অসাধারণ
(গল্প – অসাধারণ)
১
সীতানাথ ডাক্তারের দোকান বসেছিল। সকালবেলা। খবরের কাগজ এখানে আসিয়া পৌঁছ নাই—কারণ মফঃস্বল জায়গা। খবরের কাগজ না পৌঁছিলে যুক্তির আলোচনা ঠিক জমে না। অদূরবর্তী বাজারের ভাবতিক সওদা সারিয়া নবীন মুখুজ্যে, শশধর মুন্সি, কিনারাম মুখুজ্যে, মথুর মুখুজ্যে, বলাই দাঁড়িভৃ্তি ভদ্রলোক সীতানাথের ডাক্তারখানায় ফানাকের সময় পর্যায় রাজনীতি আলোচনা করিয়া থাকেন। ইঁহারা কখনো চাকুরি করেন না। দু-একজন পেনশনভোগ সরকারী কমর্চারী, এক-আধজনের বাপের পয়সা ভরপুর। ইঁহারা জামান ওজাপানের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যুক্তির পরিস্থিতি সঙ্গে এমন কথাবার্তা বলেন, যাহা হয়ং হিটলার, চার্চিল ও তোজিও অজানা। হিটলার কি ভুল করেন, চার্চিলের কি করা উচিত ছিল, জাপান এমনটা না করিয়া যদি এমনটা করিত তাহা হইলে কি ঘটােত—এ সকল মূল্যবান উপদেশ সর্বদাই সেখানে উদ্ধারিত হইতেছে।
বর্তমানে কিনারাম মুখুজ্যে বলিতেছিলেন—আরে, এই তামাকে বিল শোনা ভায়া। ভুলটা হিটলারের হল কোথায় শোনা। ডানকাকের যুক্তির পরেই—
শশধর মুন্সি বলিয়া উঠিলেন—আঃ, আপনি ঐ এক শেখে রেখেছেন ডানকাক আর ডানকাক! আসল ভুল সেখানে নয়, আসল ভুল হল—
এমন সময় একটি পুরুষের হাত ধরিয়া একজন স্ত্রীলোক ডাক্তারখানার বারান্দায় উঠিয়া আসিল স্রোতের রাস্তা হইতে। পুরুষটির বয়স চল্লিশ হইতে পঞ্চাশ-পাঁচের মধ্যে যেন কোন বয়স হইতে পারে, রোগা, পরনে খাটা ময়লা ধুতি, মেয়েটির বয়সও নিতান্ত কম নয়, তবে পুরুষটির অপেক্ষা অনেক কম, ত্রিশ-বত্রিশের বেশী হইবে না। মেয়েটির পরনে তাল-লাগানো শাড়ি, কিছুময়লা নয়—মুখে একসময় বেশ ভালই ছিল বোঝা যায়, দেহ খুব সম্ভব অনাহার ও ম্যালেরিয়ায় শীর্ণ।
মেয়েটি বারান্দার ভিতে দাঁড়াইয়া বলিল—ও ডাক্তারবাবু—
সীতানাথ ডাক্তার উহাদের দিকে একটু তাকাইয়া ভিতরে চাহিয়া বলিলেন—কি চাও?
—বাবু, এঁকে একটুখানি দেখিতে হবে।
সীতানাথ ডাক্তার বুঝিয়াছিলেন ইহাদের দ্বারা বিশেষ কোন অর্থাগমের আশা নাই—যত বড় কঠিন অসুখই হউক না কেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত চেহারা। পরনে তা ওই কাপড়। মাথা তেলাভাবে স্যাঁত। রোগীর মধ্যে গণ করিয়া উৎফুল্ল হইবার কোন কারণ নাই।
তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন—হয়েছে কি?
মেয়েটি বলিল—হবে আর কি, ওঁর জ্বর ছাড়ে না আজ দুমাস। তার ওপর ম্যালেরিয়া। শরীর একেবারে ভেঙে দিয়েছে। আমার উনি ছাড়া আর কেউ নই। আপনি দয়া করিয়া দেখুন।—বলিয়া মেয়েটি ভয়ে কাঁদিয়া ফেলিল।
সীতানাথ ডাক্তার বলিলেন—সের এয়সা এদিকে—
পরে রোগী পরীক্ষা করিয়া বলিলেন—হুঁ, দেখব কি, এর মধ্যে অনেক রোগ। কিসে এমন হয়েছে?
পুরুষটি এবার চীন্সুরে বলিল—তা বাবু অনেক দিন। আমি আজ তিন-চার মাস ভুগছি। আর এই কাশি, এ কিছুতেই যায় না—
মেয়েটি হাত তুলিয়া অধৈর্যের সুরে বলিল—তুমি চুপ করিয়া দিকিন! খুব খামখা তামার! আমার হাড় মাস জালিয়া খেল তুমি—তিন মাস ওঁর অসুখ—
তার পর আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিল—ওর কথা শুনবেন না। ওঁর কি কিছুতেই থাকে? নিজের দিকে ওঁর কোন খেয়াল নই—এই নুনুন তবে আমার কাছ—
২
কথাটা শুনাইল এমন, যেন লোকটা দাস্য কিংবা ক্রীত অথবা নৈদেশিক—সাংসারিক তুচ্ছ বিষয়ে নাভিজ্ঞই তিনি অনায়াসে। বাধ হয় ঈর্ষাভাজন হইয়াই সীতানাথ ডাক্তার পুরুষটিকে জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলেন—তোমার গিন্নী হইয়াছে কতদিন?
—তা বাবু চার-পাঁচ মাস হবে। সবার যখন…
মেয়েটি ঝাঁক দিয়া উঠিয়া বলিল, তুমি তা সব জান কি না! চুপ কর! না বাবু, দু বছর হৈল গেল। আমার হাড় মাস ভাজা ভাজা করিয়া খেল ওই মিন্সে! কি জ্বালায় যে পেড়েছি আমি, মরণ হয় তা হাড় জুড়ায় আমার!
কাহার মরণ হইলে তাহার হাড় জুড়ায়, কথার ভাব ঠিক ধরিতে পারিলাম না।
সীতানাথ ডাক্তার বলিলেন—বাড়ি কোথায়?
মেয়েটি বলিল—বাড়ি এই ঝিটিকেপাতায়। আমরা হাড়ি।
—ও! ঝিটিকেপাতায় হাড়ির বাস আছে নাকি?
—না বাবু, দেশ দেশ ভেসে বড়াই ওই ওনার নিয়ে। বিয়ে করা সায়ামী, ফলে তা পাও না! আজ দুটি বছর উনি বিছানায় পড়ে। উঠিতে হাঁটিতে পারেন না। কত অসুধ-বিষুধ করলাম আমাদের দেশ ঘের, যে যা বল তাই করি, কিছুতেই সারাতে পারলাম না, দিন দিন যেন মানুষটা উঠিতে পারে না, খেতে পারে না। তাই আজ বললাম—ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে যাই—একটু দেখুন আপনি ভাল করে, আমার আর কেউ নই। আমি এতক্ষণ বসিয়া বসিয়া দেখিতেছিলাম। এইবার বললাম—তোমার শ্বামী কি কাজ করে?
মেয়েটি ঝাঁক দিয়া বলিয়া উঠিল—কাজ! ওরে আমার কাজের শিরোমণি রে! ও করবে কাজ? সদিন পূর্বের সুয্যি পুড়িম পোন ওঠবে না?
পুরুষটি লজ্জিতভাবে বলিল—না বাবু, কাজ আমি করি না। সে ক্ষমতা নই তা করব কি? ও-ই ধান ভেনে দাইগির করে সংসার চালায়। তা এই বাজারে বড় কষ্ট হইয়াছে বাবু।
মেয়েটি বলিল, তুমি থামো বাপু, না হয় যাবে? বাবু নুনুন তবে বল। কষ্ট দুঃখের কথা ও কি জানে! সংসারের কোন খাঁজ রাখে ও?
কৃতজ্ঞতার আবেগ বোধ হয় অসংবরণীয় হইয়া উঠিল পুরুষটির। সে পুনরায় নরম সুরে বলিল—তা যা বললে ও সে কথা সত্যি বটে। ও আমাকে জানিত দায় না। নিজে সব করবে। আমি তা খাটিতে পারি না—আমার এই ডান পা একটুখোঁড়া, হাঁটিতে পারি না—এই দেখুন বাবু এই পা—
মেয়েটি আঁচল দিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল—নাও, আর বাবুদের সামনে তামায় পা বার করিতে হবে না—
কিন্তু দেখিলাম মেয়েটির চোখ ছলছল করিয়া উঠিয়াছে। এই গিন্নী-কাঁড়া খোঁড়া অকর্মণ্য বৃদ্ধের প্রতি এতটা দরদ ওর, দেখিয়া বিস্মিত হইলাম।
সীতানাথ ডাক্তার বলিলেন—তুমি ধাইয়ের কাজ জান বল না?
পুরুষটি এ-কথার উত্তর দিল। বলিল—খুব ভাল ধাই। তা যে বাড়ি যাবে, এক কাঠা করে চাল, একখানা করে কাপড়, একটু করে টাকা—ও-ই খরচ করিয়া আমায় চিকিৎসা করাবে বাবু।
মেয়েটি উহাকে থামাইয়া বলিল—তুমি চুপ কর দিকিন! তুমি কি জান ওসবের? বাবু, ধাইয়ের রাজগার আগে চলতা ভালই। এখন আপনাদের এখানে হাসপাতাল হইয়াছে পায়াতেদের জন্য। সব লোক এখানে আসে। আমাদের কাছ কড়া যাবে? ধান ভেনে যা হয়। দু মণ ধান ভানিল পাঁচ কাঠা চাল পাওয়া যায়— কিন্তু বাবু, অসুখে ভুগে ভুগে আমার গাত্র গিয়েছে, আর তেমন খাটিতে পারি না। ধান ভানা বড় খাটুনির কাজ। যে দিন ধান ভানি, আজকাল রাত্রি বড় পা কামড়ায়—
আমি বললাম—তোমার কি কি আছে আর?
মেয়েটি সাফ উত্তর দিল—যম।
—জাত হাড়ি বল না?
—হাঁ বাবু।
—ঝিটিকেপাতা থেকে এলি কি করে? স তা অনেক দূর!
—নৌকা করিয়া আসিলাম বাবু।
—ভাড়াটে নৌকা?
—অনেক কাঁদিয়া হাতে পায়ে ধরে তেরা গয়লা পয়সা ঠিক হইল। ওই আমাদের গাঁয়ের রতন মাঝি। আমি তাকে ধরম বাপ বলি ডাকি।
—ধান চাষ করা?
—না বাবু, ঘর-দার নাই তার ধানের জমি! বিচুড়ির ছাউনি একখানা ঘর, তা এবার খসে পড়েছে। না খুঁটি দিল এবার বর্ষায় সে ঘের থাকা যাবে না।
বলা হইয়াছিল। সদিন চলিয়া আসিলাম। ইহার পর হইতে ভায়ই দুদিন অন্তর মেয়েটি উহার শ্বামীর হাত ধরিয়া ডাক্তারখানায় হাজির হয়। কখনো ঔষধের দাম কমাইবার জন্য সীতানাথ ডাক্তারের হাতপায়ে পড়ে, কোনদিন শ্বামীর সঙ্গে নানারূপ ভাবে কাঁদে, কেবল রোগ সারবে, নৌকাভাড়া দিয়া আর পারে না সে—ইত্যাদি।
দেখিয়া নিয়া সীতানাথ ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করিলাম—ওকে কেমন দেখেন? ওর রোগ সারবে?
সীতানাথ ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন—বিশ্বাস তা হয় না। নানান উপসর্গ। ওর শরীর কিছুনাই—তবে চেষ্টা করছি, এই যা।
অবশ্য উহাদের সাক্ষাতে এ কথা হয় নাই।
মাসখানেক পরে একদিন ডাক্তারখানায় বসিয়া আছি, মেয়েটি আরো শীর্ণ হইয়া গিয়াছে। আর কয়দিন এমনভাবে চলিলে ইহারই চিকিৎসার প্রয়োজন হইবে। হয়ত নিজে আধপেটা খাইয়া শ্বামীর ঔষধপথ ও নৌকাভাড়া যোগাইতেছে। পরনের বস্ত্রও জীর্ণতর হইয়া উঠিয়াছে। সদিনের কাজ শেষ করিয়া তাহারা যখন চলিয়া যায় তখন মেয়েটিকে ডাকিয়া বলিলাম—শোন এদিকে!
—কি বাবু?
—ধাইয়ের কাজ করিতে পারিবে?
সে হাসিয়া বলিল—ঐ কাজই তা করি বাবু, তা আর পারব না?
আমি উহাদের সেই রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িলাম। উদ্দেশ্য আমার বাসাটা তাহাকে চিনাইয়া দেওয়া। সে মাসেই আমার বাসাতে ধাইয়ের প্রয়োজন উপস্থিত হইবে। পথে মেয়েটি বলিল—দিন না বাবু একটা কাজ জুটিয়ে। বড় কষ্ট পেড়েছি এনাকে নিয়ে। এক এক শিশু ওষুধ পাঁচ সিকে দড় টাকা। আমার রাজগার বড় মিছা হইয়া গিয়াছে। আর চলাতে পিরিচ নাই। দিন একটা জুটিয়ে, যা দেব তাই নেব। এক কাঠা চাল, একখানা কাপড়, আর না হয় আট আনা পয়সা দেব—তাই নেব। আমার খাঁই নাই বাবু অন ধাইয়ের মতে। তা বাবু আমি রাত্রি আঁতুড়ে থাকব, সাঁক তাপ করব, ছাড়া কাপড় কাচব—
অনুনয়ের সুরে বলিল—দিন একটা কাজ জুটিয়ে—
আমি বললাম—ওই আমার বাসা। আর দিনআলোকের পরে আমার বাসাতে দরকার হবে ধাইয়ের। চলো আমার সেই, দেখিয়া আসি। ওকে এখানে বসিয়ে রাখো।…পুরুষটিকে বলিলাম—তুমি এই গাছতলায় বসে থাক, বুঝলে?
বাড়িতে আসিয়া ধাইকে দেখানো হইল। কিন্তু বাড়িতে ও ধাই পছন্দ হইল না, অজুহাত অবশ্য পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত ধাই, উহাদের কি জান আছে— ইত্যাদি। কিন্তু আমার সেহ হইল, আসল কারণ মেয়েটি দেখিতে ভাল এবং আমি সেই করিয়া আনিয়াছি বলিয়া।
পরদিন আবার রাস্তায় দেখি তাহাদের সেই। ডাক্তারখানায় দুজনে বসিয়াছে।
আমাকে মেয়েটি ডাকিয়া বলিল—ও বাবু, নুনুন—
আমি তাহার কিছু না করিয়া পারিয়া লজ্জিত হইলাম। বললাম—বেলা—
—আপনার বাড়িতে হল না?
—ইয়—না—ওদের সেই কমলা ধাইয়ের কথাবার্তা আগেই হইয়া গিয়াছে কি না। তাই—
—যাগো বাবু। আপনি অন্য এক জায়গায় জুটিয়ে দিন না?
—দেখব। আর এক জায়গায় স্থান আছে আমার।
–দেখুন। ত্রিনাথ দয়া করবেন। চিরতামৃতে ভগবান বলেছেন—
হাড়ির মেয়ের মুখে এ-কথা নিয়া চমকিয়া উঠিলাম। বললাম—তুমি চিন্তামৃত পড়া? লেখাপড়া জান নাকি?
পুরুষটি বলিল—ও জানে।
—বইখানা আছে নাকি তামাদের বাড়ি?
—আছে বাবু, ও রাজ পড় আমাকে সানায়। বই পড় আর কাঁদে।
মেয়েটি সলজ্জ ভিতবাতের সুরে বলিল—তামার অত বাখান করিতে হবে না, চুপ কর। না বাবু, ওর কথা শুনবেন না। পড় একটুএকটুসেজেবলাডা। তা ও বই পড় চোখ বাজবার মতে অদ্দুর কি আমাদের আছে বাবু?
—লেখাপড়া শিখেছ কোথায়?
উহার শ্বামী বলিল—ওর মামারবাড়ি ছিল ধরমপুকুর। নেয়ারের ব্যবসা ছিল মড়। অবসাও ছিল ভাল। এখন তাদের কেউ নাই, মরে হেজ গিয়েছে—নইলে আজ এমন দুর্দশা হবে কেন ওর বাবু? ও ছেলেবেলায় মামাদের কাছে থেকে ইস্কুল নিকাপড়া করল।
—কি ইস্কুল?
বউটি ইহার উত্তর দিল, কারণ এ ভাবের উত্তর দেওয়া পুরুষটির সাধ্যাতীত। অত জটিল ভাব।
—আপার ভাইমারি ইস্কুল বাবু।
—পাস করিয়াছ?
—হুঁ। এখানে এসে পরীক্ষা দিয়া গইছিলাম।
উহার শ্বামী সসংশয় মুখে দৃঢ়েতে ঈর্ষার মুখর দিকে চাহিয়া বলিল—বাবু, ও পাস করিয়া দু টাকা ইস্কলাস পেয়ল।
বউ ধমক দিয়া উঠিল—তুমি চুপ কর দিকিন।
পুরুষটি তখন ঝাঁক সামলাইতে পারে নাই। বলিল—বাবু, আমার সেই বিয়ে হইয়া আর নিকাপড়া হল না ওর। মামারাও মরে হেজ গেল। ও যেমন মেয়ে, আমার হইয়াছে সেই যার বেল—বানের গলায় মুক্তার মালা! সব অদ্দুরের ফল আর কি! আমি ওকে খেতে দিব কি, আমি অসুখে পড় পর্যায় ওই আমার খেতে দায়। আমার এই চিকিৎসাপত্রের ওই সব চালায়। আজকাল রাজগার নাই ওর—পেটভের দুটো খেতেও পায় না— আমার বেল, তুমি সের উঠিল আমার—
বউ আবার কড়া ধমক দিয়া উঠিল—আবার! বাবুর সামনে ওই সব কথা? চলো বাড়ি তুমি—ঝাঁটা মারব তামার মুখে—তামার খুব মরাদ! মরাদের আবার বাখানা হয়—লজ্জা করে না তামার?
আমি মধ্যস্থতা করিয়া বললাম—কেন, ও তা ভালই বলেছে। ওর যা ভাল লেগেছে, ভাল বলবে না?
বউ সলজ্জ সুরে বলিল—না বাবু, যখান সখন ওসব কথা কি বলিতে বলেছে ওকে?
—তা বলুক। কোন দোষ হয়নি।
—বাবু, আমার দিন একটা কাজ জুটিয়ে—
—চেষ্টা করব। একটু অপেক্ষা কর, দেখ দু-একদিন।
—কাজ না পেলে বড় কষ্ট হবে। ধান ভানিতে শরীর আর বয় না। দু-মণ করে ধান না ভানিল এই যুক্তুর বাজারে দুটো লোকের খাওয়া হয়? তাও বাবুনুধুখাওয়া- পরা এ থেকে হয় না। একখান কাপড় ঠেকেছ। একটা আঁতুড়ের কাজ জুটিল তবু একখানা কাপড় পাব।
কয়দিন ধরিয়া তাহাদের আর দেখিলাম না। কাজও কিছু জুটাইতে পারা গেল না। কাহার বাড়িতে কি অন্তঃসত্বা আছে এ সংবাদ জোগাড় করা আমার কর্ম নয় দেখিলাম।
এই সময় মহামারী দুর্ভিক্ষ হইয়া গেল। চাউলের দাম আগুন হইয়া উঠিতেছে দিন দিন। আমাদের এই ক্ষুদ্র টাউনের আশপাশের প্রজারা হইতে দলে দলে ক্ষুধার্ত নরনারী হাঁড়ি ও মালসা হাতে ফ্যান ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতে লাগিল। ক্রমে এমন হইল ফ্যানও মিলে না। দশবিশ সের ফ্যান কোন গৃহস্থ বাড়িতে থাকে না, যাহা থাকে তাহা প্রথম মহড়াতেই ক্ষুধা-তৃষ্ণা নরনারীদের মধ্যে বিলি হইয়া যায়—একটু বেলায় যাহারা আসে, তাহাদের নুধু-হাতে ফিরিতে হয়। লোক দু-একটা করিয়া মরিতে দুর্ভিক্ষ করিল তাহাদের মধ্যে। টাউনের কুলিবাবুরা ও দাঁড়িবাবুরা প্রতিদিন একশত দেড়শত লোককে খিচুড়ি খাওয়াইতে লাগিলেন। কিন্তু অন্ধকার তৃষ্ণা অনশনকাতর দিশাহারা নরনারীদের সংখ্যার তুলনায় তাহা নিতান্তই অল্প। ইহার মধ্যে আবার ত্রিপুরা জেলা হইতে বাঙালী নরনারী আসিয়া কোথা হইতে জুটিল, তাহাদের কথা ভাল বুঝিতে পারা যায় না বলিয়া যে গৃহস্থের দোর যায়, তথা হইতে তাহারা বিতাড়িত হয়, কোথাও তাহারা তেমন সহানুভূতি পায় না।
এই মহাদুর্ভোগের হিড়িকে কত লোককে তলাইয়া যাইতে দেখিলাম। কতবার মনে ভাবিয়াছি ওই মেয়েটির কথা। ধান ভানিয়া ক্ষীণ শ্বামীর চিকিৎসা চালাইত। নৌকাভাড়া করিয়া হাত ধরিয়া লইয়া আসিত ডাক্তারখানায়। চিন্তামৃতের কথা বলিত। তাহাদের আর পিছঘাট দেখি নাই অনেকদিন। সীতানাথ ডাক্তারকে একদিন জিজ্ঞাসা করিলাম। সীতানাথ বলিলেন—না, তারা অনেকদিন আসে না। আর আসিবে কি, এই তা কলে! ওষুধের দাম দিতে পারে না—ক-শিশি ওষুধের দাম এখানে বাড়ে…
অনেকদিন উহাদের দেখি নাই। ভায় ভুলিয়াই গিয়াছি।
৩
ভদ্রমাসের দিকে আমাদের মহকুমার রিলিফ কমিটির যে লঙ্গরখানা খুলা হইল। সেখানে প্রতিদিন বাঙালী দুঃস্থ নরনারী লঙ্গরখানায় খিচুড়ি খাইতে আসিত। উহাদের মধ্যে একদিন আবার মেয়েটিকে দেখিলাম। একটা মালসায় করিয়া লঙ্গরখানার খিচুড়ি লইয়া কোথায় যাইতেছে।
আমি ডাকিয়া বললাম—তুমি কোথায় আসিয়াছ?
আমায় দেখিয়া সে লজ্জিত হইল।
বলিল—এই—
—তোমার শ্বামী কোথায়?
—ওই পুরানা ডাকঘরের পিছনে বটতলায়। আজকাল হাঁটিতে পারে না মোটে।
—চলো দেখি আসি।
কৌতূহল হইল দেখিবার জন্য, তাই গিয়াছিলাম। গিয়া মনে হইল, না, আসিলাম আমি বড় ঠিকেত হইত—কারণ যে দৃশ্য দেখিলাম, তাহা সচরাচর চোখে পড়ে না।
পুরানা পোষ্টাফিসের পিছেন যেখানে গবর্নমেণ্টের কেলরা ওয়ার্ডের ঘর, তার সামনের বটতলায় এক ছেড়া চাটাই পাতিয়া বউটির খোঁড়া শ্বামী নুইয়া আছে। মনে হইল লোকটা চাটাইয়ের সঙ্গে মিশিয়া আছে, এত ক্ষীণ। মেয়েটি তার পাশে বসিয়া লঙ্গরখানার খিচুড়ি তাহাকে খাওয়াইতেছে। দুপুরবেলা, রোদ দিয়া অনেক লোক যাতায়াত করিতেছে, কেহ চাহিয়া দেখিতেছে, কেহ দেখিতেছে না। খাওয়ানো শেষ হইলে সে কেলরা ওয়ার্ডের কলতুলে হইতে শাড়ির আঁচল ভিজাইয়া জল আনিয়া শ্বামীর মুখে নিঙড়াইয়া দিল। লোকটা হাঁকিয়া দু ঢোক জল গিলিয়া বলিল—আর একটু খাব—
মেয়েটি আবার গেল কলতুলের কাছে, আবার শাড়ির আঁচল ভিজাইয়া জল আনিয়া ওর মুখে দিল। আমি কখনো এমন দৃশ্য দেখি নাই।
বললাম—অমন করিয়া জল আনছ কেন?
মেয়েটি বাঁ-হাত দিয়া কপালের ঘাম মুছিয়া বলিল—ঘাটবাট কিছুনাই, কোথা জল আনিব?
—কেন মালসাটা?
সে মালসাটা তুলিয়া আমার কাছে আনিয়া দেখাইল। বলিল—সবটা খেতে পারিনি, আধমালসা রেয়েছে। রাত্রে দিব। খাওয়া কেমন গিয়াছে একেবারে।
তারপর মালসাটা যথাস্থানে রাখিয়া আসিয়া বলিল—বড় কষ্ট হইয়াছে বাবু—দিন না একটা কাজটাজ জুটিয়ে? এক কাঠা চাল নুধু—খুব কেমর মধ্যে করিয়া দিব—
এই তাহার সহিত আমার শেষ সাক্ষাৎ!