Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অন্যমনস্ক – জুনায়েদ ইভান

    জুনায়েদ ইভান এক পাতা গল্প83 Mins Read0

    সাবজেক্ট < অবজেক্ট

    ১

    একটা ভেজা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে কদমগাছের নিচে। এখানে অবজেক্ট কোনটি? ভেজা কুকুর নাকি কদম ফুল? এ রকম একটা চিন্তার ব্যাঘাত ঘটে আকস্মিক লোডশেডিংয়ে। আলোর রূপান্তর চোখের ইন্দ্রিয়কে সচেতন করে তোলে। রঙের অনুভূতি পরিবর্তন হয়।

    ঘটঘট শব্দ করে বন্ধ হয় সিলিং ফ্যান। সিলিং ফ্যানের একটি পাখা অর্ধেকটা ভাঙা। সেটাকে বিন্দু বানিয়ে ঘুরাতে লাগলাম আমার চোখগুলো। পাখা ঘুরতে ঘুরতে দেয়ালের কোনখানে নিশানা করে থামবে, এটি দেখার তীব্র এক বাসনা নিয়ে অপেক্ষা করছি-এমন সময় ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটের মতো একটা নীল আলো ঘরে প্রবেশ করে; তারপর বিকট শব্দে চিৎকার।

    একের পর এক বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে আমার চোখ ফের জানালায় গিয়ে ঠেকে। ভেজা কুকুরটি একটা সঙ্গী পেয়ে যায় বাঁচার। তাদের দুজনের ভেতরে সূক্ষ্ম অনুভূতি আদান-প্রদান হচ্ছে; এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে যুথি। বলল, ‘টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে।’

    ‘এখনো ক্ষিদে পায়নি’ বলা উচিত হবে কিনা ভাবছি, কেননা ডাইনিং রুম থেকে যুথির বাবা, মানে আমার শ্বশুরের কণ্ঠ ভেসে আসছে।

    যুথি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে দেখতে অনেকটা মার্কিন মডেল বেলা হাদিদের মতো লাগছে। ‘গোল্ডেন রেশিও’ পদ্ধতিতে বেলা হাদিদের মুখমণ্ডল ৯৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ নিখুঁত।

    আমি বললাম, ‘সৌন্দর্যের একটি গাণিতিক সংজ্ঞা আছে, তুমি জানো?’ যুথি কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। সূক্ষ্ম ব্যবধানের উৎপত্তিস্থল; নাকি কিছু একটা, যেটা আমি চিন্তা করতে পারছি না।

    আমি চিন্তা করতে পারছি আজ একটি বিশেষ দিন। সকাল সকাল আমাকে নতুন পাঞ্জাবি দেয়া হয়েছে, যার প্রাইস ট্যাগ এখনো ওঠানো হয়নি। পাঞ্জাবির পকেটে চিরকুট। সেটা এখনো পড়ে দেখা হয়নি। পাশের ঘর থেকে আমার শ্বশুরের কণ্ঠ ভেসে আসছে-’আনিছ!’

    প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত হতাম। একদিন যুথিকে বললাম, ‘দন্তস্য এর উচ্চারণ স্থান অগ্র দন্তমূল। তোমার বাবা এ রকম বিশ্রী করে আনিছ ডাকে, ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না।’

    ‘এটাও একটা অভিযোগ?’

    ‘অভিযোগ না, সমস্যা।’

    যুথি বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘কী ধরনের সমস্যা?’

    ‘যেসব জিনিস আমরা এড়িয়ে যাই, আমাদের অবচেতন মন সেসব জিনিস রেখে দেয়।’

    যুথির বিরক্তিকে দীর্ঘায়িত করতে চাইনি। ‘মনের যে ইচ্ছেকে আমরা দমিয়ে রাখি, সেটা কেমন করে আমাদের দমিয়ে রাখে’ এই নিয়ে একটা কিছু বলতে গিয়ে আর বলা হয়নি। সারাক্ষণই আমার এ রকম হয়। আমার কাছে মনে হয়, আমি কাউকে কিছু বোঝাতে পারি না।

    পাশের ঘর থেকে আমার শ্বশুরের কণ্ঠ ভেসে আসছে–আনিছ!’

    কিছুটা শব্দ করে ডাকার কারণে এবার ‘ছ’-এর সাথে একটা শিষ

    বাতাসে দুলছে, যার স্থায়িত্বকাল খুব করুণ।

    আমি বললাম, ‘আসছি।’

    ঘটঘট শব্দ করে সিলিং ফ্যান চলতে শুরু করে। আলোতে যুথিকে অচেনা লাগছে। হয়তো চোখ সয়ে যাবে। আলোর মতো মানুষের অনুভূতি ও কি সয়ে যায়? আমি কি যুথিকে এই ব্যাপারটা বোঝাতে পারব কখনো, আলোতে তাকে অচেনা লাগছে! নীল রং অন্ধকারে বেগুনির মতো দেখায়। কিংবা এক একটি রং অসংখ্য গোত্রে বিভক্ত।

    টেবিলে খাবার সাজানো। কালা ভুনা, শর্ষে ইলিশ আর সুরমা মাছের শুঁটকি। আমার শ্বশুর বাবা একটি হাঁসের প্রিন্টের গেঞ্জি পরে ঢেকুর তুলছেন। গেঞ্জির কিছু জায়গায় প্রিন্ট উঠে যাওয়ায় হাঁসটির মাথা মুছে গেছে। পা একটি নেই। বিশ্রী লাগছে।

    আমরা কথা বলছি বৈশ্বিক জলবায়ুর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের মশা থেকে কেমন করে তিনি ফরাসি বিপ্লবে চলে এলেন, সেটার একটা ছক আমার মাথায় নোট করা আছে। ঢেকুরের শব্দটা এখন বমির মতো লাগছে। আমি তাকে পানি খেতে বললাম।

    তিনি বললেন, ‘ফ্রান্সের শেষ রাজা লুইকে কীভাবে শিরশ্ছেদ করা হয়েছে জানো?’

    রাজা লুইকে কীভাবে শিরশ্ছেদ করা হয়, জানতে ইচ্ছে করছে না। আমার শ্বশুর বাবা প্লেটে এক টুকরো আমের আচার দিয়ে বললেন, ‘প্রথমবার তার ঘাড় সম্পূর্ণ কাটতে পারেনি। লুইয়ের রক্ত যখন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে, কয়েকজন লোক রুমালে করে সেই রক্ত রেখে দেয়।

    আমি বললাম, ‘আপনি নিজেও একটি পঙ্গু হাঁসের শিরশ্ছেদ করেছেন। আমার কথা শুনে তিনি প্রথমে হকচকিয়ে গেলেন। তারপর আমি যখন প্রিন্ট উঠে যাওয়া গেঞ্জির কথা বললাম; মুখের খাবার শেষ না করে হাসতে লাগলেন। খাবার ছিটকে পড়ছে প্লেটে, পানির জগে এমনকি আমার মুখে!

    হাসি সংক্রামক। কিন্তু কেউ সংক্রমিত হলো না।

    আমার শাশুড়ি বিরক্তি নিয়ে মাছের কাঁটা বাছতে লাগলেন। যুথিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আনিছকে আরেকটা মাছ দাও।’

    আমার অস্বস্তি লাগে। দন্তস্য উচ্চারণে তার কোনো সমস্যা নেই। এমনকি কিছুদিন আগেও তিনি আমাকে ‘আনিস’ বলেই ডাকতেন। একে বলে, সাত নকলে আসল খাস্তা।

    এই বাড়িতে প্রথম এসেছি বছর তিনেক আগে। তখন মাঘ মাসের শীত। লাল নীল আলোয় সজ্জিত বাড়ির দেয়াল, আর গেট। ধুমধাম বিয়ের আয়োজন। আলখাল্লা পরিহিত এক হুজুর উপস্থিত সুধীজনকে সাক্ষী রেখে বললেন, ‘বলুন কবুল।’

    আমি বললাম, ‘আলবৎ।’

    আমার কথা শুনে হুজুর চমকিত হলেন। বললেন, ‘আলবৎ কী? বলুন কবুল!’

    আমি বললাম, ‘কবুল।’

    আমার শ্বশুর দুটি খোরমা খেজুর হাতে দিয়ে বললেন, ‘এসো তোমাকে বাসা ঘুরিয়ে দেখাই।’

    আমি একটা ব্যাগ নিয়ে এসেছিলাম। সেটা হাতে নিয়েই তার সাথে উঠে দাঁড়ালাম। ছিমছাম পুরনো দিনের বাসা। ডাইনিং কর্নারে একটি রুম দেখিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার ঘর।’

    ঘরের দেয়ালে যুথির কিশোরী বয়সের একটি ছবি। পরিপাটি বিছানা। একটি আলমিরা, আমি ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে রাখি। রাতে খাবার সময় আমার শ্বশুর চারশ বছর পুরনো একটি গল্প বললেন। গল্পের মান অত্যন্ত নিম্ন।

    ঘরজামাই হয়ে থাকতে গিয়ে আমার প্রথম যে বোধগম্য, তা হলো মনের দ্বৈধতা। নানান চিন্তা নিজের ভেতরে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। দ্বন্দ্ব প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু আমি প্রকাশ করতে পারি না। একটা সিগারেট মুখে নিয়ে সারা ঘর চষে বেড়াতে পারি না। কিংবা মেজাজ বিগড়ে গেলে যুথিকে শব্দ করে একটা কিছু শোনাতে পারি না।

    সেদিন রাতে যুথিকে প্রথম কাছ থেকে দেখি। কেমন গুটিসুটি হয়ে আমার পাশে এসে বসে। হাতে চায়ের কাপ। আমি বললাম, ‘তোমাদের ছাদটা বেশ সুন্দর।‘

    যুথির চোখ ছোট হয়ে আসে। সারা দিনের ধকল তখনো কাটিয়ে ওঠেনি। বিছানার এক কোণে চুপ করে বসে ছিল। তারপর কী একটা বলতে গিয়ে ফের সামলে নেয়। কিছুক্ষণের নীরবতা, শান্ত নিঃশ্বাস। হাতে চায়ের কাপ। দৃষ্টি অন্যমনস্ক। কিংবা খুব মন দিয়ে কিছু ভাবছে বলে এ রকম দেখাচ্ছে।

    তারই মধ্যে করুণ সুরের মতো বেজে চলেছে রাস্তায় রিকশার ঠুন ঠুন আওয়াজ। যুথি উঠে গিয়ে জানালা লাগিয়ে দেয়। শব্দ কি তার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে? বিছানায় পড়ে থাকা চায়ের কাপ। সেটা তার নিজের জন্য নাকি আমার জন্য?

    আমি বললাম, ‘চলো আমরা ছাদে গিয়ে বসি।’

    ‘ছাদে তালা দেয়া।’

    ‘তাহলে চলো বাইরে কোথাও যাই। দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

    ‘এত রাতে?’ যুথির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

    ‘রাত সমস্যা?’

    ‘এত রাতে কোথায় যাবেন?’

    ‘আমাকে আপনি করে বলছ কেন?’

    যুথি চুপ করে থাকে।

    আমি বললাম, ‘বলো এত রাতে কোথায় যাবে?’

    ‘এত রাতে কোথায় যাবে?’

    ‘জানি না।’

    ‘কী জানো?’

    যুথি হেসে ফেলে। বাইরে মাঘ মাসের জোছনা। আমরা দুজন ঘণ্টা হিসেবে রিকশা ভাড়া করি। ঘণ্টায় দেড়শ টাকা। কুয়াশায় আচ্ছন্ন রাতের শহর। প্রায় অচেনা একটি মেয়ে, মাঝেমধ্যে চেনা মানুষের মতো করে তাকায়।

    একজন অচেনা মানুষের চেনা দৃষ্টি আর একজন চেনা মানুষের অচেনা দৃষ্টি-এই দুটা ব্যাপার খুব ভয়াবহ। প্রথমটিতে মিথ্যাকে সত্য আর দ্বিতীয়টিতে সত্যকে মিথ্যার মতো মনে হয়।

    তারপর আরও কিছু সময় আমরা বসে ছিলাম শব্দহীন, যেন অচেনা এক আগন্তুক নেমে যাবে সামনে। তার গানের গলা কেমন? ঘুমের ভেতর কথা বলে? পড়ন্ত রেললাইনে যখন ট্রেন থামে, যাত্রীরা ওঠানামা করে, হকারের চিৎকারে একটা ঘুঘু যদি নেমে আসে নিচে, সেকি বুকে ধূসর রং দেখে?

    মানুষ যখন মনে মনে কথা বলে তখন তার চোখ খুলে যায়। কিন্তু আমরা কেউ কারো চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। যুথির পরনে বিয়ের লাল শাড়ি। আমি যে তাকে বিয়ে করেছি, এই ব্যাপারটা বেশির ভাগ সময় আমার মনে থাকে না। যখন মনে পড়ে খুব অস্বস্তি লাগে।

    বললাম, ‘একদিন তোমাকে আমাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাব, দিনাজপুর। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়।’

    যুথি পাশ ফিরে তাকায়। তার দৃষ্টি আমার চোখ থেকে বুক পর্যন্ত একটি ত্রিভুজ আকৃতির বৃত্ত তৈরি করেছে। আমি বললাম, ‘আধা পাকা ধানখেত আর ডোবা পুকুরের ওপর দিয়ে প্রাচীন বরফের পর্বত।’

    ‘মেঘের মতো?’

    ‘হ্যাঁ, মেঘের মতো। যে মেঘ দাঁড়িয়ে থাকে।’

    যুথি চুপ করে থাকে। সে কি এ রকম একটা মেঘ কল্পনা করছে? ম্যাকারেল মাছের আঁশের মতো কিছু মেঘ গুমোট বেঁধে আছে মধ্য আকাশে।

    মানুষের সব চিন্তা যে রকম শূন্যে গিয়ে থামে, তেমনি শরীরের কিছু স্নায়ু হাতের আঙুলে এসে শেষ হয়। সবচেয়ে তীব্র স্পর্শ হয় আঙুলের ডগায়।

    সেদিন মধ্যরাতে আমি প্রথমবার আবিষ্কার করি, যুথির আঙুলগুলো মায়ের মতো। টানা টানা লম্বা কিন্তু মাঝে একটা ঢেউ আছে।

    বললাম, ‘তোমাকে একদিন কাঞ্চনজঙ্ঘায় নিয়ে যাব। কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে সোজা বুড়িমারী বর্ডার। তারপর শিলিগুড়ি হয়ে একটা জিপে চড়ে দার্জিলিং।

    যুথি কেমন করে যেন তাকায়। আমি মানুষের চাহনি বুঝতে পারি না। কাউকে বোঝার চেয়ে কঠিন কাজ হলো, কাউকে বুঝতে না পারা।

    বললাম, ‘তুমি ক্যালিগ্রাফি শিখেছ কোথায়?’

    ‘বাবা দেখিয়েছে?’ জিজ্ঞাস করে যুথি।

    ‘না। বায়োডাটায় দেয়া ছিল।’

    ‘তুমি জানো ক্যালিগ্রাফি কেমন করে এসেছে?’

    ‘কেমন করে?’

    ‘আগে মানুষ গুহার দেয়ালে ছবি আঁকত। একটা হরিণ হেঁটে গেছে। এই ব্যাপারটা তারা এঁকে বোঝাত। তারপর যখন অক্ষর এসেছে, তারা ছবির মতো শব্দ আঁকতে শুরু করে।’

    কী দারুণ শিল্প। একটা হরিণ বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে। ছোট একটা মেঘ নেমে এলে পায়ের ছাপ গাঢ় হয়। সে রাতে আমাদের কথা হয়েছিল নানান অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে। হরিণের পায়ের ছাপের মতো আন্দাজ করার চেষ্টা- একে অন্যকে।

    তারপর একসময় সে জিজ্ঞাসা করে, আমি কী করি।

    বললাম, ‘সেটা না জেনেই বিয়ে করেছ?’

    ‘তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই।’

    ‘চেষ্টা করছি।’

    ‘কী চেষ্টা করছ?’

    ‘সেটা জানলে তো বলতাম।’

    ‘আমি কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের অপর্ণা না।’

    ‘আক্ষেপ হচ্ছে?’

    ‘আক্ষেপের জন্য জীবন খুব ছোট।’

    ‘জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিক কী জানো?’

    ‘কী?’

    ‘সামনে কী অপেক্ষা করছে আমরা জানি না।’

    ‘আর সবচেয়ে অসুন্দর?’

    ‘মানুষের আক্ষেপ।’

    ‘তুমি কি আমাকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করছ?’

    ‘আমার সম্মোহন করার ক্ষমতা পিঠ চুলকানো পর্যন্ত।’

    যুথি হাসতে থাকে। খুব কম মানুষ আছে যারা একটা দুঃখকে হাসাতে জানে। আমি সেই দুঃখকে ভালোবাসি।

    কুয়াশা ঠেলে আমাদের রিকশা এগিয়ে যায়। হাজার বছরের শীত অতিক্রম করে আমরা তখন একে অন্যের প্রত্যেকটি আচরণ পরখ করে দেখছি। বিস্মিত হলে কেমন করে তাকায়, কিংবা যেভাবে ভাবে মনে মনে; আমি সেই মনকে কাছ থেকে দেখি।

    বললাম, ‘খড়-পাতার আগুন নাকি খেজুরের রস?’

    ‘খড়-পাতার আগুন।’

    ‘হলদে শর্ষে মাঠ নাকি সাদাকালো পাখি?’

    ‘সাদাকালো পাখি।’

    ‘কী নাম পাখির?’

    ‘মাছরাঙা।’

    ‘দলছুট?’

    ‘কী করে বুঝলে?’

    আমার রহস্যে মাখা হাসি। সেটা প্রাণহীন হতে না হতেই যুথি বলল, ‘কী করার প্ল্যান?’

    ‘কোনো প্ল্যান নেই। রিকশায় করে ঘুরব।’

    ‘লাইফের কথা বলছি।’

    ‘জীবন কি কাপড়চোপড় যে গুছিয়ে রাখতে হবে?’

    ‘জীবন কী?’

    ‘কোনো সংজ্ঞা নেই। তুমি যা ভাবো, জীবন তাই।’

    ‘সবকিছু এত সহজ করে ভাবা যায়?’

    ‘সহজ করে যখন ভাবা যায়, কঠিন করে কেন ভাবব? ব্যাবিলনীয় সভ্যতার আগে থেকে মানুষ এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছে। পেয়েছে কোনো উত্তর?’

    যুথি কী যেন বলছে। ঘন কুয়াশায় তার মুখ দিয়ে বাতাস বের হচ্ছে। আলাদা আলাদা শব্দে আলাদা রকমের ছবি। একটা মাছের সাথে বন্ধুত্ব হয় ছেঁড়া পাতার। তারপর শূন্যে গিয়ে মেশে। আমি হাত দিয়ে যুথির কথাগুলো ধরার চেষ্টা করি। যুথি বিস্মিত হয়ে বলে, ‘কী করছ?’

    ‘কিছু না। কী যেন বলছিলে…’

    ‘আমি কী বলছি সেটা তুমি শুনছ?’

    ‘আমি তোমার শব্দগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম।’

    ‘কী দেখছিলে?’

    ‘সেটা আমি বোঝাতে পারব না।’

    ‘আমি বুঝতে চাই।’

    ‘কথার মধ্য দিয়ে আমরা যে বার্তা প্রকাশ করি, সেটা খুব সামান্য। মূল বার্তা থাকে চোখের চাহনিতে।’

    রাত সাড়ে ৩টায় আমাদের রিকশা গেটের কাছে এসে থামে। রিকশা ওয়ালা ফ্যাসফ্যাসে ভাঙা গলায় বললেন, ভাড়া বাড়িয়ে দিতে। ঘণ্টায় দেড়শ টাকা। দু ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটে আসে তিনশ পঁচাত্তর টাকা। আমি তাকে পাঁচশ টাকার একটি নোট দিলাম। দিতে গিয়ে লক্ষ করলাম, আর মাত্র দুটি পাঁচশ টাকার নোট আছে। তবু লাল নীল আলোর কেমিস্ট্রিতে সাদাকালো চিন্তাগুলো রঙিন হয়ে ওঠে।

    এ বাড়িতে প্রথম যেদিন এসেছিলাম তখন মাঘ মাসের শীত। যে শীত আমাদের দুজনকে একটা রিকশায় করে নিয়ে গিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘায়। একটা সাদাকালো পাখি হাতছানি দিয়ে ডাকছিল রঙিন দুনিয়ায়। আমার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি। সেদিনও প্রাইস ট্যাগ লেগে ছিল গায়ে।

    তিন বছর আগের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটা অদ্ভুত সমস্যায় পড়ি। কালা ভুনা আর সুরমা মাছের শুঁটকি খেতে খেতে মাঝের যে সময় থেকে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম-ফিরে এসে দেখি আমার শ্বশুর; যিনি ঢেকুরের শব্দে চারপাশ অস্থির করে তুলছিলেন; সেটা থেমে গেছে। শুধু তাই না, সবকিছু কেমন যেন মন্থর হয়ে আছে। নাকি শুধু আমার কাছে এ রকম মনে হচ্ছে?

    আমার শ্বশুর টুথপিক দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে আমাকে একটি খাম দিলেন।

    আমি সেটা টেবিলের ওপর রেখে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। হবে হয়তো অফিসের কাগজপত্র। কিন্তু আমাকে সেটা খুলতে বললেন। টেবিলে যারা ছিলেন প্রত্যেকে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন; যেন তারা তাদের চোখ দিয়ে নির্দেশ করছেন, খামটি খোলার।

    আমি খামটি হাতে নিলাম। উকিল মারফত একটি তালাকনামা। আমাকে সম্বোধন করে লেখা কিনা, নিশ্চিত হবার জন্য নিজের নামটি দ্বিতীয়বার পড়লাম।

    দেখো ওরা কী সব বলছে হিব্রু ভাষায়। আমি আশ্রয়ের খোঁজে যুথির দিকে তাকালাম।

    সে অত্যন্ত নির্বিকার ভঙ্গিতে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছে। একই সাথে আমার দিকেও খেয়াল রাখছে। আমি যখন তাকালাম তখন কেমন করে যেন তাকাল। তার দৃষ্টি দায়সারা।

    আমার শ্বশুর কিছুটা ঝুঁকে এসে আমাকে দেখিয়ে দিলেন, কোথায় স্বাক্ষর করতে হবে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, রাস্তার মোড়ে কোনো পথচারীকে ঠিকানা বলে দিচ্ছেন। পেন্সিলে দাগ দিয়ে বললেন, ‘এই যে এদিকটায়।’

    বললাম, ‘আমি একটু একান্ত সময় চাই।’

    দরজায় খিল দিয়ে কাঁদার পরিকল্পনা করি। কিন্তু আমি কাঁদতে পারছি

    না। যেন আমার দুঃখ আমার সাথে কথা বলছে না।

    কান্নার প্রস্তুতি হিসেবে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কান্নার ভান করি। প্রথমে মনে মনে তারপর একটু শব্দ, যেটা মানিয়ে নেয় পরিবেশে। আয়নায় নিজেকে কাঁদতে দেখে হঠাৎই হাসি পায়। শব্দ করে হাসি। বিকৃত হাসির শব্দে যুথির বাবা চিন্তিত হয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন-’আনিছ, কিছু হয়েছে?

    টেবিলে চা সাজানো। পিরিচে রাখা নলেন গুড়ের সন্দেশ। বিড়াল যে রকম ইঁদুর মারার আগে তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলে, নলেন গুড়ের সন্দেশ হলো সেই খেলার অংশ।

    ‘ঠিক আছো তুমি?’

    ‘জি।’

    ‘তুমি কি প্রায়ই এ রকম উদ্ভটভাবে হাসো?’

    ‘জি না।’

    ‘তোমার কিছু বলার আছে?’

    আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। যুথি ডিভোর্স চাইছে, এটি একমাত্র সত্য। কেন চাইছে তার হাজারটা কারণ থাকতে পারে। কারণগুলো প্রত্যক্ষদর্শীর মতো, একেকজন একেকভাবে ঘটনা ব্যাখ্যা করে।

    বললাম, ‘আমাকে এত আপ্যায়ন করে কেন বিদায় দেয়া হচ্ছে?’

    ‘কারণ তুমি একজন ভালো মানুষ।’

    আমার শ্বশুর পুনরায় দেখিয়ে দিলেন, কোথায় স্বাক্ষর করতে হবে।

    বললাম, ‘একটি সাদা কাগজ লাগবে।’

    যুথি উঠে গিয়ে একটি সাদা কাগজ নিয়ে এল। নিজের সিগনেচার মিল না থাকায় একবার নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেই টাকা তুলতে পারিনি। আমার শ্বশুর চিন্তিত হয়ে দেখছেন, আমি কাগজে সিগনেচার প্র্যাকটিস করছি। কোনোটির সাথে কোনোটির মিল নেই।

    বললেন, ‘সাংঘাতিক সমস্যা।’

    বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে তালাকনামায় নিজের নাম দস্তখত করি। কথায় আছে, সম্ভব হবার আগে সবকিছুই অসম্ভব মনে হয়। আমার শ্বশুর ফিসফিস করে আমাকে ইদ্দতকালীন সময় সম্পর্কে একটি ধারণা দিলেন।

    ইদ্দত আরবি শব্দ। এর মানে হলো গণনা করা।’

    ‘কী গণনা করব?’

    ‘দিন গণনা করবে। একদিন, দুদিন এ রকম নব্বই দিন। তারপর তালাক কার্যকর হবে।

    আমার খুব অসহায় বোধ হলো। সবকিছু কত দ্রুত বদলে গেছে। এই আকস্মিক ট্রমা এখনো কাটিয়ে উঠিনি। সব কেমন গোলকধাঁধার মতো ঘুরছে। মনে হচ্ছে জানালা খুলে দিলে এখনো দেখা যাবে, কুকুরটি দাঁড়িয়ে আছে কদমগাছের নিচে।

    আমার শ্বশুর আমাকে আরেকটি খাম দিলেন। আজ রাত আটটায়, কল্যাণপুর থেকে দিনাজপুর যাবার একটি এসি বাসের টিকিট। এই পরিবারটির সাথে আর মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা থাকা হচ্ছে। এত দীর্ঘ সময়ের হিসাব চুকিয়ে ফেলার জন্য এই সময় যথেষ্ট না।

    আমি রুমে গিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে বসি। জরুরি যা কিছু আছে, লিখতে শুরু করি। তার কিছুক্ষণ পরেই রুমে প্রবেশ করে যুথি। সে আমাকে ব্যাগ গোছাতে অর্থাৎ চলে যেতে সাহায্য করছে।

    ‘কখনো বলোনি, আমার সাথে থাকতে চাও না।’

    ‘চেষ্টা করেছিলাম থাকতে, তাই।’

    ‘কারো সাথে থাকার জন্য যদি চেষ্টা করতে হয়, তাহলে না থাকাই ভালো।’

    যুথি চুপ করে থাকে। আমাদের হয়তো কথা বলার মতো আর কিছু নেই। সে ঠিকই করেছে, একটা ভুলকে সত্য বানাতে গেলে, সেটা সত্য হয় না। উল্টো আরও অনেক সত্যকে মিথ্যে হতে হয়।

    আমি বললাম, ‘এ রকম একটি কঠিন সিদ্ধান্ত তুমি কখন নিয়েছ?’

    ‘মাস ছয়েক আগে।’

    ‘তারপর এতগুলো দিন থাকলে কী করে?

    যুথি কোনো জবাব দেয় না। আমি ব্যাগ গোছানোর প্রস্তুতি হিসেবে কাগজ কলম নিয়ে বসলাম। কী কী জিনিস সাথে করে নেব তার একটি তালিকা করছি।

    ১. দেয়ালে ঝোলানো জলরঙের ছবি।

    একবার এক আর্ট ফেস্টিভ্যাল থেকে ছবিটি কিনেছিলাম। নিখুঁত স্বপ্নে আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘা। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হবে, মেঘের ছিদ্র দিয়ে বেহেশত দেখা যায়!

    ২. ‘স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবার একটি মনস্তাত্ত্বিক বই।

    মস্তিষ্কের কর্টেক্সে কোথায় স্মৃতি জমা হয়ে থাকে, এসব নিয়ে হাবিজাবি। পুরো বইটি শেষ করার পর ফল হলো এই যে, লেখকের নাম মনে নেই।

    ৩. বাবার হাতঘড়ি।

    সময়ের কাঁটা রাত দুটা দশ মিনিটে স্থির হয়ে আছে। বাবা মারা যাবার পর ঘড়ির ব্যাটারি খুলে রেখেছি।

    যুথি আলমারির উপরের শেলফ থেকে কয়েকটি ব্যাগ বের করে আমাকে সাহায্য করছে। দীর্ঘদিন একসাথে থাকলে ভিন্নমতের সাথেও সখ্যতা জাগে।

    বলল, ‘বাবার ঘড়িটা কোথায় রেখেছ?’

    বাবার ঘড়িটা কোথায়, মনে করতে পারছি না। স্মৃতি ভুলে যাবার বড় কারণ হলো, মানসিক স্ট্রেস। দীর্ঘ একটি শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। যুথি অপেক্ষা করছে, জলরঙের ছবি আর বই সে ব্যাগে নিয়ে রেখেছে।

    বললাম, ‘আমরা কেন আলাদা হয়েছি জানো?’

    ‘কেন?’

    ‘কারণ আমরা একসাথে থাকতে চেয়েছি।’

    ‘আমি তোমার বেশির ভাগ কথা বুঝতে পারি না।’

    ‘কারণ তুমি আমাকে তোমার মতো করে শুনছ।’

    ‘আর তুমি?’ যুথির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

    ‘দুটা বিপরীত চিন্তাসম্পন্ন মানুষ যখন একসাথে থাকতে শুরু করে তখন সমস্যা হয় না। যখন তারা তাদের চিন্তাগুলো এক করতে চায় তখনই সমস্যা।’

    ‘কী রকম সমস্যা?’

    ‘সেটা জানলে আমাকে এই সমস্যায় পড়তে হতো না।’

    আমি জীবনে বহুবার অপমানিত হয়েছি। মানুষের অপমান সুচ দিয়ে আঘাত করে আমার আত্মসম্মানবোধে। বন্ধুবান্ধব ছিল না কখনো, স্কুল-কলেজ কিংবা আজ অবধি। শ্বশুরের তদবিরে একটা চাকরি জোটে। সেটাও প্রায়

    যায় যায় অবস্থা।

    বললাম, ‘আমাদের এই দ্বন্দ্ব বস্তুগত আর ভাবগত।’

    যুখি চোখ মিটমিট করে তাকায়। বেশির ভাগ সময় আমি কাউকে কিছু বোঝাতে পারি না। এখনো তাই হচ্ছে। একটা ঢিল সাগরে ছুড়ে মারলে সাগরের কিছু হয় না। যে ঢিল মারে তার শক্তি খরচ হয়। আমার বোঝানোর চেষ্টা হলো, কিছু অনর্থক কথার সময়ক্ষেপণ।

    ব্যাগ গোছানো শেষ করে আমরা কিছুক্ষণ নিজেদের সাথে সময় কাটাই। যেন আমাদের সব দেনা পাওনা, একে অন্যকে হস্তান্তর করি। সে হয়তো চাইছে, আমি ভালো থাকি। কিন্তু সেটা তার ভালো থাকা থেকে জরুরি না।

    ‘তোমার কিছু বলার নেই?’ যুথি জানতে চায়।

    আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।

    বাসায় ফোন করে জানাই, ফিরতে ফিরতে ভোর হবে।

    মা বললেন, ‘যুথি আসবে?’

    আমি যুথির দিকে তাকাই। একটা সম্পর্ক যখন শেষ হয়, সে একা শেষ হয় না। সবাইকে সাথে নিয়ে শেষ হয়। আর যা শেষ হয় না তা হলো, জীবনের প্রতি সময়ের ঋণ।

    যুথিকে বললাম, ‘অতীত দু প্রকার। ভালো স্মৃতি আর খারাপ স্মৃতি।’

    যুথি দেয়াল থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকায়। মনোবিজ্ঞানীরা এর একটি নাম দিয়েছেন-আকর্ষণ-বিকর্ষণ দ্বন্দ্ব। যখন কারো প্রতি আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ একই সাথে কাজ করে তখন এই দ্বন্দ্ব কাজ করে।

    বলল, ‘নিজের খেয়াল রাখবে।

    ‘রাখব।’

    সবকিছু ছাপিয়ে জীবনের মূলনীতি হয়ে ওঠে সুখবাদ। কোনো একটি সুখের জন্য অপেক্ষা করা। সেটার পর অন্য কোনো সুখ।

    ২

    ভোর সাড়ে চারটায় আমি যখন দিনাজপুর বাস টার্মিনালে, তখন মুষলধারে বৃষ্টি। একটা আধশোয়া কুকুর তেড়ে আসে আমার দিকে। ফেরার সময় যুথি বয়ামে করে আমের আচার দেয়। সেটা রাস্তায় পড়ে ভেঙে গেছে।

    হঠাৎই মনের মধ্যে একটা চিন্তা আসে, যুথি ডিভোর্স দিয়েছে কেন? তালাকনামায় উকিলের পরামর্শে যে অভিযোগ সে করেছে, সেটা যে সত্য না, যুথির বাবাও তা জানে। আমিও বিব্রত করতে চাইনি, খামাখা। কথা বললেই কথা বাড়ে। সত্য তো এই যে, সে চলে যেতে চায়। কিন্তু কেন যেতে চায়?

    আমার পরনে সাদা পাঞ্জাবি। সেটা ভিজে চুপসে গেছে। পকেটে হাত দিয়ে একটি চিরকুট অনুভব করি। সেখানে কি এই প্রশ্নের জবাব দেয়া আছে?

    ঘরে গিয়ে পড়তে শুরু করি। মুশকিল হলো, বৃষ্টিতে কাগজ ভিজে গেছে। অধিকাংশ শব্দ পানিতে মিশে গেছে।

    চিঠিতে লেখা…

    ‘তোমার সাথে প্রথম যেদিন’ তারপরের দুটি শব্দ পানিতে মিশে গেছে। আমি শব্দ দুটি আন্দাজ করার চেষ্টা করি। প্রথমটি দু অক্ষরের, পরেরটি চার। দুই অক্ষরের কী শব্দ হতে পারে? দেখা নাকি কথা? চার অক্ষরের শব্দটি নিশ্চয়ই ‘হয়েছিল।

    ‘তোমার সাথে প্রথম যেদিন’

    ‘দেখা’ / ‘কথা’ হয়েছিল, তখন খুব… এর পর আর কিছু পড়া যাচ্ছে না। মাঝে একটা দুটা শব্দ আবার কিছু অস্পষ্ট আবার কিছু আবার কিছু না। সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই।

    একটা যুদ্ধ, যেখানে সব মানুষ মারা যায়, সেখানেও কেউ কেউ বেঁচে থাকে। যারা বেঁচে থাকে অনেকের হাত-পা থাকে না। চিঠির মাঝামাঝি তিনটা অক্ষত শব্দ আমার কৌতূহলে ঘি ঢালে। তারপরের শবগুলো জীবিত কিন্তু এদের হাত-পা নেই।

    প্রাথমিকভাবে খণ্ড বিখণ্ডিত দেহকে যে রকম চোখ, দাঁত দেখে শনাক্ত করা হয়, আমিও সে রকম দু একটা অক্ষর থেকে শনাক্ত করছি শব্দ। পাশাপাশি কয়েকটা শব্দকে দাঁড় করাতে পারলেই, সব রহস্যের জাল কেটে যাবে।

    আমি সেই রহস্যের জাল কাটার চেষ্টা করছি। বস্তুটি একটি কাগজ। সেখানে একটি হৃদয়ঘটিত বার্তা লেখা আছে। প্রকৃতি একটা বৃষ্টির মধ্য দিয়ে সব মুছে দেয়।

    আমার দৃষ্টি বিদ্ধ হয়, চিঠির মাঝামাঝি এক জায়গায় পাশাপাশি তিনটি শব্দ দেখে। শব্দ তিনটি হলো ‘আমাদের দূরত্বের কারণ…’ এরপরের শব্দগুলো বোঝা যাচ্ছে না। দু একটা অক্ষর দেখে বোঝার চেষ্টা শব্দকে। যে রকম দাঁত মুখ দেখে শনাক্ত করা হয় দেহ।

    আমার জানতে ইচ্ছে করে, আমাদের দূরত্বের কারণ কী হতে পারে। ব্যাপারটা আমি জানি না, তা কিন্তু না। কিন্তু যুথি কীভাবে জানে, সেটা জানতে চাই।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশেষ – জুনায়েদ ইভান
    Next Article শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – জুবায়ের আলম

    Related Articles

    জুনায়েদ ইভান

    শেষ – জুনায়েদ ইভান

    August 14, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.