Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডগার অ্যালান পো রচনাসমগ্র / অনুবাদ : জাকির শামীম

    জাকির শামীম এক পাতা গল্প1512 Mins Read0

    দ্য পারলয়েন্ড লেটার

    দ্য পারলয়েন্ড লেটার

    প্যারিস! প্যারিস শহর!

    আঠারো সাল। সে বছর শরতের একটা ঝড়ো সন্ধ্যা।

    প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ সে সন্ধ্যায় আমরা দুই বন্ধু তেত্রিশ নম্বর রুদুনো ফবুর্গ স্যাঁৎ জারমেন ঠিকানার ছোট গ্রন্থাগারটায় মুখোমুখি বসে আরামে পাইপ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গভীর চিন্তায় আত্মমগ্ন রয়েছি। বাড়ি আর গ্রন্থাগার উভয়েরই মালিক আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু মি. অগস্ত পুঁপে। আর সে-ই আমার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে। গভীর চিন্তা আমাদের মাথায় থাকলেও চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে চুরুটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে রীতিমত আরামের মধ্যেই আমরা যে ডুবে গিয়েছি, অস্বীকার করতে পারব না।

    তবে অবশ্য আমার নিজের সম্বন্ধে আমি এটুকু অন্তত বলতে পারি যে, সে সন্ধ্যায় প্রথম প্রথম বন্ধু মি. অগস্ত দুঁপের সঙ্গে যে সব প্রসঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল, আমি চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে পাইপ থেকে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে মনে মনে সে সব কথাই আওড়ে চলেছি। আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমার চিন্তার বিষয় হচ্ছে মার্গের ঘটনা। আর মারি বোগেতের খুনের রহস্য।

    আমরা যখন নিবিষ্ট মনে চিন্তার জট ছাড়াতে ব্যস্ত ঠিক তখনই আমাদের বহুদিনের বন্ধু ও পুলিশের বড় অফিসার মি. জি. হঠাৎ দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে এলেন।

    দরজার পাল্লার মৃদু অথচ কাঁচ কাঁচ আওয়াজ কানে যেতেই আমাদের উভয়েরই চিন্তায় ছেদ পড়ল। আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁকে দরজায় দেখে সাধ্যমত দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে তাকে অভ্যর্থনা করে ঘরে নিয়ে এলাম। চেয়ার এগিয়ে বসতে দিলাম।

    বহুদিন বাদে বন্ধুবর মি. জি-এর সঙ্গে দেখা হল।

    আমরা দুই বন্ধু এতক্ষণ সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারেই বসে চুরুট টানছিলাম। মি. জি. আসাতে বন্ধু এঁপে মোমবাতিটা জ্বালাবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েই আবার দুম্ করে বসে পড়ল।

    তার আবার বসে পড়ার কারণ, পুলিশ অফিসার বন্ধু জি, জানালেন, একটা জটিল সরকারি ব্যাপার সম্বন্ধে জরুরি পরামর্শ করার জন্যই তার এ-আকস্মিক আগমন। তার কথার ইঙ্গিতে বুঝতে পারলাম, বিশেষ করে বন্ধুবর দুঁপে-র মতামত জানার আগ্রহই তিনি এখানে আরও বেশি আগ্রহান্বিত হয়ে ছুটে এসেছেন।

    বন্ধুবর দুঁপে বলল–‘ব্যাপারটা যদি এমন জরুরিই হয়ে থাকে তবে কথাবার্তা বরং অন্ধকারেই হলে গভীরভাবে মনোসংযোগ করা সম্ভব হবে, কী বলেন মি. জি?

    মি. জি স্লান হেসে বললেন–এটা তোমার কিন্তু আর একটা বিচিত্র খেয়াল ছাড়া কিছু নয়।’ তিনি ‘বিচিত্র’ শব্দটা কেন ব্যবহার করলেন? আসলে নিজের বুদ্ধি দিয়ে যার বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারেন না তা-ই তার কাছে বিচিত্র এবং বিচিত্র’ শব্দটা ব্যবহার করাটাও তার একটা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে তাকে এমন হাজারো ‘বিচিত্র কাণ্ডকারখানার মধ্যেই প্রতিটা দিন–প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হয়।

    পুলিশের বড় অফিসার বন্ধুবর জি-র হাতে একটা পাইপ ধরিয়ে দিতে দিতে দুঁপে বলল, সত্যি খুবই সত্যি কথা বলছেন।

    পাইপে একটা লম্বা টান দিয়ে ঘরময় ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়ে বললাম–‘মি. জি, আবার এমনকি সমস্যা দেখা দিল যে, ভর সন্ধ্যেবেলায় আপনাকে ছুটে আসতেই হল? আশা করি নতুন কোনো খুনের ব্যাপারে

    আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে পুলিশের বড় অফিসার বন্ধু জি বলে উঠল ‘আরে, না। খুবই সহজ-সরল একটা ঘটনা।

    ‘সহজ-সরল ঘটনা?

    ‘অবশ্যই। আর তার মীমাংসা আমরা বেশ ভালোভাবেই করে ফেলতে পারব বলেই আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ, তা সত্ত্বেও মনে হলো মি. দুঁপে হয়তো পুরো ব্যাপারটা শুনলে খুবই খুশি হবেন।’

    ‘মি. দুঁপে খুশি হবেন?

    ‘মনে তো হচ্ছে। কারণ, সম্পূর্ণ ঘটনাটা যারপরনাই বিচিত্র প্রকৃতির।

    ‘সহজ-সরল আর বিচিত্র প্রকৃতির?

    ‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। আবার ও দুটোর একটাও যথাযথ নয়। সত্যি কথাটা কি, জানেন? ঘটনাটা এত সহজ-সরল হওয়াতেও আমরা কেউ-ই অনুধাবন করতে না। পারার জন্যই কেমন যেন জটিলতর হয়ে পড়েছে, ধন্ধে পড়ে গেছি। এমন সহজ একটা ব্যাপার–’

    তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে স্টুপে বলে উঠল–এমনও হতে পারে যে, ঘটনাটা খুবই বেশি রকম সহজ-সরল বলেই আপনারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, আমার অন্তত এটাই বিশ্বাস।

    পুলিশের বড় অফিসারটি সরবে হাসতে হাসতে বললেন–আপনি যে কী অবান্তর কথা বলেন!

    দুঁপে এবার বলল–‘রহস্যময় ঘটনাটা হয়তো খুব বেশি সহজ-সরল! ‘হায় ঈশ্বর! এ আবার কি ধরনের কথা মি.?

    ‘একটু বেশি রকম স্পষ্ট, এ ছাড়া আর কিছু নয়।’

    আগম্ভক পুলিশের বড় অফিসার গলা ছেড়ে হাসতে আরম্ভ করলেন। এক সময় হাসি থামিয়ে বললেন আপনার কথা শুনে হাসতে হাসতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় হয়েছে মি. দুঁপে!

    আমি পুলিশের বড় অফিসার মি. জি-র দিকে সামান্য ঝুঁকে আগ্রহ প্রকাশ করে বললাম–তবে আসল ব্যাপারটি কী, বলুন তো মি. জি?

    পুলিশের বড় অফিসার চুরুটে একটা লম্বা টান দিয়ে এক গাল ধোয়া ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসতে বসতে বললেন–সবই বলব, কিছুই বাদ দেব না। কিন্তু বিস্তারিত বিবরণ নয়, অল্প কথায় বলব। তবে বলার আগে আপনাদের সতর্ক করে দিতে চাচ্ছি যে–‘

    তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আমি বলে উঠলাম–‘সতর্ক? কেন সতর্ক কেন?

    ‘সতর্ক করে দেওয়ার উদ্দেশ্য একটাই, ব্যাপারটা কিন্তু খুবই গোপনীয়।

    ‘তাই বলুন।

    ‘হ্যাঁ, ঘটনাটা আমি কারো কাছে ফাস করেছি এ-কথা ওপরওয়ালা জানতে পারলে আমাকে যে কেবল জবাবদিহিই করতে হবে তাই নয়, চাকরিটাও খোয়াতে হবে।

    ‘ঠিক আছে, কথা দিলাম, এ-ব্যাপারে কারো কাছেই মুখ খুলব না।’

    দুঁপে বলল–‘যদি আপত্তি থাকে তবে না-ও বলতে পারেন। আমি অন্তত পীড়াপীড়ি করব না।’

    পুলিশ অফিসার মঁসিয়ে মুচকি হেসে বললেন–‘আপত্তি থাকলে আর এখানে ছুটে আসব কেন মি. দুঁপে। যাক, শুনুন তবে বলছি–‘খুবই ওপরমহল থেকে আমি জানতে পেরেছি, রাজপ্রাসাদ থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল খোয়া গেছে।

    ‘রাজপ্রাসাদ থেকে দলিল–গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল চুরি গেছে?

    ‘হ্যাঁ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলিল সেটা। আর সেটা কে গায়েব করেছে তা-ও জানা গেছে। আর তা নিয়ে এতটুকুও. সন্দেহের অবকাশ নেই।

    ‘আশ্চর্য ব্যাপার তো!’

    আমি কপালের চামড়ার ভাজ এঁকে বললাম–‘

    ‘কিন্তু এমন নিঃসন্দেহ কিভাবে—’

    ‘আরে মি., তাকে যে চুরি করতে দেখা গেছে।‘

    ‘বেশ, তারপর?’

    ‘চোরাই করা দলিলটা যে চুরি করেছে এখন তার কাছেই আছে।’

    দুঁপে অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করল–‘তা কী করে জানা সম্ভব হয়েছে?

    ‘ব্যাপারটা হচ্ছে কি মি. দুঁপে–‘দলিলটার গুরুত্ব ও প্রকৃতি এবং সেটা চোরের হাতের বাইরে চলে গেলে যা-কিছু ঘটা স্বাভাবিক ছিল, অর্থাৎ ঘটা সম্ভব ছিল তা থেকেই নিশ্চিত ভাবেই এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।

    আমি তার দিকে সামান্য ঝুঁকে আগের চেয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে বললাম–মি. জি, আরও একটু খোলসা করে বলে আমার উকণ্ঠা দূর করুন।

    দুঠোঁটের ফাঁক থেকে চুরুটটা নামিয়ে এনে পুলিশের বড় অফিসার মি. জি বললেন–মি., একটা কথা আমি রীতিমত জোর দিয়েই বলতে পারি যে, উপরোক্ত দলিলটা যার অধিকারে থাকবে সে এক বিশেষ ক্ষমতা বলে বলিয়ান হবে এমন এক বিশেষ মহলে যেখানে ওই ক্ষমতাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।’ পুলিশের এ বড় অফিসার

    দ্রলোকের কুটনীতির চাল দেওয়ার ব্যাপারটার প্রতি খুব বেশি প্রবণতা।

    বন্ধুবর দুঁপে যুগল কুঁচকে বলল–‘আমার মাথায় কিন্তু এখনও মাথামুণ্ডু কিছুই ঢুকল না।

    ‘কিছুই না?’

    ‘কিছু না।

    ‘শুনুন তবে বলছি, দলিলটা যদি কোনো অজানা তৃতীয় ব্যক্তির হাতে চলে যায় তবে এক সম্মানীয় ব্যক্তির সম্মানহানি ঘটবে। অতএব যে সম্মানীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তির যশখ্যাতি মনোবল প্রভাবে নষ্ট হতে চলেছে তিনি সে তৃতীয় ব্যক্তিটার একেবারে কজায় চলে গেছেন, ব্যাপারটা এবার কিছুটা অন্তত খোলসা হয়েছে আশা করি।

    ‘কিন্তু দলিলের মালিক, অর্থাৎ যার দলিল খোয়া গেছে তিনি যে চোরকে চিনতে পেরে গেছেন এ-কথা চোরটা যদি জেনে যায়, তবেই তো তার পক্ষে সুযোগটা নেয়া সম্ভব হবে। এখন কথা হচ্ছে, কোন চোরের বুকের পাটা এমন নয় যে ব্যাপারটাকে–‘

    আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মি., জি বলে উঠলেন–‘চোর, মানে। গুরুত্বপূর্ণ দলিলটা চুরি করেছেন মন্ত্রী ডি.আরে ভাই তিনি এমন একজন জাহাবাজ লোক যে, তার অভিধানে অসম্ভব বলে কোনো শব্দ নেই অর্থাৎ তিনি পাওে না এমন কোনো কাজই নেই তার চুরির কৌশলটা রীতিমত বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। যে দলিলটার কথা বলছি–খোলসা করে বলাই দরকার যে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি। সেটা যার কাছ থেকে যখন গায়েব করা হয়েছে তখন তিনি শোবার ঘরে একাই ছিলেন।

    ‘একা?’ একদম একাই ছিলেন?’ আমি তার কথার মাঝখানে বলে উঠলাম।

    ‘হ্যাঁ, একদমই একা ছিলেন। তারপর কি হলো শুনুন–মহিলাটি যখন সে চিঠিটার ওপর অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে চোখ বুলাচ্ছিলেন ঠিক সে মুহূর্তেই অন্য সম্মানীয় ব্যক্তিটি ব্যস্ত পায়ে সে ঘরে ঢুকলেন। তবে তার কাছে চিঠিটা গোপন রাখাই মহিলাটির একান্ত ইচ্ছা ছিল।’

    ‘কিন্তু সে সুযোগ তিনি আর পেলেন না, এই তো?’ আমি আবার তার কথার মাঝখানে বলে উঠলাম।

    ‘চেষ্টার ত্রুটি তিনি করেননি। কিন্তু তার চেষ্টানিস্ফেল হয়েছিল।

    যেমন?

    ‘মহিলাটি যন্ত্রচালিতের মতো ব্যস্ততার সঙ্গে হাতের চিঠিটাকে একটা ওয়ারের মধ্যে চালান দিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। ব্যর্থ হলেন। ফলে উপায়ান্তর না দেখে তিনি হাতের চিঠিটাকে টেবিলের ওপর ফেলতে বাধ্য হলেন।

    ‘হ্যাঁ, পরিস্থিতি এমন হলে তার পক্ষে এ ছাড়া তো করারও কিছু ছিল না।’

    ‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। তবে চিঠির গায়ে লেখা ঠিকানাটা ও পরের দিকে থাকার ফলে চিঠিটার বক্তব্য গোপনই রয়ে গেল। আর ঠিক তখনই চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকে এলে মন্ত্রী ডি।

    তাকে দেখেই মহিলাটি থতমত খেয়ে গেলেন। আর এদিকে ঘরে পা দেওয়ামাত্র মন্ত্রী ডি-র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়ল টেবিলের ওপরে রক্ষিত চিঠিটার ওপর।

    ব্যস, মুহূর্তে তার মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। কারণ, চিঠির গায়ে লেখা ঠিকানার হস্তাক্ষরটা চিনতে তিলমাত্রও ভুল হলো না।’

    ‘তারপর? তারপর কী হল?

    ‘সে মুহূর্তেই মহিলাটির ব্যস্ততা, উৎকণ্ঠা আর চোখ মুখের ভাব দেখেই তিনি চিঠিটার গুরুত্ব অর্থাৎ গোপনীয়তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন।

    ‘এবার ব্যস্ততার সঙ্গে স্বভাবসুলভ মামুলি দু-চারটি কথা সারতে সারতে টেবিলে রক্ষিত চিঠিটার মতোই অন্য আর একটা চিঠি কোটের পকেট থেকে বার করে গভীর মনোযোগের ভান করে পড়তে লাগলেন। পর মুহূর্তেই হাতের চিঠিটাকে ঝটপট ভাঁজ করে টেবিলে রেখে টেবিলের চিঠিটাকে কোটের পকেটে চালান করে দিলেন।

    এবার মুখের ভাবভঙ্গি আমূল পরিবর্তন এনে আর প্রায় মিনিট পনের ধরে সরকারি কাজকর্মের আলোচনা করলেন।

    এখানে বলে রাখা দরকার মন্ত্রী ডি–চিঠিটা বদলে নেবার সময় চিঠির মালিক আঁড়চোখে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। কিন্তু ঘরে তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিতির জন্য সবকিছু দেখেও মুখ খুললেন না। আসলে তার সাহসে কুলায়নি।

    কোনোরকম প্রতিবাদের মুখোমুখি না হয়েই মন্ত্রী ডি-বাজে চিঠিটা রেখে টেবিল থেকে গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটা বাগিয়ে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

    দুঁপে এবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল–‘কি হে, তোমার যা-কিছু জানার আগ্রহ ছিল সবই তো বলা হল। এবার নিশ্চয় ব্যাপারটা বুঝতে পারলে, যার চিঠি বেহাত হয়েছে, তিনি যে চোরকে চিনতে পেরেছেন, সেটা চোর তো জানতেই পারলেন। তাই খেলাটা যে এবার পুরোপুরি চোরের কজায় চলে গেছে, এতে আর কোনো সন্দেহই নেই।

    পুলিশের বড় অফিসার মি. ডি বললেন–‘অবশ্যই, আর এ-কাজের মাধ্যমে যে অসীম ক্ষমতা ও সুযোগ তার হাতে এলো তারই ফলে কয়েক মাস ধরে তিনি জব্বর জব্বর রাজনৈতিক মুনাফা বল্গাহীনভাবে লুটে চলেছেন।

    আরও আছে। যার চিঠিটা বেহাত হয়ে গেছে তিনি প্রতিদিন, প্রতিটা মুহূর্তেই সে চিঠিটা ফিরে পাবার গুরুত্ব সম্পর্কে যারপরনাই সচেতন হয়ে চলেছেন। কিন্তু কিভাবে তার উদ্দেশ্যটাকে বাস্তবায়িত করা যাবে? প্রকাশ্যে তো অবশ্যই করা সম্ভব নয়।’

    আমি বললাম–‘কিন্তু এতে আপনার ভূমিকা–

    ‘আরে,নিজে কিছুতেই কার্যোদ্ধার করতে পারবেন না এ-ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েই তিনি আমার ওপর চিঠিটা উদ্ধার করার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছেন।

    চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে দুঁপে এবার বলল–‘এর কারণও আছে যথেষ্টই।’.

    পুলিশের বড় অফিসার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—’কারণ?’

    কারণ বলতে আপনি কীসের ইঙ্গিত দিতে চাইছেন, বলবেন কি?

    ‘মি. ডি, আপনার চেয়ে যোগ্যতর, মানে এমন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোক আর কে-ই বা আছে যার ওপর এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন?

    ‘মি. দুঁপে, আপনি যে আমাকে ‘গ্যাস দিচ্ছেন অন্তত এটা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার অবশ্যই আছে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তিনি বললেন– কিন্তু এমনও তো হতে পারে, অনেকের কাছে আমার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার মূল্য আছে।’

    আমি মি. জি-র দৃষ্টি আমার দিকে ফিরিয়ে এনে বললাম–তবে আপনার কথা থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে–’

    ‘কোন ব্যাপারটার কথা বলছেন, বলুন তো।

    ‘বলতে চাইছি, নিসন্দেহ হওয়া যাচ্ছে যে, চিঠিটা মন্ত্রী ডি’র জিম্মাতেই এখনও রয়েছে, ঠিক কিনা?

    ‘হ্যাঁ, আর আমি এ-ব্যাপারে শতকরা একশো ভাগই নিসন্দেহ। আর এ-চিঠিটা দখলই যখন তার ক্ষমতার একমাত্র উৎস, তখন চিঠিটা উপযুক্ত কাজে ব্যবহার করামাত্রই ক্ষমতাও নিশেষ হয়ে যাবে।’

    আমার কথাটা সমর্থন করতে গিয়ে মি. জি বললেন–‘সম্পূর্ণ সত্য কথা। এরকম বিশ্বাস নিয়েই আমিও কাজ করে চলেছি। কাজে নামার পর আমার প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল, মন্ত্রী মহোদয়ের হোটেলটাকে চিরুণি তল্লাসি চালানো। কিন্তু কাজে নেমে দেখলাম, তারই অজান্তে কাজটা করাই মহাসমস্যা হয়ে দাঁড়াল। আরও অসুবিধার ব্যাপার হচ্ছে, এ ব্যাপারে আমি যদি কোনোক্রমে তার সন্দেহভাজন হয়ে পড়ি তবে। আমাকে চরম বিপদের মুখোমুখি যে হতে হবে, কোনোই দ্বিমত নেই। আর এ-সম্বন্ধে : আমাকে হিতাকাঙ্খীদের অনেকেই সতর্ক করেও দিয়েছেন।’

    ‘একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না-’

    ‘কি? কোন ব্যাপারটার ইঙ্গিত দিচ্ছেন, বলুন তো?

    ‘বলছি কি, এ রকম তদন্ত করার অধিকার তা আপনার অবশ্যই আছে মঁসিয়ে জি’।

    ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।

    ‘তাছাড়া প্যারিসের পুলিশ তো ইতিপূর্বে বহুবারই এ-কাজ করেছে বলে আমি জানি।

    ‘হ্যাঁ, তা অবশ্যই করেছে। আর এ যুক্তিতেই আমি পিছিয়ে যাইনি। আরও আছে, মন্ত্রী ডি-র আচরিত কয়েকটা অভ্যাস আমার বড় রকমের সুযোগ করে দিয়েছে।’

    ‘অভ্যাস? কী ধরনের অভ্যাস, জানতে পার কী?

    ‘অবশ্যই। যেমন ধরুন, প্রায়ই তিনি সারারাত বাড়ি থাকেন না, বাইরে কাটান। আর তার দাস-দাসীরাও সংখ্যায় বেশি নয়। সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, মনিবের থাকার ঘর থেকে বেশ কিছুটা দূরে তাদের থাকার ব্যবস্থা। সেখানেই তারা দিনের বেশ কিছু সময়, বিশেষ করে রাত কাটায়। তা ছাড়া নেপসের লোকরা এমনিতেই নেশা ভাঙ একটু বেশিই করে। আর এও তো আপনার অজানা নয় যে, আমার পকেটে এমন চাবি আছে যা ব্যবহার করে প্যারিসের যে কোনো ঘর বা আলমারি অনায়াসেই খোলা সম্ভব।’

    ‘হ্যাঁ, তা জানি বটে।

    ‘তারপর শুনুন, গত তিনমাসে এমন রাতও বাদ যায়নি যে, আমি মন্ত্রী ডি. হোটেলের ঘরগুলো ঘাটাঘাটি করিনি। সত্যি কথা বলতে কি, এ ঘটনাটার সঙ্গে আমার সম্মান জড়িয়ে রয়েছে। মুহূর্তের জন্য নীরবে ভেবে তারপরই তিনি আবার মুখ খুললেন। আর একটা কথা বলা ঠিক হবে কিনা জানি না, তবু বলছি–কাজটা হাসিল করতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ যা পাওয়া যাবে, সে অঙ্কটাও কিন্তু বেশ বড়ই।’

    ‘তাই বুঝি?’ আমি মুচকি হেসে বলে উঠলাম।

    ‘হ্যাঁ, রীতিমত লোভনীয় পুরস্কার! তাই তো চিঠি-চোর আমার চেয়ে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরে এ-সম্বন্ধে নিশ্চিত না হওয়া অবধি আমি তার হোটেলটা তল্লাসি চালাবার কাজ বন্ধ করিনি। আমার কিন্তু বিশ্বাস, হোটেলটার এমন কোনো কোণা ঘুপছি বাদ নেই, যেখানে আমি চিরুণি তল্লাসি চালাইনি।

    ‘আপনার সব কথা মেনে নিয়েই আমি বলছি, এমনটা হওয়াও তো অসম্ভব নয় যে, মন্ত্রী চিঠিটাকে নিজের বাড়িতে না রেখে অন্য কোনো গোপন স্থানে রেখে দিয়েছেন, একেবারেই অসম্ভব কী? আমি বেশ জোর দিয়েই কথাটা বললাম।

    দুঁপে আমার বক্তব্যটাকে সমর্থন করতে গিয়ে বলল–এমনটা হওয়া একেবারে যে অসম্ভব। এমন কথা বলা হয়তো ঠিক হবে না। তবে ব্যাপারটা বিচারালয়ে যা দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে মন্ত্রী ডি যেসব ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছেন বলে শুনেছি, তাতে করে এ-মুহূর্তে দলিলটা বাগিয়ে নেওয়া–এক মিনিটের নোটিশে সেটাকে তল্লাসি চালিয়ে বের করে দেওয়া দলিলটাকে নিজের জিম্মায় রাখার মতোই সমান জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    ‘আপনি, বের করে দেওয়া বলতে কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছেন?’ আমি আগ্রহান্বিত হয়ে বলে উঠলাম।

    দুঁপে কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাঁজ এঁকে বলল–‘আপনি কী বলতে চাইছেন, চিঠিটা নষ্ট করে দেওয়ার সন্দেহ রয়েছে!

    আমি মুহূর্তের জন্য ভেবে নিয়ে বললাম-–ঠিক কথা, চিঠিটা তবে ওই বাড়িতেই রয়ে গেছে। তা যদি হয় তবে সেটা মন্ত্রীর দখলে আছে, এরকম ভাবাটা তো নিতান্তই অযৌক্তিক।

    ‘হ্যাঁ, সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। পুলিশের বড় অফিসার বললেন–একবার নয়, দু দুবারই তাকে পথের মাঝে ধরে আমারই সামনে তার সর্বাঙ্গ তল্লাসি চালানো হয়।

    ‘আপনি নিজে কিন্তু এতখানি কষ্ট না করলেই পারতেন বলে আমি মনে করি। আমার ধারণা, ডি অবশ্যই বোকা হাঁদা নন, আমার বন্ধুবর দুঁপে বলল–‘অতএব তাকে যে, যে কোনো মুহূর্তে, এমনকি পথের মাঝখানে আটকে তল্লাসি চালানো হতে পাওে, তা তিনি ভালোই জানতেন, ঠিক কিনা?

    ‘না তিনি যে বোকা নন, এ ব্যাপারে তিলমাত্র সন্দেহও নেই। তবে—

    তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমি বলে উঠলাম–‘তবে? তবে কি?

    তবে তিনি একজন কবিও বটে। তাই যেহেতু কবিতার পোঁকা তার মাথায় বাসা বেঁধেছে, তখন তিনি যে একজন নিরেট বোকা, বোকার চেয়ে এক ডিগ্রিও পরে এও মিথ্যে নয়।’

    ‘আরে গুটি কয়েক কবিতা মানে ফালতু কবিতা তো আমার কলম দিয়েও বেরিয়েছে।

    আমি এবার বললাম–‘যাক গে, এবার আসল কথা, মানে তল্লাসির ফলাফলের কথা কিছু অনুগ্রহ করে বলবেন কী?

    ফলাফল? আরে মি., তল্লাসি বলতে, আমরা প্রচুর সময় ব্যয় করে সব জায়গায় চিরুনি তল্লাসি চালিয়েছি। এসব কাজে আমার অভিজ্ঞতা খুবই, মানে দিনের পরনি এ ধরনের কাজে লেগে থেকে চুল পাকিয়ে ফেলেছি। যাকগে, যে কথা বলতে চাইছি, বাড়িটার এক-একটা ঘর এক একদিন, সারাটা রাত ধরে একেকটা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। এভাবে সারাটা সপ্তাহ কেটেছে।

    ‘হ্যাঁ, তা-তো হবেই। আর বাড়িটাও তো কম বড় নয়। বাড়ি মানে, প্রাসাদ বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। যাক গে, আসল কথায় আসা যাক, সারারাত ধরে ঘরের আসবাবপত্র তল্লাসি করেছি। প্রতিটা ড্রয়ার খুলে সাধ্যমত ঘাটাঘাটি করেছি।’

    ‘হ্যাঁ, এসব তো সবার আগেই করা চাই।

    ‘অবশ্যই। আপনার তো আর অজানা নয় যে, একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশের কাছে গোপন ড্রয়ার বলে কিছু থাকা সম্ভব নয়। এ রকম একটা তল্লাসি চালাতে গিয়ে গোপন কোনো ড্রয়ার যদি কারো নজর এড়িয়ে যায়, তবে আমি বলব সে একটা আস্ত গাধা।

    তারপরের কাজের কথা আশা করি আর বলার দরকার নেই। আলমারির কাজ মিটিয়ে আমরা চেয়ারগুলোকে নিয়ে মেতে যাই, খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

    ‘কুশনওয়ালা চেয়ার, মানে ভেঙেচুরে—’

    ‘আরে ধ্যত! না ভেঙে কি কুশনওয়ালা চেয়ারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব নয়!’

    ‘কিন্তু কিভাবে? আমি চোখে অবিশ্বাসের ছাপ একে বললাম।‘

    ‘ইয়া লম্বা লম্বা সূঁচ চালিয়ে চেয়ারের কুশনগুলোকে বার বার এঁফোড়-ওঁফোড় করে পরীক্ষা করি–ব্যস, কাজ হাসিল।‘

    ‘তারপর। তারপর কী করলেন?’

    ‘তারপরের কাজ হল, টেবিলের ঢাকনাটা খুলে পরীক্ষা করা। করলামও তাই!’

    ‘কারণ কী?’

    ‘কারণ অবশ্যই আছে।‘ আঙুলের টোকায় চুরুটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে তিনি বললেন।

    ‘সেটাই তো আমি জানতে চাইছি, টেবিলের ঢাকনা সরাতে যাওয়ার পিছনে কী উদ্দেশ্য ছিল?’

    ‘শুনুন তবে, অনেক সময় দেখা যায়, টেবিলের ঢাকনা বা অন্য কোনো অংশ সরিয়ে ফেলে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পাতলা জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়। আবার দেখা যায় কোনো একটা পায়ার ভেতরের দিকটা সতর্কতার সঙ্গে খুঁড়ে ফেলে দিয়ে জরুরি ছোট জিনিসটা তার মধ্যে চালান করে নিয়ে আবার ঢাকনাটা লাগিয়ে দেওয়া হয়।

    ‘কিন্তু খাটের ব্যাপার?’

    ‘খাটকে ব্যবহার করা হয়, ছত্রীকে সরিয়ে ফেলে একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।‘

    ‘এখন জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, বাইরে থেকে ছোট হাতুড়ি বা এমনকিছু দিয়ে ঠোকাঠুকি করে কী শব্দ শুনে বাইরে থেকে সদ্য তৈরি গর্তটার অস্তিত্বের কথা অনুমান করা সম্ভব হয় কী?’

    ‘মোটেই না। অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা গর্তের মধ্যে ভরে যদি তাতে আচ্ছা করে তুলা খুঁজে দেওয়া যায়, তবে তো বোঝার কোনো উপায়ই থাকে না।‘

    ‘তবে আপনি।‘

    আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই তিনি বলতে লাগলেন–‘আমার ক্ষেত্রে তো সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, কোনোরকম শব্দ না করে কাজ হাসিল করা।‘

    ‘সমস্যা হচ্ছে, আপনি যেভাবে কোনো জিনিস গর্তে খুঁজে দেবার কথা বললেন, তাই যদি হয় তবে তো আপনার পক্ষে ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্রকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়া সম্ভব নয়, কী বলেন?

    ‘সে তো নিশ্চয়ই।

    ‘আর একটা কথা, একটা চিঠি, মানে একটা কাগজকে তো পাকিয়ে পাকিয়ে একেবারে সঁইয়ের মতো আকৃতিবিশিষ্ট করে একটা খাট বা চেয়ারের পাটাতনের কাঠের ভেতরে চালান করে দেওয়া তো অসম্ভব নয়। সবগুলো চেয়ারকে তো আর আপনাদের পক্ষে ভেঙে দেখা সম্ভব হয়নি, কী বলেন?

    ‘অবশ্যই তা সম্ভব হয়নি, সে চেষ্টা করিওনি। আমরা কিন্তু আরও ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেনি।

    ‘উপায়টা কি, দয়া করে বলবেন কী?

    ‘উপায়টা হচ্ছে, খুবই শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্র চোখে লাগিয়ে আমরা প্রতিটা আসবাবপত্রের জোড়কে তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করেছি। নতুন কোনো জোড়া তাপ্পি থাকলে তা কিছুতেই আমাদের নজর এড়িয়ে যেতে পারেনি। আসলে অতি সূক্ষ্ম কাঠের ঔড়াও অনুবীক্ষণ যন্ত্রটায় আপেলের আকৃতি বিশিষ্ট হয়ে ধরা দেয়। আঠা লাগাবার সময় সামান্যতম ত্রুটি কিছু থাকলে, আর দুটো কাঠের টুকরো জোড়া দেবার সময় এতটুকুও ফাঁক যদি নজরে পড়ে তবেই আমরা সেটার ক্ষেত্রে জোর পরীক্ষা চালিয়েছি।’

    ‘তবে আপনার কথায় তো বোঝা যাচ্ছে আপনারা বিছানাপত্র ও বিছানার চাদর, কার্পেট, মশারি আর আয়না ও ফ্রেম–সবকিছুই তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, কি বলেন?

    ‘তা-তো অবশ্যই করেছি। হ্যাঁ, যে কথা বলতে চাচ্ছি, প্রতিটা আসবাবপত্রকে এভাবে পরীক্ষা করার পর আমরা বাড়িটার দিকে মন দিলাম। প্রথমে গোটা বাড়িটাকে কয়েকটা অংশে ভাগ করে নিয়ে তাদের আলাদা আলাদা নামকরণ সেরে ফেললাম।

    নামকরণ?’ আমি মুচকি হেসে বললাম–‘নামকরণের ব্যাপারটা তো ঠিক বুঝতে পারলাম না।’

    ‘মানে বাড়িটার এক-একটা ভাগকে সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করলাম। উদ্দেশ্য। ভুলবশত যেন কোনো অংশ বাদ না পড়ে যায়। তারপর এক-একটা অংশকে প্রতি বর্গইঞ্চি করে শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রটাকে চোখে লাগিয়ে সাধ্যমত যত্নসহকারে পরীক্ষার কাজে মেতে গেলাম। এমনকি পাশাপাশি দুটো বাড়িকেও তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করতে ছাড়িনি।’

    ‘পাশাপাশি বাড়ি দুটোকেও পরীক্ষা করেছেন? তবে তো আপনাদের অনেক হাঙ্গামা পোহাতে হয়েছে, তাই না? আমি কপালের চামড়ায় ভজ এঁকে সবিস্ময়ে বললাম।

    ‘অবশ্যই। তা না করলে চলবেই বা কেন, বলুন? আর পুরস্কারের অর্থমূল্য তো আর কম নয় মি.।’

    তবে কী বাড়ির চারদিকের জমিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন নাকি?

    ‘তা কি আর করা যাবে, বাড়ির চারদিকের জমিই তো পাকা, ইট আর সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। সে জন্যই তো আমাদের পরিশ্রম আর হাঙ্গামা অনেকাংশে কমে গেছে। পুরা অঞ্চলটা নয়, দুটো ইটের জোড়া দেওয়া জায়গাগুলো আমরা কেবলমাত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছি। তবে সন্দেহজনক কোনোকিছুই আমাদের নজরে পড়েনি। কাজেই এক্ষেত্রেও হতাশ হতেই হল।

    ‘আর একটা কথা বড় জানতে ইচ্ছা করছে।

    ‘বলুন, কি আপনার জিজ্ঞাস্য?

    ‘মন্ত্রী ডি-র ফাইলপত্র আর গ্রন্থাগারে পুঁথিপত্রও অবশ্যই ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন নাকি?’

    ‘অবশ্যই। প্রতিটা ফাইল আর প্রতিটা কাগজের মোড়ক থেকে শুরু করে প্রতিটা পুঁথিপত্র পর্যন্ত পাতি পাতি করে খুঁজেছি। অন্য সব তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের মতো কেবলমাত্র নাড়াচাড়া বা ঝাঁকাঝাঁকি দিয়ে দেখিনি, বরং প্রতিটা পাতা উলটে দেখেছি।

    ‘বইগুলোর মধ্যে মোটা বইও নিশ্চয় ছিল–সেগুলোর ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, বলুন শুনি!’

    ‘যে সব বইয়ের সাধারণ মলাট দেয়া, আগে সেগুলোর কথা বলেছি, তাদের মলাট খুলে খুলে পরীক্ষা করেছি। আর যে সব মোটাসোটা বই বোর্ড-বাঁধানো তাদের আসল বাঁধাইয়ের ওপর কোনোরকম জোড়াতাপ্পি আছে কিনা খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে কসুর করিনি। তেমন কিছু নজরে পড়ামাত্র অনুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষায় মেতে গেছি।’

    ‘কিন্তু কার্পেটের আরও নিশ্চয়ই অভিযান চালিয়েছেন, তাই না?

    ‘সে তো অবশ্যই। প্রতিটা কার্পেট তুলে যেখানে-সেখানে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নল লাগিয়ে পুরোদমে পরীক্ষায় মেতে গেছি।’

    ‘কিন্তু দেওয়ালে সাঁটা কাগজপত্রের ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা নিয়েছেন?

    ‘কার্পেটের মতোই কাগজ তুলে তুলে অনুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করেছি।

    ‘মাটির তলার ঘরগুলোও নিশ্চয়ই বাদ দেননি, কী বলেন?

    ‘না, বাদ অবশ্যই দেইনি।

    ‘তাই যদি সত্যি হয় তবে তো দেখছি, আপনাদের হিসেবেই ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমি নির্দিধায় বললাম।

    পুলিশের বড় অফিসার ভ্রূ কুঁচকে বললেন–‘ভুল? হিসেবে ভুল?

    ‘হ্যাঁ, ভুল অবশ্যই ছিল। আসলে আপনাদের বাঞ্ছিত চিঠিটা তো আর তার বাড়িতে অবশ্যই ছিল না।

    ‘এবার আপনি একটা খুবই ভালো কথা বলেছেন। এবার বন্ধুবর দুঁপে-র দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন–‘মি. দুঁপে, আপনিই বলুন, এ-পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? আপনার পরামর্শের দাম আমি অবশ্যই দেব।’

    মি. দুঁপে বললেন–‘আমি কিন্তু বলব, বাড়িটাকে আরও ভালো করে প্রীক্ষা নিরীক্ষা করা দরকার।

    ‘তাতে কোনো ফায়দাই হবে না। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, চিঠিটা অবশ্যই হোটেলে নেই। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, আমার ধড়ে প্রাণের অস্তিত্ব আছে, যেমন সত্য ঠিক তেমনই সত্য চিঠিটা হোটেলে নেই।

    মি. দুঁপে আমতা-আমতা করে বললেন–‘কিন্তু এর চেয়ে ভালো কোনো পরামর্শ তো আমি দিতে পারছি না। তবে অবশ্য চিঠিটার সঠিক বিবরণ আপনি অবশ্যই পেয়ে গেছেন, তাই নয় কী?

    ‘হ্যাঁ, তা অবশ্যই পেয়েছি বটে।

    কথাটা বলতে বলতে পুলিশের বড় অফিসার পকেট থেকে একটা ছোট দিনলিপি বের করে একের পর এক পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। সে পাতায় লেখা খোয়া-যাওয়া চিঠিটার, আর তার বাইরের বিস্তারিত বিবরণ আমাদের পড়ে শোনালেন।

    চিঠিটার বক্তব্য পড়া শেষ করে দিনলিপিটা ভাঁজ করে কোটের পকেটে চালান দিতে দিতে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়েই ব্যস্ত-পায়ে চোখের পলকে আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেছেন।

    প্রায় এক মাস আর পুলিশের বড় অফিসার মি. জি-র সঙ্গে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হলো না। তারপর হঠাৎ একদিন তিনি আবার ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন।

    আমি একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে তাকে বসতে বললাম।

    চেয়ারটায় আয়েশ করে বসে তিনি একটা চুরুট দুঠোঁটের ফাঁকে আটকে তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন। তারপর একগাল ধোয়া ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে কিছু প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু করলেন।

    আমিই শেষপর্যন্ত কথাটা পাড়লাম–‘মি. জি–সেই চিঠি-চুরির ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত কী হল, বলুন তো? দীর্ঘদিন ধরে তল্লাসি চালিয়ে কোনো ফায়দা হচ্ছে না দেখে কী আপনি মন্ত্রীকে নিয়ে টানা হেঁচড়া করার চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন?

    ‘এরকমটা মনে করতে পারে বটে। তবে মি. দুঁপে-র পরামর্শ অনুযায়ী তল্লাসিটা চালাতে ত্রুটি করিনি। তবে সব চেষ্টাই বিফলে গেছে। অবশ্য আমি জানতাম কোনো ফায়দাই তাতে হবে না।’

    দুঁপে বলল–‘আপনি যেন সেদিন পুরস্কারের অর্থমূল্য কত বলেছিলেন?

    ‘আরে পুরস্কারটা বেশ বড় অঙ্কেরই ছিল। তবে সঠিক পরিমাণটা আমি বলতে রাজি নই। কিন্তু এটুকু অন্তত বলতে পারি কেউ যদি ওই চিঠিটা আমার হাতে তুলে দেয় তবে তার বিনিময়ে আমি তাকে হাসিমুখে পঞ্চাশ হাজার যঁ-র চেক দিয়ে দেব।

    আমি বললাম ‘পঞ্চাশ হাজার ফ্রা!

    ‘হ্যাঁ, পঞ্চাশ হাজারই দিতে রাজি। একটা কথা কি জানেন, দিন যতই যাচ্ছে ওই চিঠিটার গুরুত্ব ততই বেড়ে যাচ্ছে। আর সে সঙ্গে পুরস্কারের মূল্য লাগিয়ে বাড়তে বাড়তে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে।

    ‘দ্বিগুণ!

    ‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। তবে এও সত্য যে, তিনগুণ হয়ে গেলেও আমি যা-কিছু করতে পেরেছি তার বেশি এক তিলও করতে পারতাম না, এতে কোনোই সন্দেহ নেই।

    ‘অবশ্যই–তা তো অবশ্যই। দুঁপে চুরুটে ধোয়া ছেড়ে কথাটা বলে উঠল ‘তবে আমার কি বিশ্বাস, জানেন মি. জি?

    ‘কী? কোন কথা বলতে চাইছেন?’

    ‘আমি কিন্তু বলব, ব্যাপারটা নিয়ে সম্পূর্ণরূপে সক্রিয় হননি।

    পুলিশের বড় অফিসার চোখের তারায় জিজ্ঞাসার ছাপ এঁকে দুঁপে-র মুখের দিকে তাকালেন।

    দুঁপে পুর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলতে লাগল আমার বিশ্বাস আপনি আরও সচেষ্ট হলে অনেক কিছুই করতে সক্ষম হতেন।

    কপালের চামড়ার ভাঁজ এঁকে এবার পুলিশের বড় অফিসার বললেন–সে কি, আরও অনেক কিছু করতে পারতাম, আপনি বলছেন! কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হত অনুগ্রহ করে বলবেন কি?

    ‘আপনি তো সোর্স বা গোয়েন্দা কি নিয়োগ করতে পারতেন না? আচ্ছা, এবারে নেটির গল্পটা আপনার মনে নেই?

    ‘আরে ধৎ’! না, ওসব গল্পটল্প আমার মনে নেই। এবার নেটির গল্পে কথা ছাড়ান দিয়ে কাজের কথা কিছু থাকলে বলুন।

    ‘হ্যাঁ, সে-তো অবশ্যই। তাকে ফাঁসির দড়িতে লটকে দিন। কিন্তু একবার এক ধনী কৃপন লোক এবার নেটির কাছে গিয়ে ডাক্তারি পরামর্শের জন্য তাকে জোর তোয়াজ শুরু করে দিয়েছিল। ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে তার বাড়ি গিয়ে হরেকরকম কথাবার্তার ফাঁকে এক সময় নিজের ব্যামোর কথাটাকে এক কাল্পনিক লোকের ব্যামো বলে বর্ণনা করে ফেলেছিল।

    ‘হুম!

    ‘কৃপণ ধনী লোকটা কাল্পনিক রোগীর রোগ-যন্ত্রণার কথা বলতে গিয়ে যে এবার নেটিকে বলেছিল, মনে করুন, তার শরীরে এই লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনি তাকে কোন ওষুধ ও পথ্যের ব্যবস্থা দেবেন বলুন তো?’

    এবার নেটি চোখ দুটো কপালে তুলে বললেন–ওষুধের কথা জানতে চাইছেন কী ভাই,!

    ‘কেন? ব্যামো হয়েছে, ওষুধ দেবেন না?

    ‘আরে ভাই,, আগে ডাক্তারের পরামর্শ তো নেবেন। তারপর তো ওষুধের বিবেচনা করা হবে।’

    গল্পটা শুনে পুলিশের বড় অফিসার জিহকচকিয়ে উঠে বললেন–‘কিন্তু আমার কথা তো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমি তো পরামর্শ নিতে এবং বিনিময়ে মূল্য দিতেও এক পায়ে খাড়া, যে বা যারা আমাকে উপযুক্ত সাহায্য করবেন, তাকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রা হাসিমুখে দিতে রাজি আছি।’

    তার মুখের কথাটা শেষ হতে না হতেই দুঁপে ব্যস্ত হাতে ড্রয়ারটা খুলে একটা চেকবই বের করল। সেটা পুলিশের বড় অফিসারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল–‘বহুৎ আচ্ছা! তবে ওই পরিমাণ ফ্রা-র একটা চেক আমার নামে লিখে দিন।

    তার কাণ্ডকারখানা দেখে আমি যেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে কোনো রা সরল না। কেবল নীরব চাহনি মেলে ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

    দুঁপে এবার যা বলল সেটা অনেক বেশি বিস্ময়কর। সে স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল– চেকটা লিখে দিন। লেখা শেষ করে এটা আমার হাতে তুলে দেওয়ামাত্র আমি আপনার বাঞ্ছিত চিঠিটা আপনার হাতে তুলে দেব, কথা দিচ্ছি।

    আমি চোখ দুটো কপালে তুলে সবিস্ময়ে বলে উঠলাম–‘তুমি দুঁপে!’

    ‘তুমি এ কী অদ্ভুত কথা শোনাচ্ছ!’

    ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছি।’ সে এবার আরও দৃঢ়স্বরে কথাটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল।

    তার কথায় আমি যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। আর পুলিশের বড় অফিসার জি, তো রীতিমত ভিমরী খাবার যোগাড় হলেন।

    সত্যি কথা বলতে কি, কথাটা শুনেই তার বাকশক্তি যেন রোহিত হয়ে গেল। চোখের তারায় অবিশ্বাসের ছাপ এঁকে তিনি আমার বন্ধুবর দুঁপে-র দিকেনিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার হাবভাব দেখে মনে হল, তার চোখের মণি দুটো বুঝি কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

    কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তিনি নিজেকে একটু সামলে সুমলে নিয়ে কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দুঁপের কাছ থেকে চেকবই আর কলমটা নিলেন। তারপরও কিছু সময় নির্বাক নিস্পন্দভাবে কাটিয়ে চেকটা লিখলেন। সেটার গায়ে পঞ্চাশ হাজার ফ্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় লেখাঝোকা সেরে যথাস্থানে স্বাক্ষরও করলেন। তারপর চেকের পাতাটা ছিঁড়ে সেটাকে টেবিলের ওপর দিয়ে দুঁপের দিকে এগিয়ে দিলেন।

    দুঁপে স্বাভাবিকভাবেই তার হাত থেকে চেকটা নিল। মুখের সামনে ধরে মুহূর্তের জন্য সেটার গায়ে চোখ বুলিয়ে নিয়ে কোটের ভেতরের পকেটে চালান করে দিল। এবার ড্রয়ারটা খুলে বহু আকাঙ্ক্ষিত চিঠিটা বের করে নিঃশব্দে পুলিশের বড় অফিসারের হাতে তুলে দিল।

    চিঠিটা হাতে পাওয়ামাত্র তিনি নিতান্ত ব্যস্ততার সঙ্গে সেটার ভাজ খুলে দ্রুত চোখ বুলাতে লাগলেন। পর মুহূর্তেই কাঁপা-কাঁপা পায়ে অতি কষ্টে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর এক দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে, তারপর বাড়ি থেকেও বেরিয়ে গেলেন।

    আশ্চর্য ব্যাপার! বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে তিনি আমাদের সঙ্গে একটা কথাও বললেন না।

    তিনি চলে যাবার পর বন্ধুবর দুঁপে ব্যাপারটা আমার কাছে ব্যক্ত করল।

    তাদের বিচারে পুলিশের লোকরা খুবই কর্মঠ ও দক্ষ। তারা খুবই অধ্যবসায়ী। কায়দা কৌশলও ভালোই বোঝে। আর নিজেদের কর্তব্যের ব্যাপারেও তাদের সচেতনতার ঘাটতি নেই।

    তাই তো পুলিশের বড় অফিসার জি–যখন মন্ত্রী ডি-র হোটেলে তার তদন্তের বিবরণ আমাদের শোনালেন, তখনই আমি নিঃসন্দেহ হয়ে পড়লাম, তার তদন্ত নির্ঘাৎ আশানুরূপ হয়েছে। অবশ্য সে সঙ্গে এও বলছি, তার পরিশ্রমের ফলে সাফল্য যতটা হওয়া সম্ভব ঠিক ততটাই হয়েছে।

    আমি আগ্রহান্বিত হয়ে বললাম–‘ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। এর অর্থ কি বল তো?’

    ‘তারা যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল, সেগুলো কেবলমাত্র যে সঠিক ছিল তা-ই নয়, সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনও করেছিল। তাই মনে করা যেতে পারে, চিঠিটা যদি তাদের হাতের মুঠোর মধ্যে থাকত তবে সেটা তারা অবশ্যই পেয়ে যেত। এমন একটা কথা তো বাচ্চা ছেলেও-‘

    ‘হুম অস্পষ্ট একটা উচ্চারণ করা ছাড়া আমার মুখ দিয়ে আর কোনো কথাই বেরোল না। ফলে তার কথাটা শুনে আমি কেবলমাত্র ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে ছোট্ট করে হাসলাম। তবে এও সত্যি, তার কথাগুলো খুবই গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ ছিল।

    বন্ধুবর দুঁপে আবার মুখ খুলল–‘দেখুন, তারা যে পদ্ধতিটা অবলম্বন করেছিল আর সেটাকে রূপদান করার জন্য তারা যে পথ ধরেছিল–উভয়ই ভালো। কিন্তু একটা ব্যাপারে তাদের মারাত্মক একটা ত্রুটি ছিল আর লোকটা সম্পর্কে তার অপপ্রয়োগে পুলিশের বড় অফিসার এবং তার সহকারীরা যে প্রায়ই আহাম্মক বনে যায় এর মুখ্য কারণ-ই হচ্ছে যাকে নিয়ে সমস্যা তার বুদ্ধি ও ক্ষমতার কোনো খোঁজই তারা রাখে না। কাজে নামার পর তারা কেবল মাত্র নিজেদের বুদ্ধিসত্তার ও কৌশলটাকেই বড় করে দেখে।

    আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে কথাগুলো শুনতে লাগলাম। দুপে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখল–আরও আছে, তারা কোনো গোপন জিনিস ও গোপন তথ্য খুঁজে বের করার সময় কেবলই তাকে, নিজেরা কোন কায়দায় কোন জিনিস লুকিয়ে রাখে।

    আমি মুচকি হেসে তার কথাটা সমর্থন করলাম।

    সে কিন্তু থামল না। তার বক্তব্যের জের টেনে এবার সে বলল–‘যে কথা বলছিলাম, অন্য পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো করে যে কোনো ব্যাপার নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে। কিন্তু কোনো অপরাধীর বুদ্ধিমত্তা বা মানবিক গঠন যদি তাদের বুদ্ধিমত্তা বা চরিত্র থেকে সতন্ত্র হয় তবে তারা তাদের কাছেই হার মেনে যায়। মন্ত্রী ডি-র ব্যাপারটাকে আমার বক্তব্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে মনে করা যেতে পারে।

    একটা ব্যাপার ভেবে দেখুন, পুলিশের বড় অফিসারের সহযোগিরা সবকিছুকে নাড়াচাড়া করেছেন, খোঁজাখুঁজি করেছেন, ছিদ্র করে করে দেখেছেন, অনুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কম করেননি। আবার বাড়ির বাইরের সম্পূর্ণ চত্বর তারা বর্গইঞ্চি হিসেবে মেপে মেপে পরীক্ষাও করেছেন, ঠিক কিনা?

    আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম–ঠিক। সবই ঠিক বলেছ।

    দুঁপে পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে এবার বলল–‘আসলে এসব ব্যাপার স্যাপার কি জানেন? আরে, পুলিশের বড় অফিসার বছরের পর বছর ধরে নিজের কর্ম-অভিজ্ঞতা সম্বল করে কিছু সংখ্যক ছক বাধা রুটিন মাফিক কাজ করতেই কেবল জানেন, আর এটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। ফলে কার্যত তিনি প্রথম থেকেই গোলক ধাঁধায় অন্ধের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন। ফায়দা কিছুই হয়নি। তার ব্যর্থতার মূল লুকিয়ে আছে তার ধারণার মধ্যে, তিনি প্রকৃতই একটা আহাম্মক, কারণ কবি হিসেবে তার নাম-যশ রয়েছে। তার মতে নির্বোধরাই কবি, আর দুনিয়ায় যত কবি রয়েছে সবাই নির্বোধ।

    ‘আচ্ছা, তিনি সত্যি একজন বড় কবি? আমি বললাম–‘আমি তো জানতাম তারা দুই ভাই। আর উভয়েই পণ্ডিত। আমার বিশ্বাস ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস’ নিয়ে মন্ত্রী ডি–বহু পড়াশুনা করেছেন। অতএব তিনি কবি নন, একজন গণিতজ্ঞ। তিনি আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই দুঁপে বলে উঠল–‘ভুল! তুমি যা জান সবই ভুল। আমি খুব ভালোই জানি–তিনি কবি ও গণিতজ্ঞ উভয়ই। কোনো কবি যদি গণিত বিষয়ে পণ্ডিত হন তবে তার বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনাশক্তি খুবই প্রখর হয়। তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু যদি কেবলমাত্র গণিতজ্ঞ হতেন তবে কিছুতেই তার বুদ্ধি এমন তীক্ষ্ণ হত না। আর তার পক্ষে পুলিশ বিভাগের এত উঁচু পদে, মানে বড় অফিসার হওয়া কিছুতেই সম্ভব হত না, হত কি?

    ‘ভায়া এমন কথা বলে আপনি কিন্তু আমাকে খুবই অবাক করলেন মি. দুঁপে। সত্যি বলছি, আপনার কথাগুলো পৃথিবীর সবাই যা বলে ঠিক তার বিপরীত। শত শত বছর ধরে প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে তো আপনি এক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন না। সবাই তো জানে, আর স্বীকারও করে যে, গাণিতিক বুদ্ধিই হচ্ছে আসল বুদ্ধি, আপনিও আশা করি মেনে নিচ্ছেন?

    ‘আরে ধৎ! ওসব তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এখন শিকেয় তুলে রাখুন। আমরা আলোচ্য বিষয় থেকে দুরে সরে না গিয়ে বরং সে প্রসঙ্গেই আলোচনায় লিপ্ত থাকি। আমার বক্তব্য হচ্ছে, মন্ত্রী ডি–যদি কেবলমাত্র একজন গণিতজ্ঞ হতেন তবে তাকে ওই চেকটা তুলে দিতে হত না। আমি নিসন্দেহ ছিলাম, তিনি কবি ও গণিতজ্ঞ দুই-ই। আর এ কথা মাথায় রেখেই আমি তার বিচার করেছি। তিনি যে একজন মন্ত্রী এবং সাহসি চক্রান্তকারী, আমি ভালোই জানতাম। আর এ কারণেই আমি আরও নিসন্দেহ ছিলাম, এরকম একজন ঘাঘু মানুষ কিছুতেই পুলিশের কাজকর্ম সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ থাকতে পারেন না। আর এরই জন্য তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে, পুলিশ তাকে যে কোনো সময় পথের মাঝে পাকড়াও করবে, বাস্তবেও তা-ই ঘটেছিল।

    শুধু কি এ-ই? তিনি তো জানতেনই যে, তার বাড়ি-ঘর গোপনে তল্লাসি করা হবেই হবে, কার্যক্ষেত্রে হয়েছেও তা-ই। তাই কোনো বস্তু লুকিয়ে রাখার সাধারণ ও সম্ভাব্য জায়গাগুলো যে তিনি মন থেকে মুছে ফেলে দেবেন এ-তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, তাই না?

    আমি ছোট্ট করে প্রায় অনুচ্চারিত স্বরে বলে উঠলাম–হুঁম্’!’

    সে আবার বলতে লাগল–‘আমি ধরেই নিয়েছিলাম, তার বিচার-বুদ্ধি এত ভোতা হতে পারে না যে, হোটেলের যে কোনো জটিল ও গোপন স্থানই পুলিশের বড় অফিসারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়বেই পড়বে। আর এ ব্যাপারে তিনি শতকরা একশো ভাগই নিসন্দেহ ছিলেন। তার ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি আরও অনুমান করি, মন্ত্রী মশাই যেভাবেই হোক, সোজাপথ ধরেই তিনি অগ্রসর হবেন। পুলিশের বড় অফিসারের বুদ্ধি খুবই ভেঁতা। তাই তার বুদ্ধিতেই কুলায়নি যে, মন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটাকে একেবারে সবার চোখের সামনে রেখে দিতে পারেন। কিন্তু সেটাকে সবার চোখের আড়ালে রাখাই উচিত পথ।

    আমার এবার প্রথম ও প্রধান কাজ হল, মন্ত্রী ডি-র অসীম সাহস, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং কর্মক্ষমতার কথা ভাবনা-চিন্তা করা। দীর্ঘসময় ধরে ভেবে আমি এ-সিদ্ধান্তেই পৌঁছলাম যে, গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটাকে তিনি সর্বদা হাতের নাগালের মধ্যেই রাখবেন। আমি যখন গভীর ভাবনায়, তলিয়ে গেলাম, পুলিশের বড় অফিসারের নিরবচ্ছিন্ন তল্লাসি এটাই প্রমাণ করেছিল, চিঠিটা এমন কোনো জায়গায় অবশ্যই নেই যেখান থেকে তার পক্ষে সেটাকে বের করা সম্ভব হবে। অতএব আমি আরও নিশ্চিত হলাম যে, মন্ত্রী ডি চিঠিটাকে কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি, আর করবেনও না।

    এরকম ভাবনা-চিন্তার ওপর নির্ভর করে আমি এক সকালে একেবারে হঠাৎই মন্ত্রী ডি-র হোটেলে চলে গেলাম।

    কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। মন্ত্রী ডি-ঘরেই রয়েছেন দেখলাম।

    আমি তার ঘরে ঢুকতেই তিনি এমন হাব ভাব দেখাতে লাগলেন যে, ক্লান্তি অবসাদে তার শরীর যেন আর চলছে না। আমাকে যেন তিনি এটাই বোঝাতে চাইছেন, বিশ্বের জীবিত মানুষগুলোর মধ্যে তার কর্মক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ব্যাপারটা মিথ্যা নয়। কিন্তু কখন তার কর্মক্ষমতা অসাধারণ থাকে? যতক্ষণ তিনি সবার নজরের বাইরে থাকেন ততক্ষণই।

    আমি স্বগতোক্তি করলাম–‘আমার কর্মক্ষমতাই কোন অংশে কম? আমার চোখে তখন একটা সবুজ চশমা। আমি স্লান হেসে চোখের রোগ দেখা দেওয়ার জন্যই এ চশমাটা ব্যবহার করতে হয়েছে, মন্ত্রী ডি’র কাছে নানাভাবে দুঃখ প্রকাশ করলাম।

    মন্ত্রী ডি-র সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে আমি সবুজ চশমার আড়াল থেকে তার ঘরটায় অনুসন্ধিৎসু চোখের মণি দুটোকে বুলাতে লাগলাম। আমার একমাত্র লক্ষ্য, গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটা কোথায় পাওয়া যেতে পারে।

    আমি অনুসন্ধানের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলাম অদূরবর্তী বড় লোহার টেবিলটাকে। দেখলাম তার ওপরে কিছু চিঠি আর কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আর কয়েকটা বই ও দু-একটা বাদ্যযন্ত্রও রাখা আছে। দূর থেকে খোঁজা খুঁজি করে সন্দেহ করার মতো কিছুই আমার চোখে পড়ল না।

    এবার টেবিলটা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে ঘরের সর্বত্র চোখ বুলাতে বুলাতে এক সময় একটা তাস রাখার তাকের ওপর আমার দৃষ্টি স্থির হল। সেটাকে ময়লা এক টুকরো নীল ফিতের সাহায্যে ম্যান্টেল-পিসের মধ্যবর্তী একটা পিতলের বোতামের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেটার তিন-চারটি খেপে পাঁচ-ছয়টি ভিজিটিং কার্ড আর একটামাত্র চিঠির দিকে আমার নজর গেল। অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে লক্ষ্য করলাম, চিঠিটা দোমড়ানো-মোচড়ানো আর খুবই ময়লা। আর ছিঁড়ে কয়েকটা টুকরো করে ফেলা হয়েছে। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, সেটাকে নষ্ট করে ফেলার জন্যই ইচ্ছে করে বুঝি ছেঁড়া আরম্ভ করা হয়েছিল। হঠাৎ সে ইচ্ছার পরিবর্তন ঘটে, ছেঁড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

    আমি মন্ত্রী ডি-র সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে প্রায় সর্বক্ষণই সবুজ চশমাটার আড়াল থেকে ওই চিঠিটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে লাগলাম। এবার চিঠিটার ওপরের ‘ডি’ অক্ষরাট আমার দৃষ্টিতে পড়ে গেল। ডি-র নামে মেয়েলি হাতে ঠিকানাটা লেখা হয়েছে। তা-ও আমি সহজেই বুঝতে পারলাম।

    ‘ডি’ অর্থাৎ স্বয়ং মন্ত্রীর নামেই যে চিঠিটা লেখা হয়েছে, এ বিষয়ে আমার আর তিলমাত্র সন্দেহও রইল না।

    এবার আমি আবিষ্কার করলাম, যেন চিঠিটাকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ জ্ঞান করে, নিতান্ত অবহেলায় চিঠিটাকে ওই খোপটায় ছুঁড়ে রেখে দেওয়া হয়েছে।

    আমি চিঠিটাকে প্রথম দর্শনেই বুঝতে পারলাম, এ-অমূল্য সম্পদের খোঁজেই তো এখানে হানা দিয়েছি। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিসন্দেহ যে, চিঠিটা পুলিশের বড় অফিসার আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন, এটা সেটা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এর গায়ের মোহরটা অধিকতর বড় আর কালো, আর তার গায়ে ‘ইউ’ অক্ষরটা লেখা, তাতে মোহরটা ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট এবং লাল। তার গায়ে এস-পরিবারের হাতে লেখা। এখানে মেয়েলি হাতের লেখা ছোট ছোট হরফে, লেখা হয়েছে মন্ত্রী ডি-কে; আর যেখানে স্পষ্ট হরফে রাজপুরুষকে লেখা হয়েছে। একমাত্র আকারের দিক থেকে উভয় চিঠির মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেছে।

    সাদৃশ্যের তুলনায় বৈসাদৃশ্যগুলো খুবই বেশি প্রত্যক্ষ; ছেঁড়া, ময়লা অবস্থাটা মন্ত্রী ডি-র গোছগাছ ছিমছাম স্বভাবের খুবই বিরোধী আর চিঠিটা যে একেবারেই মূল্যহীন সেটা সবার কাছে প্রমাণ করার জন্য তিনি এরকম চেষ্টায় উৎসাহি হয়েছেন। আর চিঠিটাকে এমন খোলামেলা ও হাতের নাগালের মধ্যে এমন একটা জায়গায় রাখা হয়েছে যাতে কেউ ঘরে ঢুকেই সেটাকে দেখতে পাবে–যা আমার পূর্ব সিদ্ধান্তের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেছে। আমি এবার মনকে শক্ত করে বাঁধলাম।

    এখানে আমার আগে। প্রথমের দিকে আমার মনে যে সন্দেহ ছিল এখন তা আরও অনেকগুণ বেড়ে গেল।

    মন্ত্রী ডি-র ঘরে আমি নানা অজুহাতে যত বেশি সময় সম্ভব কাটাতে লাগলাম। আর একমাত্র চিঠিটার দিকে নজর রাখাই আমার একমাত্র লক্ষ্য।

    এবার আমি মন্ত্রী ডি-র সঙ্গে তারই প্রিয় একটা বিষয় নিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা শুরু করলাম। আর আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে আমি চশমার সবুজ কাঁচের ভেতর দিয়ে চিঠিটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম।

    শেষমেশ এমন একটা বস্তুর দিকে আমার নজরে পড়ল, যাতে আমার মনে যেটুকু সন্দেহ ছিল তা-ও নিঃশেষে উবে গেল। ব্যাপারটা হচ্ছে, লক্ষ্য করলাম, চিঠিটার ধারগুলো ঘষায় ঘষায় এবড়ো খেবড়ো হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এমন যে, মোটা একটা কাগজকে একবার ভাঁজ করে আবার সেটাকেই বিপরীত দিকে ভাঁজ করলে কোণগুলো যেমন অমসৃণ হয়ে যায় এটাও ঠিক সেরকমই হয়ে গেছে।

    ব্যাপারটা নিয়ে আরও কয়েক মুহূর্ত ভাবনা-চিন্তা করার পর আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, চিঠিটাকে পুরোপুরি উলটে দিয়ে নতুন করে ঠিকানাটা লেখা হয়েছে এবং তার গায়ে মোহর আঁকা হয়েছে।

    আমি ইচ্ছে করেই আমার সোনার নস্যির কৌটাটা টেবিলের ওপর ফেলে রেখে মন্ত্রী ডি-র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামলাম।

    নস্যির কৌটাটা তখন অবশ্যই মন্ত্রী মশাইয়ের চোখে পড়েনি। তা যদি পড়তই তবে তিনি সে ব্যাপারে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ যে করতেন, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।

    পরদিন সকালে নস্যির কৌটাটা আনার জন্য আবার মন্ত্রী ডি-র বাড়ি হাজির হলাম।

    ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসেই আমি অত্যুত্র আগ্রহের সঙ্গে গতদিনের প্রসঙ্গটা পাড়লাম।

    আমাদের আলোচনা কিছুটা এগোতে এগোতেই হোটেলের জানালার ঠিকনিচ থেকে আচমকা একটা শব্দ, ঠিক যেন পিস্তলের আওয়াজের মতো তীব্র আওয়াজ আমার কানে এলো। পর মুহূর্তেই একই দিক থেকে ভয়ার্ত মানুষের আর্তস্বর ভেসে এলো। আতঙ্কিত বহু মানুষের চিত্তার চ্যাঁচামেচি–ঠিক যেমনটা শোনায়–অবিকল সেরকমই আওয়াজ শুনতে পেলাম।

    মন্ত্রী ডি কিছু সময় উকর্ণ হয়ে আওয়াজটা শুনে তড়াক করে লাফিয়ে জানালার কাছে গিয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।

    ব্যস, আমিও মওকা পেয়ে গেলাম। যন্ত্রচালিতের মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে দ্রুত তাসের তাকটার কাছে চলে গেলাম। ব্যস্ত-হাতে বাঞ্ছিত চিঠিটা কোটের পকেটে চালান। করে দিয়ে অবিকল একই রকম একটা চিঠি যে জায়গায়টায় রেখে দিলাম। পর মুহূর্তেই আবার নিজের চেয়ারে ফিরে এলাম। একটা ভাঁজ-করা কাগজের গাটে ‘ডি’ অক্ষরটা নকল করে বাড়ি থেকেই কাজ সেরে কোটের পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। এবার বাঞ্ছিত কাজটা পুরোপুরি মেটাতে পেরে ভেতরে ভেতরে যারপরনাই খুশিই হলাম।

    সদর রাস্তায় এক আধ-পাগলা বন্দুকধারীর খেয়ালের জন্যই এমন একটা গণ্ডগোল বেঁধে গেল। সে লোকটা একদল নারী-পুরুষকে তাক করে বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়েছিল। পরে পরীক্ষা করে দেখা গেল, তার বন্দুকে একটাও গুলি ছিল না। তাই লোকটাকে হয় মাতাল, না হয় পাগল এরকমই কিছু একটা ভেবে সেখান থেকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হল।

    মন্ত্রী ডি-এবার জানালা থেকে ফিরে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন।

    আমি আরও দু-চারটি মামুলি কথাবার্তা বলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামলাম।

    আসলে পাগলের ভান করে হঠাৎ গুলি ছোঁড়ার জন্য আমি কিছু টাকা দিয়ে নিয়োগ করেছিলাম।

    এ পর্যন্ত বলে বন্ধুবর দুঁপে থামলে আমি বললাম–সবই তো বুঝতে পারলাম। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই মাথায় আসছে না। নকল একটা চিঠি সেখানে রেখে দেবার কি এমন জরুরি ব্যাপার ছিল? গোড়াতেই সবার চোখের সামনে চিঠিটা নিয়ে এলেই তো ল্যাটা চুকে যেত, আর সমস্যাই বা এমনকি ছিল?

    ‘ছিল। সমস্যা অবশ্যই ছিল। মন্ত্রী ডি-বড়ই দুঃসাহসি পুরুষ। আর তিনি গায়ে শক্তিও ধরেন যথেষ্টই, আরও একটা কারণ অবশ্যই ছিল।

    ‘কারণ? আরও একটা কারণ? কিন্তু কী সে কারণ, জানতে পারি কি?

    ‘কারণটা হচ্ছে, হোটেলে তার পক্ষের লোকের সংখ্যাও নেহাৎ কম ছিল না। তুমি যা বলছ, আমি ঠিক সে পথ গ্রহণ করলে আমাকে আর ধড়ে প্রাণ নিয়ে ফিরতে হত । আর এরই ফলে প্যারিসের অধিবাসীরা হয়তো আর আমার নামটাও শুনতে পেত । তবে এছাড়া অন্য আর একটা উদ্দেশ্য আমার ছিল।

    ‘উদ্দেশ্য? অন্য আর একটা উদ্দেশ্য!’

    ‘হ্যাঁ। আমার রাজনৈতিক কার্যকলাপের কথা তো আর তোমার অজানা নয়। রাজনৈতিক কার্যকলাপের দিক থেকে আমি ওই মহিলাটির দলেরই একজন।

    মন্ত্রী ডি-গত আঠারো মাস যাবৎ ওই মহিলাটাকে নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। এবার পরিস্থিতির পুরো পরিবর্তন ঘটে গেছে। মওকা বুঝে ওই মহিলাই মন্ত্রী মশাইকে পুরোপুরি বাগে এনে হাতের মুঠোয় করে নিয়েছেন। কারণ, ওই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটা যে আদৌ তাঁর হাতে নেই, এ-কথাটা তিনি জানতে না পারার জন্য তিনি তো এমন হাবভাবই দেখাবেন যেন চিঠিটা তার দখলে, হাতের মুঠোয়ই রয়েছে। আর এরই জন্য, এ পথেই তিনি নিজেই নিজের রাজনৈতিক সর্বনাশ, নিজের পতনকে অনিবার্য করে তুলবেন।

    তবে এও সত্য যে, তার এ সর্বনাশ-পতন আকস্মিক তো হবেই, কিন্তু তার চেয়ে বিসদৃশ হবে অনেক, অনেক বেশি।

    এবার কাতালীন সঙ্গীতের ব্যাপারটা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। এ সম্পর্কে যা-কিছু মন্তব্য করেছেন, যে কোনো আরোহণের ব্যাপারেই তা প্রযোজ্য সম্পূর্ণ সত্যি। ব্যাপারটা এ রকম যে, যত সহজে ও শীঘ্র ওপরে ওঠা যেতে পারে তত সহজে কিন্তু নামা সম্ভব হয় না। অন্তত এক্ষেত্রে যিনি নামবেন, মানে পতনের মুখে এগিয়ে যাবেন, তার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা নেই, করুণার তো প্রশ্নই ওঠে না।

    কেন? আর যা-ই হোক লোকটা তো বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞানহীন এক ব্যক্তি। স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই, আসল চিঠিটা কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে ওই তাসের তাকের ওপর যে চিঠিটা রেখে এসেছি, সেটা পড়ার পর তার চোখ-মুখের কী পরিবর্তন হবে তা দেখার জন্য আমি বড়ই আগ্রহী। আর এর জন্য মানসিক অস্থিরতাও কম অনুভব করছি না।

    আমি বন্ধুবর দুপেঁ-র দিকে সামান্য ঝুঁকে অত্যুগ্র আগ্রহ প্রকাশ করে বলে উঠলাম–‘আগ্রহী? আগ্রহী কেন? সে চিঠিটায় তুমি এমনকি লিখেছ, যার জন্য তোমার মধ্যে।

    আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই দুঁপে এবার বলল–‘বন্ধু, একটা কথা তো অবশ্যই স্বীকার করবে, যে চিঠিটা আমি ওই তাসের তাকের ওপর রেখে এসেছি তার পরিবর্তে সেখানে কিছু না লেখা, মানে সাদা একটা কাগজ রেখে আসাটা কী উচিত হত? আমি মনে করি তাতে তাকে অপমান করার সমানই হয়ে দাঁড়াত।

    মুহূর্তের জন্য থেমে বন্ধুবর দুঁপে এবার বলল–একটা কথা, কিছুদিন আগে ডি ভিয়েনায় আমার একটা ক্ষতি করেছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি তখনই তাকে রসিকতার ছলে সতর্ক করে দিয়েছিলাম–দেখুন, এ ব্যাপারটা আমার স্মরণ থাকবে। সে জন্যই যে, যেহেতু আমার ভালোই জানা ছিল যে, কৌশল আর বুদ্ধির খেলায় তাকে এভাবে হারিয়ে দিয়ে নাকানিচোবানি খাইয়েছে, তা জানার আন্তরিক আগ্রহ তাঁর মধ্যে জাগবেই জাগবে। আর এ কারণেই মনস্থ করে ফেললাম, সেটা বুঝতে পারার মতো কোনো সূত্র না দিলে তো সেটা খুবই মর্মান্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আর এও আমি ভালোই জানি আমার হাতের লেখার সঙ্গে তার যথেষ্ট পরিচয় আছে। অর্থাৎ দেখামাত্রই বুঝতে পারবেন, কাজটা কার দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। এরকম বিবেচনা করেই ওই কাগজটাতে এ কথাটা লিখে দিয়েছিলাম যা ক্লেবিনের ‘আত্রি’ তে পাওয়া যাবে। ‘….Undessein is friends be Sil n’est digue d’ atvee, est diague de Thieste.’

    কথাটা বলেই দুৰ্পে মুচকি হেসে বলে উঠল–‘কি বন্ধু, কী বুঝলে?

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোল্ডেন লায়ন – উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান
    Next Article লাভ ক্যান্ডি – জাফর বিপি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }