Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প563 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২৪. ট্রেনে উঠিয়াও যেন অপুর বিশ্বাস হইতেছিল না

    চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

    ট্রেনে উঠিয়াও যেন অপুর বিশ্বাস হইতেছিল না, সে সত্যই নিশ্চিন্দিপুরের মাটিতে আবার পা দিতে পারিবে নিশ্চিন্দিপুর, সে তো শৈশবের স্বপ্নলোক! সে তো মুছিয়া গিয়াছে, মিলাইয়া গিয়াছে, সে শুধু একটা অনতিস্পষ্ট সুখস্মৃতি মাত্র, কখনও ছিল না, নাইও।

    মাঝেরপাড়া স্টেশনে ট্রেন আসিল বেলা একটার সময়। খোক লাফ দিয়া নামিল, কারণ প্ল্যাটফর্ম খুব নিচু। অনেক পরিবর্তন হইয়াছে স্টেশনটার, প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে জাহাজের মাস্তুলের মতো উঁচু যে সিগন্যালটা ছেলেবেলায় তাহাকে তাক লাগাইয়া দিয়াছিল সেটা আর এখন নাই। স্টেশনের বাইরে পথের উপর একটা বড়ো জাম গাছ, অপুর মনে আছে, এটা আগে ছিল না। ওই সেই বড়ো মাদার গাছটা, যেটার তলায় অনেককাল আগে তাহাদের এদেশ ছাড়িবার দিনটাতে মা খিচুড়ি রাঁধিয়াছিলেন। গাছের তলায় দুখানা মোটরবাস যাত্রীর প্রত্যাশায় দাঁড়াইয়া, অপুরা থাকিতে থাকিতে দুখানা পুরোেনো ফোর্ড ট্যাক্সিও আসিয়া জুটিল। আজকাল নাকি নবাবগঞ্জ পর্যন্ত বাস ও ট্যাক্সি হইয়াছে, জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল—জিনিসটা অপুর কেমন যেন ভালো লাগিল না। কাজল নবীন যুগের মানুষ, সাগ্রহে বলিল—মোটর কাটে করে যাব বাবা? অপু ছেলেকে জিনিসপত্রসমেত ট্যাক্সিতে উঠাইয়া দিল, বটের ঝুরি দোলানো, মিল্ক ছায়াভরা সেই প্রাচীন দিনের পথটা দিয়া সে নিজে মোটরে চড়িয়া যাইতে পারিবে না কখনই। এ দেশের সঙ্গে পেট্রোল গ্যাসের গন্ধ কি খাপ খায়?

    চৈত্রমাসের শেষ। বাংলায় সত্যিকার বসন্ত এই সময়েই নামে। পথ চলিতে চলিতে পথের ধারে ফুলেভরা ঘেঁটুবনের সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ হইয়া গেল। এই কম্পমান চৈত্রদুপুরের রৌদ্রের সঙ্গে, আকন্দ ফুলের গন্ধের সঙ্গে শৈশব যেন মিশানো আছে—পশ্চিম বাংলার পল্লীতে এ কমনীয় বসন্তের রূপ সে তো ভুলিয়াই গিয়াছিল।

    এই সেই বেত্রবতী! এমন মধুর স্বপ্নভরা নামটি কোন নদীর আছে পৃথিবীতে? খেয়া পার হইয়া আবার সেই আষাঢুর বাজার। ভিডোল ডানলপ টায়ারের বিজ্ঞাপনওয়ালা পেট্রোলের দোকান নদীর উপরেই। বাজারেরও চেহারা অনেক বদল হইয়া গিয়াছে। তেইশ বছর আগে এত কোঠা বাড়ি ছিল না। আষাঢ় হইতে হাঁটিয়া যাওয়া সহজ, মাত্র দু মাইল, জিনিসপত্রের জন্য একটা মুটে পাওয়া গেল, মোটরবাস ও ট্যাক্সির দরুন ভাড়াটিয়া গরুর গাড়ি আজকাল নাকি এদেশ হইতে উঠিয়া গিয়াছে। মুটে বলিল-ধঞ্চে-পলাশগাছির ওই কাঁচা রাস্তাটা দিয়ে যাবেন তো বাবু? ধঞ্চেপলাশগাছি?…নামটাই তো কতকাল শোনে নাই, এতদিন মনেও ছিল না, উঃ, কতকাল পরে এই অতি সুন্দর নামটা সে আবার শুনিতেছে!

    বেলা পড়িয়া আসিয়াছে এমন সময়ে পথটা সোনাডাঙা মাঠের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল পাশেই মধুখালির বিল—পদ্মবনে ভরিয়া আছে। এই সেই অপূর্ব সৌন্দর্যভূমি, সোনাডাঙার স্বপ্নমাখানো মাঠটা মনে হইল এত জায়গায় তো বেড়াইল, এমন অপরূপ মাঠ ও বন কই কোথাও তো দেখে নাই! সেই বনবোপ, ঢিবি, বন, ফুলে ভর্তি বালা—বৈকালের এ কী অপূর্ব রূপ!

    তারপরই দূর হইতে ঠাকুরঝি পুকুরের সেই ঠ্যাঙাড়ে বটগাছটার উঁচু ঝাকড়া মাথাটা নজরে পড়িল-যেন দিকসমুদ্রে ডুবিয়া আছে-ওর পরেই নিশ্চিন্দিপুর।–ক্রমে বটগাছটা পিছনে পড়িল–অপুর বুকের রক্ত চলাইয়া যেন মাথায় উঠিতে চাহিতেছে, সারা দেহ এক অপূর্ব অনুভূতিতে যেন অবশ হইয়া আসিতেছে। ক্রমে মাঠ শেষ হইল, ঘাটের পথের সেই আমবাগানগুলো-সে রুমাল কুড়াইবার ছলে পথের মাটি একটু তুলিয়া মাথায় ঠেকাইল। ছেলেকে বলিল-এই হল তোমার ঠাকুরদার গাঁ, খোকা, ঠাকুরদাদার নামটা মনে আছে তো-বলো তো বাবা

    কি?

    কাজল হাসিয়া বলিল—শ্রীহরিহর রায়, আহা, তা কি আর মনে আছে।

    অপু বলিল, শ্রী নয় বাবা, ঈশ্বর বলতে হয়, শিখিয়ে দিলাম যে সেদিন?

     

    বানুদির সঙ্গে দেখা হইল পরদিন বৈকালে।

    সাক্ষাতের পূর্ব ইতিহাসটা কৌতুকপূর্ণ, কথাটা রানীর মুখেই শুনিল।

    রানী অপু আসিবার কথা শুনে নাই, নদীর ঘাট হইতে বৈকালে ফিরিতেছে, বাঁশবনের পথে কাজল দাঁড়াইয়া আছে, সে একা গ্রামে বেড়াইতে বাহির হইয়াছে।

    রানী প্রথমটা থতমত খাইয়া গেল—অনেককাল আগের একটা ছবি অস্পষ্ট মনে পড়িল— ছেলেবেলায় ওই ঘাটের ধারের জঙ্গলে-ভরা ভিটাটাতে হরিকাকারা বাস করিত, কোথায় যেন তাহারা উঠিয়া গিয়াছিল তারপরে। তাদের বাড়ির সেই অপু না?…ছেলেবেলার সেই অপু! পরক্ষণেই সামলাইয়া লইয়া সে কাছে গিয়া ছেলেটির মুখের দিকে চাহিল— অপুও বটে, নাও বটে। যে বয়সে সে গ্রাম ছাড়িয়া গিয়াছিল তার সে সময়ের চেহারাখানা রানীর মনে আঁকা আছে, কখনও ভুলিবে না—সেই বয়স, সেই চেহারা, অবিকল। রানী বলিল—তুমি কাদের বাড়ি এসেছ খোকা?

    কাজল বলিল—গাঙ্গুলীদের বাড়ি

    বানী ভাবিল, গাঙ্গুলীরা বড়োলোক, কলিকাতা হইতে কেহ কুটুম্ব আসিয়া থাকিবে, তাদেরই ছেলে। কিন্তু মানুষের মতো মানুষ হয়! বুকের ভিতরটা ছাঁৎ করিয়া উঠিয়াছিল একেবারে। গাঙ্গুলীবাড়ির বড়ো মেয়ের নাম করিয়া বলিল—তুমি বুঝি কাদুপিসির নাতি?

    কাজল লাজুক চোখে চাহিয়া বলিল-কাদুপিসি কে জানি নে তো? আমার ঠাকুরদাদাব এই গাঁয়ে বাড়ি ছিল—তার নাম ঈশ্বর হরিহর রায়—আমার নাম অমিতাভ রায়।

    বিস্ময়ে ও আনন্দে রানীর মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না অনেকক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে একটা অজানা ভয়ও হইল। বুদ্ধ নিঃশ্বাসে বলিল—তোমার বাবা-খোকা?…

    কাজল বলিল-বাবার সঙ্গেই তো কাল এলাম। গাঙ্গুলীবাড়িতে এসে উঠলাম রাত্রে। বাবা ওদের বাইরের ঘরে বসে গল্প করছে, মেলা লোক দেখা করতে এসেছে কিনা তাই।…

    রানী দুই হাতের তালুর মধ্যে কাজলের সুন্দর মুখখানা লইয়া আদরের সুরে বলিল—খোকন, খোকন, ঠিক বাবার মতো দেখতে-চোখ দুটি অবিকল! তোমার বাবাকে এ পাড়ায় ডেকে নিয়ে এসো খোকন। বলগে রানুপিসি ডাকছে।

    সন্ধ্যার আগেই ছেলের হাত ধরিয়া অপু রানীদের বাড়ি ঢুকিয়া বলিল—কোথায় গেলে রানুদি, চিনতে পারো?…রানু ঘরের ভিতর হইতে ছুটিয়া আসিল, অবাক হইয়া খানিকক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া রহিল, বলিল—মনে করে যে এলি এতকাল পরে?—তা ও-পাড়ায় গিয়ে উঠলি কেন? গাঙ্গুলীরা আপনার লোক হল তোর?…পরে লীলাদির মতো সেও কাঁদিয়া ফেলিল।

    কি অদ্ভুত পরিবর্তন! অপুও অবাক হইয়া দেখিতেছিল, চোদ্দ বছরের সে বালিকা রানুদি কোথায়! বিধবার বেশ, বাল্যের সে লাবণ্যের কোনও চিহ্ন না থাকিলেও রানী এখনও সুন্দরী। কিন্তু এ যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত, শৈশব-সঙ্গিনী রানুদির সঙ্গে ইহার মিল কোথায়?…এই সেই রানুদি।

    সে কিন্তু সকলের অপেক্ষা আশ্চর্য হইল ইহাদের বাড়িটার পরিবর্তন দেখিয়া। ভুবন মুখুজ্যেরা ছিলেন অবস্থাপন্ন গৃহস্থ, হেলেবেলার সে আট-দশটা পোলা, প্রকাণ্ড চণ্ডীমণ্ডপ, গরুবাদুর, লোকজনের কিছু নাই। চণ্ডীমণ্ডপের ভিটা মাত্র পড়িয়া আছে, পশ্চিমের কোঠা ভাঙিয়া কাহারা ইট লইয়া গিয়াছে-বাড়িটার ভাঙা, ধ্বসা, ছন্নছাড়া চেহারা, এ কি অদ্ভুত পরিবর্তন?

    রানী সজল চোখে বলিল–দেখছিস কি, কিছু নেই আর। মা বাবা মারা গেলেন, টুনু, খুড়িমা এঁরাও গেলেন, সতুর মা-ও মারা গেল, সতু মানুষ হল না তো, এতদিন বিষয় বেচে বেচে চালাচ্ছে। আমরাও–

    অপু বলিল—হ্যাঁ, লীলাদির কাছে সব শুনলাম সেদিন কাশীতে–

    –কাশীতে? দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছে তোর? কবে–কবে?…

    পরে অপুর মুখে সব শুনিয়া সে ভারি খুশি হইল। দিদি আসিতেছে তাহা হইলে? কতকাল দেখা হয় নাই।

    রানী বলিল—বৌ কোথায়? বাসায়—তোর কাছে?

    অপু হাসিয়া বলিল—স্বর্গে।

    —ও আমার কপাল! কতদিন? বিয়ে করিস নি আর?…

    সেই দিনই আবার বৈকালে চড়ক। আর তেমন জাঁকজমক হয় না, চড়ক গাছ পুঁতিয়া কেহ ঘুরপাক খায় না। সে বালমন কোথায়, মেলা দেখার অধীর আনন্দে ছুটিয়া যাওয়া—সে মনটা আর নাই, কেবল সে-সব অর্থহীন আশা, উৎসাহ, অপূর্ব অনুভূতির স্মৃতিটা মাত্র আছে। এখন যেন সে দর্শক আর বিচারক মাত্র, চব্বিশ বৎসরে মনটা কেমন বদলাইয়া গিয়াছে, বাড়িছে—তাহারই একটি মাপকাঠি আজ খুঁজিয়া পাইয়া দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। চড়কতলায় পুরানো আমলের কত পরিচিত বন্ধু নাই, নিবারণ গোয়ালা লাঠি খেলিত, ক্ষেত্র কাপালি বহুরূপীর সাজ দিত, হাবান মাল বাঁশের বাঁশি বাজাইয়া বিক্রয় করিত, ইহারা কেহ আর নাই, কেবল পুরাতনের সঙ্গে একটা যোগ এখনও আছে। চিনিবাস বৈরাগী এখনও তেলেভাজা খাবারের দোকান করে।

    আজ চব্বিশ বছর আগে এই চড়কের মেলার পরদিনই তারা গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিলতারপর কত ঘটনা, কত দুঃখ বিপদ, কত নূতন বন্ধুবান্ধব সব, গোটা জীবনটাই কিন্তু কেমন করিয়া এত পরিবর্তনের মধ্য দিয়াও সেই দিনটির অনুভূতিগুলির স্মৃতি এত সজীব, টাটকা, তাজা অবস্থায় আজ আবার ফিরিয়া আসিল!

    সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। চড়কের মেলা দেখিয়া হাসিমুখে ছেলেমেয়েরা ফিরিয়া যাইতেছে, কারও হাতে বাঁশের বাঁশি, কারও হাতে মাটির রং করা ছোবা পালকি। একদল গেল গাঙ্গুলীপাড়ার দিকে, একদল সোনাডাঙা মাঠের মাটির পথ বাহিয়া, ছাতিমবনের তলায় ধুলজুড়ি মাধবপুরের খেয়াঘাটে চব্বিশ বছর আগে যাহারা ছিল ছোট, এই রকম মেলা দেখিয়া ভেঁপু বাজাইতে বাজাইতে তেলেভাজা, জিবেগজা হাতে ফিরিয়া গিয়াছিল, তাহারা অনেকদিন বড়ো হইয়া নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ঢুকিয়া পড়িয়াছে—কেউ বা মারা গিয়াছে; আজ তাহাদের ছেলেমেয়েদের দল ঠিক আবার তাহাই করিতেছে, মনে মনে আজিকাল এই নিষ্পাপ দায়িত্বহীন জীবনকোরকগুলিকে সে আশীর্বাদ করিল।

     

    বৈশাখের প্রথমেই লীলা তার দেওরের সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুরে আসিল। দুই বোনে অনেকদিন পরে দেখা, দুইজনে গলা জড়াইয়া কাঁদিতে বসিল। অপুকে লীলা বলিল—তোর মনে যে এত ছিল, তা তখন কি জানি? তোর কল্যাণেই বাপের ভিটে আবার দেখলুম, কখনও আশা ছিল না যে আবার দেখব।

    শোকর জন্য কাশী হইতে একরাশ খেলনা ও খাবার আনিয়াছে, মহা খুশির সহিত গড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়া সকলের সঙ্গে দেখাশুনা করিল।

    অপু বৈকালে ছেলেকে লইয়া নৌকায় খাবরাপোতার ঘাট পর্যন্ত বেড়াইতে গেল। তেঁতুলতলার ঘাটের পাশে দক্ষিণদেশের ঝিনুকতোলা বড়ো নৌকা বাঁধা ছিল, হাওয়ায় আলকাতরা ও গাবের রস মাখানো বড়ো ডিঙিগুলার শৈশবের সেই অতি পুরাতন বিস্মৃত গন্ধ…নদীর উত্তর পাড়ে ক্রমাগত নলন, ওকড়া ও বননবুডোর গাছ, ঢালু ঘাসের জমি জলের কিনারা ছুঁইয়া আছে, মাঝে মাঝে ঝিঙে পটলের ক্ষেতে উত্তরে মজুরেরা টোকা মাথায় নিড়ান দেয়, এক এক স্থানে নদীর জল ঘন কালো, নিথর, কলার পাটির মতো সমতল—যেন মনে হয়, নদী এখানে গহন, গভীর, অতলস্পর্শ,-ফুলে ভরা উলুখড়ের মাঠ, আকন্দবন, ভঁসা খেজুরের কাঁদি দুলানো খেজুর গাছ, উইটিবি, বকের দল, উঁচু শিমুল ডালে চিলের বাসা—সবাইপুরের মাঠের দিক হইতে বড়ো এক ঝাক শামকুট পাখি মধুখালির বিলের দিকে গেল–একটা বাবলাগাছে অজস্র বন-ধুধু ফল দুলিতে দেখিয়া থোকা আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল–ওই দেখো বাবা, সেই যে কলকাতায় আমাদের গলির মোড়ে বিক্রি হয় গায়ে সাবান মাখবার জন্যে, কত ঝুলছে দেখো, ও কি ফল বাবা?

    অপু কিন্তু নির্বাক হইয়া বসিয়া ছিল। কতকাল সে এসব দেখে নাই! পৃথিবীর এই মুক্ত রূপ তাহাকে যে আনন্দ দেয়, সে আনন্দ উগ্রবীর্য সুরার মতো নেশার ঘোর আনে তাহার শিরার রক্তে, তাহা অভিভূত করিয়া ফেলে, আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, তাহা অবর্ণনীয়। ইহাদের যে গোপন বাণী শুধু তাহারই মনের কানে কানে, মুখে তাহা বলিয়া বুঝাইবে সে কাহাকে?

    দুর গ্রামের জাওয়া-বাঁশের বন অস্ত-আকাশের রাঙা পটে অতিকায় লায়ার পাখির পুচ্ছের মতো খাড়া হইয়া আছে, একধারে খুব উঁচু পাড়ে সারিবাঁধা গাঙশালিকের গর্ত, কি অপূর্ব শ্যামলতা, এই সান্ধ্য শ্রী!

    কাজল বলিল— বেশ দেশ বাবা-না?

    —তুই এখানে থাক খোকা—আমি যদি রেখে যাই এখানে, থাকতে পারবি নে? তোব পিসিমার কাছে থাকবি, কেমন তো?

    কাজল বলিল-হা, ফেলে রেখে যাবে বইকি! আমি তোমার সঙ্গে যাব বাবা।

    অপু ভাবিতেছিল শৈশবে এই ইছামতী ছিল তার কাছে কি অপূর্ব কল্পনায় ভরা! গ্রামের মধ্যের বর্ষাদিনের জলকাদাভরা পথঘাট, বাঁশপাতা পচা আঁটাল মাটির গন্ধ থেকে নিষ্কৃতি পাইয়া সে মুক্ত আকাশের তলে নদীর ধারটিতে আসিয়া বসিত। কত বড়ো নৌকা ওর ওপর দিয়া দূর দেশে চলিয়া যাইত। কোথায় ঝালকাটি, কোথায় বরিশাল, কোথায় রায়মঙ্গল-অজানা দেশের কল্পনায় মুগ্ধ মনে কতদিন সে না ভাবিয়াছে, সেও একদিন ওই রকম নেপাল মাঝির বড়ো ডিঙিটা করিয়া নিরুদ্দেশ বাণিজ্যযাত্রায় বাহির হইয়া যাইবে।

    ইছামতী ছিল পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের মা। তার তীরের আকাশ-বাতাসের সংগীত মায়ের মুখের ঘুমপাড়ানি গানের মতো শত স্নেহে তার নব-মুকুলিত কচি মনকে মানুষ করিয়া তুলিয়াছিল, তার তীরে সে সময়ের কত আকাঙ্ক্ষা, বৈচিত্র্য, রোমান্স,-তার তীর ছিল দূরের অদেখা বিদেশ, বর্ষার দিনে এই ইছামতীর কূলে-কুলে ভরা ঢলঢল গৈরিক রূপে সে অজানা মহাসমুদ্রের তীরহীন অসীমতার স্বপ্ন দেখিত—ইংরাজী বই-এ পড়া Cape Nun-এর ওদিকের দেশটা—যে দেশ হইতে লোক আর ফেরে না—He who passes Cape Nun, will either return or not—মুগ্ধচোখে কুল-হাপানোর ইছামতী দেখিয়া তখন সে ভাবিত-ওঃ, কত বড়ো আমাদের এই গাঙটা!

    এখন সে আর বালক নাই, কত বড়ো বড়ো নদীর দুকূল-ছাপানো লীলা দেখিয়াছে—গঙ্গা, শোণ, বড়দল, নর্মদাতাদের অপূর্ব সন্ধ্যা, অপূর্ব বর্ণসম্ভার দেখিয়াছে—সে বৈচিত্র্য, সে প্রখরতা ইছামতীর নাই, এখন তার চোখে ইছামতী ছোট নদী। এখন সে বুঝিয়াছে তার গরিব ঘরের মা উৎসব-দিনের বেশভূষায় তার শৈশব-কল্পনাকে মুগ্ধ করিয়া দিত, এসব বনেদি বড়ো ঘরের মেয়েদের হীরামুক্তার ঘটা, বারাণসী শাড়ির রংটং-এর কাছে তার মায়ের সেই কাচের চুড়ি, শাঁখা কিছুই নয়।

    কিন্তু তা বলিয়া ইছামতীকে সে কি কখনও ভুলিবে?

     

    দুপুরে সে ঘরে থাকিতে পারে না। এই চৈত্রদুপুরের রোদের উষ্ণ নিঃশাস কত পরিচিত গন্ধ বহিয়া আনে-শুকনো বাঁশের খোলার, ফুটন্ত ঘেঁটুনের, ঝরাপাতার সোঁদা সোঁদা বোদপোড়া মাটির, নিম ফুলের, আরও কত কি কত কিবাল্যে এই সব দুপুর তাকে ও তাহার দিদিকে পাগল করিয়া দিয়া টো টো করিয়া শুধু মাঠে বাগানে, বাঁশতলায়, নদীর ধারে ঘুরাইয়া লইয়া বেড়াইত—আজও সেই রকমই পাগল করিয়া দিল। গ্রামসুদ্ধ সবাই দুপুরে ঘুমায়—সে একা বাহির হয়—উদভ্রান্তের মতো মাঠের ঘেঁটুফুলে ভরা উঁচু ডাঙায়, পথে পথে নিঝুম দুপুরে বেড়াইয়া ফেরে—কিন্তু তবু মনে হয়, বাল্যের স্মৃতিতে যতটা আনন্দ পাইতেছে, বর্তমানের আসল আনন্দ সে ধরনের নয়-আনন্দ আছে কিন্তু তাহার প্রকৃতি বদলাইয়া গিয়াছে। তখনকার দিনে দেবদেবীরা নিশ্চিন্দিপুরের বাঁশবনের ছায়ায় এই সব দুপুরে নামিয়া আসিতেন। এক একদিন সে নদীর ধারের সুগন্ধ তৃণভূমিতে চুপ করিয়া হাতে মাথা রাখিয়া শুইয়া থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কিছুই করে না, রৌদ্রভরা নীল আকাশের দিকে চাহিয়া শুধু চুপ করিয়া থাকে কিছু ভাবেও না…সবুজ ঘাসের মধ্যে মুখ ডুবাইয়া মনে মনে বলেওগো মাতৃভূমি, তুমি ছেলেবেলায় যে অমৃতদানে মানুষ করেছিলে, সেই অমৃত হল আমার জীবনপথের পাথেয়—তোমার বনের ছায়ায় আমার সকল স্বপ্ন জন্ম নিয়েছিল একদিন, তুমি আবার শক্তি দাও, হে শক্তিরূপিণী!

    দুঃখ হয় কলিকাতার ছাত্রটির জন্য। এদের বাপের বাড়ি বৌবাজারে, মামার বাড়ি পটুয়াটোলায়, পিসির বাড়ি বাগবাজারে—বাংলাদেশকে দেখিল না কখনও। এরা কি মাধবপুর গ্রামের উলুখড়ের মাঠের ওপারের আকাশে রং-ধরা দেখিল? স্তব্ধ শরৎদুপুরের ঘন বনানীর মধ্যে ঘুঘুর ডাক শুনিয়াছে? বন-অপরাজিতা ফুলের নীরব মহোৎসব ওদের শিশু-আত্মায় তার আনন্দের স্পর্শ দিয়াছে কোনও কালে? ছোট্ট মাটির ঘরের দাওযায় আসনপিড়ি হইয়া বসিয়া নারিকেল পত্ৰশাখায় জ্যোৎস্নার কাপন দেখে নাই কখনও—এরা অতি হতভাগ্য।

     

    রানীর যত্নে আদরে সে মুগ্ধ হইয়া গেল। সতুদের বাড়ির সে-ই আজকাল কর্ত্রী, নিজের ছেলেমেয়ে হয় নাই, ভাইপোদের মানুষ করে। অপুকে রানী বাড়িতে আনিয়া রাখিল-কাজলকে দুদিনে এমন আপন করিয়া লইয়া ফেলিয়াছে যে, সে পিসিমা বলিতে অজ্ঞান। রানীর মনে মনে ধারণা, অপু শহরে থাকে যখন, তখন খুব চায়ের ভক্ত,দুটি বেলা ঠিক সময়ে চা দিবার জন্য তাহার প্রাণপণ চেষ্টা। চায়ের কোন সরঞ্জাম ছিল না, লুকাইয়া নিজের পয়সায় সতুকে দিয়া নবাবগঞ্জের বাজার হইতে চায়ের ডিস পেয়ালা আনাইয়া লইয়াছে—অপু চা তেমন খায় না কখনও, কিন্তু এখানে সে সে কথা বলে না। ভাবে-যত্ন করছে রানুদি, করুক না। এমন যত্ন আর জুটবে কোথাও? তুমিও যেমন!

    দুপুরে একদিন খাইতে বসিয়া অপু চুপ করিয়া চোখ বুজিয়া বসিয়া আছে। রানীর দিকে চাহিয়া চাহিয়া হাসিয়া বলিল—একটা বড়ো চমৎকার ব্যাপার হল—দেখো, এই টকে-যাওয়া এঁচড়-চচ্চড়ি কতকাল খাই নি নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে আর কখনও নয়—তাই মুখে দিয়েই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল রানুদি—

    রানুদি বোঝে এসব কথা—তাই রানুদির কাছে বলিয়াও সুখ।

    এ কয়দিন আকাশটা ছিল মেঘ-মেঘ। কিন্তু হঠাৎ কখন মেঘ কাটিয়া গিয়াছে সে জানে না বৈকালে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া সে অবাক চোখে চুপ করিয়া বাহিরের রোয়াকে বসিয়া রহিল+বাল্যের সেই অপূর্ব বৈকাল—যাহার জন্য প্রথম প্রথম বিরহী বালক-মন কত হইয়াছে বিদেশ, ক্রমে একটা অস্পষ্ট মধুর স্মৃতিমাত্র মনে আঁকিয়া রাখিয়া যেটা কবে মন হইতে বেমালুম অন্ততি হইয়া গিয়াছিল—

    মনে পড়ে, ছেলেবেলায় এই সব সময়ে ঘুম ভাঙিয়া তাহার মনটা কেমন অকারণে খারাপ হইত এক একদিন এমন কান্না আসিত, বিছানায় বসিয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিত—তাহার মা ঘাট হইতে আসিয়া বলিত-ও-ওই উড়ে গেল—ও-ও ওই।…কেঁদো না থোকা, বাইরে এসে পাখি দেখসে। আহা-হা তোমার বড়ো দুখখু খোকন—তোমার নাতি মরেছে, পুতি মরেছে, সাত ডিঙে ধন সমুদুরে ডুবে গিয়েছে, তোমার বড় দুখখু—কেঁদো না, কেঁদো না, আহা হা!…

    রানী পাতকুয়া হইতে জল তুলিয়া আনিতে যাইতেছে, অপু বলিল—মনে পড়ে রানুদি, এই উঠানে এমন সব বিকেলে বৌ-চুরি খেলা খেলতুম কত, তুমি, আমি, দিদি, সতু, নেড়া?

    রানী বলিল—আহা, তাই বুঝি ভাবচিস বসে বসে! কত মালা গাঁথম মনে আছে বকুলতলায়? সারাদিন বকুলতলাতেই পড়ে আছি, আমি, দুগগা—আজকাল ছেলেমেয়েরা আর মালা গাঁথে না, বকুল ফুলও আর তেমন পড়ে থাকে না কালে কালে সবই যাচ্চে।

    কিছু পরে জল লইয়া ফিরিবার সময়ে বলিল—এক কাজ কর না কেন অপু, সতু তো তোদের নীলমণি জ্যাঠার দরুন জমাটা ছেড়ে দেবে, তুই কেন গিয়ে বাগানটা নিগে যা না? তোদেরই তো ছিল—ও যা, নিজের জমি-জমাই বিক্রি করে ফেললে সব, তা আবার জমার বাগান রাখবে—নিবি তুই?

    অপু বলিল,-মায়ের বড় ইচ্ছে ছিল, রানুদি। মরবার কিছুদিন আগেও বলত বড়ো হলে বাগানখানা নিস অপু। আমার আপত্তি নেই, যা দাম হবে আমি দেব।

    প্রতি সন্ধ্যায় সতুদের বোয়াকে মাদুর পাতা হয়, বানী, লীলা, অপু, ছেলেপিলেদের মজলিশ বসে। সতুও যোগ দেয়, তবে তামাকের দোকান বন্ধ কবিয়া আসিতে তাহার রাত হইয়া যায়। অপু বলে–আচ্ছা, আজকাল তোমরা ঘাটেব পথে যাড়াতলায় পিঠে দাও না রানুদি? কই সেই কঁড়াগাছটা তো নেই সেখানে? রানী বলে—সেটা মরে গিয়েছে—তার পাশেই একটা চারা, দেখিস নি সিঁদুব দেওয়া আছে?…নানা পুরানো কথা হয়। অপু জিজ্ঞাসা করে—ছেলেবেলায় একবার পঙ্গপালের দল এসেছিল, মনে আছে লীলাদি?, গ্রামে একটি বিধবা যখন নববধূরূপে এ গ্রামে প্রথম আসেন, অপু তখন ছেলেমানুষ। তিনিও সন্ধ্যার পবে এ বাড়িতে আসেন। অপু বলে—খুড়িমা, আপনি নতুন এসে কোথায় দুধে-আলতার পাথরে দাঁড়িয়েছিলেন মনে আছে আপনার?

    বিধবাটি বললেন—সে সব কি আব এ জন্মের কথা, বাবা? সে-সব কি আর মনে আছে?

    অপু বলে—আমি বলি শুনুন, আপনাদের দক্ষিণের উঠোনে যে নিচু গোয়ালঘরটা ছিল, তারই ঠিক সামনে।

    বিধবা মেয়েটি আশ্চর্য হইয়া বলেন-ঠিক, ঠিক, এখন মনে পড়েছে, এত দিনের কথা তোমার মনে আছে বাবা!

    তাদেরই বাড়ির আর এক বিবাহে কোথা হইতে তাঁদেব এক কুটুম্বিনী আসেন, খুব সুন্দরী এতকাল পর তার কথা উঠে। সবাই তাঁকে দেখিয়াছিল সে সময়, কিন্তু নামটা কাহারও মনে নাই এখন। অপু বলে-দাঁড়াও রানুদি, নাম বলছি—তার নাম সুবাসিনী।

    সবাই আশ্চর্য হইয়া যায়। লীলা বলে—তোর তখন বয়েস আট কি নয়, তোর মনে আছে তার নাম?—ঠিক, সুবাসিনীই বটে। সবারই মনে পড়ে নামটা।

    অপু মৃদু মৃদু হাসিমুখে বলে—আরও বলছি শোনো, ডুরে শাড়ি পরত, রাঙা জমির ওপর ডুরে দেওয়া-না?

    বিধবা বধুটি বলেন, ধন্যি বাপু যা হোক, রাঙা ডুরে পরত ঠিকই, বয়েস ছিল বাইশ-তেইশ। তখন তোমার বয়েস বহুর আষ্টেক হবে। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগেকার কথা যে!

    অপুর খুব মনে আছে, অত সুন্দরী মেয়ে তাদের গাঁয়ে আর আসে নাই ছেলেবেলায়। সে বলিল-রাঙা শাড়ি পরে আমাদের উঠোনের কাটালতলায় জল সইতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ছবিটা দেখতে পাচ্ছি এখনও।

    এখানকার বৈকালগুলি সত্যই অপূর্ব। এত জায়গায় তো সে বেড়াইল, মাসখানেক এখানে থাকিয়া মনে হইল এমন বৈকাল সে কোথাও দেখে নাই। বিশেষ করিয়া বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসের মেঘহীন এই বৈকালগুলিতে সূর্য যেদিন অন্ত যাইবার পথে মেঘাবৃত না হয়, শেষ রাঙা আলোটুকু পর্যন্ত বড়ো গাছের মগডালে, বাঁশঝাড়ের আগায় হালকা সিদুরের রং মাখাইয়া দেয়, সেদিনের বৈকাল। এমন বিশ্বফুলের অপূর্ব সুরভিমাননা, এমন পাখি-ডাকা উদাস বৈকাল—কোথায় এর তুলনা? এত বেলগাছও কি এদেশটায়, ঘাটে, পথে, এ-পাড়া, ও-পাড়া সর্বত্র বিষফুলের সুগন্ধ।

    একদিন—জ্যৈষ্ঠের প্রথমটা, বৈকালে আকাশ অন্ধকার করিয়া ঈশান কোণ হইতে কালবৈশাখীর মেঘ উঠিল, তারপরেই খুব ঝড়, এ বছরের প্রথম কালবৈশাখী। অপু আকাশের দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিল—তাদের পোডভিটার বাঁশবনের মাথার উপরকার দৃশাটা কি সুপরিচিত। বাল্যে এই মাথাদুলানো বাঁশঝাড়ের উপরকারের নীলকৃষ্ণ মেঘসজ্জা মনে কেমন সব অনতিস্পষ্ট আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগাইত, কত কথা যেন বলিতে চাহিত, আজও সেই মেঘ, সেই বাঁশবন, সেই বৈকাল সবই আছে, কিন্তু সে অপূর্ব জগৎটা আর নাই। এখন যা আনন্দ সে শুধু স্মৃতির আনন্দ মাত্র। এবার নিশ্চিন্দিপুর ফিরিয়া অবধি সে ইহা লক্ষ করিতেছে—এই বন, এই দুপুর এই গভীর রাত্রে চৌকিদারের হাঁকুনি, লক্ষ্মীপেঁচার ডাকের সঙ্গে কি এক অপূর্ব স্বপ্নমাখানো ছিল, দিগন্তরেখার ওপারের এক রহস্যময় কল্পলোক তখন সদা-সর্বদা হাতছানি দিয়া আহ্বান কবিত—তাদের সন্ধান আর মেলে না।

    সে পাখির দল মরিয়া গিয়াছে, তেমন দুপুর আর হয় না; যে চাঁদ এমন বৈশাখী রাত্রে খড়ের ঘরের দাওয়ার ধারের নারিকেল পত্রশাখায় জ্যোৎস্নার কম্পন আনিয়া এক ক্ষুদ্র কল্পনাপ্রবণ গ্রাম্য বালকের মনে মূলহীন, কারণহীন আনন্দের বান ডাকাইত, সে সব চাদ নিভিয়া গিয়াছে। সেই বালকটিই বা কোথায়? পঁচিশ বৎসব আগেকার এক দুপুরে বাপ-মায়ের সঙ্গে দেশ ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিল, আর ফেরে নাই, জাওয়া-বাঁশের বনের পথে তার ছোট ছোট পায়ের দাগ অস্পষ্ট হইয়া মুছিয়া গিয়াছে বহুদিন।

    তার ও তার দিদির সে সব আশা পূর্ণ হইয়াছিল কি?

    হায় অবোধ বালক-বালিকা!…

    বোজ বোজ বৈকালে মেঘ হয়, ঝড় ওঠে। অপু বলে, রানুদি, আম কুড়িয়ে আনি? রানী হাসে। অপু ছেলেকে লইয়া নতুন কেনা বাগানে আসিয়া দাঁড়ায়–সবাইকে আম কুড়াইতে ডাকে, কাহাকেও বাধা দেয় না। বাল্যের সেই পটুলে, তেঁতুলতলী, নেকো, বাঁশতলা,—ঘন মেঘের ছায়ায় জেলেপাড়ার তো আবালবৃদ্ধবনিতা ধামা হাতে আম কুড়াইতে আসে। অপু ভাবে, আহা, জীবনে এই এদের কত আনন্দেব কত সার্থকতার জিনিস। চারিধারে চাহিয়া দেখে, সমস্ত বাগানের তলাটা ধাবমান, কৌতুকপর, চিৎকার-রত বালক-বালিকাতে ভরিয়া গিয়াছে!

    দিদি দুর্গা, ছোট্ট মেয়েটি, এই কাজলের চেয়ে কিছু বড়ো, পরের বাগানে আম কুড়াইবার অপরাধে বকুনি খাওয়া কৃত্রিম উল্লাসভরা হাসিমুখে একদিন এই ফণিমনসার ঝোপের পাশের বেড়াটা গলিয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল—বহুকালের কথাটা।

    অপু কি করিবে আমবাগানে? এই সব গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা সাধ মিটাইয়া আম কুড়াইবে এ বাগানে, কেহ তাহাদের বারণ করিবার থাকিবে না, বকিবার থাকিবে না, অপমান করিবার থাকিবে না, ফণিমনসার ঝোপের আড়ালে অপমানিত ছোট্ট খুকিটি ধুলামাখা আঁচল গুছাইয়া লইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া মৃদু মৃদু তৃপ্তির হাসি হাসিবে…

    এত দিন এখানে আসিলেও নিজেদের ভিটাটাতে ঢুকিতে পারে নাই, যদিও বাহির শুতে সেটা প্রতিদিনই দেখিত; কারণ ঘাটের পথটা তার পাশ দিয়াই। বৈকালের দিকে সে একদিন এক চুপি চুপি বনজঙ্গল ঠেলিয়া সেখানে ঢুকিল। বাড়িটা আর নাই, পড়িয়া ইট সুপাকার হইয়া আছে—সতাপাতা, শ্যাওড়ান, বনচালতার গাছ, ছেলেবেলাকার মতো কালমেঘের জঙ্গল। পিছনের বাঁশঝাড়গুলা এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাড়িয়া চারিধারে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে।

    কোনও ঘরের চিহ্ন নাই, বনজঙ্গল, রাঙা রোদ বাঁশের মগডালে। পশ্চিমের পাচিলের গায়ে সেই কুলুঙ্গিটা আজও আছে, ছেলেবেলায় যে কুলুঙ্গিটাতে সে ভাটা, বাতাবিলেবুর বল, কড়ি রাখিত। এত নিচু কুলুঙ্গিটা তখন কত উঁচু বলিয়া মনে হইত, তাহার মাথা ছাড়াইয়া উঁচু ছিল, ডিঙাইয়া দাঁড়াইলে তবে নাগাল পাওয়া যাইত! ঠেস-দেওয়ালের গায়ে ছুরি দিয়া ছেলেবেলায় একটা ভূত আঁকিয়াছিল, সেটা এখনও আছে। পাশেই নীলমণি জ্যাঠামশায়ের পোডভিটা—সেও ঘন বনে ভরা, চারিধার নিঃশব্দ, নির্জন—এ পাড়াটাই জনহীন হইয়া গিয়াছে, এধার দিয়া লোকজনের যাতায়াত বড়ো কম। এই সে স্থানটি, কতকাল আগে যেখানে দিদি ও সে একদিন চড়ুইভাতি করিয়াছিল! কণ্টকাকীর্ণ শেয়াকুল বনে দুর্গম দুর্ভেদ্য হইয়া পড়িয়াছে সারা জায়গাটা। পোড়োভিটার সে বেলগাছটা—একদিন যার তলায় ভীষ্মদেব শরশয্যা পাতিতেন তাহার নয় বৎসরের শৈশবে সেটা এখনও আছে, পুষ্পিত শাখা-প্রশাখার অপূর্ব সুবাসে অপরাহ্ণে বাতাস মিন্ধ করিয়া তুলিয়াছে।

    পাঁচিলের ঘুলঘুলিটা কত নিচু বলিয়া মনে হইতেছে, এইটাতেই অপু আশ্চর্য হইল—বার বার কথাটা তার মনে হইতেছিল। কত ছোট ছিল সে তখন! খোকার মতো অতটুকু বোধ হয়।

    কাঁচাকলায়ের ডালের মতো সেই কি লতার গন্ধ বাহির হইতেছে!…কতদিন গন্ধটা মনে ছিল, বিদেশে আর সব কথা হয়তো মনে পড়িতে পারে, কিন্তু পুরাতন দিনের গন্ধগুলা তো মনে পড়ে না–

    এ অভিজ্ঞতাটা অপুর এতদিন ছিল না। সেদিন বাঁওড়ের ধারে বেড়াইতে গিয়া পাকা বটফলের গন্ধে অনেকদিনের একটা স্মৃতি মনে উদয় হইয়াছিল—ছোট্ট কাচের পরকলা বসানো মোমবাতির সেকেলে লণ্ঠন হাতে তাহার বাবা শশী যোগীর দোকানে আলকাতবা কিনিতে আসিয়াছে—সেও আসিয়াছে বাবাব কাঁধে চড়িয়া বাবার সঙ্গে—কাচের লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো, আধঅন্ধকার বাঁশবন, বাঁওড় হইতে নাল ফুল তুলিয়া বাবা তাহার হাতে দিয়াছে—কোন্ শৈশবের অস্পষ্ট ছবিটা, অবাস্তব, ধোঁয়া-ধোঁযা! পাকা বটফলের গন্ধে কতকাল পরে তাহার সেই অত্যন্ত শৈশবের একটা সন্ধ্যা আবার ফিরিয়া আসিয়াছিল সেদিন।

    পোড়াভিটার সীমানায় প্রকাণ্ড একটা খেজুর গাছে কাঁদি কাঁদি ডাঁসা খেজুর ঝুলিতেছে—এটা সেই চারা খেজুর গাছটা, দিদি যার ডাল কাটারি দিয়া কাটিয়া গোড়ার দিকে দড়ি বাঁধিয়া খেলাঘবের গরু করিত—কত বড়ো ও উঁচু হইয়া গিযাছে গাছটা!

    এইখানে খিড়কিদোরটা ছিল, চিহ্নও নাই কোনও! এইখানে দাঁড়াইয়া দিদির চুরি-করা সেই সোনার কৌটাটা ঘুড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছিল একদিন। কত সুপরিচিত জিনিস এই দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর আজও আছে! রাঙী গাইয়ের বিচালি খাওয়ার মাটির নাদাটা কাটালতলায় বাঁশপাতা ও মাটি বোঝাই হইয়া এখনও পড়িয়া আছে। ছেলেবেলায় ঠেস দেওয়াল গাঁথার জন্য বাবা মজুর দিয়া এক জায়গায় ইট জড়ো করিয়া রাখিয়াছিলেন…অর্থাভাবে গাঁথা হয় নাই। ইটগুলা এখনও বাঁশবনের ছায়ায় তেমনি পড়িয়া আছে। কতকাল আগে মা তাকের উপর জলদানে পাওয়া মেটে কলসী তুলিয়া রাখিয়াছিল, সংসারের প্রয়োজনের জন্য–পড়িয়া মাটিতে অর্ধপ্রোথিত হইয়া আছে। সকলের অপেক্ষা সে যেন অবাক হইয়া গেল…পাঁচিলের সেই ঘুলগুলিটা আজও নতুন অবিকৃত অবস্থায় দেখিয়া-বালিচুন একটুও খসে নাই, যেন কালকের তৈরি-এই জঙ্গল ও ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কি হইবে ও কুলুঙ্গিতে?

    খিড়কিদোরের পাশে উঁচু জমিটাতে মায়ের হাতে পোতা সজনে গাছ এখনও আছে। যাইবার বছরখানেক আগে মাত্র মা ডালটা পুঁতিয়াছিল—এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে গাছটা বাড়িয়া বুড়া হইয়া গিয়াছে-ফল খাইতে আর কেহ আসে না—জঙ্গলে ঢাকিয়া পড়িয়া আছে এতকাল–অপরাহের রাঙা বোদ গাছটার গায়ে পড়িয়া কি উদাম, বিষাদ-মাখা দৃশ্যটা ফুটাইয়াছে যে…ছায়া ঘন হইয়া আসে, কাঁচাকলায়ের ডালের মতো সেই লতাটার গন্ধ আরও ঘন হয়—অপুর শরীর যেন শিহরিয়া ওঠে—এ গন্ধ তো শুধু গন্ধ নয়—এই অপরাহু, এই গন্ধের সঙ্গে জড়ানো আছে মায়ের কত রাত্রের আদরের ডাক, দিদির কত কথা, বাবার পদাবলী গানের সুর, বাল্যের ঘরকন্নার সুধাময় দারিদ্র্য–কত কি—কত কি–

    ঘন বনে ঘুঘু ডাকে, ঘুঘু—ঘু–

    সে অবাক চোখে রাঙাবোদ মাখানো সজনে গাছটার দিকে আবার চায়-মনে হয় এ বন, এ স্তুপাকার ইটের রাশি, এ সব স্বপ্ন—এখনই মা ঘাট হইতে সন্ধ্যায় গা ধুইয়া ফিরিয়া ফরসা কাপড় পরিয়া ভিজা কাপড়খানা উঠানের বাঁশের আলনায় মেলিয়া দিবে, তারপরে প্রদীপ হাতে সন্ধ্যা দিতে দিতে তাহাকে দেখিয়া থমকাইয়া দাঁড়াইয়া বিস্মিত অনুযোগের সুরে বলিয়া উঠিবে—এত সন্ধে করে বাড়ি ফিরলি অপু?

    ভিটার চারিদিকে খোলামকুচি, ভাঙা কলসী; কত কি ছড়ানো-ঠাকুরমায়ের পোডোভিটাতে তো পা রাখিবার স্থান নাই, বৃষ্টির বোয়াটে কতদিনের ভাঙা খারা, খোলামকুচি বাহির হইয়াছে। এগুলি অপুকে বড়ো মুগ্ধ করিল, সে হাতে করিয়া তুলিয়া দেখিতে লাগিল। কতদিনের গৃহস্থ জীবনের সুখ দুঃখ এগুলার সঙ্গে জড়ানো! মা পিছনের বাঁশবনে এক জায়গায় সংসারের হাঁড়িকুড়ি ফেলিত, সেগুলি এখনও সেইখানেই আছে। একটা আস্কে-পিঠে গড়িবার মাটির মুচি এখনও অভগ্ন অবস্থায় আছে। অপু অবাক হইয়া ভাবে, কোন্ আনন্দভরা শৈশব সন্ধ্যার সঙ্গে ওর সম্বন্ধ ছিল না জানি! উঠানের মাটির খোলামকুচির মধ্যে সবুজ কাচের চুড়ির টুকরা পাওয়া গেল। হয়তো তার দিদির হাতের চুড়ির টুকরা।—এ ধরনের চুড়ি ছোট মেয়েরাই পরে—টুকরাটা সে হাতে তুলিয়া লইল। এক জায়গায় আধখানা বোতল ভাঙা-ছেলেবেলায় এ ধরনের বোতলে মা নারিকেল তৈল রাখিত—হয়তো সেটাই।

    একটা দৃশ্য তাকে বড়ো মুগ্ধ করিল। তাদের রান্নাঘরের ভিটার ঠিক যে কোণে মা রাধিবার হাঁড়িকুড়ি রাখিত-সেখানে একখানা কড়া এখনও বসানো আছে, মরিচা ধবিয়া বিকৃত হইয়া গিয়াছে, আংটা খসিয়া গিয়াছে, কিন্তু মাটিতে বসিয়া যাওয়ার দরুন একটুও নড়ে নাই।

    তাহারা যেদিন রান্না খাওয়া সাবিয়া এ গাঁ ছাড়িয়া রওনা হইয়াছিল—আজ চব্বিশ বৎসর পূর্বে, মা এঁটো কড়াখানাকে ওখানেই বসাইয়া রাখিয়া চলিয়া গিয়াছিল—কে কোথায় লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু ওখানা ঠিক আছে এখনও।

    কত কথা মনে ওঠে। একজন মানুষের অন্তরতম অন্তবের কাহিনী কি অন্য মানুষ বোঝে। বাহিরের মানুষের কাছে একটা জঙ্গলে ভরা পোডোভিটা মাত্ৰ-মশার ডিপো। তুচ্ছ জিনিস। কে বুঝিবে চব্বিশ বৎসর পূর্বের এক দরিদ্র ঘরের অবোধ বালকের জীবনের আনন্দ-মুহূর্তগুলির সহিত এ জায়গার কত যোগ ছিল?

    ত্রিশ, পঞ্চাশ, একশা, হাজার, তিন হাজার বছর কাটিয়া যাইবে—তখন এ গ্রাম লুপ্ত হইবে, ইচ্ছামতই চলিয়া যাইবে, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সভ্যতা, নতুন ধরনের রাজনৈতিক অবস্থা—যাদের বিষয় এখন কল্পনা করিতেও কেহ সাহস করে না, তখন আসিবে জগতে! ইংরেজ জাতির কথা প্রাচীন ইতিহাসের বিষয়ীভূত হইয়া দাঁড়াইবে, বর্তমান বাংলা ভাষাকে তখন হয়তো আর কেহ বুঝিবে না, একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়া সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ভাষা এদেশে প্রচলিত হইবে।

    তখনও এই রকম বৈকাল, এই রকম কালবৈশাখী নামিবে তিন হাজার বর্ষ পরের বৈশাখ দিনের শেষে! তখনও এই রকম পাখি ডাকিবে, এই রকম চাঁদ উঠিবে। তখন কি কেহ জাবিবে তিনহাজার বছর পূর্বের এক বিস্মৃত বৈশাখী বৈকালের এক গ্রাম্যবালকের ক্ষুদ্র জগৎট এই রকম বৃষ্টির গন্ধে, ঝোড়ো হাওয়ায় কি অপূর্ব আনন্দে দুলিয়া উঠিত—এই স্নিগ্ধ অপরাহু তার মনে কি আনন্দ, আশা-আকাক্ষা জাগাইয়া তুলিত? তিন হাজার বছরের প্রাচীন জ্যোস্না একদিন কোন মায়াবগ্ন তাহার শৈশবমনে ফুটাইয়া তুসিয়াছিল? নিঃশব্দে শরৎ দুপুরে বনপথে ক্রীড়ারত সে ক্ষুদ্র নয় বৎসরের বালকের মনের বিচিত্র অনুভূতিরাজির ইতিস কোথায় লেখা থাকিবে? কোথায় লেখা থাকিবে, বিস্মৃত অতীতে তার সে সব আনন্দভরা জীবনযাত্রা, বিদেশ হইতে বহুদিন পরে বাড়ি ফিরিয়া মায়ের হাতে বেলের শরবৎ খাওয়ার সে মধুময় চৈত্র অপরাছুটি, বাঁশ বনের ছায়ায় অপরাহের নিদ্রা ভাঙিয়া পাপিয়ার সে মনমাতানো ডাক, কোথায় লেখা থাকিবে বর্ষাদিনের বৃষ্টিসিক্ত রাত্রিগুলির সে সব আনন্দকাহিনী।

    দুর ভবিষ্যতের যেসব তরুণ বালকবালিকার মনে এই সব কালবৈশাখী নব আনন্দের বার্তা আনিবে, কোন্ পথে তারা আসিবে?

    বাহির হইয়া আবার সে ফিরিয়া চাহিল।

    সারা ভিটার উপর আসন্ন সন্ধ্যা এক অদ্ভুত, করুণামাখা ছায়া ফেলিয়াছে, মনে হয়, বাড়িটার এই অপূর্ব বৈকাল কাহার জন্য বহুকাল অপেক্ষা করিয়া ক্লান্ত জীর্ণ, অবসন্ন ও অনাসক্ত হইয়া পড়িয়াছে—আর সাড়া দেয় না, প্রাণ আর নাই।

    বার বার করিয়া ঘুলঘুলিটার কথা মনে পড়িতেছিল। ঘুলঘুলি দুটা এত ভালো আছে এখনও, অথচ মানুষেরাই গেল চলিয়া!

    সে নিশ্চিন্দিপুরও আর নাই। এখন যদি সে এখানে আবার বাসও করে সে অপূর্ব আনন্দ আর পাইবে না—এখন সে তুলনা করিতে শিখিয়াছে, সমালোচনা করিতে শিখিয়াছে, ছেলেবেলায় যারা ছিল সাথী—এখন তাদের সঙ্গে আর অপুর কোনদিকেই মিশ খায় না তাদের সঙ্গে কথা কহিয়া আর সে সুখ নাই, তারা লেখাপড়া শিখে নাই, এই পঁচিশ বৎসরে গ্রাম ছাড়িয়া অনেকেই কোথাও যায় নাই—সবারই পৈতৃক কিছু জমি-জমা আছে, তাহাই হইয়াছে তাদের কাল। তাদের মন, তাদের দৃষ্টি পঁচিশ বৎসর পূর্বের সেই বাল্যকালের কোঠায় আজও নিশ্চল।…কোন দিক হইতেই অপুর আর কোন যোগ নাই তাহাদের সহিত। বাল্যে কিন্তু এসব দৃষ্টি খোলে নাই-—সব জিনিসের উপর একটা অপরিসীম নির্ভরতার ভাব ছিল—সব অবস্থাকেই মানিয়া লইত বিনা বিচারে। সত্যকার জীবন তখনই যাপন করিয়াছিল নিশ্চিন্দিপুরে।

    তাহা ছাড়া বাল্যের সুপরিচিত ও অতি প্রিয় সাথীদের অনেকে বাঁচিয়া নাই। বোষ্টম দাদু নাই, জ্যাঠাইমা-রানুদির মা নাই, আশালতাদি বিবাহের পর মরিয়া গিয়াছে, পটু এদেশ হইতে উঠিয়া গিয়া অন্য কোথায় বাস করিতেছে, নেড়া, রাজু রায়, প্রসন্ন গুরুমশায় কেহই আর নাই—স্বামী মারা যাওয়ার পরে গোকুলের বউ খুড়িমাকে ঠাহার ভাই আসিয়া লইয়া গিয়াছে-দশ বারো বৎসর তিনি এখানে আসেন নাই, বাঁচিয়া আছেন কিনা কেহ জানে না।

    তবু মেয়েদের ভালো লাগে। রানুদি, ও-বাড়ির খুড়িমা, রাজলক্ষ্মী, লীলাদি, এরা স্নেহে, প্রেমে, দুঃখে, শোকে যেন অনেক বাড়িয়াছে, এতকাল পরে অপুকে পাইয়া ইহারা সকলেই খুশি, কথায় কাজে এদের ব্যবহার মধুর ও অকপট। পুরাতন দিনের কথা ওদের সহিত কহিয়া সুখ আছেবহুকালের খুটিনাটি কথাও মনে রহিয়াছে—হয়তো বা জীবনের পরিধি ইহাদের সংকীর্ণ বলিয়াই, ক্ষুদ্র বলিয়াই এতটুকু তুচ্ছ জিনিসও আঁকড়াইয়া রাখিয়াছে।

    আজ সে একথা বুঝিয়াছে, জীবনে অনবরত বিরুদ্ধ অবস্থার সঙ্গে লড়াই করিয়া চলিতে হইয়াছিল বলিয়াই আজ সে যাহা পাইয়াছে—এখানে পৈতৃক জমিজমার মালিক হইয়া নির্ভাবনায় বসিয়া থাকিলে তাহা পাইত না। আজ যদি সে বিদেশে যায়, সমুদ্রপারে যায়—যে চোখ লইয়া সে যাইবে, নিশ্চিন্দিপুরে গত পঁচিশ বৎসর নিষ্ক্রিয় জীবন-যাপন করিলে সে চোখ খুলিত না। একদিন নিশ্চিন্দিপুরকে যেমন সে সুখ-দুঃখ দ্বারা অর্জন করিয়াছিল—আজ তেমনি সুখ-দুঃখ দিয়া বাহিরকে অর্জন করিয়াছে।

    নদীতে গা ধুইতে গিয়া নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় এইসব কথাই সে ভাবিতেছিল। সারাদিনটা আজ গুমট গরম, প্রতিপদ তিথি-কাল গিয়াছে পূর্ণিমা। আজ এখনই জ্যোৎস্না উঠিবে।

    এই নদীতে ছেলেবেলায় যে-সব বধূ জল লইতে আসিত, তারা এখন প্রৌঢ়, কত নাইও–মরিয়া হাজিয়া গিয়াছে, যে-সব কোকিল সেই ছেলেবেলাকার রামনবমী দিনের পুলকমুহূর্তগুলি ভরাইয়া দুপুরে কু কু ডাক দিত, কচিপাতা-ওঠা বাঁশবনে তাদের ছেলেমেয়েরা আবার তেমনি গায়।

     

    শুধু তাহার দিদি শুইয়া আছে। রায়পাড়ার ঘাটের ওধারে ওই প্রাচীন ছাতিম গাছটার তলায় তাহাদের গ্রামের শ্মশান, সেখানে। সে-দিদির বয়স আর বাড়ে নাই, মুখের তারুণ্য বিলুপ্ত হয় নাই তার কাচের চুড়ি, নাটাফলের পুটুলি অক্ষয় হইয়া আছে এখনও। প্রাণের গোপন অন্তরে যেখানে অপুর শৈশবকালের কাঁচা শিশুমনটি প্রবৃদ্ধ জীবনের শত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, উচ্চাশা ও কম্যুপের নিচে চাপা পড়িয়া মরিয়া আছে—সেখানে সে চিরবালিকা, শৈশব জীবনের সে সমাধিতে জনহীন অন্ধকার রাত্রে সেই আসিয়া নীরবে চোখের জল ফেলে—শিশু প্রাণের সাথীকে আবার খুঁজিয়া ফেরে।

    আজ চব্বিশ বৎসর ধবিয়া সাঁঝ সকালে তার আশ্রয়স্থানটিতে সোনার সূর্যকিরণ পড়ে। বর্ষাকালের নিশীথ মেঘ ঝর ঝর জল ঢালে, ফান দিনে ঘেঁটুফুল, হেমন্ত দিনে ছাতিমফুল ফোটে। জ্যোৎস্না উঠে। কত পাখি গান গায়। সে এ সবই ভালোবাসিত। এ সব ছাড়িয়া যাইতে পারে নাই কোথাও।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবযান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }