Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প563 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৬. স্কুলের সেক্রেটারি

    ষোড়শ পরিচ্ছেদ

    স্কুলের সেক্রেটারি স্থানীয় বিখ্যাত চাউল ব্যবসায়ী রামতারণ খুঁইয়ের বাড়ি এবার পূজার খুব ধুমধাম। স্কুলের বিদেশী মাস্টার মহাশয়েরা কেহ বাড়ি যান নাই, এই বাজারে চাকুরিটা যদি বা জুটিয়া গিয়াছে, এখন সেক্রেটারির মনস্তুষ্টি করিয়া সেটা তো বজায় রাখিতে হইবে! তাহারা পূজার কয়দিন সেক্রেটারির বাড়িতে প্রাণপণ পরিশ্রম করিয়া লোকজনের আদর-অভ্যর্থনা, খাওয়ানোর বিলিবন্দোবস্ত প্রভৃতিতে মহাব্যস্ত, সকলেই বিজয়া দশমীর পরদিন বাড়ি যাইবেন। অপুর হাতে ছিল ভাড়ার ঘরের চার্জ কয়দিন রাত্রি দশটা-এগারোটা পর্যন্ত খাটিবার পর বিজয়া দশমীর দিন বৈকালে সে ছুটি পাইয়া কলিকাতায় আসিল।

    প্রায় এক বৎসবের একঘেয়ে, ওই পাড়াগেঁয়ে জীবনের পর বেশ লাগে শহরের এই সজীবতা! এই দিনটার সঙ্গে বহু অতীত দিনের নানা উৎসব-চপল আনস্মৃতি জড়ানো আছে, কলিকাতায় আসিলেই যেন পুরানো দিনের সে-সব উৎসবরাজি তাহাকে পুরাতন সঙ্গী বলিয়া চিনিয়া ফেলিয়া প্রীতিমধুর কলহাস্যে আবার তাহাকে ব্যগ্র আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিয়া ফেলিবে। পথে চলিতে চলিতে নিজের ছেলের কথা মনে হইতে লাগিল বারবার। তাহাকে দেখা হয় নাই কি জানি কি রকম দেখিতে হইয়াছে। অপর্ণার মতো, না তাহার মতো?…ছেলের উপর অপু মনে মনে খুব সন্তুষ্ট ছিল না, অপর্ণার মৃত্যুর জন্য সে মনে মনে ছেলেকে দায়ী করিয়া বসিয়াছিল বোধ হয়। ভাবিয়াছিল, পূজার সময় একবার সেখানে গিয়া দেখিয়া আসিবে—কিন্তু যাওয়ার কোন তাগিদ মনের মধ্যে খুঁজিয়া পাইল না। চক্ষুলজ্জার খাতিরে খোকার পোশাকের দরুন পাঁচটি টাকা শশুরবাড়িতে মনিঅর্ডার করিয়া পাঠাইয়া পিতার কর্তব্য সমাপন করিয়াছে।

    আজিকার দিনে শুধু আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা যায়। কিন্তু তাহার কোনও পূর্বপরিচিত বন্ধু আজকাল আর কলিকাতায় থাকে না, কে কোথায় ছড়াইয়া পড়িয়াছে। গ্রে স্ট্রীটের মোড়ে দাঁড়াইয়া প্রতিমা দেখিতে দেখিতে ভাবিতে লাগিল-কোথায় যাওয়া যায়??

    তার পরে সে লক্ষ্যহীনভাবে চলিল। একটা সরু গলি, দুজন লোকে পাশাপাশি যাওয়া যায় না, দুধারে একতলা নিচু স্যাতসেঁতে ঘরে ছোট ছোট গৃহস্থেরা বাস করিতেছে—একটা রান্নাঘরে ছব্বিশসাতাশ বছরের একটি বৌ লুচি ভাজিতেছে, দুটি ছোট মেয়ে ময়দা বেলিয়া দিতেছে—অপু ভাবিল এক বৎসর পর আজ হয়তো ইহাদের লুচি খাইবার উৎসর-দিন। একটা উঁচু বোয়াকে অনেকগুলি শোক কোলাকুলি করিতেছে, গোলাপি সিল্কের ফ্ৰকপরা কোকড়াচুল একটি ছোট মেয়ে দরজার পর্দা তুলিয়া তাহার দিকে চাহিয়া আছে। একটা দৃশ্যে তাহার ভারি দুঃখ হইল। এক মুড়ির দোকানে প্রৌঢ়া মুড়িওয়ালীকে একটি অল্পবয়সি নীচশ্রেণীর পতিতা মেয়ে বলিতেছে—ও দিদি–দিদি? একটু পায়ের ধুলো দ্যাও। পরে পায়ের ধুলা লইয়া বলিতেছে, একটু সিদ্ধি খাওয়াবে না, শোনো-ও দিদি? মুড়িওয়ালী তাহার কথায় আদৌ কান না দিয়া সোনার মোটা অনন্ত-পরা ঝিয়ের সহিত কথাবার্তা কহিতেছে—মেয়েটি তাহার মনোযোগ ও অনুগ্রহ আকর্ষণ করিবার জন্য আবার প্রণাম করিতেছে ও আবার বলিতেছে–দিদি, ও দিদি?…একটু পায়ের ধুলো দ্যাও। পরে হাসিয়া বলিতেছে—একটু সিদ্ধি খাওয়াবে না, ও দিদি?

    অপু ভাবিল, এ রূপহীনা হতভাগিনীও হয়তো কলকাতায় তাহার মতো একাকী, কোন ভোলার ঘরের অন্ধকার গর্ভগৃহ হইতে আজিকার দিনের উৎসবে যোগ দিতে তাহার চুনুরি শাড়িখানা পরিয়া বাহির হইয়াছে। পাশের দোকানের অবস্থাপন্ন মুড়িওয়ালীর অনুগ্রহ ভিক্ষা করিতেছে, উৎসবের অংশ হইতে যাহাতে সে বঞ্চিত না হয়। ওর চোখে ওই মুড়িওয়ালীই হয়তো কত বড়োলোক!

    ঘুরিতে ঘুরিতে সেই কবিরাজ বন্ধুটির দোকানে গেল। বন্ধু দোকানেই বসিয়া আছে, খুব আদর করিয়া বলিল—এসো, এসো ভাই, ছিলে কোথায় এতদিন? বন্ধুর অবস্থা পূর্বাপেক্ষাও খারাপ, পূর্বের বাসা ছাড়িয়া নিকটের একটা গলিতে সাড়ে তিন টাকা ভাড়াতে এক খোলার ঘর লইয়াছে—নতুবা চলে না। বলিল—আর পারি নে, এখন হয়েছে দিন-আনি দিন-খাই অবস্থা। আমি আর স্ত্রী দুজনে মিলে বাড়িতে আচার-চাটনি, পয়সা প্যাকেট চা—এই সব করে বিক্রি করি—অসম্ভব স্ট্রাগল করতে হচ্ছে ভাই, এসো বাসায় এসো।

    নিচু স্যাঁতসেতে ঘর। বন্ধুর বৌ বা ছেলেমেয়ে কেহই বাড়ি নাই-পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে গলির মুখে বড়ো রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া প্রতিমা দেখিতেছে। বন্ধু বলিল—এবার আর ছেলেমেয়েদের কাপড়-টাপড় দিতে পারি নি–বলি ওই পুরানো কাপড়ই বোপর বাড়ি থেকে কাচিয়ে পর। বৌটার চোখে জল দেখে শেষকালে ছোট মেয়েটার জন্য এক খানা ডুরে শাড়ি—তাই। বোসো বোসো, চা খাও, বাঃ, আজকের দিনে যদি এলে। দাঁড়াও ডেকে আনি ওকে।

    অপু ইতিমধ্যে গলির মোড়ের দোকান হইতে আট আনার খাবার কিনিয়া আনিল। খাবারের ঠোঙা হাতে যখন সে ফিরিয়াছে তখন বন্ধু ও বন্ধুপত্নী বাসায় ফিরিয়াছে।-বাঃ রে, আবার কোথায় গিয়েছিলে—ওতে কি? খাবার? বাঃ রে, খাবার তুমি আবার কেন—

    অপু হাসিমুখে বলিল—তোমার আমার জন্য তো আনি নি? খুকি রয়েছে, ওই থোকা রয়েছে—এসো তো মানু—কি নাম? রমলা? ও বাবা, বাপের শখ দ্যাখোরমলা! বৌ-ঠাকরুন— ধরুন তো এটা।

    বন্ধুপত্নী আধঘোমটা টানিয়া প্রসন্ন হাসিভরা মুখে ঠোঙাটি হাত হইতে লইলেন। সকলকে চা ও খাবার দিলেন। সেই খাবারই।

    আধঘন্টাটাক পর অপু বলিল—উঠি ভাই, আবার চাপদানিতেই ফিরব-বেশ ভালো ভাইকষ্টের সঙ্গে তুমি এই যে লড়াই করছ-এতে তোমাকে ভালো করে চিনে নিলাম–কিন্তু বৌ ঠাকরুনকে একটা কথা বলে যাই—অত ভালো মানুষ হবেন না—আপনার স্বামী তা পছন্দ করেন না। দু-একদিন একটু-আধটু চুলোচুলি, হাতা-যুদ্ধ, বেলুন-যুদ্ধ-জীবনটা বেশ একটু সরস হয়ে উঠবে-বুঝলেন না? এ আমার মত নয় কিন্তু, আমার এই বন্ধুটির মত—আচ্ছা আসি, নমস্কার।

    বন্ধুটি পিছু পিছু আসিয়া হাসিমুখে বলিলওহে তোমার বৌ-ঠাকরুন বলছেন, ঠাকুরপোকে জিজ্ঞেস করো, উনি বিয়ে করবেন, না, এই রকম সন্নিসি হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াবেন?…উত্তর দাও।

    অপু হাসিয়া বলিল—দেখে শুনে আর ইচ্ছে নেই ভাই, বলে দাও। বাহিরে আসিয়া ভাবে–আচ্ছা, তবুও এরা আজ ছিল বলে বিজয়ার আনন্দটা করা গেল। সত্যিই শান্ত বৌটি। ইচ্ছে করে এদের কোনও হেল্প করি কি করে হয়, হাতে এদিকে পয়সা কোথায়?

    তাহার পর কিসের টানে সে ট্রামে উঠিয়া একেবারে ভবানীপুরে লীলাদের বাড়ি গিয়া হাজির হইল। রাত তখন প্রায় সাড়ে-আটটা। লীলার দাদামশায়ের লাইব্রেরি-ঘরটাতে লোকজন কথাবার্তা বলিতেছে, গাড়িবারান্দাতে দুখানা মোটর দাঁড়াইয়া আছে—পোকার উপদ্রবের ভয়ে হলের ইলেকট্রিক আলোগুলিতে রাঙা সিল্কের ঘেরাটোপ বাঁধা। মার্বেলের সিঁড়ির ধাপ বাহিয়া হলের সামনের চাতালে উঠিবার সময় সেই গন্ধটা পাইলকিসের গন্ধ ঠিক সে জানে না, হয়তো দামি আসবাবপত্রের গন্ধ, হয়তো লীলার দাদামশায়ের দামি চুরুটের গন্ধ—এখানে আসিলেই ওটা পাওয়া যায়।

    লীলা—এবার হয়তো লীলা…অপুর বুকটা টি টিপ করিতে লাগিল।

    লীলার ছোট ভাই বিমলেন্দু তাহাকে দেখিতে পাইয়া ছুটিয়া আসিয়া হাত ধরিল।

    এই বালকটিকে অপুর বড় ভালো লাগে মাত্র বার দুই ইহার আগে সে অপুকে দেখিয়াছে, কিন্তু কি চোখেই যে দেখিয়াছে! একটু বিস্ময়-মাখানো আনন্দের সুরে বলিল—অপূর্ববাবু, আপনি এতদিন পর কোথা থেকে? আসুন আসুন, বসবেন। বিজয়ার প্রণামটা, দাঁড়ান।

    —এসো এসো, কল্যাণ হোক, মা কোথায়?

    –মা গিয়েছেন বাগবাজারের বাড়িতে-আসবেন এখুনি-বসুন।

    -ইয়ে—তোমার দিদি এখানে তো?–না?—ও।

    এক মুহূর্তে সারা বিজয়া দশমীর উৎসবটা, আজিকার সকল ছুটাছুটি ও পরিশ্রমটা অপুর কাছে বিস্বাদ, নীরস, অর্থহীন হইয়া গেল। শুধু আজ বলিয়া নয়, পূজা আরম্ভ হইবার সময় হইতেই সে ভাবিতেছে—লীলা পূজার সময় নিশ্চয় কলিকাতায় আসিবে—বিজয়ার দিন গিয়া দেখা করিবে। আজ চাপদানির চটকলে পাঁচটার ভো বাজিয়া প্রভাত সূচনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে অসীম আনন্দের সহিত বিছানায় শুইয়া ভাবিয়াছিল—বৎসর দুই পরে আজ লীলার সঙ্গে ওবেলা দেখা হইবে এখন। সেই লীলাই নাই এখানে!…

    বিমলেন্দু তাহাকে উঠিতে দিল না। চা ও খাবার আনিয়া খাওয়াইল। বলিল-বসুন, এখন উঠতে দেব না, নতুন আইসক্রিমের কলটা এসেছে—বড়ো মামার বন্ধুদের জন্যে সিদ্ধির আইসক্রিম হচ্ছে—খাবেন সিদ্ধির আইসক্রিম? রোজ দেওয়া আপনার জন্যে এক ডিশ আনতে বলে এলুম। আপনার গান শোনা হয় নি কতদিন, না সত্যি, একটা গান করতেই হবে—ছাড়ছি নে।

    –লীলা কি সেই রায়পুরেই আছে? আসবে-টাসবে না?…

    –এখন তো আসবে না দিদি–দিদির নিজের ইচ্ছেতে তো কিছু হবার জো নেই-দাদামশায় পত্র লিখেছিলেন, জামাইবাবু উত্তর দিলেন, এখন নয়, দেখা যাবে এর পর।

    তাহার পর সে অনেক কথা বলিল। অপু এসব জানিত না।-জামাইবাবু তোক ভালো নয়, খুব রাগী, বদমেজাজী। দিদি খুব তেজী মেয়ে বলিয়া পারিয়া উঠে না—তবু ব্যবহার আদৌ ভালো নয়। নিচু সুরে বলিল—নাকি খুব মাতালও–দিদি তো সব কথা লেখে না, কিন্তু এবার বড়দিদির ছেলে কিছুদিন বেড়াতে গিয়েছিল নাকি গরমের ছুটিতে, সে এসে সব বললে। বড়দিদিকে আপনি চেনেন না? সুজাতাদি? এখানেই আছেন, এসেছেন আজ—ডাকব তাকে।

    অপুর মনে পড়িল সুজাতাকে। বড়োবৌরানির মেয়ে বাল্যের সেই সুন্দরী, তন্বী সুজাতা বর্ধমানের বাড়িতে তাহারই যৌবনপুষ্পিত তনুলতাটি একদিন অপুর অনভিজ্ঞ শৈশবচক্ষুর সম্মুখে নারী-সৌন্দর্যের সমগ্র ভাণ্ডার যেন নিঃশেষে উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিয়াছিল—বারো বৎসর পূর্বের সে উৎসবের দিনটা আজও এমন স্পষ্ট মনে পড়ে।

    একটু পরে সুজাতা হাসিমুখে পর্দা ঠেলিয়া ঘরে ঢুকি, কিন্তু একজন অপরিচিত, সুদর্শন, তরুণ যুবককে ঘরের মধ্যে দেখিয়া প্রথমটা সে তাড়াতাড়ি পিছু হটিয়া পর্দাটা পুনরায় টানিতে যাইতেছিল—বিমলেন্দু হাসিয়া বলিল—বাঃ রে, ইনিই তো অপূর্ববাবু, বড়দি চিনতে পারেন নি?

    অপু উঠিয়া পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল। সে সুজাতা আর নাই, বয়স ত্রিশ পার হইয়াছে, খুব মোটা হইয়া গিয়াছে, তার সামনের দিকে দু-এক গাছা চুল উঠিতে শুরু হইয়াছে, যৌবনের চটুল লাবণ্য গিয়া মুখে মাতৃত্বের কোমলতা। বর্ধমানে থাকিতে অপুর সঙ্গে একদিনও সুজাতার আলাপ হয় নাই-রাঁধুনীর ছেলের সঙ্গে বাড়ির বড়ড়া মেয়ের কোন আলাপই বা সম্ভব ছিল? সবাই তো আর লীলা নয়। তবে বাড়ির রাঁধুনী বামনীর ছেলেটিকে ভয়ে ভয়ে বড়োলোকের বাড়ির একতলা দালানের বারান্দাতে অনেকবার সে বেড়াইতে, ঘোরাফেরা করিতে দেখিয়াছে বটে।

    সুজাতা বলিল—এসো এসো, বোসো। এখানে কি করো? মা কোথায়?

    –মা তো অনেকদিন মারা গিয়াছেন।

    —তুমি বিয়ে-থাওয়া করেছ তো–কোথায়?

    সে সংক্ষেপে সব বলিল। সুজাতা বলিল—তা আবার বিয়ে করো নি? না, বিয়ে করে ফেলল, সংসারে থাকতে গেলে ওসব তো আছেই, বিশেষ যখন তোমার মা-ও নেই। সে বাড়ির আর মেয়েটেয়ে নেই?

    অপুর মনে হইল লীলা থাকলে, সে তোমার মা এ কথা না বলিয়া শুধু মা বলিত, তাহাই সে বলে। লীলার মতো আর কে এমন দয়াময়ী আছে যে তাহার জীবনে, তাহার সকল দারিদ্র্যকে, সকল হীনতাকে উপেক্ষা করিয়া পরিপূর্ণ করুণার ও মমতার স্নেহপাণি সহজ বন্ধুত্বের মাধুর্যে তাহার দিকে এমন প্রসারিত করিয়া দিয়াছিল? সুজাতার কথার উত্তর দিতেই একথাটা ভাবিয়া সে কেমন অন্যমনস্ক হইয়া গেল।

    সুজাতা ভিতরে চলিয়া গেলে অপুর মনে হইল, শুধু মাতৃত্বের শান্ত কোমলতা নয়, সুজাতার মধ্যে গৃহিণীপনার প্রবীণতাও আসিয়া গিয়াছে। বলিল—আসি ভাই বিমল, আমার আবার সাড়ে দশটায় গাড়ি।

    বিমলেন্দু তাহাকে আগাইয়া দিতে তাহার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দূরে আসিল। বলিল—আর বছর ফায়ূন মাসে দিদি এসেছিল, দিন পনেরো ছিল। কাউকে বলবেন না, আপনার পুরানো আপিসে একবার আমায় পাঠিয়েছিল আপনার খোঁজে—সবাই বললে তিনি চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছেন, কোথায় কেউ জানে না। আপনার কথা আমি লিখব, আপনার ঠিকানা দিন না?…দাঁড়ান, লিখে নি।

     

    মাঘীপূর্ণিমার দিনটা ছিল ছুটি। সারাদিন সে আশেপাশের গ্রামগুলো পায়ে হাঁটিয়া ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে। সন্ধ্যার অনেক পরে সে বাসায় আসিয়া শুইবামাত্র ঘুমাইয়া পড়িল। কত রাত্রে জানে না, তক্তপোশের কাছের জানলাতে কাহার মৃদু করাঘাতের শব্দে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। শীত এখনও বেশি বলিয়া জানালা বন্ধই ছিল, বিছানার উপর বসিয়া সে জানলাটা খুলিয়া ফেলিল। কে যেন বাহিরের বোয়াকে জ্যোৎস্নার মধ্যে দাঁড়াইয়া। কে?…উত্তর নাই। সে তাড়াতাড়ি দুয়ার খুলিয়া বাহিরের বোয়াকে আসিয়া অবাক হইয়া গেল—কে একটি স্ত্রীলোক এত রাত্রে তাহার জানালার কাছে দেয়াল ঘেঁষিয়া বিষণ্ণভাবে দাঁড়াইয়া আছে।

    অপু আশ্চর্য হইয়া কাছে গিয়া বলিল—কে ওখানে? পরে বিস্ময়ের সুরে বলিল-পটেশ্বরী। : তুমি এখানে এত রাত্রে? কোথা থেকে তুমি শ্বশুরবাড়ি ছিলে, এখানে কি করে

    পটেশ্বরী নিঃশব্দে কাঁদিতেছিল, কথা বলিল না-অপু চাহিয়া দেখিল, তাহার পায়ের কাছে একটা ঘোট পুটুলি পড়িয়া আছে। বিস্ময়ের সুরে বলিল—কেঁদো না পটেশ্বরী, কি হয়েছে বলো। আর এখানে এ-ভাবে দাঁড়িয়েও তো—শুনি কি হয়েছে? তুমি এখন আসছ কোখেকে বলো তো?

    পটেশ্বরী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল-রিষড়ে থেকে হেঁটে আসছি—অনেক রাত্তিরে বেরিয়েছি, আমি আর সেখানে যাব না

    -আচ্ছা, চলো চলো, তোমায় বাড়িতে দিয়ে আসি—কি বোকা মেয়ে। এত রাত্তিরে কি এ ভাবে বেরুতে আছে? ছিঃ—আর এই কনকনে শীতে, গায়ে একখানা কাপড় নেই, কিছু না—এ কি ছেলেমানুষি।

    —আপনার পায়ে পড়ি মাস্টারমশাই, আপনি বাবাকে বলবেন, আর যেন সেখানে না পাঠায় সেখানে গেলে আমি মরে যাব—পায়ে পড়ি আপনার–

    বাড়ির কাছাকাছি গিয়া বলিল—বাড়িতে যেতে বড্ড ভয় করছে, মাস্টারমশায়—আপনি একটু বলবেন বাবাকে মাকে বুঝিয়ে–

    সে এক কাণ্ড আর কি অত রাত্রে! ভাগ্যে রাত অনেক, পথে কেহ নাই!

    অপু তাহাকে সঙ্গে লইয়া দীঘড়ী-বাড়ি আসিয়া পটেশ্বরীর বাবাকে ডাকিয়া তুলিয়া সব কথা বলিল। পূর্ণ দীঘড়ী বাহিরে আসিলেন, পটেশ্বরী আমগাছের তলায় বসিয়া পড়িয়া হাঁটুতে মুখ খুঁজিয়া কাঁদিতেছে ও হাড়ভাঙা শীতে ঠক ঠক করিয়া কঁপিতেছে-না একখানা শীতবস্ত্র, না একখানা মোটা চাদর।

    বাড়ির মধ্যে গিয়া পটেশ্বরী কাঁদিয়া মাকে জড়াইয়া ধরিল—একটু পরে পূর্ণ দীঘড়ী তাহাকে ডাকিয়া বাড়ির মধ্যে লইয়া গিয়া দেখাইলেন পটেশ্বরীর হাতে, পিঠে, ঘাড়ের কাছে প্রহারের কালশিরার দাগ, এক এক জায়গায় রক্ত ফুটিয়া বাহির হইতেছে—মাকে ছাড়া দাগগুলি সে আর কাহাকেও দেখায় নাই, তিনি আবার স্বামীকে দেখাইয়াছেন। ক্রমে জানা গেল পটেশ্বরী নাকি রাত বারোটা হইতে পুকুরের ঘাটে শীতের মধ্যে বসিয়া ভাবিয়াছে কি করা যায়—দু ঘণ্টা শীতে ঠক ঠক করিয়া কাঁপিবার পরও সে বাড়ি আসিবার সাহস সঞ্চয় করিতে না পারিয়া মাস্টার মহাশয়ের জানালায় শব্দ করিয়াছিল।

    মেয়েকে আর সেখানে পাঠানো চলিতে পারে না এ কথা ঠিক। দীঘড়ী মশায় অপুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহার কোন উকিল বন্ধু আছে কি-না, এ সম্বন্ধে একটা আইনের পরামর্শ বিশেষ আবশ্যক-মেয়ের ভরণপোষণের দাবি দিয়া তিনি জামাইয়ের নামে নালিশ করিতে পারেন কিনা। অপু দিন দুই শুধুই ভাবিতে লাগিল এক্ষেত্রে কি করা উচিত।

    সুতরাং স্বভাবতই সে খুব আশ্চর্য হইয়া গেল, যখন মাঘীপূর্ণিমার দিন পাঁচেক পবে সে শুনিল পটেশ্বরীর স্বামী আসিয়া পুনরায় তাহাকে লইয়া গিয়াছে।

    কিন্তু তাহাকে আরও বেশি আশ্চর্য হইতে হইল, সম্পূর্ণ আর এক ব্যাপারে। একদিন সে স্কুল হইতে ছুটির পরে বাহিরে আসিতেছে, স্কুলের বেহারা তাহার হাতে একখানা খামের চিঠি দিলখুলিয়া পড়িল, স্কুলের সেক্রেটারি লিখিতেছেন, তাহাকে আর বর্তমানে আবশ্যক নাই—এক মাসের মধ্যে সে যেন অন্যত্র চাকুরি দেখিয়া লয়।

    অপু বিস্মিত হইল—কি ব্যাপার! হঠাৎ এ নোটিশের মানে কি? সে তখনই হেডমাস্টারের কাছে গিয়া চিঠিখানি দেখাইল। তিনি নানা কারণে অপুর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। প্রথম, সেবাসমিতির দলগঠন অপুই করিয়াছিল, নেতৃত্বও করিত সে। ছেলেদের সে অত্যন্ত প্রিয়পাত্র, তাহার কথায় ছেলেরা ওঠে বসে। জিনিসটা হেডমাস্টারের চক্ষুশূল। অনেকদিন হইতেই তিনি সুযোগ খুজিতেছিলেন—ছিদ্রটা এত দিন পান নাই-পাইলে কি আর একটা অনভিজ্ঞ ছোকরাকে জব্দ করিতে এতদিন লাগিত?

    হেডমাস্টার কিছু জানেন না—সেক্রেটারির ইচ্ছা, তাহার হাত নাই। সেক্রেটারি জানাইলেন, কথাটা এই যে, অপূর্ববাবুর নামে নানা কথা রটিয়াছে দীঘড়ী-বাড়ির মেয়েটির এই সব ঘটনা সইয়া। অনেকদিন হইতেই এ সইয়া তাহার কানে কোন কোন কথা গেলেও তিনি শোনেন নাই। কিন্তু সম্প্রতি ছেলেদের অভিভাবকদের মধ্যে অনেকে আপত্তি করিতেছেন যে, ওরুপ চরিত্রের শিক্ষককে কেন রাখা হয়। অপুর প্রতিবাদ সেক্রেটারি কানে তুলিলেন না।

    –দেখুন, ওসব কথা আলাদা। আমাদের স্কুলের ও ছাত্রদের দিক থেকে এ ব্যাপারটা অন্যভাবে আমরা দেখব কিনা! একবার যাঁর নামে কুৎসা রয়েছে, তাঁকে আর আমরা শিক্ষক হিসাবে রাখতে পারি নে–তা সে সত্যিই হোক, বা মিথ্যাই হোক।

    অপুর মুখ লাল হইয়া গেল এই বিরাট অবিচারে। সে উত্তেজিত সুরে বলিল—বেশ তো মশায়, এ বেশ জাস্টিস হল তো! সত্যি মিথ্যে না জেনে আপনারা একজনকে এই বাজারে অনায়াসে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছেন—বেশ তো?

    বাহিরে আসিয়া রাগে ও ক্ষোভে অপুর চোখে জল আসিয়া গেল। মনে ভাবিল এসব হেডমাস্টারের কারসাজি—আমি যাব তার বাড়ি খোশামোদ করতে? যায় যাক চাকরি! কিন্তু এদের আত বিচার বটে-ডিফেন্ড করার একটা সুযোগ তো খুনী আসামিকেও দেওয়া হয়ে থাকে, তাও এরা আমায় দিলে না!

    কয়দিন সে বসিয়া ভাবিতে লাগিল, এখানকার চাকুরির মেয়াদ তো আর এই মাসটা তারপর কি করা যাইবে? স্কুলের এক নতুন মাস্টার কিছুদিন পূর্বে কোন এই মাসিক পত্রিকায় গল্প লিখিয়া দশটা টাকা পাইয়াছিলেন। গল্পটা সেই ভদ্রলোকের কাছে অপু অনেকবার শুনিয়াছে। আচ্ছা, সেও এখানে বসিয়া বসিয়া খাতায় একটা উপন্যাস লিখিতে শুরু করিয়াছিল—মনে মনে ভাবিল দশ-বারো চ্যাপটার তো লেখা আছে, উপন্যাসখানা যদি লিখে শেষ করতে পারি, তার বদলে কেউ টাকা দেবে না? কেমন হচ্ছে কে জানে; একবার রামবাবুকে দেখাব।

    নোটিশ-মতো অপুর কাজ ছাড়িবার আর বিলম্ব নাই, একদিন পোস্টাফিসের ডাকব্যাগ খুলিয়া খাম ও পোস্টকার্ডগুলি নাড়িতে-চাড়িতে একখানা বড়ো, চৌকা সবুজ রংয়ের মোটা খামের ওপর নিজের নাম দেখিয়া বিস্মিত হইল—কে তাহাকে এত বড় শৌখিন খামে চিঠি দিল! প্রণব নয়, অন্য কেহ নয়, হাতের লেখাটা সম্পূর্ণ অপরিচিত।

    খুলিয়া দেখিলেই তো তাহার সকল রহস্য এখনই চলিয়া যাইবে, কেন থাক, বাসায় গিয়া পড়িবে এখন। এই অজানার আনন্দটুকু যতক্ষণ ভোগ করা যায়।

    রান্না খাওয়ার কাজ শেষ হইতে মার্টিন কোম্পানির রাত দশটার গাড়ি আসিয়া পড়িল, বাজারের দোকানে দোকানে ঝপ পড়িল। অপু পত্রখানা খুলিয়া দেখিল-দুখানা চিঠি, একখানা ছোট চার-পাঁচ লাইনের, আর একখানা মোটা সাদা কাগজে-পরক্ষণেই আনন্দে, বিস্ময়ে, উত্তেজনায় তার বুকের রক্ত যেন চলকাইয়া উঠিয়া গেল মাথায়—সর্বনাশ, কার চিঠি এ! চোখকে যেন বিশ্বাস করা যায় না লীলা তাহাকে লিখিতেছে! সঙ্গের চিঠিখানা তার ছোট ভাইয়ের—সে লিখিতেছে, দিদির এ-পত্ৰখানা তাহাদের পত্রের মধ্যে আসিয়াছে, অপুকে পাঠাইবার অনুরোধ ছিল দিদির, পাঠানো হইল।

    অনেক কথা, নপৃষ্ঠা ছোট ছোট অক্ষরের চিঠি! খানিকটা পড়িয়া সে খোলা হাওয়ায় আসিয়া বসিল। কি অবর্ণনীয় মনোভাব, বোঝানো যায় না, বলা যায় না! আরম্ভটা এই রকম— ভাই অপূর্ব,

    অনেকদিন তোমার কোন খবর পাই নি তুমি কোথায় আছ, আজকাল কি করো, জানবার ইচ্ছে হয়েছে অনেকবার কিন্তু কে বলবে, কার কাছেই বা খবর পাব? সেবার কলকাতায় গিয়ে বিনুকে একদিন তোমার পুরানো ঠিকানায় তোমার সন্ধানে পাঠিয়েছিলাম—সে বাড়িতে অন্য লোকে  আজকাল থাকে, তোমার সন্ধান দিতে পারে নি, কি করেই বা পারবে? একথা বিনু বলে নি তোমায়?

    আমি বড়ো অশান্তিতে আছি এখানে, কখনও ভাবি নি এমন আমার হবে। কখনও যদি দেখা হয় তখন সব বলব। এই সব অশান্তির মধ্যে যখন আবার মনে হয় তুমি হয়তো মলিনমুখে কোথায় পথে পথে ঘুরে বেড়াই—তখন মনের যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়। এই অবস্থায় হঠাৎ একদিন বিনুর পত্রে জানলাম বিজয়া দশমীর দিন তুমি ভবানীপুরের বাড়িতে গিয়েছিলে, তোমার ঠিকানাও পেলাম।

    বর্ধমানের কথা মনে হয়? অত আদরের বর্ধমানের বাড়িতে আজকাল আর যাবার জো নেই।

    জ্যাঠামশায় মারা যাওয়ার পর থেকেই রমেন বড়ো বাড়াবাড়ি করে তুলেছিল। আজকাল সে যা করছে, তা তুমি হয়তো কখনও শোনও নি। মানুষের ধাপ থেকে সে যে কত নিচে নেমে গিয়েছে, আর যা কীর্তিকারখানা, তা লিখতে গেলে পুঁথি হয়ে পড়ে। কোন মাবোয়াড়ির কাছে নিজের অংশ বন্ধক রেখে টাকা ধার করেছিল—এখন তার পরামর্শে পার্টিশন স্যুট আরম্ভ করেছে—বিনুকে ফাঁকি দেবার উদ্দেশ্যে। এ-সব তোমার মাথায় আসবে কোনও দিন?

     

    কত রাত পর্যন্ত অপু চোখের পাতা বুজাইতে পারিল না। লীলা যাহা লিখিয়াছে তাহার অপেক্ষা বেশি যেন লেখে নাই। সারা পত্ৰখানিতে একটা শান্ত সহানুভূতি, স্নেহপ্রীতি, করুণা। এক মুহূর্তে আজ দু বৎসরব্যাপী এই নির্জনতা অপুর যেন কাটিয়া গেল—এইমাত্র সে ভাবিতেছিল সংসারে সে একা—তাহার কেহ কোথাও নেই। লীলার পত্রে জগতের চেহারা যেন এক মুহূর্তে বদলাইয়া গেল। কোথায় সে কোথায় লীলা!.বহুদূরের ব্যবধান ভেদ করিয়া তাহার প্রাণের উষ্ণ প্রেমময় স্পর্শ অপুর প্রাণে লাগিয়াছে-কিন্তু কি অপূর্ব রসায়ন এ স্পর্শটা-কোথায় গেল অপুর চাকরি যাইবার দুঃখ–কোথায় গেল গোটা-দুই বৎসরের পাষাণভারের মতো নির্জনতা নারীহৃদয়ের অপূর্ব রসায়নের প্রলেপ তাহার সকল মনে, সকল অঙ্গে, কী যে আনন্দ ছড়াইয়া দিল। লীলা যে আছে! সব সময় তাহার জন্য ভাবে দুঃখ করে! জীবনে অপু আর কি চায়?—সাক্ষাতের আবশ্যক নাই, জন্মজন্মান্তর ব্যাপিয়া এই স্পর্শটুকু অক্ষয় হইয়া বিরাজ কবুক।

    লীলার পত্র পাইবার দিন-বারো পরে তাহার যাইবার দিন আসিয়া গেল।

    ছেলেরা সভা করিয়া তাহাকে বিদায় সম্বর্ধনা দিবার উদ্দেশ্যে চাঁদা উঠাইতেছিল—হেডমাস্টার খুব বাধা দিলেন। যাহাতে সভা না হইতে পারে সেইজন্য দলের চাইদিগকে ডাকিয়া টেস্ট পরীক্ষার সময় বিপদে ফেলিবেন বলিয়া শাসাইলেন—পরিশেষে স্কুল-ঘরে সভার স্থানও দিতে চাহিলেন না, বলিলেন তোমরা ফেয়ারওয়েল দিতে যাচ্ছ, ভালো কথা, কিন্তু এসব বিষয়ে আয়রন ডিসিপ্লিন চাই—যার চরিত্র নেই, তার কিছুই নেই, তার প্রতি কোনও সম্মান তোমরা দেখাও, এ আমি চাই নে, অন্তত স্কুল-ঘরে আমি তার জায়গা দিতে পাবি নে।

    সেদিন আবার বড়ো বৃষ্টি। মহেন্দ্র সাঁবুই-এর আটচালায় জনত্রিশেক উপবেব ক্লাসের ছেলে হেডমাস্টারের ভয়ে লুকাইয়া হাতে লেখা অভিনন্দনপত্র পড়িয়া ও গাঁদাফুলের মালা গলায় দিয়া অপুকে বিদায়-সম্বর্ধনা জানাইল, সভা ভঙ্গের পর জলযোগ কবাইল। প্রত্যেকে পায়ের ধুলা লইযা, তাহার বাড়ি আসিয়া বিছানাপত্র গুছাইয়া দিয়া, নিজেবা তাহাকে বৈকালে ট্রেনে তুলি দিল।

     

    অপু প্রথমে আসিল কলিকাতায়।

    একটা খুব লম্বা পাড়ি দিবে—যেখানে সেখানে যেদিকে দুই চোখ যায়—এতদিনে সত্যিই মুক্তি। আর কোনও জালে নিজেকে জড়াইবে না—সব দিক হইতে সতর্ক থাকিবে-শিকলের বাঁধন অনেক সময় অলক্ষিতে জড়ায় কিনা পায়ে!

    ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে গিয়া সাবা ভারতবর্ষের ম্যাপ ও অ্যাটলাস কয়দিন ধরিয়া দেখিয়া কাটাইল-ডানিয়েলের ওরিয়েন্টাল সিনারি ও পিঙ্কার্টনের ভ্রমণ-বৃত্তান্তের নানাস্থান নোট করিয়া লইল-বেঙ্গল নাগপুর ও ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলের নানাস্থানের ভাড়া ও অন্যান্য তথ্য জিজ্ঞাসা করিয়া বেড়াইল। সত্তর টাকা হাতে আছে, ভাবনা কিসের?

    কিন্তু যাওয়ার আগে একবার ছেলেকে চোখের দেখা দেখিয়া যাওয়া দরকার না? সেই দিনই বিকালের ট্রেনে সে শশুরবাড়ি রওনা হইল। অপর্ণার মা জামাইকে এতটুকু তিরস্কার করিলেন না, এতদিন হেলেকে না দেখিতে আসার দরুন একটি কথাও বলিলেন না। বরং এত আদর-যত্ন করিলেন যে অপু নিজেকে অপরাধী ভাবিয়া সংকুচিত হইয়া রহিল। অপু বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা কহিতেছে, এমন সময়ে তাহার খুড়শাশুড়ি একটি সুন্দর খোকাকে কোলে করিয়া সেখানে আসিলেন। অপু ভাবিল—বেশ খোকাটি তত! কাদের? খুড়শাশুড়ি বলিলেন–যাও তো খোকন, এবার তোমার আপনার লোকের কাছে। ধন্যি যা হোক, এমন নিষ্ঠুর বাপ কখনও দেখি নি! যাও তো একবার কোলে–

    ছেলে তিন বৎসর প্রায় ছাড়াইয়াছে–ফুটফুটে সুন্দর গায়ের রং—অপর্ণার মতো ঠোঁট ও মুখের নিচেকার ভঙ্গি, চোখ বাপের মতো ডাগর ডাগর। কিন্তু সবসুদ্ধ ধরিলে অপর্ণার মুখের আদলই বেশি ফুটিয়া উঠে খোকার মুখে। প্রথমে সে কিছুতেই বাবার কাছে আসিবে না, অপরিচিত মুখ দেখিয়া ভয়ে দিদিমাকে জড়াইয়া রহিল—অপূর মনে ইহাতে আঘাত লাগিল। সে হাসিমুখে হাত বাড়াইয়া বার বার খোকাকে কোলে আনিতে গেল—ভয়ে শেষকালে খোকা দিদিমার কাঁধে মুখ লুকাইয়া রহিল। সন্ধ্যার সময় খানিকটা ভাব হইল। তাহাকে দু-একবার বাবা বলিয়া ডাকিলও। একবার কি একটা পাখি দেখিয়া বলিল-ফাখি, ফাখি, উই এত্তা ফাখি নেবো বাবা

    প’কে কচি জিব ও ঠোঁটের কি কৌশলে ফ বলিয়া উচ্চারণ করে, কেমন অদ্ভুত বলিয়া মনে হয়। আর এত কথাও বলে থোকা!

    কিন্তু বেশির ভাগই বোঝা যায় না—উলটো-পালটা কথা, কোন্ কথার উপর জোর দিতে গিয়া কোন্ কথাব উপর দেয় কিন্তু অপুর মনে হয় কথা কহিলে খোকার মুখ দিয়া মানিক ঝরে— সে যাহাই কেন বলুক না, প্রত্যেক ভাঙা, অশুদ্ধ, অপূর্ণ কথাটি অপুর মনে বিস্ময় জাগায়। সৃষ্টি আদিম যুগ হইতে কোন শিশু যেন কখনও বাবা বলে নাই, জল বলে নাই,—কোন্ অসাধ্য সাধনই না তাহার খোকা করিতেছে!

    পথে বাবার সঙ্গে বাহির হইয়াই খোকা বকুনি শুরু করিল। হাত পা নাড়িয়া কি বুঝাইতে চায় অপু না বুঝিয়াই অন্যমনস্ক সুরে ঘাড় নাড়িযা বলে—ঠিক ঠিক। তারপর কি হল বে খোকা?

    একটা বড়ো সাঁকো পথে পড়ে, খোকা বলে-বাবা যাব–ওই দেখব।

    অপু বলে—আস্তে আস্তে নেমে যা—নেমে গিয়ে একটা কু-উ করবি–

    খোকা আস্তে আস্তে ঢালু বাহিয়া নিচে নামে-জলনিকাশের পথটার ফাঁকে ওদিকের গাছপালা দেখা যাইতেছেনা বুঝিযা বলে-বাবা, এই মধ্যে একতা বাগান–

    –কু করো তত খোকা, একটা কু করো।

    খোকা উৎসাহের সহিত বাঁশির মতো সুরে ডাকে—কু-উ-উ–পরে বলে—তুমি কলুন বাবা?

    অপু হাসিয়া বলে-কু-উ-উ-উ-উ–

    খোকা আমোদ পাইয়া নিজে আবার করে—আবার বলে—তুমি কলুন?বাড়ি ফিরিবার পথে বলে, খবিছাক এনো বাবা-দিদিমা খবিছাক আঁড়বে—খবিছাক ভালো—

    সন্ধ্যাবেলা খোকা আরও কত গল্প করে। এখানকার চাঁদ গোল। মাসিমার বাড়ি একবার গিয়াছিল, সেখানকার চাদ ছোট্ট—এতটুকু! অতটুকু চাদ কেন বাবা? শীঘ্রই অপু দেখিল, খোকা দুষ্টও বড়ো। অপু পকেট হইতে টাকা বাহির করিয়া গুনিতেছে, খোকা দেখিতে পাইয়া চিৎকার করিয়া সবাইকে বলে—দ্যাখ, কত তাকা!—আয় আয়–

    পরে একটা টাকা তুলিয়া লইয়া বলে—এতা আমি কিছুতি দেবো না।—হাতে মুঠো বাঁধিয়া থাকে—আমি কাচের ভাতা কিনব

    অপু ভাবে খোকাটা দুইও তো হয়েছে-না-দে-টাকা কি করবি?

    –না কিছুতি দেবো না—হি-হি-ঘাড় দুলাইয়া হাসে।

    অপুর টাকাটা হাত হইতে লইতে কষ্ট হয়—তবু লয়। একটা টাকার ওর কি দরকার? মিছিমিছি নষ্ট।

    কলিকাতা ফিরিবার সময়ে অপর্ণার মা বলিলেন-বাবা আমার মেয়ে গিয়েছে, যাক–কিন্তু তোমার কষ্টই হয়েছে আমার বেশি! তোমাকে যে কি চোখে দেখেছিলাম বলতে পারি নে, তুমি যে এ-রকম পথে পথে বেড়াচ্ছ, এতে আমার বুক ফেটে যায়, তোমার মা বেঁচে থাকলে কি বিয়ে না করে পারতে? খোকনের কথাটাও তো ভাবতে হবে, একটা বিয়ে করে বাবা।

    নৌকায় আবার পীরপুরের ঘাটে আসা। অপর্ণার ছোট খুড়তুতো ভাই ননী তাহাকে তুলিয়া দিতে আসিতেছিল।

    খররৌদ্রে বড়দলের নোনাজল চকচক করিতেছে। মাঝনদীতে একখানা বাদামতোলা মহাজনী নৌকা, দূরে বড়দলের মোহনার দিকে সুন্দরবনের ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্ট সীমারেখা।

    আশ্চর্য! এরই মধ্যে অপর্ণা যেন কত দুরের হইয়া গিয়াছে। অসীম জলরাশির প্রান্তের ওই অনতিস্পষ্ট বনরেখার মতই দুরের—অনেক দূরের।

    অপুদের ডিঙিখানা দক্ষিণতীর ঘেঁষিয়া যাইতেছিল, নৌকার তলায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঢেউ লাগিতেছে, কোথাও একটা উঁচু ডাঙা, কোথাও পাড় ধ্বসিয়া নদীগর্ভে পড়িয়া যাওয়ায় কাশঝোপের শিকড়গুলা বাহির হইয়া ঝুলিতেছে। একটা জায়গায় আসিয়া অপুর হঠাৎ মনে হইল, জায়গাটা সে চিনিতে পারিয়াছে—একটা ছোট খাল, ডাঙার উপরে একটা হিজল গাছ। এই খালটিতেই অনেকদিন আগে অপর্ণাকে কলিকাতা হইতে আনিবার সময়ে সে বলিয়াছিল—ও কলা-বৌ, ঘোমটা খোল, বাপের বাড়ির দ্যাশটা চেয়েই দ্যাখ।

    তারপর স্টিমার চড়িয়া খুলনা, বাঁ দিকে সে একবার চাহিয়া দেখিয়া লইল। ওই যে ছোট্ট খড়ের ঘরটি—প্রথম যেখানে সে ও অপর্ণা সংসার পাতে।

    সেদিনকার সে অপূর্ব আনন্দমুহূর্তটিতে সে কি স্বপ্নেও ভাবিয়াছিল যে, এমন একদিন আসিবে, যেদিন শূন্যদৃষ্টিতে খড়ের ঘরখানার দিকে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে সমস্ত ঘটনাটা মনে হইবে মিথ্যা স্বপ্ন?

    নির্নিমেষ, উৎসুক, অবাক চোখে সেদিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে অপুর কেমন এক দুর্দমনীয় ইচ্ছা হইতে লাগিল—একবার ঘরখানার মধ্যে যাইতে, সব দেখিতে। হয়তো অপর্ণার হাতের উনুনেব মাটির ঝিকটা এখনও আছে—আর যেখানে বসিয়া সে অপর্ণাব হাতের জলখাবার খাইয়াছিল। প্রথম যেখানটিতে অপর্ণা ট্রাঙ্ক হইতে আয়না চিরুনি বাহির করিয়া তাহার জন্য রাখিয়া দিয়াছিল…

    ট্রেনে উঠিয়া জানালার ধারে বসিয়া থাকে। স্টেশনের পর স্টেশন আসে ও চলিয়া যায়, অপু শুধুই ভাবে বড়দলের তীর, চাঁদাকাটাব বন, ভাঁটার জল কল কল করিয়া নাবিয়া যাইতেছে…একটি অসহায় ক্ষুদ্র শিশুব অবোধ হাসি—অন্ধকার রাত্রে বিকীর্ণ জলরাশির ওপারে কোথায় দাঁড়াইয়া অপর্ণা যেন সেই মনসাপোতার বাড়ির পুরাতন দিনগুলির মতো দুষ্টুমিভরা চোখে হাসিমুখে বলিতেছে—আর কক্ষনো যাবো না তোমার সঙ্গে। আর কক্ষনো না-দেখে নিয়ে।

     

    ফাল্গুন মাস। কলিকাতায় সুন্দর দক্ষিণ হাওয়া বহিতেছে, সকালে একটু শীতও, বোর্ডিংয়ের বারান্দাতে অপু বিছানা পাতিয়া শুইয়াছিল। খুব ভোরে ঘুম ভাঙিয়া বিছানায় শুইয়া তাহার মনে হল, আজ আর স্কুল নাই, টিউশনি নাই—আর বেলা দশটায় নাকে-মুখে খুঁজিয়া কোথাও ছুটিতে হবে নাআজ সমস্ত সময়টা তাহার নিজের, তাহা লইয়া সে যাহা খুশি করিতে পারে—আজ সে মুক্ত!…মুক্ত!…মুক্ত!—আর কাহাকেও গ্রাহ্য করে না সে!…কথাটা ভাবিতেই সারা দেহ অপূর্ব উল্লাসে শিহরিয়া উঠিল-বাঁধন-হেঁড়া মুক্তির উন্নাস। বহুকাল পর স্বাধীনতার আস্বাদন আজ পাওয়া গেল। ওই আকাশের ক্রমবিলীয়মান নক্ষত্রটার মতই আজ সে দূর পথের পথিক-অজানার উদ্দেশে সে যাত্রার আরম্ভ হয়তো আজই হয়, কি কালই হয়।

    পুলকিত মনে বিছানা হইতে উঠিয়া নাপিত ঢাকাইয়া কামাইল, ফরসা কাপড় পরিল। পুরাতন শৌখিনতা আবার মাথাচাড়া দিয়া উঠার দরুন দরজির দোকানে একটা মটকার পাঞ্জাবি তৈয়ারি করিতে দিয়াছিল, সেটা নিজে গিয়া লইয়া আসিল। ভাবিল-একবার ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখে আসি নতুন বই কি এসেছে, আবার কতদিনে কলকাতায় ফিরি কে জানে? বৈকালে মিউজিয়ামে রকফেলার ট্রাস্টের পক্ষ হইতে মশক ও ম্যালেরিয়া সম্বন্ধে বক্তৃতা ছিল। অপুও গেল। বক্তৃতাটি সচিত্র। একটি ছবি দেখিয়া সে চমকিয়া উঠিল। মশকের জীবনেতিহাসের প্রথম পর্যায়ে সেটা থাকে কীটতারপর হঠাৎ কীটের খোলস ছাড়িয়া সেটা পাখা গজাইয়া উড়িয়া যায়। ঠিক যে সময়ে কীটদেহটা অসাড় প্রাণহীন অবস্থায় জলের তলায় ডুকিয়া যাইতেছে নবকলেবরধারী মশা পাখা ছাড়িয়া জল হইতে শুন্যে উড়িয়া গেল।

    মানুষের তো এমন হইতে পারে! জলের তলায় সন্তরণকারী অন্যান্য মশক কীটের চোখে তাদের সঙ্গী তো মরিয়াই গেল-তাদের চোখের সামনে দেহটা তলাইয়া যাইতেছে। কিন্তু জলের ঊর্ধ্বে যে জগতে মশক নবজন্ম লাভ করিল, এরা তো তার কোনও খবরই রাখে না, সে জগতে প্রবেশের অধিকার তখনও তারা তো অর্জন করে নাই-মৃত্যুর দ্বারা, অন্তত তাদের চোখে তো মৃত্যু, তার দ্বারা। এই মশক নিম্নস্তরের জীব, তার পক্ষে যা বৈজ্ঞানিক সত্য, মানুষের পক্ষে তা কি মিথ্যা?

    কথাটা সে ভাবিতে ভাবিতে ফিরিল।

    যাইবার আগে একবার পরিচিত বন্ধুদের সহিত দেখা করিতে বাহির হইয়া পরদিন সকালে সে সেই কবিরাজ বন্ধুটির দোকানে গেল। দোকানে তাহার দেখা পাওয়া গেল না, উড়িয়া ছোকরা চাকরকে দিয়া খবর পাঠাইয়া পরে সে বাসার মধ্যে ঢুকিল।

    সেই খোলর-বাড়ি—সেই বাড়িটাই আছে। সংকীর্ণ উঠানের একপাশে দুখানা বেলেপাথরের শিল পাতা। বন্ধুটি নোড়া দিয়া কি পিষিতেছে, পাশে বড়ো একখানা খবরের কাগজের উপর একরাশ ধূসর রংয়ের গুঁড়া। সারা উঠান জুড়িয়া কুলায় ডালায় নানা শিকড়-বাকড় রৌদ্রে শুকাইতে দেওয়া হইয়াছে।

    বন্ধু হাসিয়া বলিল—এসো এসো, তারপর এতদিন কোথায় ছিলে? কিছু মনে কোরো না ভাই, খারাপ হাত, মাজন তৈরি করছি—এই দ্যাখ না ছাপানো লেবেল–চন্দ্রমুখী মাজন, মহিলা হোম ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিন্ডিকেট—আজকাল মেয়েদের নাম না দিলে পাবলিকের সিমপ্যাথি পাওয়া যায় না, তাই ওই নাম দিয়েছি। বোসো বোসো—ওগো, বার হয়ে এসো না! অপূর্ব এসেছে, একটু চা-টা করো।

    অপু হাসিয়া বলিল, সিন্ডিকেটের সভ্য তো দেখছি আপাতত মোটে দুজন, তুমি আর তোমার স্ত্রী এবং খুব যে অ্যাকটিভ সভ্য তাও বুঝছি।

    হাসিমুখে বন্ধু-পত্নী ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন, তাহার অবস্থা দেখিয়া অপুর মনে হইল, অন্য শিলখানাতে তিনিও কিছু পূর্বে মাজন-পেষা-কার্যে নিযুক্ত ছিলেন। তাহার আসিবার সংবাদ পাইয়া শিল ছাড়িয়া ঘরের মধ্যে পলাইয়াছিলেন। হাত-মুখের গুঁড়া ধুইয়া ফেলিয়া সভ্য-ভব্য হইয়া বাহির হইলেও মাথার এলোমেলো উড়ন্ত চুলে ও কপালের পাশের ঘামে সে কথা জানাইয়া দেয়।

    বন্ধু বলিল—কি করি বলল ভাই, দিনকাল যা পড়েছে, পাওনাদারের কাছে দুবেলা অপমান হচ্ছি, ঘোট আদালতে নালিশ করে দোকানের ক্যাশবাক্স সীল করে রেখেছে। দিন একটা টাকা খরচ—বাসায় কোন দিন খাওয়া হয়, কোন দিন

    বন্ধু-পত্নী বাধা দিয়া বলিলেন, তুমি ও-কাঁদুনি গেয়ো অন্য সময়। এখন উনি এলেন এতদিন পর, একটু চা খাবেন, ঠাণ্ডা হবেন, তা না তোমার কাঁদুনি শুরু হল।

    —আহা, আমি কি পথের লোককে ধরে বলতে যাই? ও আমার ক্লাসফ্রেন্ড, ওদের কাছে। দুঃখের কথাটা বললেও—ইয়ে, পাতা চায়ের প্যাকেট একটা খুলে নাও না? আটা আছে নাকি? আর দ্যাখো, না হয় ওকে খানচারেক রুতি অন্তত—

    –আচ্ছা, সে ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না। পরে অপুর দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিলেনআপনি সেই বিজয়া দশমীর পর আর একদিনও এলেন না যে বড়ো?

    চা ও পরোটা খাইতে খাইতে অপু নিজের কথা সব বলিল—শীঘ্রই বাহিরে যাইতেছে সে কথাটাও বলিল। বন্ধু বলিল—তবেই দ্যাখো ভাই, তবু তুমি একা আর আমি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এই কলকাতা শহরের মধ্যে আজ পাঁচ-পাচটি বছর যে কি করে দিন কাটাচ্ছি তা আর—এই সব নিয়ে একরকম চালাই, পয়সা-প্যাকেট চা আছে, খদিরাদি মোক আছে। মাজনের লাভ মন্দ না, কিন্তু কি জানো, এই কৌটোটা পড়ে যায় দেও পয়সার ওপর, মাজনে, লেবেলে, ক্যাপসুলে তাও প্রায় দুপয়সা-তোমার কাছে আর লুকিয়ে • কবব, স্বামী-স্ত্রীতে খাটি কিন্তু মজুরী পোষায় কি? তবুও তো দোকানীর কমিশন ধরি নি হিসেবের মধ্যে। এদিকে চার পয়সার বেশি দাম করলে কমপিট করতে পারব না।

    খানিক পরে বন্ধু বলিল—ওহে তোমার বৌঠাকরুন বলছেন, আমাদের তো একটা খাওয়া পাওনা আছে, এবার সেটা হয়ে যাক না কেন? বেশ একটা ফেয়ারওয়েল ফিস্ট হয়ে যাবে এখন, তবে উলটো, এই যা

    অপু মনে মনে ভারি কৃতজ্ঞ হইয়া উঠিল বন্ধু-পত্নীর প্রতি। ইহাদের মলিন বেশ ছেলেমেয়েগুলির শীর্ণ চেহারা হইতে ইহাদের ইতিহাস সে ভালোই বুঝিয়াছিল। কিছু ভালো খাবার আনাইয়া খাওয়ানো, একটু আমোদ আহ্লাদ করা—কিন্তু হয়তো সেটা দরিদ্র সংসারে সাহায্যের মতো দেখাইবে। যদি ইহারা না লয় বা মনে কিছু ভাবে? ও-পক্ষ হইতে প্রস্তাবটা আসাতে সে ভারি খুশি হইল।

    ভোজের আয়োজনে ছ-সাত টাকা ব্যয় করিয়া অপু বন্ধুর সঙ্গে ঘুরিয়া বাজার করিল। কইমাছ, গলদা-চিংড়ি, ডিম, আলু, ছানা, দই, সন্দেশ।

    হয়তো খুব বড়ো ধরনের কিছু ভোজ নয়, কিন্তু বন্ধু-পত্নীর আদরে হাসিমুখে তাহা এত মধুর হইয়া উঠিল। এমন কি এক সময়ে অপুর মনে হইল আসলে তাহাকে খাওয়ানোর জন্যই বন্ধুপত্নীর এ ছল। লোকে ইষ্টদেবতাকেও এত যত্ন করে না বোধ হয়। পিছনে সব সময় বন্ধুর বৌটি পাখা হাতে বসিয়া তাহাদের বাতাস করিতেছিলেন, অপু হাত উঠাইতেই হাসিমুখে বলিলেন–ও হবে না, আপনি আর একটু ছানার ডালনা নিন—ও কি, মোর্চার চপ পাতে রাখলেন কার জন্যে? সে শুনব না–

    এই সময় একটি পনেরো-ষোল বছরের ছেলে উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। বন্ধু বলিল—এসো, এসো কুঞ্জ, এসো বাবা, এইটি আমার শালীর ছেলে, বাগবাজারে থাকে। আমার সে ভায়েরা-ভাই মারা গেছে গত শ্রাবণ মাসে। পাটের প্রেসে কাজ করত, গঙ্গার ঘাটে রেললাইন পেরিয়ে আসতে হয়। তা রোজই আসে, সেদিন একখানা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তা ভাবলে, আবার অতখানি ঘুরে যাবে? যেমন গাড়ির তলা দিয়ে গলে আসতে গিয়েছে আর অমনি গাড়িখানা দিয়েছে ছেড়ে। তারপর চাকায় কেটে-কুটে একেবারে আর কি-দুটি মেয়ে, আমার শালী আর এই ছেলেটি, একরকম করে বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে চলছে। উপায় কি?…তাই আজ ভালো খাওয়াটা আছে, কাল স্ত্রী বললে, যাও কুঞ্জকে বলে এসো–ওরে বসে যা বাবা, থালা না থাকে পাতা একখানা পেতে। হাত মুখটা ধুয়ে আয় বাবা—এত দেরি করে ফেললি কেন?

    বেলা বেশি ছিল না। খাওয়াদাওয়ার পর গল্প করিতে করিতে অনেক রাত হইয়া গেল। অপু বলিল, আচ্ছা, আজ উঠি ভাই, বেশ আনন্দ হল আজ অনেকদিন পরে–

    বন্ধু বলিল, ওগো, অপূর্বকে আলোটা ধরে গলির মুখটা পার করে দাও তো? আমি আর উঠতে পারি নে—

    একটা গেট কেরোসিনের টেমি হাতে বউটি অপুর পিছনে পিছনে চলিল।

    অপু বলিল, থাক বৌ-ঠাকরুন, আর এগোবেন না, এমন আর কি অন্ধকার, যান আপনি

    –আবার কবে আসবেন?

    —ঠিক নেই, এখন একটা লম্বা পাড়ি তো দি—

    -কেন, একটা বিয়ে-থা করুন না? পথে পথে সন্ন্যাসী হয়ে এ রকম বেড়ানো কি ভালো? মাও তো নেই শুনেছি। কবে যাবেন আপনি?…যাবার আগে একবার আসবেন না, যদি পারেন।

    —তা হয়ে উঠবে না বৌ-ঠাকরুন। ফিরি যদি আবার তখন বরং—আচ্ছা নমস্কার।

    বউটি টেমি হাতে গলির মুখে দাঁড়াইয়া রহিল।

     

    পরদিন সে সকালে উঠিয়া ভাবিয়া দেখিল, হাতের পয়সা নানারকমে উড়িয়া যাইতেছে, আর কিছুদিন দেরি করিলে যাওয়াই হইবে না। এখানেই আবার চাকরির উমেদার হইয়া দোরে দোরে ঘুরিতে হইবে। কিন্তু আকাশ-পাতাল ভাবিয়াও কিছু ঠিক হইল না। একবার মনে হয় এটা ভালো, আবার মনে হয় ওটা ভালো। অবশেষে স্থির করিল স্টেশনে গিয়া সম্মুখে যাহা পাওয়া যাবে, তাহাতেই উঠা যাইবে। জিনিসপত্র বাঁধিয়া গুছাইয়া হাওড়া স্টেশনে গিয়া দেখিল, আর মিনিট পনেরো পরে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম হইতে গয়া প্যাসেঞ্জার ছাড়িতেছে। একখানা থার্ড ক্লাসের টিকিট কিনিয়া সোজা ট্রেনে উঠিয়া জানালার ধারের একটা জায়গায় সে নিজের বিছানাটি পাতিয়া বসিল।

    অপু কি জানিত এই যাত্রা তাহাকে কোন পথে চালিত করিয়া লইয়া চলিয়াছে? এই চারটা বিশ মিনিটের গয়া প্যাসেঞ্জার-পরবর্তী জীবনে সে কতবার ভাবিয়াছে যে সে তত পাঁজি দেখিয়া যাত্রা শুরু করে নাই, কিন্তু কোন মহাশুভ মাহেন্দ্রক্ষণে সে হাওড়া স্টেশনে থার্ড ক্লাস টিকিট ঘরের ঘুলঘুলিতে ফিবিঙ্গি মেয়ের কাছে গিয়া একখানা টিকিট চাহিয়াছিল—দশ টাকার একখানা নোট দিয়া সাড়ে পাঁচ টাকা ফেরত পাইয়াছিল। মানুষ যদি তাহার ভবিষ্যৎ জানিতে পারিত।

    অপু বর্তমানে এসব কিছুই ভাবিতেছিল না। এত বয়স হইল, কখনও সে গ্র্যান্ডকর্ড লাইনে বেড়ায় নাই, সেই ছোটবেলায় দুটিবার ছাড়া ইস্ট ইন্ডিয়ান বেলেও আর কখনও চড়ে নাই, রেলে চড়িয়া দূরদেশে যাওয়ার আনন্দে সে ছেলেমানুষের মতই উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিল।

    রাস্তার ধারে গাছপালা ক্রমশ কিরূপ বদলাইয়া যায, লক্ষ করিবার ইচ্ছা অনেকদিন হইতে তাহার আছে, বর্ধমান পর্যন্ত দেখিতে দেখিতে গেল কিন্তু পরেই অন্ধকারে আর দেখা গেল না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবযান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }