Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অলৌকিক নয়, লৌকিক – ২ (দ্বিতীয় খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ

    প্রবীর ঘোষ এক পাতা গল্প526 Mins Read0

    অধ্যায় আট: ঈশ্বরের ভর

    ঈশ্বরের ভর

    ঈশ্বরের ভর কখনও মানসিক রোগ, কখনও অভিনয়

    মনসা, শীতলা, কালী, তারা, দুর্গা, চড়ক পুজোর সময় শিব এবং কীর্তনের আসরে রাধা বা গৌরাঙ্গের ভর, এমনি আরও কত পরিচিত, অল্পপরিচিত, অপরিচিত ঠাকুর-দেবতারা যে মানুষের ওপর ভর করে তার ইয়ত্তা নেই। ঠাকুরে ভর হওয়া মানুষগুলোর বেশিমাত্রায় খোঁজ মিলবে মফস্বলে গ্রামে-গঞ্জে। শহর কলকাতাতেও অবশ্য ভর হওয়া মানুষের সাক্ষাৎ মেলে। ভবিষ্যৎ জানতে, অসময় থেকে উত্তরণের জন্য দৈব ওষুধ পেতে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বহু মানুষই এইসব ভর হওয়া মানুষগুলোর দ্বারস্থ হন। অনেক ক্ষেত্রে ঠাকুরে ভর হওয়া মানুষগুলো এমন সব অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য আচরণ করেন যে সাধারণ বুদ্ধিতে অনেকে এতে অলৌকিকের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। বিশ্বাস করেন মানুষটির শরীর ঈশ্বর দখল করাতেই এমনটি ঘটছে।

    কৈশোরের একটি ঘটনা। তখন দমদম পার্ক-এ থাকি। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে মাঝে-মধ্যে নাম গানের আসর বসত। শুনেছিলাম নাম-গান শুনতে শুনতে বন্ধুর মায়ের ওপর রাধার ভর হত। একবার দেখতে গেলাম। বন্ধুর মা নাম সঙ্কীর্তন করতে করতে এক সময় হঠাৎ প্রচণ্ডভাবে মাথা দোলাতে লাগলেন। মনে হতে লাগল মাথাটাই বুঝি বা গলা থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। উম্মত্তের মতো আচরণ করতে লাগলেন। ভক্তরা তাঁকে ধরাধরি করে এক জায়গায় বসালেন। ভক্তরা অনেকেই এই সময় বন্ধুর মাকে শুয়ে পড়ে প্রণাম জানাচ্ছিলেন। সেদিন শারীর-বিদ্যা বিষয়ে জ্ঞানের অভাবে বন্ধুর মায়ের এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ আমার অজানা ছিল, তাই বিস্মিত হয়েছিলাম। আজ কিন্তু শারীর-বিদ্যার কল্যাণে জানতে পেরেছি সে-দিন আমার বন্ধুর মা নাম-সঙ্কীর্তন করতে করতে ভক্তিরসে, ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে যা যা করেছিলেন সে সব ছিল হিস্টিরিয়া রোগেরই অভিব্যক্তি, অথবা নিজেকে অন্যদের চেয়ে বিশিষ্ট, শ্রদ্ধেয় বলে প্রচার করার মানসিকতায় তিনি ইচ্ছে করেই পুরো ব্যাপারটা অভিনয় করছিলেন।

    প্রাচীন যুগ থেকেই হিস্টিরিয়া রোগকে মানুষ অপার্থিব বলেই মনে করতেন। রোগের উপসর্গকে মনে করা হত ভূত বা ঈশ্বরের ভরের বহিঃপ্রকাশ। এ যুগেও সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে এখনও অনেক ক্ষেত্রেই হিস্টিরিয়া রোগী পূজিত হয় ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে। সাধারণভাবে অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত বা প্রগতির আলো থেকে বঞ্চিত সমাজের মানুষদের মধ্যেই এই ধরনের হিস্টিরিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। সাধারণভাবে এই শ্রেণির মানুষদের মস্তিষ্ককোষের স্থিতিস্থাপকতা বা সহনশীলতা কম। যুক্তি দিয়ে বিচার করে গ্রহণ করার ক্ষমতা অতি সীমিত। বহুজনের বিশ্বাসকে অন্ধভাবে মেনে নিতে অভ্যস্ত। মস্তিষ্ককোষের সহনশীলতা যাদের কম তারা এক নাগাড়ে একই ধরনের কথা শুনলে বা ভাবলে অনেক সময় মস্তিষ্কের কার্যকলাপে বিশৃঙ্খলা ঘটে। একান্ত ঈশ্বরে বিশ্বাস বা ভূতে বিশ্বাসের ফলে রোগী ভাবতে থাকে তার শরীরে ঈশ্বরের বা ভূতের আবির্ভাব হয়েছে, ফলে রোগী ঈশ্বর বা ভূতের প্রতিভূ হিসেবে অদ্ভুত সব আচরণ করতে থাকে।

    ‘ভূত-ভর’ প্রসঙ্গে এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা আগে করা হয়েছে। তাই পাঠকদের একই ধরনের কথা বলে তাঁদের ধৈর্যের উপর অত্যাচার করার চেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত করলাম। বরং এখানে একটি গণহিস্টিরিয়ার উদাহরণ তুলে দিচ্ছি।

    হিস্টিরিয়া যখন ভর

    ১৯৬৬ সালের মে মাসের ২৭ তারিখ। স্থান—রাঁচীর উপকণ্ঠের পল্লি। সময়- সন্ধ্যা। নায়িকা একটি কিশোরী। প্রচণ্ড মাথা দোলাতে দোলাতে শরীর কাঁপাতে-কাঁপাতে কী সব আবোল-তাবোল বকতে লাগল।

    সন্ধেবেলায় জল বয়ে আনার পরই এমনটা ঘটেছে, নিশ্চয়ই ভূতেই ধরেছে। বাড়ির লোকজন ওঝাকে খবর দিলেন। ওঝা এসে কাঠকয়লায় আগুন জ্বেলে তাতে ধুনো, সরষে আর শুকনো লঙ্কা ছাড়তে শুরু করল, সঙ্গে নানা অঙ্গভঙ্গি করে মন্ত্র পাঠ। মেয়েটি কঠিন গলায় ওঝার ওইসব কাজ-কর্মে বিরক্তি প্রকাশ করল। ওঝা দেখলে ভর করা ভূতের চিরকালই ক্ষুব্ধ হয়। অতএব ভূতের রাগে ওঝার উৎসাহ তো কমলই না, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে মন্ত্রসহ নাচানাচি শুরু করল।

    গম্ভীর গলায় মেয়েটি জানাল, সে ভূত নয়, ভগবান, সে ‘বড়ি-মা’ অর্থাৎ মা দুর্গা। ওঝা ওর সামনে বেয়াদপি করলে শাস্তি দেবে। ওঝা অমন অনেক দেখেছে। ভূতের ভয়ে পালাবার বান্দা সে নয়। সে তার মতো মন্ত্র-তন্ত্রে পাঠ চালিয়ে যেতে লাগল। মন্ত্র পড়া সরবের কিছুটা কাঠকয়লার আগুনে আর কিছুটা মেয়েটির গায়ে ছুড়ে মারতেই মেয়েটি অগ্নিকুণ্ড থেকে টকটকে লাল একমুঠো জ্বলন্ত কাঠ কয়লা হাতে তুলে নিয়ে ওঝাকে বলল, “এই নে ধর প্রসাদ।” ওঝার হাতটা মুহূর্তে টেনে নিয়ে ওর হাতে উপুড় করে দিল জ্বলন্ত কাঠকয়লাগুলো।

    তাপে ও যন্ত্রণায় তীব্রতায় ওঝা চিৎকার করে এক ঝটকায় কাঠকয়লা উপুড় করে ফেলে দিল। মেয়েটি কিন্তু নির্বিকার। তার চোখে-মুখে যন্ত্রণার সামান্যতম চিহ্ন লক্ষ্য করা গেল না। এমনকী, হাতে ফোস্কা পর্যন্ত নয় উপস্থিত প্রতিটি দর্শক হতচকিত, বিস্মিত। এ মেয়ে ‘বড়ি-মা’ না হয়েই যায় না। প্রথমেই নতজানু হয়ে মার্জনা ভিক্ষা করল ওঝাটি। তার বশ্যতা স্বীকারে প্রত্যেকেরই বিশ্বাস দৃঢ়তর হল।

    মেয়েটি তার মা-বাবাকে নাম ধরে সম্বোধন করে জানাল, “আমার কাছে মানত করেও মানত রাখিসনি বলে আমি নিজেই এসেছি।”

    মা-বাবা ভয়ে কেঁপে উঠলেন, মানত করে মানত না রাখতে পারার কথাও তো সত্যি। মা-বাবা মেয়ের পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়লেন। মেয়েটি রাতারাতি ‘বড়ি-মা’ হয়ে গেল। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে দলে দলে মানুষ বড়ি-মা’-র দর্শনের আশায়, কৃপালাভের আশায়, সমস্যা সমাধানের আশায় রোগ-মুক্তির আশায় হাজির হতে লাগলেন। কিশোরীটির ব্যবহারে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এসে গেছে। কেউ জুতো পায়ে, লাল পোশাক পরে বা চশমা পরে ঢুকতে গেলেই ভর্ৎসনা করছে। বড়দেরও নানা ধরনের আদেশ করছে। ভক্তরা ফল, ফুল, মেঠাইয়ে ঘর ভরিয়ে তুলতে লাগলেন। শঙ্খ-ঘণ্টা বাজিয়ে ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে চলতে লাগল বড়ি-মার পুজো। এরই মধ্যে বড়ি-মার কিছু সেবিকাও জুটে গেছে। বড়ি-মার আবির্ভাবের দিন দুয়েকের মধ্যে এক বয়স্কা বিবাহিতা সেবিকা ঘন ঘন ফিট হতে লাগলেন। এক সময় বড়ি-মার মতন মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘোষণা করলেন তিনি ‘ছোটি-মা’। একই ঘরে দু-মায়েরই পুজো শুরু হয়ে গেল।

    কিশোরী ও বিবাহিতা মহিলার ওপর বড়ি-মা ও ছোটি মা-র ভরের কাহিনি ঘিরে আশেপাশে বিরাট অঞ্চল নিয়ে তখন দারুণ উত্তেজনা; বলতে কি ধর্মোন্মাদনা। ৩০ মে এক অষ্টাদশ তরুণী ঘন ঘন ফিট হতে লাগলেন। পড়শিরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মেয়েটিকে ভূত পেয়েছে কি ঠাকুরে—বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। ওঝা আসবে, কি পুজো করবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে তাঁদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মেয়েটি ঘোষণা করল, সে মা কালী। এখানেও দলে দলে ভক্ত জুটে গেলেন। রাঁচির আশেপাশে ঈশ্বরের ঘন ঘন আবির্ভাবে ভক্তরা শিহরিত হলেন। বুঝলেন কলির শেষ হল বলে। কলি যুগ ধ্বংস করে আবার সত্য যুগ প্রতিষ্ঠা করতে এবার হাজির হলেন ধ্বংসের দেবতা মহাদেব। আট বছরের একটি বালকের মধ্যে তিনি ভর করলেন।

    ৩১মে একটি বিবাহিতা তরুণীর ওপর ভর করলেন ‘মাঝলি-মা’। সে-রাতেই এক সদ্য তরুণী নিজেকে ঘোষণা করল ‘সাঁঝলি-মা’ বলে। এদের ক্ষেত্রেও মায়েদের আবির্ভাব সূচিত হয়েছিল ঘন ঘন ফিট ও হিস্টিরিয়া রোগীর মতই মাথা ঝাঁকানো, শরীর দোলানোর মধ্য দিয়ে।

    রাঁচির মানসিক আরোগ্যশালার চিকিৎসকদের দৃষ্টি স্বভাবতই এমন এক অদ্ভুত গণহিস্টিরিয়া ঘটনার দিকে আকর্ষিত হয়েছিল। সাত দিনের মধ্যেই এইসব ভরের রোগীরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। রাঁচি মানসিক আরোগ্যশালার চিকিৎসকদের মতে, গ্রামের ভরে পাওয়া রোগীরা প্রত্যেকেই পরিবেশগতভাবে বিশ্বাস করত, ঈশ্বর সময় সময় মানুষের শরীরে ভর করে। একজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে হিস্টিরিয়ার শিকার হলে সে নিজের সত্তা ভুলে গিয়ে ঈশ্বরের সত্তা নিজের মধ্যে প্রকাশিত ভেবে অদ্ভুত সব আচরণ করতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে বেশির ভাগই শিক্ষালাভে বঞ্চিত, ধর্মান্ধ, যুক্তি-বুদ্ধি কম, আবেগপ্রবণ এবং তাদের মস্তিষ্ককোষের সহনশীলতা কম। ফলে একজনের হিস্টিরিয়া রোগ অন্যের মধ্যে দ্রুত সঞ্চারিত হয়েছে। যারা হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, তারা প্রত্যেকেই গভীরভাবে ভাষতে শুরু করেছিল ঈশ্বর তাদের ওপরেও ভর করেছে। শুরুর পর্যায়ে তাদের ভাবনা ছিল আমার ওপরেও যদি ঈশ্বর ভর করে? এক সময় ‘যদি’ বিদায় নিয়েছে। রোগীরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল ঈশ্বর তার ওপর ভর করেছে। যে ঈশ্বর অপর একজনের ওপর ভর করেছে, সে আমারে ওপরেও ভর করতে পারে। এই বিশ্বাস থেকেই তাদের প্রত্যেকের ওপর ভর করেছে এক একটি নতুন নতুন ঈশ্বর।

    কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতীমা’য়ের মেলায় ভর

    নদীয়া জেলার কল্যাণী ঘোষপাড়ায় প্রতি বছর দোল উৎসবে সতী’-মার বিরাট মেলা বসে। সার্কাস, সিনেমা, ম্যাজিক, নাগরদোলা, বাউলের গান, দোকান-পাঠ আর লক্ষ লক্ষ ভক্ত। সমাগমে মেলা আশপাশের বিরাট অঞ্চলকে জাঁকিয়ে রাখে। ‘কর্তাভজা’ সম্প্রদায়ের আউলিয়া এই মেলায় দেড়শো-দুশো তাঁবু ও আখড়া হয়, পুলিশ ফাঁড়ি বসে। পশ্চিমবাংলার বহু মানুষ নানা মানসিক ও প্রার্থনা নিয়ে আসেন। কেউ আসেন রোগমুক্তির কামনা নিয়ে, কেউ বা আসেন সন্তান কামনায়, কেউ বা অন্য কোনও সমস্যা নিয়ে। এখানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘গণ-ভর’। কয়েক শত পুরুষ ও মহিলার উপর সতী’-মার ভর হয়।

    সতীমায়ের বাকসিদ্ধ হওয়ার যে কাহিনি ভক্তদের মুখে মুখে ঘোরে, তা এরকম। অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় ভাগ্য-অন্বেষণের রামশরণ পাল এসে বসবাস শুরু করেন নদীয়া জেলার কল্যাণীর কাছে ঘোষপাড়ায়। বিয়ে করেন সদগোপ জমিদার গোবিন্দ ঘোষের মেয়ে সরস্বতীকে। আউলচাঁদ ফকিরের সঙ্গে পথে আলাপ রামশরণের। রামশরণ তাঁকে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন। আউলচাঁদ ডেরা বাঁধেন রামশরণের বাগানের ডালিমতলায়। পাশেই হিমসাগর পুকুর দেখে ফকির আনন্দে আত্মহারা। বললেন, “বাঃ, এটায় চান করলেই গঙ্গা চানের কাজ হয়ে যাবে। এর সঙ্গে গঙ্গার যোগাযোগ রয়েছে রে।”

    অদ্ভুত ব্যাপার, তারপর থেকে গঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে পুকুরেও জোয়ার-ভাটা হতো। রামশরণ ও সরস্বতী বুঝেছিলেন, ফকির বাকসিদ্ধ। একদিনের ঘটনা, সরস্বতী কিছুদিন ধরেই অসুখে ভুগছিলেন। সে-দিন অসুস্থতা খুব বাড়তে চিন্তিত রামশরণ দৌড়ালেন কবিরাজ মশাইকে ধরে আনতে। পথে আউলচাঁদ রামশরণকে থামালেন। সরস্বতীর অসুস্থতার খবর শুনে বললেন, “তোকে আর কবিরাজের কাছে যেতে হবে না। আমাকে বরং তোর বউয়ের কাছে নিয়ে চল।”

    রামশরণের কী যে কি হলো। কবিরাজের কাছে না গিয়ে আউলচাঁদকে নিয়ে ফিরলেন। ফকির সরস্বতীর শরীরে হাত বুলিয়ে দিতেই রোগের উপশম হল। মুগ্ধ, ভক্তি আপ্লুত রামশরণ ও সরস্বতী আউলচাঁদ ফকিরের কাছে দীক্ষা নিলেন। সিদ্ধপুরুষ আউলচাঁদ জানান, সরস্বতী বাকসিদ্ধ হবেন। পরবর্তী ছয় পুরুষও হবেন বাকসিদ্ধ। রামশরণ ও সরস্বতীর কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কর্তা হয়ে আউলিয়া ধর্মমত প্রচার করতে শুরু করেন। সরস্বতীর বাকসিদ্ধ ক্ষমতার কথা প্রচারিত হতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষের স্রোত এসে ভেঙে পড়তে লাগল সরস্বতীর বাড়িতে। বাক-সিদ্ধা সরস্বতী যাকে যা বলতেন তাই হতো। যে রোগীদের উপর সদয় হতেন, বলতেন, “যা ভালো হয়ে যাবি। একটু হিমসাগরের জল আর ডালিমতলার মাটি মুখে দে গে যা।” রোগীরা ভালোও হয়ে যেত। একটিই শুধু নিষেধ ছিল – শুক্রবার মাছ, মাংস, ডিম, রসুন, পেঁয়াজ, মুসুরডাল আর পুঁই খাওয়া চলবে না, চলবে না কোনও নিমন্ত্রণ খাওয়া।

    শুক্রবারটা সরস্বতী ও রামশরণের কাছে ছিল পুণ্য-বার। ওই দিনেই আউলচাঁদ ফকির ডালিমতলায় এসেছিলেন।

    দ্রুত বাক-সিদ্ধা সরস্বতী ভক্তদের কাছে হয়ে উঠলেন সতীমা। রামশরণ ও সতীমা বিশ্বাস করতেন, গৌরাঙ্গই আউলচাঁদ ফকির বেশে এসেছিলেন। আউলচাঁদ দীক্ষা দিয়েছিলেন বাইশ জনকে। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুও বাইশ জনকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। দু-জনের মধ্যে ছিল এমনি নাকি আরও অনেক মিল।

    সতী-মার মৃত্যুর পর দোল পূর্ণিমায় মেলা হচ্ছে তাও বহু বছর হলো। এই সতীমার মেলায় নাকি রামকৃষ্ণদেব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেরি সাহেব, নবীনচন্দ্র সেন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, অনেকেই গিয়েছিলেন। নবীন সেনের আত্মজীবনীতেও মেলার গণ-ভরের বিবরণ মেলে—

    ‘আমি দেখিয়াছি যে, শতশত নরনারী ‘সতীমাঈ’-র সমাধি সমীপস্থ ‘দাড়িম্বতলায় বৈষ্ণবদের মত দশাপ্রাপ্তা হইয়া অচৈতন্য অবস্থার দিনরাত্রি ধরণা দিয়া পড়িয়া থাকে, কেহ বা অপদেবতাশ্রিত লোকের মত মাথা ঘুরাইতেছে ও কেহ উন্মাদের মত নৃত্য করিতেছে।’

    এখনও একই জিনিস চলছে। অনেক ভক্তরাই হিমসাগরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে দণ্ডী খেটে ডালিম তলা ঘুরে আবার হিমসাগরে যায়। ডালিমতলার মাটি আর হিমসাগরের জল এখনও বহু বিশ্বাসীই পরম ভক্তির সঙ্গে গ্রহণ করেন। অনেকে মানত করে ডালিমতলায় বর্তমানে যে ডালিম গাছ আছে তাতে ঢিল বেঁধে যায়। মনস্কামনা পূর্ণ হলে অনেকেই ডালিমতলায় সতীমাকে শাড়ি চড়ায়। মেলায় তিন দিনে শ-পাঁচেক শাড়ি তো চড়েই। ‘গদি’-তে আসীন ‘বাবুমশায়’-কে ভক্তরা প্রণামী দিয়ে প্রণাম করে তাঁদের সমস্যার কথা জানান। ভক্তেরা বিশ্বাস করেন, গদি’-তে বসার অধিকারী বাবুমশায় সতীমার কৃপায় সে-সময় বাক-সিদ্ধ হন। বাবুমশায় অনেককেই বলেন, “যা তোর সেরে যাবে”, কারও হাতে তুলে দেন ফুল, কাউকে আদেশ দেন ডালিমতলার মাটি নিয়ে যেতে, যাকে যেমন ইচ্ছে হয় তেমনই আদেশ করেন। প্রণামী পড়ে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা।

    মেলায় ভর দেখার মতো ব্যাপার। কয়েকশো মহিলা পুরুষ ভরে আক্রান্ত হন। তাদের মাথা প্রচণ্ডভাবে দুলতে থাকে, কেউ মাটিতে সশব্দে মাথা ঠুকতে থাকেন, কেউ ছোঁড়েন চুল। হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত মানুষগুলো এক সময় ঝিমিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ‘গদি’-র ‘বাবুমশায়’ ভরে ঝিমিয়ে পড়ে থাকা মানুষগুলোর হাতে ফুল ধরিয়ে দিতেই তাঁদের ভর কেটে যায়, উঠে পড়েন। গত পনেরো বছর ধরে গদিতে আসিন অজিতকুমার কুণ্ডুই এই দায়িত্ব পালন করে চলেছিলেন।

    হাড়োয়ার উমা সতীমার মন্দিরে গণ-ভর

    উত্তর ২৪-পরগনার হাড়োয়াতে জন্মাষ্টমীর দিন উমা সতীমার মন্দিরে কর্তাভজা আউলিয়া সম্প্রদায়ের হাজার হাজার ভক্ত সমাগম হয়। উমা বিশ্বাস সতীমা হিসেবেই পরিচিতা। ওখানেও গদিতে বসেন, ‘বাবুমশায়’ অজিতকুমার কুণ্ডু। ভক্তেরা রোগ ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বাবুমশায়ের কাছে প্রণামী নিয়ে মানত করে যান, বাবুমশায় নানাজনকে নানা রকমের ব্যবস্থাপত্র দেন।

    এখানেও ৬০ থেকে ৮০ জনের ভর হয়। এই ভরও একান্তভাবেই গণ-হিস্টিরিয়া। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতোই মাথা দোলানো, মাথা-ঠোকা, হাত-পা ছোড়া, সবই করেন এঁরা। শারীরিক তীব্র আক্ষেপের ফলে একসময় রোগীরা ঝিমিয়ে পড়েন। ঝিমিয়ে পড়ে থাকা রোগীদের হাতে বাবুমশায়ের অজিত কুণ্ডু ফুল গুঁজে দিতেই ভর কেটে যায়। রোগীরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন।

    যোগীপাড়ায় শ্রাবণী পূর্ণিমায় গণ-ভর

    দমদমের যোগীপাড়ায় জীবনী দাসের মন্দির। জীবনী দাস কর্তাভজা আউলিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এখানে শ্রাবণী পূর্ণিমায় কর্তাভজা আউলিয়া সম্প্রদায়ের ভক্তরা আসেন। গানের মাঝে ভক্তদের অনেকেরই ভর হয়। প্রতি বছরই শ্রাবণী পূর্ণিমার উৎসবে ১৫ থেকে ২৫ জন ভরে পড়েন। এখানেও ভর থাকে মিনিট পঁয়তাল্লিশের মতো। ভর একজনের শুরু হতেই তার দেখাদেখি অন্যরাও ভরে আক্রান্ত হয়। প্রত্যেকেই হাত-পা ছোড়াছুড়ি করেন, প্রচণ্ড বেগে মাথা ঘুরিয়ে দোলাতে থাকেন। যখন শরীর আর দেয় না, অবসন্ন হয়ে পড়েন তখন ‘গদি’-র বাবুমশায় অজিত কুণ্ডু ভক্তদের হাতে ফুল ধরিয়ে দেন। ভক্তদের ভর কাটে।

    সতী-মা মেলার ‘গদি’-র বাবুমশায় যুক্তিবাদী হলেন

    ১৯ মার্চ ’৯০-এর সন্ধ্যা। অজিতকুমার কুণ্ডু এলেন আমার ফ্ল্যাটে। কিছুটা অভাবনীয় ঘটনা, সন্দেহ নেই। আমিই সাধারণ অবতার-জ্যোতিষীদের কাছে যাই। তাঁদের আসাটা তুলনায় খুবই কম। অজিত কুণ্ডু হাসিখুশি মানুষ। চোখের দৃষ্টিতে যথেষ্ট বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা। ফর্সা, মেদহীন লম্বা চেহরা। তীক্ষ্ণ নাক, কাঁচা-পাকা চুল, পরনে ধুতি পাঞ্জাবি, যদিও বয়স সাতাত্তর কিন্তু চেহারা ও সপ্রতিভতা দেখে বয়সটা ষাটের বেশি কিছুতেই মনে হয় না।

    আসার উদ্দেশ্যটা যখন জানালেন, তখন আরও কিছুটা বিস্মিত হলাম। অজিতবাবু আমাদের সমিতি সদস্য হতে চাইলেন। অবশ্য অজিতবাবুই প্রথম ধর্মীয় নেতা, যিনি আমাদের সমিতির সদস্য হতে চাইলেন। এর আগে একাধিক জ্যোতিষী আমাদের সমিতির প্রচেষ্টায় বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন জ্যোতিষ শাস্ত্র আদৌ কোনও বিজ্ঞান নয়, লোক ঠকানোর ব্যবস্থামাত্র এবং তারপর জ্যোতিষ চর্চা বন্ধ করে আমাদের সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করে মানুষ গড়ার কাজে ব্রতী হয়েছেন। একটা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃ-স্থানীয় একাধিক ধর্মীয় নেতা আমাদের সদস্য হয়েছেন। তাঁরাই তথাকথিত ধর্মীয় সংস্থাটির অনেক নৈতিক অপরাধ, যৌন বিকৃতির খবর জানিয়েছিলেন। অতি উচ্চশিক্ষিত এই ধর্মীয় নেতারা প্রতিষ্ঠানটির নামে, ঈশ্বরকে পাওয়ার আকুতিতে, মানবসেবার মধ্য দিয়ে মানবিকতার বিকাশ ইচ্ছাতে সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। মোহ ভঙ্গ হয়েছে। বুঝেছেন ঈশ্বর দর্শন ও ঈশ্বর অনুভূতি মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে আসা অলীক দর্শন বা অলীক অনুভূতি মাত্র। আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় এমনই এক প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতা জানিয়েছিলেন গ্রামাঞ্চলে ভূতে ভর দেখেছেন, আধুনিক মানসিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই সারিয়েছেন, কিন্তু সে বিষয়ে মুখ না খুলে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার দ্বারা ভূত তাড়িয়েছেন বলে চালাবার চেষ্টা করেছেন। ধর্মীয় নেতারা এ-ও জানিয়েছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শাখায় তাঁদের উদ্যোগেই গোপনে পড়ানো হচ্ছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটি। জানিয়েছিলেন, অনেকেই আমাদের সমিতির হয়ে কাজ করতে উৎসাহী। অনেক সন্ন্যাসীই সরাসরি আমাদের হয়ে কুসংস্কার-বিরোধী কাজে শামিল হতে চান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে। আমাদের কাছে আলোচকরা একটি সমস্যার কথা বলেছিলেন, যেটা আমাদের ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে একটা বাধার প্রাচীর তুলে রেখেছে। উচ্চশিক্ষিত সন্ন্যাসীরা চেয়েছিলেন একটি সাংবাদিক সম্মেলন ঘোষণা করে বহু সন্ন্যাসীরা তাঁদের ধর্মপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন। তবে, তার আগে আমাদের সমিতিকে সন্ন্যাসীদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনের মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

    ’৮৮-র ১১ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলনেও আমরা এই প্রসঙ্গটি তুলে জানিয়েছিলাম, সরকারি সহযোগিতায়, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারলে আমরা সাংবাদিক সম্মেলনেই ওই সন্ন্যাসীদের হাজির করব সেদিন আর্থিক সঙ্গতি-শূন্য আমরা লড়াকু সন্ন্যাসীদের আরও কাছে আরও লড়াইতে নিয়ে আসতে পারিনি। আজ পর্যন্ত আমরা পারিনি তাঁদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিতে।

    বাবু মশায় অজিতবাবুকে নিয়ে দ্বিধা ছিল অন্য রকম। তিনি কি বাস্তবিকই ওয়াকিবহাল তাঁর চিন্তাধারার বিপরীত শিবিরে আমাদের বাস। ধর্মগুরু সাজাটা যে মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে লোক ঠকানোরই নামান্তর মাত্র, এটাই তো তথ্য-প্রমাণ সহযোগে আমরা প্রমাণ করি।

    অজিতবাবুকে সদস্য করতে আমাদের সমস্যা কোথায়, সবই খোলাখুলি জানালাম। জিজ্ঞেস করলাম, “আমাদের একজন হওয়ার বিনিময়ে সতী মেলার গদিতে বসা বন্ধ রাখতে পারবেন?”

    অজিতবাবু জানালেন, “আমি কিন্তু এই উদ্দেশ্যে আসিনি, আপনাদের কাছ থেকে কিছু শিখে নিয়ে, সে-সব কাজে লাগিয়ে আরও বড় অবতার হয়ে বসব। আমার এখানে আসার কারণ আপনার ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটি। আমি যখন গদিতে বসি, তখন আমি যেন কেমন একটা শক্তি পাই। কেউ যখন প্রণাম করে উপায় জানতে চায়, আমার তখন মনে হয় সতীমাই যেন আমার মুখ দিয়ে কথা বলিয়ে নিচ্ছেন। বছরের পর বছর দেখে আসছি লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের মানত জানাতে আসছে। আবার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে প্রণাম জানিয়ে যাচ্ছে। আপনার বইটা পড়ার পর মনে হলো, আমি ছোটবেলা থেকে সতীমা, তাঁর অলৌকিক বাক-সিদ্ধ ক্ষমতা, সতী মেলায় গদির ক্ষমতা, এইসব শুনে শুনে এগুলোকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেছিলাম। আমার বিশ্বাস, আমার প্রচণ্ড আবেগকে, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভক্তি, বাউল গান, সতীমার জয়ধ্বনি এইসব মিলিয়ে অদ্ভুত একটা ভক্তিরসাশ্রিত পরিবেশ আরও বেশি প্রভাবিত করত। তারই ফলে গদিতে বসলেই আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মনে করতে থাকতাম আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি প্রকাশিত হয়েছে। আমার কথাগুলো সতীমারই নির্দেশ।

    আপনার বইটার ‘বিশ্বাসে অসুখ সারে’ অধ্যায়টা পড়ার পর আমার মনে হচ্ছে, যারা সতীমার মেলায় এসে রোগ মুক্ত হচ্ছে, তারা সতীমার প্রতি বিশ্বাসে, আমার কথায় বিশ্বাস করেই রোগ মুক্ত হচ্ছে। এবার দোলের মেলায় যাদের ভর হয়েছিল, তাদের লক্ষ্য করে আমার মনে হয়েছে আপনার কথাই সত্যি! ওরা প্রত্যেকেই প্রচণ্ড আবেগে, অন্ধবিশ্বাসে হিস্টিরিয়া রোগের শিকার হয়েছিল। একজনের ভর দেখে আরেকজন, তাকে দেখে আরেকজন, এভাবেই জনে জনে স্রেফ হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে উন্মত্ততা দেখিয়েছে, আর তাকেই সাধারণ মানুষ মনে করেছে সতীমার কৃপার ফল, স্থান মাহাত্ম্য ইত্যাদি। যখনই দেখেছি ভরে পাওয়া মানুষগুলো উন্মত্ততা প্রকাশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েছে তখনই ওদের হাতে একটা করে ফুল ধরিয়ে দিয়েছি। যারা এখানে আসে তারা এও জানে আমি ফুল হাতে দিলে ভর কেটে যায়। তাদের এই অন্ধ-বিশ্বাসের ফলেই ফুল হাতে পেতে ভর কেটেছে।

    ১৯ মার্চ ’৯০ শেষ সন্ধ্যায় বাবুমশার অজিতকুমার কুণ্ডুকে যুক্তিবাদী অজিত কুণ্ডু করে নিয়েছি। লিখিত প্রতিজ্ঞাপত্রে জানিয়েছেন—আগামী বার থেকে আর বাবুমশায়ের ভূমিকা নেবেন না। প্রত্যাশা রাখি, তিনি কথা রাখবেন।

    আর একটি হিস্টিরিয়া ভরের দৃষ্টান্ত

    এবার যে ঘটনার কথা বলছি সেটা ঘটেছিল তেলাড়ী গ্রামে। তেলাড়ী, সাতগাছিয়া বিধানসভার অন্তর্গত একটি গ্রাম। খেটে খাওয়া গরিবরাই সংখ্যাধিক। শিক্ষিতের হার শতকরা কুড়ি ভাগ। গ্রামের প্রভাবশালী মণ্ডল পরিবারের উদ্যোগে প্রতি বছর একবার মহোৎসব হয়। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকেই চাল, ডাল, টাকা তোলা হয়। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই এই মহোৎসবে যোগ দেয়।

    বছর কয়েক আগে পূর্ণিমার পরের দিন মহোৎসবের অনুষ্ঠানে সহদেব পণ্ডিতের বউয়ের ভর হল। বউটি উপোস করে ঘুরে ঘুরে মাগন মেগে (ঈশ্বরের নামে ভিক্ষা চাওয়া) এসে স্নান করে ভিজে কাপড়ে গণ্ডি কাটছিলেন। দু-তিনটে গণ্ডি কটার পর উঠেই কেমন নাচতে লাগলেন। নেচে নেচে ঘুরতে ঘুরতে বলতে লাগলেন, “তোরা ঠিকমতো আমার পুজো দিসনি। তোদের পুজোয় ত্রুটি রয়েছে।”

    ধুলো-কাদা মাখা শাড়ি, খোলা লম্বা ধুলো মাখা ভেজা চুল, পাগলের মতো দৃষ্টি, অনর্গল কথা শুনে উপস্থিত প্রায় সকলেই ধরে নিলেন—সহদেবের বউয়ের ঠাকুরের ভর হয়েছে।

    মহিলাটি পুজো মণ্ডপ ঘুরছেন আর নির্দেশ দিয়ে চলেছেন কী কী করতে হবে। ব্যবস্থাপকরা প্রত্যেকেই ওঁর কথাকেই ঠাকুরের নির্দেশ ধরে নিয়ে তা পালন করতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলেন। ঠাকুরের আদেশ অমান্য করার পরিণতির কথা ভেবে তাঁদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না!

    আবার নতুন করে পুজোর আয়োজন চলতে লাগল। মহিলার আদেশে হরিনামের দল নামগান সর্বোচ্চ সুর তুলে শুরু করলেন, খোলের উপর চাঁটিও পড়তে লাগল আরও জোরে। এমন এক অসাধারণ অলৌকিক দেবমাহাত্ম্য যাঁরা দেখার সুযোগ পেলেন তাঁরা নিজের জীবন ধন্য মনে করে অনেকেই আনন্দে কেঁদে ফেললেন। ঝড়ের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মহোৎসবের চারিপাশে শুধু মানুষ, আর মানুষ। অনেকেই ধারণা ব্যক্ত করলেন, “আজকালকার ছেলে-ছোকরাদের দিয়ে কি আর আগের মতো করে ভক্তিভরে পুজো হয়? কেউবা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে হাতটাও ভালো করে না ধুয়ে পুজোর আয়োজনে লেগে পড়ল। আরে, পুজো কি তোদের ছেলেখেলা?”

    এই ধরনের একটা মানসিকতা হয় তো মহিলাটিরও ছিল। হয় তো পরম ভক্ত মহিলাটির পুজোর আয়োজনের অনেক কিছুই মনে ধরেনি। বরং বিরক্তিতে মন ভরেছে। তারই ফলে এক সময় মেয়েটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন তার উপর দিয়েই বর্ষিত হচ্ছে ঈশ্বর নির্দেশ—বাস্তবে যা ছিল একান্তভাবে তাঁরই নির্দেশ।

    চিন্তামণির ভর মানসিক অবসাদে

    হিস্টিরিয়া ছাড়া ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ রোগীরাও অনেক সময় নিজেদের মধ্যে ঈশ্বরের সত্তার প্রকাশ ঘটেছে বলে বিশ্বাস করে অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা করতে থাকেন, যা স্বাভাবিক অবস্থায় সম্ভব নয়। ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ রোগীরাও বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত এবং কুসংস্কারে ও ধর্মীয় বিশ্বাসে আচ্ছন্ন। আক্রান্তদের বেশির ভাগই মহিলা এবং বিবাহিতা। পারিবারিক জীবনে এরা অনেক সময়ই অসুখী এবং দায়িত্বভারে জর্জরিত। এবং তার দরুন মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত। বছর তিরিশ আগের ঘটনা। খড়গপুরের চিত্তামণি বাড়ি বাড়ি বাসন মাজার কাজ করত। যখনকার ঘটনা বলছি তখন চিন্তামণি তিনটি ছেলেমেয়ের মা। স্বামী রেল ওয়াগন ভেঙে মাঝে-মধ্যে যা রোজগার করে তার সিংহভাগই নেশার পিছনে শেষ করে দেয়। মাঝে-মধ্যে নানা কারণে জেলে ঘুরে আসতে হয়। চিন্তামণির শ্বশুর-শাশুড়ি স্বামীর উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য চিত্তামণিকেই দোষ দেয়। স্বামী মাঝে-মধ্যে নেশার টাকার জন্য চিন্তামণিকে প্রচণ্ড প্রহার করে। এক সময় স্বামী কয়েক মাস জেলের লপসি খেয়ে ফিরে এসে চিত্তামণির চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে কয়েকটা দিন ওর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে অকথ্য অত্যাচার চালাল। একদিন রাতে হঠাৎ স্বামীর তর্জন-গর্জন শুরু হতেই চিন্তামণি ততোধিক গর্জন করে তার স্বামীকে আদেশ করল, সাষ্টাঙ্গে তাকে প্রণাম করতে। আদেশ শুনে স্বামী তাকে প্রহার করতে যেতেই চিন্তামণি পাগলের মতো মাথা দোলাতে দোলাতে দিগম্বরী হয়ে স্বামীর দুগালে প্রচণ্ড কয়েকটি চড় কষিয়ে বলল, “জানিস আমি কে? আমি মা-কালী।”

    চিন্তামণির এই ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ রোগ অনেকের চোখেই ছিল নেহাতই ঈশ্বরের লীলা। রেলওয়ে হাসপাতালের জনৈক চিকিৎসক চিত্তামণির স্বামীকে বলেছিলেন, অসুস্থ চিত্তামণির চিকিৎসা করাতে। বুঝিয়েছিলেন এটা একটা পাগলামো ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু চিন্তামণির স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই চিকিৎসকের সাহায্য নিতে রাজি হয়নি। রাজি না হওয়ার একটা অর্থনৈতিক কারণও বোধহয় ছিল। ভক্তদের কাছ থেকে রোজগারপাতি খুব একটা কম হচ্ছিল না।

    স্কিটজোফ্রিনিয়া রোগীদের মধ্যে ভর জিনিসটা অনেক সময় দেখা দেয়। স্কিটজোফ্রিনিয়া রোগীরা অতি আবেগপ্রবণ, তা সে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যে শ্রেণির হোক না কেন। এই আবেগপ্রবণ মনে ঈশ্বর বিশ্বাস অনেক সময় এমনই প্রভাব ফেলে যে রোগী মনে করতে থাকেন ঈশ্বর বোধহয় তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। স্কিটজোফ্রিনিয়া এই ধরনের ভুল দেখায় বা ভুল শোনায়। এই ভুল থেকেই তাঁরা নিজের সত্তার মধ্যে ঈশ্বরের সত্তাকে অনুভব করেন।

    আমাদের দেশে ভরে পাওয়া রোগীর চেয়ে ভরের অভিনয় করা অবতারদের সংখ্যা অনেক বেশি। এইসব অবতার মাতাজি বাবাজিদের বেশির ভাগই হিস্টিরিয়া, ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ বা স্কিজোফ্রেনিয়া রোগের শিকার নয়। এরা মানুষের অজ্ঞতার ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পকেট কাটে। সোজা কথায় এরা রোগী নয়, এরা অপরাধী প্রতারক।

    মা মনসার ভর

    দমদম জংশনের কাছে নিমাই হাজরার বাড়িতে মনসার থান। সেখানে ফি হপ্তার মঙ্গলবার নিমাইয়ের বিবাহিতা বোন লক্ষ্মী ময়রার ভর হয়। ভর করেন মা মনসা। ভিড় নেই-নেই করেও কম হয় না। ৭০ থেকে ১০০ ভক্তকে নানা সমস্যার বিধান দেন মা মনসা। ভর দুপুরে ভর লাগে। শেষ ভক্তটি বিদায় নিতে ঘণ্টা তিনেক সময় কেটে যায়।

    আমাদেরই এক প্রতিবেশীর কাছে শুনেছিলাম লক্ষ্মীর অতিপ্রাকৃতিক সব ক্ষমতার কথা। তিনি বললেন, লক্ষ্মীকে দেখার আগে বিশ্বাসই করতেন না, ঈশ্বর সর্বত্রগামী, তাঁর অজ্ঞাত কিছুই নেই। ভরে লক্ষ্মী এমন সব কথা বলেছে, যেগুলো সর্বত্রগামী ঈশ্বর ছাড়া কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। শুনলাম প্রতিবেশী স্বপ্নাদেশে মা মনসার ঘট পেতেছেন। ২৪ মার্চ ’৯০-এ লক্ষ্মীমা ওঁর বাড়িতে পায়ের ধুলো দেবেন। দুপুরে গেলাম। লক্ষ্মীমা তখনও ভরে বসেননি। আলাপ করিয়ে দিলেন প্রতিবেশী। পাতলা, শ্যামা তন্বী। একমাথা বব করা চুলে আজ তেল ছোঁয়ানো হয়নি। ডাগর দুটি চোখ। কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম ফুলঝুরিতে আগুন দিয়েছি। অনেক অনেক অলৌকিক ঘটনার কাহিনি শোনালেন। শুনলাম, স্বামী রিকশা চালান। পুজোর সঙ্গী হিসেবে ভাই দেবাশিসও এসেছিলেন। বি কম পাশ। টিউশনি করে সামান্য রোজগার। লিখি শুনে তিনিও আমাকে শোনাতে লাগলেন দিদি ও মনসাকে ঘিরে অদ্ভুত সব ঘটনার বিবরণ। লক্ষ্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, “মা মনসাকে দেখছেন?”

    লক্ষ্মীর জড়তাহীন উত্তর, “বহুবার।”

    আমি: কেমনভাবে দেখেছেন, একেবারে স্পষ্ট

    লক্ষ্মী: নিশ্চয়।

    আমি: দেখতে কেমন?

    লক্ষ্মী: দারুণ সুন্দরী। এক মাথা চুল প্রায় পায়ের হাঁটু ছুঁয়েছে।

    আমি: ফিগার কেমন? দেখলে বয়স কেমন মনে হয়?

    লক্ষ্মী: একেবারে সিনেমার হিরোইনের মত। দেখলে মাল করবেন সদ্য যুবতী। উনি যখনই আসেন, তখন অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ সারা বাড়ি ছড়িয়ে থাকে। প্রতিবেশীর উচ্চ-শিক্ষিতা স্ত্রী জানালেন, তিনিও মায়ের শরীরের অদ্ভুত গন্ধ পেয়েছেন।

    এক সময় পুজো শুরু হল। পুজোর সময় লাগে খুবই কম। ইতিমধ্যে বহু ভক্ত মানুষই হাজির করলেন পেন, ডটপেন। এগুলো দিয়ে লিখলে নাকি কৃতকার্যতা অনিবার্য, দেবাশিস জানালেন।

    তৃতীয় ও শেষবার পুষ্পাঞ্জলি দিয়েই লক্ষ্মীমা শরীরে বার কয়েক দুলুনি দিয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়লেন মেঝেতে। তারপর কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলেন, সঙ্গে দুহাতে চুল ধরে টানাটানি।

    শিক্ষিত-শিক্ষিতা ভক্তেরা লক্ষ্মীমাকে না ছুঁয়েই গদগদ ভক্তিতে প্রণাম জানাতে শুরু করলেন। কাঁসার ঘণ্টা, শাঁখ উলু বেজে চলল, সেই সঙ্গে ভক্তরা জোড় হাত করে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন, “মা তুমি শান্ত হও মা, মা তুমি শান্ত হও।”

    যা এক সময় শান্ত হলেন। উপুড় হয়ে পড়ে রইলেন। গৃহকর্ত্রী পরম ভক্তিভরে মাকে নানা সমস্যার কথা বলছিলেন। উত্তরণের উপায় হিসেবে মা মনসা ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছিলেন, কখনও পুজোর ফুল ছুড়ে দিয়ে সঙ্গে রাখতে বললেন, কখনও দিলেন ঘটের জল পানের বিধান, কখনও বা অদেখা মানুষটির রোগ মুক্ত করতে বিষহরি মা মনসা হঠাৎ হঠাৎ মাথা তুলে বড় বড় পাগল পাগল চোখ তাকিয়ে তিন বার ফুঁ দিয়ে ঝেড়ে দিলেন।

    এক সময় আমাকে প্রশ্ন করতে বললেন গৃহকর্ত্রী। মা মনসার পাশে বসলাম। আমার সম্বন্ধে লক্ষ্মীমা এবং দেবাশিস কেউই বোধহয় কিছু জানতেন না। হাতে গ্রহরত্নের রুপোয় বাঁধানো আংটি, গলায় ঝোলানো একটা তাবিজ দেখে সন্দেহের ঊর্ধ্বেই রেখেছিলেন। এটা-সেটা জিজ্ঞেস করার পর বললাম, “আমার ছোট বোনের গলায় ক্যানসার ধরা পড়েছে। চিকিৎসা চলছে। ভালো হবে মা?”

    বহু ভক্ত কলরোল তুললেন, “বোনের নাম বলুন।”

    বললাম, “রঞ্জিতা রুদ্র।”

    মা মনসা বললেন, “ভালো হবে না। এই বৈশাখের আগেই মারা যাবে।”

    আরও কিছু কথা-বার্তার পর ফিরে এসেছিলাম।

    সে-রাতেই প্রতিবেশী আমার ফ্ল্যাটে এসেছিলেন। আমার বোনের ক্যানসারের কথা লক্ষ্মীমা কেমন অদ্ভুত রকম বলে দিলেন, সেই প্রসঙ্গ প্রতিবেশী উত্থাপন করতে জানালাম, “বোন রঞ্জিতা বহাল তবিয়তেই আছে ক্যানসার তো হয়নি। বৈশাখে গিয়ে দেখেও আসতে পারেন। এতদিন মা লক্ষ্মীর কথা শুধু শুনেছিলাম। ওর ভরের মহিমা পরীক্ষা করতেই মিথ্যে বলেছিলাম। আপনারা শিক্ষিত হয়েও এত আবেগতাড়িত হয়ে ঠকতে চান কেন বলুন তো?”

    ঈশ্বরের ভরজানি না আমার কথাগুলো উনি কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন।

    মীরা সাঁই

    মহারাষ্ট্রের কোকন জেলায় মীরার আদি নিবাস। আঠারোটি বসন্ত অতিক্রম করার আগেই মীরা ভালোবেসে বিয়ে করেন মেহেমুদকে। মেহেমুদ যখন শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন, তখন মীরা ছ-মেয়ের মা। মীরা এই সময় শিরডি-র সাঁই-এর ভক্ত হয়ে ওঠেন। সাঁই ভক্তদের সঙ্গে গড়ে ওঠে পরিচয় ও সম্পর্ক। সাঁই ভক্তদের সামনেই একদিন মীরার ভর হয়। ভরে মীরা জানান, তিনি শিরডির সাঁই। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই মীরার ওপর সাঁইয়ের ভর হতে থাকে। দ্রুত ভক্ত সমাগমও বাড়তে থাকে। ভক্তরাই মীরার নতুন নাম রাখেন মীরা সাঁই, মীরা ভক্তদের পান করতে দিতেন মন্ত্র পড়া পবিত্র জল। মীরা বেশ কয়েকবার ভক্তসহ পদযাত্রায় তীর্থভ্রমণ করলেন, মীরা সাঁইয়ের খ্যাতি একটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, একটি সেবা সংস্থা তাঁকে দিল দু-একর জমি ও একটি বাংলো।

    এই সময় মীরা বিয়ে করেন চন্দ্রকান্তকে। চন্দ্রকান্ত মীরা সাঁইয়ের নামে করে দিলেন তাঁর নাসিকের কারখানা। চন্দ্রকান্ত ও মীরার নতুন আবাস হয় ৫৫ আরামনগর কাকেরী কমপ্লেক্সে। মীরার ভর ও ভক্ত সমাগম বাড়তেই থাকে।

    এই সময় নরেশ মাগনামী ডি এম নগর থানায় এফ আই আর করেন, মীরা সাঁই তাঁর স্ত্রী পুনমকে প্রতারণা করে আড়াই লক্ষ টাকার গয়না আত্মসাৎ করেছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে থানা একটি মামলা রুজু করে। পুলিশ কেসের তদন্তের দায়িত্ব এসে পড়ে সাব-ইন্সপেক্টর রাজা সম্ভের উপর। সম্ভের নেতৃত্বে পুলিশ প্রথমেই মীরা সাঁইয়ের কাকোরী কমপ্লেক্সের বাড়িতে হানা দেন। বাড়িতে মীরা ছিলেন না, ছিলেন তাঁর দুই মেয়ে। বাড়ি সার্চ করার সময় ঠাকুরঘরে একটি মাঝারি আকারের তালাবন্ধ বাক্স খেতে পান। মেয়েরা জানান, বাক্সের চাবি মায়ের কাছে আছে। মা আছেন শিরডির কোপর গাঁও-এর বাড়িতে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সামনে তালা ভাঙা হয়। বাক্সে ছিল দু-লক্ষ টাকার মতো গয়না। বাক্সে একটি কাগজে ‘উষা’ লেখা ছিল, তলায় ঠিকানা।

    বাক্স নিয়ে পুলিশ বাহিনী থানায় ফেরে। কাগজের ঠিকানায় পুলিশ পাঠানো হয়। পুলিশ সেখানে ঊষা নামের এক বিবাহিত মহিলার খোঁজ পেয়ে তাঁকে থানায় আনে।

    থানার জেরার জবাবে তিনি জানান, আমার স্বামী মদ ও জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন। স্বভাবতই তাঁর খরচের বহরও দিন দিন বেড়েই চলেছিল। আমি মীরা সাঁই-এর কথা শুনে তাঁর কাছে হাজির হই এবং তার উপর সাঁইয়ের ভর দেখে বাস্তবিকই ভক্তি আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে মীরা সাঁইয়ের শরণাপন্ন হই। মীরা সাঁই আমাদের গয়নাগুলো আমার স্বামীর হাত থেকে বাঁচাতে সেগুলো তাঁর কাছে রাখতে বলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে মীরা সাঁইয়ের কাছে গয়নাগুলো ফেরত চাইলে তিনি প্রতিবারই নানা বাহানা বানিয়ে আমাকে ঘুরিয়েছেন। আজ পর্যন্ত সে গয়না আর ফিরিয়ে দেননি, ফিরে পাব এ আশাও ছেড়েছি।

    থানায় কেন অভিযোগ করেননি, গয়নার মূল্য কত হবে বলে উষার ধারণা, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরে উষা জানান, তাঁর হাতে লিখিত কোনও প্রমাণ না থাকায় তিনি মীরা সাঁইয়ের মতো প্রচণ্ড প্রভাবশালিনী মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে গিয়ে আরও বেশি বিপদে জড়িয়ে পড়তে চাননি। গয়নার আনুমানিক মূল্য ছিল দু থেকে আড়াই লাখ টাকা। কিছু কিছু গয়নার খুঁটিনাটি বিবরণ ও উষা দেন। বিবরণ মিলে যাওয়ায় উষাকে বাক্সের গয়নাগুলো দেখানো হয়। তিনি জানান এগুলোই মীরা সাঁইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

    মীরা সাঁইয়ের দুই মেয়েকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে থাকে। পুলিশবাহিনী সেদিনই রওনা হন কোপ গাঁও-এ। ভোর রাতে মীরা সাঁইকে গ্রেপ্তার করা হয়। থানায় নিয়ে এলে মীরা সাঁই জেরার উত্তরে কোনও কথা বলতে অস্বীকার করেন। ১০ জানুয়ারি ’৮৬ পুলিশ মীরা সাঁইকে আন্ধেরীর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করেন, এবং তাঁর অপরাধ স্বীকার কাছে জানান পুনমের আত্মসাৎ করা গয়না রয়েছে তাঁর মেয়ে জামাই ফতিমা ও বুলু শেখের কাছে। পুলিশ ফতিমা ও বুল্লুর হেফাজত থেকে পুনমের গয়না উদ্ধার করেন।

    তারা মা-র ভর

    ২২/১, রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডে তারা কুটিরে প্রতি শনি, মঙ্গলবার অসংখ্য মানুষের ভিড় হয়। ভক্তেরা আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। কেউ আসেন সমস্যার সমাধানের আশায়। এখানে শনি-মঙ্গলে বিজলী চক্রবর্তীর ওপর মা তারার ভয় হয়, অর্থাৎ সহজ-সরল অর্থে ঈশ্বর তারা মা ভক্তদের আর্জি মতো প্রশ্নের উত্তর, সমাধানের উপায় বাতলান মিডিয়াম বিজলী চক্রবর্তীর মাধ্যমে।

    ৩০-৩৫ বছর আগে স্বপ্নে তারা মূর্তি দেখেন বিজলী। এই সময় থেকে ভরের শুরু। প্রথম ভরের সময় পাড়ার ছেলেরাই ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার পরীক্ষা করে অবাক হন। সব কিছুই স্বাভাবিক। বিজলী দেবীর দাবি মতো ডাক্তার রোগ সারাতে তাঁর অক্ষমতা জানান। কোনও ওষুধ প্রেসক্রাইব না করেই বিদায় নেন। এর কিছুদিন পর দ্বিতীয় ভর সন্ধের সময় তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে গিয়ে, সেই সময় মা তারা নাকি বিজলীর মুখ দিয়ে জানান তাঁর ঘট স্থাপন করে পুজো দিতে। তারপর থেকে ঘট স্থাপন ও পুজো! মন্দিরে মারের যে মূর্তিটি আছে বিজলীর ভগ্নিপতিই তা তৈরি করান স্বপ্নে দেখা মূর্তির অনুকরণে।

    বিজলী তারা মা নামেই বেশি পরিচিতা। তিনি যে সব ওষুধ দেন বা যাঁদের ঝেড়ে দেন, তাঁদের অনেকেই নাকি রোগমুক্ত হয়েছেন। তারামার কথায়: দৈব ওষুধ-টষুধের আমি কিছুই জানি না। আমার অলৌকিক কোনও ক্ষমতাই নেই। যা করেন, যা ক্ষমতা সবই মা তারার।

    অসুখ-বিসুখে অনেকে ঝাড়াতে যান। ভরে তারা মা ঝেড়েও দেন। কয়েক বছর আগে আমি তাঁরই এক ভক্ত শিষ্যের সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলাম। অতি স্পষ্টভাবেই জেনে ফিরেছিলাম, ‘তারা মা’র সত্যি-মিথ্যা বোঝার সামান্যতম ক্ষমতাও নেই।

    দুপুর থেকে সন্ধে তারাপীঠ ছেড়ে ‘মা’ নেমে আসেন নমিতা মাকাল-এর শরীরে

    নাওভাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে শান্তিনগর ইস্টার্ন বাইপাসে ভাঙড়ের একটি অতি সাধারণ ঘরে থাকেন নমিতা মাকাল। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় ছবি সহ তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার সময় ভালোই যাচ্ছে। ভক্তেরা প্রণামী দিচ্ছেন টাকা-পয়সা, শাড়ি, কাপড়, এটা-ওটা। শহরতলির এই এলাকাটি কিছুদিন আগেও ছিল হতশ্রী। এখন কিছুটা রং ফিরেছে।

    নমিতার বয়স বছর তিরিশ। বিয়ে বছর পনেরো আগে। স্বামী ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার। দ্বিতীয় সন্তান হবার এক বছর বাদে বাড়িতে প্রথম কালীপুজো হলো নমিতারই একান্ত আগ্রহে। মূর্তি বিসর্জনের সময় এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। নমিতার দাবি—কেউই মায়ের মূর্তি তুলতে পারেনি। সকলে বললেন, মা যখন যেতে চান না, এখানেই থাকুন। সেই থেকে এখানেই মা আছেন। মায়ের মন্দিরও তৈরি হয়েছে বছর ছয়েক হল।

    কালীপুজোর মাস দুয়েক পরের ঘটনা। বাড়িতে জন্ম অশৌচ চলছিল। সেদিনটি ছিল মঙ্গলবার। নমিতার ফোন এসেছেন বাড়িতে। তাকেই ঠাকুরের কাছে সন্ধ্যাদীপ দিতে পাঠান নমিতা। বোন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ফিরে আসেন। বলেন, ঘরে কে যেন আছেন মনে হলো, সারা শরীরের লোম আমার খাড়া হয়ে উঠল সেই অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে। আমি প্রদীপ জ্বালতে পারব না। অশৌচ থাকা সত্ত্বেও নমিতাই গেলেন। প্রদীপ জ্বালতেই কী যে হয়েছিল, নমিতার জানা নেই। পরে তিনি বাড়ির লোক ও প্রতিবেশীদের কাছে শুনলেন, মা তারা তাঁর ওপর ভর করেছিলেন। ভরে জানিয়েছেন, প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার আসবেন।

    নমিতা মাকাল
    নমিতা মাকাল

    আগে ভর হত সন্ধের সময়। এখন হয় দুপুরে। এই বিষয়ে নমিতার বক্তব্য—সন্ধের সময় তারাপীঠে মায়ের সন্ধ্যারতি হয়, তাই দুপুর ১টা ১৫ থেক সন্ধে ৬টা পর্যন্ত মা তারা আসেন নমিতার শরীরে।

    নমিতার কথা শুনে একটা নতুন তথ্য জানতে পারলাম, তারা মা ঈশ্বর হলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে একই সঙ্গে একাধিক স্থানে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। নমিতার দাবি, ভরের সময় যে কেউ যে কোনও সমস্যা নিয়ে গেলে মায়ের কৃপা হলে সমস্যার সমাধানের পথও তিনি করে দেন। যাঁরাই বিশ্বাস নিয়ে এসেছেন, তাঁরাই ফল পেয়েছেন, ডাক্তার না ডেকেও শুধুমাত্র মায়ের দয়ার জীবন পেয়েছে এমন অনেক উদাহরণও আছে।

    নমিতা মাকালকে বলেছিলাম, “আপনার কথা শুনে বুঝতেই পারছি মা শনি-মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধে থাকেন আপনার কাছে, রাতে তারাপীঠে। এবং রাতে তারাপীঠে থাকেন বলেই আপনার কাছে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। অথচ দেখুন, বেলেঘাটা থেকে এক ভদ্রলোক জ্যোতি মুখোপাধ্যায় আমাকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন—শনি-মঙ্গলবার দুপুর ১টা ১৫ থেকে ৬টা পর্যন্ত মা তারা তাঁর কাছেই থাকেন, এবং তিনি নাকি তাঁর এই কথার সপক্ষে প্রমাণও দেবেন। আপনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন, আপনি স্রেফ টাকা রোজগারের ধান্দায় লোক ঠকাতে ভরের গপ্পো ফেঁদেছেন। জ্যোতিবাবু আরও জানিয়েছেন, আপনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে তিনি প্রমাণ করে দেবেন আপনি একজন প্রতারক। জ্যোতিবাবু এই বক্তব্য জানিয়েই আপনার বিষয়ে যে পত্রিকা প্রচার করেছে, তাদের কাছেও একটি চিঠি দিয়েছেন। আমি একটি বিজ্ঞান সংস্থার সম্পাদক, জ্যোতিবাবু চান, আমি আপনাদের দুজনের দাবির বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ে জানাই কার দাবি যথার্থ। আপনি কী আমাদের পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে সহাযোগিতা করবেন?”

    নমিতা-র সহজ-সরল বক্তব্য, “আ মোলো যা, ওই লোকটার কুঠ হবে, কুঠ হবে গো! ভাত দেওয়ার মুরদ নেই কিল মারার গোঁসাই!”

    না, নমিতা আমাদের সঙ্গে কোনও সহযোগিতা করতে রাজি হন না! এবার একটা গোপন খবর ফাঁস করছি, জ্যোতি মুখোপাধ্যায় শ্বাস-প্রশ্বাসে, ঘুমে-নির্ঘুমে যুক্তিবাদী, আমাদের সমিতির অতি সক্রিয় এক আটান্ন বছরের কিশোর, চ্যালেঞ্জটা রেখেছিলেন নমিতা মাকালকে ‘মাকাল’ প্রমাণ করতে।

    একই অঙ্গে সোম-শুক্কুর ‘বাবা’ ও ‘মা’য়ের ভর

    নদীয়া জেলার মদনপুর স্টেশনে নেমে সগুণা গ্রাম, সে গ্রামের গৌরী মণ্ডলের ওপর ভোলাবাবা ও সন্তোষী মা-র অপার কৃপা। সোম-শুক্কুর পালা করে তাঁরা গৌরীর ওপর ভর করেন। গৌরী আঠাশ-তিরিশের সুঠাম যুবতী। ভরে পড়লে নাকি যে কোনও প্রশ্নের নিখুঁত উত্তর দেন। বাতলে দেন নানা সমস্যার সমাধানের উপায়। হপ্তার ওই দুটি দিন গৌরী মা-র থানে বেজায় ভিড় হয় বলে লাইন ঠিক রাখতে স্বেচ্ছাসেবক, স্বেচ্ছাসেবিকারা দর্শনার্থীদের নম্বর লেখা টিকিট ধরিয়ে দেয়।

    ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির মদনপুর শাখার দুই সদস্য অসীম হালদার এবং সুবীর রায় শাখা সম্পাদক চিররঞ্জন পালের কথামত হাজির হলেন গৌরী মা-র পানে। গৌরী মা-র ছোট বোন সন্ধ্যা অসীম ও সুবীরের হাতে নম্বর লেখা টিকিট ধরিয়ে দিলেন। বাঁশের বেড়ার দেওয়াল ও টালির চাদের নিচে বসেন গৌরী মা। ধীরে ধীরে লাইন এগোচ্ছিল। সুবীরের ঢোকার সুযোগ যখন এলো, পিছনে তখনও বিরাট লাইন। এক স্বেচ্ছাসেবিকা জানালেন, জুতো খুলে পা ধুয়ে ঢুকুন। ভিতরে ঢুকতেই আবার স্বেচ্ছাসেবিকা। তিনি বললেন, “ষোলো আনা দক্ষিণা নামিয়ে রেখে প্রণাম করে বলুন—বাবা আমি এসেছি।”

    আজ সোমবার ২০ অক্টোবর ’৯০। অতএব বাবার ভর লেগেছে গৌরীর ওপর। সুবীর পরম ভক্তের মতোই নির্দেশ পালন করলেন। চোখ বোলালেন ঘরের চারপাশে। একটা বড় সিংহাসনে অনেক দেব-দেবীর মূর্তি। কিন্তু যে বস্তুটি বিশেষ করে নজর কাড়ল, সে হলো একটা বিশাল উই ঢিবি। ঢিবিটা কিসের প্রতীক কে জানে? তবে নজর টানে।

    গৌরী মা, একটু ভুল হল, আজ তিনি বাবা, সামনে পিছনে দোল খাচ্ছিলেন। খোলা ছড়ানো চুলগুলো একবার নেমে আসছিল সামনের দিকে, ঢেকে যাচ্ছিল মুখ। আর একবার চলে যাচ্ছিল পিছনে। ‘বাবা’র পাশে বসে এক প্রৌঢ়া।

    প্রৌঢ়া বললেন, “বাবা প্রশ্ন করলে উত্তর দিও। উত্তর দিলে সায় দিও।”

    সুবীর মাথা নাড়ালেন। বাবা মাথা নাড়তে নাড়তেই জিজ্ঞেস করলেন, “কার জন্যে এসেছিস?”

    “আমার আর দাদার জন্যে।” “তোর মন স্থির নেই। কোনও কাজে মন দিতে পারিস না। নানা দিক থেকে বাধা বিপত্তি হাজির হচ্ছে। তোর কাজ হতে দিচ্ছে না।”

    সুবীর প্রৌঢ়ার নির্দেশমতো প্রতি কথায় সায় দিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে যেতে লাগলেন। ‘বাবা’ সামান্য সময়ের জন্য কথা বলা থামলেন। তারপর বললেন, “তোর সমস্যা মিটিয়ে দেব, খুশি করে দেব। তুইও আমাকে খুশি করবি তো?”

    —“নিশ্চয়ই করব বাবা।”

    —“তুচ্ছ করবি না তো?”

    —“না, না।”

    —“আমার আদেশ মানবি?”

    —“নিশ্চয়ই মানব।”

    —“আগামী সোমবার একটা জবা ফুল আর একটা বোতল নিয়ে আসিস। ফুলটা পড়ে দেব। ওটাকে রোজ সন্ধ্যায় ধূপ আর বাতি দিবি, ভক্তি ভরে পুজো করবি। কাউকে নোংরা কাপড়ে ছুঁতে দিবি না। ঘটে জল পড়ে দেব রোজ সন্ধ্যায় কুল পুজো সেরে একটু করে খাবি। যা এবার।”

    —“কিন্তু বাবা, আমার আসল সমস্যার কথাই তো কিছু বললেন না।”

    —“সেটা আবার কী?”

    —“পেটে প্রায়ই ব্যথা হয়…..”

    সুবীরের কথা শেষ হবার আগেই স্বর্গ থেকে গৌরীতে নেমে আসা ভোলাবাবা বলতে শুরু করলেন, “তোর অম্বলের রোগ আছে। গলা বুক জ্বালা করে, প্যাটে ব্যথা হয়, খিঁচ ধরে। যখন ব্যথা ওঠে সহ্য করতে পারিস না।”

    সায় দেন সুবীর—“হ্যাঁ। কিন্তু কী করলে সারবে?”

    —“আরে জল পড়াটা সে জন্যেই তো দিয়েছি। অসুখ তো তোর আসল সমস্যা নয়, আসল সমস্যা তোর মন নিয়ে, কাজে বাধা নিয়ে। যা, এবার আয়।”

    —“আমার দাদার বিষয়ে কিছু বললেন না?”

    —“তোর দাদার বুকে যন্ত্রণা হয়, গা-হাত-পায়ে ব্যথা, বুক জ্বালা করে, প্যাটে ব্যথা হয়। তোর দাদাও ফুল পুজো করবে, ধুপ আর বাতি জ্বেলে। পুজো সেরে জল পড়া খাবে।”

    —“কিন্তু দাদাকে ফুল-জল দেব কেমন করে?”

    —“কেন, বাড়ি এলে দিবি?”

    —“ওখানেই তো সমস্যা। দাদা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে, কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কি না, কিছুই জানি না।”

    —“চিন্তা করিস না। ওই ফুলের অপার ক্ষমতা। ফুলই তোর দাদাকে এনে দেবে।”

    —“কবে?”

    —“তাড়াতাড়ি।”

    —“তাড়াতাড়ি মানে দু মাসও হতে পারে, আবার দশ বছরও হতে পারে? ঠিক কবে নাগাদ আসবে?”

    —“ছ-মাস থেকে এক বছরের মধ্যে।”

    সুবীর বেরিয়ে আসতেই গৌরীর বোন সন্ধ্যা বললেন, “আপনি আমাকে আগে বলবেন তো—দাদা নিখোঁজ। সমস্ত উত্তর পাইরে দিতাম। মনে হয় ওকে কেউ ওষুধ করেছে।”

    ইতিমধ্যে আরও কিছু ভক্ত ঘিরে ধরল। তারপর অনেক প্রশ্ন—“আপনার দাদা বুঝি নিখোঁজ?” “বাবা বলে দিয়েছেন কবে আপনার দাদা ফিরবে?” “মনে হয় আপনাদের বাড়িতে কেউ ওষুধ পুঁতেছে।”

    সন্ধ্যা ভক্তদের বোঝাতে লাগলেন, “বাবার কাছে অজানা তো কিছু নেই, তাই ওঁকে দাদা নিখোঁজ হওয়ার কথা বলে দিয়েছেন। কবে ফিরবে, তাও। তবে নিয়ম পালন করতে হবে নিষ্ঠার সঙ্গে।”

    সন্ধ্যার কথায় আরো অনেক ভক্ত উৎসাহী হলেন। এঁদের অনেকেই হয় তো গৌরী-সন্ধ্যাদের এজেণ্ট, কেউ বে-ফাস কিছু বলে গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করলে নেবার জন্য মজুত রয়েছেন। সুবীর তাই ওখানেই সোচ্চার হতে পারলেন না—নিজের পেটে ব্যথার গল্পোটা বাবা-মা-র ভরের পরীক্ষা নিতেই বলানো। আর দাদার নিখোঁজ হওয়াটা? নিজেই বড় ছেলে। দাদা কই, যে নিখোঁজ হবে?

    আমাদের সমিতির শাখা ও সহযোগী সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভরের জালিয়াতি ধরেছে কাজল ভট্টাচার্যর নেতৃত্বে আমাদের সমিতির ময়নাগুড়ি শাখা—১৯টি। তারপরই অমিত নন্দীর নেতৃত্বে আমাদের চুঁচড়ো শাখা ৩টি। শশাঙ্ক বৈরাগ্যর নেতৃত্বে কৃষ্ণনগরের ‘বিবর্তন’—৩টি।

    ঈশ্বরে ভর নিয়ে আমাদের সমিতির বিভিন্ন শাখা ও সহযোগী সংস্থা কম করে একশো-র ওপর (আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির হিসেব বাদ দিয়ে) শীতলা, মনসা, কালী, তারা, বগলা, তারকভোলা, পাঁচুঠাকুর, বনবিবি, ওলাইচণ্ডী, জ্বরাসুর, পীর গোরাচাঁদ, ওলাবিবি ইত্যাদি দেবতার ভরের দাবিদারদের ওপর অনুসন্ধান চালিয়েছেন। সমস্ত তথ্য পর্যালোচনা করে এবং অনুসন্ধানকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সঙ্গে সহমত হয়েছি—এঁরা কেউই মানসিক রোগী নন। ভর এদের ভড়ং। অর্থ উপার্জনের সহজতর পন্থা। এঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের শক্তি বা ক্ষমতা বিষয়ে অতি সচেতন। ভরের রোগী হলে সচেতনতা বোধ দ্বারা কখনওই তাঁরা পরিচালিত হতে পারতেন না।

    ঈশ্বরে ভর

    একশোর ওপর এই ভরে পাওয়া বাবাজি-মাতাজির বিষয়ে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখতে পাচ্ছি—এঁরা প্রত্যেকেই রোগমুক্তি ঘটাতে পারেন বলে দাবি রাখেন। ভরে পাওয়া অবস্থায় এঁরা বিভিন্ন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেন, বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় বাতলে দেন বলেও দাবি করেন। এঁরা প্রত্যেকেই ভর হওয়ার আগে নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরিব ছিলেন। ভর পরবর্তীকাল এঁদের প্রত্যেকেরই আর্থিক সঙ্গতি বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এঁরা অনেকেই ক্যানসার সারিয়েছেন, বোবাকে দিয়ে কথা বলিয়েছেন, অন্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে দাবি রেখেছেন। এইসব দাবিদারদের প্রতিটি দাবির ক্ষেত্রেই অনুসন্ধানকারীরা অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছেন, ওই নাম-ঠিকানার কোনও মানুষের বাস্তব অস্তিত্বই নেই বা ছিল না। আবার কোন কোনও ক্ষেত্রে সেইসব মানুষদের হদিশ পাওয়া গেলেও তাঁরা বাস্তবিকই বোবা, বা অন্ধ ছিলেন, অথবা ক্যানসারে ভুগছিলেন— এমন কোনও তথ্যই ওইসব মানুষগুলো হাজির করতে পারেননি। বরং দেখা গেছে ওইসব মানুষগুলো হয় ভর হওয়া বাবাজি-মাতাজিদের আত্মীয় অথবা ভক্ত। ওরা যে এজেণ্ট হিসেবে প্রচারে নেমেছে, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

    শ্রদ্ধেয় পাঠকদের কাছে একটি বিনীত অনুরোধ—কারো কথায় কারো অলৌকিক ক্ষমতায় আস্থা স্থাপন না করে একটু জিজ্ঞাসু মন নিয়ে ভরের অবতারটিকে বাজিয়ে দেখুন—আপনার চোখে তার মিথ্যাচারিতা ধরা পড়বেই।

    তবু আমরা, সাধারণ মানুষরা, বিভ্রান্ত হই। আমাদের বিভ্রান্ত করা হয়। নামী দামী বহু প্রচারিত পত্র-পত্রিকায় অলৌকিকতা, জ্যোতিষ বা ভরের পক্ষে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলিই আমাদের, সাধারণ মানুষদের, বিভ্রান্ত করার হাতিয়ার।

    বহু থেকে একটি উদাহরণ হিসেবে আপনাদের সামনে হাজির করছি। ৩০ মে ’৯০ আনন্দবাজার পত্রিকায় বহুবর্ণের তিনটি ছবি সহ একটি বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশিত হল ‘পূজারিণীর শরীর বেয়ে’ শিরোনামে। আপনাদের অবগতির জন্য এখানে তুলে দিচ্ছি।

    পূজারিণীর শরীর বেয়ে দেবদেবীর ভর হয় পূজারিণীর শরীরে। সে সময় যা বলা যায় তাই মেলে। যা দাওয়াই দেওয়া হয় তাতেই রোগ নির্মূল হয়। ভর হয় কীভাবে?

    শনিবার বেলা দুটো। ঢাকুরিয়া স্টেশনের পাশে তিন-চার হাত উঁচু ছোট্ট একটি কালী মন্দির। মন্দিরের মাথায় চক্র ও ত্রিশূল। মন্দিরটির নাম ‘জয় মা রাঠের কালী।’ মন্দিরের সামনে একটি সিমেণ্টের বাঁধানো চাতান। সেই চাতাল ও পাশের মাঠে ইতস্তত ছড়ানো অনেক লোক। আর সেই দাওয়ার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে এক যুবতী, পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি এলোমেলো, চোখ দুটি রোজা, নাকের পাটা ফোলা, মুখের দুপাশে ক্ষীণ রক্তের দাগ। মহিলাটির ভর হয়েছে। কালী পুজো করতে করতে অচেতন হয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন মহিলা। মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। হঠাৎ মহিলা বলে উঠলেন, ‘স্বামীর লগে এয়েছিস কে?’ উপস্থিত জনতার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। শাঁখা-সিঁদুর মাঝবয়সী এক আধা-শহরে মহিলা ঠেলাঠেলি করে সামনে এলেন। মন্দিরে ছোট দরজার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে ‘মা’ বলে হাতজোড় করে ডাকতে লাগলেন। ‘মা’ বললেন—‘সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবে না। আমার জল পড়া খাইয়েছিস?’

    ‘খাইয়েছি যা। সারছে না মা’।

    ‘ওতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

    এরপর ‘মা’ ডেকে উঠলেন, “ব্যবসার জন্য এয়েছিস কে? বোস। আমার কাছে আয়।” শার্ট-প্যাণ্ট পরা মাঝবয়সী ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। একইভাবে—হাত জোড়। হাঁটু মুড়ে বসা। ‘মায়ের কাছে সমস্যার কথা জানালেন। মা অভয় দিলেন। ভদ্রলোক চলে গেলেন। ফের ‘মা’ ডাকলেন: ‘কোমরে পিঠে ব্যথার জন্য এয়েছিস কে? আয়, আয় সামনে আয়।’

    এক এক করে ছেলে মেয়ে বুড়ো মাঝবয়সী সবাই হাজির হতে লাগল। ‘মা, তাদের কোমরে, পিঠে পেটে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তারা এক এক করে চলে গেলে একটি যুবক এগিয়ে এল। ‘মা’ তার পেটে হাত বুলিয়ে দিলেন নাভিতে হাত রাখলেন। ‘মা’য়ের মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। মায়ের ‘ঝাড়া’র রকমই এই।

    ‘সন্তানের লগে এয়েছিস কে?’ যুবকটি চলে যেতেই ‘মা’-য়ের ডাক। শিশুকোলে এক রমণী এগিয়ে এলেন। ‘মা’ শিশুটাকে তাঁর বুকের ওপর শুইয়ে দুই হাতে সজোরে শিশুটির পিঠের ওপর চড় মারতে লাগলেন। তারপর শিশুটিকে দু হাত দিয়ে উঁচু করে তুলে ধরলেন এবং আবার চড় মারতে লাগলেন, এরপর ‘মা’ শিশুটিকে তার মা-য়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেন।

    মায়ের ভরমুক্তির সময় হয়ে এল। মহিলা, পুরুষ ঠেলাঠেলি করে এগোতে লাগলেন। নিজের নিজের সমস্যার কথা বলবেন এঁরা। মায়ের ভরমুক্তি হল। চিৎ হওয়ার অবস্থা থেকে উপুড় হয়ে শুলেন ‘মা’। কিছুক্ষণ পর উঠে বসলেন তিনি। পুজো করতে লাগলেন। মন্ত্র পড়ে, হাততালি দিয়ে দেবীর আরাধনা চলল।

    ‘মা’এক মধ্যবয়সী মহিলার হাত-পা কাঁপে। উঠে বসতে পারেন না। কথা বলতেও কষ্ট হয়। জানা গেল, তাঁর অসুখ দীর্ঘদিনের। তাঁকে ‘মা’ সামনে বসিয়ে প্রথমে মন্ত্র পড়ালেন। তারপর ওঠবস করতে বললেন। মহিলা ওঠবস করতে পারছিলেন না। তাঁকে জল পড়া খাওয়ানো হল। মহিলা উঠে বসলেন। এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের পিঠ ও কোমরের ব্যথা এবং এক মহিলার গ্যাসট্রিকের বেদনার একইভাবে উপশম করলেন ‘মা’। পরিচয় হল বিক্রয়ভূষণ গুহর সঙ্গে। তিনি ন্যাশনাল হেরাল্ডের সঙ্গে যুক্ত। তিন-চার বছর আগে তাঁর স্ত্রীর হাঁপানি সেরে যাওয়ার পর থেকে তিনি ‘মা’য়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। এখন ‘মা’য়ের কাছে আসেন নিয়মিত। কোনও উদ্দেশ্য নয়, শুধু ‘মা’-য়ের টানে আসেন।

    মহিলার নাম প্রতিমা চক্রবর্তী। স্বামী রেলে কাজ করেন। ছেলে একটিই। বয়স, বারো তেরো। স্বাস্থ্য মাঝারি, চোখগুলি কোটরে বসা, গভীর। চেহারার গড়ন মজবুত হলেও কোথাও একটা ক্লান্তির ছাপ আছে। মাঝে মাঝে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। কাজ করতে পারেন না। ‘মা’য়ের দয়াতেই তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।

    যাদবপুর পলিটেকনিকের ঠিক পেছনে শীতলাবাড়িতেও ভর হয়। এখানে একটি নেপালি পরিবার থাকে। যাদবপুর পলিটেকনিকের পিওনের কাজ করতেন ভদ্রলোক। সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। তাঁর স্ত্রীর ভর হয় প্রতি শনিবার। ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের কোটায়, গায়ের রঙ কালো হলেও চেহারায় বেশ একটি সুশ্রী আছে। মুখের গড়নটি ভারি সুন্দর। ছেলে, নাতি-নাতনী নিয়ে তিরিশ বছরের পরিপূর্ণ সংসার। ৬৫ সালে দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা। যাদবপুর পলিটেকনিকের কর্মী হিসেবে পলিটেকনিকের পিছনেই থাকার জায়গাটা পেয়েছিলেন তাঁরা। ১৯৭০ সালে নকশাল আন্দোলনের সময় দিল্লি থেকে আসা ১৬০০ পুলিশ ইউনিভার্সিটির চত্বরেই বাস করতে থাকে। তারা চাঁদা তুলে ‘মা’য়ের জন্য পাকা দালান তৈরি করে দেয়। এখন সেই দালানে প্রতি শনিবার ভক্ত সমাগম ঘটে। যে যার সমস্যা নিয়ে আসে। পুজো শুরু করার কিছুক্ষণ পরই ‘মা’য়ের ভর হয়। তখন সবাই প্রশ্ন করতে শুরু করে এবং ‘মা’ প্রশ্নের উত্তর দেন। সব মিলে যায়। একটি বোবা মেয়েকে সারিয়ে তুলেছেন ‘মা’। মায়ের দেওয়া জলপড়ায় উপশম ঘটেছে একটি সুন্দরী নববধূর জটিল ব্যাধির, একটি শিশুর কঠিন অসুখ।

    সাবর্ণী দাশগুপ্ত, ছবি শুভজিৎ পাল
    সাবর্ণী দাশগুপ্ত, ছবি শুভজিৎ পাল

    কলকাতার বাইরে আন্দুলের সরু রাস্তা দিয়ে মেরা একটি পুকুরের পিছনে বহুদিন থেকে একটি বাড়িতে পাশাপাশি রয়েছে লক্ষ্মী-নারায়ণ, রাধা-কৃষ্ণ ও কালী। বাংলা ১৩৭১ সালে মূর্তি প্রতিষ্ঠা। তার আগে একটি ছোট্ট বেড়া দেওয়া ঘরে পুজো হত। তখনই ‘মা’-এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এখানে ওখানে।

    মন্দিরে যিনি পুজো করেন, তাঁর বয়স ষাটের কোঠায়। শীর্ণকায়। বিধবা, কিছুদিন হল স্বামী-বিয়োগ হয়েছে। ভক্তদের দেওয়া অর্থেই সংসার চলে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার পূজোয় বসার পর ‘মা’য়ের ভর হয়। তখন ‘মা’-কে প্রশ্ন করা যায়, ‘মা’ তার উত্তর দেন। প্রশ্ন করার জন্য কুড়ি পয়সা দক্ষিণা। পুজোয় বসার কিছুক্ষণ পর মায়ের মাথা দুলতে থাকে। কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মাথার দোলাও ক্রমশ বাড়তে থাকে। তারপর একসময় ‘মা’য়ের হাত থেকে ফুল খসে পড়ে, ঘণ্টা স্থলিত হয়। ‘মা’ আচ্ছন্ন হয়ে যান। ভর হয়। ভক্তরা তখন প্রশ্ন করতে শুরু করেন। ‘মা’ আচ্ছন্ন অবস্থায় উত্তর দিয়ে থাকেন।

    ‘মা’এবং উত্তর মিলেও যায়। রোগভোগ সেরে যায়। মানুষগুলির ভিড় তাই বাড়ে।

    প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আমার ও আমাদের সমিতির কাছে প্রশ্ন হাজির করেছিলেন, এই বিষয়ে আমাদের মতামত কী? আমরা কি তুড়ি দিয়েই প্রতিবেদকের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিতে চাই? আমরা কি ঈশ্বরের ভরে পাওয়া ওইসব পূজারিণীদের মুখোমুখি হব? আমার বন্ধু আকাশবাণী কলকাতার অধিকর্তা ডঃ মলয়বিকাশ পাহাড়ীও জানতে চেয়েছিলেন, ভরে পাওয়া মানুষগুলোর বাস্তবিকই রোগীদের সারাচ্ছেন কি? সারালে কীভাবে সারাচ্ছেন? উত্তর কি সত্যি মেলে? মিললে তার পিছনে যুক্তি কী? এ জাতীয় প্রশ্ন শুধু ডঃ পাহাড়ীকে নয়, বহু মানুষকেই দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছিল।

    যথারীতি উত্তর দিয়েছিলাম। ৩ জুলাই, ’৯০ আনন্দবাজারে আমাদের সমিতির একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। চিঠিটি এখানে তুলে দিচ্ছি।

    পূজারিণীর শরীরে দেবতার ভর?

    সাবর্ণী দাশগুপ্তের ‘পূজারিণীর শরীর বেয়ে’ প্রতিবেদটি (৩০ মে) পড়ে অবাক হয়ে গেছি। লেখাটি পড়ে বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ রয়েছে যে, সাবর্ণী দাশগুপ্ত ‘ভর’ হওয়ার বিজ্ঞানসম্মত কারণগুলি বিষয়ে অবহিত নন এবং উনি ভরগ্রস্তদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন। অবশ্য তিনি তাঁর লেখার সত্যতা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকেন তবে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এ বিষয়ে সত্যানুসন্ধানে মুক্ত মনে তাঁর সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করছে। সাবর্ণীর হাতে তুলে দেব কয়েকজন ব্যক্তি যাঁরা ভরগ্রস্তদের কাছে প্রশ্ন রাখবেন। তুলে দেব পাঁচজন রোগী। ভর লাগা পূজারিণীরা রোগীদের রোগ মুক্ত করতে পারলে এবং প্রশ্নকর্তাদের প্রশ্নে সঠিক উত্তর পেলে আমরা সাবর্ণীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব এবং আমরা অলৌকিকতা-বিরোধী ও কুসংস্কার বিরোধী কাজকর্ম থেকে বিরত থাকব।

    শারীর-বিজ্ঞানের মতানুসারে ‘ভর’ কখনও মানসিক রোগ, কখনও স্রেফ অভিনয়। ভরলাগা মানুষগুলো হিস্টিরিয়া, ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ, স্কিটসোফ্রিনিয়া—ইত্যাদি রোগের শিকার মাত্র। এইসব উপসর্গকেই ভুল করা হয় ভূত বা দেবতার ভরের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। সাধারণভাবে যে সব মানুষ শিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত, পরিবেশগত ভাবে প্রগতির আলো থেকে বঞ্চিত, আবেগপ্রবণ, যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা সীমিত তাঁদেরমস্তিষ্ককোষের সহনশীলতাও কম। তাঁরা এক নাগাড়ে একই কথা শুনলে বা ভাবলে অনেক সময় মস্তিষ্কের কার্যকলাপে বিশৃঙ্খলা ঘটে। দৈবশক্তির বা ভূতে বিশ্বাসের ফলে অনেক সময় রোগী ভাবতে থাকে, তাঁর শরীরে দেবতার বা ভূতের আবির্ভাব হয়েছে। ফলে রোগী দেবতার বা ভূতের প্রতিভূ হিসেবে অদ্ভুত সব আচরণ করতে থাকেন। অনেক সময় পারিবারিক জীবনে অসুখী, দায়িত্বভারে জর্জরিত ও মানসিক অবসাদগ্রস্ততা থেকেও ‘ভর’ রোগ হয়। স্কিটসোফ্রিনিয়া রোগীরা হন অতি আবেগপ্রবণ, তা সে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত যে শ্রেণিরই হোন না কেন। এই আবেগপ্রবণতা থেকেই রোগীরা অনেকসময় বিশ্বাস করে বসেন তাঁর উপর দেবতা ভূত ভর করেছে।

    তবে ‘ভর’ নিয়ে যারা ব্যবসা চালায় তারা সাধারণভাবে মানসিক রোগী নয়; প্রতারক মাত্র।

    ভর-লাগা মানুষদের জলপড়া, তেলপড়ায় কেউ কেউ রোগমুক্তও হন বটে, কিন্তু যাঁরা রোগমুক্ত হন তাঁদের আরোগ্যের পিছনে ভর-লাগা মানুষের কোনও অলৌকিক ক্ষমতা সামান্যতমও কাজ করে না, কাজ করে ভর লাগা মানুষদের প্রতি রোগীদের অন্ধবিশ্বাস। রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিশ্বাসবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। হাড়ে, বুকে বা মাথায় ব্যথা, বুক ধড়ফড়, পেটের গোলমাল, গ্যাসট্রিকের অসুখ, ব্লাডপ্রেসার, কাশি, ব্রাঙ্কাইল অ্যাজমা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে রোগীর বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে ওষুধ-মূল্যহীন ক্যাপসুল, ইঞ্জেকশন বা ট্যাবলেট প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই ভালো ফল পাওয়া যায়। একে বলে ‘প্ল্যাসিবো’ চিকিৎসা পদ্ধতি।

    ‘যা বলা যায় তাই মেলে’-এক্ষেত্রে কৃতিত্ব কিন্তু ভর-লাগা মানুষটির নয়; তাঁর খবর সংগ্রহকারী এজেণ্টদের।

    প্রবীর ঘোষ।
    সাধারণ সম্পাদক,
    ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি,
    কলিকাতা – ৭৪।

    না, সাবর্ণী দাশগুপ্ত বা ভরে পাওয়া পূজারিণীদের কেউ আজ পর্যন্ত আমার বা আমাদের সমিতির সঙ্গে সহযোগিতা বা সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। কারণটি শ্রদ্ধেয় পাঠকরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়
    Next Article অলৌকিক নয়, লৌকিক – ১ (প্রথম খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ

    Related Articles

    প্রবীর ঘোষ

    অলৌকিক নয়, লৌকিক – 8র্থ খণ্ড – (জাতিস্মর, আত্মা, অধ্যাত্মবাদ) – প্রবীর ঘোষ

    September 20, 2025
    প্রবীর ঘোষ

    আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না – প্রবীর ঘোষ

    September 20, 2025
    প্রবীর ঘোষ

    অলৌকিক নয়, লৌকিক – ১ (প্রথম খণ্ড) – প্রবীর ঘোষ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.