অনুভবে তুমি – ২৫
।।২৫।।
কপিল ওর দিকে চোখ সরু করে তাকালো ভাড়া থেকে নেমে। ফিসফিস করে বললো, কিছু বখরা আমাদেরও দিও গুরু। পীযুষ গালাগাল দিয়ে বললো, গরু এখনো লেজ নাড়ছে শালা শকুন ঠিক রেডি। শোন, আগে কাজগুলো উদ্ধার কর ঠিক করে, তারপর বখরা চাইবি। কাল বিকেলে তুই, সুনীল আর বাপ্পা তিনজন মিলে যাবি। মালটাকে তুলে সোজা ফ্ল্যাটের চারতলায় আনবি।
কপিল ভয়ে ভয়ে বললো, কিন্তু গুরু যদি নারায়ণ স্যার জানতে পারে, তাহলে এখানে পাত্তারি গোটাতে হবে।
কেন বে? বস মদ দিতে পারে আর মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি করলেই দোষ? বস আপাতত কলকাতায় আছে। আর ওই ম্যানেজার রাজেনটাকে আমি ম্যানেজ করে নেব। তোদের যেটুকু বললাম সেটুকু করবি। বেশি কথা বলবি না। কপিল ঘাড় নেড়ে বললো, তাহলে কাল বিকেলে চলে যাবো স্টেশনে।
পীযুষ জানে নারায়ণবাবু সাচ্চা আদমি। ভুলভাল কাজ দেখলে পীযুষকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে আশ্রয় কোম্পানি থেকে। কিন্তু পীযুষ এও জানে ওর হাতের কাজ দেখার পর কাস্টমারদের অন্য কাজ তেমন পছন্দ হবে না। তাই নারায়ণবাবু বাধ্য হয়েই ওকে ডাকবে, ঠিক যে কারণে সেবার জামিন করিয়ে এনেছিল। তবে এবারে সময় মত রাইগঞ্জে এসেছিল বলেই এত বড় একটা খবর জোগাড় করতে পারলো। শালী খবরটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো টাকাই টাকা। ওই রিপোর্টার মাগিই টাকায় ভরিয়ে দেবে। তখন নারায়ণবাবুর কাজে লাথ মেরে চলে যাবে পীযুষ। আর যদি নেহাত আশ্রয় ওকে না তাড়ায় তাহলে টিকে যাবে। কিন্তু এমন টাকা ভরা গাছের সন্ধান যখন পেয়েছে তখন সেটাকে কাজে লাগবে না এমন বান্দা ও নয়। তাছাড়া যদি সত্যিই অনিরুদ্ধ পাল এ মাগির বাপ হয় তাহলে তো সোনার খনির সন্ধান পেয়ে গেছে ও। এখন শুধু খবরটা পাক্কা করে নেওয়ার অপেক্ষা। তবে এ খবর সুশোভন মাস্টারের আমলের এক মানুষের দেওয়া। এ মিথ্যে নয় বলেই জানে পীযুষ। ভাবলেই মনটা নেচে উঠছে ওর। অনিরুদ্ধ পালের ওপরে এমনিতেই বহুত রাগ জমে আছে ওর। নেহাত হারামিটা প্রচুর পাওয়ার ওয়ালা লোক তাই পীযুষ রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। নাহলে ফয়সালা তখনই করতো ও। হিসেব না মিলিয়ে রেখে দেওয়াটা ওর চরিত্রে নেই।
ফোনটা আবার বাজছে দেখেই রিসিভ করলো ও।
হ্যাঁ, অলোক বল কি খবর?
কি বললি? প্রিয়া আর প্রিয়ার মা দুজনে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে? সঙ্গে কোনো ব্যাটাছেলে আছে? নাকি ওরা দুজনেই? কোথায় গেল দেখলি?
জানোয়ারের বাচ্চা, এই জন্য তোকে মাসে মাসে আমি মদের বোতল সাপ্লাই দিই হারামি? রিকশায় চাপলো আর তুই অমনি চাঁদবদন করে ফোন করতে শুরু করলি? কোথায় গেল খোঁজ নিলি না? প্রিয়ার মা কি সেজেগুজে ছিল নাকি? অলোক আমতা আমতা করে বললো, দাদা তোমার মেয়েটা হেব্বি মাঞ্জা দিয়েছিল। বৌদি কি পড়েছিল অতটা খেয়াল করিনি। শুয়োরের বাচ্চা, ডবকা মেয়েটার প্রতি তো বেশ নজর আছে, বৌটা কেমন সেজেছে সেটা দেখতে ভুলে গেলি? কতক্ষণ পরে বাড়ি ফেরে খোঁজ নিবি, দোকানের সামনে দিয়েই তো ফিরবে, মনে রাখবি। অলোক বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, নিশ্চয়ই, আমি এবারে চোখ বড় করে দেখবো।
ফোনটা রেখে দিয়েই দীপশিখার উদ্দেশ্যে গালাগাল দিলো পীযুষ। বেইমান মেয়েছেলে একটা। গায়ক তো বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিল, এই শর্মা ছিল বলেই তো সিঁথিতে সিঁদুর উঠলো। এখন কিনা ওর সঙ্গেই গেম খেলছে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে। পীযুষকে ঠকানো? মেরে পিঠের চামড়া তুলে নেবে ওই মেয়েছেলেটার! বিছানায় তো ভিজে কাঁথার মত শুয়ে থাকে শিখা আর ও বাড়ি থেকে চলে এলেই যত চুলকানি জেগে ওঠে। এবারে বাড়ি ফিরে মা-মেয়েকে উত্তম মধ্যম ক্যালাতে হবে। তবে যদি এদের গুমোর কমে। মেয়েটার আবার তেজ হয়েছে খুব। ওরই পয়সায় খেয়ে পরে ওকেই বলে কিনা কেটে ফেলবে! শিক্ষিত মেয়ে, আইন আদালতের ফাঁকফোকর জানে বলেই একটু সমঝে চলে পীযুষ। তাই বলে অনিক নামের ওই ছেলেটা মেয়েটাকে ফুসলে নিয়ে চলে যাবে তা তো হয় না। প্রিয়ার সঙ্গে রাজারপুরের পূর্ণেন্দুর বিয়ে দেবে মনে মনে ঠিকই করে ফেলেছে পীযুষ। পূর্ণেন্দুর নিজস্ব বিলাতি মদের দোকান, টাকার কুমির। প্রিয়ার দিকে নজর আছে ওর। একদিন পীযুষকে ডেকে বলেছিল, কাকা তোমার মেয়ে বুঝি? বেশ সুন্দর ফিগার তো? পূর্ণেন্দুর প্রথম পক্ষের বউটা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল বিয়ের একবছরের মধ্যেই। নিন্দুকেরা বলে, ওটা নাকি মার্ডার। নিন্দুকের ওসব কথায় কান দেয় না পীযুষ। পূর্ণেন্দুর সঙ্গে প্রায় পাকা কথা ভিতরে ভিতরে সেরেই রেখেছে। শুধু ওর নামে যে কেসটা ঝুলছে সেটার নিষ্পত্তি হলেই প্রিয়ার সঙ্গে বিয়েটা দিয়ে দেবে। পূর্ণেন্দু ওকে ক্যাশ বেশ কিছু টাকাও দেবে প্রিয়ার সঙ্গে বিয়েটা দিলে। মনে মনে হাসে পীযুষ, টাকা তো ও বারেবারে নেবে পূর্ণেন্দুর কাছ থেকে, যতই হোক গরিব শ্বশুরের দুঃখ কি আর সহ্য করতে পারবে একমাত্র জামাই! উড়ে নিক প্রিয়া, যতদিন না পূর্ণেন্দুর কেসটা মেটে। তবে কেসটা বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি মিটে যাবে। কারণ ওর শ্বশুরবাড়ির লোক প্রমাণ করতে পারেনি যে তাদের মেয়ের মৃত্যুটা মার্ডার।
ফোনটা বার দুয়েক বেজে গেল দীপশিখার। এত বাড়ন্ত হলো কবে, যে ওর ফোন রিসিভ করছে না? ইচ্ছে করছে এখনই ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে গিয়ে মা-মেয়েকে হাতে নাতে ধরতে। কিন্তু এই মুহূর্তে নিরুপায় পীযুষ। মেয়েটাকে আটকে রেখে বাবাটার কাছ থেকে আগে টাকা বের করতে হবে, হাতের সব তাস সাজিয়ে দিয়েছে ও। খেলাটা গুটিয়ে এনে এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো অর্থ নেই। কাজটা মিটে গেলে তবেই বাড়ি যাবে পীযুষ। অনিরুদ্ধ পালকে যদি নাকে দড়ি দিয়ে না ঘুরিয়েছে তাহলে ওর নামও পীযুষ বিশ্বাস নয়।
সুশোভন মাস্টারের নাতনির বিয়েটা নাকি রাইগঞ্জ থেকে হচ্ছে এমনি খবর পেয়েছিলো পীযুষ। প্যান্ডেলওয়ালা পিনাকী ওকে বিড়ি টানতে টানতে বলেছিল, বড়লোকের সেন্টিমেন্ট বুঝলে পীযুষদা। সুশোভন মাস্টারের মেয়ে গো, কি যেন নাম, যার কলকাতায় সাংবাদিকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, তার মেয়ের নাকি এই গ্রাম থেকে বিয়ে হবে। দাদুর বাড়ি থেকে বিয়ে দেবে। বোঝো কাণ্ড। কোথায় কলকাতা আর কোথায় রাইগঞ্জ। যতই এখানে ফ্ল্যাট উঠুক, বাজার বাড়ুক কলকাতার সঙ্গে কি কোনো তুলনা হয়? কেন যে মেয়েটার বিয়ে এখান থেকে দিতে চাইছে কে জানে? মেয়ের মামা এসে বললো, মাস খানেক পরে মেয়ের বিয়ে, তাই বাড়িতে নহবত বসবে, বাড়ির বাইরে বড় প্যান্ডেল খাটাতে হবে। আমি তো মনে মনে হাসলাম, জিজ্ঞেসাও করে ফেললাম, কলকাতার মেয়ের এখান থেকে বিয়ে? তা মামা বললো, আমার দিদির ইচ্ছে দাদুর স্মৃতি জড়ানো বাড়ি থেকেই কন্যা বিদায় হোক। বোঝো দিকি পীযুষদা! বড়লোকদের ব্যাপারস্যাপার, এদের যে কখন কার জন্য মন কাঁদে কে জানে! আমার আর কি, বড় কন্ট্র্যাক্ট পেলাম, গুছিয়ে টাকা নেব।
পীযুষের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো অনিরুদ্ধ পালের মুখটা। মনের মধ্যে পুষে রাখা রাগ থেকেই খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছিল। খুঁজতে খুঁজতে এমন একটা খবর হাতে এসে পৌঁছেছে, যেটা দেখালে ওই রিপোর্টার বাবুর আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। এই খবরের জন্য অবশ্য ওকে বেশ টাকা খরচ করতে হয়েছে। যাক, শেষ অবধি মেয়েটার বিয়েটা ভেঙে দিতে পেরেছে। পিনাকী তো বললো, বিয়ের আসর থেকে নাকি বর পালিয়েছে, মেয়েও নাকি বেপাত্তা। ভাগ্যিস চিরকুটটা ঠিক সময় মত পৌঁছাতে পেরেছিল। তাই তো পুরো কেসটা এখন ওর হাতের মুঠোয় মধ্যে চলে এসেছে। এখন একটু ধরে খেলতে হবে শান্ত মাথায়। নিজে সামনে না গিয়ে কপিল, বাপ্পাকে দিয়ে কাজ তুলতে হবে।
মেয়েও তো রিপোর্টার, যদি ছবি তুলে কাগজে ছাপিয়ে দেয়, তাহলে কিডন্যাপার বলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। তাই এমন ভাবে খেলতে হবে যেন বিষয়টা বেশি না ছড়ায়। বিড়িতে দুটো টান দিয়ে প্ল্যানটা মনে মনে আঁকছিলো পীযুষ। তখনই শিখার ফোন ঢুকলো।
ফোনটা ধরেই পীযুষ বললো, কি রে মাগি, সেজেগুজে কোথায় গিয়েছিলিস? আমি বাড়িতে নেই বলে কি পিঠে দুটো ডানা গজিয়েছে নাকি?
শিখা ভাঙা গলায় বলল, পেটে যন্ত্রণা হচ্ছিল, তাই প্রিয়া ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। গলাটা টক হয়ে আছে, আর পেটে লাগছে। ফোনটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। গলা শুনেই মনে হচ্ছে অসুস্থ। পীযুষ বললো, ঘরে আছিস, খাচ্ছিস দাচ্ছিস এত রোগ বাঁধে কি করে? দেখিস, টসকে যাস না, আমার এখন অনেক কাজ বাড়ি ফিরতে পারবো না।
ফোনটা রেখে দিয়েছে শিখা। বিরক্ত লাগছে পীযুষের। এখন যদি শিখার বাড়াবাড়ি কিছু হয় তাহলে ওকেই ছুটতে হবে। এদিকে এতবড় একটা রিস্কের কাজ ফেলে বাড়িও ফিরতে পারবে না ও।
বিড়িটা সিমেন্টের মেঝেতে ঘষে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ও। একবার রিটায়ার্ড পোস্ট মাস্টারের বাড়ি যেতে হবে। কয়েকটা খবর নেওয়ার আছে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে কপিলকে বললো, কাজ সেরে সিউকিউরিটিকে বলে তবে বেরোবি, নাহলে পরে আমায় কথা শুনতে হয়। রোজ একই কথা বলতে হয় এদের। হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলো পীযুষ। অনেক কাজ, এখন ওর অনেক কাজ।
।।২৬।।
কে ফোন করেছিল নীল? কাবেরীর প্রশ্নে নীলাদ্রি মাথা উঁচু করে তাকিয়ে বলল, অনিরুদ্ধবাবু। টুটাই বাড়ি ফিরছে। উনিই গাড়ি করে পাঠিয়ে দিয়েছেন টুটাইকে। অহনাই নাকি টুটাইকে বলেছে ও এখন বিয়ে করতে পারবে না। কারণটা ঠিক কি সেটা অবশ্য অনিরুদ্ধবাবু আমার কাছে পরিষ্কার করে বললেন না। তবে মেয়ের এ হেন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইলেন। এবং টুটাইয়ের যে-কোনো দোষ ছিল না কালকের ঘটনার জন্য সেটাই বললেন। অহনার কথাতেই ও বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিল। কাবেরী উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, কিন্তু তাহলে টুটাই কেন গিয়েছিল সূর্যপুর? নীলাদ্রি বললো, বুঝলে কাবেরী, তুমি ছেলেটাকে বড্ড ভালোভাবে মানুষ করেছো গো, অহনা আনলাকি তাই ও টুটাইকে পেল না। অহনাকে নাকি একা রাইগঞ্জ স্টেশনে দেখে ওকে বাবার কাছে পৌঁছে দিতে টুটাই গিয়েছিল ওখানে। অনিরুদ্ধবাবুর মত অমন স্বনামধন্য মানুষ একবাক্যে স্বীকার করলেন, আপনারা বড় যত্ন নিয়ে সন্তান মানুষ করেছেন নীলাদ্রিবাবু। ছেলে আপনাদের হিরের টুকরো। বড় ভদ্র, মার্জিত, শান্ত স্বভাবের ছেলে নৈঋত। ওকে এই কয়েকঘণ্টায় নাকি ওনার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। উনি বললেন, আত্মীয়তা হলো না ঠিকই, কিন্তু মাঝে মাঝে নৈঋতের সঙ্গে সময় কাটানোর পারমিশনটুকু আমায় দেবেন। সব দোষ আমাদের মেয়ের, তাই টুটাই বাড়ি ফিরলে যেন আমরা কোনোভাবেই ওকে আক্রমণ না করি। বুঝলে কাবেরী, অনিরুদ্ধ বাবু মানুষ হিসাবে ভীষণ সাচ্চা। নাহলে কেউ এভাবে মেয়ের দোষ স্বীকার করে না।
কাবেরী ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। তার মানে শেষ আশাটুকুও নিভে গেল। বসুবাড়ির সবার ধারণাই সত্যি হলো। দোষী তার মানে অহনা! কাবেরীর চোখই ধোঁকা খেয়েছে। কাবেরী মাথা নিচু করে বললো, আমায় তোমরা ক্ষমা করে দিও। আর অফিসের ব্যানার্জীদার সঙ্গেই কথা বলো, আমার আপত্তি নেই। অহনার বাবা-মা ভদ্র ভালো জেনে আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই নীল। মেয়েটা আমায় এভাবে ঠকালো, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে! যাক, টুটাই ফিরে আসুক, আমরা ওর একটা ভালো বিয়ে দেব। নীলাদ্রি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, কাবেরী আজ টুটাই একা আসছে। আজ তো ওর বউ নিয়ে এবাড়িতে ঢোকার কথা ছিল। ছেলেটার ওপর দিয়ে বড্ড ঝড় বয়ে গেল গো। আমাদের শক্ত হয়ে ওকে সামলাতে হবে এখন। কাবেরী নীলের হাতটা ধরে বলল, হয়তো ভালোই হলো। ওই মেয়ের পাল্লায় পড়লে আমার ছেলেটার কপালে কি জুটতো কে জানে! বলা তো যায় না, হয়তো বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতো তারপর শুরু করত টুটাইয়ের সঙ্গে অশান্তি। এই বেশ ভালো হলো। সাময়িক কষ্ট হলেও জীবনটা তো ছোট নয়। টুটাই কখন ফিরবে বলো তো?
নীলাদ্রি ধীর গলায় বলল, ফিরতে ফিরতে সাতটা তো বাজবেই। অনু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল বোধহয়, টুটাই ফিরছে শুনেই উত্তেজিত হয়ে বলল, টুটাই ফিরছে? আমি বরং ওর ঘরটা পরিষ্কার করে রাখি বৌদিভাই। ছেলেটা বড্ড ক্লান্ত, ওর রেস্ট দরকার। আমি জানতাম, আমাদের টুটাই এমন কাজ করতেই পারে না। আমি শুভকে বলেও ছিলাম, আমার ভাইপো আমি চিনবো না? যাই তুতানকে বলি, দাদার ঘরটা ভালো করে পরিষ্কার করতে।
অনু চলে যেতেই নীলাদ্রি বললো, জানো কাবেরী যাদেরই ফোনে বলছি বিয়েটা ভেঙে গেছে একটা আকস্মিক ঘটনায়, তারাই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে, নৈঋতের মত ছেলে হয় না, ওর সঙ্গে এমন ঘটলো? কাবেরী মাথা নিচু করে বললো, সবটাই আমার দোষ। তোমরা অহনা সম্পর্কে একটু হলেও দ্বিমত পোষণ করেছিলে, আমি একাই লড়ছিলাম। আমার জন্যই আজ সকলকে অপমানিত হতে হলো, সরি নীল। নীলাদ্রি আলগোছে বললো, ডেস্টিনি, না মানলেও উপায় নেই। টুটাইয়ের মুখোমুখি কি ভাবে হব সেটাই ভাবছি। ও তো আমাদের বিশ্বাস করেই অহনাকে পছন্দ করেছিল। টুটাই কলেজে গিয়ে কিভাবে ফেস করবে ছাত্র ছাত্রীদের? নীলাদ্রি জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো, উফ, আর ভাবতে পারছি না।
কাবেরীও আর ভাবতে পারছে না। সব তালগোল পাকিয়ে হাজির হয়েছে ওর সামনে। নীল, একবার ব্যানার্জীদাকে কলটা করবে? কেমন যেন অস্থির লাগছে আমার। নীলাদ্রি কাবেরীর দিকে তাকিয়ে বলল, এত অস্থির হয়ে পোরো না। তুমি এমন করলে আমি জোর পাবো কোথা থেকে! টুটাই সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরছে এটাই আমাদের কাছে সব থেকে বড় পাওনা। সোসাইটি, প্রেস্টিজ, কলিগ এসব শব্দের থেকেও কিন্তু টুটাই আমাদের কাছে অনেক দামি। কাবেরী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, টুটাই আমায় আর কোনোদিন বিশ্বাস করবে না নীল। ক্ষমাও করবে না হয়তো। সেই টুটাই যার টিফিনবক্স আমি না গুছিয়ে দিলে নাকি তার পেট ভরতো না, সেও আমায় ভুল বুঝবে, আমি কিভাবে সামলাব নীল? নীলাদ্রি ক্লান্ত হেসে বললো, এখনকার ছেলেমেয়েরা আমাদের মত এতটা ইমোশনাল বোধহয় নয়। নয় বলেই টুটাই কাল থেকে ফোনের সুইচ অফ করে রেখে দিতে পেরেছে। একবারও আমাদের একটা কল করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনি। অহনাকে দেশের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়াটা ওর কাছে প্রায়োরিটি ছিল অথচ তোমাকে একটা কল করে নিজের খবরটা জানানো নয়, তাই না? তাই বলছি কাবেরী এত ভেবো না। আমি বরং ব্যানার্জীদাকে একটা কল করি। সন্ধে তো হয়েই গেল। কাবেরী সাগ্রহে তাকালো নীলের দিকে। হ্যাঁ, সময় নেই নষ্ট করার মত। আমিও চাই এই মাসেই টুটাইয়ের অন্যত্র বিয়ে ঠিক করতে। হঠাৎ তুতান ডাকলো ঘর থেকেই, মামিমা দেখো…দাদাভাইয়ের ল্যাপে ওই বউদিভাইটার কয়েকটা ক্লিপিং। তুতান সারাদিন টুটাইয়ের ল্যাপটপটা নিয়ে মুভি দেখে যাচ্ছে। তুতান এ বাড়িতে এলে টুটাইয়ের সব জিনিস ওর দখলেই থাকে। টুটাই বড্ড ভালোবাসে পিসির ছেলেটাকে। হয়তো নিজের ভাইবোন নেই বলেই। তুতানের কাছে টুটাইয়ের পারসোনাল কিছু নেই, সব ওদের কমন। বিয়ে করতে যাওয়ার আগে যেমন টুটাই বললো, এই তুতান তোর জেলটা একটু আমার চুলে দিয়ে দে, নিজেই তো কেত মারছিস, আরে আজ সবাই আমাকে দেখবে বস, তোকে নয়। তুতান হাসতে হাসতেই বললো, জেল লাগিয়ে আর কি করবি? তোকে তো টোপর পরে থাকতে হবে, আজ তোর সব ফ্যাশন গন… তারপরেও কাবেরী দেখলো তুতান বেশ যত্ন করে টুটাইয়ের চুল সেট করছে আর বলছে, তুই এবারে চুলটা হাবিবের কাছ থেকে কাটিসনি? তোকে যে আমি ফোনে বলেছিলাম, তাও শুনলি না? টুটাই কি উত্তর দিয়েছিল শোনা হয়নি কাবেরীর। তবে এটুকু জানে দুই ভাইয়ের বড্ড মিল। ল্যাপটপ থেকে মোবাইল সবকিছুর একসেস টুটাই আর কাউকে না দিক তুতানকে দেবেই।
ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কাবেরী বললো, কি রে?
তুতান প্লে করতেই দেখতে পেলো টিভির নামি চ্যানেলের কিছু ক্লিপিং। যেখানে অহনা মাউথপিস হাতে বাইট দিচ্ছে। নীলাদ্রি বললো, দেখো, মেয়েটার কি মারাত্মক সাহস। এই তো কদিন আগের মৌলালীর ঘটনাটা নিয়ে বলছে, তাও আবার স্পট থেকে।
নিউজ চ্যানেলের নিউজ রিডার বলছেন, মৌলালীতে এই মুহূর্তে উপস্থিত আছেন আমাদের চ্যানেলের রিপোর্টার অহনা পাল, অহনার কাছ থেকে জেনে নেব এখন ওখানকার অবস্থা ঠিক কেমন।
অহনা বেশ স্পিডেই বলছে, ‘একটু আগেই এখানে একটা মিছিলকে কেন্দ্র করে শুরু হয় গন্ডগোল। তারপর দুই দলের ইট ছোড়াছুড়ি চলেছে বেশ কিছুক্ষণ। অবশেষে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে ছত্রভঙ্গ হয়েছে মিছিল। তবুও আপনারা এখনো আমাদের ক্যামেরায় দেখতে পাচ্ছেন, মিছিলের বেশ কিছু মানুষ এখনও ছত্রভঙ্গ মিছিলকে পুনরায় সংঘবদ্ধ করার প্রয়াস চালাচ্ছে। ঘটনাস্থল এখনো উত্তপ্ত। আমি অহনা পাল, মৌলালী থেকে বলছি।’
এমন আরও বেশ কয়েকটা ভিডিও ক্লিপিং রয়েছে টুটাইয়ের এই ফোল্ডারে।
নীলাদ্রি বললো, কাবেরী তুমি কি করে এমন একটা মেয়েকে চুজ করেছিলে বলতো? রীতিমত উত্তপ্ত পলিটিক্যাল গন্ডগোলের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই মেয়ে রিপোর্টিং করছে, ভাবতে পারছো বিপদটা! এর এটাই প্রফেশন। তোমার ধারণা আছে, রিপোর্টাররা কতরকম বিপদের মধ্যে পড়ে, এসব খবর করতে গিয়ে! কিন্তু আমি ভাবছি টুটাইয়ের তার মানে অহনার প্রতি ইন্টারেস্ট তৈরি হয়েছিলো, তাই এগুলো জোগাড় করেছিল। তুতান বললো, দাদাভাইয়ের কিন্তু অহনাদিকে অপছন্দ ছিল না, এটুকু বলতে পারি। কাবেরী একটু হেসে বললো, অহনাকে অপছন্দ করবে এমন মানুষ হতেই পারে না। তবে ও যেটা করলো আমার সঙ্গে, এরপরে আর এ বাড়িতে ওর নামটুকুও উচ্চারণ করবে না কেউ।
কাবেরী দেখলো, অনু টুটাইয়ের ঘরটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। ফুলদানিতে টাটকা গোলাপ রেখেছে কিছু। বিছানায় টুটাইয়ের পছন্দের রঙের একটা চাদর পাতা। দেওয়ালে টুটাইয়ের ছোটবেলার ছবিগুলোর একটু আধটু জায়গা পরিবর্তন করেছে মনে হচ্ছে, বেশ ভালো লাগছে। তুতান বললো, মামী, মা বলেছে আমি মামার পাশের ঘরটাতে থাকবো, দাদাভাইকে এখন একটু একা ছেড়ে দেওয়া উচিত। একটু প্রাইভেসি দরকার ওর। আমি আমার ব্যাগটা নিয়ে ওই ঘরে শিফট করে যাচ্ছি। নীলাদ্রি বললো, সেই ভালো। তুই আমাদের পাশের ঘরে চলে আয়। তোর মামীর সঙ্গে ঝগড়া হলে মাঝরাতে আমাকে বাঁচাতে তুইই আসতে পারবি। নীলাদ্রি মজা করে মনের চাপ লাঘব করার চেষ্টা করছে। কাবেরী আবার তাড়া দিলো, কি গো ফোনটা করো ব্যানার্জীদাকে।
বার দুয়েক রিং হবার পরেই রিসিভ করলো ব্যানার্জীদা। সাধন ব্যানার্জী, নীলাদ্রির সঙ্গে একই পোস্টে জব করেন। বয়েসে যদিও নীলাদ্রির থেকে একটু বড়ই হবেন। নীলাদ্রি অবশ্য ওদের সমস্ত কলিগ এমনকি কাবেরীর কাছেও বিস্ময়। কারণ এত বছরের রেলের জবে কাবেরী নিজেও বার দুয়েকের বেশি প্রমোশন পায়নি। সেখানে নীলাদ্রি গুনে গুনে ছটা প্রমোশন পেয়ে এখন রীতিমত গ্রুপ-এ র গেজেটেড পোস্ট হোল্ড করে। নীলাদ্রির সব কলিগরাই প্রায় ওর থেকে সিনিয়র বা রিটায়ার করবে আর কয়েকদিনের মধ্যে এমন। সেখানে নীলাদ্রি অনেকটা কম বয়েসেই পৌঁছেছিল এই পজিশনে। কাজের ব্যাপারে ও বরাবরই ভীষণ সচেতন, সেটা অবশ্য কাবেরীও জানে।
আরে নীল, বলো বলো…ব্যানার্জীদার দরাজ গলা শোনা গেল। কিছু মনে কোরো না ভায়া, একটা সংবাদ পেলাম আমাদের সৌরভের কাছ থেকে, ও নাকি বললো, তোমার ছেলের বিয়েটা ভেঙে গেছে। তাই আমাদের নিমন্ত্রণ ক্যানসেল। তুমি নাকি সকলকে জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছো সৌরভকেই। অনেকবার ইচ্ছে করছিল তোমায় একবার কল করি, আসল বিষয়টা কি সেটা জানার জন্যই। তবুও কৌতূহল দমন করে নিলাম, হয়তো ব্যস্ত আছো এই ভেবে। কি হয়েছে নীলাদ্রি?
ব্যানার্জীদা মানুষটা বরাবরই খোলা মনের। অফিস রাজনীতিতে কোনোদিনই ইন্ধন জোগান না। ব্যানার্জীদার আসল নাম সাধন ব্যানার্জী, কিন্তু উনি এখন সকলের ব্যানার্জীদা নামেই পরিচিত। নীলাদ্রি জানে, এই মানুষটাকে সবটুকু সত্যি বলাই যায়, তবুও অফিস বলে কথা, তারপর নিজের পজিশনটার কথা ভেবেই একটু রেখে ঢেকে বলবার সিদ্ধান্ত নিলো।
নীলাদ্রি একটু থেমে থেমে বললো, হ্যাঁ ব্যানার্জীদা ঠিকই শুনেছ। বিয়েটা ভেঙে গেছে মেয়ের কারণে। পাত্রী রিপোর্টার। বিয়ের আসরে বসার আগে নাকি তার কি কাজ পড়ে গেছে, তাই সে বিয়েটা তখন করতে পারছিল না। আসলে ব্যানার্জীদা আমরা মধ্যবিত্ত মানসিকতায় মানুষ। তাই এমন ধরণের উচ্ছৃঙ্খলতা দেখতে অভ্যস্ত নই। সম্পর্ক নিয়ে শুরুতেই টানাহ্যাঁচরা করতে ইচ্ছে করেনি আর। টুটাইও আর রাজি হলো না বিয়েটা করতে, বাধ্য হয়ে ভেঙে দিলাম। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আমাদের রাডারে ধরার চেষ্টা না করাই ভালো বুঝলে তো?
এখন আমরা চাই টুটাইয়ের একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিতে। তো তোমার পরিচিত কোনো মেয়ে যদি থাকে তাহলে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
ব্যানার্জীদা বেশ আগ্রহের সঙ্গে বললো, আরে নৈঋতের মত ছেলের কি পাত্রীর অভাব হবে নাকি! আমার শালার মেয়েই তো আছে। দাঁড়াও, তোমায় আমি মিমির দুটো ছবি পাঠাই। ও তো রবীন্দ্রভারতীর মিউজিক ডিপার্টমেন্টের লেকচারার। তারপর এখন তো মিউজিক নিয়ে পি এইচ ডি করছে। নৈঋতের সঙ্গে বেশ মানাবে। আমার শালা আবার এসব ম্যাট্রিমনি সাইটে একেবারে বিশ্বাসী নয়। সাবেকি ঘটক প্রথায় বিশ্বাসী। আমি এখুনি ওদের নৈঋতের কথা বলছি। মিমিরও ফার্স্ট চয়েস প্রফেসর। আমি ছবি পাঠাচ্ছি দেখো। নীলাদ্রি তোমায় আর কাবেরী দুজনকেই তো আমি চিনি, তাই তোমাদের ফ্যামিলিতে মেয়ে দিতে আমাদের কারোর আপত্তি হবে না।
ব্যানার্জীদা কথা শেষ করতেই হোয়াটসআপে দুটো ছবি ঢুকলো। কাবেরীর পাশে অনু, শুভময়ও এসে দাঁড়িয়েছে। সবার চোখই এখন হোয়াটসআপের দিকে। ছবিটা লোড হচ্ছে। অনুই প্রথমে বললো, ওমা, দেখো কি মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে! শুভময় বললো, বেশ স্নিগ্ধ সৌন্দর্য তাই না? কাবেরীর চোখের সামনে অহনার সাহসী চোখদুটো একবার উঁকি দিয়েই ফিরে গেল অবিশ্বাসের অন্ধকারে। মেয়েটাকে দেখতে সত্যিই বেশ মিষ্টি। তবে অহনার মত নজর কাড়ে না। অহনার থেকে গায়ের রং ফর্সা, নাক টিকালো, চোখ দুটো ভাসা ভাসা, যাকে এক কথায় সুন্দরী বলা চলে। সবেতেই হয়তো এই মিমি নামক মেয়েটা অহনাকে টেক্কা দিতে পারে কিন্তু আটকে যাবে একটা জায়গায়, যেখানে অহনাই হলো সম্রাজ্ঞী। ব্যক্তিত্ব, অহনাকে দেখলে সকলের মনে একটাই সমার্থক শব্দের উদ্ভব হবে, সেটা হলো ব্যক্তিত্ব। ওই এক জায়গায় জিতে অহনা হারিয়ে দেবে মিমিকে। ধুর, কাবেরী আবার কেন ভাবছে অহনার কথা! যে ভিডিও ক্লিপিংগুলো এখুনি দেখে নীল একটাই কথা বললো, কি মারাত্মক ব্যতিক্রমী সাহস দেখেছো মেয়েটার? ব্যাকগ্রাউন্ডটা খেয়াল করো, এখনো আগুন জ্বলছে জায়গাটায়, ওখানে দাঁড়িয়ে এই মেয়ে স্পষ্ট গলার স্বরে বাইট দিচ্ছে। কোনোরকম ভয়ের লক্ষণ নেই ওর চোখে। ঠিক যে কারণে অহনাকে পছন্দ নয় নীলের, সেই একই কারণে অহনাকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না কাবেরী। অনু বললো, বৌদি কিছু বলো? মেয়েটাকে তো দুর্দান্ত দেখতে, আবার গুণের মেয়েও বটে। শুভময় বললো, রীতিমত সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ বলে কথা। আমি তো দেখতে গিয়ে একটা গান শুনতে চাইবই। কাবেরী খেয়াল করলো, সবাই বেশ মেতে উঠেছে নৈঋতের বিয়ের নতুন সম্বন্ধটা নিয়ে। নীল বললো, কাবেরী কেমন লাগলো বলো?
কাবেরী শান্ত স্বরে বললো, ভালো তো। আগের বার আমি ঠকেছি, তাই এবারে টুটাইয়ের বিয়ের দায়িত্ব তার বাবা, পিসি, পিসান নিলেই শান্তি পাবো আমি।
কাবেরী যে কেন অহনাকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না কে জানে? ওর সঙ্গে অহনার পরিচয়টা নাটকীয়ভাবে হয়েছিল বলে, নাকি কফিশপে বসে খুব সহজেই ওরা দুজনে গল্প করতে করতে অসম বয়েসি বন্ধুত্বের বেড়াজালটা ডিঙিয়ে ফেলেছিল বলে! অহনার বলা সব কথার মধ্যে সেদিন একটা কথা কাবেরীর মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। এত বয়েসে এসেও তো কখনো এমন ভাবেনি কাবেরী। এই প্রথম ভাবতে বাধ্য করেছিল অহনা।
ওর একটা ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বেশ কিছু মিথ্যে বলতে হয়েছিল কাবেরীকে। ঠিক মিথ্যে নয়, কিছু অগোছালো কথা বুনতে হয়েছিল যেগুলো পুরোটা সত্যি নয়। অহনা খুব ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা আন্টি আপনি আর আঙ্কেল তো একই অফিসে জব করতেন তাই না? আঙ্কেল কি আপনার থেকে সিনিয়র?
কাবেরী হেসে বলেছিল, হ্যাঁ, আমি যখন ক্ল্যারিক্যাল জব জয়েন করেছিলাম তখন ও এক ধাপ উঁচুতে ছিল। অফিসার ইনচার্জ।
অহনা কফিতে চুমুক দিয়ে কথাটা হালকা করে ভাসিয়ে দিয়েছিল, এখন তো আঙ্কেল এ ওয়ান অফিসার তাই না আন্টি? আপনি বোধহয় গ্রুপে বি তে আছেন তাই না?
কাবেরী ঘাড় নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ। নীল এখন অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। অহনা টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলেছিল, কেন আন্টি? কেন আঙ্কেল এতগুলো প্রমোশন পেল, আর আপনি বোধহয়, দুটো কি তিনটে?
কাবেরী ধরা গলায় বলেছিল, আমি যখন প্রেগনেন্ট ছিলাম তখন একটা প্রমোশন পেপারে বসতে পারিনি। তারপর টুটাই হওয়ার পর থেকে তো জবটুকু করতেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। রাত জেগে প্রোমোশনের জন্য পড়বো কখন? অফিস, সংসার, বাড়ি সব সামলে আর হয়ে উঠলো না গো। আসলে কাবেরী জানে, নীলাদ্রিও তেমন চায়নি, কাবেরী আরও উঁচুতে উঠুক। কিন্তু এমন জোড়াতালি অসত্য বলতেই হয় কাবেরীকে। কারণ ওরা সুখী দম্পতি।
অহনা বেশ নরম অথচ দৃঢ় স্বরে বলেছিল, আন্টি সংসারটা আঙ্কেলের নয়? নৈঋত আঙ্কেলের ছেলে নয়? আসলে কি জানেন, মেয়েরা প্রথম থেকেই ভেবে নেয়, কেরিয়ার নিয়ে ভাবার অধিকার শুধু পুরুষদের আছে। মেয়েরা তো সংসার সামলাবে। যেসব ফ্যামিলি মেয়েদের জব করাটা মেনে নেয় সেইসব ফ্যামিলিকে সমাজ খুব উঁচু জায়গায় বসিয়ে দেয়। বেশ গর্ব করে বলে, আমরা ভীষণ রকম লিবারাল। সত্যিই কি লিবারাল? বউ অফিস থেকে একটু দেরি করে ফিরলে বাড়ির লোকজনের মুখ ভার হয় না? সন্ধের চাটুকু অন্তত সে ফিরে করবে এই প্রত্যাশাটা বোধহয় সকলেরই থাকে। সেই বাড়ির ছেলে যদি অফিস করে, ক্লাব হয়ে রাত বারোটায় ফেরে তাহলেও বাড়ির লোকজন বলবে, আহা, ছেলেটার বড্ড কাজের প্রেসার। আসলে কি জানেন আন্টি, আমরা সমতা সমতা করে লাফাই ঠিকই, কিন্তু এর সঠিক অর্থ জানি না। কিছু মেয়ে মনে করে গোটা সংসার আমার হাতের মুঠোয়, এটাই তো স্বাধীনতা। কিছু মেয়ে ভাবে, অন্তর্বাসের ফিতে বের করে, হট প্যান্ট করে ঘুরছি, মানেই আমি সমতা পাচ্ছি। কিছুজন ভাবে আমি জব করছি, ব্যস আমি স্বাধীন। আসলে কি বলুন তো, সমতা শব্দের অর্থটা আমাদের মেয়েদের কাছেই ধোঁয়াশা। আমরা কোনোদিন পুরুষদের মত কেরিয়ারিস্টিক হতে পারবো না। কারণ অদ্ভুতভাবে সন্তানের দায়িত্ব, সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কোনো এক অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী এসে পড়বে আমাদের একার কাঁধে। পুরুষরা একই সংসারে সেপারেট ঘরে বসে রাত জেগে পড়ে প্রমোশন পাবে কিন্তু আমাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ডিনার টেবিল মুছে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে, বেবির কেয়ার করে তবে আমরা কেরিয়ার নামক অলীক বস্তুর কথা ভাবার সুযোগ পাবো। ততক্ষণে ক্লান্ত শরীরে ঘুম নামবে। ভোরেও উঠতে হবে আমাদেরই আগে। এটাই নিয়ম হয়ে গেছে আন্টি। যে মেয়ে এই নিয়মের বাইরে যেতে চাইবে তাকেই অন্যরা বাচাল, অসভ্য, অভদ্র বলে দাগিয়ে দেবে। আসলে কি বলুন তো, ঘুনটা ধরেছে অনেক গভীরে, রুট খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই তো আপনি এখন গ্রুপ বি তে রয়ে গেছেন এবং আঙ্কেলের প্রোমোশনের পার্টিতে আনন্দ করেছেন, ইগোটুকুও হার্ট হয়নি। যদি উল্টোটা হতো আন্টি?
যদি আজ আপনি থাকতেন আঙ্কেলের জায়গায় আর আঙ্কেল আপনার জায়গায়? তাহলে? অমিতাভ বচ্চনের অভিমানটা কিন্তু বাস্তব গল্প, শুধু মুভি নয়।
অহনার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলো কাবেরী। এই মেয়েটা কি করে জানলো ওর গভীরের ক্ষতটার কথা? মেয়েটা কি ম্যাজিক জানে? কাবেরীর মাঝে মাঝেই কষ্ট হতো, মনে হতো ও তো পারতো, নীলাদ্রি যদি একটু সাপোর্ট করতো হয়তো পারতো। স্বপ্ন তো কাবেরীও দেখেছিলো গেজেটেড পোস্টের! নীল কখনো সংসারের কোনদিকে তাকায়নি, নিজের কাজ আর কেরিয়ার নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কাবেরী অফিস সামলে সংসার, টুটাইকে নিয়েই কাটিয়ে দিলো গোটা জীবনটা। মনে মনে এই ভেবে শান্তি পেতো, ওর সংসার ওর দখলে। ভাবনাটাও যে ভুল ছিল সেটা বুঝতে পারলো টুটাইয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় যখন ওর দিকে দোষারোপের আঙুলটা উঠলো নির্দ্বিধায়।
অহনা বলেছিল, আন্টি আসলে কি বলুন তো, আমরা দিনরাত লড়াই করে যাচ্ছি, নিজের মনকে ফাঁকি দেওয়ার লড়াই, ভালো আছি জানানোর যুদ্ধ করেই চলেছি। আর যেসব মেয়েরা সমতা শব্দের মানে বোঝে তাদের মনে অনেকটা যন্ত্রণা। চোখের সামনে অন্যায় দেখেও মেনে নিতে বাধ্য হবার কষ্ট জমেই চলেছে অবিরত। ”মেয়েদের একটু মানিয়ে নিতে হয়” শব্দগুলো শুনতে শুনতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, হারিয়ে যায় প্রতিবাদের ভাষা। তাই ঘুনপোকাটা ধীরে ধীরে গভীরে আরও গভীরে প্রবেশ করে। সমাজ পাল্টাচ্ছে কথাটা তাই এখনো আমি মানতে পারি না আন্টি। ঐজন্যই তো মেয়ে রিপোর্টারের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে আপনাকে এত লড়তে হচ্ছে। তাই না?
কাবেরী সামলে নিয়ে বলেছিল, না না আমাদের ফ্যামিলির সকলের তোমায় পছন্দ, টুটাইয়ের বাবার, টুটাইয়ের, সকলের।
অহনা অল্প হেসে বলেছিল, মিথ্যে বললে অনেককে বেশ কিউট লাগে কিন্তু।
কাবেরী হেসে বলেছিল, বড্ড দুষ্টু তুমি, হবু শাশুড়ির সঙ্গে মজা হচ্ছে?
অহনা জিভ কেটে বলেছিল, এই রে ভুলেই তো গিয়েছিলাম, ঘোমটা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু জিন্স টপে ঘোমটা কোথায় পাবো?
মেয়েটার সরলতা ঘেরা সততা আর দৃঢ়তা মুগ্ধ করেছিল কাবেরীকে। অহনা যেন স্বচ্ছ আয়না, যার সামনে দাঁড়ালে বিবেক নামক বস্তুটি নড়েচড়ে বসে প্রশ্ন করতে শুরু করে। এমন এক ধারালো খাপ খোলা তলোয়ারকেই চেয়েছিল কাবেরী বউ হিসেবে।
কাবেরী অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, কথা দিলাম, টুটাই আর তোমার মধ্যে কখনো ভেদ করবো না।
অহনা মিষ্টি করে হেসে বলেছিল, বেশ তাহলে ডান, ওই কথাই রইলো, বিয়ের পর কাবেরী বসুর আদরের সেভেন্টি পার্সেন্ট আমি পাবো, বাকি থার্টি তার পুত্র। আসলে এতকাল ধরে হান্ড্রেড তো নৈঋত একাই পেয়েছে, তাই হিসেব বরাবর করার জন্য আপাতত বেশ কিছু বছর ওকে থার্টিতেই কাজ চালাতে হবে।
কি সুন্দর সাবলীল ছিল অহনার আদর চাওয়ার ভঙ্গিমা। কাবেরী এখনো ভাবতেই পারছে না, অহনা কোনো অন্যায় করতে পারে! অন্যমনস্ক কাবেরীর দিকে তাকিয়ে নীলাদ্রি বললো, কি হলো, এখনও কি রিপোর্টার তোমার মাথায় ভর করে আছে নাকি?
কাবেরী নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, না, কেউ নেই আমার মাথায়। তোমরা টুটাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করো, আমার আপত্তি নেই।
কাবেরীর কথা শেষ হবার আগেই বাড়ির গেটের সামনে একটা গাড়ির হর্ন শোনা গেল। অনু উৎসাহিত হয়ে বলল, বৌদিভাই বোধহয় টুটাই এলো। নীলাদ্রি একটু সচেতন গলায় বলল, আমরা কেউ কিন্তু ওকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করবো না। ওর যখন ইচ্ছে হবে উত্তর দেবে। শুভ বললো, আই এগ্রি উইথ দাদা।
গাড়ি থেকে নেমে টুটাই ড্রাইভারকে কিছু একটা বলছে এটুকু ব্যালকনি থেকেই দেখা যাচ্ছে, বোধহয় ড্রাইভারকে বাড়িতে আসার জন্য রিকোয়েস্ট করছে, কিন্তু গাড়িটা আর দাঁড়ালো না, বেরিয়ে গেল। টুটাই যেন একটু অস্বস্তি নিয়েই বাড়ির গেটটা খুললো। কাবেরী আর অনু দুজনেই নীচে নেমে গেছে। নীলাদ্রি আলগোছে বললো, ঠিক কি ভাবে ওর সঙ্গে শুরু করা উচিত শুভ?
শুভময় একটু ভেবে বললো, দাদা একটু টাইম দিন, সময় সব থেকে বড় মেডিসিন। ওকেই বলতে দিন, আমরা প্রশ্ন করবো না। নীলাদ্রি ঘাড় নেড়ে বললো, চলো নীচে যাই।
নিচে নামতে নামতেই শুনলো, কাবেরী বললো, একটা ফোন করা যেত টুটাই, আমরা টেনশন করছিলাম।
টুটাই বললো, নিশ্চয়ই যেত কিন্তু কাল মাথায় আসেনি ফোন করে কি বলবো? আর আজ তো অনিরুদ্ধবাবু তোমাদের কল করে নিশ্চিন্ত করেছিলেন তাই আর করিনি। তাছাড়া আমি ফোনটা অফ রেখেছি, তোমরা ছাড়াও আরও তো ফোন আসার সম্ভবনা ছিল, সেগুলো এভয়েড করার জন্যই। এনিওয়ে, আই অ্যাম ফাইন নাও।
পিসিমণি, একটু কড়া করে চা খাবো তোমার হাতের। অনু বিগলিত হয়ে বলল, এখুনি আনছি টুটাই। তোর শরীর ঠিক আছে তো রে?
টুটাই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, ফাইন।
কাবেরীর দিকে তাকিয়ে টুটাই বললো, জানি তোমাদের সকলের মনেই এখন প্রশ্নের বুদ্বুদ, কিন্তু আই নিড সাম টাইম প্লিজ। সব বলছি ডিনার টেবিলে। এনিওয়ে আজকে যে সমস্ত গেস্টদের ইনভাইট করা হয়েছিল, তাদের কি সব জানানো গেছে? নাকি এসে হাজির হবে? নীলাদ্রি সিঁড়ির শেষ ধাপে পা দিয়ে বললো, মোটামুটি নিমন্ত্রণ লিস্ট দেখে সকলকে কল করা হয়েছে। এরপরে যদি কেউ বাকি থেকে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই কারোর না কারোর মাধ্যমে সত্যিটা জেনেই গেছে।
নৈঋত অল্প হেসে বললো, দ্যাটস গুড। আমি একটু আসছি ঘর থেকে। পিমনি চা করে আনলে প্লিজ আমার রুমে পাঠিয়ে দিও। কাবেরী ছেলের দিকে তাকিয়েছিল অপলক। কেমন যেন বদলে গেছে ছেলেটা এক রাতেই। টুটাই বরাবরই একটু চুপচাপ স্বভাবের, অনেকটা বাবার মত চাপা স্বভাবের সেটা ঠিক। কিন্তু কাবেরীর সঙ্গে কথা না বলে এমন ভাবে তো কখনো এড়িয়ে যায়নি ও। তবে কি শেষ পর্যন্ত এই ঘটনার জন্য মাকেই দোষী করলো টুটাই? হবে হয়তো। এটুকুই পাওনা বাকি ছিল কাবেরীর।
অনু টুটাইয়ের ঘরে চা দিয়ে এসে বললো, ফোন ঘাঁটছিলো অন্যমনস্ক ভাবে। হয়তো ওর কলিগদের গ্রুপেও কেউ কিছু বলছে।
কাবেরী ধীর গলায় বলল, আমি জানি টুটাইয়ের এখন প্রাইভেসি দরকার, তবুও আমায় একবার যেতেই হবে ওর কাছে।
কাবেরী নীলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে এগোলো টুটাইয়ের রুমের দিকে। ঘরের বাইরে থেকেই শুনতে পেল, হ্যাঁ স্যার আমি পৌঁছে গেছি। শ্যমলদাকে বললাম, বাড়িতে এসে চা খেয়ে যেতে, বোধহয় সঙ্কোচের বশেই এলো না। আমার কোনো প্রবলেম হয়নি স্যার। তবে বাড়ির কারোর সঙ্গে এখনো কথা হয়নি। আপনার তিতির পাখির কি খবর?
সেকি, তখন থেকে ঘর বন্ধ করে বসে আছে? কিন্তু কেন? আপনি কথা বলুন। যা জেদ ওই মেয়ের! আচ্ছা স্যার, এখন রাখছি।
কাবেরী পরিষ্কার বুঝতে পারলো টুটাই অনিরুদ্ধবাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, টুটাই একবার আসবো?
টুটাই দরাজ গলায় বলল, এসো মা। কাবেরী নরম গলায় বলল, ক্ষমা করিস। তোদের নিমরাজির সুযোগ নিয়ে আমিই বিয়েটাতে উদ্যোগী হয়েছিলাম। বসু পরিবারের সম্মান, তোর, নীলের সকলের সম্মান নষ্ট হয়েছে, সেজন্য আমি দুঃখিত রে। টুটাইয়ের বিছানার কোণে বসেছিলো কাবেরী, টুটাই আধশোয়া হয়ে চা খাচ্ছিল।
আচমকা বললো, মা, বাড়ির সকলে কি অহনাকে দোষারোপ করছে এই ঘটনার জন্য?
কাবেরী ছেলের দিকে অপলক তাকিয়ে বলল, সেটা কি কিছু ভুল করছে টুটাই? অহনার খামখেয়ালিপনাতেই তো ভেঙে গেল বিয়েটা, অসম্মানিত হলাম আমরা সকলে। হ্যাঁ রে টুটাই, অহনা ঠিক কি বলেছিল রে তোকে, যে তুই ওই অপরিচিত জায়গায় পালিয়ে যাবার রিস্ক নিলি?
টুটাই হেসে বললো, অহনা বলেছিল, আমি নিরুপায় নৈঋত, বিয়েটা আমি আজ করতে পারছি না। আমাকে এখুনি বেরোতে হবে। আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড ওয়েট করছে আমার জন্য, প্লিজ হেল্প মি।
জানো মা, আমিও বিশ্বাস করেছিলাম যে সত্যিই অহনার এক্স ওর জন্য ওয়েট করছে। কাবেরী বললো, তাহলে কোনটা সত্যি টুটাই?
টুটাই একটু জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, মা, অহনার এক্স বয়ফ্রেন্ড নেই, তবে কোনো একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে যেটা আমরা জানি না, সেই জন্যই ও শেষ মুহূর্তে বিয়েটা ক্যানসেল করলো। সেই সত্যিটা ও জানাতে পারছে না, আবার মিথ্যেও বলতে পারছে না, তাই দ্বন্দ্বে ভুগছে মেয়েটা।
কাবেরী একটু অভিমানী গলায় বলল, অহনা আর আমি বন্ধু ছিলাম, ওর সব সমস্যার কথা ও আমায় বলতে পারতো টুটাই, কিন্তু বলেনি। আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছে। আরেকটা কথা বলতো, তুই কেন গেলি ওদের দেশের বাড়িতে। টুটাই রাইগঞ্জ স্টেশন থেকে আজকের ফেরা পর্যন্ত সবটুকু বললো মাকে, শুধু একটা কথা লুকিয়ে গেল। অহনার প্রতি ওর মনে সৃষ্টি হওয়া নতুন অচেনা অনুভূতির কথাটা গোপনে রেখে দিল নৈঋত সযত্নে, একান্তে।
কাবেরী বললো, টুটাই, তোর বাবা, পিসি একটা মেয়ের সঙ্গে তোর সম্বন্ধ ঠিক করছে, এ মাসেই তোর বিয়ে দিতে চায়। আসলে পরিবারের তো একটা সম্মান আছে? তাই…
তাছাড়া অহনাকে এ বাড়িতে আর কেউ কোনোদিন মেনে নেবে না। হয়তো আমিও না।
টুটাই মায়ের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে বলল, তোমরা আমায় ঠিক কি ভাব বলতো? মেরুদণ্ডহীন, অপদার্থ? এমন একটা ঘটনার পরেরদিন আরেকটা মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করবে আর আমি চুপচাপ গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাবো? আর ইউ ক্রেজি? মা প্লিজ, এদের এসব করতে বারণ করো। নাহলে কিন্তু এবারে সত্যিই আমি বিয়ের আসর থেকে উঠে যাবো। আই নিড সাম টাইম। যদি তোমরা না দিতে চাও বলো, আমি কালই একটা ফ্ল্যাট রেন্টে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। প্লিজ স্টপ দিস টাইপ অফ ননসেন্স থিঙ্কিং। মা, আমি আপাতত কাউকে বিয়ে করছি না। এটা তুমি জানিয়ে দিও বাবাকে।
টুটাই কথা শেষ করার আগেই ওর ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। কাবেরী তাকিয়ে দেখল, স্ক্রিনে উঠলো….তিতির কলিং…
অহনার ডাক নাম তিতির সেটা কাবেরী জানে। ফোনের দিকে তাকাতেই টুটাই ফোনটা আড়াল করে বললো, মা আমি একটু রেস্ট নেব। তোমার সঙ্গে পরে কথা বলি আবার। তবে তোমাদের ওই ব্যানার্জীদাকে ইমিডিয়েট জানিয়ে দাও, আমি এখন বিয়ে করবো না। কাবেরী দৃঢ় স্বরে বললো, সে না হয় জানিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু তুই জেনে রাখিস, তিতির বা অহনা আর বসুবাড়ির বউ হয়ে আসবে না, আমি মানবো না এমন খামখেয়ালিপনা।
একবার যার জন্য এ বাড়ির সকলের মাথাটা নিচু হয়ে গেছে, আমি নিজে সকলের সামনে অপমানিত হয়েছি, তাকে আমি অন্তত মেনে নেব না টুটাই। কথাটা বলার সময় গলাটা একটু ধরে এলো কাবেরীর। বড্ড আশা করেছিল মেয়েটাকে নিয়ে। আশাভঙ্গের কষ্টটা এখন জেদে পরিণত হয়েছে।
টুটাই স্থির তাকিয়ে বলল, মা, আমি তো বললাম আমি এখন বিয়েই করবো না, প্লিজ।
কাবেরী বেরিয়ে এলো, এসেই দেখলো ঘরের সামনে অনু আর নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত সবটা শুনেছে ওরা। নীলাদ্রি বললো, তাহলে আর কি, ব্যানার্জীদাকে বারণ করে দিই। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বাড়িতে আমি ঠিক আছি কেন? কখনো স্ত্রীর কখনো ছেলের ইচ্ছে মত নিজেকে চালনা করার জন্যই কি আছি এবাড়িতে? নীলাদ্রি আর কোনো দিকে না তাকিয়ে ঢুকে গেলো নিজের ঘরে। অনু হালছাড়া গলায় বলল, কত আশা করেছিলাম, ধুর, শুভকে বলি ফেরার ব্যবস্থা করতে। আর ভালো লাগছে না।
কাবেরী একা দাঁড়িয়ে থাকলো লম্বা বারান্দার শেষ প্রান্তে। মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন, অহনা কেন ফোন করছে টুটাইকে? আর টুটাই বা সেটা লুকাচ্ছে কেন ওর কাছ থেকে! মনের মধ্যে এলোমেলো বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়েই ধীর ধীরে এগিয়ে গেলো নিজের ঘরের দিকে। যাওয়ার আগেই শুনতে পেল, টুটাই ফোনে কাউকে বলছে, হ্যাঁ বলো….
নৈঋত বাইরেটা একবার ভালো করে দেখে নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। এই মুহূর্তে বাড়ির কেউ যে অহনাকে মেনে নেবার জন্য প্রস্তুত থাকবে না সেটা ও আগেই বুঝতে পেরেছিল। তাই আপাতত অহনা সম্পর্কে এ বাড়িতে একটা শব্দও উচ্চারণ করা যাবে না। উষ্ণ বাতাসকে লীনতাপ গ্রহণ করার সুযোগ দিতে হবে। আগে বাড়ির আবহাওয়া শীতল হোক তারপর না হয় ভাবা যাবে অন্য কিছু। ফোনটা কেটে গেছে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, তাই মা বাইরে বেরিয়ে যেতেই ডায়াল করলো নৈঋত। ওপ্রান্তে স্থির অকম্পিত গলায় অহনা বললো, পৌঁছে গেছো? বাড়ির কেউ তোমায় দোষারোপ করেননি তো? নাকি আমি ফোন করে বলবো, যে তুমি নির্দোষ। নৈঋত হেসে বললো, দয়া করুন মহোদয়া! এই অর্বাচীনের ওপরে এত করুণা বৃষ্টি হলে ডুবে যাবার সমূহ সম্ভবনা। আপাতত বাড়ির সবাই অহনা নামের সমার্থক হিসাবে হিরোসিমায় পড়া পরমাণু বোমাটার তুলনা করছে, তাই আপাতত নো ফোন কল। তাছাড়া তোমার পিতৃদেব ফোনে সব বলে দিয়েছে।
এখন বলতো, তুমি কি ওই ঘরেই সমাধিস্থ হয়ে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করবে নাকি? আঙ্কেল বললেন, তুমি নাকি আমি চলে আসার পর থেকেই আমার বিরহে শয্যা নিয়েছ? এগুলো কি ঠিক অহনা? আমার জন্য যদি এমন পাগলামি করো তুমি, তাহলে তো স্যারের সামনে আমার লজ্জা করবে? ধুর, তুমি এমন মিস করবে জানলে, আজ রাতটা তোমার ঘরেই থেকে যেতাম। বাংলা সিনেমার মত মাঝে পাশবালিশের দেওয়াল রেখে।
অহনা হো হো করে হেসে বললো, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসরগুলোর জন্যই বোধহয় ছেলেগুলো এমন বিছুটি টাইপ হয়, এবারে বুঝতে পারছি।
অহনার প্রাণ খোলা হাসি শুনে নৈঋত বললো, যাক আমার প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। এবারে বিজু কাকাকে ডেকে শীতের সন্ধেতে এক কাপ গরম কফি আর হালকা স্ন্যাকস হয়ে যাক। দেখো অহনা, তুমি যদি না খেয়ে থাকো, তাহলে স্যার ভাববেন, তুমি আমার জন্য মনখারাপ করে খাচ্ছ না, তুমি বোধহয় সত্যিই আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ! তখন হয়তো নেক্সট লগ্নে আমার সঙ্গেই জোর করে তোমার বিয়েটা দিয়ে দিল, বুঝতেই পারছো সেটা তোমার জন্য ভালো হবে না। তাই আপাতত তুমি আমার জন্য যতই পাগল হয়ে যাও, স্বাভাবিক গলায় বিজু কাকাকে ডেকে গুডগার্লের মত খেয়ে নাও।
জানি জানি, আমাকে দেখার পর থেকে তোমার ক্ষিদে ঘুম সব উড়ে গেছে, তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি অহনা, তবুও আপাতত যন্ত্রণা ভুলে খেয়ে নাও।
অহনা হেসে বললো, নৌটঙ্কি! বেশ, আমি খেয়ে নিচ্ছি।
নৈঋত গলাটা গম্ভীর করে বললো, জানি তুমি তোমার সামনের কোনো একটা কাজ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত, তাই হয়তো মুড ভালো নেই তোমার। তবে সাহসী হয়ে একটা কথা বলি, এসব অনুভূতি তোমার হচ্ছে না জানি অহনা, কিন্তু আরেকজনের হচ্ছে। তোমার কাছ থেকে চলে আসার পর থেকেই সেই অদ্ভুত অনুভূতির তাড়নায় বারবার দগ্ধ হচ্ছে সে। বিলিভ মি, ভালো লাগছে জানো, কষ্ট পেতে ভাল লাগছে। এমন ভাবে যে কাউকে অনুভব করা যায়, মিস করা যায়, তার জন্য কষ্ট পাওয়া যায়…আমার কোনো ধারণাই ছিল না। তাই এই চিনচিনে যন্ত্রণাটাকে আমি উপভোগ করছি মন দিয়ে। মনখারাপি বাতাসটাকে নির্দেশ দিয়েছি, আমায় বুঝিয়ে দিয়ে যাস, ভালোবাসা আপেক্ষিক নাকি দীর্ঘস্থায়ী।
অহনা, প্লিজ, নিজেকে দোষী ভেবো না, এটা ডেস্টিনি। হয়তো আমার কপালে লাভ ম্যারেজ আছে, অ্যারেঞ্জড ছিলো না। তাই ভেঙে গেছে। আরেকটা কথা, তোমার মাকে একটা কল করো। আমি বাড়ি ফিরে বুঝেছি সকলেই আমাদের বড্ড ভালোবাসে গো। হয়তো জেনারেশন গ্যাপের জন্য কিছু মতপার্থক্য হয়, কিন্তু ভালোবাসার কমতি হয় না তাতে। তাই কফি খেতে খেতে মাকে ফোন করো। আর যদি না খাও, বুঝবো তুমি আমায় বড্ড মিস করছো!
অহনা বললো, বলে বলে যে পোড়ো বাড়িকে ভূতুড়ে বাড়ি বানানো যায়, তোমায় না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না নৈঋত। আমি উঠলাম, তোমায় মিস করার থেকে বিজুকাকার তেল চপচপে বেগুনি অনেক নিরাপদ।
নৈঋত হেসে বললো, প্রয়োজনে কল করবে কিন্তু, কথা দিয়েছিলে।
অহনা বললো, যদি কখনো ডিপ্রেশন নামক অসভ্য রোগটা ধারেকাছে ঘেঁষতে চায়, অবশ্যই তাকে তাড়াতে ডাকবো তোমায়। ভালো থেকো নৈঋত।
ফোনটা কেটে দিয়েছে অহনা। নৈঋত ল্যাপটপ খুলে দেখছিলো রিপোর্টার অহনার পালের রিপোর্টিং ভিডিওগুলো। আর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল অহনার মুখের দিকে। কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে! হঠাৎই তুতানের ডাকে চমকে উঠলো নৈঋত। তুতান শান্ত স্বরে বললো, দাদাভাই লড়ে যা, আমি তোর পাশে আছি। হবু বৌদিভাইকে এবাড়িতে আনতেই হবে। তুতানের মাথায় হালকা করে একটা গাট্টা মেরে বললো, জানিস তুতান, ভাগ্যিস অহনার সঙ্গে আমার বিয়েটা ভেঙে গেল, তাই তো আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম। বিয়েটা যদি নির্দিষ্ট সময়ে হয়ে যেত তাহলে তো সম্পর্কের ঘেরাটোপে আর কর্তব্যের বেড়াজালে পড়ে গিয়ে ভালোবাসার প্রবেশ পথটা বন্ধ হয়ে যেত। এখন বরং অপেক্ষা আছে, আগ্রহ আছে, পাবার আকুতি আছে…আর এগুলো আছে বলেই ভালোবাসা নামক মহামূল্যবান অনুভূতিগুলো এসে ধরা দিচ্ছে আমার কাছে। তাই জেদ নয়, জিতে নেওয়ার লড়াইটা চালিয়ে যাবো আমি। তুতান হেসে বললো, দাদাভাই তোকে বড্ড নতুন লাগছে রে।
টুটাই মুচকি হেসে বললো, মনে হচ্ছে অহনা নামক নতুন ব্রান্ডের পারফিউমের সাইড এফেক্ট বুঝলি! তুতান বললো, দাদাভাই তুই আপসেট নোস দেখে আমি খুব খুশি হলাম রে। তোকে বিন্দাস মুডে দেখতেই অভ্যস্ত আমার চোখ দুটো, তাই ভয়ে ছিলাম, আপাতত নিশ্চিন্ত হলাম। এগিয়ে চল বন্ধু…. ঐতিহাসিক প্রেম তোমার অপেক্ষায় কমরেড। টুটাই বললো, বড্ড পেকেছিস দেখছি। তোর একটাই কাজ, গোটা বাড়ির সকলকে কনভিন্স করানো যে দাদাভাই নিড সাম টাইম। তাই এখন যেন ব্যানার্জীদার শালার মেয়ে, মুখার্জীদার বোনঝি এসব ঝঞ্ঝাট নিয়ে যেও না দাদাভাইয়ের সামনে। তাহলে হয়তো বিয়ে নামক শব্দটাকেই ভয় পেতে শুরু করবে দাদাভাই। বুঝলি, এটা বোঝানো তোর কাজ।
তুতান মুচকি হেসে বললো, ডোন্ট ওরি ব্রো, তোমার লক্ষ্মণ ভ্রাতা এখুনি কাজে বহাল হয়ে গেল। দায়িত্ব আমার। তুমি নিশ্চিন্তে দুর্গ ভেদ করার প্রচেষ্টা জারি রাখো।
।।২৭।।
বাবাই, তোমার কি মনে হয় একটা ফোন করলেই দুর্গ ভেদ করা যাবে? ভোরে উঠে আজও মর্নিং ওয়াকে যাওয়া হয়নি অনিরুদ্ধর। বাগানের ভিতরেই পায়চারি করছিল। তিতিরের গলায় চমকে উঠে বললো, কিসের দুর্গ তিতির? আর তুই এত ভোরে উঠেছিস কেন রে? ঠান্ডায় বেরিয়েছিস, গায়ে কিছু চাপিয়েছিস?
তিতির হেসে বললো, বাবাই মাঝে মাঝে আমার অবাক লাগে, তোমার ঠিক কি মনে হয় আমায়? আমি এখনো বাচ্চা আছি? তুমি জোর করে বৌটুপি পরিয়ে দিলেই পরে থাকবো? অনিরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তুই যে কেন এত দ্রুত বড় হয়ে গেলি! তুই যদি ধীরে ধীরে বড় হতিস তাহলে আমিও এত তাড়াতাড়ি বুড়ো হতাম না। তাহলে আরও বেশ কিছুদিন তোর মা আমার দিকে নজর দিতো, বুড়ো হয়ে গেলাম বলেই না আর ফিরে তাকায় না! অনিরুদ্ধর গলায় মজার ছোঁয়া। মেয়ের সঙ্গে যখন অনি সময় কাটায় তখন মনেই হয় না এই মানুষটাই নামি সাংবাদিক, গোটা বিশ্ব তাঁর ঘোরা, নামি দামি সমস্ত ক্রিকেটারদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অবলীলায়। গাম্ভীর্যের আড়ালের আসল মানুষটাকে তো খুঁজে পাওয়া যায় যখন তিতির সামনে থাকে। মেয়ে সামনে থাকলেই অনিরুদ্ধর গাম্ভীর্যের মেকি মুখোশ যায় খসে, তখন সে একেবারে দিলখোলা। তিতির আবার বললো, কি গো, দুর্গে কি এত সহজে প্রবেশ করা যাবে বলে তোমার মনে হয়? মানে ফোন করলেই ধরবে তোমার স্ত্রী?
অনিরুদ্ধ বললো, কাঠিন্য দেখলেই আমার স্ত্রী, আর আদরের সময় তো ম্যা ম্যা করে যাস তার বেলা? তিতির অন্যায়টা অন্যায়, সেটাকে আমিও সমর্থন করতে পারবো না। তুই যেটা করেছিস তারপর যদি সুচেতা তোকে ত্যাজ্য কন্যা করে আমার অন্তত কিছু বলার নেই। ফোন তুই করতেই পারিস, কথাটা বলেই তাকালো তিতিরের দিকে।
তিতিরের চোখ দুটো বেশ লাল। ভোরের ধোঁয়া ধোঁয়া আলোতেই সেটা দেখতে পাচ্ছে অনিরুদ্ধ। বাগান থেকে উঠে এসে তিতিরের কপালে হাত ছুঁইয়ে বললো, জ্বর এলো কখন রে? তিতির ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললো, এসেছে হয়তো, নাথিং সিরিয়াস। আসলে তোমার শ্রীমতি আমার ফোন রিসিভ করছেন না। আমি কাল রাতেও কল করেছিলাম। এখনও একবার করলাম, তিনি রিসিভ করলেন না, কোনো উপায় জানা থাকলে হেল্প করো।
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, আপাতত আমিই তার আদালতে সব থেকে বড় অপরাধী। আমার কথা কি সে মানবে? তবুও দেখি চেষ্টা করে। শ্যামল তো বেরিয়ে গেছে কোন ভোরে, তোর মা আজ কলকাতা ব্যাক করবে বলেছিল।
এখন বোধহয় রাস্তায় আছে। অনিরুদ্ধ ফোনটা নিয়ে ডায়াল করলো সুচেতার নম্বরটা।
বেরিয়ে পড়েছো? সুচেতা একটু জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো, রাইগঞ্জের বাড়িটা দাদাকে স্ট্যাম্প পেপারে দানপত্র করে দিলাম। চুকিয়ে দিলাম ওবাড়ির সঙ্গে সবটুকু লেনাদেনা। তুমি তো এটাই চেয়েছিলে তাই না অনি এতকাল? অনিরুদ্ধ স্থির গলায় বলল, হ্যাঁ চেয়েছিলাম। কারণ যে বাড়িতে তোমায় অসম্মানিত করা হয়েছিল, আমাকে অপমানিত করা হয়েছিল সে বাড়িতে তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে বারবার ছুটি কাটাতে যাও এটা আমি চাইনি! এটাও কি আমার অপরাধ বলে গ্রাহ্য হবে সুচেতা? যাক এসব কথা। তিতিরের বোধহয় জ্বর এসেছে। ওর তো সব ওষুধ সুট করে না, কোন ওষুধ দাও ওকে জ্বর এলে?
সুচেতা অনিরুদ্ধকে কোনো উত্তর না দিয়েই বললো, শ্যামল, সূর্যপুর চলো। গাড়িটা ঘোরাও।
গজগজ করে বললো, এত আহ্লাদে জ্বর এসে গেল? জ্বরের আর দোষ কি, সে তো জানেই চূড়ান্ত অপরাধের পরেও তাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে, তাই আহ্লাদী শরীরে গিয়ে বাসা বেঁধেছে। তা তোমার রাজকুমারী কি এখনও ঘুমাচ্ছেন?
অনিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় বলল, না ঘুমাতে পারেনি, চোখ লাল হয়ে রয়েছে। সুচেতা বললো, প্যারাসিটামল দিও না। ওর কাজ হয় না। ওষুধ আমার সঙ্গে আছে, আমি গিয়ে দিচ্ছি। আমি সবে নীলপুর পেরোচ্ছিলাম, পৌঁছে যাব খুব তাড়াতাড়ি। অনিরুদ্ধ ফোনটা কেটেই মুচকি হেসে বললো, চল ট্রিট দে। শোন ঔরঙ্গজেব কয়েক বছর চেষ্টা করেও গোলকুন্ডা ফোর্টে ঢুকতে পারেননি আর তুই মাত্র কয়েক সেকেন্ডে আমার দ্বারা ওই দুর্গের দরজা ভেদ করে ফেললি। তো ট্রিট তো বানতা হ্যায় রিপোর্টার! তোর মা আসছে এখানে। বিজু মহারাজকে বলে রাখি বৌদিমণির পায়ের ধুলো পড়ছে, আজ যেন মাছের মাথা দিয়ে ডাল আর শুক্তোটা অন্তত করে। তিতির হেসে বললো, বাবাই, তোমাদের মধ্যে এখনো এত ভালোবাসা অবশিষ্ট আছে তাও কেন তোমরা আলাদা থাকছো বলবে? ওই কয়েকটা চিঠি আমার দেখে ফেলায় কি এমন বদলে গেল যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলো? অনিরুদ্ধ ধরা গলায় বলল, সিদ্ধান্ত আমি নিইনি তিতির, তুই আর তোর মা নিয়েছিস। আমি তো হাঁপিয়ে উঠেছিলাম তোদের ছাড়া ওই ফ্ল্যাটে থাকতে। তাই কাজ কর্ম ছেড়ে বাধ্য হয়ে এই বাড়িতে এসে লুকিয়ে আছি। এই বাড়িটা করার সময়েও তোর মায়ের ইন্সট্রাকশন মতই সামনে বড় বাগান, লন এসব করা হয়েছিল। ঘরের রংও ঠিক করেছিল তোর মা। ছুটিতে ছাড়া আসাই কম হয়েছে বলে তোর মায়ের স্মৃতি এখানে একটু হলেও কম আছে। তাই হয়তো থাকতে পারছি। কোলকাতায় তো সেই বিয়ের আগে থেকে ওই ফ্ল্যাটের দায়িত্ব তোর মা-ই নিয়েছিল। ওটা নামে মাত্র আমার ফ্ল্যাট, আসলে ওর সবটুকু তোর মায়ের সাজানো। পরে তোর মায়ের ইচ্ছে হয়েছিল, নিজের চাকরির টাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে রাখবে, তাই অন্যটা কিনেছিলো। ওটাতে কোনোদিন থাকবে এমন প্ল্যান কিন্তু ছিল না। হঠাৎ আমি এতটাই অপরাধী হয়ে গেলাম, যে তোর মা আমার সঙ্গে থাকতে পারছিল না। তাই তোরা চলে গেলি ওখানে। তিতির বললো, বাবাই আমি বাধ্য হয়েছিলাম। রোজ রোজ ওই একই ইস্যুতে ঝগড়া আমার আর ভাল লাগছিলো না। আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরে ওই চিঠিগুলোর মধ্যে দিয়ে যে হাজার হাজার প্রশ্নের জন্ম হয়েছিল আমার মনে সেগুলোর কোনটারই সদুত্তর তোমরা আমায় দাওনি। যাইহোক, সে উত্তর আমি খুঁজে নেব। তবে তোমাদের সমস্যাটা যদি এই উপলক্ষ্যে মিটে যায় তাহলে আমি খুব হ্যাপি হবো বাবাই। যাও যাও একটু সেজেগুজে নাও, প্রায় মাস দুয়েক পরে তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে তোমার সুচেতার, একটু সাজগোজ তো করা উচিত। অনিরুদ্ধ হেসে বললো, আগে তোর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার দিন আমি খুব কনফিউজড থাকতাম, কি রঙের শার্ট পরবো এই নিয়ে! কি সব পাগলামিতে ভরা দিন ছিল রে। কলেজস্ট্রিট, প্রেসিডেন্সি ক্যাম্পাস, তোর মার সঙ্গে দেখা করার উন্মাদনা….আমার কেরিয়ারের উঠতির দিক, তাই কাজের প্রেশারও থাকতো, তবুও দিনের শেষে একরাশ পাওয়াতে মনটা ভরে উঠতো। আসলে সেই সময়ের সুচেতাকে আর কোনোদিনই খুঁজে পেলাম না। পেলাম না নিজের একটা ছোট্ট ভুলে। তাই সুচেতাও সারাজীবন মানিয়ে নিয়েছে, ক্ষমা করেনি আমায়, আমি নিজেও ক্ষমা করতে পারিনি নিজেকে। বাঁধন ছিল, কর্তব্য ছিল, ভালোবাসাও ছিল শুধু মিসিং ছিল উচ্ছ্বাস, তাই পানসে চায়ের মত টেস্ট হয়ে গিয়েছিল আমাদের বিবাহিত জীবনটা। তুই ছিলিস আমাদের দুজনের সেতু। তোর জন্যই আমরা কাছে থাকতাম একে অপরের। আজও তোর জন্যই তোর মায়ের সঙ্গে এতদিন পরে দেখা হবে আমার। তিতির, বাবা হিসাবে একটাই কথা বলবো, জীবনে যত বড় সত্যের সম্মুখীনই হোস না কেন, নিজেকে ভালোবাসাটা কমিয়ে দিস না। নিজেকে যদি উজাড় করে ভালোবাসতে পারিস, তবেই অন্যকে আপন করতে পারবি। নিজেকে কখনো ঘৃণা করবি না। জানবি তোর থেকে আপন তোর কেউ নেই। তাই সেই আমিটাকে আঁকড়ে ধরবি, দেখবি ওই এলোমেলো অগোছালো একান্ত আপন আমিটা কখনো তোকে ছেড়ে যাবে না। তাই অহনা নামক আমিটাকে আগলে রাখবি নিজের মধ্যে, একে কখনো অবহেলা করবি না।
বিজু এসে ট্রেটা রাখলো। দু-কাপ ব্ল্যাক কফি। তিতিরও দুধ কফি তেমন ভালোবাসে না, আর অনি তো খায় না। বিজুকে দেখে অনিরুদ্ধ বললো, এই যে বিজু মহারাজ, কদিন তো নাকে কাঁদছিলে, এ বাড়িতে নাকি ভূতের মত পড়ে থাকো। কেউ আসে না। আমি একমাস আছি, তাতেও নাকি তোমার ভরাট লাগছিলো না বাড়িটা। এবারে নাও, তোমার বৌদিমনি আসছেন। দিদিমণি তো আগেই এসে হাজির। লেগে যাও খাতির যত্নে। বিজু, একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি, মাছের মাথা দিয়ে ডাল আর শুক্তো এই দুটো যেন রেখো মেনুতে। আর শোনো ডালে যেন ঝাল দিও না, সুচেতা ডালে ঝাল একেবারেই পছন্দ করে না। আমি খেতাম বলে মেনে নিতো।
তিতির তাকিয়ে দেখছিল তার চেনা বাবাইটাকে। বাইরে মারাত্মক রাশভারী আর ভিতরের ছেলেমানুষ মানুষটাকে তিতির শুধু ভালোবাসে না, সম্মান করে অনেক বেশি।
চাটা খেতে খেতেই বারদুয়েক ঘড়ির দিকে তাকালো অনিরুদ্ধ। একটু যেন অস্থির লাগছে ওকে। তিতির বললো, তুমি তো এমন ছটফট করছো যেন ফার্স্ট ডেটিং করছো। উফ, তোমাদের একটা বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে, সেটাও ভুলে গেলে নাকি প্রেমের জোয়ারে!
যাক গে, শোনো আমি এখুনি বেরোবো। জ্বরের ওষুধ আমি অলরেডি নিয়ে নিয়েছি। তোমার গিন্নির সঙ্গে আপাতত আমার দেখা হচ্ছে না। তাকে দিন দুই স্টে করতে বলো, আমি ফিরে সম্মুখীন হবো তার। এখন দেখা হলেই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের শিকার হবো, তারপর আমার সব প্ল্যান মাঠে মারা যাবে।
অনিরুদ্ধ বললো, তুই চলে যাবি মানে? মজা নাকি রে? তোর মা এসে আমায় জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে নেবে। তিতির হেসে বললো, আমি মাকে বলে দেব তুমি মাকে তারকা রাক্ষসী বলেছো।
অনিরুদ্ধ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, তিতির তোর গায়ে জ্বর, এভাবে তুই যাবি না প্লিজ। আর শোন, তোর ওসব ভুলভাল প্রশ্নের উত্তর দুদিন পরে খুঁজতে গেলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। বিয়েটা তো আপাতত ভেঙেই দিয়েছিস, তাই তোর হাতে অঢেল সময়।
তিতির একটু অন্যমনস্ক ভাবে বললো, নেই বাবাই, সময় বড্ড কম। মাত্র সাতদিন। বিয়ের জন্য যে ছুটিটা নেওয়া ছিল ঐটুকুই। আটদিনের দিন আমায় অফিস জয়েন করতে হবে মাস্ট। নাহলে চ্যানেল ছেড়ে কথা বলবে না।
তাছাড়া আমার নিজেরও প্রচুর কাজ পেন্ডিং, অ্যাসাইনমেন্ট ফুলফিল করতে হবে। তাই এই পাঁচদিন আমি বাড়িতে বসে নষ্ট করতে পারবো না। আমার ব্যাগ গোছানো কমপ্লিট। আমি একটু টিফিন খেয়েই বেরিয়ে যাবো। ইনফ্যাক্ট মা এন্ট্রি নেবার আগেই। তাই আপাতত উঠলাম, তুমি তোমার প্রেমিকা, তথা গিন্নি তথা ঝগড়া সঙ্গিনীর সঙ্গে টাইম স্পেন্ড করো।
অনিরুদ্ধ বিস্মিত হয়ে বলল, ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাবি? মানে কদিনের জন্য যাচ্ছিস? আরে কিছু উত্তর তো আমিও ডিজার্ভ করি নাকি? তিতির স্পষ্ট গলায় বলল, না করো না। আমার ফোনে গত দশদিন ধরে মেসেজ এসেছে, চিরকুট পেয়েছি বিয়ের রাতে, তোমায় লেখা মায়ের চিঠিতে পেয়েছি কিছু অসঙ্গতি, মানসিক দ্বন্দ্বে শেষ হয়েছি আমি প্রতিনিয়ত… এত কিছুর উত্তর যখন আমি পাইনি, তখন তোমরাও কোনো উত্তর ডিজার্ভ করো না। তিতির উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। যাওয়ার সময় বেশ জোরেই বলে গেল, বিজু কাকা, টোস্ট দিয়ে যেও আমার ঘরে। আমি বেরোবো, কুইক।
অনিরুদ্ধ জানে সুচেতা এসেই আক্রমন করবে ওকে, কেন ও তিতিরকে যেতে দিলো? কিন্তু ও জানে তিতির এমন একটা মেয়ে যাকে আটকে রাখা যায় না। ও অপ্রতিরোধ্য। লুকিয়ে রাখতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। যেমন সুচেতার লুকানোর জন্যই ভেঙে গেল বিয়েটা। সত্য খুঁজতে মেয়েটা বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়।
তিতিরের প্রশ্নের উত্তরগুলো হয়তো দিতে পারতো অনিরুদ্ধ, কিন্তু তাতে সুচেতাকে হারাত আজীবনের মত। তাই নিরুপায় হয়েই চুপ করে আছে। তিতিরের ফোনে কারা কি ধরনের মেসেজ পাঠাচ্ছে সেগুলোও দেখালো না তিতির! তবে অনিরুদ্ধর ভাবনা যদি সত্যি হয় তাহলে এই পৃথিবীতে এখনো ওর শত্রু বেঁচে আছে, তাকে যদি তিতির খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে পারে, তাহলে মেয়েটার বাকি জীবনটা অন্তত নিশ্চিন্তে কাটবে। তিতির বেরিয়ে গেলেই একবার অভিরূপ স্যান্যালকে কলটা করে রাখতে হবে। অভিরূপের সোর্স দরকার হতে পারে অনির। তিতির হয়তো অভিমানে মুখ ফিরিয়ে আছে, কিন্তু বাবা হিসাবে ওকে দূর থেকে প্রটেক্ট করা ওর কর্তব্য। অভিরূপকে তিতিরের ফোন নম্বর আর ছবি সেন্ড করে রাখবে। যাতে ওরা ট্র্যাক করতে পারে। অনিরুদ্ধর এবারে বেশ চিন্তা হচ্ছে, তিতির কোনো ফাঁদে পড়তে চলেছে মনে হচ্ছে! কিন্তু সেই ছোট্ট থেকে মেয়েকে দেখেছে অনি, কোনো বিষয়ে যদি ওর মনে প্রশ্ন তৈরি হয় তাহলে ও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঝুঁকি নেবেই। মেয়েকে চেনে বলেই, সুচেতাকে বলেছিল বিয়েটা বছর খানেক পরে দাও। কোনো কারণে তিতির একটু চঞ্চল আছে এখন, তাই টাইম চাইছে। শোনেনি সুচেতা, জেদ করেই ডেট ফাইনাল করেছিল। এখন যদিও অনিই দোষী হয়েছে। অনিই নাকি তিতিরের মনে ওসব ভুলভাল প্রশ্নের বীজ বপন করার মূলে রয়েছে। কোনটা ভুল করেছে অনি? তিতির যখন সুচেতার চিঠি সামনে এনে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবাই এগুলো কি মায়ের লেখা চিঠি? তখন অনি বলেছিল হ্যাঁ। তিতিরের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল মায়ের চিঠিতে এসব কি লেখা আছে বাবাই? এগুলো কি সত্যি? মানে এমন সব ধোঁয়াশা কেন? অনি ঘাড় নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ সত্যি। তবে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর আমি তোকে দিতে পারব না, আমায় ক্ষমা করিস।
সুচেতা ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে অবিশ্বাস শুরু করেছে অনিরুদ্ধকে। ওর ধারণা অনিই নাকি তিতিরের মাথায় এসব প্রশ্নের বীজ বপন করেছে। অনিরুদ্ধ তো জানতেই পারেনি তিতিরের ফোনে কেউ এ বিষয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে! সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তিতির অনির পারসোনাল আলমারির ফাইল পত্র ঘেঁটে বের করেছিল।
মেসেজগুলো কে পাঠাতে পারে! অনির প্রফেশনাল কোনো শত্রু? নাকি তিতিরের কোনো কম্পিটিটর?
তিতির রেডি, পিঠে ব্যাগ নিয়ে জুতো পরতে পরতে বললো, বাবাই আসছি। ডোন্ট ওরি, প্রতিবারের মত এবারেও আমি জিতবো।
বেরিয়ে গেল তিতির, ঠিক কোথায় গেল তাও বলে গেল না।
সুচেতা ঢুকবে এখুনি, ঠিক কি উত্তর দেবে ওকে, সেটা নিয়েই অস্বস্তি হচ্ছে ওর। সুচেতা আবার ভুল বুঝবে অনিকে।
হ্যালো অভিরূপ? সকাল সকাল বিরক্ত করছি বলে সরি। আমায় একটা খোঁজ দিতে পারবে, পীযুষ বিশ্বাস, রাইগঞ্জ, নীলপুর অঞ্চলের বাসিন্দা, রঙের মিস্ত্রি….হ্যাঁ একবার ইভ টিজিংয়ের জন্য অ্যারেস্টও হয়েছিল, এখন ঠিক কোথায় আছে বা কি করছে? একটু আর্জেন্ট অ্যান্ড পার্সোনাল, প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি আমায় খবরটা দিতে পারবে?
অভিরূপ বললো, নিশ্চয়ই স্যার, আমি তোমার ফ্যান ছিলাম বরাবর, তাই এটুকু উপকার তো করতেই হবে। সে তোমাদের হাউজ যতই আমাদের কাজের সমলোচনা করুক। অভিরূপকে এই জন্যই এত ভালো লাগে অনিরুদ্ধর। মানুষটার মধ্যে একটা স্বচ্ছ মানসিকতা আছে।
অভিরূপকে কলটা শেষ করতেই বাইরে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। প্রমাদ গুনলো অনি, সুচেতা যদি এসে দেখে তিতির নেই, কি যে হবে!
।।২৮।।
রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে অনিকের। খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে না ওদের। প্রিয়াকে কলটা করতে হবে, ভেবেই ফোনটা পকেট বের করলো অনিক। প্রিয়ার মা মানুষটিকে অনিকের বড্ড পছন্দ হয়েছে। আন্টি ভীষণ বুদ্ধিমতী মানুষ। মহারানির মত অবুঝ নয়। যাক শেষপর্যন্ত যে মায়ের সঙ্গে বেনারসি কিনতে এসেছিলেন মহারানি তাতেই অনিক ধন্য। যা গোঁয়ার মেয়ে, এখুনি হয়তো বলে বসবে, করুণা করে বিয়ে করছিস, করবো না আমি বিয়ে। অনিক কি করে বোঝাবে প্রিয়াকে, ওকে যেদিন প্রথম দেখেছিলো অনিক সেদিন একটা কথাই মনে হয়েছিল, শ্যামলা রঙের রোগা রোগা অতি সাধারণ মেয়েকেও সুন্দরী বলা চলে। কারণ সৌন্দর্য শব্দটাও উৎপত্তি হয় মানুষের অন্তরে। প্রিয়াকে ছাড়া যে অনিক ভীষণরকমের একা এটাও বোঝে না মেয়েটা। ধুর, বুঝতে হবে না প্রিয়াকে কিছু, আন্টি তো বুঝছে অনিক ওই পাগলীটাকে কতটা ভালোবাসে। তাই তো আন্টি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেদিন ওদের বিয়ের ড্রেস কিনে দিয়েছেন। ফোনটা বের করে কল করতেই যাচ্ছিল প্রিয়াকে। সকাল থেকে কোনো মেসেজ করেনি মেয়েটা, ঘড়ির কাঁটা সকাল এগারোটার দিকে ছুটছে। প্রিয়াকে ফোনটা করার আগেই প্রিয়ার নম্বরটা স্ক্রিনে ফুটে উঠলো। ঠোঁটের কোণে হাসির ঝলক দেখা দিল অনিকের। ফোনটা রিসিভ করেই বললো, শোন না, গুড নিউজ আছে প্রিয়া। প্রিয়া উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, আমারও ভালো খবর আছে তোকে দেবার জন্য। তুই আগে বল। অনিক বললো, আগামী পরশু আমাদের রেজিস্ট্রি হবে। প্রিয়া উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, আমার পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে জবটা হয়ে গেল অনিক। এখুনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেলাম। অনিক প্রায় চিৎকার করে বললো, রিয়েলি? চল আজই ফ্ল্যাট বুক করবো। আমি খবর নিয়েছি, রাইগঞ্জে আশ্রয় কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে। চল দেখে আসি কালকে। প্রিয়া বললো, ডান। অনিক হাসতে হাসতেই বললো, পীযুষ বিশ্বাস হেরে গেল প্রিয়া তোর জেদের কাছে।
প্রিয়া কি বললো শোনার আগেই আরেকটি কণ্ঠস্বর কানে গেল অনিকের, পীযুষ বিশ্বাসকে আপনি চেনেন? কালিয়াগঞ্জ স্টেশন থেকে নেমে একটি চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল অনিক। অফিসে সেকেন্ড হাফের আগে পৌঁছাতে পারবে না আজ। রেজিস্ট্রি অফিসে কিছু লাস্ট ডকুমেন্টস জমা দেবার ছিল। সেগুলো দিয়ে স্টেশনের দিকে এগোচ্ছিল ও। পিছন ঘুরে দেখলো, খুব পরিচিত একটা মুখ, কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না অনিক, কিন্তু খুব চেনা লাগছে মেয়েটাকে। প্রিয়া ফোনের অন্যপ্রান্তে আছে ভুলে গিয়েই বললো, কোন পীযুষ বিশ্বাস?
মেয়েটা বললো, কোনো রঙের মিস্ত্রি বা এই টাইপ কাজ করে এমন কেউ আছে কালিয়াগঞ্জে? চেনেন?
প্রিয়া ওদিক থেকে হ্যালো হ্যালো করে চেঁচিয়েই যাচ্ছে, এদিকে অনিক আপ্রাণ মনে করার চেষ্টা করে চলেছে, এই মেয়েটাকে ও কোথায় দেখেছে। অবশেষে মনে পড়লো, টিভি চ্যানেলে দেখেছে। রিপোর্টার। অনিক বললো, আপনি তো রিপোর্টার তাই না? অহনা হেসে বললো, হ্যাঁ ভাই, আমি অহনা পাল। রিপোর্টার অফ ওয়েলকাম ইন্ডিয়া। অনিক ফোনটা কানে চেপে ধরে বলল, প্রিয়া কোনো একজন রিপোর্টার এসেছেন তোর বাবার খোঁজে, কি বলবো?
প্রিয়া একটু থেমে বললো, ওনাকে স্টেশনে ওয়েট করতে বল, আমি দশ মিনিটে আসছি। বাপ নামক জানোয়ারটা কোথাও নিশ্চয়ই গুল খেলে রেখেছে, নাহলে রিপোর্টার কেন আসবে। দাঁড়া আমি আসছি। বাবার নামে আরও কেলেঙ্কারি রটলে তোর বাড়ি থেকে কিছুতেই আমায় মেনে নেবে না। তার আগেই থামাতে হবে মহিলাকে। একটু ওয়েট করতে বল ওনাকে। অনিক বললো, ওকে, তুই আয় আমি আছি। অহনা বেশ ক্যাজুয়াল গলায় বলল, পীযুষ বিশ্বাসের মেয়ে আসছেন নাকি? তাহলে চা খাওয়া যেতেই পারে। রিপোর্টারদের নো টি টাইম, ব্রেক পেলেই আমরা সেটাকে টি টাইম করে ফেলি।
অনিক আর অহনা বসলো একটা বেঞ্চে। চা হাতে নিয়ে অনিক বললো, যদি কিছু না মনে করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করবো? পীযুষ বিশ্বাসকে খুঁজছেন কেন? অহনা চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, দাদা আপনাদের এখানে কি রেশনে বস্তা বস্তা চিনি দেয় নাকি? উফ, এত শরবত বানিয়েছেন। আপনি আমাকে আরেক কাপ চিনি ছাড়া চা বানিয়ে দিন। হ্যাঁ, কি যেন নাম আপনার? অনিক প্রজাপতি বিস্কিটে কামড় দিয়ে বললো, অনিক। হ্যাঁ অনিক, আসলে পীযুষ বিশ্বাস লোকটা সম্পর্কে আমার কিছু তথ্য দরকার। মানে লোকটার পাস্ট লাইফ সম্পর্কে। অনিক একটু ভেবে বললো, সে আমি আপনার উপকার করতেই পারি কিন্তু বিনিময়ে একটা জিনিস চাইবো। পীযুষ বিশ্বাসকে যাই করুন ওর মেয়ের গায়ে কোনো আঁচ লাগবে না। অহনা মুচকি হেসে বললো, ফিঁয়াসে? অনিক লাজুক মুখে বললো, উডবি। তবে ম্যাম আপনি একেবারেই ভাববেন না, প্রিয়া বা দীপশিখা আন্টির সঙ্গে পীযুষ বিশ্বাসের কোনো মিল আছে। ওরা খুব ভালো, কিন্তু প্রিয়ার বাবা ওদের মারে, গালাগাল দেয়। ওই লোকটাই প্রিয়ার জীবনের অভিশাপ। অহনা বললো, এখন বলতো অনিক, এই অঞ্চলের পুরোনো লোক কে আছে? যার কাছ থেকে আমি পীযুষের সব খবর পাবো? কথাটা শেষ হবার আগেই সাইকেল থেকে নামলো একটা অতি সাধারন চেহারার মেয়ে। যার পোশাকে বা চেহারায় নিম্নমধ্যবিত্তের চিহ্ন। স্কিনটাও শুষ্ক, জেল্লাহীন। তবে রোগা রোগা মুখে দুটো অদ্ভুত মায়াবী চোখ। চোখে একরাশ সাহসী চাউনি। জোরে সাইকেল চালিয়ে এসেছে বলেই হয়তো একটু হাঁপাচ্ছে। অনিক বললো, প্রিয়া ইনি হলেন রিপোর্টার অহনা পাল।
প্রিয়াঙ্কা হাত জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গি করে বললো, আপনি ঠিক কি কারণে এসেছেন বাবার খোঁজে? অহনা চায়ের দাম মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বলল, একটু কনফিডেন্সিয়াল, আমি কি তোমায় বিশ্বাস করতে পারি প্রিয়াঙ্কা?
প্রিয়া গজগজ করে বললো, বলেছিলাম না অনিক, ও হারামি আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। আমি আজ জব পেলাম, পরশু আমাদের রেজিস্ট্রি এসব হতেই দেবে না শান্তিতে। শোন বিয়ের আগেই এই জানোয়ারটাকে খুন করে দেব আমি, নাহলে এ আমাদের সংসার করতে দেবে না রে। আজ রিপোর্টার, কাল পুলিশ….শালা শুয়োরের জাতটাকে বাবা বলে পরিচয় দিতেই ঘেন্না হয় আমার। অনিক প্রিয়ার হাতটা চেপে ধরে বলল, কুল ডাউন। উনি কি বলতে চাইছেন আগে একটু শুনে নে।
অহনা, প্রিয়া আর অনিক একটা অমলতাস গাছের নিচে বাঁধানো বেদিতে বসলো। গ্রীষ্মকালে গাছটা হলদে ফুলে ছেয়ে থাকে। গ্রামের দিকে লোকজন বলে বাঁদর লাঠি। কিন্তু কবিগুরুর দেওয়া নাম যেহেতু অমলতাস তাই অহনা ওই নামেই ডাকে গাছটাকে। প্রিয়া সামলে নিয়ে বললো, সরি ম্যাডাম, স্ল্যাং ইউজ করতে চাই না, কিন্তু ওই লোকটার নাম শুনলেই জিভের ডগা দিয়ে এসব শব্দই বেরিয়ে আসে। দুর্ভাগ্যবশত স্কুলে, কলেজে অভিভাবকের জায়গায় এই লোকটার নাম লিখতে হয়েছে ম্যাডাম। তাই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ এভাবেই হয়ে যায়। বলুন ম্যাডাম, কি জানতে চান?
অহনা বললো, ম্যাডাম নয়, আমার নাম অহনা। তোমরা দুজনেই আমার থেকে ছোট তাই অহনাদি বলে ডাকতে পারো। আমি একটু বিস্তারিত বলি তোমাদের। গত একমাস ধরে আমার ফোনে বেশ কিছু কল আসতে শুরু করে। আমার বিয়ে ফাইনাল হবার পর থেকেই কলগুলো আসতে শুরু করে। যদিও আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, আমার ফোন নম্বরটা কি ভাবে এই লোকটা পেল? পরে অবশ্য বুঝলাম, ডেকোরেটররা মামার কাছ থেকে আমার ফোন নম্বর চেয়েছিল কয়েকটা ইনফরমেশন দেবে বলে, হয়তো সেখান থেকেই জোগাড় করেছিল লোকটা। দিনদুয়েক কল পাওয়ার পরই আমি এর নম্বর ট্র্যাক করি আমার সোর্স কাজে লাগিয়ে। তখনই জানতে পারি এই লোকটি কালিয়াগঞ্জ নামক জায়গার বাসিন্দা, নাম পীযুষ বিশ্বাস। রঙের মিস্ত্রি।
পীযুষ প্রায়ই আমায় ফোনে বলতে থাকে, আমি ওকে লাখ দশেক টাকা না দিলে ও নাকি আমার হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার চ্যানেল সব জায়গায় ওর কাছে থাকা গোপন খবরটা ছড়িয়ে দেবে। যেটা আমার কেরিয়ার বা সম্পর্কের নাকি মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে! তখনও আমি এই রকম লেবার বেল্ট টাইপের লোকটাকে গুরুত্ব দিইনি। জানি এদের সামনে আসার ক্ষমতা কোনোদিনই নেই। কিন্তু হঠাৎই আমি আমার বাবা-মায়ের কিছু পুরনো চিঠি খুঁজে পাই, তাতেও দেখলাম এই লোকটার নাম লেখা রয়েছে। যদিও ওদের কাছ থেকে আমি কোনো রকম উত্তর পাইনি। কিন্তু এটুকু বুঝেছি এই লোকটার সাথে বাবার কোনো পুরনো শত্রুতা আছে।
আমি বিভিন্ন সোর্স কাজে লাগিয়ে লোকটার বর্তমান ঠিকানা অবধি জোগাড় করতে পেরেছি। আমার বিয়ের রাতে এই লোকটাই আমায় একটা চিরকুট পাঠায়। সেই চিরকুটে লেখা ছিল, বিয়ের আসরে বসলেই সত্য ফাঁস করে দেব। আমার টাকা না মিটিয়ে বিয়েতে বসা যাবে না। যদিও আমি এসব ব্ল্যাকমেইলারদের একেবারেই গুরুত্ব দিই না, কিন্তু এই লোকটাকে দিয়েছিলাম। কারণ আমার মনে হয়েছিল, এই লোকটার নিজস্ব সম্মান নেই, স্ট্যান্ডার্ড নেই তাই এ যে-কোনো মুহূর্তে এসে যা খুশি গুজব ছড়াতেই পারে, তখন আমার বাবা-মায়ের মানসম্মান নষ্ট হবে। আর মানুষ সত্য যাচাই না করে গুজবে বেশি বিশ্বাসী। আমি বিয়ের আসর থেকে বিয়ে না করে উঠে এসেছি প্রিয়া। আমার জন্য আমার পরিবার সাফার করছে। তবুও সত্যিটাকে খুঁজে বের করতে হবে আমায়। আজ লোকটার সঙ্গে রাইগঞ্জ স্টেশনে আমার মিট করার কথা, লোকটা নাকি টাকা পেলেই আমায় সত্যিটা বলে দেবে। কিন্তু আমি এসব অন্যায়ের কাছে মাথা নিচু করার মেয়ে নই। এভাবে টাকা দিয়ে ব্ল্যাকমেইলারের মুখ বন্ধ আমি করবো না। আমি সত্যিটা জানতে চাই, তারপর সামনাসামনি মোকাবিলা হবে। প্রিয়া এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিলো অহনার কথা। তারপর শুকনো গলায় বলল, বিয়ের আসর থেকে চলে এসেছো? অহনা হেসে বললো, হ্যাঁ, আজ আমার ফুলশয্যা ছিল। সে যাক গে, এখন বলতো পীযুষ বিশ্বাস সম্পর্কে তুমি আমায় কিভাবে হেল্প করতে পারবে?
প্রিয়া ঘাড় নেড়ে বললো, কিছুই পারবো না। আপনি যেটুকু জানেন এর বাইরে আমি শুধু জানি এই লোকটা আমাকে আর আমার মাকে রেগুলার গালাগাল দেয়। আমার মাকে রোজ রাতে রেপ করে, আমার বুকের দিকে তাকিয়ে মাপে সেটার সাইজ কত। লজ্জা পাবেন না, হ্যাঁ আমি এর ঔরসজাত। বাবা শব্দটা এই লোকটার সঙ্গে কিছুতেই বসে না অহনাদি, তবুও ওই শব্দটাকে নিয়েই এতগুলো বছর চলতে হয়েছে আমায়। আমি এতদিন ভাবছিলাম, আমার রেজিস্ট্রি বিয়ের আগে যেন কোনোরকম সমস্যাতে না জড়িয়ে পড়ি, কিন্তু এখুনি সিদ্ধান্ত নিলাম একে জেলে পাঠিয়ে তবেই বিয়ে করবো। অনিক তুই বল, পাশে আছিস তুই? অনিক আলতো করে হাতটা ধরে বলল, প্রিয়া তোর পাশে না থাকলে নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করাবো কি করে? সব কিছুতেই আমায় পাশে পাবি তুই। তোর আর আমার এক ছাদের নিচে চুলোচুলি করাটাও কেউ আটকাতে পারবে না। অহনার মনটা ভালো হয়ে গেল ওদের দেখে। এমন খাঁটি ভালোবাসা আজও আছে পৃথিবীতে? আচমকা নৈঋতের মুখটা মনের পথে এসে থমকে দাঁড়ালো।
প্রিয়া বললো, অহনাদি চলো, আমাদের বাড়িতে চলো। মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। মা হয়তো তোমায় হেল্প করতে পারবে। কি তাড়াতাড়ি এরা আপন করে নিতে পারে একজন অপরিচিত মানুষকে। অনিকের ট্রেনটা বেরিয়ে গেলেই প্রিয়ার সাইকেলের পিছনে চেপে অহনা রওনা দিলো ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
পীযুষ বিশ্বাসের বাড়ির গেটে পৌঁছাতেই অহনার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল, পীযুষ ফোন করছে। অহনা বুঝলো, রাইগঞ্জে মিট করার টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে বলেই ফোন করছে পীযুষ। ফোনটা ধরে খুব স্বাভাবিক গলায় অহনা বললো, আমি এখন পুলিশ স্টেশনে, পরে কল করি? ফোনটা কেটে দিলো পীযুষ। তার মানে পুলিশে ভয় আছে লোকটার। তাই আর অকারণ প্রশ্ন করলো না।
একটা দোকানের সামনে দিয়ে আসার সময় প্রিয়া বেশ জোরে জোরেই বললো, হ্যাঁরে, কলেজে একদিন যাবি সেই আগের মত? এই পিঙ্কি, কলেজে যাবি? চল ঘুরে আসি।
অহনা কিছু বোঝার আগেই বললো, ওই যে দোকানটা দেখছো, ওই ছেলেটা বাবার চর। এখুনি বাবাকে ফোন করবে। তাই ওকে মিস ইনফরমেশন দিলাম। ও বাবাকে বলবে, আমার কোনো কলেজের বন্ধুর সঙ্গে ঘুরছি।
অহনা ওর পিঠে হাত দিয়ে বললো, তোমার তো প্রচুর বুদ্ধি প্রিয়া। প্রিয়াঙ্কা হেসে বললো, লড়াই করতে করতে শিখে গেছি। দিনরাত টিকে থাকার লড়াই। অবশেষে আজ জয়ের খবর এলো অহনাদি। আমি পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে জবটা পেয়ে গেলাম। ডিস্ট্রিক্ট পোস্ট অফিসে ডিউটি।
পীযুষ বিশ্বাসের বাড়ির অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় লোকটা জীবনে যা রোজগার করেছে তার বেশিরভাগ অংশ মদ আর জুয়ায় উড়িয়েছে। নাহলে ওর মত ডিম্যান্ডিং রঙের মিস্ত্রির বাড়ির এমন পলেস্তরা খসা অবস্থা হত না। অহনা দেখলো, প্রিয়ার মতোই রোগা রোগা একজন মহিলা বেশ ভয়ে ভয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছে। মহিলার চোখ দুটোতে সন্দেহের ঘনঘটা। উনি যেন ধরেই নিয়েছেন ওনার জীবনে আর ভালো কিছু হবার আশা নেই। নিরাশার চাউনি স্থির হয়ে রয়েছে চোখের পাতায়। লক্ষ্যহীন জীবনের দিকে হেঁটে চলেছেন কোনোমতে। তাই পা-দুটোকে নির্দেশ না দিয়ে যেন বলছেন, দোহাই তোদের যেদিকে খুশি নিয়ে চল আমায়, শুধু জানতে চাস না আমি কোথায় যেতে চাই! আমি লক্ষ্যহীন,পথভ্রষ্ট মানবী। পৃথিবীর আদিম বর্বতার শিকার, যাকে প্রতিনিয়ত ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষয় হতে হয়। রক্তপাত দেখানোর জায়গা নেই, তাই মাটি চাপা দেওয়া হয় আমার অনুভূতিদের। মানিয়ে নেওয়ার খেলা খেলতে খেলতে আমি ভুলেই গেছি আমিও একজন মানুষ! অভ্যেস শব্দটাই একমাত্র সত্য আমার জীবনে।
প্রিয়া ফিসফিস করে বললো, মা উনি আমাদের সব কথা জানেন। অহনা দেখছিল মহিলাকে অপলক। কি বলবে বুঝতে পারছিল না। পীযুষের মত লম্পট লোকের বাড়িতে ঢুকে প্রিয়া আর দীপশিখার মত মানুষের দর্শন পাবে এটা বোধহয় বুঝতে পারেনি ও। আনমনে সম্পূর্ণ অপরিচিত দীপশিখাকে বলেই ফেললো অনুচিত কথাটা, বাঁচার ইচ্ছে না থাকলে আত্মহত্যা করা ভালো আন্টি, ওই একটা অধিকার বোধহয় আপনার নাগালেই আছে তাই না?
দীপশিখা একটু অবাক হয়ে বলল, না নেই, সেটাও নেই। যেদিন জানতে পারলাম, আমি একটা প্রাণ বহন করছি শরীরে, সেদিন থেকে ওই বিলাসিতাটুকুও কেড়ে নিলেন ভগবান। যেদিন বুঝতে পারলাম, আমি চলে গেলে আমার মেয়েটা তার বাবারই দ্বারা রেপ হতে পারে সেদিন মনে হলো আত্মহত্যা বড্ড বিলাসিতা। কথাটা ঝোঁকের মাথায় বলেই দীপশিখা বোধহয় সংকুচিত হয়ে গেল একটু। আসলে পীযুষ নামক লোকটার ভয়ে আধমরা হয়ে থাকে দীপশিখা। এখনও পর্যন্ত যে সব লোকজন ওদের বাড়িতে এসেছে তারা বেশিরভাগই পীযুষের লোক। তাই বোধহয় দীপশিখা ভাবতেই পারছে না ওদের কথা শুনবে বলে কেউ আসতে পারে! অহনা দেখলো দীপশিখা ভীতু নয়, বর্তমানে সাহস হারিয়েছে মাত্র। তবে কাউকে আপন করে নেবার মানসিকতা ষোলো আনা এখনও বর্তমান।
অহনা পিঠ থেকে ব্যাগটা খুলে বারান্দায় রেখে দীপশিখাকে প্রণাম করে বললো, যদি বাঁচার মন্ত্র শিখিয়ে দিই, শিখবেন?
আপনাকে দেখে আমি ভাবতেই পারিনি আপনি এতটা কঠিন ধাতুতে গড়া। আপনি বাঁচবেন আন্টি, জীবনটাকে দেখবেন জীবিত হয়ে, আধমরা হয়ে নয়।
মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রিয়া বললো, মা অহনাদি একজন রিপোর্টার। ওয়েলকাম ইন্ডিয়া বলে একটি চ্যানেলের রিপোর্টার। অহনা বললো, আমি ডেস্ক ওয়ার্ক করি না, আমি স্পট ওয়ার্ক করি। সেই সূত্রেই আপনার সঙ্গে আলাপ করতে আসা।
দীপশিখা বললো, আমার সঙ্গে? অবিশ্বাস্য। সে যাক কথা পরে হবে। আগে কিছু খেয়ে নিন।
অহনা হেসে বললো, আপনার মেয়ের থেকে হয়তো আমি বছর চারেকের বড় হবো তাকে এমন আপনি-আজ্ঞে করবেন বুঝি?
দীপশিখা হেসে বললো, বেশ অহনা, কিছু খেয়ে নাও। তারপর শুনবো তোমার সব কথা।
অহনাকে কিছু বলতে না দিয়েই দীপশিখা রান্নাঘরের দিকে গেল। প্রিয়ার সঙ্গে কথা বলছিল অহনা। অনিকের সঙ্গে ওর পরিচয় পর্বের আর প্রেম পর্বের গল্প করতেই মেয়েটা একমাত্র স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, বাবার কথা উঠলেই গুটিয়ে যায়,অস্বস্তি এসে ঘরে ধরে প্রিয়াকে। সেটা এইটুকু সময়েই খেয়াল করেছে অহনা। দীপশিখা দুটো রুটি, পেঁপের তরকারি আর সুজির বরফি এনে সামনে রাখলো অহনার। একটু সংকোচের সঙ্গেই বললো, আমরা এমনই খাই, তোমার হয়তো অসুবিধা হবে।
অহনা হেসে বললো, আন্টি আমিও এমনই খাই, মা বেশি স্পাইসি খাবার খেতেই দেয় না। পীযুষ বিশ্বাস লোকটা সম্পর্কে ঠিক যতটা ঘৃণা জন্মেছিল অহনার মনে, তার থেকেও অনেক বেশি শ্রদ্ধা তৈরি হলো ওর মেয়ে আর বউকে দেখে। এই মানুষ দুটো জানে ঠিক পীযুষ কেমন লোক, তারপরেও এরা হাসছে, লড়াই করছে বাঁচার জন্য। শুধু তাই নয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চায় বলেই, অহনাকে সাহায্য করতে সম্মত হয়েছে প্রিয়া।
দীপশিখা বললো, তুমি যে সময়ের কথা বলছো সেই সময় আমার পীযুষের সঙ্গে বিয়েই হয়নি। আমার বিয়ে হয়েছে তারও কিছু পরে। শ্বশুরবাড়িতে আমায় নিয়েই যায়নি প্রিয়ার বাবা। ওকে ঠিক কেন ওদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছিল তার সঠিক কারণ আমি আজও ঠিকমত জানি না। শুনেছি মদ আর অসভ্যতামির জন্যই বাড়ি ছাড়া হয়েছিল। আমি ওর সংসারে আসার পর যা যা ঘটেছে সেগুলো তো বললাম আমি তোমায় কিন্তু তার আগে তো আমি কিছুই জানি না। অহনা বললো, আচ্ছা ওর কোনো নিজস্ব জিনিসপত্রের ফাইল আছে? প্রিয়া বললো, আছে একটা ব্রিফকেস, ওই তো মায়ের ঘরের ঢালাইয়ে তোলা। মাকে আর আমাকে কোনোদিন ওতে হাত দিতে বারণ করেছে। আমাদেরও জাস্ট কোনো ইন্টারেস্ট নেই। অহনা বললো, আন্টি আমি একবার দেখতে চাই ওগুলো। অহনা ভয়ে ভয়ে তাকালো প্রিয়ার দিকে। তারপর আস্তে করে বললো, যদি বুঝতে পারে, খুব মারবে যে। অহনা দৃঢ় গলায় বলল, মারবে না। আর কখনো পীযুষ বিশ্বাস আপনাদের কাউকে মারবে না। আমি অহনা পাল কথা দিলাম। কিছু হয়তো আছে অহনার চেহারায় বা কথায় নাহলে দুজন অপরিচিত মহিলা কেন নিজেদের বিপদ উপেক্ষা করে সাহায্য করবে অহনাকে?
প্রিয়া একটা টুলের ওপরে উঠে নামিয়ে আনলো ব্রিফকেসটা। ধুলো ঝেড়ে তিনজনেই বসলো ওটাকে ঘিরে। খুলতেই এক গাদা খবরের কাগজের কাটিং বেরোলো। অবাক হয়ে গেল অহনা। স্পোর্টস পাতার খবর, সব খবরের নিচেই লেখা নিজস্ব সংবাদদাতা অনিরুদ্ধ পাল।
তার মানে লোকটা আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেকার কাগজের কাটিং যত্ন করে রেখে দিয়েছে, কিন্তু কেন? বাবাইয়ের সঙ্গে লোকটার ঠিক কি সম্পর্ক? পীযুষ বিশ্বাসের যা লেভেল তাতে এই লোকটা বাবাইয়ের ধারে কাছে আসার কোনো কাল্পনিক চিত্রও আঁকা বেশ কষ্টকর। তাহলে কি? কিছু তো একটা কানেকশন আছেই বাবাইয়ের সঙ্গে, আর সেই জন্যই এই লোকটাকে নিয়ে বাবাই মাকে চিঠিতে সাবধানও করেছিল সম্ভবত। যদিও চিঠিটা মা টেনে নেওয়ায় পুরোটা পড়াও সম্ভব হয়নি। তবে এরকম কিছু লেখা ছিল বোধহয়, পীযুষ বিশ্বাস লোকটা কিন্তু ওই এলাকার লোক, তাই সুচেতা একটু সাবধান। মনে রেখো তুমি এখন একা নও, তোমার সঙ্গে আরেকটা প্রাণ বাড়ছে।
তার মানে তিতিরের কথাই বলা হয়েছে সেটা স্পষ্ট। সেই তখন থেকে বাবা চেনে এই লোকটাকে, তাই মাকে সাবধান করেছিল। সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু ও যখন জিজ্ঞেস করেছিল, কে এই পীযুষ? তখন মা মারাত্মক রেগে গিয়েছিল। বাবা বলেছিল, ওসব জানার দরকার নেই। তিতির জেদ ধরে বলেছিল, তুমি একটা কথা বলতো বাবাই, ওই লোকটা কি সত্যিই আছে? বাবা ঘাড় নেড়ে বলেছিল হ্যাঁ আছে। সেই থেকেই ফোনের মেসেজ, কল এগুলোর সঙ্গে কানেক্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল অহনা। মায়ের রাগের কারণ, বাবার উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া, বাবা-মায়ের মধ্যে দারুণ গন্ডগোল, বিয়ের রাতে চিরকুট পাওয়া সব মিলিয়ে তিতির এটুকু বেশ বুঝেছে এই লোকটার সঙ্গে ওদের ফ্যামিলির একটা কোনো গোপন শত্রুতা আছেই। আর সেই কারণেই লোকটা দায়িত্ব নিয়ে ওকে ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে। আবার মুঠো শক্ত করলো অহনা। কাগজের কাটিং, বাবা মায়ের একটা যৌথ ছবি, তিতিরের একটা এখনকার ছবি এসব এর সংগ্রহে রয়েছে। এছাড়াও সুচেতা বসুর নামে আসা অনিরুদ্ধ পালের দুটো চিঠিও এর দখলে রয়েছে। ওপরে রাইগঞ্জ পোস্ট অফিসের ছাপ রয়েছে। তার মানে পোস্টমাস্টারকে হাত করেছিল লোকটা। ওই ভাবেই ওদের খবর জোগাড় করতো লোকটা, কিন্তু কেন? এই কেনটার উত্তর খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছে অহনা। চিঠি দুটো জিন্সের পকেটে ভরে প্রিয়াকে বলল, তুলে রেখে এসো।
দীপশিখা বললো, একজন বলতে পারবে ওর ব্যাপারে সবকিছু। বিয়ের আগের সবকিছু বলতে একজনই পারবে। অহনা আচমকা দীপশিখার হাতটা চেপে ধরে বললো, প্লিজ হেল্প করুন আন্টি। এই এলোমেলো শব্দগুলো সাজাতে না পারলে আমি যে পাজেলটাকে কিছুতেই সলভ করতে পারছি না। আই নিড হেল্প।
দীপশিখা বললো, বেশ চেষ্টা করে দেখি, উনি আদৌ এ বাড়িতে আসতে রাজি হন কিনা! পীযুষের বড়দা, পেশায় শিক্ষক। খুবই সজ্জন মানুষ। তাই ভাই বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পান একে। সেই জন্যই সম্পর্ক নেই কারোর সঙ্গে। তবুও চেষ্টা করে একবার দেখি।
দীপশিখার বার তিনেক ফোনের পরে রিসিভ করলেন ফোনটা। স্কুলে আছেন এখন। দীপশিখার কথা শুনে বললেন, জানোয়ারটা এখন বাড়িতে নেই তো? তাহলে স্কুল থেকে ফেরার পথে একবার ঘুরে যাবো। তবে খেয়াল রেখো বৌমা, বেইজ্জত যেন না হতে হয় ওই কুলাঙ্গারের কাছে। দীপশিখা আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। নিজেকেই নিজে চিনতে পারছে না যেন। ওর ভিতরেই ছিল এমন সাহস? এমন নিয়ম ভাঙার শক্তি এত দিন পরেও জীবিত ছিল ওর মধ্যে। বাবা বলতেন, দীপা মা, কেন তোর নাম দীপশিখা দিলাম জানিস? তোর মধ্যে যেন আগুনের মত শক্তি থাকে, ধ্বংসের জন্য নয়, অন্যায়কে পুড়িয়ে দেবার মত লেলিহান শিখা যেন ঈশ্বর তোকে দেন। দীপশিখা তো নিজের মধ্যে কোনোদিন সেই লেলিহান শিখার দেখা পায়নি, তেলবিহীন প্রদীপে সলতেটা একটু উস্কে গেলেই মার খেতে হয়েছে পীযুষের। তাই শুকনো সলতে পোড়ার গন্ধ শুকেছে নিজের মধ্যে, তাকে কোনোদিন জ্বালিয়ে দিতে পারেনি। কদিন ধরেই সেই নিভে যাওয়া সলতের উত্তাপ টের পাচ্ছিলো শরীরে, তাই বোধহয় অনিকের সঙ্গে প্রিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করার কথা ভাবতে পেরেছে, পীযুষের চোখে ধুলো দিয়ে ওর তিলতিল করে জমানো টাকায় ওদের বিয়ের পোশাক কিনতে যেতে পেরেছিল। আজ অহনার সঙ্গে পরামর্শ করে পীযুষকে জেলে ঢোকানোর ব্যবস্থা করতে চাইছে। এতদিনের অত্যাচারে শরীর জুড়ে কালসিটেগুলো বোধহয় বিদ্রোহ করে উঠছে, প্রিয়ার জীবনটা দীপশিখার মত হতে দেবে না ভেবেই এতটা সাহসী হতে পেরেছে দীপশিখা। এর আগে নিজেকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করেনি কখনো শিখার। বিজয়ের চলে যাওয়া আর ওর স্বেচ্ছামৃত্যু বোধহয় একই মুহূর্তে ঘটেছিল। তাই তো এতগুলো বছর নির্জীবের মত কাটিয়ে দিতে পেরেছে এই চার দেওয়ালের নরকের মধ্যে।
যাকগে, ভগবান সুযোগ বারবার দেয় না। প্রিয়ার চাকরি, অনিকের সঙ্গে বিয়ে সব যোগ যখন এই সময়ে এসেছে তখন দীপশিখার মনের সুপ্ত ইচ্ছেটা বোধহয় এতদিনে পূরণ করবে ভগবান। কতদিন ওই অমানুষিক অত্যাচারের পর মদ্যপ অবস্থায় আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে লোকটা, গোটা গায়ে ব্যথা নিয়ে শুরু করতে হয়েছে সংসারের হাজারো কাজ। ঘুমন্ত লোকটাকে দেখে বহুবার মনে হয়েছে রান্নাঘর থেকে বঁটিটা গলা বরাবর চালিয়ে দিতে, তারপরেই সিনেমায় দেখা জেলের অন্ধকার কুঠুরি আর প্রিয়ার অসহায় মুখের কথা ভেবে পিছিয়ে গেছে। আজ যদি অহনার মত নামি রিপোর্টারকে ব্ল্যাকমেইল করার অপরাধে লোকটার জেল হয়, তাহলে অন্তত কয়েকটা দিন গায়ে হাওয়া লাগবে। লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করে চালিয়ে নেবে, তবুও একটু শান্তি চায়। যদিও এখন আর লোকের দুয়ারে হাত পাততে হবে না, প্রিয়া সরকারি চাকরি পেয়ে গেছে। তাই অহনার দেওয়া এই সুযোগটা কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না দীপশিখা। শুধু একটু খেয়াল রাখতে হবে, কোনোমতেই যেন কাজ মেটার আগে লোকটা বাড়িতে না ফেরে।
দীপশিখা ইচ্ছে করেই ফোনটা করলো পীযুষকে।
পীযুষ ফোনটা ধরেই বললো, কি রে খানকি মাগী আবার কি টাকা চাই নাকি? কি জন্য ফোন করছিস? আমার মটকা প্রচুর গরম আছে, এখন রাখ ফোন। দীপশিখা নরম গলায় বলল, টাকা আছে। বাড়ি ফিরবে না এখন? আজ রাতে ভাবছিলাম লুচি করবো তাই জিজ্ঞেস করলাম।
পীযুষ আরও দুটো সস্তার গালাগাল দিয়ে বললো, সোহাগ উথলে উঠছে মাগির। কেন রে, আমি বাড়িতে নেই, ঘরে নাগর আসছে না? তাকে লুচি গেলা। আমি বাড়ি ফিরবো এখনো সপ্তাহ খানেক পরে। ততদিন, মা-মেয়ে মিলে জুটিয়ে নিস কাউকে।
এত গালাগাল শুনতে ইচ্ছে করে না দীপশিখার। বাবার শেখানো মালকোষের সুর মনে পড়ে মাঝে মাঝে। কিন্তু এখন মালকোষের সুর ছাপিয়ে পীযুষের গালাগালিতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে ওর শ্রবনেন্দ্রিয়। যাইহোক, এত নোংরা কথার মধ্যে থেকে আসল কথাটুকু জেনে নিয়েছে দীপশিখা, আপাতত পীযুষের ফেরার সম্ভবনা বেশ কম। এক যদি শয়তানি না করে। সচেতন অবশ্যই থাকতে হবে।
অহনা ল্যাপটপ খুলে বসে পীযুষ সম্পর্কে ওর সোর্সদের দেওয়া ইনফর্মেশনগুলো মেলাচ্ছিলো, লোকটা এই মুহূর্তে রাইগঞ্জে রয়েছে। ”আশ্রয়” নামক কোনো একটা কোম্পানির আন্ডারে কাজ করছে। আশ্রয়ের কাজ সম্পর্কে সার্চ করলো অহনা। মেইনলি মফঃস্বলে ফ্ল্যাট কালচার চালু করাই এদের মোটিভ। দুজন ওনার আছে এই কোম্পানির। তাদের নাম এবং টেলিফোন নম্বর জোগাড় করা কমপ্লিট। যতবার ওর টিমের কঙ্কনা আর গৌরবকে ও কাজ দিয়েছে ততবার দেখেছে ওরা হান্ড্রেড পার্সেন্টেজের জায়গায় হান্ড্রেড টোয়েন্টি কাজ করেছে। কুড়ি পার্সেন্ট ওরা বেশি ইনফর্মেশন জোগাড় করে দিয়েছে অহনাকে। যবে থেকে ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ও সফট বিটে নয় পলিটিক্যাল বিটে জব করবে তবে থেকেই একটা জিনিস মাথায় রেখেছে নিঃশব্দে ইনফর্মেশন জোগারের পদ্ধতি। ও পিটিটিআই( সারাদেশের রিপোর্টিং-এর দায়িত্ব) নয় ঠিকই কিন্তু ফিল্ড ওয়ার্ক করাটাও কম রিস্কের নয়। সে তুলনায় ওদের ডেস্ক ওয়ার্ক করা ফ্রেন্ডরা অনেকটাই নিরাপদ। অন্ততঃ বিপদজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না ওদের মত। অবশ্য অহনা ইচ্ছে করেই ফিল্ড ওয়ার্ক চুজ করেছিল, কারণ থ্রিল ওর বরাবরই পছন্দের বিষয়।
একটা মেসেজ ঢুকলো ফোনে। চেক করতে গিয়ে দেখল, কঙ্কনা পাঠিয়েছে, রাইগঞ্জে একটা বড় কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে, সেখানেই রঙের কন্ট্র্যাক্ট পেয়েছে পীযুষ। ওর সঙ্গে কপিল, সুনীল আর বাপ্পা বলে তিনটে ছেলে আছে। এছাড়াও আরও কিছু লোক কাজ করে ওর টিমে।
তবে পীযুষকে একবার ইভটিজিং জাতীয় কেসে থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল। দিন সাতেক পরে এই আশ্রয় কোম্পানির ওনার ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন নিজের স্বার্থে। সেই থেকেই পীযুষ এর সঙ্গে কাজ করে।
তার আগে পর্যন্ত ও কোনো কোম্পানির আন্ডারে কাজ করতো না। দুটো ছেলে নিয়ে লোকের বাড়ি রং করতো। ওর হাতের কাজ প্রশংসা পেলেও, মানুষ হিসাবে অঞ্চলে সুনাম নেই একেবারেই। বাড়ি রাইগঞ্জ আর নীলপুরের মাঝে। বাড়ির সকলেই শিক্ষিত, ভদ্র, তাই এই লোকটা বাড়িছাড়া। দীপশিখার সঙ্গে বিয়েটা হয়েছিল কাকতলীয় ভাবেই। দীপশিখার যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার অল্প বয়সের ছবি অবধি জোগাড় করেছে কঙ্কনা। কোনো একটা কারণে বিজয়চাঁদের সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে যায় তখন পীযুষ বিয়ে করে দীপশিখাকে। দীপশিখা একজন সংগীত শিক্ষকের মেয়ে। বিজয়চাঁদও দীপশিখার বাবার কাছে গান শিখত। অত্যন্ত ভদ্র পরিবার ওদের।
দীপশিখার বাবা, দিদিদের ছবির সঙ্গে যার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ছিল তার ছবিটাতে এসে চোখটা আটকে গেলো অহনার। বিজয়চাঁদ….নামটাও তো মিলে যাচ্ছে। মুখটা নেহাতই বছর পঁচিশের একজন তরতাজা যুবকের। ছবিটাও বেশ অস্পষ্ট, বহু পুরোনো। স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো অহনা, ওর রিপোর্টার চোখে ধুলো দেওয়া এতটাও সহজ নয়। এতো বিজুকাকা!
অহনা মুচকি হেসে মনে মনে বললো, পৃথিবীটা বড্ড ছোট, আর গোলও। তাই বিজুকাকার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দীপা আন্টির বাড়িতে। মা বলে অহনার মাথায় নাকি দুষ্টু বুদ্ধির বাসা। নৈঋতও সেদিন এই বলেই ওকে সার্টিফিকেট দিয়েছে। সেই দুষ্টু বুদ্ধির তাড়নায় অহনা বেশ জোরেই ডাকলো, আন্টি একটু জল দিন না।
দীপা আন্টি দু-মিনিটের মধ্যে জলের গ্লাস হাতে ঢুকলো ওর ঘরে।
অহনার ল্যাপটপে তখন বিজুকাকার অল্প বয়েসের ছবিটা বেশ বড়সড় করে স্ক্রিন জুড়ে খোলা রয়েছে। দীপা আন্টি সেদিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। কেঁপে উঠলো যেন গ্লাসের জলটুকু। ক্ষীণ গলায় বলল, তুমি একে চেনো বুঝি?
অহনা খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, চিনি তো। ইনি হলেন চিরবিরহী পাবলিক। বিয়ে থা করেননি, সংসার করেননি। কাকে নাকি লগ্নভ্রষ্টা করেছেন সেই পাপবোধ নিয়ে বাড়ি, গ্রাম সব ছেড়েছিলেন। তারপর এদিক ওদিক টুকটাক কাজ করতে করতে একদিন বেচারা দোষ না করেও পকেটমার বলে মার খেতে যাচ্ছিলেন।
দীপা বলে উঠলো, কিছুতেই না, বিজয়দা কোনোদিন চুরি করতেই পারে না। অহনা ওর কথাটা না শোনার ভান করে বললো, আমার বাবা দেখেছিলো, বিজুকাকা কিছুই করেনি, লোকের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে বিজু মহারাজের আমাদের দেশের বাড়িতে আগমন ঘটেছে। সেই থেকেই বাগান করা, বাড়ির সব দেখাশোনা করা দায়িত্বের সঙ্গে পালন করে যাচ্ছে। সত্যি বলতে কি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছে। বিয়ে থা করেনি ভদ্রলোক, কোনো এক কালে বোধহয় গান টান গাইতো তারপর গানকে অভিশাপ ভেবে ছেড়ে দিয়েছে। কাকে নাকি লগ্নম্ভ্রষ্টা হতে হয়েছে ওর জন্য, তাই প্রতিদিন একটু একটু করে পাপ স্খলন করতে নিজের মাইনের টাকা কন্যা দায়গ্রস্ত পিতাদের দান করে আসছে এত বছর ধরে।
ভদ্রলোকের একটাই শখ, গান শোনা। আর বাগান করাটা বোধহয় শখ নয়, নিজেকে নানা কাজে ব্যস্ত রেখে অতীত থেকে পালানোর চেষ্টা। অহনা খেয়াল করলো, দীপাআন্টির দু-গাল বেয়ে জল ঝরছে। ইচ্ছে করেই একটু কাঁদতে দিলো ওকে। এত বছরের জমানো বরফ গলছে, জল তো পড়বেই। বিজুকাকা যদিও অহনাকে কোনো কথাই বলতে চায়নি, কিন্তু অহনা ওকে অনবরত খুঁচিয়ের খুঁচিয়ে বের করেছিল কিছুটা। আজ পুরোটা পরিষ্কার হলো। দীপাআন্টি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো, চিরকালের কম বোঝা মানুষ ছিল। কবে থেকে এত বুঝদার হয়ে গেল কে জানে! বিয়ে থা না করে এমনি করে কাটিয়ে দিলো জীবনটা! অমন গানের গলাও নষ্ট করলো? তাহলে আর অভিমান করে লাভ কি হলো! নিজেকে কষ্ট দিতে গিয়ে তো তাকেও দিয়ে ফেললাম যে। পীযুষকে বিয়ে করার কারণই যে ছিল তাকে দেখানো। শেষে বিজয়কে দেখাতে গিয়ে ওকেই এমন যাযাবর করে দিলাম আমি। জানো অহনা, ও খুব অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে। মল্লিক বাড়ির বড় বড় ব্যবসা, জমি সব আছে।
অহনা বললো, তাহলেই বুঝুন আন্টি সেসব ছেড়ে সেই মানুষটা যার জন্য এমন ভবঘুরে জীবন কাটালো তার কি দায়িত্ব নেই, শেষ জীবনটা অন্তত তাকে একটু শান্তি দেওয়া, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া।
অহনার হাত দুটো চেপে ধরে দীপশিখা বললো, আমায় একটিবার নিয়ে যাবে তার কাছে। গোধূলিতে তার গলায় আবার পুরবী শুনবো, ভোরে শুনবো ভৈরবী… নিয়ে যাবে অহনা। তাকে একবার অনুরোধ করে আসবো, যেন গানটা সে না ছাড়ে। বাবা তো গুরুদক্ষিণা চায়নি, মেয়ে হিসাবে এটুকু দাবি তো করতেই পারি।
অহনা হেসে বললো, সব হবে, হয়তো বাকি জীবনটা আপনি আর বিজুকাকা একসঙ্গে কাটালেন! কিন্তু তার আগে পীযুষের ব্যবস্থা করতে হবে। দীপা বললো, লোভ দেখিও না অহনা। এমনিতেই সে শুধু আমার কথা মনে রেখে জীবনে দ্বিতীয় নারী প্রবেশ করায়নি শুনেই লোভে বুকটা পরিপূর্ণ হয়ে গেল, আর লোভ দেখিও না। পা পিছলে যেতে কতক্ষণ! দীপার কথা শেষ হবার আগেই প্রিয়া বাইরে থেকে ডাকলো, মা জেঠু এসেছে। দীপশিখা বললো, এসো বাইরে এসো। উনি বারান্দায় বসেন, তারপর চলে যান। ভিতরে আসেন না। আজ বোধহয় কত বছর পরে এলেন কে জানে! প্রিয়া যখন ছোট ছিল একবার দেখতে এসেছিলেন। ভাইয়ের অমন গুণের জন্যই সম্মান হারানোর ভয়ে এদিকে আসেন না।
দীপশিখা ভদ্রলোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললো, কেমন আছেন দাদা? আপনি তো স্কুল থেকে আসছেন, আমি বরং খাবার আনি, আপনি অহনার সঙ্গে একটু কথা বলুন। ও একজন টিভির রিপোর্টার।
পীযুষের দাদাকে একটুও সময় না দিয়ে অহনা বললো, নমস্কার স্যার। আসলে পীযুষ বিশ্বাস সম্পর্কে আমার কয়েকটা ইনফর্মেশন চাই।
ভদ্রলোক ভ্রু কুঁচকে বললো, আমি প্রায় ছাব্বিশ বছর ওর সঙ্গে সম্পর্ক বহির্ভূত, আমার কাছে কোনো খবর তো নেই ওর।
অহনা ওনার কথার সূত্র ধরেই বললো, স্যার, আমি ঐ ছাব্বিশের আগের খবরটুকু জানতে চাইছি। প্লিজ, হেল্প মি। আপনাকে ছাড়া এতদিন আগের খবর বের করার সোর্স আমার নেই। আই নিড ইউর হেল্প, প্লিজ।
ভদ্রলোক প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি পড়ছিস এখন? প্রিয়া বোধহয় একটু হলেও খুশি হয়েছে অহনার সামনে ওর শিক্ষক জেঠু আসায়। মদ্যপ, জুয়াখোর, ব্ল্যাকমেইলার বাবার পরিচয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। ওর একজন ভদ্র আত্মীয় আছে, ওর ধমনিতে একজন শিক্ষিত মানুষের রক্ত বহন করছে ভেবেই বোধহয় একটু হলেও গ্লানিমুক্ত হয়েছে। তাই প্রিয়ার মুখটা উদ্ভাসিত লাগছে। প্রিয়া ঢিপ করে প্রণাম করে বললো, জেঠু আমি জব পেয়েছি। পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে। এই তো আমাদের ডিস্ট্রিক্ট পোস্টঅফিসেই আমার পোস্টিং হয়েছে। ভদ্রলোক বেশ তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, যাক বিশ্বাস বাড়ির পরের প্রজন্ম মাথা উঁচু করে বাঁচবে সমাজের বুকে। পরিচয়ের লজ্জা নিয়ে নয়।
প্রিয়া, বৌমাকে বল আমি একটু পড়ে খাবো। আগে ওনার সঙ্গে কথাটা শেষ করে নিই। প্রাইভেসি দরকার বুঝেই প্রিয়া বললো, জেঠু তুমি আর অহনাদি আমার ঘরে বসে কথা বলো। অহনা প্রিয়ার ঘরে ঢুকেই আচমকা প্রশ্ন করলো, রাইগঞ্জের শিক্ষক সুশোভন মিত্রকে চেনেন?
ভদ্রলোক অকস্মাৎ প্রশ্নে একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি কি করে তাকে চিনলে? তিনি তো বহু বছর হলো মারা গেছেন।
বলুন তো, সুশোভনবাবুর সঙ্গে পীযুষের ঠিক কি সম্পর্ক?
ভদ্রলোক মাথা নামিয়ে বললেন, সুশোভনবাবু আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। অমন মানুষ হয় না। স্বয়ং ঈশ্বর যেন। যদিও আমি ওনার রিটায়ার্মেন্টের কয়েক বছর আগেই জয়েন করেছিলাম। তবুও কাছ থেকে ওনাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
দাদাইয়ের সম্পর্কে এই কথাগুলো মায়ের আর মামুর মুখে বহুবার শুনেছে অহনা, তবুও অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তির মুখে কথাগুলো শুনে গর্ব অনুভব করছিল সংগোপনে। ফোকাস অন্যদিকে যেতে না দিয়েই অহনা বললো, এবারে বলুন, সুশোভনবাবুর সঙ্গে পীযুষের ঠিক কি সম্পর্ক ছিল? আমি একজন রিপোর্টার, তথ্য গোপন করবেন না। আপনার নাম সামনে আনবো না, এটা আমি আমার পার্সোনাল ইন্টারেস্ট থেকে করছি, প্রফেশনাল নয়।
ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে বললেন, আসলে দোষটা আমার। সুশোভনবাবুর অকস্মাৎ মৃত্যুর দায় বোধহয় কিছুটা হলেও আমার। চমকে উঠলো অহনা! কিছু ঝাপসা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যে এত গভীরে লুকিয়ে থাকা রুটে পৌঁছে যাবে ভাবতে পারেনি ও। পীযুষের দাদা শ্রী পলাশকান্তি বিশ্বাস নিজেই স্বীকারোক্তি দিচ্ছে সেই নাকি দায়ী সুশোভনবাবুর কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের জন্য! তার মানে অহনার অগোচরে বাবা-মা দুজনেই একটা দীর্ঘ চিত্রনাট্যকে লুকিয়ে রেখেছিলো সংগোপনে।
পলাশবাবু মাথা নিচু করে বললেন, হেডস্যার চিরকালের আত্মভোলা মানুষ ছিলেন। বাড়ি-ঘর, সংসার কোনোদিকেই মন ছিল না তেমন। সোহম আর সুচেতা দুজনেই শিক্ষকতা পাওয়ার পর পর বোধহয় উনি রিটায়ার করেছিলেন। বহু বছর আগের কথা তো, সময়টা সঠিক মনে করতে পারছি না। আমারও তো বয়েস হলো, আর তো বছরখানেক চাকরি আছে। আগের কথাগুলো মনে থাকলেও সময়গুলো গুলিয়ে যায় ইদানিং।
অহনা বললো, প্লিজ বলুন।
সুশোভনবাবু রিটায়ার্মেন্টের পরেও স্কুলে যেতেন, থাকতে পারতেন না বাড়িতে। ছাত্র তৈরি করাই ছিল উদ্দেশ্য। পীযুষ তখন পড়াশোনায় ইতি টেনেছে। কম বয়েস থেকেই ইভটিজিং, মদ, গাঁজায় শেষ করছিল নিজেকে।
তারপর সেই মদের টাকা তোলার জন্যই বিশ্বাস বাড়ির ছোট ছেলে হয়ে রঙের মিস্ত্রির কাজ শিখতে গেল। আমরা ভাবলাম, নোংরামি বন্ধ করে যদি মন দিয়ে কিছু করে সেটাই ভালো। আমি তখন সদ্য স্কুলের চাকরিতে ঢুকেছি। পীযুষ একদিন বাড়ি ফিরে বলেছিল, তার হাতের কাজ দেখে নাকি সবাই প্রশংসা করছে। তাই সুশোভন স্যার যখন বলেছিলেন, বাড়িটা রং করাতে হবে পলাশ, ভালো কোনো রঙের মিস্ত্রি জানা আছে নাকি? তখন পীযুষকে কাজটা ধরিয়ে দিয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি, পীযুষ কোনোদিন বদলাবে না। যেখানে ওখানে পাঠানো হবে সেখানেই নোংরামি করে আসবে।
অহনা বিমূঢ় হয়ে শুনছিলো পলাশবাবুর কথা। এমনও ঘটে! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছিল ও।
অহনা একাই প্রিয়ার ঘরে বসে আছে নিশ্চুপ হয়ে। পলাশবাবু চলে গেছেন অনেকক্ষণ আগে। আজকে রাতেই ব্যাক করবে মনে করেছিল সূর্যপুর। কিন্তু দীপাআন্টি রাতে কিছুতেই বেরোতে দেবে না। তাই কাল সকালে যাবে ও। তবে সূর্যপুর নয়, যাবে সোজা রাইগঞ্জে। পীযুষ বিশ্বাসের সঙ্গে হিসেবটা কমপ্লিট করতে হবে। একা যাওয়াটা কি ঠিক হবে? নাকি অভিরূপ আঙ্কেলের হেল্প নেবে? আচমকা নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললো অহনা, না ও একাই যাবে। দেখাই যাক কত নিচে নামতে পারে মানুষ!
প্রিয়া এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে। ধীর গলায় বলল, জেঠু কি এমন বললো দিদি, যে তুমি এমন নিস্পৃহ হয়ে গেলে?
দীপাআন্টি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, আমি জানি না দাদা তোমায় ঠিক কি তথ্য দিয়েছেন, তবে এটুকু বলতে পারি, যাই হোক না কেন, নিজেকে শক্ত রেখো। অভিমানের বশে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিও না যাতে আমার মত ভুল করে ফেল।
অহনা তাকিয়ে দেখছিল দুজন প্রবঞ্চিতা মানুষকে। পীযুষ এদের দিনের পর দিন মিথ্যের পর মিথ্যে বলে ঠকিয়ে গেছে আর এরা সরল বিশ্বাসে সেগুলো বিশ্বাস করেছে। ভেবেছে পীযুষ হয়তো শুধু মদ খেয়ে গালাগাল দেয়, এরা এখনও জানেই না, পীযুষ বিশ্বাস কত বড় ক্রিমিনাল। অহনা হাতের মুঠো শক্ত করলো, পীযুষকে জেলের ঘানি টানাবে অহনা, মিডিয়ার সামনে এনে নেকেড করবে লোকটাকে। যাতে লোকটার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটুকুও নষ্ট হয়ে যায়।
প্রিয়া বললো, দিদি, তুমি আমার বিয়ের দিন এসো না গো। অহনা হেসে বললো, না আসতে পারলেও ফোন করবো ওইদিন। অনিক ইস এ গুড গাই, নাইস চয়েস ফর ইউ। প্রিয়া একটু লজ্জা পেল যেন। অহনা অনামিকা থেকে একটা আংটি খুলে প্রিয়ার আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বললো, এটা বিয়েতে দিদির গিফট। তবে নতুন একটা গিফট পাওনা থাকলো তোমার, সেটা নেক্সটবার যখন আসবো নিয়ে আসবো। দীপাআন্টি বললো, তাকে বলো, আমি খুব ভালো আছি, মরার আগে একবার দেখতে চেয়েছি। অহনা ঘাড় নেড়ে বললো, নিশ্চয়ই বলবো বিজুকাকাকে। আমি বাড়ি ফিরেই ডেকে নেব তোমাদের আমাদের বাড়িতে। ওখানেই দেখা হবে বিজুকাকার সঙ্গে।
।।২৯।।
আমি কি জানতে পারি আমায় এভাবে এখানে ডেকে আনার অর্থটা ঠিক কি? অহনা কোথায়? তুমি যে বললে ওর খুব জ্বর এসেছে! অনিরুদ্ধ গম্ভীর হয়ে বলল, তোমাদের মা-মেয়ের ইগো প্রব্লেমটা এত বছরেও আমার মাথায় ঢুকলো না। তিতির তো তোমায় কাল কল করেছিল, তুমি তো রিসিভ করোনি শুনলাম।
সুচেতা গম্ভীর ভাবে বললো, বেশ করেছি রিসিভ করিনি। আমার সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করার সময় মনে ছিল না তোমার তিতিরের? তোমার লজ্জা করে না অনি, তুমি এখনও ওর হয়ে ওকালতি করছো? অনিরুদ্ধ খেয়াল করেছে যখন সুচেতা খুব রাগী মুডে থাকে তখন অনিরুদ্ধকে অনি বলে ডাকে। আমি জানতে চাই সে গেল কোথায়?
অনিরুদ্ধ ঠান্ডা গলায় বলল, তুমি এখানে আসছো জেনে ভোরবেলায় ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। কলকাতায় নয় মনে হলো। বললো তো, সত্যি খুঁজতে যাচ্ছি, আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো পেয়ে গেলেই ফিরে আসবো। সুচেতা মাথাটা নিচু করে বললো, উত্তরগুলো তুমি এখনও দাওনি ওকে? সেকি, এতবড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করলে কেন? অনিরুদ্ধ বেশ জোরেই বললো, বিজু ব্ল্যাক কফি নিয়ে এসো। বৌদিমনির জন্যও গরমই নিয়ে এসো, মাথা গরম দেখে ঘোলের শরবত করতে বসে যেও না। কফিই এনো। সুচেতা বিরক্ত হয়ে বলল, আমার এখন মজা করার মুড নেই। ক্রমাগত মিথ্যে শুনতে শুনতে বিশ্বাসটা হারিয়ে যাচ্ছে আমার। অনিরুদ্ধ বললো, মিথ্যে নেই এর মধ্যে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম তিতিরের গায়ে জ্বর। তাই ওষুধ জানতে তোমায় কল করেছিলাম। তুমিই জ্বর শুনে উতলা হলে, তাই চলে এলে। আমি তিতিরকে বহুবার বলেছিলাম, মা আসছে শুধু তোর জন্য, একবার অন্তত দেখা করে যা। তিতির বললো, সম্মুখীন হলেই নাকি তুমি ওকে আটকে দেবে, তাই তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল। ইদানিং এতটাই জেদ বেড়েছে মেয়েটার যে আমার কথাও শোনে না।
সুচেতা ব্যঙ্গাত্মক হেসে বললো, প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে কোন জায়গায় নিয়ে গেছো বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই। অনিরুদ্ধ নরম গলায় বলল, সুচেতা, তিতির অবাধ্য হলো ঠিকই, কিন্তু অসৎ ও নয়। লক্ষ্যে স্থির, নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকাটা কি ভুল?
সুচেতা ভাঙা গলায় বলল, সত্যিটা ওর সামনে আসলে সামলাতে পারবে তো?
কফিতে চুমুক দিয়ে অনি বললো, আমার তিতিরের ওপরে পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আশাকরি ও সবটুকু বুঝবে।
সুচেতার মুখটা কদিনের ধকলে বেশ ক্লান্ত লাগছে।
কতদিন পরে আবার সুচেতা ওর সামনে বসে আছে।
কিন্তু এই আছে তবুও নেই অনুভূতিটা বড্ড বেদনাদায়ক।
সুচেতার চোখে উদাসীন অন্যমনস্ক চাউনি, শরীরটাকে এখানে রেখে ও যেন পাড়ি দিয়েছে দূরের ভুবনে। ওর ছোট্ট নৌকাখানিতে জায়গায় অকুলান বলেই হয়তো অনির জায়গা হয়নি। একাই বাইছে খেয়া। নিজের ভার কাউকে এতটুকুও দেবে না বলে পণ করেছে যেন। অনি দাঁড়িয়ে আছে নদীর একপ্রান্তে, সুচেতার ডিঙিটা ছোট হতে হতে মিশে যাচ্ছে দূরে। অনি হাত বাড়িয়ে ডাকতে চাইছে, কিন্তু একবারও পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না সুচেতা।
ধড়ফড় করে উঠলো অনিরুদ্ধ। সুচেতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার চিন্তাটা অস্থির করে তোলে ওকে বরাবরই। সেই বিয়ের আগে থেকে এখনও পর্যন্ত এই ভয়টা কেমন যেন মনের এক কোণে গুটিয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝেই শিরশিরে ভয়টা অনিরুদ্ধর মেরুদন্ড দিয়ে খুব ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়। তখনই একলা হয়ে যাবার উপলব্ধিটা ওকে নিঃস্ব করে দেয়।
সূচী, আমার খুব ভয় করছে। গলাটা কেঁপে উঠলো অনিরুদ্ধর। সুচেতা গভীরভাবে তাকালো অনির দিকে। এমন গলায় এমন কথা অনি বলেছিল ওদের বিয়ের আগে একবারই। তারপর থেকে সুচেতা দেখেছে ভয় শব্দটা ওর মধ্যে একেবারেই নেই বরং অনিকে সবসময় ফ্রন্টে খেলতেই দেখে এসেছে সুচেতা। আজ কি এমন ঘটল যে ওর ভয় করছে। চোখে একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে অনি আবার বললো, আমার ভয় করছে সূচী।
মানুষটাকে এমন ভেঙে পড়তে দেখলে নিজের ভিতরের সব শক্তিটুকু যেন খুইয়ে ফেলে সুচেতা। যতই ঝগড়া হোক, মান অভিমানে দূরে থাকার শর্ত চলুক, সুচেতা জানে ওর ডাক পেলে সব অভিমান ভেঙে অনি এসে দাঁড়াবেই। সেই অধিকারবোধের জোরেই সুচেতা শক্তিশালী। এই মানুষটা ভয় পেলে সুচেতা যাবে কোথায়! অনিরুদ্ধর হাতের ওপরে নিজের হাতটা রেখে বললো, কিসের ভয়? তোমাদের দুজনকে হারিয়ে ফেলার ভয় সূচী। সুচেতা গাঢ় গলায় বলল, আমাকে হারিয়ে ফেললেও তোমার আদরের মেয়ে তোমার কাছেই ফিরে আসবে যখন আসল সত্যিটা জানবে। অনি বললো, যদি না আসে। অলরেডি তিতির আমায় বলেছে আমি নাকি ওর চোখে বেশ কিছুটা নেমে গেছি। কারণ সেই সময়ের ঘটে যাওয়া ঘটনার আমি কোনো প্রতিবাদ করিনি, এমনকি মিডিয়ার সামনেও কেন ওই ক্রিমিনালটাকে আনিনি সেটা নিয়ে ওর মনে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। সুচেতা বিষন্ন গলায় বলল, ও কি সবটা জানে? অনিরুদ্ধ বললো, না জানে না। হয়তো কিছুটা গেস করেছে। ওই লোকটা যে কিভাবে আমাদের সব ভেঙে দিতে চেয়েছিল সেটা এখনও ভাবতেই পারছে না। ও মনে করছে আমি একজন অ্যান্টিসোশ্যালকে জেলে ঢোকাইনি কেন! সে ঠিক কি কি করেছে সেটা ও জানে না সূচী। সুচেতা বললো, সেইজন্যই উত্তর খুঁজতে বেরিয়েছে তাই তো! এসবের থেকে ওকে সত্যিটা বলে দিলেই তো ভালো করতে অনি। তাহলে আর মেয়েটাকে ঘুরে ঘুরে মরতে হত না। অনিরুদ্ধ ঘাড় নেড়ে বললো, হয়তো বিশ্বাস করত না, ভাবতো বানিয়ে বলছি। অথবা আমাদের দুজনকে ভুল বুঝতো, কেন ওর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছি বলে দোষারোপ করতো। তাই ওকে নিজেকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে দাও সূচী। আমি জানি আমি যেভাবে আমার তিতিরকে বড় করেছি তাতে ও খুব দুর্বল মনের নয়। সত্যের সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা ওর আছে। আমার মনে হয়েছে সবটা জানার পরে ও আমাদের কাছে ফিরে আসুক। তাহলেই পরিপূর্ণ হবো আমরা। সুচেতা নির্বিকারভাবে বললো, জানি না কি হবে। তবে তোমার বয়েস হচ্ছে, এভাবে টেনশন কোরো না। প্রেসার, সুগারগুলো কন্ট্রোলে থাকবে না। মেয়ে বড় হয়েছে, এবারে যা ইচ্ছে করুক।
সুচেতার দিকে তাকিয়ে অনিরুদ্ধ বললো, এ তোমার অভিমানের কথা সূচী। তিতির আমাদের সন্তান, যতই বড় হয়ে যাক, বিয়ে হয়ে যাক আমাদেরই থাকবে।
হালকা গলায় অনি বললো, জানো, নৈঋত তিতিরের প্রেমে পড়েছে। পড়েছে শুধু নয়, রীতিমত হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা তো হয়েছে তোমার মত আনরোমান্টিক, তাই পাত্তাই দিচ্ছে না নৈঋতকে। আমি শেষে হাল ধরলাম। নৈঋতকে দায়িত্ব নিয়ে শেখালাম প্রেম কি করে করতে হয়। আর যুদ্ধ করে কি করে সংযুক্তাকে জয় করতে হয়। আমাদের প্রেসিডেন্সি ক্যাম্পাস থেকে কলেজস্ট্রিট সব গল্প শুনে ছেলে পুরো চাঙ্গা হয়ে গেল। এখন তো বডি ফেলে দিয়েছে তিতিরের জন্য।
সুচেতা ভ্রু কুঁচকে বললো, মানুষের বয়েস হলে ভীমরতি হয় শুনেছিলাম কিন্তু ঊনষাটেই কারোর চূড়ান্ত ভীমরতি হয় জানতাম না। হবু জামাইয়ের কাছে উনি নিজেদের প্রেমকাহিনী বর্ণনা করেছেন গর্ব করে। মিনিমাম লজ্জাটুকু তো ছিল বলে জানতাম, গত দু-মাসে কি সেটাও ত্যাগ করেছ?
অনি সুচেতার দিকে অপলক তাকিয়ে বলল, সূচী তুমি আজও বড্ড সুন্দর জানো, সেই কলেজস্ট্রিটে প্রথম দেখা মেয়েটার মত। আচ্ছা সূচী, সেই হারটা আছে তোমার কাছে? ওই পেন্ডেন্টটা গো, যেটা ওই দুঃসাহসিক পকেটমারটা চুরি করেছিল তোমার গলা থেকে। সুচেতার গালে বাগানের ডালিয়ার লালচে ছোপ। নরম গলায় বলল, আছে।
অনিরুদ্ধকে যেন আজ কথায় পেয়েছে। পুরোনো স্মৃতির স্রোতে নিজেও ভেসে যাচ্ছে, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সুচেতাকে। অনি ধীরে ধীরে বললো, সূচী পারলে এ জীবনেই আমায় ক্ষমাটুকু করে দিয়ে যেও। অপরাধের বোঝা বড্ড ভারী গো, ওপারে বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব কষ্টকর। সেদিন যদি লন্ডনের ফ্লাইটটা ডিলে না করতো, যদি ঠিক সময় মত তোমাদের বাড়িতে পৌঁছাতে পারতাম, যদি….
সুচেতা বললো, ডেস্টিনি অনি। সবটাই কপাল। তাইতো তিতিরের বিয়েটাও ভেঙে গেল। ভেবেছিলাম সুষ্ঠুভাবে বিয়ে দেব মেয়েটার, কিন্তু হলো না।
অনিরুদ্ধ একটু থেমে বললো, আমি রাইগঞ্জের বাড়িতে ঢুকবো না জেনেও তুমি জেদ করলে ওখান থেকেই বিয়ে দেবে…অনিকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সুচেতা বললো, তুমি জানো আমি কেন ওখান থেকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম অহনার। যাকগে এসব আলোচনা এখন থাক। আপাতত আমি এখানেই কদিন স্টে করি। অহনা ফিরলে একসঙ্গেই তিনজনে কলকাতা যাবো। অনিরুদ্ধ বললো, কোন ফ্ল্যাটে ফিরবে?
অনির এই ছেলেমানুষিগুলোর জন্যই বারবার ক্ষমা করে দেয় সুচেতা ওকে। সুচেতা এত টেনশনে মধ্যেই হেসে বললো, দুটোই তো আমার ফ্ল্যাট। একটা আমার টাকায় কেনা আর একটা আমার নামে। তাই যেটায় ইচ্ছে ফিরলেই হবে। অনিরুদ্ধ হেসে বললো, তার মানে ভাব হলো আমাদের তাই তো?
সুচেতা চলে যেতে যেতে বললো, বিজুদা, দাদাবাবু কি আজকাল সিগারেটের মধ্যে আফিং খাচ্ছে নাকি? একটু খেয়াল রেখো। অনিরুদ্ধ উঠে গিয়ে সিঁড়ির শেষ ধাপে সুচেতাকে আটকে বললো, ওপরে যাওয়ার আগে একটি বার এসো, একটা জিনিস দেখাবো।
সুচেতা প্রশ্ন না করেই নেমে এলো বাগানে। ওই দেখো বাতাবিলেবুর গাছ। দেখো কয়েকটা ফুল রয়েছে। নতুন বসিয়েছি। তোমায় বলেছিলাম না সূচী, তোমার চুল থেকে বাতাবিলেবুর ফুলের গন্ধ পাই আমি। যে গন্ধটা আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। মাটি ভেজা ফুলের গন্ধটা ক্রমশ সরে যাচ্ছিল জীবন থেকে, তাই এবারে এসে কলমের বাতাবির গাছ কিনে লাগিয়েছি বাগানে। এই গন্ধটা থেকে যাতে বঞ্চিত না হই সেই জন্যই।
সুচেতা মুচকি হেসে বললো, সে ভালোই করেছ, কচি গাছ, সদ্য ফোটা ফুলের গন্ধ তরতাজা করবে তোমায়। অনিরুদ্ধ না বুঝেই বললো, ঠিক তোমার গায়ের গন্ধের মত। সুচেতা একটু গম্ভীর স্বরে বললো, সাবস্টিটিউট যখন পেয়েই গেছো তখন আর এ অর্বাচীন এই বাড়িতে কি করছে! হনহন করে দোতলায় উঠে গেল সুচেতা। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো অনিরুদ্ধ। বিজু পাস থেকে বললো, দাদাবাবু ভুল বল ছুঁড়ে ফেলেছেন। মেয়েদের মন বোঝা আমাদের কম্ম নয়। অনিরুদ্ধ খড়কুটোর মত বিজুকে আঁকড়ে ধরে বলল, ব্যাপারটা কি হলো বলো তো?
বিজু বেশ বিজ্ঞের মত বললো, আমিও আগে বুঝতাম না পরে বুঝেছি মেয়েরা বড্ড হিংসুটে হয়। ওই যে আপনি বৌদিমনিকে ছেড়ে বাতাবির চারাতে মন দিয়েছেন ওতেই হিংসে হলো বুঝলেন?
অনিরুদ্ধ মুচকি হেসে বললো, বিজয়চাঁদের মগজ তাহলে পুরো নিরেট নয়, সেখানেও সূক্ষ্ম অনুভূতির খেলা ধরা পড়ে। যাক, আজও যে ওর কাছে আমি গুরুত্ব হারাইনি এটা জেনেই খুশি হলাম। বিজু বললো, এ এক অদ্ভুত ব্যাপার দাদাবাবু। ওরা দুরছাই করলে দোষ নেই, আমরা একটু এদিক ওদিক করলেই মুশকিল। বাতাবি গাছ থেকে পোষা পাখি সবাইকে হিংসে করবে তখন। অনিরুদ্ধ হেসে বললো, নারী চরিত্র বেজায় জটিল, সমীকরণ, সমাধান কিছুই না খুঁজে ভালোবাসে যাওয়াটাই বোধহয় সহজ পথ।
সুচেতা ওপর থেকেই ডাকলো, একবার ওপরে এসো।
অনিরুদ্ধর যেন মনে হচ্ছে এই দু-মাসের ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলার এটাই সুযোগ, শুধু দু-মাসের কেন সারাজীবন ধরে সুচেতার যা যা অভিযোগ ওর বিরুদ্ধে সেগুলোও মিটিয়ে ফেলতে হবে। কাজের প্রেসার আর ওর প্রফেশনের জন্য সেভাবে সময় দেওয়া হয়নি সুচেতাকে, তারপরেও সূচী ওকে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে। সেগুলোর ঋণও যতটা সম্ভব সুদে আসলে পূরণ করতে চায় অনি। সুযোগ হয়নি সেভাবে। সূর্যপুরের নিরিবিলিতে না হয় দু-দিন সম্পূর্ণভাবে সুচেতার ইচ্ছা অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করলোই অনি, তাতেও কি ঋণ শোধ হবে? হবে না, কারণ এতদিন ধরে অনিরুদ্ধর দেওয়ার খাতা প্রায় শূন্য, নেওয়ার খাতাটা ভর্তি হয়ে গেছে সেই কবেই।
ওপরে উঠতেই দেখলো, সুচেতা অনিরুদ্ধর বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলল, তখনই বলেছিলাম, গিজারের সুইচটা শুধু কমপ্ল্যান খাওয়া মানুষদের জন্য কোরো না, অনেকেই নাগাল পাবে না। শুনলে না কিছুতেই, পাক্কা ছয়ফুট হাইটের মানুষের জন্য টং-এ গিজারের সুইচ হলো। লম্বা ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এসে যা বলেছে, তুমি সবেতে হ্যাঁ করে গেছো। অনিরুদ্ধ সুইচটা অন করে দিয়ে বললো, ভাগ্যিস উঁচুতে করেছিলাম, তাই তো কেউ সামান্য প্রয়োজনে ডাকলো আমায়। আর তাছাড়া এই বাড়িটা করার সময় তুমি কদিন এসেছো সূচী? তুমি জানতে অনেক ভুল থেকেই যাবে, তবুও আসোনি। সুচেতা বললো, তুমি বোধহয় ভুলে গেছো, ওই ছোট কটেজটা ভাগে পেতেই তোমার মাথার পোকা নড়েছিলো, সাত তাড়াতাড়ি ঐ কটেজের জায়গায় দোতলা বাড়ি বানাতে হবে। তাই তুমি তড়িঘড়ি শুরু করে দিয়েছিলে। আমার তখন স্কুলের অ্যানুয়াল এক্সাম চলছিল। আমি কি করে আসতাম! তাও আমি তোমায় ইন্সট্রাকশন দিতাম, কিন্তু তুমি যে শোনোনি সেটা তো দিনের আলোর মতই পরিষ্কার।
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, জল গরম হয়ে গেছে, ফ্রেস হয়ে নাও। আমি তো রইলাম সূচী, চূড়ান্ত ভুলে ভরা, দোষে পরিপূর্ণ একটা মানুষ। সময় নিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে আমার দোষগুলো নাহয় ধরিয়ে দিও। আমি সময় নিয়ে শুনবো বিশ্বাস করো। সুচেতা আলগা হেসে বললো, সময়? সেকি! ওটাই যে বড় মূল্যবান তোমার কাছে। অকাতরে বিলিয়ে দিও না প্লিজ। অনিরুদ্ধ জানে গোটা জীবনে এই একটা জিনিসই সূচী চেয়েছিল ওর কাছে যেটা ও দিতে পারেনি।
অনিরুদ্ধ অসহায় গলায় বলল, খুনের আসামিকেও দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া হয় সূচী, আমাকে কি ক্ষমা করে দেওয়া যায় না?
সুচেতা বললো, ক্ষমা করার আমি কে বলো? আমায় কি খুব প্রয়োজন আছে তোমার জীবনে?
অনি বহুদিন পরে আচমকা জড়িয়ে ধরলো সুচেতাকে। থরথর করে কাঁপছে সুচেতা। অভিমানের পারদগুলো গলছে ধাপে ধাপে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সুচেতা। তিতিরের মা, অনিরুদ্ধর যৌবন, মধ্যবয়েস আর প্রৌঢ়ত্বের একমাত্র সঙ্গী, যাকে অনি চেনে বেশ কঠিন মনের সাহসী মহিলা হিসাবে, সেও ওর বুকে মুখ গুঁজে বাচ্চাদের মত কেঁদে চলেছে। সময় দিলো অনি, পারদ নামুক, বরফ গলে যাক, দীর্ঘ বছরের জমা অভিমান গলতে সময় লাগবে। অনি ওর ফুলে ফুলে ওঠা পিঠে হাত রাখলো। কানে কানে বললো, দেখো বুকে কান দিয়ে, বুড়ো বয়সেও নিজের নামই শুনতে পাবে। দোষ আমি অনেক করেছি, কিন্তু ভালোও যে বেসেছি সাধ্যমত। তাই আরেকটা সুযোগ দিয়ে দেখো, দ্বিতীয় ইনিংসে ভালো খেলবো, নট আউট থাকবো কথা দিলাম। সুচেতা দু-হাত দিয়ে অনিকে জড়িয়ে ধরে বলল, সেই প্রেসিডেন্সির সূচীকে তুমি ফেরত চাও তাই না অনি? বারবার সুচেতার মধ্যে তাকেই খুঁজে ফেরো। কখনো ভেবেছো কত কি ঘটে গেছে সেই ইনোসেন্ট মেয়েটার জীবনে?
অনিরুদ্ধ বললো, ভেবেছি, তারপরেও কিন্তু তুমি আর আমি একই আছি, একসঙ্গে আছি। তাই নিজেকে এতটা বদলে না ফেললেও পারতে।
বিজুদা বললো তুমি নাকি আজ সব আমার পছন্দের মেনু রান্না করতে বলেছো, সত্যি?
অনি ঘাড় নেড়ে বললো, সত্যি।
সুচেতা অন্যমনস্কভাবে বললো, যদি নতুন করে শুরু করতে চাই, তাহলে কি তিতিরকে আর পাবো অনি? নাকি ও দূরে চলে যাবে আমাদের থেকে?
অনিরুদ্ধ একটু জোরেই বললো, আলবাৎ পাবো, তিতির আমাদের মেয়ে, ও সবটা বুঝবে। আরেকটা কথা শোনো, নৈঋতই তোমার জামাই হবে। নৈঋত এখন আমার কাছেই লাভ ম্যারেজ করার ট্রেনিং নিচ্ছে।
সুচেতা হালকা হেসে বললো, ছেলেমানুষিটা আর গেল না। ছাড়ো, আমি বাথরুমে ঢুকবো।
বহুদিন পরে অনিরুদ্ধ আবার সেই বাতাবি লেবুর ফুলের গন্ধটা পেলো। প্রাণ ভরে টেনে নিল নিঃশ্বাসটা।
ফোনটা বাজছে পায়জামার পকেটে। বের করতেই দেখলো নৈঋত। রিসিভ করতেই বেশ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, অহনা কোথায় আঙ্কেল? আমি ফোন করলাম নট রিচেবেল বলছে কেন? ও কি বাড়িতে নেই?
অনিরুদ্ধ ঘর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। ফোনের সংলাপ যেন কোনোভাবেই শুনতে না পায় সুচেতা। সবে একটু স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছে ও, এর মধ্যেই তিতিরের টেনশন ঢুকলে হয়তো খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে, দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে ঘরে।
বাইরে বেরিয়ে এসে বললো, হ্যাঁ নৈঋত, তিতির বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে বলে যায়নি। ফোন করতে বারণ করে গেছে আমায়। কোনো একটা কাজে বেরিয়েছে এটা আমি জানি, তবে ঠিক কোথায় গেছে জানি না।
আঙ্কেল আমি বিকেলে একবার কল করবো, পেলে ভালো নাহলে একবার পুলিশে রিপোর্ট করা দরকার। খামখেয়ালিপনার একটা লিমিট থাকা উচিত, বাকিদেরও যে চিন্তা হয় এটা বুঝতে হবে ওকে।
নৈঋত ফোনটা রেখে দিয়েছে। অনিরুদ্ধ মনে মনে ভাবলো, তিতির বরাবরই এমন জেদি, সেটা আর কেউ না জানুক ও জানে ভালো করেই। তাই নৈঋত বা সুচেতার কাছে যেটা অস্বাভাবিক লাগছে অনির কাছে লাগছে না। বরং ওই মেসেজ আর চিঠিগুলো দেখার পরে যদি তিতির শান্ত হয়ে থাকতো তাহলেই ভয় করতো অনির। এখন ও নিশ্চিন্ত, সত্যিটা তিতির খুঁজে বের করবেই, কারোর কোনো হেল্প ছাড়াই করবে, আর তারপর আবার ফিরে আসবে শান্ত মনে। বিপদে পড়লে তার থেকে বেরোনোর রাস্তা ও নিজেই খুঁজে বের করবে। সবটা বোঝার পরেও বড্ড অস্থির লাগছে ওর। কোনো বিপদ হল না তো মেয়েটার! আর ভেবে বোধহয় তেমন কিছু লাভ নেই।
সুচেতার মনের অবস্থা ভালো নয়, ওকে সামলে রাখতে হবে।
দুপুরের লাঞ্চে বসেও সুচেতা বললো, কে জানে মেয়েটা কি খাচ্ছে! এর আগেও কাজের সূত্রে বহুবার বাইরে গেছে তিতির তখন সুচেতাকে এতটা অস্থির হতে দেখেনি অনি। বিয়ে ভেঙে যাওয়াটাকে অশুভ মনে করছে সূচী, তাই ভাবছে হয়তো তিতিরের কোনো বড় বিপদ হবে। অনিরুদ্ধ তাও বললো, তিতির কিন্তু মার্শাল আর্ট জানা মেয়ে, বুঝতেই পারছো আর পাঁচটা মেয়ের থেকে ও অনেকটা বেশি শক্তিশালী। তাই এত দুশ্চিন্তা না করে মন দিয়ে খেয়ে নাও। বিজু মহারাজ তোমার প্রশংসা শুনবে বলে কতক্ষন অপেক্ষা করছে খেয়াল করো।
সুচেতা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললো, বিজুদা সব রান্না খুব ভালো হয়েছে। এবারে তুমি খেয়ে নাও।
অনি, তুমি সব মনে রেখেছো, আমার পছন্দের সব মেনু….সুচেতার চোখের কোণে জল টলটল করছে দেখেই মজা করে অনিরুদ্ধ বললো, মনে না রেখে উপায় আছে কিছু? আমার জীবনের একমাত্র নারী, যাকে চিরদিন নতুন লাগে, আজও অস্তগামী সূর্যের মত রহস্যময়ী লাগে। শীতের শেষে নতুন পাতার মত চিরহরিৎ লাগে, তার সব কিছু মনে রাখবো সেটাই তো স্বাভাবিক।
সুচেতা হাসছে, চোখে জল নিয়ে হাসছে। ঠিক এভাবেই নিজের ভালো লাগার উপলব্ধি প্রকাশ করতো সূচী।
চাটনি খেতে খেতে বলল, অহনার বিয়েতে এবারে কিন্তু তুমি কন্যাসম্প্রদান করবে। তোমার মেয়ে, তুমি উপস্থিত থাকলেই সব নির্বিঘ্নে হবে। অনি একটু থমকে বললো, সম্প্রদান করবো? কেন আমার মেয়ে কি গবাদি পশু নাকি, যে সম্প্রদান করবো? ওসব নিয়ম পালন আমি করতে পারবো না সূচী। আমার মেয়েকে আমি নৈঋতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে সাহায্য করবো, ওদের জীবনসঙ্গী হয়ে ওঠার জন্য হেল্প করবো, কিন্তু আমার তিতিরের ওসব সম্প্রদান হবে না। তিতির সদর্পে যাবে ওর আরেকটা বাড়িতে। সুচেতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, বড্ড লাকি তোমার তিতির পাখি।