Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাডগার অ্যালান পো রচনাসমগ্র / অনুবাদ : জাকির শামীম

    জাকির শামীম এক পাতা গল্প1512 Mins Read0

    নেভার বেট দ্য ডেভিল ইয়োর হেড

    নেভার বেট দ্য ডেভিল ইয়োর হেড

    বিশ্বাস করুন, আমার মৃত অভিন্ন হৃদয় বন্ধু টবি ড্যামিট সম্বন্ধে কুৎসা প্রচার করতে আমি কলম ধরিনি।

    সত্যি বলছি, টবি ছিল এক অদৃষ্ট বিড়ম্বিত কুকুর। আর কুকুরের মতোই তার মৃত্যুও হয়েছে।

    তবে খুবই সত্য যে, তার অপকর্মের জন্য কেবলমাত্র তাকেই দায়ী করা চলে না, তার গর্ভধারিণী মায়েরও বহু দোষ-ত্রুটি ছিল।

    শৈশব থেকে টবির মা তাকে যখন তখন বেধড়ক মেরেছে। আর কারণে অকারণে অতিরিক্ত গালিগালাজ ও মারার জন্যই সে দিন দিন ক্রমেই খারাপ হতে হতেই জঘন্যতম পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। শেষপর্যন্ত একেবারে চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে।

    টবি বাল্য ও কৈশোরের দিনগুলো কাটিয়ে আজ রীতিমত এক জোয়ান মরদ–বড় হয়ে উঠেছে।

    তখন পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠল যে, কেবলমাত্র জুয়াড়িদের ব্যবহৃত বাছা বাছা শব্দগুলো ছাড়া অন্য কোনো শব্দ বা কথাই তার মুখে আসে না। সে যে সত্যি জুয়া খেলে বা জুয়ার আড্ডায় যাতায়াত করে এমন কথা ভাবাই যায় না। তবে সে যে কথায় কথায় বাজি ধরে, ব্যাপারটা কি, তাই না? এটা নিছকই তার একটা মুখের কথা। একেবারেই খেয়ালের বশে অর্থহীনভাবে কথাগুলো বলে। আর খামখেয়ালির বশীভূত হয়েই সে কথায় কথায় বলে–‘আমি তোমার সঙ্গে এটা-ওটা বাজি ধরতে রাজি আছি।’ তার এসব কথা কেউ তখন গায়েই মাখে না। আসলে তার বাজি ধরার ব্যাপারটা যে নিছকই একটা কথার কথা তা-তো কারোই অজানা নয়। অতএব কে আর কেনই বা আমল দিতে যাবে, বলুন?

    তা সত্ত্বেও আমি তাকে কথায় কথায় এমন বাজি ধরার ব্যাপারটা থেকে বিরত করতে তৎপর হতাম। আর এ বাজিটাকে আমি কর্তব্য বলেই ধরে নিলাম।

    আমি তাকে ডেকে বললাম–শোন হে, বাজি ধরার কথাটা, মানে এ অভ্যাসটা নীতিগতভাবে মোটেই সঙ্গত নয়। এমন কথা মুখে উচ্চারণ করা মোটেই উচিত নয়।

    আমার কথাগুলো শুনে সে –কুঁচকে আড়চোখে আমার দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকাল।

    আমার বক্তব্যটা আরও খোলসা করে বলে আমি তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম– ‘শোন হে, এমন কথা সমাজের অভদ্র মানুষদের বদ অভ্যাস ছাড়া কিছু নয়। এতএব এখন থেকেই কাউকে এমন কথা ভুলেও যেন বোলো না।

    কথাটা বলতে বলতে তার মুখের দিকে তাকালাম। সে আগের মতোই বিশেষ ভঙ্গিতে আমার দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল। তার চোখে মুখে তাচ্ছিল্যের ছাপ সুস্পষ্ট।

    আমি তবুও কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত হলাম না। আবারও বললাম–এমন কথাবার্তা যে বলে সমাজের কেউই তাকে সুনজরে দেখে না, মনে রেখো।

    সে আমাকে পাত্তাই দিল না।

    আমি তাকে বকাঝকাও কম করলাম না।

    কাজের কাজ কিছুই হলো না। আমার কথার কোনো দামই সে দিল না।

    নিষ্ফল প্রয়াস।

    আমি কড়াস্বরে প্রতিবাদ জানালাম। তা-ও পুরোপুরি বৃথাই গেল।

    এবার অন্য পথ ধরলাম। আর বকাবকি না করে সাধ্যমত গলা নামিয়ে । সহানুভূতির স্বরে তার কাছে বহুভাবে অনুরোধ রাখলাম।

    সে আগের মতোই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসল।

    ভাবলাম মহাসমস্যায় পড়া গেল তো! এবার আগের মতোই মোলায়েম স্বরে প্রসঙ্গটা সম্বন্ধে কিছু উপদেশ দিলাম।

    সে কপালে বিরক্তির ছাপ এঁকে আমার দিকে তাকাল। আমাকে বিদ্রূপ করল।

    এবার আমি মরিয়া না হয়ে পারলাম না। কর্কশ স্বরে বহুভাবে তাকে ভয় দেখালাম। ফল হলো হিতে বিপরীত। সে ভয় তো পেলই না, উপরন্তু প্রতিজ্ঞা করল। অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার কিছুই করার রইল না।

    আমি চোখের তারায় হতাশার ছাপ এঁকে তার দিকে তাকিয়ে থেকে হাল ছেড়ে দিতে পারলাম না। এবার শেষ অস্ত্রটা ছেড়ে দেবার জন্য নিজের মনকে শক্ত করে বাঁধলাম। বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে তাকে আচমকা এক লাথি মেরে বসলাম।

    সে গুলি খাওয়া বাঘের মতো গর্জন করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। পুলিশ ডেকে আনল।

    আমি রাগে বেসামাল হয়ে তার নাক ধরে টানাটানি করলাম। সে বার কয়েক সশব্দে নাক ঝাড়ল। উপায়ান্তর না দেখে সে শেষপর্যন্ত বলেই ফেলল, এরকম কাজ সে যদি ভবিষ্যতে কোনোদিন করে তবে সে নিজের মাথাটাই শয়তানের কাছে বাজি রাখবে।

    হায়! আমার এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পরিণাম শেষপর্যন্ত এই দাঁড়াল।

    টবির জীবনের দারিদ্র ছিল অন্য আর এক পাপ। হ্যাঁ, অবশ্যই পাপ। সে খুবই বেশি রকম গরিব ছিল। আর অর্থাভাবের জন্যই সে যে কথায় কথায় বাজি ধরার কথা বলত তা কোনোদিন অর্থনৈতিক রূপ লাভ, মানে বাস্তবায়িত হত না। তা নিছক মুখের কথাই রয়ে যেত।

    ‘আমি তোমার সঙ্গে এক পাউন্ড বাজি ধরছি’–এরকম কথা তার মুখ দিয়ে খুব কমই বের হত? তবে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই সে বলত–তোমার যা-যা খুশি তাই বাজি ধরছি, কোনো সমস্যা নেই। তা না হলে তুমি সাহস করে যা-খুশি বাজি ধর, তাতেই আমি রাজি, বল কী বাজি ধরব? ঠিক আছে, আমার মাথাটাকেই শয়তানের কাছে বাজি রাখছি, খুশি তো?

    সব শেষের বাজি ধরার কথাটা উচ্চারণ করতেই টবি বেশি আনন্দ পেত। কেন? এ বাজিটাতে কোনোরকম টাকাকড়ির ঝুঁকি, মানে আর্থিক লেনদেনের ব্যাপার স্যাপার থাকার জন্যই হয়তো এ ব্যাপারটায় সে আনন্দ পেত।

    আর একটা কথা বলে রাখা দরকার, টবি খুব কৃপণও হয়ে উঠেছিল। এমনও হতে পারে, এ পর্যন্ত যা-কিছু বললাম, সবই আমার মনের ভাবনা-চিন্তার ব্যাপার। আর এও হতে পারে বন্ধুর ওপর এমন সব দোষ চাপিয়ে দেওয়াও মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। তা সত্ত্বেও তার মাথায় ব্যাংক-নোটের মতো বাজিরার চিন্তা-ভাবনা যে একেবারেই অসঙ্গত, এ-ব্যাপারটাই আমি বহুভাবে চেষ্টা চরিত্র করেও বন্ধুবরের মাথায় কিছুতেই ঢোকাতে পারলাম না।

    আমার প্যানপ্যানানিতে শেষপর্যন্ত সে অন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে শয়তানের কাছে আমার মাথাটাকেই বাজি ধরব–এ বক্তব্যটাকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করল, একান্ত সম্বল হিসেবে ধরে রাখল। তার এরকম দৃঢ় মনোভাব লক্ষ্য করে আমার বিস্ময় ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হয়ে পড়তে লাগল। এতে আমি মর্মাহতও কম হলাম না। বহু দুঃখে তার এরকম অভাবনীয় মনোভাব আমাকে একটা কথাই ভাবতে ও বলতে বাধ্য করল–‘অদ্ভুত! অদ্ভুত!’

    মি. কোলরিজ হয়তো আমার বন্ধুবরের এরকম অত্যাশ্চর্য মনোভাবকে রহস্যময় বলেই আখ্যা দিতেন।

    আর মি. কান্ট হয়তো বা আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলতেন–একে একমাত্র সর্বেশ্বরবাদ ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না।

    আর মি. ইমারসন? তিনি হয়তো রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গেই বলে উঠলেন–খুবই বড় রকমের একটা ধাঁধা।’

    আমি অন্তর থেকেই বলছি–ব্যাপারটা আমার কাছে কিছুমাত্রও ভালো লাগছে না। বরদাস্ত করা কিছুতেই সম্ভব হয়নি। এদিকে বন্ধুবর ধাঁধার মন ক্রমেই ভেঙে পড়তে আরম্ভ করল।

    আমি নিজের মনের সঙ্গে দীর্ঘ বোঝাপড়ার পর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করে হলেও বন্ধুবর টবিকে রক্ষা করব। অতএব আর অহেতুক কালবিলম্ব না করে সে কাজে পুরোপুরি মেতে গেলাম। ভাবলাম, ব্যাপারটা সম্বন্ধে তাকে আরও বোঝাতে হবে, প্রয়োজনে আমার যেটুকু শক্তি আছে নিঃশেষে নিঙড়ে তাকে বোঝাবার কাজে লিপ্ত হতে হবে। মোদ্দা কথা, তাকে পথে আনার জন্য যা-কিছু করা দরকার কোনো ত্রুটিই রাখলাম না।

    আমার বক্তব্য শেষ করতে না করতেই আমার বন্ধুবর টবি এমন সব আচরণে মেতে যেত যার অর্থ–মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারতাম না। কখনো কখনো সে এমন অভাবনীয় কাণ্ড করত যা আমাকে যারপরনাই অবাক করত। কপালের চামড়ায় পর পর কয়েকটা ভাঁজ এঁকে নীরব চাহনি মেলে আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত।

    কিন্তু সে আর কতক্ষণ? পরমুহূর্তেই ঘাড়টাকে একদিকে কাৎ করে, মাথাটাকে হেলে দুটোকে প্রায় কপালে তুলে চলত। তারপর ঝট করে হাত দুটোকে সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কাঁধ দুটোকে মৃদু মৃদু ঝাঁকুনি দিত। তারপর ডান চোখটাকে সামান্য ফাঁক করে মিটি মিটি তাকায়, একেবারেই বিশেষ এক ভঙ্গি। এও বেশিক্ষণ নয়। পরমুহূর্তেই বাঁ-চোখেও তার প্রতিক্রিয়া লক্ষিত হয়। এবার দুটো চোখকে একই সঙ্গে বন্ধ করে দেয়। সত্যি অদ্ভুত! একেবারেই অদ্ভুত তার আচরণ।

    সে বেশিক্ষণ চোখ দুটো বন্ধ করে রাখে না, মানে রাখতে পারে না। পর মুহূর্তেই সে দু-দুটো চোখই এক সঙ্গে মেলে ইয়া বড় বড় করে তাকায়। তার ইয়া বড় বড় গোল চোখ দুটোর দিকে আমার দৃষ্টি যেতেই আমি তার পরিণতির কথা ভেবে ভয়ে কুঁকড়ে যাই। আমিনিস্পলক চোখের মণি দুটোতে আতঙ্কের ছাপ এঁকে তাকিয়ে থাকি। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবার জোগাড় হয়। এতেও কিন্তু সে থেমে থাকল না। সে এবার বুড়ো আঙুলটাকে নাকের ডগায় স্থাপন করে বাকি সব আঙুলগুলোকে বিচিত্র এক ভঙ্গিতে অনবরত নাচাতে লাগল। সে বিশেষ ভঙ্গিটার যথাযথ ব্যাখ্যা করে কারো মধ্যে ধারণা সঞ্চার করা সম্ভব নয়। আঙুলগুলো নাচাতে নাচাতে এক সময় হাত দুটোকে আচমকা নামিয়ে নিয়ে এসে আরও অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভাজ করে বুকের ওপর রেখে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়।

    আমার বন্ধুবর টবির ভাষণের আসল কথাগুলো আমার স্মৃতির পাতায়। পাকাপাকিভাবে লেখা হয়ে গেছে। আজ, এতদিন পরও সে-সব কথা আমার মনে আছে।

    সে আমাকে বলে, আমি মুখ বন্ধ করলেই সে ধন্য হবে। আমার কোনো পরামর্শই সে শুনতে উৎসাহি নয়। উপদেশের নামে আমার ধমক-ধামককে সে ঘৃণা করে। আর এও স্পষ্ট ভাষায় আসবে, জা নিয়ে দেয়। নিজেকে সামলে সুমলে চলার মতো যথেষ্ট ধৈর্য রাখা হয়েছে। আমার কাছে কি সে আজও ছোট্ট টবি-ই রয়ে গেছে নাকি? আমি। কি তাকে নাবালক ভেবেই এমন সব হিতোপদেশ দিতে উৎসাহি হচ্ছি? সে বয়স সে অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছে।

    এরকম কথা বলতেও সে দ্বিধা করে না-আমি কি তার চরিত্র সম্বন্ধে কোনো রকম বিরূপ মন্তব্য করতে উৎসাহি? তার কুৎসা প্রচার বানিন্দা করার ইচ্ছা কি আমার আছে? আমি একজন বোকা হাঁদা নাকি? আমার সম্বন্ধে আবারও নতুন করে জানতে আগ্রহী, আমি যে ঘর ছেড়েছি তা কি আমার মা জানেন, নাকি চুপিসারে বেরিয়ে এসেছি। সে মুচকি হেসে মন্তব্য করত। আমার নীরবতাই ব্যাপারটা ফাস করে দিয়েছে। আমাকে ধরা পড়ে যেতে সাহায্য করেছে। এর জন্য সে শয়তানের কাছে। নিজের মাথাটা বাজি ধরতেও কুণ্ঠিত তো হয়ই, বরং মনে-প্রাণে সম্মত হয়।

    আশ্চর্য ব্যাপার। আমি কি জবাব দেব তা না শুনেই বন্ধুবর টবি লম্বা লম্বা পায়ে সেখান থেকে চলে গেল। চলে গেল না বলে বরং পালিয়ে গেল বললেই ঠিক বলা হবে। তবে এও ঠিক করেছে যে, সে পালিয়ে যাওয়ায় কার্যত ভালোই করেছে। নইলে সে যদি আমার হাতের নাগালের মধ্যে থাকত তবে হয়তো বা বিশ্রি একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে বসতাম। কারণ, আমার রাগ যেমন তুঙ্গে উঠেছিল তাতে হয়তো বা তা আচ্ছা করে উত্তম মধ্যমই দিয়ে দিতাম।

    আল্লাহ সবার শাস্তি বিধান করুন। অসতর্কতাবশত তুমি আচমকা মুসলমান সম্প্রদায়ের কারো পা মাড়িয়া দিলে সে কথাটা বলেই নিজেই আক্ষেপ প্রকাশ করে। আর আমি যা-কিছু করছি, কেন? আমি বলব, সবই অবশ্যই কর্তব্যের তাগিদেই করছি। বন্ধুবর টবির প্রতি আমার কর্তব্য, তাই তো মানুষের মতোই এ অপমান জ্বালাও মুখ বুজে সহ্য করে না নিয়ে পারলাম না।

    এবার থেকে টবিকে উপদেশ দেবার ব্যাপারটা অনেকাংশে কমিয়ে দিলাম বটে, কিন্তু তার সংস্রব থেকে দূরে সরে থাকা সম্ভব হলো না। আমি আগের মতোই তার সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবেই মেলামেশা করতে লাগলাম।

    টবির আচার আচরণ, চলাফেরা আর কথাবার্তা শুনে আমি মর্মাহত হলেও, চোখের কোণে পানি ভিড় করে এলেও অম্লান মুখে, যাকে বলে রীতিমত হাসিমুখেই তার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা আগের মতোই চালিয়ে যেতে লাগলাম। আমার ব্যবহারে নতুনত্ব কিছু লক্ষিত হত না। আমরা দুজন একদিন বেড়াতে বের হলাম। পাশাপাশি, পরস্পরের হাত ধরাধরি করে আমরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে এগিয়ে চলেছি। সামনে, কিছুদূর এগোলে সে পথে একটা লম্বা সেতু পড়ল। সাঁকোটা পার হয়ে যেতে হবে। পথিকদের রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য সেতুটার মাথার ওপর ছাউনি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর জন্য ভেতরটায় আবছা অন্ধকার বিরাজ করছে। গাঢ় অন্ধকার না হলেও মোটামুটি অন্ধকারই বলা চলে। ওটার ওপর দিয়ে যাতায়াত করা কষ্টসাধ্য ব্যাপারই বটে। সূর্যের অত্যুজ্জ্বল আলো থেকে হঠাৎ অন্ধকারে ঢুকতে গিয়েই আমার মেজাজটা তিড়িক্কি হয়ে গেল।

    আমি টবির মুখের দিকে আড়চোখে তাকালাম। তার দিকে চোখ ফেরাতেই আমি যেন আচমকা একটা হোঁচট খেলাম। লক্ষ্য করে দেখলাম, আমার মধ্যে এখন বিরক্তি ভর করেছে কিন্তু তার চোখ মুখে এতটুকু পরিবর্তনের ছাপ ফুটে ওঠেনি।

    টবির মুখ কেবলমাত্র স্বাভাবিক বললে কম করেই বলা হবে, রং তার মুখে রীতিমত হাসির ঝিলিক বিরাজ করছে। আমি তাজ্জব বনে গেলাম।

    আমি চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটিয়ে, কপালের চামড়ায় ভাঁজ এঁকে তার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

    আমার বিস্ময়টুকু তার নজর এড়াল না। সে তো বলেই ফেলল–আমি যে অস্বস্তি বোধ করছি তার জন্য সে শয়তানের কাছে নিজের মাথাটা বাজি ধরতেও রাজি।

    কথাটা বলেই সে এমন চিৎকার চাচামেচি, হৈ-হুঁল্লোড় আর লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করে দিল যে, রীতিমত একটা তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল। আর সে সঙ্গে অনর্গল বড় বড় কথার ফুলঝুড়ি ছুটানোর ব্যাপার তো আছেই। এ পরিস্থিতিতে সর্বক্ষণ তার মুখে হাসির ঝিলিকের পরিবর্তে গাম্ভীর্যই বিরাজ করতে লাগল।

    উপায় নেই, যে করেই হোক অন্ধকার সেতুটা আমাদের অতিক্রম করতেই হবে। করতে লাগলাম তা-ই। সেতুটাকে একেবারে অতিক্রম করার মুহূর্তে আমার একটি বেশ উঁচু ঘোরানো দরজার সামনে হাজির হলাম। আমাদের থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেই হল। মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে সেটাকে ঘুরিয়ে আমি দরজাটা অতিক্রম করে ওপারে চলে গেলাম।

    টবি কিন্তু এভাবে যেতে নারাজ। সে জেদ ধরল, ঘোরানো ফটকটাকে সে লাফ দিয়ে পেরিয়ে যাবে।

    আমি কিন্তু নিশ্চিত যে, কিছুতেই সে ফটকটাকে লাফিয়ে ডিঙিয়ে যেতে পারবে না। তার জেদ ভাঙার জন্য আমি সাধ্যমত চেষ্টা করলাম। সে যেন লাফিয়ে ঘোরানো ফটকা ডিঙিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে। সে আমার কথাগুলো মুখ বুজে শুনলেও আসলে আমার পরামর্শটাকে আমলই দিল না।

    আমি শেষপর্যন্ত অন্য উপায় না দেখে বললাম–‘তুমি যতই হম্বিতম্বি কর না কেন আসলে কিন্তু তুমি যা করতে চাইছ তা কিন্তু কিছুতেই করতে সক্ষম করবে না।

    সে আমার কথামত কাজ করা তো দূরের ব্যাপার বরং এক ফুঙ্কারে উড়িয়ে দিল। কাজের কাজ তো হলই না বরং ফল হলো বিপরীত। একটু পরেই বুঝলাম, আসলে আমি কথাটা বলেই হয়তো ভুল করেছি। কারণ, আমার কথার জবাব দিতে গিয়ে সে বাজি ধরে ফেলল–‘শয়তানের কাছে আমার মাথাটাই বাজি ধরছি, আমি কাজটা করবই করব।’

    তার কথার জবাবে আমি মুখ খুলতে যাব ঠিক সে মুহূর্তেই আমার পাশ থেকে, একেবারে কানের কাছে কার যেন কাশির শব্দ আমার কানে এলো।

    আমি চমকে উঠলাম। কাশিটা ঠিক যেন ‘আহেম’ শব্দের মতো শোনাল।

    আমি সচকিত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক চোখ ফেরাতে লাগলাম। হঠাৎ ) সেতুটার একটা কোণের দিকে চোখ গেল। দেখলাম, এক ভদ্র চেহারার এক বুড়ো দাঁড়িয়ে। চেহারার ছবি ভদ্রলোকের মতো। আর এও লক্ষ্য করলাম, লোকটা বুড়ো খুবই বুড়ো। তার পরনে কালো রঙের প্যান্ট, আর গায়ের জামাটার রঙ ধবধবে সাদা। আর জামার সাদা গলাবন্ধের সঙ্গে কলারটাকে মনলোভা কায়দায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সত্যি সব মিলিয়ে তাকে রীতিমত কেতাদুরস্তই দেখাচ্ছে। আর তার চুলের বিশেষত্বটুকু লক্ষ্য করার মতোই। সিঁথিটা করেছে মাথার ঠিক মাঝ বরাবর। মেয়েদের সিঁথি ঠিক যেমনটি হয়ে থাকে। আর তার হাত দুটো ভাঁজ করে অদ্ভুতভাবে বুকের ওপর রাখা, একটার পরে আর একটি তুলে দেওয়া। আর চোখ দুটোকে মাথার দিকে তোলা। সব মিলিয়ে বুড়োটাকে অদ্ভুতই দেখাতে লাগল।

    আমি অনুসন্ধিৎসু চোখে বুড়ো ভদ্রলোকটাকে আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। এবার চোখে পড়ল তার সর্বাঙ্গ একটা খুবই মিহি কালো রেশমি অ্যাপ্রোণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সত্যি ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুতই মনে হল।

    আমি বুড়ো ভদ্রলোকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই কিছু বলার চেষ্টা করলাম। সে সুযোগ তিনি আমাকে দিলেন না। আমি মুখ খোলার আগেই তিনি সেই শব্দ অনুসরণ করে বলে উঠলেন–‘আহেম।

    বলে উঠলেন–‘আহেম’।

    ‘আহেম!’ হ্যাঁ, তিনি এ-কথাটা আবারও বললেন।

    তার কথাটার কি উত্তর দেব আমি সঙ্গে সঙ্গে গুছিয়ে উঠতে পারলাম না। তাই বাধ্য হয়েই নীরবে তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আর এরকম কথার কোনো উত্তর সঙ্গে সঙ্গে দেওয়াও সম্ভব নয়।

    আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধুবর টবির দিকে তাকালাম। ম্লান হেসে বললাম টবি, কী করছ?

    কোনো জবাব পেলাম না।

    এবার বললাম–কী ব্যাপার, শুনতে পাওনি টবি?’

    বুড়ো ভদ্রলোক বললেন–‘আহেম।

    লক্ষ্য করলাম কথাটা কানে যেতেই টবির মধ্যে অকস্মাৎ কেমন যেন অভাবনীয় এক পরিবর্তনের জোয়ার খেলে গেল। তার মন, আর চোখ-মুখের পরিবর্তনের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখটা টকটকে লাল হয়ে উঠল। শরীরের সবটুকুক রক্ত যেন নিঃশেষে মুখে এসে জড়ো হয়েছে। আর চোখের মণি দুটো অস্বাভাবিক চঞ্চল।

    একটু পরেই টবি মুখ খুলল। কাঁপা কাঁপা অনুচ্চ কণ্ঠে, বার কয়েক ঢোক গিলে সে বলে উঠল–‘বলছ কি হে? এ কথাগুলো তিনি বলছেন, তুমি কি ঠিক শুনেছ? শুনে রাখ, আমি যা সাব্যস্ত করছি, করবও ঠিক তা-ই। আর এ ব্যাপারে তুমি আশা করিনি সন্দেহ, তাই না? আর এও জেনে রাখ, এমন কোনো শক্তি নেই যা আমাকে কর্তব্যচ্যুত করতে পারে। এই তবে–আহেম! আহেম–এই আহেম?

    বুড়ো মানুষটাকে কেন যে এত হাসিখুশি, আর খোশ মেজাজে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়।

    ঘটনাটা একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবেই ঘটে গেল। বুড়ো ভদ্রলোক খোঁড়া-পায়ে লম্বা একটা লাফ দিয়ে সেতুর সে কোণটা থেকে এগিয়ে এসে একেবারে টবির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল। টবি কিছু ভেবে উঠতে না উঠতেই আচমকা দুহাতে তার হাতটা জড়িয়ে বার কয়েক ঝাঁকুনি দিল। এ অবিমিশ্র অনুকম্পার সঙ্গে সর্বক্ষণ হাসিমাখা মুখে তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে চলল।

    সহজ-সরল হাসির রেখা মুখে ফুটিয়ে তুলে বুড়ো লোকটা উচ্ছ্বসিত আবেগের সঙ্গে বলে উঠল–‘আরে টবি, আমি নিঃসন্দেহ, এ-বাজিটায় তোমার জয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের প্রত্যয় যত দৃঢ়ই হোক না কেন, তোমার এ-কাজটা মামুলি হলেও একটা পরীক্ষা আমাদের নিতেই হবে। মনে করতে পার এটা নিছকই আনুষ্ঠানিক একটা পরীক্ষা, বুঝলে কি না?

    টবি কপালের চামড়ায় পরপর কয়েকটা ভাঁজ এঁকে তার মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল।

    ভদ্রলোক ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল–এটা ভাববার মতো কোনো ব্যাপারই নয়। নিছকই মামুলি একটা পরীক্ষা ছাড়া একে অন্য কোনো নামেই অভিহিত করা যাবে না, আশা করি আমার বক্তব্য তোমাকে বুঝাতে পেরেছি, কী বল?

    আমার বন্ধুবর টবির মুখে একটাও রা সরল না। চোখ-মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ এঁকে সে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুততার সঙ্গে হাত চালিয়ে জামাটা খুলে ফেলল। পকেট থেকে বড়সড় একটা রুমাল বের করে চটপট কোমরে বেঁধে নিল।

    রুমালটা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে সে চোখ দুটোকে উলটে আর ঠোঁট দুটোর কোণ বাঁকিয়ে চোখ-মুখের বিচিত্র একটা পরিবর্তন ঘটিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে জবাব দিল– ‘আহেম।’

    মুহূর্তের জন্য থেমে আবার আগের মতোই অদ্ভুত ভঙ্গিতে জবাব দিল–‘আহেম’। ব্যস, এটুকুই। এর বেশি আর একটা শব্দও সে উচ্চারণ করল না। মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে দিল।

    টবির অবস্থা দেখে আমি কেবলমাত্র অবাকই নয়, যারপরনাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি আক্ষেপসূচক শব্দে উচ্চারণ না করে পারলাম না–‘আহা! একী হল। তার সে অনর্গল প্যাচাল পাড়ার স্বভাবটা কোথায় গেল। টবি এমন সংক্ষেপে এতবড় একটা ব্যাপারের নিষ্পত্তি করে ফেলল! এ. যে স্বপ্নেরও অতীত।

    আমি একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পুরো ব্যাপারটা নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। বুড়ো লোকটা কোনো কথা না বলেই টবির হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাকে সেতুটার ছায়ায় নিয়ে গেল। জায়গাটা ঘোরানো দরজাটা থেকে কয়েক হাত আগে।

    তাকে নিয়ে ছায়ায় পৌঁছে বুড়ো লোকটা নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাল।

    টবি বিস্ময়-মাখানো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে মুখ খোলার চেষ্টা করতেই বুড়ো লোকটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল–‘বাছা, আমি যা বলছি, ধৈর্য ধরে শোন–কেবলমাত্র বিবেকের তাগিদেই আমি তোমাকে এটুকু পথ দৌড়াবার সুযোগ দিতে চাচ্ছি।’

    কপালের চামড়ায় বিস্ময়ের ছাপ এঁকে টবি বলে উঠল–‘সুযোগ, দৌড়াবার সুযোগ?

    ‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।’

    ‘আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। যদি একটু খোলসা করে’।

    তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বুড়ো লোকটা ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপাত্মক হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল–‘সুযোগ ছাড়া একে আর কি বা বলতে পারি, বলুন তো ভাই? যাক গে, যে কথা বলতে চাচ্ছি–‘ওই ফটকটার কাছে আমি না পৌঁছানো অবধি তুমি এখানেই অপেক্ষা কর।’

    ‘কারণটা জানতে পারি কী?

    ‘কারণ একটাই, আমি ওখানে দাঁড়ালে ভালোভাবে দেখতে পাব, রকুটাকে তুমি ভালোভাবে অতিক্রম করতে পারলে, নাকি শ্রেষ্ঠ দৌড়বীরের অতিক্রম করলে। আর যখন লাফ দেবে তখন পায়রার ডানা-মেলে উড়ে যাবার কৌশলটা দেখাতে যেন ভুলে না, বুঝলে?’

    ‘হুম!

    ‘আরে ভায়া, সে কৌশল, মানে ভঙ্গিটাই তো আসল হে।

    টবি নীরবে তার বক্তব্য শুনতে লাগল।

    বুড়ো লোকটা আগের প্রসঙ্গের জের টেনেই এবার বললেন–‘হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, আমি যখন বলব–এক-দুই-তিন দৌড়াও ব্যস, তোমাকে দৌড় শুরু করতে হবে, বুঝলে তো?

    আমার বন্ধুবর টবি ঘাড় কাত করল।

    বুড়ো লোকটা বলল–‘মনে রেখো, যতক্ষণ আমি ‘দৌড়াও’ না বলব ততক্ষণ কিন্তু ভুলেও যেন পা-বাড়াবে না।’

    কথাটা বলতে বলতে টবিকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে ঘোরানো দরজাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। মুহূর্তের জন্য তিনি যেন একেবারে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। পর মুহূর্তেই মুখ তুলে তাকিয়ে নীরবে মুচকি হাসলেন। তারপর অ্যাপ্রোণের রশিটাকে সাধ্য মতো বাঁধতে লাগলেন।

    অ্যাপ্রোণের দড়িটা বাঁধতে বাঁধতে তিনি নিস্পলক চোখে আমার বন্ধুবর টবির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

    এদিকে টবি দৌড় শুরু করার জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়াল।

    বুড়ো ভদ্রলোকটা এবার পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেশ জোরে জোরেই উচ্চারণ করলেন–এক, দুই, তিন–এবার দৌড়াও।

    ‘দৌড়াও’ কথাটা কানে যাওয়ামাত্র আমার বন্ধু টবি দৌড়াতে শুরু করল।

    যে ঘোড়ানো দরজাটার কথা একটু আগে বলেছি সেটা কিন্তু আসলে খুব বেশি উঁচু নয়। আবার খুব বেশি নিচু এমন কথা বললে সত্য গোপনই করা হবে। তাই তো আমি সম্পূর্ণ নিসন্দেহই ছিলাম, সে দরজাটা অতিক্রম করতে পারবেই পারবে।

    আমি আর নিজেকে সামলে সুমলে রাখতে পারলাম না। উপায়ান্তর না দেখে বলেই ফেললাম–‘আশ্চর্য ব্যাপার তো! ওই বুড়ো হাড়গিলেটার কি অধিকার আছে যে আমার বন্ধুটাকে তাড়িয়ে বেড়াবে, লম্ফ-ঝম্ফ দেওয়াবে? ঘাটের মরাটার দিন তো ফুরিয়ে এসেছে, আর কয় দিনই টিকবে, কে এ-বুড়োটা? আমাকে যদি সে লাফ দেওয়ার হুকুম দিত, আমি অবশ্যই তার হুকুম তালিম করতাম না। কেনই বা আমি লাফ দিতে যাব, কোন যুক্তিতে? সে যত বড় সাক্ষাৎ শয়তানই হোক না কেন, আমি কিছুতেই তার কথামতো কাজ করতাম না। তাকে পাত্তা দেওয়ার কোনো দরকার আছে বলেই আমি মনে করি না।

    আমি তো আগেই বলেছি, সেতুটা একেবারেই অদ্ভুত ধরনের। অদ্ভুত ধরনের তার নির্মাণকৌশল। আর খিলানগুলোও সেটাকে আরও বিচিত্র করে তুলেছে। তাই প্রতি মুহূর্তেই এমন অস্বস্তিকর একটা প্রতিধ্বনি সৃষ্টি যা মনের ওপর বিশেষ একটা প্রতিক্রিয়া জাগে। আমি যখন আমার বক্তব্যের শেষের কথাগুলো বলি তখন সে প্রতিধ্বনিটা আমার কানে এলো সে রকম প্রতিধ্বনি এর আগে আমি আর কোনোদিন শুনিনি, কোনোদিনই না। সত্যি বলতে কি প্রতিধ্বনিটা ছিল বাস্তবিকই বড়ই অস্বস্তিকর। তবে এও তো খুবই সত্য আমি যা-কিছু শুনেছি, যা-কিছু ভেবেছি, আর যা-কিছু কানে এসেছে সবই তো অত্যল্পকালের মধ্যেই ঘটে গেছে। হ্যাঁ, চোখের পলকেই সবকিছু ঘটে গেছে।

    টবি, দৌড়াবার নির্দেশ পাওয়ামাত্র দৌড় শুরু করল। আর দৌড়ানো আরম্ভ করার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই সে সজোরে এক লাফ দিল।

    আমি স্পষ্টই দেখতে পেলাম অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটাই আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। হ্যাঁ, দেখতে পেলাম, টবি স্বাভাবিকভাবেই দৌড়ে গেল। সেতুটার ওপর থেকে ভালোভাবেই লাফ দিল। পাখি যেমন বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে শূন্যে উড়তে থাকে ঠিক সে রকম ওড়ার ভঙ্গিতেই শূন্যে পা দুটো অনবরত নাড়তে লাগল। আরও লক্ষ্য করলাম, অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাতাসে ভর করে সে উড়তে উড়তে বহু উঁচুতে উঠে গেল। ক্রমে উঠতে উঠতে সে একেবারে ঘোরানো দরজাটার মাথার ওপর উঠে গেল। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? চোখের পলক পড়তে না পড়তেই টবি সোজা নিচে নামতে না নামতেই ঘোরানো দরজাটার মাথার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

    আমি টবির ওপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলাম। দেখলাম, সে অদ্ভুত ধরনের ঘোরানো দরজাটার ওপর আছাড় খেয়ে পড়ামাত্র মিলানের অন্ধকার পরিবেশ থেকে কি যেন একটা বস্তু আচমকা তার এপ্রণের ওপর পড়ল। ব্যস, মুহূর্তমাত্র দেরি না করে সেটাকে অ্যাপ্রোণের ভেতর ঢুকিয়ে হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। তারপরই সে লম্বা লম্বা পায়ে ছুটতে আরম্ভ করল।

    ব্যাপার দেখে আমার তো চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবার জোগাড় হল। বাশক্তি হারিয়ে ফেলার উপক্রম। কোনোকিছু ভাববার মতো ক্ষমতাও আমি হারিয়ে বসলাম আর সে সময়ও আমার নেই। টবি কিন্তু তখনও নিশ্চল-নিথরভাবে পড়ে রয়েছে। এই মুহূর্তেই তাকে সাহায্য করা দরকার। অন্যথায় যে কোনো মুহূর্তে কোনো একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে।

    আমি আর মুহূর্তমাত্রও সময় নষ্ট না করে ব্যস্ত পায়ে টবির কাছে হাজির হলাম।

    আগেই আমি অনুমান করেছিলাম, তার চোটটা বড় রকমই লেগেছে। কাছে ছুটে গিয়ে দেখলামও তাই। আসলে তার মাথাটাই বেপাড়া হয়ে গেছে, কোথায় যেন পড়ে গেছে।

    আমি হন্যে হয়ে টবির মাথাটা খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। কিন্তু বহু খোঁজাখুঁজিতেও সেটার পাত্তা মিলল না। কোথায় যেন সেটা হারিয়ে গেছে।

    কিন্তু আমাকে তো আর এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। এর একটা সমাধান করতেই হবে। মনস্থির করে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম–টবিকে বাড়িতে নিয়ে এসে কোনো একজন হোমিওপ্যাথের শরণাপন্ন হব। অকস্মাৎ একটা মতলব মাথায় খেলে গেল। ব্যস, যা ভাবলাম, কার্যতও তা-ই করলাম। সেতুর একটা জানালা দুম্ করে খুলে দিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই করুণ সত্যটা আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

    আরও দেখলাম, ঘোরানো দরজাটার প্রায় ফুট পাঁচেক ওপরে দুটো চওড়া লোহার পাত আড়াআড়িভাবে স্থাপন করে দুটো পাতের সংযোগ সাধন করা হয়েছে।

    এবার ব্যাপারটা আমার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল, দরজাটার মাথার ওপর থেকে লাফ দেওয়ামাত্র আমার বন্ধুবর টবির গলাটা সোজা গিয়ে সে পাতলা ও প্রায় মসৃণ লোহার পাতের ওপর পড়ে। ব্যস, এতেই যা ঘটার তা ঘটে গেল।

    না, তাকে কিছুতেই রক্ষা করা গেল না। সব প্রয়াসই মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হল। হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকও চেষ্টার কোনো ত্রুটিই করেননি। কার্যত ফায়দা কিছুই হলো না। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়ে পড়তে লাগল। অন্তিম সময় আগত প্রায়।

    এ ঘটনায় একটাই কাজের কাজ হল। যারা অতিমাত্রায় আনন্দপ্রিয়, হৈ হুল্লোড়ের মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করতে চায় তারা এ থেকে একটা শিক্ষা লাভ করল।

    তাকে সমাহিত করা হল। আমি দীর্ঘসময় ধরে চোখের পানি ফেলে তার সমাধির মাটিকে ভিজিয়ে দিলাম। অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর প্রতি আমার এটা কর্তব্য মনে করেই আমি সহজে তার সমাধিক্ষেত্র ছেড়ে চলে আসতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ভারাক্রান্ত মনে সেখানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে নিতে বাধ্য হলাম ।

    টবির মৃতদেহের সকারের জন্য সামান্য কিছু যা খরচাপাতি হয়েছিল তার বিলটা উপযুক্ত সংস্থায় দাখিল করলাম। কিন্তু হতচ্ছাড়ারা দেয় টাকা মিটিয়ে দিতে সম্মত হলো না। উপায়ান্তর না দেখে আবার কবরটা খুঁড়ে টবির মৃতদেহটাকে তুলে। আনলাম। সেটাকে কুকুরের খাদ্য হিসেবে বিক্রি করে দিয়ে ব্যাপারটারনিষ্পত্তি করলাম।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোল্ডেন লায়ন – উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান
    Next Article লাভ ক্যান্ডি – জাফর বিপি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }