Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প563 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০২. সবে ভোর হইয়াছে

    সবে ভোর হইয়াছে। দেওয়ানপুর গবর্নমেন্ট মডেল ইনস্টিটিউশনের ছেলেদের বোর্ডিং-ঘরের সব দরজা এখনও খুলে নাই। কেবল স্কুলের মাঠে দুইজন শিক্ষক পায়চারি করিতেছেন। সম্মুখের রাস্তা দিয়া এত ভোরেই গ্রাম হইতে গোয়ালারা বাজারে দুধ বেচিতে আনিতেছিল, একজন শিক্ষক আগইয়া আসিয়া বলিলেন–দাঁড়াও, ও ঘোষের পো, কাল দুধ দিয়ে গেলে তো নিছক জল, আজ দেখি কেমন দুধটা!

    অপর শিক্ষকটি পিছু পিছু আসিয়া বলিলেন, নেবেন না সত্যেনবাবু, একটু বেলা না গেলে ভালো দুধ পাওয়া যায় না। আপনি নতুন লোক, এসব জায়গার গতিক জানেন না, যার-তার কাছে দুধ নেবেন না-আমার জানা গোয়ালা আছে, কিনে দেবো বেলা হলে।

    বোর্ডিং-বাড়ির কোণের ঘরে দরজা খুলিয়া একটি ছেলে বাহির হইয়া আসিল ও দূরের করোনেশন ক্লক-টাওয়ারের ঘড়িতে কয়টা বাজিয়াছে চাহিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল। সত্যেনবাবুর সঙ্গী শিক্ষকটির নাম রামপদবাবু, তিনি ডাকিয়া বলিলেন-ওহে সমীর, ওই যে ছেলেটি এবার ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেয়েছে, সে কাল রাত্রে এসেছে না?

    ছেলেটি বলিল, এসেছে স্যার, ঘুমুচ্ছে এখনও। ডেকে দেবো?-পরে সে জানালার কাছে গিয়া ডাকিল, অপূর্ব, ও অপূর্ব।

    ছিপছিপে পাতলা চেহারা, চোদ-পনেরো বৎসরের একটি খুব সুন্দর ছেলে চোখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইয়া আসিল। রামপদবাবু বলিলেন, তোমার নাম অপূর্ব ও–এবার আড়বোয়ালের স্কুল থেকে স্কলারশিপ পেয়েছ?-বাড়ি কোথায়? ও! বেশ বেশ, আচ্ছা, স্কুলে দেখা হবে।

    সমীর জিজ্ঞাসা করিল, স্যার, অপূর্ব কোন ঘরে থাকবে এখনও সেকেন মাস্টার মশায় ঠিক করে দেন নি। আপনি একটু বলবেন?

    রামপদবাবু বলিলেন, কেন, তোর ঘরে তো সীট খালি রয়েছে-ওখানেই থাকবে।

    সমীর বোধ হয় ইহাই চাহিতেছিল, বলিল-আপনি একটু বলবেন তাহলে সেকেন—

    রামপদবাবু চলিয়া গেলে অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, ইনি কে? পরে পরিচয় শুনিয়া সে একটু আঁপ্ৰতিভ হইল। হয়তো বোর্ডিং-এর নিয়ম নাই এত বেলা পর্যন্ত ঘুমানো, সে না জানিয়া শুনিয়া প্রথম দিনটাতেই হয়তো একটা অপরাধের কাজ করিয়া বসিয়াছে।.

    একটু বেলা হইলে সে স্কুল-বাড়ি দেখিতে গেল। কাল অনেক রাত্রে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল, ভালো করিয়া দেখিবার সুযোগ পায় নাই। রাত্রের অন্ধকারে আবছায়া-দেখিতে-পাওয়া সাদা রং-এর প্ৰকাণ্ড স্কুল বাড়িটা তাহার মনে একটা আনন্দ ও রহস্যের সঞ্চার করিয়াছিল।

    এই স্কুলে সে পড়িতে পাইবে!..কতদিন শহরে থাকিতে তাহাদের ছোট স্কুলটা হইতে বাহির হইয়া বাড়ি ফিরিবার পথে দেখিতে পাইত-হাই স্কুলের প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডে ছেলেরা সকলেই এক ধরনের পোশাক পরিয়া ফুটবল খেলিতেছে। তখন কতদিন মনে হইয়াছে এত বড়ো স্কুলে পড়িতে যাওয়া কি তাহার ঘটিবে কোন কালে-“এসব বড়োলোকের ছেলেদের জন্য। এতদিনে তাহার। আশা পূর্ণ হইতে চলিল।

    বেলা দশটার কিছু আগে বোর্ডিং-সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিধুবাবু তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সে কোন ঘরে আছে, নাম কি, বাড়ি কোথায়, নানা জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া বলিলেন, সমীর ছোকরা ভালো, একসঙ্গে থাকলে বেশ পড়াশুনো হবে। এখানকার পুকুরের জলে নাইবে না। কখনও-জািল ভালো নয়, স্কুলের ইন্দারার জলে ছাড়া-আচ্ছা যাও, এদিকে আবার ঘণ্টা বাজবার সময় হল।

    সাড়ে দশটায় ক্লাস বসিল। প্রথম বই খাতা হাতে ক্লাস-বুমে ঢুকিবার সময় তাহার বুক আগ্রহের ঔৎসুক্যে টিপ টিপ করিতেছিল। বেশ বড়ো ঘর, নিচু চৌকির উপর মাস্টারের চেয়ার পাতা-খুব বড়ো ব্ল্যাকবোর্ড। সব ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নিখুঁতভাবে সাজানো। চেয়ার, বেঞ্চি, টেবিল, ডেস্ক সব ঝকঝকি করিতেছে, কোথাও একটু ময়লা বা দাগ নাই।

    মাস্টারক্লাসে ঢুকিলে সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। এ নিয়ম পূর্বে সে যেসব স্কুলে পড়িত সেখানে দেখে নাই। কেহ স্কুল পরিদর্শন করিতে আসিলে উঠিয়া দাঁড়াইবার কথা মাস্টার শিখাইয়া দিতেন। সত্য সত্যই এতদিন পরে সে বড়ো স্কুলে পড়িতেছে বটে।.

    জানোলা দিয়া চাহিয়া দেখিল পাশের ক্লাসরুমে একজন কোট-প্যান্টপরা মাস্টার বোর্ডে কি লিখিতে দিয়া ক্লাসের এদিক-ওদিক পায়চারি করিতেছেন-চোখে চশমা, আধাপাকা দাড়ি বুকেব উপর পড়িয়াছে, গভীর চেহারা। সে পাশের ছেলেকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল,-উনি কোন মাস্টার ভাই?

    ছেলেটি বলিল-উনি মিঃ দত্ত, হেডমাস্টার-কিশচান, খুব ভালো ইংরিজি জানেন।

    অপূর্ব শুনিয়া নিরাশ হইল যে, তাহাদের ক্লাসে মিঃ দত্তের কোন ঘণ্টা নাই। থার্ড ক্লাসের নিচে কোন ক্লাসে তিনি নাকি নামেন না।

    পাশেই স্কুলের লাইব্রেরি, ন্যাপাথ্যালিনের গন্ধ-ভরা পুবোনো বই-এর গন্ধ আসিতেছিল। ভাবিল এ ধরনের ভরপুর লাইব্রেরির গন্ধ কি কখনও ছোটখাটো স্কুলে পাওয়া যায়?

    ঢং ঢেং করিয়া ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়ে-আড়বোয়ালের স্কুলের মতো একখণ্ড রেলেব পাটির লোহা বাজায় না, সত্যিকারের পেটা ঘড়ি।-কি গভীর আওয়াজটা!.

    টিফিনের পরের ঘণ্টায় সত্যেনবাবুর ক্লাস। চব্বিশ-পাঁচিশ বৎসরের যুবক, বেশ বলিষ্ঠ গড়ন, ইহার মুখ দেখিয়া অপুর মনে হইল ইনি ভাবি বিদ্বান, বুদ্ধিমানও বটে। প্রথম দিনেই ইহাব উপর কেমন এক ধরনের শ্রদ্ধা তাহার গড়িয়া উঠিল! সে শ্ৰদ্ধা আরও গভীর হইল ইহার মুখের ইংবিজি উচ্চারণে।

    ছুটির পর স্কুলের মাঠে বোর্ডিং-এব ছেলেদের নানা ধরনের খেলা শুরু হইল। তাঁহাদেব ক্লাসের ননী ও সমীর তাহাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়া অন্য সকল ছেলেদের সহিত পরিচয় করাইয়া দিল। সে ক্রিকেট খেলা জানে না, ননী তাহার হাতে নিজের ব্যাটখানা দিযা তাহাকে বল মারিতে বলিল ও নিজে উইকেট হইতে একটু দূরে দাঁড়াইয়া খেলার আইনকানুন বুঝাইযা দিতে লাগিল।

    খেলার অবসানে যে-যাহাব স্থানে চলিয়া গেল। খেলার মাঠে পশ্চিম কোণে একটা বড়ো বাদাম গাছ, অপু গিয়া তাহার তলায় বসিল। একটু দূরে গবর্নমেন্টের দাতব্য ঔষধালয়। বৈকালেও সেখানে একদল বোগীর ভিড় হইয়াছে, তাহাদের নানা কলরবের মধ্যে একটি ছোট মেয়ের কান্নার সুর শোনা যাইতেছে। অপূর্ব কেমন অন্যমনস্ক হইয়া গেল। চৌদ-পনেরো বৎসর বয়সের মধ্যে এই আজ প্রথম দিন, যেদিনটি সে মায়ের নিকট হইতে বহু দূরে আত্মীয়-বন্ধুহীন প্রবাসে একা কাটাইতেছে। সেদিক দিয়া দেখিতে গেলে আজ তাহার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।

    কত কথা মনে ওঠে, এই সুদীর্ঘ পনেরো বৎসরের জীবনে কি অপূর্ব বৈচিত্ৰ্য, কি ঐশ্বর্য।

    সমীর টেবিলে আলো জ্বালিয়াছে। অপুর কিছু ভালো লাগিতেছিল না-বিছানায় গিয়া শুইয়া রহিল। খানিকটা পরে সমীর পিছনে চাহিয়া তাহকে সে অবস্থায় দেখিয়া বলিল, পড়বে না?

    –আলোটা জ্বলিয়ে রাখো, সুপারিন্টেন্ডেন্ট এখুনি দেখতে আসবে, শুয়ে আছ দেখলে বাকবে।

    অপু উঠিয়া আলো জ্বলিল। বলিল, রোজ আসেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট? সেকেন্ড মাস্টার তো-না?

    সমীরের কথা ঠিক। অপু আলো জালিবার একটু পরেই বিধুবাবু ঘরে ঢুকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি রকম লাগলো। আজ ক্লাসে? পড়াশুনো সব দেখে নিয়েচ তো? সমীর, ওকে একটু দেখিয়ে দিস তো কোথায় কিসের পড়া। ক্লাসের বুটনটো ওকে লিখে দে বরং-সব বই কোেনা হয়েচে তো তোমার?.জিওমেট্রি নেই? আচ্ছা, আমার কাছে পাওয়া যাবে, এক টাকা সাড়ে পাঁচ আনা, কাল সকালে আমার ঘর থেকে গিয়ে নিয়ে এসো একখানা।

    বিধুবাবু চলিয়া গেলে সমীর পড়িতে বসিল; কিন্তু পিছনে চাহিয়া পুনরায় অপূর্বকে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া সে কাছে আসিয়া বলিল, বাড়ির জন্যে মন কেমন করছে।–না?

    তাহার পর সে খাটের ধারে বসিয়া তাহাকে বাড়ির সম্বন্ধে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। বলিল, তোমার মা একা থাকেন বাড়িতে? আর কেউ না? তার তো থাকতে কষ্ট হয়।

    অপূর্ব বলিল, ও কিসের ঘণ্টা ভাই?

    –বোর্ডিং-এর খাওয়ার ঘণ্টা-চলে যাই।

    খাওয়া-দাওয়ার পর দুই-তিনজন ছেলে তাহাদের ঘরে আসিল। এই সময়টা আর সুপারিন্টেন্ডেন্টের ভয় নাই, তিনি নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। শীতের রাত্রে আর বড়ো একটা বাহির হন না। ছেলেরা এই সময়ে এঘর-ওঘর বেড়াইয়া গল্পগুজবের অবকাশ পায়। সমীর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিল, এসো নৃপেন, এই আমার খাটে বসো-শিশির যাও ওখানে-অপূর্ব জানো তাস খেলা?

    নৃপেন বলিল, হেডমাস্টার আসবে না তো?

    শিশির বলিল, হঁবা, এত রাত্তিরে আবার হেডমাস্টার—

    অপূর্বও তাঁস খেলিতে বসিল বটে। কিন্তু শীঘ্রই বুঝিতে পারিল, মায়ের ও দিদির সঙ্গে কত কাল আগে খেলার সে বিদ্যা লইয়া এখানে তাসখেলা খাটিবে না। তাসখেলায় ইহারা সব ঘুণ, কোন হাতে কি তাস আছে সব ইহাদের নখদর্পণে। তাহা ছাড়া এতগুলি অপরিচিত ছেলের সম্মুখে তাহাকে তাহার পুরাতন মুখচোরা রোগে পাইয়া বসিল; অনেক লোকের সামনে সে মোটেই স্বচ্ছন্দে কথাবার্তা বলিতে পারে না। মনে হয়, কথা বলিলেই হয়তো ইহার হাসিয়া উঠিবে। সে সমীরকে বলিল, তোমরা খেলো, আমি দেখি। শিশির ছাড়ে না। বলিল, তিনদিনে শিখিয়ে দেব, ধরে দিকি তাস!

    বাহিরো যেন কিসের শব্দ হইল। শিশির সঙ্গে সঙ্গে চুপ করিয়া গেল এবং হাতের তাস লুকাইয়া পরের পাঁচ মিনিট এমন অবস্থায় রহিল যে সেখানে একটা কাঠের পুতুল থাকিলে সেটাও তাহার অপেক্ষা বেশি নড়িত। সকলেরই সেই অবস্থা। সমীর টেবিলের আলোটা একটু কম৷ইয়া দিল। আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না। নৃপেন একবার দরজার ফাঁক দিয়া বাহিরের বারান্দাতে উঁকি মারিয়া দেখিয়া আসিয়া নিজের তাস সমীরের তেশকের তলা হইতে বাহির করিয়া বলিল, ও কিছু না, এসো এসো-তোমার হাতের খেলা শিশির।

    রাত এগারোটার সময় পা টিপিয়া টিপিয়া যে যাহার ঘরে চলিয়া গেলে অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, তোমাদের রোজ এমনি হয় নাকি? কেউ টের পায় না? আচ্ছা, চুপ করে বসেছিল, ও ছেলেটা কে?

    ছেলেটাকে তাহার ভালো লাগিয়াছে। ঘরে ঢুকিবার পর হইতে সে বেশি কথা বলে নাই, তাহার কাঠের কোণটিতে নীরবে বসিয়া ছিল। বয়স তেরো-চোঁদ হইবে, বেশ চেহারা। ইহাদের দলে থাকিয়াও সে এতদিনে তাসখেলা শেখে নাই, ইহাদের কথাবার্তা হইতে অপূর্ব বুঝিয়াছিল।

    পরদিন শনিবার। বোর্ডিং-এর বেশির ভাগ ছেলেই সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে ছুটি লইয়া বাড়ি চলিয়া গেল। অপূর্ব মোট দুই দিন হইল আসিয়াছে; তাহা ছাড়া, যাতায়াতে খরচপত্রও আছে, কাজেই তাহার যাওয়ার কথাই উঠিতে পারে না। কিন্তু তবু তাহার মনে হইল, এই শনিবারে একবার মাকে দেখিয়া আসিলে মন্দ হইত না-সারা শনিবারের বৈকালটা কেমন খালি-খালি  ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকিতেছিল।

    সন্ধ্যার সময় সে ঘরে আসিয়া আলো জ্বলিল। ঘরে সে একা, সমীর বাড়ি চলিয়া গিয়াছে, এ রকম চুনকাম-করা ঘরে একা থাকিবার সৌভাগ্য কখনও তাহার হয় নাই, সে খুশি হইয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া নিজের খাটে বসিয়া রহিল। মনে মনে ভাবিল, এইবার সমীরের মতো একটা টেবিল আমার হয়? একটা টেবিলের দাম কত, সমীরকে জিজ্ঞাসা করব।

    পরে সে আলোটা লইয়া গিয়া সমীরের টেবিলে পড়িতে বসিল। বুটনে লেখা আছেসোমবারে পাটিগণিতের দিন। অঙ্ককে সে বাঘ বিবেচনা করে। বইখানা খুলিয়া সভয়ে প্রশ্নাবলীর অঙ্ক কয়েকটি দেখিতেছে, এমন সময় দরজা দিয়া ঘরে কে ঢুকিল। কাল রাত্রের সেই শান্ত ছেলেটি। অপুর্ব বলিল-এসো, এসো, বোসো।

    ছেলেটি বলিল, আপনি বাড়ি যান নি?

    অপু বলিল, না, আমি তো মোটে পরশু এলাম, বাড়িও দূরে। গিয়ে আবার সোমবারে আসা যাবে না।

    ছেলেটি অপুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। অপু বলিল-বোর্ডিং-এ যে আজ একেবারেই ছেলে নেই, সব শনিবারেই কি এমনই হয়? তুমি বাড়ি যাও নি কেন? তোমার নামটা কি জানি নে ভাই।

    –দেবব্রত বসু-আপনার মনে থাকে না। বাড়ি গেলাম না ইচ্ছে করে? সেকেন মাস্টার ছুটি দিলে না। ছুটি চাইতে গেলাম, বললে, আর শনিবারে গেলে আবার এ শনিবারে কি? হবে না, যাও।

    তাহার পর সে বসিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ গল্প করিল। তাহার বাড়ি শহর হইতে মাইল বারো দূরে, ট্রেনে যাইতে হয়। সে শনিবারে বাড়ি না গিয়া থাকিতে পারে না, মন হাঁপাইয়া উঠে, অথচ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছুটি দিতে চায় না। তাহার কথাবার্তার ধরনে অপু বুঝিতে পারিল যে, বাড়ি না। যাইতে পারিয়া মন আজ খুবই খারাপ, অনবরত বাড়ির কথা ছাড়া অন্য কথা সে বড়ো একটা বলিল না। দেবব্রত খানিকটা বসিয়া থাকিয়া অপুর বালিশটা টানিয়া লইয়া শুইয়া পড়িল। অনেকটা আপন মনে বলিল, সামনের শনিবারে ছুটি দিতেই হবে, সেকেন মাস্টার না দেয় হেডমাস্টারেব কাছে গিয়ে বলবো।

    অপু এ ধরনের দূর প্রবাসে এক রাত্রিবাস করিতে আদৌ অভ্যস্ত নয়, চিরকাল মা-বাপের কাছে কাটাইয়াছে, আজকার রাত্রিটা তাহার সম্পূর্ণ উদাস ও নিঃসঙ্গ ঠেকিতেছিল।

    দেবব্রত হঠাৎ বিছানা হইতে উঠিয়া বসিল, আপনি দেখেন নি বুঝি? জানেন না? আসুন না আপনাকে দেখাই, আসুন উঠে!

    পরে সে অপুর হাত ধরিয়া পিছনের দেওয়ালের বড়ো জানালাটার কাছে লইয়া গিয়া দেখাইল, সেটার পাশাপাশি দুটি গরাদে তুলিয়া ফেলিয়া আবার বসানো চলে। একটা লোক অনায়াসে সেই ফাঁকটুকু দিয়া ঘরে যাতায়াত করিতে পারে। বলিল, শুধু সমীরদা আর গণেশ জানে, কাউকে যেন বলবেন না।

    একটু পরে বোর্ডিং-এর খাওয়ার ঘণ্টা পড়িল।

    খাওয়ার আগে অপু বলিল, আচ্ছা ভাই, এ কথাটার মানে জানো?

    একখণ্ড ছাপা কাগজ সে দেবব্রতকে দেখিতে দিল। বড়ো বড়ো অক্ষরে কাগজখানাতে লেখা আছে-Literature, এত বড়ো কথা সে এ পর্যন্ত কমই পাইয়াছে, অর্থটা জানিবার খুব ক্টৌতুহল। দেবব্রত জানে না, বলিল, চলুন, খাওয়ার সময় মণিদাকে জিজ্ঞেস করবো।

    মণিমোহন সেকেন্ড ক্লাসের ছাত্র, দেবব্রত কাগজখানা দেখাইলে সে বলিল, এর মানে সাহিত্য। এ ম্যাকমিলান কোম্পানির বইয়ের বিজ্ঞাপন, কোথায় পেলে?

    অপু হাত তুলিয়া দেখাইয়া বলিল, ওই লাইব্রেরির কোণটায় কুড়িয়ে পেয়েছি, লাইব্রেরির ভেতর থেকে কেমন করে উড়ে এসেছে বোধ হয়। কাগজখানার আত্মাণ লইয়া হাসিমুখে বলিল, কেমন ন্যাপথালিনের গন্ধটা।

    কাগজখানা সে যত্ন করিয়া রাখিয়া দিল।

    হেডমাস্টারকে অপু অত্যন্ত ভয় করে। প্রৌঢ় বয়স, বেশ লম্বা, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফ-অনেকটা যাত্রার দলের মুনির মতো। ভারি নাকি কড়া মেজাজের লোক, শিক্ষকেরা পর্যন্ত তঁহাকে ভয় করিয়া চলেন। অপু এতদিন তাহাকে দূর হইতে দেখিয়া আসিতেছিল। একদিন একটা বড়ো মজা হইল। সত্যেনবাবু ক্লাসে আসিয়া বাংলা হইতে ইংরেজি করিতে দিয়াছেন, এমন সময় হেডমাস্টার ক্লাসে ঢুকিতেই সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। হেডমাস্টার বইখানা সত্যেনবাবুর হাত হইতে লইয়া একবার চোখ বুলাইয়া দেখিয়া লইয়া গম্ভীরস্বরে বলিলেন-আচ্ছা, এই যে এতে ভিক্টর হিউগো কথাটা লেখা আছে, ভিক্টর হিউগো কে ছিলেন জানো?–ক্লাস নীরব। এ নাম কেহ জানে না। পাড়াগায়ের স্কুলের ফোর্থ ক্লাসের ছেলে, কেহ নামও শোনে নাই।–

    কে বলিতে পারো।–তুমি-তুমি?

    ক্লাসে সূচি পড়িলে তাহার শব্দ শোনা যায়।

    অপুর অস্পষ্ট মনে হইল নামটা-যেন তাহার নিতান্ত অপরিচিত নয়, কোথাও যেন সে পাইয়াছে ইহার আগে। কিন্তু তাহার পালা আসিল ও চলিয়া গেল, তাহার মনে পড়িল না। ওদিকের বেঞ্চিটা ঘুরিয়া যখন প্রশ্নটা তাহাদের সম্মুখের বেঞ্চের ছেলেদের কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তখন তাহার হঠাৎ মনে পড়িল, নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে সেই পুরাতন “বঙ্গবাসী”গুলার মধ্যে কোথায় সে একথাটা পড়িয়ছে-বোধ হয়, সেই “বিলাত যাত্রীর চিঠি’র মধ্যে হইবে। তাহার মনে পড়িয়াছে! পরীক্ষণেই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল-ফরাসী দেশের লেখক, খুব বড়ো লেখক। প্যারিসে তার পাথরের মূর্তি আছে, পথের ধারে।

    হেডমাস্টার বোধ হয় এ ক্লাসের ছেলের নিকট এ ভাবের উত্তর আশা করেন নাই, তাহার দিকে চশমা-আঁটা জ্বলজ্বলে চোখে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিতেই অপু অভিভূত ও সংকুচিত অবস্থায় চোখ নামাইয়া লইল। হেডমাস্টার বলিলেন, আচ্ছা, বেশ। পথের ধারে নয়, বাগানের মধ্যে মূর্তিটা আছে—বসো, বসো সব।

    সত্যেনবাবু তাহার উপর খুব সন্তুষ্ট হইলেন। ছুটির পর তাহাকে সঙ্গে করিয়া নিজের বাসায় লইয়া গেলেন। ছোটখাটো বাড়ি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, একাই থাকেন। স্টেভ জ্বলিয়া চা ও খাবার করিয়া তাহাকে দিলেন, নিজেও খাইলেন। বলিলেন, আর একটু ভালো করে গ্রামারটা পড়বে।–আমি তোমাকে দাগ দিয়ে দেখিয়ে দেবো!

    অপুর লজ্জাটা অনেকক্ষণ কাটিয়া গিয়াছিল, সে আলমারিটার দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-ওতে আপনার অনেক বই আছে?

    সত্যেনবাবু আলমারি খুলিয়া দেখাইলেন। বেশির ভাগই আইনের বই, শীঘ্রই আইন পরীক্ষা দিবেন। একখানা বই তাহার হাতে দিয়া বলিলেন-এখানা তুমি পড়ো-বাংলা বই, ইতিহাসের গল্প।

    অপুর আরও দু-একখানা বই নামাইয়া দেখিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিল না।

     

    মাস দুই-তিনের মধ্যে বোর্ডিং-এর সকলের সঙ্গে তাহার খুব জানাশোনা হইয়া গেল।

    হয়তো তাহা ঘটিত না, কারণ তাহার মতো লাজুক ও মুখচোরা প্রকৃতির ছেলের পক্ষে সকলের সহিত মিশিয়া আলাপ করিয়া লওয়াটা একরূপ সম্ভবের বাহিরের ব্যাপার, কিন্তু প্রায় সকলেই তাহার সহিত যাচিয়া আসিয়া আলাপ করিল। তাহাকে কে খুশি করিতে পারে-ইহা লইয়া দিনকতক যেন বোর্ডিং-এর ছেলেদের মধ্যে একটা পাল্লা দেওয়া চলিল। খাবার-ঘরে খাইতে বসিবার সময় সকলেরই ইচ্ছা-অপু তাহার কাছে বসে, এ তাড়াতাড়ি বড়ো পিঁড়িখানা পাতিয়া দিতেছে, ও ঘি খাইবার নিমন্ত্রণ করিতেছে। প্ৰথম প্ৰথম সে ইহাতে অস্বস্তিবোধ করিত, খাইতে বসিয়া তাহার ভালো করিয়া খাওয়া ঘটিত না, কোনরকমে খাওয়া সাবিয়া উঠিয়া আসিত। কিন্তু যেদিন ফাস্ট ক্লাসের রমাপতি পর্যন্ত তাহাকে নিজের পাতের লেবু তুলিয়া দিয়া গেল, সেদিন সে মনে মনে খুশি তো হইলই, একটু গর্বও অনুভব করিল। রমাপতি বয়সে তাহার অপেক্ষা চার-পাঁচ বৎসরের বড়ো, ইংরেজি ভালো জানে বলিয়া হেডমাস্টারের প্রিয়পাত্র, মাস্টারের পর্যন্ত খাতির করিয়া চলেন, একটু গভীর প্রকৃতির ছেলেও বটে। খাওয়া শেষ করিয়া আসিতে আসিতে সে ভাবিল, আমি কি ওই শ্যামলালের মতো? রমাপতিদা পর্যন্ত সোধে লেবু দিল! দেয় ওদের? কথাই বলে না।

    দেবব্রত অন্ধকারের মধ্যে কাঁঠালতলাটায় তাহারই অপেক্ষা করিতেছিল। বলিল-আপনার ঘরে যাব অপূর্বদা, একটা টাস্ক একটু বলে দেবেন?

    পরে সে হাসিমুখে বলিল, আজ বুধবার, আর চারদিন পরেই বাড়ি যাব। শনিবারটা ছেড়ে দিন, মধ্যে আর তিনটে দিন। আপনি বাড়ি যাবেন না, অপূর্বদা?

    প্রথম কয়েকমাস কাটিয়া গেল। স্কুল-কম্পাউন্ডের সেই পাতাবাহার ও চীনা-জবার ঝোপটা অপুর বড়ো প্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল। সে রবিবারের শান্ত দুপুরে রৌদ্রে পিঠ দিয়া শুকনা পাতার রাশির মধ্যে বসিয়া বসিয়া বই পড়ে। ক্লাসের বই পড়িতে তাহার ভালো লাগে না, সে সব বই-এর গল্পগুলি সে মাসখানেকের মধ্যেই পড়িয়া শেষ করিয়াছে। কিন্তু মুশকিল। এই যে, স্কুল লাইব্রেরিতে ইংরে বই বেশি; যে বইগুলার বাধাই চিত্তাকর্ষক, ছবি বেশি, সেগুলা সবই ইংরেজি। ইংরেজি সে ভালো বুঝিতে পারে না, কেবল ছবির তলাকার বর্ণনাটা বোঝে মাত্র।

    একদিন হেডমাস্টারের অফিসে তাহার ডাক পড়িল। হেডমাস্টার ডাকিতেছেন শুনিয়া তাহার প্ৰাণ উড়িয়া গেল। ভয়ে ভয়ে অফিস ঘরের দুয়ারের কাছে গিয়া দেখিল, আর একজন সাহেবি পোশাক-পরা ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে বসিয়া আছেন। হেডমাস্টারের ইঙ্গিতে সে ঘরে ঢুকিয়া দুজনের সামনে গিয়া দাঁড়াইল।

    ভদ্রলোকটি ইংরেজিতে তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন ও সামনের একখানা পাতার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া কি দেখিয়া লইয়া একখানা ইংরেজি বই তাহার হাতে দিয়া ইংরেজিতে বলিলেন, এই বইখানা তুমি পড়তে নিয়েছিলে?

    অপু দেখিল, বইখানা The world of lice, মাসখানেক আগে লাইব্রেরি হইতে পড়িবার জন্য সে লইয়াছিল। সবটা ভালো বুঝিতে পারে নাই।

    সে কম্পিত কণ্ঠে বলিল, ইয়েস—

    হেডমাস্টার গর্জন করিয়া বলিলেন, ইয়েস স্যার!

    অপুর পা কাঁপিতেছিল, জিভ শুকাইয়া আসিতেছিল, থিতামত খাইয়া বলিল, ইয়েস স্যার—

    ভদ্রলোকটি পুনরায় ইংরেজিতে বলিলেন, স্লেজ কাহাকে বলে?

    অপু ইহার আগে কখনও ইংরেজি বলিতে অভ্যাস করে নাই, ভাবিয়া ভাবিয়া ইংরেজিতে বানাইয়া বলিল, এক ধরনের গাড়ি কুকুরে টানে। বরফের উপর দিয়া যাওয়ার কথাটা মনে আসিলেও হঠাৎ সে ইংরেজি করিতে পরিল না।

    –অন্য গাড়ির সঙ্গে স্নেজের পার্থক্য কি?

    অপু প্ৰথমে বলিল, ব্লেজ হ্যাজ-তারপরই তাহার মনে পড়িল-আর্টিকল-সংক্রাঙ্ক কোন গোলযোগ এখানে উঠিতে পারে। ‘এ’ বা দি’ কোনটা বলিতে হইবে তাড়াতাড়ির মাথায় ভাবিবার সময় না পাইয়া সোজাসুজি বহুবচনে বলিল, মেজেস, হ্যাভ নো হুইলস–

    –অরোরা বোরিয়ালিস কাহাকে বলে?

    অপুর চোখমুখ উজ্জ্বল দেখাইল। মাত্র দিন কতক আগে সত্যেনবাবুর কি একখানা ইংরেজি বইতে সেইহার ছবি দেখিয়াছিল। সে জায়গাটা পড়িয়া মানে না বুঝিলেও এ-কথাটা খুব গোল-ভরা বলিয়া সত্যেনবাবুর নিকট উচ্চারণ জানিয়া মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছিল। তাড়াতাড়ি বলিল, অরোরা বোরিয়ালিস ইজ এ কাইন্ড অব অ্যাটমোসফেরিক ইলেকট্রিসিটি

    ফিরিয়া আসিবার সময় শুনিল, আগন্তুক ভদ্রলোকটি বলিতেছেন, আনইউজুয়াল ফর এ বয় অব ফোর্থ ক্লাস। কি নাম বললেন? এ স্ট্রাইকিংলি হ্যান্ডসাম বয়-বেশ বেশ!

    অপু পরে জানিয়াছিল তিনি স্কুল-বিভাগের বড়ো ইন্সপেক্টর, না বলিয়া হঠাৎ স্কুল দেখিতে আসিয়াছিলেন।

    পরে সে রমাপতির ঘরে আঁক বুঝিতে যায়। রমাপতি অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে, নিজের সীট বেশ সাজাইয়া রাখিয়াছে। টেবিলের উপর পাথরের দোয়াতদানি, নতুন নিব পরানো কলমগুলি সাফ করিয়া গুছাইয়া রাখিয়াছে, বিছানাটি ধবধবে, বালিশের ওপর তোয়ালে। অপুর সঙ্গে পড়াশুনার কথাবার্তা মিটিবার পর সে বলিল, এবার তোমায় সরস্বতী পুজোতে ছোট ছেলেদের লীডার হতে হবে, আর তো বেশি দেরিও নেই, এখন থেকেই চাঁদা আদায়ের কাজে বেবুনো চাই।

    উঠিবার সময় ভাবিল, রমাপতিদার মতো এইরকম একটা দোয়াতদানি হয় আমার? চমৎকার ফুলকটা? লিখে আরাম আছে। হ্যাঁ, চাদ চাইতে যাব বইকি! ওসব হবে না। আমায় দিয়ে।–আসল কথা সে বেজায় মুখচোরা, কাহারও সহিত কথা বলিতে পরিবে না।

    সে নিজের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, দেবব্রত সমীরের টেবিলে মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া শুইয়া আছে। অপু বলিল, কি দেবু, বাড়ি যাও নি আজ?

    দেবব্রত মাথা না তুলিয়াই বলিল, দেখুন না কাণ্ড সেকেন মাস্টারের, ছুটি দিলে না-ও শনিবারে বাড়ি যাই নি, আপনি তো জানেন অপুর্বদা! বললে, তুমি ফি শনিবারে বাড়ি যাও, তোমার ছুটি হবে না।–

    দেবব্রতর জন্য অপুর মনে বড়ো কষ্ট হইল। বাড়ির জন্য তাহার মনটা সারা সপ্তাহ ধরিয়া কি রকম তৃষিত থাকে অপু সে সন্ধান রাখে। মনে ভাবিল, ওরই ওপর সুপারিন্টেন্ডেন্টের যত কড়াকড়ি। থাকতে পারে না, ছেলেমানুষ-আচ্ছা লোক!

    অপু বলিল, রমাপতিদাকে দিয়ে আমি একবার বিধুবাবুকে বলবো?

    দেবব্রত মান হাসিয়া বলিল, কাকে বলবেন? তিনি আছেন বুঝি? মেয়ের জন্যে নিধে বোহারাকে দিয়ে বাজার থেকে কমললেবু আনলেন, কপি আনালেন। তিনি বাড়ি চলে গিয়েছেন কোন কালে, সে দুটোর ট্রেনে-আর এখন বলেই বা কি হবে, আমাদের লাইনের গাড়িও তো চলে গিয়েছে-আজ আর গাড়ি নেই।

    অপু তাহাকে ভুলাইবার জন্য বলিল, এসো একটা খেলা করা যাক। তুমি হও চোর, একখানা বই চুরি করে লুকিয়ে থাকে, আমি ডিটেকটিভ হবো, তোমাকে ঠিক খুঁজে বার করবো-কিংবা ওইটে যেন একটা নকশা, তুমি ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে পালাবে, আমি তোমাকে খুঁজে বার করব—-পড়ো নি ‘নিহিলিস্ট রহস্য’? চমৎকার বই-উঃ, কি সে কাণ্ড? প্রতুলের কাছে আছে, চেয়ে দেবো।

    দেবব্রতের খেলাধুলা ভালো লাগিতেছিল না, তবুও অপুর কথার কোন প্রতিবাদ না করিয়া মাথা তুলিয়া বসিল। বলিল, আমি লাইব্রেরির ওই কোণটায় গিয়ে লুকিয়ে থাকিব?

    -লুকিয়ে থাকতে হবে না, এই কাগজখানা একটা দরকারি নকশা, তুমি পকেটের মধ্যে নিয়ে যেন রেলগাড়িতে যাচ্চো, আমি বার করে দেখে নেবো, তুমি পিস্তল বার করে গুলি করতে আসবে—

    দেবব্রতকে লইয়া খেলা জমিল না, একে সে ‘নিহিলিস্ট রহস্য’ পড়ে নাই, তাহার উপর তাহার মন খারাপ। নূতন ধরনের যুদ্ধ-জাহাজের নকশাখানা সে বিনা বাধায় ও এত সহজে বিপক্ষের গুপ্তচরকে চুরি করিতে দিল যে, তাহাকে এসব কার্যে নিযুক্ত করিলে রুশীয় সম্রাটকে পতনের অপেক্ষায় ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিদ্রোহের মুখ চাহিয়া বসিয়া থাকিতে হইত না।

    বেলা প্ৰায় পড়িয়া আসিয়াছে। বোর্ডিং-এর পিছনে দেওয়ানি আদালতের কম্পাউন্ডে অর্থীপ্রত্যার্থীর ভিড় কমিয়া গিয়াছে। দেবব্রত জানালার দিকে চাহিয়া বলিল, ক্লক টাওয়ারের ঘড়িতে কটা বেজেছে দেখুন না একবার? কাউকে বলবেন না অপূর্বদা, আমি এখুনি বাড়ি যাব।

    অপু বিস্ময়ের সুরে বলিল, এখন যাবে কিসে? এই যে বললে ট্রেন নেই?

    দেবব্রত সুর নিচু করিয়া বলিল-এগার মাইল তো রাস্তা মোটে, হেঁটে যাব, একটু রাত যদি হয়ে পড়ে জ্যোৎস্না আছে, বেশ যাওয়া যাবে।

    -এগারো মাইল রাস্তা এখন এই পড়ন্ত বেলায় হেঁটে যেতে কত রাত হবে জানো? রাস্তা কখনও হেঁটেচো তুমি? তা ছাড়া না বলে যাওয়া-যদি কেউ টের পায়?

    কিন্তু দেবব্রতকে নিবৃত্ত করা গেল না। সে কখনও রাস্তা হ্যাঁটে নাই তাহা ঠিক, রাত্রি হইবে তাহা ঠিক, বিধুবাবুর কানে কথাটা উঠিলে বিপদ আছে, সবই ঠিক কিন্তু বাড়ি সে যাইবেই-সে কিছুতেই থাকিতে পরিবে না-যাহ ঘটে ঘটবে। অবশেষে অপু বলিল, তা হলে আমিও তোমার সঙ্গে যাই।

    দেবব্রত বলিল, তা হলে সবাই টের পেয়ে যাবে, আপনি তিন-চার মাস বোর্ডিং ছেড়ে কোথাও যান নি, খাবার-ঘরে না দেখতে পেলে সবাই জানতে পারবে।

    দেবব্রত চলিয়া গেলে অপু কাহারও নিকট সে কথা বলিল না বটে, কিন্তু পরদিন সকালে খাওয়ার ঘরে দেখা গেল দেবব্রতের অনুপস্থিতি অনেকে লক্ষ করিয়াছে। রবিবার বৈকালে সমীর আসিলে তাহাকে সে কথাটা বলিল। পরদিন সোমবার দেবব্রত সকলের সম্মুখে কি করিয়া বোর্ডিংএর কম্পাউন্ডে ঢুকিবে বা ধরা পড়িলে কৃতকর্যের কি কৈফিয়ত দিবে। এই লইয়াই দুজনে অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা করিল।

    কিন্তু সকালে উঠিয়া দেবব্রতাকে সমীরের বিছানায় শুইয়া ঘুমাইতে দেখিয়া সে দস্তুর মতো অবাক হইয়া গেল। সমীর বাইরে মুখ ধুইতে গিয়াছিল, আসিলে জানা গেল যে, কাল অনেক রাত্রে দেবব্ৰত আসিয়া জানালায় শব্দ করিতে থাকে। পাছে কেউ টের পায় এজন্য পিছনের জানালাব খোলা-গরাদটা তুলিয়া সমীর তাহাকে ঘরে ঢুকাইয়া লইয়াছে।

    অপু আগ্রহের সঙ্গে শুনিতে বসিলা। কখন সে বাড়ি পৌঁছিলা? রাত কত হইয়াছিল, তাহার মা তখন কি করিতেছিলেন?-ইত্যাদি।

    রাত অনেক হইয়াছিল। বাড়িতে রাতের খাওয়া প্ৰায় শেষ হয় হয়। তাহার মা ছোট ভাইকে প্রদীপ ধরিয়া রান্নাঘর হইতে বড়োঘরের রোয়াকে পৌঁছাইয়া দিতেছেন এমন সময়

    অপু কত দিন নিজে বাড়ি যায় নাই। মাকে কত দিন সে দেখে নাই। ইহার মতো হ্যাঁটিয়া যাতায়াতের পথ হইলে এতদিনে কতবার যাইত। রেলগাড়ি, গহনার নৌকা, আবার খানিকটা হাঁটাপথও। যাতায়াতে দেড় টাকা খরচ, তাহার এক মাসের জলখাবার। কোথায় পাইবে দেড় টাকা যে, প্রতি শনিবার তো দূরের কথা, মাসে অন্তত একবারও বাড়ি যাইবে! জলখাবারের পয়সা বাঁচাইয়া আনা আষ্টেক পয়সা হইয়াছে, আর এক টাকা হইলেই-বাড়ি। হয়তো এক টাকা জমিতে জমিতে গরমের দুটিই বা আসিয়া যাইবে, কে জানে?

    পরদিন স্কুলে হৈ হৈ ব্যাপার। দেবব্রত যে লুকাইয়া কাহাকেও না বলিয়া বাড়ি চলিয়া গিয়াছিল এবং রবিবার রাত্রে লুকাইয়া বোর্ডিং-এ ঢুকিয়াছে, সে কথা কি করিয়া প্রকাশ হইয়া গিয়াছে। বিধুবাবু সুপারিন্টেন্ডেন্ট-সে কথা হেডমাস্টারের কানে তুলিয়াছেন। ব্যাপারের গুরুত্ব বুঝিয়া সমীরের প্রাণ ভয়ে উড়িয়া গেল, সেই যে জানালার ভাঙা গরাদ খুলিয়া দেবব্রতকে তাহাদের ঘরে ঢুকাইয়া লইয়াছে, সে কথা হেডমাস্টার জানিতে পারিলে কি আর রক্ষা থাকিবে? সমীর রমাপতির ঘরে গিয়া অবস্থাটা বুঝিয়া আসিল। দেবব্রত নিজেই সব স্বীকার করিয়াছে, সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় নাই, কিন্তু সমীরের জানোলা খুলিয়া দেওয়ার কথা কিছুই বলে নাই। বলিয়াছে, সে সোমবার খুব ভোরে চুপি চুপি লুকাইয়া বোর্ডিং-এ ঢুকিয়াছে, কেহ টের পায় নাই। স্কুল বসিলে ক্লাসে ক্লাসে হেডমাস্টারের সাকুলার গেল যে, টিফিনের সময় স্কুলের হলে দেবব্রতকে বেত মারা হইবে, সকল ছাত্র ও টিচারদের সে সময় সেখানে উপস্থিত থাকা চাই।

    সমীর গিয়া রমাপতিকে বলিল, আপনি একবার বলুন না। রমাপতিদা হেডমাস্টারকে, ও ছেলেমানুষ, থাকতে পারে না বাড়ি না গিয়ে, আপনি তো জানেন ও কি রকম home-sick? মিথ্যে মিথ্যে ওকে তিন শনিবার ছুটি দিলে না। সেকেন মাস্টার, ওর কি দোষ?

    উপর-ক্লাসের ছাত্রদের ডেপুটেশনকে হেডমাস্টার হ্যাঁকাইয়া দিলেন। টিফিনের সময় সকলে হলে একত্র হইলে দেবব্রতকে আনা হইল। ভয়ে তাহার মুখ শুকাইয়া ছোট হইয়া গিয়াছে। হেডমাস্টার বঞ্জ গভীর স্বরে ঘোষণা করিলেন যে, এই প্রথম অপরাধ বলিয়া তিনি শুধু বেত মারিয়াই ছাড়িয়া দিতেছেন নতুবা স্কুল হইতে তাড়াইয়া দিতেন।–রীতিমতো বেত চলিল। কয়েক ঘা বেত খাইবার পরই দেবব্রত চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। হেডমাস্টার গর্জন করিয়া বলিলেন, চুপ।। Bend this way, bend! মারা দেখিয়া বিশেষ করিয়া দেবব্রতের কান্নায় অপুর চোখে জল আসিয়া গেল। মনে পড়িল, লীলাদের বাড়ি এই রকম মার একদিন সেও খাইয়াছিল বড়োবাবুর কাছে, সেও বিনা দোষে।

    অপু উঠিয়া বারান্দায় গেল। ফিরিয়া আসিতে সমীর ধমক দিয়া চুপি চুপি বলিল, তুই ও-রকম কঁদেছিস কেন অপূর্ব? থাম না-হেডমাস্টার বকবে—

     

    সরস্বতী পূজার সময় তাহার আট আনা চাদা ধরাতে অপু বড়ো বিপদে পড়িল। মাসের শেষ, হাতেও পয়সা তেমন নাই, অথচ সে মুখে কাহাকেও না’ বলিতে পারে না, সরস্বতী পূজার চাঁদা দিয়া হাত একেবারে খালি হইয়া গেল। বৈকালে সমীর জিজ্ঞাসা করিল, খাবার খেতে গেলি নে অপূর্ব?

    সে হাসিয়া ঘাড় নাড়িল।

    সমীর তাহার সব খবর রাখে, বলিল, আমি বরাবর দেখে আসচি অপূর্ব হাতের পয়সা ভারি বে-আন্দাজি খরচ করিস তুই—বুঝেসুঝে চললে এরকম হয় না-আট আনা চাঁদা কে দিতে বলেছে?

    অপু হাসিমুখে বলিল, আচ্ছা, আচ্ছা, যা তোকে আর শেখাতে হবে না-ভারি। আমার গুরুঠাকুর–

    সমীর বলিল, না হাসি নয়, সত্যি কথা বলছি। আর এই ননী, ভুলো, রাসবেহারী-ওদের ও রকম বাজারে নিয়ে গিয়ে খাবার খাওয়াস কেন?

    অপু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলি, যাঃ বকিস নে-ওরা ধরে খাওয়াবার জন্যে, তা করব কি?

    সমীর রাগ করিয়া বলিল, খাওয়াতে বললেই অমনি খাওয়াতে হবে? ওরাও দুষ্ট্রর ধাড়ি, তোকে পেয়েছে ওই রকম তাই। অন্য কারুর কাছে তো কই ঘেঁষে না। আড়ালে তোকে বোকা বলে তা জানিস!

    -হ্যাঁ বলে বইকি!

    –আমার মিথ্যে কথা বলে লাভ? সেদিন মণিদার ঘরে তোর কথা হচ্ছিল। ওই বদমায়েশ রাসবেহারটা বলছিল-ফাঁকি দিয়ে খেয়ে নেয়,–আর ও-সব কলার লজেঞ্জুস কিনে এনে বিলিয়ে বাহাদুরি করতে কে বলেছে তোকে?

    সমীর নিতান্ত মিথ্যা বলে নাই। জীবনে এই প্রথম নিজের খরচপত্র অপুকে নিজে বুঝিয়া করিতে হইতেছে, ইহার পূর্বে কখনও পয়সাকড়ি নিজের হাতের মধ্যে পাইয়া নাড়াচাড়া করে নাইকাজেই সে টাকা-পয়সার ওজন বুঝিতে পারে না, স্কলারশিপের টাকা হইতে বোর্ডিং-এর খরচ মিটাইয়া টাকা-দুই হাতখরচের জন্য বাঁচে–এই দেড় টাকা দুটাকাকে সে টাকার হিসাবে না দেখিয়া পয়সার হিসাবে দেখিয়া থাকে। ইতিপূর্বে কখনও আটটা পয়সা একত্র হাতের মধ্যে পায় নাই–একশো কুড়িটা পয়সা তাহার কাছে কুবেরের ধনভাণ্ডারের সমান অসীম মনে হয়। মাসের প্রথমে ঠিক রাখিতে না পারিয়া সে দরাজ হাতে খরচ করে-বাঁধানো খাতা কেনে, কালি কেনে, খাবার খায়। প্রায়ই দু-চারজন ছেলে আসিয়া ধরে তাহাদিগকে খাওয়াইতে হইবে। তাহার খুব প্রশংসা করে, পড়াশুনার তারিফ করে! অপু মনে মনে অত্যন্ত গর্ব অনুভব করে, ভাবে।–সোজা ভালো ছেলে আমি! সবাই কি খাতির করে! তবুও তো মোটে পাঁচ মাস এসিচি!

    মহা খুশির সহিত তাহাদিগকে বাজারে লইয়া গিয়া খাবার খাওয়ায়। ইহার উপর আবার কেহ। কেহ ধার করিতে আসে, অপু কাহাকেও না’ বলিতে পারে না।

    এরূপ করিলে কুবেরের ভাণ্ডার আর কিছু বেশি দিন টিকিতে পারে বটে, কিন্তু একশত কুড়িটা পয়সা দশদিনের মধ্যেই নিঃশেষে উড়িয়া যায়, মাসের বাকি দিনগুলিতে কষ্ট ও টানাটানির সীমা থাকে না। দু-দশটা পয়সা যে যাহা ধার লয়, মুখচোরা অপু কাহারও কাছে তাগাদা করিতে পারে না,-প্রায়ই তাহা আর আদায় হয় না।

    সমীর ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট হাতে বাহির হইয়া গেল। অপু ভাবিল-বলুক বোকা, আমি তো আর বোকা নাই! পয়সা ধার নিয়েচে কেন দেবে না-সবাই দেবে।

    পরে সে একখানা বই হাতে লইয়া তাহার প্রিয় গাছপালা-ঘেরা সেই কোণটিতে বসিতে যায়। মনে পড়ে এতক্ষণ সেখানে ছায়া পড়িয়া গিয়াছে, চীনে-জবা গাছে কচি কচি পাতা ধরিয়াছে। যাইবার সময় ভাবে, দেখি আর কাঁটা লজেঞ্ছস আছে?-পরে বোতল হইতে গোটাকতক বাহির করিয়া মুখে পুরিয়া দেয়।–ভাবে, আসছে মাসের টাকা পেলে ওই যে আনারসের একরকম আছে, তাই কিনে আনিব এক শিশি-কি চমৎকার এগুলো খেতে! এ ধরনের ফলের আস্বাদযুক্ত লজেঞ্জুস সে আর কখনও খায় নাই!

    কম্পাউন্ডে নামিয়া লাইব্রেরির কোণটা দিয়া যাইতে যাইতে সে হঠাৎ অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া গেল। একজন বেঁটেমতো লোক ইদারার কাছে দাঁড়াইয়া স্কুলের কেরানী ও বোর্ডিং-এর বাজার সরকার গোপীনাথ দত্তের সঙ্গে আলাপ করিতেছে।

    তাহার বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাৎ করিয়া উঠিল.সে কিসের টানে যেন লোকটার দিকে পায়ে পায়ে আগাইয়া গেল.লোকটা এবার তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়াছে-হাতটা কেমন বাঁকাইয়া আছে, তখনই কথা শেষ করিয়া সে ইদারার পাড়ের গায়ে ঠেস-দেওয়ানো ছাতাটা হাতে লইয়া কম্পাউন্ডের ফটক দিয়া বাহির হইয়া গেল।

    অপু খানিকক্ষণ একদৃষ্টি সেদিকে চাহিয়া রহিল। লোকটাকে দেখিতে অবিকল তাহার বাবার

    কতদিন সে বাবার মুখ দেখে নাই। আজ চার বৎসর!

    উদগত চোখের জল চাপিয়া জবাতলায় গিয়া সে গাছের ছায়ায় চুপ করিয়া বসিল।

    অন্যমনস্কভাবে বইখানা সে উলটাইয়া যায়। তাহার প্রিয় সেই তিনরঙা ছবিটা বাহির করিল, পাশের পৃষ্ঠার সেই পদ্যটা।

    স্বদেশ হইতে বহুদূরে, আত্মীয়স্বজন হইতে বহুদূরে, আলজিরিয়ার কর্কশ, বন্ধুর, জাহীন মরুপ্রান্তে একজন মুমূর্ষ তরুণ সৈনিক বালুশয্যায় শায়িত। দেখিবার কেহ নাই। কেবল জনৈক সৈনিকবন্ধু পাশে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া মুখে চামড়ার বোতল হইতে একটু একটু জল দিঠেছে। পৃথিবীর নিকট হইতে শেষ বিদায় লইবার সময় সম্মুখের এই অপরিচিত, ধূসর উঁচুনিচু বালিয়াড়ি, পিছনের আকাশে সান্ধ্যসূৰ্যরক্তচ্ছটিা, দুরে খৰ্জ্জুরকুঞ্জ ও উর্ধ্বমুখ উক্ট্রশ্রেণীর দিকে চোখ রাখিয়া মুমূর্ষ। সৈনিকটির কেবলই মনে পড়িতেছে বহুদূরে রাইন নদীতীরবতী তাহার জন্মপল্লীর কথা…তাহার মা আছেন সেখানে। বন্ধু, তুমি আমার মায়ের কাছে খবরটা পৌঁছাইয়া দিয়ো, ভুলিয়ো না।…

    For my home is in distant Bingen, Fair Birgen on the Rhine!

    মাকে অপু দেখে নাই আজ পাঁচ মাসঃ-সে। আর থাকিতে পারে না…বোর্ডিং তাহার ভালো লাগে না, স্কুল আর ভালো লাগে না, মাকে না দেখিয়া আর থাকা যায় না।

    এই সব সময়ে এই নির্জন অপরাহুগুলিতে নিশ্চিন্দিপুরের কথা কেমন করিয়া তাহার মনে পড়িয়া যায়। সেই একদিনের কথা মনে পড়ে।…

    বাড়িতে পাশের পোড়ো ভিটার বনে অনেকগুলো ছাতারে পাখি কিচকিচ করিতেছিল, কি ভাবিয়া একটা চিল ছুঁড়িয়া মারিতেই দলের মধ্যে ছোট একটা পাখি ঘাড় মোচড়াইয়া টুপ করিয়া ঝোপের নিচে পড়িয়া গেল, বাকিগুলা উড়িয়া পলাইল। তাহার টিলে পাখি সত্য সত্য মরিবে ইহা সে ভাবে নাই, দৌড়িয়া গিয়া মহা আগ্রহে দিদিকে ডাকিল, ওরে দিদি, শিগগির আয় রে, দেখবি একটা জিনিস, ছুটে আয়–

    দুৰ্গা আসিয়া দেখিয়া বলিল, দেখি, দে-দিকি আমার হাতে! পরে সে নিজের হাতে পাখিটিকে লইয়া কৌতূহলের সহিত নাড়িয়া চড়িয়া দেখিল। ঘাড় ভাঙিয়া গিয়াছে, মুখ দিয়া রক্ত উঠিয়াছে, দুর্গার আঙুলে রক্ত লাগিয়া গেল। দুৰ্গা তিরস্কারের সুরে বলিল, আহা, কেন মারতে গেলি তুই?

    অপুর বিজয়গর্বে উৎফুল্প মন একটু দমিয়া গেল।

    দুর্গা বলিল, আজ কি বার রে? সোমবার না? তুই তো বামুনের ছেলে-চল, তুই আর আমি একে নিয়ে গিয়ে গাঙের ধারে পুড়িয়ে আসি, এর গতি হয়ে যাবে।

    তারপর দুর্গা কোথা হইতে একটা দেশলাই সংগ্ৰহ করিয়া আনিল, তেঁতুলতলার ঘাটের এক ঝোপেব ধারে শূকনো পাতার আগুনে পাখিটাকে খানিক পুড়াইল, পরে আধঝলসানো পাখিটা নদীর জলে ফেলিয়া দিয়া সে ভক্তিভাবে বলিল-হরিবোল হরি, হবি ঠাকুর ওর গতি করবেন, দেখিস! আহা, কি করেই ঘাড়টা থেতলে দিয়েছিলি? কখখনো ওরকম করিস নে আর। বনে জঙ্গলে উড়ে বেড়ায়, কাবুর কিছু করে না, মারতে আছে, ছিঃ!–

    নদী হইতে অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিয়া দুৰ্গা চিতার জায়গাটা ধুইয়া দিল।

    সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরিবার সময় কে জানে তাহারা কোন মুক্ত বিহঙ্গ আত্মার আশীৰ্বাদ লইয়া ফিবিয়াছিল!…

    দেবব্রত আসিয়া ডাক দিতে অপুর নিশ্চিন্দিপুরের স্বপ্ন মিলাইয়া গেল।

    দেবব্রত বলিল, অপুর্বদা এখানে বসে আছেন? আমি ঠিক ভেবেচি আপনি এখানেই আছেন-কি কথা ভাবচোন-মুখ ভার-ভার–

    অপু হাসিয়া বলিল-ও কিছু না, এসো বোসো। কি? চলো দেখি রাসবেহারী কি করছে।

    দেবব্রত বলিল, না, যাবেন না অপূর্বদা, কেন ওদের সঙ্গে মেশেন? আপনার নামে লাগিয়েচে, ধোপার পয়সা দেয় না, পয়সা বাকি রাখে এই সব! যাবেন না। ওদের ওখানে–

    –কে বলেচে এসব কথা?

    –ওই ওরাই বলে। বিনোদ ধোপাকে শিখিয়ে দিচ্ছিল। আপনার কাছে পয়সা বাকি না রাখতে। বলছিল, ও আর দেবে না-তিনবারের পয়সা নাকি বাকি আছে?

    অপু বলিল-বা রে, বেশ লোক তো সব! হাতে পয়সা ছিল না। তাই দিইনি-এই সামনের মাসে প্রথমেই দিয়ে দেবো।–তা আবার ধোপাকে শিখিয়ে দেওয়া-আচ্ছা তো সব।

    দেবব্রত বলিল-আবার আপনি ওদের যান খাওয়াতে! আপনার সেই খাতাখানা নিয়ে ওই বদমাইশ হিমাংশুটা আজ কত ঠাট্টা তামাশা করছিল-ওদের দেখান কেন ওসব?

    অপূর্ব বলিল—এসব কথা আমি জানি নে, আমি লিখছিলাম ননীমাধব এসে বলে-ওটা কি? তাই একটুখানি পড়ে শোনালাম। কি কি-কি বলছিল?

    –আপনাকে পাগল বলে-যন্ত রাজ্যির গাছপালার কথা নাকি শুধু শুধু খাতায় লেখা! আবোল-তাবোল শুধু তাতেই ভর্তি? ওরা তাই নিয়ে হাসে। আপনি চুপ করে এইখানে মাঝে মাঝে এসে বসেন বলে কত কথা তুলেছে

    অপুর রাগ হইল, একটু লজ্জাও হইল। ভাবিল, খাতাখানা না দেখালেই হত সেদিন! দেখতে চাইলে তাই তো দেখলাম, নইলে আমি সোধে তো আর

    মাঝে মাঝে তাহার মনে কেমন একটা অস্থিরতা আসে, এসব দিনে বোর্ডিং-এর ঘরে আবদ্ধ থাকিতে মন চাহে না। কোথায় কোন মাঠ বৈকালের রোদে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, ছায়াভিরা নদীজলে কোথায় নববধূর নাকছবির মতো পানকলস শ্যাওলার কুচ কুচা সাদা ফুল ফুটিয়া নদীজল আলো করিয়া রাখিয়াছে, মাঠের মাঝে উঁচু ডাঙায় কোথায় ঘেটুফুলের বন.এই সবের স্বপ্নে সে বিভোর থাকে, মুক্ত আকাশ, মুক্ত মাঠ, গাছপালার জন্য মন কেমন করে। গাছপালা না দেখিয়া বেশীদিন থাকা তাহার পক্ষে একেবারে অসম্ভব! মনে বেশি কষ্ট হইলে একখানা খাতায় সে বসিয়া বসিয়া যত রাজ্যের গাছের ও লতাপাতার নাম লেখে এবং যে ধরনের ভুমিশ্ৰীীর জন্য মনটা তৃষিত থাকে, তাহারই একটা কল্পিত বৰ্ণনায় খাতা ভরাইয়া তোলে। সেখানে নদীর পাশেই থাকে মাঠ, বাবলা বন, নানা বনজ গাছ, পাখিডাকা সকাল-বিকালের রোদ… ফুল। ফুলের সংখ্যা থাকে না। বোর্ডিং-এর ঘরটায় আবদ্ধ থাকিয়াও মনে মনে সে নানা অজানা মাঠে বনে নদীতীরে বেড়াইতে আসে। একখানা বাঁধা খাতাই সে এভাবে লিখিয়া পুরাইয়া ফেলিয়াছে!

    অপু ভাবিল, বলুক গে, আর কখখনো কিছু দেখাচ্ছি নে। ওদের সঙ্গে এই আমার হয়ে গেল। দেবো। আবার কখনও ক্লাসের ট্রানস্লেশন বলে!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবযান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }