Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অন্ধের বউ

    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প10 Mins Read0

    অন্ধের বউ

    বিবাহের এক বছর পরে ধীরাজ অন্ধ হইয়া গেল। চোখের একটা অসুখ আছে, বড় বিপজ্জনক অসুখ, চোখের ভিতরের চাপ যাতে বাড়িয়া যায়। অবস্থাবিশেষে এক দিনের মধ্যেই মানুষের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হইয়া যাইতে পারে।

    আগের দিনটা ছিল বিবাহের বার্ষিক তিথি। রাত্রিটা দুজনে জাগিয়া কাটাইয়া দিয়াছিল! সারা রাত কয়েক মিনিটের জন্যও চোখ না বুজিয়া প্রতিদিন সকালে একেবারে সূর্যের মুখ না দেখিলেও রাতজাগাটা তাদের অবশ্য বেশ অভ্যস্ত হইয়া আসিয়াছিল। বিবাহের প্রথম বছরে রাত দুটোর আগে ফিসফিসানি শেষ হওয়াটা সাধারণ স্বামী-স্ত্রীর পক্ষেও স্বাভাবিক নয়।

    ধীরাজ চোখে একটু যন্ত্রণা বোধ করিতেছিল, একটু ঝাপসা দেখিতেছিল। চোখ দুটি বেশ লাল দেখাইতেছিল। কিন্তু বিবাহের তিথিকে যথাযোগ্য সম্মান করার উৎসাহে ওসব সামান্য বিষয়কে তারা গ্রাহ্যও করে নাই। সুনয়না বলিয়াছিল, তাই বলে আজ রাতে ঘুমোতে পাবে না। কাল সারা দিন ঘুমিয়ো, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমারও তো চোখ জ্বালা করছে।

    তবে একটু সেই রকম নাচ দেখাও?

    চোখ বোজো?

    .

    পরদিন বিকালের দিকে ডাক্তার ডাকা হইল। তারপর তাড়াহুড়া ছুটাছুটি করিয়া অনেক কিছুই করা হইল। কিন্তু তখন বড় বেশি দেরি হইয়া গিয়াছে। ভোরে সুনয়নার হাত ধরিয়া ছাদে দাঁড়াইয়া নূতন সূর্যকেও ধীরাজ যখন ঝাপসা দেখিতেছিল তখন সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা করিলেও হয়তো কিছু হইতে পারিত। কিন্তু তখন কে ভাবিয়াছিল টকটকে লাল চোখ, যন্ত্রণা, ঝাপসা দেখা চোখের মধ্যে আলোর ঝলকমারা, এসব অন্ধ হওয়ার ভূমিকা! ওসব তারা রাতজাগার ফল বলিয়া ধরিয়া নিয়াছে।

    বিশেষজ্ঞ অনেক রকম পরীক্ষা করিলেন কিন্তু অপারেশন করিতে অস্বীকার করিলেন। বলিলেন, আর কিছুই করিবার নাই।

    পরদিন সকালে জগতের আলোর উৎস যথাসময়ে আকাশে দেখা দিলেন কিন্তু ধীরাজ সেটা টেরও পাইল না। তার চোখের আলো চিরদিনের জন্য নিভিয়া গিয়াছে।

    চোখের ডাক্তার স্পষ্টই বলিয়া দিয়াছেন, রাতজাগা ধীরাজের অন্ধ হওয়ার আসল কারণ নয়। রাত না জাগিলেই অবশ্য ভালো ছিল, কিন্তু তাতেও যে ধীরাজের চোখ বাঁচিত তাই বা জোর করিয়া কে বলিতে পারে? এ বড় সাংঘাতিক অসুখ, কত লোকের চোখ নষ্ট হইয়া গিয়াছে। কিন্তু মানুষের মন কি সহজে এসব যুক্তি মানিতে চায়? সুনয়নার কেবলই মনে হয়, ওভাবে জোর করিয়া স্বামীকে রাত না জাগাইলে চোখের অসুখটা কখনো এত তাড়াতাড়ি এরকম বাড়িয়া যাইত না। অন্তত রোগের লক্ষণগুলোকে রাতজাগার ফল ভাবিয়া নিশ্চয় তারা অবেহলা করিত না, সকালবেলাই চোখের অবস্থা দেখিয়া ভয় পাইয়া তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হইত। ভাবে আর চোখের জলে সকালবেলার আলো এমন ঝাপসা দেখায় যেন সেও আধাআধি অন্ধ হইয়া গিয়াছে।

    সেই ঝাপসা দৃষ্টিতে স্বামীর বিকৃত মুখখানা দেখিতে দেখিতে সে হাউহাউ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল, ওগো, আমার জন্যেই আমাদের এ সর্বনাশ ঘটল।

    ধীরাজ মরার মতো বলিল, তোমার কী দোষ?

    সুনয়না সজোরে নিজের কপালে করাঘাত করিয়া বলিল, কার দোষ তবে? কে তোমার টকটকে লাল চোখ দেখেও তোমায় ঘুমোতে দেয় নি? সকালে কে তোমায় বলেছে, একটু ঘুমোলেই সব সেরে যাবে? আমি তোমার চোখ নষ্ট করেছি….স্বামীর চোখখাগি হতভাগি আমি, আমার মরণ নেই। আমিও অন্ধ হয়ে যাব—নিজের চোখ উপড়ে ফেলব। যদি না উপড়ে ফেলি, মা কালীর দিব্যি করে বলছি—

    চুপ, ওসব বলতে নেই।

    ধীরাজ ব্যস্ত হইয়া সুনয়নার একখানা হাত হাতড়াইয়া খুঁজিতে আরম্ভ করায় সুনয়না হঠাৎ শিহরিয়া অস্ফুট আর্তনাদ করিয়া উঠিল। ধীরাজের কাকা অন্ধ, প্রথম এ বাড়িতে আসিয়া তাকে প্রণাম করার পর এমনিভাবে আন্দাজে তার গায়ে মাথায় শীর্ণ হাত বুলাইয়া কাকা তাকে অভ্যর্থনা আর আশীর্বাদ জানাইয়াছিলেন।

    কী খুঁজছ? কী খুঁজছ তুমি?

    তোমার হাত কই?

    এই যে—

    তার একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে গ্রহণ করিয়া ধীরাজ সান্ত্বনার সুরে বলিতে লাগিল, ওসব কথা মনেও এনো না। তোমার চোখ গেলে আমি বাঁচব কী করে? এখন থেকে তোমার চোখ দিয়েই তো দেখব। তুমি আমার সেবা করবে, কাজ করে দেবে, বইটই পড়ে শোনাবে—

    সুনয়নার হাত ছাড়িয়া দিয়া ধীরাজ তার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে থাকে। সুনয়নার মাথাটা হঠাৎ এমন জোরে তার বুকে আসিয়া পড়িয়াছে যেন সে তার বুকেই মাথা কুটিয়া মরিতে চায়। সে অন্ধ হইয়া গিয়াছে, সান্ত্বনা আর সাহস পাওয়ার বদলে সে নিজেই অপরজনকে বুঝাইয়া আদর করিয়া শান্ত করিতেছে, এটা দুজনের কারো কাছে খাপছাড়া মনে হইল না। ভালবাসার এই অন্ধ ব্যাকুলতার মতো দুর্ভাগ্যের ভালো ওষুধ জগতে আর কী আছে?

    ধীরাজ বেশি ব্যাকুল হয় নাই। কতকটা বজ্রাহত মানুষের মতো সে বিছানায় পড়িয়া আছে, মুখে বেশি কথা নাই, অদৃষ্টকে ধিক্কার দেওয়া নাই, কী পাপে তার এমন শাস্তি জুটিল ঈশ্বরের কাছে সে কৈফিয়ত দাবি করা নাই, লোভী শিশুর মতো সকলের সহানুভূতি গিলিবার অধীর আগ্রহও নাই। এখনো সে যেন নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করিয়া উঠিতে পারে নাই, চিরদিনের জন্য সে অন্ধ হইয়া গিয়াছে। মনের তলে এখনো যেন তার একটা যুক্তিহীন অন্ধ আশা জাগিয়া আছে, হয়তো সব ঠিক হইয়া যাইতে পারে। ইতোমধ্যেই সুনয়নাকে সে বলিয়াছে- তা ছাড়া কী জান, কিছুদিন পরে হয়তো একটু একটু দেখতে পাব। ভালো দেখতে পাব না বটে, চশমা-টশমা নিয়ে হয়তো ধোঁয়াটে ঝাপসা মতো কাছের জিনিস শুধু দেখতে পাব, তবু দেখতে পাব তো। খুব বড় একজন স্পেশালিস্টের কাছে যেতে হবে।

    ধীরাজের মনে যতখানি হতাশা জাগা উচিত ছিল, ধীরাজের কাছে আমল না পাইয়া তার সবখানি যেন সুনয়নাকে আশ্রয় করিয়া তাকে আত্মহারা করিয়া দিয়াছে। ধীরাজের আপসোস আর হাহুতাশ যেন মুক্তি পাইতেছে তার মুখে।

    পরপর দুটি রাত্রি সে ঘুমায় নাই। একটি রাত্রি জাগিয়াছে স্বামীর সোহাগ ভোগ করিয়া, আর একটি রাত্রি জাগিয়াছে অন্ধ স্বামীর স্ত্রী হইয়া জীবন কাটানোর বীভৎস অসুবিধাগুলোর কথা কল্পনা করিয়া। সারা রাত সে আলো নিভায় নাই। প্রথম রাত্রে তারা আলো নিভায় নাই, দুজনে দুজনকে দেখিবে বলিয়া। পরের রাত্রে সে আলো নিভায় নাই অন্ধকারের ভয়ে। হাসপাতাল হইতে ধীরাজ বাড়ি ফিরিয়াছিল রাত্রি প্রায় এগারটার সময়, শ্রান্ত, ক্লান্ত, ঘুমের নেশায় আচ্ছন্ন, অন্ধ ধীরাজ। একবাটি দুধ চুমুক দিয়া খাইয়াই সে শুইয়া পড়িয়াছিল। শুইয়া পড়িতে তাকে সাহায্য করিয়াছিল বাড়ির প্রায় সকলে, মা বাবা ভাই বোন পিসি খুড়ি ভাইপো ভাইঝি ভাগনে ভাগনির দল। বাড়ির ঠাকুর চাকর পর্যন্ত দরজায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। শুধু আসে নাই ধীরাজের অন্ধ কাকা। ধীরাজের মার মৃদু কান্নার শব্দ শুনিতে শুনিতে তখন সুনয়নার কানের মধ্যে হঠাৎ ভাঙা কাঁসির বেতালা আওয়াজের মতো কী যেন ঝমঝম করিয়া বাজিয়া উঠিয়াছিল, বিদ্যুতের আলোয় উজ্জ্বল ঘরখানা পাক খাইয়া অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল।

    মূর্ছা নয়, মূর্ছা গেলে সুনয়না পড়িয়া যাইত, জ্ঞান থাকিত না। একটু টলিতে থাকিলেও সেইখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সে প্রায় মিনিটখানেক চোখ দিয়াই যেন সেই গাঢ় স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার দেখিয়াছিল। কানের মধ্যে তখন শব্দ থামিয়া গিয়াছে। বাহিরেও কোনো শব্দ নাই। সেই স্তব্ধতাকেও সুনয়নার মনে হইয়াছিল সাময়িক অন্ধকারের অঙ্গ।

    তারপর সেই নিবিড় কালো অন্ধকার পরিণত হইয়াছিল গাঢ় কুয়াশায় এবং ক্রমে ক্রমে কুয়াশাও কাটিয়া গিয়াছিল। সকলের কথার গুঞ্জনধ্বনি হঠাৎ স্পষ্ট ও বোধগম্য হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু এক অজানা আতঙ্কে তখন সুনয়নার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করিতেছে। সে আতঙ্ক ধীরাজের চোখের জন্য নয়—চোখ যে তার নষ্ট হইয়া গিয়াছে সুনয়না আগেই সে খবর পাইয়াছিল। অন্যমনস্ক অবস্থায় হঠাৎ কানের কাছে জোরে শব্দ হইলে কিছুক্ষণের জন্য মানুষ যেমন বেহিসাবি আতঙ্কে অভিভূত হইয়া যায়, কী জন্য আতঙ্ক তাও বুঝিবার ক্ষমতা থাকে না, চিন্তাশক্তি ফিরিয়া আসিবার পরেও সুনয়না অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেই রকম একটা আতঙ্ক অনুভব করিয়াছিল।

    তাকে চমক দিয়া বাস্তবে টানিয়া আনিয়াছিল ঘর খালি হওয়ার পর ধীরাজের অস্ফুট প্রশ্ন: আলো নিভালে না?

    এ প্রশ্ন সুনয়না অনেকবার শুনিয়াছে। শোয়ার আগে আলো নিভাইতে তার প্রায়ই খেয়াল থাকে না, ধীরাজ মনে পড়াইয়া দেয়। কাল এই পরিচিত সাধারণ প্রশ্নটি শুনিয়া আকস্মিক উত্তেজনায় তার দম যেন আটকাইয়া আসিয়াছিল। ধীরাজ কী তবে ঘরের আলো দেখিতে পাইতেছে!

    ধীরাজ সাড়া দেয় নাই। তখন সুনয়না বুঝিতে পারিয়াছিল, ঘুমের অভ্যাস বশে ধীরাজ ওকথা বলিয়াছে। ঘরে আলো জ্বালানো থাক বা নিভানো হোক, ধীরাজের তাতে সব সমান।

    বুকের অস্বাভাবিক ঢিপঢিপানি কমিয়া তখন স্বাভাবিক কান্না বুকের ভিতর হইতে ঠেলিয়া উঠিয়াছিল কিন্তু ধীরাজের ঘুম ভাঙিয়া যাওয়ার ভয়ে প্রাণ খুলিয়া সে কাঁদিতেও পারে নাই।

    তারপর কখনো সন্তর্পণে বিছানায় উঠিয়া কিছুক্ষণ শুইয়া থাকিয়া আবার নামিয়া আসিয়া, কখনো একদৃষ্টিতে ঘুমন্ত স্বামীর মুখ দেখিয়া, কখনো জানালার শিক ধরিয়া পাশের বাড়ির উঠানে আবছা চাঁদের আলোয় চেনা জিনিসগুলোকে নূতন করিয়া চিনিবার চেষ্টা করিয়া আর সমস্তক্ষণ আকাশপাতাল ভাবিয়া সে রাত কাটাইয়াছে। ঘরের আলো নিভানোর কথা একবারও তার মনে পড়ে নাই।

    .

    বেলা বাড়িলে কয়েকজন প্রতিবেশী দেখা করিতে এবং দুঃখ জানাইতে আসিলেন। আগে সুনয়না ঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাইত, আজ সে উদ্ধতভাবে বিছানার কাছ হইতে শুধু একটু তফাতে সরিয়া দাঁড়ায়। এই সামান্য ব্যাপারে তার এমন বিরক্তি বোধ হয় বলিবার নয়। সকলের সমবেদনার গাম্ভীর্যে বিকৃত মুখ দেখিয়া আর অর্থহীন ভদ্রতার মিঠা মিঠা কথা শুনিয়া গায়ে যেন তার আগুন ধরিয়া যাইতে থাকে। একজন অকালবৃদ্ধ সবজান্তা ভদ্রলোক যখন অদ্ভুত একটা আপসোসের শব্দ করিয়া বলেন যে অ্যালোপ্যাথি না করিয়া হোমিয়োপ্যাথি করিলে হয়তো উপকার হইত, তখন বাঘিনীর মতো তার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া তাকে ঘরের বাহির করিয়া দেওয়ার ইচ্ছাটা দমন করা কাল রাত্রে কান্না চাপিয়া রাখার চেয়েও সুনয়নার কঠিন মনে হয়।

    হঠাৎ সে শুনিতে পাইল তার গলার আওয়াজে তারই মনের কথা কে যেন উচ্চারণ করিতেছে : আপনারা এখন আসুন, উনি একটু বিশ্রাম করবেন।

    সকলে আহত বিস্ময়ে তার এলোমেলো চুল, ক্লিষ্ট মুখ আর বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকায়। ধীরাজ ভদ্রতার খাতিরে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া বিনয়ের হাসি হাসিবার চেষ্টা করিতেছিল, তার মুখের হাসি মিলাইয়া যায়।

    সকলের আগে কথা বলেন অকালবৃদ্ধ ভদ্রলোকটি : চল হে চল, আপিসের বেলা হল।

    ধীরাজের ছোট ভাই বিরাজ সকলকে সঙ্গে করিয়া ঘরে আনিয়াছিল, সকলে চলিয়া গেলে সে বলিল, তুমি সকলকে তাড়িয়ে দিলে বউদি!

    ধীরাজ ভর্ৎসনার সুরে বলিল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

    সুনয়না উদ্ভ্রান্তভাবে বাঁ হাতের বুড়া আঙুল দিয়া নিজের কপালটা ঘষিতে থাকে, কথা বলে না। বিরাজ বছর তিনেক ডাক্তারি পড়িতেছে, সুনয়নার মূর্তি দেখিয়া এতক্ষণে তার খেয়াল হয়, হয়তো তার অসুখ করিয়াছে।

    তোমার অসুখ করেছে নাকি বউদি!

    সুনয়না মাথা নাড়িয়া ঘরের বাহিরে চলিয়া গেল। একটু পরেই বিরাজ গিয়া খবর দিল, দাদা ডাকছে বউদি।

    ঘরে ফিরিয়া গিয়া ধীরাজের পরিবর্তন দেখিয়া সুনয়না স্তম্ভিত হইয়া গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে তার মুখখানা যন্ত্রণায় বিকৃত হইয়া গিয়াছে, ডান হাতে সে নিজের চুলগুলো সজোরে মুঠা করিয়া ধরিয়া আছে।

    সুনয়না সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে?

    ধীরাজ অস্বাভাবিক চাপা গলায় বলিল, তোমার অসুখ করেছে তো? আমি টের পাই নি! বিরাজ না বললে জানতেও পারতাম না। এবার থেকে তোমার অসুখ করবে আর আমি না জেনে তোমায় খাটিয়ে মারব, বকব

    ধীরাজ হঠাৎ যেন আর্তনাদ করিয়া উঠিল, ঠকাও, ঠকাও, তুমিও আমায় ঠকাও। চোখে তো দেখতে পাই না, যা ইচ্ছা তাই বলে কচি ছেলের মতো ভোলাও। বলিয়া ধীরাজ কাঁদিতে আরম্ভ করিয়া দিল।

    আগের মতো শান্তভাবে ধীরাজ কথাগুলো বলিলে সুনয়না হয়তো তার পাশে বিছানায় আছড়াইয়া পড়িয়া কাঁদাকাটা আরম্ভ করিয়া দিত। স্বামীর ব্যাকুলতা আর কান্না দেখিয়া নিজেকে সে সংযত করিয়া ফেলিল। ধীরে ধীরে পাশে বসিয়া স্বামীর মাথাটি বুকে চাপিয়া ধরিয়া কয়েক ঘণ্টা আগে ধীরাজ যেভাবে তার মাথায় হাত বুলাইয়া তাকে সান্ত্বনা দিয়াছিল তেমনিভাবে এখন তার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে বলিল, ওরকম কোরো না। পাগল হয়েছ, তোমায় ঠকাব? ঠাকুরপোর কি কাণ্ডজ্ঞান আছে? ভাবনায় চিন্তায় রাত জেগে মুখ একটু শুকনো দেখাচ্ছে, ওমনি ঠাকুরপো ধরে নিল আমার অসুখ হয়েছে। অসুখ হলে তোমায় বলব না?

    কিন্তু বিরাজ যে বলল তোমার নার্ভাস ব্রেকডাউনের উপক্রম হয়েছে।

    ঠাকুরপো তো মস্ত ডাক্তার!

    এমন সময় আসিলেন পিসিমা। সুনয়নার দিকে কেউ নজর দিতেছে না বলিয়া বিরাজ বোধ হয় বাড়ির লোককে একটু খোঁচাইয়া দিয়াছিল, ঘরে ঢুকিয়াই পিসিমা বলিতে আরম্ভ করিলেন, নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, তুমি কী আরম্ভ করে দিয়েছ বউমা? কাল থেকে উপোস দিচ্ছ এয়োস্ত্রী মানুষ

    পিসিমার পিছনে পিছনে কাকিমাও আসিয়াছিলেন, তিনি তাড়াতাড়ি বলিলেন, আহা, থাক, থাক। এস বউমা, একটু কিছু খেয়ে নেবে এস।

    কাকিমা একটু গম্ভীর চুপচাপ মানুষ, কারো সঙ্গে বেশি মেলামেশা করেন না। এতদিন মানুষটাকে দেখিলেই সুনয়নার বড় মায়া হইত, মনে হইত, আহা, দশ-বারো বছর বেচারি অন্ধ স্বামীকে নিয়া ঘর করিতেছে। আজ কাকিমার শান্ত কোমাল মুখখানা দেখিয়া তার গভীর বিতৃষ্ণা বোধ হইতে লাগিল, আন্তরিক মমতাভরা কথাগুলো শুনিয়া মনে হইতে লাগিল, সুযোগ পাইয়া তাকে যেন ব্যঙ্গ করিতেছেন, পিসিমার মৃদু ভর্ৎসনার প্রতিবাদ করিয়া যেন ইঙ্গিতে বলিতেছেন, আহা থাক থাক, ওকে বকবেন না, ও এখন আমার দলের।

    একটু আগে সুনয়না হয়তো নিজেকে সামলাইতে না পারিয়া প্রতিবেশী ভদ্রলোকদের মতো গুরুজন দুজনকেও অপমান করিয়া বসিত। কিন্তু ধীরাজের আকস্মিক উদ্‌ভ্রান্তভাব তার সমস্ত সংগত ও অসংগত উচ্ছ্বাসের বাহির হওয়ার পথ তখনো বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিল। একটু ঘোমটা টানিয়া দিয়া সে নীরবে কাকিমার সঙ্গে চলিয়া গেল।

    .

    একবার ভাঙিয়া পড়িয়াই ধীরাজের ধৈর্য আর সংযম যেন নষ্ট হইয়া গেল। এতক্ষণে সে যেন টের পাইয়াছে তার চারদিকে যে অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে সেটা রাত্রির সাময়িক অন্ধকার নয়, ভাগ্যের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কখনো দুঃখে সে একেবারে মুষড়াইয়া পড়িতে লাগিল, কখনো অধীর হইয়া ছটফট করিতে লাগিল। মা একবার ছেলেকে দেখিতে আসিয়া ছেলের অবস্থা দেখিয়া দাঁড়াইতে পারিলেন না, চোখে আঁচল দিয়া পালাইয়া গেলেন। বাড়ির সকলে আসিয়া নানাভাবে তাকে শান্ত করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু তাতে সে যেন আরো অশান্ত হইয়া উঠিতে লাগিল।

    সব কথার জবাবে গুমরাইয়া গুমরাইয়া কেবলই বলিতে লাগিল, অন্ধ হয়ে বেঁচে থেকে কী হবে, এর চেয়ে মরাই ভালো।

    ধৈর্য আর সংযম দেখা দিল সুনয়নার মধ্যে। মনের সমস্ত অবাধ্য ও উচ্ছৃঙ্খল চিন্তাকে সে যেন জোর করিয়া মনের জেলে পুরিয়া ফেলিল, বাহিরে আর তাদের অস্তিত্বের কোনো চিহ্নই প্রকাশ পাইল না। দুজনের দ্রুত পরিবর্তন দেখিয়া মনে হইতে লাগিল, তারা যেন পরামর্শ করিয়া পরস্পরের মানসিক অবস্থাকে অদল-বদল করিয়া নিয়াছে। ধীরাজ যতক্ষণ শান্ত ছিল ততক্ষণ পাগলামি করিয়াছে সুনয়না, এবার ধীরাজকে পাগল হওয়ার সুযোগ দিয়া সুনয়না আত্মসংবরণ করিয়াছে।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসর্ববিদ্যাবিশারদের বউ
    Next Article জুয়াড়ির বউ

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প

    আসল বেনারসী ল্যাংড়া

    April 5, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    জুয়াড়ির বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    সর্ববিদ্যাবিশারদের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    প্রৌঢ়ের বউ

    March 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }