Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অসাধু সিদ্ধার্থ – জগদীশ গুপ্ত

    জগদীশ গুপ্ত এক পাতা গল্প138 Mins Read0

    অসাধু সিদ্ধার্থ – ৬

    ॥ ছয় ॥

    অজয়া পেন্সিলে ছবি আঁকিতেছিল।

    পাহাড়ের ঠিক নীচেই একটি পল্লী; তার পশ্চিম প্রান্তে রৌপ্য-প্রবাহের মত নদীটি। নদীর ওপারে যতদূর দৃষ্টি চলে ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্র; ক্ষেত্রের সীমান্ত ব্যাপিয়া দিক্-চক্ররেখা―তারি নীচে সূর্য অর্দ্ধেক ডুবিয়া গেছে। এদিকে রাখাল বালকেরা গরু ঘরে ফিরাইয়া আনিতেছে; মাথা নাড়িয়া নাড়িয়া তাহারা মন্থরগতিতে চলিয়াছে। গলায় ছোট ছোট ঘণ্টা; কোনোটি নিজের বাড়ীর কাছে আসিয়াই দাঁড়াইয়া পড়িয়াছে, কোনোটি ঘাড় ফিরাইয়া পিছাইয়া-পড়া বাছুরের দিকে চাহিয়া আছে।

    দাঁড়াইয়া দেখিতে দেখিতে হঠাৎ ননীর মনে হইল, চিত্রাঙ্কন ভালই হইতেছে। বলিল,―ভারি সুন্দর! এটা কিসের ছবি, দিদিমণি?

    অজয়া বলিল,―দেখে কিচ্ছু বোঝা যায় না, তবু “ভারি সুন্দর” কি ক’রে বললি?

    ―আমি যা বুঝেছি তাতে এ গোষ্ঠ। কিন্তু গোপীরা কই, না যশোদা?

    ―তাঁরা একটু বিলম্বে আসবেন; হে’সেলে আছেন।–বলিয়া অজয়া হাসিতে লাগিল। কিন্তু ননী গম্ভীর হইয়া গেল। “গোষ্ঠ” প্রভৃতি লইয়া ঠাট্টা ননী ভালবাসে না।

    ―আলো দিয়েছে, ঘরে চল্।–বলিয়া অজয়া ননীর মুখের দিকে চাহিয়াই তাহার হাত ধরিয়া ফেলিল, বলিল,―ক্ষমা কর্, ননী; আমার মনে ছিল না।

    ননী হাসিয়া ফেলিল, বলিল,―আমার কাছে তোমার অভ ভণিতা নকুতা করতে হবে না ত’!

    ―আলবত হবে!―বলিয়া অজয়াও হাসিতে লাগিল। সমগ্র ব্যাপারটি দু’একটি কথা উচ্চারিত হইয়াই শেষ হইয়া গেল; কিন্তু উভয়ের পরস্পরের প্রতি যে প্রীতির মধু ছিল তাহা অতিশয় নিবিড় হইয়া দু’জনাকেই কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক করিয়া রাখিল।

    ননী ল্যাম্পটার দিকে চাহিয়া ভ্রূভঙ্গী করিয়া বলিল,―আলোয় এলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়, দিদিমণি।

    ―তোর হবার ত’ কথা নয়। জানতাম যে, চোর আর প্যাচারই কেবল আলো সয় না।

    ―তুমি ছবি আঁকো বটে, কিন্তু বাইরের সঙ্গে মনের মিলের কথা তুমি ধরতে পারো না। অন্ধকার যত গাঢ় হয় তত সে স্পষ্ট; আলো যত উজ্জ্বল তত সে ধাঁধা লাগায়। আমার মনে হয়, আলোয় যত অকল্যাণ অন্ধকারে তত নয়―মানুষ উল্টোদিকেযতই চলুক না।

    ―তা হবে কিন্তু আমার বাঁ চোখটা নাচছে কেন বল্ ত-এটাও ত’ বাইরের সঙ্গে মনের মিলের কথা।

    ―দাঁড়াও মনে করি―“সীতা আর রাবণের কাঁপে বান অঙ্গ।”

    ―তার মানে?

    ―বাম অঙ্গের কাঁপুনি আমাদের পক্ষে শুভ আর পুরষের পক্ষে অশুভ সূচনা করে। তোমার সু-খবর বুঝি দাদাবাবুই আনছে।

    ―দাদার এতক্ষণ ত’ ফেরা উচিত ছিল, ননী। আমাকে ফাঁকি দিয়ে রেখে গেল, সঙ্গে নিলে না; বলে গেল, সন্ধ্যার আগেই ফিরবো।

    ―কেউ হয়তো নতুন রকম চায়ের লোভ দেখিয়ে নিয়ে গেছে; গিয়ে গল্পে ডুবে গেছেন।

    ―না, ননী; আমার বড় ভাবনা হচ্ছে। এই পাহাড়ে দেশে বিপদ পদে পদে। পথ ভুলেই হয়তো ঘুরে মরছে। মাণিককে ডাক্, সে একটা লণ্ঠন নিয়ে

    বলিতে বলিতে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিয় অজয়া থামিয়া গেল।

    .

    ―বেশ লোক তুমি। সন্ধ্যার―

    অজয়াকে দ্বিতীয়বার কথার মাঝখানেই খামিয়া যাইত হইল। রজতকে দরজার সম্মুখে দেখিয়াই সে আরম্ভ করিয়াছিল; কিন্তু তাহার পশ্চাতে সিদ্ধার্থকে দেখিয়াই সে থম্‌কিয়া গেল।

    সিদ্ধার্থকে বসাইয়া রজত বলিল,–ইনি আমার ভগিনী অজয়া, অজয়া―

    সিদ্ধার্থ বলিল,–আমার নাম সিদ্ধার্থ বসু।

    উভয়কে নমস্কার বিনিময়ের অবসর দিয়া রজত বলিল,-আমার নূতনতম বন্ধু।

    প্রধান কথাটি পরে বলছি তোমাকে। সন্ধ্যার আগেই ফেরবার কথা ছিল বটে, কিন্তু এ সন্ধ্যা ত’ ভূর্বাসার সেই সন্ধ্যা নয় যে ভস্ম হবার ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে থাকবে! কাজেই অন্ধকার অকুতোভয়ে বেড়ে গেল। তারপর বলব সবটা?―বলিয়া সিদ্ধার্থর দিকে চাহিয়া সে প্রচুর পরিমাণে হাসিতে লাগিল।

    কিন্তু সিদ্ধার্থ কেমন ভয়ে ভয়ে অজয়ার দিকে একবার চাহিয়া লইল–বুক তাহার অকারণেই দুরু দুরু করিতেছিল। কথা যখন সে কহিল তখন নিজেরই কণ্ঠস্বর কানে যাইয়া তাহার মনে হইতে লাগিল, সে যেন এখানে খাপছাড়া।

    এবং তাহার কণ্ঠ যে একটি দুর্বোধ্য বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া ফুটিবার পথ পাইল তাহা যেমন তাহার তেমনি আর দু’জনেরও বুঝিতে বাকি রহিল না।

    বলিল,―অনাগত ভয়কে উপেক্ষা করবে, ভয় এসে পড়লে উদ্ধারের উপায় দেখবে, এই নীতি শাস্ত্রে আছে। উদ্ধারের পরে বাড়ীতে এসে গল্প করা উচিত কি-না তার কোনো উপদেশ দেওয়া নেই।

    রজত বলিল,–কারো অজয়ার মত ভগিনী আছে জানলে শাস্ত্রকার চারিদিকে দেখব, এই নীতি শাস্ত্রের আছে। উদ্ধারের পরে বাড়ীতে এসে গল্প করা উচিত কি-না তার কোনো উপদেশ দেওয়া নেই।

    রজত বলিল,―কারো অজয়ার মত ভগিনী আছে জানলে শাস্ত্রকার চারিদিকে যেমন দিয়ে গেছেন, তেমনি এদিকেও একটা দাগ কেটে দিয়ে যেতেন; সম্ভবত নিষেধ করেই যেতেন। তাঁদের নিষেধের হাত খুব দরাজ ছিল।

    অজয়া বলিল,―কেন শুনি?

    ―কারণ আজকার গল্পটা যদি করি তবে কাল থেকে আমাকে বাড়ীতে নজরবন্দী হয়ে থাকতে হবে, কিম্বা খবরদারী করতে সঙ্গে একটা পাইক তুমি জুড়ে দেবে।

    অজয়া এতক্ষণে সিদ্ধার্থর দিকে ফিরিল।

    সোজা তাহার দিকে চাহিয়া বলিল,―দাদা এখন বলবে না ঝোঁক আসেনি। আপনি বলুন; সঙ্গে পাইক জুড়ে দেবার ভয় বোধ হয় আপনার নেই।

    অজয়ার এই দ্বিধাহীন অসঙ্কোচ দৃষ্টি সিদ্ধার্থর একটি স্থানে একটি নিমিষের জন্য অতর্কিত একটা ধাক্কা দিয়া গেল।

    ঠিক এমনি সজীব অথচ নির্লিপ্ত স্পষ্টতা তার সম্মুখে লোকাতীত হইয়া আজ এই প্রথম দেখা দিল―তার কোথাও ক্লেশ নাই, ক্লেদ নাই, আধ-আধ ভাব নাই, প্রয়াস নাই।

    সিদ্ধার্থ একটু নড়িয়া বসিয়া রজতের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিল; রজত চোখের ইসারায় সম্মতি দিল।

    কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সিদ্ধার্থ অজয়ার মুখের দিকে অকাতরে চাহিয়া থাকিবার একটুখানি সঙ্গত শোভন কারণের সন্ধানে মনে মনে দিগ্ধিদিকে ছুটাছুটি করিতে থাকিলেও, কারণটি হাতে আসিয়া পড়িতেই সঙ্গে সঙ্গে তার ভিতরটি অতিশয় সঙ্কুচিত দুর্বল হইয়া পড়িল।

    একবার টেবিলের দিকে চোখ নামাইয়া, একবার অন্যদিকে চাহিয়া, একবার অজয়ার দিকে চোখ ফিরাইয়া সিদ্ধার্থ বলিতে লাগিল―আপনার দাদা উঠেছিলেন পাহাড়ে সকলের শেষটায়, যেটার নাম শিবজটা। খানিকটা দূর উঠলেই শান-বাঁধানো মেঝের মত সমতল খানিকটা জায়গা আছে―তার পেছন দিকে শিবজটা নিজে, একেবারে খাড়া। দক্ষিণে জঙ্গল, উত্তরে ঝরনার নদী। পূর্বদিকে পায়ে পায়ে পথ পড়ে গেছে, তাই বেয়ে উঠেছিলেন বোধ হয় গাছের ডালপালা ধ’রে―ওঠা তেমন কঠিন নয়―কিন্তু নামবার উপক্রমেই বুঝতে পারলেন কাজটি দুরূহ―চোখ বুজে পা ফেলতে হয়, কোনো অবলম্বন নেই―কাজেই, হঠাৎ পা আলগা পাথরের উপর কি পিছল জায়গায় পড়লেই―

    রজত লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,―সিদ্ধার্থ বাবু থামুন। এইবার আমি বলি―আমার ঝোঁক এসেছে। আটকা প’ড়ে আমার মনের অবস্থাটা কেমন হয়েছিল তা উনি জানেন না। নতুন রকমের অভিজ্ঞতা। এখন হাসি পাচ্ছে, কিন্তু তখন সমস্ত পৃথিবী চোখের সামনে, চিলটি যেমন জলের নীচে নেমে যায়, তেমনি ক’রে অন্ধকারের ভেতর ডুবে যাচ্ছিল বেশ আস্তে আস্তে, জানিয়ে জানিয়ে। সেই অন্ধকারের ভেতর জেগে ঝক্ ঝক্ করছিল শুধু নরকঙ্কাল―আর প্রেতের দল সারি বেঁধে শোভাযাত্রায় বেরিয়েছিল―তাদের অট্টহাসির শব্দ যেন কানের গা ঘেঁষে করতালি বাজাচ্ছিল। একটু অত্যুক্তি হ’ল―কিন্তু যে কল্পনা নয়, তা আমি হৃদয়াঙ্গম করেছি। আমার চোখের তারার উপর একটা সাদা পর্দা নেমে এসেছিল কি না জানিনে; তবে অন্তিম তৃষ্ণা আর অন্তিম ঘর্মের ব্যাপারটা সুখের আর সুখের ব’লে কখনো আমার ভুল হবে না।–বলিয়া রজতও অতিশয় আমোদ বোধ করিয়া হা হা করিয়া হাসিতে লাগিল।

    কিন্তু অজয়ার মুখ শুকাইয়া উঠিল।

    সিদ্ধার্থ বলিল,–আপনি যে অবস্থাটার বর্ণনা করলেন, তারপরই ত’ মূর্ছা অনিবার্য।

    ―আপনার সাড়া না পেলে অজ্ঞান হয়ে যেতাম বৈ কি! আমার যে চীৎকার আপনি শুনতে পেয়েছিলেন, সে স্বর কিন্তু আমারও অপরিচিত―যেন আমারই নয়―

    অজয়াকে বলিল,-বুঝলে না?

    ―–না।

    সিদ্ধার্থ বলিল,–আমিও বুঝলাম না ঠিক।

    ―প্রাণের ভয়ে ব্যাকুল হয়ে মানুষ যে আর্তনাদ করে, সে স্বর তার কন্ঠের পরিচিত স্বর কখনই নয়―সে স্বরের মধ্যে যে তার বিসর্জনের ঢাক বাজে―পরে শুনলে সে চিনতেই পারবে না, এমন ক’রে সে চেঁচিয়েছিল। সাপে-ধরা ব্যাঙের আওয়াজ কি তার নিত্যকার ব্যবহারের শব্দ?

    বলিয়া রজত প্রসন্নমুখে নিঃশব্দ হইল।

    কিন্তু অজয়া যেন চোখের সম্মুখেই অগমৃত্যুর একটা বীভৎস দৃশ্য দেখিতেছে এমনি আতঙ্কে চমকিয়া তার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল। বলিল,―দাদা―

    ―আমার বেড়ানো বন্ধ, এই ত’? স্নেহে অন্ধ হয়ে মানব চরিত্র ভুল বুঝো না। ন্যাড়া বেলতলায় যদি দু’বার না যায়, তবে আমিই বা কেন দ্বিতীয়বার পাহাড়ে উঠবো! ননী, চা।

    ননী চা আনিতে গেল।

    এবং “আমি আসি” বলিয়াই সিদ্ধার্থ আচমকা উঠিয়া দাঁড়াইল।

    সিদ্ধার্থ ইহাদের সম্মুখে বড় অস্বস্তি বোধ করিতেছিল―যেন সে একখানি ঘূর্ণায়মান চক্রের উপর বসিয়া আছে।

    বিঘূর্ণিত চক্র যেমন তার পৃষ্ঠের উপর কোনো বস্তুকেই তিলার্দ্ধ তিষ্ঠিতে দেয় না―তেমনি একটি কাণ্ড ঘটিতেছিল সিদ্ধার্থর জ্ঞান-জগতে―তার জ্ঞান-জগৎটাই যেন অবিশ্রুত পাকের উপর পাক খাইয়া খাইয়া প্রতি মুহূর্তে তাহাকে ছুড়িয়া ফেলিতে চাহিতেছিল।

    অতীতের অপর কোনো মূল্য থাক আর নাই থাক, একেবারে নিরূপায় হইয়া তাহাকে আঁকড়াইয়া ধরিলে সেই অবলম্বন সহ্য করিবার মত দৃঢ়তা তার থাকিলেই যথেষ্ট। কিন্তু সিদ্ধার্থর তাহা নাই। অতীত তার একেবারে শূন্য, তৃণের অঙ্কুরটি পর্যন্ত তার কোথাও নাই।

    বর্তমান তাই অকস্মাৎ অসহ্য প্রখর হইয়া নিজের কাছে বড় স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে।

    তার অযোগ্যতা একেবারে দুস্তর।

    ―সে কি? চা খেয়ে যান।―বলিয়া রজত টেবিলের উপর করাঘাত করিল।

    সিদ্ধার্থ বলিল,―চা আমি খাইনে।

    ―অন্য ওজর দেখালে জোর করতাম। কিন্তু চায়ের সঙ্গে আমি চোখ বুজে গান শুনে থাকি, তাতে আপনার আপত্তি আছে?

    সিদ্ধার্থ অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া বলিল,―আজ থাক, আনন্দটা আর একদিন এসে সম্পূর্ণ ক’রে নিয়ে যাব।―বলিয়া ফেলিয়াই সিদ্ধার্থর মনে হইল, আর একটু বসিয়া গেলে ক্ষতি কি!

    অজয়া তাহার দিকে চাহিয়া বলিল,–আপনি যে আনন্দ আজ আমাকে দিয়েছেন তার তুলনা নেই।

    এমন প্রাঞ্জল গদগদ কণ্ঠ সিদ্ধার্থ আগে কখন শোনে নাই।

    তার আশার মুকুল মুখ খুলিতেছে।

    বলিল,–কাজের গুরুত্ব যদি ফলের হিসাবে ধরা হয়, তা হ’লে আপনার দাদাকে পাহাড় থেকে নামিয়ে এনে গুরুতর কাজই করেছি―যার ফলে আমার মত নির্বান্ধবের আপনাদের বন্ধুত্ব লাভ হ’ল।

    রজত বলিল,―সে বন্ধুত্বের মূল্য বিচার করবার সুযোগ কখনো পাবেন কি-না জানিনে; কিন্তু আমরা আপনার বন্ধুত্ব লাভ করবার আগেই আপনাকে দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে নিয়েছি। বন্ধু ব’লে যখন সম্মানিত করলেন, তখন বোধ হয় সমতল ক্ষেত্রেও আমাদের হিতের জন্য আপনাকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে―তখন তাকে দুর্দৈব মনে করবেন না ত’?

    ―ঈশ্বর না করুন। যেদিন আপনাদের বন্ধুত্ব দুর্দৈব মনে করবো সেইদন বুঝবো আমার দূরদৃষ্ট চরম সীমায় পৌঁছেচে। নমস্কার।

    ―নমস্কার, মাঝে মাঝে এলে বড় সুখী হবো।

    অজয়া বলিল,–আসবেন।

    তাহাকেও নমস্কার করিয়া সিদ্ধার্থ বাহির হইয়া গেল।

    সিদ্ধার্থর শেষ কথা ক’টির অকপট আন্তরিকতা অজয়ার বড় মিষ্ট লগিল।

    কিন্তু মানুষের অন্তর্যামীই জানিলেন, সিদ্ধার্থ তাদের বন্ধুত্বই চরম আনন্দের বিষয়বস্তু বলিয়া ঘুণাক্ষরেও মনে করে নাই।

    তার ভয় কাটিতেছিল―সে নিজেকে ভুলিতেছিল―তার এই আন্তরিকতার জন্ম সেইখানে। ননী চা আনিল।

    অজয়া বলিল,–আমাদের পাশের বাড়ীতে একবার এক ভাড়াটে এসে আট-দশমাস ছিল। তাদের শক্তিধর ব’লে একটা ছেলে ছিল―তাকে তোমার মনে পড়ে, দাদা?

    ―পড়ে। বড় দুর্দান্ত ছিল ছেলেটা। তার কথা হঠাৎ তোমার মনে প’ড়ে গেল কেন?

    ―–এই এ’কে দেখে। দু’জনের চেহারায় আশ্চর্য মিল–ভুরু থেকে চিবুক পর্যন্ত অবিকল এক রকম।

    ―তোমার এতও মনে থাকে; তখন ত’ তুমি আট-নয় বছরের।

    ―তার কারণ আছে। অত মার আমি কারু কাছে খাইনি―পদার্পণ ক’রেই সে

    একদণ্ডেই আমাদের আজ্ঞাবহ ভৃত্য ক’রে নিয়েছিল। বেশ মনে পড়ে; আর তার তেজের তারিফ মনে মনে এখনো করি আমি।

    ―সেও হতে পারে, বৃহত্তর সংস্করণ।

    ―না, সে নয়। নাম বললে সিদ্ধার্থ বসু; আর তার ভুরুর কোণে কাটার একটা দাগ ছিল, এ’র তা নেই। সন্দেহ হতেই আমি সেটা লক্ষ্য করেছি।

    চায়ের সঙ্গে অজয়ার গানের কথা রজতের মনেই রহিল না–বাহিরে অকাতর ভাব দেখাইলেও, ভিতরে তার দুর্দশার অবধি ছিল না। মৃত্যুমুখে সত্যই সে পতিত হইত কি-না বলা যায় না; কিন্তু তার চরম ত্রাস আর অশেষ বিভীষিকা তার অন্তর-পুরুষটিকে বহুক্ষণ মুহুর্মুহুঃ ঝাঁক দিয়া দিয়া একেবারে শীর্ণ ধরাশায়ী করিয়া রাখিয়া গেছে।

    নিঃশব্দে চা শেষ করিয়া রজত উঠিয়া পড়িল। বলিল,―শরীর আর মনটা বড্ড ঝাঁকানি খেয়েছে; বিশ্রাম করিগে।

    সিদ্ধার্থ তার লাঠিখানা হঠাৎ ফেলিয়া গিয়াছিল। ননী সেটা দুই হাতে ধরিয়া তুলিয়া বলিল,―যেমন বাহার তেমনি বহর। সৌখীন বটে। আধ মণের কম নয়!―সিদ্ধার্থ বসু।

    অজয়া বলিল―কোথায়?

    ―তিনি বোধ হয় অন্ধকারে লুপ্ত হয়ে গেছেন এতক্ষণ―আমি বলছি নামের কথা―এই লাঠির মাথায় রূপোর গায়ে লেখা রয়েছে।

    কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ননী হঠাৎ বলিয়া উঠিল,―উঃ, কি চেহারা, যেন দ্বিতীয় বৃকোদর! চোখ দুটো দেখেছ দিদিমণি, যেন জ্বলছিল।

    ―জ্বলছিল নাকি? তা ত’ দেখিনি–বাতির মত, না কয়লার মত?

    ―অন্ধকারে শিকারী বেড়ালের চোখের মত।

    অজয়া রজতের পরিত্রাণের কথাটাই ভাবিতেছিল। মিনিটখানেক অন্যমনস্কের মত চাহিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিল,―ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

    ননী হাসিতে লগিল। বলিল,―দেবারই কথা। ঐ চোখ, তার ওপর গোঁফের গোছা―ইয়া!

    কিন্তু অজয়া ধম্‌কাইয়া উঠিল,―অন্তত আজকার দিনটা তাঁর উপকার স্মরণ কর; তা না পারিস, চুপ ক’রে থাক। মানুষের চেহারা নিয়ে ইতরের মত বিদ্রূপ করিসনে।

    ননী ধমক খাইয়া নির্বিকারে চুপ করিয়া থাকিবার মেয়ে নয় তেমনি হাসিতে হাসিতেই বলিল,―আমি ত’ বিদ্রূপ করিনি দিদিমণি; তুমি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে বললে। আমি ভুল ক’রে ভেবেছি, ঐ বুঝি তার কারণ। কথা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি―কসুর মাপ করো।

    এবার অজয়াও হাসিয়া ফেলিল। বলিল,-তবু হাসছিস যে?

    ―আমার হাসি তুমি দেখো না; আমার হাসির কোনো মানে নেই।

    ―আমায় একটি কথায় ভুলোতে চাসনে, ননী। তোর মনের কথা আমি বুঝেছি।

    –তুমি কথা ফেনাচ্ছ দিদিমণি; সরল হাসির বড় জটিল অর্থ করছো। কিন্তু পুরুষের প্রতিপত্তিটা ঠিক বজায় আছে দেখছি―আদিকালে যেমন ছিল।

    ―মানে?

    ―কবে কে তেজ দেখিয়েছিল, তুমি তাই মনে ক’রে আজ সিদ্ধার্থ বাবুর দিকে ভালো ক’রে চাইতেই পারলে না।

    ―তোমার সন্দেহ অমূলক।―কি, মাণিক?

    মাণিক বলিল,―খাবার দিয়েছে। দাদাবাবু নামতে বললেন।

    .

    মাণিক চলিয়া গেলে ননী বলিল,―দেখলে মাণিকের চেহারাখানা! সেই জরিমানার দিন থেকে হাঁসা বন্ধ ক’রে দিয়েছে; মদন ত’ ক্ৰমাগত কাঁদছে।

    ―আর পারিনে। ব’লে দিস, এবারকার মত জরিমানা মাপ করা গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপোকা-মাকড় – জগদানন্দ রায়
    Next Article অব্যক্ত – জগদীশচন্দ্র বসু
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }