Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অপারেশন ওয়ারিস্তান – ইন্দ্রনীল সান্যাল

    ইন্দ্রনীল সান্যাল এক পাতা গল্প166 Mins Read0

    ৫. কাহিনি (অপারেশন ওয়ারিস্তান)

    কোচি বিমানবন্দর থেকে কলকাতা বিমানবন্দর। ২ অক্টোবর। ভোর পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ থেকে দুপু বারোটা।

    .

    সরকারি এয়ারলাইনসের ক্যাটল ক্লাস। এত সকালেও গাদাগাদি ভিড়। চেক ইন পর্ব চুকিয়ে প্লেনে উঠে অপূর্ব কুমার রায় ওরফে এ কে রে ওরফে রকি দেখল উইন্ডো সিট পেয়েছে। আইল সিটে বসে রোগাটে একটা মেয়ে। বিমানবালার চোখরাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে মোবাইলে বকবক করে যাচ্ছে। প্লেন দৌড় শুরু করার পরে বকবকানি থামিয়ে হঠাৎ রকির দিকে ঘুরে বলল, ‘বাঙালি?’

    কী বিপদ! কথা বলতে হবে নাকি? রিস্ক না নিয়ে রকি বলল, ‘ইয়াপ! অ্যান্ড ইয়ু?’

    ‘আই অ্যাম ফ্রম কেরালা। আই অ্যাম ডুইং জার্নালিজম ফ্রম ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি। ইউ লুক লাইক আওয়ার প্রফেসার। শর্ট, স্পেকট্যাকলড, লিন অ্যান্ড থিন…’

    ‘আই হোপ ইটস আ কমপ্লিমেন্ট।’ জানলার দিকে ফিরে বলল রকি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে রকি পরিচিত মুখ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কখনও-কখনও প্রেস কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করতে হয়। ভেবেচিন্তে অল্প একটু ছদ্মবেশ ধরেছে রকি। সেনাপ্রধানের পোশাকের বদলে জিনস আর টি শার্ট, চওড়া বেল্ট, পায়ে স্নিকার। ক্রুকাট চুলে জেল দিয়ে সিঁথি কাটা। চোখে মোটা, কালো ফ্রেমের চশমা। এতেই ভোলবদল হয়ে গেছে। ফ্লাইটে ট্রাভেল করছে বলে প্রস্থেসিস ব্যবহারের রিস্ক নেয়নি।

    হবু জার্নালিস্ট চিনতে পারেনি যখন, পাবলিকও পারবে না। গ্লক আগ্নেয়াস্ত্রটি দিপুর জিন্মায় ছেড়ে এসেছে রকি। এয়ারপোর্টে তাকে নিতে আসবে বিট্টু নামের একটি ছেলে। দিপুর মতো সে-ও ওয়ারিস্তান মিলিটারির পে-রোলে থাকা ভারতীয়।

    রকির হ্যান্ডলাগেজ বলতে ব্যাকপ্যাক আর পাউচ। ব্যাকপ্যাক ওপরের দেরাজে তুলে আরামসে ঘুম দিল রকি।

    নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তজার্তিক বিমানবন্দরে প্লেন ল্যান্ড করার পরে মালয়ালি মেয়েটিকে এগোতে দিল রকি। ওর সঙ্গে কথা বলার কোনও ইচ্ছে নেই। অতি উৎসাহী ফার্স্ট-টাইম ট্রাভেলার, যারা প্লেন ল্যান্ড করার আগেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে; আর ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার, যারা ভিড় কমার পরে নামবে; এই দুই দলের মাঝামাঝি, কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে সকাল পৌনে এগারোটার সময় প্লেন থেকে নামল এ কে রে। ওরফে রকি। গাঁধী জয়ন্তীর কলকাতা, ২ অক্টোবরের কলকাতা হালকা হিমের পরশ বুলিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাল।

    বাসে চেপে মেন বিল্ডিং-এ পৌঁছে কোনওদিকে না তাকিয়ে হাঁটা দিল রকি। হাঁটতে হাঁটতে এয়ারপোর্টের দেওয়ালে ঝোলানো প্ল্যাজমা টিভির দিকে চোখ চলে গেল। লাগেজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা টিভির দিকে তাকিয়ে। বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ হল, ‘সিভিল ওয়ার ইন ওয়ারিস্তান।’

    ইংল্যান্ড, ইউএসএ-র খবর কখনও বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওরা প্রোপ্যাগান্ডা মেশিনের কাজ করে। ওয়ারিস্তানে গৃহযুদ্ধ বাধেনি, এ বিষয়ে নিশ্চিত রকি। তা-ও লাগেজ নেওয়ার অছিলায় কনভেয়র বেল্টের পাশে দাঁড়াল। চোখ এবং কান টিভির পর্দায়।

    অ্যাঙ্কর বলছে, ‘ওয়ারিস্তানে আবার গৃহযুদ্ধ! প্রধানমন্ত্রী মায়া মল্লিকের নেতৃত্বে পিছিয়ে পড়া দেশটি যখন একটু একটু করে সামনের দিকে এগোচ্ছে, তখন ওয়ারিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বে দেশব্যাপী বড়সড় সংর্ঘষ ঘটে গেল।’

    সংঘর্ষ? রকির ভুরু কুঁচকে গেল। মাত্র সাতচল্লিশ ঘণ্টা আগে সে দেশ ছেড়েছে, এর মধ্যে বড়সড় সংঘর্ষ?

    ‘ডাব্লিউডিপি-র সেক্রেটারি, ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদের অন্যতম দাবিদার রাজু মন্ডল তিরিশে সেপ্টেম্বর রাত থেকে নিখোঁজ। প্রধান স্তম্ভের অনুপস্থিতিতে দলে প্রবল বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। সেন্ট্রাল এবং ইস্টার্ন প্রভিন্সে দলীয় সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে দশটি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।’

    দশটা মৃত্যু নিয়ে এত? বিরক্ত মুখে রকি লাগেজ খোঁজার অভিনয় চালিয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে ওয়ারিস্তানে রোজ একশোটা লাশ পড়ে। নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরলে সেটাকে নিয়ে নাচনকোঁদন করে মিডিয়ার কী লাভ কে জানে?

    অ্যাঙ্কর বলছে, ‘কানহাইয়া ময়দানে ওয়ারিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিশাল জনসমাবেশে পার্টির কেন্দ্রীয় স্তরের এক নেতা দাবি করেছেন, তাঁর কাছে প্রমাণ আছ যে ইন্ডিয়ার রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা ”র” ওয়ারিস্তানের মাটিতে একজন এজেন্টকে প্ল্যান্ট করেছে, যে রাজুকে হত্যা করবে। এই ব্যাপারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মায়া মল্লিকের পরোক্ষ মদত আছে বলেও দাবি করছেন তিনি।’

    রকি দাঁত কিড়মিড় করে ভাবল, জিয়াকে একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল। সেটা সে পালন করছে না কেন?

    ‘উই হ্যাভ গট অ্যানাদার ব্রেকিং নিউজ ফর ইউ। ওয়েট আ মিনিট…’ কানে লাগানো টকব্যাকে বক্তব্য শুনতে শুনতে বলছে অ্যাঙ্কর, ‘ইয়াপ! আই গেট ইট!’

    টেলিভিশনের পরদায় এখন সেনাবাহিনীর ছবি। তারা কানহাইয়া ময়দান ঘিরে ফেলেছে। প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে মিটিং করছিল ডাব্লিউডিপি-র সমর্থকরা। একে ৪৭ দেখিয়ে সেনারা তাদের গ্রেফতার করছে। একে ৪৭, অর্থাৎ অ্যাভটোম্যাট কালাশনিকোভা ফর্টি সেভেন। অ্যাসল্ট রাইফেলের লিস্টে আজও এই রাইফেল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রকি খেয়াল করল, সবার হাতে একে ৪৭ থাকলেও জিয়ার হাতে এম সিক্সটিন। সেনাপ্রধান বেটার কোয়ালিটির রাইফেল নিয়ে বেরিয়েছে।

    হ্যান্ডমাইক নিয়ে ট্রাকের উপরে উঠল জিয়া। কঠিন মুখে বলল, ‘ওয়ারিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য ডাব্লিউডিপি-র সমস্ত সদস্যকে গ্রেফতার করা হল। এই মুহূর্ত থেকে ওয়ারিস্তানে সেনাবাহিনীর শাসন চালু হল। গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি যারা তৈরি করেছে, যারা মায়া মল্লিকের দালাল, যারা ইন্ডিয়ার দালাল, তাদের জন্য রইল…’ কথা শেষ না করে এম সিক্সটিন আকাশের দিকে তুলে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করল জিয়া, ‘র‌্যাট-ট্যাট-ট্যাট-ট্যাট-ট্যাট!’ সেনাবাহিনীর সবাই যন্ত্রের মতো একে ৪৭ আকাশের দিকে তুলে ফায়ার করল, ‘র‌্যাট-ট্যাট-ট্যাট-ট্যাট-ট্যাট!’

    ‘গুড!’ দাঁতের ফাঁকে বিড়বিড় করল রকি। ওয়ারিস্তান ছাড়ার আগে সে আর নিসিম গ্রিনবার্গ মিলে এই প্ল্যানটাই করেছিল। জিয়াকে বলা হয়েছিল দেশে মিলিটারি শাসন চালু করতে। অ্যাট এনি কস্ট। ডাব্লিউডিপি-র সমর্থকরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করায় জিয়ার সুবিধেই হল। কিন্তু এর পরে আর একটা ধাপ আছে। সেইটা জিয়া কীভাবে ইমপ্লিমেন্ট করবে?

    টিভিতে জিয়ার গলা, ‘ওয়ারিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান হিসেবে আমি, জিয়া চৌধুরী, মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বকে জানাতে চাই যে…’ নাটকীয় পজ নিয়েছে জিয়া।

    রকি অবাক হয়ে জিয়াকে দেখছে। দেখছে জিয়ার এক্সপ্রেশান। সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড থেকে আর্মির প্রধান হওয়ার পরে জিয়ার বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বদলে গেছে। রকি দেখছে, ক্ষমতা কীভাবে মানুষকে বদলে দেয়। দেখছে, রুমাল কীভাবে বেড়াল হয়ে যায়।

    নাটকীয় পজের শেষে জিয়া ডিক্লেয়ার করে, ‘রাজুর আত্মগোপনের জন্য দায়ী প্রধানমন্ত্রী মায়া মল্লিক। মায়া ভেবেছে, ইন্ডিয়ার সঙ্গে সাঁট করে রাজুকে ভোটের আগে সরিয়ে দিয়ে সে আবার জিতবে। কিন্তু ওয়ারিস্তানের মানুষ বোকা নয়।’

    আবার একপ্রস্থ ‘র‌্যাট-ট্যাট-ট্যাট-ট্যাট!’

    রকি বুঝতে পারছে, তার এখনই বেরিয়ে যাওয়া উচিত। বিমান থেকে নামার পরে এতক্ষণ কেউ বিমানবন্দরের ভিতরে থাকে না। সিআইএসএফ জেরা শুরু করলে বিপদ হবে। কিন্তু রকি নড়তে পারছে না। তার পা দুটো আঠা দিয়ে টিভির সামনে আটকানো রয়েছে। অবশ্য একথা ঠিক যে অন্যান্য প্যাসেঞ্জাররাও টিভির সামনে থেকে নড়েনি। রকি টিভির দিকে তাকিয়ে রইল।

    ‘আমি জিয়া চৌধুরী, সেনাবাহিনীর প্রধান, ইন্ডিয়াকে চেতাবনি দিচ্ছি, আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে, রাজু মণ্ডল কোথায় আত্মগোপন করে আছেন। ওয়ারিস্তানের নামে শপথ করছি, এই চেতাবনি বানানো নয়। এই লড়াই ওয়ারিস্তানের শেষ লড়াই। আমাদের অস্ত্র-ভাণ্ডারে নিউক্লিয়ার ওয়েপন আছে। কয়েকমাস আগে নর্দার্ন স্টেটসে তার সফল উৎক্ষেপণ হয়েছে। আমরা আর কাউকে ভয় পাই না। আমেরিকা খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ বন্ধ করে দিলে আমরা না খেয়ে থাকব। ইংল্যান্ড ভারী শিল্প তুলে নেওয়ার ভয় দেখালে আমরা বলব, নিয়ে যাও। কিন্তু আমরা আমাদের অবস্থান থেকে নড়ছি না। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রাজু মন্ডলের খবর চাই। না পেলে, শেষ যুদ্ধ শুরু হবে।’ আবার ‘র‌্যাট-ট্যাট-ট্যাট-ট্যাট!’

    সারা বিমানবন্দর জুড়ে সবাই মিলে একসঙ্গে কথা বলছে। সবাই একসঙ্গে ওয়ারিস্তানের নিন্দে করছে। নিজের দেশ, নিজের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে এত কুৎসিত বিশেষণ কোনওদিন শোনেনি রকি। তার কান ঝাঁঝাঁ করছে। মাথা নীচু করে সে প্রধান দরজার দিকে এগোল।

    জিয়ার ভাষণের একটা অংশের অর্থ তার কাছে পরিষ্কার নয়। জিঙ্গোয়িস্টিক ধুয়ো তুলে ইন্ডিয়াকে চাপে রাখতে হবে, এই কথা জিয়াকে বলে এসেছিল রকি। নিউক্লিয়ার ওয়ারের কার্ড খেলতে বলেনি। এই কার্ড খেলার ফলে সারা পৃথিবীর কাছে ওয়ারিস্তান একঘরে হয়ে গেল। এই কথাটা বোঝার মতো বুদ্ধি বোকা মেয়েছেলেটার নেই। এক দিনের রানি হওয়ার স্বপ্নে মশগুল হয়ে ভুল বকছে। পরমাণু যুদ্ধ অত সোজা নয়। তার নির্দিষ্ট প্রাোটোকল আছে। সেসব না মেনে জিয়া ওয়ারিস্তান থেকে ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল ছাড়লে ইন্ডিয়া পালটা আঘাত করবে। ‘ফ্যাট ম্যান’ আর ‘লিটল বয়ের’ মতো পরমাণু বোমা আজকের দিনে নস্যি। ওয়ারিস্তানে জিয়া বোতাম টিপবে আর ইন্ডিয়ায় ধ্বংস হয়ে যাবে দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু। আকাশে উড়বে ডাবল ব্যাঙের ছাতা। কলকাতা শহর প্রাণহীন হয়ে যাবে। একশো কিলোমিটার ব্যাসওয়ালা ক্রেটারের মধ্যে ঢুকে যাবে বিমানবন্দর ও মেট্রো রেল, চওড়া রাস্তা ও আলোকিত বিপণি, ইশকুল ও কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল, রাজভবন ও মহাকরণ, শপিং মল ও মাল্টিপ্লেক্স, গড়ের মাঠ ও রেসকোর্স, প্রথম ও দ্বিতীয় হুগলি সেতু, হাওড়া ও শেয়ালদা স্টেশন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর অক্টারলোনি মনুমেন্ট, বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি-লরি-অটো-রিকশা।

    ওয়ারিস্তানে ধ্বংস হয়ে যাবে ইস্টার্ন, ওয়েস্টার্ন, নর্দার্ন, সার্দান আর সেন্ট্রাল প্রভিন্স। ধ্বংস হয়ে যাবে আফিম খেত, তেলের খনি, পার্লামেন্ট, কানহাইয়া ময়দান, প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান, আশিকানা, সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার। পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয় ছাই ছাড়া আর কিছু পড়ে থাকবে না।

    তাতে রকির কিছু যায় আসে না। কিন্তু গ্রিনবার্গের যায় আসে। জ্যান্ত এবং বিবাদমান দুই জনগোষ্ঠী না থাকলে তার ‘ডেথ সি শিপইয়ার্ড’-এ তালা পড়ে যাবে। গ্রিনবার্গ রকিকে কাটমানি দেবে না। রকির বাহামায় যাওয়া হবে না।

    রাজু সুস্থ হয়ে ওয়ারিস্তান ফিরলে ডাব্লিউডিপি ভোটে জিতবে। রাজু প্রধানমন্ত্রী হবে। গ্রিনবার্গ রকির পাওনাগণ্ডা বাহামায় ওয়্যার ট্রান্সফার করে দেবে। তারপর, যেমন সব রূপকথার শেষে থাকে, ‘অ্যান্ড দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার।’

    ‘দে’ মানে রকি আর কিয়ারা। নামেও কী মিল!

    সুতরাং, সমাধান একটাই। ডোনার মেয়েটাকে খুঁজে বার করে, রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া। একটা প্রাণের বিনিময়ে যদি কোটি কোটি প্রাণ বাঁচে, তবে গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে মাইনরিটিকে বলি চড়াতেই হয়।

    নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডোমেস্টিক টারমিনাস থেকে বাইরে বেরিয়ে রকি দেখল, অল্প কয়েকজন লোক প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝারি চেহারার এক ছোকরার প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘ওয়েলকাম অপূর্ব কুমার রায়।’

    তার কাছে গিয়ে রকি বলল, ‘বিট্টু?’

    ছেলেটা বলল, ‘আসুন।’

    কোচি বিমানবন্দরে রকিকে পৌঁছে দিয়েছিল দিপু। দিপুই বলেছিল, বিট্টু নামে একটা ছেলে ‘ওয়েলকাম অপূর্ব কুমার রায়’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রকির জন্য অপেক্ষা করবে। রকি দিপুকে বলে রেখেছিল কলকাতায় তার কী কী চাই। গ্লক আগ্নেয়াস্ত্রটি দিপুকে ফেরত দিয়ে বলেছিল, ‘কলকাতায় আমার আর একটা গ্লক চাই। আমি অন্য কিছু ইউজ করি না।’

    বিট্টু চালাচ্ছে লাল রঙের সেকেন্ডহ্যান্ড হ্যাচব্যাক। এটা রকির সিলেকশান। কলকাতার সবচেয়ে কমন গাড়ি। হ্যাচব্যাকে উঠে স্টার্ট দিল বিট্টু। রকি বুঝল, গাড়ির বহিরঙ্গ পুরোনো হলেও ইঞ্জিন থেকে এসি, মিউজিক সিস্টেম থেকে জানলার কাচ—সব বদলানো হয়েছে। কাচ বুলেটপ্রুফ, কিন্তু টিন্টেড নয়। এসির তেজ প্রবল। আপহোলস্ট্রি নরম এবং তুলতুলে, সাউন্ড সিস্টেমে ‘মিউজিকাল ব্রাদার্স অফ ওয়ারিস্তান’-এর গান বাজছে। পিছনের সিটে বসে রকি দেখল একটা পলিথিনের ব্যাগ রাখা। ব্যাগ খুলে রকি দেখল, তার অতি প্রিয় গ্লক আগ্নেয়াস্ত্র এবং একটি হাই এন্ড ট্যাব রাখা রয়েছে। যেটি মোবাইলের কাজও করবে। যেমনটি সে চেয়েছিল।

    ‘সিকিয়োরড কানেকশান?’ প্রশ্ন করে রকি।

    ‘ব্র্যান্ড নিউ কানেকশান। বেনামে। তা ছাড়া নম্বরটা মাস্কিং করা আছে। এয়ারটাইম প্রাোভাইডার কোম্পানির কাছে দার্জিলিং-এর টাওয়ার লোকেশান আসছে।’

    ‘হুম!’ খুশি হয় রকি। মিলিটারি প্রধান হিসেবে মোবাইল নম্বর বা ল্যান্ডলাইন নম্বর মাস্ক করা নিয়ে তার হাতেকলমে অভিজ্ঞতা আছে। কীভাবে যে-কোনও নম্বরকে ‘প্রাইভেট নাম্বার’ বানিয়ে দেওয়া যায়, কীভাবে নিজের মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে ফোন করলে, সেই মোবাইলের স্ক্রিন শুধু ‘কলিং’ শব্দটা দেখাবে—এসব তার বাঁয়ে হাত কা খেল। কেউ যদি গুগলে সার্চ দেয়, ‘হাউ টু মাস্ক মোবাইল নাম্বার’, তাহলে শয়ে শয়ে লিঙ্ক দেখায়। সেসবের বাইরেও নানান তরিকা আছে, যার মাধ্যমে যে ফোন রিসিভ করছে, তার স্ক্রিনে ভুল মোবাইল নাম্বার দেখায়। অথবা ভুল টাওয়ার লোকেশান দেখায়। এই ফোনটিতে শেষ কায়দার মাস্কিং করা আছে। তবে ট্যাব আদতে একটি কম্পিউটার। রকি ইন্টারনেট ব্যবহার করলে ইন্টারনেট প্রাোটোকল অ্যাড্রেস বা আই পি অ্যাড্রেস বার করে ফেলা যাবে। আই পি অ্যাড্রেস হল মেশিনের ঠিকানা। ঠিকানা থেকে মালিকের নাম এবং অবস্থান বোঝা যায়।

    রকির মন পড়ে বিট্টু বলল, ‘ট্যাবটা বেনামে কেনা। তা ছাড়া এতে হটস্পট শিল্ড কনফিগার করা আছে।’

    মনে মনে বিট্টুর প্রশংসা করল রকি। আই পি অ্যাড্রেস মাস্ক করার জন্য অনেক সফটওয়্যার পাওয়া যায়। হটস্পট শিল্ড সেইরকম একটি সফটওয়্যার। বিট্টু বুদ্ধিমানের মতো সেটি এই ট্যাবে ডাউনলোড করে, ট্যাব কনফিগার করে রেখেছে। এখন এই ট্যাব থেকে ফোন করলে বা ইন্টারনেট ঘাঁটলে কেউ বুঝতে পারবে না রকি চৌধুরী কলকাতা শহরে বসে করছে।

    গাড়ি চলতে শুরু করেছে। রকি বলল, ‘সামনে একটা পে-ফোনের বুথ দেখতে পাচ্ছি।’

    বিট্টু গাড়ি দাঁড় করিয়ে পার্স খুলে পাঁচটা একটাকার মুদ্রা রকির হাতে ধরিয়ে দিল।

    পে-ফোন থেকে মেঘনাদের মোবাইল নম্বর ডায়াল করে রকি। রিং হচ্ছে। রিং শুরু হতেই প্রথম কয়েন ফেলল। মেঘনাদ ফোন তুলেছে! তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রকি বলল, ‘অপূর্ব কুমার রায় বলছি।’

    মেঘনাদ চুপ। অনেকক্ষণ চুপ। অবশেষে বলল, ‘আপনার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে চাই।’

    ‘সম্ভব নয়। আমি আপনাকে পাবলিক বুথ থেকে ফোন করছি।’

    ‘আপনি একটা সিকিয়োরড মেল আইডি বলুন। আমি আপনাকে এনক্রিপটেড মেল করছি।’

    রকি এইটুকুই চাইছিল। সে বলল, ‘একেরে@জিমেল.কম’। তারপর ফোন কেটে বুথ থেকে বেরোল। বুথের বাইরে একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বছর দশেক বয়স, পরনে হাফ প্যান্ট, গোল গলা গেঞ্জি। হাতে ছোট্ট সাইজের কাগজের পতাকা আর টিনের কৌটো। ভিখিরি নাকি?

    ছেলেটা এগিয়ে এসে রকির টি শার্টে গাঁধীজির মুখ আঁকা পতাকা সেফটিপিন দিয়ে আটকে বলল, ‘আজ গাঁধীজির জন্মদিন। সামান্য কিছু সাহায্য করুন।’

    ‘ফোট বে!’ এক ধাক্কায় ছোকরাকে রাস্তায় ফেলে, টি শার্ট থেকে গাঁধীজির পতাকা ছিঁড়ে ফেলে রকি গাড়িতে উঠে বসে।

    ৬

    রাষ্ট্রপতি ভবন। গেট নম্বর পঁয়ত্রিশ। প্রকাশ বীর শাস্ত্রী অ্যাভিনিউ, নতুন দিল্লি, ভারতবর্ষ। ২ অক্টোবর।

    সকাল সাড়ে এগোরাটা থেকে দুপুর দেড়টা।

    .

    রাষ্ট্রপতি অরুণ চ্যাটার্জিকে ন্যাশনাল মিডিয়া ‘নীরব যোদ্ধা’ বলে ডাকে। তারা বলে ‘সায়লেন্ট ওয়ারিয়র ইজ হিজ মিডল নেম।’ সেই ‘অরুণ নীরব-যোদ্ধা চ্যাটার্জি’-র কাছে সকাল সাড়ে এগারোটার সময় দেখা করতে এসেছেন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হরভজন সিং। হরভজন মৃদুভাষী। অক্সফোর্ডে ইকনমিক্স নিয়ে পড়াশুনো করা মানুষটি অকৃতদার। সারা জীবন পার্টির কাজে ব্যয় করেছেন।

    বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ থেকে ওয়ারিস্তানের খবরটি পিক আপ করেছে ভারতবর্ষের সমস্ত নিউজ চ্যানেল। ইংরেজি, হিন্দি এবং প্রতিটি রিজিয়নাল ল্যাঙ্গুয়েজের চ্যানেলে ক্লিপিংটি বারংবার দেখানো হচ্ছে। নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ারের গন্ধ পেয়ে ধর্মীয় চ্যানেলগুলো মৃত্যুনাশযজ্ঞ কীভাবে করতে হবে, তার পদ্ধতি দেখাচ্ছে। গ্রহরত্নের দাম তিরিশগুণ বেড়ে গেছে। উকিল বোঝাচ্ছে কীভাবে উইল করে রাখলে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরেও সম্পত্তি বেদখল হবে না। ডাক্তাররা বোঝাচ্ছে নিউক্লিয়ার ওয়েপন শরীরের কোন কোন অঙ্গে কী কী ক্ষতি করে। পরিবেশবিদরা বোঝাচ্ছে, আগামী একশো বছরের জন্য ভারতবর্ষের আবহাওয়া কীভাবে বদলে যাবে। ট্রাভেল এজেন্টরা অন্য দেশের ভিসা জোগাড় করে দেওয়ার জন্য চড়া দাম হাঁকছে। সেনসেক্স একধাক্কায় চারশো সূচক পড়ে গেছে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম তলানিতে ঠেকেছে। ছোট ছোট শহরে লুঠপাট শুরু হয়েছে। লোকে ব্যাঙ্ক থেকে সব টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যাঙ্ক টাকা দিতে পারছে না। ব্যাঙ্কে গণ্ডগোল, এটিএমে ভাঙচুর, রাস্তাঘাট শুনশান, অনেক রাজ্যে অঘোষিত বন্ধ। একটি কনস্ট্রাকশান কোম্পানি মাটির তলায় বাঙ্কার খোঁড়া শুরু করেছে। পারমাণবিক বিষ ঢুকতে পারবে না—এমন বাঙ্কার। দশ ফুট বাই দশ ফুট বাঙ্কারের দাম কোটি টাকার আশেপাশে।

    টিভিতে খবরটি প্রথমবার টেলিকাস্ট হয়েছে মাত্র আধঘণ্টা আগে।

    হরভজন সিং-এর সঙ্গে এসেছেন ডিফেন্স মিনিস্টার অর্থাৎ কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাকেশ জৈন, ইউনিয়ন ক্যাবিনেট মিনিস্টার অফ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স মেধা ধাবোলকার এবং মিনিস্টার অফ হোম অ্যাফেয়ার্স রেণুকা মান্ডি।

    রাষ্ট্রপতি ভবন মানে ৩৪০ কক্ষবিশিষ্ট রাষ্ট্রপতির আবাসস্থল নয়। বাড়ি সংলগ্ন ৩২০ একর জোড়া বিস্তীর্ণ এলাকাও রাষ্ট্রপতি ভবনের আওতার মধ্যে পড়ে। যার মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত মুঘল গার্ডেন। রয়েছে অজস্র অফিস, স্টাফ ও সিকিউরিটির থাকার জায়গা। এই ভবনের স্থপতি এডুইন লুটিয়েন। ১৯১২ সালে নির্মাণকার্য শুরু হয়ে, শেষ হয়েছিল ১৯২৯ সালে। স্থাপত্যটি এত বড় যে পুরোটা ঘুরে দেখতে বছরখানেক লেগে যায়।

    রেসিডেন্স উইং-এ অরুণের অফিসে মেহগনি কাঠের বিশাল গোল টেবিল ঘিরে তিন পুরুষ ও দুই নারী বসে। পাশের ঘরে একাধিক আখাম্বা প্ল্যাজমা টিভি চলছে। তাদের সামনে বসে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। তারা প্রাোগ্রাম রেকর্ড করছে, নোট নিচ্ছে, ব্রিফ বানাচ্ছে।

    ‘মাননীয় প্রেসিডেন্ট,’ প্রাোটোকল মেনে শুরু করলেন হরভজন।

    ‘এখন প্রাোটোকলের সময় নয়। কাজের কথা সরাসরি বলুন।’ হরভজনকে বললেন অরুণ। ইতিবাচক ঘাড় নেড়ে হরভজন বললেন, ‘ফার্স্ট থিং ফার্স্ট। রেণুকা, কনট্রোল ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশান ইন ইচ অ্যান্ড এভরি স্টেট। এটা তোমার দায়িত্ব। প্রতিটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতার সঙ্গে কথা বলো। রাইট নাও! মোটিভেট দেম, ক্যাজোল দেম, থ্রেট দেম, ডু হোয়াটএভার ইয়ু উইশ, কিন্তু যে নৈরাজ্য ভারতজুড়ে গত আধঘণ্টায় শুরু হয়েছে, আমি এটার শেষ দেখতে চাই, বাই নেক্সট টু আওয়ারস। ক্লিয়ার?’

    ‘অ্যাঁ?’ ফাম্বল করছে রেণুকা।

    ‘অ্যাঁ নয়, বলো হ্যাঁ।’ ধমক দিলেন অরুণ। অরুণের হিন্দি বা ইংরিজি উচ্চারণ মিডিয়ার কাছে হাসিঠাট্টার বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে গো-বলয়ে রাজনীতি করে, সাতবার এলাহাবাদ থেকে ভোটে জিতে, গত কয়েক দশক ধরে দিল্লির বাসিন্দা হয়েও তাঁর হিন্দিতে বাংলার টান। তাঁর জন্য উত্তরপ্রদেশের এক হিন্দি শিক্ষক রাখা হয়েছিল, যিনি জীবনে পশ্চিমবঙ্গের ধার মাড়াননি। একমাস পঠনপাঠনের শেষে মাস্টারজিকে মিডিয়া প্রশ্ন করেছিল, ‘রাষ্ট্রপতিজি কা হিন্দি শিক্ষণ ক্যায়সা চল রহা হ্যায়?’

    জবাবে মাস্টারজি মাথা নীচু করে বলেছিলেন, ‘ভালো নয়। কিন্তু বাংলা ভাষা খুব সুইট। হম আভি ট্যাগোরকা ”আঁখ কা কিরিকিরি” পড় রহা হ্যায়। দারুণ উপোনন্যাস!’ ‘আঁখ কা করিকিরি’ মানে চোখের বালি, সেটা সাংবাদিকদের বুঝে নিতে হয়েছিল।

    অরুণের বাংলা উচ্চারণে হিন্দি বলার স্টাইল তাঁর ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রেডমার্ক হিন্দিতে অরুণ বললেন, ‘কেয়া রেণুকা বেটি, ডর লাগ রাহা হ্যায়?’

    রেণুকা বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। আমি প্রেগন্যান্ট। যদি সত্যি সত্যি ভারত-ওয়ারিস্তান যুদ্ধ বাধে, তাহলে আমার বাচ্চাটার কী হবে?’

    অরুণ উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন,

    .

    ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার…

    বারে বারে তোরে ফিরে পেতে হবে বিশ্বের অধিকার।’

    .

    রেণুকা ঝাড়খণ্ডের মেয়ে। কী বুঝলে কে জানে! হাতজোড় করে বলল, ‘আমি পারব। ঠিক দু’ঘণ্টার মাথায় আমি আপনার অফিসে রিপোর্ট পাঠাচ্ছি।’

    রেণুকার মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে অরুণ বললেন, ‘বোকা মেয়ে। তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। উনি এই যুদ্ধের ক্যাপ্টেন। তোমার যাবতীয় রিপোর্টিং হবে পিএম অফিসে। আমার কাছে আসার কোনও প্রয়োজন নেই।’

    ‘ইয়েস স্যার।’ অরুণকে আবার নমস্কার করে বেরিয়ে গেল রেণুকা।

    ‘মেধা,’ হরভজনের আঙুল মিনিস্টার অফ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের দিকে, ‘তোমার প্রগ্রেস কদ্দূর?’

    ‘আমি সাউথ ইস্ট এশিয়ার প্রতিটি দেশের প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার কাছে তাঁদের মেসেজের হার্ড কপি আছে।’ একতাড়া কাগজ নাড়ে মেধা, ‘আমি এখান থেকে বেরিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করব। জানিয়ে দেব, সাউথ-ইস্ট এশিয়ার কোনও দেশ ওয়ারিস্তানের সেনাপ্রধানের ওয়ারক্রাইতে খুশি নয়।’

    ‘ফরগেট সাউথ ইস্ট এশিয়া। ইউএসএ আর ইউকে কী বলছে?’

    ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিজে ইলেকশানের কাজে ব্যস্ত। ওঁর অফিস থেকে বিবৃতি পাওয়া গেছে। সাদামাটা অফিসিয়াল কমেন্ট থেকে পরিষ্কার, সিআইএ বা পেন্টাগনের র‌্যাডারে এমন কোনও ডেভেলপমেন্টের খবর ছিল না। দিস ইজ নিউজ টু দেম।’

    ‘ও ব্যাটারা খুব বদ হয়। কাকে কখন ল্যাজে খেলায় বোঝা যায় না।’ বিড়বিড় করেন অরুণ, যিনি দীর্ঘদিন আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

    ‘কিছু বললেন স্যার?’ নীচু গলায় প্রশ্ন করেছেন হরভজন।

    ‘না।’ হরভজনকে উত্তর দিয়ে মেধার দিকে ফিরেছেন অরুণ, ‘ইংল্যান্ডের খবর কী?’

    ‘কনজার্ভেটিভ, অ্যাজ ইউজুয়াল। ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ পদ্ধতি নিয়েছে। তবে এই কথাটা বলেছে যে, নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ারের চিক্কুর তোলা অন্যায়।’

    ‘হুম!’ মাথায় টোকা মেরে অরুণ বললেন, ‘তুমিও তা হলে যাও। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কার কাছে অফিসিয়াল রিপোর্টিং-এর পরে সাংবাদিক সম্মেলন করছ?’

    ‘রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরোচ্ছি না। আমি বেরোচ্ছি প্রাইম মিনিস্টারস অফিস থেকে, রেসপেক্টেবল অরুণ সায়লেন্ট ওয়ারিয়র চ্যাটার্জি।’ মুচকি হাসে মেধা। অরুণ লজ্জা পেয়ে বলেন, ‘সাংবাদিক সম্মেলনটা সেরে ফেল। ইউএসএ, ইউকে, ফ্রান্স, ইতালি—ডেভেলপড কানট্রির মন্তব্যগুলো আগে পড়বে। তারপর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের। সব শেষে অন্যদের।’

    ‘আচ্ছা।’ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মেধা। হরভজন ডিফেন্স মিনিস্টার রাকেশ জৈনের দিকে ঘুরে বলেন, ‘কী গেমপ্ল্যান?’

    ‘ওয়ারিস্তানের ব্যাপারে আমার একটাই গেমপ্ল্যান। কিল দেম বিফোর দে কিল ইউ।’

    অরুণ রাকেশের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,

    .

    ”বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা—

    বিপদে আমি না যেন করি ভয়…”

    .

    ওয়ারিস্তান যদি অফিসিয়ালি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাহলে আমাদের অস্ত্র তুলে নিতেই হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। ওয়ারিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান ফাঁকা আওয়াজ দিয়েছেন। আমাদের এখন একটাই কাজ। চুপ করে বসে থাকা।’

    .

    রাকেশের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে অরুণের সিদ্ধান্তে অখুশি। এক্ষুনি যুদ্ধ শুরু করলে তার ভালো লাগত। কিছু না বলে সে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।

    গোলটেবিলের দু’দিকে এখন অরুণ আর হরভজন। দুজনে একসময় একই রাজনৈতিক দলের সহযোদ্ধা ছিলেন। পরস্পরকে খুব কাছ থেকে চেনেন অন্তত চল্লিশ বছর। আজ অরুণ রাষ্ট্রপতি হয়ে দলীয় সদস্যপদ ত্যাগ করেছেন। আজ হরভজন প্রধানমন্ত্রী হয়ে মিতভাষী ও গম্ভীর হয়েছেন। কিন্তু একসময় এই দুই রাজনৈতিক নেতার দস্যিপনাকে সবাই ভয় করত। দুজনের আড্ডায় অসংসদীয় শব্দের বন্যা বইত। মহিলা সংক্রান্ত বিষয়ে পঞ্জাব দ্য পুত্তর হরভজনের খ্যাতি ছিল পৃথিবীজোড়া। অরুণ অবশ্য চিরকাল এক নারীর প্রতিই দায়বদ্ধ থেকেছেন। আজ যিদি দেশের ফার্স্ট লেডি।

    অরুণ গুনগুন করে গান ধরলেন, ‘ইয়ে রেশমি জুলফেঁ, ইয়েস সরবতি আঁখে, তুমহে দেখ কর জি রহে হ্যায় সব কোই।’

    ‘প্লিজ অরুণ, ”সরবতি” নয় ”শরবতি”। এইভাবে হিন্দির বারোটা বাজাস না। তোর জন্যে ট্যাগোর সঙই ঠিক আছে।’ ফিচেল হাসি হেসে বলেন হরভজন। এখন আর কেউ কাউকে আপনি সম্বোধন করছেন না।

    অরুণ গান থামিয়ে বলেন, ‘অক্সফোর্ডে এই গানটা শুনিয়েই তুই মায়া মল্লিককে পটিয়েছিলি না?’

    ‘শাটাপ অরুণ। মার খাবি।’

    ‘কী কপাল দেখ!’ এমন মেয়ে পছন্দ করলি যে, না পারলি তাকে গিলতে, না পারলি উগরোতে। বিয়েও করতে পারলি না। ভুলতেও পারলি না। ব্যর্থ প্রেমের কঙ্কাল ঘাড়ে নিয়ে ব্যাচেলার হয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিলি।’

    ‘তেরিততো…’ নিজেকে সামলাতে না পেরে মাতৃভাষায় ফিরে গেছেন হরভজন। দুজনে আড়চোখে দেখে নিলেন, সিকিয়োরিটির লোকেরা কত দূরে দাঁড়িয়ে। অরুণ গলা নামিয়ে বললেন, ‘আনঅফিসিয়ালি যোগাযোগ আছে?’

    ‘থাকা সম্ভব?’

    ‘তাহলে অফিসিয়ালি যোগাযোগ করা যাক।’ হাতের ইশারায় কাউকে ডাকলেন অরুণ।

    রাষ্ট্রপতি ভবনের একজন কর্মচারী এসে বলল, ‘বলুন, স্যার।’

    অরুণ বললেন, ‘ভাণ্ডারী, ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ফোন করো। বলো যে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী কথা বলতে চান। ফোন সংক্রান্ত সমস্ত প্রাোটোকল মেনটেন করো।’

    ঘাড় নেড়ে ভাণ্ডারী বিদায় নিল। আর এক কর্মচারী এসে হরভজনের সামনে কয়েকটা পাতলা ফাইল রেখে গেল। ফাইলে চোখ বুলিয়ে হরভজন বললেন, ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইং কিছু জানে না। সিআইএ, পেন্টাগন, এফবিআই, মোসাদ কিছু জানে না। পুরোটাই হোক্স বলে মনে হচ্ছে।’

    এক কর্মচারী চা নিয়ে এসেছে। মহার্ঘ্য বোন চায়নার কাপে চা ঢেলে দিল। অরুণ ব্রিটিশপন্থী। তিনি এক চামচ চিনি দিয়ে দুধ ছাড়া চা খান। হরভজনের লাগে মশলা চা। দুধের পরিমাণ বেশি। চা নামমাত্র। হরভজনের চায়ের চেহারা দেখে নাক কুঁচকে অরুণ বললেন, ‘ওটা চা না ওভালটিন?’

    ‘পসন্দ আপনা আপনা।’ চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন হরভজন। তাঁর কথার মধ্যে মেহগনি কাঠের টেবিলে রাখা ফোন ঝনঝন করে বেজে উঠল। দুজনেই চুপ করে গেলেন। একাধিক কর্মচারী এখন এই ঘরে ঢুকে পড়েছে। সবাই নি:শব্দে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে টেবিলের চারিদিকে গোল হয়ে বসল। ভাণ্ডারী ফোন তুলে বলল, ‘হ্যালো?’

    অত্যাধুনিক এই ফোনটিতে সমস্ত কথা রেকর্ড করা যায়। এছাড়াও ভয়েস মডিউলেশান বেসড একটি সফটওয়ার আছে। পরে অ্যানালিসিস করে বোঝা যায় বক্তা সত্যি বলছিল, না মিথ্যে।

    ‘হ্যালো।’ ওপ্রান্ত থেকে পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘দিস ইজ আব্রাহাম, ফ্রম প্রাইম মিনিস্টারস অফিস ইন ওয়ারিস্তান। দিস কনভার্সেশান ইজ বিয়িং রেকর্ডেড। আই অ্যাম হ্যান্ডিং ওভার দ্য লাইন টু রেসপেক্টেড প্রাইম মিনিস্টার।’

    ‘হাই! দিস ইজ ভাণ্ডারী। সেম প্রাোসিজিয়োর ইজ বিয়িং ক্যারিড ওভার হিয়ার। থ্যাঙ্কস।’ ভাণ্ডারী চুপ।

    হরভজন বললেন, ‘হ্যালো মায়া।’

    ‘হ্যালো হরভজন।’

    ‘কেমন আছেন?’

    ‘ভালো। আপনি কেমন আছেন?’

    ‘ভালো।’

    সামান্য নীরবতার শেষে হরভজন বললেন, ‘আপনার দেশ আমার দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে কেন?’

    ‘সরকার যুদ্ধঘোষণা করেনি। সেনাপ্রধান কী বলল, তাতে কী আসে যায়? তা ছাড়া…’ মায়া চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘সেনাপ্রধান তো এ-কথাও বলেছে যে রাজুর আত্মগোপনের পিছনে ইন্ডিয়ার হাত আছে। সেই দাবি নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?’

    হরভজন চুপ। অরুণ নি:শব্দে মাথা নাড়লেন।

    মায়া বললেন, ‘আমি ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বলছি, ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। আমি শান্তি, মৈত্রী, একতায় বিশ্বাসী। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প-সংস্কৃতির আদানপ্রদানে বিশ্বাসী।’

    ‘ধন্যবাদ মায়া,’ থেমে থেমে বলেন হরভজন, ‘আমি ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বলছি, গাঁধীর এই দেশও শান্তি, মৈত্রী, একতায় বিশ্বাসী। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প-সংস্কৃতির আদানপ্রদানে বিশ্বাসী। ধন্যবাদ।’

    ফোন লাইন কেটে যায়। ভাণ্ডারীর নেতৃত্বে কর্মচারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অরুণ হরভজনকে বলেন, যা, তোর কাজ শুরু করে দে। আশা করি সন্ধের মধ্যে দেশজোড়া এই বাঁদরামি বন্ধ হবে।’

    টেবিলে রাখা একটা ফাইলে টোকা মেরে হরভজন বলেন, ‘রাজুর পাস্ট হিস্ট্রি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, পড়াশুনো ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। মা-বাবাকে মার্ডার করে জুভেনাইল হোমে ছিল। সেখানেই ড্রাগ পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এখনও ড্রাগ কার্টেলের বড় মাথা। নিজেকে বাঁচাতে পলিটিক্সে ঢুকেছে। অশিক্ষিত, মাথামোটা, গো-গেটার, কানিং। এরা খুব সাংঘাতিক হয়।’

    অরুণ উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে উদাত্ত গলায় আবৃত্তি করলেন, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার…’

    ৭

    দেউলটি থেকে বাগনান। ২ অক্টোবর।

    সকাল দশটা থেকে সাড়ে দশটা।

    .

    ‘প্রথমা, আমি গণেশদা!’ মন্তব্য ভেসে এল সামনের সিট থেকে। প্রথমা এতক্ষণ জানলায় মাথা রেখে বসেছিল। খেয়াল করেনি যে পরের স্টেশন চলে এসেছে। লোকটা এই স্টেশনেই ট্রেনে উঠেছে। প্ল্যাটফর্মে তাকিয়ে স্টেশনের নাম পড়ে প্রথমা। দেউলটি।

    ‘কী রে, চিনতে পারছিস?’ প্রশ্ন করে লোকটা। উত্তর না দিয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে প্রথমা দেখে নেয় কামরায় কে কে আছে। দুজন সবজিউলি দরজার সামনে বসে হিসেব কষছে। একগাদা কমবয়সি ছেলেমেয়ে ছুটির দিনে ঘুরতে বেরিয়েছে। তাদের চেল্লামিল্লিতে কামরায় বসে থাকা দু’চারজন লোক বিরক্ত হচ্ছে। কামরায় জনসংখ্যা দেখে খুশি হল প্রথমা। সামনের লোকটা কে, জানা নেই। কিন্তু এ তাকে বিপদে ফেলতে পারবে না। পরের স্টেশনে নেমে মেয়েদের কামরায় চলে গেলেই হল।

    ‘চিনতে পারছি না।’ ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় প্রথমা।

    ‘আমি গণেশদা। রি-লাইফের ওয়ার্ডেন। এবার মনে পড়ছে?’ বলে লোকটা।

    প্রথমা বলে, ‘আপনার আই কার্ড দেখান।’

    লোকটা বলে ‘আমি পাঁচ বছর আগে রি-লাইফ ছেড়ে দিয়েছি। আইকার্ড কোথা থেকে পাব? তুই সত্যিই আমাকে চিনতে পারছিস না?’

    ‘আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। গতকাল রাতেই গণেশদা আমার সঙ্গে ছিল। আর আপনি বলছেন, গণেশদা পাঁচবছর আগে রি-লাইফ ছেড়ে দিয়েছে।’

    লোকটা কপাল চাপড়ে বলল, ‘যুক্তিতক্কো দিয়ে সব কিছু প্রমাণ হয় না। আমাকে দেখে তুই গণেশদা বলে চিনতে পারছিস কিনা বল।’

    লোকটার কথা শুনে গণেশদার চেহারা মনে করার চেষ্টা করে প্রথমা। বছর তিরিশের গণেশদার হাইট সাড়ে পাঁচফুটের আশেপাশে। শ্যামলা রং, অল্প ভুঁড়ি আছে, মাথা ভরতি চুল, একগাল দাড়িগোঁফ। সবসময় পাজামা আর ফতুয়া পরে থাকে।

    এই লোকটার বয়স মধ্য তিরিশ। মাথার চুল আর দাড়িগোঁফ শেভ করা। পরনে সিক্স পকেট কারগো, টি শার্ট আর কমব্যাট বুট। ভুঁড়ির লেশমাত্র নেই। প্রথমা বলে, ‘আপনি গণেশদা নন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব না।’

    ‘প্রথমা, আমি তোকে বাঁচাতে এসেছি। তুই প্লিজ আমার কথা শোন। সামনের কোনও স্টেশনে একটা লোক ট্রেনে উঠে বলবে সে রি-লাইফের ওয়ার্ডেন। তোকে বলবে ওর সঙ্গে যেতে।’

    ‘আপনি কী করে জানলেন যে আমার খোঁজে কেউ ট্রেনে উঠবে?’

    ‘এত প্রশ্ন করিস না। যা বলছি শোন। যে উঠবে, তার নাম বালাজি মিশ্র। ছ’ফুট লম্বা, অ্যাথলিটদের মতো চেহারা, বাঁ-কানে ইয়ারস্টাড।’

    ‘ইয়ারস্টাড মানে কী?’

    ‘কানের দুল। প্রশ্ন না করে যা বলছি চুপচাপ শোন। বালাজি বলবে, মেঘনাদ লাহিড়ি ওকে পাঠিয়েছে। তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।’

    ‘তাহলে ওই বালাজির সঙ্গে অবশ্যই আমার যাওয়া উচিত। আমি রি-লাইফে যেতেই ট্রেনে উঠেছি।’

    ‘তুই যাবি না। আমার দিব্যি। তোর গণেশদার দিব্যি।’ প্রথমার হাত ধরে মিনতি করছে লোকটা।

    প্রথমা কড়া গলায় বলল, ‘আমার হাত ছাড়ুন। নাহলে চ্যাঁচাব।’

    লোকটা তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে গুটিয়ে নিয়ে বলল, ‘পাগলামো করিস না।’

    সবজিউলি দুজন লোকটার দিকে সন্দেহজনক চোখে তাকিয়ে। প্রথমা আর একবার গলা তুললেই গালাগালি দিয়ে পিণ্ডি চটকে দেবে।

    লোকটাকে বাজিয়ে দেখতে প্রথমা বলল, ‘বালাজির সঙ্গে না গেলে কার সঙ্গে যাব? আপনার সঙ্গে?’

    ‘এতক্ষণে মাথা খুলেছে,’ উত্তেজিত লোকটা কারগোর পকেট থেকে মোবাইল বার করে বলল, ‘এটা তোর কাছে রাখ। নতুন সিমকার্ড ভরেছি। আমি ছাড়া কেউ এই নম্বর জানে না।’

    ‘আমি আপনার মোবাইল নেব কেন?’ একপরদা গলা তোলে প্রথমা।

    এক সবজিউলি অন্যজনকে বলে, ‘আজকালকার ছুঁড়িগুলো মোবাইলের লোভে যা তা শুরু করেছে।’

    সবজিউলিদের ওপরে রেগে গিয়ে প্রথমা মোবাইলটা নিয়ে বলল, ‘এবার?’

    ‘মোবাইল কী করে অপারেট করতে হয় মনে আছে? না ভুলে মেরেছিস?’

    ‘বোকার মতো কথা বলবেন না। মোবাইল ইউজ করা রকেটসায়েন্স নয়।’

    ‘না ভুললেই ভালো। তোর অসুবিধে যাতে না হয়, তার জন্য টাচফোন নিলাম না।’

    প্রথমা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘টাচফোন কাকে বলে?’

    লোকটা মৃদু হেসে বলল, ‘তোর না জানারই কথা। ওসব বাদ দে। বালাজি কোন স্টেশনে উঠবে বলা শক্ত। আমি তার আগেই এই কামরার পিছনের দিকে চলে যাব। প্যাসেঞ্জার কমে গেলে অন্য কামরাতেও চলে যেতে পারি। তখন তোর সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় এই ফোন। মোবাইল কীভাবে সায়লেন্ট এবং ভাইব্রেটর মোডে রাখে?’

    প্রথমা দেখায়। লোকটা বলে, ‘গুড। এই মোবাইলে কোনও ফোন বা মেসেজ এলে বুঝবি সেটা আমার। বালাজির সামনে ফোন বার করবি না। স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালে বালাজিকে বলবি চা বা জলের বোতল কিনে দিতে। ও যখন কামরা থেকে নামবে, সেই সময়ে মেসেজ পড়ে নিবি বা আমার সঙ্গে কথা বলে নিবি। ক্লিয়ার?’

    ‘জলের মতো।’ লোকটাকে মোবাইল ফেরত দিয়ে বলে প্রথমা।

    ‘মোবাইল আমায় দিচ্ছিস কেন?’ বিরক্ত হয়ে বলে লোকটা।

    ঘোড়াঘাটা স্টেশন এল। দুই সবজিউলি ঝাঁকা নিয়ে নেমে গেল। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েগুলো ক্যালোরব্যালোর করতে করতে নেমে গেল। বয়স্ক মানুষরাও নেমে গেছে। এখন এই কামরায় প্রথমা আর লোকটা ছাড়া কেউ নেই। প্রথমার একটু একটু ভয় করছে। তার কি কামরা থেকে নেমে যাওয়া উচিত? ট্রেন এখনও ছাড়েনি।

    গণেশদাকে নিয়ে অনেক স্মৃতি প্রথমার। রি-লাইফে গণেশদা যখন জয়েন করে তখন প্রথমার ক্লাস সেভেন। অঙ্ক করতে খুব ভালো লাগলেও ইতিহাস আর ভূগোল পড়তে খারাপ লাগত। গণেশদাই ওই দুটো সাবজেক্টে প্রথমার আগ্রহ তৈরি করে। ইতিহাসের টেক্সট বুক সরিয়ে রেখে প্রথমার হাতে তুলে দিয়েছিল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’। এক নি:শ্বাসে উপন্যাস শেষ করে গণেশদার কাছে গিয়ে প্রথমা বলেছিল, ‘ওই সময়টা নিয়ে আরও কিছু জানতে ইচ্ছে করছে।’

    রি-লাইফের লাইব্রেরি দেখিয়ে গণেশদা বলেছিল, ‘অনেক বই আছে। খুঁজে দ্যাখ। তবে দয়া করে স্কুলের টেক্সট বইটা পড়িস না।’

    গল্পের বই পড়তে পড়তে ইতিহাসে ঢুকে গিয়েছিল প্রথমা। খানিক এনসাইক্লোপিডিয়া, খানিক অনার্সের ইতিহাসের বই গল্পের ছলে পড়ে সে বুঝেছিল, ইতিহাস আসলে দারুণ ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট। অঙ্কের মতো ইন্টারস্টিং। কর্পোরেশানের স্কুলের টিচার আর টেক্সট বই মিলে বিষয়টাকে গোমড়া বানিয়ে রেখেছে।

    ভুগোলেও এক ব্যাপার। আফ্রিকার ভূগোল পড়তে গিয়ে বোর হয়ে প্রথমা গণেশদার দারস্থ হয়েছিল। গণেশদা প্রথমার হাতে তুলে দিয়েছিল ‘চাঁদের পাহাড়।’ শঙ্করের কিলিমানজারো অভিযান পড়তে পড়তে আফ্রিকার নদীনালা, গাছপালা, জলবায়ু, আবহাওয়া, জন্তু-জানোয়ার, খাদ্যাভাস, পোশাক পরিচ্ছদ—সব জেনে গিয়েছিল প্রথমা। তারপরে ভূগোলের টেক্সট বইতে ফিরে এসে অসুবিধে হয়নি।

    সামনে বসা লোকটার সঙ্গে গণেশদার গলার আওয়াজ একদম মিলে যাচ্ছে। কাল রাতেই বাবার চেম্বারের ফোন থেকে গণেশদা ষষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলছিল। কথাগুলো এখনও শুনতে পাচ্ছে প্রথমা। ‘তুই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমার আর প্রথমার ফিরতে দেরি হবে। হ্যাঁ-হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়। আমরা এখানে পেস্ট্রি আর চা খাব, রাতে কিছু না খেলেও চলবে।’

    তারপর কী হয়েছিল? প্রথমা কখন অনাথ আশ্রমে ফিরেছিল? কখন হেস্টিংস থেকে বেরিয়ে চলে এল কোলাঘাট পর্যন্ত? এই পুরো সময়টার স্মৃতি নেই কেন?

    স্মৃতি মানে অতীত। পুরোনো কথা নিয়ে না ভেবে প্রথমা বর্তমানে মনোনিবেশ করে। এই লোকটা নিজেকে গণেশদা বলে দাবি করছে। কিন্তু এ-ও বলছে যে সে আর রি-লাইফের ওয়ার্ডেন নেই। পাঁচ বছর আগে রি-লাইফ ছেড়ে দিয়েছে। অথচ প্রথমা দিব্যি মনে করতে পারছে যে কাল রাতেও সে রি-লাইফে গণেশদার সঙ্গে ছিল। লোকটা তাকে রি-লাইফে ফিরতে বারণ করছে কেন? লোকটা কী করে জানল যে তার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? লোকটা কী করে জানল যে সে এখন ট্রেনে? লোকটা কী করে জানল যে বালাজি নামের একটা লোক কয়েক স্টেশন পরে তার সঙ্গে দেখা করবে? এই লোকটা তাকে বালাজির সঙ্গে যেতে বারণ করছে কেন? লোকটা তাকে মোবাইল ফোন দিচ্ছে কেন?

    স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে। লোকটা বাইরে উঁকি মেরে প্রথমার কাছে ফেরত এসে বলল, ‘যা ভেবেছিলাম তাই। বাগনান স্টেশনে বালাজি দাঁড়িয়ে। আমি কামরার পিছনের দিকে চলে যাচ্ছি। পরের স্টেশনে পিছনের কামরায় চলে যাব। ঠিক আছে?’

    প্রথমা উত্তর দিল না। লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বেশি না ভেবে আমার কথা শোন। বালাজির পাল্লায় পড়িস না। মোবাইলটা রাখ।’ পলিথিনের প্যাকেটে মোবাইল গুঁজে দিয়ে পিছনের দিকে চলে গেল লোকটা। বাগনান স্টেশনে ট্রেন ঢুকল।

    ট্রেন দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে কামরায় উঠল একগাদা বয়স্কা মহিলা। সবাই লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে আছে। কপাল আর সিঁথি ভরতি সিঁদুর। হাতে প্রসাদের ডালা। এরা বোধহয় আশেপাশের কোনও মন্দিরে পুজো দিয়ে আসছে। কামরার অর্ধেকের বেশি ভরতি হয়ে গেল। এই সবের মধ্যে প্রথমার সামনের সিটে কেউ একজন বসল। প্রথমা কোলে রাখা প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। চোখ না তুলে খেয়াল করল, হান্টিং শু পরা পা, কালো রঙের জিনস, জলপাই সবুজ রঙের টি-শার্ট পরা বড় চেহারার একজন তার সামনে বসেছে। যে লোকটা নিজেকে গণেশদা বলে দাবি করছিল, তার কথা ঠিক হলে এই লোকটার নাম বালাজি মিশ্র। এর বাঁ-কানে ইয়ার স্টাড থাকা উচিত।

    ‘তুমি প্রথমা না?’ প্রথমাকে চমকে দিয়ে প্রশ্নটা ধেয়ে এল সামনের থেকে। প্রথমা চোখ তুলে দেখল, নীল রঙের দুটো চোখ তাকে দেখছে। চোখের মালিকের মাথার চুলে ক্রুকাট। গাল ক্লিন শেভড। লোকটা নির্ঘাত রোজ ওয়েট ট্রেনিং করে। না হলে এই রকম বাইসেপস, ট্রাইসেপস হয় না। লোকটার হাতে পোস্টকার্ড সাইজের ছবি। ছবির সঙ্গে প্রথমাকে মিলিয়ে দেখছে। লোকটার বাঁ-কানে হিরে বসানো ইয়ার স্টাড।

    ‘তোমার নাম প্রথমা তো?’ আবার জিজ্ঞাসা করল লোকটা। এবার গলার আওয়াজ এক পরদা উঁচুতে।

    প্রথমা বলল, ‘আপনি কে?’

    লোকটা বলল, ‘আমার নাম বালাজি মিশ্র। আমি রি-লাইফ অনাথ আশ্রমের ওয়ার্ডেন। তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মেঘনাদ লাহিড়ি আমাকে পাঠিয়েছেন।’ পকেট থেকে মোবাইল বার করে পটাপট বোতাম টিপে বলল, ‘এই নাও, বাবার সঙ্গে কথা বলো।’

    প্রথমা বলল, ‘অজানা লোকের সঙ্গে আমি কথা বলব না। দু:খিত।’

    ‘আমি অজানা হতে পারি, কিন্তু বাবার সঙ্গে কথা বলতে দোষ কোথায়? এই নাও, কথা বলো। রিং হচ্ছে।’

    ‘আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব না। আপনার ফোনেও কথা বলব না। আপনি আমাকে বিরক্ত করবে না।’ বালাজির ঠান্ডা, নীল চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলল প্রথমা। ট্রেন ছেড়ে দিল।

    বালাজি কিছুক্ষণ প্রথমাকে দেখল। তারপর বলল, ‘তোমার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। সদ্য একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে বেরিয়েছ। এই অবস্থায় কোনও অচেনা লোককে বিশ্বাস করা শক্ত। তুমি বলে দাও, কীভাবে আমি তোমাকে কনভিন্স করাব যে মেঘনাদ লাহিড়ি আমাকে পাঠিয়েছেন, তোমাকে রি-লাইফে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।’

    প্রথমা বলল, ‘আপনার আই কার্ড দেখি।’

    টি-শার্টের ভিতর থেকে ফিতেয় ঝোলানো আইকার্ড বার করে বালাজি। প্রথমা দেখল, আইকার্ডে লেখা, ‘বালাজি মিশ্র। ওয়ার্ডেন, রি-লাইফ।’ পাশে চেনা লোগো। নীল রঙের গোল বৃত্তের মধ্যে লাল রঙের রক্তের ফোঁটা। এই লোগো সে অ্যাম্বুল্যান্সের গায়ে দেখেছে, রি-লাইফের মৃত কর্মচারীদের শার্টে দেখেছে, তার নিজের শার্টেও দেখেছে।

    বালাজি এগিয়ে দিয়েছে ডক্টর মেঘনাদ লাহিড়ির ভিজিটিং কার্ড। তাতে লেখা, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, এমবিবিএস (ক্যাল), এমডি (পিজিআই, চণ্ডীগড়), ডিএম (হিম্যাটোলজি), (পিজিআই, চণ্ডীগড়)। তারপর একগাদা বিদেশি ডিগ্রি। একদম তলায় লেখা, ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স ফর স্টেম সেল রিসার্চ।’

    আইকার্ড এবং ভিজিটিং কার্ড ফেরত দিয়ে প্রথমা বলল, ‘আমি কোলাঘাটে এলাম কী করে? রি-লাইফের অ্যাম্বুল্যান্সে করে আমি কোথায় যাচ্ছিলাম?’

    ‘তুমি রি-লাইফের বন্ধুদের সঙ্গে কোলাঘাটে পিকনিক করতে এসেছিল। রাত্তিরে ফেরার সময় অ্যাক্সিডেন্ট হয়।’ তুড়ুক জবাব বালাজির।

    ‘অ্যাম্বুল্যান্সে করে পিকনিক?’ ভুরু কুঁচকে বলে প্রথমা।

    ‘হ্যাঁ গো। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। তোমার বাবার গাড়ি গতকাল একটাও খালি ছিল না। এদিকে তোমরা জেদ ধরেছ যে পিকনিকে যাবেই। কোনও বড় গাড়ি ভাড়াও পাওয়া গেল না। তাই এই ব্যবস্থা।’

    ‘তাহলে আমার বন্ধুরা কোথায়? কে কে ছিল আমার সঙ্গে? ষষ্ঠী আর কৃষ্ণা ছিল?’

    নামগুলো শুনে থমকাল বালাজি। বলল, ‘সবাই মারা গেছে। বডিগুলো তোলার জন্য পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে।’

    প্রথমা বলল, ‘কৃষ্ণাও মারা গেছে?’

    ‘হ্যাঁ, শুধু তুমি বেঁচে আছ। ওই জন্যই বলছি, তাড়াতাড়ি রি-লাইফে চলো।’

    প্রথমা বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন যে আমি ট্রেনে আছি? এবং এই কামরাতেই আছি?’

    ‘তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে। এ তো সোজা ব্যাপার। অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে কোলাঘাটে এসে জানলাম যে তুমি বেঁচে আছ। কোলাঘাট থেকে হাওড়ার ট্রেন ধরেছ। আমি গাড়ি ছুটিয়ে ট্রেনের আগে ঘোড়াঘাটা স্টেশনে এসে এই ট্রেনে উঠে পিছন থেকে প্রতি কামরায় তোমাকে খুঁজছিলাম। এইটায় পেয়ে গেলাম। এই লাইনে ট্রেন এত ঢিকিয়ে চলে যে গাড়িতে আগে যাওয়া যায়।’

    নিখুঁত যুক্তি। পিছনে বসে থাকা ওই লোকটা, যে নিজেকে গণেশ বলে দাবি করেছিল; আর এই বালাজি, যে নিজেকে রি-লাইফের নতুন ওয়ার্ডেন বলে দাবি করছে, এদের মধ্যে কে বেশি বিশ্বাসযোগ্য? নিজেকে প্রশ্ন করে প্রথমা। মনে মনে একটা উত্তর পেয়েও যায়। তবু আরও খানিকটা সময় নিয়ে ভাবতে হবে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় প্রথমা। তার মাথায় অজস্র প্রশ্ন কিলবিল করছে।

    বালাজি আবার মোবাইল বার করছে। একটা নম্বর ডায়াল করে বলল, ‘এই নাও। বাবার সঙ্গে কথা বলো। তাহলে সব ধোঁয়াশা কেটে যাবে।’

    প্রথমা আপত্তি করল না। মোবাইল কানে দিয়ে বলল, ‘হ্যালো?’

    ‘হ্যাঁ রে, তোর শরীর কেমন? বড় কোনও চোট লাগেনি তো?’ ভরাট গলায় প্রশ্ন ভেসে এল ওপার থেকে, ‘আমি খুব চিন্তায় রয়েছি। তুই তাড়াতাড়ি আয়।’

    গলাটা চেনা চেনা লাগলেও আলাদা কোনও অনুভূতি হল না প্রথমার। মেঘনাদ তার নিজের বাবা নয়। অনাথদের বোধহয় সম্পর্কের টান কম থাকে। প্রথমা সন্তর্পণে বলল, ‘ষষ্ঠী কেমন আছে?’

    ‘কে?’

    ‘ষষ্ঠী…রি-লাইফের ষষ্ঠী!’

    ‘ষষ্ঠী?’ অপ্রতিভ হাসে মেঘনাদ, ‘ও মারা গেছে।’

    ‘কৃষ্ণা?’

    ‘কৃষ্ণাও মারা গেছে। একমাত্র তুই বেঁচে আছিস। বালাজির সঙ্গে তাড়াতাড়ি আয়। অনেক কাজ বাকি।’ লাইন কেটে যায়। ভুরু কুঁচকে বালাজিকে মোবাইল ফেরত দেয় প্রথমা। বালাজি বলে, ‘তাহলে সব ক্লিয়ার তো?’

    প্রথমা কিছু বলার আগেই কোলে রাখা পলিথিনের প্যাকেটের মধ্যে ফড়িঙের মতো ফড়ফড় করে উঠল মোবাইল।

    ৮

    রি-লাইফ। ডক্টর মেঘনাদ লাহিড়ির চেম্বার।

    ২ অক্টোবর। সকাল দশটা থেকে এগারোটা।

    .

    তনয়া মিত্র ডক্টর মেঘনাদ লাহিড়ির চেম্বারে ঢুকে দেখল, মেঘনাদ হাইব্যাক চেয়ারে বসে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘোড়ার খুরের মতো দেখতে মেহগনি কাঠের টেবিলের এই পাশে রাখা তিনটে চেয়ারের একটায় বসল তনয়া। তাকে দেখে খেঁকিয়ে ওঠে মেঘনাদ, ‘তোমার জন্য আমার রাতের ঘুম ছুটে গেছে।’

    ‘আমি কিছুই করিনি স্যার।’ কাতর কণ্ঠে বলে তনয়া, ‘অ্যাক্সিডেন্ট কি কেউ ইচ্ছে করে করে? আপনার দুজন স্টাফ মারা গেছে। সেটা একবার ভাবুন!’

    ‘ওসব ভাবার কাজ আমার নয়। তোমার।’

    ‘আপনাকে তো বলেছিলাম যে ক্রায়োজেনিক ইউনিটটা কলকাতায় খুলতে। জায়গার কোনও অভাব নেই। কেন যে খড়গপুরে করতে গেলেন!’

    ‘যা বোঝো না, তাই নিয়ে কথা বোলো না।’ আবার খেঁকিয়ে ওঠে মেঘনাদ। তিনটে ইউনিট তিন জায়গায় করার পিছনের যুক্তিগুলো তুমি জানো। তাহলে বাজে বকছ কেন?’

    ‘তা জানি। কিন্তু এত বড় প্রজেক্ট এক ছাতার তলায় হলে কাজে কো-অর্ডিনেশান থাকে।’

    ‘তুমি শুধু লেখাপড়াতেই ভালো তনয়া। দুনিয়াদারি শেখোনি। চুরি করার সাহস আছে। ডাকাতি করার সামর্থ্য নেই। এই কারণেই নাসা তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।’

    তনয়া চুপ করে বসে রয়েছে। মেঘনাদ রেগে গিয়ে খুব পুরোনো, খুব স্পর্শকাতর একটা বিষয় নিয়ে কথা বলেছে। যে বিষয় নিয়ে কোনও আলোচনা শুনতে নারাজ তনয়া।

    .

    নাসা নিয়ে খবরের কাগজে বা সায়েন্টিফিক জার্নালে নানা খবর থাকে। কিন্তু আসল গবেষণার খবর অনেক বছর পর্যন্ত বাইরে আসে না। অনেক খবর কোনও দিনই বাইরে আসে না। ক্রায়োনিকস ডিভিশনে তেমনই এক প্রজেক্টে কাজ করছিল তনয়া। সাব-জিরো টেম্পারেচারে অ্যাস্ট্রোনটদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা নিয়ে জোরদার গবেষণা চলছিল। তনয়ার মাথাতেই সেই ‘ইউরেকা মোমেন্ট’ জন্ম নেয়, যার প্রয়োগে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।

    এ খবর বাইরের পৃথিবী জানবে না, এটাই এক্সপেকটেড। কিন্তু নাসার ভিতরেও সাফল্যের পাদপ্রদীপ নেওয়ার জন্য তনয়ার বস ম্যালকম গ্রিশ্যাম উঠে পড়ে লাগে।

    এই সময় একটা ভুল করে ফেলে তনয়া। তার কম্পিউটারে রিসার্চ সংক্রান্ত যত ডেটা ছিল, সব সে নিজের পারসোনাল মেল আইডিতে মেল করে দেয়। যাতে বাড়ির কম্পিউটার থেকে এইসব ডেটা সে অ্যাকসেস করতে পারে।

    নাসার ডকুমেন্ট বাইরে যাওয়া মানুষ খুনের সমান অপরাধ। পাঁচ মিনিটের নোটিসে তনয়ার চাকরি যায়। ক্যানসেল হয় ওয়ার্কিং ভিসা। চাকরি যাওয়ার চারদিনের মাথায় সামান্য কিছু ডলার, এক মাথা মেধা, আর লিউকিমিয়ায় আক্রান্ত একমাত্র ছেলে জুজুকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসে সে।

    জুজুর বাবার সঙ্গে জুজুর জন্মের পরেই ডিভোর্স হয়ে গেছে তনয়ার। সিঙ্গল মাদারহুড ভারতে কমন ঘটনা। মুশকিল হয়ে গেল, জুজুর ব্লাড ক্যানসার ধরা পরার পরে। রোগটা নিয়ে পড়াশুনো করেছে তনয়া। লো-গ্রেড ম্যালিগন্যান্সি, কেমোথেরাপি আর রেডিয়োথেরাপি একসঙ্গে চললে জুজু আর পাঁচটা মানুষের মতো নরমাল লাইফ লিড করতে পারবে।

    এইখানেই তনয়ার অসুবিধে হয়ে গেল। কেমোর ওষুধের দাম ভয়ানক বেশি। নার্সিং হোমে ভরতি না করে ওষুধ দেওয়া যায় না। জুজুর চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে ষাট হাজার টাকা লাগবে। যতদিন জুজু অথবা তনয়া বেঁচে থাকবে, ততদিন এই টাকা লাগবে।

    তনয়া ভারতবর্ষের বিভিন্ন আধা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জব অফার পাচ্ছিল, কিন্তু কোনওটার পে প্যাকেট এত ভালো নয় যে জুজুর চিকিৎসা বাবদ ষাট হাজার টাকা সরিয়ে রেখে সংসার চালানো যাবে।

    এই সময় মেঘনাদ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। নাসার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে ভারতবর্ষে চলে এসেছে, এইরকমটা সবাই জানত। মেঘনাদের যোগাযোগ পৃথিবীজোড়া। চুরির দায়ে ধরা পড়ে তনয়ার চাকরি গেছে, এই তথ্য মেঘনাদ জানতে পেরেছিল।

    খড়গপুরের বাড়িতে এসে মেঘনাদ তনয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে। অবিশ্বাস্য অ্যামাউন্টের মাইনে অফার করে বলে, ‘এখানেই একটা ওয়্যারহাউস কিনে সেট আপ তৈরি করো। খরচ আমার, নো-হাউ তোমার।’

    ‘কীসের সেটআপ?’ হেসে ফেলেছিল তনয়া। ‘আপনি কি জানেন, আমি কী বিষয় নিয়ে কাজ করি? আপনি যদি ভেনচার ক্যাপিটালিস্ট হন, তাহলে বলব, টাকা ঢালার আগে পড়াশুনো করুন। এটা ফাটকা নয়। এটা রিসার্চ। পিয়োর সায়েন্স নিয়ে রিসার্চ, যা আগামী পঞ্চাশ বছরে একটাকাও ডিভিডেন্ড দেবে না। সামগ্রিক মানবজাতির কোনও উপকারে আসবে কি না, এ নিয়েও ঘোর সন্দেহ আছে।’

    মেঘনাদ বলেছিল, ‘ক্রায়োনিকস নিয়ে রিসার্চ করার জন্য তোমাকে আমি মাসে একলাখ টাকা দিয়ে পুষব না। আমি তোমাকে হিউম্যান বিয়িং সাপ্লাই করব। তুমি তাদের হিমায়িত করে রেখে দেবে। যখন বলব, তখন তাদের রি-লাইফে পাঠিয়ে দেবে। এই হল তোমার জব প্রাোফাইল। রিসার্চের ধোঁকার টাটি সামনে খাড়া করো। কেউ বারণ করেনি।’

    ‘ডক্টর লাহিড়ি, আপনি বোধহয় জানেন না যে মানুষকে হিমায়িত করার পদ্ধতি আজও আবিষ্কৃত হয়নি। নাসা পর্যন্ত পেরে ওঠেনি। ওটা সায়েন্স ফিকশানের ডোমেন। পিয়োর সায়েন্সের নয়।’ নাসার বাঁধা বুলি আউড়েছিল তনয়া।

    ‘কাল যা কল্পবিজ্ঞান ছিল, আজ তাই বিজ্ঞান তনয়া। জুল ভার্ন, আইজ্যাক অ্যাসিমভ, আর্থার সি ক্লার্ক, রে ব্র্যাডবেরি আগে প্রেডিক্ট করেছেন। বিজ্ঞানীরা পরে তাকে বাস্তবায়িত করেছেন।’

    ‘হ্যাঁ, এভাবে বলতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু ক্রায়োনিকস এখনও অতটা এগোয়নি। আগামী দশ বছরের মধ্যে এটা বাস্তবায়িত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।’

    মেঘনাদ বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘তোমার বস ম্যালকম গ্রিশ্যাম আমার আন্ডারে কাজ করার জন্য তৈরি ছিল। ওর প্ল্যান ছিল নাসা ছেড়ে ক্রায়োনিকস নিয়ে নিজের ফার্ম খোলার। নাসা বা গভর্নমেন্ট ফান্ডেড অরগানাইজেশানে তো বিজ্ঞানীদের জন্য কোনও ইনসেনটিভ নেই। এই সব প্রতিষ্ঠান শুধু নো-হাউ লাইসেন্সিং-এর কাজ করে। ”ডিসকভারি টু ডেলিভারি” এই লম্বা রাস্তাটা কীভাবে ট্রাভেল করতে হয়, জানে না। তাই সারা জীবন নোংরা ল্যাব-কোট পরে কাটিয়ে দেয়। ডিজাইনার সুট পরা হয়ে ওঠে না।’

    তনয়া চুপ। ম্যালকম গ্রিশ্যাম, তার ঋষিতুল্য বস, ডলারের জন্য এত লালায়িত ছিল? মেঘনাদ ঠিক বলছে? না তাকে টোপ দেওয়ার জন্য বসের নামে কেচ্ছা গাইছে? তনয়া বলেছিল, ‘স্টেটসে কিন্তু ইন্ডিয়ার মতো খারাপ অবস্থা নয়। ওখানে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস অত্যন্ত স্ট্রং।’

    ‘নাসার বিজ্ঞানী নাসার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরে ক্রায়োনিকস নিয়ে পেটেন্টের জন্য অ্যাপ্লাই করলে তার স্থান হবে জেলে। ম্যালকম তাই আমেরিকা ছাড়ার প্ল্যান করছিল। ইন্ডিয়ায় না এলেও সিঙ্গাপুর সেটল করত। আমার আন্ডারেই কাজ করত। কিন্তু ও যে ছিঁচকে চোর সেটা পরে জানলাম। জুনিয়র রিসার্চ ফেলোর আবিষ্কার ঝেড়ে কেরিয়ার বানানো আমার একদম পছন্দ নয়। একজন বাঙালি মেয়ে ক্রায়োনিকসের স্বপ্ন সফল করতে পেরেছে জেনে আমার বুক গর্বে ভরে গেছে। তোমার চাকরি যাওয়ায় আমি খুশি। আমি চাই, এক বাঙালির সঙ্গে টিম করে আন্তর্জাতিক মানের কাজ করব। তুমি রাজি হয়ে যাও।’

    তনয়া রাজি হয়ে যায়। খড়গপুরের এক প্রান্তে বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাকটরি কিনে তাকে রিভ্যাম্প করে। জার্মানি থেকে শিপিং হয়ে আসে বিল্ডিং মেটিরিয়াল। সুইৎজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ইজরায়েল, জাপান এবং আমেরিকা থেকে আসে যন্ত্রপাতি এবং রিএজেন্ট। চারমাসের গাধার খাটনির শেষে ক্রায়োনিকস ইউনিট দাঁড়িয়ে গেল।

    মেঘনাদ টাকার ব্যাপারে দিলদরিয়া। আর্কিটেক্টকে দিয়ে এমনভাবে ডিজাইন করিয়েছে যে দু’তলা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে এত বড় একটা ল্যাবরেটরি আছে, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ল্যাব দেখলে আচ্ছা আচ্ছা সায়েন্টিস্টের চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। তনয়া যেটা জানে না, সেটা হল এই ফান্ডিং এসেছে ওয়ারিস্তান থেকে। রকি চৌধুরীর মাধ্যমে। ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে কিনে রাখা ওয়ারিস্তানের পলিসির মধ্যে পড়ে।

    নিজের রিসার্চ নিয়ে দিব্যি আছে তনয়া। গবেষণার বিষয় নির্বাচন, ফান্ডিং-এর জন্য আন্তর্জাতিক লেভেলে তদ্বির, জুনিয়র সায়েন্টিস্ট অ্যাপয়েন্ট করা, ঝাড়ুদার থেকে অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজের খবর নেওয়া—সব একা হাতে সামলায়। মাসে একবার জুজুকে মুম্বইতে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। নিয়মিত চিকিৎসা পেয়ে জুজু সুস্থ। একা একা স্কুলে যায়।

    বাড়ির বেসমেন্টে আর একটি ল্যাব আছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং রেটিনা স্ক্যানের বায়োমেট্রিক কনফার্মেশান ছাড়া এই ল্যাবের দরজা খোলে না। বাইরের পৃথিবী এই ল্যাবের খবর জানে না। জানে শুধু তনয়া, মেঘনাদ, সনাতন আর এক হেল্পার। সনাতন আর সেই হেল্পার মারা গেছে। রি-সাইকল থেকে রি-লাইফে প্রতি মাসে দুই বা তিনবার লুসির এনক্রিপ্টেড মেলে অঙ্গ গ্রহীতাদের ব্লাড গ্রুপ, এইচএলএ স্ট্যাটাস এবং যাবতীয় মেডিক্যাল রেকর্ড মেঘনাদের কাছে আসে। মেঘনাদ সেই মেল তনয়াকে পাঠিয়ে দেয়। তনয়া তার ডেটাবেস থেকে ডোনারদের খুঁজে বার করে। হিমায়িত অবস্থায় সনাতনের অ্যাম্বুল্যান্সে কেরালা পাঠিয়ে দেয়। ট্রেনে কখনওই পাঠানো হয়নি। প্লেনে দু’তিনবার গেছে। সেক্ষেত্রে হিমায়িত ডোনারকে কলকাতায় আনা হয়। রি-লাইফে ভরতি করে ক্রায়োনিকস কন্টেনার থেকে বার করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে হিপনো-সেরাম ইনজেক্ট করা হয়।

    হিপনো-সেরাম বিশেষ ধরনের ড্রাগ। ইঞ্জেকশানের ফলে গ্রহীতা ঝিমিয়ে পড়ে। হাঁটাচলা নড়বড়ে হয়ে যায়। হিপনো-সেরামের এফেক্ট থাকে চার থেকে ছ’ঘণ্টা। তবে তার আগেই লুসির অপারেশান টেবিলে তার মৃত্যু ঘটে।

    এই সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্টে তনয়ার কাজ ডোনারদের ক্রায়োপ্রিজার্ভ করে রাখা। যে ছেলে বা মেয়েটি আজ হিমায়িত হল, তার পালা কবে আসবে তনয়া জানে না।

    .

    মেঘনাদের মোবাইল বাজছে। সে ফোন দেখে বলল, ‘বালাজির ফোন। মেয়েটাকে পেয়ে গেছে বোধহয়।’ তারপর ফোন কানে দিয়ে বলল, ‘হ্যালো?’ বালাজি ওপ্রান্তে কী বলল, তনয়া শুনতে পেল না। মেঘনাদ গলার আওয়াজ নরম করে বলল, ‘হ্যাঁরে, তোর শরীর কেমন? বড় কোনও চোট লাগেনি তো? আমি খুব চিন্তায় রয়েছি। তুই তাড়াতাড়ি আয়।’

    তনয়া বুঝতে পারল, প্রথমার সঙ্গে কথা বলছে মেঘনাদ। ওদিকে মেয়েটা কী কী জিগ্যেস করছে, কে জানে! তবে মেঘনাদ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উত্তর দিচ্ছে। ‘কে?’…’ষষ্ঠী? ও মারা গেছে।’…’কৃষ্ণাও মারা গেছে। একমাত্র তুই বেঁচে আছিস। বালাজির সঙ্গে তাড়াতাড়ি আয়। অনেক কাজ বাকি।’

    কুট করে লাইন কেটে দেয় মেঘনাদ। তনয়াকে বলে, ‘আয়্যাম সরি। আমার কথায় রাগ কোরো না। নাসার পুরোনো প্রসঙ্গ তোলা আমার উচিত হয়নি। জুজু কেমন আছে?’

    ‘ভালো।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর তনয়ার। মলিনাকে ট্রে হাতে ঢুকতে দেখে সে চুপ করে গেছে। মলিনা দু’কাপ ধূমায়িত আর্ল গ্রে চা টেবিলে রেখে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল।

    ‘চা-টা খেয়ে নাও তনয়া। এই চায়ের অনেক দাম। নষ্ট হলে গায়ে লাগে। অনেক কষ্টের রোজগার।’

    তনয়া চায়ে চুমুক দিল।

    ‘গ্রামের ছেলে তো! যতই অনেক টাকা রোজগার করি না কেন, যতই বিদেশে ঘুরি না কেন, যতই দামি, বিদেশি গাড়ি কিনি না কেন, মনটা এখনও মাজদিয়ার মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলের মতো আছে। কোনও কিছু নষ্ট হতে দেখলে গায়ে লাগে।’ নিজের কাপে চুমুক দিয়ে বলে মেঘনাদ, ‘আচ্ছা তনয়া, তোমার সঙ্গে লুসির আলাপ আছে?’

    এতদিন মেঘনাদের সঙ্গে কাজ করছে তনয়া, কখনও স্ত্রী-র প্রসঙ্গ তোলেনি। তনয়া বলল, ‘না। আলাপ নেই।’

    ‘ওর এখন একটা ফোন আসবে। আমরা স্কাইপের মাধ্যমে ওয়েব-ক্যামে কথা বলব। তুমি আলাপ করবে?’

    ‘ওয়েব-ক্যামে কথা? সেটা কি ঠিক হবে? রেকর্ড রয়ে যাবে কোথাও না কোথাও। আইপি অ্যাড্রেস বার করা যাবে ইজিলি। ওসব থাক।’

    আমার ল্যাপটপের আইপি অ্যাড্রেস মাস্কিং করা আছে। লুসিরও তাই। প্রবলেম হবে না।’ মেঘনাদের কথার মধ্যে কুরকুর করে ল্যাপটপে আওয়াজ হল। মেঘনাদ কি বোর্ড টিপে বলল, ‘তনয়া, দরজাটা বন্ধ করে দাও। হাই লুসি।’

    ল্যাপটপের মনিটরে লুসির মুখ। জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং লাহিড়ি।’

    ‘মর্নিং লুসি।’ কানে হেডফোন পরে জবাব দেয় মেঘনাদ। ‘তনয়া আজ আমার চেম্বারে রয়েছে। আলাপ করবে?’

    লুসি কী বলল আন্দাজ করতে পারল তনয়া। কেন না উত্তরে মেঘনাদ বলল, ‘ঠিক আছে। আমি হেডফোন খুলে স্পিকার অন করছি। আর তনয়াকে আমার পাশে ডেকে নিচ্ছি।’

    তনয়া চেয়ার টেনে মেঘনাদের পাশে বসল। লুসি বলল, ‘হাই তনয়া!’

    তনয়া ম্লান মুখে বলল, ‘হ্যালো।’

    ‘জুজু কেমন আছে?’ কনসার্ন মাখানো গলায় জানতে চায় লুসি।

    এই প্রশ্নে তনয়া সহজ হয়। বলে, ‘ভালোই আছে। স্কুলে যাচ্ছে, খেলাধুলো করছে, বাঁদরামো করছে…’

    ‘দ্যাটস গুড!’ খিলখিলিয়ে হাসে লুসি, ‘বাঁদর বাঁদরামি করবেই। তুমি আটকাতে পারবে না।’ তনয়ার পাশ থেকে মেঘনাদ লুসিকে বলল, ‘গত দুদিনে তুমি এই প্রথম হাসলে।’

    লুসির কপালে ভাঁজ। মুখের হাসি উধাও। সে বলল, ‘রিভলভার দেখে ভয় পেয়েছিলাম। ওই ঘটনার পর থেকে শেকি হয়ে গেছি।’

    ‘কে রিভলভার দেখাল?’ প্রশ্ন করেছে তনয়া।

    মেঘনাদ বলল, ‘সে প্রসঙ্গ এখন থাক।’

    লুসি ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কথা ঘোরালো, ‘ডোনারের কী খবর?’

    ‘মেয়েটার কিছু হয়নি। বালাজি ওকে আনতে গেছে। আশা করছি বিকেলের মধ্যে চলে আসবে। হঠাৎ করে সাব জিরো টেম্পারেচার থেকে কুড়ি ডিগ্রিতে চলে আসার ফলে বডিতে কোনও এফেক্ট হয়েছে কি না সেটা তনয়া দেখে নেবে। আমি মেডিক্যাল চেক আপ করে নেব। তারপর সোজা তোমার কাছে।’

    লুসি তনয়াকে বলল, ‘কাইমেরা কাকে বলে জানো?’

    ‘ক্যামেরা?’ ল্যাপটপের স্পিকারের দিকে তাকায় তনয়া। সাউন্ড সিস্টেমে গণ্ডগোল আছে নাকি?’

    ‘ক্যামেরা নয়। কাইমেরা। গ্রিক মিথোলজিতে এই প্রাণীর কথা বলা আছে। যার মাথা সিংহের, শরীর ছাগলের আর ল্যাজ সাপের। কাইমেরা মানে একই শরীরে দুই আলাদা প্রজাতির অবস্থান।’

    ‘তার মনে হাঁসজারু বা বকচ্ছপ—এরা কাইমেরা?’ উত্তেজিত হয়ে বলে তনয়া।

    মেঘনাদ তার পিঠে হাত রেখে বলে, ‘আবোল-তাবোল নয়, লুসি জেনেটিক্স নিয়ে কথা বলছে।’

    ‘ও। সরি।’ ভিতরের উত্তেজনা চেপে রেখে তনয়া বলে, ‘বলো লুসি। আর তোমাকে বিরক্ত করব না।’

    ‘না, না, আমি বিরক্ত হইনি। কাইমেরার প্রসঙ্গ উঠলেই লোকে সাহিত্য থেকে রেফারেন্স দেয়। তারা ভুলে যায়, আমাদের চারপাশে অজস্র কাইমেরা ছড়িয়ে রয়েছে। দেখি, তুমি কেমন বলতে পারো।’

    ‘উমম…জোড়কলম গাছ।’

    ‘ব্যাং অন! আর কিছু? প্ল্যান্ট থেকে হিউম্যানে এসো।’

    তনয়া অনেক ভেবেও উত্তর দিতে পারল না। পাশ থেকে মেঘনাদ বলল, ‘এটা তোমার পারা উচিত। জুজুর কথা ভাবো।’

    দ্বিধাগ্রস্ত গলায় তনয়া বলল, ‘যাদের শরীরে অন্যের ব্লাড গিয়েছে?’

    ‘একদম ঠিক। কেন না জুজুর শরীরে ব্লাড ডোনারের কোষ রয়ে গেছে।’

    ‘অরগ্যান ট্রানসপ্ল্যান্টের রুগিরাও কাইমেরা?’

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘প্রথমার অরগ্যান ট্রানসপ্ল্যান্ট হয়েছিল?’ জানতে চায় তনয়া।

    মেঘনাদ চুপ। লুসি বলল, ‘প্রথমাকে কাইমেরা বলেছি, তার অন্য কারণ আছে। তুমি মেঘনাদের কাছ থেকে জেনে নাও। আমার একটা ফোন এসেছে। ধরে নিই। তারপরে আবার অনলাইন হব।’

    ল্যাপটপের মনিটর থেকে লুসি অদৃশ্য হয়ে যায়। তনয়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে মেঘনাদ বলে, ‘তুমি ডলির নাম শুনেছ?’

    ‘ডলি? মানে সেই ফার্স্ট ক্লোনড ভেড়া?’

    ‘হ্যাঁ। সেই ডলি। ১৯৯৬ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বিজ্ঞানী মিলে ডলিকে তৈরি করেন। ২০০৩ সালে ডলি মারা যায়। ডলি সম্পর্কে বলা হয় যে ল্যাবরেটরিতে তৈরি প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানুষের স্তনের কোষ থেকে নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার পদ্ধতির মাধ্যমে ডলিকে তৈরি করা হয়।’

    ‘শুনেছিলাম বটে!’ মুচকি হেসে বলে তনয়া ‘ম্যাম্যারি টিস্যুর সেল থেকে ডলির জন্ম বলেই ডলির আবিষ্কর্তা ভেড়ার নাম রেখেছিলেন ডলি। আমেরিকার সিঙ্গার-সং রাইটার এবং অভিনেত্রী ডলি পার্টন তাঁর ব্রেস্ট সাইজের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।’

    ‘গুড ট্রিভিয়া।’ শ্রাগ করে মেঘনাদ, ‘বিজ্ঞানী হিসেবে তোমার মনে এই প্রশ্ন আসা উচিত ছিল যে একটা সেল লাইন থেকে আস্ত একটা ভেড়া তৈরি হল কী করে? তাহলে কি ওটা টোটিপোটেন্ট স্টেম সেল ছিল? যে আদি মাতৃকোষ থেকে মাতৃগর্ভে সন্তানের সৃষ্টি হয়, সেই আদি কোষ থেকে কি ল্যাবরেটরিতেও মানুষ তৈরি সম্ভব?

    ৯

    বাগনান থেকে সাঁত্রাগাছি। ২ অক্টোবর।

    সকাল সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা।

    .

    মোবাইলের ফড়ফড়ানিতে চমকে উঠে প্রথমা বালাজির দিকে তাকাল। বালাজি বলল, ‘কী হল? চমকে উঠলে কেন?’

    ‘কিছু না…’ আমতা আমতা করে বলে প্রথমা, ‘আমাকে এক ভাঁড় চা খাওয়াবেন? স্টেশনে বিককিরি হচ্ছে।’

    ‘চা খাসব? দাঁড়াও আনছি।’ তড়বড়িয়ে সিট থেকে উঠে দরজার দিকে এগোয় বালাজি। উলুবেড়িয়া স্টেশানে অনেক লোক নামল। জানলা দিয়ে প্রথমা দেখল, বালাজি চায়ের দোকানে।

    দ্রুত প্যাকেট থেকে ফোন বার করে প্রথমা। দেখে, মোবাইলের স্ক্রিনে অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ, ‘আমি গণেশদা।’

    প্রথমা নম্বরটায় ফোন করে। পিছন ফিরে দেখে, সেই লোকটাই ফোন ধরেছে।

    ‘হ্যালো?’ মুখ ঘুরিয়ে ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে প্রথমা। বালাজি চায়ের পয়সা মেটাচ্ছে। চা-দোকানি দুটো ভাঁড়া দু’হাতে ধরে আছে। ট্রেনের হর্ন এখনও বাজেনি।

    ‘শেষবারের মতো বলছি, বালাজির সঙ্গে যাস না। যদি যাস, তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

    ‘কার সর্বনাশ হবে?’

    ‘তোর তো হবেই, আরও অনেকের হবে। ফোনে বলা যাবে না। তুই নামিস না, প্লিজ।’

    ‘তোমার কথা শুনলে বিপদে পড়ব না, এরকম গ্যারান্টি আছে?’

    ‘আছে।’

    ট্রেন হর্ন দিল। দুটো ভাঁড় ব্যালান্স করতে করতে বালাজি ট্রেনের কামরার দিকে আসছে। প্রথমা বলল, ‘লাস্ট চান্স দিলাম। এমন কিছু বলো, যাতে আমি কনভিন্সড হই যে, তুমি গণেশদা। ফ্রড নও।’

    ‘শোন তাহলে’, ফিসফিস করে বলে লোকটা, ‘তুই গত পাঁচ বছর ঘুমিয়েছিলি। তোকে যখন ঘুম পাড়ানো হয়েছিল, তখন তোর বয়স ষোলো। আজ তুই একুশ। তুই আমাকে শেষ দেখেছিলি পাঁচ বছর আগের এক রাতে। পাঁচ বছরে আমার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। তাই তুই চিনতে পারছিস না।’ ফোন কেটে দেয় লোকটা।

    প্রথমার মাথায় চিড়িক চিড়িক করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সে গত পাঁচ বছর ঘুমিয়েছিল? কীভাবে? কেন? কোথায়? রিপ ভ্যান উইঙ্কলের গল্প তার জীবনে ঘটছে নাকি? না, লোকটা ফোনে আজেবাজে বকছে? মোবাইল ব্যাগে লুকোতে লুকোতে প্রথমার মনে পড়ে, আজ ভোরবেলা খবরের কাগজ পড়ে সে জেনেছে যে ভারতের রাষ্ট্রপতি বদলে গেছে। গতকাল রাতে তার যা চেহারা ছিল, তার সঙ্গে আজ সকালে দেখা চেহারার কোনও মিল নেই। সে অনেক বড় হয়ে গেছে।

    তাহলে গতকাল রাতের স্মৃতি বলে যেটাকে প্রথমা আঁকড়ে আছে, সেটা আসলে পাঁচ বছর আগের কোনও এক রাতের স্মৃতি? এরকম আবার হয় নাকি?

    চায়ের ভাঁড় হাতে বালাজি আবার প্রথমার সামনের সিটে। ভাঁড় এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই নাও।’ ভাঁড় নিতে হাত তোলে প্রথমা। বলে, ‘বাপ রে! কাঁধে কী ব্যথা।’

    বালাজি বলে, ‘বাঁ-হাতে লেগেছে না? ডান হাতে ব্যথা হল কী করে?’

    ‘জানি না।’ চায়ে চুমুক দিয়ে প্রথমা বাইরের দিকে তাকাল। পরপর কয়েকটা স্টেশান চলে গেল। খালি ভাঁড় জানলা দিয়ে ফেলে বালাজির দিকে তাকাল প্রথমা। বালাজি খুব মন দিয়ে তাকে দেখছিল। ধরা পড়ে যাওয়ায় বোকা-বোকা মুখ করে চোখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাঁকরাইল এল। আর-এক ভাঁড় চা খাবে?’

    ‘হ্যাঁ।’ ঢক করে ঘাড় নাড়ে প্রথমা। বালাজি ট্রেনের কামরা থেকে নামলেই সে পিছন ফিরে দেখবে ওই লোকটা কী করছে। এখনও আছে, না হাল ছেড়ে পালিয়েছে।

    সাঁকরাইল স্টেশানে ট্রেন দাঁড়াতে বালাজি কামরা থেকে নেমে দৌড়োল চা-ওয়ালার কাছে। প্রথমা পিছন দিকে তাকাল। কামরায় লোক নেই বললেই হয়। যে ক’জন আছে, তার মধ্যে ওই লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। যাক বাবা। বাঁচা গেল! এর সঙ্গে যাবে, না ওর সঙ্গে, এই দোটানা শেষ। যে লোক পালিয়ে যায়, তার সঙ্গে পালানো যায় না।

    প্যাকেটের মধ্যে মোবাইল ফোন আবার ফড়ফড় করছে। লোকটা আবার ফোন করেছে। মোবাইল বার করার আগে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় প্রথমা। চা-ওয়ালা এখনও চা ঢালেনি।

    ‘হ্যালো?’ মোবাইল কানে দিয়ে বলে প্রথমা।

    ‘বালাজিকে স্টেশানে নামতে দেখে ফোন করলাম। ওই কামরায় লোক এত কমে গিয়েছে যে থাকার রিস্ক নিলাম না। পিছনের কামরায় চলে এসেছি।’

    ‘ও…’ আর কী বলবে বুঝতে না পেরে প্রথমা বলল, ‘আচ্ছা, আমার গাঁটে গাঁটে এত ব্যথা কেন? অ্যাক্সিডেন্টের জন্য?’

    ‘এই ব্যথা অ্যাক্সিডেন্টের জন্য নয়। গাঁটে গাঁটে ব্যথা একটানা পাঁচ বছর ঘুমোনোর কারণে। গত পাঁচ বছর তোর শরীরের কোনও জয়েন্ট নড়াচড়া করেনি। ঘুমন্ত অবস্থায় শরীর বেড়েছে তরতর করে। অব্যবহৃত জয়েন্টদের হঠাৎ কাজে লাগালে তারা বিদ্রোহ করবেই। এখন তুই যত নড়াচড়া করবি, তত ব্যথা কমবে। ভোরবেলা যখন তোর ঘুম ভেঙেছিল, তখনকার থেকে এখন ব্যথা অনেক কম না?’

    ‘হ্যাঁ ব্যথা কমেছে।’

    ‘আমার কথা মনে রাখিস। সাঁত্রাগাছিতে নামিস না!’ কাতর অনুরোধ করে লোকটা। প্রথমা ফোন কেটে প্যাকেটে ঢোকায়। বালাজি চায়ের ভাঁড় ব্যালান্স করে কামরায় উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। চায়ের ভাঁড় প্রথমার হাতে ধরিয়ে বালাজি বলল, ‘আর দুটো স্টেশান পরেই সাঁত্রাগাছি।’

    প্রথমা চায়ে চুমুক দিল। তার এখন আর কোনও টেনশান নেই। সাঁত্রাগাছিতে কী করবে সে ঠিক করে ফেলেছে।

    .

    সাঁত্রাগাছি স্টেশানে ট্রেন ঢুকছে। বালাজি সিট থেকে উঠে বলল, ‘চলো, আমাদের নামাতে হবে।’ নিজের আসন থেকে উঠতে গিয়ে ভুরু কুঁচকে প্রথমা বলল, ‘উফ! বাবাগো! পায়ে কী ব্যথা!’ বালাজি প্রথমার হাত ধরে বলল, ‘আস্তে আস্তে ট্রেন থেকে নামবে।’

    ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছে। এই কামরায় যত যাত্রী ছিল, সবাই নেমে গেল। প্রথমার হাত ধরে বালাজি ট্রেন থেকে নামাল। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে প্রথমা খেয়াল করল, তার হাত বালাজির শক্ত মুঠোয় বন্দি। প্রথমা আড়চোখে দেখল, তাদের কামরার ঠিক পিছনের কামরায় লোকটা নেই। কোথায় গেল তাহলে? আরও পিছনের দিকে? কে জানে? খোঁজার চেষ্টা ছেড়ে প্রথমা বালাজিকে বলে, ‘আমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তুমি হাত ছেড়ে দাও। আমি আস্তে আস্তে হাঁটব।’

    বালাজি মুঠো শিথিল করে বলল, ‘বাড়ি চলো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

    দুজনে হাঁটতে-হাঁটাতে ফ্লাই-ওভারের দিকে যাচ্ছে। ট্রেন হর্ন দিল। প্রথমা বলল, ‘একটা জলের বোতল কিনে দেবে? খুব তেষ্টা পেয়েছে।’

    বালাজি প্ল্যাটফর্মের দোকানে গিয়ে বলল, ‘একটা মিনারেল ওয়াটার দেখি।’

    ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্রথমার বাঁদিক দিয়ে চলে যাচ্ছে একের পর কামরা। এখনও ট্রেনের গতি স্লথ। এবার বাড়বে। বালাজি জলের বোতল হাতে নিয়ে দোকানিকে টাকা দিচ্ছে।

    এই মোক্ষম মুহূর্তটার জন্য প্রথমা অপেক্ষা করছিল। সে দৌড় দিল।

    ‘কোথায় যাচ্ছ?’ চিৎকার করে উঠল বালাজি। প্রথমার পাশ দিয়ে হুশহুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা দরজা। পিছনে দৌড়ে আসছে বালাজি। প্রথমা দৌড়োতে দৌড়োতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বালাজি লম্বা পদক্ষেপে তার দিকে তেড়ে আসছে। চিৎকার করে প্রথমা বলল, ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’

    হঠাৎ বাঁদিক থেকে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত প্রথমাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে নিল। কিছু বোঝার আগেই প্রথমা দেখল, সে ট্রেনের কামরায়, লোকটার হাতে বন্দি। একহাতে কামরার দরজার হাতল ধরে অন্য হাতে লোকটা তাকে ট্রেনে তুলে নিয়েছে।

    প্রথমাকে মেঝেতে নামিয়ে লোকটা বলল, ‘ফালতু টেনশান খাওয়াচ্ছিলি কেন? তুই বুঝতে পারিসনি, আমি গণেশদা?’

    লোকটার কথার উত্তর না দিয়ে প্রথমা ট্রেনের দরজা দিয়ে পিছন দিকে তাকাল। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও এখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে রেলপুলিশের কয়েকজন লোক বালাজিকে ঘিরে ধরেছে। বালাজি মোবাইলে কাউকে ধরার চেষ্টা করছে।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশেষ নাহি যে – ইন্দ্রনীল সান্যাল
    Next Article ইন দ্য হ্যান্ড অব তালেবান – ইভন রিডলি

    Related Articles

    ইন্দ্রনীল সান্যাল

    শেষ নাহি যে – ইন্দ্রনীল সান্যাল

    July 10, 2025
    ইন্দ্রনীল সান্যাল

    মধুরেণ – ইন্দ্রনীল সান্যাল

    July 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.