Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প628 Mins Read0
    ⤷

    ০১-১০. প্লাজার উপরে অবিস্থিত চল্লিশ ফুট উঁচু

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    মূল : অনুবাদ : মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এবং সালমান হক

    .

    জীবন নিয়ে আমাদের পরিকল্পনাগুলো পরিত্যাগ করতে পারলেই কেবলমাত্র যে জীবন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেটা পেতে পারবো।

    -জোসেফ ক্যাম্পবেল

    .

    তথ্য :

    এই উপন্যাসে যেসব স্থাপত্য, শিল্পকর্ম, বিজ্ঞান এবং ধর্মিয় সংগঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর বাস্তবিক অস্তিত্ব রয়েছে।

    .

    উৎসর্গ :

    আমার মায়ের স্মৃতির প্রতি…

    .

    অনুবাদক সালমান হকের উৎসর্গ :

    অর্ক, নাফীস, রাফা, শোয়েব, তূর্য, তায়েফকে
    (যাও, তোমাদেরকে বিখ্যাত করে দিলাম)

    .

    মুখ বন্ধ

    পুরনো ধাঁচের কগহুইল ট্রেনটি পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে ধীরগতিতে উপরে উঠে যাচ্ছে। মৃদু-মন্দ দুলুনি আর খাঁজ কাটা চাকার ধাতব আওয়াজের কারণে মনে হচ্ছে যেন পথ কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ওটা।

    জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে এডমন্ড কিয়ার্শ। উপরে যতদূর চোখ যায় শুধু পাথুরে পাহাড়ের সারি সারি চূড়া। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে পাথুরে কাঠিন্যই চোখে পড়ছে বেশি। এসবের মাঝেই তার চোখ যেন কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিছু জরিপ করছে। সামনে কিছু দূরে দেখা যাচ্ছে সেই মঠটা। সবচেয়ে উঁচু আর খাড়া পাহাড়টার একেবারে কিনারে অবস্থিত। যেন পাথরের বুক চিড়ে বের হয়েছে ওটা। দূর থেকে দেখলে মনে হতে পারে আস্ত একটি পাহাড় আকাশ থেকে ঝুলে আছে। সুপ্রাচীন কোন জাদুকর নিপুণ হাতে বসিয়ে দিয়েছে ওটা খাড়া পাহাড়ের গায়ে। চারশ বছরেরও আগে থেকে স্পেনের কাতালোনিয়া প্রদেশে গড়ে উঠেছে এই মঠ। অনেক ঝড়-ঝাঁপটা সহ্য করে টিকে আছে আজ অবধি। কালের করাল গ্রাস থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে প্রাগৈতিহাসিক এক নিদর্শন হয়ে ওঠেছে। এখনও ধরে রেখেছে তার অতীত ইতিহাস আর প্রাচীন ঐতিহ্য। পৃথিবীব্যাপী আধুনিকতার নামে চলতে থাকা বিশ্বাসের আগ্রাসন থেকে এখানকার বাসিন্দাদের রক্ষা করে চলছেন মঠ প্রধান। মঠবাসিরা হয়ে উঠেছেন ঐতিহ্যবাহী সনাতন ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের ধারক ও বাহক। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে গড়ে ওঠা ধর্মবিশ্বাসকে তারা লালন করছে পরম ভক্তিতে, ভালোবাসায়। এ বিশ্বাসে চির ধরানো যাবে না সহজে, টলানো যাবে না কাউকে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, এ মঠবাসিরাই এখন সত্যটা জানবে সবার আগে।

    কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তারা?

    অস্বস্তি কাজ করছে কিয়ার্শের মাঝে, কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বও ভর করেছে মনে। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, ইতিহাসও তাই বলে-ধর্মগুরুরা বেশিরভাগ সময়ই গোয়াড়ের মত আচরন করে, সহজে মানতে চায় না, বুঝতে চায় না কিছুই। ঈশ্বরে বিশ্বাসের প্রশ্নে তো আরও এক কাঠি উপরে…আর সেই ঈশ্বরের অস্তিত্বই যখন হুমকির মুখে পড়ে তখনতো কথাই নেই, সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে তারা।

    আর আমি কিনা জ্বলন্ত বর্শা ছুঁড়ে মারতে যাচ্ছি এই ভিমরুলের চাকে!

    ট্রেনটা অবশেষে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছালো। একা দাঁড়িয়ে থাকা এক লোককে দেখতে পেলো কিয়ার্শ। তার জন্যই অপেক্ষা করছে। সম্রম আর সমীহ ছাপিয়ে লোকটার বুড়ো শরীরে খেলা করছে প্রজ্ঞা। ক্যাথলিক যাজকদের ঐতিহ্যবাহী রক্তবর্ণা কোসাক পরেছে, সাথে সাদা রংয়ের রোসেটা, মাথায় একটা জুকাটো। নিমন্ত্রণকারিকে দেখামাত্রই চিনতে পারল কিয়ার্শ। অসংখ্যবার কৃশকায় লোকটাকে ছবিতে দেখেছে সে। আর এখন সামনা সামনি দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করা শুরু করেছে তার মধ্যে। অ্যাড্রিনালিনের কুঁসে ওঠা টের পাচ্ছে নিজের রক্তে। এক অনির্বচনীয় শিহরণ খেলা করছে।

    ভালদেসপিনো নিজে এসেছেন আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে! এটা ভাবতেই ভালো লাগলো কিয়ার্শের। যদিও কিছুটা বিস্মিত হয়েছে সে, তবে ভালো। লাগাটাই কাজ করছে বেশি। বিশপ আন্তোনিও ভালদেসপিনো স্পেনে নিছক কোন ধর্মিয়গুরু নন, ব্যাপক জনপ্রিয় আর সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বও বটে। রাজার বিশ্বস্ত বন্ধু আর পরামর্শক হিসেবেই সবাই তাকে চেনে। সনাতন ক্যাথলিক ঐতিহ্য আর বিশ্বাসের সঠিক রক্ষণাবেক্ষনের ব্যাপারে যেমন সবচেয়ে সরব, তেমনি স্পেনের ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীল রাজনৈতিক মতাদর্শের একজন পৃষ্ঠপোষকও তিনি। এ ধারাটিকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারেও তার অবদান অপরিসীম।

    আমার ধারণা আপনিই এডমন্ড কিয়ার্শ, তাকে ট্রেন থেকে নামতে দেখে একটা কণ্ঠ যেন ঝংকার তুলো। বিশপের গলার আওয়াজে কিছু একটা আছে, কিয়ার্শের মনে হলো গসপেল গেয়ে উঠেছেন এই যাজক।

    অপরাধি মনে হচ্ছে নিজেকে, হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে নিমন্ত্রণকারীর সাথে হাত মেলালো কিয়ার্শ। কৃশকায় আর হাড্ডিসার হাতের ছোঁয়ায় আবারও বিশপের অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার বিশালতা টের পেলো। এই মিটিংটার ব্যবস্থা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, বিশপ ভালদেসপিনো, বলল সে।

    আমাদের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেছেন বলে আমি খুশি হয়েছি। স্পষ্ট উচ্চারণের মাধুর্যময় কণ্ঠের কারণে বাঙময় হয়ে উঠলো পরিবেশ।

    কিয়ার্শের ভাবনার চেয়েও ভরাট আর গমগমে ঠেকলো বিশপের কণ্ঠ। কর্তৃত্বপরায়ণ আর প্রভাববিস্তারি একটি কণ্ঠযেন দূর থেকে মঠের ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসছে। সচরাচর বিজ্ঞানের সাথে জড়িত মানুষজনদের আমরা এড়িয়েই চলি, পারতপক্ষে তাদের সাথে কথা বলি না, বিশেষ করে কোন

    বিজ্ঞানী হলে তো নয়ই। আর আপনার মত এমন হোমড়াচোমড়া বিখ্যাত কেউ হলে তো কথাই নেই, বিশপের কণ্ঠে কিছুটা দায়সারা ভাব। এদিকে…দয়া করে এদিক দিয়ে আসুন।

    ভালদেসপিনো প্লাটফরম ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন কিয়াকে। চারদিকের পাহাড়-পর্বতে ঘুরপাক খেয়ে কনকনে বাতাস এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে বিশপের আলখাল্লা সদৃশ্য কোসাকে। তীক্ষ্ণ সূচের মত এসে বিঁধছে, হাত-পা কামড়ে ধরতে চাইছে।

    বলতে বাধ্য হচ্ছি, ভালদেসপিনো বলে উঠলেন, যেমনটা ধারণা করেছিলাম, আপনি তার থেকে বেশ আলাদা। এলোমেলো, উসকো-খুসকো চুলের উদ্ৰান্ত এক বিজ্ঞানীকে আশা করেছিলাম আমি। তার বদলে কেতাদুরস্ত, ফ্যাশন সচেতন আর সুদর্শন একজনকে দেখতে পাচ্ছি। পলকে তিনি তার অতিথির চকচকে মসৃণ কিটন কে ৫০ কাপড়ের তৈরি সট আর বার্কার অস্ট্রিচ লেদারের জুতোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। হতাশা আর তাচ্ছিল্যের আড়ালে যেন অনুমোদনের একটুকরো হাসি ঝিলিক দিয়ে গেল। ভাবখানা এমন, পুরো পৃথিবী যখন এরকম করে চলছে তখন আমার আর কীইবা করার আছে! হিপ, এরকম স্টাইলকে তো এ নামেই ডাকে, তাই না?

    কিয়ার্শ শুধু মুচকি হাসি দিলো। কয়েক যুগ আগেই হিপ শব্দটি ফ্যাশন জগৎ থেকে স্থিত হয়ে গেছে।

    আপনি এ পর্যন্ত যা যা করেছেন সেটার সুদীর্ঘ তালিকা আমি দেখেছি, বললেন বিশপ, কিন্তু তারপরও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না আপনি আসলে কী করেন?

    আমি কম্পিউটার মডেলিং আর গেম থিউরি নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ। করছি।

    মানে, বাচ্চাদের খেলার জন্য কম্পিউটার গেম বানান?

    কিয়ার্শ বুঝতে পারলো বিশপ ইচ্ছে করেই না বোঝার ভান করছেন, একটু মজা করতে চাচ্ছেন তার সাথে। ভালদেসপিনো সমসাময়িক প্রযুক্তির ব্যাপারে বেশ ভালো আর গভীর জ্ঞান রাখেন, এটা কিয়াৰ্শ আগে থেকেই জানে। এমন কি, প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আলাপ আলোচনাও করতে শুনেছে তাকে।

    না, স্যার, গেম থিওরি হলো গণিতের একটি শাখা, যেখানে গাণিতিক ধারা ও বিন্যাস পর্যালোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের কোন ঘটনার পূর্বাভাস দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

    ওহ্, হ্যাঁ…তাইতো, মনে পড়েছে এখন। কয়েক বছর আগে ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আপনি। অনেক জায়গায় বলার চেষ্টা করেছিলেন, অনেককেই সাবধান করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কেউ কানে দেয়নি আপনার কথা। পুরোপুরি নিজের উদ্যোগে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করেছিলেন সেসময়। আর সেই প্রোগ্রামটা কাজ করেছিল বলে ইউরোপও রক্ষা পেয়েছিল আসন্ন অর্থনৈতিক সংকট থেকে। আচ্ছা, আপনার প্রিয় উক্তি কোনটা? যে কথাটা প্রায়শই আওড়ান-তেত্রিশ বছর বয়সে জিশু যখন পুণরুত্থিত হয়, সেই বয়সে আমি পুরো পৃথিবীকে বাঁচিয়ে দিয়েছি।

    কিয়াশ কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল, একেবারে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে উঠলো সে, ওটা একটা হালকা চালে বলা কথা ছিল, স্যার। আর আমিও তখন বয়সে তরুণ ছিলাম।

    তরুণ? মুচকি হেসে উঠলেন বিশপ। মুখে একটা প্রচ্ছন্ন টিটকারির ভাব লেগে আছে। তাহলে এখন আপনার বয়স কত…সম্ভবত চল্লিশ?

    কাটায় কাটায়। বিশপ হাসতে লাগলেন। বাতাসের বেগ আগের চেয়ে বেড়েছে, পরনের আলখাল্লাটা বার বার এসে উড়িয়ে দিচ্ছে, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত সব ধুয়ে মুছে নিতে চাইছে। ভালো। এখনও পৃথিবীতে ঈশ্বরবিশ্বাসি কিছু মানুষ রয়েছে বলে রক্ষা, না হলে এতদিনে এসব তরুণদের হাত ধরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যেতো-আমি সেইসব প্রযুক্তিপাগল তরুণদের কথা বলছি, যারা নিজেদের আত্মার পরিশুদ্ধি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার চেয়ে ভিডিও স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। তবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে, কখনো। ভাবিনি, এমন একজন তরুণের সাথে কথা বলতে হবে, যে কিনা বর্তমান সময়ে পুরো প্রযুক্তিবিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অনেকেই আপনাকে এ যুগের প্রফেট বলে ডাকে। আপনি নিশ্চয় সেটা জানেন!

    আমিও ভাবিনি আপনাদের সাথে মিটিং করার সৌভাগ্য হবে আমার, জবাবে বলল কিয়ার্শ। মিটিংয়ের অনুরোধ করে যখন চিঠি লিখেছিলাম তখন ধরেই নিয়েছিলাম দেখা হবার সম্ভাবনা খুবই কম।

    আমি আমার কলিগদের বলেছি, অবিশ্বাসিদের সাথে কথা বললে বিশ্বাসিরাই সব সময় লাভবান হয়ে থাকে। শয়তানের কথা শুনলেই আমরা টের। পাই ঈশ্বর কতোটা মহান। হাসলেন বিশপ। মনে কিছু করবেন না, মজা করে বললাম আর কি। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। বয়সের সাথে সাথে রসবোধও ভোতা হয়ে যাচ্ছে আমার। প্রায়ই মখ ফসকে অনেক বেফাঁস কথা

    বলে ফেলি। সামনের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য ইশারা করলেন বিশপ। আমার কলিগেরা অপেক্ষা করছে। দয়া করে চলুন।

    বিশপের দেখানো পথের দিকে তাকালো কিয়ার্শ। একটা শৈলশিরার একদম শেষপ্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ধূসর পাথরের বিশাল একটি ভবন। এর হাজার ফিট নিচে রয়েছে বৃক্ষের সারি। উচ্চতা দেখে ভড়কে গেল কিয়ার্শ, খাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বিশপকে অনুসরণ করলো সে, মনোযোগ দিলো আসন্ন মিটিংটার দিকে।

    তিনটি প্রধান ধর্মের নেতারা সদ্য অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়ন পার্লামেন্টে যোগ দিতে এখানে এসেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখিয়েই অনুরোধ করেছিল কিয়ার্শ।

    জায়গাটিকে এখন সারাবিশ্বের ধর্মগুলোর পার্লামেন্টই বলা যায়!

    ১৮৯৩ সাল থেকে বিশ্বের ত্রিশটির মতো ধর্মের নেতারা এই সম্মেলন করে যাচ্ছে। প্রতিটি সম্মেলনই নতুন নতুন জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়। নিজেদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করে তারা। খৃস্টান যাজক, ইহুদি রাবাই, হিন্দু পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, জৈনধর্মের নেতা, শিখধর্মগুরু আর ইসলামের ইমামসহ অন্যান্য ধর্মের প্রতিনিধিরাও আসে।

    বিশ্বের সমস্ত ধর্মের মাঝে শান্তি স্থাপন, আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতার মাধ্যমে সেতুবন্ধন গড়ে তোলা আর সমস্ত ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে মৈত্রি স্থাপন করাই এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য।

    উদ্দেশ্য তো মহৎ, ভাবলো কিয়ার্শ। কিন্তু এমন উদ্দেশ্য সফল হবার সম্ভাবনা একদমই নেই। প্রাচীন সব কিস্সা-কাহিনী, পুরাণ আর কল্প-কথার মধ্যে মৈত্রি স্থাপন করেই বা কী লাভ?

    বিশপ ভালদেসপিনে কে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল কিয়ার্শ। মিটিংটার পরিহাসের কথা মনে করে হাসছে সে। মূসাকে পাহাড়ে উঠতে হয়েছিল ঈশ্বরের বাণী নিয়ে আসার জন্য…আর আমি উঠছি একেবারেই বিপরীত একটি উদ্দেশ্য নিয়ে।

    নিজের এই ভ্রমণের পক্ষে সাফাই হিসেবে একটি নৈতিক দায়িত্ব আছে। বলে মনে করে কিয়ার্শ। তবে এটার সাথে যে কিছুটা গর্বও রয়েছে তা-ও অজানা নয় তার কাছে। এসব ধর্মগুরুদের মুখের উপরে তাদের ধর্মগুলোর বিলুপ্ত হবার সংবাদ জানিয়ে দিয়ে এক ধরণের শান্তি পেতে চাইছে সে।

    সত্যকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করার অনেক সময় পেয়েছেন আপনারা।

    আপনার জীবনী দেখেছি আমি, হঠাৎ বলে উঠলেন বিশপ। হারভার্ডের ছাত্র ছিলেন, না?

    ওখান থেকেই গ্র্যাজুয়েট করেছি।

    আচ্ছা। কিছুদিন আগে কোথায় জানি পড়লাম, হারভার্ডের ইতিহাসে এই প্রথম ভর্তিচ্ছুক ছাত্রদের মধ্যে প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস করে না এরকম নাস্তিকদের সংখ্যা নাকি অন্য সব ধর্মবিশ্বাসি ছাত্রদের তুলনায় বেশি। এটাতো কোন সুখকর পরিসংখ্যান নয়, মি.  কিয়ার্শ।

    মিস্টার বিপশ, এর কারণ একটাই। বলতে চাইলো কিয়ার্শ। ছাত্ররা দিন দিন আরও বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে।

    পুরনো পাথুরে ভবনের সামনে ওরা চলে আসতেই বাতাসের বেগ আরো বেগে গেল। প্রবেশপথের মৃদু আলোয় বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধূপের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোরের ভেতরে পা রাখলো তারা দুজন। আলখাল্লা পরা বৃদ্ধ বিশপের সাথে তাল মেলাতে বেগ পেলো কিয়ার্শ। কিছুটা হাটার পর তারা চলে এলো অস্বাভাবিক রকমের ছোট একটি কাঠের দরজার সামনে। সেই দরজায় মৃদু টোকা দিলেন বিশপ, তারপরই দরজা খুলে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি, নিজের অতিথিকেও ভেতরে চলে আসার জন্য ইশারা করলেন।

    একটু দ্বিধার সাথেই ভেতরে পা রাখলো কিয়ার্শ। দেখতে পেলো চারকোণা একটি কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে সে। উঁচু দেয়ালগুলো জুড়ে আছে বইয়ের শেলফ, আর তাতে আছে চামড়ায় বাঁধানো মোটা মোটা বই-পুস্তক। ঘরে আছে বেশ কিছু রেডিয়েটর, যান্ত্রিক গুঞ্জন তুলছে সেগুলো। ফলে ঘরটাকে মনে হচ্ছে জীবন্ত! উপরের দিকে চেয়ে কিয়াশ দেখতে পেলো দোতলার উপরে চারপাশ জুড়ে থাকা ক্যাটওয়াকটা। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল সে এখন কোথায় আছে।

    মন্তসেরাতের বিখ্যাত লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। ভাবতেই পারেনি এখানে কখনও ঢুকতে পারবে। এই লাইব্রেরিতে এমন সব বিরল আর দুষ্প্রাপ্য বই-পুস্তক রয়েছে যা এখনকার বাসিন্দারা ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে দেখার সুযোগ মেলে না!

    কথা শেষে দু-জন কলিগের মাঝে বসেই বুকে দু-হাত ভাঁজ করে কিয়ার্শের দিকে আগ্রহভরে চেয়ে রইলেন বিশপ ভালদেসপিনো। বাকি দু-জন ধর্মিয়নেতাও ফিউচারিস্টের দিকে উৎসুক হয়ে চেয়ে আছেন। যেন তাদের সামনে কোন আসামি বসে আছে। বিশপ যে তার জন্য কোন চেয়ারের ব্যবস্থা করেননি সেটা অবশেষে বুঝতে পারলো কিয়ার্শ।

    তবে সে ভয় পেলো না, বরং বেশ মজাই লাগছে তার। সামনে বসে থাকা তিনজন বৃদ্ধের দিকে তাকালো এবার। হলি ট্রিনিটি এখন আমার সামনে বসে আছে! ভাবলো সে। তিনজন জ্ঞানী বৃদ্ধ।

    নিজেকে ধাতস্থ করার জন্য কেয়ক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো কিয়ার্শ। এরপর জানালার কাছে গিয়ে বাইরের সুন্দর দৃশ্যটা দেখলো। সেখানে শত বছরের পুরনো উপত্যকায় সূর্যের আলোয় ফুটে উঠেছে এক মনোরম দৃশ্যপট। কোলসেরোলা পর্বতমালার উঁচু-নীচু চূড়াগুলো সুন্দর দেখাচ্ছে। তারও অনেক দূরে, বালিয়ারিক সমুদ্রের উপরে জড়ো হয়েছে কালো মেঘের পুঞ্জ। ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে তারা।

    একদম মানানসই দৃশ্য, ভাবলো কিয়ার্শ। এই ঘরেও ঝড় বইবে খুব জলদি।

    জেন্টেলমেন, তিন বৃদ্ধের দিকে পেছন ফিরেই আচমকা বলে উঠলো কিয়ার্শ। বিশপ ভালদেসপিনো নিশ্চয় আপনাদেরকে বলেছেন, আমি এটা গোপন রাখতে চাই। তারপরও শুরু করার আগে আরেকবার বলে দিতে চাই, আমি যা বলবো সেটা যেন গোপনই থাকে। সোজা কথায় বললে, আমি আপনাদের কাছে মুখ বন্ধ রাখার অঙ্গিকার চাইছি। আপনারা কি এতে রাজি আছেন?

    তিনজনেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন। কিয়ার্শ অবশ্য জানে এসবের কোন দরকার নেই। নিজেদের স্বার্থেই তারা এটা গোপন রাখবেন।

    আজ আপনাদের কাছে এসেছি তার কারণ, শুরু করলো কিয়ার্শ, আমি এমন একটি আবিষ্কার করেছি যা সবাইকে হকচকিয়ে দেবে। অনেক বছর ধরেই এটা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলাম। মানব-সভ্যতার দুটো মৌলিক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি আমি এই আবিষ্কারের মাধ্যমে। সেজন্যেই আমি আজ আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছি। এর কারণ, এই আবিষ্কারের ফলে পৃথিবীর সবগুলো ধর্মবিশ্বাসের ভিত একেবারে নড়ে যাবে। সোজা কথায়…তাদের বিশ্বাসের জগতে ঘটবে বিরাট এক বিস্ফোরণ। এ মুহূর্তে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে এই আবিষ্কারের কথাটা জানি।

    সুটের পকেট থেকে বড় আকৃতির একটি স্মার্টফোন বের করে আনলো কিয়ার্শ। নিজের প্রয়োজনে জিনিসটা সাধারণ আকারের চেয়ে একটু বড় করে বানিয়ে নিয়েছে সে। তিনজনের সামনে ডিভাইসটি টেলিভিশনের মতো করে বসালো এবার। সাতচল্লিশ সংখ্যার পাসওয়ার্ড দিয়ে একটি সিকিউর সার্ভারে ঢুকে তিনবৃদ্ধকে একটি ভিডিও দেখানো হবে।

    আপনারা যেটা দেখবেন, কিয়ার্শ বলল, আমার ইচ্ছে, এক মাসের মধ্যে সারা দুনিয়ার কাছে মোটামুটি সেটাই সম্প্রচার করবো আমি। তবে তার। আগে চাইছিলাম এ বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মিয়নেতার সাথে এ নিয়ে কথা বলে নিতে। এই আবিষ্কারটি ধার্মিকদের উপরেই বেশি প্রভাব ফেলবে বলে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখতে চাই।

    শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিশপ। তাকে দেখে চিন্তিত নয় বরং বিরক্তই বলেই মনে হচ্ছে। শুরুটা বেশ নাটকিয়, মি.  কিয়ার্শ। আপনি এমনভাবে কথা বলছেন, যেন যা দেখাবেন তাতে করে এ বিশ্বের সবগুলো ধর্মবিশ্বাসের ভিত কেঁপে যাবে!

    ঘরের চারপাশে থাকা সুপ্রাচীন বই-পুস্তকগুলোর দিকে তাকালো কিয়ার্শ। শুধু ভিত কাঁপবে না, সেগুলো একেবারে ধ্বসিয়ে দেবে!

    সামনে বসে থাকা ধর্মিয়নেতাদের ভালো করে দেখে নিলো কিয়ার্শ। এরা জানে না, তিনদিন পরই নিখুঁত একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সত্যটা সারা বিশ্বের কাছে উন্মোচন করবে সে। সঙ্গে সঙ্গেই এ বিশ্বের সব মানুষ বুঝে যাবে, সবগুলো ধর্মের মধ্যেই একটা মিল রয়েছে।

    সবগুলোই চরমভাবে।

    .

    অধ্যায় ১

    প্লাজার উপরে অবিস্থিত চল্লিশ ফুট উঁচু কুকুরটার দিকে তাকালো রবার্ট ল্যাংডন। জন্তুটার গায়ের পশম ঘাস আর সুগন্ধি ফুল দিয়ে তৈরি।

    তোমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করবো আমি, মনে মনে বলল সে। সত্যিই চেষ্টা করবো।

    ।পশুটা নিয়ে আরো কিছুক্ষণ ভেবে গেল ল্যাংডন তারপর ঝুলন্ত ওয়াকওয়ে ধরে নেমে গেল বিশাল সিঁড়িটা দিয়ে। দর্শনার্থিদের পদভারে ওটা ছন্দে ছন্দে দুলছে যেন। কাজ শেষ, সিদ্ধান্ত নিলো ল্যাংডন। অসমান সিঁড়ির ধাপ ধরে নেমে যাবার সময় দু-বার পা হড়কে গেল তার। সিঁড়ির নিচে এসে থামলো সে। মাথার উপরে থাকা বিশাল জিনিসটার দিকে তাকালো।

    যা দেখার দেখে ফেলেছি।

    বিশালাকৃতির একটি কালো মাকড় তার সামনে, এর বিশাল বপুর দেহটা ত্রিশ ফিট উপরে ভেসে আছে লোহার সুদৃঢ় পা-গুলোর উপরে ভর দিয়ে। মাকড়ের তলপেটে ঝুলে আছে তারের জঞ্জালে পেচানো ডিমের একটি ঝুলি। ঝুলির ভেতরটা কাঁচের গোলকে পুরিপূর্ণ।

    ওর নাম মামান, একটা কণ্ঠ বলে উঠলো।

    চোখ নামাতেই লম্বা-চওড়া এক লোককে মাকড়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো ল্যাংডন। কালো রঙের নক্সাদার শেরওয়ানি পরে আছে সে। তার মুখে প্রায় হাস্যকর রকমের সালভাদার দালির মতো গোঁফ।

    আমার নাম ফার্নান্দো, বলতে লাগলো সে, আপনাকে এই জাদুঘরে স্বাগত জানানোর জন্য এসেছি। সামনে নামলেখা কতোগুলো টেবিলের দিকে নির্দেশ করলো লোকটি। আপনার নামটা কি আমি জানতে পারি?

    নিশ্চয়। আমার নাম রবার্ট ল্যাংডন।

    একটু আক্ষেপে বলে উঠলো লোকটি, ওহ্, আমি খুবই দুঃখিত! আপনাকে চিনতে পারিনি, স্যার!

    আমি নিজেই আমাকে দেখে চিনতে পারছি না, ভাবলো ল্যাংডন, সাদা। বো-টাই আর কালো টেইলস আর সাদা ওয়েস্টকোট পরনে তার, একটু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল সে। আমাকে দেখে একজন কেতাদুরস্ত বলেই মনে হচ্ছে। ল্যাংডনের ক্লাসিক্যাল টেইলসটা প্রায় ত্রিশ বছরের পুরনো। প্রিন্সটনের আইভি ক্লাবের সদস্য থাকাকালীন সময় থেকে এটা সযত্নে রাখা আছে তার কাছে। তবে নিয়মিত সাঁতার কাটার বদৌলতে এটা এখনও তার গায়ে সুন্দরমতো ফিট হয়। তাড়াহুড়ো করে সবকিছু প্যাক করতে গিয়ে সচরাচর যে টুক্সেডো পরে থাকে সেটার বদলে ক্লজিট থেকে ভুল ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল সে।

    আমন্ত্রণপত্রে বলা হয়েছিল সাদা-কালো জামার কথা, বলল ল্যাংডন। টেইলসটা মনে হয় ঠিকই আছে, কী বলেন?

    টেইল্স হলো ক্লাসিক একটি পোশাক! আপনাকে কিন্তু দারুণ মানিয়েছে! একটা নেমট্যাগ বের করে ল্যাংডনের জ্যাকেটের বুকে লাগিয়ে দিলো লোকটা। আপনার সাথে পরিচিত হতে পারাটা সম্মানের ব্যাপার, স্যার, বলল গোঁফওয়ালা। কোন সন্দেহ নেই, আপনি আমাদের এখানে আগেও নিশ্চয় এসেছেন?

    প্রতিফলিত হওয়া ভবনের সামনে থাকা মাকড়ের লোহার পা-গুলোর দিকে তাকালো ল্যাংডন। আসলে বলতে একটু লজ্জাই হচ্ছে, আমি এর আগে এখানে কখনও আসিনি।

    আসেননি! কপট সুরে বলল লোকটি। আপনি কি মডার্ন আর্টের সমঝদার নন?

    মডার্ন আর্টের যে চ্যালেঞ্জ সেটা ল্যাংডন সব সময়ই উপভোগ করে থাকে নির্দিষ্ট কোন একটি শিল্পকর্মকে কেন মাস্টারপিস হিসেবে বাহবা দেয়া হয় সেটা তার মাথায় আসে না :

    জ্যাকসন পোলকের রঙ চুঁইয়ে পড়া পেইন্টিং অ্যান্ডি ওয়ারহলের ক্যামবেলস সুপ ক্যান্স; মার্ক রদকোর সহজ সরল রঙের আয়তক্ষেত্রের সমারোহ। এরচেয়ে ল্যাংডন বরং, হায়ারোনিমাস বশের ধর্মিয় সিম্বলিজম অথবা ফান্সেসকো দ্য গয়ার শিল্পকর্ম নিয়ে আলাপ করতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

    আমি আসলে ক্লাসিক্যাল শিল্পকর্ম বেশি পছন্দ করি, জবাবে বলল ল্যাংডন। দা কুনিংয়ের চেয়ে দা ভিঞ্চি বেশি বুঝি।

    কিন্তু দা কুনিং আর দা ভিঞ্চি তো প্রায় একইরকম!

    ধৈর্যের সাথে হাসি দিলো ল্যাংডন। মনে হচ্ছে দা কুনিংয়ের ব্যাপারে আমাকে আরো অনেক কিছু শিখতে হবে।

    তাহলে বলবো, আপনি একদম সঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছেন! বিশালাকারের একটি ভবনের দিকে হাত তুলে দেখালো লোকটি। এখানে আপনি এই বিশ্বের সবচাইতে সেরা মডার্ন আর্টের সংগ্রহ দেখতে পাবেন! আশা করি বেশ উপভোগ করবেন আপনি।

    আমিও সেটাই মনে করি, বলল ল্যাংডন। শুধু যদি জানতে পারতাম আমি কেন এখানে এসেছি!

    আপনি এবং বাকি সবার বেলায়ই এ কথাটা খাটে! উল্লসিত হয়ে বলল লোকটি। মাথা ঝাঁকালো সে। আপনার নিমন্ত্রণদাতা আজকের রাতে আপনাদের সবাইকে কেন এখানে ডেকেছেন সে ব্যাপারটা একদম গোপন রেখেছেন। এমনকি এই জাদুঘরের কর্মচারিরাও জানে না কী ঘটতে যাচ্ছে। রহস্যের মধ্যেই তো আসল মজা-চারপাশে গুজবের ডালপালা ছড়াচ্ছে! ভেতরে কয়েক শ অতিথি আছে, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ রয়েছে, কিন্তু কেউই জানে না এই অনুষ্ঠানের এজেন্ডা কী?

    এ পৃথিবীর খুব কম নিমন্ত্রণদাতারই সাহস আছে, যে কিনা শেষ মুহূর্তে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে বলতে পারে : শনিবার রাতে চলে আসুন। আমার উপর আস্থা রাখবেন। আর তারচেয়েও কম ব্যক্তি কয়েক শ ভিআইপি অতিথিকে গাড়িতে কিংবা পেনে করে উত্তর স্পেনের এরকম একটি জায়গায় নিয়ে আসতে পারে।

    লোহার তৈরি সুবিশাল মাকড়ের নিচ দিয়ে হেঁটে গেল ল্যাংডন। মাথার উপরে বিশাল বড় লাল রঙের ব্যানারটার দিকে চোখ গেল তার।

    এডমন্ড কিয়ার্শের সাথে একটি রজনী

    এডমন্ড কিয়ার্শের কখনও আত্মবিশ্বাসের অভাব হয়নি, বেশ আমুদের সাথেই ভাবলো ল্যাংডন।

    বিশ বছর আগে তরুণ এডি কিয়ার্শ ছিল হারভার্ডে ল্যাংডনের প্রথমদিককার একজন ছাত্র-ঝাকড়া চুলের এক কম্পিউটার গিক, কোডের ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল বলে ল্যাংডনের কোড, সাইফার আর সিম্বলের ভাষা সংক্রান্ত ফ্রেশম্যানদের সেমিনারে এসেছিল সে। কিয়ার্শের সূক্ষ্ম বুদ্ধি তাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছিল। যদিও কম্পিউটারের মতো উজ্জ্বল সম্ভাবনার ক্ষেত্রের কারণে সেমিওটিকসের ধূসর জড়ত পরিত্যাগ করেছিল কিয়ার্শ, তারপরও ল্যাংডনের সাথে তার একটি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ কারণেই গ্র্যাজুয়েশনের বিশ বছর পরও তাদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

    এখন সেই ছাত্র তার শিক্ষককেও ছাড়িয়ে গেছে, ভাবলো ল্যাংডন। কয়েক আলোকবর্ষ ব্যবধানে।

    বর্তমানে এডমন্ড কিয়ার্শ হলো জগৎবিখ্যাত একজন ব্যতিক্রমধর্মি চিন্তাবিদ-বিলিয়ন ডলারের মালিক এক কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ফিউচারিস্ট, উদ্ভাবক এবং উদ্যোক্তা। চল্লিশ বছরের এই মানুষটি এখন রোবোটিক্স, ব্রেইন, সায়েন্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ন্যানোটেকনোলজির মতো আধুনিক আর অ্যাডভান্স প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় নাম। নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ অনুমাণ করার ক্ষেত্রে তার যুগান্তকারি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তাকে ঘিরে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

    অ্যাধ্যাত্মিক এক দীপ্তি।

    দেশটির প্রাচীন-ইতিহাস, আভা-গার্দ আর্কিটেক্টার, ঝামেলাহীন জিন বার আর চমৎকার আবহাওয়ার প্রতি তার ভালোলাগার কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে কিয়ার্শ মূলত স্পেনেই বসবাস করছে।

    ল্যাংডনের ধারণা, এডমন্ডের এই নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতাটা এসেছে চারপাশের দুনিয়া সম্পর্কে তার অগাধ আর বিস্তৃত জ্ঞান রাখার ফলে। সবসময় ছেলেটাকে বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতে দেখেছে সে; হাতের কাছে যা পেয়েছে, তা-ই পড়েছে। কোন বাছ-বিচার করেনি। বইয়ের প্রতি এমন আগ্রহ, আর সেগুলোতে লেখা বিষয়বস্তু যথার্থভাবে বোঝার এমন ক্ষমতা আর কারোও মাঝে দেখেনি ল্যাংডন।

    বছরে একবার ক্যামব্রিজে ফিরে আসে কিয়াশ এমআইটি মিডিয়া ল্যাবে বক্তৃতা দিতে। সেদিন রাতে দেখা যায় সে আর ল্যাংডন একসাথে খেতে বসেছে। তা-ও বোস্টনের এমন কোন রেস্তোরাঁয়, যার নাম হয়তো আগে কখনও অপেক্ষাকৃত বয়স্ক লোকটা শোনেইনি! অবশ্য ওদের মধ্যে প্রযুক্তি নিয়ে কোন কথা হয় না। কিয়ার্শের আগ্রহ ঘুরে-ফিরে শিল্পকলার আলাপচারিতার দিকেই নিয়ে যায় সে।

    রবার্ট, তুমি হচ্ছো সংস্কৃতির সাথে আমার যোগাযোগ। দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক। তোমাকে আমি আমার ব্যক্তিগত ব্যাচেলর অব আর্টস বলতে পারি!

    ব্যাচেলর শব্দটা যে ওর চিরকুমার অবস্থাকে খোঁচা দেয়ার জন্য, সেটা। বুঝতে কখনওই বেগ পেতে হয়নি ল্যাংডনের। অবশ্য তাতে সে কিছু মনেও করে না। কেননা এই খোঁচা দেয় এমন এক অকৃতদার, যার কাছে এক নারীর সাথে জীবন কাটানো মানে বিবর্তনের মুখে থাপ্পড় মারা! বিগত বছরগুলোতে একগাদা সুপারমডেলের সাথে একই ফ্রেমে বন্দি হতে দেখা গেছে তাকে।

    কম্পিউটার বিজ্ঞানে কিয়ার্শের অর্জন শুনলে যে কেউ মনে করবে, লোকটা বুঝি নাক উঁচু করে থাকা এক আঁতেল, যার বাকি দুনিয়ার দিকে কোন মনোযোগ নেই! অথচ পোশাক-আশাকে তরুণ সেলেব্রেটিদেরকেও হার মানাবে সে। একেবারে হাল-ফ্যাশনের ডিজাইন ছাড়া অন্য কোন পোশাক পরে না। আধুনিক চিত্রকর্মের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে তার। প্রায়শই ল্যাংডনকে মেইল পাঠায় সে, জানতে চায়-এই শিল্পকর্ম কেনাটা কেমন হবে?

    তারপর সে ঠিক পরামর্শের উল্টোটা করতো, মুচকি হেসে মনে মনে বলল ল্যাংডন।

    প্রায় এক বছর আগের কথা, ওকে অবাক করে দিয়ে একদিন শিল্পকর্ম নিয়ে আলাপ রেখে ঈশ্বরের ব্যাপারে জানতে চায় কিয়ার্শ। স্বঘোষিত এক নাস্তিকের মুখে ঈশ্বরের নাম শুনে অবাকই হয়েছিল রবার্ট ল্যাংডন। বোস্টানর টাইগার মামা রেস্তোরাঁয় বসে সেদিন খাওয়া-দাওয়া করছিল দু-জনে। আচমকা বিশ্বের প্রধান সব ধর্মের ব্যাপারে ল্যাংডনের মতামত জানতে চায় সে, বিশেষ। করে সৃষ্টির শুরু নিয়ে নানা ধর্মে প্রচলিত নানান অভিমতের ব্যাপারে।

    বর্তমান ধর্মমতগুলো নিয়ে তাকে মোটামুটি একটি ধারণা দিয়েছিল ল্যাংডন-ইহুদি, খৃস্টান আর ইসলাম ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব প্রায় একইরকম, সেখান থেকে শুরু করে হিন্দুদের ব্রহ্মার গল্প, ব্যাবিলনিয়দের মারডুকের কাহিনি…সবই বলেছিল তাকে।

    আচ্ছা, রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরোবার সময় জানতে চেয়েছিল ল্যাংডন। একজন ফিউচারিস্ট অতীত নিয়ে কেন মাথা ঘামাচ্ছে? তাহলে কি বিশ্ববিখ্যাত নাস্তিক অবশেষে ঈশ্বরের দেখা পেয়ে গেছে?

    আমুদে হাসি দিয়েছিল এডমন্ড। সেই আশাই করতে থাকো! আমি আসলে প্রতিপক্ষের ব্যাপারে একটু ধারণা নিতে চাচ্ছিলাম, রবার্ট।

    তার কথা শুনে হেসেছিল ল্যাংডন। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। বিজ্ঞান আর ধর্ম কিন্তু প্রতিপক্ষ নয়। দুটো আলাদা আলাদা ভাষায় একই গল্প বলার চেষ্টা করে বলতে পারো। পৃথিবী এ দুটোকে ধারণ করার মত যথেষ্ট বড়!

    সেই আলোচনার পর প্রায় এক বছর এডমন্ডের সাথে কথা হয়নি কোন। তারপর একেবারে আচমকা…বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো…ফেডএক্সের এনভেলপে ভরা প্লেনের টিকেট, হোটেলের রিজার্ভেশন আর এডমন্ডের হাতে লেখা নিমন্ত্রণ পায় ল্যাংডন। ঘটনাটা মাত্র তিনদিন আগের। আমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল :

    রবার্ট, তুমি এলে আমি খুবই খুশি হবো। গতবার তোমার কাছ থেকে শোনা কথাগুলো এই অনুষ্ঠানের প্রেরণা। নইলে হয়তো এই সম্মেলনটা সম্ভবই হতো না।

    অবাক হয়ে গিয়েছিল ল্যাংডন। ঐ রাতে এমনকিছুই বলেনি সে, যেটা একজন ফিউচারিস্টের অনুষ্ঠানের অনুপ্রেরণা হতে পারে।

    খামের ভেতরে আরও ছিল দু-জন মানুষের মুখোমুখি হয়ে থাকা একটি সাদাকালো ছবি। সেই সাথে ছিল ছোট্ট একটি কবিতাও :

    রবার্ট, সামনা-সামনি দেখা হবে যখনই ফাঁকা সেই স্থানটি উন্মোচন করবো তখনই।– এডমন্ড

    ছবিটা দেখে হেসেছিল ল্যাংডন

    ছবিটা দেখে হেসেছিল ল্যাংডন, কয়েক বছর আগে একটি ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছিল সে। ছবিটা তারই স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। কালো দুটো মুখের মাঝখানে সাদা অংশে ফুটে উঠেছে একটি চ্যালিস-জিশু খৃস্টের ব্যবহৃত শেষ পানপাত্রের আকার।

    এখন এই জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ল্যাংডন, প্রাক্তন ছাত্র কী বলবে তা জানার জন্য। আর তর সইছে না। টেইল স্যুটের পেছনটা হালকা বাতাসে উড়ছে। নারভিওন নদীর ধার দিয়ে, বাঁধানো হাঁটাপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সে। এই নদী এক সময় বর্ধিষ্ণু এই শিল্প-শহরের মূল প্রাণ ছিল। বাতাসে তামার হালকা গন্ধ পেলো সে।

    হাঁটাপথের একটা বাঁক ঘোরার পর অবশেষে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে বিশাল জাদুঘরটার দিকে তাকাল ল্যাংডন। একবারে পুরো দালানটাকে দেখা অসম্ভব। তাই অদ্ভুত আকৃতিটার এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত নজর ঘোরাতে হলো তাকে।

    এই দালান স্থাপত্যবিদ্যার সব নিয়মকে শুধু ভাঙেইনি, বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে বলা যায়। এডমন্ডের জন্য এরচাইতে ভালো জায়গা আর হয় না, ভাবল ল্যাংডন।

    স্পেনের বিলবাওতে অবস্থিত দ্য গুগেনহাইম জাদুঘর দেখলে মনে হবে, যেন ভিনগ্রহের কোন প্রাণির হেলুনিসেশান! সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইস্পাত দেখে মনে হচ্ছে, ইচ্ছেমত দোমড়ানো-মোচড়ানো হয়েছে ওটাকে। এরপর একটার সাথে আরেকটাকে ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে কোন পদ্ধতি অনুসরণ না করেই। যতদূর দেখা যায়, দালানের পুরোটা শরীর ঢেকে দেয়া হয়েছে ত্রিশ হাজারেরও বেশি টাইটেনিয়াম টাইলস দিয়ে। মাছের আঁশের মতো চকচক করতে থাকা ভবনটি একই সাথে প্রাকৃতিক এবং অপার্থিব অনুভূতির জন্ম দেয়। মনে হয় যেন ভবিষ্যতের কোন লেভিয়াথান দৈত্য পানি থেকে উঠে এসে রোদ পোহাচ্ছে!

    ১৯৯৭ সালে যখন প্রথম দালানটা উন্মোচন করা হয়, তখন এটার আর্কিটেক্ট ফ্রাঙ্ক গ্রেরির প্রশংসা করে দ্য নিউইয়র্কার বলে ছিল, টাইটেনিয়ামের আলখাল্লা পরা এক স্পন্দনরত স্বপ্নের জাহাজ বানিয়েছেন তিনি! দুনিয়া জুড়ে অন্যান্য সমালোচকরাও কম যাননি-আমাদের সময়ের সেরা স্থাপত্য! প্রাণবন্ত বুদ্ধিমত্তার ছাপ! স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন!

    এই মিউজিয়াম চালু হবার পর, আরও অনেকগুলো ডিকন্সট্রাকটিভিস্ট বা প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে ডিজাইন করা দালান গড়ে উঠতে থাকেলস অ্যাঞ্জেলসের ডিজনি কনসার্ট হল, মিউনিখের বিএমডব্লিউ ওয়ার্ল্ড, এমনকি ল্যাংডনের বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন লাইব্রেরিও সেই খাতায় নাম লিখিয়েছে। অবশ্য বিলবাওয়ের এই দালান যে পরিমাণ সাড়া জাগায় দর্শকদের মনে তার ছিটেফোঁটাও বাকিগুলো জাগাতে পারে বলে মনে হয় না।

    ল্যাংডনের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে টাইলগুলো যেন একটা আরেকটার সাথে মিলে যাচ্ছে। নতুন রূপে নিজেদেরকে ধরা দিচ্ছে প্রতিটি পদক্ষপে। এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে, বিশাল দালানটা যেন পানির উপরে ভাসছে!

    একটু অপেক্ষা করে দৃশ্যটা মনভরে দেখে নিলো ল্যাংডন। তারপর কটার সাথে মিলে যাচ্ছে। নতুন রূপে নিজেদেম।

    পানির উপর তৈরি সেতুটার দিকে এগিয়ে গেল। অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে কী করেনি, হিস-হিস শব্দে কেঁপে উঠল সে। তার পায়ের নিচ থেকে আসছে। শব্দটা। হাঁটাপথের নিচ থেকে বেরোতে থাকা কুয়াশা দেখে থমকে গেল এবার। কুয়াশার ঘন চাঁদর তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল জাদুঘরের দিকে। পুরো দালানটার ভিত্তি ঘিরে না ফেলার আগে থামলো না।

    ফগ স্কাল্পচার, কুয়াশা-শিল্প-ভাবলো ল্যাংডন।

    জাপানিজ শিল্পী ফুজিকো নাকায়ার এই কাজের ব্যাপারে পড়েছে সে। এই ভাস্কর্য অন্য সবকিছুর চেয়ে আলাদা। কেননা একে বানানো হয় দৃশ্যমান বাতাস ব্যবহার করে। কুয়াশার এমন একটি দেয়াল তৈরি করা হয়, যা সময়ের সাথে সাথে জন্ম নেয় আবার বিলীনও হয়ে যায়। আর যেহেতু একেকটা দিনের বাতাসের প্রবাহ ও আবহাওয়ার অবস্থা অন্যদিনের সাথে মেলে না, তাই প্রতিবার নতুন রূপে দেখা যায় ভাস্কর্যটিকে।

    হিস-হিস করা বন্ধ হয়ে গেল ব্রিজটার। কুয়াশার দৃশ্য যেমন উচ্চমার্গীয়, তেমনি হতবুদ্ধিকর। মনে হচ্ছে, জাদুঘরটা বুঝি পানির উপরে ভাসছে! যেন কোন ওজন নেই ওটার, মেঘের উপরে বসে রয়েছে।

    আবার হাটা শুরু করতে যাবে, এমন সময় পানির শান্ত তল অশান্ত হয়ে উঠলো ছোট ছোট একগাদা বিস্ফোরণে। একদম আচমকা, পাঁচটি আগ্নেয় থাম লেগুন থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে ছুটলো। জাদুঘরের টাইটেনিয়ামের টাইলে শুরু হলো আলোর খেলা।

    লুভর বা প্রাডোর মতো গতানুগতিক ধারার স্থাপত্যশিল্পই ল্যাংডনের পছন্দ। কিন্তু কুয়াশা আর আগুনের এই খেলা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। আসলে এই অত্যাধুনিক জাদুঘর ছাড়া অন্য কোথাও ফিউচারিস্ট লোকটির অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলে মানাতো না!

    কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে গেল ল্যাংডন। জাদুঘরের প্রবেশ পথটি বিশাল এক কালো গহ্বরের মতো, দেখে কেমন সরীসৃপ-সরীসৃপ বলে মনে হয়। ভেতরে প্রবেশ করার সময় অস্বস্তিকর অনুভূতি হলো ল্যাংডনের। মনে হলো কোন ড্রাগনের মুখের ভেতর পা রাখছে বুঝি!

    .

    অধ্যায় ২

    অপরিচিত এই শহরের ফাঁকা একটি পাবে টুলের উপর বসে আছে নেভি অ্যাডমিরাল লুই আভিলা। ভ্রমণে ক্লান্ত সে, একটা কাজের প্রয়োজনে তাকে বারো ঘণ্টায় কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এ শহরে আসতে হয়েছে। টনিক ওয়াটারের দ্বিতীয় গ্লাসে চুমুক দিয়ে বারের পেছনে রাখা রঙবেরঙের বোতলের দিকে চেয়ে আছে।

    মরুভূমিতে যে কোন লোকই ভদ্রস্থ থাকতে পারবে, মনে মনে বলল সে, কিন্তু কেবলমাত্র অনুগত আর বিশ্বস্তরাই মরুদ্যানে বসেও মুখ বন্ধ রাখতে পারবে।

    আভিলা বিগত এক বছর ধরে মুখ খোলেনি। বারের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চোখ যেতেই এক ধরণের বিরল আর সুখকর মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো।

    ভূমধ্যসাগরিয় অঞ্চলের মানুষ হিসেবে আভিলার বয়স তাকে বোঝা হিসেবে দাঁড় না করিয়ে বরং সম্পদ হিসেবে পরিণত করেছে। বিগত বছরগুলোতে তার রুক্ষ্ম কালো চাপ দাড়ি নরম আর আধাকাঁচাপাকা হয়ে গেছে। তার কালো জ্বলজ্বলে চোখদুটো হয়ে উঠেছে শান্ত আর আত্মবিশ্বাসি। অলিভ রঙা ত্বক এখন রোদেপোড়া তামাটে। তাকে দেখলে দূরের সমুদ্রে ভুরু কুচকে চেয়ে থাকা একজন বলেই মনে হয় সব সময়।

    তেষট্টি বছর বয়সেও তার শরীর হালকা-পাতলা গড়ন ধরে রাখার পাশাপাশি যথেষ্ট সতেজ রয়েছে। তার চমৎকার দৈহিক গড়নটি আরো বেশি নজর কাড়ে ইউনিফর্ম পরা থাকলে। এ মুহূর্তে আভিলা নেভির সাদা ইউনিফর্মই পরে আছে-ডাবল-ব্রেস্টের সাদা জ্যাকেট, কালো রঙের চওড়া শোল্ডার বোর্ড, এক সারি সার্ভিস মেডেল, উঁচু কলারের পরিপাটি সাদা শার্ট আর সিল্ক-ট্রিমড সাদা প্যান্ট।

    স্প্যানিশ আরমাদা এখন আর এ বিশ্বের সবচাইতে প্রভাবশালি নেভি না হতে পারে, তবে আমরা এখনও জানি অফিসারদের কিভাবে ড্রেসে সজ্জিত করতে হয়।

    বেশ কয়েক বছর অ্যাডমিরাল এই ইউনিফর্মটি পরেনি-তবে আজকের রাতটা অন্য সব রাতের মতো নয় এটা বিশেষ একটা রাত। কিছুক্ষণ আগে এই শহরের পথ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সুশ্রীমুখের নারীদের মুগ্ধ দৃষ্টি উপভোগ করেছে সে, সেই সাথে পুরুষেরাও তাকে সম্ভ্রমের সাথে সরে গিয়ে পথ করে দিয়েছে।

    শৃঙ্খলা আর নিয়ম মেনে চলে যারা তাদেরকে সবাই সম্মান করে।

    ওত্রা তনিকা? সুন্দরি বারমেইড জানতে চাইলো তার কাছে। মেয়েটার বয়স বেশি হলে ত্রিশ হবে, সুগঠিত দেহ, আর মুখে উচ্ছল হাসি।

    মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলো আভিলা। নো, গ্রাসিয়াস।

    এই পাবটা বলতে গেলে একদম ফাঁকা। বারমেইডের মুগ্ধ দৃষ্টি টের পেলো আভিলা। এরকমটা আবারো দেখতে পেয়ে বেশ ভালো লাগছে তার। অন্ধকার গহ্বর থেকে ফিরে এসেছি আমি।

    পাঁচ বছর আগে যে ভয়ঙ্কর ঘটনা তার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছিল সেটা চিরকালই তার মনে উঁকিঝুঁকি মারবে-এক লহমায় মাটি যেন হা করে তাকে পুরোপুরি গিলে ফেলেছিল।

    সেভিয়ার ক্যাথেড্রাল।

    ইস্টারের সকালে।

    স্টেইন্ড গ্লাস ভেদ করে আলো ছড়াচ্ছিল আন্দালুসিয়ানের সূর্য, ক্যাথেড্রালের অভ্যন্তরে সেই সূর্যরশ্মি বর্ণিল হয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো তখন। পাইপ অগানের সুমধুর শব্দে পুণরুত্থানের অলৌকিকতাকে উদযাপন করছিল হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ।

    কমুনিউন রেইলে হাটু গেঁড়ে বসেছিল আভিলা, ভক্তিতে উদ্বেলিত ছিল তার হৃদয়। একজীবন সমুদ্রে সার্ভিস করে ফিরে আসার পর ঈশ্বর তাকে আশির্বাদস্বরুপ সেরা একটি উপহার দান করেছিলেন-একটি পরিবার। প্রশান্তির হাসি দিয়ে পেছন ফিরে আভিলা তার কমবয়েসি স্ত্রী মারিয়ার দিকে তাকিয়েছিল। গর্ভবতি ছিল বলে সে বসেছিল একটু দূরে সাধারণ প্রার্থনাকারিদের সারি সারি লম্বা বেঞ্চিগুলোর একটাতে। তার পাশে ছিল তাদের তেরো বছরের ছেলে পেপে, উত্তেজনায় বাবার উদ্দেশে হাত নাড়িয়েছিল সে। ছেলের দিকে চোখ টিপে দিলে স্বামীর দিকে তাকিয়ে উষ্ণ হাসি দিয়েছিল মারিয়া।

    ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ, চ্যালিসটা হাতে নেবার জন্য রেলিংয়ের দিকে ফিরে তাকাতেই মনে মনে বলে উঠেছিল আভিলা।

    পরমুহূর্তেই বিকট এক বিস্ফোরণের শব্দ প্রিস্টিন চ্যাপেলটা বিদীর্ণ করে তোলে।

    চোখের নিমেষে তার সমস্ত জগৎ আগুনে ভষ্মীভূত হয়ে যায়।

    বিস্ফোরণের ধাক্কায় কমুনিউনের রেলিংয়ের উপরে ছিটকে পড়ে আভিলা, তার শরীর ধামাচাপা পড়ে যায় ধ্বংসস্তূপের আবর্জনা আর মানুয়ের ছিন্নভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিচে। জ্ঞান ফিরে আসার পর ঘন ধোয়ার কারণে শ্বাস নিতে পারছিল না সে। কয়েক মুহূর্তের জন্য বুঝতেই পারেনি কোথায় আছে, কী ঘটে গেছে।

    এরপরই তার কানে আসে যন্ত্রণাকাতর চিৎকারগুলো। কোনমতে উঠে দাঁড়াতেই বুঝতে পারে কোথায় আছে এখন। নিজেকে সে বলেছিল, একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। আতনাদ করতে থাকা মানুষজন আর বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টপকে ধোয়ায় আচ্ছন্ন ক্যাথেড্রালের ভেতরে কিছুক্ষণ আগে তার স্ত্রী আর সন্তান যেখানে ছিল সেই জায়গাটা আন্দাজ করে খোঁজার চেষ্টা করে যায় উদভ্রান্তের মতো।

    ওখানে কেউ ছিল না।

    কোন বেঞ্চ নেই। মানুষজনও নেই।

    কেবল মৃতদেহের দঙ্গল আর আগুনে পোড়া পাথরের মেঝে।

    তিক্ত এই স্মৃতিটা এক ঝটকায় বিতারিত হলো বারের দরজায় প্রচণ্ড আঘাতের শব্দে। টনিকার গ্লাসটা হাতে নিয়ে দ্রুত কয়েক চুমুক দিয়ে দিলো। আভিলা। মাথা থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্মৃতিটাকে আরো অসংখ্যবারের মতো ঝেটিয়ে বিদায় করে দিলো সে।

    আভিলা দেখতে পেলো, বারের দরজাটা পুরোপুরি খোলা, সেখান দিয়ে হন হন করে ঢুকে পড়ছে পেশিবহুল দু-জন মানুষ। সবুজ রঙের ফুটবল জার্সি তাদের বিশাল বপু ঢেকে রাখতে রাখতে যেন জীর্ণ হয়ে পড়েছে, আর একটি আইরিশ-লড়াকু গান গাইছে তারা সমস্বরে। বোঝাই যাচ্ছে, আজকের বিকেলে আয়ারল্যান্ড দলটি এখানে এসেছে খেলতে। সেই খেলা শেষ হয়ে গেছে।

    আমি এটাকে আমার চলে যাবার সময় হিসেবেই ধরে নেবো, ভাবনাটা মাথায় আসতেই উঠে দাঁড়ালো আভিলা। বিলের জন্য তাড়া দিলেও বারমেইড তার দিকে চোখ টিপে হাত নেড়ে না করে দিলো। মেয়েটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো সে।

    ব্লাডি হেল! এইমাত্র বারে ঢোকা একজন আভিলার ইউনিফর্ম দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো। এ দেখি স্পেনের রাজা!

    কথাটা বলামাত্রই দু-জন মানুষ হাসিতে ফেটে পড়লো, হুমড়ি খেয়ে এগিয়ে এলো তার দিকে।

    পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করলো আভিলা, কিন্তু বিশালাকারের লোকটি তার হাত ধরে টেনে একটা টুলের উপর বসিয়ে দিলো। আরে দাঁড়ান, মহামান্য রাজা! আমরা এত কষ্ট করে স্পেনে এসেছি আর রাজার সাথে একচোট মদ না খেয়ে কি হয়!

    যে লোকটি তার জামার হাত ধরেছে তার দিকে তাকালো আভিলা। ছাড়ো, শান্তকণ্ঠেই বলল। আমাকে যেতে হবে।

    না…তোমাকে এখানে একটা বিয়ারের জন্য থাকতে হবে, আমিগো। আরো শক্ত করে ধরলো লোকটা আর তার সঙ্গে থাকা বন্ধু নোংরা হাতে আভিলার বুকে ঝোলানো মেডেলগুলো নাড়তে শুরু করলো। দেখে মনে হচ্ছে। তুমি সত্যি সত্যি একজন হিরো, পপস। আভিলার অন্যতম একটি মূল্যবান। মেডেলে টোকা দিলো লোকটি। একটা মধ্যযুগের মুগুর? তাহলে তুমি জ্বলজ্বলে বর্ম পরা একজন নাইট? অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে।

    ধৈর্য, আভিলা নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো। এই জীবনে এরকম অসংখ্য মানুষকে সে মোকাবেলা করেছে-সাধারণ মাথামোটা মানুষজন, অসুখি, কোন কিছুর জন্য রুখে দাঁড়ায়নি যারা-অন্ধের মতো তারা এমন সব মানুষের মুক্তি।

    আর স্বাধীনতাকে হরণ করে যারা অন্যকে এসব দেবার জন্য লড়াই করেছে।

    সত্যি বলতে কি, ভদ্রভাবেই জবাব দিলো আভিলা, এই মুগুরটা স্প্যানিশ নেভির ইউনিদাদ দে অপারেসিওন্স এসপেসিয়ালেস-এর একটি সিম্বল।

    স্পেশাল অপস? লোকটা ভড়কে গিয়ে বলল। দারুণ ব্যাপার তো। তাহলে এই সিম্বলটা কীসের? আভিলার ডানহাতের দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

    হাতের তালুর দিকে তাকালো আভিলা। তালুর উল্টোপিঠে, মাঝখানের নরম মাংসের উপরে কালো রঙের একটি ট্যাটু আঁকা-চতুর্দশ শতকের একটি সিম্বল।

    নক্সা

    এই চিহ্নটি আমাকে সুরক্ষা দেবে, ভাবলো আভিলা, নক্সাটার দিকে তাকালো এবার। যদিও এটা আমার দরকার পড়বে না।

    বাদ দাও, ষণ্ডাটা বলল তাকে, অবশেষে ছেড়ে দিলো আভিলার হাত। বারমেইডের দিকে ফিরে বলল সে, তুমি খুব কিউট তো। তুমি কি শতভাগ স্প্যানিশ?

    হ্যাঁ, গর্বের সাথে জবাব দিলো মেয়েটি।

    তোমার মধ্যে কি একটুও আইরিশ নেই?

    না।

    তুমি কি একটু চাও? লোকটা হিস্ট্রিয়াগ্রস্তের মতো বারের উপর আঘাত করলো জোরে জোরে।

    তাকে বিরক্ত করো না, আদেশের সুরে বলল আভিলা।

    লোকটা ঘুরে দাঁড়ালো চোখমুখ শক্ত করে।

    তার অন্য সঙ্গিটি আভিলার বুকে জোরে ধাক্কা দিলো। তুই আমাদেরকে বলে দিবি কী করতে হবে না করতে হবে?

    আজকের দীর্ঘ ভ্রমণের পর বেশ ক্লান্ত আভিলা, গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো সে। বারের দিকে ইশারা করলো এবার। আপনারা দয়া করে বসুন। আমি আপনাদের জন্য বিয়ার কিনে দিচ্ছি।

    উনি আছেন বলে রক্ষা, বারমেইড মনে মনে বলে উঠলো। যদিও ব্যাপারটা সে সামলাতে পারতো। চেয়ে চেয়ে দেখলো কতোটা শান্তভাবেই না এই অফিসার দু দুটো বদমাশকে মোকাবেলা করছে। মনে মনে আশা করলো, অফিসার যেন ক্লোজিং টাইম পর্যন্ত এখানে থেকে যায়।

    দুই বোতল বিয়ারের অর্ডার দিলো অফিসার, সাথে তার জন্য আরেকটা টনিক। একটু আগে যে টুলে বসেছিল সেটাতেই বসে পড়লো আবার। তার দু পাশে বসে পড়লো সেই দু-জন ফুটবল ভক্ত পাণ্ডা।

    টনিক ওয়াটার? একজন টিটকারি মেরে বলল। আমি ভেবেছিলাম আমরা একসাথে একটু মদ্যপান করবো।

    বারমেইডের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত একটি হাসি দিয়ে বাকি টনিকটুকু শেষ করলো অফিসার। আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, উঠে দাঁড়িয়ে বলল সে। তোমরা তোমাদের বিয়ার উপভোগ করো, কেমন।

    সে উঠে দাঁড়াতেই দু-দুজন পাণ্ডা, যেন রিহার্সেল করা ভঙ্গিতে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে রীতিমতো জোর করে বসিয়ে দিলো আবার। অফিসারের চোখে মুহূর্তের জন্য রাগের ছটা দেখা গেলেও উধাও হয়ে গেল সেটা।

    নানাজান, আমার মনে হয় না তুমি তোমার এই প্রেমিকাকে এখানে। আমাদের সাথে একা রেখে চলে যেতে চাইছো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে অশ্লীল একটি ভঙ্গি করলো সেই পাণ্ডা।

    অফিসার বেশ কিছুক্ষণ শান্তভাবে বসে থাকার পর জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকালো।

    তাকে খপ করে ধরে ফেলল পাণ্ডা দু-জন। হেই! কী করছো তুমি?!

    আস্তে করে একটা মোবাইলফোন বের করে আনলো অফিসার। স্প্যানিশে কিছু একটা বলল সে। তার কথা বুঝতে না পেরে লোকদুটো চেয়ে থাকলে আবার ইংরেজিতে বলতে লাগলো সে। আমি দুঃখিত, আমার স্ত্রীকে কল করে বলা দরকার আমার একটু দেরি হবে। মনে হচ্ছে আমাকে এখানে আরেকটু থাকতে হবে আজ।

    এবার তুমি আসল কথা বলছে, দোস্ত! বিশালাকৃতির লোকটা বলল, বিয়ার গলাধকরণ করে বারের উপরে বেশ জোরে আছাড় মেরে রাখলো গ্লাসটা। আরেকটা দাও!

    গ্লাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে বারমেইড আয়নায় দেখতে পেলো অফিসার তার ফোনে কিছু বাটন চেপে কানে ধরলো। কলটা রিসিভ করা হলে স্প্যানিশে বলতে লাগলো সে।

    লে লামো দেসদে এল বার মলি মালোন, অফিসার বলল। গ্লাস ঢেকে রাখার কোস্টারের উপরে লেখা বারের নাম আর ঠিকানা দেখে নিয়েছে সে। কলে পারতিকুলার দে এস্রাউনজা, ওচো। একটু অপেক্ষা করে আবার বলল, নেসেসিতামো আয়ুদা ইমিদিয়াতামেস্তে। হায় দোস অমব্রেস এরিদিওস। এরপরই ফোনটা রেখে দিলো।

    দু-জন মানুষ আহত হয়েছে? বারমইেডের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। একটু ইমার্জেন্সি সাহায্যের দরকার আছে?

    তার কথার মানেটা কী সেটা বোঝার আগেই বারমেইড দেখতে পেলো সাদা ঘোলাটে কিছু একটা। অফিসার ডানদিকে একঝটকায় ঘুরে তার কনুই দিয়ে বড় পাণ্ডাটার নাকে সজোরে আঘাত করে বসেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে লোকটার মুখ ঢেকে গেল মুহূর্তে। টুল থেকে পড়ে গেল সে। দ্বিতীয় লোকটি কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই অফিসার বাম দিকে ঘুরে অন্য কনুইটা ব্যবহার করে তার শাসনালীতে আঘাত হানলো। টুল উল্টে মেঝেতে পড়ে গেল সে।

    আতঙ্কে বারুদ্ধ হয়ে বারমেইড মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। একজন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, অন্যজন দম বন্ধ হয়ে গলা চেপে ধরে রেখেছে দু-হাতে।

    আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো অফিসার। অদ্ভুত এক শীতলতায় সে তার মানিব্যাগ থেকে এক শ ইউরোর একটি নোট বের করে বারের উপরে রাখলো।

    ক্ষমা করবে আমাকে, স্প্যানিশে বলল সে। খুব জলদিই পুলিশ এসে পড়বে এখানে তোমাকে সাহায্য করার জন্য। কথাটা বলেই সে বার থেকে বের হয়ে গেল।

    বাইরে এসে বুক ভরে রাতের বাতাস টেনে নিলো অ্যাডমিরাল আভিলা। আলামেদা দে মাত্সরেদ্দো দিয়ে নদীর দিকে পা বাড়ালো সে। পুলিশের সাইরেনের শব্দ কাছে আসতেই একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় সরে এলো। খুবই সিরিয়াস একটা কাজ করতে হবে তাকে। আজকের রাতে আর কোন জটিলতায় জড়ানোর ইচ্ছে তার নেই।

    আজ রাতের মিশনের ব্যাপারে দ্য রিজেন্ট পরিষ্কারভাবে রূপরেখা জানিয়ে দিয়েছে।

    দ্য রিজেন্টের কাছ থেকে অর্ডার নিতে আভিলার জন্য তেমন বেগ পেতে হয়নি। সিদ্ধান্ত নেবার কিছু নেই। অপরাধবোধও কাজ করে না। শুধু অ্যাকশন। সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে কমান্ড দিয়েছে সে, এখন অন্যদেরকে হাল ধরতে আর জাহাজ চালাতে দিলে এক ধরণের স্বস্তিই কাজ করে তার মধ্যে।

    এই যুদ্ধে আমি একজন পদাতিক সৈন্য মাত্র।

    কয়েক দিন আগে, দ্য রিজেন্ট তার সাথে এমন একটি ভয়ানক সিক্রেট শেয়ার করে যে, আভিলার পক্ষে পুরোপুরি সমর্থন দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। গতরাতের মিশনের বর্বরতা এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, যদিও সে জানে তার এমন কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে ক্ষমা করা হবে।

    নীতি-নৈতিকতা অসংখ্য রূপে বিদ্যমান। আজ রাত শেষ হবার আগে আরো অনেক মৃত্যু ধেয়ে আসবে।

    নদীর তীরে উন্মুক্ত প্লাজায় এসে আভিলা তার সামনে থাকা বিশাল স্থাপত্যের দিকে চোখ তুলে তাকালো। লোহার টাইলে ঢাকা এটা হলো জঘন্য একটা জিনিসের আখড়া–এ যেন চূড়ান্ত একটি নৈরাজ্যকে জায়গা করে দেবার জন্য স্থাপত্যকলার দুশ বছরের উন্নতিকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলার মতোই কোন ব্যাপার।

    অনেকে এটাকে জাদুঘর বলে ডাকে। আমি এটাকে কুৎসিত দানব বলি।

    নিজের চিন্তাভাবনা গুছিয়ে নিলো আভিলা। প্লাজাটা অতিক্রম করে বিলবাওর গুগেনহাইম মিউজিয়ামের বাইরে অদ্ভুত দর্শনের ভাস্কর্যগুলোর মাঝখান দিয়ে চলে গেল সে। ভবনের কাছে আসতেই সাদা-কালো পোশাকে সজ্জিত কয়েক ডজন অতিথিকে ঘোরাফেরা করতে দেখলো।

    ঈশ্বরবিহীন মানুষের এক সমাবেশ।

    কিন্তু আজকের রাতটা যেভাবে পার হবে সেটা তাদের কল্পনায়ও নেই।

    অ্যাডমিরালের ক্যাপটা ঠিকমতো মাথায় বসিয়ে জ্যাকেটটা হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে নিলো সে। যে কাজটা করতে যাবে তার জন্য মানসিকভাবে নিজেকে শক্ত করে নিলো। আজকের রাতটি আরো বড় একটি মিশনের অংশ-ন্যায়পরায়ণদের একটি ক্রুসেড।

    সামনের প্রাঙ্গণ পেরিয়ে জাদুঘরের প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে যাবার সময় পকেটে থাকা রোসারিটা স্পর্শ করলো আভিলা।

    অধ্যায় ৩

    জাদুঘরের আর্টিয়ামটি দেখে মনে হয় এটি একটি ফিউচারিস্টিক ক্যাথেড্রাল।

    ভেতরে পা রাখতেই ল্যাংডনের চোখ গেল উপরের দিকে, এক সারি বিশাল সাদা পিলার কাঁচের পদার সাথে উঠে গেছে দুশো ফিট উপরে, ভল্টেড সিলিংয়ের দিকে। সেখান থেকে হ্যালোজেন স্পটলাইট বিচ্ছুরিত করছে বিশুদ্ধ সাদা আলো। শূন্যে ভেসে থাকা জালের মতো বিস্তৃত অসংখ্য ক্যাটওয়ার্ক, বেলকনি আর প্যাসেজগুলো সাদা-কালো ডটে অঙ্কিত। ভিজিটররা উপরের গ্যালারি থেকে যাচ্ছে আসছে, দাঁড়িয়ে আছে উঁচু জানালার সামনে, নিচের লেগুনের দিকে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। কাছেই কাঁচের এলিভেটরগুলো নিঃশব্দে নিচে নেমে যাচ্ছে আরো অনেক অতিথিকে উপরে নিয়ে আসার জন্য। এরকম জাদুঘর ল্যাংডন কখনও দেখেনি। এমনকি এর ভেতরের শব্দও তার কাছে বড় অচেনা। মুগ্ধ দর্শকদের ফিসফিসানির বদলে এখানকার কাঁচে প্রতিধ্বণিত হচ্ছে প্রাণবন্ত। মানুষজনের সরব গুঞ্জন। ল্যাংডনের কাছে কেবলমাত্র জিভের তালুতে সুপরিচিত বিশুদ্ধ একটি স্বাদ অনুভব করা বাদে বাকি সব কিছুই অচেনা লাগছে। জাদুঘরের বাতাস সারা দুনিয়াতে প্রায় একই রকম-বাতাস ফিল্টার করে তারপর আয়োনাইজড পানি দিয়ে ৪৫ শতাংশ আদ্রতা বজায় রাখা হয়।

    অনেকগুলো টাইট সিকিউটি পয়েন্ট পেরিয়ে এলো ল্যাংডন, লক্ষ্য করে দেখলো সশস্ত্র গার্ডের সংখ্যা বেশ কম। অবশেষে আরেকটি চেক-ইন টেবিলের কাছে চলে আসতেই এক তরুণী একটি হ্যান্ডসেট দেখিয়ে বলল, অদিওগুইয়া?

    হেসে ফেলল ল্যাংডন। ধন্যবাদ, লাগবে না।

    চলে যেতে উদ্যত হবে এমন সময় মেয়েটা তাকে থামিয়ে দিয়ে নিখুঁত ইংরেজিতে বলে উঠলো, আমি দুঃখিত, স্যার। কিন্তু আজ রাতে আমাদের আয়োজক মি.  এডমন্ড কিয়ার্শ বলে দিয়েছেন সবাই যেন হেডসেট ব্যবহার করে। এটা আজকের অনুষ্ঠানেরই অংশ।

    ওহ্, তাহলে তো নিতেই হচ্ছে।

    ল্যাংডন হাত বাড়িয়ে হেডসেটটা নিতে গেলে মেয়েটা তাকে হাত তুলে বিরত করে অতিথিদের দীর্ঘ তালিকায় চোখ বুলাতে লাগলো। তালিকায় তার নামটা পাওয়া গেলে অতিথির নামের সাথে ম্যাচ করা একটি নাম্বারযুক্ত হেডসেট বাড়িয়ে দিলো সে। আজকের এই ট্যুরটি প্রত্যেক ভিজিটরের জন্য আলাদাভাবে কাস্টমাইজড করা হয়েছে।

    তাই নাকি? চারপাশে তাকালো ল্যাংডন। কয়েক শ অতিথি আছে এখানে। হেডসেটটার দিকে তাকালো এবার, চিকন মেটালের একটি লুপ, যার দুই প্রান্তে বেশ ছোট দুটো প্যাড আছে। সম্ভবত তার হতবুদ্ধিকর অবস্থা দেখে। মেয়েটা উঠে এসে তাকে সাহায্য করলো।

    এগুলো একেবারেই নতুন জিনিস, ডিভাইসটা সেট করতে করতে বলল সে। এই প্যাডদুটো আপনার কানের ভেতরে ঢুকবে না, বরং মুখের উপরে বসে থাকবে। মেয়েটা হেডসেটের লুপ ল্যাংডনের মাথার পেছনে সেট করে প্যাডদুটো চোয়ালের হাড়ের ঠিক উপরে আস্তে করে বসিয়ে দিলো।

    কিন্তু কিভাবে–

    বোন কনডাকশান টেকনোলজি প্রযুক্তি। প্যাডদুটো সরাসরি চোয়ালের হাড়ের মধ্য দিয়ে শব্দ বয়ে নিয়ে যাবে আপনার কানের ককলিয়ারে। আমি এর আগে এটা ব্যবহার করে দেখেছি। খুবই অসাধারণ জিনিস-মনে হবে আপনার। মাথার ভেতরে শব্দ হচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা, এতে করে আপনার কান। বাইরের শব্দ শুনতে কোন বেগই পাবে না।

    দারুণ তো।

    এই টেকনোলজিটা মি.  কিয়াৰ্শ দশ বছর আগেই উদ্ভাবন করেছেন। এখন এটা অনেক হেডফোন ব্র্যান্ডই বাজারজাত করছে ক্রেতাদের জন্য।

    আশা করি লুডভিগ ফন বিটোভেন এর থেকে তার ভাগ পাবেন, মনে মনে বলল ল্যাংডন। এই বোন কনডাকশান টেকনোলজির সত্যিকারের উদ্ভাবক ছিলেন এক পর্যায়ে বধির হয়ে যাওয়া আঠারো শতকের এই সঙ্গিতজ্ঞ। বধির অবস্থায় একদিন তিনি আবিষ্কার করলেন তার পিয়ানোতে একটি ধাতব দণ্ড লাগিয়ে বাজানোর সময় সেটা কামড় দিয়ে রাখলে তার চোয়ালের হাড় দিয়ে পরিবাহিত হয়ে শব্দ চলে যাচ্ছে মাথার ভেতরে। বেশ ভালোমতোই তিনি সেটা শুনতে পাচ্ছেন।

    আশা করি আপনি আপনার টুর উপভোগ করবেন ভালোমতোই, মেয়েটা বলল। প্রেজেন্টেশন শুরু হবার আগে আপনি এক ঘণ্টা সময় পাবেন জাদুঘরটা ঘুরে দেখার জন্য। উপরতলায় কখন যেতে হবে সেটা আপনাকে জানিয়ে দেবে অডিও-গাইড।

    ধন্যবাদ তোমাকে। আমাকে কি কোন কিছু চাপ-টাপ দিতে হবে।

    না। এই ডিভাইসটা নিজে থেকেই চালু হয়। আপনি চলতে শুরু করলেই আপনার টুর-গাইড সচল হয়ে যাবে।

    ওহ, তাই নাকি, হেসে বলল ল্যাংডন। অতিথিদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে আর্টিয়ামের দিকে পা বাড়ালো সে। সবাই এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করছে। সবার চোয়ালের নিচেই একই রকম হেডসেট লাগানো।

    আর্টিয়ামের মাঝপথে একটি পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেলো সে। গুড ইভনিং…বিলবাওয়ের গুগেনহাইমে স্বাগতম আপনাকে।

    ল্যাংডন জানে এটা তার হেডসেট থেকে আসছে, তারপর একটু থেমে পেছন ফিরে তাকালো। ইফেক্টটা চমকে দেবার মতো নিখুঁতভাবে এক তরুণ বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে-যেন মাথার ভেতরে কেউ বসে আছে ঘাপটি মেরে।

    আপনাকে আন্তরিকভাবে স্বাগতম, প্রফেসর ল্যাংডন। খাঁটি বৃটিশ উচ্চারণে কণ্ঠটা বন্ধুভাবাপন্ন আর বেশ মিহি। আমার নাম উইনস্টন, আজ রাতে আমি আপনার গাইড হতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি।

    কাকে দিয়ে তারা এটা রেকর্ড করেছে-হিউ গ্র্যান্ট?

    আজ রাতে, উফুল্ল কণ্ঠটা বলতে লাগলো, আপনি যেখানে খুশি সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারেন, আপনি যা দেখবেন তার উপরে আমি আপনাকে যথাযথ আলোকপাত করবো।

    বোঝাই যাচ্ছে, সুরেলা কণ্ঠের ন্যারেটর আর বোন কনডাকশন টেকনোলজি ছাড়াও প্রতিটি হেডসেটে জিপিএস রয়েছে যার ফলে ভিজিটর জাদুঘরের ঠিক কোন জায়গায় অবস্থান করছে সেটার উপর ভিত্তি করেই ন্যারেটর তার কমেন্ট্রি দিতে পারে।

    আমি বুঝতে পারছি, স্যার, কণ্ঠটা যোগ করলো, আর্টের প্রফেসর হবার সুবাদে আপনি আমাদের বিশেয়জ্ঞ অতিথিদের মধ্যে অন্যতম একজন। এ কারণে আপনার ইনপুট খুবই দরকার হবে আমার। কিন্তু বাজে ব্যাপার হলো, নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের উপরে আমার বিশ্লেষণের সাথে পুরোপুরি ভিন্নমত পোষণ করার সম্ভাবনা রয়েছে আপনার! আক্ষেপের সুর ভেসে এলো কণ্ঠটা থেকে।

    আসলেই? এই স্ক্রিপ্টটা লিখেছে কে? স্বীকার করতেই হয়, উফুল্ল কণ্ঠ আর পারসোনালাইজড সার্ভিস খুবই চমকপ্রদ ব্যাপার। কিন্তু শত শত হেডসেট কাস্টমাইজ করার জন্য যে কী পরিমাণ প্রচেষ্টার দরকার পড়তে পারে সেটা ল্যাংডন কল্পনা করতেও পারলো না।

    ভালো কথা, কণ্ঠটা চুপ মেরে গেল। যেন ওটার প্রি-প্রোগ্রাম করা স্বাগত সংলাপটি শেষ হয়ে গেছে।

    আর্টিয়ামের জনসমাবেশের উপরে ঝুলে থাকা আরেকটি লাল রঙের বিশাল ব্যানারের দিকে তাকালো ল্যাংডন।

    এডমন্ড কিয়ার্শ
    আজ রাতে আমরা সামনের দিকে এগি
    য়েযাবো

    এডমন্ড আসলে কী করতে যাচ্ছে?

    এলিভেটরগুলোর দিকে তাকালো ল্যাংডন। একদল অতিথি কথাবার্তায় মশগুল। এদের মধ্যে বিশ্বব্যাপি ইন্টারনেট কোম্পানির দু-জন প্রতিষ্ঠাতা, একজন স্বনামখ্যাত ভারতীয় অভিনেতা এবং অসংখ্য ভিআইপি রয়েছে। যাদের অনেককেই তার চেনার কথা, কিন্তু সে চিনতে পারছে না। কিছুটা অনিচ্ছুক আর তেমন কোন প্রস্তুতি নেই বলে সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা বলিউড নিয়ে আলাপচারিতা এড়িয়ে যাবার জন্য বিপরীত দিকের দেয়ালে টাঙানো বিশাল বড় একটি মডার্ন আর্টের দিকে এগিয়ে গেল ল্যাংডন।

    ইন্সটলেশনটা কালচে গর্তের ভেতরে রাখা, ওর মধ্যে আছে নয়টি সংকীর্ণ কনভেয়ার বেল্ট, ওগুলো মেঝে ফুড়ে উপরের দিকে উঠে গিয়ে ছাদের ফাঁকফোকড় দিয়ে উধাও হয়ে গেছে। দেখে মনে হয়, একটি খাড়া প্লেনের নয়টি মুভিং ওয়াকওয়ের মতোই। প্রতিটি কনভেয়ারে লেখা আছে জ্বলজ্বলে বার্তা, সেগুলো যেন আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে।

    আমি সশব্দে প্রার্থনা করি…আমার ত্বকে তোমার গন্ধ পাই…তোমার নাম ধরে ডাকি আমি।

    ল্যাংডন একটু কাছে যেতেই টের পেলো নড়তে থাকা ব্যান্ডগুলো আসলে থেমে আছে; নড়াচড়ার এই দৃষ্টিভ্রমটা সৃষ্টি করা হয়েছে খাড়া বিমের উপরে ছোটছোট এলইডি লাইট বসিয়ে। বাতিগুলো বিরামহীনভাবে জ্বলে জ্বলে শব্দের আকৃতি তৈরি করছে, আর সেটা মেঝে থেকে উঠে এসে বিম ধরে উপরে উঠে সিলিংয়ে গিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে।

    আমি অনেক কাঁদি…ওখানে ছিল রক্ত…কেউ আমাকে বলেনি।

    এমনি একটু দেখার জন্য খাড়া বিমগুলোর দিকে এগিয়ে গেল ল্যাংডন।

    এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং পিস, অডিও-গাইড বলে উঠলো এবার। হঠাৎ করেই ফিরে এসেছে ওটা। এটাকে বলা হয় ইন্সটলেশন ফর বিলবাও, জেনি হোলজার নামের একজন শিল্পীর কনসেপ্ট অনুযায়ি এটার নির্মাণ করা হয়েছে। এটাতে আছে নয়টি এলইডি সাইনবোর্ড, প্রতিটা চল্লিশ ফিট লম্বা, বাস্ক, স্প্যানিশ আর ইংরেজি ভাষায় বাণী সম্প্রচার করে থাকে–এর সবটাই এইড্রসের ভীতিকর দিক এবং যারা এরফলে যন্ত্রণা ভোগ করে সেসব নিয়ে।

    ল্যাংডন স্বীকার করতে বাধ্য হলো, এটা যেমন মনোমুগ্ধকর তেমনি হৃদয়বিদারকও বটে।

    সম্ভবত আপনি জেনি হোলজারের কাজ আগেও দেখেছেন?

    ল্যাংডনের মনে হলো, উপরের দিকে ধাবমান লেখাগুলোর দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে আছে সে।

    আমি মুখ লুকাই…তোমার মুখ লুকাতে দেই…তোমাকে মাটি চাপা দেই।

    মি.  ল্যাংডন? তার মাথার ভেতরে কণ্ঠটা বলে উঠলো। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আপনার হেডসেট কি কাজ করছে ঠিকমতো?

    সম্বিত ফিরে পেলো ল্যাংডন। দুঃখিত-কি বলল? হ্যালো?

    হ্যালো, কণ্ঠটা জবাব দিলো। আমার মনে হয় আমরা এরইমধ্যে হ্যালো বলে ফেলেছি, আমি কেবল চেক করে দেখছিলাম আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন কিনা?

    আমি. ..আমি দুঃখিত, কথাটা বলতে গিয়ে সামান্য তোতলালো ল্যাংডন। এক্সিবিশন থেকে মুখ ফিরিয়ে আর্টিয়ামের অন্যদিকে তাকালো সে। আমি ভেবেছিলাম এটা রেকর্ডিং করা কথা! বুঝতে পারিনি, এটা আসলে সত্যিকারের কোন মানুষ। ল্যাংডনের চোখে ভেসে উঠলো এক সারি কিউবিকলে বসে আছে একদল কিউরেটর, তাদের সবার মাথায় হেডসেট আর হাতে জাদুঘরের ক্যাটালগ।

    কোন সমস্যা নেই, স্যার। আজ রাতে আমি আপনার পার্সোনাল গাইড। আপনার হেডসেটে একটা মাইক্রোফোনও আছে। এই প্রোগ্রামটা করা হয়েছে ইন্টারঅ্যাকটিভ অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে, যেন আমি এবং আপনি আর্ট নিয়ে আলাপ করতে পারি।

    বাকি অতিথিদেরকেও হেডসেটে কথা বলতে দেখলো ল্যাংডন। এমনকি যারা সঙ্গে করে স্বামী-স্ত্রীকেও নিয়ে এসেছে তারাও আলাদা আলাদা হেডসেট ব্যবহার করছে। হেডসেটে পার্সোনাল গাইডের সাথে কথা বলার সময় তাদের চোখেমুখেও দেখতে পাচ্ছে বিস্মিত আর অবাক হবার অভিব্যক্তি।

    সব অতিথির জন্যই প্রাইভেট গাইড রয়েছে?

    জি, স্যার। আজকে আমরা তিন শ আঠারোজন অতিথিকে এভাবে ট্যুর করাচ্ছি।

    এটা তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

    আপনি তো জানেনই, এডমন্ড কিয়াশ শিল্পকলা আর টেকনোলজির বিশাল বড় একজন ফ্যান। তিনি ব্যক্তিগতভাবে গ্রুপ ট্যুর ভীষণ অপছন্দ করেন, তাই এই সিস্টেমটা জাদুঘরের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করেছেন। এভাবে প্রাইভেট টুরে একজন ভিজিটর নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারেন, এমন সব প্রশ্ন করতে পারেন যেটা গ্রুপ ট্যুরে করতে হয়তো তিনি ইতস্তত বোধ করতেন। এটা অনেক বেশি নিবিড় আর মনোসংযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

    শুনতে হয়তো পুরনো কথা মনে হতে পারে, কিন্তু আমরা প্রত্যেকে সশরীরে ঘুরে দেখছি না কেন?

    লজিস্টিকের ব্যাপার, স্যার, লোকটা জবাব দিলো। জাদুঘরে প্রত্যেক দর্শনার্থির জন্য একজন করে পার্সোনাল ডোসেন্ট যোগ করলে মানুষের সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যাবে। এরফলে সঙ্গত কারণেই সম্ভাব্য ভিজিটরের সংখ্যা অর্ধেকে। নামিয়ে আনতে হবে। তারচেয়েও বড় কথা, সব ডোসেন্ট একসঙ্গে কথা বললে যে হাউকাউয়ের সৃষ্টি হবে সেটা মনোযোগ নষ্ট করবে। ডিসকাশনটা বাধা-বিঘ্ন ছাড়া যেন চলে সেজন্যে এটা করা হয়েছে। মি.  কিয়ার্শ সব সময় বলে থাকেন, আর্টের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়লগকে প্রমোট করা।

    আমি পুরোপুরি একমত, জবাবে বলল ল্যাংডন, এ কারণেই লোকজন খুব কমই বন্ধু অথবা প্রেমিক-প্রেমিকা নিয়ে জাদুঘরে আসে। এইসব হেডসেটকে তাহলে একটু অসামাজিকই বলা চলে।

    আপনি যদি আপনার পছন্দের মানুষ কিংবা বন্ধুদের নিয়ে আসেন, বৃটিশ উচ্চারণে জবাব এলো, তাহলে সবগুলো হেডসেট একজন ড্ডাসেন্টের কাছে অ্যাসাইন করাতে পারেন গ্রুপ ডিসকাশন উপভোগ করার জন্য। সফটওয়্যারটি খুবই অগ্রসর।

    মনে হচ্ছে তোমার কাছে সব প্রশ্নের জবাবই আছে।

    সত্যি বলতে কি, এটাই আমার কাজ। বিব্রতকর হাসি দিলো গাইড তারপর হুট করেই আবার সেটা থামিয়ে দিলো। প্রফেসর, আপনি যদি এখন আর্টিয়াম ধরে জানালাগুলোর কাছে চলে যান তাহলে এই জাদুঘরের সবচাইতে বড় পেইন্টিংটা দেখতে পাবেন।

    আর্টিয়াম ধরে এগিয়ে যাবার সময় ল্যাংডন পেরিয়ে গেল, সাদা বেইজবল ক্যাপ পরা ত্রিশটির মতো আকর্ষণীয় দম্পতিদেরকে। তাদের সবার ক্যাপের সামনে কোনো কর্পোরেট লোগো নেই, বরং আছে চমকে যাবার মতো একটি সিম্বল।

    নাস্তিক সিম্বল

    এই আইকনটি ল্যাংডন বেশ ভালো করেই চেনে। তারপরও কোনো ক্যাপে এটাকে দেখেনি সে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই স্টাইলিশ ইংরেজি A অক্ষরটি এ বিশ্বের সবচাইতে ক্রমবর্ধনশীল এবং উচ্চকিত কণ্ঠ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া নাস্তিক জনগোষ্ঠির কাছে সার্বজনীন একটি সিম্বল হয়ে উঠেছে। তারা এখন প্রতিদিন আরো জোড়ালো কণ্ঠে বলে যাচ্ছে ধর্মের বিরুদ্ধে তাদের বিবেচনায় ধর্মিয় বিশ্বাস কতোটা বিপজ্জনক হতে পারে সেটাই বলে তারা।

    নাস্তিকদের এখন নিজস্ব বেইজবল ক্যাপ আছে?

    তার আশেপাশে থাকা টেকনোলজি-প্রিয় মানুষজনদের জনসমাবেশের দিকে চোখ বুলিয়ে ল্যাংডন নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো, এইসব অ্যানালিটিক্যাল-মাইন্ডেড তরুণদের অনেকেই সম্ভবত এডমন্ড কিয়ার্শের মতোই ধর্মবিরোধি। একজন ধর্মিয় সিম্বলজির প্রফেসরের জন্য আজকের শ্রোতারা ঠিক তার শ্রোতা নয়।

    .

    অধ্যায়৪

    কন্সপিরেসিনেট.কম

    ব্রেকিং নিউজ

    আপডেট : আজকের দিনে কন্সপিরেসিনেটের সেরা ১০টি সংবাদ এখানে ক্লিক করলেই দেখতে পাবেন। এছাড়াও আমাদের কাছে। এইমাত্র পাওয়া নতুন আরেকটি সংবাদও রয়েছে!

    এডমন্ড কিয়ার্শ সারপ্রাইজ কোনো ঘোষণা দেবেন?

    স্পেনের বিলবাওর গুগেনহাইম মিউজিয়ামে প্রযুক্তি দুনিয়ার সব রথিমহারথিরা সমবেত হয়েছে এক ভিআইডি ইভেন্টে অংশ গ্রহণ করতে, যার আয়োজক ফিউচারিস্ট এডমন্ড কিয়ার্শ। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আজকের অনুষ্ঠানের জন্য। আগত অতিথিদের কাউকেই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানানো হয়নি। কিন্তু কন্সপিরেসিনেট নামপ্রকাশে অনিচছুক সংশ্লিষ্ট একজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছে, আর কিছুক্ষণ পরই এডমন্ড কিমার্শ তার বক্তব্য দেবেন, তিনি তার অতিথিদের কাছে বিস্ময়কর কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়ে চমকে দেবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। কন্সপিরেসিনেট এই ঘটনার উপরে চোখ রাখছে, নতুন কোন সংবাদ পাওয়ামাত্র জানানো হবে। ইউরোপের সবচাইতে বড় সিনাগগটি অবস্থিত বুদাপেস্টের ডোহানি স্ট্রিটে। মুরিশ স্টাইলে নির্মিত দু দুটো বিশাল মিনারসংবলিত এই ধর্মিয় উপাশনালয়ে একসঙ্গে তিন হাজারেরও বেশি ধর্মপ্রাণ মানুষ সমবেত হতে পারে-নিচের তলার বেঞ্চিগুলো পুরুষ আর বেলকনির বেঞ্চিতে নারীদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে।

    বাইরের বাগানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দখলকৃত নাৎসি বাহিনীর হাতে নিহত কয়েক শ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদির কবর রয়েছে। এই জায়গাটা জীবনবৃক্ষ দিয়ে চিহ্নিত করা-বিষণ্ণ শোকগ্রস্ত উইলো গাছের প্রতিটি পাতায় ভিক্টিমদের নাম লেখা একটি ধাতব ভাস্কর্য। জোরে বাতাস বইলে ধাতব পাতাগুলো একে অন্যের সঙ্গে বাড়ি খায়, আর বিশাল ফাঁকা জায়গায় অদ্ভুতুড়ে একটি প্রতিধ্বণির সৃষ্টি করে।

    তিন দশক ধরে এই সিনাগগের আধ্যাত্মিক নেতা শ্রদ্ধেয় তালমুদিচ এবং কাবালিস্ট পণ্ডিত-রাবাই ইয়েহুদা কোভেস-বৃদ্ধ বয়স আর ভগ্ন স্বাস্থ্য থাকা সত্ত্বেও হাঙ্গেরিসহ সারাবিশ্বের ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে বহাল আছেন।

    দানিয়ুব নদীতে সূর্য ডুবে যেতেই রাবাই কোভেস সিনাগগ থেকে বেরিয়ে এলেন। দোহানি স্ট্রিটের বুটিকের দোকান আর রহস্যময় রুইন বাস পেরিয়ে পা বাড়ালেন মার্সিয়াস ১৫ স্ট্রিটে নিজের বাড়ির দিকে। তর বাড়ি থেকে পাথর ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত এলিজাবেথ ব্রিজ, যেটা বুদা এবং পেস্টের পুরনো শহরদুটোর সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। এ দুটো শহর একত্রিত হয় ১৮৭৩ সালে।

    ইসরাইলিদের মিশর থেকে হিজরত করার দিনটিকে স্মরণ করে যে পাসওভার দিবস পালন করা হয় সেই দিবস ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে-সাধারণত এটাই বছরের সবচাইতে আনন্দঘন সময় কোভেসের কাছে-তারপরও গত সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়ন পার্লামেন্টের অধিবেশন শেষ করে ফেরার পর থেকে নিজেকে তার নিঃস্ব আর উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।

    ঐ অধিবেশনে কখনও উপস্থিত না থাকতে পারলেই ভালো হতো।

    বিশপ ভালদেসপিনো, আল্লামা সাঈদ-আল-ফজল আর ফিউচারিস্ট এডমন্ড কিয়ার্শের সাথে যে অভূতপূর্ব মিটিংটা হয়েছিল সেটা তার চিন্তাভাবনাকে তিনদিন ধরে কুরে কুরে খাচ্ছে।

    নিজের বাড়িতে এসে কোভেস সরাসরি চলে গেলেন তার সামনের প্রাঙ্গণের বাগানে, তারপর নিজের হাৎজিকোর দরজার তালা খুলে ফেললেন-এটা তার ছোট্ট একটি কটেজ, একান্তে নিরুদ্ৰবভাবে স্টাডি করার জায়গা।

    কটেজটায় মাত্র একটাই ঘর, সেখানে আছে উঁচু উঁচু বইয়ের শেলফ, তাতে ঠাসা অসংখ্য ধর্মিয়পুস্তক। নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলেন কোভেস। তার সামনে বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দঙ্গলের দিকে তাকালেন তিনি।

    কেউ যদি আমার ডেস্কটা এখন দেখে তাহলে ধরেই নেবে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

    তার কাজের জায়গায় আধডজনেরও বেশি রহস্যময় ধর্মিয় পুস্তক খোলা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেইসাথে আছে অসংখ্য স্টিকি নোট। ওগুলোর পেছনে একটা কাঠের স্ট্যান্ডের উপরে তিন তিনটি মোটা বই খোলা অবস্থায় রয়েছে-হিব্রু, আরামাইক আর ইংরেজি ভার্সনের তাওরাত-প্রতিটারই নির্দিষ্ট একটি অধ্যায় ভোলা।

    জেনেসিস-সৃষ্টিতত্ত্ব।

    আদিতে…

    স্মৃতি থেকেই কোভেস এই তিনটি ভাষায় জেনেসিস আবৃত্তি করতে পারেন। তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জোহার-এর উপর অ্যাকাডেমিক কমেন্ট্রি অথবা অ্যাডভান্স কাবালিস্ট কসমোলজিসটিক থিওরি নিয়ে পড়াশোনা করেন। কোভেসের মতো একজন পণ্ডিতের জন্য জেনেসিস পাঠ মানে আইনস্টাইনকে প্রাথমিক শ্রেণির অঙ্ক ক্লাসে পাঠানোর সমতুল্য। তা সত্ত্বেও এই সপ্তাহটি রাবাই এটাই করে গেছেন। তার ডেস্কের উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য হাতেলেখা নোট এমনভাবে এলোমেলো হয়ে আছে যেন কেউ সেগুলো নাস্তানাবুদ করে রেখে গেছে। এইসব নোটের হাতের লেখা এতটাই জড়ানো যে, রাবাই নিজেই এখন পড়তে বেগ পান।

    মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে গেছি।

    রাবাই কোভেস তাওরাত দিয়েই শুরু করেছিলেন-ইহুদি আর খৃস্টান ধর্মে জেনেসিস-এর গল্পটা একইরকম। আদিতে ঈশ্বর স্বর্গ আর নরক সৃষ্টি করেছেন। এরপর তিনি তালামুদের নির্দেশিকা লেখাগুলোর দিকে মনোযোগ দেন। মাআসেহ বেরেশিত-দ্য অ্যাক্ট অব ক্রিয়েশন-এ বর্ণিত রাবাইদের করণীয় এবং ব্যাখ্যাগুলো আবার পড়ে দেখেন। এরপর তিনি ঢু মারেন মিদরাশ-এ, প্রচলিত সৃষ্টিতত্ত্বের গল্পের মধ্যে যে বৈপরীত্য আর স্ববিরোধিতা আছে তার উপরে লেখা অসংখ্যা স্বনামখ্যাত বিশেষজ্ঞ আর পণ্ডিতের ব্যাখ্যা এবং আলোকপাতের উপরে চোখ বুলান। অবশেষে জোহার-এর আধ্যাত্মিক কাবালিস্ট বিদ্যায় ডুবে যান। যেখানে অজ্ঞাত ঈশ্বর দশটি ভিন্ন ভিন্ন সেফিরদ নাজেল করেছেন, অথবা ট্রি অব লাইফের সাথে মিল রেখে যে ডাইমেনশনগুলো সাজানো আছে, আর যা থেকে চারটি আলাদা আলাদা মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে।

    যে দুর্বোধ্য আর জটিল বিশ্বাসগুলো জুদাইজমের জন্ম দিয়েছে সেটা কোভেসকে সব সময় স্বস্তি দিয়ে থাকে মানুষ যে সব কিছু বুঝতে পারে না সেটাই যেন ঈশ্বর স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এর মধ্য দিয়ে। তারপরও এডমন্ড কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন দেখার পর, আর কিয়ার্শ যা আবিষ্কার করেছে সেটার বিস্তারিত ব্যাখ্যা, সারল্য আর স্বচ্ছতা অনুধাবন করে কোভেসের মনে হয়েছে। বিগত তিনদিন ধরে তিনি একগাদা পশ্চাদপদ আর বৈপরীত্যে ভরা সংগ্রহের দিকে তাকিয়ে আছেন। এক পর্যায়ে তিনি প্রাচীন গ্রন্থগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে দানিয়ুব নদীর তীরে হাটাহাটি করে নিজের চিন্তাভাবনাকে সুস্থির করে নিয়েছেন।

    অবশেষে যন্ত্রনাদায়ক সত্যিটা মেনে নিয়েছিলেন রাবাই কোভেস : কিয়ার্শের কাজটি এ বিশ্বের ধর্মপ্রান মানুষের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। ঐ বিজ্ঞানীর আবিষ্কার প্রায় সব প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে খুবই জোড়ালোভাবে।

    শেষ ইমেজটা আমি ভুলতে পারছি না, ভাবলেন কোভেস, ঐ প্রেজেন্টেশনের শেষদিকে তারা কিয়ার্শের বড় আকারের ফোনের ডিসপ্লেতে যা দেখেছিলেন সেটা স্মরণ করলেন। এই সংবাদ প্রতিটি মানুষকেই নাড়িয়ে দেবে-শুধুমাত্র ধার্মিকদেরই নয়।

    এখন, বিগত কিছুদিন ধরে তার এই ভাবনা সত্ত্বেও রাবাই কোভেসের সামান্যতম ধারণাও নেই, কিয়ার্শের দেয়া তথ্য নিয়ে তিনি কী করবেন।

    ভালদেসপিনো আর আল-ফজল কোন দিকনির্দেশনা খুঁজে পেয়েছেন কিনা তাতে তার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। দুদিন আগে ফোনের মাধ্যমে তাদের তিনজনের কথা হয়েছে। কিন্তু সেই আলাপ ছিল একবেরেই নিষ্ফল।

    বন্ধুরা, ভালদেসপিনো শুরু করেছিলেন এভাবে। মি.  কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনটা যে…অনেক দিক থেকেই বিব্রতকর আর উদ্বেগজনক সে ব্যাপারে আমিও নিশ্চিত। আমি তাকে ফোন করে তাগাদা দিয়েছিলাম এ নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করার জন্য কিন্তু তিনি কোন সাড়া দেননি। আমার বিশ্বাস, আমাদেরকে এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

    আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আল-ফজল বলেছিলেন। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না আমরা। পরিস্থিতির উপরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে আমাদেরকে। ধর্মবিরুদ্ধ হিসেবে কিয়ার্শ ব্যাপকভাবে পরিচিত, সে তার আবিষ্কারটি ব্যবহার করে ধর্মের যতোটুকু ক্ষতি করা সম্ভব করবে। তার আগেই কিছু একটা করতে হবে আমাদেরকে। তার আবিষ্কারটি আমাদেরকেই ঘোষণা করতে হবে। আর সেটা যতো দ্রুত সম্ভব। এর উপরে আমাদেরকে যথাযথ আলোকপাত করতে হবে যাতে করে আঘাতের মাত্রা কমিয়ে আনা যায়, আর সেটা যেন ধর্ম বিশ্বাসিদের কাছে যতোটুকু সম্ভব কম হুমকি হিসেবে আর্বিভূত হয়।

    বুঝতে পারছি জনসম্মুখে আমাদেরকে এ নিয়ে কথা বলতে হবে, ভালদেসপিনো বলেছিলেন, কিন্তু দুভাগ্যের ব্যাপার হলো, আমি কোনভাবেই বুঝতে পারছি না এই তথ্যটাকে কিভাবে নিরীহ হুমকি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন তিনি। তাছাড়া আমরা যে মি.  কিয়ার্শের কাছে প্রতীজ্ঞা করেছি, তার সিক্রেটটা প্রকাশ করবো না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার।

    কথা সত্যি, আল-ফজল বলেছিলেন, এই প্রতীজ্ঞা ভঙ্গ করার ব্যাপারে। আমার মনেও যথেষ্ট দ্বিধা রয়েছে। তবে আমার মনে হচ্ছে, বৃহত্তর স্বার্থে দুটো খারাপের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম খারাপটা বেছে নিতে হবে। আমরা সবাই আক্রান্ত মুসলমান, ইহুদি, খৃস্টান, হিন্দু, সব ধর্মমতই-আমাদের ধর্মগুলো যে মূলনীতি আর সত্যের উপরে করে দাঁড়িয়ে আছে মি.  কিয়ার্শ সেটাকে হেয় প্রতিপন্ন করছে। এই জিনিসটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে আমাদেরকে যেন আমাদের সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কোনরকম মানসিক চাপ। তৈরি না করে। এটা করা আমাদের জন্য এখন ফরজ হয়ে গেছে।

    আমার আশঙ্কা, এটা ছাড়া আর কোন উপায় বোধহয় আমাদের কাছে নেই, ভালদেসপিনো বলেছিলেন। কিয়ার্শের এই ব্যাপারটা আমরা যদি জনসম্মুখে তুলে ধরি, তাহলে সেটা এমনভাবে করতে হবে যাতে করে, তার আবিষ্কারটি নিয়ে সন্দেহ তৈরি করা যায়-ঐ লোক তার মুখ খোলার আগেই তাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে হবে সবার কাছে।

    এডমন্ড কিয়ার্শকে? আল-ফজল আৎকে উঠে বলেছিলেন। অসাধারণ মেধাসম্পন্ন একজন বিজ্ঞানী তিনি, যার কোনো কথাই আজ পর্যন্ত ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়নি? আমরা সবাই কি কিয়ার্শের সাথে ঐ মিটিংটাতে ছিলাম না? তার প্রেজেন্টেশনটা ছিল যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।

    ঘোৎ করে উঠেছিলেন ভালদেসপিনো। গ্যালিলিও, ব্রুনো আর কোপার্নিকাস তাদের সময়ে যে প্রেজেন্টেশন দিয়েছিল তারচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয় নয়। ধর্মগুলো এরকম গভীর সঙ্কটে আগেও পড়েছে। এটা নিছক আমাদের দরজায় বিজ্ঞানের আবারো আঘাত করা ছাড়া আর কিছু না।

    কিন্তু বর্তমান সঙ্কটটি পদার্থবিদ্যা আর জ্যোর্তিবিজ্ঞানের আবিষ্কারের চেয়েও অনেক অনেক বেশি ব্যাপক! আল-ফজল উত্তেজনায় বলে উঠেছিলেন। কিয়ার্শ আমাদের ধর্মবিশ্বাসের একেবারে মর্মমূলে আঘাত হেনেছে! চাইলে আপনারা বসে বসে ইতিহাস কপচাতে পারেন, কিন্তু ভুলে যাবেন না, গ্যালিলিওর মুখ বন্ধ রাখার জন্য আপনাদের ভ্যাটিকান আপ্রাণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ঐ বিজ্ঞানীর কথাই সত্যি হিসেবে টিকে আছে। কিয়ার্শের বেলায়ও সেটা হবে। এটা থামানোর কোন উপায় নেই।

    পিনপতন নীরবতা নেমে এসেছিল তখন।

    এ ব্যাপারে আমার অবস্থান একেবারে সহজ-সরল, বলেছিলেন ভালদেসপিনো। এডমন্ড কিয়ার্শ যদি এই আবিষ্কারটি না করতেন তাহলেই বেশি ভালো হতো। আমার ভয় হচ্ছে, তার এই আবিষ্কারকে মোকাবেলা করবার জন্য আমরা একেবারেই অপ্রস্তুত। আমি মনেপ্রণে চাই, এই তথ্যটা যেন কখনও প্রকাশ না পায়। তিনি একটু থেমেছিলেন। একইভাবে আমি। আবার এও বিশ্বাস করি, আমাদের এ জগতে যা কিছু ঘটে তা ঈশ্বরের। ইচ্ছাতেই ঘটে। হয়তো প্রার্থনা করলে, মি.  কিয়ার্শের সঙ্গে ঈশ্বর কথা বলবেন, তাকে এই আবিষ্কারটি প্রকাশ না করার জন্য বোঝাতে সক্ষম হবেন। তিনি।

    আল-ফজল নিজের তিক্ততা প্রকাশ করলেন সশব্দে। আমার মনে হয় না মি.  কিয়ার্শ এমন একজন মানুষ যার পক্ষে ঈশ্বরের কণ্ঠ শোনা সম্ভব।

    হয়তো সম্ভব নয়, ভালদেসপিনো বলে ওঠেন। কিন্তু প্রতিদিনই অলৌকিক ঘটনা ঘটে।

    রেগেমেগে পাল্টা বলেন আল-ফজল, আপনার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, যদি না আপনি ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করেন যে, কিয়া এটা প্রকাশ করার আগেই মারা যায়-

    জেন্টেলমেন! ক্রমশ বাড়তে থাকা উত্তেজনার মধ্যে নাক গলান কোভেস। তাড়াহুড়ো করে আমাদেরকে কোন সিদ্ধান্ত নেবার দরকার নেই। আজ রাতের মধ্যে কোন ঐক্যমতে পৌঁছানোরও দরকার নেই আমাদের। কিয়ার্শ বলেছে, তার ঘোষণাটি দেয়া হবে এক মাস পর। আমি বরং বলবো, আমরা সবাই যেন একান্তে এই বিষয়টা নিয়ে একটু গভীরভাবে ভেবে দেখি, তারপর কয়েকদিন পর আবার কথা বলি, কী বলেন আপনারা? তখন উপযুক্ত একটি পথের দিশা পেয়েও যেতে পারি আমরা।

    বিজ্ঞের মতোই বলেছেন, জবাবে বলেছিলেন ভালদেসপিনো।

    আর বেশিদিন অপেক্ষা করা ঠিক হবে না আমাদের, আল-ফজল সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন। দুদিন পর আবারো ফোনে কথা বলবো আমরা।

    একমত আমি, ভালদেসপিনো বলেছিলেন। তখনই আমরা আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেবো।

    এই ঘটনা দুদিন আগের। এখন তাদের আলাপের ফলো-আপ করার সেই রাতটি সমাগত।

    বাড়ন্ত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে রাবাই কোভেস বসে আছেন নিজের হাৎজিকোর স্টাডিতে। আজ রাতের ফোনে কথা বলার নির্দিষ্ট সময়টি এরইমধ্যে দশ মিনিট পেরিয়ে গেছে।

    অবশেষে ফোনটার রিং বেজে উঠলে কোভেস সেটা তুলে নিলেন হাতে।

    হ্যালো রাবাই, বিশপ ভালদেসপিনো বললেন, তার কণ্ঠের উদ্বেগটি স্পষ্ট। দেরি হবার জন্য আমি দুঃখিত। একটু থেমে আবার বললেন তিনি, বলতে বাধ্য হচ্ছি, আল্লামা আল-ফজল আজকের কলে যোগ দিচ্ছেন না।

    ওহ? কোভেস একটু অবাকই হলেন। সবকিছু ঠিক আছে তো?

    আমি জানি না। আজ সারাটা দিন আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি…উধাও হয়ে গেছেন। তার কলিগদের কোন ধারণাই নেই তিনি কোথায় আছেন।

    একটা শীতল প্রবাহ বয়ে গেল কোভেসের শিরদাঁড়া বেয়ে। এটা তো খুবই চিন্তার বিষয়।

    ঠিক বলেছেন। আশা করি তিনি ঠিকঠাক আছেন। দুঃখের সাথেই জানাচ্ছি, আমার কাছে আরো খবর আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য বিশপ থমালেন, তার কণ্ঠ আরো বিষাদময় হয়ে উঠলো। একটু আগে জানতে পেরেছি, এডমন্ড কিয়ার্শ একটি অনুষ্ঠানে নিজের আবিষ্কার সম্পর্কে সবাইকে অবগত করবেন…আর সেটা আজ রাতেই।

    আজ রাতেই?! বেশ জোরেই বললেন কোভেস। ও তো বলেছিল এক মাস পরে!

    হ্যাঁ, ভালদেসপিনো বললেন। মিথ্যে বলেছিল সে।

    .

    অধ্যায় ৬

    ল্যাংডনের হেডসেটে উইনস্টনের বন্ধুভাবাপন্ন কণ্ঠটি অনুরণন তুলল। প্রফেসর, ঠিক আপনার সামনেই। আমাদের সংগ্রহের সবচাইতে বিশাল পেইন্টিংটা দেখতে পাবেন। যদিও বেশিরভাগ অতিথিই এটা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে না।

    জাদুঘরের আর্টিয়ামের অপর পাশে তাকালো ল্যাংডন, কিন্তু লেগুনের ওপরে কাঁচের দেয়াল ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলো না। আমি দুঃখিত, মনে হচ্ছে আমিও এখানকার বেশিরভাগ অতিথির মতই। কোন পেইন্টিং দেখতে পাচ্ছি না।

    আসলে এটা একটু ভিন্নভাবে ডিসপ্লে করা হয়েছে, একটু হেসে বলল উইনস্টন। ক্যানভাসটা দেয়ালে টাঙানো নেই, ওটা মেঝেতে আছে।

    আমার এটা আন্দাজ করা উচিত ছিল, ভাবলো ল্যাংডন। চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো তার পায়ের নিচে বিশাল একটি আয়তক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে।

    বিশাল বড় এই পেইন্টিংটাতে কেবলমাত্র একটা রঙই ব্যবহার করা হয়েছে-গাঢ় নীলের একরঙা একটি বিশাল মাঠ-এটার চারপাশে দর্শনার্থিরা এমনভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে যেন ছোটখাটো একটি পুকুর দেখছে তারা।

    এই পেইন্টিংটার আয়তন প্রায় ছয় হাজার বর্গফুটের মতো, উইনস্টন জানালো তাকে।

    ল্যাংডন বুঝতে পারলো এটা তার ক্যামব্রিজের প্রথম অ্যাপার্টমেন্টের চেয়ে দশ গুণ বেশি বড়।

    এটা করেছেন ইয়েভত্স ক্লেইন। সুইমিংপুল নামেই এটা বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছে।

    ল্যাংডনকে মানতেই হলো, নীল রঙের এমন সমৃদ্ধ শেড দেখে ক্যানভাসের মধ্যে ডাইভ দিতে ইচ্ছে করছে তার।

    এই রঙটি ক্লেইন উদ্ভাবন করেছেন, উইনস্টন বলতে লাগলো। এটাকে এখন বলা হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্লেইন ব্লু, তার দাবি, এর গভীরতা তার নিজস্ব জগতের ইউটোপিয়ান ভিশনের বৈদহী আর সীমাহীনতাকেই প্রকাশ করে।

    ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো উইনস্টন এখন স্ক্রিপ্ট দেখে পড়ছে।

    ব্লু পেইন্টিংয়ের জন্যই ক্লেইন বেশি পরিচিত, তবে লিপ ইনটু দি ভয়েড নামে পরিচিত ভয়ঙ্কর ফটোগ্রাফের জন্যও তার খ্যাতি রয়েছে। ১৯৬০ সালে যখন তিনি এটা প্রথম প্রদর্শন করেছিলেন তখন বেশ ভীতির সৃষ্টি করেছিল।

    নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট-এর গ্যালারিতে লিপ ইনটু দি ভয়েড দেখেছে ল্যাংডন। ফটোগ্রাফিটা একটু মানসিক উদ্বিগ্নতা তৈরি করে কারণ সেখানে দেখা যায় ফিটফাট জামা-কাপড় পরা একজন মানুষ উঁচু কোন ভবনের ছাদ থেকে নিচের রাস্তায় সোয়ান ডাইভ দিচ্ছে। সত্যি বলতে এই ছবিটা আসলে একটা ট্রিক-অসাধারণভাবেই আইডিয়াটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে ফটোশপ যুগেরও বহু আগে রেজর ব্লেড ব্যবহার করে।

    আরো বলতে পারি, উইনস্টন বলল, মনোটোন-সাইলেন্স নামে একটি সঙ্গিতও কম্পোজ করেছেন ক্লেইন, যেখানে পুরো একটি সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা একটি মাত্র ডি-মাইনর কর্ড বাজিয়ে গেছে টানা বিশ মিনিট ধরে।

    এই জিনিস লোকে শুনেছে?

    হাজার হাজার লোক শুনেছে। ঐ একটা কর্ড হলো শুধুমাত্র ফার্স্ট মুভমেন্ট। সেকেন্ড মুভমেন্টে পুরো অর্কেস্ট্রা দলটি কোনো কিছু না বাজিয়ে একদম চুপচাপ বসেছিল বিশ মিনিট।

    ঠাট্টা করছো, তাই না?

    না, আমি সিরিয়াসলি বলছি। এর সমর্থনে বলা যায়, এই পারফর্মেন্সটি শুনতে যতোটা বিরক্তিকর মনে হোক না কেন, আদতে সেটা মোটেও তেমন ছিল না। মঞ্চে ছিল তিনজন নগ্ন নারী, তারা সারা দেহে নীল রঙ মেখে বিশাল

    একটি ক্যানভাসে গড়াগড়ি খেয়ে গেছে পুরোটা সময়।

    পেশাগত জীবনের বেশিরভাগ সময় ল্যাংডন নিজেকে আর্ট স্টাডিতে নিয়োজিত করলেও আর্টের দুনিয়ায় এইসব আঁভা-গার্দে শিল্পকে কিভাবে প্রশংসা করবে সেটা নিয়ে এখনও বেজায় সমস্যায় পড়ে যায়। মডার্ন আর্টের আবেদন তার কাছে এখনও একটা রহস্য হয়েই আছে।

    অসম্মান না করেই বলছি, উইনস্টন…প্রায়ই আমি বুঝতে পারি না কোনটা মডার্ন আর্ট আর কোনটা একেবারেই উদ্ভট জিনিস।

    উইনস্টন জবাব দিলো নির্লিপ্ত কণ্ঠে। এই প্রশ্নটা প্রায়শই করা হয়, তাই? আপনার ক্লাসিক আর্টের দুনিয়ায় কোন শিল্পকর্মকে প্রশংসা করা হয় শিল্পীর দক্ষতার প্রয়োগের কারণে–যেমন, তিনি কতোটা কুশলতার সাথে ক্যানভাসে তুলির আঁচড় দিয়েছেন, অথবা বাটালি দিয়ে পাথর খোদাই করেছেন। মডার্ন আর্টে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো আইডিয়া এবং এর প্রয়োগ। উদাহরণ হিসেবে বলা। যেতে পারে, যে কেউ চল্লিশ মিনিটব্যাপি একটি সিম্ফনি কম্পোজ করতে পারতো একটি মাত্র কর্ডের শব্দ আর নীরবতার উপর ভিত্তি করে, কিন্তু এই আইডিয়াটি এসেছে ইয়েল্স ক্লেইনের মাথা থেকে।

    সেটাই যথেষ্ট।

    অবশ্যই, বাইরে যে দ্য ফগ স্কাল্পচারটা দেখেছেন ওটা হলো কনসেপচুয়াল আর্টের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শিল্পীর কাছে একটি আইডিয়া আছে-ব্রিজের নিচ দিয়ে পাইপ বসিয়ে লেগুনের উপরে কুয়াশা ছড়িয়ে দেয়া-কিন্তু এই কাজটি যারা বাস্তবায়ন করেছে তারা স্থানীয় কলমিস্ত্রি। একটু থামলো উইনস্টন। যদিও আমি শিল্পীকেই বেশি কৃতিত্ব দেবো তার মিডিয়ামকে কোড হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।

    কুয়াশা একটি কোড?

    সেটাই। এর মাধ্যমে আসলে এই জাদুঘরের স্থপতিকে ট্রিবিউট করা হয়েছে।

    ফ্রাঙ্ক গেরিকে?

    ফ্রাঙ্ক ও. গেরি, শুধরে দিলো উইনস্টন।

    বাপরে।

    ল্যাংডন জানালাগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই উইনস্টন বলে উঠলো, এখান থেকে আপনি মাকড়টা বেশ ভালোভাবে দেখতে পাবেন। এখানে আসার পথে কি মামানকে দেখেছিলেন?

    জানালা দিয়ে বাইরের প্লাজায় অবস্থিত বিশালাকৃতির মাকড়টাকে দেখলো রবার্ট ল্যাংডন। তা দেখেছি। ওটাকে না দেখে উপায় নেই।

    আপনার কণ্ঠের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে আপনি ওটা পছন্দ করেননি?

    করার চেষ্টা করছি। একটু থামলো ল্যাংডন। একজন ক্লাসিস্ট হিসেবে নিজেকে এখানে বড্ড বেমানান লাগছে আমার।

    মজার তো, বলল উইনস্টন। আমি ভেবেছিলাম আপনারা সবাই মামানকে পছন্দ করবেন। ওটা জুক্সটাপজিশনের একদম ক্লাসিক্যাল উদাহরণ। সত্যি বলতে, আপনি যখন আপনার পরবর্তি ক্লাসে কনসেপ্ট নিয়ে পড়াবেন তখন ওটাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

    মাকড়টার দিকে তাকালো ল্যাংডন, কিন্তু ওরকম কিছু দেখতে পেলো না। জুক্সটাপজিশন-এর উপরে ক্লাস নেবার সময় ল্যাংডন আসলে প্রচলিত কোনকিছুই ব্যবহার করতে বেশি পছন্দ করে। আমার মনে হয় আমি যথারীতি ডেভিডকেই ব্যবহার করবো।

    হ্যাঁ। মাইকেলাঞ্জেলো হলেন গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের, মুচকি হেসে বলল উইনস্টন, একটু মেয়েলি ধাঁচের কনত্রাপোস্তো ভঙ্গিতে অসাধারণভাবেই পোজ দিয়ে আছে ডেভিড। সাধারণ ভঙ্গিতে তার বামহাতে ধরে রাখা একটুকরো নরম কাপড় ঝুলে আছে। যেন নারীত্বের নাজুকতাকেই প্রকাশ করছে ওটা। অথচ ডেভিডের চোখে ফুটে উঠেছে সুকঠিন দৃঢ়তা। তার রগ আর শিরা ফুলেফেঁপে আছে গোলিয়াথকে হত্যা করার বাসনায়। কাজটা একইসাথে সূক্ষ্ম এবং প্রাণঘাতি।

    বর্ণনাটা শুনে ল্যাংডন বেশ মুগ্ধ হলো। তার ছাত্রছাত্রিরা যদি এরকম পরিষ্কারভাবে মাইকেলাঞ্জেলোর মাস্টারপিসটা বুঝতে পারতো!

    ডেভিড-এর সাথে মামান-এর খুব একটা পার্থক্য নেই, উইনস্টন বলল। দুটোই সমভাবে জুক্সটাপজিশন তবে দুটো বিপরীতধর্মি প্রিন্সিপ্যালকে প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রকৃতিতে কালো-বিধবা মাকড় হলো ভয়ঙ্কর প্রাণী–এমন একটি শিকারী যে তার শিকারকে নিজের জালে আটকে হত্যা করে। তাকে এখানে মারাত্মক কিছু হিসেবে না দেখিয়ে বরং ডিমেপূর্ণ গর্ভবতি হিসেবে দেখানো হয়েছে, নতুন জীবন প্রসব করতে প্রস্তুত সে, এরফলে সে হয়ে উঠেছে একইসাথে শিকারী আর জননী-তার শক্তিশালি দেহটা যে অসম্ভব চিকন-চিকন পাগুলোর উপরে ভর দিয়ে আছে সেটা একইসাথে শক্তি আর নাজুকতাকেই প্রকাশ করে। যদি চান তো, মামানকে আধুনিক-যুগের ডেভিডও বলতে পারেন।

    ওরকম কিছু চাচ্ছি না, হেসে বলল ল্যাংডন, তবে স্বীকার করছি, তোমার বিশ্লেষণ আমাকে চিন্তার খোঁড়াক দিচ্ছে।

    বেশ, তাহলে আপনাকে শেষ একটা কাজ দেখাবো আমি। এটা হলো। এডমন্ড কিয়ার্শের অরিজিনাল একটি কাজ।

    তাই নাকি? আমার জানা ছিল না এডমন্ড একজন আর্টিস্ট। কথাটা শুনে হেসে ফেলল উইনস্টন। তাকে আর্টিস্ট বলবেন কি বলবেন, সেই বিচারের ভার আমি আপনার উপরেই ছেড়ে দিলাম।

    উইনস্টনের কথামতো জানালা থেকে সরে বিশাল বড় একটি জায়গায় এসে পড়লো ল্যাংডন। ওখানের দেয়ালে ঝুলছে শুকনো কাদামাটির বিশাল বড় একটি স্ল্যাব, সেটার সামনে জড়ো হয়ে আছে একদল অতিথি। প্রথম দর্শনে শুকনো কাদার এই স্ল্যাবটাকে দেখে ল্যাংডনের মনে পড়ে গেল জাদুঘরে প্রদর্শন করা ফসিলের কথা। স্ল্যাবের উপরে কাঁচাহাতের কিছু আঁকিবুকি আছে, অনেকটা অল্পবয়েসি শিশুরা যেমন নরম সিমেন্টের উপরে কাঠি দিয়ে আকিবুকি করে ঠিক তেমনি।

    লোকজনের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না তারা সন্তুষ্ট।

    এটা এডমন্ড করেছে? বেজিমুখো এক মহিলা ফোলা ফোলা ঠোঁটে অসন্তোষের সাথে বলে উঠলো। বুঝতে পারছি না।

    ল্যাংডনের শিক্ষকসত্তা আর চুপ করে থাকতে পারলো না। এটা আসলে খুবই চাতুর্যপূর্ণ, বলে উঠলো সে। এখন পর্যন্ত এই জাদুঘরে যতো কিছু দেখেছি তার মধ্যে এটাই আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে।

    মহিলা তার দিকে ঘুরে তাকালো চোখমুখ কুঁচকে। তাই নাকি? তাহলে আমাকে একটু বুঝিয়ে দিন না।

    সেটা করতে পারলে আমারও ভালো লাগবে। কাঁচাহাতে আঁকিবুকি দেয়া স্ল্যাবের আরো কাছে এগিয়ে গেল ল্যাংডন।

    আঁকিবুকি

    প্রথমেই বলছি, ল্যাংডন শুরু করলো, এডমন্ড আসলে মানবসভ্যতার। সবচাইতে প্রাচীন লিখিত ভাষা কিউনিফর্মকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এই কাদামাটির উপরে আঁকিবুকিটা করেছে।

    মহিলা চোখ পিটপিট করলো। মনে হলো না সে বুঝতে পারছে।

    মাঝখানের বড়সর দাগগুলো, বলতে লাগলো ল্যাংডন, আসলে আসিরিয়ান ভাষায় মাছ শব্দটির বানান। এটাকে বলা হয় পিক্টোগ্রাম। ভালো করে দেখলেই বুঝতে পারবেন, ডানদিক থেকে মাছের হা করা মুখের মতো আকৃতি চোখে পড়বে, সেইসাথে ওটার শরীরের ত্রিকোন আকৃতিটাও।

    জড়ো হওয়া অতিথিদের সবাই মাথা উঁচু করে তাদের সামনে থাকা শিল্পকর্মটি আরো একবার ভালো করে দেখে নিতে শুরু করলো।

    আর আপনি যদি এদিকটা দেখেন, মাছটির বামদিকে একসারি ডটের দিকে ইঙ্গিত করলো ল্যাংডন, দেখতে পাবেন, এডমন্ড মাছের পেছনে কাদার মধ্যে পদচিহ্ন সৃষ্টি করেছে-মাছেরা যে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফলে পানি থেকে মাটিতে উঠে এসেছে সেটা বোঝানোর জন্য।

    তার বক্তব্যের সাথে সানন্দে সায় দিলো হেডসেটের কণ্ঠটা।

    আর, ডানদিকের অসমান তারকাচিহ্নটি-মাছটা যেন ওই সিম্বলটা খেয়ে ফেলতে চাইছে-মানবেতিহাসের সবচাইতে প্রাচীন ঈশ্বরের প্রতীক।

    ফোলা ঠোঁটের মহিলা তার দিকে ঘুরে ভুরু কপালে তুলল। একটা মাছ ঈশ্বরকে খেয়ে ফেলছে?

    দেখে তা-ই মনে হয়। এটাকে ডারউইন ফিশের একটি কৌতুকপূর্ণ বলতে পারেন-বিবর্তন ধর্মকে গিলে খেয়ে ফেলছে। দলটির দিকে হালকাঁচালে চেয়ে কাঁধ তুলল ল্যাংডন। বলেছি না, খুবই চাতুর্যপূর্ণ একটি কাজ।

    ল্যাংডন ওখান থেকে আস্তে করে সটকে পড়তেই তার পেছনে লোকজনের গুঞ্জনটা শুনতে পেলো। উইনস্টন হেসে উঠলো হেডসেটের মধ্য দিয়ে। যা বলেছেন, প্রফেসর! আপনার এই লেকচারটা শুনতে পেলে এডমন্ড খুবই খুশি হতেন। এটার অথোদ্ধার কিন্তু খুব বেশি মানুষ করতে পারে না।

    কী আর বলব, ল্যাংডন বলল হেসে, এটাই তো আসলে আমার কাজ।

    তা ঠিক। এখন আমি বুঝতে পারছি, মি.  কিয়ার্শ কেন আমাকে বলেছিলেন আপনি তার একজন বিশেষ অতিথি। সত্যি বলতে কী, তিনি আমাকে এমন কিছু দেখাতেও বলেছেন যেটা বাকি অতিথিরা দেখতে পারবে না আজ রাতে।

    তাই নাকি? সেটা কি?

    ডানদিকের বড় জানালাটার কাছে আপনি কি কর্ডন করে রাখা একটি হলওয়ে দেখতে পাচ্ছেন?

    ডানদিকে তাকালো ল্যাংডন। পাচ্ছি।

    বেশ। তাহলে আমার কথামতো এগিয়ে যান সেদিকে

    অনিশ্চিত ভঙ্গিতে উইনস্টনের বলা নির্দেশনা মেনে এগিয়ে গেল ল্যাংডন। একটা করিডোরের প্রবেশমুখের কাছে এসে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ তাকে দেখছে কিনা। আস্তে করে সবার অলক্ষ্যে সে শেকল বাধা লোহার ছোটছোট পিলারের অবরোধ ডিঙিয়ে ঢুকে পড়লো হলওয়ের ভেতরে।

    হলওয়ে ধরে ত্রিশ ফিটের মতো এগিয়ে যাবার পর নিউম্যরিক-কিপ্যাড সম্বলিত একটি লোহার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো সে।

    এই ছয়টি ডিজিট টাইপ করুন, তারপর উইনস্টন বলে দিলো সংখ্যাগুলো।

    ল্যাংডন কোডটা টাইপ করতেই ক্লিক শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা। ঠিক আছে, প্রফেসর। এবার ভেতরে ঢুকে পড়ন।

    কয়েক মুহূর্ত কী দেখতে পাবে ভেতরে সেটা ভেবে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলো প্রফেসর। নিজেকে ধাতস্থ করে দরজাটা ধাক্কা দিলো সে। দরজার ওপাশের জায়গাটা পুরোপুরি অন্ধকারে ঢাকা।

    আমি আপনার জন্য বাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছি, উইনস্টন বলল তাকে। দয়া করে দরজাটা বন্ধ করে দিন এবার।

    ভেতরের দিকে তাকালো ল্যাংডন, কিন্তু কিছুই পেলো না। দরজাটা বন্ধ করতেই ক্লিক করে শব্দ হলো আবার।

    এক এক করে ঘরের চারপাশ থেকে নরম আলো জ্বলে উঠলে অচিন্তনীয় সুবিশাল একটি জায়গা উন্মোচিত হলো ল্যাংডনের চোখের সামনে-একটা বিশাল বড় চেম্বার-অনেকটা জাম্বো জেট বিমানের হ্যাঙ্গারের মতো দেখতে।

    চৌত্রিশ হাজার বর্গফুট, উইনস্টন বলল।

    এই ঘরটির তুলনায় জাদুঘরের আর্টিয়ামটিকে বেশ ছোট বলেই মনে হচ্ছে এখন।

    বাতিগুলো আরো বেশি উজ্জ্বল হতেই মেঝেতে বিশালাকারের কিছু জিনিস দেখতে পেলো ল্যাংডন-সাত থেকে আটটি অস্পষ্ট আবছা অবয়ব-যেন রাতের বেলায় জ্বলজ্বলে চেখে চেয়ে আছে ডাইনোসরেরা।

    এ আমি কী দেখছি? জানতে চাইলো ল্যাংডন।

    এটাকে বলে দ্য ম্যাটার অব টাইম। উইনস্টনের উফুল্ল কণ্ঠ হেডসেটের মাধ্যমে পৌঁছে গেল ল্যাংডনের কাছে। এই জাদুঘরের সবচাইতে ভারি শিল্পকর্ম এটি। দুই মিলিয়ন পাউন্ডেরর বেশি হবে এর ওজন।

    নিজেকে ধাতস্থ করতে এখনও বেগ পাচ্ছে প্রফেসর ল্যাংডন। শুধু আমাকে কেন এখানে নিয়ে আসা হয়েছে?

    আপনাকে তো বলেছিই, মি.  কিয়ার্শ আমাকে বলে দিয়েছিলেন আপনাকে যেন এই বিস্ময়কর জিনিসগুলো দেখাই।

    এবার পুরোপুরি আলোকিত হয়ে উঠলো ঘরটি। নরম জ্বলজ্বলে আলোর বন্যায় ভরে উঠলো বিশাল জায়গাটি। হতবুদ্ধিকর হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সামনে থাকা জিনিসগুলোর দিকে চেয়ে আছে ল্যাংডন.।

    আমি একটি প্যারালাল ইউনিভার্সের ভেতরে ঢুকে পড়েছি।

    .

    অধ্যায় ৭

    জাদুঘরের সিকিউরিটি চেকপয়েন্টের কাছে এসে অ্যাডমিরাল লুই আভিলা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো ঠিক সময়মতো এসেছে কিনা।

    একদম ঠিক সময়েই এসেছি।

    অতিথিদের তালিকা মিলিয়ে দেখছে যেসব কর্মচারি তাদের কাছে নিজের দকুমেস্তা ন্যাশিওনাল দে আইদেস্তিদাদ বের করে দেখালো সে। তালিকায় তার নামটা খুঁজে বের করার সময় কয়েক মুহূর্তের জন্য আভিলার নাড়িস্পন্দন বেড়ে গেল। অবশেষে তালিকার একদম নিচের দিকে তার নামটা খুঁজে পেলো তারা-একেবারে শেষ মুহূর্তে যোগ করা হয়েছে তার নাম-আভিলাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হলো এবার।

    দ্য রিজেন্ট ঠিক যেমনটা কথা দিয়েছিল আমাকে। কিভাবে সে এটা করতে পারলো সে ব্যাপারে আভিলার কোন ধারণাই নেই। আজ রাতের

    অতিথিদের তালিকায় ঠাই পাওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়।

    মোবাইলফোনটা ডিশে রাখার পর খুব সাবধানে অপ্রচলিত আর একটু ভারি রোসারিটা জ্যাকেটের পকেট থেকে বের করে ফোনের পাশে রাখলো।

    আস্তে, নিজেকে বলল সে। খুবই সাবধানে।

    সিকিউরিটি গার্ড হাত নেড়ে তাকে মেটাল ডিটেক্টরটা পার হয়ে ডিশ থেকে নিজের জিনিসগুলো নিয়ে নেবার জন্য ইশারা করলো।

    কুয়ে রোসারিও তান বনিতো, ধাতব রোসারিটার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে বলল গার্ড। রোসারিও নামে পরিচিত এই জপমালাটিতে রয়েছে ভারি

    একটি চেইন আর বৃত্তাকারের একটি ক্রুশ।

    এ্যাসিয়াস, জবাবে বলল আভিলা। আমি নিজে এটা বানিয়েছি।

    কোন ঝামেলা ছাড়াই ডিটেক্টরটা পার হয়ে অপর পাশে গিয়ে ফোন আর রোসারিওটা তুলে নিয়ে পকেটে রেখে দিলো সে। দ্বিতীয় চেকপয়েন্টের দিকে

    এগিয়ে গেলে অন্য রকম একটি অডিও হেডসেট দেয়া হলো তাকে।

    অডিও টুরের কোন দরকারই নেই আমার, মনে মনে বলল সে। এখানে আমি কাজ করতে এসেছি।

    আর্টিয়ামের ভেতরে ঢুকতেই সবার অলক্ষ্যে হেডসেটটা ট্র্যাশক্যানে ফেলে দিলো সে।

    ভবনের ভেতরে ঢুকে ভালো করে দেখে নিলো আভিলা। ফোন করার জন্য তার দরকার নিরাপদ একটি জায়গা। দ্য রিজেন্টকে জানাতে হবে সে নির্বিঘ্নেই ভেতরে ঢুকতে পেরেছে।

    ঈশ্বরের জন্য, দেশমাতৃকা আর রাজার জন্য, মনে মনে আউড়ালো সে। তবে মূলতঃ ঈশ্বরের জন্যই।

    *

    ঠিক এই মুহূর্তে, দুবাই থেকে একটু দূরে, চন্দ্রালোকিত মরুভূমির অনেকটা ভেতরে আটাত্তুর বছরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল্লামা সাঈদ-আল ফজল বালুর মধ্যে ডুবে থেকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতর হলেন। আর বেশি দূর তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

    আল-ফজলের গায়ের চামড়া পুড়ে গেছে, জিহ্বা এতটাই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যে, নিঃশ্বাস নিতেও পারছেন না। কয়েক ঘণ্টা আগে বালুময় বাতাসের কারণে চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি, তারপরও হামাগুঁড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। এক সময় তার মনে হয়েছিল বহু দূরে ধুলো উড়িয়ে ঘোড়ায় টানা কোন গাড়ি ছুটে যাচ্ছে বোধহয়। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন, ওটা সম্ভবত বাতাসের গর্জনের শব্দ। সৃষ্টিকর্তা তাকে রক্ষা করবেন-আল-ফজলের এই বিশ্বাস অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। শকুনগুলো আর আকাশে উড়ছে না এখন, তার চারপাশে জড়ো হতে শুরু করেছে ওগুলো।

    গতরাতে যে লম্বা স্পেনিয়ার্ডটি গাড়িসহ তাকে তুলে নিয়ে এসেছিল সে আল্লামার গাড়িটা বিশাল মরুভূমির বেশ খানিকটা ভেতরে চালিয়ে নিয়ে আসার সময় কোন কথাই বলেনি। এক ঘণ্টা ড্রাইভ করার পর স্পেনিয়ার্ড লোকটি গাড়ি থামিয়ে আল-ফজলকে নেমে যেতে বলে। তাকে সেই ঘন অন্ধকারে খাদ্য আর পানিহীন অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায় সে।

    আল-ফজলকে যে হাইজ্যাক করেছে সে তার পরিচয় দেয়নি, এমনকি কেন এ কাজ করছে তা-ও বলেনি। আল-ফজল কেবল লোকটার ডানহাতের তালুর উপরে অদ্ভুত একটা চিহ্ন দেখেছিল, সেটাও এক মুহূর্তের জন্য-ঐ সিম্বলটা দেখলেও তিনি চিনতে পারেননি।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কনফেশন (বেগ-বাস্টার্ড ৪) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }