Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অশনি সংকেত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প150 Mins Read0
    ⤷

    অশনি সংকেত – ১

    ১

    নদীর ঘাটে তালগাছের গুঁড়ি দিয়ে ধাপ তৈরী করা হয়েছে। দুটি স্ত্রীলোক স্নানরতা। একটি স্ত্রীলোক অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী। ত্রিশের সামান্য কিছু নিচে হয়তো হবে। অপরটি প্রৌঢ়া।

    প্রৌঢ়া বললে—ও বামুন-দিদি, ওঠো—কুমীর এয়েচে নদীতে—

    অপরা বধূটির উঠবার ইচ্ছে নেই জল থেকে এত তাড়াতাড়ি, সে কোনো জবাব না দিয়ে গলাজলে দাঁড়িয়ে রইল।

    —বামুন-দিদিকে নিয়ে আর কক্ষনো যদি নাইতে আসি!

    —রাগ কোরো না পুঁটির মা—সত্যি বলচি জলে নামলে আমার আর ইচ্ছে করে না যে উঠি—

    —কেন বামুন-দিদি?

    —যে গাঁয়ে আগে ছিলাম সেখানে কি জলকষ্ট! সে যদি তুমি দেখতে! একটা বিল ছিল, তার জল যেত শুকিয়ে, জষ্টি মাসে এক বালতি জলে নাওয়া, অথচ তার নাম ছিল পদ্মবিল—

    বধূটি হি হি করে হেসে ঘাড় দুলিয়ে বললে—পদ্মবিল! দ্যাখো তো কি মজা পুঁটির মা? চত্তির মাসে জল যায় শুকিয়ে, নাম পদ্মবিল—

    এই সময় একটি কিশোরী জলের ঘাটে নামতে নামতে বললে—অনঙ্গ-দিদি, তোমার বাড়ীতে কলু তেল দিতে এসে দাঁড়িয়ে আছে—শিগগির যাও, আমায় বলছিল, আমি বললাম ঘাটে যাচ্চি—ডেকে দেবো এখন—

    অনঙ্গ-বৌয়ের হাসি তখনও থামে নি। সে বললে—তোর বৌদিদির কাছে গল্প করছি পদ্মবিলের—জল থাকে না চত্তির মাসে—নাম পদ্মবিল—

    মেয়েটি বললে—সে কোথায় অনঙ্গ-দি?

    —সেই যেখানে আগে ছিলাম—সেই গাঁয়ে—

    —সে কোথায়?

    —ভাতছালা বলে গাঁ, অম্বিকপুরের কাছে—

    —তোমার শ্বশুরবাড়ী বুঝি?

    —না। আমার শ্বশুরবাড়ী হরিহরপুর, নদে জেলা। সেখানে বড্ড চলা-চলতির কষ্ট দেখে সেখান থেকে বেরুলাম তো এলাম ওই পদ্মবিলের গাঁয়ে—

    —তারপর?

    —তারপর সেখান থেকে এখানে।

    অনঙ্গ জল থেকে উঠে বাড়ী চলে গেল।

    গ্রামখানিতে এরাই একমাত্র ব্রাহ্মণ-পরিবার, আর সবাই কাপালী ও গোয়ালা। নদীর ধারে এ গ্রাম বেশিদিনের নয়। বরিসহাট অঞ্চলের চাষী, জমি নোনা লেগে নষ্ট হওয়াতে সেখান থেকে আজ বারো-তেরো বছর আগে কাপালীরা উঠে এসে নদীতীরের এই অনাবাদী পতিত জমি সস্তায় বন্দোবস্ত করে নিয়ে গ্রামখানা বসিয়েছিল। তাই এখনও এর নাম নতুন গাঁ, কেউ কেউ বলে চর পোলতার নতুন পাড়া।

    অনঙ্গদের বাড়ী গোয়ালপাড়ার প্রান্তে, দুখানা মেটে ঘর। খড়ের ছাউনি একখানা দোচালা রান্নাঘর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উঠানের ধারে ধারে পেঁপে ও মানকচু গাছ। চালে দিশি কুমড়োর লতা দেওয়া হয়েছে কঞ্চি দিয়ে, রান্নাঘরের পাশে গোটাকতক বেগুন গাছ, ঢেঁড়স গাছ।

    অনঙ্গ এসে দেখল বদ্যিনাথ কলু বড় একটা ভাঁড়ে প্রায় আড়াই সের খাঁটি সর্ষে-তেল এনেচে। তেল মাপা হয়ে গেলে বদ্যিনাথ বললে—মা-ঠাকরুণ, আজ আর সর্ষে দেবেন নাকি?

    —উনি বাড়ী এলে পাঠিয়ে দেবো। এখন এই তেলে এক মাস চলে যাবে—

    —আর পয়সা ছ’টা?

    —কেন খোল তো নিয়েচ, আবার পয়সা কেন?

    —ছটা পয়সা দিতে হবে সর্ষে ভাঙানির মজুরি। খোলের আর কত দাম মা-ঠাকরুণ! তাতে আমাদের পেট চলে?

    —আচ্ছা উনি বাড়ী এলে পাঠিয়ে দেবো।

    অনঙ্গ-বৌয়ের দুটি ছেলে। বড়টির বয়েস এগারো বছর, তার ডাকনাম পটল। ছোটটি আট বছরের। তাকে এখনও খোকা বলেই ডাকা হয়। পটল খুব সংসারী ছেলে—এসব তরিতরকারীর ক্ষেত সে-ই করেচে বাড়ীতে। এখন সে উঠোনের একপাশে বসে বেড়া বাঁধবার জন্যে বাঁশের বাখারি চাঁচছিল। ওর মা বললে—পটলা ওসব রাখ, এত বেলা হল, দুধ দেয়নি কেন দেখে আয় তো?

    পটল বাখারি চাঁচতে চাঁচতেই বললে—আমি পারবো না।

    —পারবি নে তো কে যাবে? আমি যাবো দুধ আনতে সেই কেষ্টদাসের বাড়ী?

    —আহা, ভারি তো বেলা হয়েছে, এখন বেড়াটা বেঁধে নিই, একটু পরে দুধ এনে দেবো—

    —না এখুনি যা।

    —তোমার পায়ে পড়ি মা। বাবা বাড়ী এলে আর বেড়া বাঁধতে পারবো না। এই দ্যাখো ছাগল এসে আজ বেগুন গাছ খেয়ে গিয়েচে।

    খোকা এসে বললে—মা, আমি দুধ আনবো? দাদা বেড়া বাঁধুক—

    অনঙ্গ সে কথা গায়ে না মেখে বললে—খোকা, গাছ থেকে দুটো কাঁচা ঝাললঙ্কা তোল, তোদের মুড়ি মেখে দি—

    খোকা জেদের সুরে বললে—আমি দুধ আনবো না মা?

    —না।

    —কেন, আমি পারি নে?

    —তোকে বিশ্বাস নেই—ফেলে দিলেই গেল!

    —তুমি দিয়ে দ্যাখো। না পারি, কাল থেকে আর দিও না।

    —কাল থেকে তো দেবো না, আজকের দু’সের দুধ তো বালির চড়ায় গড়াগড়ি যাক! তোর সর্দারি করবার দরকার কি বাপু? দুটো কাঁচাঝাল তুলতে বললাম, তাই তোল।

    এমন সময়ে পটলের বাবা গঙ্গাচরণ চক্কত্তি বাড়ী ঢুকে বললে—কোথায় গেলে—এই মাছটা ধরো, দীনু তীওর দিলে, বললে সাত-আটটা মাছ পেয়েছি—এটা ব্রাহ্মণের সেবায় লাগুক। বেশ বড় মাছটা—না? এই পটলা, পড়া গেল, শুনো গেল, ও কি হচ্ছে সকালবেলা?

    পটল মৃদু প্রতিবাদের নাকিসুরে বললে—সকালবেলা বুঝি? এখন তো দুপুর হয়ে এল—

    —না, তা হোক, ব্রাহ্মণের ছেলে, বাঁশ-কঞ্চি নিয়ে থাকে না রাতদিন!

    —ছাগল যে বেগুন গাছ খেয়ে যাচ্ছে?

    —যাক গে খেয়ে। উঠে আয় ওখান থেকে। ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে কী কাপালীর ছেলের মত দা-কুড়ুল হাতে থাকবি দিনরাত?

    অনঙ্গ বললে—কেন ছেলেটার পেছনে অমন করে লাগছ গা? বেড়া বাঁধছে বাঁধুক না, ছুটির দিন তো!

    গঙ্গাচরণ চক্কত্তি বললে—না, ওসব শিক্ষে ভালো না। ব্রাহ্মণের ছেলে, ও রকম কি ভালো?

    পটল নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বেড়া বাঁধা রেখে উঠে এল।

    অনঙ্গ স্বামীকে বললে—ওগো, একবার হরিহরের হাটে যাও না।

    —কেন?

    —একবার দেখে এসো নতুন গুড় উঠলো কিনা।

    —সে তুমি ভেবো না, আমায় গুড় কিনতে হবে না। এখান থেকেই পাওয়া যাবে। সবাই ভক্তি করে।

    বাইরে থেকে কে ডাকলে—চক্কত্তি মশায়, বাড়ী আছেন?

    গঙ্গাচরণ বললে—কে রামলাল? দাঁড়াও—

    আগন্তুক ম্যালেরিয়া রোগী, তার চেহারা দেখেই বোঝা যায়। গঙ্গাচরণ বাড়ীর বাইরে আসতেই সে নিজের ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে বললে—একবার হাতখানা দেখুন তো?

    গঙ্গাচরণ বললে—কে রামলাল? দাঁড়াও—

    আগন্তুক ম্যালেরিয়া রোগী, তার চেহারা দেখেই বোঝা যায়। গঙ্গাচরণ বাড়ীর বাইরে আসতেই সে নিজের ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে বললে—একবার হাতখানা দেখুন তো?

    গঙ্গাচরণ ধীরভাবে বললে—অমন করে হাত দেখে না। বসো, ঠাণ্ডা হও। হেঁটে এসেচ, নাড়ী চঞ্চল হবে যে! বাপু এ কোদাল কোপানো নয়! এসব ডাক্তার-বদ্যির কাজ, বড্ড ঠাণ্ডা মাথায় করতে হয়। কাল কেমন ছিলে?

    —রাত্রিতে জ্বর-জ্বর ভাব, শরীর যেন ভারী পাথর—

    —কি খেয়েছিলে?

    —দুটো ভাত খেয়েছিলাম চক্কত্তি মশাই, আর কি খাবো বলুন, তা ভাত মুখে ভালো লাগলো না।

    —যা ভেবেছি তাই। ভাত খেলে কি বলে? জ্বর সারবে কি করে?

    —আর খাবো না।

    —সে তো বুঝলাম—যা খেয়ে ফেলেচ, তার ঠ্যালা এখন সামলাবে কে? বোসো, দুটো বড়ি নিয়ে যাও—শিউলিপাতার রস আর মধু দিয়ে খেও, দ্যাখো কেমন থাকো—

    ওষুধ নিয়ে রামলাল চলে যাচ্ছিল, গঙ্গাচরণ ডেকে বললে—ওহে রামলাল, ভালো কথা, এবার নতুন সর্ষে হয়েছে ক্ষেতে? দুকাঠা পাঠিয়ে দিও তো। আমি বাজারের তেল খাইনে বাপু, সর্ষে দিয়ে কলুবাড়ি থেকে ভাঙিয়ে নিই।

    —যে আজ্ঞে। আমার ছেলে ও-বেলা দিয়ে যাবে’খন। তেমন সর্ষে এবার হয় নি চক্কত্তি মশাই। বিষ্টি হওয়াতে সর্ষে গাছে পোকা ধরে গেল কার্তিক মাসে।

    রামলালকে বিদায় দিয়ে গঙ্গাচরণ সগর্বে স্ত্রীর কাছে বলল—দেখলে তো? যাকে যা বলবো, না বলুক দিকি কেউ? সে জো নেই কারো!

    স্বামীগর্বে অনঙ্গ-বৌয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে আদরের সুরে বললে—এখন নেয়ে নাও দিকি? বেলা তেতপ্পরে হয়েচে। সেই কখন বেরিয়েচ—দুটো ছোলা-গুড় মুখে দিয়ে নাও—এখুনি তো তোমার ছাত্তরের দল আসতে শুরু করবে! তেল দিই—

    নদীতে স্নান সেরে এসে জলখাবার অর্থাৎ ছোলাভিজে ও এক টুকরো আখের পাটালি খেতে খেতে গঙ্গাচরণের মুখ তৃপ্তিতে ভরে উঠলো। অনঙ্গ জিজ্ঞাসা করলে—হ্যাঁগা, পাঠশালা খোলার কথা কিছু হল বিশ্বেস মশায়ের সঙ্গে?

    —সব হয়ে যাবে। ওঁরা নিজেরা ঘর বেঁধে দেবেন বললেন,—

    —ছেলে হবে কি রকম?

    —দুটো গাঁয়ের ছেলেমেয়ে পাচ্চি—তাছাড়া প্রাইবিট পড়ার ছাত্তর তো আছেই হাতে। এ দিগরে লেখাপড়া জানা লোক কোথায় পাবে ওরা? সকলের এখন চেষ্টা দাঁড়িয়েচে যাতে আমি থাকি।

    —সে তো ভালোই। উড়ে উড়ে বেড়িয়ে কি করবে—এখানেই থাকা যাক। আমার বড্ড পছন্দ হয়েচে। কোনো জিনিসের অভাব নেই। মুখের কথা খসতে যা দেরি—

    —রও, সব দিক থেকে বেঁধে ফেলতে হবে ব্যাটাদের। চাষা গাঁ, জিনিস বলো, পত্তর বলো, ডাল বলো, মুলো বেগুন বলো—কোনো জিনিসের অভাব হবে না। এ গাঁয়ে পুরুত নেই, ওরা বলচে, চক্কত্তি মশাই, আমাদের লক্ষ্মীপুজো, মনসা পুজোটাও কেন আপনি করুন না?

    —সে বাপু আমার মত নেই।

    —কেন—কেন?

    —কাপালীদের পুরুতগিরি করবে? শুদ্দুর-যাজক বামুন হলে লোকে বলবে কি?

    —কে টের পাচ্ছে বলো? এ অজ পাড়াগাঁয়ে কে দেখতে আসচে—তুমিও যেমন!

    —কিন্তু ঠাকুরপুজো জানো? না জেনে পুজো-আচ্চা করা—ওসব কাঁচাখেকো দেবতা, বড্ড ভয় হয়। ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করা—

    —অত ভয় করলে সংসার করা চলে না। পাঁজিতে আজকাল ষষ্ঠীপুজো মাকালপুজো সব লেখা থাকে—দেখে নিলেই হবে।

    —তুমি যা বোঝো—

    —কোনো ভয় নেই বৌ—তুমি দেখে নিও, এ ব্যাটাদের সব দিক থেকে বেঁধে ফেললে কোনো ভাবনা হবে না আমাদের সংসারে।

    অনঙ্গও তা জানে। স্বামীর ক্ষমতা সম্বন্ধে তার অসীম বিশ্বাস। কিন্তু কথা তা নয়—এক জায়গায় টিকে থাকতে পারলে সব হতে পারে, কিন্তু স্বামীর মন উড়ু-উড়ু, কোনো গাঁয়ে এক বছরের বেশি তো টিকে থাকতে দেখা গেল না। বাসুদেবপুরই বা মন্দ ছিল কি? একটু সুবিধে হয়ে উঠতে না উঠতে উনি অমনি বললেন—চলো বৌ, এখানে আর মন টিকচে না।

    অমন করে উড়ে উড়ে বেড়ালে কি কখনো সংসারে উন্নতি হয়? তবে একথা ঠিক, বাসুদেবপুরে শুধু পাঠশালায় ছেলে পড়ানোতে মাসে আট-দশ টাকা আয় হত। আর এখানে জিনিসপত্র পাওয়া যায় কত! উন্নতি হয় তো এখান থেকেই হবে। উনি যদি মন বসিয়ে থাকেন তবে সবই হতে পারে সে জানে।

    একটু পরে চার-পাঁচটি ছোট ছোট ছেলে শ্লেট বই নিয়ে দড়িবাঁধা দোয়াত ঝুলিয়ে গঙ্গাচরণের কাছে পড়তে এল।

    গঙ্গাচরণ বললে, আমি এই খেয়ে উঠলাম, একটু শুয়ে নিই—তোরা পুরোনো পড়া দ্যাখ ততক্ষণ। ওরে নসু, তোদের বাড়ীতে বেগুন হয়েছে?

    একটি ছোট ছেলে বললে—হ্যাঁ গুরুমশায়—

    গঙ্গাচরণ ধমক দিয়ে বললে—গুরুমশায় কি রে? সার বলবি। শিখিয়ে দিইচি না? বল—

    ছেলেটি ভয়ে ভয়ে বললে—হ্যাঁ সার—

    —যা গিয়ে বসে লিখগে—বেগুন নিয়ে আসবি কাল, বুঝলি?

    —আনবো সার।

    ছেলে ক’টি দাওয়ায় বসে এমন চীৎকার জুড়ে দিলে যে তাদের ত্রি-সীমানায় কারো নিদ্রা বা বিশ্রাম সম্পূর্ণ অসম্ভব। অনঙ্গ স্বামীকে বললে—ওগো তোমার ছাত্তরেরা যে কানের পোকা বের করে দিলে! ওদের একটু থামিয়ে দাও!

    গঙ্গাচরণ হেঁকে বললে—এই! পড়া থাক এখন, সবাই শটকে কড়াংকে লিখে রাখ শেলেটে। আমি ঘুমিয়ে উঠে দেখবো।

    তারপর স্ত্রীকে খুশির সুরে বললে—ছটা হয়েচে, আরও সাত-আটটা কাল আসছে পুবপাড়া থেকে। ভীম ঘোষ বলছিল, বাবাঠাকুর, আমাদের পাড়ার সব ছেলে আপনার কাছে পাঠাবো। নেতা কাপালীর কাছে পড়লে যদি ছেলে মানুষ হত, তা হলে আর ভাবনা ছিল না। ব্রাহ্মণ হল সমাজের সব কাজের গুরুমশায়। কথায় বলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত!

    গঙ্গাচরণ মন দিয়ে ছেলে পড়ায় বটে। ঘুম থেকে উঠে সে ছেলেদের নিয়ে অনেকক্ষণ ব্যস্ত রইল—কাউকে নামতা পড়ায়, কাউকে ইংরেজী ফার্স্ট বুক পড়ায়—ফাঁকিবাজ গুরুমশায় কেউ তাকে বলতে পারবে না। বেলা বেশ পড়ে গেলে সে ছাত্রদের ছুটি দিয়ে লাঠি নিয়ে বাইরে বেরুবার উদ্যোগ করতে অনঙ্গ এসে বললে, ওগো কিছু খেয়ে যাবে না—আজ দু’বাড়ী থেকে দুধ পাঠিয়ে দিয়েছিল, একটু ক্ষীর করেচি…

    বৈকালিক জলযোগ অনেকদিন অদৃষ্টে ঘটে নি।

    নানা অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে আজ তিনটি বছর কাটচে স্বামী-স্ত্রীর। সুতরাং স্ত্রীর কথা গঙ্গাচরণের কানে একটু নতুন শোনালো।

    স্ত্রীকে বললে—ছেলেদের দিয়েচ?

    —সে ভাবনা তো তোমায় করতে হবে না, তুমি খেয়ে নাও—

    খেতে খেতে পরম তৃপ্তির সঙ্গে সে স্ত্রীকে বললে—এখানে আছি ভালোই, কি বল?

    অন্য বৌয়ের মুখে সমর্থনসূচক মৃদু হাসি দেখা দিল, সে কোনো উত্তর করল না। লক্ষ্মীর কৃপা যদি হয়ই, মুখে তা নিয়ে বড়াই করতে নেই। তাতে লক্ষ্মী রাগ করেন।

    গঙ্গাচরণ খানিকটা ক্ষীরসুদ্ধ বাটি স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললে—এই নাও—

    —ও কি! না না—সবটা খেয়ে ফেল—

    —তুমি এটুকু—

    —আমার জন্যে আছে গো আছে, সে ভাবনা তোমায় করতে হবে না—

    —তা হোক। আর খাবো না—এবার বিশ্বেস মশায়ের বাড়ী যাই। পাকাপাকি করে আসি।

    —বেশি দেরি কোরো না—এখানে নাকি বুনো শুয়োর বেরোয় সন্দের পর। আমার বড্ড ভয় করে বাপু—

    .

    গঙ্গাচরণ ছায়া-ভরা বিকেলে মাঠের রাস্তা বেয়ে গন্তব্যস্থানে যেতে যেতে কল্পনাচক্ষে তার ভবিষ্যৎ গৃহস্থালীর ছবি আঁকছিল। বেশ লাগে ভাবতে। এই সব মাঠে ভালো চাষের জমি পাওয়া যায়, যদি কিছু জমি তাড়ংগাড়ার বাঁড়ুয্যে জমিদারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নেওয়ার যোগাযোগ ঘটে, যদি বিশ্বাস মশায়কে বলে-কয়ে একখানা লাঙল করা যায়, তবে ভাত-কাপড়ের ভাবনা দূর হবে সংসারের।

    অনেকদিন থেকে সে-জিনিসের ভাবনাটা চলে আসচে।

    হয়তো ভগবান ঠিক জায়গাতেই নিয়ে এসে ফেলেচেন এতদিনে।

    বিশ্বাস মশায়ও যথেষ্ট আগ্রহ দেখালেন গঙ্গাচরণকে এ-গ্রামে বসাবার জন্যে। বললেন—আপনারা আমাদের মাথার মণি—আমি আপনাকে সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।

    —একটা পাঠশালার বন্দোবস্ত আপনি করে দিন—

    —সব হয়ে যাবে—আপাতত যাতে আপনার চলে তার ব্যবস্থা করতে হবে তো? বাড়ীতে খেতে ক’জন?

    —আমার স্ত্রী ও দুটি ছেলে—

    বিশ্বাস মশায় মনে মনে হিসেব করে বললেন—ধরুন মাসে দশ আড়ি ধান—পনেরো কাঠা চাল হলে আপনার মাস চলে যাবে—কি বলেন?

    —হ্যাঁ, তাই ধরুন—

    —আর সংসারের ডালডুল, তেল-নুনও হয়ে যাবে। পুরুতগিরিটাও ধরুন—

    —সে তো ঠিক করেই রেখেচি—সংস্কৃত জিনিসটা কষ্ট করে শিখতে হয়েচে—ও বড় শক্ত জিনিস, সকলের মুখ দিয়ে কি বেরোয়? এই শুনুন তবে—ধ্যায়ন্নিত্যং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং—ইয়ে পরশুমৃগবরা ভীতিহন্তা—ইয়ে রত্নকল্পজ্বলাং—

    —বাঃ, বাঃ—

    —এটা কি বলুন তো?

    —কি করে জানবো বলুন—আমরা হচ্ছি চাষীবাসী গেরস্ত, আংক আস্ক পর্যন্ত আমাদের বিদ্যে। আর শিশুবোধক—পড়েচেন শিশুবোধক?

    পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল

    কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল—

    দেখুন কদ্দিন আগে পড়েচি, ভুলি নি। সব মনে আছে।

    গঙ্গাচরণ উৎসাহের সঙ্গে ঘাড় নেড়ে বললে—বেশ—বেশ—

    বিশ্বাস মশায় হৃষ্টমনে বললেন—বাবা মারা গেলেন অল্প বয়সে। সংসারে দুটি নাবালক ভাই—জমিজমা যা ছিল এক জ্ঞাতি খুড়ো সব নিজের বলে লিখিয়ে নিলে জরিপের সময়—

    —সে কোথায়?

    —চিত্রাঙ্গপুর, ডাবতলীর কাছে। ডাবতলীর গরুর হাট ও-দিগরে নামকরা। অত বড় গরুর হাট এ জেলায় নেই।

    —সেখান থেকে বুঝি এখানে এলেন?

    —হ্যাঁ, দেখলাম ও গাঁয়ে আর সুবিধে হবে না। মনে মনে বললাম, মন, পৈতৃক ভিটের মায়া ছাড়। এখানে কি না খেয়ে মরবো? আমি আর বিষ্টু সা—বিষ্টু সা আমার ছেলেবেলাকার বন্ধু। আমার সঙ্গে গাঁ ছেড়ে যেতে রাজী হল। তখন খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম দু’জনে। এ বলে এখানে জমি সস্তা, ও বলে ওখানে জমি সস্তা। কিন্তু মশায় জমি পাওয়াই যায় না। সস্তা তো কোথাও দেখলাম না। পঞ্চাশ টাকার কমে কোথাও জমি নেই—

    —ধানের জমি—

    বিশ্বাস মশায়ের অন্দরমহলে এই সময় শাঁকে ফুঁ পড়লো, গঙ্গাচরণ ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে বললে—ও, সন্দে হয়ে গেল—আমি এবার যাই—এবার সন্দে-আহ্নিক করতে হবে কিনা?

    আসল কথা, স্ত্রীর বুনো শুয়োর সংক্রান্ত সতর্কবাণী তার মনে পড়েচে। নতুন গাঁয়ের আশেপাশে এখনও যথেষ্ট বনজঙ্গল, অন্ধকারে চলাফেরা না করাই ভালো। সাবধানের মার নেই।

    বিশ্বাস মশায় বললেন—তা বিলক্ষণ, এখানে আমার এই বাইরের ঘরেই সন্দে-আহ্নিকের জায়গা করে দিই। গঙ্গাজল আছে বাড়ীতে। আমরা জেতে কাপালী বটে, কিন্তু আমাদের বাড়ীর মেয়েরা স্নান না করে মুখে জলটুকু দেয় না—সব মাজাঘষা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ব্রাহ্মণের সন্দে-আহ্নিক হলে এ বাড়ীতে, বাড়ী আমার পবিত্র হয়ে যাবে। তারপর একটু জল মুখে দিন—

    —না না, সে সবে এখন আর দরকার নেই—যখন এখানে আছি, তখন সবই হবে—উঠি এখন—গঙ্গাচরণ খুব ব্যস্ত হয়ে উঠলো।

    বিশ্বাস মশায় বললেন—আমার গল্পটা শুনে যান। তারপর তো—

    —আচ্ছা ও আর একদিন শুনবো এখন। সন্দে-আহ্নিকের সময় হয়ে গেলে আমার আর কোনোদিকে মন থাকে না। ব্রাহ্মণের ছেলে, সংস্কৃত পড়িচি—নিত্যকর্মগুলো তো ছাড়তে পারবো না—

    গঙ্গাচরণের কণ্ঠস্বর ভক্তিতে গদগদ হয়ে উঠলো।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিপিনের সংসার – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article অভিশপ্ত

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }