অনুভবে তুমি – ৩৫
।।৩৫।।
নৈঋত বললো, মা আজ ওয়েলকাম ইন্ডিয়ার ”রিয়েল লাইফ” অনুষ্ঠানটা আমাদের বাড়ির সকলকে দেখতে অনুরোধ করেছে অহনা। কাবেরী বললো, গত দশদিন তুই অহনার সঙ্গে দেখা করিসনি? কথাও হয়নি তোদের? সেদিন ওদের ফ্ল্যাট থেকে ফেরার পর থেকেই দেখছি তুই বড্ড মনমরা হয়ে আছিস। কথাও বলছিস না ঠিক করে, কি হয়েছে বলবি? দেখ টুটাই, সকলেরই অফিস শুরু হয়ে গেছে, তাই বাড়িতে আর বেশি টাইম দেওয়া হচ্ছে না। তাই বলে তোর কোনো সমস্যা হলে আমি শুনবো না তা কিন্তু নয়।
নৈঋত একটা জার্নাল ওল্টাতে ওল্টাতে বললো, কলেজে প্রথম যেদিন গেলাম সেদিন কলিগ থেকে স্টুডেন্ট সকলের চোখেই কৌতূহল ছিল। আমিই ক্লাসে ঢুকে বেশ ব্রেভলি বললাম, তোমরা নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গেছো আমার বিয়েটা হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আগুনের আগে খবর ছড়ায়, তাই নিশ্চয়ই জানো। তাই সকলের চোখের দৃষ্টিতে অনেক প্রশ্ন জমেছে দেখতে পাচ্ছি। আমি একে একে পরিষ্কার করছি। আমাদের দুজনের আচমকা মনে হয়েছে আমাদের বিয়েটা বন্ধুত্ব ছাড়াই হচ্ছে। পরে হয়তো দুজনের মাঝে সমস্যা হবে। তাই আমরা সেদিন এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিজেদের মাস খানেক সময় দিয়েছি, যদি দেখি দুজনের মনের মিল আছে তাহলে বিয়েটা হবে, আদার ওয়াইজ হবে না।
স্টুডেন্টরা বোধহয় মুখচোরা স্যারের কাছ থেকে এতটা স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা এক্সপেক্ট করেনি। তাই সকলে একবাক্যে চুপ করে গেছে। দু-চারজন পক্ক ছেলেমেয়ে বলেছে, স্যার ব্রেভ ডিসিশন, অ্যান্ড রাইট অলসো।
কলিগদেরও একই গল্প দিতে বাধ্য হয়েছি, তাই দ্বিতীয় দিন থেকে কলেজে আর কোনো প্রবলেম হয়নি। আসলে কি বলতো মা, এখন জেট যুগ, কারোর সময় নেই কাউকে নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার। তাই একটু গুঞ্জন উঠেই থেমে যায়। কাবেরী বললো, এটা তুই ঠিক বলছিস, আমিও খুব টেনশনে ছিলাম হয়তো অফিসে অনেকেই জিজ্ঞেস করবে। তুই জাস্ট ভাবতে পারবি না, যাদের নিমন্ত্রণ ছিল তারা পর্যন্ত কিছু জানতে চায়নি। বরং আগের মত নরম্যাল কথা বলছে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
তোর বাবাও বলছিলো, দু-একজন খুব ক্লোজড ছাড়া তেমন কারোর প্রশ্নবানের সম্মুখীন হতে হয়নি। জানিস টুটাই হয়তো লোকে পিছনে আলোচনা করছে একটু আধটু, তবে সামনে যে করছে না এতেই স্বস্তি।
নৈঋত বললো, জানো মা, অহনা কিছু একটা বলতে চাইছে আমায় কিন্তু কিছুতেই পারছে না। পারছে না বলেই দূরে চলে যাচ্ছে একটু একটু করে। অনিরুদ্ধ আঙ্কেল আর আন্টি নাকি ওদের সূর্যপুরের বাড়িতেই এখনো আছেন। আন্টির স্কুল শুরু হয়ে গেছে, তাই নাকি ছুটিতে আছেন উনি। অহনা নাকি এ কদিন একাই থাকতে চেয়েছে ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটে। আঙ্কেল আন্টি দুশ্চিন্তা করলেও কিছুই করার নেই। এমনকি আমি ফোন করলেও হাই হ্যালো করে রেখে দিচ্ছে। ঠিক কি যে ওর প্রবলেম সেটাও শেয়ার করছে না। এদিকে তো দেখলাম জব জয়েন করেছে। গতকাল সন্ধেতে সর্দার এভিনিউয়ের মিটিং কভার করেছে। টিভিতে খবরের সময় ওকে দেখালোও। কিন্তু কারোর সঙ্গে কথা বলতে ওর যে কিসের সমস্যা কে জানে। আমিও ওর প্রাইভেসিটাকে গুরুত্ব দিয়েই বিরক্ত করিনি। দেখি না একটু অপেক্ষা করে। যদি ওর কোনোরকম ফিলিংস তৈরি হয়ে থাকে আমার প্রতি তাহলে নিশ্চয়ই ও নিজেই কল করবে। নাহলে সরে আসবো আমিই ধীরে ধীরে। কাবেরী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কষ্ট হচ্ছে না রে? আসলে অহনা এমনিই ব্যতিক্রমী চরিত্র যাকে সাধারণ ছাঁচে ফেলতে গেলেই সব ওলটপালট হয়ে যায়।
তাই ধৈর্য্য তোকে ধরতেই হবে। জানিস অহনাকে আমার কেন পছন্দ হয়েছিল? অহনার মধ্যে সততা আছে স্বচ্ছতা আছে, লুকানোর প্রবণতা একেবারেই নেই। সর্বজনসমক্ষে ও সত্যি বলতে ভয় পায় না, তাতে ওর ইমেজ ম্যালাইন হলেও নয়। আমরা পারবো বল?
নৈঋত বললো, এই যে কলেজে স্টুডেন্টদের সামনে গিয়ে কনফেস করলাম টিজিংয়ের আগেই এর কারণ কিন্তু অহনা। ওই বলেছিল, সত্যিটা নিয়ে লোকজন একদিন আলোচনা করবে, কিন্তু মিথ্যে নিয়ে ফিসফিস চলে আজীবন। তাই সাময়িক ভয় করলেও স্পষ্ট অপ্রিয় সত্যের পক্ষে সব সময় থেকো নৈঋত। কলেজে গিয়ে সত্যিটা বলবে, দেখবে কেউ তোমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে না পরের দিন থেকে। জানো মা ভয় করছিল, খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, মনের মধ্যে চলছিল দোলাচল। তারপর ভাবলাম দেখাই যাক না, অহনার পরামর্শ মত চলে কি হয়। দেখলাম, অদ্ভুত রকমের সাকসেসফুল হলাম আমি। এ কদিন নিশ্চিন্তে কলেজ যাচ্ছি। কোনো সংকোচ নেই, নেই লুকোচুরি, বরং স্বাভাবিক হয়ে গেছে সবাই। যদিও অহনার মত আমার সাহস নেই, নেই সত্যি বলার ক্ষমতা। তাই সেদিন বিয়ের আসরের অরিজিনাল ঘটনাটা বলতে পারিনি অহনার নির্দেশ মত। মিথ্যেই বলেছি কিছুটা, বলতে পারো ঢেকে রেখে। কিন্তু তবুও ফেস তো করতে পেরেছি এই পরিস্থিতিকে, এর পিছনে কিন্তু মহারানির অবদান আছে। কাবেরী হেসে বললো, জানি রে অহনার সঙ্গে যারা মিশবে তারা ওকে ভুলতে পারবে না।
জানো মা, মেয়েটার কি অসম্ভব জেদ গো। একার লড়াই একা লড়বে। হয়তো ওকে ডিজার্ভ করি না, হয়তো ও আমার লাইফ পার্টনার হবে না, তবুও আমি ওকে রেসপেক্ট করবো আজীবন। কাবেরী মনখারাপি গলায় বলল, খুব ইচ্ছে ছিল জানিস, এমন একটা নিয়ম ভেঙে নিয়ম গড়ার কারিগরকে নিয়ে আসবো মেয়ে করে। তাই তো গোটা বাড়ির বিরোধিতা করেও অহনার সঙ্গে তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম। অহনা আমাকে বুঝিয়েছিলো, কম্প্রোমাইজ আর অ্যাডজাস্টমেন্টের মধ্যে পার্থক্য কোথায়। খুব ফাইন একটা লাইন আছে জানিস ওই দুটো শব্দের মধ্যে, তাই বারবার কম্প্রোমাইজকে আমরা অ্যাডজাস্টমেন্ট ভেবে ভুল করি। অহনাই আমায় প্রথম বললো, আন্টি তোমার তো সব যোগ্যতা ছিল তাহলে কেন আজ আঙ্কেলের এতগুলো প্রমোশন হলো তোমার নয়, কারণ তুমি একতরফা কম্প্রোমাইজ করে গেছো। সংসারের জন্য, সন্তানের জন্য, যে সংসার বা সন্তানটা তোমাদের দুজনেরই। জানিস টুটাই, মেয়েটার মধ্যে না ছক ভেঙে ভাবার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আমাদের ভাবনা যেখানে গিয়ে ঠোক্কর খেয়ে থমকে যায়, সমাজ, লোকলজ্জার ভয়ে গুটিয়ে যায়, ওর ভাবনা সেখান থেকে সমস্ত জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে সূর্যের আলোর মত প্রকট ভাবে।
ওই ঘটনার পর অহনা একদিন কল করেছিল আমায়, বোধহয় ক্ষমা চাইবে বলে। আমি ফোনটা রিসিভ করিনি, আসলে ওর গলায় অপরাধী কণ্ঠস্বরটা ঠিক মানায় না, তাই শুনতে চাইনি। একদিন ফোন করতে হবে মেয়েটাকে। নৈঋত নরম গলায় বলল, কাবেরী আন্টির প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা।
অনু, শুভ, তুতান ছিল কদিন বাড়িটা বেশ ভরে ছিল বল, চলে যাওয়ার পর আমাদের যে কে সেই। যে যার মত ব্যস্ত। ওহ, অহনার প্রোগ্রামটা আছে অনুকে একবার ফোন করে বলিস। পরে নাহলে আবার ঠোঁট ফোলাবে। আমি তোর পাশে না থাকলেও ও নিজে দাঁড়িয়ে অহনার সঙ্গে তোর বিয়ে দেবে বলে গেছে। এমনকি তার দাদার মাথাতেও কিছু ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে বোধহয়। নীলাদ্রিও সেদিন বললো, টুটাই কি অহনাকেই বিয়ে করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? আর যেন লোক হাসায় না, প্লিজ। ”ও মেয়ে এবাড়িতে ঢুকবে না”র মত বিদ্রোহী গলা আর নেই তোর বাবারও।
।।৩৬।।
আপনারা? আপনাদের তো ঠিক চিনলাম না। সুচেতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দীপশিখার দিকে।
অনিক সপ্রতিভ হয়ে বলল, আসলে মিস অহনা পাল আমাদের ইনভাইট করেছিলেন, উনি কি আছেন?
সুচেতা কিছু বলার আগেই অনিরুদ্ধ বললো, আপনারা যখন অহনার গেস্ট তখন ভিতরে আসুন। আমি অহনার বাবা অনিরুদ্ধ পাল। অনিক হাত জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিমা করে বললো, আমি আপনাকে বিলক্ষণ চিনি স্যার। যারা ক্রিকেট দেখে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসাবে আপনার নাম জানে না এমন মানুষ কমই আছে।
সুচেতা খেয়াল করলো, দীপশিখার চোখ দুটো গোটা বাড়িটাতে ঘুরছে। কাউকে যেন খুঁজছে। অনিরুদ্ধ বললো, অহনা তো এখন এই বাড়িতে নেই, সে কলকাতার বাড়িতে আছে। প্রিয়া বললো, জানি স্যার। অহনাদি আজকে ”রিয়েল লাইফ” প্রোগ্রামে লাইভে আসবে, আমি জানি। আমি ফোন করেছিলাম গত পরশু। আমাদের সকলকে লাইভটা দেখার জন্য রিকোয়েস্ট করেছে। অনিরুদ্ধ আর সুচেতা একটু অবাকই হয়ে গেল।
দীপশিখা, প্রিয়াঙ্কা আর অনিকের নাম কখনো অহনার মুখে শোনেনি। তাছাড়া এদের দেখেও মনে হয় না এরা অহনার খুব ক্লোজ কেউ। প্রিয়াঙ্কা সুচেতার দিকে নিজের অনামিকাটা তুলে দেখিয়ে বললো, এটা দিদি আমায় দিয়েছে।
অনিরুদ্ধ বুঝতে পারলো অহনা এদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তাই সামনের সোফায় বসে বললো, আপনারা কোথা থেকে আসছেন বলুন তো? মানে অহনা তো আমাকে ফোন করে কিছু বলেনি।
দীপশিখা ধীর গলায় বলল, আমি পীযুষ বিশ্বাসের স্ত্রী।
অহনা কদিন আগেই আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। ওর বেশ কিছু পুরোনো কথা জানার ছিলো, তাই আমার ভাসুরের কাছ থেকে সে সব জানে। আমায় ও কথা দিয়েছিল পীযুষকে ও জেলে ভরবেই। আমায় সমস্ত রকম অত্যাচার থেকে মুক্ত করবে। ও কথা রেখেছে, পীযুষ এখন জেলে।
সুচেতা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।
তার মানে অহনা পীযুষের বাড়ি অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। বাবার এক জুনিয়র কলিগ ছিল পীযুষের বড়দা, তার কাছ থেকেই বোধহয় অহনা সবটুকু জেনেছে। ওই ভদ্রলোক সবটুকু জানতো, একদিন বাবার কাছে এসে ক্ষমাও চেয়ে গিয়েছিল। ওর কথাতেই নাকি পীযুষকে বাড়ি রঙের কাজটা দিয়েছিল বাবা। ওই ভদ্রলোকই পীযুষকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
অনিরুদ্ধ সুচেতার দিকে তাকিয়েই বুঝলো ওর মনের মধ্যে কি চলছে। মেয়ে সবটুকু জেনে গেছে বুঝতে পেরেই মুখটা সাদা হয়ে গেছে সুচেতার। অহনা যে ওইটুকু সূত্র ধরে এতদূর পৌঁছে যাবে এত কম সময়ের মধ্যে সেটা অবশ্য ভাবতেই পারেনি অনিরুদ্ধ। আসলে পলিটিক্যাল বিটে কাজ করার জন্যই অহনার সোর্সগুলো কাজে দিয়েছে এক্ষেত্রে। তাই ও পীযুষকে খুঁজে বের করে ফেলেছে।
অনিক বললো, আমরা আসলে এখানে বিজয়চাঁদ অধিকারীর সঙ্গে মিট করতে এসেছিলাম। অহনাদি বলেছিল, উনি আপনার বাড়িতেই আছেন তাই….
অনিরুদ্ধ অন্যমনস্ক ভাবে বললো, বিজু? ও একটু বাজারে গেছে, এখুনি ফিরবে। আপনারা কি ওকে চেনেন? দীপশিখা বললো, চিনি, আমাদের একই পাড়ায় বাড়ি ছিল।
সুচেতা ফিসফিস করে বললো, অনি আমি কলকাতা ব্যাক করবো এখুনি। আমি অহনার কাছে যেতে চাই, প্লিজ।
অনিরুদ্ধ শান্ত গলায় বলল, সন্ধেতে অহনার প্রোগ্রাম আছে, তাই আমরা গেলেও ওর সঙ্গে দেখা হবে সেই রাতে। একটার মধ্যে লাঞ্চ করে নিয়ে স্টার্ট করবো, তাহলে পাঁচটার মধ্যে ঢুকেও যাবো ফ্ল্যাটে। ওর লাইভটা দেখতে হবে সূচী। ও নিজে যখন ফোন করে সকলকে দেখতে বলছে তখন অবশ্যই ওটা গুরুত্বপূর্ণ। সুচেতা বললো, হ্যাঁ আমাকেও পরশুদিন বললো, মা আমাদের চ্যানেলে ‘রিয়েল লাইফে’ আমি লাইভে আসছি, তুমি আর বাবা যেন দেখো। কেন গো অনিরুদ্ধ, ও হঠাৎ রিয়েল লাইফে আসছে কেন? তবে কি এসব সত্যি ঘটনা বলবে বলে?
অনিরুদ্ধ বললো, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। হয়তো চ্যানেল থেকে ওকে রিকোয়েস্ট করেছে, তাই।
অনিরুদ্ধর গলায় সেই জোরটা আপাতত নেই। অহনা যা সাহসী মেয়ে, হয়তো সবই বলতে শুরু করলো। সোশ্যাল স্ট্যাটাসের কথা কি একবারও ভাববে না মেয়েটা! মাথাটা বড্ড ঘেঁটে যাচ্ছে অনিরুদ্ধর। কি করতে চলেছে অহনা সেটা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনায় পড়েছে অনিরুদ্ধ।
বিয়ের আসর থেকে উঠে আসা, পীযুষ বিশ্বাসকে খুঁজে আনা, অভিরূপ সান্যালের হেল্প নিয়ে পীযুষকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া… সব হিসেব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। অনিরুদ্ধ ভেবেছিল, সুচেতার কষ্টটুকু ও জানুক। সত্যিটা জানুক ও। তার মানে এই নয় যে মিডিয়াতে কভার করবে বিষয়টা!
বিজয় বাজারের ব্যাগ হাতে ঢুকছিল বাড়িতে। দেখলো ড্রয়িংয়ে কয়েকজন বসে আছে। দেখেই আন্দাজ করলো দাদাবাবুর কাছে কেউ এসেছে। হয়তো কোন ক্লাবের ফিতে কাটতে যেতে হবে তার আব্দার নিয়ে। দাদাবাবু যে এখন এখানে ও তো কাউকে বলেনি, এ নিশ্চয়ই মানদার কাজ। একটা কথা যদি ওর পেটে থাকে! মনে মনে গজ গজ করতে করতেই ড্রয়িংয়ে ঢুকলো বিজু।
ব্যাগটা রান্নাঘরে রাখার আগেই গোটা ড্রয়িংয়ে ছড়িয়ে পড়লো সবজি, মাছ। ও কি ঠিক দেখছে? চেহারায় বেশ একটা পরিবর্তন এসেছে ঠিকই কিন্তু ওই চোখ, থুতনির তিল এগুলো যে এখনও একইভাবে অপরিবর্তিত। দীপশিখা? দীপার ঠোঁটটা কাঁপছে, কিছু কথা বলতে চাইছে হয়তো, পারছে না। প্রিয়াঙ্কা সবটা বুঝেই বললো, আঙ্কেল অহনাদি বলছিলো আপনাদের লাইব্রেরিটা নাকি দেখার মত, একবার দেখাবেন প্লিজ। সুচেতা ধীর পায়ে ওপরে উঠে গেল। অনিরুদ্ধ বললো, এসো।
অনিককে ইশারা করতেই ও চললো প্রিয়ার পিছন পিছন।
প্রিয়া পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল মায়ের ঠোঁটে ফিরে পাওয়ার হাসি আর চোখে হারিয়ে ফেলেছিলামের কষ্ট।
বিজয়কাকু অস্ফুটে বলে উঠলো, দীপা?
ওপরে লাইব্রেরিতে বসে দীপশিখা আর বিজয়চাঁদের জীবনের সবটুকু শুনলো সুচেতা আর অনিরুদ্ধ। শুনলো পীযুষ কি ভাবে দীপশিখাকে দিনের পর দিন অত্যাচার করেছে, কিভাবে প্রিয়াকে গালিগালাজ করেছে, মেরেছে।
অহনা নাকি ওদের বাড়িতে গিয়ে কথা দিয়ে এসেছিল, পীযুষকে আজীবন জেলে থাকার বন্দোবস্ত করবে, সেটাই করেছে। দীপশিখা বলেছে ওই কেসকে আরও জোরদার করতে এতদিনের অত্যাচারের জন্য মামলা করবে পীযুষের বিরুদ্ধে।
সুচেতা স্খলিত গলায় বলল, অনি, দীপশিখা যা পারলো, অহনা যা পারলো আমি কেন পারলাম না? যদি পারতাম তাহলে বোধহয় আমার জীবনটা অনেক সুন্দর হতো। একটা অপরাধী বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেবে ভেবেই রাতের ঘুম, জীবনের সুখ সব নষ্ট করেছি আমি। অনিরুদ্ধ বললো, আমি জানি, ঐজন্যই কেসটা মুভ করতে চেয়েছিলাম। তুমি তখন শোননি। যদি শুনতে তাহলে আমাদের রঙিন দিনগুলোকে ধূসর করে দিতে না ওই একটা রেপিস্টের জন্য। যা হবার হয়ে গেছে সূচী, তুমি যা পারনি তোমার মেয়ে তো তা পেরেছে।
সুচেতা বললো, কিন্তু অনি সেদিন যদি আমি রুখে দাঁড়াতাম তাহলে তো দীপশিখার জীবনটা এভাবে শেষ হতো না। প্রিয়ার মত একটা বাচ্চা মেয়ের বাবা সম্পর্কে ঘৃণা জন্মাত না। এগুলো সব ঘটেছে শুধু আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তে। আচ্ছা আমি দীপশিখা বা প্রিয়ার জন্য কিছু করতে পারি না?
অনিক আর প্রিয়া লাইব্রেরিতে ঘুরছিল, ঘরে ঢুকে বললো, সত্যি আঙ্কেল, দারুণ কালেকশন।
সুচেতা প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যে অনিককে বিয়ে করেছ সে তো তুমি বললে! তাহলে দীপশিখা এখন কোথায় থাকবে?
প্রিয়া বললো, মা আমাদের কাছেই থাকবে। আমরা একটা নতুন ফ্ল্যাট বুক করেছি রাইগঞ্জে। ওখানেই নিয়ে যাব। সুচেতা অনির দিকে তাকাতেই অনিরুদ্ধ বললো, প্রিয়াঙ্কা আমরা এই বাড়িটাতে থাকি না। ওই বছরে একবার হয়তো আসি। তুমি যদি চাও তাহলে তোমার মা বাকি জীবনটা বিজয়ের সঙ্গেও থাকতে পারে।
অনিক আর প্রিয়া চোখাচোখি করে বললো, এক্ষেত্রে মায়ের সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। মা গোটা জীবনটা বড্ড কষ্ট করেছে, এখন যদি মা তার গানের সঙ্গীকে খুঁজে পেয়ে ভালো থাকতে চায় আমাদের আপত্তি নেই। সুচেতা একটু হেসে বললো, দীপশিখা যদি রাজি থাকে তখন তুমি আর অনিক সপ্তাহে একদিন করে না হয় এসো মায়ের কাছে।
অনিরুদ্ধ ঘাড় ঘোরাতেই দেখলো, বিজু কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অনিরুদ্ধ বিজুকে একটু অপ্রস্তুত করার জন্যই বললো, বলো, কি আর্জি তোমার? কাজে বরখাস্ত দেবে নাকি?
বিজয় ততোধিক কাঁচুমাচু করে বললো, দাদাবাবু বড্ড অন্যায় করেছি দীপার সঙ্গে। ভগবান যখন এই বয়েসে এসে দেখা করিয়েই দিলেন তখন বাকি জীবনটা ভৈরবী, ইমন, ভূপালি নিয়েই কাটাবো ঠিক করলাম আমরা দুজনে।
তাই …..
অনিরুদ্ধ বললো, তাই এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবে নাকি?
বিজয়চাঁদ হাত কচলাতে কচলাতে বললো, যদি আপনি অনুমতি দেন তবে।
অনিরুদ্ধ হেসে বললো, যদি অনুমতি না দিই তবে কি করবে, দীপশিখাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে?
বিজয় কিছুই না বলে দাঁড়িয়ে ছিল।
অনিরুদ্ধ অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ইয়ংম্যান আমি আজই কলকাতা বেরিয়ে যাচ্ছি, তাই আমার একটা কাজ তোমায় করে দিতে হবে। সূর্যপুর বাজার থেকে একটা খুব ভালো কোয়ালিটির স্কেলচেঞ্জার হারমোনিয়াম তোমায় কিনে এনে দিতে হবে। আমি টাকা দিয়ে যাচ্ছি।
আমার এই শখের বাড়িতেই যেন সকাল সন্ধে গানের রেওয়াজ চলে। বিজু একটু অবাক হয়ে বলল, দীপাও থাকবে এখানে? অনিরুদ্ধ বললো, দেখো বিজয়চাঁদ এসব আমার প্ল্যান নয়, এসব এবাড়ির কর্তীর আদেশ। যা বলার বৌদিমনিকে বলো।
দীপশিখা কোনো কথা না বলে সুচেতার হাতটা ধরে বলল, কে বলে মেয়েরা মেয়েদের শত্রু? মেয়েরাই তো মেয়েদের অন্তরের উপলব্ধি বুঝতে পারে।
অনিক বিজয়কে বললো, কাকু আমি নিজে আন্টিকে পৌঁছে দিয়ে যাবো মাস খানেক পরে, কারণ আমরা যতদিন না ফ্ল্যাটটা পাচ্ছি, ততদিন বাড়িতে প্রিয়া একা থাক এটা আমি চাই না। আমাদের ফ্ল্যাটটা পেতে হয়তো এখনো একমাস মত লাগবে। যদিও রেডি ফ্ল্যাট বুক করেছি আমরা, তবুও পজেশন পেতে এইটুকু সময় লাগবেই। বিজয় হেসে বললো, ততদিনে আমাকেও তো গানটা মন দিয়ে প্র্যাকটিস করতে হবে, নাহলে মাস্টারমশাইয়ের মেয়েকে শোনাবো কি?
সুচেতা কোনোদিন বিজুদাকে এত খুশি হতে দেখেনি, আজ যেন হাসি উপচে পড়ছে মুখে। দীপশিখার চোখের কোণে জল টলটল করছে। মনে হচ্ছে রাজ্য জয় করে ফেলেছে। ভালোবাসার মানুষটাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ ভাগ করে নিতে চায় সকলের সঙ্গে। কত অল্পে খুশি এরা। এই মেয়েটাকে বিয়ে করে তিলতিল করে ধ্বংস করার সুযোগই পেত না পীযুষ, শুধু সুচেতার সাহসের অভাবে, কলঙ্কের ভয়ে ওই লোকটা এতদিন ঘুরছে খোলা হাওয়ায়। আর ও নিজে দিনের পর দিন আতঙ্কে শিউরে উঠেছে পুরোনো স্মৃতির দৌরাত্মে। দীপশিখার এই খুশিটুকু ফিরিয়ে দিতে পেরেছে শুধু অহনার জন্য। মেয়েটাকে একটিবার জড়িয়ে ধরে সূচী বলতে চায়, আমি কেন তোর মত করে ভাবতে পারিনি রে তিতির?
অনিরুদ্ধ বললো, বিজু, সকলের লাঞ্চের ব্যবস্থা করো তাড়াতাড়ি। আমরা আজই কলকাতা ব্যাক করছি।
দীপশিখা বিজুকে বললো, কবে থেকে এত দায়িত্ববান হলো বেখেয়ালে গানপাগল লোকটা?
বিজয় সকলের অগোচরে ওর হাতটা ধরে বলল, যবে থেকে তুমি চলে গেছো তবে থেকেই বুঝেছি, দায়িত্ব না নেওয়ার ফল কি হয়!
দীপশিখা বললো, আসলে কি জানো, অনাদর কষ্ট দেয় না, যন্ত্রণা হয় তখন যখন অসহ্য আদর পাওয়ার পরে অনাদর পাওয়া যায়। তোমার আদরে, আব্দারে থাকতে থাকতে বুঝতেই পারিনি অনাদর কার নাম, অবহেলা কাকে বলে? প্রিয়ার বাবার সংসারে গিয়ে বুঝলাম অবজ্ঞার যন্ত্রণাটা কি বীভৎস হয়।
বিজু বললো, পুরোনো কথা থাক। প্রিয়াঙ্কা তোমার মেয়ে, শুধু তোমার, তাই ও আমারও মেয়ে। দীপা আবার আমরা মালকোষের সুরে ভৈরবীর কথায় নতুন ভোর দেখবো। পুরোনো সব ভুলে বাঁচবো।
দীপশিখা বললো, অহনা মেয়েটা সাক্ষাৎ দেবী জানো, ওই আমাদের মিলিয়ে দিলো বুড়ো বয়েসে।
বিজু হেসে বললো, আমি একাই বুড়ো হয়েছি তুমি এখনো সেই ছোট্ট দীপা, যে আমার সাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো চুলের ফিতের আব্দার করবে বলে। দীপা সেই তরুণী বেলার মত ফিক করে হেসে বললো, ধ্যাৎ।
অনিক বললো, প্রিয়া, আন্টিকে এত খুশি দেখে আমার যে কি ভালো লাগছে তোকে কি বলবো। প্রিয়া ধরা গলায় বলল, দীপশিখার দীপটা বোধহয় এতদিনে একটু সাহস করে জ্বললো। ফিসফিস করে বললো, ভালো থেকো মা। সারাটা জীবন তো শুধু আমায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে গেলে, এবারে নিজের স্বপ্নগুলো একটু দেখো।
।।৩৭।।
অর্ধেন্দু সামনে এসে বললো, আর ইউ রেডি অহনা? আমরা স্টার্ট করতে পারি? অহনার গলাটা শুকিয়ে আসছে। হাতের তালু ঘামছে। ও জানে ওয়েলকাম ইন্ডিয়ার এই রিয়েল লাইফ অনুষ্ঠান মারাত্মকভাবে পুপুলার। ইনফ্যাক্ট ওদের চ্যানেলের সব থেকে হাইয়েস্ট টিআরপি যুক্ত প্রোগ্রাম এটা। তাই প্রায় গোটা বাংলা দেখছে ওকে। বুকের ভিতর ভয়টা শিরশির করে উঠলো। পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল লোহিতকনিকারা ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছে নিচের দিকে। নিজেকে সামলে নিলো অহনা। মায়ের মুখটা মনে পড়লো ওর। সবসময় চোখের কোণে একটা কষ্ট দানা বেঁধে থাকে মায়ের, ওই কষ্টের হদিশ ও এতদিন পায়নি। এখন বুঝতে পারছে মায়ের কষ্টটা কোথায়। শক্ত হলো অহনা।
অর্ধেন্দু আবার বললো, রেডি অহনা? আমাদের অ্যাঙ্কর রেডি। প্রান্তিক অনুষ্ঠানটা পরিচালনা করবে।
ক্যামেরা ওপেন হয়ে গেল।
প্রান্তিক বলতে শুরু করলো, রিয়েল লাইফ অনুষ্ঠানে আপনাদের সকলকে স্বাগত। আজকের অতিথি বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক অনিরুদ্ধ পালের সুযোগ্য কন্যা অহনা পাল। উনি নিজেও একজন সাংবাদিক। আমাদের ওয়েলকাম ইন্ডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন উনি। আজ উনি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবেন ওনার জীবনের গোপন কিছু কথা।
অহনা, পেশায় রিপোর্টার হয়েও কখনো কি মনে হয়নি, আপনি ব্যর্থ, জনগণের সামনে সঠিক নিউজ পৌঁছাতে পারছেন না কোনো বিশেষ কারণে?
অহনা বলতে শুরু করলো, শুধু রিপোর্টার নয়, সমস্ত মানুষই ভীষণভাবে ব্যর্থ পরিস্থিতির সামনে। মানুষের জীবনে এমন কিছু বাঁক আসে যখন সে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে যায় পরিস্থিতির সম্মুখে এসে। আমার বাবা অনিরুদ্ধ পালের জীবনেও এসেছিল এমনই একটা অন্ধকার সময়। যখন তিনি নামি রিপোর্টার হয়েও খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। ভালোবাসার কাছে নত হতে বাধ্য হয়েছিলেন।
নীলাদ্রি বললো, মেয়েটার বলার ভঙ্গিমাটা কিন্তু ভারী সুন্দর, ঔদ্ধত্য নেই, অহংকার নেই কিন্তু আত্মনির্ভরতা প্রকট। কাবেরী ধমক দিয়ে বললো, চুপ। এটা লাইভ হচ্ছে, পরে আর শোনার উপায় থাকবে না, চুপ করে শোনো।
কাবেরী ইচ্ছে করেই টুটাইকে ড্রয়িংরুমে ডেকে এনেছে। ওই ঘটনার পরে বাবা-ছেলের সম্পর্কের বরফটা এখনো ঠিকমত গলেনি। তাই কাবেরী চেয়েছিল, অহনাকে তিনজনেই একসঙ্গে দেখতে। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেবার তিনজনে একসঙ্গে নেবে। টুটাই বলেছিল, আমি আমার ঘরের টিভিতে দেখি মা। বাবার সামনে ইমোশনাল হয়ে পড়বো সেটা কি ঠিক হবে। আবার হয়তো বাবা এমন কিছু বলবে যে বিতর্ক হবে। তার থেকে তোমরা দেখো ড্রয়িংয়ে আমি ঘরেই দেখি। কাবেরীই জোর করে টুটাইকে এনে বসিয়েছে নীলের পাশে।
অনিরুদ্ধ পাল তখনও সেলিব্রিটি নন, তবে সিনিয়র সাংবাদিক। তার সঙ্গে আলাপ হয় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী সুচেতা মিত্রের। সুচেতা রাইগঞ্জ নামক মফস্বলের মেয়ে। বাবা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কৃতী ছাত্রী হিসাবে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। এই অবস্থায় পরিচয় হয় অনিরুদ্ধর সঙ্গে, দীর্ঘ বছর প্রেমের পর যখন দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে তখনই সুচেতার জীবনে নেমে আসে মারাত্মক বিপর্যয়।
মা, অহনাদি কি বলছে গো? বাবা অহনাদির মাকে রেপ করেছিল? ছি ছি ওই লোকটার আর কি কি গুন আছে বলতে পারো? অনিকের সামনে দাঁড়াতেই যে লজ্জা করছে আমার। প্রিয়াঙ্কার দিকে তাকিয়ে দীপশিখা বললো, আমাকেও তো ওই মানুষটা সারাটা জীবন রেপ করেই গেলো রে। সুচেতাকে বিয়ের আগে আর আমাকে সার্টিফিকেট নিয়ে রেপ, এটুকুই যা পার্থক্য।
আসলে কি জানিস, এই মানুষটার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। প্রিয়াঙ্কা টিভির দিকে চোখ রেখে মায়ের কোল ঘেঁষে বসলো। মা, আমার কেমন একটা ভয় ভয় করছে।
দীপশিখা বললো, আর ভয় কি রে, ওই যে টিভিতে দেখেছিস না স্বয়ং মা দুর্গা এসেছেন। ওই তো বধ করবে পীযুষরূপী অসুরগুলোকে।
প্রান্তিক বিস্মিত গলায় বলল, তারপর? অনিরুদ্ধ পাল বা শিক্ষিকা সুচেতা মিত্র কোনো কেস করেননি ওর বিরুদ্ধে? এমন জঘন্য ক্রাইম মেনে নিয়েছিলেন একজন মিডিয়ার মানুষ হয়ে? গলাটা ঝেড়ে নিয়ে অহনা বললো, বললাম না মানুষ কখনো কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন যখন সে সবচেয়ে অসহায়। অনিরুদ্ধ যখন জানতে পারেন সুচেতার ওপরে এমন একটা অন্যায় হয়েছে তখন রাইগঞ্জ থানায় পৌঁছেছিলেন, পীযুষ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কেস করবেন বলে। নিজের স্ত্রীর ওপরে হওয়া অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে আগ্রহী ছিলেন অনিরুদ্ধ, নিজের সম্মানের ভয় না করেই। কিন্তু ঠিক সেদিনই সুচেতার বাবা মারা যান, সেরিব্রাল অ্যাটাকে।
সোহম টিভির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললো, চিরটাকাল আমি সূচীকে ভুল বুঝে গেলাম। সূচীও কোনোদিন মুখ ফুটে বলেনি, দাদা তুই অন্যায় করছিস আমার কোনো দোষ নেই। নিজেদের সম্মান বাঁচাতে ওই লম্পটটার সঙ্গে নিজের বোনের বিয়ে দিচ্ছিলাম আমি! একবারও তলিয়ে ভাবিনি, পীযুষ কখনো সূচীর মত শিক্ষিত মেয়ের পছন্দ হতে পারে না। এমনকি অনিরুদ্ধর মত ভালো ছেলেটাকেও ভুল বুঝেছিলাম। কেন আমি এমন করলাম গো? সোহমের স্ত্রী উদাস গলায় বললো, আসলে মেয়েদের মনের খবর কেউ নেয় না। দাদা, বাবা, প্রেমিক, স্বামী কেউ নয়। তবুও তো সূচী খুব লাকি, যে অনিরুদ্ধদার মত স্বামী পেয়েছে। সোহম নিজের চুলের মুঠিতে হাত ঢুকিয়ে বললো, সেই ছোট্ট থেকে সূচীটা কেবল সহ্য করেই গেল। ক্ষমা করিস বোন।
বাবার মৃত্যু সংবাদে ভেঙে পড়েছিলো সুচেতা। তারপর সে চায়নি তার শিক্ষিকার ইমেজে কালি পড়ুক। কারণ আজও আমাদের সমাজে রেপিস্টের সবটুকু দায় ভিক্টিমকেই বইতে হয়। আঙুল ওঠে তার পোশাকের দিকে অথবা তার চরিত্রের দিকে। পুরুষের বিকৃত কামের দোষ তো আইন আদালতে মাথা খুঁড়ে পেতে হয়। মানুষের আদালতে তো দোষী সাব্যস্ত হয়েই যায় মেয়েটা। তাই সুচেতা আর চায়নি পীযুষকে নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে।
কাবেরী বললো, বলেছিলাম না কোনো কারণ ছাড়া অহনা বিয়ের আসর ছাড়েনি। এই সত্যিগুলো খুঁজে বের করে সকলের সামনে স্পষ্ট গলায় বলার জন্য যে ক্ষমতার দরকার হয় সেটা সকলের থাকে না। ও চায়নি আমাদের লুকিয়ে যেতে, তাই বাধ্য হয়েছিলো বিয়েটা ভেঙে দিতে।
নীলাদ্রি বললো, তুমি চুপ করবে? ওর কথাগুলো শুনতে দাও। আমি শুধু মেয়েটার সাহস দেখছি। এমন অকপটভাবে বলছে কি করে?
নৈঋত মনে মনে বললো, এগুলো আমাকে বললে কি খুব অন্যায় হতো? কি ভেবেছিলে? হাতটা ছেড়ে দেব? বড্ড স্বার্থপর তুমি তিতির, ভালোবাসার দাবিটুকুও বোঝ না।
এরপর খুব স্বাভাবিক ছন্দেই চলছিল অনিরুদ্ধ আর সুচেতার জীবন। সুচেতা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল, অনিরুদ্ধর ভালোবাসাই ওকে ঘন অন্ধকারের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করছিল। অনিরুদ্ধ আর সুচেতা মেতে ছিল নিজেদের কর্মজগৎ আর তাদের একমাত্র মেয়ে আমাকে নিয়ে। এতক্ষণ পর্যন্ত আমার উপস্থিতি ছিল না আপনাদের সামনে, এবারে আমি বলবো আমার কথা। ছোট্ট থেকে মায়ের শাসনে আর বাবার আদরে আমি বড় হয়েছি। লোকে বলে আমি জেদি, ব্যতিক্রমী। আমি বলি, মানুষ সাদা চোখে যেটা দেখতে অভ্যস্ত নয় সেটাকেই ব্যতিক্রমী বলে চিহ্নিত করে দেয়। আসলে দিনের পর দিন একই ধারায় জীবন কাটাতে কাটাতে মানুষ ভুলে গেছে কোনটা করা উচিত। তাই কেউ সামান্য সত্যি কথা বললে তাকে সাহসী বলা হয়। কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাকে বলা হয় প্রতিবাদী। মিথ্যের আবরণে আর মেরুদণ্ডহীনতার মুখোশে ঢেকে রাখতে রাখতে মানুষ ভুলেই গেছে মিথ্যে বলাটা অন্যায়, তার জন্য সাহস লাগে, সত্যি বলার জন্য সাহসী হতে হয় না, সৎ হলেই চলে।
যাই হোক, আমি ছোট থেকেই সাহসী আর প্রতিবাদী নামেই পরিচিত হচ্ছিলাম, তাই আমার বাবা হয়তো ভয়ে ভয়েই আমায় নাচ-গানের পরিবর্তে মার্শাল আর্টে ভর্তি করে দেন। জানি না কেন ইউনিভার্সিটি টপার হয়েও গভরমেন্ট সার্ভিসের ইচ্ছে বাদ দিয়ে রিপোর্টার হওয়ার ইচ্ছে জাগলো! আমার মা বলে, আমি নাকি বাবার দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হই। তাই বাবার পেশাটাকেই বেছে নিয়েছিলাম নিজের পেশা হিসেবে। আমার বাবা অনিরুদ্ধ পাল ইস এ রিয়েল সুপার হিরো, তাই তাকে অনুসরণ করবো সেটাই স্বাভাবিক।
অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে সুচেতা বললো, চিরকালের বাপসোহাগী মেয়ে। অনিরুদ্ধর চোখে জল। কত বড় হয়ে গেল আমার মেয়েটা, কি সুন্দর গুছিয়ে বলছে দেখো। ঋজু ভাঙ্গিমায়। সুচেতা অনিরুদ্ধর হাতটা ধরে বলল, আমার তিতির তাহলে আমায় ভুল বোঝেনি বলো? নিশ্চয়ই বুঝেছে ওকে কেন কিছু বলতে চাইনি। অনিরুদ্ধ বললো, এমন বুদ্ধিমান মেয়ে কি ভুল বুঝতে পারে গো?
আমার মা একজন কলেজের প্রফেসরের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করলো। রেপুটেড ফ্যামিলি, অত্যন্ত ভদ্র ছেলে। আমি বিয়েটা করতে চাইনি। বলেছিলাম, আর কয়েকদিন পরে করবো। কিন্তু মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল, তাই আমিও রাজি হয়ে যাই। বিয়ে ঠিক হবার কদিন পর থেকেই আমার ফোনে আসতে শুরু করে কল আর মেসেজ। আমার জীবনের এমন গোপন ঘটনা নাকি সে জানে যেটা শুনলেই আমার বিয়েটা ভেঙে যাবে। তাই তাকে দশলক্ষ টাকা দিতে হবে মুখ বন্ধ রাখার জন্য। অনিরুদ্ধ পালের কাছে দশলক্ষ টাকা হয়তো তেমন কিছুই নয়, কিন্তু আমি চাইনি কাউকে জানাতে। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করা আমার স্বভাবে নেই। যদি সত্যিই কিছু থাকে আমার অতীতে সেটাকে সামনে আনা আমারই কর্তব্য। তাই সমস্ত সোর্স কাজে লাগিয়ে জোগাড় করি পীযুষ বিশ্বাসকে। পীযুষের সূত্র ধরেই জানতে পারি এই এতক্ষণের বলা সমস্ত ঘটনাগুলো।
বিয়ের রাতে একটা ছোট্ট চিরকুট পাই, আমার শ্বশুরবাড়ির লোককে নাকি জানিয়ে দেবে আমার মায়ের কেচ্ছা। বিয়ের আসর থেকে উঠে আসি। সিদ্ধান্ত নিই সত্যিটা জানবো কারোর সাহায্য ছাড়াই। খুঁজতে খুঁজতে আমি দেখতে পাই, যে রাতে সুচেতাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাইগঞ্জ হসপিটালে এবং অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খাওয়ার জন্য ওর স্টমাক ওয়াশ করা হয়, তখনই ওর গর্ভাশয়ে একটি ভ্রূণের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন ডক্টররা।
সেইমত প্রেসক্রিপশনও লেখা হয়। হসপিটালের পুরনো স্টাফের কাছ থেকে আমি আবিষ্কার করেছি তার কপি।
আমার সন্দেহ ঘনীভূত হয়। কারণ সুচেতা আর অনিরুদ্ধর রেজিস্ট্রি ম্যারেজের ডেট এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে।
ভেবেছিলাম, যেহেতু সুচেতা আর অনিরুদ্ধর বিয়ের দীর্ঘদিন আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল, তাই হয়তো ওই ভ্রূণ তাদের ভালোবাসারই ফসল। তবুও সন্দেহ রয়েই গিয়েছিল। কারণ অনিরুদ্ধ প্রায় দুমাস দেশের বাইরে ছিল। পীযুষ বিশ্বাস আমায় ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে, শেষে কিডন্যাপ পর্যন্ত। আমি ওকে অ্যারেস্ট করাই। এবং পীযুষ বিশ্বাসের সঙ্গে নিজের ডি এন এ টেস্ট করাই সরলা নার্সিংহোমে।
সুচেতা অনিরুদ্ধর বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠে বললো, কি বলবে মেয়েটা? আমি আর পারছি না অনি।
অনিরুদ্ধ স্থির প্রস্তরমূর্তির মত তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। বুকের ভিতরটা থর থর করে কাঁপছে।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, পীযুষ বিশ্বাসের সঙ্গে আমার ডি এন এ ম্যাচ করে। অনিরুদ্ধ পাল আমার বায়োলজিক্যাল ফাদার নয়। কিন্তু আমার বাবা পীযুষ বিশ্বাস নয়। একটা সাময়িক অ্যাক্সিডেন্টের ফলেই আমি এসেছিলাম আমার মায়ের গর্ভে, কিন্তু তার মানে এই নয় আমি অযত্নের সন্তান। আমার বাবা-মা আর দ্বিতীয় সন্তান নেননি কারণ আমি যাতে কোনোভাবে নেগলেক্টেড না হই। আমি অনিরুদ্ধ পাল আর সুচেতা মিত্র পালের অত্যন্ত আদরের সন্তান। আমার বাবা আমার জন্য নিজের জীবনটা দিতে পারে, আমার মা আমায় হত্যা করেনি অবাঞ্ছিত ভেবে। বরং দুজনে একটা কথাই ভেবেছিল আমি একটা রক্তের ডেলা, আমাকে যে পাত্রে রাখা হবে তেমনিই আকার ধারণ করবো। তাই আমার সব আচরণ আমার বাবা অনিরুদ্ধ পালের মতই। আমায় দেখতে সুচেতা মিত্রর মত। আই রিপিট, আমি অহনা পাল, অনিরুদ্ধ পাল এবং সুচেতা মিত্রর একমাত্র সন্তান। রেপিস্টের একটাই পরিচয় সে একজন অপরাধী, সে বাবা হতে পারে না।
পীযুষ বিশ্বাসের নামে আপাতত গোটা তিনেক কেস সাজাতে পেরেছি, সুচেতা মিত্রর রেপ কেস, আমায় কিডন্যাপিং, ব্ল্যাকমেইলিং আর দীপশিখা মানে পীযুষের স্ত্রীর ওপরে ফিজিক্যাল টর্চার। দেখা যাক আমাদের দেশের আইন ওকে কত বছর জেল দেয়!
আজকে রিয়েল লাইফে আসার একটাই উদ্দেশ্য, ক্রাইমকে চেপে রেখে বাড়তে দেবেন না কলঙ্কের ভয়ে। তাতে দিনদিন ক্রাইম বাড়বে, তাই অপরাধীকে শেষ করুন, সত্যের মুখোমুখি হন। সত্যি লুকিয়ে রাখা কঠিন, সামনে আনা সহজ। এরপর হয়তো আমাকে অনেকেই ব্রাত্য করবে, হয়তো আমার আড়ালে চলবে ফিসফাস কিন্তু তবুও অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করবোই।
প্রান্তিক একটু ধরা গলায় বলল, হ্যাটস অফ ম্যাডাম। এগিয়ে চলুন, আমরা সকলে আছি আপনার সঙ্গে। লাইভ শেষ।
অর্ধেন্দু এগিয়ে এসে হ্যান্ডসেক করে বললো, আপনি আমাদের সাংবাদিকদের গর্ব। রিপোর্টারদের এমনই সাহসী হতে হয়, কিন্তু আমরা পারিপার্শ্বিক চাপে ক্রমাগত গুটিয়ে নিচ্ছি নিজেদের। স্যালুট অহনা।
কি হলো, কোথায় যাচ্ছিস টুটাই?
ঢাকুরিয়ায় যাবো মা।
নীলাদ্রি গম্ভীর স্বরে বললো, তোমাকে আর একা যেতে হবে না, আমরাও যাবো। কাবেরী রেডি হয়ে নাও।
কাবেরী শাড়ি পরতে পরতেই দেখলো, অনুর ফোন। রিসিভ করতেই কাঁদতে কাঁদতে বললো, বৌদি মেয়েটা কি ভালো গো। তুমি আর অমত কোরো না। অহনার সঙ্গেই টুটাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করো পরের মাসে।
কাবেরী গম্ভীর হয়ে বলল, অনু তাহলে স্বীকার করলে আমার পছন্দ ভুল নয়।
অনু একটু রাগ দেখিয়েই বললো, হ্যাঁ বাপু করলাম।
নৈঋতের মুখটা থমথম করছে। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই বললো, অহনা আমাকে অপমান করেছে মা। ও আমাকে খুব চিপ ভেবেছে। এর উত্তর ওকে দিতেই হবে। ওকে এমন ভাবার সাহস কে দিলো?
নীলাদ্রি বললো, এখন মাথা গরম করার সময় নয় টুটাই। অহনা এই মুহূর্তে খুব সেনসেটিভ পজিশনে আছে, তাই ওকে কোনো রুড ওয়েতে কথা বলো না প্লিজ।
কাবেরী দেখছিল নীলাদ্রির পরিবর্তনটা। মনে মনে বললো, তুমি কি জাদুকর অহনা, তুমি এভাবে মানুষের মনটাকে বদলে দিতে পারো?
নৈঋত ঠোঁটটা টিপে কষ্টটুকুকে গিলে নিলো। মনে পড়ে যাচ্ছিল ঢাকুরিয়ার ওদের ফ্ল্যাটের সেই সকালটা। ঘুম থেকে উঠে নৈঋতই অহনাদের কিচেনে গিয়ে দু-কাপ চা বানিয়ে অহনাকে নক করেছিল। অহনার চোখ লাল, বোঝাই যাচ্ছিল রাতে তেমন ঘুমায়নি। ওকে দেখে হালকা হেসে বলেছিল, গুড মর্নিং নৈঋত। রাতে ডিপ স্লিপ হয়েছিল? অনেকের নিজের বেড ছাড়া ঘুমই আসে না।
নৈঋত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, আমি সুখী মানুষ, যেখানে ফেলবে স্বপ্নে চন্দ্রভ্রমণ করে সাক্সেসফুলি ফিরে আসবো।
অহনা চায়ে চুমুক দিয়ে বলেছিল, বাহ, দারুণ চা বানাও।
নৈঋত মজা করে বলেছিল, বুঝতেই পারছো, আমার বউ কত লাকি হবে।
অহনা মজায় সাড়া না দিয়েই গম্ভীর স্বরে বললো, নৈঋত তুমি সকালেই ফিরে যাও বাড়ি। আমি আমার সঙ্গে তোমাকে আর জড়াতে চাই না। কারণ আমি জানি সত্যিটা জানলে তুমি হয়তো সরে যাবে, তখন অপমানিত হবো আমি। প্লিজ, আমি রিকোয়েস্ট করছি চলে যাও। কাবেরী আন্টির দৃঢ় বিশ্বাস একবার ভেঙেছি আমি, দ্বিতীয়বার তোমাদের পরিবারের রেপুটেশন নষ্ট করতে পারবো না। নৈঋত স্তব্ধ হয়ে দেখেছিলো অহনাকে। এতটুকু কাঁপেনি ওর গলা। অভিমানে বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে ছিল ও। তারপর বলেছিল, অদ্ভুত আইন তো? সত্যিটা জানার সুযোগ না দিয়েই আমি কি ভাববো তার রায় ঘোষণা করে দিচ্ছেন মাই লর্ড!
অহনা দৃঢ় গলায় বলেছিল, সত্যিটা জানার উপায় আমিই করে দেব তোমায়। তার আগে আর যোগাযোগ কোরো না। আমি ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি খেয়ে যেও।
নৈঋত শুধু বলেছিল, নো থ্যাংকস, আমি বাড়ি ফিরেই খাবো।
সেদিনের পর অজস্রবার অহনার হোয়াটসআপ চেক করেও একটা মেসেজ পাঠাতে পারেনি ও। শুধু অপেক্ষা করেছে, ধৈর্য্য ধরে থেকেছে অহনার ফোনের প্রতীক্ষায়।
অবশেষে গত পরশু ফোন করে শুধু বললো, ”ওয়েলকাম ইন্ডিয়ায়” সন্ধে সাড়ে সাতটায় ”রিয়েল লাইফ” প্রোগ্রামে লাইভ আসছি। বাড়ির সকলকে দেখতে বলো কিন্তু। আর তুমি তো অবশ্যই দেখো।
নৈঋত ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলেছিল, আমায় মনে রেখেছো জেনে খুশি হলাম। তো সত্যিটা জানার পরেও যদি আমার হাতটা বাড়ানোই থাকে তাহলেও কি ফিরিয়ে দেবে?
অহনা একটু হেসে বলেছিল, সত্যিটা ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর সেটা তো আগে শোনো, তারপর বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নেবে, না এগিয়ে দেবে সেটা ঠিক করো! নৈঋত ফাঁকা রাস্তায় একটু জোরেই হর্ন দিলো। মনে মনে বললো, আমার হাতটা বাড়ানোই আছে অহনা, তবে মনে জমেছে অভিমানের পর্দা। সেটা কিন্তু তোমাকেই ছিঁড়তে হবে।
নীলাদ্রি বললো, টুটাই এই ফুলের দোকানের সামনে একটু দাঁড়াস তো, আর কোনো চকলেটের দোকান পেলে বলিস।
কাবেরীর মনে পড়ছে অহনার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তটা। মেয়েটা যেন কালবৈশাখী ঝড়। সব চলতি নিয়মকানুনকে ভেঙে তছনছ করে দিয়ে গড়বে নিজের মত করে। কতটা সাহস থাকলে তবে গোটা দুনিয়ার সামনে এভাবে এক্সপোজড হতে পারে! কাবেরী মনে মনে বললো, এমন সাহস কেন ওর ছিল না?
ছোট পিসেমশাই যখন ক্লাস ফোরে ওর বুকে হাত দিয়েছিল তখন গাটা গুলিয়ে উঠেছিলো ওর। কেন ভয়ে, লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনি! কেন এক্সপোজ করে দিতে পারেনি পিসেমশাইয়ের আসল রূপটা! কারণ কাবেরী অহনা নয়। সবাই অহনা হতে পারে না।
নীলাদ্রি ফুল আর চকলেট কিনে গাড়িতে উঠলো।
বেল বাজাতেই দরজা খুললেন অনিরুদ্ধবাবু।
তিনজনকে এই অসময়ে একসঙ্গে দেখে বোধহয় একটু ঘাবড়ে গেছেন। নীলাদ্রিই বললো, কুটুম্বিতা করতে এলাম। ফিরিয়ে দেবেন না।
সুচেতাও এগিয়ে এসেছে। বিধ্বস্ত চেহারা। গালে এখনো শুকনো জলের রেখা। তাও ভদ্রতা করে বললো, ভিতরে আসুন প্লিজ।
কাবেরী ঢুকেই বললো, মহারানি কি এখনো ফেরেননি চ্যানেল থেকে?
অনিরুদ্ধ বললো, আমি কল করেছিলাম, বললো, গাড়িতে আছে, ফিরছে।
কাবেরী বেশ তৎপর হয়ে বলল, সুচেতা এসো তো একটু হাত লাগাও।
নীল অনেক ফুল কিনেছে। চলো বাড়িটা একটু সাজিয়ে ফেলি। তাকে ওয়েলকাম করার জন্য।
সুচেতার ঠোঁটে নরম হাসি খেলে গেল। বললো, আগে তোমাদের জন্য একটু কিছু স্ন্যাকসের ব্যবস্থা করি।
নৈঋত গম্ভীর ভাবেই বললো, আমি সুইগিতে অর্ডার করে দেব আন্টি। আপনারা বরং ধুপ, প্রদীপ, ফুল এসব দিয়ে ওই জেদি একগুঁয়ে মেয়েটাকে বরণ করার ব্যবস্থা করুন। নীলাদ্রি বললো, আঃ টুটাই কি হচ্ছে?
নৈঋত বললো, ভুল কি বললাম বাবা? বারংবার বলেছিলাম সঙ্গে রাখো, একা সবটা করতে যেও না। কে শোনে কার কথা।
অনিরুদ্ধ পিঠে হাত রেখে বললো, নৈঋত রাগ কোরো না, ওর মনের অবস্থাটা একবার বোঝো। আমরা যে এতবছর ওকে কিছুই বলিনি, এত বছর পরে ও জানতে পারছে আমি ওর বায়োলজিক্যাল ফাদার নই। বুঝতে পারছ কষ্টটা?
নৈঋত বললো, শুনুন আঙ্কেল আপনি মোটেই ওর পক্ষ নেবেন না। আমার মনের অবস্থাও যথেষ্ট খারাপ। কম টেনশন গেছে এই কদিন? আমার কাছে ওর একটাই পরিচয় ও অহনা, যাকে আমি ভালোবাসি, ব্যস।
বেলটা বাজছে দেখেই নৈঋত ঢুকে গেলো অহনার ঘরে।
করুক আদিখ্যেতা ওকে নিয়ে সবাই। কিছু করার দরকার নেই ওর।
অহনার ঘরের সামনের দেওয়ালে ওর একটা বেশ বড় ছবি টাঙানো আছে। অহনা মিষ্টি করে হাসছে তাতে। নৈঋত সেদিকে তাকিয়ে বলল, মোটেই তুমি এত মিষ্টি নয়, বড্ড ঝাল।
অহনা ফ্ল্যাটে ঢুকে একটু অবাকই হয়ে গেল। গেটের সামনে থেকে সুন্দর করে ফুল আর প্রদীপ দিয়ে সাজানো। রংবেরঙের কয়েকটা বেলুন ঝুলছে।
কাবেরী আন্টি বললো, আগে ওই চালের ঘটিটা উল্টে দাও অহনা, সৌভাগ্য উপচে পড়ুক এই সংসারে।
ফুলবিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে অহনা ঝাঁপিয়ে পড়লো বাবার বুকে। ফুঁপিয়ে উঠে বললো, বাবাই, তুমিই আমার বাবা, ওই রেপিস্টটা নয়। অনিরুদ্ধ বললো, ওমা এটা তো সবাই জানে। কাঁদছিস কেন পাগল মেয়ে। তোর মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, কচি বেলায় যখন তোর মা কিছুতেই কান্না থামাতে পারতো না তোর তখন আমি কি করতাম?
আমার হেড়ে গলায় গান গাইতাম আর তুই ফিকফিক করে হেসে ফেলতিস। তোর মা বলতো, অমন গান শুনে তোমার মেয়ে বোধহয় ভয় পেয়ে গেছে। সবাই তো জানে তুই বাপ সোহাগী মেয়ে। এ জন্য অবশ্য তোর মায়ের হিংসার শেষ নেই। সে যাকগে, কে হিংসা করছে দেখে আমাদের লাভ নেই। আমরা আমাদের গোপন সব পরামর্শ চালিয়ে যাব। সুচেতাকে জড়িয়ে ধরে অহনা বললো, তোমার আর কষ্ট নেই তো মা? গোপন করে রাখার বোঝাটা কমেছে? অপরাধীকে শাস্তি না দিতে পারার যন্ত্রণাটা কমেছে একটু?
সুচেতা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল, এর নামই প্রাপ্তি রে অহনা। আমি যেটা পারিনি সেটা তুই পেরেছিস। তৃপ্তি পেলাম শয়তানটা শাস্তি পাবে জেনে।
কাবেরী বললো, অহনা এখানে আরেক সেট বাবা-মাও উপস্থিত। বল, আমাদের বাড়ি পার্মানেন্টলি যাবি কবে?
অহনা চোখের জল মুছে বললো, মা, ডেটটা তুমি ফাইনাল করো। নীলাদ্রি অহনার মাথায় হাত রেখে বললো, আমাদের পুরোনো ভাবনার মূলে আঘাত করে চেতনা ফেরানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ অহনা। আমরা সবাই আছি তোমার পাশে। অহনা নিলাদ্রীকে প্রণাম করে বললো, তোমরা ডেট ফাইনাল করো…আমি চেঞ্জ করে আসছি।
ঘরে ঢুকেই দেখলো নৈঋত ওর ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। অহনা এগিয়ে বললো, রাগ করে আছো? সরি, তোমাদের বুঝতে আমারই ভুল হয়েছিল।
কি হলো, কথা বলবে না? হাতটা বাড়াবে না আমার দিকে? আমি অপেক্ষায় আছি….
নৈঋত ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, দেখো তো নতুন পারফিউম ইউজ করেছি, স্মেলটাতে কোনো ফিলিংস আসে কিনা?
অহনা মুচকি হেসে নৈঋতের বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বললো, একটাই অনুভূতি হচ্ছে, কেউ আমায় বড্ড ভালোবাসে।
নৈঋত ফিসফিস করে বললো,
রূপকথার রাজকন্যা নও তুমি
রূঢ় বাস্তবের নারী।
আমার স্বপ্নে এসো না তুমি লাল ঢাকাই পরে।
এসো কলমের আঁচড়ে সত্যের ছবি আঁকতে।
সাধারণ তুমি, তবুও অনন্যা।
রামধনুর আবেশে জড়ানো নও তুমি।
সূর্যের মত প্রখর, তপ্ত।
শুধু প্রেমে বা ভালোবাসায় নয়,
নিজের অস্তিত্বে মিশিয়ে নিতে চাই তোমায়।
আমার প্রতিটি রক্তকণিকায় মিশে যাক তোমার
শিরা উপশিরারা।
আমার নিত্যদিনের অভ্যাসে থাকুক তোমার একাধিপত্য।
অহনার ফোনটা বেজে উঠলো আচমকা….
তোর এ সকাল ঘুম ভেঙে দিতে পারি,
তোর এ বিকেল ঘুড়ি ছিঁড়ে দিতে পারি,
তোকে আলোর আলপিন দিতে পারি।
তোকে বসন্তের দিন দিতে পারি,
আমাকে খুঁজে দে জল ফড়িং…..
চমকে উঠে ফোনটা ধরতেই শুনলো, বাবা বলছে, একবার বাইরে আসবি তিতিরপাখি, আমরা তোদের জন্য ওয়েট করছি।
অহনা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, ছাড়ো, বাবা ডাকছে, চলো বাইরে চলো।
নৈঋত অহনার হাতটা ধরে বলল, তোকে খুঁজে দেব জলফড়িং।
.
সমাপ্ত