১৩. রাজনৈতিক দল : কান্ডারি হুঁশিয়ার
No man is an island, entire of itself, every man Is a piece of the continent, a part of the main.
—John Donne
Cowardice asks the question: Is it safe? Vanity asks the question: Is it popular? Expediency asks the question: Is it political? But Conscience asks the question: Is it right?
—Anonymous
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ
এ তুফান ভারি, দিতে হতে পারি, নিতে হতে তরী পার।
—কাজী নজরুল ইসলাম
১৩. রাজনৈতিক দল : কান্ডারি হুঁশিয়ার
১৩.১ উপক্রমণিকা
একজন চিকিৎসক, একজন প্রকৌশলী ও একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে বিতর্ক চলছে কার পেশা সবচেয়ে পুরোনো। চিকিৎসক বললেন, বাইবেলে আছে যে সৃষ্টির পঞ্চম দিনে ভগবান হজরত আদম (আ.)-এর একটি বুকের হাড় বের করে নেন এবং সেই হাড় থেকে বিবি হাওয়াকে পয়দা করেন। হজরত আদম (আ.)- এর ওপর অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। সুতরাং চিকিৎসা পেশার জন্ম বিবি হাওয়া সৃষ্টির আগে। প্রকৌশলী বললেন, আপনি তো সৃষ্টির পঞ্চম দিনের কথা বলছেন, কিন্তু আদিতে কী ছিল? বাইবেলে বলা আছে যে ভগবান বিশৃঙ্খলা থেকে স্বর্গ এবং মর্ত্যের সৃষ্টি করেন। স্বর্গ ও মর্ত্য আকাশ থেকে পড়েনি, এগুলো সৃষ্টির জন্য অবশ্যই প্রকৌশলীদের দরকার পড়েছিল। কাজেই প্রকৌশল পেশা চিকিৎসা পেশার চেয়েও পুরোনো। এবার রাজনীতিবিদ মুখ খুললেন। তিনি বললেন, প্রকৌশলীর বক্তব্য আংশিকভাবে সত্য, তবে পুরোপুরি সত্য নয়। আংশিকভাবে সত্য এ জন্য যে বিশৃঙ্খলার মধ্যে স্বর্গ ও মর্ত্য সৃষ্টিতে অবশ্যই প্রকৌশলীর প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু আদিতে কী ছিল? আদিতে ছিল বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলা কে সৃষ্টি করতে পারে? একমাত্র রাজনীতিবিদদের পক্ষেই এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা সম্ভব। সুতরাং সবচেয়ে বনেদি পেশা হলো রাজনীতি।
বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সাধারণ লোকের বিশ্বাস, রাজনীতিবিদেরা সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেন। আসলে রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তির পক্ষে তার দাবিদাওয়া নিশ্চিত করার কোনো উপায় নেই। তাই দাবিদাওয়া অর্জন করতে হলে সমমনা ব্যক্তিদের জোট বাঁধতে হয়। এ প্রসঙ্গে ম্যাকাইভারের (MacIver) রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর মতে, রাজনৈতিক দল হচ্ছে, ‘an association organized in support of some principles or policy which by constitutional means it endeavors to make the determinant of government’। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি বা আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হলে সমমনা লোকদের রাজনৈতিক দলে সম্মিলিত হতে হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। যেখানে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালু ছিল, সেখানে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব তত ছিল না। কিন্তু প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে বিভিন্ন প্রশ্নে ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেন না, সিদ্ধান্ত নেন গণপ্রতিনিধিরা। গণপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য তাই সমমনা ভোটারদের একটি রাজনৈতিক দলে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের পাঁচটি প্রধান ভূমিকা রয়েছে।
১. রাজনৈতিক দল ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্র সম্ভব নয় : সংসদে গণপ্রতিনিধিরা থাকেন। এই প্রতিনিধিরা দল ভিত্তিতে সংগঠিত হন। ভোটাররা দলের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেন। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়, তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়, আর যারা সংখ্যালঘিষ্ঠ হয় তারা বিরোধী দল হিসেবে সরকারকে দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
২. রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিনির্ধারণ করে : প্রতিটি রাজনৈতিক দল একটি রাজনৈতিক মেনিফেস্টোর মাধ্যমে সংগঠিত হয়। এই মেনিফেস্টোর ভিত্তিতেই জনগণ রাজনৈতিক দলকে ভোট দেয়। কাজেই রাজনৈতিক দলের প্রধান কাজ হলো তাদের রাজনৈতিক মেনিফেস্টো বা ঘোষণার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করা।
৩. রাজনৈতিক দল জনমত সৃষ্টি করে : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের অংশগ্রহণের জন্য তাদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। যে দেশের ভোটাররা রাজনৈতিক দিক থেকে যত শিক্ষিত, তাদের চেতনা রাজনৈতিক দিক থেকে তত সমৃদ্ধ। রাজনৈতিক দলগুলো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে জনগণকে শিক্ষা দেয়। জনগণকে তাদের ভোটাধিকার সম্পর্কে সতর্ক করে। রাজনৈতিক দল ছাড়া ভোটারদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়।
৪. রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে : প্রতিটি দেশেই স্থানীয় পর্যায়ে, আঞ্চলিক পর্যায়ে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে এবং ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এসব পরস্পরবিরোধী শক্তিকে একটি সাধারণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য প্রণোদনা সৃষ্টি করতে হয়। এ কাজটি করার জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আদান-প্রদান বা লেনদেনের দরকার হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নেপথ্যে এ কাজটি করে। এর ফলে স্থিতিশীলতার পক্ষের শক্তিগুলো শক্তিশালী হয়। অন্যথায় অস্থিতিশীল শক্তিসমূহ জোরদার হয়ে উঠতে পারে।
৫. রাজনৈতিক দলগুলো নেতা নির্বাচনে সহায়ক হয়: গণতান্ত্রিক দেশে নেতাদের জনসমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে তাঁরা জনগণের কাছে পরিচিত হতে পারেন না। রাজনৈতিক দলের ভেতর সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করে তাঁরা জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। কাজেই রাজনৈতিক নেতারাই পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করেন। তবে রাজনীতির যে রকম সৃষ্টিশীল ভূমিকা রয়েছে, তেমনি তার ধ্বংসাত্মক দিকও রয়েছে। রাজনৈতিক দল কোন্দলের সৃষ্টি করে। এই কোন্দলের হোতা হলো দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীসমূহ। এর সঙ্গে সঙ্গে দলের ভেতরে গড়ে ওঠে মক্কেলতন্ত্র (Clientism)। মক্কেলতন্ত্রের লক্ষ্য হলো, দলের উচ্চ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকেরা নিম্ন পর্যায়ের মক্কেলদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে আর নিম্ন পর্যায়ের মক্কেলরা উচ্চ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকদের ভোটের জোগান দেবে। মক্কেলতন্ত্রের ফলে রাজনীতিতে অপরাধপ্রবণতা ঢুকে পড়ে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দাবিয়ে রাখার জন্য মক্কেলরা অনেক ক্ষেত্রেই হিংসাত্মক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। এ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। এই অর্থের জোগান দুর্নীতি ও জোরজবরদস্তির মাধ্যমে দেওয়া হয়। সমাজে তাই অপরাধমূলক কার্যকলাপ বেড়ে যায়। একদিকে রাজনীতি জনসাধারণের মধ্যে চেতনা সৃষ্টি করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে, অন্যদিকে অনেক দেশে রাজনীতির ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সমাজকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ণে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা বিশ্লেষণ করা। এই প্রবন্ধটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত। প্ৰথম খণ্ডে রয়েছে উপক্রমণিকা। দ্বিতীয় খণ্ডে রাজনৈতিক দল-সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্জন ও ব্যর্থতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের জন্য সুপারিশ পেশ করা হয়েছে।
১৩.২ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের আইনসমূহ
বাংলাদেশের সংবিধানে ১৫২ অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক দলের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে :
‘রাজনৈতিক দল’ বলিতে এমন একটি অধিসঙ্গ বা ব্যক্তিসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসঙ্গ বা ব্যক্তিসমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাহিরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোন নামে কার্য করেন এবং কোন রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোন রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসঙ্গ হইতে পৃথক কোন অধিসঙ্গ হিসাবে নিজদিগকে প্রকাশ করেন।
অধিসঙ্গ বলতে জনগোত্র বা Group বোঝায়, এই সংজ্ঞা অনুসারে রাজনৈতিক দলের দুটি অবশ্যপালনীয় শর্ত রয়েছে। প্রথমত, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই একটি স্বতন্ত্র নাম থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থাকতে হবে। তবে রাজনৈতিক দল যেমন সংসদে থাকতে পারে তেমনি সংসদের বাইরেও কাজ করতে পারে। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে জনশৃঙ্খলার ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। এই বিধান অনুসারে জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আরোপিত আইনে নিষেধাজ্ঞা ছাড়া রাজনৈতিক দলের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো উপায় নেই। তবে ৩৮ অনুচ্ছেদে একটি শর্ত যোগ করা হয়েছে। এই শর্ত হলো এই যে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।’
বাংলাদেশে দুই ধরনের রাজনৈতিক দল রয়েছে। এক ধরনের রাজনৈতিক দল গণপ্রতিনিধি আইন ১৯৭২-এর অধীনে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত। আবার নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত নয়, এরূপ রাজনৈতিক দলও রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের শর্তসমূহ প্রযোজ্য নয়। তবে তাদেরকেও জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ মানতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রদায়িক সমিতি বা এ ধরনের উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক কোনো সমিতি গঠন করার অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত নয়।
গণপ্রতিনিধি আইন ১৯৭২-এ (The Representation of People Order 1972) রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্তসমূহ ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক অধ্যাদেশের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদ কিছু পরিবর্তনসহ নিবন্ধনের শর্তসমূহ অনুমোদন করে। বর্তমানে প্রচলিত আইনে কোনো দলকে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য নিম্নরূপ শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করতে হয়।
• বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদের যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার যেকোনো একটিতে কমপক্ষে একটি আসন লাভ করে থাকলে সে দলকে নিবন্ধন দেওয়া হবে।
• যদি কোনো দল কোনো আসন না-ও পেয়ে থাকে, তবে যেসব কেন্দ্রে সে দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন, সেসব নির্বাচনী এলাকায় কমপক্ষে ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে থাকলে দলটি নিবন্ধের জন্য বিবেচিত হবে।
• যদি ওপরের দুটি শর্তের একটি শর্তও কোনো দল পূরণ করতে ব্যৰ্থ হয়, তাহলে সে দলের একটি কার্যকর কেন্দ্রীয় অফিস থাকতে হবে এবং কমপক্ষে দেশের এক-তৃতীয়াংশ জেলায় শাখা অফিস থাকতে হবে এবং কমপক্ষে ১০০টি উপজেলাতে ২০০ ভোটার সদস্যসহ দলীয় সংগঠন থাকতে হবে।
উপরিউক্ত শর্তসমূহ পূরণ করলেও নিম্নলিখিত কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে
নিবন্ধন দেওয়া যাবে না :
• যদি দলের সংবিধান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচিত হয়, তবে সে দলকে নিবন্ধিত করা যাবে না।
• যদি দলের সংবিধানে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, ভাষা ও লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক কোনো বিধান থাকে, তাহলে সে দলকেও নিবন্ধন করা যাবে না।
• যদি কোনো দলের নামে, পতাকায় বা কোনো প্রতীকে বা কোনো কার্যকলাপে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে অথবা দেশের কোনো অংশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে সে দলকে নিবন্ধন দেওয়া যাবে না।
• যদি কোনো দলের সংবিধানে একদলীয় রাষ্ট্র অথবা দলবিহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকে, তাহলে সে দলকেও নিবন্ধন দেওয়া যাবে না।
• যদি দলের সংবিধানে বাংলাদেশের বাইরে ওই দলের অফিস শাখা অথবা কমিটি প্রতিষ্ঠার বিধান থাকে, তাহলে সে দলকেও নিবন্ধন দেওয়া যাবে না।
এ ছাড়া দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার জন্য নিবন্ধিত দলসমূহের
ওপর নিম্নরূপ শর্ত আরোপ করা হয়েছে :
• দলের সব পর্যায়ের কমিটি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যকে নির্বাচিত হতে হবে।
• ২০২০ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ মহিলা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
• শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের নিয়ে কোনো সংগঠন করা যাবে না।
গণপ্রতিনিধি আইন অনুসারে বাংলাদেশে নিবন্ধিত দলসমূহের তালিকা সারণি-১৩.১-এ দেখা যাবে।
সারণি-১৩.১
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের তালিকা


বাংলাদেশে ৪১টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত রয়েছে। অথচ সারণি-১৩.২ থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে কখনো সংসদে ১২টির বেশি দল থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়নি।
সারণি-১৩.২
বাংলাদেশে সংসদে বিভিন্ন দলের আসন লাভ



সারণি-১৩.১ ও সারণি-১৩.২-এর তুলনা করলে বাংলাদেশে রাজনীতির কয়েকটি ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, বর্তমানে ৪১টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত হলেও এদের সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না। দ্বিতীয়ত, যারা নির্বাচনে অংশ নেয়, তাদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্রসংখ্যক দলই আসন লাভে সমর্থ হয়। বাংলাদেশের সংসদে বিভিন্ন দলের আসনবণ্টন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সংসদে সর্বনিম্ন ৪টি এবং সর্বোচ্চ ১২টি দল প্রতিনিধি প্রেরণে সাফল্য অর্জন করে। সুতরাং নিবন্ধনকৃত ৪১টি দলের মাত্র ৩০ শতাংশ দল সংসদে আসন লাভ করে।
নিবন্ধনকৃত দলগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, ডানপন্থী; দ্বিতীয়ত, মূলধারার রাজনৈতিক দল এবং তৃতীয়ত, বামপন্থী দলসমূহ। বাংলাদেশে ৭টি দলকে নামের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। পক্ষান্তরে ১১টি দলের নামের মধ্যে ইসলাম বা মুসলিম শব্দের উল্লেখ রয়েছে। এই দলগুলোকে ডানপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। সর্বাধিক ২৩টি দলকে মূলধারার রাজনৈতিক দল বলা যেতে পারে।
সাধারণত ডানপন্থী ও বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে যারা উগ্র মতবাদে বিশ্বাস করে, তাদের চরমপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ চরমপন্থী দলই নিবন্ধনে আগ্রহী হয় না; কারণ, তারা বিশ্বাস করে যে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজ পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। তারা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পুনর্গঠন করতে চায়। এ ধরনের রাজনৈতিক দল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন গ্রহণ করতে আগ্রহী হয় না।
পৃথিবীর অনেক দেশেই এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে অতীতে চরমপন্থীদের মধ্যে বামপন্থীরাই ছিল প্রধান। কিন্তু আশির দশকের শেষ দিকে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার ফলে চরমপন্থায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন অনেক ক্ষেত্রেই উবে গেছে। যদিও নেপাল ও ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে এখনো বাম চরমপন্থীরা সক্রিয়, তবু সারা পৃথিবীতে চরম বামপন্থীদের সমর্থন কমে গেছে। বাংলাদেশে কিছু কিছু দুর্বৃত্তের দল সর্বহারা বা সমাজতন্ত্রের নাম নিয়ে বেআইনিভাবে সংগঠন গড়ে তোলে। তবে দেশের মানুষের ওপর তাদের কোনো প্রভাব নেই এবং আইনের দৃষ্টিতে তারা বেশির ভাগই দুর্বৃত্ত।
সম্প্রতি ডানপন্থীদের মধ্যে চরমপন্থায় আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহে ইসলামি মৌলবাদীরা চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কতিপয় সদস্য জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ নামে একটি বেআইনি সংগঠন গড়ে তোলে এবং সেই সঙ্গে জনসমর্থন আদায় করার জন্য জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ নামে একটি সহযোগী সংগঠন স্থাপন করে। ২০০৫ সালে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টি জেলায় ৭ মিনিটের ব্যবধানে এই সংগঠন বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। সংগঠনটি বন্ধ করে দেওয়া হয় ও তার নেতাদের বিচারে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সংগঠনটি আবার নতুন নামে ও নতুন নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে। একটি হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে ২৯ থেকে ৩৩টি চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদী দল রয়েছে, যারা দেশে ইসলামি বিপ্লব করতে চায়। এর মধ্যে হরকাতুল জিহাদ-উল-ইসলাম বাংলাদেশ, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ ও শাহাদাতে আল হিকমা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পরবর্তীকালে হিযবুত তাহ্রীর নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলাদেশে প্রায় ১০০টি ইসলামপন্থী দল রয়েছে, যারা চরমপন্থায় রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করছে। এই দলগুলোকে আইনের দিক থেকে রাজনৈতিক দল বলা যায় না কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই তারা রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন করছে। এই দলগুলোর দুটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, বাংলাদেশে বেশির ভাগ রাজনীতিবিদই বৈষয়িক স্বার্থে রাজনীতিতে অংশ নেন। আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত, অথচ এই ইসলাম-সমর্থক চরমপন্থী দলগুলো আদর্শবাদী সংগঠন। সে জন্য তাদের অপরাধমূলক কার্যকলাপকে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ বিনা বাধায় সহ্য করে। এইভাবে অনেক ক্ষেত্রে তারা পরোক্ষভাবে গণসমর্থন আদায় করে।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক দিক থেকে এ সংগঠনগুলো অত্যন্ত সবল। এদের অনেকেই বিভিন্ন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছ থেকে সাহায্য হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশ থেকে টাকা পেয়ে থাকে। এই অর্থ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ব্যবহৃত হয়। অনেক ক্ষেত্রে যেসব সংগঠন এসব বৈদেশিক সাহায্য লাভ করেছে, তারা তাদের অর্থ বিনিয়োগ করে ইতিমধ্যে দেশে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়ে থাকে যে জামায়াতে ইসলামী দলটি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভেতরে তাদের নিজস্ব অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। এরা ব্যাংক চালায়, বিশ্ববিদ্যালয় চালায়, বিমা কোম্পানি চালায়, গণমাধ্যম পরিচালনা করে, স্বাস্থ্যসেবা বিপণন করে এবং বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসা খাতে বিনিয়োগ করে প্রচুর অর্থ অর্জন করেছে। কুয়েতভিত্তিক Revival of Islamic Society, সৌদি আরবভিত্তিক Haramin Islamic Foundation, Hayatul Igacha প্রভৃতি বিদেশি সংস্থাও এ দেশে মসজিদ উন্নয়নের নামে প্রচুর অর্থ দিয়েছে। জানা যায়, তারও একটি অংশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যয়িত হচ্ছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসবাদী সংগঠনসমূহ দেশের ভেতর থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে। মধ্যপ্রাচ্যে যখন তেলের দাম বাড়ে, তখন চরমপন্থী ইসলামি সংগঠনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের অনুদান বেড়ে যায়। ২০০৬ সালে একজন পর্যবেক্ষক লিখেছেন :
The Rising price of oil has translated in to greater resources for Islamists which have usually been channeled to Bangladesh through Islamic Development Organizations and Banks like Al-Arafa Islami Bank and Al-Hamman Islamic Foundations. Currently many Bangladeshi Islamists run financial Institutions, such as, Hospitals and Industries backed by funding from abroad.[১]
২০১৩ সালে আরেকজন পর্যবেক্ষক অভিমত প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশে ইসলামিক সংগঠনগুলো বছরে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা) মুনাফা করে। এই মুনাফার কমপক্ষে ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২০০ কোটি টাকা) চরমপন্থীদের দেওয়া হয়। এই গবেষকের হিসাবে প্রায় ৫ লাখ পূর্ণকালীন কর্মীর বেতন এই অর্থ থেকে দেওয়া সম্ভব। যদি এই হিসাব সঠিক বলে ধরে নিই, তাহলে প্রতি পূর্ণকালীন কর্মীর জন্য বছরে মাত্র চার হাজার টাকা খরচ হয়। এই অঙ্ক খুবই কম, যদি ২৫ মিলিয়ন ডলার এই কাজে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তাতে সর্বাধিক লাখ দুয়েক কর্মীর অর্থের সংস্থান হতে পারে। বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থীদের আয়ের হিসাব কিছুটা অতিরঞ্জিত হলেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশে চরমপন্থী সংগঠনগুলোর অর্থায়নের ক্ষেত্রে কোনো বড় সমস্যা নেই।
১৩.৩ বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্জন ও ব্যর্থতা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অর্জন হলো, এই দলগুলো দেশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এই সাফল্যের একটি উদাহরণ হলো বাংলাদেশে ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের হার।
সারণি-১৩.৩
বাংলাদেশে ভোটার উপস্থিতির হার

সারণি-১৩.৩ সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, ১৯৭৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ ভোটের পরিমাণ ছিল ৭৫.৬ শতাংশ। ২০০৮ সালে এই হার ৮৫.২৬ শতাংশে উন্নীত হয়। এই বৃদ্ধি কতটুকু সঠিক, সেটি পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। যদি এই সংখ্যা সঠিক হয়, তবে বাংলাদেশে ভোটারদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ভোটারদের অংশগ্রহণের অবস্থা কী? এ সম্পর্কে তথ্য সারণি-১৩.৪- এ দেখা যাবে।
সারণি-১৩.৪-এ বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সাফল্য সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সারণি-১৩.৪ অনুসারে ১৬৯টি দেশের মধ্যে ভোটার উপস্থিতির হারের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান ১৪৩তম। এর অর্থ হলো বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর নিম্নতম ভোটার উপস্থিতির ২০ শতাংশের মধ্যে। সারণি-১৩.৪-এ বাংলাদেশে ৬টি নির্বাচনের ভিত্তিতে ভোটার উপস্থিতির হার হিসাব করা হয়েছে। এই হিসাবে যদি ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ
সারণি-১৩.৪
নিবন্ধনকৃত ভোটারদের সংসদ নির্বাচনে ভোটদানের শতকরা হার






সংসদের জন্য যে ব্যর্থ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই নির্বাচনের ভোটার হার অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশে ভোটার উপস্থিতির হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেশি হওয়ার কথা। তাতেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম ৫০ শতাংশের মধ্যে উন্নীত হয় না। দ্বিতীয় সমস্যা হলো ২০০৮ সালে ৮৫.২৬ শতাংশ ভোটার উপস্থিত ছিল বলে হিসাব করা হয়েছে। এই হিসাব আগের নির্বাচনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৮টি নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে ৪টি নির্বাচনে উপস্থিতির হার ছিল ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে। একটি নির্বাচনে উপস্থিতির হার ছিল ৬০ শতাংশ। মাত্র দুটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৭৪.৯৭ থেকে ৭৫.৬০ শতাংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই হার প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার সময় ফটোসহ পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এর ফলে জাল ভোটার নিবন্ধনের সংখ্যা কমে যায়। যদি এই অনুমান সত্য হয়, তাহলে ২০০৮ সালের আগের নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতির হার জাল ভোটসহ ছিল অতিরঞ্জিত। সুতরাং ২০০৮ সালে সঠিক ভোট হয়ে থাকলে ভোটার উপস্থিতির হার খুব বেশি বাড়ার কথা নয়। এই অবস্থায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাল ভোটার এবং এর উপস্থিতি সম্পর্কে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা হলো ৪১। তবে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ১৭ বছরের নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে ৪টি রাজনৈতিক দল দেশের ভোটারদের নিয়ন্ত্রণ করছে। বাকি রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য।
সারণি-১৩.৫
প্রধান ৪টি দল কর্তৃক প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা

সারণি-১৩.৫ থেকে দেখা গেছে যে গত ৩০ বছরে প্রধান চারটি দল কমপক্ষে ৯৪.৯ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৯৬.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর ৩০টির বেশি বিরোধী দল সর্বনিম্ন ভোট পেয়েছে ১.৯ শতাংশ আর সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে ১০.৭ শতাংশ। নির্দলীয় প্রার্থীরা সর্বনিম্ন ভোট পেয়েছেন ১.০৬ শতাংশ আর সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন ৪.৪ শতাংশ।
উপরিউক্ত তথ্য থেকে মনে হয় যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো দল হলো জামায়াতে ইসলামী। এরপর আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির জন্ম বাংলাদেশ সৃষ্টির পর। এ দুটি দলই দুজন সমরনায়কের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি স্থাপিত হয় ১৯৮৬ সালে। এরপরও অনেক দল আবির্ভূত হয়েছে কিন্তু তাদের কেউই জনসমর্থন লাভে সফল হয়নি। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সাফল্য এটাই প্রমাণ করে, যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে তাদের সমর্থকদের পুরস্কৃত করতে সমর্থ হয়েছে, একমাত্র তারাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় দুর্বলতা হলো এসব দলের ভেতরে কোনো গণতন্ত্রের চর্চা হয় না। প্রথমত, প্রধান চারটি দলের তিনটি দলই বংশভিত্তিক রাজনীতির দ্বারা পরিচালিত। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং এরপর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ থেকে এখন পর্যন্ত (প্রায় ৩৬ বছর ধরে) অব্যাহতভাবে দলের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৮৩ থেকে তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অব্যাহতভাবে এখন পর্যন্ত বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় পার্টি ১৯৮৬ সালে লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং গত ৩০ বছর ধরে তিনি দলের সভাপতি হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর স্ত্রী ও ভাইকে দলের কো-চেয়ারপারসন নিযুক্ত করেছেন। জামায়াতে ইসলামীতে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে এ ধরনের বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের প্রচলন নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে বাংলাদেশে মাত্র দুজন সভাপতি দীর্ঘদিন ধরে এই পদটি আঁকড়ে ধরেছিলেন। গোলাম আযম ১৯৬০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত দলের আমির ছিলেন এবং মাওলানা নিজামী ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দলের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিটি দলের গঠনতন্ত্রে সভাপতি নির্বাচনের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ বিধান অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিপালিত হয় না। বংশানুক্রমিকভাবে মনোনীত নেতা অথবা দলের প্রতিষ্ঠাতারা দলকে নিয়ন্ত্রণ করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য পদেও নির্বাচন হয় না। সভাপতিরাই তাঁদের ইচ্ছেমতো এসব পদে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। সুতরাং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এই দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে জাতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনগুলোর সম্পর্ক দুই ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমত, প্রতিটি দলেরই ফ্রন্ট বা সহযোগী সংগঠন রয়েছে। এই সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা হয়। সারণি- ১৩.৬-এ বাংলাদেশের প্রধান চারটি দলের ফ্রন্ট/সহযোগী সংগঠনের তালিকা দেখা যাবে।
সারণি-১৩.৬
বাংলাদেশে প্রধান চারটি দলের ফ্রন্ট/সহযোগী প্রতিষ্ঠানের তালিকা

ওপরের তালিকার দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত, এই তালিকা অসম্পূর্ণ। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বত্র সহযোগী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয় না, তবু বাংলাদেশে এমন কোনো পেশা নেই, যেখানে দলভিত্তিক সংগঠন গড়ে ওঠেনি। সাংবাদিক বলুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলুন, কলেজ শিক্ষক বলুন, মাদ্রাসাশিক্ষক বলুন, মাধ্যমিক শিক্ষক অথবা প্রাথমিক শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ইত্যাদি সর্বত্র দলের সহযোগীরা কাজ করেন। এর ফলে বাংলাদেশে সিভিল সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য দলের মতো জামায়াতে ইসলামীরও সহযোগী সংগঠন সর্বত্র রয়েছে। কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে না, কেননা, অনেক ক্ষেত্রে তারা গোপনে কাজ করতে চায়। জাতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তৃণমূল সংগঠনগুলোর দ্বিতীয় যোগসূত্র হলো দলের বিভিন্ন পর্যায়ের শাখা সংগঠন। এই শাখা সংগঠনগুলো সাধারণত জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌর এলাকা ও গ্রাম ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংবিধান অনুসারে এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নির্বাচিত হওয়ার বিধান রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের সংগঠনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসব সংগঠনের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। জাতীয় নেতৃত্ব পরিবর্তন করার ক্ষমতা তৃণমূল সংগঠনগুলোর নেই। তারা বড়জোর কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারে কিন্তু সেই বক্তব্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কর্তৃক গৃহীত না হলে তাদের কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই। ফলে তৃণমূল সংগঠনগুলো দলের মেনিফেস্টো বা নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে পারে না।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে মুরব্বি-মক্কেলের (Patron-cliant) সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রথমত, জাতীয় পর্যায়ের মূল নেতৃত্ব বংশানুক্রমিক ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় পর্যায়ে যেসব নেতা মূল নেতার আশীর্বাদ লাভ করেন, তাঁরাই জাতীয় নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত হন। এই জাতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বের মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তৃণমূল তাদের কার্যকলাপের জন্য সরকারের সমর্থন চায়। এই সমর্থন পেলে তারা তৃণমূল পর্যায়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারে এবং সরকারের বিভিন্ন সম্পদ, প্রকল্প ও সুযোগ-সুবিধা থেকে অনুপার্জিত মুনাফা লাভ করতে পারে। যেমন তারা চায় যে থানাগুলোতে তাদের কর্তৃত্ব থাকবে। তারা চায় বিভিন্ন সরকারি অফিসে তাদের মর্যাদা ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। এ জন্য তারা কেন্দ্রীয় নেতাদের সমর্থন আশা করে। কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের এই শর্তে সমর্থন দেন যে তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করবে। তবে এই ব্যবস্থার দুটি সমস্যা রয়েছে। প্রথম সমস্যা হলো, তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা তাদের আধিপত্য বিস্তার ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করতে চায়। এভাবে এই সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে মাস্তানরা চলে আসে। মাস্তানরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত এবং সরকারি ব্যবস্থা থেকে তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। বিরোধী দলের যারা সমর্থক, তাদের মধ্যেও একই ধরনের নেতৃত্ব রয়েছে। ফলে দলগুলোর মাস্তানরা অনেক ক্ষেত্রেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সারণি-১৩.৭-এ ২০০২ থেকে ২০১৩ সালে যেসব আন্তদলীয় সহিংস ঘটনা ঘটেছে, তার তালিকা দেখা যাবে।
সারণি-১৩.৭
২০০২ থেকে ২০১৩ সালে আন্তদলীয় সংঘর্ষ

দ্বিতীয়ত, এই সংঘর্ষ শুধু বিভিন্ন দলের মধ্যেই ঘটছে না, এই সংঘর্ষ দলের ভেতরেও দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন দলের মধ্যে উপদলীয় সংঘাতের উপাত্ত সারণি-১৩.৮-এ দেখা যাবে।
সারণি-১৩.৮
দলের মধ্যে উপদলীয় সংঘর্ষ, ২০০২ থেকে ২০১৩

সারণি-১৩.৮ থেকে দেখা যাচ্ছে যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আন্তদলীয় সংঘর্ষের তীব্রতা ও বিস্তৃতি অন্তর্দলীয় সংঘর্ষের সঙ্গে তুলনীয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে বছরে গড়ে সংঘর্ষ হয় ১ হাজার ২৫৭টি অথচ আওয়ামী লীগে অন্তর্দলীয় সংঘর্ষ ঘটে ১ হাজার ২৩৬টি। আর বিএনপির মধ্যে অন্তর্দলীয় সংঘর্ষ ঘটে গড়ে ৬১৩টি। বিএনপি-আওয়ামী লীগের আন্তদলীয় সংঘর্ষে গড়ে আহত হয় ১ হাজার ৯৬৭ জন এবং মারা যায় ২৫৬ জন। একই সময়ে আওয়ামী লীগের অন্তর্দলীয় সংঘর্ষে বছরে গড়ে মারা যান ১৫৯ জন আর আহত হন ১ হাজার ৫০০ জন।
ওপরের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় সংগঠনগুলো উপদলীয় বিরোধে জর্জরিত। এই উপদলীয় দ্বন্দ্ব নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় না। সহিংস ঘটনায় এর আত্মপ্রকাশ দেখা যায়। অতি সম্প্রতি এ ঘটনা আরও বেড়ে চলেছে। কিন্তু কোনো দলের কেন্দ্রীয় সংগঠনগুলো তৃণমূল পর্যায়ে উপদলীয় সংঘর্ষ হ্রাস করাতে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না। তৃণমূল পর্যায়ে তাই সংগঠনগুলোর মধ্যে পেশিশক্তির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে সহিংস ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
মোটকথা, দলগুলোর গঠনতন্ত্রে দলের ভেতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিস্তারিত কাঠামো প্রণয়ন করা সত্ত্বেও তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না। উপরন্তু কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যদিও নির্বাচনের বিধান রয়েছে, তবু সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্বাচন হয় না। বংশগত ক্ষমতার জোরে যিনি দলের প্রধান হন, তিনিই কেন্দ্রীয় নেতাদের বেছে নেন। এর ফলে বাংলাদেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে কিংবা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আরও কয়েকটি অসম্পূর্ণতা রয়েছে। যদিও আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে মহিলা ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর যথোপযুক্ত প্রতিনিধি নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তবু বাংলাদেশে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই এসব ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেয়নি। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোতে মহিলাদের ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর ভূমিকা এখনো সীমিত। নির্বাচনী আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর চাঁদা তোলার এবং ব্যয়ের হিসাব রাখার ব্যাপারে যেসব নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও তেমন কার্যকর হয়নি। এ জন্য আরও ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক চেতনা প্রসারে অবদান রাখলেও এরা এখনো গণতান্ত্রিক দলের উপযোগী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারেনি। তাই দলগুলোর গণতন্ত্রায়ণের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে মুরব্বি-মক্কেলের যে সম্পর্ক প্রতিটি দলের ভেতরে গড়ে উঠেছে, সে সম্পর্কের পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের কেউই চান না।
১৩.৪ উপসংহার
রাজনৈতিক জগতে নিয়ত পরিবর্তন চলছে। তাই বেশির ভাগ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও রূপান্তর চলছে। উনিশ ও বিশ শতকে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্মনির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার সম্প্রসারণের ফলে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অথচ যেসব গণমাধ্যম তখন প্রচলিত ছিল, তা এ ধরনের সমর্থন সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ছিলেন অপরিহার্য। অথচ আজকের পৃথিবীতে গণমাধ্যমের ব্যাপক সম্প্রসারণের ফলে রাজনৈতিক কর্মীদের ভূমিকার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে ২০০২ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিপা নরিস Democratic Phoenix: Reinventing Political Activism শীর্ষক একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেন।[৩] এই সমীক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিত পরিবর্তনের প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয় :
১. যেসব দেশে টেলিভিশন সীমিতভাবে চালু হয়েছে, সেসব দেশে দলীয় সদস্যদের গুরুত্ব বেশি। কারণ, এ ধরনের দেশে রাজনৈতিক বক্তব্যসমূহ মুখে মুখে প্রচার করতে হয়। যেসব রাষ্ট্রে বেশির ভাগ মানুষের সঙ্গে টেলিভিশনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা সম্ভব, সেসব রাষ্ট্রে রাজনৈতিক কর্মীদের গুরুত্ব কমে যায়।
২. অতীতে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো গির্জা অথবা ট্রেড ইউনিয়নের সমর্থন নিয়ে গড়ে উঠত। কিন্তু এখন রাজনীতির ওপর ধর্মের প্রভাব অনেক হ্রাস পেয়েছে। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে অনেক দেশে ট্রেড ইউনিয়নের গুরুত্ব কমে গেছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর চিরাচরিত উৎসসমূহের পরিবর্তন ঘটছে।
৩. গণমাধ্যমের দ্রুত অগ্রগতির ফলে রাজনৈতিক দলের বাইরে ‘প্রতিবাদ রাজনীতির’ আত্মপ্রকাশ ঘটছে। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম ব্যবহার করে গণদরখাস্ত, বিক্ষোভ, ক্রেতাদের বয়কটসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা সম্ভব। এ ধরনের কর্মসূচি রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এ ধরনের কর্মকাণ্ডে উচ্চশিক্ষিত, তরুণ ও পেশাজীবী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী (marginal groups) অংশ নিত। কিন্তু এখন প্রতিবাদ রাজনীতি সমাজের মূলধারার (mainstream) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ছে।
৪. কেউ কেউ মনে করেন যে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কমছে। তবে সংগৃহীত উপাত্ত থেকে এ সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যেসব প্রবণতার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতেও অবশ্যই পড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে টেলিভিশনের ব্যাপক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ২০১০ সালের জুন মাসে ডেইলি স্টার- এর ফোরামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে যে ২০১০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ লোক টেলিভিশন দেখার সুযোগ পায়। গত ছয় বছরে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও পল্লি অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে টিভি দর্শকের পরিমাণ আরও বেড়েছে। বর্তমানে দেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা টেলিভিশন দেখে। এ ধরনের রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারের জন্য রাজনৈতিক কর্মী অত্যাবশ্যক নয়। তবু দুটি কারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মীর সংখ্যা হ্রাস পায়নি। প্রথমত, বাংলাদেশে সংঘাতের রাজনীতি চালু রয়েছে। সংঘাতে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মীর প্রয়োজন রয়েছে। দ্বিতীয়ত, যারা রাজনীতিতে অংশ নেয়, তাদের বেশির ভাগেরই নিজস্ব কোনো পেশা নেই। এই উদ্বৃত্ত জনশক্তি তাই প্রয়োজন না থাকলেও নিজেদের স্বার্থে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকছে।
বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের তুলনায় বাংলাদেশে ‘প্রতিবাদের রাজনীতি’ অনেক দুর্বল। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিবাদ সাধারণত দুই রাজনৈতিক জোটের সংঘর্ষের রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়। এর ফলে রাজনৈতিক দলের বাইরের জনগোষ্ঠীর এতে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে না। পক্ষান্তরে সম্প্রতি সংঘটিত ‘আরব বসন্ত’কে প্রতিবাদের রাজনীতির উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। যতক্ষণ বাংলাদেশে সংঘর্ষের রাজনীতি চলবে, তত দিন এখানে ‘প্রতিবাদের রাজনীতি’র আত্মপ্রকাশ ঘটার সম্ভাবনা কম। তবু সম্প্রতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে (যথা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন) প্রতিবাদের রাজনীতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
বৈশ্বিক পরিবর্তনের বাইরেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলসমূহের রূপান্তর ঘটছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসংক্রান্ত আইনকানুন ও উপাত্তসমূহ বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের নিম্নলিখিত প্রবণতাসমূহ সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে :
১. মুরব্বি-মক্কেল চক্র ও নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতি : এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে মুরব্বি-মক্কেল চক্র। এই রাজনীতির চাবিকাঠি হচ্ছে পৃষ্ঠপোষকদের আশীর্বাদ। মক্কেলরা হালুয়া-রুটির রাজনীতি করে। যেখানে মুরব্বিরা পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারেন, সেখানেই মক্কেলদের ভিড় জমে। তবে দেশে সম্পদ সীমিত। কাজেই আইনসম্মতভাবে পৃষ্ঠপোষকতার প্রসার সম্ভব নয়। বেশির ভাগ পৃষ্ঠপোষকতাই এখানে বেআইনি। এই বেআইনি পৃষ্ঠপোষকতাকে টিকিয়ে রেখেছে দুর্নীতির দুষ্টচক্র। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশগুলোর অন্যতম। তবু এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন দেখা যায় না। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলগুলোই দুর্নীতির প্রধান সমর্থক বলে সন্দেহ করা হয়।
২. বংশানুক্রমিক রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলসমূহের প্রাণ হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা। এই ব্যবস্থায় তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সব রাজনৈতিক নেতা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হন। দলের সাধারণ সদস্যরা চাইলে যেকোনো পর্যায়ে নেতা পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বংশভিত্তিক। দলের প্রতিষ্ঠাতার গোষ্ঠীর নেতাকেই দলের প্রধান নির্বাচন করতে হয়। দলের প্রধান দলের কোন পদের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তা তিনিই নির্ধারণ করেন। এখানে দলের সাধারণ ভোটারদের কোনো দায়িত্ব নেই। দলের সংবিধানে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বিধান থাকলেও আসলে কোনো নির্বাচন হয় না।
৩. পরিবর্তনহীন রাজনীতি : সাধারণত রাজনৈতিক দলে নতুন সদস্যরা যোগ দেন রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার লক্ষ্য নিয়ে। তৃণমূল পর্যায় থেকে দলের কর্মসূচি নিয়ে বিতর্ক হয় এবং গণসমর্থনের ভিত্তিতে নতুন কর্মসূচি গৃহীত হয় ও নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যেসব দেশে দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব, সেসব দেশে নতুন দলের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশে পুরোনো রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব নয়।
৪. সহযোগী সংগঠনের আধিক্যের ফলে সিভিল সমাজের বিভক্তি ও সংঘর্ষমূলক রাজনীতির উদ্ভব : সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সিভিল সমাজের সংগঠনসমূহের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় থাকে। কিন্তু যেসব দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক বিদ্যমান, সেসব দেশে সিভিল সমাজের রাজনৈতিকীকরণ হলে সংঘর্ষের দুষ্টচক্র থেকে পরিত্রাণ অত্যন্ত শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে বেশির ভাগ বড় দলের সমর্থকেরা সহযোগী সংগঠন বা ফ্রন্ট সংগঠন করে সিভিল সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছে। সংঘর্ষের রাজনীতি তাই সমাজের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে।
৫. উপদলীয় কোন্দল (Factionalism) : উপদলীয় কোন্দল সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে কমবেশি থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আদর্শভিত্তিক নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থ এখানে রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাই বাংলাদেশে উপদলীয় রাজনীতি অনেক বেশি সহিংস। এর ফলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ অনেক ক্ষেত্রে রুদ্ধ।
৬. দলীয় ও সরকারি নেতৃত্ব অভিন্ন : গণতান্ত্রিক তত্ত্ব অনুসারে দল ও সরকার ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তাদের নেতৃত্বও হবে ভিন্ন। সরকার পরিচালনা করবেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সরকার সঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তার তদারক করবে দলীয় নেতৃত্ব। দলীয় ও সরকারি নেতৃত্ব অভিন্ন হলে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৭. অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ঘাটতি : গঠনতন্ত্র অনুসারে নিয়মিতভাবে দলের নেতৃত্বের জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নির্বাচনেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করা হয় না।
৮. তহবিল সংগ্রহে অনিয়ম এবং স্বচ্ছ হিসাবরক্ষণে ব্যর্থতা : পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই রাজনৈতিক দলসমূহের তহবিল সংগ্রহে অনিয়ম ঘটে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো এ ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ মানতে চায় না, তাই এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু আইন প্রণয়ন সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের হিসাব রক্ষার নিয়মগুলোও সঠিকভাবে প্রতিপালন করে না।
ওপরের আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে, তা অত্যন্ত ব্যাপক ও জটিল। এগুলোর সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। এসব সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান নেতৃত্বের কোনো লাভ নেই। কাজেই তাঁদের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। এখানে সংস্কারের কয়েকটি সম্ভাব্য পথ রয়েছে। প্রথমত, একটি পথ হতে পারে একবারে সব সংস্কার না করে আস্তে আস্তে সংস্কার করা। এ ধরনের সংস্কারে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত হবে না। দ্বিতীয়ত, একবারে সব আইনকানুন ঠিক করা। এর জন্য প্রয়োজন অরাজনৈতিক নেতৃত্ব। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমন একটি সুযোগ এসেছিল। ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে অনিচ্ছুক হওয়ায় এই সংস্কার-উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে। অধ্যাপক রওনক জাহান ২০১৫ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর একটি অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার প্রসঙ্গে তাঁর মূল সুপারিশসমূহ নিম্নরূপ :
১. রাজনৈতিক দলগুলোকে অগণতান্ত্রিক রীতিনীতি বর্জন করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাষ্ট্রের সম্পদের অপব্যবহার করে তাদের সমর্থকদের পুরস্কার ও বিরোধীদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং দুর্নীতি হ্রাস করতে হবে।
২. বিরোধী দলকে বয়কটের রাজনীতি বর্জন করতে হবে এবং গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে সরকারের সমালোচনা করতে হবে।
৩. সব রাজনৈতিক দলকে দলের ভেতরে ও বাইরে সহিংস রাজনীতি বর্জন করতে হবে।
৪. সরকারপ্রধান ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি হবেন না। দলের নির্বাহী কর্মকর্তারা সরকারি দায়িত্ব পালন করবেন না।
৫. রাজনৈতিক দলগুলো মুরব্বি মক্কেলদের জটাজাল সৃষ্টি না করে বিস্তারিত রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও কর্মসূচিসমূহ প্রণয়ন করবে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে।
৬. রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের গঠনতন্ত্র ও নিবন্ধনের আইনগত শর্তসমূহ অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলতে হবে।
৭. রাজনৈতিক দলগুলোর চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। দরকার হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করতে হবে।
ওপরের প্রতিটি সুপারিশই গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা হলো, এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সব বড় রাজনৈতিক দলের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা প্রয়োজন। অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের সহযোগিতার সম্ভাবনা মনে হয় সুদূরপরাহত। বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থে গণতান্ত্রিক শাসনের ক্ষেত্রে অলঙ্ঘনীয় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এসব অন্তরায় অপসারণে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। কাজেই আপাতত রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগে রাজনৈতিক সংস্কারের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যাঁরা আশাবাদী, তাঁরা মনে করেন যে দীর্ঘদিন এ অবস্থা বিরাজ করলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের পক্ষে সমর্থন সৃষ্টি হতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদ কত দীর্ঘ, তা কেউ জানে না। উপরন্তু দেশের জনগণ এ অবস্থা এত দীর্ঘ সময় ধরে মেনে না-ও নিতে পারে। এর ফলে সমস্যার সমাধান সহজ না হয়ে সমস্যা আরও জটিল হতে পারে।
স্বল্প মেয়াদে আরও তিনটি সম্ভাবনা রয়েছে। একটি হলো, প্রতিবাদের রাজনীতি। যেমনটি ঘটেছিল অতি সম্প্রতি আরব দুনিয়াতে। অন্যটি হলো ক্ষুদ্র চরমপন্থী দলের বিদ্রোহ। আরেকটি সম্ভাবনা হতে পারে সংস্কারের সমর্থনে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে অতীতে যতটা ঐকমত্য ছিল, এখন আর তা নেই। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে নতুন টানাপোড়েন চলছে। নতুন নতুন শক্তির অভ্যুদয় ঘটছে। কাজেই এই সব সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব না-ও হতে পারে। তবে যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁরা এসব নৈরাশ্যজনক প্রক্ষেপণে হতাশ হন না। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এঁরা নিশ্চয়ই সাফল্যের পথ খুঁজে পাবেন।
বাংলাদেশে শুধু গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণের জন্যই রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজনীয় নয়; বাংলাদেশে দুর্নীতি হ্রাস করতে হলেও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। অবশ্য পৃথিবীর সব দেশেই রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এ প্রসঙ্গে একটি মার্কিন চুটকি স্মরণ করা যেতে পারে। চুটকিটিতে বলা হয়, একদিন এক সুবেশধারী লোক সন্ধ্যার পর ওয়াশিংটন ডিসিতে কংগ্রেস ভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক ছিনতাইকারী এসে তাঁকে আক্রমণ করে। সে ছুরি দেখিয়ে বলে, ‘তোর যত টাকা আছে, সব টাকা আমাকে দিয়ে দে, অন্যথায় তোকে খুন করে ফেলব।’ লোকটি তখন ছিনতাইকারীকে পাল্টা ধমক দিয়ে বললেন, ‘একি করছিস, জানিস না আমি একজন কংগ্রেসম্যান। আমি অফিসে যাচ্ছি। বেশি বাড়াবাড়ি করিস না।’ ছিনতাইকারী এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং বলল, ‘হারামজাদা, তোর পকেটে যে টাকা আছে, সে টাকা তোর টাকা নয়, সে টাকা আমার মতো সাধারণ করদাতাদের টাকা। তোর টাকা দিতে হবে না, আমার টাকাই আমাকে ফেরত দে।’ এই বলে ছিনতাইকারী যখন কংগ্রেসম্যানকে ছুরিকাঘাত করল, তখন বাধ্য হয়ে মানিব্যাগটি ছিনতাইকারীর হাতে দিয়ে তিনি চলে যান। পৃথিবীর সর্বত্রই রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। দুর্নীতি একটি জটিল সমস্যা। এর রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। তবে যদি রাজনীতিবিদদের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে হয়তো এ সমস্যা আস্তে আস্তে কমে আসবে।
পাদটীকা
১. Maneeza Hossin. 2006. “The Rising Tide of Islamists in Bangladesh’. ( Mimeo). New York: Hudson Institute.
২. Abul Barakat. 2013. ‘Political Economics of Fundamentalism in Bangladesh’ (Mimeo). Bdrc. Bd. @ gmail. Com.: gmail.com.info@hdear.bd.com.
৩. Pippa Norris. 2002. Democratic Phoenix : Reinventing Political activism. Cambridge: Cambridge University Press.
৪. Rounaq Zahan. 2015. Political Parties in Bangladesh: Dhaka. Prothoma