Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প563 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৯. নন-কো-অপারেশনের উত্তেজনাপূর্ণ দিনগুলি

    ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

    নন্-কো-অপারেশনের উত্তেজনাপূর্ণ দিনগুলি তখন বছর তিনেক পিছাইয়া পড়িয়াছে, এমন সময়ে একদিন প্রণব রাজসাহী জেল হইতে খালাস পাইল।

    জেলে তাহার স্বাস্থ্যহানি হয় নাই, কেবল চোখের কেমন একটা অসুখ হইয়াছে, চোখ করকর করে, জল পড়ে। জেলের ডাক্তার মিঃ সেন চশমা লইতে বলিয়াছেন এবং কলিকাতার এক চক্ষুরোগবিশেষজ্ঞের নামে একটি পত্রও দিয়াছেন।

    জেল হইতে বাহির হইয়া সে ঢাকা রওনা হইল এবং সেখান হইতে গেল স্বগ্রামে। এক প্রৌঢ়া খুড়িমা ছাড়া তাহার আর কেহ নাই, বাপ-মা শৈশবেই মারা গিয়াছেন, এক বোন ছিল সেও বিবাহের পর মারা যায়।

    সন্ধ্যার কিছু আগে সে বাড়ি পৌঁছিল। খুড়িমা ভাঙা বোয়াকের ধারে কম্বলের আসন পাতিয়া বসিয়া মালা জপ করিতেছিলেন, তাহাকে দেখিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। খুড়িমার নিজের ছেলেটি মানুষ নয়, গাঁজা খাইয়া বেড়ায়, প্রণবকে ছেলেবেলা হইতে মানুষ করিয়াছেন, ভালোবাসেন, কিন্তু লেখাপড়া জানিলে কি হইবে, তাহার পুনঃপুনঃ সদুপদেশ সত্ত্বেও সে কেবলই নানা হাঙ্গামায় পড়িতেছে, ইচ্ছা করিয়া পড়িতেছে!

    এ বৃদ্ধবয়সে শুধু তাঁহারই মরণ নাই, ইত্যাদি নানা কথা ও তিরস্কার প্রণবকে বোয়াকের ধারে দাঁড়াইয়া শুনিতে হইল। বাগানের বড়ো কাঁঠাল গাছের একটা ডাল কে কাটিয়া লইয়া গিয়াছে খুড়িমা চৌকি দিয়া বেড়ান কখন, তিনি ও-সব পারিবেন না, তাহাকে যেন কাশী পাঠাইয়া দেওয়া হয়, কারণ কর্তাদের অত কষ্টের বিষয়-সম্পত্তি চোখের উপর নষ্ট হইয়া যাইতেছে, এ দৃশ্য দেখাও তাঁহার পক্ষে অসম্ভব।

    দিনচারেক বাড়ি থাকিয়া খুড়িমাকে একটু শান্ত করিয়া চশমার ব্যবস্থার দোহাই দিয়া সে কলিকাতায় রওনা হইল। সোদপুরে খুড়িমার একজন ছেলেবেলায়-পাতানো গোলাপফুল আছেন, তাহারা প্রণবকে দেখিতে চান একবার, সেখানে যেন সে অবশ্য যায়, খুড়িমার মাথার দিব্য। প্রণব মনে মনে হাসিল। বৎসর-চার পূর্বে গোলাপফুলের বড়ো মেয়েটির যখন ব্বিাহের বয়স হইয়াছিল, তখন খুড়িমা এই কথাই বলিয়াছিলেন, কিন্তু প্রণব যাওয়ার সময় করিয়া উঠিতে পারে নাই। তারপরই আসিল নন-কো-অপারেশনের ঢেউ, এবং নানা দুঃখ-দুর্ভোগ। সেটির বিবাহ হইয়াছে, এবার বোধ হয় ছোটটির পালা।

    কলিকাতায় আসিয়া সে প্রথমে অপুর খোজ করিল, পরিচিত স্থানগুলিতে গিয়া দেখিল, দুএকদিন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি খুঁজিল, কারণ যদি অপু কলিকাতায় থাকে তবে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে না আসিয়া থাকিতে পারিবে না। কোথাও তাহার সন্ধান মিলিল না। চাপদানিতে যে অপু নাই তাহা তিন বৎসর আগে জেলে ঢুকিবার সময় জানিত, কারণ তাহারও প্রায় এক বৎসর আগে অপু সেখান হইতে চলিয়া গিয়াছে।

    একদিন সে মন্মথদের বাড়ি গেল। তখন রাত প্রায় আটটা, বাহিরের ঘরে মন্মথ বসিয়া কাগজপত্র দেখিতেছে, সে আজকাল অ্যাটর্নি, খুড়-শশুরের বড়ো নামডাক ও পশারের সাহায্যে নতুন বসিলেও দু-পয়সা উপার্জন করে। মন্মথ যে ব্যবসায় উন্নতি করিবে, তাহার প্রমাণ প্রণব সেদিনই পাইল।

    ঘণ্টাখানেক কথাবার্তার পরে রাত সাড়ে সাতটার কাছাকাছি মন্মথ যেন একটু উসখুস করিতে লাগিল-যেন কাহার প্রতীক্ষা কবিতেছে। একটু পরেই একখানা বড়ো মোটরগাড়ি আসিয়া দরজায় লাগিল, একটি পয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের যুবকের হাত ধরিযা দু-জন লোক ঘরে প্রবেশ করিল। প্রণব দেখিয়াই বুঝিল, যুবকটি মাতাল অবস্থায় আসিয়াছে। সঙ্গের লোক দুইটির মধ্যে একজনের একটা চোখ খারাপ, ঘোলাটে ধরনের-বোধ হয় সে চোখে দেখিতে পায় না, অপর লোকটি বেশ সুপুরুষ। মন্মথ হাসিমুখে অভ্যর্থনা করিয়া বলিল, এই যে মল্লিক মশায়, আসুন, ইনিই মিঃ শর্মা?…বসুন, নমস্কার। গোপালবাবু, বসুন এইখানে। আর ওঁকে আমাদের কনডিশ সব বলেছেন তো?

    ধরনে প্রণব বুঝিল মল্লিক মশায় বড়ো পাকা লোক। উত্তর দিবার পূর্বে তিনি একবার প্রণবের দিকে চাহিলেন। প্রণব উঠিতে যাইতেছিল, মন্মথ বলিলনা, না, বসো হে। ও আমার ক্লাসফ্রেন্ড, একসঙ্গে কলেজে পড়তুম—ও ঘরের লোক, বলুন আপনি। মল্লিক মশায় একটা পুটুলি খুলিয়া কি সব কাগজ বাহির করিলেন, তাহাদের মধ্যে নিম্নসুরে খানিকক্ষণ কি কথাবার্তা হইল। সঙ্গের অন্য লোকটি দুবার যুবকটির কানে কানে ফিসফিস করিয়া কি বলিল, পরে যুবক একটা কাগজে নাম সই করিল। মন্মথ দু-বার সইটা পরীক্ষা করিয়া কাগজখানা একটা গ্রামের মধ্যে পুরিয়া টেবিলে রাখিয়া দিল ও একরাশ নোটের তাড়া মল্পিক মশায়কে গুনিয়া দিল। পরে দলটি গিয়া মোটরে উঠিল।

    প্রণব অপুর মতো নির্বোধ নয়, সে ব্যাপারটা বুঝিল। যুবকটির নাম অজিতলাল সেনশর্মা, কোনও জমিদারের ছেলে। যে-জন্যই হউক, সে দুই হাজার টাকার হ্যান্ডনোট কাটিয়া দেড় হাজার টাকা লইয়া গেল এবং মল্পিক মশায় তাহার দালাল, কারণ, সকলকে মোটরে উঠাইয়া দিয়া তিনি আবার ফিরিয়া আসিলেন ও পুনরায় প্রণবের দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে চাহিয়া মন্মথর সঙ্গে নিম্নসুরে কিসের তর্ক উঠাইলেন-সাড়ে সাত পার্সেন্টের জন্য তিনি যে এতটা কষ্ট স্বীকার করেন নাই, এ কথা কয়েকবার শুনাইলেন। ঠিক সেই সময়েই প্রণব বিদায় লইল।

    পরদিন মন্মথর সঙ্গে আবার দেখা। মন্মথ হাসিয়া বলিল—কালকের সেই কাপ্তেন বাবুটি হে—আবার শেষরাত্রে তিনটের সময় মোটরে এসে হাজির। আবার চাই হাজার টাকা,থোকে থার্টিফাইভ পার্সেন্ট লাভ মেরে দিলুম। মল্লিক লোকটা ঘুঘু দালাল। বড়োলোকের কাপ্তেন ছেলে যখন শেষরাতে ত্যাভনোট কাটছেন, তখন আমরা যা পারি করে নিতে—আমার কি, লোকে যদি দেড়হাজার টাকার হ্যান্ডনোট কেটে এক হাজার নেয় আমার তাতে কি? দোষ কি? এই-সব চরিয়েই তো আমাদের খেতে হবে! কত রাত এমন আসে দ্যাখ না, টাকার যা বাজার কলকাতায়, কে দেবে?

    প্রণব খুব আশ্চর্য হইল না। ইহাদের কার্যকলাপ সে কিছু কিছু জানে, এক অপ্রকৃতিস্থ মাতাল যুবকের নিকট হইতে ইহারা এক রাত্রিতে হাজার টাকা অসৎ উপায়ে উপার্জন করিয়া বড়ো গলায় সেইটাই আবার বাহাদুরি করিয়া জাহির করিতেছে! হতভাগ্য যুবকটির জন্য প্রণবের কষ্ট হইল—মত্ত অবস্থায় সে যে কি সই করিল, কত টাকা তাহার বদলে পাইল, হয়তো বা তাহা সে বুঝিতেও পারিল না।

    কলিকাতা হইতে সে মামার বাড়ি আসিল। মাতৃসমা বড়ো মামিমা আর ইহজগতে নাই, গত বৎসর পূজার সময় তিনি—প্রণব তখন জেলে। সেখানেই সে সংবাদটা পায়। গঙ্গানন্দকাটির ঘাটে নৌকা ভিড়িতে তাহার চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। কাল ট্রেনে সারা রাত ঘুম হয় নাই আদৌ, তাড়াতাড়ি স্নানাহার সারিয়া দোতলায় কোণেব ঘরে বিশ্রামের জন্য যাইয়া দেখিল, বিছানার উপর একটি পাঁচ ছয় বৎসরের ছেলে চুপ করিয়া শুইয়া! দেখিয়া মনে হইল, একরাশ বাসি গোলাপফুল কে যেন বিছানার উপর উপুড় করিয়া ঢালিয়া রাখিয়াছে—-হা, সে যাহা ভাবিয়াছে তাই-জ্বরে ছেলেটির গা যেন পুড়িয়া যাইতেছে, মুখ জুরের ধমকে লাল, ঠোঁট কাঁপিতেছে, কেমন যেন দিশেহারা ভাব। মাথার দিকে একখানা রেকাবিতে দুখানা আধ-খাওয়া ময়দাব রুটি ও খানিকটা চিনি। প্রণব জিজ্ঞাসা করিল—তুমি কাজল, না?

    খোকা যেন হঠাৎ চমক ভাঙিয়া কতকটা ভয় ও কতকটা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, কোনও কথা বলিল না।

    প্রণবের মনে বড় কষ্ট হইল—ইহাকে ইহারা এভাবে একা উপরের ঘবে ফেলিয়া রাখিয়াছে! অসহায় বালক একলাটি শুইয়া মুখ বুজিয়া জ্বরের সঙ্গে যুঝিতেছে, পথ্য দিয়াছে কি-না, দুখানা ময়দার হাতে-গড়া বুটি ও খানিকটা লাল চিনি। আর কিছু জোটে নাই ইহাদের? জ্বরের ঘোরে তাহাই বালক যাহা পারিয়াছে খাইয়াছে। প্রণব জিজ্ঞাসা করিল-খোকা রুটি কেন, সাবু দেয় নি তোমায়?

    খোকা বলিল–ছাবু নেই।

    –নেই কে বললে?

    —মা-মামিমা বললে ছাবু নেই।

    সে জ্বরে হাঁপাইতেছে দেখিয়া প্রণব ঠাণ্ডা জল আনিয়া তাহার মাথাটা বেশ করিয়া ধুইয়া দিয়া পাখার বাতাস করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ এরুপ করিতেই জ্বরটা একটু কমিয়া আসিল, বালক একটু সুস্থ হইল। দিশেহারা ও হাঁস-ফস ভাবটা কাটিয়া গেল। প্রণব বলিল-বলো তো আমি কে?

    খোকা বলিল-জা-জা-জা-জানি নে তো?

    প্রণব বলিল—আমি তোমার মামা হই খোকা। তোমার বাবা বুঝি আসে নি এর মধ্যে?

    কাজল ঘাড় নাড়িয়া বলিল-না-না তো, বাবা কতদিন আসে নি।

    প্রণব কৌতুকের সুরে বলিল—তুমি এত ভোলা হলে কি করে, কাজল?

    সে অপুর ছেলেকে খুব ছোটবেলায় দেখিয়াছিল। আজ দেখিয়া মনে হইল, অপুর ঠোঁটের সুকুমার রেখাটুকু ও গায়ের সুন্দর রংটি বাদে ইহার মুখের বাকি সবটুকু মায়ের মতো।

    কাজল ভাবিয়া ভাবিয়া বলিল—আমার বাবা আসবে না?

    -আসবে না কেন? বাঃ!

    –ক-ক-কবে আসবে?

    —এই এলো বলে। বাবার জন্যে মন কেমন করে বুঝি?

    কাজল কিছু বলিল না।

    অপুর উপরে প্রণবের খুব রাগ হইল। ভাবিল—আচ্ছা পাষণ্ড তো! মা-মরা কচি বাচ্চাটাকে বেঘোরে ফেলে রেখে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে বসে আছে! ওকে এখানে কে দেখে তার নেই ঠিক–দয়া মায়া নেই শরীরে?

    শশীনারায়ণ বাঁড়ুজ্যে প্রণবের নিকট জামাইয়ের যথেষ্ট নিন্দা করিলেন—বন্ধুর সঙ্গে বিয়ের যোগাযোগটি তো ঘটিয়েছিলে, ভেবে দ্যাখো তো সে আজ পাঁচ বছরের মধ্যে নিজের ছেলেকে একবার চোখের দেখা দেখতে এলো না, ত্রিশ-চল্লিশ টাকার মাইনের চাকরি করছেন আর ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভবঘুরের মতো, চাল নেই চুলো নেই, কোন জন্মে যে করবেন সে আশাও নেই—বোলো, হাড়ে চটেছি আমি–এদিকে ছেলেটি কি অবিকল তাই।…এই বয়েস থেকেই তেমনি নির্বোধ, অথচ যেমনি চঞ্চল তেমনি একগুঁয়ে। চঞ্চল কি একটু-আধটু? ওইটুকু তো ছেলে, একদিন করেছে কি, একদল গরুর গাড়ির গাড়োয়ানের সঙ্গে চলে গিয়েছে সেই পীরপুরের বাজারে—এদিকে আমবা খুঁজে পাই নে, চারিদিকে লোক পাঠাই—শেষে মাখন মুহুরির সঙ্গে দেখা, সে ধরে নিয়ে আসে। খাওয়াও, দাওয়াও, মেয়ের ছেলে কখনও আপনার হয় না, যে পর সে-ই পব।

    খোকা বাপের মতো লাজুক ও মুখচোরা—কিন্তু প্রণবের মনে হইল, এমন সুন্দর ছেলে সে খুব কম দেখিয়াছে। সারা গা বাহিয়া যেন লাবণ্য ঝরিতেছে, সদাসর্বদা মুখ টিপি কেমন এক করুণ, অপ্রতিভ ধরনের হাসি হাসে—মুখখানা এত লাজুক ও অবোধ দেখায় সে সময়…কেমন যে একটা করুণা হয়। এখানে কয়েক দিন থাকিয়া প্রণব বুঝিয়াছে, দিদিমা মারা যাওয়ার পর এ বাড়িতে বালককে যত্ন করিবার আর কেহ নাই—সে কখন খায, কখন শোয়, কি পরে-এ সব বিষযে বাড়ির কাহারও দৃষ্টি নাই। শশীনারায়ণ বাঁড়জ্যে তো নাতিকে দু-চক্ষে দেখিতে পারেন না, সর্বদা কড়া শাসনে রাখেন। তাহার বিশ্বাস এখন হইতে শাসন না করিলে এ-ও বাপের মতো ভবঘুরে হইয়া যাইবে, অথচ বালক বুঝিয়া উঠিতে পারে না, দাদামহাশয় কেন তাহাকে অমন উঠিতে-তাড়া বসিতেতাড়া দেন-ফলে সে দাদামহাশয়কে যমের মতো ভয় করে, তঁাহাব ত্রিসীমানা দিয়া হাঁটিতে চায় না।

    কলিকাতায় ফিরিয়া প্রণব দেবব্রতের সঙ্গে দেখা করিল। দেবব্রত একটু বিষণ্ণ—বিলাত যাইবার পূর্বে সে একটি মেয়েকে নিজের চোখে দেখিয়া বিবাহের জন্য পছন্দ করিয়াছিল—কিন্তু তখন নানা কারণে সম্বন্ধ ভাঙিয়া যায়—সে আজ তিন বৎসর পূর্বের কথা। এবার বিদেশ হইতে ফিরিয়া সে নিছক কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া সন্ধান লইয়া জানে মেয়েটির এখনও বিবাহ হয় নাই। মেয়েটির ডান পায়ের হাঁটুতে নাকি কি হইয়াছে, ডাক্তারে সন্দেহ করিতেছেন বোধ হয তাহাতে চিরজীবনের জন্য ওই পা খাটো হইয়া থাকিবে—এ অবস্থায় কেই-বা বিবাহ করিতে অগ্রসর হইবে? শুনিবামাত্র দেবব্রত ধরিয়া বসিয়াছে সে ওই মেয়েকেই বিবাহ করিবে-মায়ের ঘোর আপত্তি, পিসেমহাশয়ের আপত্তি, মামাদের আপত্তি-সে কিন্তু নাছোড়বান্দা। হয় ওই মেয়েকে বিবাহ করিবে, নতুবা দরকার নাই বিবাহে।

    দেবব্রতের সঙ্গে প্রণবের খুব ঘনিষ্ঠ আলাপ ছিল না, অপুর সঙ্গে ইতিপূর্বে বার-দুই-তিন তাহার কাছে গিয়াছিল এই মাত্র। এবার সে যায় অপুর কোন সন্ধান দিতে পারে কিনা তাহাই জানিবার জন্য। কিন্তু এই বিবাহ-বিভ্রাটকে অবলম্বন করিয়া মাস-দুইয়ের মধ্যে দুজনের একটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়িয়া উঠিল।

    দেবব্রত এই সব গোলমালের দরুন পিসেমহাশয়ের বাসা ছাড়িয়া কলিকাতায় হোটেলে উঠিয়াছিল-বৈকালে সেখানে একদিন প্রণব বেড়াইতে গিয়া শুনিল, দেবব্রতের মা এ বিবাহে মত দিয়াছেন, দেবব্রত বলিল—ঠিক সময়ে এসেছেন, আমি ভাবছিলুম আপনার কথা—কাল পিসেমশায়  আর বড়ো মামা যাবেন মেয়েকে আশীর্বাদ করতে, আপনিও যান ওঁদের সঙ্গে। ঠিক বিকেল পাঁচটায় এখানে আসবেন।

    মেয়ের বাড়ি গোয়াবাগানে। ছোট দোতলা বাড়ি, নিচে একটা প্রেস। মেয়ের বাপ গভর্নমেন্টের চাকরি করেন। মেয়েটিকে দেখিয়া খুব সুন্দরী বলিয়া মনে হইল না প্রণবের, গায়ের রং যে খুব ফরসা তাও নয়, তবে মুখে এমন কিছু আছে যাতে একবার দেখিলে বার বার চাহিয়া দেখিতে ইচ্ছা করে। ঘাড়ের কাছে একটা জতুকচিহ্ন, চুল বেশ বড় বড়ো ও কোকড়ানো। বিবাহের দিনও উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে ধার্য হইয়া গেল।

    দেবব্রত সংগতিপন্ন গৃহস্থ-ঘরের ছেলে। দুঃখ কষ্ট কাহাকে বলে জানে না, এ পর্যন্ত বরাবর যথেষ্ট পয়সা হাতে পাইয়াছে, তাহার পিসেমহাশয় অপুত্রক, তাহার সম্পত্তি ও কলিকাতায় দু-খানা বাড়ি দেবব্রতই পাইবে। কিন্তু পয়সা অপব্যয় করার দিকে দেবব্রতের ঝোঁক নাই, সে খুব হিসাবী ও সতর্ক এ বিষয়ে। সাংসারিক বিষয়ে দেব্রত খুব হুঁশিয়ার–পাটনায় যে চাকরিটা সে সম্প্রতি পাইয়াছে, সে শুধু তাহার জোগাড়যন্ত্র ও সুপারিশ ধরিবার কৃতিত্বের পুরস্কার—নতুবা কুড়ি-বাইশ জন বিলাতফেরত অভিজ্ঞ ইঞ্জিনীয়ারের দরখাস্তের মধ্যে তাহার মতো তরুণ ও অনভিজ্ঞ লোকের চাকুরি পাইবার কোনই আশা ছিল না। শাঁখারিটোলায় দেবব্রতের পিসেমহাশয় তারিণী মিত্রের বাড়ি হইতেই দেবব্রত বিবাহ করিতে গেল। পিসিমার ইচ্ছা ছিল খুব বড়ো একটা মিছিল করিয়া বর রওনা হয়, কিন্তু পিসেমহাশয় বুঝাইলেন ওসব একালের ছেলে বিশেষ করিয়া দেবব্রতের মতো বিলাতফেরত ছেলে—পছন্দ করিবে না। মায়ের নিকট বিবাহ করিতে যাইবার অনুমতি প্রার্থনা করিবার সময় দেবব্রতের চোখ ভিজিয়া উঠিল—স্বৰ্গগত স্বামীকে স্মরণ করিয়া দেবব্রতর মা-ও চোখের জল ফেলিলেন—সবাই বলি, তিরস্কার করিল। একজন প্রতিবেশিনী হাসিয়া বলিলেন— দোর-ধরুণীর টাকা কই?…

    দেবব্রতর পিসিমা বলিলেন–আমার কাছে গুনে নিয়ো মেজবৌ। ও-কি দোর-ধরা হল? আমার ছেলেবেলায় আমাদের বাঙাল দেশে নিয়ম ছিল দেখেছি সাতজন এয়ো আর সাতজন কুমারী এই চোদ্দজনকে দোর-ধরুণীর টাকা দিয়ে তবে বর বেরুতে পেত বাড়ি থেকে। একালে তো সব দাঁড়িয়েছে—

    দেবব্রত একটুখানি দাঁড়াইল। ফিরিয়া বলিল—মা শোন একটু।…

    আড়ালে গিয়া চুপি চুপি বলিল—চাটুজ্যে বাড়ির মেয়েটা দোর ধরার জন্যে দাঁড়িয়েছিল, আমি জানি, ছোট পিসিমা তাকে সরিয়ে দিয়েছেন—এ-সবেতে আমার মনে বড়ো কষ্ট হয়, মা। এই দশ টাকার নোটটা রাখো, তাকে তুমি দিয়োকেন তাকে সরালে বলো তো আমি জানি অবিশ্যি কেন সরিয়েছে–কিন্তু এতে লোকের মনে কষ্ট হয় তাও ওরা বোঝে না!

    মা বলিলেন—ও-কথা তোর ওদের বলবার দরকার নেই–টাকা দিলি আমি দেবো এখন। ছোট ঠাকুরঝির দোষ কি, বিধবা মেয়েকে কি বলে আজ সামনে রাখে বলো না? হিঁদুর নিয়মগুলো তো মানতে হবে, সবাই তো তোমার মতো বেহ্মজ্ঞানী হয়নি এখনও। মেয়েটার দোষ দিইনে, তার আর বয়স কি-ছেলেমানুষ—সে না-হয় অত বোঝে না, আমোদে নেচে দোর ধরবে বলে দাঁড়িয়েছে—তার বাপ-মায়ের তো এটা দেখতে হয়। শুভকাজের দিন বিধবা মেয়েকে কেন এখানে পাঠানো বাপু? তা নয়—গরিব কিনা, পাঠিয়েছে—যা কিছু ঘরে আসে-যাক। আমি দেবো এখন—তা হ্যাঁ রে, পাঁচটা দিলেই তো হত—এত কেন?…

    –না মা ওই থাক, দিয়ো। ছোটপিসিমাকে বলে বুঝিয়ে, ওতে শুভকাজ এগোয় না, আরও পিছিয়ে যায়।

    দু-তিনখানা বাড়ির মোড়ে চাটুজ্যে বাড়িটা। ইহারা সবাই ছাপাখানায় কাজ করে, বৃদ্ধ চাটুজোমশায়ও আগে কম্পােজিটরের কাজ করিতেন, আজকাল চোখে দেখেন না বলিয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন। আজকাল তাহার কাজ প্রতিবেশীদের নিকট অভাব জানাইয়া আধুলি ধার করিয়া বেড়ানো। দেবব্রত ইহাদের সকলকেই অনেক দিন হইতে চেনে। তাহার গোলাপফুল সাজানো মোটরখানা চাটুজ্যেবাড়ির সম্মুখে মোড় ঘুরিবার সময় দেবব্রত কেবলই ভাবিতেছিল, কোনও জানালার ফাঁক দিয়া তেরো বৎসরের বিধবা মেয়েটা হয়তো কৌতূহলের সহিত তাহাদেব মোটর ও ফিটন গাড়ির সারির দিকে চাহিয়া আছে।

    রাত্রের গোড়ার দিকেই বিবাহ ও বরযাত্রীভোজন মিটিয়া গেল।

    দেবব্রত বাসরে গিয়া দেখিল, সেখানে অত্যন্ত ভিড়-বাসরের ঘর খুব বড়ো নয়—সামনের দালানেও স্থান নাই, অন্য অন্য ঘরের বাক্সতোর সব দালানে বাহির করা হইয়াছে, অথচ মেয়েদের ভিড় এত বেশি যে বসা তো দূরের কথা, সকলের দাঁড়াইবার জায়গাও নাই। সে বড়ো শালাকে বলিল—দেখুন, যদি অনুমতি করেন, একটু ইঞ্জিনীয়ারিং বিদ্যে জাহির করি। এই ট্রাকগুলো এখানে বাখার কোন মানে নেই—লোক ডাকিয়ে দেওয়ালের দিকে এক সারি, এখানে আর এক সারি করে দিন সিঁড়ির ধাপে ধাপে-বুঝলেন না?…যাবার আসবারও কষ্ট হবে না অথচ এদের জায়গা হবে এখন।

    তাহার ছোট শালীরা ব্যাপারটা লইয়া তাহাকে কি একটা ঠাট্টা করিল। সবাই হাসিয়া উঠিল।

    রাত্রি একটার পর কিন্তু যে-যাহার স্থানে চলিয়া গেল। দেবব্রত বাসর হইতে বাহির হইয়া দালানের একটা স্টিলের তোরঙ্গের উপর বসিয়া একটা সিগারেট ধরাইল। তাহার মনে আনন্দের সঙ্গে কেমন একটা উত্তেজনা …মনে মনে খুব একটা তৃপ্তিও অনুভব করিল।…জীবন এখন সুনির্দিষ্ট পথে চলিবে-লক্ষ্মীছাড়ার জীবন শেষ হইল। পাটনার চাকুরিতে একটা সুবিধা এই যে, জায়গা খুব স্বাস্থ্যকর, বাড়িভাড়া সস্তা, বছরে পঞ্চাশ টাকা করিয়া মাহিনা বাড়িবে—তবে প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদ কিছু কম। সে ভাবিল—যাই ত আগে, ফৈজুদ্দীন হোসেনকে একটু হাতে রাখতে হবে, ওর হাতেই সব—অন্য সব ডিরেক্টার তো কাঠের পুতুল। ক্যান্টনমেন্টের ক্লাবে গিয়েই ভর্তি হয়ে যাবে-ওবা আবার ওসব দেখলে ভেজে কিনা!

    নববধূ এখনও ঘুমায় নাই, দেবব্রত গিয়া বলিল—বাইরে এসো না সুনীতি, কেউ নেই। আসবে?

    নববধু চেলির পুটুলি নয়, কিন্তু পায়ের জন্য তার উঠিতে কষ্ট হয়—দেবব্রত তাহাকে সযত্নে ধরিয়া দালানে আনিয়া তোরঙ্গটার উপর ধীৰে ধীরে বসাইয়া দিল। নববধূ হাসিয়া বলিল—ওই দোরটা বন্ধ করে দাও-সিঁড়ির ওইটে—শেকল উঠিয়ে দাও-হাঁঠিক হয়েছে—নইলে এক্ষুনি কেউ এসে পড়বে।

    দেবব্রত পাশে বসিয়া বলিল-রাত জেগে কষ্ট হচ্ছে খুব-না?

    –কি এমন কষ্ট, তা ছাড়া দুপুরবেলা আমি ঘুমিয়েছি খুব।

    –আচ্ছা, তুমি কনে-চন্দন পরো নি কেন সুনীতি? এখানে সে চলন নেই?

    মেয়েটি সলজ্জমুখে বলিল–মা পরাতে বলেছিলেন–

    -তবে?

    জ্যাঠাইমা বললেন, তুমি নাকি পছন্দ করবে না। দেবব্রত হাসিয়া উঠিয়া বলিল—কেন বল তো—বিলেত-ফেরত বলে? বা তো

    পরে সে বলিল—আমি সাত তারিখে পাটনায় যাব, বুঝলে, তোমাকে আর মাকে এসে নিয়ে যাব মাস-দুই পরে, সুনীতি। তোমার বাবাকে বলে রেখেছি।

    মেয়েটি নতমুখে বলিল—আচ্ছা একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না?…

    –বলো না, কি মনে করব?–

    —আচ্ছা, আমার এই পা নিয়ে তুমি যে বিয়ে করলে, যদি আমার পা না সারে? দ্যাখো, তোমার গা ছুঁয়ে সত্যি বলছি আমার ইচ্ছে ছিল না বিয়ের। মাকে কতবার বুঝিয়ে বলেছি, মা, এই তো আমার পায়ের দশা, পরের ওপর অনর্থক কেন বোঝা চাপানো সারাজীবন—তা মা বললেনতুমি নাকি খুব—তোমার নাকি খুব ইচ্ছে। আচ্ছা কেন বলো তো এ মতি তোমার হল?

    দেবব্রত বলিল—স্পষ্ট কথা বললে তুমিও কিছু মনে করবে না তো সুনীতি? তাহলে বলি শোন, তোমার এই পায়ের দোষ যদি না হত তবে আমি অন্য জায়গায় বিয়ে করে ফেলতুম—যেদিন থেকে শুনেছি পায়ের দোষের জন্য তোমার বিয়ে এই তিন বছরের মধ্যে হয় নি—সেদিন থেকে আমার মন বলেছে ওখানেই বিয়ে করব, নয় তো নয়। অন্য জায়গায় বিয়ে করলে মনে শান্তি পেতাম না সুনীতি। সেই যে তোমাকে দেখে গিয়েছিলুম, তারপর বিয়ে তখন ভেঙে গেল, কিন্তু তোমার মুখখানা কতবার যে মনে হয়েছে!…কেন কে জানে—আমি কাব্যি করছি নে সুনীতি, ওসব আমার আসে না, আমি সত্যি কথা বলছি।

    তারপর সে আজ ওবেলার চাটুজ্যে-বাড়ির বিধবা মেয়েটির কথা বলিল। বলিল—দ্যাখ, এও তো কাব্যের কথা নয়—আজ বিয়ের আসনে বসে কেবলই সেই ছোট মেয়েটার কথা মনে হয়েছে। ছোট পিসিমা তাকে তাড়িয়ে দিয়ে আজ আমার অর্ধেক আনন্দ মাটি করেছেন সুনীতি—তোমার কাছে বলছি, আর কাউকে বোলো না যেন! এ কেউ বুঝবে না, আমার মা-ও বোঝেন নি।

    ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া রাত্রি দুইটা বাজিল।

     

    কাজলের মুশকিল বাধে বোজ সন্ধ্যার সময়। খাওয়া-দাওয়া হইয়া গেলে তাহার মামিমা বলেন, ওপরে চলে যাও, শুয়ে পড়ে গিয়ে। কাজল বিপন্নমুখে রোয়াকের কোণে দাঁড়াইয়া শীতে ঠকঠক করিয়া কাঁপিতে থাকে। ওপরে কেউ নাই, মধ্যে একটা অন্ধকার সিঁড়ি, তাহার উপর দোতলার পাশের ঘবটাতে আলনায় একরাশ লেপকথা বাঁধা আছে। আধ-অন্ধকারে সেগুলো এমন দেখায়!

    আগে আগে দিদিমা সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া ঘুম পাড়াইয়া রাখিয়া আসিতেন। দিদিমা আর নাই, মামিমারা খাওয়াইয়া দিয়াই খালাস। সেদিন সে সেজ দিদিমাকে বলিয়াছিল। তিনি ঝংকার দিয়া বলিয়া উঠিলেন, আমার তো আব খেয়েদেয়ে কাজ নেই, এখন তোমায় যাই শোওয়াতে! একা এটুকু আর যেতে পারেন না, সেদিন তো পীরপুরের হাটে একা পালিয়ে যেতে পেরেছিলে? ছেলের ন্যারা দেখে বাচিনে!

    নিরুপায় হইয়া ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি বাহিয়া সে উপরে উঠে। কিন্তু ঘরে ঢুকিতে আর সাহস না করিয়া প্রথমটা দোরের কাছে দাঁড়াইয়া থাকে। কোণে কড়ির আলনার নিচে দাদামহাশয়ের একরাশ পুরোনো হুঁকার খোল ও কাদান। এককোণে মিটমিটে তেলের প্রদীপ, তাতে সামান্য একটুখানি আলো হয় মাত্র, কোণের অন্ধকার তাহাতে আরও যেন সন্দেহজনক দেখায়। এখানে একবার আসিলে আর কেহ কোথাও নাই, ছোটমামিমা নাই, ছোটদিদিমা নাই, দলু নাই, টাটি নাই—শুধু সে আর চারিপাশের এই সব অজানা বিভীষিকা। কিন্তু এখানেই বা সে কতক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিবে? ছোটমাসিমা ও বিন্দু ঝি এ ঘরে শোয়, তাহাদের আসিতে এখনও বহু দেরি, শীতের হাওয়ায় হাড়-কাপুনি ধরিয়া যায় যে! অগত্যা সে অন্যান্য দিনের মতো চোখ বুজিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া নিজের বিছানার উপর উঠিয়া ছোট লেপটা একেবারে মুড়ি দিয়া ফেলে। কিন্তু বেশিক্ষণ লেপ-মুড়ি দিয়া থাকিতে পারে নাঘরের মধ্যে কোন কিছু নাই তো? মুখ খুলিয়া একবার ভীতচোখে চারিধারে চাহিয়া দেখিয়া আবার লেপমুড়ি দেয়—আর যত রাজ্যের ভূতের গল্প কি ঠিক ছাই এই সময়টাতেই মনে আসে?

    দিদিমা থাকিতে এসব কষ্ট ছিল না। দিদিমা তাহাকে ঘুম না পাড়াইয়া নামিতেন না। কাজল উপরে আসিয়াই বিছানার উপরকার সাজানো লেপাথার স্তুপের উপর খুশি ও আমোদর সহিত বার বার লাফাইয়া পড়িয়া চেঁচাইতে থাকিত—আমি জলে ঝাপাই—হি-হি-আমি জলে ঝাঁপাই–ও দিদিমা–হি-হি–

    কোনোরকমে দিদিমা তাহার লাফানো হইতে নিবৃত্ত করিয়া শোয়াইতে কৃতকার্য হইলে সে দিদিমার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিত,—এইবার এতা গ-গ-অ-ল্প-কথার শেষের দিকে পাতলা রাঙা ঠোঁট দুটি ফুলের কুঁড়ির মতো এক জায়গায় জড়ো করিয়া না আনিলে কথা মুখ দিয়া বাহির হইত না। তাহার দিদিমা হাসিয়া বলিত—যে গুড় খাস, খেয়ে খেয়ে এমনি তোতলা। গল্প বলব, কিন্তু তুমি পাশ ফিরে চুপটি করে শোবে, নড়বেও না, চড়বেও না। কাজল ভূ কুঁচকাইয়া ঘাড় সামনের দিকে নামাইয়া থুতনি প্রায় বুকের উপর লইয়া আসিত। পরে চোখের ভুরু উপবের দিকে উঠাইয়া হাসি-ভরা চোখে চুপ করিয়া দিদিমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিত। দিদিমা বলিত, দুষ্টুমি কোরো না দাদাভাই, আমার এখন অনেক কাজ, তোমার দাদু আবার এখুনি পাশার আড্ডা থেকে আসবেন, তাকে খেতে দেব। ঘুমোও তত লক্ষ্মী ভাইটি!

    কাজল বলিত, ইল্লি!…দা-দা-দাদুকে খাবার দেবে তো ছোট মামীমা, তু-তুমি এখন যাবে বইকি?—একতা গ-গ-অ-প্ল করো, হা দিদিমা

    এ ধরনের কথা সে শিখিয়াছে বড়ো মাসতুতো ভায়েদের কাছে। তাহার বড়ো মাসিমাব ছেলে দলু কথায় কথায় বলে ইল্লি! কাজলও শুনিয়া শুনিয়া তাহাই ধরিয়াছে।

    তাহার পর দিদিমা গল্প করিতেন, কাজল জানালার বাহিরে তারাভরা, স্তব্ধ, নৈশ আকাশের দিকে চাহিয়া একবার মুখ ফুলাইত আবার হাঁ করিত, আবার ফুলাইত আবার হাঁ করিত। দিদিমা বলিত, আঃ, ছিঃ দাদু। ওরকম দুষ্টুমি করলে ঘুমুবে কখন? এখুনি তোমার দাদু ডাকবেন আমায়, তখন তো আমায় যেতে হবে। চুপটি করে শোও। নইলে ডাকব তোমার দাদুকে?

    দাদামশায়কে কাজল বড়ো ভয় করে, এইবার সে চুপ হইয়া যাইত। কোথায় গেল সেই দিদিমা! সে আরও বছর দেড় আগে, তখন তাহার বয়স সাড়ে-চার বছব-একদিন ভারি মজার ব্যাপার ঘটিয়াছিল। সে রাত্রে ঘুমাইতেছিল, সকালে উঠিলে অরু চুপি চুপি বলিল—-ঠাকুমা কাল রাতে মারা গিয়েছে, জানিস নে কাজল?

    —কো-কোথায় গিয়েছে?

    —মারা গিয়েছে, সত্যি আজ শেষরাত্রে নিয়ে গিয়েছে। তুই ঘুমুচ্ছিলি তখন।

    —আবার ক-কবে আসবে?

    অরু বিজ্ঞের সুরে বলিল—আর বুঝি আসে? তুই যা বোকা! ঠাকুরমাকে তো পোড়াতে নিয়ে চলে গেছে ওই দিকে।—সে হাত তুলিয়া নদীর বাঁকের দিকে দেখাইয়া দিল।

    অ ভারি চালবাজ। সব তাতেই ওইরকম চাল দেয়, ভারি তো এক বছরের বড়ো, দেখায় যে সব জানে সব বোঝে। ওই চালবাজির জন্যই তো কাজল অরুকে দেখিতে পারে না।

    সে খুব বিস্মিতও হইল। দিদিমা আর আসিবে না! কেন?…কি হইয়াছে দিদিমার?…বা রে।

    কিন্তু সেই হইতে দিদিমাকে আর সে দেখিতে পায় নাই। গোপনে গোপনে অনেক কাঁদিয়াছে, কোথায় দিদিমা এরকম একরাত্রের মধ্যে নিরুদ্দেশ হইয়া যাইতে পারে, সে সম্বন্ধে অনেক ভাবিয়াছে, কিছু ঠিক করিতে পারে নাই।

    আজকাল আর কেহ কাছে বসিয়া খাওয়ায় না, সঙ্গে করিয়া উপরে লইয়া আসে না, গল্প করে। একলাই এই অন্ধকারের মধ্য দিয়া আসিয়া উপরের ঘরে শুইতে হয়। সকলের চেয়ে মুশকিল হইয়াছে এইটাই বেশি কি-না!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবযান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }