Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প563 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২২. কাজল এই কয়মাসেই বেশ লেখাপড়া শিখিয়াছে

    দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

    কাজল এই কয়মাসেই বেশ লেখাপড়া শিখিয়াছে। বাড়িতেই পড়ে—অনেক সময় নিজের বই রাখিয়া বাবার বইগুলির পাতা উলটাইয়া দেখে। আজকাল বাবা কি কাজে প্রায় সর্বদাই বাহিরে বাহিরে ঘুরিয়া বেড়ায়, এইজন্য বাবার কাজও সে অনেক করে।

    বাসায় অনেকগুলো বিড়াল জুটিয়াছে। সে যখন প্রথম আসিয়াছিল তখন ছিল একটা মাত্র বিড়াল—এখন জুটিয়াছে আরও গোটা তিন। কাজল খাইতে বসিলেই পাতের কাছে সবগুলা আসিয়া জোটে। তাহারা ভাত খায় না, খায় শুধু মাছ। কাজল প্রথমে ভাবে কাহাকেও সে এক টুকরাও দিবে না–করুক মিউ মিউ। কিন্তু একটু পরে একটা অল্পবয়সের বিড়ালের উপর বড়ো দয়া হয়। এক টুকরা তাহাকে দিতেই অন্য সবগুলা কবুণসুরে ডাক শুরু করে-কাজল ভাবে–আহা, ওরা কি বসে বসে দেখবে—দিই ওদেরও একটু একটু। একে ওকে দিতে কাজলের মাছ প্রায় সব ফুরাইয়া যায়। বাঁড়ুজ্যেদের ছেলে অনু একটা বিড়ালছানাকে রাস্তার উপর দিয়া যে ইঞ্জিন যায়, ওরই তলায় ফেলিয়া দিয়াছিল—ভাগ্যে সেটা মরে নাই—যে ইঞ্জিন চালায়, সে তৎক্ষণাৎ থামাইয়া ফেলে। কাজল আজকাল একটা কেরোসিন কাঠের বাক্সে বিড়ালগুলির থাকিবার জায়গা করিয়া দিয়াছে।

    রাত্রে শুইয়াই কাজল অমনি বলে,—গল্প বলল বাবা। আচ্ছা বাবা, ওই যে রাস্তায় ইঞ্জিন চালায় যারা, ওরা কি যখন হয় থামাতে পারে, যেদিকে ইচ্ছে চালাতে পারে? সে মাঝে মাঝে গলির মুখে দাঁড়াইয়া বড়ো রাস্তার স্টিম রোলার চালাইতে দেখিয়াছে। যে লোকটা চালায় তাহার উপর কাজলের মনে মনে হিংসা হয়। কি মজা ওই কাজ করা! যখন খুশি চালানো, যতদূর হয়, যখন খুশি থামানো। মাঝে মাঝে সিটি দেয়, একটা চাকা বসিয়া বসিযা ঘোরায়। সব চুপ কবিয়া আছে, সামনেব একটা ডাণ্ডা যাই টেপে অমনি ঘটাং ঘটাং বিকট শব্দ।

    এই সময়ে অপুর হঠাৎ অসুখ হইল। সকালে অন্য দিনেব মতো আর বিছানা হইতে উঠিতেই পারিল না–বাবা সকালে উঠিয়া মাদুর পাতিয়া বসিয়া তামাক খায়, কাজলের মনে হয় সব ঠিক আছে–কিন্তু আজ বেলা দশটা বাজিল, বাবা এখনও শুইয়া—জগৎটা যেন আর স্থিতিশীল নয়, নিত্য নয়—সব কি যেন হইয়া গিয়াছে। সেই রোদ উঠিয়াছে, কিন্তু রোদের চেহারা অন্য রকম, গলিটার চেহারা অন্য রকম, কিছু ভালো লাগে না, বাবার অসুখ এই প্রথম, বাবাকে আর কখনও সে অসুস্থ দেখে নাই-কাজলের ক্ষুদ্র জগতে সব যেন ওলট-পালট হইয়া গেল। সারা দিনটা কাটিল, বাবার সাড়া নাই, সংজ্ঞা নাই-জ্বরে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া। কাজল পাউরুটি কিনিয়া আনিয়া খাইল। সন্ধ্যা কাটিয়া গেল। কাজল পরমানন্দ পানওয়ালার দোকান হইতে তেল পুরিয়া আনিয়া লণ্ঠন জালিল। বাবা তখনও সেই রকমই শুইয়া। কাজল অস্থির হইয়া উঠিল—তাহার কোনও অভিজ্ঞতা নাই এসব বিষযে, কি এখন সে করে? দু-একবার বাবার কাছে গিয়া ডাকিল, জ্বরের ঘোরে বাবা একবার বলিয়া উঠিল-স্টোভটা নিয়ে আয়, ধরাই খোকাস্টোভটা

    অর্থাৎ সে স্টোভটা ধরাইয়া কাজলকে রাঁধিয়া দিবে।

    কাজল ভাবিল, বাবাও তো সারাদিন কিছু খায় নাই-স্টোভ ধরাইয়া বাবাকে সাবু তৈরি করিয়া দিবে। কিন্তু স্টোভ সে ধরাইতে জানে না, কি করে এখন? স্টোভটা ঘরের মেঝেতে লইয়া দেখিল তেল নাই। আবার পরমানন্দের দোকানে গেল। পরমানন্দকে সব কথা খুলিয়া বলিল। পাশেই একজন নতুন-পাশকরা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের ডিসপেনসারি। ডাক্তারটি একেবারে নতুন, একা ডাক্তারখানায় বসিয়া কড়িবরগা গুনিতেছিলেন, তিনি তাহাদের সঙ্গে বাসায় আসিলেন, অপুকে ডাকিয়া তাহার হাত ও বুক দেখিলেন, কাজলকে ঔষধ লইবার জন্য ডাক্তারখানায় আসিতে বলিলেন। অপু তখন একটু ভালোসে ব্যস্তসমস্ত হইয়া ক্ষীণসুরে বলিল—ও পারবে না, রাত্তিরে এখন থাক, ছেলেমানুষ, এখন থাক।

    এই সবের জন্য বাবার উপর রাগ হয় কাজলের। কোথায় সে ছেলেমানুষ, সে বড়ো হইয়াছে। কোথায় সে না যাইতে পারে, বাবা পাঠাইয়া দেখুক দিকি সে কেমন পারে না? বিশেষত অপরের সামনে তাহাকে কচি বলিলে, ছেলেমানুষ বলিলে, আদর করিলে বাবার উপর তাহার ভারি রাগ হয়।

    বাবার সামনে স্টোভ ধরাইতে গেলে কাজল জানে বাবা বারণ করিবে, বলিবে—উহ। করিস নে থোকা, হাত পুড়িয়ে ফেলবি। সে সরু বারান্দাটার এক কোণে স্টোভটা লইয়া গিয়া কয়েকবার চেষ্টা করিয়াও সেটা জ্বালিতে পারিল না। অপু একবার বলিল—কি কচ্ছিস্ ও খোকা, কোথায় গেলি ও খোকা?—আঃ, বাবার জ্বালায় অস্থির!…ঘরে আসিয়া বলিল বাবা কি খাবে? মিছরি আর বিস্কুট কিনে আনব? অপু বলিল—না না, সে তুই পারবি নে। আমি খাবো না কিছু। লক্ষ্মী বাবু, কোথাও যেয়ো না ঘর ছেড়ে, রাত্তিরে কি কোথাও যায়? হাবিষে যাবি–

    হ্যাঁ, সে হারাইয়া যাইবে! ছাড়িয়া দিলে সে সব জায়গায় যাইতে পারে, পৃথিবীর সর্বত্র একা যাইতে পারে, বাবার কথা শুনিলে তাহার হাসি পায়।

    পরদিন সকালে উঠিয়া কাজল প্রথমে ঔষধ আনিল। বাবার জন্য ফুটপাতের দোকান হইতে খেজুর ও কমলালেবু কিনিল। একটু দূরের দুধের দোকান হইতে জ্বাল দেওয়া গরম দুধও কিনিয়া আনিল। দুধেব ঘটি হাতে ছেলে ফিরিলে অপু বলিল—কথা শুনবি নে খোকা? দুধ আনতে গেলি রাস্তা পার হয়ে সেই আমহার্স্ট স্ট্রীটের দোকানে? এখন গাড়ি ঘোড়ার বড়ো ভিড়~-যেয়ো না বাবাদে বাকি পয়সা।

    খুচরা পয়সা না থাকায় ছেলেকে সকালে ঔষধের দামের জন্য একটা টাকা দিযাছিল, কাজল টাকাটা ভাঙাইয়া এগুলি কিনিয়াছে, নিজে মাত্র এক পয়সাব বেগুনি খাইয়াছিল, (তেলেভাজা খাবাবেব উপব তাহার বেজায় লোভ) বাকি পয়সা বাবার হাতে ফেবত দিল।

    অপু বলিল—একখানা পাউরুটি নিয়ে আয়, ওই দুধেব আমি অতটা তত খাবো না, তুই অর্ধেকটা রুটি দিয়ে খা—

    -না বাবা, এই তো কাছেই হোটেল, আমি ওখানে গিয়ে–

    –না, না, সেও তো রাস্তা পার হয়ে, আপিসের সময় এখন, মোটবেব ভিড়, এবেলা ওই খাও বাবা, আমি তোমাকে ওবেলা দুটো বেঁধে দেবো।

    কিন্তু দুপুরের পর অপুর আবার খুব জ্বর আসিল। রাত্রের দিকে এত বাড়িল, আব কোনও সংজ্ঞা রহিল না। কাজল দোরে চাবি দিয়া ছুটিয়া আবার ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তাব আবার আসিলেন, মাথায় জলপটির ব্যবস্থা দিলেন, ঔষধও দিলেন। জিজ্ঞাসা কবিলেন—এখানে—আর কেউ থাকে না? তোমরা দুজনে মোটে? অসুখ যদি বাড়ে, তবে বাড়িতে টেলিগ্রাম করে দিতে হবে। দেশে কে আছে?

    —দেশে কেউ নেই। আমার মা তো নেই।…আমি আর বাবা শুধু–

    -মুশকিল। তুমি ছেলেমানুষ কি করবে? হাসপাতালে দিতে হবে তা হলে, দেখি আজ রাতটা–

    কাজলের প্রাণ উড়িয়া গেল। হাসপাতাল! সে শুনিয়াছে সেখানে গেলে মানুষ আর ফেরে না! বাবার অসুখ কি এত বেশি যে, হাসপাতালে পাঠাইতে হইবে?

    ডাক্তার চলিয়া গেল। বাবা শুইয়া আছে—শিয়রের কাছে আধভাঙা ডালিম, গোটাকতক লেবুর কোয়া। পালং শাকের গোড়া বাবা খাইতে ভালোবাসে, বাজার হইতে সেদিন পালং শাকের গোড়া আনিয়াছিল, ঘরের কোণে চুপড়িতে শুকাইতেছে-বাবা যদি আর না ওঠে? না রাঁধে? কাজলের গলায় কিসের একটা ডেলা ঠেলিয়া উঠিল। চোখ ফাটিয়া জল আসিল-ছোট বারান্দাটার এক কোণে গিয়া সে আকুল হইয়া নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিল। ভগবান বাবাকে সারাইয়া তোল, পালং শাকের গোড়া বাবাকে খাইতে না দেখিলে সে বুক ফাটিয়া মরিয়া যাইবে-ভগবান, বাবাকে ভালো করিয়া দাও।

    মেজেতে তাহার পড়িবার মাদুরটা পাতিয়া সে শুইয়া পড়িল। ঘরে লণ্ঠনটা জ্বালিয়া রাখিল–একবার নাড়িয়া দেখিল কতটা তেল আছে, সারারাত জ্বলিবে কি না। অন্ধকারে তাহার বড়ো ভয়বিশেষ বাবা আজ নড়ে না, চড়ে না, কথাও বলে না।

    দেয়ালে কিসের সব যেন ছায়া! কাজল চক্ষু বুজিল।

     

    মাসদেড় হইল অপু সারিয়া উঠিয়াছে। হাসপাতালে যাইতে হয় নাই, এই গলিরই মধ্যে বাঁড়জ্যেরা বেশ সঙ্গতিপন্ন গৃহস্থ, তাহাদের এক ছেলে ভালো ডাক্তার। তিনি অপুর বাড়িওয়ালার মুখে সব শুনিয়া নিজে দেখিতে আসিলেন ইনজেকশনের ব্যবস্থা করিলেন, শুক্রবার লোক দিলেন, কাজলকে নিজের বাড়ি হইতে খাওয়াইয়া আনিলেন। উহাদের বাড়ি সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ আলাপ হইয়া গয়াছে।

    চৈত্রের প্রথম। চাকুরি অনেক খুজিয়াও মিলিল না। তবে আজকাল লিখিয়া কিছু আয় হয়।

    সকালে একদিন অপু মেজেতে মাদুর পাতিয়া বসিয়া কাজলকে পড়াইতেছে, একজন কুড়িবাইশ বছরের চোখে-চশমা ছেলে দোরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—আজ্ঞে আসতে পারি? আপনারই নাম অপূর্বাবু? নমস্কার–

    –আসুন, বসুন বসুন। কোথেকে আসছেন?

    —আজ্ঞে, আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আপনার বই পড়ে আপনার সঙ্গে দেখা কবতে এলুম। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব সবাই এত মুগ্ধ হয়েছে, তাই আপনার ঠিকানা নিয়ে।

    অপু খুব খুশি হইল-বই পড়িয়া এত ভালো লাগিয়াছে যে, বাড়ি খুঁজিয়া দেখা কবিতে আসিয়াছে একজন শিক্ষিত তরুণ যুবক। এ তার জীবনে এই প্রথম।

    ছেলেটি চারিদিকে চাহিয়া বলিল—আজ্ঞে, ইয়ে, এই ঘরটাতে আপনি থাকেন বুঝি?

    অপু একটু সংকুচিত হইয়া পড়িল, ঘরের আসবাবপত্র অতি হীন, ছেঁড়া মাদুরে পিতাপুত্রে বসিয়া পড়িতেছে। খানিকটা আগে কাজল ও সে দুজনে মুড়ি খাইয়াছে, মেঝের খানিকটাতে তার চিহ্ন। সে ছেলের ঘাড়ে সব দোষটা চাপাইয়া সলজ্জ সুবে বলিল—তুই এমন দুষ্ট হয়ে উঠছিস খোকা, রোজ রোজ তোকে বলি খেয়ে অমন করে ছড়াস নেতা তোর—আর বাটিটা অমন দোরের গোড়ায়

    কাজল এ অকারণ তিরস্কারের হেতু না বুঝিয়া কাদফাদ মুখে বলিল—আমি কই বাবা, তুমিই তো বাটিটাতে মুড়ি

    -আচ্ছা, আচ্ছা, থাম, লেখ, বানানগুলো লিখে ফে।

    যুবকটি বলিল—আমাদের মধ্যে আপনার বই নিয়ে খুব আলোচনা–আজ্ঞে হ্যাঁ। ওবেলা বাড়িতে থাকবেন? বিভাবরী কাগজের এডিটার শ্যামাচরণবাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন, আমি—আরও তিন-চারজন সেই সঙ্গে আসব।—তিনটে? আচ্ছা, তিনটেতেই ভালো।

    আরও খানিক কথাবার্তার পর যুবক বিদায় লইলে অপু ছেলের দিকে চাহিয়া বলিল,উস্‌-স্‌-স্‌-স্‌, থোকা?

    ছেলে ঠোঁট ফুলাইয়া বলিল—আমি আর তোমার সঙ্গে কথা কব না বাবা—

    –না বাপ আমার, লক্ষ্মী আমার, রাগ কোরো না। কিন্তু কি করা যায় বল তো?

    —কি বাবা?

    —তুই এক্ষুনি ওঠ, পড়া থাক এবেলা, এই ঘরটা ঝেড়ে বেশ ভালো করে সাজাতে হবেআর ওই তোর ছেঁড়া জামাটা তক্তপোশের নিচে লুকিয়ে রাখ দিকি।—ওবেলা বিভাবরীর সম্পাদক আসবে–

    –বিভাবরী কি বাবা?

    –বিভাবরী কাগজ রে পাগল, কাগজ-দৌড়ে যা তো পাশের বাসা থেকে বালতিটা চেয়ে নিয়ে আয় তো!

     

    বৈকালের দিকে ঘরটা একরকম মন্দ দাঁড়াইল না! তিনটার পরে সবাই আসিলেন। শ্যামাচরণবাবু বলিলেন—আপনার বইটার কথা আমার কাগজে যাবে আসছে মাসে। ওটাকে আমিই আবিষ্কার করেছি মশাই! আপনার লেখা গল্পটল্প? দিন না।

    পরের মাসে বিভাবরী কাগজে তাহার সম্বন্ধে এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ বাহির হইল, সঙ্গে সঙ্গে তাহার গল্পটাও বাহির হইল। শ্যামাচরণবাবু ভদ্রতা করিয়া পঁচিশটি টাকা গল্পের মূল্যস্বরূপ লোক মারফত পাঠাইয়া দিয়া আর একটা গল্প চাহিয়া পাঠাইলেন।

    অপু ছেলেকে প্রবন্ধটি পড়িতে দিয়া নিজে চোখ বুজিয়া বিছানায় শুইয়া শুনিতে লাগিল। কাজল খানিকটা পড়িয়া বলিল—বাবা এতে তোমার নাম লিখেছে যে!

    অপু হাসিয়া বলিল—দেখেছিস খোকা, লোকে কত ভালো বলেছে আমাকে? তোকেও একদিন ওই রকম বলবে, পড়াশুনো করবি ভালো করে, বুঝলি?

    দোকানে গিয়া শুনিল বিভাবরী-তে প্রবন্ধ বাহির হইবার পরে খুব বই কাটিতেছে—তাহা ছাড়া তিন বিভিন্ন স্থান হইতে তিনখানি পত্ৰ আসিয়াছে। বইখানার অজস্র প্রশংসা!

    একদিন কাজল বসিয়া পড়িতেছে, সে ঘরে ঢুকিয়া হাত দুখানা পিছনের দিকে লুকাইয়া বলিল,-খোকা, বল তো হাতে কি?…কথাটা বলিয়াই মনে পড়িয়া গেল, শৈশবে একদিন তাহার বাবা-সেও এমনি বৈকাল বেলাটা—তাহার বাবা এইভাবেই, ঠিক এই কথা বলিয়াই খবরের কাগজের মোড়কটা তাহার হাতে দিয়াছিল! জীবনের চক্র ঘুবিয়া ঘুরিয়া কি অদ্ভুতভাবেই আবর্তিত হইতেছে, চিরযুগ ধরিয়া! কাজল ছুটিয়া গিয়া বলিল,-কি বাবা, দেখি?—পরে বাবার হাত হইতে জিনিসটা লইয়া দেখিয়া বিস্মিত ও পুলকিত হইয়া উঠিল। অজস্র ছবিওয়ালা আরব্য উপন্যাস! দাদামশায়ের বইয়ে তো এত রঙিন ছবি ছিল না? নাকের কাছে ধরিয়া দেখিল কিন্তু তেমন পুরানো গন্ধ নাই, সেই এক অভাব।

    অনেক দিন পরে হাতে পয়সা হওয়াতে সে নিজের জন্য একরাশ বই ও ইংরেজি ম্যাগাজিন কিনিয়া আনিয়াছে।

    পরদিন সে বৈকালে তাহার এক সাহেব বন্ধুর নিকট হইতে একখানা চিঠি পাইয়া গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে তাহার সঙ্গে দেখা করিতে গেল। সাহেবের বাড়ি কানাডায়, চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বয়স, নাম অ্যালবার্টন। হিমালয়ের জঙ্গলে গাছপালা খুঁজিতে আসিয়াছে, ছবিও আঁকে। ভারতবর্ষে এই দুইবার আসিল। স্টেটসম্যানে তাহার লেখা হিমালয়ের উচ্ছ্বসিত বর্ণনা পড়িয়া অপু হোটেলে গিয়া মাস-দুই পূর্বে লোকটির সঙ্গে আলাপ করে। এই দু-মাসের মধ্যে দুজনের বন্ধুত্ব খুব জমিয়া উঠিয়াছে।

    সাহেব তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। ফ্লানেলের ঢিলা সুট পরা, মুখে পাইপ, খুব দীর্ঘকায়, সুশ্রী মুখ, নীল চোখ, কপালের উপরের দিকের চুল খানিকটা উঠিয়া গিয়াছে। অপুকে দেখিয়া হাসিমুখে আগাইয়া আসিল, বলিল—দেখো, কাল একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছিল। ওরকম কোনদিন হয় নি। কাল একজন বন্ধুর সঙ্গে মোটরে কলকাতার বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলুম। একটা জায়গায় গিয়ে বসেছি, কাছে একটা পুকুর, ও-পারে একটা মন্দির, এক সার বাশগাছ, আর তালগাছ, এমন সময়ে চাঁদ উঠল, আলো আর ছায়ার কি খেলা! দেখে আর চোখ ফেরাতে পারিনে! মনে হল, Ah, this is the East…The eternal East, অমন দেখি নি কখনও।

    অপু হাসিয়া বলিল—And pray, who is the sun?…

    অ্যাশবার্টন হো-হো করিয়া হাসিয়া বলিল,-না, শোন, আমি কাশী যাচ্ছি, তোমাকে না নিয়ে আমি যাব না কিন্তু। আসছে হপ্তাতেই যাওয়া যাক চলল।

    কাশী! সেখানে সে কেমন করিয়া যাইবে! কাশীর মাটিতে সে পা দিতে পারিবে না। শত-সহস্র স্মৃতি-জড়ানো কাশী, জীবনের ভাণ্ডারের অক্ষয় সঞ্চয়ও কি যখন-তখন গিয়া নষ্ট করা যায়!…সেবার পশ্চিম যাইবার সময় মোগলসরাই দিয়া গেল, কিন্তু কাশী যাইবার অত ইচ্ছা সত্ত্বেও যাইতে পারিল না কেন?…কেন, তাহা অপরকে সে কি করিয়া বুঝায়!…

    বন্ধু বলিল, তুমি জাভায় এসো না আমার সঙ্গে?…বরোবুদরের স্কেচ আঁকব, তা ছাড়া মাউন্ট শ্যালাকের বনে যাব। ওয়েস্ট জাভাতে বৃষ্টি কম হয় বলে ট্রপিক্যাল ফরেস্ট তত জমকালো নয়, কিন্তু ইস্ট জাভার বন দেখলে তুমি মুগ্ধ হবে, তুমি তো বন ভালোবাস, এসো না!…

    বন্ধুর কাছে লীলাদের বাড়ি অনেকদিন আগে দেখা বিয়াত্রিচে দান্তের সেই ছবিটা। অপু বলিল—বতিচেলির, না?

    –না। আগে বলত লিওনার্ডোর—আজকাল ঠিক হয়েছে অ্যাম্রোজো ডা প্রেডিস-এর, বতিচেলির কে বললে?

    লীলা বলিয়াছিল। বেচারি লীলা!

    সপ্তাহের শেষে কিন্তু বন্ধুটির আগ্রহ ও অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া তাহাকে কাশী রওনা হইতে হইল। কাশীতে পরদিন বেলা বারোটার সময় পৌঁছিয়া বন্ধুকে ক্যান্টনমেন্টের এক সাহেবি হোটেলে তুলিয়া দিল ও নিজে একা করিয়া শহরে ঢুকিয়া গোধুলিয়ার মোড়ের কাছে পার্বতী আশ্রমে আসিয়া উঠিল।

    গোধুলিয়ার মোড় হইতে একটু দুরে সেই বালিকা বিদ্যালয়টা আজও আছে। ইহারই একটু দুরে তাহাদের সেই স্কুলটা! কোথায়? একটা গলির মধ্যে ঢুকিল। এখানেই কোথায় যেন ছিল। একটা বাড়ি সে চিনিল। তাহার এক সহপাঠী এই বাড়িতে থাকিত—দু-একবার তাহার সঙ্গে এখানে আসিয়াছিল। বাসা নয়, নিজেদের বাড়ি। একটি বাঙালি ভদ্রলোক শশা কিনিতেছিলেন—সে জিজ্ঞাসা করিল—এই বাড়িতে প্রসন্ন বলে একটা ছেলে আছে—জানেন? ভদ্রলোক বিস্ময়ের সুরে বলিলেন—প্রসন্ন? ছেলে! অপু সামলাইয়া বলিল—ছেলে না, মানে এই আমাদেরই বয়সি। কথাটা বলিয়া সে অপ্রতিভ হইল—প্রসন্ন বা সে আজ কেহই ছেলে নয়—আর তাহাদের ছেলে বলা চলে না—একথা মনে ছিল না। প্রসন্নর ছেলে-বয়সের মূর্তিই মনে আছে কি না! প্রসন্ন বাড়ি নাই, জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল সে আজকাল চার-পাচটি ছেলেমেয়ের বাপ।

    স্কুলটা কোথায় ছিল চিনিতে পারিল না। একজন লোককে বলিল-মশায়, এখানে শুভঙ্করী পাঠশালা বলে একটা স্কুল কোথায় ছিল জানেন?

    –শুভঙ্করী পাঠশালা? কই না, আমি তো এই গলিতে দশ বছর আছি—

    —তাতে হবে না, সম্ভবত বাইশ-তেইশ বছর আগেকার কথা।

    —ও বসাক মশায়, বসাক মশায়, আসুন একবারটি এদিকে। ওঁকে জিজ্ঞেস করুন, ইনি চল্লিশ বছরের খবর বলতে পারবেন।

    বসাক মশায় প্রশ্ন শুনিয়া বলিলেন—বিলক্ষণ! তা আর জানিনে! ওই হরগোবিন্দ শেঠের বাড়িতে স্কুলটা ছিল। ঢুকেই নিচুমতো তো! দুধারে উঁচু রোয়াক?

    অপু বলিল–হাঁ-হাঁ ঠিক। সামনে একটা চৌবাচ্চা–

    —ঠিক ঠিক–আমাদের আনন্দবাবুর স্কুল। আনন্দবাবু মারাও গিয়েছেন আজ আঠারো-উনিশ বছর। স্কুলও তার সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে। আপনি এসব জানলেন কি করে?

    –আমি পড়তুম ছেলেবেলায়। তারপর কাশী থেকে চলে যাই।

     

    একটা বাড়ি খুঁজিয়া বাহির করিল। তাদের বাড়ি মোড়েই। ইহারা তখন সোলার ফুল ও টোপর তৈরি করিয়া বেচিত। অপু বাড়িটার মধ্যে ঢুকিয়া গেল। গৃহিণীকে চিনিল-বলিল, আমাকে চিনতে পারেন? ওই গলির মধ্যে থাকতুম ছেলেবেলায় আমার বাবা মারা গেলেন?–গৃহিণী চিনিতে পারিলেন। বসিতে দিলেন, বলিলেন—তোমার মা কেমন আছেন?

    অপু বলল—তাহার মা বাঁচিয়া নাই।

    –আহা! বড়ো ভালোমানুষ ছিল! তোমার মার হাতে-সোডার বোতল খুলতে গিয়ে হাত কেটে গিয়েছিল, মনে আছে?

    অপু হাসিয়া বলিল—খুব মনে আছে, বাবার অসুখের সময়!

    গৃহিণীর ডাকে বত্রিশ-তেত্রিশ বছরের বিধবা মেয়ে আসিল। বলিলেন—একে মনে আছে?…

    –আপনার মেয়ে না? উনি কি জন্যে রোজ বিকেলে জানলার ধারে খাটে শুয়ে কাদতেন! তা মনে আছে।

    —ঠিক বাবা, তোমার সব মনে আছে দেখছি। আমার প্রথম ছেলে তখন বছরখানেক মারা গিয়েছে—তোমরা যখন এখানে এলে। তার জন্যই কাঁদত। আহা, সে ছেলে আজ বাঁচলে চল্লিশ বছর বয়েস হত।

    একবার মণিকর্ণিকার ঘাটে গেল। পিতার নশ্বর দেহের রেণু-মেশানো পবিত্র মণিকর্ণিকা! বৈকালে বহুক্ষণ দশাশ্বমেধ ঘাটে বসিয়া কাটাইল।

    ওই সেই শীতলা মন্দির—ওরই সামনে বাবার কথকতা হইত সে-সব দিনে-সঙ্গে সঙ্গে সেই বৃদ্ধ বাঙাল কথক ঠাকুরের কথা মনে হইয়া অপুর মন উদাস হইয়া গেল। কোন্ জাদুবলে তাহার বালকহৃদয়েব দুর্লভ স্নেহটুকু সেই বৃদ্ধ চুরি করিয়াছিল—এখন এতকাল পরেও তাহার উপর অপুর সে স্নেহ অক্ষুন্ন আছে—আজ তাহা সে বুঝিল।

    পরদিন সকালে দশাশ্বমেধ ঘাটে সে স্নান করিতে নামিতেছে, হঠাৎ তাহার চোখে পড়িল একজন বৃদ্ধা, একটা পিতলের ঘটিতে গঙ্গাজল ভর্তি করিয়া লইয়া স্নান সারিয়া উঠিতেছেন—চাহিয়া চাহিয়া দেখিয়া সে চিনিল-কলিকাতার সেই জ্যাঠাইমা! সুরেশের মা!…বহুকাল সে আর জ্যাঠাইমাদের বাড়ি যায় নাই, সেই নববর্ষের দিনটার অপমানের পর আর কখনও না। সে আগাইয়া গিয়া পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল—চিনতে পারেন জ্যাঠাইমা? আপনারা কাশীতে আছেন নাকি আজকাল!-বৃদ্ধা খানিকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন—নিশ্চিন্দিপুরের হরি ঠাকুরপোর ছেলে না?—এসো, এসো, চিরজীবী হও বাবা–আর বাবা চোখেও ভালো দেখিনেতার ওপর দেখো এই বয়সে একা বিদেশে পড়ে থাকা–ভারী ঘটিটা কি নিয়ে উঠতে পারি? ভাড়াটেদের মেয়ে জলটুকু বয়ে দেয়–তো তার আজ তিনদিন জ্বর–

    –ও, আপনিই বুঝি একলা কাশীবাস–সুনীলদাদারা কোথায়?

    বৃদ্ধা ভারী ঘটিটা ঘাটের রানার উপর নামাইয়া বলিলেন—সব কলকাতায়, আমায় দিয়েছে ভেন্ন করে বাবা! ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিলুম সুনীলের, গুপ্তিপাড়ার মুখুজ্যে—ওমা, বৌ এসে বাবা সংসারের হল কাল-সে সব বলব এখন বাবাতিন-এর-এক ব্রজেশ্বরের গলি-মন্দিরের ঠিক বাঁ গায়ে একা থাকি, কারুর সঙ্গে দেখাশুনো হয় না। সুরেশ এসেছিল, পুজোর সময় দুদিন ছিল। থাকতে পারে না–তুমি এসো বাবা, আমার বাসায় আজ বিকেলে, অবিশ্যি অবিশ্যি।

    অপু বলিল-দাঁড়ান জ্যাঠাইমা, চট করে ডুব দিয়ে নি, আপনি ঘটিটা ওখানে রাখুন, পেীছে দিচ্ছি।

    -না বাবা, থাক, আমিই নিয়ে যাচ্ছি, তুমি বললে এই যথেষ্ট হল–বেঁচে থাকো।

    তবুও অপু শুনিল না, স্নান সারিয়া ঘটি হাতে জ্যাঠাইমার সঙ্গে তাহার বাসায় গেল। ছোট্ট একতলা ঘরে থাকেন—পশ্চিম দিকের ঘরে জ্যাঠাইমা থাকেন, পাশের ঘরে আর একজন প্রৌঢ়া থাকেন—তাহার বাড়ি ঢাকা। অন্য ঘরগুলি একটি বাঙালি গৃহস্থ ভাড়া লইয়াছেন, যাঁদের হোট মেয়ের কথা জ্যাঠাইমা বলিতেছিলেন।

    তিনি বলিলেন—সুনীল আমার তেমন ছেলে না। ওই যে হাড়হাভাতে ছোটলোকের ঘরের মেয়ে এনেছিলাম, সংসারটাসুদ্ধ উচ্ছন্ন দিলে। কি থেকে শুরু হল শোন। ও বহুর শেষ মাসে নবান্ন করেছি, ঠাকুরঘরের বারকোশে নবান্ন মেখে ঠাকুরদের নিবেদন করে রেখে দিইছি। দুই নাতিকে ডাকছি, ভাবলাম ওদের একটু একটু নবান্ন মুখে দি। বৌটা এমন বদমায়েস, ছেলেদের আমার ঘরে আসতে দিলে না—শিখিয়ে দিয়েছে, ও-ঘরে যাস নি, নবান্নর চাল খেলে নাকি ওদের পেট কামড়াবে। তাই আমি বললাম, বলি হ্যাঁ গা বৌমা, আমি কি ওদের নতুন চাল খাইয়ে মেরে ফেলার মতলব করছি? তা শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, সেকেলে তোক ছেলেপিলে মানুষ করার কি বোঝে? আমার ছেলে আমি যা ভালো বুঝব করব, উনি যেন তার ওপর কথা না কইতে আসেন। এই সব নিয়ে ঝগড়া শুরু, তারপর দেখি ছেলেও তো বৌমার হয়ে কথা বলে। তখন আমি বললাম, আমাকে কাশী পাঠিয়ে দাও, আমি তোমার সংসারে থাকব না! বৌ রাত্রে কানে কি মন্তর দিয়েছে, ছেলে দেখি তাতেই রাজি। তাহলেই বোঝ বাবা, এত করে মানুষ করে শেষে কিনা আমার কপালে—জ্যাঠাইমার দুই চোখ দিয়া টপ টপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।

    অপু জিজ্ঞাসা করিল—কেন, সুরেশদা কিছু বললেন না?

    —আহা, সে আগেই বলি নি? সে শ্বশুরবাড়ির বিষয় পেয়ে সেখানেই বাস করছে, সেই রাজশাহী না দিনাজপুর। সে একখানা পত্র দিয়েও খোঁজ করে না, মা আছে কি মলো। তবে আব তোমাকে বলছি কি? সুরেশ কলকাতায় থাকলে কি আর কথা ছিল বাবা?

    অপুকে খাইতে দিয়া গল্প করিতে করিতে তিনি বলিলেন, ও ভুলে গিয়েছি তোমাকে বলতে, আমাদের নিশ্চিন্দিপুরের ভুবন মুখুজ্যের মেয়ে লীলা যে কাশীতে আছে, জানো না?

    অপু বিস্ময়ের সুরে বলিল লীলাদি! নিশ্চিন্দিপুরের? কাশীতে কেন?

    জ্যাঠাইমা বলিলেন—ওর ভাসুর কি চাকরি করে এখানে। বড়ো কষ্ট মেয়েটার, স্বামী তো আজ দুসাত বছর পক্ষাঘাতে পঙ্গু, বড়ো ছেলেটা কাজ না পেয়ে বসে আছে, আরও চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে সবসুদ্ধ, ভাসুরের সংসারে ঘাড় গুঁজে থাকে। যাও না, দেখা করে এসো আজ বিকেলে, কালীতলার গলিতে ঢুকেই বাঁদিকে বাড়িটা।

    বাল্যজীবনের সেই রানুদির বোন লীলাদি! নিশ্চিন্দিপুরের মেয়ে। বৈকাল হইতে অপুর দেরি সহিল না, জ্যাঠাইমার বাড়ি হইতে বাহির হইয়াই সে কালীতলার গলি খুঁজিয়া বাহির করিল—সরু ধরনের তেতলা বাড়িটা। সিঁড়ি যেমন সংকীর্ণ তেমনি অন্ধকার, এত অন্ধকার যে পকেট হইতে দেশলাই-এর কাঠি বাহির করিয়া না জ্বালাইয়া সে এই বেলা দুইটার সময়ও পথ খুঁজিয়া পাইতেছিল না!

    একটা ছোট দুয়ার পার হইয়া সরু একটা দালান। একটি দশ-বারো বছরের ছেলের প্রশ্নের উত্তরে সে বলিল, এখানে কি নিশ্চিন্দিপুরের লীলাদি আছেন? আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি বলে গিয়ে। অপুর কথা শেষ না হইতে পাশের ঘর হইতে নারীকণ্ঠের প্রশ্ন শোনা গেল, কে রে খোকা? সঙ্গে সঙ্গে একটি পাতলা গড়নের গৌরবর্ণ মহিলা.দরজার চৌকাঠে আসিয়া দাঁড়াইলেন, পরনে আধময়লা শাড়ি, হাতে শাখা, বয়েস বছর সাইত্রিশ, মাথায় একরাশ কালো চুল। অপু চিনিল, কাছে গিয়া পায়ের ধুলা সইয়া প্রণাম করিয়া হাসিমুখে বলিল, চিনতে পারো শীলাদি?

    পরে লীলা তাহার মুখের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে এবং চিনিতে পারে নাই দেখিয়া বলিল, আমার নাম অপু, বাড়ি নিশ্চিন্দিপুরে ছিল আগে।

    লীলা তাড়াতাড়ি আনন্দের সুরে বলিয়া উঠিল-ও! অপু, হরিকাকার ছেলে! এসো, এসো ভাই, এসো। পরে সে অপুর চিবুক স্পর্শ করিয়া আদর করিল এবং কি বলিতে গিয়া ঝর ঝর্ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

    অদ্ভুত মুহূর্ত! এমন সব অপূর্ব, সুপবিত্র মুহূর্তও জীবনে আসে। লীলাদির ঘনিষ্ঠ আদরটুকু অপুর সারা শরীরে একটা স্নিগ্ধ আনন্দের শিহরণ আনিল। গ্রামের মেয়ে, তাহাকে ছোট দেখিয়াছে, সে ছাড়া এত আপনার জনের মতো অন্তরঙ্গতা কে দেখাইতে পারে? লীলাদি ছিল তাহাদের ধনী প্রতিবেশী ভুবন মুখুজ্যের মেয়ে, বয়সে তাহার অপেক্ষা অনেক বড়ো, অল্প বয়সে বিবাহ হইয়াছিল, তারপরেই শশুরবাড়ি চলিয়া আসিয়াছিল ও সেইখানেই থাকিত। শৈশবে অল্পদিন মাত্র উভয়ের সাক্ষাৎ কিন্তু আজ অপুর মনে হইল লীলাদির মতো আপনার জন সারা কাশীতে আর কেহ নাই। শৈশব স্বপ্নের সেই নিশ্চিন্দিপুর, তারই জলে বাতাসে দুজনের দেহ পুষ্ট ও বর্ধিত হইয়াছে একদিন।

    তারপর লীলা অপুর জন্য আসন আনিয়া পাতিয়া দিল, দালানেই পাতিল, ঘরদোর বেশি নাই, বিশেষ করিয়া পরের সংসার, নিজের নহে। সে নিজে কাছে বসিল, কত খোঁজখবর লইল। অপুর বারণ সত্ত্বেও ছেলেকে দিয়া জলখাবার আনাইল, চা করিয়া দিল।

    তারপর লীলা নিজের অনেক কথা বলি। বড়ো ছেলেটি চৌদ্দ বছরের হইয়া মারা গিয়াছে, তাহার উপর সংসারে এই দুর্দশা। উনি পক্ষাঘাতে পঙ্গু, ভাসুবেব সংসারে চোর হইয়া থাকা, ভাসুর লোক মন্দ নন, কিন্তু বড়ো জা-পায়ে কোটি কোটি দণ্ডবৎ। দুর্দশার একশেষ। সংসারের যত উঞ্ছ কাজ সব তাহার ঘাড়ে, আপন জন কেহ কোথাও নাই, বাপের বাড়িতে এমন কেহ নাই যাহার কাছে দুই দিন আশ্রয় লইতে পারে। সতু মানুষ নয়, লেখাপড়া শেখে নাই, গ্রামে মুদির দোকান করে, পৈতৃক সম্পত্তি একে একে বেঁচিয়া খাইতেছে—তাহার উপর দুইটি বিবাহ করিয়াছে, একরাশ ছেলেপিলে। তাহার নিজেরই চলে না, লীলা সেখানে আর কি কবিয়া থাকে।

    অপু বলিল—দুটো বিয়ে কেন?

    —পেটে বিদ্যে না থাকলে যা হয়। প্রথম পক্ষের বৌয়ের বাপের সঙ্গে কি ঝগড়া হল, তাকে জব্দ করার জন্যে আবার বিয়ে করলে। এখন নিজেই জব্দ হচ্ছেন, দুই বৌ ঘাড়ে তার ওপর দুই বৌয়ের ছেলেপিলে। তার ওপর রানুও ওখানেই কিনা!

    –রানুদি? ওখানে কেন?

    –তারও কপাল ভালো নয়। আজ বছর সাত-আট বিধবা হয়েছে, তার আর কোনও উপায় নেই, সতুর সংসারেই আছে। শ্বশুরবাড়িতে এক দেওর আছে, মাঝে মাঝে নিয়ে যায়, বেশির ভাগ নিশ্চিন্দিপুরেই থাকে।

    অপু অনেকক্ষণ ধরিয়া রানুদির কথা জিজ্ঞাসা করিবে ভাবিতেছিল, কিন্তু কেন প্রশ্নটা করিতে পারে নাই সে-ই জানে। লীলার কথার পরে অপু অন্যমনস্ক হইয়া গেল। হঠাৎ লীলা বলিল—দ্যাখ ভাই অপু, নিশ্চিন্দিপুরের সেই বাঁশবাগানের ভিটে এত মিষ্টি লাগে, কি মধু যে মাখানো ছিল তাতে! ভেবে দ্যাখ, মা নেই, বাবা নেই, কিছু তো নেই, তবুও তার কথা ভাবি। সেই বাপের ভিটে আজ দেখি নি এগারো বছর। সেবার সতুকে চিঠি লিখলাম, উত্তর দিলে এখানে কোথায় থাকবে, থাকবার ঘরদোর নেই, পুবের দালান ভেঙে পড়ে গিয়েছে, পশ্চিমের ইরি দুটোও নেই, ছেলেপিলে কোথায় থাকবে,–এই সব একরাশ ওজর। বলি থাক তবে, ভগবান যদি মুখ তুলে চান কোনদিন, দেখব নয় তো বাবা বিশ্বনাথ তো চরণে রেখেছেন–

    আবার লীলা ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

    অপু বলিল, ঠিক বলেছ লীলাদি, আমারও গাঁয়ের কথা এত মনে পড়ে! সত্যিই, কি মধুমাখানো ছিল, তাই এখন ভাবি।

    লীলা বলিল, পদ্মপাতায় খাবার খাস নি কতদিন বল দিকি? এসব দেশে শালপাতায় খাবার খেতে খেতে পদ্মপাতার কথা ভুলেই গিইছি, না? আবার এক একদিন এক একটা দোকানে কাগজে খাবার দেয়। সেদিন আমার মেজ ছেলে এনেছে, আমি বলি দূর দূর, ফেলে দিয়ে আয়, কাগজে আবার মিষ্টি খাবার কেউ দেয় আমাদের দেশে?

    অপুর সারা দেহ স্মৃতির পুলকে যেন অবশ হইয়া গেল। লীলাদি মেয়েমানুষ কিনা, এত খুঁটিনাটি জিনিসও মনে রাখে। ঠিকই বটে, সেও পদ্মের পাতায় কতকাল খাবার খায় মাই, ভুলিয়াই গিয়াছিল কথাটা। তাহাদের দেশে বড়ো বড়ো বিল, পদ্মপাতা সস্তা, শালপাতার রেওয়াজ ছিল না। নিমন্ত্রণ বাড়িতেও পদ্মপাতাতে ব্রাহ্মণভোজন হইত, লীলাদির কথায় আজ আবার সব মনে পড়িয়া গেল।

    লীলা চোখ মুছিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—তুই কতদিন যাস নি সেখানে অপু? তেইশ বছর? কেন, কেন? আমি না হয় মেয়েমানুষ—তুই তো ইচ্ছে করলেই যেতে

    –তা নয় লীলাদি, প্রথমে ভাবতুম বড়ো হয়ে যখন রোজগার করব মাকে নিয়ে আবার নিশ্চিন্দিপুরের ভিটেতে গিয়ে বাস করব, মার বড় সাধ ছিল। মা মারা যাওয়ার পরেও ভেবেছিলুম, কিন্তু তার পরে–ইয়ে—

    স্ত্রীবিয়োগের কথাটা অপু বয়োজ্যেষ্ঠা লীলাদির নিকট প্রথমটা তুলিতে পারিল না। পরে বলিল। লীলা বলিল, বৌ কতদিন বেঁচেছিলেন?

    অপু লাজুক সুরে বলিল–বছর চারেক–

    –তা এ তোমার অন্যায় কাজ ভাই-তোমার এ বয়সে বিয়ে করবে না কেন?…তোমাকে তো এতটুকু দেখেছি, এখনও বেশ মনে হচ্ছে, ছোট্ট পাতলা টুকটুকে ছেলেটি—একটা কঞ্চি হাতে নিয়ে আমাদের ঘাটের পথের বাঁশতলাটায় বেড়িয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছ কালকের কথা যেন সব, না, ও কি, ছিঃ—বিয়ে করো ভাই। খোকাকে কলকাতায় রেখে এলে কেন—দেখতাম একবারটি।

    লীলাও উঠিতে দেয় না—অপুও উঠিতে চায় না। লীলার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করিল— ছেলেমেয়েগুলিকে আদর করিল। উঠিবার সময় লীলা বলিল—কাল আসিস অপু, নেমন্তন্ন রইল,এখানে দুপুরে খাবি।

    পরদিন নেমন্তন্ন রাখিতে গিয়া কিন্তু অপু লীলাদির পরাধীনতা মর্মে মর্মে বুঝিল—সকাল হইতে সমুদয় সংসারের রান্নার ভার একা লীলাদির উপর। কৈশোরে লীলাদি দেখিতে ছিল খুব ভালো—এখন কিন্তু সে লাবণ্যের কিছুই অবশিষ্ট নাই—চুল দু-চার গাছা এরই মধ্যে পাকিয়াছে, শীর্ণ মুখ, শিরা-বাহির-হওয়া হাত, আধময়লা শাড়ি পরনে, রাঁধিবার আলাদা ঘরদোর নাই, ছোট্ট দালানের অর্ধেকটা দরমার বেড়া দিয়া ঘেরা, তারই ও-ধারে রান্না হয়। লীলাদি সমস্ত রান্না সারিয়া তার জন্য মাছের ডিমের বড়া ভাজিতে বসিল, একবার কড়াখানা উনুন হইতে নামায়, আবার তোলে, আবার নামায়, আবার ভাজে! আগুনের তাপে মুখ তার রাঙা দেখাইতেছিল—অপু ভাবিল কেন এ কষ্ট করছে লীলাদি, আহা রোজ রোজ ওর এই কষ্ট, তার ওপর আমার জন্যে আর কেন কষ্ট কর?

    বিদায় লইবার সময় লীলা বলিল—কিছুই করতে পারলুম না ভাই—এলি যদি এতকাল পরে, কি করি বল, পরের ঘরকন্না, পরের সংসার, মাথা নিচু করে থাকা, উদয়াস্ত খাটুনিটা খেলি তো? কি আর করি, তবুও একটা ধরে আছি। মেয়েটা বড়ো হয়ে উঠল, বিয়ে তো দিতে হবে? ওই বঠাকুর ছাড়া আর ভরসা নেই। সন্ধেবেলাটা বেশ ভালো লাগে—দশাশ্বমেধ ঘাটে সন্ধের সময় বেশ কথা হয়, পাচালী হয়, গান হয়–বেশ লাগে। দেখিস নি?…আসিস না আজ ওবেলা—বেশ জায়গা, আসিস, দেখিস এখন। এসো, এসো, কল্যাণ হোক। তারপর সে আবার কাঁদিয়া ফেলিল-বলিল—তোদের দেখলে যে কত কথা মনে পড়ে কি সব দিন ছিল–

    এবার অপু অতিকষ্টে চোখের জল চাপিল।

    আর একটি কর্তব্য আছে তাহার কাশীতে-লীলার মায়ের সঙ্গে দেখা করা। বাঙালিটোলার নারদ ঘাটে তাঁদের নিজেদের বাড়ি আছে—জিয়া বাড়ি বাহির করিল। মেজ-বৌরানী অপুকে দেখিয়া খুব আনন্দ প্রকাশ করিলেন। চোখের জল ফেলিলেন।

    কথাবার্তা চলিতেছে এমন সময় ঘরে একটি ছোট মেয়ে ঢুকিল-বয়স ছয়সাত হইবে, ফ্রক পরা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল—অপু তাহাকে দেখিয়াই বুঝিতে পারিল লীলার মেয়ে। কি সুন্দর দেখিতে! এত সুন্দরও মানুষ হয়? স্নেহে, স্মৃতিতে, বেদনায় অপুর চোখে জল আসিলসে ডাক দিলশোনো খুকি, মা, শোনো তো।

    খুকি হাসিয়া পলাইতেছিল, মেজ-বৌরানী ডাকিয়া আনিযা কাছে বসাইয়া দিলেন। সে তার দিদিমার কাছেই কাশীতে থাকে আজকাল। গত বৈশাখ মাসে তাহার বাবা মারা গিয়াছেনলীলার মৃত্যুর পূর্বে। কিন্তু লীলাকে সে সংবাদ জানানো হয় নাই। দেখিতে অবিকল লীলা—এ বয়সে লীলা যা ছিল তাই। কেমন করিয়া অপুর মনে পড়িল শৈশবের একটি দিনে বর্ধমানে লীলাদের বাড়িতে সেই বিবাহ উপলক্ষে মেয়ে মজলিশের কথা—লীলা যেখানে হাসির কবিতা আবৃত্তি করিয়া সকলকে হাসাইয়াছিল—সে-ই লীলাকে সে প্রথম দেখে এবং লীলা তখন দেখিতে ছিল ঠিক এই খুকির মতো অবিকল!

    মেজ-বৌরানী বলিলেন—মেয়ে তো ভালো, কিন্তু বাবা, ওর কি আর বিয়ে দিতে পারব? ওর মার কথা যখন সকলে শুনবে—আর তা না জানে কে—এই মেয়ের কি আর বিয়ে হবে বাবা?

    অপুর দুর্দমনীয় ইচ্ছা হইল একটি কথা বলিবার জন্য সেটা কিন্তু সে চাপিয়া রাখিল। মুখে বলিল-দেখুন, বিয়ের জন্যে ভাববেন কেন? লেখাপড়া শিখুক, বিয়ে নাই বা হল, তাতে কি? মনে ভাবিল—এখন সে কথা বলব না, থোকা যদি বাঁচে, মানুষ হয়ে ওঠে—তবে সে কথা তুলব। যাইবার সময়ে অপু লীলার মেয়েকে আবার কাছে ডাকিল। এবার খুকি তাহার কাছে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া ডাগর ডাগর উৎসুক চোখে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

    সেদিনের বাকি সময়টুকু অপু বন্ধুর সঙ্গে সারনাথ দেখিয়া কাটাইল। সন্ধ্যার দিকে একবার কালীতলার গলিতে লীলাদের বাসায় বিদায় লইতে গেল—কাল সকালেই এখান হইতে রওনা হইবে। নিশ্চিন্দিপুরের মেয়ে, শৈশব দিনের এক সুন্দর আনন্দমুহূর্তের সঙ্গে লীলাদির নাম জড়ানোবার বার কথা কহিয়াও যেন তাহার তৃপ্তি হইতেছিল না।

    আসিবার সময় অপু মুগ্ধ হইল লীলাদির আন্তরিকতা দেখিয়া তাহাকে আগাইয়া দিতে আসিয়া সে নিচে নামিয়া আসিল, আবার চিবুক ছুইয়া আদর করিল, চোখের জল ফেলিল। যেন মা, কি মায়ের পেটের বড়ো বোন। কতকগুলো কাঠেব খেলনা হাতে দিয়া বলিল—খোকাকে দিস্তার জন্যে কাল কিনে এনেছি।

    অপু ভাবিল—কি চমৎকার মানুষ লীলাদি!…আহা, পরের সংসারে কি কষ্টটাই না পাচ্ছে! মুখে কিছু বললুম না—তোমায় আমি বাপের ভিটে দেখাব লীলাদি, এই বছরের মধ্যেই।

    ট্রেনে উঠিয়া সারাপথ কত কি কথা তাহার মনে যাওয়া-আসা করিতে লাগিল। রাজঘাটের স্টেশনে ট্রেনে উঠিল আজ কতকাল পরে! বাল্যকালে এই স্টেশনেই সে প্রথম জলের কল দেখে, কাশী নামিয়াই ছুটিয়া গিয়াছিল আগে জলের কলটার কাছে। চেঁচাইয়া বলিয়াছিল, দেখো দেখো মা, জলের কল।—সে সব কি আজ?

    আজ কতদিন হইতে সে আর একটি অদ্ভুত জিনিস নিজের মনের মধ্যে অনুভব করিতেছে, কি তীব্রভাবেই অনুভব করিতেছে। আগে তো সে এ রকম ছিল না? অন্তত এ ভাবে তোকই কখনও এর আগে—সেটা হইতেছে ছেলের জন্য মন কেমন করা।

    কত কথাই মনে হইতেছে, এই কয়দিনে-পাশের বাড়ির বাঁড়ুজ্যে-গৃহিণী কাজলকে বড় ভালোবাসে, সেখানেই তাহাকে রাখিয়া আসিয়াছে। কখনও মনে হইতেছে, কাজল যে দুষ্টু ছেলে, হয়তো গলির মোড়ে দাঁড়াইয়া ছিল, কোনও বদমাইস লোকে ভুলাইয়া কোথায় লইয়া গিয়াছে কিংবা হয়তো চুপি চুপি বাড়ি হইতে বাহির হইয়া রাস্তা পার হইতে যাইতেছিল, মোটর চাপা পড়িয়াছে। কিন্তু তাহা হইলে কি বাঁড়ুজ্যেরা একটা তার করিত না? হয়তো তার করিয়াছিল, ভুল ঠিকানায় গিয়া পৌঁছিয়াছে। উহাদের আলিসাবিহীন নেড়া ছাদে ঘুড়ি উড়াইতে উঠিয়া পড়িয়া যায় নাই তো? কিন্তু কাজল তো কখনও ঘুড়ি ওড়ায় না? একটু আনাড়ি, ঘুড়ি ওড়ানো কাজ একেবারে পারে না। না—সে উড়াইতে যায় নাই, তবে বাঁড়ুজ্যেবাড়ির ছেলেদের দলে মিশিয়া উঠিয়াছিল, আশ্চর্য কি!

    আটিস্ট বন্ধুর কথার উত্তরে সে খানিকটা আগে বলিয়াছিল—সে জাভা, বালি, সুমাত্রা দেখিবে, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ দেখিবে, আফ্রিকা দেখিবে—ওদের বিষয় লইয়া উপন্যাস লিখিবে। সাহেবরা দেখিয়াছে তাদের চোখে-সে নিজের চোখে দেখিতে চায়, তার মনের রঙে কোন্ রঙ ধরায়—ইউগান্ডার দিদিশাহীন তৃণভূমি, কেনিয়ার অরণ্য। বুড়ো বেবুন রাত্রে কর্কশ চিৎকার করিবে, হায়েনা পচা জীবজন্তুর গন্ধে উন্মাদের মতো আনন্দে হি-হি করিয়া হাসিবে, দুপুরে অগ্নিবর্ষী খররৌদ্রে কম্পমান উত্তপতরঙ্গ মাঠে প্রান্তরে জনহীন বনের ধারে কতকগুলি উঁচুনিচু সদাচঞ্চল বাঁকা রেখার সৃষ্টি করিবে। সিংহেরা দল পাকাইয়া ছোট কন্টকবৃক্ষের এতটুকু ক্ষুদ্র ছায়ায় গোলাকারে দাঁড়াইয়া অগ্নিবৃষ্টি হইতে আত্মরক্ষা করে—পার্ক ন্যাশন্যাল আলবার্ত…wild celery-র বন…

    কিন্তু খোকা যে টানিতেছে আজকাল, কোনও জায়গায় যাইতে মন চায় না থোকাকে ফেলিয়া। কাজল, খোকা, কাজল, খোকা, খোকন, ও ঘুড়ি উড়াইতে পারে না, কিছু বুঝিতে পারে না, কিছু পারে না, বড়ো নির্বোধ! কিন্তু ওর আনাড়ি মুঠাতে বুকের তার আঁকড়াইয়া ধবিয়াছে। টানিতেছে, প্রাণপণে টানিতেছে—ছোট্ট দুর্বল হাত দুটি নির্দয়ভাবে মুচড়াইয়া সরাইয়া লওয়া? সর্বনাশ! ধামা চাপা থাকুক বিদেশযাত্রা।

    ট্রেন হু-হু চলিতেছে…মাঝে মাঝে আম বন, জলার ধারে লালহাঁস বসিয়া আছে, আখের ক্ষেতে জল দিতেছে, গম কাটিতেছে। রেলের ধারের বস্তিতে উদুখলে শস্য কুটিতেছে, মহিষের পাল চরিয়া ফিরিতেছে। বড়ো বড়ো মাঠে দুপুর গড়াইয়া গিয়া ক্ৰমে রোদ পড়িয়া আসিল। দূরে দূরে চক্রবাল-সীমায় এক-আধটা পাহাড় ঘন নীল ও কালো হইয়া উঠিতেছে।

    কি জানি কেন আজ কত কথাই মনে পড়িতেছে, বিশেষ করিয়া নিশ্চিন্দিপুরের কথা। হয়তো এতকাল পরে লীলাদির সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্যই। ঠিক তাই। বহু দূরে আর একটি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের জীবনধারা, বাঁশবনের আমবনের ছায়ায় পাখির কলকাকলির মধ্য দিয়া, জানা-অজানা বনপুষ্পের সুবাসের মধ্য দিয়া সুখে-দুঃখে বহুকাল আগে বহিত—এককালে যার সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল তার—আজ তা স্বপ্ন, স্বপ্ন, কতকাল আগে দেখা স্বপ্ন! গোটা নিশ্চিন্দিপুর, তার ছেলেবেলাকার দিদি, মা ও রানুদি, মাঠ বন, ইছামতী সব অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে, ধোয়া ধোঁয়া মনে হয়, স্বপ্নের মতই অবাস্তব। সেখানকার সব কিছুই অস্পষ্ট স্মৃতিতে মাত্র আসিয়া দাঁড়াইয়া গিয়াছে।

    এই তো ফাল্গুন-চৈত্র মাস—সেই বাঁশপাতা ও বাঁশের খোলর রাশি—শৈশবের ভাঙা জানালাটার ধারে বসিয়া বসিয়া কতকাল আগের সে সব কল্পনা, আনন্দপূর্ণ দিনগুলি, শীতরাত্রির সুখস্পর্শ কাঁথার তলা,অনন্ত কালসমুদ্রে সে সব ভাসিয়া গিয়াছে, কত কাল আগে।…

    কেবল স্বপ্নে, এক একদিন যেন বাল্যের সেই বুপো চৌকিদার গভীর রাত্রের ঘুমের মধ্যে কড়া হাঁক দিয়া যায়—ও রায় মশ——য়, সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর ফিরিয়া আসে, আবার বাড়ির পাশেই সেই পোড় ভিটাতে বহাল আগের বস নামে, প্রথম চৈত্রের নানা জানা-অজানা ফুলে বনভূমি ভরিয়া যায়, তাহাদের পুরানো কোঠাবাড়ির ভাঙা জানালার ধারে অতীত দিনের শত সুখদুঃখে পরিচিত পাখির দল কলকন্ঠে গান গাহিয়া উঠে, ঠাকুরমাদের নারিকেল গাছে কাঠঠোর শব্দ বিচিত্র গোপনতায় তন্দ্রারত হইয়া পড়ে…স্বপ্নে দশ বৎসরের শৈশবটি আবার নবীন হইয়া ফিরিয়া আসে…

    এতদিন সে বাড়িটা আর নাই…কতকাল আগে ভাঙিয়া চুরিয়া ইট-কাঠ স্তুপাকার হইয়া আছে—তাহাও হয়তো মাটির তলায় চাপা পড়িতে চলিল—সে শৈশবের জানালাটার কোনও চিহ্ন নাই দীর্ঘদিনের শেষে সোনালি রোদ যখন বনগাছের ছায়া দীর্ঘতর করিয়া তোলে, ফিঙে-দোয়েল ডাক শুরু করে—তখন আর কোনও মুগ্ধ শিশু জানালার ধারে বসিয়া থাকে না-হাত তুলিয়া অনুযোগের সুরে বলে না—আজ রাতে যদি মা ঘরে জল পড়ে, কাল কিন্তু ঠিক রানুদিদিদের বাড়ি গিয়ে শোবো-রোজ রোজ রাত জাগতে পারি নে বলে দিচ্ছি।

    অপুর একটা কথা মনে হইয়া হাসি পাইল।

    গ্রাম ছাড়িয়া আসিবার বছরখানেক আগে অপু একরাশ কড়ি পাইয়াছিল। তাহার বাবা শিষ্যবাড়ি হইতে এগুলি আনেন। এত কড়ি কখনও অপু ছেলেবেলায় একসঙ্গে দেখে নাই। তাহার মনে হইল সে হঠাৎ অত্যন্ত বড়োলোক হইয়া গিয়াছে—কড়ি খেলায় সে যতই হারিয়া যাক, তাহার অফুরন্ত ঐশ্বর্যের শেষ হইবে না। একটা গোল বিস্কুটের ঠোঙায় কড়ির রাশি রাখিয়া দিয়াছিল। সে ঠোঙাটা আবার তোলা থাকিত তাদের বনের ধারের দিকের ঘরটায় উঁচু কুলুঙ্গিটাতে।

    তারপর নানা গোলমালে খেলাধুলায় অপুর উৎসাহ গেল কমিয়া, তার পরই গ্রাম ছাড়িয়া উঠিয়া আসিবার কথা হইতে লাগিল। অপু আর একদিনও ঠোঙার কড়িগুলি লইয়া খেলা করিল না, এমন কি দেশ ছাড়িয়া চলিয়া আসিবার সময়েও গোলমালে, ব্যস্ততায়, প্রথম দূর বিদেশে রওনা হইবার উত্তেজনার মুহূর্তে সেটার কথা মনেও উঠে নাই। অত সাধের কড়িভরা ঠোঙাটা সেই কড়িকাঠের নিচেকার বড়ো কুলুঙ্গিটাতেই রহিয়া গিয়াছিল।

    তারপর অনেককাল পরে সে কথা অপুর মনে হয় আবার। তখন অপর্ণা মারা গিয়াছে। একদিন অন্যমনস্ক ভাবে ইডেন গার্ডেনের কেয়াঝোপে বসিয়া ছিল, গঙ্গার ও-পারের দিকে সূর্যাস্ত দেখিতে দেখিতে কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে।

    আজও মনে হইল।

    কড়ির কৌটো! একবার সে মনে মনে হাসিল…বহুকাল আগে নিশ্চিহ্ন হইয়া লুপ্ত হইয়া যাওয়া ছেলেবেলার বাড়ির উত্তর দিকের ঘরের কুলুঙ্গিতে বসানো সেই টিনের ঠোঙাটা!দূরে সেটা যেন শূন্যে কোথায় এখনও ঝুলিতেছে, তাহার শৈশবজীবনের প্রতীকস্বরূপ…অস্পষ্ট, অবাস্তব, স্বপ্নময় ঠোঙাটা সে স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছে, পয়সায় চার গণ্ডা করিয়া মাকড়সার ডিমের মতো সেই যে ছোট ছোট বিস্কুট তারই ঠোঙাটি—উপরে একটা বিবর্ণপ্রায় হাঁ-করা রাক্ষসের মুখের ছবি…দূরে কোন্ কুলুঙ্গিতে বসানো আছে…তার পিছনে বাঁশবন, শিমুলবন, তার পিছনে সোনাডাঙার মাঠ, ঘুঘুর ডাক…তাদেরও পিছনে তেইশ বছর আগেকার অপূর্ব মায়ামাখানো নিঝুম চৈত্র-দুপুরের রৌদ্রভরা নীলাকাশ…

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবযান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }