Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অবিশ্বাসের দর্শন – অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর

    লেখক এক পাতা গল্প447 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৫. আত্মা নিয়ে ইতং বিতং

    মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। কারণ জন্ম নেওয়ার আগে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর মৃত থাকার সময় আমার কোনো ধরনের সমস্যা হয় নি।
    —মার্ক টোয়েন

    আত্মার উৎস সন্ধানে

    আত্মার ধারণা অনেক পুরনো। যখন থেকে মানুষ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়েছে, নিজের জীবন নিয়ে কিংবা মৃত্যু নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে, জীবন জগতের বিভিন্ন রহস্যে হয়েছে উদ্বেলিত, তার ক্রমিক পরিণতি হিসেবেই এক সময় মানব মনে আত্মার ধারণা উঠে এসেছে। আসলে জীবিত প্রাণ থেকে জড়জগৎকে পৃথক করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহজ সমাধান হিসেবে আত্মার ধারণা একটা সময় গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছিল বলে মনে করা হইয়[১৮৩,১৮৪,১৮৫]। আদিকাল থেকেই মানুষ ইট, কাঠ, পাথর যেমন দেখেছে, ঠিক তেমনিভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে চারপাশের বর্ণাঢ্য জীবজগতকে। ইট, পাথর বা অন্যান্য জড় পদার্থের যে জীবনীশক্তি নেই, নেই কোনো চিন্তা করার ক্ষমতা তা বুঝতে তার সময় লাগে নি। অবাক বিস্মযে সে ভেবেছে তাহলে জীবজগতের যে চিন্তা করার কিংবা চলে ফিরে বেড়ানোর ক্ষমতাটি রয়েছে, তার জন্য নিশ্চয় বাইরে থেকে কোনো আলাদা উপাদান যোগ করতে হয়েছেআয়া নামক অপার্থিব উপাদানটিই সে শূন্যস্থান তাদের জন্য পূরণ করেছে[১৮৬], তারা রাতারাতি পেয়ে গেছে জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার খুব সহজ একটা সমাধান। এখন পর্যন্ত জানা তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, আত্মা দিয়ে জীবন মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা প্রথম শুরু হয়েছিল সম্ভবত নিয়ানডার্থাল মানুষের। আমলে যারা পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে এখন থেকে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর আগে নিয়ানডার্থাল মানুষের আগে পিথেকানথ্রোপাস আর সিনানথ্রোপাসদের মধ্যে এধরনের ধর্মাচরণের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় নি। তবে নিয়ানডার্থাল মানুষের বিশ্বাসগুলো ছিল একেবারেই আদিম-আজকের দিনের প্রচলিত ধর্মমতগুলোর তুলনায় অনেক সরল। ইরাকের শানিদার নামের একটি গুহায় নিয়ানডার্থাল মানুষের বেশকিছু ফসিল পাওয়া গেছে যা দেখে অনুমান করা যায় যে, নিয়ানডার্থাল প্রিয়জন মারা গেলে তার আত্মার উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করত। এমনকি তারা মৃতদেহ কবর দেওয়ার সময় এর সাথে পুষ্পরেণু, খাদ্যদ্রব্য, অস্ত্র সামগ্রী, শিয়ালের দাঁত এমনকি মাদুলিসহ সবকিছুই দিয়ে দিত যাতে পরপারে তাদের আত্মা শান্তিতে থাকতে পারে আর সঙ্গে আনা জিনিসগুলো ব্যবহার করতে পারে। অনেক গবেষক (যেমন নিলসন গেসিটি, রবার্ট হার্টস প্রমুখ) মনে করেন, মৃতদেহ নিয়ে আদি মানুষের পারলৌকিক ধর্মাচরণের ফলেই মানবসমাজে ধীরে ধীরে আত্মার উদ্ভব ঘটেছে।[১৮৭]

    .

    আত্মা নিয়ে হরেক রকম গপ্প

    জীবন মৃত্যুর যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে আত্মাকে ‘আবিষ্কার’ করলেও সেই আত্মা কী করে একটি জীবদেহে প্রাণ সঞ্চার করে কিংবা চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটায় তা নিয়ে। প্রাচীন মানুষেরা একমত হতে পারে নি। ফলে জন্ম নিয়েছে নানা ধরনের গালগপ্প, লোককথা আর উপকথার। পরবর্তীকালে এর সাথে যোগ হয়েছে নানা ধরনের ধর্মীয় কাহিনির। জন্ম হয়েছে আধ্যাত্মবাদ আর ভাববাদের, তারপর সেগুলো সময়ের সাথে সাথে আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে এমনভাবে একাকার হয়ে গেছে যে আত্মা ছাড়া জীবন-মৃত্যুকে সংজ্ঞায়িত করাই অনেকের জন্য অসম্ভব ব্যাপার। আত্মা নিয়ে কিছু মজার কাহিনি এবারে শোনা যাক।

    জাপানিরা বিশ্বাস করে একজন মানুষ যখন ঘুমিয়ে পডে তখন তার ভেতরের আত্মা খুব ছোট পতঙ্গের আকার ধারণ করে তার হা করা মুখ দিয়ে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তারপর যখন ওই ‘আত্মা’ নামক পোকাটি ঘুরে ফিরে আবার হামাগুড়ি দিয়ে মুখ বেয়ে দেহের ভেতরে প্রবেশ করে তখনই ওই মানুষটি ঘুম থেকে জেগে উঠে।[১৮৮] মৃত্যুর ব্যাখ্যাও এক্ষেত্রে খুব সহজ। মুখ দিয়ে বেরিয়ে পোকাটি আর যদি কোনো কারণে ফেলে আসা দেহে ঢুকতে বা ফিরতে না পারে, তবে লোকটির মৃত্যু হয়। অনেক সময় ঘুমন্ত মানুষের অস্বাভাবিক স্বপ্ন দেখাকেও আত্মার অস্তিত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন প্রাচীন মানুষেরা[১৮৯,১৯০]। তারা ভাবতেন, ঘুমিয়ে পড়লে মানুষের আত্মা ‘স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমায়। আর তারপর স্বপ্নের দেশ থেকে আবার ঘুমন্ত মানুষের দেহে আত্মা ফেরত এলে মানুষটি ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আত্মা নিয়ে এধরনের নানা বিশ্বাস আর লোককথা ইউরোপ, এশ্যিা আর আফ্রিকায় ছড়িয়ে ছিল।

    আত্মার এক ধরনের প্রাগৈতিহাসিক ধারণা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী অ্যাবরোজিনসদের মধ্যে প্রচলিত ছিল[১৯১]। প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে অ্যাবরোজিনরা অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে আসার পর অনেকদিন বাইরের জগতের সাথে বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে তাদের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল চারপাশের পৃথিবী থেকে একটু ভিন্নভাবে। তাদের আত্মার ধারণাও ছিল বাইরের পৃথিবী থেকে ভিন্ন রকমের। তাদের আত্মা ছিল যোদ্ধা প্রকৃতির। তীর-ধনুকের বদলে বুমেরাং ব্যবহার করত। কোনো কোনো অ্যাবরোজিন এও বিশ্বাস করত যে, তাদের গোত্রের নতুন সদস্যরা আত্মাদের পুনরায় ব্যবহার করতে পারত। ঠিক একইভাবে প্রায় বারো হাজার বছর আগেকার আদিবাসী আমেরিকানদের মধ্যেও আত্মা নিয়ে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল, যা প্রকারান্তরে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারণার অভিযোনকেই তুলে ধরে। আফ্রিকার কালো মানুষদের মতে সকল মানুষের আত্মার রং কালো। আবার মালযের বহু মানুষের ধারণা, আত্মার রং রক্তের মতোই লাল, আর আয়তনে ভুট্টার দানার মতো। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেকের ধারণা আত্মা আসলে তরল। অস্ট্রেলিয়ার অনেকে আবার মনে করে আত্মা থাকে বুকের ভেতরে, হৃদয়ের গভীরে; আয়তনে অবশ্যই খুবই ছোট[১৯২]। কাজেই এটুকু বলা যায়, আত্মায় বিশ্বাসীরা নিজেরাই আত্মার সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞার ব্যাপারে একমত নন। আত্মা নিয়ে প্রচলিত পরস্পর বিরোধী বক্তব্যগুলো সেই সাক্ষ্যই দেয়।

    ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, হিব্রু, পার্সিয়ান আর গ্রিকদের মধ্যে আত্মা নিয়ে বহু ধরনের বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। প্রথম দিকে অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক পর্যন্ত তো বটেই-হিব্রু, ফোমেনিকানস আর ব্যবিলনীয়, গ্রিক এবং রোমানদের মধ্যে মৃত্যু-পরবর্তী আত্মার কোনো স্বচ্ছ ধারণা গড়ে ওঠেনি। তারা ভাবতেন মানুষের আত্মা এক ধরনের সংজ্ঞাবিহীন ছায়া সদৃশ (Shadowy Entity) অসম্পূর্ণ সত্ত্বা, পূর্ণাঙ্গ কিছু নয়। গবেষক ব্রেমার আত্মা নিয়ে প্রাচীন ধারণাগুলো সম্বন্ধে বলেন, মোটের ওপর আত্মাগুলো ছিল চেতনাবিহীন ছায়া ছায়া জিনিস, পূর্ণাঙ্গ সত্বা তৈরি করার মতো গুণাবলির অভাব ছিল তাতে[১৯৩]।

    সম্ভবত জরথ্রুস্ট্র ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যার আত্মা সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা আধুনিক আধ্যাত্মবাদীদের দেওয়া আত্মার ধারণার অনেকটা কাছাকাছি। জরথ্রুস্ট্র ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ বছর আগেকার একজন পার্সিয়ান। তার মতানুযায়ী, প্রতিটি মানুষ তৈরি হয় দেহ এবং আত্মার সমন্বযে, এবং আত্মার কল্যাণেই আমরা যুক্তি, বোধ, সচেতনতা এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে পারি। জরথ্রুস্ট্রবাদীদের মতে, প্রতিটি মানুষই নিজের ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ কর্ম করার অধিকারী, এবং সে অনুযায়ী, তার ভালো কাজ কিংবা মন্দ কাজের ওপর ভিত্তি করে তার আত্মাকে পুরস্কৃত করা হবে কিংবা শাস্তি প্রদান করা হবে। জরথ্রুস্ট্রের দেওয়া আত্মার ধারণাই পরবর্তীকালে গ্রিক এথেনীয় দার্শনিকেরা এবং আরও পরে খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্ম তাদের দর্শনের অঙ্গীভূত করে নেয়।  খ্রিস্টধর্মে আত্মার ধারণা গড়ে ওঠে সেন্ট অগাস্টিনের হাতে। জরথ্রুস্ট্রের মৃত্যুর প্রায় এক হাজার বছর পর অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মবেত্তা সেন্ট অগাস্টিন খ্রিস্টধর্মের ভিত্তি হিসেবে একই ধরনের মানুষ = দেহ + আত্মা) যুক্তির অবতারণা করেন। এই ধারণাই পরবর্তীকালে অস্তিত্বের দ্বৈততা (Duality) হিসেবে খ্রিস্ট ধর্মের দার্শনিক ভিত্তি প্রদান করে। এর সাথে যোগ হয় পাপ-পুণ্য এবং পরকালে আত্মার স্বর্গবাস বা নরকবাসের হরেক রকমের বক্তব্য। এগুলোই পরে ডালপালায় পল্লবিত হয়ে পরে ইসলাম ধর্মেও স্থান করে নেয়। সন্দেহ করা হয়, প্রাথমিকভাবে অগাস্টিন জরথ্রুস্ট্রবাদীদের কাছ থেকেই আত্মার ধারণা পেয়েছিলেন, কারণ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত নয় বছর অগাস্টিন ম্যানিকিন (Manchean) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাদের মধ্যে জরথ্রুস্ট্রবাদের প্রভাব বিদ্যমান ছিল পুরোমাত্রায়।

    হিব্রু এবং গ্রিকদের মধ্যে প্রথম দিকে আত্মা নিয়ে কোনো সংহত ধারণা ছিল না। এই অসংহত ধারণার প্রকাশ পাওয়া যায় হোমারের (খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০) রচনায় ‘সাইকি’ (Psyche) শব্দটির উল্লেখে। হোমারের বর্ণনানুযায়ী, কোনো লোক মারা গেলে বা অচেতন হয়ে পরলে ‘সাইকি’ তার দেহ থেকে চলে যায়। তবে সেই সাইকির সাথে আজকের দিনে প্রচলিত আত্মার ধারণার পার্থক্য অনেক। হোমারের সাইকি ছিল সংজ্ঞাবিহীন ছায়া সদৃশ অসম্পূর্ণ সত্ব; এর আবেগ, অনুভূতি কিংবা চিন্তাশক্তি কিছুই ছিল না[১৯৪]। ছিল না পরকালে আত্মার পাপ-পুণ্যের হিসাব।

    এর মাঝে গ্রিসের অযোনীয় যুগের বিজ্ঞানীরা বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী হন। ভাববাদের ভাবনা এড়িযে প্রথম যে গ্রিক দার্শনিক জীবনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হলেন, তার নাম থেলিস (৬২৪-৫৪৭ খ্রি.পূ.)। থেলিসের বক্তব্য ছিল, বস্তু মাত্রই প্রাণের সুপ্ত আধার। উপযুক্ত পরিবেশে বস্তুর মধ্যে নিহিত প্রাণ আত্মপ্রকাশ করে[১৯৫]। পরমাণুবাদের প্রবক্তা ডেমোক্রিটাস (৪৬০-৩৭০ খ্রি.পূ.) প্রাণের সাথে বস্তুর নৈকট্যকে আরও বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন। ডেমোক্রিটাস বলতেন, সমগ্র বস্তুজগৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবিভাজ্য কণা দিয়ে গঠিত। তিনি সে কণিকাগুলোর নাম দিলেন অ্যাটম বা পরমাণু। তিনি শুধু সেখানেই থেমে থাকেন নি, তার পরমাণু তত্বকে নিয়ে গেছেন প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যাতেও। তিনি বলতেন, কাদামাটি বা আবর্জনা থেকে যখন প্রাণের উদ্ভব হয় তখন অজৈব পদার্থের অণুগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সজ্জিত হয়ে জীবনের ভিত্তিভূমি তৈরি করে। ডেমোক্রিটাসের প্রায় সমসাময়িক দার্শনিক লিউসেপ্লাসও (আনুমানিক ৫০০-৪৪০ খ্রি.পূ.) এধরনের বস্তুবাদী ধারণায় বিশ্বাস করতেন। তিনি বিজ্ঞানে তিনটি নতুন ধারণা চালু করেন চরম শূন্যতা, চরম শূন্যতার মধ্য দিয়ে অ্যাটমের চলাফেরা এবং যান্ত্রিক প্রয়োজন। লিউসেপ্লাসই প্রথম বিজ্ঞানে কার্যকারণ তত্বের জন্ম দেন বলে কথিত আছে[১৯৬]। অযোনীয় যুগের দর্শনের বস্তুবাদী রূপটিকে পরবর্তীকালে আরও উন্নয়ন ঘটান এপিকিউরাস এবং লুক্রেশ্যিস, এবং তা দর্শন ও নীতিশাস্ত্রকেও প্রভাবিত করে। গ্রিক পরমাণুবাদ পরবর্তীকালে বিজ্ঞানকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। যেমন, প্রথম আধুনিক পরমাণুবিদ গ্যাসেন্ডি তার পরমাণুবাদ তৈরির জন্য ঋণ স্বীকার করেছেন ডেমোক্রিটাস এবং এপিকিউরাসের কাছে। গ্রিক পরমাণুবাদ প্রভাবিত করেছিল এরপর পদার্থবিদ নিউটন এবং রসায়নবিদ জন ডালটনকেও তাদের নিজ নিজ পরমাণু তত্ব নির্মাণে।

    কাজেই গ্রিসের অযোনীয় যুগে মেইনস্ট্রিম দার্শনিকদের চিন্তা চেতনা ছিল অনেকটাই বস্তুবাদী। কিন্তু পরে পারস্য দেশের প্রভাবে আত্মা-সংক্রান্ত সব আধ্যাত্মিক এবং ভাববাদী ধ্যান-ধারণা গ্রিকদের মধ্যে ঢুকে যায়। ভাববাদী দর্শনের তিন পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল। এরা এথেন্সের সন্তান হলেও সে এথেন্স তখন অবক্ষয়ী এথেন্স। তারপরও পরবর্তী আড়াই হাজার বছর তাদের চিন্তা-চেতনা দিয়ে মানবসমাজ প্রভাবিত হয়েছিল। এদের ক্ষমতার কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মানব ইতিহাসের প্রথম স্বাধীন নগরের বৈপ্লবিক মহত্ব থেকে তারা মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করার মতো শক্তিধর হওয়া সত্ত্বেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে ক্ষমতাকে তারা প্রতিবিপ্লবের স্বার্থে ব্যবহার করতেন[১৯৭]। তারা গণতন্ত্রের ভয়ে ভীত ছিলেন এবং গণতন্ত্রের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন। অযোনীয় যুগের দার্শনিকেরা পলে পলে বস্তুবাদের যে সৌধ গড়ে তুলেছিলেন, তা এই তিন ভাববাদী দার্শনিকের আগ্রাসনে বিলুপ্ত হয়। বস্তুবাদকে সরিযে মূলত রহস্যবাদী উপাদানকে হাজির করে তাঁরা তাঁদের দর্শন গড়ে তোলেন। প্লেটোর বক্তব্য ছিল যে, প্রাণী বা উদ্ভিদ কেউ জীবিত নয়, কেবল যখন আত্মা প্রাণী বা উদ্ভিদদেহে প্রবেশ করে তখনই তাতে জীবনের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়। প্লেটোর এ সমস্ত তত্বকথাই পরে খ্রিস্টধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনের যোগান দেয়। প্লেটোর এই ভাববাদী তত্ব অ্যারিস্টটলের দর্শনের রূপ নিয়ে এরপর হাজার খানেক বছর রাজত্ব করে। এখন প্রায় সব ধর্মমতই দার্শনিক-যুগলের ভাববাদী ধারণার সাথে সংগতি বিধান করে। আত্মা সংক্রান্ত কুসংস্কার শেষ পর্যন্ত মানবসমাজে ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করে।

    .

    আত্মার অসাড়তা

    জীব কী আর জড় কী? বুঝব কী করে কে জীব আর কে জড? জীবিতদের কীভাবে শনাক্ত করা যায়? একটি মৃতদেহ আর একটি জীবিত দেহের মধ্যে পার্থক্যই বা কী? এ প্রশ্নগুলো দিয়ে আগেকার দিনের মানুষের অনুসন্ধিৎসু মন সবসময়ই আন্দোলিত হয়েছে পুরোমাত্রায়। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেয়ে তারা শেষ পর্যন্ত কল্পনা করে নিয়েছে অদৃশ্য আত্মার ভেবেছে আত্মাই বুঝি জীবন ও মৃত্যুর যোগসূত্র। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের ভাববাদী ধ্যানধারণাগুলো কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন ধর্মে জায়গা করে নেওয়ার পর জীবন-মৃত্যুর সংজ্ঞা ধর্মীয় মিথের আবরণে পাখা মেলতে শুরু করল। কল্পনার ফানুস উড়িযে মানুষ ভাবতে শুরু করল, ঈশ্বরের নির্দেশে আজরাইল বা যমদূত এসে প্রাণহরণ করলেই কেবল একটি মানুষ মারা যায়। আর তখন তার দেহস্থিত আত্মা পাড়ি জমায় পরলোকে। মৃত্যু নিয়ে মানুষের এধরনের ভাববাদী চিন্তা জন্ম দিয়েছে আধ্যাত্মবাদের। আধ্যাত্মবাদ স্বতঃ প্রমাণ হিসেবেই ধরে নেয়-আত্মা জন্মহীন, নিত্য, অষ্কয়। শরীর হত হলেও আত্মা হত হয় না। মজার ব্যাপার হলো, একদিকে যেমন আত্মাকে অমর অক্ষয় বলা হচ্ছে, জোর গলায় প্রচার করা হচ্ছে আত্মাকে কাটা যায় না, পোড়ানো যায় না, আবার সেই আত্মাকেই পাপের শাস্তিস্বরূপ নরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটা, গরম তেলে পোড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ সবই আধ্যাত্মবাদের স্ববিরোধিতা। ধর্মগ্রন্থগুলো ঘাঁটলেই এধরনের স্ববিরোধিতার হাজারও দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। স্ববিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও আত্মার অস্তিত্ব দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী হয়েছে মানুষ। কারণ সেসময় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ছিল সীমিত। মৃত্যুর সঠিক কারণ ছিল তাদের জানার বাইরে। সেজন্য অনেক ধর্মবাদীই ‘আত্মা কিংবা ‘মন কে জীবনের আধাররূপী বস্তু হিসেবে কল্পনা করেছেন। যেমন, ইসলাম বলছে, আল্লাহ মানবজাতির সকল আত্মা একটি নির্দিষ্ট দিনে তৈরি করে বেহেস্তে একটি নির্দিষ্ট স্থানে (ইল্লিন) বন্দি করে রেখে দিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছাতেই নতুন নতুন প্রাণ সঞ্চারের জন্য একেকটি আত্মাকে তুলে নিয়ে মর্ত্যে পাঠানো হয়। আবার হিন্দু আচার্য শঙ্কর তার ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে বলেছেন, ‘মন হলো আত্মার উপাধি স্বরূপ। ওদিকে আবার সাংখ্যদর্শনের মতে ‘আত্মা চৈতন্যস্বরূপ (সাংখ্যসূত্র ৫/৬৯)। জৈন দর্শনে বলা হয়েছে, ‘চৈতন্যই জীবের লক্ষণ বা আত্মার ধর্ম (ষড়দর্শন সমুচ্চয়, পৃ. ৫০)। স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত ভাবতেন, চৈতন্য বা চেতনাই আত্মা’ (বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, পৃ. ১৬২) স্বামী অভেদানন্দের মতে, ‘আত্মা বা মন মস্তিষ্ক বহির্ভূত পদার্থ, মস্তিষ্কজাত ন্যা’ (মরণের পারে, পৃ. ৯৮)। গ্রিক দর্শনেও আমরা প্রায় একই রকম ভাববাদী দর্শনের ছায়া। দেখতে পাই, যা আগের অংশে আমরা আলোচনা করেছি। অ্যারিস্টটলের পরবর্তী গ্রিক ও রোমান দার্শনিকেরা অ্যারিস্টটলীয় দর্শনকে প্রসারিত করে পরবর্তী যুগের চাহিদার উপযোগী করে তোলেন। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে নয় প্লেটোবাদীরা ‘ঈশ্বর অজৈব বস্তুর মধ্যে জীবন সৃষ্টিকারী আত্মা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তাকে জীবন দান করেন এই মত প্রচার করতে শুরু করেন। নয় প্লেটোবাদী প্লাটিনাসের মতে, ‘জীবনদায়ী শক্তিই জীবনের মূলা’ বস্তুতপক্ষে, জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘জীবনশক্তি (Life Force) তত্ব এখান থেকেই যাত্রা শুরু করে এবং জীবনের উৎপত্তি প্রসঙ্গে ভাববাদী দর্শনের ভিত্তিও জোরালো হয়। ধর্মবাদী চিন্তা, বৈজ্ঞানিক অনগ্রসরতা, কুসংস্কার, ভয় সবকিছু মিলে শিক্ষিত সমাজে এই ভাববাদী চিন্তাধারার দ্রুত প্রসার ঘটে।

    বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আর যুক্তির প্রসারের ফলে আজ কিন্তু আত্মা দিয়ে জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার অন্তর্নিহিত ত্রুটিগুলো মানুষের চোখে সহজেই ধরা পড়ছে। যদি জীবনকে ‘আত্মার উপস্থিতি’ আর মৃত্যুকে ‘আত্মার দেহত্যাগ’ দিয়েই ব্যাখ্যা করা হয়, তবে তো যেকোনো জীবিত সত্বরই তা সে উদ্ভিদই হোক আর প্রাণীই হোক আত্মা থাকা উচিত। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে একটি দেহে কি কেবল একটিমাত্র আত্মা থাকবে নাকি একাধিক? যেমন, বেশকিছু উদ্ভিদ গোলাপ, কলা, ঘাসফুল এমনকি হাইড্রা, কোরালের মতো প্রাণীরাও কর্তন (Cut) ও অঙ্কুরোদগমের (Bud) মাধ্যমে বিস্তৃত হয়। তাহলে কি সাথে সাথে আত্মাও কর্তিত হয়, নাকি একাধিক আত্মা সাথে সাথেই অঙ্কুরিত হয়? আবার মাঝে মধ্যেই দেখা যায় যে, পানিতে ডুবে যাওয়া, শ্বাসরুদ্ধ, মৃত বলে মনে হওয়া/ঘোষিত হওয়া অচেতন ব্যক্তির জ্ঞান চিকিৎসার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মোটেই বিরল নয় তখন কি দেহত্যাগী আত্মাকেও দেহে ফিরিয়ে আনা হয়? প্রজননকালে পিতৃদত্ত শুক্রাণু আর মাতৃ দত্ত ডিম্বাণুর মিলনে শিশুর দেহকোষ তৈরি হয়। শুক্রাণু আর ডিম্বাণু জীবনের মূল, তাহলে নিশ্চয় তাদের আত্মাও আছে। এদের আত্মা কি তাদের অভিভাবকদের আত্মা থেকে আলাদা? যদি তাই হয় তবে কীভাবে দুটি পৃথক আত্মা পরম্পর মিলিত হয়ে শিশুর দেহে একটি সম্পূর্ণ নতুন আত্মার জন্ম দিতে পারে? মানব মনের এধরনের অসংখ্য যৌক্তিক প্রশ্ন আত্মার অসারত্বকেই ধীরে ধীরে উন্মোচিত করেছে।

    আত্মার সংজ্ঞাতেও আছে বিস্তর গোলমাল। কেউ আত্মার চেহারা বায়বীয় ভাবলেও (স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’ দ্র.) কেউ আবার ভাবেন তরল (প্রশান্ত মহাসাগরের অধিবাসী);কেউ আত্মার রং লাল (মালযের অধিবাসী) ভাবলেও অন্য অনেকে ভাবেন কালো (আফ্রিকাবাসী এবং জাপানিদের অনেকের এধরনের বিশ্বাস রয়েছে)। বিদেহী আত্মার পুনর্জন্ম নিয়ে সমস্যা আরও বেশি। বিশ্বের প্রধান ধর্মমত হিসেবে হিন্দু, ইসলাম এবং খ্রিস্ট ধর্মের কথা আলোচনা করা যাক। হিন্দুরা আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে; আবার অপরদিকে মুসলিম আর খ্রিস্টানদের কাছে আত্মার পুনর্জন্ম বলে কিছু নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যেকটি ধর্ম তাদের বিশ্বাসকেই অভ্রান্ত বলে মনে করে। এ প্রসঙ্গে প্রবীর ঘোষ তার ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থে বলেন[১৯৯]–

    একবার ভাবুন তো, আত্মার চেহারাটা কেমন, তাই নিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশবাসীর বিভিন্ন মত। অথচ স্বামী অভেদানন্দই এক জায়গায় বলেছেন, আমাদের মনে রাখা উচিত যে, সত্য কখনও দু’রকমের বা বিচিত্র রকমের হয় না, সত্য চিরকালই এক ও অখণ্ড।

    বিবর্তনতত্ত্বের আলোকে মানতে গেলে তো আত্মার অস্তিত্ব এবং পুনর্জন্মকে ভালোমতোই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়। বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে জড থেকেই জীবের উদ্ভব ঘটেছিল। পৃথিবীর বিশেষ ভৌত অবস্থায় নানারকম রাসায়নিক বিক্রিয়ার জটিল সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে আর তারপর বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে জৈববিবর্তনের বন্ধুর পথে। এই প্রাণের উদ্ভব এবং পরে প্রজাতির উদ্ভবের পেছনে কোনো মন বা আত্মার অস্তিত্ব ছিল না। প্রাণের উদ্ভবের পর কোটি কোটি বছর কেটে গেছে, আর আধুনিক মানুষ তো এলো মাত্র ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। তাহলে এখন প্রশ্ন হতে পারে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে মানুষের আত্মারা কোথায় ছিল? জীবজন্ত কিংবা কীটপতঙ্গ হয়ে? কোন পাপে তাহলে আত্মারা কীটপতঙ্গ হলো? পূর্বজন্মের কোন কর্মফলে এমনটি হলো? পূর্বজন্ম পূর্বজন্ম করে পেছাতে থাকলে যে প্রাণীতে আত্মার প্রথম জন্মটি হয়েছিল সেটি কবে হয়েছিল? হলে নিশ্চয়ই এককোষী সরল প্রাণ হিসেবেই জন্ম নিয়েছিল। এককোষী প্রাণের জন্ম হয়েছিল কোন জন্মের কর্মফলে?

    বিবর্তনের আধুনিক তত্ব না জানা সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতের যুক্তিবাদী চার্বাকেরা সেই খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে তাদের সেসময়কার অর্জিত জ্ঞানের সাহায্যে আত্মার অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছিলেন। আত্মাকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই সম্ভবত চার্বাকদের লড়াইটা শুরু হয়েছিল। আত্মাই যদি না থাকবে তবে কেন অযথা স্বর্গ নরকের প্রসঙ্গ টানা হয়। আত্মা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে করতে শেষ পর্যন্ত স্পষ্টভাষী চার্বাকেরা ঈশ্বর আত্মা-পরলোক-জাতিভেদ-জন্মান্তর সবকিছুকেই নাকচ করে দেন। তারাই প্রথম বলেছিলেন বেদ অপৌরুষেয়’ নয়, এটা একদল স্বার্থান্বেষী মানুষেরই রচিত। জনমানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে যাওয়া সেই সব স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণদের চার্বাকেরা ভণ্ড, ধূর্ত, চোর, নিশাচর বলে অভিহিত করেছিলেন, তারা বাতিল করে দিয়েছিলেন আত্মার অস্তিত্ব, উন্মোচন করেছিলেন ধর্মের জুয়াচুরি এই বলে–

    বেহেস্ত ও মোক্ষপ্রাপ্তি কি পরিত্রাণ লাভ ফাঁকা অর্থহীন অসার বুলিমাত্র, উদরযন্ত্রে বিসর্গের কারণে সবেগে উৎক্ষিপ্ত দুর্গন্ধময় ঢেকুরমাত্র। এসব প্যাক প্যাক বা। বাকচাতুরী নৈতিক অপরাধ, উন্মার্গ গমন, মানসিক ও দৈহিক ঔদার্যের ফলে পরান্নভোজী বমনপ্রবণ ব্যক্তিদের অদম্য কুৎসিত বমনমাত্র, পেটুকদের এবং উন্মার্গগামীদের বিলাস-কল্পনা। পরজগতে যাওয়ার জন্য কোনো আত্মার অস্তিত্ব নেই। বর্ণাশ্রমের নির্দিষ্ট মেকি নিয়ম-আচার আসলে কোনো ফল উৎপন্ন করে না। বর্ণাশ্রমের শেষ পরিণামের কাহিনি সাধারণ মানুষকে ঠকাবার উদ্দেশ্যে ধর্মকে গাঁজাবার থামি বিশেষ।

    চার্বাকেরা বলতেন, চতুর পুরোহিতদের দাবি অনুযায়ী যদি জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে বলিকৃত প্রাণী সরাসরি স্বর্গলাভ করে, তাহলে তারা নিজেদের পিতাকে এভাবে বলি দেয় না কেন? কেন তারা এভাবে তাদের পিতার স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে না?

    যদি জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে
    বলি দিলে পশু যায় স্বর্গে
    তবে পিতাকে পাঠাতে স্বর্গে
    ধরে বেঁধে বলি দাও যজ্ঞে।

    চার্বাকেরা আরও বলতেন–

    চৈতন্যরূপ আত্মার পাকযন্ত্র কোথা
    তবে তো পিণ্ডদান নেহাতই বৃথা।

    কিংবা

    যদি শ্রাদ্ধকৰ্ম হয় মৃতের তৃপ্তের কারণ
    তবে নেভা প্রদীপে দিলে তেল, উচিত জ্বলন।

    আত্মা বা চৈতন্যকে চার্বাকেরা তাঁদের দর্শনে আলাদা কিছু নয় বরং দেহধর্ম বলে বর্ণনা করেছিলেন। এই ব্যাপারটা এখন আধুনিক বিজ্ঞানও সমর্থন করে। পানির সিক্ততার ব্যাপারটা চিন্তা করুন। এই সিক্ততা জিনিসটা আলাদা কিছু নয় বরং পানির অণুরই স্বভাব-ধর্ম। ‘সিক্তাত্মা’ নামে কোনো অপার্থিব সত্ত্বা কিন্তু পানির মধ্যে প্রবেশ করে তাতে সিক্ততা নামক ধর্মটির জাগরণ ঘটাচ্ছে না। বরং পানির অণুর অঙ্গসজ্জার কারণেই ‘সিক্ততা’ নামের ব্যাপারটির অভ্যুদয় ঘটেছে। চার্বাকেরা বলতেন, মানুষের চৈতন্য বা আত্মাও তাই। দেহের স্বভাব। ধর্ম হিসেবেই আত্মা বা চৈতন্যের উদ্য ঘটছে। কীভাবে এর অভ্যুদয় ঘটে? চার্বাকেরা একটি চমৎকার উপমা দিয়ে ব্যাপারটি বুঝিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আঙ্গুর এবং মদ তৈরির অন্যান্য উপাদানগুলোতে আলাদা করে কোনো মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোই এক ধরনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো পাত্রে মিলিত করার পরে এর একটি নতুন গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে আমরা বলছি মদ। আত্মা বা চৈতন্যও তেমনই। যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগের বস্তুবাদী দার্শনিকেরা এভাবেই তাদের ভাষায় রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রাণের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কোনো রকমের আত্মার অনুকল্প ছাড়াই। তাদের এই বক্তব্যই পরবর্তীকালে ভাববাদী দার্শনিকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছিল।

    .

    আত্মা, মন এবং অমরত্ব : বিজ্ঞানের চোখে

    ভাববাদীরা যাই বলুক না কেন স্কুলের পাঠ শেষ করা ছাত্রটিও আজ জানে, মন কোনো বস্তু নয়; বরং মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কাজ কর্মের ফল। চোখের কাজ যেমন দেখা, কানের কাজ যেমন শ্রবণ করা, পাকস্থলীর কাজ যেমন খাদ্য হজম করা, তেমনই মস্তিষ্ক কোষের কাজ হলো চিন্তা করা। তাই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক তার ‘The Astonishing Hypothesis : The Scientific Search for the Soul’ গ্রন্থে পরিষ্কার করেই বলেন[২০০]  ‘বিস্ময়কর অনুকল্পটি হলো : আমার ‘আমিত্ব, আমার উচ্ছাস, বেদনা, স্মৃতি, আকাঙ্ক্ষা, আমার সংবেদনশীলতা, আমার পরিচয় এবং আমার মুক্তবুদ্ধি এগুলো আসলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ এবং তাদের আনুষঙ্গিক অণুগুলোর বিবিধ ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ চিন্তা করতে পারে বলেই নিজের ব্যক্তিত্বকে নিজের মতো করে। সাজাতে পারে, সত্য-মিথ্যের মিশেল দিয়ে কল্পনা করতে পারে তার ভেতরে ‘মন’ বলে সত্যিই কোনো পদার্থ আছে, অথবা আছে অদৃশ্য কোনো আত্মার অশরীরী উপস্থিতি। মৃত্যুর পর দেহ বিলীন হয়। বিলীন হয় দেহাংশ, মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ। আসলে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের মৃত্যু মানেই কিন্তু ‘মন’ এর মৃত্যু, সেইসাথে মৃত্যু তথাকথিত আত্মার। অনেক সময় দেখা যায় দেহের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কর্মক্ষম আছে, কিন্তু মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হারিয়ে গেছে। এধরনের অবস্থাকে বলে কোমা। মানুষের চেতনা তখন লুপ্ত হয়। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হারানোর ফলে জীবিত দেহ তখন অনেকটা জড়পদার্থের মতোই আচরণ করে। তাহলে জীবন ও মৃত্যুর যোগসূত্রটি রক্ষা করছে কে? এ কি অশরীরী আত্মা, নাকি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সঠিক কর্মক্ষমতা?

    এ পর্যায়ে বিখ্যাত ক্রিকেটার রমণ লাম্বার মৃত্যুর ঘটনাটি স্মরণ করা যাক। ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) লীগের খেলা চলাকালীন মেহেরাব হোসেন অপির একটি পুল শট ফরওয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিংরত লাম্বার মাথায় সজোরে আঘাত করে। প্রথমে মনে হয়েছিল তেমন কিছুই হয় নি। নিজেই হেঁটে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন; কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান হারালেন তিনি। চিকিৎসকেরা তাঁকে ক্লিনিকে ভর্তি করলেন। পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি তাঁকে পিজি হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হলো সেখানে তার অপারেশন হলো, কিন্তু অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। পরদিন বাইশে ফেব্রুয়ারি ডাক্তাররা ঘোষণা করলেন যে, মস্তিষ্ক তার কার্যকারিতা হারিযেছে। হার্ট-লাং মেশিনের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের কাজ চলছিল।

    ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে তিনটায় তার আইরিশ স্ত্রী কিমের উপস্থিতিতে হার্ট লাং মেশিন বন্ধ করে দিলেন চিকিৎসকেরা থেমে গেল লাম্বার হৃৎস্পন্দন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে-ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর তারিখ কোনটি হওয়া উচিত? ২২ নাকি ২৩ ফেব্রুয়ারি? আর তার মৃত্যুক্ষণটি নির্ধারণ করলেন কারা? আজরাইল/যমদুত নাকি চিকিৎসারত ডাক্তারেরা?

    এ ব্যাপারটি আরও ভালোভাবে বুঝতে হলে মৃত্যু নিয়ে দু’চার কথা বলতেই হবে। জীবনের অনিবর্তনীয় পরিসমাপ্তিকে (Irreversible Cessation of Life) বলে মৃত্যু। কেন জীবের মৃত্যু হয়? কারণ মৃত্যুবরণের মাধ্যমে আমাদের জীবন তাপগতীয় স্থিতাবস্থা (Thermodynamic Equilibrium) প্রাপ্ত হয়। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র মানতে গেলে জীবনের উদ্দেশ্য আর কিছুই নয় নিবিষ্টচিত্তে এন্ট্রপি বাড়িয়ে চলা। আমাদের খাওয়া দাওয়া, শয়ন, ভ্রমণ, মৈথুন, কিংবা রবিঠাকুরের কবিতা পাঠের আনন্দ সবকিছুর পেছনেই থাকে মোটাদাগে কেবল একটি মাত্র উদ্দেশ্য ফেইথফুলি এনট্রপি বাড়ানো। সেটা আমরা বুঝতে পারি আর নাই পারি! জন্মের পর থেকে সারা জীবন ধরে আমরা এনট্রপি বাড়িযে বাড়িযে প্রকৃতিতে তাপগতীয় অসাম্য তৈরি করি, আর শেষমেশ পঞ্চত্ব প্রাপ্তির মাধ্যমে অন্যান্য জড় পদার্থের মতো নিজেদের দেহকে তাপগতীয় স্থিতাবস্থায় নিয়ে আসি। কিন্তু কীভাবে এই স্থিতাবস্থার নির্দেশ আমরা বংশপরম্পরায় বহন করি? জীববিজ্ঞানের চোখে দেখলে, আমরা (উদ্ভিদ এবং প্রাণী) উত্তরাধিকার সূত্রে বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের পূর্বপুরুষদের যারা যৌনসংযোগের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে প্রকৃতিতে টিকে রয়েছে তাদের থেকে মরণ জিন (Death Gene) প্রাপ্ত হয়েছি এবং বহন করে চলেছি। এই ধরনের জিন (মরণ জিন) তার পরিকল্পিত উপায়েই মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে চলেছে। যৌনজননের মাধ্যমে বংশবিস্তারের ব্যাপারটিতে আমরা এখানে গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, যে সমস্ত প্রজাতি যৌনজননকে বংশবিস্তারের একটি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে, তাদের মৃত্যু নামক ব্যাপারটিকেও তার জীবজগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হয়েছে। দেখা গেছে স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রে সেক্স-সেল বা যৌন কোষগুলোই (জীববিজ্ঞানীরা বলেন ‘জার্মপ্লাজম’) হচ্ছে একমাত্র কোষ যারা সরাসরি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নিজেদের জিন সঞ্চারিত করে টিকে থাকে। জীবনের এই অংশটি অমর। কিন্তু সে তুলনায় সোমাটিক সেল দিয়ে তৈরি দেহকোষগুলো হয় স্বল্পায়ুর। অনেকে এই ব্যাপারটির নামকরণ করেছেন প্রোগ্রামড ডেথ’। এ যেন অনেকটা বেহুলা-লখিন্দর কিংবা বাবর-হুঁমায়ুনের মতো ব্যাপার: জননকোষের অমরত্বকে পূর্ণতা দিতে গিয়ে দেহকোষকে বরণ করে নিতে হয়েছে মৃত্যু-ভাগ্য। প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স হালকা চালে তার ‘সেলফিশ জিন’ বইয়ে বলেছেন, মৃত্যু’ও বোধহয় সিফিলিস বা গনোরিয়ার মতো এক ধরনের সেজুলি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ’ যা আমরা বংশপরম্পরায় সূচনালগ্ন থেকে বহন করে চলেছি! ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মতো সরলকোষী জীব যারা যৌনজনন নয়, বরং কোষ বিভাজনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে টিকে আছে তারা কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই অমর। এদের দেহ কোষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে বিভাজিত হয়, তার পর বিভাজিত অংশগুলোও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় বিভাজিত হয়; কোনো অংশই আসলে সেভাবে মৃত্যুবরণ করে না।

    ছবি। পেজ ২০৯

    চিত্র : (উপরে) স্বামীর সাথে হেনরিযেটা ল্যাকস, ১৯৪৫ সালে তোলা ছবি এবং (নিচে) ল্যাবরেটরিতে ‘অমর’ হেলা কোষ।

    আবার অধিকাংশ ক্যান্সার কোষই অমর, অন্তত তাত্বিকভাবে তো বটেই। একটি সাধারণ কোষকে জীবদ্দশায় মোটামুটি গোটা পঞ্চাশেক বার কালচার বা পুনরুৎপাদন করা যায়। এই সীমাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে হেফ্লিক লিমিট (Hayflick Limit)। কখনও সখনো ক্যান্সারাক্রান্ত কোনো কোনো কোষে সংকীর্ণ টেলোমার থাকার কারণে এটি কোষস্থিত ডিএনএ’র মরণ জিনকে স্থায়ীভাবে ‘সুইচ অফ করিয়ে দেয়। এর ফলে এই কোষ তার আভ্যন্তরীণ ‘হেফ্লিক’ লিমিটকে অতিক্রম করে যায়। তখন আক্ষরিকভাবেই অসংখ্যবার মানে অসীমসংখ্যক বার সেই কোষকে কালচার করা সম্ভব। এই ব্যাপারটাই তাত্ত্বিকভাবে কোষটিকে প্রদান করে অমরত্ব। হেনরিযেটা ল্যাকস নামে এক মহিলা ১৯৫২ সালে সার্ভিকাল ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর ডাক্তাররা ক্যান্সারাক্রান্ত দেহকোষটিকে সরিয়ে নিয়ে ল্যাবে রেখে দিয়েছিল। এই কোষের মরণ জিন স্থায়ীভাবে ‘সুইচ অফ করা এবং কোষটি এখনও ল্যাবরেটরির জারে ঠিকঠাক ভাবে ‘জীবিত অবস্থায় আছে। প্রতিদিনই এই সেল থেকে কয়েকশ বার করে সেল-কালচার করা হচ্ছে, এই কোষকে এখন ‘হেলা কোষ’ নামে অভিহিত করা হয়। যদি কোনোদিন ভবিষ্যৎ-প্রযুক্তি আর জৈবমূল্যবোধ (Bioethics) আমাদের সেই সুযোগ দেয়, তবে আমরা হয়ত হেলাকোষ ক্লোন করে হেনরিযেটাকে আবার আমাদের পৃথিবীতে ফেরত আনতে পারব। সম্প্রতি সাংবাদিক রেবেকা স্কলুট হেনরিযেটা ল্যাকস এবং তার এই ‘অমরত্বের জীবন নিয়ে একটি চমৎকার বই লিখেছেন ‘দ্য ইমমরটাল লাইফ অব হেনরিযেটা ল্যাকস’ নামে[২০১]।

    আবার ব্রাইন শ্রিম্প (brine shrimp), গোলকৃমি বা নেমাটোড, কিংবা টার্ডিগ্রেডের মতো কিছু প্রাণী আছে যারা মৃত্যুকে লুকিয়ে রাখতে পারে, জীববিজ্ঞানের ভাষায় এ অবস্থাকে বলে ‘ক্রিপ্টোবায়োটিক স্টেট। যেমন, ব্রাইন শ্রিম্পগুলো লবণাক্ত পানিতে সমানে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে, কিন্তু পানি যখন শুকিয়ে যায়, তখন তারা ডিম্বাণু উৎপাদন, এমনকি নিজেদের দেহের বৃদ্ধি কিংবা মেটাবোলিজম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। শ্রিম্পগুলোকে দেখতে তখন মৃত মনে হলেও এরা আসলে মৃত নয় বরং এদের এই মরণাপন্ন অবস্থার মধ্যেও জীবনের বীজ লুকানো থাকে। এই অবস্থাটিকেই বলে ‘ক্রিপ্টোবায়োটিক স্টেট’। কখনও তারা পানি খুঁজে পেলে আবারও নতুন করে ‘নবজীবনপ্রাপ্ত হয়। এদের অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারগুলো অনেকটা ভাইরাসের মতো ভাইরাসের কথা আরেকবার চিন্তা করা যাক। ভাইরাস জীবন ও জডের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করে। ভাইরাসকে কেউ ড বলতে পারেন, আবার জীবিত বলতেও বাধা নেই। এমনিতে ভাইরাস ‘মৃতবৎ’, তবে তারা বেঁচে ওঠে অন্য জীবিত কোষকে আশ্রয় করে। ভাইরাসে থাকে প্রোটিনবাহী নিউক্লিযিক এসিড। এই নিউক্লিযিক এসিডই ভাইরাসের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের আধার। উপযুক্ত পোষক দেহ পাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা ক্রিপ্টোবায়োটিক স্টেট’-এ জীবনকে লুকিয়ে রাখে। আর তারপর উপযুক্ত দেহ পেলে আবারও কোষ বিভাজনের মাধ্যমে অমরত্বের খেলা চালিয়ে যেতে থাকে।

    কাজেই দেখা যাচ্ছে ‘মৃত্যু’ ব্যাপারটি সব জীবের জন্যই অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক নয়। ভাইরাসের আণবিক সজ্জার মধ্যেই আসলে লুকিয়ে আছে অমরত্বের বীজ। এই অঙ্গসজ্জাই আসলে ডিএনএ-র মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় তারা কখন ঘাপটি মেরে ‘ক্রিপ্টোবায়োটিক স্টেট’-এ পড়ে থাকবে, আর কথন নবজীবনের ঝরনাধারায় নিজেদের আলোকিত করবে। সে হিসেবে ভাইরাসেরা আক্ষরিক অর্থেই কিন্তু অমর—এরা স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে না। তবে মানুষের নিজের প্রয়োজনে রাসায়নিক জীবাণুনাশক ঔষধপত্রাদির উদ্ভাবন ও তার প্রযোগে জীবাণনাশের ব্যাপারটি এক্ষেত্রে আলাদা। ঔষধের প্রযোগে আসলে এদের অঙ্গসজ্জা ভেঙে দেওয়া হয়, যেন তারা আবার পুনর্জীবন প্রাপ্ত হয়ে রোগ ছড়াতে না পারে। ঠিক একই রকমভাবে অত্যধিক বিকিরণ শক্তি প্রয়োগ করেও ভাইরাসের এই দেহগত অঙ্গসজ্জা ভেঙে দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে এদের আণবিক গঠন বিনষ্ট হবে এবং এদের জীবনের সুপ্ত আধার হারিয়ে যাবে। ফলে উপযুক্ত পরিবেশ পেলেও এরা আর পুনর্জীবন প্রাপ্ত হবে না। যারা জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারটিকে আরও ভালোমতো বিজ্ঞানের গভীরে গিয়ে বুঝতে চান তারা আণবিক জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম সি ক্লার্কের লেখা ‘সেক্স অ্যান্ড দি অরিজিন অফ ডেথ[২০২] বইটি পড়তে পারেন। ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (অবসর প্রকাশনা, ২০০৭) বইটির প্রথম অধ্যায়েও বেশ কিছু আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করে জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। উৎসাহী পাঠকেরা পড়ে নিতে পারেন।

    রমন লাম্বার মতো মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে দলছুট ব্যান্ডের গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীরও এই সুপ্রতিষ্ঠিত গায়কের ক্ষেত্রেও রক্তক্ষরণে মস্তিষ্ক তার কার্যক্ষমতা। হারিয়েছিল। তিনি চলে গিয়েছিলেন কোমায়। কোমায় একবার কেউ চলে গেলে তাকে পুনরায় জীবনে ফেরত আনা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব ব্যাপার। কোমার স্থায়িত্ব সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ থাকে। যারা চেতনা ফিরে পান, তারা সাধারণত ২/১ দিনের মধ্যেই তা ফিরে পান। বাকিদের অনেকেই মারা যান, কিন্তু অনেকে কোমা থেকে উঠে আসেন বটে, কিন্তু রয়ে যান অচেতন দশায় যাকে মেডিক্যালের ভাষায় বলে ‘নিষ্ক্রিয় দশা’ বা ‘ভেজিটেটিভ স্টেট’ (Vegetative state)। ডাক্তার এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনদের জন্য এ এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। কারণ রোগীর দেহটা বেঁচে থাকলেও মস্তিষ্ক থাকে নিষ্ক্রিয়। টেকনিক্যালি, এদের তথন মৃতও বলা যায় না, কারণ শ্বাস-প্রশ্বাসসহ কিছু শারীরিক কাজ-কর্ম চলতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। মাসাধিককাল পর এধরনের রোগীরা পৌঁছে যান স্থায়ী নিষ্ক্রিয় দশা’য় (Persistent Vegetative State)। যতই দিন পেরুতে থাকে রোগীর সচেতনতা আবারও ফিরে আসার সম্ভাবনা কমতে থাকে। অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের কোষগুলো ধীরে ধীরে মারা যেতে থাকে। ওই সময় কৃত্রিমভাবে তার দেহকে বাঁচিয়ে রাখা গেলেও তার চৈতন্য আর ফেরত আসে না। ১৯৯৪ সালে আমেরিকার মাল্টি সোসাইটি টাস্কফোর্সের এগারো জন গবেষকের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, স্থায়ী নিষ্ক্রিয় দশায় রোগী একবার পৌঁছে গেলে আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা চলে যায় শূন্যের কাছাকাছি[২০৩]। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর ডাক্তারদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হয় রোগীর জীবন-প্রদীপ নির্বাপণ করার, কারণ ততদিনে তাদের জানা হয়ে যায় যে, এ রোগী আর চৈতন্য ফিরে পাবে না। পাঠকদের নিশ্চয় ফ্লোরিডার টেরি শাইভোর ঘটনার কথা মনে আছে, যার খবর সারা আমেরিকায় আলোড়ন তুলেছিল। ১৫ বছর ধরে স্থায়ী নিষ্ক্রিয় দশা’য় থাকার পর টেরি শাইভোর স্বামীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে যখন ডাক্তাররা টেরির মুখ থেকে খাদ্যনালী খুলে দিয়ে তার ‘দেহাবসান ঘটানোর উদ্যোগ নিলেন, তখন তা আমেরিকার রাজনৈতিক মহলকে তোলপাড় করে তুলেছিল। রক্ষণশীলেরা ডাক্তারদের এ নাফরমানিকে দেখেছিলেন খোদার ওপর খোদকারি’র দৃষ্টান্ত হিসেবে। কিন্তু ডাক্তারদের করণীয় ছিল না কিছুই। টেরি শাইভোর সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই থেকে দেখা গিযেছিল অক্সিজেনের অভাবে ব্রেন টিস্যুর অনেকটুকুই নষ্ট হয়ে গেছে। আদালতের রায়ও গিয়েছিল ডাক্তারদের অনুকুলেই।

    এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ডাক্তারেরা কোন আলামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন যে, রোগী স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে নাকি চেতনা ফিরে পাওয়ার আশা আছে? এটি নিঃসন্দেহ, ডাক্তার যদি বোঝেন যে, চেতনা ফিরে আসার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও আছে, তাহলে কখনোই দেহাবসানের মাধ্যমে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত করবেন না। ডাক্তাররা আসলে সিদ্ধান্ত নেন ‘ব্রেন ইমেজিং টেকনিক নামে এক আধুনিক পদ্ধতির সাহায্যে মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করে। তারা দেখেন আহত মস্তিষ্কে আদৌ কোনো ধরনের বোধ শক্তি কিংবা চেতনার আলামত পাওয়া যাচ্ছে কিনা। অনেক সময় এই আলামত খুব সুপ্ত অবস্থায় থাকে, যা সহজে ধরা যায় না। এই অবস্থাকে বলা যেতে পারে, ন্যূনতম সচেতন অবস্থা বা মিনিমালি কনশাস। স্টেট। কাজেই ডাক্তারদেরকে খুব যত্ন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়, এবং তা দীর্ঘমেয়াদী। যেমন, এড্রিয়ান ওযেনের নেতৃত্বে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের তত্ত্বাবধানে ২৩ বছরের এক তরুণী। চিকিৎসারত অবস্থায় আছে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত এ তরুণীর মস্তিষ্ক বেশ ভালোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এক সপ্তাহ কোমায় থাকার পর চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ‘নিষ্ক্রিয় দশা’য় এসে পৌঁছেন। সেই তরুণী এখন চোখের পাপড়ি মেলতে পারেন, কিন্তু বাইরের কোনো নির্দেশ পালন করার ন্যূনতম আলামত কখনোই দেখান নি। ডাক্তারেরা মেয়েটির মস্তিষ্ক কী অবস্থায় আছে তা নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা চালালেন। যেমন, রোগীর সামনে গিয়ে বললেন, ‘কফির জন্য চিনি আর দুধ টেবিলে রাখা আছে, খাও’ এই মন্তব্যের কী প্রতিক্রিয়া রোগীর মাথায় পাওয়া যায় তা জানার জন্য MRI স্ক্যান করে খুঁজে দেখলেন চিকিৎসকেরা। দেখলেন, মস্তিষ্কের ভেতরে টেম্পোলার গাইরি নামের যে জায়গাটা আছে সেটা উদ্দীপ্ত হচ্ছে। মাথার এই জায়গাটা সুস্থ মানুষদের ক্ষেত্রে কথাবার্তা শোনা এবং বোঝার কাজে ব্যবহৃত হয়। কাজেই এটুকু বোঝা গেল, হয়ত মেয়েটি সচেতন। কিন্তু চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হতে পারলেন না। কারণ অনেক সময় গভীর ঘুমে থাকা মানুষের সামনেও এধরনের নির্দেশ দিলে তাদের মাথার এই জায়গাগুলো উদ্দীপ্ত হয়।

    আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডাক্তারেরা ঠিক করলেন, রোগীকে দিয়ে টেনিস খেলাবেন। রোগীকে নির্দেশ দেওয়া হলো মনে করো তুমি টেনিস গ্রাউন্ডে আছ। আসো এবার আমার সাথে টেনিস খেল দেখি! নিঃসন্দেহে টেনিস খেলার প্রক্রিয়াটি এমনিতে বেশ জটিল। মাথার অনেকগুলো অংশের সমন্বিত সংযোগ করে তবে খেলাটা ঠিকমতো খেলতে হয়। মাথার একটি অংশ আছে ‘সাপ্লিমেন্টারি মোটর’ এলাকা। এই এলাকাটা দেহের হাত-পাসহ অন্যান্য অঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। দেখা গেল তরুণীর মোটর এলাকা অনবরত উদ্দীপ্ত হচ্ছে। টেনিস খেললে তাই হওয়ার কথা। আবার রোগীকে নির্দেশ দেওয়া হলো এবার মনে করো তুমি তোমার বাড়িতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছ’ মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা গেল এবারে মাথার ‘প্রিমোটর, প্যারিটাল আর প্যারাহিপোক্যাম্পাল’এলাকা উদ্দীপ্ত হচ্ছে। একজন সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেও তাই হয়। বোঝা গেল মেয়েটি সম্ভবত সচেতন অবস্থায় রয়েছে। ডাক্তারেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এধরনের রোগীর আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা একেবারে শূন্য নয়, বরং পাঁচ ভাগের এক ভাগ। মন্দ নয় সম্ভাবনা। আর সেজন্যই মেয়েটিকে কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, এবং মেয়েটিও এভাবেই ‘মিনিমালি কনশাস স্টেটে রয়েছে কখনও ডাক্তারের নির্দেশ মানছে, কখনও নয়।

    অনেকদিন ধরে ‘মিনিমালি কনশাস স্টেটে’ থাকার পর আবার মোটামুটি সচেতন অবস্থায় ফিরার উদাহরণ হচ্ছে আরকান্সাসের টেরি ওয়ালিসের ঘটনা। তিনিও এক ভয়ংকর ধরনের সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ১৯৮৪ সালে চেতনা হারান এবং প্রায় ১৯ বছর ধরে ন্যূনতম সচেতন অবস্থা বা ‘মিনিমালি কনশাস স্টেট’-এ ছিলেন। দীর্ঘদিন পর ২০০৩ সালে এসে টেরি ওয়ালিস কথা বলতে শুরু করেন। সেইসাথে হাত-পা নাড়ানোর ক্ষমতাও কিছুটা ফিরে পান। এখনও তিনি হাঁটতে চলতে পারেন না, এবং কারো না কারো সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে তাকে থাকতে হয়, কিন্তু তারপরও টেরি ওয়ালিসের উন্নতি লক্ষণীয়। এ থেকে বোঝা যায়, ন্যূনতম সচেতন অবস্থা বা মিনিমালি কনশাস স্টেট থেকে আবার সচেতনতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব; কিন্তু স্থায়ী নিষ্ক্রিয় দশা’ বা পার্মানেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেট থেকে প্রত্যাবর্তন অনেকটা দুরাশাই বলতে হবে। নিচের ছবিটি দেখলে এ ব্যাপারটি হয়ত পাঠকদের জন্য আরও পরিষ্কার হবে–

    ছবি। পেজ ২১৭

    চিত্র : মস্তিষ্কে আঘাত পেয়ে কোমায় চলে যাওয়া রোগীদের বিভিন্ন অবস্থা।

    মৃত্যু নিয়ে আরও কিছু কথা বলা যাক। আসলে মানুষের মতো বহুকোষী উচ্চশ্রেণির প্রাণীদের মৃত্যু দুই ধরনের। দেহের মৃত্যু (Clincal Death) এবং কোষীয় মৃত্যু (Cellular Death)। দেহের মৃত্যুর স্বল্প সময় পরেই কোষের মৃত্যু ঘটে। মানব দেহের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, আর ফুসফুস। যেকোনো একটির বা সবগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হলে মৃত্যু হতে পারে। যেমন, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বন্ধ হলে কোমা হয়, রমণ লাম্বা কিংবা সঞ্জীব চৌধুরীর ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছে; হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা বন্ধ হওয়াকে বলে সিনকোপ, আর ফুসফুসের কার্যকারিতা বন্ধ হওয়াকে বলে আসফিক্সি। ত্রিশ চল্লিশ বছর আগেও কিন্তু মৃত্যু ব্যাপারটার সংজ্ঞা দেওয়া এতটা কঠিন ছিল না। খুব সহজ সংজ্ঞা। হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার সাথে সাথেই কিংবা ফুসফুস তার হাপরের উঠানামা বন্ধ করে দেওয়ার সাথে সাথেই ব্যক্তির জীবন-প্রদীপ নির্বাপিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৬৮ সালে হৃৎসংস্থাপন (Heart Transplant) প্রক্রিয়ার আবিষ্কার এবং এ সংক্রান্ত প্রযুক্তির উন্নয়নের পর মৃত্যুর এই সংজ্ঞা কিন্তু বদলে যায়। কীভাবে এখন হলফ করে সেই ‘হৃদদাতা’কে মৃত বলা যাবে যখন চোখের সামনেই তার হৃদয় অন্যের দেহে স্পন্দিত হয়ে চলেছে? চিকিৎসা বিজ্ঞান পুরো ব্যাপারটিকে আরও জটিল করে ফেলোে শ্বাসযন্ত্র বা রেস্পিরেটর আবিষ্কার করে-যেটি হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুসকে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। উত্তরাধুনিক কোনো কবি কিন্তু এখন মৃত্যু নিয়ে কবিতা লিখতেই পারেন এই বলে যে ‘হে হিমশীতল মৃত্যু তুমি হচ্ছে রেস্পিরেটর সুইচের সহসা নির্বাপণ!

    যত দিন যাচ্ছে ততই কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে জীবন আয়ু ত্বরান্বিত করার ব্যাপারটি খুব সাধারণ একটি বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেক মৃত্যুপথযাত্রী অসুস্থ রোগীর মৃত্যু নানাভাবে বিলম্বিত করা গেছে কারো কারো ব্যাপারে কম সময়ের জন্য, আবার কারো ব্যাপারে দীর্ঘ সময়ের জন্য। যেমন ধরুন বার্নি ক্লার্ক নামের এক ডেনটিস্ট ভদ্রলোকের উদাহরণ, যিনি ১৯৮২ সালে নিজের রোগাক্রান্ত হৃৎপিণ্ডের পরিবর্তে একটি যান্ত্রিক হৃদয় নিয়ে বেঁচে ছিলেন কয়েক মাস যাবত। আবার ১৯৮৪ সালে সদ্য জন্মলাভ করা শিশু কে কে অতিরিক্ত ২০দিন বাঁচিয়ে রাখা গিয়েছিল একটি বেবুনের হৃৎপিণ্ড সংযোজন করে।

    আশির দশকের প্রথম দিকে জেমি ফিস্কের ‘জীবন প্রাপ্তির উদাহরণটি আরেকটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হিসেবে উঠে আসতে পারে পাঠকদের কাছে। এগারো মাসের শিশু জেমি আর হয়ত বড়জোর একটা ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারত-তার জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ যকৃৎ নিয়ে। তার বাঁচার একটিমাত্র ক্ষীণ সম্ভাবনা নির্ভর করছিল যদি কোনো সুস্থ শিশুর যকৃৎ কোথাও পাওয়া যায় আর ওটি ঠিকমতো জেমির দেহে সংস্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু এত ছোট বাচ্চার জন্য কোথাওই কোনো যকৃত পাওয়া যাচ্ছিল না। যে সময়টাতে জেমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল আর ঠিক সেসময়টাতেই হাজার মাইল দূরে একটি ছোট্ট শহরে এক বিচ্ছিরি ধরনের সড়ক দুর্ঘটনায় পড়া দশ মাসের শিশু জেসি বেল্লোনকে তাড়াহুড়ো করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। যদিও মাথায় তীব্র আঘাতের ফলে জেসির মস্তিষ্ক আর কাজ করছিল না, কিন্তু দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে কিন্তু রেস্পিরেটরের সাহায্যে ঠিকই কর্মক্ষম করে রাখা হয়েছিল। জেসির বাবা রেডিওতে দিন কয়েক আগেই একটি যকৃতের জন্য জেমির অভিভাবকদের আর্তির কথা শুনেছিলেন। শোকগ্রস্ত পিতা। এত দুঃথের মাঝেও মানবিক কর্তব্য বোধকে অস্বীকার করেন নি। তিনি পার্মানেন্ট ভেজিটেশনে চলে যাওয়া নিজের মেয়ের অক্ষত যকৃৎটি জেমিকে দান করে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। জেসির রেস্পিরেটর বন্ধ করে দিয়ে তার যকৃৎ সংরক্ষিত করে মিনেসোটায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। জেমির বহু প্রতীক্ষিত অস্ত্রোপচার সফল হলো। এভাবেই জেসির আকস্মিক মৃত্যু সেদিন জেমি ফিস্ককে দান করল যেন এক নতুন জীবন। সেই ধার করা যকৃৎ নিয়ে পুনর্জীবিত জেমি আজও বেঁচে আছে-পড়াশোনা করছে, দিব্যি হেসে খেলে বেড়িয়ে পার করে দিয়েছে জীবনের পঁচিশটি বছর!

    এবার আসুন প্রিয় পাঠক আপনাদের জিমি টন্টলিউজের ঘটনাটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এক শুভ্র সকালে তরুণ জিমি লেক মিশিগানের ওপর স্কেট করতে গিয়ে একস্তর পুরু বরফের আস্তরণ ভেদ করে শীতল জলে তলিয়ে যায়। ও অবস্থাতেই ছিল সে অনেকক্ষণ প্রায় আধাঘণ্টা পরে পথচারীরা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। দেখে মনে হচ্ছিল জিমি মারাই গিযেছে বুঝি, তার হৃৎস্পন্দন, নাডি, শ্বাসপ্রশ্বাস কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গিয়ে সেবাশুশ্রূষা শুরু করার প্রায় এক ঘণ্টা পরে ছেলেটির দেহে যেন জীবনের বৈশিষ্ট্য আবারও ‘নতুন করে ফিরে আসতে শুরু করল। আসলে ঠাণ্ডা পানির তীব্র ঝাঁপটা জিমির দেহকে একেবারে অসাড় করে দিয়েছিল। যদিও সাময়িক সময়ের জন্য হৃৎস্পন্দন এবং ফুসফুসও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার অন্যান্য প্রয়োজনীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কিন্তু একটি মিনিমাম লেভেলে কাজ করে যাচ্ছিল। ঘটনাক্রমে সেই শক্তিটুকুই জিমির দেহে পুনরায় হৃৎস্পন্দন আর শ্বাসপ্রশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য ছিল যথেষ্ট। চিকিৎসকেরা একমত যে, বরফ শীতল পানি অনেক ক্ষেত্রেই ক্লোরোফর্মের মতো অবচেতকের কাজ করে অতিশীতল তাপমাত্রায় তখন দেহ চলে যায় ‘হাইবারনেশন’ বা শীতনিদ্রা-ব্যাঙ, সাপ, বাদুড়, কিছু মাছের মধ্যে যা হরহামেশাই ঘটতে দেখা যায়। দেখা গেছে এধরনের অবস্থায় দেহের বিপাকক্র্যির হার কমে যায়, এবং দেহের জন্য যতটুকু খাবার কিংবা অক্সিজেন সুস্থ অবস্থায় প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক কম শক্তি খরচ করে দেহকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। আর তাই এধরনের পরিস্থিতিতে দীর্ঘক্ষণ কাটিযেও বেঁচে যাওয়ার উদাহরণ কিন্তু জিমি একা নয়। লাস ভেগাসের মুরে ব্রাউন আধাঘণ্টা, ইউটাহ শহরে মিশেল ফাফ এক ঘণ্টা আর কানাডার তেরো মাসের শিশু এরিকা নরডবাই দুই ঘণ্টা ধরে বরফ-জলে ডুবে অচেতন হয়ে থাকবার পরও চিকিৎসকরা তাদের কিন্তু বাঁচাতে পেরেছেন। তবে সবচেয়ে অবাক করেছে জাপানের মিৎসুতাকা উছিকোশির ঘটনা। জাপানের রোকো পাহাড়ের তুষারাচ্ছন্ন পরিবেশে ২৪ দিন ধরে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার পরও কোব্ব সিটি জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে তোলা গেছে[২০৪]

    এবারে আসি মৃত্যু ক্ষণের আলোচনায়। রোগীর মৃত্যুর সঠিক সময় নির্ধারণ করাটাও অনেকক্ষেত্রে অসুবিধাজনক, কারণ দেখা গেছে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেহের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে, যেমন মস্তিষ্ক ৫ মিনিট, হৃৎপিণ্ড ১৫ মিনিট, কিডনি ৩০ মিনিট, কঙ্কাল পেশি ৬ ঘণ্টা। অঙ্গ বেঁচে থাকার অর্থ হলো তার কোষগুলো বেঁচে থাকা। কোষ বেঁচে থাকে ততক্ষণই যতক্ষণ এর মধ্যে শক্তির জোগান থাকে। শক্তি উৎপন্ন হয় কোষের অভ্যন্তরস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে। মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ হলে কোষেরও মৃত্যু হয়। কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে, মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি প্রক্রিয়া। দেহের মৃত্যু দিয়ে এর প্রক্রিয়া শুরু হয়, শরীরের শেষ কোষটির মৃত্যু পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

    .

    আত্মা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

    আত্মার ব্যাপারটা এতই কৌতূহলোদ্দীপক যে, সত্যিই দেহাতীত কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা তা অনেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচাই করে দেখতে চেয়েছেন। আর আত্মায় বিশ্বাসী গবেষকেরা আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আয়োজন করেছেন। ১৯২১ সালে ড. ডানকান ম্যাকডোগাল তার বিখ্যাত ২১ গ্রাম পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি দাবি করেন, এই পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি আত্মার ওজন নির্ণয় করতে পেরেছেন। তার পরীক্ষা ছিল খুবই সহজ। তার দাবি অনু্যায়ী তিনি ছয় জন রোগীর মৃত্যুকালে উপস্থিত ছিলেন এবং মৃত্যুর ঠিক আগের এবং পরবর্তী মুহূর্তের দেহের ওজন মেপে দেখেন, ওজনের পার্থক্য ১১ গ্রাম থেকে ৪৩ গ্রামের মধ্যে (মিডিয়ায় যেমন আত্মার ওজন একদম মাপমতো ২১ গ্রাম বলে প্রচার করা হয়, হুবহু তা অবশ্য পান নি।) ঠিক একইভাবে তিনি ছয়টি কুকুরের মৃত্যু পর্যবেক্ষণ করেন, এবং একইভাবে ওজন মেপে দেখেন ওজনের কোনো পার্থক্য পাওয়া যাচ্ছে না। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, মানুষেরই কেবল আত্মা আছে। কুকুর বিড়াল জাতীয় ইতর প্রাণীর আত্মা নেই। তার এই পরীক্ষা মিডিয়ায় চমক সৃষ্টি করলেও বৈজ্ঞানিক মহলে অচিরেই পরিত্যক্ত হয়। কারণ ম্যাকডোগাল নিজে বা অন্য কেউই এই ২১ গ্রামের পরীক্ষা পুনর্বার সম্পন্ন করে সত্যাসত্য নির্ণয় করতে পারেন নি, যা বৈজ্ঞানিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার অন্যতম মাপকাঠি। শুধু পরীক্ষাটি পুনর্বার সম্পন্ন করা গেল না-এটিই কেবল নয়, পরীক্ষার উপাত্ত বা ডেটা নিয়েও ছিল সমস্যা। ম্যাকডোগাল নিজেই গবেষণাপত্রে স্বীকার করেছিলেন, তার গৃহীত ছয়টি উপাত্তের মধ্যে দুটোকে নিজেই বাতিল করে দিয়েছিলেন কোনো ‘ভ্যালু না থাকার কারণে। দুটো উপাত্তে দেখালেন যে ওটাতে ওজন ‘ড্রপ করেছে, এবং পরবর্তীকালে এই ওজন আরও কমে গেল (আত্মা বোধহ্য ‘খ্যাপে থ্যাপে’ দেহত্যাগ করছিল!), আরেকটি ডেটায় ওজন হ্রাস না ঘটে বরং বিপরীতটাই ঘটতে দেখা গিয়েছিল, পরে এর সাথে যুক্ত হয়েছিল অন্য কোনো হ্রাসের ব্যাপার-স্যাপার (এক্ষেত্রে বোধহয় আত্মা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না উনি কি দেহত্যাগ করবেন, নাকি করবেন না, নাকি দেহত্যাগ করে আবারও দেহে পুনঃ প্রবেশ করবেন, নাকি দেহকে চিরবিদায় জানাবেন!); শুধু একটি উপাত্ত থেকে ওজন হ্রাসের ব্যাপারটা আঁচ করা গেল এবং জানা গেল এটি এক আউন্সের ৩/৪ ভাগ[২০৫]। এই একটিমাত্র ডেটা থেকে আসা সিদ্ধান্ত ভিত্তিক কোনো প্রবন্ধ গবেষণা সাময়িকীতে স্থান করতে পারা অত্যাশ্চর্য ব্যাপারই বলতে হবে।

    ম্যাকডোগালের গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর পরই ড. অগাস্টাস পি ক্লার্ক নামের একজন ডাক্তার আমেরিকান মেডিসিন জার্নালে ম্যাকডোগালের কাজের সমালোচনা করে লেখেন যে, ম্যাকডোগাল এখানে খুব স্বাভাবিক অনুকল্পটির কথা ভুলে গেছেন, তা হচ্ছে এই ওজন হ্রাসের (যদি প্রকৃতই ঘটে থাকে) ব্যাপারটাকে বাষ্পীভবনের (evaporation) মাধ্যমে দেহের পানি ত্যাগ দিয়ে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাপার হচ্ছে, মৃত্যু পর মুহূর্তে দেহের রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়, এবং ফুসফুসের মধ্যকার বাতাস রক্তকে আর ঠাণ্ডা করতে পারে না। ফলে দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায় আর দেহের লোমকূপের মাধ্যমে পানি এভাপোরেট করে বের হয়ে যাওয়ায় ওজন ঘাটতি দেখা যেতে পারে। ড. অগাস্টাস পি ক্লার্কের এই ব্যাখ্যা থেকে এটাও পরিষ্কার হয় কেন কুকুরের ক্ষেত্রে কোনো ওজন হ্রাসের ব্যাপার ঘটে নি। কারণ কুকুর মানুষের মতো ঘামের মাধ্যমে দেহকে ঠাণ্ডা করে না। এ করে প্যান্টিং (panting)-এর মাধ্যমে।

    আত্মা নিয়ে আরও অনেকেই বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ব্রুস গ্রেসনের মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতার (near death experience, সংক্ষেপে NDE) পরীক্ষা। দেহ বিচ্যুত আত্মার অস্তিত্বের সপক্ষে আকর্ষণীয় সব অভিজ্ঞতার (Out of Body Experience, সংক্ষেপে OBE) কথা ঢালাওভাবে অনেক মুমূর্ষ রোগী রোগমুক্তির পর বিভিন্ন মিডিয়ায় দাবি করে থাকেন। ব্যাপারগুলো কতটুকু সত্য তা পরীক্ষা করে সত্যাসত্য নির্ণয় করতে চাইলেন ব্রুস গ্রেসন। কীভাবে ব্রুস এ পরীক্ষাটি করলেন সেখানে যাওয়ার আগে এই মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতা বা এনডিই এবং দেহ বিচ্যুত অভিজ্ঞতা বা ওবিই নিয়ে সাধারণ পাঠকদের জন্য কিছু কথা বলে নেওয়া যাক। আমাদের খুব পরিচিত জনের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। বেশ ক’বছর আগের কথা। মুক্তমনা সদস্য এবং এই বইয়ের সহলেখক অভিজিৎ রায়ের জীবন সাথী বন্যা একবার গাড়িতে উঠতে গিয়ে গাড়ির দরজার সাথে মাথায় টক্কর লেগে দারুণ আঘাত পেলেন। গাড়িতে উঠে বলতে লাগলেন। তার সারা গা নাকি অবশ হয়ে যাচ্ছে। বিপদের কথা। তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলো। চেতন-অচেতনের মাঝামাঝি কোনো এক স্টেটে ছিল সেসময়টা (পরে বলেছিলেন সারাটা সময় নাকি তার মনে হচ্ছিল সে মারা যাচ্ছে, যদিও তার মনে হয়েছিল মৃত্যু ব্যাপারটা তেমন ভয়ানক কিছু না)। হয়ত কিছু সময়ের জন্য জ্ঞানও হারিয়ে থাকতে পারেন। তিনি। ভালো যে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর ডাক্তারদের সেবাযত্নে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পেলেন। একটু পরে দিব্যি সুস্থ সবল হয়ে বাসায় ফিরে এলেন। কিন্তু হাসপাতালে ওই আধো জাগা আধো অচেতন অবস্থার মধ্যে এক বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেললেন তিনি। এই অভিজ্ঞতার কথা তিনি এখনও সুযোগ পেলেই বলে বেড়ান। তিনি দেখছিলেন (নাকি বলা উচিত ‘অনুভব করেছিলেন), তিনি নাকি দেহ থেকে বিযুক্ত হয়ে সারা কক্ষ জুড়ে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছেন। তার কোনো ওজন নেই। হালকা পালকের মতো হয়ে গেছেন তিনি। ওভাবে ভেসে ভেসেই হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সদের শঙ্কিত মুখগুলোও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। সারা ঘরের কোথায় কী আছে সবই দেখছিলেন উপর থেকে। টেবিলে রাখা পানির গ্লাস, বিছানার এলোমেলো চাঁদর, চিন্তিত লোকজনের মুখ, সবকিছু সাইকোলজিস্টরা এ অবস্থাকেই বলেন ‘আউট অফ বডি এক্সপেরিয়েন্স। বিশ্বাসীরা এগুলোতে আত্মার দেহ-বিচ্যুত অবস্থার অপার্থিব নিদর্শন খুঁজে পান। মুমূর্ষ বা মরণপ্রান্তিক অবস্থাতেই নাকি এ অভিজ্ঞতাগুলো বেশি দেখা যায়। রোগীদের অনেকে এসময় বিরাট বড় টানেলের শেষে আলো দেখা সহ নানা ধরনের আধি ভৌতিক ব্যাপার-স্যাপার প্রত্যক্ষ করেন। কেউ কেউ হাসপাতালের বিছানায় শায়িত চারিদিকে ডাক্তার-নার্স পরিবেষ্টিত নিজের মৃতদেহ পর্যন্ত দেখতে পান। ব্রুস গ্রেসন ঠিক করলেন এ অভিজ্ঞতার গল্পগুলো আসলেই সত্য, নাকি মুমূর্ষ অবস্থায় মনোবৈকল্য, তা একটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখবেন। তিনি তার ল্যাপটপটি সাথে নিয়ে এলেন আর তাতে প্রোগ্রাম করে বিভিন্ন রঙিন ছবি (যেমন, উড়োজাহাজ, নৌকা, প্রজাপতি, ফুল ইত্যাদি) বিক্ষিপ্তভাবে ফুটিয়ে তুললেন। তারপর তিনি ল্যাপটপটিকে স্থাপন করলেন হাসপাতালের হার্টের অস্ত্রোপচার কক্ষের ছাদের কাছাকাছি কোথাও এমন একটা জায়গায় যেখানে অস্ত্রোপচারের সময়। রোগীর দৃষ্টি পৌঁছায় না, কিন্তু দেহবিযুক্ত আত্মা হয়ে সারা কক্ষ ভেসে ভেসে বেড়ালে তা রোগীর দেখতে পাওয়ার কথা। গ্রেসন এনডিই এবং ওডিই’র দাবিদার পঞ্চাশ জন রোগীর ক্ষেত্রে পরীক্ষাটি চালনা করলেন, কিন্তু একজন রোগীও ল্যাপটপের ছবিগুলোকে সঠিকভাবে বর্ণনা করতে পারেন নি[২০৬]। ঠিক একই ধরনের পরীক্ষা স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনা করেছিলেন ড. জ্যান হোল্ডেন। তিনিও গ্রেসনের মতোই নেগেটিভ ফল পেলেন[২০৭]

    আসলে তাই পাওয়ার কথা। যদি আত্মার মাধ্যমে তথাকথিত পরজগতের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হতো তবে এই নব্য প্রযুক্তি বিজ্ঞানের জগতে ইতোমধ্যেই বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলত। আমাদের এত দিনের প্রচেষ্টায় বস্তুবাদী ধ্যান ধারণার যে বৈজ্ঞানিক বুনিয়াদ পলে পলে গড়ে উঠেছে তা অচিরেই ধ্বসে পড়তো, বদলে যেত বিবর্তনের মাধ্যমে প্রাণিজগতের এবং সর্বোপরি মানুষের উৎপত্তির সামগ্রিক ধ্যান ধারণা। মানব আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে রাতারাতি তা প্রকৃতিতে মানুষকে প্রদান করত এক অভূতপূর্ব বিশিষ্টতা। কিন্তু তা হয় নি। বরং বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক সময়ের সকল আবিষ্কার গেছে এই মানবকেন্দ্রিক ধারণার বিপরীতে। কোপার্নিকাস প্রমাণ করেছিলেন আমাদের আবাসভূমি পৃথিবী নামের গ্রহটি কোনো বিশিষ্ট গ্রহ নয়, এটি না মহাবিশ্বের না এ সৌরজগতের কেন্দ্র। বরং লক্ষ কোটি গ্রহ তারকার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া সামান্য গ্রহ ছাড়া এটি কিছু নয়। এ যেন ছিল সনাতন চিন্তাভাবনার পিঠে এক রূঢ় চাবুক। এতদিনকার প্রচলিত রূপকথা, উপকথা আর ধর্মগ্রন্থের বাণীতে পৃথিবী যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল তা কোপার্নিকাসের এক চাবুকে যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। তারপর ডারউইন এসে কষলেন আরেক দফা চাবুক। তিনি দেখালেন, এ পৃথিবীর মতো এর বাসিন্দা মানুষও কোনো বিশেষ সৃষ্টি নয়, বরং অন্যান্য প্রাণীকুলের মতোই দীর্ঘদিনের ক্রমবিবর্তনের ফল। এতদিন ধরে মানুষ নিজেকে সৃষ্টির কেন্দ্রস্থলে বসিয়ে, নিজেকে ঈশ্বরের আপন প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট ভেবে যে বিশ্বাস স্থাপন করে এসেছিল, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের ধাক্কায় সেই বিশ্বাসের অট্টালিকা যেন তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ল। পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার ওপারিন, হাল্ডেন, ইউরে-মিলার, সিডনি ফক্সের ক্রমিক গবেষণা বিবর্তনকে নিয়ে গেল সূক্ষ রাসায়নিক স্তরে-যা অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থের উন্মেষকে (অজৈবজনি) বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে দিল। বস্তুত বৈজ্ঞানিক সমাজে অজৈবজনি এবং বিবর্তন তত্ত্বের প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানুষ আত্মার অস্তিত্ব ছাড়াই জীবনের উৎপত্তি, বিকাশ ও বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে পারে। কৌতূহলী পাঠকেরা এ বিষয়ে আরও জানতে চাইলে বিবর্তনের পথ ধরে’ (অবসর, ২০০৭) এবং মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (অবসর, ২০০৭) বই দুটি পড়ে দেখতে পারেন।

    কিন্তু তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে আত্মা যদি নাই থাকল, বিভিন্ন জনের মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতাগুলোকে (এনডিই এবং ওডিই) কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? ওই যে হাসপাতালে শুয়ে শুযে যে দেখতে পায় তারা হাসপাতালের কক্ষ জুড়ে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে? এরা কি সবাই তবে মিথ্যে বলছে? না মোটেও তা নয়। আর। তাছাড়া ওভাবে সবাইকে মিথ্যেবাদী বানাতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের’ দশা হবে। কারণ এধরনের ওডিই অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা এ পৃথিবীতে নেহাত কম। তো নয়। দেহ থেকে বের হয়ে ভেসে ভেসে বেড়ানোই কেবল নয়, কেউ এ সময় টানেলের শেষপ্রান্তে উজ্জ্বল আলো দেখতে পায়, কেউবা মৃত লোকজনের (যেমন সন্ত, যিশুখ্রিস্ট, মুহাম্মদ, ফেরেশতা, মৃত আত্মীয়স্বজন প্রভৃতি) দেখা পায়। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আমেরিকার শতকরা প্রায় ১৫-২০ ভাগ লোক মনে করে তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময় ওডিই বা এনডিই এর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এগুলোর কী ব্যাখ্যা?

    এর ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে, এবং তা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানেই বেরিয়ে এসেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন মস্তিষ্ক আমাদের দেহের এক অতি জটিল অঙ্গ। কী রকম জটিল একটু কল্পনা করা যাক। মস্তিষ্কের জটিলতাকে অনেক সময় মহাবিশ্বের জটিলতার সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র ছড়িয়ে ছিটিযে থেকে আমাদের পরিচিত সুবিশাল এই মহাবিশ্বে তৈরি হয়েছে বিশাল বপুর সব সৌরজগৎ কিংবা ছায়াপথের। ঠিক একই রকমভাবে বলা যায়, আমাদের করোটির ভেতরে প্রায় দেড় কিলো ওজনের এই থকথকে ধূসর পদার্থটির মধ্যে গাদাগাদি করে লুকিয়ে আছে প্রায় দশ হাজার কোটি নিউরন আর কোটি কোটি সান্যাপসেস; আর সেই সাথে সেরিব্রাম, সেরিবেলাম, ডাইসেফেলন আর ব্রেইনস্টেমে বিভক্ত হয়ে তৈরি করেছে জটিলতম সব কাঠামোর। ২০০২ সালে পিএইচডি-র কাজের অংশ হিসেবে যখন মানব মস্তিষ্কের মডেলিং করতে হয়েছিল তখন ব্রেনের প্রায় তেতাল্লিশটি কাঠামো বা প্রত্যঙ্গ শনাক্ত করে মডেলিং করেছিলাম[২০৮]। সেগুলোর ছিল বিদঘুটে সমস্ত নাম কর্পাস ক্যালোসাম, ফরনিক্স, হিপোক্যাম্পাস, হাইপোথ্যালমস, ইনসুলা, গাইরাস, কডেট নিউক্লিয়াস, পুটামেন, থ্যালামাস, সাবস্ট্যানশিয়া নায়াগ্রা, ভেন্ট্রিকুলাস ইত্যাদি। আমাদের চিন্তাভাবনা, কর্মকাণ্ড, চালচলন এবং প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা অনেকাংশেই মস্তিষ্কের এই সমস্ত বিদঘুটে নামধারী প্রত্যঙ্গগুলোর সঠিক কর্মকাণ্ডের এবং তাদের কাজের সমন্বযের ওপর নির্ভরশীল। দেখা গেছে, মস্তিষ্কের কোনো অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হলে, কিংবা এর কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হলে নানারকমের অদ্ভুতুড়ে এবং অতীন্দ্রিয় অনুভূতি হতে পারে।

    যেমন, কর্পাস ক্যালোসাম নামের গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোটি মস্তিষ্কের বামদিক এবং ডানদিকের কাজের সমন্বয় সাধন করে থাকে। আমরা সবাই জানি যে, আমাদের ব্রেন একটি হলেও এটি মূলত ডান এবং বাম-এই দুই গোলার্ধে বিভক্ত। এই দুই গোলার্ধকে আক্ষরিক অর্থেই আটকে রাখে দুই গোলার্ধের ঠিক মাঝখানে বসে থাকা কর্পাস ক্যালোসাম নামের প্রত্যঙ্গটি কোনো কারণে মাথার মাঝখানের এই অংশটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে মাথার বামদিক এবং ডানদিকের সঠিক সমন্বয় ব্যাহত হয়। ফলে রোগীর দ্বৈতসত্বর (Split Brain experience) উদ্ভব ঘটতে পারে।

    ষাটের দশকে রজার স্পেরি, উইলসন এবং মাইকেল গ্যাজানিগার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বেরিয়ে আসে মজার মজার সব তথ্য। দেখা গেল এধরনের রোগীদের। মাথার বামদিক এক ধরনের চিন্তা করছে তো ডানদিক করছে আরেক ধরনের চিন্তা[২০৯]। মাথার দুই ভাগই আলাদা আলাদাভাবে কনশাস বা চেতনামযা মাথার। বাম অংশ পেশাগত জীবনে ড্রাফটসম্যান হতে চায়, তো ডান অংশ হতে চায় রেসিং ড্রাইভার[২১০]! এখন যারা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, তাদের কাছে সহজেই এ প্রশ্নটি উত্থাপন করা যায়, মস্তিষ্ক-বিভক্ত দ্বৈতসত্বধারী রোগীদের দেহে কি তাহলে দুটি আত্মা বিরাজ করছে? বাড়তি আত্মাটি তাহলে দেহে কোত্থেকে এলো? বোঝাই যাচ্ছে, আত্মার অস্তিত্ব দিয়ে এই ঘটনার ব্যাখ্যা মেলে না, এর ব্যাখ্যা সঠিকভাবে দিতে পারে ‘দ্বিখণ্ডিত মস্তিষ্ক এবং মাথার মাঝখানে থাকা কর্পাস ক্যালোসাম নামের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কাজকর্ম।

    ছবি। পেজ ২৩১

    চিত্র : এই বইয়ের সহলেখক অভিজিৎ রায়কে পিএইচডির কাজের অংশ হিসেবে মানব মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ শনাক্ত করে ত্রি-মাত্রিক মডেলিং করতে হয়েছিল। ৪৩টি অংশ সঠিকভাবে শনাক্ত করে মডেলিং করেছিলেন তিনি। উপরের ছবিতে সেই মডেলিং-এর অংশবিশেষ দেখানো হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের চিন্তাভাবনা, কর্মকাণ্ড, চালচলন এবং প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা অনেকাংশেই মস্তিষ্কের এই সমস্ত প্রত্যঙ্গগুলোর সঠিক কর্মকাণ্ডের এবং তাদের সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল।

    আবার বিজ্ঞানীরা এও দেখেছেন, হাইপোথ্যালামাস নামে মস্তিষ্কের আরেকটি প্রত্যঙ্গকে কৃত্রিমভাবে বৈদ্যুতিক উদ্দীপ্ত করে (মূলত মৃগীরোগ সারাতে এ প্রক্রিয়াটি ব্যবহৃত হতো) দেহবিচ্যুত অবস্থার সৃষ্টি করা যায়, অন্তত রোগীরা মানসিকভাবে মনে করে যে সে দেহ বিযুক্ত হয়ে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয় মস্তিষ্কে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে (হাইপারকার্বিয়া) কিংবা কোনো কারণে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে (হাইপক্সিয়া)। কিছু কিছু ড্রাগ যেমন, ক্যাটামিন, এলএসডি, সিলোকারপিন, মেকালিন প্রভৃতির প্রভাবে নানা ধরনের অনুভূতির উদ্ভব হয় বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ সমস্ত ড্রাগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে অচৈতন্যাবস্থা থেকে শুরু করে দেহ বিযুক্ত অনুভূতি, আলোর ঝলকানি দেখা, পূর্বজন্মের স্মৃতি রোমন্থন, ধর্মীয় অভিজ্ঞতা সবকিছুই পাওয়া সম্ভব। এক ভদ্রলোককে চিনতাম যিনি যিশুখ্রিস্টকে দেখার এবং পাওয়ার জন্য এলএসডি সেবন করতেন। আমাদের আরেক বন্ধু প্রথমবারের মতো গাঁজা থেযে এমন সব কাণ্ড করা শুরু করেছিল যা মনে পড়লে এখনও হাসি পায়। হাড় কাঁপানো শীতের রাতে ‘গরমে পুইড়া যাইতাছি’, ‘আমারে হাসপাতালে নিয়া যা’ বলে হাউ মাউ কাঁদতে আর চ্যাঁচ্যাঁতে লাগলো। আমাদের তখন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ ব্যস, কলেজ পালিয়ে ‘গাঁজা খেলে কেমন লাগে’ এই রহস্য উদঘাটনে আমরা তখন ব্যস্ত। ভযই পেয়ে গিয়েছিলাম সে রাতে। যদিও শেষটায় বন্ধুটিকে হাসপাতালে নিতে হয় নি, কিন্তু পরদিন তার পাংশু মুখের দিকে তাকিযেই বুঝেছিলাম কী ধকলটাই গেছে। তার ওপর দিয়ে সারা রাত। সবাই মিলে চেপে ধরায় সে বলেছিল, ‘সারা রাত আমি শুধু দেখছিলাম আমি একটা নিকষ কালো অন্ধকার টানেলের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি, আর সবকিছু আমার ওপরে ভেঙে পড়ছে। গরম গরম বলে চ্যাঁচাঁচ্ছিলি কেন-এ প্রশ্ন করায় বলেছিল, তার নাকি মনে হয়েছিল টানেলের শেষেই দোজখের আগুন, সে আগুনে নাকি তাকে পুড়িয়ে ঝলসিযে কাবাব বানানো হবে! বলা বাহুল্য, উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, মরণ প্রান্তিক এবং দেহ-বিযুক্ত অনুভূতিগুলো আসলে কিছুই নয়, আমাদের মস্তিষ্কেরই স্নায়বিক উত্তেজনার ফসল। আর এজন্যই শ্মশানঘাটের কোনো কোনো সাধু-সন্ন্যাসী কেন গাঁজা, চরস, ভাং থেযে মা কালীকে পেয়ে গেছি’ ভেবে নাচানাচি করে, তা বোঝা যায়।

    এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী সুজান ব্ল্যাকমোরের কথা বলা যেতে পারে। সুজান ব্ল্যাকমোর মরণ-প্রান্তিক অভিজ্ঞতা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একজন মনোবিজ্ঞানী, ইংল্যান্ডের ওযেস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। এক সময় টেলিপ্যাথি, ইএসপি, পরামনোবিদ্যায় বিশ্বাসী থাকলেও, আজ তিনি এ সমস্ত অলৌকিকতা, ধর্ম এবং পরজগৎ সম্বন্ধে সংশয়ী। সংশয়ী হয়েছেন নিজে বৈজ্ঞানিকভাবে এগুলোর অনুসন্ধান করেই। তিনি ‘ডাইং টু লিভ’, ‘ইন সার্চ অফ দ্য লাইট’ এবং ‘মিম মেশিন’ সহ বহু বইয়ের প্রণেতা। তিনি তার ডাইং টু লিভ : নিযার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স (১৯৯৩) বইয়ে উল্লেখ করেছেন অক্সফোর্ডে অধ্যয়নকালীন (সত্তুরের দশকে) তিন বন্ধুর সাথে মিলে মারিজুয়ানা সেবন করে কীভাবে একদিন তার ‘আউট অব বডি’ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, কীভাবে তিনি টানেলের মধ্য দিয়ে ভেসে ভেসে বেড়িয়েছিলেন, অক্সফোর্ডের বিল্ডিঙের বাইরে ভাসতে ভাসতে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্কে পৌঁছে গিয়েছিলেন, তারপর আবার নিজের দেহে ফিরে গিয়েছিলেন[২১১]। তার এ অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কাহিনি লিপিবদ্ধ করে রাখা আছে ‘The Archives of Scientists Transcendent Experiences (TASTE) ওযেবসাইটে[১১২]। কিন্তু সুজান ব্ল্যাকমোর যা করেন নি তা হলো অন্যান্য ধর্মান্ধ ব্যক্তিবর্গের মতো ‘ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার অপার মহিমায় আপ্লুত হয়ে যাওয়া, কিংবা এ ঘটনার পেছনে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে স্রষ্টা, আত্মা কিংবা পরজগতের অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া। বরং তিনি যুক্তিনিষ্ঠভাবে এনডিই এবং ওবিই-এর বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান করেছেন এবং উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, মরণ প্রান্তিক অভিজ্ঞতাগুলো কোনো পরকালের অস্তিত্বের প্রমাণ নয়, বরং এগুলোকে ভালোমতো ব্যাখ্যা করা যায় স্নায়ু-রসায়ন, শরীরবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান থেকে আহরিত জ্ঞানের সাহায্যে।

    ছবি। পেজ ২৩৪

    চিত্র : মরণ প্রান্তিক অভিজ্ঞতার সময় অনেকেই টানেল বা সুরঙ্গ দেখে থাকেন

    কেন মরণ প্রান্তিক অভিজ্ঞতাগুলোতে কেবলই টানেল বা সুরঙ্গ দেখা যায়? বিশ্বাসীরা বলেন, ওটি ইহজগৎ আর পরজগতের সংযোগ পথ। টানেলের পেছনে আলোর দিগন্ত আসলে পরজগতের প্রতীকী রূপ। কিন্তু তাহলে অবধারিতভাবে প্রশ্নের উদয় হয় কেন কেবলই সুরঙ্গ? কেন কথনও দরজা নয় কিংবা নয় কোনো বেহেস্তি কপাট কিংবা নয় গ্রিক মিথোলজির আত্মা পারাপারের সেই ‘রিভার স্ট্যাক্স’? এখানেই সামনে চলে আসে আধ্যাত্মিকতার সাথে বিজ্ঞানের বিরোধের প্রশ্নটি। বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘সুরঙ্গ দর্শন’ আসলে মরণ প্রান্তিক কোনো ব্যাপার নয়, নয় কোনো অপার্থিব ইঙ্গিত। সেজন্যই মরণ প্রান্তিক অবস্থার বাইরেও মৃগীরোগ, মাইগ্রেনের ব্যথার সময় অনেকে সুরঙ্গ দেখে থাকতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সুরঙ্গ দেখা যেতে পারে মস্তিষ্ক যখন থাকে খুবই ক্লান্ত, শ্রান্ত, কিংবা কোনো কাজে যখন চোখের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ে। আবার কখনও সুরঙ্গ দেখা যেতে পারে এলএসডি, সাইলোকিবিন কিংবা মেকালিনের মতো ড্রাগ-সেবনে। আসলে স্নায়ুজ-কল্লোল (Neural Noise) এবং অক্ষীয়-করটিকাল জরিপণের (Retino Cortical Mapping) সাহায্যে টানেলের মধ্য দিয়ে আঁধার থেকে আলোতে প্রবেশের অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করা যায়[২১৩]। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুজীববিজ্ঞানী জ্যাক কোয়ান (Jack Cowan) ১৯৮২ সালে পুরো প্রক্রিয়াটিকে একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে গাণিতিক মডেলের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন[২১৪]। তার মডেলের সাহায্যে কোয়ান দেখিয়েছেন, কর্টেক্সে ডোরা দাগ থাকলে তা আমাদের চোখে অনেকটা সর্পিল কুণ্ডলী (Spirals) আকারে রূপ নেবে। এগুলো আমরা ছোটবেলায় ‘দৃষ্টি বিভ্রমের’ (Visual Illusion) উদাহরণ হিসেবে দেখেছি। নিচে পাঠকদের জন্য এমনই একটি ছবি দেওয়া হলো। ছবিটি দেখুন। বক্ররেখাগুলোকে সর্পিলাকার কুণ্ডলী বলে বিভ্রম হবে। যদিও বাস্তবতা হলো, বক্ররেখাগুলো একেকটি বৃত্ত।

    মরণ প্রান্তিক অভিজ্ঞতা লাভের সময় প্রায় একই রকম বিভ্রম ঘটে মস্তিষ্কের মধ্যেও। ড্রাগ সেবনের ফলে কিংবা অত্যধিক টেনশনে কিংবা অন্য কোনো কারণে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে ভিজুয়াল কর্টেক্সের গতিপ্রকৃতি সতত বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে এ সময় ব্যক্তিরা নিজেদের অজান্তেই টানেল-সদৃশ প্যাটার্নের দর্শন পেযে থাকেন। এটাই সুরঙ্গ-দর্শনের মূল কারণ। সুরঙ্গ দর্শনের এই স্নায়ুজ-কল্লোল এবং অক্ষীয়-করটিকাল জরিপণের গাণিতিক মডেলটির পরবর্তীকালে আরও উন্নতি ঘটান পল ব্রেসলফ, সুজান ব্ল্যাকমোর এবং ট্রস্কিয়াস্কো এবং অন্যান্যরা[২১৫]।

    ছবি। পেজ ২৩৭

    চিত্র : বক্ররেখাগুলোকে সর্পিলাকার কুণ্ডলীর টানেল বলে বিভ্রম হচ্ছে। যদিও বাস্তবতা হলো, বক্র রেখাগুলো একেকটি বৃত্ত। প্রমাণ হিসেবে ওগুলোর ওপর আঙুল ঘুরিয়ে দেখতে পারেন।

    ছবি। পেজ ২৩৮

    চিত্র : স্নায়ুজ-কল্লোল এবং অক্ষীয়-করটিকাল জরিপণের সাহায্যে সুরঙ্গ দর্শনের অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করা যায়।

    কাজেই বোঝা যাচ্ছে সুরঙ্গ-দর্শনের মাঝে অলৌকিক বা অপার্থিব কোনো ব্যাপার নেই, নেই কোনো পারলৌকিক রহস্য, যা আছে তা একেবারে নিরস, নিখাঁদ বিজ্ঞান। বলা বাহুল্য, সত্যজিৎ রায়ের ফেলু মিত্তিরের গোয়েন্দা গল্পের মতো ‘সুরঙ্গ-রহস্য’ শেষ পর্যন্ত সমাধান করেছে বিজ্ঞানীরাই। শুধু রহস্য সমাধান নয়, গাণিতিক মডেল টডেল করাও সারা। শুধু তাই নয়, টানেলের পাশাপাশি কেন যিশুখ্রিস্ট কিংবা মৃত-আত্মীয়স্বজনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে তারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যাপারটা হয়ত পুরোটাই সমাজ-সাংস্কৃতিক। যিশুখ্রিস্টের দেখা পান তারাই, যারা দীর্ঘদিন খ্রিস্টীয় আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন, বাবা মা, শিক্ষক, পাড়া পড়শিদের কাছ থেকে ‘খ্রিস্টীয় ধ্যানধারণা পেয়েছেন। একজন হিন্দু কথনোই মরণ প্রান্তিক অভিজ্ঞতায় খ্রিস্টের দেখা পান না, তিনি পান বিষ্ণু, ইন্দ্র বা লক্ষীর দেখা, আর না হলে ‘যমদূতেরা আবার একজন মুসলিম হত সেক্ষেত্রে দর্শন লাভ করেন আজরাইল ফেরেশতার। বোঝা। যাচ্ছে, ধর্মীয় দিব্য দর্শন’ কোনো সর্বজনীন সত্য নয়, বরং, আজন্ম লালিত ধর্মানুগত্য আর নিজ নিজ সংস্কৃতির রকমফেরে ব্যক্তিবিশেষে পরিবর্তিত হয়। কাজেই, ঈশ্বর দর্শনই বলুন আর ধর্মীয় দিব্য দর্শন’ই বলুন, এগুলোর উৎসও আসলে মানব মস্তিষ্কই। দেখা গেছে মস্তিষ্কের কোনো কোনো অংশকে উত্তেজিত করলে মানুষের পক্ষে ভূত, প্রেত, ড্রাকুলা থেকে শুরু করে শ্যতান, ফেরেশতা কিংবা ঈশ্বর দর্শন সবকিছুই সম্ভব। এ ব্যাপারটা আরও বিশদভাবে বুঝতে হলে আমাদের মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ-’টেম্পোরাল লোব সম্বন্ধে জানতে হবে।

    .

    টেম্পোরাল লোব : মস্তিষ্কের ‘গড স্পট’?

    বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানী আর গবেষকের দল অনেকদিন ধরেই সন্দেহ করছিলেন, ঈশ্বর দর্শন, দিব্যদর্শন, কিংবা ওহি প্রাপ্তির মতো ধর্মীয় অভিজ্ঞতাগুলো আসলে স্রেফ মস্তিষ্কজাত? সেই ১৮৯২ সালের আমেরিকার পাঠ্যপুস্তকগুলোতেও এপিলেন্সির সাথে ‘ধর্মীয় আবেগের সাযুজ্য খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিল। ব্যাপারটা আরও ভালোমতো বোঝা গেল বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। ১৯৫০ সালের দিকে উইল্ডার পেনফিল্ড নামের এক নিউরোসার্জন মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করার সময় ব্রেনের মধ্যে ইলেকট্রোড ঢুকিযে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে বৈদ্যুতিকভাবে উদ্দীপ্ত করে রোগীদের কাছে এর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইতেন। যখন কোনো রোগীর ক্ষেত্রে ‘টেম্পোরাল লোব’ (ছবিতে দেখুন)–এ ইলেকট্রোড ঢুকিযে উদ্দীপ্ত করতেন, তাদের অনেকে নানা ধরনের গাযেবি আওয়াজ শুনতে পেতেন, যা অনেকটা ‘দিব্য দর্শনের অনুরূপ[২১৬]। এই ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হলো, ১৯৭৫ সালে যখন বোস্টন ভেটেরান্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হাসপাতালের স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ নরমান গেসচ উইন্ড-এর গবেষণায় প্রথমবারের মতো এপিলেপ্সি বা মৃগীরোগের সাথে টেম্পোরাল লোবে বৈদ্যুতিক মিসফায়ারিং-এর একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেল। একই ক্রমধারায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ ভিলায়ানুর এস রামাচান্দ্রন তার গবেষণায় দেখালেন, টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি রোগীদের ক্ষেত্রেই ঈশ্বর-দর্শন, ওহি প্রাপ্তির মতো ধর্মীয় অভিজ্ঞতার আস্বাদনের সম্ভাবনা বেশি]২১৭]। এগুলো থেকে হয়ত অনুমান করা যায়, কেন আমাদের পরিচিত ধর্ম প্রবর্তকদের অনেকেই ‘ওহি প্রাপ্তির আগে ‘ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেতেন’, ‘গায়েবি কণ্ঠস্বর শুনতে পেতেন, তাদের ‘কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসত’ কিংবা তারা ‘ঘন ঘন মূৰ্ছা যেতেন[২১৮]।

    ছবি। পেজ ২৪১

    চিত্র : মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব : অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন মস্তিষ্কের এই অংশটিই হয়ত ধর্মীয় প্রণোদনার মূল উৎস। এই অংশটি নিয়ে গবেষণা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার সাথে এপিলেপ্পির জোরালো সম্পর্কও পাওয়া গেছে।

    এই ধরনের গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফলে উদ্বুদ্ধ হয়ে কানাডার লরেন্টিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাইকেল পারসিঙ্গার আরও একধাপ সাহসী গবেষণায় হাত দিলেন। তিনি ভাবলেন, টেম্পোরাল লোবে বৈদ্যুতিক তারতম্য যদি ধর্মীয় প্রণোদনার উৎস হয়েই থাকে তবে, উল্টোভাবে মস্তিষ্কের এই গোদা অংশটিকে উদ্দীপ্ত করেও তো কৃত্রিমভাবে ধর্মীয় প্রণোদনার আবেশ আস্বাদন করা সম্ভব, তাই না? হ্যাঁ, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে তো তা সম্ভব। ড. পারসিঙ্গার ঠিক তাই করলেন। তিনি টেম্পোরাল লোবকে কৃত্রিমভাবে উদ্দীপ্ত করে ধর্মীয় আবেশ পাওয়ারজন্য তৈরি করলেন তার বিখ্যাত ‘গড হেলমেট’। এই হেলমেট মাথায় পরে বসে থাকলে নাকি ‘রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স’ আহরণ করা সম্ভব। হেলমেট বানানোর পর অফিশিয়ালি প্রায় ছ’শ জনকে এটি পরিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এদের প্রায় ৮০ শতাংশ বলেছেন, তাদের এক ধরনের অপার্থিব অনুভূতি হয়েছে[২১৯]। তারা অনুভব করেছেন, কোনো অশরীরী কেউ (কিংবা কোনো স্পিরিট) তাদের ওপর নজরদারি করেছে। অনেকের অভিজ্ঞতার মাত্রা এর চেয়েও বেশি। যেমন, এক নারী হেলমেট পরার পর মনে হয়েছে তিনি তার মৃত মাযের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। আরেক নারীর কাছে এই অশরীরী অস্তিত্ব এতটাই প্রবল ছিল যে, পরীক্ষার শেষে যখন অশরীরী আত্মা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল, তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। হেলমেট মাথায় পরার পর ব্রিটিশ সাংবাদিক আযান কটনের পুরো সময়টা নিজেকে তিব্বতি ভিক্ষু বলে বিভ্রম হয়েছিল। বিজ্ঞানী সুজান ব্ল্যাকমোরের অভিজ্ঞতাটাই বোধহয় এক্ষেত্রে সবচেয়ে মজার। তিনি নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এভাবে[২২০]

    আমার হঠাৎ মনে হলো কেউ আমার পা ধরে টানছে, দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট করে দিচ্ছে, তারপর ধাক্কা মেরে আমাকে দেওয়ালে ফেলে দিল। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত; কিন্তু ঘটনাটা ছিল দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। আমার প্রথমে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল, পরে রাগের স্থান ক্রমান্বয়ে দখল করে নিল ভীতি…।

    অধ্যাপক ব্ল্যাকমোর পরে বলেছিলেন, ‘পারসিঙ্গারের ল্যাবরেটরিতে আমার সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এক কথায় অবিস্মরণীয়। পরে যদি বেরিয়ে আসে কোনো প্ল্যাসিবো এফেক্টের কারণে আমি এগুলোর মধ্য দিয়ে গেছি, তাহলে অবাকই হবো।”

    তবে সবার ক্ষেত্রেই যে ‘গড হেলমেট একই রকমভাবে কাজ করেছে তা কিন্তু নয়। একবার গড় হেলমেটের কার্যকারিতা দেখানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্সকে। ডকিন্স বিবর্তনবাদে বিশেষজ্ঞ একজন বিজ্ঞানী, পাশাপাশি সবসময়ই ধর্ম, অলৌকিকতা প্রভৃতি বিষয়ে উৎসুক। ধর্মের একজন কঠোর সমালোচক তিনি। নিজেকে কখনোই নাস্তিক হিসেবে পরিচিত করতে পরোয়া করেন না। ঈশ্বরে বিশ্বাস তার কাছে বিভ্রান্তি বা ডিলুশন’, ধর্মের ব্যাপারটা তার কাছে ‘ভাইরাস’। এহেন ব্যক্তিকে হেলমেট পরিয়ে তার মনের মধ্যে কোনো ধরনের ধর্মীয় অনুভূতি’ ঢোকানো যায় কিনা, এ নিয়ে অনেকেই খুব উৎসুক ছিলেন।

    ছবি। পেজ ২৪৪

    চিত্র : মাইকেল পারসিঙ্গার উদ্ভাবিত ‘গড হেলমেট’

    রিচার্ড ডকিন্স খুব আগ্রহভরেই এই পরীক্ষায় ‘গিনিপিগ’ হতে রাজি হলেন ২০০৩ সালে। ডকিন্স পারসিঙ্গারের ল্যাবরেটরিতে এসে হেলমেট পরে চেম্বারে ঢুকলেন। যথা সময় বেরিযেও আসলেন। এসে বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘আমি খুবই হতাশ। খুব ইচ্ছে ছিল ঈশ্বর দর্শনের। কিন্তু চেম্বারে বসে মাথা ঝিম ঝিম করার ভাব ছাড়া আর তো কিছু পেলাম না!’

    মনে হচ্ছে ডকিন্সের মতো যুক্তিবাদী মাথা মৃগীরোগের জন্য উপযুক্ত নয়। এদের মতো লোককে বোধহয় সহজে গায়েবি আওয়াজ শোনানো, কিংবা দিব্য দর্শন দেওয়া এত সহজ নয়। কাজেই, দুর্মুখেরা বলবেন, ডকিন্সের মতো নিরেট-মস্তিষ্ক লোকেরা পয়গম্বর হওয়ার উপযুক্ত নন! ধর্মবাদীরা কী আর সাধে বলে যে, নবুয়ত পেতে যোগ্যতা লাগে!!

    কিন্তু রিচার্ড ডকিন্সের ওপর কাজ না করলেও এটাও ঠিক সুজান ব্ল্যাকমোরসহ অনেকের মধ্যেই তো করেছে, এবং করেছে খুব ভালোভাবেই তারা নিজেরাই তা স্বীকার করেছেন। আর পারসিঙ্গারের দাবি অনুযায়ী, তার উদ্ভাবিত এ প্রক্রিয়ায় যদি ৮০ শতাংশের বেশি লোকের অপার্থিব অনুভূতি হয়েই থাকে, তবে বলতেই হয় ঈশ্বরানুভূতির মতো ব্যাপারগুলো হয়ত মস্তিষ্কের বাইরে নয়। পারসিঙ্গারের ভাষায[২২১], ঈশ্বর মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি করে নি, বরং মানুষের মস্তিষ্কই সৃষ্টি করেছে কথিত শক্তিমান ঈশ্বরের।

    .

    শেষ কথা

    আত্মা ব্যাপারটি মানুষের আদিমতম কল্পনা। এটি সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত নয় এবং আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে অপার্থিব আত্মার কল্পনা ভ্রান্তবিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। এ প্রবন্ধে আমরা খুব বিশদভাবে বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে আত্মা নামক ধারণাটিকে যাচাই করার চেষ্টা করেছি। এর থেকে যা বেরিয়ে এসেছে তা হলো আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোর সাথে ‘আত্মা’ নামক ব্যাপারটি একেবারেই খাপ খায় না। সোজা ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় আত্মার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ বিজ্ঞান পায় নি। আর যত দিন যাচ্ছে, আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণের আশা ক্রমশ রূপান্তরিত হচ্ছে দুরাশায়। বস্তুত স্নায়ুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, শরীরবিজ্ঞান, জেনেটিক্স আর বিবর্তন বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা আত্মাকে আক্ষরিক ভাবেই রঙ্গমঞ্চ থেকে হটিয়ে দিয়েছে। আর সেজন্যই যুগল-সর্পিলের (ডিএনএ) রহস্য ভেদকারী নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক বলেন[২২২], একজন আধুনিক স্নায়ু-জীববিজ্ঞানী মানুষের এবং অন্যান্য প্রাণীর আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য ‘আত্মা’ নামক ধর্মীয় ধারণার দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। ১৯২১ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন একই ধারণা পোষণ করে বলেছিলেন, ‘দেহবিহীন আত্মার ধারণা আমার কাছে একেবারেই অর্থহীন এবং অন্তঃসারশূন্য।

    কাজেই বিজ্ঞান মানতে হলে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী হওয়ার কোনো যুক্তিনিষ্ঠ কারণ নেই। প্রাচীনকালের মানুষেরা জন্ম-মৃত্যুর গূঢ় রহস্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান করতে না পেরে আশ্রয় করেছিল ‘আত্মা’ নামক আধ্যাত্মিক ধারণার বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা সেসমস্ত পুরনো এবং অসংজ্ঞায়িত ধ্যান ধারণাকে খণ্ডন করে দিয়েছে। আত্মার অস্তিত্ব ছাড়াই বিজ্ঞানীরা আজ মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর আচরণ, আচার-ব্যবহার এবং নিজের ‘আমিত্ব’ (self) এবং সচেতনতাকে (consciousness) ব্যাখ্যা করতে পারছে। এমনকি খুঁজে পেয়েছে ধর্মীয় অপার্থিব অভিজ্ঞতার বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় উৎস। আমাদের অভিমত হলো-প্রাণের অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য আত্মা একটি অপ্রয়োজনীয় এবং পরিত্যক্ত ধারণা, যেমনই আলোর সঞ্চালনকে ব্যাখ্যা করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের চোখে আজ ইথার একটি অপ্রয়োজনীয় এবং পরিত্যক্ত ধারণা। কিন্তু আত্মার সাথে ইথারের পার্থক্য হলো পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে ইথারকে হটানো সম্ভব হলেও আত্মাকে হটানো সম্ভব হয় নি, বরং আত্মা নামক পরিত্যক্ত ধারণাটিই আজও সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়। অস্তিত্বহীন আত্মার শান্তির জন্য মানুষ তাই কত কিছুই না করে! আর সাধারণ অসচেতন মানুষকে সম্মোহিত রাখতে এই আগাছার চাষকে পুরোদমে জনপ্রিয় করে রেখেছে তাবৎ ধর্মীয় সংগঠনগুলো, স্বীয় ব্যবসায়িক স্বার্থেই। তবে, এমন একদিন নিশ্চয় আসবে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবন মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার জন্য আত্মার দ্বারস্থ হবে না; আত্মার ‘পারলৌকিক শান্তির জন্য শ্রাদ্ধ-শান্তিতে কিংবা মিলাদ-মাহফিল বা চল্লিশায় অর্থ ব্যয় করবে না, মৃতদেহকে স্মশান ঘাটে পুড়িয়ে বা মাটিচাপা দিয়ে মৃত দেহকে নষ্ট করবে না, বরং কর্নিয়া, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয় প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যেগুলো মানুষের কাজে লাগে, সেগুলো মানবসেবায় দান করে দেবে (গবেষণা থেকে জানা গেছে, মানুষের একটিমাত্র মৃতদেহের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ২২ থেকে পঞ্চাশ জন অসুস্থ মানুষ উপকৃত হতে পারে[২২৩])। এছাড়াও মেডিক্যালের ছাত্রদের জন্য মৃতদেহ উন্মুক্ত করবে ব্যবহারিক ভাবে শারীরবিদ্যা শিক্ষার দু্যার। আরজ আলী মাতুব্বর তার মৃতদেহ মেডিক্যাল কলেজে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এক সময় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন[২২৪]–

    ..আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানব কল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমার মরদেহটির সাহায্যে মেডিক্যাল কলেজের শল্যবিদ্যা শিক্ষার্থীগণ শল্যবিদ্যা আয়ত্ত করবে, আবার তাদের সাহায্যে রুগ্ন মানুষ রোগমুক্ত হয়ে শান্তিলাভ করবে। আর এসব প্রত্যক্ষ অনুভূতিই আমাকে দিয়েছে মেডিক্যালে শবদেহ দানের মাধ্যমে মানবকল্যাণের আনন্দ লাভের প্রেরণা।

    সে অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে পরবর্তীকালে মেডিক্যালে নিজ মৃতদেহ দান করেছেন ড. আহমেদ শরীফ, ড. নরেন বিশ্বাস, ওয়াহিদুল হক, গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী, ফযেজ আহমদ, জ্যোতি বসু প্রমুখ। আমি যখন এ লেখাটি লিখছি সেই তারিখ অনুযায়ী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ এ তালিকায় নতুন এবং গর্বিত সংযোজন[২২৫]। সমাজ সচেতন ইহজাগতিক এ মানুষগুলোকে জানাই আমাদের প্রাণের প্রণতি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleভালোবাসা কারে কয় – অভিজিৎ রায়
    Next Article রহু চণ্ডালের হাড় – অভিজিৎ সেন

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }