Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অহিংসা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প288 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৭. কয়েকদিন জ্বরে ভুগিয়া মহেশ চৌধুরী সারিয়া উঠিলেন

    কয়েকদিন জ্বরে ভুগিয়া মহেশ চৌধুরী সারিয়া উঠিলেন। এ কয়দিন কত লোক আসিয়া যে তার খবর জানিয়া গেল, হিসাব হয় না। কেবল খবর জানা নয়, পায়ের ধুলা চাই। সদানন্দের আশ্রম জয় করিয়া আসিয়া মহেশ চৌধুরীও পর্যায়ে উঠিয়া গিয়াছেন। লোকের ভিড়েই মহেশ চৌধুরীর প্রাণ বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছিল, মাধবীলতাকে পৌঁছিয়া দিতে আসিয়া কথায় কথায় এই বিপদের কথাটা শুনিয়া বিপিন ভালো পরামর্শ দিয়া গেল। পরদিন হইতে শশধর সকলকে একটি করিয়া তুলসীপাতা বিতরণ করিয়া দিতে লাগিল–উঠানের মস্ত তুলসীগাছটি দেখিতে দেখিতে দু-একদিনের মধ্যে হইয়া গেল প্ৰায় ন্যাড়া। যারা আসে, তাদের প্রায় সকলেই চাষী-মজুরকামার-কুমার শ্রেণীর এবং বেশিরভাগই স্ত্রীলোক–তুলসীপাতা পাইয়াই তারা কৃতার্থ হইয়া যাইতে লাগিল।

    বিপিন প্রত্যেক দিন খবর জানিতে আসে। কার খবর জানিতে আসে, মহেশের অথবা মাধবীলতার সেটা অবশ্য ঠিক বোঝা যায় না। যদিও মহেশের কাছেই সে বসিয়া থাকে অনেকক্ষণ, আলাপ করে নানা বিষয়ে। আশ্রমে বিপিনের কাছে মহেশ বহুদিন ধরিয়া যে অবহেলা অপমান পাইয়া আসিতেছে, সে কথা কেউ ভুলিতে পারিতেছিল না, এখন মহেশের খাতির দেখিয়া সকলে অবাক হইয়া গিয়াছে। আশ্রমের কদমগাছের নিচেই কি মহেশের সব লাঞ্ছনার সমাপ্তি ঘটিয়াছে? সদানন্দ কি সত্যই এতকাল মহেশকে পরীক্ষা করিতেছিলেন, বিপিন এবং আশ্রমের অন্যান্য সকলে তারই ইঙ্গিতে মহেশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিতেছিল? পরীক্ষায় মহেশ সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ায় এবার বিপিন বাড়ি আসিয়া তার সঙ্গে ভাব করিয়া যাইতেছে, সেবার জন্য মাধবীলতাকে এখানে পাঠাইয়া দিয়াছে?

    বিপিন আসে, নানা বিষয়ে আলোচনা করে, আর মহেশ চৌধুরীর ভক্তদের বিশেষভাবে লক্ষ করিয়া দ্যাখে। কয়েকদিন পরে মহেশ চৌধুরীর আশীর্বাদপ্রার্থীদের সংখ্যাও কমিয়া যাইতে থাকে, বিপিনের উৎসাহেও যেন ভাটা পড়িয়া যায়। প্রতিদিন আর তাকে বাগবাদায় দেখা যায় না। আসিলেও মহেশের কাছে সে বেশিক্ষণ বসে না।

    মহেশ ব্যাকুলভাবে মাধবীলতাকে জিজ্ঞাসা করে, বিপিনবাবু যে আর আসেন না মা?

    মাধবীলতা বলে, কাজের মানুষ, নানা হাঙ্গামায় আছেন, সময় পান না।

    বড় ভালো লোক। কি বুদ্ধি, কি কৰ্মশক্তি, কি তেজ, কি উৎসাহ–সবরকম গুণ আছে। ভদ্রলোকের। এমন একটা মানুষের মতো মানুষ, জান মা, আমি আর দেখি নি।

    বিপিনের এরকম উচ্ছাসিত প্রশংসা শুনিয়া মাধবীলতা হাসিবে না দিবে, ভাবিয়া পায় না। বুদ্ধি হয়তো আছে, কিন্তু বুদ্ধি থাকিলেই কি তোক ভালো হয় নাকি? ওই স্তিমিত নিস্তেজ মানুষটার কর্মশক্তি, তেজ আর উৎসাহ!–যার মুখের চিরস্থায়ী বিষাদের ছাপ সংক্রামিত হইয়া মানুষের মনে বৈরাগ্য জাগে?

    এখানে মাধবীলতার ভালো লাগে না। মহেশ যে কদিন দক্ষিণের ভিটার ঘরটিতে দেড় শ বছরের পুরোনো খাটে শুইয়া জ্বরের ঘোরে ধুঁকিতে ধুঁকিতে থাকিয়া থাকিয়া বলিত, ওরা আমার কাছে আসছে কেন? প্রভুর কাছে পাঠিয়ে দাও ওদের, সে কদিন সেবার হাঙ্গামায় একরকম কাটিয়া গিয়াছিল, মহেশ সুস্থ হইয়া উঠিবার পর মাধবীলতার সব একঘেয়ে লাগে। গ্রামের মেয়েরা দু-চার জন করিয়া সকলেই প্রায় মাধবীলতাকে দেখিয়া গিয়াছে। পাড়ার কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হইয়াছে। কিন্তু এদের মাধবীলতার ভালো লাগে না। তাই নিজেও সে এদের কাউকে কাছে। টানিবার চেষ্টা করে নাই, নিজে হইতে তার গা ঘেঁষিয়া আসিয়া ভাব জানাইবার ভরসাও এদের হয় নাই। বেড়াইতে আসিয়া অভদ্র বিস্ময়ের সঙ্গে এরা মাধবীলতাকে শুধু দেখিয়াই যায়। আশ্রমবাসিনী কুমারী সন্ন্যাসিনী (বয়স কত হইয়াছে ভগবান জানেন) সাধারণ বেশে আশ্রম ছাড়িয়া আসিয়া মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে বাস করিতেছে, গায়ের মেয়েদের কাছে সে কতকটা স্বৰ্গচ্যুতা অপ্সরী কিন্নরীর মতো রহস্যময়ী জীব।

    এখানে মানুষ নাই, বৈচিত্র্য নাই। স্নেহমমতা আদর্যত্ন আছে, বিভূতির মা মেয়ের মতোই মাধবীলতাকে আপন করিয়া ফেলিতে চাহিয়াছেন, কিন্তু কেবল মেয়ের মতো সব সময় একজনের আপন হইতে কি মানুষের ভালো লাগে? আশ্রমের জীবনের পর কেমন নীরস একঘেয়ে মনে হয়। আশ্রম নির্জন, কিন্তু সে অনেক নরনারীর নির্জনতা, আশ্রমের নিয়মে বাধা জীবন শান্ত, কিন্তু সে নিয়মও অসাধারণ, সে শান্তিও অসামান্য। কি যেন ঘটিবার অপেক্ষায় গাছপালায় ঘেরা আশ্রমের ছোট ছোট কুটিরগুলিতে প্রতি মুহূর্তে উন্মুখ হইয়া থাকা যায়–মনে হয়, এই বুঝি আশ্রমের গাম্ভীর্যপূর্ণ শান্তভাব চুরমার করিয়া প্রচণ্ড একটা অবরুদ্ধ শক্তি আত্মপ্রকাশ করিয়া বসিবে, এমন একটা কাণ্ড ঘটিবে যা দেখিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া হাততালি দিয়া নাচা যায়। এখানে কোনোদিন কোনো কিছু ঘটিবার সম্ভাবনা নাই।

    বিপিনকে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করে, উনি কি বললেন?

    কিছু বলেন নি।

    কিছুই না? একেবারে কিছু না?

    বিপিন মাথা নাড়িয়া বলে, কি বলবে? বলবার ক্ষমতা থাকলে তো বলবে। কি কুক্ষণে যে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল মাধু!

    মাধবী ভয় ও বিস্ময়ে চুপ করিয়া থাকে। তার জন্য বিপিন আর সদানন্দের মনান্তর হইয়া গেল? জানালা দিয়া গ্রামের পথ দেখা যায়, বর্ষায় একেবারে শেষ করিয়া দিয়া গিয়াছে, এখনো ভালোরকম মেরামত হয় নাই। পথের ধারে অবনী সমাদ্দারের বাড়ির সামনে একটি গরু বাধা আছে। রোজই বাঁধা থাকে, ঘাসপাতা খায় আর কয়েকদিনের বাছুরটির গা চাটে। আজ বাছুরটি যেন কোথায় হারাইয়া গিয়াছে। আশ্চর্য না? মাধবীলতা যেদিন যেসময় কথা পাড়িল সে চলিয়া আসায় সদানন্দের কি অবস্থা হইয়াছে, সেইদিন সেই সময় বাছুরটি উধাও হইয়া গিয়া গাভীটিকে ব্যাকুল করিয়া তুলিয়াছে।

    আশ্রমের কিসে উন্নতি হবে, সে চিন্তা ওর নেই, দিনরাত নিজের কথাই ভাবছে। আমার এটা হল না, আমার ওটা হল না, আমার এটা চাই, আমার ওটা চাই। ওকে নিয়ে সত্যি মুশকিলে পড়েছি মাধু।

    কেন, উনি বেশ লোক।

    মাধবীলতার মুখে এ কথা শুনিয়া বিপিন প্রায় চমকাইয়া যায়। নৌকায় উঠিবার আগে রাগের মাথায় সদানন্দের কুটিরের দিকে পা বাড়াইয়া, স্টেজে সরলা কোমলা বনবালার অভিনয় করিয়া করিয়া হয়রান হইয়া গরম মেজাজে সাজঘরে ফিরিয়া আসা বেশ্যার মতো ফুঁসিতে ফুঁসিতে মাধবীলতা যেসব কথা বলিয়াছিল, বিপিন তার একটি শব্দও ভোলে নাই। জ্যোঙ্গালোকে দেখা মুখভঙ্গিও ভোলে নাই মাধবীলতার। সদানন্দের অত্যাচার মেয়েটার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে, তার চোখের আড়ালে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করিবার সুযোগ সদানন্দ পাইয়াছে ভাবিয়া, সে রাগের চেয়ে অনুতাপের জ্বালাতেই জ্বলিয়াছিল বেশি। সে বিপিন, আশ্রমের কোথায় মাটির নিচে কোন চারার বীজ হইতে অঙ্কুর মাথা তুলিতেছে, এ খবর পর্যন্ত যে রাখে, তাকে ফঁকি দিয়া সদানন্দ এত কষ্ট দিয়াছে মাধবীলতাকে! কি হইয়াছিল তার? আগেই কেন সে অবস্থা বুঝিয়া ব্যবস্থা করে নাই? কেন আশ্রমকে চুলায় যাইবার অনুমতি দিয়া নিজে গা এলাইয়া দিয়াছিল অসহায় শিশুর মতো?

    সদানন্দের কুটিরের সামনে একটা কদমগাছের নিচে মহেশ চৌধুরীর মহাযুদ্ধ এবং মাধবীলতার মধ্যস্থতায় সে যুদ্ধের সমাপ্তির পর কয়েকটা দিন যেভাবে কাটিয়াছিল, ভাবিলে বিপিনের এখন লজ্জা করে। শরীরটা একটু দুর্বল ছিল কিন্তু দাঁতের ব্যথা ছিল না। স্নায়ু ভোতা হইয়া থাকা উচিত ছিল বিপিনের, শ্ৰান্ত অবসন্ন দেহে দু-তিনদিন পড়িয়া পড়িয়া ঘুমানোই ছিল তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু তার বদলে কি তীব্র মানসিক যন্ত্রণাই সে ভোগ করিয়াছে। বার বার কেবলই তার মনে হইয়াছে, সে কি ভুল করিয়াছে? ছলে-বলে-কৌশলে দিগন্তের কোল হইতে তার আদর্শের সফলতাকে আশ্রমের এই মাটিতে টানিয়া আনিবার সাধনা কি তার ভ্রান্তিবিলাস মাত্র? এভাবে কি বড় কিছু মানুষ করিতে পারে না? নিজের জন্য সে কিছু চায় না, এইটুকুই কি তার নৈতিক শক্তিকে অব্যাহত রাখিবার পক্ষে যথেষ্ট নয়? ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের চেয়ে কার্যসিদ্ধিকে বড় ধরিয়া লইয়াছে বলিয়াই কি তার এত চেষ্টা আর আয়োজন ব্যর্থ হইয়া যাইবে? মনে মনে নিজের দুঃখ কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের হিসাব করিয়া বিপিন বড় দমিয়া গিয়াছে। কতটুকু লাভ হইয়াছে, কতটুকু সাৰ্থকতা আসিয়াছে? কোন্দিকে কতটুকু অগ্রসর হইতে পারিয়াছে? আশ্রম বড় হইয়াছে, আশ্রমের সম্পত্তিও বাড়িয়াছে, লোকজনও বাড়িয়াছে, কিন্তু উন্নতি হয় নাই। ভালো উদ্দেশ্যে যে মিথ্যা আর প্রবঞ্চনা আর ফন্দিবাজিকে সে প্রশ্রয় দিয়া আসিয়াছে, সে সব একান্তভাবে তার নিজস্ব গোপন পরিকল্পনার অঙ্গ, আশ্রমের জীবনে কেন সে সমস্তের প্রতিক্রিয়া ফুটিয়া ওঠে? আর এদিকে মহেশ চৌধুরী, সরল নিরীহ বুদ্ধিহীন ভালোমানুষ মহেশ চৌধুরী, না চাহিয়া সে সকলের হৃদয় জয় করিয়াছে, নিজের দুঃখময় ব্যর্থ জীবনকে পর্যন্ত সার্থকতায় ভরিয়া তুলিয়াছে। কি এমন মহাপুরুষ মহেশ চৌধুরী যে, তার পাগলামি পর্যন্ত মানুষকে মুগ্ধ করিয়া দেয়? আর কি এমন অপরাধ বিপিন করিয়াছে যে, সকলে তাকে কেবল ফাঁকিই দেয়, সদানন্দ হইতে মাধবীলতা পর্যন্ত? এইসব ভাবিতে ভাবিতে বিপিন মড়ার মতো বিছানায় পড়িয়া থাকিয়াছে অন্য মানুষ সে অবস্থায় ছটফট করে। সেই সময়েই বিপিন ভাবিয়া রাখিয়াছিল, মহেশ চৌধুরীর সঙ্গে ভাব করিয়া লোকটাকে একটু ভালোভাবে বুঝিবার চেষ্টা করিবে। তবে বিশেষ উৎসাহ তার ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে মহেশ চৌধুরীকে কাজে লাগাইবার পরিকল্পনা মনের মধ্যে গড়িয়া উঠিয়াছে। এখন আর আশ্রমের পরিসর বাড়ানো সম্ভব নয়, সম্প্রতি যে আমবাগানটা পাওয়া গিয়াছে, তাই লইয়াই আপাতত সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে। সুতরাং রাজাসায়েবের ভয়ে মহেশ চৌধুরীকে এড়াইয়া চলিবার আর তো কোনো কারণ নাই। আশ্রমে অর্থসাহায্য করাও রাজাসায়েব বন্ধ করিয়া দিয়াছেন, কিছুদিন আর পাওয়া যাইবে না। ভবিষ্যতে আবার যদি রাজাসায়েবের কাছে কিছু আদায় করা সম্ভব মনে হয় তখন অবস্থা বুঝিয়া ব্যবস্থা করা যাইবে।

    এদিকে, যাদের চাষাভূষো মানুষ বলে, জনসাধারণ নামে যারা আশ্রমকে ঘিরিয়া আছে গ্রাম আর পল্লীতে, তাদের সঙ্গে আশ্রমের একটু যোগাযোগ ঘটানো দরকার। ওদের বাদ দিয়া কোনো প্রতিষ্ঠানই গড়িয়া তোলা সম্ভব নয়। ওদের সঙ্গে এখন যে সংযোগ আছে আশ্রমের, সে না থাকার মতো। কাছাকাছি কয়েকটি গ্রামের নরনারী আশ্রমে সদানন্দের উপদেশ শুনিতে এবং সদানন্দকে প্ৰণাম করিতে আসে, প্রণামান্তে কিছু প্রণামীও দিয়া যায় কিন্তু সে আর কজন মানুষ, সে প্রণামী আর কত! তিন দিনের পথ হাঁটাইয়া অনেক দূরের গ্রাম হইতে মানুষকে যদি আশ্রমে টানিয়া আনিতে হয়, আর একদিনের প্রণামীর পরিমাণ দেখিয়া নিশ্চিন্ত মনে দেশের সর্বত্র আশ্রমের শাখা খুলিবার ব্যবস্থা আরম্ভ করিয়া দেওয়া সম্ভব করিতে হয়, তাহা হইলে অন্য কিছু করা চাই, কেবল সদানন্দকে দিয়া কাজ চলিবে না।

    মহেশ চৌধুরীকে এরা পছন্দ করে–এইসব সাধারণ মানুষগুলি। মানুষটাও ভালো মহেশ চৌধুরী। শিশুর মতো সরল।

    কয়েকদিন আসা-যাওয়া মেলামেশা করিয়া বিপিন কিন্তু একটু ভড়ুকাইয়া গেল। মহেশ চৌধুরীর আসল রূপটা সে আর খুঁজিয়া পায় না। ভালোমানুষ, শিশুর মতো সরল, কিন্তু জোর কই? আশ্রমের কদমতলায় তার যে মনের জোরের পরিচয় বিপিনকে পর্যন্ত কাবু করিয়া কয়েক দিন আনমনা করিয়া রাখিয়াছিল? ছেলের কথা বলে, ঘরের কথা বলে, নিজের কথা বলে, আর এই সব কথার মধ্যে ফোড়ন দেয় ভগবানের কথার শান্তি চাই মহেশের, শান্তি! অনেক দুঃখ পাইয়াছে, মহেশ, সে জন্য কোনো দুঃখ নাই, এবার একটু শান্তি না পাইলে যে শেষ জীবনটাও মন দিয়া ভগবানুকে ডাকা হয় না মহেশের!

    ভগবানকে ডাকবার জন্য আমরা আশ্রম করি নি।

    মহেশ চৌধুরী কৌতুকের হাসি হাসিয়া বলে, এখনো আমার সঙ্গে ছলনা করবেন বিপিনবাবু? ভগবানকে ডাকার জন্য ছাড়া আশ্ৰম হয়! তবে ভগবানকে ডাকার সুবিধের জন্যে অন্য কিছু যদি করেন–সে সবও ভগবানকে ডাকারই অঙ্গ!

    আপনি তো প্রভুর বাণী শোনেন?

    শুনি বৈকি।

    উনি কি কোনোদিন বলেছেন, আশ্রমে যারা আছেন, তাদের কাজ হল ভগবানকে ডাকা?

    বলেন বৈকি–সব সময়েই বলেন। আমরা সবাই পাপী তো বিপিনবাবু? প্ৰশ্ন শুনিয়া বিপিন গুম খাইয়া থাকে।

    মহেশ চৌধুরী সায় না পাইয়াও বলে, মহাপাপী আমরা। আমাদের কি ক্ষমতা আছে নিজে থেকে ভগবানকে ডাকবার? তাই যদি পারতাম বিপিনবাবু, মনে আমার এমন অশান্তি কেন সকলের মনে অশান্তি কেন! প্রভু আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন কি করলে ভগবানকে ডাকবার ক্ষমতা হয়, কি করলে আমরা ভগবানকে ডাকতে পারি। কাণ্ডারী একমাত্র ভগবান, কিন্তু গুরুদেবের চরণতরীই ভরসা। তর্কের কথা নয়, তর্ক বিপিন করে না, কথায় কথা তুলিয়া মানুষটাকে বুঝিবার চেষ্টা করে। অন্য সবদিক দিয়া সে হতাশ হইয়া যায়, একটিমাত্র ভরসা থাকে মহেশের নিজের বিশ্বাস আঁকড়াইয়া থাকিবার ক্ষমতা। নিজে যা জানিয়াছে তার বেশি কিছু জানিতে বা বুঝিতে চায় না, সদানন্দের কথা হোক, শাস্ত্রের বাক্য হোক, তার নিজের ব্যাখ্যাই ব্যাখ্যা। এদিক দিয়া মহেশ ভাঙিবে কিন্তু মচকাইবে না।

    এ রকম মানুষ দিয়া বিপিনের কাজ চলিবে কি?

    আচ্ছা, প্ৰভু যদি আপনাকে কোনো অন্যায় আদেশ দেন, সে আদেশ আপনি পালন করবেন?

    প্রভু অন্যায় আদেশ দিতে পারেন না।

    মনে করুন দিলেন—

    ওরকম ছেলেমানুষি অসম্ভব কথা মনে করে কি লাভ হবে বলুন?

    বিপিনের ধৈর্য অসীম।

    ওঁর আদেশ অন্যায়, আমি তা বলছি না। ধরুন, উনি ঠিকমতো আদেশ দিয়েছেন, আপনার মনে হল আদেশটা সঙ্গত নয়, তখন আপনি কি করবেন?

    মহেশ নিশ্চিন্তভাবে বলে, আদেশ অন্যায় বলে এঁর পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব।

    আদেশটা পালন করবেন তো?

    উনি যদি আমার মনের ধাঁধা মিটিয়ে দিয়ে আদেশ পালন করতে বলেন, তবে নিশ্চয় করব।

    আর যদি মনের ধাঁধা না মিটিয়ে শুধু আদেশ পালন করতে বলেন?

    মহেশ হাসিয়া বলে, যান মশায়, আপনার আজ মাথার ঠিক নেই। ওরকম উনি কখনো বলতে পারেন?

    যদি বলেন?

    আপনি আবার সেই অসম্ভব কল্পনার মধ্যে যাচ্ছেন।

    বিপিনের ধৈর্য সত্যই অসীম।

    বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে যদি বলেন? এতদিন আপনাকে যেরকম পরীক্ষা করছিলেন না, এই রকম কোনো পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি আপনাকে অন্যায় আদেশ পালন করতে বলেন?

    পরীক্ষার জন্য? আরো পরীক্ষা করবেন? মহেশের মুখ চোখের পলকে শুকাইয়া যায়। ভীতসন্ত্রস্ত শিশুর মতো অসহায় চোখ মেলিয়া সে বিপিনের মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। সদানন্দের পরীক্ষায় পাস করিয়াছে কি ফেল করিয়াছে, আজো মহেশ চৌধুরী ঠিক করিয়া উঠিতে পারে নাই, শুধু জানিয়াছে যে, সদানন্দ তাকে অনুগ্ৰহ করিয়াছে, জানিয়া এই সৌভাগ্যেই সর্বদা ডগমগ হইয়া আছে। পরীক্ষার কথা মনে হইলেই তার মুখ শুকাইয়া যায়।

    বিপিনের পিছনে বিভূতির মা অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়াছিল। দুধের বাটি হাতে করিয়া আসিয়াছে। দুধটা বেশি গরম ছিল, এমনিভাবে ধরিয়া দাঁড়াইয়া থাকাতেও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হইতে কোনো বাধা হইতেছে না, তাই এতক্ষণ দুজনের অপরূপ আলাপে বাধা দেয় নাই। এবার বলিল, বিপিনবাবু, ওঁর সঙ্গে আপনি কথায় পারবেন না। গুরুদেবের সমস্ত আদেশ উনি চোখ-কান বুজে মেনে চলবেন–ভাববেন না।

    তবু বিপিনের ভাবনার শেষ হয় না। এমন সমস্যায় সে আর কখনো পড়ে নাই। একটা মানুষকে গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ত ঠিক করিয়া ফেলিতে যে এত ভাবিতে হয়, বিপিনের সে ধারণা ছিল না। আশ্রমে যদি স্থান দেওয়া হয় মহেশকে, কাজে কি তার লাগিবে মহেশ?

    মাধবীলতাকে পর্যন্ত অন্যমনে এক সময় সে জিজ্ঞাসা করিয়া বসে, মহেশবাবু লোক কেমন

    মাধু?

    মাধবীলতা সংক্ষেপে বলে, ভালো নয়।

    সদানন্দকে মাধবীলতা ভালো লোক বলিয়া প্রশংসা করিয়াছিল। মনে পড়াতেও বিপিনের হাসি আসিল না। মাধবীলতা অন্য মানদণ্ড দিয়া বিচার করিতেছে–ভালো শব্দটারও অনেক রকম মানে আছে।

    গম্ভীরমুখে সে জিজ্ঞাসা করে, আশ্রমে ফিরে যাবে মাধু?

    যাব।

    কি করবে আশ্রমে গিয়ে?

    এ প্রশ্নের জবাব মাধবীলতা দিতে পারিল না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচতুষ্কোণ – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পুতুল নাচের ইতিকথা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }