Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অন্ধকারের গল্প – অভীক সরকার

    লেখক এক পাতা গল্প133 Mins Read0
    ⤷

    আগুনপাখি

    ড্রাগনটাকে প্রথম দেখা যায় শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে। নেতাজির কাঁধের ওপরে বসেছিল।

    ননীগোপাল সাহার হোলসেল দোকানের উলটো দিকে যে বাংলু আর অন্যান্য দেশি মদের ঠেক আছে, তাতে মাঝরাত অবধি বেহুদ্দ বাওয়াল হওয়াটা নিত্যকার ঘটনা। ঠেকটা অবশ্য শিউপ্রসাদের, ঠেকের পেছনেই তার থাকার ঘর। দুপুর থেকে ঠেকের সামনেটা রাজ্যের মুটে, মজুর, কুলিকামিনে ভরতি হয়ে থাকে। রাত বাড়লে এদের সঙ্গে এসে যোগ দেয় দূরপাল্লার ট্রাকের ড্রাইভার, চোর-চিটিংবাজ, রিটায়ার্ড গরিব শিক্ষক, আর যত রাজ্যের মাগির দালাল। জায়গাটা তখন ভিড়ে, গন্ধে, ধোঁয়ায় আর খিস্তিতে নরকগুলজার হয়ে থাকে। যত রাত বাড়ে তত বাড়ে নেশা আর মাতলামি। দোকানের সামনেই তিরতির করে বয়ে যাওয়া খোলা নর্দমার পাশে একটা ব্রিটিশ আমলের বন্ধ্যা জলের কল আছে। বিকেল থেকে রাত দশটা অবধি তারই সামনে একটা ডালা নিয়ে উবু হয়ে ঠায় বসে থাকে মঞ্জুরা বেওয়া। ডালার আগায় জ্বলতে থাকে কেরোসিনের কুপি, তার লকলকে শিখা আর কালো ধোঁয়ার মধ্যে ডালায় শুয়ে থাকে ফুলুরি, চপ, ঠান্ডা ডালবড়া, শুকনো লংকা ভাজা, সিদ্ধ কাবলি মটর আর মুরগির মাথা ভাজা। নেশার মাথায় ডালাকে ডালা উড়ে যায়। লোকজন চাট কেনার অছিলায় মঞ্জুরাকে ঘিরে লুব্ধ চোখে দেখতে থাকে তার থাই আর দাবনা, চোখ দিয়ে চেটে খায় বড়ো বড়ো ডবকা মাই দুটো। খিলখিল কানাঘুষো চলে তার মাইয়ের সাইজ, কতটা টাইট আছে এ নিয়ে। একটা পিনকনের খাম্বা নামিয়ে এ বিষয়ে চাপা গলায় সুচিন্তিত মতামত দেয় হরিসাধন মাস্টার, “বুঝলি বাঁআ, মাগিরা অনেকদিন ঠাপনা খেলে মাল হেবি টাইট থাকে। বিশ্বাস না হলে মওকা দেখে একবার টিপে দেখ না বাঞ্চোৎ।” সেই শুনে কোনো কোনো রসিক নাগর লুঙ্গির ওপর দিয়ে ল্যাওড়াটা ডলতে থাকতে মঞ্জুরার গা ঘেঁষে বসে রসালাপের উদ্দেশ্যে, আর পরক্ষণেই ছিটকে পড়ে খিস্তি শুনে। এইসব হারামি পাগলাচোদাদের গাঁড়ে গরম শিক ঢুকিয়ে দিলে যে অন্তরের জ্বালা মেটে, থুতু ছেটাতে ছেটাতে সে কথাই বারবার বলতে থাকে মঞ্জুরা বেওয়া। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় উড়তে থাকে তার শুকনো চুল, রাগে ভারী বুক দুটো ওঠানামা করতে থাকে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে আরও অশ্রাব্য খিস্তি, থুতু, কফ আর রোজকার জমানো ঘেন্না আর রাগ। ভূলুণ্ঠিত আশিকটিকে দেখে আশেপাশের লোকজন সিটি মেরে হাততালি দেয়, দু-একজন এসে গাঁড়ে কষিয়ে দুটো লাথ মারে।

    তারপর শিউপ্রসাদ এসে এইসব বেউড়া পাবলিকের ঘেঁটি ধরে বাকি পয়সা উশুল করে, তারপর কানের গোড়ায় দুটো ঠাটিয়ে বলে, “মাদারচোদ, বহুত তেল হয়েছে দেখছি তোর, চল ফোট লওড়ে, কাল যদি ফির হুজ্জত করবি তো…”

    তারপর বমি, পেচ্ছাপ আর ফেলে যাওয়া শিশি বোতল পেরিয়ে গভীর রাতে মঞ্জুরা বেওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের ভেতরে যায় হাত-পা ধুয়ে পরিষ্কার হতে। অনেকক্ষণ ধরে পেচ্ছাপ করে, অনেকটা জল প্রায় সারা গায়ে ছেটায়, গার্গল করে আওয়াজ তুলে, গরম হয়ে যাওয়া কানের লতিতে জল ছোঁয়ায়। তারপর শাড়িটা খুলে কলতলায় ধুতে ধুতে খুঁধুঁ করে কাঁদতে থাকে, এসব নাপাক গুনাহ করার জন্যে আল্লার কাছে মাফি চায়। এবং তারপরে শাড়িটা বাইরে দড়িতে টাঙিয়ে দিয়ে শিউপ্রসাদের ঘরে এসে শায়া-ব্লাউজ খুলে, কুঁচকি চুলকোতে চুলকোতে বিছানায় শুয়ে পড়ে, দোকানের সামনের বসবার ভাড়া মেটাবার জন্যে।

    রোজকার ভাড়া রোজ।

    ততক্ষণে শিউপ্রসাদও দোকান বন্ধ করে, তার সামনে খবরের কাগজ জ্বালিয়ে আরতি করে ঘরে আসে, পাজামা আর ফতুয়া খুলে টাঙিয়ে রাখে আলনায়। তারপর প্রায় ঝাঁপিয়েই পড়ে মধ্যবয়সী শরীরটা নিংড়ে নেবে বলে। খানিকক্ষণের লদকালদকির পরে থুতু হাতে নিয়ে আন্দাজে মঞ্জুরার যোনিদেশে ঘষে, লাথি মেরে পা-দুটো দু-দিকে সরায়, আর মাতাল উগ্র ঝাঁজে নিজের দীর্ঘ লিঙ্গটি সেই শিথিল, বহুপ্রজ এবং সামান্য পিচ্ছিল যোনিপথে গ্রথিত করে দেয়।

    শিউপ্রসাদের স্পষ্ট মনে আছে যে, সেদিন ভোরবেলা মঞ্জুরা বেরিয়ে গেলে প্রথমে সে কলতলায় গোসল করে, তারপর ঘরে শিউজির ফোটোর সামনে নৈমিত্তিক প্রণাম নিবেদন শেষে কাচা পাজামা আর ফতুয়া পরে দোকানের জন্যে কিছু সামান কিনতে বেরিয়েছিল। সকালটা ছিল সাফসুতরা আর খুবসুরত।

    রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করছিল শিউপ্ৰসাদ, বহোত পাপ মহাদেও, বহোত বড়া পাপ। দেশের বাড়িতে বিবি বাচ্চাদেরকে রেখে দিয়ে এখানে একা একা থেকে এইসব কারোবার… তার ওপর এই বেগানা অওরতটার সঙ্গে রোজ এসব… ঠিক নয়, বিলকুল ঠিক নয়। খুব সম্ভবত শিউজির কাছে মাফি মাংবার জন্যেই সে মাথা তুলে তাকিয়েছিল আকাশের দিকে আর ঠিক তক্ষুনি সে ড্রাগনটাকে দেখতে পায়।

    প্রথমে শিউপ্রসাদ ভেবেছিল বহুত বড়া চমগাদড়, অর্থাৎ বাদুড় হবে বোধহয়। পরক্ষণেই প্রাণীটার গলা, মুখ আর ডানার বিস্তার দেখে সে হাঁ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে।

    ততক্ষণে মোড়ের গুমটির নীচে শুয়ে থাকা দু-একটা ভিখিরিও উঠে পড়েছে। তারাও পিচুটি ভরা চোখগুলো খুলে হাঁ করে এই লতুন চিড়িয়া দেখতে তাকিয়ে থাকে ওপরে। কিন্তু তাদের এই বিস্ময় বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, হইহই করতে করতে পরমুহূর্তেই এসে পড়ে দিনের প্রথম দুশো সাতাশ,

    আর তার পেছন পেছন একটা ফাঁকা সাতচল্লিশের-বি। দুটো বাসই সবেগে আসতে আসতে রাস্তার প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা শিউপ্রসাদের পেছনে এসে ক্যাঁ-এ-এ-চ করে দাঁড়িয়ে যায়। গরগর করতে থাকা দুটো বাস থেকেই গত রাতের খোঁয়ারি না-কাটা কনডাক্টর আর হেল্পাররা খিস্তি দিতে দিতে নেমে আসে, এই গাণ্ডু চুতিয়াটির গাঁড়ে লাথ মেরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে, আর তারপরেই বেশ কয়েক জোড়া চোখ নেতাজি মূর্তির মাথার দিকে চেয়ে স্থির হয়ে যায়।

    আর তারপরেই যেন এই পুরো পরিবেশকে এক গম্ভীর ব্যঞ্জনা দিতেই আসে দিনের প্রথম ট্রাম, শ্যামবাজারের ট্রাম গুমটি থেকে। রাস্তার মাঝখানে কয়েকটা উজবুক ওপরে মাথা তুলে কী দেখছে জানার জন্যে প্রবীণ সরকারি কর্মচারী ট্রামচালকটি ট্রাম বন্ধ করেন, তারপর তুড়ি দিয়ে হাই তুলতে তুলতে নেমে আসেন, অলস চোখে ওপরে তাকান, তারপর সেই বিশাল পক্ষীরাজকে দেখে বিরস বদনে ‘হেইইও হপ হপ’ করতে করতে একটা আধলা ইট ছুড়ে দেন।

    জবাবে সেই খগরাজ এক তীক্ষ্ণ ঘষা আর্তনাদে সমস্ত উত্তর কলকাতার গলিখুঁজি সচকিত করে তোলে, সঙ্গে ছুড়ে দেয় বিশাল গোলার আকারের আগুনে থুতু। মুহূর্তে পুড়ে যায় সেই শ্লথ গিরগিটির মতন অতিকায় প্রাচীন ট্রাম, আর্তনাদ করে জ্বলতে থাকে তার বেওকুফ প্রৌঢ় চালক। ড্রাগনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা আগুন স্রোতে মুহূর্তে জ্বলে ছাই হয়ে যায় শ্যামবাজারের আকাশ জুড়ে থাকা যাবতীয় ট্রামলাইন, ইলেকট্রিকের তার, বেআইনি হুকিং, ফুটপাথ দখল করে থাকা চট জড়ানো কাঠের গুমটি আর বিভিন্ন দাবিদাওয়া সম্বলিত ফ্লেক্স ব্যানার। জ্বলতে থাকে বিভিন্ন দোকানের সামনে ডাঁই করে রাখা ছেঁড়া কাগজ আর নোংরার স্তূপ। জ্বলন্ত কয়লার সাইজের আগুনের ফুলকি উড়ে এসে আছড়ে পড়ে শিউপ্রসাদের আশেপাশে। জ্বলতে থাকা সেই ট্রামচালকটি যেন কোনো সিনেমার অলৌকিক দৃশ্যের মতন দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন চারিদিকে, তারপর নেতাজি মূর্তির সামনের রেলিঙে ঠ্যাং ভেঙে পড়ে যান। বাঁশ ফাটার মতো শব্দ করে ফাটতে থাকে তাঁর হাড় ও খুলি। শুকনো বুড়ো লোকটা একটা বিচ্ছিরি অভদ্র লোকচিত ভঙ্গিতে মরে পড়ে থাকে।

    এতটা দেখার পর শিউপ্রসাদ খেয়াল করে যে সে পেচ্ছাপ করে ফেলেছে এবং ভিজে পাজামার মধ্যে থরথর করে কাঁপছে তার সবল হাঁটু দুটো। এবং সবিস্ময়ে সে এও আবিষ্কার করে যে সে মুখ বন্ধ করতে পারছে না, মুখ থেকে প্যারালিসিস আক্রান্ত রোগীর মতন অবিরত গড়িয়ে পড়ছে থুতু ও নাল।

    আর ঠিক তক্ষুনি সেই বিশাল ড্রাগন ডানা বিস্তার করে নেমে আসে নীচে, ঠিক শিউপ্রসাদের সামনে। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ঘামে ভেজা পইতেটা জড়িয়ে ধরে শিউপ্রসাদ, আর দাঁতে জিভে জড়িয়ে ‘রামচরিতমানস’ আওড়াতে থাকে। আর তারপর একবার চোখ তুলে চাইতেই…

    দুটো উজ্জ্বল হলদে চোখ দিয়ে দানোটা ওর দিকেই চেয়ে আছে। চোখের চারিদিকে লাল আভা, আর একটা ক্লান্ত ও শান্ত ধারালো চাউনি, নিষ্ঠুর এবং খুনে চাউনি

    গরুড়, ইনি পাক্কা গরুড়জি না হয়ে যান না।

    ‘রামচরিতমানস’ আবৃত্তি করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় বোধহয় মাথাও নাড়াচ্ছিল শিউপ্রসাদ। ড্রাগনটা বেশ কিছুক্ষণ ওর মাথা দোলানিতে আনন্দ পায় এবং ওর তালে নিজের ঘাড় দোলাতে থাকে, তারপর বিরক্ত হয়ে ফের উড়ে গিয়ে নেতাজির ঘোড়ার ওপর গিয়ে বসে।

    এর আধঘণ্টার মধ্যে সারা কলকাতা ভেঙে পড়ে শ্যামবাজারের মোড়ে। বিদ্যুতের মতন ছড়িয়ে যায় সেই খবর, আর আপামর বাঙালি পিলপিল করতে করতে বেরিয়ে পড়ে ড্রাগন দেখতে। আশেপাশের বিভিন্ন বিপজ্জনক বাড়ির ওপর থেকে আরও বিপজ্জনক ভাবে ঝুলতে থাকে সমগ্র হুজ্জত-এ- বঙ্গাল। তিলধারণের জায়গা থাকে না স্টার থিয়েটার থেকে ডানলপের মোড় অবধি, মণীন্দ্র কলেজ থেকে তেঁতুল তলা অবধি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। শাসক দলের ছেলেরা এরই মধ্যে সুশৃঙ্খল ভাবে লাইন মেইনটেইন করতে নেমে পড়ে। লাইনে সুসংবদ্ধ শান্ত স্থৈর্যের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়েন নাতির হাত ধরে দাদু, কোলের ছেলের মুখে মাই গুঁজে পাড়ার সবজিওয়ালি, আধুনিকতম মোবাইল হাতে স্পাইক চুলো যুবকটি, এবং সদ্যস্নাতা, হাতের ঝুড়িতে বেলপাতা, আকন্দ ফুল, কাঁচা দুধের ঘটিসহ কিছু প্রাচীনা বৃদ্ধাও।

    বলাবাহুল্য, এর কিয়ৎক্ষণ পরে সমস্ত টিভি চ্যানেল তাদের ওবি ভ্যান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই যুদ্ধক্ষেত্রে। টিভিতে প্রাজ্ঞ পণ্ডিতেরা সরকারের সামগ্রিক শাসনব্যবস্থার মুণ্ডপাত করতে থাকেন। ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে সেই আলোচনা দেখে ফেসবুকে উত্তেজনার আগুনে ঢেউ বয়ে দেন শহরবাসী। দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, লন্ডন, নিউইয়র্ক সব জায়গা থেকে আসা ফোনে সচকিত হয়ে ওঠে পুরোনো কলকাতার পুরোনো বুড়োবুড়ি ভরতি পুরোনো বাড়িগুলো। হোয়াটসঅ্যাপে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ে ‘কলকাতায় ড্রাগন’ সম্পর্কিত হাজারটা জোক্‌স শুধু একটা পোড়া ট্রাম আর পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া একটা মৃতদেহের ক্লান্ত দৃশ্য বারবার ফিরে আসে টিভির পর্দায়।

    শিউপ্রসাদ কিন্তু ততক্ষণে প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হিরো হিসেবে বেজায় সম্মান পাচ্ছে। তার বন্ধ ঠেকটির সামনে একটা বেঞ্চির ওপরে বসে আছে সে, মুখে সামান্য বিভ্রান্ত লাজুক হাসি। পেচ্ছাপে ভেজা পাজামা গায়েই শুকিয়েছে তার। চারিদিক থেকে সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরেছে তাকে, “কখন দেখলেন?” “আপ ক্যায়া কর রহে থে”, “ড্রাগন বলে চিনতে পেরেছিলেন?” “আপ পেহলে কভি ড্রাগন দেখে হ্যায়?” “আপনার কি মনে হয় এর পেছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাত আছে?”

    হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বলতে বলতে হালকা আত্মশ্লাঘা অনুভব করছিল শিউপ্রসাদ। এসব খবর ওয়গেরাহ এতক্ষণে নওয়াদা পৌঁছে গেছে, না? শিউজির মন্দিরের পাশে বরগত পেঢ়ের নীচে পঞ্চায়েত তো পাক্কা বসেই গেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা চেনা গন্ধ পায় শিউপ্রসাদ। পাশেই জান পেহেচান কেউ দাঁড়িয়ে আছে নাকি? কথা বলতে বলতেই আড়চোখে তাকায় শিউপ্রসাদ, শাড়ির আঁচলটা চিনতে ওর বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না।

    .

    প্রত্যাশা মতোই দুপুর নাগাদ আর্মি নেমে পড়ে অ্যাকশনে এবং এসেই নিপুণ হাতে সমস্ত পরিস্থিতির কন্ট্রোল নিয়ে নেয়। আগেই লাঠি মেরে ভিড় সাফা করে ফেলে তারা। তারপর পুরো এলাকাটা আঁটোসাঁটো করে কর্ডন করে ফেলে, এলএমজি এবং লাইট আর্টিলারিসহ এক প্ল্যাটুন নাগাসেনা মজুত হয়, সঙ্গে দমদমের বিভিন্ন মাঠে একটা করে কমব্যাট হেলিকপ্টার স্ট্যান্ডবাই করে রাখা। এলাকাবাসী সমঝে যায়, হুঁহুঁ, আর্মির সঙ্গে গাঁড় পিঁয়াজি নয় বাওয়া, নাগাসৈন্য দেখে শালা পাড়ার কুত্তাগুলো অবধি কোথায় লুকিয়েচে দেকেচ?

    ততক্ষণে শুধু ভারত নয়, পৃথিবীজোড়া লক্ষ কোটি নজর শ্যামবাজারের ওপর। বস্টন থেকে বেইজিং, মরিশাস থেকে মিউনিখ, রিয়াধ থেকে রিও ডি জিনেইরো সর্বত্র আজ থরথর উত্তেজনা। এই প্রথম একবিংশ শতাব্দীর চোখে, পরি নয়, ইউনিকর্ন নয়, শেষনাগ নয়, পক্ষীরাজ নয়, মৎস্যকন্যা নয়… চিন থেকে ইউরোপ অবধি কোটি লোকের বিভিন্ন কল্পকথায় যার অবাধ বিচরণ, সেই ড্রাগন! এইমুহূর্তে লক্ষ কোটি চোখ টিভির পর্দায় চোখ সেঁটে আছে এই অষ্টম আশ্চর্যটিকে দেখার জন্যে। তার প্রতিটি নড়াচড়া এই মুহূর্তে লক্ষ করছে কয়েক হাজার ক্যামেরা। আশেপাশের সমস্ত বাড়ির ছাদ ও জানালা এখন বিবিসি, সিএনএন আদি বিভিন্ন বহুজাতিক মিডিয়া কোম্পানির অধিকারে। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। ওদিকে সন্ধে নাগাদ টিভিতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী।

    ঠেকের পিছনে নিজের ঘরে বসে মঞ্জুরা বেওয়ার আনা চারটে রোটি, পিঁয়াজ দিয়ে ভাজা কুঁদরি আর আন্ডা কারি দিয়ে গোগ্রাসে খাচ্ছিল শিউপ্রসাদ। আজ স্বাভাবিকভাবেই ঠেক বন্ধ, সারা এলাকাতে একশো চুয়াল্লিশ ধারা। তবুও ফুরফুরে মনে স্প্রাইট, লেবু আর কাঁচা লংকা দিয়ে একাই একটা বাংলুর খাম্বা পেঁদিয়েছে সে, ভাগ্যিস মঞ্জুরা মনে করে কয়েকটা ডালবড়াও এনেছিল। সে নিজেও অবশ্য একটা পাইট নামাতে ছাড়েনি। তারপর নেশাটি তর হওয়াতে দুজনেই খেতে বসে।

    খেতে খেতে আড়চোখে মঞ্জুরার মাই দুটোর দিকে তাকায় শিউপ্রসাদ, আজকে ভেতরের জামা পরেনি নাকি শালি? খুব ঢলানি বেড়েছে ছেনালটার। এতগুলো লোকের সামনে…

    তারপর নিরাসক্ত সুরে শুধোয়, “এইসব খানা বানিয়ে কে আনতে বলেছিল তোকে? খুব জরুরত তো ছিল না।”

    খেতে খেতে একটানা নৈর্ব্যক্তিক স্বরে মঞ্জুরা বলে যে আজ তো পুরো এলাকা বন্ধ। আর শিউপ্রসাদ তো হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খায়। সে ভাবল লোকটার খাওয়া জুটবে না, তাই…

    নৌটঙ্কি শালা, আঁচাতে আঁচাতে ভাবে শিউপ্রসাদ। মাসের পাঁচদিন তাকে ভাড়াটা টাকায় নিতে হয়। সেসব মেরে দেওয়ার ফিকির নয় তো শালির?

    এসে দেখে মঞ্জুরা অভ্যেস মতন ব্লাউজ আর শায়া খুলে শুয়ে আছে। পাজামা আর ফতুয়া খোলে শিউপ্রসাদ, দড়িতে টাঙায়। তারপর বিছানায় উঠে অভ্যেস বশত মঞ্জুরার মাইয়ের বোঁটা দুটো নিয়ে খেলতে থাকে, আর জিজ্ঞেস করে, “আজ তো দুকান বনধ ছিল। তুকে তো বসতে হয়নি। কীসের কিরায়া দিচ্ছিস রে?”

    “শুধু কিরায়ার জন্যে শুতে আসি, কে বলল তোমাকে?”

    শিউপ্রসাদের সব একটু ধাঁধা লেগে যায়। তাহলে শালি কী করতে আসে বে?

    “আজ ভিতরির জামাটা পরিসনি? বেশরম অওরত, অত লোকের সামনে চুচি দুটো দিখাতে বহুত ভালোলাগে, না?”

    সেই নিঃস্পৃহ নিরাসক্ত সুরে জবাব দেয় মঞ্জুরা, “পরেই এসেছিলাম। এসে খুলে রেখেছি।” কেন বলতে পারবে না শিউপ্রসাদ, জবাব শুনে একটু হালকাই লাগে বুকের ভেতর। ফলে আজ সেই চির চেনা পুরোনো ভূমি কর্ষণ করার সময় শুধু অভ্যেস নয়, কিছু আদরও পেয়ে বসে তাকে।

    পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হয় শিউপ্রসাদের, মঞ্জুরা তখনও পাশে শুয়ে। উঠেই শুনতে পায় দুমদুম করে দরজা ধাক্কাচ্ছে কে। দ্রুত উঠে পাজামা আর ফতুয়া পরে নেয় শিউপ্রসাদ, গিয়ে দরজা খোলে। দেখে দুটো নাক চ্যাপ্টা আর্মির লোক দরজা ধাক্কাচ্ছিল, পাথর কোঁদা শরীর, ভাবলেশহীন চোখমুখ।

    “কমান্ডান্ট বুলা রহেঁ হ্যাঁয়, চলো।”

    বিস্মিত হয়ে যায় শিউপ্রসাদ, “কিউ? হামনে কেয়া কিয়ে?”

    “পাতা নেহি। অর্ডার হ্যায়। চলো।”

    “আরে, লেকিন কিঁউ ভাই? ওজায়হ তো বাতাও।”

    আর্মির লোক আদেশ বোঝে, প্রতিবাদ বোঝে না। ঝট করে একজন ঘাড় চেপে ধরে, সংক্ষিপ্ত আদেশ, “চলো”।

    দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে থাকে শিউপ্ৰসাদ, “আরে হামনে ক্যা কিয়ে ভাই, হামরা ক্যা কসুর?”

    পেছন থেকে আলুথালু বিস্রস্ত বেশে ছুটে আসে মঞ্জুরা, এসেই শিউপ্রসাদের হাত ধরে থাকা নাগা সোলজারটির হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে, “সক্কালবেলা লোকটাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস বে চুতমারানিরা, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে বলছি”, বলতে বলতে হিংস্র অন্ধ রাগে কামড় বসায় সেই হাতে।

    মুহূর্তের জন্যে শিউরে উঠে হাতের মুঠি আলগা করে সেই সৈন্যটি, তারপরেই এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় আছড়ে পরে মঞ্জুরার গালে। ঠক করে উঠোনের ওপর পড়ে যায় মঞ্জুরা, কষ বেয়ে ক্ষীণ রক্তস্রোত নেমে আসে।

    ভয়ে কাঁপতে থাকা শিউপ্রসাদকে নিয়ে ডানলপের দিকে দ্রুত ঘুরে যায় মিলিটারি জিপ।

    ডানলপ পুলিশ স্টেশনের একতলাটা খালি করে আর্মির স্পেশাল ইউনিট অফিস বসানো হয়েছে। সেখানে বসেই টিভি দেখতে দেখতে ভ্রূ কুঁচকে ভাবছিলেন মেজর সঞ্জীব ব্রার। চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে, কিন্তু ড্রাগনের নড়াচড়ায় বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। নেতাজি মূর্তির আশেপাশেই সে ঘুরঘুর করছে। কখনও নীচে নেমে আসে, ডানা গুটিয়ে কী যেন ভাবতে থাকে। তারপর এদিক-ওদিক দু-পা হেঁটে ফের মূর্তির ঘাড়ে চড়ে বসে। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে মুখ করে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে চেঁচিয়ে কাকে যেন ডাকে। উত্তর কলকাতার নিশ্বাস বন্ধ করে রাখা পড়ন্ত দুপুরে ছড়িয়ে পড়ে সেই বিষণ্ণ কান্নার মতন আওয়াজ।

    আর কর্ডনের ওপারে দাঁতে দাঁত চেপে অস্ত্র হাতে অপেক্ষা করতে থাকে এক প্ল্যাটুন সৈন্য, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ইন্ডিয়ান আর্মির স্পেশাল অপারেশনস গ্রুপ মার্কোসের একটা বারো জনের ছোটো ইউনিট। সবার ওপর কড়া নির্দেশ, একদম চূড়ান্ত আউট অফ কন্ট্রোল সিচুয়েশন ছাড়া একরাউন্ড গুলিও যেন ফায়ার করা না হয়। যে-কোনো মূল্যে এই প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা ছাড়া অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, সামান্য প্রভোকেশনেই দক্ষযজ্ঞ বেধে যেতে পারে তাতে বিপুল প্রাণহানি অনিবার্য।

    সারা পৃথিবী জুড়ে চূড়ান্ত উত্তেজনা। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা বারবার পরিস্থিতির খোঁজ নিচ্ছেন। খবরের কাগজে ড্রাগন ছাড়া আর কোনো খবরই নেই। সারা পৃথিবীর পক্ষী বিশেষজ্ঞরা চুল ছিঁড়ছেন ড্রাগনের খাবার, অভ্যেস ইত্যাদি কী হতে পারে তাই নিয়ে। আনন্দবাজারের বক্তব্য, সত্যজিতের কল্পনা মতন কোনো ডুংলুংডো হয়তো সত্যিই আছে, বা কোনো প্যারালাল ইউনিভার্স। এই ড্রাগন হয়তো সেখান থেকে কোনো ভাবে ছিটকে পড়েছে এই দুনিয়াতে। বিখ্যাত কবি ‘ড্রাগনের শিরদাঁড়া’ নামে একটি কবিতা লিখে ফেলেন ফেসবুকে, সে লেখা মুহূর্তে ভাইরাল। বহুল পঠিত শিশু সাহিত্যিক ঘোষণা করেন পরের পূজাবার্ষিকীতে তাঁর প্রকাশিতব্য উপন্যাসের নাম, ‘একলা ড্রাগন আর বুরুন’।

    তবে সবকিছু ছাপিয়ে সবার মনে একই জিজ্ঞাসা, ড্রাগনটা এল কোথা থেকে? কী চায়? কী কী করতে পারে? ও কি কাউকে বা কিছু খুঁজছে? ওকে কি ধরা হবে? বা আদৌ ধরা যাবে?

    আর সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন, যদি ধরা যায়, এর মালিকানা কার হবে!

    ভ্রূ কুঁচকে অন্য কথা ভাবছিলেন মেজর ব্রার। তাঁর কাছে অত্যন্ত উচ্চমহল থেকে অর্ডার এসেছে যে নেক্সট আট ঘণ্টা যে করে হোক ড্রাগনটাকে যেন কন্টেইন করে রাখা হয়, আর তার খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা হয়। সিঙ্গাপুর থেকে টাংস্টেনের অ্যালয় দিয়ে তৈরি বিশেষ খাঁচা আসছে, সঙ্গে একদল ট্রেইনড হান্টার, পশুপাখি জীবন্ত ধরায় যাদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত।

    পাক্কা খবর আছে মেজর ব্রারের কাছে, এই ড্রাগনটাকে ধরে চায়নার হাতে তুলে দেবে ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট। সেইমতোই কথা হয়েছে দুই দেশের প্রিমিয়ারের মধ্যে। ড্রাগন চাইনিজদের কাছে ঈশ্বরতুল্য প্রাণী। বদলে ইন্ডিয়া পাবে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার পথে চিনের বাধা হয়ে না দাঁড়ানোর আশ্বাস।

    এখন কথা হচ্ছে ড্রাগনটাকে খাওয়াতে যাবে কে? এসব কাজ সাধারণত কোনো চিড়িয়াখানার ট্রেইনড কর্মচারীদের করার কথা, কিন্তু আলিপুর জু-এর লোকজন শুনেই বেঁকে বসেছে। মেজর ব্রার জানেন যে ওয়েস্ট বেঙ্গল খুবই ধর্মঘটপ্রবণ এলাকা, ফলে জোরাজুরি করারও কোনো চান্স নেই। আর এরকম একটা ফালতু ব্যাপারে আর্মির লোকেদের লাইফের রিস্ক নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। একটা উপায় অবশ্য ভেবেছিলেন মেজর ব্রার, এখনও অবধি ড্রাগনের সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছে যে লোকটা…

    ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে যায় রুমের, বুটে বুট ঠুকে স্যালুট ঠুকে রিপোর্ট করে দুই নাগা জওয়ান, দুজনেই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে শিউপ্রসাদকে, বলির পাঁঠার মতন ঠকঠক করে কাঁপছে সে।

    মধুর হাসিতে ভুবন ভরিয়ে শিউপ্রসাদকে আপ্যায়ন করেন মেজর ব্রার, “আইয়ে শিউপ্রসাদজি। সুবাহ সুবাহ থোড়া তকলিফ দেনা পড়া…”

    *****

    একটু আলগা হয় ঘননিবদ্ধ কর্ডন, হাতে একটা বালতি নিয়ে কর্ডনের ভেতরে আসে যে লোকটা, দেখে মনে হয় কয়েক ঘণ্টাতেই তার বয়স বেড়ে গেছে অনেক। ধীরে ধীরে চপ্পল পরা পা-দুটো টেনে টেনে সে এগিয়ে যায় নেতাজি মূর্তির দিকে। চোয়াল শক্ত করে ট্রিগারে হাত রেখে অপেক্ষা করে এক প্ল্যাটুন সৈন্য। বারো জন কমব্যাট রেডি মার্কোস দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে ভাবলেশহীন চোখে দৃশ্যটা দেখে, যদিও শরীরের প্রতিটি পেশি আর নার্ভ অপেক্ষারত, নির্দেশ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে এক সেকেন্ডও সময় নেবে না। আশেপাশের সমস্ত ছাদ আর জানলা থেকে বুম ক্যামেরা রেডি, তাদের অপারেটরদেরও আঙুল ঘামতে আরম্ভ করে, ধীর হয়ে আসে নিশ্বাস।

    ড্রাগনটা প্রথমে শিউপ্রসাদকে দেখেনি। একবার একটা লেজের মোচড়ে নেতাজির ঘাড় ঘুরে বুকের দিকে আসতেই নজর পড়ে, আর ঠিক তক্ষুনি বিশাল ডানা বিস্তার করে নেমে আসে তার সামনে।

    শিউপ্রসাদ আবিষ্কার করে যে অনিচ্ছাতেই ফের তার হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে, হাঁটু দুটো মনে হচ্ছে এক্ষুনি ভেঙে পড়বে। খানিকটা হেঁটে থামে সে, তারপর মাথা তুলে তাকায়, আর দেখে যে গরুড়জি ফের কালকের মতোই ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, সেই লালচে-হলুদ খুনে দৃষ্টি।

    থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ‘রামচরিতমানস’ আওড়াতে থাকে শিউপ্রসাদ, আর ধীরে ধীরে ডান হাতটা বালতির মধ্যে ঢোকায়।

    একটা তীক্ষ্ণ শিসের মতন আওয়াজের সঙ্গে শিউপ্রসাদ দেখে যে ড্রাগনের পিঠ ধনুকের মতন বেঁকে উঠেছে ক্রোধে, দুনো ফুলে উঠেছে সারা দেহ, ঘাড়টা নীচু, আর গলার কাছটায় খেলা করছে আগুনে রক্তের স্রোত। চোখ দুটো দপ করে যেন জ্বলে উঠে রক্তবর্ণ হয়ে গেল, আস্তে আস্তে মুখটা হাঁ হচ্ছে আর শিউপ্রসাদ স্পষ্ট দেখছে যে গলা থেকে টাগরার দিকে উঠে আসছে লাল লাভার স্রোত…

    ডান হাত দিয়ে বালতির ভেতর থেকে একটা জবাই করা মুরগি বের করে শিউপ্রসাদ, তুলে ধরে ড্রাগনের চোখের সামনে।

    তারপর কয়েকটি শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত।

    একটু কি থমকে গেল সেই আগুনে প্রাণীটি? আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে তার শরীর। ডানা গুটিয়ে আনে শরীরের পাশে। ফিরে আসে তার স্বাভাবিক হলুদ চোখ। সেই চোখে কি কিছু বুভুক্ষাও দেখে শিউপ্রসাদ? নইলে যতটা শক্তি গায়ে ছিল সব একত্র করে কেন সে ড্রাগনের দিকে ছুড়ে দেবে সেই মৃত মুরগির শরীর?

    খানিকক্ষণ ধরে পালাক্রমে শিউপ্রসাদ আর পালক ছাড়ানো মুণ্ডহীন মুরগির দিকে তাকাতে থাকে সেই বৃহদাকার পক্ষীসম্রাট। তারপর ধীরে ধীরে, লম্বা সাপের মতন কাটা জিভ বার করে মুরগিটাকে মুখের মধ্যে টেনে নেয় সে।

    স্থির দাঁড়িয়ে থাকে শিউপ্রসাদ, আর-একটা মুরগি শূন্যে ছুড়ে দেয় সে, খেলার ভঙ্গিতে তাকে মুখে পোরে সেই ড্রাগন। তারপর আর-একটা। এবং আর-একটা।

    মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মোছেন মেজর ব্রার, “দ্যাট বাগার ডিড ইট। ফাক ম্যান, মেরি তো গান্ড লাগ গ্যয়ি থি…”

    এরপরে আরও ধীরে শিউপ্রসাদের কাছে এগিয়ে আসে সেই বিশালকায় খগরাজ। মাথা নামিয়ে আনে শিউপ্রসাদের মুখের কাছাকাছি। নিশ্চল ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শিউপ্রসাদ। ড্রাগনটা তার মুখ নামিয়ে আনে আরও নীচে I শিউপ্রসাদের মুখের একদম কাছাকাছি।

    ধীরে, অতি ধীরে, যেন এক প্রাগৈতিহাসিক নাটকের অন্তিম বিয়োগান্ত দৃশ্যের মতন, ড্রাগনের মুখ ছোঁয় শিউপ্রসাদের মুখ।

    কাঁচা রক্ত মেশানো এক অলৌকিক জান্তব ঘ্রাণের সঙ্গে কিছু উত্তাপও অনুভব করে শিউপ্রসাদ। হঠাৎ তার গলাটা যেন দপ করে জ্বলে ওঠে। জ্বলতে থাকে তার প্রতিটা রক্তকোশ, প্রতিটা লোমকূপ। তার সমস্ত শরীর জুড়ে যেন বইতে থাকে গলন্ত লাভাস্রোত। প্রতিটি শিরা-উপশিরা যেন জ্বলে ওঠে পাহাড়ি জুমচাষের পর জ্বালানো অগ্নিশিখার মতন। লালচে- হলুদ চোখ বন্ধ করে চৈতন্য হারায় শিউপ্ৰসাদ।

    *****

    গভীর রাতে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় মঞ্জুরার।

    সারাদিন শরীর ও মনের ওপর দিয়ে বড়ো ধকল গেছে তার। সকালে আর্মির লোকের হাতে থাপ্পড়টা খাবার পর দরজার সামনে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ছিল সে। তারপর ধীরেসুস্থে উঠে খানিকক্ষণ থুম মেরে বসেছিল উঠোনে।

    কিন্তু অপমানের থেকে পেটের দায় অনেক বড়ো। খিদে বড়ো অবাধ্য জিনিস, তার ব্যবস্থা দেখতেই হয়। তবে সুবিধে এই যে নয় নয় করেও এ ঘরের অনেক কিছুই চেনা তার। কেরোসিনের স্টোভ ধরায় সে; আনাজপাতির বাক্স হাতড়ায়। তারপর চালে-ডালে খিচুড়ি বানাতে কতক্ষণ?

    ফিরে এসে শুধু খিচুড়ি খাবে লোকটা?

    দোকানপাট সব এখনও বন্ধ। এদিক-ওদিক দেখে বেরিয়ে পড়ে সে, এবং আরজিকরের দিকে হাঁটতে থাকে। আর কপালগুণে ওভারব্রিজের নীচে একটা মোমবাতি জ্বালা, ছোটো, আধাখোলা, নোংরা গুমটি পেয়ে যায় সে। আঁচলের ময়লা খুঁট থেকে দশটা টাকা দিয়ে সেখান থেকে দুটো ডিম কিনে ফের শিউপ্রসাদের ডেরায় ফিরে আসে মঞ্জুরা।

    বিকেল নাগাদ যখন আর্মির লোকজন শিউপ্রসাদের আধা অচৈতন্য শরীরটা দিয়ে যায়, স্নান করে তখন মঞ্জুরা ঘরে চুপচাপ শুয়েছিল। মিলিটারি জিপের আওয়াজ শুনে আর তারপর দরজায় আওয়াজ হতে ছুটে যায়। বডিটা নেওয়ার সময় একটু চোয়াল শক্ত হলেও, কিছু বলেনি সে।

    “বেহোঁশ হো গ্যয়ে থে জনাব। বুখার ভি হ্যায়, লেকিন ডক্টরনে বোলা কলতক ঠিক হো যায়েগা। ইয়েহ লে, দওয়াই ভি লেকর আয়ে হ্যায়, অওর ইয়ে উসকা প্রেসক্রিপশন, সাম্ভহাল ইসকো। কমান্ডান্ট সাব বোলে হ্যায় জ্যায়াদা তকলিফ হোনে সে উনকো ফোন করনে কে লিয়ে, ইয়ে লে, নাম্বার লে।” বলে একটা কাগজ ধরা হাত এগিয়ে আসে মঞ্জুরার দিকে।

    সেই হাতে একটা নতুন ব্যান্ডেজ বাঁধা। হাতের অধিকারী জওয়ানটি যাবার আগে অবশ্য একবার লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে মঞ্জুরার শরীরটা মেপে নিতে ছাড়েনি। গায়ের আঁচলটা আর- একটু টেনে সে ভাবলেশহীন ভাবে দরজাটা বন্ধ করে শিকল তুলে দেয়।

    আর তারপরেই ছুটে এসে শিউপ্রসাদের গায়ে হাত দিয়ে দেখে প্রবল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার সমস্ত গা। কোনোমতে টানতে টানতে শরীরটা কলতলায় এনে ফেলে মঞ্জুরা। বহু কষ্টে ফতুয়াটা খোলে, আর পরম মমতায় অল্প অল্প করে জল দিয়ে মাথা ধুইয়ে দিতে থাকে।

    আর তখনই ব্যাপারটা লক্ষ করে সে। কয়েক ঘণ্টাতেই হাত দুটো কেমন দীর্ঘ ও স্ফীত হয়ে পড়েছে শিউপ্রসাদের। আঙুলগুলো অস্বাভাবিক মোটা আর লম্বা হয়ে গেছে, নখগুলো আরও বেড়ে হয়ে পড়েছে হিংস্র ও সূচালো। গায়ের চামড়া অত্যধিক খসখসে ও রুক্ষ, আবছা কিছু চৌকো চৌকো দাগ দেখা যাচ্ছে।

    তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটেছে মুখের সঙ্গে। মুখটা কেমন লম্বাটে আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ঠোঁট, নাক আর কপাল যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চুপসে গেছে রোজের মদ খাওয়ার চিহ্নস্বরূপ ভারী গাল দুটো।

    থরথর কাঁপতে থাকে মঞ্জুরা। হায় আল্লাহ, এ কোন্ রোগ বাঁধিয়ে এনেছে লোকটা? দোকানের কর্মচারীদের খবর দেওয়ার উপায়ও নেই, দিয়ে লাভও নেই, তারা আসতে পারবে না। একাই সেই অচৈতন্য শরীরটাকে ধরে ধরে ঘরে তোলে সে। ঘামে, জলে ভিজে জবজবে হয়ে যাওয়া শরীর থেকে জামাকাপড় খুলে দেয় সে, নতুন জামা পরায়।

    খানিকক্ষণ পর চোখ খুলে ধীরে ধীরে উঠে বসে শিউপ্রসাদ, হিসহিসানি মেশানো ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, “ভুখ লাগি হ্যায়, খানা লাগা।”

    লালচে-হলদে চোখ দেখে আশঙ্কায় বুক দুরু দুরু করে মঞ্জুরার। আজকের রাতটা কাটুক, কাল সকালেই হাসপাতালে নিয়ে যাবে সে। দরকার হলে আর্মির দেওয়া ফোন নম্বরে ফোন করেই।

    দুর্বল হাতে খিচুড়ি আর ডিমসিদ্ধ খেতে থাকে শিউপ্ৰসাদ, মোটা, ফুলে যাওয়া আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যেতে থাকে গরম খিচুড়ি। স্পষ্ট বোঝা যায় গিলতেও কষ্ট হচ্ছে তার, দু- একবার ওয়াকও তোলে সে।

    আর তখনই দেখতে পায় মঞ্জুরা।

    লোকটার দাঁতগুলো অমন বাঁকাট্যারা হয়ে উঠল কী করে? জিভটা অমন লম্বাটে আর লালচে দেখাচ্ছে কেন? জিভের মাঝখানেও কালচে দাগটা কীসের?

    কোনোক্রমে খাওয়া শেষ করে ওষুধ খায় শিউপ্রসাদ। বা খাইয়ে দিতে হয়। কোনোমতে হাত ধোয়। বা ধুইয়ে দিতে হয়। তারপর সে স্থির হয়ে খাটের ওপর বসে থাকে।

    “কী হল? বসে আছো কেন? শুয়ে পড়ো না”, ভয় লাগে মঞ্জুরার।

    “ওরা বলছে আমাকে যেতে হবে”, শিউপ্রসাদের গলা চিরে আসা হিসহিসে ঘষা আওয়াজ শুনতে কষ্টই হয় মঞ্জুরার, কিন্তু বক্তব্যটা না বোঝার বিস্ময় তাকে আরও বিচলিত করে তোলে।

    “কী হয়েছে বুঝলাম না। কারা কী বলছে? কোথায় যেতে হবে?”

    “চায়না যানা পড়েগা রে মঞ্জুয়া। উস চিড়িয়াকো খানা খিলানে কে লিয়ে, রোজ কা রোজ। উয়ো লোগ বহোত বড়া পিঞ্জরা লায়া হ্যায়, ইয়ে চিড়িয়া মহারাজ কো লে যানেকে লিয়ে। কল হি উসে লে যায়েগা, অওর মুঝে ভি যানা পড়েগা রে, ওয়সি হি অর্ডার আয়া হ্যায়।”

    দপ করে মাথাটা গরম হয়ে যায় মঞ্জুরার, “মগের মুলুক নাকি, অ্যাঁ? বললেই যেতে হবে? দেশে আইনকানুন নেই? গরমেন নেই? পেচ্ছাপ করি অমন অর্ডারের মুখে।”

    “অর্ডার আয়া হ্যায় রে, গবরমেন কা হি অর্ডার। আমাকে যেতেই হবে, কোই চারা নেহি হ্যায় রে। চিড়িয়াটা আমার হাতে খানা খায় যে।”

    “বললেই হল, কার বাপের কত হিম্মত দেখি জোর করে নিয়ে যায়। ওষুদ তো ওরা নিজেরাই দিয়ে গেল, জানে না তোমার শরিলের অবস্তা? এই জ্বরের মধ্যে… হারামির বাচ্চাদের কি মাথায় গোবর আছে নাকি?” ফুঁসতে থাকে মঞ্জুরা।

    “যানা পড়ে গা, যেতে হবে রে, আমাকে যেতে হবে, মাথা দোলাতে দোলাতে বারবার একই কথা সুর করে বলতে থাকে শিউপ্রসাদ। লম্বাটে হয়ে যাওয়া মুখটার ছায়া দেয়ালে পড়ে বীভৎস দেখায়। ঠান্ডা হিসহিসানির সুর অজানা অশুভ মন্ত্রের মতন ছড়িয়ে পরে প্রায়ান্ধকার ঘরে।

    গা-টা শিউড়ে ওঠে মঞ্জুরার, ধাঁধা লেগে যায় চোখে। এই লোকটাকে চেনে ও?

    হঠাৎ করে মাথা দোলানি থামায় শিউপ্রসাদ, “তুই যাবি আমার সঙ্গে? হাঁ রে মঞ্জুরা, চলেগি মেরে সাথ?”

    কলতলায় বাসন মাজতে মাজতে বিড়বিড় করে একবার মানত করে মঞ্জুরা, কাল ও নিজেই যাবে আর্মির সঙ্গে কথা বলতে, না হলে দিল্লি গিয়ে ধরনা দেবে। মগের মুল্লুক নাকি? সব ঠিক হয়ে গেলে আর লোকটা সেরে উঠলেই ও কুলতলির মাজারে চাদর দিয়ে আসবে। হায় আল্লাহ, কথা নেই বার্তা নেই এইভাবে কেউ কাউকে বাড়িঘর থেকে বার করে জোর করে অন্য কোথাও পাঠায় নাকি? হারামির গরমেন্ট শালা, বিড়বিড় করে মঞ্জুরা, তারপর নিজে খেয়েদেয়ে, বাসন মেজে, গুছিয়ে রেখে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

    রাত তখন ঠিক কটা বলতে পারবে না মঞ্জুরা, বুকের ওপর অভ্যস্ত হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে যায় তার। ঘুম চোখেই ব্লাউজের হুকগুলো খুলতে থাকে সে, একটু বিরক্তিও আসে। ব্যাটাছেলে মাত্রেই এইরকম, এত জ্বর লোকটার গায়ে, তাও দেখো আজকেও চাই। আরে পালিয়ে যাচ্ছে নাকি ও? শায়ার দড়ি খুলতে খুলতে ভাবে মঞ্জুরা

    পরক্ষণেই সাপের মতন মোচড় দিয়ে ওর বুকের ওপর উঠে আসে শিউপ্রসাদ, দু-হাত দিয়ে মঞ্জুরার গাল দুটো চেপে ধরে আর তার কর্কশ, তীব্র তপ্ত ঠোঁট দুটো নেমে আসে মঞ্জুরার ঠোঁটের ওপর। গভীরতম আশ্লেষে সে চুমু খায় মঞ্জুরার ঠোঁটে, চুষতে থাকে স্থূল ঠোঁট দুটি। আর সরু, দীর্ঘ হিলহিলে জিভ ঢুকিয়ে দেয় তার মুখে…

    আর দপ করে জ্বলে ওঠে মঞ্জুরার সারা শরীর। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি প্রতি রক্তস্রোতে বয়ে যায় শানিত লাভার নদী। মনে হয় কে যেন শরীরের খাঁজে খাঁজে মোমের মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছে। গলিত মোম ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে জ্বলতে থাকে মঞ্জুরার গলা এবং হাতের চেটো দুটি, পুড়ে যায় ঘাড় ও দুই বাহুমূল।

    দীর্ঘ চুম্বনের পর মঞ্জুরার নীচের ঠোঁটটা চুষতে চুষতে স্থির হয় শিউপ্রসাদ। লালচে-হলুদ চোখ মেলে সে তাকিয়ে থাকে শরীর দিয়ে ভাড়া মেটানো এই হাফগেরস্ত মেয়েটার দিকে, আর হাত দিয়ে তার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে।

    আর তার কয়েক সেকেন্ড পরেই দুই জোড়া চোখ খুলে যায় শিউপ্রসাদের চোখের সামনে।

    লালচে-হলুদ দুটো চোখ।

    তারপর বিছানায় দুটো লাভা স্রোতের শঙ্খ লাগে যেন।

    কীসের জন্যে ঘুম ভেঙে গেল প্রথমে বোঝেনি মঞ্জুরা। শুধু টের পায় গায়ে অসম্ভব জ্বর তার। শুকনো মরুভূমির মতন গলা বুক তার, যেন জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে। কোনোমতে উঠে বসে সে, মাথাটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। মেঝেতে রাখা জলের জাগটার দিকে আন্দাজে হাত বাড়ায় মঞ্জুরা, আর তক্ষুনি খোলা দরজা দিয়ে ঝাঁপিয়ে আসা পূর্ণিমার আলোয় দেয়ালে তার হাতের ছায়া পড়ে।

    কার হাত এটা? এই স্ফীত, বলিষ্ঠ, লম্বা হাতটা কার? এই কঠিন দীর্ঘ প্ৰেত নখরগুলি কার?

    আর চুল কই? তার মাথার দীর্ঘ কেশরাশি কোথায়? তার মুখটা অত দীর্ঘ দেখাচ্ছে কেন? তার চামড়া এরকম আঁশ-আঁশ হয়ে উঠল কী করে?

    মাথার ভেতরটা শূন্য হয়ে যায় মঞ্জুরার। কোনোমতে মেঝেতে পা রাখে। এবং টের পায় যে থরথর কাঁপতে থাকা পা-দুটির চেটো আরও থ্যাবড়া ও ছড়ানো হয়ে গেছে। লম্বা বাঁকানো নখগুলি মেঝেতে খররর খররর আওয়াজ তোলে।

    নির্বাক আচ্ছন্ন প্রেতের মতন উঠে দাঁড়ায় মঞ্জুরা। খসে পড়ে তার বসন ও আবরণ, এবং সে টের পায় যে এখন ও তার আতঙ্কিত হওয়া বাকি আছে।

    তার শরীরের দুই দিকে দুই বাহুমূল থেকে পিঠ জুড়ে এক মাংসল পর্দা গজিয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। দ্রুত সেই পর্দা দুটি বাড়ছে আয়তনে, আরও স্থূল ও শক্ত হয়ে উঠছে। এবং কোনো এক বোধ অলৌকিক দৈববাণীর মতনই দ্রুত তার অবচেতন থেকে চেতনে উঠে আসে, যে এই পর্দা দুটি সে ইচ্ছে করলেই নাড়াতে পারে।

    এই দুটি তার শরীরের অংশ।

    তার ডানা।

    থপথপ করে মেঝেতে শিউড়ে ওঠার মতন আওয়াজ তুলে সে বাইরে আসে, আর স্তম্ভিত বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

    ও কে দাঁড়িয়ে উঠোনে? দুদিকে বিস্তীর্ণ ডানা, মোটা লেজ ছড়িয়ে আছে দেহের একপাশ জুড়ে। লম্বা মুখ আর বলিষ্ঠ আঁশ-আঁশ হাত।

    ঠিক যেন নেতাজি মূর্তির ওপর বসে থাকা বড়ো আগুনপাখিটার মতন না?

    মঞ্জুরার পায়ের আওয়াজে এদিকে ফেরে সেই প্রাণীটি। লালচে-হলুদ চোখে মঞ্জুরার দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ, আর তারপর মুখ নাড়িয়ে কিছু ঘষা ফিসফিসানি আওয়াজ ছুড়ে দেয় সেইদিকে।

    এবং মঞ্জুরা স্পষ্ট বোঝে সেই শব্দসমষ্টি তার কানের পর্দায় পড়ে বোধগম্য ভাষা তৈরি করছে।

    আশ্চর্যের সঙ্গে মঞ্জুরা বোঝে যে প্রাণীটি তাকে বলছে, “চল রে মঞ্জুয়া, পালিয়ে যাই, যাবি? চল একসাথে পালিয়ে যাই চল।”

    তীব্র বিস্ময় আর আতঙ্কে দিশেহারা মঞ্জুরা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে যায়, “কোথায়? কোথায় যাব নিজের বাড়িঘর ছেড়ে?” এবং তার গলা থেকে অনুরূপ ঘষা ফিসিফিসানি ছাড়া কিছুই বেরোয় না।

    “উড়ে চল না, মঞ্জুয়া, চল না আমার সাথে। হাম দোনো তো অ্যায়সে হি আভি বেঘর, বেজাত হ্যায়। চল পালিয়ে যাই, এখান থেকে উড়ে যাই, চল উড়ে যাই, চল উড়ে যাই…” বলতে বলতে সেই প্রাণীটি এসে দাঁড়ায় মঞ্জুরার সামনে, দুটি বলিষ্ঠ হাত ও ডানা মেলে জড়িয়ে ধরে মঞ্জুরাকে।

    তার কিয়ৎক্ষণ পরে দুটি ড্রাগনের তীব্র ও তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দ ছড়িয়ে যায় উত্তর কলকাতার আকাশে। তাদের অব্যক্ত ক্রোধ, ঘৃণা আর অসহায়তা যেন আগুনে বিষ হয়ে মিশে যেতে থাকে সেই কালরাত্রির সঙ্গে।

    আর ঠিক সেই মুহূর্তে নেতাজি মূর্তির দিক থেকে ভেসে আসে আর-এক তীক্ষ্ণ জান্তব আতধ্বনি, আরও প্রখর, আরও বিস্তৃত। তার মিনিট খানেক পরেই বিশাল ডানা মেলে, সদ্য ঘুমভাঙা এক কোম্পানি আতঙ্কিত জওয়ানের চোখের সামনে, উড়িয়ে আনা প্রশিক্ষিত শিকারিদের হতবাক করে দিয়ে, টাংস্টেন খাঁচার ওপর দিয়ে উড়ে আসে সেই প্রাচীন ড্রাগন, এসে বসে শিউপ্রসাদের ঘরের ছাদে। নখের টানে উপড়ে আনে সেই ছাদের অ্যাসবেস্টস নির্মিত করুগেটেড চাল। তুলে আনে পচে যাওয়া বাঁশের কাঠামো। তার লেজের এক ঝটকায় ভেঙে পড়ে লাগোয়া দোকানঘরের পুরোনো পাঁচিল। সেখান থেকে ভেসে আসা দেশীয় মদের উগ্র নেশালু গন্ধ আস্তে আস্তে বাতাস ভারী করে তুলতে থাকে।

    তারপর দরজার কাছে নেমে আসে সেই বিহঙ্গরাজ। ডানা গুটিয়ে বসে দুজনের সামনে, ঘাড় নাড়িয়ে যেন ইঙ্গিত করে তাদের।

    কিছু কি কথা হয় তাদের মধ্যে? আগুনপাখিরা কি আগুনে আখরে লিখে রাখে তাদের স্মৃতিবচন?

    আর তারপর অসময়ে জেগে ওঠা যাবতীয় হতভম্ব চোখের সামনে দিয়ে উড়তে শুরু করে সেই তিন ড্রাগন। প্রথমে তারা আকাশে একচক্কর কাটে। তারপর নেতাজি মূর্তিকে একপাক ঘুরে তারা সোজা উড়তে থাকে, আকাশে তখন পূর্ণিমা রাতের ম্লান বিধূর শেষ চাঁদ। সেইদিকে সোজা লক্ষ করে, তিনটি স্বাধীন ড্রাগন উড়তেই থাকে, উড়তেই থাকে।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleডাইনিবুড়ি ও অন্যান্য – অভীক সরকার
    Next Article মিত্তিরবাড়ির গুপ্তধন – অভীক সরকার

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }