১০. বিকেন্দ্রীকরণ : ক্ষমতার দ্বৈত হস্তান্তর (Double Devolution)
১০.১ বিকেন্দ্রীকরণের প্রভাব ও প্রকারভেদ
গত শতকের ষাটের দশকের প্রথম দিকে গল্পটি লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খানের নামে প্রচলিত ছিল। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড়ের পর তিনি উপদ্রুত অঞ্চল সফরে যান। সেখানে তাঁকে খবর দেওয়া হয় যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা সাত দিনের মধ্যে প্রণয়ন না করলে কেন্দ্ৰীয় সরকারের পক্ষে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে না। এই বার্তা পেয়ে আজম খান সঙ্গে সঙ্গে চিফ সেক্রেটারিকে ফোন করেন এবং বলেন, ‘Mr. Chief Secretary, I want the distressed person’s list in 6 days time (তিনি হাতে এক দিন সময় রাখেন and if you can not deliver on time I will give you a kick in the back.” সামরিক কর্মকর্তার গালি খেয়ে চিফ সেক্রেটারি কমিশনারকে ফোন করলেন এবং বললেন, ‘Mr. Commissioner I want this damn list in 5 days’ time and if you can not deliver on time I will give you two kicks on your back.’ কমিশনার এই ফোন পেয়ে ডেপুটি কমিশনারকে ফোন করলেন এবং বললেন, চার দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য তাঁকে দিতে হবে, অন্যথায় ডেপুটি কমিশনারের পিঠে তিনি তিনটি লাথি মারবেন। ডেপুটি কমিশনার সঙ্গে সঙ্গে মহকুমা প্রশাসককে ফোন করলেন এবং বললেন যে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে, তা তিন দিনের মধ্যে দিতে হবে আর না দিতে পারলে তাঁর পাছায় চারটি লাথি দেওয়া হবে। মহকুমা প্রশাসক সার্কেল অফিসারদের ফোন করলেন এবং বললেন, দুই দিনের মধ্যে সব তথ্য তাঁর কাছে পৌঁছাতে হবে আর যদি সার্কেল অফিসার এ কাজ যথাসময়ে করতে না পারেন, তবে তাঁর পাছায় পাঁচটি লাথি দেওয়া হবে। সার্কেল অফিসার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে জানালেন, দুদিনের মধ্যে তাঁকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হবে, অন্যথায় তাঁর পাছায় পড়বে ছয়টি লাথি। লাথির হুমকিতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান চৌকিদারকে ডেকে তাঁর পাছায় একটি লাথি মারেন এবং বলেন, এক দিনের মধ্যে সব তথ্য সংগ্রহ করে তাঁকে দিতে হবে, অন্যথায় তাঁর কপালে আরও লাথি জুটবে। মনের দুঃখে চৌকিদার অফিস থেকে বের হয়ে সামনে যে ব্যক্তিকে পেলেন, তাঁকে প্রথমে চড় মারলেন ও তারপর তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলেন। নামটি সঙ্গে সঙ্গে কাগজে টুকে নিলেন। তারপর ভাবলেন যে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির নাম চেয়েছে। শ দুয়েক নাম হলেই তাঁর কাজ হয়ে যাবে। তিনি লোকটিকে বললেন যে তাঁকে আরও ১৯৯টি নাম বলতে হবে, অন্যথায় তাঁকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। ইতিমধ্যে চৌকিদারের কাণ্ড দেখে রাস্তায় লোক জড়ো হয়ে গেছে। সবার সহযোগিতায় এক ঘণ্টার মধ্যে দুই শ নামের তালিকা তৈরি হয়ে গেল। চৌকিদার সঙ্গে সঙ্গে তা চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করলেন। চেয়ারম্যান সঙ্গে সঙ্গে তা ওপরের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। এমনি করে সারা বিভাগের তথ্য যথাসময়ে সংকলিত হয়ে গভর্নরের কাছে যথাসময়ে পৌঁছায়। গভর্নর মহাখুশি যে বেঁধে দেওয়া সময়ের অনেক আগেই তাঁর প্রশাসন কাজটি সম্পন্ন করেছে। প্ৰশাসন সাফল্য দাবি করলেও আসলে কাজটি ব্যর্থ হয়। যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়, সে তালিকা ভুয়া এবং যখন রিলিফ আসে, তখন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও চৌকিদার ভুয়া লোকদের জন্য প্রেরিত ত্রাণ অতি সহজে আত্মসাৎ করেন। ওপরের দিকে কর্তারা এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারেন যে তাঁদের প্রশাসনব্যবস্থা কার্যকর এবং ঠিক সময়ে কাজটি করেছে। কিন্তু আসলে দেখা গেল যে ওপরের কর্মকর্তারা যতই হম্বিতম্বি করুন না কেন, লাথি খেয়েছেন চৌকিদার আর চড় খেয়েছেন সাধারণ মানুষ। দুর্গত ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করা যায়নি আর ভুয়া তালিকায় রিলিফের মাল হয়ে গেছে চুরি। এ ধরনের কেন্দ্রীভূত প্রশাসনে জনগণের কোনো অংশ নেই এবং কার্যকর প্রশাসনের দৌলতে অতি দ্রুত তালিকা তৈরি হলেও জনগণের কোনো লাভ হয়নি।
মানুষের কল্যাণের জন্য প্রয়োজন হলো তৃণমূলের ক্ষমতায়ন। বেশির ভাগ রাষ্ট্রে ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়াই হচ্ছে আজকের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গিডেন্স তাই বলছেন :
Democratising democracy means having an effective devolution of power, where-as in Britain it is still strongly concentrated at the national level.[১]
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সুফল অনেক। প্রথমত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি প্রধান শক্তি হলো এই ব্যবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার রোধকল্পে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। এক স্তরে অনাচার হলে অন্যস্তরে এর প্রতিকার পাওয়া যায়; একটি প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হলে অন্য প্রতিষ্ঠানটি এই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়। পৃথিবীতে দুই ধরনের সরকার রয়েছে। এক ধরনের সরকার হলো এক স্তরভিত্তিক, যাকে ইংরেজিতে বলে Unitary সরকার। দ্বিতীয় ধরনের সরকারে একাধিক স্তর রয়েছে এবং এদের অধিকাংশই ফেডারেল সরকার নামে পরিচিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় স্তর এবং প্রাদেশিক স্তরের মধ্যে ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন করা হয়। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে না। কোনো কোনো বিষয়ে প্রাদেশিক সরকারের সিদ্ধান্তই হয় চূড়ান্ত। যেখানে একাধিক স্তরবিশিষ্ট সরকার নেই, সেখানে আইনের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত হয়।
দ্বিতীয়ত, বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তি অথবা জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করতে পারে। সরকার যত বড় হয়, তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ তত কমে যায়। বড় জনগোষ্ঠীর সরকারে সাধারণত পরোক্ষ প্রতিনিধিত্ব থাকে। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষুদ্র সরকার অত্যাবশ্যক।
তৃতীয়ত, তৃণমূল পর্যায়ের সরকারে যেসব রাজনীতিবিদ অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা সরকারে বিভিন্ন কাজ পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁরা জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে শাসনকাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তি পাওয়া যায়। যদি তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষমতা না থাকে, তাহলে রাজনীতিবিদদের প্রশিক্ষণের কোনো সুযোগ থাকে না।
চতুর্থত, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের একটি সুফল হলো, এটি জনগণের কাছে উন্নত সেবা প্রদান করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। বিকেন্দ্রীকরণের ফলে যাদের কল্যাণের জন্য সরকার-ব্যবস্থা নেয়, তারা তাদের বক্তব্য সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারে। উপরন্তু সরকারের পক্ষেও উপকারভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ হয়। তাই সামগ্রিকভাবে তৃণমূলে ক্ষমতা হস্তান্তর নাগরিকদের সেবার মান উন্নত করে।
পঞ্চমত, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ জবাবদিহির সহায়ক। যেখানে তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিরা সরকার পরিচালনা করেন, সেখানে তাঁরা জনগণের কাছাকাছি থাকেন। তাঁদের সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ মেলামেশা ঘটে, তাই জনগণ সহজেই তাদের দাবিদাওয়া তাঁদের কাছে তুলে ধরতে পারে।
ষষ্ঠত, যেসব রাষ্ট্রে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেসব দেশে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দ্বন্দ্ব হ্রাসে সহায়ক হতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ে ‘অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে সেসব সমস্যা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে না। এর ফলে বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় সংহতি বাড়িয়ে দেয়।
সবশেষে যেখানে বহুস্তরবিশিষ্ট সরকার রয়েছে, সেখানে নিম্ন পর্যায়ে সরকারের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগিতায় যেসব সরকার নিম্নস্তরে ভালো কাজ করে, তারা কাজের মানের মাপকাঠি প্রতিষ্ঠা করে। এই মাপকাঠির ভিত্তিতে যে প্রতিযোগিতা হয়, তাকে yardstick competition বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রতিযোগিতার ফলে দেশে স্থানীয় সরকারের মান উন্নীত হয়।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা প্রধানত চার ধরনের হতে পারে :
• শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ স্তর থেকে নিচের স্তরগুলোতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এ ধরনের ব্যবস্থাকে ইংরেজিতে Devolution বলা হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য হলো কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব এবং কার্যাবলি বিভিন্ন স্তরের সরকারের কাছে হস্তান্তর। এই হস্তান্তর স্থায়ীভাবে করার জন্য বিভিন্ন স্তরের সরকারের দায়িত্ব ও আর্থিক ক্ষমতা সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে বিধান করা হয়। তবে যেখানে সংবিধানে একাধিক স্তরের সরকার নেই, সেখানে স্থানীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। স্থানীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে একটা বড় তফাত হলো যে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর ফলে সরকার পরিবর্তন হলে এগুলোর পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু যেখানে প্রাদেশিক সরকার থাকে, সেখানে প্রাদেশিক সরকার সংবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজেই প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধি শুধু আইনের মাধ্যমে সম্ভব নয়, এ জন্য শাসনতন্ত্র সংশোধনের প্রয়োজন হয়। তাই প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয় না; কারণ, তারা জানে যে তাদের ক্ষমতা সংবিধানে সংরক্ষিত রয়েছে। তবে যেখানে আইনের শাসন বলবৎ রয়েছে, সেখানে বিকেন্দ্রীকৃত স্থানীয় সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হ্রাসে কোনো কোনো সময় সহায়ক হতে পারে।
• কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় এবং বিভাগসমূহের প্রশাসনিক ক্ষমতা আঞ্চলিক অথবা স্থানীয় পর্যায়ে হস্তান্তর। এই ব্যবস্থাকে ইংরেজিতে Deconcentration বলা হয়ে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে জাতীয় বিভাগসমূহের নতুন অফিস স্থাপন করে তাদের ক্ষমতা দিলেও এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। অন্যথায় আঞ্চলিক সরকার ও স্থানীয় সরকারকেও এ ধরনের ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। তবে এ ব্যবস্থা স্থায়ী নয়, কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যবস্থায় যেকোনো সময় পরিবর্তন আনতে পারে।
• সংবিধিবদ্ধ অথবা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কাছে সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর। এই ব্যবস্থাকে ইংরেজিতে বলা হয় Delegation। এই ব্যবস্থায় বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়, তবে এই ব্যবস্থা স্থায়ী নয়, পরিবর্তনশীল।
• বেসরকারি খাত অথবা বেসরকারি সংস্থায় সরকারের কার্যাবলি হস্তান্তর। ইংরেজিতে একে বলা হয় Privatization ।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে কোন দেশে কখন কী ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে, সেটা সে দেশের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।
এই প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে কীভাবে আরও গণতান্ত্রিক করা যায়, সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা। এ প্রবন্ধে চারটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগে বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতন্ত্রায়ণের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকারের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে সম্পর্কেও এই ভাগে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় ভাগে বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে প্রচলিত স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণের জন্য স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণের সম্ভাব্য কুফল ও তার সংশোধনের ব্যবস্থা সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। পঞ্চম খণ্ডে উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, সে সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করা হয়েছে।
১০.২ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : দিল্লিকা লাড্ডু?
কথায় বলে, ‘দিল্লিকা লাড্ডু যো খায়া হায় ও পস্তায়া, আর যো নেহি খায়া ও ভি পস্তায়া।’ এর অর্থ হলো, সুস্বাদু দিল্লির লাড্ডু যে খেতে পায়নি, সে নিশ্চয়ই দুর্ভাগা। কিন্তু এ লাড্ডু যে এত গুরুপাকের জিনিস, এটা সবাই হজম করতে পারে না। এর ফলে যাঁরা দিল্লির লাড্ডু খান, তাঁরাও অনেকেই পস্তান। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বিষয়টি অনেকটা দিল্লির লাড্ডুর মতো। যেখানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নেই, সেখানে অনেক জটিল সমস্যা দেখা দেয়। আবার যেখানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন রয়েছে, সেখানেও অনেক সমস্যা দেখা দেয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বিষয়টি হলো দুই ফলাবিশিষ্ট তরবারির মতো, যা এদিকেও কাটে, ওদিকেও কাটে। দেশের বাস্তব পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আবশ্যকতা।
বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো প্রদেশ নেই আর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কোনো সোচ্চার দাবিও নেই। প্রদেশ সৃষ্টির প্রস্তাব করলেই নিম্নলিখিত আপত্তিগুলো উত্থাপিত হবে।
• বাংলাদেশ একটি এক স্তরবিশিষ্ট (Unitary) রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছে। এর জনগোষ্ঠী সমরূপ, এখানে শুধু উপজাতীয় অঞ্চল ছাড়া কোনো ভিন্নতা নেই। এখানে প্রাদেশিক সরকারের দাবিও উত্থাপিত হয়নি, যদিও এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। গত ৪০ বছরের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে যোগাযোগ-ব্যবস্থার অভাবিতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছে। যমুনা সেতু নদী দ্বারা বিভক্ত দেশের দুটি প্রধান ভূখণ্ডকে একত্র করেছে। পদ্মা সেতু এই বন্ধনকে আরও দৃঢ় করবে। কাজেই বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ সৃষ্টি করলে জাতিকে বিভক্ত করা হবে।।
• এক স্তরবিশিষ্ট সরকারের বদলে দুই স্তরবিশিষ্ট সরকার প্রশাসনিক ব্যয় বাড়াবে। প্রশাসনিক ব্যয় অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে না। অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষ প্রশাসন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।
• অনেক দেশেই দেখা যায়, প্রাদেশিক সরকারসমূহ যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা জনস্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। এর ফলে ভারতের মতো দেশে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রাদেশিক সরকারসমূহকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্ৰণ করতে হয়। তবু ভারতে অনেক প্রাদেশিক সরকার রয়েছে, যাদের Bandit Democracy বা ডাকাতদের গণতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের সরকার সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসে না। যেখানে প্রদেশ নেই, সেখানে প্রদেশ সৃষ্টি করলে বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবি উঠতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, যেসব অঞ্চলে ভিন্ন ধরনের জনগোষ্ঠী রয়েছে, সেসব অঞ্চল কেন্দ্ৰ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি তুলতে পারে। উপরন্তু প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে স্থানীয় অভিজাত ব্যক্তিরা সুবিধা লাভ করেন, তাই দেশে আরও নতুন নতুন প্রাদেশিক সরকারের দাবি উঠতে থাকবে।
প্রদেশ সৃষ্টির সমস্যা অবশ্যই রয়েছে, তবু প্রদেশ সৃষ্টির কয়েকটি সুবিধা ও রয়েছে, যেগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
• প্রথমত, যে দেশে একটিমাত্র সরকার রয়েছে, সে দেশে কেন্দ্রীয় সরকারই সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়। এই সরকারে যদি একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তার বিরুদ্ধে জনগণের কোনো রক্ষাকবচ থাকে না। যেসব দেশে প্রাদেশিক সরকার আছে, সেসব দেশে কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি হয়। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সব ক্ষমতা থাকে না। বেশির ভাগ ফেডারেল রাষ্ট্রেই প্রাদেশিক সরকারের অধীনে পুলিশ থাকে। প্রাদেশিক সরকার অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবাহী হয় না। এর ফলে এ ধরনের সরকার একনায়কত্বের বিপক্ষে কাজ করে ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।
• দ্বিতীয়ত, সরকারের কাজ হলো মানুষের সেবা নিশ্চিত করা। যত ছোট সরকার হয়, জনসাধারণের তাতে অংশগ্রহণ করা সহজ হয়। সরকার বড় হলে সেটা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জনগণ সেই ধরনের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এমনকি তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথাও সরকারকে জানাতে পারে না। এর ফলে সরকারের কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ কমে যায়। বাংলাদেশে এটি একটি বড় সমস্যা। এখানে ১৬ কোটির বেশি লোক বাস করে অথচ সরকার মাত্র একটি। সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এর ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সরকারের কাছ থেকে সব সুযোগ-সুবিধা ও ন্যায়বিচার পায় না। এ ধরনের সমস্যা যে শুধু বাংলাদেশেই দেখা দিচ্ছে তা নয়, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও নতুন প্রদেশ সৃষ্টির দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। তিন শ বছর ধরে যুক্তরাজ্যে এক স্তরবিশিষ্ট রাষ্ট্র পরিচালনার পর এখন সেখানে নতুন প্রদেশ, এমনকি নতুন রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে তাই একক সরকারের বদলে প্রাদেশিক সরকার স্থাপনের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
• তৃতীয়ত, যেসব রাজনীতিবিদ কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন, তাঁদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে যেহেতু প্রাদেশিক সরকার নেই, সেহেতু রাজনীতিবিদেরা এ ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন না। প্রাদেশিক সরকার তাই রাজনীতিবিদদের মানোন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
প্রাদেশিক সরকার সুবিধা ও অসুবিধা বিবেচনা করলে মনে হয় যে বাংলাদেশের জন্য প্রাদেশিক সরকারের প্রয়োজন রয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, কতগুলো প্রদেশ বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট। যদি দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী থাকত, তাহলে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে প্রাদেশিক সরকার স্থাপন করা যেত। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠী সমরূপ। এখানে নতুন করে প্রদেশের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। একটি সমাধান হতে পারে দেশের ৬৪টি জেলাকে প্রদেশে উন্নীত করা। কিন্তু এর ফলে ব্যয়ভার অনেক বেড়ে যাবে। আরেকটি সমাধান হতে পারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে চারটি বিভাগ ছিল, সে চারটি বিভাগকে প্রদেশে উন্নীত করা। এটা করলে সরকারের ব্যয়ভার তত বাড়বে না কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে আটটি বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়া কুমিল্লা ও ফরিদপুরে দুটি নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বিভাগকে প্রদেশ করতে হলে কমপক্ষে ১০টি প্রদেশ করতে হবে। এতেও সমস্যার সমাধান হবে না। তার কারণ হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে এ ব্যবস্থায় বিভাগের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। যদি পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা প্রদেশের মর্যাদা দেওয়া হয়, তাহলে তা এই অঞ্চলের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিবেচনায় বাংলাদেশে ১১টি প্রদেশ স্থাপন করা যেতে পারে। এদের আয়তন ও জনসংখ্যা সারণি-১০.১-এ দেখা যাবে।
সারণি-১০.১
বাংলাদেশে প্রস্তাবিত প্ৰদেশসমূহ

সারণি-১০.১-এ প্রস্তাবিত বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল হবে ঢাকা বিভাগ, যার জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ১১ লাখ। সবচেয়ে কম জনসংখ্যা রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। এর জনসংখ্যা ১৬.৬৪ লাখ। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদ দিলে ফরিদপুরের জনসংখ্যাও অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে কম; এর জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় বিভাগ হলো খুলনা (২২,২৮৪ বর্গকিলোমিটার) আর সবচেয়ে ছোট বিভাগ হচ্ছে ফরিদপুর (৭,০০৫ বর্গকিলোমিটার)। ফরিদপুরকে প্রদেশ করার প্রয়োজন আছে কি না, সে সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথমত, আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় এটি ছোট। দ্বিতীয়ত, পদ্মা সেতু হলে ফরিদপুরের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়ে যাবে। ফরিদপুরের দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা ফরিদপুরে যাওয়ার চেয়ে ঢাকায় আসা পছন্দ করতে পারে। তবু যদি ফরিদপুরকে প্রদেশ না করা হয়, তাহলে ফরিদপুরের উত্তরাঞ্চলে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। অবশ্য ফরিদপুরকে বিভাগ করার একটি প্রধান যুক্তি হলো যে ঢাকা বিভাগের জনসংখ্যা অনেক বেশি এবং ফরিদপুরকে ঢাকা বিভাগে রাখলে ঢাকা বিভাগের জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি হবে। এর ফলে এ অঞ্চলের জনগণ প্রদেশ সৃষ্টির সুফল থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাই ফরিদপুরে একটি নতুন প্রদেশ স্থাপন করা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা প্রদেশের মর্যাদা দেওয়ার বিপক্ষে অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন যে এর ফলে সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। তবে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা হ্রাস করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামেই প্রথম প্রদেশ স্থাপন করা উচিত। শুধু প্রদেশ সৃষ্টি করলে হবে না, সেখানকার উপজাতিদের ভূমির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশে প্রদেশ স্থাপনের পক্ষে প্রধান যুক্তি হলো যে এখানে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত। কেন্দ্রীয় সরকারের সব ক্ষমতা আবার নির্বাহী বিভাগের প্রধানের হাতে কেন্দ্রীভূত। কাজেই এখানে কোনো Checks and Balance অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধকল্পে কোনো সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা নেই।
আয়তনে বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। এত ছোট দেশে প্রদেশ না করলেও চলে কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহৎ দেশ। ষোলো কোটি লোকের দেশে এক স্তরবিশিষ্ট সরকার পরিচালনা করে সরকারের পক্ষে সেবার মান উন্নত করা সম্ভব নয়। কাজেই বাংলাদেশে প্রদেশ সৃষ্টির প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।
১০.৩ বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার
আধুনিক অভিধায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার বাংলাদেশে ১৮৭০ সালে প্রথম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।[২] ১৮৭০ সালে The Bengal Village Chowkidari Act আইন জারি করা হয়। এই আইনে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পঞ্চায়েত মনোনয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৮৮৫ সালে The Bengal Local Self Government Act 1885 জারি করে তিন স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সর্বোচ্চ স্তরে জেলা বোর্ডকে স্থান দেওয়া হয়। এরপর মহকুমা পর্যায়ে লোকাল বোর্ড স্থাপন করা হয় এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন কমিটি স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে Bengal Village Self Government Act 1890-এর মাধ্যমে দুই- তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ মনোনীত প্রতিনিধি নিয়ে ইউনিয়ন বোর্ড স্থাপন করা হয়। লোকাল বোর্ড তুলে দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সংস্কার করা হয়। পল্লি অঞ্চলে এ ধরনের স্থানীয় সরকার গঠন করা ছাড়াও শহর অঞ্চলে মিউনিসিপ্যালিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় সরকার বলা চলে না। কারণ, এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত সরকার, এদের অর্থায়ন করত সরকার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় জমিদারদের সহায়তায় তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের নীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করত।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বজনীন ভোটাধিকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকে এবং স্থানীয় সরকারগুলো অর্থের অপ্রতুলতার জন্য তাদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। স্থানীয় সরকারকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য পাকিস্তানে প্রথম উদ্যোগ নেন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আইয়ুব সরকারের পেছনে কোনো গণসমর্থন ছিল না। দেশে আইয়ুব খান স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থাকে তাঁর সমর্থন গড়ে তোলার জন্য একটি কার্যকর সংস্থা হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। তিনি ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্র’ প্রবর্তন করেন। আসলে এই ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ছিল না। এই ব্যবস্থায় ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষমতা পান। ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যদের অর্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য সহজ ছিল। তাই আইয়ুব সরকার এই পদ্ধতি বেছে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে চার স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের ওপর থানা পরিষদ, থানা পরিষদের ওপর জেলা পরিষদ এবং জেলা পরিষদের ওপর বিভাগীয় পরিষদ স্থাপন করা হয়। কিন্তু এই পরিষদসমূহের মধ্যে এক ইউনিয়ন কাউন্সিল ছাড়া অন্যান্য স্থানীয় সরকারে সরকারি কর্মকর্তাদের সভাপতি নিয়োগ করা হয়। এর ফলে সামগ্রিকভাবে স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। মোটকথা, এই স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থা আইয়ুব খানের একনায়কত্বের খুঁটি হয়ে দাঁড়ায়। যে কারণে ১৯৬৯ সালে এক প্রচণ্ড গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ এই স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে।
স্বাধীনতার পর সংবিধানে স্থানীয় সরকারের বিধান রাখা হয় কিন্তু স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ১৯৭৫ সালে District Administration Act 1975 জারি করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে প্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তি অথবা নির্বাচিত প্রতিনিধি অথবা রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মধ্য থেকে জেলা গভর্নর নিয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার আগেই এক সামরিক অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাত হয় এবং বাংলাদেশে জেলা গভর্নর প্রথা চালু করা যায়নি। এরপর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক শাসনকর্তারা স্থানীয় সরকারকে গণসমর্থন তৈরির কাজে ব্যবহার করতে চান। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সময়কালে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামে গ্রামে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। এর একটি বড় কারণ হলো, গ্রাম সরকার ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা এর বিরোধিতা করেন। উপরন্তু গ্রাম সরকার-ব্যবস্থা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা শুরু হয়; এতে এ উদ্যোগ বিতর্কিত হয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালে গ্রাম সরকার-ব্যবস্থা বিলোপ করা হয় এবং স্থানীয় সরকার পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৮২ সালে থানা পরিষদের স্থলে উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। Local Government (Upazila Administration) Ordinance, 1982 জারি করে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় উপজেলা পরিষদকে। এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক সরকার উপজেলা পরিষদকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করে। এর ফলে উপজেলা পরিষদ আবার বিতর্কিত হয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে উপজেলা পরিষদ তুলে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে নতুন সরকার নির্বাচিত হলে উপজেলা-ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তন করা হয়।
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এখানে সামরিক শাসকেরাই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই এ ধরনের উদ্যোগ বিতর্কিত হয়েছে। জেনারেল আইয়ুব খান স্থানীয় সরকারভিত্তিক বুনিয়াদি গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেছিলেন কিন্তু প্রবল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে তাঁর সে উদ্যোগ সফল হয়নি। পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গ্রাম সরকার-ব্যবস্থার মাধ্যমে গণসমর্থন সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁর সে উদ্যোগও সফল হয়নি। তৃতীয় পর্যায়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ উপজেলা-ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে সামরিক শাসনের পক্ষে সমর্থন সৃষ্টির চেষ্টা করেন। সে প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। এর পরবর্তীকালে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য নতুন করে উদ্যোগ নেয়। এই সরকারকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন দেয় সামরিক বাহিনী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ সমাপ্ত হলে আবার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে এবং স্থানীয় সরকারের অনেক ক্ষমতা কেড়ে নেয়। উপরন্তু আইন সংশোধন করে নির্বাচিত এমপিদের স্থানীয় সরকার তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। যদিও ১৯৭২ সালের সংবিধানে জেলা পরিষদের বিধান করা হয় কিন্তু এখন পর্যন্ত, অর্থাৎ বাংলাদেশে গত ৪৫ বছরের ইতিহাসে, কখনো নির্বাচিত জেলা পরিষদ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতার পেছনে দুটি কারণ কাজ করেছে। প্রথমত, সামরিক শাসকেরা যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তাঁদের পেছনে অর্থবহ রাজনৈতিক সমর্থন থাকে না। দেশে একনায়কতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন দেওয়ার জন্য সামরিক শাসকেরা স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ ধরনের প্রচেষ্টা দেশের গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। বরং এ ধরনের উদ্যোগের ফলে দেশে গণ-আন্দোলন দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত, যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তাঁরা উপজেলা অথবা জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপস্থিতি পছন্দ করেন না। কারণ, এ ধরনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরবর্তীকালে সংসদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের মন্ত্রীরাও বিকেন্দ্রীকৃত স্থানীয় সরকার চান না। এর ফলে বাংলাদেশে নির্বাচিত জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি এবং নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের সংসদ সদস্যদের আজ্ঞাবহ করে রাখার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাঁরা শুধু ইউনিয়ন কাউন্সিলের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজি হন এই শর্তে যে ইউনিয়ন কাউন্সিলসমূহ সরকারের আদেশে পরিচালিত হবে। এই অবস্থাতে বাংলাদেশে শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা কম
লেখচিত্র-১০.১
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের কাঠামো

বাংলাদেশে বর্তমানে তিন ধরনের স্থানীয় সরকার রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে স্থানীয় সরকার রয়েছে, তা দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এই স্থানীয় সরকার কাঠামো সৃষ্টি করা হয়। এখানে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদের অধীনে তিনটি পার্বত্য জেলায় তিনটি জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং মিউনিসিপ্যালিটি ও পৌরসভা স্থাপন করা হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা পরিষদের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদ স্থাপন করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদকে কতগুলো ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে দুই ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রথমত, পল্লি অঞ্চলে তিন স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থা করা হয়েছে। সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে জেলা পরিষদ। তার নিচে উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা পরিষদের নিচে ইউনিয়ন পরিষদ। তবে এই ব্যবস্থা শহরাঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য নয়। শহর অঞ্চলে বড় শহরগুলোতে সিটি করপোরেশন এবং ছোট শহরগুলোতে তিন ধরনের মিউনিসিপ্যালিটি বা পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারগুলোর নিম্নলিখিত দুর্বলতা রয়েছে :
১. অনির্বাচিত অথবা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত জেলা পরিষদ। ১৯৭২ সালের সংবিধানে জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো জেলা পরিষদ নির্বাচন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। বর্তমানে জেলা পরিষদে পরোক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এখনো জেলা পরিষদ একটি সরকারি সংস্থা এবং একে স্থানীয় সরকারের মর্যাদা দেওয়া যায় না।
২. সরকারের নিয়ন্ত্রণ। সব স্থানীয় সরকারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রায় নিরঙ্কুশ। সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাময়িকভাবে কর্মচ্যুত করতে পারে এবং স্থায়ীভাবে অপসারণ করতে পারে। অবশ্যই স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কোনো অপরাধ করলে তাঁদের শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থার অসুবিধা হলো, সরকারই এখানে অভিযোগ গ্রহণ করে, অভিযোগের তদন্ত করে ও তদন্তের ভিত্তিতে বিচার করে। এ ধরনের ব্যবস্থায় সুষ্ঠু বিচারকাজ সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। আসলে অনেক ক্ষেত্রেই সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এর ফলে নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক কমে যায়। নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো প্রতিনিধি দোষ করলে তাঁকে নির্বাচকেরা ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে পারে। কিন্তু এই ক্ষমতা সরকার প্রয়োগ করলে তার অপব্যবহারের আশঙ্কা দেখা দেয়। এর একটি সমাধান হতে পারে যে সরকার স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত করবে কিন্তু শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকবে না। এর জন্য একটি স্বাধীন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশন অভিযুক্তের বক্তব্য ও তদন্ত প্রতিবেদন বিবেচনা করে যে সুপারিশ দেবে, সেই সুপারিশই সরকার গ্রহণ করবে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করেছিল। কিন্তু নির্বাচিত সরকার এই কমিশন বাতিল করে দিয়েছে।
৩. অর্থের জন্য জাতীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা। ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলোর একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ নিজেদের আয় থেকে বহন করে। বাকি ৭০ শতাংশ অর্থ আসে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। কেন্দ্রীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বেতন, সচিবের বেতন, চৌকিদারদের বেতন দিয়ে থাকে। উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের ব্যয়ও সরকারই বহন করে। উপজেলা পরিষদে সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বেশি। উপজেলা পরিষদ পরিচালনায় শুধু সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নই যথেষ্ট নয়, উপজেলা পরিষদকে স্থানীয় নির্বাচিত সংসদের পরামর্শও বাস্তবায়ন করতে হয়। জেলা পরিষদে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। সরকারের আদেশে ও মর্জি অনুসারে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার পরিচালিত হয়।
৪. স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মীদের মধ্যে সরকারের প্রাধান্য। উপজেলা পরিষদের প্রায় সব কর্মকর্তা সরকারি কর্মচারী। তাঁদের শাস্তি দেওয়ার বা পুরস্কৃত করার ক্ষমতা উপজেলা পরিষদের নেই। উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রেই উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সরকার কর্তৃক মনোনীত উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলে। ইউনিয়ন পরিষদের সচিবদের নিয়োগ ও চাকরি থেকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা ইউনিয়ন পরিষদের নেই। এই ক্ষমতাও সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে।
৫. স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের প্রাধান্য। স্থানীয় সরকার বিভাগের বেশির ভাগ প্রকল্পের বাস্তবায়ন স্থানীয় সরকার করে না। এগুলোর বাস্তবায়ন করে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এর ফলে স্থানীয় সরকারের সব বড় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকারের আওতাভুক্ত নয়। ২০১৬-১৭ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেট ছিল ১৬,৪৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮,১৬৮.৫ কোটি টাকা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নামে বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারের অধীন সব স্থানীয় সরকারকে (জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসমূহ) রাজস্ব ও উন্নয়ন খাতে সর্বমোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪,৫৭৫.৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে যে পরিমাণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ও বড় প্রকল্পসমূহ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত হয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ একটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা এবং এই সংস্থার ওপর স্থানীয় সরকারের কোনো খবরদারি নেই। তাই বাস্তবে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত সীমিত।
৬. স্থানীয় সরকারে স্থানীয় প্রতিপত্তিশালীদের (যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা Elites বা অভিজাততন্ত্র বলে থাকেন) প্রাধান্য। স্থানীয় সরকারে যেসব প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তাঁদের বেশির ভাগই উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির (যাঁরা হঠাৎ টাকা পেয়ে বড়লোক হয়ে গেছেন)। প্রান্তজনের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ক্ষীণ। অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধি স্থানীয় সরকারকে তাঁদের আয়ের একটি উৎস হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁদের অনেকে আদৌ পল্লি অঞ্চলে থাকেন না; তাঁরা শহরে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত এবং অনেকেই স্থানীয় সরকারকে মূলত শোষণের কাজে ব্যবহার করে থাকেন। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই বাংলাদেশে পল্লি অঞ্চলে ‘টাউট’ ব্যবস্থা চালু রেখেছেন।
উপরিউক্ত বিশ্লেষণ থেকে প্রশ্ন ওঠে যে বাংলাদেশে আদৌ কোনো স্থানীয় সরকার আছে কি না। Encyclopaedia of Social Sciences গ্রন্থে স্থানীয় সরকারের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে :
Local self-government’ is the government which has a territorial non- sovereign community having/possessing the legal right and the necessary organisation to regulate its own affairs.
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ভূখণ্ড সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়েছে এবং এরা অবশ্যই সার্বভৌম নয়। কিন্তু এদের নিজেদের বিষয় নিজেদের মতো করে পরিচালনার জন্য যথাযথ সংগঠন এবং আইনগত অধিকার নেই। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে স্থানীয় সরকার নেই। কেননা, তাদের নিজেদের কার্যক্রম নিজেদের মতো করে পরিচালনা করার পুরোপুরি আইনগত অধিকার এবং সংগঠন নেই। বাংলাদেশে তাই স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের লেজুড়ে পরিণত হয়েছে। এর ফলে এখানে স্থানীয় জনগণের ইচ্ছার চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার রয়েছে, সেখানেও তারা একটি স্বতন্ত্র সরকার নয়, তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র।
১০.৪ বিকেন্দ্রীকরণের বিকেন্দ্রীকরণ
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কুফল হ্রাস করতে পারে। তবে এটিই শুধু বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্য নয়। বিকেন্দ্রীকরণের একটি বড় লক্ষ্য হলো এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে বিত্তহীন এবং ক্ষমতাবিহীন সাধারণ মানুষ সরকার পরিচালনায় অংশ নিতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক জেফারসন বলতেন, যখন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, তখন সরকারের অধঃপতন ঘটে। আদর্শ সরকারের লক্ষ্য শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা নয়, এর লক্ষ্য হলো যাতে প্রতিটি মানুষ তার অধিকার ভোগ করতে পারে। এর জন্য এমন প্রতিষ্ঠানের দরকার, যেখানে প্রতিটি মানুষের বক্তব্য শোনা হবে। এ ধরনের ব্যবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা স্থানীয় সরকারে হস্তান্তর করলেই চলবে না, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যেসব দেশে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়, সেসব দেশে কেন্দ্র থেকে নিচের পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ ঠিকই হয় কিন্তু বিকেন্দ্রীকৃত সরকারের ক্ষমতা তাতে সব সময় জনগণের কাছে পৌঁছায় না। এর জন্য প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণের বিকেন্দ্রীকরণ যাকে সমাজতত্ত্ববিদেরা নাম দিয়েছেন Double Devolution। অ্যান্থনি গিডেন্স এ প্রক্রিয়াকে বলছেন Double Democratization বা গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণ। নিচের পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ ঘটবে না। স্থানীয় সরকারকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হতে হবে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সরকার এবং জনগণের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক থাকতে হবে। এ ধরনের সম্পর্ক শুধু ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই হবে না, এ ধরনের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। এ কাজ সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে সিভিল সমাজের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যদি ক্ষমতা হস্তান্তরের পাশাপাশি সিভিল সমাজ সুসংগঠিতভাবে কাজ করতে পারে, তবেই ক্ষমতা হস্তান্তরের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
আইনের সংশোধনের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে না-ও পৌঁছাতে পারে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামীণ প্রতিপত্তিশালীরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান। সরকারের সব উদ্যোগকে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সাধারণ মানুষের বঞ্চনা বিকেন্দ্রীকরণের পরও বেড়ে যেতে পারে। ল্যারি ডায়মন্ড বলছেন :
Decentralized political system can create niches for authoritarian figures (or movements) to consolidate their fiefdoms, safe from interventions from central authorities.”
বিকেন্দ্রীকরণ দরিদ্রদের জন্য কত উপকারী, সে সম্পর্কে তাত্ত্বিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। রাজকৃষ্ণের মতে, উন্নয়নশীল দেশসমূহের পল্লি অঞ্চলে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানসমূহে Elite বা প্রতিপত্তিশালীদের দৌরাত্ম্য সর্বত্র বিরাজ করছে। এর ফলে স্থানীয় নির্বাচিত সরকারসমূহ সব সময় দরিদ্র জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। রাজকৃষ্ণ বলছেন :
The interests of the poor are seldom represented effectively in these bodies. A massive misappropriation of resources and project benefits by dominant rural elites with the collaboration of the corrupt segment of the development bureaucracy is a regular outcome of many RD programmers- even when representative local bodies have limited or only advisory power. If their power is increased, this misappropriation is only likely to increase. (Raj Krishna, ‘Concepts and Policies of Rural Development’, Rural Development in Asia and the pacific).[৪]
এই মতের প্রতিধ্বনি করে Diana Conyers লিখেছেন :
There is a very real danger that most forms of decentralization will merely strengthen the position of the local elite and thus perpetuate existing inequalities.[৫]
সব বিশ্লেষক অবশ্য এ কথা মানতে রাজি নন যে বিকেন্দ্রীকরণের ফলে শুধু গ্রামের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিরাই উপকৃত হন। রন্ডিনেলি বলছেন, বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রতিপত্তিশালীদের প্রভাব হ্রাস পেতে পারে। রন্ডিনেলি লিখেছেন :
Decentralization can offset the influence or control over development activities by entrenched local elites who are often unsympathetic to national development policies and insensitive to the needs of the poorer groups in rural communities.[৬]
বস্তুত তাত্ত্বিক দিক থেকে বিকেন্দ্রীকরণের ফলে গরিবদের অপকার ও উপকার দুটিই হতে পারে। বিকেন্দ্রীকরণের প্রকৃত প্রভাব শুধু তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই করা যাবে না। এ সম্পর্কে মাঠপর্যায়ের তথ্যের প্রয়োজন রয়েছে। এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ৯টি সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে রন্ডিনেলি ও চিমা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে বিকেন্দ্রীকরণের ফলে পল্লি অঞ্চলের দরিদ্র মানুষেরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়নি এবং বিকেন্দ্রীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দরিদ্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেনি।[৭] Naomi Caiden ও Aaron Wildavsky নামে দুজন বিশেষজ্ঞ একই ধরনের মত পোষণ করেন। তাঁদের মতে, স্থানীয় প্রতিপত্তিশালীরা দরিদ্রের জন্য গৃহীত প্রকল্প কুক্ষিগত করেন এবং এর ফলে দরিদ্র জনগণের উপকার হয় না।[৮]
এ প্রসঙ্গে প্রণব বর্ধন যথার্থই লিখেছেন :
After all, the logic behind decentralization is not just about weakening the central authority nor is it about preferring local elites to central authority, but it is fundamentally about making governance at the local level more responsive to the felt needs of the large majority of the population. To facilitate this, the state, far from retreating into the minimalist role of classical liberalism, may sometimes have to play certain activist roles: enabling (if only as a catalyst) mobilization of people in local participatory development; neutralizing the power of local oligarchs; providing supralocal support in the form of pumppriming local finance; supplying technical and professional services toward building local capacity; acting as a watchdog for service quality standards, evaluation and auditing; investing in larger infrastructure; and providing some coordination in the face of externalities across localities.[৯]
বিকেন্দ্রীকরণের সুফল দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে দরিদ্রদের প্রতিরোধক্ষমতা (Countervailing Power) বাড়াতে হবে। এর জন্য দরিদ্রদের চেতনাকে শাণিত করতে হবে। দরিদ্রদের সংগঠিত করতে হবে। উপরন্তু ওপর থেকে বিকেন্দ্রীকরণ চাপিয়ে দিলে চলবে না, দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলনের ফলে সাফল্য অর্জিত হলে এ সাফল্য টেকসই (Sustainable) হবে।
স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য দুই পক্ষকেই উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত, স্থানীয় সরকারকে তৃণমূল পর্যায়ে কার্যাবলি সম্প্রসারণ করতে হবে এবং এসব কার্যাবলিতে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অনেক রাষ্ট্রে স্থানীয় সরকারসমূহ নিম্নতম পর্যায়ে ওয়ার্ড সভা নামে ভোটারদের সংগঠন গড়ে তোলে। এই ওয়ার্ড সভাতে সব প্রকল্পের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয় এবং ওয়ার্ড সভার সদস্যদের দ্বারা সরকারের ব্যয় যাতে অপব্যবহৃত না হয়, তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সাধারণ মানুষের সমর্থন চাওয়া হয়। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার কোনো কোনো রাষ্ট্রে স্থানীয় সরকারের বাজেট অনুমোদনের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থন চাওয়া হয়। এর ফলে গৃহীত প্রস্তাবসমূহ জনগণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়।
শুধু স্থানীয় সরকারই উদ্যোগ নেবে না, স্থানীয় জনগণকেও উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের তৃণমূল সংগঠন গড়ে তুলতে হবে এবং এই সংগঠনগুলো জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে। যেসব অঞ্চলে প্রাণবন্ত বেসরকারি সংগঠন রয়েছে, সেসব অঞ্চলে জনগণের পক্ষে অংশগ্রহণ সহজ। কাজেই সরকারেরও দায়িত্ব হবে সব অঞ্চলে তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনগুলোকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া।
১০.৫ উপসংহার
বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ২০০৮ সালে উইলিয়াম এফ ফক্স ও বালকৃষ্ণ মেনন লিখেছেন :
Over the decades, the local government system in Bangladesh has been ‘more an area of policy experimentation than one of stable institutional development’ ( Rahman and Islam 2002 : 154 ). Decentralization reforms are debated every few years under governments of all hues, various committees are launched, recommendations are made, and even piecemeal actions are taken. Yet, to date, an accountable and capable local state that upholds public interests at the local level remains elusive to Bangladesh.[১০]
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকরণের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে মাত্ৰ।
বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো সম্পর্কে সবার একমত হওয়া। এ বিষয়ে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। কেউ জেলা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করতে চান, কেউ জেলা কাউন্সিল চান না। কেউ উপজেলা পরিষদ চান, তবে তাকে পুরোপুরি ক্ষমতা দিতে চান না। আবার কেউ উপজেলা পরিষদ আদৌ চান না। সর্বনিম্ন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ সম্পর্কে তত মতবিরোধ নেই। শুধু এরশাদপন্থী জাতীয় পার্টি প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে। অন্য কোনো দলই এখন পর্যন্ত এ দাবি তোলেনি।
বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রথমে সাংবিধানিক কাঠামো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে বিকেন্দ্রীকরণের ধরন হবে এক প্রকারের, আর যদি প্রাদেশিক সরকার না থাকে, তাহলে বিকেন্দ্রীকরণের ধরন হবে অন্য প্রকারের। বাংলাদেশে বর্তমানে চার ধরনের সরকারি ব্যবস্থা রয়েছে: কেন্দ্রীয় সরকার, জেলা সরকার, উপজেলা সরকার ও ইউনিয়ন কাউন্সিল সরকার। যদি জনসংখ্যার দিক থেকে স্থানীয় সরকারের বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে বর্তমান ব্যবস্থার অবশ্যই যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আয়তন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বাংলাদেশের মতো অতি ক্ষুদ্র দেশে এই চার ধরনের সরকারের জন্য রাজস্ব বিভাজন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে বর্তমানে স্থানীয় সরকারসমূহ মূলত কেন্দ্রীয় অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু দেশটি অত্যন্ত ছোট, সেহেতু এখানে এমন কর ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত শক্ত, যেখানে স্থানীয় সরকারসমূহ তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ নিজস্ব কর থেকে সংগ্রহ করতে পারবে। যদি উচ্চ আয়ের ওপর ক্রমবর্ধিষ্ণু (Progressive) কর ব্যবস্থা চালু রাখতে হয়, তাহলে আয়কর ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখতে হবে; অন্যথায় করদাতারা তাদের আয় বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের এলাকায় ছড়িয়ে দেখাবে, যাতে তাদের মোট করের পরিমাণ কমে যায়। আমদানি- রপ্তানি কর আদায়ের ক্ষমতাও স্থানীয় সরকারকে দেওয়া সম্ভব নয়; কেননা, মাত্র কয়েকটি কেন্দ্রের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি পরিচালিত হয়। এর ফলে অল্প কিছু স্থানীয় সরকার অনেক কর আদায় করতে পারবে কিন্তু দেশের বেশির ভাগ স্থানীয় সরকারই এ ধরনের করের অংশ পাবে না। মূলত সম্পত্তির ওপর আরোপিত কর এবং বিক্রয় কর এ দুটি করের ওপর স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের পক্ষে ভ্যাটের মতো বিক্রয় করের ব্যবস্থা করাও সহজ হবে না।
রাজস্ব আদায়ের এবং জনগণের অংশগ্রহণের সমস্যা বিবেচনা করে বাংলাদেশের জন্য দুই ধরনের স্থানীয় সরকারের কাঠামো বিবেচনা করা যেতে পারে :
ক. প্রাদেশিক সরকারের অধীন স্থানীয় সরকার। বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তিন পর্যায়ের স্থানীয় সরকার যুক্তিযুক্ত হবে না। তিন পর্যায়ের সরকারের জন্য স্বতন্ত্র কর ব্যবস্থা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। যদি বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে দ্বিস্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এখানে জেলা পরিষদ তুলে দেওয়া যেতে পারে এবং উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
খ. যদি বর্তমান কাঠামো বহাল থাকে, অর্থাৎ প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে তিন স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থাতে শক্তিশালী জেলা পরিষদ গড়ে তুলতে হবে এবং জেলা পরিষদের কার্যাবলি সম্প্রসারণ করতে হবে ও তাদের আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধিরও সুযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদকে প্রকৃত অর্থে (বর্তমানে চালু ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া) শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করতে হবে।
১. কর্মকর্তা-কর্মচারী : কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা কেন্দ্রীয় সরকার-নিয়ন্ত্রিত কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে স্থানীয় সরকার চালানো সঠিক হবে না। স্থানীয় সরকারকে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা দিতে হবে।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ : বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম স্থগিত করে দিতে পারে এবং তাদের অপসারণও করতে পারে। এই ব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থার পরিপন্থী। যদি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁদের অপসারণের ক্ষমতা জনগণের হাতেই দিতে হবে। অর্থাৎ পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ সে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। যদি কোনো কর্মকর্তা- কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হন, শুধু তাঁদের অপসারণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া যেতে পারে। ফৌজদারি অপরাধ নয়, এ ধরনের অপরাধের জন্য নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার তদন্ত করতে পারে কিন্তু তাঁদের শাস্তির ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া ঠিক হবে না। এই ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য একটি স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
৩. রাজস্ব : বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজস্ব-ব্যবস্থা চালু আছে, সে ব্যবস্থাতে স্থানীয় সরকাররা অদূর ভবিষ্যতে তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে সমর্থ হবে না। অধিকাংশ স্থানীয় সরকারকে তাই কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার এই অনুদান রাজনৈতিক কারণে অপব্যবহার করে থাকে। এই ধরনের অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য একটি স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশন স্থানীয় সরকারসমূহের জন্য অর্থ বরাদ্দের নীতিমালা অনুমোদন করবে এবং সরকার এই নীতিমালা অনুসারে অর্থ বরাদ্দ করছে কি না, সে সম্পর্কে পরিবীক্ষণ করবে।
৪. স্থানীয় সরকারে প্রান্তজনের অংশগ্রহণ : বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করেন পল্লি অঞ্চলের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিরা। এর ফলে দুর্বল জনগোষ্ঠী স্থানীয় সরকারকে ব্যবহার করতে পারে না। স্থানীয় সরকারে মহিলা, দরিদ্র জনগোষ্ঠী, অন্যান্য দুর্বল জনগোষ্ঠী ইত্যাদির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকারে এদের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সবশেষে বাংলাদেশে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রয়োজন হলো প্রতিপত্তিশালীদের ক্ষমতা হ্রাস। এই উদ্দেশ্যে দেশের সর্বত্র বেসরকারি সংগঠনসমূহকে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকারে ওয়ার্ড সভা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সত্যিকার অর্থে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। সুতরাং ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে এবং গৃহীত ব্যবস্থাদি নিয়মিত পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
পাদটীকা
১. Anthony Giddens. 1999. Runaway World: How Globalization Is Reshaping Our Lives. London: Profile books. 76.
২. Kamal Siddique (ed) 1994. Local Government in Bangladesh, Dhaka; University Press Ltd.
৩. Larry Diamond. 1999. Developing Democracy: Towards Consolidation Baltimore: John Hopkins University Press, 102-138
৪. Raj Krishna. 1985, ‘Concepts and policies of Rural Devolopment’, Rural Development in Asia and Pacific Manila: ADB, 38
৫. Diana Conyers. 1985. ‘Decentralization: A Framework for Discussion’, Decentralization, Local Government Instutition and Resource Mobilization. ed Hasnat a Hye. Comilla: BARD, 363
৬. Dennis A. Rondinelli. 1981. ‘Government Decentralization in Comparative Perspective. Theory and Practice in Developing Countries’, International Review of Administrative Scince Vol. XL, Vii. No. 2, Page-1, 36.
৭. Naomi Caiden and Aaron Wildavosky. 1974. Planning and Budgeting in Poor Countries. New York John Wiley, 82
৮. Shabbir Cheema and Dennis A. Rondinelli. 1983. Implementing Programs in Asia. Nagoya: UNCRD
৯. Pranab Bardhan. 2002 ‘Decentralization of Governance and Devolopment’, The Journal of Economic Perspectives Vol. 16. No. 4 (autumn), 202-213.
১০. Wlliam F. Fox and Balkrishana Menon. 2008 ‘Decentralization in Bangladesh: Change has been elusive’. Atlanta: Andrew Young School of Policy studies (Mimeo)