Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প175 Mins Read0

    ২১-২৫. ঘনজঙ্গলের মধ্যে

    পাথরটা ছেড়ে, ছোটো ছোটো টিলাটা থেকে নেমে ওরা ঘনজঙ্গলের মধ্যে পিচ-বাঁধানো পথে এসে পড়ে ইন্দ্রজিত্ত্বাবুর বাড়ির দিকে এগোল।

    চলতে চলতে অরা বলল, একটা কথা ভেবে আমি অবাক হই। যৌবনের যেসব দুরন্ত কামনার দিনগুলিকে তুমি পেছনে ফেলে এসেছ, নিজেকে যেভাবে সংযত, সংহত করেছ, তা মনে করলেই আমি আজও অবাক হই। তবে একটা কথা তোমারও স্পষ্ট করে জানা দরকার। কষ্ট আমারও কিছু কম হয়নি। পুরুষেরা ভাবে এসব ব্যাপারে শারীরিক কষ্ট বুঝি শুধু পুরুষদের-ই। মেয়েদের কষ্টও কি কম? তাদের বুঝি কষ্ট হয় না, নিজেকে সহজ সুখের দুয়ার থেকে বারে বারে ফিরিয়ে আনতে? পরমপ্রিয় মানুষকে বারে বারে না, না, না’ বলতে।

    একটু চুপ করে থেকে বলল, অগ্নি তুমি যে, আমার জন্যে অনেক এবং অনেকরকম কষ্ট পেয়েছ, তা আমি অস্বীকার করি না। তোমাকে আমি বুঝি। আমার একমাত্র অনুরোধ যে, তুমিও আমাকে বোঝো একটু। আমরা যে, সাধারণ নই, অসাধারণ, এ কথা জেনে আমাদের দু-জনেরই গর্বিত হওয়ার কথা। নিজেদের বঞ্চনা করার মধ্যে যে, এক গভীর আনন্দ আছে। তা সহজ প্রাপ্তির মধ্যে নেই, কোনদিন-ই ছিল না। তোমার সঙ্গে শরীরী সম্পর্ক হলে আশিসের স্মৃতির কাছে তো বটেই আমরা আমাদের দুজনের কাছেই ছোটো হয়ে যেতাম, নাকি? আমাদের এই পারস্পরিক বঞ্চনার শিকার করতে পারার জন্যে আমাদের নিজেদের অভিনন্দিত করা উচিত।

    একটু থেমে অরা আবার বলল, আমি তোমাকে আমার চিঠিতেও একথা বলেছি, তুমি যদি অন্য কোনো নারীর সঙ্গে তোমার শরীরের সুখের জন্যে শারীরিক সম্পর্ক করো কোনোদিন, আমি কিছুই মনে করব না। সত্যিই বলছি, একটুও মনে করব না।

    তারপর-ই বলল, অপাই তো তোমার প্রেমে পাগল। তা ছাড়া, ওর হাবে-ভাবে মনে হয় ওর স্বামী যতই ধনী, মানী ও ভালোমানুষ হন-না কেন, শারীরিকভাবে ওকে সুখী করতে পারেননি উনি একটুও। স্ত্রীকে উনি বোঝেন না একটুও। মেয়েদের মন আর ক-জন পুরুষ বোঝে। অধিকাংশ পুরুষের কাছে মেয়েদের শরীরটাই সব। মাঝে মাঝে ভারি দুঃখ হয়।

    –আর নিজের জন্যে হয় না?

    –না। আমার জীবনে কোনো যে, অসাধারণ সাধারণের দুঃখ তাই আমাদের বাজে না।

    –তুমি কী করে বুঝলে?

    অগ্নি অবাক হয়ে বলল।

    –মেয়েরা অনেক কিছুই বোঝে যা, তোমরা বোঝো না। তা ছাড়া, ও যে, মা হতে পারেনি তারজন্যে ও নিজে দায়ী নাও হতে পারে। এখন মা হওয়ার সময় হয়তো আর নেই কিন্তু শারীরিকভাবে আনন্দিত হওয়ার সময় তো ওর শেষ হয়ে যায়নি।

    .

    ২২.

    –অরার জন্যে পোলাও-এর চাল নিয়ে এসেছি। ওঁর এক জুনিয়র চুঁচুড়া থেকে এনে দিয়েছিলেন। ভাবলাম এঁচড় নিয়ে যাই। গাছ-পাকা। ভালো গাওয়া ঘিও এনেছি। তা দিয়েই রাঁধব।

    –সবাই-ই এত ভুলে যাচ্ছে কেন? ব্যাপারটা কী ঘটছে এখানে?

    নরেশ-ই বলল।

    ব্রতীন বলল, একেই বলে প্রকৃতির অভিঘাত।

    –প্রকৃতির অভিশাপের কথা শুনেছি, অভিঘাতটা আবার কী জিনিস? এত কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ ব্যবহার করিস যে, টেনশান হয়ে যায়। হচ্ছিল এঁচড় আর পাউরুটির কথা, তারমধ্যে হঠাৎ ‘অভিঘাত’ এনে ফেললি কেন?

    –তোর দৌড় তো এঁচড় অবধিই। এঁচড়েই থাক।

    –এঁচড় তো আর পচবে না। কোথায় আছে বলুন বউদি আমি উদ্ধার করি।

    নরেশ বলল।

    –ভালো গাওয়া ঘি এনেছ আর কাল রাতে খিচুড়ির সঙ্গে দিলে না? গাওয়া ঘি দিয়ে খিচুড়ি রাঁধলে তার স্বাদ-ই তো অন্যরকম হত।

    ঘোষ সাহেব অভিযোগের সঙ্গে বললেন।

    অরা বলল, ঠিক আছে। কাল কী পরশু, আমি নিজে হাজারিবাগী ভুনিখিচুড়ি বেঁধে খাওয়াব সবাইকে। আমার মায়ের কাছে শেখা।

    তৃষা বলল, মা! তোমরা সকলে এমন খাওয়া খাওয়া করে, খেপে গেলে কেন বলো তো? চলো তাড়াতাড়ি স্নান করে তৈরি হয়ে আমরা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশন আর চাট্টি নদীটা আগে দেখে আসি।

    ব্রতীন বলল, রাঁচি যেতে আসতে গাড়ির কতক্ষণ লাগবে?

    –খুব বেশি হলে দেড় ঘন্টা।

    বলেই ব্রতীন বলল, নরেশ, আমরা সকলে ফিরে এলে তুই-ই চলে যা, একটা গাড়ি নিয়ে। সেখানে পারফেক্ট আইস-এর দোকান নিশ্চয়ই পাবি। পাউরুটি, যদি আরও লাগে। সসেজ, সালামি, বেকন আর বরফ নিয়ে আয় গিয়ে। বেশি বরফ না হলে ভদকাটা জমবে না।

    ঘোষ সাহেব বললেন, রাঁচি যদি যাবেন-ই তাহলে আমিও যাব। পথের ওপরেও মাছ নিয়ে বসে অনেক মাছওয়ালা। রাঁচি হাইকোর্ট-এ মামলা করতে এসে দেখেছিলাম গত মাসেই। তাহলে মাছও নিয়ে আসব।

    অপালা বলল, সত্যি! তুমি কি এখানে খেতেই এসেছিলে? তা ছাড়া, তোমাকে রাঁচি পাঠাতে আমার ভয়ও করে। মেন্টাল অ্যাসাইলাম-এ ভরে দিলে!

    অরা বলল, এই অপা। কী বাজে ইয়ার্কি হচ্ছে।

    ঘোষ সাহেব অপার কথাতে কান না দিয়ে বললেন। বাঃ রে। আমি একা খাব কেন? ছেলেমেয়েগুলো মাছ ছাড়া খেতে পারে নাকি?

    রুরু আর তৃষা সমস্বরে বলল, বাঃ। নিজেদের দোষ আমাদের ঘাড়ে কেন চাপাচ্ছেন মেসোমশাই?

    অপালা বলল, দেখ তৃষা, তোরা, তোদের মেসোমশাইকে। মানুষটা এইরকম-ই।

    সকলে দু-তিন কাপ করে চা খেয়ে, স্নান করে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ঘুরে দেখবার জন্যে বেরিয়ে পড়ল। একটু চাপাচাপি হল বটে কিন্তু মুখার্জিবাবুকে ওদের গাড়িতে নিয়ে নিল ব্রতীন। স্টেশনে গিয়েই অবশ্য নামিয়ে দেবে মহুয়া সংগ্রহের জন্যে। এখানের দ্রষ্টব্য স্থান তো ব্রতীন-ই জানে। সেই গাইডের কাজ করবে।

    –আমরা দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে হাটে যাব। কী বলেন মুখার্জিবাবু?

    –হ্যাঁ স্যার। হাট জমতে জমতে তো বিকেল চারটেই হয়ে যায়।

    –চার্চ, ক্লাব, স্টেশন, বুথস ফার্ম, হাটের পথ, এবং চাট্টি নদীতে নিয়ে যাব আপনাদের।

    –কঙ্কা, লাপরা আর সোডি এই তিন গ্রাম নিয়ে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। ব্রতীন বলল।

    –তুই জানলি কী করে?

    –‘একটু উষ্ণতার জন্যে’ পড়ে। ওই বইটা পড়লে এই জায়গা সম্বন্ধে তোর অজানা কিছুই আর থাকবে না।

    –এতই যদি ভালোবাসা তাহলে লেখক নিজের বাংলো বিক্রি করে দিলেন কেন?

    নরেশ বলল।

    ঘোষ সাহেব বললেন, ‘আ রাইটার শুড নেভার বি টায়েড ডাউন টু ওয়ান প্লেস।

    –সেটা অবশ্য খুব দামি কথা। সেইজন্যেই হয়তো উনি অমন সুন্দর বাংলোটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

    .

    ২৩.

    অগ্নিভর ফ্ল্যাট। সকালবেলা। অগ্নিভ ব্রতীনের সঙ্গে টেনিস খেলে ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট করছে। দু-জনে।

    অগ্নি বলল, আজ কি তোর কিছু কাজ আছে জরুরি।

    –আমার আবার কাজ কী? ছোটোমামিমাকে একবার দেখতে যেতে হবে। সে বিকেলে গেলেও হবে। বয়স হয়েছে পঁচাত্তর। তার ওপর টার্মিনাল কেস।

    –কী? ক্যান্সার?

    –তা ছাড়া কী? এখন তো একটাই রোগ। মুম্বাইতে টাটা ইনস্টিটিউটে-ও দেখিয়ে এনেছে। মাসতুতো দাদা। এখনও কেমো চলছে। তবে হয়তো আর মাসখানেক আছেন। চোখে দেখা যায় না। কী রূপসি মহিলার কী অবস্থা! কেমো করে করে সব চুল পড়ে গেছে। দেখলে ভয় করে। ওঁর নিজের মনেও এখন মৃত্যুভয় এসেছে। চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায়। সবসময় জোরে টিভি চালিয়ে বসে থাকেন। একা থাকতে ভয় পান।

    ব্রতীন বলল, সকলের-ই তো একসময়ে, এই মৃত্যুভয় আসেই। তবে জরাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। কত তাবড়-তাবড় মস্তানদের চোখের সামনে জরা-কবলিত হতে দেখলাম। জীবনে কোনো যুদ্ধেই না-হারা সব মানুষ–জরার কাছে হেরে গেলেন বিনা প্রতিবাদে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, জরাই তাঁদের হারিয়ে দিল হ্যাঁণ্ডস ডাউন।

    ব্রতীন বলল, তোর লা দোলচে ভিতা’ ছবিটার কথা মনে আছে অগ্নি?

    –ফেলিনি না আন্তোনিওনি কার যেন ছিল ছবিটা।

    –কার ছবি সেটা অবান্তর। ছবিটা আন্তোনিওনির তাতে একটা আইডিয়া ছিল সেটা আমার মনে গেঁথে আছে। আজকের ছবি তো নয়, প্রায় চল্লিশ বছর আগের ছবি। ফিলম ক্লাবে দেখেছিলাম সরলা মেমোরিয়াল হল-এ।

    –আইডিয়াটা কী? –”To die with a bang and not with a whimper”.

    –মানে, দুম করে শব্দ করে মরে যাও–কুকুরের মতো কঁকিয়ে কেঁদে মোরো না।

    –আর্নেস্ট হেমিংওয়েও এ কথা বিশ্বাস করতেন। তাই তো তাঁর জীবনে তাঁর মনোমতো বাঁচা যখন আর হল না, উনি আত্মহত্যা করে মারা গেলেন।

    –আত্মহত্যা করাটা কাপুরুষের কাজ।

    –আমার কিন্তু তা মনে হয় না।

    –কেন মনে হয় না?

    –আমার তো মনে হয়, যাঁরা এই সুন্দর পৃথিবী থেকে অমন দুম করে চলে যেতে পারেন, নিজেদের জীবন নিজে হাতে নিভিয়ে দিতে পারেন, তাঁরা অসীম সাহসের অধিকারী।

    তারপর বলল, আমি আন্তোনিওনির একটি লেখা পড়েছিলাম। তাঁর অধিকাংশ নায়ক নায়িকাই আত্মহত্যা করে কেন মারা যান এই প্রশ্নর উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ “If life is a gift of God, the right to take it away is also a gift of God”.

    –তাই?

    –তোকে একটু কাসুন্দি দিই? বেকন আর হ্যাম মাস্টার্ড ছাড়া জমে না। ইটালিয়ান মাস্টার্ড হলে তো কথাই নেই।

    –ছাড় তো। ওসব সাহেবব্যাটাদের রটনা। নিজেদের দেশে মাস্টার্ড হয় না বলেই ইটালির মাস্টার্ড-এর প্রয়োজন পড়ত ওদের। আমাদের কাসুন্দির কোনো বিকল্প আছে?

    –তুই কি রোজ-ই এসব খাস নাকি?

    –না, না। প্রতি শনি-রবিতে খাই। হ্যাম, বেকন, ডিমের পোচ, কড়কড়ে করে টোস্ট করা গার্লিক ব্রেড আর কাসুন্দি। সঙ্গে মাখন আর অরেঞ্জ মার্মালেড।

    –বয়স তো ষাট হবে শিগগির আমাদের। এখন এত ডিম খাওয়া কি উচিত?

    –আরে সেদিন সি.সি.এফ.সি.-তে পি বি দা আর চুনীদার সঙ্গে কথা হচ্ছিল।

    –কে, পি বি দা?

    –আরে পি বি দত্ত, ক্রিকেটার। আর চুনীদা মানে চুনী গোস্বামী–ফুটবলার এবং ক্রিকেটারও।

    –কী বললেন ওঁরা?

    –বললেন, ব্রতীন দিনে দুটো করে ডিম খাবি। এরকম প্রোটিন আর নেই। ওঁরা দুজনেই আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক-ই বড়ো।

    ব্রতীন বলল, আমার বাবা বলতেন গ্রামে-গঞ্জে হিন্দু-মুসলমানেরা ইকুয়ালি পুত্তর। কিন্তু তাদের বেসিক ডায়েটে একটাই ডিফারেন্স।

    –কী?

    –মুসলমানেরা পেঁয়াজ, রসুন এবং লঙ্কা হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি খায়। এগুলো, বলতে গেলে Staple Food ওঁদের কাছে। একজন মুসলমান কৃষক বা শ্রমিক যত পরিশ্রম করতে পারে একজন হিন্দু কৃষক ও শ্রমিক তা কখনোই পারে না।

    তারপর বলল, তুই কি জানিস যে, ভারতবর্ষে যতগুলো বন্দর আছে সেইসব পোর্টে যারা মজুরের কাজ করে, মাল তোলা এবং মাল খালাসের কাজ, তারা সবাই-ই মুসলমান?

    –তাই নাকি?

    –হ্যাঁ তাই।

    –তাদের দুপুরের খাদ্য হচ্ছে ক-টি আটার রুটি আর প্রচুর পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা এবং একটু আচার। আচারটুকুই বিলাসিতা।

    –এটা তো জানা ছিল না।

    –অনেকেই জানেন না, শুধু তুই কেন?

    তারপর বলল, ব্রিটিশ আর্মিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে বার্মা ফ্রন্টে একজন জেনারেল ছিলেন, তাঁর নাম জেনারেল উইংগেট। তাঁর স্টেপল-ফুড-ই ছিল কাঁচা পেঁয়াজ। তাঁর বড়ো বড়ো পকেট ভরতি পেঁয়াজ থাকত। তাঁর সৈন্যদল এমন এমন সব অবিশ্বাস্য কান্ডমান্ড ঘটিয়েছিলেন যে, আর্মি ডোকাব্যুলারিতে তাঁর ব্রিগেডের নাম হয়ে গেছিল ‘উইংগেটস সার্কাস’। আমি তো আমার বাবাকে অনুসরণ করে সকালে একটি এককোয়া রসুন মুড়ি দিয়ে খাই-ফাস্ট থিং ইন দ্যা মর্নিং, তারপর চা। আর দুপুরের ও রাতে খাওয়ার সময়ে দু-কোয়া

    রসুন ঘি দিয়ে ভাজা, দু-টি করে কাঁচালঙ্কা এবং একটি গোটা এবং সদ্য ছাল ছাড়ানো কাঁচা পেঁয়াজ।

    –সম্ভবত এইজন্যেই তাকে কোনো মেয়ে চুমু খেতে চায় না।

    অগ্নি বলল।

    –তা না চাক কিন্তু তুই নিশ্চয়ই স্বীকার করবি যে, আমার বয়সের তুলনাতে আমি শরীরে মনে অনেকের চেয়ে বেশি ইয়াং আছি।

    –হুঁ। সেইটাই তো ভয়। ম্যাকলাস্কিগঞ্জে অপালা তোর দিকে যেমন ঝুঁকেছিল তা দেখে তো তোর মন্ত্রগুপ্তিটি কী, তাই জানতে ইচ্ছে করছিল।

    –অপালা ভারি ভালো মেয়ে। বাজে কথা বলিস না।

    –আমার কাছে তো, মেয়েমাত্রই ভালো।

    –তুই তো, একজনে সমর্পিত মন-প্রাণ ঋষিকুমার। দেহিপদবল্লভ মুদারম। তুই দেবতা। মানুষ নোস।

    –আমরা প্রত্যেকেই দেবতা। তুই তোর দেবত্বকে উপলব্ধি করিসনি বা করার চেষ্ট করিসনি, তাই এ-কথা বলছিস।

    –যাক এসব ভারী ভারী কথা। আমার কাজ আছে কি না জিজ্ঞেস করছিলি কেন?

    –না, তাহলে রবীন্দ্রসদনে গিয়ে ব্রাত্য বসুর ছবিটা দেখে আসতাম।

    ব্রতীন বলল, আইনক্স-এ গিয়ে ব্ল্যাক দেখতাম। OH Kolkata-তে একদিনও খাওয়া হয়নি–ওখানে বাঙালি খাওয়াটাও খেয়ে নেওয়া যেত।

    –না। আইনক্সও যাব না। ’OH Kolkata’-তেও যাব না।

    –কেন?

    –ওদের নিয়ে এখনও যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

    -–বাবাঃ। এটা বাড়াবাড়ি। ওদের মানে, তৃষা রুরু অরা?

    –হ্যাঁ। তবে এটা বাড়াবাড়ি নয়। যেখানে পরিবার নিয়ে সকলে যায় সেখানে একা একা যেতে বড়ো স্বার্থপরের মতো মনে হয়।

    –তবুও যদি তোর নিজের পরিবার হত।

    –নিজের না হলেও নিজের-ই মতো তো।

    –যাক, এ নিয়ে আমি আর কিছু বলব না। আজকে জেদাজেদি করে রোদের মধ্যে চারটি সেট টেনিস খেলে ফেলেছি। ক্লান্ত লাগছে। আফটার অল, বয়স তো হয়েছে।

    –আমার সঙ্গে তো মাত্র দু-সেট খেললি। আর দুটো কার সঙ্গে খেললি?

    -–কেন? বিয়ান্দকারের সঙ্গে। খুব ভালো খেলে ও। যৌবনে তো কমপিটিটিভ টেনিসও খেলত।

    –তাই?

    –হ্যাঁ।

    –আজ বাড়ি গিয়ে শাওয়ারের নীচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে খুব ভালো করে চান করব। তারপর দু-বোতল বিয়ার খাব। তোর সনাতনের দোকান থেকে মঙ্গল বড়ো বড়ো কই মাছ এনেছে। কালোজিরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে তেল-কই করতে বলেছি। আজকাল তো, দেশি মাথা মোটা বড়ো কই পাওয়াই যায় না। জানি না আজ কী করে পেয়ে গেল। খাবি তো চান করে চলে আয়।

    -নাঃ। আজ যাব না।

    –কী করবি?

    –অনেকগুলো চিঠি লিখতে হবে নাগপুরে।

    –নাগপুরে কি তোর অন্য কোনো হার্টথ্রব আছে নাকি?

    –না তা নয়। তবে কর্মজীবনের অতগুলো বছর তো নাগপুরেই কাটালাম।

    –বন্ধু ও পরিচিত তো কম নেই।

    –পুরুষ না স্ত্রী?

    –দুই-ই আছেন। অনেকগুলো চিঠি পেয়েছি গত একমাসে, একটারও উত্তর দেওয়া হয়নি।

    –এই মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের দিনে এত চিঠি লেখে কোন ব্যাকডেটেড মানুষেরা?

    –চিঠি লেখা ব্যাপারটা সকলের-ই আয়ত্তাধীন নয়। ভালো চিঠি লেখা তো নয়-ই! যাঁরা ভালো চিঠি লিখতে পারেন তাঁরা চিরদিন চিঠিই লিখবেন।

    –আই বেগ টু ডিফার।

    ব্রতীন বলল।

    –অতসময় নষ্ট করাটা আজকাল মূখামি বলেই গণ্য হওয়া উচিত।

    –ব্যাপারটা তর্কের নয়। আই বেগ টু ডিফার অ্যাজ ওয়েল।

    –তুই তো কফি খাবি?

    –না চা।

    –চন্দন চা নিয়ে এসো।

    আনছি বাবু।

    চা নিয়ে এলে দু-জনেই চা-ই খেল। তারপর ব্রতীন উঠে পড়ে বলল, তাহলে চলি আজকে, ফোন করিস। দুই ব্যাচেলারের আরও একটি অলস দুপুর শুরু হবে একটু পর থেকে। আজ খুব ঘুমোব আমি। তারপর সন্ধেবেলা ছোটোমামিকে দেখে বাড়ি ফিরে আসব। নরেশটা আসতে পারে। তোর যদি কোথাও যাবার না থাকে এবং চিঠি লেখা শেষ হয়, তবে চলে আসিস। জুবিলি স্টোরস-এর পল্লব একটা ব্ল্যাক টিচার্স দিয়েছে পরশু।

    –দিয়েছে মানে? প্রেজেন্ট করেছে?

    –প্রেজেন্ট কখনো-সখনো করে না-যে, তা নয় কিন্তু রোজ প্রেজেন্ট করলে তো ওর দোকান-ই উঠে যাবে। ওর দোকানের মতো পুরোনো এবং ভালো মদের দোকান কলকাতাতে তো কম-ই আছে।

    –কালো টিচার্স, কথাটার মানে বুঝলাম না।

    –টিচার্স তো সাদাই খেয়েছিস। এই কালোটা নতুন বেরিয়েছে।

    –গুড।

    –চানচানির বাড়ি খেয়েছিলাম। যদি রাতে আসিস তো খাওয়াব। সেলিম বাখখরখানি রুটি আর গুলহার কাবাব পাঠিয়েছে। তার ছেলের জন্মদিন আজকে।

    –তা দিয়ে ডিনারও খেতে পারিস এলে।

    তারপর বলল, বুঝলি, একটা সময় পর্যন্ত সংসার করলাম না বলে মাঝে মাঝে দুঃখ হত। এখন মনে হয়, যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা প্রতিপালনের পরে রিটায়ার করার পরেও এমন কাপ্তানি করে কি জীবনটা কাটাতে পারতাম?

    –জীবনের আসল অধ্যায়-ই তো এখনও বাকি আছে।

    –সেটা কী?

    –শেষজীবন। সেটা যে, ‘ওল্ড এজ-হোম’-এই কাটবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? চিরটাজীবনই কি এমন হরিণের মতো লাফিয়ে বেড়াতে পারব?

    –সে তখন দেখা যাবে।

    –আসবি?

    –দেখি। বড়ো বহির্মুখী হয়ে উঠেছি আমি সাম্প্রতিক অতীত থেকে। এমনিতে আমি খুব-ই অন্তর্মুখী মানুষ, যদিও কুনো যাকে বলে তা নই। রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা আছে না?

    বলেই গেয়ে উঠল, “বাহির পথে বিবাগী হিয়া কীসের খোঁজে গেলি, আয়, আয়, আয় রে ফিরে আয়। পুরানো ঘরে দুয়ার দিয়া ছেঁড়া আসন মেলি বসিবি নিরালায়, আয়, আয় রে ফিরে আয়।”

    –বাঃ। ছেলেবেলা থেকে তোর গানটাকেই প্রফেশান করা উচিত ছিল। এঞ্জিনিয়র তো লক্ষ লক্ষ আছে।

    তারপর বলল, আজকাল তো কত মানুষের গান-ই শুনি। শিল্পীর ভিড়ে তো পথ চলাই দায়। কিন্তু ক-জনের গলাতে সুর লাগে বল? এখন গান শোনা একটা অত্যাচার হয়ে উঠেছে। মন ভরে না। তুই যে, কেন একটা সিডি করিস না।

    অগ্নি হেসে বলল, আগে হলেও-বা কথা ছিল। এখন দেশে ক্যাসেট আর সিডি-র বন্যা হয়ে যাচ্ছে। কে না করল সিডি? তাদের সঙ্গে নিজেকে একাসনে বসাতে রাজি নই আমি। এই বেনোজল নেমে যাক, যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকি তো এ নিয়ে ভাবা যাবে।

    –বয়স হয়ে গেলে গলা কি এরকম থাকবে?

    ভীমসেনজির গান শুনলাম সেদিন সানি টাওয়ার্স-এর জয়ন্ত চ্যাটার্জির ওখানে। আশি তো পার করেছেন কবেই কিন্তু এখনও কী গলা!

    –ভাবাই যায় না। ঈশ্বরের কৃপাতে কারও কারও গলা বয়স যত বাড়ে, ততই ভালো হয়।

    –এই তোর এক রোগ। তোর মতো আধুনিক একজন বিজ্ঞানী যে, কেন ঈশ্বর ঈশ্বর করিস তা বুঝতে আমার বড়োই অসুবিধে হয়।

    –ব্যাপারটা সকলের বোঝার নয় রে ব্রতীন। এ-বাবদে আমরা না হয়, ভিন্নমত-ই পোষণ করলাম। তাতে আমাদের বন্ধুত্বটা অটুট থাকবে। ভগবান’ মানে, দেবদেবীর কথা আমি বলিনি। বলেছি, এক সুপিরিয়র ফোর্স-এর কথা। অনেক নোবেল-লরিয়েট বিজ্ঞানীও আমার ই মতো ঈশ্বর বিশ্বাসী। এ-নিয়ে আলোচনা শুরু করলে দিন-রাত কেটে যাবে।

    –তাহলে একদিন, দিন স্থির কর। নরেশটাকেও ডাকব। ও তো প্রতি শনিবারে দক্ষিণেশ্বরে যায়, বছরে একবার তিরুপতিতেও। অথচ ছাত্র ছিল ফিজিক্সের।

    –ডাকিস। ওর বিশ্বাসের রকম আর আমার বিশ্বাসের রকমটা আলাদা।

    ব্রতীন উঠে পড়ে বলল, আমার বিশ্বাসেরও।

    ব্রতীন চলে গেলে এক ঘুম দিয়ে উঠে, চা খেয়ে স্নান করে অগ্নি লেখার টেবিলে বসল চিঠি লিখতে। নাগপুরে অনেকগুলো চিঠি লেখার ছিল কিন্তু প্রথমে সে, অরাকে চিঠি লিখতে বসল।

    বহুদিন চিঠি লেখে না অরাকে।

    টালিগঞ্জ

    কলকাতা

    শনিবার

    অরা,

    কল্যাণীয়াসু,

    বহুদিন বাদে গতকাল ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে গেছিলাম। আমার এখনকার নিরবচ্ছিন্ন আসরে মাঝে মাঝেই ন্যাশানাল লাইব্রেরির রিডিং রুম-এ গিয়ে একটু পড়াশোনা করি। বলাই বাহুল্য যে, ‘প্রেমচাঁদ’ বৃত্তি পাব বলে করি না, করি, নিজের মনের ও মানসিকতার ওপরে যে, ধুলোর আস্তরণ জমে প্রাত্যহিকতার সাধারণ্যে, যাই, তার-ই কিছুটা পরিষ্কার করতে।

    সেদিন রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’র তৃতীয় খন্ডে পড়ছিলাম যে, লাইব্রেরি’ সম্বন্ধে তিনি লিখেছেনঃ “বিদ্যুতকে মানুষ লোহার তারে বাঁধিয়াছে কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে। কে জানিত, সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে। কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে। অতলস্পর্শ কাল সমুদ্রর উপর একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিবে।”

    কি সত্যি কথা বলো?

    ম্যাকলাস্কিগঞ্জের ঘোর এখনও কাটেনি। প্রকৃতির প্রভাব যে, আমাদের জীবনে কতখানি, তা প্রকৃতির মধ্যে না গেলে বোধ হয় বোঝা যায় না। ছিন্নপত্রাবলীতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: “প্রকৃতির মধ্যে, মানুষের মধ্যে আমরা আনন্দ কেন পাই? সে আনন্দ যতই ক্ষুদ্র, যতই চঞ্চল হোক।

    এর একটি মাত্র সদুত্তর আমাদের উপনিষদেই আছে। আনন্দধ্বেব ঋদ্ধিমানি ভূতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জানি জীবন্তি, আনন্দং প্রযু্যভিসংবিশন্তি। এ কথা নিজে না বুঝলে কাউকে বোঝাবার যো নেই।”

    তাইতো আমরা গাই “জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ, ধন্য হলো ধন্য হলো মানবজীবন।”

    আমাদের উপনিষদে ‘মায়াবাদ’ প্রসঙ্গে সালম্বন ভ্রম এবং নিরালম্বন ভ্ৰম-এর কথাও আছে। সালম্বন ভ্রম হচ্ছে illusion তুমি জানলেও জানতে পারো। এখন বুঝি, তোমার আমার প্রেম হচ্ছে একটি বিশুদ্ধ সালম্বন ভ্রম।

    তুমি কী বলে?

    ইতি–অগ্নি

    চিঠিটা লিখে ফেলতে পেরে খুব হালকা বোধ করল অগ্নি নিজেকে। নিজের মন যখন গ্রীষ্মদিনের ধুলোর মধ্যে ছটফট করা চড়াইপাখির মতো অশান্ত হয়ে ওঠে তখন অরার কথা ভাবলে, অরাকে চিঠি লিখতে পারলে, সেই অশান্ত মন শান্ত হয়ে যায়। চুমু-থেরাপিরই মতো এই চিঠি-থেরাপি।

    ফোনটা বাজল এই সময়ে, নাগপুরের চিঠিগুলি শুরু করার আগেই। মনে মনে বিরক্ত হল অগ্নি।

    –ইয়েস।

    –আমি অপা বলছি।

    –’অপা’ মানে, অপালা?

    –হ্যাঁ।

    –বাবাঃ। আমার কী সৌভাগ্য!

    –আপনার সৌভাগ্য না আরও কিছু। সৌভাগ্য তো আমার।

    –তাই?

    –নয়তো কী? কী করছেন এখন?

    –এই! চিঠি লিখছিলাম।

    –কাকে? অরাকে?

    –না, নাগপুরের বন্ধুবান্ধবদের।

    –শুনেছি নাগপুরের আশেপাশে অনেক জঙ্গল আছে। একবার নিয়ে চলুন-না আমাদের। আমার জঙ্গল খুব ভালো লাগে।

    –গেলেই হল। আগে থাকতে আমাকে জানালেই হবে।

    –কোথায় কোথায় যাওয়া যায়?

    –কত জায়গাতে। চন্দ্রপুরের কাছে আন্ধারী তাড়োবা টাইগার প্রোজেক্ট আছে। দারুণ। সেখানে অনেক ভূত-গাছ আছে।

    –ভূত-গাছ? সেটা আবার কী?

    –হ্যাঁ। সত্যিই বলছি। যে জানে না, সে অন্ধকার রাতে ওই গাছ দেখলে হাত-পা ছড়ানো ভূত ভেবে ভিরমি খাবে।

    –গাছগুলোর নাম-ই ভূত গাছ?

    –ইংরেজি নাম Karu Gum trees-এ অন্য জায়গাতেও আছে। তবে কম।

    –অন্য কোন জঙ্গলে?

    –আমি পূর্ব-ভারতের জঙ্গলের কথা বলতে পারব না। আমার তো এদিকের জঙ্গল তেমন দেখা নেই। তোমাদের দৌলতে, আসলে ব্রতীনের-ই দৌলতে ঝাড়খন্ডর। ম্যাকলাস্কিগঞ্জ দেখা হয়ে গেল।

    –নাগপুর থেকে আর কোন জঙ্গলে যাওয়া যায়?

    –নাগজিরাতে। সাতপুরা রেঞ্জের গোখুরি হিলস-এর নাগজিরা। সেও দারুণ জঙ্গল। নাগপুরের কাছেই সাতপুরা রেঞ্জ-এই আছে পেঞ্চ ন্যাশানাল পার্ক। পেঞ্চ নদী বয়ে গেছে মধ্যপ্রদেশ আর মহারাষ্ট্রের মধ্যে দিয়ে। দু-রাজ্যের জঙ্গল-ই দেখার মতো। নাগপুর থেকে একটু দূরে, এই শ তিনেক কিমি দূরে আছে মেলঘাটের জঙ্গল। চিকলধারা হিল স্টেশান। আর সেখান থেকে নেমে সেমাডোহ হয়ে সমতলের জঙ্গল।

    –বাবাঃ আপনি কত জায়গাতে গেছেন!

    –কত মানুষে কত জায়গাতে যায়। আফ্রিকা, আলাস্কা, আন্টার্কটিকা, সি-ক্রইজ, লাক্সারি বোট-এ করে, মানস সরোবর। আমি তো শুধু কিছু জঙ্গলেই গেছি।

    –কাল কী করছেন?

    –কাল? কাল কী বার?

    –বারও ভুলে গেছেন? মাস ও বছর মনে আছে তো?

    –মনে পড়েছে। কাল রবিবার। কিন্তু কেন? কাল কী?

    –আপনি সন্ধেবেলা বাড়িতে থাকবেন?

    –কেন বলুন তো? হঠাৎ।

    –বলুন নয়, বলো বলুন। অরাকে তো তুমিই বলেন।

    –ও। সে তো অভ্যেস হয়ে গেছে।

    –এটাও অভ্যেস করে ফেলুন। মানে, আমাকে তুমি বলাটা।

    –বেশ। তাই না হয় বলব। কিন্তু কাল সন্ধেবেলা কী হবে?

    –আপনার কাছে আসতে চাই।

    –ঘোষ সাহেবও কি আসবেন?

    –না। তিনি তো আজ দিল্লি গেছেন সুপ্রিমকোর্টে মামলা নিয়ে। ফিরবেন সেই মঙ্গলবার।

    –ও। তুমি একাই আসতে চাও?

    –হ্যাঁ। একাই। অরাকে জানাবেন না কিন্তু।

    তারপর বলল, আপনাদের ঘোষ সাহেব কলকাতাতে ফিরলে বাড়িতে একটা পার্টি দেব। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের দলের সকলকে ডাকব সেদিন। মানে, আপনার দুই বন্ধুকেও।

    –বাঃ। সে তো উত্তম কথা। কিন্তু কাল রাতে, মানে সন্ধেতে কী হবে?

    –হতে পারে অনেক কিছুই। গিয়েই না হয় ঠিক করব। আমরা দুজনে বাইরে কোথাও খেতেও যেতে পারি। নইলে আপনার বাড়িতেই বসতে পারি। আমি আর আপনি ছাড়া আর কেউ থাকবে না কিন্তু।

    –আমার চন্দন। সে যে, আমার লোকাল গার্জেন? অন্ধের নড়ি।

    –তাকে সিনেমা দেখতে পাঠিয়ে দেবেন।

    –বাঃ বাঃ। এ তো, রীতিমতো রাহস্যময় ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। এ তো দেখছি। রুরুর, চুমকির আঙ্গাপাঙ্গা দেখার মতোই রহস্যময় ব্যাপার।

    –সেটা আবার কী?

    –এই রে। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। তবে বলব কখনো।

    –সব ব্যাপারে ঠাট্টা ভালো লাগে না আমার। আঙ্গাপাঙ্গা দেখা। সেটা আবার কী?

    –আমারও নয়।

    –কী?

    –সব ব্যাপারে ঠাট্টা।

    –এখন বলুন আমি আসব কি না। আবারও বলছি, আর কেউই যেন চলে না আসে তা দেখতে হবে কিন্তু।

    -ঠিক আছে। চন্দনকে বাইরে পাঠিয়ে দরজা লক করে দেব।

    –ল্যাণ্ডলাইনের রিসিভার নামিয়ে রাখতে হবে। মোবাইলও অফ করে রাখতে হবে।

    –বেশ তাও না হয় করব। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার। হবেটা কী বলো তো?

    –গিয়েই বলব।

    –বেশ

    -কালকে আবার সকালে ফোন করে ক্যানসেল করে দেবেন না তো?

    –আমি কথা দিলে আমার ডেডবডিও কথা রাখে।

    –বাঃ। চমৎকার। তবে ওসব মরাটরার কথা ভালো লাগে না, আমার একেবারেই।

    –আজ রাতে উত্তেজনাতে আমার ঘুম হবে না। কালকের কথা ভেবে।

    –আমারও হবে না।

    তারপর বলল, আপনি অন্ধ।

    –কেন?

    –এতদিনেও কিছু বুঝতে পারলেন না?

    –কী?

    –কাল-ই গিয়ে বলব। আমি আপনার মতো হাঁদা পুরুষ আর দেখিনি।

    –ঠিক আছে। চাইনিজ কী মোগলাই খাবার আনিয়ে রাখব কি? তুমি এলে, ফোন করেও আনানো যায় অবশ্য।

    –এখন-ই কিছু করতে হবে না। আপনার কিছুই করতে হবে না। কাল আমিই খাওয়াব আপনাকে। কালকের প্রোগ্রামটা পুরোপুরি ফ্লুইড থাকুক। সবকিছুই কাল আমি যাবার পরে প্ল্যান করব।

    –ওক্কে। ডান।

    –ক্যানসেল করবেন না যেন? প্রমিস?

    –প্রমিস। ফোনটা ছাড়ার পরে অগ্নির অত্যন্তই নার্ভাস লাগতে লাগল। এতখানি নার্ভাস কখনোই বোধ করেনি। অপার এই Move-এর পেছনে অরার কি কোনো হাত আছে? অরা কি পরীক্ষা করতে চায় অগ্নিকে? নাকি অরার প্ররোচনাতেই অপা কি অগ্নির সঙ্গে……

    নাঃ। কিছুই বুঝতে পারছে না।

    বুঝতে না পেরে চিঠি লেখার খোলা প্যাড বন্ধ করে চন্দনকে বলল, আজ সাড়ে নটাতেই শুয়ে পড়বে খেয়ে দেয়ে। ঠিক করল শোয়ার আগে একটা পয়েন্ট ফাইভ অ্যালজোলাম খাবে। তারপর ন্যাশানাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেল খুলে দিয়ে, অরার চিঠিটা খাম বন্ধ করে খামটা চন্দনকে দিয়ে কাল সকালেই পোস্ট করতে বলে টিভির সামনের ইজিচেয়ারে পা ছড়িয়ে বসল। অনেকগুলোচিঠি লেখার ছিল। মনের এই উত্তাল অবস্থাতে চিঠি লেখা সম্ভব নয়।

    সাড়ে আটটার সময়ে মোবাইলটা বাজল।

    ব্রতীন।

    –কী রে! তুই কি আসবি? নরেশ এসেছে। তুই এলেই খুলব গোল্ড-লেবেলের বোতলটা।

    অগ্নি মিথ্যে কথা বলল। বলল, নারে! জ্বরজ্বর লাগছে। আজ আমি আর যাব না। এনজয় ইয়োরসেলভস।

    -কাল টেনিস খেলতে যাবি তো?

    –দেখি, কেমন থাকি? জ্বর না এলে, যাব। তুই সকালে ফোন করিস একটা।

    –ঠিক আছে।

    বলল, ব্রতীন।

    .

    ২৪.

    অপা একটা লাল-কালো সম্বলপুরি সিল্কের শাড়ি পরে এসেছে। শ্যাম্পু করা ভোলা চুল। কী সুগন্ধি মেখেছে কে জানে! ‘রেড ডোর’ হতে পারে। অনেক বছর আগে সেমন্তী তাকে একটি ‘রেড ডোর’ পারফিউম এনে দিতে বলেছিল। জোগাড় করতে পারেনি।

    অপা যথেষ্ট সুন্দরী এবং তার মধ্যে একধরনের চাপল্য আছে, যাকে অবাঙালিরা বলে, নামকিন’। এয়ার কণ্ডিশাণ্ড গাড়িতে এসেছে, এয়ার কণ্ডিশাণ্ড ঘরে বসে আছে তবু ওর বাহুমূল ঘেমে গেছে। চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়েছে। একেবারে ডিভাস্টেটিং দেখাচ্ছে। ওকে।

    –এত গোপনীয়তা করলে, কিন্তু তোমার ড্রাইভার যদি ঘোস সাহেবকে বলে দেয় যে, তুমি একা আমার কাছে এসেছিলে।

    অগ্নি বলল।

    –বাড়ির গাড়ি নিয়ে আমি থোড়াই এসেছি। ট্রাভেল এজেন্সির গাড়ি নিয়ে এসেছি।

    –বাবাঃ। তুমি তো খুব স্কিমিং।

    –হলেই বা। মার্ডার করতে তো আসিনি।

    –তবে কি মার্ডারড হতে এসেছ?

    –দেখি কী হয়? আপনি তো অরার-ই নিরামিষ বন্ধু। নারী-বিদ্বেষী একরকম। আপনার সঙ্গে অরার সম্পর্কটা আমি আজও বুঝে উঠতে পারলাম না। এতবছরের প্রেম অথচ কখনো শরীরী সম্পর্ক হয়নি আপনাদের মধ্যে এটা অভাবনীয়।

    –সম্পর্কটা প্রেমের কি না, তা আমি আজও সঠিক জানি না। তবে কর্তব্যের নিশ্চয়ই। তা ছাড়া, প্রেমের অনেক-ই রকম থাকে। সব ‘প্রেম’ সবার বোঝার নয়।

    –যাই বলুন, আপনাদের সম্পর্কটা অ্যাবনর্মাল। হয়তো কিছুটা আনহোলসামও। অবিশ্বাস্য। অরার সঙ্গে কখনো আপনার শারীরিক সম্পর্ক হয়নি এ-কথা সত্যিই বিশ্বাস করার নয়।

    –কোরো না বিশ্বাস। তা ছাড়া হোক আর নাই হোক তাতে তোমার এত কৌতূহল কেন? আমার আর তোমার সম্পর্ক নিয়েই কি আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়?

    –তা ঠিক।

    তারপর বলল, আমি জানি না, জীবনের এই অবেলাতে এসে আমার কী হল!

    –কী হল, তা গানে বলি?

    –বলুন। অনেকদিন আপনার গান শুনি না। খালি গলাতে আপনার মতো গান খুব কম মানুষেই গাইতে পারেন।

    –হাঃ। আমি তো আর গাইয়ে নই। যন্ত্রট পাবই বা কোথায়? তা ছাড়া সেদিন রামকুমারবাবু একটি কথা বলেছিলেন এক মজলিশ-এ।

    –কী কথা?

    –বলেছিলেন, আমাদের সময়ে কথাটা ছিল, গান-বাজনা আর এখন হয়ে গেছে ‘বাজনা-গান’। মানে, হারমোনিয়াম, তবলা, সিন্থেসাইজার, গিটার, বাঁশি, পারকাশান ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক গায়ক-গায়িকার আবার জোড়ায় জোড়ায় দরকার হয়। গায়ক-গায়িকার গলা যে, কেমন তা বোঝার জোটি পর্যন্ত নেই।

    -তা যা বলেছেন। কিন্তু গানটা গাইবেন তো? কী হল গান?

    –হ্যাঁ। গাই।

    –সত্যি! আপনি যেমন করে মানুষে বলে, চানে যাই’ তেমন-ই করে গানে যান। বিনা প্রস্তুতিতে এমন গান গাইতে আমি কোনো মানুষকেই শুনিনি।

    –আমি আবার গায়ক নাকি? ছাতার গায়ক।

    –হয়েছে। এবার গান।

    কী হল আমারো সই, বলো কী করি
    নয়ন লাগিল যাহে কেমন পাশরি।
    কী হল আমারো সই বলো কী করি।
    হেরিলে হরিষচিত, না হেরিলে মরি
    তৃষিত চাতকী যেন থাকে আশা করি।
    ঘন মুখ হেরি সুখী, দুখ বিনে বারি।
    কী হল আমারো সই, বলো কী করি।

    –বাঃ সত্যি! আপনার প্রেমে যে, পড়েছি সে তো অবশ্যই। অনেক কিছুর জন্যেই পড়েছি। তারমধ্যে আপনার গান সম্ভবত একটি কারণ।

    -তুমি মেয়েটি বড়ো সরল অপালা। প্রেমে অনেক মেয়েই পড়ে কোনো না কোনো পুরুষের কিন্তু তোমার মতো অবলার মতো তা অকপটে বলতে খুব কম মেয়েই পারে। মেয়েদের প্রেম বুঝে নিতে হয় চোখের ভাষায়, তাদের নীরবতায়, তাদের আপাত-বিদ্বেষে।

    –আমরা যে, অন্যরকম। আমরা আর আপনারা বিপরীত না হলে একে অন্যের প্রতি কোনো আকর্ষণই থাকত না।

    -তা অবশ্য ঠিক।

    –আমরা তো পুরুষদের চেয়ে দুর্বল।

    –সেটা হয়তো শারীরিকভাবে। তোমাদের ভূমিকাটা প্যাসিভ, আমাদেরটা অ্যাকটিভ। তবে আজকাল নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশই কমে আসছে, সেটা ভালো কী মন্দ তা জানি না অবশ্য। মেয়েরাও ক্যারাটে শিখছে, কুংফু শিখছে, তাদের মধ্যেও জ্যাকি চ্যাঙ পাওয়া যাচ্ছে।

    -তাহলেও, আমার মনে হয় মেয়েরা দুর্বল।

    –আসলে, যেটাকে তোমরা দুর্বলতা বলে জানো, সেটাই তোমাদের বল।

    –বাঃ। বেশ বললেন তো কথাটা।

    –তা কথা বলেই কি কাটবে সময়? কিছু একটা খাও। কী খাবে? ম্যাঙ্গো-পান্না? নাকি বাকার্ডি বানিয়ে দেব? কি ব্লাডি-মারি খাবে একটা ভালো ভদকা আছে। টোম্যাটো জুসও আছে, ভালো করে বরফ দিয়ে বানিয়ে দিতে পারি।

    -আপনি যা ভালোবেসে দেবেন।

    -তাহলে তার আগে ভালোবেসে তোমার দু-চোখের পাতাতে দু-টি চুমু খাই-তারপর তোমার দু-কানের লতিতে।

    অপার মুখটি লাল হয়ে উঠল–ব্লাশ করল সে। অগ্নিভ উঠে গিয়ে তাকে দু-হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে তার দু-চোখে আর কানের লতিতে দু-টি করে চুমু খেল।

    অপা দাঁড়িয়ে উঠেছিল। তার শরীরময় রক্ত ছোটাছুটি করতে লাগল। অপা বলল, আমার শরীরে গান বাজছে। স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ সব একসঙ্গে বেজে উঠেছে।

    বলেই, অপা অনেকক্ষণ অগ্নিকে জড়িয়ে রইল। তার নরম স্তন অগ্নির দৃঢ় বুকে ঝড়ের পাখির মতো আশ্রয় খুঁজল। তারপর ভেজা চোখে অস্ফুটে বলল অপা, আমার স্বামী কোনোদিনও আমাকে এমন করে আদর করেনি।

    –তো কী করে করেছে?

    –শুয়োরে যেমন করে শটিখেত তছনছ করে, তেমন করে করেছে ফুলশয্যার রাত থেকে কাল রাত অবধি।

    অগ্নি খুব জোরে হেসে উঠল। বলল, তুমি কচুবনে শুয়োর দেখেছ কখনো?

    –দেখেছি বইকী। আমার মামাবাড়ি ছিল বহরমপুরের গ্রামে। রাতের বেলা কচুবনে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে কচুবন তছনছ করতে দেখেছি।

    হাসতে হাসতে অগ্নি বলল, স্ত্রীকে আদর করার রকম দিয়েই, একজন পুরুষের পৌরুষকে বিচার কোরো না। ঘোষ সাহেব যখন শামলা গায়ে হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্টের বিপক্ষের তাবড় উকিল ব্যারিস্টারদের তাঁর সওয়ালে কচুকাটা করেন, সেটাও কিন্তু পৌরুষের মস্ত নিদর্শন। পুরুষ এবং অবশ্যই নারীরও একমাত্র কৃতিত্বের ক্ষেত্র তো, শোয়ার ঘর নয়।

    –কিন্তু…

    –কিন্তু নয়, আমি জানি যে, অনেক মেয়ে ফ্রিজড। তাদের স্বামীরা তাদের কাছে যা-চায়, তা সারাজীবন পায় না–কিন্তু তা বলে তার জীবন, তার সংসার, তার সন্তান এসব কিছুই তো মিথ্যে হয়ে যায় না অপা। মানুষ তো পশু নয়। রমণ করাটাই তার একমাত্র কৃতিত্ব নয় –কী পুরুষের কী নারীর। মানুষের মন’টাই সব। সব না হলেও জীবনের অনেকখানি। অন্তত আমাদের ভারতীয় ঐতিহ্যে। পশ্চিমি দেশের স্ত্রী-পুরুষ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শরীর-সর্বস্ব।

    –কী বানিয়ে দেবেন বললেন দিন। আমি আজকে ড্রাঙ্ক হয়ে যাব।

    –দিচ্ছি।

    বলে, অগ্নি সেলারের দিকে এগিয়ে গেল। গ্লাসে ‘বাকার্ডি’ ঢেলে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল বরফ আর সোডার জন্যে।

    তারপর ড্রিঙ্কটি বানিয়ে অপার কাছে এসে, একটি ন্যাপকিনে গ্লাসটি মুড়ে অপার দিকে এগিয়ে দিল। বলল, বোসো ওই চেয়ারে, বসে তারিয়ে তারিয়ে খাও। ড্রাঙ্ক হতে যাবে কোন দুঃখে? ড্রাঙ্ক হয় জীবনে অসফল, ফ্রাস্ট্রেটেট, হেরে-যাওয়া মানুষেরা।

    –জিতে যাওয়া মানুষেরাও হয়। ফেইলিওরের মতো সাকসেসও মানুষকে ফ্রাস্টেটেট করে।

    –বাঃ। খুব ভালো বলেছ তো কথাটা। এমন করে ভাবিনি কখনো।

    –আপনাদের ঘোষ সাহেব-ই তো, এই স্পেসির জাজ্বল্যমান উদাহরণ একটি।

    –ঘোষ সাহেব মানুষটি বড়োভালো। আই লাইক হিম। কোনো মানুষের-ই কি সব-ই গুণ থাকে, দোষ তো দু-একটা থাকবেই।

    –সে-কথার উত্তর না দিয়ে অপালা বলল, আপনি কিছু নিলেন না? আমি বানিয়ে দেব?

    –আজ থাক। আজ তুমিই আমার নেশা হও।

    –বেশি, বেশি।

    –কপট ভর্ৎসনার স্বরে বলল, অপা। তারপরে বলল, না, আপনি একটা অন্তত ড্রিঙ্ক নিন। আমি আজ আপনার আদর খেতে এসেছি।

    –আদর তো করলাম তোমাকে অপা।

    –না।

    তারপর চোখ মাটির দিকে নামিয়ে বলল, বড়ো আদর।

    অগ্নি ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠল। বলল বাঃ দারুণ তো শব্দটি।

    –এই শব্দটিকে চালু করে দিতে হবে। যেমন চালু করব আঙ্গাপাঙ্গা শব্দটি।

    –সেটা কী শব্দ?

    অগ্নিভ জোরে হেসে উঠল বলল, ফ্যান্টাসটিক শব্দ একটা। বলব, বলব। পরে বলব।

    তারপর নিজের জন্যে একটি ভদকা তৈরি করে নিয়ে এসে বলল, জীবনে কারওকে প্রথমবার আদর করতে হলে চার দেওয়ালের মধ্যে কখনো করতে নেই।

    অপা অবাক হয়ে বলল, তাহলে? কোথায় করতে হয়?

    –প্রকৃতির মধ্যে। ফুল, পাখি, গাছ-গাছালি, চাঁদ-তারাকে সাক্ষী রেখে। মানুষের ‘বড়ো আদর’ ব্যাপারটা তো একটা মহৎ ব্যাপার, শূকর-শূকরীর চর্মঘর্ষণ নয়,–তারজন্যে আয়োজন লাগে, শরীর মনে নহবতখানাতে সানাই বাজাতে হয়।

    –আপনার ব্যাপার-স্যাপার-ই আলাদা।

    –ব্যাপার-স্যাপার নয়, বলো স্টাইল।

    তারপর বলল, তা বলতে পারো। আমি অন্য দশজনের থেকে আলাদা। আই কনটেইন মালটিটুডস।

    .

    ২৫.

    আজকে তৃষা অফিসে যায়নি। মাঝে খুব-ই খাটনি গেছে। দিল্লি-মুম্বই-চেন্নাই দৌড়াদৌড়ি করে একেবারে ক্লান্ত। রুরুর কলেজের বাংলার এক অধ্যাপক কানকাটা স্যার আচম্বিতে বড়োবাজারের গলিতে তলপেটে এক ষাঁড়ের গুঁতো খেয়ে সাংঘাতিক আহত হয়ে হাসপাতালে তিনদিন ভুগে গতকাল সন্ধেতে মারা গেছেন। তাই আজ কলেজ ছুটি।

    অরা যথারীতি স্কুলে গেছে।

    সকালের জলখাবারের পরে ভাইবোনে বসবার ঘরে বসে গল্প করছিল। আজকাল ওরা প্রত্যেকেই, নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তৃষাকে তো প্রায় দেখাই যায় না। সাতসকালে বেরিয়ে যায় গভীর রাতে ফেরে। তবে কোম্পানির গাড়িই নামিয়ে দিয়ে যায়। এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া এবং ফিরিয়ে নিয়ে আসাও কোম্পানির গাড়িই করে। বিস্পতিদিকে বলে, ভাইবোনে আজ জম্পেশ করে লুচি, ঝাল-ঝাল আলুর তরকারি, বেগুন ভাজা আর পায়েস দিয়ে ব্রেকফাস্ট করেছে। তারপর দুজনে বসে গল্প করছে।

    তৃষা বলল, অগ্নিকাকা অনেকদিন আসে না, না রে? অগ্নিকাকা এলে বাড়ির পরিবেশটাই বদলে যায় যেন।

    –যা বলেছিস। মা এতদিন স্কুলমাস্টারি করে কেমন বেরসিক, রাশভারী, রামগড়রের ছানার মতো গুরুগম্ভীর হয়ে গেছে।

    –মা-ই তো আমাদের মানুষ করেছেন। মা-এর সম্বন্ধে, এমন হেলাফেলার কথা তোর বলা উচিত নয় রুরু। তুই বড়ো ইল-ম্যানার্ড, অ্যারোগান্ট হয়ে উঠেছিস দিনে দিনে।

    –সরি। আই ডিড নট মিন টু হার্ট ইউ অ্যাণ্ড নট দ্যা লিস্ট মাই মাদার।

    –জানি।

    –তোর বাংলা ব্যাণ্ড কেমন চলছে?

    –ভালোই। পরশু একটা প্রোগ্রাম আছে আমাদের খঙ্গপুরে। ভোরে যাব সবাই বাসে করে আর গভীর রাতে ফিরব।

    –মায়ের পারমিশান নিয়েছিস?

    –আমি কি কিণ্ডারগার্টেনের ছাত্র? পারমিশানের কী আছে? তাও রাতে তো আর বাইরে থাকছি না।

    –এটা কি নতুন ব্যাণ্ড?

    –হ্যাঁ।

    –পুরানোটা ছাড়লি কেন?

    –আরে শীদাদার জন্যে। চোখের সামনে মানুষটা মেগালোম্যানিয়াক হয়ে গেল। আমরা সকলে মিলে বড়ো করলাম ব্যাণ্ডটাকে, আর তাঁর ধারণা হয়েছে, তিনি একাই এর সাকসেস-এর মূলে। মেগলোমানিয়াটা একটা অসুখে দাঁড়িয়ে গেল।

    –তা ঠিক। এই রোগটা প্রায় মহামারির চেহারা নিয়েছে সমাজের সর্বত্র। অথচ কলেরা টাইফয়েড তো নয় যে, ইনজেকশান দিয়ে ভালো করা যায়!

    তৃষা বলল।

    –ওষুধ যে, ছিল তা নয়। ছিল।

    –কী?

    –আড়ং ধোলাই। তবে আমরা ওঁকে স্পেয়ার করলাম।

    –কেন?

    –ওর ওল্ড টাইমস সেক।

    –ভালোই করেছিস।

    –তা তোদের নতুন ব্যাণ্ডের নাম কী?

    –কেঁচে গন্ডুষ।

    –কী নাম বললি?

    –বললাম-ই তো, কেঁচে গন্ডুষ। কেন? ভালো হয়নি নামটা?

    –দুর্দান্ত।

    তৃষা বলল। তারপর বলল, তোদের নতুন ব্যাণ্ডের গান শোনাস একদিন। তোর লেখা গান আছে কোনো?

    –নেই? অবশ্যই আছে।

    –কী গান? শোনাবি?

    –গিটার-ফিটার ছাড়া তো জমবে না।

    –গানের কথাটা শোনা অন্তত। প্রথম লাইনটা–প্রথম লাইনটা, রঘুদাদুর কবিতার থেকে মারা।

    –রঘুদাদু কে?

    –আরে, রুদ্র পলাশের দাদু। রঘু ব্যানার্জি।

    -–শোনা না, অতকথা না বলে।

    এক ঠোঙা খাবার নিয়ে যায় মতিলাল
    তাই দেখে দূর থেকে মারলে ছোঁ চিল

    –এটা আবার কী কবিতা?

    -কেন ‘দেশ’-এ কি এর চেয়ে খুব ভালো কবিতা বেরোয় নাকি প্রতি সংখ্যাতে? চিলের ‘ল’ আর মতিলালের ‘ল’-তে মিল নেই?

    তৃষা হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, পরের লাইনগুলো বল।

    চিলকে দেখে বাচ্চা মামা উড়িয়ে দিল ঢিলতাই না দেখে মামার মামা পিঠে ঝাড়ল কিল।

    –তৃষা বলল, বাঃ বাংলা কাব্য-সাহিত্যের ভবিষ্যৎ অতীব উজ্জ্বল।

    –বাংলা কাব্য-সাহিত্য-সংগীতের লোকাল গার্জেন তো, এখন একটি সর্বজ্ঞ মিডিয়া। তাঁদের হাতেই তো ভুবনের ভার।

    –সেই হচ্ছে কথা। আ কান্ট্রি গেটস আ মিডিয়া ইট ডিসার্ভস।

    –রুরু তারপর বলল, দ্যাখ দিদি, মাকে ক-দিন হল কেমন মন-মরা দেখছি। কেন? তুই কি জানিস?

    -কী করে বলব বল? টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো টেনশান হচ্ছে কি?

    –জানি না। মা তো কিছু বলেন না।

    –আমি কি বলব কিছু অগ্নিকাকাকে?

    –মা জানলে রাগ করতে পারেন।

    –মা জানবেন না।

    –আমি কিন্তু মাকে মাসে আরও আড়াই হাজার করে দিতে পারি। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এখুনি অত ভাববার দরকার নেই। ভবিষ্যৎ-এর ভাবনা ভাবার এখনও সময় আসেনি।

    –আমিও পারি মাকে হাজার খানেক করে দিতে।

    –তোর টিউশনির টাকা? মা নিলে তো?

    –তবে অগ্নিকাকাকেই বলব। উনি তো আমাদের বাবার-ই মতো।

    –মা বলেন, ‘বাবার মতো’ আর ‘বাবাতে’ তফাত আছে।

    –জানি।

    –দিদি। তোকে একটা কথা বলব? এ কথাটা তোর মনেও আমার থেকে অনেক-ই আগে এসেছে নিশ্চয়ই।

    –কী?

    –মা, অগ্নিকাকাকে বিয়ে করলেন না কেন? অগ্নিকাকাই তো, বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর থেকে আমাদের বাবার-ই মতো আগলেছেন। উনি না থাকলে আমাদের কী যে, হত তা কে বলতে পারে!

    –কথাটা মনে আসেনি তা নয়। বহুবছর আগে থাকতেই এসেছে। কিন্তু ব্যাপারটা মা আর অগ্নিকাকার পার্সোনাল ব্যাপার। আমাদের এক্তিয়ার নেই ও ব্যাপারে কথা বলার।

    –কিন্তু দু-জনে, দু-জনকে ভালো তো বাসেন।

    –তাতে অবশ্যই বাসেন। এমন শুদ্ধ পবিত্র ভালোবাসার কথা আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভাবতেই পারি না।

    –তা ঠিক।

    –তোর সঙ্গে হর্ষদদার কখনো ফিজিক্যাল রিলেশান হয়নি? সত্যি করে বল তো?

    –হয়েছিল। মাত্র একবারই। এবারে যখন পুণেতে গেছিলাম। আমি বলেছিলাম, বিয়ে অবধি অপেক্ষা করো। তাতে আমাদের সম্পর্কের মাধুর্য আরও বাড়বে।

    –ও কী বলল?

    –তোরা ছেলেরা বড়ো অবুঝ, অধৈর্য, ছেলেমানুষ। তোরা যাই-ই চাস এখুনি চাস। তোদের তর সয় না কিছুতেই।

    –এতে তোদের সম্পর্কটা কি আগের থেকে গম্ভীর হয়েছে?

    –গম্ভীর হয়েছে কি না বলতে পারব না কিন্তু শরীরের স্বাদ পাওয়ার পর আমারও ইচ্ছে করেছে, করে, যে আবারও পাই। বাঘ যেমন মানুষের রক্তর স্বাদ পেলে আবারও মানুষ খেতে চায়, শরীরও বোধ হয় শরীরের স্বাদ পেলে আবারও পেতে চায়। ভালোবাসাতে শরীরেরও যে, একটা মস্ত ভূমিকা আছে, তা সে-সম্পর্ক হওয়ার আগে পর্যন্ত বোঝা যায় না।

    –মানে?

    –আগে হর্ষদের প্রতি ভালোবাসার রকমটা অন্য ছিল, এখন আর একরকম হয়েছে। এত কাকুতিমিনতি করল, এমন কাঙালের মতো করল যে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ওর কাঙালপনাটা এখন আমার মধ্যেও চারিয়ে গেছে।

    –তবে? মাও তো তোর-ই মতো একজন মেয়ে, অগ্নিকাকাও হর্ষদদার মতো একজন পুরুষ। ওঁরা দু-জনে সম্পর্কটাকে এমন স্বর্গীয় করে রাখলেন এতবছর কী করে?

    –জানি না। তবে যেভাবেই তা করে রাখুন না কেন, দু-জনেরই যে, খুব-ই কষ্ট হয়েছে হয়, তাতে কোনো সন্দেহই নেই।

    –ওঁরা হয়তো ভাবেন যে, আমরা ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাকে মেনে নিতে পারব না, আপত্তি করব। আমাদের কি উচিত নয়, ওঁদের দুজনকেই জানিয়ে দেওয়া যে, আমরা কিছুমাত্রই মনে করব না।

    -–ওরে বাবা! কে বলবে? বিশেষ করে মাকে? হু উইল বেল দ্যা ক্যাট?

    –তা অবশ্য ঠিক।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article২. ভালোবাসার শালিখ
    Next Article ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ২. ভালোবাসার শালিখ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.