Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অহিংসা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প288 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৮. বিপিন ভাবিতেছিল

    বিপিন ভাবিতেছিল, মাধবীলতাকে প্রথমে আশ্রমে ফিরাইয়া আনিবে, তারপর ভাবিয়া চিন্তিয়া মহেশকেও আশ্রমে আসিয়া বাস করিতে বলিবে কিনা ঠিক করিবে। ভাবিতে ভাবিতে দিন কাটিতে লাগিল। সদানন্দের নাগালের মধ্যে আবার মাধবীলতাকে আনিয়া ফেলিতে বিপিন আর সময়ই পায়। না। নিজেই সে বুঝিতে পারে না মাধবীলতাকে ফিরাইয়া আনিবে ঠিক করিয়াও মহেশের ওখানে মেয়েটাকে কেন ফেলিয়া রাখিয়াছে। এবার অবশ্য সে মাধবীলতার সম্বন্ধে বিশেষ ব্যবস্থা করিবে, নিজেও সতর্ক থাকিবে, তবু যেন ভয় হয়।

    সদানন্দ বড় ভয়ানক মানুষ (বিপিনের মতে)। সদানন্দের মানুষ বশ করার যে ক্ষমতাকে। অসামান্য গুণ মনে করিয়া বিপিন এতদিন আশ্রমের কাজে লাগাইয়াছে, আজ সেই ক্ষমতাকে অনিষ্টকর ভয়ানক কিছু বলিয়া গণ্য করিতে বিপিনের দ্বিধা হয় না। বিজ্ঞানের সুবিধাভোগীরা যেভাবে বিজ্ঞানকে অভিশাপ দেয়, সদানন্দকেও বিপিন আজকাল তেমনি ভাবে কাজ ফুরানো পাজির দলে ফেলিয়াছে। কেবল মাধবীলতার জন্য এ বিরাগ নয়, সদানন্দের কাজ প্রকৃতপক্ষে ফুরায় নাই, মনে হইয়াছিল সদানন্দকে বাদ দিয়াও আশ্রম চালানো যাইবে, কিন্তু কল্পনাটা কার্যে পরিণত করিবার নামেই নানারকম আশঙ্কা মনে জাগায় আপনা হইতেই বিপিন টের পাইয়াছে যে, সদানন্দকে সে বিদায় দিতে চায় বটে কিন্তু এখনো সেটা সম্ভব নয়।

    যে কোনো বুদ্ধিমান উৎসাহী লোক সদানন্দকে সামনে দাঁড় করাইয়া এরকম একটি আশ্রম গড়িয়া তুলিতে পারিবে সদানন্দকে বিদায় করার পক্ষে এই এখন সবচেয়ে বড় বাধা। সদানন্দ শুধু চলিয়া গেলে আরো বেশি কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া আশ্রমকে সে চালাইয়া নিতে পারিবে, কিন্তু প্রতিহিংসার উদ্দেশ্যে সদানন্দ প্রতিযোগিতা আরম্ভ করিলে পারিবে না। হয়তো পারিবে, কোনো বিষয়েই নিজেকে বিপিন অক্ষম ভাবিতে পারিবে না, কিন্তু সাধ করিয়া সে হাঙ্গামা টানিয়া আনিবার সাহস বিপিনের নাই।

    বিপিনের সাহস কি কম? বিপিন কি ভীরু?

    মাধবীলতা তাই বলে। বলে, বিপিনবাবু? উনি অপদার্থ ভীরু কাপুরুষ।

    বলে মহেশকে। প্ৰাণ খুলিয়া বিপিনের নিন্দা করিতে পারে। মহেশ চৌধুরীর উপর বিরক্তিটা তার এত বেশি বাড়িয়া গিয়াছে, লোকটাকে দেখিলেই গায়ে যেন আজকাল তার জ্বর আসে। কিছুদিন আগে মাধবীলতা বিপিনকে বলিয়াছিল মহেশ চৌধুরী লোক ভালো নয়। তখন বিপিনের সাহচর্য সে সহ্য করতে পারি না। আজকাল মহেশ চৌধুরীর একসুরে বাধা মনোবীণার একঘেয়ে। ঝঙ্কারগুলি একেবারে অতিষ্ঠ করিয়া তোলায় বিপিনের মধ্যেও হঠাৎ সে কিছু কিছু বৈচিত্র্য আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে। বিপিনের কাছে আর তাই মহেশ চৌধুরীর সম্বন্ধে কোনোরকম মন্তব্য করে না, মহেশ চৌধুরীর কাছে বিপিনকে বিশেষণের পর বিশেষণে অভিনন্দিত করিয়া চলে চালবাজ, মিথুক, লোভী, অসংযত প্রভৃতি কত সংজ্ঞাই যে বিপিনকে সে দেয়।

    বিপিনের প্রশংসায় মহেশ কিন্তু পঞ্চমুখ। কারো সম্বন্ধে মহেশ কখনো কোনো কারণেই মত বদলায় না অন্তত স্বীকার করে না যে, নিন্দা প্রশংসায় কারো সম্বন্ধে তার ধারণার কিছুমাত্র পরিবর্তন হইয়াছে। নিন্দা সে জগতে কারো করে না, একবার যার যে গুণগান করিয়াছে, চিরকাল সমান উৎসাহের সঙ্গে তার সেই গুণকীর্তনই করিয়া যায়।

    মাধবীলতার মুখে বিপিনের বিশেষণগুলি শুনিয়া সে একে একে বিশ্লেষণ করিয়া প্ৰমাণ করিতে বসে যে, মাধবীলতা ভুল করিয়াছে, ওসব বিশেষণ বিপিনের প্রতি প্রয়োগ করা চলে না। বিপিন মহান, উদার, আত্মত্যাগী মহাপুরুষ চাল বিপিনের নাই, মিথ্যা সে কখনো বলে না, লোভী সে নয়, সংযমের তার তুলনা নাই। বিপিনের ভীরুতার অপবাদটিরও মহেশ প্রতিবাদ করে।

    মাথা নাড়িয়া হাসিয়া বলে, বিপিনবাবু ভীরু কাপুরুষ? কি যে তুমি বল মা! ওঁর মতো বুকের পাটা কটা মানুষের থাকে?

    মাধবীলতা রাগিয়া বলে, কি যে দেখেছেন আপনি বিপিনবাবুর মধ্যে! উনি যদি ভীরু কাপুরুষ নন, কে তবে ভীরু কাপুরুষ? শুনুন বলি তবে। আশ্রমের ক্ষতি করবেন ভয়ে আপনাকে উনি আশ্রমে নিতে ভরসা পাচ্ছেন না।

    রাগের মাথায় ভিতরের মস্ত বড় কথা যেন ফাঁস করিয়া দিয়াছে, এমনি গভরা অনুতাপের ভঙ্গিতে মাধবীলতা একদৃষ্টে মহেশ চৌধুরীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। মহেশ চৌধুরী হঠাৎ গম্ভীর হইয়া যায়। মনে হয়, ভিতরের আসল কথাটা জানিতে পারিয়া বুঝি চটিয়াই গিয়াছে! কিন্তু কথা শুনিয়া বোঝা যায়, এত সহজে খেইহারা হইবার মানুষ সে নয়।

    ভয় তো বিপিনবাবুর মিথ্যে নয় মা! আমাকে আশ্রমে ঠাঁই দিলে আশ্রমের ক্ষতির আশঙ্কা আছে বৈকি! আমি হলাম মহাপাপী, আমার সংস্পর্শে–

    বিপিনের ভীরুতার প্রমাণটি ফাসিয়া যায়। চালের উপরেই বিপিন চলে, এ ধারণা মনের মধ্যে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে কিন্তু উদাহরণ দাখিল করিতে গিয়া বিপিনের চালজির একটি দৃষ্টান্তের কথাও মাধবীলতা আগে এতদিন অনেক চেষ্টাতেও মনে করিতে পারে নাই। বিপিনের ভীরুতার কয়েকটি জোরালো দৃষ্টান্ত আজ সে কোনোরকমেই স্মরণ করিতে পারে না। বিপিন ভীরু সন্দেহ নাই, কিন্তু কবে কোথায় সে ভীরুতার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে?

    ভাবিতে গেলে সত্যই বড় বিস্ময় বোধ হয়। বিপিনের কি তবে দোষ বলিয়া কিছুই নাই? অভাব কেবল তার গুণের? সদ্‌গুণ একেবারে নাই বলিয়াই লোকটার চালচলন এমন নিন্দনীয় মনে হয়? সংসারে মানুষ হয় ভালো-মন্দ মেশানেনা, কারো মধ্যে ভালো বেশি, কারো মধ্যে কম, কিন্তু বিপিনের মধ্যে ভালোর নামগন্ধও নাই। তাই কি বিপিনকে মনে হয় খারাপ লোক, যদিও তার মধ্যে মন্দের ভাগটাও খুঁজিয়া মেলে না? কথাটা যেন দাঁড়াইয়া যায় ধাধায় ভালোও নাই, মন্দও নাই, কি তবে আছে বিপিনের মধ্যে? কিসের মাপকাঠিতে মানুষ তাকে মানুষ হিসাবে বিচার করিবে? তাকে কি ধরিয়া নিতে হইবে নিন্দা প্রশংসার অতীত মহামানব বলিয়া?

    বিপিন মহামানব। ভাবিলেও মাধবীলতার হাসি আসে। কিন্তু ধারণাগুলি দিয়া আপনা হইতে মনের মধ্যে যে সব ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে, সেই ধারণাগুলি দিয়া বিপিনের বিচার না করিলে, বিপিনের দোষ-গুণ নিরপেক্ষভাবে ওজন করিতে বলিলে, বিপিন সত্যই পরিণত হয়। মহামানবে।

    নিজের সমস্যাগুলি নিয়া অত্যন্ত বিব্রতভাবে বিপিনের দিন কাটিতেছে, মাধবীলতার খবর নেওয়ার সময়ও বিশেষ পাইতেছে না, এমন সময় বিভূতি একদিন বাড়ি ফিরিয়া আসিল। মহেশের অসুখ উপলক্ষে তাকে বাড়ি ফিরিতে দেওয়া হইয়াছে। না বলিয়া গ্রাম ত্যাগ করিতে পারিবে না, সূর্যাস্ত হইতে সূর্যোদয় পর্যন্ত বাড়িতে থাকিবে।

    ছেলের চেহারা দেখিয়া বিভূতির মা কাঁদিয়াই আকুল। মহেশ বলিল, কঁদছ কেন? পাপ করলে প্ৰায়শ্চিত্ত করতে হবে না?

    বিভূতি বলিল, খিদে পেয়েছে মা, খেতে দাও। খালি খেতে দাও, দিন-রাত শুধু খেতে দাও, আর কিছু নয়।

     

    পরদিন ভোরবেলা মহেশ ছেলেকে নিয়া সদানন্দের চরণ বন্দনা করিতে বাহির হইল। চরণ বন্দনার উদ্দেশ্যে আশ্ৰমে যাইতেছে, এ কথা অবশ্য বিভূতিকে জানাইল না, শুধু বলিল, আমাদের একবার আশ্রম থেকে ঘুরিয়ে আনবি, চল তো।

    কি হবে আশ্রমে গিয়ে? এাদ্দিন পরে এলাম, গাঁয়ের সকলের সঙ্গে দেখা-টেখা করি?

    পরে দেখা করিস। আগে আশ্রম থেকে ঘুরে আসবি চল।

    কিন্তু বিভূতির কাছে আশ্রমের কিছুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। গ্রামের চেনা মানুষগুলির সঙ্গে দেখা করিবার জন্যই মনটা তার ছটফট করিতেছিল। তার আসিবার খবরটা সে আসিয়া পৌঁছিবার অনেক আগেই গ্রামে ছড়াইয়া গিয়াছে সন্দেহ নাই, তবু কাল কেউ তাকে দেখিতে আসে নাই বলিয়া বিভূতি একটু আশ্চর্য হইয়া গিয়াছে। তার সংস্পর্শে আসিতে কয়েকজনের ভয় হওয়া সম্ভব, অন্তত ভয় ভাঙিতে কিছুদিন সময় লাগিবে, কিন্তু চোরা গাইয়ের সঙ্গে কপিলা গাইয়ের বাঁধা পড়িবার আতঙ্কটা কি সকলের মধ্যেই এত বেশি প্রচণ্ড যে, একজন তার খবর নিতেও আসিল না?

    না আসুক, বিভূতি নিজেই সকলের সঙ্গে দেখা করিয়া ভয় ভাঙাইয়া দিয়া আসিবে। আশ্রমে যাওয়ার প্রস্তাবে সে তাই ইতস্তত করিতে থাকে।

    আশ্রমে যাওয়ার নামে মাধবীলতা আনন্দে ডগমগ হইয়া বলে, তাই চলুন, আশ্রম দেখে আসবেন।

    বিভূতি হাসিয়া বলে, আশ্রম দেখা কি আর আমার বাকি আছে, ঢের দেখেছি।

    সে আশ্রম আর নেই, কত পরিবর্তন হয়েছে দেখে অবাক হয়ে যাবেন।

    বিভূতির জেলে যাওয়ার আগে সদানন্দের আশ্রম কেমন ছিল এবং তারপর আশ্রমের কি পরিবর্তন হইয়াছে, মাধবীলতার জানিবার কথা নয়, এটা তার শোনা কথা। মাধবীলতার উৎসাহ দেখিয়া বিভূতি আর আপত্তি করিল না, তিনজনে আশ্রমের দিকে রওনা হইয়া গেল–মহেশ, মাধবীলতা আর বিভূতি। বিভূতির মা গেল না, বলিল, আশ্রম মাথায় থাক, তোমরা ঘুরে এস।

    বাড়ির সামনে কাঁচা পথ ধরিয়া তিনজনে হাঁটিতে আরম্ভ করিয়াছে, শশধর আসিয়া জুটিল। আশ্রমে যাওয়ার একটা সুযোগও শশধর ত্যাগ করে না।

    মহেশ মাধবীলতাকে জিজ্ঞাসা করিল, হাঁটতে পারবে তো মা?

    মাধবীলতা হাসিয়া বলিল, আমাকে জিজ্ঞেস না করে বরং আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন।

    মহেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, দুর্গা, দুর্গা। সত্যি ওর চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে।

    আশ্রমে পৌঁছিয়া প্রথমেই দেখা হইয়া গেল রত্নাবলীর সঙ্গে। মাধবীলতাকে দেখিয়া সে একগাল হাসিয়া বলিল, বেঁচে আছিস?

    মহেশ তাকে জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আছ মা?

    কাছেই একটা মোটা গাছের গুঁড়ি পড়িয়াছিল, কদিন আগে গাছটা কাটা হইয়াছে। বিভূতি গুড়িতে পা ঝুলাইয়া বসিয়া পড়িল, কিছুক্ষণ বিশ্রাম না করিয়া সে আর নড়িবে না।

    মাধবীলতা বলিল, কাঠপিঁপড়ে হুল ফুটিয়ে দেবে কিন্তু।

    বিভূতি বলিল, দিক, গোখরো সাপ কামড়ালেও এখন আমি নড়ছি না।

    তখন সেইখানে কাঠের গুঁড়িতে বসিয়া সকলে গল্প আরম্ভ করিয়া দিল। শীতের সকালের প্রথম মিষ্টি রোদ আসিয়া পড়িতে লাগিল সকলের গায়ে। আরামে এমন জমিয়া উঠিল আলাপ যে মনে হইতে লাগিল, সদানন্দের চরণবন্দনার কথাটা মহেশও ভুলিয়া গিয়াছে! কিছুক্ষণ পরে কুটির হইতে বাহির হইয়া তাদের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইবার সময় স্বয়ং সদানন্দকেও কেউ দেখিতে পাইল না। খেয়াল হইল সদানন্দ যখন সামনে আর্সিয়া রোদ আড়াল করিয়া দাঁড়াইল।

    প্ৰথমে প্ৰণাম করিল মহেশ, তারপর মামার অনুকরণে শশধর। রত্নাবলী প্রণাম করায়। মাধবীলতাও ঢিপ করিয়া একটা প্রণাম ঠুকিয়া দিল।

    সদানন্দ জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আছ মাধু?

    মাধবী বলিল, ভালেই আছি।

    মহেশ বিভূতিকে বলিল, এঁকে প্রণাম কর।

    আগের কথা সদানন্দের মনে ছিল, সে তাড়াতাড়ি বলিল, থাক্, থাক্।

    মহেশ জোর দিয়া আবার বলিল, প্রণাম কর বিভূতি, এঁর আশীর্বাদে তুমি ছাড়া পেয়েছ।

    সকলে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, বিভূতি ওঠে নাই। বসিয়া থাকিয়াই সে দুহাত একত্ৰ করিয়া কপালে ঠেকাইয়া বলিল, নমস্কার, ভালো আছেন? অনেক দিন পরে দেখা হল। আপনার আশীর্বাদ গবর্নমেন্টকেও টলিয়ে দিতে পারে, তা তো জানতাম না! .

    সদানন্দ শান্তভাবে বলিল, আমার বলে নয়, আশীর্বাদ আন্তরিক হলে ভগবানকে পর্যন্ত টলিয়ে দিতে পারে বাবা।

    বিভূতি আরো বেশি শান্তভাবে বলিল, ভগবানের কথা বাদ দিন, তিনি তো সব সময়েই টলছেন মাতালের মতো। টাল সামলাতে প্রাণ বেরোচ্ছে আমাদের।

    মাধবীলতা চোখ বড় বড় করিয়া বিভূতির দিকে চাহিয়া থাকে। রত্নাবলীর সাদা দাঁতগুলি ঝকঝক করে। অস্থির হইয়া ওঠে মহেশ। কি করিবে ভাবিয়া না পাইয়াই যেন প্রথম দিকে ব্যাকুলভাবে শুধু বলিয়া চলে, আহা, ওকি আর ছি ছি। তারপর হঠাৎ রাগ করিয়া, সোজা আর শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া, গম্ভীরকণ্ঠে ডাকে, বিভূতি!

    বসা অবস্থাতেই বিভূতি বলে, কেন?

    পায়ে হাত দিয়ে এঁকে প্রণাম কর, নিজের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নাও।

    এঁকে আমার প্রণাম করতে ইচ্ছা হয় না বাবা। ক্ষমা চাওয়ার মতো অন্যায় কথা কিছু বলি নি।

    এঁকে আমি দেবতা মনে করে পূজা করি, আমার ছেলে তুই, একে তোর প্রণাম করতে ইচ্ছা হয় না? যা মনে এল বলে বসলি মুখের ওপর, তবু তোর অন্যায় কথা বলা হল না?

    বিভূতি নীরবে মাথা নাড়িল।

    করবি না প্ৰণাম?

    না।

    এবার প্রশান্তকণ্ঠে সদানন্দ বলিল, মহেশ, কি ছেলেমানুষি আরম্ভ করে দিলে তুমি?

    ছেলেমানুষি প্ৰভু?

    তুমি কি ভাব ওর প্রণাম পাওয়ার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে আছি?

    তা ভাবি নি প্রভু। ও প্রণাম করুক না করুক আপনার তাতে কি আসবে যাবে সর্বনাশ হবে ওর নিজের। ও যে আমার সন্তান প্রভু?

    সদানন্দ অভয় দিয়া বলিল, ভয় নেই, ওর কিছু হবে না। প্রণাম নিয়ে আমি আশীৰ্বাদ বিক্রি করি না মহেশ, আশীৰ্বাদ করাটা আমার ব্যবসা নয়, ভুলে যাও কেন? ছেলেমানুষের কথায় যদি আমি রাগ করি, আমি যে ওর চেয়েও ছেলেমানুষ হয়ে যাব।।

    মহেশ ভক্তিগদগদ কণ্ঠে বলিল, তা কি জানি না প্ৰভু? আপনি দেবতা, আপনার কি রাগ-দ্বেষ আছে? কিন্তু আপনাকে প্রণাম না করলে ওর অকল্যাণ হবে।

    অনিচ্ছায় প্রণাম করার চেয়ে না করাই ভালো, মহেশ।

    না প্ৰভু। প্ৰণম্যকে প্রণাম করতেই হয়। প্রণাম করতে করতে মনে ভক্তি আসে।–বিভূতি, প্ৰণাম কর একে।

    বিভূতি নীরবে মাথা নাড়িল।

    মহেশ আবার বলিল, বিভূতি, প্রণাম কর। এই দণ্ডে যদি প্রণাম না কর এঁকে, আমি যেমন আছি তেমনিভাবে যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাব, কোনোদিন আর ফিরব না।

    বিভূতি শুকনো মুখে কোনো রকমে বলিল, আমি পারব না বাবা।

    মাধবীলতার সব কথাতেই ফোড়ন দেওয়া চাই। পিতার আদেশ আর মিনতি যেখানে ব্যর্থ হইয়া গেল, যেদিকে দুচোখ যায় চলিয়া যাওয়ার ভয় প্রদর্শন পর্যন্ত কাজে লাগিল না, সেখানে কাতরকণ্ঠে বিভূতিকে অনুরোধ না জানাইয়া সে পারিল না, আহা এমন করে বলছেন সবাই, করুন না প্রণাম একবারটি?

    এমন সময় আসিল বিপিন।

    কারো দিকে বিপিন চাহিয়াও দেখিল না। সোজাসুজি মাধবীলতার কৈফিয়ত দাবি করিয়া বলিল, আমায় না জানিয়ে আশ্রমে এলে যে মাধু?

    বিপিনের মুখ দেখিয়া আর গলার আওয়াজ শুনিয়া মাধবীলতার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। মহেশ বলিল, আমি ওকে এনেছি বিপিনবাবু।

    বিপিন তীব্রস্বরে ধমক দিয়া বলিল, চুপ করুন, আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করি নি।

    প্রকাশ্যভাবে কেউ কোনোদিন বিপিনকে উঁচু গলায় কথা বলিতে শোনে নাই–বিশেষত সদানন্দের সামনে।

    সকালবেলাই এমন একটা জটিল অবস্থা সৃষ্টি হইবে কেহ কল্পনা করতে পারে নাই। মনে মনে সকলেই একটা শঙ্কা-জড়িত অস্বস্তি বোধ করিতে থাকে। বিভূতি সদানন্দকে প্রণাম করিতে অস্বীকার করায় যে খাপছাড়া কাণ্ড ঘটিবার উপক্রম হইয়াছিল, বিপিনের আবির্ভাবে এখনকার মতো সেটা চাপা পড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু সে আর কতক্ষণের জন্য? মহেশ চৌধুরী ছাড়িবার পাত্র নয়। সে প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিয়া দিয়াছে, বিভূতি সদানন্দের পায়ে হাত দিয়া প্ৰণাম না করিলে যেদিকে দুচোখ যায় চলিয়া যাইবে। বিপিনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হইয়া গেলেই সে আবার ছেলেকে নিয়া পড়িবে।

    কিন্তু কি বোঝাপড়া হইবে বিপিনের সঙ্গে? মহেশ চৌধুরী কি চুপ করিয়া থাকিবে বিপিনের ধমক সহ্য করিয়া? ধমকটা সদানন্দ দিলে সকলে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করিত, সদানন্দ এমন প্ৰচণ্ড শব্দে ধমক দিলে এতটা খারাপ শোনাইত না। মহেশ চৌধুরীর মতো ভক্তকে ধমক দিবার অধিকার সদানন্দের মতে মহাপুরুষের থাকে এবং আগেও অনেকবার অনেক ছুতায় মহেশ চৌধুরীকে সে অপমান করিয়াছে। সদানন্দের অপমান অনেকটা গা-সহা হইয়া আসিয়াছে মহেশ চৌধুরীর। কিন্তু বিপিনের অপমান সে সহ্য করিবে কেন? দুজনে যদি এখন কলহ বাঁধিয়া যায়।

    মহেশ চৌধুরী কি বলে শুনিবার জন্য সকলে উৎকৰ্ণ হইয়া থাকে।

    মহেশ চৌধুরীর মুখ দেখিয়া বিশেষ কিছু বোঝা যায় না। বিপিনের ধমকটা তার কানে গিয়াছে কিনা, এ বিষয়েও যেন কেমন সন্দেহ জাগে। চাহিয়া সে থাকে মাধবীলতার মুখের দিকে। কিছুক্ষণের জন্য তার দৃষ্টি এমন তীক্ষ্ণ ও অস্বাভাবিক মনে হয় যে, এতদিনের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের পর তার একটা নূতন রূপ আবিষ্কারের সম্ভাবনায় শশধর ও সদানন্দের কেমন ধাঁধা লাগিয়া যায়।

    মহেশ চৌধুরীর মুখ ধীরে ধীরে গম্ভীর হইয়া আসে। আকাশের দিকে একবার মুখ তুলিয়া উদাস কণ্ঠে সে বলে, মধু আশ্রমে আসতে পাবে না হুকুম দিয়েছিলেন, আমি জানতাম না বিপিনবাবু!

    মহেশ চৌধুরীর ভঙ্গিটাই মারাত্মক। তার উপর হুকুম শব্দটা সকলের কানে যেন বিধিয়া যায়।

    মাধবীলতার অপরাধক্লিষ্ট মুখের স্লানিমায় স্নায়বিক মূঢ়তার ভাবটাই এতক্ষণ স্পষ্ট হইয়াছিল, তবে মহেশ চৌধুরী ছাড়া সেটা কেউ বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিয়াছিল কিনা সন্দেহ। নিজের প্রয়োজনে কে আর ওভাবে তরুণী মেয়ের মুখ দেখিতে শেখে? সোজাসুজি ভীরুতা আর কোমলতার অভিব্যক্তি বলিয়া ধরিয়া নেওয়ায় কত ভালো লাগিতেছিল সকলের, কেমন দরদ সকলে বোধ করিতেছিল মেয়েটার জন্য। কিন্তু ওরকম বর্বরের মতো মায়া করা মহেশ চৌধুরীর ধর্ম নয়, ওরকম সঙ্কীর্ণ স্বার্থপরতা তার নাই। মানুষের এই স্বৰ্গত রসানরূপী পিপাসা-সৃষ্টির আগ্রহ ক্ষয় হইয়া যাওয়ায় অসংখ্য ছোট ছোট মুক্তির মধ্যে মহেশ শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে। মাধবীলতার ভীরু কোমল কাদ কাদ মুখখানা দেখিয়া মহেশ চৌধুরী ছাড়া আর কে বুঝিতে পারিত তার ভয় বা দুঃখ নাই, আকস্মিক স্নায়বিক উত্তেজনায় সে একটু দিশেহারা হইয়া গিয়াছে? খোঁচা দিয়া তার আত্মমর্যাদার জ্ঞান জাগাইয়া তুলিবর এবং তার অবরুদ্ধ তেজকে মুক্তি দিবার বুদ্ধি বা সহস আর কার হইত? সোনালি রোদের মতোই মাধবীলতার মুখে লালিমার আবির্ভাব ঘটিতে দেখিয়া মহেশ আবার বলে, এবারকার মতো ওকে মাপ করুন বিপিনবাবু। আপনি ওকে বারণ করেছেন জানলে বিপিনের আদেশ অমান্য করায় মাধবীলতার যে অকথ্য অপরাধ হইয়াছে তার বিরাটত্ব অনুভব করিয়া মহেশ চৌধুরী নিজেই যেন সঙ্কুচিত হইয়া যায়, কোনো রকমে এবারকার মতো মেয়েটাকে বিপিনের ক্ষমা পাওয়াইয়া দিবার ব্যাকুলতায় যেন দিশেহারা হইয়া যায়। মাধবীলতার হইয়া সে যেন বিপিনের পায়ে ধরিয়া বসিবে।

    এবার মাধবীলতা ফোস করিয়া ওঠে, বারণ করেছেন মানে? উনি বারণ করবার কে? বেশ করেছি আমি আশ্রমে এসেছি।

    বিপিন বলে, আশ্রমটা বেড়াবার জায়গা নয় মাধু।

    মাধবীলতা ব্যঙ্গ করিয়া বলে, কি করবেন, মারবেন?

    সদানন্দ বলে, আহা, কি আরম্ভ করে দিয়েছ তোমরা?

    সে কথা কানে না তুলিয়া বিপিন রাগে কাপিতে কপিতে বলে, ছেলেমানুষি কোরো না মাধু। আমার সঙ্গে এস।

    মহেশ তাড়াতাড়ি সায় দিয়া বলে, যাও মা, যাও। বিপিনবাবুর সঙ্গে যাও।

    মহেশ চৌধুরী ফোড়ন না দিলে হয়তো মাধবীলতার উদ্ধত ভাবটা ধীরে ধীরে নরম হইয়া আসিত। বিপিনের সংযমহারা রাগ দেখিতে ভিতরে ভিতরে তার যেন কেমন ভাল লাগিতেছিল। সেদিন রাত্রের কথা মাধবীলতার মনে পড়িয়া গিয়াছে, বিপিন যখন তাকে মহেশ চৌধুরীর বাড়ি রাখিয়া আসিয়াছিল। সে রাত্রের স্মৃতি ভুলিবার নয়, মাধবীলতা ভুলিয়াও যায় নাই। হঠাৎ তার খেয়াল হইয়াছে, সে রাত্রে বিপিন তার সঙ্গে যে আশ্চর্য ব্যবহার করিয়াছিল, তার মাথাটা বুকে চাপিয়া ধরিয়া ব্যাকুল হইয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল সে যেখানে যাইতে চায় পাঠাইয়া দিবে, তাকে বাড়ি কিনিয়া দিবে, তার নামে ব্যাংকে টাকা রাখিবে, মাঝখানে কয়েকদিনের ছেদ দিয়া আজ দিনের আলোয় বিপিন যেন সেই ব্যবহারেরই জের টানিয়া চলিয়াছে। তফাত কেবল এইটুকু যে, মাঝখানের সময়টাতে সে যেন সত্য সত্যই নিঃসন্দেহে বিপিনের হইয়া গিয়াছে। বিপিনের রাগ আর ধমক দিয়া জোর গলায় কথা বলার মধ্যে পর্যন্ত মাধবীলতা স্পষ্ট অনুভব করিতে পারে বিপিন। জোর খাটাইতেছে আত্মীয়তার, অন্য কিছু নয়। সে যেন বিপিনের মেয়ে বা বৌ বা ওইরকম একটা কিছু।

    কিন্তু মহেশ চৌধুরী ফোড়ন কাটায় এতগুলি মানুষের সামনে বিপিনের ব্যবহারে মেজাজটা তার চড়িয়াই যাইতে থাকে। সকলের সামনে এভাবে শাসন করিতে গেলে মেয়ে বা বৌও চটিয়া যায় বৈকি!

    মাধবীলতা বিভূতির সামনে গিয়া দাঁড়াইল, বিপিনের দিকে পিছন ফিরিয়া।

    চলুন আমরা ফিরে যাই বিভূতিবাবু। যাবেন?

    আমার ওখানে একবার আসবে না মাধু?–সদানন্দ জিজ্ঞাসা করিল।

    মহেশ সঙ্গে সঙ্গে বলিল, যাও মা যাও, প্রভুর মন্দিরে একবার যাও।

    মাধবীলতা জবাব দিল না।

    বিভূতি এতক্ষণে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। মাধবীলতাকে সঙ্গে করিয়া সে বাড়ির দিকে রওনা হওয়ার উপক্রম করে, সকলে দাঁড়াইয়া থাকে কাঠের পুতুলের মতো। বিভূতি অস্বীকার করিয়াছে। প্ৰণাম করিতে, মাধবীলতা ফিরিয়া চলিল আদেশ অমান্য করিয়া। চারিদিকে বিদ্রোহ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে নাকি সদানন্দের বিরুদ্ধে আশ্রমে দাঁড়াইয়া সদানন্দকে এভাবে অপমান আর অমান্য করা। দাঁতের বদলে রত্নাবলীর চোখ দুটি চকচক করে। শশধর বোকার মতো হাঁ করিয়া থাকে। কি করিবে বুঝিতে না পারিয়া বিপিন অসহায় ক্রোধ দমন করার জন্য একটা বিড়ি ধরায়। সদানন্দের ভীতিকর গাম্ভীর্য ঘনীভূত হইয়া আসে। বিপিন আর সদানন্দ দুজনের মনেই প্রায় এক ধরনের অদম্য ইচ্ছা জাগে ছুটিয়া গিয়া মাধবীলতাকে বগলদাবা করিয়া বিভূতিকে আথালিপাথালি প্রহার করা।

    মহেশ ডাকে, বিভূতি।

    বিভূতি দাঁড়ায় এবং মুখ ফিরাইয়া তাকায়। মাধবীলতা দাঁড়ায় কিন্তু মুখ ফিরায় না।

    মহেশ বলে, এখানে এস।

    বিভূতি কাছে আসে এবং হাই তোলে। মাধবীলতা সঙ্গে আসে কিন্তু মুখ নিচু করিয়া থাকে।

    মহেশ বলে, প্রভুকে প্রণাম কর।

    সদানন্দ বলে, তুমি বড় বাড়াবাড়ি করছ মহেশ।–সদানন্দের গলা কাঁপিয়া যায়।

    মহেশ হাত জোড় করিয়া বলে, বাড়াবাড়ি প্ৰভু? ও যদি আপনাকে এখন প্ৰণাম না করে, আমার যেদিকে দুচোখ যায় চলে যেতে হবে প্রভু!

    সদানন্দ বলে, তাই যাও তুমি, বজ্জাত কোথাকার।

    মহেশ তখনো হাত জোড় করিয়া বলে, ওকে প্রণাম না করিয়ে কেমন করে যাব প্ৰভু?

    সদানন্দ বাক্যহারা হইয়া থাকে। মহেশ বলে, বিভূতি, প্রণাম কর প্রভুকে।

    বিভূতি নড়ে না। সদানন্দ আগাইয়া গিয়া সশব্দে মহেশের গালে বসাইয়া দেয় এক চড়।

    কিছুদূরে চালার নিচে আশ্রমের অধিকাংশ নরনারী জমা হইয়াছিল; দু-চারজন করিয়া তখনো আসিয়া জুটিতেছিল। সদানন্দ আজ আত্মজ্ঞানলাভের প্রক্রিয়ায় ব্রহ্মচর্যের স্থান সম্বন্ধে উপদেশ দিবে। সকলে নিঃশব্দে সদানন্দের প্রতীক্ষা করিতে করিতে কাঠের গুড়িটার কাছে এদের লক্ষ্য করিতেছিল। ততদূর হইতে কথা বোঝ তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কিন্তু সকলের চলাফেরা আর অঙ্গভঙ্গির নির্বাক অভিনয় দেখিয়া বেশ অনুমান করিতে পারিতেছিল যে, রীতিমতো একটি ব্যাপারই ঘটিতেছে। সদানন্দ আগাইয়া গিয়া মহেশ চৌধুরীর গালে যে চড় বসাইয়া দিয়াছে, এটা তারা স্পষ্টই দেখিতে পাইল। হঠাৎ একটা জোরালো গুঞ্জনধ্বনি উঠিয়া আবার তৎক্ষণাৎ থামিয়া গেল।

    সদানন্দ সকলের আগে একবার চাহিয়া দেখিল চালার দিকে। অনেক সাক্ষীর সামনেই মহাপুরুষ সদানন্দ সাধু মহেশ চৌধুরীকে মারিয়া বসিয়াছে বটে। এখন কেবল ঘটনাটা সকলের চোখে পড়িল, পরে বিস্তারিত বিবরণ শুনিবে।

    রত্নাবলীর চোখ আর পাঁত দুই-ই তখন চকচক করিতেছে। মাধবীলতা অস্ফুট শব্দ করিয়া মুখের মধ্যে পুঁজিয়া দিয়াছে ডান হাতের চারটি আঙুল ছেলেবেলায় মাধবীর এই অভ্যাসটা ছিল, বড় হইয়া কোনোদিন এভাবে সে মুখে আঙুল ঢুকাইয়া দেয় নাই।

    থমত খাইয়া গিয়াছিল সকলেই, কিন্তু দেখা গেল অবাধ্য বিভূতি বাপের অপমানের প্রতিকার করিতে বড়ই চটপটে। মহেশ চৌধুরীর মোটা বাঁশের ছড়িটি কাঠের গুড়িতে ঠেস দিয়া রাখা ছিল। চোখের পলকে লাঠিটা তুলিয়া নিয়া সে সদানন্দের দিকে আগাইয়া আসিল। দেশের জন্য মানুষ খুন। করার কেবল পরামর্শ করার জন্য এতগুলি বছর সে আটক থাকিয়া আসিয়াছে, আজ বাপের জন্য হয়তো সত্য সত্যই মানুষ খুন করিয়া বসিত। বাধা দিল মহেশ।

    ছি বিভূতি, ছি।

    বিভূতির হাতের লাঠি ছিনাইয়া নিয়া সদানন্দের পদতলে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া মহেশ চৌধুরী তার মাথা গুজিয়া দিল।

    আপনাকে রাগিয়েছি, আমায় মাপ করুন প্রভু। ছেলে আমার আপনাকে লাঠি নিয়ে মারতে উঠেছিল, আমায় মাপ করুন প্রভু।

    প্রায় আর্তনাদ করার মতো চিৎকার করিয়া বিভূতি বলিল, তোমার কি লজ্জাশরম নেই বাবা?

    কি বকছিস্ তুই পাগলের মতো? প্ৰণাম কর বিভূতি, প্রভুকে প্রণাম কর। ও বিভূতি, শিগগির প্ৰণাম কর প্রভুকে। আমি না তোর বাপ বিভূতি? আমার দেবতাকে মারবার জন্য তুই লাঠি তুলেছিস, হাত যে তোর খসে যাবে রে, কুষ্ঠ হবে যে তোর হাতে! শিগগির প্রণাম কর বিভূতি, প্রভুকে শিগগির প্রণাম কর।

    পাগল হইয়া গিয়াছে মহেশ চৌধুরী? বিভূতি সভয় বিস্ময়ে সদানন্দের পদতলে বাপের সর্বাঙ্গীণ আত্মোৎসর্গ চাহিয়া দেখে আর তার অভিনব মন্ত্ৰোচ্চারণ শুনিয়া যায়।

    মাধবীলতা কানের কাছে ফিসফিস করিয়া বলে, প্রণাম করে নিন। তারপর ওঁকে নিয়ে বাড়ি যাই চলুন।

    বিভূতি একটু ইতস্তত করিয়া সদানন্দকে প্রণাম করিবার জন্য আগাইয়া যায়। মহেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সদানন্দের পা দুটিকে মুক্তি দেয়। হাত জোড় করিয়া নিবেদন জানায়, প্রভু, আশীর্বাদ করুন, ছেলের যেন আমার সুমতি হয়।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচতুষ্কোণ – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পুতুল নাচের ইতিকথা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }