছিল জানো? অনি কাঁধের ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে বলেছিল, এখন ড্রাইভ করতে শুরু করলে রাতের মধ্যে রাইগঞ্জ ঢুকে যাবো। চলো তোমার বাবাকে একটু চমকে দিয়ে আসি। মানে এই আপনার একমাত্র আর পার্মানেন্ট জামাই, ভালো করে দেখে নিন টাইপ সংলাপ দু-একটা বলবো, লুচি, মাংস খাবো ফিরে আসবো। সুচেতা ওর চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলেছিল, আহ্লাদ নাকি? বাবা ভাবতেই পারে না আমি কলকাতায় ভর্তি হওয়ার নাম করে প্রেম করছি এখানে। কি করে যে বলবো বাবাকে কে জানে! অনিরুদ্ধ হেসে বলেছিল, সে তোমার লুকের প্রব্লেমে হয়েছে। ভদ্রলোক ভাবতেই পারেন না তার এমন নিরীহ দেখতে মেয়ে অন্যের বুকে ঝড় তুলতে পারে। সে ঝড়ের এমন দাপট যে গোটা বিশ্বের যেখানেই যাই না কাজের সূত্রে, যতই সাদা চামড়ার নীল চোখের সুন্দরীদের দেখি না কেন, সে ঠিক উড়িয়ে এনে ফেলবে তার মেয়ের পায়ে। ভদ্রলোকের দোষ নেই, তিনি তো আর জানেন না, তার কাজল কালো চোখের অধিকারিণী মেয়েটির বাঁকা চাউনিতে একজন ধরাশায়ী হয়ে গেছে।
সুচেতা মুখ বেঁকিয়ে বলছিলো, রিপোর্টারদের নিয়ে এই এক সমস্যা, ভিতরে ভিতরে ভালো না বাসলেও কথার মায়াজালে ঠিক জড়িয়ে ফেলবে। নতুন কেনা ব্রাউন গদির সোফায় সুচেতাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটের পিঙ্ক লিপ্সটিকটা নিজের জিভে মেখে নিতে নিতে অনিরুদ্ধ বলেছিল, ভালোবাসি কিনা সে প্রমাণ পেতে গেলে আজীবন এভাবেই থাকতে হবে আমার বুকের মধ্যে। ছটফট করলেও ছাড়া পাবে না। সু আমার গোটা পরিবার থেকে আমি বিচ্ছিন্ন, জানি না কারণটা ঠিক কি! কেউই যেন আমায় ঠিক আপন করতে পারেনি। প্লিজ তুমি দূরে সরিয়ে দিও না। কথা দাও, সব পরিস্থিতিতে পাশে থাকবে আমার। সুচেতা কথা দিয়েছিল। আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, সে কথা কি সুচেতা আদৌ রেখেছে? একতরফা বোধহয় সুযোগই নিয়ে গেছে অনির কাছ থেকে। ভালো তো সুচেতাও বেসেছিলো অনিকে। তাই গ্রীষ্মের ছুটিতে এসে রাইগঞ্জে ফোন না থাকায় বেশ কিছু চিঠিও লিখেছিল অনিকে। স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটিতে মেস ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, সুচেতাও রাইগঞ্জের বাড়িতে ফিরে এসেছিল, বাবা-দাদার সঙ্গে কাটাবে কয়েকটা দিন। অনিও তো যাবে কলকাতার বাইরে। মাঝে মাঝে খুব রাগ হতো অনির ওপরে, মানুষটা যেন বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এই কয়েকমাস। জিজ্ঞেস করলে বলতো, দেখতে চাও না আমায় সাফল্যের শিখরে? সুচেতা জানে অনিরুদ্ধ কাজপাগল মানুষ, কাজ ছাড়া ও ভালো থাকতে পারে না। তাই ব্যস্ত অনিরুদ্ধর সঙ্গেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। রাইগঞ্জের বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই আত্মীয়স্বজনরা শুরু করেছিল সুচেতার বিয়ের আলোচনা। বাবারও ইদানিং শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না।
তাই দাদা তড়িঘড়ি বাড়িতে মিস্ত্রি লাগিয়ে দিল। দোতলার ঘরগুলোর মেঝেতে পাথর বসবে। সুচেতার ইচ্ছে ছিল এক তলার দক্ষিণের কোণের যে ঘরটাতে ও থাকে সেটাকেও নতুন করে সাজাতে। ওই ঘরেই কেটেছে ওর শৈশব থেকে যৌবনে উত্তীর্ণের দিনগুলো। অনিরুদ্ধকে এ-বাড়িতে যেদিন ডাকবে সেদিন প্রথমেই এই ঘরে বসতে দেবে। এই ঘরটার বর্ণনা অনিকে ও বলেছে বহুবার। বাবাকে বলতেই বাবা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। দাদা বলেছিল, একতলার ঘরগুলো আবার পরে হবে না হয়। সুচেতা একটু জেদ করেই বলেছিল, আমার ঘরটাতে আমি হালকা নীল দেওয়াল করবো আর মেঝেতে সাদা পাথর। দাদা অমত করেনি। ওর আর দাদার টাকায় কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার লোকজন আলোচনা করেছিল, ওই বাড়ির মেয়ের বোধহয় বিয়ে লাগবে তাই বাড়ির কাজ শুরু করেছে। সুচেতা আর সময় নষ্ট না করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবারে অনিরুদ্ধকে ডেকে আনবে এই বাড়িতে। ওই সুচেতাকে চেয়ে নেবে বাবার কাছ থেকে। সেই মত চিঠিও লিখেছিল অনিকে। অনি উত্তরে লিখেছিল দিন দশেক সময় দাও সু, আমি একটা স্পোর্টস মিট করতে লন্ডনে যাবো, ফিরেই আসছি তোমার কাছে। অভিমানে মুখ কালো করেছিল সুচেতা। সবসময় শুধু কাজ। শুধু জানতো, অনি যখন কথা দিয়েছে তখন দশদিন পরে ও নিশ্চয়ই আসবে এ বাড়িতে। এ কদিন অপেক্ষা করতেই হবে। ততদিনে হয়তো বাড়ির কাজটাও কমপ্লিট হয়ে যাবে। বাবার পেনশনের টাকায় সংসার চলে যায়, তবুও দাদা একটু বিরক্ত যেন। বাবা নাকি বিনা পয়সায় স্টুডেন্ট পড়ানো শুরু করেছে, এতেই দাদার রাগ। কম মাইনে নিক তাই বলে বিনামূল্যে। সুচেতা বুঝিয়ে বলেছিল, এখন তো তুই আমি দুজনেই চাকরি করছি এবার বাবাকে নিজের মত বাঁচতে দে না। দাদা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, সারাটা জীবন তো নিজের মতই বাঁচলেন রে। মাও তাই বলতো। কবে আর সংসারের কথা ভাবলেন? সুচেতা বলেছিল, ভাবেননি বুঝি? তাহলে কি তুই আমি মানুষ হতাম? বাবাকে সব বিষয়ে সমর্থন করায় দাদা এমনিতেই সুচেতার ওপরে বিরক্ত হয়ে ছিল। তারপরে বাবার আরেকটা কাজে সুচেতাকে আর সহ্যই করতে পারতো না সোহম। বাড়ির কাজ কমপ্লিট হবার আগেই বাড়িটা ওদের দুই ভাইবোনের নামে সমানভাবে লিখে দিয়েছিল বাবা। বলেছিল, আমার দুই সন্তান, তাদের সমান অধিকারে আমি বিশ্বাসী। সুচেতা সোহমের মুড দেখেই বলেছিল, বাবা, আমার সম্পত্তি দরকার নেই, তুমি সবটা দাদাকে দিয়ে দাও। বাবা হেসে বলেছিল, আমি তো অন্যায় করতে পারি না মা। সোহম জন্মের সময় আমার যতটা আনন্দ হয়েছিল, তুই জন্মের সময়েও আমার ততটাই আনন্দ হয়েছিল, তাই আমার কাছে তোরা দুজন সমান। কাউকে বঞ্চিত করার অধিকার আমার নেই।
দাদার সঙ্গে ছোট থেকেই খুব বেশি সদ্ভাব ছিল না সুচেতার। তবুও এতটা দূরত্ব তৈরি হবে সেটা অবশ্য কখনো ভাবিনি সুচেতা। বাড়িটা দুজনকে লিখে দিতেই সোহম অন্য মূর্তি ধারণ করেছিল। কথায় কথায় সুচেতাকে বলতো, সারাটা জীবন সবটুকু সুবিধা তুই ভোগ করলি। কলকাতার হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা, বাবার সব দায়িত্ব আমার ওপরে ফেলে দিয়ে কলকাতায় ছিলিস এতদিন, আবার তোর বিয়ের পরেও বাবার দায়িত্ব আমার, কিন্তু সম্পত্তির বেলায় নাকি সমান অধিকার। সোহমের ব্যবহারের জন্যই হয়তো বাবার বাঁচার ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল। অমন প্রাণবন্ত মানুষও নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। সুচেতা কি করবে বুঝতে না পেরেই অনিকে বলেছিল, প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো এখানে। অনির কলকাতার ফ্ল্যাটে পড়ে ছিল সে চিঠি কারণ ও তখন লন্ডনে ক্রিকেটের নিউজ করতে ব্যস্ত। তখনই সুচেতা আবিষ্কার করেছিল অন্ধকার শুধু কালো নয়, গাঢ় ঘন কালো হয়। সেখানে কোনো ছিদ্র দিয়েই আলো প্রবেশ করতে পারে না। এমনকি মৃত্যুও ভয় পায় সেই গহীন ঘন কালোকে। আবার শিউরে উঠলো সুচেতা। দু-হাত দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। তখনই ওর পাশে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো।
অনি কল করছে। নিজেকে ধাতস্থ করে ফোনটা রিসিভ করলো সুচেতা। ওপ্রান্ত থেকে অনিরুদ্ধ বললো, তুমি কি এখনো রাইগঞ্জে বসে বসে দাদা-বৌদির মধুর বচন শুনছো? কি হলো, গলাটা এমন লাগছে কেন সু? কাঁদছিলে? ভয় পেয়েছো? কেউ কল করে হুমকি দিয়েছে তোমায়? চুপ কেন করে আছো? সুচেতা অবাক হয়ে যাচ্ছিল, আজও ওর একটা ছোট্ট হ্যালো শুনে অনি বুঝতে পেরে যায় ওর মনের অবস্থা? সুচেতা কোনোমতে সামলে নিলো নিজেকে। আমার কথা ছেড়ে তোমার আদরের তিতির পাখির খবর বলো, কি করছে সে? নৈঋত কি এখনো ওখানেই আছে?
অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বললো, সুচেতা তিতিরের জন্য তোমার পছন্দ একেবারে পারফেক্ট। নৈঋত ছেলেটা ভীষণ ডিসেন্ট। আরেকটা কথা বলবো?
ওকে শেষ করতে না দিয়েই সুচেতা বললো, গুড চয়েস হয়েই বা কি হলো অনি? শেষপর্যন্ত বিয়েটা তো দিতে পারলাম না বলো? বসু বাড়িতে আর কোনোদিন বউ হয়ে যেতে পারবে না অহনা। মেয়েটা এটুকু বুঝলো না ওর এই প্রফেশনকে রেসপেক্ট করে যারা ওকে সাদরে বউ হিসেবে নিয়ে যেতে চেয়েছিল সেখানে বিয়ে করলে ও সমস্ত রকম স্বাধীনতা পেতো। অনি একটু ফিচেল হেসে বললো, এই সু জানো একটা মজার ঘটনা লক্ষ্য করছি। নৈঋত বোধহয় তিতিরের প্রেমে পড়েছে। তোমার বেরসিক মেয়ে তো প্রেম, ভালোবাসা বোঝে বলে আমার মনে হলো না, তোমার মতো জেদি আর একগুঁয়ে হয়েছে। কিন্তু ছেলেটা আমার মত বুঝলে। বডি ফেলে দিয়েছে তিতিরের জন্য। মনে হচ্ছে আমিও যেমন জিতেছিলাম শেষ পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডকাপটা ছেলেটাও বোধহয় জিতবে, তবে ধরে খেলতে হবে। কিন্তু ছোঁড়াটার ধৈর্য্য কম বুঝলে। এখনকার ছেলে তো, হুড়োহুড়ি করে ফেলছে। কিছুতেই বুঝছে না এই খেলায় একটার জায়গায় দুটো রান নিতে গেলেই রান আউটের সমূহ সম্ভবনা আছে। আসলে মেয়ের বাপ তো, তাই ছেলেটাকে ট্রেনিং দিতে লজ্জা পাচ্ছি। এই বয়েসে অনুঘটকের কাজ করাটা কি ঠিক হবে সুচেতা? এত দুঃখ, এমন দুশ্চিন্তার মধ্যেই অনির কথা শুনে হেসে ফেললো সুচেতা। ও জানে ওর মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই অনি এখন অনেক উল্টোপাল্টা বকবে। তবু আমল না দিয়ে বললো, কি বলছে তোমার মেয়ে? দাবিটা ঠিক কি? অনিরুদ্ধ একটু গম্ভীর স্বরে বললো, ও সত্যিটা জানতে চায়। আমি পারতাম ওকে বলে দিতে কিন্তু বলিনি। আমি চাই ও নিজেই সত্যের মুখোমুখি হোক, তারপর নিজেই গুছিয়ে নিক নিজেকে। একটু সময় চেয়েছে আমার কাছে। আমি দিয়েছি ওকে সময়। আসলে কি জানো সুচেতা অল্প বয়েস তো, তাই উত্তর না পাওয়া প্রশ্নের ভার বইতে পারছে না। নিজেই খুঁজে নিক উত্তর গুলো। আমার তো মনে হয় উত্তরগুলো খুঁজে পাবার পর ও আবার ফিরে আসবে আমাদের কাছে। যদিও অলরেডি কিছুটা আন্দাজ করে আমায় দোষারোপ করেছে, কেন আমি প্রতিবাদ করিনি সেই জন্য! আমার মনে হয় তোমারও ওকে আরেকটু সময় দেওয়া উচিত ছিল। তুমি তো ওকে চেনো, মিথ্যের সঙ্গে আপোষ করতে ও শেখেনি। বিয়েটা আর কয়েকদিন পরে হলে ওর কাছে আসা থ্রেট কল আর আমার লেখা চিঠিগুলোর উত্তর ও পেয়ে যেত। তাতে এভাবে চিরকুট পেয়ে বিয়ে ছেড়ে উঠে আসতো না। কারণ তখন ওর কাছে দিনের আলোর মত সত্যিটা পরিষ্কার থাকতো।
সুচেতা হিসহিসে গলায় বলল, আর যদি ফিরে না আসে আমার কাছে? যদি মা বলে আর না ডাকে তখন? কি উত্তর দেবে অনিরুদ্ধ তুমি? ওই চিঠিগুলো জমিয়ে রেখেছিলে কেন? আমায় আমার আসল জায়গাটা ভবিষ্যতে মনে করিয়ে দেবে বলে? একজন রিপোর্টার এসব কলে কখনোই বিশ্বাস করে না, অহনাও করতো না। যদি না তখন তোমার আলমারি ঘেঁটে ওই চিঠিগুলো পেত! এর পিছনে তোমার গাফিলতি আছে বলেই আমি মনে করি, এতদিনের সংসার বলেই ষড়যন্ত্র কথাটা বলতে বাঁধছে অনি।
অনিরুদ্ধ একটা জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, দোষারোপ করেই যদি শান্তি পাও তবে তাই সহ্য করি। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি কাল ভোরে কলকাতা ব্যাক করো। বিজু গিয়ে তোমায় কলকাতা পৌঁছে দিয়ে আসবে। আর যদি ইচ্ছে হয় সূর্যপুরে থেকে যেতে পারো কয়েকটা দিন। তাহলে নাহয় আমি কলকাতা চলে যাব। তিতির এখানে কদিন থাকবে মনে হলো, তুমি আসতে চাইলে আসতে পারো। সুচেতা রাগী গলায় বলল, আমি অহনার সম্মুখীন হতে চাই না। কলকাতা ব্যাক করবো। বিজুকে দরকার নেই, শ্যামলকে দিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দিও।
অনিরুদ্ধ শান্ত গলায় বলল, কখনো যদি ঝড় থেমে যায় তাহলে একবার ডেকো, কয়েকটা কথা বলার আছে তোমায়, জানিনা আদৌ বলা হবে কিনা কোনোদিন, তবুও চেষ্টা করবো। সুচেতা কিছু বলার আগেই অনিরুদ্ধ বললো, শ্যামলকে পাঠিয়ে দেব সকাল সকাল।
সুচেতা ব্যাগপত্র গোছাচ্ছিলো, সোহম ঘরে ঢুকে বললো, তোরা আর মানসম্মান রাখলি না। দায়িত্ব নিয়ে রাইগঞ্জের বুকে বাবার নামটা ডুবিয়ে দিয়ে গেল তার মেয়ে আর তার নাতনি। ভাগ্যিস বাবা বেঁচে নেই। সুচেতার বুকটা হুহু করে উঠছিলো। বড্ড একা ও। দাদা, বৌদি, মেয়ে, স্বামী কেউ যেন ওর নিজের নয়। বাবার মালা পরা ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর শান্ত স্বরে বললো, হয়তো আর আসবো না রাইগঞ্জ। বাড়িটা গোটাটাই তোর নামে লিখে দিতে চাই। আজ রাতের মধ্যে ব্যবস্থা করতে পারবি? আমি কাল সকালে ফিরে যাব কলকাতা।
সোহমের মুখে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখলো যেন। বেশ জোরেই বললো, আমি রাতেই ব্যবস্থা করছি। আরে উত্তমের কাছে সবসময়ই স্ট্যাম্প পেপার থাকে। তুই আপাতত দানপত্র করে দে। পরে রেজিস্টির সময় এসে একটা সাইন করে দিয়ে যাস। সুচেতা ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়লো। রাইগঞ্জ ওকে কিছু দেয়নি, শুধু কেড়ে নিয়েছে। ভেবেছিল নিজের বিয়েটা তো হয়নি এই বাড়ি থেকে, অন্তত মেয়ের বিয়েটা দেবে নিজের জন্মস্থান থেকে। এই বাড়ি ওর কাছ থেকে শুধু কেড়ে নিল। তাই অভিমানেই এই বাড়িটা ত্যাগ করবে ও। আর কখনো পা দেবে না রাইগঞ্জের মাটিতে। বাবার ঘরে গিয়ে একবার বাবার ইজি চেয়ারটায় হাত বুলিয়ে আসবে। ক্ষমা চেয়ে নেবে বাবার কাছ থেকে। বাবার দেওয়া বাড়ির অংশটুকু দাদাকে লিখে দেওয়ার আগে একবার বাবার ঘরে গিয়ে জানিয়ে আসবে বাবাকে। সুচেতা আত্মায় বিশ্বাস করে না, আবেগে বিশ্বাসী। তাই সাইন করার আগে একবার পারমিশন নিয়ে আসবে বাবার কাছ থেকে। কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে আসছে গলার কাছে। দুটো তিনটে বড় বড় ট্রলি ব্যাগ এনেছিল। এখন ক্লান্ত শরীরে সেসব গোছাতে গোছাতে হাঁফিয়ে যাচ্ছিল। বৌদি বোধহয় ইতিমধ্যেই দাদার কাছে খবরটা পেয়ে গেছে। তাই ঘরে ঢুকেই বললো, তুমি একটু বিশ্রাম নাও, আমি সব গুছিয়ে দিচ্ছি সূচী। সুচেতা মনে মনে ভাবলো, স্বার্থ বড় বিষম বস্তু।
।।২৪।।
স্বার্থপর? আপনার কেন হঠাৎ আমাকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে বলবেন? আপনার কি মনে হয়, সমস্ত প্রশ্নের তীর আপনার গায়েই লাগবে? আমার গায়ে কি মোঘল আমলের বর্ম পরা আছে নাকি? রিসেপশনের দিন গোটা অফিসের কলিগদের আসার কথা ছিল। তাহলে বুঝতে পারছেন, আমিও কতটা সমস্যার সম্মুখীন হবো। অহনা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে জোরে নিঃশ্বাস নিলো।
অনিরুদ্ধবাবুই বোধহয় প্রথম খেয়াল করেছিলেন নৈঋত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে আসার প্রতীক্ষায় রয়েছে। অনিরুদ্ধই আচমকা ডেকে উঠলেন, নৈঋত এসো এসো ভিতরে এসো। তোমরা কথা বলো, আমি দরকারি কয়েকটা কল সেরে আসছি। অহনা তখনও বাগানের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসেছিলো। অনিরুদ্ধবাবু বেরিয়ে যেতেই নৈঋত আচমকা বলে বসলো, স্বার্থপর, তুমি অত্যন্ত স্বার্থপর অহনা। অহনা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, স্বার্থপর? আপনার কি মনে হয় আমি এটা করলাম ইচ্ছে করে? আসলে কি বলুন তো ভগবান সকলকে সত্য সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে তৈরি করেন না। তাই আপনাকে আমি সত্যিটা বলতে পারছি না। সেইজন্যই আমাকে স্বার্থপর লাগছে আপনার।
নৈঋত ঘড়ির দিকে তাকালো। এবাড়িতে ওর মেয়াদ আর বড়জোর ঘণ্টা দুয়েক। তারপরেই ও রওনা দেবে কলকাতার উদ্দেশ্যে। এতক্ষণে হয়তো ওর বাড়ির সকলেই জেনে গেছে বিয়ে ভাঙার পিছনে দোষটা ঠিক কার? তাই বসুবাড়িতে যে অহনাকে আর মেনে নেবে না সেটুকু বুদ্ধি নৈঋতেরও আছে। কিন্তু এই কয়েকঘণ্টা একসঙ্গে কাটিয়ে, ওর ছোটবেলার ছবিগুলো দেখে নৈঋত বুঝতে পেরেছে মেয়েটা সত্যিই সৎ। মুখোশের আড়ালে থাকতে পারে না বলেই এতবড় রিস্ক নিয়ে, বদনাম নিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিলো। এর পিছনে যে কারণই থাক অহনার গুরুত্ব তাতে নৈঋতের কাছে এক বিন্দু কমবে না। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিল নৈঋতের। অহনার পাশে থেকে ওকে হেল্প করার সুযোগটুকু অহনা দিতে নারাজ। অথচ অহনাকে এই অবস্থায় ছেড়ে চলে যেতে মন চাইছিলো না। সত্যি বলতে কি নৈঋত অহনাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিছুতেই লজ্জা সরিয়ে প্রোপোজটা করে উঠতে পারছে না। অহনার চোখের দিকে তাকালে গুছিয়ে নেওয়া কথারা হয়ে যাচ্ছে এলোমেলো। তাই রেগে গিয়েই বলেছিল তুমি বড্ড স্বার্থপর অহনা।
অহনার বলা শেষ হলে নৈঋত বললো, অন্যের মনের অবস্থাটা বোঝাও তোমার দায়িত্ব, এটা এড়িয়ে যেতে পারো না তুমি! অহনা বললো, এড়িয়ে তো যাইনি, আমি জানি আমার বাবা-মা খুব কষ্ট পেয়েছে, কাবেরী আন্টিও খুব দুঃখ পাবেন আমার এমন ব্যবহারে, কিন্তু আমি সত্যি নিরুপায়। নৈঋত মাথা নিচু করে বললো, আমি জানি না কে কি কষ্ট পাচ্ছে, তবে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করো, জানতাম না ভালোবাসা শব্দের অনুভূতি কেমন হয়। আক্ষরিক শব্দের সঙ্গে এর অনুভূতির যে এতটা ফারাক কখনো বুঝিনি। এতদিন জানতাম ভালোবাসলে একটা টান অনুভব করে। ভালো থাকার, আনন্দে থাকার মন্ত্র হলো ভালোবাসা। আজ বুঝেছি তরল কষ্টের নাম ভালোবাসা। যে ক্রমাগত হৃৎপিণ্ডটাকে গরম লাভার মত তরল দিয়ে পুড়িয়ে চলেছে, আর আমি নিরুপায় হয়ে অসহায়ের মত তাকিয়ে দেখছি নিজের সর্বনাশ। অহনা কোনো ফিল্মি ডায়লগ নয়, আমি মেকি কিছু বলতে পারি না। লোকে বলে, অ্যানরোমান্টিক লোহালক্করের প্রফেসর। তাই এখন যেটা বলছি এর মধ্যে মিথ্যের নিঃশ্বাস অবধি নেই। ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। নিজের গভীর বাস্তববাদী মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে রণক্লান্ত আমি। যুদ্ধের সব সাজ সরঞ্জাম তোমার পায়ে নিবেদন করে অস্ত্রবিহীন আমি দাঁড়িয়ে আছি তোমার সামনে, ইচ্ছে হলে হত্যা করো, এভাবে তিলে তিলে মৃত্যুদণ্ড দিও না। তলোয়ার তোমার হাতে, একবারে বুকের বাম দিক চেপে সজোরে বসিয়ে দাও, যাতে এই অর্বাচীন তোমায় ভালোবাসি বলার স্পর্ধা আর দেখাতে না পারে। শুধু একটাই অনুরোধ, একটু একটু করে নিঃশেষ করে দিও না আমায়। সহ্য করার ক্ষমতা সত্যিই ভগবান আমায় দেয়নি। আমি জানিনা, তোমার গোপন সত্যটা ঠিক কতটা বিপর্যয় নিয়ে আসবে আমার জীবনে, তবে এটুকু বলতে পারি, যে নাবিক পথ হারিয়েছে তার কাছে ধ্রুবতারার থেকে সত্যি আর কিছুই হতে পারে না।
অহনা, পথভ্রষ্ট নাবিককে তুমি প্রথমে ধ্রুবতারার সন্ধান দাও, তারপরে তো বোঝাবে কোন আইল্যান্ডে গেলে সে বিছের দংশন খাবে? তুমি সামুদ্রিক ঝড়ে হাল ভাঙা পাল ছিঁড়ে যাওয়া জাহাজটাকে পথনির্দেশটুকু না দিয়ে সচেতনতার বার্তা দিয়ে যাচ্ছ, এ কেমন অন্যায়?
অহনার চোখে ঘন মনখারাপের ছায়া, ঠোঁট কাঁপছে তিরতির করে। নৈঋত ওর হাতটা ধরে বলল, ফিরিয়ে দিও না। পথভ্রষ্ট হয়ে কোনো এক নাম না-জানা দ্বীপে আটকে থাকবো আজীবন, যে দ্বীপের নাম ডিপ্রেশন। প্লিজ অহনা, ফিরিয়ে দিও না। শুধু তোমার সঙ্গে এক পৃথিবী চলতে চাই, আর কিছু নয়। তোমার চোখে ভরাডুবি হয়েই গেছে আমার। সাঁতার জানি না, তাই পাড়ে ওঠার ক্ষমতা নেই, আমায় হাতটা ছেড়ে দিও না। এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না আমার প্রতি।
অহনা নরম গলায় বলল, এ কাজে আমি একা যেতে চাই নৈঋত। তবে কথা দিচ্ছি, যে-কোনো প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় আমি তোমায় ডাকবো। যদি সত্যিটা শোনার পরেও আমাকেই ধ্রুবতারার স্থান দাও তাহলে সে অবশ্যই ফিরে আসবে নাবিকের কাছে।
নৈঋত ধীর গলায় বলল, অপেক্ষা যত দীর্ঘই হোক আমি প্রতীক্ষায় থাকবো। তোমার মুখে ”তুমি” ডাকটুকু আর ”আমায় মনে রাখবে” প্রতিশ্রুতিটুকু নিয়ে ফিরে যাচ্ছি কলকাতায়। সাবধানে থেকো। জানি না তুমি কিসের সন্ধানে কোন বিপদসঙ্কুল পথে যেতে চলেছো, শুধু এটুকুই বলবো সফল হয়ে ফিরে এসো।
অহনা বললো, একটা প্রতিবাদ বাকি আছে, যেটা করা উচিত ছিল আজ থেকে প্রায় বছর চব্বিশ-পঁচিশ আগে। আমার জন্মমুহূর্তেই সরব হওয়া উচিত ছিল, কেন জানিনা কেউ হয়নি। অন্যায়টাকে চুপচাপ মেনে নিয়েছে সকলে, আমি মানবো না। জানি বিপদ আছে, তবুও আমি মেনে নেব না নৈঋত। প্রতিবাদ তো আমি করবোই। নৈঋত একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো আগুন ঝরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চিবুকের দিকে। মনে মনে বললো, বিপরীত তুমি, সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা আমার স্বভাবের থেকে, তবুও আমি পরাজিত হতে চাই তোমার ব্যক্তিত্বের কাছে, তোমার সততা, সাহসের কাছে। নৈঋত আলগা স্বরে বললো, একটা জিনিস চাই, দেবে? অহনা জোরে শ্বাস নিয়ে বললো, বলো?
নৈঋত অ্যালবাম থেকে বের করে আনা মার্শাল আর্টের ড্রেস পরা কলেজ লাইফের একটা ছবি অহনার সামনে ধরে বলল, এইটা? দেবে আমায়?
অহনা একটু যেন লজ্জা পেল। এমন সাহসী মেয়েকে লজ্জা পেলেও মন্দ লাগে না। এই মেয়েকে লজ্জা পেতে দেখাটাও বোধহয় সৌভাগ্য। অহনা নরম গলায় বলল, দিলাম। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে, একটা কম্পিটিশন অ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছিলাম, তখনই কলকাতার ফ্ল্যাটে বাবা তুলেছিল। নৈঋত ছবিটা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, অহনা বললো, কি এমন দেখলে এই ছবিতে?
নৈঋত ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, অরিজিনাল অহনাকে। সাহসী, প্রতিবাদী, সৎ, আবার মাঝে মাঝে একটু আদুরে, অল্প ভীতু টেনশনে সামান্য কাবু – সবরকম এক্সপ্রেশনই আছে এই ছবিটাতে। বোধহয় কম্পিটিশন যাওয়ার আগের সামান্য ভয় আর টেনশন মিশে ছিল চোখে, সঙ্গে ছিল আমি জিতবই টাইপের মনোভাব, তাই সব মিলিয়ে এই ছবির অহনা একেবারে অরিজিনাল।
অহনা ক্লান্ত হেসে বললো, যদি কখনো চাকরি ছাড়বে ভাবো, বোলো আমায়। আমাদের দৈনিকে কবিতার কলামে তোমার লেখা ছাপাবো।
নৈঋত হেসে বললো, যদি রিপোর্টারের সঙ্গে কবি সবজায়গায় ঘুরতে পারে, মানে তোমাদের কোম্পানি যদি সেই সুযোগ দেয় তাহলে আমি রাজি।
অহনা হেসে বললো, কাবেরীআন্টি ঠিকই বলেছিল, ছেলেটা আমার এখনও ম্যাচিওরড হলো না। সত্যিই পাগল তুমি।
কিছু কিছু কথা কারোর মুখে অন্য মাত্রা পায়। অহনার বলা পাগল, ইমম্যাচিওরড কথাগুলোকে খুব সংগোপনে মনের গোপন কুঠুরিতে ভরে তালা দিয়ে দিল নৈঋত। অবসর সময় এই কথাগুলোই হবে ওর মনখারাপ ভাগানোর ওষুধ।
অহনার ঘর থেকে বেরোতেই চোখাচোখি হয়ে গেল বিজুকাকার সঙ্গে। বিজু কাকা গভীর গলায় বলল, দাদাভাই, যদি ভালোবাসো তবে অভিমানে সরে যেও না। চলে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। আজীবন বুকে পাথর চাপিয়ে থেকে যেতে হয়। গানের সুরও তখন স্তব্ধ হয়ে যায় কন্ঠনালীতে। একটু অবাক হয়েই তাকালো নৈঋত বিজুকাকার দিকে। ভদ্রলোককে দেখে তো মনে হচ্ছিল এ বাড়ির কেয়ারটেকার। এখন মনে হচ্ছে, ভদ্রলোক গায়ক মানুষ। নৈঋত নরম সুরে বললো, আগে বলো তার নাম কি? যে চলে যাওয়ায় তুমি এমন স্তব্ধতা অনুভব করেছ?
বিজুকাকা বলল, দীপশিখা। আমার গানের শিক্ষকের মেয়ে। একই সঙ্গে গান শিখতাম। বিয়ের রাতে বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। ওকে একলা ফেলে কাপুরুষের মত চলে এসেছিলাম। জীবনে আর ঘর বাঁধা হলো না। হলো না দীপশিখার নিষ্পাপ মুখটা ভুলে যাওয়া। তাই তো সুরও থমকে গেল আমার কণ্ঠনালীতে। এখন গুনগুন করেও গাইতে পারি না এক কলি। অথচ এককালে স্যার বলতেন, চড়ায় গলা তোল বিজয়, আরও চড়ায়, তোর গলা ওপরেও ফেটে যায় না, স্থির থাকে অবিচল। সেই আমি আর কখনো গাইতেই পারলাম না দাদাভাই। এবাড়ির দাদাবাবুও জানেন না এত কথা। কখনো বলিনি কাউকে। কিন্তু দিদিমণির বিয়েটা ভেঙে যাওয়া ইস্তক মনটা ছটফট করছে। তাই ভাবলাম বলেই ফেলি। সাবধান হতে পারবে তোমরা। আর ভুল যেন কেউ না করে এ ভেবেই এত কিছু বলে ফেললাম। কিছু মনে কোরো না দাদাভাই। চলো খেয়ে নেবে চলো। নৈঋত অবাক হয়ে দেখছিল, মধ্যবয়েস ছেড়ে প্রৌঢ়ত্বের দিকে পা বাড়ানো মানুষটার দিকে। যার হাতের যত্নে এত রঙিন ফুল ফোটে, বাগানে প্রজাপতির মেলা বসে, সেই মানুষটার মনের মধ্যেই এমন ধূসর ঝাপসা অন্ধকার! তবে বিজুকাকা বোধহয় ঠিকই বলছে, সময়ের গুরুত্ব অনেক, তাকে একবার অবহেলায় যেতে দিলে হাজার চেষ্টা করলেও সে ফিরে আসে না। তখন স্মৃতির স্মরণী বেয়ে একা একা পথ চলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
নৈঋত খাবার টেবিলে পৌঁছে দেখলো এইটুকু সময়ের মধ্যে বিজুকাকা অঢেল আয়োজন করেছে। অনিরুদ্ধবাবু অলরেডি চেয়ারে বসে আছেন। বসে বসে বললেন, এসো এসো নৈঋত, তিতির কি এলো না?
নৈঋত ঘাড় নেড়ে বললো, বোধহয় আমার সামনে অস্বস্তিবোধ করছে। যদিও নৈঋত মনে মনে ভীষণ রকম চাইছিলো এই বাড়িতে যে দু-ঘণ্টা সময় আছে সেটুকু অহনার সঙ্গেই কাটাতে, কিন্তু সে উপায় বোধহয় নেই। কারণ অহনা চায় না নৈঋতকে ফেশ করতে।
অনিরুদ্ধবাবু বললেন, খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও, তারপর শ্যামল তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসবে। নৈঋত বললো, আচ্ছা এখান থেকে কলকাতা ঠিক কতক্ষণ লাগে? অনিরুদ্ধবাবু কিছু বলার আগেই অহনা এসে নিজের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললো, প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা, জ্যাম থাকলে চার। আর কেউ যদি ভয়ে গাড়ির স্পিড বাড়াতে না দেয় তাহলে পাঁচ, ছয় যা খুশি লাগতে পারে।
অনিরুদ্ধবাবু তিতিরের দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, আঃ, তিতির কি হচ্ছে! না নৈঋত, মোটামুটি সাড়ে তিন মত লাগে। বিজুকাকা আর আরেকজন পিসি পরিবেশন করছিল। অহনা হঠাৎ ফোড়ন কাটলো, বিজুকাকা তোমার দাদাভাই কিন্তু বড়ি দেওয়া তরকারি খান না, আর বেগুনভাজা সবচেয়ে ফেভারিট আইটেম। তাই পারলে বেগুনভাজা বেশি করে দাও, আর বড়ি বেছে শুক্তো দিও। অনিরুদ্ধর খুব হাসি পাচ্ছিলো অহনার কথা বলার ধরন দেখে। আর তার থেকেও হাসি পাচ্ছিলো নৈঋতের বিস্মিত চাউনির দিকে তাকিয়ে। নৈঋত আমতা আমতা করে বললো, কিন্তু তুমি কি করে জানলে এগুলো?
অহনা বেশ কাব্যিক ঢঙে বললো, ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ এ রিপোর্টার! নৈঋত হেসে বললো, বুঝেছি, নিশ্চয়ই কাবেরী বসুর কাজ। বিয়ে হবে কি হবেনা না জেনেই তোমায় আমার পছন্দ অপছন্দের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। নৈঋতের স্বরতন্ত্রীর কোন একটা স্বর যে বেশ বেদনায় আছে সেটা অনুভব করলো অনিরুদ্ধ। ছেলেটাকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে। তাই নৈঋতের বলা আক্ষেপযুক্ত কথাটাতে বেশ কষ্ট হলো অনিরুদ্ধর। পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করার জন্যই অনিরুদ্ধ বললো, বুঝলে নৈঋত তিতিরের মায়ের পিছনে আমি পাক্কা পাঁচ থেকে ছয় বছর পড়ে ছিলাম। যাই বলো, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে সে মজা কোথায়, যেটা আছে সাকসেসফুল লাভ ম্যারেজে। নৈঋত সোনামুগের ডাল আর বেগুনভাজা দিয়ে খেতে খেতেই বললো, বিষয়টা ঠিক কি রকম স্যার?
অনিরুদ্ধ বললো, বেশ তোমাকে বরং আমি বিষয়টা একটু ইলাবরেট করেই বলি। দেখো, প্রথমে তো তুমি একটা মেয়েকে প্রথম দর্শনে মন দিয়ে বসে আছো, কিন্তু সে মেয়ে তখনও তোমায় বিন্দুমাত্র চেনে না। এরপর শুরু হলো তোমার মানসম্মান খোয়ানোর কাজ। তুমি অফিস, কাজ ছেড়ে সেই মেয়ের রুটিন মত শিডিউল বানিয়ে ফেললে, রোজই সেই মেয়ের সঙ্গে তুমি দেখা করছো, অবশেষে মহারানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলে। যখন অফিসে অনুপস্থিতির কারণে তোমার চাকরি প্রায় টলমল তখন তিনি তোমায় খেয়াল করলেন, এবং ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললেন, আপনাকে রোজই দেখছি আমায় ফলো করেন, কি চান বলুন তো?
কি উত্তর দেবে তুমি নৈঋত? বলা তো উচিত আমি কিডনি পাচারকারী নই, তাই হৃৎপিণ্ডটাই চাই, কিন্তু মনে রাখবে তোমার একটা লুজ বলে তুমি শেষ। তাই এই মুহূর্তে একটু ধরে খেলতে হবে।
অহনা মুখ টিপে হেসে বললো, বাবাই, তোমার এসব জ্ঞান দেওয়া তুমি থামাবে?
অনিরুদ্ধবাবু একটুও না দমে বললেন, মোটেই থামাবো না। কিছু জিনিস নৈঋতকে শেখানো আমার কর্তব্য, কারণ আমি এক্সপিরিয়েন্সড। তারপর শোনো নৈঋত, তখন তুমি ডাহা মিথ্যে বলবে বুঝলে! তোমার অফিস যে সাউথের শেষ প্রান্তে সেটা বেমালুম চেপে গিয়ে তোমায় বলতে হবে, আমারও তো নর্থের এদিকেই অফিস, তাই আমরা যদি যাতায়াতটা একসঙ্গে করি তাহলে মন্দ হয় না। মেয়েটার সন্দেহের দৃষ্টিকে খুব বেশি আমল না দিয়ে, তোমার আদৌ কোনোদিন সম্মানবোধ ছিল সেটা বিস্মৃত হয়ে ফিল্ডে নেমে যাবে। মনে রাখবে এটাই ম্যাচের সব থেকে ক্রাইসিস টাইম। এই সময় যদি টেনে কিছু রান করে ফেলতে পারো ম্যাচ তখন তোমার হাতের মুঠোয়। তাই কোনো বল ভুল খেললে চলবে না। যখন দেখবে সে মেয়েও তোমার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে, তখন সপ্তাহ খানেক রেগুলার অফিসে গিয়ে চাকরিখানা বাঁচিয়ে নাও।
পরের দিনের দেখাতেই বলো, তোমার ওপরে এ কদিন যমে মানুষে টানাটানি চলেছে। জ্বরের ঘোরেও একটাই মুখ তুমি দেখেছো, সেটা কার, তা নিশ্চয়ই তোমায় বলে দিতে হবে না। এরপর আর টেনশন নেই বেটা, ম্যাচ তোমার, চালিয়ে খেলো, ছক্কা হাঁকাও। এই এত যুদ্ধের পর যখন রাজকন্যা তোমার হলো, মানে একেবারে আপন করে তাকে পেলে বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে তখন নিজেকে আলেকজান্ডার ড্রফ মনে হবেই। সুচেতাকে জয় করার পর আমারও এমনই অনুভূতি হয়েছিল। দেখো এই সুদীর্ঘ প্রেমপর্বে ঝগড়া-ঝাটি, মান-অভিমান যাই হয়ে যাক না কেন, মনে রেখো উইকেটে টিকে কিন্তু থাকতেই হবে। ম্যাচ টলমল হতে পারে, কয়েকশো আউটের অ্যাপিল উঠতেই পারে, কিন্তু লড়ে যেতে হবে। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, এভরিথিং ইস ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। লড়তে লড়তেই একদিন অপজিট দিকের মানুষটা পরাজয় স্বীকার করে তোমার কাছে হার মানাবে।
বেশ এবারে নতুন ইনিংসের জন্য রেডি হও, কারণ প্রেমের ঝগড়ায় মিষ্টতা থাকবে, সংসারের ঝগড়া কিন্তু সুগার পেশেন্ট, শুধু করলা আর উচ্ছে সেদ্ধ খাওয়া বস্তু। তবুও ভাল লাগবে জানো নৈঋত, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনে শিহরণ জাগবে বৈকি। তাই কনক্লুশন হলো এই যে, নো অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, অনলি লাভ ম্যারেজ। লাভ ম্যারেজে বোঝা যাবে তুমি কতটা মাথা ঠান্ডা প্লেয়ার। ওয়ার্ল্ডকাপ জিতবে না সেমিফাইনালে আউট হবে!
নৈঋত বললো, স্যার অনেকটা সাহস পেলাম, লড়তে রাজি আছি। আশাকরি কোচ হিসেবে আপনাকে পাশে পাবো? বুঝতেই তো পারছেন বড্ড নভিস আমি।
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, না হে তুমি যে একেবারে নভিস সেটা মেনে নিতে পারলাম না। তোমার পারফরম্যান্স অন্তত তা বলছে না। তিতির লজ্জা পেয়ে বললো, তোমরা কি থামবে? এটা খাওয়ার টেবিল না বৃন্দাবনের আখড়া?
অনিরুদ্ধ মেয়েকে আরেকটু লেগপুলিং করার জন্যই বললো, আচ্ছা নৈঋত, তোমার কি মনে হয়, খুব সাহসী শক্ত মনের প্রতিবাদী মেয়েরাও অকারণে লজ্জা পায়? নাকি তার পিছনে যথেষ্ট কারণ থাকে?
ভাবো নৈঋত, ভাবো… আর শোনো, আমার বয়েস হয়েছে তাই পাতে দই, মিষ্টি এসব আমার চলে না। তুমি কিন্তু সব খেয়ে উঠবে। বিজু এদিকে এসো, তোমার সঙ্গে আমার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। তিতির দেখিস, নৈঋত যেন সব খেয়ে তবে ওঠে।
নৈঋত মনে মনে বললো, এমন রোমান্টিক বাবার এমন একটা যুদ্ধং দেহি টাইপ মেয়ে হয় কি করে! না, মেয়ের বাবা-মা দুজনেই অত্যন্ত ভদ্র, ভালো মানুষ। গন্ডগোল এই মেয়েটাই।
অহনা নরম গলায় বলল, কলকাতা ফিরে পৌঁছানোর খবর জানাবেন, সরি জানিও। আর ওই বাড়ির কি অবস্থা সেটাও জানিও প্লিজ। আমি একটু পরেই কাবেরী আন্টিকে কল করে বলে দেব, তোমার কোনো দোষ ছিল না, আমিই এই ঘটনার জন্য দায়ী। আশাকরি বাড়িতে ফিরে কারোর প্রশ্নের বা তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হবে না তোমায়। নৈঋত আলগোছে বললো, প্লিজ অহনা এই মুহূর্তে আমার বাড়িতে তোমায় কল করতে হবে না।
অহনা একটু অবাক হয়ে বলল, সেকি? রাইগঞ্জের স্টেশনে তুমি তো এই দাবি নিয়েই আমার সঙ্গে এতদূর এলে, এখন ফোন করতে বারণ কেন করছো?
নৈঋত আনমনে বললো, জানি না। এই কয়েকঘণ্টায় অনেককিছু ওলটপালট হয়ে গেছে অহনা। সেই রাইগঞ্জের স্টেশনে বসে থাকা ছেলেটার মনটা পাল্টে গেছে। এখন তার মনে হচ্ছে, তাকে অপমান করলেও কেউ যেন তোমায় দোষারোপ না করে! এই পরিবর্তনের আগাম বার্তা তো আমার কাছে ছিলো না, তাই তখন আমি বলেছিলাম তোমায় ফোন করতে। আপাতত নিষেধ করছি, আমার বাড়ির কারোর সঙ্গে তোমায় এখন কথা বলতে হবে না।
অহনা বললো, কিন্তু কাবেরীআন্টিকে একটা জবাবদিহি তো আমায় করতেই হবে নৈঋত, আমি তো সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারি না বিষয়টা। নৈঋত বললো, আমি বাড়ি ফিরি, তারপর তোমায় জানাবো। তার আগে কাউকে ফোন করার দরকার নেই।
অহনা, আমি ফোন করলে রিসিভ করবে? নাকি বিজি টোন শুনবো? সত্যি করে বলো তো, আমি সূর্যপুর ছাড়লেই কি ভুলে যাবে আমায়? অব্যবহৃত ডায়রির পাতায় স্থান হবে আমার?
অহনা বললো, তোমার কি মনে হয় নৈঋত?
নৈঋত বললো, আমার তো মনে হয় তুমি সম্পূর্ণা, পরিপূর্ণ তুমি, তাই ঋণী হতে চাওনা কারোর কাছে। আমি বড়ই অপ্রয়োজনীয় তোমার জীবনে, তাই আমার কথা মনে রাখার বিশেষ প্রয়োজন বোধহয় পড়বে না তোমার।
অহনা অন্যমনস্ক স্বরে বললো, সূর্যও বড় একা নৈঋত। হতে পারে তার প্রখর আলো, হতে পারে তার অসীম ক্ষমতা কিন্তু তবুও একাকীত্বটা একাকেই ভোগ করতে হয়। তাই বোধহয় চন্দ্রের সঙ্গে ভাগ করে নেয় একাকীত্বের যন্ত্রণাটা। নৈঋত বললো, সূর্য তো তবুও নিজের আলোর কয়েকভাগের একভাগও চন্দ্রকে দিয়ে নিজে যন্ত্রনা মুক্ত হয়, কিন্তু তুমি তো তোমার যন্ত্রণার তিল ভাগও শেয়ার করতে নারাজ।
অহনা বললো, নৈঋত যন্ত্রণাটা যাতে আমায় কাবু করতে না পারে সেই জন্যই তো সত্যিটা জানতে চাই। আমি যেটা ভাবছি সেটা হয়তো আমার কল্পনাপ্রসূত, তাই কয়েকটা প্রমাণ দরকার। মুশকিলটা হলো এমন কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলো বাবাই বা মাকে ডিরেক্ট করতেও পারছি না। তাই আমাকে একাই চেষ্টা করতে হবে। আমি যে সূত্র ধরে এগোতে চাইছি তার ভিত্তিটা ঠিক কতটা মজবুত এখনো সেটাই বুঝতে পারছি না। এই লড়াইটা মানসিক লড়াই নৈঋত, যদি মাঝপথে আমি ভেঙে পড়ি, যদি বর্তমানের সাহসী আমিটাকে আর খুঁজে না পাই নিজের মধ্যে তখন নিশ্চয়ই তোমায় ডাকবো, আশাকরি বন্ধু হিসাবেও সাড়া দেবে তখন। নৈঋত বুঝতে পারলো, কারণটা কিছুতেই অহনা ওকে বলবে না এখন, তাই বারবার চেষ্টা করেও একটা শব্দও বের করতে পারলো না ওর মুখ থেকে। ব্যর্থতা থেকে একটা শিক্ষা পাওয়া যায়, অতিরিক্ত চেষ্টায় সুতো ছিঁড়ে যেতে পারে, তাই ব্যর্থতাকে একটু একা থাকতে দেওয়া উচিত, জেদের বশে সবসময় জোর জবরদস্তি করা উচিত নয়।
নৈঋত কথা ঘুরিয়ে বললো, আচ্ছা অহনা তুমি কি প্রেমে বিশ্বাসী নাকি….
অহনা ওর কথাটা সম্পূর্ণ না করতে দিয়ে বললো, আসলে প্রেম করতে ঠিক সাহস হয়নি। একবার ক্রাশ খেয়েছিলাম কলেজের বিবাহিত, দুই সন্তানের বাবা একজন প্রফেসরের প্রতি, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। প্রেম করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আসলে আমি বোধহয় বাবা-মায়ের মত রোম্যান্টিক নই। বরং একটু কাঠখোট্টা টাইপ, বন্ধুরা বলে। তারপর আমার প্রোফাইলটিও তো প্রেমের উপযুক্ত নয় একেবারেই তাই বোধহয় কোনো ছেলে সাহস করে এগোতে পারেনি। মানে নামি সাংবাদিকের মেয়ে, নিজে পলিটিক্যাল বিটের রিপোর্টার, দিনরাত দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়েই ব্যস্ত, সঙ্গে মার্শাল আর্টের মত এমন একটা বিষয় মিশে গিয়ে লোকজনকে পুরো কনফিউশনে ফেলে দিয়েছে আরকি। মানে মেয়েরা সংগীত বা নৃত্য পটিয়সী হবে এটাই গুণের। মার্শাল আর্ট জানা, ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া মেয়েদের লোকে আড়ালে মদ্দাটে বলে, জানো তো? যদিও এই শব্দের সঠিক অর্থ আমার জানা নেই। বোধহয় একটু পুরুষালি বোঝাতেই ব্যবহার করা হয়। মানে মার্শাল আর্টটা পুরুষ শিখতে পারে মহিলা নয়। ভেবে দেখো নৈঋত হিপোক্রেসির কোন লেভেলে আমরা বাস করি। আমরা উদয়শঙ্করের সঙ্গে মমতাশঙ্করকে মেনে নিচ্ছি, আমরা সলিল চৌধুরীর সঙ্গে অন্তরা চৌধুরীকেও মেনে নিচ্ছি সাগ্রহে কিন্তু ব্রুসলীকে মেনে নিলেও শর্মিলা চানুকে মেনে নিতে আমাদের যত সমস্যা। তো এই জন্যই বসন্তের আনাগোনা বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে আমার দুয়ারে এসে। প্রেমে বিশ্বাসী হলেও প্রেম আসেনি, তাই অভিজ্ঞতা শূন্য বলতে পারো।
নৈঋত বললো, তার মানে সাদা খাতা তাই তো? আমি আপনমনে হিজিবিজি কাটতেই পারি।
‘এমনিতে সে একলা থাকে
জ্যোৎস্না তাকে জড়িয়ে রাখে
তবুও যদি হাত বাড়াই
সাহস করে অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে চাই
প্রেম কি তবে আগলে নেবে?
নাকি আপন মনে পালিয়ে যাবে?’
অহনা বললো, তোমার কবি হওয়া উচিত ছিল কিন্তু।
নৈঋত বললো, কবিতার শেষে কিন্তু জিজ্ঞাসা চিহ্ন আছে, তাই শ্রোতার দায়িত্ব একে শেষ করা।
অহনা একটু ভেবে বললো,
‘প্রেম তো ধরা দিতেই চায়,
অন্ধকারে হাতড়ে মরে,
আলোর ঠিকানা পেলে
ছুটেই নাহয় যাবে মাতাল সমীরণে।’
নৈঋত হেসে বললো, সঙ্গ দোষে স্বভাব নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাই আমি আপাতত পালাচ্ছি কলকাতা, তোমার ডাকের অপেক্ষায় থাকবো। আর যদি একান্ত ভুলে যাও, তাহলেও কোনো এক পাতা ঝরা শীতের নিস্তব্ধ দুপুরে নিশ্চয়ই দেখা হবে আমাদের। হয়তো তখন তুমি অন্য কারোর ঘর, জেনো আমার ঘর শূন্য সেদিনও রবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে যাবার সময় অহনা বললো, মিষ্টি না খেয়ে চললে কোথায়? বিজু কাকা বকবে কিন্তু।
নৈঋত ভাঙা গলায় বলল, আগে মিষ্টি সময় আসুক, কেউ যখন নিজের হাতে খাইয়ে দেবে মিষ্টি তখন নিশ্চয়ই খাবো। আজ থাক, কিছু তো বাকি রেখে যাই, তবেই তো লাটাইবিহীন ওড়ার কষ্টটা উপভোগ করবো আমি।
অহনা কিছু না বসে চুপচাপ বসে রইল, গন্তব্যহীন পথের শেষ দেখার চেষ্টায় মনটা আকুল হয়ে উঠলো।
নৈঋত বেরিয়ে গেল, বাবার দেওয়া একটা টিশার্ট আর জিন্স পরেছে, বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। অহনার কানের কাছে এসে বলে গেল, কি ম্যাডাম, চেয়েচিন্তে পরা ড্রেসেও আমায় সবসময় খারাপ লাগে না বুঝলেন। কেউ যদি ইচ্ছে করে একটা লেডিস জ্যাকেট আমায় পরায় তাহলে অবশ্য আমার কিছুই বলার নেই।
অহনার কষ্ট হচ্ছিল, নৈঋতকে চলে যেতে দেখে কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি গলা টিপে ধরতে চাইছিলো। ইচ্ছে করছিল, নৈঋতের সঙ্গে ছুটে চলে যেতে। ওর হাতটা টেনে ধরে বলতে, আমাকেও নিয়ে চলো প্লিজ। আজ তো আমারও তোমাদের বাড়িতেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বলা হলো না কিছুই, কয়েকটা ধোঁয়া ধোঁয়া প্রশ্ন এসে আটকে দিলো অহনার পাদুটোকে। বিজু কাকা বাগানের কয়েকটা গোলাপ নৈঋতকে দিয়ে বললো, আবার এসো কিন্তু দাদাভাই। বাবাও গম্ভীর গলায় বলল, পৌঁছে খবর দিও নৈঋত, আর মাঝে মাঝে যোগাযোগ করো, তোমাকে আমার সত্যিই বড্ড ভাল লেগেছে, আমাদের অসম বন্ধুত্বটা কিন্তু চলতেই পারে, যদি তোমার আপত্তি না থাকে। নৈঋত বাবাকে প্রণাম করে বলেছে, আমি আপনার ৭০% ফ্যান ছিলাম এখন আপনার ১০০% ফ্যান হয়ে গেছি, এসিও বলতে পারেন। তাই যোগাযোগ নিশ্চয়ই থাকবে। বেরিয়ে গেল নৈঋত। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার শেষটুকুও দেখলো তাকিয়ে তাকিয়ে। মনটা ক্ষণিকের জন্য বিকল হতে বসেছিলো ঠিক তখনই ওর ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো, রিসিভ করতেই সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর।
কি হলো, সত্যিটা জেনে কি বিয়েটা ভেঙে গেল নাকি? আমি তাহলে বড্ড দুঃখিত হলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমার শ্বশুরবাড়ির লোককে কোনো ফোন করিনি। চিঠিও পাঠাইনি। তাহলে তারা জানলো কোথা থেকে? আমি তো কেবল তোমার কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়েছি, আর তার বিনিময়ে তোমায় একটা জবরদস্ত খবর দিতে চেয়েছি, ব্যস এটুকুই। লোক জানাজানি তো আমিও করতে চাইনি।
অহনার সবকটা স্নায়ু সতর্ক হলো। ফোনটা রেকর্ড করতে করতেই বললো, আমি কাল আসছি আপনার কাছ থেকে খবরটা জানতে। লোকটা বললো, কিন্তু ফাঁকা হাতে নয়, মাত্র দশ লাখ দিলেই চলবে। তোমার বাবার একবছরের মাইনে থেকেও কম। এটুকু তো দিতেই পারো। অহনা বললো, আমি কাল গিয়ে দেখা করবো আপনার সঙ্গে, প্লেস বলুন, টাইম বলুন।
ফোনটা কেটে গেছে অনেকক্ষণ। ভাবনার বুদ্বুদগুলো মাথার মধ্যে আওয়াজ করেই চলেছে, সমাধান খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ওরা।
অবসন্ন লাগছে শরীর ও মন। বালিশে মাথা রেখে গান চালালো অহনা।
Sing me to sleep now
Sing me to sleep
Wonóót you sing me to sleep now–
Sing me to sleep
Remember me now, time cannot erase
I can hear your whispers in my mind
I’ve become what you cannot embrace
Our memory will be my lullaby…