Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডগার অ্যালান পো রচনাসমগ্র / অনুবাদ : জাকির শামীম

    জাকির শামীম এক পাতা গল্প1512 Mins Read0

    দ্য আনপ্যারালালড অ্যাডভেঞ্চার অব ওয়ান হ্যান্স ফাল

    দ্য আনপ্যারালালড অ্যাডভেঞ্চার অব ওয়ান হ্যান্স ফাল

    রটারডাম থেকে সব শেষে যে খবর পাওয়া গেছে তা হচ্ছে ওই নগরটা বর্তমানে দার্শনিক উত্তেজনায় তোলপাড় হচ্ছে। উত্তেজনা রীতিমত তুঙ্গে উঠে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    আসলে রটারডাম শহরে সম্প্রতি এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে যা একেবারেই অভাবনীয়, আর নতুনও বটে। ঘটনাগুলোকে ভালোভাবে বিচার করলে বলতেই হয় সেগুলো প্রচলিত চিন্তাধারা ও মতামতের পুরোপুরি বিরোধী। এমন কোনো ব্যাপার স্যাপার সেখানকার মানুষ অন্তর থেকে সমর্থন করা তো দূরের ব্যাপার ভাবতেই উৎসাহ পাচ্ছে না।

    আর আমার মতামত যদি জানতে চাওয়া হয় তবে আমি নির্দিধায় বলব, এর আগেই ব্যাপারটা নিয়ে ইউরোপের সর্বত্র তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। সবাই উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে তাণ্ডবে মেতে উঠেছে। সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তাধারা নিয়ে প্রচলিত মতামতের বিরোধী বক্তব্য বিচার বিশ্লেষণ করার মতো মানসিকতা এ পরিস্থিতিতে কারোরই নেই।

    আর জ্যোতির্বিদ্যা, সুস্থ চিন্তাধারা, পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর জ্যোতির্বিদ্যার বক্তব্যও মতামতের সাধ্যমত খোঁজ খবর নিয়ে যা শোনা গেছে তা হচ্ছে মাসের…তারিখে (সঠিক মাস ও তারিখ আমার পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না) অগণিত জনসমাগম, উদ্দেশ্যটা কি তা জানা নেই (স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি) শান্ত ও সুশৃঙ্খল রটারডাম নগরের এক্সচেঞ্জ এলাকাটিতে ঘটেছিল।

    সেদিন খুবই গরম পড়েছিল। এ-ঋতু হিসেবে গরমটাকে অভাবনীয়ই বলতে হয়। কেবলমাত্র অস্বাভাবিক গরমই নয়, বাতাসের লেশমাত্রও ছিল না। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। তবে আকাশের গায়ে মেঘ গাঢ় থেকে গঢ়তর হচ্ছে। মনে হলো কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামলে নামতেও পারে।

    হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম, কার্যত হলও তা-ই। জমাট-বাঁধা মেঘ থেকে পুষ্পবৃষ্টির মতো ছিটেফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল ভ্যাপসা গরম থেকেনিস্কৃতি দেবার জন্য প্রকৃতিদেবী এমন তৎপর হয়েছে।

    তা সত্ত্বেও দুপুরের দিকে সেই সমবেত জনতার মধ্যে একটু আধটু অস্থিরতা ও উত্তেজনা দেখা দিল। হাজার দশেক মানুষের কণ্ঠস্বর আকাশ বাতাস মথিত করতে লাগল। তারপরই দশ হাজার মানুষ আকাশের দিকে মুখ তুলল। পরমুহূর্তেই দশ হাজার বাঁশি যেন একই সঙ্গে বেজে উঠল।

    এতগুলো মানুষের সমবেত কণ্ঠস্বর যে ধ্বনি তুলল, তার সঙ্গে একমাত্র নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অবর্ণনীয় গর্জনেরই তুলনা চলতে পারে। গগনভেদি চিৎকার চাচামেচি যেন পুরো শহরটাকে তোলপাড় করতে লাগল। সে যে কী হৈ হট্টগোল, তা ভাষার মাধ্যমে কারো মধ্যে ধারণার সঞ্চার করা সম্ভব নয়। আর সে চিৎকার চাচামেচি রটারডাম নগরের চারদিকের বাড়িগুলোতে বাধা পেয়ে বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসে রীতিমত এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটল। সব মিলে পরিবেশটা যেন সম্পূর্ণরূপে অভাবনীয় হয়ে উঠল।

    এমন হৈ-হট্টগোলের উৎস কোথায়–কোত্থেকে আসছে তা অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যপারটা সবার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ব্যাপারটা কারো কাছেই অজানা রইল না। যে জমাটবাঁধা মেঘের কথা একটু আগেই উল্লেখ করলাম তারই একটা টুকরোর পিছনেনিরেট একটা পদার্থ হঠাৎ লক্ষ্য করলাম। সত্যিকারেরই অদ্ভুত সে পদার্থ।

    আমি বিস্ময়-মাখানো দৃষ্টিতে বিচিত্র ধরনের যে নিরেট পদার্থটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখের পলক ফেলতেও ভরসা পাচ্ছি না, যদি মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টির বাইরে চলে যায়।

    আপাতদৃষ্টিতে দেখা অদ্ভুত সেনিরেট পদার্থটা অচিরেই অধিকতর স্বচ্ছ হয়ে উঠল। সত্যি কথা বলতে কি, এমন কোনো পদার্থকে এর আগে কেউ-ই আকাশে বিচরণ করতে দেখেনি।

    ব্যাপারটা ক্রমেই সবার মধ্যে যার পরনাই রহস্যের সঞ্চার করল। আর হবে নাই বা কেন? আর এর গঠন প্রকৃতি এমন অবিশ্বাস রকম বিচিত্র যে অগণিত নারী-পুরুষ তার দিকেনিষ্পলক চোখে হাঁ করে দীর্ঘসময় ধরে তাকিয়ে থেকেও ব্যাপারটা সম্বন্ধে সামান্যতম আঁচও করতে পারছে না। আর যদি ব্যাপারটা সম্বন্ধে কোনো ধারণাই করতে না পাওে, তবে তার স্তব স্তুতিই বা কি করে করবে। ফলে কপরেল চামড়ায় বিস্ময়ের ভাজ এঁকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের কারও তো কিছু নেই।

    আসলে ওটা কী? এমন কোন বস্তু যা আকাশের গায়ে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে? কিভাবেই বা এমন অসম্ভব একটা কাণ্ড সম্ভব হচ্ছে?

    খামখেয়ালিভাবে একত্রে জমা-হওয়া রটারডামের মানুষগুলো যত ভূতের নাম তাদের জানা আছে তাদের নাম করে করে তারা জানতে চাইছে, ওটা কীসের ইঙ্গিতবাহী। কেউ কিছু জানে না, বুঝতে পারছে না, এমনকি সামান্যতম অনুমানও করতে পারছে না।

    না কেউ-ই না, অন্য কেউ তো সামান্য ব্যাপার এমনকি নগরের কর্তাব্যক্তি মিনহীর সুপারবাস ভন অ্যান্ডারডুক অকস্মাৎ উদ্ভুত এ-রহস্যটা উদ্ঘাটনের সামান্যতম সূত্রও খুঁজে পাচ্ছে না।

    পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকুল বলে কারো পক্ষে কিছু করাও সম্ভব হচ্ছে না। কোনো যুক্তিগ্রাহ্য মন্তব্যও করতে পারছে না। সবাই অসহায় ও অস্থির দৃষ্টি মেলেনিশ্চেষ্টভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

    কিছুই করার নেই বুঝেও পথে জড়ো-হওয়া প্রতিটা মানুষ নিজনিজ বাঁশিটাকে আবার মুখে তুলে নিল। দু-ঠোঁটের ফাঁকে রেখে শক্ত করে চেপে ধরল। কিন্তু হঠাৎ যেন তারা কেমন থমকে গেল।

    সবার মুখেই বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। কয়েক পা হাঁটল। আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আসলে এমন একটা অভাবনীয়, একেবারেই উদ্ভট পরিস্থিতিতে কি যে করণীয়, তা-ই ভেবে উঠতে পারছে না। শেষপর্যন্ত করার মতো কিছু না পেরে সবাই আবার নিজনিজ বাঁশিতে ফুঁ দিল। এতগুলো বাঁশির সমবেত ধ্বনি রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করল।

    এরই মধ্যে আকামেমর বিচরণকারী সেই কৌতূহল-উদ্দীপক নিরেট পদার্থটা নগরের মাথার উপরে আরও অনেক, অনেক নিচে নেমে এসেছে। কখন আর কিভাবে সে ওটা গুটিগুটি এতটা নিচে নেমে এসেছে, কেউ টেরও পায়নি। ধোয়া উদগীরক পদার্থটা সমবেত জনতার মনে আরও অনেক বেশি কৌতূহল সঞ্চার করল।

    সবাই তো ঘাড় ঘুরিয়ে চলমান সে বস্তুটার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। তাদের বিস্ময় উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।

    মিনিট কয়েকের মধ্যেই অদ্ভুত যে বস্তুটা ক্রমে নিচে নামতে নামতে একেবারেই কাছাকাছি চলে এলো।

    এবার ব্যাপারটা নিয়ে এতগুলো মানুষের ধন্ধ প্রায় ঘুচে গেল। হ্যাঁ, এতক্ষণে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল, নির্ঘাৎ ওটা বেলুন বা বেলুন জাতীয় কোনো একটা বস্তু।

    হ্যাঁ, সেটা বেলুন জাতীয় পদার্থ ঠিকই। কিন্তু সবার মনেই একই প্রশ্ন কই, এরকম কোনো বেলুন তো এর আগে কেউ কোনোদিন রটারডামের আকাশে দেখেনি! ব্যাপারটা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করার মতো অবকাশ কারো নেই। একে, অন্যের চোখের দিকে কেবল নীরব চাহনি মেলে তাকাতে লাগল আর সবিস্ময়ে আপন মনে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে চলল।

    ওটা বেলুন বা বেলুন জাতীয় পদার্থ বটে। কিন্তু আসলে বস্তুটা কি? আমার মনেও একই প্রশ্ন বার বার জাগতে লাগল। নোংরা খবরের কাগজ দিয়ে তৈরি এমন একটা বিচিত্র বেলুনের কথা কে, কবে আর কোথায়ই বা শুনেছে? অন্য কোনো দেশের মানুষ শুনে থাকলেও হল্যান্ডের মানুষ যে শোনেনি, এ-বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহও নেই।

    ইতিপূর্বে কেউ কোনোদিন এমন অদ্ভুত বেলুনের কথা না শুনলেও আজ, এ মুহূর্তে তাদের নাকের ডগায় না হলেও নাক থেকে কিছুটা ওপরে এরকম বিচিত্র একটা বেলুন যে অবস্থান করছে, তা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই।

    তবে এও সত্য যে, অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্রে আমি জানতে পেরেছি, এমন কোনো মশলা ব্যবহার করে ওটাকে তৈরি করা হয়েছে, যা ইতিপূর্বে কোনোদিনই এ ধরনের কোনো কাজে ব্যবহার করা হয়নি।

    আর এ-কথাটা বলতে বাধা নেই, রটারডামের অধিবাসীদের শুভবুদ্ধির প্রতি এ একটি মারাত্মক অসম্মানজনক ব্যাপার। আর শূন্যে ভাসমান বস্তুটার যে গঠনপ্রকৃতি, তা তো আরও অনেক বেশি অপবাদের ব্যাপার। কেন? কীসের নিন্দা? আসলে বস্তুটার গঠন প্রকৃতি এমন বিচিত্র ধরনের যে, সেটা দেখতে উলটে দেওয়া একটা গাধার টুপির চেয়ে ভালো কিছু নয়। গাধার টুপির চেয়ে খারাপ দেখতে কিছু থাকলে তা-ও ভাবা যেতে পারে।

    আর ইয়া বড় একটা লোমশ টুপিকে বিচিত্র যন্ত্রটার শেষপ্রান্তে নীল রঙের ফিতে দিয়ে অনেকটা মোটর গাড়ির মতো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বেশি বিচিত্র, যা ব্যাপার তা হচ্ছে, ওই লোমশ টুপিটার মাথায় অর্ধগোলাকার একটা টুপিকে কালো রঙের ফিতে আর রূপার বকলেস দিয়ে আচ্ছা করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এমন বিচিত্র আকৃতির কোনো বস্তুর কথা ভাবতেও উৎসাহ পাওয়া যায় না।

    তবে এ-কথা স্বীকার না করে পারা যাবে না যে, রটারডাম নগরের অধিবাসীরা শপথ করে বলতে পারে যে, তারা এমন দৃশ্য তো ইতিপূর্বে বহুবারই চাক্ষুষ করেছে। প্রকৃতপক্ষে এখন ব্যাপারটাকে উপস্থিত সবাই অভ্যস্ত দৃষ্টিতেই।

    তবে এও সত্য যে ভ্রাট গ্রেটেল কাল শূন্যে ভাসমান বেলুনের মতো বস্তুটাকে। দেখামাত্রই বিস্ময় বিস্ফরিত চোখে তাকিয়ে আনন্দের সঙ্গে চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল। তার অন্তরঙ্গ জনটির ঠিক ওরকমই একটা টুপি ছিল। আর এও বলে রাখা দরকার যে, প্রায় বছর পাঁচেক আগে ভ্রাউ গ্রেটেলও তার সঙ্গিসহ রীতিমত আকস্মিকভাবে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। আর নিতান্তই বিনা কারণে ঘটেছিল।

    আর এ বিবরণীর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাদের খবরাখবর নেবার যাবতীয় প্রয়াসই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। বহু চেষ্টা চরিত্র করেও তাদের সম্বন্ধে কোনো কথাই জানা সম্ভব হয়নি।

    আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, বর্তমানে এ নগরের পূর্বদিকে নির্জন-নিরালা এক পরিবেশে অদ্ভুত ধরনের সব জঞ্জালের স্তূপের মধ্যে এমনকিছু হাড়গোড় আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোকে মানুষের কঙ্কাল বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ব্যাপারটা বাতাসের। কাঁধে ভর করে সে মানুষের কানে পৌঁছে গেছে।

    হাড়গোড় আবিষ্কারের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু লোক নানারকম আলোচনা সমালোচনায় মেতে গেল। শেষপর্যন্ত কিছু লোকের ধারণা হলো ওখানে একটা ভয়ঙ্কর রকমের খুন হয়ে গেছে। তারা এ-বিষয়েও নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে, ভ্রাউ গ্রেটেল তার শিকার হয়েছে। অতএব ওসব হাড়গোড় তারই।

    যাক, প্রসঙ্গটাকে অন্য দিকে আর টেনে না নিয়ে গিয়ে আসল ব্যাপারটায় ফিরে যাওয়া যাক।

    ওই সেই বিচিত্র বেলুনটা মাটি থেকে একশো ফুটের মধ্যে নেমে এলো। এবার সেটাকে সবাই খুব ভালোভাবেই দেখতে পেল। ভিড় করে অপেক্ষমান মানুষগুলো এবার কেবলমাত্র বেলুনটাকেই নয়, বেলুনের আরোহীকেও দেখতে পেল। কেবল দেখতে পেল বললে ঠিক বলা হবে না, বরং স্পষ্টভাবেই দেখতে পেল।

    সত্যি লোকটা বড়ই অদ্ভুত। আর দেখে তাদের এও মনে হলো তার দৈহিক উচ্চতা খুব বেশি হলেও দুই ফুট। কিন্তু সামান্য উচ্চতায়ই লোকটা হয়তো বা দৈহিক ভারসাম্য হারিয়ে তার ছোট্ট আকাশযানটা থেকে গড়িয়ে পড়ে যেত। তবে তার পড়ে na যাওয়ার কারণ হচ্ছে, বৃত্তাকার একটা বেষ্টনির মধ্যে সে আবদ্ধ থাকার জন্যই দৈহিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে আর সেটা বুক সমান উঁচু এবং দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে বাঁধা। তাই দুর্ঘটনা ঘটতে পারেনি।

    ছোটখাট মানুষটা উচ্চতার তুলনায় তার দেহটা বেশি রকম স্থূল হওয়ায় ধরতে গেলে একটা বলের মতো আকৃতি হয়ে গেছে। তবে তার পা দুটো দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু হাত দুটো একেবারেই বিশ্রি এবং অস্বাভাবিক লম্বা। মাথার চুলগুলো সনপাটের মতো ধবধবে সাদা। আর সেগুলো একটা সরু ফিতে দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা। আর নাকটা টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো অস্বাভাবিক লম্বা ও সামান্য বাঁকানো। এক পলক দেখলেই মনে হয় সেটা উত্তেজকও অত্যুজ্জ্বল এবং তীক্ষ্ণ। আর একটা ব্যাপার আমাকে বড় কম অবাক করেনি। তার মাথায় কান বলে কিছু নেই। কানের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে দুটো একদম মসৃণ। কোনোদিন কানের অস্তিত্ব ছিল বলেও মনে হলো না। বয়সের ভারে তার চিবুক আর গাল দুটো কুঁচকে গেছে। তবে ফোলাফোলা ভাব অবশ্যই আছে আর ভাঁজ পড়াও বটে।

    আর তার পোশাক পরিচ্ছদ? গায়ে আকাশ-নীল রঙের সার্টিনের তৈরি ঢিলেঢালা একটা ফ্রক-কোট। আর তার সঙ্গে রং মিলিয়ে একটা ব্রীচেস পরা। রূপার একটা বকলেস দিয়ে হাঁটুর সঙ্গে বেঁধে দেওয়া। আর মাথায় পড়েছে হলুদ রঙের একটা টুপি। একদিকে কাৎ করে মাথায় বসানো। লাল ও লম্বাটে একটা রেশমি রুমাল অদ্ভুতভাবে একটা বো-নেট বেঁধে চমৎকারভাবে বুকের ওপর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। মা নিয়েছেও চমৎকার।

    সমতল থেকে শখানেক ফুট নেমে আসার পর বেঁটেখাট বুড়ো লোকটা যেন হঠাৎ ভয়ে মুষড়ে পড়ল। তার হাবভাব দেখে মনে হলো খুবই ভয় পেয়ে গেছে। আর এও মনে হল, মাটির আর কাছাকাছি আসতে মোটেই আগ্রহী নয়। কেন সে মানুষের তার এমন অনীহা তা-ও বুঝা গেল না।

    ভূমির কাছাকাছি আসতে চান না বলেই হয়তো বহু কষ্টে একটা ক্যানভাসের ঝোলা হাতে তুলেনিল। কি সব দিয়ে যেন সেটা ভর্তি। মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল, ঝোলাটার ভেতরে হাতটা চালান করে দিয়ে ভেতর থেকে মুঠো ভর্তি করে বালি তুলে নিয়ে নিয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগল। ব্যস, তারপরই সে একেবারে স্থির হয়ে গেল।

    কিছুক্ষণ নিশ্চল-নিথরভাবে বসে থাকার পর এক সময় সে ঝটপট হাতটাকে ফ্রক কোটের পকেটে চালান করে দিল। সেখান থেকে মরক্কো চামড়া দিয়ে বাঁধানো একটা নোটবই বের করে আনল।

    এবার সে নোট বইটাকে হাতের ওপর নিয়ে হাতটাকে বার কয়েক ওপরনিচ করে তার ওজন সম্বন্ধে ধারণা করে নিয়ে সবিস্ময়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল। বইটার ওজনই তার এরকম বিস্ময়ের কারণ।

    কয়েক মুহূর্ত বইটার দিকেনিষ্পলক চোখে বইটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর সে সেটা খুলে ভেতর থেকে একটা লম্বা কাগজ বের করে আনল। কাগজ বলতে আসলে সেটা একটা চিঠি।

    হাতের চিঠিটা বার দুতিন উলটে পাল্টে দেখে নিয়ে সে সেটাকে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নগর প্রধান সুপারবাসের দিকে ছুঁড়ে দিল।

    চিঠিটা ভাসতে ভাসতে এসে নগর প্রধানের পায়ের কাছে পড়ল।

    নগর প্রধান মুহূর্তের জন্য চিঠিটার দিকে তাকিয়ে সেটাকে মাটি থেকে তুলে নেবার জন্য নিচের দিকে ঝুঁকলেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কৌতূহলী নগরবাসীরা নীরবে ব্যাপারটা লক্ষ্য করতে লাগল। তারা মুখে কিছু না বললেও তাদের মধ্যে কৌতূহল ও চাঞ্চল্যের অভাব নেই।

    বিমানচারীর রটারডাম নগরের কাজ মিটে গেছে। এখানে তার আর কোনো দরকার নেই। কেবলমাত্র চিঠিটা যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে সে আবার ওপরে ওঠার জন্য তৎপর হল।

    বিমানটাকে ওপরে তুলতে হলে তাকে সেটা থেকে আরও কয়েকটা বালির থলেকে নিচে ফেলে দিতে হবে। এভাবে বিমানটাকে হালকা করতে পারলে তবেই তো সেটা ধীরে ধীরে উর্ধগামী হবে।

    বিমানচারী শেষপর্যন্ত করলেও তা-ই। সে একের পর এক বালির থলে বিমান থেকে ঝটপট নিচে ফেলে দিতে লাগল।

    বালির থলেগুলো যে কোথায় কার ঘাড়ের ওপর পড়ছে, সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপমাত্র নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেগুলো একের পর এক সরাসরি নগর প্রধানের পিঠের ওপর দমাদম পড়তে লাগল। আর এরই ফলে তিনি এতগুলো মানুষের চোখের সামনে একবার বা দুবার নয়, পর পর ছয়বার ডিগবাজী খাওয়ার ভঙ্গিতে উলটে গেলেন। যাকে বলে কেবলমাত্র বেইজ্জতের ব্যাপারই নয়, এতে তিনি রীতিমত নাস্তানাবুদ হতে লাগলেন।

    তবে এও সত্য যে, কেউ যদি মনে করেন নগর-প্রধান অ্যান্ডারডু বিমানচারীর এরকম একটা বিচ্ছিরি কাণ্ডকে নীরবে বরদাস্ত করেছেন, মুখ বুজে হজম করেছেন তবে কিন্তু ভুলই করা হবে।

    বরং উপস্থিত নগরবাসীদের বক্তব্য, তিনি আধা ডজনবার ডিগবাজী খাওয়ার সময় প্রত্যেক বারই পাইপ থেকে খুব জোরে বাঁশি বাজাতে লাগলেন। সাধ্যমত জোরেই বাঁশি বাজালেন। তাতে তার প্রচণ্ড ক্ষোভই প্রকাশ পেয়েছে। আর সবাই এও মনে করল, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বুঝি এভাবে বাঁশিতে ফুঁ দিতেই থাকবেন।

    বালির থলে গুলো ফেলে দেওয়ার ফলে আকাশ যানটা অনেকাংশে হালকা হয়ে যাওয়ায় ক্রমে ওপরে উঠতে উঠতে ইতিমধ্যে বেশ ওপরে উঠে গেছে। তারপর সেটা শূন্যে ভাসতে ভাসতে একসময় রটারডাম নগরের অনেক উঁচু দিয়ে এক সময় দ্রুত মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দিল। ঠিক সেভাবে সেটা মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল ঠিক সে-রকমভাবেই ক্রমে মেঘের ভেতরে ঢুকে সম্পূর্ণরূপে মেঘের মধ্যে আত্মগোপন করল। সেটা রটারডামের ভালো মানুষদের বিস্ময় মাখানো নজরের বাইরে চিরদিনের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

    বিমানটা দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর এবার পথচারী জনতার নজর পড়ল বিমান থেকে উড়ে-আসা চিঠিটার ওপর। সত্যি বলতে কি, বিমানটার অবতরণ এবং চিঠিটানিক্ষেপের ফলে মহামান্য নগরপালক ভন অ্যান্ডারভুকের দেহ-মন আর মর্যাদাকে রীতিমত বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।

    বালির বস্তার আঘাতে পদস্থ ব্যক্তিটি যত ডিগবাজী খান আর পথে গড়াগড়ি খান না কেন চিঠিটাকে কিন্তু নজরে নজরে রেখেছেন, কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেননি।

    পথচারীরা অনুসন্ধিৎসু নজরে চিঠিটার দিকে লক্ষ্য রেখে নিঃসন্দেহ হলো যে, চিঠিটা জায়গা মতোই পড়েছে। অর্থাৎ তিনি নিজেই হাত বাড়িয়ে পথের ওপর থেকে চিঠিটা হাতে তুলে নিয়েছেন।

    খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চিঠিটা লেখা হয়েছে ‘রটারডাম কলেজ অব অ্যাস্ট্রনমি’র সভাপতি এবং সহ-সভাপতি অর্থাৎ ভন অ্যান্ডারডুক এবং তাঁর সহকারী অধ্যাপক রুবাদুরের নামে। সভাপতি ভন অ্যান্ডারডুক চিঠিটা হাতে নিয়ে তাঁর সহকারী অধ্যাপক রুবাদুরের সামনে; পথের মাঝে দাঁড়িয়েই চিঠিটা খুললেন।

    খামটার মুখ খুলে ভেতর থেকে একটা চিঠি বের করে আনলেন। দেখলেন তাতে স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে–

    ‘মহামান্য সভাপতি ভন অ্যান্ডারডুক ও সহ-সভাপতি রুবাদুব, রটারডাম কলেজ অব অ্যাস্ট্রনমি’ মহাশয়দ্বয়–

    আপনাদের হয়তো স্মরণ থাকতে পারে যে, গত পাঁচ বছর আগে হান্স ফাল নামক কোনো এক ব্যক্তি তিনজন সহকারীকে নিয়ে রটারডাম নগর থেকে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। হান্স ফালের সম্পূর্ণ নাম ছিল–ভ্রাট গ্রেটেল হান্স ফাল। আর সে ছিল পেশায় কর্মকার। লোহা পড়িয়ে, পিটিয়ে পাটিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করাই ছিল তার জীবিকার একমাত্র উপায়। আর তার তিন সঙ্গিও একই পেশায় নিযুক্ত ছিল।

    কিন্তু কেন যে হান্স ফাল কাউকে কিছু না জা নিয়ে, না বলে চুপিসারে বাড়ি থেকে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল তা কেউই জানে না। মহাশয়দ্বয়, আশা করি আপনারা জেনে অবশ্যই খুশি হবেন যে, আমিই সেই হারিয়ে যাওয়া হান্স ফাল।

    আমার সহ-অধিবাসী ও পরিচিতজনরা জানেন যে, ঘেউয়ের ক্রাউট নামক গলির মুখে মুখে অবহিত ছোট্ট ইটের বাড়িটায় গত চল্লিশ বছর যাবৎ আমি বসবাস করছি।

    আমি যখন নিখোঁজ হই, তখনও সে বাড়িতেই অবস্থান করছিলাম, অর্থাৎ সে বাড়িটা থেকেই বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলাম।

    কেবলমাত্র আমার কথাই বা বলি কেন? আমার পূর্ব পুরুষরাই বংশ পরম্পরায় সে বাড়িটাতেই বাস করে গেছেন।

    আমার পূর্বসূরীরা আর আমি একই কর্মকার বৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করি। আমাদের পেশার মুখ্য কাজ ছিল হাপর মেরামত করা। এ সম্মানজনক আর লাভজনক। কাজেই আমরা স্মরণাতীতকালে নিজেদের লিপ্ত রেখেছি। আমাদের বংশের কেউ ভুলেও বংশগত পেশা ছেড়ে অন্য কোনো পেশায় নিযুক্ত হয়নি।

    সম্প্রতি মানুষ রাজনৈতিক কার্যকলাপে যেভাবে মেতে উঠেছে, রাজনীতিকে জীবনের সবচেয়ে অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়ে তাতেই সম্পূর্ণরূপে আত্ম নিয়োগ করেছেন তাতে আমার মতো রটারডম নগরের একজন সৎ মানুষের কাছে আমার এ বংশগত পেশাকে আঁকড়ে থাক ছাড়া অন্য কোনো পেশার প্রতি আগ্রহান্বিত হওয়া উচিত নয়। উপযোগিও অবশ্যই নয়।

    আরও খোলসা করে বলছি–আমার পেশায় জমার পরিমাণ ভালো; আর কোনোদিনই কাজের অভাব হয় না। কাজ করতে পারলে, শরীর বরদাস্ত করলে কাজ যতই চাওয়া যাবে অভাব হবে না, অতীতেও কোনো দিন হয়নি।

    কিন্তু যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, কথায় কথায় সে প্রসঙ্গ থেকে সরে এসেছি। হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম, আমরা ক্রমেই স্বাধীনতা, দীর্ঘ রাজনৈতিক আলোচনা ও ভাষণ, সংস্কারবাদ আর অনুরূপ সবকিছু ফলাফলগুলো সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে শিখে ফেললাম।

    অতীতে এক সময় যারা পৃথিবীর সবগুলো দেশের শীর্ষে, অর্থাৎ সবচেয়ে সেরা খদ্দের এমন আমাদের সুবিধা-অসুবিধা সম্বন্ধে ভাববার এতটুকু অবকাশ তাদের নেই, ইচ্ছারও পুরোপুরি ভাটা পড়ে গেছে।

    সত্যি কথা বলতে কি, সরকারের ক্ষমতা যত হ্রাস পেতে লাগল, যতই শক্তির ঘাটতি হতে লাগল, লোহা আর চামড়ার স্থায়িত্ব ততই বেড়ে যেতে লাগল। সে এক কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হল।

    শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি এমন খারাপ হয়ে পড়ল যে, অল্পদিনের মধ্যেই রটারডাম নগরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এক জোড়া হাপর জোগাড় করা সম্ভব হলো না। কী সমস্যায়ই না পরা গেল। এত বড় একটা নগরে একটা হাপরও মিলল না। এমনকি এমন এক জোড়া হাপরের হদিস পাওয়া গেল না, যার কোনোরকম হাতুড়ি ঘা দেওয়া বা সেলাই করার দরকার হতে পারে।

    এমন একটা সমস্যা-সঙ্কুল পরিস্থিতির মধ্যে কি করে টিকে থাকা সম্ভব বা বেশি দিন বরদাস্ত করা যেতে পারে সেটাই চিন্তার বিষয়।

    পরিস্থিতির শিকার হয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমি ইঁদুরের মতো নিঃস্ব, একেবারে গরিব হয়ে গেলাম। যাকে বলে একেবারেই কপর্দকশূন্য হয়ে গেলাম।

    পরিস্থিতি আবার আমাকে এমন রক্তচক্ষু দেখাতে লাগল যে, স্ত্রী-পুত্রের ভরণপোষণের ব্যাপারটাও আমার কাছে রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়ল। আমি একেবারে হাঁপিয়ে উঠলাম। আমার ভালো লাগত না। অন্তহীন হাহাকার আর হতাশা আমাকে পেয়ে বসল।

    অসহ্য! সে মুহূর্তে জীবনটা আমার কাছে একেবারেই অসহ্য হয়ে উঠল। তখন আমার প্রধানতম ও একমাত্র চিন্তা হয়ে দাঁড়াল কিভাবে জীবনটাকে শেষ করে দিয়ে দুর্বিসহ অশান্তির হাত থেকে চিরদিনের মতো নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। আর একমাত্র চিন্তা আমার মাথায় ভর করল, জীবনটাকে শেষ করে দেবার সুবিধাজনক উপায় কী? একই উপায় উদ্ভাবন করতে গিয়ে তন্ময় হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে লাগলাম।

    কিন্তু আপন চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকার মতো সুযোগই বা কোথায়? পাওনাদাররা আমাকে স্থির থাকতে দেয় না। তারা সময় অসময়ে বাড়ি বয়ে এসে জোর তাগাদা দিতে লাগল। তাদের ঘন ঘন তাগাদায় দুদণ্ড স্থির হয়ে বসে যে জীবনটাকে খতম করে দেওয়ার কথা ভাবব, তার সুযোগ তারা দিচ্ছে কই।

    পরিস্থিতি ক্রমেই আবারও দুর্বিষহ হয়ে পড়তে লাগল। পাওনাদাররা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমার বাড়িটার চারদিকে পাহারা দিতে থাকে। বাড়ির সীমানার বাইরে বেরোলেই আমাকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরবে, এটাই তাদের লক্ষ্য।

    পরিস্থিতি আরও একধাপ খারাপের দিকে গেল। পাওনাদাররা এগিয়ে এসে পালা করে আমার বাড়ির দরজায় বসে থেকে কড়া পাহারা দিতে লাগল। শুধু কি এ-ই? কড়া সুরে আমাকে আইনের হুমকি দিতেও ছাড়ল না। তিনটি লোক এভাবে আমাকে ভোগান্তির চরম সীমায় ঠেলে দিল। তারাই আমাকে সবচেয়ে বেশি করে উত্যক্ত করতে লাগল।

    আমি যারপরনাই মনমরা হয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝে তাদের ওপর প্রতিশোধাত্মক জেদও আমার মধ্যে চলতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যদি কোনোদিন মওকা মেলে, এ তিনজনকে যদি হাতের মুঠোয় পাই, তবে এভাবে নিরবচ্ছিন্ন উৎপীড়ন এবং অপমানের প্রতিশোধ নেবই নেব। উপযুক্ত বদলা নানিতে পারলে আমার আমার দেহ-মনের জ্বালা কমবে না। সেই শুভ মুহূর্তের আশায়, পথ চেয়ে তখনকার মতো আত্মহত্যার পরিকল্পনাটাকে বাতিল করে দিলাম। ভাবলাম, দেখাই যাক না, পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় কি না, আমার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির চাকা ঘোরে কিনা।

    ওই তিন হতচ্ছাড়া পালা করে রোজই আমার দরজা আগলে বসে থাকতে লাগল। কিন্তু দিন কয়েক এভাবে চালাতে চালাতে তাদের উৎসাহে একটু ভাটা পড়ল। লক্ষ্য। করলাম, পাহারা দিতে দিতে তাদের একজন মাঝে মধ্যেই কোথায় চলে যায়। আমি মনে মনে ভাবলাম, এ-ই মওকা। ব্যস, আর দেরি নয়। একদিন সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। তাদের চোখে ধূলো দিয়ে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু মনে আমার অন্তহীন হতাশা আর হাহাকার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হতাশ মনে বিনা উদ্দেশ্যে ছোট-বড় রাস্তা আর গলি দিয়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি, কেনই বা হেঁটে চলেছি কিছুই আমার জানা নেই।

    বিনা উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে শেষপর্যন্ত এক সময় একটা গলির মোড়ে পৌঁছলাম। সামনের একটা বইয়ের দোকানের কাছে গিয়ে আচমকা গতি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

    দোকানটার সামনে কয়েকটা চেয়ার পেতে রাখা হয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হলো, খদ্দেরদের বসার জন্যই এ-আয়োজন। সে যা-ই হোক, চেয়ার যখন খালি পাওয়া গেছে তখন বসতে আপত্তি কোথায়। মুহূর্তমাত্র দেরি না করে আমি তাদের একটা টেনে বসে পড়লাম। আর কেন যে হাতের কাছে যে বইটা পেলাম সেটাকে তাকের ওপর থেকে টেনে হাতে নিয়ে নিলাম বলতে পারব না।

    জ্যোর্তিবিজ্ঞানের ওপর লেখা একটা বই। বইটা হাতে নিয়ে একের পর এক পাতা ওল্টাতে লাগলাম। দু-চারটা পাতা উলটেই বুঝতে পারলাম, বইটা ভালোই। তবে সেটা বেশি মোটা নয়, চটি।

    বইটার লেখকের নাম ছাপা আছে–এনামের। তিনি বার্লিনের অধ্যাপক হতে পারেন। আর তা যদি না হন তবে এনামের কোনো ফরাসি পণ্ডিত।

    স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এরকম ব্যাপার স্যাপার সম্বন্ধে আমার একটু-আধটু কৌতূহল দীর্ঘদিনের। আর এ-বিষয়ে অল্পবিস্তর খোঁজখবরও আমি রাখি।

    কয়েকটা পাতা উলটে, অল্প সময়ের মধ্যে বইটার প্রতি আমার আগ্রহ যারপরনাই বেড়ে গেল। চোখের সামনে থেকে সরাতে তো পারলামই না, বরং বইটার মধ্যে নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিলাম।

    দুনিয়ার অন্য সবকিছুর অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে বইটার শেষ পাতা পর্যন্ত একবারে পড়ে শেষ করে ফেললাম। আগেই বলেছি, বইটা বেশি মোটা নয়, চটি। একবার পড়ার পর মন তৃপ্ত হলো না। আরও একবার পড়ে ফেললাম।

    বইটা পড়া শেষ করে যখন হুঁস ফিরে পেলাম তখন দেখলাম শহরের বুকে চারদিকে রাতের অন্ধকার নেমে আসতে চলেছে।

    বইটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে আত্মস্থ হবার পর ভাবলাম, রাত হয়ে গেছে। আর এখানে বসে থাকা সমিচিন হবে না, এবার বাড়ি ফেরা দরকার। চেয়ারটার আশ্রয় ছেড়ে উঠে পড়লাম। সোজা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।

    আমি বাড়ির দিকে হেঁটে চলেছি বটে, কিন্তু মন আমার পড়ে রয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় ওই চটি বইটার পাতাগুলোর মধ্যে। আর তার বক্তব্য মাথার মধ্যে অনবরত চক্কর খেয়ে চলল।

    বাড়ির দরজায় যখন পৌঁছলাম তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। চিন্তাক্লিষ্ট মন নিয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলাম।

    আলোনিভিয়ে শুয়ে পড়লাম বটে, কিন্তু কিছুতেই আমার ঘুম এলো না। ঘুম তো আর আমার আজ্ঞাবাহী নয় যে, বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে চোখ জুড়ে আসবে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ব। ঘুম তো আসার কথাও নয়, আমার মাথায় যে ভিড় করে রয়েছে গুচ্ছেরখানেক এলোমেলো আজগুবি চিন্তা। চিন্তার সে জট ছাড়াতে ছাড়াতেই রাত কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠল।

    না, ভোর হবার পর আর বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকার সম্ভব হলো না। এক লাফে অস্থির চঞ্চল মন নিয়ে বিছানা থেকে নেমে এলাম।

    বিছানা ছাড়ার পর আমার মানসিক অস্থিরতা চড়চড় করে বেড়ে চলল। নিজেকে সামলে-সুমলে রাখতে না পেরে খুব সকালেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

    সাধ্যমত লম্বা লম্বা পা ফেলে যে বইয়ের দোকানটায় হাজির হলাম। পকেট হাতড়ে পয়সা-কড়ি যা পেলাম তা দিয়ে একটা ব্যবহারিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং একটা যন্ত্র-বিজ্ঞান প্রসঙ্গে লেখা বই খরিদ করে নিলাম।

    দোকানির প্রাপ্য দাম মিটিয়ে দিয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে, বই দুটো বগলে নিয়ে সোজা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।

    বাড়ি ফেরবার পর আমাকে যেন অদ্ভুত একটা নেশায় পেয়ে বসল। একটু ফুরসৎ পেলেই বই দুটোর যে কোনো একটা নিয়ে বসে পড়ি। আর তার একের পর এক পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে লাগলাম। সে যে কী নেশা তা ভুক্তভোগি ছাড়া কাউকে বুঝিয়ে বলা বা যথাযথ ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়।

    দিনের পর দিন বই দুটোর পাতার মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে আমার মধ্যে অত্যাশ্চর্য, একেবারেই অবিশ্বাস্য একটা ভাবান্তর ঘটতে লাগল। বুঝলাম, বই দুটোর পাতায় বহুবার চোখ বুলানোর ফলেই এ-রকমটা ঘটছে।

    সত্যি বলছি, বই দুটো পর পর বেশ কয়েকবার পড়ার ফলেই একটা অদ্ভুত পরিকল্পনা আমার মাথায় খেলতে লাগল। এর পিছনে কোন শক্তির প্রভাব বেশি আমার অতিরিক্ত প্রতিভা, নাকি শয়তানের? এদের কোনটা যে আমাকে বেশি রকম প্রভাবিত করেছে তা নিশ্চিত করে আমি বলতে পারব না।

    আরও একটা একেবারেই নতুনতর মতলব আমার মাথায় খেলে গেল। আমার পাওনাদারদের মধ্যে যে তিনজন এঁটুলির মতো আমার পিছনে লেগে রয়েছে, আমার। দরজায় বসে আমার ওপর কড়া নজর রেখে চলেছে তাদের আমার দলে ভেড়াবার চেষ্টা চালাতে লাগলাম। ভাবলাম, তাদের আমার দলে ভেড়াব বললেই তো আর তারা সুড়সুড় করে আমার খাতায় নাম লেখাবে না। আমার প্রতি তাদের খোয়া-যাওয়া আস্থাকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে তাদের সার্বিক সহানুভূতি লাভ করার চেষ্টা নিছকই পাগলের চিন্তা তাদের প্রাপ্য অর্থের কিছু-না-কিছু, অন্তত অর্ধেক হলেও ফিরিয়ে দিতে হবে।

    আমি উক্ত পাওনাদার তিনজনের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার শুভবাসনা নিয়ে নিজের বসতবাটীটা বিক্রি করে দিলাম। তা দিয়ে তাদের প্রাপ্য মোট অর্থের অর্ধেক মিটিয়ে দিলাম। আর তাদের প্রতিশ্রুতি দিলাম, আমার পরিকল্পনাটা সার্থক, বাস্তবায়িত করতে পারলে অবশিষ্ট প্রাপ্য অবশ্যই মিটিয়ে দেব।

    পাওনাদার তিনজন আমার কথায় আশ্বস্ত হল। আমি এবার মওকা বুঝে আমার পরিকল্পনাটাকে সফল করার কাজে তাদের সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা প্রার্থনা করলাম।

    শিক্ষার আলোক থেকে তারা বঞ্চিত। বুদ্ধিও স্বাভাবিকভাবেই কম। তাই আমার কায়দা কৌশলে পেশ করা বক্তব্যে তারা সহজেই ঘায়েল হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি, তারা রীতিমত উচ্ছ্বসিত আবেগের সঙ্গে আমার প্রস্তাবটাকে স্বাগত জানাল। আর আমার মধ্যে খেলে গেল অভাবনীয় এক খুশির জোয়ার।

    বহু বুদ্ধি খরচ করে এবং দীর্ঘ চেষ্টা চরিত্রের মাধ্যমে এ-দিককার একটা হিল্লে করে ফেলতে পারলাম।

    এবার আমার স্ত্রীর সাহায্য-সহযোগিতা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ল। কারণ, আমার অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি করা দরকার। সে আমাকে সার্বিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিল আর তা রক্ষাও করল। তারই সহযোগিতায় আমি অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে আমার যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে পারলাম।

    হ্যাঁ, সে আমার কথা রেখেছে। এসব ব্যাপার স্যাপার ঘুণাক্ষরেও কারো কাছেই এতটুকু ফাঁস করেনি।

    আরও টাকাকড়ি চাই। আরও কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে না পারলে আমার পরিকল্পনা বাস্তবরূপ দেওয়া যে কিছুতেই সম্ভব নয়, এ-ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ। যে করেই হোক প্রয়োজনীয় অর্থ আমাকে সংগ্রহ করতেই হবে। কিন্তু উপায়? উপায় যা হোক কিছু একটা তো করতেই হবে। এতখানি এগিয়ে শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েনিশ্চেষ্ট হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে এমন সুন্দর একটা পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেলে আফসোসের আর সীমা পরিসীমা থাকবে না।

    আমি আবার মতলব ভাঁজতে লাগলাম, কিভাবে আরও কিছু পয়সা কড়ি জোগাড় করা যায়। এবার বিভিন্নরকম অজুহাত দেখিয়ে শীঘ্রই পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহু পরিচিতজনের কাছ থেকে টাকাকড়ি হাতিয়ে জড়ো করতে লাগলাম।

    এত টাকা কিভাবে, কবে শোধ করতে পারব এসব চিন্তা ভাবনা না করেই আমি সমানে ধার করে মোটা অঙ্কের টাকা জোগাড় করে ফেললাম।

    এবার একটা-দুটো করে প্রতিটা বারো গজ মাপের মসলিনের টুকরো কিনে জড়ো করতে লাগলাম। সেগুলো ক্যাম্বিক মসলিনের টুকরো। আর বেশ কিছু পরিমাণ ভালোভাবে পাক দেওয়া দড়ি, ইয়া পেল্লাই একটা বেতের মজবুত ঝুড়ি, প্রচুর পরিমাণ রবারের বার্ণিশ, আর এমন সব জিনিসপত্র এক-এক করে জোগাড় করতে মেতে গেলাম, ইয়া পেল্লাই একটা বেলুন তৈরি করতে যা-কিছু দরকার হতে পারে।

    সব জিনিসপত্র এক জায়গায় জড়ো করলাম। এবার হাত চালিয়ে জিনিসগুলো গোছগাছ করে নেওয়া দরকার। আমার স্ত্রীর ওপর এ গুরুদায়িত্বটা অর্পণ করলাম। তার ওপর আমার আস্থা পুরো দস্তুর। তবে, গোছগাছের কাজকর্ম কিভাবে সারতে হবে তা তাকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিলাম।

    স্ত্রীর সাহায্যে সবকিছু গোছগাছ করার পর আমি এবার সেগুলোকে রাতের অন্ধকারে সবার চোখের আড়ালে, খুবই সতর্কতার সঙ্গে রটারডাম নগরের পূর্বদিকের এক নির্জন নিরালা স্থানে নিয়ে জমা করলাম।

    এবার আমি পরিকল্পনামাফিক খুবই গোপনে একটা বিশেষ প্রকৃতির গ্যাস তৈরির কাজে লেগে গেলাম। সেটা এমনই এক বিশেষ প্রকৃতির গ্যাস, যা আমি ছাড়া আর কেউ-ই আজ পর্যন্ত তৈরি করেনি, করতে পারেনি। আর কিছু না হোক অন্তত এরকম কোনো কাজে অবশ্যই ব্যবহার করেনি।

    সত্যি কথা বলতে কি, আমার সে গ্যাস তৈরির গোপন রহস্যটা আমি অনায়াসেই খোলসা করতে পারতাম। কিন্তু সে যে ন্যায়ত ধৰ্মত উচিত হবে না। কারণ সত্যি কথা বলতে কি, সে গোপন তথ্যটার মালিক আমি নিজে নই, ফরাসি দেশের এক নাগরিক। সে দেশেরনিজ শহরের অধিবাসী। আর তিনি শর্ত আরোপ করেই তথ্যগুলো আমাকে বলেছেন।

    সবচেয়ে বড় কথা, আমি কোন কাজে সে গ্যাস ব্যবহার করব তা না জেনেই তিনি। আমার কাছে গোপন তথ্যটা প্রকাশ করেছেন। আর তিনি আমাকে এও বলেছেন, কোনো একটা বিশেষ জানোয়ারের ঝিল্লি ব্যবহার করেও এরকম একটা বেলুন অনায়াসেই তৈরি করে নেওয়া সম্ভব।

    হ্যাঁ, খুবই সত্য বটে, বিশেষ এ-জানোয়ারের ঝিল্লি থেকে তৈরি বেলুন থেকে গ্যাস কিছুতেই বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে না।

    তবে ওই পদ্ধতিতে বেলুন তৈরি করতে অবশ্যই বহু অর্থ ব্যয় হয়, তা ছাড়া কাম্বিক মসলিনের ওপর রবারের আস্তরণ ব্যবহার করলেও সেটা বেলুন তৈরির কাজে একই রকম উপযোগি হবে কিনা এ ব্যাপারেও আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম না।

    উক্ত ঘটনাটা এখানে উল্লেখ করার কারণও আছে যথেষ্টই। কারণটা হচ্ছে, আমার বিশ্বাস যে, এমনও হতে পারে সে ভদ্রলোক ভবিষ্যতে এরকম গ্যাস ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি দিয়ে বেলুন তৈরি করে আকাশে ওড়ার চেষ্টা করতে পারেন। আশা করি, আর খোলসা করে বলার দরকার নেই। তবুও বলছি, ভবিষ্যতে যদি এ-গ্যাস ব্যবহার করে তিনি আকাশে উড়তে আগ্রহী হন তবে আমি অবশ্যই তাকে এ-বিশেষ আবিষ্কারের খ্যাতি থেকে বঞ্চিত করতে আগ্রহী নই, করবও না।

    যা-ই হোক, আমি বেলুন তৈরির কাজে মেতে গেলাম। কঠোর পরিশ্রম, নিরবছিন্ন অধ্যবসয়ায় এবংনিষ্ঠার সঙ্গে আমি কর্তব্য কর্ম সম্পাদনে লেগে রইলাম। অল্প কয়দিনের মধ্যেই আমি বাঞ্ছিত বেলুন তৈরির কাজটা সেরে ফেললাম।

    বহু আকাঙ্ক্ষিত বেলুন তৈরির কাজটা সারার পর আমি যাত্রার উদ্যোগ আয়োজন করতে লাগলাম।

    আমি বেলুন তৈরির ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে আরও একবার কিছু অত্যাবশ্যক কথাবার্তা সেরে নেওয়া দরকার মনে করলাম। তাকে পাশে বসিয়ে কথাবার্তার মাধ্যমে তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিলাম, যে, প্রথম দিন বাড়ি থেকে গোপনে বেরিয়ে হারা উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে সেই বইয়ের দোকানে যাওয়া, বই দুটো খরিদ করা থেকে শুরু করে বেলুনটা তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে যা-কিছু করেছি, সে সব কথা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোপন রাখবে, কোনো অবস্থাতে সামান্যতম তথ্যও সে কারো কাছে ফাস করবে না। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, কথা দিল। কিন্তু আমাকে তার কাছে প্রতিশ্রুতি দিতে হল, যত শীঘ্র সম্ভব আমি তার কাছে ফিরে আসব।

    আমি এবার খরচপাতি করার পর হাতে অবশিষ্ট সামান্য যা-কিছু টাকাকড়ি, স্ত্রীর হাতে দিলাম তার সংসার খরচ হিসেবে। আমার অনুপস্থিতিতে তার খাওয়া-পড়া আর তার অন্যান্য টুকিটাকি তো তাকে কিনতে হবে। আমার ঘরণীটি সত্যি খুবই কর্মঠ মহিলা। সে পারে না এমন কাজ খুব কমই আছে। আমার সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই সে যাবতীয় কাজকর্ম সেরে নিতে পারে।

    যাক, সংসার খরচের মতো সামান্য কিছু অর্থ হাতে তুলে দিয়ে, যত শীঘ্র সম্ভব বাড়ি ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

    আমার স্ত্রী সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে বিষণ্ণ মনে, কৃত্রিম হাসির রেখা মুখে ফুটিয়ে তুলে আমাকে বিদায় জানাল।

    আমি পথে নামলাম।

    একটা কথা স্বীকার না করে পারছি না, আমি নিজের মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, আমার স্ত্রী সব সময়ই আমাকে একজন সত্যিকারের কুঁড়ের বাদশা বলেই মনে করত। যদিও সে মুখ ফুটে বল না, তবু আমার বিশ্বাস, তার বদ্ধমূল ধারণা, আমার মতো গেঁতো লোক দ্বিতীয়টি নেই। আমি তার কাছে নিতান্তই একটা আপদ না হলেও বোঝাস্বরূপ তো বটেই, এক ধরনের মানুষ আছে যারা কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা, মুখেন। মারিতং জগৎ–আমিও তাদেরই একজন। বসে বসে অলীক কল্পনা করা ছাড়া আমি নাকি আর কোনো কাজেরই নই।

    জানি না, আমার ধারণাটা কতখানি সত্য–আমার বিশ্বাস, আমার বিদায় মুহূর্তে আমার স্ত্রীর মুখে বিষণ্ণতার কালো ছায়া নেমে এলেও মনে মনে একটু আধটু হলেও সে খুশিই হয়েছে। কারণ, এরকম একটা নিষ্কর্মার চেঁকির হাত থেকে দিন কয়েকের জন্য হলেও নিষ্কৃতি পাওয়া গেল।

    স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি যখন রাস্তায় নামলাম, তখন শহরের বুকে রাত। অন্ধকার বিরাজ করছে।

    দেখলাম, আমার পাওনাদার তিনজন, এতদিন যারা আমার চক্ষুশূল ছিল, নিরবচ্ছিন্নভাবে আমাকে এতদিন জ্বালিয়ে মেরেছে, তারা আমার জন্য সদর দরজায় অপেক্ষা করছে।

    আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাওনাদার তিনজনের সঙ্গে মিলিত হলাম। হাসিমুখে সবার সঙ্গে করমর্দন সারলাম। সহকারী হিসেবে তাদের সঙ্গে নিলাম। আসলে এখন যা-কিছু করার বাকি, যা-কিছু করতে হবে তা একার দ্বারা কিছুতেই সম্ভব নয়। দু তিনজন সহকারী চাই-ই চাই। তাদের সঙ্গে আগেই এরকম কথাবার্তা সেরে রেখেছিলাম। তাই মূর্তিমান তিনজন সন্ধ্যা থেকেই সদর দরজায় মোতায়েন রয়েছে।

    পাওনাদার তিনজনকে সহকারী হিসেবে নিয়ে মালপত্রের কাছে গেলাম। আমি আর সহকারী তিনজন, মোট চারজনে মোটর, অতিকায় বেলুন আর অন্যান্য অত্যাবশ্যক সামগ্রি নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। বড় রাস্তা না ধরে অলিগলি দিয়েই আমরা হাঁটতে লাগলাম। ঘুরপথে, একটু বেশি রাস্তা অতিক্রম করতে হলেও এটাই নিরাপদ মনে করলাম।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আমাদের বাঞ্ছিত স্থানে পৌঁছে গেলাম। আমাদের কাজের উপযোগি সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় কাজ শুরু করতে কোনোরকম বেগ পেতে হলো না। আমরা জোরকদমে কাজে মেতে গেলাম। হাত চালিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আমরা যত শীঘ্র সম্ভব কাজটা সেরে ফেলার জন্য তৎপর হলাম।

    বাতাস প্রয়োগ করে বেলুনটাকে ফোলাবার সময় ছোট ছোট পিপেগুলো যেখানে রাখব মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, সেখানে সবার নজরের আড়ালে আমি আগেভাগেই গোপনীয়তা বজায় রেখে মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়ে রেখেছিলাম। এরকম সব গর্তকে পঁচিশ ফুট বৃত্তাকার ব্যাসে সাজালাম। আর পিপেটাকে বৃত্তটার ঠিক কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করার কথা। পিপেটাকে যেখানে বসানো হবে ঠিক সেখানে আর একটা অধিকতর গভীর ও ব্যাসযুক্ত একটা গর্ত খুঁড়ে ফেললাম। এবার পাঁচটা খালি পিপের মধ্যে বারুদ বোঝাই করলাম। এগুলোকে এবার গর্তগুলোর পাঁচটার মধ্যে প্রতিটাতে একটা করে ঢুকিয়ে দিলাম। এখানে বলে রাখা দরকার, প্রত্যেকটা পিপেতে পঞ্চাশ পাউন্ড করে বারুদ ঠেসে ঠেসে ঢুকিয়ে দিলাম। ছোট ছোট পিপে ও বড়সড় পিপেগুলোকে যথাপদ্ধতিতে আচ্ছাদিত বারুদ দিয়ে যুক্ত করে দিলাম। এভাবে কাজের একটা অংশ সম্পূর্ণ করার পর গর্তটাকে মাটি দিয়ে বোঝাই করে বড় পিপেটাকে তার ওপর স্থাপন করলাম। আর একটা দেশলাইয়ের কাঠির বারুদের বিপরীত মাত্র ইঞ্চিখানেক মাটির ওপর জেগে থাকে আর সেটা যেন কারো চোখে না পড়ে।

    ব্যস, কিছুটা অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এবার আমি অবশিষ্ট গর্তগুলোকে ঝটপট মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে পিপেগুলোকে জায়গামতো বসিয়ে দিলাম। যাক। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ সম্পূর্ণ করা হল।

    সেদিনটা ছিল ১ এপ্রিল।

    আগেই কথা প্রসঙ্গে বলেছি, সেটা ছিল এক ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত। তার ওপর আকাশে জমাটবাধা কালো মেঘের একাধিপত্য। ফলে তারা দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই পড়ে না। আর মাঝে মধ্যে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, যাকে বলে ইলশেগুড়ি। এমন প্রতিকুল প্রাকৃতিক পরিস্থিতির জন্য আমার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারাই মহাসমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটা পদক্ষেপেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম, অভাবনীয় অধ্যবসায় ও নিরবচ্ছিন্ন ধৈৰ্য্য সম্বল করে আমাকে কাজটার প্রতিটা ধাপ সম্পূর্ণ করতে হচ্ছিল।

    আমি কায়দা করে সহকর্মী তিনজনকে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমের কাজে লাগিয়ে দিলাম। তারাও অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আমার নির্দেশিত কাজে মেতে গেল। তবে তাদের কৌতূহলমিশ্রিত প্রশ্নবাণ আমাকে যারপরনাই উত্যক্ত করতে লাগল।

    কাজের ফাঁকে আমার সহকর্মী তিনজনের মধ্যে থেকে একজন তো কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে আমাকে সরাসরি প্রশ্নই করে বসল–এমন হরেক আকৃতি ও প্রকৃতির যন্ত্রপাতি কোন কাজে লাগবে, দয়া করে বলবেন কি? বৃষ্টিতে এভাবে ঘণ্টর পর ঘণ্টা ভিজে, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এসব কাজ করে শেষপর্যন্ত ফয়দাই বা কি হবে? এমন আরও কতসব তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নবাণে আমাকে সজাগ করে দেওয়ার জোগাড় করল।

    আমার সহকর্মীদের বিরক্তি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে লক্ষ্য করে আমি ভেতরে ভেতরে খুশিই হলাম। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় তাদের বিরক্তি ও অসন্তুষ্টি চরম পর্যায়ে উঠে গেলে, তারা হয়তো আমাকে ছেড়ে যেতেই বাধ্য হবে। তাদের ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি একটু ঘাবড়েই গেলাম। তারা চলে গেলে আমি কম-বেশি সমস্যায়ই পড়ব।

    আমি কিন্তু ভেবেই রেখেছি, আমার এ-পরিকল্পনাটাকে কোনোরকমে সাফল্যমণ্ডিত করতে পারলে, উৎরে গেলে তাদের যা-কিছু প্রাপ্য প্রতিটা কানাকড়ি পর্যন্ত শোধ করে দেব। আমার আন্তরিক ইচ্ছাটার কথা তাদের কাছে ব্যক্ত করলাম। তারা আমার কথায় তখনকার মতো আশ্বস্ত হল।

    আমার কথার ওপর ভরসা করে নতুন উদ্যমে আমার কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে কাজে মেতে গেল। আমি এবার পুরোদ েকাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলাম। সে যে কী তৎপরতা তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।

    আমি তিন সহযোগিকে নিয়ে বেলুনটাকে ফোলানোর চেষ্টা চালাতে লাগলাম। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে সেটাকে প্রয়োজন-অনুযায়ী ফোলানো সম্ভব হল।

    এবার ফোলানো বেলুনটার সঙ্গে দড়িটাকে শক্ত করে বেঁধে দিলাম, তারপর এক এক করে আমার যাবতীয় যন্ত্রপাতি–ব্যারোমিটার, দূরবীক্ষণ যন্ত্র, চৌম্বক শলাকা, কম্পাস, ইলেকট্রোমিটার, বাঁশি, পকেট-ঘড়ি, ঘণ্টা, প্রভৃতি তার মধ্যে রেখে দিলাম। কেবলমাত্র যন্ত্রপাতির কথাই বা বলি কেন? প্রচুর খাদ্যবস্তু আর পানীয় জলও গাড়িটাতে রাখলাম। খুঁটিনাটি অত্যাবশ্যক জিনিসপত্র যা-কিছু গাড়িতে নেওয়া দরকার সবকিছু গাড়িতে তোলার পর একটা মোটাসোটা বিড়াল আর একজোড়া পায়রাও গাড়িতে তুলে নিলাম।

    প্রয়োজন অনুযায়ী গাড়িটাকে তৈরি করতে রাত শেষ হয়ে গেল। এক সময় পূর্ব আকাশে ভোরের আলো দেখা দিল। শহরের বুকে ভোরের আলো ফোঁটার সময় হয়ে এলো।

    ভাবলাম, আর দেরি নয় এবার যাত্রা শুরু করা দরকার। হাতের জ্বলন্ত চুরুটটা যেন হঠাৎ আঙুলের ফাঁক থেকে খসে পড়েছে এমন ভাব দেখিয়ে সেটাকে হাত থেকে ফেলে দিলাম।

    পরমুহূর্তেই পথ থেকে চুরুটটা আমার হাতে তুলে নেবার জন্য উপুড় হবার সুযোগ পেলাম। আর এরকম চিন্তা করেই যে সেটাকে হাত থেকে ফেলে দিয়েছি তা। তো আর আর স্বীকার করার অপেক্ষা রাখে না। যাক, যে কথা বলছিলাম, চুরুটটাকে তুলে নেবার অছিলায় ছোট্ট একটা পিপের তলা থেকে সামান্য পরিমাণ বের করে রাখা। দেশলাইয়ের কাঠিটাতে আগুন জ্বেলে দিলাম।

    এমনই সন্তর্পণে এবং দ্রুততার সঙ্গে কাজটা সেরে ফেললাম যে, আমার তিন সহযোগি ব্যাপারটার কিছুমাত্রও টেরই পেল না। দেশলাইয়ের কাঠিটায় আগুন ধরিয়ে দেওয়ামাত্র আমি যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত গতিতে গাড়িটায় চেপে বসলাম। গাড়িতে চেপেই ব্যস্ত হাতে গাড়ির সঙ্গে বাঁধা একমাত্র দড়িটাকে সুতীক্ষ একটা অস্ত্র দিয়ে ঘ্যাচ করে কেটে দিলাম।

    ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। সে যে কী নিঃসীম আনন্দ, কী মজা, তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।

    একলক্ষ পঁচাত্তর পাউন্ড বালি বোঝাই কতগুলো থলে নিয়ে অভাবনীয় দ্রুতগতিতে গাড়িটা তরতর করে ওপরে উঠে যেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই আমি ওপরে, একেবারে মেঘের রাজ্যে পৌঁছে গেলাম। সে মুহূর্তে আমার মনে হলো আরও সমপরিমাণ বোঝা গাড়িতে চাপিয়েও অনায়েসেই ওপরে ওঠা সম্ভব হত।

    ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় দেখলাম, ব্যারোমিটারে পারদ ত্রিশ ইঞ্চিতে অবস্থান করছে, আর উনিশ ডিগ্রিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেন্টিগ্রেড থার্মোমিটারের পারদ।

    ওপরে ওঠার সময় একটা ব্যাপার আমাকে খুবই বিস্মিত করেছিল, গজ পঞ্চাশেক ওপরে উঠতেই একেবারেই অভাবনীয় একটা কাণ্ড ঘটে গেল। আর সেটা ঘটল মুহূর্তের মধ্যেই। অস্বাভাবিক বেগে বিশ্রি একটা কড়কড় আওয়াজ করতে করতে আমার পিছন দিক থেকে বিদ্যুতের ঝলকানির মতো আগুন, জ্বলন্ত কাঠকয়লা, আগুনের মতো গরম টুকরো টুকরো পাথর আর যন্ত্রটার ভাঙাচোরা টুকরো টুকরো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ মিলে এমন তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল যে, ব্যাপার দেখে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে পড়ার জোগাড় হল। আর মনে হলো মুহূর্তের মধ্যে আমার বুকের ভেতরে ফুসফুস বুঝি কুঁকড়ে মুচড়ে গেছে। অচিরেই বুঝি তার কাজ বন্ধ হয়েনিস্তব্ধ হয়ে যাবে।

    আমার পক্ষে বেশিক্ষণ স্থির থাকা সম্ভব হলো না। হাঁটু দুটো তিরতির করে কাঁপতে লাগল। তারপর সর্বাঙ্গে কম্পন অনুভব করলাম পর মুহূর্তেই দুম্ করে আছাড় খেয়ে গাড়িটার তলায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম, খেল খতম।

    গাড়িটার তলায় পড়ে মুমূর্ষ-প্রায় অবস্থায় আমি ভাবতে লাগলাম, ব্যাপারটাকে নিয়ে আমি মাত্রাতিরিক্ত মাতামাতি করে ফেলেছি। আর তারই ফলে আমার বরাতে আরও অনেক, অনেক দুর্ভোগই রয়েছে। সেকেন্ডের মধ্যেই আমি পৌনে মরা হয়ে গেলাম। শরীরের সবটুকু রক্ত বুঝি নিঃশেষে মাথায় উঠে গেছে।

    আমি হুমড়ি খেয়ে গাড়িটার তলায় পড়ে যাবার পর মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর একটা সংঘর্ষ আচমকা রাতের জমাটবাধা অন্ধকারকে খান খান করে আকাশটাকে টুকরো টুকরো করে দিল। সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

    ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবতেই আকস্মিক বিস্ফোরণের কারণটা আমার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, এর জন্য আমি একমাত্র আমি, নিজেই দায়ী। আমার কাজের সামান্য হেরফেরের জন্যই এরকম অত্যাশ্চর্য, একেবারে অভাবনীয় কাণ্ডটা ঘটে গেল। আর এরই জন্য আমি নিজে এখন ওটার ওপর অবস্থান করছি, আর ওর হাতের মুঠোর মধ্যে সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি।

    সেখানে, গাড়িটার তলায় অসহায়ভাবে পড়ে থাকার সময় আমার মধ্যে একটামাত্র চিন্তাই ভর করল–কি করে আমি জীবনটাকে রক্ষা করতে পারব।

    প্রথমে বেলুনটা ভেঙে-ছিড়ে, টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তার পরমুহূর্তে শত-সহস্র টুকরোয় বিভক্ত হয়ে তীব্র বেগে চারদিকে ছড়িয়ে দিল। তারপর লাটুর চেয়েও তীব্র গতিতে চক্কর খেতে লাগল। মাতালের মতো টালমাটাল হতে হতে আমাকে আচমকা দুম্ করে ছুঁড়ে দিল। আমি বেতের ঝুড়িটায় আটকা পড়ে অভাবনীয়ভাবে শূন্যে দোল খেতে লাগলাম। আমার মুখ ঝুড়িটার বাইরে আর মাথা নিচের দিকে রেখে আমি আকাশের কাছাকাছি উঁচুতে ঝুলতে লাগলাম। কোনোক্রমে ঝুড়িটার সঙ্গে আমার যে সামান্য সম্পর্ক রয়েছে, তা ছিন্ন হয়ে গেল পরিস্থিতি যে কী মর্মান্তিক হবে–উফ্! না, আর ভাবতে পারছি না। আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে।

    সে মুহূর্তে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে আমি ভাগ্য গুণে কিভাবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম তা ভাবলে আজও আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসার জোগাড় হয়। স্নায়ু শিথিল হয়ে পড়তে শুরু করে। ব্যাপারটা হচ্ছে, অভাবনীয় উপায়ে একটা দড়ির টুকরো বেতের ঝুড়িটার গা থেকে ঝুলছিল। ফুট তিনেক লম্বা ছিল সেটা। ঠিক পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে, ঈশ্বরের অপার কৃপার জন্যই হয়তো বা সে দড়িটার সঙ্গে আমার বা পায়ের গোড়ালির কাছাকাছি একেবারেই অত্যাশ্চর্যভাবে আটকে যায়। আমি সেটার সঙ্গে লটকে গেলাম। আমার তখনকার শোচনীয় পরিস্থিতির কথা কারো কাছে ব্যক্ত করা তো দূরের কথা আমি নিজেই ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।

    বাতাস। একটু বাতাস যে মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বোধ হতে লাগল। একটু বাতাসের অভাবে আমি মরিয়া হয়ে হাঁপাতে লাগলাম। মাথাটা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঝিমঝিম করতে লাগল, শরীরের সবকটা স্নায়ু, সব কটা মাংসপেশী তীব্র যন্ত্রণায় টনটন করতে লাগল। সে যে কী দুঃসহ যন্ত্রণা, কী মর্মান্তিক পরিস্থিতির মধ্যে আমি প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে লাগলাম তা পরমপিতা ছাড়া কারোরই জানার কথা নয়। আর ভাষার মাধ্যমে কারো মধ্যে ধারণার সঞ্চার করা তো নিতান্তই পাগলের প্রলাপ মাত্র।

    অসহ্য যন্ত্রণায় আমি শূন্যে ভাসমান অবস্থায় অসহায়ভাবে কাত্রাতে লাগলাম। আমার চোখ দুটো যেন কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে লাগল। অসহ্য! কী যে দুর্বিষহ যন্ত্রণায় আমি অসহায়ভাবে ধুঁকতে লাগলাম তা আর বলার নয়।

    আমার স্নায়ুগুলো ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়তে লাগল। কেমন যেন একটা বমি বমি ভাব আমাকে পেয়ে বসল। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে পড়তে লাগল। ব্যস, সংজ্ঞা হারিয়ে আমি এলিয়ে পড়লাম। আমি সংজ্ঞাহীনতার অন্ধকারের অতল গহ্বরে সম্পূর্ণরূপে তলিয়ে গেলাম। অন্ধকার! নিঃসীম অন্ধকার।

    দড়ির টুকরোটার সঙ্গে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কতক্ষণ যে ঝুলে ছিলাম তা বলতে পারব না। তবে অনেকক্ষণ যে ছিলাম তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এরকমটা বলার এবার বেল্প এক দুটো হাত ফিরিয়েই আশিরাগুলো ফুলে করে নখগুলো কারণ এই যে, আমি যখন সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকালাম তখন পূর্ব আকাশে ভোরের আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে। আর ভাঙাচোরা বেলুনটা ধীর-মন্থর গতিতে অন্তহীন সমুদ্রের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে। কাছাকাছি তো নয়ই, এমনকি যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও ডাঙার লেশমাত্রও চোখে পড়ল না।

    আমি যে ভাসতে ভাসতে কোন দিকে এবং কোথায় চলেছি তার কিছুই আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতেই হয়, আমার সে অসহনীয় যন্ত্রণা, স্নায়ুবিক শৈথিল্য এবং মানসিক অস্বস্তির তীব্রতা আগের চেয়ে অনেকাংশে হ্রাস পেয়ে গেছে।

    এবার বেশ ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে বিচার বিবেচনা করতে লাগলাম।

    একের পর এক দুটো হাতকেই ধীরে ধীরে চোখের সামনে নিয়ে এলাম। যে দুটোর দিকে মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি ফিরিয়েই আমি রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম, দৃষ্টি থমকে গেল। দেখলাম, আমার হাতের শিরা-উপশিরাগুলো ফুলে একেবারে মোটা মোটা দড়ির মতো হয়ে উঠেছে, আর আঙুলের ডগাগুলো, বিশেষ করে নখগুলো আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে, কালসিটে পড়লে ঠিক যেমনটি হয়। ব্যাপারটা ঠিক মাথায় গেল না।

    মাথাটা সাধ্যমত এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভালোভাবে হাত দুটোকে দেখলাম, কিন্তু তেমন ফোলেনি তো। অবাক হবার মতো ব্যাপারই বটে।

    ব্যাপারটাকে তখনকার মতো সামাল দেবার জন্য জ্যাকেটের পকেটে একটা হাত চালান করে দিলাম। হাতড়ে হাতড়ে কতগুলো ট্যাবলেট আর দাঁত-খড়কের মোড়কটাকে খুঁজলাম। না পেলাম না। মনটা হঠাৎ আরও বিষিয়ে উঠল। সত্যি ব্যাপার অবাক হবার মতোই বটে। সেটা কোথায় যে বেপাত্তা হয়ে গেল ভেবে কুল কিনারা পেলাম না।

    এবার উপলব্ধি করতে পারলাম, বাপায়ের গোড়ালিতে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে।নিদারুণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আর সে সঙ্গে আমার বর্তমান পরিস্থিতির একটা ধোয়াটে, ঝাপসা চেতনা অন্তরের অন্তঃস্থলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

    ব্যাপারটা আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করল। আমি কিন্তু তাতে অবাক হলাম না, এমনকি ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া তো দূরের কথাসামান্যতম ভীতিও আমার মধ্যে সঞ্চারিত হলো না।

    মিনিট কয়েকের মধ্যে গভীর চিন্তা আমাকে গ্রাস করে ফেলল। আমি চিন্তার জগতের অতলে তলিয়ে গিয়ে নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেললাম। আমি যেন এ জগতের কেউ নই, অন্য কোনো লোকে বাস করছি।

    দীর্ঘ চেষ্টার পর পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করে নিতে পারলাম। তারপরই হাত দুটোকে ঘুরিয়ে পিছন দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে পাজামার ফিতের সঙ্গে আটকানো লোহার বকলেসটাকে ধীরে ধীরে খুলে ফেললাম। আমার এবারের কাজ হলো গলাবন্ধটাকে খোলার চেষ্টা চরিত্র করে সেটাকেও কোনোরকমে খুলে ফেললাম। এবার বকলেসের সঙ্গে সেটাকে আটকে দিয়ে কোমরে আচ্ছা করে জড়িয়ে দিলাম।

    এবার মাংসপেশীর ওপর চাপ প্রয়োগ করে শরীরটাকে উপরের দিকে সামান্য তুলে বকলেসটাকে গাড়িটার ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। এবার সেটাকে বেতের ঝুড়ির সঙ্গে আচ্ছা করে বেঁধে দিলাম। বেতের ঝুড়িটার আর বিচ্ছিন্ন হবার কোনো সম্ভাবনা রইল না।

    সে মুহূর্তে আমার শরীরটা গাড়ির সঙ্গে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে লটকে রইল।

    আমি নিজেকে ভেতরে ঢুকিয়ে নেবার জন্য প্রয়াস না চালিয়ে প্রায় পনের মিনিট সেভাবেই গাড়িটার সঙ্গে লটকে রইলাম। ভাবলাম, আমি তো দিব্যিই আছি, তোফা ব্যবস্থা। কিন্তু ব্যাপারটা যে বোকামি ছাড়া কিছু নয় তা অচিরেই বুঝতে পারলাম। এবার আতঙ্ক, ভয়-ভীতি হতাশা আর নিরবচ্ছিন্ন বিষণ্ণতা আমাকে পেয়ে বসল। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তখন কী যে এক অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করে ফেলল, তা কাউকে বুঝিয়ে বলা তো সম্ভবই ছিল না, আসলে আমি নিজেই তা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলাম না। আর এরই ফলে মানসিক স্থিরতা ও মনোবল আমার মধ্য থেকে উবে গেল। সে জায়গা দখল করল জমাট বাঁধা ভীতি আর আতঙ্ক।

    ভাগ্য ভালো যে, আমার সে অভাবনীয় ভীতি আর মানসিক দুর্বলতা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। মনকে অচিরেই শক্ত করে বেঁধে ফেলা সম্ভব হল। আর এও বলে রাখা দরকার হঠাৎ জেগে ওঠা তীব্র একটা হতাশাই যেন আমাকে সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে সে বারের মতো রক্ষা করেছিল।

    এবার আমি উন্মাদের মতো গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে সমস্ত শরীরটাকে অল্প অল্প ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে একটু একটু করে ওপরের দিকে তুলতে লাগলাম। এভাবে নিজেকে তুলতে তুলতে অচিরেই ঝুড়ির মুখটাকে আঁকড়ে ধরে ফেললাম। এবার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে ওপরে তুলতে তুলতে এক সময় আমার প্রয়াস ফলপ্রসু করা সম্ভব হল। আর গাড়িটায় চেপেই দুম্ করে আছড়ে পড়লাম। সর্বাঙ্গ অনবরত থরথর করে কাঁপতে লাগল। মানুষের শরীর যে এভাবে কাঁপতে পারে আমার অন্তত জানা ছিল না।

    গাড়িটার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আমি অনবরত কাঁপতেই লাগলাম। সে মুহূর্তে আমার মনে হলো এ-কাঁপুনি বুঝি আর কোনোদিনই থামবে না। দীর্ঘ সময় কাঁপুনি অনেকটা কমে যাওয়ায় কিছুটা সুস্থবোধ করলাম।

    আমি যেন এবার সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে বেলুনটাকে দেখতে লাগলাম। সেটার অবস্থা নিরীক্ষণ করে স্বস্তি পেলাম। বুঝলাম, আমার ওপর দিয়ে তুমুল ঝড় ঝাঁপটা বয়ে গেলেও বেলুনটার তেমন ক্ষতি হয়নি। ওটার সঙ্গে যেসব যন্ত্রপাতি আটকানো ছিল সেগুলো অক্ষতই রয়েছে। আর পাথরের কুঁচি আর বালির থলেগুলো আর খাবার দাবারও খোয়া যায়নি। মজুদই আছে।

    আমি এবার পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে মুহূর্তের জন্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে সেটাকে আবার যথাস্থানে খুঁজে দিলাম। দেখলাম, দুটা বাজে।

    আমার আকাশযান বেলুনটা নিয়ে তখনও দ্রুত ওপরে উঠেই চলেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যারোমিটারের দিকে তাকালাম। বুঝলাম, আমরা এখন সমতল ভূমি থেকে পৌনে চারমাইল ওপরে অবস্থান করছি।

    এবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকালাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না, আমার পায়ের তলায় অন্তহীন উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্র অবস্থান করছে। আর তার ওপর ভাসছে। দেশলাইয়ের বাক্সের মতো কালো কালো অসংখ্য বস্তু।

    হাত বাড়িয়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্রটা নিয়ে চোখের সামনে ধরলাম। এবার চোখের সামনে বিশালায়তন একটা কামানবাহী বৃটিশ যুদ্ধজাহাজ ভাসছে। সেটা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান করছে আর অনবরত অস্বাভাবিক দোল খাচ্ছে। হঠাৎ করে দেখে মনে হলো জাহাজটা বুঝি ঢেউয়ের তালে তালে দোল খাচ্ছে।

    পায়ের তলায় সমুদ্র, মাথার ওপরে সুবিশাল নীল আকাশ আর অত্যুজ্জ্বল সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই আমার দুরবীক্ষণ যন্ত্রটার গণ্ডির মধ্যে ধরা পড়ল না।

    আমি একটু স্বস্তিবোধ করায় দ্ৰ মহাজনদের আমার পরিকল্পনাটা সম্বন্ধে দু-চার কথার মাধ্যমে নতুন করে কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।

    আশা করি আপনাদের মনে আছে, রটারডাম নগরে বসবাসকালে আমি দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে হয়ে মরিয়া হয়ে আত্মহত্যা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হয়েছিলাম। আর জেদটা এমনভাবে আমার মধ্যে চেপে বসে যা থেকে কোনো শক্তিই আমাকে। বিরত করতে পারবে না।

    তবে প্রসঙ্গক্রমে এ-কথাও বলে রাখছি যে, দারিদ্র্যজনিত। নিরবচ্ছিন্ন হতাশা হাহাকার কিন্তু আমার মধ্যে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগাতে পারেনি।

    সত্যি কথা বলতে কি, আমি পড়লাম, উভয় সঙ্কটে। পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার সুতীব্র বাসনা, আর অন্যদিকে দুঃসহ যন্ত্রণায় প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। আর এও স্বীকার না করে উপায় নেই ওই পুস্তক বিক্রেতার কাছ থেকে খরিদ করা বিশেষ বই দুটোই আমাকে পরিকল্পনাটা গ্রহণ করতে, জীবনের গতিকে অন্য পথে চালিত করতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

    যাক গে, ধানাইপানাই ছেড়ে খোলসা করে বলি–বলাতে যা ঘটে ঘটুক আমার সামর্থ্য যদি শেষপর্যন্ত অব্যাহত থাকে তবে, যদি হিম্মৎ থাকে তবে আমি সুদূরবর্তী চাদে পাড়ি জমাব। চাঁদের বুকে আমি পদচিহ্ন এঁকে দেব।

    আমার অকৃত্রিম বাসনার কথা তো আপনাদের কাছে খোলাখুলিই ব্যক্ত করলাম। এবার এক এক করে তুলে ধরছি আপাত দৃষ্টিতে আমার দুঃসাহসিক পরিকল্পনা–অভিযানটাকে বাস্তবায়িত করার জন্য আমি বলব, মানুষের ইতিহাসে এক তুলনাহীন চন্দ্র-অভিযানের কাহিনী। আর সে সঙ্গে আমার কাজের একের পর এক ধাপের অগ্রগতি ও ফলাফলের কাহিনী।

    সমতলভূমি থেকে পৌনে চারমাইল উচ্চতার কথা তো আগেই বলে রেখেছি, ঠিক কিনা? সে পরিমাণ উচ্চতায় ওঠার পর আমার, অর্থাৎ আকাশযানটার গতি উর্ধমুখি কিনা তা বোঝার জন্য একটা পালক ছেড়ে দিলাম।

    পালকটা গতি দেখে নিঃসন্দেহ হলাম, তখনও আমার আকাশযান দ্রুত উপরের দিকে ধেয়ে চলেছে।

    আমার আকাশযানটা যখন দ্রুতগতিতে ওপরের দিকে ছুটেই চলেছে তখন আর মিছে বালির থলেগুলোকে ফেলে দেওয়ার দরকার নেই। বাধ্য হয়েই আমি ওকাজ থেকে বিরত হলাম।

    তখন পর্যন্ত শ্বাসক্রিয়া ভালোভাবেই চালাতে পারছিলাম। কোনোরকম কষ্ট, কোনোই অস্বস্তিবোধ করছিলাম না। এমনকি মাথায়ও যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম না।

    এবার ঘাড় ঘুরাতেই বিড়ালটার দিকে চোখ পড়ল। সে পা চারটি ছড়িয়ে আয়েশ করে শুয়ে। আমার খুলে রাখা কোটটার ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। তবে লোলুপ দৃষ্টিতে পায়ে দড়িবাধা পায়রাগুলোর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখায় তারা উড়ে যেতে পারছে না। গাড়ির এক সমতল জায়গায় কিছু শস্যদানা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে ব্যস্ত।

    পরমুহূর্তেই আবার ঝুলন্ত ব্যারোমিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। দেখলাম, ওটার পারদস্তম্ভ ইতিমধ্যেই গুটিগুটি অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। হিসাব করে বুঝতে পারলাম, আমি ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় পাঁচ মাইল ওপরে অবস্থান করছি। আরও কত উপরের উঠতে হবে ঈশ্বরই জানেন।

    পকেট-ঘড়িটায় সাতটা বাজতে বিশ মিনিট বাকী। বেলুনটা দ্রুত একের পর এক মেঘ ডিঙিয়ে অনেকগুলো মেঘের ওপরে উঠে গেল।

    মেঘের রাজ্যে হানা দেওয়াই কেবল নয়, একেবারে মেঘের রাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়ার ফলে আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আর অন্য কয়েকটা বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হল। কিছু যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত–একের পর এক বিকল হয়ে গেল। আর মেঘের আপ্যায়নের ফলে আমাকে পুরোপুরি কাকভেজা ভিজে যেতে হল। বাস্তবিকই এ যেন এক বিচিত্র সহাবস্থান।

    সত্যি বলছি, আমার তিলমাত্র ধারণাও ছিল না যে, এত বেশি উঁচুতে মেঘের এমন অস্বাভাবিক দাপট থাকতে পারে।

    পাঁচ পাউন্ড ওজনের দুটো বালির তলে পাকা ফলের মতো বেলুনটা থেকে নিচে ফেলে দিলাম। হিসাব করে দেখলাম, থলে দুটো ফেলে দেওয়ার পরও মোট একশ পঁয়ষট্টি পাউন্ড ওজনের থলে বেলুনটায় রয়ে গেছে। আর তারই জন্য ভেসে এদিক-ওদিক না গিয়ে মেঘের দাপটকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেলুনটা সোজা আরও ওপরে উঠে গেল।

    আচমকা একট অদ্ভুত কাণ্ডের সম্মুখীন হয়ে আমি রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম। অতর্কিত উজ্জ্বল বিদ্যুতের ঝলক অভাবনীয় দ্রুততার ঘরে আকাশের এ-প্রাপ্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত আগুন জ্বেলে দিল। আলোকরশ্মি যে এত উজ্জ্বল হতে পারে এ ধারণা আদৌ আমার ছিল না। ভুলে যাবেন না, অত্যাশ্চর্য, নিতান্ত অবিশ্বাস্য এ ঘটনাটা কিন্তু রাতের অন্ধকারে ঘটেনি, দিনের বেলাতেই ঘটেছিল। আর যদি রাতের জমাট বাঁধা অন্ধকারে ঘটত তবে যে কী মনোলোভা দৃশ্যের সৃষ্টি করত তার বর্ণনা কেবল লেখনিই নয় শিল্পীর তুলিও যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারত না। সংক্ষেপে তার বর্ণনা দিলে বলতেই হয় পুরোদস্তুর অভাবনীয় দৃশ্য চাক্ষুষ করে চোখও মনকে তৃপ্ত করা যেত, সন্দেহ নেই। আবার এমনও হতে পারত, সেটা হয়তো নরকেরই কার্বনকপি।

    কি হতে পারত সে কথা ছিঁড়ে দিয়ে যেটুকু চাক্ষুষ করলাম তাতেই আমার নাড়ির গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হল, শুরু হলো বুকের ভেতরে নিরবচ্ছিন্ন ধুকপুকানি আর মাথার সবগুলো চুল যেন সঁজারুর কাটার মতো খাড়া হয়ে গেল।

    পায়ের তলায়ও চলেছে জমাটবাধা মেঘের একাধিপত্য। অন্ধকার যক্ষপুরী, দিগন্ত জোড়া অন্ধকার গহ্বরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আমি অগ্নির বর্ণনাতীত, বীভৎস নারকীয় রূপকল্পনায় নিজেকে লিপ্ত করলাম।

    উফ্! ভাগ্য–ভাগ্যের জোরেই হয়তো খুব অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছি, পিতৃদত্ত জীবনটা এবারের মতো রক্ষা পেয়ে গেছে।

    বেলুনটা যদি আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্তে মেঘের রাজ্যে অবস্থান করত তবে আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার সাধ্য কারোরই ছিল না। একেবারেই বেঘোরে প্রাণ দিতে হত।

    বেলুনটার ক্ষমতা বলেই হোক আর আমার পিতৃপুরুষের ভাগ্যের জোরেই হোক, আমি ইতিমধ্যে দ্রুত এত ওপরে উঠে গেছি যে, এরকম কোনো বিপদের আশঙ্কা মোটেই ছিল না। অতএব বেলুনটার ক্ষমতার তারিফ না করে উপায় নেই। তারই অভাবনীয় কাজের জন্যই তার নিজের অস্তিত্ব অব্যাহত রয়েছে আর আমিও প্রাণে বেঁচে গিয়েছি।

    আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। নিঃসন্দেহ হলাম, সহসা আর কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই।

    খুবই দ্রুতগতিতে ওপরে উঠে চলেছি। পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে দেখলাম, সাতটা বাজে। ব্যারোমিটারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। বুঝতে পারলাম, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে নয় মাইল অবস্থান করছি। এবার শ্বাসকষ্ট একটু বেশি রকমই অনুভব করতে লাগলাম। সে সঙ্গে মাথায়ও যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলাম। যন্ত্রণাটা ক্রমে। তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল।

    গালের কাছে হঠাৎ ঠাণ্ডা অনুভব করতে লাগলাম। হায়, এ কী অদ্ভুত কাণ্ড রে বাবা! চোখের মণি দুটো কোটর থেকে অনেকটা ঠেলে বেরিয়ে আসছে। আরও অবাক হলাম যখন দেখলাম গাড়ির সবকিছু রীতিমত বিকৃত–অস্বাভাবিক বোধ হচ্ছে, এমনকি বেলুনটা পর্যন্ত।

    এমন অভাবনীয় একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে ঘৃণাক্ষরেও ভাবিনি। তাই ভয়ে মুষড়ে পড়াটা মোটেই অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।

    এ পরিস্থিতিতে কর্তব্য স্থির করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ল। হঠাৎ বেয়াকুবের মতো একটা কাজ করে ফেললাম। পাঁচ পাউন্ড ওজনের তিন-তিনটি বালি বোঝাই থলেকে ঝটপট বাইরে ছুঁড়ে দিলাম।

    হায়! এ-কী অবিবেচকের মতো কাজ করলাম। বালি বোঝাই থলে কয়টা ফেলে দেওয়ার ফল হলো হিতে-বিপরীত। বেলুনের উর্দ্ধগতির বেগ অনেকাংশে বেড়ে গেল। সেটা তর তর করে ওপরে উঠতে উঠতে আমাকে বাতাসের এমনই এক সূক্ষ্ম স্তরে নিয়ে হাজির করল, যা আমাকে ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতিতে ফেলে দিল। কেবল আমার পক্ষেই বা বলি কেন? আমার অভিযানেরও ভীষণ অন্তরায় হয়ে উঠল।

    আচমকা আমি আরও মারাত্মক পরিস্থিতির চাপে পড়ে যন্ত্রণায় রীতিমত কাতরাতে লাগলাম। মাংসপেশীতে অস্বাভাবিক খিচুনি অনুভব করলাম। সর্বাঙ্গ থেকে থেকে কুঁকড়ে যেতে লাগল। আর তা দীর্ঘস্থায়ী না হলেও মিনিট পাঁচেক তো আমাকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে কাটাতেই হয়েছে।

    খিচুনিটা থেমে যাবার পরও আমার শারীরিক অস্বস্তি কাটল না, বেশ কিছুক্ষণ অনবরত হাঁপালাম। তার থেকে এমন কষ্ট হতে লাগল যে, দমবন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল।

    এবার আমার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে পড়ল। এখন আর কেবলমাত্র কানের ছিদ্র দুটো দিয়েই নয়, চোখের কোণ আর নাক দিয়েও চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত ঝরতে আরম্ভ করল।

    নিজের দুর্বিষহ শারীরিক অস্বস্তি সত্ত্বেও ঘাড় ঘুরিয়ে পায়রাগুলোর দিকে তাকালাম। দেখলাম, তারাও নিরবচ্ছিন্ন অস্বস্তির মধ্যে পালাবার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

    আর বিড়ালটা? তার অবস্থাও খারাপ। সে খুবই করুণ স্বরে মাও-মাও করেই চলেছে। তার জিভটা পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে। বিষক্রিয়ার ফলে যেন এদিক-ওদিক টলছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে আরও কিছুটা সময় কাটাতে হলে আমার মৃত্যু অনিবার্য।

    কেবলমাত্র বিড়ালটার কথাই বা বলি কেন? আমার পক্ষে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কতক্ষণ যে পিতৃদত্ত জীবনটাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে তা একমাত্র অন্তর্যামীও জানেন। মিনিট কয়েকের মধ্যেই আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাওয়াও কিছুমাত্র অসম্ভব নয়।

    হায়! আমার একী হল। ভাবনা-চিন্তা করার মতো শক্তিটুকুও আমার মধ্যে থেকে উবে গেছে। মাথার টানটানি ভাবটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতি আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে। যে কোনো মুহূর্তে আমার ইন্দ্রিয়গুলো এক এক করে বিকল হয়ে পড়বে। আমার চেতনা লোপ পেয়ে যাবে।

    যন্ত্রণা। অসহ্য যন্ত্রণা। সে যে কী মর্মান্তিক পরিস্থিতি তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। অনন্যোপায় হয়েই মেঝের ওপর শুয়ে পড়লাম। কিছুটা সময় শুয়ে থাকলে যদি ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তাই টান টান হয়ে শুয়ে পড়লাম।

    মিনিট কয়েক নিশ্চল-নিথরভাবে পড়ে থাকার পর মন স্থীর করেই ফেললাম রক্তক্ষরণের পরীক্ষাটা একবারটি করে দেখব, দেখতেই হবে আমাকে।

    ভাবলাম, করলামও তা-ই। উপযুক্ত দধি কোথায় যে আমার বাঞ্ছটা পূরণ করতে পারি? কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র আমি নই, ছাড়লে যে চলবেও না। তাই ঝটপট জ্যাকেটের পকেটে হাতটা চালান করে দিলাম। হাতড়ে হাতড়ে পেন্সিল-কাটা ছুরিটা পেয়ে গেলাম। সেটা দিয়ে অতর্কিতে বাঁ হাতের একটা শিরা কেটে দিলাম। গল গল করে ক্ষত স্থান দিয়ে কিছুটা রক্ত বেরিয়ে এলো। এবার কিছুটা স্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। মাথার যন্ত্রণাটাও অনেকাংশে লাঘব হয়েছে।

    শরীর থেকে ক্রমে রক্ত ক্ষরণ হতে হতে আধগামলা রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় এক এক প্রায় সব কটা খারাপ পরিস্থিতি ও অস্বস্তি কেটে যাওয়ায় হৃমনোবল অনেকাংশে ফিরে পেলাম। তা সত্ত্বেও মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াবার মতো সাহস হলো না।

    ইতিমধ্যে রক্তক্ষরণ কমতে-কমতে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। হাতের ক্ষতস্থানটায় পট্টি জড়িয়ে দিলাম।

    আরও মিনিট পনেরো শুয়েই কাটিয়ে দিলাম। দুঃসাহসের শিকার হয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে প্রমাদ ঘটতে কতক্ষণ।

    এক সময় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। এবার মনে হল, শরীরটা অনেকটা হালকা হয়ে গেছে। যন্ত্রণাগুলোর উপশম হওয়ায় বেশ স্বস্তি বোধ হচ্ছে।

    কিন্তু শরীরের অন্য সব অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে পারলেও শ্বাস কষ্টটা কিন্তু কমেছে খুব কমই।

    এবার আমার সাধের আকাশ যানটার দিকে নজর দেবার মতো অবসর পেলাম। এটা ওটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে মনে হলো শীঘ্রই কন্ডেন্সরটার ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়বে। তাই টেনে হিঁচড়ে সেটাকে বের করে সামনে নিয়ে এলাম। সেটাকে ব্যবহারের উপযোগি করে তুলতে আদাজল খেয়ে লেগে গেলাম।

    শ্বাস কষ্টের উপশম কিছুটা হলেও সম্পূর্ণরূপে স্বস্তি পেলাম না। উপায়ও তো কিছু নেই। অনন্যোপায় হয়ে আগের মতো দৃঢ়তার সঙ্গেই পরিস্থিতিটার মোকাবেলা করতে লাগলাম।

    প্রায় একই রকমভাবে আমি সময় গুজরান করতে লাগলাম। আমার আকাশ যানটা আমাকে নিয়ে ক্রমেই ওপরে উঠতে লাগল। আমি উঠছি তো উঠছিই, মুহূর্তের জন্যও আমার ওপরে ওঠার বিরাম নেই।

    তেসরা এপ্রিল। পেরিয়ে চৌঠা এপ্রিলের সকাল হল। সেদিনটাও কেটে গেল। পাঁচই এপ্রিলের সকাল এলো। আমার উৰ্দ্ধগতির বিরাম নেই। তারপর এক-এক করে ষোলই এপ্রিলও পেরিয়ে গেল।

    সতেরই এপ্রিল সেদিন ভোর হতে না হতেই আমাকে আকাশ-ভ্রমরের এক মহালগ্নের মুখোমুখি হতে হল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল। পৃথিবীর, নিচের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে না করতেই হঠাৎ নজরে পড়ল ভূ-স্তরের প্রকৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। রীতিমত অভাবনীয় ব্যাপার। চমকে উঠলাম। আমার মাথায় যেন আচমকা আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড় হল।

    আমার শরীরের সব কয়টা স্নায়ু যেন একই সঙ্গে ঝনঝ নিয়ে উঠল। যে তীব্র ভয় আর বিস্ময় আমার বুকের ভেতরে অকস্মাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তাতে আমি অভিভূত

    হয়ে পারলাম না। আর আমার সে মুহূর্তের অকল্পনীয় মানসিক পরিস্থিতির কথা কাউকে বুঝিয়ে বলা তো দূরের কথা, এমনকি ভাষায় প্রকাশ করাই দুঃসাধ্য।

    পরিস্থিতিটা আঁচ করা মাত্রই আমার হাঁটু দুটো থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার জোগাড় হল। মাথার চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে। উঠল। আর মনে হল, গায়ের রক্ত যেন ক্রমেই হিম হয়ে আসছে।

    হায়! এ কী সর্বনাশা কাণ্ড ঘটে গেছে। তবে, তবে কি বেলুনটা ফেটেই গেছে! ভয়ঙ্কর এ ধারণাটা আমার মাথায় চেপে বসল। আর এর কারণও আছে যথেষ্টই। বেলুনটা ফেটে না গেলে এমন অভাবনীয় কাণ্ড তো কিছুতেই ঘটায় না। হ্যাঁ, মানসিক স্থিরতা আমার মধ্য থেকে লোপ পেয়েছিল। বুদ্ধিভ্রম ঘটেছিল। আর অতিরিক্ত বিস্ময়ই ছিল এর কারণ।

    তবে এটা কিন্তু মিথ্যা নয় যে, আমি অনবরত নিচেই নেমে চলেছি। অনবরত অবতরণের মাধ্যমেই আরও পুরো একটা দিন কেটে গেল।

    হ্যাঁ, আমি যে ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছি এতে তিলমাত্রও ভুল নেই।

    উনিশে এপ্রিল। উনিশে এপ্রিলের ভোর। রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠল। সে দিনটা আমার জীবনের এক চরম আনন্দের দিন। আমি যে আনন্দ ও বিস্ময়ের জোয়ারে ভেসে চললাম তা কাউকে বলে বুঝাবার মতো ভাষা আমার নেই।

    আমার আকস্মিক বিস্ময়টুকুর কথা ব্যক্ত করছি। পকেট গড়িতে তখন নয়টা বাজে। সকাল নয়টা হঠাৎ মনে হলো চাঁদটা যেন আমার একেবারে কাছে চলে এসেছে। সে যে কী বিস্ময়, কী আনন্দানুভূতি তা আর বলার নয়।

    আমার আকাশযান বেলুনটা কিন্তু অনবরত দ্রুতগতিতে নিচে নেমেই চলেছে। খুব বেশি হলেও আর মাত্র আধ মাইলের ব্যবধান।

    আমি ব্যস্ত হাতে গা থেকে কোটটা খুলে ফেললাম। মাথা থেকে টুপিটা নামিয়ে আনলাম। আর ঝটপট বুটজোড়াও খুলে ফেললাম।

    এবার বেলুনটার দিকে নজর দিলাম। পকেট থেকে পেন্সিল-কাটা ছুরিটা দিয়ে সাধ্যমত দ্রুততার সঙ্গে বেলুনের দড়িটা কেটে গাড়িটাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললাম। সেটাকে দুহাতে শক্তভাবে মুঠো করে ধরে বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সারা দেশটাকে দেখতে লাগলাম।

    ব্যস, আর ভাবনা-চিন্তা করার অবকাশ পেলাম না। অতর্কিতে বিচিত্র দর্শন একটা শহরের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।

    কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মতো পড়ে রইলাম। প্রায় সংজ্ঞাহীন আমার অবস্থা।

    এক সময় ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম। দেখলাম, বেটেখাটো কুৎসিত বহু মানুষ আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। তাদের সবার চোখেই বিস্ময়ের প্রলেপ মাখানো। কপালের চামড়ায় ভাঁজ এঁকে, ভ্রু কুঁচকে সবাই আমার দিকেনিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সবাইনির্বাকনিস্পন্দ। কারো মুখে টু-শব্দটিও নেই। মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময়ই হয়তো বা তাদের বাশক্তি কেড়ে নিয়েছে।

    আমাকে তুলে বসাতে, আমাকে সাহায্য করার জন্য কেউ-ই-এগিয়ে এলো না, আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল না।

    জড়বুদ্ধি মানুষের মতো আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে লোকগুলো ঠোঁট টিপে টিপে হাসতে লাগল। কেবল আমাকে নিয়েই তাদের কৌতূহল নয়। আমি আর আমার বেলুনটা উভয়ই তাদের সমান কৌতূহলের কারণ। তাই তো তারা একবার আমার দিকে, পরমুহূর্তেই আমার বেলুনটার দিকে চোখ ফিরিয়ে কৌতূহল মিশ্রিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল।

    আমার চারদিকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চেহারা ছবি, পোশাক পরিচ্ছদ আর হাবভাব দেখে আমি ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম।

    আমি উপরের দিকে, সদ্য ফেলে-আসা পৃথিবীর দিকে মুখ তুলে তাকালাম। আমার জন্মস্থল সাধের পৃথিবীকে হয়তো বা চিরদিনের মতোই ছেড়ে এসেছি। আর কোনোদিনই হয়তো পৃথিবীর মাটিতে ফিরে যেতে পারব না। পৃথিবীর বাতাসে শ্বাসক্রিয়া চালাতে পারব না, আর দুচোখ ভরে দেখতে পারব না পৃথিবীর আলোকরশ্মি।

    অপলক চোখে মাথার ওপরের যেন দু-ডিগ্রি ব্যাসযুক্ত একটা তামাটে রঙের সুবিশাল বর্ম স্থিরভাবে আটকে রয়েছে। আর তারই একদিকের দিগন্ত রেখাটা অত্যুজ্জ্বল সোনালি আলোয় ঝিকমিক করছে। অদ্ভুত সে আলোচ্ছটায় চোখ দুটো যেন ঝলসে যাওয়ার উপক্রম। জল আর স্থলভূমির লেশমাত্রও চোখে পড়ল না। গাঢ় মেঘের আস্তরণ সবকিছুকে চোখের আড়াল করে রেখেছে। কেবলই মেঘ আর মেঘ। মেঘের আড়ালে পৃথিবীটা যেন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।

    আমার প্রিয় ভদ্র মহোদয়গণ, আমার তখনকার পরিস্থিতির কথা শুনে আপনারা হয়তো খুশিই হবেন–এভাবে একের পর এক ঝড়-ঝাঁপটা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর একেবারেই অভূতপূর্ব বিপদ থেকে অভাবনীয়ভাবে উত্তরণের মাধ্যমে শেষমেষ রটারডাম নগর থকে যাত্রা শুরু করার পর থেকে উনিশ দিনের মধ্যে এমন অবিশ্বাস্য। আর এও খুবই সত্য যে, এমন একটা অভাবনীয় কাজ কোনো পৃথিবীবাসী বাস্তবায়িত তো দূরের কথা, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

    আরে, আমার অভিযানের কথা তো এখনও শুরুই করলাম না। আসলে, ভদ্রমহোদয়গণ, আশা করি আপনারা অবশ্যই কল্পনা করতে পারছেন, যেহেতু আমি অন্য একটা গ্রহে একটা বছর নয়, পাঁচ-পাঁচটা বছর কাটিয়ে এসেছি যারনিজস্ব বৈশিষ্ট্যই যে কেবলমাত্র নজর কাড়ার মতো মনোলোভা তাই নয়, বরং দ্বিগুণ। আকর্ষণীয় উপগ্রহ হিসেবে তার সঙ্গে মানুষের পৃথিবীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য, আর তার চেয়ে বড় কথা। স্টেট কলেজ অব অ্যাস্ট্রনমির জন্য আরও বেশ কিছু আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সাধ্যমত জোগাড় করে এনেছি। এর জন্য যে আমাকে বহু কষ্ট যে স্বীকার করতে হয়েছে, আশা করি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

    হ্যাঁ, আমি যা-কিছু বলছি তার শতকরা একশো ভাগই সত্য, সম্পূর্ণ বাস্তবও বটে।

    আমার অভিযানটাকে সম্পূর্ণ করতে গিয়ে আমি এমন অনেক কিছু ফেলে এসেছি যা আমার প্রিয় ভদ্রমহোদয়গণের কাছে বিস্তারিতভাবে পেশ করতে পারলে আমার আনন্দের সীমা থাকবে না।

    আমি যে গ্রহের কথা আপনাদের কাছে বলতে চাইছি, তার আবহাওয়া, শীত আর গ্রীষ্মের অত্যাশ্চর্যভাবে চক্রাকারে আবর্তন, একদিকে কালচে সূর্যের ভয়ানক কিরণচ্ছটা আবার বিপরীত পক্ষে মেরু প্রদেশের শৈত্য, সে দেশের কুৎসিত চেহারার মানুষগুলোর আচার ব্যবহার আর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও কাজকর্ম, তাদের জ্ঞানের অভাব হেতু ভাষার অজ্ঞাতা, ভাষা প্রকাশের ক্ষমতার অভাবে অত্যাশ্চর্য এক পদ্ধতির মাধ্যমে মনের ভাব বিনিময়, চাঁদের কোনো মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর মানুষটার দুর্বোধ্য যোগাযোগ আর সব শেষে চাঁদের বহিঃস্থ দুর্বোধ্য ঘুটঘুঁটে অন্ধকার আর জমাট বাঁধা রহস্য যা আজও মানুষ দূরবীণ চোখে লাগিয়ে, অনুসন্ধিৎসু নজরে দীর্ঘসময় ধরে নিরীক্ষণ করেও উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়নি, কোনোদিন হবেও না।

    উপরোক্ত কথাগুলো আছেই, এ ছাড়া আরও অনেক কথাই আমি জানাতে আগ্রহী।

    আর আমার যা-কিছু কথা, এক এক করে সবই তো বললাম আর আমার শেষ কথাও সুধীবর্গের সামনে পেশ করেছি। এবার সবার আগে আমার পুরস্কার দাবি করছি।

    আমার স্ত্রী-পুত্র পরিজনের কাছে, আমার দেশে, মাতৃভূমি পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্য আমি অত্যুগ্র আগ্রহী হয়ে পড়েছি।

    আমার কাছে আরও যে সব ভুরি ভুরি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জমা আছে, সেগুলোর বিনিময়ে আপনাদের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ রটারডাম নগর থেকে যাত্রা করার পর আকাশপথ পরিক্রমার সময় আমার তিন পাওনাদার সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের মৃত্যুর জন্য আমাকেই সম্পূর্ণরূপে দোষারোপ করা হয়েছে। এর জন্য আমাকে যে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে তা থেকে আমাকে রেহাই দিতে হবে, অর্থাৎ আমার অনুরোধ আমাকে মার্জনা করা হোক। আর একারণেই আমি এ চিঠিটা লিখতে উৎসাহি হয়েছি। এ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যের বশীভূত হয়ে আমি এত লিখছি না।

    আমার এ চিঠিটা যে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে সে অবশ্যই একজন চন্দ্রলোকের অধিবাসী। আমি তাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছি, তিনি যেন অনুগ্রহ করে আমার এ কাজটা করে দিয়ে অবশেষ উপকার সাধন করেন, অর্থাৎ আমার এ চিঠি সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে পৌঁছে দেন।

    তাকে আরও অনুরোধ করেছি, চিঠিটা পৌঁছে দিয়েই তিনি যেন চন্দ্রলোকের উদ্দেশ্যে আবার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা না করেন। ভদ্রমহোদয়গণ আমার চিঠি পড়ে কি উত্তর দেন, তার জন্য যেন অপেক্ষা করেন। কোনোভাবে যদি আমার বাঞ্ছিত মার্জনাটা পেয়ে যান তবে সেটা নিয়েই আমার কাছে ফিরে আসেন ও সেটা আমার কাছে পৌঁছে দেন।

    ধন্যবাদান্তে
    আপনাদের সেবক
    হান্স ফাল

    আমার লেখা চিঠিটা নিয়ে আসার হিতকাঙ্খী চন্দ্রলোকবাসী যথাসময়ে পৃথিবীর বুকে হাজির হল। অতুলনীয়, একেবারেই অবিশ্বাস্য চিঠিটা অধ্যাপক রুবাদুব গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়লেন। একবার নয়, একাধিকবার তিনি চিঠিটা পড়লেন। যতবার তিনি পড়লেন ততবারই তার বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। তার বিস্ময় এমনই চরম পর্যায়ে পৌঁছাল যে আচমকা তার হাত থেকে পাইপটা দুম্ করে মাটিতে পড়ে গেল।

    এ তো গেল অধ্যাপক রুবাদুবের কথা। আর মীনহার সুপারবাস ভন আন্ডারডুক? সে মুহূর্তে তিনি চোখ থেকে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে বার কয়েক মোছামুছি করে পকেটে রাখতে গিয়েও থমকে গেলেন। তিনি নিজেকে আর নিজের সামনে এতখানি বিস্মিত হলেন যে বিস্ময়ে আর প্রশংসায় যন্ত্রচালিতের মতো গোড়ালির ওপর ভর করে যন্ত্রচালিতের মতো তিন তিনবার চক্কর খেয়ে ফেললেন।

    মীনহীর সুপারভাস ভন আন্ডারড্রক মুহূর্তের জন্য ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে মনস্থির করে ফেললেন–ক্ষমা? হ্যাঁ, এ পরিস্থিতিতে ক্ষমা চিন্তা না করাই সঙ্গত। আর ক্ষমা না করে উপায়ও তো কিছু হবার নেই।

    এদিকে অধ্যাপক রুবাদুবও নিশ্চিন্তে বসে নেই। তিনিও ক্ষমার ব্যাপারটা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তিনি শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। তারপর নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে শপথবাক্য উচ্চারণ করলেন। প্রখ্যাত অধ্যাপক ভন আন্ডারডুকও তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হলেন।

    ক্ষমা তো করা হবে, কিন্তু কিভাবে হান্স ফালকে ক্ষমা করা যাবে, সেটাই এ মুহূর্তের একমাত্র ভাবনা।

    হান্স ফালকে ক্ষমা করার উপায়টা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে করতে বিজ্ঞানীদ্বয় বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন।

    নগরপালকের বাড়ির দরজায় পৌঁছে অধ্যাপক রুবাদুব বললেন–‘চাঁদ থেকে আসা দূতটি তো চম্পট দিয়েছে। সে আবার চাদেই পাড়ি জমিয়েছে।’

    মীনহীর সুপারবাস ভন আন্ডারডুক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে নীরবে অধ্যাপকের মুখের দিকে তাকালেন।

    অধ্যাপক রুবাদুব বলে চললেন–‘দূতটির চলে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, রটারডাম নগরের অধিবাসীদের চাক্ষুষ করেই তার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছিল।

    ‘রটারডামের নাগরিকদের দেখে–

    তাকে কথাটি শেষ করতে না দিয়েই অধ্যাপক বলে উঠলেন–‘আরে ভাই, এ তো খুবই সহজ কথা, একেবারে পানির মতো সহজ ব্যাপার। অনভ্যস্ত চোখে এখানকার মানুষের অসভ্য চেহারা দেখে সে যারপরনাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। আর সে ভীতির জন্যই সে এখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, সন্দেহের কিছুমাত্রও অবকাশ নেই। এখন ক্ষমার ব্যবস্থা থাকলেও কাজের কাজ তো কিছুই হবার নয়।

    ‘কারণ? ক্ষমার ব্যবস্থা হলেও লাভ হবার নয় কেন? আমার এ-কথাও কিন্তু খুবই সহজ সরল। চাঁদের কোনো লোক ছাড়া পৃথিবীবাসী কারো পক্ষে এতটা পথ অতিক্রম করে চাঁদে হাজির হওয়া সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়।

    নগরপালক অধ্যাপকের কথাটা শুনে প্রথমে কিছু সময় গম্ভীর মুখে ভাবলেন। তারপর তিনিও তার যুক্তিটা মেনে নিলেন। অতএব ক্ষমার প্রসঙ্গটা এখানেই চাপা পড়ে গেল। তবে এও সত্য যে, গুজব তার পথ ধরেই এগিয়ে চলল। গুজবের শেষ হলো না। চিঠিটা ছাপা হল। ব্যাপারটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ব্যস, চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল। গুজবের পর গুজব–হরেক রকম মতামত ঘুরে বেড়াতে লাগল।

    অতি বিচক্ষণ কিছু লোক চাঁদের ব্যাপারটাকে পুরোপুরি একটা ভাঁওতা বলেই এক ফুঙ্কারে উড়িয়ে দিল। কিন্তু ফল হলো সম্পূর্ণ বিপরীত। শেষপর্যন্ত তারা নিজেরাই নগরবাসীর হাসির খোরাক হল, উপহাসের পাত্রে পরিণত হল।

    এতকিছু সত্ত্বেও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এরকম মানুষরা সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বুদ্ধি দিয়ে যারা ব্যাখ্যা করতে পারে না তাকেই ভাওতা আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় আসছে না। সত্যি বলছি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কোনো ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা এমন মন্তব্য করছে। কেবল মন্তব্য করাই নয়, রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গেই তারা মতামত ব্যক্ত করছে।

    তারা কোন মতামত ব্যক্ত করছে একবার দেখাই যাক না–প্রথমত-রটারডাম নগরের কিছু রসিকজনের কিছু বিশেষ বিরূপতা বর্তমান কিছু সংখ্যক জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং পৌরপ্রধান সম্বন্ধে। পুরোপুরি বিরূপতা যাকে বলে।

    দ্বিতীয়ত–বিশেষ কোনো একটা অসৎ আচরণের অপরাধে দু-দুটো কানই একেবারে গোড়া থেকে কেটে দেওয়া হয়েছে এমন এক বদ্ধ মাতাল বেঁটেখাটো একজন দিন কয়েক ধরে ব্রুজেস নগরের কাছাকাছি স্থান থেকে বেপাত্তা হয়ে গেছে। বহুবার খোঁজখবর করেও তার হদিস পাওয়া যায়নি।

    তৃতীয়ত–সম্পূর্ণ বেলুনটার গায়ে যেসব খবরের কাগজ আঁটা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সবই হল্যাণ্ডে ছাপা হয়েছিল। অতএব সেগুলো যে চাদে ছাপা হয়নি এতে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই, থাকতে পারে না। আর কাগজগুলোর গায়ে ময়লা জড়ানো, খুবই ময়লা জড়ানো। তার ওপর মুদ্রাকর প্রাক বাইবেল স্পর্শ করেও শপথ করে বলতে পারে যে, সেগুলো অবশ্যই রটারডাম নগরের ছাপাখানায়ই ছাপা।

    আর চতুর্থত–মদ্যপ হান্স ফাল নিজে আর তার পাওনাদার বলে যে তিনজন। অলস প্রকৃতির লোকের কথা উল্লেখ করেছে, মাত্র দু-তিনদিন আগেও তাদের একটা ছোট দেশি মদের দোকানে মদ গিলতে দেখা গেছে। আর তারা সমুদ্রের ওপার থেকে। নোটের গোছা নিয়ে সবেই ফিরে এসেছে। অদ্ভুত কাণ্ড বটে। উপসংহার সবাই ভাবছে, মানে ভাবাই উচিত যে, রটারডাম নগরে অবস্থিত ‘কলেজ অব অ্যাস্ট্রনমাস’ আর পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সব কলেজ–আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সম্বন্ধে মন্তব্য করছি না। তবে নিঃসন্দেহে, রীতিমত জোর দিয়েই বলা চলে, ছেড়েছুঁড়ে খুব কম করে বললেও বলা যেতে পারে, যা হওয়া দরকার, যা হওয়া স্বাভাবিক তার চেয়ে বেশি বড়, বেশি ভালো বা বেশি জ্ঞানীও কিন্তু নয়। তবে সব কলেজ ও সব জ্যোতির্বিজ্ঞানী অবশ্যই এর মধ্যে পড়ে না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোল্ডেন লায়ন – উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান
    Next Article লাভ ক্যান্ডি – জাফর বিপি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }