২০. কাহিনি (অপারেশন ওয়ারিস্তান)
হেল্পিং হ্যান্ড থেকে রি-লাইফ। ২ অক্টোবর।
দুপুর সওয়া তিনটে থেকে দুপুর সাড়ে তিনটে।
.
প্রথমে এল দর্শনের অনুভূতি। চোখ খুলে প্রথমা দেখল, সে একটা চেয়ারে বসে। ঘাড়ে অসম্ভব ব্যথা। ওখানেই পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরেছিল তার সৃষ্টিকর্তা। তার বিনাশকারী। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রথমা দেখল, তার একপাশে, চেয়ারে বসে রয়েছে গণেশদা আর সিন্টু। অন্য পাশে বসে রয়েছে ষষ্ঠী। সামনের চেয়ারে বসে রয়েছে মেঘনাদ। মেঘনাদের পাশে বসে রয়েছে লাল হ্যাচব্যাকের ড্রাইভার, সেই বয়স্ক লোকটা। দুজনের হাতে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র। বালাজি আর বুনোকে দেখা যাচ্ছে না। বয়স্ক লোকটা আর মেঘনাদ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
দর্শনের পরে এল শ্রবণের অনুভূতি। প্রথমা শুনল বয়স্ক লোকটা বলছে, ‘থ্যাঙ্ক ইয়ু ডক্টর লাহিড়ি। আপনি না থাকলে অরগ্যান ডোনার পাওয়া যেত না।’
প্রথমা শিউরে উঠে গণেশের দিকে তাকাল। গণেশের চোখ মেঝের দিকে। মেঘনাদ বলল, ‘রকি চৌধুরী থাকতে আমাকে প্রবলেম সলভ করতে হল? আমি বিজ্ঞানী। আপনি ওয়ারিস্তানের সেনাপ্রধান। আপনার কাজ আমি করে দিলে আপনি তো বেকার হয়ে যাবেন!’
‘রকি চৌধুরী?’ গর্জন করে ওঠে গণেশ। ‘ওয়ারিস্তানের আর্মি চিফ? আপনার সঙ্গে এই শয়তানটার কী দরকার? ওয়ারিস্তানের কোন যুদ্ধবাজের জন্য প্রথমাকে বলি চড়ানো হচ্ছে? রাজু মণ্ডল? যার আত্মগোপনের খবরে আজ সারাদিন টিভি সরগরম?’
রকি চিবুকে তর্জনী টকটক করে বলল, ‘ইয়োর ডায়াগনসিস ইজ স্পট অন, বাডি।’
রকির কথা না শুনে গণেশ চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘ডক্টর লাহিড়ি। আপনি জিনিয়াস, আমি জানি। আপনি উন্মাদ, আমি জানি। ম্যাড সায়েন্টিস্টের কোনও তালিকা বেরোলে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, ডক্টর মোরো, ফাউস্ট আর ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভের আগে আপনার নাম বসবে। কিন্তু ইতিহাসের এত বড় ভিলেন আপনি হবেন না, প্লিজ! প্রথমার অরগ্যান দিয়ে যুদ্ধবাজকে বাঁচাবেন না। তাহলে ভারত-ওয়ারিস্তানের যুদ্ধ বাঁধবেই। সেটাই হবে থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার। ভারত, ওয়ারিস্তান, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট সাউথ ইস্ট এশিয়া—সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রথমা মরলে ভারত মরবে। প্রথমা বাঁচলে ভারত বাঁচবে। আপনি ভারতীয় নন?’
মেঘনাদ মন দিয়ে গণেশের কথা শুনছিল। কোল্টের নল গণেশের রগে ঠেকিয়ে বলল, ‘ফাউস্টের সঙ্গে আমার তুলনা কেন? সে নিজের আত্মা শয়তানকে বিক্রি করেছিল। আমি অত কিছু করিনি। আমি নিজের মতো করে বিজ্ঞানচর্চা করেছি। সেই চর্চায় ইন্ডিয়া আমাকে কোনও সাহায্য করেনি। সাহায্য করেছে ওয়ারিস্তান। ওই দেশটা আমায় ফান্ডিং না করলে আমার স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থাকত। আমি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকলে সেটা আমার দোষ নয়। ওয়ারিস্তান সময়ের থেকে এগিয়ে থাকলে সেটা ওয়ারিস্তানের দোষ নয়। ইন্ডিয়ার এথিকস, ইন্ডিয়ার মর্যালিটি, ইন্ডিয়ার লিগ্যাল সিস্টেম এখনও মান্ধাতার বাবার আমলে পড়ে থাকলে সেটা ইন্ডিয়ার দোষ। কে যেন বলেছিল, ”হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া উইল থিঙ্ক টুমরো।” আমি বলি, ”হোয়াট মেঘনাদ লাহিড়ি অ্যান্ড ওয়ারিস্তান থট ডে বিফোর ইয়েস্টারডে, হোল ওয়ার্ল্ড উইল থিঙ্ক ডে আফটার টুমরো।” বুঝলি?’
রকি চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘আমরা সময় নষ্ট করছি। ফ্লাইটের আর দেড় ঘণ্টা বাকি। আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। এতজনকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কয়েকজনকে ডিসপোজ অফ করতে হবে।’
রকির কথা শুনে মেঘনাদ গণেশের পাশে গেল। গণেশ চমকে উঠে প্রথমার দিকে তাকাল। ষষ্ঠী চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি কী করছেন?’
মেঘনাদ প্রথমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর গণেশের রগে কোল্ট ঠেকিয়ে গুলি করল।
প্রথমা চিল চিৎকার করে উঠল। জলজ্যান্ত গণেশদা এক লহমায় রক্তমাংসের তালে পরিণত হয়েছে। মাথার ঘিলু, হাড়ের টুকরো, রক্তের ফোঁটা এসে লেগেছে প্রথমার সালোয়ার কামিজে। চেয়ার থেকে উঠে সে গণেশকে জড়িয়ে ধরে।
গুলির আওয়াজ শুনে ঘরে ঢুকেছে বালাজি আর বুনো। বুনো প্রথমাকে চেয়ারে বসিয়ে হাতদুটো পিছমোড়া করে ধরেছে। প্রথমার নড়ার উপায় নেই। প্যান্টের পকেট থেকে অ্যাম্পুল আর সিরিঞ্জ বার করে মেঘনাদ বলল, ‘এনি লাস্ট উইশ, শিম্পাঞ্জির বাচ্চা?’
শিম্পাঞ্জির বাচ্চা। নিজের উৎস জেনে ভালো লাগছে প্রথমার। শিম্পাঞ্জি! যার স্মৃতিশক্তি মানুষের থেকে অনেকগুণ বেশি। হিপনো-সেরামের বিন্দু রক্তে প্রবেশ করতে শুরু করলেই নিজের ওপরে আর কোনও কনট্রোল থাকবে না প্রথমার। রকি আর মেঘনাদের হাতের পুতুল হয়ে সে পৌঁছে যাবে কলকাতা বিমানবন্দর। সেখান থেকে কেরালার রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টারে। তার শরীর থেকে সমস্ত অরগ্যান খুবলে নিয়ে হাড়, মাংস আর চামড়া ফেলে দেওয়া হবে। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে প্রথমার মনে পড়ে যায় আজকের সারা দিন। ২ অক্টোবর! অন্ধকারে জ্ঞান ফেরা…আশেপাশে পড়ে আছে ট্রাক, অ্যাম্বুল্যান্স আর মৃতদেহ…খবরের কাগজ দেখে সাল ও তারিখ জানা, উমার সঙ্গে আলাপ…
‘কোনও শেষ ইচ্ছে?’ ইঞ্জেকশন দেওয়ার আগে আবার প্রশ্ন করেছে মেঘনাদ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রথমা। ছলছল চোখে বলল, ‘আমি আসব বলে ষষ্ঠী পায়েস বানিয়েছিল। ওই যে, টেবিলের ওপরে রাখা রয়েছে। গণেশদা আর নেই। আমি ষষ্ঠী আর সিন্টুকে পায়েস খাওয়াতে চাই।’
‘ফেয়ার এনাফ!’ এক পা পিছিয়ে বলে মেঘনাদ। ‘এক চামচ করে খাইয়ে দাও। তবে তুমি খাবে না। তুমি এম্পটি স্টম্যাকে থাকবে।’
‘ক্যান ইট বি পয়জন?’ উত্তেজিত রকি প্রশ্ন করেছে।
‘আই ডোন্ট থিঙ্ক সো। ইভন ইফ ইট ইজ, দ্য ডোনার ইজ নট হ্যাভিং ইট।’ রকিকে আশ্বস্ত করে মেঘনাদ।
বুনো প্রথমাকে ছেড়ে দিয়েছে। সে চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের কাছে গেল। পায়েসের বাটি আর চামচ নিয়ে ষষ্ঠীর সামনে দাঁড়াল। ষষ্ঠীর চোখ মেঝের দিকে। ঠোঁট টিপে বন্ধ করা। এক চামচ পায়েস ষষ্ঠীর ঠোঁটে ঠেকিয়ে প্রথমা বলল, ‘খাও।’
ষষ্ঠী চোখ তুলল না। মুখও খুলল না। মেঘনাদ বলল, ‘হারি আপ। নাটক বন্ধ করো।’
প্রথমা সিন্টুর কাছে গেল। ছেলেটা ভ্যাবলার মতো মুখ করে বসে আছে। এক চামচ পায়েস তার মুখের কাছে ধরে প্রথমা বলল, ‘পালা!’
সিন্টু এইরকম কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। চেয়ার থেকে তিড়িং করে উঠে দৌড় দিল দরজার দিকে। কিচেনের ল্যাচ খুলে বাঁদরের মতো লাফিয়ে বাইরে বেরোতে যাবে, এমন সময় রকির গ্লক থেকে একচিলতে আগুন বাতাস চেটে ধেয়ে গেল দরজার দিকে। বাতাসে শিসের শব্দ হল। সিন্টুর শিশুকণ্ঠের চিৎকারে ঝনঝন করে উঠল কিচেন। ‘ওরে বাবারে। মেরে ফেলল রে!’
বালাজি এগিয়ে গিয়ে কিচেনের দরজা বন্ধ করল। সিন্টুর ঘেঁটি ধরে আবার চেয়ারে বসাল। গুলি লেগেছে বাঁ-হাঁটুর নীচে। ঝরঝর করে রক্ত বেরিয়ে মেঝে লাল করে দিচ্ছে। ষষ্ঠী এতক্ষণে মুখ তুলে তাকিয়েছে। সে অবাক হয়ে প্রথমার দিকে তাকাল।
‘এনাফ ড্রামাবাজি হয়েছে। এবার চেয়ারে বোসো।’ গ্লক নেড়ে প্রথমাকে বলে রকি। ‘মানুষ মারা আমার কাছে রুটিন জব। বাচ্চাটাকে ইচ্ছে করে মারিনি। বডি ডিসপোজ করতে অসুবিধে হবে, তাই। তোমরা সবাই মরবে। তবে এখানে নয়, রি-লাইফে। আর আমাদের ডোনার তো অনেক বড় কাজের জন্য বলিপ্রদত্ত।’
পেট্রিডিশে জন্মমুহূর্ত থেকে প্রথমা বলিপ্রদত্ত। ভাড়াটে জরায়ুতে ভ্রূণ হিসেবে বড় হওয়ার সময় থেকে বলিপ্রদত্ত। রি-লাইফ অনাথ আশ্রমে বড় হবার সময় থেকে বলিপ্রদত্ত। ক্রায়োনিকসের জটিল এক্সপেরিমেন্টে পাঁচবছর একটানা ঘুমনোর সময়েও বলিপ্রদত্ত।
সেই বলির সময় এসে গেছে। পায়েসের বাটি কিচেনের টেবিলে রেখে চেয়ারে বসতে বসতে প্রথমা ভাবল, বলির পাঁঠার আপত্তির কথা কেউ শোনে না। হাড়িকাঠে মাথা দিয়ে পাঁঠা কি কিছু ভাবে? পাশবিক আর্তনাদ ছাড়া তার কাছে প্রতিবাদের আর কোনও ভাষা থাকে না। কিন্তু প্রথমা পশু নয়। মানুষও নয়। আধা মানুষ-আধা শিম্পাঞ্জির কাইমেরা। তার আর কিছু নেই। শুধু স্মৃতি আছে। স্মৃতিই তার অস্ত্র!
মেঘনাদ এগিয়ে এল। বুনো আবার প্রথমার হাত চেপে ধরল। প্রথমার হাতের ধমনীতে ইনজেক্ট করল নীল তরল।
আশ্চর্য এক মিষ্টি অনুভূতি হচ্ছে প্রথমার। মনে হচ্ছে, সে যেন নিজের শরীর থেকে বেরিয়ে বাতাসে উড়ছে। উড়তে উড়তে ওপর থেকে দেখছে, তিনটে চেয়ারে বসে রয়েছে, প্রথমা, ষষ্ঠী, আর সিন্টু। দাঁড়িয়ে মেঘনাদ, বালাজি, বুনো আর রকি। রকির নির্দেশে প্রথমাকে চ্যাংদোলা করে কিচেন থেকে বার করছে বালাজি আর বুনো। পিছন পিছন হাঁটছে ষষ্ঠী আর সিন্টু। তাদের পিছনে গ্লক হাতে রকি। মেঘনাদ মোবাইলে বলছে, ‘লুসি, ওটির জন্য রাজুকে প্রিপেয়ার করো। তোমার ডোনার ছ’ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে রি-সাইকলে পৌঁছে যাবে।’ রকি ট্যাব থেকে ফোন করে বলছে, ‘হ্যালো! আমি রকি চৌধুরী বলছি…’
প্রথমার মাথা জুড়ে, হৃদয় জুড়ে, শরীর জুড়ে সাত রঙের রামধনু, সাত সুরের সিমফনি, আনন্দের সপ্তম স্বর্গ! তারপর সব অন্ধকার!
বুনো ছাড়া সবাই হেল্পিং হ্যান্ড ছেড়ে চলে গেল। বালাজি গাড়ি চালাচ্ছে। সামনের সিটে বসে রকি ট্যাবে কথা বলছে। পিছনের সিটের লেগস্পেসে শুইয়ে রাখা আছে প্রথমাকে। পিছনের সিটে বসে ষষ্ঠী, সিন্টু আর মেঘনাদ। মেঘনাদের কোল্ট ষষ্ঠীর পেটে ঠেকানো। হেমারেজ হয়ে সিন্টু প্রায় অজ্ঞান। মেঘনাদ ফোনে লুসির সঙ্গে কথা বলছে…
হেল্পিং হ্যান্ডে রয়ে গেছে বুনো। মলিনা আর গণেশের বডির গতি করতে হবে। মেঘনাদের পরামর্শ মেনে দুটো বডিকেই কেটে টুকরো করে রাখতে হবে। রি-লা