Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প563 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২৩. চৈত্র মাসের প্রথমে

    ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

    চৈত্র মাসের প্রথমে একটা বড়ো পার্টিতে সে নিমন্ত্রিত হইয়া গেল। খুব বড়ো গাড়িবারান্দা, সামনের লনে ছোট ছোট টেবিল ও চেয়ার পাতা, খানিকটা জায়গা সামিয়ানা টাঙানো। নিমন্ত্রিত পুরুষ মহিলাগণ যাহারা যেখানে ইচ্ছা বেড়াইতেছেন। একটা মার্বেলের বড়ো চৌবাচ্চায় গোটাকতক কুমুদ ফুল, ঠিক মাঝখানে একটা মার্বেলের ফোয়ারা—গৃহকর্মী তাহাকে লইয়া গিয়া জায়গাটা দেখাইলেন, সেটা নাকি তাদের লিলি পন্ড। জয়পুর হইতে ফোয়ারাটা তৈয়ারি করাইয়া আনিতে কত খরচ পড়িয়াছে, তাহাও জানাইলেন।

    পার্টির সকল আমোদ-প্রমোদের মধ্যে একটি মেয়ের কণ্ঠসংগীত সর্বাপেক্ষা আনন্দদায়ক মনে হইল। ব্রিজের টেবিলে সে যোগ দিতে পারিল না, কারণ ব্রিজ-খেলা সে জানে না, গান শেষ হইলে খানিকটা বসিয়া বসিয়া খেলাটা দেখিল। চা, কেক, স্যান্ডউইচ, সন্দেশ, রসগোল্লা, গল্প-গুজব, আবার গান! ফিরিবার সময় মনটা খুব খুশি ছিল। ভাবিল—এদের পার্টিতে নেমন্তন্ন পেয়ে আসা একটা ভাগ্যের কথা। আমি লিখে নাম করেছি, তাই আমার হল। যার-তার হোক দিকি? কেমন কাটল সন্ধেটা। আহা, খোকাকে আনলে হত, ঘুমিয়ে পড়বে এই ভয়ে আনতে সাহস হল না যে-খান-দুই কেক খোকার জন্য চুপিচুপি কাগজে জড়াইয়া পকেটে পুরিয়া রাখিয়াছিল, খুলিয়া দেখিল সেগুলি ঠিক আছে কি না।

    খোকা ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ডাকিয়া উঠাইতে গিয়া বলিল, ও খোকা, খোকা, ওঠ, খুব ঘুমুচ্ছিস যে—হি-হি-ওঠ রে।

    কাজলের ঘুম ভাঙিয়া গেল। যখনই সে বোঝে বাবা আদব কবিতেছে, মুখে কেমন ধবনের মধুর দুষ্টামির হাসি হাসিয়া ঘাড় কাত করিয়া কেমন এক অদ্ভুত ভঙ্গি করিয়া আদরের প্রতীক্ষায় থাকে, আর এত আদর খাইতেও পারে!

    অপু বলিল, শোন্ খোকা গল্প করি,—ঘুমুসনে–

    কাজল হাসিমুখে বলে, বলল দিকি বাবা একটা অর্থ?

    হাত কন্ কন্ মানিকতা, এ ধন তুমি পেলে কোথা,
    রাজাব ভাণ্ডারে নেই, বেনের দোকানে নেই—

    অপু মনে মনে ভাবে-খোকা, তুই-তুই আমার সেই বাবা। ছেলেবেলায় চলে গিয়েছিলে, তখন তো কিছু বুঝি নি, বুঝতামও না—শিশু ছিলাম! তাই আবার আমার কোলে আদর কাড়াতে এসেছ বুঝি? মুখে বলে, কি জানি, জাতি বুঝি?

    —আহা-হা, আঁতি কি আব দোকানে পাওয়া যায় না! তুমি বাবা কিছু জানো না—

    –ভালো কথা, কেক এনেছি, দ্যাখ, বড়োলোকের বাড়ির কেক, ওঠ—

    –বাবা তোমার নামে একখানা চিঠি এসেছে, ওই বইখানা তোলে তো।…

    আর্টিস্ট বন্ধুটির পত্র। বন্ধু লিখিয়াছে,—সমুদ্রপারের বৃহত্তর ভারতবর্ষ শুধু কুলি আমদানির সার্থকতা ঘোষণা করিয়া নীরব থাকিয়া যাইবে? তোমাদের মতো আর্টিস্ট লোকের এখানে আসার যে নিতান্ত দরকার। চোখ থাকিয়াও নাই শতকরা নিরানব্বই জনের, তাই চক্ষুষ্মন মানুষদেব একবার এসব স্থানে আসিতে বলি। পত্রপাঠ এসো, ফিজিতে মিশনারীরা স্কুল খুলিতেছে, হিন্দি জানা ভারতীয় শিক্ষক চায়, দিনকতক মাস্টারি তো করো, তারপর একটা কিছু ঠিক হইয়া যাইবে, কারণ চিরদিন মাস্টারি করিবার মতো শান্ত ধাত তোমার নয়, তা জানি। আসিতে বিলম্ব করিয়ো না।

    পত্র পাঠ শেষ করিয়া সে খানিকক্ষণ কি ভাবিল, ছেলেকে বলিল, আচ্ছা থোকা, আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যদি চলে যাই, তুই থাকতে পারবি নে? যদি তোকে মামার বাড়ি রেখে যাই?

    কাজল কাদ-কাদ মুখে বলিল, হ্যাঁ, তাই যাবে বইকি! তুমি ভারি দেরি করো, কাশীতে বলে গেলে তিন দিন হবে, কদিন পরে এলে? না বাবা—

    অপু ভাবিল—অবোধ শিশু! এ কি কাশী? এ বহুদুর, দিনের কথা কি এখানে ওঠে?+-থাক, কোথায় যাইবে সে? কাহার কাছে রাখিয়া যাইবে খোকাকে? অসম্ভব।

    কাজল ঘুমাইয়া পড়িলে ছাদে উঠিয়া সে অনেকক্ষণ একা বসিয়া রহিল।

    দূরে বাড়িটার মাথায় সার্কুলার রোডের দিকে ভাঙা চাদ উঠিতেছে, রাত্রি বারোটার বেশি–নিচে একটা মোটর লরি ঘ ঘন্স আওয়াজ করিতেছে। এই রকম সময়ে এই রকম ভাঙা চাদ উঠিত দুরে জঙ্গলের মাথায় পাহাড়ের একটা জায়গায়, যেখানে উটের পিঠের মতো ফুলিয়া উঠিয়াই পরে বসিয়া গিয়া একটা খাজের সৃষ্টি করিয়াছে—সেই খাঁজটার কাছে, পাহাড়ি ঢালুতে বাদাম গাছের বনে দিনমানে পাকা পাতায় বনশীর্ষ যেখানে রক্তাভ দেখায়। এতক্ষণে বন-মোরগেরা ডাকিয়া উঠিত, কক্‌ কক্ কক্‌—

    সে মনে মনে কল্পনা করিবার চেষ্টা করিল, সার্কুলার রোড নাই, বাড়ি-ঘর নাই, মোটর লরির আওয়াজ নাই, ব্রিজের আজ্ঞা নাই, লিলি পন্ড নাই, তার ছোট খড়ের বাংলো ঘরখানায় রামচরিত মিশ্র মেজেতে ঘুমাইতেছে, সামনে পিছনে ঘন অরণ্যভূমি, নির্জন নিস্তব্ধ, আধ-অন্ধকার রাত্রি। ক্রোশের পর ক্রোশ যাও, শুধু উঁচু-নিচু ডাঙা, শুকনা ঘাসের বন, সাজা ও আবলুসের বন, শালবন, পাহাড়ি চামেলি ও লোহিয়ার বন-বনফুলের অফুরন্ত জঙ্গল। সঙ্গে সঙ্গে মনে আসিল সেই মুক্তি, সেই রহস্য, সে সব অনুভূতি, ঘোড়ার পিঠে মাঠের পর মাঠ উদ্দাম গতিতে ছুটিয়া চলা, সেই দৃঢ়পৌরুষ জীবন, আকাশের সঙ্গে, ছায়াপথের সঙ্গে, নক্ষত্র-জগতের সঙ্গে প্রতি সন্ধ্যায় প্রতি রাত্রে যে অপুর্ব মানসিক সম্পর্ক।

    এ কি জীবন সে যাপন করিতেছে এখানে। প্রতিদিন একই রকম একঘেয়ে নীরস, বৈচিত্র্যহীন—আজও যা, কালও তা। অর্থহীন কোলাহলে ও সার্থকতাহীন ব্রিজের আড্ডার আবহাওয়ায়, টাকা রোজগারের মৃগতৃষ্ণিকায় সুব্ধ জীবননদীর স্তব্ধ, সহজ সাবলীল ধারা যে দিনে দিনে শুকাইয়া আসিতেছে, এ কি সে বুঝিয়াও বুঝিতেছে না?

    ঘুমের ঘোরে কাজল বিছানাব মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছে, তাহাকে এক পাশে সরাইয়া শোয়াইল। একেই তো সুন্দর, তার উপর কি যে সুন্দর দেখাইতেছে খোকাকে ঘুমন্ত অবস্থায়।

    কাশী হইতে ফিরিবার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অপু বিভাববী ও বঙ্গ-সুহৃৎ দুখানা পত্রিকার তরফ হইতে উপন্যাস লিখিতে অনুরুদ্ধ হইয়াছিল। দুখানাই প্রসিদ্ধ মাসিক পত্র, দুখানারই গ্রাহক সারা বাংলা জুড়িয়া এবং পৃথিবীর যেখানে যেখানে বাঙালি আছে, সর্বত্র। বিভাবরী তাহাকে সম্প্রতি আগাম কিছু টাকা দিল—–বঙ্গসুহৃৎ-এর নিজেদের বড়ো প্রেস আছে—তাহারা নিজের খরচে অপুর একখানা ছোট গল্পের বই ছাপাইতে রাজি হইল। অপুর বইখানির বিক্রয়ও হঠাৎ বাড়িয়া গেল, আগে যে-সব দোকানে তাহাকে পুঁছিতও না—সে-সব দোকান হইতে বই চাহিয়া পাঠাইতে লাগিল। এই সময়ে একটি বিখ্যাত পুস্তক-প্রকাশক ফার্মের নিকট হইতে একখানা পত্র পাইল, অপু যেন একবার গিয়া দেখা করে।

    অপু বৈকালের দিকে দোকানে গেল। তাহারা বইখানির দ্বিতীয় সংস্করণ নিজেদের খরচে ছাপাইতে ইচ্ছুক-অপু কি চায়? অপু ভাবিয়া দেখিল। প্রথম সংস্করণ হু-হু কাটিতেছে—অপর্ণার গহনা বিক্রয় করিয়া বই ছাপাইয়াছিল, লাভটা তার সবই নিজের। ইহাদের দিলে লাভ কমিয়া যাইবে বটে, কিন্তু দোকানে দোকানে ছুটাছুটি, তাগাদা—এসব হাঙ্গামাও কমিবে। তা ছাড়া নগদ টাকার মোহ আছে, সাত পাঁচ ভাবিয়া সে রাজি হইল। ফার্মের কর্তা তখনই একটা লেখাপড়া করিয়া লইলেন— আপাতত ছশো টাকায় কথাবার্তা মিটিল, শ-দুই সে নগদ পাইল।

    দুশো টাকা খুচরা ও নোটে। এক গাদা টাকা! হাতে ধবে না। কি করা যায় এত টাকায়? পুরানো দিন হইলে সে ট্যাক্সি করিয়া খানিকটা বেড়াইত, রেস্টুরেন্টে খাইত, বায়োস্কোপ দেখিত। কিন্তু আজকাল আগেই খোকার কথা মনে হয়। খোকাকে কি আনন্দ দেওয়া যায় এ টাকায়? মনে হয় লীলার কথা। লীলা কত আনন্দ করিত আজ!

    একটা ছোট গলি দিয়া যাইতে যাইতে একটা শরবৎ-এর দোকান। দোকানটাতে পান বিড়ি বিস্কুট বিক্রি হয়, আবার গোটা দুই তিন সিরাপের বোতলও রহিয়াছে। দিনটা খুব গরম, অপু শরবৎ খাওয়ার জন্য দোকানটাতে দাঁড়াইল। অপুর একটু পরেই দুটি ছেলেমেয়ে সেখানে কি কিনিতে আসিল। গলিরই কোন গরিব ভাড়াটে গৃহস্থ ঘরের হোট ছেলে মেয়ে-মেয়েটির বছর সাত, ছেলেটি একটু বড়ো। মেয়েটি আঙুল দিয়া সিরাপের বোতল দেখাইয়া বলিল—ওই দ্যাখ দাদা সবুজ-বেশ ভালো, না? ছেলেটি বলিল—সব মিশিয়ে দ্যায়। বরফ আছে, ওই যে

    —ক পয়সা নেয়?

    —চার পয়সা।

    অপুর জন্য দোকানী শরবৎ মিশাইতেছে, বরফ ভাঙিতেছে, ছেলেমেয়ে দুটি মুগ্ধনেত্রে দেখিতে লাগিল। মেয়েটি অপুর দিকে চাহিয়া বলিল—আপনাকে ওই সবুজ বোতল থেকে দেবে, না?

    যেন সবুজ বোতলের মধ্যে শচীদেবীর পায়েস পোরা আছে।

    অপুর মন করুণা হইল। ভাবিলএরা বোধ হয় কখনও কিছু দেখে নি—এই রং করা টক চিনির রসকে কি ভাবছে, ভালো সিরাপ কি জানে না। বলিল-খুকি, খোকা শরবৎ খাবে? খাও না–ওদের দু গ্লাস শরবৎ দাও তো—

    প্রথমটা তারা খাইতে রাজি হয় না, অনেক করিয়া অপু তাহাদের লজ্জা ভাঙিল। অপু বলিল-ভালো সিরাপ তোমার আছে? থাকে তো দাও, আমি দাম দোব। কোন জায়গা থেকে এনে দিতে পারো না?

    বোতলে যাহা আছে তাহার অপেক্ষা ভালো সিরাপ এ অঞ্চলে নাকি কুত্রাপি মেলা সম্ভব নয়। অবশেষে সেই শরবই এক এক বড়ো গ্লাস দুই ভাই-বোন মহাতৃপ্তি ও আনন্দের সহিত খাইয়া ফেলিল, সবুজ বোতলের সেই টক চিনির রসই।

    অপু তাহাদের বিস্কুট ও এক পয়সা মোড়কের বাজে চকলেট কিনিয়া দিল—দোকানটাতে ভালো কিছু যদি পাওয়া যায় ছাই। তবুও অপুর মনে হইল পয়সা তার সার্থক হইয়াছে আজ।

    বাসায় ফিরিয়া তাহার মনে হইল বড়ো সাহিত্যের প্রেরণার মূলে এই মানববেদনা। ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রজাস্বত্ব আইন, সার্যনীতি, জার-শাসিত রাশিয়ার সাইবেরিয়া, শীত, অত্যাচার, কুসংস্কার, দারিদ্র—গোগোল, ডস্টয়ভস্কি, গোর্কি, টলস্টয় ও শেকভের সাহিত্য সম্ভব করিয়াছে। সে বেশ কল্পনা করিতে পারে, দাস-ব্যবসায়ের দুর্দিনে, আফ্রিকার এক মরু-বেষ্টিত পল্লীকুটির হইতে কোমল বয়স্ক এক নিগ্রো বালক পিতামাতার স্নেহকোল হইতে নিষ্ঠুরভাবে বিচ্যুত হইয়া বহু দূর বিদেশের দাসের হাটে ক্রীতদাসরূপে বিক্রিত হইল, বহুকাল আর সে বাপ-মাকে দেখিল না, ভাইবোনেদের দেখিল না—দেশে দেশে তাহার অভিনব জীবনধারার দৈন্য, অত্যাচার ও গোপন অশ্রুজলের কাহিনী, তাহার জীবনের সে অপূর্ব ভাবানুভূতির অভিজ্ঞতা সে যদি লিখিয়া রাখিয়া যাইতে পারিত! আফ্রিকার নীরব নৈশ আকাশ তাহাকে প্রেরণা দিত, তাম্রবর্ণ মরুদিগন্তের স্বপ্নমায়া তাহার চোখে অঞ্জন মাখাইয়া দিত; কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের দুর্ভাগ্য, তাহারা নীরবে অত্যাচার সহ্য করিয়া বিশ্ব হইতে বিদায় লইল।

     

    দিন দুই পরে একদিন সন্ধ্যার পর গড়ের মাঠ হইতে একা বেড়াইয়া ফিরিবার মুখে হোয়াটিওয়ে লেড়লর দোকানের সামনে একটুখানি দাঁড়াইয়াছে—একজন আধাবয়সি লোক কাছে আসিয়া বলিল-বাবু, প্রেমারা খেলবেন? খুব ভালো জায়গা। আমি নিয়ে যাব, এখান থেকে পাঁচ মিনিট। ভদ্র জায়গা, কোন হাঙ্গামায় পড়তে হবে না। আসবেন?

    অপু বিস্মিতমুখে লোকটার মুখের দিকে চাহিল। আধময়লা কাপড় পরনে, খোঁচা খোঁচা কড়া দাড়ি-গোঁফ, ময়লা দেশী টুইলের শার্ট, কজির বোতাম নাই-পানে ঠোঁট দুটো কালো। দেখিয়াই চিনিল—সেই ছাত্রজীবনের পরিচিত বন্ধু হরেন—সেই যে ছেলেটি একবার তাহাদের কলেজ ইতে বই চুরি করিয়া পলাইতে গিয়া ধরা পড়ে। বহুকাল আর দেখা-সাক্ষাৎ নাই—অপু লেখাপড়া হাড়িয়া দিবার পর আর কখনও নয়। লোকটাও অপুকে চিনি, থতমত খাইয়া গেল। অপুও বিস্মিত হইয়াছিল—এসব ব্যাপারের অভিজ্ঞতা তাহার নাই—জীবনে কখনও না—তবুও সে বুঝিয়াছিল তাহার এই ছাত্রজীবনের বন্ধুটি কোন পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে কিছু উত্তর করিবার পুর্বে হরেন আসিয়া তাহার হাত দুটি ধরিল—বলিল, মাপ করো ভাই, আগে টের পাই নি। বহুকাল পরে দেখা-থাক কোথায়?

    অপু বলিল—তুমি থাক কোথায়—এখানেই আছ—কত দিন?…

    –এই নিকটেই। তালতলা লেন–আসবে…অনেক কথা আছে—

    —আজ আর হবে না; আসছে সোমবার পাঁচটার সময় যাব। নম্বরটা লিখে নিই।

    —সে হবে না ভাই—তুমি আর আসবে না—তোমার দেখা আর পাবার ভরসা রাখি নে। আজই চলে।

    অতি অপরিচ্ছন্ন বাসা। একটি মাত্র ছোট ঘর।

    অপু ঘরে ঢুকিতেই একটা কেমন ভ্যাপসা গন্ধ তাহার নাকে গেল। ছোট্ট ঘর, জিনিসপত্রে ভর্তি, মেজেতে বিছানা-পাড়া, তাহারই একপাশে হরেন অপুর বসিবার জায়গা করিয়া দিল। ময়লা চাদর, ময়লা কথা, ময়লা বালিশ, ময়লা কাপড়, ঘেঁড়া মাদুর কলাই-করা গ্লাস, থালা, কালিপড়া হারিকেন লণ্ঠন, কাঁথার আড়াল হইতে তিন-চাবটি শীর্ণ কালো কালো ছোট হাত পা বাহির হইয়া আছে একটি সাত-আট বছরের মেয়ে ওদিকের দালানে দুয়ারের চৌকাঠের উপর বসিয়া। দালানের ওপাশটা রান্নাঘর—হরেনের স্ত্রী সম্ভবত রাঁধিতেছে।

    হরেন মেয়েটিকে বলিল—ওরে টেপি, তামাক সাজ তো–

    অপু বলিল—ছোট ছেলেমেয়েকে দিয়ে তামাক সাজাও কেন?…নিজে সাজো–ও শিক্ষা ভালো নয়–

    হরেন স্ত্রীর উদ্দেশে চিৎকার করিয়া বলিল—কোথায় রইলে গো, এদিকে এসো, ইনি আমার কলেজ আমলের সকলের চেয়ে বড়ো বন্ধু, এত বড়ো বন্ধু, আর কেউ ছিল না–এঁর কাছে লজ্জা করতে হবে না—একটু চা-টা খাওয়াও—এসো এদিকে।

    তারপর হবেন নিজের কাহিনী পাড়িল। কলেজ ছাড়িয়াই বিবাহ হয—তারপর এই দুঃখদুর্দশাবড়ো জড়াইয়া পড়িয়াছে—বিশেষত এই সব লেণ্ডি-গেণ্ডি। কত বকম করিযা দেখিয়াছে— কিছুতেই কিছু হয় না। স্কুলমাস্টারি, দোকান, চালানী ব্যবসা, ফটোগ্রাফির কাজ, কিছুই বাকি রাখে নাই। আজকাল যাহা করে তা তো অপু দেখিয়াছে! বাসায় কেহ জানে না—উপায় কি!—এতগুলি মুখে অন্ন তো—এই বাজার ইত্যাদি।

    হরেনের কথাবার্তার ধরন অপুর ভালো লাগিল না। চোখেমুখে কেমন যেন একটা—ঠিক বোঝানো যায় না –অপুর মনে হইল হরেন এই সব নীচ ব্যবসায়ে পোক্ত হইয়া গিয়াছে।

    হরেনের স্ত্রীকে দেখিয়া অপুর মন সহানুভূতিতে আর্দ্র হইয়া উঠিল। কালো, শীর্ণ চেহাবা, হাতে গাছকতক কাচের চুড়ি। মাথায় সামনে দিকে চুল উঠিয়া যাইতেছে, হাতে কাপড়ে বাটনার হলুদমাখা! সে এমন আনন্দ ও ক্ষিপ্রতার সহিত চা আনিয়া দিল যে, সে মনে করে যেন এতদিনে স্বামীর পরমহিতৈষী বন্ধুর সাক্ষাৎ যখন পাওয়া গিয়াছে—দুঃখ বুঝি ঘুচিল। উঠিবার সময় হরেন বলিলভাই, বাড়িভাড়া কাল না দিলে অপমান হব—পাঁচটা টাকা থাকে তো দাও তো?

    অপু টাকাটা দিয়া দিল। বাহির হইতে যাইতেছে, বড়ো ছেলেটিকে তার মা যেন কি শিখাইয়া দিল, সে দরজার কাছে আসিয়া বলিল—ও কাকাবাবু, আমার দু-খানা ইস্কুলের বই এখনও কেনা হয় নি—কিনে দেবেন? বই না কিনলে মাস্টার মারবে—

    হরেন ভানের সুরে বলিল–যা যা আবার বই—হ্যাঁ, ইস্কুলও যত–ফি বছর বই বদলাবে–যা এখন–

    অপু তাহাকে বলিল—এখন তো আর কিছু হাতে নেই খোকা, পকেট একেবারে খালি।

    হরেন অনেক দূর পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে আসিল। সে চাষবাস করিবার জন্য উত্তরপাড়ায় জমি দেখিয়া আসিয়াছে, দুই হাজার টাকা হইলে হয়—অপূর্ব কি টাকাটা ধার দিতে পারিবে? না হয়, আধাআধি বখরা—খুব লাভের ব্যবসা।

    প্রথম দিনের সাক্ষাতেই এ সব?

    কেমন একটা অপ্রীতিকর মনোভাব লইয়া অপু বাসায় ফিরিল। শেষে কিনা জুয়ার দালালি? প্রথম যৌবনে ছিল চোর, আরও কত কি করিয়াছে, কে খোঁজ রাখে? এ আর ভালো হইল না!

    দিন তিনেক পর একদিন সকালে হরেন আসিয়া হাজির অপুর বাসায়। নানা বাজে কথার পর উত্তরপাড়ার জমি লওয়ার কথা পাড়িল। টিউবওয়েল বসাইতে হইবে। কারণ জলের সুবিধা নাইঅপূর্ব কত টাকা দিতে পারে? উঠিবার সময় বলিল—ওহে, তুমি মানিককে কি বই কিনে দেবে বলেছিলে, আমায় বলছিল!

    অপু ভাবিয়া দেখিল এরূপ কোন কথা মানিককে সে বলে নাই—যাহা হউক, না হয় দিয়া দিবে এখন। মানিককে বইয়ের দরুন টাকা হরেনের হাতে দিয়া দিল।

    তাহার পর হইতে হরেনের যাতায়াত শুরু হইল একটু ঘন ঘন। বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে ছেলে মানিকও আসিতে লাগিল। কখনও সে আসিয়া বলে, তাহারা বায়স্কোপ দেখিতে যাইবে, টাকা দিন কাকাবাবু। কখনও তাহার জুতা নাই, কখনও ছোট খোকার জামা নাইকখনও তাহার বড়ো দিদি, ছোট দিদির বায়না। ইহারা আসিলেই দু-তিন টাকার কমে অপুর পার পাইবার উপায় নাই। হরেনও নানা ছুতায় টাকা চায়, বাড়ি ভাড়া স্ত্রীর অসুখ।

    একদিন কাজলের একটা সেলুলয়েডের ঘর-সাজানো জাপানী সামুরাই পুতুল খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। তার দিন-দুই আগে মানিকের সঙ্গে তার ছোট বোন টেপি আসিয়াছিল—অনেকক্ষণ পুতুলটা নাড়াচাড়া করিতেছিল, কাজল দেখিয়াছে। তারপর দিন দুই আর সেটার খোঁজ নাই, কাজল আজ দেখিল পুতুলটা নাই। ইহার দিন পনেরো পরে হরেনের বাসায় চায়ের নিমন্ত্রণে গিয়া অপু দেখিল, কাজলের জাপানী পুতুলটা একেবারে সামনেই একটা হ্যারিকেন লণ্ঠনের পাশে বসানো। পাছে ইহারা লজ্জায় পড়ে তাই সেদিকটা পিছু ফিরিয়া বসিল ও যতক্ষণ রহিল, লণ্ঠনটার দিকে আদৌ চাহিল না। ভাবিল-যাক গে, খুকি লোভ সামলাতে না পেরে এনেছে, খোকাকে আর একটা কিনে দেবো!

    উঠিয়া আসিবার সময় মানিক বলিল—মা বললেন, তোর কাকাবাবুকে বল—একদিন আমাদের কালীঘাট দেখিয়ে আনতে সামনের রবিবার চলুন কাকাবাবু, আমাদের ছুটি আছে, আমিও যাব।

    অপুর বেশ কিছু খরচ হইল রবিবারে। ট্যাক্সিভাড়া, জলখাবার, ছেলেপিলেদের খেলনা ক্রয়, এমন কি বড় মেয়েটির একখানা কাপড় পর্যন্ত। কাজলও গিয়াছিল, সে এই প্রথম কালীঘাট দেখিয়া খুব খুশি।

    সেদিন নিজের অলক্ষিতে অপুর মনে হইল, তাহার কবিরাজ বন্ধুটি ও তাহার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর কথা তাদের প্রথম জীবনের সেই দারিদ্র—সেই পরিশ্রম কখনও বিশেষ কিছু তো চাহে নাই কোনদিন–বরং কিছু দিতে গেলে ক্ষুন্ন হইত। কিন্তু আন্তরিক স্নেহটুকু ছিল তাহার উপর। এখনও ভাবিলে অপুর মন উদাস হইয়া পড়ে।

    বাড়ি ফিরিয়া দেখিল, একটি সতেরো-আঠারো বছরের ছোকরা তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। দেখিতে শুনিতে বেশ, সুন্দর চোখ-মুখ, একটু লাজুক, কথা বলিতে গেলে মুখ রাঙা হইয়া যায়।

    অপু তাহাকে চিনিল-চাঁপদানির পূর্ণ দিঘড়ীর ছেলে রসিকলাল—যাহাকে সে টাইফয়েড হইতে বাঁচাইয়াছিল। অপু বলিল-রসিক, তুমি আমার বাসা জানলে কি করে?

    –আপনার লেখা বেরুচ্ছে ‘বিভাবরী’ কাগজে-তাদের অফিস থেকে নিয়েছি—

    –তারপর, অনেককাল পর দেখা—কি খবর বলো।

    —শুনুন, দিদিকে মনে আছে তো? দিদি আমায় পাঠিয়ে দিয়েছে-বলে দিয়েচে যদি কলকাতায় যাস, তবে মাস্টার মশায়ের সঙ্গে দেখা করিস। আপনার কথা বড় বলে, আপনি একবার আসুন না চাপদানিতে।

    -পটেশ্বরী? সে এখনও মনে করে রেখেছে আমার কথা?

    রসিক সুর নিচু করিয়া বলিল—আপনার কথা বলে না এমন দিন নেই—আপনি চলে এসেছেন আট-দশ বছর হল—এই আট-দশ বছরের মধ্যে আপনার কথা বলে না—এমন একটা দিনও বোধ হয় যায় নি। আপনি কি কি খেতে ভালোবাসতেন—সে-সব দিদির এখনও মুখস্থ। কলকাতায় এলেই আমায় বলে, মাস্টারমশায়ের খোঁজ করিস না রে? আমি কোথায় জানব আপনার খোঁজ-কলকাতা শহর কি চাপদানি? দিদি তা বোঝে না। তাই এবার বিভাবরীতে আপনার লেখা–

    —পটেশ্বরী কেমন আছে? আজকাল আর সে-সব শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার

    –শাশুড়ি মারা গিয়েছে, আজকাল কোন অত্যাচার নেই, দু-তিনটি ছেলেমেয়ে হয়েছে, সে-ই আজকাল গিন্নি, তবে সংসারের বড়ো কষ্ট। আমাকে বলে দেয় বোতলের চাটনি কিনতে দশ আনা দাম–আমি কোথা থেকে পাব—তাই একটা ছোট বোতল আজ এই দেখুন কিনে নিয়ে যাচ্ছি ছ-আনায়। টেপারির আচার। ভালো না?

    –এক কাজ করো। চলো আমি তোমাকে আচার কিনে দিচ্ছি, আমের আচার ভালোবাসে? চলো দেশী চাটনি কিনি। ভিনিগার দেওয়া বিলিতি চাটনি হয়তো পছন্দ করবে না।

    –আপনি কবে আসবেন? আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে অথচ আপনাকে নিয়ে যাই নি শুনলে দিদি আমাকে বাড়িতে তিঞ্ছতে দেবে না কিন্তু, আজই আসুন না?

    –সে এখন হবে না, সময় নেই। সুবিধে মতো দেখব।

    অপু অনেকগুলি ছেলেমেয়ের খেলনা, খাবার চাটনি কিনিয়া দিল। রসিককে স্টেশনে তুলিয়া দিয়া আসিল। রসিক বলিল-আপনি কিন্তু ঠিক যাবেন একদিন এর মধ্যে–নইলে ওই বললাম যে—

     

    কি চমৎকার নীল আকাশ আজ! গরম আজ একটু কম।

    চৈত্র দুপুরের এই ঘন নীল আকাশের দিকে চাহিলেই আজকাল কেন শৈশবের কথাই তাহার মনে পড়ে?

    একটা জিনিস সে লক্ষ করিয়াছে। বাল্যে যখন অন্য কোনও স্থানে সে যায় নাই—যখন যাহা পড়িত—মনে মনে তাহার ঘটনাস্থলের কল্পনা করিতে গিয়া নিশ্চিন্দিপুরেরই বাঁশবন, আমবাগান, নদীর ঘাট, কুটির মাঠের ছবি মনে ফুটিয়া উঠিত—তাও আবার তাদের পাড়ার ও তাদের বাড়ির আশেপাশের জায়গার। তাদের বাড়ির পিছনের বাঁশবন তো রামায়ণ মহাভারত মাখানো ছিল— দশরথের রাজপ্রাসাদ ছিল তাদের পাড়ার ফণি মুখুজ্যেদের ভাঙা দোতলা বাড়িটা—মাধবীকঙ্কণে পড়া একলিঙ্গের মন্দির ছিল ছিরে পুকুরের পশ্চিমদিকের সীমানার বড়ো বাঁশঝাড়টার তলায় বঙ্গবাসীতে পড়া জোয়ান অব আর্ক মেষপাল চরাইত নদীপারের দেয়াড়ের কাশবনের চরে, শিমুলগাছের ছায়ায়…তারপর বড়ো হইয়া কত নতুন স্থানে একে একে গেল, মনের ছবি ক্রমশ পরিবর্তিত হইতে লাগিল—ম্যাপ চিনিল, ভূগোল পড়িল, বড়ো হইয়া যে সব বই পড়িল তাদের ঘটনা নিশ্চিন্দিপুরের মাঠে, বনে, নদীর পথেঘাটে থাকে না কিন্তু এতকালের পরেও বাল্যের যে ছবিগুলি একবার অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল তা অপরিবর্তিত আছে—এতকাল পরেও যদি রামায়ণ মহাভারতের কোনও ঘটনা কল্পনা করে নিশ্চিন্দিপুরের সেই অস্পষ্ট, বিস্মৃতপ্রায় স্থানগুলিই তার রথীভূমি হইয়া দাঁড়ায়–অনেককাল পর সেদিন আর একবার পুরোনো বইয়ের দোকানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া মাধবীকঙ্কণ ও জীবনসন্ধ্যা পড়িতেছিল—কি অত।পাতায় পাতায় নিশ্চিন্দিপুর মাখানো, বাল্যের ছবি এখনও সেই অস্পষ্টভাবে-মনে-হওয়া জঙ্গলে-ভরা পোড়ো পুকুরটার পশ্চিম সীমানায় বাশঝাড়ের তলায়!…

    এবার মাঝে মাঝে দু-একটি পূর্বপরিচিত বন্ধুর সঙ্গে অপুর দেখা হইতে লাগিল। প্রায়ই। কেহ উকিল, কেহ ডাক্তার জানকী মফঃস্বলের একটা গবর্নমেন্টের স্কুলের হেডমাস্টার, মন্মথ অ্যাটর্নির ব্যবসায়ে বেশ উপার্জন করে। দেবব্রত একবার ইতিমধ্যে সস্ত্রীক কলিকাতা আসিয়াছিল, স্ত্রীর পা সারিয়া গিয়াছে, দুটি মেয়ে হইয়াছে। চাকরিতে সে বেশ নাম করিয়াছে, তবে চেষ্টায় আছে কন্ট্রাক্টরি ব্যবসায় স্বাধীনভাবে আরম্ভ করিতে। দেওয়ানপুরের বাল্যবন্ধু সেই সমীর আজকাল ইনসিওরেন্সের বড়ো দালাল। সে চিরকাল পয়সা চিনিত, হিসাবী ছিল—আজকাল অবস্থা ফিরাইয়া ফেলিয়াছে। কষ্টদুঃখ করিতে করিতে একবারও সে ইহাদিগকে হিংসা করে না। তারপর এবার জানকীর সঙ্গে একদিন কলিকাতায় দেখা হইল। মোটা হইয়া গিয়াছে বেজায়, মনের তেজ নাই, গৃহস্থালির কথাবার্তা—অপুর মনে হইল সে যেন একটা বদ্ধ ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করিয়া বসিযা আছে।

    তাহার অ্যাটর্নি বন্ধু মন্মথ একদিন বলিল—ভাই, সকাল থেকে ব্রিফ নিয়ে বসি, সারাদিনের মধ্যে আর বিশ্রাম নেই—খেয়েই হাইকোর্ট, পাঁচটায় ফিরে একটা জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজারি করি ঘণ্টা-তিনেক–তারপর বাড়ি ফিরে আবার কাজ-খবরের কাগজখানা পড়বার সময় পাইনে, কিন্তু এত টাকা রোজগার করি, তবু মনে হয়, ছাত্রজীবনই ছিল ভালো। তখন কোন একটা জিনিস থেকে বেশি আনন্দ পেতুম—এখন মনে হয়, আই হ্যাভ লস্ট দি সস্ অফ লাইফ

    অপু নিজের কথা ভাবিয়া দেখে। কই, এত বিরুদ্ধ ঘটনার ভিতর দিয়াও তাহার মনে আনন্দ-কেন নষ্ট হয় নাই? নষ্ট হয় তো নাই-ই, কেন তাহা দিনে দিনে এমন অদ্ভুত ধরনের উচ্ছ্বসিত প্রাচুর্যে বাড়িয়া চলিয়াছে? কেন পৃথিবীটা, পৃথিবী নয়—সারা বিশ্বটা, সারা নাক্ষত্রিক বিশ্বটা এক অপরুপ বঙে তাহার কাছে রঙিন? আর দিনে দিনে এ কি গহন গভীর বহস্য তাহাকে মুগ্ধ করিয়া প্রতি বিষয়ে অতি তীব্রভাবে সচেতন কবিযা দিতেছে? …

    সে দেখিতে পায় তার ইতিহাস, তাব এই মনের আনন্দের প্রগতিব ইতিহাস, তাব ক্রমবর্ধমান চেতনাব ইতিহাস।

    এই জগতেব পিছনে আর একটা যেন জগৎ আছে। এই দৃশ্যমান আকাশ, পাখির ডাক, এই সমস্ত সংসার-জীবন-যাত্রা—তারই ইঙ্গিত আনে মাত্ৰদূর দিগন্তে বহুদূর ওপাবে কোথায় যেন সে জগৎটা-পিঁয়াজের একটা খোব মধ্যে যেমন আব একটা খোসা, তার মধ্যে আব একটা খোসা, সেটাও তেমনি এই আকাশ, বাতাস, সংসারেব আববণে কোথায় যেন ঢাকা আছে, কোন্ জীবন পারের মনেব পারের দেশে। স্থির সন্ধ্যায় নির্জনে একা কোথাও বসিয়া ভাবিলেই সেই জগৎটা একটু একটু নজরে আসে।

    সেই জগৎটার সঙ্গে যোগ-সেতু প্রথম স্থাপিত হয় তার বাল্যে—দিদি যখন মারা যায়। তারপর অনিল-মা—অপর্ণা—সর্বশেষে লীলা। দুস্তর অশ্রুর পারাবার সারাজীবন ধরিয়া পাড়ি দিয়া আসিয়া আজ যেন বহু দূরে সে দেশের তালীবনরেখা অস্পষ্ট নজরে আসে।

    আজ গোলদিঘির বেঞ্চিখানায় বসিয়া তাই সে ভাবিয়া দেখিল, অনেক দিন আগে তার বন্ধু অনিল যে-কথা বলিয়াছিল, এ জেনাবেশনের হাত হইতে কাজের ভার লওয়া—আর সবাই তো লইয়াছে, তার সকল সহপাঠীই এখন জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, দিকে দিকে জীবনের সকল কর্মক্ষেত্রে তারা নামিয়া পড়িয়াছে, কেবল ভবঘুরে হইয়াছে সে ও প্রাব। কিন্তু সত্য কথা সে বলিবে?…মন তার কি বলে?

    তার মনে হয় সে যাহা পাইয়াছে জীবনে, তাহাতেই তার জীবন হইয়াছে সার্থক। সে চায় না অর্থ, চায় নাকি সে চায়?

    সেটাও তো খুব স্পষ্ট হইয়া উঠে না। সে কি অপরুপ জীবন-পুলক এক একদিন দুপুরের রোদে ছাদটাতে সে অনুভব করে, তাকে অভিভূত, উত্তেজিত করিয়া তোলে, আকাশের দিকে উৎসুক চোখে চাহিয়া থাকে, যেন সে দৈববাণীর প্রত্যাশা করিতেছে।…

    কাজল কি একটা বই আগ্রহের সঙ্গে পড়িতেছিল—অপু ঘরে ঢুকিতেই চোখ তুলিয়া ব্যগ্র উৎসাহের সুরে উজ্জ্বলমুখে বলিল-ওঃ, কি চমৎকার গল্পটা বাবা!—শোনো না বাবা-এখানে বোসো–। পরে সে আরও কি সব বলিয়া যাইতে লাগিল। অপু অন্যমনস্ক মনে ভাবিতেছিলবিদেশে যাওয়ার ভাড়া সে জোগাড় করিতে পারে—কিন্তু খোকা—খোকাকে কোথায় রাখিয়া যায়?…মামার বাড়ি পাঠাইয়া দিবে? মন্দ কি? …কিছুদিন না হয় সেখানেই থাকুক-বছর দুই তিন তারপর সে তো ঘুরিয়া আসিবেই। তাই করিবে? মন্দ কি?

    কাজল অভিমানের সুরে বলিল—তুমি কিছু শুনছ না, বাবা–

    —শুন্ না কেন রে, সব শুনছি। তুই বলে যা না?

    —ছাই শুনছে, বলল দিকি শ্বেত পরী কোন্ বাগানে আগে গেল?

    বলিল—কোন্ বাগানে?-আচ্ছা একটু আগে থেকে বল্ তো খোকা—ওটা ভালো মনে নেই!

    খোকা অতশত ঘোরপ্যাঁচ বুঝিতে পারে না—সে আবার গোড়া হইতে গল্প বলা শুরু করিল—বলিল—এইবার তো রাজকন্যে শেকড় খুঁজতে যাচ্ছে, কেমন না! মনে আছে তো? অপু এক বর্ণও শোনে নাই) তারপর শোনো বাবা–

    কাজলের মাথার চুলের কি সুন্দর ছেলেমানুষি গন্ধ!-দোলা, চুষিকাটি, ঝিনুকবাটি, মায়ের কোল—এই সব মনে করাইয়া দেয়—নিতান্ত কচি। সত্যি ওব দিকে চাহিয়া দেখিলে আর চোখ ফিরাইতে ইচ্ছা হয় না—কি হাসে, কি চোখ দুটি—মুখ কি সুন্দর-ওইটুকু একরত্তি ছেলে—যেন বাস্তব নয়, যেন এ পৃথিবীর নয়—কোন সময় জ্যোৎস্নাপরী আসিয়া ওকে যেন উড়াইয়া লইয়া কোনও স্বপ্নপারের দেশে লইয়া যাইবে দিনরাত কি চঞ্চলতা, কি সব অদ্ভুত খেয়াল ও আবদার অথচ কি অবোধ ও অসহায়!—ওকে কি করিয়া প্রতারণা করা যাইবে?—ও তো একদণ্ড ছাড়িয়া থাকিতে পারে না–ওকে কি বলিয়া ভুলানো যায়? অপু মনে মনে সেই ফন্দিটাই ভাবিতে লাগিল।

    ছেলেকে বলিল—চিনি নিয়ে আয় তো খোকা—একটু হালুয়া করি।

     

    কাজল মিনিট দশেক মাত্র বাহিরে গিয়াছে—এমন সময় গলির বাহিরে রাস্তায় কিসের একটা গোলমাল অপুর কানে গেল। বাহির হইয়া ঘরের দোরে দাঁড়াইল–গলির ভিতর হইতে লোক দৌড়াইয়া বাহিবেব দিকে ছুটিতেছে—

    একজন বলিল—একটা কে লবি চাপা পড়েছে–

    অপু দৌড়িয়া গলির মুখে গেল। বেজায় ভিড়, সবাই আগাইতে চায়, সবাই ঠেলাঠেলি করিতেছে। অপুর পা কাঁপিতেছিল, জিভ শুকাইয়া আসিয়াছে। একজন কে বলিল—কে চাপা পড়েছে মশাই

    —ওই যে ওখানে একটা ছেলে—আহা মশায়, তখনই হয়ে গিয়েছে—মাখাটা আর নেই—

    অপু রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করিল—বয়স কত?

    বছর নয় হবে—ভদ্রলোকের ছেলে, বেশ ফরসা দেখতে—আহা!–

    অপু এ প্রশ্নটা কিছুতেই মুখ দিয়া বাহির করিতে পারিল না—তাহার গায়ে কি ছিল। কাজল তার নতুন তৈরি খদ্দরের শার্ট পরিয়া এইমাত্র বাহির হইয়া গিয়াছে—

    কিন্তু এই সময়ে হঠাৎ অপু হাতে পায়ে অদ্ভুত ধরনের বল পাইল-বোধ হয় যে খুব ভালোবাসে, সে ছাড়া এমন বল আর কেহ পায় না এমন সময়ে। খোকার কাছে এখনি যাইতে হইবে—যদি একটুও বাঁচিয়া থাকে—সে বোধ হয় জল খাইবে, হয়তো ভয় পাইয়াছে—

    ওপারের ফুটপাতে গ্যাসপোস্টের পাশে ট্যাক্সি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, পুলিশ আসিয়াছে–ট্যাক্সিতে ধরাধরি করিয়া দেহটা উঠাইতেছে। অপু ধাক্কা মারিয়া সামনের লোকজনকে হঠাইয়া খানিকটা জায়গা ফাঁকা করিয়া ফেলিল। কিন্তু ফাঁকায় আসিয়া সামনে ট্যাক্সিটার দিকে চাহিয়াই তাহার মাথাটা এমন ঘুরিয়া উঠিল যে, পাশের লোকের কাঁধে নিজের অজ্ঞাতসারে ভর না দিলে সে হয়তো পড়িয়াই যাইত। ট্যাক্সির সামনে যে ভিড় জমিয়াছে তারই মধ্যে দাঁড়াইয়া ডিঙি মারিয়া কাণ্ডটা দেখিবার বৃথা চেষ্টা করিতেছে কাজল। অপু ছুটিয়া গিয়া ছেলের হাত ধরিল-কাজল ভীত অথচ কৌতূহলী চোখে মৃতদেহটা দেখিবার চেষ্টা করিতেছিল—অপু তাহাকে হাত ধরিয়া লইয়া আসিল। কি দেখছিলি ওখানে?…আয় বাসায়–

    অপু অনুভব করিল, তাহার মাথা যেন ঝিমঝিম্ করিতেছে সারা দেহে যেন এইমাত্র কে ইলেকট্রিক ব্যাটারির শক লাগাইয়া দিয়াছে।

    গলির পথে কাজল একটু ইতস্তত করিয়া অপ্রতিভের সুরে বলিল–বাবা, গোলমালে আমায় যে সিকিটা দিয়েছিলে চিনি আনতে, কোথায় পড়ে গিয়েছে খুঁজে পাই নি।

    -যাক গে। চিনি নিয়ে চলে আসতে পারতিস কোকালে–তুই বড় চঞ্চল ছেলে খোকা।

     

    দিন দুই পরে সে কি কাজে হ্যারিসন রোড দিয়া চিৎপুরের দিকে ট্রামে চড়িয়া যাইতেছিল, মোড়ের কাছে শীলেদের বাড়ির রোকড়নবিশ রামধনবাবুকে ছাতি মাথায় যাইতে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি ট্রাম হইতে নামিল, কাছে গিয়া বলিল, কি রামধনবাবু, চিনতে পারেন?

    রামধনবাবু হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া বলিলেন, আরে অপূর্ববাবু যে! তারপর কোথা থেকে আজ এতকাল পরে! ওঃ, আপনি একটু অন্যরকম দেখতে হয়ে গিয়েছেন, তখন ছিলেন ছোকরা

    অপু হাসিয়া বলিল—তা বটে। এদিকেও চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হল-কতকাল আর ছোকরা থাকব-আপনি কোথায় চলেছেন?

    —অফিস যাচ্ছি, বেলা প্রায় এগারোটা বাজে–না? একটু দেরি হয়ে গেল। একদিন আসুন? কতদিন তো কাজ করেছেন, আপনার পুরানো অফিস, হঠাৎ চাকরিটা দিলেন ছেড়ে, তা নইলে আজ অ্যাসিসটান্ট ম্যানেজার হতে পারতেন, হরিচরণবাবু মারা গিয়েছেন কিনা।

    সত্যিই বটে বেলা সাড়ে দশটা। রামধনবাবু পুরানো দিনের মতো ছাতি মাথায় লংক্লথেব ময়লা ও হাত-হেঁড়া পাঞ্জাবি গায়ে, ক্যাম্বিশের জুতা পায়ে দিয়া অপু দশ বৎসর পূর্বে যে অফিসটাতে কাজ করিত সেখানে গুটি গুটি চলিযাছেন।

    অপু জিজ্ঞাসা করিল, রামধনবাবু, কতদিন কাজ হল ওদের ওখানে আপনার সবসুদ্ধ?

    রামধনবাবু পুবানোনা দিনের মতো গর্বিত সুরে বলিলেন, এই সাঁইত্রিশ বছব যাচ্ছে। কেউ পারবে না বলে দিচ্ছি—এক কলমে এক সেরেস্তায়। আমার দ্যায় পাঁচ-পাঁচটা ম্যানেজার বদল হল–কত এল, কত গেল—আমি ঠিক বজায় আছি। এ শর্মার চাকরি ওখান থেকে কেউ নড়াতে পারছেন না—যিনিই আসুন। হাসিয়া বলিলেন,-এবার মাইনে বেড়েছে, পয়তাল্লিশ হল।

    অপুর মাথা কেমন ঘুরিয়া উঠিল-সাঁইত্রিশ বছর একই অন্ধকার ঘরে এই হাতবাক্সের উপর ভারী খেরো-বাঁধানো রোকড়ের খাতা খুলিয়া কালি ও স্টীলপেনের সাহায্যে শীলেদের সংসারের চালডালের হিসাব লিখিয়া চলা—চারিধারে সেই একই দোকান-পসার, একই পরিচিত গলি, একই সহকর্মীর দল, একই কথা ও আলোচনা-বারো মাস, তিনশো তিরিশ দিন! সে ভাবিতে পারে না এই বদ্ধজল, পঙ্কিল, পচা পানা পুকুরের মতো গতিহীন, প্রাণহীন, ক্ষুদ্র জীবনের কথা ভাবিলেও তাহার গা কেমন করিয়া উঠে।

    বেচারি রামধনবাবু-দরিদ্র, বৃদ্ধ, ওঁর দোষ নাই, তাও সে জানে। কলিকাতার বহু শিক্ষিত সমাজে, আচ্ছায়, ক্লাবে সে মিশিয়াছে। বৈচিত্রহীন একঘেয়ে জীবন-অর্থহীন, ছন্দহীন, ঘটনাহীন দিনগুলি। শুধু টাকা, টাকা—শুধু খাওয়া–পানাসক্তি, ব্রিজখেলা, ধূমপান, একই তুচ্ছ বিষয়ে একঘেয়ে অসার বকুনি—তরুণ মনের শক্তি নষ্ট করিয়া দেয়, আনন্দকে ধ্বংস করে, দৃষ্টিকে সংকীর্ণ করে, শেষে ঘোর কুয়াশা আসিয়া সূর্যালোককে রুদ্ধ করিয়া দেয়—ক্ষুদ্র, পঙ্কিল অকিঞ্চিৎকর জীবন কোনরকমে খাত বাহিয়া চলে। সে শক্তিহীন নয়—এই পরিণাম হইতে সে নিজেকে বাঁচাইবে।

    তারপর সে রামধনবাবুর অনুরোধে কতকটা কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া শীলেদের বাড়ি গেল। সেই আপিস, ঘরদোর, লোকের দল বজায় আছে। প্রবোধ মুহুরি বড়োলোক হইবার জন্য কোন লটারিতে প্রতি বৎসর একখানি টিকিট কিনিতেন, বলিতেন—ও পাঁচটা টাকা বাজে খরচের সামিল ধরে রেখেছি দাদা। যদি একবার লেগে যায়, তবে সুদে আসলে সব উঠে আসবে।

    তাহা আজও আসে নাই, কারণ তিনি আজও দেবোত্তর এস্টেটের হিসাব কষিতেছেন।

    খুব আদর-অভ্যর্থনা করিল সকলে। মেজবাবু কাছে বসাইয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। বেলা এগারোটা বাজে, তিনি এইমাত্র ঘুম হইতে উঠিয়াছেন—বিলিয়ার্ড ঘরের সামনের বারান্দাতে চাকর তাঁহাকে এখনই তৈল মাখাইবে, বড়ো রূপার গুড়গুড়িতে রেশমের গলাবন্ধওয়ালা নলে বেহারা তামাক দিয়া গেল।

    এ বাড়ির একটি ছেলেকে অপু পূর্বে দিনকতক পড়াইয়াছিল, তখন সে ছোট ছিল, বেশ সুন্দর দেখিতে ছিলভারি পবিত্র মুখশ্রী, স্বভাবটিও ছিল ভারি মধুর। সে এখন আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে, কাছে আসিয়া পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল–অপু দেখিয়া ব্যথিত হইল যে, সে এই সকালেই অন্তত দশটা পান খাইয়াছে—পান খাইয়া ঠোঁট কালো-হাতে রুপার পানের কৌটা-পান জর্দা। এবার টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়াছে, খানিকক্ষণ কেবল ফিল্মের গল্প করিল, বাস্টার কিটনকে মাস্টারমশায়ের কেমন লাগে?…চার্লি চ্যাপলিন? নৰ্মা শিয়ারারও সে অদ্ভুত!

    ফিরিবার সময় অপুর মনটা বেদনায় পূর্ণ হইয়া গেল। বালক, ওর দোষ কি? এই আবহাওয়ার খুব বড়ো প্রতিভাও শুকাইয়া যায়-ও তো অসহায় বালক

    রামধনবাবু বলিলেন, চললেন অপূর্ববাবু? নমস্কার। আসবেন মাঝে মাঝে।

    গলির বাহিরে সেই পচা খড় বিচালি, পচা আপেলের খোলা, শুঁটকি মাছের গন্ধ।

     

    রাত্রিতে অপুর মনে হইল সে একটা বড়ো অন্যায় করিতেছে, কাজলের প্রতি একটা গুরুতর অবিচার করিতেছে। ওরও তো সেই শৈশব। কাজলের এই অমূল্য শৈশবের দিনগুলিতে সে তাহাকে এই ইট, কংক্রিট, সিমেন্ট ও বার্ডকোম্পানির পেটেন্ট স্টোনে বাঁধানো কারাগারে আবদ্ধ রাখিয়া দিনের পর দিন তাহার কাঁচা, উৎসুক, স্বপ্নপ্রবণ শিশুমন তুচ্ছ বৈচিত্র্যহীন অনুভূতিতে ভরাইয়া তুলিতেছে—তাহার জীবনে বন-বনানী নাই, নদীর মর্মর নাই, পাখির কলস্বর, মাঠ, জ্যোৎস্না, সঙ্গীসাথীদের সুখদুঃখ—এসব কিছুই নাই, অথচ কাজল অতি সুন্দর ভাবপ্রবণ বালক—তাহার পরিচয় সে অনেকবার পাইয়াছে।

    কাজল দুঃখ জানুক, জানিয়া মানুষ হউক। দুঃখ তার শৈশবে গল্পে পড়া সেই সোনা-করা জাদুকর! ছোঁড়া-খোঁড়া কাপড়, ঝুলি ঘাড়ে বেড়ায়, এই চাপদাড়ি, কোণে কাঁদাড়ে ফেরে, কারুর সঙ্গে কথা কয় না, কেউ পোঁছে না, সকলে পাগল বলে, দূর দূর করে, রাতদিন হাপর জ্বালায়; রাতদিন হাপর জ্বালায়।

    পেতল থেকে, রাং থেকে, সীসে থেকে ও-লোক কিন্তু সোনা করিতে জানে, করিয়াও থাকে।

    এই দিনটিতে বসিয়া ভাবিতে ভাবিতে সর্বপ্রথম এতকাল পরে একটা চিন্তা মনে উদয় হইল। নিশ্চিন্দিপুর একবারটি ফিরিলে কেমন হয়? সেখানে আর কেউ না থাক, শৈশব-সঙ্গিনী রানুদিদি তো আছে। সে যদি বিদেশে চলিয়া যায়, তার আগে খোকাকে তার পিতামহের ভিটাটা দেখাইয়া আনাও তো একটা কর্তব্য?

    পরদিনই সে কাশীতে লীলাদিকে পঁচিশটা টাকা পাঠাইয়া লিখিল, সে খোকাকে লইয়া একবার নিশ্চিন্দিপুর যাইতেছে, খোকাকে পিতামহের গ্রামটা দেখাইয়া আনিবে। পত্রপাঠ যেন লীলাদি তার দেওরকে সঙ্গে লইয়া সোজা নিশ্চিন্দিপুর চলিয়া যায়।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবযান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }