Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প563 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৮. অপুর এক সম্পূর্ণ নতুন জীবন

    অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

    অপুর এক সম্পূর্ণ নতুন জীবন শুরু হইল এ-দিনটি হইতে। এমন এক জীবন, যাহা সে চিরকাল ভালোবাসিয়াছে, যাহার স্বপ্ন দেখিয়া আসিয়াছে। কিন্তু কোনদিন যে হাতের মুঠায় নাগাল পাওয়া যাইবে তাহা ভাবে নাই।

    তাহাকে যে ড্রিল তাঁবুর তত্ত্বাবধানে থাকিতে হইবে, তাহা এখান হইতে আরও সতেরোআঠারো মাইল দূরে। মিঃ রায়চৌধুরী নিজের একটা ঘোড়া দিয়া তাহাকে পরদিনই কর্মস্থানে পাঠাইয়া দিলেন। নতুন স্থানে আসিয়া অপু অবাক হইয়া গেল। বন ভালোবাসিলে কি হইবে, এ ধরনের বন কখনও দেখে নাই। নিবিড় বনানীর প্রান্তে উচ্চ তৃণভূমি, তারই মধ্যে খড়ের বাংলোঘর, একটা পাতকুয়া, কুলিদের বাসের খুপড়ি, পিছনে ও দক্ষিণে পাহাড়, সেদিকের ঘন বন কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত তাহা চোখে দেখিয়া আন্দাজ করা যায় না—ক্রোশের পর ক্রোশ ধরিয়া পাহাড়, একটার পিছনে আর একটা, আর গভীর জনমানবহীন অরণ্য, সীমা নাই, কূল-কিনারা নাই। চারিদিকের দৃশ্য অতি গভীর। তাঁবুর পিছনেই ঠিক পাহাড়শ্রেণীর একটা স্থান আবার অনাবৃত, বেজায় খাড়া ও উঁচু-বিরাটকায় নগ্ন গ্রানাইট চূড়াটা বৈকালের শেষ রোদে কখনও দেখায় রাঙা, কখনও ধূসর, কখনও ঈষৎ তাম্রাভ কালো রংয়ের—এরূপ গম্ভীর-দৃশ্য অবণ্যভূমির কল্পনাও জীবনে সে করে নাই কখনও!

    অপুর সারাদিনের কাজও খুব পরিশ্রমের, সকালে স্নানের পর কিছু খাইয়াই ঘোড়ায় উঠিতে হয়, মাইল চারেক দূরের একটা জায়গায় কাজ তদাবক করিবাব পব প্রায়ই মিঃ রায়চৌধুবীর যোলো মাইল দূরবর্তী তাঁবুতে গিয়া রিপোর্ট করিতে হয় তবে সেটা রোজ নয়, দু-দিন অন্তর অন্তর। ফিরিতে কোন দিন হয় সন্ধ্যা, কোন দিন বা রাত্রি এক প্রহর দেড়হব। সবটা মিলিয়া কুড়ি-পঁচিশ মাইলের চক্র, পথ কোথাও সমতল, কোথাও ঢালু, কোথাও দুর্গম। ঢালুটাতে জঙ্গল আছে তবে তাব তলা অনেকটা পরিষ্কার, ইংরেজিতে যাকে বলে Open forest—কিন্তু পোয়াটাক পথ যাইতে না যাইতে সে মানুষের জগৎ হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া ঘন অরণ্যেব নির্জনতার মধ্যে একেবারে ডুবিয়া যায়—সেখানে জন নাই, মানুষ নাই, চারিপাশে বড়ো বড়ো গাছ, ডালে পাতায় নিবিড় জড়াজড়ি, পথ নাই বলিলেও হয়, কখনও ঘোড়া চালাইতে হয় পাহাড়ি নদীর শুষ্ক খাত বাহিয়া, কখনও গভীর জঙ্গলের দুর্ভেদ্য বেত-বন ঠেলিয়া-যেখানে বন্যশূকর বা সম্বর হরিণের দল যাতায়াতের সুড়ি পথ তৈরি করিয়াছে-সে পথে। কত ধরনের গাছ, লতা, গাছের ডালে এখানেওখানে বিচিত্র রঙয়ের অর্কিড, নিচে আজোলিয়ার হলুদ ফুল ফুটিয়া প্রভাতের বাতাসকে গন্ধভারাক্রান্ত করিয়া তোলে। ঘোড়া চালাইতে চালাইতে অপুর মনে হয় সে যেন জগতে সম্পূর্ণ একা, সারা দুনিয়ার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নাই–শুধু আছে সে, আর আছে তাহার ঘোড়াটি ও চারিপাশের এই অপূর্বদৃষ্ট বিজন বন! আর কি সে নির্জনতা! কলিকাতার বাসায় নিজের বন্ধ-দুয়ার ঘরটার কৃত্রিম নির্জনতা নয়, এ ধরনের নির্জনতার সঙ্গে তাহার কখনও পরিচয় ছিল না। এ নির্জনতা বিরাট, অদ্ভুত, এমন কিছু যাহা পূর্ব হইতে ভাবিয়া অনুমান করা যায় না, অভিজ্ঞতার অপেক্ষা রাখে।

    ভারি পছন্দ হয় এ জীবন, গল্পের বইয়ে-টুইয়ে যে রকম পড়িত, এ যেন ঠিক তাহাই। খোলা জায়গা পাইলেই ঘোড়া ছাড়িয়া দেয়, গতির আনন্দে সারাদেহে একটা উত্তেজনা আসে; খানাখন্দ, শিলা, পাইওরাইটের স্তুপ কে মানে? নত শালশাখা এড়াইয়া দোদুল্যমান অজানা লতার পাশ কাটাইয়া পৌরুষভরা উদ্দামতার আনন্দে তীরবেগে ঘোড়া উড়াইয়া চলে।

    ঠিক এই সব সময়েই তাহার মনে পড়ে—প্রায়ই মনে পড়ে—শীলেদের অফিসের সেই তিনবৎসরব্যাপী বদ্ধ, সংকীর্ণ, অন্ধকার কেরানী-জীবনের কথা। এখনও চোখ বুজিলে অফিসটা সে দেখিতে পায়, বাঁয়ে নৃপেন টাইপিস্ট বসিয়া খটখট করিতেছে, রামধন নিকাশনবিস বসিয়া খাতাপত্র লিখিতেছে, সেই বাঁধানোমোটা ফাইলের দপ্তরটানিকাশনবিসের পিছনের দেওয়ালের চুন-বালি খসিয়া দেখিতে হইয়াছে যেন একটি পূজানিরত পুরুতঠাকুর। রোজ সে ঠাট্টা করিয়া বলিত, ও রামধনবাবু, আপনার পুরুতঠাকুর আজ ফুল ফেললেন না? উঃ, সে কি বদ্ধতা—এখন যেন সেসব একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।

    সারাদিনের পরিশ্রমের পর সে বাংলোয় ফিরিয়া পাতকুয়ার ঠাণ্ডা জলে স্নান করিয়া এক প্রকার বন্য লেবুর রস মিশানো চিনির শরবত খায়—-গরমের দিনে শরীর যেন জুড়াইয়া যায় তার পরই রামচরিত মিশ্র আসিয়া রাত্রের খাবার দিয়া যায়-আটার রুটি, কুমড়া বা উঁড়সের তরকারি ও অড়হরের ডাল। বারো-তেরো মাইল দূরের এক বস্তি হইতে জিনিসপত্র সপ্তাহ অন্তর কুলিরা লইয়া আসে—মাছ একেবারেই মেলে না, মাঝে মাঝে অপু পাখি শিকার করিয়া আনে। একদিন সে বনের মধ্যে এক হরিণকে বন্দুকের পাল্লার মধ্যে পাইয়া অবাক হইয়া গেল-বড়শিঙ্গা কিংবা সম্বর হরিণ ভারি সতর্ক, মানুষের গন্ধ পাইলে তার ত্রিসীমানায় থাকে না কিন্তু তাহার ঘোড়ার বারোগজের মধ্যে এ হরিণটা আসিল কিরূপে? খুশি ও আগ্রহের সহিত বন্দুক উঠাইয়া লক্ষ করিতে গিয়া সে দেখিল লতাপাতার আড়াল হইতে শুধু মুখটা বাহিব করিয়া হরিণটিও অবাক চোখে তাহার দিকে চাহিয়া আছে-ঘোড়ায় চড়া মানুষ দেখিয়া ভাবিতেছে হয়তো, এ আবার কোন জীব! হঠাৎ অপুর বুকের মধ্যটা ছাঁৎ করিয়া উঠিল–হরিণের চোখ দুটি যেন তাহার খোকার চোখের মতো! অমনি ডাগর ডাগর, অমনি অবোধ, নিষ্পাপ; সে উদ্যত বন্দুক নামাইয়া তখনই টোটাগুলি খুলিয়া লইল। এখানে যতদিন ছিল, আর কখনও শিকারের চেষ্টা করে নাই।

    খাওয়া-দাওয়া শেষ হয় সন্ধ্যার পরেই, তার পরে সে নিজের খড়ের বাংলোর কম্পাউন্ডে চেয়ার পাতিয়া বসে।–অপূর্ব নিস্তব্ধতা! অস্পষ্ট জ্যোৎস্না ও আঁধারে পিছনকার পাহাড়ের গম্ভীরদর্শন অনাবৃত গ্রানাইট প্রাচীরটা কি অদ্ভুত দেখায়। শালকুসুমের সুবাসভরা অন্ধকার, মাথার উপরকার আকাশে অগণিত নৈশ নক্ষত্র। এখানে অন্য কোন সাথী নাই, তাহার মন ও চিন্তার উপর অন্য কাহারও দাবিদাওয়া নাই, উত্তেজনা নাই, উৎকণ্ঠা নাই—আছে শুধু সে, আর এই বিশাল অরণ্যপ্রকৃতির কর্কশ, বন্ধুর বিরাট সৌন্দর্য আর আছে এই নক্ষত্ৰভরা নৈশ আকাশটা।

    বাল্যকাল হইতেই সে আকাশ ও গ্রহনক্ষত্রের প্রতি আকৃষ্ট। কিন্তু এখানে তাদের এ কি বুপ! কুলিরা সকাল সকাল খাওয়া সারিয়া ঘুমাইয়া পড়ে-রামচরিত মিশ্র মাঝে মাঝে অপুকে সাবধান করিয়া দেয়, তাম্বুকা বাহার মৎ বৈঠিয়ে বাবুজী—শেরকা বড়া ডর হ্যায়-পরে সে কাঠকুটা জ্বালিয়া প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ড করিয়া গ্রীষ্মের রাত্রেও বসিয়া আগুন পোহায়—অবশেষে সেও যাইয়া শুইয়া পড়ে, তাহার অগ্নিকুণ্ড নিভিয়া যায়—স্তব্ধ রাত্রি, আকাশ অন্ধকার…পৃথিবী অন্ধকার… আকাশে বাতাসে অদ্ভুত নীরবতা, আবলুসের তালপাতার ফাঁকে দু-একটা তারা যেন অসীম রহস্যভরা মহাবব্যামের বুকের স্পন্দনের মতো দিদিপ করে, বৃহস্পতি স্পষ্টতর হন, উত্তর-পূর্ব কোণের পর্বতসানুর বনের উপরে কালপুরুষ উঠে, এখানে-ওখানে অন্ধকারের বুকে আগুনের আঁচড় কাটিয়া উল্কাপিণ্ড খসিয়া পড়ে। রাত্রি গভীর হইবার সঙ্গে সঙ্গে নক্ষত্রগুলো কি অদ্ভুতভাবে স্থান পরিবর্তন করে! আবলুস ডালের ফাঁকে তারাগুলা ক্রমশ নিচে নামে, কালপুরুষ ক্ৰমে পর্বতসানুর দিক হইতে মাথার উপরকার আকাশে সরিয়া আসে, বিশালকায় ছায়াপথটা তেরছা হইয়া ঘুরিয়া যায়, বৃহস্পতি পশ্চিম আকাশে ঢলিয়া পড়ে। রাত্রির পর রাত্রি এই গতির অপূর্ব লীলা দেখিতে দেখিতে এই শান্ত সনাতন জগৎটা যে কি ভয়ানক রুদ্র গতিবেগ প্রচ্ছন্ন রাখিয়াছে তাহার মিগ্ধতা ও সনাতনত্বের আড়ালে, সে সম্বন্ধে অপুর মন সচেতন হইয়া উঠিল-অতভাবে সচেতন হইয়া উঠিল।…জীবনে কখনও তাহার এত ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় নাই বিশাল নক্ষত্রজগৎটার সঙ্গে, এ-ভাবে হইবার আশাও কখনও কি ছিল?

    অপুর বাংলো-ঘরের পিছনে ও দক্ষিণে পাহাড়, পিছনকার পাহাড়তলী আধ মাইলের কম, দক্ষিণের পাহাড় মাইল দূই দূরে। সামনের বহুদূর বিস্তৃত উঁচুনিচু জমিটা শাল ও পপরেল চারা ও একপ্রকার অর্ধশুষ্ক তৃণে ভরা–অনেক দূর পর্যন্ত খোলা। সারা পশ্চিম দিকচক্রবাল জুড়িয়া বহুদুরে, বিন্ধ্য পর্বতের নীল অস্পষ্ট সীমারেখা, ছিলওয়ারা ও মহাদেও শৈলশ্রেণী–পশ্চিমা বাতাসের ধুলাবালি যেদিন আকাশকে আবৃত না করে, সেদিন বড়ো সুন্দর দেখায়। মাইল এগারো দুরে নর্মদা বিজন বনপ্রান্তরের মধ্য দিয়া বহিয়া চলিয়াছে, খুব সকালে ঘোড়ায় উঠিয়া স্নান করিতে গেলে বেলা নয়টার মধ্যে ফিরিয়া আসা যায়।

    দক্ষিণে পর্বতসানুর ঘন বন নিবিড়, জনমানবহীন, রুক্ষ ও গম্ভীর। দিনের শেষে পশ্চিম গগন হইতে অস্ত-সূর্যের আলো পড়িয়া পিছনের পাহাড়ের যে অংশটা খাড়া ও অনাবৃত, তাহার গ্রানাইট দেওয়ালটা প্রথমে হয় হলদে, পরে হয় মেটে সিঁদুরের রং, পরে জরদা রঙের হইতে হইতে হঠাৎ ধূসর ও তারপরেই কালো হইয়া যায়। ওদিকে দিগন্তলক্ষ্মীর ললাটে আলোর টিপের মতো সন্ধ্যাতারা ফুটিয়া উঠে, অরণ্যানী ঘন অন্ধকারে ভরিয়া যায়, শাল ও পাহাড়ি বাঁশের ডালপালায় বাতাস লাগিয়া একপ্রকার শব্দ হয়-রামচরিত ও জহুরী সিং নেকড়ে বাঘের ভয়ে আগুন জ্বালে, চারিধারে শিয়াল ডাকিতে শুরু করে, বন মোরগ ডাকে, অন্ধকার আকাশে দেখিতে দেখিতে গ্রহ, তারা, জ্যোতিষ্ক, ছায়াপথ একে একে দেখা দেয়। পৃথিবী, আকাশ-বাতাস অপূর্ব রহস্যভরা নিস্তব্ধতায় ভরিয়া আসে, তাঁবুর পাশের দীর্ঘ ঘাসের বন দুলাইয়া এক-একদিন বন্যবরাহ পলাইয়া যায়, দুরে কোথায় হায়েনা উন্মাদের মতো হাসিয়া উঠে, গভীর রাত্রে কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদ পাহাড়ের পিছন হইতে ধীরে ধীরে উঠিতে থাকে, এ যেন সত্যই গল্পের বইয়ে-পড়া জীবন।

    এক এক দিন বৈকালে সে ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়াইতে যায়। শুধুই উঁচু-নিচু অর্ধশুষ্ক তৃণভূমি, ছোট বড়ো শিলাখণ্ড ছড়ানো, মাঝে মাঝে শাল ও বাদাম গাছ। আর এক জাতীয় বড়ো বন্য গাছের কি অপূর্ব আঁকাবাঁকা ডালপালা, চৈত্রের রৌদ্রে পাতা ঝরিয়া গিয়াছে, নীল আকাশের পটভূমিতে পত্রশূন্য ডালপালা যেন ছবির মতো দেখা যায়। অপুর তাঁবু হইতে মাইলতিনেক দূরে একটা ছোট পাহাড়ি নদী আঁকিয়া বাঁকিয়া গিয়াছে, অপু তাহার নাম রাখিয়াছে ক্ৰতোয়া। গ্রীষ্মকালে জল আদৌ থাকে না, তাহারই ধারে একটা শাল ঝাড়ের নিচের একখানা পাথরের উপর সে এক-একদিন গিয়া বসে, ঘোড়াটা গাছের ডালে আঁধিয়া রাখে-স্থানটি ঠিক ছবির মত।

    স্বর্ণাভ বালুর উপর অন্তর্হিত বন্যনদীর উপল-ঢাকা চরণ-চিহ্ন—হাত কয়েক মাত্র প্রশস্ত নদীখাত, উভয় তীরই পাষাণময়, ওপারে কঠিন ও দানাদার কোয়ার্টজাইট ও ফিকে হলদে রঙের বড়ো বড়ো পাথরের চাইয়ে ভরা, অতীত কোন্ হিম-যুগের তুষার নদীর শেষ প্রবাহে ভাসিয়া আসিয়া এখানে হয়তো আটকাইয়া গিয়াছে, সোনালি রংয়ের নদীবালু হয়তো সুবর্ণরেণু মিশানো, অস্তসূর্যের রাঙা আলোয় অত চকচক করে কেন নতুবা? নিকটে সুগন্ধ লতাকস্তুরীর জঙ্গল, খর বৈশাখী বৌদ্রে শুরু খুঁটিগুলি ফাটিয়া মৃগনাভির গন্ধে অপরাহের বাতাস ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিয়াছে। বক্রতোয়া হইতে খানিকটা দূরে ঘন বনের মধ্যে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট ঝরনা, যেন উঁচু চৌবাচ্চা ছাপাইয়া জল পড়িতেছে এমন মনে হয়। নিচের একটা খাতে গ্রীষ্মদিনেও জল থাকে। রাত্রে ওখানে হরিদের দল জল খাইতে আসে শুনিয়া অপু কতবার দেড় প্রহর রাত্রে ঘোড়ায় চড়িয়া সেখানে গিয়াছে, কখনও দেখে নাই। গ্রীষ্ম গেল, বর্ষাও কাটিল, শরৎকালে বন্য শেফালী বনে অজস্র ফুল ফুটিল, বকেতোয়ার শাল-ঝাড়টার কাছে বসিলে তখনও ঝরনার শব্দ পাওয়া যায়—এমন সময়ে এক জ্যোৎস্নারাত্রে সে জহুরী সিংকে সঙ্গে লইয়া জায়গাটাতে গেল। দশমীর জ্যোৎস্না ডালে-খাতায় পাহাড়ি বাদাম বনের মাথায়—মি বাতাসে শেফালীর ঘন মিষ্টি গন্ধ। এই জ্যোৎস্না-মাখা বনভূমি, এই রাত্রির স্তব্ধতা, এই শিশিরা নৈশ বায়ু—এরা যেন কত কালের কথা মনে করাইয়া দেয়, যেন দূর কোনও জন্মান্তরের কথা।

    হরিণের দল কিন্তু দেখা গেল না।

    এই সব নির্জন স্থানে অপু দেখিল মনের ভাব সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়। শহরে বা লোকালয়ে যেমন আত্মসমস্যা সইয়া ব্যাপৃত থাকে, ambition লইয়া ব্যস্ত থাকে, এখানকার উদার নক্ষত্রখচিত আকাশের তলায় সে-সব আশা, আকাঙ্ক্ষা, সমস্যা অতি তুচ্ছ ও অকিঞ্চিঙ্কর মনে হয়। মন আরও ব্যাপক হয়, উদার হয়, দ্রষ্টা হয়, angle of vision একদম বদলাইয়া যায়। এইজন্য অনেক অনেক বই-ই-গার্হস্থ্য সমাজে যা খুব ঘোরর সমস্যামুলক ও প্রয়োজনীয় ও উপাদেয়—এখানকার নিঃসঙ্গ ও বিশ্বতোমুখী জীবনে তা অতি খেলো, রসহীন ও অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। এখানে ভালো লাগে সেই সব, যাহা শাশ্বত কালের। এই অনন্তের সঙ্গে যাহার যোগ আছে। অপুর সেই গ্রহবিজ্ঞানের বইখানা যেমন—এখন যেন তাদের নতুন অর্থ হয়। এত ভাবিতে শেখায়! চৈতন্যের কোন নতুন দ্বার যেন খুলিয়া যায়।

    ফান্ধুন মাসে একজন ফরেস্ট সার্ভেয়ার আসিয়া মাইল দশেক দূরে বনের মধ্যে তাঁবু ফেলিলেন। অপু তাহার সহিত ভাব করিয়া ফেলিল। মাদ্ৰাজী ভদ্রলোক, বেশ লেখাপড়া জানা। অপু প্রায়ই সন্ধ্যাটা সেখানে কাটাইত, চা খাইত, গল্পগুজব করিত, ভদ্রলোক থিওডোলাইট পাতিয়া এনক্ষত্র ও-নক্ষত্ৰ চিনাইয়া দিতেন, এক একদিন আবার দূপুরে নিমন্ত্রণ করিয়া একরকম ভাতের পিঠা খাওয়াইতেন, অপু সকালে উঠিয়া যাইত, দুপুরের পর খাওয়া সারিয়া ঘোড়ায় নিজের তাঁবুতে ফিরিত।

    ফিরিবার পথে ডানদিকের পাহাড়ি ঢালুতে বহুদুর ব্যাপিয়া শীতের শেষে লোহিয়া ও বিজনির ফুলের বন, ঘোড়া থামাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিত, তাঁবুতে ফিরিবার কথা ভুলিয়া যাইত। যে কখনও এমন নির্জন অরণ্যভূমিতে—যেখানে ক্রোশের পর ক্রোশ যাও লোক নাই, জন নাই, গ্রাম নাই, বস্তি নাই–সে-সব স্থানের মুক্ত আকাশের তলে কঠিন ব্যাসাল্ট কি গ্রানাইটেব রুক্ষ পর্বতপ্রাচীরেব ছায়ায়, নিম্নভূমিতে, ঢালুতে, আঁ আঁ দুপুরে রাশি রাশি অগণিত বেগুনি, জরদা ও শ্বেতাভ হলুদ রঙের বন্য লোহিয়া ও বিজনির ফুলেব বন না দেখিয়াছে—তাহাকে এ দৃশ্যের ধারণা বানো অসম্ভব হইবে। এমন কত শত বৎসর ধবিয়া প্রতি বসন্তে রাশি রাশি ফুল ফুটিয়া ঝরিতেছে, কেহ দেখিবার নাই, শুধু ভোমরা ও মৌমাছিদের মহোৎসব।

     

    একদিন অমরকন্টক দেখিতে যাইবার জন্য অপু মিঃ রায়চৌধুরীর নিকট ছুটি চাহিল।

    মনটা ইহার আগে অত্যন্ত উতলা হইয়াছিল, কেন যে উতলা হইল, কারণটা কিছুতেই ভালো ধরিতে পারিল না। ভাবিল এই সময় একবার ঘুরিয়া আসিবে।

    মিঃ রায়চৌধুরী শুনিয়া বলিলেন—যাবেন কিসে? পথ কিন্তু অত্যন্ত খারাপ, এখান থেকে প্রায় আশি মাইল দূর হবে, এর মধ্যে ষাট মাইল ডেন্স ভার্জিন ফরেস্ট—বাঘ, ভালুক, নেকড়ের দল সব আছে। বিনা বন্দুকে যাবেন না, ঘোড়াসহিস নিয়ে যান-রাত হবার আগে আশ্রয় নেবেন কোথাও—সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার বাঘ, রসগোল্লাটির মতো লুফে নেবে। ওই জন্যে কত দিন আপনাকে বারণ করেছি এখানেও সন্ধের পর তাঁবুর বাইরে বসবেন না বা অন্ধকারে বনের পথে একা ঘোড়া চালাবেন না—তা আপনি বড্ড রেকলেস।

    তখন সে উৎসাহে পড়িয়া বিনা ঘোড়াতেই বাহির হইল বটে, কিন্তু দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার সময় সে নিজের ভুল বুঝিতে পারিল—ধারালো পাথরের নুড়িতে জুতার তলা কাটিয়া চিরিয়া গেল, অতদূর পথ হাঁটিবার অভ্যাস নাই, পায়ে এক বিরাট ফোস্কা উঠিয়াছে। পিছনে রামচরিত বোঁচকা লইয়া আসিতেছিল, সে সমানে পথ হাঁটিয়া চলিয়াছে, মুখে কথাটি নাই। বহু দূরের একটা পাহাড় দেখাইয়া বলিল, ওর পাশ দিয়া পথ। পাহাড়টা ধোয়া ধোয়া দেখা যায়, বোঝা যায় না, মেঘ না পাহাড়—এত দুরে। অপু ভাবিল পায়ে হাঁটিয়া অতদুর সে যাইবে কদিনে?

    এ ধরনের ভীষণ অরণ্যভূমি, অপুর মনে হইল এ অঞ্চলে এতদিন আসিয়াও সে দেখে নাই। সে যেখানে থাকে, সেখানকার বন ইহার তুলনায় শিশু, নিতান্ত অবোধ শিশু। দুপুরের পর যে বন শুরু হইয়াছে তাহা এখনও শেষ হয় নাই, অথচ সন্ধ্যা হইয়া আসিল।

    অন্ধকার নামিবার আগে একটা উঁচু পাহাড়ের উপরকার চড়াই পথে উঠিতে হইল—উঠিয়াই দেখা গেল—সর্বনাশ, সামনে আবার ঠিক এমনি আর একটা পাহাড়। অপুর পায়ের ব্যথাটা খুব বাড়িয়াছিল, তৃষ্ণাও পাইয়াছিল বেজায়—অনেকক্ষণ হইতে জলের সন্ধান মেলে নাই, আবলুস গাছের তলা বিছাইয়া অম্লমধুর কেঁদফল পড়িয়া ছিল—সারা দুপুর তাহাই চুষিতে চুষিতে

    কাটিয়াছে—কিন্তু জল অভাবে আর চলে না।

    দুরে দুরে, উত্তরে ও পশ্চিমে নীল পর্বতমালা। নিম্নের উপত্যকার ঘন বনানী সন্ধ্যার ছায়ায় ধূসর হইয়া আসিতেছে, সরু পথটা বনের মধ্য দিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া নামিয়া গিয়াছে। সৌভাগ্যের বিষয়, সম্মুখে পাহাড়টার ওপারে এক মাইলের মধ্যে বন-বিভাগের একটা ডাকবাংলো পাওয়া গেল। চারিধারে নিবিড় শাল বন, মধ্যে ছোট্ট খড়ের ঘর। খনি ও বনবিভাগের লোকেরা মাঝে মাঝে রাত্রি কাটায়।

    এ রাত্রির অভিজ্ঞতা ভারি অদ্ভুত ও বিচিত্র। বাংলোতে অপুরা একটি প্রৌঢ় লোককে পাইল, সে ইহারই মধ্যে ঘরে খিল দিয়া বসিয়া কি পড়িতেছিল, ডাকাডাকিতে উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিল। জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল, লোকটা মৈথিলী ব্রাহ্মণ, নাম আজবলাল ঝা। বয়স ষাট বা সত্তর হইবে। সে সেই রাত্রে নিজের ভাণ্ডার হইতে আটা ও ঘৃত বাহির করিয়া আনিয়া অপুর নিষেধ সত্ত্বেও উৎকৃষ্ট পুরি ভাজিয়া আনিল–পরে অতিথিসৎকার সাবিয়া সে ঘরের মধ্যে বসিযা সুস্বরে সংস্কৃত রামায়ণ পড়িতে আরম্ভ করিল। কিছু পরেই অপু বুঝিল লোকটা, সংস্কৃত ভালো জানে-নানা কাব্য উত্তমরুপে পড়িয়াছে। নানা স্থান হইতে শ্লোক মুখস্থ বলিতে লাগিলকাব্যচর্চায় অসাধারণ উৎসাহ, তুলসীদাসী রামায়ণ হইতেই অনর্গল দোঁহা আবৃত্তি করিয়া যাইতে লাগিল।

    ক্রমে ওকাজী নিজের কাহিনী বলিল। দেশ ছিল দ্বারভাঙা জেলায়। সেখানেই শৈশব কাটে, তেরো বৎসর বয়সে উপনয়নের পর এক বেনিয়ার কাছে চাকরি লইয়া কাশী আসে। পড়াশুনা সেইখানেই-তারপরে কয়েক জায়গায় টোল খুলিয়া ছাত্র পড়াইবার চেষ্টা করিয়াছিল—কোথাও সুবিধা হয় নাই। পেটের ভাত জুটে না, নানা স্থানে ঘুরিবার পর এই ডাকবাংলোয় আজ সাত আট বছর বসবাস করিতেছে। লোকজন বড়ো এখানে কেহ আসে না, কালেভদ্রে এক-আধজন, সে-ই একা থাকে, মাঝে মাঝে তেরো মাইল দূরের বস্তি হইতে খাবার জিনিস ভিক্ষা করিয়া আনে, বেশ চলিয়া যায়। সে আছে আর আছে তাহার কাব্যগ্রন্থগুলি—তাহার মধ্যে দুখানা হাতে লেখা পুঁথি, মেঘদূত ও কয়েক সৰ্গ ভট্টি।

    অপুর এত সুন্দর লাগিল এই নিরীহ, অদ্ভুত প্রকৃতির লোকটির কথাবার্তা ও তাহার আগ্রহভরা কাব্যপ্রীতি—এই নির্জন বনবাসেও একটা শান্ত সন্তোষ। তবে লোকটি যেন একটু বেশি বকে, বিদ্যাটা যেন বেশি জাহির করিতে চায় কিন্তু এত সরলভাবে করে যে, দোষ ধরাও যায় না। অপু বলিল— পণ্ডিতজী, আপনাকে থাকতে দেয়, কেউ কিছু বলে না?

    –না বাবুজী, নাগেশ্বরপ্রসাদ বলে একজন ইঞ্জিনীয়ার আছেন, তিনি আমাকে খুব মানেন, সেই জন্যে কেউ কিছু বলে না।

    কথায় কথায় সে বলিল—আচ্ছা পণ্ডিতজী, এ বন কি অমরকন্টক পর্যন্ত এমনি ছন?

    —বাবুজী, এই হচ্ছে প্রসিদ্ধ বিন্ধ্যারণ্য। অমরকন্টক ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বন এমমি ঘনচিত্রকুট ও দণ্ডকারণ্য এই বনের পশ্চিমদিকে। এর কর্ণনা শুনুন তবে নৈষধচরিতে—দময়ন্তী রাজ্যভ্রষ্ট নলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পরে এই বনে পথ হারিয়ে ঘুরেছিলেন-ঝক্ষবান পর্বতের পাশের পথ দিয়ে তিনি বিদর্ভ দেশে যান। রামায়ণেও এই বনের বর্ণনা শুনবেন আরণ্যকাণ্ডে। শুনুন তবে।

    অপু ভাবিল লোকটা বর্তমানের কোনও ধার ধারে না, প্রাচীন শিক্ষা-দীক্ষায় একেবারে ডুবিয়া আছে—সব কথায় পুরাণের কথা আনিয়া ফেলে। লোকটিকে ভারি অদ্ভুত লাগিতেছিল—সারাজীবন এখানে-ওখানে ঘুরিয়া কিছুই করিতে পারে নাই—এই বনবাসে নিজের প্রিয় পুঁথিগুলা লইয়া বৎসরের পর বৎসর কাটাইয়া চলিয়াছে, কোন দুঃখ নাই, কষ্ট নাই। ঐ ধরনের লোকের দেখা মেলে না বেশি।

    ওঝাজী সুস্বরে রামায়ণের বনবর্ণনা পড়িতেছিল। কি অদ্ভুতভাবে যে চারিপাশের দৃশ্যের সঙ্গে খাপ খায়। নির্জন শালবনে অস্পষ্ট জ্যোৎস্না উঠিয়াছে, তেন্দু ও তিরঞ্জী গাছের পাতাগুলি এক এক জায়গায় ঘন কালো দেখাইতেছে, বনের মধ্যে শিয়ালের দল ডাকিয়া উঠিয়া প্রহর ঘোষণা করিল।

    কোথায় রেল, মোটর, এরোপ্লেন, ট্রেড-ইউনিয়ন? ওঝাজীর মুখে আরণ্যকাণ্ডের শ্লোক শুনিতে শুনিতে সে যেন অনেক দূরের এক সুপ্রাচীন জাতির অতীত সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে গিয়া পড়িল একেবারে। অতীতের গিরিতরঙ্গিণী-তীরবর্তী তপোবন, হোমধূমপবিত্র গোধুলির আকাশতলে বিস্তৃত অগ্নিশালা, সুগভাণ্ড, অজিন, কুশ, সমি, জলকলস, চীর ও কৃষ্ণাজিন পবিহিত সজপা মুনিগণের বেদপাঠধ্বনি…ােন্ত গিরিসানু…বনজ কুসুমের সুগন্ধ…গোদাবরীতটে পুন্নাগ নাগকেশরের বনে পুষ্পআহরণরতা সুমুখী আশ্রমবালিকাগণ-কৃশাঙ্গী রাজবধূগণ—ক্ষীণজ্যোৎস্নায় নদীজল আলো হইয়া উঠিযাছে, তীরে স্থলবেতসের বনে ময়ুর ডাকিতেছে,

    সে যেন স্পষ্ট দেখিল, এই নিবিড় অজানা অরণ্যানীর মধ্য দিয়া নির্ভীক, কবাটবক্ষ, ধনুষ্পণি প্রাচীন রাজপুত্রগণ সকল বিপদকে অক্রিম করিয়া চলিযাছেন। দূরে নীল মেঘের মতো পরিদৃশ্যমান ময়ুর-নিনাদিত ঘন বন, দুর্গম পথের নানা স্থানে শ্বাপদ রাক্ষসে পূর্ণ খন্দ, গুহা, গহুর, মহাগজ ও মহাব্যাঘ্র দ্বারা অধ্যুষিত-অজানা মৃত্যুসংকুলচারিধারে পর্বতরাজির ধাতুরঞ্জিত শৃঙ্গসকল আকাশে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে—কুন্দগুল্ম, সিন্দুবার, শিরীষ, অর্জুন, শাল, নীপ, বেতস, তিনিশ ও তমাল তরুতে শ্যামায়মান গিরিসানু…শৱদ্বারা বিদ্ধ বুরু ও পৃষত মৃগ আগুনে ঝলসাইযা খাওয়া, বিশাল ইহূদী তবুমূলে সতর্ক রাত্রি যাপন …

    ওঝাজী উৎসাহ পাইযা অপুকে একটা পুঁটলি খুলিযা একরাশ সংস্কৃত কবিতা দেখাইলেন, গর্বের সহিত বলিলেন, বাবুজী, ছেলেবেলা থেকেই সংস্কৃত কবিতায় আমার হাত আছে, একবার কাশী-নরেশের সভায় আমার গুরুদেব ঈশ্বরশরণ আমায় নিয়ে যান। একজোড়া দোশালা বিদায় পেয়েছিলাম, এখনও আছে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা। তারপর তিনি অনেকগুলি কবিতা শুনাইলেন, বিভিন্ন ছন্দের সৌন্দর্য ও তাহাতে তাহার রচিত শ্লোকের কৃতিত্ব সকল উৎসাহে বর্ণনা করিলেন। এই ত্রিশ বৎসর ধরিয়া ওঝাজী বহু কবিতা লিখিয়াছেন, ও এখনও লেখেন, সবগুলি সযত্নে সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াও দিয়াছেন, একটিও নষ্ট হইতে দেন নাই, তাহাও জানাইলেন।

    একটি অদ্ভুত ধরনের দুঃখ ও বিষাদ অপুর হৃদয় অধিকার করিল। কত কথা মনে আসিল, তাহার বাবা এই রকম গান ও পাঁচালি লিখিতেন তাহার ছেলেবেলায়। কোথায় গেল সে সব? যুগ যে বদল হইয়া যাইতেছে, ইহারা তাহা ধরিতে পারে না। ওঝাজীর এত আগ্রহের সহিত লেখা কবিতা কে পড়িবে? কে আজকাল ইহার আদর করিবে? কোন্ আশা ইহাতে পুরিবে ওঝাজীর? অথচ কত ঐকান্তিক আগ্রহ ও আনন্দ ইহাদের পিছনে আছে। চাঁপদানির পোস্টাফিসে কুড়াইয়া পাওয়া সেই ছোট মেয়েটির নামঠিকানা-ভুল পত্ৰখানার মতোই তাহা ব্যর্থ ও নিরর্থক হইয়া যাইবে।

    সকালে উঠিয়া সে ওঝাজীকে একখানা দশটাকার নোেট দিয়া প্রণাম করিল। নিজের একখানা ভালো বাঁধানো খাতা লিখিবার জন্য দিলকাছে আর টাকা বেশি ছিল না, থাকিলে হয়তো আরও দিত। তাহার একটা দুর্বলতা এই যে, যে একবার তাহার হৃদয় স্পর্শ করিতে পারিয়াছে তাহাকে দিবার বেলায় সে মুক্তহস্ত, নিজের সুবিধা-অসুবিধা তখন সে দেখে না।

    ডাকবাংলো হইতে মাইল খানেক পরে পথ ক্রমে উপরের দিকে উঠিতে লাগিল, ক্রমে আরও উপরে, উচ্চ মালভূমির উপর দিয়া পথ—শাল, বাঁশ, খয়ের, আবলুসের ঘন অরণ্য-ডাইনে বামে উঁচুনিচু ছোট বড়ো পাহাড় ও টিলা-শালপুষ্পসুরভি সকালের হাওয়া যেন মনের আয়ু বাড়াইয়া দেয়। চতুর্থ দিন বৈকালে অমরকন্টক হইতে কিছু দূরে অপরূপ সৌন্দর্যভূমির সঙ্গে পরিচয় হইল— পথটা সেখানে নিচের দিকে নামিয়াছে, দুই দিকে পাহাড়ের মধ্যে সিকি মাইল চওড়া উপত্যকা, দুধারের সানুদেশের বন অজস্র ফুলে ভরা-পলাশের গাছ যেন জ্বলিতেছে। হাত দুই উঁচু পাথরের পাড়, মধ্যে গৈরিক বালু ও উপল-শয্যায় শিশু শোণ—নির্মল জলের ধারা হাসিয়া খুশিয়া আনন্দ বিলাইতে বিলাইতে ছুটিয়া চলিয়াছে—একটা ময়ুর শিলাখণ্ডের আড়াল হইতে নিকটের গাছের ডালে উঠিয়া বসিল। অপুর পা আর নড়িতে চায় না—তার মুগ্ধ ও বিস্মিত চোখের সম্মুখে শৈশব কল্পনার স্বৰ্গকে কে আবার এভাবে বাস্তবে পরিণত করিয়া খুলিয়া বিছাইয়া দিল!

    এত দূরবিসর্পিত দিগবলয় সে কখনও দেখে নাই, এত নির্জনতার কখনও ধারণা ছিল না তাহার—বহুদূরে পশ্চিম আকাশের অনতিস্পষ্ট সুদীর্ঘ নীল শৈলরেখার উপরকার আকাশটাতে সে কি অপরূপ বর্ণসমুদ্র!

    কি অপূর্ব দৃশ্য চোখের সম্মুখে যে খুলিয়া যায়। এমন সে কখনও দেখে নাই—জীবনে কখনও দেখে নাই।

    এ বিপুল আনন্দ তাহার প্রাণে কোথা হইতে আসে।

    এই সন্ধ্যা, এই শ্যামলতা, এই মুক্ত প্রসারের দর্শনে যে অমৃত মাখানো আছে, সে মুখে তাহা কাহাকে বলিবে?…কে তাহার এ চোখ ফুটাইল, এক সাঁঝ-সকালের, সূর্যাস্তের, নীল বনানীর শ্যামলতার মায়া কাজল তাহার চোখে মাখাইয়া দিল?

    দূরবিসর্পিত চক্রবালরেখা দিগন্তের যতটুকু ঘিরিয়াছে, তাহারই কোন কোন অংশে, বহুদূরে নেমির শ্যামলতা অনতিস্পষ্ট সান্ধ্যদিগন্তে বিলীন, কোন কোন অংশে ধোঁয়া ধোঁয়া দেখা-যাওয়া বনরেখায় পরিস্ফুট, কোন দিকে সাদা সাদা বকের দল আকাশের নীলপটে ডানা মেলিয়া দূর হইতে দূরে চলিয়াছে…মন কোথাও বাধে না। অবাধ উদার দৃষ্টি, পরিচয়ের গণ্ডি পার হইয়া অদৃশ্য অজানার উদ্দেশে ভাসিয়া চলে…

    তাহার মনে হইল সত্য, সত্য, সত্য—এই শান্ত নির্জন আরণ্যভূমিতে মনের ডালপালার আলোছায়ার মধ্যে পুষ্পিত কোবিদারের সুগন্ধে দিনের পর দিন ধরিয়া এক একটি নব জগতের জন্ম হয়—এই দুর ছায়াপথের মতো তাহা দূরবিসর্পিত, এটুকু শেষ নয়, এখানে আরম্ভও নয়—তাহাকে ধরা যায় না অথচ এই সব নীরব জীবনমুহূর্তে অনন্ত দিগন্তের দিকে বিস্তৃত তাহার রহস্যময় প্রসার মনে মনে বেশ অনুভব করা যায়। এই এক বৎসরের মধ্যে মাঝে মাঝে সে তাহা অনুভব করিয়াছেও–এই অদৃশ্য জগৎটার মোহস্পৰ্শ মাঝে মাঝে বৈশাখী শালমঞ্জরীর উন্মাদ সুবাসে, সন্ধ্যাধূসর অনতিস্পষ্ট গিরিমালার সীমারেখায়, নেকড়ে বাঘের ডাকে ভরা জ্যোৎস্নাস্নাত শুভ্র জনহীন আরণ্যভূমির গাম্ভীর্যে, অগণিত তারাখচিত নিঃসীম শূন্যের ছবিতে। বৈকালে ঘোড়াটি বাঁধিয়া যখনই বক্ৰতোয়ার ধারে বসিয়াছে, যখনই অপর্ণার মুখ মনে পড়িয়াছে, কতকাল ভুলিয়া যাওয়া দিদির মুখখানা মনে পড়িয়াছে, একদিন শৈশব-মধ্যাহ্নে মায়ের-মুখে-শোনা মহাভারতের দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়াছে-তখনই সঙ্গে সঙ্গে তাহার ইহাও মনে হইয়াছে যে, যে-জীবন যে-জগৎকে আমরা প্রতিদিনের কাজকর্মে হাটে-ঘাটে হাতের কাছে পাইতেছি জীবন তাহা নয়, এই কর্মব্যস্ত অগভীর একঘেয়ে জীবনের পিছনে একটি সুন্দর পরিপূর্ণ, আনন্দভরা সৌম্য জীবন সুকানো আছে—সে এক শাশ্বত রহস্যভরা গহন গভীর জীবন-মন্দাকিনী, যাহার গতি কল্প হইতে কান্তরে; দুঃখকে তাহা করিয়াছে অমৃতত্বের পাথেয়, অশ্রুকে করিয়াছে অনন্ত জীবনের উৎসধারা…

    আজ তাহার বসিয়া বসিয়া মনে হয়, শীলেদের বাড়ি চাকুরি তাহার দৃষ্টিতে আরও শক্তি দিয়াছিল, অন্ধকার অফিস ঘরে একটুখানি জায়গায় দশটা হইতে সাতটা পর্যন্ত আবদ্ধ থাকিয়া একটুখানি ভোলা জায়গার জন্য সে কি তীব্র লোলুপতা, বুভুক্ষা, দুই টিউশনির ফাঁকে গড়ের মাঠের দিকের বড়ো গির্জাটার চুড়ার পিছনকার আকাশের দিকে তৃষিত চোখে চাহিয়া থাকার সে কি হ্যাংলামি! কিন্তু সেই বদ্ধ জীবনই পিপাসাকে আরও বাড়াইয়া দিয়াছিল, শক্তির অপচয় হইতে দেয় নাই, ধরিয়া বাঁধিয়া সংহত করিয়া রাখিয়াছিল। আজ মনে হয় চাপদানির হেড মাস্টার যতীশবাবুও তাহার বন্ধু-জীবনের পরম বন্ধু—সেই নিষ্পাপ দরিদ্র ঘরের উৎপীড়িতা মেয়ে পটেশ্বরীও। ভগবান তাহাকে নিমিত্তস্বরূপ করিয়াছিলেন—তাহারা সকলে মিলিয়া চাঁপদানির সেই কুলিবস্তির জীবন হইতে তাহাকে জোর করিয়া দূর করিয়া না দিলে আজও সে সেখানেই থাকিয়া যাইত। এমন সব অপরাহে সেখানে বিশু স্যাকরার দোকানের সান্ধ্য আড্ডায় মহা খুশিতে আজও বসিয়া তাস খেলিত।

    একথাও প্রায়ই মনে হয়, জীবনকে খুব কম মানুষেই চেনে। জন্মগত ভুল সংস্কারের চোখে সবাই জীবনকে বুঝিবার চেষ্টা করে, দেখিবার চেষ্টা করে, দেখাও হয় না, বোঝাও হয় না। তা ছাড়া সে চেষ্টাই বা কজন করে?…

    অমরকন্টক তখনও কিছু দূর। অপু বলিল, রামচরিত, কিছু শুকনো ডাল শালপাতা কুড়িয়ে আন, চা করি। রামচরিতের ঘোর আপত্তি তাহাতে। সে বলিল, হুজুর, এসব বনে বড়ো ভালুকের ভয়। অন্ধকার হবার আগে অমরকন্টকের ডাকবাংলোয় যেতে হবে। অপু বলিল, তাড়াতাড়ি চা হয়ে যাবে, যাও না তুমি। পরে সে বড়ো লোটাটায় শোনের জল আনিয়া তিন টুকরা পাথরের উপর চাপাইয়া আগুন জ্বালিল। হাসিয়া বলিল, একটা ভজন গাও রামচরিত, যে আগুন জ্বলেছে, এর কাছে তোমার ভালুক এগোবে না, নির্ভয়ে গাও।

    জ্যোৎস্না উঠিল। চারিধারে অদ্ভুত, গম্ভীর শোভা। কল্যকার কাব্যপুরাণের রেশ তাহার মন হইতে এখনও যায় নাই। বসিয়া বসিয়া মনে হইল সত্যই যেন কোন সুন্দরী, চারুনেত্রা রাজবধূ-নবপুস্পিতা মল্লীলতার মতো তন্বী লীলাময়ী—এই জনহীন নিষ্ঠুর আরণ্যভূমিতে পথ হারাইয়া বিপন্নার মতো ঘুরিতেছেন—তাহার উদ্ভ্রান্ত স্বামী ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে— দূরে ঋক্ষবান্ পর্বতের পার্শ্ব দিয়া বিদর্ভ যাইবার পথটি কে তাহাকে বলিয়া দিবে!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবযান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }