১৫. উত্তরণের সন্ধান : কোথায় চলেছি?
Cat: Where are you going?
Alice: Which Way Should I go?
Cat: That depends on where you are going?
Alice : I do not know.
Cat: Then It does not matter which way you go.
—Louis Caroll
Politicians are like bad horsemen who are so
preoccupied with staying in the saddle they can’t bother
about where they are going.
—Joseph A. Schumpeter
১৫. উত্তরণের সন্ধান : কোথায় চলেছি?
১৫.১ প্রস্তাবনা
জনৈক রসিক ব্যক্তি সংস্কারকে ব্যভিচারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য হলো, ‘যারা ব্যভিচার করে, তারা কখনো এ সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করে না। যারা পারে না, তারাই এ নিয়ে ফড়ফড় করে। যারা সংস্কার করে, তারাও এ নিয়ে বড়াই করে না; যারা সংস্কার করতে পারে না, তারাই এ সম্পর্কে হইচই করে।’ নৈতিক দিক থেকে সংস্কার ও ব্যভিচারের মধ্যে কোনো মিল নেই। ব্যভিচার গর্হিত আর সংস্কার হলো বাঞ্ছিত। তবু ব্যভিচার ও সংস্কার দুটোই হলো সামাজিক দিক থেকে অত্যন্ত অপ্রিয়। এ ধরনের অপ্রিয় কাজ লুকিয়ে সারতে পারলে ভালো হয়, হইচই করে করতে গেলেই বিপত্তি দেখা দেয়।
সংস্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘পতিত অবস্থা থেকে মুক্তি’। বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন হয় না, সেখানেই অধঃপতন দেখা দেয়। ব্রিটিশ দার্শনিক এন্ডমুন্ড বার্ক যথার্থই বলেছেন, ‘A state without the means of some change is without its means of conservation’। যেকোনো রাষ্ট্রকে বেঁচে থাকতে হলে তাকে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। তাই রাষ্ট্রকাঠামোতে সময় সময় পরিবর্তন অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।
অত্যাবশ্যক হলেও সংস্কার সহজে অর্জিত হয় না। প্রতিটি রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী জড়িয়ে থাকে। যেকোনো পরিবর্তন হলে কোনো না কোনো স্বার্থগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, তারা পরিবর্তন ঠেকানোর জন্য মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়।১ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাঁরা সংস্কারের ফলে লাভবান হন, তাঁরা সংস্কার বাস্তবায়নের ফলে যে তাঁদের লাভ হবে, তা নিজেরাও জানেন না। তাই সংস্কারের পক্ষে শক্তি থাকে অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল। সংস্কার নিয়ে যত ফড়ফড় করা হয়, তার এক অতি ক্ষুদ্র অংশের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পূর্ববর্তী ১৪টি অধ্যায়ে ছোট-বড় মিলে শতাধিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এ ধরনের বেশির ভাগ সংস্কারের অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই কম। এই গ্রন্থে যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে 1
প্রথমত, যেসব সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করলেও আমাদের সমাজ পুরোপুরি শুদ্ধ একটি আদর্শ সমাজ হবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি শুদ্ধ নয়। সব সংস্কার বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। উপরন্তু সব সংস্কার বাস্তবায়ন করলেও শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি শুদ্ধ হবে না; কেননা, সংস্কারের ফলাফল সব সময় বাঞ্ছিত হয় না। অনেক সময় সংস্কারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সংস্কার রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু কোনো দিনই রাষ্ট্রকে ‘সব পেয়েছির দেশে’ রূপান্তর করতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, প্রশ্ন হলো, অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সব সময় সংস্কার অত্যাবশ্যক নয়। বাংলাদেশে বিগত তিন দশকে রাজনীতি ও অর্থনীতি উল্টো পথে চলছে। সুশাসনের অধোগতি সত্ত্বেও মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে এবং মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ তরতর করে এগিয়ে গেছে। যদি এত দিন সংস্কার ছাড়াই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, তবে আদৌ সংস্কারের ঝক্কি-ঝামেলার প্রয়োজন রয়েছে কি?
তৃতীয়ত, যদি মেনে নিই, সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এত সব সংস্কার কি একসঙ্গে বাস্তবায়ন সম্ভব? কীভাবে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে? এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা কী, সে সম্পর্কে বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন রয়েছে।
সবশেষে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখে সংস্কার সম্পর্কে কী ধরনের উদ্যোগ যুক্তিযুক্ত ও ফলপ্রসূ হবে? শুধু সংস্কারের সুপারিশ করাই যথেষ্ট নয়, এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের কর্মসূচিও বিবেচনা করতে হবে।
এই অধ্যায়ে তাই ওপরে উল্লেখিত প্রশ্নাবলির উত্তর খোঁজা হবে। এই অধ্যায়টি চারটি খণ্ডে বিভক্ত। উপক্রমণিকার পর দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলাদেশে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে সংস্কারের সম্ভাবনা ও রণকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সংস্কার যেখানে প্রয়োজনীয়, সেখানেও সংস্কার করা সব সময় সম্ভব হয় না। উপরন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংস্কারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই সংস্কার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কাজেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংস্কারের অভিজ্ঞতা থেকে মূল বিষয়সমূহ তৃতীয় খণ্ডে উপস্থাপন করা হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করা যায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
১৫.২ সংস্কার কেন?
সমাজবিজ্ঞানের সংস্কার-সংক্রান্ত সাহিত্যে মূলত দুই ধরনের সংস্কার নিয়ে আলোচনা করা হয় : রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। সংস্কার অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হতে পারে (যেমন সাংস্কৃতিক সংস্কার, সামাজিক সংস্কার ইত্যাদি)। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে প্ৰধানত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারকেই মুখ্য সংস্কার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং অন্যান্য সংস্কারকে গৌণ সংস্কার মনে করা হয়। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কারের ফল পেতে অনেক সময় লাগে এবং কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাই ত্রুটিবিহীন নয়। সংস্কারের ফলে অনেক ভালো ফল পাওয়া গেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর অনভিপ্রেত প্রভাবও দেখা যেতে পারে। কাজেই সমাজবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বললেও মূলত অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়েই বেশি আগ্রহী। অর্থনৈতিক সংস্কারের সুফল অনেক তাড়াতাড়ি পাওয়া সম্ভব এবং অর্থনৈতিক ফলাফলের পরিমাণগত বিশ্লেষণও অপেক্ষাকৃত সহজ। কাজেই সংস্কারের পক্ষে যাঁরা বক্তব্য দিচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি জানাচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিসহ দাতা সংস্থাসমূহও সুশাসনের জন্য সংস্কারের পক্ষেই সোচ্চার। এ বক্তব্যের পক্ষে প্রধান যুক্তি হলো, সুশাসন ছাড়া টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। শাসনব্যবস্থা সংস্কার করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। আর প্রতিবন্ধকতা দূর হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে এবং মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে। তাই তাদের বক্তব্য হলো, সবার আগে প্রয়োজন সুশাসনের জন্য সংস্কার। আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য মনে হলেও আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অভিজ্ঞতা সুশাসনের অপরিহার্যতাকে সমর্থন করে না। অতি সম্প্রতি চীন ও ভারতে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে কিন্তু সুশাসনের মাপকাঠিতে এ দুটি রাষ্ট্রের অবস্থান এখনো অনেক নিচে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সুশাসনের অপরিহার্যতার ধারণাকে সমর্থন করে না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে রাজনীতি ও সুশাসন নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা প্রায় সবাই একমত যে বাংলাদেশে রাজনীতি ও সুশাসন ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। সুশাসনতত্ত্বের প্রবক্তারা বলেন, সুশাসন ছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশে সুশাসন ছাড়াই অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সুশাসন-সংক্রান্ত মূল্যায়নে ছয়টি নির্দেশক সূচক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ছয়টি সূচকের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের স্থান পৃথিবীর নিম্নতম ২০ শতাংশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সময়কালে দেখা যাচ্ছে যে সুশাসনের ছয়টি সূচকের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ নিচে নেমে গেছে এবং অন্য সূচকটিতেও আমাদের অবস্থান প্রায় অপরিবর্তিত। পক্ষান্তরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। গত চার দশকে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার ১৯৭০ সালে ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ, বর্তমানে তা ২২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল ৪২ বছর। এখন এই হার ৭০ বছরে উন্নীত হয়েছে। সাক্ষরতার হার, শিশুমৃত্যুর হার, মহিলাদের ক্ষমতায়নের হার এই সূচকগুলোতেও বাংলাদেশের নাটকীয় অগ্রগতি হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, যদি সুশাসন ছাড়াই অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশে আদৌ সংস্কারের কোনো প্রয়োজন আছে কি? সংস্কার করতে গেলে অনেক অপ্রিয় ব্যবস্থা নিতে হয়। দেশে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয় এবং অস্থিতিশীলতা অর্থনীতির অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজেই বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সুশাসনের অধোগতি কীভাবে একই সঙ্গে কাজ করছে, সেটা বুঝতে হবে।
পণ্ডিতেরা বাংলাদেশে সুশাসনের অধোগতি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে আপাতবিরোধী অবস্থান তাকে চারভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। প্রথমত, এক ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন যে বাংলাদেশে সুশাসনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি একটি অস্থায়ী পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতি টেকসই হতে পারে না। ফার্নান্ডেজ ও ক্রে নামে দুজন অর্থনীতিবিদ বলছেন, বাংলাদেশের সুশাসনের যে পরিস্থিতি, সে পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি খাপ খায় না।২ সুতরাং সুশাসন অর্জনের জন্য ব্যবস্থা না নিলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল ২০০৬ সালে। ২০০৬ থেকে ২০১৬ এই এক দশকে সুশাসনের আরও অবনতি ঘটেছে অথচ লক্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই ঘটেনি। চীনে ও ভারতে সুশাসনের অবক্ষয় সত্ত্বেও অভাবিতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছে। সুতরাং ফার্নান্দেজ ও ক্রের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে সুশাসনের অভাব থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অগ্রগতির আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিবিদ দেব রাজন। তিনি বলেছেন, সুশাসনের অভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এবং সিভিল সমাজের অসাধারণ সৃজনশীলতার ফলে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মহিলাদের ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করেছে। উৎপাদনের জন্য ঋণ সরবরাহ করেছে। গরিবদের তৈরি পণ্যের বাজারজাত করার ব্যবস্থা করেছে এবং নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে এদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এর ফলে গরিবদের সৃজনশীলতার বিকাশ সম্ভব হয়েছে। দেব রাজনের মতে, সুশাসন মূলত রাষ্ট্রের সমস্যা : বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবদান। তবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেব রাজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সাফল্যকে অতিরঞ্জিত করেছেন। বেসরকারি সংস্থাসমূহের এবং বেসরকারি খাতের অর্থনৈতিক অর্জন সম্ভব হতো না যদি না সরকার ভৌত অবকাঠামো (যথা সড়ক, বিদ্যুৎ) এবং সামাজিক অবকাঠামো (যথা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে) উদ্যোগ না নিত। বেসরকারি সংগঠনের ভূমিকা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে, কিন্তু এটি মূল শক্তি ছিল না। সুতরাং, দেব রাজনের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
তৃতীয় একটি ব্যাখ্যা এসেছে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় বলা হয় যে বাংলাদেশ যদিও সুশাসনের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নিতে পারেনি, তবু কয়েকটি জরুরি ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার করেছে।o এই সংস্কারগুলোর ফলেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। এই সংস্কারগুলো হলো নিম্নরূপ :
১. সরকার অভ্যন্তরীণ বেসরকারি খাতের বিকাশের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে।
২. বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে সব সরকারই বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশে অভিবাসনের জন্য সহায়তা প্রদান করে।
৩. রাষ্ট্র জনগণের দোরগোড়ায় সব রকম সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা স্বীকার করে নেয় এবং এসব সেবার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ভূমিকা স্বীকার করে তাদের সঙ্গে অংশীদারত্বমূলক ভিত্তিতে কাজ করে।
৪. পৃথিবীর অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সরকারি ব্যয় অপেক্ষাকৃত বেশি দরিদ্রবান্ধব। অর্থাৎ বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় করা হয়।
৫. দুর্যোগ প্রতিরোধে রাষ্ট্র তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।
বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাদের এ বক্তব্য অবশ্য বিশ্বব্যাংকের সুশাসনের ধারণাকে সমর্থন করে না। বিশ্বব্যাংক বিশ্বাস করে যে সুশাসনের জন্য সব ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। এই মতবাদের বিরোধিতা করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুলের অধ্যাপিকা মেরিলি এস গ্রিন্ডল (Merilee S Grindle)। তাঁর বক্তব্য হলো, নিম্ন আয়ের দেশসমূহের সুশাসনের জন্য সংস্কার করার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। তাই তাদের সুশাসন অর্জনের জন্য চেষ্টা না করে ‘চলনসই সুশাসন’ (Good enough Governance) প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। চলনসই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জরুরি সংস্কারের মাধ্যমে। এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ-যাবৎকালের অর্জনের ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তবে সমস্যা হলো যে ভবিষ্যতে এই উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে ক্রমশ নতুন নতুন জরুরি সংস্কার করতে হবে। কয়েক দশক এ ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে এগিয়ে গেলেও এক পর্যায়ে বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন হবে। সুতরাং, এটা কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়, শেষ পর্যন্ত সুশাসনের জন্য সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে সুশাসনের অধোগতি এবং অর্থনীতির উন্নয়নে চতুর্থ একটি ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। এ ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ অবিনাশ দীক্ষিত ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রিটচেট (Pritchett)। ৬ তাঁদের বক্তব্য হলো, যখন কোনো দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিম্ন পর্যায়ে থাকে, তখন সুশাসন ছাড়াও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়। তার কারণ, নিম্ন আয়ের দেশে প্রবৃদ্ধির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে এবং এসব সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু যখন একটি দেশ নিম্ন আয় থেকে মধ্য আয়ের পর্যায়ে উপনীত হয়, তখন সুশাসনের প্রয়োজন অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে সুশাসন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্পর্ক তখন আর সরলরৈখিক নয়। অর্থাৎ নিম্ন আয়ের দেশসমূহে এক ধরনের সম্পর্ক এবং মধ্য আয়ের দেশগুলোতে আরেক ধরনের সম্পর্ক। এ সম্পর্ক রেখাচিত্র ১৫.১-এ দেখা যাবে।
লেখচিত্র-১৫.১
সুশাসন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক

যাঁরা সুশাসনের জন্য সংস্কারের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন, তাঁদের বক্তব্য দুটি। প্রথমত, তাঁরা বলেন, যেহেতু সুশাসনের অগ্রগতি ছাড়াই ভারত, বাংলাদেশ, চীন প্রভৃতি দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, সেহেতু সুশাসনের অগ্রগতিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি আবশ্যিক শর্ত হিসেবে গণ্য করার যুক্তি নেই। সুশাসন ছাড়াও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, আরেক ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এটি মনে করা ঠিক নয় যে সুশাসন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বরং বর্তমানে যেসব দেশ উন্নত, সেসব দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছে। এ ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হা জুন চাং তাঁর Kicking away the Ladder নামক বই-এ। তিনি লিখেছেন :
Most of the institutions that are currently recommended to the developing countries as parts of the ‘good governance’ package were in fact the results, rather than the causes, of economic development of the NDCs. In this sense, it is not clear how many of them are indeed ‘necessary’ for today’s developing countries-are they so necessary that, according to the view of the IDPE, they have to be imposed on these countries through strong bilateral and multilateral external pressures?
সুশাসনে অগ্রগতি ছাড়াও অর্থনৈতিক অগ্রগতি হতে পারে। তবে সংস্কার ছাড়া এ ধরনের অগ্রগতি টিকিয়ে রাখা যায় না। এ প্রসঙ্গে লাতিন আমেরিকার দেশসমূহ, বিশেষ করে আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের ফলে আর্জেন্টিনা পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর উন্নত দেশগুলোর তুলনায় এর অর্থনীতি নিচের দিকে নামতে থাকে এবং ১৯৭০-এর দশকের পর আর্জেন্টিনায় অর্থনৈতিক অধোগতি দেখা দেয়। আর্জেন্টিনা সম্পর্কে গবেষণা করেছেন Daron Acemoglu 3 James A. Robinson। তাঁদের বক্তব্য হলো, আর্জেন্টিনার প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর হয়নি, এর ফলে আর্জেন্টিনার পক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এই দুজন গ্রন্থকার বলছেন যে আর্জেন্টিনার প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল Extractive বা উৎপাটনমূলক। উৎপাটনমূলক প্রতিষ্ঠান সমাজের উৎপাদনশীলতা ক্ষুণ্ণ করে। সমাজের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান (inclusive institutions)। আচেমগলু ও রবিনসন এ প্রসঙ্গে তাই লিখেছেন :
Extractive political institutions concentrate power in the hands of a narrow elite and place few constraints on the exercise of this power. Economic institutions are then often structured by this elite to extract resources from the rest of the society. Extractive economic institutions thus naturally accompany extractive political institutions. In fact, they must inherently depend on political institutions for their survival. Inclusive political institutions, vesting power broadly, would tend to uproot economic institutions that appropriate the resources of the many, erect entry barriers, and suppress the functioning of markets so that only a few benefit.[৮]
আর্জেন্টিনার মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহের মতো বাংলাদেশে রয়েছে উৎপাটনমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য। এসব প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর না করা পর্যন্ত টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশে সুশাসন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্পর্ক নিয়ে যে চারটি ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করা হয়েছে, তার দুটি ব্যাখ্যা থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের পর্যায়ে সুশাসনে অগ্রগতি ছাড়াও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এ অর্জন যে ভবিষ্যতেও ঘটবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হলে সুশাসনের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে দেশে সুশাসন না থাকলে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। দ্বিতীয়ত, সুশাসনের জন্য একসঙ্গে সব পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই এবং শুধু জরুরি সংস্কার করতে পারলেই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে, এ ধরনের একটি অনুমান চালু করা হয়েছে। তবে এ ধরনের অনুমানের অসুবিধা হলো, এ অনুমানের ভিত্তিতে অতীতের অর্জন বিশ্লেষণ করা সম্ভব। কিন্তু ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হলে এ ধরনের সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু কয়েক দশকের সংস্কারের পর দেখা যাবে, শুধু ছোটখাটো সংস্কারের ফলে কাজ হচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রেই বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সুশাসনের জন্য সংস্কারের প্রয়োজন না থাকলেও দীর্ঘ মেয়াদে অবশ্যই সুশাসনের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সুশাসন রাতারাতি প্রতিষ্ঠা করা যায় না, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক দশক ধরে অব্যাহতভাবে কাজ করতে হবে। আজকে যে সংস্কার করা হবে, তার ফল পেতে হয়তো ১০ বছর থেকে ২০ বছর সময় লাগবে। তত দিনে বাংলাদেশের জন্য সংস্কার অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশে সংস্কারের অনিবার্যতা প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত বক্তব্যসমূহ প্ৰণিধানযোগ্য :
• শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সংস্কার প্রয়োজনীয় নয়। সংস্কারের প্রয়োজন সাধারণ মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য। মানবাধিকার মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় অধিকার। অন্য কোনো অধিকার মানবাধিকারের বিকল্প হতে পারে না। যদি এমন পরিস্থিতি দেখা যায়, যেখানে রাজনৈতিক অধিকারের জন্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়, সেখানে রাজনৈতিক মানবাধিকারকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে সুশাসনের প্রকট অভাব রয়েছে। সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশে অবশ্যই সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে।
• অমর্ত্য সেনের ভাষায় উন্নয়ন হচ্ছে ‘মানুষ যে বাস্তব স্বাধীনতা ভোগ করে, তার সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া।’ (‘a process of expanding the real freedoms that people enjoy’) অবশ্যই মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি মানুষের স্বাধীনতা সম্প্রসারণ করে। তবু শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই মানুষের স্বাধীনতা নয়। অমর্ত্য সেন যথার্থই লিখেছেন :
But freedoms depend also on other determinants, such as social and economic arrangements (for example, facilities for education and health care as well as political and civil rights (for example the liberty to participate in public discussion and scrutiny).[৯]
মানবাধিকারের অনুষঙ্গসমূহের বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশে অবশ্যই ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।
• মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি শুধু মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যই বাড়ায় না, অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক বৈষম্য বাড়িয়ে সমাজে অসন্তোষের সৃষ্টি করে। এ ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলের চেয়ে কুফলই হয় বেশি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সোনার ফসল সাধারণ মানুষের ঘরে তোলার জন্য সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।
• অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হলে প্রতিনিয়ত সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। যদিও বর্তমানে কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার ছাড়াই অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি সম্ভব না-ও হতে পারে। অধ্যাপক প্রিটচেটের অনুমান, নিম্ন আয়ের দেশে সংস্কার ছাড়াও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব; কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশে সংস্কার ছাড়া এ অগ্রগতি চালু থাকবে না। তবে সংস্কার করতে সময় লাগে। রাতারাতি সংস্কার করা যায় না। নিম্ন আয়ের দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের জন্য ১৫-২০ বছর সময় লাগে। এই ক্রান্তিকালে যেসব দেশ সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেখানেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। সুতরাং, নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের মাঝে যে ১৫-২০ বছরের ক্রান্তিকাল রয়েছে, এটিই সংস্কার বাস্তবায়নের সবচেয়ে ভালো সময়।
১৫.৩ সংস্কারের কৌশল
সংস্কারের কৌশল সম্পর্কে দুই ধরনের মতবাদ দেখা যায় : এক ধরনের অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন যে সংস্কারের প্রকৃত সুফল পেতে হলে সব ক্ষেত্রে একই সঙ্গে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ধরনের মতবাদ প্রচণ্ড আঘাত পন্থা (Shock Tharapy অথবা Big bang approach) নামে পরিচিত। দ্বিতীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা পর্যায়ক্রমে সংস্কারের পক্ষে। এ ধরনের মতবাদকে ধীর পন্থা (Gradualism) রূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
‘প্রচণ্ড আঘাত পন্থার’ সমর্থকদের মধ্যে রয়েছেন ডেভিড লিপটন (David Lipton), জেফরি স্যাকস (Jeffery Sachs), অ্যান্ডারস অ্যাশল্যান্ড ( Anders Aslund), অ্যান্ড্রু বার্গ (Andrew Berg) প্রমুখ।১০ তাঁরা বিশ্বাস করেন যে বিচ্ছিন্ন সংস্কার কখনো ফলপ্রসূ হয় না। সব ক্ষেত্রে সংস্কার একই সঙ্গে শুরু করতে হবে এবং স্বল্পতম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে। তাঁদের বক্তব্য হলো ‘You can not cross chasm in two jumps’, অর্থাৎ লাফ দিয়ে খাদ পেরোতে হলে এক লাফেই পেরোতে হবে, দুই লাফে খাদ পেরোনোর কোনো উপায় নেই। তাঁদের বক্তব্যের পক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তিসমূহ উপস্থাপন করা হয় :
১. সামঞ্জস্যকরণের ব্যয় হ্রাস : যদি সব সংস্কার একই সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে করা যায়, তাহলে সামঞ্জস্যকরণের ব্যয় কমে যায়। যদি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার চলে, তাহলে অর্থনৈতিক পরিবেশে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। সামঞ্জস্যকরণের জন্য সামাজিক ব্যয় বাড়তে থাকে।
২. বিশ্বাসযোগ্যতা : যদি সব ক্ষেত্রে একই সঙ্গে সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, তাহলে সংস্কার বিশ্বাসযোগ্য হয়। যদি কোনো কোনো খাতে সংস্কার করা হয়, আর অন্য খাতে সংস্কার না করা হয়, তাহলে সে সংস্কার কর্মসূচি বিশ্বাসযোগ্য হয় না। এ ধরনের সংস্কার বেসরকারি খাতে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে না।
৩. রাজনৈতিক প্রতিরোধ নিষ্ক্রিয়করণ : বেশির ভাগ সংস্কারের ফলে সমাজে কারও লাভ হয়, কারো ক্ষতি হয়। এমন সংস্কার খুঁজে পাওয়া শক্ত, যাতে সবারই লাভ হয়। যদি সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়িত হয়, তাহলে সংস্কারের ফলে যাঁদের লোকসান হয়, তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় পান না। এমনকি সংস্কারের সব লোকসান সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধিও করতে পারেন না। কিন্তু সংস্কার বাস্তবায়নে যদি সময় লাগে, তাহলে যাঁদের ক্ষতি হয়, তাঁরা একত্র হন। সংস্কারের প্রক্রিয়া যত বিলম্বিত হবে, সংস্কারের শত্রুরা ততই মরিয়া হয়ে সংস্কার প্রতিহত করার চেষ্টা করবে।
৪. বিভিন্ন খাতের সংস্কারের পরিপূরকতা : অর্থনীতিবিদ জোয়ন রবিনসনের মতো তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে অর্থনীতির প্রথম সবক হলো অর্থনীতিতে সবকিছুই অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে। তাই তাঁরা মনে করেন, এক খাতের সংস্কার অন্য খাতের সংস্কারের পরিপূরক। অর্থনীতির এক খাতের সাফল্য অন্য খাতকে উজ্জীবিত করে এবং এক খাতের ব্যর্থতা অন্য খাতে সংক্রমিত হয়। কাজেই সংস্কার করতে হলে সব খাতের সংস্কারই একসঙ্গে করতে হবে। ধীর পন্থার সমর্থকগণ মনে করেন যে সংস্কার ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ মতবাদের সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে রিচার্ড পোর্টেস (Richard Portes), রোনাল্ড ম্যাকিনন ( Ronald Mckinnon), ম্যাথিয়াস ডিউয়াট্রিপন্ট (Mathias Dewatripont) এবং রোনাল্ড জেরার্ড (Ronald Gerard)।[১১] তাঁদের বক্তব্য নিম্নরূপ :
১. রাজনৈতিক বাস্তবতা : বেশির ভাগ দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো একই সঙ্গে অনেক খাতে সংস্কার করার ক্ষমতা বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের সরকারের নেই। প্রচণ্ড আঘাত দিয়ে অনেক কিছু ভেঙে দেওয়া সম্ভব, কিন্তু রাতারাতি তা পুনর্নির্মাণ করা যায় না। পুনর্নির্মাণ করতে সময় লাগে, তাই ধীর পন্থা হচ্ছে বেশির ভাগ দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা।
২. গণসমর্থন সৃষ্টি : যদি ধীর পন্থা অবলম্বন করে সংস্কারসমূহ বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সংস্কারসমূহ দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এতে সংস্কারের পক্ষে সমর্থন সৃষ্টি হয়। প্রচণ্ড আঘাত দিলে অনেক সংস্কারই অবাস্তবায়িত থাকে। এই পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে। কাজেই প্রচণ্ড আঘাত সংস্কারের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে পারে না।
৩. আনুক্রমিক (Sequential) সংস্কারের অপরিহার্যতা : কোনো সংস্কারই একবারে বাস্তবায়িত হয় না। অনেক সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয় এবং সংস্কার সফল করার জন্য বাস্তবায়নের পরও পরিবীক্ষণ করতে হয়। কাজেই সংস্কারের আনুক্রমিক বিন্যাসের প্রয়োজন রয়েছে। প্রচণ্ড আঘাত পন্থায় যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা এই আনুক্রমিক বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন না। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে প্রচণ্ড আঘাত পন্থায় গণসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে (Public Utilities) বেসরকারীকরণ করা হয়। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে বেসরকারি খাতে একচেটিয়া ব্যবসা গড়ে ওঠে এবং এসব ব্যবসা অন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ও ভোক্তাদের শোষণ করে।
৪. সংস্কারের ব্যয় হ্রাস : প্রচণ্ড আঘাত পন্থায় সংস্কারের ব্যয় অনেক ক্ষেত্রেই বিপুল হয়ে দাঁড়ায়। এই পন্থায় অনেক সময়ই অপরিবর্তনীয় ভুল করা হয়, যার মাশুল বিপুল। উদাহরণস্বরূপ স্মরণ করা যেতে পারে যে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সময়কালে রাশিয়াতে প্রচণ্ড আঘাত পন্থা ভিত্তিক যেসব সংস্কার করা হয়, তার ফলে দেশটিতে এই সময়ে স্থূল জাতীয় উৎপাত ৫৪ শতাংশ হ্রাস পায় এবং শিল্প উৎপাদন প্রায় ৯০ শতাংশ কমে যায়।
প্রকৃতপক্ষে তাত্ত্বিকেরা প্রচণ্ড আঘাত পন্থা ও ধীর পন্থার যে বিরাট ফারাকের কথা বলছেন, তা মোটেও বাস্তব নয়। প্রচণ্ড আঘাত পন্থাতেও রাতারাতি সব সংস্কার করা যায় না, সংস্কার করতে সময় লাগে। অন্যদিকে ধীর পন্থা মানে সংস্কার থেকে পিছিয়ে আসা নয়, ধীর পন্থার তাৎপর্য হলো, সংস্কার আস্তে আস্তে করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে উভয় ক্ষেত্রেই সময় লাগে এবং বাস্তবে এই দুই পন্থার মধ্যে তফাত তত বেশি নয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক স্টিগলিজ যথার্থই লিখেছেন :
In some cases what separated the two views was more a difference in perspective than reality. I was present in a seminar in Hungary when one participant said, ‘We must have rapid reform. It must be accomplished in five years.’ Another said, ‘We should have gradual reforms. It will take us five years.’ Much of the debate was about the manner of reform than the speed.[১২]
মূল বিতর্কের বিষয় এই নয় যে সব সংস্কার আঘাত পন্থায় অথবা ধীর গতিতে করা হবে। মূল বিষয় হলো তিনটি। প্রথমত, কী সংস্কার করা হবে; দ্বিতীয়ত, কে সংস্কার করবেন এবং তৃতীয়ত, কীভাবে সংস্কার করবেন। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে সংস্কার সম্পর্কে সব দেশে একই ধরনের নীতি অনুসরণ করা সম্ভব নয়। দেশভেদে সংস্কার কী, কেন, কারা এবং কীভাবে করবেন, এ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সমাধান দেখা যাবে। সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথম যে সিদ্ধান্তটি নিতে হবে সেটি হলো, কোথায় ছোট ছোট সংস্কার করা হবে আর কোথায় বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে।
যেখানে ছোট ছোট সংস্কার সম্ভব সেখানে ছোট ছোট সংস্কারের মাধ্যমেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব। যেসব দেশে দক্ষ প্রশাসন রয়েছে সে দেশে ছোট ছোট সংস্কার বাস্তবায়ন সহজ। যেসব দেশের প্রশাসন দুর্বল, সেসব দেশে ছোট ছোট পরিবর্তন করে সংস্কার বাস্তবায়ন করা যায় না। এর জন্য প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেশগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায় : ১. যেসব দেশে বিচ্ছিন্ন সংস্কারকাজ করবে; ২. যেসব দেশে বিচ্ছিন্ন সংস্কারকাজ করবে না।
যেসব দেশে বিচ্ছিন্ন সংস্কারকাজ করবে না, সেসব দেশের সমস্যাকে Humty Dumpty disorder আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। ছোটদের ছড়া Humty Dumpty নিম্নরূপ :
Humpty Dumpty sat on a wall
Humpty Dumpty had great fall
All the king’s horses and all the king’s men
Could not put Humpty Dumpty together again.
ছড়াটির সহজ অর্থ হলো, একটি ডিম ভেঙে গেলে যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, একে আর জোড়া লাগানো সম্ভব হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশের প্রশাসনেরও একই অবস্থা। ক্ষুদ্র পরিবর্তন করে এসব প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করার উপায় নেই। এসব প্রতিষ্ঠান নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এ ধরনের সমস্যার দুটি উৎস রয়েছে। একটি হলো বাস্তবতা বিবেচনা না করে বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্ধ অনুকরণ। দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলে প্রশাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা। বিশেষ করে অনেক রাষ্ট্রেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল প্রশাসনকে গ্রাস করে। যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রশাসন পরিচালিত হয় না, প্রশাসন পরিচালিত হয় রাজনৈতিক নেতাদের মর্জি অনুযায়ী। এ ধরনের ব্যবস্থাতে সংস্কার চালু করা অত্যন্ত কঠিন।
যেখানে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন, সেখানে নিম্নলিখিত পাঁচ ধরনের ব্যবস্থা বিবেচনা করা যেতে পারে :
ক. দুষ্ট কর্মকর্তাদের অপসারণ করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ করে প্রশাসনিক সংস্কার করা যেতে পারে। তবে এই ব্যবস্থা সব ক্ষেত্রে করতে গেলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে হবে। আমলাতন্ত্রে এ ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই স্বল্পসংখ্যক নির্বাচিত ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
খ. সরকারের ভূমিকা হ্রাস এবং সরকারি সেবার বেসরকারীকরণ। এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রগতি সম্ভব।
গ. নির্ধারিত ক্ষেত্রে নেতৃত্বের পরিবর্তন এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দান। নেতৃত্বে পরিবর্তন আনলে নতুন নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানে অনেক সময় সংস্কারের প্রয়োজন হতে পারে।
ঘ. অদক্ষ অথবা দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের ক্ষমতা হ্রাস করা। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত দক্ষ নেতৃত্বকে দায়িত্ব দিতে হবে।
ঙ. বহু খাতবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ খাতসমূহ চিহ্নিত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কার শুরু করা। এ ব্যবস্থায় একবারে গোটা প্রতিষ্ঠানটিকে পরিবর্তন করা হয় না। দেশের বাস্তবতা বিবেচনা করে সংস্কারের কৌশল নির্ধারণ করতে হয়।
১৫.৪ কোথায় চলেছি?
মোটা দাগে দুই ধরনের সংস্কার করা হয়ে থাকে। একধরনের সংস্কার হয় পরিস্থিতির চাপে। এ ধরনের সংস্কারকে আমরা সংকটের সমাধান হিসেবে গণ্য করতে পারি। আরেক ধরনের সংস্কার হয় পর্যালোচনা ও পরিবীক্ষণ থেকে। যাঁরা রাষ্ট্রনায়ক, তাঁরা সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন, জনমত যাচাই করেন, পর্যালোচনা করেন এবং প্রয়োজনবোধে সংস্কার করেন। এ ধরনের সংস্কার যেসব রাষ্ট্রে হয়, সেসব রাষ্ট্রে সংস্কার নিয়ে কোনো হইচই করতে হয় না। সংস্কার নিয়ে হইচই তখনই হয়, যদি রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড নিয়মিত সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা না থাকে। বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক সংস্কার হয়েছে, সেগুলো মূলত সংকট মোকাবিলা করার জন্য। গত চার দশকে বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকারকে একদলীয় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারে রূপান্তর করা হয়েছে; নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে দুজন রাষ্ট্রপতিকে। সামরিক অভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করেছে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য বারবার সংগ্রাম করতে হয়েছে। তবু বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধান কখনো বাতিল করা হয়নি। সংকট সমাধানের জন্য গত তিন দশকে আপাতদৃষ্টিতে দুটি রাজনৈতিক সংস্কার করা হয়। প্রথমত, ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের বদলে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এই সংস্কার প্রকৃত অর্থে কোনো পরিবর্তন আনেনি। রাষ্ট্রপতির যেসব ক্ষমতা ছিল, তা প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয় এবং প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকারে যে দলভিত্তিক নেতৃত্ব (Collegial) থাকে, তা কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দ্বিতীয় সংস্কার করা হয় ১৯৯৬ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। এর আগে পৃথিবীর কোনো দেশে শাসনতন্ত্রে এ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করা হয়নি। এই অভিনব পদ্ধতিতে দেশে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বৈধ নয় বলে ঘোষণা করেন এবং এরপর এই বিধান তুলে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে গভীর রাজনৈতিক সংকট সত্ত্বেও প্রকৃত অর্থে কোনো রাজনৈতিক সংস্কার করা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করে নির্বাচনের সংকট ঠেকানো হয়েছিল মাত্র। কিন্তু রাজনীতির মূল সমস্যাগুলোর সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই গ্রন্থে আট ধরনের সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
• রাষ্ট্রের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সংস্কার
• গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণের জন্য সংস্কার
• ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সংস্কার
• বিচারব্যবস্থার সংস্কার
• প্রশাসনের সংস্কার
• নির্বাচন-ব্যবস্থার সংস্কার
• সিভিল সমাজের সংস্কার
• রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার
বাংলাদেশের চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ রয়েছে : জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়াতে যে তিনটি জাতীয় রাষ্ট্র রয়েছে, এর মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ সবচেয়ে স্থিতিশীল। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি অস্থিতিশীল। জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন উপাদানের টানাপোড়েন দেখা গেলেও বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য পরিবর্তনশীল। যে বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ গ্রহণ করা হয়েছিল, সে পরিস্থিতিতে এখন অনেক বড় পরিবর্তন ঘটেছে। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার উপরে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তৃতীয় আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সুতরাং, বাংলাদেশের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা। পঞ্চম অধ্যায় ও একাদশ অধ্যায় থেকে দেখা যায় যে বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিন ধরনের সংস্কার অত্যাবশ্যক।
• আনুপাতিক নির্বাচন-পদ্ধতির প্রবর্তন
• গণভোট-ব্যবস্থার প্রবর্তন
• ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
কোনো নির্বাচন-ব্যবস্থাই পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়। প্রতিটি নির্বাচনী পদ্ধতিরই সুফল এবং কুফল রয়েছে। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের সুফল হলো, এই পদ্ধতি নির্বাচনী এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন-পদ্ধতির চেয়ে অধিক গণতান্ত্রিক। নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ্ধতিতে একজন প্রার্থী ৫০ শতাংশের অনেক কম ভোট পেয়েও নির্বাচিত হতে পারেন। কিন্তু আনুপাতিক হারে দেশ পরিচালনার জন্য ৫০ শতাংশের চেয়ে বেশি ভোটের প্রয়োজন রয়েছে। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের আরেকটি সুবিধা হলো যে দলের পক্ষে বিশেষজ্ঞদের মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব। তাঁরা দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। তৃতীয়ত, আনুপাতিক হারে নির্বাচন-পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে ছোট দলগুলোর পক্ষে রাজনীতিতে অবদান রাখা সম্ভব হয়।
কিন্তু আনুপাতিক হারের দুটি মারাত্মক দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, আনুপাতিক হারে নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে বিশেষ নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয় না। যেখানে প্রার্থীকে বিশেষ নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করতে হয়, সেখানে তাঁকে নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা এ ধরনের প্রার্থীকে জানেন, চেনেন এবং তাঁদের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করেন। সুতরাং, আনুপাতিক হারে নির্বাচন- পদ্ধতি প্রবর্তন ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। দ্বিতীয়ত, আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে অনেক ক্ষেত্রেই কোনো দল সুস্পষ্ট সংখ্যাধিক্য অর্জন করতে পারে না। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কোয়ালিশন সরকার বিভিন্ন দলের মধ্যে আপস করে সরকার পরিচালনা করে এবং তাদের পক্ষে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। এ দুটি দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে নিম্নলিখিত কারণে আনুপাতিক পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে :
ক. বাংলাদেশে নির্বাচনে অনেক জাল-জালিয়াতি হয়। নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নির্বাচনে কোনোক্রমে এক ভোট বেশি পেলেই নির্বাচিত হওয়া সম্ভব কিন্তু আনুপাতিক হারের নির্বাচনে জাল ভোটের মাধ্যমে একটি আসন লাভ করতে হলে কমপক্ষে তিন লাখ ভোট জাল করতে হবে। যদি নির্বাচনে ভালো পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় (বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক), তাহলে আনুপাতিক হারে নির্বাচনে জাল ভোটের প্রভাব অনেক কম হবে।
খ. কোয়ালিশন সরকার অর্থ সব সময়ই দুর্বল সরকার নয়। ভারতে কোয়ালিশন সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে কোয়ালিশন সরকারের মাধ্যমেও ভালোভাবে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব। পক্ষান্তরে কোয়ালিশন সরকার গঠনের একটি সুবিধাও রয়েছে। কোয়ালিশন সরকার অনেক সময় পরস্পরবিরোধী দল নিয়ে গঠন করতে হয়। তাই কোয়ালিশন সরকারে অন্য দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। এর ফলে সংঘর্ষের রাজনীতির পরিবর্তে সমঝোতার পরিবেশ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে বর্তমানে সংঘর্ষের রাজনীতি বিরাজ করছে। এ রাজনীতিতে দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে। আনুপাতিক নির্বাচন-পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে সংঘর্ষের রাজনীতি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গ. আনুপাতিক হারে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচনী এলাকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে না বলে এ ধরনের ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই দেশের সাধারণ নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। এই ব্যবস্থার সমাধান হিসেবে দুই ধরনের মিশ্র ব্যবস্থা বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, সংসদে শতকরা ৫০ ভাগ আসন আনুপাতিক হারে এবং শতকরা ৫০ ভাগ আসন নির্বাচনী এলাকার ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ব্যবস্থায় আনুপাতিক হারের কিছুটা সুফল পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, একই নির্বাচনে দুটি কক্ষ নির্বাচিত হতে পারে। একটি সংসদ হবে নিম্নকক্ষ। নিম্নকক্ষের সদস্যরা নির্বাচনী এলাকায় সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন আর উচ্চকক্ষের সদস্যরা আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। যদি নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষের সমান অধিকার থাকে, তাহলে উচ্চকক্ষে সরকার পরিচালনার জন্য কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই মিশ্র পদ্ধতি নিয়ে আরও বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ দেশে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে, সেটি পরোক্ষ। জনগণ আইনসভার সদস্যদের নির্বাচিত করেন এবং আইনসভার সদস্যরা সরকার পরিচালনা করেন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর একবার নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনের সময় জনগণ তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। কিন্তু একবার প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করেন। এই সময়ে ভোটারদের কোনো ক্ষমতা থাকে না। এ ধরনের ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই পৃথিবীর অনেক দেশেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণভোট জনগণকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে গণভোটের কোনো ব্যবস্থা নেই। এর ফলে দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য বাংলাদেশে হরতালের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। যদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নসমূহ নিয়ে গণভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে হরতালের এই ধারার পরিবর্তন করা সম্ভব। তবে গণভোটেরও অসুবিধা আছে। যদি সবকিছুর ওপর যখন-তখন গণভোট করার সুযোগ দেওয়া হয়, তখন সরকারের পক্ষে কোনো কাজ করা অত্যন্ত শক্ত হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশে তাই গণভোট প্রবর্তন করতে হবে, কিন্তু এ সম্পর্কে বিধিনিষেধ প্রণয়নেরও প্রয়োজন রয়েছে। কাজেই এই বিষয়টি সম্পর্কেও রাজনৈতিক বিতর্কের প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশে আরেকটি বড় সমস্যা হলো যে এখানে একটিমাত্র স্তরে নির্বাচিত সরকার রয়েছে। একই সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ করে, প্রাদেশিক সরকারের কাজ করে এবং প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় সরকারও পরিচালনা করে। এর ফলে বাংলাদেশে সরকারের ক্ষমতা অনেক বেশি। এ ধরনের সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খায় না। কাজেই বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে প্রাদেশিক অথবা জেলাভিত্তিক নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারকেও শক্তিশালী করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, অনেক উন্নয়নশীল দেশে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করলে সাধারণ মানুষের তত লাভ হয় না। প্রকৃতপক্ষে লাভবান হয় স্থানীয় অভিজাতরা। কাজেই বাংলাদেশে শুধু ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই হবে না, এখানে Double Devolution বা দ্বৈত ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। শুধু স্থানীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই চলবে না, স্থানীয় সরকারকেও তৃণমূলের জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
সাধারণ মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে বিলাতের কমন লর আদলে বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিলাতে শুধু গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে আইনজ্ঞদের বিশেষ অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, বেশির ভাগ মামলার ক্ষেত্রে আইনজ্ঞদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে মামলা-পাল্টা মামলার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে; মিথ্যা সাক্ষ্যের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। উপরন্তু রাষ্ট্র বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, বিচার বিভাগকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে আইনজ্ঞদের অশুভ প্রভাব হ্রাস পায়। ইউরোপের সিভিল ল ট্র্যাডিশনের ভিত্তিতে বিজ্ঞ বিচারকদের ক্ষমতা বাড়াতে এবং দুর্নীতির প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যবস্থা গড়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রশাসনব্যবস্থা আধুনিক বিশ্বের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রেশাম বিধির ব্যামোতে আক্রান্ত। গ্রেশামের বিধি অনুসারে যেখানে খারাপ মুদ্রা এবং ভালো মুদ্রা রয়েছে, সেখানে খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে তাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের প্রশাসনও বর্তমানে চলছে দুষ্টের পালন এবং শিষ্টের দমন। এই প্রশাসনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। এ কাজও রাতারাতি করা সম্ভব নয়, এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার।
উপরিউক্ত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আদর্শভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নয়, বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো সম্মোহনী নেতার বংশের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। এসব দলে রয়েছে মুরব্বি মক্কেল সম্পর্ক। মক্কেলরা মুরব্বিদের রাজনৈতিক সমর্থন জোগায় আর মুরব্বিরা মক্কেলদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে। তৃণমূল পর্যায়ের আদর্শবাদী কর্মীরা রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয় না। তাই এখানে পরিবর্তন আনতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতান্ত্ৰিক ব্যবস্থাকে সবল করছে না। এখানে সামাজিক পুঁজি দুর্বল এবং সমাজেও প্রচণ্ড দলাদলি রয়েছে। সিভিল সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সংঘর্ষের রাজনীতিতে যে আক্রমণাত্মক ভাষা চালু করা হয়েছে তার পরিবর্তন করতে হবে।
সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে বাংলাদেশে দ্রুত সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আদৌ কোনো সংস্কারের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। এর কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের কোনো চাহিদা নেই। সব বড় দলের লক্ষ্য হলো দলের প্রয়াত সম্মোহনী নেতার বংশের প্রাধান্য বজায় রাখা। তৃণমূলে যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের বেশির ভাগের কোনো আদর্শ নেই; তাঁরা মূলত হালুয়া-রুটির বখরা নিয়ে ব্যস্ত। বর্তমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংস্কারের সম্ভাবনা ক্ষীণ। অন্যদিকে (দুর্ভাগ্যক্রমে ) একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও এ ধরনের সংস্কার করা সম্ভব হবে না। ওপরে যেসব সংস্কার আলোচনা করা হয়েছে, তার কোনোটিই একনায়কত্বের হাত সবল করবে না; বরং সাধারণ মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হলে দুই স্তরে কাজ করতে হবে। প্রথমত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে একটি অধিকতর গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশে সংস্কারের পক্ষে গণসমর্থন গড়ে তুলতে হবে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবার আগে প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা। বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে একাদশ ও দ্বাদশ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই আলোচনায় দুই ধরনের সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রথমত, একটি স্বাধীন ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখানে আইনগত বা শাসনতান্ত্রিক সংস্কার তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। সমস্যা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর নগ্ন ও সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু নির্বাচন কমিশনের সংস্কারই যথেষ্ট নয়, নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কেও সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রয়োজন।
তাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে চার ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব :
• যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠান।
• সংবিধান সংশোধন করে দুই মেয়াদের জন্য অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
• সংবিধান সংশোধন করে তিন মাস মেয়াদের জন্য নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা।
• সংবিধান সংশোধন না করে নির্বাচনের আগে সর্বদলীয় সরকার-ব্যবস্থার রীতি প্রবর্তন।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তার তত্ত্বাবধানেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ব্যতিক্রম করা হয়েছিল বাংলাদেশে। এরপর পাকিস্তানেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। তবে এ ধরনের অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচন সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের তত্ত্বাবধানেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থার পক্ষে প্রধান যুক্তি হলো যে গণতান্ত্রিক দেশে কোনো অনির্বাচিত সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যায় না। তবু বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয়েছিল প্রধানত তিনটি কারণে। প্রথম কারণ হলো যে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলগুলো ‘অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে’ দেশ পরিচালনার শাসনতান্ত্রিক শপথ রক্ষা করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এরা প্রশাসনযন্ত্রকে বাধ্য করে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করতে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে একটি অতিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এখানে শুধু একটি সরকারই রয়েছে; কোনো প্রাদেশিক সরকার বা শক্তিশালী স্থানীয় সরকার নেই। এই কেন্দ্রীভূত সরকারের সব ক্ষমতার উৎস হলেন প্রধানমন্ত্রী। কাজেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যত ক্ষমতা রয়েছে, সে ধরনের ক্ষমতা পৃথিবীর খুব কম দেশেই সরকারপ্রধানদের রয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। এর ফলে এখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অধীনে নির্বাচন হলে অনেক সময়ই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
দ্বিতীয় ব্যবস্থা হতে পারে আগামী দুই নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার- ব্যবস্থা বহাল করা। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। তবে স্বীকার করেছেন যে বাংলাদেশের বিশেষ প্রয়োজনে আগামী দুই নির্বাচনের জন্য জাতীয় সংসদ ইচ্ছে করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা প্রচলন করতে পারে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিস্তারিত রায়ে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তাতে এই ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা অত্যন্ত শক্ত হবে। উপরন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই ব্যবস্থা চালু করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সাংবিধানিক সমাধান খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কাজ করা সম্ভব বলে মনে হয় না।
তৃতীয় সমাধান হতে পারে সংবিধান সংশোধন করে সংসদ কর্তৃক তিন মাসের জন্য নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এ সম্পর্কে বিভিন্ন ফর্মুলা দ্বাদশ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। এই ব্যবস্থার সুবিধা হলো, এই সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো এই সমাধানে রাজি হবে কি না, তাতে সন্দেহ রয়েছে।
চতুর্থ ব্যবস্থা হতে পারে নির্বাচনের সময় সর্বদলীয় সরকার গঠন করা। এ জন্য সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক দলগুলো রাজি হলেই সর্বদলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব। তবে সর্বদলীয় সরকার গঠিত হলেও বর্তমান বিধি অনুসারে এই সরকার হবে মূলত প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার। এর ফলে এ ধরনের সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কতটুকু সফল হবে, সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। তবে সংবিধান সংশোধন না করেও এই ব্যবস্থায় দুটি পরিবর্তন আনা যেতে পারে। প্রথমত, বর্তমান কার্যবিধিমালায় সরকারের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা রয়েছে। কার্যবিধিমালা সংশোধন করার জন্য সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী সুপারিশ করলে এবং রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করলে কার্যবিধিমালা সংশোধন করা সম্ভব। সর্বদলীয় সরকার নির্বাচনকালীন সে সরকারকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কার্যবিধিমালায় শুধু নির্বাচনকালীন সরকারের ক্ষেত্রে তিনটি পরিবর্তন আনা যেতে পারে। ১. মন্ত্রিসভার সব সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হতে হবে। যদি একজন সদস্যও কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন, তাহলে নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। এর ফলে নির্বাচনকালীন সরকারে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, কার্যবিধিমালায় সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিধান করা যেতে পারে যে নির্বাচনকালীন সরকারে সব নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন লাগবে। তৃতীয়ত, বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। একই ব্যক্তির পক্ষে দল পরিচালনা করা এবং সরকার পরিচালনা করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না; এসব ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। যদি রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়, তাহলে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে রাজনৈতিক দলগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা থাকতে পারবেন না, এ ধরনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী সরকার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমঝোতা হলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা হতে দেখা যাচ্ছে যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন শেষে আবার সংঘাতের রাজনীতিতে ফিরে যায়। যারা নির্বাচনে হারে, তারা নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন তুলতে থাকে। কিন্তু কোনো সরকারই সংস্কারের পথে পা বাড়ায় না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য অবশ্যই নির্বাচনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানই রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের বড় কোনো রাজনৈতিক দলই বড় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কারে বিশ্বাস করে না। তাদের নির্বাচনী ওয়াদার মধ্যে ওপরে উল্লেখিত রাজনৈতিক সংস্কারসমূহের কোনো উল্লেখ নেই।
সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়াও বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য দুটি উপাদান প্রয়োজন। প্রথমত, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক কর্মী রয়েছে। এদের বেশির ভাগই স্বার্থ হাসিল করার জন্য রাজনীতিতে অংশ নেয়। আদর্শবাদী রাজনৈতিক কর্মীর সংখ্যা সীমিত। আদর্শবাদী রাজনৈতিক কর্মীরা বেশির ভাগই গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাস করে না, যারা বিশ্বাস করে তাদের অনেকেই চরমপন্থী। বাংলাদেশে অর্থবহ রাজনৈতিক সংস্কার করতে হলে তাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী বাড়াতে হবে। অতীতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ওপর বারবার হামলা এসেছে, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এসব হামলা প্রতিহত করেছে। যদি গণতন্ত্রের সুফলসমূহ জনগণের কাছে তুলে ধরা যায় তাহলে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী অবশ্যই বাড়ানো সম্ভব।
গণতন্ত্রের সুফল জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য দরকার হলো সংস্কার নিয়ে বিতর্ক। বিতর্কের মধ্য দিয়েই জনগণের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেমস বুকানন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে পরিচালিত সরকার (Government by discussion)। এ ধরনের আলাপ-আলোচনার জন্য প্রয়োজন গণ তর্ক-বিতর্ক। গণ তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই সংস্কারের পক্ষে সমর্থন সৃষ্টি সম্ভব। গণ তর্ক- বিতর্ক সম্পর্কে অমর্ত্য সেন লিখেছেন :
Public reasoning includes the opportunitiny for citizens to participate in political discussion and to influence public choice. Balloting can be seen as only one of the ways— albeit a very important way to make public discussion effective, when the opportunitiny to vote is combined with the opportunitiny to speak and reject without fear. The reach and effectivemess-of voting depend critically on the opportunity for open public discussion.
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংস্কারের পক্ষে গণসমর্থন সৃষ্টির উপায় হলো উন্মুক্ত আলোচনা। এই উন্মুক্ত আলোচনা পরিচালিত হবে গণ তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে। সৌভাগ্যবশত দক্ষিণ এশিয়ায় গণ তর্ক-বিতর্কের ধারা অতি প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত রয়েছে। এখানে ধর্ম থেকে শুরু করে নারীদের ভূমিকা ইত্যাদি অনেক বিষয়ের সমাধান তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে খোঁজা হয়েছে। গণতন্ত্রও এখানে পশ্চিমের জগৎ থেকে আসেনি। অষ্টম শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালকে জনগণ নির্বাচন করে। গণ তর্ক- বিতর্কের এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য আশার কারণ। অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষ তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবে।
বাংলাদেশের নষ্ট রাজনীতির দুষ্টচক্রের সবচেয়ে জীবন্ত বর্ণনা করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ, তিনি লিখেছেন :
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা,
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
এই অদ্ভুত আঁধার থেকে মুক্তি না পেয়ে অনেকে ভাবছেন, রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনো সমাধান নেই। আসলে রাজনৈতিক ব্যর্থতার ওষুধ বিরাজনীতিকীকরণ নয়। এর প্রকৃত ওষুধ হলো জনগণকে আরও প্ৰত্যক্ষভাবে রাজনীতি করতে হবে।
তবে শুধু সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী দিয়েও হবে না, বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই শাসনতন্ত্রের সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। ঘুণে ধরা আইনকানুন পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু শাসনতন্ত্রের ও আইনের সংশোধনই যথেষ্ট নয়। এসব পরিবর্তন কার্যকর করার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন যথার্থই বলেছেন :
The constitution only gives the people the right to pursue happiness. You have to catch it yourself.
পাদটীকা
১. Mancur Olson. 1982. The Rise and Decline of Nations. New Haven and London. Yale University Press.
২. Anna Margarida Fernandez and Aart C. Kraay. 2007. ‘Property Right Instititutions Contracting Instititutions and Group in South Asia in Macro and Micro Evidence.’ In South Asia Growth and Right Regional Integration. Sadeq Ahmed and Ejaz Ghani (eds.) Delhi. Macmillan India.
৩. Santa Devarajan. 2008. ‘Two Components, Governance Indicators: Where are we when should we be going?’ World Bank Research Observer. 23(1), 31-34.
৪. World Bank. 2007. Bangladesh Strategy for Sustainable Growth. Dhaka.
৫. Merilee S. Grindle. 2004. ‘Good Enough Governance, Poverty Reduction and Reform in Developing Countries’. Governance: An International Journal of Policy Administration and Institutions. 17(4). 524-540.
৬. Lant Pritchett, Michael Woolcolk and Matt Andrews. 2012. Looking like a State: Techniques of Persistent Failure in State Capabilities for Implementation. Helsinki. UNU-WIDER.
৭. Ha Joon Chang. 2002. Kicking Away the Ladder. London. Academic Press.
৮. Daron Acemoglu and James A. Robinson. 2012. Why Nations Fail. New York. Crown Business.
৯. Amartya Sen. 2005. The Argumentative Indian. New York. Farrar, Straus and Giroux.
১০. Jeffrey Sachs. 1994. Understanding Shock Therapy. Occasional Paper. London: Social Market Foundation.
১১. Portes, Richard. 1991. “The Path of Reform in Central and Eastern Europe: An Introdution’. European Economy. Vol. 100(2), 3-151.
১২. Joseph E. Stiglitz. 2002. Globalization and Development. New York and London W.W. Norton and Company.