অধ্যায় পাঁচ: ভুতুড়ে তান্ত্রিক
ভূতুড়ে তান্ত্রিক
গৌতম ভারতী ও তাঁর ভূতুড়ে ফটোসম্মোহন
’৮৭-র ১ আগস্ট-এর সন্ধ্যা। ‘আলোকপাত’ পত্রিকার প্রতিনিধি অমিতবিক্রম রাগা এলেন। উদ্দেশ্য আমার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া। বিষয় -সম্মোহন। কথা প্রসঙ্গে অমিত জানালেন, কয়েকজন মনোরোগ চিকিৎসকেরও সাক্ষাৎকার নেবেন, যাঁরা রোগীদের রোগমুক্ত করার ক্ষেত্রে সম্মোহনের সাহায্য নেন। এবং তাঁদের কাছে এও জানতে চাইবেন, কোন্ কোন্ রোগ মুক্তির ক্ষেত্রে সম্মোহন কার্যকর ভূমিকা নেয়। এরই পাশাপাশি কয়েকজন তান্ত্রিকের সাক্ষাৎকার নেবেন, যাঁরা দাবি করেন— তন্ত্র-মন্ত্রের সাহায্যে ভৌতিক উপায়ে শুধুমাত্র একটি ফটোগ্রাফ পেলেই সেই ফটোর মালিককে সম্মোহন করতে সক্ষম। এই ধরনের ফটো-সম্মোহনের সাহায্যে তাঁরা নাকি বিরহী প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলন ও বিবাহ ঘটিয়ে দিয়ে থাকেন, শত্রুকে পায়ের সুখতলা বানিয়ে থাকেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
অমিত জানালেন কয়েকজন মনোরোগ চিকিৎসক ও তান্ত্রিকের নাম, যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছে আছে। এরই ভিতর একটি নাম গৌতম ভারতী। উত্তর কলকাতার উপকণ্ঠে লেকটাউন শিবকালী মন্দিরের গৌতম ভক্তি সিদ্ধান্ত ভারতী বিজ্ঞাপানের মাহাত্ম্যে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে খ্যাত। অনেক দিনের ইচ্ছে, গৌতম ভারতীকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখার। অমিতকে জানালাম, “গৌতম ভারতীর মুখোমুখি হওয়ার একটা আন্তরিক ইচ্ছে আমার আছে। কিন্তু সময়াভাবে ইচ্ছেটা বাস্তব রূপ নিতে পারেনি।”
আমার কথায় অমিত প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, “আপনি যদি আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় আমার সঙ্গী হন তো দারুণ হয়। ব্যাপারটা তাহলে দারুণ জমবে।”
বললাম, “আমার পরিচয় পেলে ব্যাপারটা আদৌ জমবে বলে মনে হয় না। বরং গৌতম ভারতী হয়তো মুখই খুলতে চাইবেন না। আমার একটা পরিকল্পনা আছে। আমি যদি পরিচয় গোপন করে ‘আলোকপাত’-এর প্রতিনিধি হিসেবে আপনার সঙ্গী হই, আপত্তি আছে?”
আমার যুক্তি অমিতেরও মনে ধরল। বললেন, “না না, কোনও আপত্তি নেই। আপনি তো আমাদের পত্রিকাতেও লিখেছেন এবং আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে আপনি থাকলে আমি এবং আমাদের পত্রিকা আন্তরিকভাবেই খুশি হব।”
আমি প্রস্তাব দিলাম, “আজ তাহলে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়াটা মুলতবি থাক। আমরা বরং আজ গৌতম ভারতীর আশ্রম থেকে ঘুরে আসি। আমার সাক্ষাৎকারটা আর এক দিন হবে।”
অমিত রাজ হয়ে গেলেন। অতএব দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম অ্যাডভেঞ্চারে, অবতার শিকারে।
যশোর রোড লেকটাউনের মুখে একটি বহুতল বাড়িতে গৌতম ভারতীর শিবকালী আশ্রম। ঢোকার মুখে এক মহিলা রিসেপশনিস্ট। তাঁকে জানালাম—‘আলোকপাত’ পত্রিকা থেকে আসছি। গৌতম ভারতীর একটি সাক্ষাৎকার পত্রিকায় প্রকাশ করতে আগ্রহী।
মহিলাটি এক কর্মচারীকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন ম্যানেজারবাবুকে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। অপেক্ষারত মানুষের সংখ্যা তখনও অন্তত জনা আটেক। ইতিমধ্যে গৌতম ভারতীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সাক্ষাতের একটা ছাপানো নিয়মাবলিও সংগ্রহ করলাম। তাতে লেখা গৌতম ভারতীয় সাক্ষাৎপ্রার্থীকে অবশ্যই আশ্রমের সদস্য হতে হবে। সদস্য পদ তিন রকমের: (১) ছয় মাসের জন্য ২১১ টাকা। (২) এক বছরের জন্য ৩১১ টাকা (৩) আজীবন ৫৭৫ টাকা। রিসেপশনিস্ট নিরুপমা সাউ জানালেন, প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন সাক্ষাৎপ্রার্থীকে আচার্য গৌতম ভারতী দর্শন দেন, প্রতিকারের ব্যবস্থা করে দেন। একবার দর্শন করতে গেলেও দর্শনার্থীকে ২১১ টাকা জমা দিতে হবে। প্রতিকার ব্যবস্থার খরচ আলাদা।
ম্যানেজারবাবু এলেন। প্রবীণ, পাকানো চেহারা। সন্দিগ্ধ চোখে আমাদের দুজনকে কিছুক্ষণ জরিপ করলেন। আমাদের নাম, আসার উদ্দেশ্য শুনে কিছুক্ষণ কোনও উত্তর না দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর এক সময় সরাসরি আমাকে প্রশ্ন করলেন, “আপনাকে চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।
কোথায় দেখেছি বলুন তো?”
‘বললাম, “তা তো ঠিক বলতে পারব না। তবে আপনাকে এই প্রথম দেখছি বলে মনে হচ্ছে।”
“আপনি দমদমে থাকেন?” জিজ্ঞেস করলেন ম্যানেজারবাবু।
“না। থাকি কলেজ স্ট্রিটের মেসে। তবে কাজের সূত্রে অনেক জায়গাতেই ঘুরতে হয়। দমদমেও বহুবার এসেছি।”
আমাকে ও অমিতকে বাড়ির ঠিকানা বলতে বললেন। দু’জনেই বললাম। ম্যানেজারবাবু নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে নিয়ে ‘আলোকপাত’ পত্রিকার ঠিকানা, ফোন নম্বর, সম্পাদকের নাম ইত্যাদি নিয়েই অনেক প্রশ্ন করলেন এবং কাগজটায় প্রয়োজনীয় উত্তরগুলো লিখে নিলেন। কাগজটা বুক পকেটে রেখে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “প্রবীর ঘোষকে চেনেন?” বললাম, “রামকৃষ্ণ মিশন নরেন্দ্রপুরে কাজ করেন তো? স্বাস্থ্য ভালো, টাক আছে?”
“না, না, সে নয়, পত্র-পত্রিকায় ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে লেখে?” আমার দু-চোখে দৃষ্টি মেলে রেখেই কথাগুলো বললেন ম্যানেজারবাবু।
বললাম, “না, এমন কাউকে চিনি না।”
“আপনার নামটা যেন কী বললেন?” ম্যানেজারবাবু জানতে চাইলেন। বললাম, “কুমার রায়।”
“আপনাদের কাছে ‘প্রেস কার্ড’ আছে?”
এবার অমিতই উত্তর দিলেন, “আমাদের কোনও সরকারি প্রেস কার্ড ইস্যু করা হয় না।”
“পত্রিকার তরফ থেকেও কোন্ পরিচয়পত্র এনেছেন?”
অমিত জানালেন, “এখন সঙ্গে নেই। তবে আপনি যদি চান, নিশ্চয়ই পরিচয়পত্র পরশুই দেখিয়ে যাব। কারণ কাল তো রবিবার, অফিস বন্ধ।”
ম্যানেজারবাবু বললেন, “ঠিক আছে, পরশুই পরিচয়পত্র নিয়ে আসুন, সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেব। সাক্ষাৎকারে কী কী বিষয় জানতে চান, সেগুলো একটু বলুন।”
আমিই মুখ খুললাম, জানালাম, “আমাদের লেখার বিষয় সম্মোহন। এই বিষয়ে মনোরোগ চিকিৎসক ও কয়েকজন তান্ত্রিকের সাক্ষাৎকার নিতে আগ্রহী। মনোরোগ চিকিৎসকরা যেমন বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সম্মোহন করেন, তেমনি তন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে কিছু কিছু তান্ত্রিকও তো ছবির সাহায্যেই ফটো সম্মোহন করে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে দিচ্ছেন। আমরা শুনেছি আচার্য গৌতম ভারতী ফটোসম্মোহনের সাষায্যে অনেক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটিয়ে দেন। ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলন ঘটিয়ে দেন, শত্রুকে বশ করেন। এই বিষয়েই তাঁর কাছ থেকে কিছু জানতে চাই।”
৩ আগস্ট সন্ধায় আবার হাজির হলাম শিবকালী আশ্রমে। এ-দিন আমাদের সঙ্গী আরও একজন;. সত্যিকার কুমার রায়—পেশায় চিত্র সাংবাদিক। তখনও জনাদশেক দর্শনের প্রতীক্ষায় রয়েছেন। আজও রিসেপশনিস্ট নিরুপমার কাছে হাজির হলাম। আমাদের আসার খবর পাঠালেন ভিতরে। এলেন ম্যানেজারবাবু। ম্যানেজারের হাতে অমিত আমাদের দু’জনের পরিচয়-পত্র তুলে দিলেন, সেই সঙ্গে কুমারের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, “প্রদীপ দাস, আমাদের পত্রিকার চিত্র-সাংবাদিক।” কুমারের কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ দেখে, ওর প্রতি আর সন্দেহ প্রকাশ করলেন না। দেখতে চাইলেন না ওঁর পরিচয়পত্র। আমার প্রতি যে সন্দেহ ছিল সেটা পরিচয়পত্রের কল্যাণে দূর হয়ে যাওয়ায় কুমারকেও প্রদীপ বলে ধরে নিয়েছিলেন।
ভিতরে আচার্যের কাছে আমাদের আগমনের খবর গেল। একটু পরে আহ্বান এল। দামী কার্পেটে মোড়া মেঝে। মেঝের এক প্রান্তে দেওয়াল ঘেঁষে উঁচু গদি। গদিতে হরিণের ছাল বিছানো। আশে-পাশে কয়েকটা পুরু তাকিয়া। হরিণের ছালে যিনি বসে আছেন তাঁর বয়স তিরিশের কাছাকাছি বলেই মনে হল। স্বাস্থ্য ভালো। উচ্চতা কিছুটা কম। গলায় একাধিক সোনার হার শোভা পাচ্ছে। বাহুতে দস্তুরমতো পুরু সোনার পাতে বন্দি রয়েছে ৯টি গ্রহরত্ব। গৌতম ভরাতী সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। গৌতমের মুখোমুখি আমি ও অমিত বসলাম। ‘প্রদীপ’ ছদ্মপরিচয়ের আড়ালে কুমার তাঁর ক্যামেরা নিয়ে তৎপর হলেন শাটার টেপার সময়ের সন্ধানে।
গৌতম ভারতী একজনকে ডেকে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, “কী খাবেন বলুন?”
অমিতই বললেন, “মিষ্টি খেতে পারি।”
তিনজনের জন্য মিষ্টি আর ঠাণ্ডা পানীয় আনার নির্দেশ দিয়ে গৌতম আমাদের দিকে নজর দিলেন। বরং সত্যি বলতে কি, আমার দিকেই নজর দিলেন। একটানা মিনিট দশেক পুলিশি জোরার প্রতিটি হার্ডল পার হতে হল। গৌতম নিশ্চিন্ত হলেন, আমি প্রবীর ঘোষ নই। ইতিমধ্যে তিনটি রেকাবি বোঝাই মিষ্টি এল, এল ঠাণ্ডা পানীয়। খেতে খেতে শুনছিলাম গৌতমের অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি ও অলৌকিক-ক্ষমতার অনেক অনেক কাহিনি। জানালেন, যে কোনও মানুষকে দেখলেই গৌতম তাঁর অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির সাহায্যে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই দেখতে পান। অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির কাছে মানুষের গোপনীয় কিছুই থাকতে পারে না।
আমি প্রবীর ঘোষ নই, এই বিষয়ে গৌতমের নিশ্চিন্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও নিশ্চিন্ত হলাম, গৌতমের পুঁজি কতখানি জেনে।
আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাকে দিয়েও কথা বলাচ্ছিলেন। আবেগতাড়িত মানুষের মতো আমিও কথা বলে যাচ্ছিলাম। বলছিলাম আমার অনেক দুঃখের কথা। সাংবাদিকতার লাইনে দীর্ঘবছর থেকেও প্রতিষ্ঠার মুখ দেখতে না পাওয়ার দুঃখের কথা।
গৌতম ভরসা দিলেন। বললেন, “আপনার ভক্তি আছে, অনেক গুণ আছে। জীবনে সফলতা পেতে প্রয়োজন সেইসব লুকনো গুণগুলোকে বের করে নিয়ে এসে ঠিকমতো কাজে লাগানো। একজন অভিনেতার সমস্ত প্রতিভাকে দর্শকদের সামনে সফলভাবে হাজির করতে পারেন শুধুমাত্র একজন সফল ডাইরেক্টর। মায়ের ইচ্ছের আপনি যখন আমার কাছে এসেই পড়েছেন, তখন আর চিন্তা কী? ডিরেক্টরের ভূমিকা না হয় আমিই নেব। ধরুন…ধরুন…ধরুন…”
গৌতম হঠাৎ তাঁর ডান হাতটা শূন্যে তুলে কাঁপতে কাঁপতে নামিয়ে আনলেন। আমার কপালে তাঁর কাঁপা কাঁপা হাতটা ঠেকিয়ে আমার ডান হাতে দিলেন একটি শিকড়। অমিতের হাতেও দিলেন একটি শিকড়। বললেন, “এই শিকড়টা সব সময় সঙ্গে রেখে দেবেন। মঙ্গল হবে। মানসিক শক্তি বাড়বে।”
জিজ্ঞেস করলাম, “শিকড় দুটো কি আপনার হাতেই ছিল? নাকি ও-দুটো সৃষ্টি করলেন?” আমার স্বরে স্পষ্ট বিহ্বলতা।
গৌতম হাসলেন। বললেন, “ওগুলো শূন্য থেকেই সৃষ্টি করেছি। এই তো কয়েকদিন আগে আপনাদের বিখ্যাত গায়ক অমৃক সিং অরোরাকে ঠিক এমনিভাবেই এনে দিয়েছিলাম একটা বড়সড় রঙিন পাথর।”
বিস্মিত আমি বললাম, “এতদিন জানতাম নেই থেকে আছে হয় না। আজ নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। আসলে তবুও ধন্দ থেকেই যায়; যা দেখেছি সেটা ম্যাজিক নয় তো? অথবা, সম্মোহনের ফল? এতদিনের বিজ্ঞান পড়ার সংস্কার থেকে চট্ করে বেরিয়ে আসাও তো সহজ কথা নয়। ভরসা দিলে একটা অনুরোধ করি।”
“বলুন, বলুন!” আত্মবিশ্বাসে ভরপুর গৌতম আমার দিকে তাকালেন—যে চোখে শিকারি শিকারকে খেলিয়ে তোলার মুহূর্তে তাকিয়ে থাকে।
শিশুর সরলতা নিয়েই আবদার করলাম, “আমি শিকড়টা মুঠোবন্দি করছি। আপনি এটাকে একবারের জন্য অদৃশ্য করে দিয়ে দেখান, আছে থেকে আবার নেইতেও কোনও কিছুকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব!”
আমার কথায় গৌতম মুহূর্তের জন্য হতচকিত হয়ে পড়লেন। তারপরই বহু বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানসেবী রাজনীতিবিদ ও পণ্ডিতসমাজের প্রণম্য গৌতম প্রগাম পাওয়ার যোগ্য বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে গর্জন করে উঠলেন, “আমি শুধু ঈশ্বরের দাস, আর কারও দাস নই। আপনার কথা শুনব কেন মশাই?”
বুঝলাম, ডোজটা একটু কড়া দিয়ে ফেলেছি। কাঁচুমাচু হায়ে বোকা-বোকা চোখে এমন করে গৌতমের দিকে তাকালাম, যেন অজ্ঞতার দরুন অন্যায় কিছু করে ফেলে বড় বেশি কুণ্ঠিত।
অবস্থা সামাল দিতে অমিত প্রসঙ্গান্তরে গেলেন। জানতে চাইলেন, “আপনার দৃষ্টিতে অর্থাৎ একজন সিদ্ধ তান্ত্রিকের দৃষ্টিতে সম্মোহন কী?”
উত্তরে গৌতম শুরু করলেন, সম্মোহনের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘হিপ্নোটিজম্’ ‘হিপ্নোটিজম্’ কথাটি আবার এসেছে ‘হিপ্নোসিস্’ কথা থেকে। ‘হিপ্নোস্’ কথার অর্থ ঘুম। স্বাভাবিক ঘুমের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য থাকলেও সম্মোহন-ঘুম আর স্বাভাবিক-ঘুম এক নয়, কারণ দু’য়ের মধ্যে অ-সাদৃশ্যও কম নয়। তবে এটা বলা যায়, সম্মোহন ঘুমেরই রকমফের, এবং জেগে থাকা ও ঘুমের একটা অন্তবর্তী অবস্থা।…
…কোলের ছোট্ট বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর কৌশল ও সম্মোহন-ঘুম পাড়ানোর কৌশল অনেকটা একই ধরনের। শিশুদের ঘুম পাড়ানো হয় একটানা একঘেয়ে সুরে গান গেয়ে। সম্মোহনের জন্যেও সম্মোহনকারী প্রায় একই ধরনের পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। সম্মোহনকারী যাকে সম্মোহন করতে চায়….।”
গৌতমের মুখনিঃসৃত বাণী শুনে বুঝলাম, গত দু’দিনে তিনি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক বইটির প্রথম খণ্ডের ‘সম্মোহন’ অধ্যায়টা ভালোমতোই মুখস্থ করে ফেলেছেন। অমিত একটা স্লিপ লিখে আমার হাতে এগিয়ে দিলেন। তাতে লেখা—’ও যে আপনারই বই থেকে মুখস্থ বলে যাচ্ছে।
গৌতম তাঁর সম্মোহন শক্তির যে দুটি উদাহরণ আমাদের সামনে উত্থাপন করলেন সে দু’টিরই উল্লেখ ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইতেই আছে। আমাদের মনোযোগিতায় গৌতম আরও উৎসাহিত হলেন। বললেন, কাউকে চোখ বন্ধ করতে বলে তাঁর শরীরে প্রচণ্ড গরম কিছু ঠেকানো হচ্ছে, এমন ধারণা সঞ্চার করে স্রেফ একটা আঙুল ছুঁইয়ে সম্মোহিত মানুষটির শরীরে ফোস্কা ফেলে দিতে পারেন। পারেন সম্মোহনের সাহায্যে বহু রোগীকে রোগ মুক্ত করতে।
বললাম, “সত্যি বলতে কি, আপনার মুখ থেকে শোনা সত্ত্বেও কথাগুলো বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। আপনি যদি আমার হাতে একটু ফোসকা ফেলে দেখান…।”
গৌতম চতুর মানুষ। যা পারেন না, তা গল্পেই সীমাবদ্ধ রাখেন, ঘটানোর চেষ্টা করেন না। এ-ক্ষেত্রেও তার অন্যথা করলেন না। বললেন, “মাঝে মাঝে আসুন। সময়ে অনেক কিছুই দেখতে পাবেন।”
অমিত ফটো সম্মোহনের বিষয়ে কিছু বলতে অনুরোধ করলেন। গৌতম জানালেন, “তন্ত্র হল বিজ্ঞান। তথাকথিত সাধারণ বিজ্ঞানের যেখানে শেষ, তন্ত্রের সেখানে শুরু। এতক্ষণ আপনাদের যে-সব সম্মোহনের কথা বলছিলাম, সেগুলো ঘটাতে তন্ত্রের প্রয়োজন হয় না, সামান্য চেষ্টাতেই যে কোনও মনোবিজ্ঞানীই ওইসব ঘটনা ঘটাতে পারেন। কিন্তু ফটো সম্মোহন—সেটা হল তন্ত্রের এক বিশেষ জটিল প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় কোনও একজনের ছবি পেলে সেই ছবির সাহায্যেই ছবির মালিককে সম্মোহিত করা যায়। অনেক ব্যর্থ প্রেমিক বা প্রেমিকা তাঁদের ব্যর্থ-প্রেমকে সফল করে তুলতে আমার কাছে আসে। তাদের কষ্ট দেখে ফেরাতে পারি না। ফটো সম্মোহন করে মিলন ঘটিয়ে দিয়ে ব্যর্থ জীবনে বাঁচার আনন্দ এনে দিই। আর এতেই আমার আনন্দ।”
“ব্যাপারটা কেমন ভাবে ঘটান?” সত্যিকারের কুমার রায়ই এবার প্রশ্ন করলেন।
“ধরুন একটি ছেলে এল। একটি মেয়ের সঙ্গে গভীর প্রেম ছিল। কিন্তু বর্তমানে বাড়ির চাপে বা অন্য কোনও কারণে মেয়েটি ছেলেটিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলছে। বা বলা যায় ছেলেটিকে নিজের জীবন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে চাইছে। ছেলেটিকে বললাম তার প্রেমিকার একটি ছবি এনে দিতে। ছেলেটি একটি ছবি এনে দিল। এ-বার শুরু হল যাগযজ্ঞের সাহায্যে তন্ত্রমতে মেয়েটিকে সম্মোহন করা। মেয়েটি যত দূরেই থাক, তন্ত্রের এই সম্মোহন শক্তিকে কিছুতেই সে এড়াতে পারবে না। তার মস্তিষ্ককোষে ধারণা সঞ্চার করে দিই—সে ছেলেটিকে ভালোবাসে। ছেলেটিকে ভালোবাসার মধ্যেই সে খুঁজে পাবে জীবনের সার্থকতা। এমনি তিনটে সিটিং-এরপর দেখা যাবে, মেয়েটি ছেলেটির বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারছে না। ছেলেটির সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আকুল হয়ে রয়েছে। ফলে দুজনের মিলন ঘটতেও দেরি হয় না।”
আমি প্রশ্ন তুললাম, “প্রতিটি ক্ষেত্রেই কি ফটো সম্মোহনে সফলতা পাওয়া সম্ভব?”
গৌতমও পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “কেন সম্ভব নয়? তন্ত্র যদি বিজ্ঞানই হয় তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফলতা আসতে বাধ্য। যেমন একের সঙ্গে এক যোগ করলে সব সময়ই দুই হতে বাধ্য। যাদের দায়িত্ব নিয়েছি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের মিলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছি।”
গৌতম ভারতীর আদেশে ম্যানেজারবাবু কিছু খাতাপত্তর বের করে দিলেন। গৌতম সে সব ঘেঁটে চারটি নাম বের করে দিলেন, মালা বসাক, সৌমিত্র সেন এবং স্মৃতিরেখা চ্যাটার্জি, অলোক ব্যানার্জি। বললেন, “এদের মিলন ঘটিয়েছি ফটোসম্মোহন করে।”
বললাম, “সব কিছু জানা-বোঝার পরও সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন অবিশ্বাস লাগছে। আমি একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চাই, তার ভালোবাসা চাই, মেয়েটির ছবি আপনাকে হাজির করতেই আপনি তাকে আমার করে দিলেন-ভাবতে পারা যাচ্ছে না।”
“ভাবতে না পারার মতো অনেক কিছুই এই পৃথিবীতে ঘটে চলেছে। এই যে আমি ‘মোহিনী ঔষধি’ দিয়ে থাকি, এর এমনই বশীকরণ শক্তি যার প্রভাবে যে কোন শত্রুকে, যে কোন স্ত্রী বা পুরুষকে বশে আনা সম্ভব।” জানালেন গৌতম।
বললাম, “তাহলে ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকাদের ‘মোহিনী ঔষধি’ না দিয়ে এত যাগযজ্ঞ করে ফটোসম্মোহন করার দরকার কী?”
গৌতম জানালেন, ‘মোহিনী ঔষধি’-তে বশ করা আর প্রেম পাওয়া কি এক ব্যাপার? ফটোসম্মোহন সম্মোহিত করে একজনের মনে আর একজনের প্রতি প্রেম জাগিয়ে তুলি।”
অমিত জিজ্ঞেস করলেন, “ফটো সম্মোহনের জন্য কত নেন?”
গৌতম জানালেন, “কোনও টাকা-পয়সাও নিই না। যজ্ঞের খরচটুকুই শুধু নিই।”
“সেটা কত?” অমিতই জিজ্ঞেস করলেন।
“তিন হাজার এক টাকা।”
আমি বললাম, “আপনার সমস্ত কথা শোনার পর কয়েকটা বিষয় আমার মাথায় জট পাকিয়ে গেছে। আপনি ফটো সম্মোহনের বিষয়ে বলার আগে সম্মোহন প্রসঙ্গে যে-সব কথা বললেন, এমনকী আপনি সম্মোহন করে দু-জনের ক্ষেত্রে যে দুটো ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে জানালেন সে সবই আমি সম্প্রতি পড়েছি। অমিতই মাস-খানেক আগে আমাকে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইয়ের অংশ-বিশেষের ফটো কপি পড়তে দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গ ছিল সম্মোহন। তাতে এ-সবেরই উল্লেখ ছিল। সম্মোহনের সাহায্যে অনেক রোগীকে আরোগ্য করা যায় বলে আপনি যে সব কথা বললেন, সে-সব কথার সঙ্গে সম্প্রতি আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখার হুবহু মিল লক্ষ্য করে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল, ‘সম্মোহন ও রোগমুক্তি’। সম্মোহন প্রসঙ্গে পড়ে যতটুকু জেনেছি, তাতে সম্মোহন হল মস্তিষ্কস্নায়ু কোষে ধারণা সঞ্চারের ব্যাপার। অর্থাৎ, সম্মোহন করার প্রাথমিক শর্ত, আপনি যার মধ্যে কোনও ধারণা সঞ্চার করতে চাইবেন তার মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ অবশ্যই থাকতে হবে। আপনি ফটোর মধ্যে ধারণা সঞ্চারিত করবেন কী করে? ফটো তো জড় বস্তু। ফটোর মস্তিষ্ক, স্নায়ু বা মন আছে, এ ধরনের কল্পনা তো স্রেফ পাগলামি বা চূড়ান্ত অজ্ঞতা। আপনাকে যদি চ্যালেঞ্জ জানাই, ফটো সম্মোহনের বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারবেন?”
মহা অলৌকিক শক্তিধর, অবতার গৌতম ভারতী আমার কথায় ফ্যাকাশে মেরে গেলেন। তাঁর বড় বড় চোখ দুটো সরু সরু হয়ে গেল। ফোলানো বুক থেকে হাওয়া বেরিয়ে গেল। সামনের দিকে ঝুঁকে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। নিজের অজ্ঞতাকে স্বীকার করে নিলেন। অনুরোধ করলেন তাঁর বিষয়ে বিরূপ কিছু না লিখতে।
৮৭-র নভেম্বর সংখ্যা আলোকপাতে ‘সম্মোহনে অসম্ভব সম্ভব হয়?’ শিরোনামে লেখাটি প্রকাশিত হল। সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখাটির লেখক তাপস মহাপাত্র ও অমিতবিক্রম রাণা। প্রতিবেদনটিতে লেখক জানালেন, ‘ছদ্মবেশে যাওয়া সুদক্ষ সম্মোহনবিদ প্রবীর ঘোষকে তিনি (গৌতম ভারতী) চিনতে পারলেন না কিছুতেই। শুধু তাই নয় প্রবীরবাবুর লেখা, ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বই-এর হুবহু উদাহরণ দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি বলে বাহবা চাইতেও ছাড়েননি….প্রবীরবাবুর একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তরে শেষ পর্যন্ত হার মানলেন শ্রীযুক্ত ভারতী। কিন্তু তাঁর এইসব তন্ত্রমন্ত্রের বুজরুকি কথাবার্তা প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধও করলেন। কেননা এতে তাঁর ব্যবসার ক্ষতি হবে।’ এই প্রবন্ধে প্রতিবেদক আরও জানান, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষ ফটো-সম্মোহন ক্ষমতার দাবিদারদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন কেউ তাঁদের দাবির যথার্থতা প্রমাণ করতে পারলে তিনি দেবেন ৫০,০০০ টাকা। ‘আসলে পুরো ব্যাপারটাই ফাঁকি। মানসিক ভারসাম্যহীন বিরহী প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক ঘৃণ্য উপায়ে ঠকানো।’
লেখাটির সঙ্গে গৌতম ভারতীর ভণ্ডামির চূড়ান্ত নিদর্শন হিসেবে ছদ্মপরিচয়ে চিনতে না পারা আমাকে আশীর্বাদরত গৌতম ভারতীর একটি ছবি প্রকাশিত হয়।
‘আলোকপাত’ জানুয়ারি ’৮৮ সংখ্যায় ‘পাঠকের অধিকার’ বিভাগে একটি প্রতিবাদপত্র প্রকাশিত হয়। পত্রলেখক অমৃক সিং অরোরা এবং গৌতম ভারতীর অন্যান্য ভক্তবৃন্দ জানান,
‘নভেম্বর ’৮৭ সংখ্যায় প্রকাশিত সম্মোহনের অসম্ভব সম্ভব হয়? লেখাটিতে লেকটাউন শ্রীশ্রীশিবকালী আশ্রম এবং আচার্য শ্রীগৌতম ভক্তি সিদ্ধান্ত ভারতী সম্পর্কে প্রবীর ঘোষের মিথ্যা ভাষণের প্রতিবাদ জানাই। গৌতম ভক্তি সিদ্ধান্ত ভারতীর সঙ্গে অনেক মহাপুরুষকে এভাবে প্রবঞ্চক হিসেবে তুলে ধরার জন্য আমরা ব্যথিত। নিজস্ব মতামত দিয়ে কাউকে এভাবে নস্যাৎ করার এবং হীন বলে প্রচার করার ক্ষুদ্র মানসিকতার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
উত্তরে আমি যে চিঠি দিই, তা ‘আলোকপাত’ মার্চ ১৯৮৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। জানাই,
‘জানুয়ারি ’৮৮ সংখ্যা আলোকপাতের পাঠকের অধিকার-এ প্রকাশিত আচার্য শ্রীগৌতম ভক্তি সিদ্ধান্ত ভারতীর ভক্তবৃন্দের প্রতিবাদপত্রের উত্তরে জানাই উক্ত প্রবন্ধটির লেখক আমি নই, লেখক হলেন—তাপস মহাপাত্র ও অমিতবিক্রম রাণা। শ্রীরাণা আমার একটি সাক্ষাৎকার নেন। তাঁর কাছেই শুনতে পাই তিনি আপনাদের গুরুদেবের একটি সাক্ষাৎকার নেবেন। আমি একজন অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে সত্যানুসন্ধানী মানুষ হিসেবে শ্রীরাণার সঙ্গী হতে চাইলে তিনি সানন্দে রাজি হন। তারপর যা ঘটেছে, যা দেখেছেন, তাই শ্রীরাণা লিখেছেন একজন সৎ সাংবাদিক হিসেবেই। অতএব এই লেখার মধ্যে আমার ভাষণ আসছে কোথা থেকে? মিথ্যেই বা আসছে কোথা থেকে?
যাই হোক, এ-বিষয়ে চিঠির কূটকচালির কোন প্রয়োজন আছে কী? বরং আপনাদের গুরুদেবকে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে (নিয়মমত ৫,০০০ টাকা জমা রেখে ৫০,০০০ টাকার চ্যালেঞ্জ) আমার বিরুদ্ধে সমুচিত জবাব দিতে বলুন।’
’৮৭ শেষ হল, ’৮৮ শেষ হল। গৌতম ভারতী জবাব দিতে হাজির হলেন না। বিপুলভাবে প্রচণ্ড সাড়া জাগিয়ে হাজির হলেন ’৮৯-এর ফেব্রুয়ারিতে। ১৯ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকায় ও ২১ ফেব্রুয়ারি আজকাল পত্রিকায় আলোকপাতের সেই ছবিটি সহ বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হল।
আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন
ঐশী শক্তির জয়
যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষ পৃথিবীর সমস্ত সত্ত-মহাপুরুষদের ধোঁকাবাজ বলে তাঁদের কুৎসা প্রচারে পঞ্চমুখ। কিন্তু পরিণামে সত্যের জয় নিশ্চিত। এহেন প্রবীরবাবু—৯৯ডি/১ লেকটাউন (লেকটাউন ও যশোর রোডের সংযোগ স্থল) শ্রীশ্রীশিবকালী আশ্রমে আচার্য শ্রীমদ গৌতম ভক্ত সিদ্ধান্ত ভারতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

ভারতীজীর আশীর্বাদ ভিক্ষা করেন।
আজকাল ২১ ফেব্রুয়ারি ’৮৯ প্রকাশিত বিজ্ঞাপন
পরাজিত প্রবীর ঘোষ
এক শোচনীয় ও মর্মান্তিক পরাজয়। যুক্তিবাদী সমিতির, সম্পাদক প্রবীর ঘোষ লেকটাউনস্থিত শ্রীশ্রীশিবকালী আশ্রম—৯৯ডি/১ লেকটাউন, কলিকাতা-৮৯-এর অধ্যক্ষ মাতৃসাধক আচার্য্য শ্রীমদ গৌতম ভক্তি সিদ্ধান্ত ভারতী ঠাকুরকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে তাঁর শ্রীচরণে মাথা নত করতে ও আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে বাধ্য হন।
ইতি—
শ্যামাপদ ঘোষ
এরও একটা পশ্চাৎপট রয়েছে। সেই বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা প্রয়োজন। ১২ ফেব্রুয়ারি আজকাল পত্রিকার ‘রবিবাসর’-এ আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম—‘আমার চ্যালেঞ্জাররা’। লেখাটিতে গৌতমের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের ঘটনাটির উল্লেখ করেছিলাম। সেই সঙ্গে জানিয়েছিলাম—পত্রিকাটিতে (আলোকপাত) প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষ জানিয়েছেন গৌতম ভারতী তাঁর ফটো সম্মোহনের যথার্থতা প্রমাণ করতে পারলে শ্রীঘোষ দেবেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। সে নিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি, চিঠি-চাপাটির অনেক চাপান-উতোর চলেছিল। আমি একটি চিঠিতে লিখেছিলুম, গৌতম ভারতী তাঁর দাবির সমর্থনে প্রমাণ দিলেই যেখানে ল্যাঠা চুকে যায়, সেখানে এত চিঠির কূট-কচ্চানির কী আছে?’
আজকাল-এর লেখাটির সঙ্গে একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। ছবিটি ছিল শ্রীশ্রীসদানন্দ দেবঠাকুর ও আমার। কিন্তু ভুলে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে ছবির তলায় ছাপা হয়েছিল—গৌতম ভারতীর সঙ্গে লেখক।
আমি যে লেখাটি আজকাল পত্রিকার ‘রবিবাসর’ বিভাগে দিয়েছিলাম, তাতে সদানন্দ দেবঠাকুর বিষয়ে কিছু লিখেছিলাম। সম্ভবত স্থানাভাবে অংশটিকে বাদ দিতে হয়। ফলে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হওয়ার বা সৃষ্টি করার সম্ভাবনা ছিল।
এই বিজ্ঞাপন দুটি বিশাল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছিল। অলৌকিকতার ব্যবসায়ী ও জ্যোতিষ ব্যবসায়ীরা এবং তাদের অন্ধ ভক্ত ও উচ্ছিষ্টভোগীরা এবং অলৌকিকতায় বিশ্বাসী সাধারণ মানুষেরা যুক্তিবাদের এই পরাজয়ের খবরে প্রচণ্ডভাবে উল্লসিত হয়েছে। প্রতিটি যুক্তিবাদী আন্দোলনে ব্রতী স্বেচ্ছা প্রতিষ্ঠানকে অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। অপমানিত হতে হয়েছে, ধিকৃত হতে হয়েছে। কয়েকটা দিনের জন্য বহু ক্ষেত্রেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় শত শত সংগঠনের চিঠির পাশাপাশি বহু মানুষের উৎকণ্ঠাভরা বাস্তব সত্যকে জানতে চাওয়া চিঠির পাহাড় জমেছিল। ভোর থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত বাড়িতে এসেছেন দূরের-কাছের বহু গণ-সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তাঁরা অনেকেই অভিযোগ করছেন, অলৌকিক বিরোধী অনুষ্ঠানের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে, দেওয়াল লিখনে লেপে দেওয়া হচ্ছে আলকাতরা, হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে প্রচার-পত্র ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। অলৌকিক বিরোধী অনুষ্ঠানের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে।
আমাদের সংগ্রামী সাথী যাঁরাই এসেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই বক্তব্য ছিল—একটা কিছু করতে হবে। কোণঠাসা অবতাররা আজ যে আক্রমণ চালিয়েছে, তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে না দিলে আমাদের আন্দোলনের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আমরা সঠিক আঘাত হানতে পারছি বলেই অবতাররা আজ আমাদের প্রত্যাঘাত করেছে।
কী করব আমরা? কুসংস্কার মুক্তির এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন যখন সঙ্কটের আবর্তে পাক খাচ্ছে তখন আমাদের সামনে একটি মাত্র পথ খোলা ছিল—বিজ্ঞাপনের জবাবে পাল্টা বিজ্ঞাপন দেওয়া। কারণ, আমাদের যতদূর জানা আছে, ইতিপূর্বে বিজ্ঞাপনের প্রতিবাদ পাঠানো কোনও চিঠি প্রথম শ্রেণির কোনও ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। আবার ধনকুবের অবতারদের বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপনের লড়াইয়ে নামলে তা হয়ে দাঁড়াবে অসম লড়াই। আমরা খবর পাচ্ছিলাম কিছু অবতার ও জ্যোতিষীরা এই লড়াইকে তাঁদের বাঁচার শেষ লড়াই হিসেবে ধরে নিয়ে একত্রিত ও সংগঠিত হয়েছেন। এক অবতারের টাকার জোরের সঙ্গে টক্কর দিতেই যখন আমরা অপারগ, তখন বহুর বিরুদ্ধে লড়ব কেমন করে? আমরা যখনই একটা কাগজে ছোট্ট বিজ্ঞাপন দিয়ে বাস্তব সত্যকে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরব, তখন বিরোধী শিবির দশটা কাগজে দশটা ঢাউস বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের বক্তব্যকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে।
ইতিমধ্যে ‘গোদের উপর বিষফোড়া’। আমরা বিভিন্ন সহযোগী সংস্থার ও অগ্রণী বিজ্ঞান সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসলাম আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে। সমস্ত রকমের সক্রিয় সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা। ওই উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যেই কয়েকজন অভিযোগ তুললেন, একটি স্ব-বিজ্ঞাপিত যুক্তিবাদী সমাজ সচেতন মাসিক বিজ্ঞান পত্রিকার কিছু কাছের মানুষ ইতিমধ্যে প্রচারে নেমে পড়েছে—প্রবীর ঘোষ ২০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পরাজয় মেনে নিয়েছে। আমাদের দেশে ঈর্ষাকাতর মানুষের কোনও দিনই তাভাব ছিল না। কিন্তু এমন অভাবনীয় বিপদের দিনে কেউ সহযোগিতার পরিবর্তে মিথ্যে কুৎসা রটিয়ে আখের গুছোতে চাইবে এটা বিজ্ঞান আন্দোলনের পক্ষে যেমনই দুঃখজনক, তেমনই ঘৃণ্য চক্রান্ত। অবশ্য এই ধরনের যুক্তি-বিরোধী, মিথ্যাচারিতা ও ঈর্ষাপরায়ণতার বহু দৃষ্টান্ত এর আগেও ওই পত্রিকাটি স্থাপন করেছে। আরও একবার ওদের আসল রূপটা আমাদের দেখাল।
আমরা সাধারণ মানুষের কাছে সত্যকে তুলে ধরার প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘সম্পাদক সমীপেষু’ বিভাগের সম্পাদক ধীরেন দেবনাথের হাতে প্রতিবাদপত্র তুলে দিলে তিনি জানালেন, মিথ্যে বিজ্ঞাপনের দরুন কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমাদের প্রতি তাঁর সমস্ত রকম সহানুভূতি থাকলেও, আমাদের চিঠি ছাপতে তিনি অপারগ। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অভীক সরকার ও আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তকে আমাদের সমস্যার কথা জানিয়ে কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের স্বার্থে সত্যকে তুলে ধরার অনুরোধ রেখেছিলাম। দুজনেই সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েছিলেন।
২২ ফেব্রুয়ারি আজকাল পত্রিকায় ‘প্রিয় সম্পাদক’ বিভাগে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষে আমার লেখা চিঠিটি প্রকাশিত হয়। সঙ্গে প্রকাশিত হয় আরও তিনটি চিঠি—
বুজরুকরা মিথ্যা বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নিচ্ছেন
যুক্তিবাদীদের সঙ্গে লড়াই-এ না পেরে বুজরুকরা এখন মিথ্যা বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নিচ্ছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আজকালের প্রবীর ঘোষ ও ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির বিরুদ্ধে শ্যামাপদ ঘোষ যে সচিত্র বিজ্ঞাপনটি দিয়েছেন তা নির্জলা মিথ্যা। তথ্য ও সত্যের মারাত্মক বিকৃতি ঘটিয়েছেন তিনি। বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়েছে লেকটাউন শ্রীশ্রীশিবকালী আশ্রমের অধ্যক্ষ শ্রীমদ গৌতম সিদ্ধান্ত ভারতীর কাছে পরাজিত হয়ে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছেন। বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ছবিটি ’৮৭ সালের নভেম্বরে ‘আলোকপাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তলায় ক্যাপশন ছিল ‘এই গৌতম সিদ্ধান্ত ভারতীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন প্রবীর ঘোষ।’ বিজ্ঞাপনে ক্যাপশনটিকে সম্পূর্ণ বদলে দেওয়া হয়েছে। ছবির সঙ্গে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল তা থেকেই পরিষ্কার যে গৌতম ভারতীর অলৌকিক ক্ষমতা কিছুই নেই। আলোকপাতে প্রকাশিত ওই লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘সম্মোহনে ‘অসম্ভব সম্ভব হয় কি?’ লেখক ছিলেন তাপস মহাপাত্র ও অমিত বিক্রম রাণা। ছবিটি তুলেছিলেন কুমার রায়। প্রতিবেদনে লেখকদ্বয় জানিয়েছিলেন ‘ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক পৌঁছুনোমাত্র আশ্রমাধ্যক্ষ (অর্থাৎ গৌতম ভারতী) হঠাৎই ম্যাজিকের মতো খালি হাতটি এগিয়ে দিয়ে হাতের মুঠো থেকে বের করলেন নাম-না-জানা শিকড়। এ দিব্যদৃষ্টি। সম্মোহনে ত্রিকাল দর্শনও করতে পারে। এসব তাঁর দাবি। এক্ষেত্রে বলাবাহুল্য ফটোগ্রাফারের ছদ্মবেশে যাওয়া সুদক্ষ সম্মোহনবিদ্ প্রবীর ঘোষকে তিনি চিনতে পারলেন না কিছুতেই’…‘প্রবীরবাবুর একটার পর একটা প্রশ্নে হার মানলেন শ্রীযুক্ত ভারতী। কিন্তু তাঁর এইসব তন্ত্রমন্ত্রের বুজরুকি প্রকাশ কথাবার্তা প্রকাশ না করার জন্যও অনুরোধ করলেন। কেন না এতে তাঁর ব্যবসার ক্ষতি হবে। এই লেখা থেকে পরিষ্কার হার আমার হয়নি। হেরেছেন তিনিই। ছবিটিরও একটা নেপথ্য কাহিনি আছে। গৌতম ভারতীর কাছে আমি গিয়েছিলাম আত্মপরিচয় গোপন করে। সাধারণ ভক্ত সেজে। নাম দিয়েছিলাম কুমার রায়। কিন্তু সবজান্তা এই গুরুদেব আমার আসল পরিচয় জানতে পারেননি। আর পাঁচটা ভক্তকে যেমন আশীর্বাদ করেন তেমনভাবেই আশীর্বাদ করেছিলেন আমাকে। আমি নিশ্চিত আমার পরিচয় জানার পর তিনি আমাকে আশ্রমে ঢুকতেই দিতেন না। আমার পক্ষেও সম্ভব হত না তাঁর বুজরুকি ধরা। আমাকে চিনতে না পেরে আশীর্বাদরত গৌতম ভারতীর এই ছবিটিই ‘আলোকপাতে’ ছাপা হয়েছিল। এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর আবার আসরে নেমেছেন গৌতম ভারতীর ‘ভক্তরা’। কিছুদিন আগে ‘আজকাল’ পত্রিকায় রবিবাসরে ‘আমার চ্যালেঞ্জাররা’ শীর্ষক লেখাটিতে গৌতম ভারতীর বুজরুকির মুখোশ আর একপ্রস্থ খুলে দেবার পরই আমার বিরুদ্ধে এই বিজ্ঞাপন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতা শ্যামাপদ ঘোষ-সহ প্রতিটি বুজরুক এবং তাঁদের ধারকবাহকদের উদ্দেশে জানাই টাকার জোরে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের দেশে গড়ে ওঠা কুসংস্কার বিরোধী গণ আন্দোলন বন্ধ করার ক্ষমতা আপনাদের নেই। আপনাদের বিজ্ঞাপন প্রমাণ করে আপনারা ভীত, সন্ত্রস্ত। তাই মিথ্যাচারিতাকে আশ্রয় করে গণবিজ্ঞান আন্দোলনকে আঘাত করতে চাইছেন। আমি আবার চ্যালেঞ্জ করছি আপনাদের গুরুদেবকে বলুন, সবসমক্ষে তাঁর অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা প্রমাণ করতে। চ্যান্সেঞ্জ গ্রহণের ধৃষ্টতা যদি আপনার গুরুদেবটি দেখান তাহলে তাঁর মাথা যুক্তিবাদী মানুষের পায়ে তথা আন্দোলনের কাছে নত হতে বাধ্য হবে।
প্রবীর ঘোষ, সম্পাদক, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি।
কেন এই লেখা?
আমরা ক্ষুব্ধ
(১)
জনৈক প্রবীর ঘোষের ‘আমার চ্যালেঞ্জাররা’ শীর্ষক লেখা পড়লাম। ১২ ফেব্রুয়ারি রবিবাসরে। এ ধরনের একজন আনাড়ির লেখা আজকালের মতো প্রথম শ্রেণির দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে দেখে আমরা বিস্মিত। প্রবীর ঘোষ বহু মহাপুরুষের নামে বহু বাজে উক্তি করেছেন। এর মধ্যে লেক টাউনের শ্রীশ্রীশিবকালী আশ্রমের অধ্যক্ষ গৌতম ভক্তিসিদ্ধান্ত ভারতীকে নিয়ে একটি ভুল ছবিও প্রকাশ করেছেন। এতেই প্রমাণিত হয়, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা ও আচার্যদেবকে হেয় করাই তাঁর উদ্দেশ্য। আমরা তাঁর এই হীন মনোভাবে ক্ষুব্ধ। আমরাও প্রবীর ঘোষকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি, গৌতম ভারতী ঠাকুর সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তার সত্যতা তাঁকে প্রমাণ করতে হবে। প্রমাণ করতে পারলে আমরা তাঁকে ভারতীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার টাকা দেব। প্রবীরবাবু নিচের ঠিকানায় কবে আসতে পারবেন জানলে খুশি হব। আমরা তাঁর জবাবের অপেক্ষায় রইলাম।
বিজয় দাশগুপ্ত, ৭/২, যশোর রোড, কলি-২৮।
অসীম কুমার মিত্র, কলি-৯১।
কাজল কুমার পোদ্দার, কলি-১
রজত পাল, কলি-৫০ এবং আরও অনেকে।
(২)
গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রবীর ঘোষের লেখা ‘আমার চ্যালেঞ্জাররা’ লেখাটি পড়ে আমি মর্মাহত। কারণ লেখাটির বিষয়বস্তু ছিল কতিপয় অলৌকিক ম্যাজিক প্রদর্শনকারী জ্যোতিষী ও তান্ত্রিকদের সম্বন্ধে। এবং আমার সম্বন্ধে কিছুমাত্র উল্লেখ ছিল না। অহেতুক আমার ছবিটি এই বিতর্কিত লেখাটির মধ্যে ছাপা হয়েছে। ছবিটি গৌতম ভারতীর নয়, আমার। এতে আমার হাজার হাজার ভক্ত নরনারীদের সঙ্গে আমিও অস্বস্তি বোধ করছি। কারণ এই ধরনের অলৌকিক ম্যাজিকে আমি আদৌ বিশ্বাসী নই। আমি একজন ঈশ্বর বিশ্বাসী ধর্মগুরু। যারা আমার কাছে আসে এবং শান্তি চায় তাদের দিই শান্তিময় দিব্যজীবনের পথের সন্ধান।
শ্রীশ্রীসদানন্দ দেব ঠাকুর
আনন্দধাম। কলকাতা-২৮
(৩)
১২।২।৮৯ তারিখের আজকাল পত্রিকায় শ্রী প্রবীর ঘোষের লেখা ‘আমার চ্যালেঞ্জাররা’ লেখাটি পড়ে আমরা বিস্ময়ে হতবাক। কারণ শ্রীঘোষ লেখাটিতে কতিপয় জ্যোতিষী তান্ত্রিকদের সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করে গৌতম ভারতী নামে। আমাদের পরামারাধ্য গুরুদেব শ্রীশ্রীসদানন্দ দেব ঠাকুরের ছবি ব্যবহার করেছেন। এতে তাঁর শিষ্যভক্তদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ তিনি এ ধরনের অলৌকিক ম্যাজিকের পক্ষপাতী নন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ধর্মীয় ব্যাখ্যায় আমরা আকৃষ্ট। তাঁর উপদেশ আমরা পাই সুস্থ শান্তিময় আধ্যাত্মিক জীবনের আলোর সন্ধান। কাজেই এ ধরনের বিতর্কিত লেখার মধ্যে তাঁর ছবি একেবারেই শোভা পায় না।
চিরঞ্জীব ব্রহ্মচারী
কলকাতা-৪৯।
ইতিমধ্যে সুসংগঠিতভাবে আমাদের উপর আক্রমণ ও ভীতিপ্রদর্শন চলতেই থাকে। গৌতমের ভক্ত নামধারীরা ‘আজকাল’ পত্রিকা অফিসেও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
আমাদের সমিতি ও আমাদের সহযোগী বহু সংস্থা গৌতমের মিথ্যাচারিতার জবাব দিতে সভা, পথসভা, পোস্টার, লিফলেট নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে হাজির হতে থাকেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন সাধারণ মানুষের এক বিশাল অংশ। যুক্তিবাদী আন্দোলনের জনপ্রিয়তার বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ। এতে বিপদ অনেক। যুক্তিবাদী চেতনার উন্মেষে বিপদ অনেকেরই—তারা তো সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দেবেই।
এ তো আমাদের অজানা ছিল না। এই আন্দোলন যে শ্রেণিস্বার্থকে আঘাত হানবে সেই শ্রেণি তাদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে, তীব্র প্রত্যাঘাত হানবে। এই প্রত্যাঘাতের মুখে কেউ সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, কেউ পিছু হটবে। আমাদের এই সংগ্রামেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষও যেমন পেয়েছি, তেমনি পিছু হটে যাওয়া বাক্য-সর্বস্ব মানুষও দেখেছি।
আমাদের দেশের বহু সংগঠন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লিখিতভাবে দাবি জানিয়েছিলেন, পুলিশ ও প্রশাসন যেন আক্রান্ত যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সভা-সমিতির মাধ্যমে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গৌতম ভারতীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ও আমাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবি উঠছিল। আনন্দবাজারের প্রতিনিধি দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী এই সময় আমার একটি সাক্ষাৎকার নেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, “পুলিশ বা প্রশাসন সাহায্য না করলে আপনারা কি যুক্তিবাদী আন্দোলন বন্ধ রাখবেন?”
বলেছিলাম, “একজন নাগরিক হিসেবে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে নিশ্চয়ই আমার ও আমাদের সমিতির ঘনিষ্ঠদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি করতেই পারি এবং করছিও। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও ঠিক, আমরা পুলিশ ও প্রশাসনের উপর নির্ভর করে আন্দোলন করতে নামিনি। প্রত্যাশাও করি না পুলিশ ও প্রশাসন আমাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আমরা নির্ভর করি দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের উপর। তাঁরাই আন্দালন এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তাঁরাই তো আমাদের আন্দোলনের শক্তি।
২৫ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় চার কলম জুড়ে প্রকাশিত হল—
‘অলৌকিক শক্তিধরদের’ চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন
দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী
যুক্তির পথ কখনওই সুগম নয়। সংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস যেখানে দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রাখে, সেখানে স্বেচ্ছায় যাঁরা যুক্তিবাদের পথ বেছে নেন, তাঁদের কঠিন পরীক্ষা দিতেই হয়। যেমন এই মুহূর্তে দিতে হচ্ছে প্রবীর ঘোষকে। প্রবীরবাবু ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক। অসংখ্য অবতার, মহাপুরুষ, জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, ওঝা, জানগুরু আর ‘অলৌকিক শক্তিমান’দের বিরুদ্ধে সারা দেশে এই মুহূর্তে প্রচার চালাচ্ছেন বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিনিষ্ঠ বেশ কিছু মানুষ ও সংগঠন। প্রবীর ঘোষ ও তাঁর সমিতি এঁদেরই অন্যতম। বার বার ‘হোলি ম্যাজিশিয়ান’দের চ্যালেঞ্জ জানাতে জানাতে প্রবীরবাবু এখন জড়িয়ে পড়েছেন এক সঙ্কটের ঘূর্ণিতে। প্রথম একটি বিজ্ঞাপন যাতে দাবি করা হয় তিনিও এক ‘গুরুর’ কাছে মাথা নত করেছেন। এবং প্রকাশ্যে তার প্রতিবাদ করতেই শারীরিক আক্রমণের হুমকির মুখে পড়েন। প্রবীরবাবুর মনে হয়, ‘ওরা ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছে না। ওদের টাকা আছে, তার জোরে ওরা অনেক কিছুই করতে পারে।’ তার অভিযোগ, দমদম লেকটাউন অঞ্চলে তাদের সমিতির কর্মীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে—যুক্তিবাদী বইয়ের কাউণ্টারে এসে বলা হচ্ছে, “প্রবীর ঘোষকে কেউ বাঁচাতে পারবে না; এসব করলে তোমরাও মরবে।” প্রবীরবাবু ইতিমধ্যেই দমদম থানায় লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ এখনও অবধি সক্রিয়তার পরিচয় বিশেষ দেয়নি।
‘অলৌকিক শক্তিধর’ গৌতম ভারতীকে প্রবীর ঘোষ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছেন অনেক দিন থেকেই। কিন্তু ‘অলৌকিক শক্তিধর’ বলে কথিত গৌতম ভারতীর সঙ্গে তাঁর নতুন করে বিরোধের কারণ একটি বিজ্ঞাপন—যাতে বলা হয়েছে ভারতীর কাছে হার মেনে প্রবীরবাবু তার সামনে মাথা নত করেছেন। বক্তব্যের সমর্থনে একটি ছবিও বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের ছবি ও কথায় ছিল ‘পৃথিবীর সমস্ত সন্ত-মহাপুরুষদের ধোঁকাবাজ বলে তাদের কুৎসা প্রচারে পঞ্চমুখ’ প্রবীরবাবু শ্রীমদ ভারতীর কাছে সকল প্রশ্নের সুসমাধান পেয়ে মাথা নত করে ভারতীজির আশীর্বাদ ভিক্ষা করেন। প্রবীরবাবুর মতে, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, কতখানি মিথ্যা প্রচার করা যায়—এ তারই নিদর্শন। ছবিটি অবশ্য সাজানো নয়—এক অলোকচিত্রীরই তোলা। সেই ঘটনাও ঘটেছিল সাংবাদিকদের সামনেই, ১৯৮৭ সালে—তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। পরিচয় গোপন করে প্রবীরবাবু উপস্থিত হয়েছিলেন গৌতম ভারতীর সামনে। দিব্যদৃষ্টির অধিকারী বলে প্রচারিত তান্ত্রিক আদৌ বুঝতে পারেননি প্রবীরবাবুর উদ্দেশ্য। বরং দর্শনার্থীদের একজন মনে করে ভারতী তাঁকে আশীর্বাদ করেন। সেই ছবিটি তখনই তোলা। একটি পত্রিকায় তা ছাপাও হয়। হুবহু এই ছবিটিই বিজ্ঞাপনেও রয়েছে। সেই পত্রিকার প্রতিবেদনে স্পষ্টই জানানো হয়েছিল, প্রবীরবাবুর বিভিন্ন প্রশ্নে পরাজিত গৌতম ভারতী প্রবীরবাবুকেই অনুরোধ করেছিলেন ‘তন্ত্রমন্ত্রের বুজরুকি/কথাবার্তা প্রকাশ না করতে। এখন প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে কিন্তু এর উল্টো কথাই বলা হয়েছে।
যাঁদের নামে এই বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে তাদের একজন দমদম পৌর প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত সেক্রেটারি বিজয় দাশগুপ্ত। ‘ঐশী শক্তির জয়’ শিরোনামে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ছবি সম্বন্ধে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, ছবি তোলার সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন পুরীতে। ঘটনাটি লেকটাউনের। তা সত্ত্বেও তিনি জানালেন, বিজ্ঞাপনের দায়িত্ব তাঁরই। একই মর্মে ‘প্রবীর ঘোষ পরাজিত’ শিরোনামে আর একটি বিজ্ঞাপনও মুদ্রিত হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গে বিজ্ঞাপক শ্যামাপদ ঘোষ বললেন, প্রবীরবাবু তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছিলেন। ‘কিন্তু আশীর্বাদ তো তিনি নিয়েছেন, আমরা সেটাকেই ঘুরিয়ে প্রচার করছি।’
গেলাম গৌতম ভারতীর কাছেই। বাঘছালের আসনে বসে থাকা এক দোহারা যুবক। জানতে চাইলাম। আপনি কি অলৌকিক-শক্তিমান?—“আমি? আমি কিছুই না। সবই মা। আমি কী তা কে বলবে। তোমরা বলো।” লক্ষ্য ভক্তরা। তাঁরা গুরুর আশ্চর্য সব ক্ষমতার কথা বললেন। গুরু জানিয়ে দিলেন ক্ষমতা তার নয়, ‘ক্ষমতা মায়ের’। তা সত্ত্বেও তিনি পার্থিক সম্পদ কিন্তু পান ভক্তদের কাছ থেকেই। যদিও তাঁর নিজের কথায় “আমি কিছু নিই না। ওরা দেয়। জোর করে দেয়। না নিলে তো ওদের অপমান করা হয়, তা-ই নিই। এই যে রুপোর গ্লাস, ওই যে ওটা (এয়ারকুলার), সব জোর করে ব্যবহার করায় আমাকে দিয়ে।”
এক ভক্ত জানালেন, গুরুর কোনও দাবি নেই। কেউ দু হাজার টাকা দিলে তা-ই নেন: কেউ পঁচিশ হাজার দিলে তা-ও নেন।
আপনি কীভাবে রোগ সারান?
—আমি না, আমি না—মা সারান। আমি হাত মুঠো করি। মা সন্দেশ দিলে আমি সন্দেশ দিই, মা রসগোল্লা দিলে আমিও রসগোল্লা দিই। বারবার প্রশ্ন করা সত্ত্বেও কিন্তু বিজ্ঞাপন নিয়ে আলোচনায় গেলেন না তিনি। শুধু বললেন, “ও সব ভক্তদের কাজ।” তারপরেই সারাক্ষণ করজোড়ে বসে থাকা গৌতম ভারতী সুর পাল্টে বললেন, “তবে উনি (প্রবীর ঘোষ) বড় বাড়াবাড়ি করছেন, ওঁর ব্যবস্থা ভক্তরাই করবে।” সেই সঙ্গেই জানিয়ে দিলেন, কাগজগুলোও যদি বাড়াবাড়ি করে, ভক্তরাই ব্যবস্থা নেবে। “আমি ওদের বারণ করি, ওরা আমার কথা শোনে না।”
চব্বিশ ঘণ্টাও কাটেনি; যা জানা যাচ্ছে তা থেকে মনে হচ্ছে প্রবীরবাবুর বিরুদ্ধে ভক্তরা ‘ব্যবস্থা নিতে’ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যদিও গৌতম ভারতী এও বলেছিলেন, “কে এই প্রবীর ঘোষ? সে বিখ্যাত লোকের গায়ে কাদা ছুঁড়ে বিখ্যাত হতে চাইছে।” মজার কথা, গৌতম ভারতীর শিষ্যরাই কিন্তু এই বিজ্ঞাপন ছেপে প্রবীরবাবুকে আরও বিখ্যাত হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। যার যার প্রশ্ন করে জেনেছি গৌতম ভারতী প্রবীর ঘোষের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আগ্রহী নন। প্রবীরবাবু কিন্তু স্পষ্টই বলেছেন, “মিথ্যাচারিতাকে আশ্রয় করে টাকা-পয়সার জোরে ওরা বিজ্ঞান-আন্দোলনকে আঘাত করতে চাইছে।” ভক্তদের কাছে প্রবীরবাবু তাঁদের গুরুদেবের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা প্রকাশ্যে প্রমাণের চ্যালেঞ্জও জানিয়েছেন।…(একটি সূত্রের খবরে প্রকাশ ইতিমধ্যেই লেকটাউনের শিবকালী আশ্রমের গৌতম ভারতী ও তার দাদ দমদম শিবকালী আশ্রমের গৌতম ভারতীর সঙ্গে আরও দু-একজন তান্ত্রিক ও জ্যোতিবী যুক্ত হয়েছে)।…
২ মার্চ ‘আজকাল পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হল আর একটি ছবি সহ খবর—
আত্মহত্যার চেষ্টায় ‘অলৌকিক শক্তিধর’
গৌতম ভারতী হাসপাতালে : ভাঙচুর, পুলিশ
দেবাশিস ভট্টাচার্য: ‘আত্মহত্যার’ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ‘অলৌকিক শক্তিধর’ গৌতম ভারতী এখন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এমার্জেন্সির তিনতলার বেড়ে চিকিৎসাধীন। দমদম লেকটাউনের শ্রীশ্রীশিবকালী আশ্রমের ‘অলৌকিক শক্তিধর’ এই আচার্য বুধবার ভোররাতে নিজের তলপেটে ভাঙা কাচের বোতল ঢুকিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধান। হঠাৎ-ই অ্যাপেণ্ডিসাইটিসের প্রচণ্ড ব্যথা ওঠায় ‘অলৌকিক শক্তিধর’ গৌতম ভারতী যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একটি বোতল ভেঙে নিজের তলপেটের ডানদিকে ঢুকিয়ে দেন। তারপর যন্ত্রণা-কাতর গৌতম ভারতীর চিৎকারে আশ্রমের ভক্তশিষ্যরা ছুটে এসে দেখেন চারদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এই অবস্থায় তাঁর ভক্তা-শিষ্যরা গৌতম ভারতীকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এমার্জেন্সির তিনতলায় সি বি টপ ১৩৬ নম্বর বেডে তাঁকে ভর্তি করা হয়। ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করেন। বুধবার সকালেই তাঁর অ্যাপেণ্ডিসাইটিস অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর প্রায় সারাদিনই তিনি ছিলেন অচৈতন্য। সন্ধে নাগাদ ধীরে ধীরে তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে। সারাদিনই তাঁর স্যালাইন চলে। সন্ধে সাতটা নাগাদ এক সিস্টার তাঁকে ইঞ্জেকশন দিতে এলে গৌতম ভারতী আবার রুদ্রমূর্তি ধরেন। হঠাৎই উন্মত্তের মতো আচরণ করতে থাকেন তিনি। চিৎকার করতে করতে তিনি বেড থেকে লাফ দেন। তাঁর নিজের স্যালাইনের বোতল ছিটকে পড়ে। এরপর তিনি তাঁর চারদিকের রোগীদের দিকে তেড়ে যান। তাঁদের স্যালাইনের বোতল ছিঁড়ে নিয়ে তিনি চতুর্দিকে এলোপাতাড়ি ছুঁড়তে থাকেন।
গৌতম ভারতীর উন্মত্ত আচরণে অসুস্থ অবস্থাতেও অন্যান্য রোগীরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেন। ইঞ্জেকশন দিতে আসা সিস্টার ভয়ে দৌড় চলে যান। ডাক্তাররাও ভয় পেয়ে যান। ডাক্তার এবং সিস্টারদের অনুরোধ সত্ত্বেও গৌতম ভারতর উন্মত্ততা বন্ধ হয়নি। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হন পুলিশকে খবর দিতে। তাঁরা লালবাজার এবং বৌবাজার থানায় ফোন করেন। দু ঘণ্টা পরে প্রায় রাত নটা নাগাদ পুলিশ আসে হাসপাতালে। ডাক্তারদের উপরোধ অনুরোধে যে কাজ হয়নি, পুলিশ আসামাত্রই সে কাজ সমাধা হয়। পুলিশ দেখেই গৌতম ভারতী চুপচাপ তাঁর বেডে শুয়ে পড়েন। এই প্রতিবেদক রাত দশটা নাগাদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনতলার ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখেন চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে স্যালাইনের বোতল ভাঙা কাচের টুকরো। চিকিৎসারত ডাক্তাররা জানান, সম্প্রতি যুক্তিবাদীরা ‘অলৌকিক শক্তিধর’ গৌতম ভারতীর ‘শক্তি’কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। সম্ভবত, সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে না পারার আশঙ্কায়, গৌতম ভারতীর মধ্যে ‘মস্তিষ্ক বিকৃতি’র লক্ষণ দেখা দিয়েছে। অ্যাপেণ্ডিসাইটিসের যন্ত্রণা তাঁকে ইন্ধন যুগিয়েছে। ফলে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে তিনি সম্ভবত আত্মহত্যায় প্ররোচিত হন। ডাক্তাররা জানান, গৌতম ভারতীর শারীরিক অবস্থা এখন আর সঙ্কটজনক নয়। বুধবার রাত সওয়া নটা নাগাদ গৌতম ভারতীকে দেখতে আসেন একজন মনস্তত্ত্ববিদ। চিকিৎসারত ডাক্তাররাই তাঁকে ডেকে আনেন। এদিন সন্ধ্যায় গৌতম ভারতীর উম্মত্ত আচরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মনস্তত্ত্ববিদ বলেছেন, রোগীর (গৌতম ভারতী) সম্ভবত রোজ সন্ধায় মদ, গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস আছে। এদিন (বুধবার) সন্ধায় তা না পাওয়ায় তিনি হিংসাত্মক হয়ে উঠে ভাঙচুর করেন। তবে, আরও পর্যবেক্ষণ না করে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা যাবে না বলে মনস্তত্ত্ববিদ মন্তব্য করেছেন। ২ মার্চ আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা হল। আমাকে তুলতে কোনও অবতারের ‘মা’ আসেননি। যদিও অবতারদের কথা মতো সবই মায়ের ইচ্ছে। তবু আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, অবতার নিজেই কিন্তু মায়ের শক্তির উপর সামান্যতম ভরসা করেন না। ভরসা করেছিলেন পেশীশক্তি সম্পন্ন অ-মানুষের ওপর। হায়! যাঁরা, শত্রুকে স্ব-বশে আনতে অপরকে মোহিনী ঔষধি দেন, তাঁরাই আবার শত্রুকে বশ করতে মোহিনী ঔষধির উপর ভরসা রাখতে পারেন না? বশীকরণ, ফটোসম্মোহনের দাবিদাররাও নিজের বিপদকালে অসার দাবির কথা ভুলে বাহুবলের ওপর অধিক ভরসা রাখেন!
৩ মার্চ বিভিন্ন ভাষার পত্র-পত্রিকার গুরুত্বের সঙ্গে খবরটি প্রকাশিত হল। এখানে ‘আজকাল’-এ প্রকাশিত খবরটি তুলে দিলাম—
প্রবীর ঘোষকে কিডন্যাপের চেষ্টা
অপ্রকৃতিস্থ নন গৌতম ভারতী! বিশেষজ্ঞ
আজকালের প্রতিবেদন: বুধবার রাতে মেডিক্যাল কলেজের সি বি টপ ওয়ার্ডে তাণ্ডবের নায়ক ‘অলৌকিক শক্তিধর’ গৌতম ভারতী মোটেই অপ্রকৃতিস্থ (অ্যাবনর্মাল) নন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের এই অভিমত। বৃহস্পতিবার মেডিক্যাল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান ডা. হরি গাঙ্গুলি গৌতম ভারতীকে দেখেন। চিকিৎসক ডা. মৃগাঙ্কমোহন দাসের কাছে লেখা নোটে তিনি জানিয়েছেন‘’নো অ্যাবনর্মালিটি হ্যাজ বিন ফাউণ্ড ইন হিজ স্পিচ ওরিয়েণ্টেশান অ্যাণ্ড পারসেপশান।’ এই নোটেই তিনি জানিয়েছেন বুধবার রাতে ওঁর আচরণ এক ধরনের হিস্টিরিয়া অথবা ভানও হতে পারে। রোগী অবসাদগ্রস্ত ও অপরাধবোধে আক্রান্ত। মদ্যপানের অভ্যাস রয়েছে। যাতে পান না করতে পারে সে ব্যাপারে নজর রাখা উচিত। এদিকে ‘ঐশী ক্ষমতাসম্পন্ন’ লেকটাউনের শিবকালী আশ্রমের এই আচার্যের ক্ষমতার প্রথম চ্যালেঞ্জার প্রবীর ঘোষকে এদিক সকালে দুই দুর্বৃত্ত তাঁর বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। এদিন সকাল ৮টা নাগাদ তাঁকে বাড়ির সামনেই পাকড়াও করে দুর্বৃত্তরা। বলে মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এখনই তাঁকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে। প্রবীর রুখে দাঁড়ানোয় তারা অবশ্য পিছু হটে। পরে প্রবীর সুভাষবাবুর ঘনিষ্ঠ মহলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন এদিন সকালেই তিনি দীঘা চলে গেছেন। এই ঘটনার ব্যাপারে দমদম থানায় প্রবীর একটি ডায়েরীও করেছেন। বুধবার রাতের ঘটনার প্রতিবাদে এদিন অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশন এবং স্পেশাল অ্যাটেনডেণ্ট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সুপারের কাছে একটি ডেপুটেশন দেওয়া হয়। বিক্ষোভ চলে সকাল ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। অ্যাটনডেণ্টদের অবশ্য অন্যান্য দাবিদাওয়াও ছিল। দুটি সংগঠনই এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন। এ বি জে ডি এফ-এর পক্ষ থেকে ডা. গিরিশ বেরা সুবীর ব্যানার্জি জানান বার বার জানানো সত্ত্বেও পুলিশ ঘটনার ২ ঘণ্টা · পরে এসেছে। অবস্থা সামাল দেওয়ার বদলে পুলিশ ডাক্তারদের সঙ্গেই দুর্য্যাবহার করেছে। চিকিৎসক ডাক্তার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেছেন রোগীকে আলাদাভাবে রাখা হোক। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা অবধি গৌতম ভারতীকে অন্য বেডে নিয়ে যাওয়া হয়নি। এদিন ওই ওয়ার্ডেরই বেশ কিছু রোগী অভিযোগ করেন এমন একজন পেশেণ্টের সঙ্গে তাদের থাকতে ভয় লাগছে। বুধবার রাতে তাণ্ডবের সময় ডাক্তার, নার্স, কর্মী ও রোগীদের সবাই পালিয়ে গেলেও নিরুপায় কয়েকজন রোগী বিছানাতেই ছিলেন। এঁদের অন্যত্র যাওয়ার ক্ষমতাও ছিল না। এই ঘটনা আবার ঘটুক তা তাঁরা চান না। রোগীদের অনেকেরই জিজ্ঞাসা, শুনেছি উনি বিরাট সাধুবাবা। তা হলে নিজের অ্যাপেণ্ডিক্সটা অলৌকিক ক্ষমতাবলে উনি সারিয়ে তুলছেন না কেন?
এসব সত্ত্বেও ভক্তরা এদিন ভিজিটিং আওয়ারে ভিড় জমিয়েছেন তাঁর শয্যায় সামনে। হাত পা বাঁধা ভারতী অবশ্য তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। তাঁর স্যালাইন চলছিল। এদিকে অলৌকিক শক্তিধরের ক্ষমতার প্রথম চ্যালেঞ্জার ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ এদিন এ প্রসঙ্গে জানান যুক্তিবাদীদের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে ও এখন এইসব অভিনয় শুরু করেছে। একজন বড় অভিনেতা। এই ঘটনাই প্রমাণ করেছে ও ধাপ্পাবাজ। যিনি অপরের রোগ নিরাময় করতে পারেন বলে বিজ্ঞাপন দেন তিনি নিজের রোগ নিরাময় করতে পারলেন না কেন? এমনও হতে পারে, এইসব অভিনয় করে উনি ওঁর শিষ্যদের আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। আমাদের সমিতি সহ বিভিন্ন বিজ্ঞানকর্মী সংগঠনের পক্ষ থেকে গণ বিজ্ঞান আন্দোলনের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সন্ত্রাস রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটা স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছে।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যুক্তিবাদী আন্দোলনের সমর্থনে গৌতমকে ধিক্কার জানিয়ে বহু চিঠি প্রকাশিত হয়েছে, যা আমাকে এবং আমাদের যুক্তিবাদী আন্দোলনের শক্তি জুগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে।
১৪ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকার চতুর্থ পৃষ্ঠাটি খুলেই নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারলাম না। মানুষ আমাদের আন্দোলনের সমর্থনে আছেন। নিশ্চিত হলাম, এত মানুষের ভালোবাসায় জয় ছাড়া আর কিছুই আসতে পারে না। ‘সম্পাদক সমীপেষু’ বিভাগে ‘অলৌকিক শক্তিধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ, বিপন্ন যুক্তিবাদী এবং প্রশাসন’ শিরোনামে প্রায় পৃষ্ঠা জুড়ে বহু পাঠকের চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। এরই মধ্য থেকে কিছু চিঠি আপনাদের আগ্রহ নিবারণের জন্য তুলে দিচ্ছি।
অলৌকিক শক্তিধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ,
বিপন্ন যুক্তিবাদী এবং প্রশাসন
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজারে গৌতম ভারতীর আশীর্বাদ গ্রহণরত প্রবীর ঘোষের ছবি দেখেছিলাম। ছবিটি দেখেই বুঝেছিলাম এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাই অপেক্ষায় ছিলাম আপনাদের কাগজ মারফত প্রবীর ঘোষের প্রতিবাদের।
২৫ ফেব্রুয়ারি অপেক্ষার অবসান হয়। দেখলাম প্রবীর ঘোষের প্রতিবাদের উত্তরে অলৌকিক শক্তিধর গুরুর হুমকির সংবাদ। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষেরা যখন যুক্তিগ্রাহ্য জ্ঞানের সাহায্যে মনুষ্যত্ব জাগ্রত করার চেষ্টায় রত, তখন মুষ্টিমেয় ক্ষমতালিপ্সু অলৌকিক (!) শক্তিধরদের প্রশ্রয় দিয়ে যান মানুষকে ভুল বোঝাবার জন্য।
কোনও অলৌকিক (!) কারণে হয়তো প্রবীর ঘোষ অদৃশ্য হতে পারেন। কিন্তু তাঁর যুক্তিবাদী মননের শিকড় যে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে তা এই উত্তরবঙ্গের গ্রামে বসেও অনুভব করছি। এক প্রবীর ঘোষ ইতিমধ্যেই বহু প্রবীর ঘোষের জন্ম দিয়েছে। গৌতম ভারতীর দল কি তাঁদের স্তব্ধ করতে পারবে? সাধিকা, মথুরাপুর, মালদহ
॥ ২ ॥
‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য হিসাবে সত্যিই খুব বিপন্ন বোধ করছিলাম। কলকাতা থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে আমার নিজের গ্রাম এবং সন্নিহিত কয়েকটি অঞ্চলের কয়েকজন জ্যোতিষী এবং গুরুজির তন্ত্রমন্ত্রের বুজরুকি ধোঁকাবাজির বিরুদ্ধে আমরা কয়েকজন যুবক-যুবতী সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার চালাচ্ছি। খুব একটা সাড়া যে পাচ্ছিলাম তা নয়। তবে চেতনা বাড়ছে। গ্রামে লড়াইটা একেবারেই অসম। ওঝা, জ্যোতিষী, গুরুজিদের এখানে বড় সুবিধা। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অক্ষরজ্ঞানহীন। তাছাড়া, যাঁরা শিক্ষিত তাঁদের মধ্যেও অনেকে (এঁদের দলে শিক্ষকমশাইরাও আছেন) জ্যোতিষীদের মুখনিঃসৃত বাণীকে অভ্রান্ত মনে করেন।
এ অবস্থায় কাগজে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষের ছবি-সহ একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাগজের কাটিং নিয়ে স্থানীয় গুরুজিরা প্রচারে নামেন। তাঁদের চেলারাও যত্রতত্র আমাদের অশ্লীল ভাষায় গালাগালি দেন। আনন্দবাজারে অলৌকিক শক্তিধরদের মুখোশ খুলে দিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সেটা দেখেই আট কপি আনন্দবাজার কিনে কয়েকটি গ্রামে ঘুরলাম। পূর্বে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের এটা একটা উপযুক্ত জবাব।
মধুসুদন সরকার। গাংনাপুর, নদীয়া
॥ ৩ ॥
২৫ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজারে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষের বিপদের কথা পড়লাম। ওঁর অপরাধ, তিনি তথাকথিত গুরু/বাবাদের মুখোশ খুলে দিতে চান। ধোঁকাবাজ মহাপুরুষদের পৃষ্ঠপোষকের অভাব হয় না। যুক্তিবাদী আন্দোলনকে বানচাল করতে তাঁরা যে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন সেটাই স্বাভাবিক।
বামফ্রণ্ট সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ; অবিলম্বে প্রবীরবাবুর যথোপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন এবং যুক্তিবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে যেতে দিন।
আশিস রায়চৌধুরী। জলপাইগুড়ি
॥ ৪ ॥
অলৌকিক শক্তিধরেরা কবরের ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেকে, আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে, কিংবা নাড়িবন্ধন করে সমাধিস্থ হওয়ার বিভিন্ন প্রকার ‘অলৌকিক কাণ্ড’ দেখায়। চ্যালেঞ্জ জানালাম—আমিও তাদের সামনে ওইসব খেলা দেখাব এবং তার বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি দেখাব।
সুশান্ত দে। দিঘড়া, উঃ ২৪ পঃ
॥ ৫ ॥
‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ প্রতিবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনুন্নত দেশগুলিতে যেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী শিক্ষার অভাব সেখানে একদল বুদ্ধিমান ব্যক্তি এবং এদের ঘিরে গড়ে ওঠা কিছু স্বার্থান্বেষী এবং কিছু অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমর্থকদের দল বহু লোকের কষ্টার্জিত সম্পদ কৌশলে হস্তান্তর করেন কেবল মাত্র অলৌকিক আশীর্বাদ, আশ্বাস, মাদুলি, কবচ, পাথর প্রভৃতি বুজরুকির দ্বারা। হতাশাগ্রস্ত মানুষ অলৌকিকত্বের ফাঁদে পড়ে মিথ্যা আশ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকী, মিথ্যা আশ্বাসে অচিকিৎসায় বা বিনা চিকিৎসায় প্রাণ পর্যন্ত হারাতে হয়। মাঝে মাঝে তথাকথিত গুরুদেবের প্রতারণার খবর আদালত পর্যন্তও গড়ায়। উন্নত দেশগুলিতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও সম্পদ কোনও অলৌকিক শক্তির দ্বারা অর্জিত হয়নি। সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই তাঁরা এগিয়ে গিয়েছেন ও যাচ্ছেন। কোনও স্বর্গীয় মা বা বাবা তাঁদের কিছু পাইয়ে দেয় না।
আমাদের দেশে যেখানে চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদ, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতা ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পর্যন্ত আংটি বা মাদুলি ধারণ করে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করেন সেখানে যুক্তিবাদীদের আরও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে প্রচারে নামতে হবে। যুব সমাজকে চিন্তা করতে হবে ড্রাগ অ্যাডিকশনের মতো অলৌকিকত্বের আসক্তিও একটা সামাজিক সমস্যা। যুক্তিবাদী প্রবীরবাবু একা নন, তাঁকে সমর্থন করতে অগণিত প্রগতিশীল নরনারী এগিয়ে আসবেন।
ডা. শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়। নৈহাটি
॥ ৬ ॥
প্রবীর ঘোষের চ্যালেঞ্জ যে গুরুদেবকে বেশ বিপাকে ফেলেছে তা তা প্রমাণিত হল গৌতম ভারতীর হাস্যকর হুমকি ও অসংলগ্ন বক্তব্যে। তিনি ভক্তদের দেওয়া পার্থিব সম্পদ গ্রহণ করেন, কেননা না নিলে ‘ওদের অপমান করা হয়’। আবার প্রবীর ঘোষ এবং কাগজগুলোও যদি বাড়াবাড়ি করে, ভক্তরাই ব্যবস্থা নেবে।’
এইভাবে সরাসরি ভক্তদের প্ররোচিত না করে তিনি নিজের ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ এক্ষেত্রে প্রদর্শন করতে অথবা ভক্তদের সঠিক পথে পরিচালিত করে প্রকৃত গুরু হতে পারতেন। ‘আমি ওদের বারণ করি, ওরা আমার কথা শোনে না।’ তিনি কেমন গুরু যে ভক্তরা তাঁকে মান্য না করে উন্মার্গগামী হয়।
তপনকুমার দাস। রানাঘাট, নদীয়া
॥ ৭ ॥
দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী ‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ লেখাটি (২৫-২) পড়লাম। যাঁরা প্রবীরবাবুর জীবননাশের হুমকি দিচ্ছেন তাঁদের ধিক্কার জানাই। প্রকৃত ধর্ম বুজরুকির ধার ধারে না। মহাভারত বলছে: ‘যেনাত্মনস্তত্থান্যেষাং জীবনং বৰ্দ্ধনাঞ্চাপি ধিরতে স ধর্মঃ’—অর্থাৎ যার দ্বারা নিজের এবং অপরের জীবন ও সমৃদ্ধি বিধৃত হয়, তাই ধর্ম। মনুর মতে—ধৃতি, ক্ষমা, দম, অস্তেয় (অচৌর্য), শৌচ, ইন্দ্রিয় নিগ্রহ, ধী, বিদ্যা, সত্য ও অক্রোধ—এই দশটি ধর্মের সাক্ষাৎ লক্ষণ। হারীতের মতে, ‘যাতে উন্নতি হয়, তাই শ্রেয়, তাই ধর্ম।’ যাজ্ঞবন্ধের মতে, ‘যা কু-কার্য ও কলুষ থেকে সকলকে নিবৃত্ত করে’ সৃষ্টিকে রক্ষা করছে, তাই ধর্ম। বিবেকানন্দের মতে সৎকর্মই ধর্ম এবং যা নিজের কল্যাণ করে ও জগতের হিতসাধন করে তাই ধর্ম।’
প্রকৃত গুরু যাঁরা তাঁরা কোনও দিন ধান্দায় ছোটেন না।
রাধাকৃষ্ণ প্রধান। ডায়মন্ডহারবার
॥ ৮ ॥
আমরা দুর্গাপুরে যুক্তিবাদী সংগঠন করেছি যার নাম ‘লৌকিক।’। ‘লৌকিকের’ পক্ষ থেকে গৌতম ভারতী ও তাঁর অন্ধ বিশ্বাসধারী শিষ্যদের এইটুকুই জানিয়ে রাখছি যে, প্রবীর ঘোষ ও তাঁর বিজ্ঞান সংগঠন কর্মীদের মৃত্যুর হুমকি দেওয়ার আগে একটু চিন্তা করে নেবেন।
উৎপলকুমার দে। দুর্গাপুর-১০
॥ ৯ ॥
মিথ্যাচার তথা বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমেই কুরু-পঞ্চালে ১৫০০ খ্রি. পূর্বাব্দে বাবা-প্রথার উদ্ভব হয়েছিল। পঞ্চালের আর্য জন-সমিতির তৎকালীন সেনাপতি ‘বধ্র্যশ্ব’ কয়েকটি যুদ্ধ জয় করে সমগ্র আর্যসমাজের সম্মান লাভ করে। এই সুযোগে আত্মসুখ ও অন্যের পরিশ্রমের ফল ভোগের লোভে ‘বধ্রশ্ব’ জন-সমিতির ক্ষমতা খর্ব করে রাজা প্রথার প্রবর্তন ঘটায় আর বশিষ্ঠ বিশ্বমিত্রের পূর্বপুরুষকে উৎকোচ দিয়ে তাদের ‘বাবা-পদে বসায়। পরিবর্তে এই বাবারা প্রচার করেছিল—ইন্দ্র, অগ্নি, সোম, বরুণ, বিশ্বদেব এবং অন্যান্য দেবতারা রাজাকে পাঠিয়েছেন পৃথিবীর প্রজাকে শাসন করবার জন্য। অতএব সাধারণ মানুষ যেন রাজার হুকুম মেনে চলে আর যথাবিহিত সম্মান করে। এর সবটাই ছিল বেইমানি। ‘বাবাদের’ মিথ্যাচারের ফলে পঞ্চালের আর্য-সমাজের গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছিল। পরবর্তীকালে বশ্য-পৌত্র দিবোদাসের রাজত্বে ‘বিশ্বামিত্র’ বাবাগিরি করে জনগণকে প্রতারিত করেছিল। আজ গণতান্ত্রিক পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজত্বে ভারতীরা শূন্য থেকে মায়ের দেওয়া সন্দেশ এনে খাওয়াচ্ছে আর বিজ্ঞান কর্মীদের (এঁরাও পারেন শূন্য থেকে রসগোল্লা, সন্দেশ আনতে) মেরে ফেলবার হুমকি দিচ্ছে।
স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে ঘৃণ্য রাজনীতির আবর্তে সরাসরি অন্যায়ের বিরোধিতা করতে গিয়ে কে কতটা প্রশাসনিক সাহায্য পাবেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জনপ্রতিনিধি বা আমলারা যেখানে বাবাদের দ্বারস্থ হন সেক্ষেত্রে সাহায্য পাবার আশা দুরাশা মাত্র।
অভিজিৎ বোস। হ্রড়া, উঃ ২৪ প
॥ ১০ ॥
গৌতম ভারতী জানিয়েছেন, তিনি আসলে কিছুই করেন না। মা (?)-ই সব করে থাকেন। তা হলে প্রবীরবাবুকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি কেন ‘ভক্তদের’ সাহায্য নিচ্ছেন? এখানে কি তাঁর ‘মা’ ব্যর্থ? তাঁর ভক্তরা কাগজগুলোকেও দেখে নেবে—এমন হুঙ্কারও তিনি ছেড়েছেন। তাঁর এই হুঙ্কারের কারণ কী? তিনি কি অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছেন?
চিত্তরঞ্জন পাল। হাওড়া-৩
॥ ১১ ॥
‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ শীর্ষক খবরটি (২৫-২) পড়ে বুঝলাম: সক্রেটিসের হাতে বিষ তুলে দেওয়ার যুগ থেকে অনেকটা এগিয়ে আসার অহঙ্কারটা আমাদের মিথ্যে। অলৌকিক শক্তিধরদের বুজরুকির ভিত হল মানুষের প্রশ্নহীন অন্ধ বিশ্বাস। সেই ভিতে নাড়া পড়লে মিথ্যার মিনারটি মিলিয়ে যাবার আশঙ্কায় বিপন্ন বোধ করে তারা তো ছলনা ও কৌশলের আশ্রয় নেবেনই। কারণ ধোঁকাবাজিই তাঁদের একমাত্র অবলম্বন।
জ্যোতিকণা মুখোপাধ্যায়। খড়্গপুর
॥ ১২ ॥
‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ প্রতিবেদনটি পড়লাম।
প্রবীর ঘোষ গত এক দশকের চেনা নাম। তথাকথিত ‘সর্বজ্ঞ’ ‘অমুক বাবা’ ‘তমুক ব্রহ্মচারী’দের যে কোনো অলৌকিক ক্ষমতাই নেই যৌক্তিক পদ্ধতিতে তিনি সে কথা সাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। তাঁর বিজ্ঞানমুখী কর্মকাণ্ডের জন্য কোথায় তাঁকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করব তা নয়, তিনি আজ বিপন্ন হতে বসেছেন। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে পুলিশও ইতিকর্তব্য পালনে বিমুখ।
তিমিরবরণ চাঁদ। গুসকরা, বর্ধমান
॥ ১৩ ॥
‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ (২৫-২) প্রতিবেদন পড়ে অবাক হলাম ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে কি বাক-স্বাধীনতা লোপ পাচ্ছে?
মনোজ ভোজ। কলকাতা-৬
॥ ১৪ ॥
‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ শীর্ষক সংবাদে বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন হলাম। দেশের দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হল এই সব ‘গুরুবাবা’। বর্তমানে মানুষের ভাবনা অনেক উন্নত হয়েছে, যুক্তি ছাড়া কোনও কিছুকে কেউ মেনে নিতে পারছে না। তাই ‘মায়ের সুপুত্তুর’রা মায়ের নামে ভয় দেখিয়ে বা জোর করে সাধারণ মানুষকে তাদের চেলা বানাতে চাইছে।পার্থসারথি বিশ্বাস। হেতিয়া, বাঁকুড়া
॥ ১৫ ॥
দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরীর প্রতিবেদন ‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ (২৫-২) এবং ‘ঐশী শক্তির জয়’ বিজ্ঞাপন (১৯-২) প্রকাশের জন্য যুগপৎ অভিনন্দন ও ধিক্কার। কিছু অসাধু লোক ধর্মের দোহাই দিয়ে লোক ঠকাচ্ছে। প্রবীরবাবু তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। এতেই তাদের গাত্রদাহ, শিরঃপীড়া। ওরা খুনের হুমকি দেয়। যুগে যুগে এটাই হয়ে আসছে।
সঞ্জীবকুমার রায়। মঙ্গলবাড়ি, মালদহ
॥ ১৬ ॥
২৫-২-৮৯ তারিখের আনন্দবাজার থেকে জানলাম, অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ বিপন্ন। খুবই স্বাভাবিক—কারণ, প্রবীরবাবু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে ‘অলৌকিক শক্তিধরদের’ মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে তাঁদের ভণ্ডামি জনসমক্ষে ফাঁস করে ফেলছেন যে? আসলে অল্প আয়াসে প্রচুর অর্থ রোজগারের লোকঠকানি ব্যবসায় ভাটা পড়ে যাবার আশঙ্কা বুদ্ধিমান জোচ্চোরের দল নিজেরাই বিপন্ন হয়ে প্রবীর ঘোষের প্রাণনাশের এমন আদিম বর্বরোচিত হুমকি দিচ্ছে।
যে সব ‘ভক্ত’ মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করে, তারা যে স্রেফ বুজরুকদের দালাল সেটা সাধারণ লোকেও বোঝে। দালালরা হাতসাফাই-এর কায়দা-জানা এক একজন লোককে করায়ত্ত করে অবতার ছাপ দিয়ে দেয়। আর এইভাবেই হাজার হাজার কুসংস্কারাচ্ছন্ন অসহায় বোকা লোককে ঠকিয়ে আদায় করা লাখ লাখ টাকার দান-প্রণামী নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
অশোক প্রামাণিক। বীরভূম
॥ ১৭ ॥
তথাকথিত অলৌকিক শক্তিধরদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা ও বুজরুকদের দ্বারা তাঁর প্রাণনাশের হুমকির সংবাদ আপনাদের কাগজে মুদ্রিত করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।আশিসকুমার নন্দী। ত্রিবেণী
॥ ১৮ ॥
‘ঐশী শক্তির জয়’ বিজ্ঞাপনটি যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল, ‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ শীর্ষক রিপোর্টে সেই বিভ্রান্তির অবসান ঘটেছে। ইচ্ছাকৃত প্রতিবন্ধকতার বা হুমকির দ্বারা কখনও প্রকৃত সত্যের গতিরোধ করা যায়নি, যাবেও না। ‘অলৌকিক শক্তিধর’ বুজরুকের দল সাবধান।
স্বস্তিক সেনগুপ্ত। স্কটিশ চার্চ কলেজ
॥ ১৯ ॥
ধর্মগুরুরা নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে যুক্তিবাদী বিজ্ঞামনস্ক মানুষদের প্রাণদণ্ডের হুমকি দিতে শুরু করেছেন। আগেও বিজ্ঞানীকে মরতে হয়েছে কিছু ধর্মগুরুর নির্দেশে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে দাঁড়িয়েও ধর্মগুরুদের হিংসামূলক কাজকর্মে উসকানিতে কিছু মানুষকে উৎসাহিত হতে দেখে অবাক লাগে।
মলয়কুমার দাস। কেশিয়াড়ি, মেদিনীপুর
॥ ২০ ॥
‘অলৌকিক শক্তিধরদের চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিবাদী বিপন্ন’ খবরটি পড়ে স্তম্ভিত হচ্ছি। প্রবীর ঘোষকে যাঁরা হত্যার হুমকি দেখাচ্ছেন তাঁদের জানা উচিত একজন প্রবীর ঘোষের মুখ বন্ধ করা যায় হয়তো, কিন্তু সত্যের মুখ বন্ধ করা যায় না।
আশিসকুমার চক্রবর্তী। জগদীশপুর, হাওড়া
॥ ২১ ॥
আনন্দবাজারের খবর (২৫-২-৮৯) থেকে জানলাম: যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ তথাকথিত বাবাদের বিরাগভাজন হয়েছেন। তাঁর উপর নাকি দৈহিক অক্রমণও হতে পারে। এটা প্রমাণ করে যে, যাঁরা নিজেদের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে প্রচার করেন, তাঁরা ভয় পেয়েছেন। এবং এইখানেই প্রবীরবাবুর সাফল্য।অমল রায়চৌধুরী। চন্দননগর।
ভূতুড়ে সম্মোহনে মনের মতো বিয়ে :
কাজী সিদ্দিকীর চ্যালেঞ্জ
‘আলোকপাত’ জানুয়ারি ১৯৮৮ সংখ্যায় পাঠকদের অধিকার বিভাগে ‘দোষ ধর্মের নয়, ব্যক্তির’ শিরোনামে একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠিটি লিখেছিলেন চুরুলিয়া, বর্ধমান থেকে কাজী খোদা বক্স সিদ্দিকী। চিঠিটা খুবই কৌতূহল জাগানোর মতো এবং তারই সঙ্গে যুক্তিবাদীদের বিরুদ্ধে একটি জোরালো চ্যালেঞ্জ। চিঠিটি এখানে তুলে দিলাম।
আলোকপাত নভেম্বর ৮৭ সংখ্যায় ‘সম্মোহনে অসম্ভব সম্ভব হয়?’ পড়লাম। প্রবীর ঘোষ মহাশয়ের চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে জানাই, বিজ্ঞান বিশ্ব সৃষ্টি করেনি এবং নিয়ন্ত্রকও নয়।
মূলত ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো প্রভেদ নেই। সূক্ষ্মতাত্ত্বিক ব্যাপার হেতু সাধারণ বুদ্ধিতে এর ব্যাখ্যা মেলে না। এই তত্ত্বকে প্রখ্যাত সুফী সাধক জোলনুন থেসরী তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা—
১) ঈশ্বরের একত্ব তত্ত্ব, এই জ্ঞান সাধারণ বিশ্বাসীদিগের।
২) প্রামাণিক ও যৌক্তিক তত্ত্ব, এই জ্ঞান বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতদিগের।
৩) একত্রে গুণ-রাশির তত্ত্ব, এই জ্ঞান ঈশ্বর প্রেমিক ঋষিদিগের।
এই সূত্রানুসারে প্রবীরবাবু দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত বলা যায়। এখানে ধর্মের ভড়ং করে কেউ যদি প্রতারণা করে তাহলে তা ধর্মের দোষ নয়—দোষ ব্যক্তির। এই জাতীয় প্রতারণা ধরে বিজ্ঞানের মহিমা গাথায় ধর্মকে অস্বীকার করা অহংকারের প্রকাশ মাত্র—এটা অযৌক্তিক ও অসমীচীন! এই অহংকারের বশবর্তী হয়ে তিনি বিরাট অংকের চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন। ফটো সম্মোহন বা তান্ত্রিক মতে এ জাতীয় কোনো প্রক্রিয়ার ফল হয় কি না জানি না। তবে এমন কিছু প্রক্রিয়া আছে যা আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ বা নারীর মধ্যে প্রগাঢ় প্রেমাবেগে বা বিতৃষ্ণা এনে মিলনের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিতে বা বিচ্ছিন্ন করতে পারে। অবশ্যই কোনোরূপ প্রচলিত সম্মোহন নয় এটা সম্পূর্ণ ধর্মীয় প্রক্রিয়া। প্রবীরবাবুর যদি তাঁর পরিচিত কোন নারীকে প্রকৃতই জীবন সঙ্গিনী করার ইচ্ছে থাকে তাহলে কোনো ছবি-টবি নয় শুধুমাত্র কয়েকটি প্রকৃত তথ্য দিলেই হবে। তথ্যগুলো অবশ্যই অপার্থিব নয়।
যদিও তিনি ফটো-সম্মোহন বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন তবুও তিনি আগ্রহী হলে তাঁর এ প্রক্রিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি।
প্রকাশ থাকে যে তাঁর ঘোষিত অর্থের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। মিলনের সূত্রপাত ঘটলে তিনি ইচ্ছে করলে তাঁর ঘোষিত অর্থ কোনো নির্মীয়মাণ মুসলিম ছাত্রীআবাসে বা কোন অরফ্যানেজে নিজ পছন্দ মতো দান করে দেবেন।
কাজী খোদা বক্স সিদ্দিকী’র চিঠিটি আমার নজরে আসতেই সঙ্গে সঙ্গে ৭ জানুয়ারি একটি উত্তরও পাঠিয়ে দিই ‘আলোকপাত’ পত্রিকার দপ্তরে। চিঠিটি এখানে তুলে দিচ্ছি।
আলোকপাত জানুয়ারি ’৮৮ সংখ্যায় ‘পাঠকদের অধিকার’ বিভাগে কাজী খোদা বক্স সিদ্দিকী’র একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিটিতে কাজী খোদা বক্স সিদ্দিকী আমাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন, সম্পূর্ণ ধর্মীয় প্রক্রিয়ায় তিনি আমার মনের মতো নারীকে আমার জীবন সঙ্গিনী করে দিতে পারেন। কাজী জানতে চেয়েছেন আমি তাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আগ্রহী কি না? চিঠিতে এক জায়গায় লিখেছেন অহংকারের বশবর্তী হয়ে আমি চ্যালেঞ্জ করে বসেছি। উত্তরে বিনীতভাবে জানাই—এই চ্যালেঞ্জ কোনও অহংকার নয়, এই ‘চ্যালেঞ্জ’ যুক্তিবাদী আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায়। প্রচার ও বিজ্ঞাপনের দৌলতে যে গরুগুলো গাছে চড়ে বসেছে, তাদের মাটিতে নামিয়ে এনে আবার ঘাস খাওয়াতেই এই ‘চ্যালেঞ্জ’। অবতার, জ্যোতিষী, অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদার ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগী এবং অন্ধভক্তদের কাছে অথবা কিছু ঈর্ষাকাতরদের কাছে ‘চ্যালেঞ্জ’ ‘অশোভন’ ‘অহংকার’ ইত্যাদি মনে হতেই পারে, কারণ ‘চ্যালেঞ্জ’ বাস্তব সত্যকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরে। সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু ‘চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ে জনপ্রিয় প্রশ্ন এটাই—যেখানে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেই দাবি প্রমাণ করা যায়, সত্য প্রকাশিত হয়, সেখানে চ্যালেঞ্জ গ্রহণে দ্বিধা থাকবে কেন? অলৌকিকতার বিরুদ্ধে এই চ্যালেঞ্জ যুক্তিবাদী আন্দোলনের, কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের অতি শক্তিশালী হাতিয়ার।
আমি বিবাহিত। তাই আমার মনের মতো নারীকে জীবনসঙ্গিনী করার প্রশ্নই ওঠে না। আমার এক তরুণ চিকিৎসক বন্ধু অনিরুদ্ধ কর অবিবাহিত। কাজী খোদা বক্স সিদ্দিকী যদি অনিরুদ্ধের পছন্দমতো এবং আমার নির্দেশমতো মেয়েটিকে অনিরুদ্ধর জীবনসঙ্গিনী করে দিতে পারেন তাবে অনিরুদ্ধের বিয়ের সাত দিনের মধ্যেই কাজী সাহেবের ইচ্ছেমতো প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেব পঞ্চাশ হাজার টাকা, এবং সেই সঙ্গে স্বীকার করে নেব—পৃথিবীতে অলৌকিক ঘটনার অস্তিত্ব আছে।
কাজী সাহেবের কথামতো মেয়েটির ‘কয়েকটি প্রকৃত তথ্য’ অবশ্যই দেব, উপরন্তু দেব মেয়েটির একটি ছবি।
কাজী সাহেব যদি বাস্তবিকই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ইচ্ছুক হন, তবে মেয়েটির তথ্য ও ছবি কাজী সাহেবের হাতে তুলে দেওয়ার পর দেব ৬ মাস সময়, এই সময়ের মধ্যে অনিরুদ্ধের পছন্দমতো মেয়েটির সঙ্গে তিনি বিয়ে ঘটিয়ে দিতে পারলে আমি পরাজয় স্বীকার করে নেব। নতুবা ধরে নেব কাজীসাহেব পরাজিত।
প্রবীর ঘোষ
আমার চিঠিটা আজ পর্যন্ত ‘আলোকপাত’-এর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়নি। কাজী সাহেবের চ্যালেঞ্জ যে অনেককেই নাড়া দিয়েছিল তারই প্রমাণ পাই যখন দেখি ৮৮ ফেব্রুয়ারি ‘পরিবর্তন’-পত্রিকা আমার একটি সাক্ষাৎকার নিতে এসে কাজী সাহেবের প্রসঙ্গটি তোলেন। ৩০ মার্চ ৮৮ সংখ্যায় ‘পরিবর্তন’-এ দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে কাজী সাহেবের প্রসঙ্গটুকু শুধু তুলে দিচ্ছি।
“পরিবর্তন: ‘আলোকপাত’ জানুয়ারি ’৮৮ সংখ্যায় বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ার জনৈক কাজী খোদা বক্স সিদ্দিকী আপনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিলেন, সম্পূর্ণ ধর্মীয় প্রক্রিয়ায় আপনার মনের মতো নারীকে আপনার জীবন সঙ্গিনী করতে পারেন। পরবর্তী দুটো সংখ্যা ‘আলোকপাত’-এ এমন কোনও খবর চোখ পড়ল না যাতে লেখা আছে আপনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। আপনি কি তবে পিছু হটেছেন ধরে নেব?
শ্রীঘোষ: ৭ জানুয়ারি একটি চিঠি দিয়ে ‘আলোকপাত’ সম্পাদককে জানাই, ‘আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।’ এইটুকু বলতে পারি চিঠিটি এখনও প্রকাশিত হয়নি। চিঠির প্রতিলিপিটি আপনি দেখতে পারেন।”
এখনও কাজী সাহেবের জন্য চ্যালেঞ্জ খোলাই রইল, তবে তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সময়ের মধ্যে যদি ডা. অনিরুদ্ধ কর বিয়ে করে ফেলেন তবে আমার অন্য কোনও অবিবাহিত বন্ধুর পছন্দ মতো মেয়েকে বন্ধুটির জীবন সঙ্গিনী করতে হয়।
অনিরুদ্ধ আমাকে এই প্রসঙ্গ জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মেয়েটিকে পছন্দ করার পর কাজী সাহেব যদি সেই মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করে আক্ষরিক অর্থে তাঁর হাতে-পায়ে ধরে আমার সঙ্গে বিয়ে ঘটিয়ে দেয়?”
আমি বলেছিলাম, “আপনার শ্রীদেবী, রেখা, অথবা তার চেয়েও কোনো দুর্লভ মেয়েকে বিয়ে করতে কোনও আপত্তি নেই তো।” দুর্লভ মেয়েদের যে সব নাম বলেছিলাম, তাতে অনিরুদ্ধ প্রাণ খুলে হো-হো করে হেসে বলেছিলেন, “কাজী সাহেব আপনার চিন্তার হদিশ পেলে চ্যালেঞ্জ জানানোর দুঃসাহস দেখাতেন না।”
ভূতের দুধ খাওয়া
মেদিনীপুর জেলার ‘গোলগ্রাম গ্রামোন্নয়ন সংস্থা’র আমন্ত্রণে আমাদের সমিতির সদস্যতরা ও আমাদের সহযোগী ক্যানিং যুক্তিবাদী সংস্থার সভ্যরা ’৮৮-র ১১ ফেব্রুয়ারি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান করতে যান।
গ্রামোন্নয়ন সংস্থার তরফ থেকে গুণধর মুর্মু অনুষ্ঠানের মাস দুয়েক আগে যখন প্রথম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তখনই তাঁর কাছ থেকে জেনেছিলাম, ডেবরা ও গোলগ্রাম অঞ্চলের ওঝা, গুণিন, জানগুরু সখারা কী কী তথাকথিত অপ্রাকৃতিক ক্ষমতা দেখিয়ে স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস অর্জন করেছেন। উদ্দেশ্য, সেই সব অপ্রাকৃতিক ক্ষমতার পরিচয়ই আমাদের সমিতি সভ্যরা অনুষ্ঠানে দেবেন এবং তারপর প্রতিটি অলৌকিক ক্ষমতার লৌকিক কৌশলগুলো দর্শকদের বুঝিয়ে দেবেন। এর ফলে স্বভাবতই ওঝা, গুণিন, জানগুরু, সখাদের লোকঠকানো ব্যবসা বন্ধ হবে। ইতিপূর্বে আমরা এই ভাবে কাজ করে যথেষ্ট সফলতা পেয়েছি।
আমাদের ছেলেরা ওখানে গিয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের সাড়া জাগিয়েই অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেই সঙ্গে সভায় এই ঘোষণাও করেন—আপনারা যদি কোনও অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা চান, আমাদের সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন অথবা গোলগ্রাম গ্রামোন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমরা আপনাদের জানতে চাওয়া অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা করে দেব।
ওই সভাতেই গ্রামোন্নয়ন সংস্থারই এই কর্মকর্তা গুণিন এন কে মান্নার কথা জানান। মান্না ওই অঞ্চলের অধিবাসী। তিনি সাধারণ মানুষদের সামনে বহুবার প্রমাণ করেছেন ভূত আছে। ভূত নিয়ে এসে প্রমাণ করেছেন ভূতের অস্তিত্ব। কেমনভাবে ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন? একটা কাচের গ্লাসে তাড়ি রাখা হয়। তাড়ির গ্লাসের উপর তিনি একটি মড়ার মাথা বসিয়ে দেন। নানা ধরনের মন্ত্র-তন্ত্রের সাহায্যে নরমুণ্ডকে জাগ্রত করেন। নরমুণ্ড তখন চোঁ-চোঁ করে গ্লাসের তাড়ি পান করতে থাকে। শ্রীমান্না ভক্তদের নানা বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করে দেন, নানা সমস্যা সমাধানের উপায় বাতলে দেন। এই সবই তিনি করেন ভূতের পরামর্শমতো। বাংলা চলচ্চিত্রের অতি জনপ্রিয় এক নায়কও নাকি মাঝে মধ্যে শ্রীমান্নার কাছে আসেন।
আমাদের ছেলেরা সেখানেই এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। জানিয়েছিলেন এই বিষয়ে তাঁরা নিশ্চয়ই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোলগ্রামের মানুষদের কাছে ব্যাখ্যা হাজির করবেন।
সমিতির সভ্যরা ফিরে এসে শ্রীমান্নার বিষয়টি আমাকে জানান। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের ছবি এঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, স্রেফ লৌকিক কৌশলেই বাস্তবিকই এই ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব।
২১ ফেব্রুয়ারি দমদম কিশোর ভারতী স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রতিনিধি ও অঞ্চলের বিজ্ঞানকর্মীদের নিয়ে সারাদিনব্যাপী এক কুসংস্কার বিরোধী শিক্ষা শিবিরের আয়োজন করি। সেখানে শ্রীমান্নার ভূতে তাড়ি খাওয়ার প্রসঙ্গটি আলোচনা করি। হাজির করি একটি দুধ ভর্তি গ্লাস, অর্থাৎ তাড়ির অভাবে দুধ। একটি মড়ার খুলি গ্লাসের উপর চাপিয়ে বিড়-বিড় করতেই দর্শকরা অবাক হয়ে দেখলেন গ্লাস থেকে কোন অলৌকিক ক্ষমতায় দুধ দ্রুত কমে যাচ্ছে। দর্শকদের বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে ব্যাখ্যা হাজির করতেই বিস্ফারিত চোখে নেমে এল আনন্দের জোয়ার।
কৌশল মড়ার খুলিতে ছিল না। কৌশল ছিল না দুধে বা শ্রীমান্নার তাড়িতে। কৌশল যা ছিল, সবই ছিল গ্লাসে। দুটি ভিন্ন মাপের স্বচ্ছ প্লাস্টিক গ্লাস জুড়ে তৈরি করা হয়েছিল গ্লাসটি। একটি গ্লাস যত বড় আর একটি গ্লাস তার চেয়ে সামান্য ছোট। দেখতে হবে ছোট গ্লাসটা যেন বড় গ্লাসটার মধ্যে ঢুকে যায়। ছোট গ্লাসের তলায় একটা ছোট্ট ফুটো করা রয়েছে। বড় গ্লাসের উপরে কানা ঘেঁষে ওই ধরনের আর একটা ফুটো রয়েছে। দুটো গ্লাসের কানা এমনভাবে জুড়ে দেওয়া যাতে সামান্যতম বাতাস ওই কানার কোনও অংশ দিয়ে ঢুকতে না পারে। ছবিতে গ্লাস দুটো এঁকে বোঝাবার চেষ্টা করছি।
এবার গ্লাসের ভিতর দুধ ঢাললে ছোট গ্লাসের ফুটো দিয়ে দুধ দু-গ্লাসের ফাঁকে এসেও জমা হয়। বড় গ্লাসের কানায় যে ফুটো আছে সেটা সেলোটেপ দিয়ে বন্ধ করে দিই। এবার গ্লাসটা উপুড় করে দিলে ছোট গ্লাসের দুধ যায় পড়ে। দু’গ্লাসের মাঝে ঢুকে থাকা দুধ থেকেই যায়। নরমুণ্ডটা গ্লাসে বসিয়ে মন্তর পড়ার সময় সেলোটেপটা খুলে নিতেই বাইরের বাতাস বড় গ্লাসের ফুটো দিয়ে ঢুকে পড়তে চাপ দিতে থাকে। বাইরের বাতাসের চাপে ছোট গ্লাসের ফুটো দিয়ে দুধ বেরিয়ে এসে ছোট গ্লাসের তলায় জমতে থাকে এবং দু’গ্লাসের ফাঁকে আটকে থাকা দুধ দ্রুত কমতে থাকে। এক সময় ছোট গ্লাস ও দু’গ্লাসের ফাঁকের দুধ একই সমতলে এসে হাজির হয়। দর্শকরা দেখতে পান, বিশ্বাস করেন নরমুণ্ডই দুধ খেল, পড়ে রইল সামান্য তলানি।
পরবর্তীকালে গোলগ্রামের ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ অনুষ্ঠানে ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’-র সভ্যরাই ভূতের তাড়ি খাওয়ার রহস্য উন্মোচন করেন স্থানীয় মানুষদের বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে।

তারপর থেকে এখন পর্যন্ত বহু সংস্থাই ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে এই ঘটনাটি ঘটিয়ে দেখাচ্ছেন।
‘জাগ্রত’ নরমুণ্ড সিগারেট টানল
তারাপীঠের মহাতান্ত্রিক নির্মলানন্দের নির্দেশে
১৬ জানুয়ারি ’৯০ আজকাল পত্রিকায় চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। তিন কলম জুড়ে ছবি-সহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি নিঃসন্দেহে অলৌকিক বিশ্বাসীদের ও অলৌকিক ব্যবসাদারদের নব বলে বলীয়ান করবে, কিন্তু দোদুল্যমান মানুষকে অলৌকিকতায় বিশ্বাসীদের শিবিরে টেনে নিয়ে যাবে, কিছু যুক্তিবাদীরও অস্বস্তি ঘটাবে, বিভ্রান্ত করবে।
প্রতিবেদনটি এই রকম:
‘জাগ্রত’ নরমুণ্ড সিগারেট টানল
আজকালের প্রতিবেদন: গা ছমছমে তারাপীঠ শ্মশানেই শুটিং হচ্ছে ‘তান্ত্রিক’ ছবির। এই ছবিতে অভিনয় করছেন তারাপীঠের মহাতান্ত্রিক নির্মলানন্দ তীর্থনাথ স্বয়ং। দ্বারকা নদীর ধারে তারাপীঠ শ্মশানের ওপরেই নির্মলানন্দ তীর্থনাথের ছোট আশ্রমটাই লোকেশনে। আশ্রম না বলে একটা ছোটখাটো কুঁড়েঘরই বলা উচিত। যার মধ্যে বাস নির্মলানন্দ তান্ত্রিক সাধনা করেন। তাঁর বেদির নিচেই পোতা রয়েছে একটা ন বছরের মেয়ের মৃতদেহ। ঘরের চারধারে নরমুণ্ড সারি সারি সাজানো। মাঝখানে হোমকুণ্ড। এর মধ্যে একটা নরমুণ্ডের পুরোপুরি অভিনেতা।
তন্ত্র নিয়েই ছবি। পরিচালক অঞ্জন দাসকে এ ব্যাপারে পুরোপুরি সাহায্য করছেন তান্ত্রিক নির্মলানন্দ তীর্থনাথ নিজেই। তন্ত্র হল বিজ্ঞান, কোণের দিকে আঙুল তুলে নির্মলানন্দ বললেন, এটা জাগ্রত। আমিই জাগিয়ে রেখেছি একো দিনে সিগারেট ও পাবেই। বলেই একটা সিগারেট নরমুণ্ডের মুখে গুঁজে দিলেন তীর্থনাথ। নরমুণ্ড সিগারেট খেতে শুরু করল অবিকল জীবন্ত মানুষের মতো। নির্মলানন্দ এদিকে শুটিং জোনে গিয়ে নিজের সংলাপ বলে এলেন। সন্ধ্যা রায়, অনুপকুমারের সামনে। এ ছবিতে তন্ত্রের সমস্ত ধারাই আসবে। আসরে শবসাধনা। যেখানে মৃতদেহ সরাসরি চিতা থেকে তুলে আনবেন নির্মলানন্দ তীর্থনাথ। পরিচালক অঞ্জন দাস নিজেই এই তান্ত্রিক ছবির আলোকচিত্রী। তাঁর ভয় এই সব দৃশ্য তিনি ক্যামেরায় সাহস করে শেষ অবধি ধরতে পারবেন কি না।
‘তন্ত্র’কে আকর্ষণীয় করার জন্যে এই ছবিতে একটা গল্প থাকছে। আর সেখানেই অভিনয় করছেন সন্ধ্যা রায়, অনুপকুমার প্রমুখরা। আসলে তন্ত্রের গোপন রহস্যকে তুলে ধরার জন্যেই এই ছবি। আর সেই শর্তেই এই ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হয়েছে তারাপীঠ শ্মশানের তান্ত্রিক নির্মলানন্দ ও তার সাধন মা শুক্লাতিথি বসু। রাতের শ্মশানে চিতায় হোম সেরে ভোর হতেই শুটিংয়ে নেমে পড়ছেন এখন তারাপীঠের তান্ত্রিক। যিনি দীর্ঘ বারো বছর সাধনার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন, তাঁকে ফিল্মে বন্দী করার মতো কঠিন কাজ করছেন পরিচালক অঞ্জন দাস।
প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে এই বিষয়ে আমাদের বক্তব্য জানতে চেয়ে রাশি রাশি চিঠি এলো।
২৬ ফেব্রুয়ারি সমিতির তরফ থেকে একটা চিঠি পাঠালাম ‘আজকাল’ পত্রিকার দপ্তরে। ৬ মার্চ চিঠিটি প্রকাশিত হল।
জাগ্রত নরমুণ্ড : একটি চ্যালেঞ্জ
১৬ ফেব্রুয়ারির আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘জাগ্রত নরমুণ্ড সিগারেট টানল’ প্রতিবেদনটি পড়ে জানতে পারলাম ‘তান্ত্রিক’ ছবির শুটিং হচ্ছে তারাপীঠ শ্মশানে। তন্ত্রসাধনা নিয়ে তোলা হচ্ছে ছবিটি। তন্ত্র-সাধনাকে তুলে ধরার স্বার্থে অভিনয়ে রাজি হয়েছে তান্ত্রিক নির্মলানন্দ তীর্থনাথ ও তাঁর সাধন মা শুক্লাতিথি বসু। ছবিটির পরিচালক অঞ্জন দাস। নির্মলানন্দ নাকি দাবি করেছেন—তন্ত্র হল বিজ্ঞান। তিনি নাকি নরমুণ্ডকে তন্ত্রবলে জাগ্রত করে রাখেন। প্রমাণ হিসেবে নরমুণ্ডের মুখে গুঁজে দিয়েছিলেন একটা সিগারেট। নরমুণ্ড সিগারেট টানতে লাগল অবিকল জীবন্ত মানুষের মতো।
‘আজকাল’-এর মতো একটি সমাজ সচেতন ও যুক্তিবাদী আন্দোলন প্রসারে অগ্রণী পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হওয়ায় স্বভাবতই বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে খুবই গুরুত্ব পেয়েছে। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে আমার ও আমাদের সমিতির বক্তব্য জানতে চেয়ে রাশি রাশি চিঠি এসেছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি লেকটাউন বইমেলার সাংস্কৃতিক মঞ্চে আমাদের সমিতির ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ অনুষ্ঠানে তিনজন জাগ্রত নরমুণ্ডের সিগাটে টানার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে ব্যাখ্যা চান। একজন তো কাগজের কাটিংটি পর্যন্ত হাজির করেছিলেন। সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তির অবসান কল্পে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্মলানন্দকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। তিনি নিরপেক্ষ স্থানে প্রকাশ্য সমাবেশে কৌশল ছাড়া মড়ার খুলিকে দিয়ে সিগারেট টানাতে পারলে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এবং সমিতির কয়েক’শত সহযোগী সংগঠন ও শাখা সংগঠন তাঁদের সমস্ত রকম অলৌকিক বিরোধী কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকবেন। প্রণামী হিসেবে আমি দেব ৫০ হাজার টাকা। এই চিঠিটি ‘আজকাল’-এ প্রকাশিত হওয়ার দশ দিনের মধ্যে নির্মলানন্দ আমাদের সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করলে অবশ্যই ধরে নেব নির্মলানন্দ একজন বুজরুক, প্রতারক। যদি তিনি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, তবে আমরা তাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণের এক মাসের মধ্যে কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনেই তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার পরীক্ষা নেব।
প্রবীর ঘোষ সাধারণ সম্পাদক ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি। কলকাতা-৭৪
চিঠি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষ দেখা করে, ফোনে অথবা চিঠিতে অভিনন্দন জানালেন, এঁদের অনেকেরই বক্তব্য ছিল, “আপনার চ্যালেঞ্জে নির্মালানন্দ আসবেন না। যতসব ফালতু ব্যাপার।” আমার স্ত্রী সীমার তবলচি গোবিন্দ লাহিড়ী ৮ তারিখ সকালে এসে জাগ্রত নরমুণ্ড প্রসঙ্গটি ভুলে জানালেন, “গোরক্ষবাসী রোডে এক জ্যোতিষী থাকেন। যিনি আবার তান্ত্রিকও। প্রায় শনিবারই তারাপীঠে যান। পরশুও আমি ও আমাদের পাড়ার কয়েকজন ‘আজকাল টা নিয়ে গিয়েছিলাম দেখাতে। আমরা বললাম, নির্মলানন্দ কি প্রবীরবাবুর চ্যালেঞ্জ নেবেন? তান্ত্রিক ভদ্রলোক বললেন, নির্মলানন্দকে খুব ভালোরকমই চিনি। তারাপীঠের সব তান্ত্রিককেই চিনি। নিজেও তন্ত্র বিষয়টা ভালোরকম জানি। তন্ত্রের সাহায্যে কেউ নরগুকে জ্যাত করে সিগারেট খাওয়াবে এমন আজগুবি গপ্পো কোনো দিন শুনিনি। পত্রিকার সাংবাদিক সিনেমাকে তোল্লা দিতে নিজেই বানিয়ে টানিয়ে ওসব লিখে দিয়েছে।”
গোবিন্দবাবুকে বললাম,“আপনাদের পাড়ার তান্ত্রিকটি বেডায় ধূর্ত। তাই সাংবাদিকের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে নির্মলানন্দকে ও তন্ত্রশক্তিকে বাঁচাতে চাইছেন। আপনার তান্ত্রিক প্রতিবেশী নরমুণ্ডের সিগারেট খাওয়া ব্যাপরাটা ঘটানো একেবারেই অসম্ভব বলে সাংবাদিকের উপর খবরটির পর বার-দায়িত্ব চাপাতে চাইছেন বটে, কিন্তু যদি প্রমাণ করে দিই নরমুণ্ডকে দিয়ে সিগারেট খাওয়ানো আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব তখন তিনি কী বলবেন? যে চিঠিটা আজকাল পত্রিকায় প্রকাশের জন্য দিয়েছিলাম, তার থেকে শেষ কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়নি। প্রকাশিত হলে ওই তান্ত্রিকবাবাজি ও কথা বলতেন না।”
“শেষ অংশে কী ছিল?” গোবিন্দবাবু জানতে চাইলেন।
‘অফিস কপি’ বের করে ওই অংশটুকু পড়ে শোনালাম:
‘প্রসঙ্গত জানাই, ২৫ ফেব্রুয়ারি ৯০ লেকটাউন বইমেলার অনুষ্ঠানে দর্শকদের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া একটি ছবির মুখে সিগারেট গুঁজে দিয়ে আগুন জ্বেলে দিতেই ছবিটি সিগারেট টেনেছে, রিং ছেড়েছে জীবন্ত মানুষের মতোই। উপস্থিত দর্শকরাই সাক্ষী। ঘটনাটা ঘটিয়ে ছিলাম লৌকিক কৌশলে, ছবির ভূতকে জাগ্রত করে নয়।
একই সঙ্গে পরিচালক অঞ্জন দাসের কাছে দাবি জানাচ্ছি—সত্যের নামে মিথ্যা প্রচার করা থেকে এবং অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন অথবা আবাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে প্রমাণ করুন তন্ত্র হল বিজ্ঞান।
আশা রাখি আমাদের এই দাবির সঙ্গে প্রতিটি সৎ ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ও গণসংগঠন একমত হবেন এবং সোচ্চার হবেন।’
৯ মার্চ ’৯০ বর্তমান পত্রিকাতেও ছবি-সহ চার কলম জুড়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হল—বাংলায় তন্ত্র নিয়ে ছবি হচ্ছে—তান্ত্রিক। প্রতিবেদনটির শেষ অংশে ছিল—‘তারাপীঠের শ্মশানে দাঁড়িয়ে শুটিং স্পটে নির্মলানন্দ বলেছিলেন, “তন্ত্রের প্রভাব এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি। কিছু অপপ্রয়োগে তন্ত্র নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে। তন্ত্র এখনও জাগ্রত।” —সেই সময় জনৈক সাংবাদিক বাল ফেললেন, “দেখাতে পারবেন?” —“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।” বলেই পাশের কুটিরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে দেখালেন বিশাল হোমকুণ্ডর সামনে সার সার খুলি। সেই খুলির মুখে জ্বলন্ত সিগারেট দিলেন— অবিকল মানুষের মতো সেই খুলি সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছে। সাংবাদিকরা বিস্মিত হলেন—বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর।
১৯ মার্চ ’৯০ বর্তমান পত্রিকায় এর উত্তরও প্রকাশিত হল ‘জনমত বিভাগে।
তান্ত্রিক : চ্যালেঞ্জ জানালো যুক্তিবাদী সমিতি
৯ মার্চ ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাংলায় তন্ত্র নিয়ে ছবি হচ্ছে—তান্ত্রিক’ প্রতিবেদনটিতে প্রতিবেদক অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তান্ত্রিক নির্মলানন্দ তীর্থনাথ একটি মড়ার খুলির মুখে জ্বলন্ত সিগারেট গুঁজে দিয়ে দেখালেন যে সেই খুশি সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছে। অর্থাৎ এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন যে, ‘তন্ত্র এখনও জাগ্রত’।
‘বর্তমান’-এর মতো একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হওয়ায় স্বভাবতই জনমনে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে আমার ও আমাদের সমিতির মতামত জানতে চেয়ে রাশি রাশি চিঠি এসেছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি লেকটাউন বইমেলার সাংস্কৃতিক মঞ্চে আমাদের ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ অনুষ্ঠানে তিনজন জাগ্রত নরমুণ্ডের সিগারেট টানার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে ব্যাখ্যা চান। কারণ ইতিপূর্বে অন্য একটি পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল। একজন তো ওই পত্রিকার কাটিং পর্যন্ত হাজির করেছিলেন। সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তির অবসানকল্পে ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্মলানন্দকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি, তিনি নিরপেক্ষ স্থানে প্রকাশ্য সমাবেশে কৌশল ছাড়া মড়ার খুলিকে দিয়ে সিগারেট টানাতে পারলে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ও সমিতির কয়েকশো সহযোগী সংস্থা এবং শাখা সংগঠন তাদের সমস্ত রকম অলৌকিক-বিরোধী কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবে। প্রণামী হিসেবে আমি দেব ৫০ হাজার টাকা।
ই চিঠিটি ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশের দশ দিনের মধ্যে নির্মলানন্দ আমাদের সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করলে অবশ্যই ধরে নেব নির্মলানন্দ পিছু হটেছেন। যদি তিনি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, তবে আমরা তাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণের একমাসের মধ্যে কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনেই তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ নেব।

প্রসঙ্গত জানাই, ২৫ ফেব্রুয়ারি লেকটাউনে বইমেলার অনুষ্ঠানে দর্শকদের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া একটি ছবির মুখে সিগারেট দিয়ে আগুন জ্বেলে দিতেই ছবিটি সিগারেট টেনেছে, রিং ছেড়েছে জীবন্ত মানুষের মতোই। উপস্থিত দর্শকরাই সাক্ষী। ঘটনাটা ঘটিয়ে ছিলাম লৌকিক কৌশলে, ছবির ভূতকে জাগ্রত করে নয়।
একই সঙ্গে পরিচালক অঞ্জন দাসের কাছে দাবি জানাচ্ছি সত্যের নামে মিথ্যা প্রচার করা থেকে এবং মানুষকে অন্ধকারের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন। অথবা আমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে প্রমাণ করুন ‘তন্ত্র’ হল ‘বিজ্ঞান’।
প্রবীর ঘোষ
সাধারণ সম্পাদক
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি
৭২/৮, দেবীনিবাস রোড,
কলিকাতা-৭০০ ০৭৪
৩১ মার্চ ’৯০ ‘আজকাল’ পত্রিকায় নির্মলানন্দের পাল্টা চ্যালেঞ্জ প্রকাশিত হয়। চিঠিটি এখানে তুলে দিচ্ছি।
জাগ্রত নরমুণ্ড : পালটা চ্যালেঞ্জ
৬ মার্চের আজকাল ‘জাগ্রত নরমুণ্ড: একটি চ্যালেঞ্জ’ ‘শীর্ষক চিঠি চোখে পড়ল। চিঠিটি লিখেছেন প্রবীর ঘোষ। বলতে বাধ্য হচ্ছি, চ্যালেঞ্জ করাটা প্রবীর ঘোষ মহাশয়ের একটা নেশায় পরিণত হয়েছে। ওঁর চিঠিতে ‘বুজরুকি’ কথাটা উল্লেখ করা হয়েছে বলেই নেশা কথাটা লিখতে বাধ্য হলাম। হয়তো ওঁর জানা নেই, আত্মার কোনো মৃত্যু নেই এবং অভেদানন্দের লেখা ‘মরণের পরে’ বইটাও হয়ত পড়া নেই। তন্ত্র সাধনা আত্মা নিয়ে খেলা এবং এটা বই পড়ে হয় না। এজন্য চাই কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা। ওর প্রণামীর চাইতে তারা মা এবং গুরুর আশীর্বাদ আমার কাছে যথেষ্ট। নরমুণ্ডের সিগারেট টানার ব্যাপারটা বিতর্কিত ছবির মধ্যে নেই কারণ আমার সাধনার বস্তু কখনই এভাবে প্রকাশিত করা যায় না। তবে বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকেরা যখন ছবির শুটিং দেখতে যান তখন অন্য সকল দর্শনীয় দ্রব্যের সঙ্গে এই নরমুণ্ডের সিগারেট টানা দেখে অবাক হন। তাঁরা পত্রিকায় একথা প্রকাশ করেন। চ্যালেঞ্জ থেকে চ্যালেঞ্জে আসতে বাধ্য হলাম। প্রবীর ঘোষ যেন এই চিঠি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার দশ দিনের মধ্যেই নিজের হাতে আমার সামনে এসে পরীক্ষা করেন। ওই পরীক্ষা ওই মহাশ্মশান বা আশ্রমেই করতে হবে। কারণ সাধনার বস্তু কখনই বাজারের ফলমূলের মতো তুলে আনা যায় না। যদি উনি না আসেন, তাহলে আমার যা করণীয় তা করব। আমি তান্ত্রিক না সাধক জানি না তবে মাকে নিয়ে পড়ে আছি।
নির্মলানন্দ তীর্থনাথ।
তারাপীঠ মহাশশ্মশান।
চণ্ডীপুর। বীরভূম।
৪ এপ্রিল ’৯০ ‘বর্তমান’—পত্রিকাতেও প্রকাশিত হল নির্মলানন্দের চিঠি।
প্রসঙ্গ : তান্ত্রিক
গত ৯ মার্চ ‘বর্তমান’ সংবাদপত্রে ‘বাংলায় তন্ত্র নিয়ে ছবি হচ্ছে তান্ত্রিক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল, আমি সাংবাদিকদের সামনে একটি মাথার খুলির মুখে জ্বলন্ত সিগারেট গুঁজে দেওয়ায় সেই খুলি সিগারেট ঘনঘন টান দিচ্ছিল। একথা সম্পূর্ণ সত্যি। এরপর গত ১৯ মার্চ আমার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষ একটি চিঠি লিখেছেন। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে জানাই, স্বামী অভেদানন্দের লেখা বইটি হয়তো তাঁর পড়া নেই। আত্মার কোনও মৃত্যু নেই। তন্ত্র সাধনা আত্মা নিয়ে খেলা এবং এটা বই পড়ে হয় না। কঠোর পরিশ্রম, সাধনা সেই সঙ্গে ঈশ্বরের কৃপা থাকলে তবেই এটা সম্ভব হয়। নরমুণ্ডের সিগারেট টানার ব্যাপারটা ‘তান্ত্রিক’ ছবির মধ্যে নেই। সাংবাদিকরা অন্য সকল দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে এটা দেখে অবাক হয়ে যান এবং একথা পত্রিকার প্রকাশ করেন। আমি চ্যালেঞ্জের জবাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে বাধ্য হলাম। এই চিঠি প্রকাশিত হবার দশ দিনের মধ্যে প্রবীরবাবু যেন নিজের হাতে আমার সামনে এই পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষা তারাপীঠের মহাশ্মশানেই করতে হবে। কারণ, সাধনার বস্তু কখনই বাজারের ফলমূলের মতো তুলে আনা যায় না। যদি উনি না আসেন তবে আমার যা করার তাই করব। আমি তান্ত্রিক না সাধক জানি না—তবে মা-কে নিয়ে পড়ে আছি। পত্রলেখককে অভিনন্দন-সহ শ্মশানবাসী এই অনভিজ্ঞ-র এই আবেদন রইল।
নির্মলানন্দ তীর্থনাথ
তারাপীঠ মহাশ্মশান, চণ্ডীপুর, বীরভূম
‘আজকাল’ ও ‘বর্তমান’ দুটি পত্রিকাতেই আমার বক্তব্য পাঠালাম ১ এপ্রিল ও ৪ এপ্রিল ’৯০। কিন্তু চিঠি দুটি যে কোনও কারণে হোক প্রকাশিত হয়নি। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল। আমরাই কয়েক শো চিঠি পেয়েছি—যেগুলোতে পত্রলেখক জানতে চেয়েছিলেন নির্মলানন্দের চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করেছি কি না?
আজকাল পত্রিকায় পাঠানো চিঠিটির একটি প্রতিলিপি এখানে প্রকাশ করলাম। ‘বর্তমান’ পত্রিকাতেও এই বক্তব্যের চিঠিই পাঠিয়েছিলাম।
১-৪-৯০
৩১ মার্চ আজকাল পত্রিকায় ‘জাগ্রত নরমুণ্ড: পালটা চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে প্রকাশিত চিঠিটি পড়লাম। তাঁর চিঠির প্রথম অভিযোগের উত্তরে জানাই, ‘চ্যালেঞ্জ’ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কর্মধারার বিভিন্ন পর্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায় মাত্র। আমাদের সমিতির কুসংস্কার ও জাতপাতের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী মানসিকতা গড়ে তুলতে আমরা তৃণমূল পর্যায়ের জনসাধারণের মধ্যে হাজির হয়ে তাদেরই সঙ্গে মিশে গিয়ে কুসংস্কার ও তার মূল কারণগুলোর বিষয়ে সচেতন করছি, নাটক, প্রদর্শনী, গণসংগীত, প্রতিবেদন, বইপত্র, আলোচনাচক্র, শিক্ষাচক্র ইত্যাদি মাধ্যমে। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে কেউ কোনও অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা চাইলে দেব। সাধারণ মানুষকে অবতার ও জ্যোতিষীদের ‘নেশা’ মুক্ত করতেই আমাদের চ্যালেঞ্জ। যতদিন সাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে অবতার ও জ্যোতিষীদের ‘নেশা’ থাকবে ততদিন ‘নেশা’ কাটাতে আমাদের চ্যালেঞ্জের নেশাও থাকবে৷
নির্মলানন্দ জানিয়েছেন, স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পরে’ বইটা হয় তো আমার পড়া নেই। উত্তরে বিনীতভাবে জানাই বইটির নাম ‘মরণের পারে’, ‘পরে’ নয়। কিন্তু বইটির প্রসঙ্গ টানলেন কেন, বুঝলাম না। আমার পড়া থাকা বা না থাকায় কি আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়?
বইটি পড়া আছে। অভেদানন্দের কথা মতো আত্মা মানেই ‘চিন্তা’, ‘চেতনা’, বা ‘মন’। শরীর বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ জেনেছে, মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের কাজ-কর্মের ফলই হল ‘চিন্তা’, ‘চেতনা’ বা ‘মন’। মানুষের মৃত্যুর পর তার মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের অস্তিত্ব বাস্তবে সম্ভব নয়। তাই চিন্তারূপী চৈতন্যরূপী আত্মারও মৃত্যুর পর বাস্তব অস্তিত্ব সম্ভব নয়।
নির্মলানন্দের পরীক্ষা গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম নিরপেক্ষ স্থানে এবং প্রকাশ্যে। একবারের জন্যেও অনুরোধ করিনি, আমাদের সমিতির কার্যালয়ে এসে তাঁকে প্রমাণ দিতে হবে। জানতাম নির্মলানন্দ কখনই নিরপেক্ষ স্থানে প্রকাশ্যে কোনও কৌশল ছাড়া নরমুণ্ডকে সিগারেট খাওয়াতে পারবেন না। তাই একান্ত বাধ্য হয়েই উনি প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ স্থানে হাজির হতে অক্ষমতা জানিয়েছেন। নারাজ হওয়ার পিছনে একটি কুযুক্তিও হাজির করেছেন—‘কারণ সাধনার বস্তু কখনই বাজারের ফলমূলের মতো তুলে আনা যায় না।’
সিনেমার তো এখন আন্তর্জাতিক বাজার। সেই বাজারে সাধনার ফলকে হাজির করতে পারলে নিরপেক্ষ স্থানে প্রকাশ্যে হাজির করতে অসুবিধে কোথায়? ওঁর আশ্রমে আমি গেলে আমি হারলেও হারব, জিতলেও হারব।
চিঠির শেষে নির্মলানন্দ যে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন, আমার বা আমাদের সমিতির কাছে সেটা নতুন কিছু নয়। এর আগে যখনই আক্রান্ত হয়েছি, দুর্বার জনরোষ আক্রমণকারীদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আক্রমণকারীরা কখনও হয়েছে ফেরার, কখনও বা সচেষ্ট হয়েছে আত্মহননে।
নির্মলানন্দকে আবারও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি, প্রকাশ্য নিরপেক্ষ স্থানে আপনার ক্ষমতার পরীক্ষা দিয়ে কৌশল ছাড়া নরমুণ্ডকে দিয়ে সিগারেট খাওয়ান। আর প্রকাশ্য স্থানটা কলকাতা প্রেস ক্লাব হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ধৃষ্টতা যদি নির্মলানন্দ দেখান, তাঁর মাথা যুক্তিবাদের কাছে নত হতে বাধ্য হবে। আবারও প্রমাণ হবে অলৌকিকত্বের অস্তিত্ব আছে শুধু কল্পকাহিনিতে। ঠাকুরনগর খেলার মাঠে ১৩ এপ্রিল বিকেল তিনটেয় আমাদের সমিতির ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ অনুষ্ঠানে নির্মলানন্দের ছবিকে দিয়েই সিগারেট খাওয়াব। নির্মলানন্দসহ উৎসাহিতদের উপস্থিতি কামনা করছি।
শুভেচ্ছা সহ
প্রবীর ঘোষ
সাধারণ সম্পাদক
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি
৭২/৮, দেবীনিবাস রোড
কলিকাতা-৭০০ ০৭৪ এর পরও আরও কিছু বলার রয়ে গেছে। নির্মলানন্দকে রেজেস্ট্রি ডাকে একটি চিঠি পাঠাই ২৬-৫-৯০। দীর্ঘ চার পৃষ্ঠার চিঠির প্রথম অংশটা ছিল ‘আজকাল’ ও ‘বর্তমান’-এ পাঠানো জবাব—যা শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। শেষ অংশটুকু আপনাদের কৌতূহল মেটাতে তুলে দিচ্ছি।
‘ইতিমধ্যে আমরা বহু ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে ছবিকে দিয়ে সিগারেট পান করিয়েছি। ছবি সিগারেট টেনেছে জীবন্ত মানুষের মতোই। পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলোতেও যে কোনও নিরপেক্ষ স্থানে প্রকাশ্যেই এমন ঘটনা ঘটিয়ে দেখাবেন আমাদের সমিতির বিভিন্ন শাখা ও সহযোগী সংস্থার হাজার হাজার সভ্যরা। এর জন্য আমরা আশ্রয় নিয়েছি তন্ত্রের নয়, কৌশলের।
মাসিক পত্রিকা ‘আলোকপাত’ পাঠে জানলাম, আপনি নরকঙ্কালের মুণ্ডুকে দিয়ে কারণবারিও পান করান। ইতিমধ্যে আমাদের সমিতি ও কয়েকশত সহযোগী সংস্থা ও শাখা সংগঠন নরমুণ্ডুকে দিয়ে দুধ (মদের পরিবর্তে) পান করিয়ে দেখিয়েছেন অদ্ভূত কয়েক হাজার অনুষ্ঠানে।
আমাদের সঙ্গে আপনার পার্থক্য, আমরা এগুলো ঘটিয়ে দেখিয়ে কোনও অলৌকিক ক্ষমতার দাবি রাখি না। আপনি এগুলো ঘটিয়ে দাবি করেন অলৌকিক ক্ষমতার।
যেহেতু নরমুণ্ডকে দিয়ে সিগারেট পান বা মদ্যপান লৌকিক কৌশলেই করা সম্ভব, তাই আপনার অলৌকিক ক্ষমতার দাবি বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। আমরা ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি অলৌকিক ক্ষমতা ও জ্যোতিষ ক্ষমতার দাবিদারদের দাবির যথার্থতা জানতে সত্যানুসন্ধান চালিয়ে থাকি। আপনি একজন সৎ মানুষ হলে আমাদের এই সৎ প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে আপনার দাবির ক্ষেত্রে আমাদের সত্যানুসন্ধান চালাতে সমস্তরকম সহযোগিতা করবেন—এ আশা রাখি।
আগামী ১৬ জুন রবিবার প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেছে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি। সময় বিকেল চারটা। সেদিন সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে আপনি মড়ার খুলিকে জাগ্রত করে সিগারেট ও মদ খাওয়াতে পারলে আমি ও আমাদের সমিতি পরাজয় স্বীকার করে নেব। তবে অবশ্যই ঘটনাগুলো আপনাকে ঘটাতে হবে কৌশল ছাড়া।
আমাদের সমিতির এই সত্যানুসন্ধান বিষয়ে সহযোগিতা না করলে অবশ্যই ধরে নেব আপনার তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাগুলো আর যাঁদেরই দেখান না কেন, আমাদের নিরপেক্ষ পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আপনিও আমাদের মতোই কৌশলের সাহায্যেই ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকেন।
শুভেচ্ছা সহ
প্রবীর ঘোষ
না, নির্মলানন্দ চিঠিটি গ্রহণ করেননি। সম্ভবত প্রেরক হিসেবে আমাদের সমিতির ও আমার নামটিই চিঠিটি গ্রহণ করার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চিঠিতে পুরো ঠিকানাই অবশ্য ছিল।
শ্রীনির্মলানন্দ
তারাপীঠ মহাশ্মশান, চণ্ডীপুর, বীরভূম।
নির্মলানন্দের জন্য খোলা চ্যালেঞ্জ আজও রইল। সাধ্য থাকলে যেন গ্রহণ করেন।