Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অন্যমনস্ক – জুনায়েদ ইভান

    জুনায়েদ ইভান এক পাতা গল্প83 Mins Read0

    নিয়ার ডেথ মোমেন্ট – কেস স্টাডি ৫

    ১

    বিস্তর খোলা প্রান্তর। প্রচণ্ড কুয়াশায় গাছের মূল অংশ ঢেকে গেছে। হঠাৎ তাকালে মনে হবে গাছের পাতা হাওয়ার ওপর ভাসছে। চোখে এক ধরনের ধাঁধার সৃষ্টি হয়। তারপর চোখ সয়ে যায়। কিন্তু কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে। গাছের মতো একটা মানুষও মিলিয়ে গেছে। মোতালেব হোসেন কুয়াশা সরিয়ে খুঁজতে লাগলেন। মধ্য মাঠে দাঁড়িয়ে শব্দ করে ডাকলেন ‘রুবা।’

    রুবা তার স্ত্রী। সে জবাব দেয়।

    ‘কোথায় তুমি?’

    ‘এই তো আছি।’

    ‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’

    রুবা খিলখিল করে হাসে। শব্দের উৎস দক্ষিণ দিকে। বড় একটা গাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রুবা। মোতালেব হোসেন হাঁপিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘কী করছ এখানে?’

    ‘কিছু না। কুয়াশা হতে চাও?

    ‘না।’

    ‘অনেক দূর থেকে আমার একটা ছবি তুলবে?’

    ‘দূর থেকে কেন?’

    ‘কুয়াশার কারণে মনে হবে আমার অর্ধেক শরীর হাওয়ায় ভাসছে।’

    মোতালেব হোসেন দূরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুললেন। রুবা যে জিনিস চাইছে, তার এই আনকোরা হাতে ছবিতে তা বের করা প্রায় অসাধ্য। কাছে গিয়ে বললেন ‘কুয়াশায় তোমাকে দেখা যাচ্ছে না।’

    রুবা কী সব বলছিল। তার কথার ফাঁক দিয়ে ভোর কেটে গেল। বিভ্রম সুপারিগাছের পাতাগুলো এখন বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মোতালেব হোসেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। রুবাকে হারিয়ে ফেলার সাময়িক বিভ্রম কেটে গেছে।

    ফেরার সময় বললেন, ‘তুমি আর কখনো এ রকম করবে না।’

    ‘কেন?’

    ‘আমি মানসিক স্ট্রেস নিতে পারি না।’

    ‘এত অল্পতে অস্থির হয়ে যাও!’

    দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘একটুর জন্য তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।’

    ‘নিজেকে?’ প্রশ্ন করে রুবা।

    ‘নিজেকে হারিয়ে ফেলার কোনো উপায় আছে?’

    ‘অনেকটা লুকোচুরি খেলার মতো। সবাই তোমাকে খুঁজছে, শুধু তুমি জানো তুমি কোথায়। তারপর আরও গভীরে গেলে সেখান থেকে আর বের হতে পারছ না।’

    ‘মানে আমি কোথায় লুকিয়ে আছি সেটা আমি নিজেই জানি না?’

    ‘অনেকটা তাই।’

    ‘তোমার কাছে সবকিছু খুব স্বাভাবিক মনে হয়?’

    ‘কী?’

    ‘এই যে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলি।’

    ‘তুমি তো আগে থেকেই একটু ভুলোমনা।’

    ‘কিন্তু ব্যাপারটা অন্য কিছু। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা দুজন কথা বলছি, এটা একটা মিরাকল।’

    রুবা হাসতে লাগে। বয়সের সাথে সাথে মানুষের হাসি পরিবর্তন হয়। হাসির শব্দ, মুখের চোয়াল আর ঠোঁট নাড়ার ভঙ্গিমায় খুব সূক্ষ্ম রদবদল হয়। মোতালেব হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আমার কি ডাক্তার দেখানো উচিত?’

    ‘তোমার সমস্যা কী?

    ‘আমি সারাক্ষণ এলোমেলো কল্পনা করি।’

    ‘এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়।’

    ‘কিন্তু আমি সেই কল্পনা থেকে বের হতে পারি না।’

    রুবা জানতে চায়, ‘কী রকম?’

    ‘তোমার হাসির পরিবর্তনগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলাম।’

    রুবা চুপ করে থাকে। মোতালেব হোসেন বললেন, ‘হঠাৎই তোমার হাসি মিলিয়ে গেল। আমি তখন তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে; মনে হয়েছিল এই একটা জায়গা অবিকল আগের মতো আছে।’

    ‘তারপর?’

    ‘তারপরের অংশ বেশ জটিল। তোমার হাসি মিলিয়ে গেছে কিন্তু আমার কল্পনা সেটা ধরে রেখেছে।’

    না।’

    ‘তুমি চাইছিলে ধরে রাখতে, তাই কল্পনা করছিলে।’

    ‘ঠিক তা না। আমি না চাইতেও অনেক কিছু কল্পনা করি।’

    ‘তুমি কি ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কল্পনা কর?’

    মোতালেব হোসেন নির্বিকার গলায় বললেন, ‘কল্পনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়

    ‘তুমি কল্পনা কর, তোমার কল্পনা-তোমরা আলাদা কিছু না।’

    ‘হ্যাঁ, আমার কল্পনা। আমি আমার কল্পনার নিয়ন্ত্রক।’

    ‘প্রথমে বললে, তুমি না চাইতেও অনেক কিছু কল্পনা কর। এখন বলছ, তুমিই তোমার কল্পনার নিয়ন্ত্রক। দুটা কথায় কন্ট্রাডিকশন হচ্ছে।’

    মোতালেব হোসেন চিন্তিত হয়ে কিছু সময় ভাবলেন। ভাবতে গিয়ে সচেতনভাবে নিজেকে সতর্ক করছিলেন, আবার যেন অপ্রাসঙ্গিক কল্পনা পেয়ে না বসে। পকেট থেকে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললেন, ‘ইদানীং আমার আরও কিছু সমস্যা হচ্ছে।’

    ‘কী?’

    ‘আমার সবকিছু বিভ্রম লাগে। এই যেমন একটা গাছ দেখে মনে হয়, এটা একটা ছবি। কোনো এক নিখুঁত চিত্রশিল্পী এঁকেছে।’

    আবার উল্টোটাও হয় নিশ্চয়ই।’ বলল রুবা।

    ‘কী রকম?’

    ‘একটা ছবি দেখে সেটাকে সত্যিকারের গাছ মনে হলো। ছবিতে গাছের ওপর ডানা ঝাপটানো এক পাখি স্থির হয়ে আছে। কিন্তু তোমার কল্পনা সেটাকে উড়ে যেতে দেখছে।’

    মোতালেব হোসেন অসহায় দৃষ্টি নিয়ে দেয়ালের দিকে তাকালেন। পুরনো প্রাচীরঘেরা তিনতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে ছোট একটি কুয়া। বর্ষায় ময়লা পানি জমে।

    রুবা বললেন, ‘আমি তোমার সমস্যা ধরতে পেরেছি।’

    ‘কী?’

    ‘যে সত্য তুমি মানতে চাও না, তার একটা সুন্দর ছবি তুমি মনে মনে কল্পনা কর। তারপর সেটাকে সত্য মনে কর।

    ‘আমি আমার কল্পনাকে সত্য মনে করি?’ খানিকটা চুপ থেকে জিজ্ঞাসা

    করলেন

    ‘এর থেকে মুক্তির উপায় কী?’

    ২

    একটা ছোট মেয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল গোল্ডফিশ কেনার জন্য। পথিমধ্যে টাকা হারিয়ে ফেললে সে কাঁদতে শুরু করে।

    মোতালেব হোসেন বললেন, ‘সে টাকার জন্য কাঁদছে, মনে করলে ভুল হবে।’

    ‘তাহলে কাঁদছে কেন?’ রুবা জিজ্ঞাসা করে।

    ‘সে কাঁদছে গোল্ডফিশের জন্য।’

    ‘একই কথাই হলো।

    ‘প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষের ভেতরে তফাত আছে।’

    ‘আচ্ছা এখন চুপ কর।

    মোতালেব হোসেন ছটফট করতে লাগলেন। মুভি বন্ধ করে বললেন, ‘আমার একটু অসুবিধা হচ্ছে।’

    ‘কী অসুবিধা?’

    ‘কল্পনা করতে অসুবিধা হচ্ছে।’

    ‘কী রকম?’

    ‘আমি আমার নিজের মতো করে কল্পনা করতে পারছি না। ডিরেক্টর যেভাবে দেখাতে চেয়েছে, সেভাবে দেখতে হচ্ছে।‘

    রুবা বিষণ্ন চোখে তাকায়। তার চোখ পলকহীন।

    ‘একবার ভাবো টাকার বদলে ড্রেনের স্লেবে গোল্ডফিশটি পড়ে গেছে। উদ্ধার অভিযান শেষে দেখা গেল, মাছটি মারা গেছে।’

    ‘কেন এ রকম মনে করব?’

    ‘কারণ আবার টাকা জোগাড় করা সম্ভব। কিন্তু একটা মৃত গোল্ডফিশের দেহে প্রাণ দেয়া সম্ভব না।’

    ‘সে অন্য একটি গোল্ডফিশ কিনবে।’

    ‘অন্য একটা গোল্ডফিশের জন্য তো সে কাঁদেনি।’

    রুবা বিরক্ত গলায় বলল, ‘চুপ কর প্লিজ।’

    মোতালেব হোসেন উঠে গিয়ে পিয়ানো বাজাতে শুরু করলেন। বসার ঘরে অর্ধেক জায়গা জুড়ে পিয়ানো। রুবাকে ডেকে বললেন, ‘এসো আমরা একসাথে বাজাই।’

    ‘আমি কীভাবে বাজাব?’

    ‘তুমি যা বাজাতে চাও, মুখে আওয়াজ করবে।’

    ‘কীভাবে বুঝব কী বাজাতে চাই?’

    ‘এই যে আমি শুরু করছি। তুমি আমার নোট ফলো করো।’

    কিন্তু আমাদের সুর মিলবে কী করে?

    ‘মিলেছে বলেই তো আমরা একসাথে আছি। তাই না?’

    ‘এসব তোমার কল্পনা।’

    ‘সবকিছুই কল্পনা? একটু আগে যে মুভি দেখছিলাম, ‘The White

    Balloon’. সেটাও কল্পনা?’

    ‘এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাও?’ জিজ্ঞাসা করে রুবা।

    মোতালেব হোসেন চুপ করে বসে রইলেন।

    রুবা বললেন, ‘তুমি আসলে মুক্তি চাও না।’

    ‘কেন?’

    ‘তুমি তোমার কল্পনাকে সত্য মনে কর। এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো, সত্যকে তুমি কল্পনা মনে কর।‘

    ৩

    গণক বললেন, ‘আপনার সময় আর ত্রিশ দিন। জুন মাসের ১ তারিখে আপনার মৃত্যু হবে।’

    মোতালেব হোসেন একজন যুক্তিবাদী মানুষ। গণকের কথায় তার কিছু আসে যায় না। রসিকতা করে বললেন, ‘কীভাবে মারা যাব, তা কি বলা সম্ভব?’

    গণক বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘নিষেধ আছে।’

    ‘একটু না হয় নিষেধ অমান্য করলেন।’

    গণক রাগান্বিত চোখে তাকায়। মোতালেব হোসেন ব্যাপারটা ধরতে পারেননি। বললেন, ‘দিনের বেলা নাকি রাতের বেলা?’

    ‘কী?’

    ‘কোন সময়ে মারা যাব?’

    ‘সন্ধ্যার পর।’

    ‘আপনি বলতে চাইছেন, জুন মাসের এক তারিখে সন্ধ্যার পর আমি মারা যাব?’

    গণক হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।

    ‘আপনার সাথে আমার পরবর্তী সাক্ষাৎ হবে, জুন মাসের দুই তারিখ।’

    গণক তাচ্ছিল্যের সহিত হাসতে থাকেন। হাসিতে একটা রহস্য ভাব আনার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেটা নিখুঁত না।

    এসব উদ্ভট ভবিষ্যদ্বাণীতে মোতালেব হোসেনের জীবনে কোনো প্রভাব পড়েনি। পরদিন সকালে অফিস করলেন। অফিস থেকে ফিরে এসে ‘The White Balloon’ মুভিটি আবার দেখলেন। রুবাকে বললেন, ‘একটা গোল্ডফিশের গড় আয়ু কত, তুমি জানো?’

    ‘না। সেটা জেনে কী করবে? ‘গল্পটা বুঝতে সুবিধা হতো।’

    রুবা বিরক্ত হয়। মোতালেব হোসেন রোজ অফিস থেকে ফিরে ‘The White Balloon’ দেখতে বসেন। এটা তার কাছে একটি প্রজেক্টের মতো। শেষ না করে অন্য কিছুতে মন দেয়া দুরূহ।

    মাঝেমধ্যে অবশ্য ছাদে গিয়ে বসে থাকেন। ছাদ থেকে আকাশ দেখতে তার ভালো লাগে। মেঘ ভেসে যায়, তারা ঢেকে যায়। সারাক্ষণই কিছু না কিছু হচ্ছে। রাস্তা থেকে হুট করে তাকালে আকাশের এই মুভমেন্ট চোখে পড়ে না। ইলেকট্রিকের তার, কন্সট্রাকশন ভবনের বাতি, চারপাশের কোলাহল দূরের গ্রহকে সূক্ষ্ম করে দেখার মনোযোগ কেড়ে নেয়।

    এভাবে কয়েকদিন কেটে যাবার পর একদিন সকালে হঠাৎই মনে পড়ে গণকের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। মুহূর্তের জন্য সারা শরীর কেমন হিম হয়ে গেল। তিনি ভালো করেই জানেন, এসব সত্য না। তবু কোথায় যেন কাল্পনিক ভয় কাজ করে।

    ঘটনার জন্ম সমুদ্র চিন্তা থেকে। জুনের প্রথম সপ্তাহে রুবাকে সাথে নিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাবার কথা ভাবছিলেন, ঠিক তখনই একটা ভয়, কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে আসে। কে যেন কানের পাশ দিয়ে বলছিল, ‘জুনের ১ তারিখে তুমি মারা যাবে।’

    সত্য না জেনেও, যদি সত্যি হয়, এই চিন্তা মনের ভেতরে বিভ্ৰম জন্ম দেয়। রুবাকে বলেই ফেললেন, ‘নাকি এই মাসেই যাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে?’

    ‘তোমার ইচ্ছে।’

    মোতালেব হোসেন কিঞ্চিত বেকায়দায় পড়লেন। কিন্তু এই ভয়ের স্থায়িত্বকাল কম থাকার কারণে কিছুক্ষণ পরেই আবার হারিয়ে গেলেন জীবনে। কয়েকটি দিন কেটে গেল বেশ।

    একটা দিন থেকে অন্য একটা দিনের পার্থক্য খুব সামান্য। পোশাক, খাবারের মেন্যু, পিয়ানোর নোট আর ঘুমোতে যাবার আগে ‘The White Balloon’

    কিছু না দেখেও তাকিয়ে থাকা। কিছু না শুনলেও একটা শব্দ কানে নেয়া। শব্দ অধিক পরিবর্তন হলে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। ভাবনাগুলো এমন যে কখনো কোনো পরিকল্পনা করে না। অনেকটা রিয়েকশানের মতো। বল ছুড়ে মারলে হাত বাড়িয়ে দেয়া।

    ৪

    সপ্তাহখানেক পর, মোতালেব হোসেনের ভেতরে সূক্ষ্ম একটি পরিবর্তন আসে। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে গণকের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। ভয়টা এমন যে তিনি জানেন ভয় পাবার কিছু নেই। কিন্তু ভয়কে কল্পনা করার যে ইচ্ছা, সেই ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসেছে।

    যদিও মানুষ হিসেবে তিনি একজন বিচক্ষণ এবং যুক্তিবাদী। এ রকম বহু গণকের আজগুবি বয়ান সম্পর্কে তিনি অবগত। একবার একজন রহস্য করে বলেছিলেন, ‘কেউ আপনাকে ঠিকভাবে বুঝতে পারে না।’

    মোতালেব হোসেন বললেন, ‘আপনাকে সবাই বুঝতে পারে?’

    ভদ্রলোক চোখ খুলে ভালো করে তাকালেন। বললেন, ‘অনেক রাগ কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন না।’

    ‘আপনি কি আপনার সব রাগ প্রকাশ করতে পারেন?’

    ভদ্রলোক রাগান্বিত চোখে তাকান। মোতালেব হোসেন সেই রাগকে আগ্রাহ্য করে বললেন, ‘এই যে কিছুটা উত্তেজিত হয়েছেন কিন্তু প্রকাশ করছেন না।’

    কিন্তু এবার অন্য রকম কিছু ব্যাপার ঘটছে। নিছক কল্পনা ছাপ ফেলে বিশ্বাসে। রাস্তা পার হবার সময় বাড়তি মনোযোগ দিতে গিয়ে খেয়াল হয়, এই কাজটি তিনি অগোচরে করছেন।

    ক্রমেই ব্যাপারটা বাড়তে লাগল। পরক্ষণেই নিজেকে বোঝান এরকম বাতিকগ্রস্ত হবার মতো কোনো কিছু হয়নি। একজন একটা কিছু বললেই সেটা হয়ে যায় না। তার উচিত হবে এসব ফালতু জিনিস নিয়ে চিন্তা না করা। কিন্তু এটা তার কাছে একটি প্রজেক্টের মতো। শেষ না করে অন্য কিছুতে মন দেয়া দুরূহ।

    তার খুব দেখতে ইচ্ছা করে, জুনের ১ তারিখে কী ঘটে। সন্ধ্যার পর যখন রাত হবে, কেবল তখনই তিনি হালকা হবেন। সেই সাথে এই প্রজেক্টের ইতি ঘটবে।

    তারপর, গণকের কাছে গিয়ে তার সেই হাসির জবাব ফিরিয়ে দেবেন। এমন কিছু বলবেন, যেন চোখ মেলে তাকাতে না পারে। কী বলবেন সেটা জানেন না।

    রুবার সাথে অবশ্য এই নিয়ে আলাপ হয়েছে। সে বলেছে ‘অতিরিক্ত চিন্তা থেকে এমন হয়।’

    মোতালেব হোসেন বললেন, ‘আমি যে চিন্তিত ঠিক তা না। আমি ওই ভণ্ডকে উচিত শিক্ষা দিতে চাই।’

    ‘সেটা তুমি এখনই দিতে পারো।’

    ‘এখন আমি প্রমাণ করতে পারব না. তার কথা মিথ্যা।’

    ‘এক মাস না বলে সে যদি তোমাকে দশ বছর পরের কথা বলত, তাহলে কি তুমি দশ বছর অপেক্ষা করতে?’

    ‘কিন্তু এক মাস তো অপেক্ষা করাই যায়। ‘

    ‘আচ্ছা কর।’

    ‘কিন্তু আমার মাঝে মাঝে অদ্ভুত সমস্যা হয়।’

    ‘কী রকম?’ রুবা জানতে চায়।

    ‘আমি জানি সে মিথ্যা বলছে। কিন্তু সত্য হলে কেমন হবে, এ রকম নানান চিন্তা মনে আসে।’

    ‘কী রকম চিন্তা?’

    ‘এই যেমন সন্ধ্যায় যদি আমি মারা যাই, তাহলে রাতে রাতেই আমার ডেডবডি নিয়ে পিরোজপুর যেতে হবে। আগে থেকেই গাড়ি বুক করে রাখলে ভালো হয় না?’

    রুবা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।

    মোতালেব হোসেন ঠোঁটে সিগারেট রেখে বললেন, ‘ঢাকা থেকে পিরোজপুর যেতে আট থেকে দশ ঘণ্টা সময় লাগে। ভোর বেলায় আমরা যখন পৌঁছাব, লোকজন ঘুমে থাকবে।

    ৫

    মোতালেব হোসেনের এই সমস্যা বেড়েই চলেছে। বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকে, দূরের কোনো দৃশ্যের দিকে তিনি তাকাতে পারেন না। তার দৃষ্টি ছোট হয়ে আসে, যে রকম ছোট হয়ে আসে সময়।

    তিনি চাকরি করেন রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে। নতুন একটি প্রজেক্টের কাজ দেয়া হয়েছে তাকে। কাজটি শেষ হতে আরও দু বছর সময় লাগবে। এই মুহূর্তে দু বছর পরের ঘটনা তার কাছে রিয়েলিস্টিক না। তিনি বাস করছেন মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। Watchmen নামে যে সিরিজ তিনি দেখছেন সেটার আর মাত্র দুটি পর্ব তিনি দেখতে পারবেন।

    হঠাৎ করেই তার ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেল। আটতলা অফিসের লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলেন। তার কিছুদিন পর অফিস থেকে রিজাইন করে সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকেন। এমনকি ঘরের সব ছুরি, কাঁচি সরিয়ে ফেললেন। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালে মনে হয়, ওটা খুলে তার মাথায় পড়বে।

    হন্তদন্ত হয়ে রুবাকে বলেন, ‘সুমির মাকে বলবে, কাল থেকে আর না আসতে।’

    রুবা তাকে শান্ত করে। ‘সবকিছু নিছক কল্পনা।’

    ‘কিন্তু আমি আমার কল্পনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।’

    ‘এটা এক ধরনের রোগ। তোমাকে ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব।

    ‘আচ্ছা।’

    ‘এখন একটু ঘুমাবার চেষ্টা কর।’

    মোতালেব হোসেন উঠে গিয়ে সবগুলো ইলেকট্রিকের সুইচ বন্ধ করলেন। রুবা বললেন, ‘তুমি কি এই সমস্যার সমাধান চাও?’

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘তাহলে আমাকে গণকের কাছে নিয়ে চলো।’

    ‘কিন্তু আমি তাকে বলেছি, তার সাথে পরবর্তী সাক্ষাৎ হবে জুনের ২ তারিখ।’

    ‘না।’

    ‘তার মানে তুমি বিশ্বাস করছ, জুনের ১ তারিখে অপ্রীতিকর কিছু হবে মোতালেব হোসেন শক্ত গলায় বললেন, ‘অবশ্যই।’

    ‘তাহলে অফিস থেকে রিজাইন দিলে কেন?’

    ‘এমনও তো হতে পারে, গণক তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করার জন্য নিজেই কাজটি করলেন। তাকে কোনো সুযোগ দিতে চাই না।’

    ‘তোমার কেন এ রকম মনে হয়?’

    ‘এতে করে সবচেয়ে বেশি লাভবান তিনি হবেন। হুড়হুড় করে তার ব্যবসা বেড়ে যাবে।’

    রুবা চুপ করে তাকিয়ে থাকেন। মোতালেব হোসেন বললেন, ‘থানায় জিডি করব ভাবছি।’

    ‘কী বলবে?’

    ‘যা সত্য তাই বলব।’

    তাহলে বিছানা সরালে কেন?’

    ‘সিলিং ফ্যান খুলে পড়লে সরাসরি আমার মাথায় পড়বে।’

    ‘এ রকম কিছু ঘটবে কেন মনে হচ্ছে? গণক নিশ্চয়ই এই ঘরে এসে ফ্যানের নাট ধরে কিছু করেননি।’

    ‘তা করেননি। কিন্তু আমি আমার কল্পনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।’

    ‘কিন্তু তুমি এটাও বিশ্বাস কর, অপ্রীতিকর কিছু হবে না।’

    মোতালেব হোসেন চিন্তা করতে শুরু করলেন। একটা সুস্থ সফল চিন্তাসম্পন্ন হবার জন্য যে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়, সেখানে কোনো এক জায়গায় তার সমস্যা হচ্ছে। একটা ইমেজ থেকে ছোট ছোট অনেক ইমেজ তৈরি হয়। বৃত্তের বাইরে থেকে সব ইমেজকে একসাথে দেখতে হয়। কিন্তু তিনি বৃত্তের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন।

    হঠাৎই তার ঘুম ভেঙে যায়। দুঃস্বপ্নের রেশ লেগে আছে চোখে। রুবাকে জাগিয়ে তুললেন। বললেন, ‘প্রত্যেকটি ইমেজের ভেতরে ঢুকলে আরও কিছু ইমেজ তৈরি হয়। আলাদা আলাদা বৃত্ত।’

    রুবা ঘড়ির দিকে তাকায়। তিনটা বেজে চল্লিশ মিনিট। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ঘুমাবার চেষ্টা কর।’

    ৬

    মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ।

    একদিন সকালে দুজন যুবক দরজায় কড়া নাড়ে। ডোর ভিউয়ার গ্লাস দিয়ে যতটুকু পরখ করা যায়, তাতে করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ছেলে দুটি অচেনা।

    তাদের পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে এসেছে।

    মোতালেব হোসেন দরজার ভেতর থেকে বললেন, কার কাছে এসেছেন?’

    ‘মোতালেব হোসেনের কাছে।’

    ‘কী প্রয়োজন?’

    ‘ভেতরে এসে বলি?’

    মোতালেব হোসেন চিন্তা করার জন্য সময় নিলেন। তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আগন্তুকগণ পুনরায় কড়া নাড়ে।

    ‘পরিচয়?’

    ‘আমরা মেন্টাল হেলথ নিয়ে কাজ করি।’

    ‘আমার কাছে কেন?’

    ‘ভেতরে এসে বলি? বেশি সময় নেব না।’

    তাদের বসতে দেয়া হলো। বাম পাশ থেকে দুজনের নাম যথাক্রমে মাসুক এবং রানা।

    ‘গোয়েন্দার লোক নাকি?’

    তারা দুজন চুপ করে বসে আছে। প্রশ্নটি কাকে করা হয়েছে, স্পষ্ট না। মোতালেব হোসেন প্রসঙ্গটি ধরে রেখে বললেন, ‘তোমরা দুজন মিলে তাহলে মাসুদ রানা।’

    মাসুক বলল, ‘আমার নাম মাসুক, মাসুদ না।’

    তাদের কথা শুনে মোতালেব হোসেন তব্দা খেয়ে গেলেন। তারা এসেছে একটি গবেষণার কাজ করতে। গবেষণার বিষয় নিয়ার ডেথ মোমেন্ট’

    ‘মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থাকলে একজন মানুষ কীভাবে ব্যাপারটা ফেস করে, তা নিয়ে আমরা কিছু থিসিস করছি।’ বলল মাসুক।

    মোতালেব হোসেন বেশ অবাক হলেন। এত কাজ থাকতে এ রকম একটি কাজ মানুষ বেছে নিতে পারে! বললেন, ‘তোমাদের কেন মনে হলো, আমি মারা যাব?’

    ‘আমাদের মোটেও এ রকম মনে হয়নি।’

    ‘তাহলে?’

    ‘সেটা আপনি ভাবছেন। আমরা না।’

    ‘এত সব জেনেছ কোথায়?’

    কথা এড়িয়ে মাসুক আগের কিছু কাজের নমুনা পেশ করে। রানা তাকে সাহায্য করছে। ফাইল থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে টেবিলে রাখছে।

    মাসুক বলল, ‘এর আগে আমরা আরও চারজন মানুষের সাথে এই গবেষণা করেছি। এদের তিনজন ছিলেন আইসিউর পেশেন্ট, আর একজন আত্মহত্যা করেছেন।’

    ‘কিছু মনে করবে না, তোমাদের কাজটা কী?’

    ‘মৃত্যুর আগ মুহূর্তে একজন মানুষের মানসিক অবস্থা কেমন থাকে? এসব নিয়ে একটা গবেষণা।

    যিনি আত্মহত্যা করেছেন তিনি কি করার আগে বলেছিল তোমাদের?’ রানা মাথা নাড়ে, ‘জি বলেছিল।’

    ‘তাকে থামালে না কেন?’

    ‘আমরা কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না। কাউকে বোঝানো

    কিংবা উপদেশ দেয়া আমাদের কাজ না।’

    ‘সে কেন সুইসাইড করেছিল? ফ্রাস্টেশন থেকে?’

    ‘তা তো ছিলই। এর মূলে ছিল ঘৃণা।’

    ‘ঘৃণা?’

    ‘প্রচন্ড ঘৃণা করত নিজেকে।

    মোতালেব হোসেন উঠে গিয়ে চা বানিয়ে আনলেন। একটু দেরি করে ফেরার খেসারত দিতে গিয়ে বললেন, ‘বাসায় কাজ করতেন যিনি, আপাতত নেই।’

    অনেকক্ষণ বাদে বাক্যশূন্য কিছু সময় অতিবাহিত হয়। মোতালেব হোসেন নতুন উদ্যমে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা মোট কয়টা থিসিস করবে?’

    ‘পাঁচটা।’ জবাব দেয় মাসুক।

    ‘আমি হলাম তোমাদের শেষ কেস স্টাডি?’

    ‘জি।’

    ‘এর আগের চারজনই মারা গেছে।’ বলতে বলতেই টেবিলের ওপর থেকে একটা ফাইল বের করে বলল, ‘কেস স্টাডি ১-নাম আতাহার আলি। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার হঠাৎ মনে হয়েছিল, তিনি নরকে যাবেন। ডক্টর তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখত। যতক্ষণ জেগে থাকতেন. জিনিসপত্র ভাঙতেন।

    ‘মৃত্যুর আগে আগে আর কী চিন্তা আসে মানুষের?’ জিজ্ঞাসা করলেন মোতালেব হোসেন।

    ‘একেকটা মানুষ একেক ধরনের ফেইজের ভেতর দিয়ে যায়।

    ব্যাপারটা মোতালেব হোসেনের কাছে খুবই রোমাঞ্চকর। তিনি তাদের অনুমতি দিলেন, তার সাথে থাকার। পরদিন তারা দুজন রীতিমতো বালিশ/ কাঁথা নিয়ে হাজির। খামে করে কিছু টাকা দিয়ে বলল, ‘আগামী দশ দিনের থাকা খাওয়ার যে খরচ; তার কিছু অ্যাডভান্স।

    মোতালেব হোসেন কিছুটা হতভম্ব। হাতে খাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মাসুক বলল, ‘আমাদের সব খরচ প্রতিষ্ঠান বহন করবে। আপনি খামাখা চিন্তা করবেন না।’

    একটা আধা স্টোর রুমকে ঘষামাজা করে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। রাতে খাবারের পর মোতালেব হোসেন বললেন, ‘তোমাদের এই গবেষণা কার্যক্রম কবে থেকে শুরু হবে?

    মাসুক বলল, ‘ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

    ‘কীভাবে?’

    ‘আমরা আপনাকে বোঝার চেষ্টা করছি।’

    ‘কিন্তু এটা আমার জন্য সমস্যা। ইতস্তত লাগে।’

    খানিক বাদে নিজেই উঠে গিয়ে চা নিয়ে এলেন। বললেন, ‘তোমাদের এই গবেষণা মানুষের কী কাজে লাগবে?’

    ‘হয়তো কাউকে বাঁচতে সাহায্য করবে।’ বলল মাসুক। রানা মাথা নাড়ে।

    ‘একজন মৃত্যুপথযাত্রীর কথা লিখে অন্যদের বাঁচাতে চাইছ?’

    ‘অনেকটা তাই।’

    ‘যে মারা যাচ্ছে, তাকে বাঁচাবার চেষ্টা না করে?’

    ‘সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই অনেকেই কাজ করছেন। আমাদের সেক্টর আলাদা।’

    মোতালেব হোসেন শব্দ করে হাসলেন। বললেন, ‘শেষমেশ গণকের কথা সত্য না হলে তোমাদের পরিশ্রম বিফলে যাবে।’

    মাসুক জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার কেন মনে হয় গণকের কথা সত্য হবে?’

    রানা কাগজ কলম বের করে। তার মূল কাজ মাসুককে অ্যাসিস্ট করা। মোতালেব হোসেন বললেন, ‘এর কোনো লৌকিক কারণ নেই। আমার স্ত্রী বলে, আমি আমার কল্পনাকে বিশ্বাস করি।’

    ‘একটু ব্যাখ্যা করবেন?’

    ‘কল্পনা আর সত্যের মাঝে যে ফারাক আছে, সেখানে একটা গন্ডগোল লেগে যায়।’

    ‘কী রকম?’ মাসুকের চোখ সরু হয়ে ওঠে।

    ‘গভীর ঘুমে স্বপ্নকে যে রকম সত্য মনে হয়।

    ‘কিন্তু ঘুম ভাঙার পর সেই ধারণা কেটে যায়।’

    ‘আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়। যখন রিয়্যালিটিতে ফিরে আসি, ইচ্ছে করে

    গণককে ধরে কুয়ার সামনে এনে বেঁধে রাখি।’

    ‘আপনি অধিকাংশ সময় কল্পনায় বাস করেন?’

    ‘সেটাই যদি হতো, তোমাদের সাথে কথা বলছি কেমন করে?’

    ‘তাহলে?’

    ‘রিয়্যালিটি আর কল্পনা এ দুটা একসাথে থাকতে পারে। এখানে কোনো বিরোধ নেই। আমার সমস্যা হলো ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি।’

    মাসুক মাথা নাড়ে ‘ও আচ্ছা।’

    মোতালেব হোসেন বললেন, ‘যত দূর যেতে হয়, হারিয়ে গেলে ফিরে আসা ততটাই কঠিন। সেই কঠিনকে মেনে নিলে হারানো খুব সহজ।’

    ৭

    এভাবে কয়েকটা দিন কেটে গেল। দিন দিন মোতালেব হোসেনের আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে পায়চারি করেন। তারা খোঁজেন গ্রীষ্মের আকাশে। আতাহার আলীর মতো তিনিও কি নরকে যাবেন? স্বাদহীন হয়ে ওঠে জিহ্বা, সকালের সূর্য দেখে মনে হয় দুপুর হলেই নিচে নেমে আসবে। তপ্ত আগুনে ছাই হবে লাল রক্ত।

    খুব প্রয়োজন পড়লেও বাসা থেকে বের হন না। সব সময় যে খুব আতঙ্কে থাকেন, তা না। কখনো কখনো ভালোও লাগে। মৃত্যুর অনুভূতি কেমন সেটা মারা না গেলে জানার উপায় নেই। জানতে ইচ্ছে করে। কাউকে জানাতেও ইচ্ছে করে। রুবাকে ডেকে বললেন, ‘মৃত্যু মানে শেষ, এটা সত্য না। মৃত্যু চলমান। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া।’

    ‘এখন এসব তাত্ত্বিক কথা না ভাবলেও চলবে।’

    ‘কখন ভাবব? মারা যাবার পর?’

    ‘তোমাকে কতবার বলেছি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে।’

    ‘তারা নিজেরাও নানান সমস্যায় সুইসাইড করে।’

    ‘তুমি কি আবার সুইসাইডের কথা ভাবছ?’

    মোতালেব হোসেন বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আমি কি খুব অস্বাভাবিক আচরণ করছি?’

    ‘দারোয়ানকে দিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়েছ। মানুষ কী ভাববে বল তো?’

    ‘একা থাকতে চাওয়া, তোমার কাছে অস্বাভাবিক?’

    ‘থাকতে চাওয়ার কারণ অস্বাভাবিক।’ কিছুটা থেমে রুবা বললেন, ‘তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস অন্য রকম ছিল।’

    ‘কী রকম?’

    ‘প্রচণ্ড বিচক্ষণ আর যুক্তিবাদী।’

    ‘তোমার কি ধারণা আমি গণকের কথা বিশ্বাস করি?’

    ‘সব সময় না, মাঝে মাঝে কর।’

    ‘আমার ভেতরে একটা ভয় ঢুকে গেছে। মনে হয় এই লোকটা আমাকে মেরে ফেলবে।’

    ‘কেন এ রকম মনে হয়?’

    ‘সে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়, এই জিনিস রটাতে চায়।’

    রুবা আশ্বস্ত করেন, ‘এ রকম কিছু হবে না।’

    ‘সতর্ক থাকা ভালো।’

    ‘দরজায় তালা লাগিয়ে ঘরে বসে আছো। আর এদিকে চেনা-জানা নেই; দুটা অচেনা ছেলেকে থাকতে দিলে।’

    মোবারক হোসেন চিন্তিত হয়ে বসে আছেন। রুবা রসিকতা করে বললেন, ‘এমনও হতে পারে, এদের দুজনকে গণক পাঠিয়েছে। তোমাকে মেরে ফেলার জন্য।’

    ‘মাসুককে আমি বিশ্বাস করি।’

    ‘কেন?’

    ‘জানি না। মনে হয় চোখ দেখে। কথা বলার সময় চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। সহজে পলক ফেলে না।’

    ‘চোখ দেখে মানুষকে বিশ্বাস করা যায়?’

    ‘কথায় আছে, নিজের চিন্তাগুলো সন্দেহ কর, বিশ্বাসকে না।’

    ‘কিন্তু তুমি নিজেই এই কাজটি করছ। নিজের সন্দেহকে বিশ্বাস করছ আর বিশ্বাসকে সন্দেহ।’

    মোতালেব হোসেন চিন্তিত হয়ে পড়েন। রুবার কথা তিনি ফেলে দিতে পারছেন না। আবার স্বীকারও করতে চাইছেন না। গণকের কথা যদি সত্য হয়? কারো একটা মিথ্যা কথা তার সকল সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু একটা সত্য কথা, তার আগের মিথ্যাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ তো করেই না, উল্টো, সেই সত্যকে লোকে সন্দেহ করে বসে।

    ৮

    মে মাসের ত্রিশ তারিখ। প্রখর দাবদাহে গলা শুকিয়ে যায়, এ রকম একটি দুপুর। মোতালেব হোসেন ঘন ঘন পানি পান করছেন। প্রচণ্ড উত্তেজনায় বারবার ঘড়ি দেখছেন। সেকেন্ডের কাঁটাগুলোকে মনে হচ্ছে, কেমন হুড়োহুড়ি করে ছুটছে। একটানা দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকার কারণে,

    একসময় মনে হলো, ভুল করে কাঁটা বাঁ দিকে ঘুরছে। ঘড়ির কাঁটা আসলেই ডান দিক দিয়ে ঘোরে কিনা, নিশ্চিত হবার জন্য তিনি অন্য একটি ঘড়ির দিকে তাকালেন।

    সাংঘাতিক কাণ্ড হলো, সেখানেও ঘড়ির কাঁটা বাঁ-দিকে ঘুরছে। তার কাছে ভারি আশ্চর্য লাগল, মনে হলো পৃথিবী উল্টো দিকে ঘুরছে।

    মাসুককে ডেকে বললেন, ‘আমার এক ধরনের ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশন হচ্ছে।

    মাসুক বলল, ‘উত্তেজনা থেকে এমন হচ্ছে। শান্ত হয়ে বসুন।’

    ‘তুমি একটা কাজ করতে পারবে?’

    ‘কী?’

    ‘আমাকে কিছু ঘুমের ট্যাবলেট দাও। ঘুমের ভেতরে যত সময় পার করতে পারি।’

    ‘কিন্তু আপনি সেখানে দুঃস্বপ্ন দেখবেন। ‘

    তুমিও দেখি ভবিষ্যদ্বাণী করছ।’

    মাসুক জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি কি স্বপ্নগুলো লিখতে শুরু করেছেন?’

    ‘লেখার আর সময় পেলাম কোথায়।’

    ‘যা দেখবেন লিখে ফেলবেন। স্বপ্নের মধ্য দিয়ে একজন মানুষকে অর্ধেক জানা যায়।’

    ‘বাকি অর্ধেক?’

    ‘সেটা জাগতিক।’

    ‘ইদানীং স্বপ্নে নিজেকে মৃত দেখছি।’

    ‘নেতিবাচক চিন্তা থেকে এমন হয়।’

    ‘ঘুম থেকে উঠে দেখি সামনের পাটির দাঁতগুলো বিছানায় খুলে পড়ে আছে। আমি একটা একটা করে দাঁত উঠিয়ে হাতের মধ্যে জমা করছি।’

    ‘ভয় থেকে এমন হয়। আপনার উচিত হবে দরজার সামনের তালা খুলে দেয়া। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা।’

    ‘কিসের ভয়?’

    ‘নিরাপত্তাহীনতা থেকে মানুষ এই জাতীয় দুঃস্বপ্ন দেখে।’

    ‘জ্ঞানের কথা জানার জন্য তোমার সাথে কথা বলার দরকার নেই। বই নিয়ে বসলেই হয়। ‘

    মাসুক চুপ করে বসে থাকে। পেশেন্ট যদি সাপোর্টিভ না হয়, কাজ করা খুব কঠিন।

    বাড়ির পেছনে কলাগাছ। সামনে একটি পুকুর। দেখতে যেন নদীর মতো না দেখায়, তাই পুকুরটা ছোট করে আঁকা। মনে হচ্ছে একটা টাইম মেশিনের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন তিনি। একে একে দেখতে পাচ্ছেন দুরন্ত শৈশব, মধ্যবয়সের স্ট্রাগল আর রুবার সাথে কাটানো একুশ বছর।

    সন্ধ্যায় নিজে চা বানিয়ে খেলেন। অনেকদিন পর নামাজ পড়লেন। যদি খোদার সাথে দেখা হয়, তবে এর চেয়ে খুশির আর কী হতে পারে! প্রাচীন সুফিগণ এই জাতীয় নানান কাব্য লিখেছেন। সেসব স্মরণ করে চোখ লেগে আসে সন্ধ্যায়। রাত অবধি ঘুম ভাঙতেই বিকট এক চিৎকার। এরকম কী হয় শেষ রাত?

    রুবা এগিয়ে আসে।

    ‘চব্বিশ ঘণ্টা পর যখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, তোমাকে নিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাব।‘

    ‘তার মানে এখন সবকিছু ঠিক নেই?’

    ‘না ঠিক নেই। আমি সারাক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছি।’

    ‘এতে অস্থির হবার কিছু নেই।’

    মোতালেব হোসেন মলিন গলায় বললেন, ‘আমার এই রহস্যময়

    অপেক্ষার মীমাংসা করো, প্লিজ।’

    রহস্যের কিছু নেই। এক ধরনের ডিলিউশন হচ্ছে।’

    ‘ডিলিউশন কেন হচ্ছে?’

    ডিলিউশন কেন হয় রুবার জানা নেই। গুগলে সার্চ করে দুটা কারণ পাওয়া গেছে। প্রথমটি হলো মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বিকারগত অনড়ত্ব, আর দ্বিতীয় কারণ হলো, স্ববিরোধী মানসিক অবস্থা।

    রাতে খাবারের পর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ডাকলেন মাসুককে। বললেন, ‘কিছু মনে করবে না, তোমাদের চলে যেতে হবে।’

    মাসুক বিস্মিত গলায় বলল, ‘হঠাৎ?’

    ‘হঠাৎ মানে এখনই। এখনই চলে যেতে হবে।’

    ‘কিন্তু কেন? আর মাত্র একদিন বাকি। আমরা এমনিতেই আগামীকাল সন্ধ্যার পর চলে যাব।’

    ‘তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’

    ‘অবিশ্বাস করার মতো কিছু করেছি?’

    ‘যখন বিশ্বাস করেছিলাম, তখন কি বিশ্বাস করার মতো কিছু করেছিলে?’

    মাসুক চুপ করে থাকে। তার মাথা কাজ করছে না। বলল, ‘গবেষণা কার্যক্রম প্রায় গুছিয়ে নেয়া হয়েছে। আগামীকাল উপস্থিত থাকতে না পারলে, অসম্পন্ন থেকে যাবে।’

    ‘তোমার গবেষণার কাজে সাহায্য করা নিশ্চয়ই আমার কাজ না। ‘কিন্তু আমাকে কেন অবিশ্বাস করছেন?’

    ‘আমার মনে হচ্ছে তোমরা আমাকে মেরে ফেলবে।’

    মাসুক বিস্মিত গলায় বলল, ‘আমরা আপনাকে মেরে ফেলব?’

    ‘তোমরা আমাকে মেরে ফেলবে তা বলি নাই। বলেছি, আমার তা মনে হচ্ছে।’

    রানা উঠে গিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানের সরকারি অনুমতি পত্রসহ ন্যাশনাল আইডি কার্ড পেশ করে। মোতালেব হোসেন কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন। আঙুল দিয়ে ইশারা করলেন এখনই চলে যেতে। দরজার তালা খুলে দিতে দারোয়ানকে ফোন করা হয়। ফোন রিসিভ হচ্ছে না। সেই সাথে উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে সবকিছু একই গল্পের প্লট।

    ৯

    সেই মহেন্দ্রক্ষণ। জুনের ১ তারিখ, সকাল বেলা।

    মোতালেব হোসেনকে নিয়ে যাওয়া হয় তার নিজ গ্রাম পিরোজপুরে। যেখানে কবর খোঁড়া হয়, মাটির ভেতর থেকে একটা হাত বের হয়ে আসে। হাতটি দেখে মনে হচ্ছে, কোনো একটি বাচ্চার ডান হাত। আঙুলগুলো ছোট ছোট। মোতালেব হোসেন পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, হাতটি তাকে গলা চেপে ধরবে। তিনি চিৎকার করে রুবাকে ডাকছেন। রুবা ছুটে আসে।

    ‘কী হয়েছে?’

    খানিকটা নীরবতা। চোখের পাতা হাতের তালু দিয়ে ঘষে বললেন, ‘এক গ্লাস পানি।’

    ‘আবারো দুঃস্বপ্ন?’

    বড় একটা দম নিয়ে বললেন, ‘এখন কয়টা বাজে?’ সকাল বারোটা।’

    ‘এখন সন্ধ্যা হয় কয়টায়?

    ‘ছয়টায়।’

    মোতালেব হোসেন মনে মনে হিসেব করেন, গণকের কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তার হাতে আর মাত্র ছয় ঘণ্টা সময় আছে। জীবনের শেষ ছয় ঘণ্টা তিনি কী করবেন, এ রকম একটি ছেলেমানুষি চিন্তা তার ভেতরে কাজ করে।

    চিন্তার পরের ধাপে, রুবার প্রতি তার খুব মায়া হয়। সে একা কেমন করে থাকবে! রুবার সাথে কাটানো একুশ বছরের টাইম ফ্রেম থেকে ফিরে এলেন; পুরনো প্রাচীর ঘেরা বাড়ির ছাদে, অন্ধকার রাতে কুয়ার ভেতর থেকে শব্দ ভেসে আসে। যেন বাতাসের শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে ধাক্কা দেয় কানে।

    মোতালেব হোসেন আয়নার সামনে এসে দাঁড়ান। আর কিছুক্ষণ পর নিজেকে কখনো দেখা হবে না; এ রকম একটি বার্তা, কোথায় যেন কে তাকে দিয়ে চলেছে। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ালেন। মরে যাবার পর তাকে দেখতে কেমন দেখাবে, সেটা নিয়ে খানিকটা চিন্তা করলেন। কল্পনার অবাধ স্বাধীনতায় চিন্তার ধরন বদলায়।

    একটা সাদা কাফনের কাপড় পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালে, এক অলীক ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ভয়ের ছায়া অনেক বড়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই ছোট।

    ১০

    পরদিন সকালে গণককে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মোতালেব হোসেন নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। যিনি মারা যাবার আগে তার নামে থানায় জিডি করে রেখেছিলেন।

    গণকের ভবিষ্যদ্বাণী কিংবা কাফনের কাপড় এল কোথা থেকে এই নিয়ে উভয় পক্ষের লোকজন, সত্য মিথ্যার সকল রহস্য উদ্ঘাটন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

    এমন সময় আদালতে হাজির হলেন মাসুক। তার গবেষণার প্রতিবেদন উত্থাপিত হলে সব কেমন নিঃসাড় হয়ে যায়। গল্পের স্বার্থে প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য তুলে দেয়া হলো।

    কেস স্টাডি ৫-জনাব মোতালেব হোসেন (মৃত) )

    মোতালেব হোসেন। বয়স, তেতাল্লিশ।

    তিনি তার কল্পনাকে সত্য বলে মনে করতেন। যে সত্য অযাচিত, অর্থাৎ তিনি মানতে পারছেন না কিংবা যে সত্যের কোনো অস্তিত্ব নেই; দুটা ক্ষেত্রেই তিনি ডিলিউশনের জগতে প্রবেশ করেন।

    উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, তার স্ত্রী রুবা। একদিন বসার ঘরে বসে কথা বলছিলাম এমন সময় তিনি রুবাকে ডেকে বলছিলেন, চায়ের ব্যবস্থা করতে। এমনভাবে বলছিলেন, শুনে মনে হলো, রুবা নামে কেউ হয়তো ভেতরের ঘরে আছেন। রুবাকে উদ্দেশ্য করে বললেও পরমুহূর্তে তিনি নিজেই উঠে গিয়ে চা বানিয়ে আনলেন। এরপর প্রায় সময় এই ব্যাপারটা ঘটতে থাকে।

    একা একা মুভি দেখার সময় এমনভাবে তর্ক করতেন রুবার সাথে, মনে হতো সে পাশেই বসে আছে। একসাথে পিয়ানো বাজাতেন, রান্না করতেন কিংবা নক্ষত্রের রাতে ফিরে যেতেন নস্টালজিক অতীতে।

    একুশ বছর আগে নিঃসন্তান এই দম্পতি একসাথে থাকতে শুরু করে। উনিশ বছর পর রুবা মারা যায়, রোড অ্যাকসিডেন্টে। তারপর দুটা বছর, মোতালেব হোসেন একধরনের ডিলিউশন ডিজঅর্ডারে ভুগছিলেন।

    রুবা নেই, এই সত্য তিনি মানতে পারেননি। তার কল্পনা করতে ইচ্ছা করে রুবা আছে। এটুকু প্রবণতা আমাদের সবার ভেতরেই থাকে। তার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, একসময় তিনি তার কল্পনাকে সত্য মনে করেন।

    সমস্যা আরও জটিল হয় তখন যখন তিনি নিজেই তার এই সমস্যার কথা জানতেন। রুবাকে দিয়ে তিনি নিজেই নিজেকে বলতেন, ‘তুমি

    তোমার কল্পনাকে সত্য মনে কর। এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো, সত্যকে তুমি কল্পনা মনে কর।

    বিস্তর খোলা প্রান্তরে কুয়াশা সরিয়ে খুঁজতে থাকেন রুবাকে। তিনি ভাবতেন তিনি তার কল্পনার নিয়ন্ত্রক কিন্তু তিনি এও জানতেন কল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

    প্রশ্ন আসে, গণকের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলো কী করে?

    ভয় থেকে। প্রচণ্ড ভয় থেকে একসময় তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, জুনের এক তারিখে তিনি মারা যাবেন। জুনের এক তারিখ দুপুরের পর, তার জানতে ইচ্ছা করে, মরে যাবার পর তাকে কেমন দেখাবে। একটা কাফনের কাপড় গায়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। প্রচন্ড ভয়ে মানসিক স্ট্রেস হারিয়ে স্ট্রোক করলেন।

    কাফনের কাপড় কোথায় পেয়েছেন, সেটা জানা যায়নি। সম্ভবত কোনো এক ফাঁকে জোগাড় করেছিলেন। কারণ প্রায় সময়ই তিনি মৃত্যু পরবর্তী সময় নিয়ে কথা বলতেন। রাত তিনটা বাজে ঘুম থেকে উঠে বলতেন, ভোরবেলায় আমরা যখন পিরোজপুর পৌঁছাব, লোকজন ঘুমে থাকবে।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশেষ – জুনায়েদ ইভান
    Next Article শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – জুবায়ের আলম

    Related Articles

    জুনায়েদ ইভান

    শেষ – জুনায়েদ ইভান

    August 14, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.