Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অসাধু সিদ্ধার্থ – জগদীশ গুপ্ত

    জগদীশ গুপ্ত এক পাতা গল্প138 Mins Read0

    অসাধু সিদ্ধার্থ – ৯

    ॥ নয় ॥

    অজয়াকে নাম ধরিয়া ডাকাতি সিদ্ধার্থর একটা অসম্বরণীয় লোলুপতা আসিয়াছে। তার মনে হয়, নামোচ্চারণের সঙ্গে যেন তার জীবনের সমস্ত গ্লানি কাটিয়া নূতন জগতের সুপ্রসর উদার শ্রীক্ষেত্রে সে মহোল্লাসে ভূমিষ্ট হইবে। মনে মনে অনুক্ষণ নামটি জপ করিয়া সিদ্ধার্থ তার সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রী আর প্রত্যেকটি রক্তবিন্দুকে পিপাসাতুর করিয়া তুলিয়াছে।

    কিন্তু সে-দিনের দেরী আছে।

    .

    সিদ্ধার্থ বলিতেছিল,―অতি সুন্দর! প্রকৃতির প্রকৃত মুখচ্ছবি―বিস্তৃত প্রান্তর―ঢেউয়ে ঢেউয়ে প্রসারিত হয়ে দৃষ্টি যেখানে হারিয়ে যায়, সেইখানেই মেঘের গায়ে শেষ হয়েছে। গাছগুলি ক্রমশ ক্ষুদ্রতম হয়ে বিন্দুবৎ ক্ষুদ্র হয়ে গেছে―তাদের মাথায় মাথায় পল্লবের মুকুট। এতদূরে―বিন্দুটির মত, তবু কেমন স্পষ্ট, আকাশ যেন গতিশীল হয়ে বয়ে চলেছে―সচল মেঘ, তার কোলে সচল একটি পাখীর ঝাঁক।―বলিয়া ছবিখানা দিকে অতিশয় উৎফুল্ল দৃষ্টিতে খানিক চাহিয়া থাকিয়া সিদ্ধার্থ পুনরায় বলিল, ―অতুলনীয়! বিমলবাবুর কি মত?

    দিদির আঁকা ছবির প্রশংসায় বিমল গর্বে গদগদ হইয়া উঠিয়াছিল। বলিল, –দিদির কোন কাজই অসুন্দর নয়। জানেন না বুঝি―দিদি যে প্রাইজ-হোল্ডার; ছবি এঁকে প্রাইজ পেয়েছে। সে ছবিখানা কোথাকার এক মহারাজা কিনে নিতে চেয়েছিল কত টাকা দিয়ে যেন, দিদি?

    অজয়া বলিল,–মনে নেই, তুই থাম।–বলিয়া বিমলের দিকে চাহিয়া সে তৃপ্তিভরে হাসিতে লাগিল।

    সিদ্ধার্থ বলিল,―না না, বলতে দিন। মনের ভক্তিকে বাধা দিলে মানুষের হানি করা হয়। তারপর কি হ’ল বিমালবাবু?

    ―কি আর হবে? আমরা দিলাম না!

    কিন্তু সিদ্ধার্থর বড় গোল বাধিয়া গেল―সে সেই মহারাজার স্পর্ধার দিকেই চোখ রাঙাইবে, কি এদের নিলোর্ভ আত্মসম্মানের তারিফ করিবে, কি অজয়ার পুরস্কার লাভে আনন্দ করিবে―সঙ্গে সঙ্গেই তাহা কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া যখন বিমলের তেড়ী কাটার নিন্দা করিতে যাইবে, এমন সময় সুন্দর একটা কথা তার মনে পড়িয়া গেল; বলিল –আপনি নিজেই ভাবের একটা স্ফুর্তি, তাই ভাবকে অনায়াসেই মূর্তি দিয়ে সামনে এনে দাঁড় করাতে পারেন―আজকালকার ছবিতে কেবল পরের মস্তিষ্কের ছন্দোময়ী ভাবকে নির্জীব একটা আকার দেওয়া হচ্ছে।–বলিয়া সিদ্ধার্থ চিত্রশিল্পের অধোগতিতে অত্যন্ত অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল।

    অজয়ার কিছু বলিবার ছিল না।

    সিদ্ধার্থই প্রশ্ন করিল,―আপনার সে ছবিখানার পরিকল্পনা কি?

    ―ঈর্ষা আর লোভ। নির্বিকার ভোগ আর অনাবিল সুখশান্তির মাঝখানে এরা দু’টিই স্ফীত হয়ে আছে―এদেরই আত্মপ্রসার দুর্বার হয়ে মানুষকে রাসতলের দিকে টেনে নামাচ্ছে।

    সিদ্ধার্থ বলিল, ―বাঃ!

    ―কিন্তু দাদা বলে―

    হঠাৎ অকথিত কথারই প্রতিবাদ আসিয়া পড়িল।

    রজত প্রবেশ করিয়া বলিল, দাদা কি বলে? তোমার ছবি অতি যাচ্ছেতাই―অপ্রকৃতিস্থ মনের নির্বাক প্রলাপ, নিষ্কর্মা বৃদ্ধার অসমাপ্ত কাঁথা-এইসব বলে?

    অজয়া হাসিল, না, ঠিক তা বলে না।

    ―তবে?

    ―রজতবাবু যা-ই বলুন, সেটা ওর মনের আসল কথা নয়।–বলিয়া সিদ্ধার্থ একটা আপোষের চেষ্টা করিল।

    কিন্তু রজত বলিল, –অর্থাৎ অসদুদ্দেশ্যহীন অসত্য। কিন্তু অসত্যকে সদুদ্দেশ্যের অলঙ্কার পরালেই সে নির্দোষ হয় না। তবে আসল কথা এই যে, আমার মন্তব্যের কোন মূল্য নেই।

    ―যদি মূল্য থাকে, তবে?

    ―তবে ধ’রে নিতে পারো যে, তোমার ছবি বিকৃত মস্তিষ্কের খেয়াল নয়, অসুস্থ ভাল কথা, তোমার একটি ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, চিঠি এসেছে।

    হঠাৎ একটা ধাঁধা লাগিয়া সিদ্ধার্থ স্পষ্টই চম্‌কিয়া উঠিল,―কার ছেলে?

    ―অজয়ার। ছেলে কি একটি-দু’টি! আটগণ্ডার কাছাকাছি।

    ছেলের সংখ্যা শুনিয়া সিদ্ধার্থর “ধড়ে প্রাণ” আসিলেও অন্য দিক দিয়া একটা

    অশান্তির উদয় হইল। তাহার ঐ চম্‌কিয়া ওঠার আর ব্যগ্র প্রশ্নটার একটা অর্থ উহারা নিশ্চয়ই করিয়া লইয়াছে।

    সে অর্থটা কি!

    অজয়ার ছেলে আছে শুনিয়া যে আঁতকাইয়া ওঠে সে নিশ্চয়ই কোথাও একটা দাবী সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা পোষণ করিতেছে, ইহা বুঝিয়া ফেলা ত’ কাহারো পক্ষেই অসম্ভব নহে। তাহার তরফের উদ্দেশ্যটা যদি একেবারে সোজা যাইয়া উহাদের সম্মুখে সত্যই দাঁড়াইয়া থাকে, তবে আজ হইতে এই আসা-যাওয়া সম্পূর্ণ বৃথা। নিজেকে সে ধিক্কার দিলো―মনের উপর যার এতটুকু আধিপত্য নাই, তার ষড়যন্ত্রের মধ্যে যাওয়া ক্ষ্যাপামি। সিদ্ধার্থ রজতের দিকে চাহিয়া নিজেকে লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িল।

    অজয়া বলিল,―কি অসুখ? কোটির?

    ―যার নাম রেখেছিলে দুঃখ, তারি। সামান্য অসুখ, সুর্দি-জ্বর। তোমার জন্যে বড় উতলা হয়েছে।―বলিয়া রজত সিদ্ধার্থর দিকে ফিরিল, বলিল,―আপনি হয় ত ভাবছেন, এরা বলে কি! অজয়ার অনেকগুলি পালিত পুত্রকন্যা আছে। রাস্তা থেকে অনাথ ছেলেমেয়ে কুড়িয়ে এনে―তা সে যে জাতেরই হোক, যেভাবেই তাদের জন্ম হয়ে থাক―কুড়িয়ে এনে, এক ডিপো করেছে, সেখানে নিয়ে তুলবে। ছ’মাসেই ছাব্বিশ-সাতাশটি সংগ্রহ করেছে।–বলিয়া রজত নিজেও অতিশয় পুলকিত হইয়া উঠিল।

    কিন্তু সকলের চেয়ে সুবিধা হইয়া গেল সিদ্ধার্থর―এইটিই তার নিজস্ব বিভাগ।

    চোখ-মুখ-হাত-পা ভাবাবেগে বিস্ফারিত করিয়া সে বলিতে লাগিল,–আ―এই ত’ মায়ের জাতির কাজ―মমতা উৎসের অর্গল খুলে দিয়ে অনাথের হাহাকারের নিবৃত্তি ক’রে দে’য়া। আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হয়েছিলাম, আজ ধন্য হলাম।–বলিয়া সে এমন করিয়া অজয়ার দিকে চাহিল যেন সেখান হইতেও একটা ধন্য ধন্য রবই সে আশা করিতেছে।

    অজয়া মুখ নত করিয়াছিল। সিদ্ধার্থর আশা পূর্ণ হইল না।

    রজত বলিল,―আপনারও কি ঐ মত?

    সিদ্ধার্থ মনে মনে বলিল,―তুমিও ধন্য হে বাক্যবাগীশ। চলবার পথ আরো বাড়িয়ে দাও।―প্রকাশ্যে বলিল,-ভিন্নমতের লোক আছে এই ত’ আমার পরম দুঃখ। পতিতকে ত্যাগ না ক’রে তাকে তুলে আনার চেয়ে বড় কাজ আর কি আছে জানিনে আমরা আত্মাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ গণ্য করি, কিন্তু কাজে বাহিরের অশুচির বিরুদ্ধে আমাদের দেহের সতর্কতার সীমা নাই; যেন―

    ―কিন্তু তাই ব’লে চোর-চামার-জারজ।

    একটি পলকের জন্য সিদ্ধার্থর মন যেন দিশেহারা হইয়া গেল। পরক্ষণেই, রজতের কথাটা যেন কানে যায় নাই, এমনিভাবে সে বলিতে লাগিল,–নিজের সামাজিক অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকা কর্তব্য―এইটি মনে করিয়ে দিয়ে যাদের আমরা উঠতে দিই না, উঠতে চেষ্টা করলে ধর্মের রব তুলে যাদের মাথার উপর দেবতার নামে লাঠি উদ্যত করি, তাদের প্রশান্ত বাহ্য অবয়বের নীচে কত বড় একটা বিক্ষোভ অহনিশি আলোড়িত হচ্ছে তা বুঝি আমরা কল্পনাও করতে পারিনে।–বলিয়া সিদ্ধার্থ একটু থামিয়া প্রশ্ন করিল,―তাদের ধমনীতে জল না রক্ত বইছে?

    এবং নিজেই তার উত্তর দিল,―রক্তই বইছে। আর সে-রক্ত ফুটছে। ধর্মের গ্লানির ভয়ে কল্পিত বড়-র পা চিরদিন তারা কন্ঠের উপর রাখবে না।–বলিয়া সিদ্ধার্থ অনাগত সেই নির্মুক্তির আনন্দে ঐখানে বসিয়াই বিভোর হইয়া গেল।

    রজত বলিল,–কি করবে?

    ―”তোমার মাথা চিবিয়ে খাব।” কিন্তু এটা সিদ্ধার্থর মন যা বলিল তা-ই। মুখে সে বলিল,–ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠবে তার আয়োজন সুরু হয়ে গেছে―তা না পারে সর্বশুদ্ধ রসাতলে নামিয়ে দেবে। বসুধার সঙ্গে কুটুম্বিতা পাতিয়ে অস্পৃশ্য ব’লে যে পাশের বাড়ীর ছায়া মাড়ায় না, তার যে দুর্গতি অনিবার্য তাই ঘটবে―ভগ্নাংশ তাঁর ঘটেই গেছে। বিপদে বসুধা মুখ ফিরিয়ে থাকবে, ডাকতে হবে অস্পৃশ্যকে। কিন্তু চরম বিপদ দুয়ারে, বসুধাও টিপে টিপে হেসে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে-তবু আমাদের মনে পড়ছে না যে বিপদ-বারণ পাশের বাড়ীতে। ভগবান আমাদের নিজেকে দিয়ে যেদিন নিজেকে চূড়ান্ত অপমান করাবেন সেই দিনটাকে আমি প্রাণপণে ডাকছি।―বলিয়া সিদ্ধার্থ একবার চোখ বুজিল―যেন ভগবানকে ডাকিবার এটাও একটা অবসর।

    রজত বলিল,―অজয়াও আপনার মত বিপ্লববাদী। সে বলে, দেশের যারা যথার্থ শক্তি, যথার্থ মর্ম, আমরা চাষের ভুঁই, বাসের বাড়ী থেকে পূজার মন্দির পর্যন্ত সর্বত্র সর্ব অধিকারে বঞ্চিত ক’রে তাদের এমন কোণঠাসা করে রেখেছি যে―

    ―তাদের মানসিক মৃত্যু ঘটেছে।―বলিয়া রজতের মুখের কথা যেন থাবা মারিয়া কাড়িয়া লইয়া সিদ্ধার্থ বলিতে লাগিল,―কোনো ব্যষ্টি কি সমষ্টিকে এমন অধিকার দে’য়া যেতে পারে না, যার বলে সে অপরের মানসিক মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা করতে পারে। যে শাসনের যথেচ্ছারিতা মানুষের আত্মার সর্বনাশ করে, তার মূলোচ্ছেদ যত শীঘ্র ঘটে ততই মঙ্গল। উনি ঠিক বলেন।–বলিয়া সিদ্ধার্থ চোখ বড় করিয়া অজয়ার দিকে চাহিল।

    দেখিল, অজয়ার মুখ প্রজ্ঞায় সংযমে যেমন গম্ভীর ঠিক তেমনিই আছে, কেবল গাম্ভীর্যের উপর অতুল শ্রীসম্পন্ন একটি দীপ্তি ফুটিয়া উঠিয়াছে।

    সিদ্ধার্থ “শ্রম সার্থক জ্ঞান” করিল।

    আসরের গরম কাটিয়া যায় অথচ কেহ কিছু বলে না দেখিয়া সিদ্ধার্থ বলিতে লাগিল, –ভগবান জাত দেখেন না, দেখেন মানুষের মনটি, তার সূক্ষ্ম গতিটি, তার নিগূঢ়তম অনাসক্তি। আমরা অকারণে বিস্মিত হয়ে যাই―যখন দেখি, ঘৃণ্যতম পতিতাও এক নিমেষে ভগবানের কৃপা লাভ করে। আমাদের কাজ যেমন স্থুল আর ইতর, মনটাও তেমনি নিশ্চল আর মলিন―ভগবান তাই তাঁর দৃষ্টি আমাদের ওপর থেকে তুলে নিয়েছেন।

    রজত বলিল,–অনেকেই ত’ আজকাল অনাবশ্যক সংস্কারের প্রতিকূলে দাঁড়িয়েছে। বলতে সুরু করেছে, সবাই স্বাধীন চিন্তার অধিকারী। ধর্মের ক্ষেত্র তোমার―আমার সকলের। অন্ধঅনুকরণের মত অন্ধ অনুসরণও বিপজ্জনক। যুক্তিই গণ্য। ধৰ্ম বাহ্যিক অনুষ্ঠানেই নিবন্ধ নহে―তার প্রাণ আরো গভীর স্থানে। কাজেই অনুষ্ঠানের বাহুল্য বর্জন করে ধর্মের যে মূল শক্তি তাকেই প্রসারিত করো, ইত্যাদি। ছুঁৎমার্গ পরিহার ত হয়ে এলো বলে!

    ―শুধু মত প্রচার করছে, কাজে কেউ করছে না। আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে কেবল (অজয়ার প্রতি) আপনাকে দেখলাম। ঋষির তপোসিদ্ধি আর সত্যানুভূতির চেয়েও আপনার কাজ বরণীয়। লজ্জিত হবেন না, মিথ্যা স্তুতিবাদ করছিনে।―বলিয়া নিজেই যেন একটু লজ্জিত হইয়া সিদ্ধার্থ মুখ ফিরাইল।

    তার কারণ আছে। স্তুতিবাদ নহে বলিয়া মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করিলেও কথাগুলির একটা পিঠ যেমন মাজিত ঝকঝকে, উল্টা পিঠটা তেমনি কলঙ্কিত―মলিন দিকটা রহিয়াছে কেবল তাহারি গোচরে।

    কথাগুলির পরিষ্কার অর্থ সে করিতে পারে।

    যে প্রয়োজনে সেগুলিকে সে লাগাইতে বসিয়াছে তাহার অর্থও পরিষ্কার।

    কেবল পরিষ্কার নহে সে নিজে। নিজেরই দূষিত নিঃশ্বাসে মলিন দিকটা তাহার চোখের সম্মুখেই ছিল―স্তুতিবাদের কথাটায় যেন এক ঝলক অতিরিক্ত ফুৎকার পাইয়া তাহা চতুর্ণ কালো হইয়া উঠিল।

    অজয়া বলিল,―ধর্মের সঙ্গে সম্বন্ধ হিসাবে আমি সে কাজ করিনি, অনুগ্রহ হিসাবেই করেছি, কিন্তু আপনি তার যে অর্থ করেছেন―

    ―তা কষ্টকল্পনা নয়। আপনি নিজের অজ্ঞাতসারেই এই হতভাগা দেশের বড় ব্যথার স্থানটিতে প্রলেপ দিচ্ছেন। চারিদিকে একবার চাহিয়া লইয়া সিদ্ধার্থ বলিতে লাগিল, –একটি মানুষকে পথ থেকে কুড়িয়ে এনে তাকে শিক্ষিত ভদ্র করে তুললে দেশের যথার্থ জনসংখ্যা আর চরিত্রবল বাড়ে। অস্পৃশ্য ব’লে কেউ ঘৃণা না করলে বোঝা যায় না, সেই ঘৃণার আঘাত কত বড় আঘাত। বুঝেছি―বাইরে থেকে সে আঘাত হাতুড়ির ঘায়ের মত বুকে এসে পড়ছে, আর্তনাদ করছি; আবার নিজেরই ঘরের লোকের বুকে সেই আঘাতই করতে আমাদের বাধছে না।

    অজয়া এই সময় হঠাৎ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল।

    কি কারণে তার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়িল কে জানে; কিন্তু তাহাকে নিজের অনুকূলে টানিয়া লইয়া সিদ্ধার্থ আরও উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। বলিল,―আপনার দীর্ঘ নিঃশ্বাসটি শুধু ফুসফুসের বায়ু নয়―বহুদিনের সঞ্চিত ব্যথার ইতিহাস। (রজতের প্রতি) আপনারা অর্থশালী; অর্থের সাহায্যে যতটুকু কাজ হওয়া সম্ভব―

    ধনস্থানে স্পর্শ সহে না জানিয়া শুনিয়াও কি উদ্দেশ্যে সিদ্ধার্থ অর্থশালীর অর্থ―সাহায্যের কথাটা বলিয়াছিল তাহা নিজেই সে জানে না। বোধ হয় আবেগে―

    কিন্তু তাহাকে থামিয়া ঢোক পিলিতে হইল। অর্থশালীর অর্থ সাহায্যে কতটুকু কাজ হওয়া সম্ভব তাহা তখনকার মত অনির্দিষ্ট রহিয়া গেল।

    রজত পা মোড়া দিয়া তুড়ি বাজাইয়া হাই তুলিয়া বলিল,―হরি, হরি।

    সিদ্ধার্থ আসন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সকৌতুকে বলিল,―রজতবাবু হাই তুলছেন, মানে বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। চা খান, আমি আসি।

    কিন্তু যথার্থ বিরক্ত হইয়াছিল অজয়া। সিদ্ধার্থর উচ্চারিত কথাগুলি তার মন্দ লাগিতেছিল না। নূতন নয়, কিন্তু বেশ পরিপুষ্ট কথাগুলি; কণ্ঠ সবল

    দুটিতে মিলিয়া তাহার সম্মুখে যেন একটা মনের আশ্রয়ভূমি প্রসারিত করিয়া দিতেছিল।

    তার উপর হাই তোলাটাও ঠিক সময়োচিত হয় নাই।

    অজয়াও উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল,―যাবেন না, বসুন। চা না খান, সরবৎ ক’রে দিচ্ছি।

    শুনিয়া সিদ্ধার্থ একটু হাসিল―বড় করুণ হাসি। বলিল,―বড়ই লজ্জা বোধ করছি। আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। আমার রূঢ় ব্যবহার মার্জনা করুন। ―বলিয়া উভয়কে সে নমস্কার করিল; এবং অজয়ার নির্বন্ধ-অনুরোধের মধ্যে যে সুধারস ছিল তাহাতেই অন্তর পরিপূর্ণ করিয়া লইয়া সে প্রস্থান করিল।

    .

    সিদ্ধার্থর পায়ের শব্দ সিঁড়ির শেষে শেষ হইল।

    রজত বলিল,-বক্তা ভাল, বক্তৃতার বিষয় ভাল, বক্তৃতা হৃদয়গ্রাহী, বলবার ভঙ্গীও চমৎকার; কিন্তু একটা জিনিস আমার ভাল লাগল না।

    সিদ্ধার্থর পায়ের শব্দ শুনিতে শুনিতে অজয়া একটা বেদনা অনুভব করিতেছিল।

    মানুষ একটি মূহূর্ত বসিয়াও যেমন করিয়া বিদায় লইয়া যায়, যাঁহার পায়ের শব্দ সিঁড়ি ছাড়াইয়া ঐ মিলাইয়া গেল তাঁহার যাওয়ায় তেমনটি ত’ ঘটে নাই করুণ একটা ব্যতিক্রম ঘটিয়াছে। বিদায়ের মধ্যেও সমগ্রতার মাধুর্য থাকে।

    সিদ্ধার্থ চলিয়া গেলে বিদায়ের সেই অপরিপূর্ণতাই অজয়াকে দুঃখ দিতেছিল।

    রজতের কথার প্রত্যুত্তরে অত্যন্ত অসন্তুষ্টভাবে মুখ তুলিয়া সে বলিল,―কি সে জিনিষটা?

    ―ঐ নাটকীয় প্রস্থানটি। ভাবটা যেন, তোমাদের মানসিক খোরাক দিয়ে গেলাম, ব’সে চর্বিত চর্বণ করো।

    ―সঙ্গীর অপ্রীতিকর হয়ে বসে থাকার চেয়ে স্থানত্যাগ করাই ভাল, তা তিনি জানেন। এখন নিজেকে বাঁচিয়ে একটা অর্থ ক’রে তাঁর প্রতি তুমি অবিচার করছো।

    ―অবিচার না থাকলে দাক্ষিণ্যের সুযোগই যে মেলে না। যাই হোক, সিদ্ধাৰ্থ বাবু যে ব’লে গেলেন―”বাইরে থেকে আঘাত পাচ্ছি, আর্তনাদ করছি”―তাৎপর্য কিছু বুঝলে এর?

    ―রঙের পার্থক্য বোধ হয়। সাদা―

    রজত হাত তুলিয়া দাঁতে জিব কাটিয়া বলিল,―চুপ, চুপ! শেষে কি দেশের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে তুমি! ননী? চা!

    ―সে ইচ্ছা আমার মোটেই নেই। সিদ্ধার্থ বাবুকেও ব’লে দেব ঐ রকম সব দুঃসাহসিক কথা বাংলা ভাষায় তিনি যেন প্রকাশ না করেন।

    বলিতে বলিতে হঠাৎ সে রজতের পায়ের তলায় বসিয়া পড়িল। মুখ তুলিয়া বলিল―একটা গান লিখেছি দাদা, শুনবে না?

    ―শুনব। শোনবার জন্যেই ত’ হাই উঠছিল, সিদ্ধার্থ বাবুও তাকে ভুল বুঝলেন, তুমিও ভুল বুঝলে। মৌত্যত যে কি ব্যাপার তা তোমরা জানো না।

    ননী চা আনিয়া দিল।

    বলিল,–উঃ, যেন কামারে লোহা পিটছিল। এমন বোদা আওয়াজে কথা কওয়া কারো উচিত নয়, শুনে শুনে যেন বুকের ভেতর গুর্গুর্ করে। দাদাবাবু, আমার কিন্তু একটু সন্দেহ হয়।

    ―বলো, এবং শীগগির বলো।

    ―ভয়ে বলি, না নিৰ্ভয়ে বলি?

    ―নির্ভয়ে বলো।

    ―ফুলের তোড়া আর বেনামী চিঠি পাঠিয়েছিলেন উনি।

    রজত তাড়াতাড়ি পেয়ালার ভিতর নজর দিল।

    অজয়া জ্বলিয়া উঠিল। বলিল,―অনুপস্থিত ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে তোমার এই সন্দেহ এমন কুৎসিত যে ধৈর্য রাখা কঠিন। হঠাৎ সন্দেহটা এসে গেল কি কারণে শুনি?

    হাতে হাতে প্রমাণ দেখাইয়া দিতে পারিলে সন্দেহ আর সন্দেহ থাকে না।

    সেই কথাটাই ননী বলিতে যাইতেছিল। কিন্তু রজতের চায়ের তৃষ্ণা তখন সর্বগ্রাসী হইয়া উঠিয়াছে; সে চাপা দিয়া দিলো,–ননী, সে পরে হবে। অজয়া, দিদি, আমার কিন্তু কোনো অপরাধ নেই।

    ―নেই তা জানি।

    তারপর মুহূর্তেক নিঃশব্দ থাকিয়া অজয়া বলিয়া উঠিল―কোনো দেবতা যদি দয়া ক’রে বর দিতে আসেন তাহলে আমি কি বর চাই জানো, দাদা?

    ―না, তা জানিনে, তবে চায়ের মাথায় বজ্র পড়ুক বলে―

    ―এই চাই, তুমি যেমন আমার দাদা তেমনি দাদা যেন সবারই হয়, আর সেই দাদাকে যেন কোনোদিন অসহায় ক’রে ছেড়ে যেতে না হয়।

    দেবতা তেত্রিশ কোটি হলেও তাঁদের প্রত্যেকেরই একটা নির্দিষ্ট কাজ আছে মনে হয়। মানুষকে বর দেবার কাজ কারো আছে বলে নরলোকে জানা নেই; সেদিকে তাঁদের কাউকে টানতে হলে বিস্তর তপস্যা দরকার। তোমার সে সম্বল―হঠাৎ ছেড়ে যাবার স্বার্থক কথাটা কেন বললে, অজয়া? ছেড়ে যাবে কোথায়?

    কোথাও না। চোখ বুজে গান শোনো।―বলিয়া অজয়া উঠিল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপোকা-মাকড় – জগদানন্দ রায়
    Next Article অব্যক্ত – জগদীশচন্দ্র বসু
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }