অনুভবে তুমি – ৩০
।।৩০।।
মামাই, দাদাভাই এখন বিয়ে করতে রাজি নয়। তুতান ড্রাইয়িংরুমে এসে বোমাটা ফাটিয়ে দিলো। অনু আর শুভ মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বললো, এখন বিয়ে করবে না বলেছে নাকি কোনোদিনই করবে না বলছে রে তুতান?
দেখেছো বৌদি, ছেলেটা এমন আঘাত পেয়েছে যে বিয়ে শব্দটাকে পরমাণু বোমা ভাবতে শুরু করেছে। শুভ স্থির গলায় বলল, আহা, অনু তুমি একটু চুপ করবে। ব্যাপারটা বুঝতে দাও। নীলাদ্রি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, বোঝার তো কিছু নেই, আমি ব্যানার্জীদাকে কল করে বলে দিয়েছি, মিমিদের বাড়িতে কিছু জানানোর এখুনি দরকার নেই। নৈঋত একটু অফ মুডে আছে, ঠিক হলে আমরা যোগাযোগ করবো। ব্যস, আমার দায়িত্ব শেষ। ছেলের ব্যাপারে কোনোদিনই আমাকে খুব একটা দায়িত্ব কেউ দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়নি। তাই আজ নতুন করে এই জটিলতায় না ঢোকাই ভালো। ছোট থেকে ছেলে যার কাছে মনের কথা বলতো, সেই দায়িত্ব নিলে ভালো হয়। আমি চিরকালের দর্শক হয়েই রইলাম না হয়। নীলাদ্রির গলার স্বরে অভিমান না বিরক্তি নাকি ব্যঙ্গোক্তি সেটা ভালো করে বোধগম্য হলো না কাবেরীর। শুভ বললো, তুতান, কি বলেছে টুটাই পরিষ্কার করে বলতো আমাদের।
তুতান রামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্মণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। টুটাইয়ের শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে নিজের বুদ্ধি পাঞ্চ করে বলতে শুরু করল। আসলে কি বলতো বাবা, দাদাভাই এই মুহূর্তে খুব ডাউন আছে। এখন যদি বিয়ে নিয়ে তোমরা জোর করো তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তার থেকে আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবার সময়টুকু অন্তত দাদাভাইকে দিতে হবে।
দাদাভাই একটাই কথা বললো, বাড়িতে বলে দিস তুতান, এবারে আমি বিয়ে করলে লাভ ম্যারেজ করবো, অ্যারেঞ্জড নয়। নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দেব আমি।
নীলাদ্রি নড়েচড়ে বসে বললো, লাভ ম্যারেজ? হোয়াট? এতদিন ওর লাভার কোথায় লুকিয়ে ছিল? তাহলে অহনার সঙ্গে বিয়েতে রাজিই বা হয়েছিল কেন?
অনু ভ্রু কুঁচকে বললো, দাদা, আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না রে। টুটাই পালিয়ে এসেছিল না অহনা বাধ্য করেছিল। ধুর, সব বড্ড গোলমেলে দেখছি। শুভ একটু থমকে বললো, তুতান তুই জানিস দাদাভাইয়ের প্রেমিকার কথা? কে সে? তুতানের পেটের মধ্যে হাসির বুদ্বুদের ঢেউ উঠছে, তবুও গম্ভীর মুখে ও বললো, নো আইডিয়া। দাদাভাই এই নিয়ে কিছু বলেনি আমায়। শুধু বলেছে, আমার জীবনটা এবার থেকে আমি বুঝে নেব।
যদি বাড়ির সকলে বেশি প্রেসার দেয় বিয়ে নিয়ে তাহলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। হিমালয় না আল্পস কোথায় যাবে সেটা এখনো ডিসাইডেড নয়।
অনু সবেতেই একটু বেশিই রিয়্যাক্ট করে। হিমালয়ের নাম শুনে প্রায় কঁকিয়ে বললো, না না কেউ বিয়ের জন্য জোর করবে না। বৌদিভাই, তুমি আর জোর কোরো না। বাড়ির ছেলে বাড়িতে থাকুক, সন্ন্যাসী হয়ে যাবে এ তো ভাবতেই পারছি না গো। নীলাদ্রি বিরক্ত হয়ে বলল, জীবনটা যেন প্রহসন হয়ে গেল।
কাবেরী হিসেব কষছিলো মনের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে টুটাই বাড়িতে ফিরেছে অথচ কাবেরীকে একবারের জন্যও দোষারোপ করেনি, একবারও বলেনি, মা তুমি আমার জন্য কেন এমন একটা মেয়ে পছন্দ করলে যার বিয়ে করার ইচ্ছেটাই নেই। অথবা যার স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে তাকে কেন আমার জন্য পছন্দ করলে? এসব কথা শোনার জন্য রেডি হয়েছিল কাবেরী। কারণ ছোট থেকে স্কুলের টিফিন বক্স খুলে যদি খাবার পছন্দ না হত তাহলেও টুটাই এসে কাঁদতে কাঁদতে বলতো, মা পচা টিফিন কেন দিয়েছিলে আমায়। কাবেরীর পছন্দ করা টিশার্টের কালার যদি টুটাইয়ের পছন্দ না হত তাহলেই বিদ্রোহ করতো। এমন চুপচাপ মেনে নেওয়াটা একটু অস্বাভাবিক।
টুটাই শান্ত, ভদ্র, বাধ্য, পরিবারের সম্মান সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন কিন্তু নিজের পছন্দ না হলে ওকে দিয়ে কোনো কাজ করানো যায় না। সেক্ষেত্রে অহনা বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার পর, ওর সোশ্যাল পজিশন নষ্ট হবার পরও মাকে দোষী না করার কারণটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে কাবেরী! এতক্ষণে তো হুলুস্থুল হওয়ার কথা। কেন কাবেরী এমন মেয়ে পছন্দ করেছিল বলে তাণ্ডব করার কথা টুটাইয়ের, সেসব কিছুই হচ্ছে না। উপরন্তু বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঠান্ডা হয়ে বসে আছে টুটাই। কাবেরী মনে মনে ভাবল, অহনাকে ফোন করে পৌঁছানোর সংবাদ দেওয়ার মধ্যে কি অন্য গল্প আছে? গল্পের মধ্যে গল্প বলেই হয়তো পরিষ্কার হচ্ছে না বিষয়টা। নজরে রাখতে হবে ছেলেটাকে। কিছু তো একটা চলছে টুটাইয়ের মধ্যে। সেটা যে ঠিক কি সেটাই বুঝতে পারছে না কাবেরী। টুটাইকে এ বাড়িতে যদি সব থেকে বেশি কেউ চিনে থাকে তাহলে সেটা কাবেরী। তারপরেও এত ধোঁয়াশা লাগছে কেন! নিজের ছেলেটাকেও যেন ঠিক করে চিনে উঠতে পারছে না ও। ব্যর্থতা, চূড়ান্ত ব্যর্থতা। টুটাইয়ের মনের খবর ওকে পেতে হচ্ছে তুতানের কাছ থেকে। কাবেরী হালছাড়া ভাবটা পরিত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, ছেলেটার সঙ্গে একটু কথা বলতে হবে, কিন্তু বাড়ির সকলের অলক্ষ্যে বলাটা জরুরি।
সবার মুখে বিরক্তির ছায়া, অনুষ্ঠান বাড়ির আমেজ হারিয়ে গিয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে দোষারোপ আর ব্যঙ্গক্তি। পরিবেশটাই কেমন যেন বিষিয়ে রয়েছে। আগে চলছিল টুটাইকে ফিরে পাওয়ার আগ্রহ, ওকে নিয়ে একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করছিল সবার মনে। তারপরেই যখন টুটাই সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছে এবং অহনার দোষ প্রতিপন্ন হয়েছে তখন থেকেই শুরু হয়েছে নতুন প্ল্যান। ইমিডিয়েট টুটাইয়ের একটা বিয়ে দিয়ে পরিবারের সম্মান বাঁচানোর লড়াই।
সত্যিই তো এইসব কিছুর মাঝে টুটাইয়ের মনের অবস্থা ঠিক কি সেটাই তো খোঁজ নেওয়া হয়নি মা হিসাবে। এতটা স্বার্থপর কবে হয়ে গেল কাবেরী! আজ দুপুরে লাঞ্চে বসেও ছেলেটা খাবার নাড়াচাড়া করে উঠে গেছে, ঠিক করে খেতেও পারেনি। সোশ্যাল রেসপেক্ট ফিরে পেতে গিয়ে কাবেরী বোধহয় নিজের সন্তানকেই সব থেকে বেশি অবহেলা করছে। অনু রণে ভঙ্গ দেবার ভঙ্গিতে বললো, শুভ রিটার্ন টিকিট কেটে ফেলো, শুধু শুধু তোমার অফিস, তুতানের কলেজ কামাই করে লাভ কি হবে। টুটাই তো পরিষ্কার জানিয়েই দিয়েছে, এখন বিয়ে করবে না। নীলাদ্রি সোফা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললো, যাই বইপত্র ঘাঁটি একটু। নিজেকে অন্যমনস্ক রাখতে হবে বুঝলে শুভ, তাই বই পড়তে হবে।
শুভ ফিসফিস করে বললো, বৌদিভাই, তুমি কিন্তু টুটাইয়ের সঙ্গে সফট ভাবে একটু কথা বলো, দেখো যেন ছেলেটা ডিপ্রেশনে না চলে যায়। কাবেরী একাই সোফাতে বসেছিলো, বাকিরা যে যার ঘরে চলে গেছে।
সকলে চলে যাবার পরেই টুকটুক করে টুটাইয়ের ঘরের দিকে এগোলো কাবেরী।
ঘরের দরজায় সামনে দাঁড়িয়েই শুনলো ফোনে কথা বলছে টুটাই। যদিও কারোর পার্সোনাল কথা শোনাটা অত্যন্ত অন্যায় তবুও অহনা নামটা টুটাইয়ের মুখে শুনে পা দুটো থমকে দাঁড়িয়ে গেল কাবেরীর। অভব্যতা হচ্ছে জেনেও সরে এলো না দরজার সামনে থেকে।
টুটাই বলছে, তোমায় আমি কাল দুপুর থেকে কল করছি, নট রিচেবেল কেন বলছিলো? কোথায় তুমি?
এই অহনা চুপ করে কেন আছো? প্লিজ বলো, কি হয়েছে? বাড়ি থেকে তো গতকাল বেরিয়েছিলে, এখনও ফেরনি কেন? কোথায় আছো বলবে কিছু? বুঝলাম তুমি কাজে আছো, কিন্তু কোথায় আছো? কলকাতায় এসেছো কি?
তাহলে কোথায়? ওই কালিয়াগঞ্জ নাকি একটা জায়গার নাম করেছিলে সেদিন ট্রেনে, ওখানে গেছো? প্লিজ অহনা, ফর গড সেক কিছু বলো! তোমার নিস্তব্ধতা আমায় কষ্ট দিচ্ছে অহনা। শুধু নিঃশ্বাসের আওয়াজ পাচ্ছি আমি, আর তাতেই বুঝতে পারছি মন ভালো নেই তোমার। একবার বলেই দেখো পারি কিনা! অ্যাড্রেস দাও কাল সকালেই বান্দা হাজির হয়ে যাবে তোমার কাছে। কাবেরী বেশ বুঝতে পারলো, টুটাই কেন অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। মুচকি হেসে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল ও।
নৈঋত বললো, তোমার মন ভালো করার টোটকা আছে আমার কাছে।
অহনা গাঢ় নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, নৈঋত সত্য অপ্রিয় নিশ্চয়ই শুনেছ, কিন্তু সত্য যে ভয়ঙ্কর সেটা কি কখনো শুনেছ? ধর সেই ভয়ঙ্কর সত্যের সামনে তুমি একা দাঁড়িয়ে আছো, কূলের হদিশ নেই তখন কি করবে নৈঋত? দিশেহারা হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবে বুঝি?
নৈঋত বললো, ঝাঁপ তো অবশ্যই দেব তার আগে সাঁতারটা শিখে নিতে হবে। সে তোমার জন্য আমি সাঁতার কাটতেও রাজি।
অহনা নিঃস্পৃহ গলায় বলল-
একদিন আমি পাখি হতে চেয়েছিলাম।
আকাশকে ছুঁয়ে ফেলবার তীব্র কামনায়।
যতবার আকাশকে ছুঁতে গেছি ..
ততবার সে সরে গেছে কয়েক যোজন দূরে।
আমার আকাশকে স্পর্শ করা আর হয়ে ওঠেনি।
আমি বৃষ্টি হতে চেয়েছিলাম।
সিক্ত হতে চেয়েছিলাম আপন খেয়ালে।
যতবার ভিজিয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে,
ততবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি মেঘের থেকে।
মেঘের সাথে সিক্ততা আর হয়ে ওঠেনি।
আমি ফড়িং হতে চেয়েছিলাম,
চেয়েছিলাম নগণ্য জীব হয়ে
সকলের দৃষ্টির আড়ালে স্বাধীনভাবে বাঁচবো।
ছোট্ট বাচ্চারা তাদের খামখেয়ালি খেলার বশে
আমার পায়ে সুতো বেঁধে কেড়ে নিলো আমার স্বাধীন থাকার ইচ্ছেদের।
অমলকান্তিও রোদ্দুর হতে পারেনি।
আমিও পারিনি ডানা মেলে উড়তে।
অদৃশ্য সুতোর টানে ঘুড়ির মতোই
বারবার ফিরতে হয়েছে ধরা বাঁধা জীবনে।
নৈঋত প্রায় চিৎকার করে বললো, কার লেখা অহনা?
অহনা একটু থেমে বললো, আমার। অগোছালো এলোমেলো আমির গল্প এটা।
অহনা, তুমি একটা সুযোগ দাও আমায়, আমি তোমায় আপাদমস্তক সিক্ত করি আমার ভালোবাসা দিয়ে। যখন ছটফট করতে করতে তুমি বলবে আমি ভিজে গেছি প্রেমে, তখন নিস্তার পাবে। তখন বুঝবে অসহ্য রকমের ভালো লাগা কার নাম! আর স্বাধীনতা? ওটা তোমাকে কারোর কাছ থেকে ভিক্ষে করতে হবে না, ওটা তুমি নিজেই ছিনিয়ে নেবে এই সমাজের কাছ থেকে।
অহনা, একটা কথা সত্যি করে বলো তো, আমি যখন চলে আসছিলাম তোমাদের বাড়ি থেকে তখন তোমার চোখের কোণে বিষণ্ণতার ধূসর রং লেগেছিল। আমি কি স্পর্ধা করে ওই বিষণ্ণতার এক টুকরো আমার জন্য তৈরি হয়েছে এমন ভাবতে পারি? নাকি ওই বিষণ্ণতার ওপরে আমার কোনো অধিকার নেই, ও শুধুই তোমার একান্ত ব্যক্তিগত!
অহনা যেন সুদূর আরব সাগরের তীর থেকে ক্ষীণ স্বরে বললো, নৈঋত আমি সত্যের খুব কাছে এসে গেছি, জানি না এই সত্য তোমার সামনে এলে তুমি কি বলবে! ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করবে নাকি আমার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য কাতর হবে।
নৈঋত অল্প হেসে বললো, অহনা, আকাশের তারা গোনা আমার কাজ নয়। চন্দ্র, সূর্যের হিসেব নেওয়াও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি শুধু ওই বিশাল আকাশকে চিনি। যে কখনো উজ্জ্বল নীল, কখনো মেঘের ভারে বিষণ্ণ থাকবে, কখনো আবার বৃষ্টিতে ভিজবে প্রাণ ভরে।
যাই পরিবর্তন হয়ে যাক না কেন সে আকাশই থাকবে। তার বুকে যদি তারারা না ওঠে, সূর্য যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, চাঁদ যদি অভিমান করে সরে যায় দূরে, তবুও আকাশ কিন্তু একই থাকবে তার বিশালতা নিয়ে।
অহনা ধীরে ধীরে বললো, কিন্তু সূর্য না উঠলে যে অন্ধকার হয়ে যাবে আকাশ।
নৈঋত গাঢ় গলায় বলল, আমি সেই ঘন অন্ধকারেও আকাশকে ঠিক চিনে নেব। কেন জানো, কারণ সে মিশে যাবে না ভিড়ে। তাই অহনা তুমি আমার এক্সাম নিয়ে দেখো, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমার হাতের মুঠোতে থাকবে তোমার হাত। ভয় পেয়ে যেও না, মুঠো আলগা করবো না আমি। প্লিজ অহনা, এভাবে দূরে ঠেলে দিও না আমায়। একটা সুযোগ দিয়ে দেখো, ব্যর্থ হলে চলে আসবো কোনো প্রশ্ন না করে।
অহনা বললো, বেশ তাহলে আগামীকাল চলে এসো রাইগঞ্জের আশ্রয় কমপ্লেক্সে, আমি কাল ওখানেই যাবো। আপাতত দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারছি, দুটো ইনফরমেশন পেলেই আমি নিশ্চিন্ত হয়ে যাবো, আমার ধারণা সত্যি না অমূলক। মাত্র দুটো মেলের জন্য ওয়েট করে আছি। যদি সত্যি হয়, তাহলেও তুমি আমার পাশে থাকো কিনা সেটাও পরখ করা যাবে। নৈঋত হেসে বললো, ম্যাডাম আমি জীবনের সব এক্সামে ভালো নম্বর পেয়েছি, আশা রাখি এ পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হবো সাফল্যের সঙ্গে। আসলে কি বলো তো অহনা, এটা জেদ নয় এটা আগ্রহ, তাই জিতে যাবো।
সাবধানে থেকো প্লিজ। আগামীকাল দেখা হবে।
অহনা কেটে দিলো ফোনটা। নৈঋত মনে মনে বললো, নিজের মনের পরিবর্তন নিজেই বুঝতে পারছে ভালো করে, এমন অদ্ভুত অনুভূতি তো এর আগে কখনো হয়নি!
যতক্ষণ অহনার সঙ্গে কথা বলছিল ততক্ষণ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ফোনটা কেটে যেতেই মনখারাপি বাতাস এসে একটু একটু করে ছেয়ে দিচ্ছে নৈঋতের অবুঝ মনটাকে। এই অদ্ভুত অনুভূতির নাম ঠিক কি, সেটাই তো জানে না নৈঋত। বিয়ের আসর থেকে চলে আসার সময় মারাত্মক রাগ হয়েছিল মেয়েটার ওপরে। যখন ওর সঙ্গে ট্রেনে চেপেছিলো জোর করে, তখনও ভেবেছিল শেষ দেখে ছাড়বে। এই মেয়েকে দিয়ে ঘাড় ধরে বলাবে, আমার দোষ, নৈঋত নির্দোষ। তারপর কখন, ঠিক কখন যে নৈঋত ভেসে গেল চোরাস্রোতে সেটা ও নিজেও জানে না। যখন বুঝতে পারলো ও ভাসছে তখন দেখলো সমুদ্রের মাঝখানে অবস্থান ওর। সাঁতার না জানা নৈঋত হাবুডুবু খেতে খেতে বুঝেছিলো, অহনাই ওর ডেস্টিনি। অহনাকে না পেলে কিছুতেই ভালো থাকতে পারবে না ও। ঠিক তখন থেকেই অহনার সরিয়ে দেওয়া হাতটা শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে ও। মেয়েটা এখন সত্য মিথ্যে নিয়ে চরকা কাটছে, বুঝতেই পারছে না, নৈঋতের জীবন সংশয় ওকে ছাড়া। এই অনুভূতিগুলো কাকে বোঝাবে ও? ইস, রিপোর্টাররা যে এমন আনরোম্যান্টিক হয় জানা ছিল না নৈঋতের। কি আর করা যাবে, এখন ফেরার উপায় নেই। কারণ নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে নৈঋতের হৃদয়ে পার্মানেন্ট জায়গা করে নিয়েছে অহনা। ওকে সরানো নৈঋতের সাধ্যের বাইরে।
কেউ একটা দরজায় নক করে বললো, একবার আসতে পারি? নৈঋত প্রমাদ গুনলো। মা এভাবে ফরম্যালিটি করছে মানেই কিছু নিয়ে আলোচনা করতে চায়। কাবেরী বসুর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা ও এখনো অর্জন করে উঠতে পারেনি।
তাও খুব স্বাভাবিক গলায় নৈঋত বললো, এসব কি হচ্ছে? চলে এসো।
কাবেরী এসে বসলো নৈঋতের বিছানার এক কোণে। সেই সুযোগে ও বললো, মা কাল আমায় একবার বেরোতে হবে। ফিরতে হয়তো রাত হবে। একটু পার্সোনাল কাজ আছে। কাবেরী কোনো ভণিতা না করেই বললো, অহনার সঙ্গে দেখা করতে যাবে? একটা কথা মনে রেখো, এই ফ্যামিলির কেউ কিন্তু আর অহনাকে মেনে নেবে না। এটা ভেবেই এগোচ্ছ নিশ্চয় তুমি? মা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় টুটাইকে তুমি বলে সম্বোধন করে, এটা ওর খুব একটা অস্বস্তির জায়গা। তবুও আজ শান্ত স্বরেই বললো, মা আজ তোমার অবাধ্য হয়েই বলছি, আমি অহনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। সুপরিকল্পিতভাবে নয়, নেহাতই আকস্মিক। হয়তো তুমি হাসবে আমার ভালোবাসার দিনের সংখ্যা গুনে। তবুও আমি বলবো, মুহূর্তের হিসাবে ভালোবেসেছি ওকে, তাই সময়টা নেহাত কম নয়।
কাবেরী অপলক তাকিয়ে দেখছে টুটাইকে। কবে থেকে টুটাই এত স্পষ্ট ভাবে নিজের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে শিখলো? এটা একেবারেই অজানা ছিল কাবেরীর কাছে। নাকি এই দুদিনে অহনার সংস্পর্শে এসে বদলে গেছে টুটাইয়ের ভাবনাচিন্তা। জীবন সম্পর্কে এত স্পষ্ট ধারণা কি ওকে অহনাই দিয়েছে!
কাবেরী বেশ পরিষ্কারভাবে বললো, আমিও কিন্তু পাশে থাকবো না তোমার। সম্পূর্ণ একা বসু পরিবারের বিরুদ্ধে অহনার জন্য লড়তে পারবে তো টুটাই? ভালো করে ভেবে নিও। টুটাই স্মিত হেসে বললো, পারবো মা। এটা একান্ত আমার উপলব্ধি, অহনাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে পারবো না। আচ্ছা মা, বাবাকে ছাড়া অন্য কারোর সঙ্গে বিয়ে দিলে তুমি মানতে পারতে? বোধহয় পারতে না, তাই ওয়েট করেছিলে পিমনির বিয়ে হওয়া পর্যন্ত। তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে, একজনের স্থানে অন্যজনকে জোর করে বসালে মেনে নিতে নিতে জীবনটাই ফুরিয়ে আসে। ফুরিয়ে যায় বেঁচে থাকার রসদগুলো। শুধু মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার লড়াই করতে করতে কাটিয়ে দিতে হয় গোটা জীবনটা। তুমি কি চাও, তোমার টুটাই সেভাবে কাটাক বাকি জীবনটা? যদি অহনা ওর জীবনে আমায় স্থান না দেয় তবে আমি তোমার টুটাই হয়ে রয়ে যাবো মা। ভালোই তো হবে, আমার বউকে ভাগ দিতে হবে না আমার। কাবেরী হেসে বললো, আমি টিপিক্যাল শাশুড়ি নই রে টুটাই। বিয়ের পরেও তুই আমার সন্তানই থাকবি, আর তোর বউয়ের স্বামী। কোনো লড়াই থাকবে না এই দুটো সম্পর্কে। কিন্তু টুটাই, অহনা যেটা করলো তারপরে….
মাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই নৈঋত বললো, মা ও নিরুপায় ছিল। ও যে সত্যি ঢেকে এগোতে পারে না, তাই পারলো না বিয়েটা করতে। কাবেরী চিন্তাগ্রস্তভাবে বললো, আমারও তাই মনে হয়েছিল জানিস টুটাই। অহনা এরকম মেয়ে নয়। নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণ আছে। হ্যাঁ রে টুটাই, তুই কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিস?
মা আবার তুইতে ফিরে আসায় নিশ্চিন্ত লাগছিলো নৈঋতের। একটু থেমে বললো, ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি, তবে এই কাজটা ওর প্রফেশনাল নয়, পার্সোনাল বলেই মনে হলো। মে বি, ওর বাবা মায়ের মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের কারণটা ও খুঁজে পেয়েছে আর সেই তৃতীয় ব্যক্তিটিকে আইডেন্টিফাই করার জন্যই এমন করলো। হয়তো ও চেয়েছিল ওর বাবা বিবাহবাসরে উপস্থিত থাকুক। তাই সমস্যাটা মেটানোর জন্য এমন একটা মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো। কাবেরী বললো, সবেতেই তো তুই ”হয়তো”, ”যদি”, ”মে বি” বসাচ্ছিস। তার মানে তোর কাছে কংক্রিট কোনো আনসার নেই, তাই তো?
টুটাই একটু ভেবে বললো, মা একটা জিনিস অত্যন্ত ক্লিয়ার। ওর বাবা বাইরে কোথাও যায়নি, কলকাতার বাইরে রাইগঞ্জের খুব কাছে দেশের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলো নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়ের সময়, এটাই কি যথেষ্ট নয় একটা কিছু গন্ডগোল আছে বুঝতে। আবার দেখো, তিতিরকে যে ওর বাবা ভালোবাসে না তা নয়। পাপা কি পরি সে। তাই জন্যই এমন একটা ভুল কাজ করার পরেও বাবার কাছেই ছুটে গেল। কারণ ও জানতো, যাই ঘটে যাক বাবা আমায় ফেরাবে না। বুঝতে পারছ আমি কি বলছি? আবার আমি নিজের কানে শুনেছি তিতিরের বাবা ওর মাকে ফোনে আশ্বাস দিচ্ছে, অহনার কিছু হয়নি, ও ভালো আছে, তুমি চিন্তা কোরো না। তার মানে ডিভোর্সি নয়। রিলেশন ভালোই আছে। হয়তো একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে, এবং সেটা খুব রিসেন্ট। অহনা কথায় কথায় বলেছিল, এই তো মাস তিনেক আগে ও যখন বাইরে গিয়েছিল কাজে তখন ওর বাবা আর মা দুজনেই ছিল কলকাতাতে ফ্ল্যাটে, তাই দুজনের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ফোনের ভারে নাকি ও পাগল হতে বসেছিল। দুজনে নাকি প্ল্যান করে কল করতো। একজন সকালে, আরেকজন রাতে। আর ফোন করেই ওর বাবা বলতো, সকালে তো মায়ের সঙ্গেই কথা বললি, আমার সঙ্গে তো কথাই হলো না, তাই এখন করলাম।
অহনা বলছিলো, আসলে ও বাইরে গেলে দুজনেই টেনশন করে, অথচ ও রেগে যাবে বলে ঘনঘন কল করতেও পারে না। তাই এমন যৌথ প্ল্যান চালাত ওর ওপরে। তাহলে বলো মা, তিনমাস আগেও ওর বাবা-মা একসঙ্গে ছিল। হঠাৎ মেয়ের বিয়ের আগে কি এমন ঘটে গেল যে এমন আলাদা থাকবে?
কাবেরী বললো, ঠিকই বলছিস। তোর বাবা যখন কথা বলতে গিয়েছিল মাস দুয়েক আগে তখন ভদ্রলোক তো এমন কোনো ইঙ্গিতও দেননি। যদিও তোর বাবার মনে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। তার মানে এই ঘটনা মাস দুয়েকের। কিন্তু বাবা-মায়ের এই সমস্যা জেনেই তো অহনা বিয়েতে বসতে যাচ্ছিল, তারপর ঠিক কি হলো!
নৈঋত বললো, মা আমিও ঠিক এইখানে এসেই থমকে যাচ্ছি। যুক্তিগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তবে একটা কথা বিশ্বাস করি, অহনা মিথ্যেবাদী নয়, প্রবঞ্চক নয়। তাই সত্যিটা জানতে পারলে ও আমায় জানাবেই।
কাবেরী ফিসফিস করে বললো, তাহলে আমার পছন্দ তোকে কুপকাত করলো কি বল? একেবারে ভাসছিস তো।
ঘরের বাইরে একটা পায়ের আওয়াজ পেয়েই কাবেরী বললো, শোনো টুটাই, আমি আর তোমার বিয়ের ব্যাপারে নেই। তোর বাবা, পিসি যা বলবে সেটাই হবে। আমি এসব নিয়ে কোনো কথাই বলতে চাই না। নিজে যেটা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই করবে। দয়া করে লোক হাসিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যেও না।
অনু বাইরে থেকেই বললো, বৌদি আসবো?
পিসিমণি ঘরে ঢুকেই টুটাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, বৌদি একদম ঠিক বলেছে টুটাই। তোর যাকে পছন্দ তুই বিয়ে করিস, না ইচ্ছে হলে করিস না। কিন্তু বাড়ি ছাড়ার কথা ভাববি না। আমরা কেউ তোকে বিরক্ত করবো না রে। নৈঋত বললো, আহা, তুমি এত কাঁদো কেন পিমণি? তুমি কি ক্রাইং মেশিন? আমি কোথাও যাচ্ছি না। একটু সময় দাও, আমার বিয়েতে তুমি কাঞ্চিপুরম পরেই সাজবে, বুঝলে? অনু চোখে জল নিয়ে হেসে বললো,সত্যি? বেশ বাবা, তুই তোর পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করে আনিস, বৌদি বরণ না করলে আমি করবো। আমি তোর মা নই যে জোর করে কাউকে তোর ওপরে চাপিয়ে দেব। কাবেরী মুচকি হেসে বললো, অনু, তোমাদের প্রশ্রয়েই ছেলেটা এমন বিগড়ে গেল। অনু ভ্রু কুঁচকে বললো, টুটাইয়ের মত ছেলে আরেকটা খুঁজে নিয়ে এসো দেখি?
কাবেরী গম্ভীর ভাবে বললো, অনু, এখন যদি টুটাই অহনাকে বিয়ে করে বাড়িতে ঢোকে মেনে নেবে ওই মেয়েকে? বিয়ে ভেঙে দিয়ে ওই মেয়ে এই বাড়ির সম্মান হানি ঘটিয়েছে, তাও মেনে নেবে?
অনু একটু থমকে বললো, দেখো বৌদিভাই আমি অত হিসেব বুঝি না, টুটাই যাতে ভালো থাকবে তার জন্য সব মেনে নেব।
কাবেরী ছদ্ম গাম্ভীর্যে বললো, কিন্তু ওই মেয়েকে আমি মেনে নেব না কিছুতেই। অনু রাগ করে বললো, তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ টুটাই আমারও ভাইপো। তাই ওর ওপরে আমারও অধিকার আছে। তুমি মেনে না নিলেও বিয়ে হবে, আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেব। আমি বললে দাদাও অমত করবে না। অনু উঠে দাঁড়িয়ে বললো, টুটাই আমি তোর পাশে আছি। তুই যাতে ভালো থাকবি সেটাতেই মত দেব আমি, দাদা আর তোর পিসে। নিশ্চিন্তে থাক তুই।
চিরকালের জেদি মানুষ একটা….কাবেরীর উদ্দেশ্যে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল অনু।
কাবেরী বললো, দাদার চামচা। চিরটাকাল দাদা আর বোন দুজনে দুজনের তালে তাল মেলানো পাবলিক। তবে মনটা ভালো অনুর। আর তোকে ভালোবাসে খুব। তুতান ঢুকে বললো, দাদাভাই একটা মিরাক্যাল ঘটেছে। মা গিয়ে বাবাকে বলছিলো, টুটাই যদি অহনাকেও বিয়ে করে আনে তাতেও আমার অমত নেই। বৌদি যদি মেনে না নেয়, আমি বরণ করবো। টুটাইয়ের ভালো থাকাটাই জরুরি। কাবেরী বললো, বেচারি পাঁচটা শাড়ি কিনেছিলো ভাইপোর বিয়েতে পরবে বলে, তাই বোধহয় তাড়াহুড়ো করছে। তুতান একটু বোকার মতন তাকিয়ে থাকলো নৈঋতের দিকে, তারপর কারোর খুব একটা উচ্ছ্বাস নেই ওর এমন একটা এক্সাইটিং খবরে সেটা বুঝতে পেয়েই পায়ে পায়ে বেরিয়ে গেল।
কাবেরী বললো, তুই কাল বেরোবি তো? কোথায় যাবি, কেন যাবি, জিজ্ঞেস করব না, শুধু বলবো, তোর ইচ্ছেপূরণ হোক। নৈঋত মায়ের কোলে মুখটা ডুবিয়ে বললো, তুমি হলে ওয়ার্ল্ডের বেস্ট মম। কাবেরী ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললো, উও তো ম্যা হুই।
কাবেরী বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, অহনার বাবাকে বেশ হ্যান্ডু দেখতে তাই না রে?
নৈঋত হেসে বললো, তা হ্যান্ডু আছে, কিন্তু বড্ড বউ হ্যাংলা। দিনরাত নিজেদের প্রেমের গল্প করে যাচ্ছে। কাবেরী মজার গলায় বলল, তার মানে চান্স নেই বলছিস? কি আর করা যাবে, পরকীয়া সকলের কপালে থাকে না বুঝলি? যাই, আমার ব্যক্তিগত ভদ্রলোক কেমন মুডে আছে একবার পরখ করে আসি। যদিও তাহার ভগিনী এতক্ষণে আমার কার্যের অর্ধেক সম্পন্ন করিয়া দিয়েছেন। মাকে এই মুডে অনেকদিন পরে দেখলো নৈঋত। তার মানে মাও ওর মত অহনার ব্যক্তিত্বের জাদুতে ফিদা, এটুকু মানতেই হবে। তাই অহনার এবাড়িতে আসার সম্ভাবনা আছে জেনেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। বেশ মজার মুডে আছে মা, যাক মুখের ওপর থেকে অপমানের গ্লানিটা অন্তত নামাতে পেরেছে নৈঋত। অহনা যে ইচ্ছে করে মাকে অপমান করেনি, এটা জেনেই ফুলফর্মে ফিরে এসেছে কাবেরী বসু।
নৈঋত পিঠের ছোট্ট ব্যাগটাতে টুকিটাকি কয়েকটা জিনিস গুছিয়ে নিলো। গাড়ি ড্রাইভ করে যাবে, ট্রেনে আর নয়। তাই গুগুল ম্যাপটা খুলে রুটটা দেখতে লাগলো। দুদিন আগেও অহনা ছিল না ওর জীবনে, এখন এই নামটাই কতটা জুড়ে আছে, ভেবেই ঠোঁটের কোণে নরম হাসি ফুটলো নৈঋতের। ট্রেনে ওই ছেলেগুলোকে অহনার বলা কথাগুলো মনে পড়ে হো হো করে হেসে উঠলো নৈঋত। বাপরে, কি সাংঘাতিক মেয়ে। শান্তশিষ্ট মুখটা দেখে বোঝার উপায় নেই এমন মারকুটে টাইপ অহনা। ঠিক নৈঋতের বিপরীত, আর সেই জন্যই ওর প্রতি এতটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে মনে। শুধুই আগ্রহ বলে ওড়াতে চাইলেও ওড়াতে পারছে না নৈঋত, বেশ বুঝতে পারছে এটা ভালোবাসা। ভালোবাসার সঠিক সংজ্ঞা জানা নেই। তাই সমীকরণে ফেলতে পারছে না ঠিকই কিন্তু অচেনা অনুভূতিরা ক্রমাগত ইঙ্গিত করছে ভালোবাসার দিকেই। অহনা যে ওকে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করে ডেকেছে ওর কাজে, সেটাই তো পরম পাওয়া, যা গোঁয়ার অনিরুদ্ধ পালের মেয়েটা, বাপরে। মুচকি হেসে পাশ ফিরলো নৈঋত। মনে মনে বললো, প্লিজ তিতির, আজ রাতে স্বপ্নে এসো আমার। তোমার লুকানো ডানাদুটো দিয়ে উড়তে উড়তে এসো আমার স্বপ্নে। সারারাত অনেক গল্প করি। কথা দিলাম, নো দুষ্টুমি, অনলি গল্প আর কবিতা।
সকালে উঠে রেডি হতে হতে শুনলো, বাবা মাকে জিজ্ঞেস করছে, তুমিও জানো না টুটাই কোথায় যাচ্ছে? মা শান্ত গলায় বলল, না জানি না। আমায় বলেছে কি একটা কাজ আছে পারসোনাল। তাই আমি জিজ্ঞেস করিনি। মায়ের গলাটা একটু কেঁপে গেল বোধহয়, মিথ্যে একেবারেই বলতে পারে না মা। সত্যের জন্য লড়াই করে কিন্তু মিথ্যা বলা একেবারেই অভ্যেস নেই কাবেরীর। নৈঋত বেশ বুঝতে পারছিল, বাইরে বেরোলেই নীলাদ্রি বসুর প্রশ্নটা ধেয়ে আসবে ওর দিকে তাই উত্তর রেডি করে তবে যেতে হবে ড্রয়িংয়ে, না হলে মুশকিল।
নৈঋত বেরোতেই বাবা জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছিস এত সকালে? ও রেডি হয়েই ছিল। বললো, কলেজের একটা কাজ আছে, যেতে হবে। নীলাদ্রি একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কদিন পরে যেতে পারতিস তো, এখনই কলেজে গেলে হয়তো কলিগ বা স্টুডেন্টরা এই নিয়ে কিছু মজা করবে। নৈঋত হেসে বললো, দুদিন পরে গেলে কি সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে বাবা? বরং সত্যিটা অপ্রিয় হলেও ফেস করতে হবে। শুভময় ঘাড় নেড়ে বললো, এই জন্যই টুটাই আমার এত প্রিয়। স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড, মুখ লুকিয়ে বসে থাকার ছেলে ও নয়। ভদ্রতা মেইনটেইন করে সঠিক কথা বলতে ও জানে। কাবেরী এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো, যেকোনো প্রব্লেমে পড়লে কল করবি, বুঝলি? ফোন সুইচ অফ করে রেখে দিও না, আমি টেনশনে থাকবো। নৈঋত ঘাড় নেড়ে বললো, করবো, ডোন্ট ওয়ারি।
গুগল ম্যাপ দেখে গাড়ি চালাচ্ছিল নৈঋত। পৌঁছাতে প্রায় ঘণ্টা তিনেক তো লাগবেই। একবার অহনাকে কল করে বলে দেবে কি, যে ও বেরিয়ে পড়েছে। ভাবতে ভাবতেই অনিরুদ্ধবাবুর নামটা ফুটে উঠলো গাড়ির স্ক্রিনে। রিসিভ করতেই বেশ উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, অহনার কোনো খোঁজ পেয়েছো নৈঋত। আমি তো ওকে ফোনে পাচ্ছি না।
নৈঋত সাবধানে বললো, হ্যাঁ ওর সঙ্গে কাল কথা হয়েছে আমার। ও যেখানে আছে সেখানে সিগনাল একটু খারাপ, তাই অনেক সময় ঘরের মধ্যে থাকলে ফোন নট রিচেবেল বলছে। তবে ভালো আছে।
বেশ জোরেই দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়লেন অনিরুদ্ধবাবু, তারপর শান্ত স্বরে বললেন, যাক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে এই শান্তি। আমাদের ফোন তো রিসিভই করছে না। জানি না, আমাদের ওপরে ওর কিসের এত অভিমান জমলো! নৈঋত একটা রিকোয়েস্ট করবো? যতদিন না মেয়েটা বাড়ি ফেরে ততদিন একটু খোঁজ খবর নিও, আর আমায় একটু জানিও, তাহলে অন্তত দুশ্চিন্তাটা কমে। নৈঋত বললো, টেনশন করবেন না স্যার, আমি জানাবো আপনাকে।
।।৩১।।
কপিল, বাপ্পা, সুজয় তোরা রেডি তো, মাগিটা আজ আসবে বলেছে। একটু আগেই ফোনে জানিয়েছে। দুজন স্টেশনে যাবি আর দুজন তিনতলার ওই কোণের ঘরটাতে আমাদের বিছানাটা পেতে রাখবি।
সুজয় হেসে বললো, গুরু চাখা যাবে? নাকি টাকার জন্য নিরামিষ থাকতে হবে। পীযুষ হেসে বললো, সে ধীরে সুস্থে চাখবি খন। আগে তো টাকাটা হাতাই। জুয়ায় হেরে গিয়ে বহু টাকা বাজারে ধার হয়ে গেছে রে। তাই প্রায় মাস দুয়েক ধরে গুটি সাজিয়েছি। কম খবর জোগাড় করতে হয়েছে, কম লোককে টাকা খাওয়াতে হয়েছে? সেসব আগে তুলে নিই ওই সাংবাদিক বাপটার কাছ থেকে তারপর না হয় দেখে শুনে মেয়েটাকে ভোগ করিস তোরা।
এখন কথা না বাড়িয়ে যা দেখি, অটো আমি ভাড়া করেই রেখেছি। চলে আসবে সকাল সকাল। চা ফা খেয়ে রেডি হয়ে যা। কোনোরকম ভুল হলে কিন্তু জেলে থাকবি হারামিগুলো, তাই খুব সাবধানে। কপিল ঘাড় নেড়ে বলল, চিন্তা করো না গুরু। তোমার কাজ হাসিল হলে আমরাও তো পেসাদ পাবো।
ভাড়া করা অটোতে চেপে স্টেশনে চলে গেছে। বিশ্বনাথবাবু বা উৎপলবাবু আজ-কাল আসবে না আশ্রয় কমলেক্সে। সিকিউরিটির ওপরে দায়িত্ব দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত আছে দুজনেই। এই মোক্ষম সুযোগটা অবশ্য যেচেই এসেছে পীযুষের হাতে। সুশোভন মাস্টারের নাতনির বিয়ের খবর থেকে মেয়েটার ফোন নম্বর সবটাই পীযুষ জোগাড় করেছে অত্যন্ত সচেতনভাবে। তবে এমন একটা মুখরোচক খবর যে লুকিয়ে ছিল এতদিন সেটা অবশ্য বুঝতে পারেনি। সেটা জানার পর থেকেই মনটা নেচে উঠেছে পীযুষের। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলার বান্দা ও নয়। এখন শুধু মেয়েটাকে এখানে এনে ফেলার অপেক্ষা, ব্যস কেল্লা ফতে। আসল সত্যিটা চাপা দেওয়ার জন্য বড়লোকগুলো কত টাকা খরচ করতে পারে তা ওর ভালোই জানা আছে। অনিরুদ্ধ পাল হয়তো পীযুষকে বাড়িতে ডেকে পাঁঠার মাংস খাওয়াতে খাওয়াতে হস্ত জোর করে বলবে, এ খবর কাউকে দিও না পীযুষ, বল কত চাই? আর অনিরুদ্ধর সুন্দরী বৌটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে আর পাখার বাতাস করবে পীযুষকে। চোখ বন্ধ করেই স্বপ্নটা দেখছিল পীযুষ, বিড়িতে সুখ টান দিতে দিতে। সুজয় এসে বললো, গুরু ওরা নীচে এসে গেছে।
বিড়িটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো পীযুষ।
মাগিটাকে টিভিতে দেখেছে কপিল, পীযুষ অবশ্য দেখেনি, পীযুষ শুধু ছবি দেখেছে, অবিকল সুচেতার অল্প বয়েস, তবে সুচেতার মত ফর্সা নয়, একটু যেন শ্যামলা গায়ের রংটা। কপিল বলছিলো, বেশ রাগী রাগী মুখটা। জামার বোতামগুলো লাগিয়ে নিয়ে লিফটের মুখটাতে দাঁড়ালো পীযুষ। একটুও বিশ্বাস করে না ও ওর দলের ছেলেগুলোকে। সব কটা ক্যালানে, হয়তো দেখা গেল অহনা পালের জায়গায় ধরে এনেছে অনন্যা পালকে। এদের দিয়ে রঙের কাজ করাতেই হিমশিম খেয়ে যায় পীযুষ, কিছুতেই শেডের খেলা বোঝে না। এদের দিয়ে এসব ব্ল্যাকমেইলিং-এর কাজ করাতে মোটেই সাহস পাচ্ছিলো না ও। কিন্তু ভাড়া করা গুন্ডার চার্জ বেশি, তারপর সব কটার পুলিশের খাতায় নাম আছে। রাস্তাঘাটে দেখলেই পাবলিক চিনে ফেলে এদের। একটা মেয়েকে সঙ্গে করে আনছে দেখলে হয়তো দেবে পুলিশে খবর দিয়ে। সে তুলনায় বেঁটে কপিল আর রোগা পটকা বাপ্পা অনেক সুবিধাজনক। এদের দেখে মনেই হবে না এরা কোনো খারাপ কাজ করতে পারে। চিরদুঃখী মুখ চোখ নিয়ে জন্মেছে। ভিখিরির বাচ্চাগুলো এক বোতল মদের জন্য সব করতে পারে। বুকের ভিতরটা একটু দিপদিপ করছে পীযুষের। দীপশিখার সঙ্গে বিয়ের পর আর নিজের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার পর মেয়েছেলের কোনো লাফরায় আর পড়েনি ও। পীযুষ হাড়ে হাড়ে জানে জুয়া, সাট্টা, মদ, গাঁজাতে কোনোদিন এমন বিপদ হয় না যেটা মেয়েছেলেকে উত্যক্ত করলে হয়। শালা দেশের আইন আজকাল বড্ড মেয়েছেলেদের দিকে। দীপশিখার যেহেতু ওকে পছন্দ নয় তাই বিছানায় কোনোদিনই পীযুষকে জড়িয়ে ধরে সোহাগ করেনি। বরং প্রতি রাতে প্রায় জোর করে রেপ করেছে পীযুষ। তাই রেপের মজাটাও পায় রোজই। দীপশিখা কাঁদে, ছটফট করে, পীযুষ উপভোগ করে। ঐজন্যই অন্য পুরুষদের মত একঘেয়ে লাগে না। আবার কখনো নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়, পীযুষের অবশ্য ওকে কষ্ট দিতে পারলেই আনন্দ, শরীরের সবটুকু আক্রোশ মিটিয়ে নিতে পারে।
যন্ত্রনায় ছটফট করে দীপশিখা, পীযুষ তৃপ্তি পায়, একটা বন্য তৃপ্তি। তারপর দীপার মুখে এক থ্যবরা থুতু ফেলে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে ও। বহুদিন শুকনো হয়ে পড়ে আছে আশ্রয় কমপ্লেক্সে। এই রিপোর্টারের কাছ থেকে টাকাটা পেলেই সাতদিনের জন্য ফিরবে বাড়ি। বহুদিন দীপার গায়ের কালসিটে দেখেনি পীযুষ, মনটা অস্থির লাগছে ওর। দীপার গায়ে মেরে কালসিটে ফেলতে পারলে তবে নিজেকে পুরুষ মনে হয়। মারতে মারতেই তো শক্ত হয়ে ওঠে ওর পুরুষাঙ্গ।
কপিল আর বাপ্পা মেয়েটাকে নিয়ে এলো। পীযুষ একটা রং লাগা টুল এগিয়ে দিয়ে বললো, বসো বসো। আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?
আরে তোরা হাঁ করে বসে আছিস কেন? যা, ম্যাডামের জন্য ঘন দুধের চা আর মদনের দোকানের কচুরি নিয়ে আয়। অহনা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল লোকটার দিকে।
পীযুষ বিশ্বাস। রাইগঞ্জ এলাকার নামকরা রঙের মিস্ত্রি। দীপশিখার স্বামী, প্রিয়ার বাবা…..কালচে দাঁত বের করে হাসছে লোকটা। চোখের তলায় শরীরের ওপর নিদারুণ অত্যাচার করার ফলেই গভীর কালি। এককালে হয়তো পেটানো চেহারা ছিল, কাঠামোটা তাই চওড়া হলেও বয়েসের ভারে বা অতিরিক্ত মদ্যপানে চেহারা ভেঙেছে। বয়েস আন্দাজ বছর পঞ্চান্ন তো হবেই। কিন্তু চোখের চাউনিটাতে গাটা গুলিয়ে উঠলো অহনার। হাতের ঘড়ি, আংটি এগুলো ধীরে ধীরে নিজের ব্যাগে চালান করতে থাকলো অহনা। পীযুষ ছাড়াও ওদের দলে আরও পাঁচজন লোক আছে সেটা ও লিফটে ওঠার সময়েই টের পেয়েছে। ট্রেন থেকে নামতেই যে দুটো লোক ওকে নিতে এগিয়ে এসেছিল তাদের কথাবার্তায় বেশ পরিষ্কার এরা পীযুষের আন্ডারে কাজ করে। পীযুষ হলো হেডমিস্ত্রি। কন্ট্র্যাক্ট ওই ধরে, এই ছেলেগুলো ওর ইন্সট্রাকশনে কাজ করে। তাই এরা পীযুষকে বেশ ভয় পায়। তার মানে অহনাকে লড়তে গেলে একা পীযুষের সঙ্গে লড়লে চলবে না। আরও পাঁচজনকে ঘায়েল করতে হবে। মনে মনে ছক কষছে অহনা। ওদের দাঁড়ানোর পজিশনগুলো লক্ষ্য করছিল, ওকে কোথায় দাঁড়াতে হবে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিল, যাতে সব কটাতে একসঙ্গে কভার করতে পারে ও। ওদের স্যার বলতেন, মার্শাল আর্ট একটা বিদ্যা। গায়ের জোর নয় মানসিক সংযোগ জরুরি। মনটাকে যদি স্থির করা যায় তাহলে সব শত্রুকে ঘায়েল করা সম্ভব। যদি মন চঞ্চল থাকে তাহলে এই বিদ্যা ব্যর্থ হবে। ওদের মার্শাল আর্ট স্কুলে প্রতিদিন নিয়ম করে প্রাণায়াম করানো হতো। বহুদিন প্র্যাকটিস প্রায় হয় না বললেই চলে অহনার। রিপোর্টারের কাজ করতে করতে ক্লাস করা হয়ে ওঠে না। ওই উইকএন্ডে নিজের ঘরে যেটুকু হয়। বাবা বলেছিল, একটা স্কুল খুলে দি তিতির, তুই স্টুডেন্টদের শেখা তাহলে তোরও প্র্যাকটিস হয়ে যাবে, আর কিছু ছেলে মেয়েও শেখার সুযোগ পাবে। না হয় অল্প মাইনেতেই শেখাবি। মনস্থির করেও ফেলেছিল অহনা। তারপরে কাজের প্রেসারে আজ ঝাড়গ্রাম কাল পুরুলিয়া করে সময়ই করে উঠতে পারেনি, তাই মার্শাল আর্টের স্কুল গড়ার স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি অহনার।
টুলে বসতেই পীযুষ বললো, খবরগুলো লিক করিনি কারণ আমি জানতাম তোমরা ভদ্দরলোকের ফ্যামিলি, চারিদিকে সম্মানহানি হবে। তারপরে আবার টিভি কাগজের লোক বলে কথা, আগুনের মত ছড়িয়ে যাবে। এমন বিপদ আমি কি করে করতে পারি তোমাদের বলো? তাছাড়া সুচেতা মেয়েটা বড্ড নরম ছিল গো। শুধু শরীরটা নরম ছিল এমন নয়, মনটাও নরম ছিল। গাটা জ্বলছে অহনার, এই লোকটার মুখে মায়ের নামটা শুনে।
তাহলে খবরগুলো বলি?
অহনা হেসে বললো, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, আমি বরং বলি খবরগুলো। পীযুষ একটু অবাক হয়েই বললো, আরে, তুমি সব জানো বুঝি? তা বলো দেখি ঠিক কি কি জানো?
অহনা স্থির গলায় বলল, সুশোভন মিত্রের বাড়িতে রঙের মিস্ত্রি হয়ে ঢুকেছিলিস তারপর তার মেয়ে সুচেতাকে রেপ করিস। একবার নয়, বাড়িতে কেউ না থাকার সুযোগ তিন তিনবার রেপড হয় সুচেতা মিত্র।
না, সুচেতা ওর দাদা-বাবা কাউকে বলেনি এসব কথা। নিজেদের সম্মানের জন্য। কিন্তু তুই ছাড়ার পাত্র নোস। সারা রাইগঞ্জে রটিয়ে দিয়েছিলিস তোর সঙ্গে সুচেতার প্রেম চলছে। তুই ওকে রোজ ভোগ করছিস। সুচেতা তখন বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিল। অনিরুদ্ধ পাল লন্ডনে একটা স্পোর্টসের রিপোর্ট করতে গিয়ে আটকে গিয়েছিল। বৃষ্টির জন্য খেলা ডিলে হয়েছিল, তাই রাইগঞ্জে আসবো বলেও আসা হয়ে ওঠেনি তখনও। সুচেতা তখন অনিরুদ্ধর সংগে সংসার পাতার স্বপ্নে বিভোর। ঠিক তখনই তুই ওর সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিলিস। সুশোভনবাবু, সোহম কেউ বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারছিল না তোর জন্য। এর আগেই তুই ইভটিজিং এর জন্য জেলও খেটেছিস। কিন্তু মিত্র বাড়ির অপরিণামদর্শিতা আর সমাজের ভয়ের জন্য তোর নামে কোনো কেস হয়নি। সেই সুযোগটা তুই নিয়েছিলিস।
পীযুষ হাঁ করে দেখছিলো অহনাকে। কি নির্বিকারভাবে ওকে তুই তোকারি করছে হাঁটুর বয়েসি মেয়েটা।
অহনা বললো, কারণ তোর মত শুয়োরের বাচ্চারা তো জন্মায়ই নোংরামি করার জন্য। সুচেতার দুর্বল মানসিকতার সুযোগে তুই বেঁচে গেলি। যেহেতু সুচেতা তখনও অনিরুদ্ধর কথা বলেনি বাড়িতে তাই ওকে ওর বাবা-দাদা অবিশ্বাস করতে শুরু করলো। সুচেতা তখন একটা স্কুলের শিক্ষিকা। গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছিল। কেস করলে খবরটা আর শুধু রাইগঞ্জে সীমাবদ্ধ থাকবে না। কলকাতা অবধি পৌঁছে যাবে। ওর স্কুলে যাওয়া দুস্কর হয়ে যাবে। কারণ তোর মত জানোয়াররা এই সমাজে বাস করে বলেই, রেপিস্টের থেকে বেশি লজ্জা পায় ভিকটিম। যেন দোষটা তার! অত্যাচারিত হলো সে, লজ্জা পেল সে, তার চরিত্রেই লাগলো কালি, তার পোশাক নিয়ে উঠলো প্রশ্ন, আর রেপিস্ট সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করলো। আমি যদি তোর মায়ের জায়গায় থাকতাম না, তাহলে তোকে শুধু বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতাম না, আমি তোকে গলা টিপে মেরে দিতাম রে কুত্তা। শোন পীযুষ, তুই বরং আমায় রেপ কর, আমি তোকে কলার ধরে কোর্টে তুলবো, কোর্টে দাঁড়িয়ে তোর জামাকাপড় খুলবো শুয়োরের বাচ্চা। আমি সুচেতা নই। তুই এখনো নারীশক্তি কার নাম দেখিসনি। দীপশিখা, সুচেতা এদের দেখেছিস কিনা, তাই জানিস না কাকে বলে মহিলা? তোর ভাষায় মেয়েছেলে!
পীযুষ বেশ ঘাবড়েছে অহনার কথা শুনে, এমন যে কেউ বলতে পারে এটাই তো ধারণা ছিল না। ও জানতো, সুচেতার রেপের ঘটনা শুনে অহনা ভেঙে পড়বে, হাতে পায়ে ধরে বলবে খবরটা চেপে দিতে। দিয়ে ওর হাতে টাকা দেবে। সেসব ছক উল্টে যাচ্ছে।
অহনা বললো, বাকিটা শুনে নে। সুচেতার গোটা পরিবার ওর বিরুদ্ধে চলে গেল। সুচেতার জন্যই নাকি ওই বাড়ির সম্মানহানি হয়েছে। কি করে একজন শিক্ষিকা হয়ে, শিক্ষকের মেয়ে হয়ে ও তোর মত মানুষের সঙ্গে প্রেম করতে পারে সেটা নিয়েই গোটা পরিবার ব্রাত্য করলো সুচেতাকে। তুই রীতিমত তৈরি হয়েই এসেছিলিস। তাই সুচেতার ছেঁড়া জামাকাপড়, রক্তাক্ত যোনির ছবিও তুলেছিলিস, মেয়েটা যখন প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল তখন তুই অন্য ছকে এগিয়েছিলিস।
বড়লোক বাড়ির জামাই হবার ইচ্ছে পেয়ে বসেছিলো তোকে। তাই ওই ছবি দেখিয়ে তুই সুশোভনবাবুকে রীতিমত ব্ল্যাকমেইলিং করতে শুরু করিস। ওনার শরীর ভেঙে পড়তে থাকে। রাইগঞ্জে মুখ দেখাতে পারে না ওরা। সেই অবস্থায় সুচেতার দাদা সিদ্ধান্ত নেয়, তোর সঙ্গেই সুচেতার বিয়েটা দেবে। দিয়ে ওরা তোর কিছু একটা ব্যবসা করে দেবে। এছাড়া আর কোনো অপশন ছিলো না ওদের হাতে। সুচেতা তখন একটা ট্রমার মধ্যে ছিল। বাহ্যজ্ঞান শূন্য। হাসিখুশি মেয়েটা নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। তোর সঙ্গে বিয়ের ডেটও প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। ওই ঘটনার মাস তিনেক পরে তোর সঙ্গে বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়। এদিকে অনিরুদ্ধ চিঠির পর চিঠি লিখতে থাকে ওকে। কারণ তখনও রাইগঞ্জে টেলফোন আসেনি। পিয়োনকে হাত করে সেইসব চিঠি তুই রেখে দিয়েছিলিস। অনিরুদ্ধর উত্তর না পেয়ে সুচেতা সিদ্ধান্ত নেয় ও আত্মহত্যা করবে। ও বেঁচে থাকতে তোকে বিয়ে করবে না। তোদের বিয়ের ডেটের ঠিক তিনদিন আগে অনিরুদ্ধ সুচেতার কোনো খোঁজ না পেয়ে পৌঁছায় রাইগঞ্জে। সুচেতার মেস, স্কুলের কলিগ সকলেই জানায় ও তিনমাস আসেনি।
রাইগঞ্জে পা দিয়ে সুচেতার খোঁজ করতেই অনিরুদ্ধ শুনতে পায়, ওর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। একটা রঙের মিস্ত্রীকে প্রেম করে বিয়ে করছে মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে। আকস্মিক ধাক্কায় চমকে ওঠে অনিরুদ্ধ। তবুও বিশ্বাস করতে পারেনি এটা ঘটতে পারে। তাই হাজির হয়েছিল সুচেতার বাড়িতে। সুচেতা অনিরুদ্ধকে দেখে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেন এত দেরি করে এসেছে ভেবেই হয়তো কথা বলেনি। সুচেতার বাবা-দাদা ওকে তাড়িয়ে দেয় বাড়ি থেকে। অনিরুদ্ধ হাল ছাড়ার পাত্র নয়। রাইগঞ্জের অলিতে গলিতে খুঁজে খুঁজে বের করে আসল সত্য। এমনকি তোর বাড়ির লোকও অনিরুদ্ধকে আসল সত্যিটা বলেছিল। ওখানে বসেই অনিরুদ্ধ চিঠি দিয়েছিল সুচেতাকে। কেউ একটা গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল সেই চিঠি। তাতে লেখা ছিল, পীযুষের সঙ্গে কিছুতেই যেন সূচী বিয়ে না করে। সুচেতার উত্তর না পেয়ে অনিরুদ্ধ গিয়েছিল আবার ওদের বাড়িতে। দেখেছিলো একটা মৃতপ্রায় মেয়ের গায়ে হলুদ হচ্ছে। মেয়েটা যেন বসে থাকতেই পারছে না। সন্দেহ হয়েছিল অনিরুদ্ধর। পুলিশ ডেকে নিয়ে গিয়ে সুচেতাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে তুলে এনেছিল ওদের বাড়ি থেকে। মিডিয়ার সিনিয়ার রিপোর্টারের হাতে এটুকু ক্ষমতা থাকেই। সুচেতাকে নিয়ে সোজা গিয়েছিল রাইগঞ্জ হসপিটালে। সুচেতা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল অনেকগুলো। সেগুলো ওয়াশ করা হয়। ওকে নিয়েই অনিরুদ্ধ চলে গিয়েছিলো কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে। সোহম হুমকি দিয়েছিল, অনিরুদ্ধ এভাবে মেয়েটার বিয়ে ভেঙে দেওয়ার অপরাধে কেস করবে ওরা। অনিরুদ্ধ যেন ও বাড়িতে না ঢোকে।
কলকাতায় এসে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে ওরা, সম্ভবত মন্দিরেও বিয়ে করে। অনিরুদ্ধ চেয়েছিল রেপ কেসটা নিয়ে মুভ করতে। তাকে শাস্তি দেবে বলেই, সুচেতাকে কলকাতায় রেখে রাইগঞ্জে এসেছিল অনিরুদ্ধ। থানায় ডাকা হয়েছিল তোকে। তখনই খবর এসেছিল সুশোভনবাবু হার্টফেল করেছেন। অনিরুদ্ধ কেস ফেলে ছুটেছিলো সুচেতাকে আনতে। তুইও গা ঢাকা দিয়েছিলিস রাইগঞ্জ থেকে। সুচেতা বাড়িতে বাবার মৃতদেহের পাশে বসতে পেলেও অনিরুদ্ধ ঢুকতে পারেনি, সোহম ঢুকতে দেয়নি। ওর ধারণা হয়েছিল, অনিরুদ্ধর কারণেই বাবা মারা গেছে। ওভাবে সুচেতার চলে যাওয়াটা মানতে পারেনি বাবা। এরপর সুচেতা দাদার বাড়িতে এলেও অনিরুদ্ধ কোনোদিন আসেনি রাইগঞ্জে। আর তোর নামে কেস করতেও বারণ করেছিল সুচেতা, সম্মানের ভয়ে।
অহনা দম নিয়ে বললো, কিরে সব ঠিক বলছি তো?
অহনা কিছু বোঝার আগেই পীযুষ বলল, হ্যাঁ ঠিক বলছিস। সেই জন্যই তোকে আটকে রেখে তোর মায়ের কাছ থেকে টাকা আদায় করবো আমি। খবর যখন সবই জানিস তখন তো আর নতুন নেই কিছুই, তাই তুই হবি আমার টোপ। অনিরুদ্ধ পাল এসে আমায় পায়ে টাকা দিয়ে যাবে। দুটো ছেলে এগিয়ে আসার আগেই পজিশন নিয়েছিল অহনা। তিনজনকে একসঙ্গে ধরাশায়ী করেছিল বেশ কয়েকটা কিকে। পীযুষ গালাগাল দিয়ে বলেছিল, শালা মায়ের দুধ খাসনি শুয়োরের বাচ্চা, একটা মাগির কাছ মার খেয়ে কাতরাচ্ছিস! পীযুষের দিকে এগোচ্ছিল অহনা, একে ধরে থানায় নিয়ে যাবে অহনা। কিন্তু মাথার পিছনে একটা শক্ত কিছুর আঘাতে ও চোখে অন্ধকার দেখলো। সম্ভবত পীযুষের চার নম্বর সঙ্গী পাশের ঘর থেকে এসে অহনার মাথায় বাঁশ জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। এরপর আর কিছুই মনে নেই অহনার। এখন চোখ মেলে দেখলো একটা ঘরের মধ্যে ও একা রয়েছে। ওর ফোনটা পর্যন্ত নেই সঙ্গে।
দরজার দিকে ছুটে গিয়ে দেখল, দরজাটা বাইরে থেকে লক। ব্যালকনিতে যাওয়ার দরজাটাতে একটা তালা ঝুলছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল সূর্য অস্তগামী। শীতের সূর্য বেশ তাড়াতাড়িই ডুবতে চলেছে।
বুঝতে পারলো পুলিশ সঙ্গে না এনে একা আসাটা ঠিক কতটা বোকামি হয়েছে! এখন ফোনটাও নেই সঙ্গে। কারোর সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করা যাবে না। বাবাইকে জানানোও হয়নি ও কোথায় আসছে। পীযুষের দাদার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে একটা তীব্র অভিমান দানা বেঁধেছিল মনে। বাবাই, মা কেন সব বললো না ওর কাছে? কি মনে করে ওরা অহনাকে? ও অবুঝ, আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মত ইমোশনাল হয়ে যাবে? ভুল কিছু সিদ্ধান্ত নেবে? এত দিনে এই চিনলো বাবাই তার তিতিরকে? একরাশ অভিমানে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাবাই আর মায়ের এমন একটা লড়াইয়ের কথা কেন কেউ বললো না ওকে, তাই তো এখানে আসার পর বাবাইয়ের কোনো ফোন রিসিভ করেনি অহনা। ও যে আজ রাইগঞ্জের আশ্রয় কমপ্লেক্সে আছে এই কথাটা শুধুমাত্র নৈঋত যানে। তাছাড়া এখানে পরপর তিনটে ব্লক রেডি হচ্ছে। অহনা আছে বি ব্লকে, নৈঋত এগুলো তো জানে না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো ও প্রায় পাঁচ ছয়তলা ওপরে আছে। ওপর থেকে ডাকলে কেউ শুনতেও পাবে না। তাছাড়া জায়গাটা রাইগঞ্জ মেইন মার্কেট থেকে বাইরে, জিটি রোডের ধারে। এখানে লোকবসতি নেই বললেই চলে। এখনো জায়গাটা বেশ ফাঁকা। হয়তো ধীরে ধীরে কলকাতার রাজারহাটের মতই ভর্তি হয়ে যাবো জায়গাটা। আপাতত এই কমপ্লেক্স ছাড়া তেমন বাড়ি তো চোখে পড়লো না অহনার।
অবশ্য এইটুকু জানলা দিয়ে কতটাই বা দেখা সম্ভব?
বেশ ক্ষিদে পেয়েছে অহনার, মাথাটাও কাজ করছে না।
নিশ্চুপ হয়ে বসে পড়লো অহনা। একা এসে কতটা বোকামি করেছে এখন বুঝতে পারছে। হয়তো পীযুষ এতক্ষণে বাবাইকে কল করে ওর মুক্তিপণ দাবি করে ফেলেছে। এই একটা ব্যাপারে অনিরুদ্ধ পাল বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ, তার তিতিরের ব্যাপারে। পীযুষ যদি দশ লাখের বদলে কুড়িও চায়, বাবাই দিয়ে দেবে এটা তিতির জানে। সেই জন্যই নিজের ওপরে আরও রাগ হচ্ছিল। পীযুষ যখন দেখলো, অহনার কাছে সব খবরই ওপেন হয়ে গেছে, গোপন কিছুই নেই, তখন বুঝতে পেরেছিল অহনার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারবে না। তাই ওকে কিডন্যাপ করার সেকেন্ড প্ল্যানটা কার্যকর করলো ও।
চোখ বন্ধ করে ভাবছিলো অহনা। হঠাৎই দরজার বাইরে নৈঋতের আওয়াজ শুনলো।
ছুটে গিয়ে দরজার ভিতর থেকে হাত দিয়ে জোরে জোরে আওয়াজ করলো। দুমিনিটের মধ্যেই দরজাটা খোলার আওয়াজ পেলো অহনা।
নৈঋত ঢুকলো প্রথমেই, ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো অহনাকে। থরথর করে কাঁপছিল অহনা। নৈঋতকে চেপে ধরে বলল, পীযুষকে পালিয়ে যেতে দিও না।
নৈঋত শান্ত স্বরে বললো, তোমার বাবার বন্ধু অভিরূপ আঙ্কেল হেল্প করেছেন। উনিই রাইগঞ্জ থানায় খবর দিয়ে রেখেছিলেন। কোনোরকম প্রবলেম হলে যেন ওরা হেল্প করে। আমি তো সেই দুপুর বারোটাতেই পৌঁছে গেছি এই কমপ্লেক্সে। তোমায় বারবার ফোন করেও কন্ট্যাক্ট করতে পারলাম না। তখন সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ছবি দেখিয়ে। সে একটু থমকে ”হ্যাঁ” বলতে গিয়েও ”না” বললো দেখেই সন্দেহটা বাড়ল।
দেখলাম মেইন গেটে আমার পাশ দিয়ে কয়েকজন লোক উত্তেজিত হয়ে কিছু আলোচনা করছে। বার দুই রিপোর্টার শব্দটা উচ্চারণ করলো লোকটা। তখন আর দেরি না করে সোজা থানায় গেলাম। অহনা পাল নামটা করতেই ওসি বললেন, ডিএসপি অভিরূপ সান্যাল নাকি ওনাদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, অহনার কোনোরকম সমস্যায় হেল্প করতে। তারপর থানার মেজবাবু, তিনজন কনস্টেবল নিয়ে এলেন এখানে। ওদের দেখেই ভয়ের চোটে সিকিউরিটি বলে দিল, পীযুষ বিশ্বাস বলে একজন রঙের মিস্ত্রির দুজন হেল্পারের সঙ্গে এই মেয়েটি বি ব্লকে ঢুকেছিলো। আমরা বি ব্লকের প্রতিটা ঘর, ব্যালকনি খুঁজতে খুঁজতে শেষে এসে পৌঁছালাম এই ঘরে।
অহনা, আর ইউ অল রাইট?
অহনা আবারও বললো, পীযুষ বিশ্বাস কোথায়? ওর কথা শুনেই একজন কনস্টেবল বললেন, পীযুষ আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা ফার্স্ট ফ্লোরে ছিল। আমরা সকলকে আটকে রেখেছি। অ্যারেস্ট করবো সকলকে। অহনা বললো, অফিসার আমি পীযুষকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাই। আপনাকে সাহায্য করতে হবে। আপনি যদি বলেন আমি অভিরূপ অঙ্কেলকে জানাচ্ছি, উনি পারমিশন করিয়ে দেবেন।
মেজবাবু বললেন, যতক্ষণ না আপনি ডায়রি লেখাচ্ছেন ততক্ষণ ওর নামে কোনো লিখিত কেস হয়নি। তাই অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নেই। আমি স্পেশাল ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, দুজন পুলিশ দিয়ে পুলিশ ভ্যানেই পাঠানো হচ্ছে ওকে। নৈঋত অহনার হাতটা ধরে বলল, চলো গাড়িতে ওঠো। তুমি কি বাবার কাছে যাবে?
অহনা ঘাড় নেড়ে বললো, না নৈঋত আমি সোজা কলকাতা যাবো। নৈঋত বললো, তোমার ব্যাগ আর ফোন দুটোই এখন আমার কাছে। কলকাতায় কি নিজের ফ্ল্যাটে ফিরবে?
অহনা ঘাড় নেড়ে বললো, হ্যাঁ, আজ রাতটা ঢাকুরিয়ায় থাকবো, কাল সকালে একটা কাজ আছে আমার। নৈঋত একটু গম্ভীর ভাবেই বললো, আমিও তাহলে আজ রাতে তোমার সঙ্গেই থাকবো। সরি, তোমার কোনো বারণ আর আমি শুনছি না।
অহনা কিছু বলার আগেই নৈঋত বললো, গাড়িতে ওঠো।
পুলিশ অফিসার বললেন, আমি পীযুষ বিশ্বাসকে কাল সকালে পাঠাচ্ছি ম্যাডাম। আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই নিয়ে যাওয়া হবে ওকে। আজ রাতটা এ থানার কাস্টাডিতে থাকুক। ততক্ষণে আমি একবার ওসির সঙ্গে কথা বলে নিই। অহনা ঘাড় নেড়ে বললো, ওকে সকাল দশটায় আমার কলকাতায় চাই। কোথায় নিয়ে যাবেন, অভিরূপ আঙ্কেল আপনাকে জানিয়ে দেবে রাতেই।
গাড়িতে উঠেই অহনা বললো, খুব ক্ষিদে পেয়েছে। নৈঋত স্টিয়ারিং-এ হাত দিয়ে বললো, সামনের বক্সটা খোলো, খাবার রাখা আছে তোমার, খেয়ে নাও। নৈঋত যেন আজ একটু বেশিই গম্ভীর। অহনা দেখলো, প্যাটিস, মিষ্টি এসবের একটা প্যাকেট রাখা আছে। নৈঋত বললো, আপাতত এটা খাও, রাস্তায় কোনো রেস্টুরেন্টে দাঁড়িয়ে পরে খেয়ে নিও। অহনা খেতে খেতেই বললো, তুমি কি আমার ওপরে রেগে আছো?
নৈঋত অবসন্ন গলায় বলল, অহনা এমন একটা রিস্কি কাজে কেউ যে এভাবে একা আসতে পারে আমার ধারণা ছিল না! একবার ডেকেই দেখতে পারতে, একসঙ্গে তো আসতে পারতাম। যদি ওরা তোমায় সেন্সলেস করে কোথাও সরিয়ে নিয়ে যেত, যদি খুঁজে না পেতাম আর, যদি মেরে ফেলতো…. অহনা, একটা কথা বোধহয় খুব সত্যি, একতরফা ভালোবাসায় আর যাই থাকুক অধিকারবোধ থাকে না। কারণ অপর দিকের মানুষটার কোনো ফিলিংসই নেই আমার প্রতি।
অহনা প্যাটিসটা শেষ করে বললো, বাই দ্য ওয়ে তুমি কি পারফিউম ইউজ করো বলতো? গন্ধটা বড্ড সফট, ম্যানলি কিছু ইউজ করবে এবার থেকে, যাতে বুকে মুখ গুঁজলে অন্যরকম অনুভূতি হয়।
নৈঋত হাঁ করে তাকিয়েছিল অহনার দিকে। অহনা বললো, ওদের হাত থেকে তো বেঁচে ফিরছি, কিন্তু তুমি মনে হচ্ছে বাঁচিয়ে কলকাতা নিয়ে যেতে পারবে না বুঝলে? আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে রাস্তায় কনসেনট্রেট করো। আমার মুখে মোনালিসার কারুকার্য নেই, মন দিয়ে গাড়ি চালাও। নৈঋত মুচকি হেসে বললো, মোনালিসার কারুকার্য না থাক ভীতু চোখে অপার মুগ্ধতা আছে। অহনা প্রতিবাদ করে বললো, আমি মোটেই ভীতু নই।
হর্নটা একটু জোরে বাজিয়ে নৈঋত বললো, সাহসী মেয়ে যখন মুহূর্তের বিপদে ভয় পায়, তখন তার চোখে যে ভীতু চাউনিটা ফোটে ওটাই তো অমূল্য, আজ আমি ওটা দেখেছি। আচ্ছা অহনা, অতগুলো পুলিশের সামনে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে তোমার লজ্জা করলো না। ইস, আমার তো লজ্জা করছিল।
নৈঋত আড়চোখে দেখলো, অহনার গালে সন্ধে নামার লজ্জা এসে ভিড়ে করেছে।
কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, তুমি কি লজ্জাবতী লতা? আর এই যে আজ এখানে এলে, বাড়িতে কি বলে এসেছো শুনি?
নৈঋত বললো, বলেছি কলেজের কাজ আছে।
অহনা মুচকি হেসে বললো, এগুলো হলো একতরফা প্রেমের লক্ষণ। বাড়িতে মিথ্যে বলা, উড়ুউড়ু মন, সাড়ে তিনঘণ্টা টানা ড্রাইভ করেও ক্লান্ত না হওয়া….এইসব আরকি।
নৈঋত দেখলো, অহনা সহজ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তবুও ওর চোখ দুটোতে একমুঠো কষ্ট ঘোরাঘুরি করছে। ওই কষ্টটুকুকে মুছে দিতে হবে, তাই এর উৎস জানতেই হবে ওকে। অহনা যে বড্ড বেশি চুপচাপ হয়ে আছে, কি জন্য গিয়েছিল ওরকম একটা গ্যাংএর কাছে কিছুই যে বলছে না। নৈঋত প্রাইভেসিতে বিশ্বাসী। যেটা বলতে চাইছে না সেটা নিয়ে জোর করা ওর পছন্দ নয়। তাই বারবার জিজ্ঞাসাও করা যায় না।
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করালো ও। অহনা বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। কিছু অবাধ্য চুল এসে পড়েছে ওর ঘুমন্ত চোখের ওপরে। ক্লান্ত ঠোঁটে অব্যক্ত কষ্টেরা নিশ্চুপ, টিকালো নাকে ছোট্ট একটা হীরক বিন্দু ঝিকমিক করে নিজের আভিজাত্য জানান দিচ্ছে, কানের লতিতে দুটো ছোট্ট টপ নিজেদের জায়গায় স্থির, চেকস শার্টের কলারটা একটু উঠিয়ে বোঝাতে চাইছে আমি স্বাধীনচেতা, আমি নিজের মর্জির বাদশা। ঘন নিঃশ্বাসে ওঠা নামা করছে অহনার সুগঠিত স্তন, শ্যামলা রঙের উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত ওর শরীর। নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে নৈঋত, এর থেকে বেশি সৌন্দর্য কি আদৌ আছে পৃথিবীতে? নাকি বিশ্বকর্মা বড্ড যত্নে বানিয়েছে তার মানসকন্যাকে!
হালকা গলায় ডাকলো নৈঋত, তিতির…এই তিতির…অহনা নয়, এখন তিতির বলেই ডাকতে ইচ্ছে করছে নৈঋতের। যেন একটা পাখি বাসায় ফিরে অবসন্ন হয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর ডাকে ছটফট করে উঠলো অহনা।
নৈঋত বললো, ভয়ের কিছু নেই, চলো কিছু খেয়ে নিই। কলকাতা পৌঁছাতে এখনো ঘণ্টাখানেক লাগবে।
অহনা গাড়ির বেল্ট খুলে নেমে এলো। ফিসফিস করে বললো এখানে ওয়াশরুমে পাবো কি? নৈঋত হেসে বললো, আছে ওয়াশরুম, আমি গেটের সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করেই তোমায় ডাকতে গেলাম।
অহনা মুচকি হেসে বললো, তোমার বউ যে হবে সে খুব লাকি হবে বুঝলে! এত কেয়ারিং হাজবেন্ড পাবে।
নৈঋত বললো, আমারও তাই মনে হয়, আমার বউ রিয়েলি খুব লাকি হবে, কারণ সে এতটাই অমূল্য যে তাকে কেয়ার করতে হবেই। অহনা লজ্জা পেয়ে চলে গেল ওয়াশরুমের দিকে। নৈঋত সেই সুযোগে ফোন করতে শুরু করলো।
হ্যাঁ স্যার, আমরা আপাতত একটা রেস্টুরেন্টে আছি। অহনা ওয়াশরুমে ঢুকেছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ও আপনার ওখানে যাবে কিনা, বললো না কলকাতা যাবে। সম্ভবত ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটে যাবে বললো। আমি বলেছি এই ঘটনার পরে আমি কিছুতেই তোমায় একা ছাড়বো না। আমিও থাকবো।
হ্যাঁ, অনিরুদ্ধ আঙ্কেল আপনার দেওয়া উপদেশ মাথায় নিয়েই লড়ে যাচ্ছি, দেখি জয় করতে পারি কিনা। না, টেনশন করবেন না। আমি কল করবো বা মেসেজ করবো। তবে আপনার মেয়েটিকে তো চেনেন, যদি জানে আমি আপনাদের খবর পাচার করছি তো ডিরেক্ট শুট করে দেবে আমায়। অহনা আসছে, আমি রাখলাম স্যার।
আপনার মেয়ের কোনো বিপদ হবে না, ডোন্ট ওয়ারি।
।।৩২।।
কি গো, কি বললো নৈঋত? অহনা কোথায় কোনো খোঁজ পেয়েছে? সুচেতা চিন্তিত মুখে বললো।
অনিরুদ্ধ গম্ভীরভাবে বললো, সুচেতা তুমি বড্ড ব্যাকডেটেড ছিলে বুঝলে? প্রেসিডেন্সির মেয়ে অমন ব্যাকডেটেড হলে হয়? আর আমাদের বিয়ের আগেই তো আমার ফ্ল্যাটটা হয়ে গিয়েছিল, তাহলে তুমি মেসে কেন থাকতে? মানে আমরা তো একসঙ্গেও থাকতে পারতাম?
সুচেতা চমকে উঠে বললো, বিয়ের আগেই? একসঙ্গে থাকতাম? তুমি নির্লজ্জ সেটা আমি বরাবরই টের পেয়েছি, তাই বলে এতটা সেটাও ভাবিনি।
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, আমি যে নির্লজ্জ কবে বুঝতে পেরেছিলে?
সুচেতা মুচকি হেসে বললো, তিতির যখন ঘুমাতো চুপিচুপি আমাকে নিয়ে পাশের রুমে যাওয়ার সময়েই টের পেয়েছিলাম, তুমি বড় নির্লজ্জ।
অনিরুদ্ধ গম্ভীরভাবে বললো, না না, ভারতীয় সংবিধানের কোন ধারায় লেখা আছে যে মেয়ের বাপ হয়ে গেলে আর বউকে আদর করা যায় না? ইনফ্যাক্ট এটাও লেখা নেই যে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে আর বউকে জড়িয়ে ধরা যায় না?
সুচেতা চোখ পাকিয়ে বললো, বয়েসটা বাড়ছে, ভুলে যাও কেন?
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, শ্বশুর হয়ে গেলে তার মানে রোম্যান্স চলে যাবে? এ কেমন যুক্তি সূচী। যাইহোক, তখন কিন্তু আমরা লিভ ইন করতে পারতাম। মানে তুমি যখন মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ার তখন থেকেই থাকতে পারতাম একসঙ্গে। কতগুলো বছর অকারণে নষ্ট করলাম আমরা।
তোমার মেয়ে কিন্তু তোমার মত ব্যাকডেটেড হয়নি। তিনি আজ আমাদের ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটে থাকবেন নৈঋতকে নিয়ে! সুচেতা অবাক হয়ে বলল, মানে? এই নৈঋত কি করে সবসময় অহনার কাছে থাকছে আমায় একটু বুঝিয়ে বলবে? অনিরুদ্ধ বললো, যাই বলো না কেন ছেলেটা কিন্তু ইন্টিলিজেন্ট আছে। মানে আমি পাঁচ ছয় বছর পরিশ্রম করে যেটা করতে পারলাম না ছেলেটা মাত্র তিনদিনে সেটা করে ফেললো? ভাবা যায়! নৈঋত আজ তিতিরের সঙ্গে ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটে থাকবে। সুচেতা বিস্মিত হয়ে বলল, করতে কি চাইছে ছেলেমেয়েগুলো! বিয়ে দিচ্ছিলাম, দুজনেই পালিয়ে গেল। এখন দুজনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নাইট স্টে করবে ফাঁকা ফ্ল্যাটে। এগুলো ঠিক কি হচ্ছে গো অনি! এখনকার ছেলেমেয়েগুলো এমন উল্টো কেন? এদের কি সোজা পথে হাঁটলে পায়ে কাঁটা ফোটে? তাই একই রাস্তা ঘুরপথে হাঁটে!
অনিরুদ্ধ বললো, ওদের মত করে চিনতে দাও নিজেদের, দেখবে ভুল বোঝাবুঝি কম হবে। সুচেতা বললো, কিন্তু পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস দেবযানী তো দিনরাত তাকিয়ে থাকে গো আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে, ও তো দেখবে।
এর থেকে ওই ফ্ল্যাটটাতে গেলে ভালো করতো।
সদ্য মাসখানেক গেছি ওখানে কারোর সঙ্গে চেনাই হয়নি এখনো। অনিরুদ্ধ হেসে বললো, তোমার ফ্ল্যাটের চাবি বোধহয় তিতিরের কাছে নেই।
সুচেতা মাথা নিচু করে বললো, না নেই। কারণ অহনা চায়নি। বলেছিল, বাবার ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেটটা আমার কাছে আছে, তাই আপাতত দরকার নেই। আসলে আমার ওপরে রাগ করেই নেয়নি। বাপসোহাগী কিনা!
অনিরুদ্ধ বললো, সূচী কেন যে আজ বারবার মনে হচ্ছে আমরা অনেকগুলো বছর নষ্ট করে ফেলেছি, কে জানে!
সুচেতা অনিরুদ্ধর হাতটা চেপে ধরে বলল, আমায় ক্ষমা করো। আমি শুধু তোমায় ভুল বুঝেই গেলাম। রাইগঞ্জ থেকে যেদিন তুমি আমায় কলকাতা নিয়ে এলে সেদিনই যদি আমি ওখানেই ওই অ্যাক্সিডেন্টটা ভুলতে পারতাম, তাহলে হয়তো আমাদের জীবনের মূল্যবান মুহূর্তগুলো নষ্ট হতো না। নিজেকে স্বাভাবিক করে উঠতেই কাটিয়ে দিয়েছি কতগুলো বছর।
তুমি অনবরত বলতে, সূচী ওটা জাস্ট একটা অ্যাক্সিডেন্ট। কোনো বিকৃতি হয়নি তোমার শরীরের। তুমি আমার সেই সুচেতাই আছো। ওই দুঃস্বপ্নটুকু ভুলে যাও প্লিজ। পারতাম না জানো, তুমি গায়ে হাত রাখলেও চমকে উঠতাম, রেগে যেতাম। ঘৃণা হতো নিজের ওপরে। মনে পড়ে যেতে ওই লোকটার বিকৃত, হিংস্র মুখটা। দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে বসে থাকতাম রাতের পর রাত।
অনিরুদ্ধ বললো, আমারও দোষ আছে গো, ভগবানের আসনে বসিও না আমায়। আমিও সময় দিতে পারিনি ওই ক্রাইসিস টাইমে। তখন আমি কলকাতাতেই ছিলাম না। নিউজ করতে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। কেরিয়ার কেরিয়ার করে ক্ষেপে উঠেছিলাম। সবাইকে পিছনে ফেলে শীর্ষে ওঠার মারাত্মক লোভ পেয়ে বসেছিলো আমায়।
সুচেতা বললো, গর্ব আমারও হতো তোমায় নিয়ে। কাগজ খুলেই ছুটে যেতাম খেলার পাতায়। নিজস্ব প্রতিনিধির নামটুকু দেখেই শান্তি পেতাম। কিন্তু তোমাকে যে ওই সময়টাতে কাছে চাইতাম আমি। তিতির তখন পেটে, বোধহয় সাত মাস হবে। রাতে ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছিলাম। রাত দুটোর সময় তোমায় বারংবার ফোন করছিলাম, তুমি রিসিভ করোনি। নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে গিয়েছিলে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনি আমি যে একা ফ্ল্যাটে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম।
অনিরুদ্ধ সুচেতার পিঠে হাত দিয়ে বললো, জানি সেসব অপরাধের ক্ষমা হয় না, তবুও আমি কিন্তু তোমার সেই অনিই আছি। হাজার ব্যস্ততার ফাঁকেও তোমার মুখটা মনে পড়তো বারবার। তখন যে মোবাইল ছিল না সূচী, তাই যোগাযোগ করাটাও এত সহজ ছিল না জানো।
সুচেতা বললো, যাকগে নিজেদের খারাপ-ভালোর সংসার অনেক হয়েছে, এবারে মেয়েটার ব্যবস্থা করো দেখি। দিনরাত উদ্ভট সব কাজ করে বেড়াচ্ছে। পলিটিক্যাল বিটের রিপোর্টার হওয়ার কি দরকার ছিল?
সফট বিটে কাজ করতে পারতো?
অনিরুদ্ধ বললো, টেনশন কোরো না সূচী। আজকাল আর আগের মত হয় না। মিডিয়াকে কিনে রাখে রাজনৈতিক দলগুলো। তাই তাদের মত মতই খবর পেশ করতে হয় রিপোর্টারদের। একেকটা চ্যানেল একেক রাজনৈতিক দলের। ওই জন্যই তো সাধারণ মানুষের মিডিয়ার লোকদের ওপরে খুব আক্রোশ। ওরা ভাবে কেন আমরা সঠিক খবরটা দিচ্ছি না! ওরা জানে না দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে পরের দিন রেজিগনেশন পেপার রেডি করে রাখবে কোম্পানি। তাই বংশবদ হয়ে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেই বাঁচিয়ে রাখতে হয় জবটাকে। তবে তিতির যে চ্যানেলে কাজ করে ওটা তবুও বেশ স্বচ্ছ। তাই তিতিরের বিপদের সম্ভবনা হয়তো একটু বেশি। কিন্তু আমি জানি আমার তিতির পাখি সব বিপদ রিকভার করতে পারবে।
সূচী রাগ করে বললো, বড্ড বেশি প্রশয় দাও তুমি মেয়েটাকে।
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, কারণ আমি ওকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। ও সত্যের জন্য লড়বে, ও সাবধানী, ও ব্যতিক্রমী। আর পাঁচজনের মত একই বাঁধাছকে ওকে ফেলো না সূচী। তাহলে ও দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। ওকে বাঁধতে যেও না, ওকে খোলা আকাশে উড়তে দাও।
সুচেতা বললো, তাই বলে এতবড় একটা ঘটনা ঘটানোর পরেও তার এতটুকু গিল্টি ফিলিংস থাকবে না?
এখন নৈঋতের বাড়ির লোকেরা ওকে মেনে নিলে তবে তো! নৈঋত একাই তো ওর পরিবার নয়। আমি কাবেরীর জায়গায় থাকলে কি করতাম অনি? পারতাম এভাবে বিয়ের আসর থেকে চলে যাওয়া একটা মেয়েকে মেনে নিতে! জানি না গো দুশ্চিন্তাটা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না।
অনিরুদ্ধ একটু ভেবে বললো, সূচী তোমার মনে আছে তিতির কোন চিঠিটা খুলে পড়ছিল?
সুচেতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমি ঠিক জানি না গো, সবগুলোও পড়তে পারে আবার একটাও না। আমি যখন ঘরে ঢুকলাম তখন দেখলাম, তোমার আলমারি খোলা বোধহয় নিজের পাসপোর্টটা খুঁজে পাচ্ছিলো না বলে তোমার আলমারিতে খুঁজছিলো। আমি ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলো, মা পীযুষ কে? বাবা কেন লিখেছে, পীযুষকে ছেড়ে দেওয়াটা অন্যায়? কেন লিখেছে ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট? এই লোকটা কে? তোমরা চেন একে?
আমি ওর কোনো কথার উত্তর না দিয়ে চিঠিটা কেড়ে নিয়েছিলাম।
অনিরুদ্ধ বললো, তুমি মনে করলে এমনিই ও অন্যের চিঠি পড়তে গিয়েছিল? না, তা নয়। বেশ কিছুদিন ধরে নাকি পীযুষ ওর ফোনে মেসেজ পাঠাচ্ছে, কল করছে। তিতির নম্বর ট্র্যাক করে বের করেছিল লোকটার নাম পীযুষ বিশ্বাস, রাইগঞ্জ, নীলপুর অঞ্চলের বাসিন্দা। তাই ও আমাদের চিঠিতে ওর নাম দেখে জানতে চেয়েছিল। আমিও জানতাম না, ভেবেছিলাম হয়তো চিঠিগুলো পড়েই ওর মনে সন্দেহ জন্মেছে। কিন্তু এবারে এখানে এসে এগুলো শোনার পর বুঝতে পারলাম, ওই জন্যই ও আমার সঙ্গে এই লোকটার কোনো পুরোনো শত্রুতা আছে কিনা সেটা খুঁজতে গিয়েছিল। তাই আমার আলমারি খুলে কিছু ডকুমেন্ট জোগাড় করার চেষ্টা করেছিল সম্ভবত।
সুচেতা বললো, তার মানে পীযুষ অহনার সব খবর রাখে? এমনকি ফোন নম্বরও জানে? ও যে আমাদের মেয়ে সেটাও? এখন কি হবে অনিরুদ্ধ?
আমি তো শুনেছিলাম, সে বিয়ে-থা করে সংসারী। রাইগঞ্জে তাকে আর কেউ দেখেনি কোনোদিন। এতগুলো বছর পরে আবার কেন অনি? কি চায় সে? আমার মেয়ের জীবনটাও শেষ করে দিতে চায়!
অনিরুদ্ধ একটু শান্ত গলায় বলল, বারবার বারণ করেছিলাম রাইগঞ্জে মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত কোরো না। ওটাই তো ঘাঁটি ওর। তুমি সামার ভ্যাকেশনে যে কদিন যেতে তিতিরকে নিয়ে ঐবাড়িতে, আমি আশঙ্কায় থাকতাম। ভয় করতো আমার।
সুচেতা অভিমানী গলায় বলল, দাদা-বৌদি তারপর তোমায় অনেকবার বলেছিল ওই বাড়িতে যেতে, তুমিই জেদ করে যাওনি।
অনি চেঁচিয়ে বললো, না যাইনি। সোহম কি করে ওই রেপিস্টটার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিচ্ছিল তোমার? সেদিন যদি ঠিক সময়ে না পৌঁছাতাম আমি তো তোমায় হারিয়ে ফেলতাম সূচী। কি করতাম আমি সারাটা জীবন?
রাইগঞ্জ হসপিটালের ডক্টর বলেছিলেন, আরেকটু দেরি হলে হয়তো…. তারপরে আমি তোমার দাদাকে ক্ষমা করতে পারিনি সূচী। পারবোও না কোনদিন। তাই ওই বাড়ির সঙ্গে কোনোদিন আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে না। এসব পুরনো কথা থাক এখন। এত বছরে এগুলোতে পলি পড়েছে, এখন আর এগুলো খোঁচাখুঁচি না করাই ভালো।
সুচেতা বললো, কিন্তু ওই জানোয়ারটা যে অহনাকে টার্গেট করেছে, এখন কি হবে? অনিরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তিতিরকে সবটুকু সত্যি জানতে দাও সূচী। তারপর ও যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটা আমরা মাথা পেতে নেব। সত্যিটা জানার অধিকার ওর আছে। এভাবে লুকিয়ে রাখাটা আমাদেরই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। সুচেতা নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল বাইরের বাগানের দিকে তাকিয়ে।
অনিরুদ্ধর হোমথিয়েটারে বাজছে…..
ছোট ছোট দিন আলাপে রঙিন নুড়িরই মতন..
ছোট ছোট রাত চেনা মৌ তার পলাশের বন….
অগোছালো ঘর খড়কুটোময় চিলেকোঠা কোণ ….
।।৩৩।।
আলো আলো রং জমকালো চাঁদ হয়ে যায়
চেনাশোনা মুখ জানাশোনা হাত ছুঁয়ে যায়
আজও আছে গোপন ফেরারী মন
বেজে গেছে কখন সে টেলিফোন.
কি হলো গানটা বন্ধ করলে কেন নৈঋত? কারণ আমরা এখন ঢাকুরিয়ায় তোমার ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে গেছি। অহনা বন্ধ চোখ খুলে বললো, আমি কদিন ধরেই ভাবছিলাম আমাদের ড্রাইভার শ্যামলকাকুকে ছাড়িয়ে দেব, অন্য কাজে ইনক্লুড করবো, একটা বেশ ইয়ং দেখে ড্রাইভার রাখবো। ভাবছিলাম একটা ইন্টারভিউ ডাকবো। এখন মত পরিবর্তন করলাম, ইন্টারভিউ আর ডাকবো না। আমি পাকা ড্রাইভার পেয়ে গেছি। যে সাড়ে তিনঘণ্টার রাস্তা পাঁচ ঘণ্টায় নিয়ে এলো।
নৈঋত বললো, হে হে… আরেকজন যে ওয়াশরুমে পাক্কা আধঘণ্টা আর রেস্টুরেন্টে হাত চাটতে একঘণ্টা লাগালো সেটা বুঝি ড্রাইভারের টাইমের মধ্যেই ধরা হবে? যাক, কালই গিয়ে কলেজে একটা রেজিগনেশন দিয়ে আসবো। বলবো, আমি পার্মানেন্ট জব পেয়ে গেছি, আমৃত্যু ড্রাইভারের জব।
অহনা ঠোঁট টিপে বললো, ড্রাইভার যে গুগলের ডান দিকে যান আর বাঁ দিকে যান শুনতে শুনতে এসে পৌঁছেছে সেটাই অনেক।
নৈঋত বললো, শুনুন ম্যাডাম, আমি ঐ রাইগঞ্জে এই প্রথম গাড়ি চালিয়ে গেলাম। আর যেদিন সন্ধেতে গিয়েছিলাম সেদিন তো আমি চালাইনি। আমি সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে ফুলসজ্জিত গাড়িতে গিয়েছিলাম। বুঝতেও পারিনি ফুলশয্যা ডিরেক্ট শরশয্যা হয়ে যাবে! অহনা নৈঋতের মুখে হাত চাপা দিয়ে বললো, কি হচ্ছে, এত ভুলভাল কেন বকো? বাংলা শব্দের মানে জানো না নাকি? নৈঋত ওর হাতটা চেপে ধরে বলল, তোমার বর কিন্তু দারুন লাকি হবে, এত সাবধানী বউ পাবে বলে। অহনা হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললো, শোনো, আমি গিয়ে চাবি খুলছি তুমি নিচের ওই দোকান থেকে পিৎজা কিনে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকো। তাহলে দেবযানী আন্টি ভাববে পিৎজা বয় এসেছে। তাই খেয়াল করবে না। নাহলে আজ রাতেই মায়ের কানে চলে যাবে। মহিলার সারাদিনে একটাই কাজ। নৈঋত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, জো আজ্ঞা মহারানী।
অহনা উঠে গেছে ফ্ল্যাটে। নৈঋত এখানেই এসেছিল অহনাকে দেখতে আজ থেকে মাস তিনেক আগে। জানে কোন ফ্লোরে ওদের ফ্ল্যাটটা। পিৎজা অর্ডার দিয়ে মাকে ফোনে ধরলো। মা হয়তো টেনশন করছে।
কাবেরী ফোনটা ধরেই বললো, হ্যাঁ বল। আমি একাই আছি বল। অহনা আর তুই কোথায় আছিস?
নৈঋতের কথা শুনে মা বললো, মানে? তুই আর অহনা একা থাকবি ফ্ল্যাটে? শোন টুটাই, কোনোরকম অসভ্যতামি কোরো না যেন। ওর বাবা-মা যেন আমার শিক্ষার বদনাম করতে না পারে। নৈঋত মজার গলায় বলল, বিয়েটা হলে তো ফুলশয্যা মিটে যেত মা।
কাবেরী গম্ভীর ভাবে বললো, হয়নি তো বিয়েটা। তাই সেটুকু মেইনটেইন করো।
নৈঋত মায়ের ফোনটা রেখে একচোট হেসে নিলো। মা ওকে ঠিক কি ভাবে কে জানে! বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত অহনাকে একা বাড়িতে পেয়ে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে? ভালোবাসাটা কৃপণের মত খরচ করতে নৈঋত জানে। আর তাছাড়া ওর মার্শাল আর্ট জানা হবু বউ একটা কিক মারলে ওকে আর গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যেতে হবে না, ওই কিকেই পৌঁছে যাবে যাদবপুর।
বেল বাজাতেই ঘরোয়া পোশাকে দরজাটা খুলে দিল অহনা। ভিতরে চলে এসো। ভিতরে ঢুকতেই অহনা বললো, তোমার কি কিছু পোশাক আছে ওই ব্যাগে, নাকি বাবাইয়ের ড্রেস বের করে দেব। বলতো আমার প্লাজোও পরতে পারো।
নৈঋত হেসে বললো, আবার তোমার ড্রেসের চক্করে যাতে না পরতে হয় তাই একসেট পোশাক আমার ব্যাগেই আছে।
অহনা ওর হাত থেকে পিৎজাবক্সটা নিতে নিতে বললো, তুমি করে খেতে পারবে বুঝলে? কখনো যদি কলেজে ছাত্রীদের সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে চাকরিটা খুইয়ে ফেলো তাহলে পিৎজাবয়ের জবটা তো পাক্কা।
নৈঋত সোফায় বসে বললো, সেদিনও তো এই পজিশনেই আমি বসেছিলাম। তুমি ভদ্র মেয়ের মত এসে আমার অপজিটে বসেছিলে। দেখে মনে হচ্ছিল রবীন্দ্র যুগের কোনো শান্ত নায়িকা পথ ভুলে এসে পড়েছে। গত তিনদিনে বুঝলাম, তুমি সাক্ষাৎ ব্ল্যাক উইডো টাইপ।
অহনা সামনের সোফায় বসে বললো, আচ্ছা বলো, তুমি আমার জন্য কি কি করতে পারো? শুনি তোমার সাহসী প্রেমের নমুনা।
নৈঋত একটু ভেবে বললো, ধরো তোমার সঙ্গে কাটিয়ে ফেলেছি একটা যুগ। বহুদিন পরে আবার দেখা আচমকা এক শীতের সন্ধেতে।
‘মনে পরে অহনা,
আবদারে তোমার,
হারিয়েছিলাম সবুজঘেরা দ্বীপে।
প্রশ্রয়ে তোমার,
ডুবিয়েছিলাম শীতল জলে পা।
বায়নায় তোমার,
হেঁটেছিলাম ধু ধু বালির মাঠ।
তোমার মিষ্টি হাসিতে,
ভেসেছিলাম মাঝদরিয়ায়।
তোমার আদুরে ডাকে,
কালবৈশাখী উপেক্ষা করে
ছুটেছি অনেক পথ।
তোমার অভিমানী চোখে,
চারটে সি এল বরবাদ।
তোমার প্রশ্নবানে,
ধুমজ্বরে কলেজস্ট্রিট।
তোমার আস্কারায়,
ফুচকার টকজলে বদহজম।
তোমার উড়ন্ত চুলের মায়ায়,
ট্যাক্সি খরচ বাঁচিয়ে আইনক্সের টিকিট।
তোমার অপেক্ষায়,
এই বয়সে বাবার অপমান।
এবার আমার ম্লান প্রশ্ন-
পারিনি কি বাসতে ভালো তোমায়?’
অহনা আবেশ জড়ানো গলায় বলল, তোমার কবি হওয়া উচিত ছিল নৈঋত। তোমার বউ সত্যি লাকি হবে।
নৈঋত বললো, আর যদি আমার বউ তুমি হও?
অহনা বললো, লোভ হয়, তোমায় নিজের করে পেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কদিন পরে টিভিতে আমাদের চ্যানেলে আমার একটা এক্সকুসিভ প্রোগ্রাম থাকবে, ওটা দেখার পরে সিদ্ধান্ত নিও আমায় বিয়ে করবে কিনা। তার আগে নয়।
নৈঋত হেসে বললো, কিছু কিছু সিদ্ধান্ত জীবনের চরম মুহূর্তে নেওয়া হয়ে যায়, সেটা আমৃত্যু পাল্টায় না। তাই আমি নিশ্চিত তোমার প্রোগ্রাম দেখার পরেও আমার সিদ্ধান্ত একই থাকবে।
অহনা প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তে হবে, ভীষণ টায়ার্ড দুজনেই। নৈঋত বললো, আমি একেবারে ফ্রেশ আছি। তোমার সঙ্গে রাত জাগতে রাজি। অহনা বললো, আমি রাজি নই। আমার কাল সারাদিন কাজ, তাড়াতাড়ি যাও। তুমি বাবা-মায়ের ঘরে শুয়ে পড়। গেস্টরুমে থাকতে হবে না।
নৈঋত পিছন ফিরে বললো, আমার তোমার ঘরে থাকতেও অসুবিধা নেই। আমি বড্ড ভালো ছেলে।
অহনা মুচকি হেসে বললো, আমি ভীষণ খারাপ। তুমি তাড়াতাড়ি যাও।
হাসতে হাসতে চলে গেল নৈঋত।
নৈঋত চলে যেতেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কল সেরে নিলো অহনা। অভিরূপ আঙ্কেল আশ্বাস দিলো, আগামীকাল ঠিক সময়ে অহনার বলা হসপিটালে পুলিশ কনস্টেবল পৌঁছে দেবে পীযুষকে। অহনা ডায়রি করলেই পীযুষকে ওরা জেলে চালান করবে, কিডন্যাপিংয়ের চার্জ দিয়ে।
অভিরূপ আঙ্কেলের সঙ্গে কথা শেষ করেই, ওয়েলকাম ইন্ডিয়ার ডিরেক্টারকে কল করলো অহনা। অরুন্ধতী ম্যাম ফোনটা রিসিভ করেই বললেন, অহনা কবে জয়েন করছো অফিস? অহনা খুব সাবধানে বললো, ম্যাম আমাদের চ্যানেলের ওই ”রিয়েল লাইফ” শিরোনামে যে অনুষ্ঠানটা হয় ওখানে যদি আমি একটা নিজস্ব ঘটনা শেয়ার করতে চাই তাহলে কি স্লট পাবো?
অরুন্ধতী ম্যাম এমনিতেই অহনাকে বেশ পছন্দ করেন। কোনো কাজে অহনা না বলে না বলেই হয়তো পছন্দ করেন। একটু ভেবে উনি বললেন, আসলে ওই অনুষ্ঠানে তো আমরা অতি সাধারণ থেকে সেলিব্রিটি সবাইকেই আনি, তাদের জীবনের যে-কোনো একটা সত্যি ঘটনা তারা শেয়ার করে দর্শকদের সঙ্গে। কখনো তো নিজের চ্যানেলের কোনো এমপ্লয়ী আসেনি গেস্ট হিসাবে, তাই আমাকে একবার ”রিয়েল লাইফ” এর পরিচালক অর্ধেন্দুর সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। ও যেহেতু এটার দায়িত্বে আছে তাই ওর অনুমতিটা আমার দরকার। যদি অর্ধেন্দুর কোনো প্রবলেম না থাকে, তাহলে আমার নো প্রবলেম। কবে স্লট চাও তখন জানিয়ে দিও।
অর্ধেন্দুর সঙ্গে অহনার মৌখিক পরিচয় আছে। চ্যানেলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের সময় এসে নিজেই পরিচয় করছিল। বলেছিল, আপনিই তো গ্রেট সাংবাদিক অনিরুদ্ধ পালের মেয়ে তাই না? পরিচয় করার ইচ্ছে ছিল। আপনার রিপোর্টিং আমি দেখেছি, ভীষণ রকম বোল্ড। অনেক উন্নতি করবেন। অহনাও বলেছিল, আপনার রিয়েল লাইফ আমি সুযোগ পেলেই দেখি। দুর্দান্ত পরিচালনা করেন আপনি। লাইভ হয় বলে ইন্টারেস্টিং লাগে দেখতে। অর্ধেন্দু ভট্টাচার্য হেসে বলেছিল, ম্যাডাম আপনি নিশ্চয়ই জানেন লাইভের সমস্যাটা। কোনো এডিটিং থাকে না, তাই কখনো কখনো সমস্যায় পড়তে হয় বৈকি।
কখনো ইচ্ছে হলে আসতে পারেন তো নিজের জীবনের সত্যি ঘটনা নিয়ে আমার অনুষ্ঠানে। অনিরুদ্ধ পালের মেয়ে, তাই টি.আর.পি বাড়বে বৈ কমবে না।
অহনা হেসে বলেছিল, ফিলিং ভি.আই.পি। নিশ্চয়ই যাবো একদিন।
তখন অবশ্য ব্যাপারটা নিয়ে মোটেই সিরিয়াস ছিল না ও। কিন্তু এখন ওর যাওয়ার প্রয়োজন আছে এই অনুষ্ঠানটাতে। অরুন্ধতী ম্যাম বললে, নিশ্চয়ই অর্ধেন্দু না বলবে না। ও নিজেই তো বছর দুই আগে ইনভাইট করেছিল ওকে। তখন অবশ্য অনুষ্ঠানটা নতুন নতুন শুরু হয়েছে। এখন যে হারে এর পপুলারিটি তাতে আদৌ কি রাজি হবে চ্যানেলের কাউকে অ্যালাও করতে! দেখা যাক। নাহলে অন্য কিছু ভাবতে হবে।
অহনার বন্ধু রাজদীপের দাদা ”সরলা” নার্সিংহোমের ডক্টর। ওনার হেল্প দরকার। রাজদীপকে ফোন করবে বলেই নিজের ঘরে ঢুকলো অহনা। নৈঋত আছে ফ্ল্যাটে, ফোনগুলো তাড়াতাড়ি সারতে হবে।
রাজদীপের কাছ থেকে ওর দাদার নম্বরটা নিয়ে রাখলো, রাজদীপ বললো, তুই টেনশন করিস না, আমি দাদাকে বলে রাখবো তোকে সমস্তরকম হেল্প করতে। তুই পেশেন্টকে নিয়ে কাল চলে যাস।
নৈঋত বাইরে থেকে ডাকলো, পিৎজা তো গরম খায় বললেই জানতাম, অবশ্য যাদের মেজাজ খুব গরম তারা ঠান্ডাও খায়। অন্যমনস্ক অহনা কিচেনে গিয়ে দুটো প্লেটে পিৎজা দুটো সাজিয়ে নিয়ে আসতে আসতেই বললো, মিডিলটা নাও নি? এত বেশি কেন? কে খাবে এত?
নৈঋত বললো, আমি আর তুমি।
অহনা বললো, এত?
নৈঋত হেসে বললো, আমি তো জানতাম যারা মার্শাল করা পাবলিক তারা নাকি বেশি খায়। তাই বেশি করে আনলাম। মানে মুখ আর হাত দুটো একসঙ্গে চালাতে হয়তো তাই।
অহনা স্বাভাবিক গলায় বলল, শোনো সেদিন ট্রেনে ওই লোফারগুলোকে যে গালাগাল দিয়েছিলাম সেগুলো কি তুমি কাবেরী আন্টিকে বলেছো?
নৈঋত গম্ভীর হয়ে বলল, না বলিনি, কারণ বললে মা ভাবত আমিও অসৎ সঙ্গে পড়েছি। অহনা মুখ বেঁকিয়ে বললো, আহা, উনি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্টুডেন্ট ছিলেন, এখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসর উনি যেন কোনো কিছুই জানেন না। যত বাজে কথা। নৈঋত বললো, কে বলল জানি না। বলতে শুরু করলে রাত ভোর হয়ে যাবে। কিন্তু অমন ফ্লুয়েন্টলি ইউজ করতে পারি না। জিভটা ঠিকমত ছোলা নেই এসব ব্যাপারে তাই। অহনা একটু ভেবে বললো, তুমি বাড়ি ফেরার পরে কি কি ঘটলো? নৈঋত খেতে খেতে বললো, এই দোকানের পিৎজাটা কিন্তু দারুন। ভবিষ্যতে শ্বশুরবাড়ি এলে শ্বশুরের ঘাড় ভেঙে খাবো। ভেবেই কেমন একটা উত্তেজনা হচ্ছে বুঝলে অহনা। অহনা হেসে বললো, তুমি কি একটু সিরিয়াস হতে পার না? বলো না, তোমাদের বাড়ির সবাই কি বলছিলো আমার নামে? নৈঋত সিরিয়াস মুখ করে বললো, সবাই বলছিলো, টুটাই ওই মেয়েকে আর এবাড়ির বউ করে আনা হবে না। ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও। আর বাবা, পিমনি, পিসেমনা এরা তো আমি বাড়ি ফেরার আগে মেয়েও দেখে নিয়েছিল। বাবার অফিসে কলিগের শালার মেয়ে। তিনিও মিউজিকের লেকচারার।
অহনা মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললো, তা বিয়েটা কবে হচ্ছে? ছবি আছে নাকি তোমার কাছে তার?
নৈঋত টেবিল থেকে বাঁ হাতে করে মোবাইলটা তুলে বললো, পাসওয়ার্ডটা দাও তো বাঁ হাতে করে, আমার শুধু ডান হাতের আঙুলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেট করা আছে।
খাওয়ার সময় অসুবিধা হয়।
অহনা গম্ভীরভাবে বললো, পাসওয়ার্ড বলো।
নৈঋত বললো, Titirpakhi
টাইপ করতে করতেই থমকে গেল অহনা। নৈঋত বললো, হু স্পেস নেই কিন্তু। তিতির আর পাখি একসঙ্গে লেখো তবেই খুলবে।
অহনা ফোনটা আনলক করে এগিয়ে দিল ওর দিকে। নৈঋত বাবার পাঠানো মিমির ছবিটা খুলে বললো, এই যে এনাকে।
অহনা একটু সামলে নিয়ে বললো, এত রীতিমত সুন্দরী। রূপকথার নায়িকার মত। তোমার পাশে মানাবে ভারী।
নৈঋত খেতে খেতেই বললো, জানি তো মানাবে, কিন্তু মানতে পারবো না। তাই বারণ করে দিয়েছি বাড়িতে। অকারণ একটা মেয়ের কাছে ভুল বার্তা যাক সেটা আমি চাই না। অন্তত আমার কারণে তো নয়ই।
তবে বাড়িতে সবাই স্ট্রেইট জানিয়ে দিয়েছে, অহনাকে বিয়ে করা আর যাবে না।
ভুল দেখছে কি নৈঋত? অহনার চোখের কোনটা যেন একটু চিকচিক করে উঠলো মনে হলো।
ওর জন্য কোনোরকম ফিলিংস কি আদৌ তৈরি হয়েছে অহনার মনে! নাকি এখনও ওকে শুধুই বন্ধু ভাবছে!
অহনা বললো, প্লিজ বাড়ির সকলের কথা শোনো। ওরা কেউ কিন্তু অন্যায় কিছু বলছেন না। আমার জন্য একটা রেপুটেড ফ্যামিলির ইমেজ ম্যালাইনড হবে এটা আমি কোনোভাবেই চাই না।
তাই প্লিজ, তুমি কাল ফিরে যাও বাড়ি, আর এসো না কখনো।
নৈঋত হেসে বললো, ভাগ্যিস এই রাতেই তাড়িয়ে দিচ্ছ না।
এই অহনা, তোমার কোনো ফ্রেন্ড কখনো বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে?
মানে ব্যাপারটা কি এক্সাইটিং নাকি গো? কোনোরকম ধারণা আছে তোমার?
অহনা অন্যমনস্কভাবে বললো, না নেই। নৈঋত তুমি শুয়ে পড়। আমার কয়েকটা কাজ আছে, ল্যাপটপ খুলে বসবো একবার, তারপর ঘুমাবো। চলো তোমায় বাবাইয়ের ঘরে বিছানাটা ঠিক করে দিই।
নৈঋত ঘাড় নেড়ে বললো, আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। নিজের বিছানা নিজেই ঠিক করি রেগুলার। রাজাধিরাজ নই, বা টিপিক্যাল পুরুষ মানুষ নই যে আমার বিছানা অন্যকে করে দিতে হবে। ডোন্ট ওয়ারি, তুমি কাজ করো, আমি আজ অনিরুদ্ধ স্যারের বিছানায় শুয়ে সেলিব্রিটি ফিলিংস নিয়ে ঘুমিয়ে যাই।
নৈঋত বেসিনে হাত ধুয়ে টেবিল থেকে একটা জলের বোতল তুলে নিয়ে বললো, যদি প্রয়োজন হয়, নির্দ্বিধায় ডেকো। আজ তোমার ওপর দিয়ে যা গেছে, ট্রমাটা কাটতে একটু সময় লাগবে। আমি আছি তোমার সঙ্গে।
নৈঋত শুভ রাত্রি জানিয়ে চলে গেল। ঘড়ির কাঁটা দুটো প্রতিযোগিতা করে ম্যাচ ড্র ঘোষণা করেছে এগারোটার ঘরে এসে।
নিজের ঘরে ঢুকে ল্যাপটপ খুলে পরপর এখনো পর্যন্ত পাওয়া ডকুমেন্টগুলো সব মেলাচ্ছে অহনা।
এখনও দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি ওর। একটা আগামী কাল আরেকটা সপ্তাহখানেক পরে, এই দুটো কাজ কমপ্লিট হলে ও নিশ্চিন্তে কদিন ছুটি কাটাবে নিজের মত। ছুটি? দেবে কি চ্যানেল ওকে?
নৈঋতকে বড্ড ভালো লাগছে অহনার। ছেলেটার মধ্যে একটা পজেটিভ ভাইভস ছড়ানোর ক্ষমতা আছে। যতক্ষণ সঙ্গে থাকছিলো ততক্ষণ অহনা ভুলে থাকছিলো বাস্তবের জটিল পরিস্থিতিটাকে। ওর সঙ্গে মজা করলে মনের অনেক স্ট্রেস কমে যায়। ভালোবাসা কিনা জানে না অহনা, তবে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না ওকে। মনে হচ্ছে নৈঋত থাকুক ওর এই লড়াইয়ে। ওকে বিশ্বাস করা যায়, রেসপেক্ট করা যায়। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে একবার নয় দুবার ওকে ব্যবহার করেছে অহনা, তাই আর নয়। এই লড়াইটা ওর একার। নৈঋতকে এর মধ্যে আর জড়াবে না কিছুতেই। নৈঋত সামনে এলেই দুর্বল হয়ে পড়ছে অহনা। ওর কথাগুলো অদ্ভুতভাবে রক্তে শিহরণ জাগাচ্ছে, ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে ওর ক্লান্ত শরীরে। তাই অহনা ভালো করেই বুঝতে পারছে, বাবা-মায়ের মতোই নৈঋতও ওর মনের একটা দুর্বল অংশ দখল করতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি। তাই কাল সকালে উঠে অহনার কাজ হবে, খুব শক্ত মন নিয়ে নৈঋতকে বাড়ি পাঠানো। একে তো ও কাবেরী আন্টির বিশ্বাস ভেঙেছে, আবার তার একমাত্র সন্তানকেও জড়িয়ে ফেলছে নিজের জীবনের সঙ্গে, এর থেকে অন্যায় আর হয় না। নৈঋতকে ফিরিয়ে দিতে হবে বাড়ি।
ল্যাপটপটা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো অহনা।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো, পীযুষের কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। চোখ দুটো জ্বলে উঠলো ওর। চোখের কোণে জমে উঠলো বাষ্প। বাষ্পটাকে কিছুতেই জল না হতে দেবার জন্য আপ্রাণ লড়াই করছিল অহনা। মাঝে মাঝে ও বুঝতে পারে ওর মধ্যেও একটা অতি সাধারণ মেয়ে লুকিয়ে আছে। যে মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্ট নয়, যে ইউনিভার্সিটি টপার নয়, যে স্বেচ্ছায় নামী জবের অফার অগ্রাহ্য করে রিপোর্টারের অস্থায়ী জীবন বেছে নেওয়া সাহসী মেয়েটা নয়। রাজনৈতিক নেতার সামনে আগুনের গোলার মত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া মেয়েটাও নয়, ভীষণ সাধারণ নরমসরম একটা মেয়ে। যে অনিরুদ্ধ পাল আর সুচেতা পালের কন্যা, যে নৈঋতের স্ত্রী হয়েই খুশি থাকতে চায়। যে অকপটে হাউহাউ করে কাঁদতে পারবে, যাকে নিজের কাঠিন্য বজার রাখার জন্য লুকাতে হবে না নোনতা জলের ধারাদের। কোনোদিন যদি এই ব্যতিক্রমী তকমাটা ছেড়ে সাধারণ অহনাটাকে সকলের সামনে দেখাতে পারে, সেদিন কাঁদবে ও বালিশ ভিজিয়ে।
।।৩৪।।
কি হলো, কাঁদছিস কেন প্রিয়াঙ্কা? আজ কি কাঁদার দিন? দেখ, আমার মাও এসেছে তোকে আশীর্বাদ করবে বলে। অনিকের দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রিয়াঙ্কা ঝাপসা চোখে দেখলো, অনিকের মা বসে আছে গাড়িতে। দীপশিখা আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে। প্রিয়া সকালেই বলেছে, যতই সাজো তোমায় শাশুড়ি শাশুড়ি লাগছে না কিন্তু, বড়জোর জ্যেষ্ঠ শ্যালিকা বলে চালানো যেতে পারে। মেয়ের কথায় হেসে গড়িয়েছে দীপশিখা। আজ তার বড্ড আনন্দের দিন। মেয়ে চাকরি পেয়েছে, দীপা দাঁড়িয়ে থেকে প্রিয়ার পছন্দের মানুষের হাতে ওকে তুলে দিতে পারবে, অনিক বেশ ভালো ছেলে। প্রিয়াকে ভালোও বাসে খুব। তাছাড়া আরেকটা মানুষ যে আজও ওর স্মৃতি আঁকড়ে বসে আছে ভেবেই নিজেকে এ পৃথিবীতে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে শুরু করেছে।
অনিক একটা চারচাকা ভাড়া করে এনেছে। প্রিয়ার বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।
প্রিয়া গাড়িতে উঠতেই অনিকের মা বললো, তোমাদের বিয়ে হবে, আমি না এসে থাকতে পারি? জানি অনির বাবার মত হয়তো ও পাবে না এখুনি, তবে আমি আছি তোমাদের জীবন শুরুর মুহূর্তে। প্রিয়ার পরনে লাল বেনারসি। গলায় সিটিগোল্ডের হার, হাতে দুটো সিটিগোল্ডের চুড়ি। দীপশিখার যেটুকু গয়না ছিল সবই পীযুষ কেড়ে নিয়েছে, তাই মেয়েকে দেবার মত কিছুই নেই ওর হাতে। অহনার দেওয়া আংটিটা প্রিয়ার আঙুলে আর কানে দুটো সোনার কানের দুল। প্রিয়া গাড়িতে ওঠার আগেই অনিকের মায়ের পা ছুঁয়ে বললো, আপনি আমার মনের দ্বিধা কাটিয়ে দিলেন। কেমন যেন অপরাধবোধ কাজ করছিল, অনিক ওর বাড়ির সকলকে লুকিয়ে আসছে ভেবেই তৈরি হচ্ছিলো খারাপ লাগাটা। আপনার আশীর্বাদ পেলে তবেই পূর্ণ হবে আজকের দিনটা। অনিকের মা হেসে বললেন, না বেয়ান, ছেলের আমার পছন্দ আছে। কি মিষ্টি মেয়ে, কেমন সুন্দর জীবনবোধ। পীযুষ বিশ্বাসের মেয়ে শুনেই নাক সিঁটকেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে ছেলের আমার চোখ আছে। অনি, তাড়াতাড়ি চল। এগারোটা দশে একটা ভালো সময় আছে। আমি ঠাকুরমশাইকে জিজ্ঞেস করেছি। ওই সময় তোরা সই করবি। আর বাজারের মোড় থেকে দুটো ফুলের মালা কিনে নিবি। সিঁদুর আমি সঙ্গে এনেছি। ঠাকুরের পায়ে ছোঁয়ানো সিঁদুর।
প্রিয়ার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। এমন সুখও ছিল ওর জীবনে! মদ্যপ বাবার গালিগালাজ শুনতে শুনতে মনটাই তো শুকিয়ে গিয়েছিল। মরুভূমির মত শুকনো ছিল ওর চোখ দুটো। যেন মনে হতো, চোখের সব শিরা উপশিরারা মৃত। বাবার মারের আওয়াজ, মাকে গলা ধাক্কা দেওয়া, ওকে নোংরা ভাষায় গালি শুনতে শুনতে পুরুষ জাতিটার প্রতি একটা ঘৃণা জন্মেছিল। সেই ঘৃণাকে ধুয়ে মুছে ভালোবাসার রঙে রাঙানো সহজ কাজ ছিলো না। অনিকের মত জাদুকর ছিল বলেই হয়তো প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাস করেছে, পুরুষ মানে নির্ভরতা, পুরুষ মানে প্রতিশ্রুতি রাখার একান্ত চেষ্টা। অনিক দুই মায়ের চোখ এড়িয়ে প্রিয়ার হাতটা চেপে ধরে বলল, এই যে মহারানি, এবার থেকে তুই কিন্তু প্রিয়াঙ্কা অনিক বসু হতে চলেছিস, মেয়েবেলা শেষ করে বউবেলা শুরু হবে। প্রেমিকা হিসাবে কিছু বলার আছে তোর? বউবেলায় তো আমাকে দুবেলা শাসন করবি সে আমি জানি। প্রেমিকাবেলার শেষ মুহূর্তের দাবিটুকু শুনে নিই।
প্রিয়াঙ্কা বললো, সারাজীবন প্রেমিকা থাকবো তোর। সকলের সামনে তোমার বউ, আর আড়ালে তোর প্রেমিকা।
অনিক মুচকি হেসে বললো, তথাস্তু, মনে রাখবে এই অর্বাচীন। প্রিয়া তোকে না পেলে জীবনের অর্থ বড্ড এলোমেলো হয়ে যেত রে। ভাগ্যিস তুই করুণা করলি।
প্রিয়া মনে মনে বললো, পাগল একটা, কি যে দেখেছে ওর মধ্যে কে জানে!
একটা আননোন নম্বর থেকে দীপশিখার ফোনে ফোনটা ঢুকলো। হ্যালো বলতেই, বললো, রাইগঞ্জ থানা থেকে বলছি। পীযুষ বিশ্বাসকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। অহনা পালকে কিডন্যাপিংয়ের দায়ে। ওনার স্ত্রী হিসাবে আপনি কি জামিনের আবেদন করতে চান?
দীপশিখা বললো, না চাই না। আরও কয়েকটা চার্জ যোগ করতে চাই ওর সঙ্গে। ফোনটা রেখে দিয়েছে দীপশিখা।
খবরটা এখুনি দেওয়া যাবে না কাউকে। আগে ভালোয় ভালোয় প্রিয়ার বিয়েটা মিটুক।
প্রিয়ার সিঁথিতে অনিক সিঁদুর পরিয়ে দিলো। অনিকের মা একটা সোনার চেন প্রিয়ার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললো, আমার একটাই ছেলে, তাই তার বউকে আমি অনুষ্ঠান করেই ঘরে নিয়ে যাবো। কয়েকটা দিন সময় দাও মা।
অনিক আর প্রিয়ার রেজিস্ট্রি ম্যারেজ কমপ্লিট।
একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া করে ওরা ফিরে যাবে যে যার বাড়ি।
অনিক বললো, প্রিয়া কদিনের মধ্যেই কিন্তু যাবো ফ্ল্যাট বুক করতে, রেডি থাকিস।
দীপশিখা আর প্রিয়া ফিরে এসেছে বাড়িতে। প্রিয়ার গালদুটো রঙিন। খুশি খুশি মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে।
অনিককে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা ও।
দীপশিখা স্থির গলায় বলল, তোর বাবাকে অ্যারেস্ট করেছে পুলিশ। আমার ফোনে কল এসেছিল থানা থেকে। জামিনের জন্য যাবো কিনা জিজ্ঞাসা করছিল।
প্রিয়া একটু অবাক হয়েই বললো, অ্যারেস্ট করেছে, কিন্তু কেন? মানে চার্জটা ঠিক কি? দীপশিখা বললো, অহনাকে কিডন্যাপিং করার চার্জে।
প্রিয়া হাততালি দিয়ে উঠলো। তার মানে অহনাদি কথা রেখেছে। শেষ পর্যন্ত ওই জানোয়ারটার হাত থেকে আমরা রক্ষা পেতে চলেছি মা। দীপশিখা দৃঢ় স্বরে বললো, আরও কয়েকটা চার্জ ওর নামে হওয়া দরকার রে। রোজ রাতে আমাকে যে মারত, ফিজিক্যাল হ্যারজমেন্টের চার্জ আনবো আমি ওর বিরুদ্ধে। যাতে আমি বেঁচে থাকতে আর ওর মুখ দেখতে না হয় প্রিয়া। তুই আমার নিয়ে যাবি রাইগঞ্জ থানায়?
প্রিয়া বললো, মা তার আগে আমি একবার অহনাদিকে কল করে পুরো বিষয়টা জেনে নিই তারপর তুমি, আমি আর অনিক যাবো। ওই লোকটাকে সারাজীবন অন্ধকারে রাখতে চাই আমিও।
দীপশিখা বললো, প্রিয়া আমায় একবার সূর্যপুর নিয়ে যাবি? অনিরুদ্ধ পালের বাড়ি।
প্রিয় মায়ের স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, নিশ্চয়ই যাবো মা তোমায় নিয়ে। তোমার এইটুকু ইচ্ছে যদি পূরণ করতে না পারি তাহলে আর সন্তান কিসের! আমি আর অনিক কাল ফ্ল্যাট বুক করতে যাবো, দিন তিনেক পরে রবিবার করে নিয়ে যাব তোমায়।
দীপশিখা বললো, শান্তি বড্ড শান্তি। বহুবছর পরে আমি আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাবো প্রিয়া। আমার চোখ দুটোতে অনেক ঘুম জমে আছে জানিস। প্রিয়া মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ঘুমাও মা, আজ আর আতঙ্কে থাকতে হবে না তোমাকে, কখন মারবে, কখন সিগারেটের ছ্যাঁকা দেবে, সেই ভয়ে জেগে থাকতে হবে না রাতের পর রাত। আর বেল্টের আঘাতের যন্ত্রণায় কাঁদতে হবে না তোমায় মা। তুমি ঘুমিয়ে পড়, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। দীপশিখা ধীরে ধীরে চোখ বুজলো।
বিজয়দা গান গাইছে মালকোষের সুর….ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে, লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে দীপশিখা।