Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অসাধু সিদ্ধার্থ – জগদীশ গুপ্ত

    জগদীশ গুপ্ত এক পাতা গল্প138 Mins Read0

    অসাধু সিদ্ধার্থ – ১১

    ॥ এগার ॥

    সবাই কলিকাতায় ফিরিয়াছে।

    সিদ্ধার্থ নিজের ঘরটিতে দিবা চৌকা হইয়া বসিয়া আপনমনেই আনন্দ করিতেছিল। কন্দর্প পুষ্প-শাসনে শরযোজনা করিয়াছেন; কিন্তু ধ্যানভঙ্গে ললাটনেত্রের বহ্নি ছুটাইয়া তাঁহাকে ভস্মীভূত করিতে সে উদ্যত নহে।

    নিজে সে মহাদেব নয়-ভাবিয়া সিদ্ধার্থ মনে-মনেই একটু হাসিল।

    তারপর কল্পনা করিতে লাগিল,―সর্বাঙ্গে মুহুর্মুহুঃ শিহরণ জাগিয়া উঠিতেছে―নবোদ্‌গত কদম্বকেশরের মত―দৃষ্টিতে অনন্ত আবেশ―আনন্দ, ব্যথা আর করুণার তিনটি স্রোত পাশাপাশি বহিয়া চলিয়াছে―দু’ধারে চির-বসন্তের পুষ্পিত স্ফূর্তি―আকাশে আলোক-বন্যা, ত্রিস্রোতার বক্ষে তাহারই প্রতিবিম্ব ঢলঢল করিতেছে।

    সে ভালবাসিয়াছে।

    কিন্তু সিদ্ধার্থ ষোল আনাই বর্বর নয়।

    অজয়ার অন্তর-বাহির তাহাকে এক হাতে কাছে টানিতেছে, অন্য হাতে দূরে ঠেলিতেছে। অজয়া তাহাকে ভালবাসিলে কত দিক দিয়া কত সুবিধা হইবে তাহা সে তেমনি জানে, যেমন জানে সে নিজের চির-অপরাধী অপরাধকে।

    আনন্দ তার ভাটার টানে সঙ্কীর্ণ হইয়া উঠিল। আবার জোয়ার আসিতেও বিলম্ব হইল না।

    পৃথিবী ত’ আমারই প্রতিরূপে পরিপূর্ণ। আমি কি একা দোষী? নিজে যা নয়, ছদ্ম আচরণে নিজেকে তা-ই প্রতিপন্ন করবার প্রাণান্ত প্রয়াস ত’ প্রত্যেকেরই জীবনের এক অংশ। কে কবে নিজেকে অকপটে প্রচার করেছে? অধর্মের পরাজয় হবেই ব’লে বিভীষিকা দেখাবার একটা আয়োজন আছে বটে; কিন্তু সে বৃথা―পরাজয়ের ভয়ে অধর্ম বিলুপ্ত হয়নি। অষ্টাদশপর্ব মহাভারতে যে-পরাজয় ঘোষিত হচ্ছে সে-পরাজয় অসম্পূর্ণ―সে পরাজয়ের গরিমা জয়লক্ষ্মীকে অশ্রুমুখী ক’রে তুলেছে।

    এইখানে একটু সবল বোধ করিয়া সিদ্ধার্থ হাসিয়া উঠিল।

    আমি দেশভক্ত। দেশের দুর্দশা দেখে আমার আহার নিদ্রা পালিয়েছে। আমার মা নেই, বাপ নেই, আমি অনাথ-এত গল্পও জানতাম! মা না থাকার গল্পটা বেশ কাজে লেগেছে―তাকে কাঁদিয়েছি।

    শুনতে পাই, জীবন-যুদ্ধে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা কীট-পতঙ্গে আছে, উদ্ভিদেও আছে―সেটা বিধিদত্ত প্রেরণা। তবে আমি মানুষ হয়ে কেন টিকে থাকতে চাইব না?―মনে মনে তাল ঠুকিয়া বলিল-আলবৎ চাইব। কীট-পতঙ্গ, উদ্ভিদ রং বদলায়। আমি একটু নাম বদলেছি; কিন্তু মানুষ ত’ আমি সে-ই আছি। ধরণী সব সুখ কৃপণের মত লুকিয়ে রেখেছিল―এতদিন পরে তার এক অঞ্জলি তপস্যার ফলের মত আমার সম্মুখে ছড়িয়ে দিয়েছে। কেন আমি তা’ দু’মুঠো ভ’রে কুড়িয়ে নেব না! দেবতা পূজান্তে আমায় বাঞ্ছিত বর দিয়েছে; আমি কেন তা প্রত্যাখ্যান করবো! কেউ কখনো তা করেনি। আচার্য সেদিন বক্তৃতায় বলছিল, পাপ একবার প্রবেশ করলে সে ক্ষত খনন করেই চলে―সে-ক্ষতের ধনন্তার প্রেম। প্রেমই বটে। আজ আমার মনে হচ্ছে―অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে একটা পূর্ণচ্ছেদের রেখা টেনে দিয়ে আমি―

    –“সিদ্ধার্থ বাবু, প্রাতঃপ্ৰণাম”।

    শুনিয়া সিদ্ধার্থ পূর্ণচ্ছেদের অসমাপ্ত রেখার উপর একেবারে আঁকাইয়া উঠিল। তার সুখস্বপ্ন এক মুহূর্তেই যেন অসংখ্য হিংস্র নখের আঁচড়ে রক্তাক্ত হইয়া উঠিল। কালো দু’খানি হাত অক্লান্ত আগ্রহে মালা গাঁথিয়া চলিয়াছে, মানুষের সাধ্য নাই সেই হাতের গতি সে বন্ধ করিয়া দেয়।

    সিদ্ধার্থ হতাশ্বাস শূন্য দৃষ্টিতে সম্মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

    কিন্তু রাসবিহারী যেন তামাসা পাইয়া গেল। হাসিতে হাসিতে বলিল,-এতদিন পরে দেখা, প্রতি-নমস্কারটাও করলে না!

    ―শিথিল হয়ে গেছি, বন্ধু।

    –তাই দেখছি। তোমায় আমি সর্বত্র খুঁজেছি তা বোধ হয় জানো না।–বলিয়া রাসবিহারী অনাহূতই বসিল। তার কাজ ছিল।

    সিদ্ধার্থ বলিল,―আমার সৌভাগ্য আমার জন্যে এত কষ্ট করেছ। কারণটা কি শুনি?

    ―সাক্ষ্য দিতে হবে যে!

    –কিসের?

    ―ভুলে গেলে? সেই খত-এর। তুমি যে ভাই, লেখক-সাক্ষী; উভয়পক্ষের হিতৈষী। শ্লেষের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এবং তাহা সিদ্ধার্থকে স্পর্শ করিল না।

    কিন্তু সে হঠাৎ আহত জন্তুর মত বিকৃত কণ্ঠে আর্তনাদ করিয়া উঠিল,―আমায় মেরে ফেলো রাসবিহারী―আমি তোমার কি করেছি যে তুমি আমায় ―

    বলিতে বলিতে সিদ্ধার্থ হা হা করিয়া কাঁদিয়া উঠল।

    নিদারুণ একটা দ্বন্দ্বের আর বিবেকবুদ্ধির লাঞ্ছনার মাতামাতির মধ্যে সিদ্ধার্থর দিন কাটিতেছে―বড় কষ্টের দিনগুলি। তার আত্মগ্লানির সীমা নাই।

    থাকিয়া থাকিয়া আনন্দে আশায় সে পরিপূর্ণ হইয়াও উঠিতেছে। তবু ক্লান্তি আসিয়াছে, আর বলক্ষয়কর কেমন একটা আতঙ্ক। সিদ্ধার্থ প্রাণপণে যাহা ভুলিতে চায় রাসবিহারী যেন তাহার নিষ্ঠুর অভিজ্ঞান লইয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

    জোঁক যেমন শিকারের রক্তে পূর্ণ হইয়া আপনি খসিয়া পড়ে, সিদ্ধার্থর মনে হইতে শুরু হইয়াছিল, তার অতীত তার বুকের রক্তে স্থূল ভারক্রান্ত হইয়া তাহার জীবনের অঙ্গ হইতে তেমনি বিচ্যুত হইয়া গেছে।

    কিন্তু তা হয় নাই। তাহার ঐ অনুভূতি যে সর্বৈব মিথ্যা, আর সে যে আত্মপ্রবঞ্চক, রাসবিহারী তাহাই যেন তাহার চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিলো। সত্তা যাহাকে প্রাণের ব্যগ্রতায় আড়ালে রাখিতে চায় তাহাকেই যে-কপট সম্মুখে টানিয়া আনে সে ত’ মানুষকে কাঁদাবেই।

    সিদ্ধার্থর কান্না দেখিয়া রাসবিহারী হাসিল না। বলিল,-ও হোঃ। আচ্ছা, আজ থাক। আজ তোমার মন ভাল নেই।

    কিন্তু এ দরদে সিদ্ধার্থর যন্ত্রণার বিন্দুমাত্র উপশম হইল না। গলদশ্রুলোচনে বলিতে লাগিল,―আমার মন! আমার মন আমার নেই, সে তোমার ক্রীতদাস। তার গলায় শিকল বেঁধে ছেড়ে দিয়েছ। যখন ইচ্ছা তাকে টেনে নিয়ে নিজের কাজে লাগাচ্ছ। আমার সর্বস্ব নিয়ে আমায় মুক্তি দাও, রাসবিহারী!―বলিয়া বড় ব্যাকুলনেত্রে সে রাসবিহারীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। যেন রাসবিহারী দয়া করিয়া তার সর্বস্ব গ্রহণ করিলেই বানগ্রস্ত অবলম্বনের পথে তার আর কোনো বিঘ্নই থাকে না।

    কিন্তু সিদ্ধার্থের সর্বস্ব বলিতে কি বুঝায়, তাহা রাসবিহারীর চোখের উপরেই আছে। তাই সে হাসিয়া বলিল,―তোমার সর্বস্ব নিয়ে ত’ আমি রাতারাতি রাজা হয়ে যাব; সে কোন কাজের কথাই নয়। আমার এই দায়ে উদ্ধার ক’রে দাও―তারপর তুমি মুক্ত।

    এটা যে দায় নয়, তাহা সিদ্ধার্থর মনেও পড়িল না। সে যেন ডুবিতে ডুবিতে মুক্তির কথায় পায়ের তলায় মাটি পাইয়া গেল। আকুল হইয়া বলিল,―দেবে মুক্তি?

    ―নিশ্চয়ই।

    –আর কখনো আমায় সিদ্ধার্থ ব’লে সম্বোধন করবে না? দেখা হ’লে―

    ―এমন ভাব দিখাবো যেন তোমায় আমি চিনিও না।―বলিতে বলিতে রাসবিহারী ক্রোধ অনুভব করিতে লাগিল।

    সিদ্ধার্থ বলিল,―শপথ করছো?

    রাসবিহারী ভূভঙ্গী করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল,―তোমার অকৃতজ্ঞতায় আমি অবাক হচ্ছি। যখন লিখেছিলে তখনই তোমার বোঝা উচিত ছিল, এ কাজের শেষ এইখানেই নয়। একগাল হেসে হাত ভ’রে টাকা নিয়েছিলে―তখন ত’ আমায় চক্ষুঃশূল মনে হয়নি; টাকার দিকে চেয়ে তখন ত’ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নাওনি। তখন বুঝি পাওনাদার গলা টিপে ধরেছিল?―বলিয়া রাসবিহারী রাগের ধমকে যেন ধমকিতে লাগিল।

    কথাগুলি মিথ্যা নয়।

    সিদ্ধার্থ তাহা স্বীকার করিল; বলিল, –অপরাধ হয়েছিল, আমায় ক্ষমা করো। এখনকার মত আমায় ছেড়ে দাও―আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

    –তা আসুক। শেষ কথাটা ব’লে যাই। তখন নিজের গরজে নগদ টাকা দিয়ে ফেলেছিলাম, হ্যান্ডনোটে উশুল দেওয়া হয়নি। আমি ছা-পোষা মানুষ; টাকা ত’ বেশীদিন ফেলে রাখতে পারিনে। সুদটা কর দিয়ে দেবে, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?

    কিন্তু জিজ্ঞাসার উত্তর সে পাইল না। সিদ্ধার্থ তখন অশেষ মানসিক যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্ করিতেছে।

    মানুষের প্রাণে এত সয়! বসুমতীর বুকের ভিতর দ্রবীভূত অগ্নি যেমন আছে, তেমনি সুশীতল জলস্রোতও বহিতেছে। কিন্তু তার বুকে কেবল আগুন। যদি কোনো ভগীরথের শঙ্খধ্বনির পিছু পিছু যদি কোন সুরধুনী তাহার বুকের দিকে নামিয়া আসে, তবে সে ত’ এই অগ্নির তাপে বাষ্প হইয়া যাইবে।

    ত্রাস সিদ্ধার্থর মুখে-চোখে মূর্তিমান হইয়া উঠিল।

    অজয়ার ভালবাসাই ত’ সুরধুনী; তাহার পানে নামিয়া আসিয়াছে। কিন্তু–

    সিদ্ধার্থর মনে হইতে লাগিল, আত্মহত্যা করিয়া এই যন্ত্রণার সে শেষ করিয়া দেয়।

    রাসবিহারী বলিল,–আমার শেষ কথাটার উত্তর পাইনি।

    সিদ্ধার্থ এমন দু’টি চোখ তুলিয়া তাহার দিকে চাহিল যেন সর্পের যাদুদৃষ্টির সম্মুখে পক্ষীশিশুর মূর্ছিত প্রাণটুকু ভিতরে কেবল ধুন্ধুক্‌ করিতেছে।

    সিদ্ধার্থর বাস্ফূর্তি হইল না।

    নিঃশব্দে আঙুল তুলিয়া নির্গমের পথটা সে রাসবিহারীকে দেখাইয়া দিলো।

    চূড়ান্ত অপমান বোধ করিয়া রাসবিহারী দুপদাপ্ শব্দ করিয়া জোরে জোরে পা ফেলিয়া চলিয়া গেল।

    সিদ্ধার্থর মনে হইতে লাগিল,―সে যেন পরকালের ফেরতা মানুষ। জীবিতের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আর মৃতের শীতল স্পর্শ―এই দুটির ধাক্কায় দক্ষিণে-বামে সে অবিরাম দোল খাইতেছে।

    পুরাতন বন্ধুরা শত্রু হইয়া উঠিয়াছে।

    অথচ যার জন্য এত ক্লেশ তার সম্মুখীন হইলেই জিহ্বা শুকাইয়া ওঠে। হঠাৎ একদিন সে এমন ব্যবহার করিয়া আসিয়াছে, যার কোন অর্থ করাই যায় না। তাহার দৃষ্টিতে কি ছিল কে জানে। সবাই চম্‌কিয়া উঠিয়া প্রশ্ন করিয়াছিল,-সিদ্ধার্থ বাবু কি ভূত দেখে এলেন?―শুনিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিয়াছিল। তারপর আর সেখানে সে যায় নাই। সেইদিন হইতে সে মনের চোখ দিয়া প্রাণপণে কেবলই নিজের বাহিরের চোখ দু’টিকে দেখিতেছে।

    সেখানে যেন ভয় থমথম করিতেছে। শূন্যতা তার ভয়ঙ্কর।

    .

    দু’দিন পরে বিমল রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়াছিল।

    সিদ্ধার্থকে দূরে আসিতে দেখিয়া সে আপনমনেই বলিতে লাগিল,―সিদ্ধার্থবাবু আসছেন। বেচারা রোগা হয়ে গেছে। গরীব হওয়া কি আপদ বাবা, না খেতে পেয়ে রোগা হয়ে যেতে হয়। কাজের লোক ছিল আমার বাবা; গরীব হবার ভয় রেখে যায়নি। দাদা কথায় কথায় বলে, না পড়লে খাবি কি ক’রে? মনে হয়, মুখের ওপর বলে দি’ তুমি যা ক’রে খাচ্ছো, আমিও তা-ই ক’রে খাবো। ওঁরা ভাবেন, আমি কিছু জানিনে, শর্মা সব জানে।সিদ্ধার্থবাবু?

    সিদ্ধার্থ ঘাড় হেঁট করিয়া চলিতেছিল। এইমাত্র একটি পাওনাদার তাহাকে বড় অপমান করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে; পাঠান কেবল ঘাড়ে হাত দেয় নাই।

    বিমলের ডাকে ভাবনার মাঝে সে চমকিয়া উঠিল। বলিল,―হ্যাঁ, আমি। আমার নামটা মনে আছে দেখছি।

    –না থাকাই বিচিত্র। যে-সব হাসির গল্প ক’রে গেছেন আপনি, তা নিয়ে এখনো আমাদের হাসাহাসি চলে। আসুন, দিদি ডাকছে।

    ―রজতবাবু কোথায়?

    ―গবেষণা করছেন।

    –দিদি ডাকছেন, কে বললে?

    –দিদি নিজে। জানালায় দাঁড়িয়েছিল; আপনাকে আসতে দেখে বললে, সিদ্ধার্থবাবু আসছেন, ধরে নিয়ে আয়।

    ―চলো।

    –আপনি উঠুন; আমি আসছি।

    সিদ্ধার্থ থামিয়া থামিয়া উঠিতে লাগিল।

    সিঁড়ির এক ধাপ সে ওঠে, আর একটু করিয়া দাঁড়ায়।

    সংশয়াকুল অন্তরে তার তিলার্ধ স্বস্তি নাই।

    নিজেকে মুহুর্মুহুঃ লক্ষ্য করিয়া মনটা তার যেমন অস্থির, দেহ তার তেমনি বিবশ।

    .

    অজয়া জানালার ধারে দাঁড়াইয়াই ছিল।

    সিদ্ধার্থ শেষ ধাপে আসিয়া দাঁড়াইয়াই সম্মুখে যেন বৈকুণ্ঠের দ্বার উদ্‌ঘাটিত দেখিয়া অপার বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া রহিল।

    রৌদ্রে ঘরে ঢুকিতেই অজয়ার চুলের জালে জড়াইয়া পড়িয়াছে; তাহার পায়ের নীচে দীর্ঘ ছায়া ব্যথিত হৃদয়ের একটি ম্লান নিঃশব্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মত লুটাইতেছে।

    সিদ্ধার্থর মনে হইল, সাগর-গর্ভ হইতে উঠিবার সময় লক্ষ্মীর বরাঙ্গে উত্থিত অর্ধ সূর্যালোকে ঠিক এমনি উদ্ভাসিত হইয়াছিল। দেবতাগণ উল্লাসে বিস্ময়ে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিয়াছিলেন। তাঁর একহস্তে ছিল সুধার কলসী, অন্য হস্তে―

    অজয়া হঠাৎ চোখ ফিরাইয়া সিদ্ধার্থকে দেখিতে পাইল; বলিল,―এসেছেন? আপনার কথাই ক’দিন থেকে ভাবছি। বসুন, আসছি।–বলিয়া সে অন্যঘরে চলিয়া গেল।

    কিন্তু সিদ্ধার্থর বসিবার আকাঙ্ক্ষা একেবারেই রহিল না! অজয়ার এই ভাবটি একেবারে নূতন―যেন শাসাইয়া রাখিয়া গেল।

    তার কল্পনা-পক্ষী উড়িতেছিল, ত্রেতার সমুদ্র-মন্থনের উপর।

    কিন্তু অজয়ার কথায় সে পাখা গুটাইয়া বর্তমানের সঙ্কীর্ণতম কোটরে প্রবেশ করিয়া কাঁপিতে লাগিল।

    অজয়া কি তার দাদাকে ডাকিতে গেল! সব কি ফাঁস হইয়া গেছে!

    সিদ্ধার্থর মনোরথ এক মুহূর্তে পৃথিবীঅন্বেষণ করিয়া আসিল―কোথাকার বাতাস আসিয়া ধর্মের কল নড়াইয়া দিতে পারে। কিছুই ভাল করিয়া চোখে পড়িল না; তবু সিদ্ধার্থর ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো।

    কিন্তু অজয়া তার দাদাকে ডাকিতে যায় নাই। সে একখানা বই লইয়া আসিল। বইখানা সিদ্ধার্থরই।

    বইখানা টেবিলের উপর রাখিয়া অজয়া বলিল,―আপনারই জিনিস। একদিন দৈবাৎ ফেলে গিয়েছিলেন। এর সঙ্গে আর একটা জিনিষও আপনাকে ফেরৎ দিচ্ছি।―বলিয়া অজয়া বইয়ের উপর যে জিনিষটি রাখিয়া দিলো, সিদ্ধার্থ তাহাকে খুব চেনে।

    হৃদপিণ্ড ধড়ফড় করিয়া সে সেইদিকে চাহিয়া হাঁ করিয়া রহিল।

    অজয়া বলিল,―চেনেন নিশ্চয়ই কাগজখানাকে―আপনারই বেনামী হৃদয়োচ্ছ্বাস। ভয়ে সিদ্ধার্থর মুখ পান্ডুর হইয়া উঠিল।

    অজয়া বলিতে লাগিল,―এই গুপ্ত কথাটি অপরিচিতার কাছে ঘৃণ্য উপায়ে ব্যক্ত না ক’রে গোপন রাখলে দু’পক্ষেরই সম্ভ্রম রক্ষা হ’ত।

    সিদ্ধার্থ কি বলিতে যাইতেছিল।

    কিন্তু অজয়া তাহাকে পথ দিলো না। বলিল,―অস্বীকার করবেন না। অস্বীকার করলে কুকার্যের কটুত্ব বাড়ে বই কমে না।

    অজয়ার কণ্ঠস্বর ভর্ৎসনা নিশ্চয়ই ছিল―এবং তাহার সঙ্গে আরো কি একটা পদার্থ মিশিয়া ছিল, এত ভয় ছাপাইয়াও যাহা সিদ্ধার্থর কানে বড় মিষ্ট লাগিল। সিদ্ধার্থর বুক দুরুদুরু করিতেছিল―এত আয়োজন বুঝি ধর্মের সূক্ষ্মগতির কারচুপিতেই পণ্ড হইয়া যায়। কিন্তু অজয়া ত’ অপমানে রাগিয়া আগুন হইয়া তাহাকে সম্মুখ হইতে চিরদিনের জন্য নিষ্ক্রান্ত হইয়া যাইতে আদেশ করিল না।

    উপরন্তু এমন একটু সুর যেন বাজিল―যাহা কৌতুকে স্নিগ্ধ, গোপন আনন্দে মধুময়। তখনই সিদ্ধার্থর ভয় কাটিয়া মনে হাসি ভাসিয়া উঠিল। কিন্তু স্পষ্ট সে হাসিল না―হাসাটা উচিতও হয় না।

    বলিল,―অস্বীকার আমি করছিনে, স্বীকারই করছি। তারপর চোখ নামাইয়া বলিল,–কিন্তু আমার সান্ত্বনা এই যে, তখন আমি প্রকৃতই উন্মাদ, আর মৃত্যুকামী। আমিও মর্মপীড়া কম ভোগ করিনি।

    ―উন্মত্ত অবস্থাটা কতদিন স্থায়ী হয়েছিল তা আপনিই জানেন। সুস্থ হলে কেন স্বীকার করেননি? ধরা প’ড়ে মর্মপীড়া দেখালে তাকে মেনে নিতে পারিনে।

    ―কিন্তু যা লিকেছিলাম তা অনাবিল সত্য। মরতে উদ্যত হয়েও আপনাকে দেখেই আমি মরতে পারিনি।―বলিয়াই নিজেকে অতিশয় সঙ্কটে পতিত মনে করিয়া সিদ্ধার্থ অস্থির হইয়া উঠিল―না জানি অদৃষ্টে কি আছে! তার কথাগুলি যেন প্রণয়োক্তি―আর, সুস্পষ্ট প্রণয়-নিবেদনে প্রান্তে আনিয়া যেন তাহাকে দাঁড় করাইয়া দিয়াছে।

    ইহার পর মাত্র দু’টি কি তিনটি প্রশ্ন―এবং তারপরই একেবারেই খোলাখুলি বলা―আমি তোমায় তখনই ভালবেসেছিলাম। কিন্তু অজয়ার ঠিক চোখের সম্মুখে বসিয়া সিদ্ধার্থর ক্ষুদ্র হৃদয় সহসা অতটা ভরিয়া উঠিতে ভয়ে দিশেহারা হইয়া গেল।

    অজয়া তাহার বিপন্ন মূর্তির দিকে যেন কেমন করিয়া চাহিয়া ছিল।

    সিদ্ধার্থ খানিক নীরব থাকিয়া আত্মসম্বরণ করিয়া লইয়া বলিল,―আমি বড় কদর্য আর নির্বোধ; অপ্রয়োজনের কাজেই আমি চরদিন কাটিয়ে এসেছি। আমায় মাপ করুন। মুহূর্তের ভুলে―

    অজয়াও বিপদে পড়িয়াছিল। সমগ্র ব্যাপারটা সিদ্ধার্থর কাতরতার জন্যেই হঠা একটি কথায় তুচ্ছ করিয়া তোলা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। অথচ তার ইচ্ছা নয় সে আর কষ্ট পায়।

    সিদ্ধার্থ আর অজয়া উভয়কেই আসান দিলো ননী; সে আসিয়া প্রশ্ন করিয়া দাঁড়াইল, –কি হচ্ছে দু’টিতে?

    অজয়ার মুখ লাল হইয়া উঠিল। কিন্তু হাসিয়া বলিল,–ননী, তোর কথাই ঠিক তোড়া সিদ্ধার্থবাবুই পাঠিয়েছিলেন, অবশ্য মুহূর্তের ভুলে। তারপর মর্মপীড়ায় খুব ভুগেছেন। বসুন, চা ক’রে আনি।

    অজয়া ও ননী চলিয়া যাইতেই সিদ্ধার্থর যে অবস্থা ঘটিল তাহার সংক্ষিপ্ত কোনো বৰ্ণনা নাই।

    তাহার মনে হইতে লাগিল, আকাশ নিংড়াইয়া সে এখন তার নিবিড়তম জ্যোতিঃবিন্দুটির মালিক; আর, সমুদ্র নিংড়াইয়া সে এখন তার গাঢ়তম সুধানির্যাসের অধিকারী। মোট কথা, ব্রহ্মণ্ডের সারাংশ এখন তার।

    সঙ্কটে আশাতীতভাবে উত্তীর্ণ হইয়া সিদ্ধার্থর যতটা উল্লাস ঘটিয়াছে, ননীর প্রশ্নে ঘটিয়াছে তার চতুর্গুণ। তিনটি শব্দে তৈরী একটি প্রশ্নে ননী সারাপ্রাণে এ কি অনির্বচনীয় অমৃত-স্রোত বইয়ে দিয়ে গেল―আর দু’টি নরনারীকে চিরন্তন মিলনের কোলে তুলে দিয়ে গেল তিনটি শব্দের মালায় গেঁথে! দু’টি প্রাণ বৈ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। কেবল একটিমাত্র সাক্ষী একটি নারী।

    সে পুলকিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেছে,―কিহচ্ছে দু’টিতে?

    সিদ্ধার্থ প্রাণসংশয়কর জবাবদিহির মধ্যে পড়িয়াছিল; ঐ প্রশ্নটি বিষয় মন্ত্রের কাজ করিয়াছে; কিন্তু অকৃতজ্ঞ সিদ্ধার্থর মনে হইল,–ফুলটিকে কেন ফুটেছিস জিজ্ঞাসা করার মত এ প্রশ্ন অনাবশ্যক। তার অর্থ নেই―শুধু চোখে চোখে চেয়ে দু’জনারই মুখে ফুটে উঠবে ধ্রুবতারার মত দীপ্ত, বুকে আর ধরে না এমনি উদ্বেলিত প্রেমের ঢ’লে পড়া উৎসের মত একটুখানি হাসি। প্রেমবিহ্বল দু’টি নরনারীর অশ্রান্ত, অফুরন্ত কুজনের মাঝখানে সেই একই সুরে বাঁধা কৌতুকময়ী সখীর স্মিত প্রশ্ন―কি হচ্ছে দুটিতে?

    সিদ্ধার্থ ভাবিল, প্রশ্নটি আশু ভবিষ্যতের শুভ-সূচনা―আত্মায় আত্মায় আলিঙ্গনের উপর কল্যাণীর আশিস-স্পর্শ।

    সেইদিনই―কিন্তু স্থানান্তরে, রজত বিরক্ত বোধ করিতেছিল; বলিল,―আজ বারান্দায় চায়ের আয়োজন হ’ল কি সুবিধে ভেবে, আমি সেই কথাটা খুব ভাবছি, অজয়া।

    ―অসুবিধে কি হয়েছে তা বলো।

    –আমার অসুবিধেটা তোমার চোখে পড়ল না এটা একটা নতুন কথা বটে, কিন্তু এ নতুনে মনোহারিত্ব নেই।–বলিয়া রজত মুখ কটু করিল।

    –তুমিই ব’লে থাকো, রোজকার বাঁধা-কাজের অতিরিক্ত কাজ মাঝে মাঝে করা উচিত, তাতে মানুষ কর্মঠ আর সপ্রতিভ হয়। কিন্তু আমরা কাজ করিনে, আমরা করি সেবা; তোমাদের অভ্যাসগুলোকে আদর দিয়ে চলি। অভ্যাসের বাইরে গিয়ে পড়লে কেমন লাগে তার আস্বাদ মাঝে মাঝে পেলে উপকার হয়―তাতে পুরুষের ধৈর্য বাড়ে।

    –কিন্তু ধৈর্য জিনিসটা স্থিতিস্থাপক, বাড়ালে সে বাড়ে, কিন্তু প্রাণপণ টান থাকে তার ভেতরের যে অবস্থান-কেন্দ্রটিকে সে ছেড়ে এসেছে তারই দিকে। বেশী বাড়ালে ছিঁড়ে যায় তারও দৃষ্টান্ত আছে।

    অজয়া হাসিয়া বলিল,–একটা গানের জন্যে এত কথা! বড় সৃষ্টিছাড়া বদ্-অভ্যাস করেছি কিন্তু।

    –তা মানি। কে যেন বলেছেন, দুষ্মন্ত প্রথমটা বুঝতেই পারেনি, তিনি একা শকুন্তলাকে ভালোবেসেছেন, কি সখি দুটি সমেত যে শকুন্তলা, ভাকে ভালবেসেছেন। আমিও জানিনে, আমি শুধু চা ভালবাসি, কি সুরের আর স্বাদের সম্মিলনের ফলে যে আরামটি উৎপন্ন হয় তাকে ভালবাসি। কিন্তু তোমরা তা বোঝো না―ভাবো, সবই বুঝি ভারতছাড়া কান্ড! মহাভারতেও―

    সিদ্ধার্থ বলিল,―এসবের উল্লেখ নেই।

    ―ছিল। তৃতীয় শ্রেণীর কোনো কবির প্রক্ষিপ্ত বাক্য ব’লে সে অংশ ছেঁটে দেওয়া হয়েছে।

    ―কিন্তু অনিষ্টের মূল আমি।

    ―কারণ?

    ―স্থান নির্বাচনের ভার দেওয়া হয়েছিল আমার ওপর।–বলিয়া সিদ্ধার্থ পুলক অনুভব করিতে লাগিল। কথা কাটাকাটিতে সে আর অজয়া একদিকে।

    রজত বলিল,–অবিলম্বে প্রায়শ্চিত্ত করুন।

    ―চলুন।

    সবাই উঠিয়া পড়িল। সর্বাগ্রে রজত, তার পশ্চাতে অজয়া এবং তার পশ্চাতে সিদ্ধার্থ।

    কিন্তু দু’দিন পা অগ্রসর না হইতেই সিদ্ধার্থ অকস্মাৎ মুর্ছিত হইয়া ভূপতিত হইল। এবং পরক্ষণেই ব্যাপার তুমুল হইয়া উঠিল।

    অজয়া “দাদা” বলিয়া যে ডাকটা দিলো তাহাকে আর্তনাদ বলা চলে। ননী কাছাকাছি ছিল; সে পাখা আনিতে ছুটিয়া গেল। এবং সে মানিক ও মদনকে সাহায্যার্থে আহ্বান করিয়া সিদ্ধার্থর নিকটবর্তী হইতেই অজয়া তাহার হাত হইতে পাখা টানিয়া লইয়া প্রাণপণে হাওয়া করিতে লাগিয়া গেল।

    কিন্তু সিদ্ধার্থর অচৈতন্য অত ত্বরিতে ভাঙিল না।

    স্মেলিং সল্টের শিশির আনিতে ননী পুনরায় ছুটিয়া গেছে, কিন্তু খুঁজিয়া পাইতেছে না। মদন আর মাণিক কি করিবে আদেশের অভাবে তাহা ভাবিয়া না পাইয়া দিশেহারা হইয়া আছে। বরফের কথাটা রজতের মনে আসিয়াও আসিতেছে না।

    এমন সময় সিদ্ধার্থর মাথায় হাওয়া লাগিতে সে ধীরে ধীরে চোখ খুলিল, এবং তখনই আবার চোখ বুজিয়া চরম ক্লান্তসুরে বলিল,–আমি কোথায়? অজয়া―

    বলিয়া দ্বিতীয়বার চোখ খুলিয়া সিদ্ধার্থ একটু উঠিবার চেষ্টা করিল।

    অজয়া পাখা থামাইয়া বলিল,-উঠবেন না; যেমন আছেন তেমনি থাকুন। একটু সুস্থ বোধ করছেন?

    সিদ্ধার্থ যেমন ছিল তেমনি থাকিয়া বলিল,-করছি।

    রজত বলিল,―কথা বলিও না। স্নায়বিক দৌর্বল্য; একটু বিশ্রাম করলেই ভাল হয়ে উঠবেন। ধরে উঠিয়া চেয়ারে নিয়ে বসাও। (মাণিকের প্রতি) দাঁড়িয়ে তামাসা দেখছিস?

    অকারণে ধমক খাইয়া মাণিক তাড়াতাড়ি যাইয়া সিদ্ধার্থর এক ডানা ধরিল। সিদ্ধার্থ চোখ আবার বন্ধ করিয়াছিল। রজত তার অপর ডানা ধরিল; বলিল,―আপনাকে নিয়ে চেয়ারে বসাবো; উঠুন ত’ আস্তে আস্তে।–বলিয়া মানিকের সাহায্যে অতি সন্তর্পণে সিদ্ধার্থকে তুলিয়া লইয়া চেয়ারে বসাইয়া দিলো।

    ননী স্মেলিং সল্টের শিশি লইয়া আসিয়া একপাশে দাঁড়াইয়া ছিল; কিন্তু স্মেলিং সল্ট কাহারা নাকে লাগাইবার দরকার হইল না।

    অজয়া বলিল,-ননি, খানিকটা দুধ গরম করে নিয়ে আয়, শীগির। দেরী করিস নে। তারপর সিদ্ধার্থকে বলিল,–মাথা এখনো ঘুরছে?

    সিদ্ধার্থর তখনকার লজ্জা আর সঙ্কোচ দেখিবার জিনিষ; বলিল,―সামান্য। আপনারা আর ব্যস্ত হবেন না―ক্রমশ কমে আসছে।―বলিতে বলিতে সে উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল,―আমি যাই, আপনাদের যথেষ্ট ভয় দেখিয়েছি, উপদ্রব করেছি, আর নয়।তারপর সিদ্ধার্থ ঠোঁটের কোণ মুচড়াইয়া একটু হাসিল―এমনি করিয়া যেন তার সর্বান্তঃকরণ ক্ষমা চাহিয়া চাহিয়া উহাদের পায়ে লুটাইতেছে।

    কিন্তু অজয়া রাগিয়া একেবারে খুন হইয়া গেল; বলিল,―আপনি আমাদের রক্ত―মাংসের মানুষ মনে করেন, না রাক্ষস মনে করেন? যাই ব’লে উঠে দাঁড়ালেই যেতে পারবেন ভেবেছেন?―বলিতে বলিতে রাগে তার চোখে জল আসিয়া পড়িল।

    অজয়া দুধের তাগিদ দিতে গেছে।

    রজত বলিল,–দুধটুকু অক্লেশেই খেয়ে ফেলতে পারবেন; গরম গরম পেটে গেলে সঙ্গে সঙ্গে উপকার হবে। তারপর আপনি কিঞ্চিৎ সবল বোধ করলে গুটিকতক কথা; জানতে চাইবো, দয়া ক’রে আমার জিজ্ঞাসার জবাব দিতে হবে।

    শুনিয়া সিদ্ধার্থ আবার আসনগ্রহণ করিল।

    দিব্য ঝকঝকে কাচের গ্লাসে করিয়া অজয়া আধসের টাটকা ধূমায়মান দুগ্ধ লইয়া আসিল।

    কিন্তু তৎপর্বেই সিদ্ধার্থ পনের আনা সবল হইয়া উঠিয়াছে! রজতের গুটিকতক কথা কিসের সম্পর্ক হঠাৎ এখন জিজ্ঞাসা হইয়া উঠিয়াছে তাহা অনুমান সূত্রে সিদ্ধার্থর জানা হইয়া গেছে, এবং তাহাতেই রক্ত উষ্ণ হইয়া ধমনীর বেগ বাড়িয়াও যেটুকু দুর্বলতার আভাস ছিল তাহাও দূর হইয়া গেল অজয়ার আসায়।

    রজতের জিজ্ঞাসার উত্তর সে অজয়ার সম্মুখেই দিতে পারিবে।

    বলিল,―গুটিকতক কথা বলবার মত জোর আমি পেয়েছি। জিজ্ঞাসা করুন।

    বলিয়া দুধটুকু সে চোঁ চোঁ করিয়া প্রায় এক চুমুকে শেষ করিয়া আনিল।

    রজত বলিল,–আপনার সম্পূর্ণ পরিচয়টি জানাবার প্রয়োজন হয়েছে। অশিষ্টতা মার্জনা করবেন।

    –আমার নাম কি তা জানেন। পিতার নাম ত্রৈলোক্যনাথ বসু। নিবাস হেমন্তপুর, জেলা হুগলি। পিতৃদেব লাহোরে চাকরী করতেন―সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়; আমি তখন মাতৃগর্ভে। পিতা উপার্জন করতেন যথেষ্ট; কিন্তু পরে শুনেছি তাঁর আয়ের অধিকাংশই ব্যয় হ’ত দানে। শৈশবটা কিভাবে কেটেছিল জানিনে। যখন নিজের দিকে দৃষ্টি দেবার মত বয়স হ’ল, তখন আমি ইস্কুলের অবৈতনিক ছাত্র। বৃত্তির টাকার জোরে এম. এ. পর্যন্ত উঠে হঠাৎ একদিন মনে হ’ল―কিসের আশায় এই পণ্ডশ্রম ক’রে মরছি? পিতা নিজেকে নিঃশেষ নিঃস্ব ক’রে দান ক’রে গেছেন―আমার দান করবার মত আছে শুধু বলিষ্ঠ এই দেহখানা। দেশের আর দশের কাজে দেহপাত করবো ব’লে বেরিয়ে এসে দেখি―

    কি দেখিয়াছিল কে জানে; কিন্তু বলিতে বলিতে সে থামিয়া গেল। এবং রজতদের মনে হইল, তাহার দৃষ্টি যেন তাহাদের ডিঙাইয়া, ঘর ডিঙাইয়া, বাড়ি ডিঙাইয়া, সহর ডিঙাইয়া সর্বহারা কাঙালের মত পৃথিবীর দুয়ারে ভিক্ষার্থী হইয়া দাঁড়াইয়াছে―

    দৃষ্টি এমনি করুণ।

    অজয়া বলিল,” কি দেখলেন?

    ―দেখলাম ভুল করিনি। দেশ খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত―এমন একটি ক্ষেত্র নাই যেখানে খণ্ডগুলি একত্র হয়ে সংহতি লাভ করতে পারে। মুসলমানদের দেশ নাই, কিন্তু ধর্ম আছে। খৃষ্টানের ধর্ম ধর্ম নাই, কিন্তু দেশ আছে। তারা তারই ওপর সঙ্ঘবদ্ধ। কিন্তু আমাদের না আছে ধর্মের ক্ষেত্র, না আছে দেশপ্রীতি―তাই আমরনা শতধা-বিচ্ছিন্ন। আর প্রত্যেকটি বিভিন্ন অংশ ব্যাধি আর দৈন্যের জঠরে জীর্ণ হচ্ছে। কাজে লাগলাম। কিন্তু ব্যথা দু’হাতে কাজের দিকে ঠেলতে থাকলেও শ্রান্তি আসবেই। তখনই মনে হ’ত গৃহের কথা। আমার গৃহ নেই, কিন্তু গৃহেই মানুষের বন্ধনদশা আর মুক্তিসাধনা এক সঙ্গেই ঘটে। কর্মের মাধুর্যের সেইখানেই বিকাশ। গৃহ থেকেই শ্রান্ত দেহ-মনকে সুস্থ ক’রে নিয়ে মানুষ আবার বাইরে আসে। দেনা-পাওনার এই দাবী যার কাছে আসে না, সে হয় দেবতা, না হয় পাষাণ। মনের এমনি আতুর অবসন্ন অবস্থায় আপনাদের সঙ্গে পাহাড়ে দেখা।

    ―আপনাদের দেশের বাড়ী?

    ―শূন্য। মন জুড়োবার স্থান সে নয়।–বলিয়া সিদ্ধার্থ আবার উঠিয়া দাঁড়াইল।

    নিজের উপর সিদ্ধার্থর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নাই, শ্রদ্ধাও নাই। এইদিক দিয়া সে অত্যন্ত দুর্বল। এই সব অনুসন্ধানের অবতারণা যে কিসের সূত্রপাত, কোন্ দিকে ইহার লক্ষ্য, তাহা সে বুঝিয়াছে। তাই-বোনে কি কথা হইয়াছে, কিম্বা আদৌ হইয়াছে কি না তাহা সে জানে না। কিন্তু একটা গুরুতর ভাগ্য-বিপর্যয় যে আসন্ন তাহা নিঃসংশয়ে জানিয়া অন্তরের উদ্বেলিত উল্লাস পাছে ইহাদের সম্মুখেই তাহার মুখে-চোখে উত্থলিয়া উঠিয়া তাহাকে বিপদে ফেলে এই ভয়েই সে যাই-যাই করিতেছিল―এটা পরীক্ষাও বটে।

    সিদ্ধার্থর হঠাৎ মনে হইল, তাহাকেই খুঁজিয়া খুঁজিয়া কে যেন জাল ফেলিয়া বেড়াইতেছে। সুবিমল হ্রদে তার বাস, কি পঙ্ক-কুণ্ডে। জালে জড়াইয়া উঠিলেই তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িবে। বলিল,―আজকের মত আমায় ছুটি দিন।

    রজত বলিল,–দিলাম ছুটি। কিন্তু আমার চা মাটি করেছেন, ভুলে যাবেন না যেন।

    সিদ্ধার্থ হাসিয়া বলিল,―আপনিও যেন ভুলে যাবেন না, আমি আপনার চা মাটি করছি।―বলিয়া স্মিতমুখে উভয়কে নমস্কার করিয়া সিদ্ধার্থ বাহির হইয়া আসিল।

    এবং রাস্তায় চলিতে চলিতে তার মনে হইতে লাগিল, যে সুপ্রভাতের প্রতীক্ষায় তার সর্বসংসহা প্রকৃতি এতদিন আহার-নিদ্রা-প্রীতি-গৃহ-বঞ্চিত হইয়াও একেবারে ধরাশায়ী হইয়া পড়ে নাই, তাহারই আভাস যেন পথচারী প্রত্যেকটি নরনারীর মুখে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে।

    এদিকে যা ঘটিতে লাগিল তাহাও সিদ্ধার্থ-সম্পৰ্কীয়।

    অজয়া খানিক নিঃশব্দ থাকিয়া বলিল,–দাদা―

    বলিয়াই সে চুপ করিল; কিন্তু তার সলজ্জ সম্বোধনটি অর্থালঙ্কারে এমন সুসজ্জিত, আর এমন অনুরোধে প্রার্থনায় পরিপূর্ণ হইয়া দেখা দিলো যে, স্থূলদর্শী রজত তাহাতে কেবল বিস্মিতই হইল না, শব্দাতিরিক্ত অর্থটারই সে জবাব দিলো; বলিল,–বুঝেছি, কিন্তু সব জিনিষেরই ত’ নকল আছে, দিদি! সোনা যে এমন ধাতু তাকেও মানুষ নকল ক’রে চালাচ্ছে―ধরবার যো-টি নেই।

    –তুমি কি বলতে চাও সিদ্ধার্থ বাবু নকল মানুষ!

    –বলতে চাইনে কিছুই; যাচাই ক’রে নিতে চাই। টাকাটা হাতে নিয়ে বাজিয়ে তবে পকেটে ফেলি; যে তার করে না সে ঠকে। শ্রীযুক্ত সিদ্ধার্থ বসু সম্বন্ধে আমরা কতটুকু জানি!

    শুনিয়া অজয়া আশ্চর্য হয়, হতাশ নয়, ক্ষুণ্ণ হইল-দাদার স্থূলদৃষ্টি কেবল স্থূল বস্তুর চাকচিক্য দেখে, তাহাকে অঙ্গুলির আঘাতে শুন্যে আবর্তিত করিয়া সে সম্ভোগ করিতে চায়―আত্মার অনুভূতির নিগূঢ় সম্বন্ধ সে মানিতে জানে না।

    বলিল,–পরিচয় ত’ দিয়েছেন; ভেতরকার মানুষটিকে ত’ চিনেছ।

    রজত ঘাড় নাড়িতে লাগিল,–চিনিনি। তাঁর কথা শুনেছি, গান-গল্প-বিলাপ শুনেছি, বক্তৃতা শুনেছি―এই পর্যন্ত। কিন্তু মানুষ ত’ কথার সমষ্টি নয়। আর, যে বেশী কথা বলে তার চরিত্রে আমার সন্দেহ হয়―যেন ধুলো উড়িয়ে সে আসল জিনিষটাকে ঢাকছে।

    অজয়া হাসিল; বলিল,―বাইরে তোমার চরিত্রের খ্যাতিটা কি রকম?

    –আমি কি বেশী কথা বলি? সেটা তোমার ভুল ধারণা। যা-ই হোক, তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চলতেই পারে না; পিসিমাকে ডাকতে হবে অথবা সুরেনকে।

    ―এখনই তাদের ডেকো না; একেবারে খবরটা দিও।–বলিয়া অজয়া বাহির হইয়া গেল।

    রজত চোখ বড় করিয়া মনে মনে বলিল, –বাপরে, একেবারে এতদূর!

    এবং দুর্ভাবনায় তার এমন অস্থির বোধ হইতে লাগিল যেন একটা অতিশয় দুরূহ আত্ম-বলিদানের দিকে তাহাকে কে ঠেলিয়া লইয়া চলিয়াছে, কিন্তু যাইতে তার তিলমাত্র ইচ্ছা নাই।

    সিদ্ধার্থকে রজত যে সন্দেহের চক্ষে দেখে তাহাতে সন্দেহই নাই; কিন্তু তার কারণটা ঠিক স্পষ্ট হইয়া ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে নাই। রজতের মনে হয়, যেদিক দিয়াই দেখা যাক, সিদ্ধার্থর আত্মপ্রকাশ যেন অতিরঞ্জনে দূষিত; আর, একটা তীক্ষ্ণ চক্ষু এবং বক্রচঞ্চু অভিসন্ধি যেন সাবধানে ওঁৎ পাতিয়া আছে!

    সিদ্ধার্থকে সে পরস্ব-লোলুপ মার্জার বলিয়া মনে মনে গাল দিয়া ভাবিতে লাগিল -এখন উপায়? যে-রকম অজয়ার রকম, আর যে-রকম করিয়া “একেবারে খবরটা দিও” বলিয়া নির্ভয়ে গা-ঝাড়া দিয়া গেল তাহাতে যুক্তিতর্ক প্রভৃতি কোনো কাজে লাগিবে বলিয়া ভরসা নাই। অথচ আপশোষ এই যে, ভবিষ্যতে ফল খারাপ দাঁড়াইয়া গেলে তাহাকেও ভুগিতে হইবে। কাজেই রজতের মনে হইল, যাদের ভগিনী নাই তারা আছে ভাল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপোকা-মাকড় – জগদানন্দ রায়
    Next Article অব্যক্ত – জগদীশচন্দ্র বসু
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }